poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
বিশাখা একি! এ যে সারা জ্বলছে উনোন!
চোখে যেন অগ্নিবৃষ্টি হয়েছে কখন, পুড়ে লাল
ঠোট নীল, চামড়া হলুদ
কপালে ফাটল, ভস্ম মুখে।
চাঁপাকলি আঙুলেরা কাটারি কুড়োলে কাটা ডাল।
মেঘময় কুন্তলের দশা দেখলে হাসবে আঁস্তাকুড়
মরা কচ্ছপের মতো মাথায় উপুড় বাসি খোঁপা
নদীতে আছাড় খেয়ে কপাল ভাঙার পরে নৌকারা যেমন
স্রোতে আত্মসমর্পিত ভেসে থাকা ছাড়া
ভূলে যায় গন্তব্য ও গমনাগমন
সেই হাল জ্বরে-পোড়া তোর শরীরের।
কদমতলার জন্যে তবু চোখ উড়াল ভ্রমর।
চন্দ্রাবলি, শোন!
ভালোবাসাবাসি নিয়ে খেলা হল ঢের
ঢের বাঁশী শোনা হল, ঢের হল গাগরী ভরণ।
আমার মিনতি, যদি না চাস মরণ,
কলসী নামিয়ে রাখ, খুলে ফ্যাল পায়ের নুপুর,
নীলাম্বরী, কাঁখে চন্দ্রহার।
যমুনা আকাশ-কন্যা, জলে গাঢ়, যৌবনেও গাঢ়
যমুনা কালকেও থাকবে কেউ তাকে খাচ্ছেনাকো শুষে
কদমতলাও থাকবে, কুঞ্জছায়া, নিখোঁজ কিংখাব
এবং অগুরু গন্ধে নিকানো দখিন হাওয়া তাও পাওয়া যাবে।
তার শ্যম থাকবে তোরই শ্যাম।
ডাকাতের বাঁশী শুনে পুড়ে-থাক হওয়া ব্যামো ছেড়ে
আজকে নে নিখাদ বিশ্রাম।
শ্রীরাধা শরীরের কথা রাখ,
শরীরেরই যত জ্বর-জ্বালা
নৌকাডুবি, খরা বানে-ভাসা,
বারোমাসে বারোশো মুখোশ।
আমি কি আমার এই শরীরের হাটে কেনা দাসী?
শুধু তার উঠোনেই ঝাঁট-পাট দিয়ে যাব ঋতু গুনে গুনে?
আমি যে ভূমিষ্ঠ সে কি শুধু শরীরের
সমান্তরাল হব একটুকু মিছরী দানা সুখে?
শরীরেরও কতটুকু যথার্য শরীর?
বিশাখা! যখন সূর্য ওঠে,
কিংবা সূর্য ডুবে যায়, যাবার আগের সন্ধিক্ষনে
রাজমহিষীর প্রাপ্য ভালোবাসা দিয়ে
রক্ত ওষ্ঠে দিগন্ত রাঙায়
তখন কে খুশি হল বল?
শরীরের অন্তর্গত চোখ? না শরীর?
নাকি ভিন্নতর কেউ
বুকের ভিতরে গুহা বানিয়ে আলোর স্তব যার?
বিশাখা। আহা! সে তো অন্য আলো!
আকাশের আত্মউন্মোচন।
সে আবীর যত মাখো, চোখ দিয়ে যত করো পান
অবসানহীন।
ঘরের আলোর মতো সে তো আর নিয়মের জ্বলার নেভার
ফাই ফরমাস খেটে গৃহস্থকে খুশি করবার
মাপা-জোপা আলো কিংবা আলো-কণা নয়।
সে এক দ্বিতীয় আলো
দৃষ্টির সুড়ঙ্গ বেয়ে তার অভিযান
চেতনা-শিখরে।
শ্রীরাধা। বিশাখা। তাহলে তুই একটু আগে বললি কি করে
ঢের ভালোবাসাবাসি, ডাকাতের বাঁশী?
সাজানো সংসার, স্বামী সমাজ-শৃঙ্খলা
ভিজে কাপড়ের মতো খুঁটিতে ঝুলিয়ে
আমি যার কাছে যাই সেই এক দ্বিতীয় আলোই।
কতটুকু মাছ-মাংসে শরীর সন্তুষ্ট হয় জানি
শরীরের খিদে মিটলে আরো বড় খিদে জেগে ওঠে।
আমার এ জীবনের কতটুকু ছারখার পুড়বার নশ্বর কঙ্কাল
কতটুকুপৃথিবীর রোদে-জলে মেঘে ঝড়ে চিরকাল লিখে রাখবার
স্বজন মহলে বাধ্য বিনোদিনী হয়ে বেশি সুখ
নাকি বিদ্রোহিনী হলে সমস্ত ললাট জুড়ে আকাশের আর্শীবাদ পাবো।
তারই মূল্যায়ন কিংবা সেই আত্মপরিচয় পেতে
সর্বস্বের বিনিময়ে আমি তার কাছে ছুটে যাই।
দ্বিতীয় আলোর মতো ঐ এক দ্বিতীয় পুরুষ।
তার কাছে পৌঁছলেই পেয়ে যাই নিজের শিকড়,
সংসারের কাটা-ছেঁড়া প্রত্যহের ছোট ছোট মরা
নিমেষে সেলাই এক জরির সুতোয়,
অসি-ত্বে অস্ফুট পদ্মে শত পুষ্প গেয়ে ওঠে গান।
জাগে জন্মান্তর, জাগে নতুন জন্মের নৃত্যতাল
যেন আমাকেই ঘিরে চর্তুদিকে শঙ্খের উৎসব
অন্বিস্ট রয়েছে যার, তার হাঁটা অগ্নি ছুঁয়ে ছুঁয়ে
রক্ত-রেখা পথে, শুধু তাকেই মানায় প্রতিশ্রুত
ঝড়ের রাতের অভিসার।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
মুহূর্তের সার্থকতা মানুষের কাছে আজ
বড় বেশি প্রিয়।
জীবনের স্থাপত্যের উচ্চতা ও অভিপ্রায়মালা
ছেঁটে ছোট করে দিতে
চতুর্দিকে উগ্র হয়ে রয়েছে সেলুন।
মানুষের ভাঙা-চোরা ভুরুর উপরে
চাঁদের ফালির মতো
আজ কোনো স্থির আলো নেই।
ছাতার দোকানে ছাতা যে-রকম ঝোলে
সেইভাবে মানুষের রক্ত ও চন্দনমাখা স্বপ্নগুলি
হ্যাঙ্গারে রয়েছে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
নীল তারার আকাশে কত গান যে গায় পাখি
কত যে পাখি সাগর-ছোঁয়া ডানায় রোদ ভরে
এখানে আসে-আমার কাছে আমার উঠোনেই
বধূর মতো কোমল দুটি করুণ চোখ তুলে।
বধূও আসে কাজল রাতে কাজলদিঘী জল
যখন ঢাকে চাঁদের মুখ কলমীবন ছুয়ে,
তখন আমি তাকাই শুধু তাকাই বহু দূর
তখন এই হৃদয় যেন হৃদয় কোনো গানের।
কেন যে গান-কেন যে সুর- কেন যে মন, হায়,
হাওয়ার মতো ভরিয়ে দেয় ধানের মিঠে মাঠ,
তবু যে কেন দু চোখে জল, বুকে যে কেন জ্বালা
জানিনে কেন তবুও ঠিক জীবনখানা নেই।
জীবন কই-জীবন বৈ- কেমনে বাঁচা যায়
বাঁচার স্বাদ, বাঁচার সাধ পিদিমে মেটে নাকো,
আরো যে চাই প্রাণের আলো-গানের আত্মদানের
উজাড়-বিষ সন্ধ্যা ভোর আলোয় উন্মনা।
সে আলো জ্বালি- সে প্রাণে ঢালি মরণ অঙ্গীকার
সে ক্ষতবুক কিনার জুড়ে শিবির প্রতিরোধের।
আবার যবে আলোর দিনে হীরণ-শিহরণ,
সুখের ঘর গড়বে বধূ অনির্বচনীয়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
সেই কবে বাল্যকালে বৃষ্টি হয়েছিল
সেই কবে বৃষ্টিজলে ভিজেছিল লাজুক কদম
সেই কবে কদমের ডালে এক পাখি বসেছিল
সেই পাখি বলেছিলপৃথিবীর ভিতরে আরেক
গর্ভকেশরের মতো গোপনীর পৃথিবী রয়েছে
সেই পৃথিবীর খোঁজে চাঁদ সদাগর
ঝড়ে-জলে ডুবে যাবে জেনেও নিজের নৌবহর
সমুদ্রে ভাসিয়েছিল, ঘর পোড়া আগুনের মতো সাদা ফেনা
সেই ফেনা পুষেছিল বড় বড় রাঘব বোয়াল
সেই সব বোয়ালের পেট চিরে পাওয়া গেল
মানুষের আংটি ভর্তি স্বপ্ন, সুখ, সোনার বিষাদ
সেই সব আংটি, স্বপ্ন, দুঃখ তছনছ করে
প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে।
পৃথিবীর অতীতের, আগামীকালের
অনেক অজ্ঞাতপ্রায় পান্ডুলিপি, স্থাপত্যের ভাঙা মন্দিরের
ভাস্কর্যের টুকরো-টাকরা
অনেক বিচিত্র কাঁথা, আজন্মের স্মৃতি দিয়ে বোনা
অনেক রঙীন পট, চালচিত্র, প্রতিমা, পুতুল, পোড়ামাটি
নিভৃতে, সাজানো আছে, এ সংবাদ শুনে
ছেচল্লিশ বছরের কোনো এক যুবকের পাঁজরের হাড় ফুটো করে
প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তুমি যখন শাড়ির আড়াল থেকে
শরীরের জ্যোৎস্নাকে একটু একটু করে খুলছিলে,
পর্দা সরে গিয়ে অকস্মাৎ এক আলোকিত মঞ্চ,
সবুজ বিছানায় সাদা বাগান,
তুমি হাত রেখেছিলে আমার উৎক্ষিপ্ত শাখায়
আমি তোমার উদ্বেলিত পল্লবে,
ঠিক তখনই একটা ধুমসো সাদা বেড়াল
মুখ বাড়িয়েছিল খোলা জানালায়।
অন্ধকারে ও আমাদের ভেবেছিল
রুই মৃগেলের হাড় কাঁটা।
পৃথিবীর নরনারীরা যখন নাইতে নামে আকাঙ্খার নদীতে
তখন রুই মৃগেলের চেয়ে আরো কত উজ্জ্বল
দীর্ঘশ্বাস সহ সেই দৃশ্য দেখে বেড়ালটা ফিরে চলে গেলো
হাড়কাঁটার খোঁজে অন্য কোথা অন্য কোনখানে।
দ্বিতীয় সাক্ষী ছিল তোমার হত্যাকারী চোখ
আর তৃতীয় সাক্ষী আমার রক্তের সঙ্গে ওতপ্রোত শুয়ে আছে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
জন্মমুহূর্তে বীজের চোখে যেই নামল বৃক্ষের স্বপ্ন
অমনি দ্বিখন্ডিত।
আবখানা নেমে গেল মাটির তিমিরে
শিকড়
আধখানা রয়ে গেল মাটির উপর পৃথিবীর সকাল-বিকেলে
ডালপালা।
স্বপ্ন মানেই এক অনির্বচনীয় হত্যাকারী
এক আলোকিত খড়গ।
একটা কিছু হয়ে ওঠার স্বপ্নে
বুকের মধ্যে যেই
বজ্র-বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাদলের হৈহৈ রৈরৈ হাঁকাহাঁকি
অমনি দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় আমাদের সত্তা।
আধখানা রয়ে যায় মাটির উপর পৃথিবীর সকাল-বিকেলে
ডালপালা
আধখানা নেমে যায় ভূ-গর্ভের জটিল অলিগলির অন্ধকারে
শিকড়।
অথচ শিকড়ের নিজস্ব কোনো ক্ষুধা নেই।
যেমন বেদনার নিজস্ব কোনো বেদনা নেই।
আমাদের বেদনাগুলিই আমাদের শিকড়
হরিণের কাজল-চোখ নিয়ে আমাদের বেদনাগুলি
ভালোবাসার কাছে আসে।
শ্বাপদের উদগ্রীব থাবা নিয়ে আমাদের ভালোবাসাগুলি
আকাঙ্খার কাছে যায়।
শিকড়গুলি
যার নিজস্ব কোনো ক্ষুধা নেই
ডালপালার ভীষণ ক্ষুধাকে শিরায় শিরদাঁড়ায় নিয়ে
নারীর কাছে নেমে আসে ক্ষুধিত পুরুষের মতো।
পুষ্প এক একদিন সোহাগিনী রমনী।
ডালপালাগুলি
পুষ্পের জন্যে বড় কাঙাল।
সবুজ পল্লবেরা এক একদিন হলুদ পাখির গান।
ডালপালাগুলি
সবুজ পাতার জন্যে বড় কাঙাল।
শিকড়গুলি
অর্থাৎ আমাদের বেদনা, ভালোবাসা আর আকাঙ্খাগুলি
ভীষণ ক্ষ্যাপার মতো পৃথিবী তোলপাড় করে কেবল খুঁজছে
রমনী এবং পাখি
পুষ্প এবং পল্লবের ঠিকানা
ভূ-গর্ভের জটিল অলিগলির এপাড়ায় ওপাড়ায়
এবেলায় ওবেলায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
হে প্রসিদ্ধ অমরতা
কী সুন্দর তোমার ভ্রুকুটি
ঘরের বাহিরে ডেকে এনে
ভাঙো ঘর, স্থিরতার খুঁটি।
ধবংসের আগুনে জলে ঝড়ে
তুমি রাখো মায়াবী দর্পণ
মহিমার স্পর্শ যারা চায়
রক্তপাতে তাদের তর্পণ
হে প্রসিদ্ধ অমরতা
কী উজ্জল তোমার পেরেক
বিদ্ধ ও নিহত হয় যারা
কেবল তাদেরই অভিষেক।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
কলকাতা বড় কিউবিক।
যেন পিকাশোর ইজেলে-তুলিতে
গর গরে রাগে ভাঙা।
কলকাতা সুররিয়ালিষ্ট।
যেন শাগালের নীলের লালের
গৃঢ় রহস্যে রাঙা।
কলকাতা বড় অস্থির।
যেন বেঠোফেন ঝড়ে খুঁজছেন।
সিমফনি কোনো শান্তির।
কলকাতা এক স্কাল্পচার।
রদাঁর বাটালি পাথরে কাটছে
পেশল-প্রাণের কান্তি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
যে আমাকে অমরতা দেবে
সে তোমার ছাপাখানা নয়,
সে আমার সত্তার সংগ্রাম
নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
হাওয়া তোমার আঁচল নিয়ে ধিঙ্গীনাচন করলো খেলা
সকাল বিকেল সন্ধেবেলা
চোখের খিদের আশ মেটালো লস্পটে রোদ রাস্তা ঘাটে
যখন হাঁটো সঙ্গে হাঁটে
বনের পথে হাঁটলে যখন কাঁটাগাছে টানলে কাপড়
চ্যাংড়া ছোঁড়ার ফাজলামিকে ভেবেছিলাম মারবে থাপড়।
একটা নদীর লক্ষটা হাত, ভাসিয়ে দিলে সর্বশরীর
লুটপাটেতে ছিনিয়ে নিলে ওষ্ঠপুটের হাসির জরির
জেল্লাজলুস।
কেবল আমি হাত বাড়ালেই, মাত্র আমার পাঁচটা আঙুল,
তোমার মহাভারত কলুষ।
রক্তে মাংসে মনুষ্যজীব, সেই দোষেতেই এমন কাঙাল।
কিন্তু তোমার খবর নিতে আমার কাছেই আসবে ছুটে
অনন্তকাল।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
আরশিতে সর্বদা এক উজ্জল রমণী বসে থাকে।
তার কোনো পরিচয়, পাসপোর্ট, বাড়ির ঠিকানা
মানুষ পায়নি হাত পেতে।
অনুসন্ধানের লোভে মুলত সর্বতোভাবে তাকে পাবে বলে
অনেক মোটর গাড়ি ছুটে গেছে পাহাড়ের ঢালু পথ চিরে
অনেক মোটর গাড়ি চুরমার ভেঙে গেছে নীল সিন্ধুতীরে
তারও আগে ধ্বসে গেছে শতাধিক প্রাসাদের সমৃদ্ধ খিলান
হাজার জাহাজ ডুবি হয়ে গেছে হোমারের হলুদ পাতায়।
আরশির ভিতরে বসে সে রমণী ভ্রু-ভঙ্গিতে আলপনা আঁকে
কর্পুর জলের মতো স্নিগ্ধ চোখে হেসে বা না হেসে
নানান রঙ্গীন উলে বুনে যায় বন উপবন
বেড়াবার উপত্যকা, জড়িয়ে ধরার যোগ্য কুসুমিত গাছ
লোভী মাছরাঙা চায় যতটুকু জল আর মাছ
যতটুকু জ্যোৎস্না পেলে মানুষ সন্তুষ্ট হয় স্নানে।
স্নানের ঘাটে সে নিজে কিন্তু তারও স্নান চাই বলে
অনেক সুইমিং পুল কাপেট বিছানো বেডরুমে
অনেক সুগন্ধী ফ্ল্যাট পার্ক স্ট্রীটে জুহুর তল্লাটে
ডানলোপিলোর ঢেউ ডাবলবেডের সুখী খাটে
জোনাকী যেভাবে মেশে অন্ধকারে সর্বস্ব হারিয়ে
প্রভাতে সন্ধ্যায় তারা সেইভাবে মিলেমিশে হাঁটে।
বহু জল ঘাঁটাঘাঁটি স্নান বা সাঁতার দিতে দিতে
মানুষেরা একদিন অনুভব করে আচম্বিতে
যে ছিল সে চলে গেছে নিজের উজ্জল আরশিতে।
প্রাকৃতিক বনগন্ধ, মেঘমালা, নক্ষত্রের থালা
কিংবা এই ছ’রকম ঋতুর প্রভাবে
এত নষ্ট হয়ে তবু মানুষ এখনও ভাবে সুনিশ্চিত তাকে কাছে পাবে
কাল কিংবা অন্য কোন শতাব্দীর গোধুলি লগনে
কলকাতায়, কানাডায় অথবা লন্ডনে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুস্পদল।
নিজের কস্তরী গন্ধে নিজেই বিহ্বল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার
আত্মজ কুসুমন্ডলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলল্কৃত করে ওষ্ঠতল।
আমি একা ফুটিতে পারি না
আমি একা ফোটাতে পারি না।
রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
বহু জন্য বসন্তের অম্লান মঞ্জরী ফুটে আছো
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবীথিতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুষ্প বিচ্ছুরণ।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর-সম্ভারে।
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।
আমার উদ্গত অশ্রু অভ্যর্থনা করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যনে?
মোহিনীর স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভারোবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্মার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
ভক্তিমূলক
|
প্রখর তুলির পাশে কতদিন অবনত হয়েছি বিস্ময়ে।
এ কী টান! বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুত এ কী বলবান
রেখার সংহত রূপ, রেখা যেন গর্বিত গান্ডীব,
যেন জানে শত্রুপক্ষ, যেন জানে কোথায় সংগ্রাম
এবং বিষাদও জানে, হাহাকারে সঙ্গী হতে জানে।
তখন দিগন্ত ছিল রক্তে ও রক্তিম আকাঙ্খায়
একই সঙ্গে একাকার, দুঃসময় ঘরে ও বাহিরে।
বিশ্বাসের দুর্গ ভাঙে, অবিন্যস্ত বাতাসে ছড়ায়
প্রশ্ন শুধু, প্রশ্ন বীজ প্রশ্ন বৃক্ষ হয়।
সেই দীর্ণ সময়ের দিনগুলি, দগ্ধ রাতগুলি
একটি তুলির কাছে যখনই চেয়েছে বরাভয়,
পেয়েছে বুকের বর্ম, মানচিত্র, দৃপ্ত যাত্রাপথ।
তাঁর কোনো নামাবলী নেই, তিনি নিঃসঙ্গ পথিক
ভ্রমণ বিলাসী তিনি, দুর্গমে দুরূহে নিত্য পাড়ি।
কানাকড়িহীন কিন্তু হাসিতে ঠিকরোয় রত্নকণা,
রাজাধিরাজের মতো এই নিঃস্ব এখনো প্রেরণা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আগামী চোদ্দ বছর মহিষ কিংবা নেউল রঙের মেঘের মুখদর্শন করব না কেউ।
আগামী চোদ্দ বছর আমাদের কবিতা থেকে হিজড়ে-নাচন বৃষ্টির নির্বাসন।
স্বেচ্ছাচারী এবং হামলাবাজ হাওয়াকে চোদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছি আমি
আর পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় টেলিফোনে ট্রাঙ্কলে
রেডিওগ্রামে জানিয়ে দিয়েছি
সমস্ত বিক্ষুব্ধ জলস্রোত যেন মাটিতে নাক-খত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়
দুর্গত মানুষের কাদা-পায়ে।
প্রত্যেক নদীর বাঁধকে বলে দিয়েছি হতে হবে হিমালয়ের কাঁধ সমান
প্রত্যেকটা নদীতে হতে হবে পাড়াগার লাজুক বৌ
প্রত্যেকটা ব্যারেজকে জননীর গর্ভ।
ভবিষ্যতে আর কোনদিন যদি মানুষকে ভাসতে দেখি শিকড়হীন উলঙ্গ
আর কোনদিন যদি মানুষের সাজানো-নিকোনো স্বপ্নসাধের ভিতরে ঢুকে পড়ে
দুঃস্বপ্নের খল-খল হাসি, আঁকাবাঁকা সাপ, মরা কুকুরের কান্না আর ভাঙা শাঁখা
আর কোনদিন যদি মানুষের শ্রেষ্ঠতম সংলাপ হয়ে ওঠে হাহাকার
আর কোনদিন যদি মানুষের আলতা সিদুর পরা সতী-লক্ষ্মী গৃহস্থলিকে
হেলিকপ্টার থেকে মনে হয় ছেঁড়া-কাঁথা কানির টুকরো
আমি বাধ্য হবো সভ্যতার বিরুদ্ধে ফাঁসীর হুকুম দিতে।
যতদিন মানুষের গায়ে দুর্দিনের দুর্গন্ধ এবং নষ্ট জলরেখা
রোদের কামাই করা চলবে না একনিও।
মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি দেখে যেতে চাই।
সমস্ত পুরুষ সূর্যমুখী, নারীরা ঝুমকো জবা আর শিশুরা
কমলা রঙের বোঁটায় শাদা শিউলি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
সময়ের ছারখার, অথচ তোমার মুখে আলো।
কালকেউটে এখুনি কামড়ালো
কাকে যেন, কাকে?
এবারও কি লখিন্দর পাবে বেহুলাকে?
ও বৌ ক্রমশ নীল, আরো নীল, রক্তে হিমকণা
ও বৌ আমাকে ছেঁড়ে আগুনের কুড়ি লক্ষ ফণা
ও বৌ আমার হাড়ে বিঁধে যায় কার তুরপুন?
স্মৃতি ঘুম, ঘুমই স্মৃতি
চেতনাসাম্রাজ্যে ঘন ঘুম।
ও বৌ এ কার চোখ, সব দৃশ্যে সাদা অন্ধাকার?
নীলের সবুজ ছিল, সবুজের লাল অহঙ্কার
প্রকৃতি, প্রকৃতি খেলা, এক বর্ণে বহুর বিন্যাস।
জীবন, জীবন মৃত্যু, জয়-পরাজয় নৃত্য, কথাকলি, রাস
তা তা থৈ থৈ
অসি-ত্ব উন্মূখ, তবু সে বৃহৎ ভূমিকম্প কই?
ও বৌ এ কার স্পর্শে, ভস্ম যেন, কার ভস্মাধার?
এখন খাণ্ডব মানে দাহ শুধু, পুড়ে কাঠ-হাওয়া?
খাণ্ডব অরণ্য নয় আর?
ও বৌ ক্রমশ নীল, আরো নীল, দীনতার নীল
বিশুদ্ধতা ভেঙে যায়, নতোমুখ নিজস্ব নিখিল
নীল, নীল
নীল।
সময়ের ছারখার, অথচ তোমার মুখে আলো।
কালকেউটে এখুনি কামড়ালো
কাকে যেন, কাকে?
যেখানেই আত্মদীর্ণ নীল লখিন্দার
বেহুলা কি সেখানেই থাকে?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
কী করে ভালোবাসবো বল কী করে ভালোবাসবো বল সখী,
মরুভূমির মতন যদি প্রাণের দাহে অহরহই জ্বলি,
হৃদয়ে যদি গভীর ক্ষত বালুচরের মতন গ্রাস করে,
কী করে ভালোবাসবো বল কী করে ভালোবাসবো বল সখী।
দগ্ধ যদি বুকের টানে আমার সব হাসিরা ঝরে যায়,
আমার সব সকাল আর রাত্রি যদি কাঁদনে ছলোছলো,
আমার সব সূর্যমুখী পাপড়ি ছিড়ে ধুলোয় যদি মেশে,
কী করে ভালোবাসবো বল কী করে ভালোবাসবো বল সখী।
আমার সুখ সাধের ঘরে পিদিম যদি না জ্বলে কোনোদিন,
আমার দূর মাঠের শেষে দুগোছা ধান না যদি পায় রোদ
আমার আম-মউল-স্বাদ হাওয়ায় যদি বারুদ-বিষ ছড়ায়,
কী করে ভালোবাসবো বলকী করে ভালোবাসবো বল সখী।
প্রতিটি অনাহারের রাতে সাপের ফনা দারালো তলোয়ার,
প্রতিটি রোগশোকের দিনে বেদনা যেন শিকারী কোনো রাহু
প্রতিটি মরা মনের ডালে শুকনো সব কুন্দকলি কাঁদে,
মুক্তমাখা পাপিয়ারও সুখের গান শিকলে গাঁট বাঁধা।
কী করে ভালোবাসবো আজ কী করে ভালোবাসাবো বল সখী,
আঁধার -ঘোর আমার ঘরে যদি না কেউ বীরের মতো এসে
জ্বালিয়ে যায় আগুনে এই পাষাণপুরী মনের মণি-মানিক,
কী করে ভালোবাসবো তবে কী করে ভালোবাসবো বল সখী।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
আমাকে ছুঁয়েছো তুমি
শরীর পেয়েছে প্রিয় রোদ।
আমার যা-কিছু ভেসে গিয়েছিলো
কুয়াশার পারে
সব ফিরে পেয়ে যাব এই তৃপ্ত বোধ
আমাকে করেছে নীল পাখি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
– ধরো কোন একদিন তুমি খুব দূরে ভেসে গেলে
শুধু তার তোলপাড় ঢেউ গুলো আজন্ম আমার
বুকের সোনালি ফ্রেমে পেইন্টিং এর মতো রয়ে গেল।
এবং তা ধীরে ধীরে ধুলোয়, ধোঁয়ায়, কুয়াশায়
পোকামাকড়ের সুখী বাসাবাড়ি হয়ে যায় যদি?– ধরো কোন একদিন যদি খুব দূরে ভেসে যাই
আমারও সোনার কৌটো ভরা থাকবে প্রতিটি দিনের
এইসব ঘন রঙে, বসন্ত বাতাসে, বৃষ্টি জলে।
যখন তখন খুশি ওয়াটার কালারে আঁকা ছবি গুলো
অম্লান ধাতুর মতো ক্রমশ উজ্জ্বল হবে সোহাগী রোদ্দুরে।– তার মানে সত্যি চলে যাবে?– তার মানে কখনো যাবো না।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র-নন্দিনী! আমার খুব ভয় করে ,বড় ভয় করে!
কোনও একদিন বুঝি জ্বর হবে ,দরজা দালান ভাঙ্গা জ্বর
তুষার পাতের মত আগুনের ঢল নেমে এসে
নিঃশব্দে দখল করে নেবে এই শরীরের শহর বন্দর।
বালিশের ওয়াড়ের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে ফেলা তুলো
এখন হয়েছে মেঘ,উঁড়ো হাস, সাঁদা কবুতর।
সেই ভাবে জ্বর এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে অন্য কোন ভুমন্ডলে
নন্দিনী! আমার খুব ভয় করে ,বড় ভয় করে।– বাজে কথা বকে বকে কি যে সুখ পাও শুভঙ্কর।
সত্যি বুঝি না।
কার জন্যে ছুরি নিয়ে খেলায় মেতেছো?
তুমি কি আমার চোখে রক্তদৃশ্য এঁকে দিতে চাও?– ছুরি কই? ছুরি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি জঙ্গলে
খাঁ খাঁ দুপুরের মত লম্বা ছুরি ছিল বটে কিছুদিন আগে।
তখন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল
তখন যে যুদ্ব দাঙ্গা লুটপাট ডাকাতির সম্ভাবনা ছিল
এখন ভীষন ভয় ছাড়া অন্য কোন প্রতিপক্ষ নেই ।
যুদ্ব নেই কামানের তোপ নেই , অসুখ বিসুখ কিছু নেই
ভয় ছাড়া অন্য কোন বীজানুর মারাত্মক আক্রমন নেই ।– আমার যা কিছু ছিল সবই তো দিয়েছি,শুভঙ্কর।
তোমার বাঘের থাবা তাও ভরে দিয়েছি খাবারে।
চাঁদোয়ার মত ঘন বৃক্ষ ছায়া টাঙ্গিয়ে দিয়েছি
মাথার উপরে,ঠিক আকাশের মাপে মাপে বুনে।
তবুও তোমার এত ভয়?
তবুও কিসের এত ভয়?-সেই ছেলেবেলা থেকে যা ছুয়েছি সব ভেঙ্গে গেছে।
প্রকান্ড ইস্কুলবাড়ি কাচের চিমনির মত ঝড়ে ভেঙ্গে গেল।
একান্নবর্তীর দীর্ঘ দালান-বারান্দা ছেড়া কাগজের
কুচি হয়ে গেল।
কচি হাতে রুয়ে রুয়ে সাজিয়ে ছিলাম এক উৎফুল্ল বাগান
কুরে কুরে খেয়ে গেছে লাল পিঁপড়ে,পোকা ও মাকড়।
একটা পতাকা ছিল, আকাশের অদ্বিতীয় সুর্যের মতন
তর্কে ও বিতর্কে তাও সাত আটটা টুকরো হয়ে গেল ।
গাঁয়ের নদীকে ছুঁয়ে কী ভুল করেছি
নদীর ব্রীজ কে ছুঁয়ে কী ভুল করেছি
কাগজ ও মুদ্রাযন্ত্র ছুয়ে আমি কি ভুল করেছি?
নন্দিনী!
তোমাকে যদি বাগান,পতাকা,ব্রীজ,কাগজের মতন হারাই?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্রভালবাসা, সেও আজ হয়ে গেছে ষড়যন্ত্রময়।
নন্দিনী! এসব কথা তোমার কখনো মনে হয়?
চক্রান্তের মত যেন, সারা গায়ে অপরাধপ্রবনতা মেখে
একটি যুবক আজ যুবতীর কাছাকাছি এসে
সাদা রুমালের গায়ে ফুলতোলা শেখে।
যেন এই কাছে আসা সমাজের পক্ষে খুব বিপজ্জনক।
যেন ওরা আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে গেছে মল্লিকবাগানে
যেন ওরা হাইজ্যাকের নথিপত্র জানে
এসেছে বারুদ ভরে গোপন কামানে।একটি যুবক যদি প্রতিদিন পাখি-রং বিকেলবেলায়
তার কোনো নায়িকার হাতে রাখে হাত
যেন এই কলকাতার মারাত্মক ক্ষতি করে দেবে বজ্রপাত।
কলকাতায় জঙ্গল গজাবে
কলকাতাকে সাপে-খোপে খাবে।
এই সব ফিসফাস, চারিদিকে অবিরল এই সব
ছুঁচোর কেত্তন,
একটি যুবক এসে যুবতীর কাছাকাছি বসেছে যখন।নন্দিনী! তোমার মনে পড়ে?
মামাশ্বশুরের মত বিচক্ষন মুখভঙ্গি করে
একবার এক বুড়ো হাড় এসে প্রশ্ন করেছিল,
মেয়েটির সঙ্গে কেন এত মাখামাখি
মেয়েটির মধ্যে কোন গুপ্তধন আছে-টাছে নাকি?
লুকনো এয়ারপোর্ট আছে?
জাল-নোট ছাপাবার কারখানা আছে?
আন্তর্জাতিক কোন পাকচক্র আছে?
তাহলে কিসের জন্যে ছুঁচ ও সুতোর মত
শীত-গ্রীষ্ম এত কাছে কাছে?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্রতুমিই আমার ধ্বংস হবে তা জানলে
এমন করে কি ভাসাতাম ডিঙ্গি নৌকো?
ভাসাতাম?
তুমি চলে যাবে সমুদ্রে আগে বলনি
তাহলে কি গায়ে মাখাতাম ঝড়-ঝঞ্ঝা?
মাখাতাম?
নুড়িতে-পাথরে নূপুর বাজিয়ে ছোট্ট
জলরেখা ছিলে দুই হাত দিয়ে ধরেছি।
ধরা দিয়েছ।
এখন দুকুল ভরেছে প্রবাহে প্লাবনে
উঁচু মাস্তুলে জাহাজ এসেছে ডাকতে।
ওকে সাড়া দাও।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– লোকে বলে শুনি সেলায়ে তোমার পাকা হাত
ছুঁচ দিয়ে লেখো কবিতা।– গোয়েন্দা নাকি? আমার যা কিছু লুকানো
জানতে হবে কি সবই তা?– তর্ক কোরো না জুড়ে দেবে কিনা এখুনিই
হৃৎপিন্ডের ক্ষতটা।– দিতে পারি তবে মজুরি পড়বে বিস্তর
জোগাতে পারবে অতটা?– কাজ যদি হয় নিখুঁত,পাবেই মজুরী,
ভেবেছো পালাবো গর্তে?– হৃৎপিন্ডের ভিতরে থাকে যে ঝর্ণা
দিতে হবে স্নান করতে।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– খবর্দার! হাত সরিয়ে নাও।
ব্যাগে ভরে নাও টাকাগুলো।
আজ সমস্ত কিছুর দাম দেবো আমি।– কি হচ্ছে কি শুভঙ্কর? কেন এমন পাগলামির ঢেউয়ে দুলছ?
এইজন্যই তোমার উপর রাগ হয় এমন।
মাঝে মাঝে অর্থমন্ত্রীদের মতো গোঁয়ার হয়ে ওঠো তুমি।
কাল কতবার বলেছিলুম, চলো উঠি, চলো উঠি।
আকাশ আলকাতরা হয়ে আসছে, চলো, উঠি।
এখুনি সেনাবাহিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়বে বৃষ্টি, চলো উঠি।
তুমি ঘাসের উপর বুড়ো বটগাছ হয়ে বসে রইলে।
কলকাতা ডুবল, তুমিও ডুবলে
আমাকেও ডোবালে।
কেন আমার কথা শোনো না বল তো?
আমি কি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি
যে সিংহাসনের হাতলে হাত রাখলেই হারিয়ে যাবে স্মৃতিহীন অন্ধকারে?
কলের জলের মতো
ক্যালেন্ডারের তারিখের মতো
বন্যার গায়ে গায়ে খরার মতো
আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি। এবং থাকবো।
তাহলে কেন আমার কথা শোনো না শুভঙ্কর?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্রনন্দিনী –
যতক্ষন পাশে থাকো, যতক্ষন ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকি
আমি যেন মেঘে জলে মেশা কোনো আত্মহারা পাখি।
বলতো কি পাখি?শুভঙ্কর –
যতক্ষন পাশে থাকো, যতক্ষন ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা
উল্কার স্ফুলিঙ্গ দিয়ে অন্ধকারে দীর্ঘ ছবি আঁকা।
বলতো কি ছবি?নন্দিনী –
যতক্ষন কথা বলো, হাসো ও ঝরাও ধারাজল
বীজ থেকে জেগে ওঠে অফুরন্ত গাছ, বনতল।
বলতো কি গাছ?শুভঙ্কর –
যতক্ষন পাশে থাকো ভূমিকম্প, সুখের সন্ত্রাস
পৌঁছে যাই সেখানে, যেখানে বসন্ত বারোমাস।
বলতো কি দেশ?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– তুমি আমার সর্বনাশ করেছ শুভঙ্কর।
কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার। কিচ্ছু না।
জ্বলন্ত উনোনে ভিজে কয়লার ধোঁয়া আর শ্বাসকষ্ট
ঘিরে ফেলেছে আমার দশদিগন্ত।
এখন বৃষ্টি নামলেই কানে আসে নদীর পাড় ভাঙার অকল্যাণ শব্দ
এখন জ্যোৎস্না ফুটলেই দেখতে পাই
অন্ধকার শশ্মানযাত্রীর মত ছুটে চলেছে মৃতদেহের খোঁজে।
কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার। কিচ্ছু না।
আগে আয়নার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা সাজগোজ
পাউডারে, সাবানে, সেন্টে, সুর্মায়
নিজেকে যেন কেচে ফর্সা করে তোলার মত সুখ।
এখন প্রতিবিম্বের দিকে তাকালেই
সমস্ত মুখ ভরে যায় গোলমরিচের মতো ব্রণে, বিস্বাদে, বিপন্নতায়।
এখন সমস্ত স্বপ্নই যেন বিকট মুখোশের হাসাহাসি
দুঃস্বপ্নকে পার হওয়ার সমস্ত সাঁকো ভেঙে চুরমার।
কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার। কিচ্ছু না।– তুমিও কি আমার সর্বনাশ করনি নন্দিনী?
আগে গোলমরিচের মতো এতটুকু ছিলাম আমি।
আমার এক ফোঁটা খাঁচাকে তুমিই করে দিয়েছ লম্বা দালান।
আগাছার জমিতে বুনে দিয়েছ জ্বলন্ত উদ্ভিদের দিকচিহ্নহীন বিছানা।
এখন ঘরে টাঙানোর জন্যে একটা গোটা আকাশ না পেলে
আমার ভাল লাগে না।
এখন হাঁটা-চলার সময় মাথায় রাজছত্র না ধরলে
আমার ভালো লাগে না।
পৃথিবীর মাপের চেয়ে অনেক বড় করে দিয়েছ আমার লাল বেলুন।
গোলমরিচের মতো এই একরত্তি পৃথিবীকে
আর ভালো লাগে না আমার।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– আমার আগে আর কাউকে ভালবাসনি তুমি?– কেন বাসব না? অনেক।
বিষবৃক্ষের ভ্রমর
যোগাযোগের কুমু
পুতুলনাচের ইতিকথার কুসুম
অপরাজিত-র…..– ইয়ার্কি করো না। সত্যি কথা বলবে।– রোগা ছিপছিপে যমুনাকে ভালোবেসেছিলাম বৃন্দাবনে
পাহাড়ী ফুলটুংরীকে ঘাটশিলায়
দজ্জাল যুবতী তোর্সাকে জলপাইগুড়ির জঙ্গলে
আর সেই বেগমসাহেবা, নীল বোরখায় জরীর কাজ
নাম চিল্কা– আবার বাজে কথার আড়াল তুলছ?– বাজে কথা নয়। সত্যিই।
এদের কাছ থেকেই তো ভালবাসতে শেখা।
অনন্ত দুপুর একটা ঘাস ফড়িং-এর পিছনে
এক একটা মাছরাঙ্গার পিছনে গোটা বাল্যকাল
কাপাসতুলো ফুটছে
সেইদিকে তাকিয়ে দুটো তিনটে শীত-বসন্ত
এইভাবেই তো শরীরের খাল-নালায়
চুইয়ে চুইয়ে ভালবাসার জল।
এইভাবেই তো হৃদয়বিদারক বোঝাপড়া
কার আদলে কি, আর কোনটা মাংস, কোনটা কস্তুরী গন্ধ।
ছেলেবেলায় ভালবাসা ছিল
একটা জামরুল গাছের সঙ্গে।
সেই থেকে যখনই কারো দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই
জামরুলের নিরপরাধ স্বচ্ছতা ভরাট হয়ে উঠেছে
গোলাপী আভার সর্বনাশে,
অকাতর ভালবেসে ফেলি তৎক্ষণাৎ
সে যদি পাহাড় হয়, পাহাড়
নদী হয়, নদী
কাকাতুয়া হলে, কাকাতুয়া
নারী হলে, নারী।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– তোমাদের ওখানে এখন লোডশেডিং কি রকম?
– বোলো না। দিন নেই, রাত নেই, জ্বালিয়ে মারছে।
– তুমি তখন কি করো?
– দরজা খুলে দিই।
জানলা খুলে দিই।
পর্দা খুলে দিই।
আজকাল হাওয়াও হয়েছে তেমনি ফন্দিবাজ।
যেমনি অন্ধকার, অমনি মানুষের ত্রিসীমানা ছেড়ে দৌড়।– তুমি তখন কি করো?
– গায়ে জামা-কাপড় রাখতে পারি না।
সব খুলে দিই,
চোখের চশমা, চুলের বিনুনি, বুকের আঁচল, লাজ-লজ্জা সব।– টাকা থাকলে তোমার নামে নতুন ঘাট বাঁধিয়ে দিতুম কাশী মিত্তিরে
এমন তোমার উথাল-পাতাল দয়া।
তুমি অন্ধকারকে সর্বস্ব, সব অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খুলে দিতে পার কত সহজে।
আর শুভঙ্কর মেঘের মত একটু ঝুঁকলেইকি হচ্ছে কি?শুভঙ্কর তার খিদে তেষ্টার ডালপালা নাড়লেইকি হচ্ছে কি?শুভঙ্কর রোদে-পোড়া হরিনের জিভ নাড়ালেইকি হচ্ছে কি?পরের জন্মে দশদিগন্তের অন্ধকার হবো আমি।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– দেখ, অনন্তকাল ঝিঝি পোকার মতো
আমরা কথা বলছি
অথচ কোনো কথায় শেষ হল না এখনও।
একটা লাল গোলাপের কান্নার গল্প
শোনাবে বলেছিলে
কবে বলবে?– চলো উঠি। বড্ড গরম এখানে।– দেখ, অনন্তকাল শুকনো বাঁশপাতার মতো
আমরা ঘুরছি
অথচ কেউ কাউকে ছুঁতে পারলুম না এখনো।
একটা কালো হরিনকে কোজাগরী উপহার
দেওয়ার কথা ছিল
কবে দেবে?– চলো উঠি। বড্ড ঝড়ঝাপটা এখানে।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছ শুভঙ্কর।
– এখুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।
কিন্তু তার বদলে?– বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো ?
– খেয়েছি।
কিন্তু আমার খিদের কাছে সে সব নস্যি।
কিন্তু কলকাতাকে এক খাবলায় চিবিয়ে খেতে পারি আমি।
আকাশটাকে ওমলেটের মত চিরে চিরে
নক্ষত্রগুলোকে চিনেবাদামের মত টুকটাক করে
পাহাড়গুলোকে পাঁপড় ভাজার মত মড়মড়িয়ে
আর গঙ্গা ?
সেতো এক গ্লাস সরবত।– থাক খুব বীরপুরুষ।
– সত্যি তাই।
পৃথিবীর কাছে আমি এইরকম ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ।
কেবল তোমার কাছে এলেই দুধের বালক
কেবল তোমার কাছে এলেই ফুটপাতের নুলো ভিখারী
এক পয়সা, আধ পয়সা কিংবা এক টুকরা পাউরুটির বেশি
আর কিছু ছিনিয়ে নিতে পারি না।– মিথ্যুক।
– কেন ?
– সেদিন আমার সর্বাঙ্গের শাড়ি ধরে টান মারনি ?
– হতে পারে।
ভিখারীদেরর কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করে না একদিনও ?– তোমার মধ্যে অনন্তকাল বসবাসের ইচ্ছে
তোমার মধ্যেই জমিজমা ঘরবাড়ি, আপাতত একতলা
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?– একতলা আমার একবিন্দু পছন্দ নয়।
সকাল-সন্ধে চাঁদের সঙ্গে গপ্পোগুজব হবে
তেমন উঁচু না হলে আবার বাড়ি নাকি?– আচ্ছা তাই হবে।
চাঁদের গা-ছুঁয়ে বাড়ি,
রহস্য উপন্যাসের মতো ঘোরানো-প্যাঁচানো সিঁড়ি
বাঁকে বাঁকে সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো স্বপ্নদৃশ্য
শিং-সমেত মায়া হরিণের মুন্ডু
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?– কাটা-হরিণ দেয়ালে ঝুলবে, অসহ্য।
হরিণ থাকবে বনে, বন থাকবে আমাদের
খাট পালঙ্কের চারধারে
খাট পালঙ্কের নীচে ছোট্ট একটা পাহাড়
পাহাড়ের পেট চিরে ঝর্ণা– আচ্ছা তাই হবে।
পাহাড়ের পেট চিরে ঝর্ণা, ঝর্ণার পেট চিরে কাশ্মিরী কার্পেট
সিলিং-এ রাজস্থানী-ঝাড় জলের ঝাঁঝরির মত উপুর করা
জানলার গায়ে মেঘ, মেঘের গায়ে ফুরফুরে আদ্দির
পাঞ্জাবি
পাঞ্জাবির গায়ে লক্ষ্ণৌ-ই চিকনের কাজ
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?– মেঘ রোজ রোজ পাঞ্জাবি পরবে কেন?
এক একদিন পরবে বালুচরি শাড়ি কিংবা
খাটাও-এর পাতলা প্রিন্ট
মাথায় বাগান-খোঁপা, খোঁপায় হীরের প্রজাপতি– আচ্ছা তাই হবে।
মেঘ সাজবে জরি-পাড় শাড়িতে
আর তখুনি নহবতখানার সানাই-এ জয়জ়য়ন্তী
আর তখুনি অরণ্যের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বনো জানোয়ারের হাঁক-ডাক
খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে জেগে উঠবে জলপ্রপাত
শিকারের জন্যে তীর ধনুক, দামামা দুন্দুভি
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?– তুমি এমনভাবে বলছ
যেন ভালোবাসা মানে সাপে আর নেউলে ভয়াবহ
একটা যুদ্ধ।
ভয় লাগছে।
অন্য গল্প বলো।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– কাল বাড়ি ফিরে কী করলে?
– কাঁদলাম। তুমি?
– লিখলাম।
– কবিতা? কই দেখাও।
– লিখেই কুচিকুচি।
– কেন?
– আমার আনন্দের ভিতরে অনর্গল কথা বলছিল আর্তনাদ
আর্তনাদের ভিতরে গুনগুন গলা ভাঁজছিল অদ্ভুত এক শান্তি
আর শান্তির ভিতরে সমুদ্রের সাঁইসাঁই ঝড়।
যে সব অক্ষর লিখলেই লাল হওয়ার কথা
তারা হয়ে যাচ্ছিল সাদা।
যে সব শব্দ সাদা কাশবন হয়ে দুলবে
তাদের মনে হচ্ছিল শুকনো পাতার ওড়াউড়ি।
বুঝলাম সে ভাষা আমার জানা নেই
যার আয়নায় নিজের মুখ দেখবে ভালোবাসা।– তাই বলে ছিঁড়ে ফেললে?
– বাতাস থেকে একটা অট্টহাসি লাফিয়ে উঠে বললে
পিদিমের সলতে হয়ে আরো কিছুদিন পুড়ে খাক হ।
পুড়ে খাক হ।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– উত্তরোত্তর অত্যন্ত বাজে হয়ে উঠছো তুমি।
আজ থেকে তোমাকে ডাকবো
চুল্লী।
কেন জান? কেবল পোড়াচ্ছ বলে।
সুখের জন্যে হাত পাতলে যা দাও
সে তো আগুনই।– উত্তরোত্তর অত্যন্ত যা-তা হয়ে উঠছো তুমি
আজ থেকে আমিও তোমাকে ডাকবো
জল্লাদ।
কেন জান? কেবল হত্যা করছো বলে।
তোমাকে যা দিতে পারি না, তার দুঃখ
সে তো ছুরিরই ফলা।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্রকালকে এলে না, আজ চলে গেল দিন
এখন মেঘলা, বৃষ্টি অনতিদূরে।
ভয়াল বৃষ্টি, কলকাতা ডুবে যাবে।
এখনো কি তুমি খুঁজছো নেলপালিশ?
শাড়ি পরা ছিল? তাহলে এলে না কেন?
জুতো ছেঁড়া ছিল? জুতো ছেঁড়া ছিল নাকো?
কাজল ছিল না? কি হবে কাজল পরে
তোমার চোখের হরিণকে আমি চিনি।কালকে এলে না, আজ চলে গেল দিন
এখন গোধূলি, এখুনি বোরখা পরে
কলকাতা দুবে যাবে গাঢ়তর হিমে।
এখনো কি তুমি খুঁজছো সেফটিপিন?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্রআমি তোমার পান্থপাদপ
তুমি আমার অতিথশালা ।
হঠাৎ কেন মেঘ চেঁচালো
– দরজাটা কই, মস্ত তালা ?তুমি আমার সমুদ্রতীর
আমি তোমার উড়ন্ত চুল ।
হঠাৎ কেন মেঘ চেঁচালো
– সমস্ত ভুল , সমস্ত ভুল ?আমি তোমার হস্তরেখা
তুমি আমার ভর্তি মুঠো ।
হঠাৎ কেন মেঘ চেঁচালো
– কোথায় যাবি, নৌকো ফুটো ?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র– যে কোন একটা ফুলের নাম বল– দুঃখ ।– যে কোন একটা নদীর নাম বল– বেদনা ।– যে কোন একটা গাছের নাম বল– দীর্ঘশ্বাস ।– যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল– অশ্রু ।– এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।– বলো ।– খুব সুখী হবে জীবনে ।শ্বেত পাথরে পা ।সোনার পালঙ্কে গা ।এগুতে সাতমহলপিছোতে সাতমহল ।ঝর্ণার জলে স্নানফোয়ারার জলে কুলকুচি ।তুমি বলবে, সাজবো ।বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালাঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।তুমি বলবে, ঘুমবো ।অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।তারপরবুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়েরক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটেএকটা সাপপায়ে বালুচরীর নকশানদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখবিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকেযেন বটের শিকড়মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলাধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানাফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।– সেই সাপটা বুঝি তুমি ?– না ।– তবে ?– স্মৃতি ।বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলেপোড়া ধুপের পাশে ।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্রতোমার বন্ধু কে ? দীর্ঘশ্বাস ?আমার ও তাই ।আমার শূন্যতা গননাহীন ।তোমার ও তাই ?দুরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়ডাকলে দরোজায় আসে না কেউ ।অযথা বাশি শুনে বাইরে যাইবাতাসে হাসাহাসি বিদ্রুপের ।তোমার সাজি ছিল, বাগান নেইআমার ও তাই ।আমার নদী ছিল, নৌকা নেইতোমার ও তাই ?তোমার বিছানায় বৃষ্টিপাতআমার ঘরদোরে ধুলার ঝড় ।তোমার ঘরদোরে আমার মেঘআমার বিছানায় তোমার হিম ।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র: এতো দেরী করলে কেন? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।– কি করবো বলুন ম্যাডাম? টিউশনি শেষ করে বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। আমার জন্যে তো আর গেইটের বাইরে মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে থাকে না যে ড্রাইভারের কুর্নিশ নিতে নিতে হুট করে ঢুকে পড়বো। তাই ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, কাদা-জল ভেঙ্গে, গরীবের গাড়ি মানে দু’পায়ের উপর ভরসা করেই আসতে হয় আপনার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে। তবে আজ রিক্সায় করে এসেছি নইলে একেবারে কাকভেজা হয়ে যেতাম। রিক্সা খুঁজে পেতেই যা দেরী হলো।: ইস্ বেশ ভিজে গেছো দেখছি। কাছে এসো তো, রুমাল দিয়ে মুছে দিই।– ওহো, আমি তো ভেবেছিলাম তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেবে। ঠিক আছে, রুমালই সই।: না মিস্টার, ওটা ভবিষ্যতের জন্য জমা থাকুক। যখন তোমার বউ হবো তখন ইচ্ছেটা পূরণ হবে।– আচ্ছা। আর যদি তা না হও, তবে আমি বুড়ো বয়েসে পান চিবোতে চিবোতে কোন এক বাদলঘন দিনে বসে বসে রোমন্থন করবো আজকের এই রুমালি ভালোবাসাময় সময়টাকে। নাতিপুতিকে তখন প্রথম প্রেমিকা আর এই রুমালটার গল্প শোনাবো।: প্লিজ, এভাবে বলো না। কেন আমি তোমাকে পাবো না? তুমি কি আমাকে চাও না? আমাকে ভালোবাসো না?– উত্তরটা আসলে একটু কঠিন। তোমাকে চাই আবার চাই না। ভালোবাসি আবার বাসি না।: হেয়াঁলি রাখো। আমি স্পষ্ট জানতে চাই।– তবে শোন। আমার প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের নির্মম বাস্তবতা তোমার জানা নেই। সেই জীবনে তুমি কখনো অভ্যস্ত হতে পারবেও না। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?: হ্যাঁ, করো।– একটু আগে একটা টং-এর দোকানের ছাউনিতে গা বাচিয়ে রিক্সা খুঁজছিলাম। খুব শীত শীত লাগছিলো, তখন চা খেয়েছিলাম ভাঙ্গা কাপে। আধধোয়া সে কাপে লেগেছিলো অনেক মেহনতি মানুষের ঠোঁটের ছোঁয়া, লেগেছিলো থুতুও যা এখনো আমার ঠোঁটে লেগে আছে। তুমি কি পারবে সেই ঠোঁটে চুমু খেতে?-তোমার পৌঁছুতে এত দেরী হলো ?-পথে ভিড় ছিল ?-আমারও পৌঁছুতে একটু দেরী হলোসব পথই ফাটা ।-পথে এত ভিড় ছিল কেন ?-শবযাত্রা ? কার মৃত্যু হল ?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আমারই তো অক্ষমতা
তোমার গোলাপ জানি সারারাত খুলে রেখেছিল
সাদা অন্ধকারে লাল বাঁকা সিঁড়ি দিক নির্নয়ের
সবুজ কম্পাস।
আঙুরবীথির পথ পরীর ডানার মতো উড়ে গেছে
সংগীতের দিকে।
আমার দীক্ষার কথাছিলঐখানে।
পায়ে পায়ে এত সব শিকড়-বাকড়
নাট-বল্টু, জট্ গুল্মটান
পৌছতে পারিনি।
পরাধীনতার চেয়ে ঢের বেশি বেদনার ভার হয়ে উঠেছে এখন
নানাবিধ স্বাধীন শিকল।
অক্ষরের থেকে আলো
বীজের ভিতর থেকে প্রাণকোষ ছিড়ে নিংড়ে নিয়ে
খোসার উৎসব বেশ জমজমাট বাজারে-বন্দরে।
সমুদ্র আড়াল করে সার্কাসের তাঁবু।
অফিউসের বাঁশি
দিকপাল ক্লাউনেরা পা দিয়ে বাজায়।
আমারই তো অক্ষমতা
সৌররশ্মি দুহাতে পেয়েও
গড়িনি কুঠার।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার ঢেউ
সেই সব স্পর্ম, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধাকার খুপরীর থাকে-থাকে, খাজে-খাজে
বুকের মধ্যে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
স্বরচিত নির্জনতা, সযত্ন-সৃজিত নির্জনতা
তুমি আছ পার্শ্ববর্তী,কী অপুর্ব সুখ।
বাইরে ভুলের হাওয়া বইছে বহুক।
পল্লবেরা মরে শুধু পল্লবেরা অবেলায় ঝরে
পল্লবেরা কাঁপে গায়ে হতাশার জর
বনস’লী ভুলে গেছে নিজস্ব মর্মর।
আদিম চীৎকার তুলে
কাপালিক মগ্ন মন্ত্র পাঠে
অশ্রুধ্বনি নাভীমূলে
অবনত শোকে যারা হাঁটে।
কেউ যদি চায়
বিশ্বটাকে কিনে নেবে এক ভাঁড় বিশৃঙ্খলতায়,
ভাবে তো ভাবুক।
স্বরচিত নির্জনতা,সযত্ন-সৃজিত নির্জনতা
তুমি থাকো পার্শ্ববর্তী স্বর্গে ভরি
শূন্যের সিন্দুক।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
দেখুন, দেখুন, প্রজাপতিগুলো
এবেলা-ওবেলা ঝুলতে ঝুলতে কেমন বাদুড়
আর গুয়োপোকাগুলোর কেমন বাঁই বাঁই উড়োজাহাজে পিঠ এলিয়ে
আর ঘরবাড়িগুলো
কী বিশ্রী রকম কোৎ পেড়ে চলেছে প্রসব-যন্ত্রণায়।
আসুন এই ফাঁকে আমরা একমুঠো ভাজা মৌরী খাই
আর টুথ পিকে দাঁতের মাংস খুঁটি।
দেখুন দেখুন, লম্বা মানুষগুলো
কেমন বেঁটে হয়ে যাচ্ছে গায়ে নামাবলী জড়িয়ে
আর শক্ত দেয়ালগুলো
কেমন কুজো হয়ে পড়েছে প্রতিশ্রুতির বড় হরফের ভারে
আর আবহাওয়ার তলপেটে
কেমন গোঁ গোঁ করছে নতুন বিপদ-আপদ।
আসুন এই ফাঁকে আমরা একুমঠো ভাজা মৌরী খাই
আর টুথ পিকে দাঁতের মাংস খুঁটি।
দেখুন দেখুন, ঝড় নেই
তবু ভেঙে পড়ছে ইস্পাতের পঞ্চবার্ষিকী কাঠামো।
ভেঙে পড়ছে মুখোশের হাড়গোড় এবং বক্তৃতামঞ্চ।
আর ঝড়ের পাখিগুলো।
নতুন গ্রামোফোনে গেয়ে চলেছে পুরনো কাওয়ালি।
আসুন এই ফাঁকে আমরা একমুঠো ভাজা মৌরী খাই
আর টুথ পিকে দাঁতের মাংস খুঁটি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
ফুলের গন্ধে ফোটার জন্যে
নারীর স্পর্শ পাবার জন্যে
ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে
আমরা যেদিন যুবক হোলাম।
বাইরে তখন বক্ষে বৃক্ষে
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
আমাদের সেই কান্না নিয়ে
গান গাইছে বড়ে গোলাম।
ফুলের কাছে নারীর কাছে
বুকের বিপুল ব্যথার কাছে
বেদনাবহ যে সব কথা
বলতে গিয়ে ব্যর্থ হোলাম।
তারাই যখন ফিরে আসে
কেউ ললিতে কেউ বিভাসে
স্পন্দনে তার বুঝতে পারি
বুকের মধ্যে বড়ে গোলাম।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
সবুজ পাতায় প্রথম মাখালে চুন
আট-পহরের ঘাঁটা বিছানায় ধপ ধপে সাদা চাদর
তারপর সেই সাদা চাদরে জাঁতিকাটা ফালা ফালা সুপরি
বহু যুগের ক্ষুধায় কাঁদতে কাঁদতে যে মরেছে তার কঙ্কাল,
আরেকবার বাঁচার ইচ্ছেয় যার হাড়ের ফুটোগুলো
এখনো বাঁশীর মতো ব্যাকুল
অর্থাৎ আমি,
খানিক পরেই আমার পাশে এনে বসাল তোমাকে
কেয়া-খয়েরের কুঁচি
গা ফেটে বেরোচ্ছে ঋতুবতী রমণীর নরম গন্ধ
এমন গন্ধ যে ঘুমোতে দেয় না নিশ্বাসকে
এমন নরম যাতে ভাসিয়ে দেওয়া যায় সর্বঙ্গ।
তিনদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে কে যেন মুড়ে দিল আমাদের
আর, হরিণের হলুদ মাংসে যেমন ব্যাধের তীর,
তেমনি একটি কঠিন লবঙ্গ ভেদ করে চলে গেল
তোমার মধ্যে আমাকে
আমার ভিতরে তোমাকে।
আমি বললাম, সুখী
এই বনগন্ধকেই তো শরীর ছিঁড়ে খুঁজেছি সারাটা গ্রীস্ম।
তুমি বললে, সুখী
তোমার চৌচির ডালপালাকে দেব বলেই তো সাজিয়েছি আমার বসন্ত।
আমাদের সামনে তখন অনন্তকাল।
আমাদের জিভের লালায়, দাঁতের কামড়ে, হাতের থাবায়
পৃথিবীর যত বন, তার গন্ধের ফেনা
যত পাখি, তার পশমের রোদ
যত নদী, তার নুড়ি পাখরের গান।
অমরতার ময়ুর নাচ দেখাবে বলে
যখন একটু একটু করে পেখম মেলছিল রক্তে
ঠিক তখুনি, দুটি আকীর্ণ শরীরের গোপন ভাস্কর্যকে ভেঙে-চুরে,
কেউ একজন চিবিয়ে খেতে লাগল আমাদের খিলিশুদ্ধ।
আমরা রক্তপাতের মতো গড়িয়ে পড়ছি তার ঠোঁটের কশ বেয়ে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
স্বদেশমূলক
|
আপন স্বজন দুজন মাতা।
ভালোবাসার সাঁকোর ওপর পা টলমল পা টলমল
পা বাড়ালেই পদ্মা নদী
হাত বাড়ালেই পদ্ম পাতা
এবার পাবো।
আজান-বাজান ভাটিয়ালীর কন্ঠনালীর ছন্দগাথা
প্রবহমান নদীনালায় গুনতে যাবো।
পাঁজর পোড়া গর্ত খোঁড়া হাটের মাঠের ঘরের ঘাটের
সব দরজা জানলা খুলে খুঁজতে যাবো
অগ্নিবরণ ভোরবেলাতে আমরা কজন আবহমান
ভগ্নি-ভ্রাতা।
ডাইনে বাঁয়ে দুই দিকে দুই বাংলা আমার
আপন স্বজন দুজন মাতা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
আরশিতে সর্বদা এক উজ্জল রমণী বসে থাকে।
তার কোনো পরিচয়, পাসপোর্ট, বাড়ির ঠিকানা
মানুষ পায়নি হাত পেতে।অনুসন্ধানের লোভে মুলত সর্বতোভাবে তাকে পাবে বলে
অনেক মোটর গাড়ি ছুটে গেছে পাহাড়ের ঢালু পথ চিরে
অনেক মোটর গাড়ি চুরমার ভেঙে গেছে নীল সিন্ধুতীরে
তারও আগে ধ্বসে গেছে শতাধিক প্রাসাদের সমৃদ্ধ খিলান
হাজার জাহাজ ডুবি হয়ে গেছে হোমারের হলুদ পাতায়।আরশির ভিতরে বসে সে রমণী ভ্রু-ভঙ্গিতে আলপনা আঁকে
কর্পুর জলের মতো স্নিগ্ধ চোখে হেসে বা না হেসে
নানান রঙ্গীন উলে বুনে যায় বন উপবনবেড়াবার উপত্যকা, জড়িয়ে ধরার যোগ্য কুসুমিত গাছ
লোভী মাছরাঙা চায় যতটুকু জল আর মাছ
যতটুকু জ্যোৎস্না পেলে মানুষ সন্তুষ্ট হয় স্নানে।স্নানের ঘাটে সে নিজে কিন্তু তারও স্নান চাই বলে
অনেক সুইমিং পুল কাপেট বিছানো বেডরুমে
অনেক সুগন্ধী ফ্ল্যাট পার্ক স্ট্রীটে জুহুর তল্লাটে
ডানলোপিলোর ঢেউ ডাবলবেডের সুখী খাটে
জোনাকী যেভাবে মেশে অন্ধকারে সর্বস্ব হারিয়ে
প্রভাতে সন্ধ্যায় তারা সেইভাবে মিলেমিশে হাঁটে।বহু জল ঘাঁটাঘাঁটি স্নান বা সাঁতার দিতে দিতে
মানুষেরা একদিন অনুভব করে আচম্বিতে
যে ছিল সে চলে গেছে নিজের উজ্জল আরশিতে।প্রাকৃতিক বনগন্ধ, মেঘমালা, নক্ষত্রের থালা
কিংবা এই ছ’রকম ঋতুর প্রভাবে
এত নষ্ট হয়ে তবু মানুষ এখনও ভাবে সুনিশ্চিত তাকে কাছে পাবে
কাল কিংবা অন্য কোন শতাব্দীর গোধুলি লগনে
কলকাতায়, কানাডায় অথবা লন্ডনে ।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আমি কি ধরিত্রীযোগ্য?
এই প্রশ্নে কেঁপে ওঠে তার
অসুখের ঘূণ-লাগা শরীরের অসি’-মজ্জা হাড়।
তাকে ঘিরে আছে মেঘ
তাকে ঘিরে ব্যাধের উল্লাস।
অক্ষর অন্বিষ্ঠ তার,
হাতের মুঠোয় মরা ঘাস।
প্রকৃতির হাত থেকে মানুষ নিয়েছে কেড়ে নিজের থাবায়
সংক্রামক কুয়াশা ও হিম
মানুষের হাত থেকে কখন নিয়েছে কেড়ে বিরক্ত সময়
অন্ধকার চিনবার মঙ্গল পিদিম।
কাঁটায় ছিঁড়েছে হাত
লুকনো রক্তের ফোঁটা লেগে
পান্ডুলিপি ভিজে একাকার।
আমি কি ধরিত্রীযোগ্য?
এই প্রশ্নে সে এখন সেতারের ছিঁড়ে যাওয়া তার।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
হারানো অতীত হানা দেয় ফিরে ফিরে।
পরিমাপ করি আজ কী সর্বস্বান্ত।
নিশ্বাসে বায়ু, তবু নিঃশেষ আয়ু,
প্রাণের প্রবল কলকোলাহল শান্ত।
জাগ্রত আছে যে দুটি-একটি স্নায়ু।
তারাও বিলাপ বিলায় অশ্রুনীরে।
দেখি দিগন্তে মুছে গেছে দিকপ্রান্ত
আকাশ বইছে আঁধারকে নতশিরে।
দু’হাতে কালের মন্দিরা বাজে নিত্য।
বাসনা-বহুল জীবনেই শুধু বিঘ্ন।
চীৎকার করে সন্তোগাতুর চিত্ত
আত্মার কাছে আত্মকেন্দ্র ঘিরে।
প্রাণাম্বেষণে যারা বেশী উদ্বিগ্ন
তারা নির্জনে হেঁটে যায় মন্দিরে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
সকল দুয়ার খোলা আছে
নিমন্ত্রণ-লিপি গাছে গাছে
গাঢ় চুম্বনের মত আকাশ নদীর খুব কাছে
রোদে ঝলোমলো।
কখন আসছ তুমি বলো?
বেলা যায়, দেরী হয়ে যায়
বাসি ফুল বাগানে শুকায়
অন্যান্য সমস্ত লোক আড়ম্বরপূর্ণ হেঁটে যায়
দূরের উৎসবে।
তোমার কি আরো দেরী হবে?
আজ ছিল বড় পুণ্যতিথি
সব ঘরে আত্মীয় অতিথি
পুরনো কাপড় ছেড়ে নতুন বসনে বনবীথি
সেজেছে নবীনা
জানি না তা তুমি জান কিনা।
একা আছি, শূন্যতায় আছি
বুকে ওড়ে বিতৃষ্ণার মাছি
মনের সংলাপ থেকে যা কিছু বাসনায় বাছি
জলে টলোমলো।
কখন আসছ তুমি বলো?আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
কাল রাত্তিরে
সূর্যের মুখে ফুটে উঠেছিল
হো চি-মিনের হাসি।
অথচ কাল রাত্তিরে
সূর্য ওঠার কথা ছিল না।
পরশু বিকেলে
সাত বছরের কালো গোলাপটা
থেতলে গেল
ইস্পাতের লরীতে।
অথচ কালো গোলাপটার
ফুটপাথে ফোটার কথা ছিল না।
আজ সকালে
বন্দুকের শব্দে সাদা হয়ে গেল
সবুজ বন।
অথচ মানুষের মুঠোয়
বন্দুক থাকার কথা ছিল না।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
এর আকাশে ওর আকাশে
ওষ্ঠপুটের অনেক পাখি উড়িয়ে দিলে
পায়রাকে ধান খুটিতে দিলে খোয়াই জুড়ে
বুকের দুটো পর্দাঢাকা জানলা খুলে
কতজনকে হাত-ডোবানো বৃষ্টি দিলে।
কত মুখের রোদের রেখা মুছিয়ে দিলে নীল রুমালে।
আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
চায়ের কাপে মিষ্টি দিলে হাসির থেকে
নকশাকাটা কাঁচের গ্লাসে সরবতে সুখ মিশিয়ে দিলে।
নখের আঁচড় কাটতে দিলে ডালিমবনে
দাঁতের ফাঁকে লাল সুপুরি ভাঙ্গতে দিলে।
আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
একটা জিনিস দাওনি কেবল কাউকে তুমি
আলমারিটার ঝুলন চাবি।
শূন্যতাকে রঙীন করার সাম্পু সাবান
সায়া শাড়ীর ভাঁজের নিচে
একটা ছোটো কৌটো আছে।
তার ভিতরে ভোমরা থাকে।
সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন্ হাসিতে রক্ত ঝরে ঠিক অবিকল হাসির মতো
সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন রুমালে কান্না এবং কোন আঁচলে বুকের ক্ষত
দেয়ালজুড়ে বিকট ছায়া ভাবছো বুঝি অন্য কারো?
কার ছায়াটি কিরূপ গাঢ় সে ভোমরাটি সকল জানে।
আমায় কিছু লিখতে হবে
লিখতে গেলে ভোমরাটি চাই।
তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন-চাবি
আমায় দেবে?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
ওপারে আমার ডিঙি পড়ে আছে, এপারে জল।
অনর্গল
পাতা ঝরে পড়ে। বৃদ্ধ বটের দীর্ঘশ্বাস
মেটে আকাশ
কালো থাবা নাড়ে, যেন গোগ্রাসে গিলবে সব
অর্বাচীন
পাখি বলে যায় আজ দুর্যোগ ক্ষমতাসীন।
ওপারে আমার ভিঙি পড়ে আছে, এপারে চর ধুলি কাতর
পথের দুধারে দুঃখিত বন, ঝাপসা চোখ।
ভীষণ শোক
যে-ভাবে কাঁদায়, সেইভাবে নামে নির্বিকার
মেঘলা দিন।
পাখি বলে যায় আজ দুর্যোগ ক্ষমতাসীন।
ওপারে আমার ডিঙ্গি পড়ে আছে, এপারে ঘাট
খোলা কপাট
ঘরে ডেকে আনে সেই হাওয়া যার হৃদয় নেই।
চারিদিকেই
মনে হয় যেন মরণপন্ন কারো অসুখ
চেতনাহীন।
পাখি বলে যায় আজ দুর্যোগ ক্ষমতাসীন।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
সাইকেল রিকশায় চেপে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে
সূর্যের নিকটে।
যেহেতু আমার সাদা গাড়ি নেই, রণ-পাও নেই
যেহেতু আমার লাল গাড়ি নেই, বকস-আপিস নেই
যেহেতু আমার নীল গাড়ি নেই, পদোন্নতি নেই
সাইকেল রিকশায় চেপে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে
সূর্যের নিকটে।
মানুষ ও আকাশের মাঝখানে কোনো ব্রীজ নেই
পাড়াগাঁয়ে যে-রকম বাঁশের নরম সাঁকো থাকে।
শিরীষ ছায়ায় ঢাকা একফালি স্টেশন অথবা
খুব সরু বাস স্টপও নেই কোনো নক্ষত্রের কাছে পৌছবার।
হঠাৎ জরুরী কোনো ইনজেকশন নিতে হয় যদি?
হঠাৎ বোধের নাড়ি ছিড়ে যদি রক্তপাত হয়?
হঠাৎ বিশ্বাস যদি নিভে যায় মারাত্মক ফুঁয়ে?
মানুষ তখন কার কাছে গিয়ে বলবে- বাঁচাও?
যেহেতু আমার সাদা সুটকেশে সব আছে, অগ্নিকণা নেই
যেহেতু আমার নীল পাসপোর্ট সব আছে, অস্ত্রাগার নেই
যেহেতু আমার খাঁকী হোল্ড-অলে সব আছে, অমরতা নেই
সাইকেল রিকশায় চেপে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে
সূর্যের নিকটে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
সবাই মানুষ থাকবে না।
মানুষের কেউ কেউ ঢেউ হবে, কেউ কেউ নদী
প্রকাশ্যে যে ভাঙে ও ভাসায়।
সমুদ্র সদৃশ কেউ, ভয়ঙ্কর তথাপি সুন্দর।
কেউ কেউ সমুদ্রের গর্ভজাত উচ্ছৃঙ্খল মাছ।
কেউ নবপল্লবের শুচ্ছ, কেউ দীর্ঘবাহু গাছ।
সকলেই গাছ নয়, কেউ কেউ লতার স্বভাবে
অবলম্বনের যোগ্য অন্য কোনো বৃক্ষ খুঁজে পাবে।
মানুষ পর্বতচুড়া হয়ে গেছে দেখেছি অনেক
আকাশের পেয়েছে প্রণাম।
মানুষ অগ্নির মতো
নিজে জলে জালিয়েছে বহু ভিজে হাড়
ঘুমের ভিতরে সংগ্রাম।
অনেক সাফল্যহীন মরুভুমি পৃথিবীতে আছে টের পেয়ে
ভীষণ বৃষ্টির মতো মানুষ ঝরেছে অবিরল
খরা থেকে জেগেছে শ্যমল।
মানুষেরই রোদে,
বহু দুর্দিনের শীত মানুষ হয়েছে পার
সার্থকতাবোধে।
সবাই মানুষ থাকবে না।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি
খোলামকুচির জোড়াতালি।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশানুক্রমিক দুর্বাদল।
আঁধারে প্রদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জল।
সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
এই ডালে দুঃখ এসে বসেছিল কাল।
বসে বসে দেখে গেল পাতা ঝরা, শিশিরের ঝরা
দৃশ্যকে নিহত করে হেমন্তের বাবুগিরি চাল
ফিনফিনে আদ্দির ওড়াওড়ি।
মন্দিরে আরতি নেই, দেখে গেল ধূপে ছাই ঝরা
দেখে গেল বালিশের ফাটা মুখে তুলোর বুদবুদ।
মঞ্চে মৃত অন্ধকার, চরিত্রেরা আসেনি এখনো,
শুধু ড্রপসীনে
পাহাড়ের গায়ে নদী, পলেস্তারা-খসা নীল বন।
এই ডালে দুঃখ এসে বসেছিল কাল।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
একটা দিকে খাট পালঙ্ক, আরেকদিকে ঘাম
মধ্যিখানে যজ্ঞে জলে কাঠ
এক পা ছেঅটে ভুবন জুড়ে দিগ্নজয়ী ঘোড়া
আরেক পায়ে জড়ানো চৌকাঠ।
তুলতে যাই ভোরের ফুল শিশিরকণাসহ
অগ্নিকণা লাফিয়ে ওঠে হাতে
ফর্সা রোদে শুকোতে চাই ময়লা বালুচরি
হৃদয় ভেজে অকাল বৃষ্টিপাতে।
শিরীষশাখা শান্তি দেবে, এলাম তপোবনে
হিংসা হানে দুয়ারে করাঘাত
যে ঠুকরে খায় সোনার খাঁচা অপমানের দাঁতে
তাঁর হাঁটুতেই নম্র প্রণিপাত।
একটা চোখে প্রগাঢ় প্রেম, আরেক চোখে ছানি,
আমিই কচ, আমিই দেবযানী।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীর মুখে
সেকালের মোমমাখা ঝাড়লন্ঠন স্তম্ভ ও গম্বুজ দেখা যায়।
দেখে হিংসা জাগে।মানুষ এখন যেন কোনো এক বড় উনোনের
ভাত-ডাল-তরকারির তলপেটে ডাইনীর চুলের
আগুনকে অহরহ জ্বালিয়ে রাখার
চেলা কাঠ, কাঠ-কয়লা-ঘুটে।
মানুষ এখন তার আগেকার মানুষ-জন্মের
কবচ, কুণ্ডল, হার, শিরস্ত্রাণ, বর্ম ও মুকুট
বৃষের মতন কাঁধ, সিংহ-কটি, অশ্বের কদম
পিঠে তৃণ, চোখে অহংকার
সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা গগলস্ পেয়ে খুশি।
প্লাসটিকের মানিব্যাগ, নাইলনের জামা পেয়ে খুশি।
বোবা টেলিফোন পুষে তরতাজা বিল পেয়ে খুশি।
চারকোণা সংসারের চতুর্দিকে গ্রীল এটেঁ খুশি।
বনহংসী উড়ে যায়, সে বাতাসে কাশের কথুক
এয়ারকুলারে সেই বাতাসের বাসী গন্ধ পেয়ে বড় খুশি।একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীকে দেখে
অতীতের রাজশ্রীর, হর্ষবর্ষনের মতো লাগে।
দেখে হিংসা জাগে।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
ডালিম ফুলের লাল জার্সি পেয়ে গেছি
প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে।
অনন্ত হালদার এসে বলে গেল তুমি নাকি এক তরফা আশী বছরের
ইজারা নিয়েছেঅ এই পৃথিবীর সব হাততালি।
ধনুস্টঙ্কারের মতো তুমি নাকি বেঁকে গেছ মালা পেয়ে, মালা পেয়ে পেয়ে?
অথচ জানো কাল তোমার ছায়াকে কারা পুড়িয়েছে তংসাবতী খালে।
আগামী বৈশাখে
সাত লক্ষ গোলাপের জনসভা ডেকেছে আমাকে
এবং সভার শেষে মশালের শোভাযাত্রা, বনে বনে ক্ষেপেছে পলাশ।
নক্ষত্রের কনফারেন্সে মেঘেরো মিছিল করে হেঁটেছিলো কাল সারারাত
প্রত্যেকের হাতে চিল জ্যোৎস্না কালিতে লেখা জ্বলজ্বলে পোস্টার-
সেই যুবকের হাতে তুলে দেবো এইবার পৃথিবীর ভার
ভালোবাসা পাবে বলে কলকাতার সব কাঁটাতার
ছিড়ে খুড়ে হেঁটেছে যে হিউয়েন সাঙের মতো একনিষ্ঠতায়
ডালিম ফুলের দিকে, যে ডালিম ফুল
ঘোরতর অন্ধকার প্রথম ভোরের মতো আবীরের আলো দিতে জানে।
ডালিম ফুলের লাল জার্সি পেয়ে গেছি।
প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি চেয়েছিলে
এই যে এঁকেছি।
এই তার রক্ত-নাড়ি, এই খুলি
এই তার হাড়
এই দেখ ফুসফুসের চতুদিকে পেরেক, আলপিন
সরু কাঁটাতার।
এইখানে আত্মা ছিল
গোল সূর্য, ভারমিলিয়ন
ভাঙা ফুলদানি ছিল এরই মধ্যে
ছিল পিকদানি
পিকদানির মধ্যে ছিল
পৃথিবীর কফ, থুতু, শ্লেষ্মা, শ্লেষ
অপমান, হত্যা ও মরণ।
উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি খুঁজেছিলে
এই যে এঁকেছি!
ক্ষতচিহ্নগুলি গুণে নাও।।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
লোকালয় ছিঁড়ে-খুঁড়ে, ক্ষয় ক্ষতি দুহাতে ছড়িয়ে।
গেরিলা বাতাস গেছে নৈঋত কোণের দিকে বেঁকে।
এখন কোথাও শব্দ নেই।
এখন কোথাও সুখ নেই।
রেডিও, টিভিতে শুধু
সংবাদের নানাবিধ ধানভানা আছে।
অনেকদিনের পর আকাশে ফুটেছে দুটি তারা।
বহুদিন আগেকার তিনফোটা শিশিরের জল
হাতের তালুতে নিয়ে কচুপাতা জঙ্গলের একধারে সুখী হয়ে আছে।
অনেকদিনের পরে আকাশের ঘাঁটি থেকে মিলিটারি মেঘ
ব্যারাকে ফিরেছে বলে কার্ফু উঠে গেছে,
কার্ফু উঠে গেছে বলে ঘাস-ফড়িংয়ের ঝাঁক বেরিয়ে পড়েছে
বেড়ালের নখে-চেরা ওলোট-পালোট দৃশ্যে জাফরানের খোঁজে।
অনেকদিনের পরে জেগেছে রেলের ভাঙা বাঁধ,
আকাশের তাকিয়ায় চাঁদ
যদিও সর্বাঙ্গে তার নষ্ট-ভ্রস্ট মানুষের মতো অপরাধ।
দুর্যোগ থেমেছে দেখে, এক হাঁটু সর্বনাশ ঠেলে
শহরে-জঙ্গলে আমি এসেছি আমার সব ছেঁড়া-খোঁড়া
পালক কুড়োতে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।
আকাশে জ্বলুক শুধু ঈশ্বরের সাতকোটি চোখ
বাকী সব আলকাতরা মাখুক।
আমরা নিমগ্ন হয়ে নিজস্ব চশমায় আর দেখি না কিছুই
সকলে যা দেখে তাই দেখি।
আকাশের রঙ তাই হয়ে গেছে চিরকালে নীল।
বাতাস কি শাড়ি পরে কারো জানা নেই।
মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।
সাদা মোমবাতি জ্বেলে
তোমাকে সম্পূর্ণ করে দেখি।
নারীকে বাহান্ন তীর্থ বলেছে শুনেছি এক কবি।
আমি তার গর্ভগৃহ, সরু সিড়ি, সোনার আসন
চন্দনবটিতে থাকে কতটা চন্দন
দেখে গুনে গুনে মেপে দেখে
তবেই পাতাবো মৌরীফুল।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
হয়তো সূর্যের দোষে আমাদের রক্ত আর ততখানি অগ্নিবর্ণ নয়।
নিমের পাতার মতো নুয়ে গেছে হাত আর হাড়
কবে কবে কমণ্ডলু ভরে গেছে কার্তিকের হিমে, হাহাকারে।
যে-সব পাখিরা আগে মারা গেছে আকাশের আলোর উঠোনে ধান খুঁটে
সেই সব পাখিদের পালকের শতচ্ছিন্ন আঁশ
সেই সব পাখিদের দুবেলার কথাবার্তা, দুঃখ, দীর্ঘশ্বাস
বাতাসের ভিড় ঠেলে এখন ক্রমশ এসে আমাদেরই কাছে ঠাঁই চায়।
সবই কি সূর্যের দোষে? সময়েরও বহু দোষ ছিল।
সময়ের এক চোখে ছানি ছিল অবিবেচনার
জিরাফের গলা নিয়ে সে শুধু দেখেছে দীর্ঘ অট্টালিকা, কুতুবমিনার
দেখেছে জাহাজ শুধু, জাহাজের মাস্থলের কারা কারা মেসো পিসে খুড়ো
দেখেনি ধুলো বা বালি, ভাঙা টালি, কাঁথা-কানি, খড়, খুদ-কুঁড়ো
দেখেনি খালের পাড়ে, ঝোপে-ঝাড়ে, ছেঁড়া মাদুরিতে
আরও কি কি রয়ে গেছে, আরো কারা ঊর্ধ্বমুখী সূর্যমুখী হতে চেয়েছিল
কালবৈশাখীর ক্রদ্ধ বিরুদ্ধতা ঠেলে।
সময়েরই দোষে
আমাদের বজ্র থেকে সমস্ত আগুন খসে গেল
যে রকম বাগানের ইচ্ছে ছিল পাথরের, কাঁকরের বর্বরতা ভেঙে
যে রকম সাঁতারের ইচেছ ছিল জলে স্থলে সপ্তর্ষিমণ্ডলে
ক্রমে ক্রমে সূর্য ম্লান
ক্রমে ক্রমে সময়ের সমস্ত খিলান
পোকার জটিল গর্তে, ঘুণে, ঘুনে জীর্ণ হল বলে
সোজা ঘাড়ে শাল ফেলে সে রকম হাঁটা চলা বাকী হয়ে গেল।
আবার এমনও হতে পারে
আমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আলিঙ্গন, অঙ্গীকার, উষ্ণতার তাপ
কিছুই পায়নি বলে সূর্য ও সময়
প্রতিদিন নিজেদের সমুজ্জল প্রতিভাকে ক্ষয় করে করে,
বেদগানে যে রকম শোনা গিয়েছিল, তত অগ্নিবর্ণ নয়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
মানবতাবাদী
|
এই তো আমার ক্ষিপ্ত হবার সময় এলো।
মুঠোখানেক বৃষ্টি নিয়ে রোদকে ছুঁড়ে মারতে পারি
গঙ্গাজলকে বলতে পারি, সরে দাড়াঁও, ওপার যাবো।
ও কলকাতা হে কলকাতা
নেয়াপাতি ডাবের মাথা
সবকটাকে ঝুনো করে উকুন দিয়ে চষতে পারি।
এই তো আমার ক্ষিপ্ত হবার সময় হলো।
হাড়ের মধ্যে শুকাচ্ছে ঘি
পাঁজরা খুলে কার হাতে দি
চোখ জ্বেলেছে যজ্ঞশালা এবার তবে জপেই বসি
উপবীতটা হারিয়ে গেছে জলে কিংবা জনস্রোতে
নইলে দেখতে ব্রক্ষ্মশাপে ভস্ম হতো বিশ্বভূবন।
এই তো এলো ক্ষিপ্ত হবার বিকেলবেলা।
হাতের মুঠোর রঙের শিশি পাঁচটা আঙুল পাঁচটা তুলি।
বুলিয়ে দিলেই আকাশটা লাল
বাতাসটা নীল কালচে সকাল
সবাই যেমন রগড় খুঁজছে তেমনি রগড় জুড়তে পারি।
গেরস্থ হে, ঘুমোতে যাও, বিছানা আছে হ্যাংলা হয়ে।
এখন আমি ভাঙবো তালা
সিধকাঠিতে বুকের জ্বালা
আকাশ জোড়া সোনার থালা না যদি পাই মরতে পারি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
ডাক্তারবাবু,
আমার চশমাটা বড় গোলমাল করছে আজকাল।
আপনি বলেছিলেন বাই-ফোকালের উপরেটা দুরের
আর নীচেরটা কাছের দৃশ্যের জন্যে।
আমি দূরের দৃশ্যগুলোকে দেখতে পাই বেশ বড় হরফে
কাছের দৃশ্যগুলো যেন বর্জেইস।
সেদিন উপরে ওঠার জন্যে পা দিয়েছি এমন এক সিঁড়িতে
যা নেমে গেছে আন্তাকুড়ে।
আপনি তো জানেন, বাতাসের কি অবস্থা আজকাল
বাতাসের ভিতরে ঢুকে পড়েছে কত রকমের কলকব্জা,
হাতুড়ি, পেরেক, আলপিন, কফ্ থুতু, টক্চা বমি
আর সাপের শিষ, কাপালিকের মন্ত্র।
এক একদিন একটু পরিষ্কার হাওয়া খেতে
গলি-ঘুজি থেকে বেরিয়ে পড়ি বড় রাস্তায়।
আর বড়ো রাস্তায় নামলেই
নাক-মুখ-থেৎলে গাছের দেয়ারে হোঁচট।
অথচ আপনি তো জানেন
কলকাতার মহীরুহরা মরেগেছে সেই বাপ-ঠাকুদ্দার আমলে।
গীর্জার চূড়োর মতো মহিমান্বিত সেই সব গাছ
ঘন্টা বাজাতো সকাল-সন্ধে দুবেলা
মানুষের জন্যে শুভদিন প্রার্থনা করে।
ডাক্তারবাবু,
দূরের দৃশ্যগুলোই বা
এত স্পষ্ট দেখতে পাই কেন আজকাল?
তাহলে সেদিনের ঘটনাটা বলি।
কারা যেন গত্তো খুড়ে রেখে গেছে
গড়িয়াহাটার মোড়ে,
কার্বঙ্কলের ঘায়েরমতো।
কী যে কৌতুহল হল, ঝুঁকে পড়লুম,
আর অমনি পরতে পরতে খুলে গেল
হাজার বর্গমাইল সুড়ঙ্গ।
ভিতরে বিস্তর সব মেশিনপত্তর, যন্ত্রপাতি
স্টেনো, টাইপিষট, কম্পিউটার,
ছুঁরি-কাটারি, আর সেই পুরনো কালের গিলোটিন।
বাঘের চোখের মতো লাল আলোসাদা আলো
জ্বলছে নিভছে,
নিভছে জ্বলছে।
একটা চৌকো মেশিন, অনেকটা গন্ডারের মতো,
প্রশ্ন করল আরেকটা গন্ডারকে
পৃথিবীর শেষ ভূমিকম্পটা হবে কোনখানে?
এশিয়া না আফ্রিকায়?
অমনি ধ্বক্ ধ্বক্ ধ্বক্ আগুনের ফুলকি
সাংঘাতিক সব যোগ-বিয়োগ।
চূড়ান্ত অপমৃত্যুর পর মানুষ পরবে কী রঙের জামা?
লাল না নীল?
গলায় কী রকম বকলস পরালে
মানুষের মনে হবে বেশ স্বাস্থ্যকর
এইসব নিয়ে প্রচণ্ড গবেষণা চলছে সেখানে।
আজকাল সাদা-সাপটা খবরের দিকে তাকালেও
শুনতে পাই ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদের ঢোল-সহরত।
সামান্য দেশলাই কাঠি জ্বললে
ছারখার জনপদের হাড়-কঙ্কাল।
ডাক্তারবাবু,
আপনি কি লক্ষ্য করেছেন
আগে মানুষর সংসারে কত প্রজাপতি এস বসতো
বালিসে, বিছানায়, ছাদের কার্নিশে, হৃৎপিন্ডে
কুমারী মেয়েদের লতায়-পাতায়, কুঁড়িতে।
লক্ষ্মীপেঁচার মতো অদৃম্য হয়ে গেছে
সেইসব মৌটুসী
যারা রাজকুমারের খবর পৌঁছে দিত রাজকুমারীকে।
এখন আর মানুষকে রাজমুকুটে মানায় না,
মানায় বেলবটসে আর মাস মাইনেয়।
আগে এক একদিনের আকাশ
পাছাপেড়ে রমনী সেজে।
মানুষকে জাগাতো ঢেউ দিয়ে।
এখন যেদিকে মানুষের মুখ
তার উল্টো দিকে উড়ে যাচ্ছে সমস্ত পাখি
জল এবং নৌকো।
আগে মানুষেরএকান্ত গোপনীয় অনেক কথাবার্তা ছিল
নক্ষত্রদের সঙ্গে,
এখন মানুষের দীর্ঘতম রোদনের
নক্ষত্রেরা নির্বাক।
গভীর শুশ্রুষা নামে কোনো ছায়া নেই আর কোনোখানে,
নেই হাসপাতালে
নেই আম-জাম-নারকেলের বনে
নেই বৃষ্টি বাদলে
নেই সংবাদপত্রের পাঁচের পাতার সাতের কলমেও।
ডাক্তারবাবু,
সত্যিই চশমাটা বড়ো গোলমাল করছে আজকাল।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
স্বদেশমূলক
|
লোকসংগীতে মেলে জীবনের ভাষা
মানুষের কথা শুনি লোকসংগীতে
নির্ভীক কোনো কবিকন্ঠের গান
ম্রিয়মাণ মন জাগায় আচন্বিতে।
যুলে ফলে জলে তরঙ্গায়িত দেশ
গ্রীষ্ম বর্ষা শরতে কি শোভা মাখে,
দরদী বোনেরা ভাইকে বিজয়ী করে
যমের দুয়ারে কাঁটা দেয় লাখে লাখে।
লাজবতী বৌ দু’বেলা উপোসে ধুঁকে
স্বামীকে মাতায় খুশীর অন্নদানে
অনাহারী চোখে কত রাত জননীও
শিয়র জেগেছে পুত্রের কল্যাণে।
অশীতিবর্ষ বৃদ্ধ পাঁজর জুড়ে
কত যে কামনা মাশিকের মতো গাঁথে,
দেহ মন ভাঙে তবু প্রচন্ড আশা
জীয়নকাঠির স্পর্শে হৃদয় পাতে।
লোকসংগীতে নতুন সূর্য দেখা
নতুন আলোক ভরে যায় প্রাণে মনে
সুখের গানের ভরসায় চোখ তুলে
অশ্রূর দানা ঝরে পড়ে জাগরণে।
লোকসংগীতে বিপুল অঙ্গীকার
জীবনকে চেনো জীবনকে আরো জানো,
এই যে স্বার্থসিদ্ধির চোরাবালি
এই যে পাথর নিষ্ঠুর হাতে ভাঙো।
লোকসংগীতে স্বর্গসুখের সাধ।
কঁকিয়ে কান্না নিশ্চুপ নির্বাক।
ঘর বাঁধবার বিদো্রহী আছো নাকি?
আকাশ-পাতাল দুকুল ছাপানো ডাক।
আবহমান কে বুনেছো সোনার ধান?
কে রুপনারায়নে দিয়েছো অথৈ পাড়ি?
মাটির দেয়াল কে গেঁথেছো গাঁয়ে গাঁয়ে?
কে তাঁত চালাও বোনো রামধনু শাড়ী?
একসুরে তালে কথা কও কথা কও
ভয়কন্ঠে তোলো তো জয়োল্লাস,
কৃষ্ণচুড়ায় বসন্ত জেগে আছে
সে-কথা শুনতে কান পাতে মরা ঘাস।
লোকসংগীতে বিদীর্ণ মরা মাটি
সমুদ্রে ওঠে সীমাহীন কলতান,
বন্দীশালায় বাউলকন্ঠ জলে
মনের আগল ভেঙে পড়ে খান্ খান্।
লোকসংগীত গভীর উজ্জীবন
কঁকিয়ে কান্না নিশ্চুপ নির্বাক
ঘর বাঁধবার বিদ্রোহী আছো কেউ?
আকাশে পাতালে আছড়ে পড়ে এ ডাক।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
ভীষ্মদেবের জন্যে মাঝে মাঝে মন কেমন করে
আবার যামিনী রায়ের জন্যেও।
সমস্ত বৃহৎ অট্টালিকার ভিতরে ঢুকে পড়েছে আগুনের শিকড়
সমস্ত প্রাচীন বইত্রে উইপোকার তছনছ সুড়ঙ্গ
সমস্ত সুফলা গাছের গায়ে কুড়োলের আঠারো ঘা আর রক্ত পুঁজ।
আমীর খাঁর জন্যে মাঝে মাঝে মন কেমন করে
আবার জীবনানন্দের জন্যেও।
গান এবং ছবি যখন যে পথ দিয়ে মানুষের কাছে আসতে চায়
সেই দিকেই ঝুঁকে পড়ে কড়কড়ে মেঘ আর বাতাসের লম্ফ-ঝম্ফ।
আমাদের সামনে দৃশ্য বলতে এখন চুনকাম করা দেয়াল
আর শব্দ বলতে সেই সব উল্লাস, যা সারমর্মহীন।
ভাঙা মন্দিরের টেরাকোটার জন্যে মন কেমন করে
আবার সেনেট হলের সিড়ির জন্যেও।
সেই সব মহিমাময় নক্ষত্রেরা মরে গেছে
যারা জীবনের গায়ে জড়িয়ে দেয় ভয়ঙ্কর উচ্চাভিলাষ।
সেই সব ছলবলে নদীরাও শুকিয়ে গেছে মানচিত্রে
যাদের মুখস্থ ছিল মহাদেবের জটার ঠিকানা।
ক্রমশ কমে যাচ্ছে সেই সব মানুষ যারা মৃগনাভির মতো।
মাঝে মাঝে গান্ডীবের জন্যে মন কেমন করে
আবার একতারার জন্যেও।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
কুড়োলে কাটার বয়স হয়ে এল।
এবার চোখে ছানি, চুলে পাক।
এখনো তোর ক্ষিধে মিটল না হারামজাদা?
আমি কি গাছ আছি সেই আগের মতো?
ছাল ফেটে আটখানা, হাজারটা ক্ষত
হাড়ে-মাংসে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় সেলাই।
সুতোটা রঙিন, তাই রক্ষে
ফোঁপরা ভেতরটা এড়িয়ে যায় দশজনের চক্ষে।
যখন বয়স ছিল, দিয়েছি, যখন যা চেয়েছিস।
ঠুকরে খেয়েছিস।
চাইলি নদীর মতো শরীর, ভাসতে ডুবতে
চাইলি গন্ধ রুমাল, টাটকা ঠোঁট গোলাপে রাঙা,
পা ছড়িয়ে শোবার পালঙ্ক, পা ছড়িয়ে বসার ডাঙা।
চাইলি মানপত্র সোনার থালায়
তুমুল করতালি, কুচিফুল গলার মালায়
চাইলি জিরাফের গলা, আকাশ থেকে যা দরকার পাড়বি,
চাইলি লম্বা নখ, দ্রৌপদীর শাড়ি কাড়বি
রোদ চাইলি রোদ, জ্যোৎস্না চাইলি জ্যোৎস্না
সবই তো কাসুন্দির মতো চাটনি
এবার একটু থির হয়ে বোস না।
তা নয়, কেবল ঠোকর ঠোকর, ঠোঁটের ঘা।
খুদ-কুঁড়ো বলতে এখন আছে তো কেবল স্মৃতি
হতচ্ছাড়া! তাই খাবি? তো খা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
সোনার কলসী ভেঙে যায়, উজ্জল সিঁড়িতে।
পাহাড়ও এমন করে ভাঙে
ঝর্ণার আছড়ানো জলে, সাদা ফেনা, ঘুর্ণিময় তোড়,
অথচ তা রক্তারক্তি যুদ্ধদাঙ্গা নয়।
এই ভাঙ্গা পরস্পর মিশে যাবে বলে
এর স্বাদ ওর, করতলে
ওর দেহে ঢলোঢলো শালবীথি-বাসানো প্লাবনে
এর দেহ নেমে যাবে স্নানে।
সোনার কলসী ভেঙে যায়, উজ্জল সিঁড়িতে।
নবীন জলের ঢেউ ধাপে ধাপে নামে ও গড়ায়
বাহু থেকে ব্যাকুল আঙুলে
গর্তে গর্তে, রোমকুপে, প্রত্যেক প্রতীক্ষারত চুলে।
তরুরতা যে-রকম সর্বাঙ্গীন আত্মসমর্পণে
গাছকে জড়ায়
সেইভাবে ক্রমাগত সর্বস্ব হারিয়ে নেমে আসে
সর্বস্বের লোভে।
আজ সে সমুদ্রকুলে জ্যোৎস্নায় নদীর সঙ্গে শোবে।
জলের গেলাস যদি পেয়ে যায় রোদে পোড়া হাত
সেই ভাবে ভেঙে পরস্পর প্রিয় আত্মসাৎ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
সেই পদ্মপাতাখানি ছুঁয়ে আছি তবু।
যতই ফুঁ দাও ঝড়ে নেভাতে পারবে না
মোমের আগুন।
এত ভূল কর কেন যোগে ও বিয়োগে?
ত্রিশূলের কতটুকু ক্ষমতা ক্ষতির?
নির্বাসনদণ্ড দিয়ে মুকুট কেড়েছ,
তবু দেখ পৃথিবীর পাসপোর্ট আত্মীয় করেছে।
আমার পতাকা উড়ছে
পাখিদের স্বাধীনতা ছুঁয়ে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
আগুনে আঙুল রেখে ঠায় বসে আছি
কেউ ডাকলে যাতে সাড়া পায়।
ঘরের বাইরে গোল সার্কাসের মাঠ।
নিরাপত্তা-বিধায়ক যথারীতি ভেজানো কপাট।
কবে বৃষ্টি হয়েছিল
তারই বাসি গন্ধ শোঁকে মাটি।
বুদ্ধিজীবী বাতাসের চতুষ্পাঠী চেপেছে নিলামে।
মুখ-আঁটা গোপনীয় খামে
চিঠি চালাচালি চলে সন্ধি ও সংগ্রামে।
ছুঁচের সেলাই ছেঁড়া শার্ট
দুমড়ে মুচড়ে যেভাবে বাতিল
তার চেয়ে হীনমন্যতায়
রৌদ্র আজ লোকালয় ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে চায়
জঙ্গলে ও ইলেকট্রিক খুঁটির ওপারে।
ঘরের বাইরে সব।
ঘর ফাঁকা, ঘরে শুধু পেরেক রয়েছে,
স্মরনীয়তাজ ছবি নেই।
আগুনে আঙুল রেখে বসে আছি ঠায়
সঠিক ঠিকানা খুজেঁ কেউ এলে যাতে সাড়া পায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
কাগজ পেলেই আঁকচারা কাটা অভ্যেস।
একবার আঁকছিলুম রাজবাড়ি।
আঁকতে আঁকতে হয়ে উঠলো আলকাতরা মাখা দৈত্য,
কাগজ থেকে লাফ দিয়ে উঠলো দশ আঙুলের থাবা
খাঁবো, খাঁবো, খাঁবো।
সেই থেকে আর রাজবাড়ি আঁকি না।
আঁকি রাজহাঁস, ময়ুর, জলের ঘূর্নি, আর সেই সব শিকড়
যা ডুবে আছে আকুলি-বিকুলি তৃষ্ণার ভিতরে।
পদ্মপাতায় ডুমুরের গুছির মতো ফলে থাকে যে শিশির
আঁকতে যাই, পারি না।
অন্ধকারের খোঁপায় বাগান সাজিয়ে রাখে যেসব আলোর কুঁচি
আঁকতে যাই, পারি না।
প্রচণ্ড রাগে একদিন আকঁতে বসলুম ধ্বংসের ছবি
আঁকতে আঁকতে ফুটে উঠল আশ্চর্য এক নারী।
তখরও চোখ আঁকিনি, তবুও চন্দন গন্ধে হেসে।
তখনও হাত আঁকিনি, তবুও কপালের জচুল সরিয়ে বললে
শোনো
বলেই হারিয়ে গেল ধ্বংসের আড়ালে।
তাকে ধরবো, ছোঁবো, জড়াবো, নিংড়াবো বলে
কলকাতার ট্রামলাইন, মেটেবুরুজের বসি-
মুর্শিদাবাদের কবর, অন্ধ্রের ঝড়, রাজস্থানের বালি ডিঙিয়ে
ছুটে চলেছি। ছুটে চলেছি। ছুটে চলেছি।
এখনো।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
এইখানে সব আছে। স্তব্ধতার মুখে
শুনতে পাবে অবিরল সলজ্জ সংলাপ
দৃষ্টি যদি ডুবে যায় তরল আঁধারে
তবু কারো নিংশ্বাসের উজ্জল উত্তাপ।
তোমাকে রঙিন করে দেবে স্পর্শ সুখে।
নিয়ে এসো দিনাস্তের অসংখ্য বিলাপ
কে তাকে উড়িয়ে দেবে গানের পাখির
পাখনায় বেঁধে ব্যাপ্ত অসীমের বুকে।
যেখানেই হাত ছোঁবে সে নদী-গিরির
অজ্ঞাত শিল্পীর আঁকা দৃশ্যের বিস্ময়
মেঘলোকে উঠে গেছে সিঁড়ি ধাপে ধাপ।
এইখানে নব আছে। যাকে বলো ক্ষয়
সেও তো ফোটাবে মুক্তি রক্তের কিংশুকে।
আমাকে অমৃত দেবে অন্তর্গত পাপ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
স্থির হয়ে বসে আছি, তবু কলরোল।
মাছি জানে, ছাই-হওয়া সিগারেট জানে, কতখানি স্থির।
করতলে ভাগ্যরেখা, ইতিহাসে রাজার গৌরব, মাটিতে সমাধি
জলের ভিতরে গুড় আত্মহত্যা শুয়ে থাকে যতখানি স্থির,
মানুষের ছা-পোষা সংসারে
বদ্ধমূল নানাবিধ ভ্রানি-র মতন স্থির হয়ে বসে আছি, তবু কলরোল।
কাউকে দেখিনা, শুধু জনশূণ্য পথে একা হাওয়া হাঁটে, গাছ মাথা নাড়ে
কাউকে দেখি না, শুধু বিমানের সাদা ডানা, বিধ্বস্ত গর্জনে
লজ্জিতা নারীর মতো মেঘ সরে যায়, ঘন ছায়া নামে বনে
পৃথিবী হঠাৎ
দরিদ্রের মতো ম্লান, কাক কেঁদে ওঠে।
লিখি না, আঁকি না, কোনো ভাঙাগড়া খেলাধূলা নেই
তবু কলরোল।
ডাকাডাকি আকাশে মাটিতে, ক্রমাগত অনবরতই
সভাসমিতির খাম, আমন্ত্রন ও অভিবাদনে ক্রমাগত অনবরতই
দাঁড়ানো, দৌড়ানো, ছুটোছুটি
দোলাদুলি ঢেউয়ে লোকালয়ে।
ট্রেনের টিকিট যারা কেটে আনে কাউকে চিনি না।
রিজার্ত কামরার সুখ, অতিথিশালার চাবি, আয়না, বাথরুম
যথেচ্ছ ভ্রমণ সেরে ভোরবেলা না-ভাঙার ঘুম, দীর্ঘ স্বপ্নের তালিকা
ক্রমাগত অনবরতই কেউ ডাকে, করস্পর্শে মনে হয় আত্মীয়স্বজন
যেতে হয়, থেকে যাই, কার কাছে থাকি তা জানি না।
যে সম্রদ্রে কোনদিন ওলোট-পালোট হয়নি চুল
যে পাহাড় বহুদিন বিবাগী বন্ধুর মতো দুরদেশে ছিল
তারই কাছে স্টপেজ, স্টেশন, মেলামেশা, অঢেল আমোদ।
মধ্যরাতে ছৌ-নাচ, মানুষের ভগ্ন দেহে দেবতার মুখোশ পেখম
কাড়া-নাকড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে দশদিক, চতুর্থ প্রহর
মন্দিরে মন্ত্রের মতো ধ্বনি জাগে, যাগযজ্ঞে আছি মনে হয়
ঝর্ণা নামে রক্তস্রোতে, অব্যক্ত ও অব্যাহতিহীন কলরোল শুধু কলরোল।
আত্মপ্রকাশের এক গাঢ় ইচ্ছা
হটাৎ আকাশ ছুঁয়ে ফুটে উঠবার এক গাঢ়তর অসুখ ও জ্বর
বুকের ভিতরে এনে জড়ো করে ক্রমাগত, অনবরতই,
রাশীকৃত গাছপালা, শুকনো হাড়, শিকড়-বাকড়,
নৌকোর ভাঙা দাঁড়, অফুরন্ত কালো জল ও সুর্যকিরণ।
স্থির হয়ে বসে আছি তবু কলরোল।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
ভক্তিমূলক
|
দেবার সময় সব দিয়েছেন তিনি।
সাগর জলে নোনা এবং
চায়ের জলে চিনি।
রূপ দিয়েছেন
ধূপ দিয়েছেন
মনকে অন্ধকূপ দিয়েছেন
চাঁদের আলোয় বিষ দিয়েছেন রাতে
তাঁরই কাচের বাসন ভাঙে সামান্য সংঘাতে।
দেবার সময় যা দিয়েছেন
নেবার সময় সবই নেবেন তুলে।
থাকবে কিছু রক্তফোঁটা
ঘনান্ধকার রাত্রে ফোটা
ব্যথাকাতর দু-একটি আঙ্গুলে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
কাল সারা রাত ভোর করে দিলে তুমি।
মনে হচ্ছিল শিকড় নামছে সারা গায়ে, যেন ক্রমশ গভীর মাটি
টানছে আদরে, ওদিকে উপরে আকাশেরও মুখে জননীর মতো হাসি।
হাওয়া বিলোচ্ছে পাতায় পাতায় শিরমিরে সুখ, ফলে-ফুলে ভরে গেছি।
গাছ থেকে গাছ, প্রতি মূহুর্তে জন্ম এবং পূর্নতা আর বিসতৃত হতে থাকা
গাছ থেকে গাছ, হাজার গাছের বনরাজি যেন শোভাযাত্রায় হাঁটে
একটি যুবক হয়ে গেল যুব-উৎসব কাল কাঁপলো এমন ঝড়ে।
অক্ষর থেকে অদৃশ্য এক নারীর শরীর উঠে এল যেন কাছে।
আঙুর গুচ্ছে ভরেগেল হাত, বিছানা, বেদনা, সকল শূন্যস্থান।
যে-সব সুখের জন্যে মানুষ ছিড়েছ নিজের চামড়া, রক্ত-নাড়ী
সেই সুখ নিয়ে বন্দরে এল সাতশো জাহাজ গর্বিত হাসি হেসে।
যে সব ক্ষতের রক্ত কখনো শুকোবার নয় এমনই মর্মঘাতী
তাও মুছে গেল অবিশ্রান্ত ঝরনার সাদা জলে।
গায়ের যা কিছু পুরনো ময়লা নরম তোয়ালে ঘষে ঘষে তুলে দিল,
শব্দে বাজাল সোনার চুড়ির নিক্কণ সেই অক্ষরজাত নারী।
হঠাৎ ঘুরে যায় দৃশ্যপট
হঠাৎ বনে বাজে নদীর শাঁক
প্রেমিক হয়ে ওঠো তপস্বী
শোনাও স্বাধীনতা মন্ত্র পাঠ।
প্রেয়সী, যার চুলে আকাশ পাও
প্রেয়সী, যার চোখে তিন ভুবন
তাকেও ফেলে রেখে দূরত্বে
এগিয়ে চলে এলে প্রান্তরে।
তখন তুমি যেন অন্য লোক
বিষাদ আর গাঢ় প্রতিজ্ঞায়
দৃপ্ত দেহখানা দীর্ঘকায়
বৃষ্টিভারাতুর উচ্চারণ।
শিশুর জন্যে নরম তুলোর বিছানা
যদি কেঁদে ওঠে দুগালে চাঁদের চুমো,
নারীর জন্যে দীপাবলী জ্বালা রজনী
ঘরকন্নায় কম ছায়া বেশি আলো।
পুরুষ, যাদের কর্মঠ কাঁধ, সকলে
বৃক্ষের মতো ভরপুর হবে ফসলে।
সংক্ষেপে ছিল প্রতিশ্রুতিরা এইসব।
শত্রু ছুড়েছ কামান ও কালো ঁেধায়া।
যেখানে যা-কিছু আলোর শিল্পসজ্জা
যেখানেই খাঁকি সৈন্যের লাফালাফিতে
ঘনান্ধকার পিশাচের মতো হেসেছে।
প্রস্তুত হও, সকলে এবং তুমিও
প্রেয়সী আমার চুম্বনগুলো তোলা থাক
ধ্বংস পেরোনো নীল রাত্রির জন্যে।
কাল সারারাত এইভাবে ভোর হয়ে গেল তোমার সঙ্গে।
উৎপীড়ন এবং উজ্জীবনের মাঝামাঝি
প্রচণ্ড প্রেম এবং প্রবল ঘৃণার মাঝামাঝি
দূর নেপথ্য এভং নিকটবর্তী প্রত্যক্ষের মাঝামাঝি
সজ্জিত মঞ্চের সিড়ি ভেঙে ভেঙে ক্রমশ উপরে ওঠা।
ঝাউবনের সঙ্গে যে-ভাষায় কথা বলাবলি
বিপন্ন নৌকার সঙ্গে যে-ভাষায় জোয়ার জলের আলাপ-আলোচনা
সেই ভাষায়, মঞ্চের উপর থেকে, ুতমি বাড়িয়ে দিলে বন্ধুত্ব।
কীভাবে স্পন্দিত হতে হবে এখন আমি জেনে গেছি।
এখন আমার হাতে যে-কেউ একটা মরা পাখি তুলে দিক।
আমি প্রথমেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবো বন্দনায়
দ্যাখো, দ্যাখো, প্রাচীন গ্রীওসর যাবতীয় সৌন্দর্য এর পালকে।
তার পরেই আমার গলায় ঝনঝন করে উঠবে আক্রমণ
হত্যাকারী! তুমি দেওয়ালের দিকে মুখ রেখে দাঁড়াও।।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
স্মৃতিতে সর্বাঙ্গ জ্বলে
একশ পাঁচ ডিগ্রী ঘোর জ্বর।
টালমাটাল ঝড়
ঘুষি মারে হাড়ে মাসে ব্রক্ষ্মতালু রক্তকণিকায়
যেন তাকে ছিড়েখুড়ে অন্য কিছু বানাবে এখুনি।
হঠাৎ হরিণ হয়ে হয়তো সে ছুটে যাবে বহুদূর বাঘ-ডোরা বনে
তুমুল আগুন জ্বেলে পলাশ যেখানে যজ্ঞ করে।
নিজের বিবিধ টুকরো জুড়ে জাড়ে হয়তো বা হলুদ শালিক
অর্জুন গাছের সাদা থামে
যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে সূর্যাস্ত যেখানে রোজ নামে
সেইখানে ঘরবাড়ি ভাড়া নিয়ে কিছুদিন থাকবে স্বাধীন
অথবা সে নিজেরই লালার
চমৎকার রাংতা দিয়ে গড়ে নেবে সাত-কুঠরি ঘর।
জ্বর
এইভাবে নখে চিরে করেছে উর্বর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে।
কলসী কলসী জল ঢালি সান্ত্বনার, সুবিবেচনার
কপালের জলপটি শীতের ভোরের মতো সারাক্ষণ ভিজে হয়ে থাকে
তবু জ্বর ছাড়েনাকো তাকে।
এক অগ্নিকুন্ডে থেকে আরেক আগুনে ঝাঁপ দিয়ে
ছাই মাখে, ভস্ম মাখে, চোখে আঁকে না-ঘুম-কাজল।
জ্বরে সে পাগল।
শিশুরা পায়েস ঘেঁটে গোলগাল কিসমিস পেয়ে গেলে যে রকম হাসে
সেরকমই দিগ্বীজয়ী হাসি তার দুটি পাখি-ঠোঁটে।
সে নাকি মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেছে বসন্তের সমস্ত কোকিল
গোপালপুরের সব রূপোলি ঝিনুক
পুরীর সমস্ত ঝাউবন।
সাঁওতাল পরগনা থেকে পেয়ে গেছে সব কটি নাচের মাদল।
আসলে এসব কিছু নয়
দুধের গাভীর মতো একটি নারীকে খুঁজে পেয়েছে সে কলকাতা থেকে
ছানা ওমাখন তাকে খেতে দেয় সেই রমনীটি
খেতে দেয় দু-বাটিকে ক্ষীর।
তারই গলকম্বলের স্বাদে গন্ধে এমন মাতাল
ভেবেছে পৃথিবী তার পকেটের তে-ভাঁজ রুমাল।
এই ভাবে জ্বর
নৌকো ভর্তি স্মৃতি সহ ভাসিয়ে দিয়েছে তাকে এই পৃথিবীর
ইট কাঠ বালি সুরকি পেরেকের ঢেউ-এর ওপর।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
করাত কেটে চলেছে ভিতরে
বাইরে তুলকালাম পিকনিক।
অস্ত্রাঘাতের শব্দে শিউরে উঠল কে?
বাতাস।
এক শ্মশান থেকে আর শ্মশানে ছুটছে কে?
যৌবন।
করাত কেটে চলে ভিতরে
বাইরে তুলকালাম পিকনিক।
পায়ের তলায় গুমরে গুমরে উঠছে কি?
প্লাবন।
মাটির দেয়ালে ক্রমশ লতিয়ে উঠছে কি?
মড়ক।
করাত কেটে চলছে ভিতরে
বাইরে তুলকালাম পিকনিক।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
কত রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি
পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি
অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি
কদম ফুলের গন্ধা-সিঁড়ি
ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
কত রকম সিঁড়ির ধাপে কত রকম জল
পা পিছলোলে অধঃপতন
ভাসতে পারো মাছের মতন
ডুব সাঁতারে মুঠোয় পেলে সঠিক ফলাফল।
কত রকম জলের ভিতর কত রকম মাছ।
চুনো পুঁটি রাঘব বোয়াল যার যে রকম নাচ।
পেট চিরলে আংটি কারো
কারো শুধুই আঁশ
দীর্ঘতর ফুসফুসে কার ভরাট দীর্ঘশ্বাস।
সিঁড়ির নীচ জল এবং সিঁড়ির উপর ছাদ
মেঘও পাবে মানিক পাবে
বজ্রধ্বনির খানিক পাবে
পুড়তে চাইলে রোদ
জ্যোৎস্না থেকে চাইতে পার সার্থকতাবোধ।
অনেকরকম সিঁড়ি আছে ওঠা নামা হাঁটার
ঊর্ধ্বে অভিষেকের তোরণ
নিচের ঝোপটি কাঁটার।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
খে আছি, দুখে আছি, নিজস্ব বুদবুদে ডুবে আছি
পোয়াতি নারীর মতো গর্তে বহু স্বপনের ভ্রুণ নিয়ে আছি
সধবার নিরস্তর ভয় পাছে মুছে যায় সিঁথি-শুকজতারা
সে রকমই ভয়ে-ভয়ে ঘাসের ভিতরে পোকা-মাকড়ের সঙ্গী হয়ে আছি।
পাখিরা রয়েছে সঙ্গে, রুমালের পাড়ে
লাল সুতো, নীল সুতো, সদীর বাঁশীর গান তারা বুনে দেয়।
জঙ্গলও রয়েছে সঙ্গে, এক-শৃঙ্গ গণ্ডারও রয়েছে
বাঘের নখের দাগ, আঠারো ঘায়ের রক্তপুঁজ, সে-সবও রয়েছে।
হাঙরের করাতের দাঁতে হাসি লেগে আছে, এই দৃশ্য দেখে
অপমানিতের মতো নুয়ে আছে বৃদ্ধ বৃক্ষগুলি ।
আকাশের রুখু চুলে উকুনের মতো ঘোরে দুর্দিনের মেঘ
চামচিকের রক্ত নখে হাওয়ারা হয়েছে কালো ভুত।
তবু
কাঁঠালপাতার থেকে নেমে এসে জ্যোৎস্না মুখে তুলে ধরে বাটি-ভরা দুধ।
দিনের পঞ্চান্ন ভাগ তুচ্ছতার ধুলো মেখে আছি
পুতুলনাচের সুতো নর্বাঙ্গের পেরেকে জড়ানো।
কিন্তু যেই ফিরে আসি নিজ ঘরে, নিজস্ব বুদবুদে
মাথায় মুকুট পরে জেগে ওঠে গোলাপের বনে জাহাঙ্গীর
আতর গন্ধের ঘ্রাণ নিয়ে আসে নরজাহান চোখের রেকাবে।
ফৈয়াজ খাঁ-এর মতো গলা খুলে সারা দিনমান
কে যেন শুনিয়ে যায় মালকোষে পৃথিবীর, এশিয়ার, এই কলকাতার
যাবতীয় বন্দীশালা ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্ ভেঙে ভেঙে হবে খান্ খান্ ।
শীত-রাতে দুঃসময়ে পেয়ে গেছি এখনও কল্কাপপেড়ে শাল
আত্মার ভিতরে এক সূর্য থাকে, তারই রঙে লাল।
সেই শাল গায়ে দিয়ে আছি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
একটা সাইকেল থাকলে বড় ভালো হতো
বুঝলে, রাধানাথ,
আরো ভালো হতো একটা মোটরবাইক থাকলে।
কাঠের বাকসে কুতকুতে খরগোস
সে-রকম আতুপুতু দিনকাল নয় এখন।
আগে নিজের কাছে নিজের গড়গড়ার নলের মতো
লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতো মানুষ।
এখন ৩৬ রকম বায়নাক্কা
বুঝলে রাধানাথ,
মানুষের এখন ৫২ রকম উবু-জলন্ত খিদে।
এক একটা মানুষের ড্রয়িংরুম এখন দিল্লিতে
বাথরুম ত্রিবান্দ্রমে
বেডরুম ৩২/এ গুলু ওস্তাগর লেনে।
এক একটা মানুষকে এখন একই সঙ্গে সামলাতে হচ্ছে
মেথর, ম্যাজিস্ট্রেট এবং মন্ত্রী।
টেলিফোন নামিয়ে রাখলে টেলেকস
টেলেকস ফুরিয়ে গেলে টেলিগ্রাম
ব্যস্ত স্টেনোর আঙুলের মতো
এ থেকে ওয়াই
ওয়াই থেকে এফ
এফ থেকে জি কিংবা জেড পর্যন্ত
মানুষের মারদাঙ্গা দৌড়।
নিজস্ব রেলগাড়ি ছাড়া,
বুঝলে রাধানাথ
এত সব লাঞ্চ এবং ডিনার
এত সব ক্লাব, কনফারেন্স, সেমিনার
এত সব সিড়ি, সুড়ঙ্গ এবং রঙ্গীন চোরাবালির কাছে
ঝট ঝট পৌছনো বড় হাঙ্গামার ব্যাপার।
একটা অ্যামবাসাডার থাকলে বড় ভালো হতো
বুঝলে রাধানাথ,
আরো ভালো হতো ছেলেবেলার শালিকের মতো
একটা পোষা হেলিকপ্টার থাকলে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
কাকে দিয়ে যাব এই জলরাশি, দুকুল প্লাবন
কাকে দিয়ে যাব ভাঙা তীর
বিপদসংকুল বাঁশী যদি বাজে মধ্যরাত চিরে?
কে নেবে অঞ্জলি ভরে এই জল, পিছল সংসার
অসুখের মতো এই রক্তচিহ্নহীন ধুসরতা?
সুয়ে, শুয়ে, ভেঙে পড়ে বৃক্ষ, তরুলতা
যাদের শিকড় ছিল মাটির গভীরে বদ্ধমুল,
রক্তজাত ফুল
আকাশকে উপহার দিয়েছে প্রত্যেক শুভদিনে
পৃথিবীকে উপভোগ্য স্নেহ ও মমতা।
মহীরুহ শুয়ে আছে ঘাসে,
সোঁদা গন্ধ সরল বিশ্বাসে।
কাকে দিয়ে যাব এত ক্ষত, অক্ষমতা?
যে নেবে সে জয়ী হবে জানি
যে নেবে সে বিপন্নও হবে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
হে স্বচ্ছন্দ তরুলতা, তোমরা রয়েছ বলে আছি।
চামচিকের নাচানাচি গাঢ়তর করেছে আঁধার
কোলাব্যাঙ জেনে গেছে তার হাতে মেঘ, অন্নজল
মাকড়সারও বড় সাধ মাঝ গাঙে মাছ ধরবে জালে,
ইদুর সুড়ঙ্গ কেটে চলে যাবে চাঁদের পাহাড়ে।
হে স্বচ্ছন্দ তরুলতা, তোমরা রয়েছ বলে আছি।
শিকড়ে জড়ানো মাটি, হাঁটাহাঁটি ব্যস্ত শত মুলে
শাখায় সংসার, পুষ্প-পল্লবের উঠোন দালান
মৃত্যু আছে সেখানেও, খরা আছে, বহু ভাঙচোর
ঝড় কিছু কাড়ে, কিছু বৃষ্টিজল ভাসায়-পচায়
রোদ্দুর চিবোয় কিছু, ঝরে যায়, তবু ঢের থাকে
শিশিরে স্নানের যোগ্য। পৃথিবীর তামাটে প্রান্তরে
তোমারই একমাত্র শামিয়ানা, সুস্থ, সভা, সুদৃশ্য ভাষণ।
গরুর গাড়ির ধুলো বাতাসের যতটা গভীরে
যেতে পারে, শিশু যায় জননীর যত অভ্যন্তরে
তোমরা গিয়েছ এই পৃথিবীর ততটা নিকটে।
সূর্য থেকে কতটুকু অগ্নিকণা নিতে হয় জানো
মেঘ থেকে কতটুকু জ্যোৎস্না ও কাজল
মলিনতা থেকে মুক্তো, আবর্জনা থেকে খাদ্যপ্রাণ।
দিগন্তের কোন দিকে প্রকৃত আপন গৃহকোণ,
কে আত্মীয়, শ্মশানের বিশ্বস্ত সুহৃদও কারা জানো।
হে স্বচ্ছন্দ তরুলতা, তোমরা রয়েছ বলে আছি।
জেনেছি বাঁচার অর্থ, অবিচ্ছিন্ন ফোটা, জেগে থাকা
প্রত্যহ উৎপন্ন হওয়া, প্রতিদিন নবদুর্বাদল।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তুমি বললে, রৌদ্র যাও, রৌদ্রে তো গেলাম
তুমি বললে, অগ্নিকুণ্ড জ্বালো, জ্বালালাম।
সমস্ত জমানো সুখ-তুমি বললে, বেচে দেওয়া ভালো
ডেকেছি নীলাম।
তবু আমি একা।
আমাকে করেছ তুমি একা।
একাকিত্বটুকুতেও ভেঙে চুরে শত টুকরো করে
বীজ বপনের মতো ছড়িয়ে দিয়েছ জলে-স্থলে।
তুমি বলেছিলে বলে সাজসজ্জা ছেড়েছি, ছুঁড়েছি।
যে অরণ্য দেখিয়েছ, তারই ডাল কেটেছি, খুঁড়েছি।
যখনই পেতেছ হাত দিয়েছি উপুড় করে প্রাণ
তবু আমি একা।
তবুও আমার কেউ নও তুমি
আমিও তোমার কেউ নই।
আমাদের অভ্যন্তরে স্রোতস্বিনী আছে, সেতু নেই।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
দুঃখ দিয়েছিলে তুমি
আবার লাইটারও দিয়েছিলে।
বোতাম ছিড়ে আমাকে লগ্ন করেছো
তুমি আবার বুনে দিয়েছো নাইলনের সবুজ জামা।
কমলালেবু নিংড়ে নিংড়ে বানানো সরবৎ
ভিতরে মিশিয়ে দিলে গোপন কান্নাকাটি
স্মৃতির পেস্তা-বাদাম
সেই সরবৎ খেতে হবে এখন প্রত্যহ
বাইশ বছরের যুবকটা যতদিন আমার
চুলের ভিতরে আঁচড়াবে
আগুন রঙের চিরুনি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
ভক্তিমূলক
|
দেবতা আছেন কোথাও কাছাকাছি
পায়ের চিহ্ন বনে
বনের চিহ্ন তারঁই তুলির টান
সরল রেখাঙ্কনে।
জানি না ঘর বসত-বাটী ডেরা
আছেন জানি শুধু
প্রতিদিনের কাঠে ও কেরোসিনে
উঠোন-ভর্তি দুঃখে ও দুর্দিনে
তাঁরই ব্যথার অগ্নিকণা ধু ধু ।
তুমুল হাওয়া, তরল রক্তপাত
চতুর্দিকে দাঁড়কাকেদের দাঁত
স্তুপীকৃত করাত-চেরা বুক।
কুরুক্ষেত্রে ভাঙা রথের চাকা
মৃত মানুষ জ্যান্ত শকুন ঢাকা
তীর ধনুকে ঝলমলিয়ে হাসে
তাঁহারই কৌতুক।
দেবতা আছেন কোথাও কাছাকাছি
হয়তো বোধে, হয়তো ক্রোধে, ক্ষোভে
অবিশ্বাসেও হয়তো কারু-কারু
তাঁরই ডাকে বজ্র ডাকে মেঘে
রৌদ্র ওঠে প্রকিজ্ঞায় রেগে
দৃপ্ত হাঁটে দীর্ঘ দেবদারু।
দেবতা আছেন কোথাও কাছাকাছি
জানি না ঘর বসত-বার্টী ডেরা।
প্রতিদিনের খড়ে এবং কুটোয়
তার ভিতরেই বিদীর্ণ প্রায় তাঁহার
দুঃখী চলাফেরা।
‘আমি তোমারে করিব নিবেদন
আমার সকল প্রাণমন’
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমারি সঙ্গে যুদ্ধ প্রহরে প্রহরে
তোমারই সঙ্গে সন্ধি,
তোমারই মূর্তি নির্মাণে আমি নিজেকে
করেছি পাথর চূর্ণ।
সর্বনাশের পাশা নিয়ে খেলা দুজনের,
অথচ লক্ষ্য শান্তি।
আক্রমণের তীর ও ধনুকে জ্বলছে
ক্ষমার সৌরদীপ্তি।
তোমার মৃত্যু যখন আমার কান্নায়
তুমি উল্লাসে পদ্ম,
আমার মৃত্যু যখন তোমাকে ছিঁড়ছে
আমি মুখরিত শঙ্খ।
প্রহরে প্রহরে নিহত হয়েও আমরা
অগ্নিপালকে রক্তিম,
পরস্পরের নিঃস্বতা পরিপূরণে
অর্জন করি প্রজ্ঞা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
কোন কথা মন্ত্র হবে কেউ তা জানে না।
তবু তো ঘুমের কাছে বেচে দিতে পার না সিন্দুক।
কঠিন মৃগয়া ছেড়ে বিছানার বালিশে-তোশকে
লুকোতে পার না ধনুর্বাণ।
যেহেতু নিয়েছ বেছে ব্যাধের ভূমিকা
তোমাকে তো যেতে হবে দুর্গমের গৃঢ় অভ্যন্তরে
সময়ের শতজট, ভূল-হাতছানি ভেদ করে।
যে কোনো তপস্যা চায়
নতজানু শুচিতা ও শ্রম।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
দেরাদুন এক্সপ্রেস পড়ি-মরি দৌড়ে ছুটে গেল।
কাকে ছুঁতে?
জ্বলজ্বলে যুবক সেজে কার কাছে গেল?
ডাকাতের মতো কালো অন্ধকারে, এই মাঝরাতে
কাকে খুলে দেবে বলে পরেছে আলোয়-গাঁথা হার?
চোখে তার জঙ্গলের খিদে-পাওয়া লাল চিতাবাঘ
এই বন্য থাবা দিয়ে কাকে সে জড়াবে?
প্রাগৈতিহাসিক কোনো স্মৃতির চন্দনগন্ধ মেখে
মহেনএজাদারোর বৃষ জেগে উঠে দিয়েছে হুঙ্কার
দেরাদুন এক্সপ্রেস সেইভাবে দৌড়ে চলে গেল।
কার সাথে কোন্খানে দেখা হবে তার?
সেখানে কী সবুজের ডোরাকাটা পাহাড়ের সার
কাশ্মীরী শালের মতো সামিয়ানা টাঙিয়ে রেখেছে?
বাসরঘরের ভিড়ে পান-খাওয়া পরিতৃপ্ত ঠোঁটের মতন
সেখানে কি বাগানের গায়ে-গায়ে সুখী হাওয়া বয়?
বানভট্ট যেরকম সুহাসিনী রূপসীর ঘ্রাণ পেয়েছিল
সেরকম কেউ
বনস্থলী, লতাগুল্ম, নুড়ি ওপাথর
সোনালী বালির রেখা, রাঙা ধুলো, ঝাউ, ঝরাপাতা
নদীর আয়না-জল, জড়ো করে, সব জুড়ে-জাড়ে
সেখানে কী তার জন্য ঘুমোবার বিছানার সুজনি বুনেছে?
পাখির নরম বুকে আকাঙ্কাকে জুড়োবার স্বাদ আছে জেনে
যেরকম ক্ষিপ্রতায় ব্যাধের চোখের কালো তীর ছুটে যায়
দেরাদুন এক্সপ্রেস সেইভাবে দৌড়ে চলে গেল।
কার কাছে গেল?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
কাছের বন্ধুরা ক্রমশ চলে যাচ্ছে দূরে
দূরের বন্ধুরা এগিয়ে আসছে কাছে।
আসলে কেউই সরছে না
বা নড়ছে না।
শিং এ আটকানো ডালপালার জট খুলতে খুলতে
আমিই খুঁজে চলেছি
নক্ষত্র এবং আগুন
একদিকে নক্ষত্র এবং আগুন
অন্যদিকে নগদ অভ্যর্থনা এবং উৎফুল্ল মাইক্রোফোন
এইভাবে ভাগাভাগি হয়ে গেছে বন্ধুরা।
আমি এখন চলে যেতে চাই
সেই সব বন্ধুদের পাশে
যুদ্ধের বর্শাফলকের মতো
যাদের কপারের শিরা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
অনেক বছর পরে তোর কাছে এসেছি, মল্লিকা!
বহুদিন আপিসের কাজে-কন্মে ডুবুরির মতো
বহুদি মেশিনের যন্ত্রপাতি হয়ে
বহুদিন বাবুদের গাড়ির টায়ার হয়ে সুদুরে ছিলাম।
তোর পাশে চাঁপা ছিল, টগর, ঝুমকো-জবা ছিল।
তারা কই ? মারা গেছে ? সে কি ? কবে ? সাতাত্তর সালে ?
এত মৃত্যু ঘটে গেল একাত্তর বাহাত্তর তিয়ত্তর সালে
এত হত্যা ঘটে গেল চুয়াত্তর পঁচাত্তর ছিয়াত্তর সালে।
আজ আর ধ্বংস, হত্যা, মৃত্যু কারো হৃদয়ের ভুমিকম্প নয়।
মল্লিকা ! দুঃখের কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা বল।
মল্লিকা ! নিজের স্বপ্ন-শরীরের গল্প-টল্প বল।
চাঁদের আলোর নিচে আমাদের আশাতীত খেলাঘর ছিল
সেই বাল্যকাল, সেই হরিণশিশুর কথা বল।
বহুদিন বাবুদের বাগানবাড়ির মালী হয়ে
বহুদিন বৃক্ষহীন দ্বীপান্তরে বেহুঁশ ছিলাম।
মল্লিকা ! বুকের দুধে বহু যত্নে যাকে পুষেছিলি
কই সে কিন্নরকষ্ঠী খঞ্জনীটা ? সে আসে না কেন?
মারা গেছে ? সে কি? কবে ? সাতাত্তর সালে?
এত মৃত্যু ঘটে গেল একাত্তর বাহাত্তর তিয়াত্তর সালে
এত হত্যা ঘটে গেল চুয়াত্তর পঁচাত্তর ছিয়াত্তর সালে।
বৃহৎ আকাশ তবু রাজছত্র ধরে আছে মানুষের মাখার উপর।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমার মধ্যে নিষ্ঠুরতা ছিল
এনভেলাপে ভূল ঠিকানা তাই
তোমার মধ্যে ভালোবাসাও ছিল
তারই আগুন জ্বালাচ্ছে দেশলাই।
তোমর মধ্যে ভালোবাসাও ছিল
লাল হয়েছে ছুরির নীল ধার
তোমার মধ্যে নিষ্ঠুরতাও ছিল
উপড়ে দিলে টেলিফোনের তার।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
পুরনো পকেট থেকে উঠে এল
কবেকার শুকনো গোলাপ ।
কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন
মাসে ? বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার
পাঠযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নেই ।
স্মৃতি কি আমারও আছে ?
স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে
বইয়ের তাকের মত,
লং প্লেইং রেকর্ড-ক্যাসেটে
যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভুক্ত
থাকে গান, আলাপচারীতা ?আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল,
দমকা হাওয়া যেন
লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি,
ওলোটপালটে মহাখুশি
দুঃখেরও দুপুরে গায়,
গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী ।আকাঙ্খার
ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের
অভ্রে ও আবীরে
আগুনের
দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত
ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম
মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের
ভিতরের নীলে ।স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার
বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের
আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর ।
অথচ কাল বা পরশু
কে ডেকে গোলাপ দিল
কিছুতে বলবে না ।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
দু-পাল্লা জানালা কেউ পেয়ে যায় মর্মের ভিতরে
দৈববাণী আসে সেই পথে।
তোমরা বিদীর্ণ হও, যারা গাও নক্ষত্রের স্তব
তোমরা রক্তাক্ত হও, যারা চাও দুষপ্রাপ্য লন্ঠন
তোমরা একাকী হও, যারা খোঁজো মানুষের মুখে
মহাবল্লীপুরমের স্তম্ভের মতন কারুকাজ।
ভিজে তোয়ারের মতো নিজেকে নিংড়িয়ে শুকনো করো
চিরতৃণ হয়ে ফোটো শ্মশানের কাঠ-কয়লা চিরে।
ভিখারীর প্রিয়তম আধুলির মতো যোগ্য হও
পৃথিবীর ভাঙাচোরা অ্যালুমিনিয়মের বাটিতে।
দু-পাল্লা জানালা কেউ পেয়ে যায় মর্মের ভিতরে
ঈশ্বর সেখানে এসে এইভাবে কথা বলে যান।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
গনগনে আগুনের ভিতর দিয়ে
আমাদের বাস-রুট।
পিকাসোর ছবির মতো
ক্ষতবিক্ষত ভাঙচুরে
পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে গেছি আমরা।
ফাটাচায়ের পেয়ালা থেকে লাফিয়ে উঠে
যে-সব নীরব শোক
আত্মঘাতী হওয়ার জন্যে ছুটে যায়
ঘুরন্ত চাকার দিকে
তাদের পিঠে হাত রেখে আমরা বলি
এসো।
আশবাঁটিতে মাছ-কাটার মতো ফিনকি দেওয়া
যাদের আর্তনাদে
সূর্যোদয়ের আকাশ
ভাঙা আশির মতো ঝাঁঝরা,
তাদের হাতে গন্তব্যের টিকিট দিয়ে বলি
এসো।
বিকট অন্ধকার আর নক্ষত্র লন্ঠনে মাঝখানে
কোনো বসার জায়গা না পেয়ে
যেন বন্যার্ত
এইভাবে গায়ে গা এঁটে যায় আমাদের।
বাতাস যেন
ডালপালাময় কোনো ফলন্ত গাছ
এইভাবেই বাতাসকে বিশ্বস্ত ভঙ্গিতে জড়িয়ে থাকে
আমাদের হাত-পা
নিশ্বাস
বিশ্বাস
আর গনগণে আগুনের ভিতর দিয়ে
আমাদের বাস-রুট।
খালি চোখে
রাহুতে খাওয়া সূর্যের দিকে
তাকিয়েছিল যারা
খরার খেতে আলোর বীজ-বপনের ব্যগ্রতায়,
তাদের রক্তাক্ত শহীদবেদী ছুয়ে ছুয়েই
স্টপেজ।
যে-কোনো মহৎ ভাবনার শরীর
যখনই হয়ে ওঠে
আঠারো বছরের কুমারীর মতো স্বাস্থ্যময়
গোপন সুড়ঙ্গ থেকে
ঝাঁপিয়ে পড়ে বলাৎকার
সেই সব ফুপিয়ে কান্নার গা ঘেঁষেই
স্টপেজ।
উলঙ্গ ষাঁড়েরা ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে
তিনমাথা চারমাথার
মোড়ে মোড়ে।
খুনখারাপির দাঁত
থকথকে পানের পিক ছিটিয়ে চলেছে
বাঁকে বাঁকে
আর গনগনে আগুনের ভিতর দিয়ে
আমাদের বাস-রুট।
আকাশের ছেঁড়া-কাঁথায়
চিকেন-পকসের কাতরতা নিয়ে
শুয়ে আছে মেঘ।
গত দশ বছর
বজ্রের গলায় আল্সার।
বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে শ্যামল চাষাবাদের জন্যে
প্রস্তুত বৃষ্টিরা
হারিয়ে ফেলেছে তাদের নৈশ অভিযানের
মানচিত্র।
জল নেই
অথচ থকথকে কাদা
আর গর্ত
গহ্বর
নিম্নগামী আদিম খাদ।
গন্তব্য ক্রমাগতই রয়ে যায়
দূরত্বে
অথবা ভূল রুটে বাজতে থাকে
বিপন্ন হর্ন।
গনগনে আগুনের ভিতর দিয়েই
আমাদের বাস-রুট।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
জ্যেতির্ময় বিছানা তোমার
তুমি বৃক্ষে শুকাও চাদর
তোমার বালিশ থেকে তুলো
উড়ে আসে আশ্বিনে- অঘ্রাণে।
পশমের লেপ ও তোষক
মসৃণতা ভালোবাসো তুমি
আমাদের নখে বড় ধুলো
মাংসাশীর হাড়-কাঁটা দাঁতে।
তুমি সূর্য ঘোরাও আঙুলে
নক্ষত্র-শাওয়ারে করো ম্লান
আমাদের হ্যারিকেন জ্বলে
কেরোসিনে, কখনো ক্রন্দনে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
মানবতাবাদী
|
বজ্র শব্দটাকে আমরা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে ভুলে গেছি
আর বৃক্ষ শব্দটাকেও।
টাকা-পয়সা শব্দটার ভিতরে লুকনো আছে একটা ঝুমঝুমি
এবং উচ্চারণ করা খুব সহজ।
ঘরবাড়ি শব্দটা সোফায় হেলান দেওয়ার মতো আরামদায়ক
এবং উচ্চারণ করা খুব সহজ।
গাড়িঘোড়া শব্দটা যেন সমুদ্রতীরের হৈ হৈ হাওয়া
এবং উচ্চারণ করা খুব সহজ।
সাহিত্য সংস্কৃতি এইসব শব্দ বুট জুতোর মতো ভারি ছিল বলে
আমরা বানিয়ে নিয়েছি হালকা চপ্পল।
মুক্তি শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে
একবার আমাদের হাড়েমাসে ঢুকে পড়েছিল কনকনে শীত।
তাই সংগ্রাম শব্দের মতো তাকেও আমরা যৎপরোনাসি- এড়িয়ে চলি।
নানাবিধ ছোটলাট বড়লাটের পায়ে
কচুটাতার মতো অনবরত আছড়াতে আছড়াতে
বৃক্ষ শব্দটাকে আমরা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে ভুলে গেছি
আর বজ্র শব্দটাকেও।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
অপর দেশের রোদে ভেসে আছি বিহবল বাতাসে
অকস্মাৎ ক্রেমলিনের চুড়ো থেকে বৃষ্টি ছুটে আসে।
সুতীব্র শীতের ঢাল, শত শত তীর, পথে হঠাৎ ঘেরাও।
কে তুমি হে? কোন দেশী?
জারের প্রাসাদ ভেঙে কোথা যেতে চায়?
আমি গুপ্তচর নই, বৃষ্টিকে বোঝাই কানে কানে;
ওরে তোর অস্ত্রশস্ত্র থামা,
উৎসুক অতিথি, যদি তুলে নিস হুকুমৎনামা
একটু ভিতরে যাই
পাথরের পাহারার ঘোমটা তুলে তাকাই খানিক
অনির্বচনীয়তার প্রতিমাকে ছুঁয়ে দেখি
কত মাটি, কতটা মানিক।
নদীতেই নদী থাকবে, গাছ থাকবে গাছে
রাজার মুকুটে মুক্তো, রাজ্যপাট শৃঙ্খলা সংসার
সব থাকবে যে যেখানে আছে।
শুধু তোরা সুদুরে পালালে
কিছু স্মতি, কিছু গন্ধ মেখে নিয়ে যেতে পারি
আমার রুমালে।
দোভাযিয়া ইভানোভা কাছে এসে যেই ছাতা খোলে,
তুলে নেয় বৃষ্টি অবরোধ,
ক্রেমলিনের নীলাকাশে রোদ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
তরল জলে সরলপুটি বেড়াচ্ছিল খেলে
লোকটা তাকে হঠাৎ দেখতে পেলে।
দেখতে পেয়েই চোখ হল তার কনে দেখার আলো
মনটা যেন হাত-বাড়ালো খিড়কি দুয়োর ঠেলে
মাছটি আমার চাই।
বেনারসীর শাড়ি চাইলে বেনারসীর শাড়ি
সাতমহলা বাড়ি চাইলে সাতমহলা বাড়ি
আলতা, সিদুর আতর, সাবান লংলেইং এ গান
জর্দমাখা পান চাইলে জর্দামাখা পান
মাছটি আমার চাই।
হৃদয় জুড়ে শতেক ফুটো খড় কুটোতে ঢাকা
জীবন যেন গন্ডে পড়া গুরুর গাড়ির চাকা।
তরল জলে সরল পুটি মনমোহিনী আঁশ
এক ঝিলিকেই কী সুখ দিলো, সুখ যেন সন্ত্রাস।
ওকে পেলেই শোক পালাবে
শোক পালালে স্বর্গ পাবো, চন্দ্রালোকে ঠাঁই
মাছটি আমার চাই
শোনো, মাছটি আমার চাই।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
শোকমূলক
|
একটি মৃত্যুর শোকে
আজকের ভোরবেলা ভরে গেল স্মরনীয়তায়।
অনেক দিনের পরে
রৌদ্রকেও মনে হল শিল্পসচেতন।
ঝাউবনে হাওয়ার বিলাপ:
শুনেছো তো,
মানুষটি জ্বরে ঘুমোতে গিয়েছে?
এতদিন আমাদের নাড়ী ও নক্ষত্রে মিলেমিশে
এতদিন আমদের পরবাস-যাপনের অলৌকিক পুরাণ শুনিয়ে
এতদিন প্রিয়মুখস্মৃতিগুলি সরু টানে এঁকে
দেবতার দুহিতাকে আমাদের রোজকার বৌ-ঝির সিঁথিতে সাজিয়ে
বর্ণকে মন্ত্রের ন্যায় নিনাদিত করে
ঘুমোতে যাওয়ার মতো
মানুষটি চলে গেল আরও বড় স্বপ্নের ভিতরে!
মৃত্যুর বর্ণাঢ্য শোকে
আজকের ভোরবেলা ভরে গেল শিল্পমহিমায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
রাত্রিবেলা বুকের মধ্যে একগোছা বৈদ্যুতিক তার
আর নীল রঙের একটা বালব টাঙিয়ে রাখা ভালো।
অন্ধকারে গায়ে নীল রঙের জামা পরিয়ে দিলে
স্বপ্ন দেখার দরজা খুলে দেয় সে।
মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক খাটে
স্বপ্ন দেখার আলাদা কোনো বিছানা-বালিশ নেই।
অবিকল স্বপ্নের মতো নারীরও শুয়ে নেই কোনো খাটে।
স্বপ্নের মধ্যে ছাড়া আর কোথায়
আকাশময় উলুউলু?
গায়ে-হলুদের গন্ধে আকাশ পাতাল জুড়ে ফুলশয্যা?
স্বপ্নের মধ্যেই বুক-পিঠের অসুখ-বিসুখে সরিয়ে
অবিরল জলপ্রপাতে অবিবেচকের মতো কেবল ঝরে যাওয়া
নানান নদীতে।
স্বপ্নেই শুধু দ্বিতীয়বার ফিরে পাওয়া যায় শৈশব।
সব ধুলোবালি খোলামকুচি, সব উড়ে-যাওয়া আঁচল
রঙীন পরকলা জুড়ে জুড়ে আঁকা সব মুখচ্ছবি
বৃষ্টি বাদলের ভিজে গন্ধের ভিতরে লুকিয়ে কাঁদার সুখ।
স্বপ্নেই শুধু আরেকবার অগাধ জলের ভিতর থেকে
মুখ তুলে তাকায় ছেলেবেলার লাল শালুক।
মোহিনী কলসগুলি যতদূর ভেসে যেতে চায়
ততদূর স্বপ্নের বিছানা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
জলেও কি ট্রাম-বাস চলে?
জলেও কি আছে ছাপাখানা?
২৫শে বৈশাখ এলে জলের ভিতরে মাছ, নক্ষত্রের ঝাঁক
তারাও কি কবিতার খাতা খুলে বসে?
যোগো,
জলের ভিতরে গিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?
নিজের খাটের চেয়ে শ্যাওলার বিছানা কি অধিক নরম?
তুই কি কলম ফেলে কেবল জলের ঢেউ দিয়ে
কবিতার ভূল-ভাল, পৃথিবীর ভূল-ভাল প্রুফ কেটে-কুটে
সারারাত জেগেছিলি জলে?
যোগো,
জলের ভিতরে দিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
অক্ষরমালার কাছে নতজানু হয়ে আছি আমি।
পুরনো এবং ছেঁড়াখোড়া শাড়ি-জামা-পাজামার বদলে
আমার স্ত্রী কিনে থাকেন ঝকঝকে বাসন।
মহৎ কিংবা রক্তিম আলোর ভাবনা
বেচতে আসে না কোনো ফেরিওয়ালা
সুতরাং নিজের হাতেই আমাকে খসাতে হয় নিজের ফাটল,
নিজের রক্তপাতের মাজাঘসায়
বাসী বাসনকে ঝকঝকে করতে হয় এটো-কাটা সরিয়ে।
এইভাবে
অক্ষরমালার কাছে নতজানু হয়ে আছি আমি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
গাছপালাগুলো যেন কেমন হয়ে গেছে আজকাল।
কেউ কেউ স্মান করেনি কতদিন
কেউ কেউ চুল কাটেনি কতদিন
কেউ কেউ বাসি জামাকাপড় পরে আছে কতদিন।
মনে হয় মাঝরাতে ঘুসঘুসে জ্বর হয় কারো কারো
কারো কারো হাঁপানির শ্বাসকষ্ট শুনতে পাই মাঝরাতে
স্বপ্নের মধ্যে এপাশ-ওপাশ আইঢাই করে কেউ কেউ।
কেউ কেউ নিশ্বাস ফেলে আগুনে হাপরের মতো।
গাছপালাগুলো সত্যি সত্যি কেমন হয়ে গেছে আজকাল।
একটু সব্য-ভব্য হ।
বাইরে যখন ঝড়-ঝাপটার ওলোট-পালোট হাওয়া
ঘরে শুয়ে বসে থাক দুদণ্ড।
দেখছিস তো দিনকাল খারাপ
মেঘে মেঘে দলা পাকাচ্ছে গোপন ফিসফাস
দেখছিস তো ইট চাপা পড়ে ঘাসের রঙ হলুদ।
দেখছিস তো যে-পাখি উড়তে চায় তার ডানায় রক্ত।
একটু সাবধান সতর্ক হ।
সে-সব কথা কানে ঢোকে নাকি বাবুদের?
উড়নচন্ডের মতো কেবল ঘুরছে আর পুড়ছে,
যেন এক একটি বদরাগী বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র।
এক-একদিন না চেঁচিয়ে পারি না।
-ও হতভাগারা! যাচ্ছিস কোন চুলোয়?
-ভাঙতে।
-কী?
-সেই সব থাম, যাদের গায়ে সাত শতাব্দীর ফাটল।
-তারপর?
-সেই সব পাথর, যাদের দেবতা সাজিয়ে আরতি হচ্ছে ভুল মন্ত্রে।
-তারপর?
-সেই সব তালা, যার ভিতরে ডাঁই হয়ে আছে যুগ যুগান্তের লুটের মাল।
-তাহলে ফুল ফোটাবি কবে?
-আগে আগে- গা লাগিয়ে অরণ্যহই
পরাস্ত অন্ধকারের কবর খুঁড়ি এঁদো জঙ্গলে
তারপর ডালপালা ঝাঁপিয়ে ফুল
ফুলের মশাল জ্বালিয়ে আহলাদে আটখানা হৈ হৈ উৎসব।
-তবে মরগে যা! মরে আকাশ পিদিম হ।
এই বলে আমি খিল তুলে দিই আমার খিড়কি দরজায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি।
অপরাধের হাওয়ায় ছিল ত্বরিৎগতি
সেই কাঁপুনি ঝাউ পাতাতে, ক্ষয়ক্ষতি যার গায়ের ধুলো
এমন মাদল, যার ডাকে বন আপনি দোলে
পাহাড় ঠেলে পরাণ-সখা বন্ধু আসে আলিঙ্গনে
সমস্ত রাত পায়ে পরায় সর্বস্বান্ত নাচের নেশা।
দস্যু যেমন হাতড়ে খোঁজে বাউটি বালা কেউর কাঁকন,
জলে যেমন সাপের ছোবল
আলগা মাটির আঁচল টানে
দ্বিধাকাতর দেয়াল ভাঙে নোনতা জিভে
কালকে তোমার ফুলবাগনে তেমনি আমার নখের আঁচড়
লজ্জা দিয়ে সাজানো ঘর লুট করেছে।
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি ।
ঝাঁপ দিয়েছি সর্বনাশের গোল আগুনে
উপরে কাঁটা নীচের কাঁটা শুকনো শেঁকুল
তার ভিতরে লুকিয়ে আঁটা সন্নেসীদের কাতান বঁটি
ধর্ম-কর্ম-নিয়ম-নীতি।
ঝাঁপ দিয়েছি উপোস থেকে ইচ্ছা-সুখের লাল আগুনে
পড়বে কিছু পালক পুড়ুক
অশ্বমেধের ভস্ম উডুক বাতাস চিরে।
আলগা মুঠো, পাক, না কিছু খড়ের কুটো।
হ্যাংলা পাখি যা খেতে চায় ঠুকরিয়ে খাক।
লেপ তোষকের উষ্ণ আদর না যদি পাই
একটুখানি আঁচল পেলেই গায়ের চাদর।
অনেক দিনের হাপিত্যেশে নীচে শোকের কালি
বুকের মধ্যে অনেকখানি জায়গা খালি শয্যাপাতার
তুলোর বালিশ ধুলোয় কেন মাখায় থাকুক।
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি।
কালকে ভীষণ গোঁয়ার্তুমি ঝাপটে ছিল পিঠের ডানায়
রক্তনদী কানায় কানায় উথাল-পাথাল
কামড়ে ছিঁড়ে নিংড়ে খাবে, ইচ্ছে চুরি
সমস্ত ফুল বৃন্ত কুঁড়ি, ডালপালা মুল
এমনকি তার পরাগ শুদ্ধ গর্তকেশর।
কালকে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় ঝাঁকড়া চুলে
শাদা হাড়ের দরজা খুলে রক্তে ঢুকে
খেপিয়েছিল পাঁকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা জন্তুটাকে।
বাঁধ মানে না, ব্যাধ মানে না এমন দামাল
একটুখানি রক্তমাখা মিষ্টি হাসির গন্ধ পেলেই
পলাশ যেমন এক লহমায় রাঙা মশাল জ্বালায় বনে
তেমনি জ্বালায় নিজের চোখে বাঘের চোখের অগ্নিকণা
মুখস্থ সব অরণ্যানীর পথের বাঁকে
আক্রমণের থাবা সাজায় সংগোপনে,
বনহরিনীর চরণধবনি কখন আসে কখন ভাসে।
সেই কাঙালই সব কেড়েছে কালকে তোমার
কালকে তোমার ডাল ভেঙেছি, ফুল ছিঁড়েছি।
আজকে দেখি খালি মুঠোয়
অন্য রকম কষ্ট লুটোয় ছটফটিয়ে।
বাসর-ভাঙা বাসি ফুলে উড়ছে মাছি
কেবল স্মতি গন্ধ আছে, তাইতে আছি গা ডুবিয়ে।
ডুবতে ডুবতে সব চলে যায় অন্য পারে
সুর্য থেকে সন্ধ্যা ঝরে শিশির-কাতর।
আরো অনেক ডুবতে থাকে হয়তো ছায়া, হয়তো ছবি
বৃহৎ শাড়ি যেমন ডোবে বালতি খানেক সাবান জলে।
আষ্টেপৃষ্ঠে কোমর দড়ি কেউ কি বাঁধে দিগন্তকে ?
নৌকাডুবির মতন গাঢ় আর্তনাদে
কেউ কি কাঁদে আঁধার-ভর্তি হলুদ বনে?
কালকে ছিল ঝলমলানো, আজকে বড় ময়লা ভুবন
এই ভুবনে আমার মতো করুণ কোনো ভিখারী নেই।
বুঝলে শুধু বুঝবে তুমি, তাকিয়ে দেখ
দুই হাতে দুই শুণ্য সাজি, দাঁড়িয়ে আছি
উচ্ছৃসিত পুষ্পরাজি যখন তোমার ফুলবাগানে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে দেখে অবাক হয়ে যাই বারবার।
এত আক্রমণ
পরস্পরবিরোধী এত শোকমিছিলের মধ্যেও
কী অনায়াসে বুনে যাচ্ছ লাল পশমের শৃঙ্খলা।
উদ্ভিদের চেয়ে নীরব,
ছাপানো মহাভারতের চেয়ে উদাসীন।
অথচ
পিছনের দেয়ালেই রক্তছাপ
অথচ
বুকের শাড়ি সরালেই
অনাবৃষ্টির চৌচির।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
সময় প্রতিমা!
আগুনের ঝাঁপি খুলে দিলাম তোমাকে,
আত্মসমর্পণে আমি সম্মত হলাম।
ক্ষৌরকার ডেকে এনে কাল-পরশু মাথা ন্যড়া হবো
রাজার পোষাক ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবো গঙ্গাজলে।
গায়ে বড় আঁট হয়ে, বাঁশের গাঁটের মতো খোঁচা হয়ে আছে যে সকল
স্বর্ণ বর্ণ- অলঙ্কার, লকেট, মেডেল
সেই সব মণি-মুক্তো বেনাবনে শুকোবে এখন
দেবদারু গাছগুলি তদোর দুঃখের সব গোপনীয় কথা শুধু আমাকেই বলে
ক্ষুধিত বেড়ালে নখে চিরেছে যে সব ডালপালা
তার সব আর্তনাদ আমার ঘুমের মধ্যে হাতুড়ি পেটায় ঝন্ঝন্ ।
ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পাই
সমুদ্রের ঢেউগুলি দরজার কাছাকাছি এসেছে কখন,
তখন মেঘের পাখি ভোরবেলার আলতা রং মেখে
শিয়রের কাছে বসে কথা বলে আত্মীয়ের মতো।
নোংরা জল ঢুকে ঢুকে নিঃস্ব হয়ে যাচেছ সব পৃথিবীর খনিগর্ভগুলি
এই রকম অতর্কিত শিরোনাম ফুটে ওঠে জানালায় গায়ের আকাশে।
সময় প্রতিমা!
আকাঙ্খার ঝাঁপি খুলে দিলাম তোমাকে।
আত্মসমর্পনে আমি সম্মত হলাম।
তুমি যদি যুদ্ধে যাও, আমার সমস্ত সৈন্য পাবে।
রেলকলোনীর মাঠে তুমি যদি জনসভা ডাকো
হিম হাওয়া, অন্ধকার, কাঁটাতার, রক্ত-হাসি ঠেলে
প্রত্যেকটি ব্যথিত গাছে আলোর লন্ঠন আমি টাঙাবো একাই
তোমার তুনীর আমি ভরে দেবো, বিজয় উৎসবে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
শোকমূলক
|
দীপেন বললেই
একটা প্রকাণ্ড গাছ
ঝড়াকে যার থোড়াই কেয়ার।
একটা চওড়া বাধ
য়ার কাছে নতজানু
সমস্ত প্লাবনের জল।
কি চমৎকার আগুন নিয়ে খেলা করতো
দীপেন
পুড়তো না কিছু
শুধু জলজল করে উঠতো
চারপাশের নুড়ি, পাথর, ধুলোবালি।
কী চমৎকার বাঁশী বাজাতো
দীপেন
সাপের ফণাগুলো
মুখোশ খুলে ছুটে আসতো
আলিঙ্গনের লতাপল্লবে।
দীপেন বললেই
লক্ষ্নৌ এর বাদশাহী রাত,
আমাদের আদি যৌবনের
তুলকালাম দাপাদাপি।
আবার
গানের কলির অলিতে গলিতে
কাকে খুঁজে বেড়ানো।
দীপেন বললেই
ময়দানের ঘাসে
হাজার পতাকার হৈ হৈ হাসি
শুকনো মুখের কুলঙ্গীতে
সার সার প্রদীপ।
দীপেনকে
সব গোপন কথা বলতে পারি আমি।
দীপেনকে
ছুরির ফলায় টুকরো করতে পারি আমি।
বাতিল কাগজের মতো দলা পাকাতে পারি আমি।
দীপেন শুধু বলবে
আয়! বোস হতভাগা
মুখে জয়জয়ন্তী হাসি।
দীপেন
আমি তোর শোকসভায় গিয়েছিলাম।
তুই লম্বা হতে হতে
ভালোবাসার আলোয় ভোরের মতো
রাঙা হতে হতে
ফুলের মালায়
ক্লান্ত হতে হতে
কোথায় যেন চলে যাচ্ছিস।
কোথায়?
তুই বললি
বোস্ হতভাগা। আসছি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
বৃক্ষ হবো
চারপাশে আলোকিত জলের বাঁক
জলের গভীরে নারীর সাজবদলের মতো দৃশ্য
দৃশ্যের গভীরে সুগম্ভীর ঘন্টাধ্বনি
মাতৃজঠর থেকে আমরা শুনে আসছি এই সব দৈববাণী।
ব্রাক্ষ্ম মুহুর্তের রাঙা আবীরের মতো আমাদের ভ্রমণ হবে ভূ-পৃষ্ঠময়
ঋষিকুমারের মতো আমরা খচিত হবো দুর্লভ প্রবালে
নানা রকমের লাল দেয়ালে কালো অক্ষরে
নানা রকমের কালো দেয়ালে লাল অক্ষরে
নানা রকমের গাঢ় এবং ফিকে পতাকার মিছিলে, দুন্দুভিতে
মাতৃজঠর থেকে শুনে আসছি দৈববাণী।
আহলাদে লাফিয়ে উঠেছে দুশো বছরের পুরনো কার্পেটের ধুলো
উন্মাদ নেচে উঠেছে বাঁশবাগান, ঘুটের দেয়াল
ভাঙা তক্তাপোষের পেরেক।
গম্বুজ থেকে গম্বুজে, রেলব্রীজ থেকে সাঁকোয় এবং ফ্লাইওভারে
রেডিও থেকে টিভিতে, ট্রাকটরে, ইঞ্জিনে গরুর গাড়ির কান্নায়
ভিটামিনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এইসব দৈববানী।
বৃক্ষের কালো চিমনিগুলো এখন উগরে চলেছে শোকবার্তা
বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে জলের উদ্দাম গীটার
জলের ভিতরের দৃশ্যবলীতে ঢুকে পড়েছে জন্ডিসের হাত।
দেখতে দেখতে যাদের বয়স ছিল আঠারো, এখন আটচল্লিশ,
পঞ্চদশীরা প্রৌঢ়া,
চামড়া ফেটে বল্কল, চোখে ছানি, হাঁটুতে ঘুণ।
উড়ন্ত পাখিরা হাওয়ার ভিতরে হিমের ফোঁটার মতো মুমূর্ষ!
আর ক্রমশ সূর্যাসে-র দিকে হেলে পড়ছে মহীয়ান সব ভাস্কর্য
বেঁকে যাচ্ছে পিতৃপুরুষের আজানুলম্বিত খিলান
ক্রমশ শঙ্খধ্বনির চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ঠিকানাহীন শিয়াল-কুকুরের ডাক।
সমস্ত দৈববানীর গায়ে পিত্তি, পরগাছা এবং পোকামাকড়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
বনে ও জঙ্গলে রোদ ছায়া গুলে আলপনা আঁকে
আকাশের আর্শীবাদ তৃণ শস্য সারা গায়ে মাখে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
মেঘ নামে, বৃষ্টি পড়ে, বীজেরা ভুমিষ্ট হতে থাকে
যুবতীর ভঙ্গিমায় তরুলতা দিনে দিনে পাকে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
মানুষের ঘুম ভাঙে বনবাসী পাখিদের ডাকে
আকাঙ্খাকে কাঁধে নিয়ে হেঁেট যায় সাঁকো পার হয়ে দূর বাঁকে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
পুরনো সংসারে ধুলো চমকে ওঠে অবেলার শাঁখে
নতুন বধুর লাল শাড়ির এয়োতী-রঙ পদ্ম মুখে মাখে।
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
নারীরা পুরনো হয়, যুবকেরা বেঁকে যায় দুঃখে দুর্বিপাকে
জননীরা তুলে নেয় মৃত্যুর সংসার কোলে-কাঁখে
গভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
স্বপ্নেরও অসুখ আজকাল।
সে-রকম নির্বিরোধী অমল ধবল পালতোলা স্বপ্ন আর বেড়াতে আসে না
রাত্রিকালে।
আধুনিক স্বপ্নগুলি একালের আঠারো বা উনিশ বছর বয়সের বিরক্তির মতো
সুখী হয় চৌচির চুরমারে।
আগে স্বপ্নে সারারাত চুড়িপরা হাত নিয়ে খেলা
নানান নারীর দেহ সারারাত একটি নারীতে
সরবতের মতো ঢালাঢালি।
স্বপ্নের দেয়ালগুলি আগে সাদা ছিল,
একন সেখানে, ধুমশো সাপের মতো ভয়ংকর ধ্বংসের অক্ষর।
স্বপ্নের নিজস্ব কিছু বাগান বা ঝাউবন দেবদারুবীথি সবাই ছিল
এই সব দৃশ্যে আগে নিরাপদে হেঁটে যাওয়া যেত
এখন সেখানে, অন্ধকার একা বসে দূরের আগুনে হাত সেঁকে।
এখন স্বপ্নেরও মধ্যে দুই মত, সংঘর্ষ দুবেলা
এখন স্বপ্নেরও মধ্যে অস্ত্রাঘাত, আহত চীৎকার
এখন স্বপ্নেরও মধ্যে কারো কারো মর্মান্তিক বিসর্জন অথবা বিদায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
জলের মাছের মতো অনায়াস হবে ভেবেছিলে
সব হাঁটাহাঁটি?
ভেবেছিলে ধোঁয়া, ধুলো, থুতু, কফ পেঁজা তুলো হয়ে
উড়ে যাবে অন্য দিকে, তোমাকে ছাড়িয়ে?
ভেবেছিলে পাট-ভাঙা জামায় লাগবে না
পেট্রোলের, পাঁঠা-কাটা রক্তের বা নর্দমার দাগ?
ভেবেছিলে টিকটিকির মতো রয়ে যাবে
আজীবন মসৃণ দেয়ালে?
সময়ের কারখানায় কেবল তোমারই জন্যে
তৈরি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ সরু আলপিন
ব্লেড, ছুরি, ভোজালি, কাতান,
এইটুকু জেনে রাখা ভালো।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
সে এসে সমস্ত ভেঙে দিয়ে গেল
বিকেল বেলায়।
ইটের পাঁজার মতো থরে থরে সাজানো সুখের
সাঁচীসত’প ভেঙে দিয়ে গেল।
বুকের নিভৃত কোণে স্থাপত্যের এবং সি’তির
কোনারক ভেঙে দিয়ে গেল।
চুরমার শব্দে পাখি উড়ে গেল বৃক্ষলতা ছেড়ে
নদী মুখ লুকোলো বালিতে।
এত ভাঙাভাঙি
এত টুকরো টুকরো কাঁচ, রক্তকণা
কুঁচি কুঁচি ছেঁড়া পাপড়ি, পেরেক, আলপিন
আমি একা কুড়োবো কি করে?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।ভীষণ বৃষ্টির শব্দ সারাদিন স্মৃতির ভিতরে।
একাকিনী বসে আছ বৃষ্টির ভিতরে
বালুকাবেলায়
কবেকার উইয়ে-খাওয়া ছবি।
তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।মানুষের ভীষণ বিষাদ
একদিন বেজেছে মন্দিরে শঙ্খ-ঘন্টা রবে।
মানুষের মহান বিষাদ
ভাষ্কর্যখচিত স্তম্ভে একদিন ছুঁয়েছে আকাশ।
আজ ভীষণ নীরব।জলের ভিতরে ছুরি ঢুকে গেলে
আর্তনাদহীন।রক্তের ভিতরে কান্না ঢুকে গেলে
প্রতিবাদহীন।যে যার উদ্যানে ছায়াতলে
পুষ্পের ভিতরে অগ্নি জ্বলে
সুগন্ধ শোকের সম্মূখীন।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
আরম্ভে সকল গাছই সুসাস্থ্য সবুজ।
আরম্ভে সকল মুখে কলমীলতার ছাঁদে সাদা আলপনা
সব কথা রাখালের বাঁশি
আরম্ভে সকল চোখ চশমা ও কাজল ছাড়া সরল হরিণ।
আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
অতিশয় বিচক্ষণ হতে গিয়ে যত কিছু অদল-বদল
চোখে ছানি, গালে ব্রণ, বুকে লোম
নখে রক্তপাত
লালসা ও লোভ
ডুমুর ফলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ এটেঁ যার দাঁতের মাড়িতে।অতিরিক্ত লালসায় গাছ দীর্ঘ হয়।
আরও উচু হলে আরও অনেক আকাশ
এই ভেবে জিরাফের গ্রীবা ছুঁড়ে গাছ দীর্ঘ হয়।
বাতাসে হলুদ পাতা বাসী ফুল পতনে মূর্ছায়
স্তুপাকার, জলে-স্থলে শোকধ্বনিময়।অন্যখানে আরও বেশি ভালোবাসা সোনার সিন্দুকে
এই লোভে শৈশবের রূপকথা রাজপুরী ভাঙে
ডুরে শাড়ী বদলে যায়, বিনুনীতে সাপের গড়ন
ঈর্ষার কাজল চোখে, দাঁতের হাসি ধবল করাত।যে যতই দূরে যাক
অবশেষে সকলেরই ফিরে আসা স্মৃতির ভিতরে বৃষ্টিপাতে
অনুশোচনায় বালি ঘাঁটাঘাঁটি বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি করতরে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।সমস্ত আরম্ভ জুড়ে মানুষের আলুথালু কত ছোটাছুটি
কুসুম-কুড়ানো কত ভোরবেলা, কুসুমের মতন কাঁকরও
পকেটে কত কি ছবি, আয়নাভাঙা, আতশবাজীর ফুলঝুরি
দোলের আবীর, বাঁকা রেকর্ডের গান, আঁচলে কত কি
মনোহর মন্ত্রধ্বনি, পালকি যায় পাখী যেতে পারে যত দূর।আরম্ভের সব কিছু এইরূপ প্রতিশ্রুতিময়।
ক্রমে,
ভীষণ নীরবে
প্রতিশ্রুতি, গাছ ও মানুষ
একযোগে হরিতাভ হয়।ক্রমে, ভীষণ নীরবে
চোখের কাজল, বেণী, বিত্রিত আঁচল
সোনার সিন্দুক, সব সতকর্তা, সাফল্যের স্ফীতকায় ঘাড়
স্তম্ভ, দম্ভ, জঙ্ঘা, ঊরু, গর্ব অহংকার
সবকিছু থেকে, চেয়ানো ঘামের মত অদ্ভুত বিষাদ।
অবশেষে বৃষ্টিপাত স্মৃতির ভিতরে
বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।সভ্যতা সময় কিংবা মানুষের মহাইতিহাস
এত শোকে তবুও মরেনি।
কারণ মানুষ
এখনো নিজের করতলে
তুলে নেয় অন্যের বিষাদ।
আকাশ পাতাল থেকে এত বিষ, বারুদ ও জীবানু সত্ত্বেও
এখনো মানুষ
অন্য কিছু মহত্তম সুধার আশায়
ওপরের ওষ্ঠ থেকে তার সব মলিন বিষাদ
শুষে নিতে চায়এখনো বিষাদ পাবে বলে
পুরুষ নারীর কাছে যায়
নারীরা নদীর কাছে যায়
নদীরা মাটির কাছে যায়
মাটি আকাশের দিকে চায়।তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে চাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আহা! এই পৃথিবীতে উজ্জীবিত কত না সুন্দর
কত না সুন্দর এই পৃথিবীর অথৈ হৃদয়,
সূর্যোদয়ে কত শোভা কত শোভা গোধূলি সন্ধ্যায়
নক্ষত্র ব্যাপ্তির রূপ বিরহী গগনে উন্মুখর।
সুন্দর দেখেছি কত আশ্বিনে এবং অঘ্রাণে
কতদিন হেমন্তের হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়া চুলে,
কমিষ্ঠা কন্ঠার চোখে কত দূর জীবনের সুর
সুন্দর দেখেছি কত রৌদ্রমুগ্ধ ফসলের ঘ্রাণে।
কত যে আলোর গানে একদিন দেশের যৌবন,
ফাঁসীর দড়িতে কত বুক পাতে আলোকিত প্রাণ,
শৃঙ্খলে ঝংকার ওঠে- হৃদয়ে কি আকাঙ্গা উদ্দাম
অসি’সার দেহে মনে প্রেমে প্রচন্ড উন্মেষ।
আমি যে সুন্দর ভালোবাসি
সুন্দরের কাছে মুক্তি চাই।
আমার এ মরুভূমি-মন হৃদয়ের প্রচন্ড দাহন
সুন্দরের সুখেই বিলাই।
আমি যে শান্তিকে ভালোবাসি
কোথায় শান্তির পারাবার?
ওগো তুমি বলে দাও তবে এ আঁধারে পথ পাবো কবে
আলোকের উদার ঝংকার।
ওগো তুমি বলে দাও
কোন পথে জাগবে জীবন।
কোন পথে প্রাণের মিছিল মানুষে মানুষে দৃঢ় মিল
জীবনে নতুন স্বপন।
ওগো তুমি বলে দাও কতকাল পরে
আবার পাখির গান ফিরে পাবো আমাদের ঘরে।
আবার হৃদয় মন মুগ্ধ করে জীবন তন্ময়
আবার সন্ধ্যায় ভোরে কথাকাব্য ফিরে পাবো হাসিতে খুশীতে।
সমস্ত ক্ষতের মুখে একরাশ যন্ত্রণা সরিয়ে
সমস্ত দুঃখের দেশে বাঁচবার নিঃশ্বাস ছড়িয়ে
সমস্ত মায়ের মুখে স্নেহময়ী ছবি এঁকে এঁকে
আবার বসন্ত হাওয়া কথা কবে প্রতি ঘরে ঘরে-
জীবন শুকায়ে গেলে করুণাধারায় ভরে ভরে।
ভাঙা চোরা পথে পথে আবার নতুন সব সুর
নতুন উৎসব কিংবা শেষরাত্রে সেতারের দ্রুতস্পন্দ্য মীড়ে
সমস্ত বাংলার মাঠে ঘাটে ঘাটে উঠোনে দাওয়ায় নীড়ে নীড়ে
কচি কচি ঘাসে ঘাসে বধূর ব্যাকুল চোখে মুখে
শক্তিমান পুরুষের বিদ্যুতের মতো চেতনায়
মুক্তির আনন্দ মাতে-শতধারে উচ্ছল বর্ষায়।
ওগো তুমি বলে দাও মরণ শাসানো এই দিনরাত্রি থেকে
পুঞ্জ পুঞ্জ অমাবস্যা থেকে
কবে যে সুন্দর হবো কবে যে উজ্জ্বল হবো
শরতের নীলের মতন।
কবে যে রৌদ্রের মতো শান্তি দিয়ে সাজাবো পৃথিবী
পৃথিবীর বুক জুড়ে মুঠো সুন্দরের গান।
ওগো তুমি বলে দাও কতকাল পরে
দিকে দিকে আমাদের স্বর্ণচ্ছটা জীবন নির্মান।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
বহুদিন মণিমুক্তো, মহফিল, তাজা ঘোড়া, তরুণ গোলাপ
এবং স্থাপত্য নিয়ে ভাঙাগড়া সব ভুলে আছো।
সর্বান্তঃকরণ প্রেম, যা তোমার সর্বোচ্ছ মুকুট, তাও ভুলে গেছো নাকি?
পাথরের ঢাকনা খুলে কখনো কি পাশে এসে মমতাজ বসে কোনোদিন?
সুগন্ধী স্নানের সব পুরাতন স্মৃতিকথা বলাবলি হয় কি দুজনে?
জানি প্রতি জোৎস্নারাতে তোমার উঠোনে বড় ঘোর কলরব
ক্যামেরার কালো ভীড়, আলুথালু ফুতিফার্তা, পিকনিক, ট্রানজিসটারে গান
তবু তো যমুনা সেই দুঃখের বন্ধুর মতো কাছাকাছি ঠিকই রয়ে গেছে।
হারানো উদ্যানে গাঢ় মেলামেশা মনে পড়ে গেলে
দুজনে কি কোনোদিন বেরিয়েছ নিমগ্ন ভ্রমণে
আকাশ ও ধরণীর চুম্বনের মতো কোনো স্থানে?
বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
দেওয়ান-ই-খাসের ধুলো ভারতের যতটুকু সাম্প্রতিক ইতিহাস জানে
তুমি তার সামান্য জান না, আছো ভ্রান্তিতে ও ভয়ে।
আওরঙ্গজেবের ঘোড়া মারা গেছে
এবং সে নিজে, কেউ বলেনি তোমাকে?
সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম বীরত্বেরও ঘাড়ে একদিন মৃত্যুর থাপ্পড় পড়ে
সবচেয়ে রক্তপায়ী তলোয়ার ও ভাঙে মরচে লেগে
এই সত্যকথাটুকু কোনো মেঘ.কোনো বৃষ্টি, কোনো নীল নক্ষত্রের আলো
তোমাকে বলেনি বুঝি? তাই আছো ভ্রান্তিতে ও ভয়ে,
শব্দহীন গাঢ় ঘুমে, প্রিয়তমা পাশে শুয়ে, ভুলে গেছে সেও সঙ্গীহীন
তারও চোখে নিদ্রা নেই, সে এখনো মর্মান্তিক জানে
তুমি বন্দী, পুত্রের শিকলে।
বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
আওরঙ্গজেবের ঘোড়া মারা গেছে, মারা যেতে হয়।
এখন নিশ্বাস নিতে পারো তুমি, নির্বিঘ্ন প্রহর
পরষ্পর কথা বলো, স্পর্শ করো, ডাকো প্রিয়তমা!
সর্বান্তঃকরণ প্রেম সমস্ত ধ্বংসের পরও পৃথিবীতে ঠিক রয়ে যায়।
ঠিক মতো গাঁথা হলে ভালোবাসা স্থির শিল্পকলা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
যখন ছ’সাত বছর বয়স
ঈশ্বর আকাশে কাঁপতেন কখন কী করে বসি
তাঁর নিপুণ সংসারে।
এক একটা আস্ত পুকুর এবং গগুুষে গিলে
আবার অন্য পুকুরে রুই কাতলার ভিতরে ডুবসাঁতার।
জল থেকে উপড়ে আনা শালুক ছিল
অবিকল রাজকন্যের মুখ।
এখন চল্লিশ।
এখন রক্তক্ষরণের শব্দে বুকের নিশ্বাস নিভে যায়।
যখন সাত-আট বছর বয়স
ঝকঝকে চোখ বলিদানের কাতান
বুকে ঢাক ঢোল কাঁসর ঘন্টা দিনরাতের পুজো পার্বণ
পা দুটো রাণা প্রতাপের চৈতক
চৈত-বোশেখের ঝড়ে কেবল ছুটছে ব্রক্ষান্ডের গায়ে লাথি মেরে।
ঈশ্বর সারাটা দুপুর আকাশে থাকতেন পাহারায়,
পাছে ঐ দুর্দান্ত বয়সটা আকাশের পথ চিনে ফেলে।
এখন চল্লিশ।
এখন নিশ্বাসের ভিতর কেবল স্বপ্নের দরজা ভাঙে।
যখন আঠারো বছর বয়স
দীর্ঘকার এক মন্দির তুলেচিলাম নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে
তার ভিতরে ধুপ, ধুপের ভিতরে পুস্পগন্ধ, পুস্পের ভিতরে নারী
নারীর ভিতরে আকাশময় ওষ্ঠ, ওষ্ঠের ভিতরে কেবল প্রবহমান চুম্বন।
এখন চল্লিশ।
এখন স্বপ্নের ভিতরে ঈশ্বরের তুমুল অট্রহাসি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
একটি ময়ুর তার পেখমের সবটুকু অভ্র ও আবীর দিয়েছে আমাকে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের বিছানা বালিশে
মশারির টাঙানো খাটে, দরজায়, জানালায়, নীল আয়নায়
অতিথিশালার মতো যখন-তখন এসে ঘুমোবার, হেঁটে বেড়াবার
সুখটুকু, স্বাধীনতাটুকু
সোনার চাবির মতো হাতে তুলে দিয়েছে স্বেচ্ছায়।
এটোঁ কলাপাতা ঘেঁটে অকস্মাৎ জাফরাণের ঘ্রাণ পেয়ে গেলে
ভিখারীরা যে রকম পরিতৃপ্ত হয়,
সে রকমই সুখ পেয়ে হাঁসের মতন ডুবে আছি
হিমে-রোদে, জলে স্থলে, জয়ে পরাজয়ে।
মনে হয় নিমন্ত্রণ পেয়ে গেছি নক্ষত্রলোকের।
কখন অজ্ঞাতসারে পকেটে কে পুরে দিয়ে গেছে ভিসা পাসপোর্ট
সব উড়োজাহাজের এয়ারপোর্টের
সমুদ্রের কিনারের সব কটি উচু মিনারের।
রেশমের, পশমের, মখমলের মতো শান্তি সঙ্গী হয়ে আছে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের অপর্যাপ্ত অভ্র ও আবীরে
আমার গায়ের আঁশ, ক্ষয়, ক্ষতি, ক্ষত, অক্ষমতা
সব কিছু রাঙিয়ে দিয়েছে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
গাছতলা ভরে গেছে ডেয়ো পিঁপড়েয়।
মাঝখানে মুনিঋষির মতো
নিজের মধ্যে নিজে।
ধূপ, ধুনুচি, ত্রিশূল
ত্রিশূলে টাঙানো ডমরু
গলায় রুদ্রাক্ষ, মাথায় বটঝুরি জট,
কিচ্ছু নেই।
শুধু খানিকটা আগুন পাঁজরার আড়ালে
পুড়বার মতো
কিছু কাঠ-কোঠরা
ইচ্ছে-অনিচ্ছের, লোভ-লালসার।
মুনিঋষির মতো বসে আছি গাছতলায়
ডেয়ো পিপড়েদের খুনখারাপি কামড়,
ক্ষতবিক্ষত অন্ধকারে
নিজের মধ্যে নিজে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
হৃদয়ের কাছে আমি আগে কত গোলাপ চেয়েছি
এখন পাউরুটি চাই, সিমেন্টের পারমিট চাই।
সেই রমনীর কাছে আগে কত ভূ-স্বর্গ চেয়েছি
এখন দেশলাই চাই, হাতপাখা, জেলুসিল চাই।
আগুনের কাছে আগে মানুষেরা নতজানু ছিল।
মানুষের সর্বোত্তম প্রার্থনায় বিস্তীর্ণতা ছিল:
আমাকে এমন জামা দাও তুমি, এমন পতাকা
হীরের আংটির মতো মূল্যবান এবং মহান।
আগুনের কাছে এসে এখন মানুষ করযোড়ে
ভোট চায়, কমিটির ডানলোপিলো-আঁটা গদি চায়
মহিষাসুরের নীল খড়্গ চায়, অথবা পিস্তল।
মানুষ মেঘের কাছে আগে কত কবিতা চেয়েছে
এখন পেট্রোল চায়, প্রমোশন, পাসপোর্ট চায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
দাঁতে কামড়িয়ে কে খেয়েছে চাঁদ?
সন্ধেবেলায়?
মহাশুন্যের ছড়ানো টেবিলে
পড়ে আছে যেন ছিরিছাঁদহীন ভাঙা বিস্কুট।
কে খেয়েছে চাঁদ?
ক’দিন আগেও কোজাগরী শাড়ি লুটিয়ে হেঁটেছে
বর-বর্নিনী।
যমুনার মতো চিকন অঙ্গ
বুকে তরঙ্গ, কাঁখে তরঙ্গ
আকাশের ঘাটে স্নান করে গেছে লজ্জা ভাসিয়ে
কলসী ভাসিয়ে।
কে খেয়েছে চাঁদ?
কার তৃষ্ণার উনোনে আগুন জ্বলে উঠেছিল?
আগুন দিয়ে কে মেজেছিল দাঁত?
ইচ্ছা-সুখের কালো ভীমরুল
কাকে কামড়িয়ে করেছিল লাল?
কে কয়েছে চাঁদ?
রত্নের থালা কে এটোঁ করেছে জিভের লালায়?
আলোর কুসুম ছিঁড়ে ছিঁড়ে মালা
কে গেঁথেছে মিহি মনের সুতোয়?
ফুসলিয়ে তাকে নদীর আড়ালে কে নিয়ে গিয়েছে?
সন্ধেবেলায়?
কে খেয়েছে চাঁদ?
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.