poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
তোমাকে প্রথম দেখি মধ্যাহ্নের নিঝুম চৈনিক রেস্তোরাঁয়। অবশ্য এ কথা তুমি করো না স্বীকার। তুমি বলো, আমাদের দেখা হয়েছিল অনেক আগেই কী এক মেলায়। মেলা? শুনে মনে কেমন খটকা লাগে। যদি পৃথিবীকে সুবিশাল কোনো মেলা ভাবো, তবে হয়তো কখনো কোনোখানে হয়েছিল দেখা, আজ মনে নেই, কিন্তু এ ও কি সম্ভব আমরা দু’জন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম মুখোমুখি ভোরবেলা, দুপুরে কি অপরাহ্নে অথবা মদির অস্তরাগে-যতই ক্ষণিক হোক সেই ক্ষণ- ভুলে যাবো? তাই, ভাবি- হয়তো রহস্যে ভেসে তুমি কোনো নির্বাচিত দিন মনে রেখে মৃদু হেসে আমাদের কাল্পনিক প্রথম দেখার গল্প বলো, গল্পে আছে তোমার গভীর অনুরাগ।তোমাকে প্রথম দেখি মধ্যাহ্নের নিঝুম চৈনিক রেস্তোরাঁয়। এক কোণে নিরিবিলি বসেছিলে। তোমার সমুখে (বাইরে ট্রাফিক যেন সুন্দরবনের আর্ত আদিম চিৎকার, শীত-হাওয়া দুপুরকে চুমু খায়, তামাটে কুকুর ছুটে যায় ল্যাম্পোস্টের দিকে, গোয়েন্দার মতো কেউ, না কি দেবদূত জানালার কাচে ঘষে ঠোঁট চোখ) কোকের বোতল আর বইয়ের পাতায় চোখ আর তোমার চাদ্দিকে বয়ে যাচ্ছিল প্রফুল্ল বর্তমান,- ঝোড়ো মনে ঢুকে দেখি এবং নিমেষে হৃদয়ের (অন্য কোণে কিছু কমনীয়, রুক্ষ অচেনা মুখের নড়া-চড়া পর্যটন, সিনেমা, স্ক্যান্ডাল বিষয়ক বাক্যালাপ, মুহূর্তে নিঝুম ঝরে কাঁটা চামচের তক্কে গপ্পে, ন্যাপকিনে, আমাদের পাশে বসে কীর্কেগার্ড মৃদু খাচ্ছেন রঙিন স্যুপ) নিভৃত গোলাপবন উঠলো দুলে, যখন তাকালে চোখ তুলে। এক রাশ হাওয়া গেল খেলে বুকের ভেতরে-যেন শহর ঢাকার পূনর্জন্ম ময়ূরের কলাপের মতো!সেদিন বিকেলে নিসর্গের অন্তঃপুরে তোমার কবোষ্ণ হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে অকস্মাৎ মনে হলো- পঁচিশ বছর আগে যে আমার পাশে ছিল এমনই বিকেলে, তুমি ছিলে তার গভীর আড়ালে হওয়া না হওয়ার রশ্মিজালে, আমার শতাব্দীব্যাপী প্রতীক্ষার পারে। তখনই কি সে সুদূর কালে তোমাকে প্রথম দেখি না-দেখার মায়াবী উদ্যানে?   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
এ কী? এই শহরের গাছগুলি ক্ষণে ক্ষণে রক্ত বমি ক’রে প্রবল ভাসিয়ে দিচ্ছে পথ ঘাট, মাঝে মাঝে থামছে খানিক, পরমুহূর্তেই ফের ফিন্‌কি দিয়ে রক্ত ঝরে, যেন ওরা ভীষণ আক্রোশে ছুড়ে দিচ্ছে লাল থুতু। শুধু কি আক্রোশ? নাকি ভয়ানক বিবমিষা আজ করেছে দখল এই নগরের বৃক্ষসমাজকে! ইচ্ছে হল ছুটে যাই। তাদের নিকট, সেবা শুশ্রূষায় মুছে ফেলি রোগের মলিন ছায়া, বৃক্ষসমাজের বর্তমান অস্তিত্বের ধূসরতা অকৃত্রিম সবুজে বদলে দিই, ডেকে আনি ফের পলাতক কোকিলকে রোগমুক্ত সতেজ পাতার আস্তানায়। আমি তো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল অথবা জীবনানন্দ নই, কেন আমার নাছোড় আবেদনে পীড়িত গাছের পাতা আবার সবুজ আভা ফিরে পাবে? কেন কোকিল আসবে ফিরে নাগরিক বিপন্ন গাছের মজলিশে সুর ঝরাতে আবার?মাথা নিচু ক’রে ফিরে যাচ্ছি শ্যামলীর অবসন্ন গলিমুখে; অকস্মাৎ পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে, দেখি- মাটি ফুঁড়ে আগুনের জ্বলজ্যান্ত ঢেলা চৌদিকে ছিটিয়ে পড়ে, এ কী! নড়ে ওঠে সুপ্রাচীন ডাইনোসরের মাথা, হিংস্র দাঁতগুলো নিমেষে আমাকে গেঁথে ফেলে, যেন আমি মহিমাবিহীন যীশু!  (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আজকাল খুব ভোরবেলা উঠে পড়ি, মাঝে মাঝে দেরি হয়ে যায়। কেন উঠি? এই চোখের অসুখ বেড়ে গেল যখন, তখন থেকে চোখ, কান বুক আকাশে আবির মাখা হওয়ার আগেই মাতে কাজে। ঘুম ভাঙতেই শুনি পাখিদের শিস, আচানক কোথা থেকে ভেসে আসে বকুল ফুলের গন্ধে, দেখি আমার নৈঃসঙ্গ্য গাছতলা থেকে দেখছেন একি মহৎ রবীন্দ্রনাথ। আমি দুর্ভোগের ক্রীড়নক।তোমাকে দেখি না বলে সবকিছু মন খারাপের স্পর্শে আজ কেমন বিবর্ণ, বড়ো অর্থহীন লাগে। একুশের বই মেলা টানে না আমাকে, দিনভর বসে থাকি গৃহকোণে, তৈরি করি এক সরোবর যার জলে তোমার সুন্দর মুখ দেখি অনুরাগে, বারবার সেই মুখ সরে গিয়ে ভেসে ওঠে ফের।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয় দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি এবং বুলোয় তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে।আমাদের একরত্তি উঠোনের কোণে উড়ে-আসা চৈত্রের পাতায় পাণ্ডুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায় গ্রীষ্মের দুপুরে ঢক্‌ঢক্‌ জল-খাওয়া কুঁজোয় গেলাশে, শীত-ঠকঠক রাত্রির নরম লেপে দুঃখ তার বোনে নাম অবিরাম।পিরিচ চামচ আর চায়ের বাটিতে রোদ্দুরের উল্কি-আঁকা উঠোনের আপন মাটিতে দুঃখ তার লেখে নাম।চৌকি, পিঁড়ি শতরঞ্জি চাদর মশারি পাঞ্জাবি তোয়ালে লাল কস্তাপেড়ে শাড়ি প্রখর কম্বল আর কাঁথায় বালিশে ঝাপসা তেলের শিশি টুথব্রাশ বাতের মালিশে দুঃখ তার লেখে নাম। খুকির পুতুলরানী এবং খোকার পোষমানা পাখিটার ডানা মুখ-বুজে-থাকা সহধর্মিণীর সাদা শাড়ির আঁচলে দুঃখ তার ওড়ায় পতাকা। পায়ে-পায়ে-ঘোরা পুষি-বেড়ালের মসৃণ শরীরে ছাগলের খুঁটি আর স্বপ্নের জোনাকিদের ভিড়ে বৃষ্টি-ভেজা নিবন্ত উনুনে আর পুরানো বাড়ির রাত্রিমাখা গন্ধে আর উপোসী হাঁড়ির শূন্যতায় দুঃখ তার লেখে নাম।হৃদয়ে-লতিয়ে-ওঠা একটি নিভৃততম গানে সুখের নিদ্রায় কিবা জাগরণে, স্বপ্নের বাগানে, অধরের অধীর চুম্বনে সান্নিধ্যের মধ্যদিনে আমার নৈঃশব্দ আর মুখর আলাপে স্বাস্থ্যের কৌলিন্যে ক্রূর যন্ত্রণার অসুস্থ প্রলাপে, বিশ্বস্ত মাধুর্যে আর রুক্ষতার সুতীক্ষ্ম সঙ্গিনে দুর্বিনীত ইচ্ছার ডানায় আসক্তির কানায় কানায় বৈরাগ্যের গৈরিক কৌপীনে দুঃখ তার লেখে নাম।রৌদ্রঝলকিত ভাঙা স্তিমিত আয়নায় নববর্ষে খুকির বায়নায় আমার রোদ্দুর আর আমার ছায়ায় দুঃখ তার লেখে নাম।অবেলায় পাতে-দেয়া ঠাণ্ডা ভাতে বাল্যশিক্ষা ব্যাকরণ এবং আদর্শ ধারাপাতে ফুলদানি, বিকৃত স্লেটের শান্ত মেঘলা ললাটে আর আদিরসাত্মক বইয়ের মলাটে চুলের বুরুশে চিরুনির নম্র দাঁতে দুঃখ তার লেখে নাম।কপালের টিপে, শয্যার প্রবাল দ্বীপে, জুতোর গুহায় আর দুধের বাটির সরোবরে বাসনার মণিকণ্ঠ পাখিডাকা চরে দুঃখ তার লেখে নাম। বুকের পাঁজর ফুসফুস আমার পাকস্থলিতে প্লীহায় যকৃতে আর অন্ত্রের গলিতে দুঃখ তার লেখে নাম।আমার হৃৎপিণ্ডে শুনি দ্রিমিকি দ্রিমিকি দ্রাক্‌ দ্রাক্‌ দুঃখ শুধু বাজায় নিপুণ তার ঢাক। ঐ জীমরতিভরা পিতামহ ঘড়ির কাঁটায় বার্ধক্য-ঠেকানো ছড়ি, পানের বাটায় গোটানো আস্তিনে দুমড়ানো পাৎলুনে কাগজের নৌকা আর রঙিন বেলুনে দুঃখ তার লেখে নাম।কখনো না-দেখা নীল দূর আকাশের মিহি বাতাসের সুন্দর পাখির মতো আমার আশায় হৃদয়ের নিভৃত ভাষায় দুঃখ তার লেখে নাম।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কী রকম সাজ আজ শোভা পাবে তোমার শরীরে? আনবে কি ফিরিয়ে সহজে তুমি রাঙা থরথর প্রথম যৌবন পুনরায়? শরীর যে বসন্তের অনুরূপ হ’য়ে ওঠে, তোমাকে দেখেই বোঝা যায় লহমায়। তোমার ভেতরে গান, গহন সুরভি জেগে ওঠে অগোচরে; গীতবিতানের শব্দাবলী তোমাকে আতিথ্য দেয় মহিমার স্বতন্ত্র ভুবনে ক্ষণে ক্ষণে। তোমার বিভায় আমি সর্বদা মোহিত।তোমাকে আজকে সন্ধেবেলা দেখব না, এই সাজ হবে না আমার চোখে উদ্‌ভাসিত; আমাকে এ খেদ করবে অস্থির সারাক্ষণ, গোপন ঈর্ষার হুল ফুটবে হৃদয়ে, তুমি জানবে না। তোমার শরীর আজকের মতো জ্বলে উঠবে কি ফের আমাদের দু’জনের প্রেমাঙ্কুর জাগৃতির জন্মবার্ষিকীতে?   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
গ্রাম্যপথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু নেই কোন, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরু আল খাঁ খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক; নগ্ন রৌদ্রে চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।
শামসুর রাহমান
রূপক
ঘুমাতে পারোনা তুমি কত দীর্ঘকাল। ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের একটানা ডাক সঙ্গে নিয়ে চাঁদ ডুবে যায় ছাদের কার্নিশে অস্ফুট প্রত্যুষ হাত রাখে, ঘুমাতে পারোনা তুমি। চোখ দুটো খুব রাতজাগা পাখির চোখের মতো হয়ে আসে ক্রমে, জ্বালা করে; মাথা ধরে। মুখের ভেতর নোনা স্বাদ আর হৃদয়ের ভিতর মহলে শোলা ডোবে এবং পাথর ভাসে, ভাসে বাল্যকাল।ঘুমাতে পারোনা তুমি কত দীর্ঘকাল। এখুনি আসবে এই বারান্দায় চড়ুইয়ের দল নরম রুটির লোভে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে তুমি দেখবে চাঞ্চল্য ইতস্তত, রুটির গুঁড়োর মতো ঝরবে ওদের কণ্ঠস্বর, শোনা যাবে। টুকরো টুকরো রুটি ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেও ফের বিছানায়; এখন ঘুমাও তুমি, ঘুমাতে পারোনি দীর্ঘকাল।  (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কিছুদিন ধরে খুব বিস্রস্ত, ব্যাকুল হয়ে আছি; আমাকে শিকার করে অস্থির প্রহর বারবার দ্বিধাহীন, বুঝি কোনো চিত্তহারী ক্রীড়ায় মেতেছে। আমার এ ব্যাকুলতা একান্ত নাছোড়, কিছুতেই পাই না ঈষৎ মুক্তি। সঙ্গিনীবিহীন পাখি হয়ে নীড় ছেড়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ফিরি দূরের আকাশে, পদ্মার ঊষর চরে, বিলে, ঝিলে, গহীন বনের গাছে গাছে। উন্মোচিত যন্ত্রণার ফোয়ারা হৃদয়ে।কী করব আমার এ ব্যাকুলতা নিয়ে অবেলায়? কে আমাকে বলে দেবে একে আড়ালে রাখার নিখুঁত পদ্ধতি? ফণিমনসার সহিংস আঁচড়ে রক্তের বুদ্বুদ জাগে অধীর সত্তায়। থাক, তবু থাক, এই ব্যাকুলতা, এই অস্থিরতা-এই দুই নিঠুরা যমজ ভগ্নী প্রেমের কাব্যের উৎসভূমি।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
পায়রার পালকের রোদ তোমার হাতেরও রোদ, দেয়ালের শ্যামলিমা তোমার মুখেরও শ্যামলিমা। যখন দোয়েল শ্যামা ডাকে, অস্তিত্বের চতুঃসীমা তোমার সঙ্গীতময় হয় অনুরূপ; অনুরোধ করে চন্দ্রমল্লিকার কোমলতা তোমার নিকট বিশদ থাকার জন্যে, অথচ সত্তায় হু হু চিতা সর্বদা বেড়াচ্ছো ব’য়ে হে বিষাদময়ী, হে বনিতা নৈঃসঙ্গ্যের। ধোঁয়াক্লিষ্ট হৃদয়ের কাটেনা সঙ্কট।চাইনা তোমাকে বন্দী করুক অসিত হাহাকার। আমিতো নির্লিপ্তিপ্রিয় নই; নিশ্চিত আমিও চাই ঝরুক আমার বৃষ্টি তোমার চিতার রূপানলে, তোমার সত্তায় হোক ব্যাপ্ত বকুলের শিষ্টাচার। দু’হাতে কুড়িয়ে স্বেদমুকুলিত প্রহরের ছাই বলবো না, প্রেম মুঞ্জরিত কেবল দাহঘ্ন জলে!   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
(হরিপদ দত্ত প্রিয়বরেষু)চোখের সম্মুখে আমি বড়সড় একটি বাড়িকে অতি দ্রুত খসে যেতে দেখছি এখন। এমন তো ভুলেও ভাবিনি কোনওকালে। বেশ কিছুকাল আগে, যখন সৌন্দর্য নিয়ে বাড়িটিকে দাঁড়াতে দেখেছি, করেছি কত না গল্প দিকে দিকে, জনে জনে, আজ সেই স্মৃতি আমাকে করছে নিত্য ব্যঙ্গ।এ বাড়ির কতিপয় বিভ্রান্ত বাসিন্দা, স্বার্থান্বেষী যারা, তারা নিভৃত, রহস্যময় স্থানে গভীর নিশীথে ব’সে নিজেদের মাঝে বাড়িটির কিছু অংশ অতিশয় ধড়িবাজ ধনীদের হাতে তুলে দিতে হয়েছে তৎপর। কিয়দ্দূরে বৃক্ষডালে ব’সে-থাকা পাখিরা বাড়িটির কষ্ট দেখে হাহাকার ক’রে ওঠেগাছের পাখিরা দূর থেকে দ্যাখে বাড়িটির যত ভালো বাসিন্দার নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনধারার ছবি, কিয়দ্দূর থেকে দ্যাখে আর ভাবে-এই মানুষেরা এমন দুর্দিনে আচানক কোথায় দাঁড়াবে গিয়ে? নেবে ঠাঁই? অথচ এরাই একদিন বাড়িঅলাদের নানা কাজে বাড়িয়েছে হাত।‘এই কি বিধান, হায়? ন্যায় নীতি?’-ব’লে ওরা শূন্য আসমানে তাকায়, অথচ তিনজন যুবকের কণ্ঠ গর্জে উঠে করে উচ্চারণ- ‘আর অনাচার, অবিচার মেনে নিয়ে উঁচু মাথা নিচু করবো না, করবো না। এই বাণী নুয়ে-পড়া সব অধিবাসীদের সুপ্ত শোণিতে তরঙ্গ নেচে বলে, ‘হবে জয়।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
বাগানের ফুলগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে জাঁহাবাজ পশুপ্রায় লোকগুলো ডানে বামে নিষ্ঠুর বুলেট ছুড়তে ছুড়তে ত্রাস সৃষ্টি শুধু-যেন ওরা কর্কশ বুটের নিচে পিষে নিরীহ বাঙালিদের মুছে ফেলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যেন ফুঁসছে চৌদিকে শুধু।শহরে ও গ্রামে অস্ত্রধারী জল্লাদেরা নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের ব্রত নিয়ে পাগলা কুকুর হয়ে রাজপথে আর অলিতে গলিতে হানা দেয়। রক্ত ভাসে সবখানে পশ্চিমের রক্তপায়ী পশুদের অস্ত্র থেকে প্রায় যখন তখন। লুট হতে থাকে নারীর সম্ভ্রম।অচিরে বাংলায় নানা ঘরে মাথা তোলে একে একে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বদেশের সম্ভ্রম রক্ষার জ্বলজ্বলে শপথের পতাকা উড়িয়ে দিগ্ধিদিক। প্রাণ যায় যাক, ক্ষতি নেই; দুর্বিনীত শক্রদের আমাদের ধনধান্যে পুষ্পেভরা জন্মভূমি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় ক’রে নিজস্ব সত্তাকে সমুন্নত রেখে ঢের ঝড় পাড়ি দিয়ে যেতে হবে সাফল্যের বাগিচায়।হায়, এখন তো নানা ঘাটে ছদ্মবেশী শক্রদল কী চতুর প্রক্রিয়ায় দেশপ্রেমী বৃদ্ধিজীবী আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ক্রূর ফাঁদ পেতে আড়ালে মুচকি হাসে; আসমানে কেঁপে ওঠে চাঁদ! তবু জানি, মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় আখেরে ঠিক দুলবে তারার মালা, চতুর্দিকে হবে জয়ধ্বনি।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
এই তো নিজেকে দেখছি মেঘলা, নিঝুম দুপুরে একলা হাঁটছি অচেনা পথের ধার ঘেঁষে আর আকাশ পাতাল ভাবছি কেবল। আচানক কোনও ধাবমান যান হানলে আঘাত হারাবো জীবন।অথচ আমার সেদিকে মোটেও নেই তো খেয়াল, আমার ভেতর কী যে তোলপাড় চলছে এখন, অজানা সবার। এমনকি এই আমারও মনের অজ্ঞাত সব।আমি কি ব্যর্থ প্রেমিক এখন জীবনের এই গোধূলি বেলায়? এ কথা শুনলে হেসে গুলজার করবে সবাই জমাট আসর। সত্যি তেমন নয় তো কিছুই, তবুও মনের দিগন্ত জুড়ে অচিন কুয়াশা!তবে কি মৃত্যু-চিন্তা আমাকে করছে কাতর? ঘর থেকে পথে দিয়েছে হেলায় আচমকা ছুড়ে? এ কোথায় আমি এলাম ধূসর প্রহরে এমন বেগানা মাটিতে? কী হবে এখন একলা এখানে সংজ্ঞা হারালে।হঠাৎ কেমন অট্রহাসির ধাক্কা আমাকে ধুলোয় লুটিয়ে পতিত আমার দিকে ছুড়ে দেয় ভয়াবহ ঢেউ। ডুবে যেতে থাকি কোন্‌ সে পাতালে? কে জানতো এই পরিণতি হবে আমার এমন বেয়াড়া, বেগানা এক নদী তীরে?   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
স্বীকার করাই ভালো, কিছুকাল থেকে আমরা শব্দের ভুল প্রয়োগে ক্রমশ হচ্ছি দড়। যেখানে আকাট মূর্খ শব্দটি মানায় চমৎকার, সেখানে পণ্ডিত ব্যবহার করে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাই। শক্রস্থলে বন্ধু শব্দটিকে হরহামেশাই জিভের ডাগায় নাচাই এবং যারা অতি খর্বকায় তাদের সপক্ষে দীর্ঘকায় বিশ্লেষণ সাজিয়ে নরক করি গুলজার আর মানুষের বদলে সম্প্রতি ওরাংওটাং বসিয়ে লাফিয়ে উঠি তিন হাত, খাই ডিগাবাজি করি সহবত বনচারীদের সঙ্গে দিনরাত।বস্তুত স্বর্গত হরিচরণের বিখ্যাত নিষ্ঠার প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি শেয়াল-শকুন অধ্যুষিত ভাগাড়কে স্বর্গোদ্যান বলি সটান দাঁড়িয়ে চৌরাস্তায়, এবং শব্দের ভুল প্রয়োগ-মড়কে নিমেষেই যুদ্ধবন্দি বিনিময় হয়ে যায় মন দেয়া-নেয়া।   (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কখনো নিইনি কোনো গুরুর নিকট দীক্ষা, দেহে ভস্ম মেখে বৃক্ষতলে ধূপ ধূনা জ্বেলে জোরেশোরে চিমটা বাজিয়ে লোক জড়ো করিনি কস্মিনকালে। মানবতাবাদী বাউলের তরিকায় নিত্যদিন দেহের বন্দনা করি; গীত রচনায় নিমজ্জিত, দোতারা ছাড়াই ঘুরি এ ভবের হাটে। ক্লান্ত হলে জিরোই দিঘির ঘাটে, মল্লিকার বনে, যাই ছুটে তোমার দেহের তীরে উন্মুখর পিপাসা মেটাতে।মাঝে-মধ্যে দেহমন কেমন বিষাদে ছন্নছাড়, নতঝুঁটি মোরগের মতো চেয়ে থাকি শূন্যতায়; দেহের ক্রন্দন ঘন কুয়াশা ছড়ায়, হয়ে যাই দীর্ঘশ্বাস। হে অতুলনীয়া গৌরী, তোমার দেহের পুশিদা মোকামে যে অপূর্ব পদ্ম আছে, কালেভদ্রে তার ঘ্রাণ নিয়ে দাঁড় বাই কাব্যের গহীন গাঙে।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
যখন তুমি অনেক দূরে থেকে এখানে এই গলির মোড়ে আসো, উঠোনে দাও পায়ের ছাপ ত্রঁকে, শান্তি পাই। যখন তুমি দেহের বাঁকে বাঁকে স্মৃতির ভেলা ভাসাও, তোলো পাল, মুক্ত করো যমজ পায়রাকে শান্তি পাই।যখন তুমি আমার পিপাসায় নিমেষে হও আঁজলাভরা জল, দৃষ্টিজাল ছড়াও কী আশায়, শান্তি পাই।যখন তুমি ঠোঁটের বন্দরে বিছিয়ে দাও গালিচা রক্তিম, প্রভাত জ্বালো চোখের কন্দরে, শান্তি পাই।ঝঞ্ঝাহত উজাড় এ বাগানে আন্দোলিত তুমিই শেষ ফুল! জাগাও তুমি সবুজ পাতা প্রাণে, শান্তি পাই।যখন তুমি দুপুরে ঘুমে আসো, তোমার বুকে অতিথি প্রজাপতি; থম্‌কে থাকে ভয়ে সর্বনাশও, শান্তি পাই।যখন তুমি জলের গান হয়ে আমার দেহে আমার মজ্জায় কী উজ্জ্বল জোয়ারে যাও ব’য়ে, শান্তি পাই।যখন তুমি আমার ঠোঁটে রাখো একটি লাল গোলাপ, আত্মায় ঝরাও পাতা আবেগভরে ডাকো, শান্তি পাই।যখন তুমি হাওয়ায় দাও মেলে তিমির-ছেঁড়া আমার এ পতাকা, কিংবা আসো বিরূপ জল ঠেলে, শান্তি পাই।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
অসুস্থ ঈগল নীলিমায় তার পক্ষ বিস্তারের স্মৃতি নিয়ে যেমন অনেক নিচে সময়ের ভার ব’য়ে চলে, ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে দূর নীলিমায়র দিকে দ্যাখে মাঝে মাঝে, কখনোর পাহাড়ের চড়ার সৌন্দর্য ভাবে, তেমনি আমিও হাহাকারের প্রতিমৃর্তি হয়ে রুক্ষ ধুলায় ছিলাম পড়ে ধার ছিলোনা অস্তিত্বে প্রায়, আতংকিত বিধ্বস্ত ডানার প্রতিটি পালকে চিহ্ন নিষাদের ক্রূর প্রহারের।সহসা ধুলায় কী সুন্দর ফুলের সম্ভার জাগে, আর রুক্ষ কৃষ্ণপথে বসন্তবাহার মুখরিত, তোমাকে দেখেই রোগা ঈগলের আর্ত চক্ষুদ্বয় যৌবনের মতো জ্বলজ্বলে হয়, দীপ্র অনুরাগে বুকের ভেতর হ্রদ দুলে ওঠে, পুনরায় ভীত সন্ত্রস্ত সত্তায় তার উদ্ভাসিত বাঁচার বিস্ময়।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
না, এখন আর চুপচাপ বসে থাকা যায় না, একটা কিছু করতেই হয়। ঐতো সূর্যটা গা-ঢাকা দেবো দেবো করছে কখন থেকে, সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে চতুর্দিকে এলোমেলো কত কিছু ঘটছে নিয়ত। আর বেশি দেরি হলে পাততাড়ি নিশ্চত গোটাতে হবে। তাই বেলা থাকতেই যতক্ষণ পারি রাখবো দর্শক ধরে। খালি আসরে জমে না খেলা, মাঝে মাঝে যদি করতালি ঝংকৃত না করে মঞ্চ, তবে নিজেকে উজাড় করে এই খেলা দেখিয়ে কী হবে?তোমার সকল খেলা, বলে লোকে, হয়েছে পুরোনো। বলো আর কতদিন বারংবার একই ভেলকি লাগাবে উৎসুক চোখে? মানে, এখন সবাই জানে তোমার আস্তিন থেকে ক’টা কবুতর অকস্মাৎ আসবে বেরিয়ে আর কালো টপ হ্যাটে তুমি হাত রাখলেই মঞ্চে হবে উদ্ভাসিত সহজে খরগোশ, এবং কবুল করি এ আমারই দোষ। একই খেলা দেখতে দেখতে সত্যি কেউ মনের ভেতরে আর সম্প্রতি পায় না খুঁজে আনন্দের ঢেউ। খেলায় যখনই ম্লান মনোটানি ব্যেপে আসে, তখনই দর্শক সীট ছেড়ে দাঁড়ায়, হারায় ধৈর্য, সিটি দ্যায়, কখনো ভীষণ যায় তেড়ে বেকুল স্টেজের দিকে, কখনো বা পচা ডিম, টোমাটোর গোলা ছোটে। ঐন্দ্রজালিকের হাত-পা হয়ে যায় হিম। যখন পুরোনো খেলা কোনো অর্থ করে না বহন কারো কাছে হে বন্ধু তখন কৌশল পাল্টিয়ে ফ্যালো, নিমেষে খাটাও তাঁবু শূন্যে এবং পাঠাও পা দুটো সুনীল আসমানে। নয়তো তুড়ি মেরে দিব্যি নিজেই নিজের বুকে ছুরি আমূল বিঁধিয়ে আনো রক্ত রঙের বদলে। তাহলে বলবে লোকে, দ্যাখো কী কৌশলে ঐ চটপটে লোকটা লাগায় ধন্দ প্রত্যেকের চোখে, মজাদার খেলা বটে।   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
দেখা হওয়া না-হওয়ার মধ্যে কেন জয় পরাজয় সেদিন আনলে টেনে আচানক? কার জিৎ আর কার হার হলো বলে ধরে নিলে মনের গহনে? আমিতো ভাবিনি এইমতো কস্মিনকালেও, তাই দ্রুত বিস্ময়ের পাকে জড়িয়ে গেলাম; দু’টি দিন প্রার্থনা করেও আমি পাইনি তোমার কাছে, ফলে আমার পড়ার ঘর শীতল কফিন, পড়ে আছে লেখার টেবিলে ম্লান, শোকগ্রস্ত কলম আমার।উড়ন্ত গালিচা যদি থাকতো দখলে, তবে আজ চোখের পলকে উড়ে যেতাম তোমার নিকেতনে। সইতে হতো না প্যাঁচা আর বাদুড়ের কৃষ্ণপক্ষ উপহাস ক্ষণে ক্ষণে; নিঃসঙ্গতা আমাকে এখন সঙ্গ দেয়, হাওয়া আলাপের সূত্রপাত করে, ঘরে অকস্মাৎ নড়ে ওঠে অতিকায় মত্ত সরীসৃপ।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমার হৃদয়ে ছিল লোকোত্তর সফল বাগান তর্কাতীত ঐশ্বর্যে ভাস্বর। কোনো দিন সময়ের সিংহবর্ণ মরুভূমি তাকে পারেনি ডোবাতে তরঙ্গিত বালির কবরে, অথবা উটের দীর্ঘ কোনো বেঢপ পায়ের নিচে হয়নি দলিত বাগানের কোমল পরাগ।বরং সেখানে বহু চৈত্রসন্ধ্যা তার সুরভিত প্রশান্ত চিকুর দিয়েছে এলিয়ে বারবার, আর কত চকিত রাত্রির নীলিমায় আকাশের বাঁকা সিঁড়ি বেয়ে এসেছে তো রক্তকরবীর ডালে শব্দহীন চাঁদ সে-চাঁদ দু’জনে মিলে দেখেছি অনেক সপ্রেম প্রহরে; কতবার সে চাঁদের স্মৃতি-ছবি এঁকেছি নিভৃত মনে শিল্পীর প্রজ্ঞায়।তুমিও দেখেছ রাত্রির মুকুরে ভাসে অগণন তারার বিস্ময়; হৃদয়ের হ্রদে নীল তারা জলের শয্যায় শুয়ে দেখে কত স্বপ্ন অলৌকিক। আমরা দু’জন সেই স্বপ্নের মেদুর অংশ হয়ে নিয়েছি প্রাণের উন্মীলনে জীবনের দান-আর এ বাগান আজও মুঞ্জরিত, আজও।এখানে বাগানে আমার প্রভাত হয়, রাত্রি নামে, উৎসারিত কথাহৃদয়ের সোনালি রুপালি মাছ হয়ে ভাসে আর বসন্তের আরক্ত প্রস্তাবে প্রজ্বলিত, উন্মোচিত তুমি। বাগানে আবার ঐ বর্ষার সঙ্গীত সমস্ত সত্তায় আনে অপরূপ শ্যামল আবেগ। জ্যোৎস্নার লাবণ্যে আর রৌদ্রের স্বতন্ত্র মহিমায় তুমি তন্বী গাছের বিন্যাসে আছ এই বাগানে আমার গানে গানে জীবনের দানে উল্লসিত। এবং তোমার প্রাণ প্রতিটি ফুলের উন্মোচনে শিহরিত আর উত্তপ্ত তামার মতো বাস্তবের পরিধি পেরিয়ে অভীপ্সা তোমার প্রসারিত, মনে হয়, সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কোনো জীবনের দিকে যে-জীবন পৃথিবীর প্রথম দিনের মতোই বিস্মিত চোখ রাখে আগন্তুক ভবিষ্যের চোখে অথবা প্রেমের মতো উজ্জ্বল সাহসে ভাঙা-চোরা পথে, আবর্তে আবর্তে খোঁজে চির-অচেনাকে, এমনকি হাত রাখে নিশ্চিন্তে অকল্যাণের হাতে।যখন জীবনে সেই বাগানের সঞ্চারী সুরভি ধ্রুপদী গানের মতো, সন্ধ্যার ধূপের মতো অর্পিত আবেগে করে স্তব ঈপ্সিতের, সেই ক্ষণে তোমাকেই খুঁজি বাগানের মধুর উপমা তোমার অস্তিত্বে সুরভিত আজীবন আমি।   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
ভালোই আছি আজ, জ্বরের নেই তাপ; সময় ভালো বটে শীতের কিছু পরে। হঠাৎ চেয়ে দেখি এসেছে কোত্থেকে চড়ুই পাখি দুটি এসেছে এই ঘরে।এ ঘরে বসবাস আমার বহুকাল। স্মৃতির মেঘমালা বেড়ায় ভেসে মনে : কেটেছে ক’দিন নানান বই পড়ে, কখনো গান শুনে, কখনো চুম্বনে।এ ঘরে কত রাত ভালেরি এসেছেন, কখনো কালিদাস, বোদলেয়ার, রুমি। পেরিয়ে স্বপ্নের সুনীল সেতু আর টানেল কুহকের কখনো আসো তুমি।এখানে এই ঘরে সকালে মাঝরাতে টেবিলে ঝুঁকে লিখি; হারিয়ে ফেলি পথ কখনো শব্দের গহিন জঙ্গলে। কখনো পাই কত পঙ্‌ক্তি মৃগবৎ।চড়ুই নীড় বেঁধে এখানে এই ঘরে রাখতে চায় তার প্রেমের স্বাক্ষর। অথচ জানে না সে বিপুল চরাচরে প্রকৃত প্রস্তাবে আমারই নেই ঘর।   (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এখন নিজেকে বলি মাঝে-মধ্যে, বেলা নিভে আসে ক্রমে, তুমি যমে ও মানুষের টানাটানি দেখেছো গ্রামের ঘরে, শহরের ফ্ল্যাটে, আর অধিবাস্তব নাটোর কুশীলবদের সাজঘরে অকস্মাৎ বজ্রপাত করেছো প্রত্যক্ষ সাঁঝরাতে। তাছাড়া পাহাড়ি পথে ধস নেমে যেতে দেখে আঁৎকে উঠেছি, এবং পুরানো দালানের ভিত নড়া, ভেঙেপড়া আমার সত্তার কাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছে তীব্রতায়। ভবঘুরে কাবিলের মতো যন্ত্রণর দাগ বয়ে বেড়াচ্ছি নিয়ত সাত ঘাটে।বাগান যাই না ইদানীং, কোনোদিন যদি চলে যাই ভুলে, ভয় ফণা তোলে, ফুলগুলি নিমেষে করোটি হয়ে যায়, বৃক্ষরাজি বিশীর্ণ কংকাল। গোধূলিতে বাগান উগরে দেয় ক্রমাগত পুরাতন শব। শেয়ালের দাঁতে বিঁধে থাকে যুবাদের হৃৎপিণ্ড।আমার গন্তব্য নয় নদীতীর আর, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছই-অলা নৌকা অথবা ডিঙির দোলা দেখে আজকাল পাই না আমোদ, ভাটিয়ালী শোকগাতা হয়ে জলে মেশে, নদী বারবার আমার উদ্দেশে ছুড়ে দেয় শুধু শ্মশানের ধোঁয়া।আকাশ তো আগের মতোই নীল রঙে ভরপুর, তবু তাকাই না আকাশের দিকে রাত জেগে। তারাগুলি ডাইনির চোখের ধরনে চেয়ে থাকে, এবং গর্জনশীল নদী বারবার ভীষণ কামড়ে ধরে কাজল মাটির ঘাড়, দেবদূতগণ খেঁকশেয়ালের মতো হয়ে যান দ্রুত। কখনো কখনো মেঘ ফেটে রক্ত ঝরে, কয়েকটি লাশে ঢেকে গেছে আমাদের সমস্ত আকাশ।   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কেমন করে শেখাই তাকে ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে জ্বাল্‌তে তারার বাতি, যখন কিনা আমরা নিজ অন্ধকারে শুধুই ভিজে কাদা ছোঁড়ায় মাতি!কেমন করে শেখাই তাকে ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে বলতে সত্য কথা, যখন কিনা মিথ্যা থেকে আমরা নিজে শিখছি ঠেকে চতুর কথকতা!কেমন করে শেখাই তাকে ছোট্র অবুঝ শিশুটাকে বাসতে শুধুই ভালো, যখন কিনা রাত্রিদিন আমরা নানা অর্বাচীন হচ্ছি ঘৃণায় কালো।কেমন করে বলি তাকে ছোট্ট অবুঝ শিশুটাকে ‘আস্থা রাখো ওহে’! যখন কিনা বিশ্ব জুড়ে আমরা শুধু মরছি ঘুরে নাস্তিকতার মোহে।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
পথ শক্ত অথচ মসৃণ ছিল অনেকটা, হেঁটে যেতে যেতে যেতে অকস্মাৎ পা দু’টি কাদায় ডুবে যায়। মনে হল সম্ভবত ডুবে যাব আপাদমস্তক। দম বন্ধ হয়ে এল প্রায়, কোনও মতে মাথা উঁচু রেখে শ্বাস নিতে থাকি, সজোরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি।আবার নতুন ছাঁদে পথ চলা সম্মুখে কায়েম রাখি, আরও কতদূর যেতে হবে, কোন্‌ বিপদের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ওঁৎ পেতে আছে, কে আমাকে বলে দেবে এই কৃষ্ণপক্ষে? পদযুগ বিগড়ানো, মাথার উপর ঘোরে খাপছাড়া পাখি।পাখিটা কি অশুভ সঙ্কেত কোনও? নাকি ভীষণ বেয়াড়া মাংসভুক? অতিশয় ক্লান্তি দুটি চোখ বুজলেই অতিপয় অচেনা চেহারা ভয়ঙ্কর বিকৃত আদলে দেখা দেয় বার বার, কেড়ে নেয় স্বস্তি; দৃষ্টি জ্বেলে নিই ফের।‘শোনও পথচারী, এখানেই এই বিয়াবানে যাত্রা থামিও না, ওঠো, মুছে ফেলে ক্লান্তির কুয়াশা যত পারও জোর কদমে এগোও’,-মেঘমালা চিরে যেন কার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। গোধূলির রঙ মুছে যাওয়ার আগেই ত্বরিত কদমে হাঁটি স্বপ্নাদ্য স্বর্ণিল আস্তানার অভিমুখে।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
নীরবই থাকবো আজ। হে মেয়ে তোমার যত সাধ গালমন্দ দাও, দাও অপবাদ, চোখের আগুন ঝরাও আমার সত্তা জুড়ে, যত পারো; করো খুন আমাকে, দেবো না বাধা, জানাবো না কোনো প্রতিবাদ। আমাকে হেলায় তুমি ত্যাগ করে যাবে বলে খাদ জেগে ওঠে চতুর্ধারে যেন গিলে খাবে নিমেষেই। তোমার নিষ্ঠুরতায় দ্রুত হারিয়ে ফেলছি খেই জীবনের; সময়-যাপন, মনে হয়, কী বিস্বাদ।আমিতো তোমার হাতে আমার হৃৎপিন্ড থেকে ছেঁড়া একটি গোলাপ, খুব টকটকে, করেছি অর্পণ; তোমার চলার পথে দিয়েছি উড়িয়ে স্বপ্নঘেরা রঙিন নিশান সংখ্যাহীন আর যখন তখন পাঠিয়ে কপোত কিছু তোমারই উদ্দেশে দূর নীলে নিবদ্ধ রেখোছ দৃষ্টি, তবু তুমি বিভীষিকা দিলে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আমিতো যুবক নই, মধ্য বয়সের রুক্ষ পথে নিঃসঙ্গ চলেছি হেঁটে রৌদ্রদগ্ধ আর ঝঞ্ঝাহত অভিজ্ঞ শরীরে নিয়ে পথনিষ্ঠ শ্রমণের মতো। বিমুখ সকল দিক, তবু আছি টিকে কোনো মতে। কেটেছে আমার দিন পথের কিনারে বৃক্ষমূলে বসে গান শুনে গোত্রহীন কোনো একলা পাখির, আলোজ্বলা কুটিরের খোঁজে, ভুলি কামড় ক্লান্তির, যখন আমার দিকে তুমি তাকাও দু’চোখ তুলে।পিঙ্গল বয়স নিয়ে তোমার নিটোল যৌবনের নিকটে সর্বদা নতজানু আমি; প্রতিদ্বন্দ্বী যারা তাদের বৈভব আছে জ্বলজ্বলে, যদিও মনের ঐশ্বর্যে কাঙাল নই আমিও এখনো। তুমি ছাড়া কে জানে আমার হৃস্পন্দন কত তেজী, প্রেমময়? অথচ দরজা থেকে আমাকেই ফিরে যেতে হয়।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
কেন এ বিদায় গান বারবার শোনাও আমাকে? কেউ কি কখনো মুমূর্ষের কানে কানে আওড়ায়- ফুরালো তোমার বেলা মগ্ন আমি স্বপ্নের পাড়ায়, কেন গুঁড়ো ক’রে দিতে চাও কাচের মতন তাকে? আমি তো স্বপ্নের পথ্যে ক্রমাগত বাঁচাই সত্তাকে। জীবন কাটাতে চাই সেই দু’টি চোখের তারায় চোখ রেখে, অথচ আমার দিকে প্রেত পা বাড়ায় অন্ধকারে, ঘুরি দিশাহারা ভীষণ নিশির ডাকে।আমাকে বিদায় গান কোনো ছলে শুনিও না আর; বরং আশ্বাস দাও সান্নিধ্যের এবং চুম্বন দাও আজ আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে নিবিড়-মদির। সে চুন্বনে তপ্ত অন্ধ উদ্বেলিত শেণিতে আমার উঠবে জেগে অতিদূর শতাব্দীর স্মৃতি-বিস্মরণ আর নিমেষেই হবে দীপান্বিতা তোমার শরীর।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এত পথ হেঁটে এসে কেন তুমি থমকে দাঁড়ালে? দেখছো কি নিভৃত আড়ালে সহসা এমন কিছু যা শোণিতে ছড়ায় নিমেষে অজস্র তুষার কণা অথবা চতুর ছদ্মবেশে দাঁড়ায় নিকটে এসে আতঙ্ক ভয়াল? নাকি কোনো মন্থর ময়াল পথ রোখে রাজসিক হেলায়? যাক হোক, ভয়ে তুমি বন্ধ করোনা দু’ চোখ।এই তো গন্তব্য এসে গেল বলে। দূরে রূপসীর হারের দ্যূতির মতো আলো শিহরিত, সুরে সুরে গুঞ্জরিত দশদিকে। করোনা মন্থর স্বাভাবিক গতি, দেখছো না ফুটে আছে কত জুঁই ও টগর- পথপ্রান্তে, বুক ভ’রে গন্ধ নিয়ে জোরে শুরু হবে বেনজির চাষাবাদ বিপুল বৈভবে।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
(হিতেশ মণ্ডলের স্বগত ভাষণ)আমাকে বলছ ঘুরে দাঁড়াতে, অথচ ঘুরে দাঁড়াবার মতো জায়গা পাচ্ছিলো যে। আমি খুব কিনারে গিয়েছি চলে, তুমি জেনে গেছ, তবু কেন ঘুরে দাঁড়াবার বুলি ফোটে তোমার এ মুখে? ওরা তেড়ে আসে এই শান্ত মাটি কাঁপিয়ে যখন, ঘরদোর নড়ে ওঠে চিৎকারে, তখন তুমি কেন আনো না ছুটে? আজ ঘুরে দাঁড়াবার পরামর্শ বড় ফাঁকা, বড় ফাঁকা মনে হয় এই সর্বনাশগ্রস্তকালে। ঘুরে দাঁড়াব না।যত পারে আমাকে দেখাক ভয়, আমি মৃত্তিকায় মিশে যাব। আমার ঘরের পোড়া মাটি, দলিত পীড়িত লতাপাতা দেখুক আমার নত মাথা, দেখুক দোয়েল আমি কেমন নিস্তব্ধ প্রস্তরখণ্ডের মতো। আমার তরুণ সহোদর ভিটেমাটি ছেড়ে ছুড়ে বেগানা দিগন্ত পানে ভয়ে জড়সড় চলে যেতে চায়-এই সব দেখে নিক দেবতার ভাঙা হাত, মা দুর্গার মুণ্ডহীন অগ্নিদগ্ধ ধড়।বন্ধু, আর বেশি দেরি করো না, একটু ঘুরে দাঁড়াবার মতো জায়গা দাও, এক্ষুণি দাঁড়াই।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
খুব ভোরে জেগে উঠে দেখি চেনা সুন্দর পৃথিবী আমার দিকেই গাঢ় মমতায় তাকিয়ে রয়েছে; গাছ, লাল গোলাপ কাছের নার্সারির, খোলা পথ নীলকণ্ঠ, ভাসমান মেঘ শুভেচ্ছা জানায়, ভাবি- আজ তুমি প্রিয়তমা, সুস্থ থাকবে, আনন্দে ভরে রইবে তোমার মন। কেননা আবার কাল রাতে দেখা হলো আমাদের। দুপুরে তোমার সঙ্গে কথা বলে কণ্ঠস্বর শুনে তোমাকে নীরোগ জানলাম।এমত ধারণা হলো, আমার গভীর ভালোবাসা তোমার শরীর থেকে সহজে ফেলেছে মুছে সব যন্ত্রণা, মনের ক্লেশ। এ ধারণা আমার গর্বের ঝুঁটিকে অধিক দীপ্ত করে তোলে। অথচ সন্ধ্যায় তোমার মধুর কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসুখের স্বর- ব্যর্থতা আমাকে করে গ্রাস, বড়ো ম্লান হয়ে যাই।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
বেশ কিছুদিন হলো, বহুদিন হলো অসুস্থতা চঞ্চুতে রেখেছে বিদ্ধ করে লোকটিকে। এখন সে পড়ে না সংবাদপত্র, কতদিন কবিতার বই সস্নেহে আলতো ছুঁয়ে রেখে দেয়, কখনো হয় না পড়া, মাঝে মাঝে খুব কষ্ট ক’রে একটি কি দু’টি কবিতা অথবা ‘ছিন্ন পত্রাবলী’ থেকে এক আধ পাতা চেখে নেয়, রোগাক্রান্ত ক্লান্ত চোখ বুঁজে আসে; শোণিতে শর্করা হেতু দুর্বল শরীর, মনে পড়ে- সমানবয়সী বন্ধু কেউ কেউ গত, কেউ কেউ ধুঁকছে অসুখে ইদানীং তারই মতো। সাড়ে তিন বছরের পৌত্রী এসে যখন জড়িয়ে ধরে গলা, কথা বলে শৈশবের স্নিগ্ধ স্বরে, অসুস্থ লোকটা কেমন সজীব হয়ে ওঠে, মৃত্যুচিন্তা অস্তাচলে যায়। উৎসুক অথচ ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে তাকায় শিশুর দিকে, যে সম্পদ কিংবা বিষাদ বোঝে না, ফুটে থাকে কনকচাঁপার মতো। এই বয়সেও এ বিবর্ণ কালেও যে তাকে ভালোবাসে, যখন সে চলে আসে কোনো সন্ধেবেলা, তাকে দেখলেই চিত্তময় রঙিন ফোয়ারা উচ্ছুসিত হয়, তার কণ্ঠস্বর একবার শুনলেই আরো বহুকাল বাঁচবার সাধ জাগে, তার গভীর মনোজ শুশ্রূষায় জীবনের বহু ক্ষত সেরে যায়, অন্ধকার ফুঁড়ে বৃত্ত-চাঁদ ওঠে রুগ্ন মনের দিগন্তে, লোকটার মনে হয়, বিপন্নতা জীবনকে করে উপরূপ।   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের? এখানেতো বোনাস ভাউচারের খেলা নেই কিংবা নেই মায়া কোনো গোল টেবিলের, শাসনতন্ত্রের ভেল্‌কিবাজি, নেই, নেই সার্কাসের নিরীহ অসুস্থ বাঘ, কসর দেখানো তরুণীর শরীরের ঝলকানি নেই কিংবা ফানুস ওড়ানো তা-ও নেই, তবু কেন এখানে জমাই ভিড় আমরা সবাই?আমি দুর পলাশতলীর হাড্ডিসার ক্লান্ত এক ফতুর কৃষক আমি মেঘনার মাঝি, ঝড়-বাদলের আমি চটকলের শ্রমিক, আমি মৃত রমাকান্ত-কামারের নয়ন পুত্তলি, আমি মাটিলেপা উঠোনের উদাস কুমোর, প্রায় ক্ষ্যাপা, গ্রাম উজাড়ের সাক্ষী, আমি তাঁতী সঙ্গীহীন, কখনো পড়িনি ফার্সি, বুনেছি কাপড় মোটা-মিহি সিনেমার রঙিন টিকিট মধ্যযুগী বিবর্ণ পটের মতো ধু-ধু, নিত্য সহচর, মিশিয়ে মৈত্রীর ধ্যান তাঁতে, আমিরাজস্ব দফতরের করুণ কেরানি, মাছি-মারা তাড়া-খাওয়া, আমি ছাত্র, উজ্জ্বল তরুণ, আমি নব্য কালের লেখক, আমার হৃদয়ে চর্যাপদের হরিণী নিত্য করে আসা-যাওয়া, আমার মননে রাবীন্দ্রিক ধ্যান জাগে নতুন বিন্যাসে এবং মেলাই তাকে বাস্তবের তুমুল রোদ্দুরে আর চৈতন্যের নীলে কত স্বপ্ন-হাঁস ভাসে নাক্ষত্রিক স্পন্দনে সর্বদা।আমরা সবাই এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের? কোন্‌ সে জোয়ার করেছে নিক্ষেপ আমাদের এখন এখানে এই ফাল্গুনের রোদে? বুঝি জীবনেরই ডাকে বাহিরকে আমরা করেছি ঘর, ঘরকে বাহির।জীবন মানেই মাথলা মাথায় মাঠে ঝঁ ঝাঁ রোদে লাঙল চালানো,জীবন মানেই ফসলের গুচ্ছ বুকে নিবিড় জড়ানো,জীবন মানেই মেঘনার ঢেউয়ে দাঁড় বাওয়া পাল খাটানো হাওয়ায়,জীবন মানেই পৌষের শীতার্ত রাতে আগুন পোহানো নিরিবিলি।জীবন মানেই মুখ থেকে কারখানার কালি মুছে বাড়ী ফেরা একা শিস দিয়ে,জীবন মানেই টেপির মায়ের জন্যে হাট থেকে ডুরে শাড়ি কেনা,জীবন মানেই বইয়ের পাতায় মগ্ন হওয়া, সহপাঠিনীর চুলেজীবন মানেই তালে তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলা, নিশান ওড়ানো,জীবন মানেই অন্যায়ের প্রতিবাদে শূন্যে মুঠি তোলা, অন্তরঙ্গ আলো তরঙ্গের খেলা দেখা,জীবন মানেই মায়ের প্রসন্ন কোলে মাথা রেখে শৈশবের নানা কথা ভাবা,জীবন মানেই খুকির নতুন ফ্রকে নক্সা তোলা, চারু লেস্‌ বোনা,জীবন মানেই ভায়ের মুখের হাসি, বোনের নিপুণ চুল আঁচড়ানো,জীবন মানেই প্রিয়ার খোঁপায় ফুল গোঁজা;জীবন মানেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে একা আরোগ্য ভাবনা,জীবন মানেই গলির মোড়ের কলে মুখ দিয়ে চুমুকে চুমুকে জলপান,জীবন মানেই রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়ানো,জীবন মানেই স্ফুলিঙ্গের মতো সব ইস্তাহার বিলি করা আনাচে কানাচেজীবন মানেই ... ... ... ... আবার ফুটেছে দেখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে কেমন নিবিড় হ’য়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় – ফুল নয়, ওরা শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর। একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ। এ-রঙের বিপরীত আছে অন্য রঙ, যে-রঙ লাগে না ভালো চোখে, যে-রঙ সন্ত্রাস আনে প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে-সকাল সন্ধ্যায়- এখন সে রঙে ছেয়ে গেছে পথ-ঘাট, সারা দেশ ঘাতকের অশুভ আস্তানা।আমি আর আমার মতোই বহু লোক রাত্রি-দিন ভূলুন্ঠিত ঘাতকের আস্তানায়, কেউ মরা, আধমরা কেউ, কেউ বা ভীষণ জেদী, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া। চতুর্দিকে মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ। বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ, বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে। সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা, সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা। দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই জনসাধারণ দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে হৃদয়ের হরি উপত্যকায়। সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ, শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।
শামসুর রাহমান
রূপক
আমি আর করবো কত শোক? অপরাহ্নে পাথরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে মাঝে মধ্যে থমকে দাঁড়াই। ভূগর্ভস্থ কোনো স্তব্ধ সভ্যতার মতো নিস্তব্ধতা চর্তুদিকে। এদিক ওদিক, সবদিকে খানিক তাকিয়ে, পাথরের মধ্যে দিয়ে খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে দু’পায়ে বাজিয়ে নুড়ি এগোই একাকী।ছায়াচ্ছন্ন পথ, সাঁকো, উঠোন, ইঁদারা পুরোনো কালো পাম-সু, বিবর্ণ, বিবাহমণ্ডপ, নৈশ ভোজ, ঝলমলে গোরস্থান, নানান বয়সী কত মুখ ভেসে ওঠে বারংবার। খুব উঁচু বুনো ঘাস সরাতে সরাতে দু’পায়ে বাজিয়ে নুড়ি এগোই একাকী।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
একদা যখন জ্বলজ্বলে ছিল তাঁর সত্তা তাঁকে দেখে লেগেছিল ভালো আর অন্তর্গত আভা দশজন থেকে স্পষ্ট করেছিল বিশিষ্ট, আলাদা।কণ্ঠে তাঁর বাংলার মাটি আর নদীর ঢেউয়ের অপরূপ ধ্বনি জেগে অজস্র শ্রোতাকে আনন্দিত করেছে এবং আজও জ্যোৎস্নারাতে অনেকে শুনতে পায় তাঁর গান তৃতীয় প্রহরে।মোমতাজ আলী খান মৃত্যুর পরেও কখনও কখনও তাঁর সুর শহরে ও গ্রামে মানুষের হৃদয়ের গভীরে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সুদূরে নিয়ে যান।এখনও নিষ্ঠুর এই কোলাহলময়,স্বার্থপর কালে মোমতাজ আলী খানের সন্তান নানা প্রতিকূল বেড়া ডিঙিয়ে পিতার, গুরুর সাধের মান রাখবে নিশ্চিত।এইতো গোধূলিলগ্নে দৃষ্টিপথে ভেসে ওঠে-দূরে দীর্ঘদেহী একজন পুরুষ যাচ্ছেন হেঁটে ধীরে পেরিয়ে বাঁশের সাঁকো দূরে, বহু দূরে-সত্তা তাঁর সুর হয়ে যাচ্ছে ভেসে মেঘের অন্তরে।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
পুরাকালিএ কে এক বণিক তার সবচেয়ে দামি মুক্তোটিকে বাগানের মাটির গভীরে রেখেছিল লুকিয়ে যেখানে সূর্যের তিমির-দীর্ণ আলো পৌঁছেনি কখনো, হৈমন্তী গাছের পাতা ঝরেনি যেখানে।তোমাকে পাওয়ার ইচ্ছা সেই মুক্তোর মতোই জ্বলে আমার ভেতর রাত্রিদিন আর আমি ভাবি এই সৌন্দর্যকে লালন করার আশ্চর্য সাহস কে দিল আমাকে?   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
জ্যোৎস্নার আদর খেয়ে চিতাবাঘ শোভার ভেতর নিভৃতে ঘুমায়। অকস্মাৎ খস্‌ খস্‌ শব্দে লাফাবার ভঙ্গি রচিত, দু’চোখ ফস্‌সরাসের কণা ছড়ায়, আঁধার শিহরণের নববধূ, পেশী টান টান, জ্যোৎস্না পান ক’রে তার সমগ্র সত্তায় মদিরতা জেগে ওঠে, পরিপক্ক নিশীথের মাংস দাঁতে গেঁথে খুঁজে নেবে ঝোপের আড়াল, পাবে শব্দ-শিকারীর হরফের মমতা এবং বাংলা কবিতার বুকে চোখের আগুন তার রত্ন দশকের পরপারে।দুর্ধর্ষ শিকারী কালো বন্দুকে উঁচিয়ে ধরে সেই চলমান ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের দিকে। কবির কলম বন্দুকের মুখটিকে মূক ক’রে দিতে চায়; গুলির আওয়াজ ফেটে পড়ে, ঘন ঘন আর্তনাদ, বিষাদ ভাসতে থাকে রুপালি প্লাবনে; কলম এবং কবি রক্তস্নাত, শিকারীর পদতলে নিঃস্পন্দ, নিথর।   (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
একটি আশ্চর্য মুখ দেখি আমি স্বপ্নের প্রহরে মাঝে-মাঝে; সেই একই মুখ নীল সমুদ্রের পানি থেকে জেগে ওঠে, সিক্ত ওষ্ঠে তার গূঢ় ঝলকানি হাসির, কখনো দেখি সে রয়েছে ঘুমের ভেতরে পথপার্শ্বে একাকিনী কোনো এক প্রাচীন শহরে। অজ্ঞাত শিল্পীর ক্ষিপ্র ছেনী তাকে রহস্যের রানী রূপে কবে করেছে নির্মাণ; চোখে কী গভীর বাণী নিয়ে চেয়ে থাকে শুধু নিষ্পলক নিস্পন্দ পাথরে!আশ্চর্য সে-মুখ বুঝি কেউ খৃষ্টপূর্ব জগতের। ঘুম ভেঙে গেলে ভাবি তারই কথা, ছন্দিত পাথুরে তার অবয়ব বারবার ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে। পুনরায় নীল সমুদ্রের ঢেউ তাকে দেবে ছুঁড়ে আমায় সত্তার তটে? মনে হয়, স্বপ্নের জগতে দেখা সেই মুখ যেন প্রতিচ্ছায়া তোমারই মুখের।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এই তো আমি অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটে সন্ধেবেলা পৌঁছে গেছি তিন শো বছর পুরনো এক গাছের নিচে। কিন্তু আমি এমন স্থানে এলাম কেন? নিজেকে এই প্রশ্ন ক’রে জবাব খুঁজে পাই না কোনও। আমার ভেতর মুষড়ে-পড়া সঙ্গীবিহীন পথিকটিকে কী ক’রে যে বটের তলায় এই অবেলায় করি সুখী!নই তো সাধু, কিংবা তস্‌বি-হাতে কোনও শুদ্ধ ফকির নষ্ট কালে। এই তো চোখে আসছে নেমে ঘুমের পর্দা; এই বিরানায় আয়েশ-ছড়ানো শয্যা আমি পাবো কোথায়?হঠাৎ একি! আমার সামনে দাঁড়ায় এসে হরিণ-ছানা কিন্তু কিছু পরেই এক হিংস্র পশু এসে আমায় শাসায় বেজায়, নখরগুলো রোদে ভীষণ ঝলসে ওঠে!দেখছি যা’ যা’ সব কিছু কি সত্যি না কি ক্লান্তি-কালো দুঃস্বপ্ন এক? চোখে নানা বিশ্রী ছবি উঠছে ভেসে; কখন পাবো মুক্তি আমি বটতলার এই জুলুম থেকে?   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
ইদানীং মানুষের মতো কিছু বাঁদর দেখেছি, অবিকল বাঁদরের মতো কিছু বিহ্বল মানুষ। বাহিরকে করে ঘর ওরা আর ঘরকে বাহির; রাজপথে, ফুটপাতে, বাস টার্মিনালে, ঘাসময় পার্কে আর সিনেমায় জমকালো বাঁদরের ভিড় দেখে করতালি দিতে সাধ জাগে। ইচ্ছে হয় ডেকে সবাইকে বাতাসা খাইয়ে দিই শান্ত গোধূলিতে বাঁদরের চেয়েও অধিক বাঁদরামি দেখে আজ।কিছু-কিছু অতিশয় প্রকৃষ্ট বাঁদর অন্তরালে সূক্ষ্ম কাজ করে চলে অবিরত, ঢালে লম্বা কানে নানান ঘোরালে কথা, খাল কেটে আনে কুমিরের বংশধর, কোনো বাঁদর সাজানো মঞ্চ থেকে মঞ্চান্তরে অপরূপ ভেংচি কাটে, লাঙুলের শোভা দেখিয়ে বেড়ায় আর কতিপয় ব্যথিত বাঁদর বিচ্ছেদের পদ্য লেখে এবং তুখোড় বাঁদরেরা কলম বাগিয়ে ইস্‌ বানায় থীসিস মজাদার  (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
জমে নি আমার পুণ্য এক রত্তি ভেবে নিয়ে পাড়াপড়শিরা জনান্তিকে আমাকে হাবিয়া দোজখের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন দশবার। আল্লা-অলা একজন আমাকে গাফেল আখ্যা দিয়ে মনে-মনে এশার নামায শেষে কিছু নসিহতের আহত সাগ্রহে ছিটিয়ে দেন আমার ওপর।একজন বাউল ঘুঙুর পায়ে দোতারা বাজিয়ে আমাকে মনের মানুষের নিগূঢ় সন্ধান দিতে গান গেয়ে রহেস্যের টানেন। নিয়মিত নিশীথে জিকির-করা মারফতী একজন জপেন আমার কানে কানে, ‘আখেরাতে তোমার কী হাল হবে বেখবর তুমি মুর্শিদ খোঁজো না’!একজন প্রচণ্ড পণ্ডিত খুব আড়চোখে পর্বত প্রমাণ আমার অজ্ঞতা দেখে অট্রহাসি হয়ে যান আমার কতিপয় মেরুদণ্ডহীন লোক, ‘দেখি তোর শিরদাঁড়া কই’ বলে এক ঝটকায় বিকেল বেলায় আমার চায়ের পেয়ালাটা কেড়ে নেয়, তরল পানীয় আর নিষ্ঠীবন একাকার। আমি সব কিছু উপেক্ষার পর্দার আড়ালে রেখে দেখি হাঁটি হাঁটি পা পা আমার নাতনী আমারই উদ্দেশে ছুতে আসে। কবিতার খাতা আপাতত দূরে সরিয়ে ক্ষণিক শিশুঘ্রাণ বুকে নিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে পড়ন্ত বেলায় পুণ্যস্নান করি।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আমার ঘরে ডাকে, রাত্রিদিন ডাকে ভয়াল সুরে এক চতুর তক্ষক। স্বস্তি নেই মনে, ঘুরছি এলোমেলো, অথচ সে-ই নাকি আমার রক্ষক!নানান ছলে তার সঙ্গে অবিরাম খুঁজছি বস্তুত সুযোগ সন্ধির। ভীষণ তার ডাকে নিয়ন্ত্রিত আমি, বাস্তবিক এ জীবন বন্দীর।অন্ধকার যেন জ্যান্ত অতিশয়, চতুর্ধারে আলো এখন কী দুস্থ। ধ্বস্ত চোখ মুখ, চৈতন্যে আঁধি; ঘুরছি নরলোকে একাকী, অসুস্থ।রক্তে জমে শুধু তুষারকণা, প্রাণে শংকা সর্বদা গুপ্ত হত্যার দিগ্বলয়ে ঘোর মত্ত বৈশাখী, কাঁপছে থরোথরো ভিত্তি সত্তার।দুঃস্বপ্নে চেনা শহর লুণ্ঠিত; অগ্নি ক্রমাগত করছে বনগ্রাস। রণচন্ডী মাটি দেয় না নির্ভর, নিখিল প্রাণীকুলে ব্যাপক সন্ত্রাস।এড়াতে পারিনা যে ঘরের শক্রুকে; আড়াল থেকে দ্যাখে চতুর তক্ষক। দেয়ালে ঠুকি মাথা, কখনো ঢাকি মুখ, তবে কি সে-ই হবে আমার ভক্ষক?   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়। মমতা নামের প্রুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে শিউলিশৈশবে 'পাখী সব করে রব' ব'লে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি, অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন, ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে। আজন্ম আমার সাথী তুমি, আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ'ড়ে পলে পলে, তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে আমারই বন্দরে।
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
শহীদ, বলো তো বন্ধু সেই সব দুপুর, গোধূলিবেলা আর সন্ধ্যারাত, মধ্যরাত মার্কিন মুলুকে ঢেউ হয়ে স্মৃতিতটে আছড়ে পড়ে কি কখনও সখনও? বলো, পাতাল ট্রেনের কামরায় তন্দ্রাচ্ছন্ন মুহূর্তে চকিতে জেগে ওঠো নাকি বিউটি বোর্ডিং আর লক্ষ্মীবাজারের ঘ্রাণে?যখন বস্টনে ঘন কুয়াশার কাফন জড়ানো সন্ধেবেলা কাঙ্ক্ষিত আড্ডায় মেতে ওঠ কিংবা তুষারের আলিঙ্গন ছিঁড়ে দীর্ঘক্ষণ কর্মস্থলে ডুবে থাকো, তখন কি আচানক মনে পড়ে যায়, হায়, কোনও কোনও মৃত, অর্ধমৃত ঢাকাবাসী বান্ধবের মুখ? কখনও মনে কি পড়ে বুদ্ধদের বসুর কবিতাভবনের স্পর্শময় ‘কবিতা’-পত্রের জন্যে অধীর প্রতীক্ষা আমাদের? তখন কি তোমাকে দখল করে অতীতের স্মৃতি-কাতরতা? শহীদ, যখন তুমি হিম-রাতে বন্ধ দরজা জানালা, উষ্ণ কামরার চারদিক নীরবে আবৃত্তি করো আর কোনও কবিতার বই খুলে আঙুলের ফাঁকে ধূমায়িত সিগারেট কোমল বুলিয়ে পাঠ করো কোনও বিদেশি কবির তাজা কবিতা, তখন তোমার পড়ে কি মনে সুকুমার, জাহাঙ্গীর, তাহের অথবা বুড়ো কিংবা আখতার, খালেদ চৌধুরী ফিল্মপ্রিয় দীর্ঘকায় বাচ্চু, সঞ্জীব, সৈয়দ হক, কায়সুল আর এই সত্তর-পেরুনো অতিশয় ধূসর আমার কথা? হে প্রিয় বান্ধব, বলো, মনে পড়ে নাকি?কী আশ্চর্য, শহীদ তুমিও, হ্যাঁ, তুমিও জ্বল জ্বলে একদা-কিশোর, এ-ও সম্ভব ষাটে থরথর? যায় উচ্ছলতা, ঔজ্জ্বল্য কী দ্রুত ক্ষয়ে ফিকে হয়ে যায়, হাহাকার জেগে রয়; শুধু কি যৌবন অস্তাচলে মিশে যায়? সৌহার্দের, সখ্যের গোধূলি লুপ্ত হয় দীর্ঘশ্বাসে। কাদা থেকে উঠে-আসা অতিকায় জন্তুর জঠরে যাচ্ছে চলে বাগান, পূর্ণিমা-চাঁদ, বাংলার মানব মানবী!শহীদ, হে প্রিয় বন্ধু আমার, তুমি কি ফিরে এসে ভূমিধসে অসহায়, দুঃস্বপ্ন-তাড়িত ভাঙাচোরা মানুষের ভিড়ে মিশে অন্ত্রাঘাত মাটি-চাপা পড়ে কোনও এক অজ্ঞাত কবির শোকগাথা হতে চাও? আপাততসুদূরের অনন্য প্রবাসী তুমি আর এই অবসন্ন আমি শক্রময় নিজ বাসভূমে পরবাসী।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
সে রাতে ছিলেন তিনি মাইফেলে। আশি বছরের ম্লান খড়কুটো তাঁর সমগ্র সত্তায়।কী উদাস চক্ষুদ্বয়, শিরাপুঞ্জে বয় মাঘ, শুধু দীর্ঘশ্বাস ঘিরে রয় তাঁকে; দেখছেন ঘরে ঝাড় লণ্ঠনের শোভা নেই; মনে পড়ে, বাইজীর ব্যস্ত নূপুরের মতো বেজেছিলো কত প্রহর এবং বারোমাস ছিলো বেনো সুরের নক্‌শায়! অন্য নিবিড় আকাশ চকিতে উঠতো জেগে আড়ালে ধামার, খেয়ালের।ঈষৎ নোয়োনো মাথা তুলে প্রতিপক্ষ শূন্যতার মূক পটে আঁকলেন উদারার গান্ধার মধুর- তখন বাইরে অমাবস্যা, ঘরে অঝোর পূর্ণিমা। দেখি না পাঞ্জবি কিংবা কালো মখমলের টুপি তাঁর, এমন কি চোখ-মুখ। এখন তো নিজে তিনি সুর, শুধু সুর, অজর তরুণ এক, লুপ্ত সব সীমা।   (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
তোমার ফেরার দিন আজ। ঘর-বার ঘর-বার করছি কেবল, কোনো কিছুতেই মন বসছে না এ মুহূর্তে, এ রকম তোলপাড় চেনা কি অচেনা সহজে যায় না বলা। আজ লঘু হবে মনোভার। কী ভাবে বরণ করি তোমাকে? স্বাগত জানাবার নেই কো আমার অধিকার বিমান বন্দুরে গিয়ে; আমার নিজের ঘরে বসে যদি রুমাল উড়িয়ে অদেখা তোমাকে ছুঁই, কে থাকে বারণ করবার?তোমার উদ্দেশে আজ হীরকের তোরণ নির্মাণ করব সযত্নে আর আমার সকল স্বপ্ন এসে হবে লাল গালিচা নিভৃতে, তুমি লঘু পায় হেঁটে যেও তোমার মোটরকারে। আমি যত গান, প্রেমের কবিতা লিখে এতকাল রেখেছি খাতায়, ওরা সব স্বাগত জানাবে তোমাকেই ভালোবেসে।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
আমি আমার বাড়িতে প্রত্যহ আসা-যাওয়ার পথে একটি গাছকে দেখি। অসামান্য কিছুই নয়, ফুলটুলও তেমন ফোটে না তার ডালে। সবুজ পাতাগুলি ঝলমলিয়ে ওঠে রোদে, পান করে জ্যোৎস্নাধারা। সবুজ পাতাগুলি কখনো হলদে হয়, তারপর পাতা ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে গাছটিকে উলঙ্গ ক’রে। আমি তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমার মধ্যবয়সের ক্লান্তি মুছে ফেলতে যাই না, ওকে দেখি দূর থেকে, বাড়ি ফেরার পথে, বাড়ি থেকে বেরুবার সময়। কখনো কখনো শুনি কী একটা পাখি ডাকতে থাকে, ডাকতে থাকে ডাকতে থাকে গাছটিকে সঙ্গীতময় ক’রে। একদিনের কথা, কোত্থেকে এক ছন্নছাড়া উদ্ভ্রান্ত ফকির সেই গাছতলায় আস্তানা গাড়লো কদিনের জন্যে, তারপর বলা-কওয়া নেই হঠাৎ নিরুদ্দেশ। মাঝে-মধ্যে পাড়ার দু-একজন মাস্তান সময়ের তোয়াক্কা না করে আড্ডা দেয় সেখানে, ওদের মধ্যে কেউ গাঁজেল, কেউ তাড়ি টানে, কেউ নারীর আঁচল, কেউবা পাকিয়েছে হাত ছোরা খেলায়। ছাপোষা মানুষ আমি, বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকের অক্ষম সন্তান। ইদানীং বয়সের ভারে ভয়ানক নুয়ে পড়েছেন আমার পিতা, অবসর তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে, জীবনের হাতে মার খেতে খেতে তিনি ভীষণ অবনত। যখন তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়েন, তখন তাঁকে শাদাসিধে আলমগীরের মতো মনে হয় আমার নিজস্ব স্বপ্নের খোয়ারিতে। আমি এখনো মাথা নত করিনি। যা আমার শিক্ষক জনক আমাকে শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন সেই উজ্জ্বল সবকটি আমি শিখে নিয়েছি শান-বাঁধানো পথের ধারের সেই গাছ থেকে, শিখে নিয়েছি তুমুল ঝড়-বাদলেও কী করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
লিপিমূলক
আমরা বাগান চাই আমরা ক’জন অকপট, শান্তিবাদী ক্লান্ত নাগরিক এমন বাগান চাই যেখানে ফুলের কাছে সহজে পারবো যেতে, ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে দিব্যি পা দুটো নাড়বো অকারণ মাঝে মাঝে। কী কী ফুল থাকবে বাগানে তার সুদীর্ঘ তালিকা বলোতো পাঠাতে পারি পৌর সমিতির কাছে। ভদ্রমহোদয়,আমরা বাগান চাই, আমরা ক’জন হতচ্ছাড়া, যারা মাঝরাস্তা দিয়ে ভাগ্যের ছ্যাকড়া গাড়ি হাঁকাতে হাঁকাতে বড়ো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সম্প্রতি, আমরাই শহরে বাগান চাই লিরিকের প্রসন্নতা-ছাওয়া; এবং বিশ্বেস করো আছে আজো চাওয়ার সাহস।২ চেতনপুরে ফুলের চারায় ধরলো নতুন কলি; ছেঁড়া জামায়, জুতোর গর্তে করছি স্বপ্ন জড়ো। স্বপ্ন-আভায় স্বর্গ হলো চেনা ময়লা গলি, হিংসুটে সব মত্ত পথিক সরো তোমরা সরো। আমরা কিছু দুর্বিনীত বাগান বাগান বলে কান করেছি ঝালাপালা মানী-গুণীর বটে। ফুলবাগানের অলীক মালী শুনছি সে কোন্‌ ছলে মস্ত বাগান সাজিয়ে দেবে, দৈবে কতোই ঘটে!শিল্পকর্মে আস্থা ছিল বলেই ক্ষুধার দাঁতে দীর্ণ হয়ে ক্লিন্ন প্রাণে পোড়াই আতশবাজি। ঘুমাক তারা ঘুমাক সুখে নিদ্রা এলে রাতে, ঝুলিয়ে কাঁধে মরা পাখি আমরা ঘুরতে রাজি।৩ এমন বাগান চাই যেখানে গেলেই নির্বিবাদে লতাপাতা জড়ানো ঘোড়ার মূর্তি দেখে অচিরাৎ ভুলবো দুঃসহ শোক, বস্তুত বাগানে এসে কোনো কোনো দিন- বুধবার, শুক্রবার, কিংবা রবিবার, হোক না যে কোন দিন, খুঁজবো অদৃশ্য আরোহীকে লোহার ঘোড়ার পিঠে! দেখবো বেঞ্চিতে বসে অচেনা কে লোক চুরুটটা ফুঁকে ফুঁকে ইতস্তত স্মৃতির খোলামকুচি ছড়াচ্ছে প্রচুর। বুঝি নিঃসঙ্গতা কালো সহোদর তার!আমাদের রমণীর মুখে ফুলের স্তবকগুলি মেলুক আরক্ত ডানা, আমাদের শিশুদের মুখে দয়ালু বাতাস দিক চুমু ঘন ঘন, ফুলবাগানের ডাল মাতাল কবিকে দিক কবিতার পংক্তি উপহার।এবং সেসব ডালে বিষ পিঁপাড়েরা কখনো সদলবলে বাঁধতে না পারে যেন বাসা; যদি বাঁধে তাহলে কি করে যাবো বাগানের পথে? কী করে ছেলেরা ডাল বেয়ে বেয়ে কেবলি হারিয়ে যাবে পাতার জঙ্গলে?ভদ্রমহোদয়! বারো মাস তের পার্বণ-কাতর লাজুক আত্মাকে বসতিতে যথাযথ রাখার প্রয়াসে নিত্য উচাটন আমরা কখনো গুহাকে করিনি ঘর, রাখিনি পানীয় করোটিতে, আঁকিনি স্বর্গের নক্সা বাঘছালে, তুকতাক মন্ত্রের প্রাচীন কোনো পুঁথি ছিল না সম্মুখে সর্বক্ষণ। হল্‌দে পুঁথির তুলোট পাতা আকাঙ্ক্ষার শবটাকে কখনো পারে কি দিতে চাপা? একদিন লক্ষ্যে পৌছে যাবো নিরাপদে আমরা তেমন কেউ নই; দূরে ও নিকটে প্রকৃতই লক্ষ্য কিছু আছে কিনা সেও তো জানি না। নানান ফুলের গাছে সুশীতল জল দেবো বলে দু’বেলা অসীম ধৈর্যে ঝারি হাতে সবাই প্রস্তুত, অথচ বাগানই নেই, কোথাও বাগান নেই আজ।  (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
এবং সত্যের মুখ দেখেছিলেন ব’লেই তিনি, সক্রেটিস, সয়েছেন নির্যাতন, অকাতরে পান করেছেন হেমলক-এই আত্মাহুতির পুরাণ চিরঞ্জীব; বিশ্বচরাচরে এভাবেই ছিনিমিনি খেলা খেলে যুগে যেগে পরাক্রান্ত কবন্ধ সমাজ চক্ষুষ্মনদের নিয়ে। আপোষের ক্লিন্ন যষ্ঠি হাতে এখানে সেখানে ঘোরা কখনো ছিনো না তাঁর ধাতে, তাই আজো আমাদের ভাবলোকে তিনি মহারাজ।তবে কি একাই তিনি নির্ষাতিত নিগৃহীত খৃষ্টপূর্বকালে? তাঁর সমকালে হয়নি শিকাব অন্য কেউ দাঁতাল অমানবিক হিংস্র অন্ধতার? অবশ্যই আরো কেউ কেউ হয়েছেন বলি নিজ নিজ মত প্রকাশের দায়ে; ইতিহাস আড়ালেই রেখেছে তাঁদের, তবু তাঁরা সত্যেই অচিনা বীজ।   (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আমি কি হারিয়ে ফেলে পথ এসেছি এখানে এই জনহীন প্রায় অবাস্তব জায়গায়? চারদিকে দৃষ্টি মেলে দেখতে পাচ্ছি না মানব-সন্তান, পশুপাখি কাউকেই, এমনকি গাছপালা, হ্রদ তা-ও নেই।হঠাৎ কোত্থেকে এক অর্ধনগ্ন পুরুষ নাচতে শুরু করে এবং নিমেষে জায়গাটা অপার্থিব মনে হলো আর আমি ডানা মেলে উড়ে যেতে-যেতে মেঘে মিশে যেতে থাকি। পাখি হয়ে গেছি ভেবে পক্ষী-সমাজের রীতি, নীতি মেনে নিতে থাকি।আমাকে কে যেন বলে কানে কানে, ‘তুমি এ কার নির্দেশে মানবের রীতি-নীতি বিসর্জন দিয়ে উড়ে যাচ্ছো দিব্যি মনের খেয়ালে মেঘলোকে? ডানা খসে যাচ্ছে অতি দ্রুত, এখন আমি কি পতনের ধ্বংসকণা হয়ে যাবো?২ আমি কি তোমার দোরে গিয়ে কড়া নেড়ে নেড়ে শুধু ক্লান্ত হয়েই নিজ বাসগৃহে ফিরে এসে, হায়, হাতে তুলে নেবো কবিতার বই! তার মুখ যদি দেখতে পেতাম, যদি তার কথা শুনতে পেতাম, যদি তার দু’টি মায়াবী নয়ন আমার চোখের ধূসর মরুতে দিতো ঢেলে সুধা, আমার হৃদয় হয়ে যেতো এক পুষ্পবাগান!গৃহিণী আমার পাশে এসে শোয়, নানা কাজে খুব ক্লান্ত শরীরে ঘুম এসে চুমো খায় তার চোখে। কবিতার বই বুকে রেখে আমি দেখতে না-পাওয়া দয়িতার কথা ভাবতে গিয়েই কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি আমার মনের রুক্ষ বাগানে চকিতে ফুল হয়ে ফোটে।৩ অনেকটা পথ আমাকে হেঁটে যেতেই হবে, এই সত্য রৌদ্রের মতো ঝলমল করে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাকে। দৃষ্টি দূরে প্রসারিত করে খানিক ভাবলেই বুঝতে পারছি, আমার এ ভ্রমণ তেমন সহজ হবে না। এই তো ইতিমধ্যেই পায়ে ফোস্কা পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে, একটু বসে জিরিয়ে নিলে মন্দ হতো না। পরমুহূর্তেই মনে হলো, এই অবেলায় এখানে থামলে কে জানে কোন্‌ বিপদ লাফিয়ে পড়বে পথিকের ওপর। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতেই কয়েকটি পাথর আমার দিকে ধেয়ে আসে। থমকে দাঁড়াতেই যেন কার কান্নার রোল আমাকে ভয়ার্ত করে তোলে। এমন ডুকরে ডুকরে কে কাঁদছে? সে কেন আসছে না আমার দিকে নির্ভয়ে?৪ আমাকে কোথায় তুমি কোন্‌ পথে নিয়ে যাবো পারবো কি সহজে বুঝতে? ভুল পথে চলে যাওয়া মুশকিল নয় বটে, তা বলে কি থাকবো অনড়? যেতে হবে বহুদূরে উজিয়ে সকল বাধা, পথ চেয়ে রয়েছে অনেকে। ডাক দিয়ে যাবো জোরে ডানে বামে সবদিকে, শুনুক, নাই-বা শুনুক কেউ।৫ এই যে আখেরে এই ঘোর অন্ধকারে এসে গেছি জনহীনতায়, ক্রমাগত ও রাম, রহিম, বলো ভাইসব, কোথায় তোমরা? আমাকে আশ্বস্ত করো বজ্রধ্বনি ছড়িয়ে চৌদিকে। সেই কবে থেকে এই ধ্বনি শোনার আশায় আছি দিনরাত জেগে আর আঁকছি কত না ছবি কাঠ-কয়লায় দেয়ালে দেয়ালে। আমাদের অনেক সাথির রক্তে-লেখা ইতিহাস হচ্ছে না কি উচ্চারিত রাজপথে, বস্তিতে বস্তিতে, ছাত্রাবাসে? দিকে দিকে জয়ধ্বনি শোনার আশায় এ বাংলার বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক, যুবতী কান পেতে রয়েছে সর্বদা আর কাঙ্ঘিত সেদিন দিকে দিকে উড়বে গৌরবে আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় পতাকা আর জনগণ গড়বে নতুন ইতিহাস।  (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মশারির ঘেরাটোপে চোখ মেলে দেখি- অন্ধকার সরে যাচ্ছে, যেন জেলে আস্তে সুস্থে তার জাল ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছে খুব নিরিবিলি; একটি কি দুটি পাখি ডাকে, নারকেল গাছের পাতার ঝিলিমিলি, মেঝেতে গড়ায় প্রজাপতি, মরা; হাওয়া, বাথরুমে গেলে নিলবে তো পানি? যাই। প্রতিবেশী বাড়ির জানলা খোলা, হলদে পর্দা নড়ে এবং আমার ঘরে ওড়ে কত পদাবলী নানান যুগের, দেয়ালে দেয়ালে, বারান্দায় সকালবেলার স্বাধিকার। বাজলো কলিং বেল, দরজাটা খোলো।খবরের কাগজের চেনা গন্ধ, আসছে পাশের ঘর থেকে চায়ের সোনালি ঘ্রাণ, টোস্টার সেঁকছে ঈষৎ বাদামি রুটি; লেখার টেবিলে বসে আছি, শুক্রবাসরীয় পাতায় বন্ধুর কবিতার দ্যুতি, খরার বাত্তিরে বিদ্যুল্লতা, তাঁর সঙ্গে কাল ফোনে হয়েছিল কিছু কথা, সে-কথায় অসমান্য ঝলক লাগেনি, তিনি কি লেখেন সত্যি, নাকি অন্য কেউ, অন্তর্গত, গোপনে জপায় তাঁকে অলৌকিক তস্‌বিদানার মতো অক্ষরের মালা? খরায় লেখনী তাঁর হোক অন্নপূর্ণ; খাবারের প্লেট, কানায় কানায় ভরা হাতে এলেন গৃহিণী, চলে যাই একা-একা মায়া কাননের দিকে। তাকেই কি বলে কেউ ইদানীং অজানা স্টেশন রহস্যের কুয়াশায় মোড়া?মোটর কারের হর্ণ, গলি শকুন্তলা, চমকে তাকায়, যায় সুটকেস আর সামান্য সম্বল নিয়ে একজন রিকশায়, গিটার হাতে; মুটে বয় সব্জিময় ঝাঁকা, হাঁকে মাঠা-অলা। কবেকার নির্ঝরের গান লীলায়িত সমগ্র সত্তায় অকস্মাৎ মনে হয়-কয়েক শতাব্দী আগে ছিলাম কুটিরে পদকর্তা মাঝে-মধ্যে অর্ধাহারে অথচ হৃদয়ে উঠতো বেজে যখন তখন অনন্তের সুর, ছুটে যেতাম রোদ্দুরে পুড়ে নীলাম্বরী শাড়ি-পরা সেই গৌরী ধোপানীর ঘাটে। তার অঞ্জলিতে ওষ্ঠ রেখে ব্রাত্যের দূরত্ব মুছে ফেলে আমার তৃষ্ণার জল করতাম পান, অমরতা নিয়েছিল দত্তক আমাকে।   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
এমন কুটিল অন্ধকারে হঠাৎ কোথায় যাব? জানোই তো রাগী শুয়োরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে পরিবেশ সকল সময়। তবে আমি কোথায় খুঁজব শান্তিনিকেতন?এখন দেখছ না কি শুধু শীতাতপ- নিয়ন্ত্রিত নতুন মোটরকারে জ্বলজ্বলে দুপুরে ঘুরছে মাথায় মুকুট-পরা সাঙ্যাৎ খুনীর সঙ্গে? কান খাড়া রাখলেই গলি কিংবা রাজপথ থেকে ঠিক নিয়ত আসছে ভেসে জালিমের হুঙ্কার এবং অসহায় উৎপীড়িত নরনারীদের আর্তনাদ।দুপুরেও অমাবস্যা তুখোড় মোড়ল ইদানীং। অসহায় কুমারীর সম্ভ্রম রক্ষাই দায়; শহরে ও গ্রামে কত যে নারীর জীবনের আলো নরপশুদের থাবার দাপটে নিভে গেছে, কে তার হিসেব রাখে?তবুও মানুষ ঘর বাঁধে, আসমানে নক্ষত্রের মাইফেল বসলে দেখতে চায়। শিশুকে জড়ায় বুকে আর কান পাতে দূর থেকে ভেসে-আসা বাউলের গান অথবা বাঁশির সুরে, ভালবাসে দয়িতাকে ডাগর জ্যোৎস্নায়।  (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
হ্যালো হ্যালো জাভেদ, তুমি শুনতে পাচ্ছ? এখানে কিছুই শোনা যাচ্ছে না। অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, শুধু হ্যালো হ্যালো বলাই সার, ওপার থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। টেলিফোনের ভেতর একটা ভূতুড়ে আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো ধ্বনি আমার কানে বাজছে না আজ।অথচ একজন মানুষের কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে আমি কী রকম তৃষ্ণার্তা হয়ে উঠেছি তুমি তা বুঝতে পারবে না জাভেদ। ক’দিন ধরে আমি এই আমার একলা ঘরে বিছানাবন্দি হয়ে আছি। আমার টিপয়ে এখন সূর্যাস্তের রঙের মতো ত্র্যান্টিবায়টিক ক্যাপসুল, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, থার্মেমিটার আর একটা পিরিচে কয়েকটা বিস্কুট। বুঝতেই পারছ জাভেদ এই ঘর থেকে বের হবার সামর্থ্য আমার নেই।আজ কদিন ধরে আমি কোথাও যেতে পারছি না। মাঝে মাঝে দেয়ালের টিকটিকির শব্দ পাখিটাখির গান কিংবা কোনো উঠাইগিরা কুকুরের ডাক শুনতে পাই। কিন্তু জাভেদ এখন আমি সবচেয়ে বেশি শুনতে চাই একজন মানুষের প্রকৃত কণ্ঠস্বর। আমি সেই থেকে একটানা হ্যালো হ্যালো করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু তুমি এখনো নিরুত্তর। কতদিন আমি তোমার ভরাট গলার ওঠানামা শুনি না। হাসপাতালের বেড়ে নয়, আমি আমার নিজের ঘরেই বিছানায় নিঃসঙ্গ শুয়ে আছি। আমার শিয়রে অনিদ্রোয় হ্রদে ভেসে বেড়ানো কোনো নার্স নেই গলায় মালার মতো স্টোথিসকোপ দুলিয়ে ডাক্তার আমার পালসবিট গুনছে না। শরীরে নিদ্রার রজনীগন্ধা ফোটে না, জাভেদ। কারো কণ্ঠস্বর, হোক সেই স্বর চেনা কি অচেনা, মধুর অথবা কর্কশ, শুনতে পেলেই আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠব।জাভেদ, অসুখ তো একলা পথে ভ্রমণেই মতো। এখন আমি ভ্রমণ করছি এক বিশাল মরুভূমিতে, যেখানে মরীচিকা আছে মরূদ্যান নেই, সাপে ওগরানো বিষ আছে, নেই এক ফোঁটা দ্রাক্ষারস। আমি এই মরুভূমির বালিয়াড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ছি বারংবার, রাশি রাশি বালুকণায় ভরে গিয়েছে আমার মুখ, আমার কণ্ঠনালী। এখন আমি প্রাণপণে চাই প্রত্যাবর্তন। আমি চেয়ে আছি অস্পষ্ট দিগন্তের দিকে, যেমন তীর্থযাত্রী আপন নিবাসে ফিরে আসার তাগিদে তাকায় তার ফেরার পথে। জাভেদ, বারবার দিনদুপুরে রাতবিরেতে বেজে ওঠে আমার টেলিফোন। আর রিসিভার তুললেই অনেক্ষণ ধরে একটা যান্ত্রিক ভূতুড়ে আওয়াজ হতে থাকে, কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই না।   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
গান থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে, নিরিবিলি বসে নিশীথের ঘাসে, সমাধিতে। কখনো দেখিনি তাকে, ছিল কুয়াশার মতো ছায়ার মেদুর করতলে, পথের চিবুকে লীন।কিছু কি বলার ছিল তার? চেয়েছিল নামাতে প্রানী গুরুভার? চিন্তার নিমগ্ন স্তরে তার ছায়া সঞ্চরণশীল, আমার হাতের কাছে জল হয়ে বয়ে যায়, নাচের আমার ঠোঁটের ফাঁকে।এরকম হ’তে থাকে বার বার। ফুলে বোঁচায়, মৌমাছির সোনালি গুঞ্জনে মিশে থাকে; কখনো বেরিয়ে আসে কবিতার পংক্তির হৃদয় ছিন্ন করে, কিন্তু সে আমার ধরা ছোঁওয়ার বাইরে।পুরুষ অথবা নারী নয়, হঠাৎ লাফিয়ে-ওঠা মাছ নয়, দেবতাও নয়, নয় কোনো প্রেতযোনি; তবু আছে মিথ্যার উচ্ছল হাটে সত্যের চেয়েও সত্য হয়ে নিত্যদিন ব্যবহৃত শব্দের আড়ালে, যেন মেঘে-মেশা হাওয়া।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
আমার বসতবাড়ি, পুঁইমাচা, উঠোন, ইঁদারা আমার দু’চোখ থেকে ওরা মুছে দিতে চায়; ভরদুপুরে পুকুরে নিত্যদিন জুড়িয়েছি শরীর, এ পথে হেঁটে গিয়েছি বিকেলে হাটে, প্রাণ ভরে কথা বলে কাটিয়েছি কত বেলা কাশেম মহিম আর মজিদের সঙ্গে। কোনোদিন শুনেছি বাউল গান, ভেসে গেছি মুর্শিদি, কীর্তনে। ওরা আজ আমার স্মৃতিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে হো হো হেসে ওঠে, ওদের পায়ের নিজে আমার স্বপ্নেরা বড় আর্তনাদে করে।তুলসীতলায় সাঁঝে দীপহীন স্তব্ধতা শীতল দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে, নাটমন্দিরের ছাই হাওয়ার, হৃদয়ে ওড়ে! সন্ধ্যার আহ্নিকে এখন বসে না মন। সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াই সারাক্ষণ আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে একমুঠো চিড়েগুড় খেয়ে, অতি সন্তর্পণে ছায়া হয়ে হেঁটে যাই, ভিখিরির মতো পুঁজিহীন একটু আশ্রয় খুঁজে সদাশয় গেরস্তের কাছে।ও হরি, হে আল্লাহ, বলো প্রভু দয়াময় আমার দেশের মাটি, ধুলিকণা আলো-হাওয়া, জল কেন আজ এমন নিষিদ্ধ হবে আমারই সংসারে? তোমার দুনিয়া, দীনবন্ধু, সমকালে কেন এত ছোট মনে হয়? তবে কি আমাকে শেষে, হায়, নিজ চোখে দেখে যেতে হবে আত্মজার লুণ্ঠির সম্ভ্রম আর নিঃশব্দে সাজাতে হবে আমার নিজেরই গুপ্ত চিতা?   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
হায়, এ কেমন জায়গায় ডেরা আমার, যেখানে গাছগাছালির চিহ্ন নেই, সবুজের জন্যে চোখ পিপাসার্ত সারাক্ষণ। পিপাসা মেটে না কিছুতেই; নীলিমায় চোখ দুটো রেখে কিছুক্ষণ স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের ছোঁয়া পাব, তারও পথ বন্ধ। আসমান, সে-ও বড় সঙ্কুচিত বহুতল কিছু বাড়ির সন্ত্রাসেকোনও দিকে স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। বহুকাল যাবত প্রত্যহ কানে খুব জোরে ধাক্কা দেয়্য স্কুটার, মোটরকার, বাস আর দ্রুতগামী ট্রাকের ধমক। ভাবি, সারাক্ষণ কানে তুলো গুঁজে রাখি কিংবা বিধি বাম হয়ে আমাকে বধির করে দিলে রক্ষা পাই। কালেভদ্রে কান পেতে রাখি, যদি কোনও যাদুবলে কোকিল অথবা অন্য কোনও গায়ক পাখির অকৃপণ সুরের স্বর্গীয় সুরসুধা, পদাবলী-সঞ্চারিত মাধুর্যের প্রত্যাশা নির্বোধ স্বপ্ন ছায়া বৈ তো নয়!   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
হ্যাঁ গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। তোমাকে ভালো না বেসে পারা যায় না, তোমাকে ভালো না বেসে বাঁচা অসম্ভব। আমার প্রতি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে তোমার বসতি। কী ক’রে আমি পথ হাঁটবো, আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে দেবো সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখার জন্যে, কী ক’রে আমি আঁজলায় ভরে নেবো শান্তির জলধারা, কী ক’রে আমি কবিতা লিখবো তোমাকে ভালো না বেসে? হ্যাঁ, গৌরী, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অচল মুদ্রা বৈ তো নয়। হ্যাঁ, গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। সুন্দরবনের আরণ্যক শোভার শপথ, গারো পাহাড়ের আর্ত নিস্তব্ধতার শপথ, উত্তরবঙ্গের রাঙামাটির পথের শপথ, পার্বত্য চট্রগ্রামের পাকদন্ডি, ঝর্ণা আর পাহাড়ি যুবার অপার বেদনার শপথ, মেঘনার অজস্র ঢেউয়ের শপথ, পদ্মার ঝলসে ওঠা চকচকে ইলিশের শপথ, পরিযায়ী পাখিদের অনলস রঙিন ডানার শপথ, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।হ্যাঁ গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। মসজিদের কবুতরময় গম্বুজ আর উঁচু মিনারের শপথ, মন্দিরের সন্ধ্যাপ্রদীপ আর ঘন্টাধ্বনির শপথ, নির্জার আইকনের, অর্গানের প্রার্থনা-মন্দ্রিত সঙ্গীতের শপথ, বৌদ্ধ বিহারের নিরলঙ্কার সৌম্য কান্তির শপথ, তোমাকে, হ্যাঁ শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।নীল পদ্মের উন্মীলন, সরোবরের জ্যোৎস্নাঝলসিত আহ্বান, হরিণের চোখের মায়া, উদাস দুপুরে ঘুঘুর ডাক, সন্ধ্যামগ্ন ঝোপঝাড়ে জোনাকির জ্বলে-ওঠা আর নিভে যাওয়া, সাঁঝ-লাগা গাঁয়ের পথে রাখালের ঘরে ফেরা, ঘাটে-ভেড়া নৌকার মৃদু আলো আর নূর হোসেন স্কোয়ারের জাগরণের শপথ, অপশাসন-বিরোধী প্রতিবাদী মিছিলের শপথ, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।পেত্রার্কার সনেট, কাতাল্লুসের প্রেমের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান, রুমির মাসনভি, গালিবের পাথরের বুকে ফুল-ফোটানো গজল, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁর ‘যমুনা কে তীর’ চাইকোভস্কির রাজহংসী শোভিত হ্রদের অলৌকিক বিচ্ছুরণ, বাংলার অজানা মাঝির মেদুর গলার ভাটিয়ালী, উত্তরবঙ্গের এবড়ো-থেবড়ো পথে গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া এবং আমার সকল লেখা এবং না-লেখা কবিতার শপথ, তোমাকে, আজ শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, গৌরী,   (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
লিখতে কহ যে দিনরাত্তির কাদের জন্যে লিখব? কাদের জন্যে দুঃখের পাঠ করুণ ভাষ্যে শিখব?ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার আর মোক্তার আর রাজনীতিবিদ আদার ব্যাপারী আর ব্যাংকার পেডেন্ডো আর মিহি কলাবিদ খুঁটবে আমার কাব্য। তাদের জন্যে লিখব এবং তাদের জন্যে ভাবব?শকুন-উকিল ঘোর ঠিকাদার আর নিধিরাম সর্দার আর হুজুরের জি-হাঁ হুঁকোবরদার বৈদ্য এবং বৈশ্য ঘাঁটব আমার প্রাণ-নিংড়ানো সাধের অনেক শস্য।তাদের জন্যে সকাল সন্ধে গাধার খাটুনি খাটব? হঠাৎ-আলোর ঝলকানি-লাগা সরু দড়িটায় হাঁটব?   (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
গোধূলিবেলায় অকস্মাৎ আমার অভ্যন্তর থেকে একজন, তার ভেতর থেকে অন্য একজন, ওর বুক ফুঁড়ে আরেকজন বেরিয়ে এসে বসে চেয়ারে। যারা বেরিয়ে এলো ঈষৎ প্রফুল্ল কায়দায়, অভিন্ন ওদের অবয়ব। ওরা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে একই ধরনের হাসির আভাস ঠোঁটে ফুটিয়ে। ওদের মুখে কোনও কথা নেই, শুধু তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি ওদের অভিবাদন জানাবো কি জানাবো না, মনস্থির করতে পারি না।কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে ওঠে একজনের ধুধু কণ্ঠস্বর, ‘আমাকে চিনতে পারছো না? তোমার তো না চেনার কথা নয় আমাকে। আমি হলাম তুমি, যে-তুমি ব্যর্থ হলে আমাকে চিনতে। তুমি আমার ভেতরে থেকে একদা ছুটোছুটি করেছো শৈশবে, কৈশোরে সবুজ খোলা মাঠে। আমার ভেতর মিশে ভোরবেলা গাছগাছালিময় পাড়াগাঁর ছোঁয়ালাগা পথ পেরিয়ে দিঘিপারে বসে ছিপে তুলে এনেছো সতেজ মাগুর। আমি সেই মৎস্য শিকারী।দ্বিতীয় জন হাত নেড়ে চোখ ঠেরে বলে, ‘আমাকে চিনলে না তুমি? আমি সেই লোক, যে প্রতিক্রিয়ার দুর্গ-কাঁপানো শব্দমালা উপহার দিয়েছে সমাজকে তার যৌবনের মধ্যাহ্নে। তোমার সঙ্গে এই আমি নানা মুণির হিংসা, দ্বেষ, চরম শক্রতার শরাঘাত সয়েছি। জানি না বহুমুখী ভোগান্তি শেষ হবে কবে! তৃতীয় জন নিজের চারদিকে নৈঃশব্দের পাহারা বসিয়ে কেবল হাসির আভা ছড়িয়ে বসে থাকে এক পাশে। গোধূলি মিশে যায় গাঢ় সন্ধ্যায়। ওরা তিনজন সুদক্ষ অভিনেতার মতো আমার ভেতরে প্রবেশ করে।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
সঙ্গমে কী সুখ পাবে তুমি? ওটা থাক, শারীরিক ব্যাপার স্যাপার ভারি স্থুল মনে হয়, ঘেন্না লাগে। বরং চুম্বনা নাও, আলিঙ্গনে বাঁধো অনুরাগে, আমার আঙুল নিয়ে খেলা করো, আমি অনিমিখ চেয়ে থাকি তোমার চোখের দিকে। শোনো, বাস্তবিক এটুকুই চাই আমি, তার বেশি নয়। যদি জাগে কোনোদিন কামনার বন্য ঢেউ শরীরী ভূভাগে তাহলে আমার আত্মা বলবে আমাকে ধিক, ধিক।তোমার এ উচ্চারণ মেনে নিতে মনোকষ্ট হয়; শরীর এবং আত্মা দুটি পাখি বসে একই ডালে গান গায় প্রীতিবশে। নয়, ওরা তো পৃথক নয় কেউ কারো থেকে; যত দূরে পারো ঠেলে দাও, তবু তোমার ঘাটেই যাবো খেয়া বেয়ে লিবিডোর খালে, মেটাবো অকুল তৃষ্ণা। এখনো তো নই জবুথবু।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আসে না দু’চোখে ঘুম কিছুতেই কোনো কোনো রাতে তোমাকে প্রবল ভেবে। কত হিজিবিজি, ছায়াবাজী প্রহরে প্রহরে দেখি, দেখি অস্থিচর্মসার মাঝি নৌকোর কংকাল নিয়ে বুকে ঝোড়ো জলের আঘাতে ছিন্নভিন্ন কালো চরে। নয় সবুজ পাতার ভিড়ে, ভাঙা কবরের পাশে একটি কোকিল করে বাস, স্মৃতিপোষ্য, আর গানে তার শিহরিত বুনো ঘাস ঘন ঘন, মহাকায় কৃকলাস ঘোরে নদীতীরে।নির্ঘুম রাত্তিরে জ্বলি শূন্য ঘরে অত্যন্ত একাকী, কী বলতে কী বলে ফেলি নিজেকেই। একটি প্রতিমা, সে তোমারই অবয়ব, জেগে ওঠে বাস্তবের সীমা ছিঁড়ে খুঁড়ে, পুনরায় স্বপ্নস্মৃতিময় সে বৈভব সরে যায় দূরে, ভগ্ন কণ্ঠে ডাকি, তোমাকে ডাকি, এখন তোমাকে ছাড়া সুনিশ্চিত বাঁচা অসম্ভব।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
সন্ধ্যারাতে জুয়েল আইচ বহুদিন পর ফের আমাকে মোটরকালে নিয়ে আমাদের শ্যামলীর বাসায় এলেন নক্ষত্রের পানে চেয়ে বেদনার পানে বড় বেশি ঝুঁকে গিয়ে। তাকে দেখে আমাদের দীপিতা ত্বরিত এল ছুটে। ছোট্র এই মেয়ে আগে জুয়েলের জাদু দেখেছিল এক সন্ধ্যারাতে। সেই স্মৃতি নিয়ে এল টেনে তাকে আমাদের আলাপের কাছে।অনেকের মতো দীপিতাও জেনে গেছে মজাদার গায়েবি ক্ষমতা-কত কিছু হাত থেকে আচানক হয় যে উধাও, উহাদের খোঁজ পায় না ত কেউ, যদি না জুয়েল তার কেরামতি খাটিয়ে সেগুলি ফের নিয়ে আসে হাতে। জাদুকর জুয়েল পায়রা কিংবা অন্য কিছু হাওয়ায় বিলীন ক’রে আমাদের তাক লাগানোয় ছিলেন না উৎসাহী তেমন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজের কিছু কথা জানালেন গল্পচ্ছলে কৃতী কথকের মতো আর আমরা ক’জন শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ যেন আগাগোড়া।জুয়েলকে সে-রাতে বিদায় দিতে গিয়ে দীপিতার বাবা নিচে নেমে যায় অন্ধকারে। দীপিতার জন্মদাত্রী টিয়া ঠাট্রাচ্ছলে বলে তার মেয়েকে, ‘তোমার বাবা হওয়ায় মিলিয়ে গেছে জুয়েলের ম্যাজিকের ছোঁয়ায় কোথায় যেন।‘দীপিতা মায়ের কথা শুনে কেঁদে ফেলে। আমি তাকে সান্ত্বানার কথা ব’লে থামাই ফোঁপানি ওর। ভাবি- একদিন যখন আমার ক্ষয়া শরীর হঠাৎ ভীষণ নিস্পন্দ শৈত্যে ছেয়ে যাবে, প্রাণপাখি উড়ে অজানায় হবে লুপ্ত, চিহ্নহীন, সেই ক্ষণে জুয়েল অথবা প্রবাদপ্রতিম হুডিনির চেয়েও অধিক খ্যাতিমান কোনও জাদুকরও ব্যর্থ হবে ফেরাতে আমাকে এই সুন্দর ভুবনে।   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
আজ প্রত্যুষ ঘুম ভাঙতেই আমার দৃষ্টির দিগন্তে তোমার মুখের চন্দ্রোদয়। তুমি ফিরে আসছো ভাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্নতার আবির ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে, বইয়ের র্যাবকে, কবিতার খাতায়, আমার দেহমনে। আজকের দিন ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁর সেতারের আলাপের মাধুর্য হয়ে ওঠে। রাত বাড়তেই অধৈর্য আমি তোমাকে দু’বার টেলিফোন করি। লাইনের ব্যস্ততায় সঙ্কোচ ও লজ্জায় অন্ধডোবায় হাবুডুবু খাই।এই শহরের সবচেয়ে তুখোড় সাংবাদিক, যার নখদর্পণে সারা দেশের নাড়ি-নক্ষত্র, আমাকে জানাতে পারলেন না তোমার প্রত্যাবর্তনের খবর; মেঘ, পলাশ এমন কি কোনো রাতজাগা পাখিও বলতে পারলো না তুমি এলে কি এলে না। তবুও কি গাইতে হবে ওদের বন্দনাগীতি? এখন আমি উদয়শঙ্করের নটরাজ। অন্তর্গত ধ্বংস ও নির্মাণে ভয়ঙ্কর চঞ্চল।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
যেতে চাই, আকৈশোর মগ্নতায়, অতি সন্তর্পণে স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে কবিতার অন্তঃপুরে যেতে চাই। হয়তো সেখানে রহস্যের ফটক পেরিয়ে দেখবো আছেন সেই আমর বাগানে নয়জন ভুবন-মোহিনী; নয়টি নিবিড় নীল চেয়ারে হেলান দিয়ে বুনছেন কিছু অন্তহীন সোনালি সূতোয়।ফুলগুলি (হল্‌দে, লাল, সুনীল, বেগুনি) বাতাসে নর্তকী যেন। কেবলি হোঁচট খাই, সার্চ লাইটের ঝাঁ-ঝাঁ আলো দেখাবো না পথ জানি, তবু যেতে চাই উজিয়ে সকল বাধা প্রেমিকের মতো। হয়তো সেখানে দেখবো রাস্তার ধারে চিতাবাঘ সূর্যমুখী ফুলে মুখ রেখে বাঘিনীর স্মৃতি আনে ডেকে কিংবা কাকাতুয়া কোনো দাঁড়টাকে তার বানিয়ে চাঁদের নৌকো আহলাদে দুলছে সর্বদাই। রঙিন ধুলোর পথে মনে হবে বিকেলের আলো সুন্দরবনের তরুণ জ্বলন্ত বাঘ হয়ে ফের নেমেছে নদীতে!দেখবো চকিতে, কয়েকটি ঘোড়া দ্রুত কাকে যাচ্ছে নিয়ে,- বৃষ্টির সুরের মতো আরক্ত কাঁকরে খুর বাজে, খুর বাজে শুধু।সুবচনী হাঁস নিয়ে খেলছে বালক, জানালার অনেক বাইরে ঝুঁকে ডাকছে মা বেলা গেলো বলে। বারান্দায় একা বসে কে এক প্রবীণ ভদ্রলোক নিমগ্ন দান্তের কাব্যে, সূর্যাস্তের গাঁদা ফুল-রঙ বিশুষ্ক ফলের মতো মুখে পড়ে; জানু বেয়ে তার একটি চঞ্চল শিশু উঠছে নামছে বার বার।ইহুদীটা শহরের বাড়িগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে উড়ে, থলি কাঁধে, জীর্ণ টুপি নড়ছে মাথায়। কোনোমতে কাকের চোখকে দিয়ে ফাঁকি কেউবা ছিঁড়ছে রুটি, ক দিনের বাসি, নড়বড়ে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে। কাকগুলি পাখা ঝাপটায় নগরের সুবিশাল নীলপক্ষ ঘড়ির আয়নায়।ছাদের চূড়োয় বুঝি একা কেউ বাজায় বেহালা ভুল সুরে। মধ্যরাতে উলঙ্গ গাধার পিঠে কেউ গান গায় তারস্বরে। কী যেন পুড়ছে ভয়ানক শব্দ করে, সভ্যতার বিশ্বস্ত দলিল হয়তোবা। নিমেষেই সমস্ত শহর দেখবো কী করে হয়ে যায় ফণিমনসার বন -এইতো মিশ্রিত চিত্র (সব নয়) সেখানে ছড়ানো।মেঘ রৌদ্র, এভেনিউ টেলিগ্রাফ তার ইত্যাদির নাম ধরে ডেকে-ডেকে যাবো চলে ঐ কবিতার অন্তঃপুরে।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
কোথায় তোমার উৎস কবিতা হে কবিতা আমার? কোন্‌ নেই-দেশ থেকে অকস্মাৎ তুমি, পৃথিবীর কোন্‌ প্রান্ত থেকে আসো? স্যীন্‌ কিংবা রাইনের তীর অথবা টেমস্‌ ভল্গা, মিসিসিপি নীল নদ-কার তরঙ্গে নেচেছো তুমি? সত্য তুমি কেটেছো সাঁতার সেসব নদীতে আর নীল চঞ্চু রেখেছো নিবিড় ঢেউয়ে ঢেউয়ে, তবু মেঘনা নদীর তীরে নীড় তোমার সর্বদা নক্ষত্রের মতো জ্বলে দুর্নিবার।যখন তোমার উৎস খুঁজি, কোরবানীর ম্রিয়মাণ পশুর ভড়কে-যাওয়া চোখ, ডালিমের ফেটে-পড়া বুক, কবেকার শান্ত প্রান্তরের খোড়ো ঘর, ঝরা শৈশব, খঞ্জের যানে মেঘে মেঘে ভ্রমণ, নিঝুম বন মনে পড়ে বারংবার। নও তুমি দীপ্র বাতিঘর, এ বিরান উদাস আঁধারে তুমি কম্পমান ম্যাজিক লন্ঠন।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
পুনরায় জাগরণ, পুল্মঢাকা আমার গুহার আঁধারে প্রবিষ্ট হলো রশ্মিঝর্না, জাগালো কম্পন এমন নিঃসাড় ম্রিয়মান সত্তাতটে। যে-চুম্বন মৃতের পান্ডুর ওষ্ঠে আনে উষ্ণ শিহরণ, তার স্পর্শ যেন পেলাম সহসা এতকাল পরে, আর তৃণহীন বীতবীজ মৃত্তিকায় মদির বর্ষণ দেখালো শস্যের স্বপ্ন। শিরায় শিরায় সঞ্চরণ গোলাপের, নতুন মুদ্রার মতো খর পুণিমার।পাথুরে গুহার কাছে স্বপ্নজাত বনহংসী ওড়ে অপ্সরার ভঙ্গিতে এবং তার পাখার ঝাপটে মৃতপ্রায় সাপ নড়ে ওঠে ফের, মহাশ্চর্য দান পেয়ে যায় কী সহজে, কারুকাজময় ত্বক ফোটে শরীরে নতুন তার। তুমি এলে প্লাবনের পরে, যে-তুমি আমার স্বপ্ন, অন্নজল, অস্তিত্বের গান।    (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
গোধূলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে কে যেন ডাকে আমাকে, বলে- আর নয় নিষ্ক্রিয়তার মদে চুর হ’য়ে বসে-থাকা, আর নয়, আফিমে বুঁদ হ’য়ে ঝিমুনি। এবার শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়াও; স্থবিরতার পাথর হটিয়ে এবার সামনে পা বাড়াবার পালা। যারা আলো-তাড়ানো অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়ছে, যারা আগাছাগুলো উপড়ে ফেলে মানুষ মানুষে সম্প্রীতির সাঁকো গড়ছে, যারা আগামী শতাব্দীর দিকে মুখ রেখে করছে নতুন সভ্যতার নান্দীপাঠ, যারা চাষ করছে মানবতার পতিত মাঠ, এসো আমরা সবাই হাত লাগাই তাদের কাজে। এসো আমরা প্রতিক্রিয়ার শ্যাওলা-ছাওয়া ভিত কাঁপিয়ে গান গাই।সময়ের ঘাড় ধরে যারা নিয়ে যেতে চাইছে প্রস্তর যুগে, এসো আমরা আমাদের দিকে ধেয়ে-আসা সেসব পাথর ফেরত পাঠাই চির স্থবিরতার দিকে। আমাদের কণ্ঠে প্রশ্রয় দেবো না পরাজয়ের আঁধার-আক্রান্ত ধুসরতাকে,আমাদের গীতধারায় আশ্রয় পাক জয়ধ্বনি। ওরে তোরা সব জয়ধ্বনি কর বলে আমরা এগিয়ে যাবো, এবার আমাদের সামনে পা বাড়াবার পালা।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
নৈশ ভোজনের পর মার্কিন টাইম ম্যাগজিন উল্টেপাল্টে তুলে নিই ডিফোর রবিনসন ক্রূশো, কিছুক্ষণ ঘুরি তার সঙ্গে; কী অদ্ভুত বেশভূষো নিজের শরীরে দেখি, ছাগগন্ধে এই ঘুমহীন রাত্রি ভরপুর, অকস্মাৎ পিঁপড়ের ঝাঁক ধেয়ে আসে চতুর্দিকে থেকে। অতিকায় ওরা, টেলিফোন তার, খাট, দেয়ালের মাঠ, যেন অত্যন্ত গোপন ষড়যন্ত্রে বুঁদ হয়ে, উঠছে চেয়ার বেয়ে বেয়ে।পিঁপড়েগুলি চকচকে লাল গ্রেনেডের মতো, যে কোনো মুহূর্তে ওরা ভীষণ পড়বে ফেটে, ঘর নিমেষে কাঠের গুঁড়ো হবে, জলপাইরঙ জীপে চেপে এসে আমার হদিশ কেউ পাবে না, আহত আমি রইবো ঢাকা ভগ্নতূপে, দুঃস্বপ্নের এ প্রহর এত দীর্ঘ কেন? কেন বন্দী আমি পিঁপড়ের দ্বীপে?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
মেঘের আড়ালে তুমি লুকাও হে চাঁদ, ঢাকো মুখ তাড়াতাড়ি, মহুয়া আসছে তার অপরূপ রূপ নিয়ে ধীর পদক্ষেপে কংসাই নদীর ধারে, ধূপ জ্বলছে হৃদয়ে তার, নদীর ঢেউয়ের মতো বুক ওঠা নামা করে আর বস্তুত নদেরচাঁদ নয়, আমিই জলের ঘাটে একা বসে আছি প্রতীক্ষায়। তার হাত ধরে নিয়ে যাবো বেদেদের পাহারায় ধুলো দিয়ে নিজের ডেরায়, পাবে না সে আর ভয়।সৌন্দর্য ঐশ্বর্য তার, উপরন্তু মন ঝকঝকে স্বচ্ছ সরোবর এক; গহন দু’চোখ। মাঝে মাঝে কথায় কৌতুক খেলে, কিন্তু সৌন্দর্যই হলো কাল শেষ অব্দি; বিষ-ছুরি, পুরুষের সিক্ত, লকলকে লালসার জিভ থেকে পারিনি বাঁচাতে তাকে, বাজে তার মৃত্যুধ্বনি, আমাকেও ঘিরে ধরে ক্রূর জাল।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
ক’দিন থেকে আমার ডান হাতের মধ্যমা এক অর্থহীন হরতাল শুরু করেছে। কোনও কাজই করবে না আর। আজ সকালে হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে উদ্ধত ভঙ্গিতে। কোনও নেপথ্যাচারী স্বৈরাচারীর লেলিয়ে দেওয়া দালালের মতো আমার বিরুদ্ধে লাগাতার শ্লোগান দিতে শুরু করেছে। প্রেমের কবিতা লেখার সময় সে আমার কলম স্পর্শ করবে না-এই ওর ঘরফাটানো দাবি। বুঝতে পারি না, কেন এই না-হক দাবি মধ্যমার? আমার দিকে সরোষে এক স্মারকলিপি ছুঁড়ে দিয়েছে সে। স্মারলিপি পড়ে হতবাক আমি ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকি সেই লুম্পেনের দিকে। বিশেষত প্রেমের কবিতা লেখার সময় সহযোগিতার দরজায় সে ডবল তালা ঝুলিয়ে দেবে। টেবিলে দাঁড়ানো মধ্যমাকে বললাম, “দ্যাখো হে, বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছ। কী না করেছি আমি তোমার জন্যে? তোমার কষ্ট হবে ভেবে কখনও কখনও লেখা মাঝ-পথে থামিয়ে দিয়েছি। তোমাকে গোলাপের মখমল-পাপড়ি ছোঁবার, শিশুকে আদর করবার, আমার দয়িতার গাল, গলা, স্তন, কোমর স্পর্শ করবার অধিকার দিয়েছি অকুণ্ঠচিত্তে। ‘গীতবিতানে’র পাতা সমুদয়, গ্রিক ট্রাজেডি, প্লেটোর ‘রিপালিক’, রিল্কের ‘ডুইনো এলিজি’, জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’-এর পাতা ওল্টানোর অসামান্য সুযোগ কি দিইনি তোমাকে?”হে প্রিয় মধ্যমা আমার, কে তোমাকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে আজ? আমার কোনও কোনও প্রবীণ বন্ধু প্রেমের কবিতার সঙ্গে আমার এত লদকালদকি পছন্দ করেন না। ‘লদকালদকি’ শব্দটি অবিশ্যি তাদেরই মুখনিঃসৃত। ভাবলে কী করে তুমি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেই আমি প্রেমের কবিতার দেশ থেকে নির্বাসিত হব হে মধ্যমা? তোমার অজানা নয় যে স্বদেশ, জ্ঞানান্বেষণ, কবিতা এবং ভালোবাসার প্রতি চিরনিবেদিত। যার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখতে না পেলে, যার সঙ্গে একদিন দেখা না হলেই হৃদয় হয় আহত পাখি, যার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে কবিতার ভাষা ভুলে যাই, তাকে নিয়ে কবিতা লিখব না কারও ফরমানের ধমকে এমন উদ্ভট চিন্তা তোমার মাথায় ঢোকাল কে?দেখ, তোমার স্মারকলিপি কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছি বাজে কাগজের ঝুড়িতে। তুমি কোন্‌ ছার, তোমরা দশজন সঙ্গী ঐক্যজোট বেঁধে ধর্মঘট করলেও মাথা নত করব না, মানব না হার। যত কষ্টই হোক দাঁত দিয়ে কলম চেপে ধরে কবিতা লিখব, প্রেমের কবিতাই লিখব। দেখে নিও, প্রেমের দেবতা হবেন আমার পরম সহায়। আমার খাতার পাতা-জোড়া এক নন্দিনীর হরফে-গড়া প্রতিমার মুখের হাসির ঝর্ণাধারা দেখে তোমাদের ধর্মঘটী মুখ চুন হয়ে যাবে। তোমাদের ঘিরে ছেয়ে আসবে ঘোর অমাবস্যা।   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
এই ছিল তবে আমার ভাগ্যে মধ্যদুপুরে বিনা মেঘে এই বিপুল বজ্রপাত? পিতা হত আর পিতৃশোকেই ভগ্নী আমার উন্মাদিনী সে হয়েছে আকস্মৎ।কত ঝঞ্ঝায় কত যে প্লাবনে কেটেছে আমার মাতৃস্নেহের ছায়াহীন শৈশব। বিকৃত শত মুখোশের ঢঙে নাচে অবিরত অধিবাস্তব নাট্যের কুশীলব।নাছোড় অশেষ দাবানল জ্বলে শিরায় শিরায়, হৃদয়ের শত ফুল্‌কি দুচোখে ওড়ে। তীক্ষ্ণ অসির সূচিমুখ আমি করছি পরখ, শক্র কোথায় কোন্‌ প্রান্তরে ঘোরে?আমার নিরাহ বয়েসী পিতার লাশ ওরা খুব তাড়াহুড়ো করে মাটিতে রেখেছে ঢেকে। রক্তের ঋণ শোধার জন্যে মনে হয় তিনি আর্ত কণ্ঠে আমাকেই যান ডেকে।আজীবন শুধু রাজসেবা করে জনক আমার বার্ধক্যেই হলেন অসির বলি। জঘন্য এই হত্যা আমাকে দেয় ধিক্কায়, আমি নিজস্ব ধোঁয়াটে নরকে জ্বলি।ভগ্নী আমার কালের বৃন্তে স্বর্গ কুসুম, মেলেছিল তার প্রতিটি পাপড়ি সুখে। রাজার কুমার কী জানি কেমন বাজালো বেহাগ, দুঃখ-ফলানো ঢেউ ওঠে তার বুকে। চৈতি রাতের স্বপ্নে মগ্ন যুবরাজ তাকে শোনালো ব্যাকুল মদির গুজ্ঞরণ। সোনালী নদীর মত সেই স্বর শুনে হয়ে গেল একটি মেলডি তরুণীর তনুমন।দর্শনঘেঁষা বাক্যবিলালসী বুদ্ধিজীবী সে, দিশাহারা যেন মননের সংকটে। ভগ্নী শোনেনি বারণা আমার, রাখেনি মিনতি- পড়ল জড়িয়ে ঊর্ণার ক্রুর জটে।কোন্‌ ইঙ্গিতে অপাপবিদ্ধ তরুণীর প্রতি কুমার করেছে নিষ্ঠুর আচরণ? নিশ্বাসে তার পুষ্পপোড়ানো গ্রীষ্মের দাহ, ভাষায় প্রাকৃত বৃশ্চিক-দংশন।সারল্য তার পায়নিকো ক্ষমা, মগজের কোষে অপ্রকৃতি গায় বড় এলোমেলো গান। তন্বী শরীরে জলচুম্বন, নিখাদ পূররী, ভুঁইচাপা আর জলবিছুটির ঘ্রাণ!রাজার বাগানে সাপ তোলে তার চক্কর-আঁকা ফুটন্ত মাথা; ঘাতক, গুপ্তচর আশপাশে ঘোরে, করে কানাঘুষো। মারি ও মড়কে কংকাল হয় কত লোক লস্কর।দশকে দশকে বাটপাড় আর ঘোড়ল দালাল, লুটেরার পাল আসে পালটিয়ে রূপ। ইতরজনের বহ্বারম্ভ সাধু সজ্জন ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে আজ বড় নিশ্চুপ। কানকখা শুনে মিত্রকা আমি শক্র ভেবেছি, সত্তা আমার হীন দ্বৈরথে মাতে। যে-জাল নিজেই বিছিয়েছি ষড়যন্ত্রে ব্যাপক, অসহায় আমি আটকা পড়েছি তাতে।জোর যার তার মুলুক সত্য, দুর্ভোগ বাড়ে গণমানুষের, খরাকবলিত দেশ। ঘুচাবো দীনতা, এমন সাধ্য নেই একতিল, আমি নগণ্য ব্যর্থ লেয়ার্টেস। রাজার কুমার হয়তো পারতো দুর্গ প্রাকারে জ্বালাতে সূর্য অমাবস্যার রাতে, কিন্তু এখানে কেবলি শবের ছড়াছড়ি আর বীর যুবরাজ নিহত আমারই হাতে।   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
সব কিছু ঠিকঠাক, আজই তুমি যাবে দ্বিপ্রহরে বায়ুযানে; আমার অবুঝ মনোকষ্ট, দীর্ঘশ্বাস অথবা চোখের জল ক্ষণে ক্ষণে খুসখুসে কাশ করবে না পথ অবরোধ আর কবিতার ঘরে হবে না এখন হরতাল। দিয়েছি বারণ করে সবাইকে, আমার না-লেখা কবিতারা আজ নীল পাখি হয়ে উড়বে তোমার খুব কাছে। ঝিলমিল করলে কোথাও কিছু ভেবো আমার আনন্দ ঝরে।আজ কবিতার খাতাটিকে সাক্ষী রেখে দিচ্ছি কথা- তোমার যাবার আগে আর পরে মন খারাপের ভেলা ভাসবে না কোনোক্রমে, জেনো কাটাবো সময় গান শুনে ক্যাসেট প্লেয়ারে, আড্ডা দিয়ে। মনোব্যথা মেঘদলে, পাখির ডানায় হবে নীল, তুমি ফের ফিরে এসে দেখবে আমার মুখ কত দীপ্ত হয়।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
গরিলারা দলে দলে তড়িঘড়ি কামিজ পাৎলুন পরে মসজিদ গুঁড়ো করে আর আগুন ধরায় দেবালয়ে; মানুষের স্বপ্নের বসতি পোড়ে, তাজা রক্ত বয় পথে, ত্রাস-তাড়িত তরুণী মূক হয় যূথবদ্ধ লালসার লকলকে নিঃশ্বাসে এবং গরিলারা ক্রমশ সংখ্যায় বাড়ে শহরে ও গ্রামে।কালপুরুষের মুখে পড়েছে বিস্তর চুনকালি, সূর্যের জ্বলন্ত চোখ থেকে অবিরল অশ্রু ঝরে, পৃথিবীর দৃশ্য দেখবে না বলে সূর্য বন্ধ করে চোখ, দুপুরেই ঘোর অমাবস্যা নামে দিকে দিকে।গালিবের গজলেরা ঘাতকেরা অস্ত্রের ছায়ায় অশ্রুপাত করে নিশিদিন, রবীন্দ্র রচনাবলী ব্যর্থতায় অপমানের অবনত, মিলনের ভগ্ন সেতু দেখে নজরুল নষ্ট নীড়ে বুক চাপড়ান।কান্নাও আসে না আর; প্রতিবাদ শরাহত পাখি, যা’ কিছু গৌরবদীপ্ত ত্রস্ত সব বিবরে লুকায়। মানুষকে দেখেই মানুষ প্রাণপণে পালাবার পথ খোঁজে, বন্য পশুদের আজ বড় হাসি পায়।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
শয্যাত্যাগ, প্রাতরাশ, বাস, ছ’ঘণ্টার কাজ, আড্ডা, খাদ্য, প্রেম, ঘুম, জাগরণ; সোমবার এবং মঙ্গলবার বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি আর রবিবার একই বৃত্তে আবর্তিত আর আকাশ তো মস্ত একটা গর্ত- সেখানে ঢুকব নেংটি ইঁদুরের মতো। থরথর হৃদয়ে প্রতীক্ষা করি, স্বপ্ন দেখি আগামীকালের সারাক্ষণ, অনেক আগামীকাল্য উজিয়ে দেখেছি তবু থাকে আরেক আগামীকাল। সহসা আয়নায় নিজের ছায়াকে দেখি একদিন-উত্তীর্ণ তিরিশ।পূর্ণিমা চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে, অস্তিত্বকে মুড়ে খবরের কাগজে ছড়াই দৃষ্টি যত্রতত্র, নড়ি, মাঝে-মাঝে ন’ড়ে বসি, সত্তার স্থাপত্যে অবিরল অলক্ষ্যে গড়িয়ে পড়ে মাছের ঝোলের মত জ্যোৎস্না আর আমি বিজ্ঞাপন পড়ি, হাত-পা ছড়িয়ে পড়িএবার কলপ দিন, আপনি তো জানেন অকাল- পক্ব চুলে কলপ লাগালে অনায়াসে ফিরে আসে ফেরারি যৌবন… আর এই ফলপ্রদ টনিকটা খাবেন প্রত্যহ তিনবার ঠিকঠাক দাগ মেপে অর্থাৎ চায়ের চামচের দু’চামচ এবং খাবার আগে কিংবা পরে, তাহলে বাড়বে ক্ষিদে আর স্নায়ুগুলি নিশ্চিত সবল হবে, যদি খান সুস্বাদু টনিক।ধরা যাক যা-কিছু লিখেছি সবি পড়ে লোকে, প’ড়ে প্রচুর তারিফ করে, ব্যাংকের খাতাও স্ফীতকায়; উন্নতির সবগুলি গোল ধাপ পেয়েছে আমার সুকৃতী পায়ের ছাপ, ইচ্ছাপূরণের যত গানহৃদয়ের সাতটি মহলে পেলো খুঁজে সফলতা; জীবনের প্রতিটি সুন্দর স্বপ্ন পাপড়ি মেলে চেয়েছ আমার দিকে পত্নীর গার্হস্থ্য প্রণয়ের পরিণাম পুত্র-কন্যা সহজে এসেছে যথারীতি এবং নিজের বাড়ি, সাজানো বাগান, ধরা যাক, গাজরের ক্ষেত, মুরগি ইত্যাদির স্বচ্ছন্দ বিন্যাসে মানবজীবন ধন্য। শৈশবের সাধের কল্পনা নকশা অনুসারে, ধরা যাক, একে একে ঘটল সবি। অনেক সমুদ্র ঘুরে কত বন্দরের গন্ধ মেখে একদিন সার্থবাহ বার্ধক্যের অবসন্ন ঘটে ফিরে আসে পণ্যবাহী সার্থক জাহাজ, পালতোলা, গলাফোলা নাবিকের গানে গুঞ্জরিত। মূর্খ যত চেঁচিয়ে মরুক তারা, পূর্ণতার স্তবে রাত্রিদিন জপেছি ভীষণ মন্ত্র ক্ষয়ে ক্ষয়ে… কিন্তু তারপর?আড় হয়ে বিকেলের রোদ পড়ে চায়ের আসরে; কয়েকটি সুবেশ তরুণ-তরুণীর সংগত সংলাপে গোলাপ বাগান জ্বলে রক্তিম কুঁড়ির জাগরণে মুহূর্তের অতন্দ্র মালঞ্চে। টেবিলের ফুলদানি জ্যোৎস্নার বিস্ময়ে ফোটে মহিলার অন্ধকার ঘরে। নিয়ন আলোর মতো কারুর হাসির শত কণা জাগায় স্মৃতির শব, হাড়হিম দেহে লাগে তাপ। আমি নই ইডিপাস, তাহলে কী করে উচ্চরোলে সভাসদ মাঝে করি উচ্চারণ ‘অবশেষে বলি ভালো সবকিছু ভালো?’ অসংগতি, না আমার মধ্যে নেই, রয়েছে সেখানে রেস্তোরাঁয়, অন্ধকারে দেয়ালে আমার চতুর্দিকে, বলতে পারো বরং নিজেই আমি নিমজ্জিত, ওহে, এ-অসংগতির মধ্যে। লিপস্টিক ঘষে মুছে-ফেলা ঠোঁটের মতন আত্মা নিয়ে কী আশ্বাসে বাঁচায় যায় যন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ডে, বিরক্তির মাছির জ্বালায়?যেহেতু উপায় নেই ফেরবার, আমার সম্মুখে দুটি পথ অবারিত, আমন্ত্রণে প্রকট চটুল- গলায় বিশ্বস্ত ক্ষুর কিংবা অলৌকিক বিশ্বাসের রাজ্যে শুধু অন্ধের স্বভাবে বিচরণ, সায় দেয়া কবন্ধের শাস্ত্রের শাসনে, পরচুলা খ’সে পড়া ক্রমাগত অনর্থক যুক্তিহীন মাথা নেড়ে-নেড়ে।ঈশ্বর কি শিউরে ওঠেন মলভাণ্ডে? উনুনের কড়াইয়ের তীব্র জ্বালে কুঁকড়ে যান কাগজের মতো? যদি বলি প্রবঞ্চনা ঈশ্বরের অন্য নাম তবে সত্য থেকে সঠিক ক’গজ দূরে আমার সংশয়ী পদক্ষেপ? তা হলে বিশ্বস্ত ক্ষুর গলায় ছোঁয়ালে অথবা ক’ফোঁটা বিষ কণ্ঠ বেয়ে নেমে গেলে এই জ্বঠরের পাকে পাকে, পার্থক্যের কী জটিল সূত্র উন্মোচিত হবে পরিণামে?    (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
বেকসুর আমি তবু আমাকেই মৃত্যুদন্ড দিলে। কী করে তোমার কাছে অপরাধী, এখনো জানি না; কস্মিকালেও আমি শক্রুতা সাধিনি, শুধু বাণী, অলৌকিক, প্রেমময়, বাজিয়েছি। সেই সুরে ছিলে মিশে তুমি বসন্তের পাতার গভীরে, শান্ত ঝিলে, শস্যক্ষেতে, নীলিমায়। এই কি আমার অপরাধ? আমার সর্বস্ব দিয়ে রাত্রিদিন একটি নিখাদ প্রেমস্বপ্ন গড়ি, তা-ও ভেঙে যায় কী ককর্শ ঢিলে।আমাকে পাঠালে নির্বাসনে, দিলে দন্ড ভয়ংকার। তোমার সান্নিধ্য থেকে, অমন দৃষ্টির থেকে দূরে, বহুদূরে চকিতে সরিয়ে দিলে-এই শাস্তি, বলো, মৃত্যুর চেয়েও বেশি, ঢের বেশি নয় কি কঠোর? তুমি কি দেখতে চাও সর্বদা আমার ছলোছলো চোখ? চাও আমার হৃদয় খাক কীট কুরে-কুরে?   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এই যে কখনও আমি বিচলিত হয়ে পড়ি সন্ধ্যা নামলেই, অন্তর্লোক গাঢ় অন্ধকার দ্রুত ছেয়ে এলেই কে যেন বোধাতীত ভাষার আবৃত্তি করে বেশ কিছুক্ষণ। মনে হয়, কোনও পাখি বস্তুত আপন মনে সুরেলা ছন্দের এক অর্থহীন গান দিচ্ছে উপহার প্রকৃতিকে প্রত্যাশার পরপারে বাস ক’রে।নিঃসঙ্গ পাখির সুর থেমে গেলে দূরের চাঁদের ভগ্নাংশ চকিতে কোন্‌ বিরানায় মুখ থুবড়ে মিলিয়ে যায়, বলতে পারে না কেউ কোনও কালে, শুধু অরণ্যের গাছপালা, হ্রদ জানে সেই রহস্যের ইতিহাস। একজন চন্দ্রাহত লোক কিছু পঙ্‌ক্তি উচ্চারণ করে বারবার, দেয় চন্দ্রিমার ভগ্নাংশের খোঁজ।এখন যেদিকে যাই পথ কী ভীষণ ক্ষেপে ওঠে, ডাকাবুকো পশুর ধরনে তিন হাত ওপরে লাফিয়ে উঠে চকিতে কামড়ে দেয়, আমি চীৎকারে বিদীর্ণ করে দিতে চাই চতুর্দিক, অথচ গলায় হায়, এতটুকু শব্দ কিছুতেই পরিস্ফুট হয় না তখন। ব্যর্থতায় হাতের আঙুলগুলো খুব জোরে কামড়াতে থাকি।কখনও আমার চারদিকে সুন্দরীরা নাচ, গান জুড়ে দেয় বেশ কিছুক্ষণ বিনা কোনও প্রত্যাশায়। খাতা খুলে বসে থাকি লেখার টেবিল ঘেঁসে, যদি পঙ্‌ক্তিমালা পদ্যরূপে করে আলিঙ্গন নিত্য এই শব্দমালা সন্ধানীকে।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
আরাগঁ তোমার কাছে কোনোদিন পরিণামহীন এই পংক্তিমালা জানিনা পৌঁছবে কিনা, তবু তোমারই উদ্দেশে এই শব্দাবলী উড়ে যাক পেরিয়ে পাহাড় অনেক পুরনো হ্রদ বনরাজি এবং প্রান্তর। আমার এলসা আজ যৌবনের মধ্যদিনে একা জীবনকে ফুলের একটি তোড়া ভেবে টেবে আর গানের গুঞ্জনে ভরে কোথায় আয়নার সামনে চুল আঁচড়ায়, দীর্ঘ কালো চুল, পা দোলায় কোন সে চত্বরে ব’সে অপরাহ্নে কিংবা পড়ে ম্লান মলাটের কবিতার বই কিংবা কোনো পাখির বাসার দিকে চোখ রেখে কী-যে দ্যাখে, ভাবে আমি তা’ জানিনা, শুধু তার স্বপ্নের ফোঁটার মতো গাঢ় দু’টি আর সুরাইয়ের গ্রীবার মতন গ্রীবা মনে পড়ে।আরাগঁ আমার চোখে ইদানীং চালশে এবং আমার নৌকো নোঙরবিহীন, তবু দেখি কম্পমান একটি মাস্তুল দূরে, কেমন সোনালি। অস্থিচর্মসার মাল্লা কবে ভুলে গেছে গান, কারো কারো মাথায় অসুখ, ওরা বিড় বিড় ক’রে আওড়ায় একটি অদ্ভুত ভাষা, মাঝে-মধ্যে দূর হ দূর ব’লে ঘুমের ভেতরে কাদের তাড়ায় যেন, আমি শুধু দেখি একটি মাস্তুল দূরে, কেমন সোনালি। তরমুজ ক্ষেতের রৌদ্রে নগ্ন পদ সে থাকে দাঁড়িয়ে- আমার কবিতা। কখনো আমাকে ডেকে নিয়ে যায় বনবাদাড়ে যেখানে সাপের সংগম দ্যাখে স্তম্ভিত হুতোম প্যাঁচা, যেখানে অজস্র স্বপ্নের রঙের মতো ঘোড়া খুরে খুরে ছিন্ন ভিন্ন করে ঘাস ফুল কখনো আমাকে ডাকে শহরতলীর বর্ষাগাঢ় বাসস্টপে কখনো বা সিনেমার জনময়তায়, আমার স্তিমিত জন্মস্থানেএবং আমার ঘরে খেলাচ্ছলে আঙুলে ঘোরায় একটি রুপালি চাবি, বাদামি টেবিল ক্লথ খোঁটে চকচকে নখ দিয়ে-আমার কবিতা। আবার কখনো তার সুপ্রাচীন তরবারির মতন বাহু অত্যন্ত বিষণ্ন মেঘ, তার দুটি চোখ ভয়ংকর অগ্নিদগ্ধ তৃণভূমি হয়।যে-বাড়ি আমার নয়, অথচ যেখানে আমি থাকি তার দরোজায় কে যেন লিখেছে নাম কৃষ্ণাক্ষরে-অসুস্থ ঈগল। পাড়াপড়শিরা বলে, মাঝে-মধ্যে মধ্যরাতে জীর্ণ বাড়িটার ছাদ আর প্রাচীন দেয়াল থেকে তীব্র ভেসে আসে নিদ্রাছুট রোগা ঈগলের গান, কী বিষণ্ণ-গর্বিত গান। আরাগঁ তোমার মতো আমিও একদা শক্রুপরিবৃত শহরের হৃদয়ে স্পন্দিত হ’য়ে লিখেছি কবিতা রুদ্ধশ্বাস ঘরে মৃত্যুর ছায়ায় আর স্বাধীনতার রক্তাক্ত পথে দিয়েছি বিছিয়ে কত রক্তিম গোলাপ।আরাগঁ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে, যেখানে সুর্যের চুম্বনে ফসল পাকে, রাঙা হয় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল, সজীব মুখের ত্বক রুটির মতোই ঝলসে যায়, যেখানে বিশদ খরা, কখনো বা ভীষণ নির্দয় বানভাসি, যেখানে শহুরে লোক, গ্রাম্যজন অনেকেই শাদাসিধে, প্রায় বেচারাই, বলা যায়; আমাদের হালচাল সাধারণ, চাল-চুলো অনেকের নেই। আমাদের মাস ফুরোবার অনেক আগেই হাঁড়ি মড়ার খুলির মতো ফাঁকা হ’য়ে যায়, দীর্ঘ দূরন্ত বর্ষায় গর্তময় জুতো পায়ে পথ চলি, অনেকের জুতো নেই।ধুতামি জানিনা, মোটামুটি শাদাসিধে লোকজন আশেপাশে চরকি ঘোরে এবং দু’মুঠো মোটা চালের ডালের জন্যে ক্ষুধার্ত আমরা। ক্ষুধার্ত সত্তার পূর্ণ সূর্যোদয়, ভালোবাসা নান্মী লাল গোলাপের জন্যেআরাগঁ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে আজ, যেখানে দানেশমন্দ ব’সে থাকে অন্ধকার গৃহকোণে বুরবক সেজে জরাগ্রস্ত মনে, অবসাদ-কবলিত কখনো তাড়ায় আস্তে অস্তিত্বের পচা মাংসে উপবিষ্ট মাছি। আরাগঁ তবুও জ্বলে গ্রীষ্মে কি শীতে আমাদের স্বপ্ন জ্বলে খনি-শ্রমিকের ল্যাম্পের মতো   (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
সে রাতে তুমিই ছিলে ঘরের মিয়ানো অন্ধকারে বিছানায় উন্মোচিত। তোমার বিশদ ডাগর নগ্নতা আমি আকুল আঁজলা ভ’রে পান ক’রে বারবার মৃত্যুকে তফাৎ যাও বলবার দীপ্র অহংকার অর্জন করেছিলাম। নিপোশাক তোমার শরীর জ্যোৎস্না-কমান ধোয়া মসজিদের মতো তখন বস্তুত আমার চোখের নিচে। স্তনপল্লী জ্বলে, যেমন সন্তের জ্যোতিশ্চক্র অবলীলাক্রমে আর তৃষ্ণাতুর ওষ্ঠ রেখে নাভির লেগুনে ভেবেছি তোমার সুদূর প্রপিতামহী কেউ এমনি সাবলীল নগ্নতায় ভেসে কারুর চোখের আভা করেছে দাবি।তোমার শরীর কোথাও নিরালা পথ, মসৃণ অথবা তরঙ্গিত, কোথাও বা সুরভিত ঝোপ, আমার ওষ্ঠ-পথিক ক্রমাগত আঁকে পদচিহ্ন সবখানে। কে জানতো এমন পুরোনো গাঢ়, প্রায় আর্তনাদের মতোই ডাক, শিখাময় ডাক মাংসের আড়ালে থাকে, থাকে লুকোনো এমন বিস্ফোরণ!সেই নিরঞ্জন রাতে আমার তামাম নিঃসঙ্গতা ঈষৎ স্পন্দিত নগ্নতার দিকে হাত দিয়েছিলো বাড়িয়ে এবং তোমার সপ্রাণ চুললগ্ন বেলফুল কী কৌশলে আমার বয়স নিয়েছিল চুরি ক’রে। আমার সকল রোমকূপ পল রবসনী সুরে সে মুহূর্তে গীতপরায়ণ-আমি তোমার দিকেই ছুটে যাই, যেমন ওড়ার বাসনায় ছটফতে পাখি আকাশের নীলে, যেমন লাঙল নগ্ন ফসলাভিলাষী রিক্ত মাঠে।প্রেমিক সেকেলে শব্দ, তবু আমি তাই ইদানীং। তুমি নরকের দ্বার, ত্রিলোকে রটায় অনেকেই, আমি সেই দ্বারে নতজানু, নির্গ্রন্থ পুরুষ এক স্বর্গের প্রকৃত সংজ্ঞা অভিধা ইত্যাদি প্রবল ভাসিয়ে দিই আমার স্বকীয় শোণিতের কোলাহলে। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
সে লিখবে বলে বসে আছে নির্মল সুফীর মতো গভীর রাত্তিরে। চৌদিকের চেঁচামেচি গেছে থেমে অনেক আগেই, ক্রুশ হ’য়ে প্রকাশিত তার ব্রত অন্তরালে; সে লিখবে বলে আকাশ এসেছে নেমে ছিটিয়ে নক্ষত্র কিছু। গাছপালা জানায় কুর্নিশ, নিশীথের পক্ষীকুল ডানা থেকে ঘুম ঝেড়ে ঝুড়ে জুড়ে দেয় গান, সে লিখবে বলে অলীকে উষ্ণীষ মাথায় জ্বলছে তার, গূঢ় মন্ত্রধ্বনি জাগে মেধা জুড়ে। ধ্যান মানে এক ধরনের যাদুভাষ্য, জন্মান্তর বলা চলে, সে তার জানে বলেই প্রতীক্ষা করে খুব ধৈর্য ধরে বিভিন্ন প্রহরে; যদি কোনোদিন ভুল হয়ে যায় তার আরাধনায় বিভ্রমে সে প্রথম অনুতাপে আরো বেশি সত্তার গভীরে দেয় ডুব, অনন্তর ভেসে ওঠে হাতে নিয়ে অনন্তের ফুল।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
অলীক আশার বাণী শোনাতে আসি নি। গেছি ভুলে সেই মায়াবৃক্ষ, আশা যার নাম; টুপ টাপ ফল পড়বে না, যত ইচ্ছে ঝাঁকি দাও। যা-কিছু সম্বল জমেছিল পুরুষানুক্রমে গ্যাছে সবই, মর্মমূলে দুর্মর কীটের বাসা; আত্মা বন্দী কুহকিনী-চুলে। সঙ্গীরা খোঁয়াড়ে তৃপ্ত; ড্রাগ-অয়াডিক্টের আচরণ কী ক’রে দখল করে সবাইকে? কোথায় শরণ নেব আজ? থাকবো কি হরদম শূন্যতায় ঝুলে?সবখানে চন্দ্রবোড়া, শঙ্খিণী, দাঁড়াশ; পথ নেই পালাবার; পক্ষীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে মেঘে উড়ে যাবে? রূপকথা শুয়োরের ক্লিন্ন চোয়ালেই জীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। দিনরাত্রি চরম উদ্বেগে কন্টকিত; দশদিকে শুধু মধ্যযুগের বিস্তার, এরকম ব্যাপক সংকটে নেই কারুরই নিস্তার।   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
মানব হারায় পথ বারংবার, জগৎ সংসার সুবিশাল ঊর্ণনাভ হয়ে প্রবল জড়ায় তাকে সারাক্ষণ, অমানিশা সত্যকে আড়াল করে রাখে দৃষ্টি থেকে; হয়ে যায় দৃশ্য ও অদৃশ্য একাকার। এখন ফেরারি শান্তি, নিয়ত সংঘর্ষ পৃথিবীতে কী ব্যাপক শ্মশানের ধোঁয়া ছড়ায় নিমেষে, শত শত দীপ্র নগরে মড়ক ব্যেপে আসে। তথাগত দেখলে এমন ধ্বংস হতেন ভয়ার্ত অম্বালিতে।এই তো দেখছি আমি নিরন্নের বিশীর্ণ ভিক্ষায় ব্যথিত সিদ্ধার্থ বসেছেন ধ্যানী উপবাসে; তিনি সর্বব্যাপী অন্ধকার দেখে আনন্দের দিকে হাত বাড়িয়ে সত্যের দীপ তুলে ধরেছেন। প্রতীক্ষায় সুজাতা তণ্ডুল নিয়ে বসে আছে স্তব্ধ, একাকিনী- হৃদয় কপিলাবস্তু, স্তূপময় পূণ্য সারনাথ।  (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
গর্ব করবার মতো কিছু নয়, সামান্যই পুঁজি। রোদ আনতে চাঁদিনী ফুরায়; তার চুলে, নাভিমূলে বৃষ্টি মেখে দিলে প্রাণে বয়ে যায় খরার পবন। বাড়ির সম্মুখে সন্তর্পণে পদচ্ছাপ রেখে গেলে কোমল হরিণ কোনো বাজে না গভীর রাতে বাঁশি। অভ্র দিয়ে শান্তির কুটির বানানোর বাসনায় কামলার মতো খাটি সারাদিন, তবু অসমাপ্ত দেয়ালে গজায় বুনো ঘাস। কবে থেকে ব’সে আছি নতমুখে, মহাজন তাগাদা শোনায়, নিদ্রাছুট নিশীথে আমাকে ঠোকরাতে থাকে অশান্তির পাখি।  (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
তোমার সান্নিধ্যে কিছুকাল অলৌকিক সরোবরে কেটেছি সাঁতার, অকস্মাৎ শেষ হলো জলকেলি, যেমন কেবল আলাপেই সাঙ্গ করেন সঙ্গীত কোনো গুণী কী খেয়ালে। জানতাম, বিদায়ের পালা আসবেই একদিন হৃদয়ে ছড়িয়ে রাশি রাশি তেজস্ক্রিয় ছাই, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে ভয়ংকর অবসান, কখনো ভাবিনি আগে। তুমি কিংবা আমি কেউ নয় দায়ভাগী এমন সংকটে।যা ঘটেছে কে জানে প্রকৃতপক্ষে তার বিষবীজ আমাদের অগোচরে আমরা দুজনই পরস্পর করেছি রোপণ কিনা অসতর্কভাবে? চতুর্দিকে দৃষ্টি-অন্ধ-করা ঝড়, বেনো জলে লুপ্ত সাঁকো আর নিরাশ্রয় মৃত পাখি ভাসমান। যখন তোমাকে আমার সবচে বেশি প্রয়োজন, তখনই হঠাৎ চলে গেলে।   (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কে তুমি এখন এই অবেলায় আমাকে ঘুমের শান্তি থেকে জাগিয়ে তুলেছ অন্ধকারে? বেশ কিছুক্ষণ পরে নানা শব্দের অনুরণে চোখ দু’টি বুজে এলে কে যেন হঠাৎ আমাকে খুঁচিয়ে তুলে দেয়; চেয়ে দেখি কেউ নেই, বাতাসের খুব জোর স্পর্শ থাকি।কিছুক্ষণ ডানে বামে ঘুরে পুনরায় ঘুমোবার চেষ্টায় প্রলুপ্ত হয়ে চোখের পাতাকে শান্তি দিতে চেয়ে ব্যর্থ হই। কিছুক্ষণ পরে হাতে হাল আমলের এক বাক্যগ্রন্থ নিয়ে কেন জানি ব্যর্থ হই। তবে কি আমাকে পদ্য ত্যাগ করেছে আখেরে? ঘরে এলোমেলো পায়চারি করি।আমি কি উন্মদ হয়ে যাব? না হলে এমন হাল হচ্ছে কেন আমার? কবিতা, অনেকেই জানেন আমার প্রাণ। যদি সে আমাকে ছেড়ে যায় ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরের মতো, তবে আমি ঘরে ও বাইরে ঘুরে বেড়ালেও নিষ্প্রাণ পুতুল হয়ে থেকে যাব আর বকব প্রলাপ।এখনও আমার লেখা কবিতা অনেকে, যতদূর জানি, দিব্যি ভালোবেসে পড়েন এবং তাদের বিশেষ অপছন্দ হলে ঠিক জানিয়ে ছাড়েন। প্রকৃতই বোদ্ধা যারা তারা নিন্দা ছুড়ে দিলে খেদ নেই কোনও, উপরন্তু বেশ কিছু ভেবে ভবিষ্যতে শুধরে নেয়ার চেষ্টা থেকে হই না বিরত।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ, বন্য কেশরের জ্বলছে বিদ্যুৎ। চোখের কোণে কাঁপে তীব্র নরলোক, তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ।আকাশে মেঘদল সঙ্গ চায় বুঝি, মাটির নির্ভর উঠছে দুলে শুধু। বাতাসে ঝলমল মুক্ত তলোয়ার, তিনটি তলোয়ার আঁধারে ঝলসায়।স্বপ্নহীনতায় স্বকাল হলো ধু-ধু, স্বস্তি নেই খাটো মাঠের মুক্তিতে। খুরের ঘায়ে ওড়ে অভ্র চৌদিকে, তিনটি শাদা ঘোড়া স্বপ্ন তিনজন।শূন্যে মেঘদল যাচ্ছে ডেকে দূরে, মেঘের নীলিমায় দেয় না ধরা তারা; লক্ষ গোলাপের পাপড়ি ওঠে ভেসে, অন্ধকারে যেন মুখের রেখাগুলো।তিনটি ঘোড়া বুঝি সাহস হৃদয়ের, ত্রিকাল কেশরের শিখায় জাগ্রত। শূন্য পিঠে ভাসে মুকুট উজ্জ্বল, তিনটি শাদা ঘোড়া বাতাসে দেয় লাফ।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
তোমার অভিমানগুলো রাতের দেয়ালে মাথা কুটে কুটে গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল নিঝুম মেঝেতে এবং আমি সেগুলো জড়ো করে একটি পুষ্পস্তবক বানিয়ে তার চৌদিকে ভ্রমরের মতো গুঞ্জরণ তুলি। সেই সুর নকশা আঁকে নৈশ প্রহরে।তোমার দুচোখের কান্না, হৃদয়ের অশ্রু-ফোঁটা শ্রাবণ-দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে ঝরতে থাকে অবিরল; আমি সেই অশ্রুকণাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তৈরি করি মুক্তার এক অনুপম হার।রাতজাগা পাখির বুকে পুষ্পস্তবক আর মুক্তোর হারের কবিতা লিখে তাকে পাঠিয়ে দিলাম শুকনো মেঘের কাছে; মেঘ ওকে আলিঙ্গন করে ভিজে উঠলো ঝরে পড়ার জন্যে।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
কংক্রীট বনে ঘেমো জনস্রোতে বলো তোমাকে কোথায় কোন্‌ ঠিকানায় খুঁজি? কবন্ধ এই শহরে সন্ধ্যা হলো, এদিকে ফুরায় বয়সের ক্ষীণ পুঁজি।সেই কবে থেকে চলেছে অন্বেষণ। ক্লান্তি আমার শরীরে সখ্য গড়ে, তোমার গহন ঊর্মিল যৌবন আনে আশ্বন এখনো বন্ধ ঘরে।মনে পড়ে যায় শরীরে তোমার নাচে খর বর্ষার তন্বী পাহাড়ি নদী। তোমারই চুলের নিভৃত ছায়ার কাছে চাই আমি চাই আশ্রয় নিরবধি।দেয়ালের লেখা আমিও করেছি পাঠ- জুটবে ভাগ্যে উপেক্ষা অবশেষ। সাক্ষী এ নদী, সোনা-ওগরানো মাঠ, খুঁজেছি স্বর্গ তোমাকেই ভালবেসে।নশ্বরতার প্রতাপ জেনেও আমি করি সঞ্চয় স্বপ্নফলানো স্মৃতি, তোমারই ছায়ার আজো আমি অনুগামী, যদিও হারানো জানি জাগতিক রীতি। ভেবেছি ক্রমশ বিস্মরণের লেকে তুমি ডুবে গেলে হবে না কিছুই ক্ষতি, কিন্তু তোমার স্মৃতির পীড়ন থেকে আমৃত্যু নেই আমার অব্যাহতি।বিরোধী কালের জতুগৃহে করে বাস সত্তা আমার ভস্মে গিয়েছে ঢেকে; মেলে না কোথাও এক কণা আশ্বাস, রজ্জুও নেই সর্পের ব্যতিরেকে।ধ্বংস বাজায় চৌদিকে তার ঢাক, কোথায় নিলালো তোমার পায়ের রেখা? বিপাকে লুপ্ত আমার ব্যাকুল ডাক, প্রলয়ান্তে ও পাবো কি তোমার দেখা?   (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
রূপক
এই যে আপনি আমার বাসার জানালার ভেতর দিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কে আপনি? আপনার এই কাজটি কি তেমন ভালো হচ্ছে? আমার গলার আওয়াজ জানালা থেকে স’রে গেল। জানালাটি বন্ধ করার সঙ্গেই একটি বিটকেল আওয়াজ দৌড়ে এসে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। বাইরের অচেনা ব্যক্তি- কেউ কি তাকে স’রে যেতে হুকুম দিলেন? কে বলবে? খানিক পরে কে যেন আমাকে মাথা বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়।ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বেজায় কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হল আর আমার পাশেই একজন তরুণীকে দেখতে পেয়ে ভড়কে গেলাম। তরুণী মৃদু হেসে আমাকে মধুর সম্বোধন জানালেন। মুহূর্তে ঘরের পরিবেশ গেল বদলে। তরুণী উধাও, পাশের শয্যায় একজন বিকট পাণ্ডা দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর ওর মুখ থেকে ঝুলছে কাঁচা মাংস। তার হাসির তাড়নায় সারা ঘর গমগম করছে, বেজায় কাঁপছে।খানিক পরে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ ট্রে-হাতে ঘরে ঢুকলেন। তিনি এমন সালাম জানালেন যে, আমার হাত সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে আদাব জানাল। তাঁর ট্রেটিও ছিল বেশ জমকালো। ট্রের খাবারগুলোও জমকালো। এবং -খানিক পরেই বেজে উঠল রবীন্দ্রসংগীত। এবং বেশকিছু পরে হাল আমলের কবির কবিতাও বেজে উঠল রেকর্ডে। হয়তো সন্ধ্যারাতে কিংবা ভোরবেলা গায়ক গায়িকা হাজির হবেন এই এলাকার সংগীতপ্রেমীর তৃষ্ণা মেটাতে।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আর কত করবো আমি নিভৃতে তোমার ইস্তেজার সারাবেলা প্রতিদিন? এখন তোমাকে খুঁজে ফিরি প্রষ্ফুটিত গোলাপ এবং গন্ধরাজে, ঝিরিঝিরি হাওয়ার হেরেমে মেঘে নদীবক্ষে বেকারার হৃদয়ে প্রকৃত পক্ষে। তবু আজো তোমার দিদার স্থগিত, অথচ দেখি তোমাকেই বাসের ভিতরে বসে-থাকা, দুপুরে রিকশায় অপরাহ্নে স্মিত ঘরে ক্ষণিকের জন্য লুপ্ত মাতলামি সকল দ্বিধার।এ-তুমি প্রকৃত তুমি নও কিছুতেই, যদি হতে তাহলে হৃদয় পরবাসে কাটতো না এতকাল বিভ্রমবশত সত্যি। যে হাত আমার দুষ্ট ক্ষতে নিরাময় ছড়াবে রেণুর মতো, সে-হাত নাকাল কেন হবে মারীবৎ স্বেচ্ছাচারে? প্রতিক্ষণ যাকে চাই একাকিনী শান্ত বুদোয়ারে, সে কোথায় থাকে?   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
মনে পড়ে, সুদূরকালে এক সতেজ সকালে নাজিমুদ্দিন রোডে বেতার ভবনে আমার সদ্য লেখা কবিতা নিয়ে আপনার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম কবিতা পাঠের আমন্ত্রণে। আগেই আপনার, আহসান হাবীব আর ফররুখ আহমদের নানা কবিতার সঙ্গে ছিল পরিচয়।কী করে ভুলব স্নেহময় সেই ডাক যা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল আজিমপুর কলোনির ঝকঝকে ফ্ল্যাটে, যেখানে ছিল আপনার জীবনযাত্রার আসর? হ্যাঁ, আপনার আন্তরিক আমন্ত্রণ আমাকে বারবার নিয়ে যেত বাইরে শান্ত, অন্তরে উদ্দাম এক তরুণকে। সেই তরুণের শ্রদ্ধাঞ্জলি উন্মীলিত ছিল আপনারই দিকে। আজ এই সত্তর-পেরুনো আমার মনে সেলুলয়েডে এক চিত্রমালা যেন উদ্ভাসিত, দেখছি এক কামরায় আপনারা কজন বন্ধু, প্রত্যেকেই মাঝবয়েসী-প্রায়, তাসের রাজা, রানী আর গোলাম নিয়ে মশগুল আর এক তাজা তরুণ অনুরুদ্ধ হয়ে আপনার পূর্ব-প্রকাশিত এলোমেলো ছড়ানো অনেক কবিতা একটি পৃথুল খাতায় কপিরত নিবিষ্ট চিত্তে। হঠাৎ স্তব্ধতা চিরে ডেকে উঠে দুপুরকে আরও বেশি উদাস ক’রে তোলে আকাশে পাক-খাওয়া চিল। কলম থামিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে দেয় কবিতায়-পাওয়া সেই তরুণ।শ্রদ্ধেয় করি, আপনি আজ এই আশি বছর বয়সে সেই তরুণকে আবিষ্কার করতে পারবেন কি এমন ভাঙাচোরা আমার ভেতরে, আপনার আনন্দ, বেদনা, রোগ, শোক এবং চলার পথে উদ্দীপনা, ক্লান্তি, পুরস্কৃত প্রহর, এমনকি হতাশার অন্তত খানিক অংশীদার? আপনি কি বিশ্বাস করেন না আমার এই প্রশ্নের ব্যাকুলতা? আপনি কি, হে আমার অগ্রজ সার্থক কবি, মৃদু হেসে খারিজ করে দেবেন নিবেদিত এই কথামালা? স্বজন-পরিবৃত, পুষ্পশোভিত ড্রইংরুমে মনে কি পড়বে না সেই নিবেদিত-চিত্ত স্বপ্লভাষী, লাজুক, স্বপ্ন-তাড়িত, কবিতা মাতাল তরুণের কথা?   (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
বহুদিন আগে একজন বৃদ্ধ এক বিকেলের নম্র অবসরে শোনালেন আমাকে অজানা এক গল্প যা বানানো নয় এক রত্তি। কোনওকালে না-শোনা কাহিনী শোনা গেল। মনোযোগ সহকারে পাতাময় গাছের তলায় কিছুক্ষণ। স্তব্ধতায় কথকের গাঢ় উচ্চারণ সৃষ্টি করে ভিন্ন প্রভা।বৃদ্ধ কথকের কথা শুনতে চেয়ে দেখি আকাশে সূর্যের আলো ঝিমিয়ে এসেছে আর কয়কটি পাখি গাছের শাখায় এসে ব’সে নিয়েছে আশ্রয়। বৃদ্ধ তার সফেদ দাড়িতে হাত বুলিয়ে গল্পের সূচনা করেই থেমে আকাশের দিকে তাকালেন।ইতোমধ্যে পার্শ্বাবর্তী হ্রদে মৃদু ছলছল ক’রে ওঠে জল আর বৃদ্ধ কথকের চোখে ভেসে ওঠে তিনজন যুবতীর অপরূপ সাঁতার এবং কিছুক্ষণ কেটে গেলে দেখা দেয় অন্য উপসর্গ হয়তো-বা কেটে গেলে জ্যোৎস্না এই প্রিয় পৃথিবীতে- মায়ামায় দুনিয়ার যেন আর কোনও জান্নাতের সৃষ্টি করে।একদিন বৃদ্ধ তার এই প্রিয় শহরের নানা পথ ঘুরে কেমন বেদনা বোধ করে ধীরে ব’সে পড়লেন আর চতুর্দিকে নানা মানুষজনের কাণ্ডকারখানা দেখেটেখে আকাশের দিকে চেয়ে খুব জোরে হেসে উঠলেন। এই আচরণে পথচারীদের কেউ-কেউ থামলেন, অনেকেই বাঁকা হেসে দূরগামী।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
যুদ্ধবাজ সাইরেনে উচ্চকিত কৈশোর আমার গলির বিধ্বস্ত ঘরে। গুলির শব্দের প্রতীক্ষায় কেটেছে ভুতুড়ে রাত্রি অন্ধকারে এবং তামার মতো দিন খাকির প্রতাপে কাঁপে শান্তির ভিক্ষায়।যৌবন দুর্ভিক্ষ-বিদ্ধ, দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভাঙে দেশ, এদিকে নেতার কণ্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি ভাষা খোঁজে। আদর্শের ভরাডুবি, মহাযুদ্ধ শেষ, মঞ্চ তৈরিঃ কে হবে নায়ক তবে? করি কার স্তুতি?সগৌরবে ঢাক-ঢোল বাজালো সে ধ্বংসের উৎসবে যারা তারা কেউ পেলে শিরোপ, কেউবা পতনের ঝাঁ-ঝাঁ স্মৃতি; বহু মাঠ গেলো ভরে নামহীন শবে। পচা মাংস দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বেশ্যার স্তনের উষ্ণতার মনস্তাপ মাখে যে- লোকটা মগজেই ঘোরে তার শবাধার, একগাছি দড়ি কিংবা ক্ষুর- যা-কিছু হননপ্রিয়, যা-কিছু অত্যন্ত সহজেই জীবনকে করে তোলে অর্থহীন জীর্ণ আস্তাকুঁড়।চতুর বক্তৃতাবলী, প্রচারণা, সংঘের ধূর্তামি ছাড়া কল্কে পাওয়া ভার! বুক বেঁধে নির্বোধ সাহসে বিবর্ণ স্যাণ্ডেল পায়ে ঘুরেছি ধুলোয় রোজ আমিঃ হা-ঘরে বন্ধুর খোঁজে কতদিন বেড়িয়েছি চষে সারাটা শহর। অন্ধকারে কতো আনোরারা, বামী ইতস্তত গেছে ডুবে- দেখেছি স্বচক্ষে আর কষে দিয়েছি বিড়িতে টান একাকিত্বে যখন তখন। স্বরণের আঠা দিয়ে হতাশ প্রেমের জলছবি সেঁটেছি সত্তার ফ্রেমে। মধ্যপথে কেড়েছেন মন রবীন্দ্রঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি।কখনো শুনিনি পার্কে বসে হরিণের ডাক কিংবা পরীর আশ্চর্য স্তন আনেনি মোহের জ্যোৎস্না চোখে, জানালার শক্ত শিকে কোনোদিন। নিজেকে প্রতিভা- বান ভেবে ঘেঁটেছি নন্দনতত্ত্ব, যা বলুক লোকেস্বপ্নে শুধু হাঁসের ঝাপট দেখি কশাইখানায়ঃ মনে হয় স্ট্রেচারের ক্যানভাসে পড়ে আছি একা, কানে আসে কানাঘুষো, যেতে যেতে কে যেন জানায়ঃ এইতো বেজেছে ঘণ্টা, হবে না কখনো আর দেখা।বতিচেলী নারী নয়, মাতিসের রমণীর মতো তেমন কাউকে নয়, যে-হোক সে-হোক নারীকেই পাশে নিয়ে রাস্তায় হাঁটবো ভেবে সুখে অবিরত হঠাৎ নিজেরাই পায়ে মেরেছি কুড়াল। মেরে খেইহারিয়েছি জীবনের। মধ্যে মধ্যে ইচ্ছে হয় বলি জীবন, থামোহে বাপু, শুনেছি তোমার বাচালতা অনর্গল বহুদিন; এবার দিয়েছি জলাজ্ঞলি মেরুদণ্ডহীন, ক্লীব আশাকে তোমার। যে ব্যর্থতা আমাকে শাসায় নিত্য, আমি তারই অগ্নিকুণ্ডে জ্বলি। তোমরা আসবে কেউ? খোঁজো যারা ক্ষিপ্র সার্থকতা!যেহেতু যথেষ্ট নই ভদ্রলোক তাই জবুথবু সমাজের মোড়লেরা যথারীতি করেছে বিদায় ওহে অর্ধচন্দ্র দিয়ে। কোনোমতে সামলে নিয়ে তবু প্রতিবাদ করবো কি করবো না, পড়েছি দ্বিধায়।একদিন নিত্যসঙ্গী ছিল যারা তারা ডানে বামে সরে পড়ে, আমি শুধু যাইনে কোথাও। চোখে ভ্রম, আরেক যুদ্ধের ছায়া যৌবনের অপরাহ্ণে নামে এবং জীবন জানি সারাক্ষণ সিসিফস-শ্রম।   (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
প্রায়শ এমনই হয়, অনিদ্রার অঙ্গার ভীষণ পোড়ায় রাত্রিকে আর শরীরকে আমার; যেদিকে তাকাই কেবল পোড়া গন্ধ পাই। অন্ধকার ফিকে হয়ে এলে মনে হয় পাখির উৎসব এ দহন বেবাক ফেলবে মুছে, শান্তি জলে স্নাত হবে মন, বঞ্চনার হাহাকার থাকবে না, এ জগতে টিকে থাকার দুর্মর বাসনায় কোনো মন্ত্র নেব শিখে আর রোদে হাস্যেজ্জ্বল হবে হৃদয়ের উপবন।পাখির ডানার ছন্দ, রোদের সিস্ফনি জানি আজ পারবে না আমাকে ফিরিয়ে দিতে গত নিশীথের লুণ্ঠিত সময়, গুণী ভাস্করের কোনো কারুকাজ আমার জ্বলন্ত কামনার ভস্মরাশি থেকে ফের গড়তে অনিন্দ্য মূর্তি ব্যর্থ হবে। শুধু গৌরী নিজে পারে এ দহন মুছে দিতে প্রণয়-ধারায় ভিজে।  (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
একজন লোক, যার চালচুলো নেই, ঝরে গ্যাছে ফুটো পকেটের বিবর্ণ মানি ব্যাগের মতো যার সংসার যে স্বপ্নের ভগ্নাংশ কুড়োতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় বারংবার, ট্রাফিক-অরণ্যে পরীর আর্তনাদ শুনতে শুনতে, পালাতে পালাতে অবসন্ন সন্ধ্যার ঠোঁটে ওষ্ঠে চেপে কোথাও এক কোণে ঘুমোতে চায় কিছুক্ষণ। তার শুকনো মুখে ঝরে স্মৃতির মতো একরাশ পাতা, হাওয়া এলোমেলো করে দেয় রুক্ষ চুল, কয়েকটি পাখি ভীষণ হল্লা করে বিকেলকে কাঁপিয়ে ওড়ে দিগ্ধিদিক। সে হয় অবসাদগ্রস্ত, তার মুখ নিদ্রার স্তনে গচ্ছিত,- যেন কোনো প্রৌঢ় মণিরত্নের ঠিকরোনো আলোর মতো ব্যাকুলতায় মুখ ঘষে তন্বী-সত্তায় এবং তার নিজেকে মনে হয় ভাঙা বাবুই পাখির বাসার মতো।লোকটা সন্ধ্যাকে সমুদ্র ভেবে ভাসায় নিজস্ব জলযান, গাভিন গাভির মতো পালে লাগে দিগন্তের ঘ্রাণ, অকস্মাৎ সে দ্যাখে, গলুইয়ে এক তরুণী, জল-ছুঁই-ছুঁই তার চুল, মসৃণ, ছন্দিত হাত, চোখে পৌরাণিক সৌন্দর্যের বিস্ময়, দৃষ্টি তারই দিকে নিবদ্ধ, সে সোনালি বর্শিতে বিদ্ধ। লোকটা রত্নদ্বীপের জাগরণ অনুভব করে নিজের ভেতরে আর তন্বীর সামনে নতজান, হয়ে সে বলে- আমাকে দিয়েছো তুমি নতুনের সাহস, যৌবনের অহংকার।লোকটার কাহিনী, যদি কাহিনী বলা যায় একে, এখানে শেষ হলেই ছিল ভালো, মোটামুটি তৃপ্তিকর। কিন্তু তা হওয়ার নয় কস্মিনকালেও। অন্য পরিণাম ওঁৎ পেতে আছে তার জন্যে, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে যে কোনো সময়- যেমন তার নৌকো হঠাৎ ফুটো হয়ে যাবে কিংবা সে নিজেই পুড়িয়ে ফেলবে নিজস্ব চন্দ্রোপণ জলযান অথবা দু’দিকে বিস্মৃত যুগল পথের কোনটিকে ঠিক পথ ভেবে এগোবে, মনস্থির করতে না পেরেকেবলি পথের ধারে যাবে আর ফিরে আসবে বারে বারে। হয়তো সে সারাক্ষণ পার্কের বেঞ্চিতে বসে আরাধনা করবে নীরবতার আর সন্ধ্যামালতীর সান্নিধ্যের স্বপ্ন দেখবে ঝিমুতে ঝিমুতে অথবা বিস্কুট চিবুতে চিবুতে, হয়তো বা মন দেবে মূলো আর গাজর ফলানোয়, গো-পালনে, হেঁটে যাবে সর্ষে ক্ষেত্রের ভেতরে, জোনাকিতে ছেয়ে যাবে সমস্ত শরীর কোনো কোনো রাতেকিংবা পতঙ্গরূপে সকাল-সন্ধ্যা উড়ে বেড়াবে ছমছমে পোড়োবাড়ি আর গোরস্তানে। কাহিনীর সমাপ্তির তাগিদে। লোকটার সম্ভাব্য পরিণামের যে কোনো একটি, যার যেমন ইচ্ছে, বেছে নিতে পারে। আপত্তি জানানোর জন্যে সে একটা আঙুলও নাড়বে না।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
এখনো কি অন্ধকার কোণে একা ভীষণ নিশ্চুপ আড়ালে থাকবো বসে? এখনো কি কারো খুব কালো চুলের ছায়ার কথা ভেবে-ভেবে, গহন দৃষ্টির অত্যন্ত রাঙ্ময় কোনো ভিতর ভূবন আবিষ্কার করে দিব্যি সম্মেহিত কাটাবো প্রহর? এখনো কি? নিজের প্রশ্নের কাছে নিজেকেই বড় অসহায় মনে হয়। সে আমার দিকে তার সুরভিত করতল পুনরায় বাড়িয়ে দেবে কি ভেবে আমিএখনো উদ্বেগে কাঁপি। বৈরী বায়ুস্তরে বিপর্যস্ত ঈগল আবার যদি না পায় আশ্রয় কোনোখানে, তবে কার কী বা এসে যায়? তার ছিন্ন ডানা থেকে একটি অস্পষ্ট ইতিহাস আর্তস্বরে উন্মোচিত হতে চায়। ঝড়ক্লান্ত ঈগলের রক্তাক্ত ডানায় আমার অতীত মগ্ন, নিজেরই শোণিত করি পান।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
যদি আমার একটা নোটবুক থাকত তাহলে আমার নিজস্ব ভাবনাগুলোকে টুকে রাখতে পারতাম আর এখন কী সহজেই না সেরে ফেলা যেত কাজটা। খুব অল্প সময়ে পদ্মার ধু ধু চরের মতো একটা পাতা সেজে উঠত কতিপয় পঙ্‌ক্তিতে। কঁকিয়ে-ওঠা সিঁড়িতে পা রাখতেই মনে হলো কে যেন আমার পাশাপাশি হাঁটছে। হাড়-কাঁপানো শীতল নিঃশ্বাস আমাকে স্পর্শ করে। কবিতা লেখার জন্যে কী কী আমাকে করতে হয়, এ-কথা যদি কেউ বুঝতে পারত। জ্যোৎস্নারাতে ঝরাপাতার ওপর হরিণের পায়ের শব্দ শোনার জন্যে আমি কান পেতে রাখি কত প্রহর, গুলিবিদ্ধ পক্ষিণীর আর্তনাদে অনুভব করার জন্যে কতবার চিৎকার করে উঠি, রাত-বিরেতে, ঝর্ণাজলে আদিবাসী যুবা নিজের মুখের যে বিষণ্ন ছায়া দেখে তার প্রতিচ্ছবি আমার মধ্যে দেখতে গিয়ে যে বেদনা প্রত্যক্ষ করি একটি কবিতা লেখার জন্যে, কে তার খোঁজ রাখে? একটি কবিতা লেখার জন্যে আমি অভিধান শুঁকি, যেমন সানুরাগ শুঁকি প্রিয়তমার শরীর। একটি কবিতা লেখার জন্যে আমাকে লাশকাটা ঘরে শুতে হয় লাশের চেয়ে অধিক লাশ হয়ে। কতিপয় পঙ্‌ক্তি লেখার জন্যে মৃণালিনী ঘোষালের শব হয়ে আমাকে ভাসতে হয় করুণ জ্যোৎস্নায়। একটি কবিতা লেখার জন্যে আমি রঁদার ভাবুক হই, হই রিলকের বাঘ, ভ্যান গগের আত্মপ্রতিকৃতি। একটি কবিতা লেখার জন্যে জীবনানন্দের সঙ্গে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।   (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়। অনেক শতাব্দী অস্তিত্বের শৈলাবাসে ফুলপাতা, উদাস সুরভি, কিছু ওষুধের চাপা ঘ্রাণ নিয়ে, পায়ে নিয়ে কম্বলের তাপ, অনেক শতাব্দী মিশরের সুপ্রাচীন প্রকোষ্ঠের মতো মগজের ভেতরে কখনো অমাবস্যা, কখনো ডাগর পূণিমা, অদ্ভুত ফ্রেস্কো নিয়ে বসে আছি, মনে হয়। স্পন্দন আছে কি নেই, বোঝা মুশকিল। অকস্মাৎ কেমন খটকা লাগে, চোখের পাতা কি জমে যাবে উত্তুরে হাওয়ায়? চতুষ্পার্শ্বে কত কিছু খর জলধারার মতোন বয়ে গেছে, ফেলে গেছে কোনো কোনো চিহ্ন-প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন, আড়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখি সময়ের লালা ঝরে হাসপাতালের বারান্দায়, করিডোর, ব্যাঙ্ক কাউন্টারে, ভিখিরির খুব সংকুচিত নগ্ন মধ্যাহ্ন ভোজনে, মিশকালো আইবুড়ো মেয়েটির শুভ্র প্রার্থনায়, সময়ের লালা ঝরে বেদেনীর নিতম্বে নিয়ত।তিনখণ্ড গীতবিতানের ভালোবাসা খরাগ্রস্ত সত্তাকে লালন করে নিশিদিন। ডাকঘর ডাকে বেহালার সুরে আমি ছুটে যাই একা, পত্রগুচ্ছ এখন আমার নামে এসেছে কি আসে নি, ভাবিনা এতটুকু। তাহলে এ-ও সত্য কবিতা লাফিয়ে উঠে ব্যাপক আঁধারে চুমু খায় পুলিশের শাদা দস্তানায় অথবা লেহন করে গণিকার পাইকারী ঊরু? কবিতা কি তপোজ্জ্বল ওষ্ঠ রাখে মৃতের অধরে? নাকি বৈদেশিক দূতাবাসে এর ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে গোলাপের মতো ঝরে যায় পুরু গালিচায়?কবিতা কখনো চুপিসাকে ক’ফোঁটা চোখের জল, কিছু ফুল রেখে আসে মর্গে, পথে পথে ঘোরে, মিশে যায় শহীদ বেদীর অর্ঘ্যে, মিশে যায় ফেরারীর পায়ের আওয়াজে। কবিতা কখনো জিরাফের গলা বেয়ে ওঠে, কখনো সুদূর নীলিমানিমগ্ন তীক্ষ্ম চিলের চোখের ভেতরে প্রবেশ করে, কখনো বা জাহাজডুবির পরে দ্বীপে শুয়ে-শুয়ে দ্যাখে শুধু চকচকে মাছের মতোন জলধোয়া নিজের শরীর, কখনো বা পিছুটান তার কাছ থেকে টেনে নেয় কিছু দীর্ঘশ্বাস।অনেক শতাব্দী ভারি মনোকষ্টে আছি, মনে হয়। যখন সূর্যাস্ত রাঙা চেলীর মতোন কোমল ছড়িয়ে পড়ে আকাশে, আড়াল ছিঁড়ে খুঁড়ে। জ্বলজ্বলে একটি মোরগ চায় তার প্রতি আমার কাছে, যেন জেনে নিতে চায় তার প্রতি আমার প্রকৃত মনোভাব আর অনেক শতাব্দী কাঁপে ঈষদুষ্ণ মোহন কিরীটে, মনোভূমে ফিরে আসে হাঁস স্বপ্নছায়া নিয়ে মেঘার্দ্র ডানায়। পারস্পর্যহীন সব বলে আমি দিনরাত্রি মনোকষ্টে থাকি। অনেক শতাব্দী চুপচাপ বসে আছি, মনে হয়। আমার ওপর অবিরল সময়ের লালা। হঠাৎ কবিতা এসে বসে খুব কাছে, হাত ধরে বলে-চলো, খানিক বেড়িয়ে আসি, যেখানে তোমার খুশি, ওঠো, খামোকা কোরো না দেরী, খুঁজো না টিফিন ক্যারিয়ার কিংবা ক্লাস্ক, স্যুটকেশ হোল্ডল ইত্যাদি থাক, বাস ছেড়ে দেবে।   (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
(বন্ধু তওফিক আজিজ খানের স্মরণে)জীবন তো প্রকৃত খেলারই মাঠ, আমরা সবাই খেলে যাই যে যার মতোই। যতদূর জানি তুমি শুরু থেকে শেষ অব্দি খেলেছ, বান্ধব, নিজের ধরনে ক্রিকেটের দক্ষ ব্যাটস্‌ম্যানের ভঙ্গিমায়। সাজিয়েছ আপন সংসার সুচারু অভিনিবেশে, যেমন ব্যাটস্‌ম্যান তার সফল ইনিংস। প্রতি পদক্ষেপে ছিল নিষ্ঠা আর ভঙ্গিতে সুষমা। বিপরীত দিক থেকে বল এলে কখনো ধৈর্যের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিয়েছে, কখনো-বা ফুটিয়েছ চারের মারের ফুলঝুরি।ফুলবাণে বিদ্ধ হয়ে যখন উতলা ছিলে খুব, তখন সে কাঙ্ক্ষিতা তোমার প্রিয় জীবনসঙ্গিনী হয়ে বাঁধলো তোমাকে আলিঙ্গনে। তোমরা দুজন গড়েছিলে সুখের, শান্তির নীড়। প্রিয়ার চুম্বন আর সন্তানের খেলা তোমার ক্লান্তির ছায়াটিকে সহজে দিয়েছে মুছে। জীবনের মাঠে কখন যে কোন্‌ অঘটন ঘটে, কে তার হিশের রাখে? তোমার প্রতিটি শটে ছিল শিল্পের বিভাস, তবে কেন সেঞ্চুরী না হাঁকিয়ে হঠাৎ পরাজয় মেনে নিয়ে ব্যাট মাঠে ঠুকে ঠুকে বিশ্রামের কুয়াশায় নাকি ভবঘুরে মেঘদলে, পড়লে ঘুমিয়ে সেই শোকে, হে বন্ধু, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না কস্মিনকালে। কেন চলে গেলে?ছিল না নাছোড় স্তব্ধ অভিমান কোনো? যতদূর চিনেছি তোমাকে, ছিলে তুমি দিব্যি হাসিখুশি, বাস্তবের খেলাঘরে সমর্পিত। কোন্‌ সে খেয়ালি আম্পায়ার আচমকা আঙুলের সংকেতে তোমাকে পিচ ছেড়ে যেতে বললেন আর সেই জ্বলজ্বলে ইনিংসটি পুরো না খেলেই তুমি হায়, মিশে গেলে অজানা কোথায়!  (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
সনেট
আজকের সন্ধ্যেটির নির্জনতা আমাকে কাতর করেছে ভীষণ, ইচ্ছে হলো নদী আনি, মাঠ, গাছ নিয়ে আসি, আনি দোল পূর্ণিমার তিথি আর নাচ দেবদূতদের নদীতটে। তুমি স্মৃতির আতর সিল্কের রুমালে নিয়ে আসবে এখানে, থর থর হৃদয়ে অপেক্ষা করি, অথচ তোমার শাড়িটিকে ঝলসাতে দেখছি না একবারও এখনো এদিকে; আমার সত্তায় বয় কী-যে স্থিতি ওপড়ানো ঝড়।এই সন্ধ্যেবেলা তুমি ছিলে না আমার পাশে খুব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে এবং চতুর্দিকে ছিল ধু ধু মরুভূর দীর্ঘশ্বাস, নিঃসঙ্গতা আমাকে লেহন করছিলো কুকুরের মতো, আমি বারবার ডুব দিচ্ছিলাম অসহায়তার জলে। ঘাটে ছিলো শুধু তলাহীন নৌকা এক, কিয়দ্দূরে ভয়ঙ্কর বন।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
নদীর ঝাপ্টায় চমকে উঠে তাকাই, উপকূলের ঘুম সত্তা ছেড়ে মেঘমালায় লীনঃ কয়েকটি পাখি চঞ্চুতে রৌদ্রের অকপট সততা নিয়ে আমাকে প্রদক্ষিণ করে, ওদের ডানায় ঢেউয়ের স্বরগ্রাম, চোখে ভবিষ্যতের নীলকান্ত মণির বিচ্ছুরণ, বন্ধুরা কোথায়? আমারতো একসঙ্গে স্তব্ধতাকে গান উপহার দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম পর্যটনে।ডাঙায় নৌযানের টুকরো টাকরা এক বিপর্যয়ের মূক কথক; দূর দিগন্তের গা ধুইয়ে উতরোল জলরাশি; সারা শরীরে মাঝ গাঙের জলজ ঘ্রাণ, মৎস্যঘ্রাণ নিয়ে অবসাদের বালির চিকচিকে শয্যায় শুয়ে আছি, সহযাত্রীরা কোন অন্ধকারে অন্ধকার হয়ে হিংস্র অতীতের দখলে? পাখির চিৎকারে চিন্তা তরঙ্গে নেমে আসে আর্তনাদ ছেড়ে যাওয়ার পরের স্তব্ধতা। গা ঝাড়া দিই জলচর পাখির মতো। আমাকে ফিরে যেতে হবে অনেক আগেকার বিস্ফোরণের বলয়ে, এক অগ্নিপথ থেকে অন্য অগ্নিপথে যেতে হবে হেঁটে। সেখানে এই বিড়ম্বিত ব-দ্বীপের ইতিহাস রাজহাঁসের মতো গ্রীবা তুলে দাঁড়ানো।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ? তেমন যোগ্য সমাধি কই ? মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো অথবা সুনীল-সাগর-জল- সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই ! তাইতো রাখি না এ লাশ আজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে, হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
পুরোনো দিনের টানে মাঝে-মধ্যে এখনো সকালে অথবা বিকেলে কিংবা ভর সন্ধ্যেবেলা তসলিম রশিদের কাছে যাই। আমার নিজের বাসা থেকে ওর বাসগৃহ বেশ দূরে আরশি নগর বলা যায়, যদিও পড়শি নেই কোন তার প্রকৃতি প্রস্তাবে।কখনো কখনো তার সঙ্গে হয় না আমার দেখা মাসাধিক কাল। কখনো বা দেখা পেয়ে যাই। তসলিম রশিদের বয়স হয়েছে ইদানীং। মানে তার চুলে চকখড়ি গাঢ় দিয়েছে বুলিয়ে উদাসীন শিল্পী এক। এখন সে লেখে না কবিতা রাত জেগে থাকে না তাকিয়ে নাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা আকাশের দিকে। আজকাল সহজে আসে না ঘুম, নিয়মিত খায় সেডাকসান। গায় না সে মিছিলের গান গলা ছেড়ে, পাখিটাখি দেখে না ঝিলের ধারে, থাকে নিজের ভেতর নিজেকেই লুকিয়ে চুরিয়ে রেখে।তিন তাসে মজেছে সে, শোনা যায়, এবং আকণ্ঠ দিশি মদ গিলে বেহুঁশ বাসায় ফেরে মধ্যরাতে, নিজেরই ছায়ার মতো। কোনো কোনো রাতে বাহিরকে করে ঘর বিলাবাজ ইয়ারের সঙ্গে। খিস্তি করে, বমিতে ভাসায় ঘর মাঝে-সাঝে। যদি কেউ তাকে কবিতার কথা বলে খেলাচ্ছলে, তবে বেধড়ক ক্ষেপে ওঠে র্যাঁলবোর ধরনে। কী এক জটিল জালে স্বেচ্ছাবন্দি, দলে দলে মাকড়সা তার চোয়ালে, কপালে, গালে, গলায়, বুকের কাছে ঘোরে দিনরাত, অথচ পায় না টের, যেন হারিয়ে ফেলেছে বোধ, রোজ হাঁটাচলা করে নিজের অনুকরণে, লতাগুল্ম, পাখি থেকে দূরে, ক্রমান্বয়ে কংক্রিটের অবয়বে নিঝুম আশ্রয় পেতে চায়। কতদিন ভাবি তসলিম রশিদের কাছে যাবো না কখনো আর দূরে সেই আরশি নগরে, নিজের অজান্তে তবু বার বার সেখানেই যাই, চলে যাই।   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)