poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
কথা ছিল না। আমরা যারা বুকের ভেতর ফুল, ধুলো আর আলকাতরার
গন্ধমাখা হাওয়া টেনে নিই, সিগারেট ধরাই, সিনেমায় ভিড় বাড়াই, আপিশ
করি আড্ডা দিই, বিছানায় যাই স্ত্রীর সঙ্গে, তাদের অনেকের বেঁচে থাকার কথা
ছিল না।
ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলাম রাতে। রাস্তায় কুসংস্কারের মতো অন্ধকার।
বাড়িটার সামনে এসে চমকে উঠি। খুব অচেনা মনে হয়। এর দেয়াল, দরজা,
ছাদের কার্নিশ কিছুই যেন আগে দেখিনি। অথচ এই বাড়িতেই আমার
নিত্যদিনের আসা-যাওয়া; রৌদ্র আর জ্যোৎস্নাপায়ী এ-বাড়ি আমার মুখস্থ।
আর মুগ্ধাবেশে চেয়ে থাকি কখনো কড়িকাঠের দিকে, কখনো বা পুরানো
জানালার নির্জনতায়।
সারাদিন এক অস্বস্তি ছিল রোদে, হাওয়ায়। যেন রোদ আর হাওয়া থেকে
অনেক দূরে চলে যেতে হবে। চলে যেতে হবে জাহাজড়ুবির অসহায় যাত্রীর
মতো। এই অস্বস্তি প্লেগের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা শহরে। একটা চাপা
উত্তেজনা পথচারীদের দখল করে রেখেছে। ওরা অপেক্ষমাণ কিছু একটার
জন্যে, যেমন নিদ্রামগ্ন চোখ স্বপ্নাচ্ছন্নতায় মেতে থাকে প্রত্যুষের প্রতীক্ষায়।
ব্যাকা-ট্যারা গলির মোড়ে, পথের ধারে অফিসের কামরায়, করিডোরে
ফিস্ফিসিয়ে কথা বলছে কয়েকজন। সেই মুহূর্তে কোনো ভাবোল্লাস তাদের
মধ্যে তরঙ্গিত হচ্ছিলো কিনা জানি না।
সারাদিনের পর স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকানে সন্ধ্যা কাটিয়ে ক্লান্ত পায়ে বাড়ি
ফিরি। সচরাচর এত তাড়াতাড়ি বাড়িমুখো হই না। উৎকণ্ঠা নিয়ে রাতে খাবার
খেলাম, এলোমেলো কিছু ভাবলাম, তারপর যথারীতি গেলাম বিছানায়।
বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মরহুম পিতার কথা মনে পড়লো।
তাঁর উপস্থিতি টের পাই ঘরে। তাঁর পরনে সেই শাদা পাঞ্জাবি আর পা-জামা,
মাথায় কালো মখমলী টুপি, হাতে লাঠি। লাঠির মুণ্ডে লতাপাতার নক্শা।
হঠাৎ আমার ঘরে কেন তাঁর এই উপস্থিতি? তিনি কি আমাকে সতর্ক করে
দিতে এসেছেন, যাতে কোনো খানা-খন্দে আমি মুখ থুবড়ে না পাড়ি? কিন্তু
তিনি কোনো সতর্কবাণী উচ্চারণ করেননি। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন
পারলৌকিক উদাসীনতায়। ওল্ড টেস্টামেন্টের কোনে বর্ষীয়ান পয়গম্বরের
মতো মনে হচ্ছিল তাঁকে, বিশেষত তাঁর টিকালো নাক আর সফেদ দাড়ির
জন্য। এই দৃশ্যে এক ধরনের মহিমা ছিল। আমার পিতার কাছে অনেক কিছু
শিখেছি আমি। কিন্তু সেই মুহূর্তে কেবল মনে পড়ছিল, তাঁর শেখানো একটা
প্রবাদ-‘খোঁড়ার পা খালেই পড়ে। কেন মনে পড়ছিল, বলতে পারবো না।
আমার পিতার গানের গলা ছিল না। বরং তিনি ছিলেন প্রকৃতই সুরছুট। তাঁর
কণ্ঠে গাম্ভীর্য ছিল, ছিল না মাধুর্য। গান তিনি গাইতেন না। তবে কখনো
কখনো বিছানায় শুয়ে-শুয়ে গুন গুন করতেন। শুধু একটি গানের বেসুরো
গুঞ্জরণ শুনেছি তাঁর কণ্ঠে বারংবার ‘দিন ফুরালো, সমঝে চলো’-এই ক’টি শব্দ
ছাড়া সে গানের কোনো কথা আমার মনে পড়ে না।
আমার লেখার টেবিলের কাছে রাখা শূন্য চেয়ারটিতে তিনি বসে আছেন।
নিঃসাড়, নিশ্চুপ। আমি উঠে বসতে চাই। তাঁকে তাজিম দেখানোর উদ্দেশ্যে।
কিন্তু পারি না। আমাকে কেউ যেন গেঁথে দিয়েছে বিছানায়। আমি ছটফট
করছি শয্যাত্যাগের জন্যে, পিতার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। শয্যাবন্দি আমি
বাক্ শক্তিরহিত। জনক তাঁর পুত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন ভাবলেশহীন।
ঘরের ভেতর কয়েকটি শজারু আর উড়ুক্কু মাছ। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ওদের প্রতি,
যেন তিনি ওদের নিয়ে এসেছেন সঙ্গে লাঠির সংকেতে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টের পাইনি। শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন। গাছের
গুঁড়ির মতো ঘুমোতে থাকি। ঘর কেঁপে ওঠে বারবার, ঘুমের ভেতরে টের
পাই। তখন ক’টা বাজে জানতে পারিনি। ঘড়ি দেখার মতো উৎসাহ ছিল না
এত ক্লান্ত ছিলাম সে-রাতে। গাঢ় ঘুমে চোখ বুঝে আসছিল। ভয়ংকর শব্দসমূহ
সেই ঘুমে সামান্য চিড় ধড়িয়ে ছিল মাত্র তার বেশি কিছু নয়।
মাতাল যেমন সাময়িক মতিচ্ছন্নতায় বোধের বাইরে পড়ে থাকে, তেমনি আমি
ছিলাম সে-রাতে। আমার সীমাহীন অবসাদ, নিষ্ক্রিয়তা আর পাথুরে ঘুম
আমার শয্যাসঙ্গিনীর মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে ভয়ানক শব্দ শুনে
চমকে-ওঠা ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা ছিল না আমাদের। ঘুমন্ত আমরা টের
পাইনি কি ভয়াবহ এক সকাল অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
একটি সকাল কী ভীষণ বদলে দিলো সন্ত্রস্ত আমাকে আর ভিন-দেশী
জেনারেলদের বুটজুতোয় থেঁৎলে-যাওয়া, বুলেটের ঝড়ে ক্ষত-বিক্ষত আমার
আপন শহরকে।(অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
দূর থেকে দেখে ঈর্ষার তাপ লাগে সত্তায়।
তার এলোমেলো রুক্ষ চুলের ঘন অরণ্যে
হরিণের খেলা,
সোনালি সাপের এঁকে বেঁকে চলা, অথবা কখনো
কাঠুরের চোখ, শাণিত কুঠার দেখেছি সহসা।জ্বলজ্বলে গালে
কর্কশ দাড়ি, ছিপছিপে গায়ে ছেঁড়া পাঞ্জাবী, পায়ে চম্পল
বিবর্ণ আর মুমূর্ষু খুব। রাস্তার ভিড় গহন দুপুরে
চিরে যায় সেই
সতেজ একলা যুবক, যেমন সাগর-জলের বুক কেটে দ্রুত
এগোয় জাহাজ, কেমন অচিন। নিজের ভেতর
জ্বলি অনিবার।ঔদাস্যের
পাল তুলে চলে হাওয়া থেকে কী যে যখন তখন
মোহন মাগনা কুড়িয়ে সে নয়, আবার ফিরিয়ে
দ্যায় সহজেই
শূন্যের হাতে রূপান্তরের ভিন্ন খেলায়, যেন যাদুকর।
আমাকে দ্যাখেনা। আমি তাকে দেখি, যেমন দুপুর।
রোদ্দুর দ্যাখে।তার জ্বলন্ত
মহানিশাময় ক্ষুধার্ত চোখ কোথায় কখন
হয় নিবদ্ধ, কেউ তো জানে না। বুঝি তার চোখে
কিলবিলে কীট, পদ্ম-কোরক! পদযুগল তার অবশ্য এই
শক্ত মাটিতে সচল, অথচ প্রায়শই মাথা মেঘমালা ছোঁয়।কখনো সখনো
থাকতে দ্যায় না আমাকে আমার মধ্যে সে তেজী,
আমাকে আমার গহন ভেতর থেকে টেনে আনে!
বাইরে দাঁড়িয়ে
বড় অসহায়, ভীষণ নগ্ন, আড়ষ্ট লাগে।কিন্তু সে রোজ
ত্রিলোক-বিহারী। দূর থেকে দেখে আমি কি শুধুই
জ্বলতে থাকবো? (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
ছায়াতেই থেকো তুমি, বাইরে যেও না। ইদানীং
রোদ্রে বড় বেশি আঁচ, উপরন্তু পাজীর পা ঝাড়া
এ সময়, কী বেয়াড়া লোকজন। এ পাড়া ও পাড়া
সর্বত্র লুটেরা ঘোরে, আর কত যে পার্টি মিটিং,
বশ্ম্বদ, কবন্ধ তো বটে, চলে বিরামবিহীন।
আড়ালে থাকবে তুমি নির্বিবাদে, কোমল রাত্তিরে
বলবো তোমার কানে কানে কথা, জোনাকির ভিড়ে,
মল্লিকার কাছে যাবো, স্বপ্ন-মসলিনে হবো লীন!অথচ তোমার মধ্যে কী-যে এক বিদ্যুৎ চমক
খেলে যায় বারংবার, বুঝি তাই গোলাপে, জবায়
খোঁজো তুমি জীবনের ভিন্নরূপ, চিরচেনা ছক
ছেড়ে সহজেই চলে আসো, বলো আমার উদ্দেশে-
থাকবো তোমারই পাশে রৌদ্রদগ্ধ পথে, যাবো ভেসে
জাগর জোয়ারে দীপ্র, যাবো রুদ্র মিছিলে, সভায়। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
কখনো আমার প্রতি এরকম তীক্ষ্ম বিরূপতা
দেখিনি তোমার ইতিপূর্বে। আমি সত্যি অপরাধ
করেছি, স্বীকার করি, নিজের অজ্ঞাতসারে, সাধ
করে নয়, তবু কেন আজো দিচ্ছ ছুঁড়ে বিষলতা
হে গৌরী আমার দিকে? রূঢ়ভাবে আমাকে বেজায়
একপেশে বলে খুব দিয়েছ ধিক্কার বারে বারে,
ফলে লুকিয়েছি মুখ স্বরচিত ভীরু অন্ধকারে
ভাসতে ভাসতে গ্লানি-সমুদ্দুরে ভঙ্গুর খেয়ায়।তোমাকে ফিরিয়ে আনবার কোনো পথ জানা নেই;
তেমন কুশলী নই বাক্যের তুবড়ি তাড়াতাড়ি
জ্বেলে টেলিফোনে কিংবা সাক্ষাতে ভেজাব মন এই
দীপ্ত অনুরাগের খরায়। মতান্তর মনান্তরে
রূপ নিলে শুরুতেই অপটু আনাড়ি আমি হারি,
সম্পর্কে গ্রহণ দেখে কেঁপে উঠি বাহিরে-অন্তরে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
বসন্ত, এখন আমি যুবা নই আর,
উচ্ছ্বাস আমাকে মানায় না,
এখন যুবক যুবতীরা সহজেই
তোমার শোভায় মেতে ওঠে দিগ্ধিদিক।যখন গাছের ডালে জ্বলজ্বলে পুষ্পরাজি দেখা
দেয়, আর সুরে সুরে তারুণ্যের
বিজয় ঘোষিত হয়, পরিবেশ যেন
রবীন্দ্রনাথের গীতসুধা হয়ে যায় লহমায়।জীবনে বঞ্চনা আছে, আছে অত্যাচার,
অবিচার, প্রতারণা, তবু
যখন হাওয়ায় দুলে ওঠে গাছের সবুজ পাতা,
রঙিন ফুলের শোভা হৃদয়ের গভীরে বেহেস্তি আলো আনে।ঘরে ঘরে, হে বসন্ত, তোমার উদ্দেশে গীতিমালা,
কবিতা এখন নিবেদিত, নৃত্যশিল্পী
বিচিত্র মুদ্রায় তুলে ধরে ক্ষণে ক্ষণে তোমাকেই।
ওগো ঋতুরাজ ঘরে ঘরে তোমারই বন্দনা আজ।সচ্ছল ঘরেই শুধু এখন নন্দিত নও তুমি,
চেয়ে দ্যাখো তোমার রঙিন চোখ মেলে,
শহরের ঘিঞ্জি এক মহল্লার দীন ঘরে
একজন কুট্রি যুবা সঙ্গিনীর খোঁপায় সাজায় লাল ফুল। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সকাল থেকেই আমার হৃদয় জুড়ে প্রখর তৃষ্ণা। বুক পুড়ে যাচ্ছে অনবরত।
ভাদ্রের জলধারা মুছতে ব্যর্থ হবে এই দাউ দাউ তেষ্টা জুড়োতে।
বনপোড়া শিঙঅলা হরিণের মতো অসহায় দৃষ্টিতে তাকাই এদিক
ওদিক। যেন চলেছি বেঢপ চালে এক মরু পথে। নেকড়ের
মতো খেঁকিয়ে ওঠা রোদ আমাকে ভাজছে কাবাব রূপে।
দু’চোখে ক্ষুধার্ত পশুর জঠরজ্বালা। পথে পড়ে থাকা ঘোড়ার
কংকাল, রুক্ষ গাছের ডালে ঝুলন্ত বিষধর সাপ, বালিতে
লুণ্ঠিত পুরানো রক্ত চিহ্নময় পোশাক, আর অতিকায় মরু কাঁকড়া
আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। হোঁচট খেয়ে বারবার বালিতে মুখ
থুবড়ে পড়ি। আমার চোখের তৃষ্ণা আর বুকের তেষ্টা এক যোগে
আর্তনাদ করে মরু নদীর মতো।আজ তোমাকে দেখার সঙ্গেই হৃদয়ের দু’কূল ছাপিয়ে
জেগে ওঠে তৃষ্ণানিবারণী জলময়তা। আমাদের
দুজনের দু’টি হাত পরস্পর চুম্বন ধারায় ভাসতে থাকে
কিছুক্ষণ। আমার মুখাবয়বে আন্দোচ্ছাসের ঝাপটা দেখে
তুমি মুগ্ধ হলে। কয়েক মিনিট পরেই আমার মুখের বিষণ্নতার
উকিঝুঁকি দেখে তোমাকে স্পর্শ করে মন খারাপের নীলাভ
আঙুল। তুমি আমার বিষণ্নতার উৎস জানতে চাইলে আমি
নিজের অসুস্থতার কপট উচ্চারণ করি। অথচ তোমাকে ক’দিন
এখানে দেখতে পাব না ভেবেই আমার হৃদয় ধুলোয়
লুটিয়ে পড়েছে আহত দোয়েলের মতো।তোমাকে আবার দেখার জন্যে নিরুপায় হয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও
সাতদিন। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার নিষ্করুণ ঘরে কী করে করবো বসবাস? (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
সত্যি কি জীবিত আমি? এই যে শ্যামলী পাড়াটির এক কোণে
একটি বাড়ির ছোট ঘরে প্রায়শই বসে থাকি,
ওল্টাই বইয়ের পাতা, তাকাই বাইরে, দেখি কাছের গাছের
পাতার চাঞ্চল্য মাঝে মাঝে, বাথরুমে মুখ ধুই, প্লেট পেতে
আহারাদি সেরে নিই, এখনও ঘুমিয়ে পড়ি, খাতার সফেদ
পাতাদের দিকে চেয়ে থাকি,-একি সত্যি?কেটে গেল কতদিন, মাস আর কত না বছর
যেন এক লহমায়-এভাবেই যায়,
যেমন ভোরের আলো সন্ধ্যার আন্ধারে মিশে যায়।
বাসায় বেঁধেছি ডেরা, কাটিয়েছি কত ষড়ঋতু
আনন্দে, বিষাদে আর জীবনের নানা বাঁকে প্রিয়
বন্ধু আর বান্ধবীর মুখোমুখি হয়েছি চকিতে
ভাগ্যগুণে বহুবার। বুদ্ধিজীবী বন্ধুর ড্রইংরুমে দেশী কি বিদেশী
সাহিত্য-কেন্দ্রিক আলোচনা কিংবা ঘরোয়া আলাপে
কেটে গেছে কত না বিকেল আর কত মধ্যরাত আর নানা
প্রহর কেটেছে প্রেমিকার আলিঙ্গনে
চুম্বনের স্বর্গীর স্বাদের আভা নিয়ে-সত্যি কি এসব?স্বদেশে, বিদেশে করে বসবাস ঘনিষ্ঠ স্বজন অনেকেই;
আমার নিকেট থাকে জীবনসঙ্গিনী, পুত্র, পুত্রবধূ আর
নয়নের মণি দুই পৌত্রী নয়না, দীপিতা। অকস্মাৎ
কখন যে চলে যাবো, নিশ্চিত বিলীন হবো মহাশূন্যতায়
শুধু ক’জনের স্মৃতিরূপে রয়ে যাবো, স্মৃতি বিলীন হয়
বিস্মৃতির অন্ধকারে। আমার পার্থিব বাড়িঘর, ব্যক্তিগত
গ্রন্থাগার, স্বরচিত পুস্তকাদি-ধুলো হবে সবই জনমের
আগে আর মরণের পরে শুধু শুধু
অস্তিত্বহীনতা, এ জগতে বটে এসেছিলাম একদা, অবশেষে
বস্তুত নিশ্চিহ্ন হওয়া ছাড়া সত্যি কোথাও যাওয়া নেই। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, অবসন্ন হাটুরের মতো বসে আছি
হাঁটু মুড়ে নগর ভেলায়।
এ এক প্রকৃত খেলা, এই ভেসে-যাওয়া তীরবর্তী শোভা দেখে,
জ্যোৎস্নার মাধ্যমে গড়ে তোলা মধুর সম্পর্ক কোনো
মহিলার সাথে।
বাতিল প্রেমিক যদি ফের খুঁজে পায় বেলাবেলি সম্প্রীতির ডেরা,
তাহ’লে সে নীলিমাকে জানিয়ে অভিবাদন, প্রায়
ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে উড়ে উড়ে অপরাহ্নে
ঘাসের অম্লান সবুজকে চুমু খেয়ে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, দেয়ালের শ্যাওলায়
মগ্ন হবে গৃহপ্রবেশের সূরে এক লহমায়। কয়েক শতাব্দী তার
আঙুলে উঠবে নেচে, দেশলাই জ্বালালে আঁধারে
প্রাচীন দেয়ালচিত্র অকস্মাৎ হবে উন্মোচিত, বুঝিবা আহত হবে
কাতর হৃদয় তার অতীতের অসামাজিকতা হেতু আর
রাখবে সে চোখ টিকটিকি কিংবা বাতির ওপর।জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, ঢাকাও মরাল হতে জানে
পূর্ণিমায়, দেখে নিই। যেন দরদালান সমেত যাচ্ছে উড়ে
দুলিয়ে বিপুল ডানা মগজের জ্যোৎস্নায় আমার।
ওলোট-পালোট কত স্মৃতি গোলাপের মতো ঝরে
এখন আমাকে ঘিরে, ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে পড়ি।
শৈশব কাঠের ঘোড়া চেপে আসে, যৌবনের খর দিনগুলি,
রাত্রিগুলি খুব মেশামেশি করে রক্ত কণিকায়,চামর দোলায় কোন, অব্যক্ত তরুণী, তবু কিছু স্বেদচিহ্ন
থেকে যায় আমার এ শরীর-পেরুনো অন্য এক অবয়বে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, আমিও ভাসছি ক্রমাগত।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে, ঢাকা ওরা মৃত, ওরা পূর্বগামী পরিজন,
বুঝি ওরা বারংবার মরীচিকার চিৎকার শুনে
ছুটে গেছে, কোথায় যে মরুদ্যান প্রস্রবণ নিয়ে
আমন্ত্রণে উন্মুখর বেলা শেষে, করেনি খেয়াল। ওরা মৃত,
ভ্রান্তির গহ্বরে ওরা হারিয়ে ফেলেছে কণ্ঠস্বর।
দেখি প্লেগ-কবলিত শহরের মতো
ক্রুর অমাবস্যার এলাকা-
ছিন্নভিন্ন জামা, জীর্ণ জুতো পড়ে আছে ইতস্ততঃ
কাঁটাগুল্ম, পাথরের মধ্যে, ফুলের কেয়ারিগুলি ভরে ওঠে
পচা নাড়িভুড়ি আর হাড়গোড়ে। দেখি কতিপয়
ন্যাংটো লোক পথে
করছে বপন মৃত্যু,-আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি তাহ’লে?আমার অসুখ বলে ঢাকা মন খারাপ করেছে।
ওর চোখে-মুখে বিষণ্নতা জেগে থাকে সারাক্ষণ,
যত বলি ফুল্ল স্বরে, ভেবোনা লক্ষ্মীটি, আমি খুব
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবো, দেখে নিও,
তত সে খারাপ করে মন, চোখে জমে অশ্রুকণা,
আমার শিয়রে বসে থাকে ঠিক নার্সের ধরনে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছো তুমি ঢাকা বেসামাল পূর্ণিমায়।
যাবো না স্বাস্থ্যের লোভে কোনো শৈলাবাসে,
তুমি আছি থেকো তুমি আমার অসুখ সেরে যাবে।
জ্বরদগ্ধ চোখে দেখি জ্যোৎস্না-ধোয়া স্নেহজাত পথ্য
তার হাতে নাচ আর রোজ নিয়ে আসে কিছু ফুল
রোগীর টেবিলে সুখ ফোটানোর অমল উদ্দেশ্যে।
আমার অস্তিত্ব থেকে অসুখের ছায়া সরে যাচ্ছে, দেখে যাও। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
সমাজের বিভিন্ন কন্দরে কিংবা খোলামেলা ঘাটে
কীভাবে সম্পর্ক এই মনুষ্য সমাজে
ভীষণ হোঁচট খেয়ে পঙ্গু হয়ে যায়, অনেকেই
সহজে পায় না টের। কালো মেঘ গ্রাস করে সারা উজ্জ্বলতা।কিছু কেঠো সামাজিকতার আবরণ
হয়তো-বা রয়ে যায় বাসি, পচা খাদ্যের ধরনে,
যেমন নদীর ঠোঁটে ঢেউগুলো চুমো খাওয়ার পরেও
ভেজা বালি রোদের ধমকে শুক্নো, ধুধু
অবয়বে টিকে থাকে। আন্তরিক পরিচয় পথ
ভুলে অমাবস্যার খপ্পরে পড়ে গেলে ঘটে বটে বিপর্যয়।এই যে এখনও খুব চড়া রোদ ছায়াময় তিয়াত্তর
বছর বয়সে নিত্য পলায়নপর
কবিতা নামের নিরুপমার পেছনে
পেছনে আপ্রাণ ছুটি, সে কি নির্বুদ্ধিতা
আমার? খেয়াল শুধু? যখন অনেকে দ্বিপ্রহরে
কিংবা সন্ধ্যারাতে গল্প গুজবে বেজায় মেতে রাতে
গৃহিণীর আলিঙ্গনে সুখে ঘুমের চুমোয় মজে থাকে, আমি
তখন চেয়ারে বসে আকাশ পাতাল ভেবে চলি।সমাজ সংসার সব ভুলে সুফী সাধকের মতো ধ্যানে,
মগ্নতায় সফেদ পাতায় পংক্তিমালা
সৃজনে মাতাল হই-জানি না এসব কিছু উন্মাদের স্বপ্ন
নাকি কিছু বেখাপ্পা প্রলাপ।জানি, জীবনের নানা বাঁকে প্রচুর ভ্রুকুটি আর
বিষাক্ত সমালোচনা সাপের মতোই
প্রকাশ্যে কি অপ্রকাশ্যে আমাকে ছোবল
মেরেই চলেছে-নিয়তির এই আঁকিবুকি, বলো,
কীভাবে এড়িয়ে যাবো? তবু অমাবস্যার শক্রতা
কুটোর মতোই ভেসে যায় একদিন পূর্ণিমার জাগরণে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
অকস্মাৎ বাষট্রির এই ছন্নছাড়া ধূলিঝড়ে
একি লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। আকাশটা বুঝি
ভাঙল কাচের বাসনের মতো আর
গাছপালাগুলোর মাতন
যেন ক্ষ্যাপা সন্ন্যাসীর নাচ,
শেকড় বাকড় ছেড়ে দেবে ছুট। মুখের উপর
তোমার চুলের ঝাপ্টা। আমি পথ দেখি না, আকাশ
অথবা চলন্ত যান-কিছুই দেখি না,
এই দুরু অনুভবে
আমার কেবল তুমি। কখন যে বিদ্যুতের মতো
ঝল্সে উঠে নেমে গেলে পথে,
আমার চাতক ব্যাকুলতা তোমাকে পেল না খুঁজে।অন্ধ ভিখারির ব্যগ্রতায়
নিঃশব্দে কুড়াতে থাকি টুকরো টুকরো কথা,
তোমার বিব্রত দীর্ঘশ্বাস, ভাঙাচোরা
আমার স্বপ্নের ফিসফিস।বাষট্রির এই ছন্নছাড়া ধূলিঝড়ে
কোথায় খুঁজব ডেরা? নিজের শরীর থেকে মুঠো
মুঠো ছাই উড়িয়ে, ফুরিয়ে আয়ু-রেণু
টলতে টলতে আজ এইতো আমার পথ চলা। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
ক এখন একা-একা প্রতিদিন ঘুরছে শহরে।
ফুটপাত ত্র্যাভেনিউ, বিপনী-বিতান, অলিগলি-
কিছুই পড়ে না বাদ। কোন অলৌকিক বনস্থলী
দিয়েছিলো গূঢ় ডাক মধ্যরাতে, তার মনে পড়ে
মাঝে-মধ্যে। ক এখন প্রায়শ আপনকার ঘরে
থাকে না, বসে না চুপচাপ। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ছুড়ে
হাঁটে, শুধু একা, যেতে চায় দ্রুত বহুদূরে।
শহর থাকুক পড়ে, ক এখন বলে রুক্ষ স্বরে।যতই এগিয়ে যায়, তত সে বিরূপ শহরেই
কী আশ্চর্য, ঘুরপাক খায় এবং নিজেকে তার
বড় অসহায় লাগে, বুকে ভয়ঙ্কর ধূলিঝড়,
জব্দ বীণা, মৃত সিংহ। কখনো হারিয়ে ফেলে খেই
চিন্তার, একাকী থাকে পড়ে রিক্ত ঢিবির ওপর-
যেন সে তুখোড় বিক্রেতার হাতে স্তিমিত শিকার। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
হঠাৎ মধ্যরাতে কেন যে উধাও হল ঘুম,
বুঝতে পারিনি। অনেকক্ষণ জানালার বাইরে
তাকিয়ে অন্ধকার আর গাছের পাতাগুলোর
কাঁপুনি দেখে নিজেকে কেন যেন ভীষণ
অসহায় মনে হল। বুঝিবা জানালায়
রাতজাগা এক পাখি এসে বসল।পাখিকে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকতে দেখে
ভাবলাম সে বুঝি বোবা। অথচ
বেশ পরে ওর বেজায় খড়খড়ে স্বর শুনে নিজের
ভুল গেল ভেঙে। ওর ওই নীরবতা এবং
হঠাৎ প্রায় গর্জে-ওঠা শুনতে পেয়ে খানিক
ভীত হয়ে পড়ি! কে এই পাখি? আমাকে
করবে না তো আক্রমণ? কিছুক্ষণ আবার
চোখ বন্ধ রেখে জানি না কিসের ভরসায় আবার
দৃষ্টি মেলে ধরি। হঠাৎ পাখিটি কী ক’রে যে মধুর
সুরে ডেকে ওঠে, কথা বলে মানবিক ভাষায়-
বিস্ময়ে চমকে উঠে দিখে ওকে। হঠাৎ পাখি
উড়ে চ’লে যায়-জানব না কখনও। শুধু ভাবব!
ভাবছি এতকাল পরে আজও, যদি সে
পাখি বলে যেত আমাকে জীবন আর কাব্যের
নানা সমস্যার সমাধন তা হ’লে খেদ যেত ডুবে
আক্ষেপের শত ঢিল। এখনও হাতে কলম
নিয়ে কী দিনে কী রাতে কাগজে আঁচড় কাটি; জানি না
কখনও সার্থকতা আমাকে চুম্বন করবে কি না। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
কে যেন ঠুকরে দিল খুব জোরে ঘুমন্ত আমাকে
আপাদ মস্তক। চোখ খুলতেই দেখি, একি পুবে ও পশ্চিমে,
উত্তর দক্ষিণে ভয়ঙ্কর দাঁত-নখ বের-করা অন্ধকার-
বসে আছে বিকট শকুন এক, যার
চঞ্চু থেকে ঝরছে শোণিত। ‘মানবতা
হয়েছে শিকার তার’, কারা যেন গলিপথে হেঁটে
যেতে-যেতে বলে গেল ভয়ার্ত গলায়। শয্যা ছেড়ে
উঠতে চেয়েও ব্যর্থ আমি, এক ফোঁটা আলো নেই কোনওখানে।বহুদিন হ’ল শহরে ও গ্রামে, কোনওখানে কারও
ঠোঁটে হাসি নেই, এমনকি শিশুরাও হঠাৎ হাসতে ভুলে গেছে
যেন কোন্ অশুভ সংকেতে। আমি আজ
কলমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুনি হাহাকার,
খাতার সফেদ পাতা কেঁপে ওঠে নিরন্ত ফোঁপানি এবং
শৃংখলিত কারও ঝাঁকুনিতে যেন। কে আজ সহায়?
এই হিংস্র অন্ধকারে, হে বিদ্রোহী কবি, আজকাল
আপনাকে বড় বেশি মনে
পড়ছে আমার ক্ষণে ক্ষণে, আপনি তো ঢের আগে
কারার লৌহকপাট তুমুল ভাঙার,
লোপাট করার আর জোর সে হ্যাঁচকা টানে
গারদগুলোকে, ওহো, প্রলয় দোলায়
দুলিয়ে কঠোব কুশাসন সমাপ্তির মন্ত্র জপিয়ে ছিলেন
দেশবাসীদের দিকে দিকে শহরে ও পাড়াগাঁয়।এই বুনো তিমিরে আপনি কবি পুনরায় সূর্যের মতোই
চোখ মেলে বাবরি দুলিয়ে ঝোড়ো বেগে এই জ্যৈষ্ঠে চলে এলে
ভণ্ডদের ক্রূর খেলা হবে শেষ, পশ্চাতগামীর ভুয়ো জয়ঢাক
যাবে থেমে তিমির-বিনাশী প্রগতির
দীপ্ত সুরে। আমরা এখনও ব্যর্থতার
কাদায় আকণ্ঠ ডুবে আছি, হয়ে যাচ্ছি ক্রমে কাদার পুতুল!শুভবাদী পুষ্পগুলি ঝরে যায় অতিশয় দ্রুত,
জানি আজ জাঁহাবাজ দানোদের পায়ের টোকায়
বিচূর্ণ, বিধ্বস্ত কত বিদ্যাপীঠ, বোবা
কান্নায় ত্রিলোক কম্পমান!
মূঢ়, মূর্খদের থুতু, বাচালতা তাড়িয়ে বেড়ায়
বস্তুত ধীমানদের সর্বক্ষণ, পথে ও বিপথে
পড়ে থাকে লাশ, শুধু লাশ। কারও দিকে
কারও তাকাবার ইচ্ছেটাও মৃত। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
ভয়ানক ভয় পেয়ে গেছি। এরকম পরিস্থিতি
হবে, যাকে বলে
স্বপ্নেও ভাবিনি কোনো দিন। আমাকে সবাই মিলে
করিয়ে দিয়েছে দাঁড়। এ ব্যাপারে সত্যি বলতে কী,
প্রস্তুতি ছিল না এতটুকু।
এই চোখ ধাঁধানো আলোয়
মনে হলো আমি যেন সুদূর নূহের আমলের জালার ভেতর থেকে বেরিয়ে
এসেছি
অকস্মাৎ,
যেমন ডিমের
সাদাটে খোলস ভেঙে বড় কোন পাখির শাবক
এসে যায় রোদে। চুলে
চিরুনির আঁচড় পড়েনি কতকাল, নখগুলো
দীর্ঘ আর নোংরা, শার্ট বোতামবিহীন। সেই কবে।
স্বপ্নের ভেতর এক জোড়া মোকাসিন
হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন থেকেই নাঙা পায়ে
কেবলি ঘুরছি দিগ্ধিদিক। ট্রাউজার
ঊর্ণনাভ জাল দিয়ে তৈরি, দোমড়ানো-মোচড়ানো।আমাকে বলতে হবে কিছু কথা শ্রোতার উদ্দেশে,
যারা বসে আছেন সমুখে,
বাগানের কেয়ারির ফুলের মতন সারি সারি। কী বলব
এমন যা শুনে তাঁরা মুগ্ধতার ঘোরে
বাহবা দেবেন ঘন ঘন? হলঘর
করতালিময় হয়ে উঠবে নিমেষে? অতিশয়
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকি, ঠোঁট
শিলীভূত বহু আগেকার মৃতদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে,
সেসব প্রাচীন কণ্ঠস্বর আজ ঠাঁই পেতে চায়
আমার গলায়। আমি কান
বন্ধ করে বোধহীনতায় ডুবে থাকি। কিছুক্ষণ।
এবং উইংস-এর অন্তরালে প্রম্পটার সাজবার ভীষণ হিড়িক
পড়ে যায়। কে কার ওপরে
টেক্কা দিয়ে জোগাবে আমার মুখে নিজেদের কথা,
এ নিয়ে বিস্তর
কিচিরমিচির শোনা গেল। কিন্তু আমি
যদি বলি কোনো কথা তাহলে করব উচ্চারণ
আমার আপন কথা, যতটুকু পারি
নিজেরই ধরনে।আমি মুখ খুলতেই দেখি হলঘরে কোনো সিটে কেউ নেই, কবরখানার
নিস্তব্ধতা ভর করে আছে চতুর্দিকে। নিরর্থক
ভয়ে আমি কাঠ হয়ে ছিলাম এ মঞ্চে সারাক্ষণ। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
এ বয়সে একটি কাঠের ঘোড়া স্বপ্নের ভেতরে
নিরিবিলি চলে আসে। চমৎকার এই খেলনার
কাছে বেশ কিছু শিক্ষণীয় আছে, সে বাংলা ভাষার
দেহে স্বপ্নগুঁড়ো ছড়াবার পর রীতির শেকড়ে
দেয় টান; ছিঁড়ে ফেলে প্রথার নির্মোক মত্ত ঝড়ে
নিরালম্ব যুক্তিহীনতায় ফুল্ল স্বেচ্ছাচারিতার
দীপ জ্বালে এলোমেলো। নানাবিধ বস্তুর আঁধার
হননের পর ক্রীড়াপ্রিয় ভাষা অন্য পথ ধরে।স্বপ্নাশ্রিত কাঠের ঘোড়াটি ভাঙচুর সমর্থন
করে আর দৃষ্টি তার নিবদ্ধ উত্তর-আধুনিক
শিল্পের দিকেই আর রূপকল্পে আনে আলোড়ন।
অভিনব এবং খরার পরে সবুজের বানে
ভেসে যাই; অতঃপর হেলেনের চেয়েও অধিক
মহুয়ার রূপের কদর হয় গাথা আর গানে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
ভোরবেলা চোখ মেলতেই দেখি আকাশে কালো মেঘের
জটলা। মেঘ গলছে বৃষ্টি হয়ে, ঘুমের ঘ্রাণময় মন
ভিজতে থাকে। রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম তুমি এসেছ আমার কাছে
কদম কানন পেরিয়ে সেই নীল যমুনার তীর ঘেঁষে কত দূর থেকে।
জাগরণের এই মুহূর্তে হঠাৎ তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্যে আমার
হৃদয় হলো কদম ফুল। আকাশের ঘনকৃষ্ণ মেঘ আর রাধা-
বিদ্যুৎ দেখি। তারপর নেমে-আসা বৃষ্টিধারার দিকে তাকিয়ে থাকি
নিষ্পলক। কেমন ব্যাকুলতা ঠোঁট তোমার ঘুমের সরোবরে
কোনও ঢেউ জাগাতে পারবে না এখন। তুমি জানবেও না এই মুহূর্তে
তোমাকে দেখার জন্যে আমি কেমন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আমার চতুর্দিকে
জেগে-ওঠা মরুভূমিতে। এই যে আমার হৃদয় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে
তোমার নিদ্রিত শরীরকে একটু স্পর্শ করার জন্যে, এ-কথা তুমি বুঝবে
কী করে? আমার হৃদয়ের ওষ্ঠ তোমার ঠোঁটে মিলিত হওয়ার উদ্দেশে
পাখি হয়ে উঠতে চাইছে তুমি অনুভব করতে পারবে কি, যখন তোমার
শরীর থেকে ঝরে যাবে ঘুমের কুয়াশা? (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
এইমাত্র কবিতার মনোহর বাড়ি থেকে একলা, উদাস
বেরিয়ে এলেন তিনি। কিয়দ্দুরে আড়ালে দাঁড়িয়ে
ঘন ঘন ফুঁকছেন সিগারেট; ধোঁয়া
ঘিরে ধরে তাকে, কাছে ধারে
তরুণ কবিরা নেই, কেউ নেই, কোথাও গুঞ্জন নেই কোনো;
তিনি একা, আজ বড় একা, দুঃখের কাফনে মোড়া।একদা ছিলেন মিছিলের প্রথম কাতারে, মুখে
ফুটতো শ্লোগান স্ফূলিঙ্গের মতো, যেন
নিজেই পতাকা, এরকম উড়তেন জনারণ্যে কী সুন্দর।
অধুনা বিবরবাসী, অন্য কাউকেই
নয়, নিজেকেই বেশি দ্যাখেন চৌদিকে। জপতপ
আছে বটে, আছে সন্ন্যাসীর মতো মন্ত্রের সাধনা।এগিয়ে গেলাম তার দিকে। এক রাশ ধোঁয়া থেকে
কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আরে তুমি, কী অবাক কাণ্ড,
তুমি এলে অবশেষে এ নির্জন কোণে? ভুল ছবি
দেখছি কি? আজকাল আমাকে গলিতে কুষ্ঠরোগী
ভেবে কেউ ঘেঁষে না নিকটে। হা, আমার কিবা দিন কিবা রাত্রি’।
‘আপনার কাছে আমি কবিতার ডৌল দেখে নেব’, জানালাম।‘পদ্য রাখো, আমাকে একটু স্পর্শ করো, বহুদিন মানুষের
নিঃশ্বাস লাগে না গায়ে, ছোঁয়া না আমাকে কেউ আর।
কারো দিকে প্রীতিবশে তাকালেও তার
দৃষ্টি বড় বেশি ঠাণ্ডা মনে হয়; হায়,
এর চেয়ে তাচ্ছিল্য বরং ভালো, বলে তিনি যেন নক্ষত্রের
সঙ্গে কিছু কথা সেরে নেয়ার তাগিদে ধোঁয়াশায় মিশে যান। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
শহরে নেমেছে সন্ধ্যা, যেন নীরব ধর্মযাজিকা
প্রার্থনায় নতজানু। ফুটপাতে বেকার যুবক,
বিশীর্ণ কেরানী ঘোরে, লাস্যময়ী দৃষ্টির কুহক
হেনে হেঁটে যায়, কেউ কেউ দোকানকে মরীচিকা
ভেবে চিত্রবৎ স্থাণু কারো কারো চোখে স্বপ্নশিখা।
ক্লান্ত পাখিঅলা পঙ্গু পথিকের সঙ্গে মারাত্মক
বচসায় মাতে আর স্বপ্ননাদিষ্ট পুলিশও নিছক
অভ্যাসে বাজায় বাঁশি, কম্পমান কৃষ্ণ যবনিকা।আমাকেও সন্ধ্যা তার কেশ-তমসায় ঘন ঢেকে
কেমন বিষণ্ন ঘণ্টা বার বার বাজায় আমার
অস্তিত্বের অণুপরমাণুময় ক্রূদ্ধ বনভূমি
লুকানো সৈনিক নিয়ে ধেয়ে আসে চতুর্দিক থেকে,
ক্লান্তিতে দুচোখ বুজে আসে, জীর্ণ আমার সত্তার
মরুতে জীবনতৃষ্ণা কী প্রবল জাগিয়েছো তুমি। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
এখনো আমার কবিতার যারা আগ্রহী পাঠক
আর যারা কখনো ছুঁয়েও দ্যাখেন না এইসব
পঙ্ক্তিমালা, তাদের জরুরি মূল্যবান কলরব
স্তব্ধতায় ঝিমোলে খানিক, মুছে ফেলে কিছু ছক
আমার কবিতা এই ক্রান্তিকালে গূঢ় পর্যটক
নান্দনিক ভূমণ্ডলে। জীবনের শিঙ ধরে যুঝি
সাধ্যমতো; নানা স্তরে রূপের আড়ালে রূপ খুঁজি,
যতই ধরুন খুঁত বিজ্ঞ, সন্ধানী সমালোচক।এই শহরেই আছে একজন যার ধ্যানে কাটে
সারাবেলা, যার নাম উচ্চারণে ক্লান্তি নেই আর
যার কথাশিল্প থেকে পাই কত কবিতার শাঁস,
যার পদধ্বনি বাজে আমার সনেটে বারবার,
যাকে খুঁজে পেতে চায় কৌতূহলী জন এই বাটে,
তার উদ্দেশেই ন্যস্ত আমার এ নিঃশ্বাস, বিশ্বাস। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রকৃতিমূলক
|
আবার নিভৃতে বসন্তকে কী ব্যাকুল আলিঙ্গন
করলাম রাত্রির প্রথম যামে; জ্যোৎস্না ঝলসিত
সরোবরে স্নিগ্ধতায় অবগাহনের অনুপম
মুগ্ধতা আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল অলকনন্দার
তটে যেন মন্ত্রবলে। পুনরায় বাঁচার আনন্দে
আশ্চর্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠি, গীতবিতানের পাতা
খুলে বসি, গীতধারা বয় শিরায় শিরায় আর
ওষ্ঠ সিক্ত হয় ক্ষণে ক্ষণে পুলকের মদিনায়।এ প্রখর শীতে অনুভব করি আমার শরীরে
গজায় সবুজ পাতা, রঙ-বেরঙের ফুল ফোটে
অকস্মাৎ বহুদিন পর। সে, রূপসী সাহসিকা,
আমাকে জাগিয়ে তোলে শোকগ্রস্ত ভস্মস্তূপ থেকে
কী সহজে; করিনি শিকার কুড়া বন-বনান্তরে,
তবুও পেয়েছি আমি মলুয়াকে কদমতলায়! (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
ভাবিনি এমন ভয়ঙ্কর অন্ধকার তীক্ষ্ণ দাঁত
বের করে দেশকে করবে গ্রাস। ঢ্যাঙা, ক্ষিপ্ত ঘোড়া
চারপায়ে করে তছনছ দেখি দেশজোড়া
চলে কুশাসন লম্বকর্ণদের, ভীষণ সংঘাত
পথে পথে, স্বামীহারা নারী আজ করে অশ্রুপাত
কত ঘরে, সংগ্রামী মানুষ মরে গুলির বৃষ্টিতে,
প্রবল ঝাঁকুনি লাগে মানবিকতার দৃঢ় ভিতে
শ্রেয়োবোধ লুপ্তপ্রায়, সহিংসতা নাচে দিন-রাত।যেদিকে তাকাই দেখি মাটি ফুঁড়ে বেরোয় অদ্ভুত
প্রাণী দলে দলে, যেন বিকট গণ্ডার, যায় ছুটে
মানুষের পেট চিরে ফেলার উদ্দেশ্যে, এইসব
হিংস্র মূর্তি সংহার করবে যারা তাদের নিখুঁত
প্রক্রিয়া হয়েছে শুরু অন্তরালে, ওরা লুটে-পুটে
খাবে না কিছুই শুধু বাজাবে সৃষ্টির কলরব। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
কে তুমি আমাকে দূর অজানায় নিয়ে
যাওয়ার উদ্দেশ্যে মন্ত্র পড়ছ এমন
অপূর্ব মধুর সুরে? তুমি কি প্রচ্ছন্ন জাদুকর?
তোমার জাদুর ধোঁয়া আমার চৈতন্যে
ছাড়তে কোরো না চৈষ্টা, ব্যর্থতায় সকল প্রহরে
খাবি খেয়ে পরিণামে হারাবে চেতনা।জানি তুমি আমার কথায় এতটুকু করছ না
কর্ণপাত; আমাকে নির্বোধ
ঠাউরে অন্তরে হেসে আমাকে জাদুর ধূম্রজালে
বন্দি করে রেখে দেবে চিরতরে অশুভের গোলাম বানিয়ে।
না, আমি তোমার কোনও তেলেসমাতির
ধোঁয়ায় হারাব জ্ঞান-এই আশা ঝবরে কালিতে।আমার জীবন শুধু রাশি অপরূপ ফুল
নিয়ে গুণগ্রাহীদের আসরে কাটিয়ে
পুরস্কার লাভের স্বপ্নের ঝলমলে পথে ঘুরে
বেড়ানোর নকল সুখের খেলা নয় বলে জানি।
এই তো দেখছি আমি পাহাড়ি পাথর থেকে দ্রুত
গড়িয়ে পড়ছি আর শরীরের নানা অংশ ছিঁড়ছে ভীষণ।তা হ’লে কি এভাবেই পঙ্গুর ধরনে সারা জীবন আমাকে
নিজের ব্যর্থতা বয়ে কাটাতেই হবে? পথে হেঁটে
গেলে অন্য পথিকেরা আমার পঙ্গুত্ব দেখে মনে-মনে কেউ-
কেউ কষ্ট অনুভব করে। দিন যায়, দিন আসে।
দেখছি মানুষ কী সহজে মানুষের রক্ত ঝরায় এবং
কখনও কখনও মানুষেরই হাত বহু মানুষকে রক্ষা করে। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
হে শহর, হে প্রিয় শহর, হে অন্তরঙ্গ আমার,
তুমি কি আমাকে পাঠাতে চাও বনবাসে?
নইলে কেন এই উত্তেজনা তোমার সমগ্র সত্তা জুড়ে?
কেন এই আয়োজন, দাঁতে-দাঁত-ঘষা আয়োজন
প্রহরে প্রহরে? হে শহর, তুমি কি বাস্তবিকই
নির্বাসন বরাদ্দ করেছ আমার জন্যে?হে শহর, হে প্রিয় শহর, হে মোহিনী আমার,
দেখি এখন তুমি আমার চোখে চোখ রেখে
তাকাতে পারো কি না।
এই তো আমি তোমাকে দেখছি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে,
তোমার চোখ কেন মাটিতে নিবদ্ধ?
কেন এই অস্বস্তির দ্বিধা তোমার চোখে?
তাহলে কি আমি বুঝে নেব যে তোমার চোখ
আমাকে আর চাইছে না?
তাহলে কি আমাকে একথা মেনে নিতে হবে যে,
যে-তুমি আমার শৈশবকে চেটে চেটে বয়স্ক করেছ,
যে-তুমি আমার যৌবনকে ঢেকে দিয়েছ রাশি
রাশি কৃষ্ণচূড়ায়,
যে-তুমি আমার চল্লিশোত্তর আমাকে শাণিত করেছ,
সেই তুমি আমার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ মনে-মনে?হে শহর, হে আমার আপন শহর,
তোমাকে ঘিরে আমার কিছু স্মৃতি কাননবালার মতো গান গায়।
তোমার কি মনে পড়ে না একদা কী দিন রাত্রি ছিল আমার?
আমি তোমার বুকে মাথা রেখে
গলা ছেড়ে গান গাইতাম নির্দ্বিধায় প্রহরে প্রহরে।
আমিই তো ছিলাম প্রথম আবিষ্কারক তোমার সৌন্দর্যের।
তোমার সৌন্দর্যের শপথ, আমার আগে অন্য কেউই
এমন মজেনি তোমার সৌন্দর্যে।
তুমি কি ভুলে গেছ সেসব উথাল-পাথাল মুহূর্ত,
যখন দু’পায়ে তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরতে আর আমি
তোমার স্পন্দিত স্তনে মুখ রেখে একটা মদির স্বপ্ন হয়ে যেতাম?
আমার আঙুলের বাঁশি তোমার মাংসের স্তরে স্তরে
সুর জাগিয়ে তুলত, তুমি কি ভুলে গেছ?
তোমার কি মনে পড়ে না
তোমার জন্যে কী অক্লান্ত ছুটে বেড়াতাম সূর্যোদয় থেকে
সূর্যাস্তের দিকে,
যেমন প্রাচীন গ্রিক দেবগণ পশ্চাদ্ধাবন করতেন
সুন্দরীদের প্রান্তরে প্রান্তরে, বন-বনান্তরে?
আহ্ কী দিন রাত্রি ছিল একদা আমার।তোমার কটিদেশে হিংস্রতার আস্ফালন দেখতে পাচ্ছি।
তোমার আস্তিনের অন্ধকারে কোনো বাঘনখ লুকিয়ে নেই তো?
তোমার ঝলমলে আংটির গহ্বরে ক’ফোঁটা কালো জহর
জমা করে রেখেছ আমার জন্যে?
তোমার মনের অলিগলিতে কোনো দুরভিসন্ধি নেই,
এ-কথা আজ আমি জোরাল কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারছি কই?শহর, হে প্রিয় শহর আমার, হে বিশ্বাসঘাতিনী
ইদানীং তুমি আমাকে বড় বেশি সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছ।
তোমাকে নির্ভয়ে আলিঙ্গন করতে পারছি না আর,
চুম্বন এঁকে দিতে পারছি না তোমার রক্তিম ওষ্ঠে-
এ এক চরম শাস্তি যা আমাকে খাচ্ছে কেবলি।
এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি এই দারুণ আড়ালে,
কে জানে কেউ আড়ি-পেতে শুনছে কিনা আমাদের এই কথাবার্তা!
কে জানে ক’জন পঞ্চ ব্যঞ্জনপুষ্ট ঘাতক এখন তৈরি হচ্ছে গুপ্ত আস্তানায়,যেখানে মৃত্যু তার ভোগ নিতে আসে,
যেখানে দাঁড়কাকের মতো কী একটা পাখা ঝাপটায় সর্বক্ষণ
যেখানে হাজার হাজার মৃন্ময় বদনা নরমুন্ড হয়ে নাচে
জ্যোৎস্নায়?
ওরা কোনো যূপকাঠ নির্মাণ করছে কিনা ঘোর অমাবস্যায়,
কে আমাকে বলে দেবে?বুকের রক্ত ঝরিয়ে
যে-বাগান গড়ে তুলেছি দিনের পর দিন,
তুমি তার প্রতিটি ইঞ্চি তছনছ করে দিয়েছ এক অন্ধ ক্রোধে।
একদা যেসব সুন্দর উপহার তুলে দিয়েছিলে আমার হাতে,
নিজের হাতেই তুমি আজ সেগুলি
ছিনিয়ে নিতে চাও আবার? আমার বুকের মধ্যে
যে রুপালি শহর জেগে থাকে তার আশ্চর্য কলরব নিয়ে,
সেখানে তুমি পাথুরে স্তব্ধতা ছড়িয়ে দিতে চাও
কিসের নেশায় হে শহর আমার, হে ভয়ংকর ভাস্কর?তোমার কাছে গোলাপ প্রার্থনা করে আমি নতজানু,
তুমি কেন ক্যাকটাস ছুড়ে দাও?
তোমার চোখে দেখছি ফলের সম্ভার, পোকাকীর্ণ শব,
বিবাহবাসর, ঘাসঢাকা গোরস্থান, নবজাতকের তুলতুলে শরীর,
বৃদ্ধের তোবড়ানো গাল, যুবকের মসৃণ চিবুক, মরা মাছ,
উড়ন্ত মরাল, কংকালসার মহিষ, যুবতীর গ্রীবা, পোড়ো বাড়ি,
সতেজ ডালিয়া আর লুটেরার লোভী হাত আর সন্তের চোখ,হে শহর, হে আমার আদরিণী বেড়াল,
এ তোমার কেমন ঢঙ বলো তো?
যেন তোমাকে আমরা খেতে দিইনি কোনো দিন
সকালবেলার আলোর মতো দুধ,যেন তোমার নরম পশমে আঙুল ডুবিয়ে বসে থাকিনি
ঘণ্টার পর ঘণ্টা,
যেন তোমার চোখে চোখ রেখে বলিনি মনে রেখো!হে শহর, হে প্রিয় শহর, হে অন্তরঙ্গ আমার,
তুমি কি সেই ভীষণ দলিলে সই করে ফেলেছ,
যার প্রতাপে আমি কাঁদব দীর্ঘ পরবাসে?
আমার সঙ্গে কোনো ছলাকলার প্রয়োজন নেই,
তুমি অসংকোচে উচ্চারণ করতে পারো নিষ্ঠুরতম ঘোষণা-
আমি রৌদ্রমাখা ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে যাব
প্রতিবাদহীন, কোনো অভিমানকে প্রশ্রয় না দিয়েই।
তবে যাবার আগে
আমি তোমার সবচেয়ে ভয়ংকর রূপও দেখে নিতে চাই, হে
বিশ্বাসঘাতিনী।
আমি অপেক্ষা করব,
তোমার নীলচক্ষু বৎসদের সকল খেলা গোধূলিতে মিলিয়ে গেলে,
আমি তোমার ওষ্ঠে চুম্বন এঁকে
সৌন্দর্যের ভিতরে মৃত্যু এবং মৃত্যুর ভিতরে সৌন্দর্য দেখে যাব,
আমি সন্তের মতো অপেক্ষা করব উপবাসে দীর্ঘকাল। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
আকাশ এমন দ্রুত কেন কালো হয়ে
গ্রাম আর শহরের অধিবাসীদের
ভীষণ কাঁপিয়ে দিচ্ছে? দৃষ্টি জুড়ে
কী দেখছে তারা আকাশের কালিমায়? ঝাঁক ঝাঁক
ঢের কালো দীর্ঘদেহী শকুন উড়ছে কাঁটাময়
অনাহারে হিংস্র ওষ্ঠ নিয়ে। ওরা ছিঁড়ে খেতে চায়
পথে-হেঁটে-যাওয়া আর বারান্দায় দাঁড়ানো অনেক
নারী পুরুষকে যেন। অকস্মাৎ একত্রে সবাই
লাঠিসোঁটা আর কেউ-কেউ স্টেনগান নিয়ে খুনি
পাখিদের মেরে প্রিয় শহরের আর গ্রামের বাশিন্দা মিলে
তাড়াল নিমেষে দূরে অজানায়। শান্তি এল ফিরে। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
ছিলেন আটক তিনি এলোমেলো ভাবনার হিম কুয়াশায়;
উপমা, উৎপ্রেক্ষা কিংবা স্রেফ শাদাসিধা
বর্ণনার অবয়ব-এসব কিছুই নয়। মেঘদল থেকে
ভেসে-আসা নিঃসঙ্গ, রহস্যময় বলছে তাকেই‘কবি, তুমি কলম টেবিলে রেখে নিষ্ক্রিয় থাকবে কতকাল?
তোমার চোখে কি পড়ছে না
পুঞ্জ পুঞ্জ হিংস্র অন্ধকার
গিলে খাচ্ছে তোমার আপনকার শহর ও গ্রাম?‘কিব, তুমি আর কতদিন, বল, থাকবে এমন উদাসীন
এই অবিরাম তাজা রক্তঝরা, আর্তনাদময়
দিনগুলি, রাতগুলি, হানাদার ছোরা
আর বুলেটের তাণ্ডবের ক্রূর ঝড়ে?‘কবি, তুমি শোনোনি কি ভাসমান মেঘদলে ধর্ষিতা, গ্লানির
কাঁটায় ভীষণ জর্জরিত আত্মঘাতী মহিমার
ম্লান মুখ ঝরায় নালিশ এই নিষ্ক্রিয়, বেজায়
মূক সমাজের দিকে? শোননি কি তুমি?‘কবি, তোমার কি জানা নেই পুলিশী সন্ত্রাসে বড় জর্জরিত
প্রগতি ও কল্যাণের পথে অগ্রসর, প্রতিবাদী সেই
তরুণের অস্ত্রাঘাত-চিহ্নিত, নিষ্প্রাণ
শরীরের ভেসে-ওঠা জলাশয়ে, মা’র চোখে বান?’
কালো রাত প্রত্যুষে রূপান্তরিত হওয়া সঙ্গেই সেই মেঘবাসী
প্রশ্নকর্তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কবি যেন ঘোর
দুঃস্বপ্নের অরণ্য পেরিয়ে জেগে ওঠেন এবং
ফেলে-রাখা কলমটি প্রবল আবেগে তুলে নেন। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
বৃষ্টির সেহ্রা পরে ফ্ল্যাটবাড়িটা দাঁড়ানো
রাস্তার ধারে। তোমার ড্রইরুমে
আমরা দুজন গল্প করছি এটা সেটা নিয়ে, মাঝে মাঝে
পড়ছি কবিতা। কখনো জীবনানন্দের
দারুচিনি দ্বীপের ভেতর আমার প্রবেশ,
কখনো বা আলিঙ্গনরহিত অঙ্গে অঙ্গে
ইয়েটস-এর শাদা পাখির পাখার ঝাপট
আর সমুদ্রের ফেনা ছুঁয়ে যাওয়া। এক সময় চায়ে
চুমুক দিতে দিতে
ছন্দ বিষয়ে তোমার কৌতুহল চড় ইয়ের আঙ্গিক।আমার কাছ থেকে তুলে নিচ্ছিলে জবাব,
যেমন পাখি ফলমূল
চঞ্চু দিয়ে। টিপয়ে শূন্য চায়ের কাপ আর
স্ন্যাকস-এর ভগ্নাংশ; তখনো
বৃষ্টির বাজনা থামে নি। সোফায়
গা এলিয়ে হঠাৎ তুমি বললে, ‘ধরা যাক তোমার
ডান হাত আমার হাতে এসে নীড় বাঁধলো
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধরনে, তখন কী করবে তুমি?’চমকে উঠলাম। আমিতো সেই কবে থেকে
প্রবেশ করতে চাই তোমার একলা ভেতরে,
জাগিয়ে তুলতে চাই তোমার
অত্যন্ত ভেতরকার তোমাকে আর তোমার সত্তায় সরাসরি
মিশিয়ে দিতে চাই আমার সত্তা।
জীবনানন্দের কাব্যসম্ভার থেকে
চোখ তুলে তুমি তাকালে
আমার মধ্যবিত্ত সংস্কারে আরণ্যক ঝড় জাগিয়ে।
তোমার দৃষ্টি এবং হাসিতে ক্রমাগত
কাঁপতে থাকে কয়েক শতাব্দীর আলো-অন্ধকার। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
প্রতিদিন কত কিছু চোখে পড়েঃ পথঘাট, যান,
এবং দোকানপাট, ঝকঝকে, মানুষের ভিড়,
রেস্তোরাঁ, শ্যামল পার্ক, নৌকোময় শান্ত নদীতীর
চিড়িয়খানার বন্দী পশুপাখী, পুরোনো অর্গান।
পথে কৃষ্ণচূড়ার বিদ্রোহ, একজন বর্ষীয়ান
নিঃশব্দে পোহান স্মৃতি, তাঁর গলকস্বলের ভাঁজে
চুমু খায় ভোরবেলা; বেহালাবাদক মাঝে মাঝে
দেখা দেয়, নোংরা গলিটাও হয়ে ওঠে ঐকতান।দৃশ্যে পরেও দৃশ্য, ভিন্ন ভিন্ন, কেমন সুদূর
অগোচরে থেকে যায়। কল্পনায় জাগে দীপাবলি,
খৃষ্টপূর্ব কোনো কুমারীর হস্তধৃত পদ্মকলি,
মায়াবী মানস হংস, সরোবর; বিপুল বৈভবে
জেগে ওঠে সামান্যের অবয়ব কখনো বা, তবে
হে মেয়ে তোমাকে স্বপ্নে দেখাটাই সবচে মধুর। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
একটি ক্রন্দনরত বড়ো মাছ শুয়ে আছে ডিশে
মশলাসজ্জিত রূপে; আহার্য সে, আমরা ক’জন
তবু তাকে স্পর্শ করা থেকে বিরত ছিলাম, বুঝি
মাছের কান্নার জল সে-রাতে দেখেছিলাম, ফলে
অন্য আহার্যের স্বাদে রসনাকে সিক্ত করে ফিরে
গেলাম যে-যার ঘরে। সেই মাছ সঙ্গে ছিল এই
বয়েসী কবির, তার চোখে স্বপ্নের অজস্র কুঁড়ি
ফোটার আশায় ছিল, কবির তা মনে হয়েছিল।ঘরে বসে ভাবি সে-রাতের রেস্তোঁরার কিছু কথা,-
একটি টেবিলে গোল হয়ে বসেছিল তিনজন
নারী আর একজন অর্ধনারীশ্বর। মৃদু পর্যটন
ছিল কারো কারো নয়নের, ছিল মার্জিত তামাশা;
একজন স্বর্ণাভ রমণী আর এই কবি আজো
স্মৃতিতে ধারণ করে মাছটির অশ্রুর শিশির। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
তাঁকে চেনে না এমন কেউ নেই এ শহরে
তিনি থাকেন
সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় হাঁটেন মোজাইক করা মেঝেতে
বসেন ময়ূর সিঙ্ঘাসনসুলভ পদিমোড়া চেয়ারে
খ্যাতি তাঁর পায়ের কাছে কুকুরের মত
কুঁই কুঁই শব্দে লেজ নাচায়
হলফ করে বলতে পারি আমাদের আগামী
বংশধররা বাধ্যতামূলকভাবে পড়বে তাঁর সচিত্র জীবনী
স্কুল কলেজে সমাজ রাষ্ট্র জগৎসংসার বিষয়ক তাঁর হ্যাণ্ডবুক
সুকান্ত লাইনো টাইপে
প্রকাশিত হবে বছরের পর বছর
আর এওতো অবধারিত যে তাঁর জন্মবার্ষিকী এবং
মৃত্যুবার্ষিকীতে আপামর জনসাধারণ
ভোগ করবেন সরকারি ছুটিআমাদের এই পঙ্গু দেশ যাতে তিন লাফে এলাহি
পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে পারে
সেজন্যে রাত জেগে তিনি দেখেন বন্যায় ভেসে যাওয়া
ছাগলের পেটের মত ঢোসকা নিবন্ধ
ফজরে দশ মিনিট নামাজ পড়ার পর তিনি
পনেরো মিনিট তেলাওয়াত করেন কোরান পাক
খুরপি আর ঝারি হাতে
আধঘণ্টা বাগান করেন
দুর্লভ জাতের গোলাপ ফোটানোই তার লক্ষ্য
এক ঘন্টা কাটে তাঁর
ব্রেকফাস্টা করে খবরের কাগজ পড়ে
আর ডেটারজেন্ট সুবাসিত সাফসুতরো বাথরুমে
তিনি দশটা পাঁচটা অফিস করেন নিয়মিত
ক্লাবের টেনিসকোর্টে কাটান ঘণ্টা দেড়েক
ছেলেমেয়েদের আদর করেন পনেরো মিনিট
ঘড়ি ধরে ঘরের বউকে সোহাগ করেন ত্রিশ মিনিট
পরের বউকে নব্বই মিনিটমাশাল্লা মজবুত তাঁর গাঁথুনি
ইস্পাতি গড়ন অথচ
মাখনের মত নরম তাঁর মন
প্রত্যহ তিনি পরিবগুর্বোদের জন্যে দুঃখ করেন
পাক্বা তিন মিনিট। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যাবে যদি চ’লে যাও, কোরো না খামোকা কালক্ষেপ।
অতীত ফেলতে চাও মুছে ইরেজার দিয়ে ঘ’ষে
সাত তাড়াতাড়ি? এত বিরূপতা শুনি, কার দোষে?
আমাকে সাজালে মস্ত অপরাধী করবো না আক্ষেপ
কোনো দিন। এই যে ভুগছি নিত্য, তোমার ভ্রুক্ষেপ
নেই তাতে কিছুমাত্র। তীরে এসে নৌকা ডুবে যায়
বার বার, বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে থাকি অসহায়;
করি না প্রার্থনা আর কার্বাঙ্কলে কৃপার প্রলেপ।কী ক’রে ফেলবে মুছে ওষ্ঠ থেকে চুম্বনের দাগ
এত শীঘ্র? রাত্রিবেলা একা যখন ঘুমাতে যাবে
নিস্তাপ বালিশে মাথা রেখে, ঝেড়ে-ফেলা অনুরাগ
আগুনের হল্কা হ’য়ে রাতভর তোমাকে পোড়াবে।
তোমার বিরুদ্ধে নেই ধিক্কার অথবা অনুযোগ,
আমার জন্যেই থাক মনস্তাপ আর দুঃখভোগ। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
দুপুরটার যেন গায়ে হলুদ আজ। আমি জানি, একটু পরেই তুমি
নরম পায়ে তোমাদের দোলনায় ছায়াটে বারান্দায় এসে বসবে।
দৃষ্টি ছড়িয়ে দেবে সামনের দিকে, চোখে পড়বে একটি কি দু’টি
ছুটন্ত মোটারকার, রিক্শা। কোনও কোনও পথচারীও হবেন দৃশ্যমান।
এরই মধ্যে হয়তো আমার কথা ভাববে তুমি দূরের গাছটির প্রতি
মনোযোগী হয়ে। হয়তো তোমার কোনও বান্ধবীকে আজ টেলিফোন
না করার লজ্জা তোমাকে খানিক বিব্রত করবে, একটু পরে চোখ
ফেরাতেই তুমি হঠাৎ আবিষ্কার করবে তোমার খুব কাছে একটি পাখিকে।
তোমাকে আমার একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে পাখিকে জানিয়েছিলাম।
বিনীত অনুরোধ। ওকে বলেছি, ‘তোমাদের কথা এত লিখেছি, তার
বিনিময়ে তুমি কি আমার দয়িতার কাছে বয়ে নিয়ে যাবে না একটি
বার্তা?’ আমার কণ্ঠস্বরে আকুলতা পাঠ করে পাখি তার পাখা ছড়িয়ে
দেয় আমার সামনে। আমি প্রসারিত পাখায় লিখলাম, ‘আজ সন্ধ্যায়
এসো, প্রতীক্ষায় থাকব। তুমি এখন নিশ্চয় পড়ে উঠতে পেরেছ বিহঙ্গবাহিত
লিপি। মনে-মনে বলছ, ‘কবির আদিখ্যেতা দেখে বাঁচিনে; টেলিফোন না
করে পাখির পালকে খবর পাঠিয়েছেন। এক সময় বার্তাবাহক পক্ষীটিকে
তুমি আদর বুলোতে থাকবে। সেই স্পর্শ আমাকেই প্রজ্বলিত করবে আর
আমি লেখার টেবিলে বসে একটি প্রেমের কবিতা লেখার জন্যে শব্দের
ঝর্ণাধারাকে ডেকে আনব খাতায় পাতায়, ভাসব আনন্দ-প্লাবনে। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
লোকটা একলা হাঁটে ফুটপাতে, পার্কে
বসে কিছুক্ষণ গাছ গাছালির মাঝে, শোনে ‘এ জগতে কার কে’
ব’লে একজন বৃদ্ধ, হয়তো ছিটগ্রস্ত, গেলেন বেরিয়ে,
যেন কোন ব্যর্থ, নিঃস্ব অভিনেতা। লোকটা এড়িয়ে
কৌতূহলী দৃষ্টি বেঞ্চি ছেড়ে উঠে যায়,এবং তাকায় আশপাশে, আত্মসুখে বুঁদ, দ্যাখে বসন্ত জাগ্রত
তরুণীর যৌবনের মতো।
লোকটা কখনো ঘাসে কখনো আকাশে
চোখ রাখে, কখনোবা নীল মসজিদের গম্বজের
অনেক ওপরে উড়ে যায়, মেঘে ভাসে;
ইচ্ছে হলে ফের
পাতালে প্রবেশ ক’রে, জলপুরী দেখে
কাটার প্রহর;
জলকিন্নরীর কথা বলে, গাঢ় চুমো এঁকে
ওদের অধর
কেমন রাঙিয়ে দেয়, কখনো বা বিরান উদ্যানে
জাগায় ফুলের গুচ্ছ শুকনো গাছে ফের গানে গানে।বড় বেশি জনহীন পথে লোকটা একাকী হাঁটে
শিস্ দিতে দিতে, ভাবে পা রাখবে সোনালি চৌকাঠে
ঝেড়ে ফেলে ধুলোবালি শান্ত বেলাশেষে।
অকস্মাৎ কী-যে হয়, দূরে থাকে ঘর,
নিমেষে সে মেশে
অক্ষরের ভিড়ে, হয়ে যায় অলৌকিক কণ্ঠস্বর। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
অঙ্গুরি এসেছ তুমি ফিরে অজ্ঞাতবাসের পর
আমার এ ঘরে আজ। বহুদিন ছিলে অন্ধকারে
বস্তুত গা ঢাকা দিয়ে; তোমাকে ভেবেছি বারে বারে,
দেখেছি তোমার স্বপ্ন কত, ইতিমধ্যে বহু ঝড়
ঝাপ্টা গ্যাছে, বিস্মৃতির এক্কা দোক্কা তোমার খবর
সহজে ফেলেছে মুছে কখনো সখনো। কোন্ তারে
কখন লেগেছে সুর পুনরায় কোমল গান্ধারে,
আমিতো পাইনি টের; ছিল খুব হৃদয়ের জ্বর!হে অঙ্গুরি, তোমার শরীরে লতাগুল্ম, বুনো ঘাস,
গৃহত্যাগী যুবকের স্বেদ, ধুলো ইত্যাদির ঘ্রাণ
লেগে আছে, সবচেয়ে বেশি আছে ভালোবাসবার
সাধ ও ক্ষমতা যা সহজে মুমূর্ষুকে পারে প্রাণ-
শক্তি ধার দিতে আর লহমায় দূরের আকাশ
বুকে এনে স্বপ্ন দেখাতেও পারে ঘর বাঁধবার। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
একবারও আমি কি বলেছি আসবো না আগামীতে
তোমাদের কাছে আর? উত্তোলিত হাতের মুঠোয়
লাগবে না নীলিমার ছোঁয়া?
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখে কোনোদিন
পদযাত্রা করবো না? তবে
কেন এত কানাঘুষো তোমাদের চায়ের আসরে
বস্তুত আমাকে নিয়ে? আমিতো বলিনি আসবো না,
মেলাবো না কণ্ঠ তোমাদের কণ্ঠস্বরে। তবু কেন
কথায় কথায়
কাঁটার ঝিলিক রাত্রিদিন? হায়, আমার নসিব,
এখনো ধোঁয়াচ্ছে ঘোর সংশয় নিয়ত।এই যে আমাকে, হে বন্ধুরা, এত দিন কাছে পিঠে
দেখতে পাচ্ছো না, এর মানে এ নয় যে আমি দূরে
সরে গেছি তোমাদের কাছ
থেকে, আপাতত
গা এলিয়ে আশমানে চোখ রেখে দেখে
নিচ্ছি তারাদের মাইফেল। বহুদিন
আকাশের দিকে তাকানো
ঝিমানো ঝিলের মতো অবসর ছিল না আমার।এই যে এখন জনসভা, হট্রগোল ছেড়ে ছুড়ে নিরালায়
গোলাপ, চামেলী, জুঁই নিয়ে, বই নিয়ে
মেতে আছি প্রায় সারাক্ষণ, তা বলে ভেবো না আমি
পলাতক। ভেবো নাপ আমার
অঙ্গীকার সরোবরে ডুবিয়ে মাছের
বুড়বুড়ি, ফাৎনার কম্পন আর পাতা ভেসে-যাওয়া
দেখে দেখে জীবন কাটিয়ে দেবো। এটা সত্য বটে,
পাখির চোখের অভ্যন্তরে
কোন্ রহস্যের খেলা চলে তার অন্বেষণে আজ দীর্ঘ বেলা বয়ে যায়।
কে আমি? কোথায় যাব? ইত্যকার প্রশ্নেরও ঠোকর
খেতে হয়, এর মানে এ নয় যে দানবের দাপটের কথা,
সংহার মূর্তির কথা ভুলে গেছি, সকল কিছুই
জ্বলন্ত লোহার সদ্য ছ্যাঁকের মতোই
দগদগে হয়ে আছে স্মৃতির কপালে।এই যে মধুর এক মহিলার মুখ মনে করে
প্রহরে প্রহরে জ্বলি একা, তার উদ্দেশে সাজাই
অক্ষরের অর্ঘ্য রাত জেগে,
এর অর্থ যদি এ রকম প্রকৃত দাঁড়িয়ে যায়,
ভাবি না দেশের কথা, দশের দুর্দশা
বিষয়ে চরম উদাসীন আমি, তাহলে মিথ্যাকে
রাশি রাশি প্রশ্রয়ের মালা
পরিয়ে হুল্লোড় করা ছাড়া আর হবে না কিছুই।
এখন থমকে আছে সব, মনে হয়। অতিশয় ক্লান্ত আমি,
ব্যধির মুঠোয় বন্দি। জানি না কখন
আবার মুক্তির হাওয়া হাড়ে আনবে ফিরিয়ে তেজ,
অস্তিত্বে উঠবে জ্বলে বিদ্রোহী দেয়ালি
নিমেষে উপেক্ষা করে সব ভাঙচুর। শুধু জানি,
থমকে দাঁড়ানো মানে সকল সময় একেবারে
থেমে যাওয়া নয়, দেখে নিও
প্রয়োজন হলে কোনো হাঁক ডাক শোনার আগেই
আবার আসবো চলে প্রতিবাদী মিছিলে মিটিঙে।
আমিতো বলিনি আসবো না; আপাতত
স্বপ্নের চুমকিগুলি নেড়ে চেড়ে খানিক জিরিয়ে
নিতে চাই। আসবোই, ছুটে আসবোই।
শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যদিও
ঘুমিয়ে পড়েছে তবু চেতনার গভীর ভূস্তরে
একটি জাগর পাখি ক্রমাগত গান গেয়ে যায়। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
চতুষ্পার্শ্বে যাচ্ছে শোনা মুহুর্মুহু পিশাচের হল্লা,
ওদের শরীরে পচা মাংসের উৎকট গন্ধ, বুনো
অন্ধকারে পদশব্দ এলোমেলো, ক্ষুধার্ত শকুনও
পালায় সে দৃশ্য দেখে; অতিশয় সন্ত্রস্ত মহল্লা।
প্রতিটি মুহূর্ত কাটে, যেন কোনো ভীষণ দন্তুর
নেকড়ে ছিঁড়ছে খরগোশ। সর্বব্যাপী ভয়ংকর
অসিত উত্থানে বুঝি না কে শক্রু মিত্র কেবা। খর
ছলনায় খল মাতে, হতবুদ্ধি বান্ধবও জন্তুরমতোই আমার দিকে আসে ধেয়ে। আজ ছদ্মবেশ
করেছি ধারণ, নইলে আত্মরক্ষা দায়। প্রেমিকার
সঙ্গেও ট্রাজিক চতুরালি চলে, বোঝে না সে কারা
ক্রীড়নক বানিয়েছে ওকে, তার রুক্ষ এলোকেশ
ভাসবে নদীর জলে, ভাঁড় হবে মূক, আমি পরিখার
পাশে করোটির সঙ্গে জুড়বো আলাপ দিশেহারা। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্রুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে।গলিত কাচের মতো জলে ফাত্না দেখে দেখে রঙিন মাছের
আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা। মনে পড়ে কাঁচি দিয়ে
নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমি হাসিখুশির খেয়া বেয়ে
পৌঁছে গেছি রত্নদীপে কম্পাস বিহনে।তুমি আসো আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন্ বিশাল
গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসো,
আসো কাঠবিড়ালির রূপে,
ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ
মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বার বার কিম্বা টুকটুকে লঙ্কা ঠোঁট টিয়ে হ’য়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।আমার এ অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা।
যুদ্ধের আগুণে,
মারীর তাণ্ডবে,
প্রবল বর্ষায়
কি অনাবৃষ্টিতে,
বারবনিতার
নূপুর নিক্কনে
বনিতার শান্ত
বাহুর বন্ধনে,
ঘৃণায় ধিক্কারে,
নৈরাজ্যের এলো-
ধাবাড়ি চিত্কারে,
সৃষ্টির ফাল্গুনেহে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মিলিত সর্বক্ষণজাগরণে।তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার ?
উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংশ্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে
নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা;
কাঁপি না ভয়ে আর দ্বিধার নেই দোলা
এবার তবে রাতে হাজার দীপ জ্বেলে
সাজাবো তার পথ যদি সে হেঁটে আসে।
যদি সে হেঁটে আসে, প্রাণের ছায়াপথ
ফুলের মতো ফুটে তারার মতো ফুটে
জ্বলবে সারারাত, ঝরবে সারারাত।
জেনেছি কাকে চাই, বলি না তার নাম
ভিড়ের ত্রিসীমায়; স্বপ্ন-ধ্বনি শুধু
হৃদয়ে বলে নাম, একটি মৃদু নাম।
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
একটি নকশা-কাটা ঘুড়ি হাওয়া আর
মেঘে মেঘে উড়তে উড়তে
চকিতে লাটাই-লগ্ন গতিময় সুতো প্রতিদ্বন্দ্বী
লাটাবাজের তীক্ষ্ণ সুতোর আঁচড়ে
ভাসতে ভাসতে কোথায় যে কত দূরে
লীন হ’ল, জানতে পারেনি নকশা-কাটা সেই ঘুড়ির মালিক।বেদনার্ত সেই লোক ভেবে, জেগে তিন দিনরাত
হারানো ঘুড়িটি সৃষ্টি করেছিল স্বপ্নাদ্য আদলে
হয়তো-বা, অপরূপ এক নকশা ছিল
ঘুড়ির সত্তায়। ঘুম নেই চোখে তার, নিরানন্দ
বসে থাকে এক কোণে, কী-যে ভাবে আকাশকুসুম,
নিজেও কি জানে সেই লোক? শুধু বয় হাহাকার।নিজেকে পীড়িত করে প্রায়শ উপোসে, দিনরাত
কী-যে ভাবে মানুষটি, বোঝা দায়। কোনও এক
অমাবস্যা-রাতে, কী আশ্চর্য, নিরালোক ঘর তার
হয়ে ওঠে জ্যোৎস্নাময়, শিরায় শিরায়
ছন্দ নেচে ওঠে, হাত সৃষ্টির দোলায় মশগুল
এবং অনিন্দ ঘুড়ি জন্ম নিতে থাকে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
বার বার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।
‘আবার আসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝ’রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।
|
শামসুর রাহমান
|
প্রকৃতিমূলক
|
যখন অধ্যাপকের জিভের ডগায়
তোমার কবিতাবলী ভীষণ চর্চিত হ’তে থাকে,
তখন আমার কেউ নও তুমি হে রবীন্দ্রনাথ।
যখন ঘোড়েল রাজনীতিবিদ মাতে
মঞ্চ থেকে মঞ্চান্তরে
তোমার প্রবল নাম সংকীর্তনে
তোমার রচনাবলী না পড়েই, তখন তোমাকে
চিনি না এবং
যখন তোমার গান সরকারি আসরে অলঙ্কার
হয়ে বাজে উদাসীন কানে, তখনও আমার
কেউ নও তুমি।যখন নিভৃতে দেখি তুমি পদ্মাতীরে হেঁটে যাও
আদিগন্ত সরল জ্যোৎস্নায় গীতিবিতানের স্মৃতিময়তায়,
তখন তোমার দিকে বিস্মিত তাকাই,
তখন তোমার দিকে তাকাই,
তখনই আমার তুমি, একান্ত আমার,
ভেজা মাটি, স্বর্ণ রেণু, সমস্ত আকাশ যেন তোমার হৃদয়,
আমার অন্তর জুড়ে তোমারই অমর্ত্য পদধ্বনি। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
সারাদিন কাজ করে সন্ধেবেলা রহমত আলী
গৃহিণীর জন্যে কিছু ফুল নিয়ে বস্তিতে ফেরার
পথে দ্যাখে আসমানে রূপালি টাকার মতো চাঁদ
হাসছে। হঠাৎ এ কী! মিশমিশে অন্ধকার থাবা
দিয়ে ঢেকে ফেলে চতুর্দিক। এ কেমন
তুফান কাঁপিয়ে দিচ্ছে সব কিছু? কেমন ধ্বংসের আলামত?
‘এ কেমন রাত এলো’? রহমত আলী নিজেকেই
প্রশ্ন করে। নড়বড়ে ঘর তার জ্বরতপ্ত রোগীর লাহান
ভীষণ কাঁপছে, যেন এক্ষুণি পানিতে
ভেসে যাবে। তার গৃহিণী রহিমা
বেজায় ভয়ার্ত চোখে তাকায় স্বামীর দিকে আর
কোলের সন্তানটিকে বুকে চেপে ধরে।আসমান বেজায় গর্জনে চতুর্দিক
কাঁপিয়ে তুলছে; রহমত আলী কেঁপে-ওঠা ঘরে
বসে দ্যাখে, বড় জোরে পানি
ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে
দিয়েছে হাঙ্গাম জুড়ে। বুঝি নিমেষেই
সব কিছু ডুবে যাবে, ভেসে যাবে, বুঝিবা নিশ্চিহ্ন
হবে সব কিছু, যাবে মুছে, হায়, সাধের সংসার।
এ কেমন মশারি ধরেছে ঘিরে চতুর্দিক থেকে?
কখন যে ডুবেছে কুটির তার, রহমত বুঝতে পারেনি।
ডুবতে ডুবতে
ঘুমের সজল মায়াজাল থেকে জেগে
রহমত নিজেকে দেখতে পায় কাঠের তক্তায়।
কোথায় সংসার তার? কোথায় রহিমা?
হা কপাল! কোথায় সন্তান? ধোঁয়া, সব কিছু ধোঁয়া। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আমি কি অজ্ঞাতবাসে আছি? এ-রকম থেকে যাবো
গোপনীয় মনোকষ্টে ডুবে বহুদিন দলছাড়া?
কীট-পতঙ্গের সঙ্গে উচ্চারণহীন মেলামেশা,
বিষণ্ণ বিকেলে হ্রদে ভাসমান প্রেমিকের জামা,
আর ঊর্ণাজালের মতই ঝোপঝাড়ে তেজী আলো,
মাথার ওপর উড্ডয়নপরায়ণ একা দীর্ঘপদী পাখি-
ভাবি আজো নিসর্গের পৃষ্ঠপোষকতা
রয়েছে অটুট। গোধুলিতে খোলামেলা
ঢিবির ওপরে ব’সে দেখি জীবনের ঢ্যাঙা ছিরি!জীবন আমার হাতে কোন সে ঠিকানা গুঁজে দিয়ে
দেখিয়েছে খোলা পথ; পথে
তৃণ ছিলো, কাঁটাঝোপ ছিলো, ছিলো সাঁকো,
হরিণের লাফ ছিলো, উজ্জ্বল সাপের
হিস্হিস্ ছিলো, কিছু কাটাকুটি, কিছু ভুল ছিলো-
ভাবতে-ভাবতে হাঁটি, কায়ক্লেশে হাঁটি,
কখনো নিঝুম ব’সে থাকি পথপ্রান্তে, ক্ষয়ে-যাওয়া
দাঁতে ছায়া চিবোতে-চিবোতে দিন যায়।
দিন যায়,
কখনো-কখনো খুব সহজে যায় না।
কোনো-কোনো ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই কষ্ট পাই,
বিষণ্ণতা ব্যেপে আসে শ্রাবণের মেঘের ধরনে,
উদ্যানের পাশে
কী এক সৌন্দর্য ফৌত হয়ে প’ড়ে থাকে, মনে হয়
পুরোনো কবর থেকে কোনো পূর্বপুরুষ আমার
বেরিয়ে এলেন পৌরপথে, প্রতিকার চেয়ে-চেয়ে
পুনরায় ত্বক-মাংস তাঁর খ’সে যায়, খ’সে যায়,
বুঁজে আসে কবরের চোখ। দিন খুব
দীর্ঘ লাগে, দীর্ঘশ্বাসে-দীর্ঘশ্বাসে প্রহর উদাস।মাঝরাতে যখন ভীষণ একা আমি,
যখন আমার চোখে ঘুম নেই একরত্তি, আমি
বিপর্যস্ত বিছানায় প’ড়ে আছি ক্রশের ধরেন,
তখন অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে
কে এক নৃমুন্ডধারী অশ্ব এসে বলেঃ
শোনো হে তোমার
নিজের শহরে আজ আমাদের রাজ
পাকাপোক্ত হলো;
দ্যাখো চেয়ে আমাদের সংকেতবহুল
পোস্টারে-পোস্টারে
ছেয়ে গ্যাছে শহরের প্রতিটি দেয়াল আর ছায়া-কেবিনেটে
জ্যোতিশ্চক্রগুলি নৃত্যপর, কবিসংঘ এই অশ্ব সমাজের,
মানে আমাদের সমর্থনে দিনরাত্রি
বেহাল কাটায় দীর্ঘ স্তোত্র রচনায়।তোমার শহরে, শোনো, একটিও ভিক্ষুক নেই আর।
হাসপাতালের সব বেড খালি, কেননা এখন
আর রোগী নেই কেউ। পাগলাগারদও আজ বাশিন্দাবিহীন,
অতিশয় পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকগুলো কুচকাওয়াজের ঢঙে
দিব্যে হেঁটে যায়
নতুন মুদ্রার মতো চকচকে রাস্তায়-রাস্তায়!
বাছা-বাছা যুক্তিবাদী রাজনীতিবিদ
পরিবর্তনের গূঢ় পতাকা পকেটে পুরে নব্য খোয়ারিতে
ছায়াস্নিগ্ধ বনভোজনের চমৎকার
মানুসরুটি খেয়ে
দাঁত খুঁটছেন ঘন-ঘন আর মাঝে-মাঝে
দরাজ গলায় গান ধরেন পার্টিতে ফের অকস্মাৎ ঘুমিয়ে পড়েন
প্রতারক জ্যোৎস্নার কার্পেটে।ফলস্ ত্র্যালার্ম শুনে ভয় পেও না বেহুদা, ছুটে
যেও না বাইরে, চোখ-কান বুঁজে প’ড়ে থেকো নিজস্ব শয্যায়
বিপদকে গ্রেপ্তার করেছি আমরা, বিপুল ধ্বংসকে
পাঠিয়েছি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, তোমার নিজের
শহরকে খলখলে রক্ষিতার মতো সাজিয়ে দিয়েছি
আপাদমস্তক অহংকারী অলংকারে।আমার ব্যর্থতা
কবরখানার হল্দে ঘাসে নাঙা সন্ন্যাসীর মতো
শুয়ে থাকে সাবলীল,
আমার ব্যর্থতা ফণিমনসার মতো তীক্ষ্ম অহংকারে
রৌদ্রজ্যোৎস্না পোহার নিয়ত,
আমার ব্যর্থতা টাওয়ারের প্রতি বাড়িয়ে দু’হাত
ধুলোয় গড়াতে থাকে কখনো-বা শিস দিতে-দিতে
চলে যায় নিরুদ্দেশে, বেকার যুবার মতো ছেঁড়া জুতো পায়ে
পথে-পথে ঘোরে,
সর্বস্বান্ত নবাবের মতো চেয়ে থাকে সূর্যাস্তের দিকে বড়ো
উদাসীন, গলির দোকান থেকে সিগারেট কেনে ধারে আর
আমার ব্যর্থতা ব্যর্থ কবির ধরনে
খুব হিজিবিজি কাটাকুটির অরণ্যময় কালো খাতা খুলে
ব’সে থাকে, সিগারেট ঠোঁটে, ছাই ঝ’রে যায়, শুধু
ছাই ঝ’রে যায়।এইসব কথা লিখে অধিক রাত্তিরে কবি ধূসর বালিশে
মুখ চেপে কাঁদে, রক্তে মাংসে হাড়ে ও মজ্জায় ঝরে
কান্না ঝরে অবিরল।
কবির অশ্রুর চেয়ে দামী মায়াময় অন্য কিছু আছে কি জগতে? (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
এখন কোথায় যাবো পথ খুঁজে এই মধ্যরাতে
একা একা? পান্থনিবাসের সব দরোজা জানালা
বন্ধ, পথও লুপ্ত, অস্তিত্বের স্বরে স্তরে বিশ্রী জ্বালা-
হঠাৎ হবে কি দেখা কীর্কেগার্ড, নীটশের সাথে?
এ কেমন শূন্যতায় পা দু’টো দেখাচ্ছে খেল এই
দর্শকবিহীন পথে? নাকি অলৌকিক কিছু চোখ
রয়েছে তাকিয়ে সর্বক্ষণ! স্মৃতি-বিস্মৃতির ঢোক
গিলে বলি নিজেকেই-নেই, কোথাও কিছুই নেই।ভীষণ বদলে যাচ্ছে দৃশ্যাবলী, হাতের নিকট
হাত এসে কী যে বলে বাউল গানের মতো শুধু।
ব্লিপ, ব্লিপ, হিরোশিমা মন আমার, ব্লিপ, ব্লিপ, রীতি,
নাতি, রাজনীতি, রশোমন, রোসো মন, কে চম্পট
দিলো কানা গলির ভেতর? ব্লিপ, ব্লিপ, রুক্ষ, ধুধু
বয়স আমার, নীল ম্যাপ, ট্যাঙ্ক, ককটেল-স্মৃতি। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
‘ভালোবাসি’, এই কথাটি বলতে গিয়ে
কণ্ঠে লাগে সংকোচের ফাঁসি?
এমনতো নয়, ভালোবাসা এবার প্রথম
হৃদয় জুড়ে হলো পুষ্পরাশি।
ইতোমধ্যে তোমার আগে বহুজনই
আমার কাছে শুনেছে এই বাঁশি।
একে আমার অপরাধের কালো ভেবে
করুক লোকে নিত্য হাসাহাসি,
তুমি ঘৃণায় ও-মুখ তোমার সরাও যদি,
বলবো তবু বলবো ‘ভালোবাসি। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
তোমাকে দেখলে ভয় পাই খুব, বুকের ভেতর
অশ্বক্ষুরের প্রখর শব্দ, জাগে কলরব
প্রাকারে প্রকারে। ক্রূদ্ধ মশাল, কাঁপে থরথর
ঘুমধরা হাড়, চোখে ভাসমান বেকসুর শব।তোমার অমন ভবিষ্যময় চোখে তাকালেই
পারমাণবিক ভস্ম আমাকে করে দ্রুত গ্রাস
হাতড়ে হাতড়ে কোনো সূত্রের পাই না যে খেই,
পায়ের তলায় মাটি অস্থির, বর্বিত ত্রাস।দোহাই তোমার এক্ষুণি ফের খুলোনা এ মুখ।
ফস ক’রে তুমি কী যে ব’লে দেবে, দেয়ালের দিকে
তর্জনী তুলে স্তোত্র পাঠের উদাত্ত সুখ
চোখে নেবে কিছু হয়তো আনবে কাল-রাত্রিকে।তোমার ভীষণ ভাবী কথনের নেই কোনো দাম
মাঠে কি পার্কে, কলোনীতে, মেসে, গলির গুহায়।
আত্মাকে ঢেকে খবর-কাগজে যারা অবিরাম
প্রমত্ত তারা দেয়ালে কিছুই দেখে না তো, হায়।অন্যে বুঝুক না বুঝুক আমি জানি ঐ ঠোঁট
নড়লেই কালবৈশাখী দেবে দিগন্তে হানা,
প্রলয়ের সেনা গোপনে বাঁধবে নির্দয় জোট
হত্যার সাথে, ঝাপটাবে খুব নিয়তির ডানা।তুমি বলেছিলে, জননী তোমার কুক্কুরী-রূপ
পাবে একদিন, জনক সর্বনাশের বলয়ে
ঘুরপাক খেয়ে হবেন ভীষণ একা, নিশ্চুপ;
নগরে ধ্বনিত হবে শোকগীতি লম্বিত লয়ে।
দেবতা তোমার জিহ্বায় কেমন অভিশাপ ঘিরে
দিয়েছেন, তার ছায়ায় প্রতিটি গহন উক্তি
ধ্বংস রটায় আধা-মনস্ক মানুষের ভিড়ে
খুলবে না মুখ-এলো করি এই চরম চুক্তি। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
প্রতিদিন নিজেকে খণ্ডিত ক’রে বুঝে নিতে চাই
এতকাল এত পথ হেঁটে,
এত ধুলোবালি গায়ে ঠাঁই দিয়ে আখেরে কী পেয়ে
চৌদিকে ছড়াব ফুলঝুরি? কেউ-কেউ
তাকায় আমার দিকে যেন সে দেখছে কোনও-এক
আজব অদ্ভুত কিমাকার জীব যাকে ধরে নিতে
হবে ঠিক চিড়িয়াখানায়! হাসব কি
কাঁদব না ভেবে আসমানে চোখ রেখে পথ হাঁটি।মধ্যরাতে কে যে ডাকে ঘুমন্ত আমাকে
পারি না বুঝতে কিছুতেই। দোর খুলে
তাকাই আঁধারে যতদূর পারি কালিমাকে ভেদ
ক’রে আর বাড়াই দু’হাত ছুঁতে আগন্তু কটিকে।
এই যে তোমরা আজ সারাদিন দাঁড়িয়ে রয়েছ
রোদে পড়ে বৃষ্টির ধারায় ভিজে,
কী লাভ হয়েছে তাতে? দয়াপরবশ
কেউ কি এসেছে একমুঠো খাদ্য কিংবা পানীয়ের
বাটি নিয়ে? না, এখন এই আজকের দুনিয়ায়
আসে না সহজে কেউ ক্ষুধার্তের হাহাকার দূর করে দিতে।না, আমার উক্তিতে নিখাদ সত্য নেই। আজও এই
ইট-চুন-পাথরের যুগেও কোনও-না-কোনও
স্থানে ফুল ফোটে, অপরূপ জল বয়ে যায়।
মানুষ পশুর রূপ সর্বক্ষণ করে না ধারণ কিছুতেই। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
দীর্ঘ আয়নায় নিজের ছায়া ঠোঁট নেড়ে স্তিমিত কণ্ঠস্বরে
প্রশ্ন করে, ‘বলতে কি পারো কে তুমি? ভড়কে গিয়ে ছায়াকে ছুঁই,
জানতে চাই কেন সে এমন সওয়াল করেছে ব্যাকুলতায় এই
গোধূলিবেলায়। ছায়া তাকায় আমার দিকে, কিছুক্ষণ থেমে
বলে, ‘আমি নিজেই জানি না কেন এই অবেলায় এমন প্রশ্ন ছুড়ে
দিয়েছি তোমার দিকে। তোমার মনের গভীরে কখনও কি
উঁকি দেয়নি এমন সওয়াল?’ মাথার সব কোণা হাতড়ে যাচাই
করি, কখনও ব্যাপারটি আমাকে প্রশ্নাতুর করেছে কি না। আবছা
কিছু মনে পড়ে, অথচ মুহূর্তেই গাঢ় কালো মেঘমালা দিয়েছে
ঢেকে অস্পষ্ট কথাকে। আয়নার ছায়া থেকে দূরে সরে গিয়ে
বসি পাশের ঘরে, যেখানে আমার তিনটি বুক-শেলফ্-ভরা নানা
বই রয়েছে হাতের স্পর্শের নীরব, ব্যাকুল প্রতীক্ষায়। আমার প্রিয় এই ঘরে
লেখার টেবিল, টেলিফোন সেট, কয়েকটি পুরোনো, নতুন
কলম, কছু সাদা কাগজের প্যাড, একটি টেবিলল্যাম্প, টেবিলের
শরীর-ঘেঁরা পুরোনো চেয়ার, অদূরে স্থিত খাট, মনে হয়,
অনুরক্ত, মায়াময় দ্যাখে।
কতকাল নিজের সঙ্গে বসবাস করছি, অথচ আজ অব্দি নিজের
প্রকৃত সত্তা অচেনা রয়ে গেল। বই পড়ি, টেবিলে ঝুঁকে লিখি, কখনও
দিনে, সর্বদা রাতে বিছানায় শুয়ে স্মৃতির জাল ফেলি, অচমকা
গুটিয়ে নিই, নিদ্রার কুয়াশায় হারাই। কখনও কখনও জেগে উঠে
অন্ধকারে চোখ মেলে তাকাই জীবনসঙ্গিনী, দেয়াল, দরজা জানালা,
বুক শেল্ফ-এর দিকে। ঘরের তিমির প্রশ্ন করে আমাকে, ‘কে তুমি?
বলতে পারো প্রকৃত কে তুমি? অস্থিরতায় বিছানায় এ-পাশ
ও-পাশ করি। দম বন্ধ হয়ে আসে যেন, হঠাৎ উঠে বসি, পাথুরে
অন্ধকার আমাকে গিলে খেতে চায়। বাতি জ্বেলে তাকাই চৌদিকে,
কিঞ্চিৎ স্বস্তি পাই, তবু প্রশ্ন জাগে, ‘কে আমি? আমার গন্তব্য
কোথায়? কে আমাকে বলে দেবে?’ ঘরের আলো নিভে গেছে যেন,
হাহাকারময় অন্ধকার গম্ভীর কণ্ঠস্বরে করে উচ্চারণ,
‘কোথায় যেতে চাও? বস্তুত চির-তিমির ছাড়া কোথাও যাওয়ার নেই।‘ (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আমার ছেলেটা জ্বরে ধুঁকছিলো,জ্বলছিলো তার
চোখ দুটো, টকটকে কৃষ্ণচূড়া। কী ভেবে নিলাম
ছোট হাত মুঠোর ভিতর আর ছুঁয়ে দেখলাম
কপালটা যাচ্ছে পুড়ে, হাঁপাচ্ছে সে এবং মাথার
ব্যথায় কাতর খুব। শুকনো ঠোঁট পাখির ছানার
দুরু দুরু বুক যেন, টের পাই। বাইরে উদ্দাম
হাওয়া, দরজায়, জানালার দিচ্ছে হানা অবিরাম।
কেবলি শিউরে উঠি ডাক্তারকে ডাকবো আবার?কৃষ্ণচূড়া তাকালো আমার চোখে। “খুব বেশি তোর
কষ্ট হচ্ছে খোকা? মাথাটা বুলিয়ে দিই, ঘুমো তুই”
বললাম। সাড়া শব্দ নেই কোনো, বেড়ালটা হাই
তোলে বসে এক কোণে। নিদ্রোহীন ভাবি, হায় ভোর
কি হবে না আর? পারবো না ওর যন্ত্রণা কিছুই
নিতে আমি! যন্ত্রণায় আমরা নিঃসঙ্গ সর্বদাই। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এ কেমন চলে যাওয়া উড়িয়ে রুমাল কাকডাকা
দুপুরে একাকী দূরে, বিন্দু হয়ে যাওয়া? দুটি পাখি
ছিল ডালে; শাখাচারী পক্ষীদ্বয় দু’ ফোঁটা চোখের
পানি যেন। ভুরুর মতন ঝিল, শিকের আড়ালে
কতিপয় প্রাণী আর রঙিন চাঞ্চল্য আপাতত
ভাস্কর্য আমার মনে। দুপুরেই চৌরাহায় আজ
হঠাৎ গোধূলি আসে ব্যেপে। একটু আগেই ছিলে
আমার হাতকে সভ্যতার চারু কারুকাজ ক’রে।
এখনো কাটেনি ঘোর সান্নিধ্যের; মদ্যপের মতো
সম্মুখে তাকিয়ে আছি; আশপাশে ধুম বিলাবাট্টা
হয় হোক, নেই চোখ কান সেদিকে আমার। প্রাণ
গুণীর পুষ্পিত তান তোমার সৌরভে। এই পাখি,
পাতার টোপর-পরা গাছ, আমাদের প্রসারিত
ব্যগ্র হাত কেন ফ্রিজ শট হয়ে যায়না নিমেষে? (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
ওরা কাকে
শূলে চড়াবে কৃষ্ণপক্ষে? রক্ষে নেই,
রক্ষে নেই তোর, ধেই ধেই নাচছে
মাটি কাঁপিয়ে মুখোশ মুখে রাক্ষসের দল। ছল চাতুরী
ওদের তুই বুঝবি নে। মাথায় হাতুড়ি মারলো
কারা? ওরা, যারা গাছের পাতায়
ফড়িং আর প্রজাপতির ঝাঁকে, নদীর বাঁকে বাঁকে
ধরালো জাহাঁবাজ আগুন আজ।রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর। বক্ষে দ্যাখ তুলেছে ফণা
চক্র-আঁকা সাপ। নড়বি নে, নড়লে তোর
অন্তরসুদ্ধ হয়ে যাবে নীল, খাবে তোকে জলবিছুটি,
অন্তর্ভেদী কাঁকড়া। ওরে, ঝাঁকড়াচুলো ডাকাতগুলো
আসছে ধেয়ে সড়কি হাতে। থামা ওদের
থামা, থাকিস নে মুখ চেয়ে থর থর উঠবে কেঁপে
ঘরদোর, কাঁদবে ছেলেমেয়ে নারীর সন্ত্রম
ভাসবে মান্দাসে।রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর। চক্ষে
অগ্নিদগ্ধ বিভ্রম; নাড়া, হাত-পা নাড়া,
বাজা কাড়া নাকাড়া, দে বল্লমে তুই ধার। আঘাত
আসছে ধেয়ে, খুঁজিস নে গর্ত
এই শর্তহীন যুদ্ধে, লুকোস নে মুখ কারো
বক্ষে, সারা জনম দুধ খেয়েছিস যার, তাকে একটু সুখ দে।
ভাবিস নে গেলো সব চুকে বুকে,
রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর,
যদি না রুখে দাঁড়াস। দ্যাখ চেয়ে স্বচক্ষে
তোর দোরগোড়ায় তিনটি দাঁড়াশ। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এখনো আমার মন আদিম ভোরের কুয়াশায়
প্রায়শ আচ্ছন্ন হয়। মনে হয় স্বচ্ছন্দ কৌশলে
অমার শহরটিকে প্রাচীন দেবতা করতলে
সর্বদা আছেন ধরে; পশু-পাখি কেমন ভাষায়
কথা বলে, খৃষ্টপূর্ব শতাব্দীর নারী কি আশায়
বসে থাকে নদীতীরে। ছিন্ন শির, বীণা খর জলেসে-সুরের ক্ষীণ ছায়া, মনে হয়, আজো মাঝে মাঝে
আমার নিমগ্ন অবচেতনের প্রচ্ছন্ন প্রদোষে
খেলা করে, নইলে কেন অস্তিত্বের তন্ত্রীতে আমার
জাগে সূক্ষ্ম কম্পন এমন? মর্মমূলে কেন বাজে
সাহসা অদৃশ্য বাণী? খর স্রোতে চোখ রেখে ব’সে
আছি একা ঔদাস্যের তটে, নেই লোভ অমরার। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, বসে আছি পুরানো চেয়ারে
নিশ্চুপ, নিঝুম খুব, যদিও অন্তরে আঁধিঝড়
বইছে অনেকক্ষণ। মাঝে-মাঝে এদিক ওদিক
চেয়ে দেখি, চোখ পড়ে সারি সারি বই, জানলার
পর্দায়, সোফায় আর টেলিফোন সেটে। যেন আমি
কারো মৃদু পদধ্বনি শোনার আশায় কান পেতে
রয়েছি কখন থেকে। এখানে সে পা রাখে কিনা এ
সন্ধ্যেবেলা আমার দৃষ্টির গালিচায়, দেখা যাক।সম্ভবত আসবে সে যে-কোনো মুহূর্তে, ঘরে ঢুকে
তাকাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ, ধরবে জড়িয়ে,
পায়েল উঠবে বেজে তার পায়ে, চোখ থেকে তার
ঝরবে নানান চিত্রকল্প, চুল দেবে প্রতীকের
ঘন ছায়া; কবিতা আসবে এভাবেই অকস্মাৎ
আমার সান্নিধ্যে কিংবা ব্যর্থ হবে ব্যাকুল প্রতীক্ষা। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সে বসেছিল তার প্রশস্ত বারান্দায়
শরীরে যৌবনের গোধূলি নিয়ে। আমি,
বার্ধক্যের দোরগোড়া-পেরুনো, তার মুখোমুখি
অন্ধকারের ডানার রেশমি ছায়ায়।একটি ক্লান্ত পাখির ডানা ঝাড়ার শব্দে
চিড় ধরে নিস্তব্ধতায়, হঠাৎ এক সময়
মনে হলো, সে নেই এই সন্ধ্যাময় বারান্দায়,
তার জায়গায় স্থাপিত
প্রসিদ্ধ কোনো ভাস্করের শিল্পিত পাথর।
সেই ভাস্কর্য এবং আমার মাঝখানে
দুলতে থাকে, ক্রমাগত দুলতে থাকে
আমার একটি না-লেখা কবিতা। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
লোকটা পুরানো এক কবরের কাছে ব’সে থাকে
প্রতিদিন, মাঝে-সাঝে ঘাস টানে, ধুলোর হরফে
কী-যে লেখে হিজিবিজি, ফুঁ দিয়ে ওড়ায়। কেউ তাকে
উত্যক্ত করে না, শুধু বালকেরা কখনো সখনো
কিছু বলাবলি করে, ফন্দি আঁটে ঢিল ছুঁড়ে দেবে
দৌড় মহল্লার দিকে। তার উদাসীনতায় কোনো
চিড় টিড় ধরে না ব’লেই ওরা এলেবেলে ভেবে
চলে যায়, তৃপ্তি খোঁজে চানাচুর, মালাই বরফে।লোকটা হঠাৎ একদিন কোথায় যে অগোচরে
উদাস প্রস্থান করে। তাকায় না ফিরে, হেঁটে যায়
সহায় সম্বলহীন; কেঁপে ওঠে কবরের ঘাস
বুঝিবা বিচ্ছেদে, আজ কারো কোনো বেহালার ছড়ে
জাগবে না সুর, ছন্দপতনের রেশ কবিতায়
ফোটে আর পথের ধূসর হাতে জমে দীর্ঘশ্বাস। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
মানবের ব্যাখ্যা নিয়ে ঘামাই না মাথা আজকাল।
মানুষ বিষয়ে কী বলেছে রেনেসাঁস, কাকে বলে
মানবতা, শুভাশুভ, দুর্জনের অনাচার, সাধু
সন্তের উদার ঐশী পর্যটন, ইত্যাদি কিছুই
এখন ভাবিনা আর। সংসারে ক’জন নিরিবিলি
অন্ন ভাগ করে খাই, কখনো পান্থনিবাসে ঠাঁই
খুঁজি, ঘুর একা একা ভেঙ্গে যাওয়া মেলায় কখনো,
নিজের শরীর থেকে পশুগন্ধ মুছে ফেলি কিছু।মানুষ বলেই গোলাপের প্রতি যাই অনুরাগে,
সযত্নে পালিশ করি জুতো, মোজা দিই রোদে আর
হঠাৎ ভীষণ রেগে যাই, মাঝে মাঝে অভিমান
মেঘের মতোন গাঢ় ছেয়ে যায় সমগ্র সত্তায়।
মানুষ বলেই মানবীর দিকে তাকাই গহন,
স্তব্ধ রাতে হেসে উঠি কখনো খারাপ হয় মন। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
এমন একলা এই পথ, কোনোখানে সাড়া নেই
জনমানবের। বুঝি বাতাসের স্বরে
গলে গিয়ে মিশে যাবে আমাদের সত্তার সুরভি,
এমন নিঃসঙ্গ এই পথ!‘এখানে আসে না কেউ’ তুমি বলেছিলে, ‘খরগোশ,
প্রজাপতি, জোনাকি অথবা ঝিঁঝি হরেক রকম
নানারঙা পাখ্পাখালি, কাঠবিড়ালী ছাড়া
এখানে আসে না কেউ। রৌদ্র ওঠে, মেঘ ফেলে ছায়া,
গাছাপালা আর্দ্র হয় বৃষ্টির আদরে। আর দ্যাখো
সোনালি-হলুদ ফুল গুচ্ছ অর্পিত স্তবকে
বিন্দু বিন্দু আনন্দের সমবায় শুধু।তোমার পায়ের নিচে শুক্নো পাতাগুলো
উঠল বেজে, তুমি ছোট গাছটার ডাল ধরে দেখি,
দাঁড়ালে, রইলে মাথা নিচু করে ক্ষণকাল, আমি
বললাম, ‘সবকিছু বদ্লে গেছে তুমি আছ বলে।আর তুমি
‘ঘুরে-বেড়ানোর মতো বেশ জায়গা। নেই
উঁকি-দেয়া চোখ, উদ্যত তর্জনী আশে-পাশে,
এবং দূরের আকাশকে
মনে হয় এখানে আকাশ অবিকল।এরোপ্লেন উড়ে গেল মাথার উপর এক ঝাঁক
শব্দের মৌমাছি উঁচু উঁচু গাছ স্পর্শ করে
আমাদের স্তব্ধতাকে করেছে গুঞ্জিত।তোমার আমার মধ্যে যে-শিল্পিত দূরত্ব অটুট
চিরদিন, তারই রূপ রইল এখানে ধরা এই
জনহীন পথপ্রান্তে গুচ্ছ ফুলের স্তবকে।কোনো দিন মফস্বলে একরত্তি অখ্যাত স্টেশনে
থামলে রাত্রির ট্রেন, শেষ রাতে মরা জ্যোৎস্না ঠেলে
চা খেয়ে মাটির খুড়ি ছুড়ে ফেলে দেব প্লাটফর্মে,
(হুইসিলে পাড়াগাঁর ছবি দূরে হবে সচকিত)
হঠাৎ ধরাব সিগারেট, ভাবব কতদিনকার
সেই নদী, বন, সাঁকো, আর
তোমার পায়ের নিচে কত শুকনো পাতার মর্মর। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রকৃতিমূলক
|
ভোরবেলাতেই আকাশ মুখ কালো করে ব’সে আছে।
প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি কান্না ঝরবে
ওর চোখ থেকে। সেই কখন থেকে তাকিয়ে রয়েছি, অথচ
আকাশে মাঝে-মাধ্যে আঁধার-চেরা একটি কি দু’টি
বিদ্যুতের আসা-যাওয়া করা ছাড়া তেমন কোনও
পরিবর্তন নেই। হাতের কাব্যগ্রন্থটি টেবিলের এক পাশে
সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করি। না, ঘুম
আসবে না। কোনও কবিতা কি উঁকিঝুঁকি দেবে এক্ষুণি?বাইরে বৃষ্টিধারা নেই, জলোচ্ছ্বাস নেই, তবু মনে হলো
আমি দিব্যি ভিজে উঠেছি কার সঙ্গে মিলনের
বাসনা আমাকে যেন পৌঁছে দিয়েছে বৃষ্টি ভেজা,
অপরূপ বাসরে, যেখানে স্বর্গীয় পুষ্পরাজির ঘ্রাণ
ছড়ানো আর কে এক সুন্দরী তার বৃষ্টি ভেজা
প্রগাঢ় মধ্যরাতের মতো কেশরাজি ছড়িয়ে বসে আছে
কদমতলায়। আমার হৃদয় ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে
মনোরম বাদ্যযন্ত্রের মতো। আমি কবিতা হয়ে যাই।আচমকা বৃষ্টিস্নাত রূপসী প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে
তাকায় আমার দিকে। তাকে দেখে মনে হলো অনেক কালের
পরিচিতা সে আমার। তার দিকে এগিয়ে যেতেই
সে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার বিস্ময় কেটে যাওয়ার আগেই
আমি ওকে স্পর্শ করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠি। আমি
সমস্ত আবেগ প্রয়োগ ক’রে ওকে আলিঙ্গন করলাম।
তার মায়াবী স্পর্শ পেলাম কি পেলাম না,
উপলব্ধি করার আগেই আমরা দু’জন কোথায় যেন অদৃশ্য। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এখন একটি নয়, দু’টি নয়, তিনটিও নয়, একপাল
চিত্রল হরিণ আসে শহরের অখ্যাত গলিতে,
আসে সাবলীলভাবে। বনবাসকালীন বন্যতা
এখনো যায়নি মুছে, ইট পাথরের কাছে যেন
ভয় করবার কিছু নেই, যেন ওদের আহত করবে না
কোনো অস্ত্র, পড়বে না মোটরকারের নিচে কিংবা
বাজারে দেবে না বেচে কেউ শস্তা দামে। আস্তে সুস্থে
ওর এই ছায়াচ্ছন্ন গলিতে প্রবেশ করে আরআমার বাড়িকে ঝিল ভেবে বিশ্রামের প্রত্যাশায়
উঠোনে ঘাসের মতো স্বপ্ন ডোবে। এইসব প্রাণী
কী করে এখানে এল, এই প্রশ্ন আমাকে কেবলি
ঠোকরাতে থাকে, অকস্মাৎ স্তব্ধ তার মধ্য থেকে
ছন্দিত গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আসে একটি হরিণ-
বলে, ‘শুধে দিতে চাই আজ সেই কবেকার ঋণ। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
কে তুমি আমাকে স্পর্শ করলে
আচমকা শেষরাতের
অন্তিম প্রহরে? চোখ খুলতেই দেখছি
অপরূপ তুমি ঝুঁকে রয়েছে
আমার মুখের উপর চুমো খাওয়ার
ভঙ্গিতে। আমি ভাবতেই পারিনি এমন দৃশ্য।
অপরূপ প্রতিমার মতো হে তরুণী,
তোমার হাসি দেখে মনে হ’ল, এমন
ঠোঁট-ঝরা হাসি দেখে আমি তো কোন ছার
ফেরেশতাও চমকে উঠে তোমাকে স্পর্শ করার
জন্য উদ্বেল হয়ে উঠত। তোমার একটি চুমোর
বদলে হয়তো বেহেশত ছেড়ে দুনিয়ায় বসত চাইত।খানিক পরে, তখনও আলো খুব জোরালো
হয়নি, ছায়ার মতো অস্তিত্ব যার সে আমার
খুব কাছে এসে গুনগুন করে কী যেন
বলতে চেয়ে বলতে পারছে না। তার দু’চোখ
থেকে ঝরতে শুরু করল ফোঁটা ফোঁটা পানি এবং
আমি তাকে স্পর্শ করতে গিয়ে ধুলোয় গড়াই। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
এখন ডাকার কথা নয় তার এই মধ্যরাতে অকস্মাৎ,
তবুও এমন আর্ত কণ্ঠস্বরে উঠলো ডেকে, যেন
দিয়েছে বসিয়ে দাঁত কেউ তার বুকে হিংস্রতায়।
যেমন নিপুণ দর্জি কাঁচি দিয়ে কাটে মখমল,
তেম্নি তার ডাক নিশীথকে চিরে ঝরে ফুটপাতে,
কলোনীর ফ্ল্যাটে আর বস্তির বিনীত দোচালায়।
প্রহর প্রগাঢ় হয়, মধ্যরাতে পাখির ভূমিকা
মেনে নিয়ে বালিশের গালে খুব জোরে, গাল চেপে
চুপচাপ শূন্য এক কুটিরের কথা, দূর কোনো
বনানীর কথা ভাবি; খড়কুটো উড়ে আসে ঘরে।এবং পাখির ডাকে ঝিল, কারো স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ,
পদচ্ছাপময় দীর্ঘ পথ, প্রাচীন যে ধাতুশিল্পী
বানায় সোনার পাখি কী তন্ময় অন্ধকার ঘরে,
তাকে, আপনার আবডালে নিজেকেই পেয়ে যাই।
মধ্যরাতে পাখি ডেকে যায়, ডেকে যায় কী একাকী,
এই ডাক শুনে শুনে এ জীবন কেটে যাবে বুঝি! (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
এই যে আমি পথ হাঁটছি দিনের পর দিন, শহরের ধুলোবালি
মাখছি শরীরে হামেশা, বুকে টেনে নিচ্ছি বিষের ধোঁয়া,
দাবদাহের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি-এর পরিণতি কী শেষ তক?
কখনও কখনও ক্লান্তির প্রহরে এই প্রশ্ন আমাকে কামড়ে ধরে।
কামড়ের জ্বালা ভুলে থাকার জন্যে চোখ মেলে দিই ঘরের
জানলার বাইরে। এই সামান্য ছোট ঘর, লেখার টেবিল, চেয়ার,
খাট আর বেশ কিছু বই নিয়ে আমার এক নিজস্ব জগৎ। নাছোড়
প্রয়োজন কিংবা মোহন কোনও সাধ ছাড়া এখান থেকে অন্য কোথাও
পা বাড়াই না সহজে। চার দেয়ালের ভেতর নিজের মনের সঙ্গে
বিরতিহীন এক খেলায় আমি মশগুল। এই খেলার রৌদ্র জ্যোৎস্নাময়
পথেই নিত্য তোমার আসা যাওয়া। বুঝি তাই আমার হৃদয়ে আজও
বসন্ত ঝরায় পুষ্পবৃষ্টি। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমের গুহায়
নিশ্চেতন, এ ঘরে বসে যায় প্রজাপতি, ফড়িং, জোনাকি, গাঙচিল,
ডাহুক, দোয়েল, পাপিয়া আর লাল নীল পদ্মের আসর। ছেঁউড়িয়ার
একতারা আর শান্তিনিকেতনের এস্রাজ হয় সঙ্গীতময়। রবীন্দ্রনাথ সেই
আসরে গ্যেয়টেকে হাত ধরে নিয়ে আসেন, নজরুল ইসলাম মনোহর
বাবরি দুলিয়ে নাচ জুড়ে দেন শ্যামা সঙ্গীতের তালে তালে পাবলো
নেরুদা আর মায়াকোভস্কির সঙ্গে। রুক্ষ, রোদেপোড়া ভ্যানগগ এক উন্মাতাল ঘোরে
ক্যানভাসে তোলেন তুলি এবং রঙের ঝড়। আমার সৌভাগ্যে ঝলমলে
আমি দেখি চোখ ভরে, শুনি অলৌকিক কলতান। তুমি দাঁড়িয়ে
আছো এক কোণে আমার হাতে ঘনিষ্ঠ, মদির, দ্যুতিময় হাত রেখে। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
পুনরায় চুপিসারে দয়ার্দ্র আষাঢ়ী পূর্ণিমায়
দেখা হলো আমাদের, যেন ক্লাশ-পালানো দু’জন
ছাত্রছাত্রী সেরে নিয়ে অন্তরঙ্গ সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ
জ্যোৎস্নার চুম্বন নিয়ে দেহমনে চীনা রেস্তোরাঁয়
খুঁজে নিই অস্থায়ী আশ্রয়। নিভৃতির প্রত্যাশায়
একটি কেবিনে ঢুকি; দৃষ্টিপথে তোমার যৌবন
আশ্চর্য ঝলসে ওঠে, সরোবরে চাঁদিনী যেমন;
হৃদয়ে হরিণী এক হাঁটে চর্যাপদের ভাষায়।সহজে পাই না এরকম মুহূর্তের উপহার
এ শহরে; কেবলি জড়িয়ে যাই সুকঠিন লতা
আর ক্যাকটাসে, সারা শরীর, দু’চোখ ছিঁড়ে ফেটে
যেতে চায়। এরই মধ্যে কালেভদ্রে ভুল লোকাচার
এ মিলন উদগ্র মরুর বুকে মরূদ্যান যথা-
যতদিন বেঁচে আছি, অন্তত এভাবে যাক কেটে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
(বিপ্রদাশ, বড়ুয়া প্রিয়বরেষু)এখানে বেইলি রোডে তোমরা এসেছো আজ বিনা
আমন্ত্রণে ওগো পক্ষীকুল দূরদেশ থেকে জানি
আশ্রয়ের খোঁজে; তোমরাও নিরাপত্তা চাও, ধূর্ত
শিকারির শর কিংবা গুলি এড়িয়ে বাঁচার সাধ
তোমাদেরও বুকে জ্বলে প্রদীপের মতো। এইসব
নাগরিক গাছে কেন নিলে ঠাঁই শীতের দুপুরে?
পাড়াটা নীরব কিছু, তবু মোটর কারের হর্ন
বেজে ওঠে মাঝে মাঝে, কালো ধোঁয়া পথে ভাসমান।যাকে ভালোবাসি, সে কখনো সখনো হঠাৎ
পাখি হয়ে নীলিমায় কিংবা কোনো ঝিলে কী খেয়ালে
উড়ে যেতে চায় হাফ ধরে এলে শহুরে জীবনে।
অনেকেই নির্দয় শহর ছেড়ে অন্য কোনোখানে
যাত্রায় আগ্রহী খুব চকচকে ছোরা, বুলেটের
ভয়ে; হায়, কেন যে তোমরা এলে এখানে সুন্দর?
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
জীবনানন্দীয় পরিবেশে অপরাহ্নে পাশাপাশি,
মনে পড়ে, ছায়াচ্ছন্নতায় আমরা ছিলাম বসে
মাঝে-মধ্যে গাছ থেকে শুক্নো পাতা পড়ছিলো খসে;
উচ্ছ্বসিত বিকেলের রঙ এবং তোমার হাসি
একাকার, প্রকৃতির কাছে আজো কিসের প্রত্যাশী
আমরা ভাবছিলাম। দেখি, হংস-হংসী ঠোঁট ঘষে
পরস্পর উড়ে যায় বিল ছেড়ে; মগজের কোষে
কোষে কী মদির শিখা জ্বলে, বাজে স্বেচ্ছাচারী বাঁশি।আমিতো পারিনি হতে বনহংস, তুমিও পারোনি
বনহংসী হতে সে বিলের ধারে। পাঁশুটে ভব্যতা
আঁকড়ে ছিলাম ব’সে চুপচাপ, যদিও শিরায়
উঠেছিলো জেগে শত পালতোলা মাতাল তরণী।
বুঝতে পারিনি, হায় তোমার সত্তায় ব্যাকুলতা,
কী-যে ছিলো তোমার চোখের দুটি অসিত হীরায়। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
রাগের কারণ থালেও আমি আর রাগান্বিত হইনা এখন।
কারণাবিহীন ক্রোধে ফেটে পড়ে, আকাশের দিকে ছোঁড়ে হাত,
লাথি মারে, হায় আল্লা, আলখাল্লা-মোড়া সমাজের বেবুনসদৃশ
ঘোর বয়স্ক পাছায়,
তেমন ভীষণ রাগী লোক নই আমি, উপরন্তু
এখন আমার কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই।
কেউ কোনো বাঁকা কথা, কটু কথা বললেও মেজাজ
আজকাল হিস হিস করে না কখনো, কারো উপেক্ষা আমাকে
করে না কাতর আর। সন্ধ্যেবেলা মরুভূমি আজ, উষর সন্ধ্যায়
বুকে কতউটের কংকাল, ভাঙ্গা বেহালা ছড়ানো ইতস্তত,
বালিয়াড়ি রক্ত শুষে নেয়, রক্ত শুষে নেয়, ঠাণ্ডা
পানির বদলে সর্পবিষ ঝরে ডাইনীর মতো বৃক্ষচূড়া থেকে,
তবুও নিজের হাত কামড়ে ধরি না বারংবার। বসে থাকি
গৃহকোণে চুপচাপ, যেন বা উপোসী বৃদ্ধ, ক্ষয়ে সমর্পিত।সূর্যমুখী হার-পরা গাধা অজস্র পদ্যের পাতা খাচ্ছে বলে
প্রতিদিন যততত্র নতুন সারস মৃত পড়ে থাকে বলে
রাগ নেই, কোনো খেদ নেই
স্বতই জীবনোজ্জ্বল রুবেন্স-রমণী প্রায় কমনীয় ত্বকময়ী দয়িতা
আমাকে
একদিন ত্যাগ করে যাবে ভেবে। বসে থাকি একা বেড়ালের
পশমে ডুবিয়ে হাত, পশম কোমল বলে লিরিকের স্বরে-
বেঁচে আছো তুমি, বেঁচে আছো অলৌকিক মহল্লায়,
দেয়ালের ড্যাম্প-নকশা, কাচের গেলাশ টেবিলের উপত্যকা,
ঘাসফুল গান গায় তোমার সত্তায়, তুমি ওদের প্রগাঢ় মাতৃভাষা জানো।এখন আমার কোনো ইন্দ্রনীল অভিমান নেই,
শুধু কবিতার চোখ অনুরাগে আমার দু’চোখ
না ছুঁলে কেমন করে মন আর বুকের ভিতর মৃত কোনো
শহর নিশুত কেঁদে ওঠে। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
পরদেশে কোনো এক সতেজ সকালে জেগে উঠে
প্রেরণাতাড়িত কোনো কবির মতোই প্রিয়তমা
তোমাকে লিখেছিলাম চিঠি থর থর হৃদয়ের
হরফে; সে চিঠি তুমি পাওনি কখনো। ডাকঘর
থেকে বিলি হয়নি নিশ্চিত। ফলে কারো কোনো ক্ষতি
না হলেও আমার আবেগ কিছু হয়ে গ্যাছে গুম
অজানায় দু’পাতা লেখার সঙ্গে। যে পত্র পায়নি
তোমার হাতের স্পর্শ, তারই জন্যে করি শোক আজো।অনেকের কাছেই এ এক তুচ্ছ ঘটনা। অথচ
ভেবেছি বিদেশে কত নিঃসঙ্গ প্রহরে, সেই চিঠি
পড়েছে সবার অগোচরে সমাজ সংসার ভুলে আর
তোমার চুম্বনে হরফের ঠোঁট সমৃদ্ধ হয়েছে।
হায়, সেই প্রতীক্ষা তোমার আর কিছু স্বপ্ন, কথা
ঝরে গ্যাছে বিনষ্ট ফলের মতো নীরব আন্ধারে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যেন নিশীথের ওষ্ঠ থেকে ঝরে গূঢ় শব্দাবলি
সাবলীল, যেন খুব সুদূরের জ্যোৎস্নাছায়া মেখে
চকিতে এসেছে ওরা নিরিবিলি গাঢ় চুমো এঁকে
দিতে রুক্ষ একাকীত্বে আমার এবং স্বপ্ন-পলি
ক্রমশ গড়বে বেভে সত্তাতটে। এ কার অঞ্জলি
আমার সম্মুখে এলো রাত্রিময় নিরুদ্দেশ থেকে
এমন উল্লেখযোগ্যভাবে নিজেকে রহস্যে ঢেকে?
আমাকে ছুঁয়েছে কণ্ঠস্বর, আমি কী তন্ময় জ্বলি।আমার নিকটে নেই সেই রুপময়ী অবয়ব,
নিষ্ঠুর পাখির মতো রাত্রি রূষ্টি চঞ্চুর আঘাতে
আমাকে করেছে ক্ষতবিক্ষত কেবলই; আমি তারই
মুখরেখা ভেবে ভেবে প্রহর কাটাই, শূন্য হাতে
পড়ে থাকি বড়ো একা, সেই মোহিনীর করি স্তব
এবং উঠোনে দেখি স্বপ্নপ্রায় চাঁপারঙ শাড়ি। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি
যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই। কাঁধে
ক্রূশকাঠ থাকতেই হবে কিংবা কাঁটার মুকুট
মাথায় পরতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা না।
এসব মহান
অলংকার আমার দরকার নেই। বাস্তবিক আমি
এক হাত নীল ট্রাউজারের পকেটে রেখে অন্য হাত নেড়ে নেড়ে
সিঁড়ি বেয়ে ‘আচ্ছা চলি, তাহলে বিদায়’ ব’লে একটি উচ্ছিষ্ট
রাত্রি ফেলে রেখে
নির্জন পেছনে
অত্যন্ত নিভৃত নিচে, শিরদাঁড়াময়
নক্ষত্রটোলার পত্রপত্রালির ঈষৎ দুলুনি নিয়ে
খুব নিচে চলে যেতে চাই।অবশ্য সহজ নয় এভাবে চকিতে চলে যাওয়া। ত্র্যাশট্রেতে
টুকরো টুকরো মৃত সিগারেট, শূন্য গ্লাশগুলো
বৈধব্যে নিস্তব্ধ আর টেবিলে বেজায় উল্টোপাল্টা পান্ডুলিপি
-প্রস্থানের আগে
এই সব খুঁটিনাটি বেকুব অত্যন্ত আর্তস্বরে কিছু ডাক দেয়।তখন আমার বুকে তিন লক্ষ টিয়ে
তুমুল ঝাঁপিয়ে পড়ে, কয়েক হাজার নাঙা বিকট সন্যাসী
চিমটে বাজাতে থাকে চতুর্ধারে, পাঁচশো কামিনী
দুলুনিপ্রবণ স্তন বের করে ধেই ধেই নাচ শুরু করে।
আর আমি চোখ-কান বন্ধ ক’রে সাত তাড়াতাড়ি
বিদায় বিদায় ব’লে ক্ষিপ্র দৌড়বাজের মতন
ছুটে যাই, ছুটে যাই দূরে অবিরত। ইচ্ছে হলেও প্রবল
কাউকে দিই না অভিশাপ; এতদিনে জেনে গেছি
আমার কর্কশ অভিশাপেকোনো নারী গাছ কিংবা প্রতিধ্বনি হবে না কখনো,
অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় ফেলবে না হারিয়ে নৌকোয় কোনো শকুন্তলা,
এমন কি খসবে না একটিও পালক বিবাগী মরালের।
সার্কাস ফুরিয়ে গেলে এক্রোব্যাট অথবা ক্লাউন
সবাই বিষণ্ন হয় অগোচরে হয়তো বা। কেউ ছেড়ে চুল,
অন্ধকার তাঁবুর ভেতর কেউ খায় হাবুডুবু
দুঃস্বপ্নের ক্ষুধার্ত কাদায়,কেউ বা একটি লাল বলের পেছনে
ছুটতে ছুটতে কৈশোরের সমকামী প্রহরে প্রবেশ করে,
বমিতে ভাসায় মাটি কেউ, কেউ উত্তপ্ত প্রলাপে!হে আমার বন্ধুগণ, দোহাই আপনাদের, দেরি সইছে না;
দিন বলে দিন,
তা’হলে আমি কি এই সার্কাসের কেউ? আপনারা
যে যাই বলুন, এই গা ছুঁয়ে বলছি মাঝে-মধ্যে,
না, ঠিক হলো না, প্রায়শই বলা চলে,
নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। স্বজনের লাশ
কবরে নামিয়ে চটপটঢোক ঢোক গিলতে পারি মদ খুব ধোঁয়াটে আড্ডায়,
প্রিয়তম বন্ধু
আত্মহত্যা করেছে শুনেও নিদারুণ
মানসিক নিপট খরায়
অবৈধ সংগম ক’রে ঘামে নেয়ে উঠতে পারি সহজ অভ্যাসে।আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি
যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই। অথচ হঠাৎ
একজন তারস্বরে বলে ওঠে, ‘নো এক্সিট, শোনো
তোমার গন্তব্য নেই কোনো’। না থাকুক, তবু যাবো,
দিব্যি হাত নেড়ে নেড়ে চলে যাবো, কেউবাধা দিতে এলে
বিষম শাসিয়ে দেবো, লেট মি এলোন, স’রে দাঁড়াও সবাই……
লক্ষ্মী কি অলক্ষ্মী আমি চাই না কিছুই, চাই শুধু যেতে চাই। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
সেই কখন থেকে খুঁজছি নিজের বাড়ি, দুপুর গড়িয়ে
বিকেল হল, গোধূলি ছুঁল সন্ধ্যাকে, তবু
খুঁজে পাচ্ছি না আপনকার বাড়ি। পাড়ায় পাড়ায়
প্রতিটি বাড়ির কলিংবেল টিপে, অথবা
দরজার কড়া নেড়ে ব্যাকুল জিগ্যেশ করি, বলতে পারেন
এই বাড়িটি কার? অমুক আমি, এটা কি আমার নিবাস?বাড়ির মালিক অথবা ভাড়াটে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে চকিতে
দরজা বন্ধ করে দেয় মুখের উপর। নিরাশ
আমি এই পথ থেকে সেই পথে, এক গলি ছেড়ে আরেক
গলিতে রাম, রহিম, বড়ুয়া ডেভিডের
ঠিকানায় পৌঁছে নিজের বাড়ির হদিশ খুঁজি।ঘুরতে ঘুরতে, এ বাড়ি সে বাড়ি করতে করতে বড়ই
ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার এই বেলা অবেলার অন্বেষণের জন্য
ঘুটঘুটে রাত্তিরে, এই ক্লান্তির জন্য ক্ষমা চাইব কার কাছে? হায়, অভাগা
আমার এমন কেউ কি আছেন
যার করুণাধারায় মুছে যাবে অবসাদ, সকল গ্লানি?
অভিভাবকহীন, অসহায় আমি ডুবে আছি অরণ্যরোদনে।গোধূলিবেলায় পুরনো একটি বাড়ির দরজা থেকে
ব্যর্থতার মুঠো মুঠো অন্ধকার নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ
অমলকান্তি এক বালক এসে দাঁড়ায় সামনে এবং
কিছু না ব’লেই আমাকে পরিচালিত করে কোলাহল থেকে
দূরে আশ্চর্য নির্জনতায়, ঠেলে দেয় ঊর্ধ্বলোকে মেঘের
মহল্লায়, ডানাহীন আমি উড়তে থাকি নক্ষত্রের জলসায়। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সতেজ ঘাসের মতো চকচকে এক ঘোড়া দৌড়ে এসে
একটা জলাশয়ের সামনে দাঁড়ালো।
তখনো তার কেশর থেকে, ক্ষুর থেকে মুছে যায়নি সূর্যাস্তের রঙ।টলটলে জলের দিকে গ্রীবা বাড়িয়ে
দেখলো সে, আধখানা চাঁদ বন্দিনি রাজকন্যার মতো
চেয়ে আছে তার চোখের প্রতি।
বনের ঘন কালো আকাশের নিষ্পলক চেয়ে থাকা-
সব কিছু অমান্য করে সে
তার মুখ বাড়িয়ে দিলো জলাশয়ে, জলপানের জন্যে নয়,
বন্দিনি রাজকন্যার ওষ্ঠে চুম্বন আঁকার জন্যে।শীতল পানির স্পর্শ নিয়ে ফিরে এল ওর মুখ
অচুম্বিত, বিচূর্ণিত চাঁদ
প্রত্যাবর্তন করে তার নিজস্ব অবয়বে।
তেজী আর চকচকে ঘোড়াটার কেশর থেকে
ঝরতে থাকে বিন্দু বিন্দু
জলের মতো স্বপ্ন আর
স্বপ্নের মতো জল।রহস্যময় বনের দিকে তাকিয়ে
হঠাৎ ঘোড়াটার মনে পড়ে গেল
সেই ভুলুণ্ঠিত তেজস্বী সওয়ারের কথা, একদা যে তার পিঠে বসে
ঘুরে বেড়াতো দূর-দূরান্তে,
যার হাতে ছিল ভালোবাসার পতাকা
আর মাথায় সূর্যের মতো উষ্ণীষ। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এখানেও নেই, ওখানেও নেই-
মধ্যিখানেই বেঁধেছি ডেরা।
ধু-ধু পোড়ো মাঠে শরাহত ঘোড়া
জীবন নষ্ট স্বপ্নে ঘেরা।সে কবে সুদূর বেঞ্চিতে ব’সে
বর্ণমালার জেলে দেয়ালি,
বিপর্যয়ের জ্বের টেনে আজ
খেটে খেটে হাড় করছি কালি।একদা মজেছি মায়া সরোবরে,
জলকন্যার কুহকী গানে;
মধ্যরাত্রে লিখছি পত্র
নীল কাগজের মদির টানে।
জানলা-প্রেমের মধুর ঝিলিক
ছিল জাগরুক মনের কোণে,
শেষে অবশ্য সায় দিতে হ’ল
নাছোড় পিতার নির্বাচনে।প্রাথমিক মোহ-মাধুর্য শেষে
বৎসরান্তে পাতে ভাত বাড়া হলে,
দুখিনী মায়ের অংশ কাড়ে।ঊনসত্তরে দরাজ গলায়
দিয়েছি স্লোগান আমিও বটে…
গণতরঙ্গে শহীদের লাশ, মেতেছি ব্যাপক ধর্মঘটে।
অনেকের মতো আড়ালেই থেকে
মুক্তিযুদ্ধে দিয়েছি সায়।
যে যাই বলুক, সারকথা এই-
বিশ্বে চলছে মাৎস্যন্যায়।ঘোর সন্ত্রাস, ধর্ষিতা দেশ;
অগ্নিদগ্ধ একাত্তরে
প্রাণপক্ষীকে যুগিয়েছি ত্রাণ
যত্রতত্র কলমা পড়ে।সকাল-সন্ধ্যা মুখে বিদ্রোহী,
বিপ্লবী বুলি আউড়ে চলি।
সম্মুখে দেখি মোক্ষ লাভের
চিরায়ত সেই অন্ধ গলি।গোষ্ঠীভুক্ত প্রাণী আমি, তবু
হঠাৎ ব্যক্তিস্বরূপ জাগে;
আবার নিমেষে গড্ডলিকায়
মিশে যাই ম্লান অস্তরাগে।সুবিধাবাদের ঝুটা খুঁটে খুঁটে
আমিও ঈষৎ মার্কসবাদী।
মধ্যে-মধ্যে দ্বিধা-খোয়ারিতে
সহজিয়া সুরে কণ্ঠ সাধি।একি মরীচিকা বিলাসে মজেছি
যুগসন্ধ্যায় যৌথ ভ্রমে,
বিস্মৃত কিছু প্রাণীর মতোই
আমরা লুপ্ত হচ্ছি ক্রমে। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
মনে পড়ে কোনোদিন আমাদের আবদ্ধ জলায়
চিলে তুমি রাজহংসী। শ্যাওয়ার পিছল সবুজে
কখনো হয়নি ম্লান শাদা পাখা, আলো খুঁজে খুঁজে
গ্নণ্ডি ছেড়ে চলে গেছো বহু দূরে। তোমার চলায়
এ-কাল মেলেছে দল। প্রতারণা কি ছলাকলায়
আনোনি বিভ্রম কোনো মগ্ধ চোখে; স্বপ্নের গম্বুজে
বাধোনি সুখের বাসা মসৃণ আরামে চোখ বুজে
এবং হওনি বিদ্ধ শিকারীর তীরের ফলায়।জলার কাদায় আজো আমাদের চঞ্চু, পাখা ডোবে,-
মজে থাকি অধঃপাতে। মধ্যে-মধ্যে হাই তুলি, ভাবি
এখন কোথায় তুমি? বুঝি না দারুণ সর্বনাশ
পেতেছে জটিল ফাঁদ আমাদের অস্তিত্বের লোভে।
উড়ো কথা কানে আসেঃ মেটাতে এ জীবনের দাবি
ইতিমধ্যে এমন কি তুমিও হয়েছো পাতিহাঁস। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
এখন বলার কিছু নেই আর তাই থাকি আপাতত
চুপচাপ, প্রায় বোবা, বলা যায়। তুমিও আগের
মতো কথা পুষ্পসারে দাওনা ভরিয়ে ক্ষণে ক্ষণে
আমার প্রহর আজ। যদিও কখক নই নিপুণ, তুখোড়,
তবু ছিলো দীর্ঘস্থায়ী কথোপকথন
আমাদের; ছিলো, মনে পড়ে, প্রহরে প্রহরে।এখন আমার চোখ কথা বলে, প্রতিটি আঙুলে
সযত্বে সাজায় শূন্যে কথামালা, আমার বুকের
রোমারাজি কথা হয়ে ফোটে থরে থরে
পাঁজরে পাঁজরে সর্বক্ষণ
কথার পিদিম জ্বলে,
হৃদয়ের গাঢ় অন্ধকার
অন্য মানে পায়, তাই সহজে খুলি না মুখ আর।এখনো বাসিন্দা আমি স্বপ্নময় জেরুজালেমের।
সেখানে নিঃশব্দে পথ চলি, কত যে গলির মোড়
ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকে, দীঘল চুলের
ছায়া নামে মুখের ওপর
জোয়্যরি জ্যোৎস্নায়।
রাস্তায় কি ঘরে কেউ বলে না কখনো কথা, শুধু
সুরে সুরে জেগে থাকে আদিগন্ত বাখের উৎসব।
স্বপ্ন-নগরীতে, বলো, কথার কি দরকার? বরং
যুগ যুগ চেয়ে থাকা যায়
কারো চোখে চোখ রেখে কথার চেয়েও খুব গভীর ভাষায়,
হৃদয় জেরুজালেম জেনে
হাঁটা যায় নানান শতকে,
কারো হাত ধ’রে স্বপ্নময়
জেরুজালেমের পথে। শত ভুল শুধরে নেয়া যায়
একটি চুম্বনে,
মে চুম্বনে পড়বে ছায়া দীর্ঘ মিনারের জলপাই পল্লবের।এখন তো মেঘমালা, গাছের সতেজ পাতা, বৈশাখী রোন্দুর,
শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, পাখির অমর্ত্য গান আমাদের হয়ে
প্রহরে প্রহরে
আমাদের দুজনের হয়ে
করবে রচনা নয়া কথার জেরুজালেম। কে বলেছে?
একজন কেউ, আছে যার খুব স্বপ্নবিলাসী উদাত্ত পাখা। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আমি যে এই আমির খোলস ছেড়ে ছুঁড়ে যখন তখন
বেরিয়ে আসি,
রৌদ্রেপোড়া জ্যোৎস্না মোড়া এই সমাচার তোমার চেয়ে
ভালো ক’রে কেউ জানে না।
ফুটফুটে খুব সকালবেলা কিংবা ধরো পিতামাতার
বুক-কাঁপানো ঘুম-তাড়ানো ডাগর কোনো মেয়ের মতো
মধ্যরাতে
এই যে আমি ঘরে বাইরে কেমন যেন হ’য়ে উঠি,
তোমার চেয়ে বেশি বলো
কেই বা জানে?আমাকে এক ভীষণ দানো তাড়িয়ে বেড়ায় অষ্টপ্রহর,
তীব্র খাঁ খাঁ খিদের চোটে আমার মাংস
অস্থি মজ্জা চেটে চুটে হরহামেশা সাবাড় করে।
লকলকানো চুল্লিতে দেয় হেলায় ছুঁড়ে,
অথবা সে অগ্নিমান্দ্যে ভুগলে তখন খামখেয়ালি খেলায় মাতে।
তপস্বী এক বেড়াল সেজে ঘুরে বেড়ায় আশে পাশে
আমার ঘরে।রাত্রিবেলা অনেক দামী রত্ন স্বরূপ দু’চোখ জ্বেলে
আঁধার লেপা চুপ উঠোনে কিংবা কৃপণ বারান্দাটায়
আলস্যময় কোমল পশুর গন্ধ বিলায়
এবং আমি ইঁদুর যেন।
আবার কখন রুক্ষ মরু চতুর্ধারে জ্বলতে থাকে,
বুকের ভেতর শুশুনিয়া, হাতড়ে বেড়াই জলের ঝালর;
মুখের তটে ঝরে শুধুই তপ্ত বালি; কখনো-বা পায়ের নিচে
বেজে ওঠে বেগানা হাড়।
এই যে এমন দৃশ্যাবলি উদ্ভাসিত যখন তখন,
তুমি ছাড়া কেউ দেখে না।
হঠাৎ দেখি, মুখোশ-পরা আবছা মানুষ দু-রঙা ঐ
ঘুঁটিগুলো সামনে রেখে বললো এসে,
‘তোমার সঙ্গে খেলবো পাশা।
জনবিহীন জাহাজ-ডেকে দ্যুতক্রীড়ায় মত্ত দু’জন
ডাকিনীদের নিশাস হয়ে বাতাস ফোঁসে চতুর্দিকে,
মাঝে মধ্যে চোখে-মুখে ঝাপ্টা লাগে লোনা পানির।
প্রতিযোগীর শীর্ণ হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ চমকে উঠি,
যেন আমি ইলেকট্রিকের শক পেয়েছি অন্ধকারে।
প্রতিযোগী কিতাব নিসাড়, নীল-শলাকা আঙুলগুলো
দারুণ শীতে মৃত কোনো সাপের মতো ঠাণ্ড এতো-
শিউরে উঠি।
মুখোশধারীর চক্ষু তো নেই, শুধুই ধু ধু যুগ্ম কোটর।ভীষণ দানো দুরন্ত সেই পেলব বেড়াল এবং কালো
মুখোশ-পরা আবছা মানুষ আসলে সবতুমিই জানি।
ভূমন্ডলে তোমার চেয়ে চমকপ্রদ চতুর কোনো বহুরূপী
কে-ই বা আছে?আপন কিছু স্বপ্ন তোমায় বাট্রা দিয়ে খাট্রা মেজাজ
শরীফ করি।
তোমার জন্যে টুকরো টুকরো সত্তাটাকে নিংড়ে নিয়ে
রূপান্তরের গভীরে যাই কখনো বা কেবল চলি।
জানিনা হায়, সামনে কী-যে আছে পাতা-
ফুল্ল কোনো মোহন রাস্তা কিংবা বেজায় অন্ধ গলি।
তোমার জন্যে সকাল সন্ধ্যা নিজেকে খুব বদলে ফেলি,
অন্তরালে বদলে ফেলি।তোমার জন্যে চড়ুই হয়ে চঞ্চু ঘষি শ্বেত পাথরে,
কখনো ফের স্বর্ণচাঁপায় এক নিমিষে হই বিলীন।
কখনো বা পিঁপড়ে হ’য়ে দুর্গ বানাই ব্যস্তবাগীশ
ছুটে বেড়াই দেয়াল পাড়ায়।তোমার জন্যে হই শহুরে শীর্ণ কুকুর, দীর্ণ বুকে গাড্ডা থেকে
পান করি জল;তোমার জন্যে হই আসামী ফাঁসির এবং নোংরা সেলে
ব’সে ব’সে নিষিদ্ধ ঐ বহর্জীবন নিয়ে কেমন জ্বরের ঘোরে
উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখি, ক্বচিৎ কোনো শব্দ শুনি।
তোমার জন্যে যখন তখন নিজেকে খুব বদলে ফেলি, আমূল আমি
বদলে ফেলি। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
প্রত্যাশার বাইরেই ছিল ব্যাপারটি। রোজকার
মতোই টেবিল ঘেঁষে পুরোনো চেয়ারে
আরামে ছিলাম বসে, ঘড়িতে তখন
সকাল আটটা ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি কি না-লেখা কোনও কবিতার পঙ্ক্তি মনে-মনে
সৃজনে ছিলাম মগ্ন? একটি কি দুটি শব্দ হয়তো-বা ভেসে
উঠছিল আমার মানস-হ্রদে। আচমকা
চোখে পড়ে ঘরে একটি প্রজাপতির চঞ্চলতা।বেশ কিছুকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ দিব্যি গিলে রেখেছে আমার,
আমাদের বসতিকে। আলো জ্বালাবার
প্রয়াস নিমেষে ব্যর্থ হয় জাহাঁবাজ
তিমিরবিলাসী ক্রূর হাওয়ার সন্ত্রাসে নিত্যদিন। তবুও তোএকজন রঙিন অতিথি ঘরটিকে দান করে অকৃপণ
সোন্দর্যের আভা, মুগ্ধ চোখে দেখি তাকে। মনে হয়,
একটি কবিতা যেন ওড়াউড়ি করছে এ-ঘরে,
অথচ দিচ্ছে না ধরা আমার একান্ত করতলে, যার ধ্যানে
দীর্ঘকাল মগ্ন ছিল কবিচিত্ত সম্ভবত অবচেতনায়
আধো জাগরণে কিংবা ঘুমের আংশিক এলাকায়। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এখন আমার আশাবাদ
অন্ধের যষ্টির মতো এদিকে-ওদিকে ঠুকে ঠুকে
করছে পরখ পথঘাট, মাঝে মাঝে কী বিস্বাদ
লাগে সবকিছু, এ জীবন ধুঁকে ধুঁকে
পথ চলে, কখনো বা থমকে দাঁড়ায়
খেলনার জ্বলজ্বলে বাক্সের সমুখে, ফেলে ঠাণ্ডা দীর্ঘশ্বাস।
কখন যে বাক্সটির ভেতরে হারায়
নিজেকেই, অনন্তর ফিরে আসে। বেবাক বাতিল এলেবেলে
ছিট কাপড়ের টুকরো হ’য়ে স্বপ্নগুলি ওড়ে। আমার জীবনে তুমি এলে
অকস্মাৎ, যেন উপদ্রুত এলাকায় চন্দ্রোচ্ছ্বাস। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
যখন পুনেরো বছরের তটে তোমার শরীর
তরঙ্গিত নিরিবিলি সেই তোমাকেই দেখলাম-
রয়েছ দাঁড়িয়ে একা নাগরিক নিসর্গের মাঝে
নিস্তব্ধ রমনা পার্কে শীতের দুপুরে। রোদ, হাওয়া
নীরবে খাচ্ছিল চুমো তোমাকে নিবিড়। নীল শাড়ি,
তোমার প্রথম শাড়ি, আসন্ন প্রখর যৌবনের
সঙ্কেতে কেমন মদালসা। তুমি যেন সদ্য স্নান
সেরে স্নিগ্ধতার সরোবরে মৃদু নিচ্ছিলে বিশ্রাম।নিষ্প্রভ রঙিন ফটোগ্রাফে প্রস্ফুটিত তরুণীর
প্রেমের অনলে পুড়ি প্রথম দৃষ্টিতে। রূপ তার
চিরদিন থাকবে অম্লান, সময়ের স্পর্শহীন।
অধর,স্তনাগ্র, চোখ, গ্রীবা, ঊরু, নিতম্ব দেখছে
গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন অবিরাম; সে স্বপ্নের অভ্র-গুঁড়ো
এখন আমার কবিতায় অলৌকিক স্পন্দমান। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
যখন তোমার চোখ আমার দু’চোখে রাখো তুমি,
মনোলীন অন্ধকারে জ্বলে ঝাড়লণ্ঠনের শোভা,
কখনো জাহাজ আসে উড়িয়ে নিশান, কখনো বা
হরিণের ক্ষুর ডোবে ঝিলে, স্বপ্ন হয় বনভূমি।
তোমার অতল দু’টি চোখ তুলে তাকাও যখন,
মৃত কোনো সভ্যতার প্রাসাদের দীপাধারে রূপ
জেগে ওঠে, মগজের কোষে পোড়ে কী মোহন ধূপ,
রূক্ষ পথ হয় গীতবিতানের পাতার মতোন।তোমার চোখের নিরালায় স্বর্গপথ ওঠে দুলে,
কাঁপে হ্রদ, বনস্থলী, একজন কবির হৃদয়
প্রায়শ বিছিয়ে দেয় কাতরতা, মৃত্যু গান গায়
রাজপুরুষের বেশে হননের তীব্র স্পৃহা ভুলে।
অমন চোখের জন্যে অপলক চোখে সুনিশ্চয়
শতাব্দী শতাব্দী ধরে ব্যাকুল প্রতীক্ষা করা যায়। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সেদিন জুনের দুপুর ছিল, একলা ছিলে তুমি।
ঘরের দুপুর বাড়ায় গ্রীবা,
হঠাৎ তোমার পায়ের, নিচে উঠলো কেঁপে ভূমি।
তখন আমি কিসের ঘোরে নিজের ভেতর একা বাঁচছি, মরছি, মরছি, বাঁচছি।
এমনি করেই দ্বন্দ্ব থেকে ফোটে দুঃখরেখা!
ক্লান্ত মনে পড়ছি ধুধু দেয়াল-জোড়া লেখা।
বুকের ভেতর মরুর জ্বালা,
তোমার সঙ্গে ক’যুগ যেন হয়নি আমার দেখা।ঘরে-বাইরে সঙ্গে আমার নোংরা নরক ঘোরে।
কোথাও কিছু নেইকো পাওয়ার,
বাগান-ফাগান, কোঠাবাড়ি ধুলোর মতো ওড়ে।তোমার বুকে ওষ্ঠ চেপে ভুলি গেরস্থালি-
শহর কালো বিন্দু হয়ে
শূন্যে মিলায়, সত্তা জুড়ে ঝরে সময়-বালি। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
সযত্নে রাখবে পুষে তুমি সর্বদা আমার স্মৃতি,
করি না এমন অসম্ভব দাবি, বিস্মৃতিপ্রবণ,
কম বেশি, সকলেই। মাঝে-মধ্যে করলে স্মরণ
উদাস প্রহরে কোনো, খুব ফিকে-হয়ে-আসা প্রীতি
ধূলোর দবিজ পর্দা চকিতে সরিয়ে যথারীতি
তুললে স্মিত মুখ, আমি তোমার নিকট আমরণ
থাকবো কৃতজ্ঞ আর ঘটুক যতই অঘটন,
স্মৃতিতে জ্বলবে তবু তোমার স্বপ্নের মতো সিঁথি।আমাকে রাখবে কিনা মনে, হে নবীনা, চিরদিন
তা ভেবে উদ্বিগ্ন নই আদপেই আমি আপাতত,
চাই না তোমার দীপ্র দরজায় অভ্যর্থনাহীন
দাঁড়িয়ে থাকতে আর। এসো কাছে এসো বলে ডাকে
তোমাকে আমার প্রতি অঙগ সময়ের প্রতি বাঁকে;
এসো কাছে এসো তুমি শ্রাবণের বিদ্যুতের মতো। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
আমিও মেঘকে দূত ক’রে এখুনি পাঠাতে চাই
তার কাছে, যে-আছে আমার পথ চেয়ে
প্রতিক্ষণ। কালিদাস নই, তবু কত অনুনয়
করি মেঘকন্যাদের উদ্দেশে, অথচ ওরা চুপ
থাকে, সাড়া দেয় না কখনো একালের
শাদামাটা কবির অধীর মিনতিতে। নিরুপায়
আমি ধর্ণা দিই টেলিফোনের নিকট। কিন্তু তবু
স্বস্তি নেই; টেলিফোনও বিগড়ে থাকে যখন তখন।সে জানে, আমার মেঘদূত নেই কোনো, তার
কাছে বার্তা পাঠানো সহজ নয় সকল সময়।
যখন গহন বর্ষা হৃদয়ের দু’ কূল ছাপিয়ে
স্পন্দমান, তাকে কাছে পাওয়ার বাসনা অগ্নিবাণ
হ’য়ে জ্বলে, পোড়ায় আমাকে। তার অশ্রুধারা আর
শ্রাবণের জলধারা নীল শূন্যে একাকার হয়। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ
ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে, আমি একা
খড়ের গাদার শুয়ে ভাবি
মুমূর্ষু পিতার কথা, যার শুকনো প্রায়-শব প্রায় অবাস্তব
বুড়োটে শরীর
কিছুকাল ধরে যেন আঠা দিয়ে সাঁটা
বিছানায়। গতায়ু হবেন যিনি আজ কিংবা কাল,
অথবা বছর ঘরে, আপাতত ভাবছি তাঁকেই,
তাঁকেই ভাবছি যিনি ঘোড়াকে জরুর মতো ভালোবেসেছেন
আজীবন। মুমূর্ষু পিতার চোখে তরুণ ঘোড়ার
কেশরের মতো মেঘ জমে প্রতিক্ষণ। মাঝে-মাঝে
তাঁকে কেন যেন
দুর্বোধ্য গ্রন্থের মতো মনে হয়, ভাষা যার আকাশ-পাতাল
এক করলেও, মাথা খুঁড়ে মরলেও
এক বর্ণ বুঝি না কখনও।“জকির শার্টের মতো ছিল দিন একদা আমারও,
রেসের মাঠের সব কারচুপি নখের আয়নায়
সর্বদা বেড়াতো ভেসে। প্রতিদিন গলির দোকানে
ইয়ার বন্ধুর সাথে চায়ের অভ্যস্ত পেয়ালায়
দিয়েছি চুমুক সুখে। বিড়ির ধোঁয়ায় নানারঙ
পরীরা নেচেছে ঘুরে আর অবেলায়
কোথাও অশেষ স্বপ্ন ভাড়া পাওয়া যাবে ভেবে কতো
অলিগলি বেড়িয়েছি চষে আর রাতের বাতাসে
উড়িয়ে রুমাল হেসে শক্রতা, ব্যর্থতা ইত্যাদিকে
কাফন পরিয়ে
আপাদমস্তক
‘বলোতো তোমরা কেউ স্বপ্ন ভাড়া দেবে’-
বলে তীব্র কণ্ঠস্বরে মাথায় তুলেছি পাড়া, ভাগ্যদোষে পাইনি উত্তম।
“রাজা-রাজড়ার দিন নেই আর ছাপার হরফে
কত কিছু লেখা হয়, কানে আসে। ছোটো-বড়ো সব
এক হয়ে যাবে নাকি আগামীর সখের নাটকে!
বর্তমানে এ দেশের স্ত্রী-পুরুষ সাপের পাঁচ পা
হঠাৎ দেখেছে যেন। দিনগুলি হিস্টিরিয়া রোগী”-কখন ও মুমূর্ষু পিতা ঘোড়ার উজ্জ্বল পিঠ ভেবে
সস্নেহে বুলোন হাত অতীতের বিস্তৃত শরীরে।
মাঝে-মাঝে গভীর রাত্তিতে
দেখেন অদ্ভুত স্বপ্নঃ কে এক কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়া উড়িয়ে কেশর
পেরিয়ে সুদূর
আগুন রঙের মাঠ তাঁকে নিতে আসে।অথচ আমার স্বপ্নে রহস্যজনক ঘোড়া নয়,
কতিপয় চিম্নি, টালি, ছাদ, যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্টরির
ধোঁয়ার আড়ালে ওড়া পায়রার ঝাঁক
এবং একটি মুখ ভেসে ওঠে, আলোময় মেঘের মতোই
একটি শরীর
আমার শরীর মেশে, আমি স্বপ্নে মিশি,
রুপালি স্রোতের মতো স্বপ্ন কতিপয়
আমার শরীরে মেশে, আমি মিশি, স্বপ্ন মেশে, আমাকে নিয়ত
একটু একটু করে স্বপ্ন গিলে ফেলে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন এক কবি, দিলখোলা,
আড্ডাবাজ, কথাবার্তায় তুখোড়, দীর্ঘকায়।
মনে হতো, উঠে দাঁড়ালেই তাঁর
একরাশ লম্বা চুল চকিতে নিয়ে আসবে
মেঘের ঘ্রাণ। সন্ধেবেলা ঢকঢকে সুরা পান, শেষ রাতে
বালিশে বুক চেপে ডুকরে ডুকরে কাঁদা
স্নেহশীলা জননীর জন্যে, বাংলা যার নাম।
বড় কষ্ট, বড় কষ্ট, বুকের ভেতর শ্বাসের টান নিয়ে
চলত লেখা লাগাতার কবিতা ও গান;
অথচ দিনদুপুরে হাসি-খুশি চায়ের আসরে প্রতিদিন।
দুর্নীতি নাম্লী বারবনিতা ঘামে-ভেজা বগল,
দূরভিসন্ধিময় ঊরু আর নাভিমূলের
সন্ধান রাখতেন তিনি গোয়েন্দার ধরনে এবং
মিথ্যাগুলো যে-কোনো ঢঙে রঙিন কাঁচুলি
আর ঘাগরা আর বাহারি দোপাট্রা প’রে এলেও
তাঁর তীক্ষ্ম চোখে পড়ত ধরা ওদের স্বরূপ।
টেরিকাটা, স্যুট-সজ্জিত পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়ানো
ফেরেব্বাজ লোকগুলো কাছে এলেই
গলির লাশের দুর্গন্ধে
তাঁর নাড়িভুঁড়ি আসত উল্টে নিমেষে।একবার তিনি লিখলেন এক পদ্য আতশবাজির মতো
জ্ব’লে ওঠে। আমি তখন কলাকৈবল্যবাদীদের
ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয়
সুবচনে ভরপুর, মনে মনে বললাম
তাজা একটা গোলাপ শুঁকতে শুঁকতে-ছিঃ,
এ-ও কি কবিতা?
আজ যখন জনগণনন্দিতা দুই বন্দিনীকে
মুড়ে রেখেছে নিঃসঙ্গতা,
স্বৈরাচারীদের লোহার হাত স্বদেশকে দিচ্ছে ঠেলে
ক্রমাগত জাহান্নামের আগুনে,
ঘাতকদের মসৃণ পথে-প্রান্তরে, মুখে শান্তির বুলি
আর ড্রাগনের দাঁতের মতো অশান্তির বীজ বপন করছে
অষ্টপ্রহর, তখন আমার অতীতের মূঢ়তা
ভেংচি কাটে আমাকে।এখন মনে হয়, সেই কবির
জনতার সংগ্রাম চলবেই পঙ্ক্তিটি তেজী মাছের মতো
লাফিয়ে উঠছে ঘন ঘন, কবিতার
দাঁড়িপাল্লা আর বাটখারার অনেক
ওপরে উঠে
প্রবল হাসছে, যেন সূর্যমুখী।
আগুনের ডানাঅলা পাখির ভর্ৎসনায় নিজেই
আমি নিজের কুশপুত্তলিকা পোড়াই।এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন এক কবি, দিলখোলা,
আড্ডাপ্রিয় আর আমুদের, গুরুজন অথচ সুহৃদ।
তাঁর কথা আজ মনে পড়ে বারবার,
মনে পড়ে দীর্ঘকায় সেই পুরুষকে,
যিনি লেখার টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেই, ভাবতে ভালো লাগে,
তাঁর একরাশ দীর্ঘ চুল এক ঝটকায় নিয়ে আসবে মেঘের ঘ্রাণ (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
রূপক
|
ব্যাপারটা কিছুতেই আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না
খুলে বলাই ভাল
ইদানীং আমি আমার একটা আঙুল নিয়ে
খুব মুশকিলে পড়েছি
হতো যদি অনামিকা কড়ে কিংবা বুড়ো আঙুল
তাহলে তেমন ক্ষতি ছিল না
আসলে আমি আমার তর্জনী সম্পর্কে
ভীষণ উদ্বিগ্ন কেননা
একটা সিগারেট ধরাতে কিংবা কলম ধরতে পর্যন্ত
আমার ভারি কষ্ট হচ্ছে আজকালভাল কথা নিজের বিষয়ে
একটা জরুরি তথ্য জানাতে ভুলে গিয়েছি
আমি এই শহরেরই একজন কবি
বইয়ের দোকানে আমার কিছু কাব্যগ্রন্থ কিনতে পাওয়া যায়
সমালোচকদের জহুরী নজর আছে
আমার ওপর
বলা যেতে পারে কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব কিছু
ধারণাও আছে আমার
আমি চাই আমার প্রতিটি পংক্তিতে
তরুণ পাখির ডানার ঝলসানি আর স্পন্দন
তন্বী স্তনের নিটোল সুষমা
বুদ্ধিমান যুবকের দিলখোলা হাসি এবং
বয়েসী দুঃখী মুখের কুঞ্চন
এবং
আমার ম্যানিফেস্টোর প্রথম লাইন হল
কাব্যগ্রন্থ কস্মিন কালেও প্রচার পুস্তিকা হবে না
ধুত্তোরি আসল কথা থেকেই দূরে সরে এসেছি
য বলছিলাম
ইদানীং আমি আমার একটা আঙুল নিয়ে
খুব মুশকিলে পড়েছি
একদিন আমি খুব রাত করে একা একা
হাঁটছিলাম রাস্তায়
রাস্তা তখন সান্নাটা আর মরা জ্যোৎস্না নিঃশব্দ
সোনাটার মত ছড়িয়ে ছিল চারদিকে
হঠাৎ বলাকওয়া নেই কোত্থেকে এক ঝাপ উঁচানো
গাউন পরা কসবীর মত পরী দাঁড়াল আমার মুখোমুখি
এবং আমি ওকে রাস্তা দেখানোর সঙ্গে যাঃ শালা
জদ্যত আমার তর্জনীটাকে
সে কামড়ে ধরল
অনম খাপ্চু চেহারার আড়ালে এই ধাষ্টামি
আমি ভাবতেই পারিনি
চিৎকার করে উঠলাম আত্ময় জ্বালাধরান
যন্ত্রণায়
অথচ আমার গলা থেকে এক ফুট্কি আওয়াজও
বেরুল না আর ঐ পরী না ফরী
ওর ডানায় ভর করে ট্রাফিক আইল্যাণ্ডের ওপর দিয়ে
উড়তে উড়তে জয়নুলের পাইন্যার না হয়ে গেলআরেকদিন একটা ডালকুত্তা
আমার এই জখমি আঙুলটাকে কামড়ে ধরল
মানে তর্জনীটাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে
ওর দাঁতের বেজায় সুখ করে নিল
অন্য একদিন ধোপদুরস্ত এক চাপ্টাবাজ
কামড়ে ধরল আমার আঙুল
দুনিয়াসুদ্ধ সবারই এক নাছোড় আক্রোশ
আমার এই আঙুলের ওপর
লোকে খামকা আমাকে ছিটেল বলে না
যখনই কোথোও আমি কোনরকম ধাষ্টামি বহুরূপী গব্বাবাজি
দেখতে পাই তখনই উদ্যত হয় আমার তর্জনী
আর যে পায় সে-ই যখন তখন আমার আঙুল কামড়ে ধরে(আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দু'জনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
'আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও
চুম্বনে চুম্বনে।'
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
মারী ও মড়কে পুড়ে-পুড়ে হাড়
কালি হলো আর জটিল সড়কে
হেঁটে হেঁটে পায়ে ক্ষত বেড়ে যায়;
দান্তের মতো নরকে ভ্রমণ অব্যাহত।খাঁ-খাঁ জ্যোৎস্নায় নগ্নিকা দেখি
শুকোতে দিচ্ছে ছেঁড়া শাড়ি তার।
বিশীর্ণ শিশু ঘন-ঘন করে
মায়ের শূন্য হাতের তালুতে দৃষ্টিপাত।চরাচরব্যাপী হাহাকার শুনে,
অধিবাস্তব পালা দেখে আজ
রাত্তিলোভী চাঁদ ওঠে না তো
রোগা কেরানির আপিস কামাই করার মতো।মল্লিকা বনে দিনরাত্তির
কবর খুঁড়ছে শবসাধকেরা;
ছিঁচকাঁদুনের দল মর্শিয়া
গেয়ে এলেবেলে করে প্রস্থান অস্তাচলে।আর কিছু আমি পারি না-ই পারি,
অন্তত আজ কথা দিতে পারি-
আমার কবিতা কড়া নেড়ে যাবে
ঘুমন্ত সব নিঝুম বাড়িতে একলা হাতে। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
সেদিন পথে যেতে বিরানায় চোখে পড়ল
এক ধ্বংসস্তূপ তার ক্ষয়াটে শোকগ্রস্ত
অস্তিত্ব ঘোষণা করছে নিস্তব্ধ দীর্ঘশ্বাস
এবং হাহাকার ছড়িয়ে। তার বুকে
গুচ্ছের বুনো ঘাসের দাপট।
হঠাৎ কোথা থেকে একটি শঙ্খচিল
উড়ে এসে বসলো সেই ধ্বংসস্তূপে, ওর চোখের
তীক্ষ্ণতায় সংগ্রামী মানুষের অদম্য জেদ।ঘরে ফিরে এসেও দৃষ্টিতে ভেসে উঠছিল
ধ্বংসস্তূপটির ছন্নছাড়া চেহারা, বুঝিরা আমার
বিগত জীবন আর সেদিনই যখন তুমি বললে, ‘তোমাকে
ভালোবাসি, ভালোবাসি যে, তক্ষুণি দেখলাম, ধ্বংসস্তূপে
অজস্র ফুলের বাহার আর একটি রামধুন নিবিড়
আলিঙ্গনরত, যেন খাজুরাহোর মিথুনমূর্তির বিমূর্ত রূপ।
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
আমারই কাঁটার ঘায়ে গৌরী তুমি কেঁদেছ সে-রাতে
নিজেকে অকূল নদী করে; সে কান্নার রুদ্ধ জল
অকস্মাৎ রাত্রির হৃদয় জুড়ে করে ছল ছল,
স্তব্ধতা ছাপিয়ে ওঠে, মিশে যায় তিমির-প্রপাতে।
আমি নিজে নিরন্তর অন্তরের নির্দয় সংঘাতে
বিপর্যস্ত, নিজেকেই ছিঁড়ি-খুঁড়ি, তোমাকেও কষ্ট
দিই খুব জানি না কিসের জন্যে। হায়, আমি নষ্ট,
বিবেচনাহীন লোক, অহেতুক যে ভাঙনে মাতে।যখন তোমার বুক চিরে অসিত পাথর-চাপা
কান্নার দুর্বার জল নিমেষে বেরিয়ে পড়ে আর
তুমি থর কাঁপো অন্তর্গত শীতে, অসহায়
লাগে বড়ো নিজেকে তখন; আজ কোনো লুকোছাপা
নয়, সরাসরি বলা যাক-আমাদের মনোভার
ঘুচে যাবে, গৌরী শোনো, আহত পাখিও গান গায়! (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
নিজে সে অলক্ষ্যে থাকে, হাতে তার নানাবিধ সুতো,
কলকাঠি, নানা রঙা, নাড়ে চাড়ে যখন তখন,
এবং যেমন খুশি রাত্রিদিন বলায় ওদের দিয়ে টন
টন কথা, আসলে সে নিজেরই একান্ত মনঃপুত
বাছা বাছা শব্দাবলী আওড়ায়; তার ছলছুতো
বোঝা দায়, তারই কণ্ঠস্বর বাজে, কেবল ক’জন
ওরা ঠোঁট নাড়ে, নাচে পুতুলের আত্মীয় স্বজন
পুষ্পাকুল স্টেজে, মাঝে মাঝে হয় বটে তালচ্যুত।এ এক মজার খেলা চলে রাত্রিদিন। এজলাসে
ভারিক্কী বিচারপতী, চুপচাপ, আসামী হাজির।
চতুর উকিলদ্বয় তোতাপাখি। পরিণামহীন
মামলায় শুধু বাদ-বিসম্বাদই সার; চোখে ভাসে
সুতোবন্দী নানাজন, কেউকেটা, উজির, নাজির।
যার হাতে সুতো সেকি নিজেও পুতুল সমাসীন? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
চঞ্চলা নর্তকী নও, অথচ যখন হাঁটো কিংবা ছুটে যাও,
বর্ষার বৃষ্টির পরে রামধনু উঠলে আকাশে,
বারান্দায়, চলায় সহজে লাগে ছন্দের বিদ্যুৎ।
যখন আয়নার সামনে লিপস্টিক মাখো ঠোঁটে, হাই-হিল জুতো
পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামো, হাতে বই, বুকের উপর
কালো বেণী, চিবুকে ঘামের ফোঁটা, কী-যে ভালো লাগে।যখন বাগান যাও, ফুল তোলো, ঝকঝকে দাঁতে
হঠাৎ কামড়ে ধরো সবুজ পেয়ারা, ময়নাকে
ছাতু দাও খেতে আর ভাঁড়ারের অন্ধকার কোণে
আঁতকে ওঠো আরশোলা দেখে, পানি চেয়ে
ভেঙে ফ্যালো গ্লাস, নখ খাও এবং চাবির রিং
ঘোরাও আঙুলে
অথবা সুরের তাল কেটে গেলে তন্ময় বিকেলে
খিলখিল ওঠো হেসে, ক্যারম খেলতে গিয়ে সারা
খেলাটাই করো মাটি
কী করে বোঝাই কতো ভালো লাগে তোমাকে তখন!অবশ্য কখনো
কবিতা পড় না তুমি (ক্লাসের বরাদ্দ পদ্য ছাড়া)
তাতে কী? তবুও এ সুন্দর শরীরী সৌরভে মেতে
পৃথিবীতে আছ তাই মেটাই চোখের তৃষ্ণা
সারাক্ষণ।হয়ত পারতে হতে সোনালি-নিবিড় বালুকণা
আমার মুঠোয় ঝলোমলো, ভাবি তুমি অর্গানের
ধ্বনির মতোই শ্রাবণের কালো ফোঁটা পাতাবাহারের বুকে,
বাগানের টসটসে ফলের সুরভি, মাংসে-বেঁধা
গোলাপের কাঁটা হয়তো পারতে হতে… (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
প্রেমমূলক
|
১
তোমার চোখের মতো আমি দেখিনি কখনো,
তোমার ঠোঁটের মতো ঠোঁটে ওষ্ঠ করিনি স্থাপন
কোনোদিন, তোমার বুকের পাখি একদা ধ্বনিত এ
জীবনে।
তোমার চুলের মতো চুল কোথাও কি এরকম
ছায়া দেয় ক্লান্তির প্রহরে? মুছে ফেলে হিংস্র
দুঃস্বপ্নগুলোকে?
এই যে কবিতা লিখে সত্যের অধিক সত্য রটিয়ে দিলাম
সারা বাংলাদেশে, তার মর্মকথা তুমিই জানো না।২
বালিকা-বয়সে তুমি কী রকম ছিলে? বাগানের চারাগাছ
জড়িয়ে কোমল বুকে উঠতে কি দুলে ফুল হওয়ার
আশায়?
অনেক বছর আগে-যখন দোয়েল ছিল হৃদয়ে আমার,
যখন আমার চোখ যৌবনের প্রথম স্বপ্নের আচ্ছন্নতা-
তুমি যে বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে হাসিখুশি নীল-শাদা
ফ্রক
পরে, বেণী দুলিয়ে সকালবেলা, আমি ছড়ি হাতে
গোধূলিতে
তার কাছ ঘেঁষে হাঁটি একা মাঝে-মাঝে বৈকালিক ভ্রমণের
অছিলায়, যদি পেয়ে যাই তোমার বালিকা-বয়সের ঘ্রাণ।৩
একটি সোনালি দিন শুধু দিয়েছিলে উপহার,
কেবল একটি দিন কেটেছিল সান্নিধ্যে তোমার
প্রতিটি মুহূর্ত নেচেছিল, মনে পড়ে, শ্যামা পাখির মতন
নিরিবিলি, একটি সোনালি দিন পথে ঘুরে
লিখেছি কবিতা, প্রিয়তমা, তোমারই উদ্দেশে। যদি
একটি দিনের সঙ্গ কবিতার ইতিহাসে অমরতা পায়,
তা’হলে বলো তো কেন এরকম কার্পণ্য তোমার?
৪
ক’দিন জ্বরের ঘোরে কেটেছে আমার; তুমি এলে
অপরাহ্নে এবং উপেক্ষা করে পরিবেশ আমার উপর ঝুঁকে
ঠোঁটে ঠোঁটে ছোঁয়ালে প্রগাঢ়, স্তনভার
লহমায় দ্রুত করে হৃৎস্পন্দন আমার। কী সহজে
ভুলে গেলে সমাজের বিরূপতা, আমাকে সারিয়ে
তুললে অলৌকিক পথ্যে, তোমার কবোষ্ণ কোলে মাথা
রেখে শুয়ে থাকি আর কখনো তোমাকে, কখনো বা
কবিতাকে দেখে নিই-ক’দিন জ্বরের পরে এই তো তোমার সঙ্গে স্বপ্নে দেখা
হলো।৫
এখন ঘুমিয়ে আছো তুমি বৈবাহিক বিছানায়,
মৈথুনের ক্লান্তি কুয়াশার মতো লেগে আছে সারা
শরীরে তোমার, প্রেম জাগে সপ্তর্ষিমন্ডলে আর
আমি দূরে বাংলা কবিতার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি
এক ঠায়, ঘুম নেই। তোমার নিদ্রার রূপ ভেবে
চতুর্দশপদী লিখি, গোপন ঈর্ষায় জ্ব’লে নিই
প্রতিশোধ নিজেরাই উপর। শোনো, একদিন আমিও
ঘুমিয়ে পড়ব, জাগব না আর, তুমি জেগে থেকো।৬
ঢাকার সুন্দরীদের খ্যাতি প্রজাপতি হয়ে ওড়ে
বহু ঠোঁটে, লাস্যময়ী রমণীরা সৌন্দর্যের উগ্র ঢেউ
তুলে কূটনৈতিক পার্টিতে কিংবা ফ্যাশন শো-এর
ঝলমলে হলঘরে ঘোরে প্রায়শই। তোমাকে যায় না দেখা
সেখানে কখনো, তুমি আছো খুব নিরালায়
এই শহরের এক কোণে আপন সৌন্দর্য নিয়ে। তোমার
মতন
সুন্দর দেখিনি কাউকেই। অবিশ্বাস্য মনে হ’লে
আমার প্রেমের পদাবলী ভাল ক’রে প’ড়ে দেখো। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এই যে দেখছি আকাশ, পায়ের তলার
সোঁদা মাটি, বাতাসের গাছের
সবুজ পাতার কম্পন ক্ষণে ক্ষণে, পাখির
উড়ে এসে বসা পাশের বাড়ির উন্মোচিত ছাদে,
কিয়দ্দূরে একজন পথিকের হেঁটে-যাওয়া সবই
নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে, সত্যি বলতে কি,
বিশিষ্ট করে তুলেছে, যদিও এই গলিতে
তেমন কোনও আয়োজন নেই উৎসবের।তা’হলে কেন মনে এই বুড়ো সুড়ো আমার অন্তরে
এই অবেলায় ফুটেছে নানা সুগন্ধি ফুল,
কেন সত্তা-নাচানো গানের সুর প্রস্ফুটিত?
কেন তিনজন বয়েসী ব্যক্তি
হাত ধরাধরি করে গাইছেন পুরনো দিনের বিস্মৃত
এক গান। আকাশের বঙ্কিম চাঁদ ডেকে আনে নক্ষত্রদের।এই আমি কিছুক্ষণ আগেও নববর্ষের আহ্বান,
সত্যি বলতে কি, শুনতে পাইনি। তিনজন বুড়োর
মিলিত নৃত্য আমাকে
চকিতে উৎসবে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে
ভুলিয়ে দিলো বাস্তবের নির্দয় প্রহার এবং
সমাজের কাণ্ডারিদের প্রতারণা, ভ্রূকুটি,
হঠাৎ মনে হলো, আকাশের উৎফুল্ল পূর্ণিমা
প্রখর অমাবস্যা হয়ে আমাদের ভীষণ কামড়াতে থাকে।
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
সকালের রোদে এই সাতই আশ্বিনে
আরো একটি দিন এলো জানাতে সাদর
সম্ভাষণ। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চাদরে পা ঘষি,
অন্যমনে আঙুল চালিয়ে দিই চুলে
কোথাও উজ্জ্বল মোটরের হর্ন বেজে ওঠে (শুনি)
চেনা শব্দ হরেক রকম। টিক টিক ঘরি বাজে, ঠিক ঠিক
টিকটিকি সাড়া দেয় সহযোগী তন্ময় নিষ্ঠায়।
বাথরুমে গড়ায় কলের পানি, বারান্দায় দেখি
হাওয়ায় টবের ফুলে সে কী গলাগলি।আলোলাগা ভালোলাগা বেলা
খেলা করে সত্তার প্রাঙ্গণে
-বেঁচে আছি।আলনায় ঝোলানো আমার
ইজের কামিজ সাদা দেয়ালের ফুল,
টেবিলে পুরানো ছবি, শুকনো ফল, দাড়ি কামাবার
সরঞ্জাম, অসমাপ্ত কবিতার পাণ্ডুলিপি, বই
সবকিছু ঝলমলিয়ে ওঠে
আশ্বিনের রোদ্দুরে এবং
মনে হয় থাকব এখানে চিরদিন।যখন পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে
রুটি মাখনের ঘ্রাণ, সোনালি চায়ের
সুগন্ধ, চূড়ির শব্দ, দরজায় আড়ালে তোমার
কণ্ঠস্বর ছোঁয় প্রাণ, ভাবি কী সুন্দর
এই বেঁচে থাকা… (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
পুরানো ভাড়াটে চলে গেলে কোনো বাসা বেশিদিন
খালি পড়ে থাকে না এখন।
পুনরায় ‘বাড়ি ভাড়া দেওয়া হইবেক’ ফলকটি
বসতে না বসতেই সরে যায়, অন্ধকার
ঘরে আলো জ্বলে, বারান্দায় হেঁটে যায় কেউ কেউ,
জানালায় পর্দা লাগে, শিশুর আনন্দধ্বনি বাজে
মাঝে-মাঝে, কাসেট প্লেয়ারে
রবীন্দ্রনাথের চিরকালীন গহন ব্যাকুলতা।এখানে সিঁড়িতে আগেকার কেউ যে-কথা বলেছে
প্রায়ই তার প্রতিধ্বনি এখন আরেক
কণ্ঠে জাগে। অনেক পুরানো সিন্দুকের ডালা-খোলা
গন্ধময় স্মৃতি ঘোরে আনাচে কানাচে। কার হাসি
সোনালি ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে হেমন্ত-বিকেলে?
এখন যে ভায়োলেট-রঙ
শাড়ি প’রে সাজাচ্ছে চায়ের সরঞ্জাম,
তার? নাকি আগেকার কারো?পুরানো দেয়ালে কিছু দাগ জমা হয়, সাঁঝবাতি
জ্বালায় না কেউ;
অন্দরে বেদনা শুয়ে আছে সাবলীল ঘরে-ফেরা
নাবিকের মতো, বয়ে যাওয়ার সময়, তবু
টেবিলে আসে না কেউ। ভোরে
দরজার কাছে এসেছিল ট্রাক, একটি কি দু’টি কাক
ছাদের কার্নিশে উঠেছিল ডেকে। কোথায় যে গেল
ওরা লটবহরসমেত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি রেখে? (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
প্রিয় এই শহরের কোনও পথ দিয়ে
হেঁটে যাই যখন একাকী
ভোরবেলা হাওয়ার আদর উপভোগ করতে করতে আর
বিরান বাগান ব’লে মনে হয় পরিবেশ,
আর কেন যেন হাহাকার হু হু ক’রে জেগে ওঠে
বারবার; নিজেকে কবরস্তানে অনুভব করি।কিছুক্ষণ পরে রোদ শিশুর হাসির মতো জেগে
উঠে চুমো খায় সঙ্গীহীন
এই পথচ্চারীটিকে। ভাবনার গোরস্তান দ্রুত উবে যায়,
মানুষের সাড়া জাগে নানা দিকে আর
কার যেন জ্বলজ্বলে ডাক আমাকে আচ্ছন্ন করে।
এদিক সেদিক দৃষ্টি মেলে দিই আর কান পাতি।না, কেউ আমাকে ডাকছে না কোনও গলি
অথবা কাছের চা-খানায়
আপ্যায়ন করার উদ্দেশে। তবু কেন মনে হয়
কে যেন ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে আমন্ত্রণ ক্রমাগত
জানাচ্ছে আমাকে। তাকে অবহেলা করে
চলে যাওয়া অনুচিত হবে ব’লে সেদিকে বাড়াই পদযুগ।হায়, এগোতেই দৃষ্টি থেকে ঘরবাড়ি, মুক্ত পার্ক
এবং দোকানপাট বেবাক উধাও
চতুর্দিকে বালি, শুধু বালি আর আমি ক্রমাগত
ডুবে যাচ্ছি বড় দ্রুত বালির ভেতরে। ক্ষণকাল
পরে যেন কার, সম্ভবত কোনও কল্যাণ কামিনী
তার অপরূপ হাতে মুক্ত করেন আমাকে অনাবিল হেসে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
এই আমি এতকাল বৈঠা বেয়ে প্রায়
তীরে এসে ডিঙি, হায় ডুবে
যেতে দেব? হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি-মাথা-
ভর্তি শাদা চুল ওড়ে দূরন্ত বাতাসে।
পাড়ার অনেকে আজও আমার তেজের
তারিফে প্রায়শ মেতে ওঠে, গুণ গায়।কখনও শ্রমের পরে ক্লান্ত আমি ছেঁড়া বিছানায়
গা ঢেলে দিলেই ঘুম এসে চুমো খায় আর
কিছুক্ষণ কিংবা বেশ কিছুক্ষণ কেটে
গেলে হুর-পরী ডানা মেলে এই
গরিবের হৃদয়কে নাচের মাধ্যমে
বেহেশতের অপরূপ হুরিময় নর্তকীর নাচে
চঞ্চলিত হয় চতুর্দিক, হয়ে ওঠে তারাময়!
বৈঠাবায়ী মাঝি হয়ে ওঠে বেহেশতের অধিবাসী!
অকস্মাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে মায়াবী স্বপ্নের
অপরূপ স্পর্শের গৌরব ভুলতে না পেরে ভাবি,-
শুধু ভাবি নর্তকীর অঙ্গভঙ্গি, হাসির ফোয়ারা,
ওদের নাচের ভঙ্গি। শরীরের ঘ্রাণ
তাদের মাতাল করে, যেন এখনও জীবন্ত।
এই আমি বৈঠা বেয়ে বারবার সেই স্বপ্ন দেখি।জেনে গেছি যে-পথে হাঁটতে হবে, সেই পথ
বড় বেশি কণ্টকিত, তদুপরি নানা দিকে খুব
ভয়ঙ্কর রক্তলোভী পশুর নিয়ত
বিচরণ পড়ে চোখে। অথচ সে-পথ
এড়িয়ে উদ্দিষ্ট সীমানায় পৌঁছুতেই হবে ঠিক।
ভয়াবহ সেই পথে মনুষ্য-হাড়ের স্তূপ কঙ্কালের! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
চিন্তামূলক
|
স্বপ্নের ভেতরে পেয়েছি একটি সংখ্যা, তিনশো তের,
৩১৩ হীরের লকেটের মতো দোলে
সারাক্ষণ দৃষ্টিপথে, মায়াবী।
এই সংখ্যা দুলে উঠলেই অজস্র ময়ূর পেখম মেলে
আমার একলা ঘরে, অবিস্মরণীভাবে
গোলাপ বাগান উন্মীলিত হয় মেঝে ফুঁড়ে হঠাৎ,
দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসে সিংহাসন।
এই সংখ্যা দুলে উঠলেই
একজন তৃষ্ণার্ত পথিককে দেখি আঁজলা ভ’রে ঝরনা তুলে নিতে,প্রাচীন গীতে গুঞ্জরিত হয় সত্তা,
নাবিকের নিরাপত্তাময় জলপথে নামে গোধূলি বেলা,
প্রেমিকের ওষ্ঠে ঝরে শত চুম্বন, মধুর, মদির,
বারবার ফিরে আসে বিয়ে বাড়ির চিত্রিত কুলো
আর রঙিন মাটির প্রদীপ।এই স্বপ্নাদ্য সংখ্যা
কিসের যোগফল কিংবা গুণফল, জানিনা;
অবশ্যই পুণ্যফল মানি।যখন ৩১৩ রবাবের মতো বাজে
এই শহরের সকল মূকের কণ্ঠ থেকে ঝরে দিব্য সঙ্গীত,
যখন ৩১৩ একটি বাক্যশোভা,
এই শহরের ব্যর্থতম কবির লেখনী হয় সকল কবিতার উৎস,
যখন ৩১৩ নীল নক্ষত্রের মতো জ্বলে,
প্রতিটি পথভ্রষ্ট পাত্থজন তার গন্তব্যে পৌঁছে যায়,
যখন ৩১৩ হাতের মতো প্রসারিত হয়,
হতচ্ছাড়া তীরভূমি হয়ে যায় সবচেয়ে সম্পন্ন বন্দর,
নাবিকের গানে আর সুন্দরীদের গুঞ্জনে মুখর,
যখন ৩১৩ মসলিনের রুমালের মতো ওড়ে,
বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্যসমূহ যায় থেমে,
যখন ৩১৩ চোখের তারার মতো কাঁপে,
এই শহরের অন্ধ সম্প্রদায় একসঙ্গে ফিরে পায় দৃষ্টি,
এই শহরের সকল নৈরাশ্যবাদী বুকের ভেতর
গান গায় জলকন্যা,
৩১৩ যখন দরবেশের তসবিহ,
ধাবমান ক্ষুধার্ত বাঘ হরিণকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দেয়
সীমাহীন নিস্পৃহতায়,
নিষ্ঠুরতম জল্লাদের হত বেহালা হ’য়ে বাজে,
সবচেয়ে বিপজ্জনক চোরাবালি বদলে যায় পার্কে,
ভয়াল ময়াল রঙধনুর বর্ণচ্ছটায়।এই যে আমি স্বপ্নাদ্য একটি সংখ্যা নিয়ে মেতে আছি,
এই সংখ্যাটিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে
অনেক খানাখন্দে পড়েছি কাঁটাতারে আটকে আমার
হাত-পা হয়েছে জখম, তবু কোনো
কূলকিনারা হয়নি, শুধু রূপসীর হাসির মতো
একটা মরীচিকা আমাকে ডেকে নিয়ে গেছে বারংবার।কে আমি? কী-ই বা আমি? সেই
চিরকেলে প্রশ্ন করি নিরন্তর নিজেকেই। এখানে
এসেছি কেন? কী কর্তব্য আমার?
আখেরে কোথায় যাবো? এই যে ব’সে থাকি নিশ্চুপ,
চোখ রাখি গাছের মগডালে, শুনি টিকটিকির ধ্বনি,
মাঝে-মধ্যে ভাবি ঐ গাছের বাকল এসে লাগবে আমার শরীরে,
হয়তো আমাকে দেয়াল ভেবে জন্মান্ধজন
উন্নয়নশীল দেশে ঘনিয়ে-আসা দুর্নীতির মতো অন্ধকারে
পথ চলবে। স্বরূপ অন্বেষায় ক্লান্ত আমি
পথের নকশা হারিয়ে ফেলেছি-
কেউ কি আমাকে বলে দেবে অনেক আমির ভিড়ে
কোন্ আমি বাস্তবিকই আমি?
বলে দেবেন কি কোনো যীশু কিংবা শাক্যমুণি?একপালে ডালকুত্তা-তাড়িত কয়েদী যেমন
ভুলুন্ঠিত হয়ে খিম্চে ধরে মাটি কিংবা শেকড়বাকড়
তেমনি আমি হাত বাড়িয়েছি সেই আমার
স্বপ্নাদ্য সংখ্যাটির দিকে স্বপ্নাদিষ্ট পুরুষের মতো।৩১৩ যখন কোনো গুণীর সর্বদা-তরুণ কণ্ঠের তান,
রাজবন্দীগণ দেবদূতের মতো উড়ে যান নীলিমায়
জন্মান্ধ সেল ছেড়ে
লাঞ্ছিত, নির্যাতিত জননেতা ভূষিত হন জয়মাল্যে,
স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জে জনগণ বাক-স্বাধীনতা ফিরে পান
অবলীলায়।৩১৩ তুমি ফিরে এসো আমার চোখের পাতায়,
ফিরে এসো করতলে, ফিরে এসো আমার
স্বপ্নে জাগরণে, যেমন শস্য ফিরে আসে
ভাগ ভাষীর ভাবনায়, দুঃসহ জীবন যাপনে, বুকের ভেতরে,
৩১৩ তুমি ফিরে এসো। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
সনেট
|
এখন এ মধ্যরাতে মনে রেখো ধ্বনি বেজে ওঠে
সারা চরাচরে; শাখাচ্যুত পাতা গাছের উদ্দেশে
বলে, মনে রেখো, সমুদ্রের ক্ষিপ্র ঢেউ তটে এসে
চুর্ণ হয়ে প্রতিবার আমাকে ভুলো না বলে ছোটে
আবার পিছনে। গোধূলির নিঃসঙ্গ আকাশ চোখে
অস্তরাগ মেখে করে উচ্চারণ আসন্ন রাত্রির কানে,-
মনে রেখো, মনে রেখো, জাগে ভোরের পাখির গানে,
বিদায়ী মুহূর্তে কম্পমান প্রেমিকের অন্তর্লোকে।যতই বাজুক গাঢ় মনে রেখো ধ্বনি জলে-স্থলে,
তবু আমি কোনোদিন জানাবো না করুণ মিনতি
তরুণী তোমার কাছে, বলবো না আর্তস্বরে জলে
ভাসিয়ে দুচোখ, মনে রেখো। যদি তুমি মন থেকে
ক্ষ্যাপাটে শিল্পীর মতো মুছে ফেলো আমাকে, বিবেকে
বাধবে কি? অকস্মাৎ থেমে যাবে পৃথিবীর গতি? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
মানবতাবাদী
|
কেমন সুর্যাস্ত এলো ছেয়ে চরাচরে, রক্তচ্ছটা
সর্বত্র ভীষণ জ্বলজ্বলে, ধরায় দারুণ জ্বালা
আমার দু’চোখে, আর যেদিকে তাকাই দেখি শুধু
একটি ফ্যাকাশে মুখ, নিষ্প্রভ তরুণ ফল যেন,
ভূলুণ্ঠিত গোধূলিতে। ঝকঝকে বল্লমের মতো,
মনে পড়ে, উঠেছিলো ঝল্সে সে ক্রুর রণক্ষেত্রে
সুকান্ত তেজস্বী যুবা। যদিও দূরন্ত যোদ্ধা, তবু
ছিলো না ঔদ্ধত্য কিংবা কর্কশতা কন্ঠস্বরে তার।
যেমন সে অশ্বারোহণে কি অস্ত্রশিক্ষায় নিপুণ
তেমনি পারদর্শী বাক্য উচ্চারণে, সৌজন্যে ভাস্বর।
শত্রুসংহারের নেশা। যে-বীরের শিরায় শিরায়
অত্যন্ত ফেনিল তার কন্ঠস্বরে রবাবের সুর
পাখির ওড়ার মতো, কখনো জানিনি আগে;হায়,
যে অন্ধ কৃষক তীক্ষ্ম কাস্তের আঘাতে স্বপ্নময়,
সাধের ফসল তার কেটে ফেলে অকালে, আমিও
তারই মতো বিভ্রমের মনহুশ ঊর্ণাজালে বন্দী
হয়ে নিজ হাতে ক্ষিপ্র করেছি বিরানা এই বুক,
আমার বয়সী বুক। যে মহল গড়েছি নিয়ত
স্বপ্নে, যখন তা কাছে এলো আসমানী ইশারায়
প্রকৃত নির্মাণ হ’য়ে, নিজেই করেছি তাকে ধু-ধু
ধ্বংসস্তুপ। কেন তাকে দেখামাত্র হৃদয় আমার
হয়নি উদ্বেল পিতৃস্নেহে? নিমেষেই কেন চোখ
হয়নি বিপুল বাষ্পাকুল? তবে কি রক্তের টান
দুর্মর সংস্কার কোনো? শুধু জনশ্রুতি, যুগ যুগ
ধ’রে যা’ লালিত আমাদের যৌথ সরল স্মৃতিতে?
কেন তাকে দেখামত্র বর্ম খুলে ফেলে, অস্ত্র রেখে
জড়িয়ে ধরিনি বুক, নিইনি মাথার ঘ্রাণ তার?
তাহ’লে পাঁজরে তার বর্শা-চালনার আগে কেন
কাঁপেনি আমার বুক একরত্তি? কেন এই হাত
মুহূর্তে হয়নি শিলীভূত? জয়মত্ত বীর আমি,
হইনি স্থবির কেন ক্ষণকাল? কেন অহমিকা
রৌদ্রঝলসিত শিরস্ত্রাণ হ’য়ে রইলো সর্বক্ষণ?
ধিক তোকে হে মূঢ় অহমিকা, ধিক।তাহমিনা,
মিথ্যার অক্ষরে কেন লিখেছিলে বিভ্রান্ত খেয়ালে
প্রতারক পত্র তুমি আঠারো বছর আগে? কেন
পুত্রের পিতাকে রেখেছিলে পুত্রহীন ক’রে, কেন?
তুমিতো জানো না এই হতভাগ্য পিতা পুত্রহীন
হয়েছে দ্বিতীয়বার। তুমিতো জানো না! তাহমিনা
তোমার দুলাল আজ এই বিয়াবানে কী নিষ্প্রাণ
কী নিঃস্পন্দ পড়ে আছে অশ্রুময় ঘাতক পিতার
ফজুল স্নেহের খিমাতলে!কেন আমি আজ তাকে
মিছেমিছি করি দায়ী? রাখ্শারোহী রুস্তম কি ছুটে
পারতো না যেতে ভুল আত্মজার জন্মের সংবাদ
পেয়ে? কেন সে যায় নি পাঁচ দশ মাস পরে কিংবা
দু’চার বছর পরে? কেন তার রক্তে জাগেনি কল্লোল
সন্তানের অকর্ষণে? কন্যা কি সন্তান নয় তবে?
কন্যার ওষ্ঠে কি হাসি ফোটেনা কখনো কিংবা তার
মাথায় থাকেনা ঘ্রাণ? কন্যা পিতাকে দুই হাতে
ধরে না জড়িয়ে? খেলনার জন্যে করে না আবদানে
কোনোদিন? থাকে না প্রবাসী জনকের প্রতীক্ষায়?
কন্যার শিরায় প্রবাহিত হয় না কি জনকের
সতেজ শোণিত ধারা? অনবোলা পরিন্দা সে-ও তো
যোজন যোজন দূর থেকে উড়ে আসে নীড়ে তার
শাবকের কাছে স্নেহবশে, সন্তান পুত্র কি কন্যা
করে না বিচার। হায়, কোন্ অভিশাপে হে রুস্তম
রণমত্ত অবিচল স্নেহহীন প্রবাদপ্রতিম বীর, তুমি
রেখেছো নিজেকে দূরে এতকাল দয়িতা এবং
সন্তানের কাছ থেকে? কী এমন ক্ষতি হতো কার
যদি এ যুদ্ধের ডঙ্গা স্তব্ধ হতো অনেক আগেই,
যদি দৈববলে আফ্রসিয়াবের রণমত্ততার
হতো অবসান এই সর্বনাশা দ্বৈরথের আগে,
যদি কায়কাউসের জলপাই পাতা উঠতো নেচে
আমার পুত্রের বুকে রুস্তমের মনহুশ বর্শা
উদ্যত হওয়ার আগে? কিন্তু, হায়, তা’ হওয়ার নয়।
আমরা ধনুক যাঁর হাতে তিনি নিজস্ব ইচ্ছায়
বাঁকান যতটা আমাদের, ততটাই বেঁকে যাই,
কেউ কেউ মচকাই, কেউবা ভীষণ খান খান।
লাশ নিয়ে বসে আছি,এখন ভীষণ ক্লান্ত আমি;
ওষ্ঠময় মরুবালি, সারামুখে খুনেলা রেখার
হিজিবিজি, মনে হয় হৃতজ্যোতি প্রবীণ ঈগল
সত্তায় নিয়েছে ঠাঁই। শুধু মাঝে-মাঝে পামীরের
উদাত্ত প্রান্তরেয়ার আলরুরুজের চূড়া থেকে
ভেসে-আসা সোহরার সোহরাব ধ্বনি, যা’ আমারই
শূন্য পাঁজরের আর্তনাদ, শুনে কেঁপে উঠি, যেন
মরুর শীতার্ত রাতে আহত নিঃসঙ্গ পুশুরাজ।এই আমি কতদিন ছাগলের চামড়ার মশক
থেকে ঢেলে আকন্ঠ করেছি পান ঝাঁঝালো শারাব
ইয়ারের মজলিশে রাত্রির তাঁবুতে। আকৈশোর
মৃগয়াবিলাসী আমি, ছুটেছি অরণ্যে, দীর্ঘশ্বাস-
ময় প্রান্তরের বুকে, কী এক নেশায় বুঁদ হ’য়ে
করেছি শিকার বাঘ, সংখ্যাহীন পাহাড়ি হরিণ।
মাজেন্দারানের পথে লড়েছি সিংহের সঙ্গে আর
হয়েছে নিমেষে দীর্ণ আমার নেজায় ভয়ানক
আতশবমনকারী অজগর; পাথুরে জমিনে,
রেগিস্তানে কত যে মড়ার খুলি প্রত্যহ উঠেছে
বেজে দ্রুত হাওয়া-চেরা রাখশ-এর প্রখর খুরাঘাতে,
সফেদ দৈত্যের প্রাণ করেছি সংহার, গুহাবন্দী
কায়কাউসের আয়ু-রাশ্মি দীপ্র দীর্ঘস্থায়ীকরার উদ্দেশ্যে শত শত খ্যাত গর্বিত বীরের
শিরশ্ছেদ করেছি হেলায় ধূলিগ্রস্ত রণক্ষেত্রে।
শুনিনি এমন যোদ্ধা আছে ত্রিভূবনে, রক্তে যার
জমে না তুষারকণা রুস্তমের রণহুংকারে হঠাৎ।
সোহবার তোর এই বালিমাখা রক্তাক্ত শরীর,
সেই পরাক্রান্ত চিরজয়ী রুস্তমকে আজ স্তব্ধ
ইরান-তুরাণ ব্যাপী অস্তরাগে করেছে ভীষণ
ক্লান্ত ওরে, পরাজিত। মিটেছে আগ্রাসী রণক্ষুধা,
আর নয় দুনিয়া কাঁপানো দামামার অট্রহাসি,
এইতো রেখেছি বর্ম খুলে, পড়ে থাকে তলোয়ার।
সোহরাব ফিরবে না আর;জানিনা মৃত্যুর পরে,
সে কেমন পটভূমি রয়েছে সাজানো, কোন্ মঞ্চ?
পুনরায় ভাঙবে কি ঘুম কোনো ভোরবেলা খুব
নিঝুম খিমায় স্নিগ্ধ হাওয়ার কম্পনে? শিরস্ত্রাণে
পরবে কি খসে দূরযাত্রী রাঙা পাখির পালক?
নতুন সামানগাঁয়ে যাবো কি আবার গোধূলিতে
কোনোদিন পথশ্রান্ত? প্রাক্তন প্রিয়ার হাত নেবো
তুলে হাতে, দেখবো মেহেদি-নক্শা তার করতলে
অথবা রহস্যময় কোনো সুর শুনে মরুদ্যান
ছেড়ে চলে যাবো দূর কুহকিনী নারীর গুহায়?
তুলে নেবো হাতে ফের ভল্ল, গদা, আত্মজ হননে
উঠবো কি মেতে পুনরায়? আঁজলায় নহরের
পানি নিয়ে হবো স্বপ্নাচ্ছন্ন? মৃত্যু শুধু নিরুত্তর
অন্ধকার নাকি আলো ভিন্নতর, জানিনা কিছুই।
তবে আজ জোনাকিরআসা-যাওয়া অন্য মানে প্রায়
আমার নিকট; শোনো রাখ্শ, নিত্যসঙ্গী কালশ্রান্ত
হে অশ্ব আমার, নেই অবসর, রাত্রি ছেয়ে আসে,
এখন প্রস্তুত হও, তোমার কেশরগুচ্ছ থেকে
ঝেড়ে ফেলো হাহাকার, আমাদের যেতে হবে দূর
আপন শস্তানে, বইতে হবে প্রিয় সওদা শোকের।
তোমার সওয়ার দুই-একজন মৃত, অন্যজন
জীবন্মৃত; ছোটো, ছোটো নিরন্তর, হে অশ্ব আমার।
আবার দাঁড়াবে এক দুঃখী পুত্রহীন পিতা
নিজের পিতার সামনে, হবে নতজানু তাঁর কাছে,
নাম যার বীর জাল এবং তুষারমৌলি তাঁর
শির; ফিরে যাবে নিজবাসভূমে সেই সওদাগরের
মতো, যে সর্বস্ব তার হারিয়ে ফেলেছে মরুপথে
প্রবল লুন্ঠনকারী তাতারস্যুর ক্রুর হাতে।
কখনো পাবো না দেখা তবুনিয়ত খুঁজবো তাকে,
বিদেহী যুবাকে, দিকে দিকে অন্তহীন বিরানায়,
মরীচিকাময় পথে, অন্তর্লোকে যে আমাকে খুঁজে
বেরিয়েছে এতকাল বালিয়াড়ি, দুর্গম প্রান্তর,
শত্রুর শিবির আর ভুবননন্দিত যোদ্ধাসংঘে।এখন নামুক শান্তি দিগন্তে দিগন্তে রেগিস্তানে,
এখন নামুক শান্তি আলরুরুজের জ্যোৎস্নাধোয়া
চূড়ায়, নামুক শান্তি ইতিহাস-তরঙ্গিত এই
আমূদরিয়ায় আর সামানগাঁয়ের গুলবাগে,
ফলের বাগানে রৌদ্রঝলসিত নহরে নহরে,
দিনান্তে উটের কাফেলায়, হরিণেয় পিপাসায়,
এখন নামুক শান্তি কায়কাউসের ব্যাঘ্রচর্ম
খিমায় এবং আফ্রাসিয়াবের সব অস্ত্রাগারে,
এখন নামুক শান্তি বেবাক তাতারী আস্তনায়,
এখন নামুক শান্তি রণলিপ্সু বিক্ষুব্ধ তুরাণে,
এখন নামুক শান্তি তিমিরান্ধ বিদীর্ণ ইরানে।
(ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান
|
স্বদেশমূলক
|
সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও
শিশিরের মতো জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়
জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ
বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে
ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,
কখনো অত্যন্ত ক্ষীপ্র জাগুয়ার তাকে
প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে
চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,
এতটুকু ঘুমাতে দেয়নি।
কাল রাত ঢাকা ছিল প্রেতের নগরী,
সবাই ফিরেছে ঘরে সাত তাড়াতাড়ি। চতুর্দিকে
নিস্তব্ধতা ওঁৎ পেতে থাকে,
ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি
কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক।
মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃশব্দ্যকে
আরো বেশি তীব্র করে তোলে
প্রহরে প্রহরে, নূর হোসেনের চোখে
খোলা পথ ওর
মোহন নগ্নতা দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দুর্বার। অন্ধকার
ঘরে চোখ দুটি অগ্নিঘেরা
জানালা, কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যৎ।
এমন সকাল তার জীবনে আসেনি কোনোদিন,
মনে হয় ওর; জানালার কাছে পাখি
এ-রকম সুর
দেয়নি ঝরিয়ে এর আগে, ডালিমের
গাছে পাতাগুলি আগে এমন সতেজ
কখনো হয়নি মনে। জীবনানন্দের
কবিতার মায়াবী আঙুল
তার মনে বিলি কেটে দেয়। অপরূপ সূর্যোদয়,
কেমন আলাদা,
সবার অলক্ষে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে
আঁকা হয়ে যায়,
যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে।
উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.