poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
আর যদি নাই আসো,ফুটন্ত জলের নভোচারী বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো, সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো তোমার অভাব বুঝি ; কে জানে হয়তো অবশেষে বিগলিত হতে পারো ; আশ্চর্য দর্শনবহু আছে নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে, গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে ।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
আমার বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি অগণিত যুবতী চলেছে। এইসব বিবাহিতা এবং অবিবাহিতা যুবতীদিগের প্রত্যেকের অন্তরে জয়পতাকা কিভাবে থাকে আমি সু ন্দর নিখুঁতভাবে দেখি তাকিয়ে তাকিয়ে ওরা যখন হাঁটেঁ বাবসে থাকে। প্রত্যেকটি যুবতীর অন্তরে জয়পতাকা প্রবেশ করেছে বহুবার, নিজের অন্তরে ঢোকা জয়পতাকাকে খুব ভালবাসে যে কোনো যুবতী। অনেক জয়পতাকা অন্তরে প্রবেশ করে তার মধ্যে যে জয়পতাকা অন্তরে আনন্দ দেয় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তাকেই বিবাহ করে অনূড়া যুবতীগণ। আমার বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রতিদিন আমি দেখি অগণিত যুবতী চলেছে।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
কবিতা বুঝিনি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক । এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে— এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে, তারকা, জোনাকি—সব ; লম্বিত গভীরহয়ে গেলে না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে অধরা জ্যোত্স্নাকে ; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি । এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
করবী তরুতে সেই আকাঙ্ক্ষিত গোলাপ ফোটে নি । এই শোকে ক্ষিপ্ত আমি ; নাকি ভ্রান্তি হয়েছে কোথাও? অবশ্য অপর কেউ, মনে হয়, মুগ্ধ হয়েছিল, সন্ধানপর্বেও দীর্ঘ, নির্নিমেষ জ্যোৎস্না দিয়ে গেছে । আমার নিদ্রার মাঝে, স্তন্যপান করার মতন ব্যবহার ক’রে বলেশিহরিত হৃদয়ে জেগেছি । হায় রে বাসি না ভালো, তবু এও ধন্যসার্থকতা, এই অভাবিত শান্তি, মূল্যায়ন, ক্ষিপ্ত শোকে ছায়া । তা না হ’লে আস্বাদিত না হবার বেদনায় মদ, হৃদয় উন্মাদ হয়, মাংসে করে আশ্রয়-সন্ধান । অখচ সুদূর এক নারী শুধু মাংস ভোজনের লোভে কারো কাছে তার চিরন্তন দ্বার খুলেছিলো, যথাকালে লবণের বিস্বাদ অভাবে ক্লিষ্ট সেও । এই পরিনাম কেউ চাই না, হে মুগ্ধ প্রীতিধারা, গলিত আগ্রহে তাই লবণ অর্থাৎ জ্যোৎস্নাকামী ।
বিনয় মজুমদার
চিন্তামূলক
শব্দ ব্রহ্ম । অর্থাৎ শব্দের আকার আছে । ‘সফেদা’ একটি শব্দ- ধ্বনি । এই শব্দের আকার সফেদা ফলটি যেমনি ঠিক তেমনি । এর শব্দতাতিবক প্রমাণ আছে । ‘আতা’ একটি শব্দ- ধ্বনি । আতা শব্দটির চেহারা ঠিক আতা ফলটির মতো । পাঠকআপনিও এইরকম নতুন শব্দ দিয়ে ধ্বনি দিয়ে নতুন ফল বানাতে পারেন। একটি নতুন শব্দ- ধ্বনি ‘হিবয়া’ । হিবয়া উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে একটি নতুন ফল দেখা যাচ্ছে ।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
তপ্ত লৌহদণ্ড জল ডোবাতে এবং সেই জল খেত নরনারীগণ, তার ফলে মানুষের রক্তাল্পতা দুর্বলতা জনিত অসুখ সেরে যেত। এইভাবে এককালে বাঁচতাম মানুষেরাএই পৃথিবীতে। তবে সবই ঠিক আছে, ঘুমোবার আগে মনেপড়ে সারা দিনের ঘটনা। মাঝরাতে বিছানায় চাঁদের জ্যোৎস্না এসে পড়ে দূর থেকে। শুধু চাঁদ দেখবার জন্য আমি বিছানায় উঠে বসি, চাঁদ আছে বলে ঘুমোতে বিলম্ব হয়। আমি তাড়াতাড়ি ফের যাব।
বিনয় মজুমদার
স্বদেশমূলক
পৃথিবী,সূর্য ও চাঁদ এরা জ্যোতিস্ক এবং আকাশের তারাদের কাছে চলে যাবো । আমাকে ও মনে রেখো পৃথিবীর লোক আমি খুব বেশী দেশে থাকি নি কখনো । আসলে তিনটি মাত্র দেশে আমি থেকেছি,এখন আমি থাকি বঙ্গদেশে,আমাকেও মনে রেখো বঙ্গদেশ তুমি ।
বিনয় মজুমদার
চিন্তামূলক
বর্ষাকালে আমাদের পুকুরে শাপলা হয়, শীত গ্রীষ্মে এই পুকুর সম্পূর্ণ শুশক হয়ে যায় পুকুরের নিচে ঘাস গিজায়,তখন– পুকুরে শাপলা আর থাকে না, আবার সেই বর্ষাকাল আসে তখন পুকুরটিতে জল জমে পুনরায় শাপলা গজায়। এই হলো শাপলার কাহিনী, শাপলা ফুল শাপলার পাতা ছন্দে ছন্দে দুলে যায়, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ইত্যাদি সমেত। এবং পুকুরটিও চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল, পুকুরের আনন্দ বেদনা পাতা হয়ে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে পৃথিবীতে, এই বিশ্বলোকে। শাপলার ফুলে ফুলে পাতায় কখনো মিল থাকে, মিল কখনো থাকে না।
বিনয় মজুমদার
রূপক
পাঠক মুখ দিয়ে উচ্চারণ করুন ‘নিড়িহা’ । দেখুন মাথার উপর দিয়ে একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে । এই নিড়িহা পাখিটি আমি বানিয়েছি । বহুদিন আগে ছাপা হয়ে গেছে । কবি অজয় নাগ মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল ‘দাদা , এমন অদ্ভুত একটি শব্দ বানিয়েছেন? ‘ এতদিন পরে আমি অজয়ের প্রশ্নের জবাব লিখে জানালাম । এইবার পাঠক জোরে উচ্চারণ করুন ‘পিড়িহা’ । দেখুন মাথার উপর দিয়ে একটি পাখি উড়ে যাচ্ছে । পাখিটি পাঠক বানালেন । এইবার জোরে উচ্চারণ করুন ‘ফিড়িহা’ । পাঠক দেখুন মাথার উপর দিয়ে একটা ল্যাংটো বালক দেখা যাচ্ছে । পাঠক এই বালকটিকে বানালেন । এইবার পাঠক জোরে উচ্চারণ করুন ‘বিড়িহা’ । পাঠক দেখুন মাথার উপর দিয়ে শকুনের মতো বিরাট একটি পাখিউড়ে যাচ্ছে ।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝরে যায়। দেখে কবিকুল এত ক্লেশ পায়, অথচ হেতরু, তুমি নিজে নির্বিকার, এই প্রিয় বেদনা বোঝো না। কে ক্থোয় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি। নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোনো পঙক্তি আর মনে নেই গোধূলিতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। অথবা গৃহের থেকে ভুল বহির্গত কোনো শিশু হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুণ্ঠিত শিশুকে করাঘাত ক’রে ক’রে ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে আড়ালে যেও না ; আমি এত দিনে চিনেছি কেবল অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি, ক্ষিপ্র হাত দুটি— ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা একা ব্যর্থ বারিপাত । কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে নাকি? সার্থক চক্রের আশায় শেষের পঙক্তি ভেবে ভেবে নিদ্রা চ’লে গেছে । কেবলি কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে । তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধুর ঈর্ষিত স্থান চায়, মালিকায় গাঁথা হয়ে ঘ্রাণ দিতে চায় । কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে—ক্রমাগত ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ, উত্তেজনা শির্ষ লাভ করে, আমাদের চিন্তাপাত, কসপাত ঘটে, শান্তি নামে । আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে ।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে। অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল- আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি। অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়। উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রানের উপরে। আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায় আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে। আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো , চাকা, রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো। আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
চাদেঁর গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, মেঝের উপরে দাড়িয়েঁ রয়েছে চাঁদ, প্রকাশ্য দিনের বেলা, স্পষ্ট দেখা যায় চাদেঁর গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, ঘাসগুল ছোট করে ছাঁটা। ঘাসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় গুহার উপরকার ভাঁজ। গুহার লুকোনো মুখ থেকে শুরু হয়ে সেই ভাঁজটি এসেছে বাহিরে পেটের দিকে। চাঁদ হেঁটে এসে যেই বিছানার উপরে দাঁড়াল অমনি চাঁদকে বলি,’ তেল লাগাবে না আজ’ শুনে চাঁদ বলে ‘মাখব নিশ্চয়, তবে একটু অপেক্ষা কর’ বলে সে অয়েল ক্লথ নিয়ে পেতে দিল বিছানায়, বালিশের কিছু নিচে, তারপর হেঁটে এসে চলে গেল নিকটে তাকের দিকে,একটি বোতল থেকেবাম হাতে তেল নিয়ে এল এসে তেল মাখা হাতে ভুট্টাটি চেপেধরে। যখন ধরল তার আগেই ভুট্টাটি খাড়া হয়ে গিয়েছিল। চাঁদ আমি দুজনেই মেঝেতে দাঁড়ানো মুখোমুখি এক হাতে ঘসে ঘসে ভুট্টার উপরে চাঁদ তেল মেখে দিল।
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে | শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মত কণা-কণা কী ছড়ায়, কে ছড়ায় ; শোনো, কী অস্ফুট স্বর, শোনো ‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা, এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা? নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’ তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার জানো না, এখন তবে স্বর শোনো,অবহিতহও | সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরাকত বেশি বিপদসংকুল তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ, এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী, সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে | তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু, মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!
বিনয় মজুমদার
প্রেমমূলক
এখন পাকুড়গাছে সম্পূর্ণ নূতন পাতা, তার সঙ্গে বিবাহিত এই বটগাছে লাল লাল ফল ফলে আছে। চারিদিকে চিরকাল আকাশ থাকার কথা,আছে কিনা আমি দেখে নিই। অনেক শালিক পাখি আসে রোজ এই গাছে,বট ফলগুলি তারা খুটেঁ খুটেঁ খায় বসন্তের হাওয়া বয়, শালিকের ডাক এবং পাতার শব্দ মিশে একাকার হয়ে চারদিকে ভাসে। এখন অনেক মেঘ সোনালি রূপালি কালোআকাশে আকাশে। একটি মুকুট সেই পাকুড় গাছের নিচেশাড়ি পরে দাড়িয়েঁ রয়েছে। মদের ফেনার মতো সাদা সাদা দাঁত আমি অনেক দেখেছি। জেনেছি আগুন যত্ দুরেই হোক না কেন তাকে দেখা যায়। মুকুরের বুকে ঠাঁই পেতে হলে সরাসরি সম্মুখেই চলে যেতে হয় পিছনে বা পাশে নয়; গ্রন্থ ছন্দোবদ্ধ হলে তবে আপনিই মনে থাকে মৃত্যু অবধিই থাকে; মানুষ সমুদ্রকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।
মল্লিকা সেনগুপ্ত
প্রেমমূলক
শুভম তোমাকে অনেকদিন পরে হটাত দেখেছি বইমেলার মাঠে গতজন্মের স্মৃতির মতন ভুলে যাওয়া গানের মতন ঠিক সেই মুখ, ঠিক সেই ভুরু শুধুই ঈষৎ পাক ধরা চুল চোখ মুখ নাক অল্প ফুলেছে ঠোঁটের কোনায় দামি সিগারেট শুভম, তুমি কি সত্যি শুভম!মনে পড়ে সেই কলেজ মাঠে দিনের পর দিন কাটত কীভাবে সবুজ ঘাসের মধ্যে অন্তবিহীন সোহাগ ঝগড়া! ক্রমশই যেন রাগ বাড়ছিল তুমি চাইতে ছায়ার মতন তোমার সঙ্গে উঠব বসব আমি ভাবতাম এতদিন ধরে যা কিছু শিখেছি, সবই ফেলনা! সব মুছে দেব তোমার জন্য?তুমি উত্তম-ফ্যান তাই আমি সৌমিত্রের ভক্ত হব না! তোমার গোষ্ঠী ইস্টবেঙ্গল আমি ভুলে যাব মোহনবাগান! তুমি সুচিত্রা, আমি কণিকার তোমার কপিল, আমার তো সানি! তোমার স্বপ্নে বিপ্লব তাই আমি ভোট দিতে যেতে পারব না!এমন তরজা চলত দুজনে তবুও তোমার ঘাম গন্ধ সস্তা তামাক স্বপ্নের চোখ আমাকে টানত অবুঝ মায়ায় আমার মতো জেদি মেয়েটিও তোমাকে টানতো প্রতি সন্ধ্যায় ফাঁকা ট্রাম আর গঙ্গার ঘাটেতারপর তুমি কম্পিউটার শেখার জন্য জাপান চললে আমিও পুণের ফিলমি কোর্সে প্রথম প্রথম খুব চিঠি লেখা সাত দিনে লেখা সাতটা চিঠি ক্রমশ কমল চিঠির সংখ্যা সপ্তাহে এক, মাসে একটা ন মাসে ছ মাসে, একটা বছরে একটাও না… একটাও না… ডাক বাক্সের বুক খাঁ খাঁ করে ভুলেই গেছি কতদিন হল, তুমিও ভুলেছ ঠিক ততদিনতারপর সেই পৌষের মাঠে হটাত সেদিন বইমেলাতে দূরে ফেলে আসা গ্রামের মতো তোমার মুখটা দেখতে পেলাম শুভম, তুমি কি সত্যি শুভম!
মল্লিকা সেনগুপ্ত
মানবতাবাদী
ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গমবোনা শুরু করেছিল আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন করেছিল শিশু সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে ? আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক, কে শ্রমিক নয় নতুনযন্ত্রের যারা মাসমাইনের কারিগর শুধু তারা শ্রম করে ! শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল সেই শ্রমিকগৃহিণী প্রতিদিন জল তোলে, ঘর মোছে, খাবার বানায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে রাত হলে ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে সেও কি শ্রমিক নয় ! আপনি বলুন মার্কস, শ্রম কাকে বলে ! গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে আর কমরেড শুধু যার হাতে কাস্তে হাতুড়ি ! আপনাকে মানায় না এই অবিচার কখনো বিপ্লব হলে পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে ?
মল্লিকা সেনগুপ্ত
প্রেমমূলক
শুভম তোমাকে অনেকদিন পরে হটাত দেখেছি বইমেলার মাঠে গতজন্মের স্মৃতির মতন ভুলে যাওয়া গানের মতন ঠিক সেই মুখ, ঠিক সেই ভুরু শুধুই ঈষৎ পাক ধরা চুল চোখ মুখ নাক অল্প ফুলেছে ঠোঁটের কোনায় দামি সিগারেট শুভম, তুমি কি সত্যি শুভম!মনে পড়ে সেই কলেজ মাঠে দিনের পর দিন কাটত কীভাবে সবুজ ঘাসের মধ্যে অন্তবিহীন সোহাগ ঝগড়া! ক্রমশই যেন রাগ বাড়ছিল তুমি চাইতে ছায়ার মতন তোমার সঙ্গে উঠব বসব আমি ভাবতাম এতদিন ধরে যা কিছু শিখেছি, সবই ফেলনা! সব মুছে দেব তোমার জন্য?তুমি উত্তম-ফ্যান তাই আমি সৌমিত্রের ভক্ত হব না! তোমার গোষ্ঠী ইস্টবেঙ্গল আমি ভুলে যাব মোহনবাগান! তুমি সুচিত্রা, আমি কণিকার তোমার কপিল, আমার তো সানি! তোমার স্বপ্নে বিপ্লব তাই আমি ভোট দিতে যেতে পারব না!এমন তরজা চলত দুজনে তবুও তোমার ঘাম গন্ধ সস্তা তামাক স্বপ্নের চোখ আমাকে টানত অবুঝ মায়ায় আমার মতো জেদি মেয়েটিও তোমাকে টানতো প্রতি সন্ধ্যায় ফাঁকা ট্রাম আর গঙ্গার ঘাটেতারপর তুমি কম্পিউটার শেখার জন্য জাপান চললে আমিও পুণের ফিলমি কোর্সে প্রথম প্রথম খুব চিঠি লেখা সাত দিনে লেখা সাতটা চিঠি ক্রমশ কমল চিঠির সংখ্যা সপ্তাহে এক, মাসে একটা ন মাসে ছ মাসে, একটা বছরে একটাও না… একটাও না… ডাক বাক্সের বুক খাঁ খাঁ করে ভুলেই গেছি কতদিন হল, তুমিও ভুলেছ ঠিক ততদিনতারপর সেই পৌষের মাঠে হটাত সেদিন বইমেলাতে দূরে ফেলে আসা গ্রামের মতো তোমার মুখটা দেখতে পেলাম শুভম, তুমি কি সত্যি শুভম!
মল্লিকা সেনগুপ্ত
মানবতাবাদী
ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গমবোনা শুরু করেছিল আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন করেছিল শিশু সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে ? আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক, কে শ্রমিক নয় নতুনযন্ত্রের যারা মাসমাইনের কারিগর শুধু তারা শ্রম করে ! শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল সেই শ্রমিকগৃহিণী প্রতিদিন জল তোলে, ঘর মোছে, খাবার বানায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে রাত হলে ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে সেও কি শ্রমিক নয় ! আপনি বলুন মার্কস, শ্রম কাকে বলে ! গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে আর কমরেড শুধু যার হাতে কাস্তে হাতুড়ি ! আপনাকে মানায় না এই অবিচার কখনো বিপ্লব হলে পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে ?
মল্লিকা সেনগুপ্ত
মানবতাবাদী
আশ্বিনের এক প্রাগৈতিহাসিক সকালে শ্রীরামচন্দ্র যে দুর্গার বোধন করেছিলেন স্বর্গের দেবপুরুষগণ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যে রণদেবীকে অসুর নিধনে পাঠিয়েছিলেন সেই দুর্গাই একুশ শতকে নারীর ক্ষমতায়ন। তাঁর মহাতেজ চিরজাগরুক আগুন হয়ে জ্বলে উঠুক মাটির পৃথিবীর প্রতিটি নারীর মধ্যে। হে মহামানবী, তোমাকে সালাম!মেয়েটির নাম দুর্গা সোরেন বটেক মায়ের ছিলনা অক্ষর জ্ঞান ছটেক। সর্বশিক্ষা অভিযানে পেয়ে বৃত্তি দুর্গা হয়েছে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি। সাঁওতালি গান, ইংরেজি ভাষা বাঁ হাতে কম্প্যুটারে শিখেছে ইমেল পাঠাতে। অঙ্কের স্যার ভুল হলে যোগ বিয়োগে গায়ে হাত দেয় পড়া শেখানোর সুযোগে। দুর্গা জানেনা কোনটা যৌন লাঞ্ছনা স্যারটা নোংরা বটেক!–কথাটা মানছ না? শেষে একদিন স্যারের নোংরা হাতটা মোচড়ে দিয়েছে দুর্গা, মেরেছে ঝাপটা! ওরে অর্ধেক আকাশে মাটিতে শ্যাওলা আকাশে উড়বে, হবে কল্পনা চাওলা। যদি না বিমান ভেঙে পড়ে তার দুদ্দাড় মহাকাশচারী হবেই বটেক দুর্গা।বিশ্বায়নে পণ্যায়নে খণ্ড খণ্ড মানচিত্রে বাংলা বিহার রাজস্থানে সাধারণী নমস্তুতে! পণ্যব্রতে, পত্নীব্রতে মোহমুদ্রা,ধ্বংসমুদ্রা প্রযুক্তিতে গৃহকর্মে সাধারণী নমস্তুতে! আমার দুর্গা পথে প্রান্তরে স্কুল ঘরে থাকে আমার দুর্গা বিপদে আপদে আমাকে মা বলে ডাকে। আমার দুর্গা আত্মরক্ষা শরীর পুড়বে, মন না আমার দুর্গা নারী গর্ভের রক্তমাংস কন্যা। আমার দুর্গা গোলগাল মেয়ে, আমার দুর্গা তন্বী। আমার দুর্গা কখনো ঘরোয়া, কখনো আগুন বহ্নি। আমার দুর্গা মেধাপাটেকর, তিস্তা শিতলাবাদেরা আমার দুর্গা মোম হয়ে জ্বালে অমাবস্যার আঁধেরা। আমার দুর্গা মণিপুর জুড়ে নগ্নমিছিলে হাঁটে আমার দুর্গা কাস্তে হাতুড়ি, আউশ ধানের মাঠে। আমার দুর্গা ত্রিশূল ধরেছে,স্বর্গে এবং মর্ত্যে আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে।আন্দোলনে উগ্রপন্থে, শিক্ষাব্রতে কর্মযজ্ঞে রান্নাঘরে, আঁতুড় ঘরে। মা তুঝে সালাম ! অগ্নিপথে, যুদ্ধজয়ে, লিঙ্গসাম্যে, শ্রেণিসাম্যে দাঙ্গাক্ষেত্রে, কুরুক্ষেত্রে। মা তুঝে সালাম! মা তুঝে সালাম! মা তুঝে সালাম!
রফিক আজাদ
চিন্তামূলক
নগর বিধ্বস্ত হ’লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়ি উলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে। ‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি - তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে। সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে-কাছে নেই : চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি। রক্ত-পুঁজে মাখামাখি আমাদের ভালবাসাবাসি; এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাঙ্খার খেই। যেখানে রয়েছো স্থির – মূল্যবান আসবাব, বাড়ি; কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না। শব্দহীন চ’লে যাবে জীবনের দরকারী গাড়ি - কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না। প্রোথিত বৃক্ষের মতো বদ্ধমূল আমার প্রতিভা - সাধ ছিল বেঁচে থেকে দেখে যাবো জিরাফের গ্রীবা।
রফিক আজাদ
প্রেমমূলক
এমন অনেক দিন গেছে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি, হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে- কোনো বন্ধুর জন্যে কিংবা অন্য অনেকের জন্যে হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো… এমন অনেক দিনই তো গেছে কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি- হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো একসঙ্গে বেরুবো।” এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।” হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো; -আমি অপেক্ষায় থেকেছি। যুদ্ধের অনেক আগে একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো, “জীবনে তো কিছুই দেখলি না ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে দিনাজপুরে নিয়ে যাবো কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি, বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি, পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি, গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান পেয়ে যেতেও পারিস, তৈরী থাকিস- আমি আসবো” -আমি অপেক্ষায় থেকেছি; আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর জন্যেও অপেক্ষায় থেকেছি, বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে অপেক্ষায় থেকেছি- কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো না, -প্রতীক্ষা করবো। ‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম, অভিধানে শব্দ-দু’টির তেমন কোনো আলাদা মানে নেই- কিন্তু আমরা দু’জন জানি ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক, ‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ— আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন, অনেকের প্রয়োজন মেটায়। ‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ, ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য, আমরা কি একে অপরের জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ? আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকবো- ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের জন্যে প্রতীক্ষমান, আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে, দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আমার পায়ে শিকড় গজাবে… আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না…
রফিক আজাদ
প্রেমমূলক
যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেব জীবনের ভুলগুলি যদি ভালবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘপথে তুলে নেব ঝোলাঝুলি যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষে মখমল দিন পাব যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো আর সমুদ্র সাঁতরাবো যদি ভালবাসা পাই আমার আকাশ হবে দ্রুত শরতের নীল যদি ভালবাসা পাই জীবনে আমিও পাব মধ্য অন্তমিল।
রফিক আজাদ
মানবতাবাদী
হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো, তোমার উদ্ধত আচরনে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দু:খ পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ,অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার, বলো: মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ, এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন…হে আমার প্রিয় বলপেন, দ্যাখো , চোখ তুলে তোমার সামনে কেমন সুন্দর সুবেশ পরিপাটি ভদ্রলোক খুব অভিমানে ফুলো-গালে দাঁড়িয়ে আছেন তোমার অভদ্র আচরনে, উচ্চারণ-অযোগ্য তোমার শব্দ- ব্যবহারে বড়োই আহত, সুরুচিতে তার দারুন লেগেছে তোমার ঐ অপ্রিয় কথন, ওরা কী ক’রে সইবেন বলো, অতএব, গড় হও, কুর্নিশ করো মধ্যবিত্ত সুরুচিকে: তারাই তো শাসন করছেন তোমার দেশ, তোমার কাল বলতে গেলে ওরাই তো দেশকাল; বলো হে কলম, হে বলপেন, হে আমার বর্বর প্রকাশ-ভঙিমা- এই নাকে খত দিচ্ছি আর কখনো গালমন্দ পারবো না, আপনাদের ভন্ডামিকে শ্রদ্ধা করতে শিখবো, আপনাদের অপমান হজম করার অপরিসীম ক্ষমতাকে সম্মান করবো, আর কোনোদিন এমনটি হবে না, হে মহামান্য মধ্যবিত্ত রুচিবোধ, আপনাদের মতো সব অপমান হজম ক’রে এখন থেকে, নাইট সয়েল বানিয়ে ফেলে দেবো শরীরের বাইরে- হে বন্য লেখনী, হে অমোচনীয় কালি, হে ইতর বলপেন, নত হও, নত হতে শেখো… শান্ত হও, ভদ্র হও ভদ্রলোকদের মতো আড়াল করতে শেখো অপ্রিয় সত্যকে, প্রিয় মিথ্যা বলা শিখে নাও, বিক্রি করে দাও তোমার বিবেক- উচ্চারন কোরো না এমন শব্দ, যা শুনে আহত হবেন তাঁরা- নত হও, নত হ’তে শেখো; তোমার পেছনে রয়েছে যে পবিত্র বর্বর মন ও মস্তিস্ক তাকে অনুগত দাসে পরিণত হ’তে বলো, হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো, ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্বারে ধর্না দিও- শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি…হে অনার্য লেখনী আমার, সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দাও, বলো, মহোদয়, গরীব চাষার ছেলে আমি বেয়াদবি হয়ে গেছে মাফ ক’রে দিন, ঘুমের ব্যাঘাত হয় আপনাদের এমন কর্মটি আর কক্ষনো ভুলেও করবো না ..হে আমার ককর্শ কলম, ভদ্র হও, সুমসৃণ হও- এতোদিন ধ’রে এতো যে শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ সমস্ত সমাজ তোমাকে দিলো, সব ব্যর্থ হ’য়ে গ্যালো? এতোটা বছর তোমাকে যে র‌্যাঁদা মারা হলো তবে তা কিসের জন্যে তোমার অভদ্র আচরণ সহ্য করবার জন্যে? এই চমৎকার সমাজ ও সময়ের যোগ্য হ’য়ে ওঠো, ভোঁতা হ’তে শেখো, হে অপ্রিয় উচ্চারণ, বোবা হয়ে যাও, কালা হ’য়ে যাও- প্রতবাদ কোরো না; মেনে নাও সবকিছু, মেনে নিতে শেখো, মেরুদন্ড বাঁকা ক’রে ফ্যালো, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আর চেষ্টা পর্যন্ত কোরো না, হে কলম, হে প্রিয় বলপেন, নত হও নম্র হ’তে শেখো আর স্বভাব পাল্টাও- যেমন চলছে তেমনটি চলতে দাও, খবর্দার প্রতিবাদ করবে না, কাপ করতে ব্লা হ’লে রা’টি কাড়বে না –হে অমোচনীয় কালিভরা প্রিয় কলম আমার, বড় বাড় বেড়েছে তোমার আজকাল, গত দশ বছরে তোমার আচরণ হয়েছে আপত্তিকর, আগে তো এমন তুমি কখনো ছিলে না, চমৎকার ছেলেমানুষি স্বভাব ছিলো; সামান্য জৈন্তা ছিলো তোমার লেখায়, সবাই তো মিষ্টি হেসে মেনে নিয়েছিলো, ভালোই তো ছিলো সেটা, হঠাৎ কেন যে হ’লো তোমার দুর্মতি ক্ষুধা পেলে ভাত চাও,হওয়া-খাওয়া পছন্দ করো না, শ্যামল বাংলাদেশে কর্মে মরুভূমি বিস্তারিত হচ্ছে ব’লে চীৎকার করো, পদ্য লেখা ভুলে গিয়ে প্রতিবাদ লেখো- এমনটি চলবে না, আর চলতে দেয়া যায় না…হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও, শিখে নাও শিক্ষিত শিম্পানজিদের আচরন-বিধি, অতএব, নত হও, নত হ’তে শেখো, নতজানু হও।।
রফিক আজাদ
প্রেমমূলক
যাও পত্রদূত, বোলো তার কানে-কানে মৃদু স্বরে সলজ্জ ভাষায় এই বার্তা: “কোমল পাথর, তুমি সুর্যাস্তের লাল আভা জড়িয়ে রয়েছো বরতনু; প্রকৃতি জানে না নিজে কতোটা সুন্দর বনভূমি।” যাও, বোলো তার কানে ভ্রমরসদৃশ গুঞ্জরণে, চোখের প্রশংসা কোরো, বোলো সুঠাম সুন্দর শরীরের প্রতি বাঁকে তার মরণ লুকিয়ে আছে, অন্য কেউ নয়, সে আমার আকণ্ঠ তৃষ্ণার জল: চুলের প্রশংসা কোরো, তার গুরু নিতম্ব ও বুক সবকিছু খুব ভালো, উপরন্তু, হাসিটি মধুর! যাও পত্রদূত, বোলো “হে মাধবী, কোমল পাথর, দাঁড়াও সহাস্য মুখে সুদূর মধুর মফঃস্বলে! বিনম্র ভাষায় বোলো, “উপস্থিতি খুবই তো উজ্জ্বল, যুক্তিহীন অন্ধ এক আবেগের মধ্যে, বেড়াজালে, আবদ্ধ হয়েছো উভয়েই, পরস্পর নুয়ে আছো একটি নদীর দিকে—বোলো তাকে, “অচ্ছেদ্য বন্ধন ছিঁড়ে ফেলা সহজ তো নয় মোটে, কোমল পাথর!” যাও পত্রদূত, বোলো—ভালোবাসা গ্রীষ্মের দুপুর? নীরব দৃষ্টির ভাষা-বিনিময়—দিগন্ত সুদূর?
রফিক আজাদ
প্রেমমূলক
ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি, পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা; ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া, বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি; ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি খুব করে ঝুঁকে থাকা; ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া; ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালা সামনে অবিরল কথা বলা; ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও মুখোমুখি বসে থাকা।
রফিক আজাদ
মানবতাবাদী
১. খররৌদ্রময় এই দিন— শ্যামল বাংলায় বুঝি ফের নেমে আসে খরা! খরতাপে রুদ্ধশ্বাসক্ষুদ্র এই গ্রামীণ শহর, এ রকম এই দিনে চেতনায়ও খরার প্রদাহ— নির্বাচনে হেরে-যাওয়া প্রার্থী যেন: বিরক্ত, বিব্রত; এ রকম দুঃসময়ে এল বৃষ্টির শব্দের মতো সুখকর এই পত্র—প্রাগের প্রাচীর থেকে উড়ে! কুপিত, বিব্রতকর এই রোদে খামটি খুলিনি; আমি তো অপেক্ষা জানি: এই খররৌদ্রে কখনো কি প্রিয় বান্ধবীর লেখা চিঠি খোলা চলে? অতএব, রেখে দিই যত্ন করে নিজস্ব ড্রয়ারে! ১১ জুলাই রাতে অকস্মাৎ বৃষ্টি নেমে এল যেন দীর্ঘদিন পর হঠাৎ হারিয়ে-যাওয়া আমার সন্তান ঘরে ফিরে এল। বাইরে এখন বৃষ্টি, বৃষ্টির স্নিগ্ধতা বহু দিন পর যেন আমার হূদয়ে প্রীত মধ্যযুগ ভরে দিয়ে গেল!এখনো বাইরে বৃষ্টি: জানালায় জলের প্রপাত— এই বুঝি প্রকৃষ্ট সময় যখন প্রশান্ত মন, হূদয়ে যখন আর খেদ নেই কোনো, ভারাতুর নয় আর মন, ক্রোধ নেই, ঘৃণা নেই—অবিশ্বাস্য শান্তিপ্রিয় আজ এই মাঞ্চুরীয় রাখাল বালক; হূদয়ে কোনোই শোক নেই—শোকানুভূতিও নেই— অসম্ভব শান্ত আজ—সমাহিত—আমার হূদয়! নষ্ট করে ফেলে-দেয়া জীবনের জন্য নেই কোনো শোচনা ও তাপ;—বৃষ্টির সৌগন্ধে ভরে আছে মন! মনে হচ্ছে আমার মতন সুখী কেউ নেই আর পৃথিবীর কোনো প্রান্তে ১১ জুলাই এই রাতে!২. এখন আপনার চিঠি খোলা যায় এই পরিবেশে: এ কী করেছেন! খামে ভরে কেউ কারুকে পাঠায় গোবি-সাহারার দীর্ঘ হাহাকার, চীনের প্রাচীর? স্তব্ধ হয়ে থাকি চিঠি পড়ে: সারাটা দুনিয়া জুড়ে মানুষের এত দুঃখ—এর থেকে পরিত্রাণ নেই? —বৃষ্টির প্রপাত শুনে, গাছের সবুজে চোখ রেখে শিশুদের গালে চুমো খেয়ে আমরা পারি না ফের এই দুঃখী গ্রহটির অন্তর্গত অসুখ সারাতে?
রফিক আজাদ
স্বদেশমূলক
আমাকে খুঁজো না বৃথা কাশ্মীরের স্বচ্ছ ডাল হ্রদে, সুইৎসারল্যান্ডের নয়নলোভন কোনো পর্যটন স্পটে, গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায়ও নয়, খুঁজো না ফরাসি দেশে_ পারীর কাফেতে, মধ্যরাতে; রাইন বা মাইনের তীরে, সুবিস্তীর্ণ ফলের বাগানে. . . আমাকে খুঁজো না জাম্বো জেটে, দ্রুতগামী যাত্রীবাহী জাহাজের কিংবা কোনো বৃহৎ সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজের ডেকে. . . ভুল করে অন্ধ গলি-ঘুঁজি পার হয়ে, যদি এই আঁধার প্রকোষ্ঠে আসো দেখবে উবুড় হয়ে বাংলার এই মানচিত্রে মুখ থুবড়ে প'ড়ে আছে চলি্লশ বছর. . . আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ঠেকে আছে পদ্মার ওপর এবং আমার দু'চোখের অবিরল ধারা বয়ে গিয়ে কানায়-কানায় ভ'রে দিচ্ছে সব ক'টি শুষ্ক নদী, এবং দেখতে পাবে শ্যামল শস্যের মাঠ আমার বুকের নিচে আগলে রেখেছি. . .
রফিক আজাদ
মানবতাবাদী
ভীষণ ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে অনুভূত হতে থাকে- প্রতিপলে- সর্বগ্রাসী ক্ষুধা অনাবৃষ্টি- যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে- জ্বেলে দ্যায় প্রভুত দাহন- তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবী অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়ঃ বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে আমার সামান্য দাবী পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর- ভাত চাই- এই চাওয়া সরাসরি- ঠান্ডা বা গরম সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে কোনো ক্ষতি নেই- মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবী; অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা চাইনিতোঃ নাভি নিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক; যে চায় সে নিয়ে যাক- যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও জেনে রাখোঃ আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই। যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন- সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমেঃ থাকবে না কিছু বাকি- চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে। যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে ধরো পেয়ে যাই- রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে। সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে। দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা, নদী-নালা গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।
রফিক আজাদ
মানবতাবাদী
স্পর্শকাতরতাময় এই নাম উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে, অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,- চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে খুব শক্তিশালী মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব। চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ, চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি; চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি। চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি। চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে উঠে কি? প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না-না ক’রে ওঠে? - চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে। বৃক্ষদের সাহচার্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব সুখে আছে। চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের কারু-কারু মনে, কেউ-কেউ এখনো তো পোষে বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া। চুনিয়া শুশ্রুষা জানে, চুনিয়া ব্যান্ডেজ জানে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু- চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না; চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়- শান্তি ভালোবাসে, কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে। চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না। রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ; চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত মারণাস্ত্রগুলো ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে। চুনিয়া তো চায় মানুষের তিনভাগ জলে রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক্। চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি সুগন্ধি ফুলের চাষে ভ’রে তোলা হোক। চুনিয়ারও অভিমান আছে, শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে; শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে। চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে নিশিদিন আশার পিদ্দিম জ্বেলে রাখে। চুনিয়া বিশ্বাস করে: শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।
রফিক আজাদ
প্রেমমূলক
তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে— তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে, আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনা— তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠে তুমুল তোলপাড় হূদয়ে সর্বদা… হলো না পাশাপাশি বিপুল পথ-হাঁটা, এমন কথা ছিল চলব দুজনেই জীবন-জোড়া পথ যে-পথ দিকহীন মিশেছে সম্মুখে আলোর গহ্বরে…।
রফিক আজাদ
চিন্তামূলক
জীবন একটি নদীর নাম, পিতামাতার ঐ উঁচু থেকে নেমে-আসা এক পাগলা ঝোরা— ক্রমশ নিম্নাভিমুখী; পাথুরে শৈশব ভেঙে কৈশোরের নুড়িগুলি বুকে নিয়ে বয়ে চলা পরিণামহীন এক জলধারা— গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বেলে-এঁটেল-দোআঁশ মাটি ভেঙে-ভেঙে সামনে চলা এক ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী; এই বয়ে চলা পথে বিভিন্ন বৃক্ষের সঙ্গে চলে দ্বিরালাপ; একবার এক বৃদ্ধ অশ্বথের সঙ্গে হয় তার অল্পক্ষণ স্থায়ী আদাব-সালাম বিনিময়, তাকে বলেছিলো সেই বুড়ো: “এ্যাতো তাড়াহুড়ো করো না হে, ধীরে বয়ে যাও, তোমার চলার পথে পড়বে অনেক বৃক্ষ— সবুজ, সতেজ— তাদের শাখায় আছে পাখিদের প্রিয় ঘরবাড়ি, পাখিদের শাবকেরা আছে— তাদের রয়েছে খুব নরম পালক, যেন ঐ বৃক্ষ আর তার আশ্রিতজনের কোনো ক্ষতি না হয় তোমার দ্বারা; যদি পারো ঊষর মাটির মধ্য দিয়ে বয়ে যেয়ো, সর্বদা এড়িয়ে যেয়ো পাখির নিবাস… আমি তাকে কোনো কথাই পারিনি দিতে; নদীর ধর্ম তো অবিরাম বয়ে চলা, বহমান তার স্রোতধারা ভেঙে নিয়ে চলে পাড়ের সমৃদ্ধ মাটি, গৃহস্থের আটচালা, মাটির উনুন, প্রবীণ লাঙল, ধানী মরিচের টাল, তরমুজের ক্ষেত, পোষা বেড়ালের মিউ, ফলবান বৃক্ষের বাগান, কাঁথা ও বালিশসহ সম্পন্ন সংসার। তেমন আহ্লাদ নেই তার ভেঙে ফেলতে দু’পাড়ের সোনার সংসার; সে তো খুব মনস্তাপে পোড়ে, নিরুপায় অশ্রুপূর্ণ চোখে দীর্ঘশ্বাস চেপে সে-ও দু’পাড়ে তাকায়: এক পাড়ে দাঁড়ানো নারীকে বাঁচাতে গিয়ে অপর পাড়ের নিরুদ্বিগ্ন পাখিদের বাসা তছনছ করে ছোটে, তাকে তো ছুটতে হয়, সে যে নিরুপায় তার কষ্ট থাকে তার বুকে; তারও বুক ভেঙে যেতে পারে— বুকভাঙা অভিজ্ঞতা তারও তো রয়েছে— থাকতে পারে, থাকে… সে কথা ক’জন জানে। নদীকে তোমরা জানো ভাঙচুরের সম্রাট! দু’কূল-ছাপানো তার আবেগে উদ্বেল পলি তোমাদের জীবনে কি এনে দ্যায়নি কখনো শস্যের সম্ভার?
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
কবিতা বোঝে না এই বাংলার কেউ আর দেশের অগণ্য চাষী, চাপরাশী ডাক্তার উকিল মোক্তার পুলিস দারোগা ছাত্র অধ্যাপক সব কাব্যের ব্যাপারে নীরব! স্মাগলার আলোচক সম্পাদক তরুণীর দল কবিতা বোঝে না কোনো সঙ অভিনেত্রী নটী নারী নাটের মহল কার মনে কাতোটুকু রঙ? ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে কবিতা বোঝে না! কবিতা বোঝে না আর বাংলার বাঘ কুকুর বিড়াল কালো ছাগ, খরগোস গিরগিটি চতুর বানর চক্রদার যত অজগর! কবিতা বোঝে না এই বাঙলার বনের হরিণী জঙ্গলের পশু-পাশবিনী। শকুনী গৃধিনী কাক শালিক চড়ুই ঘরে ঘরে ছুঁচো আর উই; বাংলার আকাশের যতেক খেচর কবিতা বোঝে না তারা। কবিতা বোঝে না অই বঙ্গোপসাগরের কতেক হাঙর!
আল মাহমুদ
মানবতাবাদী
সেলের তালা খোলা মাত্রই এক টুকরো রোদ এসে পড়লো ঘরের মধ্যে আজ তুমি আসবে । সারা ঘরে আনন্দের শিহরণ খেলছে । যদিও উত্তরের বাতাস হাড়েঁ কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বইছে , তবু আমিঠান্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার সেন্ট্রিকে ডেকে বললাম, আজ তুমি আসবে । সেন্ট্রি হাসতে হাসতে আমার সিগ্রেটে আগুন ধরিয়ে দিল । বলল , বারান্দায় হেটেঁ ভুক বাড়িয়ে নিন দেখবেন , বাড়ী থেকে মজাদার খাবার আসবে । দেখো , সবাই প্রথমে খাবারের কথা ভাবে । আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে । ক্ষুধার্ত মানুষ হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে । সংবাদপত্রগুলোও না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয় । রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে আমি কতদিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি চেপে ধরেছি । হায় স্বাধীনতা , অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম । আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায় । যাতে আমি আমরা উৎস খুঁজে না পাই । কিন্তু তুমি তো জানো কবিদের উৎস কি ? আমি পাষাণ কারার চৌহদ্দিতে আমার ফোয়ারাকে ফিরিয়ে আনি । শত দুর্দৈবের মধ্যেও আমরা যেমন আমাদের উৎসকে জাগিয়ে রাখতাম । চড়ুই পাখির চিৎকারে বন্দীদের ঘুম ভাঙছে । আমি বারান্দা ছেড়ে বাগানে নামলাম। এক চিলতে বাগান ভেজা পাতার পানিতে আমার চটি আর পাজামাভিজিয়ে চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ থেকে একগোছা শাদাআর হলুদ ফুল তুললাম । বাতাসে মাথা নাড়িয়ে লাল ডালিয়া গাছ আমাকে ডাকলো । তারপর গেলাম গোলাপের কাছে । জেলখানার গোলাপ , তবু কি সুন্দর গন্ধ ! আমার সহবন্দীরা কেউ ফুল ছিড়েঁ না , ছিঁড়তেও দেয় না কিন্তু আমি তোমার জন্য তোড়া বাঁধলাম । আজ আর সময় কাটতে চায়না । দাড়ি কাটলাম । বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম । ওদিকে দেয়ালের ওপাশে শহর জেগে উঠছে । গাড়ীর ভেঁপু রিক্সার ঘন্টাধ্বনি কানেআসছে । চকের হোটেলগুলোতে নিশ্চয়ই এখন মাংসেরকড়াই ফুটছে । আর মজাদার ঝোল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে গরীব খদ্দেরদের পাতে পাতে । না বাইরে এখন আকাল । মানুষ কি খেতে পায় ? দিনমজুরদের পাত কি এখন আর নেহারির ঝোলে ভরে ওঠে ? অথচ একটা অতিকায় দেয়াল কত ব্যবধানই নাআনতে পারে । আ , পাখিরা কত স্বাধীন । কেমন অবলীলায় দেয়াল পেরিয়ে যাচ্ছে জীবনে এই প্রথম আমি চড়ুই পাখির সৌভাগ্যে কাতর হলাম । আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে । সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয় । আমি কতবার তোমাকে বলেছি , দেখো মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না । এর অন্য ব্যবস্হা দরকার , দরকার সামাজিক ন্যায়ের । দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে । আ , যদি আমার কথা বুঝতে । প্রিয়তমা আমার , তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে । আর উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে । দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙ্গা মানুষেরকোলাহল । যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে । যারা ঠেলে । চালায় । হানে । ঘোরায় । ওড়ায় । পেড়ায় । আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায় । সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী । কোনদিন শুকোয় না । শোনো , তাদের কলরব । বন্দীরা জেগে উঠছে । পাশের সেলে কাশিরশব্দ আমি ঘরে ঘরে তোমার না ঘোষণা করলাম বললাম , আজ বারোটায় আমার ‘দেখা’ । খুশীতে সকলেই বিছানায় উঠে বসলো । সকলেরই আশা তুমি কোন না কোন সংবাদ নিয়ে আসবে । যেন তুমি সংবাদপত্র ! যেন তুমি আজ সকালের কাড়জের প্রধান শিরোনামশিরা! সূর্য যখন অদৃশ্য রশ্মিমালায় আমাকে দোলাতে দোলাতে মাঝ আকাশে টেনে আনলো ঠিক তখুনি তুমি এলে । জেলগেটে পৌছেঁ দেখলাম , তুমি টিফিন কেরিয়ার সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছো । হাসলে , ম্লান , সচ্ছল । কোনো কুশল প্রশ্ন হলো না । সাক্ষাৎকারের চেয়ারে বসা মাত্রই তুমিখাবার দিতে শুরু করলে । মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে , আবরা ধরপাকড় শুরু হয়েছে । আমি মাথা নাড়লাম । মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে , অমুক বিপ্লবী আর নেই আমি মাথা নামালাম । বললে , ভেবোনা , আমরা সইতে পারবো । আল্লাহ , আমাদের শক্তি দিন । তারপর আমরা পরস্পরকে দেখতে লাগলাম । যতক্ষণ না পাহারাদারদের বুটের শব্দ এসে আমাদের মাঝখানে থামলো ।
আল মাহমুদ
রূপক
শেষ হয়নি কি, আমাদের দেয়া-নেয়া? হাত তুলে আছে, পাড়ানি মেয়েটি বিদায়ের শেষ খেয়া, ডাকছে আমাকে হাঁকছে আমাকে আমিই শেষের লোক। শ্লোক শেষ হলো, অন্ত-মিলেরও শেষ। কাঁপছে নায়ের পাটাতন বুঝি ছেড়ে যেতে উৎসুক। আমি চলে গেলে এ পারে আঁধারে কেউ থাকবেনা আর সব ভেসে গেছে এবার তবে কি ভাসাবো অন্ধকার? আলো-আঁধারির এই খেলা তবে আমাকে নিয়েই শেষ আমার শরীর কাঁপছে যেমন কাঁপছে বাংলাদেশ।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
অনিচ্ছায় কতকাল মেলে রাখি দৃশ্যপায়ী তৃষ্ণার লোচন ক্লান্ত হয়ে আসে সব, নিসর্গও ঝরে যায় বহুদূর অতল আঁধারে আর কী থাকলো তবে হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন আমার কাফন আমি চাদরের মতো পরে কতদিন আন্দোলিত হবো কতকাল কতযুগ ধরে দেখবো, দেখার ভারে বৃষের স্কন্ধের মতোনুয়ে আসে রাত্রির আকাশ? কে ধারালো বর্শা হেনে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে সেই কৃষ্ণকায় ষাঁড়ের শরীরে আর সে আঘাত থেকে কী-যে ঝরে পড়ে ঠিক এখনো বুঝি না একি রক্ত, মেদ, অগ্নি কিম্বা শ্বেত আলোঝরে যায় অবিরাম অহোরাত্র প্রাণ আর কিমাকার ভূগোলে কেবলই– ঝরে যায় ঝরে যেতে থাকে। ক্রমে তাও শেষ হলে সে বন্য বৃষভ যেন গলে যায় নিসর্গশোভায়। তুমি কি সোনার কুম্ভ ঠেলে দিয়ে দৃশ্যের আড়ালে দাঁড়াও হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন? আকাশে উবুড় হয়ে ভেসে যেতে থাকে এক আলোর কলস অথচ দেখে না কেউ, ভাবে না কনককুম্ভ পানকরে কালের জঠর; ভাবে না, কারণ তারা প্রতিটি প্রভাতে দেখে ভেসে ওঠে আরেক আধার ছলকায়, ভেসে যায়, অবিশ্রাম ভেসে যেতে থাকে। কেমন নিবদ্ধ হয়ে থাকে তারা মৃত্তিকা,সন্তান আর শস্যের ওপরে পুরুষের কটিবন্ধ ধরে থাকে কত কোটি ভয়ার্ত যুবতী ঢাউস উদরে তারা কেবলই কি পেতে চায় অনির্বাণ জন্মের আঘাত। মাংসের খোড়ল থেকে একে একে উড়ে আসে আত্মার চড়ুই সমস্ত ভূগোল দ্যাখো কী বিপন্ন শব্দে ভরে যায় ভরে যায়, পূর্ণ হতে থাকে। এ বিষণ্ণ বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পংক্তিও হবো না হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন? লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া– আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া– আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া– আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।
আল মাহমুদ
স্বদেশমূলক
ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক ! শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে দুয়োর বেঁধে রাখ। কেন বাঁধবো দোর জানালা তুলবো কেন খিল ? আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে ফিরবে সে মিছিল। ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিয়ুরকে ডাক। কোথায় পাবো মতিয়ুরকে ঘুমিয়ে আছে সে ! তোরাই তবে সোনামানিক আগুন জ্বেলে দে।ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক ! শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে দুয়োর বেঁধে রাখ।কেন বাঁধবো দোর জানালা তুলবো কেন খিল ? আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে ফিরবে সে মিছিল।ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিয়ুরকে ডাক।কোথায় পাবো মতিয়ুরকে ঘুমিয়ে আছে সে ! তোরাই তবে সোনামানিক আগুন জ্বেলে দে।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
তোমাকে ডেকেছি বলে আমি নড়ে ওঠে জগত জঙ্গম পর্বতও পাঠায় সেলামি নদী ফেলে সাগরে কদম।ঝাক বেঁধে পাখি উড়ে যায় চঞ্চুতে আহার্যের স্তব কথা বলো, হাওয়ার ভাষায় সীমাহীন নীলিমা নীরব। আমিও ক্ষুধার্ত বটে আজ ওষ্ঠে জমা ব্যার্থতার নুন, জীবন কি ডানারই আওয়াজ কিংবা কোন উড়ন্ত শকুন? আজ একটু ঠাঁই দাও মেঘে সাঁকো বাঁধো শূন্যের ওপর বুকে টানো মাংসের আবেগে যেন নিজ সন্তানের জ্বর।আর নয় প্র‍েম, দাও দয়া আরোগ্যের গন্ধে ভরা হাত নিঃসীম আকাশে শ্বেত বয়া ছোঁয় যেন আমার বরাত। ভাগ্যেরও অদৃশ্যে বসে যিনি ঠিক রাখে আত্নার বাদাম। আমি ঠিক চিনি বা না চিনি তারই প্র‍তি অজস্র‍ সালাম।তোমাকে ডেকেছি বলে আমি নড়ে ওঠে জগত জঙ্গম পর্বতও পাঠায় সেলামি নদী ফেলে সাগরে কদম।ঝাক বেঁধে পাখি উড়ে যায় চঞ্চুতে আহার্যের স্তব কথা বলো, হাওয়ার ভাষায় সীমাহীন নীলিমা নীরব। আমিও ক্ষুধার্ত বটে আজ ওষ্ঠে জমা ব্যার্থতার নুন, জীবন কি ডানারই আওয়াজ কিংবা কোন উড়ন্ত শকুন? আজ একটু ঠাঁই দাও মেঘে সাঁকো বাঁধো শূন্যের ওপর বুকে টানো মাংসের আবেগে যেন নিজ সন্তানের জ্বর।আর নয় প্র‍েম, দাও দয়া আরোগ্যের গন্ধে ভরা হাত নিঃসীম আকাশে শ্বেত বয়া ছোঁয় যেন আমার বরাত। ভাগ্যেরও অদৃশ্যে বসে যিনি ঠিক রাখে আত্নার বাদাম। আমি ঠিক চিনি বা না চিনি তারই প্র‍তি অজস্র‍ সালাম।তোমাকে ডেকেছি বলে আমি নড়ে ওঠে জগত জঙ্গম পর্বতও পাঠায় সেলামি নদী ফেলে সাগরে কদম।ঝাক বেঁধে পাখি উড়ে যায় চঞ্চুতে আহার্যের স্তব কথা বলো, হাওয়ার ভাষায় সীমাহীন নীলিমা নীরব। আমিও ক্ষুধার্ত বটে আজ ওষ্ঠে জমা ব্যার্থতার নুন, জীবন কি ডানারই আওয়াজ কিংবা কোন উড়ন্ত শকুন? আজ একটু ঠাঁই দাও মেঘে সাঁকো বাঁধো শূন্যের ওপর বুকে টানো মাংসের আবেগে যেন নিজ সন্তানের জ্বর।আর নয় প্র‍েম, দাও দয়া আরোগ্যের গন্ধে ভরা হাত নিঃসীম আকাশে শ্বেত বয়া ছোঁয় যেন আমার বরাত। ভাগ্যেরও অদৃশ্যে বসে যিনি ঠিক রাখে আত্নার বাদাম। আমি ঠিক চিনি বা না চিনি তারই প্র‍তি অজস্র‍ সালাম।
আল মাহমুদ
রূপক
ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায় নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহূর্তেমুকুরে।ভয়াবহ ভূতের আর্শিতে আমাকে পশুর মতো মনে হতে থাকে। ধূসর হাওয়ায় পাশব কেশর ওড়ে, অনাচারী বিষয়ী নখর নষ্ট করে গাছপালা নারীশিশু জনতা শহর!কখনো অসৎ থাবা অকস্মাৎ উত্তোলিত হলে দেখি সেই বিম্বিত পশুর দর্পিত হিংস্র‍ চোখ আমাকেই লক্ষ করে জ্বলে; চিবুক লেহন করে, সে অলীক মহূর্তের ক্র‍োধ জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে এক শিশু আর পশুর বিরোধ।ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায় নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহূর্তেমুকুরে।ভয়াবহ ভূতের আর্শিতে আমাকে পশুর মতো মনে হতে থাকে। ধূসর হাওয়ায় পাশব কেশর ওড়ে, অনাচারী বিষয়ী নখর নষ্ট করে গাছপালা নারীশিশু জনতা শহর!কখনো অসৎ থাবা অকস্মাৎ উত্তোলিত হলে দেখি সেই বিম্বিত পশুর দর্পিত হিংস্র‍ চোখ আমাকেই লক্ষ করে জ্বলে; চিবুক লেহন করে, সে অলীক মহূর্তের ক্র‍োধ জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে এক শিশু আর পশুর বিরোধ।ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায় নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহূর্তেমুকুরে।ভয়াবহ ভূতের আর্শিতে আমাকে পশুর মতো মনে হতে থাকে। ধূসর হাওয়ায় পাশব কেশর ওড়ে, অনাচারী বিষয়ী নখর নষ্ট করে গাছপালা নারীশিশু জনতা শহর!কখনো অসৎ থাবা অকস্মাৎ উত্তোলিত হলে দেখি সেই বিম্বিত পশুর দর্পিত হিংস্র‍ চোখ আমাকেই লক্ষ করে জ্বলে; চিবুক লেহন করে, সে অলীক মহূর্তের ক্র‍োধ জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে এক শিশু আর পশুর বিরোধ।
আল মাহমুদ
প্রেমমূলক
আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি বৃক্ষের মতো অনড় নই তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব কিন্তু এখন দেখ আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও হয়ে গিয়েছি বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা বাঁশি বাজিয়ে ফুঁ ধরেছি আর চতুর্দিক থেকে কেঁদে উঠেছে রাধারা আমি কি বলেছিলাম ঘর ভেঙে আমার কাছে এসো আমি কি বলেছিলাম যমুনায় কলস ভাসিয়ে সিক্ত অঙ্গে কদমতলায় মিলিত হও ? আমি তো বলিনি লাজ লজ্জা সংসার সম্পর্কযমুনার জলে ভাসিয়ে দাও আমি তো নদীর স্বভাব জানি স্রোত বুঝি কূল ভাঙা বুঝি কিন্তু তোমাকে বুঝতে বাঁশিতে দেখ কতগুলো ছিদ্র সব ছিদ্র থেকেই ফুঁ বেরোয় আর আমার বুক থেকে রক্ত।
আল মাহমুদ
স্বদেশমূলক
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ? বরকতের রক্ত।হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে এমন লাল যে, সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে ছড়াও ফুলের বন্যা বিষাদগীতি গাইছে পথে তিতুমীরের কন্যা।চিনতে না কি সোনার ছেলে ক্ষুদিরামকে চিনতে ? রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে মুক্ত বাতাস কিনতে ?পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায় ঝাঁপ দিল যে অগ্নি, ফেব্রুয়ারির শোকের বসন পরলো তারই ভগ্নী।প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী আমায় নেবে সঙ্গে, বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ? বরকতের রক্ত।হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে এমন লাল যে, সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে ছড়াও ফুলের বন্যা বিষাদগীতি গাইছে পথে তিতুমীরের কন্যা।চিনতে না কি সোনার ছেলে ক্ষুদিরামকে চিনতে ? রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে মুক্ত বাতাস কিনতে ?পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায় ঝাঁপ দিল যে অগ্নি, ফেব্রুয়ারির শোকের বসন পরলো তারই ভগ্নী।প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী আমায় নেবে সঙ্গে, বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ? বরকতের রক্ত।হাজার যুগের সূর্যতাপে জ্বলবে এমন লাল যে, সেই লোহিতেই লাল হয়েছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে ছড়াও ফুলের বন্যা বিষাদগীতি গাইছে পথে তিতুমীরের কন্যা।চিনতে না কি সোনার ছেলে ক্ষুদিরামকে চিনতে ? রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে মুক্ত বাতাস কিনতে ?পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায় ঝাঁপ দিল যে অগ্নি, ফেব্রুয়ারির শোকের বসন পরলো তারই ভগ্নী।প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী আমায় নেবে সঙ্গে, বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।
আল মাহমুদ
শোকমূলক
ঈদের দিনে জিদ ধরি না আর কানে আমার বাজে না সেই মায়ের অলঙ্কার। কেউ বলে না খাও পাতের ভেতর ঠাণ্ডা হলো কোর্মা ও পোলাও। কোথায় যেন মন চলে যায় মেঘের ওপর ভেসে দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে মাতৃছায়া এসে। ছায়া কেবল ছায়া ছায়ার ভেতর বসত করে চিরকালের মায়া। মায়ার মোহে মুগ্ধ আমি মায়ায় ডুবে থাকি মায়ার ঘোরে বন্দী আমি নিজকে বেঁধে রাখি॥
আল মাহমুদ
সনেট
১সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি, আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি; ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন, ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি; দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি । বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না; তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা; দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা ।১সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি, আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি; ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন, ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি; দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি । বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না; তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা; দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা ।১সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি, আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি; ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন, ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি; দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি । বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না; তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা; দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা ।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
আজকাল চোখে আর অন্য কোনো স্বপ্নই জাগেনা। কবিতার কথা বুঝি, কবিতার জন্য বহুদূর একাকী গিয়েছি পদচারণার স্মৃতি সারাদিন দুঃখবোধ ঐকান্তিক সখ্যতা ভেঙেছে ত্যাগে দুঃখে ভরে আছে সামান্য পড়ার ঘর সন্তানসহ দুঃখী সঙ্গিনীর মুখ। অবোধ বাল্যেও নাকি একটা ছোট কাপও ভাঙিনি– আমার আম্মা প্রায়ই আমার বোনের কাছে শৈশব শোনান। সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাসে জ্যান্ত পাখির ডানা কবিতার ছন্দ ইত্যাদি কেন জানি বহু চেষ্টা সত্বেও আমি কিছুতেই ভাঙতে পারি না। ক্রিশেনথিমাম নাকি ইতস্তত ছড়িয়ে লাগালে অবশেষে উদ্যান বড় সুন্দর দেখায়। কই, আমি তো এখনও আমার উদ্ভিদগুলো সাজিয়ে লাগাই।
আল মাহমুদ
প্রকৃতিমূলক
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল ডাবের মতো চাদঁ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল। ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে এলেম ঘর ঘুমন্ত এই মস্ত শহর করছিলো থরথ । মিনারটাকে দেখছি যেন দাড়িয়ে আছেন কেউ, পাথরঘাটার গির্জেটা কি লাল পাথরের ঢেউ ? চৌকিদারের হাক শুনে যেই মোড় ফিরেছি বায় – কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিল আয় আয়। পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দিঘীটার পাড় এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার । আমায় দেখে কলকলিয়ে দীঘির কালো জল বললো, এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল- পকেট থেকে খুলো তোমার পদ্য লেখার ভাজঁ রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ । দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুল পাখিদের সব কাব্য হবে, কাব্য হবে- জুড়লো কলরব । কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই ।
আল মাহমুদ
শোকমূলক
কথা বলি আমি ঝরে যায় ঝরাপাতা হাওয়ায় উড়ছে তোমাদের হালখাতা। তোমাদের সাথে ব্যবধান চিরদিন হিসেব নিকেশ মেলে না তো কোনো দিন। সামনে কেবল খোলা আছে এক পথ এই পথে কবে চলে গেছে সেই রথ। রথের মেলায় এসেছিল এক ছেলে বিস্ময়ভরা চোখের পাপড়ি মেলে। ওই সেই ছেলে হারিয়ে গিয়েছে মাঠে তাকে খুঁজে ফিরি হাটেবাটে ঘাটেঘাটে। তার চোখে জ্বলে আগামী দিনের রোদ পোশাকে তো তার ছিল সম্ভ্রম বোধ সাহসের কথা বলতো সে আগেভাগে এখন সে নেই বলো তো কেমন লাগে।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
এই গতির মধ্যে মনে হয় কি যেন একটা স্থির হয়ে থাকে। আমাদের চারিদিকে যখন কোনো গতিকেই আমরা থামাতে পারছি না। সবকিছুই, না কলম না চিন্তা, এমন কি দীর্ঘজীবী বিপ্লবও মুখ থুবড়ে দ্রুত পেছনে হটে গিয়ে ক্রেনের আংটাকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে– মহামতি অনড় লেনিনের মূর্তের গলায় উপড়ে ফেলার শিকল পরাতে। তখন কেন মনে হবে এমন একটা কিছু আছে যা টলছে না? দ্যাখো তোমার মেয়েটিকে দ্যাখো, দুদিন আগেও যে কাঁটা বেছে না দিলে সরষে দেয়া পদ্মার ইলিশ পর্যন্ত মুখে তুলতে পারতো না এখন সে প্রেমের সাথে সাক্ষাতের জন্য উত্তর গোলার্ধের উত্তর প্রান্তে একাকী উড়াল দিতে টিকেট হাতে নাচছে। কত দ্রুত আমাদের হাত গলে বেরিয়ে যাওয়াশিশুরা বিশ্বের ভারসাম্যের দিকে ঘাড় নুইয়ে দৌড়ে গেল। আর আমরা ভাবলাম গতিই জীবন। গতিই যদি জীবন তবে তোমার আমার মধ্যে সুস্থিরতা কি আর অবশিষ্ট থাকে? এখন তুমি একটা চাদরে নকশা তুলছ। আর আমি দেখছি তোমার সর্বাঙ্গে লাবণ্যের ঘামে স্থিরছায়ার স্থবিরতা। তোমার আত্মার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে তোমার অমৃতের আধার দুটি। যা সন্তানের লেহনে, পানে আর তৃপ্তিতে অফুরন্ত। ও আমার অবাধ্য দৃষ্টি, তুমি স্থিরতার বেদীর ওপর এই বিশ্বময়ীকে দ্যাখো। লোকে যাকে সুখে ও যন্ত্রণায় প্রেম নাম কহে।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
আর আসবো না বলে দুধের ওপরে ভাসা সর চামোচে নিংড়ে নিয়ে চেয়ে আছি। বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া যেন সাদা স্বপ্নের চাদর বিছিয়েছে পৃথিবীতে। কেন এতো বুক দোলে? আমি আর আসবো না বলে? যদিও কাঁপছে হাত তবু ঠিক অভ্যেসের বশে লিখছি অসংখ্য নাম চেনাজানা সমস্ত কিছুর। প্রতিটি নামের শেষে, আসবো না। পাখি, আমি আসবো না। নদী আমি আসবো না। নারী, আর আসবো না, বোন। আর আসবো না বলে মিছিলের প্রথম পতাকা তুলে নিই হাতে। আর আসবো না বলে সংগঠিত করে তুলি মানুষের ভিতরে মানুষ। কথার ভেতরে কথা গেঁথে দেওয়া, কেন? আসবো না বলেই। বুকের মধ্যে বুক ধরে রাখা, কেন? আর আসবো না বলেই। আজ অতৃপ্তির পাশে বিদায়ের বিষণ্ণ রুমালে কে তুলে অক্ষর কালো, ‘আসবো না’ সুখ, আমি আসবো না। দুঃখ, আমি আসবো না। প্রেম, হে কাম, হে কবিতা আমার তোমরা কি মাইল পোস্ট না ফেরার পথের ওপর?
আল মাহমুদ
রূপক
একবার এক শহুরে কাকের দলে মিশে গিয়েছিলো গানের কোকিল পাখি মনে ছিলো তার কোন মতে কোনো ছলে শেখা যায় যদি জীবিকার নানা ফাঁকি।শুধু গান ছাড়া বুদ্ধির নানা খেলা শিখবে সে এই চালাক কাকের ভিড়ে, পার হয়ে মহানগরীর অবহেলা কন্ঠ সাধবে প্র‍ভাতের বুক চিরে।কিন্তু বাতাসে ফিরে এলো ওর গান জন জীবনের কোলাহলে ভয় পেয়ে ধুলোয় হাওয়ায় কেবলি যে অপমান কাকের কলহ আকাশের মন্দিরে। কাকেরা যে বোঝেনা গানের ভাষা রুক্ষ পালকে তীব্র‍ কন্ঠে হাসে গানের পাখির নিভে যায় কত আশা সবুজ পাহাড়ে একদিন ফিরে আসে।মহুয়ার গাছে দুঃখের নানা শ্লোক তারপর থেকে শোনা যায় রোজ রোজ কার সঙ্গীতে কাঁপে অরণ্যলোক কোন্ পক্ষীর হৃদয়ের নির্যাসে??একবার এক শহুরে কাকের দলে মিশে গিয়েছিলো গানের কোকিল পাখি মনে ছিলো তার কোন মতে কোনো ছলে শেখা যায় যদি জীবিকার নানা ফাঁকি।শুধু গান ছাড়া বুদ্ধির নানা খেলা শিখবে সে এই চালাক কাকের ভিড়ে, পার হয়ে মহানগরীর অবহেলা কন্ঠ সাধবে প্র‍ভাতের বুক চিরে।কিন্তু বাতাসে ফিরে এলো ওর গান জন জীবনের কোলাহলে ভয় পেয়ে ধুলোয় হাওয়ায় কেবলি যে অপমান কাকের কলহ আকাশের মন্দিরে। কাকেরা যে বোঝেনা গানের ভাষা রুক্ষ পালকে তীব্র‍ কন্ঠে হাসে গানের পাখির নিভে যায় কত আশা সবুজ পাহাড়ে একদিন ফিরে আসে।মহুয়ার গাছে দুঃখের নানা শ্লোক তারপর থেকে শোনা যায় রোজ রোজ কার সঙ্গীতে কাঁপে অরণ্যলোক কোন্ পক্ষীর হৃদয়ের নির্যাসে??একবার এক শহুরে কাকের দলে মিশে গিয়েছিলো গানের কোকিল পাখি মনে ছিলো তার কোন মতে কোনো ছলে শেখা যায় যদি জীবিকার নানা ফাঁকি।শুধু গান ছাড়া বুদ্ধির নানা খেলা শিখবে সে এই চালাক কাকের ভিড়ে, পার হয়ে মহানগরীর অবহেলা কন্ঠ সাধবে প্র‍ভাতের বুক চিরে।কিন্তু বাতাসে ফিরে এলো ওর গান জন জীবনের কোলাহলে ভয় পেয়ে ধুলোয় হাওয়ায় কেবলি যে অপমান কাকের কলহ আকাশের মন্দিরে। কাকেরা যে বোঝেনা গানের ভাষা রুক্ষ পালকে তীব্র‍ কন্ঠে হাসে গানের পাখির নিভে যায় কত আশা সবুজ পাহাড়ে একদিন ফিরে আসে।মহুয়ার গাছে দুঃখের নানা শ্লোক তারপর থেকে শোনা যায় রোজ রোজ কার সঙ্গীতে কাঁপে অরণ্যলোক কোন্ পক্ষীর হৃদয়ের নির্যাসে??
আল মাহমুদ
রূপক
ভয়ের ডানায় বাতাস লেগেছে মুখে শীতল সবুজ থরথর করে বুকে কাঁপছে আত্মা, আত্মার পাখি এক ‘ঝাপটানি তুলে নিজের কথাই লেখ’ পাখির কথায় পাখা মেললাম নীলে নীল এসে বুঝি আমাকেই ফেলে গিলে নীল ছাড়া দেখি চারিদিকে কিছু নেই তুমি ছাড়া, তুমি-তুমি পুরাতন সেই। চির পুরাতন কিন্তু নতুন তোমার চোখের তারা আমাকে কেবল ইশারায় করে প্রান্তরে দিশেহারা তবুও তো আমি এখনো তোমার ছায়া খুঁজে ফিরি আর ভাবি অলৌকিক মায়া মুক্তির গান গাইবে এমন কবি কই এই দেশে? কবিতার পরে কবিতাই থাকে স্বপ্নকে ভালোবেসে।
আল মাহমুদ
প্রকৃতিমূলক
বৃষ্টির ছাঁটে শিহরিত হয় দেহ কেউ বলে আমি কবি কি না সন্দেহ তবু তো কবিতা আমাকে ঘিরেই নাচে নাচুনে মেয়ের মতোই সেও কি বাঁচে? বৃষ্টির কণা ফণা ধরে আছে পথে পথ কই বলো রথ থেমে আছে ঘাটে এ খেলার মাঠে সূর্য নেমেছে পাটে। কেবল আমার মুখেই লালের তুলি তুমিও দাঁড়ালে, নাচবে কি চুল খুলি তবে শুরু করো নৃত্যের আয়োজন নাচো দিল খুলে নাচো খুলে প্রাণ-মন।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া– আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট! কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর। কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা। কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।
আল মাহমুদ
প্রকৃতিমূলক
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা আব্বা বলেন, মন দে; পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাঁপার গন্ধে। আমার কেবল ইচ্ছে জাগে নদীর কাছে থাকতে, বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে পাখির মতো ডাকতে।সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে কর্ণফুলীর কূলটায়, দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি ফেরেস্তারা উল্টায়। তখন কেবল ভাবতে থাকি কেমন করে উড়বো, কেমন করে শহর ছেড়ে সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো ! তোমরা যখন শিখছো পড়া মানুষ হওয়ার জন্য, আমি না হয় পাখিই হবো, পাখির মতো বন্য।
আল মাহমুদ
রূপক
হয়তো-বা স্বপ্ন ছিলো। ঘুমঘোরে মিথ্যার ম্যাজিক আমাকে দেখিয়ে ছিলো বাষ্পরুদ্ধ চেহারা তোমার। পাখির বিলাপে ভরা ঘোরলাগা গ্র‍ামের কুটিরে একটি বালক শুধু শুনেছিলো নদীর রোদন। এখন সে পাড়ি দেয় সপ্তসিন্ধু, দশদিকে চোখ মায়ার কাজলে ভেজা দৃষ্টি তার ক্লান্তির রুমালে মুছে নিয়ে ঘরে এসে দেখে কেউই অপেক্ষায় নেই।তার কোন দেশ নেই। নিরুপায় ভিসার বিপাকে কালেভদ্র‍ে উড়ে আসা শুষ্ক এক নদীর কিনারে। দাঁড়াও পথিক বর, পত্র‍হীন অশ্বথের শাখা নড়ে উঠে বোঝায় সে অতিথির অনাত্নীয় নয়। যদিও চুড়োয় বসে নিঃস্ব এক শুকুনী নিজেই নিজের পালক ছিঁড়ে উদরের অনল নিভায়।একটি সমাধি তাকে বাশঝাঁড়ে ইশারায় ডাকে আকস্মাৎ দৃষ্টি তার মর্মভেদী। মাটির অতলে দেখে সে চেহারা সেই বাষ্পরুদ্ধ বেদনার নদী মৃদু শব্দে ভরে গিয়ে — এতদিন কোথায় যে ছিলে শেষ অনুযোগ নিয়ে মুখে যায় মাটির মায়ায়।হয়তো-বা স্বপ্ন নয়। নয় কোন মিথ্যার ম্যাজিক একদা আমারও ছিলো দেশ, দশ, নারীর নয়ন। দেহের ভিতরে ছিলো প্র‍েম,স্বপ্ন, আত্নার আদেশ। কিন্তু আজ ভিসার বিপাকে পড়ে ফিরে আসা পাখি। খুঁজে ফেরে পত্র‍পুষ্প ভরা কোন উদ্যানের ডাল। আমার বিহনে দ্যাখো নদী শুষ্ক, গুল্মহীন মাটি কেবল উঁইয়ের ঢিবি। বৃষ্টিহীন পরাজিত মেঘ ব্র‍জ্র‍ের আওয়াজ তুলে ফিরে যায় দিগন্তের দিকে।হয়তো-বা স্বপ্ন ছিলো। ঘুমঘোরে মিথ্যার ম্যাজিক আমাকে দেখিয়ে ছিলো বাষ্পরুদ্ধ চেহারা তোমার। পাখির বিলাপে ভরা ঘোরলাগা গ্র‍ামের কুটিরে একটি বালক শুধু শুনেছিলো নদীর রোদন। এখন সে পাড়ি দেয় সপ্তসিন্ধু, দশদিকে চোখ মায়ার কাজলে ভেজা দৃষ্টি তার ক্লান্তির রুমালে মুছে নিয়ে ঘরে এসে দেখে কেউই অপেক্ষায় নেই।তার কোন দেশ নেই। নিরুপায় ভিসার বিপাকে কালেভদ্র‍ে উড়ে আসা শুষ্ক এক নদীর কিনারে। দাঁড়াও পথিক বর, পত্র‍হীন অশ্বথের শাখা নড়ে উঠে বোঝায় সে অতিথির অনাত্নীয় নয়। যদিও চুড়োয় বসে নিঃস্ব এক শুকুনী নিজেই নিজের পালক ছিঁড়ে উদরের অনল নিভায়।একটি সমাধি তাকে বাশঝাঁড়ে ইশারায় ডাকে আকস্মাৎ দৃষ্টি তার মর্মভেদী। মাটির অতলে দেখে সে চেহারা সেই বাষ্পরুদ্ধ বেদনার নদী মৃদু শব্দে ভরে গিয়ে — এতদিন কোথায় যে ছিলে শেষ অনুযোগ নিয়ে মুখে যায় মাটির মায়ায়।হয়তো-বা স্বপ্ন নয়। নয় কোন মিথ্যার ম্যাজিক একদা আমারও ছিলো দেশ, দশ, নারীর নয়ন। দেহের ভিতরে ছিলো প্র‍েম,স্বপ্ন, আত্নার আদেশ। কিন্তু আজ ভিসার বিপাকে পড়ে ফিরে আসা পাখি। খুঁজে ফেরে পত্র‍পুষ্প ভরা কোন উদ্যানের ডাল। আমার বিহনে দ্যাখো নদী শুষ্ক, গুল্মহীন মাটি কেবল উঁইয়ের ঢিবি। বৃষ্টিহীন পরাজিত মেঘ ব্র‍জ্র‍ের আওয়াজ তুলে ফিরে যায় দিগন্তের দিকে।হয়তো-বা স্বপ্ন ছিলো। ঘুমঘোরে মিথ্যার ম্যাজিক আমাকে দেখিয়ে ছিলো বাষ্পরুদ্ধ চেহারা তোমার। পাখির বিলাপে ভরা ঘোরলাগা গ্র‍ামের কুটিরে একটি বালক শুধু শুনেছিলো নদীর রোদন। এখন সে পাড়ি দেয় সপ্তসিন্ধু, দশদিকে চোখ মায়ার কাজলে ভেজা দৃষ্টি তার ক্লান্তির রুমালে মুছে নিয়ে ঘরে এসে দেখে কেউই অপেক্ষায় নেই।তার কোন দেশ নেই। নিরুপায় ভিসার বিপাকে কালেভদ্র‍ে উড়ে আসা শুষ্ক এক নদীর কিনারে। দাঁড়াও পথিক বর, পত্র‍হীন অশ্বথের শাখা নড়ে উঠে বোঝায় সে অতিথির অনাত্নীয় নয়। যদিও চুড়োয় বসে নিঃস্ব এক শুকুনী নিজেই নিজের পালক ছিঁড়ে উদরের অনল নিভায়।একটি সমাধি তাকে বাশঝাঁড়ে ইশারায় ডাকে আকস্মাৎ দৃষ্টি তার মর্মভেদী। মাটির অতলে দেখে সে চেহারা সেই বাষ্পরুদ্ধ বেদনার নদী মৃদু শব্দে ভরে গিয়ে — এতদিন কোথায় যে ছিলে শেষ অনুযোগ নিয়ে মুখে যায় মাটির মায়ায়।হয়তো-বা স্বপ্ন নয়। নয় কোন মিথ্যার ম্যাজিক একদা আমারও ছিলো দেশ, দশ, নারীর নয়ন। দেহের ভিতরে ছিলো প্র‍েম,স্বপ্ন, আত্নার আদেশ। কিন্তু আজ ভিসার বিপাকে পড়ে ফিরে আসা পাখি। খুঁজে ফেরে পত্র‍পুষ্প ভরা কোন উদ্যানের ডাল। আমার বিহনে দ্যাখো নদী শুষ্ক, গুল্মহীন মাটি কেবল উঁইয়ের ঢিবি। বৃষ্টিহীন পরাজিত মেঘ ব্র‍জ্র‍ের আওয়াজ তুলে ফিরে যায় দিগন্তের দিকে।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি। আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক কত রাত তো অমনি থাকিস। আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম। অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না। আর আমি এঁদের ভাই সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি। কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো। শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায় শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানোছিটানো ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা। কলার ছোট বাগান। দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন, ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান …। বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসেফেলবেন। ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই। আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবো।
আল মাহমুদ
সনেট
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ। ফেলে যাচ্ছি খড়কুটো, পরিধেয়, আহার, মৈথুন– নিরুপায় কিছু নাম, কিছু স্মৃতি কিংবা কিছু নয়; অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকেরলেগুন কার হাত ভাঙে চুড়ি? কে ফোঁপায়? পৃথিবীনিশ্চয়। স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়? কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ? নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়! আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।
আল মাহমুদ
স্বদেশমূলক
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে। নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে? -হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে। বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে। জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক। বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই, আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই। কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ। সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো! ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ। এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
আল মাহমুদ
শোকমূলক
এ কেমন অন্ধকার বঙ্গদেশ উত্থান রহিত নৈশব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখিও বসে না। নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায় কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্যকোন শ্যামলতা নেই। বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন। গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতেথাকি নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবেনা আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর! অবিশ্বস্ত হাওয়া আছে, নেই কোন শব্দের দ্যোতনা, দু’একটা পাখি শুধু অশত্থের ডালে বসে আজও সঙ্গীতের ধ্বনি নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাক্যালাপ করে; বৃষ্টিহীন বোশেখের নিঃশব্দ পঁচিশ তারিখে।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
আর আসবো না বলে দুধের ওপরে ভাসা সর চামোচে নিংড়ে নিয়ে চেয়ে আছি। বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া যেন সাদা স্বপ্নের চাদর বিছিয়েছে পৃথিবীতে। কেন এতো বুক দোলে? আমি আর আসবো না বলে? যদিও কাঁপছে হাত তবু ঠিক অভ্যেসের বশে লিখছি অসংখ্য নাম চেনাজানা সমস্ত কিছুর। প্রতিটি নামের শেষে, আসবো না। পাখি, আমি আসবো না। নদী আমি আসবো না। নারী, আর আসবো না, বোন। আর আসবো না বলে মিছিলের প্রথম পতাকা তুলে নিই হাতে। আর আসবো না বলে সংগঠিত করে তুলি মানুষের ভিতরে মানুষ। কথার ভেতরে কথা গেঁথে দেওয়া, কেন? আসবো না বলেই। বুকের মধ্যে বুক ধরে রাখা, কেন? আর আসবো না বলেই। আজ অতৃপ্তির পাশে বিদায়ের বিষণ্ণ রুমালে কে তুলে অক্ষর কালো, ‘আসবো না’ সুখ, আমি আসবো না। দুঃখ, আমি আসবো না। প্রেম, হে কাম, হে কবিতা আমার তোমরা কি মাইল পোস্ট না ফেরার পথের ওপর?
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
একটু ছিল বয়েস যখন ছোট্ট ছিলাম আমি আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি। উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা তারার দেশে উড়তো আমার পরাণ আত্মহারা। জোছনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ। দেহ থাকতো এই শহরে উড়াল দিতো মন মেঘের ছিটার ঝিলিক পেয়ে হাসতো দু’নয়ন। তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দু’টি পা নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না। খেলার সাথী ছিল তখন প্রজাপতির ঝাঁক বনভাদালির গন্ধে কত কুটকুটোতো নাক; কেওড়া ফুলের ঝোল খেয়ে যে কোল ছেড়েছে মা’র তার কি থাকে ঘরবাড়ি না তার থাকে সংসার? তারপরে যে কী হলো, এক দৈত্য এসে কবে পাখনা দুটো ভেঙে বলে মানুষ হতে হবে। মানুষ হওয়ার জন্য কত পার হয়েছি সিঁড়ি গাধার মত বই গিলেছি স্বাদ যে কি বিচ্ছিরি। জ্ঞানের গেলাস পান করে আজ চুল হয়েছে শণ কেশের বাহার বিরল হয়ে উজাড় হলো বন। মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে ? অফিস বাড়ির মধ্যে রোবোট কলম ধরেছে। নরম গদি কোশন আসন চশমা পরা চোখ লোক ঠকানো হিসেব লেখে, কম্প্যুটারে শ্লোক। বাংলাদেশের কপাল পোড়ে ঘূর্ণিঝড়ে চর মানুষ গড়ার শাসন দেখে বুক কাঁপে থরথর। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’- গান শোননি ভাই ? মানুষ হবার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই।
আল মাহমুদ
চিন্তামূলক
কিছুই থাকে না দেখো, পত্র পুষ্প গ্রামের বৃদ্ধরা নদীর নাচের ভঙ্গি, পিতলের ঘড়া আর হুকোর আগুন উঠতি মেয়ের ঝাঁক একে একে কমে আসে ইলিশের মৌসুমের মতো হাওয়ায় হলুদ পাতা বৃষ্টিহীন মাটিতে প্রান্তরে শব্দ করে ঝরে যায়। ভিনদেশী হাঁসেরাও যায় তাদের শরীর যেন অর্বুদ বুদ্বুদ আকাশের নীল কটোরায়। কিছুই থাকেনা কেন? করোগেট, ছন কিংবা মাটির দেয়াল গায়ের অক্ষয় বট উপড়ে যায় চাটগাঁর দারুণ তুফানে চিড় খায় পলেস্তরা, বিশ্বাসের মতন বিশাল হুড়মুড় শব্দে অবশেষে ধসে পড়ে আমাদের পাড়ার মসজিদ! চড়ুইয়ের বাসা, প্রেম, লতাপাতা, বইয়ের মলাট। দুমড়ে মুচড়ে খসে পড়ে। মেঘনার জলের কামড়ে কাঁপতে থাকে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার ভাসে ঘর, ঘড়া-কলসী, গরুর গোয়াল বুবুর স্নেহের মতো ডুবে যায় ফুল তোলা পুরোনো বালিশ। বাসস্থান অতঃপর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না জলপ্রিয় পাখিগুলো উড়ে উড়ে ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে বাতাসের ফেনা।
আল মাহমুদ
সনেট
হারিয়ে কানের সোনা এ-বিপাকে কাঁদো কি কাতরা? বাইরে দারুন ঝড়ে নুরে পড়ে আনাজের ডাল, তস্করের হাত থেকে জেয়র কি পাওয়া যায় ত্বরা – সে কানেট পরে আছে হয়তো বা চোরের ছিনাল ! পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিত সমাজ। ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখাযায় ঢেকে যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ? ভেঙ্গোনা কাঁচের চুড়ি, ভরে দেবো কানের ছেঁদুর এখনো আমার ঘরে পাওয়া যাবে চন্দনের শলা, ধ্রুপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড় ক্ষমা করো হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা। তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর না দেখার ভান করে কতকাল দেখবে, চঞ্চলা?
আল মাহমুদ
হাস্যরসাত্মক
অঙ্ক নিয়ে বসলে আমার কখন কী যে হয় টেবিলটাও পর হয়ে যায় বইগুলো সব ভয়। ভয়ের চোটে ভাবতে থাকি শহর ভেঙে কেউ দালান কোঠা বিছিয়ে দিয়ে তোলে খেতের ঢেউ। রাস্তাগুলো নদী এবং গলিরা সব খাল ইলেকট্রিকের খাম্বাগুলো পাল্টে হলো তাল। মোটরগাড়ি গরুর পালে হাম্বা তুলে হাঁটে পুলিশগুলো গুলিস্তানে নিড়ানি ঘাস কাটে। আব্বা হলেন কাকতাড়ুয়া আম্মা হলুদ পাখি বুবুরা সব ভুঁইকুমড়ো পাতায় ঢেকে রাখি। সবাই যখন পাল্টে গেছে নিজের ঘরে নাই আমিই তখন ইচ্ছে মতন খোকন হয়ে যাই। কেউ বলে না আঁক কষতে কেউ বলে না লেখ্ কেউ ধরে না কানের লতি, কেউ বলে না শেখ্। ঢাকা শহর, ঢাকা শহর সবুজ হয়ে যাও কলেজগুলো সর্ষে বাগান ভার্সিটিতে লাউ।
আল মাহমুদ
প্রকৃতিমূলক
মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে মেঘের মত পাল উড়িয়ে কী ভাসে! মাছের মত দেখতে এ কোন পাটুনি ভর দুপুরে খাটছে সখের খাটুনি। ওমা এ-যে কাজল বিলের বোয়ালে পালের দড়ি আটকে আছে চোয়ালে আসছে ধেয়ে লম্বা দাড়ি নাড়িয়ে, ঢেউয়ের বাড়ি নাওয়ের সারি ছাড়িয়ে।কোথায় যাবে কোন উজানে ও-মাঝি আমার কোলে খোকন নামের যে-পাজি হাসেছ, তারে নাও না তোমার নায়েতে গাঙ-শুশুকের স্বপ্নভরা গাঁয়েতে; সেথায় নাকি শালুক পাতার চাদরে জলপিপিরা ঘুমায় মহা আদরে, শাপলা ফুলের শীতল সবুজ পালিশে থাকবে খোকন ঘুমিয়ে ফুলের বালিশে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র
প্রেমমূলক
তারপরও কথা থাকে; বৃষ্টি হয়ে গেলে পর ভিজে ঠাণ্ডা বাতাসের মাটি- মাখা গন্ধের মতন আবছায়া মেঘ মেঘ কথা; কে জানে তা কথা কিংবা কেঁপে ওঠা রঙিন স্তব্ধতা। সে কথা হবে না বলা তাকে: শুধু প্রাণ ধারণের প্রতিজ্ঞা ও প্রয়াসের ফাঁকে ফাঁকে অবাক হৃদয় আপনার সঙ্গে একা-একা সেই সব কুয়াশার মত কথা কয়। অনেক আশ্বর্য কথা হয়তো বলেছি তার কানে। হৃদয়েরকতটুকু মানে তবু সে কথায় ধরে! তুষারের মতো যায় ঝরে সব কথা কোনো এক উত্তুঙ্গ শিখরে আবেগের, হাত দিয়ে হাত ছুঁই, কথা দিয়ে মন হাতড়াই তবু কারে কতটুকু পাই। সব কথা হেরে গেলে তাই এক দীর্ঘশ্বাস বয়, বুঝি ভুলে কেঁপে ওঠে একবার নির্লিপ্ত সময়। তারপর জীবনের ফাটলে-ফাটলে কুয়াশা জড়ায় কুয়াশার মতো কথা হৃদয়ের দিগন্তে ছড়ায়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র
চিন্তামূলক
হাঁকে ফিরিওলা— কাগজ বিক্রী, পুরানো কাগজ চাই! ঘরের কোণেতে সঞ্চিত যত তাড়াগুলি হাতড়াই | পুরানো কাগজ চাই | বহুদিন ধরে জঞ্জাল বাড়ে সের দরে বেচি তাই | কেমন করিয়া একটি তাহার হঠাত্ নজরে পড়ে, দেখি সমুদ্রে যাত্রী-জাহাজ কোথাও ডুবিল ঝড়ে | হঠাত্ নজরে পড়ে, আবার কোথায় মানুষের মাথা, বিকাল খুলির দরে |নিরুদ্দেশ কে সন্তান লাগি ঘোষিছে পুরস্কার, মৃত্যুঞ্জয় অমৃত কারা রিছে আবিষ্কার | ঘোষিছে পুরস্কার, পলাক খুনে লুকায়ে কোথায় চাই যে হদিস্ তার |কোন সে বধুর বুকের আগুন ভিতর করিয়া খাক্, অবশেষে লাগে বসনে তাহার, পুড়ে গেল সাতপাক | ভিতর করিয়া খাক্, কোন্ সে গিরির গরল অনল ঘটাল দুর্বিপাক |হারানো তারিখ ফিরে আসে ফের পুরানো কাগজ পড়ি ; আমার নয়নে সহসা পোহায় সে দিনের বিভাবরী | পুরানো কাগজ পড়ি, রাখিল ধরনী সেই দিনটির পায়ের চিহ্ন ধরি |সে পদচিহ্ন কোথায় মিলাল তারপর নাহি খোঁজ! মানুষের ঘরে সকলের বড় উত্সব নওরোজ | তারপরে নাহি খোঁজ ; যাত্রী জাহাজে ডুবিল যে, বুঝি, তারো ঘরে আজি ভোজ |রক্তে ছোপান অশ্রুতে ভেজা পুরাতন যত খাতা, সব জঞ্জাল আজিকে, হলেও রঙীন সুতোয় গাঁথা | পুরাতন যত খাতা, তাতে কোন্ দিন কি দাগ লাগিল কে বৃথা ঘামায় মাথা |হাঁকে ফিরিওয়ালা, কাগজ বিক্রী, পুরানো কাগজ চাই | ঘর ভরি যত মিছে জঞ্জাল জমাবার নাই ঠাঁই | পুরানো কাগজ চাই ; আদর যহার ফুরালো, তাদেরে সের দরে বেচ ভাই
প্রেমেন্দ্র মিত্র
মানবতাবাদী
নির্জন প্রান্তরে ঘুরে হঠাত্ কখন, হয়তো পেতেও পারি পাখিদের মন। আর শুধু মাটি নয় শ্স্য নয়, নয় শুধু ভার, আর-এক বিদ্রোহী ধিক্কার– পৃথিবী-পরাস্ত-করা উজ্জল উত্ ক্ষেপ। আজো এরা মাঠে-ঘাটে মাটি খুঁটে খায়, মেনে নেয় সব কিছু দায় ; তবু এক সুনীল শপথ তাদের বুকের রক্ত তপ্ত করে রাখে। জীবনের বাঁকে বাঁকে, যত গ্লানি যত কোলাহল ব্যাধের গুলির মতো বুকে বিঁধে রয়, সে-উত্তাপে গ’লে গিয়ে হ’য়ে যায় ক্ষয়। শুধু দুটি তীব্র তীক্ষ্ণ দুঃসাহসী ডানা, আকাশের মানে না সিমানা। কোনোদিন এ-হৃদয় হয় যদি একান্ত নির্জন, হয়তো পেতেও পারি পাখিদের মন –আর এক সূর্য-সচেতন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র
মানবতাবাদী
নগরের পথে পথে দেখেছ অদ্ভুত এক জীব ঠিক মানুষের মতো কিংবা ঠিক নয়, যেন তার ব্যঙ্গ-চিত্র বিদ্রূপ-বিকৃত ! তবু তারা নড়ে চড়ে কথা বলে, আর জঞ্জালের মত জমে রাস্তায়-রাস্তায়। উচ্ছিষ্টের আস্তাকূড়ে ব’সে ব’সে ধোঁকে আর ফ্যান চায়।রক্ত নয়, মাংস নয়, নয় কোন পাথরের মতো ঠান্ডা সবুজ কলিজা। মানুষের সত্ ভাই চায় সুধু ফ্যান; তবু যেন সভ্যতার ভাঙেনাকো ধ্যান ! একদিন এরা বুঝি চষেছিল মাটি তারপর ভুলে গেছে পরিপাটি কত-ধানে হয় কত চাল; ভুলে গেছে লাঙলের হাল কাঁধে তুলে নেওয়া যায়। কোনোদিন নিয়েছিল কেউ, জানেনাকো আছে এক সমুদ্রের ঢেউ পাহাড়-টলানো।অন্ন ছেঁকে তুলে নিয়ে, ক্ষুধাশীর্ণ মুখে যেই ঢেলে দিই ফ্যান মনে হয় সাধি এক পৈশাচিক নিষ্ঠুর কল্যাণ ; তার চেয়ে রাখি যদি ফেলে, পচে পচে আপন বিকারে এই অন্ন হবে না কি মৃত্যুলোভাতুরা অগ্নি-জ্বালাময় তীব্র সুরা ! রাজপথে এই সব কচি কচি শিশুর কঙ্কাল–মাতৃস্তন্যহীন, দধীচির হাড় ছিলো এর চেয়ে আরো কি কঠিন ?
প্রেমেন্দ্র মিত্র
রূপক
প্রথম সাপটা দেখবে নিথর পাথর সন্মোহিত, কোন সে আদিম অন্ধ অঘোর অন্বেষণের দ্বিধা আঁধার-ছোঁয়ানো ছায়া-বিদ্যুত হেনে খোলে কুণ্ডলী!তারপর সাপ অনেক দেখবে কেঁপে-ওঠা শরবন। কাঁটা-দেওয়া ঘাস সভয়ে শুনবে গোপন সঞ্চারণ, —শোনা না-শোনার সীমানার শুধু স্তব্ ধতা শিহরিত |সব শেষে এক সাহসী সকাল গহন অতল থেকে, হিমেল হিংসা ছেঁকে নিয়ে এসে রোদ্দুরে মেলাবে কি? ছন্দে মেলাবে ঘৃণা-পিচ্ছল বিবরের সরীসৃপের বিষফণা আর পাখিদের নীল মুক্তি!
প্রেমেন্দ্র মিত্র
প্রেমমূলক
হাওয়া বয় সনসন তারারা কাঁপে । হৃদয়ে কি জং ধরে পুরনো খাপে !কার চুল এলোমেলো কিবা তাতে আসে গেল! কার চোখে কত জল কেবা তা মাপে?দিনগুলো কুড়াতে কত কি তো হারাল ব্যথা কই সেই ফলা-র বিধেঁছে যা ধারালো!হাওয়া বয় সনসন তারারা কাঁপে । জেনে কিবা প্রয়োজন অনেক দূরের বন । রাঙা হলো কুসুমে, না বহ্নিকাপে? হৃদয় মর্চে ধরা পুরনো খাপে!!
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী, সন্তান দ্বারে উপবাসী, দাও মানবতা ভিক্ষা দাও! জাগো গো,                জাগো গো, তন্দ্রা-অলস জাগো গো, জাগো রে!                জাগো রে!             ১ মুক্ত করিতে বন্দিনী মা'য় কোটি বীরসুত ঐ হেরো ধায় মৃত্যু-তোরণ-দ্বার-পানে— কার টানে? দ্বার খোলো দ্বার খোলো! একবার ভুলে ফিরিয়া চাও।কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...          ২ জননী আমার ফিরিয়া চাও! ভাইরা আমার ফিরিয়া চাও! চাই মানবতা, তাই দ্বারে কর হানি মা গো বারেবারে— দাও মানবতা ভিক্ষা দাও! পুরুষ-সিংহ জাগো রে! সত্যমানব জাগো রে। বাধা-বন্ধন-ভয়-হারা হও সত্য-মুক্তি-মন্ত্র গাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...               ৩ লক্ষ্য যাদের উৎপীড়ন আর অত্যাচার, নর-নারায়ণে হানে পদাঘাত জেনেছে সত্য-হত্যা সার। অত্যাচার! অত্যাচার!! ত্রিশ কোটি নর-আত্মার যারা অপমান হেলা করেছে রে শৃঙ্খল গলে দিয়েছে মা'র— সেই আজ ভগবান তোমার! অত্যাচার! অত্যাচার!! ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-নাই কি লাজ— নাই কি আত্মসম্মান ওরে নাই জাগ্রত ভগবান কি রে আমাদেরো এই বক্ষোমাঝ? অপমান বড় অপমান ভাই মিথ্যার যদি মহিমা গাও! কোরাস্:—  ভিক্ষা দাও... ৪ আল্লায় ওরে হকতা'লায় পায়ে ঠেলে যারা অবহেলায়, আজাদ-মুক্ত আত্মারে যারা শিখায়ে ভীরুতা করেছে দাস— সেই আজ ভগবান তোমার! সেই আজ ভগবান তোমার! সর্বনাশ! সর্বনাশ! ছি-ছি নির্জীব পুরবাসী আর খুলো না দ্বার! জননী গো! জননী গো! কার তরে জ্বালো উৎসব-দীপ? দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!! মঙ্গল-ঘট ভেঙে ফেলো, সব গেল মা গো সব গেল! অন্ধকার! অন্ধকার! ঢাকুক এ মুখ অন্ধকার! দীপ নেবাও! দীপ নেবাও। কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...                    ৫ ছি ছি ছি ছি এ কি দেখি গাহিস তাদেরি বন্দনা-গান, দাস সম নিস হাত পেতে দান! ছি-ছি-ছি ছি-ছি-ছি ওরে তরুণ ওরে অরুণ! নরসুত তুমি দাসত্বের এ ঘৃণ্য চিহ্ন মুছিয়া দাও! ভাঙিয়া দাও, এ-কারা এ-বেড়ি ভাঙিয়া দাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...                ৬ পরাধীন বলে নাই তোমাদের সত্য-তেজের নিষ্ঠা কি! অপমান সয়ে মুখ পেতে নেবে বিষ্ঠা ছি? মরি লাজে, লাজে মরি! এক হাতে তোরে 'পয়জার' মারে আর হাতে ক্ষীর সর ধরি! অপমান সে যে অপমান! জাগো জাগো ওরে হতমান! কেটে ফেলো লোভী লুব্ধ রসনা, আঁধারে এ হীন মুখ লুকাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ৭ ঘরের বাহির হয়ো না আর, ঝেড়ে ফেলো হীন বোঝার ভার, কাপুরুষ হীন মানবের মুখ ঢাকুক লজ্জা অন্ধকার। পরিহাস ভাই পরিহাস সে যে, পরাজিতে দিতে মনোব্যথা—যদি জয়ী আসে রাজ-রাজ সেজে। পরিহাস এ যে নির্দয় পরিহাস! ওরে কোথা যাস বল কোথা যাস ছি ছি পরিয়া ভীরুর দীন বাস? অপমান এত সহিবার আগে হে ক্লীব, হে জড়, মরিয়া যাও!কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...              ৮ পুরুষসিংহ জাগো রে! নির্ভীক বীর জাগো রে! দীপ জ্বালি কেন আপনারি হীন কালো অন্তর কালামুখ হেন হেসে দেখাও! নির্লজ্জ রে ফিরিয়া চাও! আপনার পানে ফিরিয়া চাও! অন্ধকার! অন্ধকার! নিশ্বাস আজি বন্ধ মা'র অপমানে নির্মম লাজে, তাই দিকে দিকে ক্রন্দন বাজে— দীপ নেবাও! দীপ নেবাও! আপনার পানে ফিরিয়া চাও!কোরাস্‌:— ভিক্ষা দাও...
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি। সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি। আমরা সেই সে জাতি।।পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙ্গাড়ি শীতল শান্তিধারা, উচ্চ- নীচের ভেদ ভাঙ্গি দিল সবারে বক্ষ পাতি। আমরা সেই সে জাতি।।কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি ক ইসলাম সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম। আমির- ফকিরে ভেদ নাই সবে সব ভাই এক সাথী আমরা সেই সে জাতি।।নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার, আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি। আমরা সেই সে জাতি।।
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
হো-হো-হো উররো হো-হো! হো-হো-হো উররো হো-হো উররো হো-হো বাস কী মজা! কে শুয়ে চুপ সে ভুঁয়ে, নারছে হাতে পাশ কী সোজা! হো-বাবা! ঠ্যাং ফুলো যে! হাসে জোর ব্যাংগুলো সে ড্যাং তুলো তার ঠ্যাংটি দেখে! ন্যাং ন্যাং য়্যাগগোদা ঠ্যাং আঁতকে ওঠায় ডানপিটেকে! এক ঠ্যাং তালপাতা তার যেন বাঁট হালকা ছাতার! আর পাটা তার ভিটরে ডাগর! যেন বাপ! গোবদা গো-সাপ পেট-ফুলো হুস এক অজাগর! মোদোটার পিসশাশুড়ি গোদ-ঠ্যাং চিপসে বুড়ি বিশ্ব জুড়ি খিসসা যাহার! ঠে-ঠে ঠ্যাং নাক ডেঙা ডেং এই মেয়ে কি শিষ্যা তাহার? হাদে দেখ আসছে তেড়ে গোদা-ঠ্যাং ছাঁতসে নেড়ে, হাসছে বেড়ে বউদি দেখে! অ ফুলি! তুই যে শুলি দ্যাখ না গিয়ে চৌদিকে কে! বটু তুই জোর দে ভোঁ দৌড়, রাখালে! ভাঙবে গোঁ তোর নাদনা গুঁতোর ভিটিম ভাটিম! ধুমাধুম তাল ধুমাধুম পৃষ্ঠে, - মাথায় চাটিম চাটিম! ‘ইতু’ মুখ ভ্যাংচে বলে – গোদা ঠ্যাং ন্যাংচে চলে ব্যাং ছা যেন ইড়িং বিড়িং! রাগে ওর ঠ্যাং নড়ে জোর য়্যাদ্দেখেছিস – তিড়িং তিড়িং! মলিনা! অ খুকুনি! মা গো! কী ধুকপুকুনি হাড়-শুগুনি ভয়-তরাসে! দেখে ইস ভয়েই মরিস ন্যাংনুলোটার পাঁইতারাকে।গোদা-ঠ্যাং পুঁচকে মেয়ে আসে জোর উঁচকে ধেয়ে কুঁচকে কপাল, ইস কী রগড়! লেলিয়ে দে ঢেলিয়ে! ফোঁস করে ফের! বিষ কী জবর! ইন্দু! দৌড়ে যা না! হাসি, তুই বগ দেখা না! দগ্‌ধে না! তোল তাতিয়ে! রেণু! বাস, রেগেই ঠ্যাঙাস, বউদি আসুন বোলতা নিয়ে! আর না খাপচি খেলো! ওলো এ আচ্ছি যে লো, নাচছি তো খুব ঠ্যাং নিয়ে ওর! ব্যাচারির হ্যাঁস-ফ্যাসানির শেষ নেই, মুখ ভ্যাংচিয়ে জোর! ধ্যাত! পা পিছলে যে সে পড়ে তার বিষ লেগেছে ইস! পেকেছে বিষ-ফোঁড়া এক! সে ব্যথায় ঠ্যাং ফুলে তাই ঢাক হল পা-র পিঠ জোড়া দেখ! আচ্ছু! সত্যি সে শোন কারুর এক রত্তি সে বোন, দোষ নেই এতে দোষ নিয়ো না! আগে তোর ঠ্যাং ফুলে জোর, তারপরে না দস্যিপনা! আয় ভাই আর না আড়ি, ভাব কর কান্না ছাড়ি, ঘাড় না নাড়ি, কসনে ‘উহুঁ’! লক্ষ্মী! ধ্যাত, শোক কী? ছিঁচ-কাঁদুনে হসনে হুঁ হুঁ! উষাদের ঘর যাবিনে? লাগে তোর লজ্জা দিনে? বজ্জাতি নে রাখ তুলে লো! কেন? ঠ্যাং তেড়েং বেড়েং? হাসবে লোকে? বয়েই গেল!  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আমি গাই তারি গান- দৃপ্ত-দম্ভে যে যৌবন আজ ধরি' অসি খরশান হইল বাহির অসম্ভবের অভিযানে দিকে দিকে। লক্ষ যুগের প্রাচীন মমির পিরামিডে গেল লিখে তাদের ভাঙার ইতিহাস-লেখা। যাহাদের নিঃশ্বাসে জীর্ণ পুঁথির শুষ্ক পত্র উড়ে গেল এক পাশে। যারা ভেঙে চলে অপ-দেবতার মন্দির আস্তানা, বক-ধার্মিক নীতি-বৃদ্ধের সনাতন তাড়িখানা। যাহাদের প্রান স্রোতে ভেসে গেল পুরাতন জঞ্জাল, সন্সকারের জগদল-শিলা, শাস্ত্রের কঙ্কাল। মিথ্যা মোহের পূজা-মন্ডপে যাহারা অকূতোভয়ে এল নির্মম-মোহ-মুগদর ভাঙনের গদা ল'য়ে বিধি-নিষেধের চীনের প্রাচীরে অসীম দুঃসাহসে দু'-হাতে চালাল হাতুড়ি শাবল। গরস্থানেরে চ'ষে ছুঁড়ে ফেলে যত শব কঙ্কাল বসালো ফুলের মেলা, যাহাদের ভিড়ে মুখর আজিকে জীবনের বালি-বেলা। -গাহি তাহাদেরি গান বিশ্বের সাথে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান।-সেদিন নিশীথ-বেলা দুস্তর পারাবারে যে যাত্রী একাকী ভাসালো ভেলা, প্রভাতে সে আর ফিরিল না কূলে। সেই দুরন্ত লাগি' আঁখি মুছি আর রচি গান আমি আজিও নিশীথে জাগি'। আজো বিনিদ্র গাহি গান আমি চেয়ে তারি পথ-পানে। ফিরিল না প্রাতে যে জন সে-রাতে উড়িল আকাশ-যানে নব জগতের শরসন্ধানী অসীমের পথ-চারী, যার ভরে জাগে সদা সতর্ক মৃত্যু দুয়ারে দ্বারী!সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভে, দিগদিগন্তে জু'ড়ে জীবনোদ্বেগে তাড়া ক'রে ফেরে নিতি যারা মৃত্যুরে, মানিক আহরি' আনে যারা খুঁড়ি' পাতাল যক্ষপুরী; নাগিনীর বিষ-জ্বালা সয়ে করে ফণা হ'তে মণি চুরি। হানিয়া বজ্র-পানির বজ্র উদ্ধত শিরে ধরি' যাহারা চপলা মেঘ-কন্যারে করিয়াছে কিঙ্করী। পবন যাদের ব্যজনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী,- এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম, তাহাদের গান গাহি। গুঞ্জরি' ফেরে ক্রন্দন মোর তাদের নিখিল ব্যেপে- ফাঁসির রজ্জু ক্লান্ত আজিকে যাহাদের টুঁটি চেপে! যাহাদের কারাবাসে অতীত রাতের বন্দিনী ঊষা ঘুম টুটি' ঐ হাসে!
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
আদি উপাসনালয় -- উঠিল আবার নূতন করিয়া -- ভূত প্রেত সমুদয় তিনি শত ষাট বিগ্রহ আর মূর্তি নূতন করি' বসিল সোনার বেদীতে যে হায় আল্লার ঘর ভরি।সহিতে না পারি এ দৃশ্য, এই স্রষ্টার অপমান, ধেয়ানে মুক্তি-পথ খোঁজে নবী, কাঁদিয়া ওঠে পরান। খদিজারে কন-- "আল্লাতালার কসম, কাবার ঐ "লাৎ" "ওজ্জা"র করিব না পূজা, জানি না আল্লা বই। নিজ হাতে যারে করিল সৃষ্টি খড় আর মাটি দিয়া কোন্‌ নির্বোধ পূজিবে তাহারে হায় স্রষ্টা বলিয়া!"সাধ্বী পতিব্রতা খাদিজাও কহেন স্বামীর সনে-- "দূর কর ঐ লাত্‌ মানাতেরে, পূজে যাহা সব-জনে। তভ শুভ-বরে একেশ্বর সে জ্যোতির্ময়ের দিশা পাইয়াছি প্রভু, কাটিয়া গিয়াছে আমার আঁধার নিশা।"ক্রমে ক্রমে সব কোরেশ জানিল -- মোহাম্মদ আমিন করে না কো পূজা কাবার ভূতেরে ভাবিয়া তাদেরে হীন।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
গাহি তাহাদের গান- ধরণীর হাতে দিল যারা আনি' ফসলের ফরমান। শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভ'রে ফুলে-ফলে! বন্য শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা যাদের শাসলে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা। যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে বনের ব্যাঘ্র ময়ূর সিংহ বিবরের ফণী ল'য়ে। এল দুর্জয় গতি-বেগ-সম যারা যাযাবর-শিশু -তারাই গাহিল নব প্রেম-গান ধরণী-মেরীর যিশু- যাহাদের চলা লেগে উল্কার মত ঘুরিছে ধরণী শূন্যে অমিত বেগে!খেয়াল-খুশীতে কাটি' অরণ্য রচিয়া অমরাবতী যাহারা করিল ধ্বংস সাধপ্ন পুনঃ চঞ্চলমতি, জীবন-আবেগে রুধিতে না পারি' যারা উদ্ধত-শির লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়, গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর। নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু অভিযানে, পক্ষ বাঁধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্বপানে! তবুও থামে না যৌবন বেগ, জীবনের উল্লাসে চ'লেছে চন্দ্র-মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে। যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে করিতেছে ফিরি, ভীম রণভূমে প্রান বাজি রেখে হারে। আমি-মরু-কবি-গাহি সেই বেদে বেদুঈনদের গান, যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান। জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুন উগ্রসুখে সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে! আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব-সম কোনো বাধা মানিল না, বর্বর বলি' যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা, কূপ-মন্ডুক 'অসংযমী'র আখ্যা দিয়াছে যারে, তারি তরে ভাই গান রচে' যাই, বন্দনা করি তারে।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার, অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার। দিনের পর দিন গিয়েছে হয়নি আমার ছুটি, বুকের ভিতর ব্যর্থ কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি বসে   ঢুলত আঁখি দুটি! আহা আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া লাগল চোখে তোমার চাওয়া তাইতো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার। তোমার তরে বুকের তলায় অনেক দিনের অনেক কথা জমা, কানের কাছে মুখটি থুয়ে গোপন সে-সব কইব প্রিয়তমা! এবার শুধু কথায় গানে রাত্রি হবে ভোর শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর অভি-মানিনীরে মোর! যখন     তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি মলিন মুখে ফুটবে হাসি, হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি অরুণ ছবি তার।  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ! গাইবি আবার কণ্ঠছেঁড়া বিষ-অভিশাপ-সিক্ত গান। আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! আয় রে আমার বাঁধন-ভাঙার তীব্র সুখ জড়িয়ে হাতে কালকেউটে গোখরো নাগের পীত চাবুক! হাতের সুখে জ্বালিয়ে দে তোর সুখের বাসা ফুল-বাগান! আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! বুঝিসনি কি কাঁদায় তোরে তোরই প্রাণের সন্ন্যাসী! তোর অভিমান হল শেষে তোরই গলার নীল ফাঁসি! (তোর) হাসির বাঁশি আনলে বুকে যক্ষ্মা-রুগির রক্ত-বান, আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! ফানুস-ফাঁপা মানুষ দেখে, হায় অবোধ ছুটে এলি ছায়ার আশায়, মাথায় তেমনি জ্বলছে রোদ। ফাঁকির ফানুস ছাই হল তোর, খুঁজিস এখন রোদ-শ্মশান! আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! তুই যে আগুন, জল-ধারা চাস কার কাছে? বাষ্প হয়ে যায় উড়ে জল সাগর-শোষা তোর আঁচে। ফুলের মালার হুলের জ্বালায় জ্বলবি কত অগ্নি-ম্লান! আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! অগ্নি-ফণী! বিষ-রসানো জিহ্বা দিয়ে দিস চুমা, পাহাড়-ভাঙা জাপটানি তোর – ভাবিস সোহাগ-সুখ-ছোঁওয়া! মৃত্যুও যে সইতে নারে তোর সোহাগের মৃত্যু টান! আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!সুখের লালস শেষ করে দে, স্বার্থপর! কাল-শ্মশানের প্রেত-আলেয়া! তুই কোথা বল বাঁধবি ঘর? ঘর-পোড়ানো ত্রাস-হানা তুই সর্বনাশের লাল-নিশান! আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! তোর তরে নয় শীতল ছায়া, পান্থ-তরুর প্রেম-আসার, তুই যে ঘরের শান্তি-শত্রু, রুদ্র শিবের চণ্ড মার। প্রেম-স্নেহ তোর হারাম যে রে কসাই-কঠিন তুই পাষাণ! আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! সাপ ধরে তুই চাপবি বুকে সইবে না তোর ফুলের ঘা, মারতে তোকে বাজ পাবে লাজ চুমুর সোহাগ সইবে না! ডাক-নামে ডাক তোর তরে নয়, আহ্বান তোর ভীম কামান। আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ! ফণীমনসার কাঁটার পুরে আয় ফিরে তুই কালফণী, বিষের বাঁশি বাজিয়ে ডাকে নাগমাতা – ‘আয় নীলমণি!’ ক্ষুদ্র প্রেমের শূদ্রামি ছাড়, ধর খ্যাপা তোর অগ্নি-বাণ! আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
আসিলে    কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি। ও চরণ    ছুঁই কেমন হাতে মোর মাখা যে কালি॥ দখিনের    হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতি শবে-রাত    আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥ তালিবান    ঝুমকি বাজায়, গায় মোবারক-বাদ৪ কোয়েলা। উলসি    উপচে পলো পলাশ অশোক ডালের ওই ডালি॥ প্রাচীন ওই    বটের ঝুরির দোলনাতে হায় দুলিছে শিশু। ভাঙা ওই    দেউল-চূড়ে উঠল বুঝি নৌ-চাঁদের ফালি॥ এল কি    অলখ-আকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ। এল কি    আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েস গাজ্জালি৫॥ সানাইয়াঁ    ভয়রোঁ বাজায়, নিদ-মহলায় জাগল শাহজাদি। কারুণের    রুপার পুরে নূপুর-পায়ে আসল রূপ-ওয়ালি। খুশির এ‍    বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরীঁ। লাল এ    লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি॥ বাসি ফুল    কুড়িয়ে মালা না-ই গাঁথিলি, রে ফুল-মালি! নবীনের    আসার পথে উজাড় করে দে ফুল ডালি॥পদ্মা ২৭.২.২৭ (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
চিন্তামূলক
পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখাবাহিরে অন্তরে ঝড় উঠিয়াছে আশ্রয় যাচি হায় কাহার কাছে!বুঝি দুখ নিশি মোর হবে না হবে না ভোর ফুটিবে না আশার আলোক রেখা।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
রেশমি চুড়ির শিঞ্জিনীতে রিমঝিমিয়ে মরমকথা পথের মাঝে চমকে কে গো থমকে যায় ওই শরম-নতা। কাঁখচুমা তার কলসি-ঠোঁটে উল্লাসে জল উলসি ওঠে, অঙ্গে নিলাজ পুলক ছোটে বায় যেন হায় নরম লতা। অ-চকিতে পথের মাঝে পথ-ভুলানো পরদেশী কে হানলে দিঠি পিয়াস-জাগা পথবালা এই উর্বশীকে! শূন্য তাহার কন্যা-হিয়া ভরল বধূর বেদন নিয়া, জাগিয়ে গেল পরদেশিয়া বিধুর বধূর মধুর ব্যথা।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
ঐ ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে আজ মেতে।। এই রোদ-সোহাগী পউষ-প্রাতে অথির প্রজাপতির সাথে বেড়াই কুঁড়ির পাতে পাতে পুষ্পল মৌ খেতে। আমি আমন ধানের বিদায়-কাঁদন শুনি মাঠে রেতে।। আজ কাশ-বনে কে শ্বাস ফেলে যায় মরা নদীর কূলে, ও তার হলদে আঁচল চ’লতে জড়ায় অড়হরের ফুলে! ঐ বাবলা ফুলের নাকছবি তার, গা’য় শাড়ি নীল অপরাজিতার, চ’লেছি সেই অজানিতার উদাস পরশ পেতে।। আমায় ডেকেছে সে চোখ-ইশারায় পথে যেতে যেতে।। ঐ ঘাসের ফুলে মটরশুটির ক্ষেতে আমার এ-মন-মৌমাছি ভাই উঠেছে তাই মেতে।।
কাজী নজরুল ইসলাম
চিন্তামূলক
চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়।।অবতার শ্রীরাম যে জানকীর পতি তারো হ'ল বনবাসা রাবণ-কর দুর্গতি। আগুনেও পুড়িল না ললাটের লেখা হায়।।স্বামী পঞ্চ পান্ডব, সখা কৃষ্ণ ভগবান, দুঃশাসন করে তবু দ্রৌপদীর অপমান। পুত্র তার হ'ল হত যদুপতি যার সহায়।।মহারাজ শ্রীহরিশ্চন্দ্র রাজ্যদান করে শেষ শ্মশান- রক্ষী হয়ে লভিল চন্ডাল বেশ। বিষ্ণু- বুকে চরণ- চিহ্ন, ললাট- লেখা কে খন্ডায়।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
হে মোর প্রিয়, হে মোর   নিশীথ-রাতের গোপন সাথি! মোদের   দুইজনারেই জনম ভরে কাঁদতে হবে গো – শুধু   এমনি করে সুদূর থেকে, একলা জেগে রাতি। যখন   ভুবন-ছাওয়া আঁচল পেতে নিশীথ যাবে ঘুম, আকাশ বাতাস থমথমাবে সব হবে নিঝঝুম, তখন   দেব দুঁহু দোঁহার চিঠির নাম-সহিতে চুম! আর   কাঁপবে শুধু গো, মোদের   তরুণ বুকের করুণ কথা আর শিয়রে বাতি। মোরা   কে যে কত ভালোবাসি কোনোদিনই হবে না তা বলা, কভু   সাহস করে চিঠির বুকেও আঁকব না সে কথা; শুধু   কইতে-নারার প্রাণপোড়ানি রইবে দোঁহার ভরে বুকের তলা। শুধু    চোখে চোখে চেয়ে থাকার – বুকের তলায় জড়িয়ে রাখার ব্যাকুল কাঁপন নীরব কেঁদে কইবে কি তার ব্যথা!    কভু   কী কথা সে কইতে গিয়ে হঠাৎ যাব থেমে, অভিমানে চারটি চোখেই আসবে বাদল নেমে। কত   চুমুর তৃষায় কাঁপবে অধর, উঠবে কপোল ঘেমে। হেথা   পুরবে নাকো ভালোবাসার আশা অভাগিনি, তাই   দলবে বলে কলজেখানা রইনু পথে পাতি।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে, হাবুডুবু খায় তারা-বুদবুদ, জোছনা সোনায় রাঙে! তৃতীয়া চাঁদের "সাম্পানে" চড়ি চলিছে আকাশ প্রিয়া, আকাশ-দরিয়া উতলা হ’ল গো পুতলায় বুকে নিয়া। তৃতীয়া চাঁদের বাকি "তের কলা" আবছা কালোতে আঁকা নীলিম-প্রিয়ার নীলা "গুল রুখ" অব-গুণ্ঠনে ঢাকা। সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী, সেহেলি "লায়লী" দিয়ে গেছে চুপে কূহেলী-মশারী টানি! দিক-চক্রের ছায়া-ঘন ঐ সবুজ তরুর সারি, নীহার-নেটের কুয়াশা মশারি –ওকি বর্ডার তারি? সাতাশ তারার ফুল-তোড়া হাতে আকাশ নিশুতি রাতে গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে! উহু উহু করি কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে নীলা হুরী, লুকিয়ে দেখে তা "চোখ গেল" বলে চেঁচায় পাপিয়া ছুঁড়ি! "মঙ্গল" তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্রহর জাগে, ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে- বুঝি বধূর নিশাস লাগে! উল্কা-জ্বালার সন্ধানী-আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী ‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করিতেছে পায়চারি! সেহেলিরা রাতে পালায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে, হেথা হোথা ছোটে-পিকের কণ্ঠে ফিক ফিক ক’রে হাসে! আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি শিশিরের রূপে ঘর্ম-বিন্দু ঝ’রে ঝরে পড়ে সখি, নবমী চাঁদের ‘সসারে’ ও কে গো চাঁদিনী-শিরাজি ঢালি’ বধূর অধর ধরিয়া কহিছে- ‘তহুরা পিও লো আলি’! কার কথা ভেবে তারা-মজলিসে দূরে একাকিনী সাকী চাঁদের ‘সসারে’ কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি। ফরহাদ-শিরী-লায়লী-মজনু মগজে ক’রেছে চিড়, মস্তানা শ্যামা দধিয়াল টানে বায়ু-বেয়ালার মীড়! আনমনা সাকী! অমনি আমারো হৃদয় পেয়ালা-কোণে কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখি লিখো মুছো ক্ষণে ক্ষণে ।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আমি   নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন। শেষে   সে-ই আমারে কাঁদায়, যারে করি আপনারই জন।           দূর হতে মোর বাঁশির সুরে পথিক-বালার নয়ন ঝুরে তার   ব্যথায়-ভরাট ভালোবাসায় হৃদয় পুরে গো! তারে   যেমনি টানি পরান-পুটে অমনি   সে হায় বিষিয়ে উঠে! তখন   হারিয়ে তারে কেঁদে ফিরি সঙ্গীহারা পথটি আবার নিজন।       মুগ্ধা ওদের নেই কোনো দোষ, আমিও ওগো ধরা দিয়ে মরি, প্রেম-পিয়াসি প্রণয়ভুখা শাশ্বত যে আমিই তৃপ্তিহারা, ঘরবাসীদের প্রাণ যে কাঁদে পরবাসীদের পথের ব্যথা স্মরি তাইতো তারা এই উপোসির ওষ্ঠে ধরে ক্ষীরের থালা, শান্তিবারিধারা।          ঘরকে পথের বহ্নিঘাতে দগ্ধ করি আমার সাথে, লক্ষ্মী ঘরের পলায় উড়ে এই সে শনির দৃষ্টিপাতে গো! জানি আমি লক্ষ্মীছাড়া বারণ আমার উঠান মাড়া, আমি   তবু কেন সজল চোখে ঘরের পানে চাই? নিজেই কি তা জানি আমি ভাই? হায়   পরকে কেন আপন করে বেদন পাওয়া, পথেই যাহার কাটবে জীবন বিজন? আর   কেউ হবে না আপন যখন, সব হারিয়ে চলতে হবে পথটি আমার নিজন। আমি   নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
ওরে       আয়! ঐ       মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়– ওরে       আয়! ঐ       ইস্‌লাম ডুবে যায়! যত শয়তান সারা ময়দান জুড়ি    খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়-গান শোন্ গায়! আজ   শখ করে জুতি-টক্করে তোড়ে  শহীদের খুলি দুশ্‌মন পায় পায়– ওরে আয়! তোর    জান যায় যাক, পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায়! ধরে     ঝন্‌ঝার ঝুঁটি দাপটিয়া শুরু মুস্‌লিম-পঞ্জায়! তোর   মান যায় প্রাণ যায়– তবে    বাজাও বিষাণ, ওড়াও নিশান! বৃথা ভীরু সম্‌ঝায়! রণ-       দুর্মদ রণ চায়! ওরে   আয়! ঐ       মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়! ওরে   আয়! ঐ       ঝননননন রণ-ঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়! শুনি     এই ঝন্‌ঝনা-ব্যঞ্জনা নেবে গঞ্জনা কে রে হায়? ওরে   আয়! তোর       ভাই ম্লান চোখে চায়, মরি    লজ্জায়, ওরে    সব যায়, তবু      কব্‌জায় তোর শম্‌শের নাহি কাঁপে আফ্‌সোসে হায়? রণ-    দুন্দুভি শুনি খুন-খুবি নাহি      নাচে কি রে তোর মরদের ওরে দিলিরের গোর্দায়?                    ওরে    আয় মোরা    দিলাবার খাঁড়া তলোয়ার হাতে আমাদেরি শোভা পায়! তারা     খিঞ্জির যারা জিঞ্জির-গলে ভূমি চুমি মূরছায়! আরে   দূর দূর! যত কুক্কুর আসি    শের-বব্বরে লাথি মারে ছি ছি ছাতি চড়ে! হাতি ঘা‌'ল হবে ফেরু-ঘায়? ঐ       ঝননননন রণঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়! ওরে    আয়! বোলে   দ্রিম্‌ দ্রিম্ তানা দ্রিম, দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়! ঐ                    শের-নর হাঁকড়ায়– ওরে       আয়! ছোড়্   মন-দুখ, হোক   কন্দুক ঐ       বন্দুক তোপ, সন্দুক তোর পড়ে থাক, স্পন্দুক বুক ঘা'য়! নাচ্ তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ– থৈ       তা‌ণ্ডব, আজ পাণ্ডব সম খাণ্ডব-দাহ চাই!                      ওরে       আয়! কর      কোর্‌বান আজ তোর জান দিল্ আল্লার নামে ভাই। ঐ       দীন্ দীন্-রব আহব বিপুল বসুমতী ব্যোম ছায়! শেল–   গর্জন করি     তর্জন হাঁকে, বর্জন নয় অর্জন আজ, শির তোর চায় মায়! সব   গৌরব যায় যায়; বোলে দ্রিম্ দ্রিম্ তানা দ্রিম্ দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়! ওরে  আয় ! ঐ   কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সাজ্জায়! ওরে  আয়! মুখ            ঢাকিবি কি লজ্জায়?                   হুর্        হুর্‌রে। কত       দূর রে সেই    পুর রে যথা খুন-খোশ্‌রোজ খেলে হর্‌রোজ দুশ্‌মন-খুনে ভাই! সেই   বীর-দেশে চল্ বীর-বেশে, আজ    মুক্ত দেশে রে মুক্তি দিতে রে বন্দীরা ঐ যায়! ওরে     আয়! বল্‌        'জয় সত্যম্ পুরুযোত্তম', ভীরু যারা মার খায়! নারী  আমাদেরি শুনি রণ-ভেরী হাসে খলখল হাত-তালি দিয়ে রণে ধায়! মোরা     রণ চাই রণ চাই, তবে    বাজহ দামামা, বাঁধই আমামা, হাথিয়ার পাঞ্জায়! মোরা   সত্য ন্যায়ের সৈনিক, খুন-গৈরিক বাস গা'য়। ওরে     আয়! ঐ   কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সজ্জায়! ওরে     আয়! অব–       রুদ্ধের দ্বারে যুদ্ধের হাঁক নকিব ফুকারি যায়! তোপ্ দ্রুম্ দ্রুম্ গান গায়! ওরে     আয়!ঐ     ঝননরণন খঞ্জর-ঘাত পঞ্জরে মূরছায়! হাঁকো হাইদার, নাই নাই ডর, ঐ     ভাই তোর ঘুর-চর্খীর সম খুন খেয়ে ঘুর্ খায়! ঝুটা  দৈত্যেরে নাশি  সত্যেরে দিবি    জয়-টীকা তোরা, ভয় নাই ওরে ভয় নাই হত্যায়!                ওরে     আয়! মোরা    খুন্‌-জোশি বীর, কঞ্জুশি লেখা আমাদের খুনে নাই! দিয়ে    সত্য ও ন্যায়ে বাদশাহি, মোরা জালিমের খুন খাই! মোরা     দুর্মদ, ভর্‌পুর্ মদ খাই     ইশ্‌কের, ঘাত-শম্‌শের ফের নিই বুক নাঙ্গায়! লাল   পল্টন মোরা সাচ্চা, মোরা    সৈনিক, মোরা শহীদান বীর বাচ্চা, মরি   জালিমের দাঙ্গায়! মোরা অসি বুকে বরি হাসি মুখে মরি জয় স্বাধীনতা গাই! ওরে     আয়! ঐ   মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!!——————————- শম্‌শের– তরবারি। খুন-খুবি– রক্তোন্মত্ততা দিলির– সাহসী, নির্ভীক দিলবার– প্রাণবন্তা। জিঞ্জির– শিকল শের-বববরে– সিংহ শের-নর– পুরুষসিংহ হাঁকাড়ায়– গর্জন করিতেছি কোরবান– উৎসর্গ খুন-খোশ-রোজ– রক্ত-মহোৎসব। হররোজ– প্রতিদিন আমামা – শিরস্ত্রাণ নকিব– তূর্যবাদক হাইদার– মহাবীর হজরত আলীর হাঁক খুন-জোশ– রক্ত-পাগলামি কঞ্জুশি– কৃপণতা ইশকের– প্রেমের শহীদান– Martyrs
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
সকল জাতির সব মানুষের বন্ধু হে মোহ্‌সিন! এ যুগে তুমিই শোধ করিয়াছ এক আল্লার ঋণ॥ ভোগ করনিকো বিপুল বিত্ত পেয়ে, ভিখারি হইলে শুধু আল্লারে চেয়ে, মহাধনী হলে আল্লার কৃপা পেয়ে, দুনিয়ায় তাই রহিলে কাঙাল দীন॥মানুষের ভালোবাসায় পাইলে আল্লার ভালোবাসা, সৃষ্টির তরে কাঁদিয়া, পুরালে তব স্রষ্টার আশা। তব দান তাই ফুরায়ে নাহি ফুরায়, বিত্ত হইল নিত্য এ দুনিয়ায়, শিখাইয়া গেলে, মুসলিম তারে কয় অর্থ যাহারে কিনিতে পারে না, যে নহে লোভ-মলিন॥   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ? বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক, খাও একা পাও যেথায় যেটুক! বাতাবি-নেবু সকল্গুলো একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো! তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও? ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল? দেখনি তবে? রাঙাদা'কে ডাকবো? দেবে ঢিল! পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা! তাইতো তার নাকটি বোঁচা! হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস! একলাই খাও হাপুস হুপুস! পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে! হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!ইস। খেয়োনা মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও! আমিও খবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও! কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি' হবে? বৌদি হবে? হুঁ, রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঁঃ!এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো? ফ্রকটা নেবে? জামা দু'টো? আর খেয়ো না পেয়ারা তবে, বাতাবি নেবুও ছাড়ুতে হবে! দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুট? অ-মা দেখে যাও!- কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল! সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল- ঝিঙে ফুল।গুল্মে পর্ণ লতিকার কর্ণে ঢল ঢল স্বর্ণে ঝলমল দোলে দুল- ঝিঙে ফুল।পাতার দেশের পাখী বাঁধা হিয়া বোঁটাতে, গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে। পউষের বেলা শেষ পরি' জাফরানি বেশ মরা মাচানের দেশ ক'রে তোল মশগুল- ঝিঙে ফুল।শ্যামলী মায়ের কোলে সোনামুখ খুকু রে আলুথালু ঘুমু যাও রোদে-গলা দুকুরে।প্রজাপতি ডেকে যায়- 'বোঁটা ছিঁড়ে চ'লে আয়।' আসমানের তারা চায়- 'চ'লে আয় এ অকূল!' ঝিঙে ফুল।।তুমি বল-'আমি হায় ভালোবাসি মাটি-মায়, চাই না ও অলকায়- ভালো এই পথ-ভুল।' ঝিঙে ফুল।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
একটি শুধু বেদনা মানিক আমার মনের মণিকোঠায় সেই তো আমার বিজন ঘরে দুঃখ রাতের আঁধার টুটায়।          সেই মানিকের রক্ত-আলো ভুলাল মোর মন ভুলাল গো। সেই মানিকের করুণ কিরণ আমার বুকে মুখে লুটায়। আজ   রিক্ত আমি কান্না হাসির দাবি দাওয়ার বাঁধন ছিঁড়ে ওই   বেদনা-মণির শিখার মায়াই রইল একা জীবন ঘিরে। এ কালফণী অনেক খুঁজি পেয়েছে ওই একটি পুঁজি গো! আমার  চোখের জলে ওই মণিদীপ আগুন হাসির ফিনিক ফোটায়।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে চলত নিতুই সকাল-সাঁঝে। আর এ পথে চলবে না সে সেই ব্যথা হায় বক্ষে বাজে।আমার দ্বারের কাছটিতে তার ফুটত লালী গালের টোলে, টলত চরণ, চাউনি বিবশ কাঁপত নয়ন-পাতার কোলে – কুঁড়ি যেমন প্রথম খোলো গো! কেউ কখনও কইনি কথা, কেবল নিবিড় নীরবতা সুর বাজাত অনাহতা গোপন মরম-বীণার মাঝে। মূক পথের আজ বুক ফেটে যায় স্মরি তারই পায়ের পরশ বুক-খসা তার আঁচর-চুমু, রঙিন ধুলো পাংশু হল, ঘাস শুকাল যেচে বাচাল জোড়-পায়েলার রুমঝুমু!আজও আমার কাটবে গো দিন রোজই যেমন কাটত বেলা, একলা বসে শূন্য ঘরে – তেমনি ঘাটে ভাসবে ভেলা – অবহেলা হেলাফেলায় গো! শুধু সে আর তেমন কর মন রবে না নেশায় ভরে আসার আশায় সে কার তরে সজাগ হয়ে সকল কাজে।ডুকরে কাঁদে মন-কপোতী – ‘কোথায় সাথির কূজন বাজে? সে পা-র ভাষা কোথায় রাজে?’(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার, তোমায় আমি ক'রব সৃজন- এ মোর অহংকার! এমনি চোখের দৃষ্টি দিয়া তোমায় যারা দেখলো প্রিয়া, তাদের কাছে তুমি তুমিই। আমার স্বপনে তুমি নিখিল-রূপের রাণী- মানস-আসনে!সবাই যখন তোমায় ঘিরে ক'রবে কলরব, আমি দূরে ধেয়ান-লোকে র'চব তোমার স্তব। র'চব সুরধুনী-তীরে আমার সুরের উর্বশীরে, নিখিল কন্ঠে দুলবে তুমি গানের কন্ঠ-হার- কবির প্রিয়া অশ্রুমতী গভীর বেদনার!যেদিন আমি থাকবনা ক' থাকবে আমার গান, ব'লবে সবাই, 'কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ?' আকাশ ভরা হাজার তারা রইবে চেয়ে তন্দ্রাহারা, সখার সাথে জাগবে রাতে, চাইবে আকাশে আমার গানে প'ড়বে মনে আমায় আভাসে!বুকের তলা ক'রবে ব্যথা, ব'লবে কাঁদিয়া, 'বন্ধু! সে কে তোমার গানের মানসী প্রিয়া?' হাসবে সবাই, গাইবে গীতি, তুমি নয়ন-জলে তিতি' নতুন ক'রে আমার গানে আমার কবিতায় গহীন নিরালাতে ব'সে খুঁজবে আপনায়! রাখতে যেদিন নারবে ধরা তোমায় ধরিয়া ওরা সবাই ভুলবে তোমায় দু'দিন স্মরিয়া, আমার গানের অশ্রুজলে, আমার বাণীর পদ্মদলে দুলবে তুমি চিরন্তনী চির-নবীনা! রইবে শুধু বাণী, সে-দিন রইবে না বীণা!নাই বা পেলাম কন্ঠে আমার তোমার কন্ঠহার, তোমায় আমি ক'রব সৃজন এ মোর অহংকার! এইত আমার চোখের জলে, আমার গানের সুরের ছলে, কাব্যে আমার, আমার ভাষায়, আমার বেদনায়, নিত্যকালের প্রিয় আমায় ডাকছ ইশারায়!চাই না তোমায় স্বর্গে নিতে, চাই এ ধুলাতে তোমার পায়ে স্বর্গ এনে ভুবন ভুলাতে! ঊর্ধ্বে তোমার- তুমি দেবী, চাই না দেবীর দয়া, যাচি প্রিয়ার আঁখিজল, একটু দুখে অভিমানে নয়ন টলমল!যেমন ক'রে খেলতে তুমি কিশোর বয়শে- মাটির মেয়ের দিতে বিয়ে মনের হরষে। বালু দিয়ে গড়তে গেহ জাগত বুকে মাটির স্নেহ, ছিল না তো স্বর্গ তখন সূর্য তারা চাঁদ, তেমনি ক'রে খেলবে আবার পাতবে মায়া-ফাঁদ!মাটির প্রদীপ জ্বালবে তুমি মাটির কুটীরে, খুশীর রঙে ক'রবে সোনা ধূলি-মুঠিরে। আধখানে চাঁদ আকাশ 'পরে উঠবে যবে গরব-ভরে তুমি বাকী-আধখানা চাঁদ হাসবে ধরাতে, তড়িৎ প'ড়বে তোমার খোঁপায় জড়াতে!তুমি আমার বকুল যূথী- মাটির তারা-ফুল, ঈদের প্রথম চাঁদ গো তোমার কানের পার্সি-দুল। কুসুমী রাঙা শাড়িখানি চৈতী-সাঁঝে প'রবে রাণী, আকাশ-গাঙে জাগবে জোয়ার রঙের রাঙা বান, তোরণ-দ্বারে নাজবে করুণ বারোয়াঁ মূলতান।আমার রচা গানে তোমায় সেই বেলা-শেষে এমনি সুরে চাইবে কেহ পরদেশী এসে! রঙীন সাঁঝে ঐ আঙিনায় চাইবে যারা, তাদের চাওয়ায় আমার চাওয়া রইবে গোপন!- এ মোর অভিমান, যাচবে যারা তোমায়-রচি তাদের তরে গান!নাই বা দিলে ধরা আমার ধরার আঙিনায়, তোমায় জিনে গেলাম সুরের স্বয়ম্বর-সভায়! তোমার রূপে আমার বুবন আলোয় আলোয় হ'ল মগন! কাজ কি জেনে-কাহার আশায় গাঁথছ ফুল-হার, আমি তোমার গাঁথছি মালা এ মোর অহংকার!
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
বলো হে পরম প্রিয়-ঘন মোর স্বামী! আমাতে কাহারও অধিকার নাই, এক সে তোমার আমি। ভালো ও মন্দে মধুর দ্বন্দ্বে কী খেলা আমারে লয়ে খেলিতেছ তুমি, কেহ জানিবে না, থাকুক গোপন হয়ে! আমারেও তাহা জানিতে দিয়ো না শুধু এই জানাইয়ো, আমার পূর্ণ পরম মধুর, মধুর তুমি হে প্রিয়! আমার জানা ও না-জানা সর্ব অস্তিত্বের প্রভু একা তুমি হও! সেথা কারও ছায়া পড়ে নাকো যেন কভু! তোমার আমার পরমানন্দ ফোটে ছন্দ ও গানে, তুমি শুনো তাহা, তুমি লঘু ; গুরুজন হাত দিক কানে! লতার প্রলাপ গোলাপের মতো কথা মোর কেন ফোটে! তুমি জান, কেন উষা আসে ভোরে, কেন শুকতারা ওঠে। ঘুমে জাগরণে শয়নে স্বপনে সর্বকর্মে মম তব স্মৃতি তব নাম যেন হয় সাথি মোর, প্রিয়তম! নিবিড় বেদনা হইয়া আমার বক্ষে নিত্য থেকো, ভুলিতে দিয়ো না, আমি যদি ভুলি অমনি আমারে ডেকো! তুমি যারে ভোলো, ভাগ্যহীন সে তোমারে ভুলিয়া যায়, তুমি কৃপা করে চাহ যার পানে, সেই তব প্রেম পায়। তুমি যারে ডাক, পাগল হইয়া সেই ধায় তব পথে, বাঁশি না শুনিলে বন-হরিণী কি ছুটে আসে বন হতে? চাঁদ ওঠে আগে, দেখে অনুরাগে চকোরী ব্যাকুলা হয়, এত পাখি আছে, চাতকীরই কেন মেঘের সাথে প্রণয়? কে দিলে তাহারে মেঘের তৃষ্ণা, হে রস-মধুর, বলো! তুমি রস দিলে আঁখির আকাশ হয় জল-ছলছল। চাঁদ যবে ওঠে, চকোর তাহার চকোরীরে ভুলে যায়, চকোরীও ভোলে চকোরে, যখন চাঁদের সে দেখা পায়। চাঁদের স্বপন ভুলিয়া দুজন নীড়ে কেন ফিরে আসে? তব লীলা ধরা পড়ে যায়, দেখে কেউ কাঁদে, কেউ হাসে। তুমি নির্গুণ নাকি? আমি দেখি গুণের অন্ত নাই, ভিক্ষা যাচ্ঞা করিতে আসিয়া শুধু তব গুণ গাই! ভুলে যাই আমি কী ভিক্ষা চাই, পরান কাহারে যাচে, খুঁজিয়া পাই না ভিক্ষার ঝুলি, চোরে চুরি করিয়াছে! মন হাসে, প্রাণ কাঁদে! বলে, জানি চুরি করে কোন চোরে। তোমারে যে চায় ভিক্ষা, তাহার ঝুলিটিও নাও হরে! যে হাতে ভিক্ষা চায়, ভিখারির সে হাত কাড়িয়া লও, হে মহামৌনী! কাঁদ কেন এত? কথা কও কথা কও! কত যুগ গেল, কত সে জনম শুনিনি তোমার কথা, এত অনুরাগ দিয়ে, বৈরাগী, কেন দিলে বধিরতা? তোমারে দেখার দৃষ্টি দিলে না, দিলে শুধু আঁখিজল, অশ্রু তোমার কৃপা ; তবু আঁখি হল নাকি নির্মল? দৃষ্টিরে কেন ফিরাইয়া দাও – তব সৃষ্টির পানে? বলো, বলো, কোথা লুকাইয়া আছ সৃষ্টির কোনখানে! ঊর্ধ্বে যাব না, লহো হাত ধরে তব সৃষ্টির কাছে, কোথা তুমি, সেথা লয়ে যাও, এই অন্ধ ভিখারি যাচে! কী ভিক্ষা চায় ভিখারি তোমার, আগে থেকে রাখো জেনে, চাহিব যখন, হে চোর, তখন পলায়ো না হার মেনে। আর কিছু নয়, চির প্রেমময়, তোমারে ভিক্ষা চাই, এক তুমি ছাড়া এই ভিখারির কিছুই চাওয়ার নাই! তব দেওয়া এই তনুমনপ্রাণ মোর যাহা কিছু আছে, তুমি জান, কেন নিবেদন করে দিয়াছি তোমার কাছে। যা-কিছু পেয়েছি, পাইতেছি যাহা, পাইব যা কিছু পরে, সে যে তব দান, তাই নিবেদিত থাক উহা তব তরে। তোমার দানের সম্মান, প্রভু, আমি কি রাখিতে পারি? তব দান দাও সকলে বিলায়ে, আমারে করো ভিখারি! তব দান মোর কামনা ও লোভ সঞ্চিত করে রাখে, বঞ্চিত করে তোমার মিলনে, ওই সবই ঘিরে থাকে! দান দিয়ে মোরে দিয়ো না ফিরায়ে, হে দানী, তোমারে দাও, তব দান নিয়ে তব ভিখারিরে চিরতরে চিনে নাও! তোমারেই চাই জেনে করিয়াছ চুরি ভিক্ষার ঝুলি, ধরা পড়িয়াছ মনোচোর, দাও চোখের বাঁধন খুলি। সব ভুলে যাই, কিছু মনে নাই, খেলাতেছিলে কী খেলা, আমারই মতন ঘুমাইতে কারে দাওনি? তব নাম লয়ে সুদূর মিনারে কে ডাকিছে ভোরবেলা?   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
চুন করে মুখ প্রাচীর পরে বসে শ্রীযুত খোকা, কেননা তার মা বলেছেন সে এক নিরেট বোকা। ডানপিটে সে খোকা এখন মস্ত একটা বীর, হুংকারে তাঁর হাঁস মুরগির ছানার চক্ষুস্থির! সাত লাঠিতে ফড়িং মারেন এমনই পালোয়ান! দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লে সেদিন আস্ত আলোয়ান! ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা, তাঁরে কিনা বোকা বলা? কী এর উচিত সাজা? ভাবতে ভাবতে খোকার হঠাৎ চিন্তা গেল থেমে, দে দৌড় চোঁ-চাঁ আঁধমহলে পাঁচিল হতে নেমে! বুকের ভেতর ছপাই নপাই ধুকপুকুনির চোটে, বাইরে কিন্তু চতুর খোকা ঘাবড়ালেন না মোটে। হাঁপিয়ে এসে মায়ের কাছে বললে, “ওগো মা! আমি নাকি বোক-চন্দর? বুদ্ধি দেখে যা! ওই না একটা মটকু বানর দিব্যি মাচায় বসে লাউ খাচ্ছে? কেউ দেখেনি, দেখি আমিই তো সে। দিদিদেরও চোখ ছিল তো, কেউ কি দেখেছেন? তবে আমায় বোকা কও যে! এ্যাঁ-এ্যাঁ, হাস ক্যান্? কী কও? ‘একী বুদ্ধি হল?’ দেখবে তবে? হাঁ, বুদ্ধি আমার … ভোলা! তু-উ-উ! লৌ-হা হা-হা-হা!”  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
॥ ১॥          আজ বন-উপবন-মে চঞ্চল মেরে মন-মে মোহন মুরলীধারী কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম। সুনো মোহন নূপুর গুঁজত হ্যায়, বাজে মুরলী বোলে রাধা নাম॥ কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥ বোলে বাঁশরি আও শ্যাম-পিয়ারি– ঢুঁড়ত হ্যায় শ্যাম-বিহারী, বনবালা সব চঞ্চল ওড়াওয়ে অঞ্চল কোয়েল সখী গাওয়ে সাথ গুণধাম॥ কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥ ফুলকলি ভোলে ঘুংঘট খোলে পিয়াকি মিলনকি প্রেমকি বোলি বোলে, পবন পিয়া লেকে সুন্দর সৌরভ হাঁসত যমুনা সখী দিবস-যাম॥ কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥ ॥ ২॥ খেলত বায়ু ফুল-বনমে আও প্রাণ-পিয়া। আও মনমে প্রেম-সাথি আজ রজনি গাও প্রাণ-প্রিয়া॥ মন-বনমে প্রেম মিলি ভোলত হ্যায় ফুল-কলি, বোলত হ্যায় পিয়া পিয়া। বাজে মুরলিয়া॥ মন্দিরমে রাজত হ্যায় পিয়া তব মুরতি, প্রেম-পূজা লেও পিয়া, আও প্রেম-সাথি, চাঁদ হাসে তারা সাথে আও পিয়া প্রেম-রাথে, সুন্দর হ্যায় প্রেম-রাতি, আও মোহনিয়া। আও প্রাণ-পিয়া॥॥ ৩॥ চক্র সুদর্শন ছোড়কে মোহন তুম ব্যনে বনওয়ারি। ছিন লিয়ে হ্যায় গদা পদম সব মিল করকে ব্রজনারী॥ চার ভুজা আব দো বানায়ে, ছোড়কে বৈকুন্ঠ ব্রিজ-মে আয়ে, রাস রচায়ে ব্রিজ-কে মোহন ব্যন গয়ে মুরলীধারী॥ সত্যভামা-কো ছোড়কে আয়ে, রাধা-প্যারি সাথ-মে লায়ে, বৈতরণি-কো ছোড়কে ব্যন গয়ে যমুনাকে তটচারী॥ ॥ ৪॥ তুম প্রেমকে ঘনশ্যাম ম্যায় প্রেম কি শ্যাম প্যারি। প্রেম কা গান তুমহরে দান ম্যায় হুঁ প্রেম-ভিখারি॥ হৃদয় বিচমে যমুনা-তীর তুমহরি মুরলী বাজে ধীর, নয়ন-নীর কী বহত যমুনা প্রেমকে মাতোয়ারি॥ যুগ যুগ হোয়ে তুমহরি লীলা মেরে হৃদয়-বনমে। তুমহরে মোহন মন্দির পিয়া মোহত মেরে মনমে। প্রেম-নদী-নীর নিত বহি যায়, তুমহরে চরণ কো কাঁহু না পায়, রোয়ে শ্যাম-প্যারি সাথে ব্রজনারী আও মুরলীধারী॥ ॥ ৫॥ ঝুলন ঝুলায়ে ঝাউ ঝক ঝোরে, দেখো সখী চম্পা লচকে। বাদরা গরজে দামিনী দমকে॥ আও ব্রজ-কি কুঙারি ওঢ়ে নীল শাড়ি, নীল কমল-কলিকে পহনে ঝুমকে॥ হাররে ধান কি লও মে হো বালি, ওড়নি রাঙাও শতরঙ্গি আলি, ঝুলা ঝুলো ডালি ডালি, আও প্রেম-কুঙারি মন ভাও, প্যারে প্যারে সুর-মে শাওনি সুনাও! রিমঝিম রিমঝিম পড়ত কোয়ারে, সুন পিয়া পিয়া কহে মুরলী পুকারে, ওহি বোলি-সে হিরদয় খটকে॥॥ ৬॥ ঝুলে কদমকে ডারকে ঝুলনা মে কিশোরী কিশোর। দেখে দোউ এক এক-কে মুখকো চন্দ্রমা-চকোর– য্যায়সা চন্দ্রমা চকোর হোকে প্রেম-নেশা বিভোর॥ মেঘ-মৃদং বাজে ওহি ঝুলনাকে ছন্দ্-মে, রিমঝিম বাদর বরষে আনন্দ্-মে, দেখনে যুগল শ্রীমুখ-চন্দ-কো গগন ঘেরি আয়ে ঘনঘটা-ঘোর॥ নব নীর বরষণে কো চাতকী চায়, ওয়সে গোপী ঘনশ্যাম দেখ তৃষ্ণা মিটায়; সব দেবদেবী বন্দনা-গীত গায়– ঝরে বরষা-মে ত্রিভুবন-কি আনন্দাশ্রু-লোর॥ ॥ ৭॥ প্রেমনগর-কা ঠিকানা কর-লে প্রেমনগর-কা ঠিকানা। ছোড় কারিয়ে দো-দিন-কা ঘর ওহি রাহ-মে জানা॥ দুনিয়া দওলত হ্যায় সব মায়া, সুখ-দুখ হ্যায় দো জগৎ কা কায়া, দুখ-কো তু গলে লাগা লে– আগে না পসতানা॥ আতি হ্যায় যব রাত আঁধারি– ছোড় তুম মায়া বন্ধন ভারি, প্রেম-নগর কি কর তৈয়ারি আয়া হ্যায় পরোয়ানা॥ ॥ ৮॥ সোওত জগত আঁঠু জান রাহত প্রভু মন-মে তুমহারে ধ্যান। রাত-আঁধেরি-সে চাঁদ সমান প্রভু উজ্জ্বল কর মেরা প্রাণ॥ এক সুর বোলে ঝিওর সারে রাত– এ্যায়সে হি জপ তুহু তেরা নাম, হে নাথ! রুম রুম মে রম রহো মেরে এক তুমহারা গান॥ গয়ি বন্ধু কুটুম স্বজন– ত্যজ দিনু ম্যায় তুমহারে কারণ, তুম হো মেরে প্রাণ-আধারণ– দাসী তুমহারি জ্ঞান॥ (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
আমাদের ভালো করো হে ভগবান। সকলের ভালো করো হে ভগবান।।আমাদের সব লোকে বাসিবে ভালো। আমরাও সকলেরে বাসিব ভালো। রবে না হিংসা দ্বেষ দেহ ও মনে ক্লেশ, মাটির পৃথিবী হবে স্বর্গ- সমান- হে ভগবান।।জ্ঞানের আলোক দাও হে ভগবান। বিপুল শক্তি দাও হে ভগবান।।তোমারই দেওয়া জ্ঞানে চিনিব তোমায়, তোমারই শক্তি হবে কর্মে সহায়। ধর্ম যদি সাথী হয় রবে না ক দুঃখ ভয়, বিপদে পড়িলে তুমি করো যেন ত্রান- হে ভগবান।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
বল রে বন্য হিংস্র বীর, দুঃশাসনের চাই রুধির। চাই রুধির রক্ত চাই, ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই দুঃশাসনের রক্ত চাই! দুঃশাসনের রক্ত চাই!! অত্যাচারী সে দুঃশাসন চাই খুন তার চাই শাসন, হাঁটু গেড়ে তার বুকে বসি ঘাড় ভেঙে তার খুন শোষি। আয় ভীম আয় হিংস্র বীর, কর অ-কণ্ঠ পান রুধির। ওরে এ যে সেই দুঃশাসন দিল শত বীরে নির্বাসন, কচি শিশু বেঁধে বেত্রাঘাত করেছে রে এই ক্রূর স্যাঙাত। মা-বোনেদের হরেছে লাজ দিনের আলোকে এই পিশাচ। বুক ফেটে চোখে জল আসে, তারে ক্ষমা করা? ভীরুতা সে! হিংসাশী মোরা মাংসাশী, ভণ্ডামি ভালবাসাবাসি! শত্রুরে পেলে নিকটে ভাই কাঁচা কলিজাটা চিবিয়ে খাই! মারি লাথি তার মড়া মুখে, তাতা-থৈ নাচি ভীম সুখে। নহি মোরা ভীরু সংসারী, বাঁধি না আমরা ঘরবাড়ি। দিয়াছি তোদের ঘরের সুখ, আঘাতের তরে মোদের বুক। যাহাদের তরে মোরা চাঁড়াল তাহারাই আজি পাড়িছে গা’ল! তাহাদের তরে সন্ধ্যা-দীপ. আমাদের আন্দামান-দ্বীপ! তাহাদের তরে প্রিয়ার বুক আমাদের তরে ভীম চাবুক। তাহাদের ভালবাসাবাসি, আমাদের তরে নীল ফাঁসি। বরিছে তাদের বাজিয়া শাঁখ, মোদের মরণে নিনাদে ঢাক। জীবনের ভোগ শুধু ওদের, তরুণ বয়সে মরা মোদের। কার তরে ওরে কার তরে সৈনিক মোরা পচি মরে? কার তরে পশু সেজেছি আজ, অকাতরে বুক পেতে নি বাজ। ধর্মাধর্ম কেন যে নাই আমাদের, তাহা কে বোঝে ভাই? কেন বিদ্রোহী সব-কিছুর? সব মায়া কেন করেছি দূর? কারে ক’স মন সে-ব্যথা তোর? যার তরে চুরি বলে চোর। যার তরে মাখি গায়ে কাদা, সেই হয় এসে পথে বাধা। ভয় নাই গৃহী! কোরো না ভয়, সুখ আমাদের লক্ষ্য নয়। বিরূপাক্ষ যে মোরা ধাতার, আমাদের তরে ক্লেশ-পাথার। কাড়ি না তোদের অন্ন-গ্রাস, তোমাদের ঘরে হানি না ত্রাস; জালিমের মোরা ফেলাই লাশ, রাজ-রাজড়ার সর্বনাশ! ধর্ম-চিন্তা মোদের নয়, আমাদের নাই মৃত্যু-ভয়! মৃত্যুকে ভয় করে যারা, ধর্মধ্বজ হোক তারা। শুধু মানবের শুভ লাগি সৈনিক যত দুখভাগী। ধার্মিক! দোষ নিয়ো না তার, কোরবানির১ সে, নয় রোজার২ ! তোমাদের তরে মুক্ত দেশ, মোদের প্রাপ্য তোদের শ্লেষ। জানি জানি ঐ রণাঙ্গন হবে যবে মোর মৃৎ-কাফন৩ ফেলিবে কি ছোট একটি শ্বাস? তিক্ত হবে কি মুখের গ্রাস? কিছুকাল পরে হাড্‌ডি মোর পিষে যাবি ভাই জুতিতে তোর! এই যারা আজ ধর্মহীন চিনে শুধু খুন আর সঙিন; তাহাদের মনে পড়িবে কার ঘরে পড়ে যারা খেয়েছে মার? ঘরে বসে নিস স্বর্গ-লোক, মেরে মরে তারে দিস দোজখ৪! ভয়ে-ভীরু ওরে ধর্মবীর! আমরা হিংস্র চাই রুধির! শহতান মোরা? আচ্ছা, তাই। আমাদের পথে এসো না ভাই। মোদের রক্ত-রুধির-রথ, মোদের জাহান্নামের পথ, ছেড়ে দেও ভাই জ্ঞান-প্রবীণ, আমরা কাফের ধর্মহীন! এর চেয়ে বেশি কি দেবে গা’ল? আমরা পিশাচ খুন-মাতাল। চালাও তোমার ধর্ম-রথ, মোদের কাঁটার রক্ত-পথ। আমরা বলিব সর্বদাই দুঃশাসনের রক্ত চাই!! চাই না ধর্ম, চাই না কাম, চাই না মোক্ষ, সব হারাম আমাদের কাছে: শুধু হালাল৫ দুশমন-খুন লাল-সে-লাল॥ ——————————— ১ কোরবানি– বলি। ২. রোজা– উপবাস ৩. মৃৎ-কাফন –লাশ যেখানে থাকে। ৪. দোজখ –নরক ৫. হালাল –পবিত্র
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
হায় অভাগি! আমায় দেবে তোমার মোহন মালা? বদল দিয়ে মালা, নেবে আমার দহন-জ্বালা? কোন ঘরে আজ প্রদীপ জ্বেলে ঘরছাড়াকে সাধতে এলে গগনঘন শান্তি মেলে, হায়! দু-হাত পুরে আনলে ও কি সোহাগ-ক্ষীরের থালা আহা দুখের বরণ ডালা? পথহারা এই লক্ষ্মীছাড়ার পথের ব্যথা পারবে নিতে? করবে বহন, বালা? লক্ষ্মীমণি! তোমার দিকে চাইতে আমি নারি, দু-চোখ আমার নয়ন জলে পুরে, বুক ফেটে যায় তবু এ-হার ছিঁড়তে নাহি পারি, ব্যথাও দিতে নারি, – নারী! তাই যেতে চাই দূরে। ডাকতে তোমায় প্রিয়তমা দু-হাত জুড়ে চাইছি ক্ষমা, চাইছি ক্ষমা চাইছি ক্ষমা গো! নয়ন-বাঁশির চাওয়ার সুরে বনের হরিণ বাঁধবে বৃথা লক্ষ্মী গহনবালা। কল্যাণী! হায় কেমনে তোমায় দেব যে-বিষ পান করেছি নীলের নয়ন-গালা।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)