poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
শামসুর রাহমান
প্রেমমূলক
চল্লিশটি বর্ষার সজল স্পর্শ তোমাকে আকুল করে আজো, আজো দেখি তুমি জানালার কাছ ঘেঁষে বাইরে তাকিয়ে আষাঢ়ের জলধারা দ্যাখো খুব মুগ্ধাবেশে; মনে হয়, আষাঢ় তোমার মন আর হৃদয় শ্রাবণ। তুমি এই তো সেদিন ঘন কালো মেঘদল দেখে, শুনে বৃষ্টির জলতরঙ্গ বল্‌লে নিবিড় মেদুর স্বরে, ‘এ বৃষ্টি আমার, এই বর্ষা আমাকে সস্নেহে তার দীর্ঘ আঙুলে ছুঁয়ে যায়।এখন দেখছি আমি কবেকার তোমার আঠারো বছরকে চুমো খাচ্ছে আনন্দে নিভৃতে খোলা ছাদে কাঁচের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি। বাদল দিনের ফুল কদমের বুনো ঘ্রাণে শিহরিত তুমি ক্ষণে ক্ষণে। এমন বর্ষার দিনে তোমার কি সাধ জাগে কেউ নিরিবিলি টেলিফোনে ‘রাধা’ ব’লে ডাকুক তোমাকে?  (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
দু’টুকরো, তিন টুকরো, চার টুকরো পাঁচ টুকরো বহু টুকরো দিনভর রাতভর। এভাবেই কৈ মাছের নাচ নেচে, নিজের রক্ত নিজে ছেঁচে বেশ কিছু গড়বড় ক’রে বেঁচে আছে। ওর কাছে কীসের যে কী দাম; বিষের নাকি লোকশ্রুত অমৃতের, বোঝা দায়। কাম ওকে প্রায়শই গনগনে লোহা বানায়; অথচ তেমন সরোবর কই, যেখানে মনোমুগ্ধকর শীতলতা?আসলে ওসব বাজে কথা, আকাট মূর্খের বুজরুকি। জানে না, কোন্‌ কাজে কোন্‌ ঝুঁকি, শরীর টরীর সব নয়। অন্য কিছু অবশ্যই আছে। গাছে বাকল থাকে, ফল মূলও লভ্য। ডালই একমাত্র, বাকি সব ফক্কিকার, এমন ভাবার সুযোগ নেই সভ্য মানুষের। শীঘ্র চ’লে যাবে ভেবে দীর্ঘ জীবনের আকাংক্ষা দোলায় মাথা, ভোলায় নশ্বরতা। ‘যা’ কিছু পেলাম সীমিত এ জীবনে তাকেই সেলাম’ বলে সে প্রীত, মাটির ঢেলা ছুঁড়ে দেয় দূরে সূর্য ডুবুডুবু বেলায়। বয়স ফুরোচ্ছে, কালের বায়স কর্কশ সুরে দেয় জানান। তাতে কী? দুধে-ভাতে নাই বা গেলো থাকা। একেবারে ভূখা নয়, রুখা সুখা খাচ্ছে দু’বেলা।এরও বেশি কিছু চাই ওর। কীসের জন্যে হাহাকার সত্তা জুড়ে? আগুন রঙের অশ্বক্ষুরে উঠুক বেজে জমিন; খাল শুকোলে কী করে থাকবে মীন? নতুন কাল ডেকে আনার ইন্দ্রজাল কোথায়? কোনো মন্ত্র কেউ কি জানে না? যন্ত্রণা, সাপ-কামড়ানো যন্ত্রণা আপাদমস্তক। চামড়া ফুঁড়ে গল গল বেরোয় বিষ। কাঁহাতক আর সইবে সে?   (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
কে আমাকে এমন সতর্ক করে আজ বারংবার ভয়ার্ত রাত্তিরে? ঘোড়াগুলি আস্তাবলে করছে চিৎকার, উটেরা উৎকর্ণ বড়। ওরা টের পায়, ঘোর অমঙ্গল কাছে এলে ওরা টের পেয়ে যায়। বেদনার্ত চোখ মেলে দেখি আকাশে বিদ্যুচ্চমক ঘন ঘন, অথচ বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই।আমি কি ছিলাম অন্ধ অথবা বধির? আমার বিরুদ্ধে কত হাত মরুভূর জহরিলা সাপের মতন তুলেছে ব্যাপক ফণা ক্রমাগত, দেখতে পাইনি। কেউ কেউ বলেছে আমার চতুর্দিকে ভয়ংকর ফাঁদ পাতা, অথচ দিইনি কান রটনায় কোনোদিন। ওরা আমার রক্তের লোভে ঘোরে রাত্রিদিন শ্বাপদের মতো অন্তরালে, কখনো প্রকাশ্যে জনসভা ক’রে শাসায় আমাকে- যেন আমি অপরাধী আপাদমস্তক, যেন আমি প্রিয় স্বদেশের জন্যে ফেলিনি মাথার ঘাম পায়ে, আরববাসীর ধুধু পানিকষ্ট দ্রুত লাঘবের জন্যে যেন করিনি খনন কূপ শহরে শহরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে।একবার ভেবে দেখ হে নগরবাসী কে আমি, কী কাজ আমি করেছি নিঃশব্দে এতকাল। বাজাইনি ঢাক ঢোল, আত্মপ্রচারের মোহে নগরকে কখনো দিইনি মুড়ে রঙিন কাগজে। নিজেই নিজের কথা বলা সমীচীন নয় কোনোকালে, তবু কিছু কথা বলি, কেননা অত্যন্ত ক্ষীণ জানি জনস্মৃতি। জনগণ যাতে সুখী হয়, সেজন্যে এ-আমি করেছি নির্মাণ পথ, বাঁধ, সুস্নিগ্ধ সরাই; করেছি সত্যের জন্যে রোকেয়ার সঙ্গে ন’বছর নির্বাসিত জীবনযাপন; শত বিপর্যয়ে রেখেছি নিজেকে খাড়া মসজিদের মিনারের মতো। মানব কল্যাণ আর প্রগতি সর্বদা ছিল ধ্রুবতারা আমার জীবনে, কিন্তু যারা নিত্য বিপক্ষে আমার করে কানাঘুষা, দেয় অপবাদ স্বজনপ্রীতি আর আমার সকল কাজে ধরে খুঁত সর্বক্ষণ তারা কলঙ্ক লেপন করে আমার নামের অবয়বে, যেমন অবুঝ শিশু দোয়াত উপুড় করে সফেদ কাগজে খেলাচ্ছলে। আমার বিরুদ্ধে ওরা নানান ফিকিরে নিয়ত খেপিয়ে তোলে অগণিত মানুষকে শুধু। আমার সকল কীর্তি যেন উটের পায়ের ছাপ মরুর বালিতে-বাতাসের ঝটকায় মুছে যায় নিমেষেই; হত্যাকারীগণ হচ্ছে তৈরি অন্ধকারে, শানাচ্ছে বিষাক্ত হাতিয়ার এবং অপ্রতিরোধ্য ওরা আসবেই দলে দলে জোট বেঁধে বর্বর নেশায় মেতে। কিন্তু তারা মূঢ় অর্বাচীন; জানে না যে-রক্ত ধারা বইবে আজ আমার শরীর থেকে তার গতি থামবে না কোনোকোলে। এই রক্তস্রোত অবিরল বয়ে যাবে দশকে দশকে আর শতকে শতকে।  (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
সজনে গাছের ডালে পাখি ডাকে ডবকা দুপুরে, গায় গান পাড়ার মাস্তান, নেশাভাঙ করে আর হিজড়া ধরনে নাচে, যেন ওরা মায়াবনে দেবদূত দেখে খুব প্রাণিত এখন। গলি থেকে তরুণী বেরোয়া একা, ফেরিঅলা ডেকে যায় দুপুরকে চিরে-চিরে; অকস্মাৎ কেমন চাঞ্চল্য জাগে মানুষের ভিড়ে, ট্রাফিক পুলিশ উচ্চকিত, বাঁশি বাজে, কী বিপন্ন বিহ্বলতা চতুর্দিকে, ট্রাকের তলায় চাপা পড়েছে উদোম মানবতা।   (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
স্বদেশমূলক
সেই যে কখন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি বড় একা তোমার নিস্তব্ধ দোরে, তুমি খেয়ালই করোনি। হায়, কিছুতেই তুমি ভুলেও একটিবার তাকাচ্ছো না এই গরিবের দিকে!না হয় আমার গায়ে চোখ-জুড়ানো পোশাক নেই, না হয় আমার কথা জাঁদুরেল কোনও শরিফের মতো কেতাদুরস্ত হওয়ার তেমন সুযোগ কিছুতেই পাইনি কস্মিনকালে।তা’বলে অশেষ ঘেন্না পেয়ে দিগ্ধিদিক লুকিয়ে নিতান্ত সাধারণ মুখ লুকিয়ে বেড়াবো, এমনও তো মেনে নেয়া যায় না সহজে। অজান্তেই এই সত্তা বিদ্রোহের আগুনে উত্তপ্ত হয়ে উঠে।আমার জৌলুশ নেই বটে, কিন্তু বিদ্যার বৈভব আমার অন্তরে আছে, তুমি তার পরিচয় পেয়েছো নিশ্চিত, তবু কেন তোমার নিস্তব্ধ দোরে এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায়। ভিখারির ধরনে নিশ্চুপ সময়ের দাস হবো?তোমার তো জানা আছে আমাদের শহীদ, উন্নত শির নেতা কখনও জালিম আর অন্যায় বিলাসী কারও সঙ্গে করেননি সন্ধি। তিনি নেই, তাঁর আদর্শের ওজ্জ্বল্য, মহিমা রয়ে গেছে অবিচল।   (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
চাঁদের আংশিক ক্ষয় আর নক্ষত্রের ত্রস্তরূপ দেখে বুড়ো শিরিষের ডালে রাতজাগা প্যাঁচা বলে- ‘কবি আর বুদ্ধিজীবী হননের কাল ফের শুরু হলো বুঝি! জেনেছি, সদর স্ট্রিটে ক’জন সন্ত্রাসী ক্রোধে জ্বলে একজন দীপ্ত বুদ্ধিজীবীকে শাসায় সতেজ জীবনকে প্রাণহীন ধূলায় লুটিয়ে দেবে বলে ক্ষিপ্র বুলেটে, আরেকজন অপহৃত হতে হতে কোনোমতে জীবনের কণ্ঠলগ্ন থেকে যান।কী কসুর তাঁদের? বস্তুত যারা অন্যের ভিটায় প্রায়শ চড়ায় ঘুঘু, ছড়ায় আন্ধার চতুর্দিকে, শহরকে জঙ্গল বানাতে চায় ক্রূরতায় মজে, ওদের বিপক্ষে দৃঢ়চিত্ত কবি আর বুদ্ধিজীবী আমজনতাকে বাগানের, অন্ধ কুয়ো নয়, নীল সমুদ্রের স্বপ্ন আর ঠিক পথ দেখান সর্বদা।   (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
বিচলিত হয়ো না এখন, স্থির হও সমুদ্রতলের মতো, ধাক্কা খাবে, খেতে হবে বহুদিন, ভেঙচি কেটে চলে যাবে বহু লোক, কেউ কেউ হানবে আঘাত, সয়ে যাও সবকিছু ধৈর্য ধরে।তোমার হৃৎপিণ্ড ঠুকরে ঠুকরে খাবে বিশাল শকুন, খেতে দাও; এরকমই হয় চিরদিন, পাথরে থাকবে বন্দি তুমি বহুকাল। কেননা তোমার কাছে মুক্তিবাণী আছে, বয়ে যাও যন্ত্রণার শুরুভার হে নীরবে।দেবতারা খুব ঈর্ষাকাতর তোমার সাহসের দীপ্তি দেখে, তোমাকে পোড়ায় তাই উহাদের ক্রোধ। এভাবে পুড়তে হবে দিনরত্রি, জ্যোৎস্নার প্রলেপ সহজে পাবে না তুমি মরবার আগে।বিচলিত হয়ো না এখন, গলা ছেড়ে গাও গান প্রহরে প্রহরে, পাখি আর লতাপাতা কীট পতঙ্গ শুনুক কী অমর্ত্য সুর বাজে মর্ত্যবাসীর গলায় বেদনায়; আকাশ আসবে নেমে শৃংখলিত দু’পায়ে তোমার।   (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা পথের ধুলোবালি চোখে-মুখে ছড়িয়ে সন্ধ্যায়? কেন যাচ্ছি? কী হবে সেখানে গিয়ে? জানা নেই। মাঝে-মাঝে বিছানায় শুয়ে সাত-পাঁচ ভেবে চলি। অতীতের কিছু কথা স্মৃতিপটে ভাসে।হঠাৎ ভীষণ শব্দ আমাকে কামড়ে ধরে যেন- ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। অন্ধকার যেন আরও বেশি গাঢ় হয়ে যায়, এমনকি নিজ হাত এতটুকু পড়ছে না স্বদৃষ্টিতে। থেকে যেতে হ’ল আখেরে সেখানে, যে-স্থানের সবকিছু বেজায় অজানা!আজকাল প্রায়শই জানাশোনা লোকের মৃত্যুর খবর বিষণ্ন করে অতিশয় টেলিফোন, কখনও সংবাদপত্র কিংবা রেডিওর মারফত। কোনও-কোনও আত্মীয়স্বজন যারা অতি সাধারণ, নামের জৌলুসহীন, আড়ালেই থাকে। লক্ষ, কোটি মানুষের মতো।কখনও কখনও আয়নায় নিজের চেহারা দেখে সহসা চমকে ওঠে। এই আমি আজ আমার আপনজনদের মাঝে হেসে, খেলে থাকি; একদিন আচানক মুছে যাব ধুলো-তখন সত্তা, পদ্য এবং আপনজন-সবই শুধু অর্থহীন, হাহাকার!   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
ছিলাম তন্দ্রার ঘাটে, চোখ ঢুলু ঢুলু, অকস্মাৎ বেনো জল। শ্মশানের কাঠ ভেসে এসে বলে, ‘ধরো’; বুকে নিয়ে ভাসমান। অন্ধ জলে অবিরল হাবুডুবু খাই। ওপারে তন্দ্রার ঘাটে ব’সে আছে বেজায় একাকী খেয়া মাঝি, নৌকো দোলে, ভাঙা দাঁড় হাহাকার বয়, অসিত চাদরে ঢাকা বিশুষ্ক শরীর, ঘাড়ে তার বিষণ্ন করোটি।  (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
চিন্তামূলক
জ্যোৎস্নামাখা মধ্যরাতে নিঝুম পথে একলা আমি যাচ্ছি হেঁটে। আগে পিছে দৃষ্টি রাখি, কিন্তু কোনও আদম কোথাও দেয় না দেখা।এই যে আমি বিজন পথে বড় একা খুঁজছি ডেরা একটু শুধু ক্লান্তি-কণা মুছে নিতে কিংবা ঘুমের মেঘে ভেসে জড়িয়ে কোনও সোহাগিনীর দীপ্ত শরীর উধাও হতে।হেঁটে-হেঁটে পথের ধারে একটি গাছের কাছে গিয়ে ছায়ার আদর গায়ে মেখে ঋষির ঢঙে বসে পড়ি। হঠাৎ দেখি, সামনে আমার দাঁড়ানো এক বাউল হাতে একতারাটা ঝুলিয়ে নিয়ে।দেখেই তাকে উঠে দাঁড়াই, শ্রদ্ধা জানাই নুইয়ে মাথা। চেহারা তার চেনা খুবই, সাধক তিনি লালন সাঁই- মাথায় আমার হাত রেখে তাঁর স্নেহ বুলিয়ে, একটি চোখের আলোয় তিনি দেন ভাসিয়ে পথিকটিকে।একতারাকে সুর বানিয়ে লালন এক লালনগীতি গাইতে গাইতে গেলেন মিশে জ্যোৎস্না-ধোওয়া চক্রবালে। আমি শুধু মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে থাকি ধূসর পথে; সাগর মেতে ওঠে মনে, পা চালিয়ে এগিয়ে যাই।   (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ)
শামসুর রাহমান
মানবতাবাদী
তোমাকে পাঠাতে চাই শহরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, ভিড়ে কেরানীর কলোনীতে, মতজুরের ঝুপড়িতে আর মাছরাঙাময় বিলে; কৃষকের কুপিজ্বলা রাত্রির কুটিরে, তোমাকে পাঠাতে চাই ফ্যাক্‌টরির চঞ্চল চাকার খুব কাছে, হটে, অন্তত জোনাকি-ঝলসিত ঝোপঝাড়ে, কুমোর পাড়ায় অর জেলের ডিঙিতে পুকুরের স্তব্ধ ঘাটে, চাঁদের সংকেতে চমকিত ছোট ঘরে, চুপিসারে একে একে আসা পার্টি কর্মীদের যুক্তিতর্কে আন্দোলিত গোপন বৈঠকে; যদি যাও তুমি পাবে নব্য ভাষা সেখানে, আশ্বাস দিতে পারি। কখনো হয়ো না ভীতসালঙ্কারা হবার দরকার নেই। তোমার গলার মনিহার খুলে ফেলো; কঙ্কন কেয়ুর থাক, অবান্তর রুপালি নুপুর। তোমার সত্তায় বাজে চরাচরে-মন্থিত গহন কত সুর।শুধু চাই তোমার দু’চোখে যেন বিলে জলপানরতা হরিণীর দৃষ্টি জেগে থাকে, আকাশের নীলে যে-স্বপ্ন বেড়ায় ভেসে, তার স্পর্শ পাক তোমার স্পন্দন, অন্ধকার রাত্তিরে যখন একা বাড়ি ফেরে যুবা নান্দীপাঠ সেরে বিপ্লবের তার যোগ্য উদ্দীপনা আমিও তোমাতে চাই। আর নানা ঘাট ঘুরে তুমি কুড়াবে অসীম ধৈর্যৈ অধরার কণা।ভয় নেই হে, আমার গান, কথা দিচ্ছি, কখনো তোমাকে করবো না অপমান। ওথেলোর মতো অন্ধ ক্রোধে তোমার সুন্দর গরা টিপে তোমাকে নিহত করবো না কস্মিনকালেও। যেখানেই যাও, সভা থমকে দাঁড়াবে জেনো; বলবে সবাই সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে ‘কেমন সতেজ রক্তজবা সাজহীন অপরূপ সাজে এলো আমাদের ঘরে’।   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)
নাজিম মাহমুদ
মানবতাবাদী
বজ্র কঠিন শপথ আবার লহ সবাই শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য কহ সবাই; শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই।।মানবতার নিধনযজ্ঞ বিভৎসতা বিভেদ বুদ্ধি, বিদ্বেষ বিষ, হিংস্রতা হিংসা দ্বন্দ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে করব ছাই শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই।।পলাতক আজ শুভ্র কপোত আকাশ নীল আগামী সূর্যে করবে আবার সে ঝিলমিল।তা যদি না হয়, বুঝব আমরা মানুষ নই, শিরায় শিরায় এখনও পশুর রক্ত বই তা যদি না হয়, গর্ব বড়াই দিও না ঠাঁই শান্তি চাই শান্তি চাই শান্তি চাই।। (নাজিম মাহমুদের লেখা এ গানটির সুর দিয়েছেন সাধন সরকার)
নাজিম মাহমুদ
স্বদেশমূলক
জাগো হে বাংলার জনতা বলো মানুষ মানুষের জন্য ধর্ম বিভেদ বিষ জীর্ন করো পুন্য এ জীবন ধন্য স্বাপদে ভরা জনারণ্যে এ জঘন্য করো দূর আমাদের পাপ অগন্য।।বলো হোয়ো নাকো হিংসায় মত্ত বলো বলো সবে মানবতা সত্য পৃথিবীটাকে বদলে দাও নব এক শতক সমাগত।জ্ঞানের প্রদীপ আজ জ্বালো এই আমাদের বাংলাদেশে সৈনিক লহো তুলে ঝান্ডা চেতনার  নব উন্মেষে তোমারই আঘাতে অবশেষে যাবে ভেসে যারা এখনও অন্ধ অচৈতন্য।।বলো হয়োনাকো …. শতক সমাগত।মৌলবাদের কোন ঠাঁই নাই এই আমাদের বাংলাদেশে সৈনিক লহো তুলে ঝান্ডা চেতনার  নব উন্মেষে তোমারই আঘাতে অবশেষে যাবে ভেসেযারা করেছে ধর্ম পূঁজিপণ্য।।বলো হয়োনাকো …শতক সমাগত। (এটি স্বননের সম্মেলক সঙ্গীত)
নাজিম মাহমুদ
চিন্তামূলক
বড় বড় ত্যাগ যতো সহজ ছোটো ছোটো ত্যাগ ততোই কঠিন বড় ত্যাগে এক ধরনের অহম আছে ছোটো ছোটো ত্যাগে কোনো ঘোষনা নেই বড় ত্যাগ প্রত্যাশা করে সহস্র সাধুবাদ মানুষের করতালি ইতিহাসে স্বাক্ষর ছোটো ছোটো ত্যাগ কিছুই চায় না সহজাত সে এক প্রবৃত্তি দারুন গরমে ট্রেনে জানলার সীট প্রচণ্ড ভীড়ে বাসের আসন দীর্ঘ কিউতে নিজ স্থান অনায়াসে সে ছেড়ে দেয় অচেনা কাউকে তাঁর প্রয়োজন বেশি একথা ভেবে- বড় ত্যাগে বড় বড় ইমারৎ ওঠে হাসপাতাল-স্কুল-কলেজ-এতিমখানা ছোটো ছোটো ত্যাগ স্ফুলিঙ্গের মতো একটু জ্বলেই ফুরিয়ে যায় কেউ তাকে মনেও রাখে না না যে ছাড়ে, না যে পায় তবুও অভ্যেসবশত ছোটো ছোটো ত্যাগ বৃষ্টিতে ছাতা মেলে দেয় অন্যকে আহার্যের ভাগ দেয় সহযাত্রীকে কারো অসুবিধায় এগিয়ে যায় দু’পা বড় ত্যাগ কখনো সখনো কেউ কেউ করে মানুষের মতো মানুষ না হয়েও তা সে পারে ছোটো ছোটো ত্যাগের লেখাজোকা নেই প্রাত্যহিক জীবনের এইসব টুকরো টুকরো ত্যাগ একজন মানুষকে সনাক্ত করে মানুষ বলে সেই মানুষ হওয়া সত্যিই সহজ নয়।
শেখ ফজলুল করিম
মানবতাবাদী
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর ? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, –মানুষেতে সুরাসুর ! রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়, আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়। প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে, স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।
শেখ ফজলুল করিম
নীতিমূলক
শত শত ক্রোশ করিয়া ভ্রমণ জ্ঞানীর অন্বেষণে সহসা একদা পেল সে প্রবীণ কোনো এক মহাজনে। সুধালো, হে জ্ঞানী, আকাশের চেয়ে উচ্চতা বেশি কার? জ্ঞানী বলে, বাছা, সত্যের চেয়ে উঁচু নাই কিছু আর। পুনঃ সে কহিল, পৃথিবীর চেয়ে ওজনে ভারি কি আছে? জ্ঞানী বলে, বাছা, নিষ্পাপ জনে দোষারোপ করা মিছে। জিজ্ঞাসে পুনঃ, পাথরের চেয়ে কি আছে অধিক শক্ত? জ্ঞানী বলে, বাছা, যে হৃদয় হয় জগদীশ প্রেমভক্ত। কহিল আবার, অনলের চেয়ে উত্তাপ বেশি কার? জ্ঞানী বলে, বাছা, ঈর্ষার কাছে বহ্নিতাপও ছার। পুছিল পথিক, বরফের চেয়ে শীতল কি কিছু নাই? জ্ঞানী বলে, বাছা, স্বজন-বিমুখ হৃদয় যে ঠিক তাই। সুধালো সে জন, সাগর হইতে কে অধিক ধনবান? জ্ঞানী বলে, বাছা, তুষ্ট হৃদয় তারো চেয়ে গরীয়ান।
শেখ ফজলুল করিম
চিন্তামূলক
জিব্রাইল জিজ্ঞাসিল নূহ পয়গাম্বরে ‘বলো, বলো বর্ষীয়ান, দয়া করে মোরে এত বর্ষ আয়ু তব হলো বসুধার কেমন দেখিলে তুমি বলো না ইহার?’ নূহ বলে, ‘মহাত্মন, কী বলিব আর দেখিলাম, এক গৃহ, তার দুটি দ্বার, এক দ্বার দিয়া জীব প্রবেশ করিয়া অন্য দ্বারপথে সবে যেতেছে চলিয়া।’
শেখ ফজলুল করিম
প্রকৃতিমূলক
ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায় দামাল ছেলের মতো ডাক দে বলে, আয়রে তোরা আয় ডাকব তোদের কত!মুক্ত মাঠের মিষ্টি হাওয়া জোটে না যা ভাগ্যে পাওয়া হারাসনে ভাই অবহেলায় রে দিন যে হলো গত।ছোট্ট নদী কোন সুদূরে ধায় বক্ষে রজত-ধারা ডাক দে বলে, আয়রে ছুটে আয় রুগ্ন সাহস-হারা।লাগলে মাথায় বৃষ্টি-বাতাস উলটে কি যায় সৃষ্টি আকাশ? রোদের ভয়ে থাকলে শুয়ে রে নৌকা বাইবে কারা? ছোট্ট নদী কোন সুদূরে ধায় বক্ষে রজত-ধারা।সবুজ বনের শীতল কোলের কাছে একটি খড়ো ঘর ডাক দে বলে, ভুলেছো ভাই মোরে তাই ভেবেছো পর।ইটের পাঁজায় চক্ষু বুঁজে নিত্য নুতন অভাব খুঁজে শেষ হবে তোর জীবনধারা যে থাকবে বালুচর। সবুজ বনের শীতল কোণে রে একটি খড়ো ঘর।সাত-সকালে ঝাঁপি মাথায় চাষী মাঠের দিকে যায় ডাক দে বলে, “এই তো তোদের পথ বাঁচতে যারা চায়।পেটের ক্ষিদে মেটে না যার এই রাতে ঠাঁই কোথা তার? বাঁচতে হলে লাঙ্গল ধর রে আবার এসে গাঁয়।” সাত-সকালে ঝাঁপি মাথায় চাষী মাঠের দিকে ধায়।
শেখ ফজলুল করিম
চিন্তামূলক
আর্দ্র মহীতলে হেথা চির নিদ্রাগত ব্যথাতুর দীন কবি, অফুরন্ত সাধ ভুলে যাও একটি তার জনমের মতো হয়তো সে করিয়াছে শত অপরাধ পান্থপদ রেণুপুত এ শেষ ভবন হতে পারে তার ভাগ্যে সুখের নন্দন।
শেখ ফজলুল করিম
নীতিমূলক
সাত শত ক্রোশ করিয়া ভ্রমণ জ্ঞানীর অন্বেষণে, সহসা একদা পেল সে প্রবীণ কোনো এক মহাজনে। শুধাল, ”হে জ্ঞানী! আকাশের চেয়ে উচ্চতা বেশি কার?” জ্ঞানী বলে, ”বাছা, সত্যের চেয়ে উঁচু নাহি কিছু আর।” পুনঃ সে কহিল, ”পৃথিবীর চেয়ে ওজনে ভারী কি আছে?” জ্ঞানী বলে, ”বাছা, নিষ্পাপ জনে দোষারোপ করা মিছে।” জিজ্ঞাসে পুনঃ, ”পাথরের চেয়ে কি আছে অধিক শক্ত?” জ্ঞানী বলে, ”বাছা, সেই যে হৃদয় জগদীম-প্রেম-ভক্ত।” কহিল আবার, ”অনলের চেয়ে উত্তাপ বেশি কার?” জ্ঞানী বলে, ”বাছা, ঈর্ষার কাছে বহ্নিতাপও ছার।” পুছিল পথিক, ”বরফের চেয়ে শীতর কি কিছু নাই?” জ্ঞানী বলে, ”বাছা স্বজন-বিমুখ হৃদয় যে ঠিক তাই।” শুধাল সে জন, ”সাগর হইতে কে বেশি ধনবান?” জ্ঞানী বলে, ”বাছা, তুষ্ট হৃদয় তারো চেয়ে গরীয়ান।”
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
চিন্তামূলক
বলো না কাতর স্বরে, বৃথা জন্ম এ সংসারে এ জীবন নিশার স্বপন, দারা পুত্র পরিবার, তুমি কার কে তোমার বলে জীব করো না ক্রন্দন; মানব-জনম সার, এমন পাবে না আর বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন; কর যত্ন হবে জয়, জীবাত্মা অনিত্য নয় ওহে জীব কর আকিঞ্চন । করো না সুখের আশ, পরো না দুখের ফাঁস, জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়, সংসারে সংসারী সাজ, করো নিত্য নিজ কাজ, ভবের উন্নতি যাতে হয় । দিন যায় ক্ষণ যায়, সময় কাহারো নয়, বেগে ধায় নাহি রহে স্থির, সহায় সম্পদ বল, সকলি ঘুচায় কাল আয়ু যেন শৈবালের নীর । সংসার-সমরাঙ্গনে যুদ্ধ কর দৃঢ় পণে, ভয়ে ভীত হইও মানব; কর যুদ্ধ বীর্যবান, যায় যাবে যাক প্রাণ মহিমাই জগতে দূর্লভ । মনোহর মূর্তি হেরে, ওহে জীব অন্ধকারে, ভবিষ্যতে করো না নির্ভর; অতীত সুখের দিন, পুনঃ আর ডেকে এনে, চিন্তা করে হইও না কাতর । মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়, সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্ব্জা ধরে আমরাও হব বরণীয় । সমর-সাগর-তীরে, পদাঙ্ক অঙ্কিত করে আমরাও হব হে অমর; সেই চিহ্ন লক্ষ করে, অন্য কোনো জন পরে, যশোদ্বারে আসিবে সত্বর । করো না মানবগণ, বৃথা ক্ষয় এ জীবন সংসার সমরাঙ্গন মাঝে; সঙ্কল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা, রত হয়ে নিজ নিজ কাজে । দিন যায়, ক্ষণ যায়, সময় কাহারো নয়, বেগে ধায়, নাহি রহে স্থির, সহায় সম্পদ বল, সকলি ঘুচায় কাল, আয়ু যেন শৈবালের নীর । জাতি-দেশ-বর্ণ ভেদ ধর্ম ভেদ নাই । শিশুর হাসির কাছে, সবি প’ড়ে থাকে পাছে, যেখানে যখন দেখি তখনি জুড়াই।
আনিসুল হক
প্রকৃতিমূলক
এত কেন গরম বর্ষাকালে? ঝড়ে উড়ে যায় যায় গো আমার মুখের বসনখানি আমার বুকের বসনখানি আমার রইল না লাজলজ্জা এত কেন গরম বর্ষাকালে আমার শরম ওড়ে মেঘের ফোলা পালে ঘামে ভেজে আমার গৃহসজ্জা ঘামে ভেজে আমার অলস শয্যা লোডশেডিং কেন বর্ষাকালে? এতই যদি গরম বর্ষাকালে আমি তবে ছাদের জলে ভিজি এতই যদি গরম বর্ষাকালে আমি তবে বৃষ্টিজলে ভিজি ভিজুক আমার যত গরমগুলো ভিজুক আমার যত শরমগুলো মধ্যরাতে ছাদে আমি ভিজি বিজলি জ্বলুক সব উজালা করে আমায় আমি ভেজাব আজ সকল শূন্য করে
আনিসুল হক
প্রেমমূলক
শাহানা, তুমি গোলাপী জামা প’রে জীবন্ত গোলাপের মতো ক্যাম্পাসে এসো না, আমার খারাপ লাগে।সখী পরিবৃতা হয়ে মোগল-দুহিতার মতো করিডোরে অমন ক’রে হেঁটো না, আমার খারাপ লাগে।শাহানা, তুমি চিবুক নাড়িয়ে রাঙা মাড়িতে দুধ শাদা হাতে লালিম জিহ্বায় গিটারের তারের মতো বেজে উঠো না — দরদালান কেঁপে উঠে, ঢিল পড়ে বুকের পুকুরে, কাঁপে পানি থিরিথিরি, আমার খারাপ লাগে।শাহানা, তুমি টিফিন আওয়ারে ক্লাসরুমে ব’সে অমন করে রাধার মতো দীর্ঘ চুল মেলে দিও না অন্ধকার করে আসে সারাটা আকাশ নিবে যায় সবগুলি নিয়ন কালো মেঘের উপমা দিতে আমার ভালো লাগে না।শাহানা, তুমি ক্যাফেটেরিয়ায় নিরেট চায়ের কাপে ওই দুটি ঠোঁট রেখো না; নিদাঘ খরার পোড়ে ঠোঁটের বাগান, মরুভূর মতো জ্বলে তৃষ্ণার্ত সবুজ;আমার মরে যেতে সাধ হয়।
আনিসুল হক
প্রেমমূলক
বৃষ্টি তুমি এসো তুমুল করে বেসো
আনিসুল হক
প্রকৃতিমূলক
আমার একটা কদম বৃক্ষ আছে! আমি তাকে নীপ বলে ডাকি। আইনত গাছটা আমার নয়, আমি ঠিক তার পাশের বাসায় থাকি! কিন্তু তাকে ডেকে আমি বলি, ওগো নীপ তুমি কিন্তু আমার! তুমি আমার তুমি আমার শুধুই! তোমার ছায়ায় দিবারাত্র শুই। কদম আমার কথায় মাথা নাড়েন, চুলের বেণি বৃষ্টিশেষে ঝাড়েন। বলেন, যখন আকাশ থাকে মেঘলা, আমার ছায়া কোথায় তখন? একলা আমি তখন ছায়াবিহীন একাকিনী! জলের কাছে মেঘের কাছে ভীষণ ঋণী। আমি বলি, ছায়া তখন বিশ্বজুড়ে তোমাকে পাই ঠিক তখনই অন্তঃপুরে জানলা দিয়ে চেয়ে থাকি তোমার দিকে, মাথা রাখি তোমার কোলে, লোহার শিকে... বাতাস ওঠে, পাতা নড়ে, হাসেন নীপ! আমার কিযে ভালো লাগে তার সমীপ। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে আমার কদম বৃষ্টিভেজা শাড়ির দামে জড়িয়ে থাকেন আমি তাকে নজর করি সোনার পুষ্প অঙ্গে দোলে, নীলাম্বরী রাধার কাঁখে আমার কদম আমার নীপ পীনোন্নত আমার কদম আমার নীপ ব্রীড়ানত বৃষ্টি থামে রৌদ্র ওঠে কদম ছায়া কদমে তার আপনি লোটে আমিও ঠিক লুকোই যে তার ছায়ার সাথে এমনভাবে থাকতে পারি রাত-বিরাতে! কদম ফুলের গায়ের গন্ধে মাদকতা! আমায় বলে, তিনি কিন্তু পতিব্রতা! বর্ষা গেলে শরৎ আসে, হেমন্ত যায় শীতের শেষে বসন্ত তার বাতাস কাঁদায় কাঠুরেরা আসে তখন কুড়াল হাতে আমার কদম ন্যাড়া হবেন রক্তপাতে কদম বলেন, আমি নাকি তোমার একার এ জগতে কেউ কি আছেন আমায় দেখার এমন করে ছাঁটবে আমায় প্রতি বছর! দেখবে তুমি, জানালা আর তোমার কছর! হাত বাড়িয়ে বলি আমি, কাঠুরে ভাই, এমন করে কদম গাছকে কাটতে যে নাই! হাসে ওরা। স্বত্ব তোমার আছে নাকি! আমি বলি, আমি যে ওর পাশে থাকি। ওরা বলে, থাকলে পাশে গাছের কিবা যায় বা আসে নিজের উঠান জুড়ে একটা বৃক্ষ লাগাও সেই গাছেতে বছর ভরে পত্র জাগাও আমরা সে গাছ কাটতে আসব না কখনও কাটতে বলবে না কোনোদিন ঊর্ধ্বতনও আমার একটা কদম আছে পড়শি কদম আমায় দেখে হয়ে পড়েন হতোদ্যমও আমি ভাবি আমার কদম ব্যক্তিগত জানি সেটা সম্ভব নয় আইনত বর্ষা এলে তবু যখন কদম ফোটে রেনু ঠিকই এসে আমার অঙ্গে লোটে আমি তখন হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে ছুঁই বৃষ্টিজলে আখর লিখি, রয় না কিছুই
আনিসুল হক
প্রকৃতিমূলক
এমন দিনেই কেবল তোমাকে ভাবা যায়। এমন ঘনঘোর সরিষায়। ইলিশে। বৃষ্টি পড়বে। আমি তোমাকে ভাবব। বৃষ্টি পড়ছে না। আমি তোমাকে ভাবছি না। বৃষ্টি পড়ো পড়ো, ভাবনা ভাবনা আসি আসি। বৃষ্টি ঝরো ঝরো, দুজনে থরো থরো। রোদ উঠল। আমি তোমাকে ভুলে থাকছি। রিকশায় হুড উঠল। আমি তোমাকে ভুলেই আছি। একদম ভাবছি না। নখ নয়, আনখ-নখরা নয়। আজ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টি নাই। ঝকঝকা দিন। তাহলে আজকে আর তোমার কথা ভাববই না। আকাশে মেঘ। আজ তোমাকে আমার সঙ্গে সঙ্গে রাখব। আজ তুমি আমার শেষ পারানির কড়ি গো! বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি তোমাকে ভুলে গেলাম। ফেলে রেখে এলাম। আজ আবার তোমাকে হারালাম। প্রিয়তমা, ছাতা আমার। তাহা তো এ জগতে ক্ষতিকারক। এবং ভীষণ মনোভারক। ঘন ঘন তোমাকে ভুলে যাওয়া। তোমাকে হারানো। খুব রোদ উঠছে। আবার তোমার অনুপস্থিতি আমার মনে বাজছে। মাথার ঘিলু তেতে উঠছে। আমি তোমাকে মিস করছি। একদিন তোমাকে কিস করেছিলাম। প্রিয়তমা, আমব্রেলা আমার। আকাশে জমলে মেঘ সোনা আমাকে প্রিয়তমা তুমি মিস কি করো না!
সুফিয়া কামাল
ছড়া
ইতল বিতল গাছের পাতা গাছের তলায় ব্যাঙের মাথা। বৃষ্টি পড়ে ভাঙ্গে ছাতা ডোবায় ডুবে ব্যাঙের মাথা।
সুফিয়া কামাল
ভক্তিমূলক
প্রসন্ন প্রভাতে আজি যাত্রা শুরু কর হে কাফেলা! সম্মুখে আলোকদীপ্ত বেলা। দূর পথ প্রসারিত, দিকে দিকে চঞ্চল জীবন। আঁধার নির্মোক হতে কর উন্মোচন গতিময় দৃপ্ত প্রাণাবেগ, ভেদ করি সংশয়ের মেঘ চলো চলো যাত্রাপথে, সম্মুখে অনন্ত সম্ভাবনা! পথে পথে যদি দেয় হানা খল মুষিকের দল, তবু চলো চলো হে কাফেলা! তোমারে দেখাবে পথ দীপ্ত রাঙ্গা উদয়ের বেলা। আবারও নামিবে রাত্রি, তবু দ্বিধা করিয়ো না আর, রুদ্ধ করিয়ো না গতি, লক্ষ্য দৃঢ় রাখিয়ো তোমার মনযিল-ই-মোকসেদে তুমি উপনীত হবে একদিন, দুর্বার রাখিয়ো গতি! পথ কভু নহে অন্তহীন। হে কাফেলা! যাত্রা করো! মনযিলে মনযিলে যাও বলে আজি এ প্রভাতে আলোকের পথে ঈদগার পথে চলে খুশী ভরা ক-টি প্রাণ কটি আনন্দের গান স্বার্থ বিহীন অন্তর নিয়ে ক-টি জন করে আজি দান।
সুফিয়া কামাল
স্বদেশমূলক
অনেক কথার গুঞ্জন শুনি অনেক গানের সুর সবচেয়ে ভাল লাগে যে আমার ‘মাগো’ ডাক সুমধুর। আমার দেশের মাঠের মাটিতে কৃষাণ দুপুরবেলা ক্লান্তি নাশিতে কন্ঠে যে তার সুর লয়ে করে খেলা। মুক্ত আকাশে মুক্ত মনের সেই গান চলে ভেসে জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে মরি যেন এই দেশে। এই বাংলার আকাশ-বাতাস এই বাংলার ভাসা এই বাংলার নদী, গিরি-বনে বাঁচিয়া মরিতে আশা। শত সন্তান সাধ করে এর ধূলি মাখি সারা গায় বড় গৌরবে মাথা উচু করি মানুষ হইতে চায়।
সুফিয়া কামাল
প্রকৃতিমূলক
অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার_ বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড় দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে। সুমধুর মোহে ধীরে ধীরে ধীরে প্রদীপ্ত ভাস্কর এসে বেলাশেষে দিবসের তীরে ডুবিল যে শান্ত মহিমায়, তাহারি সে অস্তরাগে বসন্তের সন্ধ্যাকাশ ছায়। ওগো ক্লান্ত দিবাকর! তব অস্ত-উৎসবের রাগে হেথা মর্তে বনানীর পল্লবে পল্লবে দোলা লাগে। শেষ রশ্মিকরে তব বিদায়ের ব্যথিত চুম্বন পাঠায়েছ। তরুশিরে বিচিত্র বর্ণের আলিম্পন করিয়াছে উন্মন অধীর মৌনা, বাক্যহীনা, মূক বক্ষখানি স্তব্ধ বিটপীর। তারো চেয়ে বিড়ম্বিতা হেথা এক বন্দিনীর আঁখি উদাস সন্ধ্যায় আজি অস্তাচল-পথপরি রাখি ফিরাইয়া আনিতে না পারে দূর হতে শুধু বারে বারে একান্ত এ মিনতি জানায় : কখনও ডাকিয়ো তারে তোমার এ শেষের সভায়! সাঙ্গ হলে সব কর্ম, কোলাহল হলে অবসান, দীপ-নাহি-জ্বালা গৃহে এমনি সন্ধ্যায় যেন তোমার আহ্বান গোধূলি-লিপিতে আসে। নিঃশব্দ নীরব গানে গানে, পূরবীর সুরে সুরে, অনুভবি তারে প্রাণে প্রাণে মুক্তি লবে বন্দী আত্মা-সুন্দরের স্বপ্নে, আয়োজনে, নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প-বিকাশের প্রয়োজনে।
সুফিয়া কামাল
প্রেমমূলক
আমার এ বনের পথে কাননে ফুল ফোটাতে ভুলে কেউ করত না গো কোনদিন আসা-যাওয়া। সেদিন ফাগুন-প্রাতে অরুণের উদয়-সাথে সহসা দিল দেখা উদাসী দখিন হাওয়া।… বুকে মোর চরণ ফেলে বধুঁ মোর আজকে এলে আজি যে ভরা সুখে কেবলই পরাণ কাঁদে।
সুফিয়া কামাল
শোকমূলক
“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?” কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি- “দখিন দুয়ার গেছে খুলি? বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল? দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?” “এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?” কহিল সে সুদূরে চাহিয়া- “অলখের পাথার বাহিয়া তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান? ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।” কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি, বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।” কহিল সে মৃদু মধুস্বরে- “নাই হ’ল, না হোক এবারে- আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া- রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।” কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই? যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।” কহিল সে পরম হেলায়- “বৃথা কেন? ফাগুন বেলায় ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন? মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?” “হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?” কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?” কহিল সে কাছে সরি আসি- “কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী- গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
সুফিয়া কামাল
মানবতাবাদী
অন্তর তৃষা মিটাতে এনেছে মমতার মধু-সুধা? রিক্তের প্রাণ ভরিবে কি আজ পুণ্যের আশ্বাসে? অবহেলিতেরে ডেকে নেবে ঘরে, তাদের দীর্ঘশ্বাসে। ব্যথিত মনের সম বেদনায় দূর করি দিয়ে প্রাণ জুড়াবে, শুনাবে ভরসায় ভরা আগামী দিনের গান? হে কাফেলা! তুমি চল পাঁওদল কাঁধেতে মিলায়ে কাঁধ, পথে পথে আজ চলিছে যাহারা তাহাদের সংবাদ লও, শোনো ঘরে কার আজও আছে অনাহার, তবুও ভিক্ষা মাগিতে এ পথে বাহির হবে না আর। কত সে মাতার সন্তান আজও রহিয়াছে কারাগারে- শোন ফরিয়াদ, মাথা কুটে বারে বারে পাষাণ প্রাচীর ভাঙ্গিতে পারেনি যারা ঈদের খুশী কি ঘরে আনিয়াছে তারা? তাদের অশ্রু মুছাতে তোমরা যাত্রীরা কর পণ, আজকে দিনের শপথ রহুক বেদনায় ভরা মন। উৎসব তোলো সার্থক করে তাহাদের আঁখিজল মুছায়ে, আবার আগামী দিনেতে মেলি আনন্দ দল।
সুফিয়া কামাল
প্রকৃতিমূলক
সবুজ পাতার খামের ভেতর হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে কোন্ পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে? আনল ডেকে মটরশুঁটি, খেসারি আর কলাই ফুলে আনল ডেকে কুয়াশাকে সাঁঝ সকালে নদীর কূলে। সকাল বেলায় শিশির ভেজা ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায় শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে। আরও এল সাথে সাথে নুতন গাছের খেজুর রসে লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা মিষ্টি রোদে খেতে বসে। হেমন্ত তার শিশির ভেজা আঁচল তলে শিউলি বোঁটায় চুপে চুপে রং মাখাল আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
উড়ানীর চর ধূলায় ধূসর যোজন জুড়ি, জলের উপরে ভাসিছে ধবল বালুর পুরী। ঝাঁকে বসে পাখি ঝাঁকে উড়ে যায় শিথিল শেফালি উড়াইয়া বায়; কিসের মায়ায় বাতাসের গায় পালক পাতি; মহা কলতানে বালুয়ার গানে বেড়ায় মাতি। উড়ানীর চরে কৃষাণ-বধূর খড়ের ঘর, ঢাকাই সীমের উড়িছে আঁচল মাথার পর। জাঙলা ভরিয়া লাউ এর লতায় লক্ষ্মী সে যেন দুলিছে দোলায়; ফাল্গুনের হাওয়া কলার পাতায়, নাচিছে ঘুরি; উড়ানী চরের বুকের আঁচল কৃষাণ-পুরি। উড়ানীর চর উড়ে যেতে চায় হাওয়ার টানে; চারিধারে জল করে ছল ছল কি মায়া জানে। ফাগুনের রোদ উড়াইয়া ধূলি, বুকের বসন নিতে চায় খুলি; পদ ধরি জল কলগান তুলি, নূপুর নাড়ে; উড়ানীর চর চিক্ চিক্ করে বালুর হারে। উড়ানীর চরে ছাড়-পাওয়া রোদ সাঁঝের বেলা- বালু লয়ে তার মাখামাখি করি জমায় খেলা। কৃষানী কি বসি সাঁঝের বেলায় মিহি চাল ঝাড়ে মেঘের কুলায়, ফাগের মতন কুঁড়া উঠে যায় আলোক ধারে; কচি ঘাসে তারা জড়াজড়ি করে গাঙের পারে। উড়নীর চরে তৃণের অধরে রাতের রানী, আঁধারের ঢেউ ছোঁয়াইয়া যায় কি মায়া টানি। বিরতী কৃষাণ বাজাইয়া বাঁশী, কাল-রাতে মাখে কাল-ব্যথারাশি; থেকে থেকে চর শিহরিয়া ওঠে, বালুকা উড়ে; উড়ানীর চর ব্যথায় ঘুমায় বাঁশীর সুরে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
রাখালের রাজা! আমাদের ফেলি কোথা গেলে ভাই চলে, বুক হতে খুলি সোনা লতাগুলি কেন পায়ে দলে? জানিতেই যদি পথের কুসুম পথেই হইবে বাসি, কেন তারে ভাই! গলে পরেছিলে এতখানি ভালবাসি? আমাদের দিন কেটে যাবে যদি গলেতে কাজের ফাঁসি কেন শিখাইলে ধেনু চরাইতে বাজায়ে বাঁশের বাঁশী? খেলিবার মাঠ লাঙল বাজায়ে চষিতেই যদি হবে, গাঁয়ের রাখাল ডাকিয়া সেথায় রাজা হলে কেন তবে? তুমি চলে গেছ, শুধু কি আমরা তোমারি কাঙাল ভাই! হারায়েছি গান, গোচরণ মাঠ, বাঁশের বাঁশরী তাই। সোজাসুজি আজ উধাও চলিতে কোথা সে উধাও মাঠ, গোখুর ধূলোয় চাঁদোয়া-টাঙানো কোথা সে গাঁয়ের বাট? চরণ ফেলিতে চরণ চলে না শস্য-খেতের মানা, খেলিবার মাঠে বড় জমকালো মিলেছে পাটের থানা। গেঁয়ো শাখী আজ লুটায়ে পড়িছে কাঁচা পাকা ফল-ভারে, তলে তলে তার মাঠের রাখাল হাট মিলাইতে নারে। চষা মাঠে আজ লাঙল চলিতে জাগে না ভাটীর গান সারা দিন খেটে অন্ন কুড়াই, তবু তাতে অকুলান। ধানের গোলার গর্বেতে আজি ভরে না চাষীর বুক, টিনের ঘরের আট-চালা বেঁধে রোদে জ্বলে পায় সুখ। বাছের নায়েতে ছই দিয়ে চাষী পাটের বেপার করে, দাবাড়ের গরু হালের খেতে যে জোয়াল বহিয়া মরে। হেমন্ত নদী ঢেউ খেলেনাক সারীর গানের সুরে, গরু-দৌড়ের মাঠখানি চাষী লাঙলেতে দেছে ফুঁড়ে। মনে পড়ে ঘর ছোনের ছাউনি, বেড়িয়া চালের বাতা, কৃষাণ বধূর বুকখানি যেন লাউ এর লতায় পাতা। তারি পাশে পাশে প্রতি সন্ধ্যায় মাটির প্রদীপ ধরি কুমারী মেয়েরা আশিস মাগিত গ্রাম-দেবতারে স্মরি। আজকে সেখানে জ্বলে না প্রদীপ, বাজে না মাঠের গান, ঘুমলী রাতের প্রহর গণিয়া জাগে না বিরহী প্রাণ। শূনো বাড়িগুলো রয়েছে দাঁড়ায়ে, ফাটলে ফাটলে তার, বুনো লতাগুলো জড়ায়ে জড়ায়ে গেঁথেছে বিরহ-হার। উকুন যাহার গায়ে মারা যায়- থন থন করে তাজা, এমন গরুরে পালিয়া কৃষাণ নিজেরে বনে না রাজা! ধানের গোলার গর্ব ভুলেছে, ভুলেছে গায়ের বল, চক্ষু বুজিয়া খুঁজিছে কোথায় টাকা বানানোর কল। সারাদিন ভরি শুধু কাজ কাজ আরও চাই আরও-আরও- ক্ষুধিত মানুষ ছুটিছে উধাও, তৃষ্ণা মেটে না কারও। পেটে নাই ভাত, মুখে নাই হাসি, রোগে হাড়খানা সার, প্রেত-পুরি যেন নামিয়া এসেছে বাহিয়া নরক-দ্বার। হাজার কৃষাণ কাঁদিছে অঝোরে কোথা তুমি মহারাজ? ব্রজের আকাশ ফাড়িয়া ফাড়িয়া হাঁকিছে বিরহ-বাজ। আমরা তোমারে রাজা করেছিনু পাতার মুকুট গড়ে, ছিঁড়ে ফেলে তাহা মণির মুকুট পরিলে কেমন করে? বাঁশরী বাজায়ে শাসন করেছ মানুষ-পশুর দল, সুর শুনে তার উজান বহিত কালো যমুনার জল। কোন প্রাণে সেই বাঁশের বাঁশরী ভেঙে এলি গেঁয়ো বাটে? কার লোভে তুই রাজা হলি ভাই! মথুরার রাজপাটে? বাঁশীর শাসন হেলায় সয়েছি, বুনো ফলে দিছি কর, অসির শাসন কি দিয়ে সহিব, বেচিয়াছি বাড়ি ঘর; হালের গরুরে নিলামে দিয়েও মিটাতে পারিনি ভুখ, আধখানা ফলে পেট ভরে যেত- ভেবে ভেবে হয় দুখ; এত পেয়ে তোর সাধমেটেনাক, দুনিয়া জুড়িয়া ক্ষুধা, আমরা রাখাল মাঠের কাঙাল যোগাইব তারি সুধা! শোনরে কানাই! পষ্ট কহিছি, সহিব না মোরা আর, সীমার বাহিরে সীমা আছে যদি, ধৈর্যেরো আছে বার। ভাবিয়াছ ওই অসির শাসনে মোরা হয়ে জড়সড়, নিজের ক্ষুধার অন্ন আনিয়া চরণে করিব জড়? বাঁশীর শাসন মেনেছি বলিয়া অসিও মানিতে হবে! শুরু দেয়া-ডাকে কাজরী গেয়েছি, ঝড়েও গাহিব তবে? বাঁশীর শাসন বুকে যেয়ে লাগে, নত হয়ে আসে শির, অসির শাসনে মরাদেরো মাঝে জেগে ওঠে শত বীর। ভাবিয়াছ, মোরা গাঁয়ের রাখাল, নাই কোন হাতিয়ার, যে লাঙল পারে মাটিরে ফাড়িতে, ভাঙিতেও পারে ঘাড়। ঝড়ের সঙ্গে লড়িয়াছি মোরা, বাদলের সাথে যুঝি, বর্ষার সাথে মিতালী পাতায়ে সোনা ধান করি পুঁজি। * * * তবুও সেখানে প্রদীপ জ্বালাই ঘন আঁধারের কোলে, আঁকড়িয়া আছি পল্লীর মাটি কোন্ ক্ষমতার বলে! জনমিয়া যারা দুখের নদীতে শিখিয়াছে দিতে পাড়ি, অসির শাসন তরিবে তাহারা যাক না দুদিন চারি। পষ্ট করিয়া কহিছি কানাই, এখন সময় আছে, গাঁয়ে ফিরে চল, নতুবা তোমায় কাঁদিতে হইবে পাছে। জনম-দুখিনী পল্লী-যশোদা আশায় রয়েচে বাঁচি, পাতায় পাতায় লতায় লতায় লতিয়ে স্নেহের সাজি। হিয়াখানি তার হানা-বাড়ি সম ফাটলে ফাটলে কাঁদি বক্ষে লয়েছে তোমারি বিরহ বনের লতায় বাঁধি। আঁধা পুকুরের পচা কালো জলে মুরছে কমল- রাধা, কৃষাণ বধূরা সিনান করিতে শুনে যায় তারি কাঁদা। বেনুবনে তুমি কবে বেঁধেছিলে তোমার বাঁশের বাঁশী, দখিনা বাতাস আজিও তাহারে বাজাইয়া যায় আসি! কোমল লতায় দোলনা বাঁধিয়া শাখীরা ডাকিছে সুরে, আর কত কাল ভুলে রবি ভাই, পাষাণ মথুরা-পুরে? আমরা ত ভাই! ভেবে পাইনাক তোরি বা কেমন রীত, একলা বসিয়া কেতাব লিখিস ভুলিয়া মাঠের গীত। পুঁথিগুলো সব পোড়াইয়া ফ্যাল, দেখে গাও করে জ্বালা, কেমনে কাটাস সারাদিন তুই লইয়া ইহার পালা? ওরাই তো তোরে যাদু করিয়াছে, মোরা যদি হইতাম, ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া বানাইয়া ঘুড়ির আকাশে উড়াইতাম! রাজধানী যেরে পরদেশ তোর-ইট কাঠ দিয়ে ঘেরা, ইট-কাঠ তাই আঁটঘাট বেঁধে মনেও কি দিলি বেড়া? এত ডাক ডাকি শুনে ন শুনিস, এমনি কঠিন হিয়া- আমরা রাখাল ভাবিয়া না পাই- গলাইব কিবা দিয়া? একেলা আমরা মাঠে মাঠে ফিরি, পথে পথে কেঁদে মরি, আমাদের গান শোনে নারে কেউ, লয়নাক হাত ধরি। * * * চল গাঁয়ে যাই, আঁকাবাঁকা পথ ধূলার দোলায় দোলে, দুধারের খেত কাড়াকাড়ি করে তাহারে লইতে কোলে। কদম্ব রেণু শিহরিয়া উঠে নতুন পাটল মেঘে, তমালের বনে বিরহী রাধার ব্যথা-দেয়া যায় ডেকে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(নয়)আষাঢ় মাসে রূপীর মায়ে মরল বিকার জ্বরে, রূপা সাজু খায়নি খানা সাত আট দিন ধরে | লালন পালন যে করিত 'ঠোঁটের' আধার দিয়া, সেই মা আজি মরে রূপার ভাঙল সুখের হিয়া | ঘামলে পরে যে তাহারে করত আবের পাখা ; সেই শাশুড়ী মরে, সাজুর সব হইল ফাঁকা | সাজু রূপা দুই জনেতে কান্দে গলাগলি ; গাছের পাতা যায় যে ঝরে, ফুলের ভাঙে কলি | এত দুখের দিনও তাদের আস্তে হল গত, আবার তারা সুখেরি ঘর বাঁধল মনের মত |
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
তিন চন্দনের বিন্দু বিন্দু কাজলের ফোঁটা কালিয়া মেঘের আড়ে বিজলীর ছটা — মুর্শিদা গান ওই গাঁখানি কালো কালো, তারি হেলান দিয়ে, ঘরখানি যে দাঁড়িয়ে হাসে ছোনের ছানি নিয়ে ; সেইখানে এক চাষীর মেয়ে নামটি তাহার সোনা, সাজু বলেই ডাকে সবে, নাম নিতে যে গোনা | লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী, ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি | মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে, রাঙা ঠোঁটের লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে | ফুল-ঝর-ঝর জন্তি গাছে জড়িয়ে কেবা শাড়ী, আদর করে রেখেছে আজ চাষীদের ওই বাড়ি | যে ফুল ফোটে সোণের খেতে, ফোটে কদম গাছে, সকল ফুলের ঝলমল গা-ভরি তার নাচে | কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা, তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা | গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি, চাষী মেয়ের রূপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি ? রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ, পাটের বনের বউ টুবাণী, নাইক দেখার লোভ | দেখেছি এই চাষী মেয়ের সহজ গেঁয়ো রূপ, তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ! দু একখানা গয়না গায়ে, সোনার দেবালয়ে, জ্বলছে সোনার পঞ্চ প্রদীপ কার বা পূজা বয়ে! পড়শীরা কয়—মেয়ে ত নয়, হলদে পাখির ছা, ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ | এমন মেয়ে—বাবা ত নেই, কেবল আছেন মা ; গাঁওবাসীরা তাই বলে তায় কম জানিত না | তাহার মতন চেরন “সেওই” কে কাটিতে পারে, নক্সী করা পাকান পিঠায় সবাই তারে হারে | হাঁড়ির উপর চিত্র করা শিকেয় তোলা ফুল, এই গাঁয়েতে তাহার মত নাইক সমতুল | বিয়ের গানে ওরই সুরে সবারই সুর কাঁদে, “সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে” — বলে কি লোক সাধে? ***** সাজু = পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো জেলায় বাপের বাড়িতে মুসলমান মেয়েদের নাম ধরে ডাকা হয় না | বড় মেয়েকে বড়ু, মেজ মেয়েকে মাজু, সেজ মেয়েকে সাজু এইভাবে ডাকা হয় | শ্বশুর-বাড়ির লোকে কিন্তু এ নামে ডাকতে পারে না | গোনা = পাপ বউ টুবাণী = মাঠের ফুল
জসীম উদ্‌দীন
স্বদেশমূলক
দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীরে খোঁজ করি, মন্দিরে আজ বাজেনাকো শাঁখ সন্ধ্যা-সকাল ভরি। তুলসীতলা সে জঙ্গলে ভরা, সোনার প্রদীপ লয়ে, রচে না প্রণাম গাঁয়ের রুপসী মঙ্গল কথা কয়ে। হাজরাতলায় শেয়ালের বাসা, শেওড়া গাছের গোড়ে, সিঁদুর মাখান, সেই স্থান আজি বুনো শুয়োরেরা কোড়ে। আঙিনার ফুর কুড়াইয়া কেউ যতনে গাঁথে না মালা, ভোরের শিশিরে কাঁদিছে পুজার দুর্বাশীষের থালা। দোল-মঞ্চ যে ফাটিলে ফাটিছে, ঝুলনের দোলাখানি, ইঁদুরে কেটেছে, নাটমঞ্চের উড়েছে চালের ছানি। কাক-চোখ জল পদ্মদীঘিতে কবে কোন রাঙা মেয়ে, আলতা ছোপান চরণ দুখানি মেলেছিল ঘাটে যেয়ে। সেই রাঙা রঙ ভোলে নাই দীঘি, হিজলের ফুল বুকে, মাখাইয়া সেই রঙিন পায়েরে রাখিয়াছে জলে টুকে। আজি ঢেউহীন অপলক চোখে করিতেছে তাহা ধ্যান, ঘন-বন-তলে বিহগ কন্ঠে জাগে তার স্তব গান। এই দীঘি-জলে সাঁতার খেলিতে ফিরে এসো গাঁর মেয়ে, কলমি-লতা যে ফুটাইবে ফুল তোমারে নিকটে পেয়ে। ঘুঘুরা কাঁদিছে উহু উহু করি, ডাহুকেরা ডাক ছাড়ি, গুমরায় বন সবুজ শাড়ীরে দীঘল নিশাসে ফাড়ি। ফিরে এসো যারা গাঁও ছেড়ে গেছো, তরুলতিকার বাঁধে, তোমাদের কত অতীত-দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে। সুপারির বন শুন্যে ছিঁড়িছে দীঘল মাথার কেশ, নারকেল তরু উর্ধ্বে খুঁজিছে তোমাদের উদ্দেশ। বুনো পাখিগুলি এডালে ওডালে, কইরে কইরে কাঁদে, দীঘল রজনী খন্ডিত হয় পোষা কুকুরের নামে। কার মায়া পেয়ে ছাড়িলে , এদেশ, শস্যের থালা ভরি, অন্নপূর্ণা আজো যে জাগিছে তোমাদের কথা স্মরি। আঁকাবাঁকা রাকা শত নদীপথে ডিঙি তরীর পাখি, তোমাদের পিতা-পিতামহদের আদরিয়া বুকে রাখি ; কত নমহীন অথই সাগরে যুঝিয়া ঝড়ের সনে, লক্ষীর ঝাঁপি লুটিয়া এনেছে তোমাদের গেহ-কোণে। আজি কি তোমরা শুনিতে পাও না সে নদীর কলগীতি, দেখিতে পাও না ঢেউএর আখরে লিখিত মনের প্রীতি ? হিন্দু-মুসলমানের এ দেশ, এ দেশের গাঁয়ে কবি, কত কাহিনীর সোনার সুত্রে গেঁথেছে সে রাঙা ছবি। এদেশ কাহারো হবে না একার, যতখানি ভালোবাসা, যতখানি ত্যাগ যে দেবে, হেথায় পাবে ততখানি বাসা। বেহুলার শোকে কাঁদিয়াছি মোরা, গংকিনী নদীসোঁতে, কত কাহিনীর ভেলায় ভাসিয়া গেছি দেশে দেশ হতে। এমাম হোসেন, সকিনার শোকে ভেসেছে হলুদপাটা, রাধিকার পার নুপুরে মুখর আমাদের পার-ঘাটা। অতীতে হয়ত কিছু ব্যথা দেছি পেয়ে বা কিছুটা ব্যথা, আজকের দিনে ভুলে যাও ভাই, সে সব অতীত কথা। এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, নুতন দৃষ্টি দিয়ে, নুতন রাষ্ট্র গুড়িব আমরা তোমাদের সাথে নিয়ে। ভাঙ্গা ইস্কুল আবার গড়িব, ফিরে এসো মাস্টার। হুঙ্কারে ভাই তাড়াইয়া দিব কালি অজ্ঞানতার। বনের ছায়ায় গাছের তলায় শীতল স্নেহের নীড়ে, খুঁজিয়া পাইব হারাইয়া যাওয়া আদরের ভাইটিরে ।
জসীম উদ্‌দীন
শোকমূলক
হাসু বলে একটি খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে- না জানি কোন অজান দেশে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে। বন হতে সে পলিয়ে গেছে, বনে কাঁদে বনের লতা, ফুল ফুটে কয় সোনার খুকু! ছেড়ে গেলি মোদের কোথা? বনের শাখা দুলিয়ে পাতা-করত বাতাস তাহার গায়ে। তাহার শাড়ীর আঁচল লাগি ঝুমকো লতা দুলত বনে, গাছে গাছে ফুল নাচিত তাহার পদধ্বনির সনে। বনের পথে ডাকত পাখি, তাদের সুরের ভঙ্গী করে- কচি মুখের মিষ্টি ডাকে সারাটি বন ফেলত ভরে। প্রতিধ্বনি তাহার সনে করত খেলা পালিয়ে দূরে, সুরে সুরে খুঁজত সে তার বনের পথে একলা ঘুরে। সেই হাসু আজ পালিয়ে গেছে, পাখির ডাকের দোসর নাহি, প্রতিধ্বনি আর ফেরে না তাহার সুরের নকল গাহি। হাসু নামের একটি খুকু পালিয়ে গেছে অনেক দূরে, কেউ জানে না কোথায় গেছে কোন্ বা দেশে কোন্ বা পুরে। বাপ জানে না, মায় জানে না কোথায় সে যে পালিয়ে গেছে, সেও জানে না, কোন সুদূরে কে তাহারে সঙ্গে নেছে। কোনোখানে কেউ ভাবে না, কেউ কাঁদে না তাহার তরে, কেউ চাহে না পথের পানে, কখন হাসু ফিরবে ঘরে। মায় কাঁদে না, বাপ কাঁদে না, ভাই-বোনেরা কাঁদছে না তার, খেলার সাথী কেউ জানে না, সে কখনও ফিরবে না আর। ফিরবে না সে, ফিরবে নারে, খেলা ঘরের ছায়ার তলে, মিলবে না সে আর আসিয়া তার বয়সের শিশুর দলে। পেয়ারা-ডালে দোলনা খালি, ইঁদুরে তার কাটছে রশি, চোড়ুই ভাতির হাঁড়ির পরে কাক দুটি আজ ডাকছে রশি, খেলনাগুলি ধূলায় পড়ে, হাত-ভাঙা কার, পা ভাঙা কার, ঝুমঝুমিটি বেহাত হয়ে বাজছে হাতে যাহার তাহার। এসব খবর কেউ জানে না, সে জানে না, কেমন করে কখন যে সে পালিয়ে গেলে তাহার চিরজনম তরে। জানে তাহার পুতলগুলো অনাদরে ধুলায় লুটায়, বুকে করে আর না চুমে, পুতুল-খেলার সেই ছোট মায়। মাতৃ হারা মিনি-বিড়াল কেবা তাহার দুঃখ বুঝে, কেঁদে কেঁদে বেড়ায় সে তার ছোট্ট মায়ের আঁচল খুঁজে। খেলা ঘর আজ পড়ছে ভেঙে, শিশু কল-তানের সনে, পুতুল বধূ আর সাজে না পুতুল-বরের বিয়ের কনে। হাসু নামের সোনার খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে, সাত-সাগরের অপর পারে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে। পালিয়ে গেছে সোনার হাসুঃ- খেলার সাথী আয়রে ভাই- আজের মত শেষ খেলাটি এইখানেতে খেলে যাই। সেখানটিতে খেলেছিলাম ভাঁড়-কাটি সঙ্গে নিয়ে, সেইখানটি দে রুধে ভাই ময়না কাঁটা পুতে দিয়ে।
জসীম উদ্‌দীন
চিন্তামূলক
এখনো গন্ধ বন্ধ কোরকে, দুএকটি রাঙা দল, উকি ঝুঁকি দিয়ে পান করিতেছে ভোরের শিশির জল। রঙিন অধরে সরল হাসিটি, বিহান বেলার আগে, মেঘগুলি যেন রঙে ডুগুডুগু ঊষসীর অনুরাগে। এ হাসি এখনি কৌতুক হয়ে নাচিবে নানান ঢঙে, মেঘের আড়ালে কভু লুকোচুরি খেলিবে কতা রঙে। আঁখি দুটি আজো স্বচ্ছ-সরল কাজল দীঘির মত, কারো কলসীর আঘাতে এখনো হয় নাই ঢেউ-ক্ষত। সব কিছু এর মুকুরে এখনো উজ্জ্বল হয়ে ভাসে, যে আসে নিকটে তাহারেই সে যে আদরিয়া ভালবাসে। আরো কিছুদিন পরে এই আঁখি বিদ্যুদ্দাম হয়ে, নৃত্য চপল খেলিয়া বেড়াবে মেঘ হতে মেঘে বয়ে। ওই ভুরু-ধনু আরো বাঁকাইয়া চাহনীর তীরগুলি, কত হতভাগা মৃগেরে বধিবে কাজলের বিষগুলি। ওই বাহু দুটি যুগল মমতা, যে হয় নিকটতর, তাহারি গলায় পরাইয়া দেয় জানে না আপন পর। কিছুদিন পরে ও বাহু লতায় ফুটিবে মোহের ফুল, আকর্ষণের মন্ত্র পড়িয়া ছড়াবে রঙের ভুল। তাহারি বাঁধনে বন্দী হইতে চির জনমের তরে, আসিবে কুমার রূপ-গানে তার অধর বাঁশরী ভরে। বক্ষের পরে আধ-মুকুলিত যুগল কমল দুটি, এখনো সুবাসে ভরে নাই দিক পল্লব দলে ফুটি। কিছুদিন পরে ওই মন্দিরে অনঙ্গ নিজে পশি, ভালবাসিবার মন্ত্র রচিবে ধ্যানের আসনে বসি। মন্ত্র-সিদ্ধ একদন তার ফুল ধনু করি থির, ফিরাবে ঘুরাবে স্বেচ্চায় সেথা স্থাপি এ যুগল তীর। এখনো অফুট কুসুমিত দেহ, জবা কুসুমের দ্যুতি, আনত ঊষার নব-মেঘদলে রাঙিছে রূপের সত্ততি। নিহারে ভূসিথ কুসুম কমল আধেক মুদিত আঁখি, সরসী নাচিছে হরষিত দোলে আরশীতে তারে রাখি। বিহান বেলার আধ ঘুমে পাওয়া আধ স্বপনের স্মৃতি, দূরাগত কোন সুখদ বাঁশীর আবছা মধুর গীতি। সে যেন ঊষার হসিত কপোলে শ্বেত চন্দন ফোঁটা, সে যেন পূজার নিবেদিত ফুল দেবতা চরণে লোটা। আরো ক্ষণকাল দাঁড়াও গো মেয়ে! তোমার সোনার হাসি, আরো ক্ষণকাল দেখে চলে যাই আমি কবি পরবাসী। আরো ক্ষণকাল করগো বেলম, ভোরের শিশির কণা, তাই দিয়ে যদি হয় কভু কোন অমরতা-গীতি বোনা। আমি ক্ষণিকের অতিথি তোমার, তব অনাগত দিনে, জানি জানি এই পথিক সখারে লইতে পাবে না চিনে। ওই দেহ বীণা বাজিবে সেদিন, হাত চোখ মুখ কান, শত তার হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়াবে কুহক গান। তারি ঝঙ্কারে রণিবে ধরণী, ফুলের স্তবক হয়ে, আসিবে পূজারী স্তব-গান গেয়ে ওদেহের দেবালয়ে। তাহাদের তরে রাখিয়া গেলাম আমার আশীর্বাদ, যেন তারা পায় তোমার মাঝারে মোর অপূরিত সাধ।
জসীম উদ্‌দীন
ছড়া
গল্পবুড়ো, তোমার যদি পেটটি ভরে রূপকথা সব গিজ গিজ গিজ করে, আর যদি না চলতে পার, শোলক এবং হাসির, ছড়ার, পড়ার কথার ভরে; যদি তোমার ইলি মিলি কিলি কথা খালি খালি ছড়িয়ে যেতে চায় সে পথের ধারে, তবে তুমি এখানটিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে ডাক দিও ভাই- ডাক দিও ভাই! মোদের পূর্নিমারে। যদি তোমার মিষ্টি মুখের মিষ্টি কথা আদর হয়ে ছড়িয়ে যেতে চায় যে পথের কোণে, কথা যদি চুমোর মত-ফুলের মত, রঙিন হয়ে চায় হাসিতে ফোটে ফুলের সনে; যতি তোমার রাঙা কথা রামধনুকের রঙের মত, ছড়িয়ে পড়ে কালো মেঘের গায়ে, যদি তোমার হলদে কথা হলদে পাখির পাখার পরে সোয়ার হয়ে, ছড়িয়ে পড়ে সরষে ফুলের হলদে হাওয়ার বায়ে; যদি তোমার সবুজ কথা শস্যক্ষেতের দিগন্তরে, ছড়িয়ে যেতে চায় যে বারে বারে; তবে তুমি এখানটিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে, ডাক দিও ভাই! ডাক দিও ভাই! মোদের পূর্ণিমারে! গল্পবুড়ো! আবার যদি গাজীর গানের দলটি নিয়ে, নাচের নূপুর জড়িয়ে পায়ে, গাজীর আশা ঘুরিয়ে বায়ে, খঞ্জনীতে সুরটি দিয়ে, রূপকথারি আসর গড় সুদূর কোন গাঁয়ে; চন্দ্রভান রাজার মেয়ে আবার যদি নেমে আসে, ঘুমলি চোখের পাতার পরে তোমার গানের বায়ে; আবার যদি মদন কুমার সপ্ত-ডিঙা সাজিয়ে নিয়ে, দেয় গো পাড়ি কালাপানি-পূবান পানি পেরিয়ে গিয়ে, ক্ষীর-সাগরের অপর পারে মধুমালার দেশেঃ- দুধে ধবল আলতা বরণ রাজার কনে ঘুমায় হেসে হেসে, পাঁচ মানিকের পঞ্চ প্রদীপ পাহারা দেয় হাতের পায়ের আর শিয়রের দেশে- আবার যদি গাঁয়ের যত ছেলের মেয়ের, বোনের ভায়ের মায়ের ঝিয়ের সবার বুকের সে রূপকথার সে রূপ-সাগর আনতে টেনে পরাণ তোমার কান্দে বারে বারে; তবে তুমি ডাক দিও ভাই! ডাক দিও ভাই! ডাক দিও ভাই! মোদের পূর্নিমারে!
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
ও বাবু সেলাম বারে বার, আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু, বাড়ি পদ্মা পার। মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি মোরা পঙ্কি বেইচা খাই- মোদের সুখের সীমা নাই, সাপের মাথার মণি লয়ে মোরা করি যে কারবার। এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি মোরা আরেক ঘাটে খাই, মোদের বাড়ি ঘর নাই; সব দুনিয়া বাড়ি মোদের সকল মানুষ ভাই; মোরা, সেই ভায়েরে তালাশ করি আজি ফিরি দ্বারে দ্বারে; বাবু সেলাম বারে বার।
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
গীতারা কোথায় গেলো, আহা সেই পুতুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়ে। দেখলে তাহারে মায়া মমতার ধারা বয়ে যায় সারা বুকখানি ছেয়ে, আদরি তাহারে কথা না ফুরায় কথার কুসুম আকাশে বাতাসে উঠে বেয়ে, দেখলে তাহারে ছাড়ায় ছড়ায় ছড়ায় যে মন গড়ায় ধরণী ছেয়ে। ওদের গ্রামের চারিদিক বেড়ি ঘিরেছে দস্যুদল, ঘরে ঘরে তারা আগুন জ্বালায়ে ফুকারে অগ্নিকল। সেই কচি মেয়ে কোলে তুলে নিতে কোল যে জুড়িয়ে যেত, কে মারিল তারে ? মানুষ কি পারে নিষ্ঠুর হতে এত। অফুট কুসুম কে দলেছে পায়ে? কথার সে বুলবুলি, কোন নিষ্ঠুর বধেছে তাহারে গলায় আঙ্গুল তুলি ? সে বন-হরিণী নিষ্ঠুর হতে পালাবার লাগি হেথায় হোথায় কত না ঘুরেছে হায়। সারা গাঁও করি উথাল পাথাল বাণ-বিদ্ধ যে করিয়াছে ব্যাধ তায়। আহারে আমার ছোট গীতামণি, তোর তরে আজ কেঁদে ফিরি সবখানে, মোর ক্রদন নিঠুর দেশের সীমানা পেরিয়ে পারিবে কি যেতে কোন দরদীয় কানে।
জসীম উদ্‌দীন
স্বদেশমূলক
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও- ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও ! কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে, কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে। গুরার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘষে ঘষে, মামা-বাড়ির বলব কথা-শুনো বসে বসে। কে যাওরে পাল-ভরে কোন দেশে ঘর, পাছা নায়ে বসে আছে কোন সওদাগর ? কোন দেশে কোন গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে, কোন দেশে হিরামন পাখি বাস করে। কোন দেশে রাজ-কনে, খালি ঘুম যায়, ঘুম যায় আর হাসে হিম-সিম বায়! সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই, ছোট মোর বোনটিরে সাথে যাদি পাই। পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও- তোমার যে পালে নাচে ফুলঝুরি বাও- তোমার যে নার ছই আবের ঢাকনি, ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধুনি। সোনার না’বাঁধনরে তার গোড়ে গোড়ে, হিরামন পঙ্খির লাল পাখা ওড়ে। তার পর ওড়েরে ঝালরের হাসি, ঝলমল জলে জ্বলে রতনের রাশে। এই নাও বেয়ে যায় কোন সওদাগর, কয়ে যাও-কয়ে যাও, কোন দেশে ঘর ? পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও- ঘরে আছে ছোট বোন তারে নিয়ে যাও। যে না গাঙে সাতধার করে গলাগলি, সেথা বাস কুহেলির-লোকে গেছে বলি। পারাপার দুই নদী-মাঝে বালচুর, সেইখানে বাস করে চাঁদ-সওদাগর। এপারে ভুতুমের বাসা ও-পারেতে টিয়া- সে খানেতে যেয়োনারে নাওখানি নিয়া। ভাইটাল গাঙ দোলে ভাটী গেঁয়ো সোঁতে, হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোনমতে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
ওরে হাইলা লোকের লাঙ্গল বাঁকা, জনম বাঁকা চাঁদ রে ... জনম বাঁকা চাঁদ তার চাইতে অধিক বাঁকা, হায় হায় যারে দিসি প্রাণ রে ... দুরন্ত পরবাসী। আমার হাড় কালা করলাম রে ... আমার দেহ কালার লাইগা রে। ওরে আমার অন্তর কালা করলাম রে ... দুরন্ত পরবাসী। মনু রে ... ওরে কূল বাঁকা, গাঙ বাঁকা, বাঁকা গাঙের পানি রে ... বাঁকা গাঙের পানি সকল বাঁকায় বাইলাম নৌকা, হায় হায় তবু বাঁকারে না জানি রে ... দুরন্ত পরবাসী। আমার হাড় কালা করলাম রে ... আমার দেহ কালার লাইগা রে। ওরে আমার অন্তর কালা করলাম রে ... দুরন্ত পরবাসী। মনু রে ... ওরে হাড় হইল জর জর, অন্তর হইল গুড়া রে ... অন্তর হইল গুড়া পিরিতী ভাঙ্গিয়া গেলে, হায় হায় নাহি লাগে জোড়া রে ... দুরন্ত পরবাসী। আমার হাড় কালা করলাম রে ... আমার দেহ কালার লাইগা রে। ওরে আমার অন্তর কালা করলাম রে ... দুরন্ত পরবাসী।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
ও আমার গহিন গাঙের নায়া, ও তুমি অফর বেলায় লাও বায়া যাওরে- কার পানে বা চায়া। ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়, পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায়রে- আবছা মেঘে হাতছানি দ্যায়, কে জানি মোর সয়া। এই না গাঙের আগের বাঁকে আমার বধূর দ্যাশ; কলাবনের বাউরি বাতাস দোলায় মাথার ক্যাশ; কওই খবর তাহার লাইগা, কাইন্দা মরে এক অভাইগারে; ও তার ব্যথার দেয়া থাইকা থাইকা ঝরে নয়ন বায়া।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(পাঁচ)আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে, গ্রামভরা-ভর ছুটল ঝপট লট্ পটা সব করে | রূপার বাড়ির রুশাই-ঘরের ছুটল চালের ছানি, গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি | ওগাঁর বাঁশ দশটা টাকায়, সে-গাঁয় টাকায় তেরো, মধ্যে আছে জলীর বিল কিইবা তাহে গেরো | বাঁশ কাটিতে চলল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া, দুপুর বেলায় খায় যেন সে---মায় দিয়াছে কিরা | মাজায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্ চকাচক্ ধার, কাঁধে রঙিন গামছাখানি দুলছে যেন হার | মোল্লা-বাড়ির বাঁশ ভাল, তার ফাঁপগুলি নয় বড় ; খাঁ-বাড়ির বাঁশ ঢোলা ঢোলা, করছে কড়মড় | সর্ব্বশেষে পছন্দ হয় খাঁ-বাড়ির বাঁশ : ফাঁপগুলি তার কাঠের মত, চেকন-চোকন আঁশ |বাঁশ কাটিতে যেয়ে রূপাই মারল বাঁশে দা, তল দিয়ে যায় কাদের মেয়ে---হলদে পাখির ছা! বাঁশ কাটিতে বাঁশের আগায় লাগল বাঁশের বাড়ি, চাষী মেয়ের দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় ছাড়ি | লম্বা বাঁশের লম্বা যে ফাঁপ, আগায় বসে টিয়া, চাষীদের ওই সোনার মেয়ে কে করিবে বিয়া! বাঁশ কাটিতে এসে রূপাই কাটল বুকের চাম, বাঁশের গায়ে বসে রূপাই ভুলল নিজের কাম | ওই মেয়ে ত তাদের গ্রামে বদনা-বিয়ের গানে, নিয়েছিল প্রাণ কেড়ে তার চিকন সুরের দানে |'খড়ি কুড়াও সোনার মেয়ে! শুকনো গাছের ডাল, শুকনো আমার প্রাণ নিয়ে যাও, দিও আখার জ্বাল | শুকনো খড়ি কুড়াও মেয়ে! কোমল হাতে লাগে, তোমায় যারা পাঠায় বনে বোঝেনি কেন আগে?' এমনিতর কত কথাই উঠে রূপার মনে, লজ্জাতে সে হয় যে রঙিন পাছে বা কেউ শোনে | মেয়েটিও ডাগর চোখে চেয়ে তাহার পানে, কি কথা সে ভাবল মনে সেই জানে তার মানে!এমন সময় পিছন হতে তাহার মায়ে ডাকে, 'ওলো সাজু! আয় দেখি তোর নথ বেঁধে দেই নাকে! ওমা! ও কে বেগান মানুষ বসে বাঁশের ঝাড়ে!' মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানি দেখছে বারে বারে |খানিক পরে ঘোমটা খুলে হাসিয়া এক গাল, বলল, 'ও কে, রূপাই নাকি? বাঁচবি বহকাল! আমি যে তোর হইযে খালা, জানিসনে তুই বুঝি? মোল্লা বাড়ির বড়ুরে তোর মার কাছে নিস্ খুঁজি | তোর মা আমার খেলার দোসর---যাকগে ও সব কথা, এই দুপুরে বাঁশ কাটিয়া খাবি এখন কোথা?'রূপাই বলে, 'মা দিয়েছেন কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া' 'ওমা! ও তুই বলিস কিরে? মুখখানা তোর ফিরা! আমি হেথা থাকতে খালা, তুই থাকবি ভুখে, শুনলে পরে তোর মা মোরে দুষবে কত রুখে! ও সাজু, তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি, ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি |'চলল সাজু বাড়ির দিকে, মা গেল ওই পাড়া | বাঁশ কাটতে রূপাই এদিক মারল বাঁশে নাড়া | বাঁশ কাটিতে রূপার বুকে ফেটে বেরোয় গান, নলী বাঁশের বাঁশীতে কে মারছে যেন টান! বেছে বেছে কাটল রূপাই ওড়া-বাঁশের গোড়া, তল্লা বাঁশের কাটল আগা, কালধোয়ানির জোড়া ; বাল্ কে কাটে আল্ কে কাটে কঞ্চি কাটে শত, ওদিক বসে রূপার খালা রান্ধে মনের মত |সাজু ডাকে তলা থেকে, 'রূপা-ভাইগো এসো,' ---এই কথাটি বলতে তাহার লজ্জারো নাই শেষও! লাজের ভারে হয়তো মেয়ে যেতেই পারে পড়ে, রূপাই ভাবে হাত দুখানি হঠাৎ যেয়ে ধরে |যাহোক রূপা বাঁশ কাটিয়া এল খালার বাড়ি, বসতে তারে দিলেন খালা শীতল পাটি পাড়ি | বদনা ভরে জল দিল আর খড়ম দিল মেলে, পাও দুখানি ধুয়ে রূপাই বসল বামে হেলে | খেতে খেতে রূপাই কেবল খালার তারীফ করে, 'অনেক দিনই এমন ছালুন খাইনি কারো ঘরে |' খালায় বলে 'আমি ত নয়, রেঁধেছে তোর বোনে,' লাজে সাজুর ইচ্ছা করে লুকায় আঁচল কোণে | এমনি নানা কথায় রূপার আহার হল সারা, সন্ধ্যা বেলায় চলল ঘরে মাথায় বাঁশের ভারা |খালার বাড়ির এত খাওয়া, তবুও তার মুখ, দেখলে মনে হয় যে সেথা অনেক লেখা দুখ | ঘরে যখন ফিরল রূপা লাগল তাহার মনে, কি যেন তার হয়েছে আজ বাঁশ কাটিতে বনে | মা বলিল, 'বাছারে, কেন মলিন মুখে চাও?' রূপাই কহে, 'বাঁশ কাটিতে হারিয়ে এলেম দাও |'
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
ইতল বেতল ফুলের বনে ফুল ঝুর ঝুর করেরে ভাই। ফুল ঝুর ঝুর করে ; দেখে এলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে। ধানের আগায় ধানের ছড়া, তাহার পরে টিয়া, নমুর মেয়ে গা মাজে রোজ তারির পাখা দিয়া, দুর্বাবনে রাখলে তারে দুর্বাতে যায় মিশে, মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে। লাউয়ের ডগায় লাউয়ের পাতা, রৌদ্রেতে যায় ঊনে, গা-ভরা তার সোহাগ দোলে তারির লতা বুনে। যে পথ দিয়ে যায় চলে সে, যে পথ দিয়ে আসে, সে পথ দিয়ে মেঘ চলে যায়, বিজলী বরণ হাসে। বনের মাঝে বনের লতা, পাতায় পাতায় ফুল, সেও জানে না নমু মেয়ের শ্যামল শোভার তুল। যে মেঘের জড়িয়ে ধরে হাসে রামের ধনু, রঙিন শাড়ী হাসে যে তার জড়িয়ে সেই তনু। গায়ে তাহার গয়না নাহি, হাতে কাচের চুড়ি; দুই পায়েতে কাঁসার খাড়ু, বাজছে ঘুরি ঘুরি। এতেই তারে মানিয়েছে যা তুলনা নেই তার; যে দেখে সে অমনি বলে, দেখে লই আরবার। সোনা রুপার গয়না তাহার পরিয়ে দিলে গায়, বাড়ত না রুপ, অপমানই করতে হত তায়। ছিপছিপে তার পাতলা গঠন, হাত চোখ মুখ কান, দুলছে হেলছে মেলছে গায়ে গয়না শতখান । হ্যাচড়া পুজোর ছড়ার মত ফুরফুরিয়ে ঘোরে হেথায় হোথায় যথায় তথায় মনের খুশীর ভরে। বেথুল তুলে, ফুল কুড়িয়ে, বেঙ্গে ফলের ডাল, সারাটি গাঁও টহল দিয়ে কাটে তাহার কাল। পুতুল আছে অনেকগুলো, বিয়ের গাহি গান, নিমন্ত্রণে লোক ডাকি সে হয় যে লবেজান। এসব কাজে সোজন তাহার সবার চেয়ে সেরা, ছমির শেখের ভাজন বেটা, বাবরি মাথায় ঘেরা। কোন বনেতে কটার বাসার বাড়ছে ছোট ছানা, ডাহুক কোথায় ডিম পাড়ে তার নখের আগায় জানা। সবার সেরা আমের আঁটির গড়তে জানে বাঁশী, উঁচু ডালে পাকা কুলটি পাড়তে পারে হাসি। বাঁশের পাতায় নথ গড়ায়ে গাবের গাঁথি হার, অনেক কালই জয় করেছে শিশু মনটি তার।
জসীম উদ্‌দীন
চিন্তামূলক
তাহারে কহিনু, সুন্দর মেয়ে! তোমারে কবিতা করি, যদি কিছু লিখি ভুরু বাঁকাইয়া রবে না ত দোষ ধরি।” সে কহিল মোরে, “কবিতা লিখিয়া তোমার হইবে নাম, দেশে দেশে তব হবে সুখ্যাতি, আমি কিবা পাইলাম ?” স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিনু কি দিব জবাব আর, সুখ্যাতি তরে যে লেখে কবিতা, কবিতা হয় না তার। হৃদয়ের ফুল আপনি যে ফোটে কথার কলিকা ভরি, ইচ্ছা করিলে পারিনে ফোটাতে অনেক চেষ্টা করি। অনেক ব্যথার অনেক সহার, অতল গভীর হতে, কবিতার ফুল ভাসিয়া যে ওঠে হৃদয় সাগর স্রোতে। তারে কহিলাম, তোমার মাঝারে এমন কিছু বা আছে, যাহার ঝলকে আমার হিয়ার অনাহত সুর বাজে। তুমিই হয়ত পশিয়া আমার গোপন গহন বনে, হৃদয়-বীণায় বাজাইয়া সুর কথার কুসুম সনে। আমি করি শুধু লেখকের কাজ, যে দেয় হৃদয়ে নাড়া, কবিতা ত তার ; আর যেবা শোনে-কারো নয় এরা ছাড়া। মানব জীবনে সবচেয়ে যত সুন্দরতম কথা, কবিকার তারই গড়ন গড়িয়া বিলাইছে যথাতথা। সেকথা শুনিয়া লাভ লোকসান কি জানি হয় না হয়, কেহ কেহ করে সমরকন্দ তারি তরে বিনিময়।
জসীম উদ্‌দীন
ছড়া
শিউলি নামের খুকির সনে আলাপ আমার অনেকদিনের থেকে হাসিখুশি মিষ্টমিশি অনেক কথা কই যে তারে ডেকে। সেদিন তার কইনু ‘খুকি- কী কী জিনিস কওতো তোমার আছে? সগৌরবে বলর, অনেক-অনেক কিছু আছে তাহারকাছে; সাতটা ভাঙা পেন্সিল আর নীল বরণের ভাঙা দু-খান কাঁচ, মারবেল আছে তিন-চারটে, কড়ি আছে গণ্ডা ছ কি পাঁচ। ডলি পুতুল, মিনি পুতুল, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল আর- পুঁতির মালা, রঙিন ঝিনুক, আরও অনেক খেলনা আছে তার। আছে তাহার পাতার বাঁশি, টিনের উনুন, শোলার পাখির ছা, সাতটা আছে ঝুমঝুমি তার আর আছে তার একটি খেলার মা।
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
ও মোহন বাঁশী! বাজাও বাজাওরে কানাই! ধীরে অতি ধীরে; আমি জল আনিতে যমুনাতে, ও বাঁশী শুনব ফিরে ফিরেরে কানাই! ধীরে অতি ধীরে। কলসী ভরার ছলে, তোমার ছায়া দেখব জলেরে কানাই! আমি হারায়ে পায়ের নূপুর, ও ঘরে নাহি যাব ফিরেরে কানাই। ধীরে অতি ধীরে। তোমার বাঁশীর স্বরে যদি কলসীর জল নড়েরে, তারে ঘুম পাড়াবরে, কাঁকণ বাজাইয়া করেরে কানাই! আমি কেমনে মানাব আমার নয়নের নীরের কানাই! ধীরে অতি ধীরে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
কইবার নি পাররে নদী গেছে কতদূর? যে কূল ধইরা চলেরে নদী সে কূল ভাইঙ্গা যায়, আবার আলসে ঘুমায়া পড়ে সেই কূলেরি গায়; আমার ভাঙা কূলে ভাসাই তরীরে যদি পাই দেখা বন্ধুর। নদীর পানি শুনছি নাকি সায়র পানে ধায়, আমার চোখের পানি মিলব যায়া কোন সে দরিয়ায় সেই অজানা পারের লাইগারে আমার কান্দে ভাটির সুর।
জসীম উদ্‌দীন
ছড়া
এত হাসি কোথায় পেলে এত কথার খলখলানি কে দিয়েছে মুখটি ভরে কোন বা গাঙের কলকলানি। কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে কলমী ফুলের গুলগুলানি। কে দিয়েছে চলন বলন কোন সে লতার দোল দুলানী।কাদের ঘরে রঙিন পুতুল আদরে যে টইটুবানি। কে এনেছে বরণ ডালায় পাটের বনের বউটুবানী। কাদের পাড়ার ঝামুর ঝুমুর কাদের আদর গড়গড়ানি কাদের দেশের কোন সে চাঁদের জোছনা ফিনিক ফুল ছড়ানি।তোমায় আদর করতে আমার মন যে হলো উড়উড়ানি উড়ে গেলাম সুরে পেলাম ছড়ার গড়ার গড়গড়ানি।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
(রূপক নাটিকা) ওলো সোনার বরণী, তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি! রাঙা তোমার ঠোঁটরে কন্যা, রাঙা তোমার গাল, কপালখানি রাঙা নইলে লোকে পাড়বে গালরে; তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি! সাঁঝের কোলে মেঘরে-তাতে রঙের চূড়া, সেই মেঘে ঘষিয়া সিন্দুর করছি গুঁড়া গুঁড়ারে, তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি! এই না সিন্দুর পরিয়া নামে আহাশেতে আড়া, এই সিন্দুরের বেসাতি করতে হইছি ঘর-ছাড়ারে; তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি! কাণা দেয়ায় ঝিলিক মারে কালা মেঘায় ফাঁড়ি, তোমার জন্য আনছি কন্যা মেঘ-ডম্বুর শাড়ীরে; তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি! শাড়ীখানি পর কন্যা, সিন্দুর খানি পর, আঙ্খের পলক দেইখা আমি যাই হাপনার ঘররে; তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি! থাক থাক বানিয়ারে নিরালে বসিয়া মা-ধনের আগে আমি আসি জিজ্ঞাসিয়া। শোন শোন ওহে মা-ধন! শুনিয়া ল তোর কানে, আমি তো যাব মা-ধন বানিয়ার দোকানে। এক ধামা দাও ধান আমি কিনিব পুঁতির মালা আরো ধামা দাও ধান আমি কিনিব হাতের বালা। বিদেশী বানিয়ারে! বোঝা তোমার মাথে, দেখাও দেখি কি কি জিনিস আছে তোমার সাথে? আমার কাছে সিন্দুর আছে ওই না ভালের শোভা, তোমার রাঙা-ঠোঁটের মত দেখতে মন-লোভা। আমরা তো জানি না সিন্দুর কেমনে পরে, আমরা তো দেখি নাই সিন্দুর কাহারো ঘরে। সোনার বরণ কন্যারে! দীঘল মাথার ক্যাশ, সিন্দুর পরাইতে পারি যাও যদি মোর দ্যাশ। ঘরে আছে ভাইয়ের বৌ লক্ষ্মীর সমান, তোমার মাথায় সিন্দুর দিয়া জুড়াইব প্রাণ। শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে, তোমার না সিন্দুর লইতে কত দাম লাগে? আমার না সিন্দুর লইতে লাগে হাসিমুখ, আমার না সিন্দুর লইতে লাগে খুশীবুক। নিলাম নিলাম, সিন্দুর নিলাম হাসি-মুখে কিনি, আরো কি ধন আছে তোমার আমরা নি তা চিনি? আরো আছে হাতের শাঁখা, আছে গলার হার, নাকের বেশর নথও আছে সোনার বাঁধা তার। আমরা তো নাহি জানি বানিয়া শাঁখা বলে কারে, দেখি নাই তো নথের শোভা সোনাবান্ধা তারে। সোনার বরণ কন্যা, তোমার সোনার হাত পাও, শাঁখা যদি না পরিলে কিসের সুখ পাও? সাতো ভাইয়ের সাতো বউ সাতো নথ নাকে, পূব-দুয়াইয়া বাড়ি মোদের উজ্জল কইরা থাকে। শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে, তোমার না নথ ও শাঁখায় কত দাম লাগে? আমার না শাঁখা লইতে লাগে হাসিমুখ, আমার না নথ লইতে লাগে খুশীবুক। নিলাম, নিলাম, নথও নিলাম, নিলাম, তোমার শাঁখা, তোমার কথা বানিয়ারে রিদ্রে রইলো আঁকা। ওই বিদেশী বানিয়া মোরে পাগল করিয়া গেছে, আমার মন কাড়িয়া নেছেরে সজনি! শাঁখা না কিনিতে আমি হাতে বাঁধলাম ডোর; সিঁথার সিন্দুর কিনে চক্ষে দেখি ঘোর! নথ না কিনিয়া আমি পন্থে করনু বাসা, একেলা কান্দিয়া ফিরি লয়ে তারি আশা।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
আজকে রাতরে যাইতে দেব না, শুধু শুধু কথা কয়ে, তারা ফুটাইব, হাসি ছড়াইব আঁধারের লোকালয়ে। গোলাপী ঠোঁটের কৌটায় করে রাখিব রাতেরে ভরি, তোমার দু-খানি রঙিন বাহুর বাঁধনে তাহারে ধরি। আজকের রাত শুধু আজকের-যত ভাল ভাল কথা, কয়ে আর কয়ে ফুটাইব তাতে যত স্বপনের লতা! আজকের রাত, মেরু কুহেলির এক ফোঁটা সরু চাঁদ, আজের রাত-শত নিরাশার একটি পূরিত সাধ। আজের রাতেরে জড়ায়ে রাখিব তোমার সোনার গায়, আজকের রাতেরে দোলায় দোলাব তবনিশ্বাস বায়। আজকের রাতে কথা কব আমি-যত ভাল ভাল কথা, কথার ফুলেতে সাজাইয়া দেব তোমার দেহের লতা! কথায় কথায় উড়ে যাব আমি, ছড়াইয়া যাব আর, মরে যাব আমি নিঃশেষ হয়ে বিস্মৃতি পারাবার। দিবসে যা হয় হইবে তখন, রাতের পেয়ালা ভরি, দেহ-মদিরার সোনালী পানীয় উথলি যাইবে পড়ি। আজকের রাতে বল, ভালবাসি বল বল তুমি মোর, না হয় ভুলিও যখন হইবে তোমার রজনী ভোর- আমার রজনী ভোর হবেনাক, এ রাত জহর-জাম, পান করে আমি শেষ-নাহি-হওয়া নিদ্রা যে লভিলাম।
জসীম উদ্‌দীন
রূপক
তেপান্তরের মাঠেরে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে রে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে ; দুলছে সদাই ধুলার দোলায় ঘূর্ণি হাওয়ার ভরে। মাঝখানে তার বট-বিরিক্ষি ঠান্ডা পাতার বায়ে, বাতাসেরে শীতল করে ছড়ায় মাটির গায়ে। সেথায় আছে খোসমানী সে সোনার বরণ গা, বিজলী-বরণ হাত দুখানি আলতা-পরা পা। সন্ধ্যাবেলা যখন এসে দাঁড়ায় প্রদীপ করে, হাজার তারা ফুঠে ওঠে নীল আকাশের পরে। পাকা তেলাকুচের ফলে রাঙাতে ঠোঁট দুটি, সন্ধ্যা-সকাল রাঙা হয়ে হাসে কুটিকুটি। রামধনু, তার শাড়ীর পাড়ে দোল খাইবে বলে, সাতটি রঙের সাতটি হাসি ছড়ায় মেঘের দলে। সাদা সাদা বকের ছানা নরম পাখা মেলে, বলে, কন্যা, তোমার শাড়ীর পাড়ে ফিরব খেলে। মেঘের গায়ে বিজলী মেখে বলে, কন্যা, আয়। তোরে আজি জড়িয়ে নেব নীলাম্বরীর ছায়। সে যখনে হাসে তখন হাসে যে ফুলগুলি, গান গাহিলে বেড়ে তারে নাচে যে বুলবুলি। সকাল হলে দুর্বাশীষের নীহার-জলে নেয়ে, আকাশ দিয়ে নেচে বেড়ায় ফুলের রেণু খেয়ে। এই খুকীটির সঙ্গে তোমার আলাপ যদি থাকে, ব’লো যেন আসমানীরে বারেক কাছে ডাকে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
সোনার চান, বাতাসে পাতিয়া বুকরে শুনি আকাশের গান। আজ নদীতে উঠিয়া ঢেউ আমার কূলে আইসা লাগে, রাতের তারার সাথে ঘরের প্রদীপ জাগেরে। চান্দের উপর বসাইয়ারে যেবা গড়ছে চান্দের বাসা, আজ দীঘিতে শাপলা ফুটে তারির লয়ে আশারে। উড়িয়া যায় হংসরে পঙ্খী, যায়রে বহুত দূর, আজ তরলা বাঁশের বাঁশী টানে সেই সুররে। আজ কাঙ্খের কলসী ধইরারে কান্দে যমুনার জল, শিমূলের তুলা লয়ে বাতাস পাগলরে।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো, মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো। রানতে বসে জল আনতে সকল কাজেই হাসি যে তার, এই নিয়ে সে অনেক বারই মায়ের কাছে খেয়েছে মার। সান করিয়া ভিজে চুলে কাঁখে ভরা ঘড়ার ভারে মুখের হাসি দ্বিগুণ ছোটে কোনমতেই থামতে নারে। এই মেয়েটি এমনি ছিল, যাহার সাথেই হত দেখা, তাহার মুখেই এক নিমেষে ছড়িয়ে যেত হাসির রেখা মা বলিত, বড়ুরে তুই, মিছেমিছি হাসিস্ বড়, এ শুনেও সারা গা তার হাসির চোটে নড় নড়! মুখখানি তার কাঁচা কাঁচা, না সে সোনার, না সে আবীর, না সে ঈষৎ ঊষার ঠোঁটে আধ-আলো রঙিন রবির! কেমন যেন গাল দুখানি মাঝে রাঙা ঠোঁটটি তাহার, মাঠে ফোটা কলমি ফুলে কতকটা তার খেলে বাহার। গালটি তাহার এমন পাতল ফুঁয়েই যেন যাবে উড়ে দু একটি চুল এলিয়ে পড়ে মাথার সাথে রাখছে ধরে। সাঁঝ-সকালে এ ঘর ও ঘর ফিরত যখন হেসে-খেলে; মনে হত ঢেউয়ের জ্বলে ফুলটিরে কে গেছে ফেলে! এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে ও পথ দিয়ে চলতে ধীরে ওই মেয়েটির রূপের গাঙে হারিয়ে গেল কলসটিরে। দোষ কি তাহার? ওই মেয়েটি মিছেমিছি এমনি হাসে, গাঁয়ের রাখাল! অমন রূপে কেমনে রাকে পরাণটা সে! এ পথ দিয়ে চলতে তাহার কোঁচার হুড়ুম যায় যে পড়ে, ওই মেয়েটি কাছে এলে আচঁলে তার দে সে ভরে। মাঠের হেলের নাস্তা নিতে হুকোর আগুন নিবে যে যায়, পথ ভুলে কি যায় সে নিতে, ওই মেয়েটি রানছে যেথায়? নিড়ের ক্ষেতে বারে বারে তেষ্টাতে প্রাণ যায় যে ছাড়ি, ভর-দুপুরে আসে কেবল জল খেতে তাই ওদের বাড়ি! ফেরার পথে ভুলেই সে যে আমের আঁটির বাশীটিরে, ওদের গরের দাওয়ায় ফেলে মাঠের পানে যায় সে ফিরে। ওই মেয়েটি বাজিয়ে তারে ফুটিয়ে তোলে গানের ব্যাথা, রাঙা মুখের চুমোয় চুমোয় বাজে সুখের মুখর কথা! এমনি করে দিনে দিনে লোক- লোচনের আড়াল দিয়া, গেঁয়ো স্নেহের নানান ছলে পড়ল বাঁধা দুইটি হিয়া! সাঁঝের বেলা ওই মেয়েটি চলত যখন গাঙের ঘাটে ওই ছেলেটির ঘাসের বোঝা লাগত ভারি ওদের বাটে। মাথার বোঝা নামিয়ে ফেলে গামছা দিয়ে লইত বাতাস, ওই মেয়েটির জল-ভরনে ভাসতে ঢেউয়ে রূপের উছাস। চেয়ে চেয়ে তাহার পানে বলত যেন মনে মনে, জল ভর লো সোনার মেয়ে! হবে আমার বিয়ের কনে? কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা, মেঠো বাঁশী বাজিয়ে তোমায় ঘুম পাড়াব, গাঁয়ের বালা! বাঁশের কচি পাতা দিয়ে গড়িয়ে দেব নথটি নাকের, সোনা লতায় গড়ব বালা তোমার দুখান সোনা হাতের। ওই না গাঁয়ের একটি পাশে ছোট্র বেঁধে কুটিরখানি, মেঝের তাহার ছড়িয়ে দেব সরষে ফুলের পাঁপড়ি আনি। কাজলতলার হাটে গিয়ে আনব কিনে পাটের শাড়ী, ওগো বালা! গাঁয়ের বালা! যাবে তুমি আমার বাড়ি?” এই রুপেতে কত কথাই আসত তাহার ছোট্র মনে, ওই মেয়েটি কলসী ভরে ফিরত ঘরে ততক্ষণে। রুপের ভার আর বইতে নারে কাঁখখানি তার এলিয়ে পড়ে, কোনোরুপে চলছে ধীরে মাটির ঘড়া জড়িয়ে ধরে। রাখাল ভাবে, কলসখানি না থাকলে তার সরু কাঁখে, রুপের ভারেই হয়ত বালা পড়ত ভেঙে পথের বাঁকে। গাঙোন জল ছল-ছল বাহুর বাঁধন সে কি মানে, কলস ঘিরি উঠছে দুলি’ গেঁয়ো-বালার রুপের টানে। মনে মনে রাখাল ভাবে, “গাঁয়ের মেয়ে! সোনার মেয়ে। তোমার কালো কেশের মত রাতের আঁধার এল ছেয়ে। তুমি যদি বল আমায়, এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি কলাপাতার আঁধার-ঘেরা ওই যে ছোট তোমার বাড়ি। রাঙা দু’খান পা ফেলে যাও এই যে তুমি কঠিন পথে, পথের কাঁটা কত কিছু ফুটতে পারে কোনমতে। এই যে বাতাস-উতল বাতাস, উড়িয়ে নিলে বুকের বসন, কতখন আর রুপের লহর তোমার মাঝে রইবে গোপন। যদি তোমার পায়ের খাডু যায় বা খুলে পথের মাঝে, অমর রুপের মোহন গানে সাঁঝের আকাশ সাজবে না যে। আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! একা একা পথে চল, ব্যথায় ব্যথায় আমার চোখে জল যে ঝরে ছল ছল।” এমনিতর কত কথায় সাঁঝের আকাশ হত রাঙা, কখন হলুদ, আধ-হলুদ, আধ-আবীর মেঘ ভাঙা। তার পরেতে আসত আঁধার ধানের ক্ষেতে, বনের বুকে, ঘাসের বোঝা মাথায় লয়ে ফিরত রাখাল ঘরের মুখে। সেদিন রাখাল শুনল, পথে সেই মেয়েটির হবে বিয়ে, আসবে কালি ‘নওশা’তাহার ফুল-পাগড়ী মাথায় দিয়ে। আজকে তাহার ‘হলদি-ফোটা’ বিয়ের গানে ভরা বাড়ি, মেয়ে-গলার করুণ গানে কে দেয় তাহার পরাণ ফাড়ি’। সারা গায়ে হলুদ মেখে সেই মেয়েটি করছিল সান, কাঁচা সোনা ঢেলে যেন রাঙিয়ে দেছে তাহার গা’খানা। চেয়ে তাহার মুখের পানে রাখাল ছেলের বুক ভেঙে যায়। আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! কেমন করে ভুললে আমায় ? সারা বাড়ি খুশীর তুফান-কেউ ভাবে না তাহার লাগি, মুখটি তাহার সাদা যেন খুনী মকর্দ্দমার দাগী। অপরাধীর মতন সে যে পালিয়ে এল আপন ঘরে, সারাটা রাত মরল ঝুরে কি ব্যথা সে বক্ষে ধরে। বিয়ের ক’নে ছলছে আজি শ্বশুর-বাড়ি পালকী চড়ে চলছে সাথে গাঁয়ের মোড়ল বন্ধু ভাই-এর কাঁধটি ধ’রে । সারাটা দিন বিয়ে বাড়ির ছিল যত কল-কোলাহল গাঁয়ের পথে মূর্ত্তি ধরে তারাই যেন চলছে সকল। কেউ বলিছে, মেয়ের বাপে খাওয়াল আজ কেমন কেমন, ছেলের বাপের বিত্তি বেসাৎ আছে কি ভাই তেমন তেমন? মেয়ে-জামাই মিলছে যেন চাঁদে চাঁদে মেলা, সুর্য যেমন বইছে পাটে ফাগ-ছড়ান সাঁঝের বেলা! এমনি করে কত কথাই কত জনের মনে আসে, আশ্বিনেতে যেমনি তর পানার বহর গাঙে ভাসে। হায়রে আজি এই আনন্দ, যাবে লয়ে এই যে হাসি, দেখল না কেউ সেই মেয়েটির চোখদুটি যায় ব্যথায় ভাসি। খুঁজল না কেউ গাঁয়ের রাখাল একলা কাঁদে কাহার লাগি বিজন রাতের প্রহর থাকে তাহার সাথে ব্যথায় জাগি। সেই মেয়েটির চলা-পথে সেই মেয়েটির গাঙের ঘাটে একলা রাখাল বাজায় বাঁশী ব্যথার ভরা গাঁয়ের বাটে। গভীর রাতে ভাটীর সুরে বাঁশী তাহার ফেরে উদাস তারি সাথে কেঁপে কেঁপে কাঁদে রাতের কালো বাতাস। করুণ করুণ-অতি করুণ বুকখানি তার উতল করে, ফেরে বাঁশীর সুরটি ধীরে ধীরে ঘুমো গাঁয়ের ঘরে ঘরে। “কোথায় জাগো বিরহিণী ! ত্যজি বিরল কুটিরখানি, বাঁশীর ভরে এস এস ব্যথায় ব্যথায় পরাণ হানি। শোন শোন দশা আমার, গহন রাতের গলা ধরি’ তোমার তরে ও নিদয়া, একা একা কেঁদে মরি। এই যে জমাট রাতের আঁধার, আমার বাঁশী কাটি তারে, কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, কেঁদে মরে বারে বারে।” ডাকছাড়া তার কান্না শুনি একলা নিশা সইতে নারে, আঁধার দিয়ে জড়ায় তারে, হাওয়ায় দোলায় ব্যথার ভারে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
নয় মত্স চেনে গহিন গম্ভ পঙ্খী চেনে ডাল ; মায় সে জানে বিটার দরদ যার কলিজার শ্যাল! নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ ; জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত | . — গাজীর গান আষাঢ় মাসে রূপীর মায়ে মরল বিকার জ্বরে, রূপা সাজু খায়নি খানা সাত আট দিন ধরে | লালন পালন যে করিত “ঠোঁটের” আধার দিয়া, সেই মা আজি মরে রূপার ভাঙল সুখের হিয়া | ঘামলে পরে যে তাহারে করত আবের পাখা ; সেই শাশুড়ী মরে, সাজুর সব হইল ফাঁকা | সাজু রূপা দুই জনেতে কান্দে গলাগলি ; গাছের পাতা যায় যে ঝরে, ফুলের ভাঙে কলি | এত দুখের দিনও তাদের আস্তে হল গত, আবার তারা সুখেরি ঘর বাঁধল মনের মত |
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
বার রাইত তুই যা রে পোহাইয়ে | বেলা গে ল সন্ধ্যা হৈল—ও হৈলরে! গৃহে জ্বালাও বাতি, না জানি অবলার বন্ধু আসবেন কত রাতিরে! রাইত তুই—যা পোহাইয়ে রাইত না এক পরের হৈল, ও হৈলরে! তারায় জ্বলে বাতি ; রান্ধিয়া বাড়িয়া অন্ন জাগ্ ব কত রাতিরে ; রাইত তুই যারে—যা পোহাইয়ে | রাইত না দুই পরের হৈল ও হৈলরে, ডালে ডাকে শুয়া অঞ্চল বিছায়া নারী কাটে চেকন গুয়ারে | রাইত তুই যারে—যা পোহাইয়ে | রাইত না প্রভাত হৈল—ও হৈলরে, কোকিল করে কুয়া, খুইলে দাও মন্দিরার কেওয়াড় লাগুক শিতল হাওয়ারে | রাইত তুই যারে—যা পোহাইয়ে | . — রাখালী গান রূপাই গিয়াছে ‘কাইজা’ করিতে সেই ত সকাল বেলা, বউ সারাদিন পথ পানে চেয়ে, দেখেছে লোকার মেলা | কত লোক আসে কত লোক যায়, সে কেন আসে না আজ, তবে কি তাহার নসিব মন্দ, মাথায় ভাঙিবে বাজ! বালাই, বালাই, ওই যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া, আসিছে লোকটি, ওই কি রূপাই ? নেচে ওঠে তার হিয়া | এলে পরে তারে খুব বকে দিবে, মাথায় ছোঁয়াবে হাত, কিরা করাইবে লড়ায়ের নামে হবে না সে আর মাৎ | আঁচলে চোখেরে বার বার মাজে, নারে না সে ত ও নয়, আজকে তাহার কপালে কি আছে, কে তাহা ভাঙিয়া কয় | লোহুর সাগরে সাতার কাটিয়া দিবস শেষের বেলা, রাত্র-রাণীর কালো আঁচলেতে মুছিল দিনের খেলা | পথে যে আঁধার পড়িল সাজুর মনে তার শত গুণ, রাত এসে তা ব্যথার ঘায়েতে ছিটাইল যেন নুন! ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা, সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা | পাতায় পাতায় খস্ খস্ খস্, শুনে কান খাড়া করে, যারে চায় সে ত আসেনাক শুধু ভুল করে করে মরে | তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে, ভাল লাগেনাক তার ; আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায়, বার বার খুলে দ্বার | কেন আসে নারে! সাজুর যদি গো পাখা আজ বিধি, উড়িয়া যাইয়া দেখিয়া আসিত তাহার সোনার নিধি | নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী-ফুল, প্রথমে যেদিন রূপারে সে দেখে, সে খুশির সমতুল | আঁকিল তাদের বিয়ের বাসর, আঁকিল রূপার বাড়ি, এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি | দুয়ার খুলিয়া দেখিল সে চেয়ে—রূপাই আসিছে বটে, ”এতক্ষণে এলে ? ভেবে ভেবে যেগো প্রাণ নাই মোর ঘটে | আর জাইও না কাইজা করিতে, তুমি যাহাদের মারো, তাদের ঘরে ত আছে কাঁচা বউ, ছেলেমেয়ে আছে কারো |” রূপাই কহিল কাঁদিয়া, “বউগো ফুরায়েছে মোর সব, রাতে ঘুম যেতে শুনিবে না আর রূপার বাঁশীর রব | লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে, আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে | লোহু লয়ে আজ সিনান করেছি, রক্তে ভেসেছে নদী, বুকের মালা যে ভেসে যাবে তাতে আগে জানিতাম যদি! আঁচলের সোনা খসে যাবে পথে আগে যদি জানতাম, হায় হায় সখি, নারিনু বলিতে কি যে তবে করিতাম !” বউ কেঁদে কয়, “কি হয়েছে বল, লাগিয়াছে বুঝি কোথা, দেখি ! দেখি !! দেখি !!! কোথায় আঘাত, খুব বুঝু তার ব্যথা !” “লাগিয়াছে বউ, খুব লাগিয়াছে, নহে নহে মোর গায়, তোমার শাড়ীর আঁচল ছিঁড়েছে, কাঁকন ভেঙেছে হায়! তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়ু ছিঁড়েছে গলার হার, তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর | আজ ‘কাইজায়’ অপর পক্ষে খুন হইয়াছে বহু | এই দেখ মোর কাপড়ে এখনো লাগিয়া রহিছে লহু | থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি, খোঁজ পেলে পরে এখনি আমার ধরে নিয়ে যাবে টুঁটি | সাথীরা সকলে যে যাহার মত পালায়েছে যথা-তথা, আমি আসিলাম তোমার সঙ্গে সেরে নিতে সব কথা | আমার জন্য ভাবিনাক আমি, কঠিন ঝড়িয়া-বায়, যে গাছ পড়িল, তাহার লতার কি হইবে আজি হায়! হায় বনফুল, যেই ডালে তুই দিয়েছিলি পাতি বুক, সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর সে সকল সুখ | ঘরে যদি মোর মা থাকিত আজ তোমারে সঙ্গে করি, বিনিদ্র রাত কাঁদিয়া কাটাত মোর কথা স্মরি স্মরি! ভাই থাকিলেও ভাইয়ের বউরে রাখিত যতন করি, তোমার ব্যথার আধেকটা তার আপনার বুকে ভরি | আমি যে যাইব ভাবিনাক, সাথে যাইবে কপাল-লেখা, এযে বড় ব্যথা! তোমারো কপালে এঁকে গেনু তারি রেখা!” সাজু কেঁদে কয়, “সোনার পতিরে তুমি যে যাইবে ছাড়ি, হয়ত তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি | সে দুখেরে আমি ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া, এ পোড়া রূপেরে কি দিয়া ঢাকিব—ভেবে মরে মোর হিয়া | তুমি চলে গেলে পাড়ার লোকে যে চাহিবে ইহার পানে, তোমার গলার মালাখানি আমি লুকাইব কোন্ খানে!” রূপা কয়, “সখি দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই, সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই | মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে, তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে |” এমন সময় ঘরের খোপেতে মোরগ উঠিল ডাকি, রূপা কয়, “সখি! যাই—যাই আমি—রাত বুঝি নাই বাকি!” পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায় ; সাজু কয়, “ ওগো শোন, আর কি গো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন ? দীঘল রজনী—দীঘল বরষ—দীঘল ব্যথার ভার, আজ শেষ দিনে আর কোন কথা নাই তব বলিবার ?” রূপা ফিরে কয়, “না কাঁদিয়া সখি, পারিলামনাক আর, ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল দেয়ার ধার |” “এই শেষ কথা!” সাজু কহে কেঁদে, “বলিবে না আর কিছু ?” খানিক চলিয়া থামিল রূপাই, কহিল চাহিয়া পিছু, “মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোন ব্যথা লাগে, দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে | সিন্দুরখানি পরিও ললাটে—মোরে যদি পড়ে মনে, রাঙা শাড়ীখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী-কোণে | মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাঁধিও চুল, আলসে হেলিয়া খোপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল | যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে—না শুনি আমার বাঁশী, বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুখে মেখে রাঙা হাসি | চেয়ো মাঠ পানে—গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান ; কান পেতে থেকো, যদি শোনো কভু সেখায় আমার গান | আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া, মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া!” ঘরের খোপেতে মোরগ ডাকিল, কোকিল ডাকিল ডালে, দিনের তরণী পূর্ব-সাগরে দুলে উঠে রাঙা পালে | রূপা কহে, “তবে যাই যাই সখি, যেটুকু আধার বাকি, তারি মাঝে আমি গহন বনেতে নিজেরে ফেলিব ঢাকি |” পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায়, তবু ফিরে ফিরে চায় ; সাজুর ঘরেতে দীপ নিবু নিবু ভোরের উতল বায় | ****************** নিশাল = অবিরাম
জসীম উদ্‌দীন
নীতিমূলক
সবার সুখে হাসব আমি কাঁদব সবার দুখে, নিজের খাবার বিলিয়ে দেব অনাহারীর মুখে।আমার বাড়ির ফুল-বাগিচা, ফুল সকলের হবে, আমার ঘরে মাটির প্রদীপ আলোক দিবে সবে।আমার বাড়ি বাজবে বাঁশি, সবার বাড়ির সুর, আমার বাড়ি সবার বাড়ি রইবে না ক দুর।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
সোনার বরণী কন্যা সাজে নানা রঙ্গে, কালো মেঘ যেন সাজিলরে। সিনান করিতে কন্যা হেলে দুলে যায়, নদীর ঘাটেতে এসে ইতি উতি চায়। বাতাসে উড়িছে শাড়ী, ঘুরাইয়া চোখ, শাসাইল তারে করি কৃত্রিম রোখ। হলুদ মাখিয়া কন্যা নামে যমুনায়, অঙ্গ হলুদ হইয়া জলে ভাইসা যায়। ডুবাইয়া দেহ জলে থাকে চুপ করে, জল ছুঁড়ে মারে কভু আকাশের পরে। খাড়ু জলে নাইমা কন্যা খাড়ুমাঞ্জন করে, আকাশের রামধনু হেলেঢুলে পড়ে। তারপরে বাহু দুটি মেলে জলধারে, ঘুরাইল ফিরাইল কত লীলাভরে। বাহু দুটি মাজে কন্যা অতি কৌতুহলে, খসিয়া পড়িছে রূপ সোনালিয়া জলে। অঞ্জলি পরি জল অধরে ছুঁড়িছে, জলন্ত অঙ্গার হতে ফুলকি উড়িছে। খুলিয়া কুন্তলভার ছড়াইল জলে, আকাশ নামিল যেন সমুদ্দুরের কোলে। দু-হাত বিধায়ে চুলে যত মাঞ্জন করে, মেঘেতে বিজলী যেন ফেরে লীলাভরে। গলা জলে নেমে কন্যা গলা মাঞ্জন করে, ঢেউগুলি টলমল মালার ফুলের কর্ণফুলের ভূষণ লয়ে কোন ঢেউ খোঁপার কুসুম লোভে কেউ হাসে গায় সিনান করিয়া কন্যা উঠে জল হতে, তরল লাবনী ধারা ঝরে অঙ্গ স্রোতে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
চৌদ্দ উইড়া যায়রে হংস পক্ষি পইড়া রয়রে ছায়া ; দেশের মানুষ দেশে যাইব—কে করিবে মায়া | — মুর্শিদা গান আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে, নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে | মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি, ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি! নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি, কোন্ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি ! বাতাসের পায়ে বাজেনা আজিকে ঝল মল মল গান, মাঠের ধূলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয় ম্লান! সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে, মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে! মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল, এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল | লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে, বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে | তবু এই-গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই-গাঁওটির পানে, কতদিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে | মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ ; সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ! এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধাঁ, যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাঁধা | সকলেই জানে সেই কোন্ কালে রূপা বলে এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি | বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা, খন্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা | রূপা একদিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে, তারি আশা-পথে চাহিয়া চাহিয়া বউটি মরিল শেষে | মরিবার কালে বলে গিয়েছিল — তাহার নক্সী-কাঁথা, কবরের গায়ে মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা! বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে, শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে | প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়, রোগ পাণ্ডডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়! শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙীন শাড়ী, রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি! সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই নক্সী-কাঁথা,— আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা | কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,— মহা-শূণ্যেতে উড়িয়াছে কেবা নক্সী-কাথাটি ধরে ; হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশীটি বাজায় করুণ সুরে, তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে | সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ, ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ | শেষ
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(এগার)'ও রূপা তুই করিস কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে? বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে |' 'কি বলিলা বছির মামু ?' উঠল রূপাই হাঁক ছাড়িয়া, আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া | পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে, বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি, আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে! লম্ফে রূপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা, ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা | কোথায় রল রহম চাচা, কলম শেখ আর ছমির মিঞা, সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া! বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরা গফর-গাঁয়ে, এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান গোরের ছায়ে? 'আলী-আলী' হাঁকল রূপাই হুঙ্কারে তার গগন ফাটে, হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে! ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রূপার বাড়ি ; ডাক শুনে তার আসল ছুটে রহম চাচা, ছমির মিঞা, আসল হেঁকে কাজেম খুনী নখে নখে আঁচড় দিয়া | আসল হেঁকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পড়ি, এক নিমেষে গাঁয়ের লোকে রূপার বাড়ি ফেলল ভরি | লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে, এক লাঠিতে একশ লোকেরমাথা যে জন আস্ ল  দলে | দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী, গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি |গর্জি উঠে গদাই ভূঁঞার ; মোহন ভূঁঞার ভাজন বেটা, যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা | সব গাঁর লোক এক হল আজ রূপার ছোট উঠান পরে, নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ-খেলানো বাঁশীর স্বরে! রূপা তখন বেরিয়ে তাদের বলল, 'শোন ভাই সকলে, গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে |' বছির মামু বলছে খবর---মোল্লারা সব কাসকে নাকি ; আধেক জমির ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায় : আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায় |' থামল রূপাই---ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া, নাগ-নাগিনীর ফণায় যেমন তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া | গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ায় লাঠি, রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি |রূপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, 'থাল বাজারে থাল বাজারে, থাল বাজায়ে সড়কি ঘুরা হানরে লাঠি এক হাজারে | হানরে লাঠি---হানরে কুঠার, গাছের ছ্যন্ আর রামদা ঘুরা, হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয় রে তোরা |' 'আলী! আলী! আলী! আলী!!!' রূপার যেন কণ্ঠ ফাটি, ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে কাঁপছে আকাশ কাঁপছে মাটি | তারি সুরে সব লেঠেল লাঠির, পরে হানল লাঠি, 'আলী-আলী' শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি | আগে আগে ছুটল রূপা---বৌঁ বৌঁ বৌঁ সড়কি ঘোরে, কাল সাপের ফণার মত বাবরী মাথায় চুল যে ওড়ে | লল পাছে হাজার লেঠেল 'আলী-আলী' শব্দ করি, পায়ের ঘায়ে মাঠের ধূলো আকাশ বুঝি ফেলবে ভরি! চলল তারা মাঠ পেরিয়ে, চলল তারা বিল ডেঙিয়ে, কখন ছুটে কখন হেঁটে বুকে বুকে তাল ঠুকিয়ে | চলল যেমন ঝড়ের দাপে ঘোলাট মেঘের দল ছুটে যায়, বাও কুড়ানীর মতন তারা উড়িয়ে ধূল্ পথ ভরি হায়! দুপুর বেলা এল রূপাই গাজনা চরের মাঠের পরে, সঙ্গে এল হাজার লেঠেল সড়কি লাঠি হস্তে ধরে! লম্ফে রূপা শূণ্যে উঠি পড়ল কুঁদে মাটির পরে, থকল খানিক মাঠের মাটি দন্ত দিয়ে কামড়ে ধরে | মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে, 'আলী! আলী!' শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে | হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয় 'আলী আলী হজরত আলী,' সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি! তারাও সবে আসল জুটে দলে দলে ভীম পালোয়ান, 'আলী আলী' শব্দে যেন পড়ল ভেঙে সকল গাঁখান! সামনে চেয়ে দেখল রূপা সার বেঁধে সব আসছে তারা, ওপার মাঠের কোল ঘেঁষে কে বাঁকা তীরে দিচ্ছে নাড়া | রূপার দলে এগোয় যখন, তারা তখন পিছিয়ে চলে, তারা আবার এগিয়ে এলে এরাও ইটে নানান কলে | এমনি করে সাত আটবারে এগোন পিছন হল যখন রূপা বলে, 'এমন করে 'কাইজা' করা হয় না কখন |' তাল ঠুকিয়ে ছুটল রূপাই, ছুটল পাছে হাজার লাঠি, 'আলী-আলী --- হজরত আলী' কণ্ঠ তাদের যয় যে ফাটি | তাল ঠুকিয়া পড়ল তারা বন-গেঁয়োদের দলের মাঝে, লাঠির আগায় লাগল লাঠি, লাঠির আগায় সড়কি বাজে | 'মার মার মার' হাঁকল রূপা, --- 'মার মার মার' ঘুরায় লাঠি, ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি | আজ যেন সে মৃত্যু-জনম ইহার অনেক উপরে উঠে, জীবনের এক সত্য মহান্ লাঠির আগায় নিচ্ছে লুটে! মরণ যেন মুখোমুখি নাচছে তাহার নাচার তালে, মহাকালের বাজছে বিষাণ আজকে ধরার প্রলয় কালে | নাচে রূপা---নাচে রূপা--- লোহুর গাঙে সিনান করি, মরণরে সে ফেলছে ছুড়ে রক্তমাখা হস্তে ধরি | নাচে রূপা---নাচে রুপা---মুখে তাহার অট্টহাসি, বক্ষে তাহার রক্ত নাচে, চক্ষে নাচে অগ্নিরাশি | ---হাড়ে হাড়ে নাচন তাহার, রোমে রোমে লাগছে নাচন, কি যেন সে দেখেছে আজ, রুধতে নারে তারি মাতন | বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রূপার লোকও ফিরল বহু, রূপা তবু নাচছে, গায়ে তাজা-খুনের হাসছে লোহু |
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
কৃষাণী দুই মেয়ে পথের কোণে দাঁড়িয়ে হাসে আমার পানে চেয়ে। ওরা যেন হাসি খুশীর দুইটি রাঙা বোন, হাসি-খুশীর বেসাত ওরা করছে সারাখন। ঝাকড়া মাথায় কোঁকড়া চুলে, লেগেছে খড়কুটো, তাহার নীচে মুখ দুখানি যেন তরমুজফালি দুটো। সেই মুখেতে কে দুখানি তরমুজেরি ফালি, একটি মেয়ে লাজুক বড়, মুখর আরেক জন, লজ্জাবতীর লতা যেন জড়িয়ে গোলাপ বন। একটি হাসে, আর সে হাসি লুকায় আঁচল কোণে, রাঙা মুখের খুশী মিলায় রাঙা শাড়ীর সনে। পউষ-রবির হাসির মত আরেক জনের হাসি, কুয়াশাহীন আকাশ ভরে টুকরো-মেঘে ভাসি। চাষীদের ওই দুইটি মেয়ে ঈদের দুটি চাঁদ, যেই দেখেছি, পেরিয়ে গেল নয়নপুরীর ফাঁদ।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
আমার বাড়ি যাইও ভোমর, বসতে দেব পিঁড়ে, জলপান যে করতে দেব শালি ধানের চিঁড়ে। শালি ধানের চিঁড়ে দেব, বিন্নি ধানের খই, বাড়ির গাছের কবরী কলা, গামছা-বাঁধা দই। আম-কাঁঠালের বনের ধারে শুয়ো আঁচল পাতি, গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস করব সারা রাতি। চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো মাখিয়ে দেব সুখে তারা ফুলের মালা গাঁথি, জড়িয়ে দেব বুকে। গাই দোহনের শব্দ শুনি জেগো সকাল বেলা, সারাটা দিন তোমায় লয়ে করব আমি খেলা। আমার বাড়ি ডালিম গাছে ডালিম ফুলের হাসি, কাজলা দীঘির কাজল জলে কাঁসগুলি যায় ভাসি। আমার বাড়ি যাইও ভোমর, এই বরাবর পথ, মৌরী ফুলের গন্ধ শুঁকে থামিও তব রথ।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর। যে মোরে করিল পথের বিবাগী, - পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি। দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর ; আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর। আমার এ কুল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাঁধি, যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি; সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ, আমি দেই তারে বুকভরা গান; কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর। মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি, রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল-মালঞ্চ ধরি । যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বার্ণী, আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি, কত ঠাঁই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার, নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার। রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা, করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা। শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে, তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে। ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান, এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ? ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু, শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু। ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে, ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে?” মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ” ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ?” পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত, পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ। নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান, ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ। ভাল করে দাও আল্লা রছুল। ভাল কোরে দাও পীর। কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর। বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি, বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি। চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি, দুর ছাই। কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি। যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে, বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে। ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল, করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল? আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?” মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে, ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে। “শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে, রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে। খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে, ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।” ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত, বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত। রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে, কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে। সাঁঝ হোয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ, হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান। এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে, ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি-সাঁঝে? কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার, ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার। আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই, বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই। করিম যে গেল? রহিম চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা; উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা। আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা, ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা। ঘরের চালেতে ভুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর, মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দুর-দুর। পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি, কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি। ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে বুড়ো পাতা ঝরে বনে, ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে। রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা। সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা। পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা, আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
কাল সে আসিয়াছিল ওপারের বালুচরে, এতখানি পথ হেঁটে এসেছিল কি জানি কি মনে করে। কাশের পাতায় আঁচড় লেগেছে তাহার কোমল গায়, দুটি রাঙা পায়ে আঘাত লেগেছে কঠিন পথের ঘায়। সারা গাও বেয়ে ঘাম ঝরিতেছে, আলসে অবশ তনু, আমার দুয়ারে দাঁড়াল আসিয়া দেখিয়া অবাক হনু। দেখিলাম তারে- যার লাগি একা আশা-পথ চেয়ে থাকি, এই বালুচরে মাথা কুটে কুটে ফুকারিয়া যারে ডাকি। দেখিলাম তারে- যার লাগিএই উদাস ঝাউ-এর বন, বরষ বরষ মোর গলা ধরি করিয়াছে ক্রন্দন। দেখিলাম তারে, তবু কেন হায় বলিতে নারিনু ডাকি, কোন অপরাধে আমার ললাটে দিলে এত ব্যথা আঁকি! বলিতে নারিনু, ওগো পরবাসী, দেখিতে এলে কি তাই, আগুন জ্বেলেছ যেই ঘন-বনে সেকি পুড়ে হল ছাই! এলে কি দেখিতে-দূর হতে যারে হেনেছিলে বিষ-বাণ, সে বন বিহগী বেঁচে আছে কিবা জীবনের অবসান! বলিতে নারিনু, নিঠুর পথিক, কেন এলে মিছামিছি অলস চরণ, অবশ দেহটি, সারা গায়ে ঘাম, ছি ছি! এতখানি পথ হাঁটিয়া এসেছে কত না কষ্ট সহি, তারি কাছে মোর দুখের কাহিনী কেমন করিয়া কহি! নয়নের জল মুছিয়া ফেলিনু, মুখে মাখিলাম হাসি, কহিলাম, বুঝি পূর্বের সুরুয সাঁঝেতে উদিল আসি! আঁচলে তাহারে বাতাস করিণু চরণ দুখানি ধূয়ে, মাথার কেশেতে মুছাইয়া দিয়ে বসিলাম কাছে নুয়ে! কহিলাম-বড় ভাগ্য আমার, আজিকার দিনখানি, এমনি করিয়া রাখাযায় নাকি দুই হাতে যদি টানি! রবির চলার পথ, আজিকার তরে ভুলিতে পারে না অস্ত পারের পথ? কৌটায় ভরে সিঁদুর ত রাখি, আজিকার দিন হায়, এমনি করিয়া কৌটার মাঝে ভরে কি রাখা না যায়! এই দিনটিরে মাথায় কেশেতে বেঁধে রাখা যায়নাকি! মিছেমিছি কত বকিয়া গেলাম ছাই পাশ থাকি থাকি। শুনে সে কেবল হাসি-মুখে তার আরও মাখাইল হাসি, সেই রাঙা মুখে- যে মুখেরে আমি এত করে ভালবাসি। মুখেতে মাখিল হাসি, সোনা দেহখানি নাড়া দিয়ে গেল বুঝি হাওয়া ফুল-বাসী! কাল এসেছিল এই বালুচরে আর মোর কুঁড়ে ঘরে- তার পাশে চলে ছোট্ট নদীটি দুইখানি তীর ধরে। সেই দুই তীরে রবি-শস্যেতে দিগন্ত গেছে ভরি- রাই সরিষার জড়াজড়ি করে ফুলের আঁচল ধরি। তারি এক তীরে বাঁকা পথখানি, দীঘল বালুর লেখা, সেই পথ দিয়ে এসেছিল কাল আঁকিয়া পায়ের রেখা। কাল এসেছিল, চখা আর চখী এ ওরে আদর করি, পাখা নেড়েছিল, তারি ঢেউ লাগি নদী উঠেছিল নড়ি। তারি ঢেউ বুঝি ভেসে এসেছিল আমার পাতার ঘরে- বহুদিন পরে পেয়েছিনু তারে শুধু কালিকার তরে। কালিকার দিন, মেরু- কুহেলির অনন্ত আঁধিয়ারে শুধু একখানা আলোক- কমল ফুটেছিল এক ধারে। মহা-সাগরের দিগন্ত-জোড়া ফেন-লহরীর পরে প্রদীপ-তরনী ভেসে এসেছিল বুঝি এ ব্যথার ঝড়ে! কালকে তাহারে পেয়েছিনু আমি, হায়, হায়, কত-কাল, যারে ভাবি এই শূনো বালুচরে চিতায় দিয়েছি জ্বাল; সেই তারে হায়, দেখিয়া নারিনু খুলিয়া দেখাতে আমি এই জীবনের যত হাহাকার উঠিয়াছে দিন-যামী, - যে আগুনে আমি জ্বলিয়া মরেছি, সে-দাবদাহন আনি কোন্ প্রাণে আমি নারী হয়ে সেই ফুলের তনুতে হানি! শুধু কহিলাম-পরাণ বন্ধু! তুমি এলে মোর ঘরে, আমি ত জানিনে কি করে যে আজ তোমারে আদর করে! বুকে যে তোমারে রাখিব বন্ধু, বুকেতে শ্মাশান জ্বলে; নয়নে রাখিব! হায়রে অভাগা, ভাসিয়া যাইবে জলে! কপালে রাখিব! এ ধরার গাঁয়ে আমার কপাল পোড়া; মনে যে রাখিব! ভেঙে গেছে সে যে কভু নারে লাগে জোড়া! সে কেবল শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চাহিল আমার পানে; ও যেন আরেক দেশের মানুষ, বোঝে না ইহার মানে। সামনে বসায়ে দেখিলাম তারে, দেখিলাম সেই মুখ। ভাবিলাম ওই সুমেরু হইতে কি করে যে আসে দুখ। দেখিতে দেখিতে সকাল কাটিল, দুপুরের উঁচু বেলা, পশ্চিম দেশে গড়ায়ে পড়িল মেঘেতে আঁকিয়া খেলা। বালুচর হতে বিদায় মাগিল নতুন বকের সারি, পাখায় পাখায় আকাশের বুকে শেফালীর ফুল নাড়ি। সে মোরে কহিল“দিন চলে গেল, আমি তবে আজ আসি? -যার রাঙা মুখ ফুলের মতন, তাতে মাখা মিঠে হাসি। সে মোরে কহিল, একটি কথায় ভাঙিল স্বপন মোর, ভাঙিল তাহার সোনার চুড়াটি, ভাঙিল সকল দোর। সে মোরে কহিল, “শোন তাপসিনি। আজকের মত তবে, বিদায় হইনু, আবার আসিব মোর খুশী হবে যবে।” হাসিয়াই তারে কহিলাম, “সখা বিদায় সমস্কার” অভাগিনী আমি রুষিতে নারিনু নয়ন জলের ধার। খানিক যাইয়া ফিরিয়া চাহিল, কহিল আমারে, “নারি। কোন কিছু কয়ে ব্যথা দেছি তোমা, কেন চোখে তব বারি?” আমি কহিলাম, “সুন্দর সখা, আমার নয়ন ধার- পাইয়াও যেগো পাইবে তোমারে ভাষা এই বেদনার।’ “ আমি কি নিঠুর?” সে মোরে শুধাল, আমি কহিলাম, “নয়। ফুলেরো আঘাত গায়ে লাগে যার, কে তারে নিঠুর কয়? গলায় যাহারে মালা দেই নাক হয়ত মালার ভারে, তাহার কোমল ফুলের অঙ্গে কোন ব্যথা দিতে পারে । ছুঁইনা যাহারে ভয়ে, ও দেহ-তরুর অফুট কুসুম যদি পড়ে হায় খয়ে। সে মোরে দিয়েছে এই এত জ্বালা এ-কথা ভাবিব যবে রোজ-কেয়ামত ভেঙে পড়ে যেন আমার মাথায় তবে।” “তবে কেন কাঁদ? হায় তাপসিনি।জীবনের ভোরখানি, কার হেলা পেয়ে আজিকে এনেছ মরণের দেশে টানি।” আমি কহিলাম-“সোনার বন্ধু এ-মোর ললট-লেখা কেউ পারিবে না মুছাইয়া দিতে ইহার গভীর রেখা। মাথার পসরাখানি, মাথায় লইয়া চলিতে হইবে সমুখে চরণ টানি। এ-জীবনে কেউ দোসর হবে না, নিবে না করিয়া ভাগ, এই বুক ভরি জমায়েছি যত তীব্র বিষের দাগ। তবু বলি সখা। কেন কাঁদি আমি, তোমারে দেখিয়া মোর, কেন বয়ে যায় শাঙনের ধারা ভাঙিয়া নয়ন দোর। আমি কাঁদি সখা, তুমি কেন হেথা মানুষ হইয়া এলে- বিধির গড়া ত সবই পাওয়া যায়, মানুষের নাহি মেলে। আকাশ গড়েছে শ্যাম-ঘন-নীল, দুধের নবনী মেঘে- সন্ধ্যা সকাল প্রতিদিন যায় নব নব রুপ মেখে; যত দুরে যাই তত দুরে পাই, কেউ নাহি করে মানা, কেউ নাহি পারে কাড়িয়া লইতে মাথার আকাশখানা। বিধাতা গড়েছে সুন্দর ধরা, কাননে কুসুম-কলি, কোলে কোলে তার পাখি গাহে গান, গুঞ্জরে মধু অলি। বাতাস চলেছে ফুল কুড়াইয়া পাখায় জড়ায়ে ঘ্রাণ- যারে পায় তারে বিলাইয়া যায় ফুল-সখীদের দান। তটিনী চলেছে গাহি- তার জলে আজ সম-অধিকার, কারো কোন ব্যধা নাহি। শুধু মানুষের পায়না মানুষ, নাহি কারো অধিকার, মানুষ সবারে পাইল এভাবে। মানুষ হল না কার। কেন তুমি সখা। মানুষ হইলে, অতটুকু দেহ ভরি, বিশ্ব-জোড়া এ রুপ-পিপাসারে কেন রাখিয়াছ ধরি। আমি কাঁদি সখা। কেন তুমি নাহি আকাশের মত হলে- যেখানে যেতাম তোমারে পেতাম.দেখিতাম নানা ছলে। আকাশের তলে ঘর যারা বাঁধিয়াছে তাদের তৃষ্ণা অমনি বিপুলতর। তুমি কেন সখা। কানন হলে না, ফুলের সোহাগ পরি- রঙিন তোমার দেহ-নীপখানি পুলকে উঠিত ভরি। বাউল বাতাসে ভাসিয়া যেতাম তোমার ফুলের বনে, অনন্ত-তুষ্ণা মিটায়ে দিতাম অনন্ত-পাওয়া সনে। কেন তুমি সখা। মানুষ হইলে। সীমারে বরণ করি- অসীম ক্ষুধারে সীমার বেড়ার বাহিরে রেখেছ ধরি। তুমি কেন সখা! এমন হলে না-যত দুরে যাইতাম আকাশের মত যত দুরে চাহি তোমারেই পাইতাম। আমি অনন্ত, আমি যে অসীম, অনন্ত মোর ক্ষুধা- বিপুল এ-দেশে ভাসিয়েছ তুমি একটু সীমার সুধা। হায় রে মানুষ হায়। কেমন করিয়া পাব তারে, যারে ধরা ছোঁয়া নাহি যায়। আমি কাঁদি কেন সুন্দর সখা।তোমারে বলিব খুলি। এই বেদনায়, কেন তুমি এলে মানুষ হইয়া ভুলি? যে মানুষ এই ধরারে দেখিছে নীতির চশমা পরি, যার যাহা পায় তাই লয় সে যে পালায় ওজন করি। জগৎ জুড়িয়া পাতিয়াছে যারা মনুসংসিতা বই- আমি কাঁদি সখা! আর কিছু নও তুমি সে মানুষ বই। জগতের মজা ভারি- চোখ বেঁধে যারা ধরারে দেখিল তাহাদেরি নাম জারি। বাহিরে হাসিছে নীতির জগৎ, তাহার আড়ালে বসি, কাঁদে উভরায় উলঙ্গ নর পরি শাসনের রসি। সে বলে যে আমি না ভাল মন্দ, আমি নর-নারায়ণ, মহা-শক্তিরে বাঁধিয়া রেখেছে সংস্কার বন্ধন। আমি কাঁদি সখা। আমার মাঝারে আছে সে আমার আমি, মোর সুখে-দুখে মন্দ-ভালোয় সুনাম-কুনামে নামী ; এ-জগতে কেউ চাহিল না তারে ; এ-মোর পসরাখানি, যারে দিতে যাই, সেই ফিরে চায় হেলায় নয়ন টানি। জগতের হাটে তাই সে মোর আমারে খন্ড করিয়া দোকানে বিকায়ে যাই। কেউ হাসি চায়, কেউ ভালবাসা, কেউ চায় মিঠে-কথা, কেউ নিতে চায় নয়নের জল কেউ চায় এর ব্যথা। শস্যের ক্ষেতে একেলা কৃষাণ বীজ ছড়াইয়া যাই- কোথা পাপ কোথা পুণ্য ছড়ানু, কোন কিছু মনে নাই। আমি কাঁদি সখা। হাটে-বেচা সেই খন্ড আমারে লয়ে, যারে ভালবাসি-তাহার পূজায় কেমনে আনিব বয়ে। হায় হায় সখা। তুমি কেন হলে হাটের দোকানদার- খন্ড করিয়া চাহ যারে তুমি পূর্ণ চাহনা তার? সব কথা মোর শুনে সে কেবল কহিল একটু হাসি- “মোর যত কথা কব একদিন, আজকের মত আসি?” পায়ে পায়ে পায়ে যতদুর গেল, নিমেষ রহিনু চেয়ে ; সন্ধ্যা-তিমিরে কলস ডুবাল সাঁঝের রঙিন মেয়ে। শূন্য চরের মাতাল বাতাস রাতের কুহেলি-কেশ নাড়িয়া নাড়িয়া হয়রাণ হয়ে ফিরিল ঊষার দেশ। কত দিন গেল, কত রাত এলো ঋতুর বসন পরি, চলে কাল-নটী বরণে বরণে বরষের পথ ধরি। আজো বসে আছি এই বালুচরে, দুহাত বাড়ায়ে ডাকি কাল যে আসিল এই বালুচরে, আর সে আসিবে নাকি?
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা নিশিতে যাইও ফুলবনে। জ্বালায়ে চান্দের বাতি আমি জেগে রব সারা রাতি গো; কব কথা শিশিরের সনে রে ভোমরা! নিশিতে যাইও ফুলবনে। যদিবা ঘুমায়ে পড়ি- স্বপনের পথ ধরি গো, যেও তুমি নীরব চরণে রে ভোমরা! (আমার ডাল যেন ভাঙে না, আমার ফুল যেন ভাঙে না, ফুলের ঘুম যেন ভাঙে না)। যেও তুমি নীরব চরণে রে ভোমরা! নিশিতে যাইও ফুলবনে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
তেরো বিদ্যাশেতে রইলা মোর বন্ধুরে | বিধি যদি দিত পাখা, উইড়া যাইয়া দিতাম দেখা ; আমি উইড়া পড়তাম সোনা বন্ধুর দেশেরে | আমরা ত অবলা নারী, তরুতলে বাসা বান্ধিরে ; আমার বদন চুয়ায়া পড়ে ঘামরে | বন্ধুর বাড়ী গঙ্গার পার গেলে না আসিবা আর ; আমার না জান বন্ধু, না জানে সাঁতাররে | বন্ধু যদি আমার হও উইড়া আইসা দেখা দাও তুমি দাও দেখা জুড়াক পরাণরে | . — রাখালী গান একটি বছর হইয়াছে সেই রূপাই গিয়াছে চলি, দিনে দিনে নব আশা লয়ে সাজুরে গিয়াছে ছলি | কাইজায় যারা গিয়াছিল গাঁয়, তারা ফিরিয়াছে বাড়ী, শহরের জজ, মামলা হইতে সবারে দিয়াছে ছাড়ি | স্বামীর বাড়ীতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে, তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে | একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত, প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত | ও-গাঁয়ে রূপার ভাঙা ঘরখানি মেঘ ও বাতাসে হায়, খুঁটি ভেঙে আজ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে পথের গায় | প্রতি পলে পলে খসিয়া পড়িছে তাহার চালের ছানি, তারও চেয়ে আজি জীর্ণ শীর্ণ সাজুর হৃদয়খানি | রাত দিন দুটি ভাই বোন যেন দুখেরই বাজায় বীণ | কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ, কি করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান! কেন বিধি তারে এত দুখ দিল, কেন, কেন, হায় কেন, মনের-মতন কাঁদায় তাহারে “পথের কাঙালী” হেন ? সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে, সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা, দুখের সাগরে ভাসিছে তেমনি সাজুর হৃদয়খানা | কোন্ জালুয়ার মাছ সে খেয়েছে নাহি দিয়ে তায় কড়ি, তারি অভিশাপ ফিরেছে কি তার সকল পরাণ ভরি ! কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিঁড়েছিল নিজ হাতে, তাহারি ছোঁয়া কি লাগিয়াছে আজ তার জীবনের পাতে ! তোর দেশে বুঝি দয়া মায়া নাই, হা-রে নিদারুণ বিধি কোন্ প্রাণে তুই কেড়ে নিয়ে গেলি তার আঁচলের নিধি | নয়ন হইতে উড়ে গেছে হায় তার নয়নের তোতা, যে ব্যাথারে সাজু বহিতে পারে না, আজ তা রাখিবে কোথা ? এমনি করিয়া কাঁদিয়া সাজুর সারাটি দিবস কাটে, আমেনে কভু একা চেয়ে রয় দীঘল গাঁয়ের বাটে | কাঁদিয়া কাঁদিয়া সকাল যে কাটে—দুপুর কাটিয়া যায়, সন্ধ্যার কোলে দীপ নিবু-নিবু সোনালী মেঘের নায়ে | তবু ত আসে না ! বুকখানি সাজু নখে নখে আজ ধরে, পারে যদি তবে ছিঁড়িয়া ফেলায় সন্ধ্যার কাল গোরে | মেয়ের এমন দশা দেখে মার সুখ নাই কোন মনে, রূপারে তোমরা দেখেছ কি কেউ, শুধায় সে জনে জনে | গাঁয়ের সবাই অন্ধ হয়েছে, এত লোক হাটে যায়, কোন দিন কিগো রূপাই তাদের চক্ষে পড়ে নি হায় ! খুব ভাল করে খোঁজে যেন তারে, বুড়ী ভাবে মনে মনে, রূপাই কোথাও পলাইয়া আছে হয়ত হাটের কোণে | ভাদ্র মাসেতে পাটের বেপারে কেউ কেউ যায় গাঁরষ নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার | জনে জনে বুড়ী বলে দেয়, “দেখ, যখন যখানে যাও, রূপার তোমরা তালাস লইও, খোদার কছম খাও |” বর্ষার শেষে আনন্দে তারা ফিরে আসে নায়ে নায়ে, বুড়ী ডেকে কয়, “রূপারে তোমরা দেখ নাই কোন গাঁয়ে !” বুড়ীর কথার উত্তর দিতে তারা নাহি পায় ভাষা, কি করিয়া কহে, আর আসিবে না যে পাখি ছেড়েছে বাসা | চৈত্র মাসেতে পশ্চিম হতে জন খাটিবার তরে, মাথাল মাথায় বিদেশী চাষীরা সারা গাঁও ফেলে ভরে | সাজুর মায়ে যে ডাকিয়া তাদের বসায় বাড়ির কাছে, তামাক খাইতে হুঁকো এনে দ্যায়, জিজ্ঞাসা করে পাছে ; “তোমরা কি কেউ রূপাই বলিয়া দেখেছ কোথাও কারে, নিটল তাহার গঠন গাঠন, কথা কয় ভারে ভারে |” এমনি করিয়া বলে বুড়ী কথা, তাহারা চাহিয়া রয়,— রুপারে যে তারা দেখে নাই কোথা, কেমন করিয়া কয় ! যে গাছ ভেঙেছে ঝড়িয়া বাতাসে কেমন করিয়া হায়, তারি ডালগুলো ভেঙে যাবে তারা কঠোর কুঠার-ঘায় ? কেউ কেউ বলে, “তাহারি মতন দেখেছিন একজনে, আমাদের সেই ছোট গাঁয় পথে চলে যেতে আনমনে |” “আচ্ছা তাহারে সুধাও নি কেহ, কখন আসিবে বাড়ী, পরদেশে সে যে কোম্ প্রাণে রয় আমার সাজুরে ছাড়ি ?” গাঙে-পড়া-লোক যেমন করে তৃণটি আঁকড়ি ধরে, তেমনি করিয়া চেয়ে রয় বুড়ী তাদের মুখের পরে | মিথ্যা করেই তারা বলে, “সে যে আসিবে ভাদ্র মাসে, খবর দিয়েছে, বুড়ী যেন আর কাঁদে না তাহার আশে |” এত যে বেদনা তবু তারি মাঝে একটু আশার কথা, মুহুর্তে যেন মুছাইয়া দেয় কত বরষের ব্যথা | মেয়েরে ডাকিয়া বার বার কহে, “ভাবিস না মাগো আর, বিদেশী চাষীরা কয়ে গেল মোর—খবর পেয়েছে তার |” মেয়ে শুধু দুটি ভাষা-ভরা আঁখি ফিরাল মায়ের পানে ; কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে | গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস, বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস | আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা, ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা | আজকে কত না কথা লয়ে যেন বাজিছে বুকের বীনে, সেই যে প্রথম দেখিল রূপারে বদনা-বিয়ের দিনে | তারপর সেই হাট-ফেরা পথে তারে দেখিবার তরে, ছল করে সাজু দাঁড়ায়ে থাকিত গাঁয়ের পথের পরে | নানা ছুতো ধরি কত উপহার তারে যে দিত আনি, সেই সব কথা আজ তার মনে করিতেছে কানাকানি | সারা নদী ভরি জাল ফেলে জেলে যেমনি করিয়া টানে, কখন উঠায়, কখন নামায়, যত লয় তার প্রাণে ; তেমনি সে তার অতীতেরে আজি জালে জালে জড়াইয়া টানে, যদি কোন কথা আজিকার দিনে কয়ে যায় নব-মানে | আর যেন তার কোন কাজ নাই, অতীত আঁধার গাঙে, ডুবারুর মত ডুবিয়া ডুবিয়া মানক মুকুতা মাঙে | এতটুকু মান, এতটুকু স্নেহ, এতটুকু হাসি খেলা, তারি সাথে সাজু ভাসাইতে চায় কত না সুখের ভেলা ! হায় অভাগিনী ! সে ত নাহি জানে আগে যারা ছিল ফুল, তারাই আজিকে ভুজঙ্গ হয়ে দহিছে প্রাণের মূল | যে বাঁশী শুনিয়া ঘুমাইত সাজু, আজি তার কথা স্মরি, দহন নাগের গলা জড়াইয়া একা জাগে বিভাবরী | মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রূপার বিদায় বাণী— “মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি |” আরও মনে পড়ে, “দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই, সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই |” হায় হায় পতি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন ; সাজুর বেদনা সকলেই শোনে, শোনে না সে একজন | গাছের পাতারা ঝড়ে পরে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে, পাড়া প্রতিবেশী নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে | হায় রে বধির, তোর কানে আজ যায় না সাজুর কথা ; কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই বুক ভরা ব্যথা | হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূরের দেশে, আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে ! দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাই-এর লতা, পাতাগুলি তার উনিয়া পড়েছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা | হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলি বাকি, আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কতরূপ ফাঁকি | সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস, বলিতে বলিতে ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস | নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি, ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি | অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা, তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা | এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন সে একদিন, কৃষাণীর ঘরে আদরিনী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন | স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে, সিলাই করেছে সেজে ; গুন গুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে | সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই, সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই | খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রূপার বিদায় ছবি, খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা, আঁকিল সে তার সবি | আঁকিল কাঁথায়—আলু থালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ-নারী, দেখিছে তাহার স্বামী তারে যায় জনমের মত ছাড়ি | আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে, বুকে কর হানি, কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে | এমনি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে, তার চেয়ে সাজু অসহ্য ব্যথা আপনার বুকে বহে | তারপর শেষে এমনি হইল, বেদনার ঘায়ে ঘায়ে, এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝরিয়া-বায়ে | কি যে দারুণ রোগেতে ধরিল, উঠিতে পারে না আর ; শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়ন-ধার | হায় অভাগীর একটি মানিক ! খোদা তুমি ফিরে চাও, এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও ! ফিরে চাও তুমি আল্লা রসুল ! রহমান তব নাম, দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম ! মেয়ে কয়, “মাগো ! তোমার বেদনা আমি সব জানি, তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি ! সোনা মা আমার ! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা, ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা ! একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূঁচ সুতা দাও হাতে, শেষ ছবি খানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে |” পাণ্ডুর হাতে সূঁচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে, আঁকিয়া আঁকিয়া আঁখিজল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে | কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি, তারি কাছে এক গেঁয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি ; রাত আন্ধার কবরের পাশে বসি বিরহী বেশে, অঝোরে বাজায় বাঁশের বাঁশীটি বুক যায় জলে ভেসে | মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বার বার করি, দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি | দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি, “সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি ; এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে, ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে ! সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল, জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল | হয়ত আমার কবরের ঘুম ভেঙে যাবে মাগো তাতে, হয়ত তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে | এ ব্যথা সে মাগো কেমনে সহিবে, বোলো তারে ভালো করে, তার আঁখি জল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে | মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই, আমি গেলে মোর কবরের গায়ে এরে মেলে দিও তাই ! মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে, জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে |” বলিতে বলিতে আর যে পারে না, জড়াইয়া আসে কথা, অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি দারুণ ব্যথা | কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়, “সাজু সাজু ! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয় ?” “আল্লা রসুল ! আল্লা রসুল !” বুড়ী বলে হাত তুলে, “দীন দুঃখীর শেষ কান্না এ, আজিকে যেয়ো না ভুলে !” দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে চায় আঁধার রাতের কালি, উতলা বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে যায়, সব খালি ! সব খালি !! “সোনা সাজুরে, মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে, তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একেলা ঘরে !” দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে, রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ার দাপে | ****************** জালুয়া = জেলে
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘেরআড়ে, কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে। কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়, ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়! বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়, সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়। কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া! হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি, নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি! চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে, না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে! কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, – হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি! দিকে দিগেনে- যতদূর চাহি, পাংশু মেঘেরজাল পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল। গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, – গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়! কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি, কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধেকসি কসি। কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল। মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীরসুরে, আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে। লাঠির উপরে, ফুলের উপরে আঁকা হইতেছে ফুল, কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল। তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে- আমীর সাধুর নাও, বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজগাঁও। ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হতে ওর হাতে, নানান রকম রসি বুনানও হইতেছে তার সাথে। বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে, এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে! যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষীরা, আর ওই রূপ-কথা, বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্প-লতা। বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি, সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছেবসি। কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি, তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি। বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে, মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে। আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে, বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।
জসীম উদ্‌দীন
রূপক
বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে বালুর চরে, কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া গাঁয়ের ঘরে। কোমল তৃণের পরশ লাগিয়া, পায়ের নুপুর পড়িয়াছে খসিয়া। চলিতে চরণ ওঠে না বাজিয়া তেমন করে। কোথায় খেলার সাথীরা আমার কোথায় ধেনু, সাঝেঁর হিয়ায় রাঙিয়া উঠিছে গোখুর-রেণু। ফোটা সরিষার পাঁপড়ির ভরে চরো মাঠখানি কাঁপে থরে থরে। সাঁঝের শিশির দুচরণ ধরে কাঁদিয়া ঝরে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
মধুমতী নদী দিয়া, বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে কূলে ঢেউ আছাড়িয়া। জলের উপরে ভাসাইয়া তারা ঘরবাড়ি সংসার, নিজেরাও আজ ভাসিয়া চলেছে সঙ্গ লইয়া তার। মাটির ছেলেরা অভিমান করে ছাড়িয়া মায়ের কোল, নাম-হীন কত নদী-তরঙ্গে ফিরিছে খাইয়া দোল। দুপাশে বাড়ায়ে বাঁকা তট-বাহু সাথে সাথে মাটি ধায়, চঞ্চল ছেলে আজিও তাহারে ধরা নাহি দিল হায়। কত বন পথ সুশীতল ছায়া ফুল-ফল-ভরা গ্রাম, শস্যের খেত আলপনা আঁকি ডাকে তারে অবিরাম! কত ধল-দীঘি গাজনের হাট, রাঙা মাটি পথে ওড়ে, কারো মোহে ওরা ফিরিয়া এলো না আবার মাটির ঘরে। জলের উপরে ভাসায়ে উহারা ডিঙ্গী নায়ের পাড়া, নদীতে নদীতে ঘুরিছে ফিরিছে সীমাহীন গতিধারা। তারি সাথে সাথে ভাসিয়া চলেছে প্রেম ভালবাসা মায়া, চলেছে ভাসিয়া সোহাগ, আদর ধরিয়া ওদের ছায়া। জলের উপরে ভাসাইয়া তারা ঘরবাড়ি সংসার, ত্যাগের মহিমা, পুন্যের জয় সঙ্গে চলেছে তার। সামনের নায়ে বউটি দাঁড়ায়ে হাল ঘুরাইছে জোরে, রঙিন পালের বাদাম তাহার বাতাসে গিয়াছে ভরে। ছই এর নীচে স্বামী বসে বসে লাঠিতে তুলিছে ফুল, মুখেতে আসিয়া উড়িছে তাহার মাথায় বাবরী চুল। ও নায়ের মাঝে বউটিরে ধরে মারিতেছে তার পতি, পাশের নায়েতে তাস খেলাইতেছে সুখে দুই দম্পতি। এ নায়ে বেঁধেছে কুরুক্ষেত্র বউ-শাশুড়ীর রণে, ও নায়ে স্বামীটি কানে কানে কথা কহিছে জায়ার সনে! ডাক ডাকিতেছে, ঘুঘু ডাকিতেছে, কোড়া করিতেছে রব, হাট যেন জলে ভাসিয়া চলেছে মিলি কোলাহল সব। জলের উপরে কেবা একখানা নতুন জগৎ গড়ে, টানিয়া ফিরিছে যেথায় সেথায় মনের খুশীর ভরে। কোন কোন নায়ে রোদে শুখাইছে ছেঁড়া কাঁথা কয়খানা, আর কোন নায়ে শাড়ী উড়িতেছে বরণ দোলায়ে নানা। ও নাও হইতে শুটকি মাছের গন্ধ আসিছে ভাসি, এ নায়ের বধূ সুন্দা ও মেথি বাঁটিতেছে হাসি হাসি। কোনখানে ওরা সি’র নাহি রহে জ্বালাতে সন্ধ্যাদীপ, একঘাট হতে আর ঘাটে যেয়ে দোলায় সোনার টীপ। এদের গাঁয়ের কোন নাম নাই, চারি সীমা নাহি তার, উপরে আকাশ, নীচে জলধারা, শেষ নাহি কোথা কার। পড়শী ওদের সূর্য, তারকা, গ্রহ ও চন্দ্র আদি, তাহাদের সাথে ভাব করে ওরা চলিয়াছে দল বাঁধি, জলের হাঙর-জলের কুমীর- জলের মাছের সনে, রাতের বেলায় ঘুমায় উহারা ডিঙ্গী-নায়ের কোণে। বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে মধুমতী নদী দিয়া, বেলোয়ারী চুড়ি, রঙিন খেলনা, চিনের সিদুর নিয়া। ময়ূরের পাখা, ঝিনুকের মতি, নানান পুতিঁর মালা, তরীতে তরীতে সাজান রয়েছে ভরিয়া বেদের ডালা। নায়ে নায়ে ডাকে মোরগ-মুরগী যত পাখি পোষ-মানা, শিকারী কুকুর রহিয়াছে বাঁধা আর ছাগলের ছানা। এ নায়ে কাঁদিছে শিশু মার কোলে- এ নায়ে চালার তলে, গুটি তিনচার ছেলেমেয়ে মিলি খেলা করে কৌতুহলে। বেদের বহর ভাসিয়া চলেছে, ছেলেরা দাঁড়ায়ে তীরে, অবাক হইয়া চাহিয়া দেখিছে জলের এ ধরণীরে! হাত বাড়াইয়া কেহ বা ডাকিছে- কেহ বা ছড়ার সুরে, দুইখানি তীর মুখর করিয়া নাচিতেছে ঘুরে ঘুরে। চলিল বেদের নাও, কাজল কুঠির বন্দর ছাড়ি ধরিল উজানী গাঁও। গোদাগাড়ী তারা পারাইয়া গেল, পারাইল বউঘাটা, লোহাজুড়ি গাঁও দক্ষিণে ফেলি আসিল দরমাহাটা। তারপর আসি নাও লাগাইল উড়ানখালির চরে, রাতের আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে তখন মাথার পরে। ধীরে অতি ধীরে প্রতি নাও হতে নিবিল প্রদীপগুলি, মৃদু হতে আরো মৃদুতর হল কোলাহল ঘুমে ঢুলি! কাঁচা বয়সের বেদে-বেদেনীর ফিস ফিস কথা কওয়া, এ নায়ে ওনায়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া শুনিছে রাতের হাওয়া। তাহাও এখন থামিয়া গিয়াছে, চাঁদের কলসী ভরে, জোছনার জল গড়ায়ে পড়িছে সকল ধরণী পরে। আকাশের পটে এখানে সেখানে আবছা মেঘের রাশি, চাঁদের আলোরে মাজিয়া মাজিয়া চলেছে বাতাসে ভাসি। দূর গাঁও হতে রহিয়া রহিয়া ডাকে পিউ, পিউ কাঁহা, যোজন যোজন আকাশ ধরায় রচিয়া সুরের রাহা। এমন সময় বেদে-নাও হতে বাজিয়া বাঁশের বাঁশী, সারা বালুচরে গড়াগড়ি দিয়ে বাতাসে চলিল ভাসি, কতক তাহার নদীতে লুটাল, কতক বাতাস বেয়ে, জোছনার রথে সোয়ার হইয়া মেঘেতে লাগিল যেয়ে। সেই সুর যেন সারে জাহানের দুঃসহ ব্যথা-ভার, খোদার আরশ কুরছি ধরিয়া কেঁদে ফেরে বারবার।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
পাঁচ লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন — ময়মনসিংহ গীতিকা আশ্বিনেতে ঝড় হাঁকিল, বাও ডাকিল জোরে, গ্রামভরা-ভর ছুটল ঝপট লট্ পটা সব করে | রূপার বাড়ির রুশাই-ঘরের ছুটল চালের ছানি, গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি | ওগাঁর বাঁশ দশটা টাকায়, সে-গাঁয় টাকায় তেরো, মধ্যে আছে জলীর বিল কিইবা তাহে গেরো | বাঁশ কাটিতে চলল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া, দুপুর বেলায় খায় যেন সে—মায় দিয়াছে কিরা | মাজায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্ চকাচক্ ধার, কাঁধে রঙিন গামছাখানি দুলছে যেন হার | মোল্লা-বাড়ির বাঁশ ভাল, তার ফাঁপগুলি নয় বড় ; খাঁ-বাড়ির বাঁশ ঢোলা ঢোলা, করছে কড়মড় | সর্ব্বশেষে পছন্দ হয় খাঁ-বাড়ির বাঁশ : ফাঁপগুলি তার কাঠের মত, চেকন-চোকন আঁশ | বাঁশ কাটিতে যেয়ে রূপাই মারল বাঁশে দা, তল দিয়ে যায় কাদের মেয়ে—হলদে পাখির ছা! বাঁশ কাটিতে বাঁশের আগায় লাগল বাঁশের বাড়ি, চাষী মেয়ের দেখে তার প্রাণ বুঝি যায় ছাড়ি | লম্বা বাঁশের লম্বা যে ফাঁপ, আগায় বসে টিয়া, চাষীদের ওই সোনার মেয়ে কে করিবে বিয়া! বাঁশ কাটিতে এসে রূপাই কাটল বুকের চাম, বাঁশের গায়ে বসে রূপাই ভুলল নিজের কাম | ওই মেয়ে ত তাদের গ্রামে বদনা-বিয়ের গানে, নিয়েছিল প্রাণ কেড়ে তার চিকন সুরের দানে | “খড়ি কুড়াও সোনার মেয়ে! শুকনো গাছের ডাল, শুকনো আমার প্রাণ নিয়ে যাও, দিও আখার জ্বাল | শুকনো খড়ি কুড়াও মেয়ে! কোমল হাতে লাগে, তোমায় যারা পাঠায় বনে বোঝেনি কেন আগে?” এমনিতর কত কথাই উঠে রূপার মনে, লজ্জাতে সে হয় যে রঙিন পাছে বা কেউ শোনে | মেয়েটিও ডাগর চোখে চেয়ে তাহার পানে, কি কথা সে ভাবল মনে সেই জানে তার মানে! এমন সময় পিছন হতে তাহার মায়ে ডাকে, “ওলো সাজু! আয় দেখি তোর নথ বেঁধে দেই নাকে! ওমা! ও কে বেগান মানুষ বসে বাঁশের ঝাড়ে!” মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানি দেখছে বারে বারে | খানিক পরে ঘোমটা খুলে হাসিয়া এক গাল, বলল, “ও কে, রূপাই নাকি? বাঁচবি বহকাল! আমি যে তোর হইযে খালা, জানিসনে তুই বুঝি? মোল্লা বাড়ির বড়ুরে তোর মার কাছে নিস্ খুঁজি | তোর মা আমার খেলার দোসর—যাকগে ও সব কথা, এই দুপুরে বাঁশ কাটিয়া খাবি এখন কোথা?” রূপাই বলে, “মা দিয়েছেন কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া” “ওমা! ও তুই বলিস কিরে? মুখখানা তোর ফিরা! আমি হেথা থাকতে খালা, তুই থাকবি ভুখে, শুনলে পরে তোর মা মোরে দুষবে কত রুখে! ও সাজু, তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি, ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি |” চলল সাজু বাড়ির দিকে, মা গেল ওই পাড়া | বাঁশ কাটতে রূপাই এদিক মারল বাঁশে নাড়া | বাঁশ কাটিতে রূপার বুকে ফেটে বেরোয় গান, নলী বাঁশের বাঁশীতে কে মারছে যেন টান! বেছে বেছে কাটল রূপাই ওড়া-বাঁশের গোড়া, তল্লা বাঁশের কাটল আগা, কালধোয়ানির জোড়া ; বাল্ কে কাটে আল্ কে কাটে কঞ্চি কাটে শত, ওদিক বসে রূপার খালা রান্ধে মনের মত | সাজু ডাকে তলা থেকে, “রূপা-ভাইগো এসো,” —এই কথাটি বলতে তাহার লজ্জারো নাই শেষও! লাজের ভারে হয়তো মেয়ে যেতেই পারে পড়ে, রূপাই ভাবে হাত দুখানি হঠাৎ যেয়ে ধরে | যাহোক রূপা বাঁশ কাটিয়া এল খালার বাড়ি, বসতে তারে দিলেন খালা শীতল পাটি পাড়ি | বদনা ভরে জল দিল আর খড়ম দিল মেলে, পাও দুখানি ধুয়ে রূপাই বসল বামে হেলে | খেতে খেতে রূপাই কেবল খালার তারীফ করে, “অনেক দিনই এমন ছালুন খাইনি কারো ঘরে |” খালায় বলে “আমি ত নয়, রেঁধেছে তোর বোনে,” লাজে সাজুর ইচ্ছা করে লুকায় আঁচল কোণে | এমনি নানা কথায় রূপার আহার হল সারা, সন্ধ্যা বেলায় চলল ঘরে মাথায় বাঁশের ভারা | খালার বাড়ির এত খাওয়া, তবুও তার মুখ, দেখলে মনে হয় যে সেথা অনেক লেখা দুখ | ঘরে যখন ফিরল রূপা লাগল তাহার মনে, কি যেন তার হয়েছে আজ বাঁশ কাটিতে বনে | মা বলিল, “বাছারে, কেন মলিন মুখে চাও?” রূপাই কহে, “বাঁশ কাটিতে হারিয়ে এলেম দাও |” ***** খাম = থাম গেরো = বাধা খড়ি = জ্বালানি কাঠ বেগান = পর খালা = মাসী ছালুন = তরকারি দাও = দা
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
ও বাজান, চল, যাই চল মাঠে লাঙল বাইতে, গরুর কাঁধে লাঙল দিয়া ঠেলতে ঠেলতে ঠেলতে। মোরা লাঙল খুঁড়ে ফসল আনি পাতাল পাথার হইতে, সব দুনিয়ার আহার জোগাই সেই না ফসল হইতে, আর আমরা কেন খাইতে না পাই পারো কি কেউ কইতে। বউ দিয়াছে গলায় দড়ি সাতদিন না খাইতে, ভুখের জ্বালা সইতে, কবরখানায় রইতে; এবার লাঙর দিয়ে খুঁড়ি মাটি তারি দেখা পাইতে। মোরা, মাঠ চিরি ভাই! লাঙল দিয়ে, মোদের বুক চেরা তার চাইতে, মাঠ চিরিলে ফসল ফলে, ও ফসল ফলে না বুক হইতে। এবার মাটি খুঁড়বরে ভাই, ফসল নাহি পাইতে, ও মাটি খুঁড়ে দেখব আর কতদূর কবরখানায় যাইতে।
জসীম উদ্‌দীন
শোকমূলক
শেষ রাত্রের পান্ডুর চাঁদ নামিছে চক্রবালে, রজনী গন্ধা রূপসীর আঁখি জড়াইছে ঘুম-জালে। অলস চরণে চলিতে চলিতে ঢলিয়া ঢলিয়া পড়ে, শিথিল শ্রানি- চুমিছে তাহার সারাটি অঙ্গ ধরে! উতল কেশেরে খেলা দিতে শেষ উতল রাতের বায়ু: ঘুমাতে ঘুমাতে কাঁপিয়া উঠিছে স্মরিয়া রাতের আয়ু। রজনী- গন্ধা রাতের রূপসী ঝুমিছে শ্রানি-ভরে, অঙ্গ হইতে ঝরিছে কুসুম একটি একটি করে। শিয়রে চাঁদের দীপটি ঝুমিয়া হইয়া আসিছে ম্লান, রাত-বিহগীর কন্ঠে এখন মৃদু হোয়ে এল গান। পূর্ব তোরণে আসিছে রুপসী রঙিন উষসী-বালা, হসে- লইয়া রাঙা দিবসের অফুট কুসুম-ডালা। রজনী-গন্ধা ঘুমায় আলসে শিথিল দেহটি তার, লুটাইয়া পড়ে বৃন্তশয়নে স্বপন নদীর পার। ভুবন ভোলানো মরি মরি ঘুম- অপরূপ, অপরূপ! বিধাতা বুঝিবা ধ্যান করিতেছে যুগ যুগ রহি চুপ! এ রূপ মহিমা সহিতে পারে না ভোরের রূপসী ঊষা; রজনী ফুলের অঙ্গ হইতে হরিয়া লইছে ভূষা! শাড়ীতে তাহার তারা ফুলগুলি দলিয়া পিষিছে পায়ে, ভেঙেছে রাতের পাখির বাঁশরী উদাস বনের বায়ে! শিয়রে চাঁদের মণি দীপ-খানি থাপড়ে নিবায়ে দিল, অঙ্গ হইতে শিশির ফোঁটার গহনা কাড়িয়া নিল। থামিল বনের ঝিঁঝির কন্ঠে ঘুম পাড়ানিয়া সুর, জোনাকী পরীরা দীপগুলি লয়ে চলিল গহনা-পুর। মৃত আত্মারা কবরে লুকাল, মহা রহস্য তার, আঁচলে জড়ায়ে ধীরে ধীরে ধীরে রজনী রুধিল দ্বার। চারিদিকে নব আলোকের জয় ; চিরপরিচিত সব, মহা-কোলাহলে আরম্ভ হলো দিনের মহোৎসব। এখন শুধুই লোক জানাজানি মুখ চেনাচিনি আর, দেনা-পাওনার হিসাব করিয়া ‘বানিয়া খুলিল দ্বার। কোথায় ঘুমাল রজনী-গন্ধা কিবা রহস্য-জাল, সারারাতি তারে জড়াইয়াছিল ? কে শোনে সে জঞ্জাল। রাতের রজনী-গন্ধা ঘুমায়, চির বিস্মৃতি-পুরে- তবু রয়ে রয়ে কি করণ বাঁশী বেজে ওঠে বহুদুরে।
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ, মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ। চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া, ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া। তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে, চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে। ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও। মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও। গইজদ্দীন গরু ছেড়ে দিয়ে খাওয়ায়েছে মোর ধান, ইচ্ছা করিছে থাপপড় মারি, ধরি তার দুটো কান। তবু তার পাশে বসিয়া নামাজ পড়িতে আজিকে হবে, আল্লার ঘরে ছোটোখাটো কথা কেবা মনে রাখে কবে! মৈজদ্দীন মামলায় মোরে করিয়াছে ছারেখার, টুটি টিপে তারে মারিতাম পেলে পথে কভু দেখা তার। আজকে জামাতে নির্ভয়ে সে যে বসিবে আমার পাশে, তাহারো ভালর তরে মোনাজাত করিব যে উচ্ছাসে। মাহে রমজান আসিয়াছে বাঁকা রোজার চাঁদের ন্যায়, কাইজা ফেসাদ সব ভুলে যাব আজি তার মহিমায়। ভুমুরদি কোথা, কাছা ছাল্লাম আম্বিয়া পুঁথি খুলে, মোর রসুলের কাহিনী তাহার কন্ঠে উঠুক দুলে। মেরহাজে সেই চলেছেন নবী, জুমজুমে করি স্নান, অঙ্গে পরেছে জোছনা নিছনি আদমের পিরহান। নুহু আলায়হুছালামের টুপী পরেছেন নবী শিরে, ইবরাহিমের জরির পাগরী রহিয়াছে তাহা ঘিরে। হাতে বাঁধা তার কোরান-তাবিজ জৈতুন হার গলে, শত রবিশশী একত্র হয়ে উঠিয়াছে যেন জ্বলে। বুরহাকে চড়ে চলেছেন নবী কন্ঠে কলেমা পড়ি, দুগ্ধধবল দূর আকাশের ছায়াপথ রেখা ধরি। আদম ছুরাত বামধারে ফেলি চলে নবী দূরপানে, গ্রহ-তারকার লেখারেখাহীন ছায়া মায়া আসমানে। তারপর সেই চৌঠা আকাশ, সেইখানে খাড়া হয়ে, মোনাজাত করে আখেরী নবীজী দুহাত উর্ধ্বে লয়ে। এই যে কাহিনী শুনিতে শুনিতে মোল্লা বাড়ির ঘরে, মহিমায় ঘেরা অতীত দিনেরে টানিয়া আনিব ধরে। বচন মোল্লা কোথায় আজিকে সরু সুরে পুঁথি পড়ি, মোর রসুলের ওফাত কাহিনী দিক সে বয়ান করি। বিমারের ঘোরে অস্থির নবী, তাঁহার বুকের পরে, আজরাল এসে আসন লভিল জান কবজের তরে। আধ অচেতন হজরত কহে, এসেছ দোস্ত মোর, বুঝিলাম আজ মোর জীবনের নিশি হয়ে গেছে ভোর একটুখানিক তবুও বিমল করিবারে হবে ভাই! এ জীবনে কোন ঋণ যদি থাকে শোধ করে তাহা যাই। *** *** মাটির ধরায় লুটায় নবীজী, ঘিরিয়া তাহার লাশ, মদিনার লোক থাপড়িয়া বুক করে সবে হাহুতাশ। আব্বাগো বলি, কাঁদে মা ফাতিমা লুটায়ে মাটির পরে, আকাশ ধরনী গলাগলি তার সঙ্গে রোদন করে। এক ক্রন্দন দেখেছি আমরা বেহেস্ত হতে হায়, হাওয়া ও আদম নির্বাসিত যে হয়েছিল ধরাছায়; যিশু-জননীর কাঁদন দেখেছি ভেসে-র পায়া ধরে, ক্রুশ বিদ্ধ সে ক্ষতবিক্ষত বেটার বেদন স্মরে। আরেক কাঁদন দেখেছি আমরা নির্বাসী হাজেরার, জমিনের পরে শেওলা জমেছে অশ্রু ধারায় তার; সবার কাঁদন একত্রে কেউ পারে যদি মিশাবার, ফাতিমা মায়ের কাঁদনের সাথে তুলনা মেলে না তার। আসমান যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল তাহার মাথায় হায়, আব্বা বলিতে আদরিয়া কেবা ডাকিয়া লইবে তায়। গলেতে সোনার হারটি দেখিয়া কে বলিবে ডেকে আর, নবীর কনের কন্ঠে মাতাগো এটি নহে শোভাদার। সেই বাপজান জনমের মত গিয়াছে তাহার ছাড়ি। কোন সে সুদূর গহন আঁধার মরণ নদীর পাড়ি। জজিরাতুল সে আরবের রাজা, কিসের অভাব তার, তবু ভুখা আছে চার পাঁচদিন, মুছাফির এলো দ্বার। কি তাহারে দিবে খাইবারে নবী, ফাতেমার দ্বারে এসে; চারিটি খোরমা ধার দিবে মাগো কহে এসে দীন বেশে। সে মাহভিখারী জনমের মত ছাড়িয়া গিয়াছে তায়, আব্বাগো বলি এত ডাক ডাকে উত্তর নাহি হায়। এলাইয়া বেশ লুটাইয়া কেশ মরুর ধূলোর পরে, কাঁদে মা ফাতেমা, কাঁদনে তাহার খোদার আরশ নড়ে। কাঁদনে তাহার ছদন সেখের বয়ান ভিজিয়া যায়, গৈজদ্দীন পিতৃ-বিয়োগ পুন যেন উথলায়! খৈমুদ্দীন মামলায় যারে করে ছিল ছারেখার, সে কাঁদিছে আজ ফাতিমার শোকে গলাটি ধরিয়া তার। মোল্লাবাড়ির দলিজায় আজি সুরা ইয়াসিন পড়ি, কোন দরবেশ সুদূর আরবে এনেছে হেথায় ধরি। হনু তনু ছমু কমুরে আজিকে লাগিছে নূতন হেন, আবুবক্কর ওমর তারেখ ওরাই এসেছে যেন। সকলে আসিয়া জামাতে দাঁড়াল, কন্ঠে কালাম পড়ি, হয়ত নবীজী দাঁড়াল পিছনে ওদেরি কাতার ধরি। ওদের মাথার শত তালী দেওয়া ময়লা টুপীর পরে, দাঁড়াইল খোদা আরশ কুরছি ক্ষনেক ত্যাজ্য করে। *** মোল্লাবাড়িতে তারাবি নামাজ হয় না এখন আর, বুড়ো মোল্লাজি কবে মারা গেছে, সকলই অন্ধকার। ছেলেরা তাহার সুদূর শহরে বড় বড় কাজ করে, বড় বড় কাজে বড় বড় নাম খেতাবে পকেট ভরে। সুদূর গাঁয়ের কি বা ধারে ধার, তারাবি জামাতে হায়, মোমের বাতিটি জ্বলিত, তাহা যে নিবেছে অবহেলায়। বচন মোল্লা যক্ষ্মা রোগেতে যুঝিয়া বছর চার, বিনা ঔষধে চিকিৎসাহীন নিবেছে জীবন তার। গভীর রাত্রে ঝাউবনে নাকি কন্ঠে রাখিয়া হায়, হোসেন শহিদ পুঁথিখানি সে যে সুর করে গেয়ে যায়। ভুমুরদি সেই অনাহারে থেকে লভিল শূলের ব্যথা, চীৎকার করি আছাড়ি পিছাড়ি ঘুরিতে যে যথা তথা। তারপর সেই অসহ্য জ্বালা সহিতে না পেরে হায়, গলে দড়ি দিয়ে পেয়েছে শানি- আম্রগাছের ছায়। কাছা ছাল্লাম পুঁথিখানি আজো রয়েছে রেহেল পরে, ইদুরে তাহার পাতাগুলি হায় কেটেছে আধেক করে। লঙ্কর আজ বৃদ্ধ হয়েছে, চলে লাঠিভর দিয়ে, হনু তনু তারা ঘুমায়েছে গায়ে গোরের কাফন নিয়ে। সারা গ্রামখানি থম থম করে স্তব্ধ নিরালা রাতে; বনের পাখিরা আছাড়িয়া কাঁদে উতলা বায়ুর সাথে। কিসে কি হইল, কি পাইয়া হায় কি আমরা হারালাম, তারি আফসোস শিহরি শিহরি কাঁপিতেছে সারা গ্রাম। ঝিঁঝিরা ডাকিছে সহস্র সুরে, এ মূক মাটির ব্যথা, জোনাকী আলোয় ছড়ায়ে চলিছে বন-পথে যথা তথা।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(বার)রূপাই গিয়াছে ‘কাইজা’ করিতে সেই ত সকাল বেলা, বউ সারাদিন পথ পানে চেয়ে, দেখেছে লোকার মেলা | কত লোক আসে কত লোক যায়, সে কেন আসে না আজ, তবে কি তাহার নসিব মন্দ, মাথায় ভাঙিবে বাজ! বালাই, বালাই, ওই যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া, আসিছে লোকটি, ওই কি রূপাই ? নেচে ওঠে তার হিয়া | এলে পরে তারে খুব বকে দিবে, মাথায় ছোঁয়াবে হাত, কিরা করাইবে লড়ায়ের নামে হবে না সে আর মাৎ |আঁচলে চোখেরে বার বার মাজে, নারে না সে ত ও নয়, আজকে তাহার কপালে কি আছে, কে তাহা ভাঙিয়া কয় | লোহুর সাগরে সাতার কাটিয়া দিবস শেষের বেলা, রাত্র-রাণীর কালো আঁচলেতে মুছিল দিনের খেলা | পথে যে আঁধার পড়িল সাজুর মনে তার শত গুণ, রাত এসে তা ব্যথার ঘায়েতে ছিটাইল যেন নুন!ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা, সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা | পাতায় পাতায় খস্ খস্ খস্, শুনে কান খাড়া করে, যারে চায় সে ত আসেনাক শুধু ভুল করে করে মরে | তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে, ভাল লাগেনাক তার ; আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায়, বার বার খুলে দ্বার | কেন আসে নারে! সাজুর যদি গো পাখা আজ বিধি, উড়িয়া যাইয়া দেখিয়া আসিত তাহার সোনার নিধি | নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী-ফুল, প্রথমে যেদিন রূপারে সে দেখে, সে খুশির সমতুল | আঁকিল তাদের বিয়ের বাসর, আঁকিল রূপার বাড়ি, এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি |দুয়ার খুলিয়া দেখিল সে চেয়ে---রূপাই আসিছে বটে, ”এতক্ষণে এলে ? ভেবে ভেবে যেগো প্রাণ নাই মোর ঘটে | আর জাইও না কাইজা করিতে, তুমি যাহাদের মারো, তাদের ঘরে ত আছে কাঁচা বউ, ছেলেমেয়ে আছে কারো |” রূপাই কহিল কাঁদিয়া, “বউগো ফুরায়েছে মোর সব, রাতে ঘুম যেতে শুনিবে না আর রূপার বাঁশীর রব | লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে, আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে | লোহু লয়ে আজ সিনান করেছি, রক্তে ভেসেছে নদী, বুকের মালা যে ভেসে যাবে তাতে আগে জানিতাম যদি! আঁচলের সোনা খসে যাবে পথে আগে যদি জানতাম, হায় হায় সখি, নারিনু বলিতে কি যে তবে করিতাম !”বউ কেঁদে কয়, “কি হয়েছে বল, লাগিয়াছে বুঝি কোথা, দেখি ! দেখি !! দেখি !!! কোথায় আঘাত, খুব বুঝু তার ব্যথা !” “লাগিয়াছে বউ, খুব লাগিয়াছে, নহে নহে মোর গায়, তোমার শাড়ীর আঁচল ছিঁড়েছে, কাঁকন ভেঙেছে হায়! তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়ু ছিঁড়েছে গলার হার, তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর | আজ ‘কাইজায়’ অপর পক্ষে খুন হইয়াছে বহু | এই দেখ মোর কাপড়ে এখনো লাগিয়া রহিছে লহু | থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি, খোঁজ পেলে পরে এখনি আমার ধরে নিয়ে যাবে টুঁটি | সাথীরা সকলে যে যাহার মত পালায়েছে যথা-তথা, আমি আসিলাম তোমার সঙ্গে সেরে নিতে সব কথা | আমার জন্য ভাবিনাক আমি, কঠিন ঝড়িয়া-বায়, যে গাছ পড়িল, তাহার লতার কি হইবে আজি হায়! হায় বনফুল, যেই ডালে তুই দিয়েছিলি পাতি বুক, সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর সে সকল সুখ | ঘরে যদি মোর মা থাকিত আজ তোমারে সঙ্গে করি, বিনিদ্র রাত কাঁদিয়া কাটাত মোর কথা স্মরি স্মরি!ভাই থাকিলেও ভাইয়ের বউরে রাখিত যতন করি, তোমার ব্যথার আধেকটা তার আপনার বুকে ভরি | আমি যে যাইব ভাবিনাক, সাথে যাইবে কপাল-লেখা, এযে বড় ব্যথা! তোমারো কপালে এঁকে গেনু তারি রেখা!” সাজু কেঁদে কয়, “সোনার পতিরে তুমি যে যাইবে ছাড়ি, হয়ত তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি | সে দুখেরে আমি ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া, এ পোড়া রূপেরে কি দিয়া ঢাকিব---ভেবে মরে মোর হিয়া | তুমি চলে গেলে পাড়ার লোকে যে চাহিবে ইহার পানে, তোমার গলার মালাখানি আমি লুকাইব কোন্ খানে!”রূপা কয়, “সখি দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই, সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই | মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে, তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে |”এমন সময় ঘরের খোপেতে মোরগ উঠিল ডাকি, রূপা কয়, “সখি! যাই---যাই আমি---রাত বুঝি নাই বাকি!” পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায় ; সাজু কয়, “ ওগো শোন, আর কি গো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন ? দীঘল রজনী---দীঘল বরষ---দীঘল ব্যথার ভার, আজ শেষ দিনে আর কোন কথা নাই তব বলিবার ?” রূপা ফিরে কয়, “না কাঁদিয়া সখি, পারিলামনাক আর, ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল দেয়ার ধার |”“এই শেষ কথা!” সাজু কহে কেঁদে, “বলিবে না আর কিছু ?” খানিক চলিয়া থামিল রূপাই, কহিল চাহিয়া পিছু, “মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোন ব্যথা লাগে, দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে | সিন্দুরখানি পরিও ললাটে---মোরে যদি পড়ে মনে, রাঙা শাড়ীখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী-কোণে | মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাঁধিও চুল, আলসে হেলিয়া খোপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল | যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে---না শুনি আমার বাঁশী, বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুখে মেখে রাঙা হাসি | চেয়ো মাঠ পানে---গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান ; কান পেতে থেকো, যদি শোনো কভু সেখায় আমার গান | আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া, মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া!”ঘরের খোপেতে মোরগ ডাকিল, কোকিল ডাকিল ডালে, দিনের তরণী পূর্ব-সাগরে দুলে উঠে রাঙা পালে | রূপা কহে, “তবে যাই যাই সখি, যেটুকু আধার বাকি, তারি মাঝে আমি গহন বনেতে নিজেরে ফেলিব ঢাকি |” পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায়, তবু ফিরে ফিরে চায় ; সাজুর ঘরেতে দীপ নিবু নিবু ভোরের উতল বায় |
জসীম উদ্‌দীন
চিন্তামূলক
চলে মুসাফির গাহি, এ জীবনে তার ব্যথা আছে শুধু, ব্যথার দোসর নাহি। নয়ন ভরিয়া আছে আঁখিজল, কেহ নাই মুছাবার, হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেহ নাই শুনিবার। চলে মুসাফির নির্জন পথে, দুপুরের উঁচু বেলা, মাথার উপরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া করিছে আগুন-খেলা। দুধারে উধাও বৈশাখ-মাঠ রৌদ্রেরে বুকে চাপি, ফাটলে ফাটলে চৌচির হয়ে করিতেছে দাপাদাপি। নাচে উলঙ্গ দমকা বাতাস ধুলার বসন ছিঁড়ে, ফুঁদিয়ে ফুঁদিয়ে আগুন জ্বালায় মাঠের ঢেলারে ঘিরে। দুর পানে চাহি হাঁকে মুসাফির, আয়, আয়, আয়, আয়, কস্পন জাগে খর দুপুরের আগুনের হলকায়। তারি তালে তালে দুলে দুলে উঠে দুধারের স্তব্ধতা, হেলে নীলাকাশ দিগনে- বেড়ি বাঁকা বনরেখা-লতা। চলে মুসাফির দুর দুরাশার জনহীন পথ পাড়ি, বুকে করাঘাত হানিয়া সে যেন কি ব্যথা দেখাবে ফাড়ি। নামে দিগনে- দুপুরের বেলা, আসে এলোকেশী রাতি, গলায় তাহার শত তারকার মুন্ডমালার বাতি। মেঘের খাঁড়ায় রবিরে বনিয়া নাচে সে ভয়ঙ্করী, দুর পশ্চিমে নিহত দিনের ছিন্নমুন্ড ধরি। রুধির লেখায় দিগন্ত বায় লোল সে রসনা মেলি, হাসে দিগনে- মত্ত ডাকিনী করিয়া রক্ত-কেলি। চলেছে পথিক-চলেছে সে তার ভয়ঙ্করের পথে, বেদনা তাহার সাথে সাথে চলে সুরের ইন্দ্ররথে। ঘরে ঘরে জ্বলে সন্ধ্যার দীপ, মন্দিরে বাজে শাঁখ, গাঁয়ের ভগ্ন মসজিদে বসি ডাকে দুটো দাঁড়কাক। কবরে বসিয়া মাথা কুটে কাঁদে কার বিরহিনী মাতা, চলেছে পথিক আপনার মনে বকিয়া বকিয়া যা-তা। চলেছে পথিক-চলেছে পথিক-কতদুর-কতদুর, আর কতদুর গেলে পরে সে যে পাবে দেখা বন্ধুর। কেউ কি তাহার আশাপথ চাহি গণেছে বয়ষ মাস, ধুঁয়ার ছলায় কাঁদিয়া কি কেউ ভিজায়েছে বেশবাস? কিউ কি তাহারে দেখায়েছে দীপ কানো গেঁয়ো ঘর হতে, মাথার কেশেতে পাঠায়েছে লেখা গংকিণী নদী সোঁতে? চলেছে পথিক চলেছে সে তার ললাটের লেখা পড়ি, সীমালেখাহীন পথ-মায়াবীর অঞ্চলখানি ধরি। ঘরে ঘরে ওঠে মৃদু কোলাহল, বঁধুরা বধুর গলে, বাহুর লতায় বাহুরে বাঁধিয়া প্রণয়-দোলায় দোলে। বাঁশী বাজে দুরে সুখ-রজনীর মদিরা-সুবাস ঢালি, দীঘির মুকুরে হেরে মুখ রাত চাঁদের প্রদীপ জ্বালি। নতুন বধুর বক্ষে জড়ায়ে কচি শিশু বাহু তুলি, হাসিয়া হাসিয়া ছড়াইছে যেন মণি-মানিকের ধুলি। চলেছে পথিক-রহিয়া রহিয়া করিছে আর্তনাদ- ও যেন ধরার সকল সুখের জীবন- প্রতিবাদ। রে পথিক ! বল, কারে তুই চাস, যে তোরে এমন করে, কাঁদাইল হায়, কেমন করিয়া রহিল সে আজ ঘরে? কোন ছায়া-পথ নীহারিকা পারে, দেখেছিলি তুই কারে, কোন সে কথার মানিক পাইয়া বিকাইলি আপনারে । কার গেহ ছায়ে শুনেছিলি তুই চুড়ির রিণিকি-ঝিনি, কে তোর ঘাটেতে এসেছিল ঘট বুড়াইতে একাকিনী । চলে মুসাফির আপনার রাহে কোন দিকে নাহি চায়, দুর বনপথে থাকিয়া থাকিয়া রাত-জাগা পাখি গায়। গগনের পথে চাঁদেরে বেড়িয়া ডাকে পিউ, পিউ কাঁহা, সে মৌন চাঁদ আজো হাসিতেছে, বলিল না, উহু আহা। বউ কথা কও-বউ কথা কও-কতকাল -কতকাল, রে উদাস, বল আর কতকাল পাতিবি সুরের জাল। সে নিঠুর আজো কহিল না কথা, রহস্য-যবনিকা খুলিয়া আজিও পরাল না কারো ললাটে প্রণয় টীকা। চলেছে পথিক চলেছে সে তার দুর দুরাশার পারে, কোনো পথবাঁকে পিছু ডাকে আজ ফিরাল না কেউ তারে। চলেছে পথিক চলেছে সে যেন মৃত্যুর মত ধীরে, যেন জীবন- হাহাকার আজি কাঁদিছে তাহার ঘিরে। চারিদিক হতে গ্রাসিয়াছে তারে নিদারুণ আন্ধার, স্তব্ধতা যেন জমাট বেঁধেছে ক্রন্দন শুনি তার।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
নয়া জমিদার আদিলদ্দীন ধরি সকিনারে হাত, কহিল, চল গো সোনার বরণী, মোর ঘরে মোর সাথ! মালার মতন করিয়া তোমারে পরিয়া রাখিব গলে, পঙ্খী করিয়া পুষিব তোমারে উড়াব আকাশ ভরি, আমার দুনিয়া রঙিন করিব তোমারে মেহেদী করি। সকিনা কহিল, আপনি মহান, হতভাগিনীর তরে, যাহা করেছেন জিন্দেগী যাবে ঋণ পরিশোধ করে। তবুও আমারে ক্ষমা করিবেন, আপনার ঘরে গেলে, বসিতে হইবে হতভাগিনীরে কলঙ্ক কালি মেলে। আসমান সম আপনার কুল, মোর জীবনের মেঘে, যত চান আর সুরুয তারকা সকল ফেলিবে ঢেকে। ধোপ কাপড়েতে দাগ লাগিলে যে সে দাগ মোছেনা আর, অভাগীর তরী ভাসাইতে দিন ভুলের গাঙের পার। আদিল কহিল, সুন্দর মেয়ে! থাক চাঁদ মেঘে ঢেকে, তুমি যে উদয় হও মোর মনে জোছনা ঝলক এঁকে। মোর ভালবাসা চান্দের সম, তব কলঙ্ক তার, শোভা হয়ে শুধু ছড়ায়ে পড়িবে নানা কাহিনীতে আর। সকিনা কহিল, পাড়ে পড়ি তুমি আমারে বুঝোনা ভুল, কত না বিপদ সায়র হইতে তুমি মোরে দেছ কূল। তোমার নিকটে জমা রাখিলাম ইহ-পরকাল মোর, দন্ডের তরে তোমারে ভুলিলে আমি যেন লই গোর। তোমার লাগিয়া আমি যে বন্ধু তাপসিনী হয়ে রব, গহন বনেতে কুঁড়ে ঘরে বসি তব নাম শুধু লব। ক্ষমা করো মোরে, তোমার জীবনে দোসর হইব বলে, সাধ থাকিলেও সাধ্য নাহিক আমারি ভাগ্য ফলে। আদিল কহিল, সুন্দর মেয়ে! তুমি কেন ভয় পাও? আমার আকাশে তুমি হবে মোর উদয়-তারার নাও। এই বুক মোর এত প্রসারিত, তাহার আড়াল দিয়া, দুনিয়া ছড়ান তব কলঙ্ক রাখিব যে আবরিয়া। এ বাহুতে আছে এত বিক্রম, তার মহা-মহিমায়, এতটুকু গ্লানি আনিতে পাবে না কেউ এ জীবনটায়। তবু মোরে ক্ষমা করিও বন্ধু! সকিনা কহিল কাঁদি, যারে ভালবাসি তারে কোন প্রাণে দেব এই দেহ সাধি। একটি বিপদ হতে উদ্ধার পাইবার লাগি তার, আরটি বিপদে পড়িতে হয়েছে বদলে এ দেহটার। পন্যের মত দেহটারে সে যে বিলায়েছে জনে জনে, কোন লালসার লাগি নহে শুধু বাঁচিবার প্রয়োজনে। এই মন লয়ে কতজন সনে করিয়াছে অভিনয়, কত মিথ্যার নকল রচিয়া ফিরেছে ভুবনময়। সে শুধু ক্ষুধার আহারের লাগি কে তাহা বুঝিতে পাবে? সবাই তাহারে চিন্তা করিবে নানা কুৎসিতভাবে! সেই মন আর সেই দেহ যাহা সবখানে কদাকার, কেমন করিয়া দিবে তারে যেবা সব চেয়ে আপনার! পায়ে পড়ি তব, শোন গো বন্ধু! ছাড় অভাগীর আশা, আমারে লইয়া ভাঙিওনা তব আসমান সব বাসা। আদিল কহিল, বুঝিলাম মেয়ে! রজনী হইলে শেষ, রাতের বাসারে উপহাসি পাখি চলে যায় আর দেশ; সকল বিপদ হইতে তোমারে করিয়াছি উদ্ধার, আমারে লইয়া তোমার জীবনে প্রয়োজন কিবা আর? কি কথা শুনালে পরাণ বন্ধু! সকিনা কাঁদিয়া কয়, তীক্ষ্ম বরশা-শেল যে বিধালে আমার জীবনটায়। এত যদি মনে ছিল গো বন্ধু, এই অভাগিনী তরে, তোমার পরাণ ওমন করিয়া এমনই যদি বা করে; আমারে লইয়া এতই তোমার হয় যদি প্রয়োজন, আজি হতে তবে সঁপিলাম পায়ে এই দেহ আর মন। সাক্ষী থাকিও আল্লা রসুল! আপন অনিচ্ছায়, সব চেয়ে যেবা পবিত্র মম তারে দিনু আমি হায়; এই দেহ মন যাহা জনে জনে কালি যে মাকায়ে গেছে, তাই নিল আজি মোর ফেরেস্তা আপনার হাতে যেচে। বনে থাকো তুমি পউখ পাখালী আমারে করিও দোয়া, আজ হতে আমি বন্দী হইনু লইয়া ইহার ময়া। অনেক ঊর্ধ্বে থাকগো তোমরা চন্দ্র-সূরুয দুটি, মোদের জীবন রহে যেন সদা তোমাদের মত ফুটি। দোয়া কর তুমি সোনার পতিগো, দোয়া কর তুমি মোরে, তোমার জীবনে জড়ালাম আমি লতার মতন করে। এ লতা বাঁধন জনমের মত কখনো যেন না টুটে, যত ভালবাসা ফুলের মতন রহে যেন এতে ফুটে। সকিনারে লয়ে আদিল এবার পাতিল সুখের ঘর, বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর। সোঁতের শেহলা ভাসিতে ভাসিতে এবার পাইল কূল, আদিলবলিল, গাঙের পানিতে কুড়ায়ে পেঁয়েছি ফুল। এই ফুল আমি মালায় গাঁথিয়া গলায় পরিয়া নেব, এই ফুল আমি আতর করিয়া বাতাসে ছড়ায়ে দেব। এই ফুলে আমি লিখন লিখিব, ভালবাসা দুটি কথা, এই ফুলে আমি হাসিখুশি করে জড়াব জীবন-লতা। করিলও তাই, সকিনারে দিয়ে রঙের রঙের শাড়ী, আদিল কহিল, সবগুলি মেঘ এসেছে সন্ধ্যা ছাড়ি। সবগুলি পাখি রঙিন পাখায় করেছে হেথায় মেলা, সবগুলি রামধনু এসে দেহে জুড়েছে রঙের খেলা। ঝলমল মল গয়নায় গাও ঝলমল মল করে, ঝিকিমিকি ঝিকি জোনাক মতিরা হাসিছে অঙ্গ ধরে।
জসীম উদ্‌দীন
চিন্তামূলক
রূপেরে কহিনু ডাকি হায় রূপ! তুমি কেন চলে যাও, তুমি কেন একখানে স্থির হয়ে রহিতে না পাও! তুমি কি জান না রূপ, আঁখিতে কাজল-লতা একেঁ, তরুণীরা তোমারে ধরিতে পাতে ফাঁদ- দশন মুকুতা মালা দিয়ে জড়ায়ে হাসির রাঙা চাঁদ তুমি কি জান না রূপ, বাহুর বিজলী লতা দুটি, বাহুরে ছাড়িয়া যদি যায়; লহর পহর জাগে বসি শাড়ীর সুনীল দরিয়ায়। তুমি কি জান না রূপ, দেহের ধূপের পাত্র ভরি, তোমা লাগি হোম-মন্ত্র ধ্বনিছে দিবস বিভাবরী; কত যে হইল প্রাণবলি কত যে হইল তনুক্ষয়, হায় রূপ! চিরচঞ্চল রূপ!…. তবু তুমি কাহারো ত হলে নয়। তোমার তনুর হাওয়া লাগি প্রেম-ফুল ফুটিয়া টুটিয়া মরে যায়, কথার কাকলি ওড়ে পথে সোহাগে আগরে মূরছায়। রূপ! তুমি রূপ! কারো লাগি থামিলে না কোন পথ বাঁকে একটি আশিষ-কণা, একটু করুণা-বারি, দয়া করে নাহি দিলে কাকে। রূপেরে কহিনু ডাকি, শোন রূপ, আমাদের কলূষ অন্তর, তোমারে ছুঁইতে যেয়ে হায় আমাদের ধরণীর ধূলিরে মাখাই তব গায়; শিশুরা সরল মন, চোখে মুখে স্বরগের চুমু লেগে আছে, তুমি কি পার না রূপ! কিছুদিন রহিবারে খেলাঘরে তাহাদের কাছে? ফুলেরা তাদেরও চেয়ে ভাল, হাসিমুখে চেয়ে থাকে খালি, কথা নাহি জানে, পাখিরা বনের পাখি ডালে ডালে মধুর কাকলি করে ফেরে; তুমি কি তাদের মাঝে কিছুদিন রহিতে পার না রূপ! তোমার চলার পথ ছেড়ে? রূপেরে কহিনু ডেকে আরো, হায় রূপ! চিরচঞ্চল রূপ, দেহ হতে দেহ পানে ধাও, তোমা হেরি এত কথা জাগে মোর মনে; তোমার কি কোন কথা নাই? আমরা তোমারে চাহি, তুমি কি কারেও নাহি চাও! আরো কহিলাম তারে, রূপ! তুমি তনুতে তনুতে বাসা বাঁধি, রজনী প্রভাতে চলে যাও; তোমার নাহিক তৃপ্তি- কি চেয়ে কি যেন নাহি পাও। তোমার হাতের বর-মালা নিশীথে পরায়ে কারো গলে প্রভাতে খুলিয়া লয়ে যাও; কারে যে বেসেছ ভাল তুমি তা জান না বলে রূপ, কেবলি সমুখ পানে ধাও। বড় যে অভাগা রূপ, বড় যে অবলা রূপ, জানে না কি করে কথা বলে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী, উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি | — রাখালী গানএই এক গাঁও, ওই এক গাঁও — মধ্যে ধু ধু মাঠ, ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ | এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ ; গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ | ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া, ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া |এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে, কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে! মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল, বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল | এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে, জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে! কেউবা বলে — আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি ; এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে, ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়, জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়ে | কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি, শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি | মাঠের মাঝের জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ, জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ ! বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি, মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি | সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানে ধায়, ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় | এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে |এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর — শুধুই জলের ডাক, তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নেইকো কোন ফাঁক | ও-গাঁর বধু ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে, কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসে লাগে | এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে, ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে! এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান, ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান | এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে ; অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে |এ-গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও-গাঁর লোকের সনে, কাইজা ফ্যাসাদ্ করেছে যা জানেই জনে জনে | এ-গাঁর লোকেও করতে পরখ্ ও-গাঁর লোকের বল, অনেকবারই লাল করেছে জলীর বিলের জল | তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ, মাঝখানে তার ধূলায় দোলে দুখান দীঘল বাট ; দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা, এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা |নকশী কাঁথার মাঠ পর্ব ২
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
বামুন বাড়ির মেয়ে, কাঁচা রোদের বরণ ঝরে গা-খানি তার বেয়ে- সে রোদ দেখা যায়, যেমনি বনের পাতার ফাঁকে, শিশু-রবির টুকরো আলো ছড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকো; তেমনি তাহার বসন বেয়ে, আঁচলখানি বেয়ে, যে পথ দিয়ে চলে সে পথ রূপে যে যায় নেয়ে। এই গাঁয়েতে আধলা পুকুর, পচা কাজল জল; বেঙের ছাতি তাহার বুকে ভাসছে অবিরল। সেখানেতে পানার বহর মশার দলের সনে, চিরস্থায়ী ঘর বাঁধিয়া বাস করে নির্জনে। তারির ফাঁকে বরষ বরষ জল-সাপলার পরী, চাঁদের আলো মাখায় তাহার ফুলেল কুটীর ভরি। সেই জলেরি ঢেউ বাঁধিয়া সূক্ষ্ম লতার সনে কলমী-কুসুম নিতুই সাজে নতুন বিয়ের কনে। সেখানেতে পদ্মপাতায় মেলি পূজার ফুল, কলমিনী পুকুর জলে ভাসায় জাতি-কুল। তেমনি এই সুদূর গাঁয়ে ম্যালেরিয়ার বাস, ঝগড়া ফেসাদ-কুসংস্কার ঘুরছে চারি পাশ। এরির মধ্যে বাস করে এই বামুন বাড়ির মেয়ে, সবার সনে থেকেও সে যে একলা সবার চেয়ে। ও যেন ঠিক কুমুদ-কুসুম দীঘির পচা জল, আজও তাহার পায়নি ছুঁতে পরাগ শতদল। ও যেন ঠিক ঝুমকো লতা জড়িয়ে গাঁয়ের সব, হাসছে উহার পাতায় পাতায় ফুলে িমহোৎসব। এই গাঁয়েতে বরষ বরষ আসছে মাহমারী, হাজার পরাণ ধূলায় লোটে চরণ ঘায়ে তারি। আসে হেথায় বসন্ত আর কলেরা প্লেগ আদি, ওই মেয়েটির প্রতি এদের কেউ নাহি হয় বাদী। সে যেন গাঁর পূজার কুসুম, সকল অত্যাচার, সাহস নাহি পায় ছুঁইতে চরণ দুটি তার। আছে গাঁয়ের নারদ-পিসী ক্ষান্ত মাসীর মাতা, যাহার যত পোপন কিছু লিখছে ভরি খাতা। আছে গাঁয়ে মোক্ষদা সে খ্যাংরামুখী বুড়ী; মুখে কথার বজ্রশিলা ফিরছে ছুঁড়ি ছুঁড়ি। ওই মেয়েটির জগৎ যেন তাদের হতে আর; কিংবা তারা বুঝছে যে ও, নাগাল পাওয়ার বার। ওই মেয়েটির চলন-চালন আর যে হাসি-খুশী, কারো হাসি-খুশীর সনে হয়নি আজো দুষী। এ গাঁয় প্রথম চাঁদ আসিয়া বসে শিমূল ডালে, সোনা হাসির মুঠি মুঠি ছড়ায় উহার গালে। সন্ধ্যা বেলায় যে রঙ ঝরে গাঁয়ের পুকুর জলে; সেও হয়ত ওরির পায়ে আলতা মাখার ছলে। গাঁয়ের মাঝে বামুন বাড়ি সকল বাড়ির সেরা; চার ধারে তার নানান বরণ ফুল-বাগিচার বেড়া। পাতায় পাতায় ফলের বাসা, ফুলের স্বপন মাঝে, ফুলের চেয়েও ফুলেল সাজে বামুন বড়ি রাজে। তাদের ঘরে ঠাকুর আছে মন্ত্র পড়ি রোজ তুলসী তামা গঙ্গাজলে দেয় যে পূজার ভোজ। সেথায় জ্বলে হোমের আগুন, ঘন্টা কাঁসর বাজে, তাহার মাঝে বামুন বাড়ির পূজার ঠাকুর রাজে। বামুন পাড়ার স্বপন যেন ধূপের ধোঁয়ায় হেসে, পূজারতির মন্ত্র সনে বেড়ায ভেসে বেসে। হোমাগুনের গন্ধ ঝরে সারাটি গাও বেয়ে তারি মতন দাঁড়িয়ে হাসে বামুন বাড়ির মেয়ে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
গান-বারমাসির সুর যাওরে বৈদেশী বন্ধু যাও হাপন ঘরে, অভাগী অবলার কথা রাইখ মনে করে। তোমার দেশেতে বন্ধু। ফুটবে কদম কলি, আমার দেশে কাজল্যা মেঘা নামবে ঢলি ঢলি। সেই না কাজলা মেঘা ঝরে রয়া রয়া, বিজলীর আগুন তাতে পড়ে খয়া খয়া। সেই আগুন-লাগিবো আমার বুকের বসনে, সেই আগুন লাগিবো আমার বে-ঘুম শয়নে। আপন দেশে যাওরে বন্ধু। আপনার ঘর, দেখিবা আপন জন পরবাস-অন্তর। মায়েতে মুছাবে মুখ বুকের বসন দিয়া, বইনে ত করবো বাতাস আবের পাঙ্খা দিয়া। মায়ে না বসায়া তোমায় কোলের উপর, নিরালে জিগাইব কত পরবাসের খবর। মায়ের না আগেরে বন্ধু, বইনের না আগে, কইও এ অভাগীর কথা যদি মনে লাগে। মা বুনের আদরে বন্ধু থাকবা যখন ঘরে অভাগী অবলার কথা দেইখ মনে করে। ভাবিও তোমার মায়ে যে যত্তন করে, তেমনি যত্তন কান্দে বৈদেশ নগরে। হাপনার ভাইএ বইনে যে আদর করে, তেমনি আদর আছে বেগানারও ঘরে। ঘরেতে আছে তোমার ধর্ম সোদ্দের বোন, তোমার উপর দাবী তাহার জানে সর্বজন। মায়েরও আছে দাবী, বুকের দুধ দিয়া, তোমারে মানুষ করল কত না করিয়া। আমি যে বেগানা নারী কোন দাবী নাই, সেই দুঃখে মরিরে, বন্ধু !কুল নাহি পাই। বৈদেশী পৈড়াত !তুমি টাকায় খাটো জন, তারে আজ কি দাম দিলা যার নিলা মন। আমার দেশে ধান কাটিতে মন কাটিয়া গেলে, ধানের দামই নিয়ে গেলে মনের দামটা ফেলে। সেই না ধানের খেতে আবার ঐব ধান, শাঙইনা পনিতে ভাসপো কাজইলা আসমান আমার মনেতে বন্ধু। শুধুই চত্রিক মাস, দুপুইয়া আসমান ছাড়ে আগুনীর শ্বাস। সেই না আসমানের তলে বাজ ডাকে রয়া, কেমন গোঁয়াইব কাল মোরে যাও কয়া।
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
পুরান পুকুর, তব তীরে বসি ভাবিয়া উদাস হই, খেজুরের গোড়ে বাঁধা ছোট ঘাট, করে জল থই থই; রাত না পোহাতে গাঁয়ের বধুরা কলসীর কলরবে, ঘুম হতে তোমা জাগাইয়া দিত প্রভাতের উৎসবে। সারাদিন ধরি ঘড়ায় ঘড়ায় তব অমৃতরাশি, বধুদের কাঁখে ঢলিয়া ঢলিয়া ঘরে ঘরে যেত হাসি। ‘বদনায়’ভরা একটুকু, তারি ভরসায় গেঁয়ো-চাষী, চৈত্র-রোদের করুণ করিয়া বাজাত গানের বাঁশী। মাঠ হতে তারা জ্বলিয়া পুড়িয়া আসিত তোমার তীরে, খেজুর পাতায় সোনালী চামর দোলাতে তাদের শিরে। শান্ত হইয়া গামছা ভিজায়ে তোমার কাজল-জলে, নাহিয়া নাহিয়া সাধ মিটিত না-আবার নাহিবে বলে। এইখানে বসি পল্লী-বধূরা আধেক ঘোমটা খুলি, তোমার মুকুরে মুখখানি হেরে জল-ভরা যেত ভুলি। সখিতে সখিতে কাঁধে কাঁধ ধরি খেলিত যে জল-খেলা, সারাটি গাঁয়ের যত রূপ আছে তব বুকে হত মেলা, পুকুরের জল উথলি পাথালি ভাসিত তাদের হাসি, - ফুলে ফুল লাগি ফুলেরা যেমন ভেঙে হয় রাশি রাশি। আজি মনে পড়ে, পুরান পুকুর, মায়ের আঁচল ধরে, একটি ছেলের ঝাঁপাঝাঁপি খেলা তোমার বুকের পরে। ওই এত জলে সাঁপলার ফুল, -তারি ছিল এত লোভ, তাই তুলিবারে জলে ডুবিলেও মনে নাহি ছিল ক্ষোভ। আজিকে তোমার কোথায় সে জল? কোথা সেই বাঁধা ঘাট, গেঁয়ো বধূদের খাড়ুতে মুখর কোথা সে পুকুর বাট? চারিধারে তব বন-জঙ্গল পাতায় পাতায় ঢাকা, নিকষ-রাতের আঁধার যেন গো তুলিতে রয়েছে আঁকা। ডুকরিয়া কাঁদে ডাহুক ডাহুকী তরু-মর্ম্মর স্বনে, তারি সাথে বুঝি উঠিছে শিহরি যত ব্যথা তব মনে! হিজল গাছের মালা হতে আজি খসিয়া রঙিন ফুল, সাঁঝের মতন দিতেছে ব্যথিয়া তোমার চরণমূল। সন্ধ্যা-সকালে আসিত যাহারা কলসী লইয়া ঘাটে, তারা সবে আজি বিদায় নিয়েছে মরণ পারের হাটে। বক্ষ-মুকুরে সোনা মুখখানি দেখিবারে কেহ নাই, কুচুরী পানায় আধ বুকখানি ঢাকিয়া রেখেছ তাই! ঘুচাও ঘুচাও মৌন তড়াগ, বুকের আরসীখানি, মোর বাল্যের যত ভুলো-কথা সারা গায়ে দাও টানি। সেই ছেলেবেলা স্বপ্নের মত কত স্নেহ ভরা মুখ, এনে দাও, শুধু বারেক দেখিয়া ভরে লই সারা বুক। এনে দাও সেই তব তীরে বসি মেঠো রাখালের বাঁশী স্বপনের ভেলা দুলায়ে দুলায়ে আকাশেতে যাক্ ভাসি। হায়রে, সেদিন আসে না ফিরিয়া! শুধু ভিজে আঁখি পাতা, পুরানো স্বপন কুড়ায়ে কুড়ায়ে আকাশেতে জাল পাতা! তুমিও সজনি, আমারি মতন না জানি কাঁদিছ কত, ছোট ঢেউগুলি নাড়িয়া নাড়িয়া পাড়েরে করিছ ক্ষত। বনদেবী আজ সমবেদনায় আঁচল বিছায়ে জলে, ব্যথাতুরা তব সারা বুকখানি ঢেকেছে কলমী দলে।
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
বস্তীর বোন, তোমারে আজিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, যত দূরে যাব তোমাদের কথা চিরদিন মনে রবে। মনে রবে, সেই ভ্যাঁপসা গন্ধ অন্ধ-গলির মাঝে, আমার সে ছোট বোনটির দিন কাটিছে মলিন সাজে। পেটভরা সে যে পায় না আহার, পরনে ছিন্নবাস, দারুণ দৈন্য অভাবের মাঝে কাটে তার বারোমাস। আরো মনে রবে, সুযোগ পাইলে তার সে ফুলের প্রাণ, ফুটিয়া উঠিত নানা রঙ লয়ে আলো করি ধরাখান। পড়িবার তার কত আগ্রহ, একটু আদর দিয়ে, কেউ যদি তারে ভর্তি করিত কোন ইস্কুলে নিয়ে; কত বই সে যে পড়িয়া ফেলিত জানিত সে কত কিছু, পথ দিয়ে যেতে জ্ঞানের আলোক ছড়াইত, পিছু পিছু! নিজে সে পড়িয়া পরেরে পড়াত, তাহার আদর পেয়ে, লেখাপড়া জেনে হাসিত খেলিত ধরনীর ছেলেমেয়ে। হায়রে দুরাশা, কেউ তারে কোন দেবে না সুযোগ করি, অজ্ঞানতার অন্ধকারায় রবে সে জীবন ভরি। তারপর কোন মূর্খ স্বামীর ঘরের ঘরনী হয়ে, দিনগুলি তার কাটিবে অসহ দৈন্যের বোঝা বয়ে। এ পরিনামের হয় না বদল? এই অন্যায় হতে বস্তীর বোন, তোমারে বাঁচাতে পারিবনা কোনমতে? ফুলের মতন হাসিখুশী মুখে চাঁদ ঝিকি মিকি করে, নিজেরে গলায়ে আদর করিয়া দিতে সাধ দেহ ভরে। তুমি ত কারুর কর নাই দোষ, তবে কেন হায়, হায়, এই ভয়াবহ পরিনাম তব নামিছে জীবনটায়। এ যে অন্যায়, এ যে অবিচার, কে রুখে দাঁড়াবে আজ, কার হুঙ্কারে আকাশ হইতে নামিয়া আসিবে বাজ। কে পোড়াবে এই অসাম্য-ভরা মিথ্যা সমাজ বাঁধ, তার তরে আজ লিখিয়া গেলাম আমর আর্তনাদ। আকাশে বাতাসে ফিরিবে এ ধ্বনি, দেশ হতে আর দেশে, হৃদয় হইতে হৃদয়ে পশিয়া আঘাত হানিবে এসে। অশনি পাখির পাখায় চড়িয়া আছাড়ি মেঘের গায়, টুটিয়া পড়িবে অগ্নি জ্বালায় অসাম্য ধারাটায়! কেউটে সাপের ফণায় বসিয়া হানিবে বিষের শ্বাস, দগ্ধ করিবে যারা দশ হাতে কাড়িছে পরের গ্রাস। আলো-বাতাসের দেশ হতে কাড়ি, নোংরা বস্তী মাঝে, যারা ইহাদের করেছে ভিখারী অভাবের হীন সাজে; তাহাদের তরে জ্বালায়ে গেলাম শ্মাশানে চিতার কাঠ, গোরস্তানেতে খুঁড়িয়া গেলাম কবরের মহা-পাঠ। কাল হতে কালে যুগ হতে যুগে ভীষণ ভীষণতর, যতদিন যাবে ততজ্বালা ভরা হবে এ কন্ঠস্বর। অনাহারী মার বুভুক্ষা জ্বালা দেবে এরে ইন্ধন, দিনে দিনে এরে বিষায়ে তুলিবে পীড়িতের ক্রন্দন। দুর্ভিক্ষের স্তন পিয়ে পিয়ে লেলিহা জিহ্বা মেলি, আকাশ-বাতাস ধরণী ঘুরিয়া করিবে রক্ত কেলি।
জসীম উদ্‌দীন
শোকমূলক
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক। এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা, সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা। সোনালী ঊষায় সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি, লাঙ্গল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি। যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত, এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোর তামাশা করিত শত। এমন করিয়া জানিনা কখন জীবনের সাথে মিশে, ছোট-খাট তার হাসি-ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে। বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা, আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ। শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু পয়সা করি দেড়ী, পুঁতির মালা এক ছড়া নিতে কখনও হতনা দেরি। দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে, সন্ধ্যাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুর বাড়ির বাটে ! হেস না–হেস না–শোন দাদু সেই তামাক মাজন পেয়ে, দাদী যে তোমার কত খুশি হোত দেখিতিস যদি চেয়ে। নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, ‘এতদিন পরে এলে, পথপানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখি জলে।’ আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়, কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝ্ঝুম নিরালায়। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, ‘আয় খোদা, দয়াময়, আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়।’ তার পরে এই শুন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি, যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি। শত কাফনের শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি গনিয়া গনিয়া ভুল করে গনি সারা দিনরাত জাগি। এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে, গাড়িয়া দিয়াছি কতসোনা মুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে। মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক, আয় আয় দাদু, গলাগলি ধরে কেঁদে যদি হয় সুখ। এইখানে তোর বাপ্জী ঘুমায়, এইখানে তোর মা, কাঁদছিস তুই ? কি করিব দাদু, পরান যে মানে না ! সেই ফাল্গুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি, বা-জান, আমার শরীর আজিকে কি যে করে থাকি থাকি। ঘরের মেঝেতে সপ্ টি বিছায়ে কহিলাম, বাছা শোও, সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কি জানিত কেউ ? গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে, তুমি যে কহিলা–বা-জানেরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে? তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে, সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে। তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দু হাতে জড়ায়ে ধরি, তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিন-মান ভরি। গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে, ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো মাঠখানি ভরে। পথ দিয়ে যেতে গেঁয়ো-পথিকেরা মুছিয়া যাইতো চোখ, চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক। আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি, হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি। গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা, চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ। উদাসিনী সেই পল্লীবালার নয়নের জল বুঝি, কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি। তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ, হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বীষের তাজ। মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, ‘বাছারে যাই, বড় ব্যথা রল দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই; দুলাল আমার, দাদু রে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে, কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।’ ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গণ্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে, কি জানি আশিস্ করি গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে। ক্ষণ পরে মোরে ডাকিয়া কহিল, ‘আমার কবর গায়, স্বামীর মাথার ‘মাথাল’ খানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।’ সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে, পরানের ব্যথা মরে না কো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। জোড়-মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়, গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়ে। জোনাকি মেয়েরা সারা রাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো, ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নুপুর কত যেন বেসে ভাল। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,’রহমান খোদা, আয়, ভেস্ত নাজেল করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়ে।’ এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরীর মতন মেয়ে, বিয়ে দিয়েছিনু কাজীদের ঘরে বনিয়াদী ঘর পেয়ে। এত আদরের বু-জীরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে। হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে। খবরের পর খবর পাঠাত, ‘দাদু যেন কাল এসে, দু দিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে। শ্বশুর তাহার কসাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে, অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে। সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে, ফোটে না সেথায় হাসি, কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিত ভাসি। বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন, কে জানিত হায়, তাহারও পরানে বাজিবে মরণ-বীণ! কি জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে, এইখানে তারে কবর দিয়াছি দেখে যাও দাদু ধীরে। ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেউ ভাল, কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো। বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন, পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে যেন তারি বেদনার বীণ। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,’আয় খোদা দয়াময়!। আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়।’ হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু সাত বছরের মেয়ে, রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে। ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কি জানি ভাবিত সদা, অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা। ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে, তোমার দাদীর মুখখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে। বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা, রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা। একদিন গেনু গজ্নার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে, ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে। সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে, কি জেনি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গ্যাছে। আপন হসেতে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি– দাদু ধর–ধর–বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি। এইখানে এই কবরের পাশে, আরও কাছে আয় দাদু, কথা ক’সনাক, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু। আস্তে আস্তে খুড়ে দেখ্ দেখি কঠিন মাটির তলে, দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে। ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে, এমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে। মজীদ হইছে আজান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর, মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দুর! জোড়হাতে দাদু মোনাজাত কর্, ‘আয় খোদা, রহমান, ভেস্ত নাজেল করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ!’
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
নমুর পাড়ায় বিবাহের গানে আকাশ বাতাস উঠিয়াছে আজি ভরি, থাকিয়া থাকিয়া হইতেছে উলু, ঢোল ও সানাই বাজিতেছে গলা ধরি। রামের আজিকে বিবাহ হইবে, রামের মায়ের নাহি অবসর মোটে; সোনার বরণ সীতারে বরিতে কোনখানে আজ দূর্বা ত নাহি জোটে। কোথায় রহিল সোনার ময়ূর, গগনের পথে যাওরে উড়াল দিয়া, মালঞ্চঘেরা মালিনীর বাগ হইতে গো তুমি দূর্বা যে আনো গিয়া। এমনি করিয়া গেঁয়ো মেয়েদের করুণ সুরের গানের লহরী পরে, কত সীতা আর রাম লক্ষণ বিবাহ করিল দূর অতীতের ঘরে। কেউ বা সাজায় বিয়েরে কনেরে, কেউ রাঁধে রাড়ে ব্যস্ত হইয়া বড়, গদাই নমুর বাড়িখানি যেন ছেলেমেয়েদের কলরবে নড় নড়। দূর গাঁর পাশে বনের কিনারে দুজন কাহারা ফিস্ ফিস্ কথা কয়! বিবাহ বাড়ির এত সমারোহ সেদিকে কাহারো ভ্রক্ষেপ নাহি হায়! সোজন, আমার বিবাহ আজিকে, এই দেখ আমি হলুদে করিয়া স্নান, লাল-চেলী আর শাঁখা সিন্দুর আলতার রাগে সাজিয়েছি দেহখান। তোমারে আজিকে ডাকিয়াছি কেন, নিকটে আসিয়া শুন তবে কান পাতি, এই সাজে আজ বাহির যেথা যায় আঁখি, তুমি হবে মোর সাথী। কি কথা শুনালে অবুঝ! এখনো ভাল ও মন্দ বুঝিতে পারনি হায়, কাঞ্চাবাঁশের কঞ্চিরে আজি যেদিকে বাঁকাও সেদিকে বাঁকিয়ে যায়। আমার জীবনে শিশুকাল হতে তোমারে ছাড়িয়া বুঝি নাই আর কারে, আমরা দুজনে একসাথে রব, এই কথা তুমি বলিয়াছ বারে বারে। এক বোঁটে মোরা দুটি ফুল ছিনু একটিরে তার ছিঁড়ে নেয় আর জনে; সে ফুলেরে তুমি কাড়িয়া লবে না? কোন কথা আজ কহে না তোমার মনে? ভাবিবার আর অবসর নাহি, বনের আঁধারে মিশিয়াছে পথখানি, দুটি হাত ধরে সেই পথে আজ, যত জোরে পার মোরে নিয়ে চল টানি। এখনি আমারে খুঁজিতে বাহির হইবে ক্ষিপ্ত যত না নমুর পাল, তার আগে মোরা বন ছাড়াইয়া পার হয়ে যাব কুমার নদীর খাল। সেথা আছে ঘোর অতসীর বন, পাতায় পাতায় ঢাকা তার পথগুলি, তারি মাঝ দিয়া চলে যাব মোরা, সাধ্য কাহার সে পথের দেখে ধুলি। হায় দুলী! তুমি এখনো অবুঝ, বুদ্ধি-সুদ্ধি কখন বা হবে হায়, এ পথের কিবা পরিণাম তুমি ভাবিয়া আজিকে দেখিয়াছ কভু তায়? আজ হোক কিবা কাল হোক, মোরা ধরা পড়ে যাব যে কোন অশুভক্ষণে, তখন মোদের কি হবে উপায়, এই সব তুমি ভেবে কি দেখেছ মনে? তোমারে লইয়া উধাও হইব, তারপর যবে ক্ষিপ্ত নমুর দল, মোর গাঁয়ে যেয়ে লাফায়ে পড়িবে দাদ নিতে এর লইয়া পশুর বল; তখন তাদের কি হবে উপায়? অসহায় তারা না না, তুমি ফিরে যাও! যদি ভালবাস, লক্ষ্মী মেয়েটি, মোর কথা রাখ, নয় মোর মাথা খাও। নিজেরি স্বার্থ দেখিলে সোজন, তোমার গেরামে ভাইবন্ধুরা আছে, তাদের কি হবে! তোমার কি হবে! মোর কথা তুমি ভেবে না দেখিলে পাছে? এই ছিল মনে, তবে কেন মোর শিশুকালখানি তোমার কাহিনী দিয়া, এমন করিয়া জড়াইয়াছিলে ঘটনার পর ঘটনারে উলটিয়া? আমার জীবনে তোমারে ছাড়িয়া কিছু ভাবিবারে অবসর জুটে নাই, আজকে তোমারে জনমের মত ছাড়িয়া হেথায় কি করে যে আমি যাই! তোমার তরুতে আমি ছিনু লতা, শাখা দোলাইয়া বাতাস করেছ যারে, আজি কোন প্রাণে বিগানার দেশে, বিগানার হাতে বনবাস দিবে তারে? শিশুকাল হতে যত কথা তুমি সন্ধ্যা সকালে শুনায়েছ মোর কানে, তারা ফুল হয়ে, তারা ফল হয়ে পরাণ লতারে জড়ায়েছে তোমা পানে। আজি সে কথারে কি করিয়া ভুলি? সোজন! সোজন! মানুষ পাষাণ নয়! পাষাণ হইলে আঘাতে ফাটিয়া চৌচির হত পরাণ কি তাহা হয়? ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে, তখনি তা মোছে ঠোঁটেরি হাসির ঘায়, কথার লেখা যে মেহেদির দাগ-যত মুছি তাহা তত ভাল পড়া যায়। নিজেরি স্বার্থ দেখিলে আজিকে, বুঝিলে না এই অসহায় বালিকার, দীর্ঘজীবন কি করে কাটিবে তাহারি সঙ্গে, কিছু নাহি জানি যার। মন সে ত নহে কুমড়ার ফালি, যাহারে তাহারে কাটিয়া বিলান যায়, তোমারে যা দেছি, অপরে ত যবে জোর করে চাবে কি হবে উপায় হায়! জানি, আজি জানি আমারে ছাড়িতে তোমার মনেতে জাগিবে কতেক ব্যথা, তবু সে ব্যথারে সহিওগো তুমি, শেষ এ মিনতি, করিও না অন্যথা। আমার মনেতে আশ্বাস রবে, একদিন তুমি ভুলিতে পারিবে মোরে, সেই দিন যেন দূরে নাহি রয়, এ আশিস আমি, করে যাই বুক ভরে। এইখানে মোরা দুইজনে মিলি গাড়িয়াছিলাম বটপাকুড়ের চারা, নতুন পাতার লহর মেলিয়া, এ ওরে ধরিয়া বাতাসে দুলিছে তারা! সরু ঘট ভরি জল এনে মোরা প্রতি সন্ধ্যায় ঢালিয়া এদের গোড়ে আমাদের ভালবাসারে আমরা দেখিতে পেতাম ইহাদের শাখা পরে। সামনে দাঁড়ায়ে মাগিতাম বর-এদেরি মতন যেন এ জীবন দুটি, শাখায় জড়ায়ে, পাতায় জড়ায়ে এ ওরে লইয়া সামনেতে যায় ছুটি। এ গাছের আর কোন প্রয়োজন? এসো দুইজনে ফেলে যাই উপাড়িয়া, নতুবা ইহারা আর কোনো দিনে এই সব কথা দিবে মনে করাইয়া। ওইখানে মোরা কদমের ডাল টানিয়া বাঁধিয়া আম্রশাখার সনে, দুইজনে বসি ঠিক করিতাম, কেবা হবে রব, কেবা হবে তার কনে। আম্রশাখার মুকুল হইলে, কদম গাছেরে করিয়া তাহার বর, মহাসমারোহে বিবাহ দিতাম মোরা দুইজনে সারাটি দিবসভর। আবার যখন মেঘলার দিনে কদম্ব শাখা হাসিত ফুলের ভারে, কত গান গেয়ে বিবাহ দিতাম আমের গাছের নববধূ করি তারে। বরণের ডালা মাথায় করিয়া পথে পথে ঘুরে মিহি সুরে গান গেয়ে তুমি যেতে যবে তাহাদের কাছে, আঁচল তোমার লুটাত জমিন ছেয়ে। দুইজনে মিলে কহিতাম, যদি মোদের জীবন দুই দিকে যেতে চায়, বাহুর বাঁধন বাঁধিয়া রাখিব, যেমনি আমরা বেঁধেছি এ দুজনায়। আজিকে দুলালী, বাহুর বাঁধন হইল যদিবা স্বেচ্ছায় খুলে দিতে, এদেরো বাঁধন খুলে দেই, যেন এই সব কথা কভু নাহি আনে চিতে। সোজন! সোজন! তার আগে তুমি, যে লতার বাঁধ ছিঁড়িলে আজিকে হাসি, এই তরুতলে, সেই লতা দিয়ে আমারো গলায় পরাইয়ে যাও ফাঁসি। কালকে যখন আমার খবর শুধাবে সবারে হতভাগা বাপ-মায়, কহিও তাদের, গহন বনের নিদারুণ বাঘে ধরিয়া খেয়েছে তায়। যেই হাতে তুমি উপাড়ি ফেলিবে শিশু বয়সের বট-পাকুড়ের চারা, সেই হাতে এসো ছুরি দিয়ে তুমি আমারো গলায় ছুটাও লহুর ধারা। কালকে যখন গাঁয়ের লোকেরা হতভাগিনীর পুছিবে খবর এসে, কহিও, দারুণ সাপের কামড়ে মরিয়াছে সে যে গভীর বনের দেশে। কহিও অভাগী ঝালী না বিষের লাড়ু বানাইয়া খাইয়াছে নিজ হাতে; আপনার ভরা ডুবায়েছে সে যে অথই গভীর কূলহীন দরিয়াতে। ছোট বয়সের সেই দুলী তুমি এত কথা আজ শিখিয়াছ বলিবারে, হায় আমি কেন সায়রে ভাসানু দেবতার ফুল- সরলা এ বালিকারে! আমি জানিতাম, তোমার লাগিয়া তুষের অনলে দহিবে আমারি হিয়া, এ পোড়া প্রেমের সকল যাতনা নিয়ে যাব আমি মোর বুকে জ্বালাইয়া। এ মোর কপাল শুধু ত পোড়েনি তোমারো আঁচলে লেগেছে আগুন তার; হায় অভাগিনী, এর হাত হতে এ জনমে তব নাহি আর নিস্তার! তবু যদি পার মোরে ক্ষমা কোরো, তোমার ব্যথার আমি একা অপরাধী; সব তার আমি পূরণ করিব, রোজ কেয়ামতে দাঁড়াইও হয়ে বাদী। আজকে আমারে ক্ষমা করে যাও, সুদীর্ঘ এই জীবনের পরপারে- সুদীর্ঘ পথে বয়ে নিয়ে যেয়ো আপন বুকের বেবুঝ এ বেদনাবে। সেদিন দেখিবে হাসিয়া সোজন খর দোজখের আতসের বাসখানি, গায়ে জড়াইয়া অগ্নির যত তীব্র দাহন বক্ষে লইবে টানি। আজিকে আমরে ক্ষমা করে যাও, আগে বুঝি নাই নিজেরে বাঁধিতে হায়, তোমার লতারে জড়ায়েছি আমি, শাখা বাহুহীন শুকনো তরুন গায়। কে আমারে আজ বলে দিবে দুলী, কি করিলে আমি আপনারে সাথে নিয়ে, এ পরিণামের সকল বেদনা নিয়ে যেতে পারি কারে নাহি ভাগ দিয়ে। ওই শুন, দূরে ওঠে কোলাহল, নমুরা সকলে আসিছে এদিন পানে, হয়ত এখনি আমাদের তারা দেখিতে পাইবে এইভাবে এইখানে। সোজন! সোজন! তোমরা পুরুষ, তোমারে দেখিয়া কেউ নাহি কিছু কবে, ভাবিয়া দেখেছ, এইভাবে যদি তারা মোরে পায়, কিবা পরিণাম হবে? তোমরা পুরুষ-সমুখে পিছনে যে দিকেই যাও, চারিদেকে খোলা পথ, আমরা যে নারী, সমুখ ছাড়িয়া যেদিকেতে যাব, বাধাঘেরা পর্ব্বত। তুমি যাবে যাও, বারণ করিতে আজিকার দিনে সাধ্য আমার নাই, মোরে দিয়ে গেলে কলঙ্কভার, মোর পথে যেন আমি তা বহিয়া যাই, তুমি যাবে যাও, আজিকার দিনে এই কথাগুলি শুনে যাও শুধু কানে, জীবনের যত ফুল নিয়ে গেলে, কন্টক তরু বাড়ায়ে আমার পানে। বিবাহের বধূ পালায়ে এসেছি, নমুরা আসিয়া এখনি খুঁজিয়া পাবে, তারপর তারা আমারে ঘিরিয়া অনেক কাহিনী রটাবে নানানভাবে। মোর জীবনের সুদীর্ঘ দিনে সেই সব কথা চোরকাঁটা হয়ে হায়, উঠিতে বসিতে পলে পলে আসি নব নবরূপে জড়াবে সারাটি গায়। তবু তুমি যাও, আমি নিয়ে গেনু এ পরিনামের যত গাঁথা ফুল-মালা। ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর মোরে, আকাশ সায়রে তোমার চাঁদের গায়, আমি এসেছিনু, মোর জীবনের যত কলঙ্ক মাখাইয়া দিতে হায়! সে পাপের যত শাসি-রে আমি আপনার হাতে নীরবে বহিয়া যাই, আজ হতে তুমি মনেতে ভাবিও, দুলী বলে পথে কারে কভু দেখ নাই। সোঁতের শেহলা, ভেসে চলে যাই, দেখা হয়েছিল তোমার নদীর কূলে, জীবনেতে আছে বহুসুখ হাসি, তার মাঝে তুমি সে কথা যাইও ভুলে। যাইবার কালে জনমের মত শেষ পদধূলি লয়ে যাই তবে শিরে, আশিস্ করিও, সেই ধূলি যেন শত ব্যথা মাঝে রহে অভাগীরে ঘিরে। সাক্ষী থাকিও দরদের মাতা, সাক্ষী থাকিও হে বনের গাছপালা- সোজন আমার প্রাণের সোয়ামী, সোজন আমার গলার ফুলের মালা। সাক্ষী থাকিও চন্দ্র-সূর্য, সাক্ষী থাকিও- আকাশের যত তারা, ইহকালে আর পরকালে মোর কেহ কোথা নাই, কেবল সোজন ছাড়া। সাক্ষী থাকিও গলার এ হার, সাক্ষী থাকিও বাপ-ভাই যতজন সোজন আমার পরাণের পতি, সোজন আমার মনের অধিক মন। সাক্ষী থাকিও সীথার সিদুর, সাক্ষী থাকিও হাতের দুগাছি শাঁখা, সোজনের কাছ হইতে পেলাম এ জনমে আমি সব চেয়ে বড় দাগা। দুলী! দুলী! তবে ফিরে এসো তুমি, চল দুইজনে যেদিকে চরণ যায়, আপন কপাল আপনার হাতে যে ভাঙিতে চাহে, কে পারে ফিরাতে তায়। ভেবে না দেখিলে, মোর সাথে গেলে কত দুখ তুমি পাইবে জনম ভরি, পথে পথে আছে কত কন্টক, পায়েতে বিঁধিবে তোমারে আঘাত করি। দুপুরে জ্বলিবে ভানুর কিরণ, উনিয়া যাইবে তোমার সোনার লতা, ক্ষুধার সময়ে অন্ন অভাবে কমল বরণ মুখে সরিবে না কথা। রাতের বেলায় গহন বনেতে পাতার শয়নে যখন ঘুমায়ে রবে, শিয়রে শোসাবে কাল অজগর, ব্যাঘ্র ডাকিবে পাশেতে ভীষণ রবে। পথেতে চলিতে বেতের শীষায় আঁচল জড়াবে, ছিঁড়িবে গায়ের চাম, সোনার অঙ্গ কাটিয়া কাটিয়া ঝরিয়া পড়িবে লহুধারা অবিরাম। সেদিন তোমার এই পথ হতে ফিরিয়া আসিতে সাধ হবে না আর, এই পথে যার এক পাও চলে, তারা চলে যায় লক্ষ যোজন পার। এত আদরের বাপ-মা সেদিন বেগানা হইবে মহা-শত্রুর চেয়ে, আপনার জন তোমারে বধিতে যেখানে সেখানে ফিরিবে সদাই ধেয়ে। সাপের বাঘের তরেতে এ পথে রহিবে সদাই যত না শঙ্কাভরে, তার চেয়ে শত শঙ্কা আকুলহইবে যে তুমি, বাপ-ভাইদের ডরে। লোকালয়ে আর ফিরিতে পাবে না, বনের যত না হিংস্র পশুর সনে, দিনেরে ছাপায়ে, রাতের ছাপায়ে রহিতে হইবে অতীব সঙ্গোপনে। খুব ভাল করে ভেবে দেখ তুমি, এখনো রয়েছে ফিরিবার বসর, শুধু নিমিষের ভুলের লাগিয়া কাঁদিবে যে তুমি, সারাটি জনমভর। অনেক ভাবিয়া দেখেছি সোজন, তুমি যেথা রবে, সকল জগতখানি শত্রু হইয়া দাঁড়ায় যদিবা, আমি ত তাদেরে তৃণসম নাহি মানি। গহন বনেতে রাতের বেলায় যখন ডাকিবে হিংস্র পশুর পাল, তোমার অঙ্গে অঙ্গ জড়ায়ে রহিব যে আমি, নীরবে সারাটি কাল। পথে যেতে যেতে ক্লান্ত হইয়া এলায়ে পড়িবে অলস এ দেহখানি, ওই চাঁদমুখ হেরিয়া তখন শত উৎসাহ বুকেতে আনিব টানি। বৃষ্টির দিনে পথের কিনারে মাথার কেশেতে রচিয়া কুটির খানি, তোমারে তাহার মাঝেতে শোয়ারে সাজাব যে আমি বনের কুসুম আনি। ক্ষুধা পেলে তুমি উচু ডালে উঠি থোপায় থোপায় পাড়িয়া আনিও ফল, নল ভেঙে আমি জল খাওয়াইব, বন-পথে যেতে যদি পায়ে লাগে ব্যথা, গানের সুরেতে শুনাইবে আমি শ্রানি- নাশিতে সে শিশুকালের কথা। তুমি যেথা যাবে সেখানে বন্ধু! শিশু বয়সের দিয়ে যত ভালবাসা, বাবুই পাখির মত উচু ডালে অতি সযতনে রচিব সুখের বাসা। দূরের শব্দ নিকটে আসিছে, কথা কহিবার আর অবসর নাই, রাতের আঁধারে চল এই পথে, আমরা দুজনে বন-ছায়ে মিশে যাই। সাক্ষী থাকিও আল্লা-রসুল, সাক্ষী থাকিও যত পীর আউলিয়া এই হতভাগী বালিকারে আমি বিপদের পথে চলিলাম আজি নিয়া। সাক্ষী থাকিও চন্দ্র-সূর্য! সাক্ষী থাকিও আকাশের যত তারা, আজিকার এই গহন রাতের অন্ধকারেতে হইলাম ঘরছাড়া। সাক্ষী থাকিও খোদার আরশ, সাক্ষী থাকিও নবীর কোরানখানি, ঘর ছাড়াইয়া, বাড়ি ছাড়াইয়া কে আজ আমারে কোথা লয়ে যায় টানি। সাক্ষী থাকিও শিমূলতলীর যত লোকজন যত ভাই-বোন সবে, এ জনমে আর সোজনের সনে কভু কোনখানে কারো নাহি দেখা হবে। জনমের মত ছেড়ে চলে যাই শিশু বয়সের শিমূলতলীর গ্রাম, এখানেতে আর কোনদিন যেন নাহি কহে কহে সোজন-দুলীর নাম।
জসীম উদ্‌দীন
স্বদেশমূলক
খেতের পরে খেত চলেছে, খেতের নাহি শেষ সবুজ হাওয়ায় দুলছে ও কার এলো মাথার কেশ। সেই কেশেতে গয়না ও পরায় প্রজাপতির ঝাঁক, চঞ্চুতে জল ছিটায় সেথা কালো কালো কাক। সাদা সাদা বক-কনেরা রচে সেথায় মালা, শরৎকালের শিশির সেথা জ্বালায মানিক আলা। তারি মায়ায় থোকা থোকা দোলে ধানের ছড়া, মার আঁচলের পরশ যেন সকল অভাব-হরা। সেই ফসলে আসমানীদের নেইকো অধিকার, জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে হাহাকার। বনের পরে বন চলেছে বনের নাহি শেষ, ফুলের ফলের সুবাস ভরা এ কোন্ পরীর দেশ? নিবিড় ছায়ায় আঁধার করা পাতার পারাবার, রবির আলো খন্ড হয়ে নাচছে পায়ে তার। সুবাস ফুলের বুনোট করা বনের লিপিখানি, ডালের থেকে ডালের পরে ফিরছে পাখি টানি। কচি কচি বনের পাতা কাঁপছে তারি সুরে, ছোট ছোট রোদের গুড়ো তলায় নাচে ঘুরে, মাথার পরে কালো কালো মেঘেরা এসে ভেড়ে বুনো হাতীর দল এসেছে আকাশখানি ছেড়ে। এই বনেতে আসমানীদের নেইকো অধিকার, জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে অনাহার। নদীর পরে নদী গেছে নদীর নাহি শেষ, কত অজান গাঁ পেরিয়ে কত না-জান দেশ। সাত সাগরের পণ্য চলে সওদাগরের নায়, সুধার ধারা গড়িয়ে পড়ে গঞ্জ নগর ছায়। চখায় মুকর বালুর চরা হাসে কতই তীরে, ফুলের বনে রঙিন হয়ে যায় বা কভু ধীরে; কত মিনার-সৌধ চূড়ার কোল ঘেঁষিয়া যায়, কত শহর হাট-বন্দর বাজার ফেলে বায়। কত নায়ের ভাটিয়ালীর গানে উদাস হয়ে, নদীর পরে নদী চলে কোন অজানায বয়ে। সেই নদীতে আসমানীদের নেইক অধিকার, জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে হাহাকার।
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
বিশ্ববাসীরা শোন, মোদের কাহিনী শুনিয়া কাঁদিবে নাই কি দরদী কোন? সীমান্ত পার হয়ে যারা গেছে হয়ত বেঁচেছে যবে, এখানে যাহারা রয়েছি জানিনে কিবা পরিণাম হবে। প্রতিদিন শুনি ভীষণ হইতে খবর ভীষণতর, শিহরিয়া উঠি থাপড়াই বুক জীয়ন্তে মরমর, রাত্র দিনের দু-খানি পাখায় লিখি অসহ্য গাথা, চোখের সামনে দোলায় দেশের নিষ্ঠুর শাসন-দাতা।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
দীঘিতে তখনো শাপলা ফুলেরা হাসছিলো আনমনে, টের পায়নিক পান্ডুর চাঁদ ঝুমিছে গগন কোণে । উদয় তারার আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পুবের পথে, ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে। গোরস্থানের কবর খুঁড়িয়া মৃতেরা বাহির হয়ে, সাবধান পদে ঘুরিছে ফিরিছে ঘুমন্ত লোকালয়ে। মৃত জননীরা ছেলে মেয়েদের ঘরের দুয়ার ধরি, দেখিছে তাদের জোনাকি আলোয় ক্ষুধাতুর আঁখি ভরি। মরা শিশু তার ঘু্মন্ত মার অধরেতে দিয়ে চুমো, কাঁদিয়া কহিছে, “জনম দুখিনী মারে, তুই ঘুমো ঘুমো।” ছোট ভাইটিরে কোলেতে তুলিয়া মৃত বোন কেঁদে হারা, ধরার আঙনে সাজাবে না আর খেলাঘরটিরে তারা। দুর মেঠো পথে প্রেতেরা চলেছে আলেয়ার আলো বলে, বিলাপ করিছে শ্মশানের শব ডাকিনী যোগীনি লয়ে। রহিয়া রহিয়া মড়ার খুলিতে বাতাস দিতেছে শীস, সুরে সুরে তার শিহরি উঠিছে আঁধিয়ারা দশধিশ। আকাশের নাটমঞ্চে নাচিছে অন্সরী তারাদল, দুগ্ধ ধবল ছায়াপথ দিয়ে উড়াইয়ে অঞ্চল। কাল পরী আর নিদ্রা পরীরা পালঙ্ক লয়ে শিরে, উড়িয়া চলেছে স্বপনপুরীর মধুবালা-মন্দিরে। হেনকালে দুর গ্রামপথ হতে উঠিল আজান-গান । তালে তালে তার দুলিয়া উঠিল স্তব্ধএ ধরাখান। কঠিন কঠোর আজানের ধবনি উঠিল গগন জুড়ে। সুরেরে কে যেন উঁচু হতে আরো উঁচুতে দিতেছে ছুঁড়ে। পু্র্ব গগনে রক্ত বরণ দাঁড়াল পিশাচী এসে, ধরণী ভরিয়া লহু উগারিয়া বিকট দশনে হেসে। ডাক শুনি তার কবরে কবরে পালাল মৃতের দল, শ্মাশানঘাটায় দৈত্য দানার থেমে গেল কোলাহল। গগনের পথে সহসা নিবিল তারার প্রদীপ মালা চাঁদ জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে গেল ভরি আকাশের থালা। তখনো কঠোর আজান ধ্বনিছে, সাবধান সাবধান! ভয়াল বিশাল প্রলয় বুঝিবা নিকটেতে আগুয়ান। ওরে ঘুমন্ত-ওরে নিদ্রিত-ঘুমের বসন খোল, ডাকাত আসিয়া ঘিরিয়াছে তোর বসত-বাড়ির টোল। শয়ন-ঘরেতে বাসা বাঁধিয়াছে যত না সিঁধেল চোরে, কন্ঠ হইতে গজমতি হার নিয়ে যাবে চুরি করে। শয়ন হইতে জাগিল সোজন, মনে হইতেছে তার কোন অপরাধ করিয়াছে যেন জানে না সে সমাচার। চাহিয়া দেখিল, চালের বাতায় ফেটেছে বাঁশের বাঁশী, ইঁদুর আসিয়া থলি কেটে তার ছড়ায়েছে কড়িরাশি। বার বার করে বাঁশীরে বকিল, ইদুরের দিল গালি, বাঁশী ও ইঁদুর বুঝিল না মানে সেই তা শুনিল খালি। তাড়াতাড়ি উঠি বাঁশীটি লইয়া দুলীদের বাড়ি বলি, চলিল সে একা রাঙা প্রভাতের আঁকা-বাঁকা পথ দলি। খেজুরের গাছে পেকেছে খেজুর, ঘনবন-ছায়া-তলে, বেথুল ঝুলিছে বার বার করে দেখিল সে কুতুহলে। ও-ই আগডালে পাকিয়াছে আম, ইসরে রঙের ছিরি, এক্কে ঢিলেতে এখনি সে তাহা আনিবারে পারে ছিঁড়ি। দুলীরে ডাকিয়া দেখাবে এসব, তারপর দুইজনে, পাড়িয়া পাড়িয়া ভাগ বসাইবে ভুল করে গণে গণে। এমনি করিয়া এটা ওটা দেখি বহুখানে দেরি করি, দুলীদের বাড়ি এসে-পৌঁছিল খুশীতে পরাণ ভরি। দুলী শোন্ এসে- একিরে এখনো ঘুমিয়ে যে রয়েছিস্? ও পাড়ার লালু খেজুর পাড়িয়া নিয়ে গেলে দেখে নিস্! সিঁদুরিয়া গাছে পাকিয়াছে আম, শীগগীর চলে আয়, আর কেউ এসে পেড়ে যে নেবে না, কি করে বা বলা যায়। এ খবর শুনে হুড়মুড় করে দুলী আসছিল ধেয়ে, মা বলিল, এই ভর সক্কালে কোথা যাস্ ধাড়ী মেয়ে? সাতটা শকুনে খেয়ে না কুলোয় আধেক বয়সী মাগী, পাড়ার ধাঙড় ছেলেদের সনে আছেন খেলায় লাগি। পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেতে পাড়ায় যে টেকা ভার, চুন নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার! এ সব গালির কি বুঝিবে দুলী, বলিল একটু হেসে, কোথায় আমার বসয় হয়েছে, দেখই না কাছে এসে। কালকে ত আমি সোজনের সাথে খেলাতে গেলাম বনে, বয়স হয়েছে এ কথা ত তুমি বল নাই তক্ষণে। এক রাতে বুঝি বয়স বাড়িল? মা তোমার আমি আর মাথার উকুন বাছিয়া দিব না, বলে দিনু এইবার। ইহা শুনি মার রাগের আগুন জ্বলিল যে গিঠে গিঠে, গুড়ুম গুড়ুম তিন চার কিল মারিল দুলীর পিঠে। ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চাহিয়া সোজন দেখিল এ অবিচার, কোন হাত নাই করিতে তাহার আজি এর প্রতিকার। পায়ের উপরে পা ফেলিয়া পরে চলিল সমুখ পানে, কোথায় চলেছে কোন পথ দিয়ে, এ খবর নাহি জানে। দুই ধারে বন, লতায়-পাতায় পথেরে জড়াতে চায়, গাছেরা উপরে ঝলর ধরেছে শাখা বাড়াইয়া বায়। সম্মুখ দিয়া শুয়োর পালাল, ঘোড়েল ছুটিল দূরে, শেয়ালের ছাও কাঁদন জুড়িল সারাটি বনানী জুড়ে। একেলা সোজন কেবলি চলেছে কালো কুজঝটি পথ, ভর-দুপুরেও নামে না সেথায় রবির চলার রথ। সাপের ছেলম পায়ে জড়ায়েছে, মাকড়ের জাল শিরে, রক্ত ঝরিছে বেতসের শীষে শরীরের চাম ছিঁড়ে। কোন দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই রায়ের দীঘির পাড়ে, দাঁড়াল আসিয়া ঘন বেতঘেরা একটি ঝোপের ধারে। এই রায়-দীঘি, ধাপ-দামে এর ঘিরিয়াছে কালো জল, কলমি লতায় বাঁধিয়া রেখেছে কল-ঢেউ চঞ্চল। চারধারে এর কর্দম মথি বুনো শুকরের রাশি, শালুকের লোভে পদ্মের বন লুন্ঠন করে আসি। জল খেতে এসে গোখুরা সপেরা চিহ্ন এঁকেছে তীরে, কোথাও গাছের শাখায় তাদের ছেলম রয়েছে ছিঁড়ে। রাত্রে হেথায় আগুন জ্বালায় নর-পিশাচের দল, মড়ার মাথায় শিস দিয়ে দিয়ে করে বন চঞ্চল। রায়েদের বউ গলবন্ধনে মরেছিল যার শাখে, সেই নিমগাছ ঝুলিয়া পড়িয়া আজো যেন কারে ডাকে! এইখানে এসে মিছে ঢিল ছুঁড়ে নাড়িল দীঘির জল, গাছেরে ধরিয়া ঝাঁকিল খানিক, ছিঁড়িল পদ্মদল। তারপর শেষে বসিল আসিয়া নিমগাছটির ধারে, বসে বসে কি যে ভাবিতে লাগিল, সেই তা বলিতে পারে। পিছন হইতে হঠাৎ আসিয়া কে তাহার চোখ ধরি, চুড়ি বাজাইয়া কহিল, কে আমি বল দেখি ঠিক করি? ও পাড়ার সেই হারানের পোলা। ইস শোন বলি তবে নবীনের বোন বাতাসী কিম্বা উল্লাসী তুমি হবেই হবে! পোড়ামুখীরা এমনি মরুক- আহা, আহা বড় লাগে, কোথাকার এই ব্রক্ষদৈত্য কপালে চিমটি দাগে। হয়েছে হয়েছে, বিপিনের খুড়ো মরিল যে গত মাসে, সেই আসিয়াছে, দোহাই! দোহাই! বাঁচি না যে খুড়ো ত্রাসে! ‘‘ভারি ত সাহস!’’ এই বলে দুলী খিল্ খিল্ করে হাসি, হাত খুলে নিয়ে সোজনের কাছে ঘেঁষিয়া বসিল আসি। একি তুই দুলী! বুঝিবা সোজন পড়িল আকাশ হতে, চাপা হাসি তার ঠোঁটের বাঁধন মানে না যে কোনমতে। দুলী কহে, দেখ! তুই ত আসিলি, মা তখন মোরে কয়, বয়স বুঝিয়া লোকের সঙ্গে আলাপ করিতে হয়। ও পাড়ার খেঁদি পাড়ারমুখীরে ঝেঁটিয়ে করিতে হয়। আর জগাপিসী, মায়ের নিকটে যা তা বলিয়াছে তারা। বয়স হয়েছে আমাদের থেকে ওরাই জানিল আগে, ইচ্ছে যে করে উহাদের মুখে হাতা পুড়াইয়া দাগে। আচ্ছা সোজন! সত্যি করেই বয়স যদিবা হত, আর কেউ তাহা জানিতে পারিত এই আমাদের মত? ঘাড় ঘুরাইয়া কহিল সোজন, আমি ত ভেবে না পাই, আজকে হঠাৎ বয়স আসিল? আসিলই যদি শেষে, কথা কহিল না, অবাক কান্ড, দেখি নাই কোনো দেশে। দুলালী কহিল, আচ্ছা সোজন, বল দেখি তুই মোরে, বয়স কেমন! কোথায় সে থাকে! আসে বা কেমন করে! তাও না জানিস! সোজন কহিল, পাকা চুল ফুরফুরে, লাঠি ভর দিয়ে চলে পথে পথে বুড়ো সে যে থুরথুরে। দেখ দেখি ভাই, মিছে বলিসনে, আমার মাথার চুলে, সেই বুড়ো আজ পাকাচুল লয়ে আসে নাইতরে ভুলে? দুলীর মাথার বেণীটি খুলিয়া সবগুলো চুল ঝেড়ে, অনেক করিয়া খুঁজিল সোজন, বুড়োনি সেথায় ফেরে! দুলীর মুখ ত সাদা হয়ে গেছে, যদি বা সোজন বলে, বয়স আজিকে এসেছে তাহার মাথার কেশেতে চলে! বহুখন খুঁজি কহিল সোজন-নারে না, কোথাও নাই, তোর চুলে সেই বয়স-বুড়োর চিহ্ন না খুঁজে পাই! দুলালী কহিল, এক্ষুণি আমি জেনে আসি মার কাছে আমার চুলেতে বয়সের দাগ কোথা আজি লাগিয়াছে। দুলী যেন চলে যায়ই আর কি, সোজন কহিল তারে, এক্ষুণি যাবি? আয় না একটু খেলিগে বনের ধারে। বউ-কথা কও গাছের উপরে ডাকছিল বৌ-পাখি, সোজন তাহারে রাগাইয়া দিল তার মত ডাকি ডাকি। দুলীর তেমনি ডাকিতে বাসনা, মুখে না বাহির হয়, সোজনেরে বলে, শেখা না কি করে বউ কথা কও কয়? দুলীর দুখানা ঠোঁটেরে বাঁকায়ে খুব গোল করে ধরে, বলে, এইবার শিস দে ত দেখি পাখির মতন স্বরে। দুলীর যতই ভুল হয়ে যায় সোজন ততই রাগে, হাসিয়া তখনদুলীর দুঠোট ভেঙে যায় হেন লাগে। ধ্যেৎ বোকা মেয়ে, এই পারলি নে, জীভটা এমনি করে, ঠোটের নীচেতে বাঁকালেই তুই ডাকিবি পাখির স্বরে। এক একবার দুলালী যখন পাখির মতই ডাকে, সোজনের সেকি খুশী, মোরা কেউ হেন দেখি নাই তাকে। দেখ, তুই যদি আর একটুকু ডাকিতে পারিস ভালো, কাল তোর ভাগে যত পাকা জাম হবে সব চেয়ে কালো। বাঁশের পাতার সাতখানা নথ গড়াইয়া দেব তোরে, লাল কুঁচ দেব খুব বড় মালা গাঁথিস যতন করে! দুলী কয়, তোর মুখ ভরা গান, দে না মোর মুখে ভরে, এই আমি ঠোঁট খুলে ধরিলাম দম যে বন্ধ করে। দাঁড়া তবে তুই, বলিয়া সোজন মুখ বাড়ায়েছে যবে, দুলীর মাতা যে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল কলরবে। ওরে ধাড়ী মেয়ে, সাপে বাঘে কেন খায় না ধরিয়া তোরে? এতকাল আমি ডাইনি পুষেছি আপন জঠরে ধরে! দাঁড়াও সোজন! আজকেই আমি তোমার বাপেরে ডাকি, শুধাইব, এই বেহায়া ছেলের শাসি- সে দেবে নাকি? এই কথা বলে দুলালীরে সে যে কিল থাপ্পড় মারি, টানিতে টানিতে বুনো পথ বেয়ে ছুটিল আপন বাড়ি। একলা সোজন বসিয়া রহিল পাথরের মত হায়, ভাবিবারও আজ মনের মতন ভাষা সে খুঁজে না পায়?
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
দুই এক কালা দতের কালি যা দ্যা কলম লেখি, আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি, —ও কালা, ঘরে রইতে দিলি না আমারে | — মুর্শিদা গান এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল, কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল! কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া, তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া | জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, গা-খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু | বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল, বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল | কচি ধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষী, মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি | কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি, কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি | জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভূবনময় ; চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয় | সোনায় যে জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার’ রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার | কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন, তারি পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন | সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ, কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক | যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও! সেই কালোতে সিনান করি উজল তাহার গাও | আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী, খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি | জারীর গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে, “শাল-সুন্দী-বেত” যেন ও, সকল কাজেই লাগে | বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল লোহা যেন, রূপাই যেমন বাপের বেটা, কেউ দেখেছ হেন? যদিও রূপা নয়কো রূপাই, রূপার চেয়ে দামী, এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামী | ***** পাগাল = ইস্পাত
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে; আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব কাহারে শুধাইরে? ওপারে মেঘের ঘটা, কনক বিজলী ছটা, মাঝে নদী বহে সাঁই সাঁইরে; আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাইরে; আমি দেখিতে দেখিতে সে রূপ আবার দেখি নাইরে।বেসম নদীর পানি, ঢেউ করে হানাহানি, ভাঙা এ তরনী তবু বাইরে, আমার অকূলের কূল দয়াল বন্ধুর যদি দেখা পাইরে।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
কোথা হতে এলো রসের বৈরাগী আর বোষ্টমী, আকাশ হতে নামল কি চান হাসলাপরা অষ্টমী। চেকন চোকন বোষ্টমী তার ঝটরা মাথায় দীঘল কেশ, খেজুর গাছের বাগড়া যেমন পূব হাওয়াতে দুলছে বেশ। পাছা পেড়ে শাড়িখানি পাছা বেয়ে যায় পড়ে, বৈরাগী কয়, তারির সাথে ফাঁস লাগায় যাই মরে। মুখখানি তার ডাগর ডোগর ঘষামাজা কলসখানি। বৈরাগী কয় গলায় বেঁধে মাপতে পারি গাঙের পানি। সঙ্গে চলে বৈরাগী তার তেল কুচ কুচ নধর কায়, গয়লা বাড়ির ময়লা বাছুর রোদ মেখেছ সকল গায়। আকাশেরও কালো মেঘে প্রভাতেরি পড়ছে আলো, সামনে লয়ে পূর্ণিমা চাঁদ অমাবস্যা যায় কি ভাল। হাতে তাহার ঘুব ঘুমা ঘুম বাজে রসের একতারা, বৈরাগী বউর রূপের গাঙ্গে মুর্চ্ছি সে সুর হয় হারা। বৈরাগী যে চলছে পথে চলছে রসের রূপখানি, বৈরাগী তার একতারাতে চলছে তারি সুর হানি। হিসেব লেখে বেনের ছেলে অঙ্কে তাহার হয় যে ভুল, নুন মাপিতে চুন মেপে কয় বৈরাগিনীর হয় না তুল। বৈরাগী আর বোষ্টমী যায়-মহাজনের থামছে খাতা, থামছে পালা থামছে পাথর, ওরা দুজন নয়কো যা-তা। সিকে কড়ায় পোয়া কড়ায় ছিল যেথায় হিসাব নিকাশ, একতারারি ঝঙ্কারেতে আনল সেথার কি অবকাশ। কৃষ্ণশোকে রাই মরিল, তমাল লতা মুরছে পড়ে, সাজী মশায় বান ডাকালমহাজনী খাতার পরে। চলতে পথে সবার ঘরে হুকোর মাথায় আগুন জ্বলে। বৈরাগী ভাই! বসো বসো তামাক খেয়েই যেয়ো চলে। চলতে পথে বাটায় বাটায় পান ভরা হয় সবার ঘরে, বউরা বলে, বোষ্টমী সই পান সেজেছি তোমার তরে। বৈরাগী আর বোষ্টমী যায়, রবিবারের দিনটি নাকি একতারারি ঝঙ্কারেতে গায়ের পথে যায় গো ডাকি। ঘুব ঘুমা ঘুম বাজনা বাজে অবসরের ঘন্টাখানি, পথের মাঝে যেইবা শুনে অমনি ছাড়ে কাজের ঘানি। গাঁয়ের ধারে বটের তলে বৈরাগী আর বোষ্টমী গায়, একতারারি তারে তারে সুরের পরে সুর মূরছায়। ঘাসের বোঝা ফেলছে চাষী হালের গরু বেপথ যায়, মান সায়রের কলমিনী শাম-সায়রো ভাসছে হায়। যাক গরু আজ পরের ক্ষেতে, ধান নিড়ান থাক না ভাই, শ্যাম গেছে আজ ব্রজ ছেড়ে কেমন করে বাঁচবে রাই? গান গেয়ে যে বৈরাগী যায় গাঁয়ের পথে অনেক দূর, মাঠের কাজে কৃষাণ ছেলের বুকের মাঝে কানছে সুর। গানে গানে দেখছে যেন দুধারে ধান সবুজ সাচা, মাঝ দিয়ে যায় বৈরাগিনী মুখখানি তার কাঁচা কাঁচা।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়, পদ্মা নদীর উজান বাঁকে ছোট্ট ডিঙি নায়। পদ্মা নদী কাটাল ভারী, চাক্কুতে যায় কাটা, তারির পরে জেলের তরী করে উজান+ভাঁটা। জলের উপর শ্যাওলা ভাসে, স্রোতের ফুলও ভাসে, তারির পরে জেলের তরী ফুলেল পালে হাসে; তারি সাথে ভাসায় জেলে ভাটীর সুরে গান, জেলেনী তার হয়ত তাহার সাথেই ভেসে যান। জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়, জেলেনী বউ জাল যে বুনায় বসে ঘরের ছায়। সূতোর পরে সুতো দিয়ে বুনোয় দীঘল জাল, তারির সাথে বুনিয়ে চলে দীঘল মনের হাল। জেলে তাহার নেই যে ঘরে, ভোরের কোকিল ডাকে জেলেনী বউ আপন মনে জাল বুনাতেই থাকে। জেলে গেছে মাছ ধরিতে হায়, পূব কোণেতে মেঘের গায়ে চক্কর দিয়ে যায়। বাও ডাকিল, ঢেউঁ হাঁকিল তল তলা নাওখানি, জেলেনী বউ ঘরের থেকে সেঁচছে তাহার পানি। বৈষম শাপট! জেলের কুঁড়ে ভাঙবে যে এই বেলা গাঙের থেকে দিচ্ছে জেলে বৈঠাতে তার পেলা। গাঙে কাঁপে জেলের তরী, ঘরে জেলের প্রিয়া, মধ্যে তারি আসন-যাওন করছে জেলের হিয়া। জেলে ভাবে ঘরের কথা, বউ যে জেলের তরী, এরি মধ্যে ঝড় পাগেলা কোথায় যে যায় সরি। লাভের মাঝে হাজরা তলা দুগ্ধেতে যায় ভাসি, গঙ্গা দেবীর কপাল ভালো পূজায় উঠেন হাসি! জেলে গেছে মাছ ধরিতে বাঁকে, জেলেনী বোর মন ভালো না বলতে নারে কাকে! জাল বুনিতে ভুল হয়ে যায়, সূতো কেবল ছেঁড়ে জেলে বাঁকের বগীলা তার মন নিয়েছে কেড়ে। জলের ঘাটে কলস তাহার ভরেও নাহি ভরে, ইচ্ছা করে কলসীটিরে বাঁধি মাথার কেশে, ভাসিয়ে দেয় জেলে তাহার রয় যে বে গান দেশে। জেলে বাঁকে মাছ ধরিতে যায়, কূল হারা সেই গাঙে কাহার কুল লইয়া হায়! অথই নদীর অথই পানি জালে না পায় তাল অথই মনের ব্যথা জেলের তার চেয়ে জঞ্জাল। কত নদী পেরিয়ে এলো ততই নদী ছাড়ি, ব্যথার নদী উথল পাথল জমছেনাক পাড়ি। মাটির মায়া কাটালো যে ভাটীর সুরে হায়, কেন তাহার পরাণ টানে সুদূর ভাটী গাঁয়!
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
ও তোর নাম শুনিয়ারে, ও তোর রূপ দেখিয়ারে, ও তোর ডাক শুনিয়ারে, ও তোর ভাব জানিয়ারে, সোনা, আমার মন ত না রয় ঘরেরে। সাগরে উঠিয়া ঢেউ কূলে আইসা পড়ে, কূল নাই, কিনারা নাই কুল-কলঙ্কিনীর তরে; কান্দিয়া কান্দাব বন্ধু! এমন দোসর নাই, আমি সাজায়ে ব্যথার চিতা নিজ হাতে জ্বালাইরে। তুমিত জানিতে বন্ধু প্রেমের কত জ্বালা, তবে কেন পরিলে গলে আমার ফুলের মালা; তবে কেন কদম্বতলে বাঁশরী বাজালে, কিবা অপরাধে বন্ধু, অবলা বধিলে।
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
মুজিবর রহমান। ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান। বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে, জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞঝা-অশনি বেয়ে । বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার। হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যে অঙ্গার ; দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে, দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে ; তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি। মুজিবর রহমান। তব অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত-স্নান। পীড়িত-জনের নিশ্বাস তারে দিয়েছে চলার গতি, বুলেটে নিহত শহীদেরা তার অঙ্গে দিয়েছে জ্যেতি। দুর্ভিক্ষের দানব তাহারে অদম্য বল, জঠরে জঠরে অনাহার-জ্বালা করে তারে চঞ্চল। শত ক্ষতে লেখা অমর কাব্য হাসপাতালের ঘরে, মুর্হুমুহু যে ধবনিত হইছে তোমার পথের পরে। মায়ের বুকের ভায়ের বুকের বোনের বুকের জ্বালা, তব সম্মুখ পথে পথে আজ দেখায়ে চলিছে আলা। জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী পাছে, তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে। রাজভয় আর কারাশৃঙ্কল হেলায় করেছ জয়। ফাঁসির মঞ্চে-মহত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়। বাঙলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমুর্ত রাজ, প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ। তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার। অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছে-স্তব্ধ হুকুমদার। এই বাঙলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ, সন্ন্যাসী বেশে দেশ-বন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক। শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী-জীবন করিয়া দান, মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান। তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর, জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাঙলার। সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত ত্রাস, কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস। তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়, আমরা বাঙালীর মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়। ধন্য এ কবি ধন্য এ যুগে রয়েছে জীবন লয়ে, সম্মুখে তার মহাগৌরবে ইতিহাস চলে বয়ে। ভুলিব না সেই মহিমার দিন, ভাষার আন্দোলনে । বুরেটের ভয় তুচ্ছ করিয়া ছেলেরা দাঁড়াল রণে । বরকত আর জব্বার আর সালাম পথের মাঝে, পড়ে বলে গেলো, “আমরা চলিনু ভাইরা আসিও পাছে।” উত্তর তার দিয়েছে বাঙালী, জানুয়ারী সত্তরে, ঘরের বাহির হইল ছেলেরা বুলেটের মহা-ঝড়ে। পথে পথে তারা লিখিল লেখন বুকের রক্ত দিয়ে, লক্ষ লক্ষ ছুটিল বাঙালী সেই বাণী ফুকারিয়ে। মরিবার সে কি উন্মাদনা যে, ভয় পালাইল ভয়ে, পাগলের মত ছোট নর-নারী মৃত্যুরে হাতে লয়ে। আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি, দিকে দিগনে- বাজিল যেদিন বাঙালীর জয়ভেরী। মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার, বঙ্গ-বঙ্গ শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার। আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা, জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা। মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি, বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকসী-কাঁথার ছবি। মানুষ মানুষ রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার, এক সাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর রুপালীর তার পরে, পরাণ ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্বভরে। আম-কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কুটিরগুলির তলে, সুখ যে আসিয়া গড়াগড়ি করি খেলাইবে কুতুহলে। আরো একদিন ধন্য হইব চির-নির্ভীকভাবে, আমাদরে জাতি নেতার পাগড়ি ধরিয়া জবাব চাবে, “কোন অধিকারে জাতির স্বার্থ করিয়াছ বিক্রয়?” আমার এদেশ হয় যেন সদা সেইরুপ নির্ভয়। ১৬ই মার্চ, ১৯৭১ সন
জসীম উদ্‌দীন
স্বদেশমূলক
আমি একজন মুক্তি-যোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে, ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগী । কখনো সে ধরে রেজাকার বেশ, কখনো সে খান-সেনা, কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা। কখনো সে পশি ঢাকা-বেতারের সংরক্ষিত ঘরে, ক্ষেপা কুকুরের মরণ-কামড় হানিছে ক্ষিপ্ত স্বরে।আমি চলিয়াছি চির-নির্ভীক অবহেলি সবকিছু নরমুণ্ডের ঢেলা ছড়াইয়া পশ্চাত-পথ পিছু। ভাঙিতেছি স্কুল ভাঙিতেছি সেতু ষ্টিমার জাহাজ লরি, খান-সৈন্যরা যেই পথে যায় আমি সে পথের অরি ওরা ভাড়া-করা ঘৃণ্য গোলাম স্বার্থ-অন্ধ সব, মিথ্যার কাছে বিকাতে এসেছে স্বদেশের বৈভব!আমরা চলেছি রক্ষা করিতে মা-বোনের ইজ্জত, শত শহীদের লোহুতে জ্বালানো আমাদের হিম্মত। ভয়াল বিশাল আঁধার রাত্রে ঘন-অরণ্য ছায়, লুণ্ঠিত আর দগ্ধ-গ্রামের অনল সম্মুখে ধায়। তাহার আলোতে চলিয়াছি পথ, মৃত্যুর তরবার, হস্তে ধরিয়া কাটিয়া চলেছি খান-সেনা অনিবার।এ সোনার দেশে যতদিন রবে একটিও খান-সেনা, ততদিন তব মোদের যাত্রা মুহুর্তে থামিবে না। মাঠগুলি পুনঃ ফসলে ফসলে পরিবে রঙিন বেশ, লক্ষ্মীর ঝাঁপি গড়ায়ে ছড়ায়ে ভরিবে সকল দেশ। মায়ের ছেলেরা হবে নির্ভর, সুখ হাসি ভরা ঘরে, দস্যুবিহীন এদেশ আবার শোভিবে সুষম ভরে।