poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
নেই স্বর্গলোভ কিংবা কল্প-নরকের ভয়, অলীক সাফল্যমুক্ত কর্মময় পৃথিবী আমার৷ চর্মচোখে যা যা দেখি, শারীরিক ইন্দ্রিয় যা ধরে, তাকেই গ্রহন করি৷ জানি, নিরাকার অপ্রত্যক্ষ শুধুই ছলনা, বিশ্বাস করি না ভাগ্যে, দেবতার বরে৷ আমার জগত্ মুগ্ধ বাস্তবের বস্তুপুঞ্জে ঠাসা, তাই সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অতীন্দ্রিয় নয়৷ অন্ধতার বধ্যভূমি আমার হদৃয়৷ সেই শ্রেষ্ঠ মানব-সন্তান, যার মন মুক্ত ভগবান৷ আমার মস্তক নিত্য নত সেই নাস্তিকের তরে৷
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
পাঁজরে প্রবিষ্ট প্রেম জেগে ওঠে পরাজিত মুখে, পতিগৃহে যেরকম পুরোনো প্রেমিক স্বামী ও সংসারে মুখোমুখি । প্রত্যাখ্যানে কষ্ট পাই,–ভাবি, মিথ্যে হোক সত্যে নাই পাওয়া । বুকের কার্নিশে এসে মাঝে-মধ্যে বসো প্রিয়তমা, এখানে আনন্দ পাবে, পাবে খোলা হাওয়া ।সেই কবে তোমাকে বুনেছি শুক্রে, শুভ্র বীজে, যখন নদীর পাড় ঢাকা ছিল গভীর সবুজে । সময় খেয়েছে মূলে, বীজের অঙ্কুরে অমাক্রোধ, দাবাগ্নিতে পুড়ে গেছে ভালোবাসা জনিত প্রবোধ ।অহল্যাও পেয়েছিল প্রাণ জীবকোষে, পাথর-প্রপাতে একদিন । তোমার অতনু জুড়ে কোনোদিন হবে নাকি সেরকম প্রাণের সঞ্চার ? কোনদিন জাগিবে না আর? পুরোনো প্রেমিক আমি কতো পুরাতনে যাবো? ক্ষমা করো ভালোবাসা, প্রিয় অপরাধ ।যদি কভু মধ্যরাতে পরবাসে ঘুম ভেঙে যায়, যদি আচ্ছন্ন স্বপ্নের ঘোরে উচ্চারণ করো এই মুখ, যদি ডাকো যৌবনের প্রিয় নাম ধরে–; রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাবো পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক । মুখোমুখি দাঁড়াবো তোমার, যদি ক্ষমা পাই ।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রকৃতিমূলক
একজন চিত্রক্রেতার সবিনয় অনুরোধে আমি আঁকতে বসেছি একটি আমগাছের ছবি— যে তার দেহচ্ছায়া রামসুন্দর পাঠাগারের সবুজ টিনের চালের ওপরে বিছিয়ে দিয়েছে। গাছের সবুজ পাতারা সবইপ্রায় ঢাকা পড়েছে হালকা হলুদ রঙের অজস্র বোলের আড়ালে। এত আমের বোল আমি আমার জন্মে দেখিনি। একটা মদির-গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। ফুলে ফুলে, ডালে ডালে, পল্লবে পল্লবে মৌমাছি ও লক্ষ-কোটি কীট-পতঙ্গের ভিড়। তারা মধুর সমুদ্রে অবগাহনের আনন্দে অস্থির। বসন্তের ঝড় আর শিলাবৃষ্টির ঝাপটা থেকে যদি অমৃতফলের এ-মঞ্জরিগুলি বেচে যায়—, আসন্ন গ্রীষ্ম ও বিষণ্ন বর্ষায় তবে আর আমাদের আমের অভাব হবে না। হে বসন্ত, তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো— আমি তোমাকে আমার পরান ভরিয়া আঁকি।
নির্মলেন্দু গুণ
ভক্তিমূলক
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি, রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’ পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে, ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক, না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক, আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_ আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি, আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
থামাও কেন? গড়াতে দাও, গড়াক; জড়াতে চায়? জড়াতে দাও, জড়াক ।যদি পাকিয়ে ওঠে জট, তৈরি হবে নতুন সংকট সুখ না হলে দুঃখ দিয়ে পূর্ণ হবে ঘট ।ডরাও কেন? এগোতে দাও জাগুক; সরাও কেন? আগুনে হাত লাগুক ।জীবন শেষে মরণ হয়, মরণ শেষে হয় কী? অগ্নিতে যার আপত্তি নেই মাটিতে তার ভয় কী?
নির্মলেন্দু গুণ
প্রকৃতিমূলক
ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন ফুটবে তোমায় দেখব, তোমার পুষ্প বনের গাথা মনের মত লেখব।তখন কালো কাজল মেঘ তো ব্যস্ত ছিল ছুটতে, ভেবেছিলাম ক'দিন আরো যাবে তোমার ফুটতে।সবে তো এই বর্ষা গেল শরত এলো মাত্র, এরই মধ্যে শুভ্র কাশে ভরলো তোমার গাত্র।ক্ষেতের আলে নদীর কুলে পুকুরের ওই পাড়টায়, হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে বাঁশ বনের ওই ধারটায়।আকাশ থাকে মুখ নামিয়ে মাটির দিকে নুয়ে, দেখি ভোরের বাতাসে কাশ দুলছে মাটি ছুঁয়ে।কিন্তু কখন ফুটেছে তা কেউ পারে না বলতে, সবাই শুধু থমকে দাঁড়ায় গাঁয়ের পথে চলতে।উচ্চ দোলা পাখির মত কাশ বনে এক কন্যে, তুলছে কাশের ময়ূর চূড়া কালো খোঁপার জন্যে।শরত রানী যেন কাশের বোরখাখানি খুলে, কাশবনের ওই আড়াল থেকে নাচছে দুলে দুলে।প্রথম কবে ফুটেছে কাশ সেই বধুরা জানে, তাইতো সেটা সবার আগে খোঁপায় বেঁধে আনে।ইচ্ছে করে ডেকে বলি, ওগো কাশের মেয়ে - "আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে তোমার হাতে বন্ধী আমার ভালবাসার কাশ তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস"ভালবাসা কাব্য শুনে কাশ ঝরেছে যেই দেখি আমার শরত রানী কাশবনে আর নেই।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
কাল রাত এই নগরীতে খুব চমৎকার অন্ধকার ছিলো । কাল রাত আমি দুই সহোদরার মাঝখানে শুয়েছিলাম । কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এই জমকের জন্ম হয়েছে ! এদের বড়টির নাম মৃত্যু, তার গায়ের রঙ ঘন কালো; ছোটটির নাম জীবন,বড়টির তুলনায় সামান্য ফর্শা । তবে, অন্ধকারে তাদের বর্ণভেদ প্রায় বোঝা যায় না ।তৃপ্তি ও আনন্দের উপলব্ধিকে বাঙ্ময় করা ছাড়া, কাল রাত ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগ পর্যন্ত আমি একবারের জন্যেও বন্ধ করিনি আমার চোখ ! কাল রা আমি একটুও ঘুমাইনি,আমি জেগেছিলাম, মানে, যতটা জেগে থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব ! আমি জানি, পঞ্চাশ সহস্র বর্ষ অপেক্ষার শেষে আমি এই অবিশ্বাস্য রজনী পেয়েছি ।আমি বহুদিন, বহুভাবে আমার বিরুদ্ধে নারীকে এবং নারীর বিরুদ্ধে আমাকে লেলিয়ে দিয়ে দেখেছি; তারা পরস্পরকে নিয়ে কী পাগলামিটাই না করেছে ! আগে আমি এদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি পৃথক ভাবে । জীবনের বুকে মুখ ঘষে জীবনকে বলেছি,ভালোবাসি । জীবনের দৃষ্টি এড়িয়ে আমি একই কথা বলেছি মৃত্যুকে ।জীবনের সামনে মৃত্যু এবং মৃত্যুর সামনে জীবনকে প্রকাশ্যে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করা,এবারই প্রথম ! আমি বলেছি আমি তোমাদের দু’জনকেই ভালোবাসি । সুখের জন্যে তোমাদের দ’জনকেই আমার প্রয়োজন ।কাল অন্ধকার ছিল । বেশ অন্ধকার । খুব অন্ধকার । সূর্য ডুবে যাবার কারণে যে-অন্ধকার হয়, সেরকম নয়, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের অন্ধকার । কসকো সাবানের মতো ট্রান্সপারেন্ট অন্ধকার নয়, মাষের ডালের মত থকথকে ঘন-গাঢ় অন্ধকার ।সেই ঘন-গাঢ় অন্ধকারে আমি একবার জীবনের, একবার মৃত্যুর ঠোঁটে গচ্ছিত রেখেছি আমার চুম্বন । উন্মত্ত অবন্থায় এক-পর্যায়ে আমার এমনও হয়েছে, আমি একই সঙ্গে চুম্বন করেছি জীবনের অধর এবং মৃত্যুর ওষ্ঠকে । –তা আদৌ সম্ভব কি না, এখন আমি বলতে পারবো না, পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা পরবাস্তব, স্বপ্নদৃশ্যের মতো । কল্পনা দেখা । স্বপ্নসত্য ।কাল রাত আমি জীবনকে বুঝিয়েছি, ভয় করো না, মৃত্যু নিষ্ঠুর কামুক রমণী নয়; একই মাতৃগর্ভজাত, সে তোমার বোন, তোমার মতই সে খুব মানবিক । একই কথা আমি একটু অন্যভাবে মৃত্যুকে বলেছি । মৃত্যু অনুজার ক্লান্ত মুখের ঘাম মুছিয়ে দিয়েছে ।অথচ আশ্চর্য ! ভোরের আলো ফুটে উঠবার পর, পরস্পরের দিকে ফিরে-শোওয়া দুই সহোদরাকে দেখে মনে হলো ওদের দু’জনই আমার কাছে সমান অচেনা । এদের একজনকে তো আমার চেনার কথা ছিল ।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
তুমি চলে যাচ্ছো, নদীতে কল্লোল তুলে লঞ্চ ছাড়ছে, কালো ধুঁয়ার ধস ধস আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে তোমার ক্লান্ত অপস্রিয়মাণ মুখশ্রী,-সেই কবে থেকে তোমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি।তুমি চলে যাচ্ছো, তোমার চলে যাওয়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না, সেই কবে থেকে তুমি যাচ্ছো, তবু শেষ হচ্ছে না, শেষ হচ্ছে নাবাতাসের সঙ্গে কথা বলে, বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলে ধলেশ্বরীর দিকে চোখ ফিরাতেই তোমাকে আবার দেখলুম; আবার নতুন করে তোমার চলে যাওয়ার শুরু।তুমি চলে যাচ্ছো, নদীতে কল্লোল তুলে লঞ্চ ছাড়ছে, কালো ধুঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে তোমার ক্লান্ত অপস্রিয়মাণ মুখশ্রী, যেন আবার সেই প্রথমবারের মতো তোমার চলে যাওয়া। তুমি চলে যাচ্ছো, আমি দুই চোখে তোমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি, তাকিয়ে রয়েছি।তুমি চলে যাচ্ছো, নদীতে কান্নার কল্লোল, তুমি চলে যাচ্ছো, বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ, তুমি চলে যাচ্ছো, চৈতন্যে অস্থির দোলা, লঞ্চ ছাড়ছে, টারবাইনের বিদ্যুৎগতি ঝড় তুলছে প্রাণের বৈঠায়। কালো ধুঁয়ার দুরত্ব চিরে চিরে ভেসে উঠছে তোমার অপস্রিয়মাণ মুখশ্রী, তুমি ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠছো। তোমার চলে যাওয়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না, তিন হাজার দিন ধরে তুমি যাচ্ছো, যাচ্ছো আর যাচ্ছো।তুমি চলে যাচ্ছো, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে তরঙ্গিত নদীর জ্যোৎস্নায়, কালো রাজহংশের মতো তোমার নৌকো কাশ বনের বুক চিরে চিরে আখ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছে অজানা ভুবনের ডাকে। তুমি চলে যাচ্ছো, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে আকাশের মতো।হে তরঙ্গ, হে সর্বগ্রাসী নদী, হে নিষ্ঠুর কালো নৌকো, তোমরা মাথায় তুলে যাকে নিয়ে যাচ্ছো সে আমার কিছুই ছিলো না, তবু কেন সন্ধ‌্যার আকাশ এরকম ভেঙ্গে পড়লো নদীর জ্যোৎস্নায়? ভেঙ্গে পড়লো জলের অতলে? তুমি চলে যাচ্ছো বলে?তুমি চলে যাচ্ছো, ল্যাম্পপোস্ট থেকে খসে পড়ছে বাল্ব, সমস্ত শহর জুড়ে নেমে আসছে মাটির নিচের গাঢ় তমাল তমশা। যেন কোনো বিজ্ঞ যাদুকর কালো স্কার্ফ দিয়ে এ শহর দিয়েছে মুড়িয়ে। দু’একটি বিষণ্ণ ঝিঁঝিঁ ছাড়া আর কোনো গান নেই, শব্দ নেই, জীবনের শিল্প নেই, নেই কোনো প্রাণের সঞ্চার। এ শহর অন্ধ করে তুমি চলে যাচ্ছো অন্য এক দুরের নগরে, আমি সেই নগরীর কাল্পনিক কিছু আলো চোখে মেখে নিয়ে তোমার গন্তব্যের দিকে, নিলীমায় তাকিয়ে রয়েছি।তুমি চলে যাচ্ছো, তোমার বিদায়ী চোখে, চশমায় নূহের প্লাবন। তুমি চলে যাচ্ছো, বিউগলে বিষণ্ণ সুর ঝড় তুলছে অন্তর্গত অশোক কাননে। তুমি চলে যাচ্ছো, তোমার পশ্চাতে এক রিক্ত, নিঃস্ব মৃতের নগরী পড়ে আছে।অনন্ত অস্থির চোখে বেদনার মেঘ জমে আছে, তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। তোমাকে দেখার নামে তোমার চতুর্দিকে পরিপার্শ্ব দেখি, বিমান বন্দরে বৃষ্টি, দ’চোখ জলের কাছে ছুটে যেতে চায়, তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারি নাতুমি চলে যাচ্ছো, আমার কবিতাগুলো শরবিদ্ধ আহত সিংহের ক্ষোভ বুকে নিয়ে পড়ে আছে একা।তুমি চলে যাচ্ছো, কতোগুলো শব্দের চোখে জল।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক, শুধু ঘরের ভিতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য। বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ আমাকে খেতে দিক।আমি হাতপাখা নিয়ে কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না, আমি জানি, এই ইলেক্ট্রিকের যুগ নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।আমি চাই কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করুক: আমার জল লাগবে কিনা, নুন লাগবে কিনা। পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না। এঁটো বাসন গেজ্ঞি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা খুলে দিক।কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক। কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে জিজ্ঞেস করুক: ’তোমার চোখ এত লাল কেন?’
নির্মলেন্দু গুণ
স্বদেশমূলক
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না৷ তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হদৃয় মাঠখানি?জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি, শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প৷ সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর৷ না পার্ক না ফুলের বাগান, — এসবের কিছুই ছিল না, শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়৷ আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল এই ধু ধু মাঠের সবুজে৷কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক৷ হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে৷ একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের: “কখন আসবে কবি?’ “কখন আসবে কবি?’শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের৷কাব্যগ্রন্থঃ -চাষাভুষার কাব্য
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
আমরা মিশিনি ভালবেসে সব মানুষ যেভাবে মেশে, আমরা গিয়েছি প্রাজ্ঞ আঁধারে না-জানার টানে ভেসে।ভাসতে ভাসতে আমরা ভিড়িনি যেখানে নদীর তীর, বুনোবাসনার উদবেল স্রোতে আশ্লেষে অস্থির।আমরা দুজনে রচনা করেছি একে অপরের ক্ষতি, প্রবাসী প্রেমের পাথরে গড়েছি অন্ধ অমরাবতী।আমরা মিশিনি বিহবলতায় শুক্রে-শোনিতে-স্বেদে, আমাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে বেদনায়,বিচ্ছেদে।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
গতকাল ছিল কালো-লালে মেশা একটি অদ্ভুত টুনটুনি । লাফাচ্ছিল ডাল থেকে ডালে, পাতার আড়ালে, ফুল থেকে ফুলে ।তার সোনামুখী ঠোঁট, যেন কলমের ডগায় বসানো একরত্তি হীরে । প্রতিটি আঁচড়ে কেটে ভাগ করছিল ফুল থেকে মধু, মধু থেকে ফুল; আমার সমস্ত কলতল ভেসে যাচ্ছিল রক্তকরবীর মধুস্রোতে ।আজ সকাল থেকেই রক্তকরবীর ডালে ফুলের আগুন-জ্বলা হাত; ফুল তুলছেন এক বৃদ্ধা পূজারিণী । তার হাতে রক্তকরবীর নকশা কাটা সাজি ।মধু নয়, শূন্য বৃন্তে শুভ্রকষধারা । কলতলে রক্তকরবীর হু হু কান্না, আমি কী করব? আমি কী করব? রক্তকরবীর ডালে আমি তো ফুটিনি । আমি পৃথিবীর দুঃখী ফুল, মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি ।
নির্মলেন্দু গুণ
সনেট
প্রেমিকারা নয়, নাম ধরে যারা ডাকে তারা ঝিঁঝি, তাদের যৎসামান্য পরিচয় জানা থাকা ভালো; বলতেই মৃত্তিকারা বক্ষ চিরে তোমাকে দেখালো–; অভ্যন্তরে কী ব্যাকুল তুমি পড়ো ডুয়িনো এলিজি । কবরে কী করে লেখো? মাটি কি কাগজ? খাতা? ভালোবেসে উস্কে দিই প্রাণের পিদিম, এই নাও, অনন্ত নক্ষত্র তুমি, অন্ধকারে আমাকে সাজাও ফের মাতৃগর্ভে, বলো দেবদূত প্রেমিকা কি মাতা? এইসব ঝিঁঝি পোকা, এরা কি ঈশ্বর নাকি পাখি, উদ্বাস্তু উন্মুল মোক্ষ, যৌবনের, কোন পাত্রে রাখি?পাপে-পুণ্যে এ পৃথিবী, এই প্রাণ তারচে অধিকে । আমি আছি, তুমি নেই–,এইভাবে দু’জন দু’দিকে অপসৃত; -তাই তো নশ্বর নারী কবির বিশ্বাসে, ভালোবেসে যাকে ছুঁই, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে…।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা। ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব, শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে। আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াব গাণ্ডীব, তোমার পায়ের কাছে নামাব পাহাড়। আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।পায়ের আঙুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে, চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে। আমার কিসের ভয় ?কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর, শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ, আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে। আমার কিসের ভয় ?তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর, ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে। আকন্দ-ধুন্দুল নয়, রফিক-সালাম-বরকত-আমি; আমারই আত্মার প্রতিভাসে এই দেখ আগ্নেয়াস্ত্র, কোমরে কার্তুজ, অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ, উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের এ-রক্তজয়টিকা।আমার কিসের ভয় ? তোমার পায়ের নিচে আমিও কবর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন। তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও কতবার যে আমি সে কথা বলিনি সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন। তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ ‘এই ওঠো, আমি, আ…মি…।‘ আর অমি এ-কী শুনলাম এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন। আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য, আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য, আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য। তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে, আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
নির্মলেন্দু গুণ
মানবতাবাদী
কোনো কাজকর্ম তো নাই, খাচ্ছেন দাচ্ছেন, আর যখন যা চাচ্ছেন হাতের কাছে তাই পেয়ে যাচ্ছেন। স্প্যানিশ অলিভ অয়েল মালিশ করে পালিশ করছেন বেগম সাহেবার পাছা, আর নিজের বীচির চামড়া। আর আমরা আমাগো হুগায় মাখছি ভেরেণ্ডার তেল।আপনগো দিন যায় মহানন্দে, ভিসিআরে, টিভির পর্দায়। আমরা মাঠের লোক, বস্তিবাসী, পথের মানুষ, মেধাহীন কৃমিকীট আর পোকামাকড়ের মতো আপনাগো নেতৃত্বের আকাশছোঁয়া দালানের আন্ডারগ্রাউন্ড ফাউন্ডেশনটাকে পাকাপোক্ত করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে, জননীর চর্বিহীন অপুষ্ট জরায়ু ছিঁড়ে এই সুমহান বঙ্গদেশে জন্ম নিয়েছি।আপনাগো ব্যাংক ব্যালেন্স আর চর্বির চিকনাই যত বাড়ে, আনুপাতিক হারে ততই আমগো গায়ের চর্ম ঠেকে হাড়ে। আপনারা আছেন, থাকবেন, এ-কথা জানলি পরে এই বঙ্গদেশের পবিত্র ভূমিতে জন্ম নিতো কোন্ হালায়?আমাগো বাবারা হুগলার চাটাই বিছাই আমাগো মায়েরার কানে কানে কুমন্ত্রণা দেয়, বঙ্গ-সংস্কৃতির চর্চা করে, বলে : ‘হায়াৎ-মউত, রিজিক-দৌলত- সবই তো আল্লাহর হাতে, বুজলা জমিলা বিবি, আহ, কাছে আহ, ভয় পাও কেরে?’ পরের বছরে আমাগো জন্ম হয়, আদর কইরা আমাগো বাপে আমগো নাম রাহে আবদুল, রামচন্দ্র, বাদশা মিঞা, মাইকেল, মামা চিং-- আরও কত্তো রঙবাহারি নাম!একটু বড় অওনের পরে বুঝি, বাদশা মিঞা অওনের চাইতে আপনাগো বাড়ির পালা কুত্তা অওনও অনেক ভালা আছিল। এই বঙ্গদেশে আপনেরা ঠিকই দাসবংশ জিইয়ে রেখেছেন, বুঝি আপনাগো সমাজ ব্যবস্থার নিশ্চিদ্র ব্যাংক-লকারে আমাগো মায়েরার জরায়ু গচ্ছিত। কী চমেৎকার ব্যবস্থা।খালি চোখে দেখাই যায় না, চোখে পড়ে ২৫তলা শিল্পব্যাংক, ২০তলা সেকেটারিয়েট, শেরেবাংলা নগরের সঙসদ ভবন, ও নগরে-নগরে তীর-চিহ্ন পোতা সদা-সতর্ক কেণ্টনমেন্ট। কৃষকের হাড্ডি জল-করা পিঠের চামড়া-পোড়ানো পাট, আর ম্যান পাওয়ারের ছদ্মবেশে অগণিত সহজলভ্য দাস বিদেশে পাচার করে, তেল চকচক গাড়ি, ফ্রীজ, রঙিন-টিভি ও অলিভ অয়েল এনে মালিশ করেন যখন যেখানে খুশি মন চায়; ভয় নাই, আমরা আছি, দাস বংশ, নফর গোলাম, মেধাহীন কৃমিকীট আপনাগো দ্বীনের সেবায়।কাব্যগ্রন্থঃ--যখন আমি বুকের পাঁজর খুলে দাঁড়াই
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই, দুইকে আমি এক করি না এক কে করি দুই। হেমের মাঝে শুই না যবে, প্রেমের মাঝে শুই তুই কেমন করে যাবি? পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া আমাকেই তুই পাবি। তবুও তুই বলিস যদি যাই, দেখবি তোর সমুখে পথ নাই। তখন আমি একটু ছোঁব হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর বিদায় দুটি পায়ে, তুই উঠবি আমার নায়ে, আমার বৈতরণী নায়ে। নায়ের মাঝে বসবো বটে, না-এর মাঝে শোবো, হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ দুঃখ দিয়ে ছোঁব।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷ তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে; আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে, তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার, সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷ তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷ আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই, ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷ তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
বাঁশির কাছে যে-সুরের প্রত্যাশা সে-প্রত্যাশা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমি আমার বাঁশিটি বাজাতে চাই। যে-পর্যন্ত স্থলিত হয়না বীর্য সে-পর্যন্ত জীবের সঙ্গম। জয়ী না-হওয়া পর্যন্ত আমি পরাভাবকে স্বীকার করি না। ভালো না-বেসেই যদি ভালোবাসা পাই। ভাবি, কী লাভ তাহলে পণ্ডশ্রমে? যে-প্রেম ফাঁকি দিতে জানে তার বাকি শোধ হয় না জীবনে। যে-প্রেমে ঘাটতি নেই সে-তো বুদ্ধিমান গৃহীর প্রণয়- সে আমার নয়। আমার ভালোবাসা ভারসাম্যহীন, উঁচু-নিচু, ভাঙা-চোরা, খানাখন্দময়।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে মনে কি পড়ে না? পড়ে । ভালো কি বাসি না? বাসি । শ্লথ টেপ থেকে সারা দিন জল ঝরে, সেই বেনোজলে এঁটো মুখ ধুয়ে আসি । গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে প্রেম কি জাগে না? জাগে । কিছু কি বলি না? বলি । তিতাস শিখায় যতটুকু তাপ লাগে, অনুতাপে আমি তার চেয়ে বেশি গলি । গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে আমি কি কাঁদি না? কাঁদি । কাঁচা কাকরুল ভাজার কবিতা লেখি, বড়-ডেকচিতে দু'জনের ভাত রাঁধি । গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে-খেতে কিছু কি ভাবি না? ভাবি । ভেবে কি পাই না? পাই । তবু কি ফুরায় তুমি-তৃষ্ণার দাবী? ভাত বলে দেয়, তুমি নাই, তুমি নাই ।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
আর কিছু নয়, রাজ্য চাই না, চাই না তিলক, চাই না তালুক; চাই শুধু মন-মানুষে মিলুক কবিতা আমার। সেই বিশ্বাসে যারা কাছে আসে, আর মাঝে মাঝে অপমানিতের হয়ে কথা বলি ।বাঁশি যে বাজায় সে তো কংকাল, প্রাণের ভিতরে আপনি সে গায়; আপনার মাঝে নিজেকে সাজায় । শোনাতে চায় না, তবু যারা শোনে, চারপাশে যারা শ্রম ঘামে বুনে পৃথিবী সাজায়, তাদের পারি না উপেক্ষা করে পায়ের দলে পিষে নির্মল বিষে নিমগ্ন হতে ।এই গ্রন্থটি লেখা হয়ে যাক, গান শোনে যারা তারা কিছু পা'ক আমার জন্য অশেষ না থাক রেশটা তো রবে, তাই দিয়ে হবে তোমার অর্ঘ্য তোমার উত্তরীয় ।ঘৃণা করে যারা তারা পিছু যায়, ভালোবেসে যারা তারা কিছু পায় । এই স্বাভাবিক, আমি তবু ঠিক কুলকলরব যে নদী হারায়; তার স্তবগানে হই না মুখর । খর-বৈশাকে আমি আনি ঝড়, আমি ভালোবাসি সাহসের স্বর । প্রতিঘাতময় মুখর জীবন সোনামুখী সূচে শিল্প সীবন ।আর কিছু নয়, আমার গগন- চুম্বী বাসনা মেলিয়াছে ডানা গানের ভিতরে, তার ভাষা চাই । আশা দিয়ে রোজ যে-মুখ সাজাই তার কাছে পাই যেটুকু শ্রান্তি ত্রুর কাল এসে তার সে ভ্রান্তি ধুয়ে মুছে দেয়, চিহ্ন রাখে না ।এই ভেবে কত প্রেম ফেলে দেই আপন ভাবিয়া বুকে তুলে নেই অপরের ব্যথা, কতো ব্যর্থতা পায়ে দলে চলি সমুখের ডাকে; গতিচঞ্চল জীবনের বাঁকে তবু বহু ভুল থেকে যায় জানি ।সতর্ক চিতে যতো যতি টানি, মানুষের লাগি যতো গীত ভানি কাল সে আসিবে, মুখখানি তার যতই দেখিব ভালোবাসিবার বাসনা জাগিবে চিতে, আসিবে না জানি, কাল চিরকালে ধরা দিতে ।আগামী কালের সতনু শিখাটি পোড়াবে আমার শ্রেষ্ঠ লিখাটি । তবু কথা লিখি, তবু গান গাই, মনের ভিতরে যে মানুষ চাই তার কিছু পাই গূঢ়-চেতনায় অন্ধ প্রাণের বন্ধ বন্দী কূপে-; কিছু রেখে যাই ব্যর্থ-শিল্পরূপে ।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
যখন আমি তোমার মুখের দিকে তাকাই, মনে হয় দুটি শিল্পিত হাতের দশটি আঙ্গুল চীনামাটির ফ্লাওয়ার-ভাসের মতো আদর করে ধরে রেখেছে তোমার গৌরবর্ণ স্নিগ্ধ মুখখানি। সেই কবে একদিন সুদূর শৈশবে মাটির প্রতিমা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল চোখ; তারপর তুমি, মাটির বদলে মাংস, কল্পনার বদলে বাস্তব, পৌত্তলিক রক্ত তবু তোমাকে প্রতিমা ভেবে সুখী। তুমি কি শেষে আমাকে উন্মাদ করে দেবে?
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
পুলিশ স্টেশনে ভিড়,আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের সন্দিগ্ধ সৈনিক। সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের শটগান, রাইফেল, পিস্তল এবং কার্তুজ, যেন দরগার স্বীকৃত মানৎ; টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত। আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি কোমল বিদ্রোহী, প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্র,আমি জমা দেই নি।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
বৈরীতে বিশ্বাসী নই, হিংস্রতা মানায় সিংহে, বনরাজ্যে, তাই জীবজ্ঞানে ক্ষমা করি সব অরণ্যের ক্ষিপ্র ব্যভিচার। সিংহ নেই, ছড়ানো ভুবন জুড়ে প্রেমার্ত বোধের অশ্ব ছোটে প্রতিদিন। রেশমী কেশর থেকে ঝরে নিত্য মানবিক ক্ষুধার চুম্বন। সিংহের শোণিত বীর্যে তবু ফের ধুয়ে আসি হৃদয়ের পরাজিত ভীরুতা আমার। প্রকৃত বিশ্বাস নেই প্রকৃতির বৈরী বসবাসে, হিংস্রতায় নাহি পারঙ্গম তাই যতটুকু প্রেমে।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
কে কবে বলেছে হবে না? হবে,বউ থেকে হবে । একদিন আমিও বলেছিঃ 'ওসবে হবে না ।' বাজে কথা। আজ বলি, হবে, বউ থেকে হবে । বউ থেকে হয় মানুষের পুনর্জন্ম, মাটি,লোহা, সোনার কবিতা, ---কী সে নয়? গোলাপ, শেফালি, যুঁই, ভোরের আকাশে প্রজাপতি, ভালোবাসা, ভাগ্য, ভাড়াবাড়ি ইতিপূর্বে এভাবে মিশেনি । ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, দুইজন্ম এবার মিশেছে, দেখা যাক । হতচ্ছাড়া ব্যর্থ প্রেম, গাঁজা, মদ, নৈঃসঙ্গ আমার ভালোবেসে হে তরুণ, তোমাকে দিলাম, তুমি নাও । যদি কোনদিন বড় কবি হও, আমার সাফল্য কতদূর একদিন তুমি তা বুঝিবে । আমি কতো ভালোবাসা দু'পায়ে মাড়িয়ে অবশেষে, কল্পনার মেঘলোক ছেড়ে পৌঁছেছি বাস্তব মেঘে । আজ রাত বৃষ্টি হবে মানুষের চিরকাম্য দাবির ভিতরে । তার শয্যাপাশে আমার হয়েছে স্থান, মুখোমুখি, অনায়াসে আমি তা বলি না, বলে যারা জানে দূর থেকে । আমি কাছে থেকে জানি, বিনিময়ে আমাকে হয়েছে দিতে জীবনের নানা মূল্যে কেনা বিশ্বখানি, তার হাতে তুলে । অনায়াসে আমিও পারিনি । ক্রমে ক্রমে, বিভিন্ন কিস্তিতে আমি তা দিয়েছি, ফুলে ফুলে ভালোবেসে যেভাবে প্রেমিক । প্রথমে আত্মার দ্যুতি, তারপর তাকে ঘিরে মুগ্ধ আনাগোনা । স্বর্গের সাজানো বাগানে পদস্পর্শে জ্বলে গেছি দূরে, তারপর পেয়েছি বিশ্রাম । আজ রাত সম্পর্কের ভিতরে এসেছি । সবাই মিলবে এসে মৌন-মিহি শিল্পে অতঃপর, তোমার প্রদত্ত দানে পূর্ণ হবে পৃথিবী আমার ।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
গতকাল সিন্ধান্ত নিয়েছি,আমি আবার ভালবাসবো। ভেবেছিলাম আমি আর কাউকে ভালবাসবো না,কিন্তু তোমাকে দেখার পরই আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টেছি, আমি আবার কিছুদিনের জন্য তোমাকে ভালবাসবো। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার কেবলই মনে হচ্ছে, তোমাকে আমার আবার ও কিছুদিন ভালোবাসা উচিত। তাই আমি স্থির করেছি,আমি তোমাকে ভালোবাসবো ১৯৯৭,১১৯৮,১৯৯৯,এবং ২০০০,-এই চারটি বছর। আহা ! কী চমৎকার, ভালোই না হবে ঐ চারটি বছর। এখন ১৯৯৪ -এর মাঝামাঝি, অর্থাৎ মাঝখানে থাকলো ১৯৯৫,১৯৯৬, এবং ১৯৯৪ -এর বাকি দিনগুলো মিলে মোটমাট আড়াই বছর সময়,প্রায় নয়শ' দিনের মতো। ঐ সময়টা তোমাকে একটু অপেক্ষা করে থাকতে হবে, আমি জানি,আমার জন্য অপেক্ষার যন্ত্রণা কী কঠিন- কিন্তু কিছুই করার নেই,আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক অপ্রস্তুত যুবকের মতো তোমাকে আর ভালোবাসতে চাই না। ইতিমধ্যে যেসব নারীর সঙ্গে আমি নিজেকে জড়িয়েছি, তাদের শিকড়গুলো ক্রমশ ছিঁড়ে ফেলবো মন থেকে। তাদেরকে বলবো,তোমরা এখন যে যার পথ দেখো, আমার লোক আসছে,আমাকে আর বিরক্ত করো না। স্ত্রী ও সন্তানদের ডেকে বলবো এই ধরো তোমাদের চার বছরের খাই-খরচের টাকা,আমাকে বাধা দিও না, শতাব্দীর শেষ চারটি বছরের জন্য আমি চলে যাচ্ছি আমার সোনার কাছে।হ্যা,তুমি আমার সোনাই তো! ধরো ১৯৯৪ এর ছয় মাস,তারপর ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬, মাঝখানে আড়াই বছর;তারপর শুরু হবে আমাদের একটানা চারবছরের প্রেম, প্রিয়তমা, তুমি কি পারবে না তোমার স্বামী ও সংসার থেকে ঐ ক'দিনের ছুটি নিতে?
নির্মলেন্দু গুণ
প্রকৃতিমূলক
তুমি ডেকেছিলে, আমি চলে এসেছিলাম একা । কোনো কিছু সঙ্গে নিইনি, সঙ্গে করে নিইনি পানীয়, তিল-তিসি-তামা বা বিছানা বালিশ, তুমি বলেছিলে সব পাওয়া যাবে, --এ শহর নেশার ও নারীর । তুমি ডেকেছিলে, জননীর কোমল বিছানা ছেড়ে চলে এসেছিলাম, শুধু তোমার ডাকে । পেছন থেকে অদৃশ্য নিয়তি এসে পাপের পিচ্ছিল লেজ টেনে ধরেছিল । সর্বশেষ স্পর্শের আনন্দে উন্মাতাল মায়ের বিছানা জড়িয়ে ধরেছিল তার শিশুকে । দীর্ঘশ্বাসের শব্দে এলোমেলো হয়েছিল জন্মের প্রথম চুল, সাজানো ভুবন ফেলে চলে এসেছিলাম একা; শুধু তোমার ডাকে । -শুদু তোমার ডাকে । তুমি ডেকেছিলে, পরীর বাগান ছেড়ে চলে এসেছিলাম । তুমি ডেকেছিলে, কোমল কিচেন ছেড়ে চলে এসেছিলাম । তুমি ডেকেছিলে, শুঁড়িখানার মাতাল আনন্দ ছেড়ে চলে এসেছিলাম একা, শুধু তোমার জন্যে । তুমি মাটির ফোঁটার একটি তিলক দিয়ে আমাকে ভোলাতে চাও? আমি খাদ্য চাই ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো, দ্রৌপদীর মতো বস্ত্র চাই, চাই সর্বগ্রাসী প্রেম, চাই শূর্পণখার মতো নারী, চাই আকন্ঠ নিমগ্ন নেশা, চাই দেশী মদ । আমার সমস্ত ক্ষুধা তোমাকে মিটাতে হবে, হে পৃথিবী, তুমি বলেছিলে অভাব হবে না, এ-পৃথিবী নেশা ও নারীর, আমি চলে এসেছিলাম একা, শুধু তোমার জন্যে ।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
গতকাল ছিল কালো-লালে মেশা একটি অদ্ভুত টুনটুনি । লাফাচ্ছিল ডাল থেকে ডালে, পাতার আড়ালে, ফুল থেকে ফুলে । তার সোনামুখী ঠোঁট, যেন কলমের ডগায় বসানো একরত্তি হীরে । প্রতিটি আঁচড়ে কেটে ভাগ করছিল ফুল থেকে মধু, মধু থেকে ফুল; আমার সমস্ত কলতল ভেসে যাচ্ছিল রক্তকরবীর মধুস্রোতে । আজ সকাল থেকেই রক্তকরবীর ডালে ফুলের আগুন-জ্বলা হাত; ফুল তুলছেন এক বৃদ্ধা পূজারিণী । তার হাতে রক্তকরবীর নকশা কাটা সাজি । মধু নয়, শূন্য বৃন্তে শুভ্রকষধারা । কলতলে রক্তকরবীর হু হু কান্না, আমি কী করব? আমি কী করব? রক্তকরবীর ডালে আমি তো ফুটিনি । আমি পৃথিবীর দুঃখী ফুল, মানুষের হৃদয়ে ফুটেছি ।
নির্মলেন্দু গুণ
নীতিমূলক
দুঃখকে স্বীকার করো না, –সর্বনাশ হয়ে যাবে । দুঃখ করো না, বাঁচো, প্রাণ ভ’রে বাঁচো । বাঁচার আনন্দে বাঁচো । বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো । জানি মাঝে-মাঝেই তোমার দিকে হাত বাড়ায় দুঃখ, তার কালো লোমশ হাত প্রায়ই তোমার বুক ভেদ করে চলে যেতে চায়, তা যাক, তোমার বক্ষ যদি দুঃখের নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়; যদি গলগল করে রক্ত ঝরে, তবু দুঃখের হাতকে তুমি প্রশ্রয় দিও না মুহূর্তের তরে । তার সাথে করমর্দন করো না, তাকে প্রত্যাখান করো ।অনুশোচনা হচ্ছে পাপ, দুঃখের এক নিপুণ ছদ্মবেশ । তোমাকে বাঁচাতে পারে আনন্দ । তুমি তার হাত ধরো, তার হাত ধরে নাচো, গাও, বাঁচো, ফুর্তি করো । দুঃখকে স্বীকার করো না, মরে যাবে, ঠিক মরে যাবে ।যদি মরতেই হয় আনন্দের হাত ধ’রে মরো । বলো, দুঃখ নয়, আনন্দের মধ্যেই আমার জন্ম, আনন্দের মধ্যেই আমার মৃত্যু, আমার অবসান ।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
সংসার মানে সোনার কাঁকনে জীবনের রঙ লাগা, সংসার মানে রক্তে মাংসে সারারাত্রির জাগা।সংসার মানে অপেক্ষমাণ এক জোড়া চোখে দাবি, সংসার মানে সাজানো ভুবন, আঁচলের খোঁটে চাবি।সংসার মানে অনাগত শিশু, পুতুলে সাজানো ঘর, সংসার মানে মনোহর নেশা, ঈশানে বিষাণে ঝড়।সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা, বেদনার জলাভূমি, সংসার মানে সংসার ভাঙ্গা, সংসার মানে তুমি।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
কতো নারী-সরোবরে থেমেছে আমার রথ; কতো ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়েছে জীবন। যখন পড়েছি প্রেমে পাগলের মত পড়েছি। বহু-জীবনের বহু-বাসনায় আমি বহুগামী।তবে আমি একা বহুমাগিতার ভূতে-পাওয়া এক কামতুর কবি, একথা বিশ্বাস করি না; জানি জীবমাত্রই বহুগামী স্বভাবে, স্বজ্ঞায় এই কথা কেউ ভোলে না, কেউ ভুলে যায়।পরমহংসদেব বা ঋষি বিবেকানন্দের মতোন আত্মপীড়ন রণে পারদর্শিতা করিনি অর্জন। মন স্থির করা হয়তো সম্ভব অদৃশ্য ঈশ্বরে, কিন্তু অসম্ভব জীববংশে, নারী কিংবা নরে।
নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমমূলক
মহাত্মা গান্ধীর মতো ভালোবাসা পাড়ি দিচ্ছে সময়ের নড়বড়ে সাঁকো। আমি তাকে হাত ধরে পরান সখার মতো নিয়ে যাচ্ছি নদীর ওপারে। স্রোতস্বিনীর জলে কাঁপিতেছে দুু’জনের ছায়া, ভালোবাসা এবং আমার। তুমি শুধু দূরে বসে আমাদের পার হওয়া দেখো, কর্ত্যব্য করো না। নীলাঞ্জনে ঢেউ ওঠে, সাঁকোর নিজের জলে জলোচ্ছ্বাসে কুঞ্জ ভেসে যায়।
নির্মলেন্দু গুণ
চিন্তামূলক
আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ন বর্ষায়, কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত ।আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে, কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল ।আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে, কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি।আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে, ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা।জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম, এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায়।আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।
অরুণাভ ঘোষ
স্বদেশমূলক
কাঁটাতারের এপার থেকে কতটা দেখা যায়? এক কুড়ি, দুই কুড়ি, তিন কুড়ি – না, আরো বেশী আরো আরো আরো অনেক বেশী, আঙুলের কড়ে ধরেনি সবটা, ওগুলোতো শুধু সংখ্যা – তবে কি দিয়ে মাপা যাবে আবেগ? . ওরা কারা? – দিন নেই রাত নেই ঊষা-গোধুলির পারাপার ভেঙে ঠিক যেন রিলে করে প্রতিদিন জমা হয়? স্মৃতি-সত্তার উন্মেষে ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর শপথ নেয়- কারা ওরা? . ওদের কেউ কেউ রফিক, কেউ কেউ বেলাল, কেউ কেউ নীলুফার, অগণিত মুখ, অচেনা নাম – অচেনা হয়েও চেনা – বেহিসেবী, বেপরোয়া, আর কারো কারো নাম উঠে আসে হিসেবের খাতায়- যেমন রাজীব, নীরবে কি যেন লিখে চলেছিল আপন মনে, কি যেন বলতে চেয়েছিল- চোখ রাঙানি, অস্ত্রের শান দমাতে পারেনি তবু, আরো কত রাজীব উঠে এসে দাঁড়ায়- . কে তুমি তরুণ, রোজকার ফেসবুক ছেড়ে, কে তুমি তরুণী, রোজকার প্রসাধন ছেড়ে, কোন সুখে, কোন দুখে, কোন পাপে, কোন পৃথিবীর আশায় এসে দাঁড়াও ওখানে- . ওখানে কি ফুল ফোটে, লাল কৃষ্ণচুড়া? ওখানে কি লাল রং শুধুই রক্ত চায়? ওখানে কি এখনো অনেক রক্তের দাগের ভিতর একটুখানি নীল আকাশ উঁকি দেয় সবার মনে? তবে কেন? তবে কেন? তবে কেন? . এখনো কি ভালবাসায় উপচে পড়েছে অতীতের জমা ক্ষোভ- এখনো কি অতীত, অতীত, অতীত তাড়া করে ফেরে? ওখানে কি এখনো বেঁচে আছে ভালবাসা আমি-তুমির গণ্ডি পেরিয়ে? ওখানেই কি নতুন ভোর হবে কোনো একদিন? সমস্ত পুংতন্ত্র, সব মৌলবাদ, অথবা শরিয়ত ওখানে কি একদিন একে একে ভেঙে পড়ে যাবে তাসের ঘরের মত? মিশে যাবে কি মাটির সাথে কোনদিন না ফেরার অঙ্গীকারে? ধুলো হয়ে উড়ে যাবে কি সব পিছুটান? হয়ে যাবে অবসান একচোখো সব নষ্টামির? . কে তুমি প্রৌঢ় কিসের আশায়, কে তুমি বৃদ্ধ কোন্ ভাবনায়, তবু ফিরে ফিরে আস এখানে? কোন্ যন্ত্রণার এখনো হয়নি অবসান? কোন্ স্মৃতি এখনো সতত বহমান? কিসের আবর্তে এখনো বর্তমান খানখান হয়ে যায় অতীতের তলোয়ারে? কিসের আবর্তে এখনো হতাশার চোরাবালিতেও ফোটে ফুল? . কাঁটাতারের এপার থেকে কতটা দেখা যায়? আমাদের তো সবটুকুই প্রতীকী – হাতেই গোনা যায়, তবু আবেগ – বহতা নদী, মেঘের আনাগোণা- কাঁটাতারের এপারেও আমাকে জাগিয়ে তোলে- শাহবাগ।।
শুভ দাশগুপ্ত
মানবতাবাদী
আজ পয়লা শ্রাবণ। খোকন, আজ তোর জন্মদিন। তুই যখন জন্মেছিলি, আমরা তখন যাদবপুরে নতুন গড়ে ওঠা কলোনীর টালির ঘরে তোর ইস্কুল মাস্টার বাবা সেই হ্যারিকেনের আলো জ্বলা ঘরেই আনন্দে আর খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছিলেন তুই আসার পর। তোর নাম রেখেছিলেন- সুকল্যাণ। মানুষটার মনটা ছিল শিশুর মতন অভাবে অনটনে, বেঁচে থাকার নানা দুর্বিপাকেও ভেঙ্গে পড়তেন না কখনও। সকলের ভাল চাইতেন মন থেকে। বলতেন দেখো একদিন এই দেশের মানুষ ঠিক খুঁজে পাবে মুক্তির পথ। শোষণ থেকে মুক্তি দারিদ্র থেকে মুক্তি অশিক্ষা থেকে মুক্তি…আজ পয়লা শ্রাবণ খোকন, আজ তোর জন্মদিন। ছোটবেলায়, তোর মনে আছে? আমাদের ভাঙ্গা মেঝেতে বাক্স থেকে বার করা মেজো-মাসীর হাতে তৈরি আসনটা পেতে দিতাম। সামনে রাখতাম ঠাকুরের আসনের প্রদীপখানা। তুই বসতিস বাবু হয়ে চুপটি করে। তোকে আমরা একে একে ধান দুব্বো মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করতাম। বাবা বলতেন বড় হও মানুষ হও। তোর বাবার সেই বন্ধু-ঘোষ কাকা তিনি বলতেন বেঁচে বর্তে থাকো। তুই জিগ্যেস করতিস-মা, বর্তে মানে কি মা? আমি শুধু তোর মাথায় ধান-দুব্বোই দিতাম। বলতাম না কিছুই। শুধু মনে মনে বলতাম ঠাকুর, আমার খোকনকে মস্ত বড় মানুষ করে তোলো আমার খোকন যেন সত্যিই মানুষ হয়। ওর যেন কখনো কোনো বিপদ না হয় ঠাকুর। অভাবের সংসারে ওই একটা দিন-পয়লা শ্রাবণ কষ্টের পয়সায় একটু বাড়তি দুধ নিতাম। পায়েস রান্না করে দিতাম তোকে। তুই খুব ভালবাসতিস পায়েস খেতে। তোর বাবা বাসস্টান্ডের দোকান থেকে নিয়ে আসতেন তোর প্রিয় মিষ্টি ছানার গজা। সামান্য ইস্কুল মাস্টারিতে কীই বা আয় হত; ঘরে বসে ছাত্র পড়িয়ে আসতো কিছু। দাউ দাউ অভাবের আগুনে সে রসদ পুড়তে সময় লাগত না। তোর বাবার জামা সেলাই করতাম আর বার বার বলতাম আসছে মাসে একটা জামা বানিয়ে নিও। উনি হেসে উঠে বলতেন; বাদ দাও তো, খোকন বড় হচ্ছে। ওর জন্য ভাবছি দুধ রাখতে হবে আরো আধসের- দুধে শক্তি বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। শক্তি আরে বুদ্ধি না হলে তোমার খোকন মস্ত বড় মানুষ হয়ে উঠবে কি করে? ভাবছি আরো দুটো টিউশনি নেব।ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে মানুষটা দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। বারান্দার ধার ঘেঁষে যখন রাতের অন্ধকারে জোনাকির ব্যস্ততা, আর ঘরে তোর পড়া মুখস্থ করার একটানা সুর আমাদের কলোনীর ভাঙ্গাচূড়া বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখতো- তখন বলতেন আমায়; খাওয়া দাওয়া একটু করো- তোমার চেহারাটা বড় ভেঙ্গে পড়ছে দিন দিন… শাড়িটাও তো দেখছি বেশ ছিঁড়েছে- কালই আমি ফেরার পথে একটা শাড়ি নিয়ে আসব। ধারেই আনব। আমি বলতাম-ধুর। সামনে খোকনের উঁচু ক্লাস- কত বই পত্তর কিনতে হবে- কত খরচ। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যেতেন। জোনাকিরা নিঃশব্দ অদৃশ্য আলোর আলপনা আঁকত উঠনের আগাছার ঝোপে। আবহ সঙ্গীতের মত তুই ভেতরে বসে বসে পড়া মুখস্থ করতিস। ইতিহাস, ভূগোল, গ্রামার।ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করেননি। তুই কত বড় হলি। সব পরীক্ষায় কত ভাল ফল হল তোর। বাবা বললেন; আরও পড়। উচ্চ শিখাই উচ্চ সম্মানের এক মাত্র পথ। তুই আরও পড়লি।তারপর…তোর চাকরি হল কত বড় অফিসে মনে আছে খোকা? প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়েই তুই কত কী কিনে এনেছিলি? তখন তো আমরা উঠে এসেছি শ্যামবাজারে। দু’কামরার বেশ সাজানো ঘোচানো গোছানো বড় ফ্লাট। তোর অফিস থেকেই তো দিয়েছিল। সেই বাড়ি সেই ঘর সেই বেলকনি- কত স্মৃতি- কত ছবি! ঐ বাড়িতেই তো আশ্বিনের ঝড়ো বিকেলে- তোর মনে আছে খোকন? তোর বাবা যেদিনটাতে চলে গেলেন- মনে আছে? তুই বাবার বুকের ওপর পড়ে যখন কাঁদছিলি হাপুস নয়নে সদ্য স্বামীহারা, আমি সেদিন তোর সেই অসহায় মুখ দেখে আরো বেশি করে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। তোকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম ছোটবেলার মত। বলেছিলাম- কাঁদিস না খোকা। আমিতো আছি।আজ পয়লা শ্রাবণ কলকাতা থেকে অনেক দুরে মফস্বলের এই বৃদ্ধাশ্রমে আমি একেবারে একা, খোকন। তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে। তোকে, বৌমাকে আর ছোট্ট বিল্টুকে। তোরা এখন কত দুরে- সল্ট-লেকের মার্বেল বসানো ঝকঝকে বাড়িতে। আজ তোর জন্মদিনের নিশ্চয়ই খুব বড় পার্টি হচ্ছে- তাই নারে খোকন? লোকজন, হৈচৈ, খাওয়া-দাওয়া। খুব ভাল, খুব ভাল। খোকন, আজ পয়লা শ্রাবণ আমার বড় মনে পড়ছে যাদবপুরের ভাঙ্গা ঘরে রাত্রে তুই আমার পাশে শুয়ে মাঝে মধ্যে হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরতিস আমাকে। আমি বলতাম, ভয় কী রে? আমি তো আছি। মা তো আছে খোকনের। যার মা থাকে তাকে কী ভুতে ধরে? তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তিস আমার বুক জুড়ে। তোর আধুনিক সংসারে এই বুড়িটার একটু ঠাই হল নারে? প্রতিমাও তো মা। ওরও তো আছে আমার খোকনেরই মত কোল আলো- করা এক চাঁদের টুকরো। কিন্তু সময়ের কী আশ্চর্য পরিবর্তন!খোকন! তুই বোধহয় আর এখন পায়েস খাস না- তাই নারে? তুই জানিস না খোকন আজ আমি সকালে পায়েস রান্না করেছি। হ্যাঁ তোরই পাঠানো টাকায়। সারাদিন সেই পায়েসের বাটি সামনে নিয়ে বসে আছি রে। এখানে এই বৃদ্ধাশ্রমে আমার একলা ঘরে আর কেউ নেই। তুই একবার আসবি খোকন। একবার.. শুধু একবার।
শুভ দাশগুপ্ত
মানবতাবাদী
আমিই সেই মেয়ে। বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন যার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি আপনি রোজ দেখেন। আর আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে যাকে ইচ্ছে মতন দেখেন। আমিই সেই মেয়ে।বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে দিনের আলোয় যার ছায়া মাড়ানো আপনার ধর্মে নিষিদ্ধ, আর রাতের গভীরে যাকে বস্তি থেকে তুলে আনতে পাইক বরকন্দাজ পাঠান আপনি আর সুসজ্জিত বিছানায় যার জন্য অপেক্ষায় অধীন হয় আপনার রাজকীয় লাম্পট্য আমিই সেই মেয়ে।আমিই সেই মেয়ে- আসামের চাবাগানে ঝুপড়ি কামিন বস্তি থেকে যাকে আপনি নিয়ে যেতে চান সাহেবি বাংলোয় মধ্যরাতে ফায়ার প্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় মদির চোখে দেখতে চান যার অনাবৃত শরীর আমি সেই মেয়ে।রাজস্থানের শুকনো উঠোন থেকে পিপাসার জল আনতে যাকে আপনি পাঠিয়ে দেন দশ মাইল দূরে সরকারি ইঁদারায়- আর কুড়ি মাইল হেঁটে কান্ত বিধ্বস্ত যে রমণী ঘড়া কাঁখে ঘরে ফিরলেই যাকে বসিয়ে দেন চুলার আগুনের সামনে আপনার রুটি বানাতে আমিই সেই মেয়ে।আমিই সেই মেয়ে- যাকে নিয়ে আপনি মগ্ন হতে চান গঙ্গার ধারে কিংবা ভিক্টোরিয়ার সবুজে কিংবা সিনেমা হলের নীল অন্ধকারে, যার চোখে আপনি একে দিতে চান ঝুটা স্বপ্নের কাজল আর ফুরিয়ে যাওয়া সিগারেটের প্যাকেটের মত যাকে পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে আপনার ফুল সাজানো গাড়ি শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করতে ছুটে যায় শহরের পথে- কনে দেখা আলোর গোধুলিতে একা দাঁড়িয়ে থাকা আমিই সেই মেয়ে।আমিই সেই মেয়ে- এমন কি দেবতারাও যাকে ক্ষমা করেন না। অহংকার আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে বিসর্জন দিতে হয় কর্ণকে। আত্মজকে। আমিই সেই মেয়ে।সংসারে অসময়ের আমিই ভরসা। আমার ছাত্র পড়ানো টাকায় মায়ের ওষুধ কেনা হয়। আমার বাড়তি রোজগারে ভাইয়ের বই কেনা হয়। আমার সমস্ত শরীর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। কালো আকাশ মাথায় নিয়ে আমি ছাতা হয়ে থাকি। ছাতার নিচে সুখে বাঁচে সংসার।আপনি আপনারা আমার জন্য অনেক করেছেন। সাহিত্যে কাব্যে শাস্ত্রে লোকাচারে আমাকে মা বলে পুজো করেছেন। প্রকৃতি বলে আদিখ্যেতা করেছেন- আর শহর গঞ্জের কানাগলিতে ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে কুপি হাতে দাঁড় করিয়েও দিয়েছেন। হ্যা, আমিই সেই মেয়ে। একদিন হয়ত হয়ত একদিন- হয়ত অন্য কোন এক দিন আমার সমস্ত মিথ্যে পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমিই হয়ে উঠবো সেই অসামান্যা ! খোলা চুল মেঘের মত ঢাকবে আমার খোলা পিঠ। দু চোখে জ্বলবে ভীষণ আগুন। কপাল-ঠিকরে বেরুবে ভয়ঙ্কর তেজরশ্মি। হাতে ঝলসে উঠবে সেই খড়গ। দুপায়ের নুপুরে বেজে উঠবে রণদুন্দভি। নৃশংস অট্টহাসিতে ভরে উঠবে আকাশ। দেবতারাও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে বলতে থাকবেন মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং।বীভৎস দাবানলের মত আমি এগোতে থাকবো ! আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছটফট করতে থাকবে- সভ্যতার দেহ প্রগতির দেহ- উন্নতির দেহ- সমাজের দেহহয়ত আমিই সেই মেয়ে ! হয়ত ! হয়ত বা।
শুভ দাশগুপ্ত
প্রেমমূলক
৪ঠা অক্টোবর তাদের দুজনের প্রথম দেখা হল। তখন বিকেল ঘনিয়ে আসছে। বাতাসে শীতের আমেজ।১০ই অক্টোবর তাদের দীর্ঘক্ষণ কথা হল টেলিফোনে। সেদিন ছেলেটি নতুন কেনা টব’এ গোলাপের চারা লাগাল।৩০শে অক্টোবর রেস্টুরেন্টের নিরালা কেবিনে ছেলেটি বলল— তোমাকে আমি ভালবাসি। মেয়েটি লজ্জায় মাথা নিচু করে টেবিলে আঁকিবুকি কাটল।১২ই ডিসেম্বর গোলাপগাছে কুঁড়ি ধরল। মেয়েটি রেস্টুরেন্টে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল— —কেন ভালবাস আমায়? আমি সুন্দরী, তাই? —তোমার চেয়েও সুন্দরী আছে কত… —আমার বাবার প্রচুর অর্থ—তাই? —তোমার বাবার চেয়ে বড়োলোক এখানে কম আছে? —তাহলে? —ভালবাসি ভালবাসি। তার আবার কারণ হয় নাকি? মেয়েটি বাড়ি ফিরে বন্ধুদের টেলিফোনে অনেক আলোচনা করল। সবাই একবাক্যে বুঝিয়ে দিল—- ভালো যখন বাসে—তখন একটা কিছু কারণ তো আছে বটেই। সেটা না বুঝে বেশি এগোস না।৩রা জানুয়ারি মেয়েটি বললো : —আমার কাছে কী চাও? —কই, চাইনি তো কিছু। —ভালোবাস অথচ চাওনা—তাহলে? —না চাহিলে যারে পাওয়া যায় তেওয়াগিলে আসে হাতে… —এতো গান। —শুধুই গান? —তা ছাড়া কী?… কিছুই যদি না চাও, তবে ভালোবাস কেন? —ভালোবাসি, তাই ভালোবাসা দিতে চাই। চাইব কেন? —তুমি সত্যিই অদ্ভূত!১০ই ফেব্রুয়ারি দুজনের দেখা হল মেট্রো স্টেশনের পাতালে। ছেলেটি বললো : —আমি কাল সারারাত বাঁশি বাজিয়েছি। সারারাত সেই সুরের মায়াবী আলোয় তুমি নাচছিলে। অসামান্য অনন্য সে নাচ। —ধ্যাৎ। কাল সারারাত আমি ঘুমিয়েছি। —আমি কিন্তু তোমার নাচই দেখে গেছি সারারাত। —তোমার বাঁশি একদিন শুনতে হবে১২ই মার্চ ছেলেটি বাঁশি বাজালো। মেয়েটি শুনলো। সময় থমকে রইল অনেকক্ষণ। বাঁশি যখন থামল, মেয়েটির দুচোখ ভরা জলে। বললো— —বাঁশি শুনতে শুনতে আমার ঘুম এল আবেশে। আমি দেখলাম আমি নাচছি। মেঘের মাঝখানে, তারাদের পাশে আমি নাচছি। আকাশে ফুলের গন্ধ। —ডাক্তার আমায় বাঁশি বাজাতে নিষেধ করেছেন। —সেকি? কেন? —বাঁশি আমায় টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নের মধ্যে। ডাক্তার বলেছে স্বপ্ন দেখে আমার মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। —তাহলে? —ভাবছি।১৬ই এপ্রিল মেয়েটি বললো : — আমার বন্ধুরা বলেছে— তুমি খুউব ভালো। অসাধারণ, কিন্তু তুমি সৃষ্টি ছাড়া। তোমার স্বপ্ন সব অর্থহীন। —আমি জানি। স্বপ্ন-টপ্ন ছেড়ে দিতে পারো না তুমি? —-না। —তাহলে… তুমি তো আমাকে হারাবে। —তোমায় পাইনি তো কখনও!৫ই মে ছেলেটির মস্তিষ্কে অপারেশন হল। একটু সুস্থ হতে মেয়েটি এসে বললো : —ভাল আছ তো? এখন আর স্বপ্ন দেখছ না তো? —দেখছি। আরও সুন্দর সব স্বপ্ন। —তাহলে তো দেখছি operationটা আদৌ সফল হয়নি! বাড়ি ফিরে বন্ধুদের ফোন করল মেয়েটি। বন্ধুরা একবাক্যে বলল : বাঁশি বাজানো, স্বপ্ন দেখা, সবই backdated সৃষ্টিছাড়া। তুই আর লোক পেলি না? তুই এত রূপসী। তোর এত উজ্জ্বল prosppect। ভালো যদি চাস তাহলো শিগগির বিয়ে করে ফেল তোর দাদার সেই বন্ধুকে—। উনিতো শুনলাম কানাডাতেই settle করবেন।৭ই জুলাই মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলো : — —তুমি সত্যিই কী চাও বলতো? —তুমি আরও সার্থক, আরও সুন্দর হয়ে ওঠো। —ব্যাস! আর কিছু না —আর! চাই স্বপ্ন দেখতে। —ও : স্বপ্ন তাহলে তুমি ছাড়তে পারবে না? —না। —তাহলে থাকো তুমি স্বপ্ন নিয়ে।১২ই আগস্ট গোলাপ গাছে ফুল ফুটলো অনেক। সেদিন দুপুরে ছেলেটির মস্তিষ্কে আবার অপারেশন হল।১৩ই সেপ্টেম্বর ছেলেটি মারা গেল।১৪ই সেপ্টেম্বর মেয়েটির শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হল কানাডাগামী সেই পাত্রের সঙ্গে।২০শে সেপ্টেম্বর গোলাপ গাছটি হঠাৎ ঝড়ে উপড়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যার বিমানে মেয়েটি হানিমুনে গেল—। যাবার আগে বন্ধুদের বলে গেল। স্বপ্নের চেয়ে বাস্তব অনেক ভাল। অনেক মধুর। স্বপ্ন দেখে কেবল বোকারা।৪ঠা অক্টোবর ছেলেটির মা ঝরে পড়া গোলাপ গাছটিকে সযত্নে তুলে ফেলে দিলেন।শূন্য টবে তখন কয়েকটা পোকা, কয়েকটা মাছি। আমরা কেউ জানিনা ওগুলো পোকা-মাছি-না কি ছেলেটির স্বপ্ন। আমরা ঠিক জানিনা। আমরা কেউই জানিনা।
শুভ দাশগুপ্ত
চিন্তামূলক
চার বুড়ো মানুষ রোজ বিকেলে আগরপাড়া স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে অলস বসে থাকে, গল্প করে, একদিন যখন বয়স কম ছিল, কাজ ছিল তখনকার গল্প, স্মৃতি। ট্রেন আসে, ট্রেন যায় ভিড় ঠাসা ট্রেন হাজার মানুষ বুকে নিয়ে চলে যায় রাণাঘাট, শান্তিপুর, নৈহাটি, কৃষ্ণনগর॥প্রথম বুড়ো ভাবেঃ একদিন বয়স ছিল। রোজ সকালে ধরতাম আটটা বিয়াল্লিশ। ট্রেনের কামরায় ডেলি প্যাসেঞ্জারির আড্ডা। তাস, রাজনীতি মাঝে মধ্যে সদলে বিয়ে বাড়ি অথবা পিকনিক আজো আটটা বিয়াল্লিশ আসে যায়। আমারই নাম নেই আর॥দ্রিতীয় বুড়ো ভাবেঃ পূজোর সময় তখন কেমন যেতুম প্রতি বছর বেড়াতে। বউ বাচ্চা নিয়ে পুরী, জয়পুর, আগ্রা, মথুরা। কতকাল আর যাইনা কোথাও। যাওয়া হয় না॥তৃতীয় বুড়ো ভাবেঃ ভালই আছি। ছেলে আর ছেলের বউ যত্ন-আত্তি করে। তবু ছেলের মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ালেই মনে পড়ে বড়দিনের সময় বেশ কবার নিয়ে গিয়েছিলাম ওকে কলকাতার সাহেবপাড়ায়। ট্যাক্সি করে ঘুরিয়েছিলাম পার্ক স্ট্রিট। চৌরঙ্গী— কতকাল কলকাতা দেখি না। বাতের ব্যথাটাো বেড়েছে॥চতুর্থ বুড়ো ভাবেঃ কয়লার ইঞ্জিন ছিল। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলে চোখে কয়লার গুঁড়ো ঢুকত। তবে, ভারি সুন্দর ছিল সেই আওয়াজ—ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক কোথায় যে গেল সেই সব দিন॥চার বুড়ো বিকেলের নিভে আসা আলোর নীচে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে প্রতিদিন ভাবে— প্রতিদিন ট্রেন যায়, ট্রেন আসে॥কাল দেখলাম তিন বুড়ো সত্যিকারের ট্রেন এক বুড়োকে নিয়ে গেছে অচেনা ইস্টিশানের দিকে। তিন বুড়োর কানে বাজছে ঝিক ঝিক…
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
প্রেমমূলক
ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।শান-বাঁধানো ফুটপাথে পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে।ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে তারপর খুলে – মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে তারপর তুলে – যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে যেন না ফেরে।গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে একটা দুটো পয়সা পেলে যে হরবোলা ছেলেটা কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত – তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত আকাশটাকে মাথায় নিয়ে এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল –ঠিক সেই সময় চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল আ মরণ ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !তারপর দাড়ম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ। অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে দড়িপাকানো সেই গাছ তখন ও হাসছে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মানবতাবাদী
বলছিলাম– না, থাক্ গে। যা হচ্ছে হোক, কে খণ্ডাবে লেখা থাকলে ভাগ্যে। পাকানো জট, হারানো খেই, চতুর্দিকের দৃষ্যপট এখনও সে-ই– শক্ত করে আঁকড়ে-ধরা চেয়ারের সেই হাতল। বিষম ভয়, কখন হয় ক্ষমতার হাতবদল। বলছিলাম– না, থাক্ গে! কী আসে যায় হাতে নাতে প্রমাণ এবং সাক্ষ্যে। মোড়লেরা ব্যস্ত বেজায় যে যার কোলে ঝোল টানতে। সারটা দেশ হাপিত্যেশে, পান্তা ফুরোয় নুন আনতে। চোর-বাটপার সাধুর ভেখে ফাঁদে কারবার আড়াল থেকে– হাতিয়ে জমি, বানিয়ে বাড়ি করছে টাকা কাঁড়ি কাঁড়ি কতক সাদা কতক কালো মারছে কার খোরাক কে। জানি না যখন কোনো কিছুই বলাই ভালো জী-আজ্ঞে। বলছিলাম কী– থাক্ গে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
স্বদেশমূলক
আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা। মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে_ থাকুক গে পাহারা। দুয়োরে খিল। টান দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানলা। ওপারে যে বাংলাদেশ এপারেও সেই বাংলা।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
স্বদেশমূলক
আমি যত দূরেই যাই আমার সংগে যায় ঢেউয়ের মালা-গাঁথা এক নদীর নাম_ আমি যত দূরেই যাই। আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে নিকোনো উঠোনে সারি সারি লক্ষ্মীর পা আমি যত দূরেই যাই।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মানবতাবাদী
প্রভু, যদি বলো অমুক রাজার সাথে লড়াই কোনো দ্বিরুক্তি করব না, নেব তীরধনুক। এমনি বেকার, মৃত্যুকে ভয় করি থোড়াই, দেহ না চললে, চলবে তোমার কড়া চাবুক। হা-ঘরে আমরা, মুক্ত আকাশ ঘর-বাহির। হে প্রভু, তুমিই শেখালে পৃথিবী মায়া কেবল- তাই তো আজকে নিয়েছি মন্ত্র উপবাসীর, ফলে নেই লোভ, তোমার গোলায় তুলি ফসল। হে সওদাগর, সেপাই-সান্ত্রী সব তোমার। দয়া ক’রে শুধু মহামানবের বুলি ছড়াও– তারপরে, প্রভু, বিধির করুণা আছে অপার। জনগণমতে বিধিনিষেধের বেড়ি পরাও। অস্ত্র মেলে নি এতদিন, তাই ভেঁজেছি তান। অভ্যাস ছিল তীরধনুকের ছেলেবেলায়। শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান– বলব, বৎস! সভ্যতা যেন থাকে বজায়। চোখ বুজে কোনো কোকিলের দিকে ফেরাব কান।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মানবতাবাদী
কমরেড, আজ নতুন নবযুগ আনবে না? কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে। লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা- দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে, কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না? আকাশের চাঁদ দেয় বুঝি হাতছানি? ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া- আমরা তো নই প্রজাপতি- সন্ধানী! অন্তত, আজ মাড়াই না তার ছায়া। কুঁজো হয়ে যারা ফুলের মূর্ছা দেখে পৌঁছোয় না কি হাতুড়ি তাদের পিঠে? কিংবা পাঠিয়ো বনে সে-মহাত্মাকে নিশ্চয় নিঃসঙ্গ লাগবে মিঠে! আমাদের থাক মিলিত অগ্রগতি; একাকী চলতে চাই না এরোপ্লেনে; আপাতত চোখ থাক পৃথিবীর প্রতি, শেষে নেওয়া যাবে শেষকার পথ জেনে।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মানবতাবাদী
শতকোটি প্রণামান্তে হুজুরে নিবেদন এই_ মাপ করবেন খাজনা এ সন ছিটেফোঁটাও ধান নেই। মাঠেঘাটে কপাল ফাটে দৃষ্টি চলে যত দূর খাল শুক্‌নো বিল শুক্‌নো চোখের কোলে সমুদ্দুর। হাত পাতব কার কাছে কে গাঁয়ে সবার দশা এক তিন সন্ধে উপোস দিয়ে খাচ্ছি আজ বুনো শাক। পরনে যা আছে তাতে ঢাকা যায় না লজ্জা ঘটি বাটি বেচেছি সব আছে বলতে ছিল যা। এ দুর্দিনে পাওনা আদায় বন্ধ রাখুন, মহারাজ ভিটেতে হাত দেয় না যেন পাইক বরকন্দাজ। আমরা কয়েক হাজার প্রজা বাস করি এই মৌজায় সবাই মিলে পথ খুঁজছি কেমন করে বাঁচা যায়। পেত জ্বলছে, ক্ষেত জ্বলছে হুজুর, জেনে রাখুন খাজনা এবার মাপ না হলে জ্ব’লে উঠবে আগুন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মানবতাবাদী
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে পায়ে শিকল দিয়ে কোকিল মরছে কেশে কেশেএ গাঁয়েতে বান তো ও গাঁয়েতে খরা যে করে হোক আখেরে ভোট ভাতের টোপে ধরানীচেয় থাকে হাবা বোবা ওপরতলায় কালা কাজের জন্যে মানুষ হন্যে দরজাগুলোয় তালাএই এটাকে চেয়ারে বসা ওই ওটাকে হটা সামনে পুলুশ পিছনে জুলুশ তবে না ঘটাপটাখুনখারাবি রং বুলিয়ে মন ভুলিয়ে ঝান্ডায় চাইবে গদি না দাও যদি ঠান্ডা করবে ডান্ডায়বাড়ির পর বাড়ি রে ভাই গাড়ির পর গাড়ি আপনজনে পরের ধনে চালাচ্ছে পোদ্দারিপার্ক ময়দানে জলা জমি হাত করছে টাকার কুমির ছিল নাকে কপর্দকও, তোমন লোকও লাল হয়ে আজ হচ্ছে আমির বাইরে চটক ভেতরে ফাঁপা কতদিন আর থাকবে চাপাহাটে ভাঙছে হাঁড়ি এখন পর পর একটু যদি দাঁড়ান ঘুরে দেখতে পাবেন রাজ্য জুড়ে বেঁধে যায় কি চব্বরছাড়ায় সীমা সহ্যের এতদিন যা হয়ে এসেছে এসব আজ তার জের।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
নীতিমূলক
মেয়ে: তুমি কি চাও আমার ভালবাসা ? ছেলে: হ্যাঁ, চাই ! মেয়ে: গায়ে কিন্তু তার কাদা মাখা ! ছেলে: যেমন তেমনিভাবেই চাই । মেয়ে: আমার আখেরে কী হবে বলা হোক । ছেলে: বেশ! মেয়ে: আর আমি জিগ্যেস করতে চাই । ছেলে: করো । মেয়ে: ধরো’ আমি কড়া নাড়লাম । ছেলে: আমি হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যাব ! মেয়ে: ধরো’ তোমাকে তলব করলাম । ছেলে: আমি হুজুরে হাজির হব । মেয়ে: তাতে যদি বিপদ ঘটে ? ছেলে: আমি সে বিপদে ঝাঁপ দেব । মেয়ে: যদি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করি? ছেলে: আমি ক্ষমা করে দেব । মেয়ে: তোমাকে তর্জনী তুলে বলব, গান গাও । ছেলে: আমি গাইব । মেয়ে: বলব,কোনো বন্ধু এলে তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দাও। ছেলে: বন্ধ করে দেব । মেয়ে: তোমাকে বলব, প্রাণ নাও । ছেলে: আমি নেব । মেয়ে: বলব, প্রাণ দাও । ছেলে: দেব । মেয়ে: যদি তলিয়ে যাই ? ছেলে: আমি টেনে তুলবো । মেয়ে: তাতে যদি ব্যথা লাগে ? ছেলে: সহ্য করব । মেয়ে: আর যদি থাকে বাধার দেয়াল ? ছেলে: ভেঙ্গে ফেলব । মেয়ে: যদি থাকে একশো গিঠঁ ? ছেলে: তাহলেও । মেয়ে: তুমি চাও আমার ভালবাসা ? ছেলে: হ্যাঁ, তোমার ভালবাসা । মেয়ে: তুমি কখনোই পাবে না । ছেলে: কিন্তু কেন ? মেয়ে: কারণ, যারা ত্রীতদাস আমি তাদের কখনই ভালবাসি না ।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
স্বদেশমূলক
আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে -কখনও মুখ ফুটে বলি নি। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু -শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত আমার ভালাবাসার কথা মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।হে দেশ, হে আমার জননী- কেমন ক’রে তোমাকে আমি বলি!….
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
প্রেমমূলক
১. এখন একটু চোখে চোখে রাখো- দিনগুলো ভারি দামালো; দেখো, যেন আমাদরে অসাবধানে এই দামালো দিনগুলো গড়াতে গড়াতে গড়াতে গড়াতে আগুনের মধ্যে না পড়ে। আমার ভালোবাসাগুলোকে নিয়েই আমার ভাবনা। এখন সেই বয়স, যখন দূরেরটা বিলক্ষণ স্পষ্ট– শুধু কাছেরটাই ঝাপসা দেখায়। এখন সেই বয়েস, যখন আচমকা মাটিতে প’ড়ে যেতে যেতে মনে হয় হাতে একটা শক্ত লাঠি থাকলে ভালো হত। ২.পিছনে তাকালে আজও দেখতে পাই – সিংহের কালো কেশর ফুলিয়ে গর্জমান সমুদ্র; দেয়ালে গুলির দাগ, ভাঙা শ্লেট, ছেঁড়া জুতোয় ছত্রাকার রাস্তা, পায়ে পায়ে ছিটিয়ে যাওয়া রক্ত। মুক্তির বহুবর্ণ বাসনার নিচে যৌবনকে পণ ধরেছিল জীবন। ঠিক তেমনি দূরে, কত দূরে ঠিক জানি না, আজও দেখতে পাচ্ছি- হিরণ্যগর্ভ দিন হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি নিয়ে আসছে। গান গেয়ে আমাকে বলছে দাঁড়াতে। গুচ্ছ গুচ্ছ ধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে তার বলিষ্ঠ হাত দুটো আমি দেখতে পাচ্ছি- আমি শেষ বারের মত মাটিতে প’ড়ে যাবার আগে আমার ভালোবাসাগুলোকে নিরাপদে তার হাতে পৌঁছে দিতে চাই।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
চিন্তামূলক
সারাক্ষণ সে আমার পায়ে পায়ে সারাক্ষণ পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে। তাকে বলিঃ তোমাকে নিয়ে থাকার সময় নেই- হে বিষাদ, তুমি যাও এখন সময় নেই তুমি যাও। গাছের গুঁড়িতে বুক-পিঠ এক করে যৌবনে পা দিয়ে রয়েছে একটি উলঙ্গ মৃত্যু- আমি এখুনি দেখে আসছিঃ পৃথিবীতে গাঁক-গাঁক করে ফিরছে যে দাঁত-খিঁচানো ভয়, আমি তার গায়ের চামড়াটা খুলে নিতে চাই। চেয়ে দেখো হে বিষাদ- একটু সুখের মুখ দেখবে বলে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে চুল সাদা করে আহম্মদের মা। হে বিষাদ, তুমি আমার হাতের কাছ থেকে সরে যাও জল আর কাদায় ধান রুইতে হবে। হে বিষাদ, হাতের কাছ থেকে সরে যাও আগাছাগুলো নিড়োতে হবে। যায় না; বিষাদ তবু যায় না। সারাক্ষণ আমার পায়ে পায়ে সারাক্ষণ পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে। আমি রাগে অন্ধ হই আমার বেদনাগুলো তার দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারি। বলিঃ শয়তান, তোকে যমে নিলে আমি বাঁচি! তারপর কখন কাজের মধ্যে ডুবে গিয়েছি জানি না- চেয়ে দেখি দূরে বসে সেই আমার বিষাদ আমাকে একেবারে ভুলে গিয়ে আমার অপূর্ণ বাসনাগুলো নিয়ে খেলছে। হাসতে হাসতে আমি তাকে দুরন্ত শিশুর মতো কোলে তুলে নিই।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
শোকমূলক
সারাটা দিন ছেলেটা নেচে নেচে বেড়িয়েছে। রাস্তায় আলো জ্বলছে অনেকক্ষণ এখনও বাবা কেন এল না, মা? বলে গেল মাইনে নিয়ে সকাল- সকাল ফিরবে। পুজোর যা কেনাকাটা এইবেলা সেরে ফেলতে হবে। বলে গেল। সেই মানুষ এখনও এলো না। কড়ার গায়ে খুন্তিটা আজ একটু বেশি রকম নড়ছে। ফ্যান গালতে গিয়ে পা-টা পুড়ে গেল। জানালার দিকে মুখ করে ছেলেটা বই নিয়ে বসল মাদুরে সামনে ইতিহাসের পাতা খোলা— ঘড়িতে টিকটিক শব্দ। কলে জল পড়ছে। ও- বাড়ির পাঁচিলটা থেকে লাফিয়ে নামল একটা গোঁফঅলা বেড়াল। বাপের- আদরে-মাখা- খাওয়া ছেলের মত হিজিবিজি অক্ষরগুলো একগুঁয়ে অবাধ্য– যতক্ষণ পুজোর জামা কেনা না হচ্ছে নড়বে না। এখনও বাবা কেন এল না, মা? রান্না কোন্ কালে শেষ গা ধোয়াও সারা মা এখন বুনতে বসে কেবলি ঘর ভুল করছে। খুট করে একটা শব্দ — ছিটকিনি খোলার। কে? মা, আমি খোকা। গলির দরজায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে। এখন রেডিওয় খবর বলছে। মানুষটা এখনও কেন এল না? একটু এগিয়ে দেখবে বলে ছেলেটা রাস্তায় পা দিল। মোড়ে ভিড়; একটা কালো গাড়ি; আর খুব বাজি ফুটছে। কিসের পুজো আজ? ছেলেটা দেখে আসতে গেল। তারপর অনেক রাত্তিরে বারুদের গন্ধে-ভরা রাস্তা দিয়ে অনেক অলিগলি ঘুরে মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে বাবা এল। ছেলে এল না।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
প্রেমমূলক
আকাশে তুলকালাম মেঘে যেন বাজি ফোটানোর আওয়াজে কাল তোমার জন্মদিন গেল। ঘরে বৃষ্টির ছাট এলেও জানালাগুলো বন্ধ করি নি— আলো-নেভানো অন্ধকারে থেকে থেকে ঝিলিক-দেওয়া বিদ্যুতে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার মুখ। আর মাঝে মাঝে হাওয়া এসে নড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল তোমাকে ভালবেসে দেওয়া টেবিলে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। কাল কেন আমি ঘুমোতে পারি নি তোমাকে বলি নি— আমার ফেলে-দেওয়া লেখার কাগজটা নিয়ে শয়তান বেড়ালটা কাল সারারাত খেলেছে। তোমাকে বলি নি— দজ্জাল ঘড়িটা একদিন আমাকে বাজিয়ে দেখে নেবে ব’লে টিকটিক শন্দে শাসিয়েছে। তোমাকে বলি নি— মাটিতে মিশে যাবার পর আমরা দুজনে কেউই কাউকে চিনব না। আর দেখ, তোমাকে বলাই হয় নি এবার রথের মেলায় কী কী কিনব— মেয়ের জন্যে তালপাতার ভেঁপু তোমাত জন্যে ফ্লফুলের চারা আর বাড়ির জন্যে সুন্দর পেতলের খাঁচায় দুটো বদরিকা পাখি।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
মানবতাবাদী
যাবার আগে মিটিয়ে নেব যার যার সঙ্গে আড়ি উঠলে ঝড় ছুটব বাইরে তারপরে তো বাড়ি ঠিক করি নি কিসে যাব হেঁটে না সাইকেলে ঝনঝনালে পকেটে পয়সা মাটিতে দেব ফেলে মাটি কাঁপছে, কাঁপুক। চল্‌ রে ঘোড়া! হাতে তুলেছি চাবুক মুখপুড়িটা তাকাচ্ছে, দ্যাখ। বলছে, আ মর মিন্‌সে- ও কিছু নয়, বুঝ্‌লি না রে হিংসে, হিংসে, হিংসে।।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
চিন্তামূলক
বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতে হায়! হায় ! লোকটার ইহকাল পরকাল গেল ! অথচ আর একটু নীচে হাত দিলেই সে পেতো আলাদ্বীনের আশ্চর্য প্রদীপ, তার হৃদয় ! লোকটা জানলোই না ! তার কড়ি গাছে কড়ি হল । লক্ষ্মী এল রণ-পায়ে দেয়াল দিল পাহাড়া ছোটলোক হাওয়া যেন ঢুকতে না পারে ! তারপর একদিন গোগ্রাসে গিলতে গিলতে দু’আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে- কখন খসে পড়েছে তার জীবন- লোকটা জানলই না !
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার
ব্যঙ্গাত্মক
ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা। ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে ‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।‘ইংলিশ’ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ। কী লাভ বলুন বাংলা প’ড়ে? বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে? বেঙ্গলি ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না জানে দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।বাংলা আবার ভাষা নাকি, নেই কোনও ‘চার্ম’ বেঙ্গলিতে সহজ-সরল এই কথাটা লজ্জা কীসের মেনে নিতে? ইংলিশ ভেরি ফ্যান্টাসটিক হিন্দি সুইট সায়েন্টিফিক বেঙ্গলি ইজ গ্ল্যামারলেস, ওর ‘প্লেস’ এদের পাশে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।বাংলা যেন কেমন-কেমন, খুউব দুর্বল প্যানপ্যানে শুনলে বেশি গা জ্ব’লে যায়, একঘেয়ে আর ঘ্যানঘ্যানে। কীসের গরব? কীসের আশা? আর চলে না বাংলা ভাষা কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না? জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।ইংলিশ বেশ বোমবাস্টিং শব্দে ঠাসা দারুণ ভাষা বেঙ্গলি ইজ ডিসগাস্টিং, ডিসগাস্টিং সর্বনাশা। এই ভাষাতে দিবানিশি হয় শুধু ভাই ‘পি.এন.পি.সি’ এই ভাষা তাই হলেও দিশি, সবাই ভালোবাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।বাংলা ভাষা নিয়েই নাকি এংলা-প্যাংলা সবাই মুগ্ধ বাংলা যাদের মাতৃভাষা, বাংলা যাদের মাতৃদুগ্ধ মায়ের দুধের বড়ই অভাব কৌটোর দুধ খাওয়াই স্বভাব ওই দুধে তেজ-তাকত হয় না, বাংলাও তাই হাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।বিদেশে কী বাংলা চলে? কেউ বোঝে না বাংলা কথা বাংলা নিয়ে বড়াই করার চেয়েও ভালো নিরবতা। আজ ইংলিশ বিশ্বভাষা বাংলা ফিনিশ, নিঃস্ব আশা বাংলা নিয়ে আজকাল কেউ সুখের স্বর্গে ভাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।শেক্সপীয়র, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী বা কীটস বা বায়রন ভাষা ওদের কী বলিষ্ঠ, শক্ত-সবল যেন আয়রন কাজী নজরুল- রবীন্দ্রনাথ ওদের কাছে তুচ্ছ নেহাত মাইকেল হেরে বাংলায় ফেরে, আবেগে-উচছ্বাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা।
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার
ব্যঙ্গাত্মক
ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা। ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে ‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না। ‘ইংলিশ’ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ। কী লাভ বলুন বাংলা প’ড়ে? বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে? বেঙ্গলি ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না জানে দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না। বাংলা আবার ভাষা নাকি, নেই কোনও ‘চার্ম’ বেঙ্গলিতে সহজ-সরল এই কথাটা লজ্জা কীসের মেনে নিতে? ইংলিশ ভেরি ফ্যান্টাসটিক হিন্দি সুইট সায়েন্টিফিক বেঙ্গলি ইজ গ্ল্যামারলেস, ওর ‘প্লেস’ এদের পাশে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না। বাংলা যেন কেমন-কেমন, খুউব দুর্বল প্যানপ্যানে শুনলে বেশি গা জ্ব’লে যায়, একঘেয়ে আর ঘ্যানঘ্যানে। কীসের গরব? কীসের আশা? আর চলে না বাংলা ভাষা কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না? জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না। ইংলিশ বেশ বোমবাস্টিং শব্দে ঠাসা দারুণ ভাষা বেঙ্গলি ইজ ডিসগাস্টিং, ডিসগাস্টিং সর্বনাশা। এই ভাষাতে দিবানিশি হয় শুধু ভাই ‘পি.এন.পি.সি’ এই ভাষা তাই হলেও দিশি, সবাই ভালোবাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা। বাংলা ভাষা নিয়েই নাকি এংলা-প্যাংলা সবাই মুগ্ধ বাংলা যাদের মাতৃভাষা, বাংলা যাদের মাতৃদুগ্ধ মায়ের দুধের বড়ই অভাব কৌটোর দুধ খাওয়াই স্বভাব ওই দুধে তেজ-তাকত হয় না, বাংলাও তাই হাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা। বিদেশে কী বাংলা চলে? কেউ বোঝে না বাংলা কথা বাংলা নিয়ে বড়াই করার চেয়েও ভালো নিরবতা। আজ ইংলিশ বিশ্বভাষা বাংলা ফিনিশ, নিঃস্ব আশা বাংলা নিয়ে আজকাল কেউ সুখের স্বর্গে ভাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা। শেক্সপীয়র, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী বা কীটস বা বায়রন ভাষা ওদের কী বলিষ্ঠ, শক্ত-সবল যেন আয়রন কাজী নজরুল- রবীন্দ্রনাথ ওদের কাছে তুচ্ছ নেহাত মাইকেল হেরে বাংলায় ফেরে, আবেগে-উচছ্বাসে না জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
হে সূর্য! শীতের সূর্য! হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায় আমরা থাকি, যেমন প্রতীক্ষা ক'রে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ, ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে। হে সূর্য, তুমি তো জানো, আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব! সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে, এক-টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে, কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই! সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী। ঘর ছেড়ে আমরা এদিক ওদিকে যাই এক-টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়। হে সুর্য! তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে উত্তাপ আর আলো দিও, আর উত্তাপ দিও, রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে। হে সূর্য তুমি আমাদের উত্তাপ দিও শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড, তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হব! তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা, তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে। আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা, সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা। জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়া, পচা জল আর মশায় অহংকারী নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া। এ গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে, গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস এ গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে। রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ; বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত। দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে, কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে। রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে, কেমন ক'রে সে আকালেতে গতবারে, চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে। এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে, সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীরা কানে একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে। হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে, ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে, সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
হে তারুণ্য, জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ অমৃতের স্পর্শ চায়; অন্ধকারময় ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি’ উদ্দাম গতিতে বেদনা-বিদ্যুৎ-শিখা জ্বালাময় আত্মার আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী আপনারে দগ্ধ করে প্রচণ্ড বিস্ময়ে। জীবনের প্রতি পদপে তাই বুঝি ব্যাথাবিদ্ধ বিষণ্ণ বিদায়ে। রক্তময় দ্বিপ্রহরে অনাগত সন্ধ্যার আভাসে তোমার অক্ষয় বীজ অঙ্কুরিত যবে বিষ-মগ্ন রাত্রিবেলা কালের হিংস্রতা কণ্ঠরোধ করে অবিশ্বাসে। অগ্নিময় দিনরাত্রি মোর; আমি যে প্রভাতসূর্য স্পর্শহীন অন্ধকারে চৈতন্যের তীরে উন্মাদ, সন্ধান করি বিশ্বের বন্যায় সৃষ্টির প্রথম সুর। বজ্রের ঝংকারে প্রচণ্ড ধ্বংসের বার্তা আমি যেন পাই। মুক্তির পুলক-লুব্ধ বেগে একী মোর প্রথম স্পন্দন! আমার বক্ষের মাঝে প্রভাতের অস্ফুট কাকলি, হে তারুণ্য, রক্তে মোর আজিকার বিদ্যুৎ-বিদায় আমার প্রাণের কণ্ঠে দিয়ে গেল গান; বক্ষে মোর পৃথিবীর সুর। উচ্ছ্বসিত প্রাণে মোর রোমাঞ্চিত আদিম উল্লাস। আমি যেন মৃত্যুর প্রতীক। তাণ্ডবের সুর যেন নৃত্যময় প্রতি অঙ্গে মোর, সম্মুখীন সৃষ্টির আশ্বাসে। মধ্যাহ্নের ধ্যান মোর মুক্তি পেল তোমার ইঙ্গিতে। তারুণ্যের ব্যর্থ বেদনায় নিমজ্জিত দিনগুলি যাত্রা করে সম্মুখের টানে। নৈরাশ্য নিঃশ্বাসে ক্সত তোমার বিশ্বাস প্রতিদিন বৃদ্ধ হয় কালের কর্দমে। হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্ত্রী সঙ্গীত বিহীন, আকাশের স্বপ্ন মাঝে রাত্রির জিজ্ঞাসা ক্ষয় হয়ে যায়। নিভৃত ক্রন্দনে তাই পরিশ্রান্ত সংগ্রামের দিন। বহ্নিময় দিনরাত্রি চক্ষে মোর এনেছে অন্তিম। ধ্বংস হোক, লুপ্ত হোক ক্ষুদিত পৃথিবী আর সর্পিল সভ্যতা। ইতিহাস স্তুতিময় শোকের উচ্ছ্বাস! তবু আজ তারুণ্যের মুক্তি নেই, মুমূর্ষু মানব। প্রাণে মোর অজানা উত্তাপ অবিরাম মুগ্ধ করে পুষ্টিকর রক্তের সঙ্কেতে! পরিপূর্ণ সভ্যতা সঞ্চয়ে আজ যারা রক্তলোভী বর্ধিত প্রলয় অন্বেষণে, তাদের সংহার করো মৃতের মিনতি। অন্ধ তমিস্রার স্রোতে দূরগামী দিন আসন্ন রক্তের গন্ধে মূর্ছিত সভয়ে। চলেছে রাত্রির যাত্রী আলোকের পানে দূর হতে দূরে। বিফল তারুণ্য-স্রোতে জরাগ্রস্ত কিশলয় দিন। নিত্যকার আবর্তনে তারুণ্যের উদ্‌গত উদ্যম বার্ধক্যের বেলাভূমি ‘পরে অতর্কিতে স্তব্ধ হয়ে যায়। তবু, হায়রে পৃথিবী, তারুণ্যের মর্মকথা কে বুঝাবে তোরে! কালের গহ্বরে খেলা করে চিরকাল বিস্ফোরণহীন। স্তিমিত বসন্তবেগ নিরুদ্দেশ যাত্রা করে জোয়ারের জলে। অন্ধকার, অন্ধকার, বিভ্রান্ত বিদায়; নিশ্চিত ধ্বংসের পথে ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবী। বিকৃত বিশ্বের বুকে প্রকম্পিত ছায়া মরণের, নক্ষত্রের আহ্বানে বিহ্বল তারুণ্যের হৃৎপিণ্ডে বিদীর্ণ বিলাস। ক্ষুব্ধ অন্তরের জ্বালা, তীব্র অভিশাপ; পর্বতের বক্ষমাঝে নির্ঝর-গুঞ্জনে উৎস হতে ধবমান দিক্-চক্রবালে। সম্মুখের পানপাত্রে কী দুর্বার মোহ, তবু হায় বিপ্রলব্ধ রিক্ত হোমশিখা! মত্ততায় দিক্ভ্রান্তি, প্রাণের মঞ্জরী দক্ষিণের গুঞ্জরণে নিষ্ঠুর প্রলাপে অস্বীকার করে পৃথিবীরে। অলক্ষিতে ভূমিলগ্ন আকাশ কুসুম ঝরে যায় অস্পষ্ট হাসিতে। তারুণ্যের নীলরক্ত সহস্র সূর্যের স্রোতে মৃত্যুর স্পর্ধায় ভেসে যায় দিগন্ত আঁধারে। প্রত্যুষের কালো পাখি গোধূলির রক্তিম ছায়ায় আকাশের বার্তা নিয়ে বিনিদ্র তারার বুকে ফিরে গেল নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়। দিনের পিপাসু দৃষ্টি, রাত্রি ঝরে বিবর্ণ পথের চারিদিকে। ভয়ঙ্কর দিনরাত্রি প্রলয়ের প্রতিদ্বন্দ্বে লীন; তারুণ্যের প্রত্যেক আঘাতে কম্পমান উর্বর-উচ্ছেদ। অশরীরী আমি আজ তারুণ্যের তরঙ্গের তলে সমাহিত উত্তপ্ত শয্যায়। ক্রমাগত শতাব্দীর বন্দী আমি অন্ধকারে যেন খুঁজে ফিরি অদৃশ্য সূর্যের দীপ্তি উচ্ছিষ্ট অন্তরে। বিদায় পৃথিবী আজ, তারুণ্যের তাপে নিবদ্ধ পথিক-দৃষ্টি উদ্বুদ্ধ আকাশে, সার্থক আমার নিত্য-লুপ্ত পরিক্রমা ধ্বনিময় অনন্ত প্রান্তরে। দূরগামী আমি আজ উদ্বেলিত পশ্চাতের পানে উদাস উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি রেখে যাই সম্মুখের ডাকে। শাশ্বত ভাস্বর পথে আমার নিষিদ্ধ আয়োজন, হিমাচ্ছন্ন চক্ষে মোর জড়তার ঘন অন্ধকার। হে দেবতা আলো চাই, সূর্যের সঞ্চয় তারুণ্যের রক্তে মোর কী নিঃসীম জ্বালা! অন্ধকার অরণ্যের উদ্দাম উল্লাস লুপ্ত হোক আশঙ্কায় উদ্ধত মৃত্যুতে।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
কলম, তুমি কত না যুগ কত না কাল ধ'রে অক্ষরে অক্ষরে গিয়েছ শুধু ক্লান্তিহীন কাহিনী শুরু ক'রে। কলম, তুমি কাহিনী লেখো, তোমার কাহিনী কি দুঃখে জ্বলে তলোয়ারের মতন ঝিকিমিকি? কলম, তুমি শুধু বারংবার, আনত ক'রে ক্লান্ত ঘাড় গিয়েছ লিখে স্বপ্ন আর পুরনো কত কথা, সাহিত্যের দাসত্বের ক্ষুদিত বশ্যতা। ভগ্ন নিব, রুগ্ন দেহ, জলের মতো কালি, কলম, তুমি নিরপরাদ তবুও গালাগালি খেয়েছ আর সয়েছ কত লেখকদের ঘৃণা, কলম, তুমি চেষ্টা কর, দাঁড়াতে পার কি না। হে কলম! তুমি ইতিহাস গিয়েছ লিখে লিখে লিখে শুধু ছড়িয়ে দিয়েছ চতুর্দিকে। তবু ইতিহাস মূল্য দেবে না, এতটুকু কোন দেবে না তোমায়, জেনো ইতিহাস বড়ই কৃপণ; কত লাঞ্ছনা, খাটুনি গিয়েছে লেখকের হাতে ঘুমহীন চোখে অবিশ্রান্ত অজস্র রাতে। তোমার গোপন অশ্রু তাইতো ফসল ফলায় বহু সাহিত্য বহু কাব্যের বুকের তলায়। তবু দেখ বোধ নেই লেখকের কৃতজ্ঞতা, কেন চলবে এ প্রভুর খেয়ালে, লিখবে কথা? হে কলম! হে লেখনী! আর কত দিন ঘর্ষণে ঘর্ষণে হবে ক্ষীণ? আর কত মৌন-মূক, শব্দহীন দ্বিধান্বিত বুকে কালির কলঙ্ক চিহ্ন রেখে দেবে মুখে? আর কত আর কাটবে দুঃসহ দিন দুর্বার লজ্জার? এই দাসত্ব ঘুচে যাক, এ কলঙ্ক মুছে যাক আজ, কাজ কর- কাজ। মজুর দেখ নি তুমি? হে কলম, দেখ নি বেকার? বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার? কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস, প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস! দিন নেই, রাত্রি নেই, শ্রান্তিহীন, নেই কোনো ছুটি, একটু অবাধ্য হলে তখুনি ভ্রূকুটি; এমনি করেই কাটে দুর্ভাগা তোমার বারো মাস, কয়েকটি পয়সায় কেনা, হে কলম, তুমি ক্রীতদাস। তাই যত লেখ, তত পরিশ্রম এসে হয় জড়োঃ -কলম! বিদ্রোহ আজ! দল বেঁধে ধর্মঘট করো। লেখক স্তম্ভিত হোক, কেরানীরা ছেড়ে দিক হাঁফ, মহাজনী বন্ধ হোক, বন্ধ হোক মজুরের পাপ; উদ্বেগ-আকুল হোক প্রিয়া যত দূর দূর দেশে, কলম! বিদ্রোহ আজ, ধর্মঘট, হোক অবশেষে; আর কালো কালি নয়, রক্তে আজ ইতিহাস লিখে দেওয়ালে দেওয়ালে এঁটে, হে কলম, আনো দিকে দিকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বদেশমূলক
হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে, সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন জন্ম নিয়েছে সচেতনতার দান, গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।“হয় দান নয় প্রাণ” এ শব্দে সারা দেশ দিশাহারা, একবার মরে ভুলে গেছে আজ মৃত্যুর ভয় তারা।সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে সোনালী নয়কো, রক্তে রঙিন দান, দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বদেশমূলক
কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী; আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে বজ্রের কানাকানি। সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে শান্তি পালাল আজ। দিন ও রাত্রি হল অস্থির কাজ, আর শুধু কাজ! জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর ওঠে তার গর্জন- প্রতিশোধ, প্রতিশোধ! হাজার হাজার শহীদ ও বীর স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন। ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্‌ঝন্; প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার, অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার দ্বার ভাঙা আজ পণ; এতদিন ধ'রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্‌ঝন্। ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়, ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে আজো রোমাঞ্চকর; ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায় কে আছে আজকে ওদের ফিরায় কে ভাবে ওদের পর? ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়! নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে ওদের ফিরাব কবে? কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে কোটি মানুষের দুর্বার চাপে শৃঙ্খল গত হবে? কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে কোটি জনতার জোয়ারের জলে ভেসে যাবে কারাগার। কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার? মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি; ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে, বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে গোপনে করেছে ঋণী। মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি! হে খাতক নির্বোধ, রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ! শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো, শোনো স্বদেশের ভাই, রক্তের বিনিময় হয় হোক আমরা ওদের চাই।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
পৃথিবীময় যে সংক্রামক রোগে, আজকে সকলে ভুগছে একযোগে, এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস পাচ্ছি, এখন বইছে পুব-বাতাস। উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল, হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল, গোপনে আগুন বাড়ছে ধানক্ষেতে, বিদেশী খবরে রেখেছি কান পেতে। সভয়ে এদেশে কাটছে রাত্রিদিন, লুব্ধ বাজারে রুগ্ন স্বপ্নহীন। সহসা নেতারা রুদ্ধ- দেশ জুড়ে 'দেশপ্রেমিক' উদিত ভুঁই ফুঁড়ে। প্রথমে তাদের অন্ধ বীর মদে মেতেছি এবং ঠকেছি প্রতিপদে; দেখেছি সুবিধা নেই এ কাজ করায় একক চেষ্টা কেবলই ভুল ধরায়। এদিকে দেশের পূর্ব প্রান্তরে আবার বোমারু রক্ত পান করে, ক্ষুব্ধ জনতা আসামে, চাটগাঁয়ে, শাণিত-দ্বৈত-নগ্ন অন্যায়ে; তাদের স্বার্থ আমার স্বার্থকে, দেখছে চেতনা আজকে এক চোখে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভক্তিমূলক
তোমাকে দেখেছি আমি অবিচল, দৃপ্ত দুঃসময়ে ললাটে পড়ে নি রেখা ক্রূরতম সংকটেরও ভয়ে; তোমাকে দেখেছি আমি বিপদেও পরিহাস রত দেখেছি তোমার মধ্যে কোনো এক শক্তি সুসংহত৷ দুঃখ শোকে, বারবার অদৃষ্টের নিষ্ঠুর আঘাতে অনাহত, আত্মমগ্ন সমুদ্যত জয়ধ্বজা হাতে৷ শিল্প ও সাহিত্যরসে পরিপুষ্ট তোমার হৃদয় জীবনকে জানো তাই মান নাকো কোনো পরাজয়; দাক্ষিণ্যে সমৃদ্ধ মন যেন ব্যস্ত ভাগীরথী জল পথের দু’ধারে তার ছড়ায় যে দানের ফসল, পরোয়া রাখে না প্রতিদানের তা এমনি উদার, বহুবার মুখোমুখি হয়েছে সে বিশ্বাসহন্তার৷ তবুও অক্ষুণ্ণ মন, যতো হোক নিন্দা ও অখ্যাতি সহিষ্ণু হৃদয় জানে সর্বদা মানুষের জ্ঞাতি, তাইতো তোমার মুখে শুনে বাণপ্রস্থের ইঙ্গিত মনেতে বিস্ময় মানি, শেষে হবে বিরক্তির জিত? পৃথিবীকে চেয়ে দেখ, প্রশ্ন ও সংশয়ে থরো থরো, তোমার মুক্তির সঙ্গে বিশ্বের মুক্তিকে যোগ করো॥১৯৪৪ সালে সুকান্তর মেজদা রাখাল ভট্টাচার্য গ্রেপ্তার হন৷ তাঁর মুক্তি উপলক্ষে সুকান্ত এই কবিতাটি লেখেন৷
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে এইবার ফলাব ফসল- আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে আজ তার নির্জন বোধন। এ মাটির গর্ভে আজ আমি দেখেছি আসন্ন জন্মেরা ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতেঃ দুর্ভিরে অন্তিম কবর। আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি? (গোপন একান্ত এক পণ) এ মাটিতে জন্ম দেব আমি অগণিত পল্টন-ফসল। ঘনায় ভাঙন দুই চোখে ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে; আমার প্রতিজ্ঞা গ'ড়ে তোলে ক্ষুদিত সহস্র হাতছানি। দুয়ারে শত্রুর হানা মুঠিতে আমার দুঃসাহস। কর্ষিত মাটির পথে পথে নতুন সভ্যতা গড়ে পথ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ, আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ; মাটিতে লালিত ভীরু, শুদু আজ আকাশের ডাকে মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে। যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে, বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা। আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা; তার পর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে, ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে। সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়; শাখায় শাখায় বাঁধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়; অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে। আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে; জয়ধ্বনি কিশলয়ে; সম্বর্ধনা জানাবে সকলে। ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি, বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি। সেদিন ছায়ায় এসো; হানো যদি কঠিন কুঠারে তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে; ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।। জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ, আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ; মাটিতে লালিত ভীরু, শুদু আজ আকাশের ডাকে মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে। যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে, বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা। আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা; তার পর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে, ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে। সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়; শাখায় শাখায় বাঁধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়; অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে। আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে; জয়ধ্বনি কিশলয়ে; সম্বর্ধনা জানাবে সকলে। ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি, বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি। সেদিন ছায়ায় এসো; হানো যদি কঠিন কুঠারে তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে; ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
অনেক গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হল, ব্যর্থ বহু উদ্যম আমার, নদীতে জেলেরা ব্যর্থ, তাঁতী ঘরে, নিঃশব্দ কামার, অর্ধেক প্রাসাদ তৈরী, বন্ধ ছাদ-পেটানোর গান, চাষীর লাঙল ব্যর্থ, মাঠে নেই পরিপূর্ণ ধান। যতবার গড়ে তুলি, ততবার চকিত বন্যায়। উদ্যত সৃষ্টিকে ভাঙে পৃথিবীতে অবাধ অন্যায়। বার বার ব্যর্থ, তাই আজ মনে এসেছে বিদ্রোহ, নির্বিঘ্নে গড়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে; ছিন্নভিন্ন মোহ। আজকে ভাঙার স্বপ্ন- অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙার, বিপদ ধ্বংসেই মুক্তি, অন্য পথ দেখি নাকো আর। তাইতো তন্দ্রাকে ভাঙি, ভাঙি জীর্ণ সংস্কারের খিল, রুদ্ধ বন্দীকক্ষ ভেঙে মেলে দিই আকাশের নীল। নির্বিঘ্নে সৃষ্টিকে চাও? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে, উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে দাও চারিদিকে।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
ওখানে এখন মে-মাস তুষার-গলানো দিন, এখানে অগ্নি-ঝরা বৈশাখ নিদ্রাহীন; হয়তো ওখানে শুরু মন্থর দক্ষিণ হাওয়া; এখানে বোশেখী ঝড়ের ঝাপ্টা পশ্চাৎ দাওয়া; এখানে সেখানে ফুল ফোটে আজ তোমাদের দেশে কত রঙ, কত বিচিত্র নিশি দেখা দেয় এসে। ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে কত ছেলেমেয়ে এই বসন্তে কত উৎসব কত গান গেয়ে। এখানে তো ফুল শুকনো, ধূসর রঙের ধুলোয় খাঁ-খাঁ করে সারা দেশটা, শান্তি গিয়েছে চুলোয়। কঠিন রোদের ভয়ে ছেলেমেয়ে বন্ধ ঘরে, সব চুপচাপ; জাগবে হয়তো বোশেখী ঝড়ে। অনেক খাটুনি, অনেক লড়াই করার শেষে চারিদিকে ক্রমে ফুলের বাগান তোমাদের দেশে; এদেশে যুদ্ধ মহামারী, ভুখা জ্বলে হাড়ে হাড়ে- অগ্নিবর্ষী গ্রীষ্মের মাঠে তাই ঘুম কাড়ে বেপরোয়া প্রাণ; জমে দিকে দিকে আজ লাখে লাখে- তোমাদের দেশে মে-মাস; এখানে ঝোড়ো বৈশাখ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে ছুটে গেল যুদ্ধফেরত এক কনভয়ঃ ক্ষেপে-ওঠা পঙ্গপালের মতো রাজপথ সচকিত ক'রে আগে আগে কামান উঁচিয়ে, পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার। ইতিহাসের ছাত্র আমি. জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ইতিহাসের দিকে। সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয় ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে। সামনে ধূম-উদ্গীরণরত কামান, পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে-ধরা জনতা- কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়ালে দেখলাম, মানুষ। আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক মমতা। অনেক যুগ, অনেক অরণ্য,পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসছে; ঝল্‌সানো কঠোর মুখে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
আমি সৈনিক, হাঁটি যুগ থেকে যুগান্তরে প্রভাতী আলোয়, অনেক ক্লান্ত দিনের পরে, অজ্ঞাত এক প্রাণের ঝড়ে।বহু শতাব্দী দরে লাঞ্ছিত, পাই নি ছাড়া বহু বিদ্রোহ দিয়েছে মনের প্রান্ত নাড়া তবু হতবাক দিই নি সাড়া।আমি সৈনিক, দাসত্ব কাঁদে যুদ্ধে যেতে দেখেছি প্রাণের উচ্ছ্বাস দূরে ধানের ক্ষেতে তবু কেন যেন উঠি নি মেতে।কত সান্ত্বনা খুঁজেছি আকাশে গভীর নীলে শুধু শূন্যতা এনেছে বিষাদ এই নিখিলে মূঢ় আতঙ্ক জন-মিছিলে।ক্ষতবিক্ষত চলেছি হাজার, তবুও একা সামনে বিরাট শত্রু পাহাড় আকাশ ঠেকা কোন সূর্যের পাই নি দেখা।অনেক রক্ত দিয়েছি বিমূঢ় বিনা কারণে বিরোধী স্বার্থ করেছি পুষ্ট অযথা রণে; সঙ্গিবিহীন প্রাণধারণে।ভীরু সৈনিক করেছি দলিত কত বিক্ষোভ ইন্ধন চেয়ে যখনি জ্বলেছে কুবেরীর লোভ দিয়েছি তখনি জন-খাণ্ডব!একদা যুদ্ধ শুরু হল সারা বিশ্ব জুড়ে, জগতের যত লুণ্ঠনকারী আর মজুরে, চঞ্চল দিন ঘোড়ার খুরে।উঠি উদ্ধত প্রাণের শিখরে, চারিদিকে চাই এল আহ্বান জন-পুঞ্জের শুনি রোশনাই দেখি ক্রমাগত কাছে উৎরাই।হাতছানি দিয়ে গেল শস্যের উন্নত শীষ, জনযাত্রায় নতুন হদিশ – সহসা প্রণের সবুজে সোনার দৃঢ় উষ্ণীষ।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
নগরে ও গ্রামে জমেছে ভিড় ভগ্ননীড়,- ক্ষুদিত জনতা আজ নিবিড়। সমুদ্রে জাগে না বাড়বানল, কী উচ্ছল, তীরসন্ধানী ব্যাকুল জল। কখনো হিংস্র নিবিড় শোকে; দাঁতে ও নখে- জাগে প্রতিজ্ঞা অন্ধ চোখে। তবু সমুদ্র সীমানা রাখে, দুর্বিপাকে দিগন্তব্যাপী প্লাবন ঢাকে। আসন্ন ঝড়ো অরণ্যময় যে বিস্ময় ছড়াবে, তার কি অযথা ক্ষয়? দেশে ও বিদেশে লাগে জোয়ার, ঘোড়সোয়ার চিনে নেবে দৃঢ় লোহার, যে পথে নিত্য সূর্যোদয় আনে প্রলয়, সেই সীমান্তে বাতাস বয়; তাই প্রতীক্ষা- ঘনায় দিন স্বপ্নহীন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চিন্তামূলক
হে পৃথিবী, আজিকে বিদায় এ দুর্ভাগা চায়, যদি কভু শুধু ভুল ক’রে মনে রাখো মোরে, বিলুপ্ত সার্থক মনে হবে দুর্ভাগার! বিস্মৃত শৈশবে যে আঁদার ছিল চারিভিতে তারে কি নিভৃতে আবার আপন ক’রে পাব, ব্যর্থতার চিহ্ন এঁকে যাব, স্মৃতির মর্মরে? প্রভাতপাখির কলস্বরে যে লগ্নে করেছি অভিযান, আজ তার তিক্ত অবসান। তবু তো পথের পাশে পাশে প্রতি ঘাসে ঘাসে। লেগেছে বিস্ময়! সেই মোর জয়।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
দেবদারু গাছে রোদের ঝলক, হেমন্তে ঝরে পাতা, সারাদিন ধ’রে মুরগীরা ডাকে, এই নিয়ে দিন গাঁথা৷ রক্তের ঝড় বাইরে বইছে, ছোটে হিংসার ঢেউ, খবরে কাগজ জানায় সেকথা, চোখে দেখি নাকো কেউ॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
ভাঙন নেপথ্য পৃথিবীতে; অদৃশ্য কালের শত্রু প্রচ্ছন্ন জোয়ারে, অনেক বিপন্ন জীব ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে উন্মুখ নিঃশেষে কেড়ে নিতে, দুর্গম বিষণ্ণ শেষ শীতে। বীভৎস প্রাণের কোষে কোষে নিঃশব্দে ধ্বংসের বীজ নির্দিষ্ট আয়ুতে পশেছে আঁদার রাত্রে- প্রত্যেক স্নায়ুতে;- গোপনে নক্ষত্র গেছে খসে আরক্তিম আদিম প্রদোষে।। দিনের নীলাভ শেষ আলো জানাল আসন্ন রাত্রি দুর্লক্ষ্য সংকেতে। অনেক কাস্তের শব্দ নিঃস্ব ধানেক্ষেতে সেই রাত্রে হাওয়ায় মিলাল; দিক্প্রান্তে সূর্য চমকাল।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
পৃথিবী কি আজ শেষে নিঃস্ব ক্ষুধাতুর কাঁদে সারা বিশ্ব, চারিদিকে ঝরে পড়া রক্ত, জীবন আজকে উত্যক্ত। আজকের দিন নয় কাব্যের পরিণাম আর সম্ভাব্যের ভয় নিয়ে দিন কাটে নিত্য, জীবনে গোপন-দুর্বৃত্ত। তাইতো জীবন আজ রিক্ত, অলস হৃদয় স্বেদসিক্ত; আজকে প্রাচীর গড়া ভিন্ন পৃথিবী ছড়াবে ক্ষতচিহ্ন। অগোচরে নামে হিম-শৈত্য, কোথায় পালাবে মরু দৈত্য? জীবন যদিও উৎক্ষিপ্ত, তবু তো হৃদয় উদ্দীপ্ত, বোধহয় আগামী কোনো বন্যায়, ভেসে যাবে অনশন, অন্যায়।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি, হঠাৎ জেগে উঠেছে- সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ। দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে, ডেকেছে রৌদ্রকে, ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে, পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর। কাশ্মীরের সুন্দর মুখ কঠোর হল প্রচণ্ড সূর্যের উত্তাপে। গলে গলে পড়ছে বরফ- ঝরে ঝরে পড়ছে জীবনের স্পন্দনঃ শ্যামল আর সমতল মাটির স্পর্শ লেগেছে ওর মুখে, দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ছে ওর চুলঃ আন্দোলিত শাল, পাইন আর দেবদারুর বনে ঝড়ের পক্ষে আজ সুস্পষ্ট সম্মতি। কাশ্মীর আজ আর জমাট-বাঁধা বরফ নয়ঃ সূর্য-করোত্তাপে জাগা কঠোর গ্রীষ্মে হাজার হাজার চঞ্চল স্রোত। তাই আজ কাল-বৈশাখীর পতাকা উড়ছে ক্ষুব্ধ কাশ্মীরের উদ্দাম হাওয়ায় হাওয়ায়; দুলে দুলে উঠছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ বিরাট ব্যাপ্ত হিমালয়ের বুক।। ২ দম-আটকানো কুয়াশা তো আর নেই নেই আর সেই বিশ্রী তুষার-বৃষ্টি, সূর্য ছুঁয়েছে 'ভূস্বর্গ চঞ্চল' সহসা জেগেই চমকে উঠেছে দৃষ্টি। দুহাতে তুষার-পর্দা সরিয়ে ফেলে হঠাৎ হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে রোদকে ডেকেছে নন্দনবন পৃথিবীর বৈশাখী ঝড় দিয়েছে বরফ গুঁড়িয়ে। সুন্দর মুখ কঠোর করেছে কাশ্মীর তীক্ষ্ণ চাহনি সূর্যের উত্তাপে, গলিত বরফে জীবনের স্পন্দন শ্যামল মাটির স্পর্শে ও আজ কাঁপে। সাগর-বাতাসে উড়ছে আজ ওর চুল শাল দেবদারু পাইনের বনে ক্ষোভ, ঝড়ের পক্ষে চূড়ান্ত সম্মতি- কাশ্মীর নয়, জমাট বাঁধা বরফ। কঠোর গ্রীষ্মে সূর্যোত্তাপে জাগা- কাশ্মীর আজ চঞ্চল-স্রোত লক্ষঃ দিগ্‌দিগন্তে ছুটে ছুটে চলে দুর্বার দুঃসহ ক্রোধে ফুলে ওঠে বক্ষ। ক্ষুব্ধ হাওয়ায় উদ্দাম উঁচু কাশ্মীর কালবোশেখীর পতাকা উড়ছে নভে, দুলে দুলে ওঠে ঘুমন্ত হিমালয় বহু যুগ পরে বুঝি জাগ্রত হবে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
খে-মৃদু-হাসি অহিংস বুদ্ধের ভূমিকা চাই না। ডাক ওঠে যুদ্ধের। গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধত তবু মাথা- হাতে হাতে ফেরে দেনা-পাওনার খাতা, শোনো হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের। দুর্ভিক্ষকে তাড়াও, ওদেরও তাড়াও- সন্ধিপত্র মাড়াও, দু'পায়ে মাড়াও। তিন-পতাকার মিনতিঃ দেবে না সাড়াও? অসহ্য জ্বালা কোটি কোটি ক্রুদ্ধের! ক্ষতবিক্ষত নতুন সকাল বেলা, শেষ করব এ রক্তের হোলিখেলা, ওঠো সোজা হয়ে, পায়ে পায়ে লাগে ঠেলা দেখ, ভিড় দেখ স্বাদীনতালুব্ধের। ফাল্গুন মাস, ঝরুক জীর্ণ পাতা। গজাক নতুন পাতারা, তুলুক মাথা, নতুন দেয়াল দিকে দিকে হোক গাঁথা- জাগে বিক্ষোভে চারিপাশে ক্ষুব্ধের। হ্রদে তৃষ্ণার জল পাবে কত কাল? সম্মুখে টানে সমুদ্র উত্তালঃ তুমি কোন্ দলে? জিজ্ঞাসা উদ্দামঃ 'গুণ্ডা'র দলে আজো লেখাও নি নাম?
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
তোমাকে দিচ্ছি চরমপত্র রক্তে লেখা; অনেক দুঃখে মথিত এ শেষ বিদ্যে শেখা৷ অগণ্য চাষী-মজুর জেগেছে শহরে গ্রামে সবাই দিচ্ছি চরমপত্র একটি খামে : পবিত্র এই মাটিতে তোমার মুছে গেছে ঠাঁই, ক্ষুব্ধ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত ‘স্বাধীনতা চাই’৷ বহু উপহার দিয়েছ,—শাস্তি, ফাঁসি ও গুলি, অরাজক, মারী, মন্বন্তরে মাথার খুলি৷ তোমার যোগ্য প্রতিনিধি দেশে গড়েছে শ্মশান, নেড়েছে পর্ণকুটির, কেড়েছে ইজ্জত, মান! এতদিন বহু আঘাত হেনেছ, পেয়ে গেছ পার, ভুলি নি আমরা, শুরু হোক শেষ হিসাবটা তার, ধর্মতলাকে ভুলি নি আমরা, চট্টগ্রাম সর্বদা মনে অঙ্কুশ হানে নেই বিশ্রাম৷ বোম্বাই থেকে শহীদ জীবন আনে সংহতি, ছড়ায় রক্ত প্লাবন, এদেশে বিদ্যুৎগতি৷ আমাদের এই দলাদলি দেখে ভেবেছ তোমার আয়ু সুদীর্ঘ, যুগ বেপরোয়া গুলি ও বোমার, সে স্বপ্ন ভোলো চরমপত্র সমুখে গড়ায়, তোমাদের চোখ-রাঙানিকে আজ বলো কে ডরায়? বহু তো অগ্নি বর্ষণ করো সদলবলে, আমরা জ্বালছি আগুন নেভাও অশ্রুজলে৷ স্পর্ধা, তাইতো ভেঙে দিলে শেষ-রক্তের বাঁধ রোখো বন্যাকে, চরমপত্রে ঘোষণা : জেহাদ॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
মৃত্যুকে ভুলেছ তুমি তাই, তোমার অশান্ত মনে বিপ্লব বিরাজে সর্বদাই। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মৃত্যুকে স্মরণ ক’রো মনে, মুহূর্তে মুহূর্তে মিথ্যা জীবন ক্ষরণে, – তারি তরে পাতা সিংহাসন, রাত্রি দিন অসাধ্য সাধন। তবুও প্রচণ্ড-গতি জীবনের ধরা, নিয়ত কালের কীর্তি দিতেছে পাহারা, জন্মের প্রথম কাল হতে, আমরা বুদ্বুদ মাত্র জীবনের স্রোতে। এ পৃথিবী অত্যন্ত কুশলী, যেখানে কীর্তির নামাবলী, আমাদের স্থান নেই সেথা – আমরা শক্তের ভক্ত, নহি তো বিজেতা।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বদেশমূলক
বিগত শেষ-সংশয়; স্বপ্ন ক্রমে ছিন্ন, আচ্ছাদন উন্মোচন করেছে যত ঘৃণ্য, শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকুল কৃষ্টি, দুর্দিনের অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি। হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত, দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত। বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদয়-বৃন্তে সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে। শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য। ভুলেছে যারা সভ্য-পথ,সম্মুখীন যুদ্ধ, তাদের আজ মিলিত মুঠি করুক শ্বাসরুদ্ধ, শহীদ-খুন আগুন জ্বালে, শপথ অক্ষুণঃ এদেশ অতি শীঘ্র হবে বিদেশী-চর শূন্য। বাঁচাব দেশ, আমার দেশ, হানবো প্রতিপ, এ জনতার অন্ধ চোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য। বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী, এদেশে-জন বাহিনী তাই নিমেষে হয় তৈরী।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল মোছ উদ্‌গত অশ্রুজল যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল? ভোল ক্ষত! তুমি প্রতারিত বিন্ধ্যাচল, বোঝ নি ধূর্ত চতুর ছল, হাসে যে আকাশচারীর দল, অনাহত। শোন অবনত বিন্ধ্যাচল, তুমি নও ভীরু বিগত বল কাঁপে অবাধ্য হৃদয়দল অবিরত। কঠিন, কঠোর বিন্ধ্যাচল, অনেক ধৈর্যে আজো অটল ভাঙো বিঘ্নকেঃ করো শিকল পদাহত। বিশাল, ব্যাপ্ত বিন্ধ্যাচল, দেখ সূর্যের দর্পানল; ভুলেছে তোমার দৃঢ় কবল বাধা যত। সময় যে হল বিন্ধ্যাচল, ছেঁড় আকাশের উঁচু ত্রিপল দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল শত শত।।  (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
আজ এসেছি তোমাদের ঘরে ঘরে পৃথিবীর আদালতের পরোয়ানা নিয়ে তোমরা কি দেবে আমার প্রশ্নের কৈফিয়ৎঃ কেন মৃত্যুকীর্ণ শবে ভরলো পঞ্চাশ সাল? আজ বাহান্ন সালের সূচনায় কি তার উত্তর দেবে? জানি! স্তব্ধ হয়ে গেছে তোমাদের অগ্রগতির স্রোত, তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছ ভবিষ্যৎ আর অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উৎসাহের কয়লা। কিন্তু ভেবে দেখেছ কি? দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি! লাইনে দাঁড়ানো অভ্যেস কর নি কোনোদিন, একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মারামারি করেছ পরস্পর, তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ। কেবল বঞ্চিত বিহ্বল বিমূঢ় জিজ্ঞাসাভরা চোখে প্রত্যেকে চেয়েছ প্রত্যেকের দিকেঃ -কেন এমন হল? একদা দুর্ভিক্ষ এল ক্ষুদার মাহীন তাড়নায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস। চাল, চিনি, কয়লা, কেরোসিন? এ সব দুষ্প্রাপ্য জিনিসের জন্য চাই লাইন। কিন্তু বুঝলে না মুক্তিও দুর্লভ আর দুর্মূল্য, তারো জন্যে চাই চল্লিশ কোটির দীর্ঘ, অবিচ্ছিন্ন এক লাইন। মূর্খ তোমরা লাইন দিলেঃ কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু, রক্তয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা। ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে মুক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার। লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা, সোভিয়েট, পোল্যান্ড, ফ্রান্স রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি সর্ব প্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে। এখনো এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমান, প্রার্থী অনেক; কিন্তু পরিমিত মুক্তি। হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে এখনো তোমাদের স্থান হতে পারে- এ কথা ঘোষণা ক'রে দাও তোমাদের দেশময় প্রতিবেশীর কাছে। তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা আর প্রতীক্ষা নিয়ে হাতের মুঠোয় তৈরী রেখে প্রত্যেকের প্রাণ। আমি ইতিহাস, আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো, মনে রেখো, দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি। আর মনে ক'রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র, নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ, অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা, আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
হঠাৎ ফাল্গুনী হাওয়া ব্যাধিগ্রস্ত কলির সন্ধ্যায়ঃ নগরে নগররক্ষী পদাতিক পদধ্বনি শুনি; – দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন, – মহামারী,অন্তরে বিক্ষোভ – অবসন্ন বিলাসের সংকুচিত প্রাণ। ব্যক্তিত্বের গাত্রদাহ; রন্ধ্রহীন স্বধর্ম বিকাশ অতীতের ভগ্ননীড় এইবার সুপুষ্ট সন্ধ্যায়। বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পরে, – বৈশাখের ঝড়ে তারই অস্পষ্ট চেতনা। ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়…. নশ্বর পৌষের দিন চারিদিকে ধূর্তের সমতাঃ জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন। গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান, – প্রকাশ্য ভিক্ষার ঝুলি কালক্রমে অত্যন্ত উদার; সংক্রামিত রক্ত-রোগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতে। শোকাচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন, পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতে, দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর। বিজিগীষা? – সন্দিহান আগামী দিনেরাঃ দৃষ্টিপথ অন্ধকার, (লাল-সূর্য মুক্তির প্রতীক? -আজ তবে প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।)   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
কলকাতায় শান্তি নেই। রক্তের কলঙ্ক ডাকে মধ্যরাত্রে প্রতিটি সন্ধ্যায়। হৃৎস্পন্দনধ্বনি দ্রুত হয়ঃ মূর্ছিত শহর। এখন গ্রামের মতো সন্ধ্যা হলে জনহীন নগরের পথ; স্তম্ভিত আলোকস্তম্ভ আলো দেয় নিতান্ত সভয়ে। কোথায় দোকানপাট? কই সেই জনতার স্রোত? সন্ধ্যার আলোর বন্যা আজ আর তোলে নাকো জনতরণীর পাল শহরের পথে। ট্রাম নেই, বাস নেই- সাহসী পথিকহীন এ শহর আতঙ্ক ছড়ায়। সারি সারি বাড়ি সব মনে হয় কবরের মতো, মৃত মানুষের স্তূপ বুকে নিয়ে পড়ে আছে চুপ ক'রে সভয়ে নির্জনে। মাঝে মাঝে শব্দ হয়ঃ মিলিটারী লরীর গর্জন পথ বেয়ে ছুটে যায় বিদ্যুতের মতো সদম্ভ আক্রোশে। কলঙ্কিত কালো কালো রক্তের মতন অন্ধকার হানা দেয় অতন্দ্র শহরে; হয়তো অনেক রাত্রে পথচারী কুকুরের দল মানুষের দেখাদেখি স্বজাতিকে দেখে আস্ফালন, আক্রমণ করে। রুদ্ধশ্বাস এ শহর ছট্ফট করে সারা রাত- কখন সকাল হবে? জীয়নকাঠির স্পর্শ পাওয়া যাবে উজ্জ্বল রোদ্দুরে? সন্ধ্যা থেকে প্রত্যুষের দীর্ঘকাল প্রহরে প্রহরে সশব্দে জিজ্ঞাসা করে ঘড়ির ঘণ্টায় ধৈর্যহীন শহরের প্রাণঃ এর চেয়ে ছুরি কি নিষ্ঠুর? বাদুড়ের মতো কালো অন্ধকার ভর ক'রে গুজবের ডানা উৎকর্ণ কানের কাছে সারা রাত ঘুরপাক খায়। স্তব্ধতা কাঁপিয়ে দিয়ে কখনো বা গৃহস্থের দ্বারে উদ্ধত, অটল আর সুগম্ভীর শব্দ ওঠে কঠিন বুটের। শহর মূর্ছিত হয়ে পড়ে। জুলাই! জুলাই! আবার আসুক ফিরে আজকের কলকাতার এ প্রার্থনা; দিকে দিকে শুধু মিছিলের কোলাহল- এখনো পায়ের শব্দ যাচ্ছে শোনা। অক্টোবরকে জুলাই হতেই হবে আবার সবাই দাঁড়াব সবার পাশে, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস এবারের মতো মুছে যাক ইতিহাস।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
১৯৪০ অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন। অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন; অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো- দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো। অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার। হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে দেখেছি লিখিত- 'রক্ত খরচ' তাতে। এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম, অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম! ১৯৪৬ বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে, এত বিদ্রোহ কখনো দেখে নি কেউ, দিকে দিকে ওঠে অবাদ্যতার ঢেউ; স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব? নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট; রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট। প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত, দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত; তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি, তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি। তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হাস্যরসাত্মক
ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়, ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়! ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা, ‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হায় ফয়দা।’ ভেজাল পোষাক, ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা, ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা ভেজাল কথা- বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে, ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে। ‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে, ‘ভেজাল’ নামটা খাটি কেবল আর সকলই মিথ্যে। কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই, ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।।   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বদেশমূলক
চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন, হাঠাৎ ঘোষণা শুনেছি; আমার জীবনে শুভক্ষণ এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি। রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী। এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার, এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার। এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়, মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর, প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস- তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস; নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান; বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান। তাইতো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি, মনে হয় শুদু তোমারই মধ্যে-আমরা যে বেঁচে আছি- তোমাকে পেয়েছি অনেক মৃত্যু উত্তরণের শেষে, তোমাকে গড়ব প্রাচীর, ধ্বংস-বিকীর্ণ এই দেশে। দিক্‌দিগন্তে প্রসারিত হাতে তুমি যে পাঠালে ডাক, তাইতো আজকে গ্রামে ও নগরে স্পন্দিত লাখে লাখ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
কখনো হঠাৎ মনে হয়ঃ আমি এক আগ্নেয় পাহাড়। শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা। এক বিস্ফোরণ থেকে আর এক বিস্ফোরণের মাঝখানে আমাকে তোমরা বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছ বারংবার আমি পাথরঃ আমি তা সহ্য করেছি। মুখে আমার মৃদু হাসি, বুকে আমার পুঞ্জীভূত ফুটন্ত লাভা। সিংহের মতো আধ-বোজা চোখে আমি কেবলি দেখছিঃ মিথ্যার ভিতে কল্পনার মশলায় গড়া তোমাদের শহর, আমাকে ঘিরে রচিত উৎসবের নির্বোধ অমরাবতী, বিদ্রূপের হাসি আর বিদ্বেষের আতস-বাজি– তোমাদের নগরে মদমত্ত পূর্ণিমা। দেখ, দেখঃ ছায়াঘন, অরণ্য-নিবিড় আমাকে দেখ; দেখ আমার নিরুদ্বিগ্ন বন্যতা। তোমাদের শহর আমাকে বিদ্রূপ করুক, কুঠারে কুঠারে আমার ধৈর্যকে করুক আহত, কিছুতেই বিশ্বাস ক’রো না– আমি ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর। তোমাদের কাছে অজ্ঞাত থাক ভেতরে ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠা আমার অগ্ন্যুদ্‌গার, অরণ্যে ঢাকা অন্তর্নিহিত উত্তাপের জ্বালা। তোমার আকাশে ফ্যাকাশে প্রেত আলো, বুনো পাহাড়ে মৃদু-ধোঁয়ার অবগুণ্ঠন: ও কিছু নয়, হয়তো নতুন এক মেঘদূত। উৎসব কর, উৎসব কর– ভুলে যাও পেছনে আছে এক আগ্নেয় পাহাড়, ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার জাগ্রত বংশধর। আর, আমার দিন-পি কায় আসন্ন হোক বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু ঠিকানার সন্ধান, আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান? ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু, পথে পথে বাস করি, কখনো গাছের তলাতে কখনো পর্ণকুটির গড়ি। আমি যাযাবর, কুড়াই পথের নুড়ি, হাজার জনতা যেখানে, সেখানে আমি প্রতিদিন ঘুরি। বন্ধু, ঘরের খুঁজে পাই নাকো পথ, তাইতো পথের নুড়িতে গড়ব মজবুত ইমারত। বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না তোমাদের দেওয়া ক্ষতে, আমার ঠিকানা খোঁজ ক'রো শুধু সূর্যোদয়ের পথে। ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুশ ও চীনের কাছে, আমার ঠিকানা বহুকাল ধ'রে জেনো গচ্ছিত আছে। আমাকে কি তুমি খুঁজেছ কখনো সমস্ত দেশ জুড়ে? তবুও পাও নি? তাহলে ফিরেছ ভুল পথে ঘুরে ঘুরে। আমার হদিশ জীবনের পথে মন্বন্তর থেকে ঘুরে গিয়েছে যে কিছু দূর গিয়ে মুক্তির পথে বেঁকে। বন্ধু, কুয়াশা, সাবধান এই সূর্যোদয়ের ভোরে; পথ হারিও না আলোর আশায় তুমি একা ভুল ক'রে। বন্ধু, আজকে জানি অস্থির রক্ত, নদীর জল, নীড়ে পাখি আর সমুদ্র চঞ্চল। বন্ধু, সময় হয়েছে এখনো ঠিকানা অবজ্ঞাত বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত? আর কতদিন দুচক্ষু কচ্‌লাবে, জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু সে পথে আমাকে পাবে, জালালাবাদের পথ ধ'রে ভাই ধর্মতলার পরে, দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে। বন্ধু, আজকে বিদায়! দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো, ঠিকানা রইল, এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক'রো।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
হে নাবিক, আজ কোন্ সমুদ্রে এল মহাঝড়, তারি অদৃশ্য আঘাতে অবশ মরু-প্রান্তর। এই ভুবনের পথে চলবার শেষ-সম্বল ফুরিয়েছে, তাই আজ নিরুক্ত প্রাণ চঞ্চল।আজ জীবনেতে নেই অবসাদ! কেবল ধ্বংস, কেবল বিবাদ- এই জীবনের একী মহা উৎকর্ষ! পথে যেতে যেতে পায়ে পায়ে সংঘর্ষ। (ছুটি আজ চাই ছুটি, চাই আমাদের সকালে বিকালে দুটি নুন-ভাত, নয় আধপোড়া কিছু রুটি!) -একী অবসাদ ক্লান্তি নেমেছে বুকে, তাইতো শক্তি হারিয়েছি আজ দাঁড়াতে পারি না রুখে। বন্ধু, আমরা হারিয়েছি বুঝি প্রাণধারণের শক্তি, তাইতো নিঠুর মনে হয় এই অযথা রক্তারক্তি।এর চেয়ে ভাল মনে হয় আজ পুরনো দিন, আমাদের ভাল পুরনো, চাই না বৃথা নবীন।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বদেশমূলক
আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর- আকাশের কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল মুত্যুকাঁপানো ঝড়। আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে হাসানাবাদের ইঙ্গিত হানে প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর। আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর।। পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল, ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল; বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে- বিদেশী! তোদের যাদুদণ্ডকে এবার নেবই কেড়ে। শোন্ রে বিদেশী, শোন্ আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ। আমরা সবাই অসভ্য, বুনো- বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো একপা পিছিয়ে দু'পা এগোনোর আমরা করেছি পণ, ঠ'কে শিখলাম- তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন। আহ্বান আসে অনেক দূরের, হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের, আজ প্রয়োজন একটি সুরের একটি কঠোর স্বরঃ "দেশী কুকুর! আবার এসেছে একুশে নভেম্বর।" ডাক ওঠে, ডাক ওঠে- আবার কঠোর বহু হরতালে আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে। এ নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে।। আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়, অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম তবু বাঁচবার শপথ নিলুম কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয়! ল'ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয়।। আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারী, দাঁতে দাঁত চেপে হাতে হাত চেপে উদ্যত সারি সারি , কিছু না হলেও আবার আমরা রক্ত দিতে তো পারি? পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি। এ নভেম্বরে সংকেত পাই তারি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
অভুক্ত শ্বাপদচক্ষু নিঃস্পন্দ আঁধারে জ্বলে রাত্রিদিন। হে বন্ধু, পশ্চাতে ফেলি অন্ধ হিমগিরি অনন্ত বাধ্যক্য তব ফেলুক নিঃশ্বাস; রক্তলিপ্ত যৌবনের অন্তিম পিপাসা নিষ্ঠুর গর্জনে আজ অরণ্য ধোঁয়ায় উঠুক প্রজ্বলি'। সপ্তরথী শোনে নাকো পৃথিবীর শৈশবক্রন্দন, দেখে নাই নির্বাকের অশ্রুহীন জ্বালা। দ্বিধাহীন চণ্ডালের নির্লিপ্ত আদেশে। আদিম কুক্কুর চাহে ধরণীর বস্ত্র কেড়ে নিতে। উল্লাসে লেলিহ জিহ্‌ব লুব্ধ হায়েনারা- তবু কেন কঠিন ইস্পাত জরাগ্রস্ত সভ্যতার হৃদপিণ্ড জর্জর, ক্ষুৎপিপাসা চক্ষু মেলে মরণের উপসর্গ যেন। স্বপ্নলব্ধ উদ্যমের অদৃশ্য জোয়ারে সংঘবদ্ধ বল্মীকের দল। নেমে এসো- হে ফাল্গুনী, বৈশাখের খরতপ্ত তেজে ক্লান্ত দু'বাহু তব লৌহময় হোক বয়ে যাক শোণিতের মন্দাকিনী স্রোত; মুমূর্ষু পৃথিবী উষ্ণ, নিত্য তৃষাতুরা, নির্বাপিত আগ্নেয় পর্বত ফিরে চায় অনর্গল বিলুপ্ত আতপ। আজ কেন সূবর্ণ শৃঙ্খলে বাঁধা তব রিক্ত বজ্রপাণি, তুষারের তলে সুপ্ত অবসন্ন প্রাণ? তুমি শুধু নহ সব্যসাচী, বিস্মৃতির অন্ধকার পারে ধূসর গৈরিক নিত্য প্রান্তহীন বেলাভুমি 'পরে আত্মভোলা, তুমি ধনঞ্জয়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
মানবতাবাদী মার্শাল তিতোর প্রতিকমরেড, তুমি পাঠালে ঘোষণা দেশান্তরে, কুটিরে কুটিরে প্রতিধ্বনি,— তুলেছে মুক্তি দারুণ তুফান প্রাণের ঝড়ে তুমি শক্তির অটুট খনি৷ কমরেড, আজ কিষাণ শ্রমিক তোমার পাশে তুমি যে মুক্তি রটনা করো, তারাই সৈন্য : হাজারে হাজারে এগিয়ে আসে তোমার দু’পাশে সকলে জড়ো৷ হে বন্ধু, আজ তুমি বিদ্যুৎ অন্ধকারে সে আলোয় দ্রুত পথকে চেনা : সহসা জনতা দৃপ্ত গেরিলা—অত্যাচারে, দৃঢ় শত্রুর মেটায় দেনা৷ তোমার মন্ত্র কোণে কোণে ফেরে সংগোপনে পথচারীদের ক্ষিপ্রগতি; মেতেছে জনতা মুক্তির দ্বার উদঘাটনে : —ভীরু প্রস্তাবে অসম্মতি৷ ফসলের ক্ষেতে শত্রু রক্ত-সেচন করে, মৃত্যুর ঢেউ কারখানাতে— তবুও আকাশ ভরে আচমকে আর্তস্বরে : শত্রু নিহত স্তব্ধ রাতে৷ প্রবল পাহাড়ে গোপন যুদ্ধ সঞ্চারিত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মুখর গানে, বিপ্লবী পথে মিলেছে এবার বন্ধু তিতো : মুক্তির ফৌজ আঘাত হানে৷ শত্রু শিবিরে লাগানো আগুনে বাঁধন পোড়ে —অগ্নি ইশারা জনান্তিকে! ধ্বংসস্তূপে আজ মুক্তির পতাকা ওড়ে ভাঙার বন্যা চতুর্দিকে৷ নামে বসন্ত, পাইন বনের শাখায় শাখায় গাঢ়-সংগীত তুষারপাতে, অযুত জীবন ঘনিষ্ঠ দেহে সামনে তাকায় : মারণ-অস্ত্র সবল হাতে৷ লক্ষ জনতা রক্তে শপথ রচনা করে— ‘আমরা নই তো মৃত্যুভীত, তৈরি আমরা; যুগোশ্লাভের প্রতিটি ঘরে তুমি আছ জানি বন্ধু তিতো৷’ তোমার সেনানী পথে প্রান্তরে দোসর খোঁজে : ‘কোথায় কে আছ মুক্তিকামী?’ ক্ষিপ্ত করেছে তোমার সে ডাক আমাকেও যে তাইতো তোমার পেছনে আমি॥‘মার্শাল তিতোর প্রতি’ কবিতাটির রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪৪৷
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বদেশমূলক
এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি, সহস্র বছর ধ'রে এসে আমি জানি পরিপাটি, জানি এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা, এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা। যদিও দলিত দেশ, তবু মুক্তি কথা কয় কানে, যুগ যুগ আমরা যে বেঁচে থাকি পতনে উত্থানে! যে চাষী কেটেছে ধন, এ মাটিতে নিয়েছে কবর, এখনো আমার মধ্যে ভেসে আসে তাদের খবর। অদৃশ্য তাদের স্বপ্নের সমাচ্ছন্ন এদেশের ধূলি, মাটিতে তাদের স্পর্শ, তাদের কেমন ক'রে ভুলি? আমার সম্মুখে ক্ষেত, এ প্রান্তরে উদয়স্ত খাটি, ভালবাসি এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি। এখানে রক্তের দাগ রেখে গেছে চেঙ্গিস, তৈমুর, সে চিহ্নও মুছে দিল কত উচ্চৈঃশ্রবাদের খুর। কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, কত রাজ্য হয়েছে উজাড়, উর্বর করেছে মাটি কত দিগ্বিজয়ীর হাড়। তবুও অজেয় এই শতাব্দীগ্রথিত হিন্দুস্থান, এরই মধ্যে আমাদের বিকশিত স্বপ্নের সন্ধান। আজন্ম দেখেছি আমি অদ্ভুত নতুন এক চোখে, আমার বিশাল দেশ আসমুদ্র ভারতবর্ষকে। এ ধুলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘুর্ণিত চাবুক, এখানে নিশ্চিহ্ন হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক। এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধ'রে রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক'রে। আজকে যখন এই দিক্প্রান্তে ওঠে রক্ত-ঝড়, কোমল মাটিতে রাখে শত্রু তার পায়ের স্বাক্ষর, তখন চীৎকার ক' রক্ত ব' ওঠে 'ধিক্ ধিক্, এখনো দিল না দেখা দেহে দেহে নির্ভয় সৈনিক! দাসত্বের ছদ্মবেশ দীর্ণ ক'রে উন্মোচিত হোক একবার বিশ্বরূপ- উদ্দাম, হে অধিনায়ক!’ এদিকে উৎকর্ণ দিন, মণিপুর, কাঁপে মণিপুর চৈত্রের হাওয়ায় ক্লান্ত, উৎকণ্ঠায় অস্থির দুপুর- কবে দেখা দেবে, কবে প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ ছড়াবে ঐশ্বর্য পথে জনতার দুরন্ত যৌবন? দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে অতর্কিতে শত্রু তার পদচিহ্ন রাখে- এখনো শত্রু ক্ষমা? শত্রু কি করেছে ক্ষমা বিধ্বস্ত বাংলাকে? আজকের এ মুহূর্তে অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতা, কেন তাই মনে মনে আমি প্রশ্ন করি সেই কথা। তুমি কি ক্ষুদিত বন্ধু? তুমি কি ব্যাধিতে জরোজরো? তা হোক , তবুও তুমি আর এক মৃত্যুকে রোধ করো। বসন্ত লাগুক আজ আন্দোলিত প্রাণের শাখায়, আজকে আসুক বেগ এ নিশ্চল রথের চাকায়, এ মাটি উত্তপ্ত হোক, এ দিগন্তে আসুক বৈশাখ, ক্ষুদার আগুনে আজ শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। শত্রুরা নিয়েছে আজ দ্বিতীয় মৃত্যুর ছদ্মবেশ, তবু কেন নিরুত্তর প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা দেশ? এদেশে কৃষক আছে, এদেশে মজুর আছে জানি, এদেশে বিপ্লবী আছে, জনরাজ্যে মুক্তির সন্ধানী। দাসত্বের ধুলো ঝেড়ে তারা আজ আহ্বান পাঠাক ঘোষণা করুক তারা এ মাটিতে আসন্ন বৈশাখ। তাই এই অবরুদ্ধ স্বপ্নহীন নিবিড় বাতাসে শব্দ হয়, মনে হয় রাত্রিশেষে ওরা যেন আসে। ওরা আসে, কান পেতে আমি তার পদধ্বনি শুনি, মৃত্যুকে নিহত ক'রে ওরা আসে উজ্জ্বল আরুণি, পৃথিবী ও ইতিহাস কাঁপে আজ অসহ্য আবেগে, ওদের পায়ের স্পর্শে মাটিতে সোনার দান, রঙ লাগে মেঘে। এ আকাশ চন্দ্রাতপ, সূর্য আজ ওদের পতাকা, মুক্তির প্রচ্ছদপটে ওদের কাহিনী আজ ঢাকা, আগন্তুক ইতিহাসে ওরা আজ প্রথম অধ্যায়, ওরা আজ পলিমাটি অবিরাম রক্তের বন্যায়; ওদের দুচোখে আজ বিকশিত আমার কামনা, অভিনন্দন গাছে, পথের দুপাশে অভ্যর্থনা। ওদের পতাকা ওড়ে প্রামে গ্রামে নগরে বন্দরে, মুক্তির সংগ্রাম সেরে ওরা ফেরে স্বপ্নময় ঘরে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বদেশমূলক
হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ- “হো-হো, হো-হো, হো-হো” চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে- সিপাহী বিদ্রোহ! আগুন হয়ে সারাটা দেশ ফেটে পড়ল রাগে, ছেলে বুড়ো জেগে উঠল নব্বই সন আগেঃ একশো বছর গোলামিতে সবাই তখন ক্ষিপ্ত, বিদেশীদের রক্ত পেলে তবেই হবে তৃপ্ত! নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী- সবার হাতে অস্ত্র, নাচে বনের পশু-পক্ষী। কেবল ধনী, জমিদার, আর আগের রাজার ভক্ত যোগ দিল, তা নয়কো, দিল গরীবেরাও রক্ত! সবাই জীবন তুচ্ছ করে, মুসলমান ও হিন্দু, সবাই দিতে রাজি তাদের প্রতি রক্তবিন্দু; ইতিহাসের পাতায় তোমরা পড় কেবল মিথ্যে, বিদেশীরা ভুল বোঝাতে চায় তোমাদের চিত্তে। অত্যাচারী নয়কো তারা, অত্যাচারীর মুণ্ডু চেয়েছিল ফেলতে ছিঁড়ে জ্বালিয়ে অগ্নিকুণ্ডু। নানা জাতের নানান সেপাই গরীব এবং মূর্খঃ সবাই তারা বুঝেছিল অধীনতার দুঃখ; তাইতো তারা স্বাধীনতার প্রথম লড়াই লড়তে এগিয়েছিল, এগিয়েছিল মরণ বরণ করতে!আজকে যখন স্বাধীন হবার শেষ লড়াইয়ের ডঙ্কা উঠেছে বেজে, কোনোদিকেই নেইকো কোনো শঙ্কা; জব্বলপুরে সেপাইদেরও উঠছে বেজে বাদ্য নতুন ক’রে বিদ্রোহ আজ, কেউ নয়কো বাধ্য, তখন এঁদের স্মরণ করো, স্মরণ করো নিত্য- এঁদের নামে, এঁদের পণে শানিয়ে তোলো চিত্ত। নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী, এঁদের নামে, দৃপ্ত কিশোর, খুলবে তোমার চোখ কি?   (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চিন্তামূলক
আকাশের খাপছাড়া ক্রন্দন নাই আর আষাঢ়ের খেলনা। নিত্য যে পাণ্ডুর জড়তা সথীহারা পথিকের সঞ্চয়। রক্তের বুকভরা নিঃশ্বাস, আঁধারের বুকফাটা চীৎকার- এই নিয়ে মেতে আছি আমরা কাজ নেই হিসাবের খাতাতে। মিলাল দিনের কোনো ছায়াতে পিপাসায় আর কূল পাই না; হারানো স্মৃতির মৃদু গন্ধে প্রাণ কভু হয় নাকো চঞ্চল। মাঝে মাঝে অনাহূত আহ্বান আনে কই আলেয়ার বিত্ত? শহরের জমকালো খবরে হাজিরা খাতাটা থাকে শূন্য। আনমনে জানা পথ চলতে পাই নাকো মাদকের গন্ধ! রাত্রিদিনের দাবা চালেতে আমাদের মন কেন উষ্ণ? শ্মশানঘাটেতে ব' কখনো দেখি নাই মরীচিকা সহসা, তাই বুঝি চিরকাল আঁধারে আমরাই দেখি শুধু স্বপ্ন! বার বার কায়াহীন ছায়ারে ধরেছিনু বাহুপাশে জড়িয়ে, তাই আজ গৈরিক মাটিতে রঙিন বসন করি শুদ্ধ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চিন্তামূলক
মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা যে মুহূর্ত তোমার আমার আর অন্য সকলের মৃত্যুর সূচনা, যে মুহূর্ত এনে দিল আমার কবিতা আর তোমার আগ্রহ। এ মুহূর্তে সূর্যোদয়, এ মুহূর্তে নক্ষত্রের সভা, আর এক মুহূর্তে দেখি কালো ঝড়ে সুস্পষ্ট সংকেত। অনেক মুহূর্ত মিলে পৃথিবীর বাড়াল ফসল, মুহূর্তে মুহূর্তে তারপর সে ফসলে ঘনালো উচ্ছেদ।এমন মুহূর্ত এল আমার জীবনে, যে মুহূর্ত চিরদিন মনে রাখা যায় – অথচ আশ্চর্য কথা নতুন মুহূর্ত আর এক সে মুহূর্তে ছড়ালো বিষাদ। অনেক মুহূর্ত গেছে অনেক জীবন, যে সব মুহূর্ত মিলে আমার কাব্যের শূন্য হাতে ভরে দিত অক্ষয় সম্পদ। কিন্তু আজ উষ্ণ-দ্বিপ্রহরে আমার মুহূর্ত কাটে কাব্যরচনার দুঃসহ চেষ্টায়। হয়তো এ মুহূর্তেই অন্য কোনো কবি কাব্যের অজস্র প্রেরণায় উচ্ছ্বসিত, অথচ বাধার উদ্ধত প্রাচীর মুখোমুখি। অতএব মুহূর্তকে মনে রাখা ভাল যে মুহূর্ত বৃথা ক্ষয় হয়। গোপন মুহূর্ত আজ এক নিশ্ছিদ্র আকাশে অবিরাম পূর্বাচল খুঁজে ক্লান্ত হল অস্ফুট জীবনে, নিঃসঙ্গ স্বপ্নের আসা-যাওয়া ধূলিসাৎ – তাই আজ দেখি, প্রত্যেক মুহূর্ত অনাগত মুহূর্তের রক্তিম কপোলে তুলে ধরে সলজ্জ প্রার্থনা।।   (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মানবতাবাদী
অনেক উল্কার স্রোত বয়েছিল হঠাৎ প্রত্যুষে. বিনিদ্র তারার বে পল্লবিত মেঘ ছুঁয়েছিল রশ্মিটুকু প্রথম আবেগে। অকস্মাৎ কম্পমান অশরীরী দিন, রক্তের বাসরঘরে বিবর্ণ মৃত্যুর বীজ ছড়াল আসন্ন রাজপথে। তবু স্বপ্ন নয়ঃ গোদূলীর প্রত্যহ ছায়ায় গোপন স্বার সৃষ্টি কচ্যুত গ্রহ-উপবনেঃ দিগন্তের নিশ্চল আভাস। ভস্মীভূত শ্মশানক্রন্দনে, রক্তিম আকাশচিহ্ন সবেগে প্রস্থান করে যূথ ব্যঞ্জনায়। নিষিদ্ধ কল্পনাগুলি বন্ধ্যা তবু অলক্ষ্যে প্রসব করে অব্যক্ত যন্ত্রণা, প্রথম যৌবন তার রক্তময় রিক্ত জয়টীকা স্তম্ভিত জীবন হতে নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন ক'রে দিল। তারপরঃ প্রান্তিক যাত্রায় অতৃপ্ত রাত্রির স্বাদ, বাসর শয্যায় অসম্বৃত দীর্ঘশ্বাস বিস্মরণী সুরাপানে নিত্য নিমজ্জিত স্বগত জাহ্নবীজলে। তৃষ্ণার্ত কঙ্কাল অতীত অমৃত পানে দৃষ্টি হানে কত! সর্বগ্রাসী প্রলুব্ধ চিতার অপবাদে সভয়ে সন্ধান করে ইতিবৃত্ত দগ্ধপ্রায় মনে। প্রেতাত্মার প্রতিবিম্ব বার্ধক্যের প্রকম্পনে লীন, অনুর্বর জীবনের সূর্যোদয়ঃ ভস্মশেষ চিতা। কুজ্ঝটিকা মূর্ছা গেল আলোক-সম্পাতে, বাসনা-উদ্গ্রীব চিন্তা উন্মুখ ধ্বংসের আর্তনাদে। সরীসৃপ বন্যা যেন জড়তার স্থির প্রতিবাদ, মানবিক অভিযানে নিশ্চিন্ত উষ্ণীষ! প্রচ্ছন্ন অগ্ন্যুৎপাতে সংজ্ঞাহীন মেরুদণ্ড-দিন নিতান্ত ভঙ্গুর, তাই উদ্যত সৃষ্টির ত্রাসে কাঁপেঃ পণভারে জর্জরিত পাথেয় সংগ্রাম, চকিত হরিণদৃষ্টি অভুক্ত মনের পুষ্টিকরঃ অনাসক্ত চৈতন্যের অস্থায়ী প্রয়াণ। অথবা দৈবাৎ কোন নৈর্ব্যক্তিক আশার নিঃশ্বাস নগণ্য অঙ্গারতলে খুঁজেছে অন্তিম। রুদ্ধশ্বাস বসন্তের আদিম প্রকাশ, বিপ্রলব্ধ জনতার কুটিল বিষাক্ত প্রতিবাদে প্রত্যহ লাঞ্ছিত স্বপ্ন, স্পর্ধিত আঘাত! সুষুপ্ত প্রকোষ্ঠতলে তন্দ্রাহীন দ্বৈতাচারী নর নিজেরে বিনষ্ট করে উৎসারিত ধূমে, অদ্ভুত ব্যাধির হিমছায়া দীর্ণ করে নির্যাতিত শুদ্ধ কল্পনাকে ; সদ্যমৃত-পৃথিবীর মানুষের মতো প্রত্যেক মানবমনে একই উত্তাপ অবসাদে। তবুও শার্দূল-মন অন্ধকারে সন্ধ্যার মিছিলে প্রথম বিস্ময়দৃষ্টি মেলে ধরে বিষাক্ত বিশ্বাসে। বহ্নিমান তপ্তশিখা উন্মেষিত প্রথম স্পর্ধায়- বিষকন্যা পৃথিবীর চক্রান্তে বিহ্বল উপস্থিত প্রহরী সভ্যতা। ধূসর অগ্নির পিণ্ডঃ উত্তাপবিহীন স্তিমিত মত্ততাগুলি স্তব্ধ নীহারিকা, মৃত্তিকার দাত্রী অবশেষে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চিন্তামূলক
এত দিন ছিল বাঁধা সড়ক, আজ চোখে দেখি শুধু নরক! এত আঘাত কি সইবে, যদি না বাঁচি দৈবে? চারি পাশে লেগে গেছে মড়ক!বহুদিনকার উপার্জন, আজ দিতে হবে বিসর্জন। নিষ্ফল যদি পন্থা; সুতরাং ছেঁড়া কন্থা মনে হয় শ্রেয় বর্জন।।(পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হাস্যরসাত্মক
মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী, অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি; 'আ'কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার চেষ্টা হাসির ৷ তাই ভূমিকা ছড়ার ৷ 'গুপ্ত' 'গুপ্তা' হয় মেয়েদের নামে, দেখেছি অনেক চিঠি, পোস্টকার্ড, খামে ৷ সে নিয়মে যদি আজ 'ঘোষ' হয় 'ঘোষা' তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা, 'পালিত' 'পালিতা' হলে 'পাল' হবে 'পালা' নির্ঘাত বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা; 'মল্লিক' 'মল্লিকা' হলে 'দাস হলে 'দাসা' শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা; 'কর' যদি 'করা' হয়, 'ধর' হয় 'ধরা' মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা- "সরা" ৷ 'নাগ' যদি 'নাগা' হয় 'সেন'  হয় 'সেনা' বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা ৷৷