poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
কাজী নজরুল ইসলাম
শোকমূলক
কোন্‌ সুদূরের চেনা বাঁশীর ডাক শুনেছিস্‌ ওরে চখা? ওরে আমার পলাতকা! তোর প’ড়লো মনে কোন্‌ হারা-ঘর, স্বপন-পারের কোন্‌ অলকা? ওরে আমার পলাতকা! তোর জল ভ’রেছে চপল চোখে, বল্‌ কোন্‌ হারা-মা ডাকলো তোকে রে? ঐ গগন-সীমায় সাঁঝের ছায়ায় হাতছানি দেয় নিবিড় মায়ায়- উতল পাগল! চিনিস্‌ কি তুই চিনিস্‌ ওকে রে? যেন বুক-ভরা ও গভীর স্নেহে ডাক দিয়ে যায়, “আয়, ওরে আয় আয় আয়, কেবল আয় যে আমার দুষ্টু খোকা! ওরে আমার পলাতকা!’’ দখিন্‌ হাওয়ায় বনের কাঁপনে- দুলাল আমার! হাত-ইশারায় মা কি রে তোর ডাক দিয়েছে আজ? এতকদিনে চিন্‌লি কি রে পর ও আপনে! নিশিভোরেই তাই কি আমার নামলো ঘরে সাঁঝ! ধানের শীষে, শ্যামার শিসে- যাদুমণি! বল্‌ সে কিসে রে, তুই শিউরে চেয়ে ছিঁড়লি বাঁধন! চোখ-ভরা তোর উছলে কাঁদন রে! তোরে কে পিয়ালো সবুজ স্নেহের কাঁচা বিষে রে! যেন আচম্‌কা কোন্‌ শশক-শিশু চ’ম্‌কে ডাকে হায়, “ওরে আয় আয় আয় আয় রে খোকন আয়, বনে আয় ফিরে আয় বনের চখা! ওরে চপল পলাতকা’’।।
কাজী নজরুল ইসলাম
শোকমূলক
মোহররমের চাঁদ ওঠার তো আজিও অনেক দেরি, কোন কারবালা-মাতম উঠিল এখনি আমায় ঘেরি'? ফোরাতের মৌজ ফোঁপাইয়া ওঠে কেন গো আমার চোখে! নিখিল-এতিম ভিড় ক'রে কাঁদে আমার মানিস-লোকে! মর্সিয়া-খান! গা'সনে অকালে মর্সিয়া-শোকগীতি, সর্বহারার অশ্রু-প্লাবনে সয়লাব হবে ক্ষিতি!......আজ যবে হায় আমি কুফার পথে গো চলিতে চলিতে কারবালা মাঝে থামি, হেরি চারিধারে ঘিরিয়াছে মোরে মৃত্যু-এজিদ-সেনা, ভায়েরা আমার দুশমন-খুনে মাখিতেছে হাতে হেনা, আমি শুধু হায় রোগ শয্যায় বাজু কামড়ায়ে মরি! দানা-পানি নাই পাতার খিমায় নির্জীব আছি পড়ি'। এমন সময় এল 'দুলদুল' পৃষ্ঠে শূন্য জিন, শূন্যে কে যেন কাঁদিয়া উঠিল- 'জয়নাল আবেদিন'! শীর্ণ-পাঞ্জা দীর্ণ-পাঁজর পর্ণকুটীর ছাড়ি' উঠিতে পড়িতে ছুটিয়া আসিনু, রুধিল দুয়ার দ্বারী! বন্দিনী মা'র ডাক শুনি শুধু জীবন-ফোরাত-পারে, 'এজিদের বেড়া পারায়ে এসেছি, যাদু তুই ফিরে যারে!' কাফেলা যখন কাঁদিয়া উঠিল তখন দুপুর নিশা!- এজিদে পাইব, কোথা পাই হায় আজরাইলের দিশা? জীবন ঘিরিয়া ধূ-ধূ করে আজ শুধু সাহারার বালি, অগ্নি-সিন্ধু করিতেছি পান দোজখ করিয়া খালি! আমি পুড়ি, সাথে বেদনাও পুড়ে, নয়নে শুকায় পানি, কলিজা চাপিড়া তড়পায় শুধু বুক-ভাঙা কাৎরানি! মাতা ফাতেমার লাশের ওপর পড়িয়া কাতর স্বরে হাসান হোসেন কেমন করিয়া কেঁদেছিল, মনে পড়ে!*******************************অশ্রু-প্লাবনে হাবুডুবু খাই বেদনার উপকূলে, নিজের ক্ষতিই বড় করি আমি সকলের ক্ষতি ভুলে! ভুলে যাই-কত বিহগ-শিশুরা এই স্নেহ-বট-ছায়ে আমারই মতন আশ্রয় লভি' ভুলেছে আপন মায়ে। কত সে ক্লান্ত বেদনা-দগ্ধ মুসাফির এরই মূলে বসিয়া পেয়েছে মা'র তসল্লি, সব গ্লানি গেছে ভুলে! আজ তারা সবে করিছে মাতম আমার বাণীর মাঝে, একের বেদনা নিখিলের হ'য়ে বুকে এত ভারী বাজে! আমাদের ঘিরিয়া জমিছে অথৈ শত নয়নের জল, মধ্যে বেদনা-শতদল আমি করিতেছি টলমল! নিখিল-দরদী ছিলেন আম্মা! নাহি মোর অধিকার সকলের মাঝে সকলে ত্যাজিয়া শুধু একা কাঁদিবার!আসিয়াছি মাগো জিয়ারত লাগি' আজি অগ্রজ হ'য়ে মা-হারা আমার ব্যথাতুর ছোট ভাইবোঙ্গুলি লয়ে। অশ্রুতে মোর অন্ধ দু'চোখ, তবু ওরা ভাবিয়াছে হয়ত তোমার পথের দিশা মা জানা আছে মোর কাছে! জীবন-প্রভাতে দেউলিয়া হ'য়ে যারা ভাষাহীন গানে ভর ক'রে মাগো চলেছিল গোরস্থানের পানে, পক্ষ মেলিয়া আবরিলে তুমি সকলে আকুল স্নেহে, যত ঘর-ছাড়া কোলাকুলি করে তব কোলে তব গেহে!'কত বড় তুমি' বলিলে, বলিতে, 'আকাশ শূনয় ব'লে এত কোটি তারা চন্দ্র সূর্য গ্রহে ধরিয়াছে কোলে। শূন্য সে বুক তবু ভরেনি রে, আজো সেথা আছে ঠাঁই, শূন্য ভরিতে শূন্যতা ছাড়া দ্বিতীয় সে কিছু নাই।'গোর-পলাতক মোরা বুঝি নাই মাগো তুমি আগে থেকে গোরস্থানে দেনা শুধিয়াচ আপনারে বাঁধা রেখে! ভুলাইয়া রাখি গৃহ-হারাদের দিয়া স্ব-গৃহের চাবি গোপনে মিটালে আমাদের ঋণ-মৃত্যুর মহা-দাবি! সকলেরে তুমি সেবা ক'রে গেলে, নিলে না কারুর সেবা, আলোক সবারে আলো দেয়, দেয় আলোকেরে আল কেবা?আমাদেরও চেয়ে গোপন গভীর কাঁদে বাণী ব্যথাতুর, থেমে গেছে তার দুলালী মেয়ের জ্বালা-ক্রন্দন সুর। কমল-কাননে থেমে গেছে ঝড়ে ঘূর্ণির দামাডোল, কারার বক্ষে বাজে না ক' আর ডাঙন-ডঙ্কা-রোল! বসিবে কবে জ্ঞানের তখতে, বাংলার মুসলিম! বারে-বারে টুটে কলম তোমার না লিখিতে শুধু 'মিম'।*********************************সে ছিল আরব-বেদুঈনদের পথ-ভুলে-আসা মেয়ে, কাঁদিয়া উঠিত হেরেমের উঁচা প্রাচীরের পানে চেয়ে! সকলের সাথে সকলের মতো চাহিত সে আলো বায়ু, বন্ধন-বাঁধ ডিঙাতে না পেরে ডিঙাইয়া গেল আয়ু!সে বলিত, "ঐ হেরেম-মহল নারীদের তরে নহে, নারী নহে যারা ভুলে বাঁদী-খানা ঐ হেরেমের মোহে! নারীদের ঐ বাঁদী ক'রে রাখা অবিশ্বাসের মাঝে লোভী পুরুষের পশু-প্রবৃতী হীন অপমান রাজে! আপন ভুলিয়া বিশ্বপালিকা নিত্য-কালের নারী করিছে পুরুষ জেল-দারোগার কামনার তাঁবেদারি! বলে না কোরান, বলে না হাদিস, ইসলামী ইতিহাস, নারী নর-দাসী, বন্দিনী র'বে হেরেমেতে বারো মাস! হাদিস কোরান ফেকাহ লয়ে যারা করিছে ব্যবসাদারি, মানে না ক' তারা কোরানের বানী-সমান নর ও নারী! শাস্ত্র ছাঁকিয়া নিজেদের যত সুবিধা বাছাই ক'রে নারীদের বেলা গুম হ'য়ে রয় গুমরাহ যত চোরে!" দিনের আলোকে ধরেছিল এই মুনাফেকদের চুরি, মসজিদে বসে স্বার্থের তরে ইসলামে হানা ছুরি! আমি জানি মাগো আলোকের লাগি' তব এই অভিযান হেরেম-রক্ষী যত গোলামের কাঁপায়ে তুলিত প্রান! গোলা-গুলি নাই, গালাগালি আছে, তাই দিয়ে তারা লড়ে, বোঝে না ক' থুথু উপরে ছুঁড়িলে আপনারি মুখে পড়ে! আমরা দেখেছি, যত গালি ওরা ছুঁড়িয়া মেরেছে গায়ে, ফুল হয়ে সব ফুটিয়া উঠিয়া ঝরিয়াছে তব পায়ে। **************************কাঁটার কিঞ্জে ছিলে নাগ্মাতা সদা উদ্যত-ফণা আঘাত করিতে আসিয়া 'আঘাত' করিয়াছে বন্দনা! তোমার বিষের নীহারিকা- লোকে নিতি নব নব গ্রহ জন্ম লভিয়া নিষেধ- জগতে জাগায়েছে বিদ্রোহ! জহরের তেজ পান ক'রে মাগো তব নাগ-শিশু যত নিয়ন্ত্রিতের শিরে গড়িয়াছে ধ্বজা বিজয়োদ্ধত! মানেনি ক' তারা শাসন- ত্রাসন বাধা-নিষেধের বেড়া,- মানুষ থাকে না খোঁইয়াড়ে বন্ধ, থাকে বটে গরু-ভেড়া।এসম-আজম তাবিজের মত আজো তব রুহু পাক, তাদের ঘেরিয়া আছে কি তেমনি বেদনায় নির্বাক? অথবা 'খাতুনে-জান্নাত'মাতা ফাতিমার গুলবাগে গোলাব-কাঁটায় রাঙা গুল হ'ইয়ে ফুটেছে রক্তরাগে?***************************তোমার বেদনা- সাগরে জোয়ার জাগিল যাদের টানে, তারা কোথা আজ? সাগর শুকালে চাঁদ মরে কোনখানে?যাহাদের তরে অকালে, আম্মা, জান দিলে কোরবান, তাদের জাগায় সার্থক হোক তোমার আত্নদান! মধ্যপথে মা তোমার প্রানের নিভিল যে দীপ-শিখা, জ্বলিক নিখিল-নারীও-সীমান্তে হ'য়ে তাই জয়টিকা! বন্দিনীদের বেদনার মাঝে বাঁচিয়া আছ মা তুমি, চিরজীবী মেয়ে, তবু যাই ওই কবরের ধূলি চুমি'! মৃত্যুর পানে চলিতে আছিলে জীবনের পথ দিয়া, জীবনের পানে চলিছ কি আজ মৃত্যুরে পারাইয়া?
কাজী নজরুল ইসলাম
স্তোত্রমূলক
তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে। প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে! আমির-উল-মুমেনিন, তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন। তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি, বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী? ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান? মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান? আবার লুটায়ে পড়ি। 'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি। উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু! আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু! ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন! সত্যের আলো  নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ। শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি! ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি? পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি। আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর- 'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।' *  *  *  *  *  *  *  *  *  * অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে, ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে। শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ। সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে, বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে। হেরি পশ্চাতে চাহি- তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি। দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে- উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে! হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি একটি  মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি। প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি! মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে, সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে। কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে, তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।' ...ভৃত্য দস্ত চুমি কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি? উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?' খলিফা হাসিয়া বলে, 'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে। রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।' কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই। আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই। আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা। ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা। ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি, মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী। জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা, কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা। জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব- অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয়  হে মানব।' *  *  *  *  *  *  *  *  *  * তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়, সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়। মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান, তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান, সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা, বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না। *  *  *  *  *  *  *  *  *  * মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি, মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়, উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়। শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে, বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে, আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'। কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা, বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা! রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার? মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে! এত যে কোমল প্রাণ, করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান! মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে! ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি- 'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।' আবু শাহমার গোরে কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে। খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে, 'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে, একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে, রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে। হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট! অপমান তব করিব না আজ করিয়া  নান্দী পাঠ, মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই। (সংক্ষেপিত)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না, জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না। ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না, শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।। হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা, আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না। ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না। চলার তোমার বাকী পথটুকু- পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক- হায়,  অমন ক’রে ও অকর”ণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না, ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না।। দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি তব ব্যথা কেউ বোঝে না, তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী, পথে ফেরে যারা পথ-হারা, কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না, বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি? দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে? এ যে মিছে অভিমান পরবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে! তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায় কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায় আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়- পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক! কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না, ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আমার   বিদায়-রথের চাকার ধ্বনি ওই গো এবার কানে আসে। পুবের হাওয়া তাই কেঁদে যায় ঝাউয়ের বনে দিঘল শ্বাসে। ব্যথায় বিবশ গুলঞ্চ ফুল মালঞ্চে আজ তাই শোকাকুল, মাটির মায়ের কোলের মায়া ওগো আমার প্রাণ উদাসে।       অঙ্গ আসে অলস হয়ে নেতিয়ে-পড়া অলস ঘুমে, স্বপনপারের বিদেশিনীর হিম-ছোঁয়া যায় নয়ন চুমে। হাতছানি দেয় অনাগতা, আকাশ-ডোবা বিদায়-ব্যথা লুটায় আমার ভুবন ভরি বাঁধন ছেঁড়ার কাঁদন-ত্রাসে।       মোর বেদনার কপূর্রবাস ভরপুর আজ দিগ্‌বলয়ে, বনের আঁধার লুটিয়ে কাঁদে হরিণটি তার হারার ভয়ে। হারিয়ে পাওয়া মানসী হায় নয়নজলে শয়ন তিতায়, ওগো, এ কোন্ জাদুর মায়ায় দু-চোখ আমার জলে ভাসে। আজ    আকাশ-সীমায় শব্দ শুনি অচিন পায়ের আসা-যাওয়ার, তাই মনে হয় এই যেন শেষ আমার অনেক দাবি-দাওয়ার। আজ কেহ নাই পথের সাথি, সামনে শুধু নিবিড় রাতি, আমায়   দূরের বাঁশি ডাক দিয়েছে, রাখবে কে আর বাঁধন-পাশে।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
অকূল তুফানে নাইয়া কর পার পাপ দরিয়াতে ডুবে মরি কান্ডারি নাই কড়ি নাই তরী প্রভু পারে তরিবার।। থির নহে চিত পাপ-ভীত সদা টলমল পুণ্যহীন শূন্য মরু সম হৃদি-তল নাহি ফুল নাহি ফল পার কর হে পার কর ডাকি কাঁদি অবিরল নাহি সঙ্গী নাহি বন্ধু নাহি পথেরি সম্বল। সাহারায় নাহি জল শাওন বরিষা সম তব করুণার ধারা ঝরিয়া পড়ুক পরানে আমার।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে, লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গরস্থানে। হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত- কংকাল কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গরুর পাল? রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু- সলিলে হায়, বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়। থালা, ঘটি, বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে, তীর খাওয়া বুক, ঋণে- বাঁধা- শির, লুটাতে খোদার রাহে।জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ? একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু- পাঁজরের হাড়? আসমান- জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে। এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর পুটে। কৃষকের ঈদ!ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার, যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার। মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু- বন্যা আসে এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা- মসজিদে আশেপাশে।কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে? চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারি মাঝে চোখে বিঁধে জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধণীরা এসেছে সেথা, এই ঈদগাহে তুমি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা? নিঙ্গাড়ি’ কোরান হাদিস ও ফেকাহ, এই মৃতদের মুখে অমৃত কখনো দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বল বুকে। নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি, হায় তোতাপাখি! শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি? ফল বহিয়াছ, পাওনিক রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি, লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি।আল্লা- তত্ত্ব জেনেছ কি, যিনি সর্বশক্তিমান? শক্তি পেলো না জীবনে যে জন, সে নহে মুসলমান। ঈমান! ঈমান! বল রাতদিন, ঈমান কি এত সোজা? ঈমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানি বোঝা?শোনো মিথ্যুক! এই দুনিয়ায় পুর্ণ যার ঈমান, শক্তিধর সে টলাইতে পারে ইঙ্গিতে আসমান। আল্লাহর নাম লইয়াছ শুধু, বোঝনিক আল্লারে। নিজে যে অন্ধ সে কি অন্যরে আলোকে লইতে পারে? নিজে যে স্বাধীন হইলনা সে স্বাধীনতা দেবে কাকে? মধু দেবে সে কি মানুষে, যাহার মধু নাই মৌচাকে?কোথা সে শক্তি- সিদ্ধ ইমাম, প্রতি পদাঘাতে যার আবে- জমজম শক্তি- উৎস বাহিরায় অনিবার? আপনি শক্তি লভেনি যে জন, হায় সে শক্তি-হীন হয়েছে ইমাম, তাহারি খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন। দীন কাঙ্গালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাগিদ কোথা সে মহা- সাধক আনিবে যে পুন ঈদ? ছিনিয়া আনিবে আসমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি, ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি। সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে? রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
তুমি ভাসাইলে আশাতরি, প্রভু, দুর্দিন ঘন ঝড়ে, ততবার ঝড় থেমে যায়, তরি যতবার টলে পড়ে। তুমি যে-তরির কাণ্ডারি তার ডুবিবার ভয় নাই, তোমার আদেশে সে তরির দাঁড় বাহি, গুন টেনে যাই। আসে বিরুদ্ধশক্তি ভীষণ প্রলয়-তুফান লয়ে কাঁপে তরণির যাত্রীরা কেহ নিরাশায় কেহ ভয়ে। নদীজল কাঁপে টলমল যেন আহত ফণীর ফণা, দমকে অশনি চমকে দামিনী – ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা। অন্ধ যামিনী, দেখিতে পাই না কাণ্ডারি তুমি কোথা? তোমার জ্যোতিতে অগ্রপথের দূর করো অন্ধতা! তোমার আলোরে আবৃত করে ভয়াল তিমির রাতি, দূর করো ভয়, হে চির-অভয়, জ্বালায়ে আশার বাতি! হে নবযুগের নব অভিযান-সেনাদল, শোনো সবে, তোমরা টলিলে তুফানে তরণি আরও চঞ্চল হবে। এ তরির কাণ্ডারি আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান, বিশ্বাস রাখো তাঁর শক্তিতে, এ তাঁহার অভিযান। ভয় যার মনে যুদ্ধ না করে তার পরাজয় হয়, ভয় যার নাই মরিয়াও সেই শহিদের হয় জয়। অগ্রপথের সেনারা করে না পৃষ্ঠপ্রদর্শন, জয়ী হয় তারা জীবনে, অথবা মৃত্যু করে বরণ! জীবন মৃত্যু সমান তাদের, ঘুম জাগরণ সম, এক আল্লাহ্‌ ইহাদের প্রভু, বন্ধু ও প্রিয়তম। আল্লার নামে অভিযান করি, আমাদের ভয় কোথা, দুবার মরে না মানুষ, তবুও কেন এ দুর্বলতা। ডুবে যদি তরি, বাঁচি কীবা মরি, আল্লা মোদের সাথি, যেখানেই উঠি তাঁর আশ্রয় পাব মোরা দিবারাতি। মোদের ভরসা একমাত্র সে নিত্য পরম প্রভু, দুলুক তরণি, আমাদের মন নাহি দোলে যেন কভু। পাব কূল মোরা পাব আশ্রয় – রাখো বিশ্বাস রাখো, তাঁর কাছে করো শক্তি ভিক্ষা, তাঁরে প্রাণ দিয়া ডাকো। পূর্ণ ধৈর্য ধারণ করিয়া থির করো প্রাণমন, দূর হবে সব বাধা ও বিঘ্ন,আসিবে প্রভঞ্জন। হয়তো প্রভুর পরীক্ষা ইহা, ভয় দেখাইয়া তিনি ভয় করিবেন দূর আমাদের, জ্ঞাতা একক যিনি! পার হইতেছি মোরা নিরাশা ও অবিশ্বাসের নদী, ডুবিবে তরণি, যদি ভয় পাই অধৈর্য আসে যদি! হে নবযুগের নৌসেনা, রণতরির নওজোয়ান! আল্লারে নিবেদন করে দাও আল্লার দেওয়া প্রাণ। পলাইয়া কেহ বাঁচিতে পারে না মৃত্যুর হাত হতে, মরিতে হয় তো মরিব আমরা এক-আল্লার পথে। পৃথিবীর চেয়ে সুন্দরতর কত যে জগৎ আছে, সে জগৎ দেখে যাব আনন্দধামে আল্লার কাছে। – আমাদের কীবা ভয় – আমাদের চির চাওয়া-পাওয়া এক আল্লাহ্‌ প্রেমময়! তাঁর প্রেমে মোরা উন্মাদ, তাঁর তেজ হাতে তলোয়ার, মোদের লক্ষ্য চির-পূর্ণতা নিত্য সঙ্গ তাঁর। দুলুক মোদের রণতরি, যেন মনতরি নাহি দোলে, যেখানেই যাই মোরা জানি ঠাঁই পাব, পাব তাঁর কোলে। থেমে যাবে এই দুর্যোগ-ঘন প্রলয় তুফান ঝড়, ‘কওসর-অমৃত’ পাব, করো আল্লাতে নির্ভর! মোদের অপূর্ণতা ও অভাব পূরণ করিবে সে, অসম্ভবের অভিযান-পথে সৈন্য করেছে যে! তাঁরই নাম লয়ে বলি, বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো, তাঁর সাথে ভাব হয় যার, তার অভাব থাকে না কোনো। তাঁহারই কৃপায় তাঁরে ভালোবেসে, বলে আমি চলে যাই, তাঁরে যে পেয়েছে, দুনিয়ায় তার কোন চাওয়া-পাওয়া নাই। আর বলিব না। তাঁরে ভালোবেসে ফিরে এসে মোরে বলো, কী হারাইয়া কী পাইয়াছ তুমি, কী দশা তোমার হল!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর, আজ্‌কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার! আজ্‌কে তোমার জন্মদিন- স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন হাত্‌ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার! এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার! শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল, কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল? আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ, নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,- কোন্‌ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল ঢেকেছে আজ কোন্‌ দেবতার কোন্‌ সে পাষাণ-তল? অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’ আস্‌ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ ঘাটে আমি রই ব’সে আমার মাণিক কই গো সে? পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্‌ছে বুকে ঘা! আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা! বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্‌রে ওঠে মন, পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন। তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুল্‌ছে মহুল বন, ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন! প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই, মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্‌নি যেত নুই। হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল, গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল থর্‌কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই! বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই! চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব, দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর! ভুঁই- তারকা সুন্দরী সজনে ফুলের দল ঝরি’ থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর। ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর! পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ! খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ! লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই, বলতে, ‘আমি অমনি চাই! খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ! হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ” ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল, জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল হঠাৎ জলে রাখত্‌ে পা, কাজলা দীঘির শিউরে গা- কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল! ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল! উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়, ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়! শঙ্খ বাজে মন্দিরে, সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে, ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়! মাঠের বাঁশী বন্‌-উদাসী ভীম্‌পলাশী গায়অ বাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে! আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে? ডাবের শীতল জল দিয়ে মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে? প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে? বউল ঝ’রে  ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম, রসের পীড়ায় টস্‌টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম! কামরাঙারা রাঙল ফের পীড়ন পেতে ঐ মুখের, স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম- জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম! ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর, ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর! সেই চাহনি নীল-কমল ভ’রল আমার মানস-জল, কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর! বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর! তরী আমার কোন্‌ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল, স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল! পাহাড়তলীর শালবনায় বিষের মত নীল ঘনায়! সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল! হায় গো, আমার ভিন্‌ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল! কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই, কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই! কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর- কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর? তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই? কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই! পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’, এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা! আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায় আকুল দোলা লাগবে না’য়, এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।
কাজী নজরুল ইসলাম
চিন্তামূলক
(কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘খাঁচার পাখি’ শীর্ষক করুণ কবিতাটি পড়িয়া)কে ভাই তুমি সজল গলায় গাইলে গজল আপশোশের? ফাগুন-বনের নিবল আগুন, লাগল সেথা ছাপ পোষের।দরদ-ভেজা কান্না-কাতর ছিন্ন তোমার স্বর শুনে ইরান মুলুক বিরান হল এমন বাহার-মরশুমে।সিস্তানের ওই গুল-বাগিচা গুলিস্তান আর বোস্তানে সোস্ত হয়ে দখিন হাওয়া কাঁদল সে আপশোশ-তানে।এ কোন যিগর -পস্তানি সুর? মস্তানি সব ফুল-বালা ঝুরল, তাদের নাজুক বুকে বাজল ব্যথার শূল-জ্বালা।আবছা মনে পড়ছে, যে দিন শিরাজ -বাগের গুল ভুলি শ্যামল মেয়ের সোহাগ-শ্যামার শ্যাম হলে ভাই বুলবুলি, –কালো মেয়ের কাজল চোখের পাগল চাওয়ার ইঙ্গিতে মস্ত্ হয়ে কাঁকন চুড়ির কিঙ্কিণি রিন ঝিন গীতে।নাচলে দেদার দাদরা তালে, কারফাতে, সরফর্দাতে, – হাঠাৎ তোমার কাঁপল গলা ‘খাঁচার পাখি’ ‘গর্বাতে’।চৈতালিতে বৈকালি সুর গাইলে, “নিজের নই মালিক, আফ্‌সে মরি আপশোশে আহ্, আপ-সে বন্দী বৈতালিক।কাঁদায় সদাই ঘেরা-টোপের আঁধার ধাঁধায়, তায় একা, ব্যথার ডালি একলা সাজাই, সাথির আমার নাই দেখা।অসাড় জীবন, ঝাপসা দুচোখ খাঁচার জীবন একটানা।” অশ্রু আসে, আর কেন ভাই, ব্যথার ঘায়ে ঘা হানা?খুব জানি ভাই, ব্যর্থ জীবন ডুবায় যারা সংগীতেই, মরম-ব্যথা বুঝতে তাদের দিল-দরদি সঙ্গী নেই।জানতে কে চায় গানের পাখি বিপুল ব্যথার বুক ভরাট, সবার যখন নওরাতি, হায়, মোদের তখন দুঃখ-রাত!ওদের সাথি, মোদের রাতি শয়ন আনে নয়ন-জল; গান গেয়ে ভাই ঘামলে কপাল মুছতে সে ঘাম নাই অঞ্চল।তাই ভাবি আজ কোন দরদে পিষছে তোমার কলজে-তল? কার অভাব আজ বাজছে বুকে, কলজে চুঁয়ে গলছে জল!কাতর হয়ে পাথর-বুকে বয় যবে ক্ষীর-সুরধুনী, হোক তা সুধা, খুব জানি ভাই, সে সুধা ভরপুর-খুনই।আজ যে তোমার আঁকা-আঁশু কণ্ঠ ছিঁড়ে উছলে যায় – কতই ব্যথায়, ভাবতে যে তা জান ওঠে ভাই কচলে হায়!বসন্ত তো কতই এল, গেল খাঁচার পাশ দিয়ে, এল অনেক আশ নিয়ে, শেষ গেল দীঘল-শ্বাস নিয়ে।অনেক শারাব খারাব হল, অনেক সাকির ভাঙল বুক! আজ এল কোন দীপান্বিতা? কার শরমে রাঙল মুখ?কোন দরদি ফিরল? পেলে কোন হারা-বুক আলিঙ্গন? আজ যে তোমার হিয়ার রঙে উঠল রেঙে ডালিম-বন!যিগর-ছেঁড়া দিগর তোমার আজ কি এল ঘর ফিরে? তাই কি এমন কাশ ফুটেছে তোমার ব্যথার চর ফিরে?নীড়ের পাখি ম্লান চোখে চায়, শুনছে তোমার ছিন্ন সুর; বেলা-শেষের তান ধরেছে যখন তোমার দিন দুপুর!মুক্ত আমি পথিক-পাখি আনন্দ-গান গাই পথের, কান্না-হাসির বহ্নি-ঘাতের বক্ষে আমার চিহ্ন ঢের ;বীণ ছাড়া মোর একলা পথের প্রাণের দোসর অধিক নাই, কান্না শুনে হাসি আমি, আঘাত আমার পথিক-ভাই।বেদনা-ব্যথা নিত্য সাথি, – তবু ভাই ওই সিক্ত সুর, দুচোখ পুরে অশ্রু আনে উদাস করে চিত্ত-পুর!ঝাপসা তোমার দুচোখ শুনে সুরাখ হল কলজেতে, নীল পাথারের সাঁতার পানি লাখ চোখে ভাই গলছে যে!বাদশা-কবি! সালাম জানায় ভক্ত তোমার অ-কবি, কইতে গিয়ে অশ্রুতে মোর কথা ডুবে যায় সবই!  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
পউষ এলো গো! পউষ এলো অশ্র”-পাথার হিম পারাবার পারায়ে ঐ যে এলো গো- কুজঝটিকার ঘোম্‌টা-পরা দিগন-রে দাঁড়ায়ে।। সে এলো আর পাতায় পাতায় হায় বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়, অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায় পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে।। পউষ এলো গো- এক বছরের শ্রানি- পথের, কালের আয়ু-ক্ষয়, পাকা ধানের বিদায়-ঋতু, নতুন আসার ভয়। পউষ এলো গো! পউষ এলো- শুক্‌নো নিশাস্‌, কাঁদন-ভারাতুর বিদায়-ক্ষণের (আ-হা) ভাঙা গলার সুর- ‘ ওঠে পথিক! যাবে অনেক দূর কালো চোখের কর”ণ চাওয়া ছাড়ায়ে।।’
কাজী নজরুল ইসলাম
ব্যঙ্গাত্মক
* হুগলি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন জেলের সকল প্রকার জুলুম আমাদের উপর দিয়ে পরখ করে নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় জেলের মূর্তিমান ‘জুলুম’ বড়-কর্তাকে দেখে এই গেয়ে আমরা অভিনন্দন জানাতাম। তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে। আমার এ গান তোমারি ধ্যান, তুমি ধন্য ধন্য হে॥ রেখেছে সান্ত্রী পাহারা দোরে আঁধার-কক্ষে জামাই-আদরে বেঁধেছ শিকল-প্রণয়-ডোরে। তুমি ধন্য ধন্য হে॥ আ-কাঁড়া চালের অন্ন-লবণ করেছে আমার রসনা-লোভন, বুড়ো ডাটা-ঘাঁটা লাপসি শোভন, তুমি ধন্য ধন্য হে॥ ধরো ধরো খুড়ো চপেটা মুষ্টি, খেয়ে গয়া পাবে সোজা স-গুষ্টি, ওল-ছোলা দেহ ধবল-কুষ্টি তুমি ধন্য ধন্য হে॥
কাজী নজরুল ইসলাম
শোকমূলক
আমার   পিয়াল বনের শ্যামল পিয়ার ওই বাজে গো বিদায়বাঁশি, পথ-ঘুরানো সুর হেনে সে আবার হাসে নিদয় হাসি। পথিক বলে পথের গেহ বিলিয়েছিল একটু স্নেহ, তাই দেখে তার ঈর্ষাভরা কান্নাতে চোখ গেল ভাসি। তখন মোদের কিশোর বয়স যেদিন হঠাৎ টুটল বাঁধন, সেই হতে কার বিদায়-বেণুর জগৎ জুড়ে শুনছি কাঁদন। সেই কিশোরীর হারা মায়া ভুবন ভরে নিল কায়া, দুলে আজও তারই ছায়া আমার সকল পথে আসি।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
এসো এসো এসো ওগো মরণ! এই   মরণ-ভীতু মানুষ-মেষের ভয় করো তো হরণ॥ না বেরিয়েই পথে যারা পথের ভয়ে ঘরে বন্ধ-করা অন্ধকারে মরার আগেই মরে, তাতা থইথই তাতা থইথই তাদের বুকের পরে ভীম   রুদ্রতালে নাচুক তোমার ভাঙন-ভরা চরণ॥ দীপক রাগে বাজাও জীবন-বাঁশি, মড়ার মুখেও আগুন উঠুক হাসি। কাঁধে পিঠে কাঁদে যেথা শিকল জুতোর-ছাপ, নাই সেখানে মানুষ সেথা বাঁচা-ও মহাপাপ। সে   দেশের বুকে শ্মশান-মশান জ্বালুক তোমার শাপ, সেথা  জাগুক নবীন সৃষ্টি আবার হোক নব নামকরণ॥ হাতের তোমার দণ্ড উঠুক কেঁপে এবার দাসের ভুবন ভবন ব্যেপে, মেষগুলোকে শেষ করে দেশ-চিতার বুকে নাচো! শব করে আজ শয়ন, হে শিব জানাও তুমি আছ। মরায়-ভরা ধরায়, মরণ! তুমিই শুধু বাঁচো – এই   শেষের মাঝেই অশেষ তুমি, করছি তোমায় বরণ॥ জ্ঞান-বুড়ো ওই বলছে জীবন মায়া, নাশ করো ওই ভীরুর কায়া ছায়া! মুক্তিদাতা মরণ! এসো কালবোশেখির বেশে; মরার আগেই মরল যারা, নাও তাদেরে এসে। জীবন তুমি সৃষ্টি তুমি জরা-মরার দেশে, তাই   শিকল-বিকল মাগছে তোমার মরণ-হরণ শরণ॥   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
ওই রাঙা পায়ে রাঙা আলতা প্রথম যেদিন পরেছিলে, সেদিন তুমি আমায় কি গো ভুলেও মনে করেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে?জানি, তোমার নারীর মনে নিত্য-নূতন পাওয়ার পিয়াস হঠাৎ কেন জাগল সেদিন, কণ্ঠ ফেটে কাঁদল তিয়াস! মোর আসনে সেদিন রানি নূতন রাজায় বরলে আনি, আমার রক্তে চরণ রেখে তাহার বুকে মরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।মর্মমূলে হানলে আমার অবিশ্বাসের তীক্ষ্ম ছুরি, সে-খুন সখায় অর্ঘ্য দিলে যুগল চরণ-পদ্মে পুরি। আমার প্রাণের রক্তকমল নিঙড়ে হল লাল পদতল, সেই শতদল দিয়ে তোমার নতুন রাজায় বরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।আমায় হেলায় হত্যা করে দাঁড়িয়ে আমার রক্ত-বুকে অধর-আঙুর নিঙড়েছিলে সখার তৃষা-শুষ্ক মুখে। আলতা সে নয়, সে যে খালি আমার যত চুমোর লালি! খেলতে হোরি তাইতে, গোরি, চরণতরি ভরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।জানি রানি, এমনি করে আমার বুকের রক্তধারায় আমারই প্রেম জন্মে জন্মে তোমার পায়ে আলতা পরায়! এবারও সেই আলতা-চরণ দেখতে প্রথম পায়নি নয়ন! মরণ-শোষা রক্ত আমার চরণ-ধারে ধরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।কাহার পুলক-অলক্তকের রক্তধারায় ডুবিয়ে চরণ উদাসিনী! যেচেছিলে মনের মনে আমার মরণ? আমার সকল দাবি দলে লিখলে ‘বিদায়’ চরণতলে! আমার মরণ দিয়ে তোমার সখার হৃদয় হরেছিলে – আলতা যেদিন পরেছিলে।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন! ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,– আজিকার এ খুন কোর্‌বানির! দুম্বা-শির      রুম্-বাসীর শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন? বাস্‍! চুপ খামোশ রোদন! আজ  শোর ওঠে জোর 'খুন দে, জান দে, শির দে বৎস' শোন! ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। খঞ্জর মারো গর্দানেই, পঞ্জরে আজি দরদ নেই, মর্দানি'ই পর্দা নেই ডর্‌তা নেই আজ খুন্-খারাবিতে রক্ত-লুব্ধ মন! খুনে  খেল্‌ব খুন্-মাতন! দুনো  উন্মাদনাতে সত্য মুক্তি আন্‌তে যুঝ্‌র রণ। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। চড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার মুস্‌লিমে সারা দুনিয়াটার। 'জুল্‌ফেকার' খুল্‌বে তার দু'ধারী ধার্‌ শেরে-খোদার রক্তে-পূত-বদন! খনে আজকে রুধ্‌ব মন! ওরে  শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্! ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। আস্তানা সিধা রাস্তা নয়, 'আজাদি' মেলে না পস্তানোয়! দস্তা নয় সে     সস্তা নয়! হত্যা নয় কি মৃত্যুও? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্ কাঁদে-শক্তি-দুঃস্থ শোন্– 'এয়্‌  ইব্‌রাহিম্ আজ কোর্‌বানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!' ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। এ তো নহে লোহু তরবারের ঘাতক জালিম জোর্‌বারের! কোরবানের জোর-জানের খুন এ যে, এতে গোর্দা ঢের রে, এ ত্যাগে 'বুদ্ধ' মন! এতে    মা রাখে পুত্র পণ্! তাই  জননী হাজেরা বেটারে পরাল বলির পূত বসন! ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। এই দিনই 'মীনা'-ময়দানে পুত্র-স্নেহের গর্দানে ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে রেখেছে আব্বা ইব্‌রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ! ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন! আজ  জল্লাদ নয়, প্রহলাদ সম মোল্লা খুন-বদন! ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। দ্যাখ্    কেঁপেছে 'আরশ' আস্‌মানে, মন-খুনি কি রে রাশ মানে? ত্রাস প্রাণে?-তবে রাস্তা নে‍! প্রলয়- বিষাণ কিয়ামতে তবে বাজাবে কোন্ বোধন? সেকি       সৃষ্টি-সংশোধন? ওরে  তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!– ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। মুস্‌লিম-রণ-ডঙ্কা সে, খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে? টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে ওরে  হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ! ঢালে    বাজ্‌বে ঝন্-ঝনন! ওরে  সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন! ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। জোর চাই আর যাচ্‌না নয় কোরবানি-দিন আজ না ওই? বাজ্‌না কই? সাজ্‌না কই? কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ? বল্– 'যুঝ্‌ব জান্ ভি পণ!' ঐ   খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ! আজ  আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন। ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন। ———————————– রহমান– করুণাময় খামোশ– নীরব। গর্দানে– স্কন্ধে জান্নাত– স্বর্গ জুলফেকার– মহাবীর হজরত আলীর বিশ্বত্রাস তরবারি শের-খোদা– খোদার সিংহ; হজরত আলীকে এই গৌরাবান্বিত নামে অভিহিত করা হয়। জোরবার– বলদৃপ্ত জোর-জান– মহাপ্রাণ আজাদি– মুক্তি আব্বা– বাবা ইবরাহিম– Abraham হাজেরা– হজরত ইবরাহীমের স্ত্রী
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
আজ   না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে ওই   কংস-কারার দ্বার ঠেলে। আজ   শব-শ্মশানে শিব নাচে ওই ফুল-ফুটানো পা ফেলে॥ আজ   প্রেম-দ্বারকায় ডেকেছে বান মরুভূমে জাগল তুফান, দিগ্‌বিদিকে উপচে পড়ে প্রাণ রে! তুমি   জীবন-দুলাল সব লালে-লাল করলে প্রাণের রং ঢেলে॥ ওই   শ্রাবস্তি-ঢল আসল নেমে আজ ভারতের জেরুজালেমে মুক্তি-পাগল এই প্রেমিকের প্রেমে রে‌! ওরে   আজ নদীয়ার শ্যাম নিকুঞ্জে রক্ষ-অরি রাম খেলে॥ ওই    চরকা-চাকায় ঘর্ঘরঘর শুনি কাহার আসার খবর, ঢেউ-দোলাতে দোলে সপ্ত সাগর রে! ওই    পথের ধুলা ডেকেছে আজ সপ্ত কোটি প্রাণ মেলে। আজ   জাত-বিজাতের বিভেদ ঘুচি, এক হল ভাই বামুন-মুচি, প্রেম-গঙ্গায় সবাই হল শুচি রে! আয়   এই যমুনায় ঝাঁপ দিবি কে বন্দেমাতরম বলে– ওরে    সব মায়ায় আগুন জ্বেলে॥  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
ভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায় কে যেন আমারে ডাকে সে কি তুমি? সে কি তুমি? সে কি তুমি?কার স্মৃতি বুকে পাষানের মত ভার হয়ে যে থাকে সে কি তুমি, সে কি তুমি? কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন হায় ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায় কার সকরুন আঁখি দুটি যেন রাতের মত মুখপানে চেয়ে থাকে সে কি তুমি? সে কি তুমি?নিশির বাতাশ কাহার হুতাশ দীর্ঘ নিশাস সম ঝড় তোলে এসে অন্তরে মোর ওগো দুরন্ত মম সে কি তুমি, সে কি তুমিমহাসাগরের ঢেউ এর মতন বুকে এসে বাজে কাহার রোদন পিয়া পিয়া নাম ডাকে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি আমার চম্পা- শাঁখে সে কি তুমি? সে কি তুমি?
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
(শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা, করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই সীমা। বিচার-দিনের বিভু! কেবল তোমারি আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি। সহজ সরল পথে মোদেরে চালাও, যাদের বিলাও দয়া সে পথ দেখাও। অভিশপ্ত আর পথভ্রষ্ট যারা, প্রভু, তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল (যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম, ফিরদৌসের একমুঠো প্রেম, আজো করে ঝলমল।কত সম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাহ্‌জাহানে শ্বেত মর্মরে সেই বিরহীর ক্রন্দন মর্মর গুঞ্জরে অবিরল।কেমনে জানিল শাহ্‌জাহান, প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়! (তাই) পাষাণ প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়? (যেন) তাজের পাষাণ অঞ্জলি লয়ে নিঠুর বিধাতা পানে অতৃপ্ত প্রেম বিরহী-আত্মা আজো অভিযোগ হানে (বুঝি) সেই লাজে বালুকায় মুখ লুকাইতে চায় শীর্ণা যমুনা জল।।
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি তুমি কেন হায় আসিলে হেথায় সুখের স্বরগ হইতে নামি।চারিপাশে মোর উড়িছে কেবল শুকনো পাতা মলিন ফুলদল বৃথাই কেন হায় তব আঁখিজল ছিটাও অবিরল দিবসযামী।এলে অবেলায় পথিক বেভুল বিঁধিছে কাঁটা নাহি যবে ফুল কি দিয়া বরণ করি ও চরণ নিভিছে জীবন, জীবনস্বামী।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
নদীপারের মেয়ে! ভাসাই আমার গানের কমল তোমার পানে চেয়ে। আলতা-রাঙা পা দুখানি ছুপিয়ে নদী-জলে ঘাটে বসে চেয়ে আছ আঁধার অস্তাচলে। নিরুদ্দেশে ভাসিয়ে-দেওয়া আমার কমলখানি ছোঁয় কি গিয়ে নিত্য সাঁঝে তোমার চরণ, রানি? নদীপারের মেয়ে! গানের গাঙে খুঁজি তোমায় সুরের তরি বেয়ে। খোঁপায় গুঁজে কনক-চাঁপা, গলায় টগর-মালা, হেনার গুছি হাতে বেড়াও নদীকূলে বালা। শুনতে কি পাও আমার তরির তোমায়-চাওয়া গীতি? ম্লান হয়ে কি যায় ও-চোখে চতুর্দশীর তিথি? নদীপারের মেয়ে! আমার ব্যথার মালঞ্চে ফুল ফোটে তোমায়-চেয়ে। শীতল নীরে নেয়ে ভোরে ফুলের সাজি হাতে, রাঙা উষার রাঙা সতিন দাঁড়ায় আঙিনাতে। তোমার মদির শ্বাসে কি মোর গুলের সুবাস মেশে? আমার বনের কুসুম তুলি পর কি আর কেশে? নদীপারের মেয়ে! আমার কমল অভিমানের কাঁটায় আছে ছেয়ে! তোমার সখায় পূজ কি মোর গানের কমল তুলি? তুলতে সে-ফুল মৃণাল-কাঁটায় বেঁধে কি অঙ্গুলি? ফুলের বুকে দোলে কাঁটার অভিমানের মালা, আমার কাঁটার ঘায়ে বোঝ আমার বুকের জ্বালা?   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা। তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হু'র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।- অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।.. 'ময় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
১ নাই    তা   জ তাই    লা    জ? ওরে   মুসলিম, খর্জুর-শিষে তোরা সাজ! করে   তসলিম হর কুর্নিশে শোর আওয়াজ শোন   কোন মুজ্‌দা সে উচ্চারে হেরা আজ ধরা-মাঝ! উরজ-য়্যামেন নজ্‌দ হেজাজ তাহামা ইরাক শাম মেশের ওমান তিহারান স্মরি কাহার বিরাট নাম। পড়ে   ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্‌লাম। চলে   আঞ্জাম দোলে   তাঞ্জাম খোলে   হুর-পরি মরি ফিরদৌসের হাম্মাম ! টলে   কাঁখের কলসে কওসর ভর , হাতে আব-জমজম জাম । শোন   দামাম কামান তামাম সামান নির্ঘোষি কার নাম পড়ে   ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্লানম।’ ২ মস্       তান ! ব্যস       থাম্! দেখ   মশ্‌গুল আজি শিস্তান-বোস্তান , তেগ   গর্দানে ধরি দারোয়ান রোস্তাম । বাজে   কাহারবা বাজা, গুলজার গুলশানগুলশান : পুষ্প-বাটিকা। গুলফাম ! দক্ষিণে দোলে আরবি দরিয়া খুশিতে সে বাগে-বাগ , পশ্চিমে নীলা‘লোহিতে’র খুন-জোশিতে রে লাগে আগ, মরু   সাহারা গোবিতে সব্‌জার জাগে দাগ! নূরে  কুর্শির পুরে   ‘তূর’ -শির, দূরে   ঘূর্ণির তালে সুর বুনে হুরি ফুর্তির, ঝুরে   সুর্খির ঘন লালি উষ্ণীষে ইরানিদূরানি তুর্কির! আজ   বেদুইন তার ছেড়ে দিয়ে ঘোড়া ছুড়ে ফেলে বল্লম পড়ে   ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাললাম।’ ৩ ‘সাবে   ঈন’ তাবে   ঈন হয়ে   চিল্লায় জোর ‘ওই ওই নাবে দীন ! ভয়ে   ভূমি চুমে ‘লাত্ মানাত’ -এর ওয়ারেশিন । রোয়ে   ওয্‌যা-হোবলইবলিসখারেজিন , – কাঁপে   জীন্ ! জেদ্দার পূবে মক্কা মদিনা চৌদিকে পর্বত, তারই মাঝে ‘কাবা’ আল্লার ঘর দুলে আজ হর ওক্ত্ , ঘন     উথলে অদূরে ‘জম-জম’ শরবৎ! পানি    কওসর, মণি    জওহর আনি   ‘জিবরাইল’ আজ হরদম দানে গওহর , টানি    মালিক-উল-মৌতজিঞ্জির – বাঁধে মৃত্যুর দ্বার লৌহর। হানি   বরষা সহসা ‘মিকাইল’ করে ঊষর আরবে ভিঙা , বাজে   নব সৃষ্টির উল্লাসে ঘন ‘ইসরাফিল’ -এর শিঙা!৪ জন্   জাল কঙ্   কাল ভেদি,  ঘন জাল মেকি গণ্ডির পঞ্জার ছেদি,  মরুভূতে একী শক্তির সঞ্চার! বেদি   পঞ্জরে রণে সত্যের ডঙ্কার ওংকার! শঙ্কারে করি লঙ্কার পার কার ধনু-টংকার হুংকারে ওরে সাচ্চা-সরোদে শাশ্বত ঝংকার? ভূমা-   নন্দে রে সব টুটেছে অহংকার! মর-  মর্মরে নর-  ধর্ম রে বড়ো   কর্মরে দিল ইমানের জোর বর্ম রে, ভর্   দিল্ জান্ – পেয়ে শান্তি নিখিল ফিরদৌসের হর্ম্য রে! রণে   তাই তো বিশ্ব-বয়তুল্লাতে মন্ত্র ও জয়নাদ – ‘ওয়ে  মার্‌হাবা ওয়ে মার্‌হাবা এয়্ সর্‌ওয়ারে কায়েনাত !’ ৫ শর- ওয়ান দর্- ওয়ান আজি   বান্দা যে ফেরউন শাদ্দাদ নমরুদ মারোয়ান ; তাজি   বোর্‌রাক্ হাঁকে আশমানে পর্‌ওয়ান, – ও যে   বিশ্বের চির সাচ্‌চারই বোর্‌হান – ‘কোর-আন’! ‘কোন্ জাদুমণি এলি ওরে’ – বলি রোয়ে মাতা আমিনায় খোদার হবিবে বুকে চাপি, আহা, বেঁচে আজ স্বামী নাই! দূরে    আব্‌দুল্লার রুহ্ কাঁদে, “ওরে আমিনারে গমি নাই –দেখো   সতী তব কোলে কোন্ চাঁদ, সব ভর-পুর ‘কমি’ নাই।’ ‘এয়্  ফর্ জন্দ’ – হায়   হর্‌দম্ ধায়    দাদা মোত্‌লেব কাঁদি, – গায়ে ধুলা কর্দম! ‘ভাই।  কোথা তুই?’ বলি বাচ্চারে কোলে কাঁদিছে হাম্‌জা দুর্দম! ওই   দিক্‌হারা দিক্‌পার হতে জোর-শোর আসে, ভাসে ‘কালাম’ – ‘এয়   ‘শাম্‌সোজ্জোহা বদরোদ্দোজা কামারোজ্জমাঁ’ সালাম!’      (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয় মৃণ্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা তাই দুর্গতি ঘুচিল না হায়।যে মহাশক্তির হয় না বিসর্জন অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুক্ষণ মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী সেই দুর্গারে দেশ চায়।আমাদের দ্বিভুজে দশভুজা শক্তি দে পরব্রক্ষ্মময়ী শক্তি পূজার ফল ভক্তি কি পাব শুধু হব না কি বিশ্বজয়ী?এ পূজা বিলাস সংহার কর যদি পুত্র শক্তি নাহি পায়।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
অমর কানন মোদের অমর-কানন! বন কে বলে রে ভাই, আমাদের তপোবন, আমাদের তপোবন।  এর   দক্ষিণে ‘শালী’ নদী কুলুকুলু বয়, তার   কূলে কূলে শালবীথি ফুলে ফুলময়, হেথা   ভেসে আসে জলে-ভেজা দখিনা মলয়, হেথা          মহুয়ার মউ খেয়ে মন উচাটন।দূর প্রান্তর-ঘেরা আমাদের বাস, দুধহাসি হাসে হেথা কচি দুব-ঘাস, উপরে মায়ের মতো চাহিয়া আকাশ, বেণু-বাজা মাঠে হেথা চরে ধেনুগণ  মোরা  নিজ হাতে মাটি কাটি, নিজে ধরি হাল, সদা  খুশিভরা বুক হেথা হাসিভরা গাল, মোরা  বাতাস করি গো ভেঙে হরিতকি-ডাল, হেথা  শাখায় শাখায় শাখী, গানের মাতন। প্রহরী মোদের ভাই ‘পুরবি’ পাহাড়, ‘শুশুনিয়া’ আগুলিয়া পশ্চিমি দ্বার, ওড়ে  উত্তরে উত্তরি কাননবিথার, দূরে   ক্ষণে ক্ষণে হাতছানি দেয় তালী-বন।   হেথা  খেত-ভরা ধান নিয়ে আসে অঘ্রান, হেথা  প্রাণে ফোটে ফুল, হেথা ফুলে ফোটে প্রাণ, ও রে  রাখাল সাজিয়া হেথা আসে ভগবান, মোরা         নারায়ণ-সাথে খেলা খেলি অনুখন।   মোরা  বটের ছায়ায় বসি করি গীতাপাঠ, আমাদের পাঠশালা চাষি-ভরা মাঠ, গাঁয়ে গাঁয়ে আমাদের মায়েদের হাট, ঘরে ঘরে ভাইবোন বন্ধুস্বজন।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
অনেক ক’রে বাসতে ভালো পারিনি মা তখন যারে, আজ অবেলায় তারেই মনে পড়ছে কেন বারে বারে।। আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চুমে, চুমুর পরে চুম দিয়ে ফের হান্‌তে আঘাত ভোরের ঘুমে। ভাব্‌তুম তখন এ কোন্‌ বালাই! কর্‌ত এ প্রাণ পালাই পালাই। আজ সে কথা মনে হ’য়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝরে। অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় ব্যথার ভারে।। তর”ণ তাহার ভরাট বুকের উপ্‌চে-পড়া আদর সোহাগ হেলায় দু’পায় দ’লেছি মা, আজ কেন হায় তার অনুরাগ? এই চরণ সে বক্ষে চেপে চুমেছে, আর দু’চোখ ছেপে জল ঝ’রেছে, তখনো মা কইনি কথা অহঙ্কারে, এম্‌নি দার”ণ হতাদরে ক’রেছি মা, বিদায় তারে।। দেখেওছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা, দ্বার হ’তে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাটা। ভেবেছিলাম আমার কাছে তার দরদের শানি- আছে, আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিন্‌তে নেরে দেবতারে। ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে।। পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী, মাগো আমি ভিখারিনী, আমি কি তাঁয় চিন্‌তে পারি? তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা নিইনি, নিইনি মণির মালা, দেব্‌তা আমার নিজে আমায় পূজল ষোড়শ-উপচারে। পূজারীকে চিন্‌লাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে।। আমায় চাওয়াই শেষ চাওয়া তার মাগো আমি তা কি জানি? ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী। ওরে আমার ভালোবাসা! কোথায় বেঁধেছিলি বাসা যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে? নিঃশ্বসিয়া উঠছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে!’ সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া? দূর হ’তে মা দূরন-রে ডাকে তাকে পথের ছায়া। মাঠের পারে বনের মাঝে চপল তাহার নূপুর বাজে, ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে, ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে? মাগো আমায় শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধ’রে রাখার? তার তরে নয় ভালোবাসা সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার। তাই মা আমার বুকের কবাট খুলতে নারল তার করাঘাত, এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে, আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে।। সোহাগে সে ধ’রতে যেত নিবিড় ক’রে বক্ষে চেপে, হতভাগী পারিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্‌ত কেঁপে। রাজ ভিখারীর আঁখির কালো, দূরে থেকেই লাগ্‌ত ভালো, আসলে কাছে ক্ষুধিত তার দীঘল চাওয়া অশ্র”-ভারে। ব্যথায় কেমন মুষড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনে তরে।। আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ পরশ-সুধা, আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ ক’রে দিই এ আমারে! যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে? আজ বুঝেছি এ-জনমের আমার নিখিল শানি–আরাম চুরি ক’রে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম। হে বসনে-র রাজা আমার! নাও এসে মোর হার-মানা-হারা! আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে, দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন ক’রে কাঁদতে পারে! তোমার কথাই সত্য হ’ল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে, দাবাললের দার”ণ দাহ তুষার-গিরি আজকে দহে। জাগল বুকে ভীষণ জোয়ার, ভাঙল আগল ভাঙল দুয়ার মূকের বুকে দেব্‌তা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে। বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে-মাগো মানা ক’র্‌ছ কারে? স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তারই চ’লে যাওয়ার সাথে, এখন আমার একার বাসার দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে। ঘুম ভাঙাতে আস্‌বে না সে ভোর না হ’তেই শিয়র-পাশে, আস্‌বে না আর গভীর রাতে চুম-চুরির অভিসারে, কাঁদাবে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে। আজ পেলে তাঁয় হুম্‌ড়ি খেয়ে প’ড়তুম মাগো যুগল পদে, বুকে ধ’রে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে। ব’সতে দিতাম আধেক আঁচল, সজল চোখের চোখ-ভরা জল- ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে, আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে। দেখ্‌তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী, মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে ব’লত,‘ আমি ভালোবাসি!’ ব’ল্‌তে গিয়ে সুখ-শরমে লাল হ’য়ে গাল উঠত ঘেমে, বুক হ’তে মুখ আস্‌ত নেমে লুটিয়ে যখন কোল-কিনারে, দেখ্‌তুম মাগো তখন কেমন মান ক’রে সে থাক্‌তে পারে! এম্‌নি এখন কতই আমা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যাথায়, রাগে, অনুরাগে। চোখের জলের ঋণী ক’রে, সে গেছে কোন্‌ দ্বীপান-রে? সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর সুদূরপারে? ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে? তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর, চৌচির হ’য়ে প’ড়বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর। চীৎকারে তার উঠবে কেঁপে ধরার সাগর অশ্র” ছেপে, উঠবে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে, ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘুর্ণি নেচে ঘিরবে তারে। ছি, মা! তুমি ডুকরে কেন উঠছ কেঁদে অমন ক’রে? তার চেয়ে মা তারই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে! শুনতে শুনতে তোমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ি। – ও কে খোলে দুয়ার ওমা? ঝড় বুঝি মা তারই মতো ধাক্কা মারে? ঝোড়ো হওয়া! ঝোড়ো হাওয়া! বন্ধু তোমার সাগর পারে! সে কি হেথায় আসতে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে, যে দেশে নেই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে! তবু কেন থাকি’ থাকি’, ইচ্ছা করে তারেই ডাকি! যে কথা মোর রইল বাকী হায় যে কথা শুনাই কারে? মাগো আমার প্রাণের কাঁদন আছড়ে মরে বুকের দ্বারে! যাই তবে মা! দেকা হ’লে আমার কথা ব’লো তারে- রাজার পূজা-সে কি কভু ভিখারিনী ঠেলতে পারে? মাগো আমি জানি জানি, আসবে আবার অভিমানী খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে, ব’লো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে!
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
শুরু করিলাম পূত নামেতে খোদার কৃপা করুণার যিনি অসীম পাথার।অনন্ত কল্যাণ তোমা' দিয়াছি নিশ্চয়, অতএব তব প্রতিপালক যে হয় নামায পড় ও দাও কোরবাণী তাঁরেই, বিদ্বেষ তোমারে যে, অপুত্রক সে-ই।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে! ছবি আমার বুকে বেঁধে পাগল হ’লে কেঁদে কেঁদে ফিরবে মর” কানন গিরি, সাগর আকাশ বাতাস চিরি’ যেদিন আমায় খুঁজবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে! স্বপন ভেঙে নিশুত্‌ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে, কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় উঠবে ও-বুকে ছমকে,- জাগবে হঠাৎ চমকে! ভাববে বুঝি আমিই এসে ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে, ধরতে গিয়ে দেখবে যখন শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন! বেদ্‌নাতে চোখ বুঁজবে- বুঝবে সেদিন বুজবে। গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিঁড়ে আস্‌বে যখন কান্না, ব’লবে সবাই-“ সেই য পথিক তার শেখানো গান না?’’ আস্‌বে ভেঙে কান্না! প’ড়বে মনে আমার সোহাগ, কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ! প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি অশ্র”-হারা কঠিন আঁখি ঘন ঘন মুছবে- বুঝ্‌বে সেদিন বুঝবে! আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ’রবে তোমার অঙ্গন, তুলতে সে ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ- কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন! শিউলি ঢাকা মোর সমাধি প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’! বুকের মালা ক’রবে জ্বালা চোখের জলে সেদিন বালা মুখের হাসি ঘুচবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে! আসবে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির-ছেঁচা রাত্রি, থাকবে সবাই – থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রী! আসবে শিশির-রাত্রি! থাকবে পাশে বন্ধু স্বজন, থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন, বঁধুর বুকের পরশনে আমার পরশ আনবে মনে- বিষিয়ে ও-বুক উঠবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে! আসবে আবার শীতের রাতি, আসবে না ক আ সে- তোমার সুখে প’ড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে, আসবে না ক’ আর সে! প’ড়বে মনে, মোর বাহুতে মাথা থুয়ে যে-দিন শুতে, মুখ ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়! সেই স্মৃতি তো ঐ বিছানায় কাঁটা হ’য়ে ফুটবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে! আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে, সেই তরীতে হয়ত কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে- দুলবে তরী রঙ্গে, প’ড়বে মনে সে কোন্‌ রাতে এক তরীতে ছিলেম সাথে, এমনি গাঙ ছিল জোয়ার, নদীর দু’ধার এমনি আঁধার তেম্‌নি তরী ছুটবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে! তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ, আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ- সখার কারা-বন্ধ! বন্ধু তোমার হান্‌বে হেলা ভাঙবে তোমার সুখের মেলা; দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর, বইতে প্রাণের শান- এ ভার মরণ-সনে বুঝ্‌বে- বুঝবে সেদিন বুঝ্‌বে! ফুট্‌বে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী, আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদ্‌নী- চৈতী-রাতের চাঁদ্‌নী। ঋতুর পরে ফির্‌বে ঋতু, সেদিন-হে মোর সোহাগ-ভীতু! চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়, আমার মতন চোখ ভ’রে চায় যে-তারা তা’য় খুঁজবে- বুঝ্‌বে সেদিন বুঝ্‌বে! আস্‌বে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন, কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন- টুটবে যবে বন্ধন! পড়বে মনে, নেই সে সাথে বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে- আপনি গালে যাচবে চুমা, চাইবে আদর, মাগ্‌বে ছোঁওয়া, আপনি যেচে চুমবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে। আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হান্‌ত, সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান– আসবে তখন পান’। হয়ত তখন আমার কোলে সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে, আপনি সেদিন সেধে কেঁদে চাপ্‌বে বুকে বাহু বেঁধে, চরণ চুমে পূজবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে!
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
এ কী বিস্ময়! আজরাইলেরও জলে ভর-ভর চোখ! বে-দরদ দিল্ কাঁপে থর-থর যেন জ্বর-জ্বর শোক। জান-মরা তার পাষাণ-পাঞ্জা বিলকুল ঢিলা আজ, কব্‌জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ , খাক চুমে নীলা তাজ । জিব্‌রাইলের আতশি পাখা সে ভেঙে যেন খান খান, দুনিয়ার দেনা মিটে যায় আজ তবু জান আন্-চান! মিকাইল অবিরল লোনা    দরিয়ার সবই জল ঢালে    কুল মুল্লুকে , ভীম বাতে খায় অবিরল ঝাউ দোল। এ কি    দ্বাদশীর চাঁদ আজ সেই? সেই রবিয়ল আউওল ? ২ ঈশানে কাঁপিছে কৃষ্ণ নিশান, ইস্‌রাফিলের ও প্রলয়-বিষাণ আজ কাতরায় শুধু! গুমরিয়া কাঁদে কলিজা-পিষানো বাজ! রসুলের দ্বারে দাঁড়ায়ে কেন রে আজাজিল শয়তান? তারও বুক বেয়ে আঁশু ঝরে, ভাসে মদিনার ময়দান! জমিন্-আশমান জোড়া শির পাঁও তুলি তাজি বোর্‌রাক্ , চিখ্ মেরে কাঁদে ‘আরশে’ র পানে চেয়ে, মারে জোর হাঁক! হুরপরি শোকে হায় জল-    ছলছল চোখে চায়। আজ    জাহান্নমের বহ্নি-সিন্ধু নিবে গেছে ক্ষরি জল, যত    ফিরদৌসের নার্গিস-লালা ফেলে আঁশু-পরিমল। ৩ মৃত্তিকা-মাতা কেঁদে মাটি হল বুকে চেপে মরা লাশ, বেটার জানাজা কাঁদে যেন – তাই বহে ঘন নাভি-শ্বাস! পাতাল-গহ্বরে কাঁদে জিন, পুন মলো কি রে সোলেমান ? বাচ্চারে মৃগী দুধ নাহি দেয়, বিহগীরা ভোলে গান! ফুল পাতা যত খসে পড়ে, বহে উত্তর-চিরা বায়ু, ধরণির আজ শেষ যেন আয়ু, ছিঁড়ে গেছে শিরা স্নায়ু! মক্কা ও মদিনায় আজ    শোকের অবধি নাই! যেন    রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদসম ছুটে। কাঁপে    ঘন ঘন কাবা , গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে।৪ নকিবের তূরী ফুৎকারি আজ বারোয়াঁর সুরে কাঁদে, কার তরবারি খান খান করে চোট মারে দূরে চাঁদে? আবুবকরের দর দর আঁশু দরিয়ার পারা ঝরে, মাতা আয়েষার কাঁদনে মুরছে আশমানে তারা ডরে! শোকে উন্মাদ ঘুরায় উমর ঘূর্ণির বেগে ছোরা, বলে ‘আল্লার আজ ছাল তুলে নেব মেরে তেগ্ , দেগে কোঁড়া ।’ হাঁকে ঘন ঘন বীর – ‘হবে,   জুদা তার তন শির, আজ যে বলিবে নাই বেঁচে হজরত – যে নেবে রে তাঁরে গোরে।’ আজ দারাজ দস্তে তেজ হাতিয়ার বোঁও বোঁও করে ঘোরে! ৫ গুম্বজে কে রে গুমরিয়া কাঁদে মসজিদে মস্‌জিদে? মুয়াজ্জিনের হোশ্ নাই, নাই জোশ চিতে, শোষ হৃদে! বেলালেরও আজ কণ্ঠে আজান ভেঙে যায় কেঁপে কেঁপে, নাড়ি-ছেঁড়া এ কী জানাজার ডাক হেঁকে চলে ব্যেপে ব্যেপে! উস্‌মানের আর হুঁশ নাই কেঁদে কেঁদে ফেনা উঠে মুখে, আলি হাইদর ঘায়েল আজি রে বেদনার চোটে ধুঁকে! আজ    ভোঁতা সে দুধারি ধার ওই    আলির জুলফিকার ! আহা    রসুল-দুলালি আদরিণী মেয়ে মা ফাতেমা ওই কাঁদে, ‘কোথা    বাবাজান।’ বলি মাথা কুটে কুটে এলোকেশ নাহি বাঁধে! ৬ হাসান-হুসেন তড়পায় যেন জবে-করা কবুতর, ‘নানাজান কই!’ বলি খুঁজে ফেরে কভু বার কভু ঘর। নিবে গেছে আজ দিনের দীপালি, খসেছে চন্দ্র-তারা, আঁধিয়ারা হয়ে গেছে দশ দিশি, ঝরে মুখে খুন-ঝারা! সাগর-সলিল ফোঁপায়ে উঠে সে আকাশ ডুবাতে চায়, শুধু       লোনা জল তার আঁশু ছাড়া কিছু রাখিবে না দুনিয়ায়। খোদ    খোদা সে নির্বিকার, আজ    টুটেছে আসনও তাঁর! আজ      সখা মহ্‍বুবে বুকে পেতে দুখে কেন যেন কাঁটা বেঁধে, তারে      ছিনিবে কেমনে যার তরে মরে নিখিল সৃষ্টি কেঁদে!৭ বেহেশ্‌ত     সব আরাস্তা আজ, সেথা মহা ধুম-ধাম, গাহে        হুরপরি যত, ‘সাল্লালাহু আলায়হি সাল্‌লাম।’ কাতারে কাতারে করজোড়ে সবে দাঁড়ায়ে গাহিছে জয়, – ধরিতে না পেরে ধরা-মা-র চোখে দর দর ধারা বয়। এসেছে আমিনা আবদুল্লা কি, এসেছে খদিজা সতী? আজ        জননীর মুখে হারামণি-পাওয়া-হাসা হাসে জগপতি! ‘খোদা,    একী তব অবিচার!’ বলে    কাঁদে সুত ধরা-মা-র। আজ        অমরার আলো আরও ঝলমল, সেথা ফোটে আরও হাসি, শুধু         মাটির মায়ের দীপ নিভে গেল, নেমে এল অমা-রাশি আজ        স্বরগের হাসি ধরার অশ্রু ছাপায়ে অবিশ্রাম ওঠে        একী ঘন রোল – ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্‌লাম।’
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
বাদলা-কালো স্নিগ্ধা আমার কান্ত এল রিমঝিমিয়ে, বৃষ্টিতে তার বাজল নুপূর পায়জোরেরই শিঞ্জিনী যে। ফুটল উষার মুখটি অরুণ, ছাইল বাদল তাম্বু ধরায়; জমল আসর বর্ষা-বাসর, লাও সাকি লাও ভর-পিয়ালায়। ভিজল কুঁড়ির বক্ষ-পরাগ হিম-শিশিরের আমেজ পেয়ে হমদম! হরদম দাও মদ, মস্ত্ করো গজল গেয়ে! ফেরদৌসের ঝরকা বেয়ে গুল-বাগিচায় চলচে হাওয়া, এই তো রে ভাই ওক্ত খুশির, দ্রাক্ষারসে দিলকে নাওয়া। কুঞ্জে জরীন ফারসি ফরাস বিছিয়েচে আজ ফুলবালারা, আজ চাই-ই চাই লাল-শিরাজি স্বচ্ছ-সরস খোর্মা-পারা! মুক্তকেশী ঘোর-নয়না আজ হবে গো কান্তা সাকি, চুম্বন এবং মিষ্টি হাতের মদ পেতে তাই ভরসা রাখি! কান্তা সাথে বাঁচতে জনম চাও যদি কওসর-অমিয়, সুর বেঁধে বীণ সারেঙ্গিতে খুবসে শিরীন শরাব পিয়ো! খুঁজবে যেদিন সিকান্দারের বাঞ্ছিত আব্-হায়াত কুঁয়ায়, সন্ধান তার মিলবে আশেক দিল-পিয়ারার ওষ্ঠ চুমায়! খামখা তুমি মরছ কাজী শুষ্ক তোমার শাস্ত্র ঘেঁটে, মুক্তি পাবে মদখোরের এই আল-কিমিয়ার পাত্র চেটে!   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
স্তোত্রমূলক
ভাঙা বাংলার রাঙা যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে। তাই তো তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে॥ দহন-বনের গহন-চারী– হায় ঋষি– কোন্ বংশীধারী নিঙ্‌ড়ে আগুন আন্‌লে বারি অগ্নি-মরুর মাঝে। সর্বনাশা কোন্ বাঁশি সে বুঝ্‌তে পারি না যে॥ দুর্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হান্‌ছিলে বৈশাখে, হঠাৎ সে কার শুন্‌লে বেণু কদম্বের ঐ শাখে। বজ্রে তোমার বাজ্‌ল বাঁশি, বহ্নি হলো কান্না হাসি. সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী– মন সরে না কাজে। তোমার নয়ন-ঝুরা অগ্নি-সুরেও রক্ত-শিখা বাজে॥কাব্যগ্রন্থঃ-অগ্নিবীণা
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
কে জানে কোথায় চলিয়াছি ভাই মুসাফির পথচারি, দু'ধারে দু'কুল দুঃখ-সুখের-মাঝে আমি স্রোত-বারি! আপনার বেগে আপনি ছুটেছি জন্ম-শিখর হ'তে বিরাম-বিহীন রাত্রি ও দিন পথ হ'তে আন পথে! নিজ বাস হ'ল চির-পরবাস, জন্মের ক্ষন পরে বাহিরিনি পথে গিরি-পর্বতে-ফিরি নাই আর ঘরে। পলাতকা শিশু জন্মিয়াছিনু গিরি-কন্যার কোলে, বুকে না ধরিতে চকিতে ত্বরিতে আসিলাম ছুটে চ'লে। জননীরে ভুলি' যে-পথে পলায় মৃগ-শিশু বাঁশী শুনি', যে পথে পলায় শশকেরা শুনি' ঝরনার ঝুনঝুনি, পাখী উড়ে যায় ফেলিয়া কুলায় সীমাহীন নভোপানে, সাগর ছাড়িয়া মেঘের শিশুরা পলায় আকাশ-যানে,- সেই পথ ধরি' পলাইনু আমি! সেই হ'তে ছুটে চলি গিরি দরী মাঠ পল্লীর বাট সজা বাঁকা শত গলি। -কোন গ্রহ হ'তে ছিঁড়ি উল্কার মত ছুতেছি বাহিয়া সৌর-লোকের সিঁড়ি! আমি ছুটে যাই জানিনা কোথায়, ওরা মোর দুই তীরে রচে নীড়, ভাবে উহাদেরি তীরে এসেছি পাহাড় চিরে। উহাদের বদূ কলস ভরিয়া নিয়ে যায় মোর বারি, আমার গহনে গাহন করিয়া বলে সন্তাপ-হারী! ঊহারা দেখিল কেবলি আমার সলিলের শিতলতা, দেখে নাই-জ্বলে কত চিতাগ্নি মোর কূলে কূলে কোথা! -হায়, কত হতভাগী- আমিই কি জানি- মরিল ডুবিয়া আমার পরশ মাগি'। বাজিয়াছে মোর তটে-তটে জানি ঘটে-ঘটে কিঙ্কিণী, জল-তরঙ্গে বেজেছে বধূর মধুর রিনিকি-ঝিনি। বাজায়েছে বেণু রাখাল-বালক তীর-তরুতলে বসি'। আমার সলিলে হেরিয়াছে মুখ দূর আকাশের শশী। জানি সব জানি, ওরা ডাকে মোরে দু'তীরে বিছায়ে স্নেহ, দীঘি হ'তে ডাকে পদ্মমুখীরা 'থির হও বাঁধি গেহ!' আমি ব'য়ে যাই- ব'য়ে যাই আমি কুলু-কুলু-কুলু-কুলু শুনি না- কোথায় মোরই তীরে হায় পুরনারী দেয় উলু! সদাগর-জাদী মণি-মাণিক্যে বোঝাই করিয়া তরী ভাসে মর জলে,-'ছল ছল' ব'লে আমি দূরে যাই সরি'। আঁকড়িয়া ধ'রে দু'তীর বৃথাই জড়ায়ে তন্তুলতা, ওরা দেখে নাই আবর্ত মর, মোর অন্তর-ব্যথা! লুকাইয়া আসে গোপনে নিশীথে কূলে মোর অভাগিনী, আমি বলি 'চল ছল ছল ছল ওরে বধূ তোরে চিনি! কূল ছেড়ে আয় রে অভিসারিকা, মরণ-অকূলে ভাসি!' মোর তীরে-তীরে আজো খুঁজে ফিরে তোরে ঘর-ছাড়া বাঁশী। সে পড়ে ঝাঁপায়-জলে, আমি পথে ধাই-সে কবে হারায় স্মৃতির বালুকা-তলে! জানি না ক' হায় চলেছি কোথায় অজানা আকর্ষণে, চ'লেছি যতই তত সে অথই বাজে জল খনে খনে। সন্মুখ-টানে ধাই অবিরাম, নাই নাই অবসর, ছুঁইতে হারাই-এই আছে নাই- এই ঘর এই পর! ওরে চল চল ছল ছল কি হবে ফিরায়ে আঁখি? তরি তীরে ডাকে চক্রবাকেরে তরি সে চক্রবাকী! ওরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায় কূলের কুলায়-বাসী, আঁচল ভরিয়া কুড়ায় আমার কাদায়-ছিটানো হাসি। ওরা চ'লে এক্যায়, আমি জাগি হায় ল'ইয়ে চিতাগ্নি শব, ব্যথা-আবর্ত মচড় খাইয়া বুকে করে কলরব! ওরে বেনোজল, ছল ছল ছল ছুটে চল ছুটে চল! হেথা কাদাজল পঙ্কিল তোরে করিতেছে অবিরল। কোথা পাবি হেথা লোনা আঁখিজল, চল চল পথচারী! করে প্রতীক্ষা তোর তরে লোনা সাত-সমুদ্র-বারি!
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখীর ঝড় ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল, সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল ! মৃত্যু-গহন অন্ধকূপে মহাকালের চণ্ড-রূপে— বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর ! ওরে ঐ হাসছে ভয়ঙ্কর ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! ঝামর তাহার কেশের দোলার ঝাপটা মেরে গগন দুলায়, সর্ব্বনাশী জ্বালা-মুখী ধূমকেতু তার চামর ঢুলায় ! বিশ্বপাতার বক্ষ-কোলে রক্ত তাহার কৃপাণ ঝোলে দোদুল দোলে ! অট্টরোলের হট্টোগোলে স্তব্ধ চরাচর— ওরে ঐ স্তব্ধ চরাচর ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! দ্বাদশ-রবির বহ্নি-জ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন-কটায়, দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গ তার ত্রস্ত জটায় ! বিন্দু তাহার নয়ন-জলে সপ্ত মহা-সিন্ধু দোলে কপোল-তলে ! বিশ্ব-মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর ‘পর— হাঁকে ঐ “জয় প্রলয়ঙ্কর !” তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! মাভৈঃ মাভৈঃ ! জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে ! জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ-লুকানো ঐ বিনাশে ! এবার মহা-নিশার শেষে আসবে ঊষা অরুণ হেসে করুণ বেশে | দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর, আলো তার ভরবে এবার ঘর ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! ঐ যে মহাকাল সারথি রক্ত-তড়িত চাবুক হানে, রণিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন বজ্র-গানে ঝড় তুফানে ! ক্ষুরের দাপট তারায় লেগে উল্কা ছুটায় নীল খিলানে | গগন-তলের নীল খিলানে ! অন্ধ কারার অন্ধ কূপে দেবতা বাঁধা যজ্ঞ-যূপে পাষাণ-স্তূপে ! এই ত রে তার আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর— শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! ধ্বংশ দেখে ভয় কেন তোর ? — প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন | আসছে নবীন—জীবন-হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন | তাই সে এমন কেশে বেশে প্রলয় ব’য়েও আসছে হেসে— মধুর হেসে ! ভেঙে আবার গ’ড়তে জানে সে চির-সুন্দর ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !! ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তরে ডর ? তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !— বধূরা প্রদীপ তুলে ধর ! কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর !— তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ ! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্ !
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
‘হর   হর হর শংকর হর হর ব্যোম’ – একী   ঘন রণ-রোল ছায়া চরাচর ব্যোম! হানে   ক্ষিপ্ত মহেশ্বর রুদ্র পিনাক, ঘন   প্রণব-নিনাদ হাঁকে ভৈরব-হাঁক ধু ধু   দাউ দাউ জ্বলে কোটি নর-মেধ-যাগ, হানে   কাল-বিষ বিশ্বে রে মহাকাল-নাগ! আজ  ধূর্জটি ব্যোমকেশ নৃত্য-পাগল, ওই   ভাঙল আগল ওরে ভাঙল আগল! বোলে  অম্বুদ-ডম্বুর কম্বু বিষাণ, নাচে   থই-তাতা থই-তাতা পাগলা ঈশান! দোলে  হিন্দোলে ভীম-তালে সৃষ্টি ধাতার, বুকে   বিশ্বপাতার বহে রক্ত-পাথার! ঘোর   মার’ দৈত্য, অসুর, প্রেত,  রক্ত-পিশাচ, রণ-দুর্মদ সুর। করে   ক্রন্দসী-ক্রন্দন অম্বর রোধ – ত্রাহি   ত্রাহি মহেশ হে সম্বরো ক্রোধ! সুত   মৃত্যু-কাতর, হাহা অট্টহাসি হাসে   চণ্ডী চামুণ্ডা মা সর্বনাশী। কাল-  বৈশাখী ঝঞ্ঝারে সঙ্গে করি – রণ-   উন্মাদিনী নাচে রঙ্গে মরি! উর-   হার দোলে নরমুণ্ড-মালা, করে   খড়্গ ভয়াল, আঁখে বহ্নি-জ্বালা! নিয়া   রক্তপানের কী অগস্ত্য-তৃষা নাচে   ছিন্ন সে মস্তা মা, নাইকো দিশা! ‘দে রে   রক্ত দে রক্ত দে’ রণে ক্রন্দন, বুঝি   থেমে যায় সৃষ্টির হৃৎ-স্পন্দন! জ্বলে   বৈশ্বানরের ধু ধু লক্ষ শিখা, আজ   বিষ্ণু-ভালে লাল রক্ত-টিকা! শুধু   অগ্নি-শিখা ধু ধু অগ্নি-শিখা, শোভে   করুণার ভালে লাল রক্ত-টিকা! রণ-   শ্রান্ত অসুর-সুর-যোদ্ধৃ-সেনা, শুধু   রক্ত-পাথার, শুধু রক্ত-ফেনা! একী   বিশ্ব-বিধ্বংস নৃশংস খেলা, কিছু   নাই কিছু নাই প্রেত-পিশাচে মেলা। আজ   ঘরে ঘরে জ্বলে ধু ধু শ্মশান মশান – হোক   রোষ অবসান, ত্রাহি ত্রাহি ভগবান! আজি   বন্ধ সবার পূতি-গন্ধে নিশাস, বিষে   বিশ্ব-নিসাড়, বহে জোর নাভিশ্বাস! দেহো   ক্ষান্ত রণে, ফেলো রঙ্গিণী বেশ, খোলো   রক্তাম্বর মাতা সম্বরো কেশ! এ তো  নয় মাতা রক্তোন্মত্তা ভীমা! আজ   জাগৃহি মা, আজ জাগৃহি মা। তব   চরণাবলুণ্ঠিত মহিষ-অসুর, হল   ধ্বংস অসুর, লীন শক্তি পশুর। তবে   সম্বরো রণ, হোক ক্ষান্ত রোদন– হোক   সত্য-বোধন আজ মুক্তি-বোধন! এসো   শুদ্ধা মাতা এই কাল-শ্মশানে আজ   প্রলয়-শেষে এই রণাবসানে! জাগো   জাগো মানব-মাতা দেবী নারী! আনো   হৈম ঝারি, আনো শান্তি-বারি! এসো   কৈলাস হতে মা গো মানস-সরে, নীল   উৎপল-দলে রাঙা আঁচল-ভরে। এসো   কন্যা উমা, এসো গৌরী রূপে,– বাজো   শঙ্খ শুভ, জ্বালো গন্ধ ধূপে! আজ   মুক্ত-বেণি মেয়ে একাকী চলে, ওই   শেফালি-তলে হেরো শেফালি-তলে। ওড়ে   এলোমেলো অঞ্চল আশ্বিন-বায়, হানে   চঞ্চল নীল চাওয়া আকাশের গায়! ঘোষে   হিমালয় তার মহা হর্ষ-বাণী, – এল   হৈমবতী, এল গৌরী রানি। বাজো   মঙ্গল শাঁখ, হোক শুভ-আরতি, এল   লক্ষ্মী-কমলা, এল বাণী-ভারতী। এল   সুন্দর সৈনিক সুর কার্তিক, এল   সিদ্ধি-দাতা, হেরো হাসে চারিদিক! ভরা   ফুল-খুকি ফুল-হাসি শিউলির তল, আজ   চোখে আসে জল, শুধু চোখে আসে জল! নিয়া   মাতৃ-হিয়া নিয়া কল্যাণী-রূপ এল   শক্তি স্বাহা, বাজো শাঁখ, জ্বালো ধূপ! ভাঁজো   মোহিনী সানাই, বাজো আগমনি-সুর, বড়ো   কেঁদে ওঠে আজ হিয়া মাতৃ-বিধুর। ওঠে   কণ্ঠ ছাপি বাণী সত্য পরম – বন্-   দে মাতরম্। বন্‌দে মাতরম্!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আদর গর-গর বাদর দর-দর এ-তনু ডর-ডর কাঁপিছে থর-থর॥ নয়ন ঢল-ঢল [সজল ছল-ছল] কাজল-কালো-জল ঝরে লো ঝর ঝর॥ ব্যাকুল বনরাজি            শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে সজনী! মন আজি          গুমরে মনে মনে। বিদরে হিয়া মম বিদেশে প্রিয়তম এ-জনু পাখিসম বরিষা জর-জর॥ [বিজুরি হানে ছুরি           চমকি রহি রহি বিধুরা একা ঝুরি            বেদনা কারে কহি।] সুরভি কেয়া-ফুলে এ হৃদি বেয়াকুলে কাঁদিছে দুলে দুলে বনানী মর মর॥ নদীর কলকল            ঝাউ-এর ঝলমল দামিনী জ্বল জ্বল          কামিনী টলমল। আজি লো বনে বনে শুধানু জনে জনে কাঁদিল বায়ুসনে তটিনী তরতর॥ আদুরি দাদুরি লো           কহো লো কহো দেখি এমন বাদরি লো            ডুবিয়া মরিব কি? একাকী এলোকেশে কাঁদিব ভালোবেসে? মরিব লেখা-শেষে সজনি সরো সরো।  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না।ধানী রং ঘাঘরীর মেঘ রং ওড়না পরিতে আমারে মাগো অনুরোধ কোরোনা কাজরী কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া সে কি ফেরার পথ পেল না মা পেল না?আমার বিদেশীরে খুঁজিতে অনুখন বুনোহাঁসের পাখার মতো উড়ু উড়ু করে মনঅথৈ জলে মাগো পথঘাট থৈথৈ আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই? কদমকেশর বলে কোথা তোর কিশোর চম্পাডালে ঝুলে শূন্য ঝুলনা।
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
শিশু যাদুকরকাজী নজরুল ইসলাম পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর! কোন রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই, রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই। নবনীতে সুকোমল লাবণি লয়ে এলি কে রে অবনীতে দিগ্বিজয়ে। কত সে তিমির-নদী পারায়ে এলি- নির্মল নভে তুই চাঁদ পহেলি। আমরার প্রজাপতি অন্যমনে উড়ে এলি দূর কান্তার-কাননে। পাখা ভরা মাখা তোর ফুল-ধরা ফাঁদ, ঠোঁটে আলো চোখে কালো-কলঙ্কী চাঁদ! কালো দিয়ে করি তোর আলো উজ্জ্বল- কপালেতে টিপ দিয়ে নয়নে কাজল। তারা-যুঁই এই ভুঁই আসিলি যবে, একটি তারা কি কম পড়িল নভে? বনে কি পড়িল কম একটি কুসুম? ধরণীর কোলে এলি একরাশ চুম। স্বরগের সব-কিছু চুরি করে, চোর, পলাইয়া এলি এই পৃথিবীর ক্রোড়! তোর নামে রহিল রে মোর স্মৃতিটুক, তোর মাঝে রহিলাম আমি জাগরুক।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’, কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি! কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে! যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’ দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে! বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’। পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা। কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা। কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে! কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা! প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’ আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’ অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি। সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’ যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’, ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে! ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও, যদিও শহীদ হইতে রাজী ও! ‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে! হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী। ‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি! ‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে, ‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’ গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি! স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী! ‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’ ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’- যুগের না হই, হজুগের কবি বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী, দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু? হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু! বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম, রাজ-সরকার রেখেছেন মান! যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে, হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে! যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল, মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল, তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে। হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে! প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে ‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়! বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায় গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে, গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে! রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী, স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী, চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে। মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন, বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন। কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়! কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস! কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ! টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ। মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস! হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে! দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে। রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা, বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে! অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে, মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে। প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’, কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি! কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে! যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’ দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে! বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’। পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা। কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা। কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে! কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা! প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’ আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’ অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি। সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’ যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’, ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে! ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও, যদিও শহীদ হইতে রাজী ও! ‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে! হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী। ‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি! ‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে, ‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’ গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি! স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী! ‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’ ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’- যুগের না হই, হজুগের কবি বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী, দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু? হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু! বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম, রাজ-সরকার রেখেছেন মান! যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে, হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে! যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল, মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল, তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে। হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে! প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে ‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়! বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায় গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে, গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে! রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী, স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী, চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে। মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন, বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন। কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়! কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস! কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ! টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ। মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস! হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে! দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে। রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা, বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে! অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে, মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে। প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’, কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি! কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে! যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’ দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে! বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’। পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা। কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা। কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে! কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা! প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’ আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’ অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি। সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’ যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’, ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে! ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও, যদিও শহীদ হইতে রাজী ও! ‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে! হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী। ‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি! ‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে, ‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’ গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি! স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী! ‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’ ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’- যুগের না হই, হজুগের কবি বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী, দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু? হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু! বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম, রাজ-সরকার রেখেছেন মান! যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে, হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে! যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল, মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল, তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে। হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে! প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে ‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়! বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায় গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে, গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে! রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী, স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী, চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে। মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন, বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন। কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়! কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস! কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ! টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ। মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস! হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে! দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে। রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা, বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে! অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে, মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে। প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
সই, ভালো করে বিনোদ-বেণী বাঁধিয়া দে মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিননী-ফাঁদে।সই চপল পুরুষ সে, তাই কুরুশ-কাঁটায় রাখিব খোঁপার সাথে বিঁধিয়া লো তায় তাহে রেশমী জাল বিছায়ে দে ধরিতে চাঁদে।বাঁধিতে সে বাঁধন হারা বনের হরিণ জড়ায়ে দে জরীন্‌ ফিতা মোহন ছাঁদেপ্রথম প্রণয় রাগের মত আল্‌তা রঙে রাঙায়ে দে চরণ মোর এমনি ঢঙে সই পায়ে ধরে বঁধু যেন আমারে সাধে।।
কাজী নজরুল ইসলাম
চিন্তামূলক
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস; উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার, বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার! দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস, অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস, অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ! শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম, দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম! আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজলটলটল ধরণীর মত করুণায়! তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায় করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’ সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল? জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,- রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে, তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে। কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা, দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!…. গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা, দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন, হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্‌, ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো, অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো, আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার, তাই এবে কর্‌ ভোগ!-পড়ে হাহাকার নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি, কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি! চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু, কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু, দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ, আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান, প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,- তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ, তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ। সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু, উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু। মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে! নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে! লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’ ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’ সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী? যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি! প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’! বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্‌ মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই ‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই। ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’ বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’! নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায় দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্‌ভায় চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ! আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে! পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার। ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!- সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর, কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার, দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি? কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি? কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!…. আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই, ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
বৃথাই ওগো কেঁদে আমার কাটল যামিনী। অবেলাতেই পড়ল ঝরে কোলের কামিনী – ও  সে শিথিল কামিনী। খেলার জীবন কাটিয়ে হেলায় দিন না যেতেই সন্ধেবেলায় মলিন হেসে চড়ল ভেলায় মরণ-গামিনী। আহা   একটু আগে তোমার দ্বারে কেন নামিনি। আমার  অভিমানিনী।       ঝরার আগে যে কুসুমে দেখেও দেখি নাই ও যে   বৃথাই হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল, ছোট্ট বুকের একটু সুরভি আজ তারই সেই শুকনো কাঁটা বিঁধচে বুকে ভাই – আহা   সেই সুরভি আকাশ কাঁদায় ব্যথায় যেন সাঁঝের পুরবি জানলে না সে ব্যথাহতা পাষাণ-হিয়ার গোপন কথা, বাজের বুকেও কত ব্যথা কত  দামিনী! আমার   বুকের তলায় রইল জমা গো – না-কওয়া সে অনেক দিনের অনেক কাহিনি। আহা    ডাক দিলি তুই যখন, তখন কেন থামিনি! আমার অভিমানিনী।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
ভোর হল, ওঠ জাগো মুসাফির, আল্লা - রাসুল বোল গাফলিয়াতি ভোল রে অলস, আয়েশ আরাম ভোল।।এই দুনিয়ার সরাইখানায় (তোর) জনম গেল ঘুমিয়ে হায়! ওঠ রে সুখশয্যা ছেড়ে, মায়ার বাঁধন খোল।।দিন ফুরিয়ে এল যে রে দিনে দিনে তর দিনের কাজে অবহেলা করলি জীবনভোর।।যে দিন আজো আছে বাকী খোদারে তুই দিসনে ফাঁকি আখেরে পার হবি যদি পুলসিরাতের পোল।।
কাজী নজরুল ইসলাম
ব্যঙ্গাত্মক
১ ওই    তেত্রিশ কোটি দেবতাকে তোর তেত্রিশ কোটি ভূতে আজ    নাচ বুড্‌ঢি নাচায় বাবা উঠতে বসতে শুতে! ও ভূত         যেই দেখেছে মন্দির তোর নাই দেবতা নাচছে ইতর, আর    মন্ত্র শুধু দন্ত-বিকাশ, অমনি ভূতের পুতে, তোর    ভগবানকে ভূত বানালে ঘানি-চক্রে জুতে॥২ ও ভূত          যেই জেনেছে তোদের ওঝা আজ নকলের বইছে বোঝা, ওরে     অমনি সোজা তোদের কাঁধে খুঁটো তাদের পুঁতে, আজ ভূত-ভাগানোর মজা দেখায় বোম-ভোলা বম্বুতে!৩ও ভূত         সর্ষে-পড়া অনেক ধুনো দেখে শুনে হল ঝুনো, তাই     তুলো-ধুনো করছে ততই যতই মরিস কুঁথে, ও ভূত     নাচছে রে তোর নাকের ডগায় পারিসনে তুই ছুঁতে!৪          আগে   বোঝেনিকো তোদের ওঝা তোরা   গোঁজামিলের মন্ত্র-ভজা। (শিখলি শুধু চক্ষু-বোঁজা) শিখলি শুধু কানার বোঝা কুঁজোর ঘাড়ে থুতে, তাই    আপনাকে তুই হেলা করে ডাকিস স্বর্গদূতে॥৫  ওরে        জীবন-হারা, ভূতে-খাওয়া! ভূতের হাতে মুক্তি পাওয়া সে কি সোজা? – ভূত কি ভাগে ফুসমন্তর ফুঁতে? তোরা    ফাঁকির ‘কিন্তু’ এড়িয়ে – পড়বি কূলহারা ‘কিন্তু’তে!৬  ওরে           ভূত তো ভূত – ওই মারের চোটে ভূতের বাবাও উধাও ছোটে! ভূতের বাপ ওই ভয়টাকে মার, ভূত যাবে তোর ছুটে। তখন     ভূতে-পাওয়া এই দেশই ফের ভরবে দেবতা দূতে॥(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
রূপের সওদা কে করিবি তোরা আয় রে আয়, নওরোজের এই মেলায়! ডামাডোল আজি চাঁদের হাট, লিট হ'ল রূপ হ'ল লোপাট! খুলে ফেলে লাজ শরম-ঠাট! রূপসীরা সব রূপ বিলায় বিনি কিম্মতে হাসি-ইঙ্গিতে হেলাফেলায়! নওরোজের এই মেলায়!শা'জাদা উজির নওয়াব-জাদারা-রূপ-কুমার এই মেলায় খরিদ-দার! নও-জোয়ানীর জহুরী ঢের খুঁজিছে বিপণি জহরতের, জহরত নিতে-টেড়া আঁখের জহর কিনিছে নির্বিকার! বাহানা করিয়া ছোঁয় গো পিরান জাহানারার নওরোজের রূপ-কুমার!ফিরি ক'রে ফেরে শা'জাদী বিবি ও বেগম সা'ব চাঁদ মুখের নাই নেকাব? শূন্য দোকানে পসারিণী কে জানে কে করে বিকি-কিনি! চুড়ি-কঙ্কনে রিণিঠিনি কাঁদিছে কোমল কড়ি রেখাব! অধরে অধরে দর কষাকষি-নাই হিসাবহেম-কপোল লাল গোলাব।হেরেম-বাঁদীরা দেরেম ফেলিয়া মাগিছে দিল, নওরোজের নও-ম'ফিল! সাহেব, গোলাম, খুনী আশেক, বিবি বাঁদী,-সব আজিকে এক! চোখে চোখে পেশ দাখিলা চেক দিলে দিলে মিল এক সামিল! বে-পরওয়া আজ বিলায় বাগিচা ফুল-ত'বিল! নওরোনের নও-ম'ফিল।ঠোঁটে ঠোঁটে আজ মিঠি শরবৎ ঢাল উপুড়, রণ-ঝনায় পা'য় নূপুর। কিস্মিস-ছেঁচা আজ অধর, আজিকে আলাপ 'মোখতসর'! কার পায়ে পড়ে কার চাদর, কাহারে জড়ায় কার কেয়ূর, প্রলাপ বকে গো কলাপ মেলিয়া মন-ময়ূর, আজি দিলের নাই সবুর।আঁখির নিক্তি করিছে ওজন প্রেম দেদার তার কাহার অশ্রু-হার চোখে চোখে আজ চেনাচেনি! বিনি মূলে আজ কেনাকেনি, নিকাশ করিয়া লেনাদেনি 'ফাজিল' কিছুতে কমে না আর! পানের বদলে মুন্না মাগিছে পান্না-হার! দিল সবার 'বে-কারার'!সাধ ক'রে আজ বরবাদ করে দিল সবাই নিমখুন কেউ কেউ জবাই! নিকপিক করে ক্ষীণ কাঁকাল, পেশোয়াজ কাঁপে টালমাটাল, গুরু ঊরু-ভারে তনু নাকাল, টলমল আঁখি জল-বোঝাই! হাফিজ উমর শিরাজ পলায়ে লেখে 'রুবাই'! নিমখুন কেউ কেউ জবাই!শিরী লাইলীরে খোঁজে ফরহাদ খোঁজে কায়েস নওরোজের এই সে দেশ! ঢুঁড়ে ফেরে হেথা যুবা সেলিম নূরজাহানের দূর সাকিম, আরংজিব আজ হইয়া ঝিম হিয়ায় হিয়ায় চাহে আয়েস! তখত-তাউস কোহিনূর কারো নাই খায়েশ, নওরোজের এই সে দেশ!গুলে-বকৌলি ঊর্বশীর এ চাঁদনী-চক, চাও হেথায় রূপ নিছক। শারাব সাকী ও রঙে রূপে আতর লোবান ধূনা ধূপে সয়লাব সব যাক ডুবে, আঁখি-তারা হোক নিষ্পলক। চাঁদ মুখে আঁক কালো কলঙ্ক তিল-তিলক চাও হেথায় রূপ নিছক।হাসির নেশায় ঝিম মেরে আছে আজ সকল, লাল পানির রঙমহল! চাঁদ-বাজারে এ নওরোজের দোকান ব'সেছে মমতাজের, সওদা করিতে এসেছে ফের শা'জাহান হেথা রূপ-পাগল। হেরিতেছে কবি সুদূরের ছবি ভবিষ্যতের তাজমহল- নওরোজের স্বপ্ন-ফল!গুলে-বকৌলি- পরীদের রাণী, দেরেম- রৌপ্যমুদ্রা, ত'বিল-তহবিল, ম'ফিল-সভা আশেক-প্রেম, মোখতাসর- সংক্ষেপ, মুন্না- সাধারণত বা৬দীর নাম, ফাজিল-অতিরিক্ত বে-কারার- ধৈর্যহারা
কাজী নজরুল ইসলাম
চিন্তামূলক
হায় রে, আমার এ বদনসিব হ'ত যদি মনের মত! কিংবা গ্রহের চক্র ঘুরে আবার আমার বন্ধু হত! পালিয়ে যেত যৌবন মোর যখন হাতের মুঠি হ'তে, রেকাব সম রাখত ধ'রে এই জরারে সমুন্নত!!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
ওরে   এ কোন্ স্নেহ-সুরধুনী নামল আমার সাহারায়? বক্ষে কাঁদার বান ডেকেছে, আজ হিয়া কূল না হারায়! কণ্ঠে চেপে শুষ্ক তৃষা মরুর সে পথ তপ্ত সিসা, চলতে একা পাইনি দিশা ভাই; বন্ধ নিশাস – একটু বাতাস! এক ফোঁটা জল জহর-মিশা! – মিথ্যা আশা, নাই সে নিশানাই! হঠাৎ ও কার ছায়ার মায়া রে? – যেন   ডাক-নামে আজ গাল-ভরা ডাক ডাকছে কে ওই মা-হারায়! লক্ষ যুগের বক্ষ-ছাপা তুহিন হয়ে যে ব্যথা আর কথা ছিল ঘুমা, কে সে ব্যথায় বুলায় পরশ রে? – ওরে   গলায় তুহিন কাহার কিরণতপ্ত সোহাগ-চুমা? ওরে ও ভূত, লক্ষ্মীছাড়া, হতভাগা, বাঁধনহারা। কোথায় ছুটিস! একটু দাঁড়া, হায়! ওই তো তোরে ডাকচে স্নেহ, হাতছানি দেয় ওই তো গেহ, কাঁদিস কেন পাগল-পারা তায়? এত    ডুকরে কিসের তিক্ত কাঁদন তোর? অভিমানি! মুখ ফেরা দেখ যা পেয়েচিস তাও হারায়! হায়,   বুঝবে কে যে স্নেহের ছোঁয়ায় আমার বাণী রা হারায়।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আয় বেহেশতে কে যাবি আয় প্রানের বুলন্দ দরওয়াজায়, 'তাজা-ব-তাজা'র গাহিয়া গান চির-তরুণের চির-মেলায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।যুবা-যুবতীর সে-দেশে ভিড়, সেথা যেতে নারে বুঢঢা পীর, শাস্ত্র-শকুন জ্ঞান-মজুর যেতে নারে সেই হুরী-পরীর শরাব সাকীর গুলিস্তাঁয়। আয় বেহেশ্তে কে যাবি আয়।।সেথা হর্দম খুশীর মৌজ, তীর হানে কালো-আঁখির ফৌজ, পায়ে পায়ে সেখা আরজি পেশ, দিল চাহে সদা দিল-আফরোজ, পিরানে পরান বা৬ধা সেথায়, আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।করিল না যারা জীবনে ভুল দলিল না কাঁটা, ছেঁড়েনি ফুল, দারোয়ান হয়ে সারা জীবন আগুলিল বেড়া, ছুঁল না গুল,- যেতে নারে তারা এ-জলসায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।বুড়ো নীতিবিদ-নুড়ির প্রায় পেল না ক' এক বিন্দু রস চিরকাল জলে রহিয়া হায়!- কাঁটা বিঁধে যার ক্ষত আঙুল দোলে ফুলমালা তারি গলায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।তিলে তিলে এক্যারা পীষে মারে অপরের সাথে আপনারে, ধরণীর ঈদ-উৎসবে রোজা রেখে প'ড়ে থাকে দ্বারে, কাফের তাহারা এ ইদগায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।বুলবুল গেয়ে ফেরে বলি' যাহারা শাসায়ে ফুলবনে ফুটিতে দিল না ফুলকলি; ফুটিলে কুসুম পায়ে দলি' মারিয়াছে, পাছে বাস বিলায়! হারাম তা'রা এ -মুশায়েরায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।হেথা কোলে নিলে দিলরুবা শারাবী গজল গাহে যুবা, প্রিয়ার বে-দাগ কপোলে গো এঁকে দেয় তিল মনোলোভা, প্রেমের পাপীর এ-মোজরায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।আসিতে পারে না হেথা বে-দীন মৃত প্রান-হীন জরা-মলিন। নৌ-জোয়ানীর এ-মহফিল খুন ও শরাব হেথা অ-ভিন হেথা ধনু বাঁধা ফুলমালায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।পেয়ালায় হেথা শহীদি খুন তলোয়ার-চোঁয়া তাজা তরুণ আঙ্গুর-হৃদি চূয়ানো গো গেলাসে শরাব রাঙা অরুণ। শহীদে প্রেমিকে ভিড় হেথায়। আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।প্রিয়া-মুখে হেথা দেখি গো চাঁদ, চাঁদে হেরি প্রিয়-মুখের ছাঁদ। সাধ ক'রে হেথা করি গো পাপ, সাধ করে বাঁধি বালির বাঁধ, এ রস-সাগরে বালু-বেলায়! আয় বেহেশতে কে যাবি আয়।।
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে, পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে। গোর - আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।।কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত ঐ মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত। সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই।।কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে, আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে (আল্লার নাম জপতে চাই) ।।
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
নিদ্রা-দেবীর মিনার-চুড়ে মুয়াজ্জিনের শুনছি আরাব, – পান করে নে প্রাণ-পেয়ালায় যুগের আলোর রৌদ্র-শারাব! উষায় যারা চমকে গেল তরুণ রবির রক্ত-রাগে, যুগের আলো! তাদের বলো, প্রথম উদয় এমনি লাগে! সাতরঙা ওই ইন্দ্রধনুর লাল রংটাই দেখল যারা, তাদের গাঁয়ে মেঘ নামায়ে ভুল করেছে বর্ষা-ধারা। যুগের আলোর রাঙা উদয়, ফাগুন-ফুলের আগুন-শিখা, সীমন্তে লাল সিঁদুর পরে আসছে হেসে জয়ন্তিকা!   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান!- আমার আঁখির দুখ-দীপ নিয়া বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া, যতটুকু হেরি বিস্ময়ে মরি, ভ’রে ওঠে সারা প্রাণ! এত ভালো তুমি? এত ভালোবাসা? এত তুমি মহীয়ান্‌? ভগবান! ভগবান! তোমার সৃষ্টি কত সুন্দর, কত সে মহৎ, পিতা! সৃষ্টি-শিয়রে ব’সে কাঁদ তবু জননীর মতো ভীতা! নাহি সোয়াসি-, নাহি যেন সুখ, ভেঙে গড়ো, গড়ে ভাঙো, উৎসুক! আকাশ মুড়েছ মরকতে-পাছে আঁখি হয় রোদে ম্লান। তোমার পবন করিছে বীজন জুড়াতে দগ্ধ প্রাণ! ভগবান! ভগবান! রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে- ‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে। এই ধরণীর যাহা সম্বল,- বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল, সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখীর কন্ঠে গান,- সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!’ ভগবান! ভগবান! শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ। আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ! তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে, সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান। সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান! ভগবান! ভগবান! তব কনিষ্ঠ মেয়ে ধরণীরে দিলে দান ধুলা-মাটি, তাই দিয়ে তার ছেলেদের মুখে ধরে সে দুধের বাটি! ময়ূরের মতো কলাপ মেলিয়া তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া- সন্তান তার সুখী নয়, তারা লোভী, তারা শয়তান! ঈর্ষায় মাতি’ করে কাটাকাটি, রচে নিতি ব্যবধান! ভগবান! ভগবান! তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী, রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী! মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া! সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস’ান! ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান! ভগবান! ভগবান! জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়, সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়। মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ, মাটির মালিক তাঁহারাই হন- যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান। নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান। ভগবান! ভগবান! অন্যায় রণে যারা যত দড় তারা তত বড় জাতি, সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি! তোমার চক্র রুধিয়াছে আজ বেনের রৌপ্য-চাকায়, কি লাজ! এত অনাচার স’য়ে যাও তুমি, তুমি মহা মহীয়ান্‌ । পীড়িত মানব পারে না ক’ আর, সবে না এ অপমান- ভগবান! ভগবান! ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহি ক’ আর! ‘ মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে ‘মার মার!’ রক্ত যা ছিল ক’রেছে শোষণ, নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ! শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান- ‘ জয় নিপীড়িত জনগণ জয়! জয় নব উত্থান! জয় জয় ভগবান!’ তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে কবির ভোগ, এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ। তাজা ফুল ফলে অঞ্চলি পুরে বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে, কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান? আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ- এতদিনে ভগবান! যে-আকাশে হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা, সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কা’রা? উদার আকাশ বাতাস কাহারা করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা? তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান? হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান? ভগবান! ভগবান! তোমার দত্ত হসে-রে বাঁধে কোন্‌ নিপীড়ন-চেড়ী? আমার স্বাধীন বিচরণ রোধে কার আইনের বেড়ী? ক্ষুধা তৃষা আছে, আছে মোর প্রাণ, আমিও মানুষ, আমিও মহান্‌ ! আমার অধীনে এ মোর রসনা, এই খাড়া গর্দান! মনের শিকল ছিঁড়েছি, পড়েছে হাতের শিকলে টান- এতদিনে ভগবান! চির-অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উ”চ শির। বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর। এতদিনে তার লাগিয়াছে ভালো- আকাশ বাতাস বাহিরেতে আলো, এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ। মুক্ত-কন্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান- জয় নিপীড়িত প্রাণ! জয় নব অভিযান! জয় নব উত্থান!
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল। মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল। আমরা ছাত্রদল।। মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে যাত্রা নাঙ্গা পায়, আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই বিষম চলার ঘায়! যুগে-যুগে রক্তে মোদের সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল! আমরা ছাত্রদল।। মোদরে কক্ষচ্যুত ধুমকেতু-প্রায় লক্ষহারা প্রাণ, আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর নিত্য বলিদান। যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন, আমরা পশি নীল অতল, আমরা ছাত্রদল।। আমরা ধরি মৃত্যু-রাজার যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ, মোদের মৃত্যু লেখে মোদের জীবন-ইতিহাস! হাসির দেশে আমরা আনি সর্বনাশী চোখের জল। আমরা ছাত্রদল।। সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়, আমরা করি ভুল। সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব, আমরা ভাঙি কূল। দার”ণ-রাতে আমরা তর”ণ রক্তে করি পথ পিছল! আমরা ছাত্রদল।। মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল বক্ষে ভরা বাক্‌, কন্ঠে মোদের কুন্ঠ বিহীন নিত্য কালের ডাক। আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি সরস্বতীর শ্বেত কমল। আমরা ছাত্রদল।। ঐ দারুণ উপপ্লাবের দিনে আমরা দানি শির, মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে বিংশ শতাব্দীর! মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে ভ’রেছি মা’র শ্যাম আঁচল। আমরা ছাত্রদল।। আমরা রচি ভালোবাসার আশার ভবিষ্যৎ মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায় আকাশ-ছায়াপথ! মোদের চোখে বিশ্ববাসীর স্বপ্ন দেখা হোক সফল। আমরা ছাত্রদল।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
[তখন শরৎ-সন্ধ্যা। আস্মানের আঙিনা তখন কার্বালা ময়দানের মতো খুনখারাবির রঙে রঙিন। সেদিনকার মহা-আহবে গ্রীক-সৈন্য সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইহা গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ সৈন্যই রণস্থলে হত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। বাকি সব প্রাণপণে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতেছে। তুরস্কের জাতীয় সৈন্যদলের কাণ্ডারী বিশ্বত্রাস মহাবাহু কামাল-পাশা মহাহর্ষে রণস্থল হইতে তাম্বুতে ফিরিতেছেন। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যদল মহাকল্লোলে অম্বর-ধরণী কাঁপাইয়া তুলিতেছে। তাহাদের প্রত্যেকের বুকে পিঠে দুই জন করিয়া নিহত বা আহত সৈন্য বাঁধা। যাহারা ফিরিতেছে তাহাদেরও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোলাগুলির আঘাতে, বেয়নটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত, পোষাক-পরিচ্ছদ ছিন্নভিন্ন, পা হইতে মাথা পর্যন্ত রক্তরঞ্জিত। তাহাদের কিন্তু সে দিকে ভ্রূক্ষেপও নাই। উদ্দাম বিজয়োন্মাদনার নেশায় মৃত্যু-কাতর রণক্লান্তি ভুলিয়া গিয়া তাহারা যেন খেপিয়া উঠিয়াছে। ভাঙা সঙ্গীনের আগায় রক্ত-ফেজ উড়াইয়া ভাঙা-খাটিয়া-আদি-দ্বারা-নির্মিত এক অভিনব চৌদলে কামালকে বসাইয়া বিষম হল্লা করিতে করিতে তাহারা মার্চ করিতেছে। ভূমিকম্পের সময় সাগর কল্লোলের মতো তাহাদের বিপুল বিজয়ধ্বনি আকাশে-বাতাসে যেন কেমন একটা ভীতি-কম্পনের সৃজন করিতেছে। বহু দূর হইতে সে রণ-তাণ্ডব নৃত্যের ও প্রবল ভেরী-তূরীর ঘন রোল শোনা যাইতেছে। অত্যধিক আনন্দে অনেকেরই ঘন ঘন রোমাঞ্চ হইতেছিল। অনেকেরই চোখ দিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতেছিল।] [সৈন্য-বাহিনী দাঁড়াইয়া। হাবিলদার-মেজর তাহাদের মার্চ করাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যগণ গাইতেছিল,–] ঐ খেপেছে পাগ্লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল সামাল তাই। কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো   কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! [হাবিলদার-মাজর মার্চের হুকুম করিল,-কুইক্ মার্চ!] লেফ্ট! রাইট! লেফ্ট!! লেফ্ট! রাইট! লেফ্ট!! [সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ করিতে লাগিল] ঐ খেপেছে পাগ্লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল সামাল তাই! কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো    কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! [হাবিলদার-মেজর;- লেফ্ট্! রাইট!] সাব্বাস্ ভাই! সাব্বাস্ দিই, সাব্বাস্ তোর শম্শেরে। পাঠিয়ে দিলি দুশ্মনে সব যম-ঘর একদম্-সে রে! বল্ দেখি ভাই বল্ হাঁ রে, দুনিয়ার কে ডর্ করে না তুর্কির তেজ তলোয়ারে? [লেফট্! রাইট! লেফ্ট্!] খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া! বুজ্দিল্ ঐ দুশ্মন্ সব বিল্কুল্ সাফ হো গিয়া! খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া! হুর্রো হো! হুর্রো হো! দস্যুগুলোয় সাম্লাতে যে এমনি দামাল কামাল চাই! কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো  কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! [হাবিলদার-মেজর;- সাবাস সিপাই! লেফ্ট্! রাইট্! লেফ্ট!] শির হতে এই পাঁও-তক্ ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে রণ-ভিতুদের শান্তি-বাণী শুন্বে কে? পিণ্ডারিদের খুন-রঙিন নোখ-ভাঙা এই নীল সঙিন তৈয়ার হেয়্ হর্দম ভাই ফাড়্তে যিগর্ শত্রুদের! হিংসুক-দল! জোর তুলেছি শোধ্ তাদের! সাবাস্ জোয়ান! সাবাস্! ক্ষীণজীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্– এম্নি করে রে– এমনি জোরে রে– ক্ষীণজীবি ঐ জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্!– ঐ চেয়ে দ্যাখ্ আসমানে আজ রক্ত-রবির আভাস!– সাবাস্ জোয়ান! সাবাস্!! [লেফট্! রাইট! লেফ্ট্] হিংসুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের, তাই তারা আজ নেস্ত-নাবুদ, আমরা মোটেই হইনি জের ! পরের মুলুক লুট করে খায় ডাকাত তারা ডাকাত ! তাই   তাদের তারে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত ! কি বলো ভাই শ্যাঙাত? হুর্রো হো ! হুর্রো হো ! ! দনুজ দলে দল্তে দাদা এম্নি দামাল কামাল চাই ! কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো       কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! [হাবিলদার মেজর: রাইট্ হুইল্! লেফ্ট্া রাইট্! লেফ্ট্! সৈন্যগণ ডানদিকে মোড় ফিরিল।] আজাদ মানুষ বন্দী করে, অধীন করে স্বাধীন দেশ, কুল্ মুলুকের কুষ্টি করে জোর দেখালে ক'দিন বেশ, মোদের হাতে তুর্কি-নাচন নাচ্লে তাধিন্ তাধিন্ শেষ! হুর্রো হো! হুর্রো হো! বদ্-নসিবের বরাত খারাব বরাদ্দ তাই কর্লে কি না আল্লায়, পিশাচগুলো পড়্ল এসে পেল্লায় এই পাগলাদেরই পাল্লায়! এই    পাগলাদেরই পাল্লায়!! হুর্রো হো! হুর্রো– ওদের     কল্লা দেখে আল্লা ডরায়, হল্লা শুধু হল্লা, ওদের    হল্লা শুধু হল্লা, এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধর্তে আসেন তুর্কি-তাজি মর্দ গাজি মোল্লা! হাঃ! হাঃ! হাঃ! হেসে   নাড়িই ছেড়ে বা! হা হা   হাঃ! হাঃ! হাঃ! [হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্ট্ রাইট্! লেফ্ট্! সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!] ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই! অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল সামাল তাই! কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! হো হো  কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! [হাবিলদার-মেজর;- লেফ্ট্ হুইল্! য়্যাজ্ য়ু ওয়্যার্!- রাইট হুইল!– লেফ্ট্! রাইট! লেফট্!] [সৈন্যদের আঁখির সামনে অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা ভাসিয়া উঠিল।] দেখ্চ কি দোস্ত অমন করে? হৌ হৌ হৌ! সত্যি তো ভাই!– সন্ধেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ! শহীদ সেনার টুক্টুকে বৌ লাল-পিরাহান-পরা, স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগডগে আন্কোরা!– না না না,–কল্জে যেন টুকরো-করে-কাটা হাজার তরুণ শহীদ বীরের,–শিউরে উঠে গা'টা! আস্মানের ঐ সিং-দরজায় টাঙিয়েছে কোন্ কসাই! দেখতে পেলে এক্ষুনি গে এই ছোরাটা কল্জেতে তার বসাই! মুণ্ডুটা তার খসাই! গোস্বাতে আর পাইনে ভেবে কি যে করি দশাই! [হাবিলদার-মেজর-সাবাস সিপাই! লেফ্ট্! রাইট্! লেফ্ট্!] [ঢালু পার্বত্য পথ, সৈন্যগণ বুকের পিঠের নিহত ও আহত সৈন্যদের ধরিয়া সন্তর্পণে নামিল।] আহা কচি ভাইরা আমার রে! এমন কাঁচা জানগুলো খান্ খান্ করেছে কোন্ সে চামার রে? আহা কচি ভাইরা আমার রে! ! [সাম্নে উপত্যকা। হাবিলদার মেজর :– লেফ্ট্ ফর্ম! সৈন্য- বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল! হাবিলদার মেজর :-ফর্ওয়ার্ড ! লেফ্ট্ ! রাইট্ ! লেফ্ট্ !] আস্মানের ঐ আঙরাখা খুন-খারাবির রঙ মাখা কি খুবসুরৎ বাঃ রে বা ! জোর বাজা ভাই কাহারবা! হোক্ না ভাই এ কারবালা ময়দান– আমরা যে গাই সাচ্চারই জয়-গান ! হোক্ না এ তোর কার্বালা ময়দান ! ! হুর্রো হো ! হুর্রো– [সাম্নে উপত্যকা– হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে। হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিতে লাগিল। হুকুম দিয়া গেল– 'মার্ক্ টাইম্।' সৈন্যরা এক স্থানেই দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল–] দ্রাম্! দ্রাম্! দ্রাম! লেফ্ট্! রাইট! লেফ্ট! দ্রাম্! দ্রাম্! দ্রাম্! আস্মানে ঐ ভাস্মান যে মস্ত দুটো রঙের তাল, একটা নিবিড় নীল-সিয়া আর একটা খুবই গভীর লাল,– বুঝ্লে ভাই! ঐ নীল সিয়াটা শত্রুদের! দেখ্তে নারে কারুর ভালো, তাইতে কালো রক্ত-ধারার বইছে শিরায় স্রোত ওদের। হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল! গৃধ্নু ওরা, লুব্ধ ওদের লক্ষ্য অসুর বল– হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল! জালিম ওরা অত্যাচারী! সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই! জালিম ওরা অত্যাচারী! সৈনিকের এই গৈরিকে ভাই– জোর অপমান করলে ওরাই, তাই তো ওদের মুখ কালো আজ, খুন যেন নীল জল!– ওরা    হিংস্র পশুর দল! ওরা    হিংস্র পশুর দল!! [হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল-ফর্ওয়ার্ড! লেফ্ট্ হুইল্– সৈন্যগণ আবার চলিতে লাগিল-লেফ্ট্ রাইট্! লেফ্ট্!] সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হলো মরে। তোদের মতন পিঠ ফেরেনি প্রাণটা হাতে করে,– ওরা     শহীদ হলো মরে! পিট্নি খেয়ে পিঠ যে তোদের ঢিট হয়েছে! কেমন! পৃষ্ঠে তোদের বর্শা বেঁধা, বীর সে তোরা এমন! মুর্দারা সব যুদ্ধে আসিস্! যা যা! খুন দেখেছিস্ বীরের? হা দেখ্ টক্টকে লাল কেমন গরম তাজা! মুর্দারা সব যা যা!! [বলিয়াই কটিদেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল] ত্রঁরাই বলেন হবেন রাজা! আরে যা যা! উচিত সাজা তাই দিয়েছে শক্ত ছেলে কামাল ভাই! [হাবিলদার মেজর;- সাবাস সিপাই!] এই তো চাই! এই তো চাই! থাক্লে স্বাধীন সবাই আছি, নেই তো নাই, নেই তো নাই! এই তো চাই!! [কতকগুলি লোক অশ্রুপূর্ণ নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছিল। তাহাদের দেখিয়া সৈন্যগণ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল।] মার্ দিয়া ভাই মার্ দিয়া! দুশ্মন্ সব হার্ গিয়া! কিল্লা ফতে হো দিয়া। পর্ওয়া নেহি, যা নে দো ভাই যো গিয়া! কিল্লা ফতে হো গিয়া! হুর্রো হো! হুর্রো হো! [হাবিলদার-মেজর;-সাবাস জোয়ান! লেফ্ট্! রাইট্!] জোর্সে চলো পা মিলিয়ে, গা হিলিয়ে, এম্নি করে হাত দুলিয়ে! দাদ্রা তালে 'এক দুই তিন' পা মিলিয়ে ঢেউএর মত যাই! আজ   স্বাধীন এ দেশ! আজাদ মোরা বেহেশ্তও না চাই! আর          বেহেশ্তও না চাই!! [হাবিলদার-মেজর:- সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!] ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল তাই! কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই ! হো হো    কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই ! ! [সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল। নগর-বাসিনীরা ঝরকা হইতে মুখ বাড়াইয়া এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত। আজ বধূর মুখের বোরকা খসিয়া পড়িয়াছে। ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতেছিল। সৈন্যগণ চীৎকার করিয়া উঠিল।] ঐ শুনেছিস্? ঝর্কাতে সব বল্ছে ডেকে বৌ-দলে, 'কে বীর তুমি? কে চলেছ চৌদলে?' চিনিস্নে কি? এমন বোকা বোনগুলি সব!– কামাল এ যে কামাল! পাগলি মায়ের দামাল ছেলে! ভাই যে তোদের! তা না হলে কার হবে আর রৌশন্ এমন জামাল? কামাল এ যে কামাল!! উড়িয়ে দেবো পুড়িয়ে দেবো ঘর-বাড়ি সব সামাল! ঘর-বাড়ি সব সামাল!! আজ আমাদের খুন ছুটেছে, হোশ টুটেছে, ডগ্মগিয়ে জোশ উঠেছে! সাম্নে থেকে পালাও! শোহরত দাও নওরাতি আজ! হর্ ঘরে দীপ জ্বালাও! সাম্নে থেকে পালাও! যাও ঘরে দীপ জ্বালাও!! [হাবিলদার-মেজর:- লেফ্ট্ ফর্ম্! লেফ্ট্! রাইট! লেফ্ট্!-ফরওয়ার্ড্!] [বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল। পার্শ্বেই পরিখার সারি। পরিখা-ভর্তি নিহত সৈন্যের দল পচিতেছে এবং কতকগুলি অ-সামরিক নগরবাসী তাহা ডিঙাইয়া ডিঙাইয়া চলিতেছে।] ইস্! দেখেছিস! ঐ কারা ভাই সাম্লে চলেন পা, ফস্কে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা! ও তাই শিউরে ওঠে গা! হাঃ হাঃ হাঃ! মরল যে সে মরেই গেছে, বাঁচ্ল যারা রইল বেঁচে! এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি তার আঁ? মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ! [সম্মুখে সঙ্কীর্ণ ভগ্ন সেতু। হাবিলদার-মেজর অর্ডার দিল-'ফর্ম্ ইন্টু সিঙ্গল্ লাইন'। এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ও আহত ভাইদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পণে 'স্লো মার্চ' করিয়া পার হইতে লাগিল।] সত্যি কিন্তু ভাই! যখন মোদের বক্ষে-বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই– কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে! কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কল্জেখানা পেষে! নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে তখন ডুক্রে কেন কেঁদেও ফেলি শেষে! কে যেন ভাই কল্জেখানা পেষে!! ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা! বুক যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস দিই, যতই বলি বাহা! লক্ষ্মীমণি ভাইটি আমার, আহা!! ঘুমোও ঘুমোও মরণ-পরের ভাইটি আমার, আহা!! অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা! ঘুমোও এখন ঘুমোও ঘুমোও ভাইটি ছোট আহা! মরণ-বধূর লাল রাঙা বর! ঘুমো! আহা, এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো! হতভাগা রে! মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে না জানি কোন্ ফুট্তে-চাওয়া মানুষ-কুঁড়ির হিয়ায়! তরুণ জীবন এম্নি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়! অরুণ খুনের তরুণ শহীদ! হতভাগ্য রে! মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে! তাই যত আজ লিখ্নে-ওয়ালা তোদের মরণ ফুর্তি-সে জোর লেখে! এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু-কথা! হাসি রকম দেখে! মরলে কুকুর ওদের, ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে! খবর বেরোয় দৈনিকে, আর   একটি কথায় দুঃখ জানান, 'জোর মরেছে দশটা হাজার সৈনিকে!' আঁখির পাতা ভিজল কি না কোনো কালো চোখের, জান্ল না হায় এ-জীবনে ঐ সে তরুণ দশটি হাজার লোকের! পচে মরিস পরিখাতে, মা-বোনেরাও শুনে বলে 'বাহা'! সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথার ব্যথী কেউ কি রে নেই? আহা!– আয় ভাই তোর বৌ এল ঐ সন্ধ্যা মেয়ে রক্ত-চেলি পরে, আঁধার-শাড়ি পরবে এখন পশ্বে যে তোর গোরের বাসর-ঘরে!– ভাবতে নারি, গোরের মাটি করবে মাটি এ মুখ কেমন করে– সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে! বিদায়-বেলায় আরেকটিবার দিয়ে যা ভাই চুমো! অনাদরের ভাইটি আমার! মাটির মায়ের কোলে এবার ঘুমো!! [নিহত সৈন্যদের নামাইয়া রাখিয়া দিয়া সেতু পার হইয়া আবার জোরে মার্চ করিতে করিতে তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল।] ঠিক বলেছ দোস্ত তুমি! চোস্ত কথা! আয় দেখি–তোর হস্ত চুমি! মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের? আব্-জম্-জম্ আনলে এরা, আপনি পিয়ে কল্সি বিষের! কে মরেছে? কান্না কিসের? বেশ করেছে! দেশ বাঁচাতে আপ্নারি জান শেষ করেছে! বেশ করেছে!! শহীদ ওরাই শহীদ! বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে খুন ওদেরি লোহিত! শহীদ ওরাই শহীদ!! [এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল। মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্যসামন্ত ও সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে আত্মহারা হইয়া 'ডবল মার্চ' করিতে লাগিল] হুর্রো হো! হুর্রো হো!! ভাই-বেরাদর পালাও এখন! দূর্ রহো! দূর্ রহো!! হুর্রো হো! হুর্রো হো! [কামাল পাশাকে কোলে করিয়া নাচিতে লাগিল] হৌ হৌ হৌ! কামাল জিতা রও! কামাল জিতা রও! ও কে আসে? আনোয়ার ভাই?– আনোয়ার ভাই! জানোয়ার সব সাফ!! জোর নাচো ভাই! হর্দম্ দাও লাফ! আজ জানোয়ার সব সাফ! হুর্রো হো! হুর্রো হো!! সব-কুছ আব্ দূর্ রহো! – হুর্রো হো! হুর্রো হো!! রণ জিতে জোর মন মেতেছে!-সালাম সবায় সালাম!– নাচ্না থামা রে! জখ্মি ঘায়েল ভাইকে আগে আস্তে নামা রে! নাচ্না থামা রে!– [আহতদেরে নামাইতে নামাইতে] কে ভাই? হাঁ হাঁ, সালাম! –ঐ শোন্ শোন্ সিপাহ্-সালার কামাল ভাই-এর কামাল। [সেনাপতির অর্ডার আসিল] 'সাবাস! থামো! হো! হো! সাবাস! হল্ট্! এক! দো!' [এক নিমিষে সমস্ত কল-রোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখনো কি তারায় তারায় যেন ঐ বিজয় গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণ হইয়া মিলিয়া গেল–] ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই! অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই! কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই। হো হো,     কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!! —————————— তু নে– তুমি। কামাল কিয়া– অভাবনীয় কাণ্ড করলে, অসম্ভব করলে! ['কামাল মানে কিন্তু পূর্ণ'] শমশেরে– তরবারিকে। বিল্কুল সাফ হো গিয়া– একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে। খুব কিয়া–আচ্ছা করেছ। বুজদিল–ভীরু, কাপুরুষ। পাঁও তক– পা পর্যন্ত। নেস্ত-নাবুদ– ধ্বংস-বিধ্বংস কুল মুলুক– সমস্ত দেশ। আজাদ– মুক্ত বদ্-নসিব– দুর্ভাগ্য ত্যজি– যুদ্ধাশ্ব পিরাহান– পিরান। গোস্বা– ক্রোধ খুবসরৎ– সুন্দর সিয়া– কৃষ্ণবর্ণ। জালিম– উৎপীড়ক মুর্দা– মৃত জামাল– রূপ। জোশ– উত্তেজনা শোহরত– ঘোষণা নোরাতি– উৎসব-রাত্রি ভাই-বেরাদর– আত্মীয়-স্বজন। জিতা রও– বেঁচে থাক আব্– এখন জখ্মি – ঘায়েল, আহত। সিপাহি-সালার – প্রধান সেনাপতি কালাম– হুকুম
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
কী যে ছাই ধানাই-পানাই – সারাদিন বাজছে সানাই, এদিকে কারুর গা নাই আজই না মামার বিয়ে! বিবাহ! বাস, কী মজা! সারাদিন মণ্ডা গজা গপাগপ খাও না সোজা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। তবু বর হচ্ছিনে ভাই, বরের কী মুশকিলটাই – সারাদিন উপোস মশাই শুধু খাও হরিমটর! শোনো ভাই, মোদের যবে বিবাহ করতে হবে – ‘বিয়ে দাও’ বলব, ‘তবে কিছুতেই হচ্ছিনে বর!’ সত্যি, কও না মামা, আমাদের অমনি জামা অমনি মাথায় ধামা দেবে না বিয়ে দিয়ে? মামিমা আসলে এ ঘর মোদেরও করবে আদর? বাস, কী মজার খবর! আমি রোজ করব বিয়ে॥(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আমি     যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু! সাত      সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে, মম       ধূম-কুণ্ডুলি করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘর ঘোলাটে! আমি     অশিব তিক্ত অভিশাপ, আমি     স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার– আর    মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ, আমি   অশিব তিক্ত অভিশাপ!আমি     সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে, আমি     বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে। শোঁও    শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই, ঘুর্       পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই মম       পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি; করি      উল্কা-অশনি-বৃষ্টি,– আমি   একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি। আমি   অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!আমি   আপনার বিষ-জ্বালা-মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া জোর   বুঁদ হয়ে আমি চলেছি ধাইয়া ভাইয়া! শুনি    মম বিষাক্ত 'রিরিরিরি'-নাদ শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব-ঘোরার প্রণব-নিনাদ! ধূর্জটি-শিখ করাল পুচ্ছে দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাঁটা করে ঘুরাই উচ্চে, ঘুরাই– আমি   অগ্নি-কেতন উড়াই!– আমি   যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু এই    স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!ঐ     বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত মম    অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ! আমি   জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী, তাই   বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি। আমি   জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও! তাই   বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও! তোর   নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি! আর   যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি। মম    তূরীয় লোকের তির্যক্ গতি তূর্য গাজন বাজায় মম    বিষ নিশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!কচি   শিশু-রসনায় ধানি-লঙ্কার পোড়া ঝাল আর   বন্ধ কারায় গন্ধক ধোঁয়া, এসিড, পটাশ, মোন্‌ছাল, আর   কাঁচা কলিজায় পচা ঘা'র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই! পেলে   বাহান্ন-শও জাহান্নমেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!আমি   যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু– এই     স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু! আমি   শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি, আমি   ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি! তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘুরে বোঁও করে ফের দু'পাক নি! কৃতঘ্নী আমি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!         পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর– শোন্ রে মর, শোন্ অমর!– সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা! এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জানো কি তা? কি বলো? কি বলো? ফের বলো ভাই আমি শয়তান-মিতা! হো হো  ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা! ছোট   শন শন শন ঘর ঘর সাঁই সাঁই! ছোট         পাঁই পাঁই! তুই    অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই! ওরে   ভয় নাই তোর মার নাই!! তুই    প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু, তুই    উগ্র ক্ষিপ্ত তেজ-মরীচিকা ন'স্ অমরার ঘুম-সেতু তুই     ভৈরব ভয় ধূমকেতু! আমি    যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু এই      স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু !ঐ       ঈশ্বর-শির উল্লজ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি, আমি   বসিব বলিয়া পেতেছে ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি ! খ্যাপা  মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি লোকে  বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি ! এই    শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি ওরে   ছড়ানো রয়েছে, কত যায় গড়াগড়ি ! মহা    সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি, তার    ললাট তপ্ত অভিশাপ-ছাপ এঁকে দিই আমি যদি ! তাই   টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,আমি   বাজাই আকাশে তালি দিয়া 'তাতা-উর্-তাক্' আর   সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক! মম    নিশাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে ওঠে ঘুৎকার আর   পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুৎকার!কাল            বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার তখনি রক্ত শোষে না রে তার, দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড-সুখে পুচ্ছ সাপটি খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে! তেমনি করিয়া ভগবানে আমি দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী ঘিরিয়া  ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি এই অগ্নি-বাঘিনী আমি যে সর্বনাশী!আজ   রক্ত-মাতাল উল্লাসে মাতি রে– মম    পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি, রক্ত রুদ্র উল্লাসে মাতি রে! ভগবান? সে তো হাতের শিকার!– মুখে ফেনা উঠে মরে! ভয়ে   কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের 'পরে! অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়াঅজগর কাল-কেউটে সে কোন ফিরিয়া ফিরিয়া চায়, আর ঘোরে শন্‌ শন্ শন্, ভয়-বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন– তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে, আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম বিধাতা তাদের কাঁপিছে রুদ্র ঘূর্ণির মাঝে মম!আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে, স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি পাছে বা বড় হয়ে তারে গ্রাসে!
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে– মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে – বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে। আসল হাসি, আসল কাঁদন মুক্তি এলো, আসল বাঁধন, মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে। ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে – আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস, ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস, গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে! ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন, মদন মারে খুন-মাখা তূণ পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে গো দিগ বালিকার পীতবাসে;আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে! আজ কপট কোপের তূণ ধরি, ঐ আসল যত সুন্দরী, কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন, কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে! তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের আমার চোখে জল আসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর, আসল নিকট, আসল সুদূর আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে! ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল হাসল শিশির দুবঘাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আজ জাগল সাগর, হাসল মরু কাঁপল ভূধর, কানন তরু বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান ভৈরবীদের গান ভাসে, মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে– মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে – বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে। আসল হাসি, আসল কাঁদন মুক্তি এলো, আসল বাঁধন, মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে। ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে – আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস, ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস, গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে! ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন, মদন মারে খুন-মাখা তূণ পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে গো দিগ বালিকার পীতবাসে;আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে! আজ কপট কোপের তূণ ধরি, ঐ আসল যত সুন্দরী, কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন, কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে! তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের আমার চোখে জল আসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর, আসল নিকট, আসল সুদূর আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে! ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল হাসল শিশির দুবঘাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আজ জাগল সাগর, হাসল মরু কাঁপল ভূধর, কানন তরু বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান ভৈরবীদের গান ভাসে, মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে– মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে – বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে। আসল হাসি, আসল কাঁদন মুক্তি এলো, আসল বাঁধন, মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে। ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে – আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস, ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস, গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে! ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন, মদন মারে খুন-মাখা তূণ পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে গো দিগ বালিকার পীতবাসে;আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে! আজ কপট কোপের তূণ ধরি, ঐ আসল যত সুন্দরী, কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন, কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে! তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের আমার চোখে জল আসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর, আসল নিকট, আসল সুদূর আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে! ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল হাসল শিশির দুবঘাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আজ জাগল সাগর, হাসল মরু কাঁপল ভূধর, কানন তরু বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান ভৈরবীদের গান ভাসে, মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
দুঃখে আমি মগ্ন প্রভু, দুয়ার খোলো করুণার! আমায় করো তোমার জ্যোতি, অন্তর মোর অন্ধকার। স্বর্গ যদি অর্জিতে হয় এতই পরিশ্রম করে- সে ত আমার পারিশ্রমিক, নয় সে দয়ার দান তোমার।
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির নির্মল শান্ত অচঞ্চল ধ্রুব-জ্যোতি। অশান্ত এ চিত করো হে সমাহিত সদা আনন্দিত রাখো মতি॥ দুঃখ শোক সহি অসীম সাহসে অটল রহি যেন সম্মানে যশে তোমার ধ্যানের আনন্দ-রসে নিমগ্ন রহি হে বিশ্বপতি॥ মন যেন না টলে কল কোলাহলে, হে রাজ-রাজ, অন্তরে তুমি নাথ সতত বিরাজ। বহে তব ত্রিলোক ব্যাপিয়া, হে গুণী ওংকার-সংগীত সুর-সুরধুনী, হে মহামৌনী, যেন সদা শুনি সে সুরে তোমার নীরব আরতি॥  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
মোর অপরাধ শুধু মনে থাক! আমি হাসি, তার আগুনে আমারই অন্তর হোক পুড়ে খাক! অপরাধ শুধু মনে থাক!নিশীথের মোর অশ্রুর রেখা প্রভাতে কপোলে যদি যায় দেখা, তুমি পড়িয়ো না সে গোপন লেখা গোপনে সে লেখা মুছে যাক অপরাধ শুধু মনে থাক!এ উপগ্রহ কলঙ্ক-ভরা তবু ঘুরে ঘিরি তোমারই এ ধরা, লইয়া আপন দুখের পসরা আপনি সে খাক ঘুরপাক। অপরাধ শুধু মনে থাক!জ্যোৎস্না তাহার তোমার ধরায় যদি গো এতই বেদনা জাগায়, তোমার বনের লতায় পাতায় কালো মেঘে তার আলো ছাক। অপরাধ শুধু মনে থাক!তোমার পাখির ভুলাইতে গান আমি তো আসিনি, হানিনি তো বাণ, আমি তো চাহিনি কোনো প্রতিদান, এসে চলে গেছি নির্বাক। অপরাধ শুধু মনে থাক।কত তারা কাঁদে কত গ্রহে চেয়ে ছুটে দিশাহারা ব্যোমপথ বেয়ে, তেমনই একাকী চলি গান গেয়ে তোমারে দিইনি পিছু-ডাক। অপরাধ শুধু মনে থাক!কত ঝরে ফুল, কত খসে তারা, কত সে পাষাণে শুকায় ফোয়ারা, কত নদী হয় আধ-পথে হারা, তেমনই এ স্মৃতি লোপ পাক। অপরাধ শুধু মনে থাক!আঙিনায় তুমি ফুটেছিলে ফুল এ দূর পবন করেছিল ভুল, শ্বাস ফেলে চলে যাবে সে আকুল – তব শাখে পাখি গান গাক। অপরাধ শুধু মনে থাক!প্রিয় মোর প্রিয়, মোরই অপরাধ, কেন জেগেছিল এত আশা সাধ! যত ভালোবাসা, তত পরমাদ, কেন ছুঁইলাম ফুল-শাখ। অপরাধ শুধু মনে থাক!আলোয়ার মতো নিভি,পুনঃ জ্বলি, তুমি এসেছিলে শুধু কুতূহলী, আলেয়াও কাঁদে কারও পিছে চলি – এ কাহিনি নব মুছে যাক। অপরাধ শুধু মনে থাক! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
এসো এসো এসো আমার চির-পুরানো! বুক জুড়ে আজ বসবে এসো হৃদয়-জুড়ানো! আমার চির-পুরানো!    পথ বিপথে কতই আমার নিত্য নূতন বাঁধন এসে যাচে, কাছে এসেই অমনি তারা পুড়ে মরে আমার আগুন আঁচে। তারা  এসে ভালোবাসার আশায় একটুকুতেই কেঁদে ভাসায়, ভীরু তাদের ভালোবাসা কেঁদেই ফুরানো। বিজয়িনী চিরন্তনী মোর! একা  তুমিই হাস বিজয়-হাসি দীপ দেখিয়ে পথে ঘুরানো।    তুমি যেদিন মুক্তি দিলে হেসে বাঁধন কাটলে আপন হাতে, প্রেম-গরবি আপন প্রেমের জোরে, জানতে আমায় সইবে না কেউ বইবে না ভার হার মেনে সে আসতে হবে আবার তোমার দোরে।    গরবিনি! গর্ব করে এই কপালে লিখলে জয়ের টিকা ‘চঞ্চল এই বাঁধন-হারায় বাঁধতে পারে এক এ সাহসিকা!’ প্রিয়! তাই কি আমার ভালোবাসা সবাই বলে সর্বনাশা, এই    ধূমকেতু মোর আগুন-ছোঁয়া বিশ্ব-পোড়ানো? সর্বনাশী চপল প্রিয়া মোর! তবে    অভিশাপের বুকে তুমিই হাসবে এসো নয়ন ঝুরানো॥  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
গুলশন কো চুম চুম কহতে বুলবুল, রুখসারা সে বে-দরদি বোরকা খুল! হাঁসতি হ্যায় বোস্তাঁ, মস্ত্ হো যা দোস্তাঁ, শিরি শিরাজি সে যা বেহোশ জাঁ। সব কুছ আজ রঙিন হ্যায় সব কুছ মশগুল, হাঁস্‌তি হ্যায় গুল হো কর দোজখ বিলকুল হা রে আশেক মাশুক কি চমনোঁ মে ফুলতা নেই দোবারা ফুল ফুল ফুল ফুল॥  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর, আজ্‌কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার! আজ্‌কে তোমার জন্মদিন- স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন হাত্‌ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার! এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল, কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল? আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ, নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,- কোন্‌ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল ঢেকেছে আজ কোন্‌ দেবতার কোন্‌ সে পাষাণ-তল?অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’ আস্‌ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ ঘাটে আমি রই ব’সে আমার মাণিক কই গো সে? পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্‌ছে বুকে ঘা! আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্‌রে ওঠে মন, পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন। তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুল্‌ছে মহুল বন, ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই, মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্‌নি যেত নুই। হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল, গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল থর্‌কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই! বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই!চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব, দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর! ভুঁই- তারকা সুন্দরী সজনে ফুলের দল ঝরি’ থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর। ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ! খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ! লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই, বলতে, ‘আমি অমনি চাই! খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ! হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল, জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল হঠাৎ জলে রাখত্‌ে পা, কাজলা দীঘির শিউরে গা- কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল! ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল!উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়, ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়! শঙ্খ বাজে মন্দিরে, সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে, ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়! মাঠের বাঁশী বন্‌-উদাসী ভীম্‌পলাশী গায়অবাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে! আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে? ডাবের শীতল জল দিয়ে মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে? প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম, রসের পীড়ায় টস্‌টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম! কামরাঙারা রাঙল ফের পীড়ন পেতে ঐ মুখের, স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম- জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর, ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর! সেই চাহনি নীল-কমল ভ’রল আমার মানস-জল, কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর! বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!তরী আমার কোন্‌ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল, স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল! পাহাড়তলীর শালবনায় বিষের মত নীল ঘনায়! সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল! হায় গো, আমার ভিন্‌ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল!কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই, কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই! কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর- কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর? তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই? কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’, এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা! আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায় আকুল দোলা লাগবে না’য়, এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর, আজ্‌কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার! আজ্‌কে তোমার জন্মদিন- স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন হাত্‌ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার! এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল, কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল? আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ, নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,- কোন্‌ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল ঢেকেছে আজ কোন্‌ দেবতার কোন্‌ সে পাষাণ-তল?অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’ আস্‌ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ ঘাটে আমি রই ব’সে আমার মাণিক কই গো সে? পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্‌ছে বুকে ঘা! আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্‌রে ওঠে মন, পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন। তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুল্‌ছে মহুল বন, ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই, মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্‌নি যেত নুই। হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল, গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল থর্‌কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই! বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই!চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব, দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর! ভুঁই- তারকা সুন্দরী সজনে ফুলের দল ঝরি’ থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর। ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ! খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ! লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই, বলতে, ‘আমি অমনি চাই! খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ! হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল, জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল হঠাৎ জলে রাখত্‌ে পা, কাজলা দীঘির শিউরে গা- কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল! ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল!উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়, ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়! শঙ্খ বাজে মন্দিরে, সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে, ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়! মাঠের বাঁশী বন্‌-উদাসী ভীম্‌পলাশী গায়অবাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে! আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে? ডাবের শীতল জল দিয়ে মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে? প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম, রসের পীড়ায় টস্‌টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম! কামরাঙারা রাঙল ফের পীড়ন পেতে ঐ মুখের, স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম- জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর, ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর! সেই চাহনি নীল-কমল ভ’রল আমার মানস-জল, কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর! বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!তরী আমার কোন্‌ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল, স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল! পাহাড়তলীর শালবনায় বিষের মত নীল ঘনায়! সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল! হায় গো, আমার ভিন্‌ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল!কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই, কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই! কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর- কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর? তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই? কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’, এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা! আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায় আকুল দোলা লাগবে না’য়, এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর, আজ্‌কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার! আজ্‌কে তোমার জন্মদিন- স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন হাত্‌ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার! এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল, কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল? আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ, নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,- কোন্‌ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল ঢেকেছে আজ কোন্‌ দেবতার কোন্‌ সে পাষাণ-তল?অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’ আস্‌ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ ঘাটে আমি রই ব’সে আমার মাণিক কই গো সে? পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্‌ছে বুকে ঘা! আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্‌রে ওঠে মন, পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন। তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুল্‌ছে মহুল বন, ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই, মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্‌নি যেত নুই। হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল, গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল থর্‌কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই! বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই!চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব, দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর! ভুঁই- তারকা সুন্দরী সজনে ফুলের দল ঝরি’ থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর। ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ! খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ! লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই, বলতে, ‘আমি অমনি চাই! খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ! হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল, জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল হঠাৎ জলে রাখত্‌ে পা, কাজলা দীঘির শিউরে গা- কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল! ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল!উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়, ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়! শঙ্খ বাজে মন্দিরে, সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে, ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়! মাঠের বাঁশী বন্‌-উদাসী ভীম্‌পলাশী গায়অবাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে! আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে? ডাবের শীতল জল দিয়ে মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে? প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম, রসের পীড়ায় টস্‌টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম! কামরাঙারা রাঙল ফের পীড়ন পেতে ঐ মুখের, স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম- জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর, ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর! সেই চাহনি নীল-কমল ভ’রল আমার মানস-জল, কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর! বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!তরী আমার কোন্‌ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল, স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল! পাহাড়তলীর শালবনায় বিষের মত নীল ঘনায়! সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল! হায় গো, আমার ভিন্‌ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল!কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই, কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই! কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর- কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর? তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই? কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’, এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা! আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায় আকুল দোলা লাগবে না’য়, এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
নীহারিকালোকে অনিমিখে চেয়ে আছেন বৈজ্ঞানিক, কত শত নব সূর্য জনমি রাঙায় অজানা দিক! আমি চেয়ে আছি তোদের পানে যে, ওরে ও শিশুর দল, নূতন সূর্য আসিছে কোথায় বিদারিয়া নভোতল! দিব্য জ্যোতির্দীপ্ত কত সে রবি শশী গ্রহ তারা তোদের মাঝারে লভিয়া জনম ঘুরিতেছে পথহারা, আত্মা আমার জেগে আছে যেন মেলি অনন্ত আঁখি, মাহেন্দ্রক্ষণ উদয় উষার – আরও কতদিন বাকি? জাগো অমৃতের সন্তান, জাগো বেদ-ভাষিণীর দল! বিশ্বে ভোগের মন্থনে আজ উঠিয়াছে হলাহল। অসুর-শক্তি শ্রান্ত হইয়া আজিকে আপন বিষে ঊর্ধ্বে চাহিছে দেবতার পানে, জ্বালা জুড়াইবে কীসে। আমি দেখিয়াছি, তোমাদের শুচি ক্ষুদ্র তনুর মাঝে সেই ঊর্ধ্বের দিব্য শক্তি শান্তি অমৃত রাজে। খোলো গুন্ঠন, ভোলো বন্ধন, ভাঙো ভবনের কারা, বাহির ভুবনে আসিয়া দাঁড়াও, বাধাহীন ভয়হারা। শোনো অমৃতের পুত্র! দুয়ারে দাঁড়ায়ে তোমার কাছে জরাগ্রস্ত ভিখারি যযাতি নবযৌবন যাচে! কুমারী উমার রূপে কতকাল অচল পিতার গেহে হে মহাশক্তিরূপিণী শিবানী, বদ্ধ রহিবে স্নেহে? হে মহাশক্তি, তোমারে হারায়ে পুরুষোত্তম শিব পথের ভিখারি, মৃতের শ্মশানে হয়েছে ঘৃণ্য জীব! কে বলে তোমরা বালক বালিকা? তোমরা ঊর্ধ্ব হতে নামিয়া এসেছ শুদ্ধ শক্তি দিব্য জ্যোতিস্রোতে। হৃদয়-কমণ্ডলু হতে তব অমৃতধারা ছিটাও, ঈর্ষাক্লান্ত জর্জরিত এ বিশ্বে শান্তি দাও। বাঁচাতে এসেছ, বাঁচিতে আসনি হেথা শুধু পশু সম, তপস্যা ত্যাগে পুরুষ হেথায় হয় পুরুষোত্তম; সংসারী হয়ে নারী এই দেশে হয় ঋষি বেদবতী, আনো সেই আশা, শক্তি, ধরায় স্বর্গের সেই জ্যোতি। দূর করো এই ভেদজ্ঞান, এই হানাহানি, মলিনতা, আনো ধূর্জটি-জটা হতে তব জাহ্নবীর পবিত্রতা।… প্রণাম-পুষ্পাঞ্জলি লয়ে আছি পূজারি বসিয়া একা, তোমাদের সেই দিব্য স্বরূপে কবে পাব হায় দেখা!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
ওগো বাদলের পরী! যাবে কোন্ দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী! ওগো ও ক্ষণিকায়, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজ তব? পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্ দেশ অভিনব? তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পাণ্ডুর কেয়া-রেণু/ তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেনু। কুমারী ভীরু-বেদনা-বিধূর প্রণয়-অশ্র“ সম। ঝরিছে শিশির-সিক্ত সেফালী নিশি-ভোরে অনুপম। ওগো ও কাজল মেয়ে, উদাস আকাশ ছলছল চোখ তব মুখে আছে চেয়ে। কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে। ওগো জলের দেশের কন্যা। তব ও বিদায় পথে কাননে কাননে কদম-কেশর ঝরিছে প্রভাত হ’তে। তোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে ঊঠিল যে বল্লরী তরুর কণ্ঠ জড়াইয়া তারা কাঁদে নিশিদিন ভরি।’ ‘বৌ-কথা-কও’ পাখি উড়ে গেছে কোথা, বাতায়নে বৃথা বউ করে ডাকাডাকি। চাঁপার গেলাস গিয়াছে ভাঙিয়া, পিয়াসী মধুপ এসে’ কাঁদিয়া কখন গিয়াছে উড়িয়া কমল-কুমদী দেশে। তুমি চলে যাবে দূরে, ভদরের নদী দুকূল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে! যাব যবে দূর হিম-গিরি শিল, ওগো বাদলের পরী ব্যথা ক’রে বুক উঠিবে না কভু সেথা কাহারেও স্মরি? সেথা নাই জল, কঠিন তুষার, নির্মম শুভ্রতা- কে জানে কী ভাল বিধুর ব্যথা -- না মধুর পবিত্রতা! সেথা মহিমার ঊর্ধ্বে শিখরে নাই তরলতা হাসি, সেথা যাও তব মুখের পায়ের বরষা-নূপুর খুলি, চলিতে চকিতে চমকি’ উঠ না, কবরী উঠে না দুলি। সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্না তাপসিনী অচপল, তোমার আশায় কাঁদিবে ধারায় তেমনি “ফটিক-জল” 
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
বন্ধু, তোমায় স্বপ্ন-মাঝে ডাক দিল কি বন্দিনী সপ্ত সাগর তেরো নদীর পার হতে সুর-নন্দিনী!বীণ-বাদিনী বাজায় হঠাৎ যাত্রা-পথের দুন্দুভি, অরুণ আঁখি কইল সাকি, ‘আজকে শরাব মুলতুবি!’সাগর তোমায় শঙ্খ বাজায়, হাতছানি দেয় সিন্ধু-পার, গানের ভেলায় চললে ভেসে রূপকথারই রাজকুমার!গানের ভেলায় চললে ভেসে রূপকথারই রাজকুমার! লয়ে সুরের সোনার কাঠি দিগ‌্‌বিজয়ে যাও সেথায়।বন্দী-দেশের আনন্দ-বীর! আনবে তুমি জয় করি ইন্দ্রলোকের উর্বশী নয় – কণ্ঠলোকের কিন্নরী।শ্বেতদ্বীপের সুর-সভায় আজকে তোমার আমন্ত্রণ, অস্ত্রে যারা রণ জেতেনি বীণায় তারা জিনল মন।কণ্ঠে আছে আনন্দ-গান, হস্ত-পদে থাক শিকল; ফুল-বাগিচায় ফুলের মেলা, নাই-বা সেথা ফলল ফল।বৃত্ত-ব্যাসে বন্দী তবু মোদের রবির অরুণ-রাগ জয় করেছে যন্ত্রাসুরের মানব-মেধের লক্ষ যাগ।ছুটছে যশের যজ্ঞ-ঘোড়া স্পর্ধা-অধীর বিশ্বময়, তোমার মাঝে দেখব বন্ধু নূতন করে দিগ্‌বিজয়।বীণার তারে বিমান-পারের বেতার-বার্তা শুনছি ওই কণ্ঠে যদি গান থাকে গো পিঞ্জরে কেউ বন্ধ নই।চলায় তোমার ক্লান্তি তো নাই নিত্য তুমি ভ্রাম্যমান, তোমার পায়ে নিত্য নূতন দেশান্তরের বাজবে গান।বধূর মতন বিধুর হয়ে সুদূর তোমায় দেয় গো ডাক, তোমার মনের এপার থেকে উঠল কেঁদে চক্রবাক!ধ্যান ভেঙে যায় নবীন যোগী, ওপার পানে চায় নয়ন, মনের মানিক খুঁজে ফের বনের মাঝে সর্বক্ষণ।দূর-বিরহী, পার হয়ে যাও সাত সাগরের অশ্রুজল, আমরা বলি – যাত্রা তোমার সুন্দর হোক, হোক সফল!  (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
রঙ্গীলা আপনি রাধা তারে হোরীর রং দিও না ফাগুনের রাণী যে রাই তারে রঙে রাঙিয়ো না।রাঙ্গা আবির রাঙ্গা ঠোঁটে গালে ফাগের লালী ফোটে রংসায়রে নেয়ে উঠে অঙ্গে ঝরে রঙের সোনা।অনুরাগ-রাঙা মনে রঙের খেলা ক্ষণে ক্ষণে অন্তরে যার রঙের লীলা (তারে) বাহিরে রং লাগিয়ো না।।
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
আজি  রক্ত-নিশি-ভোরে একী  এ শুনি ওরে, মুক্তি-কোলাহল বন্দি-শৃঙ্খলে, ওই  কাহারা কারাবাসে মুক্তি-হাসি হাসে, টুটেছে ভয়-বাধা স্বাধীন হিয়া-তলে॥ ললাটে লাঞ্ছনা-রক্ত-চন্দন, বক্ষে গুরু শিলা, হস্তে বন্ধন, নয়নে ভাস্বর সত্য-জ্যোতি-শিখা, স্বাধীন দেশ-বাণী কণ্ঠে ঘন বোলে, সে ধ্বনি ওঠে রণি ত্রিংশ কোটি ওই মানব-কল্লোলে॥ ওরা  দু-পায়ে দলে গেল মরণ-শঙ্কারে, সবারে ডেকে গেল শিকল-ঝংকারে, বাজিল নভ-তলে স্বাধীন ডঙ্কারে, বিজয়-সংগীত বন্দি গেয়ে চলে, বন্দিশালা মাঝে ঝঞ্ঝা পশেছে রে উতল কলরোলে॥ আজি  কারার সারা দেহে মুক্তি-ক্রন্দন, ধ্বনিছে হাহা স্বরে ছিঁড়িতে বন্ধন, নিখিল গেহ যথা বন্দি-কারা, সেথা কেন রে কারা-ত্রাসে মরিবে বীর-দলে। ‘জয় হে বন্ধন’ গাহিল তাই তারা মুক্ত নভ-তলে॥ আজি  ধ্বনিছে দিগ্‌বধূ শঙ্খ দিকে দিকে, আজি  গগনে কারা যেন চাহিয়া অনিমিখে, ধু ধু ধু হোম-শিখা জ্বলিল ভারতে রে, ললাটে জয়টিকা, প্রসূন-হার-গলে চলে রে বীর চলে; সে নহে নহে কারা, যেখানে ভৈরব- রুদ্র-শিখা জ্বলে॥ জয় হে বন্ধন-মৃত্যু-ভয়-হর! মুক্তিকামী জয়। স্বাধীন-চিত জয়। জয় হে জয় হে! জয় হে! জয় হে!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে কে দিয়েছে গালি তারে কে দিয়েছে গালি রাগ করে সে সারা গায়ে মেখেছে তাই কালি।যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে আরো মধুর লাগে তাহার হাসিমুখের চেয়ে কে কালো দেউল করে আলো অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি।পরেনি সে বসনভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ তারি কাছে হার মানে রে ভুবনমোহন বেশ।রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে আমার রাগী মেয়ে, তাই তারে দিই জবা ফুলের ডালি।।
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
(শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।বল, আমি শরণ যাচি ঊষা-পতির, হাত হতে তার - সৃষ্টিতে যা আছে তির। আঁধার-ঘন নিশীথ রাতের ভয় অপকার- এ সব হ'তে অভয় শরণ যাচি তাঁহার। যাদুর ফুঁয়ে শিথিল করে (কঠিন সাধন) সংকল্পের বাঁধন, যাচি তার নিবারণ। ঈর্ষাতুরের বিদ্বেষ যে ক্ষতি করে- শরণ যাচি, পানাহ্ মাগি তাহার তরে।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
নামহারা ওই গাঙের পারে বনের কিনারে বেতস-বেণুর বনে কে ওই বাজায় বীণা রে। লতায়-পাতায় সুনীল রাগে সে-সুর সোহাগ-পুলক লাগে, সে সুর ঘুমায় দিগঙ্গনার শয়নলীনা রে। আমি কাঁদি, এ সুর আমার চিরচেনা রে।ফাগুন-মাঠে শিস দিয়ে যায় উদাসী তার সুর, শিউরে ওঠে আমের মুকুল ব্যথায় ভারাতুর। সে সুর কাঁপে উতল হাওয়ায়, কিশলয়ের কচি চাওয়ায়, সে      চায় ইশারায় অস্তাচলের প্রাসাদ-মিনারে। আমি কাঁদি, এই তো আমার চিরচেনা রে।   (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
পউষ এলো গো! পউষ এলো অশ্র”-পাথার হিম পারাবার পারায়ে ঐ যে এলো গো- কুজঝটিকার ঘোম্‌টা-পরা দিগন-রে দাঁড়ায়ে।। সে এলো আর পাতায় পাতায় হায় বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়, অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায় পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে।। পউষ এলো গো- এক বছরের শ্রানি- পথের, কালের আয়ু-ক্ষয়, পাকা ধানের বিদায়-ঋতু, নতুন আসার ভয়। পউষ এলো গো! পউষ এলো- শুক্‌নো নিশাস্‌, কাঁদন-ভারাতুর বিদায়-ক্ষণের (আ-হা) ভাঙা গলার সুর- ‘ ওঠে পথিক! যাবে অনেক দূর কালো চোখের কর”ণ চাওয়া ছাড়ায়ে।।’
কাজী নজরুল ইসলাম
স্তোত্রমূলক
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর, লঙ্ঘিলে আজি ভয়দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর। বন্দি তোমায় বন্দিবীর জয় জয়স্তু বন্দিবীর!! অগ্রে তোমার নিনাদে শঙ্খ, পশ্চাতে কাঁদে ছয়-বছর, অম্বরে শোনো ডম্বরু বাজে–‘অগ্রসর হও, অগ্রসর!’ কারাগার ভেদি নিশ্বাস ওঠে বন্দিনী কোন্ ক্রন্দসীর, ডান-আঁখে আজ ঝলকে অগ্নি, বাম-আঁখে ঝরে অশ্রু-নীর। বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডি-মুক্ত বন্দি-বীর, লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর। বন্দি তোমায় বন্দিবীর জয় জয়স্তু বন্দিবীর!! পথতরুছায় ডাকে ‘আয় আয়’ তব জননীর আর্ত স্বর, এ আগুন-ঘরে কাঁপিল সহসা ‘সপ্তদশ সে বৈশ্বানর’। আগমনি তব রণদুন্দুভি বাজিছে বিজয়-ভৈরবীর, জয় অবিনাশী উল্কা-পথিক চিরসৈনিক উচ্চশির। বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর, লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর। বন্দি তোমায় বন্দিবীর জয় জয়স্তু বন্দিবীর!! রুদ্ধ-প্রতাপ হে যুদ্ধবীর, আজি প্রবুদ্ধ নব বলে। ভুলো না বন্ধু, দলেছ দানব যুগে যুগে তব পদতলে! এ নহে বিদায়, পুন হবে দেখা অমর-সমর-সিন্ধুতীর, এসো বীর এসো, ললাটে এঁকে দি অশ্রুতপ্ত লাল রুধির। বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দি-বীর, লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর। বন্দি তোমায় বন্দিবীর জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
মাভৈঃ! মাভৈঃ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান গোরস্থান! ছিল যারা চির-মরণ-আহত, উঠিয়াছে জাগি’ ব্যথা-জাগ্রত, ‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অর্জুন’ ছোঁড়ে বাণ। জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান! মরিছে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ, বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ-মরণে নাহি লাজ। জেগেছে শক্তি তাই হানাহানি, অস্ত্রে অস্ত্রে নব জানাজানি। আজি পরীক্ষা-কাহার দস্ত হয়েছে কত দারাজ! কে মরিবে কাল সম্মুখে-রণে, মরিতে কা’রা নারাজ। মূর্চ্ছাতুরের কন্ঠে শুনে যা জীবনের কোলাহল, উঠবে অমৃত, দেরি নাই আর, উঠিয়াছে হলাহল। থামিসনে তোরা, চালা মন্থন! উঠেছে কাফের, উঠেছে যবন; উঠিবে এবার সত্য হিন্দু-মুসলিম মহাবল। জেগেছিস তোরা, জেগেছে বিধাতা, ন’ড়েছে খোদার কল। আজি ওস্তাদে-শাগরেদে যেন শক্তির পরিচয়। মেরে মেরে কাল করিতেছে ভীরু ভারতের নির্ভয়। হেরিতেছে কাল,-কবজি কি মুঠি ঈষৎ আঘাতে পড়ে কি-না টুটি’, মারিতে মারিতে কে হ’ল যোগ্য, কে করিবে রণ-জয়! এ ‘মক্‌ ফাইটে’ কোন্‌ সেনানীর বুদ্ধি হয়নি লয়! ক’ ফোঁটা রক্ত দেখিয়া কে বীর টানিতেছে লেপ-কাঁথা! ফেলে রেখে অসি মাখিয়াছে মসি, বকিছে প্রলাপ যা-তা! হায়, এই সব দুর্বল-চেতা হবে অনাগত বিপ্লব-নেতা! ঝড় সাইক্লোনে কি করিবে এরা! ঘূর্ণিতে ঘোরে মাখা? রক্ত-সিন্ধু সাঁতরিবে কা’রা-করে পরীক্ষা ধাতা। তোদেরি আঘাতে টুটেছে তোদের মন্দির মসজিদ, পরাধীনদের কলুষিত ক’রে উঠেছিল যার ভিত! খোদা খোদ যেন করিতেছে লয় পরাধীনদের উপাসনালয়! স্বাধীন হাতের পূত মাটি দিয়া রচিবে বেদী শহীদ। টুটিয়াছে চূড়া? ওরে ঐ সাথে টুটিছে তোদের নিঁদ! কে কাহারে মারে, ঘোচেনি ধন্দ, টুটেনি অন্ধকার, জানে না আঁধারে শত্রু ভাবিয়া আত্মীয়ে হানে মার! উদিবে অরুণ,ঘুচিবে ধন্দ, ফুটিবে দৃষ্টি, টুটিবে বন্ধ, হেরিবে মেরেছে আপনার ভায়ে বদ্ধ করিয়া দ্বার! ভারত-ভাগ্য ক’রেছে আহত ত্রিশূল ও তরবার! যে-লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির-চূড়া, সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গ গুঁড়া! প্রভাতে হবে না ভায়ে-ভায়ে রণ, চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন। করুক কলহ-জেগেছে তো তবু-বিজয়-কেতন উড়া! ল্যাজে তোর যদি লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আমি     এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম, আর     কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম, তখন     মুকুর পাশে একলা গেহে আমারই এই সকল দেহে চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো, আহা     পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম।         তখন তুমি নাইবা প্রিয় নাই বা রলে কাছে। জানব আমার এই সে দেহে এই সে দেহে গো তোমার    বাহুর বুকের শরম-ছোঁয়ার কাঁপন লেগে আছে। তখন    নাই বা আমার রইল মনে কোনখানে মোর দেহের বনে জড়িয়ে ছিলে লতার মতন আলিঙ্গনে গো, আমি    চুমোয় চুমোয় ডুবাব এই সকল দেহ মম, এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আজ   নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো। পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায় চাওয়া ছলছল? বলো সখী বলো বলো মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে, ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি দূরের পথিক গেছে চলে – আবার ফিরে আসবে বলে গো? স্বর শুনে কার চমকে ওঠ? আ-হা! ও লো ও যে বিহগ-বেহাগ নির্ঝরিণীর কল-কল। ও নয় লো তার পায়ের ভাষা, আ-হা, শীতের শেষের ঝরা-পাতার বিদায় ধ্বনি ও, কোন কালোরে কোন ভালোরে বাসলে ভালো, আ-হা! খুঁজছ মেঘে পরদেশি কোন পলাতকার নয়ন-অমিয়? চুমছ   কারে? ও নয় তোমার চির-চেনার চপল হাসির আলো-ছায়া, ও যে   গুবাক-তরুর চিকন পাতায় বাদল-চাঁদের মেঘলা মায়া। ওঠো পথিক-পূজারিনি উদাসিনী বালা! সে যে  সবুজ-দেশের অবুঝ পাখি কখন এসে যাচবে বাঁধন, কে জানে ভাই, ঘরকে চলো। ও কী? চোখে নামল আবার বাদল-ছায়া ঢলঢল? চলো সখি ঘরকে চলো।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
ভুলিতে পারিনে তাই আসিয়াছি পথ ভুলি ভোলো মোর সে অপরাধ, আজ যে লগ্ন গোধূলি।এমনি রঙিন বেলায় খেলেছি তোমায় আমায় খুঁজিতে এসেছি তাই সেই হারানো দিনগুলি।তুমি যে গেছ ভুলে, ছিল না আমার মনে তাই আসিয়াছি তব বেড়া দেওয়া ফুলবনে গেঁথেছি কতই মালা এই বাগানের ফুল তুলি আজও হেথা গাহে গান আমার পোষা বুল্‌বুলি।চাহ মোর মুখে প্রিয়, এস গো আরও কাছে হয়তো সে দিনের স্মৃতি তব নয়নে আছে হয়তো সে দিনের মতই প্রাণ উঠিবে আকুলি।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
[‘শাখ-ই-নবাত’ বুলবুল-ই-শিরাজ কবি হাফিজের মানসীপ্রিয়া ছিলেন।]শাখ-ই-নবাত শাখ-ই-নবাত! মিষ্টি রসাল ‘ইক্ষু-শাখা’। বুলবুলিরে গান শেখাল তোমার আঁখি সুরমা-মাখা। বুলবুল-ই-শিরাজ হল গো হাফিজ গেয়ে তোমার স্তুতি, আদর করে ‘শাখ-ই-নবাত’ নাম দিল তাই তোমার তুতি। তার আদরের নাম নিয়ে আজ তুমি নিখিল-গরবিনি, তোমার কবির চেয়ে তোমায় কবির গানে অধিক চিনি। মধুর চেয়ে মধুরতর হল তোমার বঁধুর গীতি, তোমার রস-সুধা পিয়ে, তাহার সে-গান তোমার স্মৃতি। তোমার কবির – তোমার তুতির ঠোঁট ভিজালে শহদ দিয়ে, নিখিল হিয়া সরস হল তোমার শিরিন সে রস পিয়ে। কল্পনারই রঙিন পাখায় ইরান দেশে উড়ে চলি, অনেক শত বছর পিছের আঁকাবাঁকা অনেক গলি – তোমার সাথে প্রথম দেখা কবির যেদিন গোধূলিতে, আঙুর-খেতে গান ধরেছে, কুলায়-ভোলা বুলবুলিতে। দাঁড়িয়েছিলে একাকিনী ‘রোকনাবাদের নহর’ তীরে, রঙিন ছিল আকাশ যেন কুসুম-ভরা ডালিম-শাখা তোমার চোখের কোনায় ছিল আকাশ-ছানা কাজল আঁকা। সন্ধ্যা ছিল বন্দি তোমার খোঁপায়, বেণির বন্ধনীতে ; তরুণ হিয়ার শরম ছিল জমাট বেঁধে বুকের ভিতে! সোনার কিরণ পড়েছিল তোমার দেহের দেউল চূড়ে, ডাঁসা আঙুর ভেবে এল মউ-পিয়াসি ভ্রমর উড়ে। তিল হয়ে সে রইল বসে তোমার গালের গুলদানিতে, লহর বয়ে গেল সুখে রোকনাবাদের নীল পানিতে। চাঁদ তখনও লুকিয়ে ছিল তোমার চিবুক গালের টোলে, অস্তরবির লাগল গো রং শূন্য তোমার সিঁথির কোলে। ওপারেতে একলা তুমি নহর-তীরে লহর তোলো, এপারেতে বাজল বাঁশি, ‘এসেছি গো নয়ন খোলো!’… … … তুললে নয়ন এপার পানে – মেলল কি দল নার্গিস তার? দুটি কালো কাজল আখর – আকাশ ভুবন রঙিন বিথার! কালো দুটি চোখের তারা, দুটি আখর, নয়কো বেশি ; হয়তো ‘প্রিয়া’, কিংবা ‘বঁধু’ – তারও অধিক মেশামেশি! কী জানি কী ছিল লেখা – তরুণ ইরান-কবিই জানে, সাধা বাঁশি বেসুর বোলে সেদিন প্রথম কবির কানে। কবির সুখের দিনের রবি অস্ত গেল সেদিন হতে, ঘিরল চাঁদের স্বপন-মায়া মনের বনের কুঞ্জপথে। হয়তো তুমি শোননি আর বাঁশুরিয়ার বংশীধ্বনি, স্বপন-সম বিদায় তাহার স্বপন-সম আগমনি। রোকনাবাদের নহর নীরের সকল লহর কবির বুকে, ঢেউ তোলে গো সেদিন হতে রাত্রি দিবা গভীর দুখে। সেই যে দুটি কাজল হরফ দুটি কালো আঁখির পাতে, তাই নিয়ে সে গান রচে তার ; সুরের নেশায় বিশ্ব মাতে! অরুণ আঁখি তন্বী সাকি পাত্র এবং শারাব ভুলে, চেয়ে থাকে কবির মুখে করুণ তাহার নয়ন তুলে। শারাব হাতে সাকির কোলে শিরাজ কবির রঙিন নেশা যায় গো টুটে ক্ষণে ক্ষণে – মদ মনে হয় অশ্রু মেশা।অধর-কোণে হাসির ফালি ঈদের পহিল চাঁদের মতো – উঠেই ডুবে যায় নিমেষে, সুর যেন তার হৃদয়-ক্ষত। এপার ঘুরে কবির সে গান ফুলের বাসে দখিন হাওয়ায় কেঁদে ফিরেছিল কি গো তোমার কানন-কুঞ্জ ছায়ায়? যার তরে সে গান রচিল, তারই শোনা রইল বাকি? শুনল শুধু নিমেষ-সুখের শারাব-সাথি বে-দিল্ সাকি?শাখ-ই-নবাত! শাখ-ই-নবাত! পায়নি তুতি তোমার শাখা, উধাও হল তাইতে গো তার উদাস বাণী হতাশ-মাখা। অনেক সাকির আঁখির লেখা, অনেক শারাব পাত্র-ভরা, অনেক লালা নার্গিস গুল বুলবুলিস্তান গোলাব-ঝোরা ব্যর্থ হল, মিটল না গো শিরাজ কবির বুকের তৃষা, হয়তো আখের শাখায় ছিল সুধার সাথে বিষও মিশা! নইলে এ গান গাইত কে আর, বইত না এ সুরধুনী; তোমার হয়ে আমরা নিখিল বিরহীরা সে গান শুনি। আঙুর-লতায় গোটা আঙুর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবারি, শিরাজ-কবির সাকির শারাব রঙিন হল তাই নিঙাড়ি। তোমায় আড়াল করার ছলে সাকির লাগি যে গান রচে, তাতেই তোমায় পড়ায় মনে, শুনে সাকি অশ্রু মোছে! তোমার চেয়ে মোদের অনেক নসিব ভালো, হায় ইরানি! শুনলে নাকো তোমায় নিয়ে রচা তোমার কবির বাণী। তোমার কবির রচা গানে মোদের প্রিয়ার মান ভাঙাতে তোমার কথা পড়ে মনে, অশ্রু ঘনায় নয়ন-পাতে!ঘুমায় হাফিজ ‘হাফেজিয়া’য়, ঘুমাও তুমি নহর-পারে, দিওয়ানার সে দিওয়ান-গীতি একলা জাগে কবর-ধারে। তেমনি আজও আঙুর-খেতে গেয়ে বেড়ায় বুলবুলিরা, তুতির ঠোঁটে মিষ্টি ঠেকে তেমনি আজও চিনির সিরা। তেমনি আজও জাগে সাকি পাত্র হাতে পানশালাতে – তেমনি করে সুরমা-লেখা লেখে ডাগর নয়ন-পাতে। তেমনি যখন গুলজার হয় শারাব-খানা, ‘মুশায়েরা’, মনে পড়ে রোকনাবাদের কুটির তোমার পাহাড়-ঘেরা। গোধূলি সে লগ্ন আসে, সন্ধ্যা আসে ডালিম-ফুলি, ইরান মুলুক বিরান ঠেকে, নাই সেই গান, সেই বুলবুলি। হাফেজিয়ায় কাঁদন ওঠে আজও যেন সন্ধ্যা প্রভাত – ‘কোথায় আমার গোপন প্রিয়া কোথায় কোথায় শাখ-ই-নবাত!’ দন্তে কেটে খেজুর-মেতি আপেল-শাখায় অঙ্গ রেখে হয়তো আজও দাঁড়াও এসে পেশোয়াজে নীল আকাশ মেখে, শারাব-খানায় গজল শোনো তোমার কবির বন্দনা-গান; তেমনি করে সূর্য ডোবে, নহর- নীরে বহে তুফান। অথবা তা শোন না গো, শুনিবে না কোনো কালেই; জীবনে যে এল না তা কোনো লোকের কোথাও সে নাই!অসীম যেন জিজ্ঞাসা ওই ইরান-মরুর মরীচিকা, জ্বালনি কি শিরাজ-কবির লোকে তোমার প্রদীপ-শিখা? বিদায় সেদিন নিল কবি শূন্য শারাব পাত্র করে, নিঙ্‌ড়ে অধর দাওনি সুধা তৃষিত কবির তৃষ্ণা হরে! পাঁচশো বছর খুঁজেছে গো, তেমনি আজও খুঁজে ফিরে কবির গীতি তেমনি তোমায় রোকনাবাদের নহর-তীরে!(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আগুন জ্বলে না মাসে কতদিন হায় ক্ষুধিতের ঘরে, ক্ষুধার আগুনে জ্বলে কত প্রাণ তিলে তিলে যায় মরে। বোঝে না ধনিক, হোক সে হিন্দু হোক সে মুসলমান, আল্লা যাদের নিয়ামত দেন, পাষাণ তাদের প্রাণ!কত ক্ষুধাতুর শিশুর রসনা খুদকণা নাহি পায়, মা-র বুক ছেড়ে গোরস্তানের মাটিতে গিয়া ঘুমায়। যত দৌলত হাশমতওয়ালা হেরে তাহা পাশে থেকে, আতর মাখিয়া পাথরের দল যেন ছায়াছবি দেখে!ভেবেছে এমনই নিজে খেয়ে দেয়ে হইয়া খোদার খাসি দিন কেটে যাবে! এ সুখের দিন কভু হবে নাকো বাসি। জগতের লোভী মরিতেছে আজ আল্লার অভিশাপে, তবুও লোভের কাঁথা জড়াইয়া লোভী সব নিশি যাপে!একটা খাসিরে ধরিয়া যখন জবাই করে কশাই, আর একটা খাসি তখনও দিব্যি পাতা খায়, ভয় নাই। ভেবেছ ওদেশে হতেছে শাস্তি, তোমাদের হইবে না, তাই শোধ করিলে না আজও সেই পরম দানীর দেনা।আর ক-টা দিন বেঁচে থাকো, যাঁর ঋণ করিয়াছ, তিনি তোমাদের প্রাণ দৌলত নিয়ে খেলবেন ছিনিমিনি। কী ভীষণ মার খাইবে সেদিন, বোঝ না অন্ধ জীব, তোমাদের হাড়ে ভেলকি খেলিবে সেদিন এই গরিব।বেতন চাহিলে শুনিতে পায় না, মনিবের রাগ হয়, ‘তিনদিন হাঁড়ি চড়েনিকো’ শুনে ভাবে একী কথা কয়! ঘরের পার্শ্বে লেগেছে আগুন, বোঝে না স্বার্থপর, আর দেরি নাই, পুড়িয়া যাইবে তাহারও সোনার ঘর।বঞ্চিত রেখে দরিদ্রে, যারা করিয়াছে সঞ্চয়, দেখিবে এবার, তার সঞ্চয় তার অধিকারে নয়। অর্থের ফাঁদ পেতে দস্যুরে ডাকিয়া আনিছে যারা তাহারাই আগে মরিবে, ভীষণ শাস্তি পাইবে তারা।উপবাস যার দিনের সাধনা, নিশীথে শয়নসাথি, যাহারা বাহিরে গাছতলে থাকে, ঘরে জ্বলে নাকো বাতি, তাদের ধৈর্য সহিষ্ণুতা কি পাবে না পুরস্কার? তারা তিলে তিলে মরে আনিয়াছে এবার খোদার মার!তাদেরই করুণ মৃত্যু এনেছে ভয়াল মৃত্যু ডাকি, তাদের আত্মা শান্তি পাইবে ভোগীর রক্ত মাখি। মানুষের মার নয় এ রে দাদা, এ যে আল্লার মার, এর ক্ষমা নাই, এ নয় ধরার ভাঁড়ামি রাজবিচার।উৎপীড়ক আর ভোগীদের আসিয়াছে রোজ-কিয়ামত ধূলি-রেণু হয়ে উড়ে যাবে সব ইহাদের নিয়ামত। এদেরই হাতের অস্ত্র কাটিবে এদেরই স্কন্ধ, শির, ইহারা মরিলে দুনিয়া হইবে স্নিগ্ধ, শান্ত, স্থির।বাক্সের পানে চেয়ে চেয়ে চোখ ফ্যাকাশে হয়েছে বুঝি! বাক্স ও চাবি নেবে না উহারা, কেড়ে নেবে শুধু পুঁজি। খাবি খায় তবু চাবি ছাড়ে নাকো! উৎকট প্রলোভন মরে না কিছুতে, আত্মঘাতী তা না হয় যতক্ষণ!আমরা গরিব, শুকায়ে হয়েছি চামড়ার আমচুর, খামচে ধরেছে মাংসওয়ালারে ক্ষুধিত বুনো কুকুর। কোন বন থেকে কে জানে এসেছে নেকড়ে বাঘের দল, আমাদের ভয় নাই, আমাদের নাইকো গোরু-ছাগল।সামলাও মাল মালওয়ালা, দেখো পয়মাল হবে সব, ঊর্ধ্বে নিত্য শুনিতেছ নাকি শকুনের কলরব? ধূমকেতু নয়, কোন মেথরানি হাতে মুড়ো ঝ্যাঁটা লয়ে এসেছে আকাশে; পৃথিবী উঠেছে ভীষণ নোংরা হয়ে!নোংরা, লোভী ও ভোগী রহিবে না শুদ্ধ এ পৃথিবীতে, এ আবর্জনা পুড়ে ছাই হবে নরকের চুল্লিতে। আসিছে ফিরিয়া এই বাংলায় কাঙালের শুভদিন, আজিও সময় আছে ধনী, শোধ করো তাহাদের ঋণ!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি, মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি! আমি এ-পার, তুমি ও-পার, মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্‌ছানি, আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁওয়াখানি।নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয়! আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়! এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে, আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়, কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয়!চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর। গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর। গান ফুরালো যাব যবে গানের কথাই মনে রবে, পাখী তখন থাকবো না ক’-থাকবে পাখীর ঘর, উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর!তোমার পারে বাজল কখন আমার পারের ঢেউ, অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ। উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে একটি পালক প’ড়লে পথে ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও! ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও!বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি ঝুরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী? মনের মনে নিশীথ-রাতে চুমু দেবে কি কল্পনাতে? স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি! মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী!দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল! কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল! তোমায় পেলে থামত বাঁশী, আসত মরণ সর্বনাশী। পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল। বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও, দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও। থাকবে তুমি ছায়ার সাথে মায়ার মত চাঁদনী রাতে! যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও! শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও!ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর! তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর। কোথায় আছ কেমনে রাণি কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি! ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর! চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!রাত্রে যখন এক্‌লা শোব-চাইবে তোমার বুক, নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ, দুখের সুরায় মস্ত্‌ হ’য়ে থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে, কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ! ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ!গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান। থামবে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান! শিল্পী আমি, আমি কবি, তুমি আমার আঁকা ছবি, আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান। চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান।তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর, কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির। গোপন তুমি আসলে নেমে কাব্যে আমার, আমার প্রেমে, এই-সে সুখে থাকবে বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর? দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড়!বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান, মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান! যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে করবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে ভোলার মাঝে উঠবে বেঁচে, সেই তো আমার প্রাণ! নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেলে গেলাম গান!পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি, মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি! আমি এ-পার, তুমি ও-পার, মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্‌ছানি, আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁওয়াখানি।নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয়! আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়! এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে, আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়, কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয়!চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর। গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর। গান ফুরালো যাব যবে গানের কথাই মনে রবে, পাখী তখন থাকবো না ক’-থাকবে পাখীর ঘর, উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর!তোমার পারে বাজল কখন আমার পারের ঢেউ, অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ। উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে একটি পালক প’ড়লে পথে ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও! ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও!বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি ঝুরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী? মনের মনে নিশীথ-রাতে চুমু দেবে কি কল্পনাতে? স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি! মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী!দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল! কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল! তোমায় পেলে থামত বাঁশী, আসত মরণ সর্বনাশী। পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল। বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও, দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও। থাকবে তুমি ছায়ার সাথে মায়ার মত চাঁদনী রাতে! যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও! শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও!ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর! তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর। কোথায় আছ কেমনে রাণি কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি! ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর! চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!রাত্রে যখন এক্‌লা শোব-চাইবে তোমার বুক, নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ, দুখের সুরায় মস্ত্‌ হ’য়ে থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে, কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ! ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ!গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান। থামবে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান! শিল্পী আমি, আমি কবি, তুমি আমার আঁকা ছবি, আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান। চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান।তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর, কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির। গোপন তুমি আসলে নেমে কাব্যে আমার, আমার প্রেমে, এই-সে সুখে থাকবে বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর? দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড়!বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান, মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান! যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে করবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে ভোলার মাঝে উঠবে বেঁচে, সেই তো আমার প্রাণ! নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেলে গেলাম গান!পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি, মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি! আমি এ-পার, তুমি ও-পার, মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্‌ছানি, আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁওয়াখানি।নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয়! আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়! এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে, আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়, কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয়!চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর। গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর। গান ফুরালো যাব যবে গানের কথাই মনে রবে, পাখী তখন থাকবো না ক’-থাকবে পাখীর ঘর, উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর!তোমার পারে বাজল কখন আমার পারের ঢেউ, অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ। উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে একটি পালক প’ড়লে পথে ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও! ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও!বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি ঝুরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী? মনের মনে নিশীথ-রাতে চুমু দেবে কি কল্পনাতে? স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি! মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী!দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল! কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল! তোমায় পেলে থামত বাঁশী, আসত মরণ সর্বনাশী। পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল। বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও, দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও। থাকবে তুমি ছায়ার সাথে মায়ার মত চাঁদনী রাতে! যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও! শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও!ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর! তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর। কোথায় আছ কেমনে রাণি কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি! ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর! চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!রাত্রে যখন এক্‌লা শোব-চাইবে তোমার বুক, নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ, দুখের সুরায় মস্ত্‌ হ’য়ে থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে, কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ! ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ!গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান। থামবে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান! শিল্পী আমি, আমি কবি, তুমি আমার আঁকা ছবি, আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান। চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান।তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর, কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির। গোপন তুমি আসলে নেমে কাব্যে আমার, আমার প্রেমে, এই-সে সুখে থাকবে বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর? দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড়!বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান, মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান! যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে করবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে ভোলার মাঝে উঠবে বেঁচে, সেই তো আমার প্রাণ! নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেলে গেলাম গান!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
কর্ণাটের গঙ্গা-পূত কাবেরীর নীরে প্রভাতে সিনানে আসে শ্যামা বেণিবর্ণা কর্ণাটকুমারী এক, নাম মেঘমালা। সিনানের আগে নিতি কাহার উদ্দেশে চামেলি চম্পক ফুল তরঙ্গে ভাসায়। ভিনদেশি বুঝি এক বণিক কুমার হেরিয়া সে এণাক্ষীরে তরণি ভিড়ায়ে রহে সেই ঘাটে বসি,যেতে নাহি চায়। স্নান-স্নিগ্ধা শ্যামলীর স্নিগ্ধতর রূপে ডুবে যায় আঁখি তার, কন্ঠে ফোটে গান – (কর্ণাটি সামন্ত – তেতালা) কাবেরী নদীজলে কে গো বালিকা। আনমনে ভাসাও চম্পা শেফালিকা॥ প্রভাত সিনানে আসি আলসে কঙ্কণ তাল হানো কলসে, খেলে সমীরণ লয়ে কবরীর মালিকা॥ দিগন্তে অনুরাগে নবারুণ জাগে তব জল ঢলঢল করুণা মাগে। ঝিলম রেবা নদীতীরে মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে তোমারেই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা॥ দ্বিধাহীনা মেঘমালা জানিত না লাজ কুন্ঠাহীন মুখে তার ছিল না গুন্ঠন! গান শুনি কুমারের কাছে আসি কহে – কারে খোঁজে মেঘদূত? হে বিদেশি কহো! কহিতে কহিতে চাহি কুমারের চোখে কী যেন হেরিয়া মুখে বেধে যায় কথা। সেদিন প্রথম যেন আপনারে হেরি, আপনি সে উঠিল চমকি! দেহে তার লজ্জা আসি টেনে দিল অরুণ আঙিয়া! ভরা ঘট লয়ে ঘরে ফিরে! নিশি রাতে সুরের সুতায় গাঁথে কথার মুকুল।–(নাগ স্বরাবলী – তেতালা) এসো চিরজনমের সাথি। তোমারে খুঁজেছি দূর আকাশে জ্বালায়ে চাঁদের বাতি॥ খুঁজেছি প্রভাতে, গোধূলি-লগনে, মেঘ হয়ে আমি খুঁজেছি গগনে, ঢেকেছে ধরণি আমার কাঁদনে অসীম তিমির রাতি॥ ফুল হয়ে আছে লতায় জড়ায়ে মোর অশ্রুর স্মৃতি বেণুবনে বাজে বাদল নিশীথে আমারই করুণগীতি! শত জনমের মুকুল ঝরায়ে ধরা দিতে এলে আজি মধুবায়ে বসে আছি আশা-বকুলের ছায়ে বরণের মালা গাঁথি॥ গান গাহি চমকিয়া ওঠে মেঘমালা। আপনারে ধিক্কারে সে মরিয়া মরমে – যদি কেহ শুনে থাকে তাহার এ গান, কী ভাবিবে যদি শোনে বিদেশি বণিক! সেদিন কাবেরীতীরে এল মেঘমালা বেলা করি। গাঁয়ের বধূরা একে একে সিনান সারিয়া ফিরে গেছে গৃহকাজে। বণিককুমার খোঁজে কী যেন মানিক! নীল শাড়ি পরি তন্বী মেঘমালা আসে শ্লথগতি মদালসা, বিলম্বিতা বেণি। বণিককুমার চাহি ওপারের পানে, গাহে গান, – না দেখার ভান করি যেন। – (নীলাম্বরী – তেতালা) নীলাম্বরী শাড়ি পরি, নীল যমুনায় কে যায়, কে যায়, কে যায়। যেন জলে চলে থল-কমলিনী, ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥ কলসে কঙ্কণে রিনিঠিনি ঝনকে চমকায় উন্মন চম্পাবনকে, দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥ অঙ্গের ছন্দে পলাশ, মাধবী, অশোক ফোটে, নূপুর শুনি বনতুলসীর মঞ্জরি উলসিয়া ওঠে! মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধূলি নামিয়া এল বুঝি পথ ভুলি। তাহারই অঙ্গ-তরঙ্গ-বিভঙ্গে কূলে কূলে নদীজল উথলায়॥ মেঘমালা কুমারের আঁখি ফিরাইতে কত রূপে শব্দ করে কলসে কঙ্কণে। সাঁতারিয়া কাবেরীর শান্ত বক্ষ মাঝে অশান্ত তরঙ্গ তোলে! বণিক কুমার হাসি তীরে আসি কহে, ‘অঞ্চলের ফুল অকারণে নদীজলে ভাসাও বালিকা। ও ফুল আমারে দাও! দেবতা তোমার প্রসন্ন হবেন, পাবে মনোমতো বর।’ মেঘমালা আঁচলের ফুলগুলি লয়ে নদীজলে ভাসাইয়া – ঘটে জল ভরি চলে এল ঘরপানে, চাহিল না ফিরে – দেখিল না কার দুটি আঁখি আঁখিনীরে ভরে গেছে কূলে কূলে। ঘরে ফিরে আসি মেঘমালা আপনার মনে মনে কাঁদে –(নারায়ণী–আদ্ধা-কাওয়ালি) রহি রহি কেন সেই মুখ পড়ে মনে। ফিরায়ে দিয়াছি যারে অনাদরে অকারণে॥ উদাস চৈতালি দুপুরে মন উড়ে যেতে চায় সুদূরে যে বনপথে সে ভিখারি-বেশে করুণা জাগায়েছিল সকরুণ নয়নে॥ তার বুকে ছিল তৃষ্ণা, মোর ঘটে ছিল বারি। পিয়াসি ফটিকজল জল পাইল না গো ঢলিয়া পড়িল হায় জলদ নেহারি॥ তার অঞ্জলির ফুল পথধূলিতে ছড়ায়েছি সেই ব্যথা নারি ভুলিতে। অন্তরালে যারে রাখিনু চিরদিন অন্তর জুড়িয়া কেন কাঁদে সে গোপনে॥ জলে আর যায় নাকো কর্ণাট কুমারী চলে গেল তরি বাহি বিদেশি কুমার তরণি ভরিয়া তার নয়নের নীরে! সেদিন নিশীথে ঝড় বাদলের খেলা, মেঘমালা চেয়ে আছে বাতায়ন খুলি কাবেরী নদীর পানে! ঘন অন্ধকারে বিজলি-প্রদীপ জ্বালি কোন বিরহিণী খুঁজে যেন তারই মতো দয়িতে তাহার। কাঁদিয়া কাঁদিয়া কবে পড়ে যে ঘুমায়ে, ঘুমায়ে স্বপন দেখে গাহিছে বিদেশি – (মিশ্র নারায়ণী – তেতালা) নিশি রাতে রিম-ঝিম-ঝিম বাদল নূপুর বাজিল ঘুমের মাঝে সজল মধুর। দেয়া গরজে বিজলি চমকে জাগাইল ঘুমন্ত প্রিয়তমকে আধ ঘুম-ঘোরে চিনিতে নারি ওরে কে এল, কে এল বলে ডাকিছে ময়ূর। দ্বার খুলি পড়শি কৃষ্ণা মেয়ে আছে চেয়ে মেঘের পানে আছে চেয়ে। কারে দেখি আমি কারে দেখি, মেঘলা আকাশ, না ওই মেঘলা মেয়ে। ধায় নদীজল মহাসাগর পানে বাহিরে ঝড় কেন আমায় টানে জমাট হয়ে আছে বুকের কাছে নিশিথ আকাশ যেন মেঘ-ভারাতুর॥ মেঘমালা চমকিয়া জাগি ছুটে যায় পাগলিনিপ্রায় নদীতীরে। ডাকি ফেরে ঝড় বাদলের সাথে কন্ঠ মিশাইয়া – ‘কুমার! কুমার! কোথা প্রিয়তম মোর! লয়ে যাও মোরে তব সোনার তরিতে!’ হারাইয়া গেল তার ক্ষীণ কন্ঠস্বর অনন্ত যুগের বিরহিণীর কাঁদন যে পথে হারায়ে যায়। আজও মোরা শুনি কাবেরীর জল-ছলছল অশ্রু-মাখা কর্ণাটিকা রাগিণীতে তাহারই বেদনা॥(মনোরঞ্জনী – তেতালা-ঢিমা) ওগো বৈশাখী ঝড়! লয়ে যাও অবেলায় ঝরা এ মুকুল। লয়ে যাও আমার জীবন,– এই পায়ে দলা ফুল॥ ওগো নদীজল! লহো আমারে বিরহের সেই মহা পাথারে চাঁদের পানে চাহি যে পারাবার, অনন্তকাল কাঁদে বেদনা-ব্যাকুল॥ ওরে মেঘ! মোরে সেই দেশে রেখে আয় যে দেশে যায় না শ্যাম মথুরায়, ভরে না বিষাদ-বিষে এ-জীবন যে দেশের ক্ষণিকের ভুল॥  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
হয়ত তোমার পাব’ দেখা, যেখানে ঐ নত আকাশ চুমছে বনের সবুজ রেখা।। ঐ সুদূরের গাঁয়ের মাঠে, আ’লের পথে বিজন ঘাটে; হয়ত এসে মুচকি হেসে ধ’রবে আমার হাতটি একা।। ঐ নীলের ঐ গহন-পারে ঘোম্‌টা-হারা তোমার চাওয়া, আনলে খবর গোপন দূতী দিক্‌পারের ঐ দখিনা হাওয়া।। বনের ফাঁকে দুষ্টু তুমি আসে- যাবে নয়্‌না চুমি’ সেই সে কথা লিখছে হেতা দিগ্বলয়ের অরুণ-লেখা।
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
ওরে ভয় নাই আর, দুলিয়া উঠেছে হিমালয়-চাপা প্রাচী, গৌরশিখরে তুহিন ভেদিয়া জাগিছে সব্যসাচী! দ্বাপর যুগের মৃত্যু ঠেলিয়া জাগে মহাযোগী নয়ন মেলিয়া, মহাভারতের মহাবীর জাগে, বলে ‘আমি আসিয়াছি।’ নব-যৌবন-জলতরঙ্গে নাচে রে প্রাচীন প্রাচী! বিরাট কালের অজ্ঞাতবাস ভেদিয়া পার্থ জাগে, গান্ডীব ধনু রাঙিয়া উঠিল লক্ষ লাক্ষারাগে! বাজিছে বিষাণ পাঞ্চজন্য, সাথে রথাশ্ব, হাঁকিছে সৈন্য, ঝড়ের ফুঁ দিয়া নাচে অরণ্য, রসাতলে দোলা লাগে, দোলায় বসিয়া হাসিছে জীবন মৃত্যুর অনুরাগে! যুগে যুগে ম’রে বাঁচে পুনঃ পাপ দুর্মতি কুরুসেনা, দুর্যোধনের পদলেহী ওরা, দুঃশাসনের কেনা! লঙ্কাকান্ডে কুরুক্ষেত্রে, লোভ-দানবের ক্ষুধিত নেত্রে, ফাঁসির মঞ্চে কারার বেত্রে ইহারা যে চির-চেনা! ভাবিয়াছ, কেহ শুধিবে না এই উৎপীড়নের দেনা? কালের চক্র বক্রগতিতে ঘুরিতেছে অবিরত, আজ দেখি যারা কালের শীর্ষে, কাল তারা পদানত। আজি সম্রাট্‌ কালি সে বন্দী, কুটীরে রাজার প্রতিদ্বন্দী! কংস-কারায় কংস-হন্তা জন্মিছে অনাগত, তারি বুক ফেটে আসে নৃসিংহ যারে করে পদাহত! আজ যার শিরে হানিছে পাদুকা কাল তারে বলে পিতা, চির-বন্দিনী হতেছে সহসা দেশ-দেশ-নন্দিতা। দিকে দিকে ঐ বাজিছে ডঙ্কা, জাগে শঙ্কর বিগত-শঙ্কা! লঙ্কা সায়রে কাঁদে বন্দিনী ভারত-লক্ষ্মী সীতা, জ্বলিবে তাঁহারি আঁখির সুমুখে কাল রাবণের চিতা! যুগে যুগে সে যে নব নব রূপে আসে মহাসেনাপতি, যুগে যুগে হ’ন শ্রীভগবান্‌ যে তাঁহারই রথ-সারথি! যুগে যুগে আসে গীতা-উদ্‌গাতা ন্যায়-পান্ডব-সৈন্যের ত্রাতা। অশিব-দক্ষযজ্ঞে যখনই মরে স্বাধীনতা-সতী, শিবের খড়গে তখনই মুন্ড হারায়েছে প্রজাপতি! নবীন মন্ত্রে দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী, জাগো রে জোয়ান! ঘুমায়ো না ভূয়ো শান্তির বাণী শুনি- অনেক দধীচি হাড় দিল ভাই, দানব দৈত্য তবু মরে নাই, সুতা দিয়ে মোরা স্বাধীনতা চাই, ব’সে ব’সে কাল গুণি! জাগো রে জোয়ান! বাত ধ’রে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি! দক্ষিণ করে ছিঁড়িয়া শিকল, বাম করে বাণ হানি’ এস নিরস্ত্র বন্দীর দেশে হে যুগ-শস্ত্রপাণি! পূজা ক’রে শুধু পেয়েছি কদলী, এইবার তুমি এস মহাবলী। রথের সুমুখে বসায়ো চক্রী চত্রুধারীরে টানি’, আর সত্য সেবিয়া দেখিতে পারি না সত্যের প্রাণহানি। মশা মেরে ঐ গরজে কামান-‘বিপ্লব মারিয়াছি। আমাদের ডান হাতে হাতকড়া, বাম হাতে মারি মাছি!’ মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি, টিকি দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি! বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী, যা হোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার ম’রে বাঁচি!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
এমন করে অঙ্গনে মোর ডাক দিলি কে স্নেহের কাঙালি! কে রে ও তুই কে রে? আহা  ব্যথার সুরে রে, এমন  চেনা স্বরে রে, আমার ভাঙা ঘরের শূন্যতারই বুকের পরে রে। এ কোন     পাগল স্নেহ-সুরধুনীর আগল ভাঙালি? কোন্ জননির দুলাল রে তুই, কোন্ অভাগির হারামণি, চোখ-ভরা তোর কাজল চোখে রে আহা    ছলছল কাঁদন চাওয়ার সজল ছায়া কালো মায়া সারাখনই উছলে যেন পিছল ননি রে! মুখভরা তোর ঝরনাহাসি শিউলি সম রাশি রাশি আমার     মলিন ঘরের বুকে মুখে লুটায় আসি রে! বুক-জোড়া তোর ক্ষুদ্ধ স্নেহ দ্বারে দ্বারে কর হেনে যে যায় কেউ কি তারে ডাক দিল না? ডাকল যারা তাদের কেন দলে এলি পায়? কেন আমার ঘরের দ্বারে এসেই আমার পানে চেয়ে এমন থমকে দাঁড়ালি? এমন চমকে আমায় চমক লাগালি? এই কি রে তোর চেনা গৃহ, এই কিরে তোর চাওয়া স্নেহ হায়! তাই কি আমার দুখের কুটির হাসির গানের রঙে রাঙালি? হে মোর    স্নেহের কাঙালি। এ সুর যেন বড়োই চেনা, এ স্বর যেন আমার বাছার, কখন সে যে ঘুমের ঘোরে হারিয়েছিনু হয় না মনে রে! না চিনেই আজ তোকে চিনি, আমারই সেই বুকের মানিক, পথ ভুলে তুই পালিয়ে ছিলি সে কোন ক্ষণে সে কোন বনে রে! দুষ্টু ওরে, চপল ওরে, অভিমানী শিশু! মনে কি তোর পড়ে না তার কিছু? সেই অবধি জাদুমণি কত শত জনম ধরে দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে রে, আমি  মা-হারা সে কতই ছেলের কতই মেয়ের মা হয়ে বাপ খুঁজেছি তোরে! দেখা দিলি আজকে ভোরে রে! উঠছে বুকে হাহা ধ্বনি আয় বুকে মোর হারামণি, আমি  কত জনম দেখিনি যে ওই মু-খানি রে! পেটে-ধরা নাই বা হলি, চোখে ধরার মায়াও নহে এ, তোকে পেতেই জন্ম জন্ম এমন করে বিশ্ব-মায়ের ফাঁদ পেতেছি যে! আচমকা আজ ধরা দিয়ে মরা-মায়ের ভরা-স্নেহে হঠাৎ জাগালি। গৃহহারা বাছা আমার রে! চিনলি কি তুই হারা-মায়ে চিনলি কি তুই আজ? আজকে আমার অঙ্গনে তোর পরাজয়ের বিজয়-নিশান তাই কি টাঙালি? মোর    স্নেহের কাঙালি।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আর জিজ্ঞাসা করিব না কোনো কথা আপনার মনে কয়ে যাব আমি আপন মনের ব্যথা। ভোরের প্রথম-ফোটা ফুলগুলি গোপনে তুলিয়া আনি অঞ্জলি দিতে তোমার দুয়ারে দাঁড়াই যুক্তপাণি। আমার চেয়েও সকরুণ চোখে ফুলগুলি চেয়ে থাকে, মোর সাথে ওরা তব পায়ে চাহে অর্পিতে আপনাকে, – তব তনু হেরি ফুলগুলি যেন অধিক ফুল্ল হয়, মনে ভাবে, ওই অঙ্গের সাথে কবে হবে পরিচয়! তুমি দ্বিধাভরে যেন ভয়ে ভয়ে আস উহাদের কাছে! ভাব বুঝি ওই ফুলের ঝাঁপিতে লোভের সাপিনি আছে! মুখ ফুটে তাই বলিতে পার না, ‘ওই ফুলগুলি দাও।’ আমার গানের ফুলগুলি বোঝে, উহাদের ভয় পাও। চেয়ে দেখি, হায়, বেদনায় মোর ফুল্ল ফুলের গুছি সূর্যের নামে শপথ করিয়া কাঁদে – ‘শুচি মোরা শুচি।’ ছড়াইয়া দিই পথের ধুলাতে প্রেম-ফুল-অঞ্জলি, ‘দেখ সাপ নাই, নাই কাঁটা’ – আমি ফিরে যেতে যেতে বলি। অবুঝ ভিখারি-মন যেতে যেতে পিছু ফিরে ফিরে চায় – ছড়ানো একটি ফুল তুলে সে কি লুকাল এলো-খোঁপায়? দূর হতে দেখে পাষাণ-মুরতি তেমনি দাঁড়ায়ে আছে, ফুল এড়াইয়া চলে গেলে তুমি কলঙ্ক লাগে পাছে! তোমার চলার পথে পড়ে যত এই পৃথিবীর ধূলি তারও চেয়ে কি গো মলিনতা-মাখা আমার কুসুমগুলি? ধুলায় তোমায় ভুলায় না পথ, পথ ভোলাবে কি ফুল? ভয় পাও কি গো যদি শোনো পথে গাহে বন-বুলবুল? তুমি শুনিলে না, তবু মোর কথা থামিতে চাহে না কেন? তোমার ফুলের ফাল্গুন মাসে ঝোড়ো মেঘ আমি যেন! তব ফুল-ভরা উৎসবে কেন জল ছিটিয়ে সে যায় তব সাথে তার কোন সে জীবনে কোন যোগ ছিল, হায়! ভয় করিয়ো না, মেঘ আসে – মেঘ শেষ হয়ে যায় গলে, আমার না-বলা কথা বলা হলে আমিও যাইব চলে। আমি জানি, এই ফাগুন ফুরাবে, খর-বৈশাখ এসে কী যেন দারুণ আগুন জ্বালাবে তোমাদের এই দেশে। ভালো লাগিবে না কিছু সেই দিন উৎসব হাসি গান, ফাগুনে যে মেঘ এসেছিল, তার তরে কাঁদিবে গো প্রাণ। ডাকিবে, ‘এসো হে ঘনশ্যাম বারিবাহ, জ্বলে গেল বুক, জুড়াও জুড়াও দাহ।’অভিমানী মেঘ সেদিন যদি গো নাহি আসে আর ফিরে, যে সাগর থেকে মেঘ এসেছিল – যেয়ো সে সাগর তীরে। তোমারে হেরিলে হয়তো আমার অভিমান যাব ভুলে, তব কুন্তল-সুরভিতে সাড়া পড়িবে সাগরকূলে। আমি উত্তাল তরঙ্গ হয়ে আছাড়ি পড়িব পায়ে, জলকণা হয়ে ছিটায়ে পড়িব তব অঞ্চলে, গায়ে। এই ভিখারির কথা শুনি আজ হাসিবে হয়তো প্রিয়া, তবু বলি, তুমি কাঁদিয়া উঠিবে সাগর দেখিতে গিয়া। মনে পড়ে যাবে, তোমার আকাশে মেঘ হয়ে কোনোদিন কেঁদেছিল এই সাগর তোমারে ঘিরিয়া বিরামহীন। তোমারে না পেয়ে শত পথ ঘুরে কেঁদে শত নদীনীরে সাগরের জল সাগরে এসেছে ফিরে। তোমারে সিনান করায়েছিল সে অমৃতধারার কূলে ছেয়ে দিয়েছিল তোমার ভুবন বিহ্বল ফুলে ফুলে! তব ফুলময় তনু লয়ে ওঠে বৃন্দাবনে যে গীতি, তোমারে যে আজ নিবেদন করে ত্রিলোক শ্রদ্ধা প্রীতি। মেঘ-ঘনশ্যাম কোনো বিরহীর স্মৃতি আছে তার সাথে, মেঘ হয়ে কেঁদে এসেছিল, গেছে আঁধারে মিশায়ে রাতে। ‍সাগরে যেদিন ঝাঁপায়ে পড়িবে! তোমার পরশ পেয়ে প্রলয়-সলিলে রূপ ধরে আমি উঠিব গোপনে গেয়ে! আমার হৃদয় ছোঁয় যদি প্রিয়া তোমার তনুর মায়া, পরম শূন্যে ভাসিয়া উঠিবে আবার আমার কায়া। আজ চলে যাই – এই পৃথিবীরে আর লাগে নাকো ভালো। হেথা মানুষের নিশ্বাসে নিভে যায় যে প্রেমের আলো! সেদিন যেন গো দ্বিধা নাহি আসে কোনো লোক যেন নাহি থাকে পাশে, যে নামে আমারে ডাকিলে না আজ সেদিন ডেকো সে নামে কী বলে ডাকিলে বেঁচে উঠি আমি শুধাইয়ো রাধা শ্যামে। যে নিরাধার শ্যাম শ্রীরাধার প্রেমে রূপ ধরে আসে পৃথিবীর বুকে নেমে, যদি কোনো দিন দেখা পাও তার – মোর স্মৃতি থাকে মনে, রোদনের বান আনে যদি তব প্রেমের বৃন্দাবনে, ‘কোথায় হারিয়ে গেছি আমি’ শুধায়ো নিরালা ডাকি, খুঁজিয়া আনিবে হয়তো আমারে তাঁহার পরম আঁখি॥   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
বল বীর - বল উন্নত মম শির! শির     নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর! বল বীর - বল     মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি' চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি' ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর! মম     ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! বল বীর - আমি চির-উন্নত শির!আমি     চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-     প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি     মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! আমি দুর্ব্বার, আমি     ভেঙে করি সব চুরমার! আমি     অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি     দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল! আমি     মানি নাকো কোনো আইন, আমি     ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম, ভাসমান মাইন! আমি     ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর! আমি     বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর! বল বীর - চির উন্নত মম শির!আমি     ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী, আমি     পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী! আমি     নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি     আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি     হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি     চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি' পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি' ফিং দিয়া দিই তিন দোল্! আমি     চপলা-চপল হিন্দোল!আমি     তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা', করি      শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা! আমি     মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর। আমি     শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর। বল বীর - আমি     চির-উন্নত শির!        আমি     চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ, আমি     দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্ ভরপুর মদ। আমি     হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি, আমি     যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি! আমি     সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি     অবসান, নিশাবসান। আমি     ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য, মম     এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য। আমি     কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির। আমি     ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। বল বীর - চির উন্নত মম শির।আমি     সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক আমি     যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক! আমি     বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি     আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! আমি     বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি     ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার, আমি     পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড, আমি     চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড! আমি     ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি     দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব! আমি     প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, আমি     মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস! আমি     কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী, আমি     অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী! আমি     প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল, আমি     উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল, আমি     উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!আমি     বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি     ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি। আমি     উন্মন মন উদাসীর, আমি     বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর! আমি     বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি     অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের! আমি     অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত-     চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর! আমি     গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন, আমি     চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্। আমি     চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি     যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর! আমি     উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া, আমি     পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া! আমি     আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি, আমি     মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! - আমি     তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ! আমি     সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!আমি     উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি     বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন! ছুটি     ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে, তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে! আমি     বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, আমি     পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল! আমি     তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ, আণি     ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প! ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', - ধরি     স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'! আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল, আমি     ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!             আমি     অর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহা-     সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্ ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্ মম বাঁশরী তানে পাশরি' আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি     রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে     সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! আমি     বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!আমি     আমি শ্রাবণ প্লাবন- বন্যা, কভু     ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা - আমি     ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! আমি     অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, আমি     ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি! আমি     ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, আমি     জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!আমি     মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়, আমি     অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়! আমি     মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, আমি     তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য আমি     উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! আমি     চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি     পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! আমি     হল বলরাম স্কন্ধে, আমি     উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।        মহা-     বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি     সেই দিন হব শান্ত, যবে     উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না - বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি     সেই দিন হব শান্ত! আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি     স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন! আমি     বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!        আমি চির-বিদ্রোহী বীর - আমি     বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
মন বলে তুমি আছ ভগবান চোখ বলে তুমি নাই মিছে শুধু তোমায় ডেকে ডেকে মরি দেখা কভু নাহি পাই।মন বলে ঐ তৃণ-লতা-গাছে তব সে অরূপ মিলাইয়া আছে চোখ বলে কেন কল্পনা দিয়ে নিজেরে নিজে ভুলাই।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আসিবে তুমি জানি প্রিয় আনন্দে বনে বসন্ত এলো ভুবন হল সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর।বনানতে পবন অশান্ত হল তাই কোকিল কুহরে, ঝরে গিরি নির্ঝরিণী ঝর ঝর।ফুল্ল যামিনী আজি ফুল সুবাসে চন্দ্র অতন্দ্র সুনীল আকাশে আনন্দিত দীপান্নিত অম্বর।অধীর সমীরে দিগঞ্চল দোলে মালতী বিতানে পাখি পিউ পিউ বোলে অঙ্গে অপরূপ ছন্দ আনন্দ-লহর তোলে দিকে দিকে শুনি আজ আসিবে রাজাধিরাজ প্রিয়তম সুন্দর।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
কোন মরমির মরম ব্যথা আমার বুকে বেদনা হানে, জানি গো, সেও জানেই জানে। আমি কাঁদি তাইতে যে তার ডাগর চোখে অশ্রু আনে, বুঝেছি তা প্রাণের টানে।     বাইরে বাঁধি মনকে যত ততই বাড়ে মর্ম-ক্ষত, মোর সে ক্ষত ব্যথার মতো বাজে গিয়ে তারও প্রাণে কে কয়ে যায় হিয়ার কানে।উদাস বায়ু ধানের খেতে ঘনায় যখন সাঁঝের মায়া, দুই জনারই নয়ন-পাতায় অমনি নামে কাজল-ছায়া!     দুইটি হিয়াই কেমন কেমন বদ্ধ ভ্রমর পদ্মে যেমন, হায়, অসহায় মূকের বেদন বাজল শুধু সাঁঝের গানে, পুবের বায়ুর হুতাশ তানে। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
ওই    সর্ষে ফুলে লুটাল কার হলুদ-রাঙা উত্তরি। উত্তরি-বায়    গো – ওই    আকাশ-গাঙে পাল তুলে যায় নীল সে পরির দূর তরি॥ তার    অবুঝ বীণার সবুজ সুরে মাঠের নাটে পুলক পুরে, ওই    গহন বনের পথটি ঘুরে আসছে দূরে কচিপাতা দূত ওরই॥ মাঠঘাট তার উদাস চাওয়ায় হুতাশ কাঁদে গগন মগন বেণুর বনে কাঁপচে গো তার দীঘল শ্বাসের রেশটি সঘন। তার    বেতস-লতায় লুটায় তনু, দিগ্‌বলয়ে ভুরুর ধনু, সে     পাকা ধানের হীরক-রেণু নীল নলিনীর নীলিম-অণু মেখেছে মুখ বুক ভরি॥(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
এতদিন ছিলে ভূবনের তুমি আজ ধরা দিলে ভবনে, নেমে এলে আজ ধরার ধূলাতে ছিলে এতদিন স্বপনে! শুধু শোভাময়ী ছিলে এত দিন কবির মানসে কলিকা নলিন, আজ পরশিলে চিত্ত- পুলিন বিদায় গোধূলি- লগনে। ঊষার ললাট-সিন্দুর-টিপ সিথিঁতে উড়াল পবনে।। প্রভাতে ঊষা কুমারী, সেজেছে সন্ধ্যায় বধূ ঊষসী, চন্দন- টোপা- তারা- কলঙ্কে ভ'রেছে বে-দাগ- মু'শশী। মুখর মুখ আর বাচাল নয়ন লাজ সুখে আজ যাচে গুন্ঠন, নোটন- কপোতি কন্ঠে এখন কূজন উঠিছে উছসি'। এতদিন ছিলে শুধু রূপ- কথা, আজ হ'লে বধূ রূপসী।। দোলা চঞ্চল ছিল এই গেহ তব লটপট বেণী ঘা'য়, তারি সঞ্চিত আনন্দে ঝলে ঐ ঊর- হার মনিকায়। এ ঘরের হাসি নিয়ে যাও চোখে, সে গৃহ- দ্বীপ জ্বেলো এ আলোকে, চোখের সলিল থাকুক এ-লোকে- আজি এ মিলন মোহানায় ও- ঘরের হাসি বাশিঁর বেহাগ কাঁদুক এ ঘরে সাহানায়।। বিবাহের রঙ্গে রাঙ্গা আজ সব, রাঙ্গা মন, রাঙ্গা আভরণ, বলো নারী- "এই রক্ত- আলোকে আজ মম নব জাগরণ!" পাপে নয় পতি পুণ্যে সুমতি থাকে যেন, হ'য়ো পতির সারথি। পতি যদি হয় অন্ধ, হে সতী, বেঁধো না নয়নে আবরণ অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন তোমার সত্য আচরণ।।
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
রবি, শশী, জ্যোতিষ্ক সব, বান্দা তোমার, জ্যোতির্মতি! যেদিন হ'তে বান্দা হ'ল পেল আঁধার -হরা জ্যোতি! রাগে- অনুরাগে মেশা তোমার রুপের রৌশনীতে চন্দ্র হ'ল স্নিগ্ধ-কিরণ, সূর্য হল দীপ্ত অতি!!
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
ঘুমাইয়া ছিল আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন, বহু বৎসর মুখ চেপে ছিল পাষাণের আবরণ। তার এ ঘুমের অবসরে যত ধনলোভী রাক্ষস প্রলোভন দিয়ে করেছিল যত বুদ্ধিজীবীরে বশ। অর্থের জাব খাওয়ায়ে তাদের বলদ করিয়ে শেষে লুঠতরাজের হাট ও বাজার বসাইল সারা দেশে। সেই জাব খেয়ে বুদ্ধিওয়ালার হইল সর্বনাশ, ‘শুদ্ধি স্বামী’ ও ‘বুদ্ধু মিয়াঁ-র হইল তাহারা দাস! বুঝিল না, এই শুদ্ধি স্বামী ও বুদ্ধু মিয়াঁরা কারা খাওয়ায় কাগুজে পুরিয়ায় পুরে এরাই আফিম, পারা! সাত কোটি বাঙালির সাত জনে শুধু টাকা দিয়ে দাস করে, এরা হল কোটিপতি বাঙালি রক্ত পিয়ে। কাগুজে মগুজে ধূর্ত বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিবলে, ছুরি আর লাঠি ধরাইয়া দিল বাঙালির করতলে। জানে এরা ভায়ে ভায়ে হেথা যদি নাহি করে লাঠালাঠি, কেমন করিয়া শাঁস শুষে খাবে, ইহাদের দিয়া আঁটি? আঁটি খেয়ে যবে ভরে নাকো পেট, শূন্য বাটি ও থালা, বাঙালি দেখিল এত পাট, ধান, মেটে না ক্ষুধার জ্বালা! তখন বিরাট আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবনে নাড়া দিয়া যেন জাগাইয়া দিল ঝঞ্জা প্রভঞ্জনে! জেগে উঠে দেখে রক্তনয়নে আগ্নেয়গিরি একী! ওরই ধান ওরই বুকে কুটিতেছে বিদেশি কল ও ঢেঁকি! উহারই বিরাট অঙ্গে উঠেছে মিলের চিমনিরাশি, উহারই ধোঁয়ায় ধোঁয়াটে হয়েছে আঁখির দৃষ্টি, হাসি। এ কোন যন্ত্রদৈত্য আসিয়া যন্ত্রণা দেয় দেহে? দাসদাসী হয়ে আছে নরনারী স্বীয় পৈতৃক গেহে। একী কুৎসিত মূর্তিরা ফেরে আগুনের পর্বতে, ক্যাঙালির মতো, বাঙালি কি ওরা – লেজ ধরে চলে পথে? ভুঁড়ি-দাস আর নুড়ি-দাস যত মুড়ি খায় আর চলে, যে-কথা উহারা বলাইতে চায়, চিৎকার করে বলে! বিদারিত হল বহ্নিগিরির মুখের পাষাণভার, কাঁপিয়া উঠিল লোভীর প্রাসাদ ভীম কম্পনে তার! ক্রোধ হুংকার ওঠে ঘন ঘন প্রাণ-গহ্বর হতে, ‘লাভা’ ও অগ্নিশিখা উঠে ছুটে উর্ধ্ব আকাশপথে।কই রে কই রে স্বৈরাচারীরা বৈরী এ বাংলার? দৈন্য দেখেছ ক্ষুদ্রের, দেখনিকো প্রবলের মার! দেখেছ বাঙালি দাস, দেখনিকো বাঙালির যৌবন, অগ্নিগিরির বক্ষে বেঁধেছ যক্ষ তব ভবন! হেরো, হেরো, কুণ্ডলী-পাক খুলি আগ্নেয় অজগর বিশাল জিহ্বা মেলিয়া নামিছে ক্রোধ-নেত্র প্রখর। ঘুমাইয়া ছিল পাথর হইয়া তার বুকে যত প্রাণ, অগ্নিগোলক হইয়া ছুটিছে তিরবেগে সে পাষাণ! নিঃশেষ করে দেবে আপনারে আগ্নেয়গিরি আজি, ফুলঝুরি-সম ঝরিবে এবার প্রাণের আতসবাজি! ঊর্ধ্বে উঠেছে ক্রুদ্ধ হইয়া অদেখা আকাশ ঘেরি ; তোমাদের শিরে পড়িবে আগুন, নাই বেশি আর দেরি! তোমাদের যন্ত্রের এই যত যন্ত্রণা-কারাগার এই যৌবনবহ্নি করিবে পুড়াইয়া ছারখার। সুতি ধুতিপরা দেখেছ বিনয়- নম্র বাঙালি ছেলে, ঢল ঢল চোখ জলে ছলছল একটু আদর পেলে! দুধ পায় নাই, মানুষ হয়েছে শুধু শাকভাত খেয়ে, তবুও কান্তি মাধুরী ঝরিছে কোমল অঙ্গ বেয়ে। তোমাদের মতো পলোয়ান নয়, নয় মাংসল ভারী, ওরা কৃশ, তবু ঝকমক করে সুতীক্ষ্ণ তরবারি! বঙ্গভূমির তারুণ্যের এ রঙ্গনাটের খেলা বুঝেও বোঝেনি যক্ষ রক্ষ, বুঝিবে সে শেষ বেলা!শাড়ি-মোড়া যেন আনন্দ-শ্রী দেখো বাংলার নারী, দেখনি এখনও, ওঁরাই হবেন অসি-লতা তরবারি! ওরা বিদ্যুল্লতা-সম, তবু ওরাই বজ্র হানে, ওরা কোথা থাকে, তোমরা জান না, সাগর ও মেঘ জানে। যুগান্তরের সূর্য যখন উদয়-গগনে ওঠে, সূর্যের টানে ছুটে আসে মেঘ ; তাহারই আড়ালে ছোটে ওরা যেন ভীরু পর্দানশীন! ওরাই সময় হলে ঘন ঘন ছোঁড়ে অশনি অত্যাচারীর বক্ষতলে! শ্যামবঙ্গের লীলা সে ভীষণ সুন্দর, রেখো জেনে, বাঘের মতন নাগের মতন দেখি, যে বাঙালি চেনে! তাদেরই জড়তা-পাষাণ টুটিয়া ঝরিছে অগ্নিশিখা, কে জানে কাহার তকদীরে ভাই কী শাস্তি আছে লিখা! ধোঁয়া দেখে যদি না নোয়াও মাথা, বছর খানিক বেঁচো! দেখিবে হয়েছি ফেরেশতা মোরা, তোমরা হয়েছ কেঁচো!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
ভেদি দৈত্য-কারা উদিলাম পুন আমি কারা-ত্রাস চির-মুক্ত বাধাবন্ধ-হারা উদ্দামের জ্যোতি-মুখরিত মহা-গগন-অঙ্গনে – হেরিনু, অনন্তলোক দাঁড়াল প্রণতি করি মুক্ত-বন্ধ আমার চরণে। থেমে গেল ক্ষণেকের তরে বিশ্ব-প্রণব-ওংকার, শুনিল কোথায় বাজে ছিন্ন শৃঙ্খলে কার আহত ঝংকার! কালের করাতে কার ক্ষয় হল অক্ষয় শিকল, শুনি আজি তারই আর্ত জয়ধ্বনি ঘোষিল গগন পবন জল স্থল। কোথা কার আঁখি হতে সরিল পাষাণ-যবনিকা, তারই আঁখি-দীপ্তি-শিখা রক্ত-রবি-রূপে হেরি ভরিল উদয়-ললাটিকা। পড়িল গগন-ঢাকে কাঠি, জ্যোতির্লোক হতে ঝরা করুণা-ধারায় – ডুবে গেল ধরা-মা-র স্নেহ-শুষ্ক মাটি, পাষাণ-পিঞ্জর ভেদি, ছেদি নভ-নীল – বাহিরিল কোন্ বার্তা নিয়া পুন মুক্তপক্ষ অগ্নি-জিব্রাইল! দৈত্যাগার দ্বারে দ্বারে ব্যর্থ রোষে হাঁকিল প্রহরী! কাঁদিল পাষাণে পড়ি সদ্য-ছিন্ন চরণ-শৃঙ্খল! মুক্তি মার খেয়ে কাঁদে পাষাণ-প্রাসাদ-দ্বারে আহত অর্গল! শুনিলাম – মম পিছে পিছে যেন তরঙ্গিছে নিখিল বন্দির ব্যথা-শ্বাস – মুক্তি-মাগা ক্রন্দন-আভাস। ছুটে এসে লুটায়ে লুটায়ে যেন পড়ে মম পায়ে; বলে – ‘ওগো ঘরে-ফেরা মুক্তি-দূত! একটুকু ঠাঁই কিগো হবে না ও ঘরে-নেওয়া নায়ে?’ নয়ন নিঙাড়ি এল জল, মুখে বলিলাম তবু – ‘বন্ধু! আর দেরি নাই, যাবে রসাতল পাষাণ-প্রাচীর-ঘেরা ওই দৈত্যাগার, আসে কাল রক্ত-অশ্বে চড়ি, হেরো দুরন্ত দুর্বার!’ – বাহিরিনু মুক্ত-পিঞ্জর বুনো পাখি ক্লান্ত কণ্ঠে জয় চির-মুক্তি ধ্বনি হাঁকি – উড়িবারে চাই যত জ্যোতির্দীপ্ত মুক্ত নভ-পানে, অবসাদ-ভগ্ন ডানা ততই আমারে যেন মাটি পানে টানে। মা আমার! মা আমার! এ কী হল হায়!কে আমারে টানে মা গো উচ্চ হতে ধরার ধূলায়? মরেছে মা বন্ধহারা বহ্নিগর্ভ তোমার চঞ্চল, চরণ-শিকল কেটে পরেছে সে নয়ন-শিকল। মা! তোমার হরিণ-শিশুরে বিষাক্ত সাপিনি কোন টানিছে নয়ন-টানে কোথা কোন্ দূরে! আজ তব নীলকণ্ঠ পাখি গীতহারা হাসি তার ব্যথা-ম্লান, গতি তার ছন্দহীন, বদ্ধ তার ঝরনাপ্রাণধারা! বুঝি নাই রক্ষীঘেরা রাক্ষস-দেউলে এল কবে মরু-মায়াবিনী সিংহাসন পাতিল সে কবে মোর মর্ম-হর্ম্যমূলে! চরণ-শৃঙ্খল মম যখন কাটিতেছিল কাল – কোন্ চপলার কেশ-জাল কখন জড়াতেছিল গতিমত্ত আমার চরণে, লৌহবেড়ি যত যায় খুলে, তত বাঁধা পড়ি কার কঙ্কণবন্ধনে! আজ যবে পলে পলে দিন-গণা পথ-চাওয়া পথ বলে – ‘বন্ধু, এই মোর বুক পাতা, আনো তব রক্ত-পথ-রথ –’ শুনে শুধু চোখে আসে জল, কেমনে বলিব, ‘বন্ধু! আজও মোর ছিঁড়েনি শিকল! হারায়ে এসেছি সখা শত্রুর শিবিরে প্রাণ-স্পর্শমণি মোর, রিক্ত-কর আসিয়াছি ফিরে!’... যখন আছিনু বদ্ধ রুদ্ধ দুয়ার কারাবাসে কত না আহ্বান-বাণী শুনিতাম লতা-পুষ্প-ঘাসে! জ্যোতির্লোক মহাসভা গগন-অঙ্গন জানাত কিরণ-সুরে নিত্য নব নব নিমন্ত্রণ! নাম-নাহি-জানা কত পাখি বাহিরের আনন্দ-সভায় – সুরে সুরে যেত মোরে ডাকি। শুনি তাহা চোখ ফেটে উছলাত জল – ভাবিতাম, কবে মোর টুটিবে শৃঙ্খল, কবে আমি ওই পাখি-সনে গাব গান, শুনিব ফুলের ভাষা অলি হয়ে চাঁপা-ফুলবনে। পথে যেত অচেনা পথিক, রুদ্ধ গবাক্ষ হতে রহিতাম মেলি আমি তৃষ্ণাতুর আঁখি নির্নিমিখ! তাহাদের ওই পথ-চলা আমার পরানে যেন ঢালিত কী অভিনব সুর-সুধাগলা! পথ-চলা পথিকের পায়ে পায়ে লুটাত এ মন, মনে হত, চিৎকারিয়া কেঁদে কই – ‘হে পথিক, মোরে দাও ওই তব বাধামুক্ত অলস চরণ! দাও তব পথচলা পা-র মুক্তি-ছোঁয়া, গলে যাক এ পাষাণ, টুটে যাক ও-পরশে এ কঠিন লোহা!’ সন্ধ্যাবেলা দূরে বাতায়নে, জ্বলিত অচেনা দীপখানি, ছায়া তার পড়িত এ বন্ধন-কাতর দু-নয়নে! ডাকিতাম, ‘কে তুমি অচেনা বধূ কার গৃহ-আলো? কারে ডাক দীপ-ইশারায়? কার আশে নিতি নিতি এত দীপ জ্বাল? ওগো, তব ওই দীপ সনে ভেসে আসে দুটি আঁখি-দীপ কার এ রুদ্ধ প্রাঙ্গণে!’ – এমনই সে কত মধু-কথা ভরিত আমার বদ্ধ বিজন ঘরের নীরবতা। ওগো, বাহিরিয়া আমি হায় এ কী হেরি – ভাঙা-কারা বাহু মেলি আছে মোর সারা বিশ্ব ঘেরি! পরাধীনা অনাথিনি জননী আমার – খুলিল না দ্বার তাঁর, বুকে তাঁর তেমনই পাষাণ, পথতরুছায় কেহ ‘আয় আয় জাদু’ বলি জুড়াল না প্রাণ! ভেবেছিনু ভাঙিলাম রাক্ষস-দেউল আজ দেখি সে দেউল জুড়ে আছে সারা মর্মমূল! ওগো, আমি চির-বন্দি আজ, মুক্তি নাই, মুক্তি নাই, মম মুক্তি নতশির আজ নতলাজ! আজ আমি অশ্রুহারা পাষাণ-প্রাণের কূলে কাঁদি – কখন জাগাবে এসে সাথি মোর ঘূর্ণি-হাওয়া রক্ত-অশ্ব উচ্ছৃঙ্খল আঁধি! বন্ধু! আজ সকলের কাছে ক্ষমা চাই – শত্রুপুরীমুক্ত আমি আপন পাষাণপুরে আজি বন্দি ভাই!   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
‘শহিদান’দের ঈদ এল বকরীদ! অন্তরে চির-নওজোয়ান যে তারই তরে এই ঈদ। আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান, নির্লোভ নিরহংকার যারা, যাহারা নিরভিমান, দানব-দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে, ফিরদৌস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে, অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাশ করিতে যারা জন্ম লয়েছে চিরনির্ভীক যৌবন-মাতোয়ারা, – তাহাদেরই শুধু আছে অধিকার ঈদ্গাহে ময়দানে, তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান মাল কোরবানে। বিভুতি, ‘মাজেজা’, যাহা পায় সব প্রভু আল্লার রাহে কোরবানি দিয়ে নির্যাতিতেরে মুক্ত করিতে চাহে। এরাই মানব-জাতির খাদেম, ইহারাই খাক্‌সার, এরাই লোভীর সাম্রাজ্যেরে করে দেয় মিসমার! ইহারাই ‘ফিরোদৌস-আল্লা’র প্রেম-ঘন অধিবাসী তসবি ও তলোয়ার লয়ে আসি অসুরে যায় বিনাশি। এরাই শহিদ, প্রাণ লয়ে এরা খেলে ছিনিমিনি খেলা, ভীরুর বাজারে এরা আনে নিতি নব নওরোজ-মেলা! প্রাণ-রঙ্গিলা করে ইহারাই ভীতি-ম্লান আত্মায়, আপনার প্রাণ-প্রদীপ নিভায়ে সবার প্রাণ জাগায়। কল্পবৃক্ষ পবিত্র ‘জৈতুন’ গাছ যথা থাকে, এরা সেই আশমান থেকে এসে, সদা তারই ধ্যান রাখে! এরা আল্লার সৈনিক, এরা ‘জবীহুল্লা’-র সাথি, এদেরই আত্মত্যাগ যুগে যুগে জ্বালায় আশার বাতি। ইহারা, সর্বত্যাগী বৈরাগী প্রভু আল্লার রাহে, ভয় করে নাকো কোনো দুনিয়ার কোনো সে শাহানশাহে। এরাই কাবার হজের যাত্রী, এদেরই দস্ত চুমি! কওসর আনে নিঙাড়িয়া রণক্ষেত্রের মরুভূমি! ‘জবীহুল্লা’র দোস্ত ইহারা, এদেরই চরণাঘাতে, ‘আব-জমজম’ প্রবাহিত হয় হৃদয়ের মক্কাতে। ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ? আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ? আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী? সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম করি তারে, ঈদ্গাহে গিয়া তারই সার্থক হয় ডাকা আল্লারে। অন্তরে ভোগী, বাইরে যে রোগী, মুসলমান সে নয়, চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য যে পরিচয়! লাখো ‘বকরা’র বদলে সে পার হবে না পুলসেরাত সোনার বলদ ধনসম্পদ দিতে পার খুলে হাত? কোরান মজিদে আল্লার এই ফরমান দেখো পড়ে, আল্লার রাহে কোরবানি দাও সোনার বলদ ধরে। ইব্রাহিমের মতো পুত্রেরে আল্লার রাহে দাও, নইলে কখনও মুসলিম নও, মিছে শাফায়ৎ চাও! নির্যাতিতের লাগি পুত্রেরে দাও না শহিদ হতে, চাকরিতে দিয়া মিছে কথা কও– ‘যাও আল্লার পথে’! বকরীদি চাঁদ করে ফরয়্যাদ, দাও দাও কোরবানি, আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাঁহার না-ফরমানি! পিছন হইতে বুকে ছুরি মেরে, গলায় গলায় মেলো, কোরো না আত্ম-প্রতারণা আর, খেলকা খুলিয়া ফেলো! উমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদে মনে কর, শুধু সালওয়ার পরিয়ো না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো! কোথায় আমার প্রিয় শহিদল মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ? এসো ঈদের নামাজ পড়িব, আলাদা আমাদের ময়দান!  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
ওরে আমার বুকের বেদনা! ঝঞ্ঝা-কাতর নিশীথ রাতের কপোত সম রে আকুল এমন কাঁদন কেঁদো না।কখন সে কার ভুবনভরা ভালোবাসা হেলায় হারালি, তাইতো রে আজ এড়িয়ে চলে সকল স্নেহে পথে দাঁড়ালি! ভিজে ওঠে চোখের পাতা তোর, একটি কথায় – অভিমানী মোর! ডুকরে কাঁদিস বাঁধনহারা, ‘ওগো, আমায় বাঁধন বেঁধো না’।বাঁধন গৃহের সইল না তোর, তাই বলে কি মায়াও ঘরের ডাক দেবে না তোকে? অভিমানী গৃহহারা রে!চললে একা মরুর পথেও সাঁঝের আকাশ মায়ের মতন ডাকবে নত চোখে, ডাকবে বধূ সন্ধ্যাতারা যে!জানি ওরে, এড়িয়ে যারে চলিস তারেই পেতে চলিস পথে। জোর করে কেউ বাঁধে না তাই বুক ফুলিয়ে চলিস বিজয়রথে। ওরে কঠিন! শিরীষকোমল তুই! মর্মর তোর মর্মে ছাপা বেল কামিনী জুঁই! বুকপোরা তোর ভালবাসা, মুখে মিছে বলিস ‘সেধো না’। আমার    বুকের বেদনা। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
"আমি হব সকাল বেলার পাখি সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।"সুয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে, 'হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন', মা বলবেন রেগে।বলব আমি- 'আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক, হয়নি সকাল, তাই বলে কি সকাল হবে নাক'?আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে ? তোমার ছেলে উঠবে মা গো রাত পোহাবে তবে।
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
আয় লো সই খেলব খেলা ফাগের ফাজিল পিচকিরিতে। আজ শ্যামে জোর করব ঘায়েল হোরির সুরের গিটকিরিতে। বসন ভূষণ ফেল লো খুলে, দে দোল দে দোদুল দুলে, কর লালে লাল কালার কালো আবির হাসির টিটকিরিতে॥(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
ল্যাবেন্ডিশ* বাহিনীর বিজাতীয় সঙ্গীত (*কলকাতার এক জাতীয় সিপাহী) কোরাস্:     কে বলে মোদেরে ল্যাডাগ্যাপচার? আমরা সিভিল গাড়, অরাজক এই ভারত-মাঠে হে আমরা উদ্‌মো ষাঁড়॥ মোরা লাঙল জোয়াল দড়াদড়ি-ছাড়া, বড় সুখে তাই দিই শিং-নাড়া, অসহ-যোগীও করিবে না তাড়া রে— ওরে ভয় নাই, ওরা বৈষ্ণব বাঘ, খাবে না মোদের হাড়! চলো ব্যাং-বীর, বলো ঠ্যাং নেড়ে জোর, ছেডেডে ডেডেং হার্‌র্! কোরাস্:   কে বলে ইত্যাদি— মোরা গলদঘর্ম যদিও গলিয়া, বড় বেজুত করেছে লেজুড় ডলিয়া, তবু গলদ করো না বলদ বলিয়া হে, মোরা বড় দরকারি সরকারি গরু, তরকারি নহি তার! তবে গতিক দেখিয়া অধিক না গিয়া সটান পগার পার! কোরাস্:    কে বলে ইত্যাদি— আজ গোবরগণেশ গোবরমন্ত ল্যাজে ও গোবরে খিঁচেন দন্ত, তবু করুণার নাহিকো অন্ত হে, যত মামাদের কড়ি ধামা-ধরে দিয়া আমাদেরি ভাঙে ঘাড়! আর বাবাদেরে বেঁধে ঠ্যাঙাতে মোরাই কেটে দি বাঁশের ঝাড়। কোরাস্:    কে বলে ইত্যাদি— হয়ে ইভিলের গুরু ডেভিল পশুর— সিভিল-বাহিনী, কি এত কসুর করেছি মাইরি? বলো তো শ্বশুর হে! ঐ রাঙামুখে বাবা অন্ন দি তুলি নিজে খাই জোলো মাড়, তবু সেলাম ঠুকিতে মলাম বাবা গো বক্র মাজা ও ঘাড়! কোরাস্:    কে বলে ইত্যাদি— বহে কালাতে ধলাতে গঙ্গা-যমুনা, আমরা তাহারি দিব্যি নমুনা, এ-রীতি পিরীতি বুঝিবে কভু না হে, তাই কালামুখ প্রেমে আলা করি হাঁকি— 'তাড়্‌রে নেটিভ্ তাড়্'! তবে কোপন-স্বভাব দেখিলে অমনি গোপন খাম্বা-আড়! কোরাস্:  কে বলে ইত্যাদি— এবে কাঁপিবে মেদিনী শত উৎপাতে চিৎপটাং সে কত 'ফুট্‌পাথে' হবে আমাদেরি ভীম কোঁৎকাতে হে! তবে পরোয়া কি দাদা? ক্যাঁকড়ার সম নিসপিস নাড়ো দাঁড়, যদি নিশ্চল হাতে পিস্তল কাঁপে তবু গোঁফে দাও চাড়। কোরাস্:   কে বলে ইত্যাদি— বাবা!       যদিও এ-দেহ ঝুনো ঠনঠন তবু লোকে ভাবে ঠুঁটো পল্টন। আরে ঘোড়া নাই? বাস্, পায়ে হন্টন হে! বাজে করতাল—আজ হরতাল। ডাকে আত্মা যে খাঁচা ছাড়্! ওরে 'ওয়ান্ পেস্ স্টেপ্ ফরওয়ার্ড মার্চ, থুড়ি থুড়ি ব্যাক্‌ওয়ার্ড্।'
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
হায় হাবা মেয়ে, সব ভুলে গেলি দয়িতের কাছে এসে! এত অভিমান এত ক্রন্দন সব গেল জলে ভেসে ! কূলে কূলে এত ভুলে ফুলে কাঁদা আছড়ি পিছাড়ি তোর, সব ফুলে গেলি যেই বুকে তোরে টেনে নিল মনোচোর! সিন্ধুর বুকে লুকাইলি মুখ এমনই নিবিড় করে, এমনই করিয়া হারাইলি তুই আপনারে চিরতরে – যে দিকে তাকাই নাই তুই নাই! তোর বন্ধুর বাহু গ্রাসিয়াছে তোরে বুকের পাঁজরে – ক্ষুধাতুর কাল রাহু!বিরহের কূলে অভিমান যার এমন ফেনায়ে উঠে, মিলনের মুখে সে ফিরে এমনই পদতলে পড়ে লুটে? এমনই করিয়া ভাঙিয়া পড়ে কি বুক-ভাঙা কান্নায়, বুকে বুক রেখে নিবিড় বাঁধনে পিষে গুঁড়ো হয়ে যায়? তোর বন্ধুর আঙুলের ছোঁয়া এমনই কি জাদু জানে, আবেশে গলিয়া অধর তুলিয়া ধরিলি অধর পানে! একটি চুমায় মিটে গেল তোর সব সাধ সব তৃষা, ছিন্ন লতার মতন মুরছি পড়িলি হারায়ে দিশা! – একটি চুমার লাগি এতদিন ধরে এত পথ বেয়ে এলি বেয়ে এলি কি রে হতভাগি?গাঙ-চিল আর সাগর-কপোত মাছ ধরিবার ছলে, নিলাজি লো, তোর রঙ্গ দেখিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে। দুধারের চর অবাক হইয়া চেয়ে আছে তোর মুখে, সবার সামনে লুকাইলি মুখ কেমনে বঁধুর বুকে? নীলিম আকাশে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মেঘের গুণ্ঠন ফেলে বউ-ঝির মতো উঁকি দিয়ে দেখে কুতূহলী-আঁখি মেলে।‘সাম্পান’-মাঝি খুঁজে ফেরে তোর ভাটিয়ালি গানে কাঁদি, খুঁজিয়া নাকাল দুধারের খাল – তোর হেরেমের বাঁদি! হায় ভিখারিনি মেয়ে, ভুলিলি সবারে, ভুলিলি আপনা দয়িতেরে বুকে পেয়ে! তোরই মতো নদী আমি নিরবধি কাঁদি রে প্রীতম লাগি, জন্ম-শিখর বাহিয়া চলেছি তাহারই মিলন মাগি! যার তরে কাঁদি – ধার করে তারই জোয়ারের লোনা জল তোর মতো মোর জাগে না রে কভু সাধের কাঁদন-ছল। আমার অশ্রু একাকী আমার, হয়তো গোপনে রাতে কাঁদিয়া ভাসাই, ভেসে ভেসে যাই মিলনের মোহানাতে, আসিয়া সেথায় পুনঃ ফিরে যাই। – তোর মতো সব ভুলে লুটায়ে পড়ি না – চাহে না যে মোরে তারই রাঙ্গা পদমূলে! যারে চাই তারে কেবলই এড়াই কেবলই দি তারে ফাঁকি ; সে যদি ভুলিয়া আঁখি পানে চায় ফিরাইয়া লই আঁখি! –তার তীরে যবে আসি অশ্রু-উৎসে পাষাণ চাপিয়া অকারণে শুধু হাসি! অভিমানে মোর আঁখিজল জমে করকা-বৃষ্টি সম, যারে চাই তারে আঘাত হানিয়া ফিরে যায় নির্মম! একা মোর প্রেম ছুটিবে কেবলই নিচু প্রান্তর বেয়ে, সে কভু ঊর্ধ্বে আসিবে না উঠে আমার পরশ চেয়ে – চাহি না তাহারে! বুকে চাপা থাকা আমার বুকের ব্যথা, যে বুক শূন্য নহে মোরে চাহি – হব নাকো ভার সেথা! সে যদি না ডাকে কী হবে ডুবিয়া ও-গভীর কালো নীরে, সে হউক সুখী, আমি রচে যাই স্মৃতি-তাজ তার তীরে! মোর বেদনার মুখে চাপিয়াছি নিতি যে পাষাণ-ভার! তা দিয়ে রচিব পাষাণ-দেউল সে পাষাণ-দেবতার!কত স্রোতধারা হারাইছে কূল তার জলে নিরবধি, আমি হারালাম বালুচরে তার, গোপন-ফাল্গুনদী!   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল, মোরা বিধাতার মত নির্ভয় মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।। মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন, বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন চিত্তমুক্ত শতদল।। মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর। কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর, মোরা শক্তি অটল মহীধর। হাসি গান শ্যাম উচ্ছল বৃষ্টির জল বনফল খাই- শয্যা শ্যামল বনতল।।