poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
আজ আমি, বলা যেতে পারে, পর্যুদস্ত ভয়ানক।
আমাকে ধরেছে ঘিরে ধূর্ত কাক, হাড়গিলা আর
কাদাখোঁচা, ক্রমাগত চঞ্চুর আঘাতে অন্ধকার
দেখছি, নিজের ক্ষত দেখে ভয় পাই। কাঁহাতক
সইব এমন নির্যাতন? হায়, আমার পালক
নেই যে ত্বরিৎ উড়ে যাবো বহুদূরে নীলিমার
নিভৃত অভয়াশ্রমে। সাধগুলো হচ্ছে ছারখার
কর্কশ চিৎকারে, আমি ভূলুণ্ঠিত, উদ্যত ঘাতক।একজন কোকিল শহরে আছে যার গানে গানে
আমার প্রহর খুব উদ্ভাসিত; আমি নিত্য কান
পেতে থাকি; হা কপাল, আজকাল সে-ও তো আহত
ভীষণ, হৃদয় তার জর্জরিত বিপক্ষের বাণে;
কণ্ঠ থেকে তার ঝরে ক্ষোভ আর বেদনার তান,
তবু সুপ্রভাত শুভরাত্রি জ্বলে নক্ষত্রের মতো। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ,
পাখিদের ওড়াউড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।
রোদ আমার ভেতরে বাজতে থাকে মোহন বাদ্যযন্ত্রের মতো
আর আমি যেন নিভৃত আরোগ্যশালায়
একটু একটু করে স্বাস্থ্য ফিরে পাই। ভোর স্বপ্নের ভাষায়
অপরূপ কোলাহলময় আমার শিরায় শিরায়;
আমি সঙ্গমকালীন একাকিত্বের কথা ভুলে, ভুলে উঠোনের কথা
দিগন্ত আর ধাবমান অশ্বপালের কথা ভাবি।এখন সেই জাগরণের মুহূর্তে
আমি কি জানতাম কী বিপুল আশ্চর্য অপেক্ষা করছে
আমার জন্যে? কয়েক ঘণ্টা পরেই ঝকঝকে দুপুরে
আমার অস্তিত্বকে উদ্ভাসিত করে একজন
সিঁড়ির ধাপ ছেড়ে
উঠে আসবে আমার বাঁ পাশে? তার দৃষ্টি আর হাসিতে
আমার পরমায়ু হবে গভীর সঞ্জীবিত?তখন কি আমি জানতাম
দুপুর এমন বাঙ্ময় হতে পারে, হতে পারে কোনো পাখির দীর্ঘ ডাক?হৃদের ছলছলানি? এমন সম্মোহনময়?
পুলিশের বাঁশি, মাইল মাইলব্যাপী বুটের শব্দ,
বম্ব্যরের মৃত্যুবর্ষী গর্জন, বাতিল শাসনতন্ত্রের হাহাকার
আর পাঁচসালা পরিকল্পনার আর্তনাদ ছাপিয়ে
একটা দুপুর চাইকোভস্কির সুর হতে পারে, আগে জানিনি।
একজন, বহুদিন আগেকার রাত্রির গহন থেকে আফ্রোদিতির মতো
উঠে-আসা একজন, দুপুরকে অনন্য উপহারে রূপান্তরিত করে
আমার উদ্দেশে। সেই উপহার
হাত বাড়ায় আমার দিকে, আমি মুগ্ধাবেশে
পান করি সেই দৃশ্য। দুপুর, আকাশের দিকে বাহু-তোলা গাছ,
রৌদ্রাক্রান্ত পথ, ধাবমান যান আর আমরা দুজন
নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে যাই।
কী সুন্দর তুমি, দুপুর উচ্চারণ করে তোমার কানে কানে;
তুমি হাসো দুপুরকে অবিশ্বাস করে,
সেই হাসি দুপুরকে করে তোলে আরো প্রগলভ।
এই শহুরে দুপুরে অকস্মাৎ ভাবি-
এ দুপুর জানে প্রতিবিপ্লবীর ভ্রান্তির মতো কিছু কথোপকথন
আমাদের আছে,
এ দুপুর জানে ভূমিহীন কৃষকের স্বপ্নের মতো কিছু স্বপ্ন
আমাদের বাস্তবে লতিয়ে ওঠে,
এ দুপুর জানে গুপ্তহত্যার মতো নিঃশব্দ ভয়ংকর কিছু
বারংবার ঘটতে থাকে আমাদের ভেতর,
এ দুপুর জানে ল্যাজারাস আড়মোড়া ভাঙে উদাস প্রান্তরে,
তোমার অনাবৃত বাহুর মতো যেন কোন স্মৃতি
ঝুলে রয় মনের ঝোপঝাড়ে,
এ দুপুর জানে খরগোশেরও ঘাড়ে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি
মিশে থাকে,
কোথায় ব্যাপক জতুগৃহে অনেকানেক ঘোড়া পুড়ে যায়।
কী সুন্দর তুমি, মনে মনে বলি।
তখন আমার চতুষ্পার্শ্বে ট্রাফিকের মাতলামি,
রাস্তা উপচে-পড়া মানুষ, দোকানপাটের বিজ্ঞাপনী ইশারা,
চিত্রতারকার রঙচঙে ছবি,অথচ আমি
কিছুই দেখি না, শুনি না কিছুই। দুপুরে
আমার দু’চোখ জুড়ে তুমি শুধু তুমি।
কী সুন্দর তুমি, আবৃত্তি করি তোমার সৌন্দর্য
আর হঠাৎ মনে পড়ে, তোমাকে ধরে রাখতে পারব না কখনো।
হয়তো এমন দিন আসবে,
যখন আকাশে সূর্য হাসবে রাষ্ট্রদূতের মতো অথবা চাঁদ
আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক কর্মার মতো
গা-ঢাকা দেবে মেঘের ভূতলে,
কিংবা হলদে পাতার মতো হেমন্ত ছোঁবে আমাকে,
ঝমঝমিয়ে আষাঢ় নামবে এ শহরে
আর আমি নির্বাসিত হবো তোমার সান্নিধ্যের অলকাপুরী থেকে।
চাই, তোমাকেই চাই বলে আমার অস্তিত্ব এক-দীর্ঘ চিৎকারে
রূপান্তরিত হবে, দিনযাপন মনে হবে
নিরন্ধ্র কারাবাসের মতো; আর তোমার উদ্দেশে আমার ডাক
প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে আমারই কাছে বারে বারে।
যখন কোনো কোনো দুঃস্বপ্নসংকুল
রাতে ঘুমের বড়ি সেবন করার পরও ঘুম আসবে না তোমার,
তখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তুমি, চোখ মেলে দিও
ক্ষুধিত অন্ধকারে,
তখন দেখতে পারবে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে একজন
তোমারই প্রতীক্ষায়; কোনো পাহারাদার তাকে ‘দূর হট’ বলে
তাড়াতে পারবে না,
এমনকি আজরাইলের অন্ধ, দুর্বিনীত ডানাও না। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আজকাল বিছানায় বড় বেশি শুয়ে থাকে একা,
বালিশে অনেকক্ষণ মুখ গুঁজে সময় যাপন
করে, কড়িকাঠ গোনে। বাড়িটা পুরনো, নড়বড়ে;
বুড়ো কাকাতুয়ার বিবর্ণ
পালকের মতো রঙ দেয়ালে অস্পষ্ট। পলেস্তরা
খসে পড়ে মাঝে-মধ্যে; প্রাচীন পদ্যের ঋদ্ধ পংক্তির মতন
কি যেন গুমরে ওঠে ক্ষয়ে-যাওয়া বাঘছালে ইঁদুরের দৌড়
কাঠের চেয়ারে শাদা বেড়ালের স্বপ্নাশ্রিত মাথা,
খবর কাগজ ঘোর উন্মাদের স্মৃতির মতন
লুটোয় মেঝেতে আর দিন যায়, দীর্ঘ বেলা যায়।রোদের জঙ্গলে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে
এখন সে গা-গতর এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়
রৌদ্রদগ্ধ শ্রমিকের মতো।
সে কি একবুক অভিমান নিয়ে শুয়ে থাকে, নাকি
সত্তাময় অপমান নিয়ে হতে চায় আত্মঘাতী?
নানান ফলের প্রতি তার দুর্বলতা আছে ব’লে
শিয়রে সাজিয়ে রাখে সযত্নে অলীক ফলমূল। আলস্যের
ভায়োলেট মখমলে গুটিসুটি পড়ে থাকে; চোখের পাতায়
ঘুম নয়, কিছু তন্দ্রা লেগে থাকে মোহের মতন।
স্বপ্নের টানেলে ঘোরে নিরুদ্দেশে, নিজেকে সংশয়মুক্ত রেখে
তারই করতলে রাখে মাথা খুব নিটোল আস্থায়
যে তার অকুন্ঠ পিঠে আমূল বসিয়ে দেবে ছোরা সুনিশ্চিত।
কখনো হঠাৎ তার তন্দ্রার ঝালর কাঁপে, অলিতে-গলিতে
রাত্রিদিন নানা কলরব, ছদ্মবেশী শজারুর ভিড় বাড়ে
ক্রমাগত আশেপাশে। প্রকৃত ধর্মের চেয়ে ধর্ম-কোলাহলে
অত্যন্ত মুখর আজ শহর ও গ্রাম। বিশ্বযুদ্ধে নেই কারো সায় আর,
তবু অতিকায় কালো রাজহাঁসের মতন ছায়া ফেলছে সমর
বসতিতে, মনীষায়, সভ্যতার মিনারে-মিনারে। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কেন এই ভোরবেলা দু’চোখে আমার
বস্তুত কিছুই ধরা পড়ছে না? কিছুকাল ধরে
দৃষ্টি ঘুণে-ধরা সত্য, তবু
অন্ধ তো হইনি আজও, তবে কেন ঘোর
অমাবস্যা এমন পাথুরে
পর্দা আজ ঝুলিয়ে দিয়েছে
চারদিকে? এখন কোথায় কোন দিকে
আন্দাজে বাড়াব দু’টি হাত, চালাব পা
ঠিকঠাক বিভ্রমের ঘাড় মট্কে দিয়ে?
কোন্ গান জোগাবে প্রেরণা সুন্দরের হাত ধরে যেতে?তীরে তরী প্রতীক্ষাপ্রবণ, কিন্তু গায়েব যে-মাঝি,
কোথায় খুঁজব তাকে? আমাকে যে পাড়ি দিতে হবে মহানদী
সূর্যাস্তের আগে, ঘুমাঙ্কিত সুরে ঢুলে
নদীর ভেতর থেকে কে ডাকে আমাকে?
সেই সুরে সুপ্রাচীন শ্যাওলার রঙ,
বিলুপ্ত মাছের ঘ্রাণ ভাসমান-এ কেমন ঘোর
আমাকে রয়েছে ঘিরে অবেলায়? তরঙ্গে তরঙ্গে
অবিরাম ওঠে নামে এ কার কঙ্কাল?
এই খেয়া নায়ের মাঝির নাকি? তবে
কী ক’রে পেরুব মহানদী এখন কে দেবে বলে?দেব কি তরঙ্গে ঝাঁপ? সাঁতার শিখিনি, ঝাঁপ দিলে
সলিল সমাধি সুনিশ্চিত; আমার করুণ লাশ
মহোল্লাসে ছিঁড়ে খাবে মাছের মিছিল
এবং কঙ্কাল হয়ে ভাসব নদীতে। জানবে না
কেউ সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠবার আগে
নদীতীরে ছিলাম প্রতীক্ষারত একা।
মুহূর্তেই স্থানান্তর, পৌঁছে যাই ছাদহীন ভাঙা দেয়ালের
নড়বড়ে ঘরময় এলাকায় মৃত অনেকেই, জীবিতরা অর্ধমৃত,
মূক ও বধির আর সর্বত্র গোঙানি, সারাদিন
রোদ আর সারারাত জ্যোৎস্নাধারা কাঁদে, শুধু কাঁদে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তবু হয়, এ রকমই হয়
কখনো চাওনি তুমি এ রকম হোক, তবু সব লতাগুল্ম,
জলজ্যান্ত গাছ
শুকিয়ে বিবর্ণ হলো, বড় শীর্ণ। ফুলদানি শূন্য বহুকাল,
নানারাঙা পাখিরা উধাও-
ওরা কি মেতেছে আত্মহননে কোথাও? ঝাড়লণ্ঠনের শোভা
সহসা গিয়েছে মুছে, ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় কেবলি ঝুলে থাকে
ছাদে, ঘরময়
পশুবিষ্ঠা, বারংবার হাত খুঁজে পাই না কোথাও আজ হাত।
কখনো চাওনি তুমি এ রকম হোক, তবু হয়,
এ রকমই হয়।এ শহরে আছে এক পথ, কখনো সে স্নিগ্ধ কখনো বা
গরিমায় ঝলমলে, মাঝে-মধ্যে যেন আর্টেমিস-
ছায়ার মতোন তার গায়ের বাকল ছেড়ে ছুড়ে করে স্নান
জোরালো জ্যোৎস্নায়।
তুমি জানবে না কোনোদিন সে পথের জন্যে একজন কবির হৃদয়
কী রকম আর্তনাদ করে রাত্রিদিন। সর্বক্ষণ আমি তার করি ধ্যান
যেমন উদ্ভ্রান্ত পাখি অলভ্য স্বর্গের। এ দারুণ শুশুনিয়া
বুভুক্ষ, তামাটে
জমিনে কর্কশ মুখ রেখে ব্যাধের উদ্যম থেকে পলাতক
প্রাণীর মতোন আজো তোমার জন্যেই বেঁচে আছি
বললে কি তুমি আজ করবে বিশ্বাস? জানবে না কোনোদিন
আমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে তোমারই নাম গুঞ্জরিত, আমি
শুধু দূর থেকে দেখি পথরেখা, তৃষ্ণা বাড়ে সত্তাময়। যাবো
কি সেখানে?
হাত পেতে নেবো জল রুক্ষ সন্নাসীর মতো? এ রকম হোক,
কখনো চাইনি আমি; তবু হয়, এ রকমই হয়।
একটি আশ্রয় আমি যুগ যুগ পরে পেয়ে গেছি ভেবে খুব
সম্মোহিত হয়ে
ছিলাম অনেকদিন, অলৌকিক খড়কুটো দিয়ে সাজিয়েছি
তাকে, হৃদয়ের ফুল্ল তাপে
রেখেছি সর্বদা উষ্ণ, কখনো চোখের জলে ধুলাবালি
ধুয়ে মুছে নক্ষত্রের মতো।
অকস্মাৎ বজ্রপাত, আমি দগ্ধ আশ্রয়ের কাহিনী শোনাই ঘুরে ফিরে
গাছপালা, নদীনালা, সূর্যাস্তকে নিশীথের প্রেতের মতোন কণ্ঠস্বরে। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
এখন আমি বড় ক্লান্ত, আমার দৃষ্টি ক্রমশ
ধূসর হয়ে আসেছ। সন্ধ্যার
সোনালি-কালো প্রহরে ভাবছি, বাচ্চু,
কতদিন তোর সঙ্গে আমার দেখা নেই।
দিনের এই হট্রগোল আর
চেঁচামেচিতে কতজনের গলা শুনি,
কিন্তু তোর কণ্ঠস্বর আমি শুনিনা।তোর তিন ভাই প্রায় রোজানা আমার কাছে আসে,
আরেকজনের কাছেই থাকি দিনরাত।
শুধু তুই কালেভদ্রে আসিস, মাঝে-মধ্যে
টেলিফোনে শুনি তোর গলা।
আমি জানি তুই তোর নাম মিলিয়ে দিয়েছিস
গাছের পাতায়, ফসলের শীর্ষে,
মেঘনা নদীতে, অলি গলি আর অ্যাভিনিউতে
শহীদের স্মৃতিসৌধে, মৌন মিছিলে।
বাচ্চু তুই সবখানেই আছিস,
শুধু দূরে সরে গিয়েছিস আমার কাছ থেকে।আমার ইন্দ্রধনু বয়সে তোকে আমি
পেটে ধরেছি দশ মাস দশ দিন, তোর-নাড়ি-ছেঁড়া
চিৎকার এখনো মনে পড়ে আমার।
মনে পড়ে তোর হামাগুড়ির, মুখের প্রথম বুলি।
হাঁটি হাঁটি পা-পা ক’রে তুই
চলে যেতি ঘর থেকে বারান্দায়, তোর মৃদু তাড়ায়
রেলিঙ থেকে উড়ে যেত পাখি,
আমি দেখতাম দুচোখ ভ’রে।
কখনো কখনো ফোরাত নদীর ধারে
তীরে তীরে ঝাঁঝরা-হয়ে যাওয়া কাচবন্দি
দুলদুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তুই
তাকিয়ে থাকতিস, যেন ভবিষ্যতের দিকে আটকা পড়েছে।
তোর দুটো চোখ।
জ্বরে তোর শরীর পুড়ে গেলে,তুই আমার
হাত নিয়ে রাখতিস তোর কপালে,
তোর কাছ থেকে আমাকে এক দণ্ডের জন্যেও
কোথাও যেতে দিসনি কখনো।
অথচ আজ তুই নিজেই
আমার নিকট থেকে যোজন যোজন দূরে বিলীয়মান।
বাচ্চু, তোর নাড়ি-নক্ষত্র আমার নখদর্পণে,
কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়,
তোর পরিচয়ের আবছা ঝালর কতটা দুলে ওঠে আমার চোখে?
তোর এখনকার কথা ভাবলে
হজরত ঈশা আর বিবি মরিয়মের কথা মনে পড়ে যায়।
যখন ওরা তাঁকে কাঁটার মুকুট পরিয়ে
কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিল ক্রুশকাঠ,
কালো পেরেকে বিদ্ধ করেছিল সারা শরীর
তখন তাঁর কাছে ছিলেন না মাতা মরিয়ম।
তোর আর আমার মধ্যেওএকাকিত্বের খর নদী, আমি সেই নদী কিছুতেই
পাড়ি দিতে পারি না।
তোর কথা ভেবে ইদানীং আমি বড় ভয় পাই, বাচ্চু।
তাই বারবার ইসমে আজম পড়ে
তোর বালা মুসিবত তাড়িয়ে বেড়াই।
তুই তোর নিজস্ব সাহস, স্বপ্ন আর আকাঙ্খাগুলিকে
আগলিয়ে রাখ, যেমন আমি তোকে রাখতাম
তোর ছেলেবেলায়। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
আন্ধারে হারিয়ে পথ বেদিশা ঘুরেছি কতকাল
জটিল অরণ্যে, গণকবরের বিরানায়; খাদে
আর চোরাবালিতে হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যেতে
যেতে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি। রক্তপায়ী বাদুড়ের
ডানার আঘাতে, চিতাবাঘের থাবার হামলায়
সন্ত্রস্ত ছিলাম বহুকাল। কখনো কখনো পথ
খোঁজার উদ্যম লুপ্ত হয়েছে, মোহিনী রূপে কত
ডাকিনী নিয়েছে ডেকে গুহায় সংহারে অবিচল।হতাশায় চুল ছিঁড়ে, মাথা কুটে শ্মশান ঘাটের
কাছে, গোরস্তানে পথক্লেশে পরিশ্রান্ত ঘুমিয়েছি
সর্পিনীর ফণার ছায়ায়। অকস্মাৎ তুমি এসে
আমাকে প্রকৃত পথ দেখিয়ে সম্মুখে নিয়ে গিয়ে
বললে, দ্যাখো, আমাদের গন্তব্যের স্বর্ণচূড়া কাছে
এসে গ্যাছে, এইতো অদূরে বেজে ওঠে নহবৎ। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
গভীর রাতে অগ্নিবর্ণ এক ঘোড়া উন্মুক্ত প্রান্তরে বেধড়ক
দৌড়ুতে থাকে এদিক সেদিক। কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক,
সেদিকে বন্দুমাত্র দৃষ্টি নেই তার। তার এই দৌড়ে ছন্দ আছে কি
নেই, এ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। ছুটতে তো ছুটছেই।কখন যে সে নিখুঁত চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে মোহন
এক বাগানের পাশে, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। এই ঘোরাতেই
সে আনন্দের ঝিলিক উপভোগ করছে প্রতিটি মুহূর্তে।
সে কি ইতিমধ্যে ক্লান্তির কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি?
ওর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কি ব্যথা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না?
সে কি এই মুহূর্তেই স্বেদাক্ত শরীরে লুটিয়ে পড়বে না ধুলোয়?না, তার তেজী আকাঙ্ক্ষাকে এখনও ম্লান করতে পারেনি
এই শ্রম। যতই স্বেদ ঝরুক ওর শরীর থেকে, ক্লান্তি যতই
থাবা সবাক ওর সত্তায়, দমে কুঁকড়ে যাওয়ার পাত্র সে
নয়। এখনও ওর শরীরে প্রতিটি রন্ধ্রে ঘোরার বাসনা চঞ্চল।অন্ধকার নয়, আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের সঞ্জীবনী আলো ঘোড়াকে
টগবগে করে তোলে আরও। মৃত্তিকাবিহারী অশ্ব মুহূর্তে
চলে যায় আসমানে তারার মেলায়। সেখানে মহানন্দে
বেশ কিছুক্ষণ উড়ে বেড়ানোর পর মাটির টান তাকে নিচে
নেমে আসার জন্যে উতলা করে তোলে। টগবগে ঘোড়া মর্ত্যে নেমে আসে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আমি কি তোমাকে মেয়ে
ভালোবেসে অবশেষে
অপবাদ বয়েই বেড়াবো?
পড়ে আছি এক কোণে,
বয়সের ভারে আজ
তা’ বলে কি হেলাই প্রাপ্য?আজও পূর্ণিমা-চাঁদ জেগে থাকে আসমানে,
জাগে না কি হৃদয় তোমার?
হয়তো তুষার কিছু জমেছে সেখানে,
নইলে কেন দেখা দাও না আর?আমার এ কাতরতা দেখে দূরে আকাশের
তারাও কাঁপতে থাকে খুব!
তুমি এতটুকু আর
বিচলিত নও তো কিছুতে।তা’হলে আমি কি আজ সবকিছু থেকে দূরে
সরে কোনও ভাগাড়ে থাকবো?
তবু কেন জানি আমি
মাথা নেড়ে আচমকা
ফের উঠে সোজাই দাঁড়াই। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কড়া নেই; ব্যস, এইটুকু যা তফাত। কিছুকাল
ছোট এক ঘরের ভিতরে
আছি, হয়তো
গভীর ভূতলাশ্রয়ী রাজনীতিপরায়ণ কেউ
ধূর্ত ফেউদের খরদৃষ্টির আড়ালে
এরকম করে বসবাস।
নিভৃতে নিজেকে ক্রমাগত
নিজের ভিতরে খুব গুটিয়ে নিয়েছি।আমি কি কারুর ভয়ে ইদানীং এমন আড়াল
খুঁজি রাত্রিদিন?
আস্তে সুস্থে দু’পা
এগিয়ে গেলেই ছুঁতে পারি মল্লিকার শরীরাভা
এবং নিবিষ্ট বসা যায় গুঞ্জরিত
চাখানায় বুলিয়ে ব্যাপক ভ্রাতৃদৃষ্টি শুভবাদী
কথোপকথনে নাক্ষত্রিক নীড় খোঁজা চলে আর
সত্তাময় রাঙা ধূলো নিয়ে ফেরা নিভাঁজ সহজ।কোথাও যাই না; মূর্তিমান সান্ত্রী নেই আশেপাশে,
তবু চতুর্দিকে কী নাছোড় কবন্ধ পাহারা
মাঝে-সাঝে ইচ্ছে হলে পর্দাটা সরিয়ে
জানালার বাইরে তাকাই,
চোখ দিয়ে ছুঁই
গোলাপ, টগর, জুঁই, আকাশ-সাজানো
দূর সাইরেবিয়ার, গোধূলিমাতাল হংসযূথ।
সর্বোপরি পায়চারি নিজের ভেতরকার ছাঁদনাতলায়।কোথাও যাওয়ার নেই, শুধু অন্তর্গত
পথের বিস্ময়মাখা হাওয়া
বয় ভিন্ন স্তরে, নীলিমার স্পর্শ লাগে; অন্ধকারে বিছানায়
শুয়ে ভাবি বাসারির কথা,
সিস্টার্ন চ্যাপেল আর ইরাসমূজের মানবিক দীপ্তিমালা
দুলে ওঠে, অকস্মাৎ একজন পর্যটক, পায়ে তার বৎসরান্তিক
ধূলো, চুল এলোমেলো, খোলা গেরেবান,
দাঁড়ায় দরজা ঘেঁষে, বলে-চলো যাই। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
হঠাৎ তিনি আমার স্মৃতির বনস্থলি রোমাঞ্চিত
করলে আমি প্রবেশ করি ছেলেবেলার শ্যামল মুঠোয়।
চোখের কোণে হারিয়ে-যাওয়া সুদূর চোখের, শীর্ণ হাতের,
তাঁর সে গায়ের হলদে কোটের ইতস্তত ঝলক লাগে।হলদে কোটে কেমন যেন চুরুট চুরুট গন্ধ ছিলো,
চোখের কোণে সে কোন্ ঝিলের ইস্পাতী এক ঝিলিক ছিলো।
টাঙ্গি হাতে ভালুক টালুক খুব মেরেছেন হেলায় ফেলায়-
তাঁর বিষয়ে আরো বহু এমনিতরো গল্প ছিলো।হলদে কোটের সিংহপুরুষ সুদূর আমার ছেলেবেলায়
দিয়েছিলেন হাতে তুলে একটি পুতুল, মনে পড়ে।
মনে পড়ে, পুতুলটাকে কোথায় যেন, কখন যেন
হারিয়ে ফেলে সেই ছেলেটা দুঃখ খুবই পেয়েছিলো।তেমন পুতুল আর দেখিনি ভূভারতে, দোকান-পাটে
তন্ন তন্ন করেও আমি পাইনি খুঁজে দেশ-বিদেশে।
তেমন পুতুল ঝরে শুধু অলৌকিকের মুঠো থেকে?
স্মৃতির সুতোয় লটকে থাকে নীল্চে নীল্চে দুর্বলতা।সেই যে তিনি পুতুল দিয়ে সাত সকালে নিলেন বিদায়
আর দেখিনি তাঁকে আমি এই শহরে, অন্য কোথাও।
তখন থেকে খুঁজছি তবু দেননি তিনি আমায় দেখা,
জ্বলছে মনে ভিন্ন কালের হলদে কোটের উদাস আভা।যদি তাঁকে একটা কিছু দিতে পারার একটুখানি
সুখের সময় পেতাম তবে ধন্য হতাম রুক্ষ বেলায়।
তাঁরই জন্যে দুঃখ-সুখের পদ্য বিছাই দোরে দোরে,
হঠাৎ যদি বিবাগী সিএ বর্ষীয়ানের চোখে পড়ে! (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
সে একলা হাঁটে, হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে যোজন যোজন দূরে।
ফুটপাত, আইল্যান্ড, দালানের ভিড়, ফ্ল্যাটরাজি,
অজস্র দোকানপাটি ছেড়ে সে একলা হাঁটে, যায়
প্রান্তরের কাছে,
নদীর কিনারে।
পানির গভীরে চোখে মেলে কী-যে খোঁজে সূর্যাস্তের
রঙের আড়ালে, কম্পমান নৌকোগুলি বুঝি তার
স্মৃতির নিঝুম খাল বেয়ে সদ্য এসেছে এখানে।তার হাতে বাদ্যযন্ত্র নেই কোনো, তবু তার কাছ থেকে সুর
ভেসে আসে, বুঝি রিস্টওয়াচের থেকে বংশীধ্বনি সৃষ্টি হয়,
না কি তার তন্দুরের মতো লাল চোখ থেকে, হৃৎপিণ্ডের থেকে?
যখন সে পেয়ালায় ওষ্ঠ রাখে, পেয়ালা উপচে পড়ে সুর,
আবার কখনো বুক জমে যায় পাথরের মতো, উদাসীন
প্রাণের সকল তন্ত্রী, সংগীত ও ভীষণ ক্রূর মূক হতে পারে।মাঝে-মাঝে তাকে
সরাইখানার আলো, ম্যান্ডোলিন পারে না থামাতে, সবকিছু
ছেড়ে ছুড়ে সে একলা হাঁটে। দ্যাখে স্বপ্নের রঙের মতো গাভি
ওড়ে পূর্ণিমায় আর কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে
পথপ্রান্তের, কেউ কেউ দোলনায় দুলে দুলে করছে বিলাপ।
মেঘে মেঘে মেহগনি কফিনের মিছিল এবং
সিংহের খণ্ডিতে মাথা, এক গুচ্ছ সোনালি চাবির ঐকতান,
এনামেল-রঙ দেবদূত।
মাথার ভেতরে তার বাবুই পাখির তছনছ বাসা, কালো
পেন্সিলের আঁকাবাঁকা রেখার মতোন পিঁপড়ে-সারি,
ছিন্নভিন্ন একরাশ ভ্রমণ কোমল, কিছু দুর্গের প্রাকার-
দু’তিন শতাব্দী তার মাথার ভেতরে খেলে যায়।
সন্দেহপ্রবণ তার প্রতি অনেকেই এমন কি কৃষ্ণচূড়া
কোকিল, পাহাড়ি ঝরণা তাকে কতিশয় ঘাঘু এক
গোয়েন্দা ঠাউরে নেয়। সে একলা হাঁটে, কখনো বা
দুপুর সাঁতরে এসে বিকেলের ঘাটে বসে চুপে
ঘাসের ওপরে ঝুঁকে গোপন রিপোর্ট লেখে কিছু
খরগোশ, কোকিল আর রজনীগন্ধার, কেউ কেউ
দু’পাশে মার্জিনে পায় ঠাই।অকস্মাৎ ফিরে আসে মানুষের ভিড়ে একা-একা।
যদি কেউ কোনো প্রশ্ন করে তাকে, তবে সে নীরবই
থাকে বেশি, মাথা নাড়ে মাঝে-মধ্যে, আবার কখনো
ইচ্ছে হ’লে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলে উত্তরের দায় সারে।
যখন সবাই থাকে চুপচাপ, তখন হঠাৎ তারস্বরে
আকাশ ফাটিয়ে
একাকী সে লোক সহস্র জনের মতো-আজ
আমরা সর্বস্ব দিয়ে কিনেছি এ কোন
সোনালি সাপের মতো পণ্য ভয়ংকর?
সে একলা হাঁটে। ফিরে গেলে গৃহকোণে, প্রভুভক্ত
বয়েসী কুকুর তাকে শুঁকবে কি পুরোনো স্মৃতির মতো আজ
এতকাল পরে?
কোনো সঙ্গী নেই পাশে। কেউ চোরাবালি, কেউ ধুধু
প্রান্তরে অথবা দৈত্যকবলিত গুহায়, কেউ বা সমুদ্রে চিরলীন।
সে একলা হাঁটে। হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে, বুঝি কেউ তার
প্রতীক্ষায় আছে চুল খুলে আর ওঁৎ পেতে আছে প্রতিদ্বন্দ্বী
থামের আড়ালে বহুজন। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
যখন তোমার বাহুর বাসরে
মগ্ন ছিলাম চন্দ্রিত চন্দ্রায়,
আলো-আঁধারির চকিত সীমায়,
লালনের গান দূর হতে এলো ভেসে।
সে গানের ধ্বনি স্তব্ধ সায়রে
ফোটায় নিবিড় অজস্র শতদল।
ধুলোয় উধাও সে গানের কলি
গ্রামছাড়া পথে মনের মানুষ খোঁজে।শৈশব-গাঁথা জামতলা আর
কনক দুপুরে শ্রাবণ দিঘির ডুব,
ঘোরলাগা ভোর, অভিজ্ঞ সাঁঝ-
সবি আছে বুঝি স্মৃতির অভ্রে ডুবে।কে আসে ঘাসের স্তব্ধ সবুজে
নীরবে নগ্ন শুভ্র চরণ ফেলে?
সে-যে সেই গান স্পন্দনে যার
আঁধারেও চির মনের মুকুল জ্বলে।অবচেতনার গহন ধারায়
তারাময় মনে জাগে স্বপ্নের পলি।
একটি চাঁপার বিন্দুতে মেশে
সব দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিত অবসান।সে গানের সুর জীবনে ঝরায়
জুঁই-চামেলির অরূপ সুরভি আজও
অস্তরাগের ধ্যানী বাসনায়
জ্বলে ওঠে ক্কীণ দীপ্ত চন্দ্রকলা।কাল মন্থনে চেতনায় জাগে
অতীতের দ্বীপ, স্মৃতির প্রবালে লাল।
বর্তমানের মুক্ত আধারে
ভবিষ্যতের দীপাবলি ওঠে ভেসে।সে-গানের ধ্বনি ফিরে ফিরে আসে
মর্ত্যজীবীর রঙিন ধুলোর পথে-
তারই মাধুর্যে ঋতুতে ঋতুতে
রৌদ্রছায়ায় শান্ত বাগানে বাঁচি।সে-গান আমার বৈশাখী দিনে
যাত্রী-প্রাণের তৃষ্ণার সরোবর।
তারই টানে চলি বাকাচোরা পথে-
লালনের গান স্মৃতির দোসর সে-যে। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
আড়ি পাতা স্বভাব নয়
তবু শুনে ফেলি ফিসফিসে কিছু কথা
পাখি গাছকে বললো
সংটাকুল বিশ্বে অসংখ্য উদ্বাস্তুর কালে
সবুজ টোপরপরা বর তুমিই
আমার নিখরচার ঘরচেয়ার টেবিলকে বললো
দিন নেই রাত নেই আমরা সকল সময়
মুখোমুখি অদৃশ্য স্পন্দিত হৃদয়ে
চুড়ান্ত চুম্বনের জন্য অপেক্ষমাণ
তোশক খাটকে বললো
তোমার আমার যুগ্মতা সমাজে
ন্যায্যত শয্যা ব’লে খ্যাত
অথচ আমাদের মিলন চিরন্তন ফুলশয্যাবই শেলফকে বললো
তাক-লাগানো তোমার ঔদার্য
কর্কশ বিবাপুর্ণ খন্ড প্রলয়ময় দুনিয়ায়
বৈপরীত্যের চমৎকার সহাবস্থান তোমার তাকগুলোকলম খাতাকে বললো
রোদপোড়া বৃষ্টিভেজা পরিশ্রমী চাষীর মতো
তোমাকে চাষ করি নিয়ত
আমাদের তন্নিষ্ঠ সঙ্গমে ফসলের কী বাহারপ্রজাপতি সর্ষে ক্ষেতকে বললো
ঢেউ বললো নৌকাকে
ফুটপাত দোকানকে বললো চুপিসাড়ে
নক্ষত্র বললো আকাশকে
আড়বাঁশি ঠোঁটকে ঠোঁট বয়ে-যাওয়া সুরকে
গ্রীষ্মের গেলাস টলমলে আবেহায়াতকে
মৌমাছি শূন্য পাতাকে বললো
শূন্যতা বললো শব্দহীনতায় চিরন্তন শূন্যতাকে (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
না রাজু, তোমাকে আমরা ঘুমোতে দেব না।
এই যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তোমার শিয়রে
প্রতারিত, লুষ্ঠিত মানুষের মতো,
আমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই যে তোমাকে
ঘুমোতে দেবে।
জেগে থাকতেই ভালবাসতে তুমি
এই নিদ্রাচ্ছন্ন দেশে; অন্ধকারে দু’টি চোখ সর্বক্ষণ
জ্বলত পবিত্র দীপশিখার মতো,
সেই চোখে আজ রাজ্যের ঘুম।
না রাজু, তোমার এই ভঙ্গি আমাদের প্রিয় নয়,
এই মুহূর্তে তোমার সত্তা থেকে
ঝেড়ে ফেলো নিদ্রার ঊর্ণাজাল।
তোমার এই পাথুরে ঘুম আমাদের
ভয়ানক পীড়িত করছে;
রাজু, তুমি মেধার রশ্মি-ঝরানো চোখ মেলে তাকাও
তোমার জাগরণ আমাদের প্রাণের স্পন্দনের মতোই
প্রয়োজন।দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুব করেছে তোমাকে।
টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া
তোমার রক্তের কণ্ঠস্বরে ছিল
পৈশাচিকতা হরণকারী গান। ঘাতক-নিয়ন্ত্রিত দেশে
হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি,
মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোকউচ্চারিত হয়েছিল তোমার কণ্ঠে,
তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার
মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা
তাই ওরা, বর্বরতা আর অন্ধকারের প্রতিনিধিরা,
তোমাকে, আমাদের বিপন্ন বাগানের
সবচেয়ে সুন্দর সুরভিত ফুলগুলির একজনকে,
হনন করেছে, আমাদের ভবিষ্যতের বুকে
সেঁটে দিয়েছে চক্ষুবিহীন কোটরের মতো একটি দগদগে
গর্ত।
শোনো, এখন যাবতীয় গাছপালা, নদীনালা,
ফসলের ক্ষেত, ভাসমান মেঘমালা, পাখি আর মাছ-
সবাই চিৎকারে চিৎকারে চিড় ধরাচ্ছে চরাচরে, ‘চাই
প্রতিশোধ।‘
নক্ষত্রের অক্ষর শব্দ দু’টি লিখে দিয়েছে আকাশে
আকাশে।যে-তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষণ্নতায়, সে নও তুমি।
প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু ক’রে আজও নতুন সভ্যতার
আকর্ষণে
হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে,
তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে
নিঃশঙ্ক মুদ্রায়,
ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,
তুমি বার বার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের
পাখি। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
বিশ্ববিদ্যালয়ে লগ্ন একজন মেদুর যুবক
ঝাঁ ঝাঁ এক দুপুরে আমার কাছে এসে সবিনয়ে
কিছুক্ষণ এটা সেটা বলে আমার নিকট থেকে
লাজনম্র স্বরে, যেন নিজের সঙ্গেই আলাপের
সূত্রপাত করে, জেনে নিতে চায় প্রণয়ের সংজ্ঞা
ঈষৎ গভীরভাবে। হরিচরণের অভিধান
বিশদ স্মরণ করি, গুণিজনদের তহবিল
উপুড় করেও শেষ অব্দি থেকে যাই নিরুত্তর।যখন তোমার চোখে চোখ রেখে তন্ময় ডুবুরি
হই, হাত ছুঁয়ে নিজে বীণা হয়ে বেজে উঠি আর
তোমার কথার ছায়া চামর দোলায় হৃদপুরে,
তখন আমার খুব ইচ্ছে হয় জ্ঞানপিপাসু ঐ
বিদ্যার্থীকে ডেকে বলি, ভালোবাসা কাকে বলে যদি
জানতো চাও, মানবীর চোখের তুমি গভীর তাকাও। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
তুমি তো জানোই আমি কোনোকালে নই বিত্তবান।
আমার বাড়ির দরোজায় দেয় না পাহারা কোনো
উর্দিপরা দারোয়ান যমমুখো, অথবা কখনো
হুঁকোবর্দারের দল আহ্লাদের ঝড়ে খানখান
করে না স্তব্ধতা আমার এ নিভৃত ডেরার, ধান
নেই অফুরান শত শত সম্পন্ন গোলায়। শোনো,
মেয়ে বলি, তবু নই বিশীর্ণ ভিক্ষুক, যত ঘন
কৃষ্ণ হোক দুর্দশার মেঘ, চাই না কৃপার দান।তাই আমি আর্তস্বরে ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও বলে
কখনো হবো না নতজানু তোমার পুষ্পিত এই
দরবারে, বরং সর্বস্ব নেবো লুটে নিমেষেই
সাগর দস্যুর মতো হঠকারিতায়। জ্বলজ্বলে
চোখে শুধু থাকবে তাকিয়ে তুমি, কোন কূট ছলে
ফেরাবে দূর্বার অতিথিকে? তোমার সে শক্তি নেই। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
কেন তুমি এত দেরি করছ বলো তো? পরদেশ
থেকে কোনো টেলিগ্রাম কিংবা এক টুকরো চিঠি তুমি
পাঠাওনি, পাইনি তোমার টেলিফোন, মনোভূমি
বড়োই তৃষিত, রুক্ষ, কিন্তু আমি পুষি না বিদ্বেষ।
রুগ্ন ফুসফুস আর কতটা টানবে দীর্ঘশ্বাস
এতদিন? ডিপ্রেশনে কাতর সম্প্রতি; চাতকের
মতো চেয়ে থাকি প্রতিক্ষণ, কাটে না যে বিরহের
দিনরাত্রি, পরদেশে ভালো আছো, আমার বিশ্বাস।তোমার ফেরার আগে যদি আয়ু ফুরায় আমার
তা হলে কী হবে গৌরী? অনুশোচনার ক্লান্ত ভেলা
ভিড়বে সে কোন্ ঘাটে? যাক ভাবতাম কবিতার
কবুতর উড়িয়ে তোমাকে আগে ভাগে ভোরবেলা
আনতে পারবো ঠিক এ শহরে। ব্যর্থতার গাঢ়
কলঙ্ক বইছি কবি রূপে, দেরি করো যত পারো। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আমার ভিতর রাশি রাশি নিউজপ্রিন্টের রোল ঢুকে গেছে
সরাসরি, দ্যাখো আজ কেমন কাগুজে গন্ধ রয়েছে ছড়িয়ে
সত্তাময়; হিজিবিজি লক্ষ লক্ষ অক্ষর বেজায়
চেঁচামেচি করে, প্রায় অশ্লীলতা বলা যায়, আর কি অস্থির
ওরা সর্বক্ষণ, ওরা ভীষণ কলহপরায়ণ। উন্মাতাল,
বেহালাবাদক তুমি সুরে সুরে আমার ভিতর থেকে অই
তাল তাল খসখসে
নিউজপ্রিন্টের মণ্ড তুলে এনে ক্লিন্ন ডাষ্টবিনে ছুঁড়ে দাও।
ওসব ফক্কড় হিবিজিবি
অক্ষর সুনীল শূন্যতায়, নক্ষত্রের পরপারে।দূষিত রক্তের মতো কালিতে নিমগ্ন আমি সকল সময়
যেন অপদেবতা একাকী।
আমাকে যায় না চেনা আগেকার মতো, অতি দ্রুত
কেমন নির্মুখ আমি হয়ে যাচ্ছি এ খর বেলায়।
বেহালাবাদক তুমি কালির সমুদ্র থেকে আমাকে
নিমেষে তুলে আনো
ধ্বনির মোহন ঝড় তুলে দীপ্রছড় টেনে টেনে।নিজের রক্তাক্ত বেশভূষা দেখে, ক্ষত দেখে দেখে ঘুরঘুট্রি
অন্ধকারে শ্বাপদের গুহায় আমার কাটে সারাবেলা, তার
নখরে রয়েছে বাঁধা পরমায়ু আমার এবং
নক্ষত্র দেখিনা কতকাল জলাশয়ে
দেখিনি আপন মুখ, যে রূপালি শহরে যাবার কথা ছিল,
পড়েনি সেখানে পদচ্ছাপ।
বেহালাবাদক তুমি বানিয়ে সূরের স্বপ্নময় পথরেখা
আমাকে সেখানে পৌঁছে দাও, পৌঁছে দাও।
আমি এক ঊর্ণাজালে আটকা পড়ে গেছি,
কষ্ট পাচ্ছি, কষ্ট পাচ্ছি অনেক শতক ধরে, বুঝিরা পাঁজর
খসে যাবে বদরাগী হাওয়ার আঁচড়ে।
বেহালাবাদক তুমি আমাকে কর্কশ ঊর্ণাজাল থেকে দ্রুত
মুক্তি দাও, মুক্তি দাও সঙ্গীতের উধাও গৌরবে
কিংবা ঊর্ণাজাল হয়ে যাক ফুলশয্যা অথবা তোমার বাদ্য।বেহালাবাদক তুমি এতদিন পরেও কি পাওনি আমার
কোনো চিঠি? হায়,
আমিতো চিঠিতে ডাকটিকিটে লাগাতে
ভুলে যাই, বারংবার ভুল হয়ে যায়। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
শোকমূলক
|
হয়নি খুঁজতে বেশি, সেই অতদিনের অভ্যাস,
কী করে সহজে ভুলি? এখনও গলির মোড়ে একা
গাছ সাক্ষী অনেক দিনে লঘু-গুরু ঘটনার
আর এই কামারশালার আগুনের ফুলকি ওড়ে
রাত্রিদিন হাপরের টানে। কে জানত স্মৃতি এত
অন্তরঙ্গ চিরদিন? জানতাম তুমি নেই তবুআঠারো সাতে কড়া নেড়ে দাঁড়ালাম
দরজার পাশে। মনে হলো হয়তো আসবে তুমি,
মৃদু হেসে তাকাবে আমার চোখে, মসৃণ কপালে,
ছোঁয়াবে আলতো হাত, বলবে ‘কী ভাগ্যি আরে
আপনি? আসুন। কী আশ্চর্য। ভেতরে আসুন। দেখিঅন্ধকারে বন্ধ দরোজায় দুটি চোখ আজও দেখি
উঠল জ্ব’লে। কতদিনকার সেই চেনা মৃদু স্বর
আমার সত্তাকে ছুঁয়ে বাতাসে ছড়াল
স্মৃতির আতর।শূন্য ঘরে সোফাটার নিষ্প্রাণ হাতল
কী করে জাগল এইক্ষণে? একটি হাতের নড়া
দেখলাম যেন, চা খেলাম যথারীতি
পুরানো সোনালি কাপে, ধরালাম সিগারেট, তবু
সবটাই ঘটল যেন অলৌকিক
যুক্তি-অনুসারে।মেঝের কার্পেটে দেখি পশমের চটি
চুপচাপ, তোমার পায়ের ছাপ খুঁজি
সবখানে, কৌচে শুনি আলস্যের মধুর রাগিণী
নিঃশব্দ সুরের ধ্যানে শিল্পিত তন্দ্রায়।জানালায় সিল্ক নড়ে, ভাবি কত সহজেই তারা
তোমাকে কীটের উপজীব্য করেছিল,
সারাক্ষণ তোমার সান্নিধ্যে পেত যারা
অনন্তের স্বাদ।বারান্দায় এলাম কী ভেবে অন্যমনে, পারব না
বলতে আজ। জানতাম তুমি নেই, তবু (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
এখন নতুন নয় আর আমাদের পরিচয়।
বেশ কিছুদিন, বলা যায়, কী মধুর এক সাথে
কাটিয়েছি আমরা দু’জন কথা বলে কত, হাতে
হাত রেখে, পথ চলে শস্যক্ষেত, সাঁকো, জলাশয়
বনানীর ধার ঘেঁসে। তোমার সান্নিধ্যে প্রতিবার
গিয়েছি, যেমন ছুটে যায় দ্রুতপায়ে একা একা
পুণ্যার্থী তীর্থের দিকে আর যখনই হয়েছে দেখা
তোমার দৃষ্টিতে শূচি হয়েছে তো সমগ্র আমার।যতই প্রগাঢ় আর দীর্ঘ হোক পরিচয় আমাদের,
যতই বলো না কেন ভালোবাসি তোমাকেই আমি,
তবু এক অস্থিরতা বারে বারে ক্রুর বৃশ্চিকের
মতোন দংশন করে আমাকে এবং অন্তর্যামী
সাক্ষী আমি স্বভাবত সন্দেহপ্রবণ নই মোটে;
তবুও সন্দেহ-কীট তোমার সত্তায় মাথা কোটে। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
বাঁচো, তুমি বাঁচো ধীরে স্থির অনাবিল বেঁচে থাকো।
এক বুক রৌদ্রছায়া নিয়ে বাঁচো; কাকে
বলে বাঁচা, এনিয়ে খামোকা যুক্তিতর্ক
করো না কখনো, বাঁচো, তুমি শুধু বাঁচো।এইতো তোমাকে ছুঁয়ে যায় হাওয়া, পাখি
শোনায় কত যে গান, জ্যোৎস্না তোমার পায়ের কাছে
কোমল লুটিয়ে পড়ে, গাছের নিবিড় পাতাগুলি
খোলাখুলি তোমাকে জপায় রোজ, ‘বাঁচো, তুমি বাঁচো’।ম্লান, ছেঁড়া বাচাল পোস্টার পথে পড়ে আছে, শিশু
বখিল উঠানে খিলখিল হাসে খেলনাবিহীন;
বারান্দায় একজন তরুণী শ্রাবণ-কালো চুলে
চালায় চিরুনি চিরায়ত ডৌলে-চোখ ভরে দ্যাখো।জ্বর ছেড়ে গেছে, মুখ নেই তেতো স্বাদ, ফল খাও, কাশিটাও
তেমন নাছোড় নয়। রোগ শোক সত্ত্বেও গভীর তুমি বাঁচো।
মেঘের ওপারে নয়, এখানেই কোথাও তোমার জন্যে কেউ
প্রতীক্ষায় আছে, তার আর কবিতার জন্যে বাঁচো, তুমি বেঁচে থাকো। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
শাদা পোশাকের লোক, মাথায় সফেদ টুটি, ছিল
বন্দরে বন্দরে, আমাদের
পরিচিত, তাসের আড্ডার একজন। মাঝে-মাঝে
কী-যে হতো তার, তাস ফেলে
জমাট টেবিল ছেড়ে ছুড়ে যেতো চলে,
যেন সে শুনেছে গান জলকন্যাদের। নাম তার কখনো হয় নি জানা।
কোথায় যে গেল
এ নিয়ে আমরা কেউ ঘামাই নি মাথা কোনোদিন।চাঁদের বন্দি সে, শোনা গেল, জ্যোৎস্নার মায়ায় মজে
হঠাৎ হারিয়ে গেছে ঘোর সামুদ্রিক কুয়াশায়।
অনেক বছর কেটে যায়, বার্ধক্য ছুঁয়েছে আমাদের
তাসের আড্ডার সঙ্গীদের, আমাকেও;
কেউ আত্মভোলা, কেউ স্মৃতি সচেতন, কেউবা স্তিমিত খুব।
একদিন যথারীতি তাসের টেবিলে বসে দেখি
এসেছে সে ফিরে, শাদা পোশাকের যুবা, কী আশ্চর্য, চোখ তার
মুক্তো এক জোড়া, ওষ্ঠে অপার্থিব নীরবতা আর
সমস্ত শরীর থেকে ঝরে
অবিরল সমুদ্রের ফোঁটা ফোঁটা সবুজাভ জল। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
কত কিছুই তো ঘটে অজান্তে কত বিজ্ঞ
জ্ঞাতসার ব্যক্তির অজ্ঞাতে। কখনও কখনও
তিনি জানার ভান করেন বটে, অথচ
তার অন্তরে একটি কি দু’টি কীট কামড় দিতেই থাকে।দেখেছি কোনও কোনও আড্ডায় ঘণ্টার পরেও
ঢের বেশি সময় গড়ায়, আড্ডাবাজগণ
টেবিল চাপড়ান। কেউ কেউ রঙিন কাগজে বেজায়
ঝুঁকে আস্তে সুস্থে কলম চালান প্রেমিকার উদ্দেশে।কেউ কেউ গালভরা দাড়ি নিয়ে একেবারে নিঝুম
বসে থাকে হাতের পাশে চার পাঁচটি
ইংরেজি বই নিয়ে। চেহারায় তার বিদগ্ধ
প্রচ্ছায়া জাগরিত। তাকে ঘিরে আরও কেউ কেউ জমায় তুমুল আসর।তরুণ, বিগত-তরুণদের সেই প্রিয় আড্ডায়,
মাঝারি দোকান নামজাদা হয়ে ওঠে চা-বিস্কুট এবং
লেখক ও শিল্পীদের আসা-যাওয়ার কারণে। সে দোকানে চোখ
পড়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তি এবং গুপ্তচরদের ভীষণ কুটিল দৃষ্টিতে।নামজাদা সেই চায়ের দোকান চকিতে মরুর ধরনে
হয়ে গেলো। লেখক-শিল্পীরা কিংবা অধ্যাপক কেউ
আসেন না এই পথে ইদানিং, যদিও ভাবনা এবং লেখনী
কিছুই থামেনি তাদের; চলছেই শিল্পীর তুলি, কবির কলম। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
কিছুদিন হল কী-যে হয়েছে আমার, কিয়দ্দূরে
তাকালেই চোখে পড়ে রঙ বেরঙের
নানা চৌকো নক্শা, কখনও বা শাদা অথবা ধূসর
গোলাকার বস্তু যেন। মাঝে মাঝে হঠাৎ আমার
কাছে ব’সে-থাকা কারও পরিচ্ছন্ন মুখে ফুটে ওঠে
গুটি বসন্তের মতো দাগ। এ আমার কী-যে হল!চোখে সাম্প্রতিক অস্ত্রোপচারের পর আচানক
এই অঘটন বিষাদের জালে করেছে আটক
আমাকে, তবে কি এভাবেই বাকি পথ প্রায়শই
থমকে, চমকে পাড়ি দিতে হবে? এই বিভীষিকা
থেকে, হায়, নেই কি আমার মুক্তি? কখন কী ছবি
ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে, সে আতঙ্কে ডুবে থাকি বেলা অবেলায়!আমি তো দেখতে চাই কদম ফুলের রূপ সজল আষাঢ়ে,
গোধূলির নরম আলোয় বারান্দার রেলিঙে খানিক ঝুঁকে
দাঁড়ানো তন্বীর শরীরের সৌন্দর্য-ঝরানো মুদ্রা,
মেঘের বাগান ছুঁয়ে-যাওয়া
পাখির ডানার সুকোমল সঞ্চালন,
এবং শুনতে চাই দূর থেকে ভেসে-আসা বাঁশির আহ্বান।এমনই নসিব, আজকাল বার বার চোখে ভাসে
নদীর নিস্পৃহ বুকে কুমারীর লাশ; হন্তারক লাপাত্তা এবং
কন্যাহারা জনক জননী শোকে রুদ্ধবাক্, বুকে
হাহাকার। সন্ত্রাস মুকুট পরে রাজপথে ভ্রাম্যমাণ শিস্
দিতে দিতে; গেরস্তের ঘরে দীপ নিভে যায় যখন তখন,
আমার দু’চোখে ভেসে ওঠে ঘাতকের বিজয়ী মিছিল!সম্প্রতি নিজেই আমি আমার চোখের আচরণে বড় বেশি
ক্ষুব্ধ, সর্বক্ষণ ওরা সম্পূর্ণ মুদ্রিত থাকলেও
দেখি নানা ভয়াবহ বিকৃত মুখের আনাগোনা,
রক্তময় দেয়াল এবং বিধ্বস্ত বিছানা
এই বিভীষিকা থেকে আমি কি পাবো আন মুক্তি? যদি
দু’চোখ উপড়ে ফেলি নিজ হাতে, তবুও কি নয়? (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
গুড মর্নিং বাংলাদেশ, সুপ্রভাত,
হাউ ডু ইউ ডু?
সুপ্রভাত সাতরওজা, মাহুৎটুলি নবাবপুর,
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, পুরানা পল্টন;
সুপ্রভাত বাগেরহাট, মহাস্থানগড়, ময়নামতি,
সুপ্রভাত পলাশতলী, পাড়াতলী,
সুপ্রভাত আদিয়াবাদের খাল, তাল তমাল হিন্তাল,
নিতাই জেলের জাল, কাশেম মাঝির নাও,
বঁইচি ফুল, কামেলার কানের দুল,
সুপ্রভাত বরিশাল, সুনামগঞ্জ তেঁতুলিয়া, টেকনাফ,
সুপ্রভাত বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা,
সুরমা, কর্ণফুলী।
গুড মর্নিং বাংলাদেশ, সুপ্রভাত,
তুমি কেমন আছো?
বাংলাদেশ, কখনো তুমি ডুরে শাড়ি পরে
ধান ভানো, কখনো জীন্স পরে মেতে ওঠো
ডিসকো নাচে।
কখনো তুমি কলসি কাঁখে জলকে যাও, কখনোবা
পুকুরঘাটে গল্প করো, সুন্দর একটা পাখি দেখে ভাসো
খুশির ঢেইয়ে, গ্রীষ্মের দুপুরে তালপাতার
পাখা দিয়ে বাতাস ক’রে
ঘুম পাড়াও পঞ্চম সন্তানকে; পান, সুপুরি এগিয়ে দাও
অতিথির দিকে, রাঁধো পাব্দা মাছের সালুন;
পৌষালী রাতে একা একা তৈরী করো
নক্শি কাঁথা। দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশ, যারা তোমার সংস্কৃতির পাছায়
চিমটি কাটে, ঘষে দেয় বিষলতা,
আল্লাহ তাদের হায়াত দরাজ করুন।
যারা তোমার বাজু থেকে কেয়ূর,
নাক থেকে নোলক আর নাকছাবি,
গলা থেকে হাঁসুলি,
কোমর থেকে বিছাহার খুলে নিয়ে
পাচার করে দেশান্তরে,
আল্লাহ তাদের হায়াত দরাজ করুন,
যেসব ধাপ্পাবাজ সুদিনের সপক্ষে মিথ্যার থুতু ছিটায়,
আল্লাহ তাদের হায়াত দরাজ করুন
শোনো বাংলাদেশ, স্বপ্নের ফেনা লেগে তোমার চোখ
এমন অন্ধ হয়ে যায়নি যে, তুমি
দেখতে পাচ্ছো না শকুনের ঝাঁক বড়শির মতো নখ দিয়ে
আকাশের উদর ছিঁড়ে খুঁড়ে হিঁচড়ে টেনে আনছে
মেঘের নাড়িভুঁড়ি;
দেখতে পাচ্ছো না সংসদ ভবন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে,
রাজনীতিবিদগণ জনগণের কাছ থেকে
বিছিন্ন হয়ে বনভোজন করছেন দীর্ঘকাল;
শাসনতন্ত্র কাটা ঘুড়ির মতো ভাসমান,
উন্নয়ন বিশারদগণ পাঁচসালা পরিকল্পনাকে
কুরে কুরে খাচ্ছেন ঘুণের ধরনের।
দেখতে পাচ্ছো না বখাটে বুদ্ধিজীবীদের মাথায়
বেধড়ক উৎসাহে ক্রমাগত হাগছে প্যাঁচা আর বাদুড়,
দেখতে পাচ্ছো না, সাত ঘাট থেকে চেয়ে-চিন্তে-আনা
হে ব্যর্থ অন্নপূর্ণা,যে, তোমার সন্তানের পাতের ভাত খায় সাত কাকে।
গুড মর্নিং বাংলাদেশ সুপ্রভাত
হাউ ডু ইউ ডু?
তুমি কি জেল্লাদার হ্যাট-কোট-পরা শাঁসালো বিদেশীকে দেখে
তোমার উরুদ্বয় ফাঁক করে দেবে নিমেষে?
আমি আমার আগুন-ওগড়ানো চোখ হ্যামলেটের মতো
এখন সরিয়ে নিচ্ছি বটে, কিন্তু হে ধর্ষিতা,
বারবার আমি আমার লড়াকু হাত-পাগুলোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে
রাখতে পারবো কি? (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আকাশের কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ পাড়ার নার্সারির কচি ঘাস
চিবিয়ে খাচ্ছে। ওদের চোখে তৃপ্তির কুয়াশা আর গোলাপগুলি
ঈষৎ লাজনম্র আর ভয়কাতর। এখানে তোমার দৃষ্টি পড়েনি ক’দিন।
আকাশ থেকে এক অতিকায় পাখি এসে নামলে, তুমি তার জঠর থেকে
বেরিয়ে আসবে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে। মনের চোখে দেখব তোমাকে।
তুমি কি এলে বহু যুগের স্মৃতি জড়িয়ে তোমার সত্তায়? তোমার চোখে যেন
সুদূরতার ছায়ানিঝুম আত্মপ্রকাশ। জানলার শার্সি ধরে সেই কবে থেকে
দাঁড়িয়ে আছি। ঘণ্টা দেড়েক আগে বৃষ্টি এক পশলা চুমো ঝরিয়ে
গেছে আশেপাশে দরদালানে, গলিতে, নার্সারিতে। কয়েকটি কোঁকড়ানো মেঘ,
যেগুলি চরছিল নার্সারিতে, চিবোচ্ছিল কচি ঘাস, এখন উধাও। তুমি তোমার
ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছ মধ্যরাত্রির শয্যায়। আমার বাসনাগুলি পুরুষ
মৌমাছি হয়ে উঠছে তোমার ক্লান্ত যৌবনের মৌচাক ঘিরে, তুমি না
জেনেই ঘুমিয়ে পড়বে।এখন আমার অসমাপ্ত কবিতা তোমাকে ভাবছে কয়েকটি সড়ক, বইয়ের
দোকান, ট্রাফিক-লাইট, মসজিদ, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান
আর সিনেমা হলের ওপার থেকে। আমার অসমাপ্ত কবিতার রঙিন মাছগুলি
ডুবসাঁতার দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে তোমার মেহগলি কাঠের খাটের কিনারে
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোমল নিদ্রায় তোমার শরীর অন্যায়বিহীন আর
কী নির্মল। অন্য কোনও পুরুষের স্পর্শের কালো কখনও তোমার শরীরে
ছড়িয়েছে কি না, এ নিয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা এখন তেমন ভাবিত নয়।
সে এখন গাঢ় অনুরাগে এই নিঝুম প্রহরে তোমার অধরে, গালে, স্তনযুগলে
আর নাভিমূলে মন্দিরে পুরোহিতের মতো প্রসাদ-রেণু ছিটিয়ে দিচ্ছে অবিরল।
রাত্রির টাইম-পিসে এই মুহূর্তে কটা বাজে, খেয়াল নেই। তোমার ঘুম, একটি
রাতজাগা পাখি, হাওয়ো-মাতাল গাছ, জনহীন গলি, এতিমখানার অন্ধ নীরবতা
আমার মধ্যে কী এক অস্থিরতা ডেকে আনে। অন্ধকারের আড়ালে ঢাকা-পড়া
নক্ষত্র আর ভাসমান মেঘের গলা জড়িয়ে আমার অসমাপ্ত কবিতা গন্তব্যের
প্রায় সীমান্তে পৌঁছে যায়। দ্রুত হতে থাকে বুকের স্পন্দন। এই যাত্রা কে জানে
কোথায় থামবে? কোনও পুরানো কবরস্তানে নাকি নতুন কোনও পুষ্পল উদ্যানে? (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
প্রত্যহ কিছু না কিছু দৃশ্য আমি চুরি ক’রে নিই।ভিন্ন চরিত্রের রৌদ্র, আলাদা জ্যোৎস্নার
বিনম্র কম্পন, অগোচর রাস্তা এবং গ্রন্থের
অত্যন্ত রহস্যময় লিপি চুরি করে নিই; সিঁড়ির আড়ালে
ছায়াচ্ছন্ন মোহন মিথুন মূর্তি, লোপামুদ্রা ভীষণ বিব্রত
শাড়ির আঁচল নিয়ে; একজন বৃদ্ধ, বর্তমানচ্যুত কাছিমের মতো
মুখে বর্ষিয়সী মহিলার অবয়বে
বসন্তের চেলি দেখে কেমন বিহ্বল। বালকের
হাতে গাছ তুলে দেয় ফুল, পুর্ণিমার অন্তঃপুরে
কেউ সিদ কেটে
অভাবিত রূপালি প্লাবনে ভাসে, স্বদেশী ম্যাডোনা
সন্তানের সৎকারের জন্যে পাতে শোকশীর্ণ হাত-
কখনো এসব দৃশ্য, কখনো বা অন্য ধরনের
দৃশ্যাবলি প্রত্যহ কিছু না কিছু চরি ক’রে নিই।কোত্থেকে হঠাৎ প্রজাপতি, শ্যামা এসে
সহমর্মিতায় দুলে বলেঃ
‘এমন তস্কর তুমি আলো-আঁধারিতে,
তবে কি পাড়ায় বলো নিন্দে রটবে না?’
কখনো মৌচাকেযদি পড়ে ঢিল, আমি রবীন্দ্রনাথের
আপদের মতো করবো ব্যাখ্যা কৃতকর্মের এবং
দোরে দোরে কবিতার ফুল চন্দন দিয়ে, যতদিন বাঁচি,
প্রায়শ্চিত্ত করবো বারংবার। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
সত্যি-বলতে আজকাল যে যার মর্জিমাফিক
আমার কবিতার গালে ঠিক গুনে গুনে
ঠাস ঠাস চড় চাপড় লাগিয়ে দ্যায়। কেউ পানের
পিক ছোঁড়ে মুখে, গলা ধাক্কা, গুঁতো,
পাক্কারদ্দা আছে লেগে। কেউ
মোড়লী চালে কান মুচড়ে নিজের তপ্ত মেজাজে
ঢালে ঠাণ্ডা পানি। কেউবা ফেউ লেলিয়ে
পরখ করে, কান্না জুড়ে দ্যায় কিনা অভিমানী
আমার পংক্তিমালা। মাতব্বর
সেই লোক, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যে রাষ্ট্বপতিকে নিজের বাপের চেয়েও
কদর করে বেশি, ঘাসের সাপের ধরনের
সেই লোক, আমার কবিতার
একটি হাত খসিয়ে র্যা কেট বানিয়ে টেনিস
খেলতে শুরুকরে।
অন্যজন পাঁজরের হাড় খুলে নিয়ে
পগার পার, পাঁড়মাতাল
এক মুরগীচোর আমার নগ্ন কবিতার ঠ্যাঙ ধ’রে
করে টানাটানি, মারে ল্যাঙ। এক লেজযুক্ত
সজ্জন সাফ সাফ ব’লে দিলো আমার সদ্য-লেখা
পংক্তিমালাকে, ‘এই যে শুনছিস, যার
হাত থেকে উৎসারিত তোরা, সেই উজবুক
খাসির গোশ্তের মতো মৃত
এক দশক আগে। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? দাঁড়া
বেকুবের দল, কে আছিস তাড়াতাড়ি
আলমারি থেকে বের ক’রে আন ওর ম্রিয়মাণ কংকাল।এরই ফাঁকে বেশ্যালয়-ফেরত এক মাস্তান
বেলফুল জড়ানো হাতে
আমার কবিতার মুণ্ডু লোফালুফি
ক’রে চিবুতে থাকে, যেন কচকচ খাচ্ছে টোমাটো।
পাড়ার পাঁচজনের এই কাণ্ড কারখানা দেখে
কবিতা আমার বেদম হাসে, হেসেই খুন, যেন সার্কাসে
কয়েকটি বেবুন জবর লাফাচ্ছে, দিচ্ছে সুড়সুড়ি,
কাতুকুতু, থুতু ছিটোচ্ছে যেখানে সেখানে,
ভেংচি কাটছে, ইত্যাদি।
ব্যপারটা এরকম, দেখে-শুনে কিন্তু মনেই
হয় না পিলে চমকে-দেওয়া এক জন্তু আমাদের গিলে
খেতে এগিয়ে আসছে হেলে দুলে,
লেজ আছড়ে কাঁপাচ্ছে মাটি। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
স্ফটিক সকালবেলা সে কী জন্ম কান্না দশদিক
জাগানো আমার
এবং কৈশোরে কোনো এক দ্বিপ্রহরে
আমার নেহার
বোনকে হারিয়ে বুকফাটা চিৎকারে আকাশটিকে
চিনেমাটি বাসনের মতো খানখান
করে দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সবার অলক্ষ্যে সন্ধ্যেবেলা।
যৌবন আমিও গলা ফাটিয়েছি মিছিলে মিছিলে
আর বর্ণমালাকে কী ক্ষিপ্র মুড়ে ঘৃণা
আর অঙ্গীকারে
দিয়েছি পরায়শ ছুড়ে শক্রর শিবিরে। এতদিনে
বড় ধ’রে এসেছে আমার গলা, প্রায়
বুজে গেছে পানা পুকুরের
মতো, আমি চাই
এখন আমার কণ্ঠে উঠুক নিছক বেজে কোমল গান্ধার। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
শোনো তোমরা হে আমার বাল্যবন্ধুগণ-
শোনো আফজাল, তাহের, ফরহাদ, সূর্যকিশোর।
আজ পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
ভাবছি তোমাদের কথা।আফজাল, আমি জানতাম
সেলুলয়েডে একটা নির্মল কাহিনী রচনার সাধ ছিলো তোমার।
তাহের, তুমি একটা বিরাট সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে।
ফরহাদ, গ্রাম-থেকে-আনা তোমার গোলাপী রঙের টিনের
স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো
যাবতীয় চিরকুট, সবুজ শাল আর একটা রাজহাঁস।
সূর্যকিশোর,
প্রতিদিন সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাওয়াতেই ছিলো তোমার আনন্দ।আফজাল, তোমার সেই সেলুলয়েডী সাধ, যদ্দূর জানি,
পূর্ণ হয়নি। এইতো সেদিন আমরা কতিপয় শোকার্ত মানুষ
গোলাপজল আর লোবানের ঘ্রাণময় হাতে
তোমাকে শুইয়ে দিলাম মাটির নিচে, যেখানে
কাঁকড়াবিছে আর পোকামাকড়ের ঘনিষ্ঠ গেরস্থালি।
প্রতিবাদহীন তুমি ছিলে অসম্ভব নিশ্চুপ, অথবা শার্টের কলারে
কিং জ্যাকেটের আস্তিনে একটা পিঁপড়ে
অথবা, কাঁচপোকা আনাগোনা করলে তুমি
মাথাখারাপ-করা অস্বস্তিতে ভুগতে, টোকা মেরে উড়িয়ে দিতে
তৎক্ষণাৎ। মনে পড়ে, আফজাল তোমার সঙ্গে দেখেছিলাম
জীবনের প্রথম জোনাকি আর তোমার স্মৃতি এখন জোনাকি।তাহের তুমি সেতু তৈরির স্বপ্ন খারিজ করে
বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে একদিন পাড়ি জমালে সুদূর বিদেশে।
তুমি আজ ফেঁসে গিয়েছো ভিনদেশী এক শহরে, ডিপার্টমেন্টাল
স্টোরের ঝলমলে করিডোরে, ব্যাংক ত্র্যাকাউন্টের ঝকমকিতে,
চকচকে এস্কেলেটারে।ফরহাদ, তোমার সেই ‘এলাহি ভরসা’ খচিত
গোলাপী রঙের টিনের স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে-পড়া রাজহাঁস
গ্রামীণ তেজারতির অন্ধকার গুদামে দম আটকে
মারা গ্যাছে। তুমি চটজলদি
তাকে দাফন করেছো জামতলায় হল্দে পাতার নিচে।সূর্যকিশোর; সেই যে তুমি হাঙ্গামায় বেচারামের
দেউড়ির বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেলে
সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে, তারপর তোমার কোনো খোঁজখবর
আমি পাইনি। তুমি কি পশ্চমবঙ্গের রাইটার্স বিল্ডিং এ
কলম পিষছো? নিত্যদিন মিশছো চৌরঙ্গীর ভিড়ে ? নাকি
ডেলি প্যাসেজ্ঞারি করছো মফস্বলী ট্রেনে?
সূর্যকিশোর, তুমি কি আজ খুচরো যন্ত্রাংশের কারবারি?
তুমি কি ধিকিয়ে-ধিকিয়ে-চলা খবর কাগজের
সংবাদ-শিকারি? তুমি কি ফাটকা বাজারে ঘোরো নিত্যদিন?
সূর্যকিশোর, হে বন্ধু আমার, তুমি এখনো
সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যেতে ভালোবাসো প্রত্যহ?
ইতিহাসের চেল্লাচিল্লি আর রাজনীতির হৈ-হল্লায়
তুমি বেঁচে আছো কিনা, আমি তা জানি না সূর্যকিশোর।শোনো তোমরা শোনো, হে আমার বাল্যবন্ধুগণ,
পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
আমি ভাবছি তোমাদের
এবং ভাবছি আমার নিজের কথা।
একদা সুকান্তের মতো গালে হাত দিয়ে
পুরোদস্তুর কবির কায়দায়
একটা ফটো তুলেছিলাম,
উই-খাওয়া সেই ফটো আজ
কোথায় হারিয়ে গ্যাছে। তোমাদের অলক্ষ্যেকী রহস্যময় সখ্যে
অক্ষরের পরী ভর করেছিলো আমার ওপর। এখনো
গায়ে-কাটা-দেওয়া প্রহরে প্রহরে
আমার নিভৃত ঘরে, পথে-বিপথে তার
অনির্দিষ্ট আনাগোনা।
শোনো তোমরা শোনো, হে বাল্যবন্ধুরা আমার, শোনো
আমার ঘরে নিমেষে বস্তুময়তার উপরিতলে পিছলে
অনেক রঙিন মাছ এসে যায়, সাঁতার কাটে, এসে যায়
জলাভূমির ধারে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের
হাড়গোড়ের সারে মজ্ঞরিত লক্ষ লক্ষ টাটকা গোলাপ। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
কায়ক্লেশে পথ চলি, অকস্মাৎ ঘোর সন্ধ্যা নামে;
সব দিকে লুপ্ত গাছপালা, নদীনালা, হল্দে ক্ষেত,
ত্রস্ত পাখি, গেরস্তের ঘর জনমনিষ্যি সমেত।
তবে কি এসেছি আমি পথ ভুলে নৈরাশের গ্রামে?
একটু পরেই ফের আকাশের ঘুরঘুট্রি খামে
তারার অক্ষরে লেখা নতুন ঠিকানা অনিকেত
আমাকে দেখায় পথ। কাক-তাড়ুয়ার মতো প্রেত
স’রে যায়, মধ্যে মধ্যে বৃক্ষতলে গা ঢালি বিশ্রামে।কখনো ম্যুনিখে ঘুরি, কখনো বা ঢাকাই বস্তিতে,
কত স্বপ্ন জমা হয় অবচেতনের স্তরে স্তরে
চল্তি পথে, অকস্মাৎ দৃষ্টি জুড়ে কালো বধ্যভূমি
ভেসে ওঠে, কংকাল বাজায় বাঁশি, বিবর্ণ আর্শিতে
মুখ দ্যাখে শীর্ণ প্রৌঢ় কবি, বার-বার মনে পড়ে-
সে কবে সোনালি দিন কালো ক’রে চলে গেছো তুমি! (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
সূর্যোদয় কখনো দেখেনি বলে তিনটি যুবক
প্রত্যহ একত্র হয়ে ধর্ণা দেয় সূর্যাস্তের কাছে।
‘সূর্যের চুল্লিতে আমি বহুদিন সেঁকেছি আত্মাকে
উল্টিয়ে পাল্টিয়ে, ওহে, তবু দেখি এখানে-সেখানে
থেকে যায় স্যাঁতেসেঁতে কিছু ভাব। অর্থাৎ এখনও
জীবন খোলেনি তার সবগুলি দ্বার সরাসরি,
বস্তুত হাতের পাঁচ অলক্ষ্যে দিয়েছে রেখে, তাই
পৃথিবীর রকে আজও হামাগুড়ি দিই, কেউ-কেউ‘হাঁটি-হাঁটি পা-পা এইমতো কতো নাবালক ছাঁদে
ক্রমাগত চলেছি হোঁচট খেয়ে প্রতিটি প্রহর।
তালগোল কেবলি পাকিয়ে যায় এই পরজীবী
অস্তিত্বের বিমূর্ত চৌকাঠে। পথে দৌড়ে এসে দেখি
আমার আসার আগে যাত্রীর বান্ডিল নিয়ে ওই
ছেড়ে যায় বাস’- এই বলে সটান মাঠের মরা
ঘাসে শুয়ে দুই-মুখ-ফিরে-আসা সিগারেটে দিল
সুখটান প্রথম যুবক। চেয়ে দ্যাখে প্রায় নেভা
আকাশে সূর্যের স্টোভ সূর্যাস্তের রঙ দেখে তার
মনে পড়ে হঠাৎ মোটরে দেখা মহিলার ঠোঁট।‘ইয়ার বলেছ তোফা। সেই কবে নড়বড়ে টোলে
জল পড়ে পাতা নড়ে মুখস্থ করেছিলুম জন
ত্রিশেক বালক মিলে ঐকতানে প্রশান্ত সকালে,
দুপুরের অন্ধ-করা রোদে আজ কে কোথায়, ওহে,
পড়েছে যে ছিটকে দূরে। ধড়িবাজ যে লোকটা
দেখাল ঘুঘুর ফাঁদ, একদিন সে-ই জানব না
ছিল চেনা সুবোধ বালক, শ্লেটে যার চকখড়ি
বুলাত আদর্শ জীবনের শর্তাবলি প্রথামতো।‘ভুলেছি সবার নাম। তাদের মুখের রেখাটুকু
মুছে গেছে স্মৃতির অস্থির ক্যানভাস থেকে আজ।
সূর্যাস্তের রোগা আলো’-অবজ্ঞার ঢিল ছুড়ে দূরে
দ্বিতীয় কথক ভাবে- ‘রাশেদা ভাবীর ম্লান ঠোঁট।‘নামে কী-বা আসে যায়, বলেছেন, কবি-নাট্যকার;
সত্যি, কী-বা আসে যায় নামে’, বলে তৃতীয় যুবক
ঝাড়ল হাতের ছাই, ‘ধরো এই তোমার নামের
যে-অর্থ দাঁড়ায় তার কতটুকু তুমি? কিন্তু যদি
বলি কেউ আমার নামের খামে মনের খেয়ালে
বসায় তোমার নাম, অথবা আমরা তিনজন
যদি ফের তুলে নিই যে-কোনো তিনটি নাম যার
যেটা ইচ্ছে, তাতে কিছু হবে কি বিশেষ হের-ফের?‘নেমকহারাম নই, দেখেছি তো আরজি পেশ করে
এই জীবনের কাছে রাত্রিদিন, নেপোয় মেরেছে দইটুকু-
আমরা ক’জন শুধু শুকনো মুখে শূন্য হাতে শেষে
প্রত্যহ এসেছি ফিরে রকবাজ সন্তদের ভিড়ে’,
তৃতীয় যুবক ভাবে ‘মধ্যাহ্নের চিৎকারের পরে
এখনও রয়েছে লেগে আকাশের প্যালেটে যে-রঙ,
তাকি নয় উত্তপ্ত সন্ধ্যায় বন্ধ্যা গণিকার ঠোঁট?’‘আমার জীবনে সুখ নেই’, প্রথম যুবক বলে।
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, বাতাসে দ্বিতীয় স্বর
নকশা আঁকে হিজিবিজি।। চিন্তার কপাটে পড়ে খিল।
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, বলে তৃতীয় কথক।
সূর্যোদয় কখনো দেখেনি বলে তারা তিনজন
সূর্যাস্তের কাছে চেয়েছে শিখতে কিছু জীবনের
রসায়ন। প্রথম যুবক দ্যাখে দ্বিতীয়ের চোখেনেই তার নিজের চোখের মণি, তৃতীয়ের চোখ
সেখানে কাঁপছে মৃদু। দ্বিতীয় কথক দ্যাখে তার
নিজের থ্যাবড়া নাক নিয়েছে প্রথমজন কেড়ে।
হোক না কার্বন কপি পরস্পর, কী-বা আসে যায়
রকবাজ সন্তদের ভিড়ে, ওহে, কী-বা আসে যায়…
প্রাণপণ হেঁকে বলো শূন্যতায় কী-বা আসে যায়। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
যদি কেউ পথে যেতে-যেতে জোরে ঢোল
বাজাতে বাজাতে বলে, ‘শোনো ভাইবোন,
হও সাবধান, আমাদের এ শহরে
নানা স্থানে, এমনকি অলিতে-গলিতে রক্তলোভী
হায়েনারা হঠাৎ পড়েছে ঢুকে,-ভয়
না পেয়ে দাঁড়াও রুখে সামান্য যে-কোনও
অস্ত্র থাকলেও হাতে। যতদূর জানি,
আমাদের দেশবাসীদের অনেকেই দেশপ্রিয়, স্বার্থত্যাগী।কে না জানে এই দেশের বাশিন্দারা স্বদেশের মান
রক্ষার কারণে হাসিমুখে দিতে পারেন জীবন।
তা হ’লে কী করে শক্র পারবে ছিনিয়ে নিতে প্রিয়
স্বাধীনতা, তাদের কখনও?
এখন হায়েনাদের ঘোরাঘুরি, লাফালাফি বড়
বেশি চোখে পড়ে,
তা হ’লে একদা যারা স্বাধীনতা এনেছিল
ঝরিয়ে নিজের রক্ত তারা আকাশের
দিকে চেয়ে হাসবে কি কাঁদবে ভেবেই
পাচ্ছে না কিছুতে। রাত এলে হাসে চাঁদ বাঁকা হাসি।যে যতই হাসাহাসি করুক-না কেন যতকাল
এদেশে থাকবে প্রগতির বুনিয়াদ,
অগ্রসর মানবের জয়গান, ততদিন এখানে বইবে
কল্যাণের স্রোত, গাওয়া হবে স্নিগ্ধ গীত,
ততদিন মানুষের কল্যাণ, প্রণয় থাকবেই।
হয়তো তখন আরও অগ্রসর মানব-মানবী জন্ম নেবে। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যখন প্রকৃত কবি কবিতার চোখে চোখ রাখে
কোজাগরী পূর্ণিমায় কিংবা ব্যাপক অমাবস্যায়
দারুণ অনলবর্ষী গ্রীষ্মে, শীতে অথবা বর্ষায়,
কদম ফুলের মতো খুব শিহরিত হতে থাকে
কবিতার স্তন আর যখন সে তন্বী কবিতাকে
বুকে টেনে নিয়ে ওর গালের মাংসের স্বর্ণাভায়
ঠোঁট ঘষে, যখন হৃদয় তার তীব্র চুমো খায়
কবিতার গোপনে, তখন সে স্বপ্নের নগ্ন বাঁকে।এমনও তো হয়, মাঝে মাঝে সেই নিষ্ঠুরাতমার
কিছুতে মেলে না দেখা। দিন যায়, মাস যায় কত,
তবু তার পদধ্বনি বাজে না কোথাও, কী অসুখে
জ্ব’লে পুড়ে একা কবি আদিগন্ত উজ্জ্বল আমার
দিকে হাঁটে, খোঁজে পানশালা, হয়ে সে সতত
মাতাল দর্পণে ঢোকে, কবিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।
‘আবার আসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝ’রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
উনিশ শো উনসত্তরের
তরুণ চীৎকৃত রৌদ্রে যে-ছেলেটা খেলতো রাস্তায়,
বানাতো ধুলোর দুর্গ, খেতো লুটোপুটি নর্দমার ধারে
বিস্ময়ে দেখতো চেয়ে ট্রাক, জীপ,
রাইফেল, টিউনিক, বেয়োনেট, বুট, হেলমেট,
এখন সে টলমল পদভরে শরীক মিছিলে।
লাজনম্র যে মেয়েটি থাকতো আড়ালে সর্বক্ষণ,
যে ছিল অসূর্যস্পশ্যা, এখন সে ঝলসায় মিছিলে মিছিলে।
তাদের পায়ের নিচে করে জ্বলজ্বল নীল নকশা নব্য সভ্যতার।বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হতাশাকে লাথি মেরে, ভয়কে বেদম লাঠি পেটা ক’রে
সবখানের শ্লোগানের ফুলকি ছড়াই।
বারবার আমাদের হাত হয় উদ্দাম নিশান,
বারবার ঝড়ক্ষুব্ধ পদ্মা হই আমরা সবাই।আমাকেই হত্যা করে ওরা, বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
উনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই
আমাকেই হত্যা করে ওরা
পথের কিনারে
এভন্যুর মোড়ে
মিছিলে, সভায়-
আমাকেই হত্যা করে, ওরা হত্যা করে বারবার।
তবে কি আমার
বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হ’য়ে যাবে ?
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
উনিশশো ছিয়াশির মার্চ মাসে রাত বারোটায় কী উদ্বেল
কে যে কড়া নেড়ে
ভাঙাল আমার ঘুম, যদিও সুইচ টিপে বেল
বাজালেই হতো; প্রায় তেড়ে
এসে দেখি সুপ্রাচীন ধরাচূড়া নিয়ে একজন
আছেন দাঁড়িয়ে একা, আমার ফ্ল্যাটের দরজায়। আমি তাঁকে
‘ভেতর আসুন’ বলে সোফায় আসন
গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানালাম। পথের কুকুর ডাকে
নির্জন রাস্তাকে চমকিয়ে। ‘ঘোর কলি মহাশয়,
ছিনতাই হয়ে গেছে সর্বস্ব আমার’ বলে রাতের অতিথি
আড়চোখে আমার দৃশ্যমান যা বিষয়-আশয়
নিলেন নিপুণ দেখে। ভীতি
জাগে মনে, তিনি কি আমাকে শেষে তুখোড় তস্কর
ঠাউরে এলেন ফ্ল্যাটে? রত্নহার নাকি গজমোতি
হারালেন, অনুগ্রহ করে বলুন তো মান্যবর?
‘ওসব কিছুই নয়, সম্ভ্রমের সবুজিমা’, বলেন বিমূঢ় বিদ্যাপতি। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
ফিরে যাও আমার দুয়ার থেকে তোমরা এখন
ফিরে যাও; কিছুতেই তোমাদের দেবো না মাড়াতে
আমার চৌকাঠ! তোমরাতো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
নিরুদ্দেশ যাত্রায় দিয়েছো পাড়ি কতো না সমুদ্র
অথবা বীরভূমে ধু ধু হয়েছো তৃষ্ণার জল তাঁর
প্রহরে প্রহরে আর নজরুল জ্যৈষ্ঠের দুরন্ত
মেঘের মতন বাবরি দুলিয়ে মোহন বলাৎকার
করেছেন তোমাদের ওপর প্রত্যহ। কবেকার।জীবনানন্দের জন্যে চকিতে করেছো উন্মোচন
করুণ শঙ্খের মতো স্তন এবং সুধীন্দ্র দত্ত
নিখিল নাস্তির মৌনে ডুবে তোমাদের নাভিমূলে
যৌনাঙ্গের অগভীর কেশে রেখেছেন মুখ ভুলতে
মনস্তাপ। তোমরাতো সাজিয়েছো বিষ্ণুদে’র ঘর
রাত্রিদিন, দিয়েছো সন্ধ্যায় তুলে শ্বেত বাহু মুখ।
এখনো তো বুদ্ধদেব বসুর শয্যায় তোমাদের
ব্রার টুক্রো সিঁদুরের রঙ প’ড়ে থাকে ইতস্তত।ফিরে যাও, আমার দুয়ার থেকে ধিক্কার কুড়িয়ে
ফিরে যাও। তোমাদের চোখে তুলে রাখবার ইচ্ছে
মৃত টিকটিকি হ’য়ে আছে, বুকে নেবো না উৎফুল্ল।
বলে দিচ্ছি, ছলাকলা ব্যর্থ হবে; বিসমিল্লাহ খান
যতই বাজান তাঁর পুষ্পিত সানাই, তোমাদের
হাত ধ’রে আনবো না বাসরে কখনো। তোমরাতো
উচ্ছিষ্ট উর্বশী; ফিরে যাও, ফিরে যাও, যদি পারো
নতুন পাতার মতো সজীব শিহর নিয়ে এসো। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
তোমাকে দিইনি আংটি, বাগদত্তা ছিলে না আমার
কোনোকালে, গোধূলিতে তুমি লাজরক্তিম যেদিন
বসবে উৎসব হয়ে বিবাহমন্ডপে, সঙ্গীহীন
থাকবো বিনিদ্র ঘরে চুপচাপ, যেমন খামার
পুড়ে গেলে নিঃস্ব চাষী বসে থাকে হা-হা শূন্যতায়।
ছিলো না আমার অধিকার কোনোদিন পুষ্পাকুল
উদ্যানে তোমার, শুধু স্বপ্নের ভিতরে কিছু ফুল
তুলেছি বাগান থেকে মাতাল আঙুলে, বলা যায়।যখন রঙিন পথে হেঁটে যাবে তুমি যৌবনের
সৌরভ ছড়িয়ে, পদস্পর্শে হবে চূর্ণ ছন্নছাড়া
কবির নিটোল স্বপ্ন; ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত লেবাস
পড়বে তোমার চোখে। দাঁতে-ছেঁড়ে সে-বেশ বরের
নয়; ছিলো যার, তাকে পশুপাল করে তাড়া
রাত্রিদিন, সঙ্গী তার কংকাল-কর্কশ সর্বনাশ। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
নিশ্চয় তোমার মনে আছে একটি বাগান তুমি
আর আমি খুব গোপনীয়তায় সাজিয়েছিলাম
রঙ বেরঙের ফুলে। ইচ্ছে করে বাগানের নাম
রাখিনি আমরা, শুধু গড়েছি সুন্দর পুষ্পভূমি
পানি ঢেলে চারার শিকড়ে তুলে ফেলে পরগাছা
অগণিত। সে বাগানে নানা পাখি দ্বিধাহীন এসে
শুনিয়েছে গান আমাদের, কী মধুর সুর ভেসে
গেছে দূরে কোথাও, শিখেছি কাকে বলে তীব্র বাঁচা।অথচ বসন্তদিনে চলে গেলে তুমি অকস্মাৎ
কাটিয়ে সকল মায়া বাগানের। ঝরে যাচ্ছে ফুল
যত্নের অভাবে, ক্রমাগত বেড়ে ওঠে বুনো ঘাস,
আমি আর কত পারি একা একা? দিন যায়, রাত
আসে, তুমি আসো না এখানে ছিঁড়ে যায় মর্মমূল
এবং বাগানময় বয় শুধু প্রেতের নিশ্বাস। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আমার চৌদিকে এই সন্ধেবেলা দুরন্ত আগুন
হঠাৎ উঠল জ্ব’লে। কী করে জ্বলল?
কারাই-বা, বলা-কওয়া নেই, সর্বনাশা
ওই খেলা জুড়ল আমার সঙ্গে! ওরা কারা?
আমার তো জানা নেই। যতদুর জানি
কার বাড়া ভাতে ছাই ঢালিনি কখনও।চারপাশে চোখে পড়ে নানা লোক দ্রুত
নানা ছলে নিজেদের ভাগ্য জ্বলজ্বলে
ক’রে তোলে। অপারগ যারা
সাদাসিধে তারা ড্যাবডেবে চোখে শুধু
চেয়ে থাকে কিংবা বড়জোর ঠোকে
নিজের কপাল। কেঁপে ওঠে হঠাৎ প্যাঁচার ডাকে!কে তুমি চলেছ একা অন্ধকার-ঘেরা
পথে অতি দ্রুত, যেন তোমার অনুপস্থিতি সেই
স্থানে অনেকের ঢের ক্ষত, কারও কারও
সর্বনাশ হয়ে যাবে। বুঝি তাই সবাই রয়েছে প্রতীক্ষায়।
হয়তো তোমার পদযুগ ভীষণ নিশ্চল হয়ে এল,
সম্ভবত পৌঁছুনোর আগেই মূর্ছিত হবে তুমি!এই তো অদূরে অপরূপ আলিশান দালানের
ছায়া যেন যাচ্ছে দেখা বেশ কিছু সবুজ গাছের
অন্তরালে। কারা সেই দালানে করেন বাস সুখে?
সত্যি সুখে? নাকি দুঃখ সুন্দর সুখের
ভাঁজে ব’সে পড়ে দালানের গালিচায়।
ঘন-ঘন মধ্যরাতে করুণ ধ্বনিত হয় সুর! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
১
যদি বদলে দেয়া যেতো নিছক এই ছকবাঁধা জীবন। প্রাতঃকৃত্য, খবরের
কাগজ শুঁকে শুঁকে কিছুসময় কাটানো, রুটি-তরকারি, ধোঁয়া-ওগরানো চা,
স্বল্পকালীন দরকারি গার্হস্থ্য কথাবার্তা, অফিসে দৌড়ানো, কাজ-অকাজ,
আড্ডা, নোংরা টয়লেটে আরশোলা পায়ে-মাড়ানো, মলমূত্রত্যাগ, কায়ক্লেশে
ঘরে ফেরা, নৈশ আহার, বেঁচে-থাকা না-থাকার ভাবনা, এই পৃথিবীতে কে
কাহার, নিদ্রা, যেন উন্মাদের লাগাতার কাগজ ছেঁড়া, মৈথুন, নিদ্রা, ভোরে
সদ্যচরের মতো জাগরণ-দুঃসহ এই পুনরাবৃত্তি। মরিয়া জুয়াড়িবৎ সর্বস্ব পণ
রেখে এক দানে জীবনকে পাল্টে ফেলার সাধ ময়ূরের পেখম। এমন কি পারে
না হতে আর নই গৃহী, নির্দিষ্ট কোথাও বারবার আওয়া নেই, নেই ফিরে আসা?
উপেক্ষিত নিসর্গের সঙ্গে আলাপ, শ্যামলিম উপত্যকায় শুয়ে-শুয়ে শ্লথগতি
মেঘের শোভা নিরীক্ষণ, অনূঢ়া, স্বাস্থ্যবতী, কামার্তা গয়লানীর সঙ্গে শয়ন
সুস্নিগ্ধ ঝোপের আড়ালে কিছুক্ষণ, ঘাগরা ওল্টানো, শ্বাসরোধকারী চুম্বন,
ক্ষমাহীন আলিঙ্গন, মিলন, পুনর্মিলন; অনন্তর পাহাড়-বেয়ে-ওঠা, অশ্লীল,
আক্রমণপরায়ণ মানবপিণ্ড থেকে দূরে ভ্রমণ, পাহাড়ি প্রাণীর বিধানবিরোধী
সহযাত্রী; নির্ধারিত বৃত্তিহীন ফলমূল ভক্ষণে ক্ষুধার নিবৃত্তি,-এসব কিছুই কি
সম্ভাব্যতার পরপারে? জীবনকে আত্মদ্রোহে স্থাপন করতে প্রবল ইচ্ছুক আমি
প্রথাছুট, বৈচিত্র্যময় চলমানতায়।
২
জগৎ-সংসারে কে আছে এমন যার শ্রুতি বিমোহিত নয় ঘন সবুজ পত্রালি
থেকে কিচ্ছুরিত সূর্যরশ্মির মতো কোকিলের সুর, ঝর্ণাজল আর নুড়ির মোহন
সংঘর্ষে উৎপন্ন মৃদু কলম্বর আর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির হৃদয় থেকে উৎসারিত
বংশীধ্বনিতে? এমন কারও সন্ধান কি পাব যে আবদুল করিম খাঁর যমুনা
তীরের স্বর্গীয়, চিরব্যাকুল ছলাৎছল, রবিশঙ্করের সেতারের নির্ঝর, য়ুহিদি
মেনহুইনের বেহালা-নিঃসৃত সুরধারায় অবগাহনে অনিচ্ছুক? বন্দনীয় এইসব
সুর থেকেও, হে মেয়ে অনেক মধুর তোমার প্রেমার্দ্রে কণ্ঠস্বর, যা আমার
ভেতরের চাপা আগুনকে উসকিয়ে কখনও দীপান্বিত শবে বরাত, কখনও বা
আবীর-ছাড়ানো বসন্তোৎসব।
৩
সারা দিনমান ইট ভাঙার শব্দ, ঘাম-ঝরানো খাটুনি। আমার মুহূর্তগুলো
ভারী হাতুড়ির অবিরাম পিটুনিতে বিচূর্ণিত। হে মধ্যরাত্রির শান-বাঁধানো
ফুটপাথ, হে নিঃসঙ্গতার কালো সাঁড়াশি, মাঝ মেঘনার লাফিয়ে-ওঠা ডাগর,
রূপসী মাছ, নিষ্পাপ চুম্বনের স্মৃতি, অবসরের আঙুলে ঘূর্ণ্যমান আংটি, পুরানো,
শূন্য বাড়ির অভ্যন্তরীণ প্রতিধ্বনি, দিগন্তের শব্দহীন, ধূসর চিৎকার, দু’জনের
কল্পিত পলায়ন, সংসারবিহীন সংসার, খরার পরে বৃষ্টির তুমুল কত্থক,
নেশাতুর নানা প্রহরের সাইকেডেলিক চিত্রমালা, আঙুলের ডগার কাঠিন্য,
কুকুর কুকুরীর বেআব্রু প্রণয়, হে গা-গুলোনো, নিঃশ্বাস অপহরণকারী গার্হস্থ্য,
হে অন্তর্গত লতাগুল্মঢাকা সন্ন্যাস-তোমাদের কাছ থেকে বহুকাল কর্জ নিয়েছি
বিরল সম্পদ। ধারদেনা চুকিয়ে দেয়ার সাধ অনেক দিনের, অথচ নিষ্ফল শ্রম
আর খঞ্জ প্রেরণায় সতত আমি অধমর্ণ।
৪
তুমি কি জান যখন দুষ্ট বালক আগুন ধরিয়ে দেয় নীড়ে, ছিন্নপালক,
শাবকহারা পাখির তখনকার অভিব্যক্তি? হতে কি পার নৌকো ডোবার মুহূর্তে
যাত্রীর অনুভূতির অংশীদার? জিভ বার করে দেয়া দেয়ালের আর্তনাদের সঙ্গে
তুমি পরিচিত, একথা ধরে নিয়ে বলি, উদ্যানের ফুল, ঝুঁকে-থাকা আকাশ,
আমার সংশয়াকুল মনে বইয়ে দেয় না সুবাতাস। অপরাহ্নের ক্রোড়ে সমর্পিত
ঘাসঘেরা করোটির ওপর প্রজাপতি আর ফড়িং-এর ওড়াউড়ি, প্রায়শ নির্ঘুম
রাতে, হে প্রধান সুন্দরী, তোমার বাসার দিকে ফেরানো আমার মুখ, সম্মোহিত,
তন্নিষ্ঠ, তুমি কি জান?
৫
কী হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে? আয়ত তোমার চোখ, সেই জন্যেই
সপ্তর্ষিমণ্ডল, পর্যটক মেঘ, উদ্ভিন্ন গোলাপ। সোনালি তোমার বাহু, সেই জন্যেই
এই আলিঙ্গন, শূন্যতার খুনসুটি, হাওয়ার মাতলামি। স্ফুরিত তোমার ঠোঁট,
সেই জন্যেই তৃষাতুর কথা, অন্ধকারকে দীপান্বিতা-করা হাসি, মদির আগুন
ধরানো চুম্বন, বুজে আসা আমার চক্ষুদ্বয়। নিখুঁত তোমার গলা, সেই জন্যে
কাঁধ-বেয়ে-নেমে আসা চুলের জড়িয়ে ধরা, আমার নিঃসঙ্গতা আর
অনুপস্থিতিকে চুমুক-খাওয়া কণ্ঠস্বর, পথ-হাঁটার ওপর ছড়িয়ে পড়া গান। কী
হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে চিররৌদ্র, চিররাত্রিময় এই শহরে? কী
করব আমি, যদি অনিবার্য হয়ে ওঠে দিগন্তে মিলিয়ে-যাওয়া পক্ষধ্বনির মতো
বিচ্ছেদ? সত্যি-সত্যি কুরে-কুরে-খাওয়া বিরহ কি ডিম পাড়বে আমার
অস্তিত্বের অতল গহ্বরে? চাবিফোকর দিয়ে বিশ্বদর্শন সম্ভবপর কিনা, এ নিয়ে
নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা গ্যাছে মাঝে মাঝে নানা কাজের ফাঁকে। কাটা
মুণ্ডু ভাসমান, বড় রকমের বিস্ফোরণে আসমান ভেঙে পড়বার উপক্রম।
কোথায় লুকিয়ে বাঁচবে, সে-পথ খুঁজতে খুঁজতে সবাই বেসামাল। আমার
চোখে শুধু চাবিফোকর আর তোমার বিপন্ন মুখ। একটি প্রশ্ন ঐন্দ্রজালিকের
মতো আমার নাক বরাবর ছুঁড়ে মারছে মুঠো মুঠো ঝিলিক-দেয়া তারা-কি
হতো আমার, যদি তুমি না থাকতে? টোপর-পরা বিদ্রূপ ব্যালকনিতে বসে পা
দোলায় ঘন ঘন; ধপাস শব্দে চমকিত দেখি নিজেকে মেঝেতে, চোখ দুটো
উল্টে যাচ্ছে, জানলাভেদী সেবিকা জ্যোৎস্না চোখের পাতায় আঙ্গুল বুলোয়!
আমার সঙ্গে কেউ কি ধুলোয় খেলতে আসবে আবার ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও
কামড়ে-ধরা কোনও খেলা?
৬
আর কড়া নেড়ে-নেড়ে ক্লান্তির ভারে-নুয়ে-পড়া নয়। এবার দড়াম ঢুকে পড়বো
দস্যুতার শিখায় প্রজ্বলিত। মনঃপূত নয় এই আচরণ, কিন্তু কি করা? নিষিদ্ধ ফল
ভক্ষণের পরে হতচকিত আদমের মতো পাতাময় ত্রিডাল নেব না ভিক্ষা;
জ্যোতির্ময় উন্মাদনা আমাকে উদোম করেছে। চার দেয়াল ডালকুত্তা, ধুলোমাখা
নিভন্ত বাল্বগুলো ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকে, সোফা অতিকায় হাড়গিলা,
ভয়-ধরানো। হাওয়া ভূতুড়ে, শক্ত লতার মতো জাপটে ধরে, মটমটিয়ে ওঠে
হাড়গোড়, মাংস-মজ্জা খসে খসে পড়তে চায়। রামধনু পোশাক ছুঁড়ে দাও, ফিরে
যাই। আমার হৃদয় আঁচড়াচ্ছে বাজপাখি, সী মোরগের সৌজন্যে এখানে আসা না-
আসা। আমাদের দু’জনের মেঘমেদুর সম্পর্ক এখন ঘাতকের মারণাস্ত্রের ছায়া।
ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে বুনো জানোয়ারের জ্বলন্ত টিকাবৎ চোখের দিকে।৭
সুকৌশলে ছাঁটা অনেকখানি, সৈনিকের কদম-ছাঁট চুল যেন। হাওয়ায়
পালকের কুচি, নীলিমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয়া মুনাসিব; ওড়া বারণ। স্পষ্ট
কোনও কারণ ওরা বলবে না সহজবোধ্য ভাষায়। ধারণা, হয়ত অমূলক নয়,
অনেক ওপরে, আকাশের জাজিমে আয়েশে গড়ানো অশোভন অভাজনের পক্ষে।
সেখানে সুনীল কক্ষের ফরাসে মখমলী তাকিয়ায় ঠেস্ দিয়ে যারা ফরাসি টানে
ফুড়ুক ফুড়ুক, দ্যাখে বাইজীর নাচ ঢুলুঢুলু লালচে চোখে লকলকে লালচে, তারা
শুধু বশংবদ তোতা পাখি পুষে তৃপ্তির ফোয়ারায় গা ভেজায়। সেখানে ঈগল পায়
না আমন্ত্রণলিপি। ওকে তপ্ত কড়াইতে ভেজে ভেজে অভ্যক্ষ কাবাব বানানো ছুঁড়ে
দেবে নোংরা বুদ্বদময় নর্দমায়। কী আশ্চর্য, সবাই দেখতে পায়, ভস্মরাশি থেকে
উত্থিত বিহঙ্গের অবাধ, বর্ণাঢ্য ওড়া মেঘের স্তরে স্তরে। অগ্নিগোলক নির্বাপিত
ওর ডানার ঝাপ্টায়, চূড়ান্ত নীলিমাকে সে ছোঁবেই। ওড়ো, হাওয়া কেটে-কেটে,
সূর্যের সোনালি চুলের ভেতর দিয়ে তার অনিঃশেষ ওড়া। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আমাকে অস্থির করে কী লাভ তোমার, প্রিয়তমা?
এই যে আমার নিদ্রা নির্বাসিত মাঝে-মাঝে, দম
বন্ধ হয়ে আসে কোনো কোনো দিন, অকস্মাৎ যম
করে উপদ্রব, চতুর্দিকে খুব গাঢ় হয় অমা
তাতে তুমি ভাসো কি সুখের সরোবরে? করো ক্ষমা
আমার কসুর হলে অথবা স্খলন হলে কম
কিংবা বেশি; তুমি তো ভালোই জানো, এই বেরহম,
অশুদ্ধ সময়ে শুধু পতনের কালি হয় জমা!নক্ষত্র, সজীব নদী, গাছের পত্রালি জুড়ে থাকে
অস্থিরতা, কখনো তা চোখে পড়ে কখনো-পড়ে না;
বস্তুত আমার সিংহভাগ ছটফটি আড়ালেই
থেকে যায়। কবিতা লেখার কালে যে-ঝড় আমাকে
ধ্বস্ত করে, তারও বেশি ছন্নছাড়া প্রাণের এরেনা
আমার তোমার কষ্টে। মনে আজ প্রসন্নতা নেই। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
ভদ্রলোক প্রত্যহ একলা নিঝুম বসে থাকেন কোনার
ঘরে। প্রায়শ একটি দু’টি রঙিন
পাখি এসে বসে বারান্দায়, তাকায়
লাগোয়া ঘরের ভেতর। বয়সী ভদ্রলোক সাদরে
মুড়ি, মুড়কি ছিটিয়ে দেন পাখিদের উদ্দেশে।
পাখিরা নিমেষে ভোজ সেরে ফেলে উধাও।ঘরের বাসিন্দা চেয়ারে হেলান দিয়ে কী-যে ভাবেন
তিনি-ই জানেন। অতিথি পাখিদের কথা?
না কি সদ্য-পড়া কবি পাবলো নেরুদার কাব্য-গ্রন্থের
মহিমা? কখন যে কার মনে খেলে যায় কোন্ সে
সরল ভাবনা অথবা জটিল, প্রায়-অবোধ্য বিষয়-
কে বলতে পারে? মন তো আফ্রিকার জঙ্গল নিছক।কী সব ভাবনা ভদ্রলোকের মানসে দিঘির মাছের
মতো লাফিয়ে ওঠে। কেন যে
তার অতীতের প্রায় মুছে-যাওয়া এক ঘটনা দিঘির পারের
ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। মুছে যায় সে-ছবি
বহু যুগের ওপারের স্তব্ধতায়। বদলাতে থাকে অনেক
ছবি। সে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে দিঘির কিনারে।পুনরায় কখন ঠায় জেগে ওঠে সে ঠাওর করতে
ব্যর্থ হয়। নড়বড়ে ভাবনা
তাকে ভোগায়। অকস্মাৎ তালুতে ফোটে তিনটি গোলাপ।
শকুনের ঝাঁকের দাপট ক্রমাগত বাড়লে
বন্দুক হাতে ভদ্রলোক হঠাৎ রণমূর্তি করেন ধারণ।
সবাই বোঝে না, কেউ কেউ বুঝে ‘ধন্য ধন্য’ করে নীরবে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
পাড়ার দোকান থেকে একটি সাবান কিনে এনে
রেখে দিলো নিজের দেরাজে। মোড়কের ভাঁজ খুলে
প্রায়শই ঘ্রাণ নেয়, আবার গচ্ছিত রাখে স্মিত
হেসে যথাস্থানে, সেই ঘ্রাণ তাকে ন্যালক্ষ্যাপা করে
বারংবার, নিয়ে যায় সময়ের অন্য পারে। কার
গায়ে একরম ঘ্রাণ ছিলো? গোসলের পর খোলা,
ঈষৎ ফাঁপানো চুলে যে আসতো নিঃশব্দে দ্বিপ্রহরে,
তার গায়ে? কখনও-সখনও সোনারুর মতো ঢঙে
চোখ রাখে সাবানের প্রতি, টেবিলে স্থাপিত হলে।
কখনও সে বানাবে না, তবু বস্তুটির খুঁটিনাটি
প্রস্তুতিপর্বের কথা ভাবে, আমদানি রপ্তানির
হিসেবে-নিকেশ করে। কেঠো দেরাজের ভেতরেও
সুঘ্রাণ; করে না এস্তেমাল তাকে, পাছে এ সাবান
পানির সংসর্গে জীবনের মতো দ্রুত ক্ষয়ে যায়। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তোর কাছ থেকে দূরে, সে কোন নিশ্চিন্তিপুরে পালাতে চেয়েছি
প্রতিদিন, বুঝলি মতিন!
হয়তো বা টের পেয়ে অবশেষে নিজেই উধাও হয়ে গেলি
একটি নদীর তীরে, মাঠ-ঘেঁষা, গাছ ঘেরা, জুঁইকি চামেলি
ইত্যাদির ঘ্রাণময় বিজন নিবাসে। আমি তোকে
দীর্ঘ চোদ্দ বছরের সাইকেডেলিক স্মরণের তীব্র ঝোঁকে
ডাকি মধ্যরাত্রির মতো বুক ছিঁড়ে বারংবার,
প্রতিধ্বনি শুধু গূঢ় প্রতিধ্বনি ফিরে আসে মগজে আমার।কেমন আছিস তুই? এখনো কি ভীষণ অস্থির তুই, ওরে?
এখনো কি অতি দ্রুত হেঁটে যাস দুঃস্বপ্নের ঘোরে
অলীক অলিন্দে কোনো? অবাস্তব বনবাদাড়ে ঘুরিস একা
ছিন্ন বেশ, নগ্নপদ সন্তের মতোন? তোর দেখা,
মানে তোর ঝলমলে প্রকৃত সত্তার দেখা পাবো কি আবার
কোনোদিন? তোকে হারাবার
পর তুই অতিশয় বেগানা আমার বড় বেশি উদাসীন
হয়ে গেলি, রূপান্তরে আমার দুঃখের মতো, বুঝলি মতিন।যখন এখানে ছিলি, বুকের নিকটে ছিলি, তোর হস্তদ্বয়
আমার স্বপ্নের ঝাড়লণ্ঠন বেবাক অতিশয়
হিংস্রতায় বারংবার দিয়েছে দুলিয়ে। চুরমার
হয়েছে এ-ঘরে নিত্য যা কিছু ভঙ্গুর আর প্রগাঢ় সুমরি
মতো অন্ধকার চোখে নেমে এসেছে আমার ভর দুপুরেই।
এখন এখানে নেই, তুই নেই; আমার বুকের মধ্যে
সবুজ পুকুর!এই তো সেদিন আমি খাতার পাতায় মগ্ন ছিলাম একাকী
অপরাহ্নে অক্ষরের গানে তরঙ্গিত। ‘সবই ফাঁকি’,
কে যেন চেঁচিয়ে বলে। দেখি খুব থমথমে সমুখে দাঁড়িয়ে
কাল-কিশোরের মতো তুই, যেন দীর্ঘ পথ নিমেষে মাড়িয়ে
এসেছিস বলে দিতে আমার উদ্যাম সব এলোমেলো,
দারুণ বেঠিক।
দিচ্ছিস চক্কর তুই ঘরময়, আমিও ঘুরছি দিগ্ধিদিক
জনাকীর্ণ এ শহরে কে জানে কিসের টানে পরিণামহীন,
বুঝলি মতিন।যখন এখানে ছিলি, ছিল এক ঝাঁক চিলের ক্রন্দন ঘরে,
ছিল তীক্ষ্ম কলরব সকল সময়, মনে পড়ে।
এখন আমার ঘর অত্যন্ত নীরব, যেন শ্লেট, মূক, ভারী।
কখনো চাইনি আমি এমন নিশ্চুপ ঘরবাড়ি। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যখন ছিলাম সাত বছরের খেয়ালি বালক,
মধ্যদিনে বিছানাকে রত্নদ্বীপ ভেবে সযতনে
খুঁজতাম গুপ্তধন। শিকারের খোঁজে ঘুরে বনে
দিতাম মাথায় গুঁজে সাতরঙা পাখির পালক
রেড ইণ্ডিয়ানদের মতো আর উটের চালক
সেজেছি তো সাহারায়। সে-সব দুপুরে ক্ষণে ক্ষণে
চিরচেনা বাঁশি-অলা বাজাতো টিনের বাঁশি, মনে
জ্বালাতো আতশবাজি, গলিময় সুরের আলোক।আজ এই জীবনের মধ্যদিনে ভাবি যদি সেই
বাঁশি-অলা ফিরে আসে, এ-গলির মোড়ে ঘুরে ঘুরে
বাজায় টিনের বাঁশি, তা হলে আনাড়ি তার সুরে
পাবো কি আনন্দ আর? ডেকে এনে নিজের পাশেই
আবার বসাবো তাকে? অসম্ভব, সে পৃথিবী পড়ে
হয়ে গেছে ছাই আর সে-বালক অনেক আগেই! (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আকাশকে ধন্যবাদ। এ শূন্যতা, এই নীল আমাকে বাঁচায়,
রইলাম চিরঋণী। এনামেল-মসৃণ উধাও মেঘদল
ছুঁয়ে যায় এরোপ্লেন; ক্রমাগত উঠছি উপরে,
যাচ্ছি চলে দূরে ফেলে বিন্দু
বিন্দু মাঠ,
গাছ পালা,
সরু নদী,
দপ্দপে
লোকালয়, সব কিছু দূরে ফেলে। আমার সত্তায়
বাজে নীলিমার স্তব; আকাশের অকূল সাহারা
চষে চষে কী বেল কী জুঁই
প্রত্যহ ফোটাতে চাই বুঝি না কিছুই। নীলিমায়
প্রপেলর গুজ্ঞনে মৃত্যুকে ভুলে থাকি প্রহরে প্রহরে।
না, আমি কখনও আর নিচে নামবো না,
নামবো না, নামবো না।
মনে পড়ে কৈশোরের সতেজ সকালে কতদিন
আকাশে দিয়েছি ছেড়ে ঘুড়ি আকাঙ্ক্ষার। মেঘমালা
কখনও হয়েছে ফুল, কখনও বা এজ্ঞেলের পুণ্য ডানা হয়ে
দৃশ্যলোভী বালকের হৃদয় করেছে জয় ক্ষণে ক্ষণে, ফের
মুহূর্তে বদলিয়ে রঙ হয়ে গেছে মিকেলেজ্ঞেলোর
আদমের মুখ, দীপ্ত, প্রসারিত হাত, দৃষ্টি খোলা।
বুঝি তাই আজীবন আকাশ-মাতাল আমি, তাই
পরিণামে হলো হবার-
নীলিমাকে করেছি সুহৃদ
রত্রিদিন
উপরে উঠছি বলে চক্ষুশূল হবো কি সবার?
না, আমি কখনও আর নিচে নামবো না,
নামবো না, নামবো না।
নিচে নর্দমার গন্ধ। অজস্র পিচ্ছিল কেঁচো বিষাক্ত জজ্ঞাল।
ভালবেসে কেবলি বর্ধিত করে অস্তিত্বের ঢিবি, চতুর্দিকে
অস্তিচর্মসার মানুষের ভিড় আর পথে পথে অধঃপাত
দাঁত বের করে হাসে। নগরে জঙ্গলে ভেদচিহ্ন লুপ্তপ্রায়,
সবাই ঘাঁটছে নোংরা আবর্জনা উৎসবের উত্তেজনা নিয়ে ।
প্রেম তো সুদীর্ঘ
পত্রের-মার্জেন-ঘেঁষা পুনশ্চের মতো সংকুচিত, ক্ষণজন্মা
শিল্পীরা জলের দরে বিকোয় বাজারে, প্রগতির চাকা দেখি
অবিরত পাঁকে আট্কে যায়; স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা, উদরতা,
করুণা নামক কিছু বিখ্যাত বিষয় আগাগোড়া শোকাবহ
বিশাল কাফনে মুড়ে লোকগুলো মহানন্দে বগল বাজায়,
ঘৃণাকে আনন্দ ভেবে শান্তিকে তর্জমা করে হিংসার কাঁটায়!বরং আমার এরোপ্লেন শূন্যতায় হযে যাক
খান্ খান্, তবু আমি নিচে নামবো না।
ক্ষধার চিৎকার থেকে, নর্দমার তীব্র গন্ধ থেকে
দারিদ্রের দাঁত নখ থেকে, আতঙ্কের থেকে দূরে,
সমস্ত কাঙালপনা, ক্ষুদ্রতার থেকে
আর কিনু গোয়ালার গলি থেকে দূরে,
নীলিমার নহবত শুনে-শুনে যাবো ঊর্ধ্বে যাবো,
আরো ঊর্ধ্বে আরো
না, আমি কখনো আর নিচে নামবো না,
নামবো না,
নামবো না…… (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আর কত দূরে নিয়ে যাবে বলো? আর কত পথ
হেঁটে যেতে হবে? থামলেই যদি
ঝোপঝাড় থেকে জাঁহাবাজ পশু লাফিয়ে শরীর
টুঁটি চেপে ধরে, কী হবে আমার? নিরস্ত্র আমি,
এমনকি হাতে অস্ত্র দিলেও কাউকে কখনও
ভুলেও দেবো না আঘাত, এমন শিক্ষা পেয়েছি মা, বাবার কাছে।হঠাৎ একদা কী ক’রে যে আমি খাতার পাতায়
কোন্ ঘোরে ডুবে পঙ্ক্তির পর
পঙ্ক্তি সাজিয়ে লিখে ফেললাম একটি পদ্য
নিজের কাছেই রহস্য হয়ে রইলো সত্যি। যতদূর জানি
আমার বংশে কখনও কারুর কলমের ডগা
ভুলেও করেনি পদ্য রচনা। অবশ্য ছিল শিক্ষার আলো।কী করে যে এক গোধূলি-লগ্নে আমার সমুখে
মুখোমুখি এসে বসলো অচেনা মোহিনী নীরবে
রহস্য-জাল ছড়িয়ে আমার সত্তায়, আমি
তার ইঙ্গিতে সেই যে লেখনী হাতে নিয়ে এক
খেলায় মেতেছি, তার জের আজও
চলছে প্রায়শ বেলা-অবেলায়।গ্রামে ও শহরে লগ্ন আমার জীবন, তাই তো
পুরনো গলির ধুলো আর ধুঁয়ো বমি-করা
কারখানা আর মোটর গাড়ির আওয়াজে মুখর দিনরাত কাটে।
অবশ্য আমি কখনও সখনও আমাদের প্রিয়
পাড়াতলী গাঁয়ে, মেঘনা নদীর নিঝুম শাখায়
নৌকো-ভ্রমণে পানকৌড়ির, মাছরাঙার
রূপ দেখে সুখে কাটাই সময়। পাড়াতলীতেই
দাদা, নানা, বাবা এবং আমার ছেলে শান্তিতে চিরনিদ্রায়
সমাহিত, তাই সেই ভূমি বড়ই পবিত্র প্রিয় এ কবির কাছে।
জানি না আমার সাফল্য কিছু প্রদীপের মতো
জ্বলবে তিমিরে না কি বিফলতা বয়ে নিয়ে সদা
বেঘোরে ঘুরবো এদিক সেদিক। কোনও কিছু আজ
মোহরূপে আর পারে না আমাকে বন্দি করতে। যতদিন বেঁচে
আছি এই ধু ধু ধুলোর জগতে, ততদিন কালি
কলমের খেলা খেলে যাবো ঠিক, শেষে যা-ই হোক। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আমি কি নিজের ঘরে বসে একা পেশেন্স খেলেই
সময় কাটিয়ে দেবো? অন্য কিছু করার বাসনা
মগজে তোলে না মাথা। এমনকি কবিতার কণা
উদার প্রকৃতি থেকে আজ কুড়ানোর সাধ নেই;
নিজেকে বিরান চর মনে হয় এই সকালেই,
যেহেতু তোমার কণ্ঠস্বর, হে আমার সুলোচনা,
শুনছি না দু’শতাব্দী ধরে; তোমাকে যে দেখব না
কতকাল তা জানি না; চিন্তার হারিয়ে যাচ্ছে খেই।এখন আমাকে দেখে যে কেউ সহজে নেবে বুঝে
আমি যে ভূতলবাসী। তাজা রোদ, জ্যোৎস্না বহুকাল
আমাকে করেনি স্পর্শ; আমার চোয়ালে পাবে খুঁজে
লুণ্ঠিত বাড়ির ছায়া; সারারাত বাঘিনীর ছাল
ঝুলে থাকে আমার ওপর, চেয়ে থাকি নিষ্পলক
এক উন্মাদের দিকে, বুকে জ্বলে অসুস্থ ঝলক। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কী ক’রে যে এত দ্রুত কণ্টকিত আঁধারে
ঢুকে পড়েছি, টের পাইনি।
পথে ক’জন অন্ধ পথিক আমাকে
স্বেচ্ছায় দিব্যি কথা বলার ভঙ্গিতে
মুগ্ধ করে ফেললো, টের পাইনি। ওরা
কখন যে আমাকে ছেড়ে দিলো, বুঝিনি।আমার কাপড়ে অনেক কাঁটা জড়িয়ে গেলো
কখন, টেরই পাইনি। হঠাৎ এক
কর্কশ আওয়াজ আমাকে কামড়ে ধরছে
বারবার। এদিক-সেদিক তাকাতেই দূরের
এক গাছের ডালে অসামান্য এক পাখিকে
দেখি, যার কণ্ঠস্বর কখনও কর্কশ আর কখনও
মধুর সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে অচেনা, নির্জন
বুনো জায়গায়। আমার যাত্রা থামে না।সূর্যের তেজ ম্লান হতেই প্রশান্ত অদূরে
গাছতলায় একজন বুজুর্গকে দেখতে পাই। কী যেন
আমাকে তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। পক্ক কেশ আলেম
তাকান আমার দিকে অপরূপ
দৃষ্টি মেলে। হাতে তাঁর এক অজানা কেতাব।
ইচ্ছে হলো তাঁর পা ছুঁয়ে অবনত হই। পরক্ষণে
দৃশ্য মুছে যায়। আমি মেঘমালার দিকে তাকিয়ে
নতুন এক কবিতার প্রতিমা পেয়ে যাই। আড়াল ফোটে
আসমানে ভাসমান কার্পেট প্রবীণ যাত্রী
তাকান আমার দিকে হাসিস্নাত দৃষ্টিতে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
বহুদিন পর আজ কোকিলের ডাক শুনলাম
বন্ধুর সৌজন্যে টেলিফোনে কথা বলার সময়।
তার রিসিভার থেকে আচানক মাদকতাময়
কুহু কুহু স্বর এলো ভেসে কানে, যেন শূন্য জাম
ভরে ওঠে সাকীর সুরায়, আমি ওমর খৈয়াম
যেন, বুঁদ হয়ে যাই। শ্যামলীতে কখনো শুনিনি
কোকিলের ডাক, অন্য পাখিদের কাছে আমি ঋণী
সর্বদাই, যেহেতু এখানে ওরা আসে ছিমছাম।নিঃসঙ্গ কোকিল কী ব্যাকুল ডাকে সন্ত্রস্ত শহরে
বারবার। কাকে ডাকে? কাকে তার খুব প্রয়োজন
এ মুহূর্তে ভূতুড়ে দুপুরে? আমার ভেতরকার
একজন তারই মতো ডেকে যাচ্ছে প্রতিটি প্রহরে
অন্তরতমাকে। এ ভয়ার্ত নগরকে, বলে মন-
সুন্দর করেনি ত্যাগ, যতই বাড়ুক অন্ধকার। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি
গোলাপ নেবো।
গুলবাগিচা বিরান ব’লে, হরহামেশা
ফিরে যাবো,
তা’হবে না দিচ্ছি ব’লে।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি
গোলাপ নেবো।ফিরতে হ’লে বেলাবেলি হাঁটতে হবে
অনেকখানি।
বুক-পাঁজরের ঘেরাটোপে ফুচকি মারে
আজব পাখি।
পক্ষী তুমি সবুর করো,
শ্যাম-প্রহরে ডোবার আগে, একটু শুধু
মেওয়া খাবো।শিরায় শিরায় এখনো তো রক্ত করে
অসভ্যতা।
বাচাল কণা খিস্তি করে, হাফ গেরস্ত
প্রেমের টানে;
হঠাৎ দেখি, চক্ষু টেপে
গন্ধবণিক কালাচাঁদের, মিষ্টি মিষ্টি
হ্রস্ব পরী।বিষ ছড়ালো কালনাগিনী বুকের ভেতর
কোন সকালে।
হচ্ছি কালো ক্রমাগত, অলক্ষুণে
বেলা বাড়ে।
সর্পিণী তুই কেমনতরো?
বিষ-ঝাড়ানো রোজা ডেকে রক্ষা পাওয়া
কঠিন হলো।ছিলাম প’ড়ে কাঁটাতারেবিদ্ধ হ’য়ে
দিন-দুপুরে,
রাতদুপুরে, মানে আমি সব দুপুরে
ছিলাম প’ড়ে।
বাঁচতে গিয়ে চেটেছিলাম
রুক্ষ ধুলো; জব্দ নিজের কষ-গড়ানো
রক্তধারায়।ইতিমধ্যে এই মগজে, কয়খানা হাড়
জমা হলো?
ইতিমধ্যে এই হৃদয়ে, কয়খানা ঘর
ধ্বংস হলো?
শক্ত পাক্কা হিসাব পাওয়া।
টোক-ফর্দের পাতাগুলো কোন পাতালে
নিমজ্জিত?তাল-সুপুরি গাছের নিচে, সন্ধ্যা নদীর
উদাস তীরে,
শান-বাঁধানো পথে পথে, বাস ডিপোতে,
টার্মিনালে,
কেমন একটা গন্ধ ঘোরে।
আর পারি না, দাও ছড়িয়ে পদ্মকেশর
বাংলাদেশে।ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি
লাশ নেবো না।
নই তো আমি মুদ্দোফরাস। জীবন থেকে
সোনার মেডেল,
শিউলিফোটা সকাল নেবো।
ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার আমি
গোলাপ নেবো্।
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
একদা আমারও ছিল একটি আকাশ সীমাহীন
এবং সেখানে কত উড়ন্ত উৎসব প্রতিদিন,
অজস্র রুমাল যেন হাওয়ায় ঊর্মিল। আজ বড়
খণ্ডিত সংকীর্ণ সে আকাশ, মেঘদল কী মলিন।
আমি নিজে বহু নিচে মহিমাবঞ্চিত, জড়োসড়ো
ডানা নিয়ে ভুলুণ্ঠিত সারাক্ষণ। যদিও কখনো
সখনো কিঞ্চিৎ ডানা জোড়া পেতে চায় নীলিমার
স্পর্শ, তবু উঁচু আরো উঁচুতে সহজে আমি আরপারিনা মেলতে পাখা। বুঝি আজ মেঘাশ্রয়ী মনও
হারিয়ে ফেলেছি আর বায়ুস্তরে কাক শালিকের
নিয়ত সংস্রবে ভুলে গেছি রাজসিক পাখিদের
পরিচয়। অতীতের সৌন্দর্যের মতো কী সূদূর
ওরা ইদানীং ক্ষুব্ধ ডানায় এখনো জাগে সুর,
মাঝে-মাঝে ভ্রান্তিবিলাসে ভাবি আমিও স্বাধীন। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
দূরের একটা বাড়ি আমাকে ভূতগ্রস্ত করে ফেলেছে ইদানীং।
বাড়িটার দেয়াল দরজা জানালা অলিন্দ,
বল্লমের মতো ছাদের চূড়ো-সবকিছু
লগ্ন আমার ভাবনায় সকল সময়। বাড়ি আমাকে দীর্ণ করে
উল্টা-পাল্টা করে ফেলে আমার মগজের কোষ।বাড়িটাকে আমি অনেক দূরে থেকে দেখি প্রতিদিন,
কখনো তাকে প্রাচীন কোনো দুর্গ বলে ভ্রম হয়,
কখনো গ্রিক পুরাণের একচক্ষূ দানবের মতো লাগে ওকে,
দূর্গ হলেই যেন মানাতো বেশি, এমনি গোমড়ামুখো সে বাড়ি।সেই দুর্গ, থুড়ি, সেই বাড়ির ভেতরে যাওয়ার ছাড়পত্র
আমার নেই, যদিও এক ধরনের নিরাসক্ত আমন্ত্রণ
থাকে সর্বদাই।
ছাড়পত্র ছাড়াই আমি যাত্রা করি বাড়িটার দিকে;
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হই,
তবু পৌঁছুতে পারি না তার ত্রিসীমানায়।
কখনো পথ আমাকে ঘন অরণ্যের দিকে নিয়ে যায়,
ভয়ংকর কর্দমাক্ত খাদের কিনারে কখনো বা
তখন একদল কংকাল ভারী কাঠের শব্দের মতো
হাসতে থাকে, হাসতে থাকে বিরতিহীন।
বাড়ি, তুমি কেন আমাকে বাইরে রাখো সর্বক্ষণ?
প্রবেশাধিকার চেয়ে আমি বারংবার
টেলিফোন করি হন্তদন্ত হয়ে, ওপার থেকে
পাই না কোনো সাড়াশব্দ;
শুধু এক দঙ্গল বানরের কিচির মিচির ভেসে আসে,
আমি দিনরাত্রি ডায়াল করতেই থাকি ক্রমাগত।
কখনো অবসন্ন চেতনায় নক্ষত্রের আলো
বিকিয়ে উঠবে ভেবে প্রতীক্ষা করি, প্রতীক্ষা করি,
প্রতীক্ষা করি।
বাড়ি, আমার প্রতিটি মুহূর্তকে গোলাপকুঁড়ি বানাই
তোমার জন্যে,
বাড়ি, তোমার কথা ভবে আমার একেকটি দিন
কী দীর্ঘ রক্তাক্ত কাটে।
বাড়ি, আমি তোমার প্রতি আমার সকল স্বপ্নের মাধুর্য
অর্পণ করেছি, তুমি কেন বারংবার দুঃস্বপ্ন দাও?
বাড়ি, তুমি আমার পরমায়ু নিয়ে খেলছো সর্বক্ষণ,
আমার আয়ু ডালকুত্তার মতো খেয়ো না তুমি,
বাড়ি, হে বাড়ি?বাড়ি, তুমি হাজার হাজার নেকড়ের নখর দিয়ে তৈরী,
তোমার গা-ভরা ড্রাগনের দাঁত দেখিয়ে
আমাকে প্রতিহত করতে চাও,
আমার দরবেশ পদ্য
তোমার তল্লাট থেকে শূন্য-হাতে ফিরে আসবে বারংবার?
প্রাচীন দূর্গের মতো যে বাড়ি তার উদ্দেশ্যে পত্র লিখি প্রত্যহ,
হা নসিব, লেখা হওয়া মাত্রই
প্রত্যেকটি পত্রের সকল ব্যাকুল অক্ষর উবে যায়, রঙিন
ডাকটিকিটগুলি শীতের পাতা হয়ে ঝরে যায়
ধূলায় পাথুরে রাস্তায়।
প্রাচীন দূর্গের মতো একটা বাড়ি অনেক দূর থেকে
দেখে দেখে এখন আমি ভূতগ্রস্ত, ভয়ানক ভুতগ্রস্ত। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
যখন তোমাকে দেখি ফুলদানি সাজাতে গোলাপ
অথবা রজনীগন্ধা, ক্যামেলিয়া দিয়ে
এবং সোনালী থালা ভ’রে তোলো বেলফুল আর
স্বর্ণচাঁপা এনে,
তখন তোমাকে কী-যে ভালো লাগে আমার, সুপ্রিয়া।
এমনকী যখন ছ্যা ঢালো পেয়ালায়
কিংবা কারো সমুখে এগিয়ে দাও খাবারের প্লেট-
তাতেও শিল্পের সুষমার স্পর্শ থাকে।জানি তুমি অবসরে কখনো সখনো সূঁচ আর
সুতোয় কাপড়ে খুব মগ্নতায় ফোটাও কত যে
রঙ বেরঙের ফুল। রূপদক্ষ আঙুলের মৃদু
ছোঁয়ায় শিল্পের জন্ম হয়। কখনো-বা সহজেই
রিফু হয় শাল, শার্ট, শাড়ি, আরো কত কিছু।
যখন তোমার কোনো কথা কিংবা আচরণে
বড় বেশি ছিঁড়ে যায় আমার হৃদয়,
তাকে রিফু করবার মতো সূঁচ-সুতো
অথবা দক্ষতা
জগৎ-সংসারে নেই,
এ-সত্য আমার চেয়ে অধিক কে জানে! (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
একটি পাখী রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।
পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনো তাঁর ঠোটে হয়তো গচ্ছিত।
কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো সেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।
যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
স্ফটিক পাত্রে রুপালি পানীয়
কাঁপছে তরল জ্যোৎস্নার মতো,
অঞ্জলি ভরা ফুলের পরাগ
অঙ্গার হলো চোখ ফেরাতেই।
পিপাসায় জ্বলি এবং আমিও
চরম ক্ষতির বোঝা টেনে চলি।জ্ঞানের গরিমা উঁচু মিনারের
চূড়ো না ছুঁতেই হারিয়েছে খেই;
সকালসন্ধে দর্শন খুঁড়ে
এনেছি চকিত চতুর মুষিক।তুমি যা-ই বলো চরাচরে আজও
অলীক ঘটনা ঘটছে সদ্য।
জ্ঞানীণ্ডণীদের নাকের তলায়
অহরত কত খেল চমকায়
কে তার ভাষ্য দেবে নির্ভুল?
ত্রিলোকে তেমন মল্লিনাথের,
ঈশ্বর জানে, দেখা মেলা ভার।কালো মহাদেশ অনিশ্চিতের
নাগরদোলায় ঘুরছে সদাই
এবং অযুত তারার মুলুকে
মহাশূন্যের সেনা দেয় হানা।ভালুকের কড়া দাপটে ঈগল
ক্ষুব্ধ চিত্তে ঝাপটায় ডানা;
সমানে-সমানে কোলাকুলি তাই
বিমূঢ় সিংহ খাচ্ছে বিষম।শীর্ষ মেলাটি বুদ্বুদ যেন
এক লহমার ফুৎকারে ফাটে;
থাকবে বজায় ঠাণ্ডা লড়াই।সিংহমশাই ছয় মোড়লের
হাটে যেতে চান, কিন্তু সহসা
পথ আগলায় শক্রপক্ষ।
দিনকাল বড় বেয়াড়া এখন-
এমনকি তার শুকনো হাড়ের,
হায়রে কপাল, আশ্বাস নেই।
গাত্র বাঁচিয়ে পুণ্যবানেরা
পথ চলে বটে দৈনন্দিন,
কিন্তু তাঁদের শান্ত সকাল,
অলস দুপুর অমাবস্যার
কুটিল আঁধারে হচ্ছে বিলীন।হাবেভাবে তাঁরা এত সমাহিত,
ঈশ্বর যেন বন-ভোজনের
ঠাণ্ডা আমেজে মগ্ন এখন।নরমুণ্ডের ভয়াল নৃত্যে
চলছে যখন স্বপ্ন হনন,
দুঃস্বপ্নের ঊর্ণাজালেই
দার্শনিকের প্রবীণ কণ্ঠে
মানবতা আনে অযুত যুগের
সূর্যোদয়ের প্রেমঘন ভাষা। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
নও বিদেশিনী, বাংলাই বলো, তবু মাঝে মাঝে
বুঝি না তোমার ভাষা পুরোপুরি, ফলে বেশ ভুল
বোঝাবুঝি হয়, যেন জমে মনে, অন্তর্গত ফুল
কেমন মুষঢ়ে পড়ে এবং বসে না মন কাজে।
কখনো কখনো এরকম হয় ভোরে কিংবা সাঁঝে
কয়লার গুঁড়ো আর ধুলোবালি ছায়ায় পুতুল
হয়ে আসে, চিকচিকে মরীচিকা এবং অকূল
দরিয়া আছড়ে পড়ে, ভ্রান্তির অর্কেস্ট্রা তীব্র বাজে।প্রজাপতি আর জোনাকিরা দলে দলে আজকাল
আমার চৌদিকে গড়ে পাঁচিল, নির্বিঘ্নে থাকে, বলে-
‘যাকে ভালোবাসো, কখনো সে কথার অস্পষ্ট জাল
ছড়িয়ে প্রয়োগ করে সান্ধ্যভাষা কড়ি ও কোমলে,
আত্মহননের অন্ধ ইচ্ছেটাকে দূরে রাখবার
শিল্প জানে। ধোঁয়াশা সরাতে চাই তোমার ভাষার। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সেদিন একালবেলা আয়নার সমুখে দাঁড়াতেই
হাত থেকে টুথব্রাশ খ’সে যায় আর
হঠাৎ বেরিয়ে আসে আমার হৃদয়,
ঠাঁই নেয় জানালার গ্রিলে, যেন পাখি,
উড়ে যাবে ঘন কুয়াশায়। গোধূলির
আকাশ রঙিন কাঁথা, মেঘ সেলাইয়ের
কাজে মগ্ন একজন; আমার হৃদয়
তার বুকে ঝুলে থাকে, যেন নষ্ট চাঁদ।
হৃদয়বিহীন আমি চাঁদ খেয়ে ফেলি ফালি ফালি
ক’রে আর আমার ভক্ষক নাম রটে চরাচরে। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কখনও হাটে নেই, মাঠেও নেই, শুধু
মগ্ন থাকে একা নিজের মতো।
গহন সত্তায় যেন কে মঠবাসী
পেতেছে আস্তানা, হৃদয়ে ক্ষত।দিবস দাবানল, ক্ষুধিত আগুনের
হল্কা বয়ে যায় একলা ঘরে
ঘনিয়ে এলে রাত খরায় ছারখার
দগ্ধ আত্মায় বৃষ্টি ঝরে।মানসে ঈগলের অহংকার-মণি,
সুদূর নীলিমার অন্ত নেই।
নীলিমা ছুঁয়ে ছেনে জমিনে ফিরে আসে
জীবনপরায়ণ সন্ত সেই।করে না চেচাঁমেচি, কণ্ঠস্বর তার
পড়শী শোনে পেতে আড়ালে আড়ি;
কখনও শৃঙ্ক্ষলা উচ্চারণে বাজে,
কথারা কখনও-বা এলোপাতাড়ি।দৃষ্টি প্রত্যহ রেখে সে দূর পথে
রৌদ্রে, মেঘপুরে কাটায় বেলা;
ভ্রমণাতুর তার হৃদয় অজানায়
ভাসায় কুয়াশায় ভ্রষ্ট ভেলা।যখন অন্তরে টানাপোড়েন নেই,
তখন মরশুম শূন্যতার।
ডুবলে নৈরাশে, হঠাৎ কাঁটাবনে
দ্বান্দ্বিকতা আনে দ্যুতিবিথার। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ দেখতে চাই দু’চোখ ভ’রে
যখন তোমাকে দেখতে পাই না,
তোমার পাশে ব’সে কিছু সময় কাটানো থেকে
বঞ্চিত হই, তখন মনে হয়-
আমি যেন সেই রোগী, যাকে শ্বাসকষ্ট ভোগায়
প্রতি মুহূর্তে। তোমার মুখ অদর্শনের
অন্ধকার তীরে থাকলে
এই মতো অনুভূত হয়,
আমি এক বিয়াবান কন্টকময় পথ
পাড়ি দিচ্ছি দিগভ্রান্ত পথিকের মতো; আমাকে
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে বহু উদ্ধত ফণিমনসা।
সে-পথে বিষধর সাপের কুণ্ডলী,
হিংস্র জন্তুর আধ-খাওয়া নরদেহ এবং
দৃষ্টি-অন্ধ করা দীর্ঘস্থায়ী আঁধিঝড়।ক্যালেন্ডারের তিন শো পঁয়ষট্রি দিনের তিন শো দিনই
তোমাকে দেখতে পাই না। বাকি দিনগুলি
তোমার দেখা পাই কখনো প্রকাশ্যে, কখনো-বা সঙ্গোপনে।
সতর্ক, ক্রূর দৃষ্টির পাহারা,
নিষেধের সদা উদ্যত তর্জনী,
বাধার দুর্লঙ্ঘ্য কাঁটাতার তোমাকে
দেখতে দেয় না প্রতিদিন। এই বিরূপ সংসারের
অদৃশ্য, অমানবিক নিপীড়নে কাটে আমার দিনরাত্রি।
অনেক বছর
তুমিহীনতায় কেটে গ্যাছে। আমরা কেউ কাউকে
দেখতে পাইনি, যদিও এই একই শহরে ছিলাম দু’জন;
আরো ক’বছর আগে
কেন আমরা আমাদের হইনি? কেন?
তবুও যে শেষ পর্যন্ত মিলিত হলাম আমরা,
একেই পরম সৌভাগ্য জ্ঞান করি।
কঠোর বাধার বেড়া ডিঙিয়ে,
বলা যেতে পারে, তোমাকে দেখি প্রতিদিন,
প্রতিক্ষণ স্বপ্নে, আমার ভাবনার নন্দন-কাননে। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
তোমার ফেরার দিন আসন্ন বলেই প্রিয়তমা
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি পলাশ-মঞ্জরি হয়ে রোদ
জ্যোৎস্না মেখে নেয়। ভাবি, এ মুহূর্তে নির্জনতাবোধ,
যা বিরহ, তোমাকে দখল করে দূর রমরমা
হোটেলের লাউঞ্জে অথবা কামরায়। ঘন অমা
তোমাকে ধরে কি ঘিরে? না কি হাস্যে লাস্যে পরিবার
পরিজন নিয়ে কাটে বেলা? আমি বেদনার ভার
বয়ে চলি, করোটিতে আশঙ্কার ছায়া হয় জমা।তোমার প্রহর কাটে, অনুমান করি, স্বপ্ন ঘোরে
দোকানে, মোটরকারে কখনো বা হাঁটো রাজপথে
যাও কোনো বিখ্যাত উদ্যানে, আর তোমার শরীর
মনোমুগ্ধকর ছন্দে দুলে ওঠে সমুদ্র সৈকতে
যেখানে দুপুরবেলা দলে দলে স্নানার্থীরা ভিড়
জমায়, এখানে প্রতীক্ষায় আমার অন্তর পোড়ে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলিঃ
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?
বৃক্ষ বলে, আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।জীর্ণ দেয়ালের কানে বলিঃ
দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?
পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে,
এই ইট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে
হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।একজন বৃদ্ধের নিকটে গিয়ে বলি, নতজানু,
হে প্রাচীন দয়া ক’রে দেবেন কি একটি কবিতা?
স্তব্ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠ- যদি
আমার মুখের রেখাবলী
তুলে নিতে পারো
নিজের মুখাবয়বে, তবে
হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্যে
এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং
বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকবো কতোকাল?
বলো, কতোকাল? (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
এই যে সর্বত্র ভয়ঙ্কর কাঁটাময়
জায়গায় বহু দূর থেকে
হাঁটতে হাঁটতে একা পৌঁছে গেছি
অনিচ্ছা সত্ত্বেই-একি ভবিতব্য শুধু?এগোতে গেলেই চারদিক থেকে সব হিংস্র কাঁটা
বিঁধবে শরীরে আর বৃষ্টির ফোঁটার মতো রক্ত
ঝরবে এবং আমি রক্তহীনতায়
জনহীন ভয়ঙ্কর পথে পড়ে থাকবো নিশ্চিত।হয়তো খানিক পরে মানুষের শোণিতের ঘ্রাণে
ক্ষুধার্ত পশুর ঝাঁক এসে
জুটবে আমাকে ঘিরে। পাশব হামলা অতিশয়
দ্রুত ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে গিলে ফেলে দিব্যি তৃপ্তি পাবে।তবে কি বেগানা এই জনহীন এলাকায় আমার জীবন
অন্তিম নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে
নিভে যাবে ঝড়-ক্ষুব্ধ দিনে কিংবা রাতে?
কাঁটাবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে পৌঁছুতে হবে শান্ত আস্তানায়।যাক ছিঁড়ে যাক ক্লান্ত শরীর আমার, তবু যেতে
হবে সেই এলাকায় যেখানে পূর্ণিমা-চাঁদ চুমো
খাবে আসমান, নদী, মাটি আর মানুষকে। চৌদিক কেমন
নিমেষে বদলে ফেলে রূপ। গীতসুধা পান করে নানা প্রাণী। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
আমি কি প্রত্যহ ভীতসন্ত্রস্ত মানুষে হয়ে কাটাবো সময়?
আমাকে মোড়ল আর তার
স্যাঙাত এবং তল্পিবাহকেরা
দেখাবে রক্তিম চোখ যখন তখন
আর আমি মাথা হেঁট করে
দূরে চলে যাবো আর গৃহকোণে লুকাবো নিজেকে।
তাহলে আমি কি এভাবেই
কাটাবো এখানে দিনরাত?
বালিশে লুকিয়ে মুখ নিজেকে ধিক্কার
দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে
ছিঁড়বো মাথার চুল? অমাবস্যা-রাতে
হবো আত্মাঘাতী?কী আমার দান এ সমাজে?
আমি কি পেরেছি বদলাতে সমাজের
চেহারা নিজের সাধ অনুসারে? পেরেছি কি
ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিতে কুসংস্কার?পারিনি এখনও আমি আমার কাছের
মানে অন্তরঙ্গ জনদের ভাবনা-চিন্তাকে ঠিক
আমার ধারায় এনে সমাজের চেহারায় আলোর ঝলক
সৃষ্টি করে নিজেরা ক্রমশ ধন্য হতে।আসন্ন সন্ধ্যায় অন্ধকারে ছিঁড়ে আমরা কি
পারবো না পূর্ণিমার চাঁদ এনে আমাদের সব
অকল্যাণ মুছে ফেলে আগামীকে কল্যাণের আলোয় প্রদীপ্ত
করে এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে ধন্য হতে?
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যেসব কবিতা আমি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলি,
মেলার মাটির পাখি হয়ে ওরা শূন্যে ঝুলে থাকে,
শ্রাবণ ধারায় গলে যায়, পুনরায় যেন ডাকে
মাটির ভেতর থেকে বীজ-স্বরে। বকুল, চামেলি
কিংবা মল্লিকার মাংসে পুর্নজন্ম নিতে চায়, গূঢ় চেলি
হ’য়ে সূর্যাস্তের দিকে উড়ে যাবে ভেবে শূন্যতাকে
তুষ্ট করবার ব্যর্থতায় অন্ধকারে মুখ ঢাকে।
টেবিলে সাগর দস্যু আর জলকন্যাদের কেলি।আহত কবিতাবলী ছিন্ন ভিন্ন আঙুলের মতো
তাহলে বিদায় বলে অন্তর্হিত প্রেতের বাসায়।
রক্তাক্ত পালক ওড়ে ইতস্তত উত্তরে দক্ষিণে,
পুবেও পশ্চিমে ঝরে বালির সারস অবিরত।
একটি ক্ষুর্ধাত কুকুরকে ঘোর বৃষ্টিময় দিনে
ছেঁড়া স্বপ্ন ছুঁড়ে দিই কবিতার জন্মের আশায়। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
দীর্ঘ পথ হেঁটেছে সে, তবু তার ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই
এতটুকু। আরও কিছু পথ বাকি আছে ভেবে তার সত্তা
সরোদের মতো বেজে ওঠে। পথ চলতে কতবার পুরু সবুজ।
ঘাসে গড়াগড়ি খেয়েছে, দেখেছে ঝোপের কান ঘেঁষে
খরগোশের দৌড়, কাঠবিড়ালির ত্রস্ত তাকানো, বাদাম মুখে
নিয়ে গাছের কোটরে লুকানো। কতবার সে গোধূলিতে নদীতীরে
দাঁড়িয়েছি, কতদিন ছুটেছে এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতির
পেছনে, কত রাত ফুলের সুগন্ধ আর গোল চাঁদ তাকে জাগিয়ে
রেখেছে। কবেকার জাহাজডুবি, নাবিকদের হাহাকার আর
মধ্যসমুদ্রে চকিতে ভেসে-ওঠা মৎস্যকন্যাদের গানের কথা ভেবে স্বপ্নে
সে ডুবে গেছে। অনেকটা পথ হেঁটেছে সে, আরও কিছু পথ আছে
বাকি, এ-কথা ভাবলেই মনের ভেতর তার করতালি।এই দীর্ঘ পথ হাঁটতে গিয়ে সে গল্প জুড়ে দিয়েছে কাছের হরেক
রকম গাছগাছালি আর দূরের আকাশের তারাদের সঙ্গে, ঘনিষ্ঠ
বসে গেছে দোয়েল, কোকিল, বুলবুলি, ঘুঘু আর ডাহুকের মেলায়।
পথ চলতে ওর সখ্য হয়েছে কত মানুষের সঙ্গে, তারা অনেকে সাধারণ,
কেউ কেউ অসাধারণ। এবং এই চলার পথেই সে অন্ধকারে আতশবাজির
মতো জ্বলে উঠে হাত রেখেছে গৌরীর হাতে, ওর কালো চোখের অতল
নির্জনে ডুবে মনে হয়েছে মনে এই মানবীকে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের হাজার
বছর আগে থেকে ভালোবেসেছে। গৌরীর কথা কখনও আলিঙ্গন, কখনও
চুম্বন হয়ে স্পর্শ করে তাকে। অনেকটা পথ হাঁটার পর সামনের দিকে
দৃষ্টি ছড়িয়ে ওর মনে হয়, এ পথের শেষ কোথায়, কখন-জানা নেই।
সে জানে, তার এতটুকু ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই একরক্তি। সে চায়, পথ
যেন ফুরিয়ে না যায় চলার পথে যেন থাকে চঞ্চল প্রজাপতির দল,
গাছের পাতার মৃদু কম্পন, দোয়েলের শিস, মৎস্যকন্যার ঝলসানি, গৌরীর
বাড়িয়ে-দেওয়া সোনালি হাত। পথ চলাতেই যে তার ছন্দোময়
শিহরণ। আচমকা ছন্দপতন তার কাম্য নয় কিছুতেই। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
আমার মাথার ক্ষত দ্যাখে লোকে ফুলের মতন
উন্মীলিত প্রতিদিন, আমি বিশ শতকের যিশু।
আমার চৌদিকে দেখি ক্রুশকাঠ নিয়ে যাচ্ছে বয়ে
মুখ বুজে কয়েকটি শীর্ণ শব, তারাই আবার
জ্বলজ্বলে রাত্রির দোকানে এসে কয় খিলি পান
কিনে দলছাড়া হয় অথবা প্রচণ্ড ক্ষোভে মেতে
নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ে তোলে তারার কবর
দেখতে চায় না চাঁদ ভেসে যাক অবারিত নীলে।আমার মাথাটা যেন বহ্নিমান একটি শহর
যেখানে মানুষ, যান, বিজ্ঞাপন, রেডিওর গান,
ভিখিরির চ্যাঁচামেচি, বেশ্যার বেহায়া অনুরাগ,
কানাঘুষো, নামহীন মৃত শিশু আবর্তিত শুধু।আমাকে শাসায় ভাগ্য সারাক্ষণ, বাগে পেয়ে যদি
টিট করে দেয় ঈর্ষাতুর দেবদূত দুঃস্বপ্নের
মুখোশ দেখিয়ে তবে কী মজা লুটবে অন্ধকারে
আমার দুর্দশা দেখে নোনাধরা চারটি দেয়াল!ক্লান্ত হয়ে স্বপ্ন দেখি পেরিয়ে হুলুদ মরুভূমি
একটি বিকট সিংহ আত্মাটাকে নেড়ে-চেড়ে শেষে
ছুড়ে ফেলে দিয়ে জীর্ণ জঞ্জালে নিঃশব্দে চলে গেছে।
হয়তো রোচেনি মুখে, কিংবা যেটা যোগ্য কুকুরের
কী করে বসাবে ভাগ তাতে অরণ্যের অধীশ্বর?
নিজের ছায়াকে দেখি হেঁটে যায় দূরে, আমি তার
অনুগামী। কয়েকটি প্রবঞ্চক স্বর গান হয়ে
মিশে যায় কঙ্কালের মতন বৃক্ষের অন্তরালেতিনটি ডাইনী বুড়ি দূরের আকাশ থেকে সাদা
চাঁদটাকে উপড়ে এনে, গুঁড়ো করে পাচনের সাথে
মিশিয়ে বিকৃত শব্দে টেনে নিয়ে তৃষিত জঠরে
বলে তারা কেন বৃথা করো তুমি নিজেরই মৃগায়?
মাথার ক্ষতের ঘ্রাণে জেগে দেখি ঘরের দেয়ালে
অলীক ফুলের নকশা, চতুর্দিকে যৌবনের রঙ
নিয়েছে জড়তা শুষে। শরীর চিৎকারে দীর্ণ হয়
আমি কি এখনও যুবা আলোকিত আয়ুর ভূগোলে? (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
যখন রোদে ভোরের চুমোয় জেগে উঠি
আশেপাশের সব কিছুকেই কেমন যেন
অচিন দেশের দৃশ্য ভেবে
নিজেকে খুব খাপছাড়া আর একলা লাগে।এলোমেলো কত কিছুই ভাবতে থাকি
এই আমি কি সত্যি কোনও বিশেষ ব্যক্তি নাকি ঘরের
আসবাবেরই অংশ কিছু? না কি বনের
প্রাণীর মতোই জীবিত এক পশু কিংবা পাখি?ভোরের আলো একটু তেজী হলে পরেই
আমার ভেতর ক্রমান্বয়ে
ভাবনা যেন বদলে যেতে থাকে এবং বুঝতে পারি-
সত্যি আমি আদমেরই বংশ থেকে জন্মেছি ঠিক।তবে কেন সাতসকালে এমনতরো
ভাবনা এসে দখল করে আমার মতো শাদাসিধে
মানুষটিকে? দুনিয়া খুবই হিংস্র হয়ে উঠেছে আজ;
তবু নানা পাড়ায় কিছু মধুর সুরে কোকিল ডাকে।হায়রে আমি মন্দভাগ্য নিয়ে কাটাই
বৃক্ষহারা গলির কোণে! এই গলিতে গায়ক পাখি
কিংবা কোকিল কোনও কালেই ঝরায় না সুর,
মাঝে মাঝে ফিল্মি গানের ধাক্কা লাগে কানে জোরে! (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যে এলো তোমার কাছে অবশেষে উড়িয়ে আঁচল
বিরূপ হাওয়ায় তার সৌন্দর্য তুলনাহীন; তাকে
দেখে তুমি দূরবর্তী সন্ধ্যায় হঠাৎ অচেনাকে
বড় বেশী চেনা বলে অন্তরালে কেমন চঞ্চল
হ’য়ে উঠেছিলে, তার সুগভীর চোখের কাজল,
মনে হলো, যুগ-যুগান্তের স্মৃতি নিয়ে কাকে ডাকে
স্বপ্নের সংকেতে, তুমি ভেবেছিলে হয়তো তোমাকে
নিয়ে যাবে খৃষ্টপূর্ব কালে, শুষে নেবে অমঙ্গল।এখন সে স্মিত হেসে দাঁড়ায় তোমার পাশে, ঠোঁটে
হৃদয় পুষ্পিত হয় ক্ষণে ক্ষণে, ঝরে যায় কত যে শতক
সুপ্রাচীন থরথর চুম্বনে চুম্বনে ভালোবাসা
মিসরীয় সম্রাজ্ঞীর চোখের মতন জ্বলে ওঠে-
মাঝে মাঝে স্বপ্নে দ্যাখো যমজ সোনালি ঘোড়া চক
চক করে জ্যোৎস্নারাতে, বুকে জাগে শোণিতের ভাষা। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
ডাহুক তার গলার ভেতর রাত্রিকে খানিক খেলিয়ে, খানিক
বাজাতে বাজাতে নিজের ভেতর স্থির হয়। ডাহুক গহনতায়
ডুব দিতে থাকে ক্রমাগত; ডাহুকের পালকগুলো রাত্রি
হয়ে ওঠে। রাত্রিময়তা রাত্রিকে স্পর্শ করে ডাহুককণ্ঠে।
ডাহুক আমাকে দেয় রাত্রি, যেমন সাকী ভরে তোলে সুরাপায়ীর পাত্র।
রাত্রি এমন এক প্রহরে প্রবেশ করে, যখন রাত্রি, ডাহুক আর এই আমার
মধ্যে কোনও ভেদচিহ্ন থাকে না। ডাহুক ফোঁটা ফোঁটা আঙুরের রস হয়ে
ঝরে, হয়ে যায় বিন্দু বিন্দু সুর।ডাহুকের সুর আমাকে বহুদূর নিয়ে যায় ভিন্ন এক দৃশ্যের ভিতরে।
কে সেখানে দাঁড়িয়ে? তিন মাথা-অলা ভয়ঙ্কর এক প্রাণী দাঁড়ানো
আমার সামনে। গায়ক পাখিদের চিরশক্র এই প্রাণীর চারপাশে
ছড়ানো অনেক রক্তাক্ত পালক, বহু পাখির ছিন্ন মুণ্ডু, অর্ধভুক্ত যকৃৎ,
প্লীহা। আর কী অবাক কাণ্ড, সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীর আমিষাশী
দন্ত-নখরের নাছোড় হিংস্রতাকে ফাঁকি দিয়ে এক দ্যুতিময়
পাখির কী তন্ময় উড়াল, সপ্ত সিন্ধু দিগন্তে অন্তহীন
প্রকৃতি-মাতানো কী গান! (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
সর্বদাই ছিল পণ, যাই বলুক, সর্বক্ষণ
হাঁটবো সামনের দিকে, চলে যাবো সুউচ্চ চূড়ায়
আখেরে একদিন সূর্যাস্তের রঙ মেখে রুক্ষ গায়।
কস্মিনকালেও তাকাবো না ফিরে, মনের মতোন
পথ না-ই থাক, তবু হেঁটে যাবো, যখন তখন
একটি কি দু’টি ফল ছিঁড়ে নেবো ঝরণাতলায়
অঞ্জলি উঠবে ভরে জলে, শুনেছি রূপকথায়-
তাকালে পিছনপানে মানুষের দীপ্র দেহমনশিলীভূত হয়, কোথায় যে জন্মস্থান, কোন বাঁকে
নতুন জাহাজ ভিড়েছিল, কার ওষ্ঠে চুমু, খেয়ে
যাত্রারম্ভ-মুছে যায় সবকিছু। তাকাবো না ফিরে,
করেছি শপথ, তবু সিঁড়ি, অনেক মুখের ভিড়ে
স্বতন্ত্র একটি মুখ, দোচালা, বনানী গান গেয়ে
ওঠে; হায়, প্রত্যেকেরই মর্মঘাতী পিছুটান থাকে। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
এই ভরদুপুরে যখন আমার বুক
বিরান পথের মতো খাঁ খাঁ, যখন আমার ধূসর
দৃষ্টিময় চোখ ফেটে জল ঝরতে চাইছে, যখন
তোমার বিচ্ছেদে আমি কাতর, নতুন করে মনে হলো
তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল
অনেক অনেক বছর আগেই,
যেমন কৃষকের প্রয়োজন ফসলের ঢেউ খেলানো
ক্ষেতের, যেমন কবির প্রয়োজন দ্যুতিপ্রতিম
প্রেরণার, যেমন বিপ্লবীর প্রয়োজন
আলো বিকিরণকারী আদর্শের, যেমন পিপাসার্ত
পথিকের শীতল জল, যেমন অন্ধের
জ্যোতির ঝলক, যেমন মিছিলের
অগ্রযাত্রার জন্যে প্রয়োজন হিল্লোলিত নিশানের।তুমি আমার হৃদয়ের কদমতলায়
পা রাখার অনেক আগে
ঘুরেছি এখানে সেখানে, হেসেছি খেলেছি
অনেক রঙিন পুতুলের সঙ্গে, অথচ আমার অজান্তে
আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম অবচেতনের
কানন –পথে। সেই সব পতুলের
কারো কারো রঙ চটে গ্যাছে
সহজেই, কেউ কেউ ভেঙে লুটিয়ে পড়েছে ধুলোয়,
কারো কারো মন বসেনি খেলায়,
ফলত হয়েছে উধাও আমার চোখে ধুলো ছড়িয়ে।বুঝতেই পারছ,
তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল অনেক অনেক বছর
আগেই; যা হবার নয় তা নিয়ে
অরণ্যে রোদন অবান্তর জানি, তবুও
আক্ষেপের তীর বিদ্ধ হয় মর্মমূলে।
অসীম আকাশের দিকে
তাকিয়ে ভেবে ভেবে সারা হই-
যদি তুমি কয়েক বছর আগে কিংবা
আমি কয়েক বছর পরে
জন্ম নিতাম, তাহলে কী এমন ক্ষতি হতো কার?তুমি এসেই কেমন বদলে দিয়েছ আমার জীবন;
এখন আমি বয়সের ধুলি ঝেড়ে ফেলে
তারুণ্যের তরঙ্গিত নদীতে নেমেছি,
এখন আমি গোরস্তানের কথা ভুলে গোলাপ বাগানের
কথা ভাবি। আমাদের দু’জনের ভালোবাসা
নীল পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগে
নিমজ্জিত ছিলাম হতাশার ঘোর অমাবস্যায়,
এখন আশাবাদ
আমার চৈতন্য-প্রবাহে ঝলসাচ্ছে, যেমন
ফসলের মরশুমে চাষীর কাস্তে থেকে
ঠিকরে-পড়া রোদ। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
এমন নিঃশব্দে কে দাঁড়ায় দরজায়
ভোরবেলা স্মিত দশটায়
গজলের মদির আঙ্গিকে? বলপেন
খাতার পাতায় সমর্পিত; বলি, ‘এখুনি এলেন?’
নিরুত্তর; বুঝতে হয় না কষ্ট, খাতা থেকে উঠে
এখানে ব্যাকের পাশে রয়েছে সে স্বতঃষ্ফুর্ত ফুটে।এই জ্ঞান হৃদয়ে ঝরায় অশ্রুকণা, এরকম
পুনর্জন্ম ক্ষণিকের, তুব কল্পনার সেবাশ্রম
আঁকড়ে থাকতে চাই। তার এই আসা-যাওয়া থাকবে অটুট,
যতদিন মুঠোয় আমার লগ্ন চাদরের খুঁটি
হায়াতের; ধু ধু ফাঁকা পথ,
গাছের নোয়ানো ডালে দোয়েল, নৈরাশ্য যযুগপৎ।মনোনীতা অস্তরালে, ডেকেই চলেছি এতকাল,
ডেকে-ডেকে আমার দু’চোখে আজ শিমুলের লাল। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
কুয়োর শীতল জল আঁজলায় নিয়ে সন্ধেবেলা
চেয়ে থাকি কিছুক্ষণ; জলে কার মুখ ভেসে ওঠে।
পাখির চিৎকার শুনি, ভাঙে শীতল জলের খেলা
অকস্মাৎ, অদূরে কোথাও শরমিলা ফুল ফোটে।২
তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কোনো কুয়োতলায়
কিংবা কোনো বাঁশের ঝাড়ে।
তোমাকে আমি দেখেছিলাম এই শহরে কিছু দূরে
স্বল্প ভিড়ে হ্রদের ধারে।
বসেছিলাম পাশাপাশি, হাওয়ায় ছিলো মাদকতা,
ছিলো কিছু জলজ ঘ্রাণ;
চোখের চাওয়ায়, কথা বলার ঈষৎ মায়ায়
দুলেছিলো দু’টি প্রাণ।৩
তোমার দাঁড়ানো বারান্দায়,
পশামি চপ্পল পায়ে হেঁটে বেড়ানো চাঁদের নিচে, একা
ব’সে থাকা ঘাসে,
অথবা তাকানো সন্ধেবেলা আকাশের
উড়ে-যাওয়া পাখিদের দিকে,
জঙ্গলে সফল পিকনিক, কানায় কানায় ভরা
অবকাশে খাটে শুয়ে নিভৃতে তোমার
নিমগ্ন কবিতা পাঠ, দূরন্ত হাওয়ায়
ফিরোজা শাড়ির আঁচলের নৌকার উদ্দাম পাল
হয়ে যাওয়া-এইসব দেখে যদি
কেটে যেত সারাটি জীবন।৪
কী ক’রে এখন শান্ত থাকবো বলো
যখন তোমার চোখ দু’টি ছলো ছলো?
আমার হৃদয় ঝড়ের রাতের পথ,
নিঃশ্বাস নেয় রুগ্ন পক্ষীবৎ।
বিষাদ তোমার রূপের পড়শি ব’লে
মনে হয় যেন পড়েছি অগাধ জলে। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এখন আমার আশে-পাশে কেউ নেই। ঘর অন্ধকার নয়, একটা
বাতি জ্বলছে। অনুগ্র আলো যেন জাল; আমি স্বেচ্ছা-
বন্দি হয়ে আছি সেই জালে। কেউ নেই আমার পাশে, মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে নেই কাউ। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না এই
মুহূর্তে। মুহূর্তেগুলো থেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরছে
আমার ওপর। সময় বয়ে চলেছে একটানা, আমার আয়ুর পুঁজি
ক্ষইয়ে দিয়ে। এখন কোনো বইয়ের পাতায় চোখ বুলোতে
পর্যন্ত ইচ্ছে করছে না, অথচ বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ
অত্যন্ত তীব্র। প্রহরে-প্রহরে বই থেকে আমি শোষণ করে নিই
আনন্দ, সমৃদ্ধ হয়ে উঠি দিনের পর দিন।
এখন আমার আশে-পাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না এখন যদি
খাতা খুলে লিখতে শুরু করি, কেউ ঢুকে পড়বে না আমার
ঘরে, কিংবা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখবে না কি আমি
লিখছি। কোনো উঁকি ঝুঁকি মারবে না কেউ। চারপাশে এখন
নিভাঁজ নিঃসঙ্গতা। আমার একাকীত্ব জলচর প্রাণীর মতো
আলো পোহাচ্ছে। একটু আগে আমার বিচ্ছেদ ঘটেছে
স্বপ্নের সঙ্গে, হয়তো এজন্যেই একটা শূন্যতাবোধ
আপাতত দখল করে নিয়েছে আমাকে। স্বপ্ন ভেঙে গেলে
খুব একলা লাগে। কী স্বপ্ন দেখছিলাম আমি? ঘুম
যখন শরীরকে ত্যাগ করে যায়, তখন কোনো কোনো স্বপ্নের
কথা খুব স্পষ্ট মনে থাকে, যেন চোখ বন্ধ করলেই সেই
স্বপ্ন আবার দেখতে পাবো। এমন কিছু স্বপ্ন দেখি যা
স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে যায় অন্তহীন অস্পষ্টতায়।
আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। যারা স্বপ্নকে অর্থহীন
বলে উড়িয়ে দেয়, আমি তাদের কেউ নই। আমি স্বপ্নকে
অর্থময় মনে করি। স্বপ্ন বিশ্লেষণে অপটু বলেই সকল
স্বপ্ন আমাদের কাছে অর্থহীন। কী স্বপ্ন দেখছিলাম
আমি? সব কিছু মনে নেই, আবছা হয়ে গেছে অনেক
কিছুই। বহু পথ হেঁটে আমি প্রবেশ করেছি একটা
পুরনো নিঝুম বাড়িতে। ঠিক প্রবেশ করেছি, বলা
যাবে না, বাড়িটার বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ছি, অনেকক্ষণ
থেকে; কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ আসছে না।
তবে কি কোনো বাসিন্দা নেই এই নিঝুম বাড়িতে?
দরজা খুললো না দেখে সেখান থেকে অন্য দিকে রওয়ানা
হলাম। তারপর নিজেকে দেখতে পেলাম জনশূন্য,
ধুধু প্রান্তরে। জমি ফেটে চৌচির। কোথাও এক ডগা ঘাস
নেই, এক ফোঁটা পানি নেই। শুধু ঝিঁঝি পোকার
ডাকের মতো একটা শব্দ উঠে আসছে মাটি থেকে। হঠাৎ
যেন মাটি ফুঁড়ে বেরুলো একটা কালো মানুষ। মানুষ
না বলে কংকাল বলাই ভালো। লোকটা মাটির ওপর
বসে পড়লো এবং কোত্থেকে যেন একটা শিশু এসে বসলো ওর
কোল জুড়ে। হাড়-জিরজিরে শিশুটির দু’চোখে জীবনের
দ্রুত পলায়নের দৃশ্য। সেই লোকটা আর শিশুটিকে
দেখে মনে হলো যেন মৃত্যু শুয়ে আছে মৃত্যুর কোলে।
আর কী কী দেখেছিলাম। মনে পড়ছে না।
কিছুতেই মনে পড়ছে না।
স্বপ্নটির কী অর্থ দাঁড়ায় আমি জানি না। স্বপ্ন বিশ্লেষণের
ক্ষমতা থেকে আমি বঞ্চিত। এই স্বপ্ন কেন দেখলাম?
অনেকদিন থেকে একটা বাড়ি খুঁজছি বলেই কি সেই
পুরনো, নিঝুম বাড়িটা দেখা দিলো আমার স্বপ্নে, যে বাড়ি
আমি আগে কখনও দেখিনি? সংবাদপত্রে দেখা
ইথিওপিয়ার অনাহারী মানুষের ফটোগ্রাফই আবার আমার
স্বপ্নে হানা দিলো নতুন করে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার
জানা নেই। জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারব না। এই
স্বপ্নের অন্তরালে অন্য কোনো গূঢ়ার্থ কি নিহিত?
এই স্বপ্ন আমাকে একলা করে দিয়েছে। এখন আমার আশে-
পাশে কেউ নেই। স্বপ্ন দেখতে আমার ভালো লাগে।
ঘুমের মরুভূমিতে স্বপ্ন তো মরূদ্যান। হারিয়ে-যাওয়া কিছু
চিত্রের খোঁজে স্বপ্ন দ্যাখে আমার কণ্ঠনালী, নাভিমূল,
বাহু, নখ, মাথার চুল। কখনও-কখনও স্বপ্ন আর বাস্তবের
মধ্যে আমি কোনো ভেদচিহ্ন খুঁজে পাই না। কুলুঙ্গিতে
তুলে রাখা কবেকার সবুজাভ দোয়াত ফেরেশতা হয়ে
আমার সঙ্গে কথা বলে যখন, তখন বুঝতে পারি না আমি স্বপ্নের
আচ্ছন্নতায় মজে আছি নাকি বাস্তবের চবুতরায় দাঁড়িয়ে
কবুতর ওড়াচ্ছি একের পর এক।
এখন আমার মাথার ভেতর সুকণ্ঠ কোনো পাখির মতো গান
গাইছে এই শহর। লোকগীতির এই শহর, ডিসকো
নাচের শহর, দোয়া-দরুদ আর মোনাজাতের শহর, ভিখারির শহর,
বেশ্যা দালালের শহর, রাশি-রাশি মিথ্যা বাগানের
শহর, ক্রুশবিদ্ধ সত্যের শহর, বিক্ষোভ মিছিলের শহর,
স্লোগান-ঝংকৃত শহর, কবির মৌচাকের মতো শহর,
শেষ রাত্রির বাইজীর মতো এই শহর। এই মুহূর্তে আমি
যা স্পর্শ করবো তা উন্মোচিত হবে নতুন তাৎপর্য নিয়ে।
গাছের বাকল হবে তরুণীর ত্বক, পথের ধূলো রূপান্তরিত
হবে রাজা সোলেমানের খনির মর্ণিরতা, ভিখারিণীর
কানি হবে সালোমের লাস্যময়ী পট্রবস্ত্র। এখন আমি নিজেকে
স্বর্শ করলে আমার ভেতর থেকে শত-শত ময়ূর
বেরিয়ে এসে পেখম ছড়িয়ে দেবে উঠোন জুড়ে। যদি এখন
আমি খাতার শাদা পাতা স্পর্শ করি, তাহলে সেখানে
বইবে অলকানন্দা, গড়ে উঠবে আর্ডেনের বন, লতাগুল্মে
ঝলসে উঠবে হোমারের স্বপ্নময় হাত। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
মানুষের অবয়ব থেকে, নিসর্গের চোখ থেকে
এমন কি শাক সব্জি, আসবাব ইত্যাদি থেকেও
স্মৃতি ঝরে অবিরল। রাজপথ এবং পলাশ
যখন চমকে উঠেছিল পদধ্বনি, বন্দুকের
শব্দে ঘন ঘন, স্মৃতি নিজস্ব বুননে অন্তরালে
করেছে রচনা কিছু গল্প-গাথা, সত্যের চেয়েও
বেশি দীপ্র। কান্তিমান মোরগের মতো মাথা তুলে
কখনো একটি দিন দেয় ডাক, পরিপার্শ্ব দোলে,
মানুষ তাকায় চতুর্দিকে, কেউ কৌতূহলে, কেউগভীর তাগিদে কোনো, যেন কিছু করবার আছে,
সত্তায় চাঞ্চল্য আসে। করতলে স্বপ্নের নিভৃতে
মনে পড়ে, দিকচিহ্ন, গেরস্থালি, নক্ষত্র দুলিয়ে
অভিমানী বাংলাভাষা সে কবে বিদ্রোহ করেছিল। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
“নারে খোকা আজ তুই যাসনে বাইরে, দ্যাখ চেয়ে
বাইরে ভীষণ ঝড়। অন্ধকার রাত্তিরে যেসব
ভয়াল দৈত্যের কথা বলি তোকে লালকমলের
সেই গল্পে তারা আজ দলে দলে শক্ত মাটি ফুঁড়ে
এখানে এসেছে তেড়ে-ঘরবাড়ি, টেলিগ্রাফ তার
যা পাবে সম্মুখে তারা তছনছ করবে নিশ্চয়।“বাইরে এখন বড়ো অন্ধকার, ডাইনীর চুল
ওড়ে চতুর্দিকে আর হাজার হাজার হিংস্র মোষ
ফেনায়িত মুখে ছোটে দিগ্বিদিক, খুরের আঘাতে
আকাশ ভাঙলো বুঝি-দাঁড়া, দরজাটা ভেজিয়ে দি’,
আয় ওরে বুকে আয়, বাইরে ভীষণ অন্ধকার;
না তুই যাসনে আজ যাসনে বাইরে, কথা রাখ”-
এ বলে মায়ের বুক নিত টেনে তার সে খোকাকে
কবেকার ঝোড়ো দিনে, আমি ভয়ে লুকাতাম মুখ।অথচ এখন আমি ভয়ানক দুর্যোগে একাকী
বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ঝোড়ো হাওয়া তাঁবুর বনাত
কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে আজ হিংসার ফুৎকারে।
ছিঁড়ে-খুড়ে খাবে বলে দৈত্য-দানো চক্রান্তের টানে
আসে তেড়ে পৌরপথে। সম্মিলিত নেকড়ে হায়েনা
রক্তমাখা কাপড়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে চক্রাকারে
ঘোরে, আমি নিরুপায়। ইতিমধ্যে আমার শরীর
ছিন্নভিন্ন গণ্ডারের বৈরিতায়। সময় উজিয়ে
আসেনাকো কানে আর উৎকণ্ঠিত সেই কণ্ঠস্বরঃ
“নারে খোকা আজ তুই যাসনে বাইরে, কথা রাখ”
-মায়ের চকিত কণ্ঠ লিপ্ত এ-কালের কলরোলে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
কোথায় শিউলিতলা, সেই কবেকার ভোরবেলা-
যখন কুড়িয়ে ফুল, পেরিয়ে শিশিরভেজা পথ
বসতে পুকুর ঘাটে, দৃষ্টি মেলে দিতে তুমি দূর
বহুদূর বনানীর দিকে অথবা সাঁতার কেটে
কাটতো তোমার বেলা কারো কথা ভেবে নিরালায়?
কোথায় সে তন্বী যার বুকে গোলাপের অব্যর্থ উন্মেষ?
কোথায় সে প্রতিবাদী তরুণ যে ছিলো সর্বক্ষণ
তোমার হৃদয় জুড়ে অনিন্দ্য স্বপ্নিল অশ্বারোহী?যেও না অতীতে ফিরে, এখন ফেলো না দীর্ঘশ্বাস
অতিশয় কালদগ্ধ শিউলিতলার কথা ভেবে।
এখন তোমার কানে একজন প্রৌঢ়ের আড়ালে
যে যুবা আবৃত্তি করে হৃদয়ের নতুন সংহিতা,
ফিরিয়ে দিও না তাকে, কেননা সে শিলীভূত বুকে
সহজে জাগাতে পারে পাথরগলানো প্রস্রবণ। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
অন্তত তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবো আজ, এমন
প্রত্যাশার দোয়েল শিস দিয়েছিল বারবার ভাবনার উঠোনে।
এইমাত্র ঘড়িতে রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের
সঙ্কেত; পাশের শিশুপল্লী ঘুমোচ্ছে, গলি নিঝুম,
রাত্রি কালো কফিনের ভিতর শুয়ে আছে, কুয়াশা
নামছে তার চোখে। দূরের নক্ষত্রেরা তাকিয়ে রয়েছে
কফিনের দিকে, অথচ তোমার টেলিফোন সরোদের তানের
ধরনে বেজে ওঠে নি। তুমি কি আসো নি এখনো?আমি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো দুর্ভিক্ষকবলিত
বিশুষ্ক, করুণ মানুষের মতো ত্রাণসামগ্রীর আশায়?
আমার ওপর ছুটে যাচ্ছে নাদির শাহের কেশর দোলানো
অশ্বপাল, তৈমুরের নাঙা তলোয়ার আমাকে ক্রমাগত
রক্তাক্ত করছে এবং মেরুপ্রদেশের ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল
আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আমি আর কত সইব এই স্বৈরাচার? (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
কে এক খননপ্রিয় লোক চলেছে নিয়ত খুঁড়ে
অগোচরে, খননের নিঝুম আওয়াজ
কানে আসে; যদি যাও তার কাছে দেখে নিতে কাজ
তার, দেখবে বসে আছে কর্মহীন, যেন কোনো কুঁড়ে
সমাসীন নিরালায়। সরে এলে তুমি
পুনরায়, বিনীত সে শব্দ উঠেবে বেজে
তোমাকে চমকে দিতে। অবারিত মাঠ, তৃণভূমি
শস্যের সম্ভাবনায় সেজে
ওঠে বুঝি সুবর্ণ রেখায়; বহুকাল থেকে সেই
অক্লান্ত খননপ্রিয় লোক
প্ররোচনাহীন আমাকেই
করেছে দখল ঠিক আমার অজ্ঞাতে। খননের তীব্র ঝোঁক
আমার ভেতরকার কাঁচা মাটি থেকে
তুলে আনে অক্ষরের নানা মূর্তি। চাদ্দিক আভায় যায়
ঢেলে।(হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
ভক্তিমূলক
|
যখন পাঞ্জাবি আর পাজামা চাপিয়ে
শরীরে সকালে কিংবা বিকেলে একলা হেঁটে যান
প্রায় প্রতিদিন দীর্ঘকায় সবুজ গাছের
তলা দিয়ে তাঁকে বাস্তবিক সাধারণ মনে হয়।যখন বাজারে গিয়ে মাছ, তরকারি
কিংবা মাংস কেনার তাগিদে
কসাই-এর সঙ্গে দামদর করেন কি ঠিকমতো?
তখন কিছুতে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে
কিছু ছাত্র-পড়ানো শিক্ষক ছাড়া অন্য কিছু ভাবা
মুশকিল। মাছের হিসাব ছেড়ে বিক্রেতার সংসারের খোঁজ নেন।বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ক্লাসে
সেই অধ্যাপক ধীরে প্রবেশ করলে
ক্লাস মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত বক্তৃতা তাঁর সারাক্ষণ-
ছাত্রছাত্রী সবাই সাজাত মনে শ্রদ্ধার মঞ্জরি।আত্মভোলা নন তিনি, নন অচেতন সমাজের
কল্যাণ কি অকল্যাণ বিষয়ে কখনও যতদূর
জানি দৃষ্টি তাঁর সদা মানবের প্রগতির দিকে
প্রসারিত। কী প্রবীণ, কী নবীন সকলের বরেণ্য নিয়ত।এখনও সিদ্ধির পরে, খ্যাতির শিখরে পদার্পণ
করেও সাধনা তাঁর থামেনি, বরং মাঝে-মাঝে
এখনও গভীর রাতে ঘুমন্ত জীবনসঙ্গিনীর পাশে শুয়ে
অথবা টেবিলে ঝুঁকে থিসিসের ভাবনায় কাটান প্রহর। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
আমার হৃদয় জুড়ে সারাক্ষণ এ কী জলহাওয়া।
আবহকুক্কুট ঘোরে উল্টোপাল্টা, দিকচিহ্নগুলি
সহসা গিয়েছে উড়ে, দরজা, জানালা ঘুলঘুলি
কম্পমান ক্ষণে ক্ষণে। খুব একা কোনো গানে-পাওয়া
লোকের স্বভাবে ঘুরি দিগ্ধিদিক মানুষের হাটে,
কখনো দারুণ জনশূন্যতায়। রুদ্র ভূকম্পন
মাঝে মাঝে আনে শোক; নৌকো, সেতু ছাড়াই গহন
খর নদী পার হতে হবে, হবে যেতে ফুল্ল ঘাটে।স্মৃতি ভেতরে স্মৃতি ক্রিয়াশীল পারম্পর্যহীন-
তছনছ ঘরবাড়ি, ক্ষুধার্ত শহর, ডালপালা,
ছিন্নভিন্ন, তরুণীর স্বেদসিক্ত স্তন, একজন
খোঁড়া লোক, চা খানার নির্জন টেবিল, অন্তরীণ
তেজী যুবা ভেসে ওঠে ডুবে যায় এবং যখন
বিপর্যয় অস্ত যায়, বাজে ফের নিষ্পিষ্ট বেহালা। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
ভক্তিমূলক
|
(হুমায়ুন আজাদের উদ্দেশে)গ্যয়েটের ফাউস্টের মতোই কাটছে প্রধানত
ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে জীবন তোমার। জ্ঞানার্জনে
অক্লান্ত সাধক তুমি, উপরন্তু কাব্য রচনায়
সিদ্ধিলাভ করেছো এবং
প্রতিক্রিয়াবিরোধী ব’লেই ওরা অশুভ তিমিরে
তোমার বিশুদ্ধ রক্ত বইয়ে দিয়েছে হিংস্রতায়।বিদ্যা, যতটুকু জানা আছে, মানসের শ্রীবৃদ্ধির
বস্তুত অপরিহার্য শ্রেষ্ঠ উপাদান। তুমি তাই আভা তার
দিয়েছো ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসুক শিক্ষার্থীদের মনে
নিত্যদিন। সমাজের নানা বয়সের
আগ্রহী পুরুষ, নারী তোমার জ্ঞানের ছোঁয়া পেয়ে
আলোকিত হয়ে ঢের বস্তুত কৃতজ্ঞ বোধ করেছেন যখন তখন।
মূর্খেরা ভেবেছে তুমি অস্ত্রাঘাতে নিষ্প্রাণ হ’লেই
নিভে যাবে তোমার সৃষ্টির আলোমালা,
অথচ জানে না ওরা সর্বদা সজীব তুমি, অমর তোমার
প্রোজ্জ্বল রচনাবলি। তোমার শরীর
কোনওকালে মৃত্তিকায় বিলুপ্ত হলেও
যুগ যুগ জ্বলজ্বলে রয়ে যাবে বাংলার দালান,
কুটিরে, নদীর ঢেউয়ে। দেশপ্রেমী প্রতিটি প্রাণের
আসনে হে কবি হুমায়ুন তুমি আজ অধিরাজ। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
জানি না এরকম কিছু আছে কি নেই
মৌতের আগেই প্রত্যহ সয়ে চলেছি গোরের আজাব
প্রায়শ চোখে অমাবস্যা
মগজে বৃশ্চিক হাঁটে আঁচড়ে কাটে পাগলা কুকুরকিছু থাক না থাক এপারে ওপারে
ধুক ধুক আছে হামেশা কলিজায়
এদিকেও বাড়ায় হাত বিদ্রোহী রোবট
কম্পিউটার-নির্ভর জীবনে এ কেমন কহর
কে তুলে দেয় জহরভরা পেয়ালা আমার হাতে
দন্ত-নখর বের করা সন্ধেবেলা
আমাকে ঘানিতে পিষছে সর্ষের মতো
সকালে সূর্যোদয়ের ইনাম রাতে খওফের সাজাবন্দনা-লিপ্সা কাউকেই সাজে না কস্মিনকালে
তবে কেন মেষপালে এমন তোলপাড়
বিগ ব্যাঙের পরে অযুত অযুত বছর কেটেছে
গ্যালাক্সিতে ঘুরছে গ্রহ-উপগ্রহএকদিন সূর্য অপরাহ্নের উনুন হবে
ফৌত হবে তামাম প্রাণিকুল
শীতার্ত শূন্যতাকে ওম দিতে ব্যর্থ শূন্যতা
ভাবলেই শিরদাঁড়ায় হিমপ্রবাহবলবো না মাফ করে দিও শত নাফরমানী আমার
হে রহস্যাবৃত ওগো অনির্বচনীয়
এতকাল করেছি তাজিম ফুল নারী এবং মনীষাকে
নানা রাগ-রাগিনীর প্রলম্বিত জিকিরে
সবই কি নাকাম আখেরে
পাই না নিশ্চিত জবাব দানেশমন্দ কোনো কেতাবে (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
আমার চোখ কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে
নইলে কেন আমি কোন কিছু
দেখতে পাচ্ছি না?
আমার কণ্ঠ কি আমার কাছে থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন আমার কণ্ঠ থেকে সত্য কি মিথ্যা কিছুই
উচ্চারিত হচ্ছে না?আমার পা দুটো কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন ওরা সামনের দিকে
এগোতে পারছে না?আমার হাত দুটো কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন ওরা এত লঙ্কাকাণ্ডের পরেও
মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে না?আমার কলম কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন আমি খাতার পাতায় উচ্চারণের স্তবক
ফোটাতে পারছি না? (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আমাকে কেউ ইশ্বরের প্রতিদ্বন্দী বলে
সম্বোধন করল কি করল না তাতে আমার
কিছু যায় আসে না। আমার স্তুতি কিংবা নিন্দায়
পাড়াপাড়শিরা হুল্লোড়ের হাট বসিয়ে লাঠালাঠি,
মাথা ফাটাফাটি করলেও সেদিকে আমার
লেশামাত্র নজর নেই।তোমরা কি দ্যাখো নি কী করে নিমেষে
বিকল্প সৌরলোক, ভিন্ন চাঁদ, স্বতন্ত্র
তারাভরা নিশীথের আকাশ আমি তৈরি করি?
তোমাদের চোখে কি পড়ে নি আমার বানানো
সেই বাগিচা যা’ আদম ও হাওয়ার উদ্যানের চেয়েও সুন্দর,
অথচ সেখানে নেই সবুজ সাপের হিস্হিসে পরামর্শ?
নিশ্চয়ই সেই বাগানে তোমরা দেখেছ
বেহেশ্তের হুরীদের অধিক রূপবতী তরুণীদের, যারা
তারায়-গড়া ময়ূরপঙ্খী নাও কুমারী জলে ভাসিয়ে
রওয়ানা হয় প্রেমোপাখ্যানময়
দ্বীপের উদ্দেশে। ঢেউয়ের তালে তালে দোলে তাদের স্তন,
তাদের উল্লসিত কেশে জলকণা চিক চিক করে। সমুদ্রতলে
সুলেমানী রত্ন ভাণ্ডারের চেয়েও ঐশ্বর্যময় খাজাঞ্চিখানা
নির্মাণ করেছি, এ-ও তোমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি, আমার বিশ্বাস।তোমরা কি অগ্রাহ্য করো আমার দাবি? আমাকে আজ
গোধূলি বেলায় প্রতারক অপবাদ দিয়ে
এই তমসাচ্ছন্ন, অবক্ষয়-স্পৃষ্ট নগরী থেকে
তাড়িয়ে দিতে চাও? এই তো আমি মেঘের
শাদা ঘোড়ায় সওয়ার, ঘোরাচ্ছি আঙুল
আর চতুর্দিকে অন্ধকারকে লজ্জা দিয়ে
শিশুর হাসির মতো ফুটে উঠছে আলো,
খরাপীড়িত নরনারীর পায়ের তলায় বয়ে যাচ্ছে
জলধারা গ্রামীণ কন্যাদের গীত ধ্বনির মতো-
তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? দ্যাখো, আমারই ইচ্ছায়কীরকম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অজস্র গোলাপ
আবর্জনার স্তূপে, দুঃস্থ কবিয়াল
যুবরাজের ভঙ্গিতে তার সারিন্দায়
লাগাচ্ছে দিক-জাগানো নতুন সুর, জমির আল
মিশে যাচ্ছে স্বর্গগঙ্গায় এবং আততায়ীদের
ধারালো অস্ত্রগুলো মিলনমালা হয়ে দুলছে।এখন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আমার অস্তিত্ব
তরঙ্গিত নদীর মতো এক নাচ, ঘূর্ণমান
দরবেশের মতো আত্মহারা আর টাল সামলে
নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই আমি কেমন পাথুরে স্তব্ধতা। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
গত কয়েকটি দিন আমাদের বড়ো এলোমেলো,
শরবিদ্ধ ছিল, চতুর্দিকে হৈ-হুল্লোড়, ধূলিঝড়
ছিল, ছিল তর্ক আর কর্কশ বচসা, বুনো জ্বর,
যা স্পর্শ করেছে আমাদেরও, কখন যে খুব খেলো
হয়েছি নিজেরই কাছে, বস্তুত পাইনি টের। ভুল
করেছি আমিও জেনেশুনে, কলহের সূত্রপাতে
পারিনি টানতে ছেদ, পড়েনি সে-তথ্য মনে, যাতে
ছিল সত্য, ফলে বিদ্ধ করেছে আমাকে শত হুল।তুমি কি আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহের দোলা
কখনো পুষেছ মনে? আমাকে নির্দয় আর খল
ভেবেছ কি বিভ্রান্তির-ঝাপ্সা কোনো ক্ষণে? শোনো, ঘোলা
জলে মৎস্যশিকারি তো আমি নই উপরন্তু ছল
ধাতে নেই, পেয়েছি প্রেমের দেবতার বরাভয়-
প্রলয়েও আমাদের ভালোবাসা অম্লান, অক্ষয়। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
বেশ কিছুকাল থেকে বসে আছে পাথুরে বেঞ্চিতে।
সূর্যাস্ত বিছায় স্নেহ চোখে, মুখে, ভুরুতে, আঙুলে;
চুল ওড়ে, প্রশস্ত কপালে বৈরাগ্যের পথরেখা,
শ্মশানের কাঠ পোড়ে হৃদয়ের ভিতরে এবং
চক্ষুদ্বয় পাখির রঙের অন্তরালে ভিন্ন কোনো
বর্ণশোভা দেখে নিতে খুব স্থির। এ ভঙ্গিতে তার
ঈষৎ স্থাপত্য আছে, আছে শুদ্ধ সঙ্গীতময়তা।
স্বাস্থ্যান্বেষী ব্যক্তিবর্গ, বয়েসী, এবং কতিপয়
চমকিলা যুবা তাকে দেখে হাসে, কেউ-কেউ শিস্
দেয়, যেন বৃক্ষাশ্রিত পাখিরা উদ্দিষ্ট, এই মতো
ভান করে হেঁটে যায়। কারুর দিকেই নেই তার
দৃষ্টি, শুধু নিজের ভেতরে চোখ সঞ্চরণশীল
অতিশয়; এখন সত্তায় তার ঠোনা দিলেও সে
নড়বে না এতটুকু, মনে হয়; যেন-বা পাথর। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
নানা জনের নানা কথা,
কেউ কারো কথা শুনছে বলে
মনে হলো না। শুধু একটা কলরব
সারা ঘর জুড়ে। বহু কণ্ঠস্বরের
মধ্যে আমার গলার আওয়াজ
সাঁঝ বেলার আলোর মতো আবছা।আমি থমকে দাঁড়ানো, জখমি, তেজী
ঘোড়ার মতো আন্দোলন বিষয়ে
কিছু বলতে চাইলাম। নামী দামী
নেতারা মুখে ঐক্যের বুলি নিয়ে
অনৈক্যের বহু মুণ্ডু-অলা ষাঁড়টিকে
ছেড়ে দিয়েছেন ময়দানে; এই সুযোগ যিনি
এদেশের হর্তা কর্তা বিধাতা,
তিনি গণতন্ত্রকে দিব্যি
ঘোল খাইয়ে ছাড়ছেন। নিজে
তিনি সাচ্চা ধার্মিক কিনা তা শুধু
আলেমুল গায়েবই বলতে পারেন,
তবে নিজের তখতটিকে সামলে সুমলে,
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমের তাগিদে
ধর্মের কল নাড়াতে চাইছেন
জোরেশোরে। কিন্তু তার কি জানা নেই
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে?এসব কথা বলতে চাইছিলাম উচ্চকণ্ঠে,
কিন্তু আমার গলা থেকে কোনো আওয়াজ
বেরুচ্ছিল না। ক্লান্ত হয়ে জনশূন্য ঘরে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেবিলে মাথা রেখে;
হতাশার কুয়াশা
আমাকে জড়িয়ে রেখেছে।
হঠাৎ চমকে উঠে দেখি, কে যেন
হাত রেখেছে আমার কাঁধে।
তাকে কখনো দেখেছি বলে
মনে হলো না, অথচ অনেক চেনা সেই মুখ।তাঁর হাতে জ্বলজ্বলে একটি পতাকা,রক্তের মতো লাল!
জোরালো কণ্ঠে বললেন তিনি-,
তোমরা এভাবে অরণ্যে রোদন করবে,
একে অন্যের কুশ পুত্তলিকা পোড়াবে,
হতাশার আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণে
বুঁদ হয়ে থাকবে পরাজয়ের নেশায়,
এ জন্যেই কি রাজবন্দিরা বছরের পর বছর
জীবন ক্ষইয়ে দিচ্ছেন জেলে?
এ জন্যেই কি আমরা বুকের রক্ত দিয়ে
স্বদেশের ধুলোমাখা পা
ধুয়েছি বার বার?
এ জন্যেই কি সেজে গুজে নওশা হবার বয়সে
আমরা বরণ করেছি শাহাদত?
কেন তুমি এমন নীরব, নিঝুম হয়ে আছো?
আমার কণ্ঠস্বর কোথাও পৌছয় না,
আমি বললাম তাঁর চোখে চোখ রেখে।
‘এ নিয়ে ভাবনা করো না,
বজ্র বয়ে বেড়াবে তোমার কণ্ঠস্বর,
আর সেই আওয়াজ পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে।
কানে আসে তাঁর গমগমে উত্তর।তারপর সেই শহীদ মাথা উঁচিয়ে
হাওয়ায় নিশান উড়িয়ে
জোর কদমে চললেন এগিয়ে।
আমি তাঁকে অনুসরণ করবো কি করবো না
ভাবছি এবং চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই দেখি
তাঁর পেছনে
গনগনে এক জনসমুদ্র। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেয়ে হয়।
দীর্ঘবেলা কাটিয়েছি শব্দের সহিত,
কখনো সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলে সজীব লতার মতো
দেখি টান থেকে যায়, থাকে
এখান সেখানে মায়া, বিষণ্নতা, আনন্দের স্মৃতি।বাউল যেমন গোধূলিকে একতারাময় বড়
উদাস বাজায়,
কখনো-সখনো শব্দ আমাকেও তেমনি করে ধ্বনি,
সমগ্র সংগীত হয় আমার ভিতরে। তবু জানি
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেতে হয়।আজো সারাদিনমান আমি শব্দের কথাই ভাবি।
কখনো অত্যন্ত প্রয়োজনে, কখনো-বা, যতদূর
মনে হয় প্রয়োজনহীন
শব্দ খুঁজে নিরুদ্দেশগভীর জঙ্গলে, ঝর্ণা তলে, পাহাড়ের
দুর্গম জটিল পথে, সাগর সঙ্গমে, গুপ্ত দ্বীপে।
শব্দের নিজস্ব রীতি সৃষ্টি হয় আনাচে কানাচে
অগোচরে, প্রকাশ্যেও, শব্দ জায়মান
রৌদ্রজ্বলে যেন লতাগুল্ম।
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেতে হয়।আমিও জেনেছি শব্দ প্রতিশোধপরায়ণ খুব
প্রেতের মতন-
কখন যে রক্ত শুষে নেয়, লেবু কাঁটা হয়ে শ্রুত
ক্ষত তৈরি করে
সত্তাময়। কখনো-বা শিং-অলা হরিণের সরল ধরনে
কেবলি জড়িয়ে যাই শব্দের লতায়। কিছু শব্দ
আমার ভিতরে জেগে ওঠে অকস্মাৎ
আমারই অজ্ঞাত।যেশাসের গাধাটিকে মনে রেখে উচ্চারণ করি
‘গর্দভ’ এবং সব ওলোট-পালোট, তছনছ হয়ে যায়।
বাসগৃহ ব’লে আমি হেঁটে যাই প্রফুল্ল শরীরে,
অথচ আশ্রয়ে নয়, পৌঁছে যাই বিশদ শ্মশানে।
ভালোবাসা উচ্চারণ করতে গিয়ে হৃদয়ের স্বরে বারংবার
কী রুক্ষ ধিক্কার নিয়ে ফিরে আসি নিজস্ব গুহায়। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
শামিয়ানার নিচে তাকে দেখলাম বিষাদাবৃতা
দুপুরবারোটায়,
যার হাতে এখন মেহেদির রঙের বদলে
জীবনসঙ্গীর বুকের জমাট রক্তের অদৃশ্য ছোপ।তার শোকস্তব্ধ মুখ থেকে বারবার
সরিয়ে নিচ্ছিলাম দৃষ্টি;
অসম্ভব এই শোকের দিকে
নিষ্পলক চেয়ে থাকা। আমার ভেতরে রাগী এক বাজপাখির
ডানা ঝাপটানি, সেই পাখির চঞ্চু আর নখর
প্রসারিত হস্তারকদের প্রতি, যারা হেনেছে
সংকল্পের মতো একটি সতেজ মানুষকে।লোক থই থই এই সড়ক দ্বীপে
বিষাদাবৃতা নারীর আঁচলের খুঁট ধরে দাঁড়ানো
তার তিন বছরের কন্যা,যার খেলাঘরে
এখন মহররমের মর্সিয়া।ওদের দু’জনের পায়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতো
গড়িয়ে পড়ছে চারদিকের জয়োল্লাস আর
আমার হৃদয়ের স্পন্দিত হাত
ওদের জানায় অভিবাদন
দুপুর বারোটায়।ইচ্ছে হলো এক্ষুনি রঙধনু পুরে দিই শিশুর মুঠোয়,
যার পিতার বুকে বুলেট ফুটিয়েছে রক্তগোলাপ,
যিনি আলো ছিনিয়ে আনার ব্রত নিয়ে
কবরের অন্ধকারে নিদ্রিত,
যার মৃত্যু দুঃসময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ত্বকে লিখে গ্যাছে
প্রতিবাদী গাথা,
যার মৃত্যু ঘোষণা করেছে স্বৈরাচারের মৃত্যু
যার মৃত্যু দুরাত্মাদের বুকে ধরিয়েছে ফাটল,
যার মৃত্যু এ মাটিতে পুঁতে দিয়েছে বিজয় নিশান।এই নারী কার কাছে জানাবেন অভিযোগ?
রৌদ্র-জ্যোৎস্নার কাছে? বাতাসের কাছে?
বৃক্ষরাজি কিংবা আকাশের কাছে?
যারা ভরদুপুরে তার সত্তায় ছুঁড়ে দিয়েছে বৈধব্যের ধুধু শাদা,
তারা কি ক্ষমার ছায়ায় কাটাবে প্রহর?
যারা তার যৌবনের স্বপ্নমালাকে কুটি কুটি ছিঁড়ে
ফেলে দিয়েছে ধুলায়
তারা কি সুখস্বপ্নে থাকবে বিভোর?
যারা তার সংসারকে করেছে ক্রূশবিদ্ধ,
তারা কি হেঁটে যাবে নিষ্কন্টক পথে?এইতো সেদিনও শোকাচ্ছন্ন নারীর শরীর
ভিজে উঠতো সুখী বৃষ্টিতে,
আজ শামিয়ানার নিচে বসে তিনি বারবার আঁচলে ঢাকছেন মুখ
দুপুর বারোটায়,
যেন দুঃখিনী বাংলাদেশ চোখ থেকে
অবিরত মুছে ফেলছে অশ্রুধারা। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কেন মানুষের মুখ বারবার ম্লান হয়ে যাবে?
কেন আমাদের হাতে পায়রা পাথর হয়ে যাবে?
মুখের ভেতরে কেন অমাবস্যা ঊর্ণাজাল বুনে
যাবে ক্রমাগত? যোদ্ধবেশে শত শত
কংকাল সওয়ার হয়ে আসে
কেন রাতে ভৌতিক ঘোড়ায়?
কেন আমাদের
এত মৃত্যু দেখে যেতে হবে অসহায় ভঙ্গিমায়?অবেলায় একটি বিপুল উল্টে-যাওয়া দোয়াতের কালির ধরনে
রক্তধারা বয়ে যায়। রক্তভেজা চুলে শব্দহীন
গোঙানি; চোয়ালে, মেরুদণ্ডে, দুটি চোখে,
হাড়ের ভেতরে স্মশানের ধোঁয়াবিষ্ট
হাওয়ার মতোই কিছু বয়ে যায়, বয়ে যেতে থাকে।যে-হাত মুছিয়ে দিতো তার চির দুঃখিনী মায়ের
চোখ থেকে জলধারা, সেই হাত কেমন নিঃসাড়, শূন্য আজ।
যে-চোখ দেখতো প্রেমিকার মুখরেখা কনে-দেখা
আলোয় অথবা সূর্যোদয়ে,
সেই চোখ ডিমের ছড়ানো
কুসুমের মতো হয়ে গেছে,
যে-ঠোঁট স্ফুরিত হতো কবিতার পঙ্ক্তির চুম্বনে,
সে-ঠোঁটে ঘুমায় আজ স্তব্ধতার ভাস্কর্য নিধর।
একলা যে-কানে
বোনের সোনালি
চুড়ির শব্দের মতো আনন্দের ধ্বনি
হতো গুঞ্জরিত আজ সে-কানে স্থবির অন্ধকার
কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। কফিনের আলোড়নে
পাখিদের সংগীত পেরেক বিদ্ধ হয়।মারা গেল, কখনো তাদের কেউ দোর খুলবে না
বাজালে কলিং বেল। বন্ধু এলে ঘরে
হাত ধ’রে নিয়ে বসাবে না কিংবা নিজে
বসবে না চেয়ারে হেলান দিয়ে, বুলোবে না চোখ
টেবিলে-উল্টিয়ে-রাখা আধপড়া বইয়ের পাতায়,
অথবা ব্যথিত, ক্ষয়া চাঁদের নিকট
চাইবে না শৈশবের শিউলি-সকাল
আবার পাবার বর! সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় ভাববে না
কাকে তার বড় প্রয়োজন ছিল। ‘কাল যাবো ঠিক
আমার গ্রামের বাড়ি, ট্রেন থেকে নামবো স্টেশনে
ঝুলিয়ে গেরুয়া ব্যাগ কাঁধে, দেবো সুখে
চুমুক চায়ের ঠুঁটো পেয়ালায় হাশমত আলির দোকানে’-
এই শব্দাবলি
জমাট রক্তের মতো লেগে থাকে শূন্যতার গালে।
যারা গেল, তাদের এখনোআঁকড়ে রাখতে চায় এ দেশের শেকড়-বাকড়,
আঁকড়ে রাখতে চায় লতাগুল্ম আর
গহীন নদীর বাঁক, আঁকড়ে রাখতে চায় শারদ রোদ্দুরে
ডানা মেলে-দেয়া কবুতরের ঝলক,
আঁকড়ে রাখতে চায় নিঝুম তুলসীতলা, জোনাকির ঝাঁক।এদেশের পতিটি গোলাপ আজ ভীষণ মলিন,
প্রতিটি সবুজ গাছ যেন অর্ধ-নমিত পতাকা,
আমাদের বর্ণমালা হয়ে গেছে শোকের অক্ষর,
আমার প্রতিটি শব্দ কবরের ঘাসের ভেতরে
হাওয়ার শীতল দীর্ঘশ্বাস;
আমার প্রতিটি চিত্রকল্প নিষ্প্রদীপ ঘর আর
আমার উপমাগুলি মৃতের মুঠোর শূন্যতায় ভরপুর,
আমার কবিতা আজ তুমুল বৃষ্টিতে অন্ধ পাখির বিলাপ। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
বলা যেতে পারে-
সে-তো আজ নয়, বহুকাল আগে,
যখন আমার দেহ মনে
কৈশোর নিভৃতে খেলছিল অপরূপ
খেলা ভোরবেলা, রৌদ্রময় দ্বিপ্রহর,
মেঘঢাকা গাঢ় সন্ধ্যায় আর
গভীর রহস্যময় রাতে ছিলাম নিমগ্ন আর
কে এক রহস্যময়ী সঙ্গিনী ছিলেন উদ্যানের মায়াপথেসে-রাতে, এখনও মনে পড়ে-
দিগন্তের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কানে
ভেসে এসেছিল কোন্ এক
বংশীবাদকের মন-জয়-করা সুর! কান পেতে
শুনি আমি খুঁজি তাকে দিগ্ধিদিক। শুধু
সুর আসে ভেসে, বাদকের দেখা পাইনে কিছুতে।এ কেমন বাঁশি যার সুর ভাসে, অথচ বাদক
অদৃশ্য সর্বদা? তার দেখা
পাওয়ার আশায় ঘুরি প্রহরে প্রহরে, শুধু তার
সুর ভেসে আসে, ছুঁয়ে যায় এই নিবেদিত-প্রাণ
আমাকে তবুও অপরূপ শিল্পী তার সবটুকুউ
রূপ থেকে দান ক’রে ঝলসিত হতে নন রাজী।তবে কি আমার ঝুলি অপূর্ণই রবে সর্বকাল?
যদি আমি মাথা কুটে মরি বাঁশি, তবু
তুমি দেবে না কি ঢেলে তোমার সকল
সুরের অক্ষয় ডালি আমার কম্পিত অঞ্জলিতে? (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
ব্যক্তিগত রাজার কাছে হাঁটু গেড়ে
যাচঞা করি একটি কিছু
ইতল বিতল।
দৃষ্টিতে তাঁর চন্দ্র ধরে, সূর্য ধরে;
জ্বলছে হাতে রক্তজবা
চমৎকার।
শস্য ক্ষেতে তাঁর পতাকা নিত্য ওড়ে,
ফুলের তিনি খুব উদাসীন
অধীশ্বর।সকাল যখন সকাল থেকে
যাচ্ছে স’রে অনেক দূরে
কিংবা কাছে,
রাত্রি আবার রাত্রি থেকে,
আমার করুণ অঞ্জলিতে
অন্ধকারে উঠবে ফুটে পদ্ম কোনো?বুকের ভেতর মাছরাঙা আর
দীপ্ত আঁশের মৎস্য নিয়ে
ঐতো আমার সন্ত রাজা
ফুটপাতে নীল একলা হাঁটেন।
পার্কে ব’সে বেলুন ছাড়েন,
কিংবা বাসের পাদানিতে
ঝুলে ঝুলে যান যে কোথায়!
কখনো ফের জনসভায়
অনেক মুখের একটি মুখে
যান মিশে যান,-
আবার কখন চিমটে বাজান বৃক্ষতলায়।
ব্যক্তিগত রাজা যিনি তিনি বেবাক পোশাক খুলে
ঐ চলেছেন ভেসে ভেসেজ্যোৎস্নাস্রোতে, রৌদ্রমায়ায়।
আমি কি তাঁর অমন গহন ছায়া তুলে
আমার চোখে পাগল হবো?
ঘোর দুপুরে দিলেন ছুঁড়ে কাঁটার মুকুট
নগ্ন হাতে আমার মাথাআ লক্ষ্য ক’রে।
ব্যক্তিগত রাজা আমার অগাধ রোদে
একলা হাঁটেন, একলা হাঁটেন
সত্তাজোড়া অসুখ নিয়ে
একলা হাঁটেন।বৈতরণী অন্ধকারে বনবাদাড়ে
পায়ের রক্তে যন্ত্রণারই পুষ্প এঁকে
একলা হাঁটেন, একলা হাঁটেন
ধূসর কোনো ইস্টিশানে,
মেঘে মেঘে একলা হাঁটেন। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
দেখি প্রত্যহ দুঃখের তটে
ভাসে স্বপ্নের রুপালি নৌবহর।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
কী করে বাঁচাই স্বপ্নের মায়াতরী?পথের প্রান্তে দেখি দিনরাত
একটি বৃক্ষ-পিতৃপুরুষ যেন।
মাথা নেড়ে নেড়ে বলেন সদাই-
“বাচো, সুখী হও, তোমাদের ভালো হোক।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
দিগন্ত-জোড়া প্রলয়ের ঝড়ে
কী করে বাঁচাই প্রবীণ বৃক্ষটিকে?আজকাল লোকে যায় না বাগানে,
তবু তো ধুলায় গোলাপ বাগান বাঁচে।
সেখানে পাখির কণ্ঠে ধ্বনিত
হৃদয়-মথিত কতো মানবিক গান।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
ফাগুনের স্মৃতি ঝলকিত ফুল
কী করে বাঁচাই বারুদের ঘ্রাণ থেকে?আমার মায়ের প্রশান্ত চোখ
জেগে রয় রোজ সংসারে নানা কাজে।
প্রসারিত তাঁর হাতের মায়ায়
অন্ধকারেও জ্বলে ওঠে দীপাবলি।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
দিগন্ত-জোড়া প্রলয়ের ঝড়ে
কী করে বাঁচাই পুণ্য সে দীপাবলি?
পুতুলের মতো আমার মেয়েটা
সারাদিনমান পুতুল খেলায় মাতে।
ডাকলে কেবলি দৌড়ে পালায়,
লাল জুতুয়াটা কোথায় যে পড়ে থাকে।
বিপদের এই ভীষণ আঁধিতে
আজকে আমার একটি ভাবনা শুধুঃ
হিংসুক সেই দৈত্যের থেকে
কী করে বাঁচাই খুকির পুতুলগুলি? (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
তিনজন ঘোড়সওয়ার সারাদিন অনেক
এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে
ঘোর সন্ধ্যাবেলা এসে পৌঁছলো ঢের পুরনো
এক দালানের সামনে। ঘোড়াদের পিঠ থেকে
নেমে বেঁধে ওদের গাছের ডালে বেঁধে দালানে
প্রবেশ করেই গা ছমছমিয়ে ওঠে তাদের।
পরস্পর মুখের দিকে তাকিয়ে তারা খানিক
চমকে ওঠে। কোনও কথাই ঝরে না কণ্ঠস্বর থেকে।ঘোড়সওয়ারেরা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি ক’রে দালানে
বসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। বেশ পরে খানিক
চাঁদের ফিকে আলো ভাঙা জানলা
দিয়ে ঘরে ঢোকে সলজ্জ অতিথির ধরনে।অতিশয় ক্লান্ত ঘোড়সওয়ারেরা মেঝেতে ঘুমোবার
চেষ্টা করতেই কানে ভেসে আসে কাদের
যেন পদধ্বনি। ওরা ভাঙা জানলা থেকে দৃষ্টি
মেলে দিতেই দ্যাখে ক’জন অপরূপ সুন্দরী
হেঁটে যেতে-যেতে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। স্তম্ভিত
ঘোড়সওয়ারদের ঘোর কাটতে কাটতে কত যুগ কেটে গেলো, কে বলবে?ঘোড়সওয়ারত্রয় জানলার কাছে মূর্তির ধরনে
রইলো দাঁড়িয়ে। বাইরে নানা গাছের ডালে সতেজ ভোরের
পাখিদের কোরাস ঝরায় অকৃপণ সুর। ঘোড়সওয়ারেরা
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো? কত শতাব্দী? ঘোড়সওয়ারেরা
কোথায়, কখন গেলে পাবে তাদের
মনের মতো জগৎ? কোথাও তেমন কিছু বাস্তবিক আছে কি?আলোর আহ্বানে ঘোড়সওয়ারত্রয় অতিশয় পুরোনো
দালান থেকে বেখাপ্পা হাসিতে কাঁপতে
কাঁপতে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি মেলে পরস্পর
অর্থহীন, মারমুখো ঝগড়া বাঁধিয়ে
একে অন্যকে ভয়ঙ্কর জখম করে। অদূরে
গাছের ডালে বন্দি শাদা, কালো এবং
লাল রঙের তিনটি ঘোড়া ওদের
মালিকদের কাণ্ডে ভয়ে, ঘৃণায়, ক্রোধে বন্ধন ছিঁড়ে পালায়। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
‘নত হও, নত হও’ ব’লে নির্বাপিত এজলাসে
পরচুলা-পরা বিজ্ঞ বিচারক খাগের কলমে
লিখলেন রায়, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটার
ভাবলেশহীন মুখ। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, ছন্নছাড়া,
তার বুক-চেরা পথে কুহকের অচিন সঙ্গীত
তোলে ঢেউ, কেউ ডেকে-ডেকে ঘুমিয়ে পড়েছে; সে-তো
বোবা-কালা নয়, তবু মৌনের নিঃস্পৃহ তাঁবেদার
সর্বক্ষণ, পোকা-খাওয়া ফলের মতোই স্তব্ধ মুখ।মনে-মনে বলে, ‘ছাগ দেবতার কাছে নত হওয়া
কী ক’রে সম্ভব?’ নইলে অনিবার্য বলি যূপকাঠে,
মন্ত্রপাঠে প্রস্তুত পুরুত, ঠেলাঠেলি অবান্তর
ঠেকে তার; কৌতূহলী জনতার কোলাহল ভেঁপু
বাজায় কিশোর, নারীদের কারো কারো কাঁখে শিশু;
অবশেষে বিচারক, অপরাধী দু’জনই দণ্ডিত। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কখনো গিয়েছি আগে সেখানে, মানে সে বহুদূরে
মফস্বলী পুরানো মহলে?
দুপুর, নিবিড় হয় চোখের পাতায় আর উদাস পুকুরে;
সিঁড়িতে পা রাখতেই উষ্ণ করতলে
তার হাত চলে আসে। কার? আজ ছায়াচ্ছন্ন নিস্তব্ধ দুপুরে,
নিসর্গের অন্তঃপুরে
গাছগাছালির
মাঝে দৈববলে
সহসা পেয়েছি যাকে, তার? নাকি ভুলে-যাওয়া কোনো পাঁচালির
সুন্দরীতমার? সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই, পাশে হাঁটে
আমার জাগর স্বপ্ন শাড়ির আঁচলে
নিয়ে অতীতের ঘ্রাণ। কে যেন রয়েছে বসে শ্যাওলাঢাকা পুকুরের ঘাটে
বড় একা, অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে তার
কিছু আলো, কিছু অন্ধকার।
পঞ্জিকার পাতা ওড়ে উল্টাপাল্টা, মাঝে-মধ্যে দোলে ঝাড়বাতি
প্রাচীন অট্রালিকার হঠাৎ হাওয়ায়, পাখি তার সাথী
খুঁজতে খুঁজতে ফের কী মসৃণ সবুজে লুকায়,
সে আমাকে ডাকে মনে মনে, আমি তাকে ডাকি;
শিউলিতলার ছায়া স্মৃতি খুঁটে খায়।
ঘরের ভেতরে ইতিহাস অলৌকিক কলরবে
জেগে ওঠে বর্ষীয়ান কান্তিমান কথকের গাঢ় কণ্ঠস্বরে
পুরানো গানের মতো। দেয়ালে হরিণ শিং বাতিল গৌরবে
যেনবা কৌতুকপ্রদ, তাতে মায়া আছে; মায়া আছে সারা ঘরে।
বৃষ্টিগুঁড়ো দুপুরকে করে বুটিদার; মনে পড়ে
আরেক বর্ষার গান, অবিকল এই সিঁটি কবেকার, এমন চত্বরে,
মনে পড়ে, নিরিবিলি ঘরে কারো ওষ্ঠে ওষ্ঠ রেখে অমরতা
খুঁজেছি ব্যাকুল;
বুঝি তারও রাত্রিময় গহন খোঁপায় ছিল ফুল
এবং পরনে চাঁপারঙ শাড়ি, তাকেও দিয়েছি কথা,
টেনেছি বুকের কাছে, আমার ত্বকের গান বেজেছে সুদূর তার ত্বকে!
সে মুখ পড়লে মনে রক্তে লতাগুল্ম গান হয়, চোখ হয়
কণ্ঠস্বর, হস্তদ্বয় কালহীন স্পন্দিত হৃদয়,
আর মাঝে-মধ্যে মনে হয়, সব কিছু জাতিষ্মর দীর্ঘশ্বাস,
মনে হয় আমার নিবাস,
ছিল সেখানেই, সেই প্রাচীন মহলে দূর বিস্মৃত শতকে। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.