poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
কাজী নজরুল ইসলাম
স্তোত্রমূলক
হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি, এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি! এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান, বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরলি না প্রাণ? দুরন্ত গো, মহাবাহু ওগো রাহু, তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী! সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী! হে দুর্গম! খোলো খোলো খোলো দ্বার। সারি সারি গিরি-দরী দাঁড়ায়ে দুয়ারে করে প্রতীক্ষা তোমার। শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি করিছে বন্দনা তব, বলী! তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কল্লোল আপনাতে আপনি বিভোল! পাশে না শ্রবণে তব ধরণীতে শত দুঃখ-গীত; দেখিতেছ বর্তমান, দেখেছ অতীত, দেখিবে সুদূরে ভবিষ্যৎ- মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রষ্টা, ঋষি, উদাসীনবৎ! ওঠে ভাঙে তব বুকে তরঙ্গের মতো জন্ম-মৃত্যু দুঃখ-সুখ, ভূমানন্দে হেরিছ সতত! হে পবিত্র! আজিও সুন্দর ধরা, আজিও অম্লান সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়া নিতি স্নান! জগতের যত পাপ গ্লানি হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তব স্নেহ-পাণি! ধরা তব আদরিনী মেয়ে, তাহারে দেখিতে তুমি আস’ মেঘ বেয়ে! হেসে ওঠে তৃণে-শস্যে দুলালী তোমার, কালো চোখ বেয়ে ঝরে হিম-কণা আনন্দাশ্রু-ভরা! জলধারা হ’য়ে নামো, দাও কত রঙিন যৌতুক, ভাঙ’ গড়’ দোলা দাও,- কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক! হে বিরাট, নাহি তব ক্ষয়, নিত্য নব নব দানে ক্ষয়েরে ক’রেছ তুমি জয়! হে সুন্দর! জলবাহু দিয়া ধরণীর কটিতট আছো আঁকড়িয়া ইন্দ্রানীলকান্তমণি মেখলার সম, মেদিনীর নিতম্ব সাথে দোল’ অনুপম! বন্ধু, তব অনন্ত যৌবন তরঙ্গে ফেনায়ে ওঠে সুরার মতন! কত মৎস্য-কুমারীরা নিত্য তোমা’ যাচে, কত জল-দেবীদের শুষ্ক মালা প’ড়ে তব চরণের কাছে, চেয়ে নাহি দেখ, উদাসীন! কার যেন স্বপ্নে তুমি মত্ত নিশিদিন! মন্থর-মন্দার দিয়া দস্যু সুরাসুর মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্ন-পুর, হরিয়াছে উচ্চেঃশ্রবা, তব লক্ষ্মী, তব শশী-প্রিয়া তার সব আছে আজ সুখে স্বর্গে গিয়া! ক’রেছে লুন্ঠন তোমার অমৃত-সুধা-তোমার জীবন! সব গেছে, আছে শুধু ক্রন্দন-কল্লোল, আছে জ্বালা, আছে স্মৃতি, ব্যথা-উতরোল উর্ধ্বে শূন্য, নিম্নে শূন্য,-শূন্য চারিধার, মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার! হে মহান! হে চির-বিরহী! হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে মোর বিদ্রোহী, সুন্দর আমার! নমস্কার! নমস্কার লহ! তুমি কাঁদ,-আমি কাঁদি,-কাঁদে মোর প্রিয়া অহরহ। হে দুস্তর, আছে তব পার, আছে কূল, এ অনন্ত বিরহের নাহি পার–নাহি কূল–শুধু স্বপ্ন, ভুল। মাগিব বিদায় যবে, নাহি র’ব আর, তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার! বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয় উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া! তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার, মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার। চট্টগ্রাম ৩১/০৭/১৯২৬
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
মূক করে ওই মুখর মুখে লুকিয়ে রেখো না, ওগো কুঁড়ি, ফোটার আগেই শুকিয়ে থেকো না! নলিন নয়ান ফুলের বয়ান মলিন এদিনে রাখতে পারে কোন সে কাফের আশেক বেদীনে? রুচির চারু পারুল বনে কাঁদচ একা জুঁই, বনের মনের এ বেদনা কোথায় বলো থুই? হাসির রাশির একটি ফোঁটা অশ্রু অকরুণ, হাজার তারা মাঝে যেন একটি কেঁদে খুন! বেহেশতে কে আনলে এমন আবছা বেথার রেশ, হিমের শিশির ছুঁয়ে গেছে হুরপরিদের দেশ! বরষ পরের দরশনের কই সে হরষণ, মিলবে না কি শিথিল তোমার বাহুর পরশন? শরম টুটে ফুটুক কলি শিশির-পরশে ঘোমটা ঠেলে কুণ্ঠা ফেলে সলাজ হরষে।   (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
এই শিকল- পরা ছল মোদের এ শিকল- পরা ছল। এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।।তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়, ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন- ভয় এই বাঁধন প'রেই বাঁধন- ভয়কে করবো মোরা জয়, এই শিকল- বাঁধা পা নয় এ শিকল- ভাঙ্গা কল।।তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্ব গ্রাস, আর ত্রাস দেখিয়েই করবে ভাবছো বিধির শক্তি হ্রাস।। সেই ভয় দেখানো ভুতের মোরা করব সর্বনাশ, এবার আনবো মাভৈঃ- বিজয়- মন্ত্র বল- হীনের বল।।তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়ঃ সেই ভয়ের টুটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়। মোরা আপনি মনে মরার দেশে আনব বরাভয়, মোরা ফাঁসি প'রে আনব হাসি মৃত্যু- জয়ের কল।।ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল- ঝঞ্চনা, এ যে মুক্ত পথের অগ্রদুরী চরণ- বন্দনা! এই লাঞ্চিতেরাই অত্যাচারকে হাঞ্ছে লাঞ্চনা, মোদের অস্থি দিয়েই জ্বল্বে দেশে আবার বজ্রানল।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
ওড়াও ওড়াও লাল নিশান!.... দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান! ওড়াও ওড়াও লাল নিশান॥ শীতের শ্বাসেরে বিদ্রুপ করি ফোটে কুসুম, নব-বসন্ত-সূর্য উঠিছে টুটিয়া ঘুম, অতীতের ওই দশ-সহস্র বছরের হানো মৃত্যু-বাণ ওড়াও ওড়াও লাল নিশান॥ চির বসন্ত যৌবন করে ধরা শাসন, নহে পুরাতন দাসত্বের ওই বদ্ধ মন, ওড়াও ওড়াও লাল নিশান! ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান। বসন্তের এই জ্যোতির পতাকা ওড়াও ঊর্ধ্বে গাহোরে গান! লাল নিশান! লাল নিশান!(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আমি      এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম, কাঁদবে এ বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম – তখন মুকুরপাশে একলা গেহে আমারই এই সকল দেহে চুমব আমি চুমব নিজেই অসীম স্নেহে গো! আহা  পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম, কম সরস-হরষ সম। তখন তুমি নাইবা – প্রিয় – নাইবা রলে কাছে, জানব আমার এই সে দেহে এই সে দেহে গো তোমার বাহুর বুকের শরম-ছোঁয়ার আকুল কাঁপন আছে – মদির অধীর পুলক নাচে! তখন নাইবা আমার রইল মনে কোনখানে মোর দেহের বনে জড়িয়েছিলে লতার মতন আলিঙ্গনে গো! আমি  চুমোয় চুমোয় ডুবাব এই সকল দেহ মম – ওগো শ্রাবণ-প্লাবন সম। (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আজ যবে প্রভাতের নব যাত্রীদল ডেকে গেল রাত্রিশেষে, ‘চল আগে চল’, – ‘চল আগে চল’ গাহে ঘুম-জাগা পাখি, কুয়াশা-মশারি ঠেলে জাগে রক্ত-আঁখি নবারুণ নব আশা। আজি এই সাথে, এই নব জাগরণ-আনা নব প্রাতে তোমারে স্মরিনু বীর প্রাতঃস্মরণীয় ! স্বর্গ হতে এ স্মরণ-প্রীতি অর্ঘ্য নিয়ো ! নিয়ো নিয়ো সপ্তকোটি বাঙালির তব অশ্রু-জলে স্মৃতি-পূজা অর্ঘ‌্য অভিনব!আজও তারা ক্রীতদাস, আজও বদ্ধ-কর শৃঙ্খল-বন্ধনে দেব ! আজও পরস্পর করে তারা হানাহানি, ঈর্ষা-অস্ত্রে যুঝি ছিটায় মনের কালি-নিরস্ত্রের পুঁজি! মন্দভাষ গাঢ় মসি দিব্য অস্ত্র তার! ‘দুই-সপ্ত কোটি ধৃত খর তরবার’ সে শুধু কেতাবি কথা, আজও সে স্বপন! সপ্তকোটি তিক্ত জিহ্বা বিষ-রসায়ন উদ‍্‍গারিছে বঙ্গে নিতি, দগ্ধ হল ভূমি! বঙ্গে আজ পুষ্প নাই, বিষ লহো তুমি! কে করিবে নমস্কার! হায় যুক্তকর মুক্ত নাহি হল আজও! বন্ধন-জর্জর এ কর পারে না দেব ছুঁইতে ললাট! কে করিবে নমস্কার? কে করিবে পাঠ তোমার বন্দনা-গান? রসনা অসাড়! কথা আছে বাণী নাই ছন্দে নাচে হাড়!ভাষা আছে আশা নাই, নাই তাহে প্রাণ, কে করিবে এই জাতিরে নবমন্ত্র দান! অমৃতের পুত্র কবি অন্নের কাঙাল, কবি আর ঋষি নয়, প্রাণের অকাল করিয়াছে হেয় তারে! লেখনী ও কালি যত না সৃজিছে কাব্য ততোধিক গালি! কণ্ঠে যার ভাষা আছে অন্তরে সাহস, সিংহের বিবরে আজ পড়ে সে অবশ! গর্দান করিয়া উঁচু যে পারে গাহিতে নব জীবনের গান, বন্ধন-রশিতে চেপে আছে টুঁটি তার! জুলুম-জিঞ্জির মাংস কেটে বসে আছে, হাড়ে খায় চিড় আর্ত প্রতিধ্বনি তার! কোথা প্রতিকার! যারা আছে—তারা কিছু না করে নাচার!নেহারিব তোমারে যে শির উঁচু করি, তাও নাহি পারি, দেব! আইনের ছড়ি মারে এসে গুপ্ত চেড়ী। যাইবে কোথায়! আমার চরণ নহে মম বশে, হায়। এক ঘর ছাড়ি আর ঘরে যেতে নারি, মর্দজাতি হয়ে আছে পর্দা-ঘেরা নারী! এ লাঞ্ছনা, এ পীড়ন, এ আত্মকলহ, আত্মসুখপরায়ণ পরাবৃত্তি মোহ– তব বরে দূর হোক! এ জাতির পরে হে যোগী, তোমার যেন আশীর্বাদ ঝরে ! যে-আত্মচেতনা-বলে যে আত্মবিশ্বাসে যে-আত্মশ্রদ্ধার জোরে জীবন উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মরা জাতি বাঁচে, যোগী, তব কাছে জাতি সেই শক্তি যাচে!স্বর্গে নহে, আমাদের অতি কাছাকাছি আছ তুমি হে তাপস, তাই মোরা যাচি তব বর, শক্তি তব! জেনেছিলে তুমি স্বর্গাদপি গরীয়সী এই বঙ্গভূমি! দিলে ধর্ম, দিলে কর্ম, দিলে ধ্যান জ্ঞান, তবু সাধ মিটিল না, দিলে বলিদান আত্মারে জননি-পদে, হাঁকিলে, “মাভৈঃ! ভয় নাই, নব দিনমণি ওঠে ওই! ওরে জড়, ওঠ তোরা!” জাগিল না কেউ, তোমারে লইয়া গেল পারাপারী ঢেউ।অগ্রে তুমি জেগেছিলে অগ্রজ শহিদ, তুমি ঋষি, শুভ প্রাতে টুটেছিল নিদ, তব পথে যাত্রী যারা রাত্রি-দিবা ধরি ঘুমাল গভীর ঘুম, আজ তারা মরি বেলাশেষে জাগিয়াছে! সম্মুখে সবার অনন্ত তমিস্রাঘোর দুর্গম কান্তার! পশ্চাতে ‘অতীত’ টানে জড় হিমালয়, সংশয়ের ‘বর্তমান’ অগ্রে নাহি হয়, তোমা-হারা দেখে তারা অন্ধ ‘ভবিষ্যৎ’, যাত্রী ভীরু, রাত্রি গুরু, কে দেখাবে পথ!হে প্রেমিক, তব প্রেম বরিষায় দেশে এল ঢল বীরভূমি বরিশাল ভেসে। সেই ঢল সেই জল বিষম তৃষায় যাচিছে ঊষর বঙ্গ তব কাছে হায়! পীড়িত এ বঙ্গ তব কাছে হায়! পীড়িত এ বঙ্গ পথ চাহিছে তোমার, অসুর নিধনে কবে আসিবে আবার!   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
তোমার কন্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কন্ঠের গান -- এইটুকু শুধু রবে পরিচয় ? আর সব অবসান ? অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়, গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয় ? হয়তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়ত কহিনি কথা, গানের বানী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা ? হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার, তাহারি প্রতিধ্বনি কন্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণরণি' -- উপকূলে ব'সে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে ? বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দু'ল হয়ে শুধু কানে ? হায় ভেবে নাহি পাই -- যে - চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই । সাগরের সেই ফুলে ফুলে কাদা কূলে কূলে নিশিদিন ? সুরেরে আড়ালে মূর্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ ? আমার গানের মালার সুবাস ছুঁল না হৃদয়ে আসি' ? আমার বুকের বাণী হল শুধু তব কন্ঠের ফাঁসি? বন্ধু গো যেয়ো ভুলে -- প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধায় রেখো না সে ফুল তুলে ! উপবনে তব ফোটে যে গোলাপ -- প্রভাতেই তুমি জাগি' জানি, তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি' । যে কাঁটা লতায় ফুটেছে সে-ফুল রক্তে ফাটিয়া পড়ি' সারা জনমের ক্রন্দন যার ফুটিয়াছে শাখা ভরি' দেখ নাই তারে ! -- মিলন মালার ফুল চাহিয়াছ তুমি, তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুমঝুমি ! ভোল মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়, আমি শুধু তব কন্ঠের হার, হৃদয়ে কেহ নয় ! জানায়ো আমারে যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি-- কন্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি !
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে– মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে - বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে। আসল হাসি, আসল কাঁদন মুক্তি এলো, আসল বাঁধন, মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে। ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে - আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস, ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস, গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে! ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন, মদন মারে খুন-মাখা তূণ পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে গো দিগ বালিকার পীতবাসে;আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে! আজ কপট কোপের তূণ ধরি, ঐ আসল যত সুন্দরী, কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন, কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে! তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের আমার চোখে জল আসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর, আসল নিকট, আসল সুদূর আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে! ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল হাসল শিশির দুবঘাসে আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!আজ জাগল সাগর, হাসল মরু কাঁপল ভূধর, কানন তরু বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান ভৈরবীদের গান ভাসে, মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে! আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার। অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার। দিনের পরে দিন গিয়েছে, হয়নি আমার ছুটি, বুকের ভিতর মৌন-কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি। আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া, লাগল চোখে তোমার চাওয়া, তাই তো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার। তোমার তরে বুকের তলায় অনেক দিনের অনেক কথা জমা, কানের কাছে মুখটি থুয়ে গোপন সে সব কইব প্রিয়তমা। এবার শুধু কথায়-গানে রাত্রি হবে ভোর, শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর। তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি, মলিন মুখে ফুটবে হাসি, হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি করুণ ছবি তার।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
জোর জমিয়াছে খেলা! ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকালবেলা। এই জনগণ-অরণ্যে যেন বহিত না প্রাণবায়ু, শিথিল হইয়া ছিল যেন সব স্নায়ু! সহসা মৌন-অরণ্যে আজ উঠেছে প্রবল ঝড়, ভিড় করে পাখি নীড় ছেড়ে করে কোলাহল-মর্মর। জমাট হইয়া ছিল সাগরের জল, সহসা গলিয়া ছুটিল স্রোতের ঢল। ময়দানে জোর ভিড় জমিয়াছে বড়ো ছোটো মাঝারির, স্বদেশি বিদেশি লোভী নির্লোভ হেটো মেঠো বাজারির! এই দিকে ‘রাজি’, ওদিকে ‘নারাজি’ দল, সেন্টারে পড়ে আছে ‘ভারতের স্বাধীনতা’-ফুটবল! ‘রাজি’ জয়ী হবে বলে বাজি রাখে মজুর ও বিড়িওয়ালা, কেল্লার ধারে জমায়েত হয়ে বাঁধা রেখে ঘটি থালা। কাহার কেল্লা ফতে হবে সবে কয়, ‘রাজি’রা খেলিতে জানে, উহারাই জয়ী হবে নিশ্চয়। ‘গ্যালারি’ ভরতি মধ্যবিত্ত আধা-বড়োলোক যত, ছাতা উঁচাইয়া ‘রাজি’দের জয়ধ্বনি করে অবিরত। ‘নারাজি’ দলের ‘সাপোর্টার’ যত কোট প্যান্ট চাপকান, সংখ্যায় সাত কুড়ি, তবু তিন হাত তুড়িলাফ খান! এরা খায় বিড়ি, ওরা খায় সিগারেট, এরা খায় চানাচুর ও বাদাম, ওরা চপ কাটলেট! জোর জমিয়াছে খেলা, বুট-পরা পায়ে ফুটবলে লাথি মারে, হুল্লোড় মেলা! খাইয়া ‘ফাউল-কারি’ ‘নারাজি’রা কেবল ফাউল করে, রেফারিকে দেয় কাফেরি ফতোয়া যদি সে ফাউল ধরে! ‘শেম’ ‘শেম’ বলে জনগণ, হ্যাটুয়ারা দেয় হ্যাটে তালি, খেলতে পারে না, ফেলিতে পারে না ঠেলা দিয়ে, দেয় গালি। কোন দল জেতে কোন দল হারে, উঠিয়াছে কোন্দল, ‘নারাজি’র দিকে বুড়োরা, ‘রাজি’র জোয়ান নতুন দল।               উঠেছে হট্টগোল ওই দিল – গোল, গোল! মটরুর নানা দেড় চোখ কানা, ঝুড়ি তুলে মারে কিক, লুঙ্গি ধরে চলে ‘রাজি’রা এবার গোল দিল দেখো ঠিক! ‘নারাজি’রা হল যেন আলু-ভাজি, করে শুধু হ্যান্ডবল, যত গোল খায় তত গোলমাল করে তারা অবিরল! কবুতর ওড়ে, মোগলি লম্ফ মারে বগলের ছাতা, ‘জয় রাজি’ বলে ওড়ায় রঙিন কুচি কাগজের পাতা। খেলা জমিয়াছে জোর, ‘নারাজি’রা রাগে, ‘রাজি’রা ততই হাসিয়া করে স্কোর! ‘নারাজি’র দলে বিদেশি খেলুড়ি, ‘রাজি’র দেশের ছেলে, ‘রাজি’রা পায়ের জোরে খেলে ‘নারাজি’রা গা-র জোরে ঠেলে। আজও খেলা শেষ হয় নাই ময়দানে, ‘হাফটাইমের’ আগেই কে গোল খেয়েছে সবাই জানে। এরই মাঝে আসিয়াছে ঘনঘটা রুক্ষ আকাশ ঘিরে, কারা যেন ক্রোধে নীল আশমান বিজলি-নখরে চিরে! বাজে বাদলের মাদল ঝাঁজর মৃদঙ্গ গুরুগুরু, মাথার উপরে ছাতার তাম্বু, বৃষ্টি হয়েছে শুরু! দর্শক দ্যাখে, এঁকেবেঁকে পড়ে মাঠে কারা পিছলায়ে, ‘রাজি’ দল ছোটে তিরের মতন চাকা বাঁধা যেন পায়ে! খেলা জোর জমিয়াছে, দর্শক সব এবার এগিয়ে এসেছে দড়ির কাছে। বৃষ্টি নেমেছে, এবার দৃষ্টি প্রখর করো রে দাদা, কার দিকে কত হয় সে ফাউল, কে ছিটায় কত কাদা। খেলা দ্যাখো, দ্যাখো খেলা, ‘রাজি’ কি ‘নারাজি’ জয়ী হল, বলো তোমরাই সাঁঝ-বেলা! কবুতরগুলি ফেরে নাই ঘরে, ঘুরিছে মাথার পর, কাহারা জিতিল, দেশে দেশে গিয়া শুনাবে খোশখবর!   (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
১ আদর-গর-গর বাদর দর-দর এ-তনু ডর-ডর কাঁপিছে থর-থর। নয়ন ঢল-ঢল সজল ছল-ছল, কাজল কালো জল ঝরে লো ঝরঝর। ২ ব্যাকুল বন-রাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে, সজনি! মন আজি গুমরে মনে মনে। বিদরে হিয়া মম বিদেশে প্রিয়তম, এ জনু পাখি সম বরিষা-জরজর। ৩ কাহার ও মেঘোপরি গমন গম-গম? সখী রে মরি মরি, ভয়ে গা ছম-ছম। গগনে ঘন ঘন সঘনে শোনো-শোনো ঝনন রণরণ – সজনি ধরো ধরো। ৪ জলদ-দামা বাজে জলদে তালে তালে, কাজরি-নাচা নাচে ময়ূর ডালে ডালে। শ্যামল মুখ স্মরি সখিয়া বুক মোরি উঠিছে ব্যথা ভরি আঁখিয়া ভরভর।৫ বিজুরি হানে ছুরি চমকি রহি রহি বিধুরা একা ঝুরি বেদনা কারে কহি। সুরভি কেয়া-ফুলে এ হৃদি বেয়াকুলে, কাঁদিছে দুলে দুলে বনানী মর-মর। ৬ নদীর কলকল, ঝাউয়ের ঝল-মল, দামিনী জ্বলজ্বল, কামিনী টল-মল। আজি লো বনে বনে শুধানু জনে জনে, কাঁদিল বায়ুসনে তটিনী তরতর। ৭ আদুরি দাদুরি লো কহো লো কহো দেখি, এমন বাদরি লো ডুবিয়া মরিব কি? একাকী এলোকেশে, কাঁদিব ভালোবেসে, মরিব লেখা-শেষে, সজনি সরো সরো।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
আরে আরে সখী          বারবার ছি ছি ঠারত চঞ্চল আঁখিয়া সাঁবলিয়া। দুরু দুরু গুরু গুরু          কাঁপত হিয়া উরু হাথসে গির যায় কুঙ্কুম-থালিয়া। আর না হোরি          খেলব গোরি আবির ফাগ দে পানি মে ডারি হা প্যারি – শ্যাম কী ফাগুয়া লাল কী লুগুয়া ছি ছি মোরি শরম ধরম সব হারি মারে ছাতিয়া মে কুঙ্কুম বে-শরম বানিয়া।  (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আন্‌মনে জল নিতে ভাসিল গাগরী সাঁতার জানি না, আনি কলস কেমন করি।জানি না বলিব কি, শুধাবে যবে ননদী কাহার কথা ভাবে পোড়া মন নিরবধি গাগরী না ভাসিয়া ভাসিতাম আমি যদি- কি বলিব কেন মোর ভিজিল গো ঘাগরীএকেলা কুলবধূ, পথ বিজন, নদীর বাঁকে ডাকিল বৌ-কথা-কও কেন হলুদ চাঁপার শাখে বিদেশে শ্যাম আমার, পড়ল মনে সেই ডাকে ঠাঁই দে যমুনে বুকে, আমিও ডুবিয়া মরি।।
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
অমানিশায় আসে আঁধার তেপান্তরের মাঠে; স্তব্ধ ভয়ে পথিক ভাবে,– কেমনে রাত কাটে! ওই যে ডাকে হুতোম-পেঁচা, বাতাস করে শাঁ শাঁ! মেঘে ঢাকা অচিন মুলুক; কোথায় রে কার বাসা? গা ছুঁয়ে যায় কালিয়ে শীতে শূন্য পথের জু জু– আঁধার ঘোরে জীবন-খেলার নূতন পালা রুজু।   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ, সর্বহারা নাই কো, প্রিয়! আমার চেয়ে তোমার কাছে, নাই সখি, কেউ অনাত্নীয়! তোমার বেণীর শৃংখলে গো নিত্য আমি বন্দী কেন? মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগল, পিয়ে তোমার প্রেম- অমিয়!!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনি ঝিনি বাজে লো খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি কালো ছোঁড়ার কাঁকাল ধরে নাচে মাতাল ছুঁড়ি লো খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি।মহুয়া মদের নেশা পিয়ে, বুঁদ হয়েছে বৌয়ে-ঝিয়ে চাঁদ ছুটছে মনকে নিয়ে যেন ডুরি ছেঁড়া ঘুড়ি লো।বাজে নুপূর পাঁইজোড়, সারা গায়ে নাচের ঘোর ওলো লেগেছে মন হল নেশায় বিভোর ওই আকাশে চাঁদ হের মেঘের সাথে যেন করে খুন্‌সুড়ি লো।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
প্রাচীর দুয়ারে শুনি কলরোল সহসা তিমির-রাতে, মিসরের শের, শির শমশের-সব গেল এক সাথে! সিন্ধুর গলা জড়ায়ে কাঁদিতে দু'তীরে ললাট হানি' ছুটিয়া চ'লেছে মরু-বকৌলি 'নীল' দরিয়ার পানি! আঁচলের তার ঝিনুক মানিক কাদায় ছিটায়ে পড়ে, সোঁতের শ্যাওলা আলো কুন্তল লুটাইছে বালুচরে...... মরু-'সাইমুম'-তাঞ্জামে চড়ি' কোন পরীবানু আসে? 'লু'-হাওয়া ধরেছে ধ'রেছে বালুর পর্দা সম্ভ্রমে দুই পাশে! সূর্য নিজেরে লুকায় টানিয়া বালুর আস্তরণ, ব্যজনী দুলায় ছিন্ন পাইন-শাখায় প্রভঞ্জন। ঘূর্ণি-বাঁদীরা নীল দরিয়ায় আ৬চল ভিজায়ে আনি' ছিটাইছে বারি, মেঘ হ'তে মাগি' আনিছে বরফ-পানি। ও বুঝি মিসর- বিজয়লক্ষো মূরছিতা তাঞ্চামে, ওঠে হাহাকার ভগ্ন মিনার আঁধার দীওয়ান-ই-আমে! কৃষানের গরু মাঠে মাঠে ফেরে, ধরেনি ক' আজ হাল, গম-ক্ষেত ভেঙ্গে পানি ব'য়ে যায় তবু নাহি বাঁধে আ'ল, মনের বাঁধেরে ভেঙ্গেছে যাহার চোখের সাঁতার পানি মাঠের পানি ও আ'লেরে কেমনে বা৬ধিবে সে, নাহি জানি। হৃদয়ে যখন ঘনায় শাঙন, চোখে নামে বরষাত, তখন সহসা হয় গো মাথায় এমনি বজ্রপাত! মাটিরে উজায়ে উপুড় হইয়া কাঁদিছে শ্রমিক কুলি, বলে-"মা গো তোর উদিরে মাটির মানুষই হ'য়েছে ধূলি, রতন মানিক হয় না তো মাটি, হীরা সে হীরাই থাকে, মোদের মাথায় কোহিনূর মণি- কি করিব বল তাকে? দুর্দিনে মা গো যদি ও-মাটির দুয়ার খুলিয়া খুঁজি, চুরি করিবি না তুই এ মানিক? ফিরে পাব হারা পুঁজি? লৌ পরশি' করিনু শপথ, ফিরে নাহি পাই যদি নতুন করিয়া তর বুকে মোরা বহাব রক্ত-নদী!"আভীর-বালারা দুধাল গাধীরে দোহায় না, কাঁদে শুয়ে, দুম্বা শিশুরা দূরে চেয়ে আছে দুধ ঘাস নাহি ছুঁইয়ে। মিষ্টি ধারাল মিছরির ছুরি মিসরী মেয়ের হাসি, হাঁসা পাথরের কুঁচি-সম দাঁত,- সব যেন আজ বাসি! আঙুর লতার অলকগুচ্ছ- ডাঁশা আঙুরের থোপা, যেন তরুণীর আঙুলের ডগা- হুরী বালিকার খোঁপা, ঝুরে ঝুরে পড়ে হতাদরে আজ অশ্রুর বুঁদ-সম! কাঁদিতেছে পরী, চারিদিকে অরি, কোথায় অরিন্দম! মরু- নটী তার সোনার ঘুঙুর ছুঁড়িয়া ফেলেছে কাঁদি' হলিদ খেঁজুর-কাঁধিতে বুঝি বা রয়েছে তাহারা বা৬ধি' নতুন করিয়া মরিল গো বুঝি আজি মিসরের মমি, শ্রদ্ধায় আজি পিরামিড যায় মাটির কবরে নমি'! মিসরে খেদিব ছিল বা ছিল না, ভুলেছিল সব লোক, জগলুলে পেয়ে ভুলেছিল ওরা সুদান-হারার শোক। জানি না কখন ঘনাবে ধরার ললাটে মহাপ্রলয়, মিসরের তরে 'রোজ-কিয়ামৎ'ইহার অধিক নয়! রহিল মিস, 'চ'লে গেল তার দুর্মদ যৌবন, রুস্তম গেল, নিষ্প্রভ কায়খসরু-সিংহাসন। কি শাপে মিসর লভিল অকালে জরা যযাতির প্রায়, জানি না তাহার কোন সুত দেবে যৌবন ফিরে তায়; মিসরের চোখে বহিল নতুন সুয়েজ খালের বান, সুদান গিয়াছে- গেল আজ তার বিধাতার মহাদান! 'ফেরাউন' ডুবে না মরিতে হায় বিদায় লইল মুসা, প্রাচী'র রাত্রি কাটিবে না কি গো, উদিবে না রাঙা ঊষা?***********************শুনিয়াছি, ছিল মমির মিসরে সম্রাট ফেরাউন, জননীর কোলে সদ্য প্রসূত বাচ্চার নিত খুন! শুনেছিল বাণী, তাহারী রাজ্যে তাহার রাজপথ দিয়া অনাগত শিশু আসিছে তাহার মৃত্যু-বারতা নিয়া। জীবন ভরিয়া করিল যে শিশু-জীবনের অপমান, পরের মৃত্যু-আড়ালে দাঁড়ায়েসে-ই ভাবে, পেল প্রাণ! জনমিল মুসা, রাজভয়ে মাতা শিশুরে ভাসায় জলে, ভাসিয়া ভাসিয়া সোনার শিশু গো রাজারই ঘাটেতে চলে। ভেসে এল শিশু রানীরই কোলে গ, বাড়ে শিশু দিনে দিনে শত্রু তাহারি বুকে চ'ড়ে নাচে, ফেরাউন নাহি চিনে। এল অনাগত তারি প্রাসাদের সদর দরজা দিয়া, এখনো প্রহরী জাগে বিনিদ্র দশ দিক আগুলিয়া! -রসিক খোদার খেলা, তারি বেদনায় প্রকাশে রুদ্র যারে করে অবহেলা!মুসারে আমরা দেখিনি, তোমায় দেখেছি মিসর-মুনি, ফেরাউন মোরা দেখিনি, দেখেছি নিপীড়ন ফেরাউনী। ছোটে অনন্ত সেনা-সামন্ত অনাগত কার ভয়ে, দিকে দিকে খাড়া কারা-শৃঙ্খল, জল্লাদ ফাঁসি ল'য়ে। আইন-খাতার পাতায় পাতায় মৃত্যুদন্ড লেখা, নিজের মৃত্যু এড়াতে কেবলি নিজেরে করিছে একা! সদ্যপ্রসুত প্রতি শিশুটিরে পিয়ায় অহর্নিশ শিক্ষা দিক্ষা সভ্যতা ব'লি তিলে তিলে-মারা বিষ। ইহারা কলির নব ফেরাঊন ভেল্কি খেলায় হাড়ে, মানুষে ইহারা না মেরে প্রথমে মনুষ্যত্ব মারে! মনুষ্যত্বহীন এই সব মানুষেরই মাঝে কবে হে অতি-মানুষ, তুমি এসেছিলে জীবনের উৎসবে। চারিদিকে জাগে মৃত্যুদন্ড রাহকারা প্রতিহারী, এরই মাঝে এলে দিলেন আলোক নির্ভীক পথচারী। রাজার প্রাচীর ছিল দাঁড়াইয়া তোমারে আড়াল করি' আপনি আসিয়া দাঁড়াইলে তার সকল শূন্যে ভরি'! পয়গম্বর মুসার তবু তো ছিল 'আষা' অদ্ভুত, খোদ সে খোদার প্রেরিত- ডাকিলে আসিত স্বররগ-দূত! প্যগম্বর ছিলে না ক'তুমি- পাওনি ঐশী বাণী, স্বর্গের দূত ছিল না দসর, ছিলে না শস্ত্র-পাণি আদেশে তোমার নীল দরিয়ার বক্ষে জাগেনি পথ, তোমারে দেখিয়া করেনি সালাম কোনো গিরিপর্বত! তবুও এশিয়া আফ্রিকা গাহে তোমার মহিমা গান, মনুষত্ব্য থাকিলে মানুষ সর্বশক্তিমান!দেখাইলে তুমি, পরাধীন জাতি হয় যদি ভয়হারা, হোক নিরস্ত্র, অস্ত্রের রণে বিজয়ী হইবে তারা। অসি দিয়া নয়, নির্ভীক করে মন দিয়া রণ জয়, অস্ত্রে যুদ্ধে জয় করা সাজে- দেশ জয় নাহি হয়। ভয়ের সাগর পাড়ি দিল যেই শির করিল না নীচু, পশুর নখর দন্ত দেখিয়া হটিল না কভু পিছু, মিথ্যাচারীর ভ্রুকুটি-শাসন নিষেধ রক্ত-আঁখি না মানি- জাতির দক্ষিণ করে বা৬ধিল অভয় রাখী, বন্ধন যারে বলিন্দ হ'য়ে নন্দন-ফুলহার, না-ই হ'ল সে গো পয়গম্বর নবী দেব অবতার, সর্বকালের সবদেশের সকল নর ও নারী করে প্রতীক্ষা, গাহে বন্দনা, মাগিছে আশিস তারি!*************************'এই ভারতের মহামানবের সাগর-তীরে' হে ঋষি, তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল চরিতেছে দিবানিশি! গোষ্ঠে গোষ্ঠে আত্নকলহ অজাযুদ্ধের মেলা, এদের রুধিরে নিত্য রাঙিছে ভারত-সাগর-বেলা। পশুরাজ যবে ঘাড় ভেঙে খায় একটারে ধরে আসি' আরটা তখনো দিব্যি মোটায়ে হ'তেছে খোদার কাসি! শুনে হাসি পায় ইহাদেরও নাকি আছে গো ধর্ম জাতি, রাম-ছাগল আর ব্রহ্ম-ছাগল আরেক ছাগল পাতি! মৃত্যু যখন ঘনায় এদের কশা'য়ের কল্যাণে, তখনো ইহারা লাঙল উঁচায়ে এ উহারে গালি হানে। ইহাদের শিশু শৃগালে মারিলে এরা সভা ক'রে কাঁদে, অমৃতের বাণি শুনাতে এদের লজ্জায় নাহি বাধে! নিজেদের নাই মনুষত্ব্য, জানি না কেমনে তারা নারীদের কাছে চাহে সতীত্ব, হায় রে শরম-হারা! কবে আমাদের কোন সে পুরুষে ঘৃত খেয়েছিল কেহ আমাদের হাতে তারি বাস পাই, আজো করি অবলেহ! আশা ছিল, তবু তোমাদেরি মত অতি-মানুষেরে দেখি', আমরা ভুলিব মোদের এ গ্লানি খাঁটি হবে যত মেকী! তাই মিসরের নহে এ শোক এই দুর্দিন আজি, এশিয়া আফ্রিকা দুই মহাভূমে বেদনা উঠেছে বাজি'! অধীন ভারত তোমারে স্মরণ করিয়াছে শতবার, তব হাতে ছিল জলদস্যুর ভারত-প্রবেশ-দ্বার। হে 'বনি ইসরাইলের' দেশের অগ্রনায়ক বীর, অঞ্জলি দিনু 'নীলের' সলিলে অশ্রু ভাগিরথীর! সালাম করারও স্বাধীনতা নাই সোজা দুই হাত তুলি' তব 'ফাতেহা'ইয় কি দিবে এ জাতি বিনা দু'টো বা৬ধা বুলি! মলয়-শীতলা সুজলা এ দেশে-আশিস করিও খালি- উড়ে আসে যেন তোমার দেশের মরুর দু'মুঠো বালি।তোমার বিদায়ে দূর অতীতের কথা সেই মনে পড়ে, মিসর হইতে বিদায় লইল মুসা যবে চিরতরে, সম্ব্রমে স'রে পথ ক'রে দিল নীল দরিয়ার বারি, পিছু পিছু চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া মিসরের নর-নারী। সৈন্য-সম ছোটে ফেরাউন-সেনা ঝাঁপ দিয়া পড়ে স্রোতে, মুসা হ'ল পার, ফেরাউন ফিরিল না নীল নদী হ'তে! তোমার বিদায়ে করিব না শোক, হয়ত দেখিব কাল তোমার পিছনে মরিছে ডুবিয়া ফেরাউন দজ্জাল!
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী, সন্তান দ্বারে উপবাসী, দাও মানবতা ভিক্ষা দাও! জাগো গো,জাগো গো, তন্দ্রা-অলস জাগো গো, জাগো রে! জাগো রে! ১ মুক্ত করিতে বন্দিনী মা'য় কোটি বীরসুত ঐ হেরো ধায় মৃত্যু-তোরণ-দ্বার-পানে— কার টানে? দ্বার খোলো দ্বার খোলো! একবার ভুলে ফিরিয়া চাও। কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ২ জননী আমার ফিরিয়া চাও! ভাইরা আমার ফিরিয়া চাও! চাই মানবতা, তাই দ্বারে কর হানি মা গো বারেবারে— দাও মানবতা ভিক্ষা দাও! পুরুষ-সিংহ জাগো রে! সত্যমানব জাগো রে। বাধা-বন্ধন-ভয়-হারা হও সত্য-মুক্তি-মন্ত্র গাও! কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ৩ লক্ষ্য যাদের উৎপীড়ন আর অত্যাচার, নর-নারায়ণে হানে পদাঘাত জেনেছে সত্য-হত্যা সার। অত্যাচার! অত্যাচার!! ত্রিশ কোটি নর-আত্মার যারা অপমান হেলা করেছে রে শৃঙ্খল গলে দিয়েছে মা'র— সেই আজ ভগবান তোমার! অত্যাচার! অত্যাচার!! ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-নাই কি লাজ— নাই কি আত্মসম্মান ওরে নাই জাগ্রত ভগবান কি রে আমাদেরো এই বক্ষোমাঝ? অপমান বড় অপমান ভাই মিথ্যার যদি মহিমা গাও! কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ৪ আল্লায় ওরে হকতা'লায় পায়ে ঠেলে যারা অবহেলায়, আজাদ-মুক্ত আত্মারে যারা শিখায়ে ভীরুতা করেছে দাস— সেই আজ ভগবান তোমার! সেই আজ ভগবান তোমার! সর্বনাশ! সর্বনাশ! ছি-ছি নির্জীব পুরবাসী আর খুলো না দ্বার! জননী গো! জননী গো! কার তরে জ্বালো উৎসব-দীপ? দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!! মঙ্গল-ঘট ভেঙে ফেলো, সব গেল মা গো সব গেল! অন্ধকার! অন্ধকার! ঢাকুক এ মুখ অন্ধকার! দীপ নেবাও! দীপ নেবাও। কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ৫ ছি ছি ছি ছি এ কি দেখি গাহিস তাদেরি বন্দনা-গান, দাস সম নিস হাত পেতে দান! ছি-ছি-ছি ছি-ছি-ছি ওরে তরুণ ওরে অরুণ! নরসুত তুমি দাসত্বের এ ঘৃণ্য চিহ্ন মুছিয়া দাও! ভাঙিয়া দাও, এ-কারা এ-বেড়ি ভাঙিয়া দাও! কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ৬ পরাধীন বলে নাই তোমাদের সত্য-তেজের নিষ্ঠা কি! অপমান সয়ে মুখ পেতে নেবে বিষ্ঠা ছি? মরি লাজে, লাজে মরি! এক হাতে তোরে 'পয়জার' মারে আর হাতে ক্ষীর সর ধরি! অপমান সে যে অপমান! জাগো জাগো ওরে হতমান! কেটে ফেলো লোভী লুব্ধ রসনা, আঁধারে এ হীন মুখ লুকাও! কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ৭ ঘরের বাহির হয়ো না আর, ঝেড়ে ফেলো হীন বোঝার ভার, কাপুরুষ হীন মানবের মুখ ঢাকুক লজ্জা অন্ধকার। পরিহাস ভাই পরিহাস সে যে, পরাজিতে দিতে মনোব্যথা—যদি জয়ী আসে রাজ-রাজ সেজে। পরিহাস এ যে নির্দয় পরিহাস! ওরে কোথা যাস বল কোথা যাস ছি ছি পরিয়া ভীরুর দীন বাস? অপমান এত সহিবার আগে হে ক্লীব, হে জড়, মরিয়া যাও! কোরাস্:— ভিক্ষা দাও... ৮ পুরুষসিংহ জাগো রে! নির্ভীক বীর জাগো রে! দীপ জ্বালি কেন আপনারি হীন কালো অন্তর কালামুখ হেন হেসে দেখাও! নির্লজ্জ রে ফিরিয়া চাও! আপনার পানে ফিরিয়া চাও! অন্ধকার! অন্ধকার! নিশ্বাস আজি বন্ধ মা'র অপমানে নির্মম লাজে, তাই দিকে দিকে ক্রন্দন বাজে— দীপ নেবাও! দীপ নেবাও! আপনার পানে ফিরিয়া চাও! কোরাস্:— ভিক্ষা দাও...
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় – শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় – কাঁদে মোর আগমনি আকাশ বাতাস বনানীতে। জন্ম মোর পশ্চিমের অস্তগিরি-শিরে, যাত্রা মোর জন্মি আচম্বিতে প্রাচী-র অলক্ষ্য পথ-পানে মায়াবী দৈত্যশিশু আমি ছুটে চলি অনির্দেশ অনর্থ-সন্ধানে! জন্মিয়াই হেরিনু, মোরে ঘিরি ক্ষতির অক্ষৌহিণী সেনা প্রণমি বন্দিল – ‘প্রভু! তব সাথে আমাদের যুগে যুগে চেনা, মোরা তব আজ্ঞাবহ দাস – প্রলয় তুফান বন্যা, মড়ক দুর্ভিক্ষ মহামারি সর্বনাশ!’ বাজিল আকাশ-ঘণ্টা, বসুধা-কাঁসর; মার্তণ্ডের ধূপদানি – মেঘ-বাষ্প-ধূমে-ধূমে ভরাল অম্বর! উল্কার হাউই ছোটে, গ্রহ উপগ্রহ হতে ঘোষিল মঙ্গল; মহাসিন্ধু-শঙ্খে বাজে অভিশাপ-আগমনি কলকল কল কলকল কল কলকল কল! ‘জয় হে ভয়ংকর, জয় প্রলংকর’ নির্ঘোষি ভয়াল বন্দিল ত্রিকাল-ঋষি। ধ্যান-ভগ্ন রক্ত-আঁখি আশিস দানিল মহাকাল। উল্লম্ফিয়া উঠিলাম আকাশের পানে তুলি বাহু, আমি নব রাহু! হেরিলাম সেবারতা মহীয়সী মহালক্ষ্মী প্রকৃতির রূপ, সহসা সে ভুলিয়াছে সেবা, আগমন-ভয়ে মোর প্রস্তর-শিখার সম নিশ্চল নিশ্চুপ! অনুমানি যেন কোনো সর্বনাশা অমঙ্গল ভয় জাগি আছে শিশুর শিয়র-পাশে ধ্যানমগ্না মাতা, শ্বাস নাহি বয়। মনে হল ওই বুঝি হারা-মাতা মোর! মৌনা ওই জননীর শুভ্র শান্ত কোলে – প্রহ্লাদকুলের আমি কাল-দৈত্য-শিশু – ঝাঁপাইয়া পড়িলাম ‘মা আমার’ বলে। নাহি জানি কোন্ ফণিমনসার হলাহল-লোকে – কোন্ বিষ-দীপ-জ্বালা সবুজ আলোকে – নাগমাতা কদ্রু-গর্ভে জন্মেছি সহস্রফণা নাগ ভীষণ তক্ষকশিশু! কোথা হয় নাগনাশী জন্মেজয়-যাগ – উচ্চারিছে আকর্ষণ-মন্ত্র কোন্ গুণী – জন্মান্তর-পার হতে ছুটে চলি আমি সেই মৃত্যু-ডাক শুনি! মন্ত্র-তেজে পাংশু হয়ে ওঠে মোর হিংসা-বিষ-ক্রোধ-কৃষ্ণ প্রাণ, আমার তুরীয় গতি – সে যে ওই অনাদি উদয় হতে হিংসাসর্প-যজ্ঞমন্ত্র-টান! ছুটে চলি অনন্ত তক্ষক ঝড় – শন – শন – শনশন শন সহসা কে তুমি এলে হে মর্ত্য-ইন্দ্রাণী মাতা, তব ওই ধূলি-আস্তরণ বিছায়ে আমার তরে জাতকের জন্মান্তর হতে? লুকানু ও-অঞ্চল-আড়ালে, দাঁড়ালে আড়াল হয়ে মোর মৃত্যু-পথে! ব্যর্থ হল অঞ্চল-আড়াল; বহ্নি-আকর্ষণ মন্ত্র-তেজে ব্যাকুল ভীষণ রক্তে রক্তে বাজে মোর – শনশন শন – শন – শন – ওই শুন দূর – দূরান্তর হতে মাগো, ডাকে মোরে অগ্নি-ঋষি বিষহরি সুর! জননী গো চলিলাম অনন্ত চঞ্চল, বিষে তব নীল হল দেহ, বৃথা মা গো দাব-দাহে পুড়ালে অঞ্চল! ছুটে চলি মহা-নাগ, রক্তে মোর শুনি আকর্ষণী, মমতা-জননী দাহে মোর পড়িল মুরছি; আমি চলি প্রলয়-পথিক – দিকে দিকে মারী-মরু রচি। ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় – শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় – কোলাহল-কল্লোলের হিল্লোল-হিন্দোল – দুরন্ত দোলায় চড়ি – ‘দে দোল দে দোল’ উল্লাসে হাঁকিয়া বলি, তালি দিয়া মেঘে উন্মদ উন্মাদ ঘোর তুফানিয়া বেগে! ছুটে চলি ঝড় – গৃহ-হারা শান্তি-হারা বন্ধ-হারা ঝড় – স্বেচ্ছাচার-ছন্দে নাচি !       ক্কড়ক্কড় ক্কড় কণ্ঠে মোর লুণ্ঠে ঘোর বজ্র-গিটকিরি, মেঘ-বৃন্দাবনে মুহু      ছুটে মোর বিজুরির জ্বালা-পিচকিরি! উড়ে সুখ-নীড়, পড়ে ছায়া-তরু,       নড়ে ভিত্তি রাজ-প্রাসাদের, তুফান-তুরগ মোর উরগেন্দ্র-বেগে ধায়। আমি ছুটি অশান্ত-লোকের প্রশান্ত-সাগর-শোষা উষ্ণশ্বাস টানি। লোকে লোকে পড়ে যায় প্রলয়ের ত্রস্ত কানাকানি! ঝড় – ঝড় – উড়ে চলি ঝড় মহাবায়-পঙ্খিরাজে চড়ি, পড়-পড় আকাশের ঝোলা শামিয়ানা মম ধূলিধ্বজা সনে করে জড়াজড়ি! প্রমত্ত সাগর-বারি – অশ্ব মম তুফানির খর ক্ষুর-বেগে আন্দোলি আন্দোলি ওঠে। ফেনা ওঠে জেগে ঝটিকার কশা খেয়ে অনন্ত তরঙ্গ-মুখে তার ! আমি যেন সাপুড়িয়া          মারি মন্ত্র-মার– ঢেউ-এর মোচড়ে তাই        মহাসিন্ধু-মুখে জল-নাগ-নাগিনিরা আছাড়ি পিছাড়ি মরে ধুঁকে! প্রিয়া মোর ঘূর্ণিবায়ু     বেদুইন-বালা চূর্ণি চলে ঝঞ্ঝা-চুর মম আগে আগে। ঝরনা-ঝোরা তটিনীর নটিনি-নাচন-সুখ লাগে শুষ্ক খড়কুটো ধূলি শীত-শীর্ণ বিদায়-পাতায় ফাল্গুনী-পরশে তার। – আমার ধমকে নুয়ে যায় বনস্পতির মহা মহিরুহ, শাল্মলি, পুন্নাগ, দেওদার, ধরি যবে তার জাপটি পল্লব-ঝুঁটি, শাখা-শির ধরে দিই নাড়া; গুমরি কাঁদিয়া ওঠে প্রণতা বনানী, চচ্চড় করে ওঠে পাহাড়ের খাড়া শির-দাঁড়া! প্রিয়া মোর এলোমেলো গেয়ে গান আগে আগে চলে; পাগলিনি কেশে ধূলি চোখে তার মায়া-মণি ঝলে। ঘাগরির ঘূর্ণা তার ঘূর্ণি-ধাঁধা লাগায় নয়নালোকে মোর। ঘূর্ণিবালা হাসির হররা হানি বলে – ‘মনোচোর। ধরো তো আমারে দেখি’ – ত্রস্ত-বাস হাওয়া-পরি, বেণি তার দুলে ওঠে সুকঠিন মম ভালে ঠেকি। পাগলিনি মুঠি মুঠি ছুঁড়ে মারে রাঙা পথধূলি, হানে গায় ঝরনা-কুলুকুচু, পদ্ম-বনে আলুথালু খোঁপা পড়ে খুলি! আমি ধাই পিছে তার দুরন্ত উল্লাসে; লুকায় আলোর বিশ্ব চন্দ্র সূর্য তারা পদভর-ত্রাসে! দীর্ঘ রাজপথ-অজগর সংকুচিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, ধরণি-কূর্মপৃষ্ঠ দীর্ণ জীর্ণ হয়ে ওঠে মত্ত মোর প্রমত্ত ঘর্ষণে। পশ্চাতে ছুটিয়া আসে মেঘ ঐরাবত-সেনাদল গজগতি-দোলা-ছন্দে; স্বরগে বাজে বাদল-মাদল! সপ্ত সাগর শোষি শুণ্ডে শুণ্ডে তারা– উপুড় ধরণি-পৃষ্ঠে উগারে নিযুত লক্ষ বারি-তীর-ধারা। বয়ে যায় ধরা-ক্ষত-রসে সহস্র পঙ্কিল স্রোত-ধার। চণ্ডবৃষ্টি-প্রপাত-ধারা-ফুলে বরষার বুকে ঝলে জল-মালা-হার। আমি ঝড়, হুল্লোড়ের সেনাপতি; খেলি মৃত্যু-খেলা ঘূর্ণনীয়া প্রিয়া-সাথে। দুর্যোগের হুলাহুলি মেলা ধায় মম অশ্রান্ত পশ্চাতে! মম প্রাণরঙ্গে মাতি নিখিলের শিখী-প্রাণ মুহু-মুহু মাতে! শ্যাম স্বর্ণ পত্রে পুষ্পে কাঁপে তার অনন্ত কলাপ। – দারুণ দাপটে মম জেগে ওঠে অগ্নিস্রাব-জ্বলন্ত-প্রলাপ ভূমিকম্প-জরজর থরথর ধরিত্রীর মুখে! বাসুকি-মন্দার সম মন্থনে মম সিন্ধুতট ভরে ফেনা-থুকে। জেগে ওঠে মম সেই সৃষ্টি-সিন্ধু-মন্থন-ব্যথায় রবি শশী তারকার অনন্ত বুদবুদ! – উঠে ভেঙে যায় কত সৃষ্টি কত বিশ্ব আমার আনন্দ-গতিপথে। শিবের সুন্দর ধ্রুব-আঁখি যমের আরক্ত ঘোর মশাল-নয়ন-দীপ মম রথে। জয়ধ্বনি বাজে মোর স্বর্গদূত ‘মিকাইলের’ আতশি-পাখায়। অনন্ত-বন্ধন-নাগ-শিরস্ত্রাণ শোভে শিরে! শিখী-চূড়ায় তায় শনির অশনি ওই ধূমকেতু-শিখা, পশ্চাতে দুলিছে মোর অনন্ত আঁধার চিররাত্রি-যবনিকা! জটা মোর নীহারিকাপুঞ্জ-ধূম পাটল পিঙ্গাস, বহে তাহে রক্ত-গঙ্গা নিপীড়িত নিখিলের লোহিত নিষ্কাশ। ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় – ক্কড়ক্কড় ক্কড় – বজ্র-বায়ু দন্তে-দন্তে ঘর্ষি চলি ক্রোধে! ধূলি-রক্ত বাহু মম বিন্ধ্যাচল সম রবিরশ্মি-পথ রোধে। ঝঞ্ঝনা-ঝাপটে মম ভীত কূর্ম সম সহসা সৃষ্টির খোলে নিয়তি লুকায়। আমি ঝড়, জুলুমের জিঞ্জির-মঞ্জীর বাজে ত্রস্ত মম পায়! ধাক্কার ধমকে মম খান খান নিষিদ্ধের নিরুদ্ধ দুয়ার, সাগরে বাড়ব লাগে,         মড়ক দুয়ার্কি ধরে আমার ধুয়ার! কৈলাসে উল্লাস ঘোষে ডম্বরু ডিণ্ডিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম! অম্বর-ডঙ্কার ডামাডোল সৃজনের বুকে আনে অশ্রু-বন্যা ব্যথা-উতরোল। ভাণ্ডারে সঞ্চিত মম দুর্বাসার হিংসা ক্রোধ শাপ। ভীমা উগ্রচণ্ডা ফেলে উল্কারূপী অগ্নি-অশ্রু, সহিতে না পারি মম তাপ! আমি ঝড়, পদতলে ‘আতঙ্ক’-কুঞ্জর, হস্তে মোর ‘মাভৈঃ’-অঙ্কুশ। আমি বলি, ছুটে চলো প্রলয়ের লাল ঝাণ্ডা হাতে, – হে নবীন পরুষ পুরুষ! স্কন্ধে তোলো উদ্ধত বিদ্রোহ-ধ্বজা; কণ্টক-অশঙ্ক রে নির্ভীক! পুরুষ ক্রন্দন-জয়ী, – দুঃখ দেখে দুঃখ পায় – ধিক তারে ধিক আমি বলি, বিশ্ব-গোলা নিয়ে খেলো লুফোলুফি খেলা! বীর নিক বিপ্লবের লাল-ঘোড়া, ভীরু নিক পারে-ধাওয়া পলায়ন-ভেলা! আমি বলি, প্রাণানন্দে পিয়ে নে রে বীর, জীবন-রসনা দিয়া প্রাণ ভরে মৃত্যু-ঘন ক্ষীর! আমি বলি, নরকের ‘নার’ মেখে নেয়ে আয় জ্বালা-কুণ্ড সূর্যের হাম্মামে। রৌদ্রের-চন্দন-শুচি, উঠে বসো গগনের বিপুল তাঞ্জামে! আমি ঝড় মহাশত্রু স্বস্তি-শান্তি-শ্রীর, আমি বলি, শ্মশান-সুষুপ্তি শান্তি – জয়নাদ আমি অশান্তির। পশ্চিম হইতে পূর্বে ঝঞ্ঝনা-ঝাঁঝর ঝঞ্ঝা-জগঝম্প ঘোর – বাজায়ে চলেছি ঝড় – ঝনাৎ ঝনাৎ ঝন ঝমরঝমরঝন ঝননঝননশন শনশনশন হুহু হুহু হুহু – সহসা কম্পিত-কণ্ঠ-ক্রন্দন শুনি কার – ‘উহু! উহু উহু উহু!’ সজল কাজল-পক্ষ্ম কে সিক্তবসনা একা ভিজে – বিরহিণী কপোতিনী, এলোকেশ কালোমেঘে পিঁজে। নয়ন-গগনে তার নেমেছে বাদল, ভিজিয়াছে চোখের কাজল, মলিন করেছে তার কালো আঁখি-তারা বায়ে-ওড়া কেতকীর পীত পরিমল! এ কোন্ শ্যামলী পরি পুবের পরিস্থানে কেঁদে কেঁদে যায় – নবোদ্ভিন্ন কুঁড়ি-কদম্বের ঘন যৌবন-ব্যথায়! জেগেছে বালার বুকে এক বুক ব্যথা আর কথা, কথা শুধু প্রাণে কাঁদে, ব্যথা শুধু বুকে বেঁধে, মুখে ফোটে শুধু আকুলতা! কদম্ব তমাল তাল পিয়াল-তলায় দূর্বাদল-মখমলে শ্যামলী-আলতা তার মুছে মুছে যায়! বাঁধে বেণি কেয়া-কাঁটা বনে। বিদেশিনি দেয়াশিনি একমনে দেয়া-ডাক শোনে! দাদুরির আদুরি কাজরি শোনে আর আঁখি-মেঘ-কাজল গড়ায়ে দুখ-বারি পড়ে ঝরঝরি। ঝিমঝিম রিমঝিম – রিমিরিমি রিম ঝিম বাজে পাঁইজোর – কে তুমি পুরবি বালা? আর যেন নাহি পাই জোর চলা-পায়ে মোর, ও-বাজা আমারও বুকে বাজে। ঝিল্লির ঝিমানি-ঝিনিঝিনি শুনি যেন মোর প্রতি রক্ত-বিন্দু-মাঝে! আমি ঝড়? ঝড় আমি? – না, না, আমি বাদলের বায়! বন্ধু! ঝড় নাই কোথায়? ঝড় কোথা? কই? – বিপ্লবের লাল-ঘোড়া ওই ডাকে ওই – ওই শোনো, শোনো তার হ্রেষার চিক্কুর, ওই তার ক্ষুর-হানা মেঘে! – না, না, আজ যাই আমি, আবার আসিব ফিরে, হে বিদ্রোহী বন্ধু মোর! তুমি থেকো জেগে! তুমি রক্ষী এ রক্ত-অশ্বের, হে বিদ্রোহী অন্তর্দেবতা! – শুনো শুনো মায়াবিনী ওই ডাকে ফের – পুবের হাওয়ায় – যায় – যায় – সব ভেসে যায় পুবের হাওয়ায় – হায়! –  (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
যেমন  ছাঁচি পানের কচি পাতা প্রজাপতির ডানার ছোঁয়ায়, ঠোঁট দুটি তার কাঁপন-আকুল একটি চুমায় অমনি নোয়ায়। জল-ছলছল উড়ু-উড়ু চঞ্চল তার আঁখির তারা, কখন বুঝি দেবে ফাঁকি সুদূর পথিক-পাখির পারা, নিবিড় নয়ন-পাতার কোলে, গভীর ব্যথার ছায়া দোলে, মলিন চাওয়া (ছাওয়া) যেন দূরের সে কোন্ সবুজ ধোঁয়ায়। সিঁথির বীথির খসে-পড়া কপোল-ছাওয়া চপল অলক পলক-হারা, সে মুখ চেয়ে নাচ ভুলেছে নাকের নোলক। পাংশু তাহার চূর্ণ কেশে, মুখ মুছে যায় সন্ধে এসে, বিধুর অধর-সীধু যেন নিঙড়ে কাঁচা আঙুর চোয়ায়। দিঘল শ্বাসের বাউল বাজে নাসার সে তার জোড়-বাঁশিতে, পান্না-ক্ষরা কান্না যেন ঠোঁট-চাপা তার চোর হাসি সে। ম্লান তার লাল গালের লালিম, রোদ-পাকা আধ-ডাঁশা ডালিম, গাগরি ব্যথার ডুবায় কে তার টোল খাওয়া গাল-চিবুক-কুয়ায়। চায় যেন সে শরম-শাড়ির ঘোমটা চিরি পাতা ফুঁড়ি, আধফোঁটা বউ মউল-বউল, বোলতা-ব্যাকুল বকুল কুঁড়ি বোল-ভোলা তার কাঁকন চুড়ি ক্ষীরের ভিতর হিরের ছুরি, দু-চোখ-ভরা অশ্রু যেন পাকা পিয়াল শালের ঠোঙায়। বুকের কাঁপন হুতাশ-ভরা, বাহুর বাঁধন কাঁদন-মাখা, নিচোল বুকের কাঁচল আঁচল স্বপন-পারের পরির পাখা। খেয়াপারের ভেসে-আসা গীতির মতো পায়ের ভাষা, চরণ-চুমায় শিউরে পুলক হিমভেজা দুধ-ঘাসের রোঁয়ায়। সে যেন কোন্ দূরের মেয়ে আমার কবিমানস-বধূ; বুকপোরা আর মুখভার তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু। নিশীথ-রাতের স্বপন হেন, পেয়েও তারে পাইনে যেন, মিলন মোদের স্বপন-কূলে কাঁদনভরা চুমায় চুমায়। নামহারা সেই আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোঁয়ায়।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া॥ হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান, তাই তো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশো-খান! এখন দেখিস ভারত-জোড়া পচে আছিস বাসি মড়া, মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া॥ জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল, তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল। যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত, আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো, যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া॥ দিন-কানা সব দেখতে পাসনে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে কেমন করে পিষছে তোদের পিশাচ জাতের জাঁতাকলে। (তোরা)  জাতের চাপে মারলি জাতি, সূর্য ত্যজি নিলি বাতি, তোদের   জাত-ভগীরথ এনেছে জল জাত-বিজাতের জুতো-ধোয়া॥ মনু ঋষি অণুসমান বিপুল বিশ্বে যে বিধির, বুঝলি না সেই বিধির বিধি, মনুর পায়েই নোয়াস শির। ওরে মূর্খ ওরে জড়, শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়ো, (তোরা)   চিনলিনে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥ সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এই বিশ্ব মায়ের বিশ্ব-ঘর, মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম-পর। (তোরা)  সৃষ্টিকে তাঁর ঘৃণা করে স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে ভস্মে ঘৃত ঢালা সে যে বাছুর মেরে গাভি দোওয়া॥ বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত? কোন ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ? নারায়ণের জাত যদি নাই, তোদের কেন জাতের বালাই? (তোরা)  ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া॥ ভগবানের ফৌজদারি-কোর্ট নাই সেখানে জাতবিচার, (তোর)   পইতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার। জাত সে শিকেয় তোলা রবে, কর্ম নিয়ে বিচার হবে, (তা-পর)   বামুন চাঁড়াল এক গোয়ালে, নরক কিংবা স্বর্গে থোয়া॥ (এই)   আচার-বিচার বড়ো করে প্রাণ দেবতায় ক্ষুদ্র ভাবা, (বাবা)   এই পাপেই আজ উঠতে বসতে সিঙ্গি-মামার খাচ্ছ থাবা। তাই নাইকো অন্ন নাইকো বস্ত্র, নাইকো সম্মান, নাইকো অস্ত্র, (এই)   জাত-জুয়াড়ির ভাগ্যে আছে আরও অশেষ দুঃখ-সওয়া॥   (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
উটমুখো সে সুঁটকো হাশিম, পেট যেন ঠিক ভুঁটকো কাছিম! চুলগুলো সব বাবুই দড়ি – ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি! তিন-কোনা ইয়া মস্ত মাথা, ফ্যাচকা-চোখো; হস্ত? হাঁ তা ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা! নিটপিটে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা! গাইতি-দেঁতো, উঁচকে কপাল আঁতকে ওঠেন পুঁচকে গোপাল! নাক খাঁদা ঠিক চামচিকেটি! আর হাসি? দাঁত খামচি সেটি! পাঁচের মতন থুতনো ব্যাঁকা! রগঢিলে, হুঁ ভূতনো ন্যাকা! কান দুটো টান – ঠিক সে কুলো! তোবড়ানো গাল, টিকটা ছুলো! বগলা প্রমাণ ঘাড়টি সরু, চেঁচান যেন ষাঁড় কী গোরু! চলেন গিজাং উরর কোলা ব্যাং, তালপাতা তাঁর ক্ষুর-ওলা ঠ্যাং! বদরাগি তায় এক-খেয়ালি বাস রে! খেঁকি খ্যাঁক-শেয়ালি! ফ্যাঁচকা-মাতু, ছিঁচকাঁদুনে, কয় লোকে তাই মিচকা টুনে! জগন্নাথী ঠুঁটো নুলো, লোম গায়ে ঠিক খুঁটোগুলো! ল্যাবেন্ডিসি নড়বড়ে চাল, তুবড়ি মুখে চড়বড়ে গাল! গুজুর-ঘুণে, দেড়-পাঁজুরে, ল্যাডাগ্যাপচার, ন্যাড়-নেজুড়ে! বসেন সে হাড়-ভাঙা ‘দ’, চেহারা দেখেই সব মামা ‘থ’! গিরগিটে তার ক্যাঁকলেসে ঢং দেখলে কবে, ‘ধেত, এ যে সং!’ খ্যাঙরা-কাটি আঙলাগুলো, কুঁদিলে শ্রীমুখ বাংলা চুলো! পেটফুলো ইয়া মস্ত পিলে, দৈবাতে তায় হস্ত দিলে জোর চটিতং, বিটকেলে চাঁই! ইঁট খাবে নাকো সিঁটকেলে ভাই! নাক বেয়ে তার ঝরচে সিয়ান, ময়রা যেমন করছে ভিয়ান! স্বপন দেখেন হালকা নিঁদে – কুইনাইন আর কালকাসিঁদে! বদন সদাই তোলো হাঁড়ি, গুড়ামুড়ি খান ষোলো আড়ি! ঠোকরে সবাই ন্যাড়া মাথায় – শিলাবিষ্টি ছেঁড়া ছাতায়! রাক্ষুসে ভাত গিলতে পারে বাপ রে, বিড়াল ডিঙতে নারে! হন না ভুলেও ঘরের বাহির, কাঁথার ভিতর জ্বরের জাহির! পড়বে কি আর, দূর ভূত ছাই, ওষুধ খেতেই ফুরসত নাই! বুঝলে? যত মোটকা মিলে বাগাও দেখি পটকা পিলে! বাজবে পেটে তাল ভটাভট নাক ধিনাধিন গাল ফটাফট! ঢাকডুবাডুব ইড়িং-বিড়িং নাচবে ফড়িং তিড়িং তিড়িং! চুপসো গালে গাব গুবাগুব গুপি-যন্তর বাজবে বাঃ খুব! দিব্যি বসে মারবে মাছি, কাশবে এবং হাঁচবে হাঁচি! কিলবিলিয়ে দুটো ঠ্যাং নড়বে যেমন ঠুঁটো ব্যাং!!  (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
বোমার ভয়ে বউ, মা, বোন, নেড়রি গেঁড়রি লয়ে দিগ্‌বিদিকে পলায় ভীরু মানুষ মৃত্যু ভয়ে! কোনখানে হায় পলায় মানুষ, মৃত্যু কোথায় নাই? পলাতকের দল! বলে যাও সে-দেশ কোথায় ভাই? মানুষ মরে একবার, সে দুবার মরে নাকো, হায় রে মানুষ! তবু কেন মৃত্যুর ভয় রাখ। আরেক দেশে পালিয়া তোমার মৃত্যুভয় কি যাবে? মৃত্যু – ভ্রান্তি দিবানিশি তোমায় ভয় দেখাবে। না মরিয়া বীরের মতো মৃত্যু আলিঙ্গিয়া, তিলে তিলে মরে ভীরু যে যন্ত্রণা নিয়া, সে যাতনার চেয়ে বোমার আগুন স্নিগ্ধ আরও! মরণ আসে বন্ধু হয়ে, মরতে যদি পার তেমন মরণ। দেখবে সেদিন সবে, পৃথ্বী হবে নতুন আবার মৃত্যু-মহোৎসবে।আল্লাহ্‌ ভগবানের আমরা যদি আশ্রয় পাই, সেই সে পরম অভয়াশ্রমে মৃত্যুর ভয় নাই! যেতে পার তাঁর কাছে ছুটে তুমি প্রবল তৃষ্ণা লয়ে? তাঁহারে ছুঁইলে ছোঁবে না তোমারে কখনও মৃত্যুভয়ে! সেখানে যাওয়ার ট্রেন কোন ইস্টিশনে সে পাওয়া যায়? সে প্ল্যাটফর্ম দেখেছ কি কভু? দেখনিকো তুমি হায়! যেখানেই তুমি পালাও, মৃত্যু সাথে সাথে দৌড়াবে! জানিয়াও কেন অকারণে মৃত্যুর ভয়ে খাবি খাবে? দেখেছি ভীষণ মানুষের স্রোত ভীষণ শাস্তি সয়ে, চলেছে অজানা অরণ্যে যেন ভীতি-উন্মাদ হয়ে! পুরুষের রূপে দেখাছি বউমা করে কোণ ঠাসাঠাসি, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া বাক্স বোঁচকা পোঁটলা রাশি। যাহারা যাইতে পারিল না, পড়ে রহিল অর্থাভাবে সঞ্চিত নাই অর্থ, কোথায় ক্ষুধার অন্ন পাবে? তাহাদের কথা ভাবিল না কেউ, ধরিল না কেহ হাতে, কেহ বলিল না, ‘মরিতে হয়তো এসো মরি এক সাথে!’ কেহ বলিল না, ‘কেন পলাইব, এসো দল বেঁধে রই, সংঘবদ্ধ হইয়া আমরা এসো সৈনিক হই।’ ক্ষুদ্র অস্ত্র লয়ে কি করিয়া যুদ্ধ করিছে চীন? অস্ত্র ধরিতে পারে না, যাহারা অন্তরে বলহীন। যাহারা নির্যাতিত মানবেরে রক্ষা করিতে চায়, আকাশ হইতে নেমে আসে, হাতে অস্ত্র তারাই পায়! বোমার ভয় এ নহে, ইহা ক্লীব ভীরুর মৃত্যুভয়, ইহারা ধরার বোঝা হয়ে আছে, ইহারা মানুষ নয়।যে দেশে তাদের জন্ম সে দেশ ছেড়ে এরা পরদেশে, কেমন করিয়া খায় দায়, মুখ দেখায়, বেড়ায় হেসে? অর্থের চাকচিক্য দেখায়, হায় রে লজ্জাহীন, ইহাদেরই শিরে বোমা যেন পড়ে, ইহারা হোক বিলীন! বোমা দেখেনিকো, শব্দ শোনেনি, শুধু তার নামে প্রেমে এদের সর্ব অঙ্গ ব্যাকুল হইয়া উঠেছে ঘেমে! জীবন আর যৌবন যার আছে, সেই সে মৃত্যুহীন, গোরস্তানের শ্মশানের ভূত যারা ভীরু যারা দীন! কেন বেঁচে আছে এরা পৃথিবীরে ভারাক্রান্ত করে? ইহাদেরই শিরে পড়ে যেন যদি বোমা কোনোদিন পড়ে!নওজোয়ানরা এসো দলে দলে বীর শহিদান সেনা; তোমরা লভিবে অমর-মৃত্যু, কোনো দিন মরিবে না! ইতিহাসে আর মানবস্মৃতিতে আছে তাহাদেরই নাম, যারা সৈনিক, দৈত্যের সাথে করেছিল সংগ্রাম! যারা ভীরু, তারা কীটের মতন কখন গিয়েছে মরে, তাদের কি কোনো স্মৃতি আছে, কেউ তাদের কি মনে করে? ক্ষুদ্র-আত্মা নিষ্প্রাণ এরা, ইহারা গেলেই ভালো, ভিড় করেছিল নিরাশা-আঁধার, এবার আসিবে আলো! দেশের জাতির সৈনিক যদি কোনো দিন জয় আনে, এই আঁধারের জীব যদি ফিরে আসে আলোকের পানে, ইহাদের কাঁধে লাঙল বাঁধিয়া জমি করাইয়ো চাষ, তবে যদি হয় চেতনা এদের, হয় যদি ভয় হ্রাস! চল্লিশ কোটি মানুষ ভারতে, এক কোটি হোক সেনা, কোনো পরদেশি আসিবে না, কোনো বিদেশিরা রহিবে না! বিরাট বিপুল দেশ আমাদের, কার এত সেনা আছে, ভারত জুড়িয়া যু্দ্ধ করিবে? পরাজয় লভিয়াছে, এই মৃত্যুর ভয় শুধু, এরা রোগে ভুগে পচে মরে, তবু লভিবে না অমৃত ইহারা মৃত্যুর হাত ধরে! সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা ভাই শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ভবে, এই অস্ত্রেই সর্ব অসুর দানব বিনাশ হবে, চল্লিশ কোটি মানুষ মারিতে কোথা পাবে গোলাগুলি, সর্বভয়ের রাক্ষস পশু পালাবে লাঙ্গুল তুলি। বোমা যদি আসে, দেখে যাব মোরা বোমা সে কেমন চিজ, তাহারই ধ্বনিতে ধ্বংস হইবে সর্ব ক্লৈব্য-বীজ! যাহারা জন্ম-সৈনিক, তারা ছুটে এসো দলে দলে, শক্তি আসিবে পৃথিবী কাঁপিবে আমাদের পদতলে। আমরা যুঝিয়া মরি যদি সব ভীরুতা হইবে লয়, পৃথিবীতে শুধু বীর-সেনাদের জয় হোক, হোক জয়।  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ভক্তিমূলক
আমার বিফল পূজাঞ্জলি অশ্রু-স্রোতে যায় যে ভেসে। তোমার আরাধিকার পূজা হে বিরহী, লও হে এসে। খোঁজে তোমায় চন্দ্র তপন, পূজে তোমায় বিশ্বভুবন, আমার যে নাথ ক্ষণিক জীবন মিটবে কি সাধ ভালোবেসে॥ না-দেখা মোর বন্ধু ওগো, কোথায় বাঁশি বাজাও একা, প্রাণ বোঝে তা অনুভবে নয়ন কেন পায় না দেখা! সিন্ধু যেমন বিপুল টানে তটিনীরে টেনে আনে, তেমনি করে তোমার পানে আমায় ডাকো নিরুদ্দেশে॥   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
চিন্তামূলক
বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে, সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে - উদাস পথিক ভাবে। ‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে, ‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে; পথের পথিক পথেই বসে থাকে, জানে না সে কে তাহারে চাবে। উদাস পথিক ভাবে। বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে, ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে শৈলমূলে শৈলবালা নাবে - উদাস পথিক ভাবে। বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি, বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি, বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি, একলা থাকার গানখানি সে গাবে - উদাস পথিক ভাবে। হঠাত্‍ তাহার পথের রেখা হারায় গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়, পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায় আর কি পূবের পথের দেখা পাবে উদাস পথিক ভাবে।
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
জাগো– জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত! যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি’ হাঁকে নিপীড়িত-জন-মন-মথিত বাণী, নব জনম লভি’ অভিনব ধরণী ওরে ওই আগত।। আদি শৃঙ্খলা সনাতন শাস্ত্র-আচার মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার! ভেদি’ দৈত্য-কারা! আয় সর্বহারা! কেহ রহিবে না আর পর-পদ-আনত।। কোরাস্‌ : নব ভিত্তি ’পরে নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে! শোন্‌ অত্যাচারী! শোন্‌ রে সঞ্চয়ী! ছিনু সর্বহারা, হব’ সর্বজয়ী।। ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ, নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ! এই ‘অন্তর-ন্যাশনাল-সংহতি’ রে হবে নিখিল-মানব-জাতি সমুদ্ধত।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
এপার ওপার জুড়িয়া অন্ধকার মধ্যে অকূল রহস্য-পারাবার, তারই এই কূলে নিশি নিশি কাঁদে জাগি চক্রবাক সে চক্রবাকীর লাগি। ভুলে যাওয়া কোন জন্মান্তর পারে কোন সুখ-দিনে এই সে নদীর ধারে পেয়েছিল তারে সারা দিবসের সাথি, তারপর এল বিরহের চির-রাতি, – আজিও তাহার বুকের ব্যথার কাছে, সেই সে স্মৃতি পালক পড়িয়া আছে!কেটে গেল দিন, রাত্রি কাটে না আর, দেখা নাহি যায় অতি দূর ওই পার। এপারে ওপারে জনম জনম বাধা, অকূলে চাহিয়া কাঁদিছে কূলের রাধা। এই বিরহের বিপুল শূন্য ভরি কাঁদিছে বাঁশরি সুরের ছলনা করি! আমরা শুনাই সেই বাঁশরির সুর, কাঁদি – সাথে কাঁদে নিখিল ব্যথা-বিধুর।কত তেরো নদী সাত সমুদ্র পার কোন লোকে কোন দেশে গ্রহ-তারকার সৃজন-দিনের প্রিয়া কাঁদে বন্দিনী, দশদিশি ঘিরি নিষেধের নিশীথিনী। এ পারে বৃথাই বিস্মরণের কূলে খোঁজে সাথি তার, কেবলই সে পথ ভুলে। কত পায় বুকে কত সে হারায় তবু – পায়নি যাহারে ভোলেনি তাহারে কভু।তাহারই লাগিয়া শত সুরে শত গানে কাব্যে, কথায়, চিত্রে, জড় পাষাণে, লিখিছে তাহার অমর অশ্রু-লেখা। নীরন্ধ্র মেঘ বাদলে ডাকিছে কেকা ! আমাদের পটে তাহারই প্রতিচ্ছবি, সে গান শুনাই – আমরা শিল্পী কবি। এই বেদনার নিশীথ-তমসা-তীরে বিরহী চক্রবাক খুঁজে খুঁজে ফিরে কোথা প্রভাতের সূর্যোদয়ের সাথে ডাকে সাথি তার মিলনের মোহানাতে। আমরা শিশির, আমাদের আঁখি-জলে সেই সে আশার রাঙা রামধনু ঝলে।   (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে। গৃহকোন ছাড়ি আসিয়াছ আজ দেবতার মন্দিরে। পুতুল লইয়া কাটিয়াছে বেলা আপনারে ল'য়ে শুধু হেলা-ফেলা, জানিতে না, আছে হৃদয়ের খেলা আকুল নয়ন-নীরে, এত বড় দায় নয়নে নয়নে নিমেষের চাওয়া কি রে? আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে।।আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে। জানিতে না আঁখি আঁখিতে হারায় ডুবে যায় বাণী ধীরে! তুমি ছাড়া আর ছিল না ক' কেহ ছিল না বাহির ছিল শুধু গেহ, কাজল ছিল গো জল ছিল না ও উজল আঁখির তীরে। সে-দিনও চলিতে ছলনা বাজেনি ও চরণ-মঞ্জীরে! আমি জানি তুমি কেন চাহ না ক' ফিরে।।আমি জানি তুমি কেন কহ না ক' কথা! সে দিনও তোমার বনপথে যেতে পায়ে জরাত না লতা! সে-দিনও বেভুল তুলিয়াছ ফুল ফুল বিঁধিতে গো বিঁধেনি আঙুল, মালার সাথে যে হৃদয়ও শুকায় জানিতে না সে বারতা, জানিতে না, কাঁদে মুখর মুখের আড়ালে নিসঙ্গতা। আমি জানি তুমি কেন কহ না ক' কথা।।আমি জানি তব কপটতা, চতুরালি! তুমি জানিতে না, ও কপোলে থাকে ডালিম-দানার লালী। জানিতে না ভীরু রমণীর মন মধুকর-ভারে লতার মতন কেঁপে মরে কথা কন্ঠ জড়ায়ে নিষেধ করে গো খালি, আঁখি যত চায় তত লজ্জায় লজ্জা পাড়ে গো গালি! আমি জানি তব কপটতা, চুরতালি!আমি জানি, ভিরু! কিসের এ বিস্ময়। জানিতে না কভু নিজেরে হেরিয়া নিজেরি করে যে ভয়! পুরুষ পুরুষ- শুনেছিলাম নাম, দেখেছ পাথর করনি প্রণাম, প্রণাম করেছ লুব্ধ দ'কর চেয়েছে চরণ-ছোঁয়া। জানিতে না, হিয়া পাথর পরশি' পরশ-পাথরও হয়! আমি জানি, ভীরু, কিসের এ বিস্ময়।।কিসের তোমার শঙ্কা এ, আমি জানি। পরানের ক্ষুধা দেশের দ'-তীরে করিতেছে কানাকানি! বিকচ বুকের বকুল-গন্ধ পাপড়ি রাখিতে পারে না বন্ধ, যত আপনারে লুকাইতে চাও তত হয় জানাজানি, অপাঙ্গে আজ ভিড় ক'রেছে গো লুকানো যতেক বাণী। কিসের তোমার শঙ্কা, এ আমি জানি।।আমি জানি, কেন বলিতে পার না খুলি'। গোপনে তোমায় আবেদন তার জানায়েছে বুলবুলি। যে-কথা শুনিতে মনে ছিল সাধ, কেমনে সে পেল তারি সংবাদ? সেই কথা বঁধু তেমনি করিয়া বলিল নয়ন তুলি' কে জানিত এত যাদু-মাখা তার ও কঠিন অঙুলি। আমি জানি কেন বলিতে পার না খুলি'।আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা, ব্যথার পরশে হয়েছে তোমার সকল অঙ্গ সোনা! মাটির দেবীরে পরায় ভূষণ সোনার সোনায় কিবা প্র্যোজন? দেহ-কূল ছাড়ি' নেমেছে মনের অকূল নিরঞ্জনা। বেদনা আজিকে রূপেরে তোমার করিতেছে বন্দনা। আমি জানি তুমি কেন যে নিরাভরণা।।আমি জানি, ওরা বুঝিতে পারে না তোরে। নিশীথে ঘুমালে কুমারী বালিকা, বদূ জাগিয়াছে ভোরে! ওরা সাঁতারিয়া ফিরিতেছে ফেনা শুক্তি যে ডোবে- বুঝিতে পারে না! মুক্তা ফলেছে- আঁখির ঝিনুক ডুবেছে আঁখির লোরে। বোঝা কত ভার হ'লে- হৃদয়ের ভরাডুবি হয়, ওরে, অভাগিনী নারী, বুঝাবি কেমন ক'রে।।
কাজী নজরুল ইসলাম
স্তোত্রমূলক
হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে চির-বিরহী, হে অতৃপ্ত! রহি’ রহি’ কোন্‌ বেদনায় উদ্বেলিয়া ওঠ তুমি কানায় কানায়? কি কথা শুনাতে চাও, কারে কি কহিবে বন্ধু তুমি? প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে উর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভুমি! কথা কও, হে দুরন্ত, বল, তব বুকে কেন এত ঢেউ জাগে, এত কলকল? কিসের এ অশান্ত গর্জন? দিবা নাই রাত্রি নাই, অনন্ত ক্রন্দন থামিল না, বন্ধু, তব! কোথা তব ব্যথা বাজে! মোরে কও, কা’রে নাহি ক’ব! কা’রে তুমি হারালে কখন্‌? কোন্‌ মায়া-মণিকার হেরিছ স্বপন? কে সে বালা? কোথা তার ঘর? কবে দেখেছিলে তারে? কেন হ’ল পর যারে এত বাসিয়াছ ভালো! কেন সে আসিল, এসে কেন সে লুকালো? অভিমান ক’রেছে সে? মানিনী ঝেপেছে মুখ নিশীথিনী-কেশে? ঘুমায়েছে একাকিনী জোছনা-বিছানে? চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার? কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার? বল, বন্ধু বল, ও কি গান? ওকি কাঁদা? ঐ মত্ত জল-ছলছল- ও কি হুহুঙ্কার? ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার? টানিয়া সে মেঘের আড়াল সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল? চাঁদের কলঙ্ক ঐ, ও কি তব ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ? দূরে থাকে কলঙ্কিনী, ও কি রাগ? ও কি অনুরাগ? জান না কি, তাই তরঙ্গে আছাড়ি’ মর আক্রোশে বৃথাই?…. মনে লাগে তুমি যেন অনন্ত পুরুষ আপনার স্বপ্নে ছিলে আপনি বেহুঁশ! অশান্ত! প্রশান্ত ছিলে এ-নিখিলে জানিতে না আপনারে ছাড়া। তরঙ্গ ছিল না বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নি ক’ নাড়া! বিপুল আরশি-সম ছিলে স্বচ্ছ, ছিলে স্থির, তব মুখে মুখ রেখে ঘুমাইত তীর।– তপস্বী! ধেয়ানী! তারপর চাঁদ এলো-কবে, নাহি জানি তুমি যেন উঠিলে শিহরি’। হে মৌনী, কহিলে কথা-“মরি মরি, সুন্দর সুন্দর!” “সুন্দর সুন্দর” গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর! সেই সে আদিম শব্দ, সেই আদি কথা, সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা, সেই বুঝি বুঝিলে রাজন্‌ একা সে সুন্দর হয় হইলে দু’জন! কোথা সে উঠিল চাঁদ হৃদয়ে না নভে সে-কথা জানে না কেউ, জানিবে না,  চিরকাল নাহি-জানা র’বে। এতদিনে ভার হ’ল আপনারে নিয়া একা থাকা, কেন যেন মনে হয়-ফাঁকা, সব ফাঁকা কে যেন চাহিছে মোরে, কে যেন কী নাই, যারে পাই তারে যেন আরো পেতে চাই! জাগিল আনন্দ-ব্যথা, জাগিল জোয়ার, লাগিল তরঙ্গে দোলা, ভাঙিল দুয়ার, মাতিয়া উঠিলে তুমি! কাঁপিয়া উঠিল কেঁদে নিদ্রাতুরা ভূমি! বাতাসে উঠিল ব্যেপে তব হতাশ্বাস, জাগিল অন্তত শূন্যে নীলিমা-উছাস! রোমাঞ্চিত হ’ল ধরা, বুক চিরে এল তার তৃণ-ফুল-ফল। এল আলো, এল বায়ু, এল তেজ প্রাণ, জানা ও অজানা ব্যেপে ওঠে সে কি অভিনব গান! এ কি মাতামাতি ওগো এ কি উতরোল! এত বুক ছিল হেথা, ছিল এত কোন! শাখা ও শাখীতে যেন কত জানাশোনা, হাওয়া এসে দোলা দেয়, সেও যেন ছিল জানা কত সে আপনা! জলে জলে ছলাছলি চলমান বেগে, ফুলে হুলে চুমোচুমি-চরাচরে বেলা ওঠে জেগে! আনন্দ-বিহ্বল সব আজ কথা কহে, গাহে গান, করে কোলাহল! বন্ধু ওগো সিন্ধুরাজ! স্বপ্নে চাঁদ-মুখ হেরিয়া উঠিলে জাগি’,  ব্যথা ক’রে উঠিল ও-বুক। কী যেন সে ক্ষুধা জাগে, কী যেন সে পীড়া, গ’লে যায় সারা হিয়া, ছিঁড়ে যায় যত স্নায়ু শিরা! নিয়া নেশা, নিয়া ব্যথা-সুখ দুলিয়া উঠিলে সিন্ধু উৎসুক উন্মুখ! কোন্‌ প্রিয়-বিরহের সুগভীর ছায়া তোমাতে পড়িল যেন, নীল হ’ল তব স্বচ্ছ কায়া! সিন্ধু, ওগো বন্ধু মোর! গর্জিয়া উঠিল ঘোর আর্ত হুহুঙ্কারে! বারে বারে বাসনা-তরঙ্গে তব পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর, ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, উর্ধ্ব প্রিয়া স্থির! ঘুচিল না অনন্ত আড়াল, তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদি সাথে কাল! কাঁদে গ্রীষ্ম, কাঁদে বর্ষা, বসন্ত ও শীত, নিশিদিন শুনি বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত, নিখিল বিরহী কাঁদে সিন্ধু তব সাথে, তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে! সেই অশ্রু-সেই লোনা জল তব চক্ষে — হে বিরহী বন্ধু মোরা — করে টলমল! এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া। চট্টগ্রাম ২৯/০৭/১৯২৬
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
অসত্য যত রহিল পড়িয়া, সত্য যে গেল চ’লে বীরের মতন মরণ-কারারে চরণের তলে দ’লে। যে-ভোরের তারা অরুণ-রবির উদয়-তোরণ-দোরে ঘোষিল বিজয়-কিরণ-শঙ্খ-আবার প্রথম ভোরে, রবির ললাট চুম্বিল যার প্রথম রশ্মি-টীকা, বাদলের বায়ে নিভে গেল হায় দীপ্ত তাহারি শিখা! মধ্য গগনে স্তব্ধ নিশীথ, বিশ্ব চেতন-হারা, নিবিড় তিমির, আকাশ ভাঙিয়া ঝরিছে আকুল-ধারা গ্রহ শশী তারা কেউ জেগে নাই, নিভে গেছে সব বাতি, হাঁক দিয়া ফেরে ঝড়- তুফানের উতরোল মাতামাতি! হেন দুর্দিনে বেদনা-শিখার বিজলি-প্রদীপ জ্বেলে কাহারে খুঁজিতে কে তুমি নিশীথ-গগন-আঙনে এলে? বারে বারে তব দীপ নিভে যায়, জ্বালো তুমি বারে বারে, কাঁদন তোমার সে যেন বিশ্বপিতারে চাবুক মারে! কি ধন খুঁজিছ? কে তুমি সুনীল মেঘ-অবগন্ঠিতা? তুমি কি গো সেই সবুজ শিখার কবির দীপাম্বীতা? কি নেবে গো আর? ঐ নিয়ে যাও চিতার দু-মুঠো ছাই! ডাক দিয়ো না ক’, মূর্ছিতা মাতা ধুলায় পড়িয়া আছে, ডাক দিয়ো না ক’, শূন্য এ ঘর, নাই গো সে আর নাই, গঙ্গা-সলিলে ভাসিয়া গিয়াছে তাহার চিতার ছাই! আসিলে তড়িৎ-তাঞ্জামে কে গো নভোতলে তুমি সতী? সত্য-কবির সত্য জননী ছন্দ-সরত্বতী? ঝলসিয়া গেছে দু’চোখ মা তার তোরে নিশিদিন ডাকি’, বিদায়ের দিনে কন্ঠের তার গানটি গিয়াছে রাখি’ সাত কোটি এই ভগ্ন কন্ঠে; অবশেষে অভিমানী ভর-দুপুরেই খেলা ফেলে গেল কাঁদায়ে নিখিল প্রাণী! ডাকিছ কাহারে আকাশ-পানে ও ব্যাকুল দু’হাত তুলে? কোল মিলেছে মা, শ্মশান-চিতায় ঐ ভাগীরথী-কূলে! ভোরের তারা এ ভাবিয়া পথিক শুধায় সাঁঝের তারায়, কাল যে আছিল মধ্য গগনে আজি সে কোথায় হারায়? সাঁঝের তারা সে দিগন্তের কোলে ম্লান চোখে চায়, অস্ত-তোরণ-পার সে দেখায় কিরণের ইশারায়। মেঘ-তাঞ্জাম চলে কার আর যায় কেঁদে যায় দেয়া, পরপার-পারাপারে বাঁধা কার কেতকী-পাতার খেয়া? হুতাশিয়া ফেরে পূরবীর বায়ু হরিৎ-হুরীর দেশে জর্দা-পরীর কনক-কেশর কদম্ব-বন-শেষে! প্রলাপ প্রলাপ প্রলাপ করি সে আসিবে না আর ফিরে, ক্রন্দন শুধু কাঁদিয়া ফিরিবে গঙ্গার তীরে তীরে! ‘তুলির লিখন’ লেখা যে এখনো অরুণ-রক্ত-রাগে, ফুল্ল হাসিছে ‘ফুলের ফসল’ শ্যামার সবজি-বাগে, আজিও ‘তীর্থরেণু ও সলিলে’ ‘মণি-মঞ্জুষা’ ভরা, ‘বেণু-বীণা’ আর ‘কুহু-কেকা’-রবে আজো শিহরায় ধরা, জ্বলিয়া উঠিল ‘ অভ্র-আবির’ ফাগুয়ায় ‘হোম শিখা’,- বহ্নি-বাসরে টিট্‌কারি দিয়ে হাসিল ‘হোমন্তিকা’- এত সব যার প্রাণ-উৎসব সেই আজ শুধু নাই, সত্য-প্রাণ সে রহিল অমর,মায়া যাহা হ’ল ছাই! ভুল যাহা ছিল ভেঙে গেল মহাশূন্যে মিলালো ফাঁকা, সৃজন-দিনের সত্য যে, সে-ই রয়ে গেল চির-আঁকা! উন্নতশির কালজয়ী মহাকাল হ’য়ে জোড়পাণি স্কন্ধে বিজয়-পতাকা তাহারি ফিরিবে আদেশ মানি! আপনারে সে যে ব্যাপিয়া রেখেছে আপন সৃষ্টি-মাঝে, খেয়ালী বিধির ডাক এল তাই চ’লে গেল আন্‌-কাজে। ওগো যুগে যুগে কবি, ও-মরণে মরেনি তোমার প্রাণ, কবির কন্ঠে প্রকাশ সত্য-সুন্দর ভগবান। ধরায় যে বাণী ধরা নাহি দিল, যে-গান রহিল বাকী আবার আসিবে পূর্ণ করিতে, সত্য সে নহে ফাঁকি! সব বুঝি ওগো, হারা-ভীতু মোরা তবু ভাবি শুধু ভাবি, হয়ত যা গেল চিরকাল তরে হারানু তাহার দাবি। তাই ভাবি,আজ যে শ্যামার শিস খঞ্জন-নর্তন থেমে গেল, তাহা মাতাইবে পুনৎ কোন্‌ নন্দন-বন! চোখে জল আসে, হে কবি-পাবক, হেন অসময়ে গেলে যখন এ-দেশে তোমারি মতন দরকার শত ছেলে। আষাঢ়-রবির তেজোপ্রদীপ্ত তুমি ধূমকেতু-জ্বালা, শিরে মণি-হার, কন্ঠে ত্রিশিরা ফণি-মনসার মালা, তড়িৎ-চাবুক করে ধরি’ তুমি আসিলে হে নির্ভীক, মরণ-শয়নে চমকি’ চাহিল বাঙালী নির্নিমিখ। বাঁশীতে তোমার বিষাণ-মন্দ্র রণরণি/ ওঠে জয় মানুষের জয়, বিশ্বে দেবতা দৈত্য সে বড় নয়! করোনি বরণ দাসত্ব তুমি আত্ম-অসম্মান, নোয়ায়নি মাথা, চির জাগ্রত ধ্রুব তব ভগবান, সত্য তোমার পর-পদানত হয়নি ক’ কভু, তাই বলদর্পীর দন্ড তোমায় স্পর্শিতে পারে নাই! যশ-লোভী এই অন্ধ ভন্ড সজ্ঞান ভীরু-দলে তুমিই একাকী রণ-দুন্দুভি বাজালে গভীর রোলে। মেকীর বাজারে আমরণ তুমি র’য়ে গেলে কবি খাঁটি, মাটির এ-দেহ মাটি হ’ল, তব সত্য হ’ল না মাটি। আঘাত না খেলে জাগে না যে-দেশ, ছিলে সে-দেশের চালক, বাণীর আসরে তুমি একা ছিলে তূর্য-বাদক বালক। কে দিবে আঘাত? কে জাগাবে দেশ? কই সে সত্যপ্রাণ? আপনারে হেলা করি’ করি মোরা ভগবানে অপমান। বাঁশী ও বিষান নিয়ে গেছ, আছে ছেঁড়া ঢোল ভাঙা কাঁসি, লোক-দেখানো এ আঁখির সলিলে লুকানো রয়েছে হাসি। যশের মানের ছিলে না কাঙাল, শেখোনি খাতির-দারী, উচ্চকে তুমি তুচ্ছ করোনি, হওনি রাজার দ্বারী! অত্যাচারকে বলনি ক’ দয়া, ব’লেছ অত্যাচার, গড় করোনি ক’ নিগড়ের পায়, ভয়েতে মানোনি হার। অচল অটল অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি তুমি উরিয়া ধন্য ক’রেছিলে এই ভীরুর জন্মভূমি। হে মহা-মৌনী, মরণেও তুমি মৌন মাধুরী পি’য়া নিয়েছ বিদায়, যাওনি মোদের ছল-করা গীতি নিয়া! তোমার প্রয়াণে উঠিল না কবি দেশে কল-কল্লোল, সুন্দর! শুধু জুড়িয়া বসিলে মাতা সারদার কাল। স্বর্গে বাদল মাদল বাজিল, বিজলী উঠিল মাতি’, দেব-কুমারীরা হানিল বৃষ্টি-প্রসূন সারাটি রাতি। কেহ নাহি জাগি’, অর্গল-দেওয়া সকল কুটীর-দ্বারে পুত্রহারার ক্রন্দন শুধু খুঁজিয়া ফিরিছে কারে! নিশীথ-শ্মশানে অভাগিনী এক শ্বেত-বাস পরিহিতা, ভাবিছে তাহারি সিঁদুর মুছিয়া কে জ্বালালো ঐ চিতা! ভগবান! তুমি চাহিতে পার কি ঐ দু’টি নারীস পানে? জানি না, তোমায় বাঁচাবে কে যদি ওরা অভিশাপ হানে!
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
চল্ চল্ চল্ ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণী-তল অরুণ প্রাতের তরুণ দল চল্ রে চল্ রে চল্ চল্ চল্ চল্।। ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত আমরা টুটিব তিমির রাত বাঁধার বিন্ধ্যা চল।। নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহাশশ্মান আমরা দানিব নতুন প্রাণ বাহুতে নবীন বল।। চলরে নওজোয়ান শোনরে পাতিয়া কান- মৃত্যু-তোরণ-দুয়ারে-দুয়ারে জীবনের আহ্বান ভাঙ্গরে ভাঙ্গ আগল চল্ রে চল্ রে চল্ চল্ চল্ চল্।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
আজ   নলিন-নয়ান মলিন কেন বলো সখী বলো বলো! পড়ল মনে কোন্ পথিকের বিদায়-চাওয়া ছলছল? বলো সখী বলো বলো!!      মেঘের পানে চেয়ে চেয়ে বুক ভিজালে চোখের জলে, ওই সুদূরের পথ বেয়ে কি চেনা-পথিক গেছে চলে ফিরে আবার আসব বলে গো? স্বর শুনে কার চমকে ওঠ (আহা), ওগো ওযে বিহগ-বেহাগ, নির্ঝরিণীর কলকল। ও নয় গো তার পায়ের ভাষা (আহা) শীতের শেষের শুকনো পাতার ঝরে পড়ার বিদায়-ধ্বনি ও; কোন্ কালোরে কোন্ ভালোরে বাসলে ভালো (আহা) পরদেশি কোন্ শ্যামল বঁধুর শুনচ বাঁশি সারাক্ষণই গো? চুমচো কারে? ও নয় তোমার পথিক-বধুঁর চপল হাসি হা-হা, তরুণ ঝাউয়ের কচি পাতায় করুণ অরুণ কিরণ ও যে (আ-হা)! দূরের পথিক ফিরে নাকো আর (আহা আ-হা) ও সে সবুজ দেশের অবুঝ পাখি কখন এসে যাচবে বাঁধন, চলো সখী ঘরকে চলো! ও কী? চোখে নামল কেন মেঘের ছায়া ঢল ঢল॥(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
কর্থ্যভাষা কইতে নারি শুর্দ্ধ কথা ভিন্ন। নেড়ায় আমি নিম্ন বলি (কারণ) ছেঁড়ায় বলি ছিন্ন॥ গোঁসাইকে কই গোস্বামী, তাই মশাইকে মোর্স্বামী। বানকে বলি বন্যা, আর কানকে কন্যা কই আমি॥ চাষায় আমি চশ্‌শ বলি, আশায় বলি অশ্ব। কোটকে বলি কোষ্ঠ, আর নাসায় বলি নস্য॥ শশারে কই শিষ্য আমি, ভাষারে কই ভীষ্ম। পিসিরে কই পিষ্টক আর মাসিরে মাহিষ্য॥ পুকুরকে কই প্রুষ্করিণী, কুকুরকে কই ক্রুক্কু। বদনকে কই বদনা, আর গাড়ুকে গুড়ুক্কু॥ চাঁড়ালকে কই চণ্ডাল, তাই আড়ালকে অণ্ডাল। শালারে কই শলাকা, আর কালায় বলি কঙ্কাল॥ শ্বশুরকে কই শ্মশ্রু, আর দাদাকে কই দদ্রু। বামারে কই বম্বু, আর কাদারে কই কদ্রু॥ আরও অনেক বাত্রা জানি, বুঝলে ভায়া মিন্টু। ভেবেছ সব শিখে নেবে, বলছিনে আর কিন্তু॥   (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
বন্ধু গো সাকি আনিয়াছ নাকি বরষের সওগাত – দীর্ঘ দিনের বিরহের পরে প্রিয়-মিলনের রাত। রঙিন রাখি, শিরীন শারাব, মুরলী, রবাব, বীণ, গুলিস্তানের বুলবুল পাখি, সোনালি রুপালি দিন। লালা-ফুল সম দাগ-খাওয়া দিল, নার্গিস-ফুলি আঁখ, ইস্পাহানির হেনা-মাখা হাত, পাতলি কাঁখ! নৈশাপুরের গুলবদনির চিবুক গালের টোল, রাঙা লেড়কির ভাঙা ভাঙা হাসি, শিরীন শিরীন বোল। সুরমা-কাজল স্তাম্বুলি চোখ, বসোরা গুলের লালি, নব বোগাদাদি আলিফ-লায়লা, শাজাদি জুলফ-ওয়ালি। পাকা খর্জুর, ডাঁশা আঙ্গুর, টোকো-মিঠে কিসমিস, মরু-মঞ্জীর আব-জমজম,যবের ফিরোজা শিস। আশা-ভরা মুখ,তাজা তাজা বুক, নৌ-জোয়ানির গান, দুঃসাহসীর মরণ-সাধনা, জেহাদের অভিযান। আরবের প্রাণ, ফারেসের বাজু নৌ-তুর্কির, দারাজ দিলীর আফগানি দিল, মূরের জখমি শির। নীল দরিয়ায় মেসেরের আঁসু, ইরাকের টুটা তখ্‌ত, বন্দী শামের জিন্দান-খানা, হিন্দের বদবখ্‌ত! – তাঞ্জাম-ভরা আঞ্জাম এ যে কিছুই রাখনি বাকি, পুরানো দিনের হাতে বাঁধিয়াছ নতুন দিনের রাখি।… চোখের পানির ঝালর-ঝুলানো হাসির খাঞ্চাপোশ – যেন অশ্রুর গড়খাই-ঘেরা দিল্‌খোস ফেরদৌস – ঢাকিয়ো বন্ধু তব সওগাতি-রেকাবি তাহাই দিয়ে, দিবসের জ্বালা ভুলে যেতে চাই রাতের শিশির পিয়ে ! বেদনার বানে সয়লাব সব, পাইনে সাথির হাত, আনো গো বন্ধু নূহের কিশতি– ‘বার্ষিকী সওগাত!’[কৃষ্ণনগর ২৫ অগ্রহায়ণ,১৩৩৩] (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা। রুধির-নদীর পার হতে ওই ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা! বন্ধু গো, সখা, আজি এই নব জয়-যাত্রার আগে দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে বন্ধু তোমার ; দাও দাদা দাও তব রূপ-মসি ছানি অঞ্জলি ভরি শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি! তোমার নীচতা, ভীরুতা তোমার, তোমার মনের কালি উদ্‌গারো সখা বন্ধুর শিরে ; তব বুক হোক খালি! সুদূর বন্ধু, দূষিত দৃষ্টি দূর করো, চাহো ফিরে, শয়তানে আজ পেয়েছে তোমায়, সে যে পাঁক ঢালে শিরে! চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ ঘৃণা-ঢেলা, যে ভোগানন্দ দাসেদেরে গালি হানিয়াছ দুই বেলা, আজি তাহাদেরই বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি! বাঁদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালোবাসিয়াছ বাঁদরামি! হে অস্ত্রগুরু! আজি মম বুকে বাজে শুধু এই ব্যথা, পাণ্ডবে দিয়া জয়কেতু, হলে কুক্কুর-কুরু-নেতা! ভোগ-নরকের নারকীয় দ্বারে হইয়াছ তুমি দ্বারী, হারামানন্দে হেরেমে ঢুকেছ হায় হে ব্রহ্মচারী! তোমার কৃষ্ণ রূপ-সরসীতে ফুটেছে কমল কত, সে কমল ঘিরি নেচেছে মরাল কত সহস্র শত, – কোথা সে দিঘির উচ্ছল জল, কোথা সে কমল রাঙা, হেরি শুধু কাদা, শুকায়েছে জল, সরসীর বাঁধ ভাঙা! সেই কাদা মাখি চোখে মুখে তুমি সাজিয়াছ ছি ছি সং, বাঁদর-নাচের ভালুক হয়েছ, হেসে মরি দেখে ঢং। অন্ধকারের বিবর ছাড়িয়া বাহিরিয়া এসো দাদা, হেরো আরশিতে – বাঁদরের বেদে করেছে তোমায় খ্যাঁদা! মিত্র সাজিয়া শত্রু তোমারে ফেলেছে নরকে টানি, ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানি! যাহারা তোমারে বাসিয়াছে ভালো, করিয়াছে পূজা নিতি, তাহাদের হানে অতি লজ্জার ব্যথা আজ তব স্মৃতি। নপুংসক ওই শিখণ্ডী আজ রথের সারথি তব, – হানো বীর তব বিদ্রুপ-বাণ, সব বুক পেতে লব ভীষ্মের সম ; যদি তাহে শর-শয়নের বর লভি, তুমি যত বল আমিই সে-রণে জিতিব অস্ত্র-কবি! তুমি জান, তুমি সম্মুখ রণে পারিবে না পরাজিতে, আমি তব কাল যশোরাহু সদা শঙ্কা তোমার চিতে, রক্ত-অসির কৃষ্ণ মসির যে কোনো যুদ্ধে, ভাই, তুমি নিজে জান তুমি অশক্ত, করিয়াছ শুরু তাই চোরা-বাণ ছোঁড়া বেল্লিকপনা বিনামা আড়ালে থাকি ন্যক্কার-আনা নপুংসকেরে রথ-সম্মুখে রাখি। হেরো সখা আজ চারিদিক হতে ধিক্কার অবিরত ছি ছি বিষ ঢালি জ্বালায় তোমার পুরানো প্রদাহ-ক্ষত! আমারে যে সবে বাসিয়াছে ভালো, মোর অপরাধ নহে! কালীয়-দমন উদিয়াছে মোর বেদনার কালীদহে – তাহার দাহ তা তোমারে দহেনি, দহেছে যাদের মুখ তাহারা নাচুক জ্বলুনির চোটে। তুমি পাও কোন সুখ? দগ্ধ-মুখ সে রাম-সেনাদলে নাচিয়া হে সেনাপতি! শিব সুন্দর সত্য তোমার লভিল একী এ গতি? যদিই অসতী হয় বাণী মোর, কালের পরশুরাম কঠোর কুঠারে নাশিবে তাহারে, তুমি কেন বদনাম কিনিছ বন্ধু, কেন এত তব হিয়া দগদগি জ্বালা? – হোলির রাজা কে সাজাল তোমারে পরায়ে বিনামা-মালা? তোমার গোপন দুর্বলতারে, ছি ছি করে মসিময় প্রকাশিলে, সখা, এইখানে তব অতি বড়ো পরাজয়। শতদল-দলে তুমি যে মরাল শ্বেত-সায়রের জলে। ওঠো সখা, বীর, ঈর্ষা-পঙ্ক-শয়ন ছাড়িয়া পুনঃ, নিন্দার নহ, নান্দীর তুমি, উঠিতেছে বাণী শুনো। ওঠো সখা, ওঠো, লহো গো সালাম, বেঁধে দাও হাতে রাখি, ওই হেরো শিরে চক্কর মারে বিপ্লব-বাজপাখি! অন্ধ হোয়ো না, বেত্র ছাড়িয়া নেত্র মেলিয়া চাহো – ঘনায় আকাশে অসন্তোষের নিদারুণ বারিবাহ। দোতালায় বসি উতাল হোয়ো না শুনি বিদ্রোহ-বাণী, এ নহে কৌরব, এ কাঁদন উঠে নিখিল-মর্ম ছানি। বিদ্রুপ করি উড়াইবে এই বিদ্রোহ-তেঁতো জ্বালা? সুরের তোমরা কী করিবে তবু হবে কান ঝালাপালা অসুরের ভীম অসি-ঝনঝনে, বড়ো অসোয়াস্তি-কর! বন্ধু গো, এত ভয় কেন? আছে তোমার আকাশ-ঘর! অর্গল এঁটে সেথা হতে তুমি দাও অনর্গল গালি, গোপীনাথ মলো? সত্য কি? মাঝে মাঝে দেখো তুলি জালি বারীন* ঘোষের দ্বীপান্তর আর মির্জাপুরের বোমা, লাল বাংলার হুমকানি,– ছি ছি, এত অসত্য ও মা, কেমন করে যে রটায় এ সব ঝুটা বিদ্রোহী দল! সখী গো, আমায় ধরো ধরো! মাগো, কত জানে এরা ছল! সই লো, আমার কাতুকুতু ভাব হয়েছে যে, ঢলে পড়ি আঁচলে জড়ায়ে পা চলে না গো, হাত হতে পড়ে ছড়ি! শ্রমিকের গাঁতি, বিপ্লব-বোমা, আ মলো তোমরা মরো! যত সব বাজে বাজখাঁই সুর, মেছুনি-বৃত্তি ধরো! যারা করে বাজে সুখভোগ ত্যাগ, আর রাজরোষে মরে, ওই বোকাদের ইতর ভাষায় গালি দাও খুব করে। এই ইতরামি, বাঁদরামি-আর্ট আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে হন্যে কুকুর পেট পালো আর হাউ হাউ মরো কেঁদে? এই নোংরামি করে দিনরাত বল আর্টের জয়! আর্ট মানে শুধু বাঁদরামি আর মুখ ভ্যাংচানো কয়! আপনার নাক কেটে দাদা এই পরের যাত্রা ভাঙা ইহাই হইল আদর্শ আর্ট, নাকি-সুর, কান রাঙা! আর্ট ও প্রেমের এই সব মেড়ো মাড়োয়ারি দলই জানে, কোনো বিদ্রোহ অসন্তোষের রেখা নাই কোনোখানে! সব ভুয়ো দাদা, ও-সবে দেশের কিছুই হইবে নাকো, এমনই করিয়া জুতো খাও আর মলমল-মল মাখো! –জ্ঞান-অঞ্জন-শলাকা তৈরি হতেছে এদের তরে, দেখিবে এদের আর্টের আঁটুনি একদিনে গেছে ছড়ে! বন্ধু গো! সখা! আঁখি খোলো, খোলো শ্রবণ হইতে তুলা, ওই হেরো পথে গুর্খা-সেপাই উড়াইয়া যায় ধুলা! ওই শোনো আজ ঘরে ঘরে কত উঠিতেছে হাহাকার, ভূধর প্রমাণ উদরে তোমার এবার পড়িবে মার! তোমার আর্টের বাঁশরির সুরে মুগ্ধ হবে না এরা, প্রয়োজন-বাঁশে তোমার আর্টের আটশালা হবে ন্যাড়া! প্রেমও আছে সখা, যুদ্ধও আছে, বিশ্ব এমনই ঠাঁই, ভালো নাহি লাগে, ভালো ছেলে হয়ে ছেড়ে যাও, মানা নাই! আমি বলি সখা, জেনে রেখো মনে কোনো বাতায়ন-ফাঁকে সজিনার ঠ্যাঙা সজনিরই মতো হাতছানি দিয়ে ডাকে। যত বিদ্রুপই করো সখা, তুমি জান এ সত্য-বাণী, কারুর পা চেটে মরিব না; কোনো প্রভু পেটে লাথি হানি ফাটাবে না পিলে, মরিব যেদিন মরিব বীরের মতো, ধরা-মা-র বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাশ্বত! আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস! ততদিন সখা সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!   (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি, মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি! আমি এ-পার, তুমি ও-পার, মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্‌ছানি, আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁওয়াখানি। নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয়! আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়! এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে, আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়, কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয়! চেনার বন্ধু,  পেলাম না ক’ জানার অবসর। গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর। গান ফুরালো যাব যবে, গানের কথাই মনে রবে, পাখী তখন থাকবো না ক’-থাকবে পাখীর স্বর! উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর! তোমার পারে বাজ্‌ল কখন আমার পারের ঢেউ, অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ। উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে একটি পালক প’ড়লে পথে ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও! ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও! বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি ঝুরবে তুমি এক্‌লা মনে, বনের কেতকী? মনের মনে নিশীথ্‌-রাতে চুম্‌ দেবে কি কল্পনাতে? স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি! মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী! দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল! কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল! তোমায় পেলে থাম্‌ত বাঁশী, আস্‌ত মরণ সর্বনাশী। পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল। বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল। বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও, দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও। থাকবে তুমি ছায়ার সাথে মায়ার মত চাঁদনী রাতে! যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও! শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও! ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর! তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর। কোথায় আছ কেম্‌নে রাণি কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি! ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর! চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর! রাত্রে যখন এক্‌লা শোব-চাইবে তোমার বুক, নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ, দুখের সুরায় মস্ত্‌ হ’য়ে থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে, কল্পনাতে আঁক্‌ব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ! ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ! গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান। থাম্‌বে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান! শিল্পী আমি, আমি কবি, তুমি আমার আঁকা ছবি, আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান। চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান। তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর, কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির। গোপন তুমি আস্‌লে নেমে কাব্যে আমার, আমার প্রেমে, এই-সে সুখে থাক্‌বে বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর? দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড়! বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান, মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান! যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে কর্‌বে মনে, সে-দিন প্রিয়ে ভোলার মাঝে উঠবে বেঁচে, সেই তো আমার প্রাণ! নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেয়ে গেলাম গান! চট্টগ্রাম ২৮/০৭/১৯২৬
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকৃতিমূলক
সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী? নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী!অল্কার পানে বলাকা ছুটিছে মেঘ-দূত- মন মোহিয়া চঞ্চুতে রাঙ্গা কলমীর কুঁড়ি- মরতের ভেট বহিয়া।সখীর গাঁইয়ের সেঁউতি- বোঁটার ফিরোজায় রেঙ্গে পেশোয়াজ আসমানী আর মৃন্ময়ী সখী মিশিয়াছে মেঠো পথ- মাঝ।আকাশ এনেছে কুয়াশা- উড়ুনী, আসমানী- নীল- সাঁচুলী, তারকার টিপ, বিজলীর হার, দ্বিতীয় - চাঁদের হাঁসুলী।ঝরা বৃষ্টির ঝরঝর আর পাপিয়া শ্যামার কূজনে বাজে নহবত আকাশ ভূবনে- সই পাতিয়েছে দু-জনে!আকাশের দাসী সমীরণ আনে শ্বেত পেঁজা- মেঘ ফেনা ফুল, হেথা জলে থলে কুমুদে আলুথালু ধরা বেয়াকুল। আকাশ০ গাঙ্গে কি বান ডেকেছে গো, গান গেয়ে চলে বরষা, বিজুরীর গুণ টেনে টেনে চলে মেঘ- কুমারীরা হরষা।হেথা মেঘ পানে কালো চোখ হানে মাটির কুমার মাঝিরা, জল ছুড়ে মারে মেঘ-বালা দল, বলে- 'চাহে দেখ পাজীরা!'কহিছে আকাশ, 'ওলো সই, তোর চকোরে পাঠাস নিশিথে, চাঁদ ছেনে দেবো জোছনা- অমৃত তোর ছেলে যত তৃষিতে। আমারে পাঠাস সোঁদা- সোঁদা- বাস তোর ও-মাটির সুরভি, প্রভাত ফুলের পরিমল মধু, সন্ধ্যাবেলার পুরবী!'হাসিয়া উঠিল আলোকে আকাশ, নত হ'ইয়ে এল পুলকে, লতা-পাতা-ফুলে বাঁধিয়া আকাশে ধরা কয়, 'সই, ভূলোকে বাঁধা প'লে আজ', চেপে ধরে বুকে লজ্জায় ওঠে কাঁপিয়া, চুমিল আকাশ নত হ'ইয়ে মুখে ধরণীরে বুকে ঝাঁপিয়া।
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে সে কি বাস করলে তাড়া, বলি থাম একটু দাঁড়া।পুকুরের ঐ কাছে না লিচুর এক গাছ আছে না হোথা না আস্তে গিয়ে য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে গাছে গো যেই চড়েছি ছোট এক ডাল ধরেছি,ও বাবা মড়াত করে পড়েছি সরাত জোরে। পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই, সে ছিল গাছের আড়েই। ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার, ধুমাধুম গোটা দুচ্চার দিলে খুব কিল ও ঘুষি একদম জোরসে ঠুসি।আমিও বাগিয়ে থাপড় দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড় লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল, দেখি এক ভিটরে শেয়াল! ও বাবা শেয়াল কোথা ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা দেখে যেই আঁতকে ওঠা কুকুরও জাড়লে ছোটা! আমি কই কম্ম কাবার কুকুরেই করবে সাবাড়!‘বাবা গো মা গো’ বলে পাঁচিলের ফোঁকল গলে ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে, যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!যাব ফের? কান মলি ভাই, চুরিতে আর যদি যাই! তবে মোর নামই মিছা! কুকুরের চামড়া খিঁচা সেকি ভাই যায় রে ভুলা- মালীর ঐ পিটুনিগুলা! কি বলিস? ফের হপ্তা! তৌবা-নাক খপ্তা!বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে সে কি বাস করলে তাড়া, বলি থাম একটু দাঁড়া।পুকুরের ঐ কাছে না লিচুর এক গাছ আছে না হোথা না আস্তে গিয়ে য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে গাছে গো যেই চড়েছি ছোট এক ডাল ধরেছি,ও বাবা মড়াত করে পড়েছি সরাত জোরে। পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই, সে ছিল গাছের আড়েই। ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার, ধুমাধুম গোটা দুচ্চার দিলে খুব কিল ও ঘুষি একদম জোরসে ঠুসি।আমিও বাগিয়ে থাপড় দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড় লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল, দেখি এক ভিটরে শেয়াল! ও বাবা শেয়াল কোথা ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা দেখে যেই আঁতকে ওঠা কুকুরও জাড়লে ছোটা! আমি কই কম্ম কাবার কুকুরেই করবে সাবাড়!‘বাবা গো মা গো’ বলে পাঁচিলের ফোঁকল গলে ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে, যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!যাব ফের? কান মলি ভাই, চুরিতে আর যদি যাই! তবে মোর নামই মিছা! কুকুরের চামড়া খিঁচা সেকি ভাই যায় রে ভুলা- মালীর ঐ পিটুনিগুলা! কি বলিস? ফের হপ্তা! তৌবা-নাক খপ্তা!বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে সে কি বাস করলে তাড়া, বলি থাম একটু দাঁড়া।পুকুরের ঐ কাছে না লিচুর এক গাছ আছে না হোথা না আস্তে গিয়ে য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে গাছে গো যেই চড়েছি ছোট এক ডাল ধরেছি,ও বাবা মড়াত করে পড়েছি সরাত জোরে। পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই, সে ছিল গাছের আড়েই। ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার, ধুমাধুম গোটা দুচ্চার দিলে খুব কিল ও ঘুষি একদম জোরসে ঠুসি।আমিও বাগিয়ে থাপড় দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড় লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল, দেখি এক ভিটরে শেয়াল! ও বাবা শেয়াল কোথা ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা দেখে যেই আঁতকে ওঠা কুকুরও জাড়লে ছোটা! আমি কই কম্ম কাবার কুকুরেই করবে সাবাড়!‘বাবা গো মা গো’ বলে পাঁচিলের ফোঁকল গলে ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে, যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!যাব ফের? কান মলি ভাই, চুরিতে আর যদি যাই! তবে মোর নামই মিছা! কুকুরের চামড়া খিঁচা সেকি ভাই যায় রে ভুলা- মালীর ঐ পিটুনিগুলা! কি বলিস? ফের হপ্তা! তৌবা-নাক খপ্তা!
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
জনম জনম গেলো, আশা পথ চাহি, মরু মুসাফির চলি, পার নাহি নাহি। বরষও পরে বরষ, আসে যায় ফিরে, পিপাসা মিটায়ে চলি, নয়নেরও তীরে, জ্বালিয়া আলেয়া শিখা, নিরাশার মরিচীকা, ডাকে মরু প্রাণনিকা, শত গীত গাহি। জনম জনম গেলো, আশা পথ চাহি। এ মরু ছিল গো কবে সাগরের বারি স্বপনে হেরি গো তারে আজো মরুচারী সেই সে সাগর তলে যে তরী ডুবিল জলে সে তরী-সাথীরে খুঁজি মরুপথ বাহি
কাজী নজরুল ইসলাম
স্বদেশমূলক
আসে নাই ফিরে ভারত-ভারতী মা’র কতদিন দ্বীপান্তর? পুণ্য বেদীর শূন্যে ধ্বনিল ক্রন্দন-‘দেড় শত বছর।’…. সপ্ত সিন্ধু তের নদী পার দ্বীপান্তরের আন্দামান, রূপের কমল রূপার কাঠির কঠিন স্পর্শে যেখানে ম্লান, শতদল যেথা শতধা ভিন্ন শস্ত্র-পাণির অস্ত্র-ঘাস, যস্ত্রী যেখানে সাস্ত্রী বসায়ে বীনার তন্ত্রী কাটিছে হায়, সেখানে হ’তে কি বেতার-সেতার এসেছে মুক্ত-বন্ধ সুরা? মুক্ত কি আজ বন্দিনী বাণী? ধ্বংস হ’ল কি বক্ষ-পুর? যক্ষপুরীর রৌপ্য-পঙ্কে ফুটিল কি তবে রূপ-কমল? কামান গোলার সীসা-স্তুপে কি উঠেছে বাণীর শিশ-মহল? শান্তি-শুচিতে শুভ্র হ’ল কি রক্ত সোঁদাল খুন-খারাব? তবে এ কিসের আর্ত আরতি, কিসের তরে এ শঙ্কারাব?… সাত সমুদ্র তের নদী পার দ্বীপান্তরের আন্দামান, বাণী যেথা ঘানি টানে নিশিদিন, বন্দী সত্য ভানিছে ধান, জীবন চুয়ানো সেই ঘানি হ’তে আরতির তেল এনেছ কি? হোমানল হ’তে বাণীর রক্ষী বীর ছেলেদের চর্বি ঘি? হায় শৌখিন পূজারী, বৃথাই দেবীর শঙ্খে দিতেছ ফুঁ, পুণ্য বেদীর শূন্য ভেদিয়া ক্রন্দন উঠিতেছে শুধু! পূজারী, কাহারে দাও অঞ্জলি? মুক্ত ভারতী ভারতে কই? আইন যেখানে ন্যায়ের শাসক, সত্য বলিলে বন্দী হই, অত্যাচারিত হইয়া যেখানে বলিতে পারি না অত্যাচার, যথা বন্দিনী সীতা সম বাণী সহিছে বিচার-চেড়ীর মার বাণীর মুক্ত শতদল যথা আখ্যা লভিল বিদ্রোহী, পূজারী, সেখানে এসেছ কি তুমি বাণী পূজা-উপচার বহি? সিংহেরে ভয়ে রাখে পিঞ্জরে, ব্যাঘ্রেরে হানে অগ্নি-শেল, কে জানিত কালে বীণা খাবে গুলি, বাণীর কমল খাটিবে জেল! তবে কি বিধির বেতার-মন্ত্র বেজেছে বাণীর সেতারে আজ, পদ্মে রেখেছে চরণ-পদ্ম যুগান্তরের ধর্মরাজ? তবে তাই হোক। ঢাক অঞ্জলি, বাজাও পাঞ্চজন্য শাঁখ! দ্বীপান্তরের ঘানিতে লেগেছে যুগান্তরের ঘুর্ণিপাক!
কাজী নজরুল ইসলাম
ছড়া
খালেদ! খালেদ! শুনিতেছে নাকি সাহারার আহা-জারি? কত ‘ওয়েসিস’ রচিল তাহার মরু-নয়নের বারি। মরীচিকা তার সন্ধানী-আলো দিকে দিকে ফেরে খুঁজি কোন নিরালায় ক্লান্ত সেনানী ডেরা গাড়িয়াছ বুঝি! বালু-বোররাকে সওয়ার হইয়া ডাক দিয়া ফেরে ‘লু’, তব তরে হায়! পথে রেখে যায় মৃগীরা মেশক-বু! খর্জুর-বীথি আজিও ওড়ায় তোমার জয়ধ্বজা, তোমার আশায় বেদুইন-বালা আজিও রাখিছে রোজা। ‘মোতাকারিব’-এর ছন্দে উটের সারি দুলে দুলে চলে, দু-চোখ তাদের দিশাহারা পথে আলেয়ার মতো জ্বলে। ‘খালেদ! খালেদ!’পথ-মঞ্জিলে ক্লান্ত উটেরা কহে, “বণিকের বোঝা বহা তো মোদের চিরকেলে পেশা নহে!” ‘সুতুর-বানের’ বাঁশি শুনে উট উল্লাস-ভরে নাচে, ভাবে, নকিবের বাঁশরির পিছে রণ-দামামাও আছে। ন্যুব্জ এ পিঠ খাড়া হত তার সওয়ারের নাড়া পেয়ে, তলওয়ার তির গোর্জ নেজায় পিঠ যেত তার ছেয়ে। খুন দেখিয়াছে, তূণ বহিয়াছে, নুন বহেনিকো কভু!* * *বালু ফেড়ে ওঠে রক্ত-সূর্য ফজরের শেষে দেখি, দুশমান-খুনে লাল হয়ে ওঠে খালেদি আমামা এ কী! খালেদ! খালেদ! ভাঙিবে নাকি ও হাজার বছরি ঘুম? মাজার ধরিয়া ফরিয়াদ করে বিশ্বের মজলুম!– শহিদ হয়েছ? ওফাত হয়েছে? ঝুটবাত! আলবত! খালেদের জান কব‍্‍জ করিবে ওই মালেকুল-মৌত? বছর গিয়াছে গেছে শতাব্দী যুগযুগান্ত কত, জালিম৯ পারসি রোমক রাজার জুলুম সে শত শত রাজ্য ও দেশ গেছে ছারেখারে! দুর্বল নরনারী কোটি কোটি প্রাণ দিয়াছে নিত্য কত‍্‍ল-গাহেতে তারই! উৎপীড়িতের লোনা আঁসু-জলে গলে গেল কত কাবা, কত উজ তাতে ডুবে মলো হায়, কত নূহ্ হল তাবা!সেদিন তোমার মালেকুল-মৌত কোথায় আছিল বসি? কেন সে তখন জালিম রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে পশি বেছে বেছে ওই ‘সঙ্গ্-দিল’দের কব‍্‍জ করেনি জান? মালেকুল-মৌত সেদিনও মেনেছে বাদশাহি ফরমান!– মক্কার হাতে চাঁদ এল যবে তকদিরে আফতাব কুল-মখলুক দেখিতে লাগিল শুধু ইসলামি খাব, শুকনো খবুজ খোর্মা চিবায়ে উমর দারাজ-দিল ভাবিছে কেমন খুলিবে আরব দিন-দুনিয়ার খিল, – এমন সময় আসিল জোয়ান হাথেলিতে হাথিয়ার, খর্জুর-শিষে ঠেকিয়াছে গিয়া উঁচা উষ্ণীয় তার! কব‍্‍জা তাহার সব‍্‍জা হয়েছে তলওয়ার-মুঠ ডলে, দু-চোখ ঝালিয়া আশায় দ‍জ‍্‍লা ফোরাত পড়িছে গলে! বাজুতে তাহার বাঁধা কোর-আন, বুকের দুর্মদ বেগ, আলবোরজের‍ চূড়া গুঁড়া-করা দস্তে দারুণ তেগ। নেজার৪ ফলক উল্কার সম উগ্রগতিতে ছোটে, তির খেয়ে তার আশমান-মুখে তারা-রূপে ফেনা ওঠে। দারাজ দস্ত যেদিকে বাড়ায় সেইদিক পড়ে ভেঙে, ভাস্কর-সম যেদিকে তাকায় সেইদিক ওঠে রেঙে! ওলিদের বেটা খালেদ সে বীর যাহার নামের ত্রাসে পারস্য-রাজ নীল হয়ে উঠে ঢলে পড়ে সাকি-পাশে! রোম-সম্রাট শারাবের জাম -হাতে থরথর কাঁপে, ইস্তাম্বুলি বাদশার যত নজ্জুম আয়ু মাপে! মজলুম যত মোনাজাত করে কেঁদে কয় “এয়্ খোদা, খালেদের বাজু-শমশের রেখো সহি-সালামতে সদা।” আজরাইলও সে পারেনি এগুতে যে আজাজিলের আগে, ঝুঁটি ধরে তার এনেছে খালেদ, ভেড়ি ধরে যেন বাঘে! মালেকুল-মৌত করিবে কব‍্‍জ রু্হ্ সেই খালেদের?– হাজার হাজার চামড়া বিছায়ে মাজারে ঘুমায় শের!খালেদ! খালেদ! ফজর হল যে, আজান দিতেছে কৌম, ওই শোনো শোনো –”আস‍্‍সালাতু খায়র মিনান্নৌম!” যত সে জালিম রাজা-বাদশারে মাটিতে করেছে গুম তাহাদেরই সেই খাকেতে খালেদ করিয়া তয়ম্মুখ বাহিরিয়া এসো, হে রণ-ইমাম, জামায়েত আজ ভারী! আরব, ইরান, তুর্ক, কাবুল দাঁড়ায়েছে সারি সারি! আব-জমজম উথলি উঠিছে তোমার ওজুর তরে, সারা ইসলাম বিনা ইমামেতে আজিকে নামাজ পড়ে! খালেদ! খালেদ! ফজরে এলে না, জোহরকাটানু কেঁদে, আসরে ক্লান্ত ঢুলিয়াছি শুধু বৃথা তহ‍্‍রিমা বেঁধে! এবে কাফনের খেলকা পরিয়া চলিয়াছি বেলা-শেষে, মগ‍্‍রেবের আজ নামাজ পড়িব আসিয়া তোমার দেশে! খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু, সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু! তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা, মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরই বিভীষিকা! হঠিতে হঠিতে আসিয়া পড়েছি আখেরি গোরস্থানে, মগ‍্‍রেব-বাদে এশার১ নামাজ পাব কিনা কে সে জানে! খালেদ! খালেদ! বিবস্ত্র মোরা পরেছি কাফন শেষে, হাথিয়ার-হারা, দাঁড়ায়েছি তাই তহ‍্‍রিমা বেঁধে এসে!ইমামতি তুমি করিবে না জানি, তুমি গাজি মহাবীর, দিন-দুনিয়ার শহিদ নোয়ায় তোমার কদমে শির! চারিটি জিনিস চিনেছিলে মতুমি, জানিতে না হের-ফের, আল্লা, রসুল, ইসলাম আর শের-মারা শমশের! খিলাফত তুমি চাওনিকো কভু চাহিলে – আমরা জানি, – তোমার হাতের বে-দেরেগ৩ তেগ অবহেলে দিত আনি!উমর যেদিন বিনা অজুহাতে পাঠাইল ফরমান, – “সিপাহ্-সালার খালেদ পাবে না পূর্বের সম্মান, আমার আদেশ – খালেদ ওলিদ সেনাপতি থাকিবে না, সাদের অধীনে করিবে যুদ্ধ হয়ে সাধারণ সেনা!” ঝরা জলপাই-পাতার মতন কাঁপিতে কাঁপিতে সাদ, দিল ফরমান, নফসি নফসি জপে, গণে পরমাদ! খালেদ! খালেদ! তাজিমের সাথে ফরমান পড়ে চুমি সিপাহ-সালারের সকল জেওরখুলিয়া ফেলিলে তুমি। শিশুর মতন সরল হাসিতে বদন উজালা করি একে একে সব রেখে দিলে তুমি সাদের চরণ পরি! বলিলে, “আমি তো সেনাপতি হতে আসিনি, ইবনে সাদ, সত্যের তরে হইব শহিদ, এই জীবনের সাধ! উমরের নয়, এ যে খলিফার ফরমান, ছি ছি আমি লঙ্ঘিয়া তাহা রোজ-কিয়ামতে হব যশ-বদনামি?” মার মুখো যত সেনাদলে ডেকে ইঙ্গিতে বুঝাইলে, কুর্নিশ করি সাদেরে, মামুলি সেনাবাসে ডেরা নিলে! সেনাদের চোখে আঁসু ধরে না কো, হেসে কেঁদে তারা বলে, – “খালেদ আছিল মাথায় মোদের, এবার আসিল কোলে!” মক্কায় যবে আসিলে ফিরিয়া, উমর কাঁদিয়া ছুটে, এ কী রে, খলিফা কাহার বক্ষে কাঁদিয়া পড়িল লুটে! “খালেদ! খালেদ!” ডাকে আর কাঁদে উমর পাগল-প্রায় বলে, “সত্যই মহাবীর তুই, বুসা দিই তোকে, আয়! তখ‍্‍তের পর তখ‍্‍ত যখন তোমার তেগের আগে ভাঙিতে লাগিল, হাতুড়ি যেমন বাদামের খোসা ভাঙে, – ভাবিলাম বুঝি তোমারে এবার মুগ্ধ আরব-বাসী সিজদা করিবে, বীরপূজা বুঝি আসিল সর্বনাশী! পরীক্ষা আমি করেছি খালেদ, ক্ষমা চাই ভাই ফের, আজ হতে তুমি সিপাহ-সালার ইসলাম জগতের!”খালেদ! খালেদ! কীর্তি তোমার ভুলি নাই মোরা কিছু, তুমি নাই তাই ইসলাম আজ হটিতেছে শুধু পিছু। পুরানো দামামা পিটিয়া পিটিয়া ছিঁড়িয়ে গিয়াছে আজ, আমামা অস্ত্র ছিল নাকো তবু দামামা ঢাকিত লাজ! দামামা তো আজ ফাঁসিয়া গিয়াছে, লজ্জা কোথায় রাখি, নামাজ রোজার আড়ালেতে তাই ভীরুতা মোদের ঢাকি! খালেদ! খালেদ! লুকাব না কিছু, সত্য বলিব আজি, ত্যাগী ও শহিদ হওয়া ছাড়া মোরা আর সব হতে রাজি! রীশ-ই বুলন্দ্, শেরওয়ানি, চোগা, তসবি ও টুপি ছাড়া পড়ে নাকো কিছু, মুসলিম-গাছ ধরে যত দাও নাড়া!* * *খালেদ! খালেদ! সবার অধম মোরা হিন্দুস্থানি, হিন্দু না মোরা মুসলিম তাহা নিজেরাই নাহি জানি! সকলে শেষে হামাগুড়ি দিই, –না, না, বসে বসে শুধু মুনাজাত৬করি, চোখের সুমুখে নিরাশা-সাহারা ধুধু! দাঁড়ায়ে নামাজ পড়িতে পারি না, কোমর গিয়াছে টুটি, সিজদা করিতে ‘বাবা গো’বলিয়া ধূলিতলে পড়ি লুটি! পিছন ফিরিয়া দেখি লাল-মুখ আজরাইলের ভাই, আল্লা ভুলিয়া বলি, “প্রভু মোর তুমি ছাড়া নাই।” টক্কর খেতে খেতে শেষে এই আসিয়া পড়েছি হেথা, খালেদ! খালেদ! রি রি করে বুকে পরাধীনতার ব্যথা! বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে! হানফী, ওহাবী, লা-মজহাবীর৯ তখনও মেটেনি গোল, এমন সময় আজাজিল এসে হাঁকিল, ‘তল্পি তোল!’ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি, বাহিরের দিকে তত গুনতিতে মোড়া বাড়িয়া চলেছি গোরু ছাগলের মতো! খালেদ! খালেদ! এই পশুদের চামড়া দিয়ে কি তবে তোমার পায়ের দুশমন-মারা দুটো পয়জারও হবে? হায় হায় হায়, কাঁদে সাহারায় আজিও তেমনই ও কে? দজলা-ফোরাত নতুন করিয়া মাতম করিছে শোকে! খর্জুর পেকে খোর্মা হইয়া শুকায়ে পড়েছে ঝুরে আঙুর বেদানা নতুন করিয়া বেদনার রসে পুরে। এক রাশ শুখো আখরোট আর বাদাম ছাড়াতে লয়ে আঙুল ছেঁচিয়া মুখ দিয়া চুষে মৌনা আরবি-বউয়ে! জগতের সেরা আরবের তেজি যুদ্ধ-তাজির চালে বেদুইন-কবি সংগীত রচি নাচিতেছে তালে তালে! তেমনই করিয়া কাবার মিনারে চড়িয়া মুয়াজ্জিন আজানের সুরে বলে, কোনোমতে আজও বেঁচে আছে দ্বীন! খালেদ! খালেদ! দেখো দেখো ওই জমাতের পিছে কারা দাঁড়ায়ে রয়েছে, নড়িতে পারে না, আহা রে সর্বহারা! সকলের পিছে নহে বটে তবু জমাত-শামিল নয়, উহাদের চোখে হিন্দের মতো নাই বটে নিদ‍্‍-ভয়! পিরানের সব দামন ছিন্ন, কিন্তু সে সম্মুখে পেরেশান৪ ওরা তবু দেখিতেছি ভাঙিয়া পড়েনি দুখে! তকদির বেয়ে খুন ঝরে ওই উহারা মেসেরি বুঝি। টলে তবু চলে বারে বারে হারে বারে বারে ওরা যুঝি। এক হাতে বাঁধা হেম-জিঞ্জির আর এক হাত খোলা কী যেন হারামি নেশার আবেশে চক্ষু ওদের ঘোলা!ও বুঝি ইরাকি? খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখো, ওঠো, শ্বেত-শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মুঠো! দুহাতে দুপায়ে আড়-বেড়ি দেওয়া ও কারা চলিতে নারে, চলিতে চাহিলে আপনার ভায়ে পিছন হইতে মারে। মরদের মতো চেহারা ওদের স্বাধীনের মতো বুলি, অলস দু-বাজু দু-চোখ সিয়াহ অবিশ্বাসের ঠুলি! শামবাসী৭ ওরা সহিতে শেখেনি পরাধীনতার চাপ, তলওয়ার নাই, বহিছে কটিতে কেবল শূন্যে খাপ! খালেদ! খালেদ! মিসমার হল তোমার ইরাক শাম, জর্ডন নদে ডুবিয়াছে পাক জেরুজালেমের নাম! খালেদ! খালেদ! দুধারি তোমার কোথা সেই তলোয়ার? তুমি ঘুমায়েছ, তলোয়ার তব সে তো নহে ঘুমাবার! জং ধরেনিকো কখনও তাহাতে জঙ্গের খুনে নেয়ে, হাথেলিতে তব নাচিয়া ফিরেছে যেন বেদুইন মেয়ে! খাপে বিরামের অবসর তার মেলেনি জীবনে কভু, জুলফিকার৩ সে দুখান হয়েছে, ও তেগ টুটেনি তবু। তুমি নাই তাই মরিয়া গিয়াছে তরবারিও কি তব? হাত গেছে বলে হাত-যশও গেল? গল্প এ অভিনব! খালেদ! খালেদ! জিন্দা হয়েছে আবার হিন্দা৪ বুড়ি, কত হামজারে মারে জাদুকরি, দেশে দেশে ফেরে উড়ি!ও কারা সহসা পর্বত ভেঙে তুহিন স্রোতের মতো, শত্রুর শিরে উন্মদবেগে পড়িতেছে অবিরত! আগুনের দাহে গলিছে তুহিন আবার জমিয়া উঠে, শির উহাদের ছুটে গেল হায়! তবু নাহি পড়ে টুটে! ওরা মরক্কো মরদের জাত মৃত্যু মুঠার পরে, শত্রুর হাতে শির দিয়া ওরা শুধু হাতে পায়ে লড়ে! খালেদ! খালেদ! সর্দার আর শির পায় যদি মূর খাসা জুতো তারা করিবে তৈরি খাল দিয়া শত্রুর!খালেদ! খালেদ! জাজিরাতুল সে আরবের পাক মাটি পলিদ হইল, খুলেছে এখানে যুরোপ পাপের ভাঁটি! মওতের দারু পিইলে ভাঙে না হাজার বছরি ঘুম? খালেদ! খালেদ! মাজার আঁকড়ি কাঁদিতেছে মজলুম।খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের, চাই না মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের।কৃষ্ণনগর, ২১ অগ্রহায়ণ, ’৩৩ (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
মদির স্বপনে মম মন ভবনে জাগো চঞ্চলা বাসন্তিকা, ওগো ক্ষনিকা ওগো ক্ষনিকা।।মোর গগনের ঊল্কার প্রায় চমকি ক্ষনেক চকিতে মিলায় তোমার হাসির যুঁই কনিকা ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা।।পুষ্পধনু তব মন রাঙ্গানো বঙ্কিম ভুরু হানো হানো তোমার উতল উত্তরীয় আমারো চোখে প্রিয় ছুঁইয়ে দিও যৌবনের দাও রাজ- টীকা ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা আমি হবো ওগো আমি হবো তোমার মালার মলিকা ওগো ক্ষনিকা, ওগো ক্ষনিকা
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়! বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়! কোরাস :   বল,      হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়। বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ পুরুষোত্তম জয়। তুই       নির্ভর কর আপনার পর, আপন পতাকা কাঁধে তুলে ধর! ওরে  যে যায় যাক সে, তুই শুধু বল, ‘আমার হয়নি লয়’! বল,      ‘আমি আছি’, আমি পুরুষোত্তম, আমি চির-দুর্জয়। বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ... তুই      চেয়ে দেখ ভাই আপনার মাঝে, সেথা জাগ্রত ভগবান রাজে, নিজ  বিধাতারে মান, আকাশ গলিয়া ক্ষরিবে রে বরাভয়! তোর  বিধাতার ধাতা বিধাতা, বিধাতা কারারুদ্ধ কি হয়? বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ... আজ      বক্ষের তোর ক্ষীরোদ-সাগরে অচেতন নারায়ণ ঘুম-ঘোরে শুধু   লক্ষ্মীর ভোগ লক্ষ্য তাঁহার, নয় কিছুতেই নয়! তোর  অচেতন চিতে জাগারে চেতনা নারায়ণ চিন্ময়। বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ... ওই      নির্যাতকের বন্দি-কারায় সত্য কি কভু শক্তি হারায়? ক্ষীণ  দুর্বল বলে খণ্ড ‘আমি’র হয় যদি পরাজয়, ওরে  অখণ্ড আমি চির-মুক্ত সে, অবিনাশী অক্ষয়! বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ... ওরে      সত্য যে চির-স্বয়ম্ প্রকাশ, রোধিবে কি তারে কারাগার-ফাঁস? ওই   অত্যাচারীর সত্য পীড়ন? আছে তার আছে ক্ষয়! সেই  সত্য মোদের ভাগ্য-বিধাতা, যাঁর হাতে শুধু রয়। বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ...      যে      গেল সে নিজেরে নিঃশেষ করি তাদের পাত্র দিয়া গেল ভরি! ওই   বন্ধু মৃত্যু পারেনিকো তাঁরে পারেনি করিতে লয়! তাই   আমাদের মাঝে নিজেরে বিলায়ে সে আজ শান্তিময়! বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ... ওরে      রুদ্র তখনই ক্ষুদ্রেরে গ্রাসে আগেই যবে সে মরে থাকে ত্রাসে, ওরে  আপনার মাঝে বিধাতা জাগিলে বিশ্বে সে নির্ভয়! ওই   শূদ্র-কারায় কভু কি ভয়াল ভৈরব বাঁধা রয়? বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ... ওই      টুটে-ফেটে-পড়া লোহার শিকল, ভগবানে বেঁধে করিবে বিকল? ওই   কারা ওই বেড়ি কভু কি বিপুল বিধাতার ভার সয়? ওরে  যে হয় বন্দি হতে দে, শক্তি আত্মার আছে জয়। বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। ... ওরে      আত্ম-অবিশ্বাসী, ভয়-ভীত! কেন হেন ঘন অবসাদচিত? বল   পর-বিশ্বাসে পর-মুখপানে চেয়ে কি স্বাধীন হয়? তুই   আত্মাকে চিন, বল ‘আমি আছি’, ‘সত্য আমার জয়’! বল,      নাহি ভয়, নাহি ভয়, বল,      মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। বল,      হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়! (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান! যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মারগিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ, পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ! কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ? করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান! যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মারগিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ, পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ! কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ? করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান! যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মারগিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ, পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ! কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ? করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!
কাজী নজরুল ইসলাম
শোকমূলক
পথের দেখা এ নহে গো বন্ধু এ নহে পথের আলাপন। এ নহে সহসা পথ-চলা শেষে শুধু হাতে হাতে পরশন।। নিমেষে নিমেষে নব পরিচয়ে হ’লে পরিচিত মোদের হৃদয়ে, আসনি বিজয়ী-এলে সখা হ’য়ে, হেসে হ’রে নিলে প্রাণ-মন।। রাজাসনে বসি’ হওনি ক’ রাজা, রাজা হ’লে বসি, হৃদয়ে, তাই আমাদের চেয়ে তুমি বেশী ব্যথা পেলে তব বিদায়ে। আমাদের শত ব্যথিত হৃদয়ে জাগিয়া রহিবে তুমি ব্যথা হ’য়ে, হ’লে পরিজন চির-পরিচয়ে- পুনঃ পাব তার দরশন, এ নহে পথের আলাপন।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
তোমারে পড়িছে মনে আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে, যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে কেতকী-বধূর অবগুন্ঠিত ও বুকে- তোমারে পড়িছে মনে। হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নে ঝিলিমিলি-তলে ম্লান   লুলিত অঞ্ছলে চাহিয়া বসিয়া আছ একা, বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা। বারে বারে নিভে যায় শিয়রেরে বাতি, তুমি জাগ, জাগে সাথে বরষার রাতি।                           সিক্ত-পক্ষ পাখী তোমার চাঁপার ডালে বসিয়া একাকী হয়ত তেমনি করি, ডাকিছ সাথীরে, তুমি চাহি' আছ শুধু দূর শৈল-শিরে ।। তোমার আঁখির ঘন নীলাঞ্জন ছায়া গগনে গগনে আজ ধরিয়াছে কায়া । ...আজি হেথা রচি' নব নীপ-মালা-- স্মরণ পারের প্রিয়া, একান্তে নিরালা অকারণে !-জানি আমি জানি তোমারে পাব না আমি। এই গান এই মালাখানি রহিবে তাদেরি কন্ঠে- যাহাদেরে কভু চাহি নাই, কুসুমে কাঁটার মত জড়ায়ে রহিল যারা তবু। বহে আজি দিশাহারা শ্রাবণের অশান্ত পবন, তারি মত ছুটে ফেরে দিকে দিকে উচাটন মন, খুঁজে যায় মোর গীত-সুর কোথা কোন্‌ বাতায়নে বসি' তুমি বিরহ-বিধুর। তোমার গগনে নেভে বারে বারে বিজলীর দীপ, আমার অঙ্গনে হেথা বিকশিয়া ঝরে যায় নীপ। তোমার গগনে ঝরে ধারা অবিরল, আমার নয়নে হেথা জল নাই, বুকে ব্যথা করে টলমল।আমার বেদনা আজি রূপ ধরি' শত গীত-সুরে নিখিল বিরহী-কন্ঠে--বিরহিণী--তব তরে ঝুরে! এ-পারে ও-পারে মোরা, নাই নাই কূল! তুমি দাও আঁখি-জল, আমি দেই ফুল!
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
সখি পাতিসনে শিলাতলে পদ্মপাতা, সখি দিসনে গোলাব-ছিটে খাস্‌ লো মাথা! যার অন্তরে ক্রন্দন করে হৃদি মন্থন তারে হরি-চন্দন কমলী মালা- সখি দিসনে লো দিসনে লো, বড় সে জ্বালা! বল কেমনে নিবাই সখি বুকের আগুন! এল খুন-মাখা তৃণ নিয়ে খু’নেরা ফাগুন! সে যেন হানে হুল্‌-খুনসুড়ি, ফেটে পড়ে ফুলকুঁড়ি আইবুড়ো আইবুড়ো বুকে ধরে ঘুণ! যত বিরহিণী নিম্‌-খুন-কাটা ঘায়ে নুন! আজ লাল-পানি পিয়ে দেখি সব-কিছু  চুর! সবে আতর বিলায় বায়ু বাতাবি নেবুর! হ’ল মাদার আশোক ঘা’ল, রঙন তো নাজেহাল! লালে লাল ডালে-ডাল পলাশ শিমুল! সখি তাহাদের মধু ক্ষরে-মোরে বেঁধে হুল্‌! নব সহকার-মঞ্জরী সহ ভ্রমরী! চুমে ভোমরা নিপট, হিয়া মরে গুমরি’। কত ঘাটে ঘাটে সই-সই ঘট ভরে নিতি ওই, চোখে মুখে ফোটে খই,- আব-রাঙা গাল, যত আধ-ভাঙা ইঙ্গিত তত হয় লাল! আর সইতে পারিনে সই ফুল-ঝামেলা! প্রাতে মল্লী চাঁপা, সাঁজে বেলা চামেলা! হের ফুটবো মাধী হুরী ডগমগ তরুপুরী, পথে পথে ফুলঝুরি সজিনা ফুলে! এত ফুল দেখে কুলবালা কূল না ভুলে! সাজি’ বাটা-ভরা ছাঁচিপান ব্যজনী-হাতে করে স্বজনে বীজন কত সজনী ছাতে! সেথা চোখে চোখে সঙ্কেত কানে কথা-যাও ধেৎ,- ঢ’লে-পড়া অঙ্কেতে মন্‌মথ-ঘায়! আজ আমি ছাড়া আর সবে মন-মত পায়। সখি মিষ্টি ও ঝাল মেশা এল এ কি বায়! এ যে বুক যত জ্বালা করে মুখ তত চায়! এযে শরাবের মতো নেশা এ পোড়া মলয় মেশা, ডাকে তাহে কুলনাশা কালামুখো পিক। যেন কাবাব করিতে বেঁধে কলিজাতে শিক্‌! এল আলো-রাধা ফাগ ভরি’ চাঁদের থালায় ঝরে জোছনা-আবীর সারা শ্যাম সুষমায়! যত ডাল-পালা নিম্‌খুন, ফুলে ফুলে কুঙ্কুম্‌, চুড়ি বালা রুম্‌ঝুম, হোরির খেলা, শুধু নিরালায় কেঁদে মরি আমি একেলা! আজ সঙ্কেত-শঙ্কিত বন-বীথিকায় কত কুলবধূ ছিঁড়ে শাড়ি কুলের কাঁটায়! সখি ভরা মোর এ দু’কুল কাঁটাহীন শুধু ফুল! ফুলে এত বেঁধে হুল? ভালো ছিল হায়, সখি ছিঁড়িত দু’কূল যদি কুলের কাঁটায়! হুগলী, ফাল্গুন ১৩৩২
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
যদিও মদ নিষিদ্ধ ভাই, যত পার মদ চালাও, তিনটি কথা স্মরণ রেখে; কাহার সাথে মদ্য খাও? মদ- পানের কি যোগ্য তুমি? কি মদই বা করেছ পান?- জ্ঞান পেকে না ঝুনো হলে মদ খেয়ো না এক ফোঁটাও।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
কেমনে রাখি আঁখিবারি চাপিয়া প্রাতে কোকিল কাঁদে, নিশীথে পাপিয়া।এ ভরা ভাদরে আমারি মরা নদী উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি আমার এ ভাঙ্গা ঘাটে আমার এ হূদি তটে চাপিতে গেলে ওঠে দুকুল ছাপিয়া।নিষেধ নাহি মানে আমার এ পোড়া আঁখি জল লুকাব কত কাজল মাখি মাখি ছলনা করে হাসি অমনি জলে ভাসি ছলিতে গিয়া আসি ভয়েতে কাঁপিয়া।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
১। ‘স্বাগতা’ – ১৬ মাত্রা (তা – না তা – নাবাবা – তা – নানা – তা – তা -) স্বাগতা কনক-চম্পক-বর্ণা       ছন্দিতা চপল নৃত্যের ঝরনা। মঞ্জুলা বিধুর যৌবন-কুঞ্জে       যেন ও চরণ-নূপুর গুঞ্জে, মন্দিরা মুরলি-শোভিত হাতে     এসো গো বিরহ-নীরস-রাতে হে প্রিয়া কবির প্রাণ অপর্ণা॥ ২। ‘প্রিয়া’ – ৭ মাত্রা (নাবা তা – না তা -) ‘মহুয়া’-বনে বন-পাপিয়া       এখনও ঝুরে নিশি জাগিয়া। ফিরিয়া কবে প্রিয় আসিবে       ধরিয়া বুকে কহিবে প্রিয়া॥ শুনি, নীরবে গগনে বসি         কহ যে-কথা বিরহী শশী, তব রোদনে বঁধু এ মনে         যমুনা বহে কূল-প্লাবিয়া॥ ৩। ‘মধুমতী’ - ৮ মাত্রা (নাবাবাবা নানা তা – দু-বার) বনকুসুম-তনু তুমি কি মধুমতী। ঢলঢল নয়নে রস-ঘন মিনতি। রুমুঝুমু ঘুমুরে ঘুমুঘুমু বিবশা, নিথর বসুমতী, নিশিমদ-অলসা, মুরছিত চরণে শত মদন রতি॥ রস-ছলছল গো তব মধু-কলসে ঝরঝর ঝরনা অনুখন বরষে, – অরুণিত-নয়না মধুর রসবতী॥ ৪। ‘মত্তময়ূর’ – ২২ মাত্রা মত্তময়ুরছন্দে নাচে কৃষ্ণ প্রেমানন্দে। রুম ঝুম ঝুম মঞ্জীর বাজে কঙ্কণ মণিবন্ধে॥ রিমঝিম রিমঝিম ঝিম কেকা-বর্ণ ঘন বরষে, তৃষ্ণা-তৃপ্ত আত্মা নাচে নন্দনলোকে হরষে, ঝঞ্ঝার ঝাঁঝরতাল বাজে শূন্যে মেঘ-মন্দ্রে॥ পল্লব-ঘন-চক্ষে ঝরে অশ্রু-রসধারা পুব-হাওয়াতে বংশী ডাকে আয় রে পথহারা। বন্দে দামিনী-বর্ণা রাধা বৃন্দাবন-চন্দে॥৫। ‘রুচিরা’ – ১৮ মাত্রা ভ্রমর নূপুর-পরিহিতা          কৃষ্ণ-কুন্তলা। বলয়-কাঁকন-ঝনকিতা         ছন্দ-চঞ্চলা॥ মলয়-সমীর ঝিরিঝিরি         অঙ্গে গুঞ্জরে। কদম কেশর ঝুরুঝুরু          চম্পা মুঞ্জরে। চটুলনয়ন চমকিতা           জ্যোৎস্না-অঞ্চলা॥ বিধুর কোকিল-কুহরিত        আম্রকুঞ্জে গো, রূপের পরাগ ঝরে তব        পুঞ্জে পুঞ্জে গো। নিখিল-ভুবন তব রাস         নৃত্য হিন্দোলা॥ ৬। ‘দীপক-মালা’ – ১৬ মাত্রা (তা – নানা – তা – তা, তা না তা নাতা) দীপক-মালা গাঁথো গাঁথো গাঁথো সই। আনত আঁখি তোলো তোলো গো! বেদন-জ্বালা ভোলো ভোলো গো! মান-ভুলানো এল রাত সই॥ কাজল আঁকো নীল আঁখিতে, চেয়ো না লাজে আঁখি ঢাকিতে, আসন প্রাণে পাতো পাতো সই॥ ৭। ‘মন্দাকিনী’ – ১৬ মাত্রা (নানা নানা নানা তা না তা তা নাতা) জল-ছলছল এসো মন্দাকিনী। রস-ঢলঢল বারি-সঞ্চারিণী॥ হৃদয়-গগন আজি তৃষ্ণাভরে উতল হইল প্রেম-গঙ্গা তরে, মুদিত নয়ন খোলো বৈরাগিনী॥ বিরস ভুবন রাখো সঞ্জীবিতা, সজল সলিল আনো হিল্লোলিতা, ঝর ঝর স্রোত-উন্মাদিনী॥৮। ‘মঞ্জুভাষিণী’ – ১৮ মাত্রা (নানা তা – নাতা নানানা তানা তানাতা) আজও ফাল্গুনে বকুল কিংশুকের বনে, কহে কোন কথা নিশীথ স্বপনে আনমনে॥ মৃদুমর্মরে পথের পল্লবের সাথে গাহের কোন গীতি নিশীথে পানসে জ্যোৎস্নাতে, খোঁজে কার স্মৃতি নীরস শুভ্র চন্দনে॥ গ্রহচন্দ্রে কয় – সে কি গো মৃত্যু-দ্বার খুলে হয়ে সৃষ্টিপার গিয়াছে অমৃতের কূলে, কাঁদে কোন শোকে পরম সুন্দরের সনে॥  ৯। ‘মণিমালা’ – ২০ মাত্রা মঞ্জু মধু-ছন্দা             নিত্যা, তব সঙ্গী সিন্ধুর তরঙ্গ             নৃত্যের কুরঙ্গী॥ গুঞ্জা বেলা পদ্ম            পুঞ্জীভূত বক্ষে, অশ্রু-লাজ কুন্ঠা            শঙ্কা-ঘন চক্ষে, অঙ্গে শ্যামকান্তা           মন্দাকিনী-ভঙ্গি॥ অঙ্গুলিতে বন্দী            অঙ্কুরিত ছন্দ, কণ্ঠে সুর-লক্ষ্মী            বৃন্দাবনানন্দ, গঙ্গা এলে বক্ষে           সন্ধ্যারাগে রঙ্গি॥ ১০। ‘ছন্দবৃষ্টিপ্রপাত’ – ৪৮ মাত্রা তারকা-নূপুরে নীল নভে ছন্দ শোন ছন্দিতার সৃষ্টিময় বৃষ্টি হয় নৃত্য সেই নন্দিতা সাগরে নদীতে ঢেউ তোলে সেই দেবীর মুক্তকেশ, সংগীতের হিন্দোলে তাঁর আঁখির প্রেম আবেশ, পবনে পবনে হিল্লোলে নীল আঁচল চঞ্চলার ছন্দোময় আনন্দময় চরণশ্রী বন্দি তাঁর॥ ১১। সৌরাষ্ট্র ভৈরব – তেতালা (বাদী মধ্যম) মদালস ময়ুর-বীণা কার বাজে অরুণ-বিভাসিত অম্বর-মাঝে॥ কোন মহা-মৌনীর ধ্যান হল ভঙ্গ? নেচে ফেরে অশান্ত মায়া-কুরঙ্গ তপোবনে রঙ্গে অনঙ্গ বিরাজে॥ নিদ্রিত রুদ্রের ললাট-বহ্নি পাশে তার হেসে ফেরে বনবালা-তন্বী। বিজড়িত জটাজুটে খেলে শিশু শশী দেয় মালা চন্দন ভীরু উর্বশী শংকর সাজিল রে নটরাজ সাজে॥  (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী। ওরে ও তরুণ ঈশান, বাজা তোর প্রলয় বিষাণ ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।গাজনের বাজনা বাজা, কে মালিক, কে সে রাজা, কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে? হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি, সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!ওরে ও পাগলা ভোলা, দে রে দে প্রলয় দোলা, গারদগুলা জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে মার হাঁক হায়দারী হাঁক, কাধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক ওরে ডাক, মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে।নাচে ওই কালবোশাখী, কাটাবী কাল বসে কি দেরে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি লাথি মার ভাঙ্গরে তালা, যত সব বন্দী শালায়-আগুন-জ্বালা, আগুন-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।
কাজী নজরুল ইসলাম
মানবতাবাদী
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।- অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।- অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।- অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
কাজী নজরুল ইসলাম
রূপক
বন্ধু আমার! থেকে থেকে কোন্‌ সুদূরের বিজন পুরে ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে? আমার অনেক দুখের পথের বাসা বারে বারে ঝড়ে উড়ে, ঘর-ছাড়া তাই বেড়াই ঘুরে।। তোমার বাঁশীর উদাস কাদন শিথিল করে সকল বাঁধন কাজ হ’ল তাই পথিক সাধন, খুঁজে ফেরা পথ-বঁধরে, ঘুরে’ ঘুরে’ দূরে দূরে।। হে মোর প্রিয়! তোমার বুকে একটুকুতেই হিংসা জাগে, তাই তো পথে হয় না থামা-তোমার ব্যথা বক্ষে লাগে! বাঁধতে বাসা পথের পাশে তোমার চোখে কান্না আসে উত্তরী বায় ভেজা ঘাসে শ্বাস ওঠে আর নয়ন বুঝে, বন্ধু, তোমার সুরে সুরে।।
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রেমমূলক
তোরা   কোথা হতে কেমনে এসে মণি-মালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি। আমার   পথিক-জীবন এমন করে ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।আমায়   বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে তারা   হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে, তোরা   কেমন করে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে ওই    কচি বাহুর রেশমি ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে! তোরা   চলতে গেলে পায়ে জড়াস, ‘না’ ‘না’ বলে ঘাড়টি নড়াস, কেন   ঘর-ছাড়াকে এমন করে ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি।  ওরে   চোখে তোদের জল আসে না– চমকে ওঠে আকাশ তোদের চোখের মুখের চপল হাসিতে। ওই    হাসিই তো মোর ফাঁসি হল, ওকে   ছিঁড়তে গেলে বুকে লাগে, কাতর কাঁদন ছাপা যে ও হাসির রাশিতে! আমি   চাইলে বিদায় বলিস, ‘উঁহু, ছাড়ব নাকো মোরা’ ওই   একটু মুখের ছোট্ট মানাই এড়িয়ে যেতে নারি, কত    দেশ-বিদেশের কান্নাহাসির বাঁধনছেঁড়ার দাগ যে বুকে পোরা, তোরা    বসলি রে সেই বুক জুড়ে আজ, চিরজয়ীর রথটি নিলি কাড়ি। ওরে    দরদিরা! তোদের দরদ শীতের বুকে আনলে শরৎ, তোরা    ঈষৎ-ছোঁয়ায় পাথরকে আজ কাতর করে অশ্রুভরা ব্যথায় ভরালি।  (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
আমার যা কিছু, আজ শেষ হয়ে এল অন্ধের থেকে জোৎস্নাকে ধার করি কোথায় কে যেন উঁচু করে টিপ পরে! মাথা নিচু করে সময় পেরোয় ঘড়িআকাশে আবার পুজোর বৃষ্টি আসে প্যান্ডেলে আসে রাত জাগবার চোখ ফুটপাথে হাঁটে তোমার প্রেমিক যত তাঁদের দু হাতে আজ কাশফুল হোকপৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি তোমার পুজোকে নিজের শরৎ ভাবি এ শহর ক্রমে বাঁশের কেল্লা হল চুম্বন হল বোনাসে নতুন দাবিদূর থেকে এল বন্ধুর মতো অটো শপিং-এ তোমার মনে এল সোনা-মাটি আঙুলে জড়িয়ে কবেকার মেঘমালা বকুল জমায় অন্ধ কলকাতাটিআমিও অন্ধ, বিশ্বাস করো তুমি হাতের স্পর্শে কী কঠিন লাগে চেনা আকাশ কপালে উঁচু করে চাঁদ পরে দেখলে, তোমার কিছু মনে পড়বে না।
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
কে যেন আজ ডাকল তোমায় অন্ধকারে জলের অতীত স্পর্শ কি আর সবাই পারে?রূপকথাটির দৈত্য ছিল বক্ষ জুড়ে এক পৃথিবী যেমন করে সূর্য ঘুরেআমার থেকে পৌঁছতে চায় তোমার কাছে বুঝতে পারে অন্য কোথাও অর্থ আছেএই আলো এই অন্ধকারের বাইরে কোথাও আমায় তুমি কোটর থেকে বের করে নাওগাছের আঙুল সাজিয়ে তোলো ফুলের ফোঁটায় যেমন করে একলা পাখি সূর্য ওঠায়ঠিক সেভাবে আমার বুকের দৈত্য মারো সারিয়ে তোলো বাজ পোড়া এই অন্ধকারওঋণ নিয়ে এই ভোরবেলাকার পত্রটুকুর সহজ জলে উপছে ওঠে আমার পুকুরনৌকা চলে তার শরীরে আপন মনে…আমার সবই তোমার হল এই শ্রাবণে
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
সারাদিন আজ বৃষ্টি আসুক পাখি ভেজা গাছেদের ডানায় বসুক ঘুম আমিও নাহয় তোমার দু চোখে রাখি মেঘ জমা কোনও পাহাড়ের মরসুমতুমিও কোথাও আলো ছায়া বেঁচে থাকো মেঘ পিঠে নিয়ে আমিও বেরই ট্রাম বড় গাছেদের গোপনে পালক রাখো শহরে ওড়াও নরম গোলাপি খামসাদা কাগজের মনমরা আলো ভাসে বুকের শহর বহুদিন ভাঙাচোরা প্যাস্টেল রঙে কারা যেন ফিরে আসে… বিগত জন্মে ছেড়ে গিয়েছিল ওরা!তুমিও আমায় ছেড়ে গেলে বৈশাখে এখন শ্রাবণ নির্জন পথে ঋণ গলাচেরা পাখি কাকে যে এমন ডাকে আজকে তোমার একলা থাকার দিন
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
আলোর শহর চমকে উঠল অন্ধকারে আসতে আসতে বৃদ্ধ হল গাছের পাতা জং ধরা ট্রাম কোথায় যেন আনমনা আজ হারিয়ে গেল তোমার দেওয়া অঙ্ক খাতাতুমিও কোথাও হারিয়ে গেছ, আর আসো না। আয়না-কোণায় ঘুমিয়ে থাকে মনমরা টিপ শূন্য ঘরে পর্দা ওড়ে, বই জমে যায়… বন্ধু আমার বুকের ভেতর একলা ব-দ্বীপসব তো আছে। তবুও কেন কিচ্ছুটি নেই? আতসবাজির আলোয় কেন রাত কাটে না? একলা পাগল ঘুমিয়ে থাকে পথের পাশে… তার দু চোখের স্বপ্নগুলো ভীষণ চেনাবাদবাকি সব ক্লান্ত ঋতুর মেরুন শহর যার পাশে রোজ বইতে থাকে বৃদ্ধা নদী এই শহরের কোথাও আছো – মনকে বোঝাই – অন্ধকারে তাই তো জ্বলে আকাশপ্রদীপ
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
ছড়া
এই এখানে মাঠ বসালো ওই ওখানে নদী গাছের নীচে বসিয়ে দিল ক্লান্ত রাখাল ছেলে মেঘ বসালো ওপর দিকে নীচের দিকে বাড়ি পুজোর মুখে এই বাড়িতে তোমরা যারা এলে তাদের হাতে তোরং দিলো হলুদ সবুজ ছাতা চেককাটা প্যান্ট, রবার জুতো, মালাই বরফ গাড়ি কাশের বাদার, ভরিয়ে দিল কু-ঝিকমিক ছুটি পাগলী মায়ের জন্য দিল, পুজোর নতুন শাড়ি প্যান্ডেলে মাইক লাগিয়ে দিলো, কোলের টাকে জামা আর যারা সব মেঘলা তাদের মুখের মেঘটুকু সরিয়ে দিতে বাবার সাথে ছাদের ওপর গিয়ে সূর্য ছিঁড়ে ড্রইং খাতায় আটকে দিলো খুকু
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
আমি তোমার কাছে খারাপ বাকি সবার কাছে ভালকোনও অন্ধ কুয়োতলায় যেন একলা মৃদু আলোআমি সবার কাছে আকাশ শুধু তোমার কাছে ঘুড়িএই ভাঙা শহর নিয়ে তাকে ইচ্ছে মতো জুড়িআর বিক্রি করি একা ব্যাগে রাংতা করি জড়োকোনও মেসেজ এলেই ভাবি তুমি আমায় মনে করো?ভুল ভাঙতে জীবন কাটে তোমার সময় বড় দামিসব একলা লাজুক ছেলের কাছে দু হাত পাতি আমিযদি সামান্য ভাগ করে ওই রোদের মিহি জরিআমি তোমার অচল নয়া তুমি আমার মাধুকরীতুমি রাত্রি শেষের হাওয়া যেন আমার কাছে থামেভাবি ক্রেয়ন নিয়ে আমি একা ঘুরব রঙিন ট্রামেআর সেসব দেখে তুমি ঠিক আসবে ফিরে আবারআর মাছের লোভে বিড়াল ফের চাটবে বসে থাবাআমি থাবার নীচে ঘুমোই তুমি অনেক দূরে কারো…আমি আগলে রাখি তোমায় তুমি আমায় কেন মারো?
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
বহুদূরে যেন কুয়াশা পড়েছে আজ মাফলার এসে জড়িয়ে ধরেছে ঘুম কলকাতা জুড়ে বৃষ্টি নামবে ঠিক তোমার মনেও বকুলের মরশুমসেই দেখে আমি ঝড় জলে একাকার মানি ব্যাগে রাখি কুচি পাতাদের ঘাম তুমি কি কোথাও ট্রাম থেকে নেমে গেলে? আমিও নরকে সারারাত নামলামশুধু রয়ে গেল আলতো পিপারমিন্ট ঠোঁট জুড়ে বাজে সন্ধের এপ্রিল এলো হাওয়া লেগে মেলো হয়ে আসা দিন তোমার চিবুকে ঈশ্বর আঁকে তিলএকলা শহর এঁকে রাখে সবকিছু তুমিও ক্রমশ ফেলে দাও সব আমি বাউণ্ডুলেরা তাই জড়ো হই মেঘে ভাঙা কবিতায় তছনছ হয়ে নামি…
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
মাথার ওপর চাঁদ ভেঙেছে ওর জোৎস্না-গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে ওই দল বেঁধে সব তোমার কাছে আসি আমরা যারা নবম শ্রেণী হইআমরা যারা আর আসে না ঘুম গন্ধ রাবার আর মানে না পোষ বুক পকেটে সব পেয়েছির পরে আমরা যারা লুকোনো আপশোষউল্টো জামায় দিন কেটে যায় বেশ একটা তারা আকাশ থেকে টুপ বাস স্টপেজে আর নামে না কেউ বিশাল বড় চাঁদের তলায় চুপএকটা শহর… একলা শহর আজ রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাম… কেউ ছিল না অন্ধ তোমার পাশে আমিই নাহয় সামান্য বসলামমাথার ওপর সেদিন থেকে তারা… বুকের ভেতর টলছে পাতাল রেল সামলে তবু লড়াইটুকু রাখি আমরা যারা নবম শ্রেণী ফেল
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে একলা কিছু চোখের জল এই শহরে কাদের বাড়ি কোন মানুষের আবাসস্থল?এত্তো ভীড়ে একলা কারা ঘুম-বালিশে কীসের দাগ? স্বপ্ন-জোড়া অন্ধকারে কোথায় হারাও সেই চিরাগ?হাসির নীচে লুকিয়ে ছিল শীতল, প্রাচীন, হিম কুয়ো তোমায় ভুলে বাঁচল কারা? চতুর্দিকে এই ব্যূহসামলে তুমি ফিরবে কোথায়? অন্ধকারে কার বাড়ি? ‘মনের মধ্যে রাখছি ধরে তাই কি তোমার হাত ছাড়ি?’ভাবতে গিয়ে শরৎ ফুরোয় মেরুন হয়ে আসল বন তোমার সারা জীবন জুড়ে চলছে দেবীর বিসর্জন
স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রেমমূলক
বছর শেষের অ্যালবামে চৈত্র এসে আজ থামেছোট্ট শহর, ঘুম-বাড়ি বুকের তলায় রেলগাড়িঝড় না ওঠা এক বছর তোমায় মনে নেই তো ওরএকলা দুপুর দোকলা ট্রাম আমিও তো ঠিক তাই ছিলামতাই ছিলাম বাস স্টপেজ বিষ মেশানো রোদের তেজ এখন সাজায় চৈত্র সেলআটকে যাওয়া পাতালরেল… বাদাম মুড়ির এক ঠোঙা…রাত্রি জুড়ে চাঁদ তোমায় ঠুকরে মারে। শুধুই মার…তবুও তোমার নিউ ইয়ার ঝড় ফেরতের সাহস পাকপাল্টে দাঁড়াও হে বৈশাখ
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত, রাখালেরা পুনর্বার বাশিঁতে আঙুল রেখে রাখালিয়া বাজাবে বিশদ। কথা ছিলো বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপনি খুলে বসবে না, চিত্রল তরুণ হরিনেরা সহসাই হয়ে উঠবে না রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট।কথা ছিলো, শিশু হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদের নাম। নদীর চুলের রেখা ধ’রে হেঁটে হেঁটে যাবে এক মগ্ন ভগীরথ, কথা ছিলো, কথা ছিলো আঙুর ছোঁবো না কোনোদিন।অথচ দ্রাক্ষার রসে নিমজ্জিত আজ দেখি আরশিমহল, রাখালের হাত দুটি বড় বেশি শীর্ণ আর ক্ষীণ, বাঁশি কেনা জানি তার কখনোই হয়ে উঠে নাই-কথা ছিলো, চিল-ডাকা নদীর কিনারে একদিন ফিরে যাবো। একদিন বট বিরিক্ষির ছায়ার নিচে জড়ো হবে সহজিয়া বাউলেরা, তাদের মায়াবী আঙুলের টোকা ঢেউ তুলবে একতারায়- একদিন সুবিনয় এসে জড়িয়ে ধ’রে বোলবে: উদ্ধার পেয়েছি।কথা ছিলো, ভাষার কসম খেয়ে আমরা দাঁড়াবো ঘিরে আমাদের মাতৃভূমি, জল, অরন্য, জমিন, আমাদের পাহাড় ও সমুদ্রের আদিগন্ত উপকূল- আজন্ম এ জলাভূমি খুঁজে পাবে প্রকৃত সীমানা তার।কথা ছিলো, আর্য বা মোঘল নয়, এ জমিন অনার্যের হবে। অথচ এখনো আদিবাসী পিতাদের শৃঙ্খলিত জীবনের ধারাবাহিকতা কৃষকের রন্ধ্রে রক্তে বুনে যায় বন্দিত্বের বীজ। মাতৃভূমি-খন্ডিত দেহের ’পরে তার থাবা বসিয়েছে আর্য বণিকের হাত।আর কী অবাক! ইতিহাসে দেখি সব লুটেরা দস্যুর জয়গানে ঠাঁসা, প্রশস্তি, বহিরাগত তস্করের নামে নানারঙ পতাকা ওড়ায়। কথা ছিলো, ‘আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন’, আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ। অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে। জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি, আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
‘হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় ঋণে অথচ আমার শস্যের মাঠ ভরা। রোদ্দুর খুঁজে পাই না কখনো দিনে, আলোতে ভাসায় রাতের বসুন্ধরা। টোকা দিলে ঝরে পচা আঙুলের ঘাম, ধস্ত তখন মগজের মাস্তুল নাবিকেরা ভোলে নিজেদের ডাক নাম চোখ জুড়ে ফোটে রক্তজবার ফুল। ডেকে ওঠো যদি স্মৃতিভেজা ম্লান স্বরে, উড়াও নীরবে নিভৃত রুমালখানা পাখিরা ফিরবে পথ চিনে চিনে ঘরে আমারি কেবল থাকবে না পথ জানা– টোকা দিলে ঝরে পড়বে পুরনো ধুলো চোখের কোণায় জমা একফোঁটা জল। কার্পাস ফেটে বাতাসে ভাসবে তুলো থাকবে না শুধু নিবেদিত তরুতল জাগবে না বনভূমির সিথানে চাঁদ বালির শরীরে সফেদ ফেনার ছোঁয়া পড়বে না মনে অমীমাংসিত ফাঁদ অবিকল রবে রয়েছে যেমন শোয়া হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে অথচ আমার ব্যাপক বিরহভূমি ছুটে যেতে চাই– পথ যায় পায়ে থেমে ঢেকে দাও চোখ আঙুলের নখে তুমি।’
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন! বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা-দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি, কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত?সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু- না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি, যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি।সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি সহজে থাকি না কাছে, পাছে বাঁধা পড়ে যাই। বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন- সুতো ধ’রে, আমি শুধু যাই দূরে।আমি দূরে যাই- স্বপ্নের চোখে তুমি মেখে নাও ব্যথা- চন্দন চুয়া, সারাটি রাত্রি ভাসো উদাসীন বেদনার বেনোজলে…এতো সহজেই ভালোবেসে ফ্যালো কেন?
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
আহারে বৃষ্টির রা, সোহাগি লো, আমি থাকি দূর পরবাসে। কান্দে না তোমার বুকে একঝাঁক বুনোপাখি অবুঝ কৈতর? কেমনে ফুরায় নিশি? বলো সই, কেমনে- বা কাটাও প্রহর? পরাণ ছাপায়ে নামে বাউরি বাতাস, দারুণ বৃষ্টির মাসে। যে বলে সে বলে কথা, কাছে বসে, হাতে খিলিপান দিয়ে কয়- এতো জল ঝরে তবু পরান ভেজে না কেন, কও তো মরদ? দুয়ারে লাগায়ে খিল যদি কেউ থাকে তারে কে দেবে দরদ। শরীরের মোহনায় দেখি তার বুনো ঢেউ রক্ত-মাংসময়। শরীর গুটায়ে রাখি, শামুকের মতো যাই গুটায়ে ভেতরে। অন্ধকার চিরে চিরে বিজুলির ধলা দাঁত উপহাসে হাসে, আমি বলি- ক্ষমা দাও, পরান বন্ধুয়া মোর থাকে পরবাসে, দেহের রেকাবি খুলে পরানের খিলিপান কে খাওয়াবে তোরে। গতবার আষাঢ়ও পার হয়ে গেলো তাও নামে না বাদল, এবার জ্যোষ্ঠিতে মাঠে নেমে গেছে কিষানের লাঙল-জোয়াল। আমাদের মাঝে দেখো জমির ভাগের মতো কতো শত আল্, এই দূর পরবাস কবে যাবে? জমিনের আসল আদল। কবে পাবো? কবে পাবো আল্ হীন একখণ্ড মানব-জমিন? পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি। মহুয়ার মদ খেয়ে মত্ত হয়ে থাকা সেই পার্বনের তিথি কবে পাবো? কবে পাবো শর্তহীন আবাদের নির্বিরোধ দিন?
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
তুমি বরং কুকুর পোষো, প্রভুভক্ত খুনসুটিতে কাটবে তোমার নিবিড় সময়, তোর জন্য বিড়ালই ঠিক, বরং তুমি বিড়ালই পোষো খাঁটি জিনিস চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায় খুঁজে এবার পেয়েছ ঠিক দিক ঠিকানা লক্ষী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো শুকরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়, কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান। ঘাটাঘাটির ঘনঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি, তুমি বরং ওই পুকুরেই নাইতে নামো উংক পাবে, জলও পাবে। চুল ভেজারও তেমন কোন আশঙ্কা নেই, ইচ্ছেমত যেমন খুশি নাইতে পারো। ঘোলা পানির আড়াল পেলে কে আর পাবে তোমার দেখা। মাছ শিকারেও নামতে পারো তুমি বরং ঘোলা পানির মাছ শিকারে দেখাও তোমার গভীর মেধা। তুমি তোমার স্বভাব গাছে দাঁড়িয়ে পড়ো নিরিবিলির স্বপ্ন নিয়ে আর কতকাল? শুধু শুধুই মগজে এক মোহন ব্যধি তুমি বরং কুকুর পোষো, বিড়াল পোষো, কুকুর খুবই প্রভুভক্ত এবং বিড়াল আদরপ্রিয় তোমার জন্য এমন সামঞ্জস্য তুমি কোথায় পাবে ?
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
পেছনে তাকালে কেন মূক হয়ে আসে ভাষা ! মনে পড়ে সেই সব দুপুরের জলাভূমি, সেই সব বেতফল, বকুল কুড়ানো ভোর, আহা সেই রাঙাদির আঁচলতলের উত্তাপ, মনে পড়ে... মনে পড়ে, বন্দরে সেই সব কালোরাত, ঈগলের মতো ডানা সেই বিশাল গভীর রাতে, একটি কিশোর এসে চুপি চুপি সাগরের কূলে দাঁড়াতো একাকী তন্ময় চোখে তার রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে। কবে তারে ডাক দিয়ে নিয়ে গেলো যৌবন সুচতুর, কবে তারে ডেকে নিলো মলিন ইটের কালো সভ্যতা ! সবুজ ছায়ার নিচে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে মা যাকে শোনাতো সেই তুষারদেশের কথা, তার চোখে আজ এতো রাতজাগা ক্লান্তির শোক ! পেছনে তাকালে কেন নিরবতা আসে চোখে ! মনে পড়ে- জ্যোৎস্নায় ঝলোমলো বালুচর, একটি কিশোর- তার তন্ময় দুটি চোখে রাশি রাশি কালোজল- সুদূরের মাস্তুল মনে পড়ে...
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা। জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে ক্রমশঃ উঠছে ফুটে ক্ষয়রোগ, রোগেরপ্রকোপ একদার অন্ধকারে ধর্ম এনে দিয়েছিল আলো, আজ তার কংকালের হাড় আর পঁচা মাংসগুলো ফেরি কোরে ফেরে কিছু স্বার্থাণ্বেষী ফাউল মানুষ- সৃষ্টির অজানা অংশ পূর্ণ করে গালগল্প দিয়ে। আফিম তবুও ভালো, ধর্ম সে তো হেমলকবিষ। ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃণ্য চতুরতা, মানুষের পৃথিবীকে শত খণ্ডে বিভক্ত করেছে তারা টিকিয়ে রেখেছে শ্রেণীভেদ ঈশ্বরের নামে। ঈশ্বরের নামে তারা অনাচার করেছে জায়েজ। হা অন্ধতা! হা মুর্খামি! কতোদূর কোথায় ঈশ্বর! অজানা শক্তির নামে হত্যাযজ্ঞ কতো রক্তপাত, কত যে নির্মম ঝড় বয়ে গেল হাজার বছরে! কোন্ সেই বেহেস্তের হুর আর তহুরাশরাব? অন্তহীন যৌনাচারে নিমজ্জিত অনন্ত সময়? যার লোভে মানুষও হয়ে যায় পশুর অধম। আর কোন দোজখ বা আছে এর চেয়ে ভয়াবহ ক্ষুধার আগুন সে কি হাবিয়ার চেয়েখুব কম? সে কি রৌরবের চেয়ে নম্র কোন নরোমআগুন? ইহকাল ভুলে যারা পরকালে মত্ত হয়েআছে চলে যাক সব পরপারে বেহেস্তে তাদের আমরা থাকবো এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে, দ্বন্দ্বময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায় আগামীর স্বপ্নে মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি, ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে… এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ? বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ। এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো। জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর, আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়। এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী, স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ? একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ? জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন। বাতাশে লাশের গন্ধ নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান। মাটিতে রক্তের দাগ - চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড় এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা- তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার, নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি ঘুমুতে পারিনা… রক্তের কাফনে মোড়া – কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা। স্বাধীনতা, সে আমার – স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন - স্বাধীনতা – আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল। ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত, রাখালেরা পুনর্বার বাশিঁতে আঙুল রেখে রাখালিয়া বাজাবে বিশদ। কথা ছিলো বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপনি খুলে বোসবে না, চিত্রর তরুন হরিনেরা সহসাই হয়ে উঠবে না রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট। কথা ছিলো , শিশু হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদের নাম। নদীর চুলের রেখা ধ‌‌রে হেঁটে হেঁটে যাবে এক মগ্ন ভগীরথ, কথা ছিলো, কথা ছিলো আঙুর ছোঁবো না কোনোদিন। অথচ দ্রাক্ষার রসে নিমজ্জিত আজ দেখি আরশিমহল, রাখালের হাত দুটি বড় বেশি শীর্ণ আর ক্ষীণ, বাঁশি কেনা জানি তার কখনোই হয়ে উঠে নাই- কথা ছিলো, চিল-ডাকা নদীর কিনারে একদিন ফিরে যাবো। একদিন বট বিরিক্ষির ছায়ার নিচে জড়ো হবে সহজিয়া বাউলেরা, তাদের মায়াবী আঙুরের টোকা ঢেউ তুলবে একতারায়- একদিন সুবিনয় এসে জড়িয়ে ধরে বোলবেঃ উদ্ধার পেয়েছি। কথা ছিলো, ভাষার কসম খেয়ে আমরা দাঁড়াবো ঘিরে আমাদের মাতৃভূমি, জল, অরন্য, জমিন, আমাদের পাহাড় ও সমুদ্রের আদিগন্ত উপকূল- আজন্ম এ-জলাভূমি খঁজে পাবে প্রকৃত সীমানা তার। কথা ছিলো, আর্য বা মোঘল নয়, এ-জমিন অনার্যের হবে। অথচ এখনো আদিবাসী পিতাদের শৃঙ্খলিত জীবনের ধারাবাহিকতা কৃষকের রন্ধ্রে রক্তে বুনে যায় বন্দিত্বের বীজ। মাতৃভূমি-খন্ডিত দেহের পরে তার থাবা বসিয়েছে আর্য বণিকের হাত। আর কী অবাক! ইতিহাসে দেখি সব লুটেরা দস্যুর জয়গানে ঠাঁসা, প্রশস্তি, বহিরাগত তস্করের নামে নানারঙা পতাকা ওড়ায়। কথা ছিলো ‌’আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন’, আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ। অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে। জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি, আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
তাঁর চোখ বাঁধা হলো। বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ। থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো, জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে। মা...মাগ... চেঁচিয়ে উঠলো সে। পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক। পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে। জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ তার দেহে টসটসে আঙুরের মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো। দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ, এবার সে চিৎকার করতে পারলো না। তাকে চিৎ করা হলো। পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট, কালো ও কর্কশ। কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিলো, বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা। সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলো- বুঝি সে-কারণে ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার সার্ট। প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস। তার দুটো হাত- মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে, যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট, লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো। সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত। তার দশটি আঙুল- যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর, প্রেয়সীর চিবুকের তিল। যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথীর হাত, স্বপ্নবান হাতিয়ার, বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো। সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা। লোহার সাঁড়াশি দিয়ে, একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার নির্দোষ নখগুলো। কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ। সে এখন মৃত। তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত। তার থ্যাতলানো একখানা হাত পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর, আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা-
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে , আছো তুমি হৃদয় জুড়ে। ঢেকে রাখে যেমন কুসুম, পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম। তেমনি তোমার নিবিঢ় চলা, মরমের মূল পথ ধরে। পুষে রাখে যেমন কুসুম, খোলসের আবরণে মুক্তোর ঘুম। তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া, ভিতরের নীল বন্দরে। ভাল আছি ভাল থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো। দিয়ো তোমার মালাখানি, বাউলের এই মনটারে। আমার ভিতরে বাহিরে...
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
ভালবাসার সময় তো নেই ব্যস্ত ভীষন কাজে, হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।ঘামের জলে ভিজে সাবাড় করাল রৌদ্দুরে, কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।কাজের মাঝে দিন কেটে যায় কাজের কোলাহল তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।নদী আমার বয় না পাশে স্রোতের দেখা নেই, আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।তোমার দিকে ফিরবো কখন বন্দী আমার চোখ পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
ভালবাসার সময় তো নেই ব্যস্ত ভীষন কাজে, হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে। ঘামের জলে ভিজে সাবাড় করাল রৌদ্দুরে, কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে। কাজের মাঝে দিন কেটে যায় কাজের কোলাহল তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল। নদী আমার বয় না পাশে স্রোতের দেখা নেই, আটকে রাখে গেরস্থালির লেই। তোমার দিকে ফিরবো কখন বন্দী আমার চোখ পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
চিন্তামূলক
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয় চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে। জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে- জীবন সুন্দর আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়! বিদায়ের সেহনাই বাজে নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে এই যে বেঁচে ছিলাম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয় সবাইকে অজানা গন্তব্যে হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি অজান্তেই চমকে ওঠি জীবন, ফুরালো নাকি! এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
এতোদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই, পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত পারিজাতহীন কঠিন পাথরে। প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে, নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা__ এই খেলা আর কতোকাল আর কতোটা জীবন! কিছুটাতো চাই__হোক ভুল, হোক মিথ্যে প্রবোধ, আভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই। আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন__আর কতোদিন? ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতোটা বিলাবে? কতো আর এই রক্ত-তিলকে তপ্ত প্রনাম! জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারনাময়? এতো ক্ষয়, এতো ভুল জ’মে ওঠে বুকের বুননে, এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরন কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়। তুমি জানো না__আমি তো জানি, কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন, এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত! তুমি জানো নাই__আমি তো জানি। মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে, মাংশের ঘরে আগুন পুষেছে, যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু, করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার। পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা, চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক। তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়, পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু। বৈশাখি মেঘ ঢেকেছে আকাশ, পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায় ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন? নীল অভিমান পুড়ে একা আর কতোটা জীবন? কতোটা জীবন!! ৩১.০৫.৭৬; কাঁঠালবাগান, ঢাকা
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে- উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ, পরস্পর খুড়ে খুড়ে নিভৃতি খুঁজেছি। তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই। যেভাবে ঝিনুক খুলে মুক্ত খোঁজে লোকে আমাকে খুলেই তুমি পেয়েছো অসুখ, পেয়েছো কিনারাহীন আগুনের নদী। শরীরের তীব্রতম গভীর উল্লাসে তোমার চোখের ভাষা বিস্ময়ে পড়েছি- তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই। জীবনের ’পরে রাখা বিশ্বাসের হাত কখন শিথিল হয়ে ঝ’রে গেছে পাতা। কখন হৃদয় ফেলে হৃদপিন্ড ছুঁয়ে বোসে আছি উদাসীন আনন্দ মেলায়- তোমাকে পারিনি ছুঁতে-আমার তোমাকে, ক্ষাপাটে গ্রীবাজ যেন, নীল পটভূমি তছ নছ কোরে গেছি শান্ত আকাশের। অঝোর বৃষ্টিতে আমি ভিজিয়েছি হিয়া- তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
১.থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুকএকলা থাকার খুব দুপুরেএকটি ঘুঘু ডাকুক ২.দিচ্ছো ভীষণ যন্ত্রণাবুঝতে কেন পাছো না ছাইমানুষ আমি, যন্ত্র না! ৩.চোখ কেড়েছে চোখউড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই, পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে, নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা- এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন! কিছুটাতো চাই- হোক ভুল, হোক মিথ্যো ও প্রবোধ, অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন- আর কতোদিন? ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতটা বিলাবে? কতো আর এই রক্ত তিলকে তপ্ত প্রণাম! জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে, এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়। তুমি জানো নাই- আমি তো জানি, কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন, এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।তুমি জানো নাই- আমি তো জানি। মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে, মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে, যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু, করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা, চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক। তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়, পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ, পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়- ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন? নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন? কতোটা জীবন!!
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
আমার এখন সমস্তটাই স্মৃতিসৌধ, হৃৎপিন্ডে পিন ফোটানো কালো ব্যাজের মৌন বিষাদ, একুশে ভোর, নগ্ন পায়ে শহীদ মিনার, আমার এখন সমস্তটুক্ এক মিনিটের নীরবতা।দু’চোখ বেয়ে রাত্রি ঝরে, পাংশুটে রাত, রক্তমাখা চাঁদের দেহে জোৎস্না উধাও, উল্টে পড়ে রোদের বাটি, আমার এখন আকাশ জুড়ে দুঃস্বপ্নের দালানকোঠা।উঠোনে সাপ অবিশ্বাসের ভীষণ কালো রক্তজবা, লকলকে জিভ, এখন আমার সমস্তটাই লখিন্দরের লোহার বাসর।আঙুলগুলো ঝ’রে পড়ছে হাত থেকে ফুল, ঘরের পাশে লক্ষèীপ্যাঁচার ধাতব গলা, আমার এখন শঙ্খচিলের কান্নাভেজা দুপুরবেলা, শূন্য খা-খা একাকী মাঠ, ঘাসের ডগায় নীল ফড়িং-এর নিমগ্নতা।আমার এখন হৃদয় শুধু হৃদয় বোলে দু’হাত মেলে চাতক পাখি… আমার এখন বুকের ভেতর কবর শুধু কবর খোঁড়ার ভারি শব্দ। দু’চোখ বেয়ে সকাল ঝরে, উল্টে পড়ে স্বপ্নবাটি। আমার এখন নিজের মধ্যে নিজের কফিন, সমস্ত রাত করাতকলের কষ্টধ্বনি- এখন আমার সমস্তটাই পিরামিডের মগ্ন মমি।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
খুব কাছে এসো না কোন দিন যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে এ চোখ থেকে ঐ চোখের কাছে থাকা এক পা বাড়ানো থেকে অন্য পায়ের সাথে চলা কিংবা ধরো রেল লাইনের পাশাপাশি শুয়ে অবিরাম বয়ে চলা । যে কাছাকাছির মাঝে বিন্দু খানেক দূরত্বও আছে মেঘের মেয়ে অতো কাছে এসোনা কোন দিন দিব্যি দিলাম মেঘের বাড়ীর, আকাশ কিংবা আলোর সারির।তার চেয়ে বরং দূরেই থেকো যেমন দূরে থাকে ছোঁয়া, থেকে স্পর্শ রোদ্দুরের বু্‌ক, থেকে উত্তাপ শীতলতা, থেকে উষ্ণতা প্রেমে্‌র, খুব গভীর ম্যাপে যেমন লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা তেমন দূরেত্বেই থেকে যেও- এক ইঞ্চিতেও কভু বলতে পারবে না কেউ কতটা কাছা কাছি এসেছিলে বলে দূরত্বের পরিমাপ দিতে পারেনি পৃথিবী।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
এ কেমন ভ্রান্তি আমার ! এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে, দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ। এলে মনে হয় অন্যরকম জল হাওয়া, প্রকৃতি, অন্য ভূগোল, বিষুবরেখারা সব অন্য অর্থবহ- তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রান। হাত রাখলেই মনে হয় স্পর্শহীন করতল রেখেছো চুলে, স্নেহ- পলাতক দারুন রুক্ষ আঙুল। তাকালেই মনে হয় বিপরীত চোখে চেয়ে আছো, সমর্পন ফিরে যাচ্ছে নগ্ন পায়ে একাকী বিষাদ- ক্লান্ত করুণ ছায়ার মতো ছায়া থেকে প্রতিচ্ছায়ে। এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি.. কুশল শুধালে মনে হয় তুমি আসোনি পাশে বসলেও মনে হয় তুমি আসোনি। করাঘাত শুনে মনে হয় তুমি এসেছো, দুয়ার খুল্লেই মনে হয় তুমি আসোনি। আসবে বললে মনে হয় অগ্রিম বিপদবার্তা, আবহাওয়া সংকেত, আট, নয়, নিম্নচাপ, উত্তর, পশ্চিম- এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি। চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে, চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভূবনে আছো।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
পৃথিবীতে মানুষ তখনও ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায়নি । ভুমির কোনো মালিকানা হয়নি তখনো । তখনো মানুষ শুধু পৃথিবীর সন্তান । অরন্য আর মরুভূমির সমুদ্র আর পাহাড়ের ভাষা তখন আমরা জানি । আমরা ভূমিকে কর্ষন করে শস্য জন্মাতে শিখেছি । আমরা বিশল্যকরনীর চিকিৎসা জানি আমরা শীত আর উত্তাপে সহনশীল ত্বক তৈরি করেছি আমাদের শরীরের । আমরা তখন সোমরস, নৃত্য আর শরীরের পবিত্র উৎসব শিখেছি । আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায় আর আমাদের পুরুষেরা শিকার করে ঘাই হরিন। আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি । জ্বলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি আর প্রশংসা করি পৃথিবীর । আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি । পৃথিবীর পূর্নিমা রাতের ঝলোমলো জ্যোৎস্নায় পৃথিবীর নারী আর পুরুষেরা পাহাড়ের সবুজ অরন্যে এসে শরীরের উৎসব করে । তখন কী আনন্দরঞ্জিত আমাদের বিশ্বাস । তখন কী শ্রমমুখর আমাদের দিনমান । তখন কী গৌরবময় আমাদের মৃত্যু । তারপর – কৌমজীবন ভেঙে আমরা গড়লাম সামন্ত সমাজ । বন্যপ্রানীর বিরুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্রগুলো আমরা ব্যবহার করলাম আমাদের নিজের বিরুদ্ধে । আমাদের কেউ কেউ শ্রমহীনতায় প্রশান্তি খুঁজে পেতে চাইলো । দুর্বল মানুষেরা হয়ে উঠলো আমাদের সেবার সামগ্রী । আমাদের কারো কারো তর্জনী জীবন ও মৃত্যুর নির্ধারন হলো । ভারী জিনিস টানার জন্যে আমরা যে চাকা তৈরি করেছিলাম তাকে ব্যবহার করলাম আমাদের পায়ের পেশীর আরামের জন্যে । আমাদের বন্য অস্ত্র সভ্যতার নামে গ্রাস করে চললো মানুষের জীবন ও জনপদ । আমরা আমাদের চোখকে সুদূরপ্রসারী করার জন্যে দূরবীন আর সূক্ষ্ নিরীক্ষনের জন্যে অনুবীক্ষন তৈরি করলাম । আমাদের পায়ের গতি বর্ধন করলো উড়ন্ত বিমান । আমাদের কন্ঠস্বর বর্ধিত হলো, আমাদের ভাষা ও বক্তব্য গ্রন্থিত হলো, আমরা রচনা করলাম আমাদের অগ্রযাত্রার ইতিহাস । আমাদের মস্তিষ্ককে আরো নিখুঁত ও ব্যপক করার জন্যে আমরা তৈরি করলাম কম্পিউটার । আমাদের নির্মিত যন্ত্র শৃঙ্খলিত করলো আমাদের আমাদের নির্মিত নগর আবদ্ধ করলো আমাদের আমাদের পুঁজি ও ক্ষমতা অবরুদ্ধ করলো আমাদের আমাদের নভোযান উৎকেন্দ্রিক করলো আমাদের । অস্তিত্ব রক্ষার নামে আমরা তৈরী করলাম মারনাস্ত্র । জীবনরক্ষার নামে আমরা তৈরি করলাম জীবনবিনাশী হাতিয়ার । আমরা তৈরি করলাম পৃথিবী নির্মূল-সক্ষম পারমানবিক বোমা । একটার পর একটা খাঁচা নির্মান করেছি আমরা । আবার সে খাঁচা ভেঙে নতুন খাঁচা বানিয়েছি – খাঁচার পর খাঁচায় আটকে পড়তে পড়তে খাঁচার আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো টুকরো হয়ে আজ আমরা একা হয়ে গেছি । প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি । কী ভয়ংকর এই একাকীত্ব ! কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা ! কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা ! এই সৌরমন্ডলের এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে যে-শিশুর জন্ম । দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন যে-কিশোরের । জ্যোৎস্না যাকে প্লাবিত করে । বনভূমি যাকে দুর্বিনীত করে । নদীর জোয়াড় যাকে ডাকে নশার ডাকের মতো । অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক জোয়াল গোলাম বানানোর শিক্ষাযন্ত্র । অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এক হৃদয়হীন ধর্মের আচার । অথচ যাকে শৃঙ্খলিত করা হয়েছে স্বপ্নহীন সংস্কারে । যে-তরুন উনসত্তরের অন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যে-তরুন অস্ত্র হাতে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়েছে যে-তরুনের বিশ্বাস, স্বপ্ন, সাধ, স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভেঙে খান খান হয়েছে, অন্তবে রক্তাক্ত যে-তরুন নিরুপায় দেখেছে নৈরাজ্য, প্রতারনা আর নির্মমতাকে । দুর্ভিক্ষ আর দুঃশাসন যার নির্ভৃত বাসনাগুলো দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করেছে যে-যুবক দেখেছে এক অদৃশ্য হাতের খেলা দেখেছে অদৃশ্য এক কালোহাত যে-যুবক মিছিলে নেমেছে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে আকন্ঠ মদের নেশায় চুর হয়ে থেকেছে অনাহারে উড়নচন্ডী ঘুরছে যে-যুবক ভয়ানক অনিশ্চয়তা আর বাজির মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে নিজেকে যে-পুরুষ এক শ্যমল নারীর সাথে জীবন বিনিময় করেছে যে-পুরুষ ক্ষুধা, মৃত্যু আর বেদনার সাথে লড়ছে এখনো, লড়ছে বৈষম্য আর শ্রেনীর বিরুদ্ধে – সে আমি । আমি একা । এই ব্রক্ষ্মান্ডের ভিতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা । আমার অন্তর রক্তাক্ত । আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত । আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত । আমার শবীর লাবন্যহীন । আমার জীভ কাটা । তবু এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে আমাকে তড়ায়... আমাদের কৃষকেরা শূন্য পাকস্থলি আর বুকের ক্ষয়কাশ নিয়ে মাঠে যায় । আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত, হাড্ডিসার । আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থহীন । আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভৎস-করুন । আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, অকালমৃত্যু আর দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে । পৃথিবীর যুদ্ধবাজ লোকদের জটিল পরিচালনায় ষড়যন্ত্রে আর নির্মমতায়, আমরা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকে পড়েছি । কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা ! আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকা পড়েছি । কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা ! কী বিভৎস এই ভালোবাসাহীনতা ! কী নির্মম এই স্বপ্নহীনতা ! আজ আমরা আবার সেই বিশ্বাস আর আনন্দকে ফিরে পেতে চাই আজ আমরা আবার সেই সাহস আর সরলতাকে ফিরে পেতে চাই আজ আমরা আবার সেই শ্রম আর উৎসবকে ফিরে পেতে চাই আজ আমরা আবার সেই ভালোবাসা আর প্রশান্তিকে ফিরে পেতে চাই আজ আমরা আবার সেই স্বাস্থ্য আর শরীরের লাবন্যকে ফিরে পেতে চাই আজ আমরা আবার সেই কান্নাহীন আর দীর্ঘশ্বাসহীন জীবনের কাছে যেতে চাই আর আমরা শোষন আর ষঠতা অকালমৃত্যু আর ক্ষুধার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে চাই । আমাদের সমৃদ্ধ এই বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাময় এই শিল্পসম্ভার নিয়ে আমাদের দূরলক্ষ্য আর সুক্ষ্ম বীক্ষন নিয়ে আমাদের দ্বন্ধময় বেগবান দর্শন নিয়ে আমরা ফিরে যাবো আমাদের বিশ্বাসের পৃথিবীতে আমাদের শ্রম, উৎসব, আনন্দ আর প্রশান্তির পৃথিবীতে । পরমানুর সঠিক ব্যবহার আমাদের শস্যের উৎপাদন প্রয়োজনতুল্য করে তুলবে, আমাদের কারখানাগুলো কখনোই হত্যার অস্ত্র তৈরি করবে না, আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিরোগ করবে পৃথিবীকে; আমাদের মর্যদার ভিত্তি হবে মেধা, সাহস আর শ্রম । আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষের মতো স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচন্ড পৌরষদীপ্ত হবে । আমাদের নারীরা হবে শ্রমবতী, লক্ষীমন্ত আর লাবন্যময়ী । আমাদের শিশুরা হবে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পদন। আমরা শস্য আর স্বাস্থের, সুন্দর আর গৌরবের কবিতা লিখবো । আমরা গান গাইবো আমাদের বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা করে । আমরা উৎসব করবো শস্যের আমরা উৎসব করবো পূর্নিমার আমরা উৎসবা করবো আমাদের গৌরবময় মৃত্যু আর বেগমান জীবনের । কিন্তু – এই স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে সামান্য কিছু মানুষ । অস্ত্র আর সেনা-ছাউনিগুলো তাদের দখলে । সমাজ পরিচালনার নামে তারা এক ভয়ংকর কারাগার তৈরী করেছে আমাদের চারপাশে । তারা ক্ষুধা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে তারা বস্ত্রহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে তারা গৃহহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে তারা জুলুম দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে বুলেট দিয়ে বন্দী করেছে । তারা সবচেয়ে কম শ্রম দেয় আর সবচে বেশি সম্পদ ভোগ করে; তারা সবচে ভালো খাদ্যগুলো খায় আর সবচে দামি পোশাকগুলো পরে । তাদের পুরুষদের শরীর মেদে আবৃত, কদাকার; তাদের মেয়েদের মুখের ত্বক দেখা যায় না, প্রসাধনে ঢাকা; তারা আলস্য আর কর্মহীনতায় কাতর, কুৎসিত । তারা আমাদের জীভ কেটে নিতে চায় তারা আমাদের চোখ উপড়ে ফেলতে চায় তারা আমাদের মেধা বিকৃত করতে চায় তারা আমাদের শ্রবন বধির করে দিতে চায় তারা আমাদের পেশীগুলো অকেজো করে দিতে চায় আমাদের সন্তানদেরও তারা চায় গোলাম বানাতে ; একদা অরন্যে যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রানী হত্যা করে আমরা অরন্যজীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি, আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্যমানুষগুলো নির্মুল করে আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো ।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন! বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা- দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি, কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত? সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু- না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি, যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি। সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি সহজে থাকি না কাছে, পাছে বাঁধা পড়ে যাই। বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন-সুতো ধ’রে, আমি শুধু যাই দূরে। আমি দূরে যাই- স্বপ্নের চোখে তুমি মেখে নাও ব্যথা-চন্দন চুয়া, সারাটি রাত্রি ভাসো উদাসীন বেদনার বেনোজলে... এতো সহজেই ভালোবেসে ফ্যালো কেন?
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
প্রেমমূলক
থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুক একলা থাকার খুব দুপুরে একটি ঘুঘু ডাকুক দিচ্ছো ভীষণ যন্ত্রণা বুঝতে কেন পাছো না ছাই মানুষ আমি, যন্ত্র না! চোখ কেড়েছে চোখ উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি, ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে- এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে, মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ। এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো। জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার। আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী, স্বাধীনতা, -একি তবে নষ্ট জন্ম? একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল?জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।বাতাশে লাশের গন্ধ- নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান। মাটিতে রক্তের দাগ- চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না- তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার, নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ, মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি ঘুমোতে পারিনা-রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা। স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন- স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
মানবতাবাদী
অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই, কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই। এতোটা গ্রহণ এতো প্রশংসা প্রয়োজন নেই কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখান। সাহস আমাকে প্ররোচনা দেয় জীবন কিছুটা যাতনা শেখায়, ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায় অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই। বুকে ঘৃণা নিয়ে নীলিমার কথা অনাহারে ভোগা মানুষের ব্যথা প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই- করুণাকাতর বিনীত বাহুরা ফিরে যাও ঘরে। নষ্ট যুবক ভ্রষ্ট আঁধারে কাঁদো কিছুদিন কিছুদিন বিষে দহনে দ্বিধায় নিজেকে পোড়াও না হলে মাটির মমতা তোমাতে হবে না সুঠাম, না হলে আঁধার আরো কিছুদিন ভাসাবে তোমাকে। অতোটা প্রেমের প্রয়োজন নেই ভাষাহীন মুখ নিরীহ জীবন প্রয়োজন নেই- প্রয়োজন নেই কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই চাই কিছু লাল তীব্র আগুন।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
চিন্তামূলক
সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি যে-রকম আকাশ পৃথিবী দ্যাখে, পৃথিবী আকাশ, একবার অন্ধকারে, একবার আলোর ছায়ায় একবার কুয়াশা-কাতর চোখে, একবার গোধুলির ক্লান্ত রোদে- সারারাত স্বপ্ন দেখি-সারাদিন স্বপ্ন দেখি। একখানি সুদূরের মুখ জ্ব’লে থাকে চেতনার নীলে, কে যেন বাদক সেই স্বপ্নের ভেতরে তোলে বিষাদের ধ্বনি আঁকে সেই প্রিয়মুখে-সুদূরের মুখে বর্ণময় রঙিন বিষাদ।ফিরে আয় বোলে ডাকি- সে বাদক উদাসিন থামে না তবুও… সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি- স্বপ্নের ভেতরে তুমি হে আমার বিষণ্ন সুন্দর চোখের সমুখে আজ কেন এসে দাঁড়ালে নিঠুর! কেন ওই রক্তে-মাংসে, কেন ওই নশ্বর ত্বকের আবরণে এসে আজ শুধোলে কুশল?হে আমার বিষণ্ন সুন্দর হৃদয়ের কূল ভেঙে কেন আজ এতো জল ছড়ালো শরীরে কেন আজ বাতাসে বসন্ত দিন ফিরে এলো কুয়াশার শীতে!কে  সেই বংশীবাদক স্বপ্নের শিয়রে বসে বাজাতেন বাঁশি বেদনার ধ্বনি তুলে রাত্রি দিন, সে আজ হারালো কোথায়?বেদনার রঙ দিয়ে আমি যারে আঁকি হৃদয়ের রক্ত দিয়ে আমি যারে আঁকি আমার কষ্ট দিয়ে, আমার স্বপ্ন দিয়ে যে আমার নিভৃত নির্মাণ সেই তুমি- হে আমার বিষণ্ন সুন্দর মর্মমূল ছিঁড়ে এসে ঠাঁই নিলে কেন এই মাংসের বুকে! কেন ওই বৃক্ষতলে, কেন ওই নদীর নিকটে এসে বোলে গেলে তোমার ঠিকানা!আমি তো প্রার্থনাগুলো শস্যের বীজের মতো দিয়েছি ছড়িয়ে জল তাকে পুষ্টি দেবে, মাটি তাকে ভূমি দেবে, তুমি তার গভীর ফসল- বাতাসে তুলোর মতো তুমি তবে উড়ে এলে কেন! কেন আজ পোড়া তুষের গন্ধে শুধু জন্মের কথা মনে পড়ে! শৈশব কৈশোর এসে মিশে থাকে ফাল্গুনের তুমুল হাওয়ায় একটি রাত্রি কেন হয়ে ওঠে এতো দীর্ঘ দীর্ঘ রাত?হে আমার বিষণ্ন সুন্দর দু’চোখে ভাঙন নিয়ে কেন এই রুক্ষ দুঃসময়ে এলে কেন সমস্ত আরতির শেষে আজ এলে শূন্য দুখানি হাত! কেন এলে, বিষণ্ন সুন্দর, তুমি কেন এলে?
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
চিন্তামূলক
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি। শুন্যতার দিকে চোখ, শুন্যতা চোখের ভেতরও– এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি। বিলুপ্ত বনস্পতির ছায়া, বিলুপ্ত হরিণ। মৌসুমী পাখির ঝাঁক পালকের অন্তরালে তুষারের গহন সৌরভ ব’য়ে আর আনে না এখন। দৃশ্যমান প্রযুক্তির জটাজুটে অবরুদ্ব কাল, পূর্ণিমার চাঁদ থেকে ঝ’রে পড়ে সোনালী অসুখ। ডাক শুনে পেছনে তাকাই– কেউ নেই। এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি একা…. সমকালীন সুন্দরীগণ অতিদ্রুত উঠে যাচ্ছে অভিজাত বেডরুমে, মূল্যবান আসবাবপত্রের মতন নির্বিকার। সভ্যতা তাকিয়ে আছে তার অন্তর্গত ক্ষয় আর প্রশংসিত পচনের দিকে। উজ্জ্বলতার দিকে চোখ, চেয়ে আছি– ডীপ ফ্রিজে হিমায়িত কষ্টের পাশেই প্রলোভন, অতৃপ্ত শরীরগুলো খুঁজে নিচ্ছে চোরাপথ– সেক্সড্রেন। রুগ্নতার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা বিলাচ্ছে অপচয়– মায়াবী আলোর নিচে চমৎকার হৈ চৈ, নীল রক্ত, নীল ছবি জেগে ওঠে একখন্ড ধারালো ইস্পাত–চকচকে, খুলির ভেতরে তার নড়াচড়া টের পাই শুধু। ইতিমধ্যে ককটেলে ছিন্নভিন্ন পরিচয়,সম্পর্ক,পদবী– উজ্জ্বলতার ভেতরে ফণা তুলে আর এক ভিন্ন অন্ধকার। গ্লাসভর্তি অন্ধকার উল্টে দিই এই অন্ধকারে।
ব্রত চক্রবর্তী
মানবতাবাদী
অনেকদিন পর রাস্তায় তোমাকে দেখলাম, মিলিদি। বুড়ি হয়ে গেছ। না থাক, বর্ণনা। তবে ভারি কষ্ট হলো। কী রূপ ছিল তোমার, একদা। সেই জাঁকজমকের বিয়ে মনে পড়ল। কিন্তু ফিরলে ক’মাস পরেই। স্বামী লোকটার আরেকটা সংসার দেখে, অসহ্য রাগে। তুমি আর যাওনি, সে-ও নেয়নি। তারপর কত বছর। বয়স গা থেকে গড়িয়ে গেল, রূপ, সোনার দিনগুলো। বাপের সংসারে বড়ি দিতে দিতে, কাপড় কাচতে কাচতে, সেলাইয়ের ফোঁড় তুলতে তুলতে। চতুর্দিকে কত বদল তারপর। তুমি রয়ে গেলে সেই অথৈ বিষাদজলে শরীর ডুবিয়ে মন ডুবিয়ে। এই সেদিন গঙ্গার জল গিয়ে পড়ল পদ্মায়, হংকং ঢুকে গেল চিনে, তুমি কই কোনও নতুন ঘটনা নিলে না জীবনে। কী পেলে মিলিদি, এতগুলো বছর? চিনতেই পারনি। নাম ধরে ডাকতে থমকে দাঁড়ালে। অল্প মুখ তুললে। চোখ। আর আমি ভীষণ চমকাই দেখে সিঁথির ধু ধু আলপথের পাশে একচিলতে সিঁদুর, আজও। আজও? ভীষণ রাগ হলো, হঠাৎ। তারপরই অসহায় হয়ে যাই তোমার কথা ভেবে, মিলিদি। ধু ধু আলপথ দেখি, তিলক ফোঁটার মতন ওই একচিলতে সিঁদুর দেখি, আর মনে মনে বলি, দুটো নদী পারল পরস্পরের ঢেউ মেলাতে, দুটো দেশ পারল, আর দুজন মানুষ পারে না?
অসীম সাহা
প্রেমমূলক
আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণে ভেসে যাবে সমগ্র পৃথিবী- এই ভেবে বিরহী যক্ষের মতো যখন আকাশের দিকে আকুল নয়নে তাকিয়ে রয়েছি, তখন আমাকে বিস্মিত করে সজল-সঘন কালো মেঘ কখন যে অসভ্য ছেলের মতো চোখ ঠেরে মুহূর্তে উধাও হয়ে গেছে- আমি তা টেরও পাইনি। তার মানে এখন আর মেঘলা-ধূসর আকাশের কোনো অস্তিত্ব নেই- তার বদলে প্রকৃতিকে গৃহবন্দি করে সে এখন খোশমেজাজে যত্রতত্র ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।অথচ কথা ছিলো, বাদল-বরিষনে তুমি এসে বসে থাকবে কদমতলায়, আর আমি একটি হৃদয়ের ব্যাকুল বাঁশির সুর শুনতে পাই বা না পাই, ঝড় ও বৃষ্টির জল উপেক্ষা করে আমার পদ্ম-কোমল পা দুটো চেপে-চেপে নিজের রক্তের ভেতর দিয়ে প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে আসবো তোমার কাছে। কিন্তু আষাঢ়ের প্রকৃতি হঠাৎ এমন করে বেয়াড়া হয়ে উঠবে, কে তা জানতো? বর্ষাও যে কখনো কখনো এমন বেরসিক আচরণ করতে পারে, জীবনে এই প্রথম আমি তা প্রত্যক্ষ করলাম। অতএব কী আর করা? আবার নতুন দিনের প্রতীক্ষা ছাড়া তোমার কিংবা আমার আর তো কিছুই করার নেই। তাই এসো, এই অলস ও উদাস অবসরে উভয়ে উভয়কে বহফোনে এমন কিছু বার্তা পাঠাই, যাতে প্রবল বর্ষণের মধ্যে যে ভয়ংকর বজ্রপাত হয়, আর তাতে কেঁপে ওঠে সহজ হৃদয়, তেমনি করে শিহরনের ছোঁয়া লেগে দু’জনেই কেঁপে উঠি, আর তুমি যেন আমাকে কিছুতেই ভুল বুঝে বাঁশির সুর থামিয়ে দিতে না পারো- অন্তত যেন বুঝতে পারো, সত্যিই আমি পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে, আমার কোমল দুটি পা টিপে টিপে, দুর্গম পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে তোমার দিকেই ছুটে আসতে চেয়েছিলাম, তা যেন সত্যিই আমি তোমার কাছে প্রমাণ করতে পারি।কিন্তু তুমিই বলো, প্রকৃতি যদি আমাদের সহায় না হয়, তা হলে ইচ্ছে থাকলেও আয়ান-ঘরণী হয়ে আমি কেমন করে প্রকাশ্য দিবালোকে তোমার দিকে আকুল হৃদয়ে ছুটে আসতে পারি? তুমি যদি কৃষ্ণ না হয়ে আমার হাতে তুলে দিতে তোমার মর্মহরণকারী বাঁশি, তা হলে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারতে, অবরুদ্ধ সংসারের প্রজাপতি-জাল ছিন্ন করে তোমার কাছে ছুটে যেতে গিয়ে আমাকে কতোটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে !তাই বলছি, প্রয়োজনে তোমার চোখের জলে আমাকে ভাসিয়ে দাও, তবু গোমড়া আকাশের মতো অমন মুখ ভার করে বসে থেকো না। তুমি যদি আমার ওপর অমন অভিমান করে বসে থাকো, তা হলে আমি বলবো, ‘এ জন্মেই কৃষ্ণ না হয়ে তুমি অন্তত একবার আয়ান-ঘরণী হয়ে দেখো, কাজটা সত্যি সত্যিই অতটা সহজ নয়’ !
অসীম সাহা
চিন্তামূলক
মৃত্যু-৫ অসীম সাহাকেউ তো আসেনি কাছে, কেউ তো দেয়নি মুখে একবিন্দু জল, কেউ তো বলেনি ডেকে, ‘এখন কেমন আছো?’ শুধু অবিরল চোখ বেয়ে নেমে গেছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুকণা, আর চোখে ঘুম, শূন্য থেকে নেমে এসে আমাকে দিয়েছে শাস্তি, দিয়েছে হুকুম : আর কটা দিন থাকো, তারপর আমি এসে নিয়ে যাবো যেখানে নেবার, এখনো হয়নি কিছু, শুধু কিছু বাকি আছে সাক্ষ্য দেবার।তারপর তোকে আমি শান্তি দেবো, চিরজীবনের মতো শান্তি পাবি তুই, এবার ঘুমিয়ে পড়্, আমিও দু’চোখ বুজে তোর কাছে শুই। তারপর শেষরাতে একদিন চার কাঁধে আমরাই নিয়ে যাবো তোকে, কাঁদবে মানুষ,আর কাঁদবে প্রেয়সী তোর,সন্তানেরা কাঁদবে খুব শোকে। তবুও যেতেই হবে, মানুষের এই তো নিয়তি আর এই তো সে-গান, সময় হলেই তবে দেহ থেকে উড়ে যাবে পাখির পরান।
অসীম সাহা
স্বদেশমূলক
কাল রাতে ওরা আমার দেহ থেকে সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছে আমাকে ওরা এক নিঃসঙ্গ অন্ধকার রাতের থমথমে নিস্তব্ধতার মধ্যে বেঁধে রেখে বলেছে, ‘শাট আপ। কথা বললেই গুলি করব!’তখনই সমস্ত পৃথিবী কাঁপিয়ে, সমস্ত চরাচর, বনভূমি কাঁপিয়ে একটা ভয়ানক হাহাকার, মৃতদের কলরোল উড়ে এসে আমার বুকের কাছে আছড়ে পড়েছে; আমি কেঁপে উঠেছি।আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আমার মায়ের মুখ একটি নিঃসঙ্গ একাকী প্রদীপের নিচে বেদনায় নুয়ে থাকা আমার জন্মদাত্রীর এলায়িত দেহের ভঙ্গিমা চৌকাঠে এলোমেলো বাতাসের আঘাতে উদাসীন আমার প্রিয়তমা, আমার সন্তান, আমার একমাত্র উত্তরাধিকার। এইসব ভাবতে ভাবতে আমার রক্তের ভেতরে জেগে উঠেছে এক পরাজিত সৈনিকের আহত, ক্ষতবিক্ষত, ক্লান্ত-দেহের অস্বাভাবিক স্থবিরতা।অথচ আমাকে থামলে চলবে না। আমার সামনে কোটি কোটি মানুষের গগনবিদারী চিৎকার আমার সামনে বিস্তৃত দিগন্তের নিচে অনাবিল সবুজ ধানের ক্ষেত আমার সামনে পাকা ধানের মতো জীবনের অবিরত সম্ভাবনার সোনালী ভাঁড়ারআমার চোখে জল নেমে আসে। আমি অনেকদিন অসম্ভব বৃষ্টির বিপুল জ্যোৎস্নার মধ্যে শিশুর মতো খেলতে পারি নি দুরন্ত বলের মতো সহস্র স্বপ্নের মধ্যে আমার নিবিড় প্রেম অশ্ব হয়ে ছুটতে পারে নি কোনোদিকে শুধু রক্তলাল এ জীবন বহতা নদীর মতো প্রয়োজনে ছুটে গেছে দৃশ্য থেকে অদৃশ্যের দিকে। বুকের ভিতরে জেগে উঠেছে শতাব্দীর নীল আর্তনাদ জেগে উঠেছে শোষণের সহস্র কাহিনীশৃঙ্খলিত জীবনের মর্মঘাতী অতীত যাতনা। সাথে সাথে আমার শিথিল হাত জড়াতে জড়াতে মুুষ্টিবদ্ধ ইস্পাতে পরিণত হয়েছে আমার কম্পিত করতলে ঘেমে উঠেছে শতাব্দী-লাঞ্ছিত মানুষের এক অসম্ভব উজ্জ্বল রাসায়নিক বাল্ব। আমি এক্ষুণি আমার বাল্ব ছুঁড়ে দেব আজ কোন পরিত্রাণ নেই কাল রাতে তোমরা আমার দেহ থেকে সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছ আজ তার প্রতিশোধ এক ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে তোমাদের এক-একটা জীবনকে আমি আমার স্বপ্নের আঘাতে ভেঙে টুকরো করে দেব। আমার বুকের ভিতরে এক নিঃশংসয় নগরীর প্রজ্বলিত আভা আমার বুকের ভিতরে একটি সমান পৃথিবীর সবুজ মানচিত্র আমি এখন ইচ্ছে করলেই সমস্ত পৃথিবীকে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, শুধু প্রয়োজন প্রতিটি ঐতিহাসিক রক্তবিন্দুর কাছ থেকে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস জেনে নেওয়া আমি সেই রক্তবিন্দু থেকে সম্মুখের ইতিহাস অবধি নিজের রক্তবিন্দুকে প্রবাহিত করে দিতে চাই আমি একটি রক্তপাতহীন পৃথিবীর জন্যে এই মুহূর্তে পৃথিবীর মর্মঘাতী রক্তপাত করে যেতে চাই।
অসীম সাহা
প্রেমমূলক
যে প্রশস্ত পথের সন্ধান তুমি পেয়েছো সেই পথ ধরে তুমি সামনের দিকে এগিয়ে যাও প্রলয়ের অন্ধকার তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!শুধু আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিও; বিভক্ত কাচের দুপাশে দুরকমের তুমি আর নেপথ্যের হাহা অন্ধকারে আমি একা! তুমি আর একবার বুঝে নাও- প্রশস্ত পথ ধরে তুমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে কিনা? আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি : অন্তত আমার প্রলয়ের অন্ধকার কিছুতেই তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!যদি তুমি পারো তবে যাও- তুমি যাও।!
অসীম সাহা
ব্যঙ্গাত্মক
কিছু কিছু আমলা আছে তাদের বড়ো গামলা আছে তাতেই বহন করেন তারা মাল। তাদের অনেক পাওয়ার আছে অনেককিছু খাওয়ার আছে কুমির এনে তারাই কাটেন খাল। কেউ বা আবার খোদার খাসি কেউ বা আবার বাঘের মাসি কেউ বা আবার বিক্রি করেন দেশ। কেউ বা আবার মিষ্টি হেসে পাচার করেন সব বিদেশে দেশটা তখন হয় যে পুরো শেষ। আমলা নামক এই খুনিরা লাঞ্ছনা দেয়, যে গুণীরা জ্বালায় আলো সবার মনের মাঝে। তাঁদের ওরা আঘাত করে আগুন জ্বালায় তাঁদের ঘরে তবু তারা বহাল থাকে কাজে। যে আমলারা দেশপ্রেমিক তারাই ঘোরে এদিক-ওদিক পায় না তারা, তাদের যেটা ন্যায্য তার বদলে ভাগ্যে জোটে চাকরি থেকে রিজাইন মোটে মন্ত্রী সাহেব তাদের করেন ত্যাজ্য। ন্যায়ের বিচার পায় না তারা মাথার উপর প্রবল খাড়া পদোন্নতি হয় না তাদের ভাগ্যে। এই কথা আর লিখবো কতো সবাই বুঝুন নিজের মতো লিখবো না আর দুখের কথা, থাক গে।
অসীম সাহা
রূপক
বাইপাস দিয়ে নতুন রাস্তা ধরে ছুটে যেতে আমার খুব ভালো লাগে! কিন্তু তার জন্যে সংযোগ-সড়ক চাই- হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এরকম ভাবতে-ভাবতে যখন জানলাম, সংকীর্ণ পথের শেষপ্রান্তে ব্যারিকেড দিয়ে বসে আছে রক্তকণিকার জমাটবাঁধা কিছু কেয়াকাঁটার ঝাড়- তখন তাকে অপসারিত করার জন্য সশস্ত্র পুলিসবাহিনীর মতো যখন একা একা খুব দ্রুতবেগে ছুটে গেলো স্প্রিংয়ের কেমিক্যালসজ্জিত কিছু স্বয়ংক্রিয় তার- আমার চোখে নেমে এলো অসমাপ্ত ঘুম! ঘুম ভাঙলে জানতে পারলাম, এরই মধ্যে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটে গেছে কোলাহলমুখরিত হৃদয়ের আন্তরপ্রদেশে;! ২.৭৫ সেন্টিমিটার আকারের অপ্রতিরোধ্য ট্যাংকও তাকে প্রতিহত করতে পারেনি কোথাও! অন্ধকার রাত্রির বাইপাস পার হয়ে অবদমিত একটি হৃদয় শুধু ছুটে গেছে মাধবীলতার বনে, অসংবৃত সুন্দরের কাছে! বেসরকারি গ্রামে গ্রামে আগুনের হলকায় সরে গেছে মৃত্যুর বাইপাসে ধাবমান আর একখানি তরল হৃদয়!!
অসীম সাহা
ছড়া
কেমনতরো রোগ ওরে ভাই এই যে ‘চিকুন গুনিয়া’ এক আঘাতে মুহূর্তে সে কাঁপাচ্ছে সব দুনিয়া। ধরছে যাকে, মারছে তাকে, এমন মারা মারছে ভাই দেহের ভেতর, হাড়ের ভেতর হাতুড়িটা মারছে ঘাই। ‘ও বাবা গো, ও মা গো মা’ বলেই সবাই হচ্ছে কাৎ চিকুন ব্যাটার আক্রমণে, নিথর দেহ অকস্মাৎ। জ্বরের সঙ্গে বমি রে ভাই, অচৈতন্য সব দেহ ভালো করে দেখলে পড়ে, মনে হবে শবদেহ। এমন রোগ তো দেখিনি ভাই, মশার এমন কঠিন তেজ! তার কামড়ে মানুষ হয়েও কাঁপছে যেন সবার লেজ। ঘরে ঘরে ঢুকে চিকুন, মারছে ব্যথায় মানুষকে এক ঘায়েতে মানুষ কাহিল, করছে কি কাৎ ফানুসকে? যা খুশি তা করুক চিকুন, চলুন আমরা সুস্থ হই স্বাধীন দেশে থাকবে চিকুন, মানবো না তা কিচ্ছুতেই। আসুন সবাই একসাথে হই, তাড়াই `চিকুন গুনিয়া’ বাঁচুক দেশের মানুষগুলো, মশারি দেই বুনিয়া।