poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
হাস্যরসাত্মক
|
মিচকে-মারা কয় না কথা মনটি বড়ো খুঁতখুঁতে।
‘ছিঁচকাঁদুনে’ ভ্যাবিয়ে ওঠেন একটু ছুঁতেই না ছুঁতে।
ড্যাবরা ছেলে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থেকে গাল ফুলান,
সন্দেশ এবং মিষ্টি খেতে – বাসরে বাস – এক জাম্বুবান!
নিম্নমুখো-যষ্টি ছেলে দশটি ছেলে লুকিয়ে খান,
বদমায়েশির মাসি পিসি, আধখানা চোখ উঁচিয়ে চান!
হাঁদারা হয় হদ্দ বোকার, সব কথাতেই হাঁ করে!
ডেঁপো চতুর আধ-ইশারায় সব বুঝে নেয় ঝাঁ করে!
ভোঁদা খোকার নামটি ভুঁদো বুদ্ধি বেজায় তার ভোঁতা।
সব চেয়ে ভাই ইবলিশ হয় যে ছেলেদের ঘাড় কোঁতা।
পুঁয়ে-লাগা সুঁটকো ছেলে মুখটা সদাই মুচকে রয়!
পেটফুলো তার মস্ত পিলে, হাত-পাগুলোও কুঁচকে রয়!
প্যাঁটরা ছেলের য়্যাব্বড়ো পেট, হাত নুলো আর পা সরু!
চলেন যেন ব্যাংটি হো হো উ-র্ গজ-ঢাক গাল পুরু!
গাবদা ছেলের মনটি সাদা একটুকুতেই হন খুশি,
আদর করে মা তারে তাই নাম দিয়েছেন মনটুসি।
ষাঁড়ের নাদ সে নাদুস নুদুস গোবর-গণেশ যে শ্রীমান,
নাঁদার মতন য়্যাভ ভুঁড়ি তাঁর চলতে গিয়ে হুমড়ি খান!
ছ্যাঁচড় ছেলে বেদড় ভারি ধুমসুনি খায় সব কথায়।
উদমো ছেলে ছটফটে খুব একটুকুতেই উতপুতায়!
ফটকে ছেলে ছটকে বেড়ায় আঁটি তারা বজ্জাতের,
দুষ্টু এবং চুলবুলেরা সবখানে পায় লজ্জা ঢের।
বোঁচা-নাকা খাঁদা যে হয় নাম রেখো তার চামচিকে,
এসব ছেলে তেঁদড় ভারী ডরায় না দাঁত-খামচিকে!
টুনিখুকির মুখটি ছোটো টুনটুনি তার মন সরল,
ময়না-মানিক নাম যার ভাই মনটি তারও খুব তরল!
গাল টেবো যাঁর নাম টেবি তাঁর একটুকুতেই যান রেগে।
কান-খড়কে মায়ের লেঠা, রয় ঘুমুলেও কান জেগে।
খুদে খুকির নামটি টেপু মা-দুলালি আবদেরে।
ডর-পুকুনে আঁতকে ওঠে নাপতে দেখে আঁক করে!
পুঁটুরানি বাপ-সোহাগি, নন্দদুলাল মানিক মা-র,
দাদু বুড়োর ন্যাওটা যে ভাই মটরু ছাগল নামটি তার!
ভুতো ছেলে ঠগ বড়ো হয়, ভয় করে না কাউকে সে,
নাই পরোয়া যতই কেন কিল আর থাপড় দাও ঠেসে।
দস্যি ছেলে ভয় করে না চোখ-রাঙানি ভূত-পেরেত,
সতর-চোখি জুজুর খোঁজে বেড়িয়ে বেড়ায় রাত বিরেত!
ডানপিটেরা ঝুলঝাপপুর গুলি-ডাণ্ডায় মদ্দ খুব!
বাঁদরা-মুখোর ভ্যাংচিয়ে মুখ দাঁত খিঁচে বে-হদ্দ হুব!
বীর বাদল সে – দেশের তরে প্রাণ দিতে ভাই যে শিখে,
আনবে যে সাত-সাগর-পারের বন্দিনী দেশ-লক্ষ্মীকে!
কেউ যদি ভাই হয় তোমজদের এমনিতরো মর্দ ফেরো,
হো হো! তাকে পাঠিয়ে দেব বাচ্চা হোঁদল কুতকুতের! (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
চাঁদ হেরিতেছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে।
ছুটে তরঙ্গ বাসনাভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।
হেরিছে রজনি রজনি জাগিয়া
চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া,
কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া
কুমুদীরে কাঁদাইতে।না জানি সজনি কত সে রজনি কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া,
হেরেছে শশীরে সরসী-মুকুরে ভীরু ছায়াতরু কাঁপিয়া।
কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরনি
চির-বিরহিণী রোহিণী ভরণী,
অবশ আকাশ বিবশা ধরণি
কাঁদানিয়া চাঁদনীতে। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
না ফুরাতে শরতের বিদায়-শেফালি,
না নিবিতে আশ্বিনের কমল-দীপালি,
তুমি শুনেছিলে বন্ধু পাতা-ঝরা গান
ফুলে ফুলে হেমনে-র বিদায়-আহবান!
অতন্দ্র নয়নে তব লেগেছিল চুম
ঝর-ঝর কামিনীর, এল চোখে ঘুম
রাত্রিময়ী রহস্যের; ছিন্ন শতদল
হ’ল তব পথ-সাথী; হিমানী-সজল
ছায়াপথ-বিথী দিয়া শেফালি দলিয়া
এল তব মায়া বধূ ব্যথা-জাগানিয়া!
এল অশ্রু হেমনে-র,এল ফুল-খসা
শিশির-তিমির-রাত্রি; শ্রান- দীর্ঘশ্বাসা
ঝাউ-শাখে সিক্ত বায়ু ছায়া-কুহেলির
অশ্রু-ঘন মায়া-আঁখি, বিরহ-অথির
বুকে তব ব্যথা-কীট পশিল সেদিন!
যে-কান্না এল না চোখে, মর্মে হ’ল লীন,
বক্ষে তাহা নিল বাসা, হ’ল রক্তে রাঙা
আশাহীন ভালবাসা, ভাষা অশ্রু-ভাঙা!
বন্ধু, তব জীবনের কুমারী আশ্বিন
পরিল বিধবা বেশ করে কোন্ দিন,
কোন্ দিন সেঁউতির মালা হ’তে তার
ঝ’রে গেল বৃন-গুলি রাঙা কামনার-
জানি নাই; জানি নাই, তোমার জীবনে
হাসিছে বি”েছদ-রাত্রি, অজানা গহনে
এবে যাত্রা শুরু তব, হে পথ-উদাসী!
কোন্ বনান-র হ’তে ঘর-ছাড়া বাঁশী
ডাক দিল, তুমি জান। মোরা শুধু জানি
তব পায়ে কেঁদেছিল সারা পথখানি!
সেধেছিল, এঁকেছিল ধূলি-তুলি দিয়া
তোমার পদাঙ্ক-স্মৃতি।
রহিয়া রহিয়া
কত কথা মনে পড়ে! আজ তুমি নাই,
মোরা তব পায়ে-চলা পথে শুধু তাই
এসেছি খুঁজিতে সেই তপ্ত পদ-রেখা,
এইখানে আছে তব ইতিহাস লেখা।
জানি না ক’ আজ তুমি কোন্ লোকে রহি’
শুনিছ আমার গান হে কবি বিরহী!
কোথা কোন্ জিজ্ঞাসার অসীম সাহারা,
প্রতীক্ষার চির-রাত্রি, চন্দ্র, সুর্য, তারা,
পারায়ে চলেছ একা অসীম বিরহে?
তব পথ-সাথী যারা-পিছু ডাকি’ কহে,
‘ওগো বন্ধু শেফালির, শিশিরের প্রিয়!
তব যাত্রা-পথে আজ নিও বন্ধু নিও
আমাদের অশ্রু-আর্দ্র এ স্মরণখানি!’
শুনিতে পাও কি তুমি, এ-পারে ও-পারে?
এ কাহার শব্দ শুনি মনের বেতারে?
কতদূরে আছ তুমি কোথা কোন্ বেশে?
লোকান-রে, না সে এই হৃদয়েরি দেশে
পারায়ে নয়ন-সীমা বাঁধিয়াছ বাসা?
হৃদয়ে বসিয়া শোন হৃদয়ের ভাষা?
হারায়নি এত সূর্য এত চন্দ্র তারা,
যেথা হোক আছ বন্ধু, হওনি ক’ হারা!
সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,
সব আছে! নাই শুধু সেই নিতি নিতি
নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে,
আরো প্রিয় ক’রে পাওয়া চির প্রিয়জনে-
আদি নাই, অন- নাই, ক্লানি- তৃপ্তি নাই-
যত পাই তত চাই-আরো আরো চাই,-
সেই নেশা, সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান
সেই কল্পলোকে নব নব অভিযান,-
সব নিয়ে গেছ বন্ধু! সে কল-কল্লোল,
সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত-উতরোল!
আজ সেই প্রাণ-ঠাসা একমুঠো ঘরে
শূন্যের শূন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে!….
হে নবীন, অফুরন- তব প্রাণ-ধারা।
হয়ত এ মরু-পথে হয়নি ক’ হারা,
হয়ত আবার তুমি নব পরিচয়ে
দেবে ধরা; হবে ধন্য তব দান ল’য়ে
কথা-সরস্বতী! তাহা ল’য়ে ব্যথা নয়,
কত বাণী এল, গেল, কত হ’ল লয়,
আবার আসিবে কত। শুধু মনে হয়
তোমারে আমরা চাই, রক্তমাংসময়!
আপনারে ক্ষয় করি’ যে অক্ষয় বাণী
আনিলে আনন্দ-বীর, নিজে বীণাপাণি
পাতি’ কর লবে তাহা, তবু যেন হায়,
হৃদয়ের কোথা কোন্ ব্যথা থেকে যায়!
কোথা যেন শূন্যতার নিঃশব্দ ক্রন্দন
গুমরি’ গুমরি’ ফেরে, হু-হু করে মন!
বাণী তব- তব দান- সে তা সকলের,
ব্যথা সেথা নয় বন্ধু! যে ক্ষতি একের
সেথায় সান-্বনা কোথা? সেথা শানি- নাই,
মোরা হারায়েছি,- বন্ধু, সখা, প্রিয়, ভাই।…
কবির আনন্দ-লোকে নাই দুঃখ-শোক,
সে-লোকে বিরহে যারা তারা সুখী হোক!
তুমি শিল্পী তুমি কবি দেখিয়াছে তারা,
তারা পান করে নাই তব প্রাণ-ধারা!
‘ পথিকে’ দেখেছে তা’রা, দেখেনি ‘গোকুলে’,
ডুবেনি ক’-সুখী তা রা-আজো তা’রা কূলে!
আজো মোরা প্রাণা”ছন্ন, আমরা জানি না
গোকুল সে শিল্পী গল্পী কবি ছিল কি-না!
আত্মীয়ে স্মরিয়া কাঁদি, কাঁদি প্রিয় তরে
গোকুলে পড়েছে মনে-তাই অশ্রু ঝরে!
না ফুরাতে আশা ভাষা, না মিটিতে ক্ষুধা,
না ফুরাতে ধরণীর মৃৎ-পাত্র-সুধা,
না পূরিতে জীবনের সকল আস্বাদ-
মধ্যাহ্নে আসিল দূত! যত তৃষ্ণা সাধ
কাঁদিল আঁকড়ি’ ধরা, যেতে নাহি চায়!
ছেড়ে যেতে যেন সব স্নায়ু ছিঁড়ে যায়!
ধরার নাড়ীতে পড়ে টান! তরুলতা
জল বায়ু মাটি সব কয় যেন কথা!
যেয়ো না ক’ যেয়ো না ক’ যেন সব বলে-
তাই এত আকর্ষণ এই জলে স’লে
অনুভব করেছিলে প্রকৃতি-দুলাল!
ছেড়ে যেতে ছিঁড়ে গেল বক্ষ, লালে লাল
হ’ল ছিন্ন প্রাণ! বন্ধু, সেই রক্ত ব্যথা
র’য়ে গেল আমাদের বুকে চেপে হেথা!
হে তরুণ, হে অরুণ, হে শিল্পী সুন্দর,
মধ্যাহ্ন আসিয়াছিলে সুমেরু-শিখর
কৈলাসের কাছাকাছি দারুণ তৃষ্ণায়,
পেলে দেখা সুন্দরের, স্বরগ-গঙ্গায়
হয়ত মিটেছে তৃষ্ণা, হয়ত আবার
ক্ষুধাতুর!-স্রোতে ভেসে এসেছে এ-পার
অথবা হয়ত আজ হে ব্যথা-সাধক,
অশ্রু-সরস্বতী কর্ণে তুমি কুরুবক!
হে পথিক-বন্ধু মোর, হে প্রিয় আমার,
যেখানে যে লোকে থাক/ করিও স্বীকার
অশ্রু-রেবা-কূলে মোর স্মৃতি-তর্পণ,
তোমারে অঞ্জলি করি’ করিনু অর্পণ!
সুন্দরের তপস্যায় ধ্যানে আত্মহারা
দারিদ্র্যে দর্প তেজ নিয়া এল যারা,
যারা চির-সর্বহারা করি’ আত্মদান,
যাহারা সৃজন করে, করে না নির্মাণ,
সেই বাণীপুত্রদের আড়ম্বরহীন
এ-সহজ আয়োজন এ-স্মরণ-দিন
স্বীকার করিও কবি, যেমন স্বীকার
ক’রেছিলে তাহাদের জীবনে তোমার!
নহে এরা অভিনেতা, দেশ-নেতা নহে,
এদের সৃজন-কুঞ্জ অভাবে, বিরহে,
ইহাদের বিত্ত নাই, পুঁজি চিত্তদল,
নাই বড় আয়োজন,নাই কোলাহল;
আছে অশ্রু, আছে প্রীতি, আছে বক্ষ-ক্ষত,
তাই নিয়ে সুখী হও, বন্ধু স্বর্গগত!
গড়ে যারা, যারা করে প্রাসাদ নির্মাণ
শিরোপা তাদের তরে, তাদের সম্মান।
দু’দিনে ওদের গড়া প’ড়ে ভেঙে যায়
কিন’ স্রষ্টা সম যারা গোপনে কোথায়
সৃজন করিছে জাতি, সৃজিছে মানুষ
অচেনা রহিল তা’রা। কথার ফানুস
ফাঁপাইয়া যারা যত করে বাহাদুরী,
তারা তত পাবে মালা যমের কস’রী!
‘আজ’টাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা?
ইতিহাস আছে, আছে অবিষ্যৎ, যাহা
অনন- কালের তরে রচে সিংহাসন,
সেখানে বসাবে তোমা বিশ্বজনগণ।
আজ তারা নয় বন্ধু, হবে সে তখন,-
পূজা নয়-আজ শুধু করিনু স্মরণ।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
বন্ধুগণ, আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন,
আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রান আজ বীণার মত বেজে উঠেছে।
তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠছে- “আমি ধন্য হলুম”, “আমি ধন্য হলুম”।
আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে।
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি।
কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার ধর্ম।
তবু বলছি, আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে,
গোরস্তানের পথে তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মুর্তিতে ব্যাথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। কারাগারের অন্ধকূপে তাঁকে দেখেছি।
ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি।আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ।
এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই।
আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে।
ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কোনটাই নয়।
আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।
সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না।
কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে চুরি । হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ।
মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে।
এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।
আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান- বেদনার গান গেয়ে যাব আমি।
দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ’।“
জীবনে সেই ট্র্যাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি।
কিন্তু, আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত দগ্ধ। মেঘের উর্ধ্বে শূণ্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।
আমার বেশ মনে পড়ছে। একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে।
আমার মন তীব্র পুত্র শোকে যখন ভেঙে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময় আমার বাড়িতে হাস্নাহেনা ফুটেছে।
আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য, আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে।
যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূণ্য থাকে অসময়ে নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না, আমি সেই নজরুল।
সেই নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কী দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পুর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ
এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে,
আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসি নি।
আমি নেতা হতে আসি নি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নিরব
অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে! দেশপ্রেমী,ত্যাগী,বীর,বিদ্রোহী-
বিশেষনের পর বিশেষন,টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে,বক্তার পর বক্তা! এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু, তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে
আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ কোরো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বোলো -
‘বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি’।তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল, নিশ্চুপ;
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
এসো বিদ্রোহী মিথ্যা-সূদন আত্মশক্তি বুদ্ধ বীর!
আনো উলঙ্গ সত্যকৃপাণ, বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির।তূরীয়ানন্দে ঘোষো সে আজ
‘আমি আছি’– বাণী বিশ্ব-মাঝ,
পুরুষ-রাজ!
সেই স্বরাজ!জাগ্রত করো নারায়ণ-নর নিদ্রিত বুকে মর-বাসীর;
আত্ম-ভীতু এ অচেতন-চিতে জাগো ‘আমি-স্বামী নাঙ্গা-শির’…এসো প্রবুদ্ধ, এসো মহান
শিশু-ভগবান জ্যোতিষ্মান।
আত্মজ্ঞান-
দৃপ্ত-প্রাণ!জানাও জানাও, ক্ষুদ্রেরও মাঝে রাজিছে রুদ্র তেজ রবির !!
উদয়-তোরণে উড়ুক আত্ম-চেতন-কেতন ‘আমি-আছি’-রকরহ শক্তি-সুপ্ত-মন
রুদ্র বেদনে উদ্বোধন,
হীন রোদন –
খিন্ন-জনদেখুক আত্মা-সবিতার তেজ বক্ষে বিপুলা ক্রন্দসীর!
বলো, নাস্তিক হউক আপন মহিমা নেহারি শুদ্ধ ধীর!কে করে কাহারে নির্যাতন
আত্ম-চেতন স্থির যখন?
ঈর্ষা-রণ
ভীম-মাতন
পদাঘাত হানে পঞ্জরে শুধু আত্ম-বল-অবিশ্বাসীর,
মহাপাপী সেই, সত্য যাহার পর-পদানত আনত শির।জাগাও আদিম স্বাধীন প্রাণ,
আত্মা জাগিলে বিধাতা চান।
কে ভগবান? –
আত্ম-জ্ঞান!গাহে উদ্গাতা ঋত্বিক গান অগ্নি-মন্ত্র শক্তি-শ্রীর।
না জাগিলে প্রাণে সত্য চেতনা, মানি না আদেশ কারও বাণীর !এসো বিদ্রোহী তরুণ তাপস আত্মশক্তিবুদ্ধ বীর,
আনো উলঙ্গ সত্য-কৃপাণ বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
উম্মত আমি গুনাহগার
(সুন্ধু ভৈরবী- কার্ফা)উম্মত আমি গুনাহগার
তবু ভয় নাহি রে আমার
আহমদ আমার নবী
যিনি খোদ হাবিব খোদার।।যাঁহার উম্মত হতে চাহে সকল নবী,
তাহারি দামন ধরি' পুলসিরাত হব পার।।কাঁদিবে রোজ হাশরে সবে
যবে নাফসি ইয়া নাফসি রবে,
ইয়া উম্মতী বলে একা কাঁদিবেন আমার মোখতার।।কাঁদিবেন সাথে মা ফাতিমা ধরিয়া আরশ আল্লার
হোসায়েনের খুনের বদলায় মাফী চাই পাপী সবাকার।।দোযখ হয়েছে হারাম যে দিন পড়েছি কালেমা,
যেদিন হয়েছি আমি কোরানের নিশান- বর্দার।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
হায় চির-ভোলা! হিমালয় হতে
অমৃত আনিতে গিয়া
ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের
মৃত্যু-গরল পিয়া!
কেন এত ভালো বেসেছিলে তুমি
এই ধরণির ধূলি?
দেবতারা তাই দামামা বাজায়ে
স্বর্গে লইল তুলি!
হুগলি
৩রা আষাঢ়, ১৩৩২
(চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়,
নেই কি রে কেউ সত্যসাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?
শিকলগুলো বিকল করে পায়ের তলায় মাড়ায়, –
বজ্র-হাতে জিন্দানের ওই ভিত্তিটাকে নাড়ায়?
নাজাত -পথের আজাদ মানব নেই কি রে কেউ বাঁচা,
ভাঙতে পারে ত্রিশ কোটি এই মানুষ-মেষের খাঁচা?
ঝুটার পায়ে শির লুটাবে, এতই ভীরু সাঁচা? –
ফন্দি-কারায় কাঁদছিল হায় বন্দি যত ছেলে,
এমন দিনে ব্যথায় করুণ অরুণ আঁখি মেলে,
পাবক-শিখা হস্তে ধরি কে তুমি ভাই এলে?
‘সেবক আমি’ – হাঁকল তরুণ কারার দুয়ার ঠেলে।
দিন-দুনিয়ায় আজ খুনিয়ার রোজ-হাশরের মেলা,
করছে অসুর হক-কে না-হক, হক-তায়ালায় হেলা!
রক্ষ-সেনার লক্ষ আঘাত বক্ষে বড়োই বেঁধে,
রক্ষা করো, রক্ষা করো, উঠতেছে দেশ কেঁদে।
নেই কি রে কেউ মুক্তি-সেবক শহিদ হবে মরে,
চরণ-তলে দলবে মরণ ভয়কে হরণ করে,
ওরে জয়কে বরণ করে –
নেই কি এমন সত্য-পুরুষ মাতৃ-সেবক ওরে?
কাঁপল সে স্বর মৃত্যু-কাতর আকাশ-বাতাস ছিঁড়ে,
বাজ পড়েছে, বাজ পড়েছে ভারতমাতার নীড়ে!
দানব দলে শাস্তি আনে নাই কি এমন ছেলে?
একী দেখি গান গেয়ে ওই অরুণ আঁখি মেলে
পাবক-শিখা হস্তে ধরে কে বাছা মোর এলে?
‘মা গো আমি সেবক তোমার! জয় হোক মা-র।’
হাঁকল তরুণ কারার-দুয়ার ঠেলে!
বিশ্বগ্রাসীর ত্রাস নাশি আজ আসবে কে বীর এসো
ঝুট শাসনে করতে শাসন, শ্বাস যদি হয় শেষও।
– কে আজ বীর এসো।
‘বন্দি থাকা হীন অপমান!’ হাঁকবে যে বীর তরুণ, –
শির-দাঁড়া যার শক্ত তাজা, রক্ত যাহার অরুণ,
সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের,
খোদার রাহায় জান দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের।
দেশের পায়ে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের,
সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের।
হঠাৎ দেখি আসছে বিশাল মশাল হাতে ও কে?
‘জয় সত্যম্’ মন্ত্র-শিখা জ্বলছে উজল চোখে।
রাত্রি-শেষে এমন বেশে কে তুমি ভাই এলে?
‘সেবক তোদের, ভাইরা আমার! – জয় হোক মা-র!’
হাঁকল তরুণ কারার দুয়ার ঠেলে!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
শোকমূলক
|
কাব্য-গীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্ঠা, দ্রষ্ঠা, ঋষি ও ধ্যানী
মহাকবি রবি অস্ত গিয়াছে! বীণা, বেণুকা ও বাণী
নীরব হইল। ধুলির ধরণী জানিনা সে কত দিন
রস- যমুনার পরশ পাবেনা। প্রকৃতি বাণীহীন
মৌন বিষাদে কাঁদিবে ভুবনে ভবনে ও বনে একা;
রেখায় রেখায় রুপ দিবে আর কাহার ছন্দ লেখা?
অপ্রাকৃত মদনে মাধবী চাঁদের জ্যোৎস্না দিয়া
রূপায়িত রসায়িত করিবে কে লেখনী, তুলিকা নিয়া?ব্যাস, বাল্মীকি,কালিদাস, খৈয়াম, হাফিজ ও রুমী
আরবের ইমরুল কায়েস যে ছিলে এক সাথে তুমি!
সকল দেশের সক্ল কালের সকল কবিরে ভাঙ্গি'
তাঁহাদের রুপে রসে রাঙ্গাইয়া, বুঝি কত যুগ জাগি'
তোমারে রচিল রসিক বিধাতা, অপরুপ সে বিলাস,
তব রুপে গুনে ছিল যে পরম সুন্দরের আভাস। এক সে রবির আলোকে তিমির- ভীত এ ভারপ্তবাসী
ভেলেছিল প্রাধীনতা- পিড়ন দুঃখ- দৈন্যরাশি।
যেন উর্ধ্বের বরাভয় তুমি আল্লাহর রহমত,
নিত্য দিয়াছ মৃত এ জাতিরে অমৃত শরবত,
সকল দেশের সব জাতির সকল লোকের তুমি
অর্ঘ্য আনিয়া ধন্য করিলে ভারত- বঙ্গভুমি।।তোমার মরুতে তোমার আলোকে ছায়া- তরু ফুল-লতা
জমিয়া চির স্নিগ্ধ করিয়া রেখেছিল শত ব্যথা।
অন্তরে আর পাইনা যে আলো মানস-গগন-কবি,
বাহিরের রবি হেরিয়া জাগে যে অন্তরে তব ছবি।
গোলাব ঝরেছে, গোলাবি আতর কাঁদিয়া ফিরিছে হায়।
আতরে কাতর করে আরো প্রান, ফুলেরে দেখিতে চায়।ফুলের, পাখির, চাঁদ-সুরুজের নাহি ক' যেমন জাতি,
সকলে তাদেরে ভালোবাসে, ছিল তেমনি তোমার খ্যাতি।
রস-লোক হতে রস দেয় যারা বৃষ্টিধারার প্রায়
তাদের নাহি ক' ধর্ম ও জাতি, সকলে ঘরে যায়
অবারিত দ্বার রস- শিল্পীর, হেরেমেও অনায়াসে
যায় তার সুর কবিতা ও ছবি আনন্দে অবকাশে।ছিল যে তোমার অবারিত দ্বার সকল জাতির গেহে,
তোমারে ভাবিত আকাশের চাঁদ, চাহিত গভীর স্নেহে।
ফুল হারাইয়া আঁচলে রুমালে তোমার সুরভি মাখে
বক্ষে নয়নে বুলায়ে আতর, কেঁদে ঝরাফুল ডাকে।আপন জীবন নিঙ্গাড়ি' যেজন তৃষাতুর জনগণে
দেয় প্রেম রস, অভয় শক্তি বসি' দূর নির্জনে,
মানুষ তাহারি তরে কাঁদে, কাঁদে তারি তরে আল্লাহ,
বেহেশত হতে ফেরেশ্তা কহে তাহারেই বাদশাহ।শত রুপে রঙ্গে লীলা- নিকেতন আল্লার দুনিয়াকে
রাঙ্গায় যাহারা, আল্লার কৃপা সদা তাঁরে ঘিরে থাকে।
তুমি যেন সেই খোদার রহম, এসেছিল রুপ ধরে,
আর্শের ছায়া দেখাইয়া ছিলে রুপের আর্শি ভরে।কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও
উর্দ্ধে থাকি' এ পাষান জাতিরে রসে গলাইয়া দাও।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
চম্কে চম্কে ধীর ভীরু পায়
পল্লী-বালিকা বন-পথে যায়
একেলা বন-পথে যায়।সাড়ি তার কাঁটা-লতায়
জড়িয়ে জড়িয়ে যায়
পাগল হাওয়াতে অঞ্চল লয়ে মাতে
যেন তার তনুর পরশ চায়।
একেলা বনপথে যায়।শিরীষের পাতায় নূপুর
বাজে তার ঝুমুর ঝুমুর
কুসুম ঝরিয়া মরিতে
চাহে তার কবরীতে,
পাখী গায় পাতার ঝরোকায়।
একেলা বনপথে যায়।চাহি তার নীল নয়নে
হরিণী লুকায় বনে,
হাতে তার কাঁকন হতে
মাধবী লতা কাঁদে
ভ্রমরা কুন্তলে লুকায়।
একেলা বনপথে যায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
পরান ভরে পিয়ে শরাব,
জীবন যাহা চিরকালের।
মৃত্যু-জরা-ভরা জগৎ
ফিরে কেহ আসবেনা ফের।
ফুলের বাহার, গোলাব- কপোল,
গেলাস- সাথী মস্ত-ইয়ার,
এক লহমার খুশির তুফান,
এইতো জীবন!- ভাবনা কিসের!!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
যাও যাও তুমি ফিরে, এই মুছিনু আঁখি
কে বাঁধিবে তোমারে, হায় বনের পাখি।মোর এত প্রেম আশা, মোর এত ভালোবাসা
আজ সকলি দুরাশা, আর কি দিয়ে রাখি।এই অভিমান জ্বালা, মোর একেলারি কালা
প্রান মিলনেরি মালা, দাও ধুলাতে ঢাকি।তোমার বেঁধেছিল নয়ন শুধু এ রূপের জালে
তাই দু দিন কাঁদিয়া হায় সে বাঁধন ছাড়ালে।মোর বাঁধিয়াছে হিয়া, তায় ছাড়াব কি দিয়া
সখা হিয়া ত নয়ন নহে
সে ছাড়ে না কাঁদিয়া, দু দিন কাঁদিয়া।আজ যে ফুল প্রভাতে হায় ফুটিল শাখাতে
তায় দেখিল না রাতে, সে ঝরিল নাকি।হায় রে কবি প্রবাসী, নাই হেথা সুখ হাসি
ফুল ঝরে হলে বাসি, রয় কাঁটার ফাঁকি।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
সখি! নতুন ঘরে গিয়ে আমায় প’ড়বে কি আর মনে?
সেথা তোমার নতুন পূজা নতুন আয়োজনে!
প্রথম দেখা তোমায় আমায়
যে গৃহ-ছায় যে আঙিনায়,
যেথায় প্রতি ধূলিকণায়,
লতাপাতার সনে
নিত্য চেনার বিত্ত রাজে চিত্ত-আরাধনে,
শূন্য সে ঘর শূন্য এখন কাঁদছে নিরজনে।।সেথা তুমি যখন ভুল্তে আমায়, আস্ত অনেক কেহ,
তখন আমার হ’য়ে অভিমানে কাঁদত যে ঐ গেহ।
যেদিক পানে চাইতে সেথা
বাজ্তে আমার স্মৃতির ব্যথা,
সে গ্লানি আজ ভুলবে হেথা
নতুন আলাপনে।
আমিই শুধু হারিয়ে গেলেম হারিয়ে-যাওয়ার বনে।।আমার এত দিনের দূর ছিল না সত্যিকারের দুর,
ওগো আমার সুদুর ক’রত নিকট ঐ পুরাতন পুর।
এখন তোমার নতুন বাঁধন
নতুন হাসি, নতুন কাঁদন,
নতুন সাধন, গানের মাতন
নতুন আবাহনে।
আমারই সুর হারিয়ে গেল সুদুর পুরাতন।।সখি! আমার আশাই দুরাশা আজ, তোমার বিধির বর,
আজ মোর সমাধির বুকে তোমার উঠবে বাসর-ঘর!
শূণ্য ভ’রে শুনতে পেনু
ধেনু-চরা বনের বেণু-
হারিয়ে গেনু হারিয়ে গেনু
অন–দিগঙ্গনে।
বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে!
এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
সাম্যের গান গাই!-
যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।
এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনি করেনিক’ কে আছে পুরুষ-নারী?
আমরা ত ছার; পাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারী!
তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ সে টলমল,
দেবতার পাপ-পথ দিয়া পশে স্বর্গে অসুর দল!
আদম হইতে শুরু ক’রে এই নজরুল তক্ সবে
কম-বেশী ক’রে পাপের ছুরিতে পুণ্য করেছে জবেহ্ !
বিশ্ব পাপস্থান
অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান্!
থর্মান্ধরা শোনো,
অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো!
পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেথা পাপ!
সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ।
এদের এড়াতে না পারিয়া যত অবতার আদি কেহ
পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ।
বন্ধু, কহিনি মিছে,
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব হ’তে ধ’রে ক্রমে নেমে এস নীচে-
মানুষের কথা ছেড়ে দাও, যত ধ্যানী মুনি ঋষি যোগী
আত্মা তাঁদের ত্যাগী তপস্বী, দেহ তাঁহাদের ভোগী!
এ-দুনিয়া পাপশালা,
ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূণ্য-ছালা!
হেথা সবে সম পাপী,
আপন পাপের বাট্খারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি!
জবাবদিহির কেন এত ঘটা যদি দেবতাই হও,
টুপি প’রে টিকি রেখে সদা বল যেন তুমি পাপী নও।
পাপী নও যদি কেন এ ভড়ং, ট্রেডমার্কার ধুম?
পুলিশী পোশাক পরিয়া হ’য়েছ পাপের আসামী গুম।
বন্ধু, একটা মজার গল্প শোনো,
একদা অপাপ ফেরেশতা সব স্বর্গ-সভায় কোনো
এই আলোচনা করিতে আছিল বিধির নিয়মে দুষি,’
দিন রাত নাই এত পূজা করি, এত ক’রে তাঁরে তুষি,
তবু তিনি যেন খুশি নন্-তাঁর যত স্নেহ দয়া ঝরে
পাপ-আসক্ত কাদা ও মাটির মানুষ জাতির’ পরে!
শুনিলেন সব অন্তর্যামী, হাসিয়া সবারে ক’ন,-
মলিন ধুলার সন-ান ওরা বড় দুর্বল মন,
ফুলে ফুলে সেথা ভুলের বেদনা-নয়নে , অধরে শাপ,
চন্দনে সেথা কামনার জ্বালা, চাঁদে চুম্বন-তাপ!
সেথা কামিনীর নয়নে কাজল, শ্রেনীতে চন্দ্রহার,
চরণে লাক্ষা, ঠোটে তাম্বুল, দেখে ম’রে আছে মার!
প্রহরী সেখানে চোখা চোখ নিয়ে সুন্দর শয়তান,
বুকে বুকে সেথা বাঁকা ফুল-ধনু, চোখে চোখে ফুল-বাণ।
দেবদুত সব বলে, ‘প্রভু, মোরা দেখিব কেমন ধরা,
কেমনে সেখানে ফুল ফোটে যার শিয়রে মৃত্যু-জরা!’
কহিলেন বিভু-‘তোমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ যে দুইজন
যাক্ পৃথিবীতে, দেখুক কি ঘোর ধরণীর প্রলোভন!’
‘হারুত’ ‘মারুত’ ফেরেশতাদের গৌরব রবি-শশী
ধরার ধুলার অংশী হইল মানবের গৃহে পশি’।
কায়ায় কায়ায় মায়া বুলে হেথা ছায়ায় ছায়ায় ফাঁদ,
কমল-দীঘিতে সাতশ’ হয়েছে এই আকাশের চাঁদ!
শব্দ গন্ধ বর্ণ হেথায় পেতেছে অরূপ-ফাঁসী,
ঘাটে ঘাটে হেথা ঘট-ভরা হাসি, মাঠে মাঠে কাঁদে বাঁশী!
দুদিনে আতশী ফেরেশতা প্রাণ- ভিজিল মাটির রসে,
শফরী-চোখের চটুল চাতুরী বুকে দাগ কেটে বসে।
ঘাঘরী ঝলকি’ গাগরী ছলকি’ নাগরী ‘জোহরা’ যায়-
স্বর্গের দূত মজিল সে-রূপে, বিকাইল রাঙা পা’য়!
অধর-আনার-রসে ডুবে গেল দোজখের নার-ভীতি,
মাটির সোরাহী মস-ানা হ’ল আঙ্গুরী খুনে তিতি’!
কোথা ভেসে গেল-সংযম-বাঁধ, বারণের বেড়া টুটে,
প্রাণ ভ’রে পিয়ে মাটির মদিরা ওষ্ঠ-পুষ্প-পুটে।
বেহেশ্তে সব ফেরেশ্তাদের বিধাতা কহেন হাসি’-
‘ হার”ত মার”তে কি ক’রেছে দেখ ধরণী সর্বনাশী!’
নয়না এখানে যাদু জানে সখা এক আঁখি-ইশারায়
লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায়।
সুন্দরী বসুমতী
চিরযৌবনা, দেবতা ইহার শিব নয়-কাম রতি!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
বঁধু, মিটিলনা সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়
তাই আবার বাসিতে ভালো আসিব ধরায়।আবার বিরহে তব কাঁদিব
আবার প্রণয় ডোরে বাঁধিব
শুধু নিমেষেরি তরে আঁখি দুটি ভ’রে
তোমারে হেরিয়া ঝ’রে যাব অবেলায়।যে গোধূলি-লগ্নে নববধূ হয় নারী
সেই গোধূলি-লগ্নে বঁধু দিল আমারে গেরুয়া শাড়িবঁধু আমার বিরহ তব গানে
সুর হয়ে কাঁদে প্রাণে প্রাণে
আমি নিজে নাহি ধরা দিয়ে
সকলের প্রেম নিয়ে দিনু তব পায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
ভুলি নাই পুনঃ তাই আসিয়াছি ফিরে
ওগো বন্ধু, ওগো প্রিয়, তব সেই তীরে!
কূল-হারা কূলে তব নিমেষের লাগি
খেলিতে আসিয়া হায় যে কবি বিবাগি
সকলই হারায়ে গেল তব বালুচরে, –
ঝিনুক কুড়াতে এসে – গেল আঁখি ভরে
তব লোনা জল লয়ে, –তব স্রোত-টানে
ভাসিয়া যে গেল দূর নিরুদ্দেশে পানে!
ফিরে সে এসেছে আজ বহু বর্ষ পরে,
চিনিতে পার কি বন্ধু, মনে তারে পড়ে?বর্ষার জোয়ারে যারে তব হিন্দোলায়
দোলাইয়া ফেলে দিলে দুরাশা-সীমায়,
ফিরিয়া সে আসিয়াছে তব ভাটি-মুখে,
টানিয়া লবে কি আজ তারে তব বুকে?খেলিতে আসিনি বন্ধু, এসেছি এবার
দেখিতে তোমার রূপ বিরহ-বিথার।
সেবার আসিয়াছিনু হয়ে কুতূহলী,
বলিতে আসিয়া – দিনু আপনারে বলিকৃপণের সম আজ আসিয়াছি ফিরে
হারায়েছি মণি যথা সেই সিন্ধু-তীরে!
ফেরে না তা যা হারায় – মণি-হারা ফণী
তবু ফিরে ফিরে আসে! বন্ধু গো, তেমনি
হয়তো এসেছি বৃথা চোর বালুচরে!–
যে চিতা জ্বলিয়া, –যায় নিভে চিরতরে,
পোড়া মানুষের মন সে মহাশ্মাশানে
তবু ঘুরে মরে কেন, –কেন সে কে জানে!
প্রভাতে ঢাকিয়া আসি কবরের তলে
তারি লাগি আধ-রাতে অভিসারে চলে
অবুঝ মানুষ, হায়! – ওগো উদাসীন,
সে বেদনা বুঝবে না তুমি কোনোদিন!হয়তো হারানো মণি ফিরে তারা পায়,
কিন্তু হায়, যে অভাগা হৃদয় হারায়
হারায়ে সে চিরতরে! এ জনমে তার
দিশা নাহি মিলে, বন্ধু! – তুমি পারাবার,
পারাপার নাহি তব, তোমার অতলে
যা ডোবে তা চিরতরে ডোবে আঁখিজলে!
জানিলে সাঁতার, বন্ধু, হইলে ডুবুরি,
করিতাম কবে তব বক্ষ হতে চুরি
রত্নহার! কিন্তু হায় জিনে শুধু মালা
কী হইবে বাড়াইয়া হৃদয়ের জ্বালা!
বন্ধু, তব রত্নহার মোর তরে নয় –
মালার সহিত যদি না মেলে হৃদয়!হে উদাসী বন্ধু মোর, চির আত্মভোলা,
আজি নাই বুকে তব বর্ষার হিন্দোলা!
শীতের কুহেলি-ঢাকা বিষণ্ণ বয়ানে
কীসের করুণা মাখা! কূলের সিথানে
এলায়ে শিথিল দেহ আছ একা শুয়ে,
বিশীর্ণ কপোল বালু-উপাধানে থুয়ে!
তোমার কলঙ্কী বঁধু চাঁদ ডুবে যায়
তেমনই উঠিয়া দূর গগন-সীমায়,
ছায়া এসে পড়ে তার তোমার মুকুরে,
কায়াহীন মায়াবীর মায়া বুকে পূরে
ফুলে ফুলে কূলে কূলে কাঁদ অভিমানে,
আছাড়ি তরঙ্গ-বাহু ব্যর্থ শূন্য পানে!
যে কলঙ্কী নিশিদিন ধায় শূন্য পথে –
সে দেখে না, কোথা, কোন বাতায়ন হতে,
কে তারে চাহিয়াছে নিতি! সে খুঁজে বেড়ায়
বুকের প্রিয়ারে ত্যজি পথের প্রিয়ায়!ভয় নাই বন্ধু ওগো, আসিনি জানিতে
অন্ত তব, পেতে ঠাঁই অন্তহীন চিতে!
চাঁদ না সে চিতা জ্বলে তব উপকূলে –
কে কবে ডুবিয়া হায়, পাইয়াছে তল?
এক ভাগ থল সেথা, তিন ভাগ জল!এসেছি দেখিতে তারে সেদিন বর্ষায়
খেলিতে দেখেছি যারে উদ্দাম লীলায়
বিচিত্র তরঙ্গ-ভঙ্গে! সেদিন শ্রাবণে
ছলছল জল-চুড়ি-বলয়-কঙ্কণে
শুনিয়াছি যে-সঙ্গীত, যার তালে তালে
নেচেছে বিজলি মেঘে, শিখী নীপ-ডালে।
যার লোভে অতি দূর অস্তদেশ হতে
ছুটে এসেছিনু এই উদয়ের পথে! –ওগো মোর লীলা-সাথি অতীত বর্ষার,
আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার!
চলে গেছে আজি সেই বরষার মেঘ,
আকাশের চোখে নাই অশ্রুর উদ্বেগ,
গরজে না গুর গুর গগনে সে বাজ,
উড়ে গেছে দূর বনে ময়ূরীরা আজ,
রোয়ে রোয়ে বহে নাকো পুবালি বাতাস,
শ্বসে না ঝাউয়ের শাখে সেই দীর্ঘশ্বাস,
নাই সেই চেয়ে-থাকা বাতায়ন খুলি
সেই পথে – মেঘ যথা যায় পথ ভুলি।
না মানিয়া কাজলের ছলনা নিষেধ
চোখ ছেপে জল ঝরা, –কপোলের স্বেদ
মুছিবার ছলে আঁখি-জল মোছা সেই,
নেই বন্ধু, আজি তার স্মৃতিও সে নেই!থর থর কাঁপে আজ শীতের বাতাস,
সেদিন আশার ছিল যে দীরঘ-শ্বাস –
আজ তাহা নিরাশায় কেঁদে বলে, হায় –
“ওরে মূঢ়, যে চায় সে চিরতরে যায়!
যাহারে রাখিবি তুই অন্তরের তলে
সে যদি হারায় কভু সাগরের জলে
কে তাহারে ফিরে পায়? নাই, ওরে নাই,
অকূলের কূলে তারে খুঁজিস বৃথাই!
যে-ফুল ফোটেনি ওরে তোর উপবনে
পুবালি হাওয়ার শ্বাসে বরষা-কাঁদনে,
সে ফুল ফুটিবে না রে আজ শীত-রাতে
দু ফোঁটা শিশির আর অশ্রুজল-পাতে!”আমার সান্ত্বনা নাই জানি বন্ধু জানি,
শুনিতে এসেছি তবু – যদি কানাকানি
হয় তব কূলে কূলে আমার সে ডাক!এ কূলে বিরহ-রাতে কাঁদে চক্রবাক,
ও কূলে শোনে কি তাহা চক্রবাকী তার?
এ বিরহ একি শুধু বিরহ একার?কুহেলি-গুণ্ঠন টানি শীতের নিশীথে
ঘুমাও একাকী যবে, নিশব্দ সংগীতে
ভরে ওঠে দশ দিক, সে নিশীথে জাগি
ব্যথিয়া ওঠে না বুক কভু কাও লাগি?
গুণ্ঠন খুলিয়া কভু সেই আধরাতে
ফিরিয়া চাহ না তব কূলে কল্পনাতে?
চাঁদ সে তো আকাশের, এই ধরা-কূলে
যে চাহে তোমায় তারে চাহ না কি ভুলে?তব তীরে অগস্ত্যের সম লয়ে তৃষা
বসে আছি, চলে যায় কত দিবা-নিশা!
যাহারে করিতে পারি চুমুকেতে পান
তার পদতলে বসি গাহি শুধু গান!
জানি বন্ধু, এ ধরার মৃৎপাত্রখানি
ভরিতে নারিল যাহা – তারে আমি আনি
ধরিব না এ অধরে! এ মম হিয়ার
বিপুল শূন্যতা তাহে নহে ভরিবার!
আসিয়াছি কূলে আজ, কাল প্রাতে ঝুরে
কূল ছাড়ি চলে যাব দূরে বহুদূরে।বলো বন্ধু, বলো, জয় বেদনার জয়!
যে-বিরহে কূলে কূলে নাহি পরিচয়,
কেবলই অনন্ত জল অনন্ত বিচ্ছেদ,
হৃদয় কেবলই হানে হৃদয়ে নিষেধ ;
যে-বিরহে গ্রহ-তারা শূন্যে নিশিদিন
ঘুরে মরে ; গৃহবাসী হয়ে উদাসীন –
উল্কা-সম ছুটে যায় অসীমের পথে,
ছোটে নদী দিশাহারা গিরিচূড়া হতে ;
বারে বারে ফোটে ফুল কণ্টক-শাখায়,
বারে বারে ছিঁড়ে যায় তবু না ফুরায়
মালা-গাঁথা যে-বিরহে, যে-বিরহে জাগে
চকোরী আকাশে আর কুমুদী তড়াগে ;
তব বুকে লাগে নিতি জোয়ারের টান,
যে-বিষ পিইয়া কণ্ঠে ফুটে ওঠে গান –
বন্ধু, তার জয় হোক! এই দুঃখ চাহি
হয়তো আসিব পুনঃ তব কূল বাহি।
হেরিব নতুন রূপে তোমারে আবার,
গাহিব নতুন গান। নব অশ্রুহার
গাঁথিব গোপনে বসি। নয়নের ঝারি
বোঝাই করিয়া দিব তব তীরে ডারি।
হয়তো বসন্তে পুনঃ তব তীরে তীরে
ফুটিবে মঞ্জরি নব শুষ্ক তরু-শিরে।
আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি,
আসিবে নতুন পাখি শুনাইতে গীতি,যেদিন ও বুকে তব শুকাইবে জল,
নিদারুণ রৌদ্র-দাহে ধুধু মরুতল
পুড়িবে একাকী তুমি মরূদ্যান হয়ে
আসবি সেদিন বন্ধু, মম প্রেম লয়ে!
আঁখির দিগন্তে মোর কুহেলি ঘনায়,
বিদায়ের বংশী বাজে, বন্ধু গো বিদায়! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রকৃতিমূলক
|
বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজই দোল।
আজো তা’র ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি, তন্দ্রাতে বিলোল। আজো হায় রিক্ত শাখায় উত্তরী বায় ঝুরছে নিশিদিন,
আসেনি, যখন’ হাওয়া গজল গাওয়া, মৌমাছি বিভোল।। কবে সে ফুল কুমারী ঘোমটা চিরি’ আসবে বাহিরে,
গিশিরের স্পর্শমুখে ভাঙ্গবে, রে ঘুম রাঙবে, রে কপোল।। ফাগুনের মুকুল জাগা দুকুল ভাঙ্গা আসবে ফুলের বান,
কুঁড়িদের ওষ্ঠপুটে লুটবে হাসি, ফুটবে গালে টোল।। কবি তুই গন্ধে ভু’লে ডুবলি জলে কূল পেলিনে আর,
ফুলে তোর বুক ভরেছিল, আজকে জলে ভরবে আঁখির কোল |
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
অগ্র-পথিক হে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল।
রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন ভাইরা মোর,
বসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর!
রাখ তৈয়ার হাথেলিতে হাথিয়ার জোয়ান,
হান রে নিশিত পাশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ!
কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥কোথায় মানিক ভাইরা আমার, সাজ রে সাজ!
আর বিলম্ব সাজে না, চালাও কুচকাওয়াজ!
আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ
বিপদ বাধার কণ্ঠ ছিঁড়িয়া শুষিব খুন!
আমরা ফলাব ফুল-ফসল।
অগ্র-পথিক রে যুবাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর,
হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির!
দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ
সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,
মরু-সঞ্চর গতি-চপল।
অগ্র-পথিক রে পাঁওদল,
জোর কদম চল রে চল॥স্থবির শ্রান্ত প্রাচী-র প্রাচীন জাতিরা সব
হারায়েছে আজ দীক্ষাদানের সে-গৌরব।
অবনত-শির গতিহীন তারা। মোরা তরুণ
বহিব সে ভার, লব শাশ্বত ব্রত দারুণ
শিখাব নতুন মন্ত্রবল।
রে নব পথিক যাত্রীদল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান,
চলমান-বেগে প্রাণ-উছল।
রে নবযুগের স্রষ্টাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
অভিযান-সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে
বনে নদীতটে গিরি-সংকটে জলে থলে।
লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমিষে,
জয় করি সব তসনস করি পায়ে পিষে,
অসীম সাহসে ভাঙি আগল!
না জানা পথের নকিব-দল,
জোর কদম চল রে চল॥পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবিরে
বাঁধ বাঁধি চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে।
রসাতল চিরি হীরকের খনি করি খনন,
কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,
পায়ে হেঁটে মাপি ধরণিতল!
অগ্র-পথিক রে চঞ্চল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা এসেছি নবীন প্রাচী-র নবস্রোতে
ভীম পর্বত ক্রকচ-গিরির১ চূড়া হাতে,
উচ্চ অধিত্যকা প্রণালিকা হইয়া বার;
আহত বাঘের পদ-চিন ধরি হয়েছি বার ;
পাতাল ফুঁড়িয়া, পথ-পাগল।
অগ্রবাহিনী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আয়র্ল্যান্ড, আরব, মিশর, কোরিয়া চীন,
নরওয়ে, স্পেন, রাশিয়া, – সবার ধারি গো ঋণ!
সবার রক্তে মোদের লোহুর আভাস পাই,
এক বেদনার ‘কমরেড’ভাই মোরা সবাই।
সকল দেশের মোরা সকল ।
রে চির-যাত্রী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥বলগা্-বিহীন শৃঙ্খল-ছেঁড়া প্রিয় তরুণ!
তোদের দেখিয়া টগবগ করে বক্ষে খুন।
কাঁদি বেদনায়, তবু রে তোদের ভালোবাসায়
উল্লাসে নাচি আপনা-বিভোল,নব আশায়।
ভাগ্য-দেবীর লীলা-কমল,
অগ্রপথিক রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
তরুণ তাপস! নব শক্তিরে জাগায়ে তোল।
করুণার নয়–ভয়ংকরীর দুয়ার খোল।
নাগিনি-দশনা রণরঙ্গিণী শস্ত্রকর
তোর দেশ-মাতা, তাহারই পতাকা তুলিয়া ধর।
রক্ত-পিয়াসি অচঞ্চল
নির্মম-ব্রত রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত যুবারা, শুন!
মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু, শকুন।
ভ্রুকুটি হানিছে পুরাতন পচা গলিতে শব,
রক্ষণশীল বুড়োরা করছি তারই স্তব
শিবারা চেঁচাক, শিব অটল!
নির্ভীক বীর পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥আগে – আরও আগে সেনা-মুখ যথা করিছে রণ,
পলকে হতেছে পূর্ণ মৃতের শূন্যাসন,
আছে ঠাঁই আছে, কে থামে পিছনে? হ আগুয়ান!
যুদ্ধের মাঝে পরাজয় মাঝ চলো জোয়ান!
জ্বাল রে মশাল জ্বাল অনল!
অগ্রযাত্রী রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
নতুন করিয়া ক্লান্ত ধরার মৃত শিরায়
স্পন্দন জাগে আমাদের তরে, নব আশায়।
আমাদেরই তারা – চলিছে যাহারা দৃঢ় চরণ
সম্মুখ পানে, একাকী অথবা শতেক জন।
মোরা সহস্র-বাহু-সবল।
রে চির-রাতের সন্ত্রিদল,
জোর কদম চল রে চল॥
জগতের এই বিচিত্রতম মিছিলে ভাই
কত রূপ কত দৃশ্যের লীলা চলে সদাই!–
শ্রমরত ওই কালি-মাখা কুলি, নৌ-সারং,
বলদের মাঝে হলধর চাষা দুখের সং,
প্রভু স-ভৃত্য পেষণ-কল, –
অগ্র-পথিক উদাসী-দল,
জোর কদম চল রে চল॥নিখিল গোপন ব্যর্থ-প্রেমিক আর্ত-প্রাণ
সকল কারার সকল বন্দী আহত-মান,
ধরার সকল সুখী ও দুঃখী, সৎ, অসৎ,
মৃত, জীবন্ত, পথ-হারা, যারা ভোলেনি পথ, –
আমাদের সাথি এরা সকল।
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোরকদম চল রে চল॥
ছুঁড়িতেছে ভাঁটা জ্যোতির্চক্র ঘূর্ণমান
হেরো পুঞ্জিত গ্রহ-রবি-তারা দীপ্তপ্রাণ;
আলো-ঝলমল দিবস, নিশীথ স্বপ্নাতুর, –
বন্ধুর মতো চেয়ে আছে সবে নিকট-দূর।
এক ধ্রুব সবে পথ-উতল।
নব যাত্রিক পথিক দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমাদের এরা, আছে এরা সবে মোদের সাথ,
এরা সখা – সহযাত্রী মোদের দিবস-রাত।
ভ্রূণ-পথে আসে মোদের পথের ভাবী পথিক,
এ মিছিলে মোরা অগ্র-যাত্রী সুনির্ভিক।
সুগম করিয়া পথ পিছল
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥ওগো ও প্রাচী-র দুলালি দুহিতা তরুণীরা,
ওগো জায়া ওগো ভগিনীরা। ডাকে সঙ্গীরা।
উঠুক তোমার মণি-মঞ্জীর ঘন বাজি
আমাদের পথে চল-চপল।
অগ্র-পথিক তরুণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
ওগো অনাগত মরু-প্রান্তর বৈতালিক!
শুনিতেছি তব আগমনি-গীতি দিগ্বিদিক।
আমাদেরই মাঝে আসিতেছ তুমি দ্রুত পায়ে। –
ভিন-দেশী কবি! থামাও বাঁশরি বট-ছায়ে,
তোমার সাধনা আজি সফল।
অগ্র-পথিক চারণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চাহি না তরল স্বপন, হালকা সুখ,
আরাম-কুশন, মখমল-চটি, পানসে থুক
শান্তির বাণী, জ্ঞান-বানিয়ার বই-গুদাম,
ছেঁদো ছন্দের পলকা, উর্ণা, সস্তা নাম,
পচা দৌলত; – দুপায়ে দল!
কঠোর দুখের তাপসদল,
জোর কদম চল রে চল॥পান-আহার ভোজে মত্ত কি যত ঔদরিক?
দুয়ার জানালা বন্ধ করিয়া ফেলিয়া চিক
আরাম করিয়া ভুঁড়োরা ঘুমায়?–বন্ধু, শোন,
মোটা ডালরুটি, ছেঁড়া কম্বল,ভূমি-শয়ন,
আছে তো মোদের পাথেয়-বল!
ওরে বেদনার পূজারি দল,
মোছ রে অশ্রু, চল রে চল॥
নেমেছে কি রাতি? ফুরায় না পথ সুদুর্গম?
কে থামিস পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম?
বসে নে খানিক পথ-মঞ্জিলে, ভয় কী ভাই,
থামিলে দুদিন ভোলে যদি লোকে – ভুলুক তাই!
মোদের লক্ষ্য চির-অটল!
অগ্র-পথিক ব্রতীর দল,
বাঁদরে বুক, চল রে চল॥
শুনিতেছি আমি, শোন ওই দূরে তূর্য-নাদ
ঘোষিছে নবীন উষার উদয়-সুসংবাদ!
ওরে ত্বরা কর! ছুটে চল আগে – আরও আগে!
গান গেয়ে চলে অগ্র-বাহিনী, ছুটে চল তারও পুরোভাগে!
তোর অধিকার কর দখল!
অগ্র-নায়ক রে পাঁওদল!
জোর কদম চল রে চল॥(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
হার মেনেছ বিদ্রোহীকে বাঁধতে তুমি পারবে না!
তোমার সর্বশক্তি আমায়,
বাঁধতে গিয়ে হার মেনে যায়!
হায়! হাসি পায়, হেরেও তুমি হারবে না?
হেরে গেলে! বিদ্রোহীকে বাঁধতে তুমি পারবে না।অশান্ত এ ধূমকেতুকে ঘুম পাড়াবে কোন মায়া?
তোমার সর্বমায়ার কাঁদন,
মা-র মমতা প্রেমের বাঁধন
স্পর্শ করে বিদগ্ধ হয়, রুদ্রস্বরূপ মোর কায়া।
অশান্ত এ ধূমকেতুকে ঘুম পাড়াবে কোন মায়া?ধরতে আমায় জাল পেতেছে জটিল তোমার সাত আকাশ!
সে জাল ছিঁড়ে এ ধূমকেতু
বিনাশ করে বাঁধার সেতু,
সপ্ত স্বর্গ পাতাল ঘিরে ভস্ম করে সকল বিঘ্ন সর্বনাশ।
এই ধূমকেতু ছিঁড়ে সে জাল
এই মহাকাল! রুদ্র দামাল
শূন্যে নাচে প্রলয়-নাচন সংহারিয়া সর্বনাশ।শান্তি দিয়ে অশান্তকে ধরার ধুলায় আনতে চাও,
দুর্গে এনে দুরন্তকে –
অশ্রু চাহ রুক্ষ চোখে!
আমার আগুন নিভবে নাকো যতই গলায় মালা দাও!
শান্তি দিয়ে অশান্তকে ধরার ধুলায় আনতে চাও!সংহার মোর ধর্ম, আমি বিপ্লব ও ঝঞ্ঝা ঝড়,
স্বধর্মে নিধন ভালো –
কেন আন প্রেমের আলো?
সতী-দেহত্যাগের পর শংকর কি বাঁধে ঘর?আনন্দ আর অমৃত রস কার আগুনে যায় জ্বলে?
শান্তি সমাহিতের মাঝে
কেন রুদ্র বিষাণ বাজে?
কোন যাতনায় শিশু কাঁদে, শান্তি পায় না মা-র কোলে?লক্ষ্মীছাড়ার হাতে তুমি ঐশ্বর্য চাও দিতে?
লোভী ভোগীলক্ষ্মী লয়ে
রাক্ষস আর দৈত্য হয়ে
কী নির্যাতন করছে তোমার সৃষ্টিতে।
লক্ষ্মীছাড়ার হাতে তুমি ঐশ্বর্য চাও দিতে?করব আমি ধ্বংস সর্ব বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বকে।
মিথ্যা হল কোরান ও বেদ
এই অসাম্য অশান্তি ভেদ
প্রলয় কি বাঁধতে পারে বলয়-পরা নর্তকী!
এখানে সিংহ থাকে!
অসিংহ সব মহাত্মাকে
দাও গিয়ে ওই হরিনামের হরতকি!
রুদ্রকে কে শূদ্র করে
ক্ষুদ্র ধরায় রাখবে ধরে।
অহম শিকল কে পরাবে সোহম স্বয়ম্ভূকে!হে মৌনী, উত্তর দাও সামনে এসে রূপ ধরে,
পূজা করে ক্ষমা করে
তোমায় মানুষ জনম ভরে,
কী দিয়েছ তাদের বলো, থেকো নাকো চুপ করে!কেন দুর্বলেরে করে প্রবল নির্যাতন?
এই সুন্দর বসুন্ধরা
রাক্ষস আর দৈত্যভরা
কেমন করে করব তোমায় অভেদ বলে সম্ভাষণ।লজ্জা তোমার হয় না যখন তোমায় বলে কৃপাময়!
পুত্র মরে, মা তবু হায়!
প্রেমভরে ডাকে তোমায়;
ওগো কৃপণ! বিশ্বে তোমার দাতা বলে পরিচয়!কেন পাপ ও অপরাধের কথা তোমার শাস্ত্র কয়!
কে দিল মানবজন্ম,
কে দিল ধর্মাধর্ম,
মুক্ত তুমি, মানুষ কেন এ বন্ধন-জ্বালা সয়?তুমি বল, ‘আমার একা তোমার উপর অধিকার।’
সেই অধিকার তোমার পরে
বলো কেন দাও না মোরে?
তোমার মতো পূর্ণ হব, এই ছিল মোর অহংকার!মনের জ্বালা স্নিগ্ধ নাহি করে তোমার চন্দ্রালোক!
এত কুসুম এত বাতাস
কেন তবু এ হাহুতাশ,
কোন শোকে অশান্তিতে দেবতা হয় চণ্ডাশোক !কেন সৃষ্টি করলে নরক, জন্মায়নি যখন মানব
কেন তাদের ভয় দেখাও?
ভয় দেখিয়ে ভক্তি চাও?
তোমার পরম ভক্তেরা তাই হয় শয়তান, হয় দানব!বিদ্রোহী করেছে মোরে আমার গভীর অভিমান।
তোমার ধরার দুঃখ কেন
আমায় নিত্য কাঁদায় হেন?
বিশৃঙ্খল সৃষ্টি তোমার, তাই তো কাঁদে আমার প্রাণ!বিদ্রোহী করেছে মোরে আমার গভীর অভিমান!
আমার কাছে শান্তি চায়
লুটিয়ে পড়ে আমার গায় –
শান্ত হব, আগে তারা সর্বদুঃখ-মুক্ত হোক! (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
করেছ পথের ভিখারিনি মোরে কে গো সুন্দর সন্ন্যাসী?
কোন বিবাগির মায়া-বনমাঝে বাজে ঘরছাড়া তব বাঁশি?
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।
তব প্রেমরাঙা ভাঙা জোছনা
হেরো শিশির-অশ্রু-লোচনা,
ওই চলিয়াছে কাঁদি বরষার নদী গৈরিকরাঙা-বসনা।
ওগো প্রেম-মহাযোগী, তব প্রেম লাগি নিখিল বিবাগি পরবাসী!
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।মম একা ঘরে নাথ দেখেছিনু তোমা ক্ষীণ দীপালোকে হীন করি,
হেরি বাহির আলোকে অনন্তলোকে এ কী রূপ তব মরি মরি!
দিয়া বেদনার পরে বেদনা
নাথ একী এ বিপুল চেতনা
তুমি জাগালে আমার রোদনে, অন্ধে দেখালে বিশ্ব-দ্যোতনা।
ওগো নিষ্ঠুর মোর! অশুভ ও-রূপ তাই এত বাজে বুকে আসি।
ওগো সুন্দর সন্ন্যাসী।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
সর্বনাশের পরে পৌষ মাস
এল কি আবার ইসলামের?
মন্বন্তর-অন্তে কে দিল
ধরণিরে ধন-ধান্য ঢের?
ভুখারির রোজা রমজান পরে
এল কি ঈদের নওরোজা?
এল কি আরব-আহবে আবার
মূর্ত মর্ত-মোর্তজা?
হিজরত করে হজরত কি রে
এল এ মেদিনী-মদিনা ফের?
নতুন করিয়া হিজরি গণনা
হবে কি আবার মুসলিমের?
* * *
বরদ-বিজয়ী বদরুদ্দোজা৪
ঘুচাল কি অমা রৌশনিতে?
সিজাদ করিল নিজ্দ হেজাজ৬
আবার ‘কাবা’র মসজিদে।
আরবে করিল ‘দারুল-হার’–
ধসে পড়ে বুঝি ‘কাবা’র ছাদ!
‘দীন দীন’রবে শমশের-হাতে
ছুটে শের-নর ‘ইবনে সাদ’!
মাজার ফাড়িয়া উঠিল হাজার
জিন্দান-ভাঙা জিন্দা বীর!
গারত হইল করদ হুসেন,
উঁচু হল পুন শির নবির!
আরব আবার হল আরাস্তা,
বান্দারা যত পড়ে দরুদ।
পড়ে শুকরানা‘আরবা রেকাত’
আরফাতে যত স্বর্গ-দূত।
ঘোষিল ওহদ, ‘আল্লা আহদ !’
ফুকারে তূর্য তুর পাহাড়
মন্দ্রে বিশ্ব-রন্ধ্রে-রন্ধ্রে
মন্ত্র আল্লা-হু-আকবার!
জাগিয়া শুনিনু প্রভাতি আজান
দিতেছে নবীন মোয়াজ্জিন।
মনে হল এল ভক্ত বেলাল
রক্ত এ-দিনে জাগাতে দীন!
জেগেছে তখন তরুণ তুরাণ
গোর চিরে যেন আঙ্গোরায়।
গ্রিসের গরুরী গারত করিয়া
বোঁও বোঁও তলোয়ার ঘোরায়।
রংরেজ৭ যেন শমশের যত
লালফেজ-শিরে তুর্কিদের।
লালে-লাল করে কৃষ্ণসাগর
রক্ত-প্রবাল চূর্ণি ফের।
মোতি হার সম হাথিয়ার দোলে
তরুণ তুরাণি বুকে পিঠে!
খাট্টা-মেজাজ গাঁট্টা মারিছে
দেশ-শত্রুর গিঁঠে গিঁঠে!
মুক্ত চন্দ্র-লাঞ্ছিত ধ্বজা
পতপত ওড়ে তুর্কিতে,
রঙিন আজি ম্লান আস্তানা
সুরখ রঙের সুর্খিতে
বিরান১০ মুলুক ইরানও সহসা
জাগিয়াছে দেখি ত্যজিয়া নিদ!
মাশুকের বাহু ছাড়ায়ে আশিক
কসম করিছে হবে শহিদ!
লায়লির প্রেমে মজনুন আজি
‘লা-এলা’র তরে ধরেছে তেগ।
শিরীন শিরীরে ভুলে ফরহাদ
সারা ইসলাম পরে আশেক!
পেশতা-আপেল-আনার-আঙুর-
নারঙ্গি-শেব-বোস্তানে
মুলতুবি আজ সাকি ও শরাব
দীওয়ান-ই-হাফিজ জুজদানে!
নার্গিস লালা লালে-লাল আজি
তাজা খুন মেখে বীর প্রাণের,
ফিরদৌসীর রণ-দুন্দুভি
শুনে পিঞ্জরে জেগেছে শের!
হিংসায়-সিয়া শিয়াদের তাজে
শিরাজী-শোণিমা লেগেছে আজ।
নৌ-রুস্তম উঠেছে রুখিয়া
সফেদ দানবে দিয়াছে লাজ?
মরা মরক্কো মরিয়া হইয়া
মাতিয়াছে করি মরণ-পণ,
স্তম্ভিত হয়ে হেরিছে বিশ্ব–
আজও মুসলিম ভোলেনি রণ!
জ্বালাবে আবার খেদিব-প্রদীপ
গাজি আবদুল করিম বীর,
দ্বিতীয় কামাল রীফ-সর্দার–
স্পেন ভয়ে পায়ে নোয়ায় শির!
রীফ৬ শরিফ সে কতটুকু ঠাঁই
আজ তারই কথা ভুবনময়!–
মৃত্যুর মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ে
দেখেছে যাহারা, তাদেরই জয়!
মেষ-সম যারা ছিল এতদিন
শের হল আজ সেই মেসের!
এ-মেষের দেশ মেষ-ই রহিল
কাফ্রির অধম এরা কাফের!
নীল দরিয়ায় জেগেছে জোয়ার
‘মুসা’র উষার টুটেছে ঘুম।
অভিশাপ-‘আসা’ গর্জিয়া আসে
গ্রাসিবে যন্ত্রী-জাদু-জুলুম।
ফেরাউন১ আজও মরেনি ডুবিয়া?
দেরি নাই তার, ডুবিবে কাল!
জালিম-রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে
জ্বলেছে খোদার লাল মশাল!
কাবুল লইল নতুন দীক্ষা
কবুল করিল আপনা জান।
পাহাড়ি তরুর শুকনো শাখায়
গাহে বুলবুল খোশ এলহান!
পামির ছাড়িয়া আমির আজিকে
পথের ধুলায় খোঁজে মণি!
মিলিয়াছে মরা মরু-সাগরে রে
আব-হায়াতের৩ প্রাণ-খনি!
খর-রোদ-পোড়া খর্জুর তরু–
তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর!
“সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা”
ভারতের বুকে নাই রুধির!
জাগিল আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।–
সর্বনাশের পরে পৌষমাস
এলো কি আবার ইসলামের?
* * *
কসাই-খানার সাত কোটি মেষ
ইহাদেরই শুধু নাই কি ত্রাণ
মার খেয়ে খেয়ে মরিয়া হইয়া
উঠিতে এদের নাই প্রাণ?
জেগেছে আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।
এয়্ খোদা! এই জাগরণ-রোলে
এ-মেষের দেশও জাগাও ফের!হুগলি,
অগ্রহায়ণ, ১৩৩১
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিছে তার,
ওরে ভীরু, ওঠ, এখনই টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার!
কৃষ্ণ মেঘের নিশান তাহার দোলে পশ্চিম-তোরণে ওই,
ভ্রুকুটি- ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে নাচে নদনদী তাথই থই।
তরবারি তার হানিছে ঝিলিক সর্পিল বিদ্যুল্লেখায়,
হানিবে আঘাত তোর স্বপ্নের শিশমহলের দরোয়াজায় ;
কাঁদিবে পূর্ব পুবালি হাওয়ায়, ফোটাবে কদম জুঁই কুসুম ;
বৃষ্টিধারায় ঝরিবে অশ্রু, ঘনালে প্রলয় রবে নিঝুম?যে দেশে সূর্য ডোবে – সেই দেশে হইল নবীন সূর্যোদয়,
উদয়-অচলে টলমল করে অস্ত-রবির আঁধার ভয়!
যুগ যুগ ধরি, তপস্যা দিয়ে করেছি মহিরে মহামহান,
ফুটায়েছি ফুল কর্ষিয়া মরু, ধূলির ঊর্ধ্বে গেয়েছি গান।
আজি সেই ফুলে-ফসল-মেলায় অধিকার নাই আমাদেরই,
আমাদের ধ্যান-সুন্দর ধরা আমাদের নয় আজি হেরি!
গীত-শেষে নীড়ে ফিরিবার বেলা হেরি নীড়ে বাসা বাঁধে শকুন,
মাংস-লোলুপ ফিরিতেছে ব্যাধ স্কন্ধে রক্ত-ধনুর্গুণ!
নীড়ে ফিরিবার পথ নাই তোর, নিম্নে নিষাদ, ঊর্ধ্বে বাজ,
তোর সে অতীত মহিমা আজিকে তোরে সব চেয়ে হানিছে লাজ!উঠিয়াছে ঝড় – ঝড় উঠিয়াছে প্রলয়-রণের আমন্ত্রণ,
‘আদাওতি’র এ দাওতে কে যাবি মৃত্যুতে প্রাণ করিয়া পণ?
ঝড়ে যা উড়িবে, পুড়িবে আগুনে, উড়ুক পুড়ুক সে সম্বল,
মৃত্যু যেখানে ধ্রুব তোর সেথা মৃত্যুরে হেসে বরিবি চল!
অপরিমাণ এ জীবনে করিবি জীবিতের মতো ব্যয় যদি,
ঊর্ধ্বে থাকুক ঝড়ের আশিস, চরণে মরণ-অম্বুধি!বিধাতার দান এই পবিত্র দেহের করিবি অসম্মান?
শকুন-শিবার খাদ্য হইবি, ফিরায়ে দিবি না খোদার দান?
এ-জীবন ফুল-অঞ্জলি সম নজরানা দিবি মৃত্যুরে, –
জীবিতের মতো ভুঞ্জি জীবন ব্যয় করে যা তা প্রাণ পুরে!
চরণে দলেছি বিপুলা পৃথ্বী কোটি গ্রহ তারা ধরি শিরে,
মোদের তীর্থ লাগি রবি শশী নিশিদিন আসে ফিরে ফিরে।
নিঃসীম নভ ছত্র ধরিয়া, বন্দনা-গান গাহে বিহগ,
বর্ষায় ঝরে রহমত-পানি-প্রতীক্ষমাণ সাত স্বরগ।
অপরিমাণ এ দানেরে কেমনে করিবি, রে ভীরু অস্বীকার?
মৃত্যুর মারফতে শোধ দিব বিধির এ মহাদানের ধার।
রোগ-পাণ্ডুর দেহ নয় – দিব সুন্দর তনু কোরবানি,
রোগ ও জরারে দিব না এ দেহ, জীবন-ফুলের ফুলদানি।
তাজা এ স্বাস্থ্য সুন্দর দেহ মৃত্যুরে দিবি অর্ঘ্যদান,
অতিথিরে দিবি কীটে-খাওয়া ফুল? লতা ছিঁড়ে তাজা কুসুম আন!আসিয়াছে ঝড়, ঘরের ভিতর তাজিম করিয়া অতিথে ডাক,
বন্ধুর পথে এসেছে বন্ধু, হাসিয়া দস্তে দস্ত রাখ।
যৌবন-মদ পূর্ণ করিয়া জীবনের মৃৎপাত্র ভর,
তাই নিয়ে সব বেহুঁশ হইয়া ঝঞ্ঝার সাথে পাঞ্জা ধর।ঝঞ্ঝার বেগ রুধিতে নারিবে পড়-পড় ওই গৃহ রে তোর,
খুঁটি ধরে তার কেন বৃথা আর থাকিস বসিয়া, ভাঙ এ দোর!
রবির চুল্লি নিভিয়া গিয়াছে, ধূম্রায়মান নীল গগন,
ঝঞ্ঝা এসেছে ঝাপটিয়া পাখা, ধেয়ে আয় তুই ক্ষীণ পবন! (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার হাতের সকল কাজে
হবে শুভ নিরবধি-
প্রিয়, তোমার ভাগ্যবশে
নিয়তির এই নির্দেশ যদি;
দাও তাহলে পান করে নিই
তোমার দেওয়া শিরীন শরাব,
হ'লেও হব চির-অমর,
হয়ত ও-মদ সুধা-নদী!!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট,
উদয়-গোধূলি-রঙে রাঙা হয়ে
উঠেছিল যথা অস্তপাট।
আ-নীল গগন-গম্বুজ-ছোঁয়া
কাঁপিয়া উঠিল নীল অচল,
অস্তরবিরে ঝুঁটি ধরে আনে
মধ্য গগনে কোন পাগল!
আপন বুকের রক্তঝলকে
পাংশু রবিরে করে লোহিত,
বিমানে বিমানে বাজে দুন্দুভি,
থরথর কাঁপে স্বর্গ-ভিত।
দেবকী মাতার বুকের পাথর
নড়িল কারায় অকস্মাৎ
বিনা মেঘে হল দৈত্যপুরীর
প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত।
নাচে ভৈরব, শিবানী, প্রমথ
জুড়িয়া শ্মশান মৃত্যুনাট, -
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব ভারতের হলদিঘাট।অভিমন্যুর দেখেছিস রণ?
যদি দেখিসনি, দেখিবি আয়,
আধা-পৃথিবীর রাজার হাজার
সৈনিকে চারি তরুণ হটায়।
ভাবী ভারতের না-চাহিতে আসা
নবীন প্রতাপ, নেপোলিয়ন,
ওই ‘যতীন্দ্র’ রণোন্মত্ত –
শনির সহিত অশনি-রণ।
দুই বাহু আর পশ্চাতে তার
রুষিছে তিনটি বালক শের,
‘চিত্তপ্রিয়, ‘মনোরঞ্জন,
‘নীরেন’ – ত্রিশূল ভৈরবের!
বাঙালির রণ দেখে যা রে তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠি, জাঠ!
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
চার হাতিয়ারে – দেখে যা কেমনে
বধিতে হয় রে চার হাজার,
মহাকাল করে কেমনে নাকাল
নিতাই গোরার লালবাজার!
অস্ত্রের রণ দেখেছিস তোরা,
দেখ নিরস্ত্র প্রাণের রণ;
প্রাণ যদি থাকে – কেমনে সাহসী
করে সহস্র প্রাণ হরণ!হিংস-বুদ্ধ-মহিমা দেখিবি
আয় অহিংস-বুদ্ধগণ
হেসে যারা প্রাণ নিতে জানে, প্রাণ
দিতে পারে তারা হেসে কেমন!
অধীন ভারত করিল প্রথম
স্বাধীন-ভারত মন্ত্রপাঠ,
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
সে মহিমা হেরি ঝুঁকিয়া পড়েছে
অসীম আকাশ, স্বর্গদ্বার,
ভারতের পূজা-অঞ্জলি যেন
দেয় শিরে খাড়া নীল পাহাড়!
গগনচুম্বী গিরিশের হতে
ইঙ্গিত দিল বীরের দল,
‘মোরা স্বর্গের পাইয়াছি পথ –
তোরা যাবি যদি, এ পথে চল!
স্বর্গ-সোপানে রাখিনু চিহ্ন
মোদের বুকের রক্ত-ছাপ,
ওই সে রক্ত-সোপানে আরোহি
মোছ রে পরাধীনতার পাপ!
তোরা ছুটে আয় অগণিত সেনা,
খুলে দিনু দুর্গের কবাট!’
বালাশোর – বুড়িবালামের তীর –
নব-ভারতের হলদিঘাট।
*********************কাব্যগ্রন্থ - প্রলয়শিখা
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
এই নীরব নিশীথ রাতে
শুধু জল আসে আঁখিপাতে।
কেন কি কথা স্মরণে রাজে?
বুকে কার হতাদর বাজে?
কোন্ ক্রন্দন হিয়া-মাঝে
ওঠে গুমরি’ ব্যর্থতাতে
আর জল ভরে আঁখি-পাতে।।
মম বর্থ জীবন-বেদনা
এই নিশীথে লুকাতে নারি,
তাই গোপনে একাকী শয়নে
শুধু নয়নে উথলে বারি।
ছিল সেদিনো এমনি নিশা,
বুকে জেগেছিল শত তৃষা
তারি ব্যর্থ নিশাস মিশা
ওই শিথিল শেফালিকাতে
আর পূরবীতে বেদনাতে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!
ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া।
শিহরি’ উঠো না, শাস্ত্রবিদের ক’রো না ক’ বীর, ভয়-
তাহারা খোদার খোদ্ ‘প্রাইভেট সেক্রেটারী’ ত নয়!
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি!
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি!
রত্ন লইয়া বেচা-কেনা করে বণিক সিন্ধু-কুলে-
রত্নাকরের খবর তা ব’লে পুছো না ওদের ভুলে’।
উহারা রত্ন-বেনে,
রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে!
ডুবে নাই তা’রা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে,
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও, সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
ওই ঘর ভুলানো সুরে
কে গান গেয়ে যায় দূরে
তার সুরের সাথে সাথে
মোর মন যেতে চায় উড়ে।তার সহজ গলার তানে
সে ফুল ফোটাতে জানে
তার সুরে ভাটির টানে
নব জোয়ার আসে ঘুরে।তার সুরের অনুরাগে
বুকে প্রণয়-বেদন জাগে
বনে ফুলের আগুন লাগে
ফুল সুধায় ওঠে পুরে।বুঝি সুর সোহাগে ওরই
পায় যৌবন কিশোরী
হিয়া বুঁদ হয়ে গো নেশায়
তার পায়ে পায়ে ঘুরে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
জাগো সৈনিক-আত্মা! জাগো রে দুর্দম যৌবন!
আকাশ পৃথিবী আলোড়ি আসিছে ভয়াল প্রভঞ্জন।
রক্ত রসনা বিস্ফারি আসে করাল ভয়ংকর!
অগ্নি উগারি ওড়ে আগ্নেয়ী জুড়িয়া নীলাম্বর।
এখনও তন্দ্রা নিদ্রা জড়তা ক্লৈব্য গেল না তোর?
ব্রজ দমকে দামিনী চমকে, এল ঘনঘটা ঘোর!
এখনও ঘুমাবে হে অমর মানবাত্মা অন্ধকারে
পরি দৈন্যের শৃঙ্খল হায় পাতালের কারাগারে!
গরজে কামান, তোপ, গোলাগুলি ছুটিছে দিগ্বিদিকে,
জড়াইয়া ধরে প্রিয়া-সম সৈনিক সেই বহ্নিকে।
গুলি ও গোলারে প্রিয়ার বুকের মালার ফুলের মতো
লইতেছে তুলি আজ জগতের বীর সৈনিক যত।
জাগো জাগো এদেশের দুর্বার দুরন্ত যৌবন!
আগুনের ফুল-সুরভি এনেছে চৈতালি সমীরণ।
সেই সুরভির নেশায় জেগেছে অঙ্গে অঙ্গে তেজ,
রক্তের রঙে রাঙায় ভুবন ভৈরব রংরেজ!
জাগো অনিদ্র অভয় মুক্ত মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ,
তোমাদের পদধ্বনি শুনি হোক অভিনব উত্থান
পরাধীন শৃঙ্খল-কবলিত পতিত এ ভারতের!
এসো যৌবন রণ-রস-ঘন হাতে লয়ে শমশের!
মৃত্যুর নয় – অমৃতের উৎসবের আমন্ত্রণ
আসিতেছে ওই রক্ত-রঙিন লিপি লয়ে যে মরণ–
বরণ করিয়া চলো সেই উৎসব-অভিযান-পথে,
মহাশক্তির তুষার গলিয়া ছুটুক প্রবল স্রোতে!
দঙ্গল বাঁধি এসো ময়দানে করিয়া কুচকাওয়াজ,
গর্জি উঠুক বক্ষে রণোন্মত্ত গোলন্দাজ!
রক্তে রক্তে এ কোন রুদ্র নটরাজ নাচে নাচে রে!
মৃত্যুরে খুঁজি মধুমাছি, মৃত্যুর মধু কোথা আছে রে!
সাইক্লোন নাচে শিরায় শিরায় মন সেথা চলে ছুটে
কোথায় বোমার ধূপদানি হতে বারুদের ধোঁয়া উঠে?
চলো জাগ্রত মানবাত্মা সামরিক সেনাদল,
যথা প্রাণ ঝরে-ঝরে পড়ে যেন বাদলের ফুলদল!
মাদল বাজিছে কামানের ওই শোনো মহা-আহ্বান!
জীবনের পথে চলো আর চলো – ‘অভিযান, অভিযান’! (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
শোকমূলক
|
কোরাস্: বাংলার 'শের', বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
বাংলার ঋষি বাংলার জ্ঞান বঙ্গবাণীর শ্বেতকমল,
শ্যাম বাংলার বিদ্যা-গঙ্গা অবিদ্যা-নাশী তীর্থ-জল!
মহামহিমার বিরাট পুরুষ শক্তি-ইন্দ্র তেজ-তপন—
রক্ত-উদয় হেরিতে সহসা হেরিনু সে-রবি মেঘ-মগন।
কোরাস্: বাংলার 'শের', বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
মদ-গর্বীর গর্ব-খর্ব বল-দর্পীর দর্প-নাশ
শ্বেত-ভিতুদের শ্যাম বরাভয় রক্তাসুরের কৃষ্ণ ত্রাস।
নব ভারতের নব আশা-রবি প্রাচী'র উদার অভ্যুদয়
হেরিতে হেরিতে হেরিনু সহসা বিদায়-গোধূলি গগনময়।
কোরাস্: বাংলার 'শের', বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
পড়িল ধসিয়া গৌরীশঙ্কর হিমালয়-শির স্বর্গচূড়,
গিরি কাঞ্চন-জঙ্ঘা গিরিল—বাংলার যবে দিন-দুপুর।
শিশুক-হাঙর শোষিছে রক্ত, মৃত্যু শোষিছে সাগর-প্রাণ—
পরাধীনা মা'র স্বাধীন সুতের মেদ-ধূমে কালো দেশ-শ্মশান।
কোরাস্: বাংলার 'শের', বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
অরাজক মারি মড়া-কান্নায় দেশ-জননীর বদ্ধ শ্বাস,
হে দেব-আত্মা! স্বর্গ হইতে দাও কল্যাণ, দাও আভাস,
কেমন করিয়া মৃত্যু মথিয়া মৃত্যুঞ্জয় হয় মানব;
শব হয়ে গেছ, শিব হয়ে এস দেবকী-কারার নীল কেশব।
কোরাস্: বাংলার 'শের', বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনার,
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসী বাসনায়।।
আমারই মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে,
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।
আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম,
অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।
আমারই রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া,
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,
আপনারি গলে দোলে হায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
আজকে দেখি হিংসা-মদের মত্ত-বারণ-রণে
জাগ্ছে শুধু মৃণাল-কাঁটা আমার কমল-বনে।
উঠল কখন ভীম কোলাহল,
আমার বুকের রক্ত-কমল
কে ছিঁড়িল-বাঁধ-ভরা জল
শুধায় ক্ষণে ক্ষণে।
ঢেউ-এর দোলায় মরাল-তরী নাচ্বে না আন্মনে।।
কাঁটাও আমার যায় না কেন, কমল গেল যদি!
সিনান-বধূর শাপ শুধু আজ কুড়াই নিরবধি!
আস্বে কি আর পথিক-বালা?
প’রবে আমার মৃণাল-মালা?
আমার জলজ-কাঁটার জ্বালা
জ্ব’লবে মোরই মনে?
ফুল না পেয়েও কমল-কাঁটা বাঁধবে কে কঙ্কণে?
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
থেমে আসে রজনির গীত-কোলাহল,
ওরে মোর সাথি আঁখি-জল,
এইবার তুই নেমে আয় –
অতন্দ্র এ নয়ন-পাতায়।
আকাশে শিশির ঝরে, বনে ঝরে ফুল,
রূপের পালঙ্ক বেয়ে ঝরে এলোচুল ;
কোন গ্রহে কে জড়ায়ে ধরিছে প্রিয়ায়,
উল্কার মানিক ছিঁড়ে ঝরে পড়ে যায়।
আঁখি-জল, তুই নেমে আয় -
বুক ছেড়ে নয়ন-পাতায়!...
ওরে সুখবাদী
অশ্রুতে পেলিনে যারে, হাসিতে পাবি কি তারে আজি?
আপনারে কতকাল দিবি আর ফাঁকি?
অন্তহীন শূন্যতারে কত আর রাখবি রে কুয়াশায় ঢাকি?
ভিখারি সাজিলি যদি, কেন তবে দ্বারে
এসে ফিরে যাস নিতি অন্ধকারে?
পথ হতে আন-পথে কেঁদে যাস লয়ে ভিক্ষা-ঝুলি,
প্রাসাদ যাচিস যার তারেই রহিলি শুধু ভুলি? সকলে জানিবে তোর ব্যথা,
শুধু সে-ই জানিবে না কাঁটা-ভরা ক্ষত তোর কোথা?
ওরে ভীরু, ওরে অভিমানী!
যাহারে সকল দিবি, তারে তুই দিলি শুধু বাণী?
সুরের সুরায় মেতে কতটুকু কমিল রে মর্মদাহ তোর?
গানের গহিনে ডুবে কতদিন লুকাইবি এই আঁখি-লোর?
কেবলই গাঁথিলি মালা, কার তরে কেহ নাহি জানে!
অকূলে ভাসায়ে দিস, ভেসে যায় মালা শূন্য-পানে।
সে-ই শুধু জানিল না, যার তরে এত মালা-গাঁথা,
জলে-ভরা আঁখি তোর, ঘুমে-ভরা আঁখি-পাতা।
কে জানে কাটিবে কিনা আজিকার অন্ধ এ নিশীথ,
হয়তো হবে না গাওয়া কাল তোর আধ-গাওয়া গীত,
হয়তো হবে না বলা, বাণীর বুদ্বুদে যাহা ফোটে নিশিদিন!
সময় ফুরায়ে যায় – ঘনায়ে আসিল সন্ধ্যা কুহেলি-মলিন!
সময় ফুরায়ে যায়, চলো এবে, বলি আঁখি তুলি –
ওগো প্রিয়, আমি যাই, এই লহো মোর ভিক্ষা-ঝুলি!
ফিরেছি সকল দ্বারে, শুধু তব ঠাঁই
ভিক্ষা-পাত্র লয়ে করে কভু আসি নাই।
ভরেছে ভিক্ষার ঝুলি মানিকে মণিতে,
ভরে নাই চিত্ত মোর! তাই শূন্য-চিতে
এসেছি বিবাগি আজি, ওগো রাজা-রানি,
চাহিতে আসিনি কিছু! সংকোচে অঞ্চল মুখে দিয়ো নাকো টানি।জানাতে এসেছি শধু– অন্তর-আসনে
সব ঠাঁই ছেড়ে দিয়ে – যাহারে গোপনে
চলে গেছি বন-পথে একদা একাকী,
বুক-ভরা কথা লয়ে – জল-ভরা আঁখি।
চাহিনিকো হাত পেতে তারে কোনোদিন,
বিলায়ে দিয়েছি তারে সব, ফিরে পেতে দিইনিকো ঋণ!
ওগো উদাসিনী,
তব সাথে নাহি চলে হাটে বিকিকিনি।
কারও প্রেম ঘরে টানে, কেহ অবহেলে
ভিখারি করিয়া দেয় বহুদূরে ঠেলে!
জানিতে আসিনি আমি, নিমেষের ভুলে
কখনও বসেছ কি না সেই নদী-কূলে,
যার ভাটি-টানে –
ভেসে যায় তরি মোর দূর শূন্যপানে।
চাহি না তো কোন কিছু, তবু কেন রয়ে রয়ে ব্যাথা করে বুক,
সুখ ফিরি করে ফিরি, তবু নাহি সহা যায়
আজি আর এ-দুঃখের সুখ।...
আপনারে দলিয়া, তোমারে দলিনি কোনোদিন,
আমি যাই, তোমারে আমার ব্যথা দিয়ে গেনু ঋণ। (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
অধর নিসপিস
নধর কিসমিস
রাতুল তুলতুল কপোল;
ঝরল ফুল-কুল,
করল গুল ভুল
বাতুল বুলবুল চপল।
নাসায় তিলফুল
হাসায় বিলকুল,
নয়ান ছলছল উদাস,
দৃষ্টি চোর-চোর
মিষ্টি ঘোর-ঘোর,
বয়ান ঢলঢল হুতাশ।
অলক দুলদুল
পলক ঢুল ঢুল,
নোলক চুম খায় মুখেই,
সিঁদুর মুখটুক
হিঙুল টুকটুক,
দোলক ঘুম যায় বুকেই।
ললাট ঝলমল
মলাট মলমল
টিপটি টলটল সিঁথির,
ভুরুর কায় ক্ষীণ
শুরুর নাই চিন,
দীপটি জ্বলজ্বল দিঠির।
চিবুক টোল খায়,
কী সুখ-দোল তায়
হাসির ফাঁস দেয় – সাবাস।
মুখটি গোলগাল,
চুপটি বোলচাল
বাঁশির শ্বাস দেয় আভাস।
আনার লাল লাল
দানার তার গাল,
তিলের দাগ তায় ভোমর;
কপোল-কোল ছায়
চপল টোল, তায়
নীলের রাগ ভায় চুমোর॥(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
(শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।আসিয়াছে আল্লার শুভ সাহায্য বিজয়!
দেখিবে - আল্লার ধর্মে এ জগৎময়
যত লোক দলে দলে করিছে প্রবেশ,
এবে নিজ পালক সে প্রভুর অশেষ
প্রচার হে প্রসংশা কৃতজ্ঞ অন্তরে,
কর ক্ষমা প্রার্থনা তাঁহার গোচরে।
করেন গ্রহন তিনি সবার অধিক
ক্ষমা আর অনুতাপ-যাচ্ঞা সঠিক।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
দেখা দিলে রাঙা মৃত্যুর রূপে এতদিনের কি গো রানি?
মিলন-গোধূলি-লগনে শুনালে চির-বিদায়ের বাণী।
যে ধূলিতে ফুল ঝরায় পবন
রচিলে সেথায় বাসর-শয়ন,
বারেক কপোলে রাখিয়া কপোল, ললাটে কাঁকন হানি,
দিলে মোর পরে সকরুণ করে কৃষ্ণ কাফন টানি।
নিশি না পোহাতে জাগায়ে বলিলে, ‘হল যে বিদায় বেলা।”
তব ইঙ্গিতে ও-পার হইতে এপারে আসিল ভেলা।
আপনি সাজালে বিদায়ের বেশে
আঁখি-জল মম মুছাইলে হেসে,
বলিলে, ‘অনেক হইয়াছে দেরি, আর জমিবে না খেলা!
সকলের বুকে পেয়েছ আদর, আমি দিনু অবহেলা।‘
‘চোখ গেল উহু চোখ গেল’বলে কাঁদিয়া উঠিল পাখি,
হাসিয়া বলিলে, ‘বন্ধু, সত্যি চোখ গেল ওর নাকি?’
অকূল অশ্রু-সাগর-বেলায়
শুধু বালু নিয়ে যে-জন খেলায়,
কী বলিব তারে, বিদায়-ক্ষণেও ভিজিল না যার আঁখি!
শ্বসিয়া উঠিল নিশীথ-সমীর, ‘চোখ গেল’কাঁদে পাখি!দেখিনু চাহিয়া ও-মুখের পানে – নিরশ্রু নিষ্ঠুর!
বুকে চেপে কাঁদি, প্রিয় ওগো প্রিয়, কোথা তুমি কত দূর?
এত কাছে তুমি গলা জড়াইয়া
কেন হুহু করে ওঠে তবু হিয়া,
কী যেন কী কীসের অভাব এ বুকে ব্যথা-বিধুর!
চোখ-ভরা জল, বুক-ভরা কথা, কণ্ঠে আসে না সুর।
হেনার মতন বক্ষে পিষিয়া করিনু তোমারে লাল,
ঢলিয়া পড়িলে দলিত কমল জড়ায়ে বাহু-মৃণাল!
কেঁদে বলি, ‘প্রিয়া, চোখে কই জল?
হল না তো ম্লান চোখের কাজল!’
চোখের জল নাই – উঠিল রক্ত – সুন্দর কঙ্কাল!
বলিলে, ‘বন্ধু, চোখেরই তো জল, সে কি রহে চিরকাল?’
ছল ছল ছল কেঁদে চলে জল, ভাঁটি-টানে ছুটে তরি,
সাপিনির মতো জড়াইয়া ধরে শশীহীন শর্বরী।
কূলে কূলে ডাকে কে যেন, ‘পথিক,
আজও রাঙা হয়ে ওঠেনি তো দিক!
অভিমানী মোর! এখনই ছিঁড়িবে বাঁধন কেমন করি?
চোখে নাই জল – বক্ষের মোর ব্যথা তো যায়নি মরি!’
কেমনে বুঝাই কী যে আমি চাই, চির-জনমের প্রিয়া!
কেমনে বুঝাই – এত হাসি গাই তবু কাঁদে কেন হিয়া!
আছে তব বুকে করুণার ঠাঁই,
স্বর্গের দেবী – চোখে জল নাই!
কত জীবনের অভিশাপ এ যে, কতবার জনমিয়া –
পারিজাত-মালা ছুঁইতে শুকালে – হারাইলে দেখা দিয়া।
ব্যর্থ মোদের গোধূলি-লগন এই সে জনমে নহে,
বাসর-শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির-বিরহে!
কত সে লোকের কত নদনদী
পারায়ে চলেছি মোরা নিরবধি,
মোদের মাঝারে শত জনমের শত সে জলধি বহে।
বারেবারে ডুবি বারেবারে উঠি জন্ম-মৃত্যু-দহে!
বারে বারে মোরা পাষাণ হইয়া আপনারে থাকি ভুলি,
ক্ষণেকের তরে আসে কবে ঝড়, বন্ধন যায় খুলি।
সহসা সে কোন সন্ধ্যায়, রানি,
চকিতে হয় গো চির-জানাজানি!
মনে পড়ে যায় অভিশাপ-বাণী, উড়ে যায় বুলবুলি।
কেঁদে কও, ‘প্রিয়, হেথা নয়, হেথা লাগিয়াছে বহু ধূলি।’
মুছি পথধূলি বুকে লবে তুলি মরণের পারে কবে,
সেই আশে, প্রিয়, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে!
কে জানিত হায় মরমের মাঝে
এমন বিয়ের নহবত বাজে!
নবজীবনের বাসর-দুয়ারে কবে ‘প্রিয়া’‘বধূ’হবে –
সেই সুখে, প্রিয়া, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
-বিশ বৎসর আগে
তোমার স্বপ্ন অনাগত ‘নবযুগ’-এর রক্তরাগে
রেঙে উঠেছিল। স্বপ্ন সেদিন অকালে ভাঙিয়া গেল,
দৈবের দোষে সাধের স্বপ্ন পূর্ণতা নাহি পেল!
যে দেখায়েছিল সে মহৎ স্বপ্ন, তাঁরই ইঙ্গিতে বুঝি
পথ হতে হাত ধরে এনেছিলে এই সৈনিকে খুঁজি?
কোথা হতে এল লেখার জোয়ার তরবারি-ধরা হাতে
কারার দুয়ার ভাঙিতে চাহিনু নিদারুণ সংঘাতে।–
হাতের লেখনী, কাগজের পাতা নহে ঢাল তলোয়ার,
তবুও প্রবল কেড়ে নিল দুর্বলের সে অধিকার!
মোর লেখনীর বহ্নিস্রোত বাধা পেয়ে পথে তার
প্রলয়ংকর ধূমকেতু হয়ে ফিরিয়া এল আবার!
ধূমকেতু-সম্মার্জনী মোর করে নাই মার্জনা
কারও অপরাধ ; অসুরে নিত্য হানিয়াছে লাঞ্ছনা!-
হারাইয়া গেনু ধুমকেতু আমি দু-দিনের বিস্ময়,
মরা তারাসম ঘুরিয়া ফিরিনু শূন্য আকাশময়।সে যুগের ওগো জগলুল! আমি ভুলিনি তোমার স্নেহ,
স্মরণে আসিত তোমার বিরাট হৃদয়, বিশাল দেহ।
কত সে ভুলের কাঁটা দলি, কত ফুল ছড়াইয়া তুমি,
ঘুরিয়া ফিরেছ আকুল তৃষায় জীবনের মরুভূমি।
আমি দেখিতাম, আমার নিরালা নীল আশমান থেকে
চাঁদের মতন উঠিতেছ, কভু যাইতেছ মেঘ ঢেকে।
সুদূরে থাকিয়া হেরিতাম তব ভুলের ফুলের খেলা,
কে যেন বলিত, এ চাঁদ একদা হইবে পারের ভেলা।সহসা দেখিনু, এই ভেলা যাহাদের পার করে দিল,
যে ভেলার দৌলত ও সওদা দশ হাতে লুটে নিল,
বিশ্বাসঘাতকতা ও আঘাত-জীর্ণ সেই ভেলায়
উপহাস করে তাহারাই আজ কঠোর অবহেলায়!
মানুষের এই অকৃতজ্ঞতা দেখি উঠি শিহরিয়া,
দানীরে কি ঋণী স্বীকার করিল এই সম্মান দিয়া?
যত ভুল তুমি করিয়াছ, তার অনেক অধিক ফুল
দিয়াছ রিক্ত দেশের ডালায়, দেখিল না বুলবুল!
যে সূর্য আলো দেয়, যদি তার আঁচ একটুকু লাগে,
তাহারই আলোকে দাঁড়ায়ে অমনি গাল দেবে তারে রাগে?
নিত্য চন্দ্র সূর্য; তারাও গ্রহণে মলিন হয়;
তাই বলে তার নিন্দা করা কি বুদ্ধির পরিচয়?
এই কী বিচার লোভী মানুষের? বক্ষে বেদনা বাজে,
অর্থের তরে অপমান করে আপনার শির-তাজে!
দুঃখ কোরো না, ক্ষমা করো, ওগো প্রবীণ বনস্পতি!
যার ছায়া পায় তারই ডাল কাটে অভাগা মন্দমতি।আমি দেখিয়াছি দুঃখীর তরে তোমার চোখের পানি,
এক আল্লাহ্ জানেন তোমারে, দিয়াছ কী কোরবানি!
এরা অজ্ঞান, এরা লোভী, তবু ইহাদেরে করো ক্ষমা,
আবার এদেরে ডেকে আল্লার ঈদ্গাহে করো জমা।
শপথ করিয়া কহে এ বান্দা তার আল্লার নামে,
কোনো লোভ কোনো স্বার্থ লইয়া দাঁড়াইনি আমি বামে।
যে আল্লা মোরে রেখেছেন দূরে সব চাওয়া পাওয়া হতে,
চলিতে দেননি যিনি বিদ্বেষ-গ্লানিময় রাজপথে,
যে পরম প্রভু মোর হাতে দিয়া তাঁহার নামের ঝুলি,
মসনদ হতে নামায়ে, দিলেন আমারে পথের ধূলি,
সেই আল্লার ইচ্ছায় তুমি ডেকেছ আমারে পাশে!–
অগ্নিগিরির আগুন আবার প্রলয়ের উল্লাসে
জাগিয়ে উঠেছে, তাই অনন্ত লেলিহান শিখা মেলি,
আসিতে চাহিছে কে যেন বিরাট পাতাল-দুয়ার ঠেলি,
অনাগত ভূমিকম্পের ভয়ে দুনিয়ায় দোলা লাগে,
দ্যাখো দ্যাখো শহিদান ছুটে আসে মৃত্যুর গুলবাগে!
কে যেন কহিছে, ‘বান্দা আর এক বান্দার হাত ধরো,
মোর ইচ্ছায় ওর ইচ্ছারে তুমি সাহায্য করো,’
তাই নবযুগ আসিল আবার। রুদ্ধ প্রাণের ধারা
নাচিছে মুক্ত গগনের তলে দুর্দম মাতোয়ারা।
এই নবযুগ ভুলাইবে ভেদ, ভায়ে ভায়ে হানাহানি,
এই নবযুগ ফেলিবে ক্লৈব্য ভীরুতারে দূরে টানি।
এই নবযুগ আনিবে জরার বুকে নবযৌবন,
প্রাণের প্রবাহ ছুটিবে, টুটিবে জড়তার বন্ধন।
এই নবযুগ সকলের, ইহা শুধু আমাদের নহে,
সাথে এসো নওজোয়ান! ভুলিয়া থেকো না মিথ্যা মোহে।
ইহা নহে কারও ব্যাবসার, স্বদেশের স্বজাতির এ যে,
শোনো আশমানে এক আল্লার ডঙ্কা উঠিছে বেজে।মোরা জনগণ, শতকরা মোরা নিরানব্বই জন,
মোরাই বৃহৎ, সেই বৃহতের আজ নবজাগরণ।
ক্ষুদ্রের দলে কে যাবে তোমরা ভোগবিলাসের লোভে?
আর দেরি নাই, ওদের কুঞ্জ ধূলিলুন্ঠিত হবে!
আছে হাদের বৃহতের তৃষা, নির্ভয় যার প্রাণ,
সেই বীরসেনা লয়ে জয়ী হবে নবযুগ-অভিযান।
আল্লার রাহে ভিক্ষা চাহিতে নবযুগ আসিয়াছে,
মহাভিক্ষুরে ফিরায়ো না, দাও যার যাহা কিছু আছে।
জাগিছে বিরাট দেহ লয়ে পুন সুপ্ত অগ্নিগিরি,
তারই ধোঁয়া আজ ধোঁয়ায়ে উঠেছে আকাশভুবন ঘিরি।
একী এ নিবিড় বেদনা
একী এ বিরাট চেতনা
জাগে পাষাণের শিরায় শিরায়, সাথে জনগণ জাগে,
হুংকারে আজ বিরাট, ‘বক্ষে কার পা-র ছোঁয়া লাগে,
কোন মায়াঘুমে ঘুমায়ে ছিলাম, বুঝি সেই অবসরে
ক্ষুদ্রের দল বৃহতের বুকে বসে উৎপাত করে!
মোর অণুপরমাণু জনগণ জাগো, ভাঙো ভাঙো দ্বার,
রুদ্র এসেছে বিনাশিতে আজ ক্ষুদ্র অহংকার।’ (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
কত ছল করে সে বারে বারে দেখতে আসে আমায়।
কত বিনা-কাজের কাজের ছলে চরণ দুটি
আমার দোরেই থামায়। জানলা-আড়ে চিকের পাশে
দাঁড়ায় এসে কীসের আশে,
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল গাল দুটিকে ঘামায়। সবাই যখন ঘুমে মগন দুরুদুরু বুকে তখন
আমায় চুপে চুপে
দেখতে এসেই মল বাজিয়ে দৌড়ে পলায়,
রং খেলিয়ে চিবুক গালের কূপে!
দোর দিয়ে মোর জলকে চলে
কাঁকন হানে কলস-গলে!
অমনি চোখাচোখি হলে
চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়, চোখ দুটিকে নামায়। সইরা হাসে দেখে তাহার দোর দিয়ে মোর
নিতুই নিতুই কাজ-অকাজে হাঁটা,
করবে কী ও? রোজ যে হারায় আমার দোরেই
শিথিল বেণির দুষ্টু মাথার কাঁটা! একে ওকে ডাকার ভানে
আনমনা মোর মনটি টানে,
কী যে কথা সেই তা জানে
ছল-কুমারী নানান ছলে আমারে সে জানায়। পিঠ ফিরিয়ে আমার পানে দাঁড়ায় দূরে
উদাস নয়ান যখন এলোকেশে,
জানি, তখন মনে মনে আমার কথাই ভাবতেছে সে,
মরেছে সে আমায় ভালোবেসে! বই-হাতে সে ঘরের কোণে
জানি আমার বাঁশিই শোনে,
ডাকলে রোষে আমার পানে,
নয়না হেনেই রক্তকমল-কুঁড়ির সম চিবুকটি তার নামায়। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
হে মোর রাণি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী
দিনে দিনে ক্লানি- আনে, হ’য়ে ওঠে ভারী,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।
ওগো জীবন-দেবী।
আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তৃণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে’,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
আজ নতুন করে পড়ল মনে মনের মতনে
এই শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।
কার কথা আজ তড়িৎ-শিখায়
জাগিয়ে গেল আগুন লিখায়,
ভোলা যে মোর দায় হল হায়
বুকের রতনে।
এই শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে।
আজ উতল ঝড়ের কাতরানিতে গুমরে ওঠে বুক
নিবিড় ব্যথায় মূক হয়ে যায় মুখর আমার মুখ।
জলো হাওয়ার ঝাপটা লেগে
অনেক কথা উঠল জেগে
পরান আমার বেড়ায় মেগে
একটু যতনে।
এই শাঙন সাঁঝের ভেজা হাওয়ায়, বারির পতনে। (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর
কে সেই সুন্দর, কে?
আমি যার বিলাস যমুনা, বিরহ বিধুর
কে সেই সুন্দর, কে?যাহার গলে আমি বনমালা
আমি যার কথার কুসুমডালা
না দেখা সুদূর
কে সেই সুন্দর, কে?যার শিখীপাখা লেখনী হয়ে
গোপনে মোরে কবিতা লেখায়
সে রহে কোথায় হায়?আমি যার বরষার আনন্দ কেকা
নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনীরেখা
যে মম অঙ্গের কাঁকন-কেয়ূর
কে সেই সুন্দর, কে?
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
যাস কোথা সই একলা ও তুই অলস বৈশাখে?
জল নিতে যে যাবি ওলো কলস কই কাঁখে? সাঁঝ ভেবে তুই ভর-দুপুরেই দু-কূল নাচায়ে
পুকুরপানে ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজায়ে
যাসনে একা হাবা ছুঁড়ি,
অফুট জবা চাঁপা-কুঁড়ি তুই!
দ্যাখ্ রং দেখে তোর লাল গালে যায়
দিগ্বধূ ফাগ থাবা থাবা ছুঁড়ি,
পিক-বধূ সব টিটকিরি দেয় বুলবুলি চুমকুড়ি –
ওলো বউল-ব্যাকুল রসাল তরুর সরস ওই শাখে॥
দুপুর বেলায় পুকুর গিয়ে একূল ওকূল গেল দুকূল তোর,
ওই চেয়ে দ্যাখ পিয়াল-বনের দিয়াল ডিঙে এল মুকুল-চোর।
সারং রাগে বাজায় বাঁশি নাম ধরে তোর ওই,
রোদের বুকে লাগল কাঁপন সুর শুনে ওর সই।
পলাশ অশোক শিমূল-ডালে
বুলাস কি লো হিঙুল গালে তোর?
আ – আ মলো যা! তাইতে হা দ্যাখ,
শ্যাম চুমু খায় সব সে কুসুম লালে
পাগলি মেয়ে! রাগলি নাকি? ছি ছি দুপুর-কালে
বল কেমনে দিবি সরস অধর-পরশ সই তাকে? (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ছড়া
|
‘সাত ভাই চম্পা জাগো’ –
পারুলদি ডাকল, না গো?
একী ভাই, কাঁদচ? – মা গো
কী যে কয় – আরে দুত্তুর!পারায়ে সপ্ত-সাগর
এসেছে সেই চেনা-বর?
কাহিনির দেশেতে ঘর
তোর সেই রাজপুত্তুর?মনে হয়, মণ্ডা মেঠাই
খেয়ে জোর আয়েশ মিটাই! –
ভালো ছাই লগাছে না ভাই,
যাবি তুই একেলাটি!দিদি, তুই সেথায় গিয়ে
যদি ভাই যাস ঘুমিয়ে,
জাগাব পরশ দিয়ে
রেখে যাস সোনার কাঠি। (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
নার্গিস-বাগমে বাহার কী আগমে ভরা দিল দাগমে –
কাঁহা মেরি পিয়ারা, আও আও পিয়ারা।
দুরু দুরু ছাতিয়া ক্যায়সে এ রাতিয়া কাটুঁ বিনু সাথিয়া
ঘাবরায়ে জিয়ারা, তড়পত জিয়ারা।
দরদে দিল জোর, রঙিলা কওসর
শরাবন তহুরা লাও সাকি লাও ভর,
পিয়ালা তু ধর দে, মস্তানা কর দে, সব দিল ভর দে
দরদ মে ইয়ারা – সঙ্গ দিল ইয়ারা।
জিগর কা খুন নেহি, ডরো মত সাকিয়া,
আঙ্গুরী-লোহুয়ো, - ক্যাঁও ভিঙ্গা আঁখিয়া?
গিয়া পিয়া আতা নেহি মত কহো সহেলি,
ছোড়ো হাত – পিয়ালা য়ো ভর দে তু পহেলি!
মত মাচা গওগা, বসন্তমে বাহবা ম্যায় সে ক্যা তৌবা?
আহা গোলনিয়ারা সখি গোলনিয়ারা –
শরাব কা নূর সে রৌশন কর দে দুনিয়া আঁধিয়ারা
দুনিয়া আঁধিয়ারা দুনিয়া আঁধিয়ারা।
(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রকৃতিমূলক
|
ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রানে আজি অঘ্রান হ'ল মাৎ।
'গিন্নি-পাগল' চা'লের ফিরনী
তশতরী ভ'রে নবীনা গিন্নী
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশীতে কাঁপিছে হাত।
শিরনী রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ী গন্ধে তেলেসমাত!মিঞা ও বিবিতে বড় ভাব আজি খামারে ধরে না ধান।
বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান!
'শাশবিবি' কন, 'আহা, আসে নাই
কতদিন হ'ল মেজলা জামাই।'
ছোট মেয়ে কয়, 'আম্মা গো, রোজ কাঁদে মেজো বুবুজান!'
দলিজের পান সাজিয়া সাজিয়া সেজো-বিবি লবেজান!হল্লা করিয়া ফিরিছে পারার দস্যি ছেলের দল!
ময়নামতীর শাড়ী-পরা মেয়ে গয়নাতে ঝলমল!
নতুন পৈঁচি বাজুবন্দ প'রে
চাষা-বৌ কথা কয় না গুমোরে,
জারী গান আর গাজীর গানেতে সারা গ্রাম চঞ্চল!
বৌ করে পিঠা 'পুর'-দেওয়া মিঠা, দেখে জিভে সরে জল!মাঠের সাগরে জোয়ারের পরে লেগেছে ভাটির টান।
রাখাল ছেলের বিদায়-বাঁশীতে ঝুরিছে আমন ধান!
কৃষক-কন্ঠে ভাটিয়ালী সুর
রোয়ে রোয়ে মরে বিদায়-বিধুর!
ধান ভানে বৌ, দুলে দুলে ওঠে রূপ-তরঙ্গে বান!
বধূর পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকিও প্রান!হেমন্ত-গায় হেলান দিয়ে গো রৌদ্র পোহায় শীত!
কিরণ-ধারায় ঝরিয়া পড়িছে সূর্য - আলো-সরিৎ!
দিগন্তে যেন তুর্কী-কুমারী
কুয়াশা-নেকাব রেখেছে উতারি'!
চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশীথ,
নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হ'ল হরিৎ পাতারা পীত!নবীনের লাল ঝান্ডা উড়ায়ে আসিতেছে কিশলয়,
রক্ত নিশান নহে যে রে ওরা রিক্ত শাখার জয়!
'মুজদা' এনেছে অগ্রহায়ণ-
আসে নৌরোজ খোল গো তোরণ,
গোলা ভ'র রাখ সারা বছরের হাসি-ভরা সঞ্চয়।
বাসি বিছানায় জাগিতেছে শিশু সুন্দর নির্ভয়!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
ওগো প্রিয় তব গান
আকাশ গাঙের জোয়ারে উজান বাহিয়া যায়।
মোর কথাগুলি কাঁদিছে বুকের মাঝারে,
পথ খুঁজে নাহি পায়।ওগো দখিনা বাতাস, ফুলের সুরভি বহ
ওরি সাথে মোর না বলা বাণী লহ।
ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহ
বন্দিনী গিরি-ঝরণা পাষাণতলে যে কথা কহিতে চায়।ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি
তোদের ভাটির স্রোতে
নিয়ে যা আমার না বলা কথাগুলি
ধুয়ে মোর বুক হতে।ওরে ‘চোখ গেল’ ‘বৌ কথা কও’ পাখি
তোদের কণ্ঠে মোর সুর যাই রাখি।
ওরে মাঠের মুরলি কহিও তাহারে ডাকি
আমার এ কলি, না-ফোটা বুলি, ঝরে গেল নিরাশায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ছড়া
|
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।
আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল! …
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা…!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
কোন ঘর-ছাড়া বিবাগীর বাঁশি শুনে উঠেছিল জাগি'
ওগো চির-বৈরাগী!
দাঁড়ালে ধুলায় তব কাঞ্চন-কমল-কানন ত্যাগি'-
ওগো চির বৈরাগী।ছিলে ঘুম-ঘোরে রাজার দুলাল,
জানিতে না কে সে পথের কাঙ্গাল
ফেরে পথে পথে ক্ষুধাতুর-সাথে ক্ষুধার অন্ন মাগি',
তুমি সুধার দেবতা 'ক্ষুধা ক্ষুধা' বলে কাঁদিয়া উঠিলে জাগি'-
ওগো চির-বৈরাগী!আঙ্গিয়া তোমার নিলে বেদনার গৈরিক-রঙ্গে রেঙ্গে'
মোহ ঘুমপুরো উঠিল শিহরি' চমকিয়া ঘুম ভেঙ্গে!
জাগিয়া প্রভাতে হেরে পুরবাসী
রাজা দ্বারে দ্বারে ফেরে উপবাসী,
সোনার অঙ্গ পথের ধুলায় বেদনার দাগে দাগী!
কে গো নারায়ন নবরূপে এলে নিখিল-বেদনা-ভাগী-
ওগো চির-বৈরাগী!'দেহি ভবিত ভিকষাম' বলি' দাঁড়ালে রাজ-ভিখারী,
খুলিল না দ্বার, পেলে না ভিক্ষা, দ্বারে দ্বারে ভয় দ্বারী!
বলিলে, 'দেবে না? লহ তবে দান-
ভিক্ষাপূর্ণ আমার এ প্রান!'-
দিল না ভিক্ষা, নিল না ক' দান, ফিরিয়া চলিলে যোগী।
যে-জীবন কেহ লইল না তাহা মৃত্যু লইল মাগি'।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?
হয়ত তোমায় স-ন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।
না-ই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি;
তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তারা আমাদের জ্ঞাতি;
আমাদেরই মতো খ্যাতি যশ মান তারাও লভিতে পারে,
তাহাদের সাধনা হানা দিতে পারে সদর স্বর্গ-দ্বারে।-
স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী-পুত্র হ’ল মহাবীর দ্রোণ,
কুমারীর ছেলে বিশ্ব-পূজ্য কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন.
কানীন-পুত্র কর্ণ হইল দান-বীর মহারথী
স্বর্গ হইতে পতিতা গঙ্গা শিবেরে পেলেন পতি,
শান-নু রাজা নিবেদিল প্রেম পুনঃ সেই গঙ্গায়-
তাঁদেরি পুত্র অমর ভীষ্ম, কৃষ্ণ প্রণমে যায়!
মুনি হ’ল শুনি সত্যকাম সে জারজ জবালা-শিশু,
বিস্ময়কর জন্ম যাঁহার-মহাপ্রেমিক সে যিশু!-
কেহ নহে হেথা পাপ-পঙ্কিল, কেহ সে ঘৃণ্য নহে,
ফুটিছে অযুত বিমল কমল কামনা-কালীয়-দহে!
শোনো মানুষের বাণী,
জন্মের পর মানব জাতির থাকে না ক’ কোনো গ্লানি!
পাপ করিয়াছি বলিয়া কি নাই পুণ্যেরও অধিকার?
শত পাপ করি’ হয়নি ক্ষুন্ন দেবত্ব দেবতার।
অহল্যা যদি মুক্তি লভে, মা, মেরী হ’তে পারে দেবী,
তোমরাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি’?
তব সন্তানে জারজ বলিয়া কোন্ গোঁড়া পাড়ে গালি,
তাহাদের আমি এই দু’টো কথা জিজ্ঞাসা করি খালি-
দেবতা গো জিজ্ঞাসি-
দেড় শত কোটি সন্তান এই বিশ্বের অধিবাসী-
কয়জন পিতা-মাতা ইহাদের হ’য়ে নিষ্কাম ব্রতী
পুত্রকন্যা কামনা করিল? কয়জন সৎ-সতী?
ক’জন করিল তপস্যা ভাই সন্তান-লাভ তরে?
কার পাপে কোটি দুধের বা”চা আঁতুড়ে জন্মে’ মরে?
সেরেফ্ পশুর ক্ষুধা নিয়ে হেথা মিলে নরনারী যত,
সেই কামানার সন্তান মোরা! তবুও গর্ব কত!
শুন ধর্মের চাঁই-
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!
অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ছড়া
|
মা ডেকে কন, ‘খোকন-মণি! গপ্প তুমি জানো?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বললে খোকন, ‘গপপ জানি, জানি আমি গানও!’
বলেই খুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল –
‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’
মা সে হেসে তখন
বলেন, ‘উহুঁ, গান না, তুমি গপ্প বলো খোকন!’
ন্যাংটা শ্রীযুত খোকা তখন জোর গম্ভীর চালে
সটান কেদারাতে শুয়ে বলেন, “সত্যিকালে
এক যে ছিল রাজা আর মা এক যে ছিল রানি,
হাঁ মা আমি জানি,
মায়ে পোয়ে থাকত তারা,
ঠিক যেন ওই গোঁদলপাড়ার জুজুবুড়ির পারা!
একদিন না রাজা –
ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড়ভাজা!
রানি গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক!
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে
হাতির মতন একটা বেড়াল-বাচ্চা শিকার করে।
এসে রাজা দেখেন কিনা বাপ!
রাজবাড়িতে আগড় দেওয়া, রানি কোথায় গাপ!
দুটোয় গিয়ে এলেন রাজা সতরোটার সে সময়!
বলো তো মা-মণি তুমি, খিদে কি তায় কম হয়?
টাটি-দেওয়া রাজবাড়িতে ওগো,
পান্তাভাত কে বেড়ে দেবে?
খিদের জ্বালায় ভোগো!
ভুলুর মতন দাঁত খিঁচিয়ে বলেন তখন রাজা,
নাদনা দিয়ে জরুর রানির ভাঙা চাই-ই মাজা।
এমন সময় দেখেন রাজা আসচে রানি দৌড়ে
সারকুঁড় হতে ক্যাঁকড়া ধরে রাম-ছাগলে চড়ে!
দেখেই রাজা দাদার মতন খিচমিচিয়ে উঠে –”
‘হাঁরে পুঁটে!’
বলেই খোকার শ্রীযুত দাদা সটান
দুইটি কানে ধরে খোকার চড় কসালেন পটাম্।
বলেন, ‘হাঁদা! ক্যাবলাকান্ত! চাষাড়ে।
গপ্প করতে ঠাঁই পাওনি চণ্ডুখুড়ি আষাঢ়ে?
দেব নাকি ঠ্যাংটা ধরে আছাড়ে?
কাঁদেন আবার! মারব এমন থাপড়,
যে কেঁদে তোমার পেটটি হবে কামার শালার হাপর!’
চড় চাপড় আর কিলে,
ভ্যাবাচ্যাকা খোকামণির চমকে গেল পিলে!
সেদিনকারের গপ্প বলার হয়ে গেল রফা,
খানিক কিন্তু ভেড়ার ভ্যাঁ ডাক শুনেছিলুম তোফা! (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
শহীদের লোহু, দিলিরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।
যুঝেছে এখানে তুর্কি-সেনানী,
য়ুনানি, মিস্রি, আর্বি, কেনানি–
লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্ বেদুঈন্দের চাঙ্গা শির!
নাঙ্গা-শির্–
শম্শের হাতে, আঁসু-আঁখে হেথা মূর্তি দেখেছি বীর-নারীর!
শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
'কুত-আমারা'র রক্তে ভরিয়া
দজ্লা এনেছে লোহুর দরিয়া;
উগারি সে খুন তোমাতে দজ্লা নাচে ভৈরব 'মস্তানি'র।
এস্তা-নীর
গর্জে রক্ত-গঙ্গা ফোরাত, –'শাস্তি দিয়েছি গোস্তাখির!'
দজ্লা-ফোরাত-বাহিনী শাতিল! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
বহায়ে তোমার লোহিত বন্যা
ইরাক আজমে করেছ ধন্যা;–
বীর-প্রসূ দেশ হলো বরেণ্যা মরিয়া মরণ মর্দমির!
মর্দ বীর
সাহারায় এরা ধুঁকে মরে তবু পরে না শিকল পদ্ধতির।
শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব্! পূত যুগে যুগে তোমার তীর!
দুশ্মন্-লোহু ঈর্ষায়-নীল
তব তরঙ্গে করে ঝিলমিল্,
বাঁকে বাঁকে রোষে মোচড় খেয়েছ পিয়ে নীল খুন পিণ্ডারির!
জিন্দা বীর
'জুলফিকার' আর 'হায়দরি' হাঁক হেথা আজো হজরত্ আলীর-
শাতিল্-আরব!-শাতিল্-আরব!! জিন্দা রেখেছে তোমার তীর।
ললাটে তোমার ভাস্বর টীকা
বস্রা-গুলের বহ্নিতে লিখা–
এ যে বসোরার খুন-খারাবি গো রক্ত-গোলাব-মঞ্জরীর!
খঞ্জরীর
খঞ্জরে ঝরে খর্জুর সম হেথা লাখো দেশ-ভক্ত-শির!
শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব!! পূত যুগে তোমার তীর।
ইরাক-বাহিনী! এ যে গো কাহিনী,–
কে জানিত কবে বঙ্গ-বাহিনী
তোমারও দুঃখে 'জননী আমার!' বলিয়া ফেলিবে তপ্ত নীর!
রক্ত-ক্ষীর–
পরাধীনা! একই ব্যথায় ব্যথিত ঢালিল দু-ফোঁটা ভক্ত-বীর।
শহীদের দেশ! বিদায়! বিদায়!! এ অভাগা আজ নোয়ায় শির!
—————————–
শাতিল আরব– আরব দেশের একটি নদীর নাম।
দিলির– অসম সাহসী
য়ুয়ানি– য়ুনান দেশের অধিবাসী
মিস্রিা– মিশরের অধিবাসী
কেনানি– কেনানের অধিবাসী
চাঙ্গা– টাটকা
কুত-আমারা–
কুতল-আমার নামক স্থান, যেখানে জেনারেল টাউনসেন্ড বন্দী হন।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
[গান]
ভাই হয়ে ভাই চিনবি আবার গাইব কি আর এমন গান।
(সেদিন)দুয়ার ভেঙে আসবে জোয়ার মরা গাঙে ডাকবে বান॥
(তোরা)স্বার্থ-পিশাচ যেমন কুকুর তেমনি মুগুর পাস রে মান।
(তাই) কলজে চুঁয়ে গলছে রক্ত দলছে পায়ে ডলছে কান॥
(যত) মাদি তোরা বাঁদি-বাচ্চা দাস-মহলের খাস গোলাম।
(হায়) মাকে খুঁজিস? চাকরানি সে, জেলখানাতে ভানছে ধান॥
(মা’র) বন্ধ ঘরে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হলো দুই নয়ান।
(তোরা) শুনতে পেয়েও শুনলিনে তা মাতৃহন্তা কুসন্তান॥
(ওরে)তোরা করিস লাঠালাঠি (আর) সিন্ধু-ডাকাত লুঠছে ধান।
(তাই) গোবর-গাদা মাথায় তোদের কাঁঠাল ভেঙে খায় শেয়ান॥
(ছিলি) সিংহ ব্যাঘ্র, হিংসা-যুদ্ধে আজকে এমনি ক্ষিণ্ণপ্রাণ।
(তোদের) মুখের গ্রাস ঐ গিলছে শিয়াল তোমরা শুয়ে নিচ্ছ ঘ্রাণ॥
(তোরা) কলুর বলদ টানিস ঘানি গলদ কোথায় নাইকো জ্ঞান।
(শুধু) পড়ছ কেতাব, নিচ্ছ খেতাব, নিমক-হারাম বে-ঈমান॥
(তোরা) বাঁদর ডেকে মানলি সালিশ, ভাইকে দিতে ফাটল প্রাণ।
(এখন) সালিশ নিজেই 'খা ডালা সব' বোকা তোদের এই দেখান॥
(তোরা) পথের কুকুর দু'কান-কাটা-মান-অপমান নাইকো জ্ঞান।
(তাই) যে জুতোতে মারছে গুঁতো করছ তাতেই তৈল দান॥
(তোরা) নাক কেটে নিজ পথের যাত্রা ভঙ্গ করিস বুদ্ধিমান।
(তোদের) কে যে ভাল কে যে মন্দ সব শিয়ালই এক সমান॥
(শুনি) আপন ভিটেয় কুকুর রাজা, তার চেয়েও হীন তোদের প্রাণ।
(তাই) তোদের দেশ এই হিন্দুস্থানে নাই তোদেরই বিন্দু স্থান॥
(তোদের) হাড় খেয়েছে, মাস খেয়েছে, (এখন) চামড়াতে দেয় হেঁচকা টান
(আজ) বিশ্ব-ভুবন ডুকরে ওঠে দেখে তোদের অসম্মান॥
(আজ) সাধে ভারত-বিধাতা কি চোখ বেঁধে ঐ মুখ লুকান।
(তোরা) বিশ্বে যে তাঁর রাখিস নে ঠাঁই কানা গরুর ভিন্ বাথান॥
(তোরা) করলি কেবল অহরহ নীচ কলহের গরল পান।
(আজো) বুঝলি না হায় নাড়ি-ছেঁড়া মায়ের পেটের ভায়ের টান॥
(ঐ) বিশ্ব ছিঁড়ে আনতে পারি, পাই যদি ভাই তোদের প্রাণ।
(তোরা) মেঘ-বাদলের বজ্রবিষাণ (আর) ঝড়-তুফানের লাল নিশান॥
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
চিত্ত- কুঁড়ি- হাস্না- হানা মৃত্যু- সাঁঝে ফুটলো গো!
জীবন- বেড়ায় আড়াল ছাপি' বুকের সুবাস টুটলো গো!
এই ত কারার প্রাকার টুটে'
বন্দী এল বাইরে ছুটে,
তাই ত নিখিল আকুল- হৃদয় শ্মশান- মাঝে জুটল গো!
ভবন- ভাঙ্গা আলোর শিখায় ভূবন রেঙ্গে উঠলো গো।স্ব-রাজ দলের চিত্ত- কমল লুটল বিশ্বরাজের পায়,
দলের চিত্ত উঠলো সুটে শতদলের শ্বেত আভায়।
রূপে কুমার আজকে দোলে
অপরূপের শীশ- মহলে,
মৃত্যু- বাসুদেবের কোলে কারার কেশব ঐ গো যায়,
অনাগত বৃন্দাবনে মা যশদা শাঁখ বাজায়।আজকে রাতে যে ঘুমুলো, কালকে প্রাতে জাগবে সে।
এই বিদায়ের অস্ত আঁধার উদয়-ঊষার রাংবে রে!
শোকের নিশির শিশির ঝরে
ফলবে ফসল ঘরে ঘরে,
আবার শীতের রিক্ত শাখায় লাগবে ফুলেল রাগ এসে।
যে মা সাঁঝে ঘুম পাড়াল, চুম দিয়ে ঘুম ভাংবে সে।না ঝ'রলে তাঁর প্রান- সাগরে মৃত্যু- রাতের হিম- কণা
জীবন- শুক্তি ব্যররথ হ'ত, মুক্তি- মুক্তা ফ'লত না।
নিখিল আঁখির ঝিনুক মাঝে
অশ্রু- মাণিক ঝলত না যে!
রোদের উনুন না নিবিলে চাঁদের সুধা গ'লত না।
গগন- লোকে আকাশ বধুর সন্ধ্যা- প্রদীপ জ্ব'লত না।মরা বাঁশে বাজবে বাঁশি কাটুক না আজ কুঠার তায়,
এই বেনুতেই ব্রজের বাঁশি হয়ত বাজবে এই হেথায়।
হয়ত এবার মিলন- রাসে
বংশীধারী আসবে পাশে,
চিত্ত- চিতার ছাই মেখে শিব সৃষ্টি- বিষান ঐ বাজায়!
জন্ম নেবে মেহেদী ঈসা ধরার বিপুল এই ব্যথায়।কর্মে যদি বিরাম না রয়,শান্তি তবে আসত না!
ফ'লবে ফসল- নইলে নিখিল নয়ন- নীরে ভাসত না!
নেই ক' দেহের খোসার মায়া,
বীজ আনে তাই তরুর ছায়া,
আবার যদি না জন্মাত, মৃত্যুতে সে হাসত না।
আসবে আবার- নৈলে ধরায় এমন ভালো বাসত না!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে
অঝোর নয়নে রে।
দু'হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি
পড়িল কি মনে রে।।দুধের ছাওয়াল আসগর এই পানি ছাহিয়ে রে
দুষ্মনের তীর খেয়ে বুকে ঘুমাল খুন পিয়ে রে,
শাদীর নওশা কাসেম শহীদ এই পানি বহনে রে।।এই পানিতে মুছিল রে হাতের মেহেদী সকীনার,
এই পানিরই ঢেউয়ে ওঠে তারি মাতম হাহাকার,
শহীদানের খুন মিশে আছে এই পানিরই সনে রে।।বীর আব্বাসের বাজু শহীদ হলো এরি তরে রে,
এই পানি বিহনে জয়নাল খিমায় তৃষ্ণায় মরে রে,
শোকে শহীদ হলেন হোসেন জয়ী হয়েও রণে রে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়,
বিশ্বাসী! বলো আসবে আবার প্রভাত-রবির জয়!
খণ্ড করে দেখছে যারা অসীম জীবনটাই,
দুঃখ তারাই করুক বসে, দুঃখ মোদের নাই।
আমরা জানি, অস্ত-খেয়ায় আসছে রে উদয়।
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।হারাই-হারাই ভয় করেই না হারিয়ে দিলি সব!
মরার দলই আগলে মড়া করছে কলরব।
ঘরবাড়িটাই সত্য শুধু নয় কিছুতেই নয়।
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।দৃষ্টি-অচিন দেশের পরেও আছে চিনা দেশ,
এক নিমেষের নিমেষ-শেষটা নয়কো অশেষ শেষ।
ঘরের প্রদীপ নিবলে বিধির আলোক-প্রদীপ রয়।
বিদায়-রবির করুণিমায় অবিশ্বাসীর ভয়।জয়ধ্বনি উঠবে প্রাচীন চিনের প্রাচীরে,
অস্ত-ঘাটে বসে আমি তাই তো নাচি রে।
বিদায়-পাতা আনবে ডেকে নবীন কিশলয়,
বিশ্বাসী! বল আসবে আবার প্রভাত-রবির জয় । (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
এস প্রিয় আরো কাছে
পাইতে হূদয়ে যে বিরহী মন যাচে।দেখাও প্রিয়-ঘন স্বরূপ মোহন
যে রূপে প্রেমাবেশে পরাণ নাচে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি করআসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশায় নৃত্য পাগল
সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক ভেনে ভাঙলো আগল
মৃত্যুগহন অন্ধকুপে মহাকালের চন্ডরূপে ধূম্রধূপে
বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর
ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর
তোরা সব জয়ধ্বনি করদ্বাদশ রবির বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়নকটায়
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়
বিন্দু তাহার নয়নজলে সপ্তমহাসিন্ধু দোলে কপোলতলে
বিশ্বমায়ের আসন তারই বিপুল বাহুর পর
হাঁকে ঐ জয় প্রলয়ংকর
তোরা সব জয়ধ্বনি করমাভৈঃ মাভৈঃ জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে
জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে
এবার মহানিশার শেষে আসবে ঊষা অরুণ হেসে তরুণ বেশে
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশুচাঁদের কর
আলো তার ভরবে এবার ঘর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ব্যঙ্গাত্মক
|
মিলের খিল খুলে গেছে!
কিলবিল করছিল, কাঁচুমাচু হয়েছিল –
কেঁচোর মতন –
পেটের পাঁকে কথার কাতুকুতু!
কথা কি ‘কথক’ নাচ নাচবে
চৌতালে ধামারে?
তালতলা দিয়ে যেতে হলে
কথাকে যেতে হয় কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে
তালের বাধাকে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে!
এই যাঃ! মিল হয়ে গেল!
ও তাল-তলার কেরদানি – দুত্তোর!
মুরগিছানার চিলের মতন
টেকো মাথায় ঢিলের মতন
পড়বে এইবার কথার বাণ্ডিল।
ছন্দ এবার কন্ধকাটা পাঁঠার মতন ছটফটাবে।
লটপটাবে লুচির লেচির আটার মতন!
অক্ষর আর যক্ষর টাকা গোনার মতো
গুনতে হবে না –
অঙ্কলক্ষ্মীর ভয়ে কাব্যলক্ষ্মী থাকতেন
কুঁকড়োর মতন কুঁকড়ে!
ভাবতেন, মিলের চিল কখন দেবে ঠুকরে!
আবার মিল!–
গঙ্গার দু-ধারে অনেক মিল,
কটন মিল, জুট মিল, পেপার মিল –
মিলের অভাব কী?
কাব্যলোকে মিল থাকবে কেন?
ওকে ধুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দাও!
ওখানেও যে মিল আছে!
ধুলো যদি কুলোয় যায় চুলোয় যায়,
হুলো ভুলোয় যদি ল্যাজে মাখে!
ল্যাজ কেটে বেঁড়ে করে দেব!
এঁড়ে দামড়া আছে যে!
আমার মিল আসছে! – মুশকিল আসান।অঙ্কলক্ষ্মীকে মানা করেছিলাম,
মিলের শাড়ি কিনতে।
অঙ্কলক্ষ্মীর জ্বালায় পঙ্কলক্ষ্মী পদ্ম
আর ফোটে না!
তা বলতে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে।
এ কবিতা যদি পড়ে
গায়ে ধানি লংকা ঘষে দেবে! –
আজ যে বিনা প্রয়াসেই অনুপ্রাসের
পাল পেয়েছি দেখছি!
মিল আসছে – যেন মিলানের মেলায়
মেমের ভিড়!
নাঃ! – কবিতা লিখি।
তাকে দেখেছিলাম – আমার মানসীকে
ভেটকি মাছের মতো চেহারা!
আমাকে উড়ে বেহারা মনে করেছিল!
শাড়ির সঙ্গে যেন তার আড়ি।
কাঁখে হাঁড়ি – মাথায় ধামা।
জামা ব্লাউজ শেমিজ পরে না।
দরকার বা কি?
তরকারি বেচে!
সরকারি ষাঁড়ের মতন নাদুস-নুদুস!
চিচিঙ্গের মতন বেণি দুলছিল।সে যে-দেশের, সে-দেশে আঁচলের চল নাই!
চলেন গজ-গমনে।
পায়ে আলতা নাই, চালতার রং।
নাম বললে – ‘আজুলি’
আমি বললাম – ‘ধ্যেৎ, তুমি কাজুলি।’
হাতে চুড়ি নাই,
তুড়ি দেয় আর মুড়ি খায়।
গলায় হার নাই, ব্যাগ আছে।
পায়ে গোদ,
আমি বলি, ‘প্যাগোডা’ সুন্দরী!
গান গাই, ‘ওগো মরমিয়া!’
ও ভুল শোনে! ও গায় –
‘ওগো বড়ো মিয়াঁ!’
থাকত হাতে ‘এয়ার গান!’
ও গায় গেঁয়ো সুরে, চাঁপা ফুল কেয়ার গান। –
দাঁতে মিশি, মাঝে মাঝে পিসি বলতে ইচ্ছা করে।
ডাগর মেয়েরা আমাকে যে হাঙর ভাবে।
হৃদয়ে বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ!
ভিক্ষা চাই না, শিক্ষা দিয়ে দেবে।
তাই ধরেছি রক্ষাকালীর চেড়িকে।
নেংটির আবার বকেয়া সেলাই!
কবিতে লেখার মশলা পেলেই হল
তা না-ই হল গরম মশলা। –
নাঃ, ঘুম আসছে,
রান্নাঘরের ধূম আসছে।
বউ বলে, নাক ডাকছে,
না শাঁখ ডাকছে।
আবার মিল আসছে –
ঘুম আসছে –
দুম্বা ভেড়ার দুম আসছে!
-----------------------শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ!
ভেদ করি পুন বন্ধ কারার অন্ধকারের পাষাণ-ফাঁদ!
এস অনাগত নব-প্রলয়ের মহা সেনাপতি মহামহিম!
এস অক্ষত মোহান্ধ-ধৃতরাষ্ট্র-মুক্ত লৌহ-ভীম!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
ছয়বার জয় করি কারা-ব্যুহ, রাজ-রাহু-গ্রাস-মুক্ত চাঁদ!
আসিলে চরণে দুলায়ে সাগর নয়-বছরের মুক্ত-বাঁধ!
নবগ্রহ ছিঁড়ি ফণি-মনসার মুকুটে তোমার গাঁথিলে হার,
উদিলে দশম মহাজ্যোতিষ্ক ভেদিয়া গভীর অন্ধকার!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
স্বাগত শুদ্ধ রুদ্ধ-প্রতাপ, প্রবুদ্ধ নব মহাবলী!
দনুজ-দমন দধীচি-অস্থি, বহ্নিগর্ভ দম্ভোলি!
স্বাগত সিংহ-বাহিনী-কুমার! স্বাগত হে দেব-সেনাপতি!
অনাগত রণ-কুরুক্ষেত্রে সারথি-পার্থ-মহারথী!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
নৃশংস রাজ-কংস-বংশে হানিতে তোমরা ধ্বংস-মার
এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র, ভাঙিয়া পাষাণ-দৈত্যাগার!
এস অশান্তি-অগ্নিকাণ্ডে শান্তিসেনার কাণ্ডারি!
নারায়ণী-সেনা-সেনাধিপ, এস প্রতাপের হারা- তরবারি!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর!
ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!
না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।
জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
স্বর্গ হইতে জননী তোমার পেতেছেন নামি মাটিতে কোল,
শ্যামল শস্যে হরিৎ ধান্যে বিছানো তাঁহারই শ্যাম আঁচল।
তাঁহারি স্নেহের করুণ গন্ধ নবান্নে ভরি উঠিছে ঐ,
নদীস্রোত-স্বরে কাঁদিছেন মাতা, 'কই রে আমার দুলাল কই?'
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
মোছো আঁখি-জল, এস বীর! আজ খুঁজে নিতে হবে আপন মায়,
হারানো মায়ের স্মৃতি-ছাই আছে এই মাটিতেই মিশিয়া,হায়!
তেত্রিশ কোটি ছেলের রক্তে মিশেছে মায়ের ভস্ম-শেষ,
ইহাদেরি মাঝে কাঁদিছেন মাতা, তাই আমাদের মা স্বদেশ।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর!
এস বীর! এস যুগ-সেনাপতি! সেনাদল তব চায় হুকুম,
হাঁকিছে প্রলয়, কাঁপিছে ধরণী, উদ্গারে গিরি অগ্নি-ধূম।
পরাধীন এই তেত্রিশ কোটি বন্দির আঁখি-জলে হে বীর,
বন্দিনী মাতা যাচিছে শক্তি তোমার অভয় তরবারির।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
গল-শৃঙ্খল টুটেনি আজিও, করিতে পারি না প্রণাম পা'য়,
রুদ্ধ কণ্ঠে ফরিয়াদ শুধু গুমরিয়া মরে গুরু ব্যথায়।
জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম,
শত্রু-খড়্গ-ছিন্ন-মুণ্ড দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ছড়া
|
ভোর হোলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকী ছোট রে!
খুকুমণি ওঠ রে!
রবি মামা
দেয় হামা
গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান
গায় গান
শোনো ঐ, 'রামা হৈ'।
ত্যাজি' নীড়
ক'রে ভিড়
ওড়ে পাখী আকাশে,
এন্তার
গান তার
ভাসে ভোর বাতাসে!
চুলবুল
বুলবুল
খুকুমনি উঠবে!
খুলি'হাল
তুলি' পাল
ঐ তরী চ'ললো,
এইবার
এইবার
খুকু চোখ খুললো!
আলসে
নয় সে
ওঠে রোজ সকালে,
রোজ তাই
চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে।
উঠল
ছুটল
ঐ খোকাখুকী সব,
'উঠেছে
আহে কে'
ঐ শোনো কলরব।
নাই রাত
মুখ হাত
ধোও, খুকু জাগো রে!
জয়গানে
ভগবানে
তুষি'বর মাগো রে!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
আমি ঝড় পশ্চিমের প্রলয়-পথিক –
অসহ যৌবন-দাহে লেলিহান-শিখ
দারুণ দাবাগ্নি-সম নৃত্য-ছায়ানটে
মাতিয়া ছুটিতেছিনু, চলার দাপটে
ব্রহ্মাণ্ড ভণ্ডুল করি। অগ্রে সহচরী
ঘূর্ণা-হাতছানি দিয়া চলে ঘূর্ণি-পরি
গ্রীষ্মের গজল গেয়ে পিলু-বারোয়াঁয়
উশীরের তার-বাঁধা প্রান্তর-বীণায়।
করতালি-ঠেকা দেয় মত্ত তালিবন
কাহারবা-দ্রুততালে। – আমি উচাটন
মন্মথ-উম্মদ আঁখি রাগরক্ত ঘোর
ঘূর্ণিয়া পশ্চাতে ছুটি, প্রমত্ত চকোর
প্রথম-কামনা-ভিতু চকোরিণী পানে
ধায় যেন দুরন্ত বাসনা-বেগ-টানে।
সহসা শুনিনু কার বিদায়-মন্থর
শ্রান্ত শ্লথ গতি-ব্যথা, পাতা-থরথর
পথিক-পদাঙ্ক-আঁকা পুব-পথশেষে।
দিগন্তের পর্দা ঠেলি হিমমরুদেশে
মাগিছে বিদায় মোর প্রিয়া ঘূর্ণি-পরি,
দিগন্ত ঝাপসা তার অশ্রুহিমে ভরি।
গোলে-বকৌলির দেশে মেরু-পরিস্থানে
মিশে গেল হাওয়া-পরি।
অযথা সন্ধানে
দিকচক্ররেখা ধরি কেঁদে কেঁদে চলি
শ্রান্ত অশ্বশ্বসা-গতি। চম্পা-একাবলী
ছিন্ন ম্লান ছেয়ে আছে দিগন্ত ব্যাপিয়া, -
সেই চম্পা চোখে চাপি ডাকি, ‘পিয়া পিয়া’!
বিদায়-দিগন্ত ছানি নীল হলাহল
আকণ্ঠ লইনু পিয়া, তরল গরল –
সাগরে ডুবিল মোর আলোক-কমলা,
আঁখি মোর ঢুলে আসে – শেষ হল চলা!
জাগিলাম জন্মান্তর-জাগরণ-পারে
যেন কোন্ দাহ-অন্ত ছায়া-পারাবারে
বিচ্ছেদ-বিশীর্ণ তনু, শীতল-শিহর!
প্রতি রোমকূপে মোর কাঁপে থরথর।
কাজল-সুস্নিগ্ধ কার অঙ্গুলি-পরশ
বুলায় নয়ন মোর, দুলায়ে অবশ
ভার-শ্লথ তনু মোর ডাকে – ‘জাগো পিয়া।
জাগো রে সুন্দর মোরি রাজা শাঁবলিয়া।’জল-নীলা ইন্দ্রনীলকান্তমণি-শ্যামা
এ কোন মোহিনী তন্বী জাদুকরী বামা
জাগাল উদয়-দেশে নব মন্ত্র দিয়া
ভয়াল-আমারে ডাকি – ‘হে সুন্দর পিয়া!’
– আমি ঝড় বিশ্ব-ত্রাস মহামৃত্যুক্ষুধা,
ত্র্যম্বকের ছিন্নজটা – ওগো এত সুধা,
কোথা ছিল অগ্নিকুণ্ড মোর দাবদাহে?
এত প্রেমতৃষা সাধ গরল প্রবাহে? –
আবার ডাকিল শ্যামা, ‘জাগো মোরি পিয়া!’
এতক্ষণ আপনার পানে নিরখিয়া
হেরিলাম আমি ঝড় অনন্ত সুন্দর
পুরুষ-কেশরী বীর! প্রলয়কেশর
স্কন্ধে মোর পৌরুষের প্রকাশে মহিমা!
চোখে মোর ভাস্বরের দীপ্তি-অরুণিমা
ঠিকরে প্রদীপ্ত তেজে! মুক্ত ঝোড়ো কেশে
বিশ্বলক্ষ্মী মালা তার বেঁধে দেন হেসে!
এ কথা হয়নি মনে আগে, – আমি বীর
পরুষ পুরুষ-সিংহ, জয়লক্ষ্মী-শ্রীর
স্নেহের দুলাল আমি; আমারেও নারী
ভালোবাসে, ভালোবাসে রক্ত-তরবারি
ফুল-মালা চেয়ে! চাহে তারা নর
অটল-পৌরুষ বীর্যবন্ত শক্তিধর!
জানিনু যেদিন আমি এ সত্য মহান –
হাসিল সেদিন মোর মুখে ভগবান
মদনমোহন-রূপে! সেই সে প্রথম
হেরিনু, সুন্দর আমি সৃষ্টি-অনুপম!
যাহা কিছু ছিল মোর মাঝে অসুন্দর
অশিব ভয়াল মিথ্যা অকল্যাণকর
আত্ম-অভিমান হিংসা দ্বেষ-তিক্ত ক্ষোভ –
নিমেষে লুকাল কোথা, স্নিগ্ধশ্যাম ছোপ
সুন্দরের নয়নের মণি লাগি মোর প্রাণে!
পুবের পরিরে নিয়া অস্তদেশ পানে
এইবার দিনু পাড়ি। নটনটী-রূপে
গ্রীষ্মদগ্ধ তাপশুষ্ক মারী-ধ্বংস-স্তূপে
নেচে নেচে গাই নবমন্ত্র সামগান
শ্যামল জীবনগাথা জাগরণতান!
এইবার গাহি নেচে নেচে,
রে জীবন-হারা, ওঠ বেঁচে!
রুদ্র কালের বহ্নি-রোষ
নিদাঘের দাহ গ্রীষ্ম-শোষ
নিবাতে এনেছি শান্তি-সোম,
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!
জেগে ওঠ ওরে মূর্ছাতুর!
হোক অশিব মৃত্যু দূর!
গাহে উদ্গাতা সজল ব্যোম,
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম!
ওম্ শান্তি, শান্তি ওম॥এসো মোর শ্যাম-সরসা
ঘনিমার হিঙুল-শোষা
বরষা প্রেম-হরষা
প্রিয়া মোর নিকষ-নীলা
শ্রাবণের কাজল গুলি
ওলো আয় রাঙিয়ে তুলি
সবুজের জীবন-তুলি,
মৃতে কর প্রাণ-রঙিলা॥
আমি ভাই পুবের হাওয়া
বাঁচনের নাচন-পাওয়া,
কারফায় কাজরি গাওয়া,
নটিনীর পা-ঝিনঝিন!
নাচি আর নাচনা শেখাই
পুরবের বাইজিকে ভাই,
ঘুমুরের তাল দিয়ে যাই –
এক দুই এক দুই তিন॥
বিল ঝিল তড়াগ পুকুর
পিয়ে নীর নীল কম্বুর
থইথই টইটম্বুর!
ধরা আজ পুষ্পবতী!
শুশুনির নিদ্রা শুষি
রূপসি ঘুম-উপোসি!
কদমের উদমো খুশি
দেখায় আজ শ্যাম যুবতি॥
হুরিরা দূর আকাশে
বরুণের গোলাব-পাশে
ধারা-জল ছিটিয়ে হাসে
বিজুলির ঝিলিমিলিতে!
অরুণ আর বরুণ রণে
মাতিল ঘোর স্বননে
আলো-ছায় গগন-বনে
‘শার্দূল বিক্রীড়িতে।’(শার্দূল-বিক্রীড়িত ছন্দে)
উত্রাস ভীম
মেঘে কুচকাওয়াজ
চলিছে আজ,
সোন্মাদ সাগর
খায় রে দোল!
ইন্দ্রের রথ
বজ্রের কামান
টানে উজান
মেঘ-ঐরাবত
মদ-বিভোল।
যুদ্ধের রোল
বরুণের জাঁতায়
নিনাদে ঘোর,
বারীশ আর বাসব
বন্ধু আজ।
সূর্যের তেজ
দহে মেঘ-গরুড়
ধূম্র-চূড়,
রশ্মির ফলক
বিঁধিছে বাজ।
বিশ্রাম-হীন
যুঝে তেজ-তপন
দিক-বারণ
শির-মদ-ধারায়
ধরা মগন!
অম্বর-মাঝ
চলে আলো-ছায়ায়
নীরব রণ
শার্দূল শিকার
খেলে যেমন।
রৌদ্রের শর
খরতর প্রখর
ক্লান্ত শেষ,
দিবা দ্বিপ্রহর
নিশি-কাজল!
সোল্লাস ঘোর
ঘোষে বিজয়-বাজ
গরজি আজ
দোলে সিং-বি-
ক্রীড়ে দোল।(সিংহ-বিক্রীড় ছন্দে)
নাচায় প্রাণ রণোন্মাদ- বিজয়-গান, গগনময় মহোৎসব।
রবির পথ অরুণ-যান কিরণ-পথ ডুবায় মেঘ- মহার্ণব।
মেঘের ছায় শীতল কায় ঘুমায় থির দিঘির জল অথই থই।
তৃষায় ক্ষীণ ‘ফটিক জল’ ‘ফটিক জল’ কাঁদায় দিল চাতক ওই।
মাঠের পর সোহাগ-ঢল জলদ-দ্রব ছলাৎছল ছলাৎছল
পাহাড়-গায় ঘুমায় ঘোর অসিত মেঘ- শিশুর দল অচঞ্চল।
বিলোল-চোখ হরিণ চায় মেঘের গায়, চমক খায় গগন-কোল,
নদীর-পার চখির ডাক ‘কোয়াককো’ বনের বায় খাওয়ায় টোল।
স্বয়ম্ভূর সতীর শোক- ধ্যানোম্মাদ- নিদাঘ-দাব তপের কাল
নিশেষ আজ! মহেশ্বর উমার গাল চুমার ঘায় রাঙায় লাল।(অনঙ্গশেখর ছন্দে)
এবার আমার বিলাস শুরু অনঙ্গশেখরে।
পরশ-সুখে শ্যামার বুকে কদম্ব শিহরে।
কুসুমেষুর পরশ-কাতর নিতম্ব-মন্থরা
সিনান-শুচি স-যৌবনা রোমাঞ্চিত ধরা।
ঘন শ্রোণির, গুরু ঊরুর, দাড়িম-ফাটার ক্ষুধা
যাচে গো আজ পরুষ-পীড়ন পুরুষ-পরশ-সুধা।
শিথিল-নীবি বিধুর বালা শয়ন-ঘরে কাঁপে,
মদন-শেখর কুসুম-স্তবক উপাধানে চাপে।
আমার বুকের কামনা আজ কাঁদে নিখিল জুড়ি,
বনের হিয়ায় তিয়াস জিয়ায় প্রথম কদম-কুঁড়ি।
শাখীরা আজ শাখায় শাখা পাখায় পাখায় বাঁধা,
কুলায় রচে, মনে শোনে শাবক শিশুর কাঁদা।
তাপস-কঠিন উমার গালে চুমার পিয়াস জাগে,
বধূর বুকে মধুর আশা কোলে কুমার মাগে!
তরুণ চাহে করুণ চোখে উদাসী তার আঁখি,
শোনে, কোথায় কাঁদে ডাহুক ডাহুকের ডাকি!
এবার আমার পথের শুরু তেপান্তরের পথে,
দেখি হঠাৎ চরণ রাঙা মৃণাল-কাঁটার ক্ষতে।
ওগো আমার এখনও যে সকল পথই বাকি,
মৃণাল হেরি মনে পড়ে কাহার কমল-আঁখি! (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
গুঞ্জা-মালা গলে কুঞ্জে এস হে কালা
বনমালী এস দুলাইয়া বনমালা।তব পথে বকুল ঝরিছে উতল বায়ে
দলিয়া যাবে চলি অরুণ-রাঙা পায়ে
রচেছি আসন তরুর তমাল ছায়ে
পলাশে শিমুলে রাঙা প্রদীপ জ্বালা।ময়ুরে নাচাও এসে তোমার নূপুর তালে
বেঁধেছি ঝুলনিয়া ফুলেল্ কদম ডালে
তোমা বিনে বনমালী বিফল এ ফুল-দোল
বাঁশী বাজিবে কবে উতলা ব্রজবালা।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
রবির জন্মতিথি কয়জন জানে?
অঙ্ক কষিয়া পেয়েছ কি বিজ্ঞানে?
ধ্যানী যোগী দেখেছে কি? জ্ঞানী দেখিয়াছে?
ঠিকুজি আছে কি কোনো জ্যোতিষীর কাছে?
নাই – নাই ! কত কোটি যুগ মহাব্যোমে
আলো অমৃত দিয়ে ধ্রুব রবি ভ্রমে!
জানে না জানে না। উদয় ও অস্ত তাঁর
সে শুধু লীলাবিলাস, গোপন বিহার।
রবি কি অস্ত যায়? অন্ধ মানব
রবি ডুবে গেল বলে করে কলরব।
রবি শাশ্বত, তাঁর নিত্য প্রকাশ
রূপ ধরি পৃথিবীতে ক্ষণিক বিলাস
করিয়া চলিয়া যায় জ্যোতির্লোকে,
এখনও দ্রষ্টা নেহারে তাঁর চোখে।
এই সুরভির ফুল রস-ভরা ফল
রবির গলিত প্রেমবৃষ্টির জল
কবিতা ও গান সুর-নদী হয়ে বয়
রবি যদি মরে যায় পৃথিবী কি রয়!
জন্ম হয়নি যাহার জ্যোতির্লোকে,
তন্দ্রা টুটেনি যাহার অন্ধ চোখে,
রবির জন্মতিথি দেখেনি সে-জন
আজও তার কাছে রবি অপ্রয়োজন।
কবি হয়ে এল রবি এই বাংলায়
দেখিল বুঝিল বলো কতজন তাঁয়?
রবি দেখে পেয়েছে যে আলোক প্রথম
তাঁরই মাঝে লভে রবি প্রথম জনম।
নিরক্ষর ও নিস্তেজ বাংলায়
অক্ষরজ্ঞান যদি সকলেই পায়,
অ-ক্ষর অব্যয় রবি সেই দিন
সহস্র করে বাজাবেন তাঁর বীণ।
সেদিন নিত্য রবির জন্মতিথি
হইবে। মানুষ দিবে তাঁরে প্রেমপ্রীতি। (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
দোহাই তোদের! এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল্!
ঢের দেখালি ঢাক ঢাক আর গুড় গুড়, ঢের মিথ্যা ছল।
এবার তোরা সত্য বল॥
পেটে এক আর মুখে আর এক – এই যে তোদের ভণ্ডামি,
এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম-দামি।
নিজের কাছেও ক্ষুদ্র হলি আপন ফাঁকির আপশোশে,
বাইরে ফাঁকা পাঁইতারা তাই, নাই তলোয়ার খাপ-কোশে।
তাই হলি সব সেরেফ আজ
কাপুরুষ আর ফেরেব-বাজ,
সত্য কথা বলতে ডরাস, তোরা আবার করবি কাজ!
ফোঁপরা ঢেঁকির নেইকো লাজ!
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি দেখেই ঘর ছুটিস সব রামছাগল!
যুক্তি তোদের খুব বুঝেছি, দুধকে দুধ আর জলকে জল!
এবার তোরা সত্য বল॥২বুকের ভিতর ছ-পাই ন-পাই, মুখে বলিস স্বরাজ চাই,
স্বরাজ কথার মানে তোদের ক্রমেই হচ্চে দরাজ তাই!
‘ভারত হবে ভারতবাসীর’ – এই কথাটাও বলতে ভয়!
সেই বুড়োদের বলিস নেতা – তাদের কথায় চলতে হয়!বল রে তোরা বল নবীন –
চাইনে এসব জ্ঞান-প্রবীণ!
স্ব-স্বরূপে দেশকে ক্লীব করছে এরা দিনকে দিন,
চায় না এরা – হই স্বাধীন!
কর্তা হবার শখ সবারই, স্বরাজ-ফরাজ ছল কেবল!
ফাঁকা প্রেমের ফুসমন্তর, মুখ সরল আর মন গরল!
এবার তোরা সত্য বল॥৩মহান-চেতা নেতার দলে তোল রে তরুণ তোদের নায়,
ওঁরা মোদের দেবতা, সবাই করব প্রণাম ওঁদের পায়।
জানিস তো ভাই শেষ বয়সে স্বতই সবার মরতে ভয়,
ঝড়-তুফানে তাঁদের দিয়ে নয় তরি পার করতে নয়।জোয়ানরা হাল ধরবে তার
করবে তরি তুফান পার!
জয় মা বলে মাল্লা তরুণ ওই তুফানে লাখ হাজার
প্রাণ দিয়ে ত্রাণ করবে মার!
সেদিন করিস এই নেতাদের ধ্বংস-শেষের সৃষ্টি কল।
ভয়-ভীরুতা থাকতে দেশের প্রেম ফলাবে ঘণ্টা ফল!
এবার তোরা সত্য বল॥৪ধর্ম-কথা প্রেমের বাণী জানি মহান উচ্চ খুব,
কিন্তু সাপের দাঁত না ভেঙে মন্ত্র ঝাড়ে যে বেকুব!
‘ব্যাঘ্র সাহেব, হিংসে ছাড়ো, পড়বে এসো বেদান্ত!’
কয় যদি ছাগ, লাফ দিয়ে বাঘ অমনি হবে কৃতান্ত!
থাকতে বাঘের দন্ত-নখ
বিফল ভাই ওই প্রেম-সেবক!
চোখের জলে ডুবলে গর্ব শার্দুলও হয় বেদ-পাঠক,
প্রেম মানে না খুন-খাদক।
ধর্মগুরু ধর্ম শোনান, পুরুষ ছেলে যুদ্ধে চল।
সেও ভি আচ্ছা, মরব পিয়ে মৃত্যু-শোণিত-অ্যালকোহল!
এবার তোরা সত্য বল॥৫প্রেমিক ঠাকুর মন্দিরে যান, গাড়ুন সেথায় আস্তানা!
শবে শিবায় শিব কেশবের – তৌবা – তাঁদের রাস্তা না!
মৃতের সামিল এখন ওঁরা, পূজা ওঁদের জোরসে হোক,
ধর্মগুরু গোর-সমাধি পূজে যেমন নিত্য লোক!তরুণ চাহে যুদ্ধ-ভূম!
মুক্তি-সেনা চায় হুকুম!
চাই না ‘নেতা’, চাই ‘জেনারেল’, প্রাণ-মাতনের ছুটুক ধূম!
মানব-মেধের যজ্ঞধূম।
প্রাণ-আঙুরের নিঙরানো রস – সেই আমাদের শান্তি-জল।
সোনা-মানিক ভাইরা আমার ! আয় যাবি কে তরতে চল।
এবার তোরা সত্য বল॥৬যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ!
ধামা-ধরা! জামা-ধরা! মরণ-ভীতু! চুপ রহো!
আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ!
এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি – মরব শেষ!
নরম গরম পচে গেছে, আমরা নবীন চরম দল!
ডুবেছি না ডুবতে আছি, স্বর্গ কিংবা পাতাল-তল! (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
ওই অভ্র-ভেদী তোমার ধ্বজা
উড়ল আকাশ-পথে।
মা গো, তোমার রথ-আনা ওই
রক্ত-সেনার রথে॥
ললাট-ভরা জয়ের টিকা,
অঙ্গে নাচে অগ্নিশিখা,
রক্তে জ্বলে বহ্নিলিখা – মা!
ওই বাজে তোর বিজয়-ভেরি,
নাই দেরি আর নাই মা দেরি,
মুক্ত তোমার হতে॥
আনো তোমার বরণডালা, আনো তোমার শঙ্খ, নারী!
ওই দ্বারে মা-র মুক্তি সেনা, বিজয়-বাজা উঠছে তারই।
ওরে ভীরু! ওরে মরা!
মরার ভয়ে যাসনি তোরা;
তোদেরও আজ ডাকছি মোরা ভাই!
ওই খোলে রে মুক্তি-তোরণ,
আজ একাকার জীবন-মরণ
মুক্ত এ ভারতে॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
সতী হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে
বিষাণ ত্রিশূল ফেলি গভীর বিষাদে
জটাজুটে গঙ্গা নিস্তরঙ্গা
রাহু যেন গ্রাসিয়াছে ললাটের চাঁদে।দুই করে দেবী-দেহ ধরে বুকে বাঁধে
রোদনের সুর বাজে প্রণব নিনাদে
ভক্তের চোখে আজি ভগবান শঙ্কর
সুন্দরতর হল পড়ি মায়া ফাঁদে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
শিকলে যাদের উঠেছে বাজিয়া বীরের মুক্তি-তরবারি,
আমরা তাদেরই ত্রিশ কোটি ভাই, গাহি বন্দনা-গীতি তারই॥
তাদেরই উষ্ণ শোণিত বহিছে আমাদেরও এই শিরা-মাঝে,
তাদেরই সত্য-জয়-ঢাক আজি মোদেরই কণ্ঠে ঘন বাজে।
সম্মান নহে তাহাদের তরে ক্রন্দন-রোল দীর্ঘশ্বাস,
তাহাদেরই পথে চলিয়া মোরাও বরিব ভাই ওই বন্দি-বাস॥
শিকলে যাদের ...
মুক্ত বিশ্বে কে কার অধীন? স্বাধীন সবাই আমরা ভাই।
ভাঙিতে নিখিল অধীনতা-পাশ মেলে যদি কারা, বরিব তাই।
জাগেন সত্য ভগবান যে রে আমাদেরই এই বক্ষ-মাঝ,
আল্লার গলে কে দেবে শিকল, দেখে নেব মোরা তাহাই আজ॥
শিকলে যাদের ...
কাঁদিব না মোরা, যাও কারা-মাঝে যাও তবে বীর-সংঘ হে,
ওই শৃঙ্খলই করিবে মোদের ত্রিশ কোটি ভ্রাতৃ-অঙ্গ হে।
মুক্তির লাগি মিলনের লাগি আহুতি যাহারা দিয়াছে প্রাণ
হিন্দু-মুসলিম চলেছি আমরা গাহিয়া তাদেরই বিজয়-গান
শিকলে যাদের ... (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে যত ফল,
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,
সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে যামিনী-শানি-, সমীরণ, বারিবাহ!
দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীতে হ’য়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।
স্বর্ণ-রৌপ্যভার,
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।
পুরুষ হৃদয়-হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না’ক অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব,
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা,-
লব-কুশে বনে ত্যজিয়াছে রাম, পালন ক’রেছে সীতা।
নারী সে শিখা’ল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরা’ল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভুতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে ক’রে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ!
তিনি নর-অবতার-
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর-
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও , উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।
শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন, যেথা যত আভরণ!
ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হ’তে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি’!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরন-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
গুনে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়।
রূপে লাবন্যে মাধুরী ও শ্রীতে হুরী পরী লাজ পায়।।
নর নহে, নারী ইসলাম পরে প্রথম আনে ঈমান,
আম্মা খাদিজা জগতে সর্ব-প্রথম মুসলমান,
পুরুষের সব গৌরবস্নান এক এই মহিমায়।।
নবী নন্দিনী ফাতেমা মোদের সতী নারীদের রাণী,
যাঁর ত্যাগ সেবা স্নেহ ছিল মরূভুমে কওসর পানি,
যাঁর গুণ-গাথা ঘরে ঘরে প্রতি নর-নারী আজো গায়।।
রহিমার মত মহিমা কাহার, তাঁর সম সতী কেবা,
নারী নয় যেন মূর্তি ধরিয়া এসেছিল পতি সেবা
মোদের খাওয়ালা জগতের আলা বীরত্বে গরিমায়।।
রাজ্য শাসনের রিজিয়ার নাম ইতিহাসে অক্ষয়,
শৌর্যে সাহসে চাঁদ সুলতানা বিশ্বের বিস্ময়।
জেবুন্নেসার তুলনায় কোথায় জ্ঞানের তাপস্যার।।
বারো বছরের বালিকা লায়লা ওহাবীব দলপতি
মোদের সাকিনা জাহানারা যেন ধৈর্য মূর্তিমতী,
সে গৌরবের গোর হয়ে গেছে আঁধারের বোরকায়।।
আঁধার হেরেমে বন্দিনী হলো সহসা আলোর মেয়ে,
সেই দিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে
লক্ষ খালিদা আসিবে, যদি এ নারীরা মুক্তি পায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়।
আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।।আমার কিসের শঙ্কা,
কোরান আমার ডঙ্কা
ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।।কালেমা আমার তাবিজ, তৌহিদ আমার মুর্শিদ,
ঈমান আমার ধর্ম, হেলাল আমার খুর্শিদ।
'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি
আমার জেহাদ- বাণী?
আখের মোকাম ফেরদৌস খোদার আরশ যেথায় রয়।।আরব মেসের চীন হিন্দ মুসলিম- জাহান মোর ভাই,
কেহ নয় উচ্চ কেহ নীচ, এখানে সমান সবাই।
এক দেহ এক দিল এক প্রান,
আমীর ফকির এক সমান,
এক তকবীরে উঠি জেগে, আমার হবেই হবে জয়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
বলো ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ
নবযুগ ওই এল ওই
এল ওই রক্ত-যুগান্তর রে।
বলো জয় সত্যের জয়
আসে ভৈরব-বরাভয়
শোনো অভয় ওই রথ-ঘর্ঘর রে॥
রে বধির! শোন পেতে কান
ওঠে ওই কোন্ মহা-গান
হাঁকছে বিষাণ ডাকছে ভগবান রে।
জগতে জাগল সাড়া
জেগে ওঠ উঠে দাঁড়া
ভাঙ পাহারা মায়ার কারা-ঘর রে।
যা আছে যাক না চুলায়
নেমে পড় পথের ধুলায়
নিশান দুলায় ওই প্রলয়ের ঝড় রে।
সে ঝড়ের ঝাপটা লেগে
ভীম আবেগে উঠনু জেগে
পাষাণ ভেঙে প্রাণ-ঝরা নির্ঝর রে।
ভুলেছি পর ও আপন
ছিঁড়েছি ঘরের বাঁধন
স্বদেশ স্বজন স্বদেশ মোদের ঘর রে।
যারা ভাই বদ্ধ কুয়ায়
খেয়ে মার জীবন গোঁয়ায়
তাদের শোনাই প্রাণ-জাগা মন্তর রে।
ঝড়ের ঝাঁটার ঝাণ্ডার নেড়ে
মাভৈঃ-বাণীর ডঙ্কা মেরে
শঙ্কা ছেড়ে হাঁক প্রলয়ংকর রে।
তোদের ওই চরণ-চাপে
যেন ভাই মরণ কাঁপে,
মিথ্যা পাপের কণ্ঠ চেপে ধর রে।
শোনা তোর বুক-ভরা গান,
জাগা ফের দেশ-জোড়া প্রাণ,
যে বলিদান প্রাণ ও আত্মপর রে॥
মোরা ভাই বাউল চারণ,
মানি না শাসন বারণ
জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।
দেখে ওই ভয়ের ফাঁসি
হাসি জোর জয়ের হাসি,
অ-বিনাশী নাইকো মোদের ডর রে!
গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই,
মরা-প্রাণ উটকে দেখাই
ছাই-চাপা ভাই অগ্নি ভয়ংকর রে॥
খুঁড়ব কবর তুড়ব শ্মশান
মড়ার হাড়ে নাচাব প্রাণ
আনব বিধান নিদান কালের বর রে।
শুধু এই ভরসা রাখিস
মরিসনি ভিরমি গেছিস
ওই শুনেছিস ভারত-বিধির স্বর রে।
ধর হাত ওঠ রে আবার
দুর্যোগের রাত্রি কাবার,
ওই হাসে মা-র মূর্তি মনোহর রে॥(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।
তুমি কোনদিন কারো করনি বিচার,
কারেও দাওনি দোষ। ব্যথা-বারিধির
কূলে ব’সে কাঁদ’ মৌনা কন্যা ধরণীর
একাকিনী! যেন কোন্ পথ-ভুলে-আসা
ভিন্-গাঁ’র ভীর” মেয়ে! কেবলি জিজ্ঞাসা
করিতেছে আপনারে, ‘ এ আমি কোথায়?’
দূর হ’তে তারাকারা ডাকে, আয় আয়!
তুমি যেন তাহাদের পলাতকা মেয়ে
ভুলিয়া এসেছ হেথা ছায়া-পথ বেয়ে!
বিধি ও অবিধি মিলে মেরেছে তোমায়
মা আমার-কত যেন! চোখে-মুখে, হায়
তবু যেন শুধু এক ব্যথিত জিজ্ঞাসা-
‘ কেন মানে? এরা কা’রা! কোথা হ’তে আসে
এই দুঃখ ব্যথা শোক?’ এরা তো তোমার
নহে পরিচিত মাগো, কন্যা অলকার!
তাই সব স’য়ে যাও নির্বাক নিশ্চুপ,
ধূপেরে পোড়ায় অগ্নি-জানে না তা ধূপ!…
দূর-দূরান-র হ’তে আসে ছেলে-মেয়ে,
ভুলে যায় খেলা তা’রা তব মুখ চেয়ে!
বলে, ‘তুমি মা হবে আমার?’ ভেবে কী যে!
তুমি বুকে চেপে ধর, চক্ষু ওঠে ভিজে
জননীর কর”ণায়! মনে হয় যেন
সকলের চেনা তুমি, সকলেরে চেন!
তোমারি দেশের যেন ওরা ঘরছাড়া
বেড়াতে এসেছে এই ধরণীর পাড়া
প্রবাসী শিশুর দল। যাবে ওরা চ’লে
গলা ধ’রে দুটি কথা ‘মা আমার’ ব’লে!
হয়ত আসিয়াছিল, যদি পড়ে মনে,
অথবা সে আসে নাই-না এলে স্মরণে!
যে-দুরন- গেছে চ’লে আসিবে না আর,
হয়ত তোমার বুকে গোরস’ান তার
জাগিতেছে আজো মৌন, অথবা সে নাই!
মন ত কত পাই-কত সে হারাই..
সর্বসহা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা!
শূন্য নাহি রহে কভু মাতা ও বিধাতা।
হারা-বুকে আজ তব ফিরিয়াছে যারা-
হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
রূপক
|
রে নীড়-হারা, কচি বুকে শায়ক-বেঁধা পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
কোথায় রে তোর কোথায় ব্যথা বাজে?
চোখের জলে অন্ধ আঁখি কিছুই দেখি না যে?
ওরে মাণিক! এ অভিমান আমায় নাহি সাজে-
তোর জুড়াই ব্যথা আমার ভাঙা বক্ষপুটে ঢাকি’।
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী,
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
বক্ষে বিঁধে বিষ মাখানো শর,
পথ-ভোলা রে! লুটিয়ে প’লি এ কা’র বুকের’ পর!
কে চিনালে পথ তোরে হায় এই দুখিনীর ঘর?
তোর ব্যথার শানি- লুকিয়ে আছে আমার ঘরে নাকি?
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
হায়, এ কোথায় শানি- খুঁজিস্ তোর?
ডাক্ছে দেয়া. হাঁকছে হাওয়া, কাঁপছে কুটীর মোর!
ঝঞ্ঝাবাতে নিবেছে দীপ, ভেঙেছে সব দোর,
দুলে দুঃখ রাতের অসীম রোদন বক্ষে থাকি’ থাকি’!
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
এমন দিনে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
মরণ যে বাপ বরণ করে তারে,
‘মা’ ‘মা’ ডেকে যে দাঁড়ায় এই শক্তিহীনার দ্বারে!
মাণিক আমি পেয়ে শুধু হারাই বারে বারে,
ওরে তাই তো ভয়ে বক্ষ কাঁপে কখন দিবি ফাঁকি!
ওরে আমার হারামণি! ওরে আমার পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
হারিয়ে পাওয়া ওরে আমার মাণিক!
দেখেই তোরে চিনেছি, আয়, বক্ষে ধরি খানিক!
বাণ-বেঁধা বুক দেখে তোরে কোলে কেহ না নিক,
ওরে হারার ভয়ে ফেলতে পারে চিরকালের মা কি?
ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি।
এ যে রে তোর চির-চেনা স্নেহ,
তুই তো আমার ন’সরে অতিথ্ অতীত কালের কেহ,
বারে বারে নাম হারায়ে এসেছিস এই গেহ,
এই মায়ের বুকে থাক যাদু তোর য’দিন আছে বাকী!
প্রাণের আড়াল ক’রতে পারে সৃজন দিনের মা কি?
হারিয়ে যাওয়া? ওরে পাগল, সে তো চোখের ফাঁকি!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
হিংসাই শুধু দেখেছ এ চোখে? দেখ নাই আর কিছু?
সম্মুখে শুধু রহিলে তাকায়ে, চেয়ে দেখিলে না পিছু!
সম্মুখ হতে আঘাত হানিয়া চলে গেল যে-পথিক
তার আঘাতেরই ব্যথা বুকে ধরে জাগ আজও অনিমিখ?
তুমি বুঝিলে না, হায়,
কত অভিমানে বুকের বন্ধু ব্যথা হেনে চলে যায়!আঘাত তাহার মনে আছে শুধু, মনে নাই অভিমান?
তোমারে চাহিয়া কত নিশি জাগি গাহিয়াছে কত গান,
সে জেগেছে একা – তুমি ঘুমায়েছ বেভুল আপন সুখে,
কাঁটার কুঞ্জে কাঁদিয়াছে বসি সে আপন মনোদুখে,
কুসুম-শয়নে শুইয়া আজিকে পড়ে না সেসব মনে,
তুমি তো জান না, কত বিষজ্বালা কণ্ঠক-দংশনে!
তুমি কি বুঝিবে বালা,
যে আঘাত করে বুকের প্রিয়ারে, তার বুকে কত জ্বালা!ব্যথা যে দিয়াছে – সম্মুখে ভাসে নিষ্ঠুর তার কায়া,
দেখিলে না তব পশ্চাতে তারই অশ্রু-কাতর ছায়া!..
অপরাধ শুধু মনে আছে তার, মনে নাই কিছু আর?
মনে নাই, তুমি দলেছ দুপায়ে কবে কার ফুলহার?কাঁদয়ে কাঁদিয়া সে রচেছে তার অশ্রুর গড়খাই,
পার হতে তুমি পারিলে না তাহা, সে-ই অপরাধী তাই?
সে-ই ভালো, তুমি চিরসুখী হও, একা সে-ই অপরাধী!
কী হবে জানিয়া, কেন পথে পথে মরুচারী ফেরে কাঁদি!হয়তো তোমারে করেছে আঘাত, তবুও শুধাই আজি,
আঘাতের পিছে আরও কিছু কি গো ও বুকে ওঠেনি বাজি?
মনে তুমি আজ করিতে পার কি –তব অবহেলা দিয়া
কত যে কঠিন করিয়া তুলেছ তাহার কুসুম-হিয়া?
মানুষ তাহারে করেছ পাষাণ–সেই পাষাণের ঘায়
মুরছায়ে তুমি পড়িতেছ বলে সেই অপরাধী হায়?
তাহারই সে অপরাধ –
যাহার আঘাতে ভাঙিয়া গিয়াছে তোমার মনের বাঁধ!কিন্তু কেন এ অভিযোগ আজি? সে তো গেছে সব ভুলে!
কেন তবে আর রুদ্ধ দুয়ার ঘা দিয়া দিতেছে খুলে?
শুষ্ক যে-মালা আজিও নিরালা যত্নে রেখেছে তুলি
ঝরায়ো না আর নাড়া দিয়ে তার পবিত্র ফুলগুলি!
সেই অপরাধী, সেই অমানুষ, যত পার দাও গালি!
নিভেছে যে-ব্যথা দয়া করে সেথা আগুন দিয়ো না জ্বালি!‘মানুষ’, ‘মানুষ’শুনে শুনে নিতি কান হল ঝালাপালা!
তোমরা তারেই অমানুষ বল – পায়ে দল যার মালা!
তারই অপরাধ – যে তার প্রেম ও অশ্রুর অপমানে
আঘাত করিয়া টুটায়ে পাষাণ অশ্রু-নিঝর আনে!
কবি অমানুষ – মানিলাম সব! তোমার দুয়ার ধরি
কবি না মানুষ কেঁদেছিল প্রিয় সেদিন নিশীথ ভরি?
দেখেছ ঈর্ষা – পড়ে নাই চোখে সাগরের এত জল?
শুকালে সাগর –দেখিতেছ তার সাহারার মরুতল!
হয়তো কবিই গেয়েছিল গান, সে কি শুধু কথা – সুর
কাঁদিয়াছিল যে – তোমারই মতো সে মানুষ বেদনাতুর!
কবির কবিতা সে শুধু খেয়াল? তুমি বুঝিবে না, রানি,
কত জ্বাল দিলে উনুনের জলে ফোটে বুদ্বুদ্-বাণী!
তুমি কী বুঝিবে, কত ক্ষত হয়ে বেণুর বুকের হাড়ে
সুর ওঠে হায়, কত ব্যথা কাঁদে সুর-বাঁধা বীণা-তারে!সেদিন কবিই কেঁদেছিল শুধু? মানুষ কাঁদেনি সাথে?
হিংসাই শুধু দেখেছ, দেখনি অশ্রু নয়ন-পাতে?
আজও সে ফিরিছে হাসিয়া গাহিয়া? –হায়, তুমি বুঝিবে না,
হাসির ফুর্তি উড়ায় যে – তার অশ্রুর কত দেনা! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
মরণ-রথের চাকার ধ্বনি ওই রে আমার কানে আসে।
পুবের হাওয়া তাই নেমেছে পারুল বনে দীঘল শ্বাসে।
ব্যথার কুসুম গুলঞ্চ ফুল
মালঞ্চে আজ তাই শোকাকুল,
গোরস্থানের মাটির বাসে তাই আমার আজ প্রাণ উদাসে।
অঙ্গ আসে অবশ হয়ে নেতিয়ে-পড়া অলস ঘুমে
সাগর-পারের বিদেশিনীর হিম-ছোঁওয়া যার নয়ন চুমে।
হৃদয়-কাঁদা নিদয় কথা
আকাশ-ভেজা বিদায়-ব্যথা
লুটায় গো মোর ভুবন ভরি বাঁধন ছেঁড়ার কাঁদন ত্রাসে।
মোর কাফনের কর্পূর-বাস ভরপুর আজ দিগবলয়ে,
বনের শাখা লুটিয়ে কাঁদে হরিণটি তার হারার ভয়ে।
ফিরে-পাওয়া লক্ষ্মী বৃথাই
নয়ন-জলে বক্ষ তিতায়
ওগো এ কোন্ জাদুর মায়ায় আমার দু-চোখ শুধু জলে ভাসে।
আজ আকাশ-সীমায় শব্দ শুনি অচিন কাদের আসা যাওয়ার,
তাই মনে হয় এই যেন শেষ আমার সকল দাবি দাওয়ার।
আজ কেহ নাই পথের সাথি,
সামনে শুধু নিবিড় রাতি
আমায় দূরের মানুষ ডাক দিয়েছে রাখবে কে আর বাঁধন পাশে। (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
যাত্রীরা রাত্তিরে হতে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার?
প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে!
ঝন্ঝা ও ঘন দেয়া স্বনিল রে ঈশানে!
নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ!
মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ!
নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে,
ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে।
তমসাবৃতা ঘোরা ‘কিয়ামত’ রাত্রি,
খেয়া-পারে আশা নাই ডুবিল রে যাত্রী!
দমকি দমকি দেয়া হাঁকে কাঁপে দামিনী,
শিঙ্গার হুঙ্কারে থরথর যামিনী!
লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে–
অবহেলি জলধির ভৈরব গর্জন
প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জন!
পুণ্য-পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ,
ধর্মেরি বর্মে সু-রক্ষিত দিল্ সাফ!
নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও
কাণ্ডারী আহ্মদ তরী ভরা পাথেয়।
আবুবকর উস্মান উমর আলি হায়দর
দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাঁড়ি-মুখে সারি-গান –লা-শরিক আল্লাহ!
‘শাফায়ত’-পাল-বাঁধা তরণীর মাস্তুল,
‘জান্নাত্’ হতে ফেলে হুরি রাশ্ রাশ্ ফুল।
শিরে নত স্নেহ-আঁখি মঙ্গল দাত্রী,
গাও জোরে সারি-গান ও-পারের যাত্রী।
বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,
ঐ হলো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার।
————————–
আহমদ– মোহাম্মদ (সা)।
লা-শরিক আল্লাহ– ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কেহ উপাস্য নাই।
শাফায়ত– পরিত্রাণ
জান্নাত– স্বর্গ
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।।
কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বরগ পানে।
জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি
যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি,
কেমন করে আঞ্ছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে,
কেমন জোরে টানলেসাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে।
কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে,
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয় চুড়ে।
তুহিন মেরু পার হয়ে যায়
সন্ধানীরা কিসের আশায়;
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।।
কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি।
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে
স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ
তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি!
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।।
রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে।
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
নীতিমূলক
|
পুথির বিধান যাক পুড়ে তোর,
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
(এই) খোদার উপর খোদকারি তোর
মানবে না আর সর্বলোক!
মানবে না আর সর্বলোক!!
(তোর) ঘরের প্রদীপ নিবেই যদি,
নিবুক না রে, কীসের ভয়?
আঁধারকে তোর কীসের ভয়?
(ওই) ভুবন জুড়ে জ্বলছে আলো,
ভবনটাই সে সত্য নয়।
ঘরটাই তোর সত্য নয়।
(ওই) বাইরে জ্বলছে চন্দ্র সূর্য
নিত্যকালের তাঁর আলোক।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
লোক-সমাজের শাসক রাজা,
(আর) রাজার শাসক মালিক যেই,
বিরাট যাঁহার সৃষ্টি এই,
তাঁর শাসনকে অগ্রে মান
তার বড়ো আর শাস্ত্র নেই,
তার বড়ো আর সত্য নেই!
সেই খোদা খোদ সহায় তোর,
ভয় কী? নিখিল মন্দ ক’ক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
বিধির বিধি মানতে গিয়ে
নিষেধ যদি দেয় আগল
বিশ্ব যদি কয় পাগল,
আছেন সত্য মাথার পর, –
বেপরোয়া তুই সত্য বল।
বুক ঠুকে তুই সত্য বল!(তখন) তোর পথেরই মশাল হয়ে
জ্বলবে বিধির রুদ্র-চোখ!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
মনুর শাস্ত্র রাজার অস্ত্র
আজ আছে কাল নাইকো আশ,
কাল তারে কাল করবে গ্রাস।
হাতের খেলা সৃষ্টি যাঁর
তাঁর শুধু ভাই নাই বিনাশ,
স্রষ্টার সেই নাই বিনাশ!
সেই বিধাতায় মাথায় করে
বিপুল গর্বে বক্ষ ঠোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
সত্যতে নাই ধানাই পানাই
সত্য যাহা সহজ তাই,
সত্য যাহা সহজ তাই;
আপনি তাতে বিশ্বাস আসে,
আপনি তাতে শক্তি পায়
সত্যের জোর-জুলুম নাই
সেই সে মহান সত্যকে মান –
রইবে না আর দুঃখ-শোক।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
নানান মুনির নানান মত যে,
মানবি বল সে কার শাসন?
কয় জনার বা রাখবি মন?
এক সমাজকে মানলে করবে
আরেক সমাজ নির্বাসন,
চারিদিকে শৃঙ্খল বাঁধন!
সকল পথের লক্ষ্য যিনি
চোখ পুরে নে তাঁর আলোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!! সত্য যদি হয় ধ্রুব তোর,
কর্মে যদি না রয় ছল,
ধর্ম-দুগ্ধে না রয় জল,
সত্যের জয় হবেই হবে,
আজ নয় কাল মিলবে ফল,
আজ নয় কাল মিলবে ফল।
(আর)প্রাণের ভিতর পাপ যদি রয়
চুষবে রক্ত মিথ্যা-জোঁক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
জাতের চেয়ে মানুষ সত্য,
অধিক সত্য প্রাণের টান,
প্রাণ-ঘরে সব এক সমান।
বিশ্বপিতার সিংহ-আসন
প্রাণবেদিতেই অধিষ্ঠান,
আত্মার আসন তাইতো প্রাণ।
জাত-সমাজের নাই সেথা ঠাঁই
জগন্নাথের সাম্য-লোক
জগন্নাথের তীর্থ-লোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
চিনেছিলেন খ্রিস্ট বুদ্ধ
কৃষ্ণ মোহম্মদ ও রাম –
মানুষ কী আর কী তার দাম।
(তাই) মানুষ যাদের করত ঘৃণা,
তাদের বুকে দিলেন স্থান
গান্ধি আবার গান সে গান।
(তোরা) মানব-শত্রু তোদেরই হায়
ফুটল না সেই জ্ঞানের চোখ।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!(বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
আসিলে আলোক-জননি।
প্রভায় তোমার উদিল প্রভাত
হেম-প্রভ হল ধরণি॥
ভগ্ন দুর্গে ঘুমায়ে রক্ষী
এলে কি মা তাই বিজয়-লক্ষ্মী,
‘মেয়্ ভুখা হুঁ’-র ক্রন্দন-রবে
নাচায়ে তুলিলে ধমনি ॥
এসো বাংলার চাঁদ-সুলতানা
বীর-মাতা বীর-জায়া গো॥
তোমাতে পড়েছে সকল কালের
বীর-নারীদের ছায়া গো॥
শিব-সাথে সতী শিবানী সাজিয়া
ফিরিছ শ্মশানে জীবন মাগিয়া,
তব আগমনে নব-বাংলার
কাটুক আঁধার রজনি॥ (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!
তোদের কোন্ ভায়ের আজ বিদায়-ব্যথায় নয়ান ছল-ছল?
ওই কারা-ঘর তো নয় হারা-ঘর,
হোথাই মেলে মা-র-দেওয়া বর রে!
ওরে হোথাই মেলে বন্দিনী মা-র বুক-জড়ানো কোল!
তবে কীসের রোদনরোল?
তোরা মোছ রে আঁখির জল।
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!।
আজ কারায় যারা, তাদের তরে।
গৌরবে বুক উঠুক ভরে রে!
মোরা ওদের মতোই বেদনা ব্যথা মৃত্যু আঘাত হেসে
বরণ যেন করতে পারি মাকে ভালোবেসে।
ওরে স্বাধীনকে কে বাঁধতে পারে বল?
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!
ও ভাই প্রাণে যদি সত্য থাকে তোর
মরবে নিজেই মিথ্যা, ভীরু চোর।
মোরা কাঁদব না আজ যতই ব্যথায় পিষুক কলজে-তল।
মুক্তকে কি রুখতে পারে অসুর পশুর দল?
মোরা কাঁদব যেদিন আসবে তারা আবার ফিরে রে,
কাঙালিনি মায়ের আমার এই আঙিনা-তল।
ও ভাই মুক্তিসেবক দল॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
রূপক
|
নিরুদ্দেশের পথে যেদিন প্রথম আমার যাত্রা হল শুরু।
নিবিড় সে-কোন্ বেদনাতে ভয়-আতুর এ বুক কাঁপল দুরু-দুরু।
মিটল না ভাই চেনার দেনা, অমনি মু্হুর্মুহু
ঘরছাড়া ডাক করলে শুরু অথির বিদায়-কুহু
উহু উহু উহু!
হাতছানি দেয় রাতের শাঙন,
অমনি বাঁধে ধরল ভাঙন –
ফেলিয়ে বিয়ের হাতের কাঙন –
খুঁজে বেড়াই কোন আঙনে কাঁকন বাজে গো!
বেরিয়ে দেখি ছুটছে কেঁদে বাদলি হাওয়া হু হু!
মাথার ওপর দৌড়ে টাঙন, ঝড়ের মাতন, দেয়ার গুরু গুরু।পথ হারিয়ে কেঁদে ফিরি, ‘আর বাঁচিনে! কোথায় প্রিয়,
কোথায় নিরুদ্দেশ?’
কেউ আসে না, মুখে শুধু ঝাপটা মারে নিশীথ-মেঘের
আকুল চাঁচর কেশ। ‘তাল-বনা’তে ঝঞ্ঝা তাথই হাততালি দেয় বজ্রে বাজে তূরী,
মেখলা ছিঁড়ি পাগলি মেয়ে বিজলি-বালা নাচায় হিরের চুড়ি
ঘুরি ঘুরি ঘুরি
ও সে সকল আকাশ জুড়ি! থামল বাদল রাতের কাঁদা,
হাসল, আমার টুটল ধাঁধা,
হঠাৎ ও কার নূপুর শুনি গো?
থামল নূপুর, ভোরের তারা বিদায় নিল ঝুরি।
আমি এখন চলি সাঁঝের বধূ সন্ধ্যাতারার চলার পথে গো!
আজ অস্তপারের শীতের বায়ু কানের কাছে বইছে ঝুরু-ঝুরু। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
নাম-হারা তুই পথিক শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে।
কোন নামের আজ পরলি কাঁকন? বাঁধনহারার কোন্ কারা এ?
আবার মনের মতন করে
কোন নামে বল ডাকব তোরে?
পথভোলা তুই এই সে ঘরে
ছিলি ওরে, এলি ওরে বারে বারে নাম হারায়ে।
ওরে জাদু, ওরে মানিক, আঁধার ঘরের রতন-মণি!
ক্ষুধিত ঘর ভরলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী।
আজ কেন রে নিবিড় মুখে
কান্না-সায়র উথলে বুকে?
নতুন নামে ডাকতে তোকে
ওরে কে কণ্ঠ রুখে? পাঁচ-ফাগুনের জুঁই-চারা এ!
আজ মন-পাখি ধায় মধুরতম নাম আশিসের শেষ ছাড়ায়ে।
(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
তরুণ প্রেমিক, প্রণয় বেদন
জানাও জানাও বে-দিল প্রিয়ায়
ওগো বিজয়ী, নিখিল হূদয়
কর কর জয় মোহন মায়ায়।নহে ও এক হিয়ার সমান
হাজার কাবা হাজার মস্জিদ
কি হবে তোর কাবার খোঁজে
আশয় খোঁজ তোর হূদয় ছায়ায়।প্রেমের আলোয় যে দিল্ রোশন
যেথায় থাকুক সমান তাহার
খুদার মস্জিদ মুরত মন্দির
ইশাই দেউল ইহুদখানায়।অমর তার নাম প্রেমের খাতায়
জ্যোতির লেখায় রবে লেখা
দোজখের ভয় করে না সে
থাকে না সে বেহেস্তের আশায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
লো কিশোরী কুমারী!
পিয়াসি মন তোমার ঠোঁটের একটি গোপন চুমারই॥
অফুট তোমার অধর ফুলে
কাঁপন যখন নাচন তুলে
একটু চাওয়ায় একটু ছুঁলে গো!
তখন এ-মন যেমন কেমন-কেমন কোন্ তিয়াসে কোঙারি? –
ওই শরম-নরম গরম ঠোঁটের অধীর মদির ছোঁয়ারই।
বুকের আঁচল মুখের আঁচল বসন-শাসন টুটে
ওই শঙ্কা-আকুল কী কী আশা ভালোবাসা ফুটে সই?
নয়ন-পাতার শয়ন-ঘেঁসা
ফুটচে যে ওই রঙিন নেশা
ভাসা-ভাসা বেদনমেশা গো!
ওই বেদন-বুকে যে সুখ চোঁয়ায় ভাগ দিয়ো তার কোঙারই!
আমার কুমার হিয়া মুক্তি মাগে অধর ছোঁয়ায় তোমারই॥
(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
[স্থান– প্রহরী–বেষ্টিত অন্ধকার কারাগৃহ, কনস্ট্যান্টিনোপ্ল্।
কাল–অমাবস্যার নিশীথ রাত্রি।]
[চারিদিকে নিস্তব্ধ নির্বাক। সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি-সাস্ত্রীর পায়চারির বিশ্রী খট্খট্ শব্দ। ঐ জিন্দানখানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয়-সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী। তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন– সমস্ত-কিছুতে যেন একটা ব্যথিত-বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল। তরুণ প্রদীপ্ত মুখমণ্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশি বয়স্ক বোধ হইতেছিল।
সেইদিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তরুণ সেনানীকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে।
আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি। তাহার হাতে, পায়ে, কটিদেশে, গর্দানে উৎপীড়নের লৌহ-শৃঙ্খল। শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানী স্বপ্নে তাহার 'মা'-কে দেখিতেছিল। সহসা চীৎকার করিয়া সে জাগিয়া উঠল। তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই। শুধু হিমানি-সিক্ত বায়ু হা হা স্বরে কাঁদিয়া গেল, 'হায় মাতৃহারা!'
স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বাম বাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিল। কারাগৃহের লৌহ-শলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া তুলিতেছিল।
এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল। তরুণ বন্দী চীৎকার করিয়া উঠিল, 'আনোয়ার!'–]
আনোয়ার! আনোয়ার!
দিলাওয়ার তুমি, জোর তলওয়ার হানো, আর
নেস্ত-ও-নাবুদ করো, মারো যত জানোয়ার!
আনোয়ার! আফসোস্!
বখতেরই সাফ্ দোষ,
রক্তেরও নাই ভাই আর সে যে তাপ জোশ,
ভেঙে গেছে শম্শের–পড়ে আছে খাপ কোষ!
আনোয়ার! আফসোস্!
আনোয়ার! আনোয়ার!
সব যদি সুম্সাম, তুমি কেন কাঁদো আর?
দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার!
আনোয়ার! আর না!–
দিল্ কাঁপে কার না?
তল্ওয়ারে তেজ নাই! –তুচ্ছ স্মার্ণা,
ঐ কাঁপে থরথর মদিনার দ্বার না?
আনোয়ার! আর না!
আনোয়ার! আনোয়ার!
বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো, আর
খুন করো –খুন করো ভীরু যত জানোয়ার!
আলোয়ার! জিঞ্জির–
পরা মোরা খিঞ্জির!
শৃঙ্খলে বাজে শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,–
নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্কির!
গর্দানে জিঞ্জির!
আনোয়ার! আনোয়ার!
দুর্বল্ এ গিদ্ধড়ে কেন তড়্পানো আর?
জোরওয়ার শের কই? জের্বার জানোয়ার!
আনোয়ার! মুশ্কিল
জাগা কঞ্জুশ্-দিল,
ঘিরে আসে দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল!
ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ কিল!
আনোয়ার! মুশ্কিল!
আনোয়ার! আনোয়ার!
বেইমান মোরা, নাই জান আধ-খানও আর।
কোথা খোঁজো মুস্লিম? –শুধু বুনো জানোয়ার!
আনোয়ার! সব শেষ!–
দেহে খুন অবশেষ!–
ঝুটা তেরি তলওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ !
আওরত সম ছি ছি ক্রদন রব পেশ ! !
আনোয়ার ! সব শেষ !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
জনহীন এ বিয়াবানে মিছে পস্তানো আর !
আজো যারা বেঁচে আছে তারা খ্যাপা জানোয়ার !
আনোয়ার ! –কেউ নাই !
হাথিয়ার? –সেও নাই !
দরিয়াও থম্থম্ নাই তাতে ঢেউ, ছাই !
জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে'ও ভাই !
আনোয়ার ! কেউ নাই !
আনোয়ার ! আনোয়ার !
যে বলে সে মুস্লিম– জিভ্ ধরে টানো তার !
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার !
আনোয়ার ! ধিক্কার !
কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার–
তল্ওয়ারে শুরু যার স্বধীনতা শিক্ষার!
যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিক্দার!
আনোয়ার! ধিক্কার!
আনোয়ার ! আনোয়ার!
দুনিয়াটা খুনিয়ার, তবে কেন মনো আর
রুধিরের লোহু আঁখি? –শয়তানি জানো সার!
আনোয়ার ! পঞ্জায়
বৃথা লোকে সম্ঝায়,
ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্ নাচে ঝন্ঝায়,
খুন-খেগো তল্ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,
আনোয়ার ! পঞ্জায়!
আনোয়ার ! আনোয়ার!
পাশা তুমি নাশা হও মুসলিম-জানোয়ার,
ঘরে যত দুশ্মন, পরে কেন হানো মার?–
আনোয়ার ! এসো ভাই!
আজ সব শেষও যাই!–
ইস্লামও ডুবে গেল, মুক্ত স্বদেশও নাই!-
তেগ ত্যাজি বরিয়াছি ভিখারির বেশও তাই!
আনোয়ার ! এসো ভাই!!
[সহসা কাফ্রি সাস্ত্রীর ভীম চ্যালেঞ্জ্ প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনির মতো হুঙ্কার দিয়া উঠিল– 'এয়্ নৌজওয়ান, হুঁশিয়ার!' অধীর ক্ষোভে তিক্ত রোষে তরুণের দেহের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল! তাহার কটিদেশের, গর্দানের, পায়ের শৃঙ্খল খানখান হইয়া টুটিয়া গেল, শুধু হাতের শৃঙ্খল টুটিল না। সে সিংহ-শাবকের মতো গর্জন করিয়া উঠিল–]
এয়্ খোদা! এয়্ আলি! লাও মেরি তলোয়ার!
[সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। ঐ মাতৃমূর্তির পার্শ্বেই তাহার মায়েরও শৃঙ্খলিত ভিখারিনি বেশ। তাঁদের দুইজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু। অভিমানী পুত্র অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল–]
ও কে? ও কে ছল আর?
না-মা, মরা জানকে এ মিছে তর্সানো আর!
আনোয়ার ! আনোয়ার!!
[কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল। অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাহারই আর্ত প্রতিধ্বনি গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-'আঃ-আঃ-আঃ!'
আজ নিখিল বন্দী-গৃহে গৃহে ঐ মাতৃমুক্তিকামী তরুণেরই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে। যেদিন এ ক্রন্দন থামিবে, সেদিন সে-কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিব জানি না! তখন হয়তো হারা-মা-আমার আমায় 'তারার পানে চেয়ে চেয়ে' ডাকবেন। আমিও হয়তো আবার আসিব। মা কি আমায় তখন নূতন নামে ডাকিবেন? আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে? আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে, আর কেন যেন মনে হইতেছে, 'আসিবে সেদিন আসিবে!']
———————————-
সুমসাম– নিঝঝুম।
জিঞ্জির– শৃঙ্খল
খিঞ্জির– শূকর
রোণা– ক্রন্দন
জোরওয়ার– বলবান
শের– বাঘ
গিদ্ড়ে– শৃগাল
জোরবার– ক্ষত-বিক্ষত
কঞ্জুশ্-দিল– কৃপণ মন
বিয়াবান– মরুভূমি।
হাথিয়ার– অস্ত্র
দিক্দার– তিক্ত-বিরক্ত
তেগ– তলোয়ার।
তরসানো– দুঃখে দেওয়া
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
তোমারি আঁখির মত আকাশের দুটি তারা
চেয়ে থাকে মোর পানে নিশীথে তন্দ্রাহারা।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?ক্ষীণ আঁখিদীপ জ্বালি বাতায়নে জাগি একা
অসীম অন্ধকারে খুঁজি তব পথরেখা
সহসা দখিনবায়ে চাঁপাবনে জাগে সাড়া।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?তব স্মৃতি যদি ভুলি ক্ষণতরে আনকাজে
কে যেন কাঁদিয়া ওঠে আমার বুকের মাঝে।বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে
বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে
ঝড় চলে যায় কেঁদে, ঢালিয়া শ্রাবণধারা।
সে কি তুমি? সে কি তুমি?
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদআজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।তোরে মারল' ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
আমার সকল ধ্যানে জ্ঞানে,
বিচিত্র সে সুরে সুরে
গাহি তোমার বন্দনা গান,
রাজাধিরাজ, নিখিল জুড়ে!
কী বলেছে তোমার কাছে
মিথ্যা ক'রে আমার নামে
হিংসুকেরা,- ডাকলে না আজ,
তাইতে আমায় তোমার পুরে!!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
বাদল-রাতের পাখি!
কবে পোহায়েছে বাদলের রাতি, তবে কেন থাকি থাকি
কাঁদিছ আজিও ‘বউ কথা কও’শেফালির বনে একা,
শাওনে যাহারে পেলে না, তারে কি ভাদরে পাইবে দেখা?…
তুমি কাঁদিয়াছ ‘বউ কথা কও’সে-কাঁদনে তব সাথে
ভাঙিয়া পড়েছে আকাশের মেঘ গহিন শাওন-রাতে।
বন্ধু, বরষা-রাতি
কেঁদেছে যে সাথে সে ছিল কেবল বর্ষা-রাতেরই সাথে!
আকাশের জল-ভারাতুর আঁখি আজি হাসি-উজ্জ্বল ;
তেরছ-চাহনি জাদু হানে আজ, ভাবে তনু ঢল ঢল!
কমল-দিঘিতে কমল-মুখীরা অধরে হিঙ্গুল মাখে,
আলুথালু বেশ – ভ্রমরে সোহাগে পর্ণ-আঁচলে ঢাকে।
শিউলি-তলায় কুড়াইতে ফুল আজিকে কিশোরী মেয়ে
অকারণ লাজে চমকিয়া ওঠে আপনার পানে চেয়ে।
শালুকের কুঁড়ি গুঁজিছে খোঁপায় আবেশে বিধুরা বধূ,
মুকুলি পুষ্প কুমারীর ঠোঁটে ভরে পুষ্পল মধু।
আজি আনন্দ-দিনে
পাবে কি বন্ধু বধূরে তোমার, হাসি দেখে লবে চিনে?
সরসীর তীরে আম্রের বনে আজও যবে ওঠ ডাকি
বাতায়নে কেহ বলে কি, “কে তুমি বাদল-রাতের পাখি!
আজও বিনিদ্র জাগে কি সে রাতি তার বন্ধুর লাগি?
যদি সে ঘুমায় – তব গান শুনি চকিতে ওঠে কি জাগি?
ভিন-দেশি পাখি! আজিও স্বপন ভাঙিল না হায় তব,
তাহার আকাশে আজ মেঘ নাই – উঠিয়াছে চাঁদ নব!
ভরেছে শূন্য উপবন তার আজি নব নব ফুলে,
সে কি ফিরে চায় বাজিতেছে হায় বাঁশি যার নদীকূলে?
বাদলা-রাতের পাখি!
উড়ে চলো – যথা আজও ঝরে জল, নাহিকো ফুলের ফাঁকি! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে
দূর গগনে প্রিয় তিমির-পারে।জেগে যবে দেখি বঁধু তুমি নাই কাছে
আঙিনায় ফুটে ফুল ঝরে পড়ে আছে
বাণ-বেঁধা পাখী সম আহত এ প্রাণ মম
লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে অন্ধকারে।মৌনা নিঝুম ধরা ঘুমায়েছে সবে
এসো প্রিয় এই বেলা বক্ষে নীরবে।কত কথা কাঁটা হয়ে বুকে আছে বিঁধে
কত আভিমান কত জ্বালা এই হূদে
দেখে যাও এসো প্রিয় কত সাধ ঝরে গেল
কত আশা মরে গেল হাহাকারে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
হে পার্থসারথি
বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য-শঙ্খ।
চিত্তের অবসাদ দূর করো, করো দূর
ভয়-ভীত জনে করো হে নিঃশঙ্ক॥
জড়তা ও দৈন্য হানো হানো
গীতার মন্ত্রে জীবন দানো
ভোলাও ভোলাও মৃত্যু-আতঙ্ক॥
মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে,
শোনাও শোনাও, অনন্তকাল ধরি
অনন্ত জীবন-প্রবাহ বহে॥
দুরন্ত দুর্মদ যৌবন-চঞ্চল
ছাড়িয়া আসুক মা-র স্নেহ-অঞ্চল
বীর সন্তান দল
করুক সুশোভিত মাতৃ-অঙ্ক॥(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান
আসিবে আজ বন্ধু মোর।
স্বপন মাখিয়া সোনার পাখায়
আকাশে উধাও চিত-চকোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।হিজল বিছানো বন পথ দিয়া
রাঙায়ে চরণ আসিবে গো প্রিয়া।
নদীর পারে বন কিনারে
ইঙ্গিত হানে শ্যাম কিশোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।চন্দ্রচূড় মেঘের গায়
মরাল-মিথুন উড়িয়া যায়,
নেশা ধরে চোখে আলো-ছায়ায়
বহিছে পবন গন্ধ চোর।
আসিবে আজ বন্ধু মোর।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
অনন্তকাল এ-অনন্তলোকে
মন-ভোলানোরে তার খুঁজে ফিরে মন।
দক্ষিণা-বায় চায় ফুল-কোরকে ;
পাখি চায় শাখী, লতা-পাতা-ঘেরা বন।
বিশ্বের কামনা এ – এক হবে দুই ;
নূতনে নূতনতর দেখিবে নিতুই॥
তোমারে গাওয়াত গান যার বিরহ
এড়িয়ে চলার ছলে যাচিয়াছ যায়,
এল সেই সুদূরের মদির-মোহ
এল সেই বন্ধন জড়াতে গলায়।
মালা যে পরিতে জানে, কন্ঠে তাহার
হয় না গলার ফাঁসি চারু-ফুলহার॥
জলময়, নদী তবু নহে জলাশয়,
কূলে কূলে বন্ধন তবু গাহে গান ;
বুকে তরণির বোঝা কিছু যেন নয়–
সিন্ধুর সন্ধানী চঞ্চল-প্রাণ।
দুই পাশে থাক তব বন্ধন-পাশ,
সমুখে জাগিয়া থাক সাগর-বিলাস॥
বিরহের চখাচখি রচে তারা নীড়,
প্রাতে শোনে নির্মল বিমানের ডাক ;
সেই ডাকে ভোলে নীড়, ভোলে নদীতীর,
সন্ধ্যায় গাহে : ‘এই বন্ধন থাক’!
আকাশের তারা থাক কল্পলোকে,
মাটির প্রদীপ থাক জাগর-চোখে॥ (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
তুমি আমার সকালবেলার সুর
বিদায় আলোয় উদাস করা অশ্রুভারাতুর।ভোরের তারার মতো তোমার সজল চাওয়ায়
ভালোবাসা চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়
রাত্রিশেষের চাঁদ তুমি গো, বিদায়বিধুর।তুমি আমার ভোরের ঝরা ফুল
শিশির নাওয়া শুভ্রশুচি পূজারিণীতুল।অরুণ তুমি তরুণ তুমি করুণ তারও চেয়ে
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ লোকের মেয়ে
তুমি ইন্দ্রসভার মৌনবীণা নীরবনিঠুর।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
অনেক ছিল বলার, যদি সেদিন ভালোবাসতে
পথ ছিল গো চলার, যদি দুদিন আগে আসতে
আজকে মহাসাগর স্রোতে চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা, সেই আঁধারে ভাসতে
যাই সেই আঁধারে ভাসতে।গহন রাতি ডাকে আমায়, এসে তুমি আজকে
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার বিদায় বেলার সাঁঝকে
আসতে যদি হে অতিথি, ছিল যখন শুক্লা তিথি
ফুটতো চাঁপা, সেদিন যদি চৈতালী চাঁদ হাসতে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও
ভীম বজ্র-বিষাণে
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!অগ্নি-তূর্য কাঁপাক সূর্য
বাজুক রুদ্রতালে ভৈরব –
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!নট-মল্লার দীপক-রাগে
জ্বলুক তাড়িত-বহ্নি আগে
ভেরির রন্ধ্রে মেঘমন্দ্রে জাগাও বাণী জাগ্রত নব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!দাসত্বের এ ঘৃণ্য তৃপ্তি
ভিক্ষুকের এ লজ্জা-বৃত্তি,
বিনাশো জাতির দারুণ এ লাজ, দাও তেজ দাও মুক্তি-গরব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!খুন দাও নিশ্চল এ হস্তে
শক্তি-বজ্র দাও নিরস্ত্রে;
শীর্ষ তুলিয়া বিশ্বে মোদেরও দাঁড়াবার পুন দাও গৌরব –
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!ঘুচাতে ভীরুর নীচতা দৈন্য
প্রেরো হে তোমার ন্যায়ের সৈন্য
শৃঙ্খলিতের টুটাতে বাঁধন আনো আঘাত প্রচণ্ড আহব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!নির্বীর্য এ তেজঃ-সূর্যে
দীপ্ত করো হে বহ্নি-বীর্যে,
শৌর্য ধৈর্য মহাপ্রাণ দাও, দাও স্বাধীনতা সত্য বিভব!
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও! (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
এ কোন্ পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী মা-র আঙিনায়।
ত্রিশ কোটি ভাই মরণ-হরণ গান গেয়ে তাঁর সঙ্গে যায়॥
অধীন দেশের বাঁধন-বেদন
কে এল রে করতে ছেদন?
শিকল-দেবীর বেদির বুকে মুক্তি-শঙ্খ কে বাজায়॥
মরা মায়ের লাশ কাঁধে ওই অভিমানী ভায়ে ভায়ে
বুক-ভরা আজ কাঁদন কেঁদে আনল মরণ-পারের মায়ে।
পণ করেছে এবার সবাই,
পর-দ্বারে আর যাব না ভাই!
মুক্তি সে তো নিজের প্রাণে, নাই ভিখারির প্রার্থনায়॥
শাশ্বত যে সত্য তারই ভুবন ভরে বাজল ভেরি,
অসত্য আজ নিজের বিষেই মরল ও তার নাইকো দেরি।
হিংসুকে নয়, মানুষ হয়ে
আয় রে, সময় যায় যে বয়ে!
মরার মতন মরতে, ওরে মরণভীতু! ক-জন পায়!
ইসরাফিলের শিঙা বাজে আজকে ঈশান-বিষাণ সাথে,
প্রলয়-রাগে নয় রে এবার ভৈরবীতে দেশ জাগাতে।
পথের বাধা স্নেহের মায়ায়
পায় দলে আয় পায় দলে আয়!
রোদন কীসের ? – আজ যে বোধন!
বাজিয়ে বিষাণ উড়িয়ে নিশান আয় রে আয়॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রকৃতিমূলক
|
মধুকর মঞ্জীর বাজে বাজে গুন্ গুন্ মঞ্জুল গুঞ্জরণে
মৃদুল দোদুল নৃত্যে বন শবরী মাতে কুঞ্জবনে।বাজায়ছে সমীর দখিনা
পল্লবে মর্মর বীণা
বনভুমি ধ্যান-আসীনা
সাজিল রাঙা কিশলয় বসনে।ধূলি-ধূসর প্রান্তর পরেছিল গৈরিক সন্ন্যাসী সাজ
নব দূর্বাদল শ্যাম হলো আনন্দে আজ।লতিকা বিতানে ওঠে ডাকি
মুহু মুহু ঘুমহারা পাখি
নব নীল অঞ্জন মাখি
উদাসী আকাশ হাসে চাঁদের সনে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
তখনো অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু
অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরু-গুরু-গুরু!
আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন ইন্দ্রের আগমনী?
শুনি, অন্দুব-কম্বু- নিনাদে ঘন বৃঙ্ঘিত- ধ্বনি।
বাজে চিক্কুর- হ্রেষা- হর্ষণ মেঘ- মন্দুরা- মাঝে,
সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলয়ংকর সাজে।ঘনায় অশ্রু-বাষ্প- কুহেলি ঈশান- দিগঙ্গনে,
স্তব্ধ- বেদনা দিগ-বালিকারা কী যে কাঁদুনী শোনে!
কাঁদিছে ধরার তরু-লতা-পাতা, কাঁদিছে পশু-পাখী,
ধরার ইন্দ্র স্বর্গে চলেছে ধূলির মহিমা মাখি'।
বাজে আনন্দ- মৃদং গগনে, তড়িৎ-কুমারী নাচে,
মর্ত্য- ইন্দ্র বসিবে গো আজ স্বর্গ- ইন্দ্র কাছে।
সপ্ত- আকাশ- সপ্তস্বরা হানে ঘন করতালি,
কাঁদিছে ধরায় তাহারি প্রতিধ্বনি-খালি, সব খালি!হায় অসহায় সর্বংসহা মৌনা ধরণী মাতা,
শুধু দেব- পূজা তরে কি মা তর পুষ্প হরিৎমাতা?
তোর বুকে কি মা চির-অতৃপ্ত রবে সন্তান-ক্ষুধা?
তোমার মাটির পাত্রে কি গো মা ধরে না অমৃত-সুধা?
জীবন- সিন্ধু মথিয়া যে-কেহ আনিবে অমৃত-বারি
অমৃত-অধিপ দেবতার রোষ পড়িবে কি শিরে খাঁটি
তারে স্বর্গের আছে প্রয়োজন, যারে ভালোবাসে মাটি।কাঁটার মৃণালে উঠেছিল ফুটে যে চিত্ত- শতদিল
শোভেছিল যাহে বাণী কমলার রক্ত-চরণ-তল,
সম্ভ্রম-নত পূজারী মৃত্যু ছিঁড়িল সে শতদলে-
শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য অর্পিবে বলি' নারায়ণ-পদতলে!
জানি জানি মোরা, শংখ-চক্র-গদা যাঁর হাতে শোভে-
পায়ের পদন হাতে উঠে তাঁর অমর হইয়া র'বে।
কত শান্ত্বনা- আশা-মরিচিকা কত বিশ্বাস-দিশা
শোক- সাহারায় দেখা দেয় আসি, মেটে না প্রানের তৃষা!দুলিছে বাসুকি মণীহারা ফণী, দুলে সাথে বসুমতী,
তাহার ফনার দিন-মণি আজ কোন গ্রহে দেবে জ্যোতি!
জাগিয়া প্রভাতে হেরিনু আজিকে জগতে সুপ্রভাত,
শয়তানও আজ দেবতার নামে করিছে নান্দীপাঠ!
হে মহাপুরুষ, মহাবিদ্রোহী, হে ঋষি, সোহম-স্বামী!
তব ইঙ্গিতে দেখেছি সহসা সৃষ্টি গিয়াছে থামি',
থমকি গিয়াছে গতির বিশ্ব চন্দ্র- সূর্য- তারা,
নিয়ম ভুলেছে কঠোর নিয়তি, দৈব দিয়াছে সাড়া!যখনি স্রষ্ঠা করিয়াছে ভুল, ক'রেছ সংস্কার,
তোমারি অগ্রে স্রষ্টা তোমারে ক'রেছে নমস্কার!
ভৃগুর মতন যখনি দেখেছ অচেতন নারায়ণ,
পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা, জেগেছে জগজ্জন!
ভারত-ভাগ্য-বিধাতা বক্ষে তব পদ-চিন ধরি'
হাঁকিছেন, 'আমি এমন করিয়া সত্য স্বীকার করি!
জাগাতে সত্য এত ব্যাকুলতা এত অধিকার যার,
তাহার চেতন- সত্যে আমার নিযুত নমস্কার!'আজ শুধু জাগে তব অপরূপ সৃষ্টি- কাহিনী মনে,
তুমি দেখা দিলে অমিয়-কন্ঠ বাণীর কমল-বনে!
কখন তোমার বীণা ছেয়ে গেল সোনার পদন-দলে,
হেরিনু সহসা ত্যাগের তপন তোমার ললাট-তলে!
লক্ষী দানিল সোনার পাপড়ি, বীণা দিল করে বাণী,
শিব মাখালেন ত্যাগের বুভূতি কন্ঠে গরল দানি',
বিষ্ণু দিলেন ভাঙ্গনের গদা, যশোদা-দুলাল বাঁশি,
দিলেন অমিত তেজ ভাস্কর, মৃগাঙ্ক দিল হাসি।চির গৈরিক দিয়া আশিসিল ভারত-জননী কাঁদি',
প্রতাপ শিবাজী দানিল মন্ত্র, দিল উষ্ণীষ বাঁধি'।
বুদ্ধ দিলেন ভিক্ষাভান্ড, নিমাই দিলেন ঝুলি,
দেবতারা দিলেন মন্দার-মালা, মানব মাখালো ধূলি।
নিখিল-চিত্ত-রঞ্জন তুমি উদিলে নিখিল ছানি'-
মহাবীর, কবি, বিদ্রোহী, ত্যাগী, প্রেমিক, কর্মী, জ্ঞানী!
হিমালয় হ'তে বিপুল বিরাট উদার আকাশ হ'তে,
বাধা-কুঞ্জর তৃণ-সম ভেসে গেল তব প্রান-স্রোতে!ছন্দ গানের অতীত হে ঋষি, জীবনে পারিনি তাই
বন্দিতে তোমা',আজ আনিয়াছি চিত্ত-চিতার ছাই!
বিভূতি-তিলক! কৈলাস হ'তে ফিরেছ গরল পি'ইয়া,
এনেছি অর্ঘ্য শ্মশানের কবি ভস্ম বিভূতি নিয়া!
নাও অঞ্জলি, অঞ্জলি নাও, আজ আনিয়াছি গীতি
সারা জীবনের না-কওয়া কথার ক্রন্দন-নীরে তিতি'!
এত ভালো মোরে বেসেছিলে তুমি, দাওনি ক' অবসর
তোমারেও ভালোবাসিবার, আজ তাই কাঁদে অন্তর! আজিকে নিখিল-বেদনার কাছে মোর ব্যথা যতটুক,
ভাবিয়া ভাবিয়া স্বান্ত্বনা খুঁজি, তবু হা হা করে বুক~
আজ ভারতের ইন্দ্র-পতন,বিশ্বের দুর্দিন,
পাষান বাংলা প'ড়ে এককোনে স্তব্ধ অশ্রুহীন!
তারি মাঝি হিয়া থাকিয়া গুমরি' গুমরি' ওঠে,
বক্ষের বাণী চক্ষের জলে ধুয়ে যায়, নাহি ফোটে!
দীনের বন্ধু, দেশের বন্ধু, মানব-বন্ধু তুমি,
চেয়ে দেখ আজ লুটায় বিশ্ব তোমার চরণ চুমি'।
গগনে তেমনি ঘনায়েছে মেঘ, তেমনি ঝরিছে বারি,
বাদলে ভিজিয়া শত স্মৃতি তব হ'ইয়ে আসে ঘন ভারি।পয়গম্বর ও অবতার- যুগে জন্মিনি মোরা কেহ,
দেখিনি ক' মোরা তাঁদের, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ,
কিন্তু যখনি বসিতে পেয়েছি তোমার চরণ-তলে
না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছু নয়ন ভ'রেছে জলে!
সারা প্রান যেন অঞ্জলি হ'য়ে ও-পায়ে প'ড়েছে লুটি',
সকল গর্ব উঠেছে মধুর প্রণাম হইয়া ফুটি'!
বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনি ক' চোখে তাহে,
নাহি আফসোস, দেখেছি আমরা ত্যাগের শাহানশাহে;
নিমাই লইল সন্ন্যাস প্রেমে, দিইনি ক' তারে ভেট,
দেখিয়াছি মোরা 'রাজা-সন্ন্যাসী', প্রেমের জগৎ- শেঠ!শুনি, পরার্থে প্রান দিয়া দিল অস্থি বনের ঋষি;
হিমালয় জানে, দেখেছি দধীচি গৃহে ব'সে দিবানিশি!
হে নবযুগের হরিশ্চন্দ্র! সাড়া দাও, সাড়া দাও!
কাঁদিছে শ্মশানে সুত-কোলে সতী, রাজর্ষি ফিরে চাও!
রাজকুলমান পুত্র-পত্নী সকল বসর্জিয়া
চন্ডাল-বেশে ভারত-শ্মশান ছিলে একা আগুলিয়া,
এস সন্ন্যাসী, এস সম্রাট, আজি সে শ্মশান-মাঝে,
ঐ শোনো তব পুন্য জীবন- শিশুর কাঁদন বাজে!দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যূপে ফেলে
ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ বীর বারে বারে অবহেলে।
ইবরাহিমের মত বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া
কোরবানী দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী-হিয়া।
ফেরেশতা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,
ভগবান-বুক মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!প্রজা-রঞ্জন রাম-রাজা দিল সীতারে বিসর্জন,
তাঁরও হয়েছিল যজ্ঞে স্বর্ণ-জানকীর প্রয়োজন,
তব ভান্ডার- লক্ষীরে রাজা নিজ হাতে দিলে তুলি'
ক্ষুধা-তৃষাতুর মানবের মুখে, নিজে দিলে পথ-ধূলি,
হেম-লক্ষীর তোমারও জীবন-যাগে ছিল প্রয়োজন,
পুড়িলে যজ্ঞে, তবু নিলে না ক' দিলে যা বিসর্জন!
তপোবলে তুমি অর্জিলে তেজ বিশ্বামিত্র-সম,
সারা বিশ্বের ব্রাম্মন তাই বন্দিছে নমো নমো!হে যুগ- ভীষ্ম! নিন্দার শরশয্যায় তুমি শুয়ে
বিশ্বের তরে অমৃত-মন্ত্র বীর-বাণী গেলে থুয়ে!
তোমার জীবনে বলে গেলে- ওগো কল্কি আসার আগে
অকল্যানের কুরুক্ষেত্রে আজো মাঝে মাঝে জাগে
চির-সত্যের পাঞ্চজন্য, কৃষ্ণের মহাগীতা,
যুগে যুগে কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা!
তুমি নব ব্যাস, গেলে নবযুগ-জীবন-ভারত চরি'
তুমিই দেখালে-ইন্দ্রেরই তরে পারিজাত-মালা শচী!
আসিলে সহসা- অত্যাচারীর প্রাসাদ-স্তম্ভ টুটি'
নব-নৃসিংহ-অবতার তুমি, পড়িল বক্ষে লুটি'
আর্ত-মানব-হৃদি-প্রহ্লাদ, পাগল মুক্তি-প্রেমে!
তুমি এসেছিলে জীবন গঙ্গা তৃষাতুর তরে নেমে!
দেবতারা তাই স্তম্ভিত হের' দাঁড়ায়ে গগন তলে
নিমাই তোমারে ধরিয়াছে বুকে, বুদ্ধ নিয়াছে কোলে!তোমারে দেখিয়া কাহারো হৃদয়ে জাগেনি ক' সন্দেহ
হিন্দু কিম্বা মুসলিম তুমি অথবা অন্য কেহ।
তুমি আর্তের, তুমি বেদনার, ছিলে সকলের তুমি,
সবারে যেমন আল দেয় রবি, ফুল দেয় সবে ভূমি!
হিন্দুর ছিলে আকবর তুমি মুসলিমের আরংজিব,
যেখানে দেখেছ জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব!
নিন্দা-গ্লানির পঙ্ক মাখিয়া, পাগল, মিলন-হেতু
হিন্দু- মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে-সেতু!
জানিনা আজি কে অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান,
ঈর্ষা-পঙ্কে পঙ্কজ হ'য়ে ফুটুক এদের প্রান!
হে অরিন্দম, মৃত্যুর তীরে ক'রেছ শত্রু জয়,
প্রেমিক! তোমার মৃত্যু-শ্মশান আজিকে মিত্রময়!
তাই দেখি, যারা জীবনে তোমায় দিল কন্টক-হুল,
আজ তাহারাই এনেছে অর্ঘ্য নয়ন-পাতার ফুল!
কি যে ছিলে তুমি জানি না ক' কেহ, দেবতা কি আওলিয়া,
শুধু এই জানি, হেরি আর কারে ভরেনি এমন হিয়া।আজি দিকে দিকে বিপ্লব-অহিদল খুঁজে ফেরে ডেরা,
তুমি ছিলে এই নাগ-শিশুদের ফণী-মনসার বেড়া!
তুমিই রাজার ঐরাবতের পদতল হ'তে তুলে
বিষ্ণু-শ্রীকর-অরবিন্দরে আবার শ্রীকরে থুলে!
তুমি দেখিছিলে ফাঁসির গোপীতে বাঁশির গোপীমোহন,
রক্ত-যমুনা-কূলে রচে' গেলে প্রেমের বৃন্দাবন!
তোমার ভগ্ন চাকায় জরায়ে চালায়েছে এরা রথ,
আপন মাথার মানিক জ্বালায়ে দেখায়েছে রাতে পথ,
আজ পথহারা আশ্রয়হীন সাপুড়ে মারণ- মন্ত্র সুরে!যেদিকে তাকাই কূল নাহি পাই, অকূল হতাশ্বাস,
কোন শাপে ধরা স্বরাজ-রথের চক্র করিল গ্রাস?
যধিষ্ঠিরের সম্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী,
ঐ হের' দূরে কৌরব-সেনা উল্লাসে ওঠে নাচি'।
হিমালয় চিরে আগ্নেয়-বাণ চীৎকার করি' ছুটে,
শত ক্রন্দন-গঙ্গা যেন গো পড়িছে পিছনে টুটে!
স্তব্ধ- বেদনা গিরিরাজ ভয়ে জলদে লুকায় কায়-
নিখিল অশ্রু সাগর বুঝি বা তাহারে ডুবাতে চায়!
টুটিয়াছে আজ গর্ব তাহার, লাজে নত উঁচু শির,
ছাপি' হিমাদ্রি উঠিছে প্রণাম সমগ্র পৃথিবীর!
ধূর্জটি-জটা-বাহিনী গঙ্গা কা৬দিয়া কাঁদিয়া চলে,
তারি নিচে চিতা- যেন গো শিবের ললাটে অগ্নি জ্বলে!মৃত্যু আজিকে হইল অমর পরশি' তোমার প্রান,
কালো মুখ তার হ'ল আলোময়, শ্মশানে উঠিছে গান।
অগুরু- পুষ্প-চন্দন পুড়ে হল সুগন্ধতর,
হ'ল শুচিতর অগ্নি আজিকে, শব হ'ল সুন্দর!
ধন্য হইল ভাগীরথী-ধারা তব চিতা-ছাই মাখি',
সমিধ হইল পবিত্র আজি কোলে তব দেহ রাখি'!
অসুর নাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্বোধনে
আঁখি উপাড়িতে গেছিলেম রাম, আজিকে পড়িছে মনে;
রাজর্ষি! আজি জীবন উপাড়ি দিলে অঞ্জলি তুমি,
দনুজ- দলনী জাগে কিনা-আছে চাহিয়া ভারত-ভূমি!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
ঘোর –
ঘোর রে ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর
ওই স্বরাজ-রথের আগমনি শুনি চাকার শব্দে তোর॥
১
তোর ঘোরার শব্দে ভাই
সদাই শুনতে যেন পাই
ওই খুলল স্বরাজ-সিংহদুয়ার, আর বিলম্ব নাই।
ঘুরে আসল ভারত-ভাগ্য-রবি, কাটল দুখের রাত্রি ঘোর॥
২
ঘর ঘর তুই ঘোর রে জোরে
ঘর্ঘরঘর ঘূর্ণিতে তোর
ঘুচুক ঘুমের ঘোর
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
তোর ঘুর-চাকাতে বল-দর্পীর তোপ কামানের টুটুক জোর॥
৩
তুই ভারত-বিধির দান,
এই কাঙাল দেশের প্রাণ,
আবার ঘরের লক্ষ্মী আসবে ঘরে শুনে তোর ওই গান।
আর লুটতে নারবে সিন্ধু-ডাকাত বৎসরে পঁয়ষট্টি ক্রোড়॥
৪
হিন্দু-মুসলিম দুই সোদর,
তাদের মিলন-সূত্র-ডোর রে
রচলি চক্রে তোর,
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
আবার তোর মহিমায় বুঝল দু-ভাই মধুর কেমন মায়ের ক্রোড়॥
৫
ভারত বস্ত্রহীন যখন
কেঁদে ডাকল – নারায়ণ!
তুমি লজ্জা-হারী করলে এসে লজ্জা নিবারণ,
তাই দেশ-দ্রৌপদীর বস্ত্র হরতে পারল না দুঃশাসন-চোর॥
৬ এই সুদর্শন-চক্রে তোর
অত্যাচারীর টুটল জোর রে ছুটল সব গুমোর
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
তুই জোর জুলুমের দশম গ্রহ, বিষ্ণু-চক্র ভীম কঠোর॥
৭
হয়ে অন্নবস্ত্রহীন
আর ধর্মে কর্মে ক্ষীণ
দেশ ডুবছিল ঘোর পাপের ভারে যখন দিনকে দিন,
তখন আনলে অন্ন পুণ্য-সুধা, খুললে স্বর্গ মুক্তি-দোর॥
৮
শাসতে জুলুম নাশতে জোর
খদ্দর-বাস বর্ম তোর রে অস্ত্র সত্যডোর,
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
মোরা ঘুমিয়ে ছিলাম, জেগে দেখি চলছে চরকা, রাত্রি ভোর॥
৯
তুই সাত রাজারই ধন,
দেশ- মা-র পরশ-রতন,
তোর স্পর্শে মেলে স্বর্গ অর্থ কাম মোক্ষ ধন।
তুই মায়ের আশিস, মাথার মানিক, চোখ ছেপে বয় অশ্রু-লোর॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.