poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
তোমায় যেমন করে ডেকেছিল আরব মরুভূমি;
ওগো আমার নবী প্রিয় আল আরাবী,
তেমনি করে ডাকি যদি আসবে নাকি তুমি।।যেমন কেঁদে দজলা ফোরাত নদী
ডেকেছিল নিরবধি,
হে মোর মরুচারী নবুয়তধারী,
তেমনি করে কাঁদি যদি আসবে নাকি তুমি।।যেমন মদিনা আর হেরা পাহাড়
জেগেছিল আশায় তোমার
হে হযরত মম, হে মোর প্রিয়তম,
তেমনি করে জাগি যদি আসবে নাকি তুমি।।মজলুমেরা কাবা ঘরে
কেঁদেছিল যেমন করে,
হে আমিনা- লালা, হে মোর কামলীওয়ালা,
তেমনি করে চাহি যদি আসবে নাকি তুমি।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
শোকমূলক
|
চল-চঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে,
ওগো এই গঙ্গার কূলে।
দিশাহারা মাতা দিশা পেয়ে তাই নিয়ে গেছে কোলে তুলে
ওগো এই গঙ্গার কূলে।।
চপল চারণ বেণু-বীণে তা’র
সুর বেঁধে শুধু দিল ঝঙ্কার,
শেষ গান গাওয়া হ’ল না ক’ আর,
উঠিল চিত্ত দুলে,
তারি ডাক-নাম ধ’রে ডাকিল কে যেন অস্ত-তোরণ-মূলে,
ওগো এই গঙ্গার কূলে।।
ওরে এ ঝোড়ো হাওয়ায় কারে ডেকে যায় এ কোন সর্বনাশী
বিষাণ কবির গুমরি’ উঠিল, বেসুরো বাজিল বাঁশী।
আঁখির সলিলে ঝলসানো আঁখি
কূলে কূলে ভ’রে ওঠে থাকি’ থাকি’,
মনে পড়ে কবে আহত এ-পাখী
মৃত্যু-আফিম-ফুলে,
কোন ঝড়-বাদলের এমনি নিশীথে প’ড়েছিল ঘুমে ঢুলে।
ওগো এই গঙ্গার কুলে।।
তার ঘরের বাঁধন সহিল না সে যে চির বন্ধন-হারা,
তাই ছন্দ-পাগলে কোলে নিয়ে দোলে জননী মুক্তধারা!
ও সে আলো দিয়ে গেল আপনারে দহি’,
অমৃত বিলালো বিষ-জ্বালা সহি’,
শেষে শান্তি মাগিল ব্যথা-বিদ্রোহী
চিতার অগ্নি-শূলে!
পুনঃ নব-বীনা-করে আসিবে বলিয়া এই শ্যাম তরুমূলে
ওগো এই গঙ্গার কূলে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
শূণ্য এ বুকে পাখি মোর আয়
ফিরে আয় ফিরে আয়।
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়।
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ
পান্ডুর হলো আকাশের চাঁদ
কেঁদে নদী হলো করুণ বিষাদ
ডাকে আয় তীরে আয়।।
আকাশে মেলিয়া শত শত কর
খোঁজে তোরে তরু ওরে সুন্দর
তোর তরে বনে উঠিয়াছে ঝড়
লুটায় লতা ধূলায়।
তুই ফিরে এলে ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বন ফুল দল
ধূসর আকাশ হইবে সুনীল
তোর চোখের চাওয়ায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
আদি উপসনালয়-
উঠিল আবার নতুন করিয়া- ভুত প্রেত সমুদয়
তিন শত ষাট বিগ্রহ আর আমুর্তি নতুন করি'
বসিল সোনার বেদীতে রে হায় আল্লার ঘর ভরি'।
সহিতে না পারি' এ দৃশ্য, এই স্রষ্টার অপমান,
ধেয়ানে মুক্তি-পথ খোঁজে নবী, কাঁদিয়া ওঠে পরান।
"খদিজারে কন- আল্লাতালার কসম, কা'বার ঐ
"লাৎ""ওজ্জার" করিবনা পূজা, জানিনা আল্লা বই।
নিজ হাতে যারে করিল সৃষ্টি খড় আর মাটি দিয়া
কোন নির্বোধে পূজিবে তাহারে হায় স্রষ্টা বলিয়া।"
সাধবী পতিব্রতা খদিজাও কহেন স্বামীর সনে--
"দূর কর ঐ লাত-মানাতেরে, পূজে যাজা সব -জনে।
তব শুভ-বরে একেশ্বর সে জ্যোতির্ময়ের দিশা।
পাইয়াছি প্রভু, কাটিয়া গিয়াছে আমার আঁধার নিশা।"
ক্রমে ক্রমে সব কোরেশ জানিল; মোহাম্মদ আমীন
করে নাকো পূজা কা'বার ভূতেরে ভাবিয়া তাদেরে হীন।
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, য্ত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!
বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
অকাল-সন্ধ্যা
[জয়জয়ন্তী কীর্তন]খোলো মা দুয়ার খোলো
প্রভাতেই সন্ধ্যা হল
দুপুরেই ডুবল দিবাকর গো।
সমরে শয়ান ওই
সুত তোর বিশ্বজয়ী
কাঁদনের উঠছে তুফান ঝড় গো॥
সবারে বিলিয়ে সুধা,
সে নিল মৃত্যু-ক্ষুধা,
কুসুম ফেলে নিল খঞ্জর গো।
তাহারই অস্থি চিরে
দেবতা বজ্র গড়ে
নাশে ওই অসুর অসুন্দর গো।
ওই মা যায় সে হেসে।
দেবতার উপরে সে,
ধরা নয়, স্বর্গ তাহার ঘর গো॥
যাও বীর যাও গো চলে
চরণে মরণ দলে
করুক প্রণাম বিশ্ব-চরাচর গো।
তোমার ওই চিত্ত জ্বেলে
ভাঙ্গালে ঘুম ভাঙ্গালে
নিজে হায় নিবলে চিতার পর গো।
বেদনার শ্মশান-দহে
পুড়ালে আপন দেহে,
হেথা কি নাচবে না শংকর গো॥আরিয়াদহ
৬ আষাঢ়, ১৩৩২
(চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ছড়া
|
আমি হবো সকালবেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো,
হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে নাকো?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
ঊষা দিদির ওঠার আগে উঠবো পাহাড়চূড়ে,
দেখবো নিচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে,
ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়,
বলবো আমি ‘ভোর হলো যে, সাগর ছুটে আয়!
ঝরনা মাসি বলবে হাসি’, ‘খোকন এলি নাকি?’
বলবো আমি নইকো খোকন, ঘুমজাগানো পাখি!’
ফুলের বনে ফুল ফোটাবো, অন্ধকারে আলো,
সূয্যিমামা বলবে উঠে, ‘খোকন, ছিলে ভালো?’
বলবো ‘মামা, কথা কওয়ার নাইকো সময় আর,
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙো ঘুমের দ্বার।’
রবির আগে চলবো আমি ঘুমভাঙা গান গেয়ে,
জাগবে সাগর- পাহাড়-নদী, ঘুমের ছেলেমেয়ে!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
রক্তাম্বর পর মা এবার
জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন।
দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন
বাজে তরবারি ঝনন-ঝন।
সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেল মা গো
জ্বাল সেথা জ্বাল কাল্-চিতা।
তোমার খড়গ-রক্ত হউক
স্রষ্টার বুকে লাল ফিতা।
এলোকেশে তব দুলুক ঝন্ঝা
কাল-বৈশাখী ভীম তুফান,
চরণ-আঘাতে উদ্গারে যেন
আহত বিশ্ব রক্ত-বান।
নিশ্বাসে তব পেঁজা-তুলো সম
উড়ে যাক মা গো এই ভুবন,
অ-সুরে নাশিতে হউক বিষ্ণু
চক্র মা তোর হেম-কাঁকন।
টুটি টপে মারো অত্যাচারে মা,
গল-হার হোক নীল ফাঁসি,
নয়নে তোমার ধূমকেতু-জ্বালা
উঠুক সরোষে উদ্ভাসি।
হাসো খলখল, দাও করতালি,
বলো হর হর শঙ্কর!
আজ হতে মা গো অসহায় সম
ক্ষীণ ক্রন্দন সম্বর।
মেখলা ছিঁড়িয়া চাবুক করো মা,
সে চাবুক করো নভ-তড়িৎ,
জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝরে
লালে-লাল হোক শ্বেত হরিৎ।
নিদ্রিত শিবে লাথি মারো আজ,
ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা,
পিয়াও এবার অ-শিব গরল
নীলের সঙ্গে লাল মেশা।
দেখা মা আবার দনুজ-দলনী
অশিব-নাশিনী চণ্ডি রূপ;
দেখাও মা ঐ কল্যাণ-করই
আনিতে পারে কি বিনাশ-স্তূপ।
শ্বেত শতদল-বাসিনী নয় আজ
রক্তাম্বরধারিণী মা,
ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
শোকমূলক
|
ওরে অভিমানিনী!
এমন করে বিদায় নিবি ভুলেও জানিনি।
পথ ভুলে তুই আমার ঘরে দু-দিন এসেছিলি,
সকল সহা! সকল সয়ে কেবল হেসেছিলি।
হেলায় বিদায় দিনু যারে
ভেবেছিনু ভুলব তারে হায়!
ভোলা কি তা যায়?
ওরে হারা-মণি! এখন কাঁদি দিবস-যামিনী। অভাগি রে! হাসতে এসে কাঁদিয়ে গেলি,
নিজেও শেষে বিদায় নিলি কেঁদে,
ব্যথা দেওয়ার ছলে নিজেই সইলি ব্যথা রে,
বুকে সেই কথাটাই কাঁটার মতন বেঁধে! যাবার দিনে গোপন ব্যথা বিদায়-বাঁশির সুরে
কইতে গিয়ে উঠল দু-চোখ নয়নজলে পুরে!
না কওয়া তোর সেই সে বাণী,
সেই হাসিগান সেই মু-খানি, হায়!
আজও খুঁজি সকল ঠাঁই।
তোরে যাবার দিনে কেঁদে কেন ফিরিয়ে আনিনি?
ওরে অভিমানিনী। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার দয়ার পেয়ালা প্রভু উপচে পড়ুক আমার'পর
নিত্য ক্ষুধার অন্ন পেতে না যেন হয় পাততে কর।
তোমার মদে মস্ত করো আমার 'আমি'র পাই সীমা,
দুঃখে যেন শির না দুখায় অতঃপ্র, হে দুঃখহর!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
১দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥
কেঁদো না, দমো না, বেদনা-দীর্ণ এ প্রাণে আবার আসিবে শক্তি,
দুলিবে শুষ্ক শীর্ষে তোমারও সবুজ প্রাণের অভিব্যক্তি।
জীবন-ফাগুন যদি মালঞ্চ-ময়ূর তখতে আবার বিরাজে,
শোভিবেই ভাই, ওই তো সেদিন, শোভিবে এ শিরও পুষ্প-তাজে॥২হোয়ো না নিরাশ, অজানা যখন ভবিষ্যতের সব রহস্য,
যবনিকা-আড়ে প্রহেলিকা-মধু, – বীজেই সুপ্ত স্বর্ণ শস্য!
অত্যাচার আর উৎপীড়নে সে আজিকে আমার পর্যুদস্ত,
ভয় নাই ভাই! ওই যে খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্ত!
দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥৩দুদিনের তরে গ্রহ-ফেরে ভাই সব আশা যদি না হয় পূর্ণ,
নিকট সেদিন, রবে না এদিন, হবে জালিমের গর্ব চূর্ণ!
পুণ্য-পিয়াসী যাবে যারা ভাই মক্কার পূত তীর্থ লভ্যে;
কণ্টক-ভয়ে ফিরবে বা তারা বরং পথেই জীবন সঁপবে।
দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥৪অস্তিত্বের ভিত্তি মোদের বিনাশেও যদি ধ্বংস-বন্যা,
সত্য মোদের কাণ্ডারি ভাই, তুফানে আমরা পরোয়া করি না।
যদিও এ পথ ভীতি-সংকুল, লক্ষ্যস্থলও কোথায় দূরে,
বুকে বাঁধো বল, ধ্রুব-অলক্ষ্য আসিবে নামিয়া অভয় তূরে।
দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥৫অত্যাচার আর উৎপীড়নে সে আজিকে আমরা পর্যুদস্ত,
ভয় নাই ভাই! রয়েছে খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্ত!
কী ভয় বন্দি, নিঃস্ব যদিও, অমার আঁধারে পরিত্যক্ত,
যদি রয় তব সত্য-সাধনা স্বাধীন জীবন হবেই ব্যক্ত!
দুঃখ কী ভাই হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
কত ছল করে সে বারেবারে দেখতে আসে আমায়।
কত বিনা-কাজের কাজের ছলে চরণ দুটি আমার দোরেই থামায়॥
জানলা আড়ে চিকের পাশে
দাঁড়ায় এসে কিসের আশে,
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে,
গাল দুটিকে ঘামায়।
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল
দুরু দুরু বুকে
সবাই যখন ঘুমে মগন তখন আমায় চুপে চুপে
দেখতে এসেই মল বাজিয়ে দৌড়ে পলায়
রঙ খেলিয়ে চিবুক গালের কূপে।
দোর দিয়ে মোর জলকে চলে
কাঁকন মারে কলস-গলে
অমনি চোখোচোখি হলে
চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়, চোখ দুটিকে নামায়।
সইরা হাসে দেখে ছুঁড়ির দোর দিয়ে মোর
নিতুই নিতুই কাজ-অকাজে হাঁটা।
করবে কী ও? রোজ যে হারায় আমার পথেই
শিথিল বেণির দুষ্টু মাথার কাঁটা!
একে ওকে ডাকার ভানে
আনমনা মোর মনটি টানে,
চলতে চাদর পরশ হানে
আমারও কী নিতুই পথে তারই বুকের জামায়॥
পিঠ ফিরিয়ে আমার পানে দাঁড়ায় দূরে
উদাসনয়ান যখন এলোকেশে,
জানি, তখন মনে মনে আমার কথাই
ভাবতেছে সে, মরেছে সে আমায় ভালোবেসে।
বই হাতে সে ঘরের কোণে
জানি আমার বাঁশিই শোনে,
ডাকলে রোষে আমার পানে
নয়না হেনেই রক্তকমল-কুঁড়ির সম চিবুকটি তার নামায়॥ (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
কোথা সে পূর্ণ সিদ্ধ ও যোগী, দেখেছ কি কেউ তাঁরে,
দনুজ-দলনী শক্তিরে পুন ভারতে জাগাতে পারে?
কোথা সে শ্রীরাম, বশিষ্ঠ, কোথা তাপস কাত্যায়ন,
যাঁর সাধনায় হইবে কাত্যায়নীর অবতরণ!
ভারত জুড়িয়া শুধু সন্ন্যাসী সাধু ও গুরুর ভিড়,
তবু এ ভারত হইয়াছে কেন ক্লীব মানুষের নীড়?
‘প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী, নাহি বিশ্বম্’ বলি কেউ
আবার আনিতে পারে কি ভারতে মহাশক্তির ঢেউ?
পাতাল ফুঁড়িয়া দানব দৈত্য উঠিয়াছে পৃথিবীতে,
এল না তো কেউ শক্তি-সিদ্ধ তাদের সংহারিতে!
কোথা সেই মহাতান্ত্রিক, কোথা চিন্ময়ী মহাকালী?
মন্দিরে মন্দিরে মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা খালি!
শক্তিরে খুঁজি পটুয়ার পটে, মাটির মুরতি মাঝে
চিন্ময়ী শ্রীচণ্ডিকা তাই প্রকাশ হল না লাজে।
কোন দুর্গারে পূজিয়া শ্রীরাম হরিলেন দুর্গতি?
সেই শ্রীদুর্গা কোথা আজ, কেউ দেখেছ তাঁহার জ্যোতি?
শুম্ভ নিশুম্ভেরে যে মারিল, সে চণ্ডী কি গেছে মরে?
কুম্ভমেলায় শুধায়েছ কেউ সাধুদের জটা ধরে?
জটা তাহাদের কটা হয়ে গেল, কটাহ হইল চোখ,
আনিতে পারিল তবু কি তাহারা একটি ফোঁটা আলোক?
পরিশ্রমের ভয়ে আশ্রমে আশ্রমে ছেলেমেয়ে
আশ্রয় লয়ে বাঁচিয়াছে! মেদ বাড়িতেছে খেয়ে দেয়ে!
মহাপ্রভুর নাম রাখিয়াছে ভিক্ষুক নেড়া নেড়ি,
এরা কি ভাঙিবে অসুরের কারা, পায়ের শিকল বেড়ি?
ধর্মের নামে এই অধর্ম, তাই তো ধর্মরাজ
অভিশাপ দেন দারিদ্র্যব্যাধি দুর্গতিরূপে আজ।
গঙ্গায় নেয়ে তীর্থে গিয়ে কে শক্তি লভিয়া আসে?
মাংসের স্তূপ বেড়ে বেড়ে শুধু যায় মৃত্যুর গ্রাসে।
কে ঘুচাবে এই লজ্জা ও ঘৃণা, কোথা সে যুগাবতার?
জগন্নাথের রথ দেখিব না, পথ চেয়ে আছি তাঁর। (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
আজি মনে মনে লাগে হোরী
আজি বনে বনে জাগে হোরী।।
ঝাঁঝর করতাল খরতালে বাজে
বাজে কংকন চুড়ি মৃদুল আওয়াজে
লচকিয়া আসে মুচকিয়া হাসে
প্রেম-উল্লাসে শ্যামল গৌরী।।
আজি কদম্ব তমাল রঙ্গে লালে লাল
হলো কৃষ্ণ ভ্রমর ভ্রমরী
রঙ্গের উজান চলে কালো যমুনার জলে
আবীর রাঙ্গা হলো ময়ূর-ময়ূরী।।
মোর হৃদি বৃন্দাবন যেন রাঙে
রাধা শ্যাম যুগল চরণ রাগে
ও চরণ ধূলি যেন ফাগ হ’য়ে মেশে রে
অন্তরে পড়ে মোর ঝরি’।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্তোত্রমূলক
|
হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর
হে মোর বিদ্রোহী!
রহি’ রহি’
কোন্ বেদনায়
তরঙ্গ-বিভঙ্গে মাতো উদ্দাম লীলায়!
হে উন্মত্ত, কেন এ নর্তন?
নিষ্ফল আক্রোশে কেন কর আস্ফালন
বেলাভূমে পড়ো আছাড়িয়া!
সর্বগ্রাসী! গ্রাসিতেছ মৃত্যু-ক্ষুধা নিয়া
ধরণীরে তিলে-তিলে!
হে অস্থির! স্থির নাহি হ’তে দিলে
পৃথিবীরে! ওগো নৃত্য-ভোলা,
ধরারে দোলায় শূন্যে তোমার হিন্দোলা!
হে চঞ্চল,
বারে বারে টানিতেছ দিগন্তিকা-বন্ধুর অঞ্চল!
কৌতুকী গো! তোমার এ-কৌতুকের অন্ত যেন নাই।-
কী যেন বৃথাই
খুঁজিতেছ কূলে কূলে
কার যেন পদরেখা!-কে নিশীথে এসেছিল ভুলে
তব তীরে, গর্বিতা সে নারী,
যত বারি আছে চোখে তব
সব দিলে পদে তার ঢালি’,
সে শুধু হাসিল উপক্ষায়!
তুমি গেলে করিতে চুম্বন, সে ফিরালো কঙ্কণের ঘায়!
–গেল চ’লে নারী!
সন্ধান করিয়া ফের, হে সন্ধানী, তারি
দিকে দিকে তরণীর দুরাশা লইয়া,
গর্জনে গর্জনে কাঁদ–“পিয়া, মোর পিয়া!’’
বলো বন্ধু, বুকে তব কেন এত বেগ, এত জ্বালা?
কে দিল না প্রতিদিন? কে ছিঁড়িল মালা?
কে সে গরবিনী বালা? কার এত রূপ এত প্রাণ,
হে সাগর, করিল তোমার অপমান!
হে মজনু, কোন্ সে লায়লীর
প্রণয়ে উন্মাদ তুমি?-বিরহ-অথির
করিয়াছে বিদ্রোহ ঘোষণা, সিন্ধুরাজ,
কোন্ রাজকুমারীর লাগি’? কারে আজ
পরাজিত করি’ রণে, তব প্রিয়া রাজ-দুহিতারে
আনিবে হরণ করি?-সারে সারে
দলে দলে চলে তব তরঙ্গের সেনা,
উষ্ণীষ তাদের শিরে শোভে শুভ্র ফেনা!
ঝটিকা তোমার সেনাপতি
আদেশ হানিয়া চলে উর্ধ্বে অগ্রগতি।
উড়ে চলে মেঘের বেলুন,
‘মাইন্’ তোমার চোরা পর্বত নিপুণ!
হাঙ্গর কুম্ভীর তিমি চলে ‘সাবমেরিন’,
নৌ-সেনা চলিছে নীচে মীন!
সিন্ধু-ঘোটকেতে চড়ি’ চলিয়াছ বীর
উদ্দাম অস্থির!
কখন আনিবে জয় করি’-কবে সে আসিবে তব প্রিয়া,
সেই আশা নিয়া
মুক্তা-বুকে মালা রচি’ নীচে!
তোমার হেরেম্-বাঁদী শত শুক্তি-বধূ অপেক্ষিছে।
প্রবাল গাঁথিছে রক্ত-হার-
হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর-তোমার প্রিয়ার!
বধূ তব দীপাম্বীতা আসিবে কখন?
রচিতেছে নব নব দ্বীপ তারি প্রমোদ-কানন।
বক্ষে তব চলে সিন্ধু-পোত
ওরা তব যেন পোষা কপোতী-কপোত।
নাচায়ে আদর করে পাখীরে তোমার
ঢেউ-এর দোলায়, ওগো কোমল দুর্বার!
উচ্ছ্বাসে তোমার জল উলসিয়া উঠে,
ও বুঝি চুম্বর তব তা’র চঞ্চুপুটে?
আশা তব ওড়ে লুব্ধ সাগর-শকুন,
তটভূমি টেনে চলে তব আশা-তারকার গুণ!
উড়ে যায় নাম-নাহি-জানা কত পাখী,
ও যেন স্বপন তব!-কী তুমি একাকী
ভাব কভু আনমনে যেন,
সহসা লুকাতে চাও আপনারে কেন!
ফিরে চলো ভাঁটি-টানে কোন্ অন্তরালে,
যেন তুমি বেঁচে যাও নিজেরে লুকালে!-
শ্রান্ত মাঝি গাহে গান ভাটিয়ালী সুরে,
ভেসে যেতে চায় প্রাণ দূরে-আরো দূরে।
সীমাহীন নিরুদ্দেশ পথে,
মাঝি ভাসে, তুমি ভাস, আমি ভাসি স্রোতে।
নিরুদ্দেশ! শুনে কোন্ আড়ালীর ডাক
ভাটিয়ালী পথে চলো একাকী নির্বাক?
অন্তরের তলা হ’তে শোন কি আহবান?
কোন্ অন্তরিকা কাঁদে অন্তরালে থাকি’ যেন,
চাহে তব প্রাণ!
বাহিরে না পেয়ে তারে ফের তুমি অন্তরের পানে
লজ্জায়-ব্যথায়-অপমানে!
তারপর, বিরাট পুরুষ! বোঝা নিজ ভুল
জোয়ারে উচ্ছ্বসি’ ওঠো, ভেঙে চল কূল
দিকে দিকে প্লাবনের বাজায়ে বিষাণ
বলো, ‘ প্রেম করে না দুর্বল ওরে করে মহীয়ান্!’
বারণী সাকীরে কহ, ‘ আনো সখি সুরার পেয়ালা!’
আনন্দে নাচিয়া ওঠো দুখের নেশায় বীর, ভোল সব জ্বালা!
অন্তরের নিষ্পেষিত ব্যথার ক্রন্দন
ফেনা হ’য়ে ওঠে মুখে বিষর মতন।
হে শিব, পাগল!
তব কন্ঠে ধরি’ রাখো সেই জ্বালা-সেই হলাহল!
হে বন্ধু, হে সখা,
এতদিনে দেখা হ’ল, মোরা দুই বন্ধু পলাতকা।
কত কথা আছে-কত গান আছে শোনাবার,
কত ব্যথা জানাবার আছে-সিন্ধু, বন্ধু গো আমার!
এসো বন্ধু, মুখোমুখি বসি,
অথবা টানিয়া লহ তরঙ্গের আলিঙ্গন দিয়া, দুঁহু পশি
ঢেউ নাই যেথা-শুধু নিতল সুনীল!-
তিমির কহিয়া দাও-সে যেন খোলে না খিল
থাকে দ্বারে বসি’,
সেইখানে ক’ব কথা। যেন রবি-শশী
নাহি পশে সেথা।
তুমি র’বে-আমি র’ব-আর র’বে ব্যথা!
সেথা শুধু ডুবে র’বে কথা নাহি কহি’,-
যদি কই,-
নাই সেথা দু’টি কথা বই,
আমিও বিরহী, বন্ধু, তুমিও বিরহী!’
চট্টগ্রাম ৩১/০৭/১৯২৬
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
রূপক
|
এবার আমার জ্যোতির্গেহে তিমির প্রদীপ জ্বালো।
আনো অগ্নিবিহীন দীপ্তিশিখার তৃপ্তি অতল কালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো। নয়ন আমার তামস-তন্দ্রালসে
ঢুলে পড়ুক ঘুমের সবুজ রসে,
রৌদ্র-কুহুর দীপক-পাখা পড়ুক টুটুক খসে,
আমার নিদাঘদাহে অমামেঘের নীল অমিয়া ঢালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো। মেঘে ডুবাও সহস্রদল রবি-কমলদীপ,
ফুটাও আঁধার-কদম-ঘুমশাখে মোর স্বপন মণিনীপ।
নিখিলগহন-তিমির তমাল গাছে
কালো কালার উজল নয়ন নাচে,
আলো-রাধা যে কালোতে নিত্য মরণ-যাচে –
ওগো আনো আমার সেই যমুনার জলবিজুলির আলো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো। দিনের আলো কাঁদে আমার রাতের তিমির লাগি
সেথায় আঁধার-বাসরঘরে তোমার সোহাগ আছে জাগি।
ম্লান করে দেয় আলোর দহন-জ্বালা
তোমার হাতের চাঁদ-প্রদীপের থালা,
শুকিয়ে ওঠে তোমার তারা-ফুলের গগন-ডালা।
ওগো অসিত আমার নিশীথ-নিতল শীতল কালোই ভালো।
তিমির প্রদীপ জ্বালো। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
হাস্যরসাত্মক
|
সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?”সাহেব কহেন, “কী চমৎকার,
বলতেই দাও, আহা হা!”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি,
বাহাহা বাহাহা বাহাহা!”সাহেব কহেন, “কথাটা কি জান? সেদিন -”
মোসাহেব বলে, “জানি না আবার?
ঐ যে, কি বলে, যেদিন -”সাহেব কহেন, “সেদিন বিকেলে
বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।”
মোসাহেব বলে, “আহা হা, শুনেছ?
কিবা অপরুপ গল্প!”সাহেব কহেন, “আরে ম’লো! আগে
বলতেই দাও গোড়াটা!”
মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা! হুজুরের গোড়া!
এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!”সাহেব কহেন, “কি বলছিলাম,
গোলমালে গেল গুলায়ে!”
মোসাহেব বলে, “হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে।
দিব কি হস্ত বুলায়ে?”সাহেব কহেন, “শোনো না! সেদিন
সূর্য্য উঠেছে সকালে!”
মোসাহেব বলে, “সকালে সূর্য্য? আমরা কিন্তু
দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!”সাহেব কহেন, “ভাবিলাম, যাই,
আসি খানিকটা বেড়ায়ে,”
মোসাহেব বলে, “অমন সকাল! যাবে কোথা বাবা,
হুজুরের চোখ এড়ায়ে!”সাহেব কহেন, “হ’ল না বেড়ানো,
ঘরেই রহিনু বসিয়া!”
মোসাহেব বলে, “আগেই বলেছি! হুজুর কি চাষা,
বেড়াবেন হাল চষিয়া?”সাহেব কহেন, “বসিয়া বসিয়া
পড়েছি কখন ঝিমায়ে!”
মোসাহেব বলে, “এই চুপ সব! হুজুর ঝিমান!
পাখা কর, ডাক নিমাইএ”সাহেব কহেন, “ঝিমাইনি, কই
এই ত জেগেই রয়েছি!”
মোসাহেব বলে, “হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা
আগেই সবারে কয়েছি!”সাহেব কহেন, “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত
হনুমান আর অপদেব!”
“হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?”
প্রণামিয়া কয় মোসাহেব।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
শপথ প্রথম দিবস- বেলার শপথ রাতের তিমির- ঘন,
করেন নি প্রভু বর্জন তোমা', করেন নি দুশমনী কখনো।
পরকাল সে যে উত্তমতর, হইকাল আর দুনিয়া হ'তে,
অচিরাত তব প্রভু দানিবেন (সম্পদ) খুশী হইবে যাতে।
পিতৃহীন সে তোমারে তিনি কি করেন নি পরে শরন দান?
ভ্রান্ত পথে তোমারে পাইয়া তিনিই না তোমা পথ দেখান?
তিনি কি পাননি অভাবী তোমারে আভাব সব করেন মোচন?
করিয়ো না তাই পিতৃহীনের উপরে কখনো উতপীড়ন।
যে জন প্রার্থী--- তাহারে দেখিও করো না তিরস্কার কভু,
বক্ত করহ নিয়ামত যাহা দিলেন তোমারে তব প্রভু।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
রূপক
|
আমার কোন কুলে আজ ভিড়লো তরী
এ কোন সোনার গাঁয়?
আমার ভাটির তরী আবার কেন
উজান যেতে চায়?দুখেরে কান্ডারী করি
আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙ্গা তরী
তুমি ডাক দিলে কি স্বপন পরী
নয়ন ইশারায় গো?নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিলে ঝড়ের রাতি
কে এলে মোর সুরের সাথি
গানের কিনারায়?সোনার দেশের সোনার মেয়ে
ওগো হবে কি মোর তরীর নেয়ে
এবার ভাঙ্গা তরী চল বেয়ে
রাঙা অলকায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
শোকমূলক
|
(কবি শরদিন্দু রায়ের অকালমৃত্যু উপলক্ষ্যে)বাঁশির দেবতা! লভিয়াছ তুমি হাসির অমর-লোক,
হেথা মর-লোকে দুঃখী মানব করিতেছি মোরা শোক!
অমৃত-পাথারে ডুব দিলে তুমি ক্ষীরোদ-শয়ন লভি,
অনৃতের শিশু মোরা কেঁদে বলি, মরিয়াছ তুমি কবি!
হাসির ঝঞ্ঝা লুটায়ে পড়েছে নিদাঘের হাহাকারে,
মোরা কেঁদে বলি, কবি খোয়া গেছে অস্ত-খেয়ার পারে!আগুন-শিখায় মিশেছে তোমার ফাগুন-জাগানো হাসি,
চিতার আগুনে পুড়ে গেছ ভেবে মোরা আঁখি-জলে ভাসি।
অনৃত তোমার যাহা কিছু কবি তাই হয়ে গেছে ছাই,
অমৃত তোমার অবিনাশী যাহা আগুনে তা পুড়ে নাই।
চির-অতৃপ্ত তবু কাঁদি মোরা, ভরে না তাহাতে বুক,
আজ তব বাণী আন্-মুখে শুনি, তুমি নাই, তুমি মূক।অতি-লোভী মোরা পাই না তৃপ্তি সুরভিতে শুধু ভাই,
সুরভির সাথে রূপ-ক্ষুধাতুর ফুলেরও পরশ চাই।
আমরা অনৃত তাই তো অমৃতে ভরে ওঠে নাকো প্রাণ,
চোখে জল আসে দেখিয়া ত্যাগীর আপনা-বিলানো দান।
তরুণের বুকে হে চির-অরুণ ছড়ায়েছ যত লালি,
সেই লালি আজ লালে লাল হয়ে কাঁদে, খালি সব খালি!কাঁদায়ে গিয়াছ, নবরূপ ধরে হয়তো আসিবে ফিরে,
আসিয়া আবার আধ-গাওয়া গান গাবে গঙ্গারই তীরে,
হয়তো তোমায় চিনিব না, কবি, চিনিব তোমার বাঁশি,
চিনিব তোমার ওই সুর আর চল-চঞ্চল হাসি।
প্রাণের আলাপ আধ-চেনাচেনি দূরে থেকে শুধু সুরে,
এবার হে কবি, করিব পূর্ণ ওই চির-কবি-পুরে।…ভালোই করেছ ডিঙিয়া গিয়াছ নিত্য এ কারাগার,
সত্য যেখানে যায় নাকো বলা, গৃহ নয় সে তোমার।
গিয়াছ যেখানে শাসনে সেখানে নহে নিরুদ্ধ বাণী,
ভক্তের তরে রাখিয়ো সেখানে আধেক আসনখানি।
বন্দী যেখানে শুনিবে তোমার মুক্তবদ্ধ সুর, –
গঙ্গার কূলে চাই আর ভাবি কোথা সেই থসুর-পুর!গণ্ডির বেড়ি কাটিয়া নিয়াছ অনন্তরূপ টানি,
কারও বুকে আছ মূর্তি ধরিয়া, কারও বুকে আছ বাণী।
সে কি মরিবার? ভাঙি অনিত্যে নিত্য নিয়াছ বরি,
ক্ষমা করো কবি, তবু লোভী মোরা শোক করি, কেঁদে মরি।
না-দেখা ভেলায় চড়িয়া হয়তো আজিও সন্ধ্যাবেলা
গঙ্গার কুলে আসিয়া হাসিছ দেখে আমাদের খেলা!হউক মিথ্যা মায়ার খেলা এ তবুও করিব শোক,
‘শান্তি হউক’ বলি যুগে যুগে ব্যথায় মুছিব চোখ!
আসিবে আবারও নিদাঘ-শেষের বিদায়ের হাহাকার,
শাঙনের ধারা আনিবে স্মরণে ব্যাথা-অভিষেক তার।
হাসি নিষ্ঠুর যুগে যুগে মোরা স্নিগ্ধ অশ্রু দিয়া,
হাসির কবিরে ডাকিব গভীরে শোক-ক্রন্দন নিয়া। (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ছড়া
|
[সুর : ‘একদা তুমি প্রিয়ে আমারই এ তরুমূলে’]একদা তুমি আগা দৌড়ে কে ভাগা মুরগি লেকে।
তোমারে ফেলনু চিনে ওই আননে জমকালো চাপ দাড়ি দেখে॥
কালো জাম খাচ্ছিলে যে সেইদিন সেই গাছে চড়ে
কালো জাম মনে করে ফেললে খেয়ে ভোমরা ধরে।
‘চুঁ করো আওর চাঁ করো ছোড়ে গা নেই,
সব কুছ কালা কালা খা জায়ে গা’ – বললে হেঁকে॥
ভুলো আর টেমি জিমি চেনে যে ওই ঝাঁকড় চুলে,
তোমারে দেখলে পরে তারস্বরে আসে তেড়ে ল্যাজুড় তুলে।
ও-পাড়ার হীরু তোমায় দেখেই পালায় পগার-পারে,
‘রুপিয়া লে আও,’ বলে ধরলে তাহার ছাগলটারে।
দেখিয়াই মটরু মিয়াঁর মুরগি লুকায় ঝোপের আড়ে,
তাই কি ছেলেমেয়ে মুরগি-চোরা বলে ডাকে॥ (ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
১
শহীদের ঈদ এসেছে আজ
শিরোপরি খুন-লোহিত তাজ,
আল্লাহর রাহে চাহে সে ভিখ্:
জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে
আল্লার রাহে তাহারে দে,
চাহি না ফাঁকির মণিমানিক।
২
চাহি না ক’ গাভী দুম্বা উট,
কতটুকু দান? ও দান ঝুট।
চাই কোরবানী, চাই না দান।
রাখিতে ইজ্জত্ ইসলামের
শির চাই তোর, তোর ছেলের,
দেবে কি? কে আছ মুসলমান?
৩
ওরে ফাঁকিবাজ, ফেরেব-বাজ,
আপনারে আর দিস্নে লাজ,-
গরু ঘুষ দিয়ে চাস্ সওয়াব?
যদিই রে তুই গরুর সাথ
পার হয়ে যাস পুল্সেরাত,
কি দিবি মোহাম্মদে জওয়াব।
৪
শুধাবেন যবে-ওরে কাফের,
কি করেছ তুমি ইসলামের?
ইসলামে দিয়ে জাহান্নম
আপনি এসেছ বেহেশ্ত্ ’পর-
পুণ্য-পিশাচ! স্বার্থপর!
দেখাস্নে মুখ, লাগে শরম!
৫
গরুরে করিলে সেরাত পার,
সন্তানে দিলে নরক-নার!
মায়া-দোষে ছেলে গেল দোজখ।
কোরবানী দিলি গরু-ছাগল,
তাদেরই জীবন হ’ল সফল
পেয়েছে তাহারা বেহেশ্ত্-লোক!
৬
শুধু আপনারে বাঁচায় যে,
মুসলিম নহে, ভন্ড সে!
ইসলাম বলে-বাঁচ সবাই!
দাও কোরবানী জান্ ও মাল,
বেহেশ্ত্ তোমার কর হালাল।
স্বার্থপরের বেহেশ্ত্ নাই।
৭
ইসলামে তুমি দিয়ে কবর
মুসলিম ব’লে কর ফখর!
মোনাফেক তুমি সেরা বে-দীন!
ইসলামে যারা করে জবেহ্,
তুমি তাহাদেরি হও তাবে।
তুমি জুতো-বওয়া তারি অধীন।
৮
নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং,
ইয়া উয়া প’রে সেজেছ সং,
ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম!
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কর জড়,
ত্যাগের বেলাতে জড়সড়!
তোর নামাজের কি আছে দাম?
৯
খেয়ে খেয়ে গোশ্ত্ রুটি তো খুব
হয়েছ খোদার খাসী বেকুব,
নিজেদের দাও কোরবানী।
বেঁচে যাবে তুমি, বাঁচিবে দ্বীন,
দাস ইসলাম হবে স্বাধীন,
গাহিছে কামাল এই গানই!
১০
বাঁচায়ে আপনা ছেলে-মেয়ে
জান্নাত্ পানে আছ্ চেয়ে
ভাবিছ সেরাত হবেই পার।
কেননা, দিয়েছ সাত জনের
তরে এক গরু! আর কি, ঢের!
সাতটি টাকায় গোনাহ্ কাবার!
১১
জান না কি তুমি, রে বেঈমান!
আল্লা সর্বশক্তিমান
দেখিছেন তোর সব কিছু?
জাব্বা-জোব্বা দিয়ে ধোঁকা
দিবি আল্লারে, ওরে বোকা!
কেয়ামতে হবে মাথা নীচু!
১২
ডুবে ইসলাম, আসে আঁধার!
ব্রাহিমের মত আবার
কোরবানী দাও প্রেয় বিভব!
“জবীহুল্লাহ্” ছেলেরা হোক,
যাক সব কিছু-সত্য রোক!
মা হাজেরা হোক মায়েরা সব।
১৩
খা’বে দেখেছিলেন ইব্রাহিম-
“দাও কোরবানী মহামহিম!”
তোরা যে দেখিস্ দিবালোকে
কি যে দুর্গতি ইসলামের!
পরীক্ষা নেন খোদা তোদের
হাববের সাথে বাজি রেখে!
১৪
যত দিন তোরা নিজেরা মেষ,
ভীরু দুর্বল, অধীন দেশ,-
আল্লার রাহে ততটা দিন
দিও না ক’ পশু কোরবানী,
বিফল হবে রে সবখানী!
(তুই) পশু চেয়ে যে রে অধম হীন!
১৫
মনের পশুরে কর জবাই,
পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।
কশাই-এর আবার র্কোবানী!-
আমাদের নয়, তাদের ঈদ,
বীর-সুত যারা হ’ল শহীদ,
অমর যাদের বীরবাণী।
১৬
পশু কোরবানী দিস্ তখন
আজাদ-মুক্ত হবি যখন
জুলম-মুক্ত হবে রে দীন।-
কোরবানীর আজ এই যে খুন
শিখা হয়ে যেন জালে আগুন,
জালিমের যেন রাখে না চিন্!!
আমিন্ রাব্বিল্ আলামিন!
আমিন রাব্বিল্ আলামিন!!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
যেখানেতে দেখি যাহা
মা- এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শিতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।কত করি উৎপাত
আবদার দিন রাত,
সব স'ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজের র'ন নাহি খেয়ে
শত দোষে দোষী তবু মা তো তাজে না।ছিনু খোকা এতটুকু,
একটুতে ছোট বুক
যখন ভাঙ্গিয়া যেতো, মা-ই সে তখন
বুকে করে নিশিদিন
আরাম-বিরাম-হীন
দোলা দেয়া শুধাতেন, 'কি হলো খোকন?'আহা সে কতই রাতি
শিয়রে জ্বালায়ে বাতি
একটু অসুখ হলে জাগেন মাতা,
সব-কিছু ভুলে গিয়ে
কেবল আমায়ের নিয়ে
কত আকুলতা যেন জগন্মাতা।যখন জন্ম নিনু
কত অসহায় ছিনু
কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোন কিছু,
ওঠা বসা দূরে থাক-
মুখে নাহি ছিল নাক,
চাহনি ফিরিত শুধু আর পিছি পিছু।তখন সে মা আবার
চুমু খেয়ে বারবার
চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়
বুঝিয়া নিতেন যত
আমার কি ব্যথা হোতো,
বল কে এমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়।।তারপর কত দুখে
আমারে ধরিয়া বুকে
করিয়া তুলেছে মাতা দেখ কত বড়
কত না সে সুন্দর
এ দেহ এ অন্তর
সব মোরা ভাই বোন হেথা যত পড়।পাঠশালা হতে যবে
ঘরে ফিরি যাব সবে,
কত না আদরে কোলে তুলি' নেবে মাতা,
খাবার ধরিয়া মুখে
শুধাবেন কত সুখে
কত আজ লেখা হলো, পড়া কত পাতা?পড়া লেখা ভালো হ'লে
দেখেছ সে কত ছলে
ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে।
বলে, 'মর খোকামনি!
হীরা- মানিকের খনি,
এমনটি নাই কারো!' শুনে বুক ভরে।গা'টি গরম হলে
মা সে চোখের জলে
ভেসে বলে 'ওরে যাদু কি হয়েছে বল।'
কত দেবতার 'থানে'
পীরে মা মানত মানে-
মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।যখন ঘুমায়ে থাকি
জাগে রে কাহার আ৬খি
আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম।
তাই কত ছড়া গানে
ঘুম-পাড়ানীরে আনে,
বলে,'ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চখে চুম।'দিবানিশি ভাবনা
কিসে ক্লেশ পাব না,
কিসে সে মাউষ হব, বড় হব কিসে;
বুক ভরে ওঠে মা'র
ছেলেরি গরবে তাঁর,
সব দুখ সুখ হয় মায়ের আশিসে।আয় তবে ভাই বোন,
আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধুলি শিরে লয়ে মা'র;
মা'র বড় কেহ নাই-
কেউ নাই কেউ নাই!
নত করি বল সবে 'মা আমার! মা আমার!'
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রকৃতিমূলক
|
বিদায়, হে মোর বাতায়ন-পাশে নিশীথ জাগার সাথী!
ওগো বন্ধুরা, পান্ডুর হয়ে এল বিদায়ের রাতি!
আজ হ'তে হ'ল বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,
আজ হ'তে হ'ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।...অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ কপোল রাখি’
কাঁদিতেছে চাঁদ, "মুসাফির জাগো, নিশি আর নাই বাকি।"
নিশীথিনী যায় দূর বন-ছায়, তন্দ্রায় ঢুলুঢুল্,
ফিরে ফিরে চায়, দু’হাতে জড়ায় আঁধারের এলোচুল।--
চমকিয়া জাগি, ললাটে আমার কাহার নিশাস লাগে?
কে করে বীজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে?
জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে জাগিছে স্বপনচারী
নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক-তরুর সারি!তোমাদের আর আমার আঁখির পল্লব-কম্পনে
সারা রাত মোরা কয়েছি যে কথা, বন্ধু, পড়িছে মনে!--
জাগিয়া একাকী জ্বালা ক'রে আঁখি আসিত যখন জল,
তোমাদের পাতা মনে হ’ত যেনো সুশীতল করতল
আমার প্রিয়ার!--তোমার শাখার পল্লবমর্মর
মনে হ’ত যেন তারি কন্ঠের আবেদন সকাতর।
তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আঁখির কাজল-লেখা,
তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা।
তব ঝিরঝির মিরমির যেন তারি কুন্ঠিত বাণী,
তোমার শাখায় ঝুলানো তারির শাড়ির আঁচলখানি।
--তোমার পাখার হাওয়া
তারি আঙ্গুলি-পরশের মত নিবিড় আদর-ছাওয়া!ভাবিতে ভাবিতে ঢুলিয়া পড়েছি ঘুমের শ্রান্ত কোলে,
ঘুমায়ে স্বপন দেখেছি,-- তোমারি সুনীল ঝালর দোলে
তেমনি আমার শিথানের পাশে। দেখেছি স্বপনে, তুমি
গোপনে আসিয়া গিয়াছ আমার তপ্ত ললাট চুমি’।হয়ত স্বপনে রাড়ায়েছি হাত লইতে পরশখানি,
বাতায়নে ঠেকি’ ফিরিয়া এসেছে, লইয়াছি লাজে টানি’।
বন্ধু, এখন রুদ্ধ করিতে হইবে সে বাতায়ন!
ডাকে পথ, হাঁকে যাত্রীরা, ‘কর বিদায়ের আয়োজন’। --আজি বিদায়ের আগে
আমারে জানাতে তোমারে জানিতে কত কি যে সাধ জানে!
মর্মের বাণী শূনি তব, শুধু মুখের ভাষায় কেন
জানিতে চায় ও বুকের ভাষারে লোভাতুর মন হেন?
জানি--মুখে মুখে হবে না মোদের কোনদিন জানাজানি,
বুকে বুকে শুধু বাজাইবে বীণা বেদনার বীণাপাণি।হয়তো তোমারে দেখিয়াছি , তুমি যাহা নও তাই ক'রে,
ক্ষতি কি তোমার, যদি গো আমার তাতেই হৃদয় ভরে?
সুন্দর যদি করে গো তোমারে আমার আঁখির জল,
হারা-মোমতাজে লয়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজম'ল,
--বল তাহে কার ক্ষতি?
তোমারে লইয়া সাজাব না ঘর, সৃজিব অমরাবরী।।..হয়ত তোমার শাখায় কখনো, বসেনি আসিয়া পাখী
তোমার কুঞ্জে পত্রপুঞ্জে কোকিল ওঠেনি ডাকি'।
শূন্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া পল্লব-আবেদন
জেগেছে নিশীথে জাগেনি ক' সাথে খুলি' কেহ বাতায়ন।
-- সব আগে আমি আসি'
তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ, গিয়াছি গো ভালোবাসি!
তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয়-লেখা,
এইটুকু হোক সান্ত্বনা মোর, হোক বা না হোক্ দেখা।...তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না।
কোলাহল করি' সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না
--নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।--শুধাইতে নাই, তবুও শুধাই আজিকে যাবার আগে--
ঐ পল্লব-জাফ্রি খুলিয়া তুমিও কি অনুরাগে
দেখেছ আমারে--দেখিয়াছি যবে তামি বাতায়ন খুলি'?
হাওয়ায় না মোর অনুরাগে তব পাতা উঠিয়াছে দুলি'।
তোমার পাতার হরিৎ আঁচলে চাঁদিনী ঘুমায়ে যবে,
মূর্ছিতা হবে সুখের আবেশে,--সে আলোর উৎসবে
মনে কি পড়িবে এই ক্ষণিকের অতিথির কথা আর?
তোমার নিশ্বাস শূন্য এ ঘরে করিবে কি হাহাকার?
চাঁদের আলোক বিস্বাদ কি গো লাগিবে সেদিন চোখে?
খড়খড়ি খুলি' চেয়ে র'বে দূর অস্ত অলখ-লোকে?-
--অথবা এমনি করি'
দাঁড়ায়ে রহিবে আপন ধেয়ানে সারা দিনমান ভরি'?মলিন মাটির বন্ধনে বাঁধা হয় অসহায় তরু,
পদতলে ধূলি, উর্দ্ধে তোমার শূন্য গগন-মরু।
দিবসে পুড়িছ রৌদ্রের দাহে, নিশীথে ভিজিছ হিমে,
কাঁদিবারও নাই শকতি, মৃত্যু-আফিসে পড়িছ ঝিমে!
তোমার দুঃখ তোমারেই যদি, বন্ধু, ব্যথা না হানে,
কি হবে রিক্ত চিত্ত ভরিয়া আমার ব্যথার দানে!...
* * *
ভুল করে' কভু আসিলে স্মরণে অমনি তা যেনো ভুলি'।
যদি ভুল ক'রে কখনো এ মোর বাতায়ন যায় খুলি',
বন্ধ করিয়া দিও পুনঃ তায়!.......তোমার জাফ্রি-ফাঁকে
খুঁজো না তাহারে গগন-আঁধারে--মাটিতে পেলে না যাকে!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
এত দিনে অবেলায়-
প্রিয়তম!
ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম
দিবাযামী
যবে আমি
নেচে ফিরি র”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়-
এ দিনে অ-বেলায়
জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি।
পূজারিণী!
ঐ কন্ঠ, ও-কপোত- কাঁদানো রাগিণী,
ঐ আখি, ঐ মুখ,
ঐ ভুর”, ললাট, চিবুক,
ঐ তব অপরূপ রূপ,
ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী জিনি’-
চিনি সব চিনি।
তাই আমি এতদিনে
জীবনের আশাহত ক্লান- শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে
মূর্ছাতুর সারা প্রাণ ভ’রে
ডাকি শুকু ডাকি তোমা’
প্রিয়তমা!
ইষ্ট মম জপ-মালা ঐ তব সব চেয়ে মিষ্ট নাম ধ’রে!
তারি সাথে কাঁদি আমি-
ছিন্ন-কন্ঠে কাঁদি আমি, চিনি তোমা’, চিনি চিনি চিনি,
বিজয়িনী নহ তুমি-নহ ভিখারিনী,
তুমি দেবী চির-শুদ্ধ তাপস-কুমারী, তুমি মম চির-পূজারিণী!
যুগে যুগে এ পাষাণে বাসিয়াছ ভালো,
আপনারে দাহ করি, মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো,
বারে বারে করিয়াছ তব পূজা-ঋণী।
চিনি প্রিয়া চিনি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি চিনি চিনি!
চিনি তোমা’ বারে বারে জীবনের অস–ঘাটে, মরণ-বেলায়,
তারপর চেনা-শেষে
তুমি-হারা পরদেশে
ফেলে যাও একা শুণ্য বিদায়-ভেলায়!
দিনানে-র প্রানে- বসি’ আঁখি-নীরে তিনি’
আপনার মনে আনি তারি দূর-দূরানে-র স্মৃতি-
মনে পড়ে-বসনে-র শেষ-আশা-ম্লান মৌন মোর আগমনী সেই নিশি,
যেদিন আমার আঁখি ধন্য হ’ল তব আখি-চাওয়া সনে মিশি।
তখনো সরল সুখী আমি- ফোটেনি যৌবন মম,
উন্মুখ বেদনা-মুখী আসি আমি ঊষা-সম
আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর,
জীবনের ফোটো-ফোটো রাঙা নিশি-ভোর,
বাধা বন্ধ-হারা
অহেতুক নেচে-চলা ঘূর্ণিবায়ু-পারা
দুরন- গানের বেগ অফুরন- হাসি
নিয়ে এনু পথ-ভোলা আমি অতি দূর পরবাসী।
সাথে তারি
এনেছিনু গৃহ-হারা বেদনার আঁখি-ভরা বারি।
এসে রাতে-ভোরে জেগে গেয়েছিনু জাগরণী সুর-
ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলে তুমি কাছে এসেছিলে,
মুখ-পানে চেয়ে মোর সকর”ণ হাসি হেসেছিলে,-
হাসি হেরে কেঁদেছিনু-‘তুমি কার পোষাপাখী কান-ার বিধুর?’
চোখে তব সে কী চাওয়া! মনে হ’ল যেন
তুমি মোর ঐ কন্ঠ ঐ সুর-
বিরহের কান্না-ভারাতুর
বনানী-দুলানো,
দখিনা সমীরে ডাকা কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো
আদি জন্মদিন হ’তে চেন তুমি চেন!
তারপর-অনাদরে বিদায়ের অভিমান-রাঙা
অশ্র”-ভাঙা-ভাঙা
ব্যথা-গীত গেয়েছিনু সেই আধ-রাতে,
বুঝি নাই আমি সেই গান-গাওয়া ছলে
কারে পেতে চেয়েছিনু চিরশূন্য মম হিয়া-তলে-
শুধু জানি, কাঁচা-ঘুমে জাগা তব রাগ-অর”ণ-আঁখি-ছায়া
লেগেছিল মম আঁখি-পাতে।
আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে
বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে
ঝ’লেছিল, গ’লেছিল গাঢ় ঘন বেদানার মায়া,-
কর”ণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী
অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া।
তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো
পূজারিণী! আঁখি-দীপ-জ্বালা তব সেই সিগ্ধ সকর”ণ আলো।
তারপর-গান গাওয়া শেষে
নাম ধ’রে কাছে বুঝি ডেকেছিনু হেসে।
অমনি কী গ’র্জে-উঠা র”দ্ধ অভিমানে
(কেন কে সে জানে)
দুলি’ উঠেছিল তব ভুর”-বাঁধা সি’র আঁখি-তরী,
ফুলে উঠেছিল জল, ব্যথা-উৎস-মুখে তাহা ঝরঝর
প’ড়েছিল ঝরি’!
একটু আদরে এত অভিমানে ফুলে-ওঠা, এত আঁখি-জল,
কোথা পেলি ওরে কা’র অনাদৃতা ওরে মোর ভিখারিনী
বল্ মোরে বল্ ।
এই ভাঙা বুকে
ঐ কান্না-রাঙা মুখ থুয়ে লাজ-সুখে
বল্ মোরে বল্-
মোরে হেরি’ কেন এত অভিমান?
মোর ডাকে কেন এত উথলায় চোখে তব জল?
অ-চেনা অ-জানা আমি পথের পথিক
মোরে হেরে জলে পুরে ওঠে কেন এত ঐ বালিকার আঁখি অনিমিখ?
মোর পানে চেয়ে সবে হাসে,
বাঁধা-নীড় পুড়ে যায় অভিশপ্ত তপ্ত মোর শ্বাসে;
মণি ভেবে কত জনে তুলে পরে গলে,
মণি যবে ফণী হয়ে বিষ-দগ্ধ-মুখে
দংশে তার বুকে,
অমনি সে দলে পদতলে!
বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা,
ভিখরিণী! তারে নিয়ে এ কি তব অকর”ণ খেলা?
তারে নিয়ে এ কি গূঢ় অভিমান? কোন্ অধিকারে
নাম ধ’রে ডাকটুকু তা’ও হানে বেদনা তোমারে?
কেউ ভালোবাসে নাই? কেই তোমা’ করেনি আদর?
জন্ম-ভিখারিনী তুমি? তাই এত চোখে জল, অভিমানী কর”ণা-কাতর!
নহে তা’ও নহে-
বুকে থেকে রিক্ত-কন্ঠে কোন্ রিক্ত অভিমানী কহে-
‘নহে তা’ও নহে।’
দেখিয়াছি শতজন আসে এই ঘরে,
কতজন না চাহিতে এসে বুকে করে,
তবু তব চোখে-মুখে এ অতৃপ্তি, এ কী স্নেহ-ক্ষুধা
মোরে হেলে উছলায় কেন তব বুক-ছাপা এত প্রীতি সুধা?
সে রহস্য রাণী!
কেহ নাহি জানে-
তুমি নাহি জান-
আমি নাহি জানি।
চেনে তা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ-
কোথা হ’তে আসে এত অকারণে প্রাণে প্রাণে বেদনার টান!
নাহি বুঝিয়াও আমি সেদিন বুঝিনু তাই, হে অপরিচিতা!
চির-পরিচিতা তুমি, জন্ম জন্ম ধ’রে অনাদৃতা সীতা!
কানন-কাঁদানো তুমি তাপস-বালিকা
অনন- কুমারী সতী, তব দেব-পূজার থালিকা
ভাঙিয়াছি যুগে যুগে, ছিঁড়িয়াছি মালা
খেলা-ছলে; চিন-মৌনা শাপভ্রষ্টা ওগো দেববালা!
নীরবে স’য়েছ সবি-
সহজিয়া! সহজে জেনেছ তুমি, তুমি মোর জয়লক্ষ্মী, আমি তব কবি।
তারপর-নিশি শেষে পাশে ব’সে শুনেছিনু তব গীত-সুর
লাজে-আধ-বাধ-বাধ শঙ্কিত বিধুর;
সুর শুনে হ’ল মনে- ক্ষণে ক্ষণে
মনে-পড়ে-পড়ে না হারা কন্ঠ যেন
কেঁদে কেঁদে সাধে, ‘ওগো চেন মোরে জন্মে জন্মে চেন।’
মথুরায় গিয়ে শ্যাম, রাধিকার ভুলেছিল যবে,
মনে লাগে- এই সুর গীত-রবে কেঁদেছিল রাধা,
অবহেলা-বেঁধা-বুক নিয়ে এ যেন রে অতি-অন-রালে ললিতার কাঁদা
বন-মাঝে একাকিনী দময়নী ঘুরে ঘুরে ঝুরে,
ফেলে-যাওয়া নাথে তার ডেকেছিল ক্লান–কন্ঠে এই গীত-সুরে।
কানে- প’ড়ে মনে
বনলতা সনে
বিষাদিনী শকুন-লা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে।
হেম-গিরি-শিরে
হারা-সতী উমা হ’য়ে ফিরে
ডেকেছিল ভোলানাথে এমনি সে চেনা কন্ঠে হায়,
কেঁদেছিল চির-সতী পতি প্রিয়া প্রিয়ে তার পেতে পুনরায়!-
চিনিলাম বুঝিলাম সবি-
যৌবন সে জাগিল না, লাগিল না মর্মে তাই গাঢ় হ’য়ে তব মুখ-ছবি।
তবু তব চেনা কন্ঠ মম কন্ঠ -সুর
রেখে আমি চ’লে গেনু কবে কোন্ পল্লী-পথে দূরে!–
দু’দিন না যেতে যেতে এ কি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে
প্রথম উঠিল কাঁদি’ অপরূপ ব্যথা-গন্ধ নাভি-পদ্ম-মুলে!
খুঁজে ফিরি কোথা হ’তে এই ব্যাথা-ভারাতুর মদ-গন্ধ আসে-
আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে।
কেঁদে ওঠে লতা-পাতা,
ফুল পাখি নদীজল
মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল,
কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন-জ্বালায়-জাগা অতৃপ্ত বিধাতা!
পোড়া প্রাণ জানিল না কারে চাই,
চীৎকারিয়া ফেরে তাই-‘কোথা যাই,
কোথা গেলে ভালোবাসাবাসি পাই?
হু-হু ক’রে ওঠে প্রাণ, মন করে উদাস-উদাস,
মনে হয়-এ নিখিল যৌবন-আতুর কোনো প্রেমিকের ব্যথিত হুতাশ!
চোখ পুরে’ লাল নীল কত রাঙা, আবছায়া ভাসে, আসে-আসে-
কার বক্ষ টুটে
মম প্রাণ-পুটে
কোথা হ’তে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ-ব্যথা আসে?
মন-মৃগ ছুটে ফেরে; দিগন-র দুলি’ ওঠে মোর ক্ষিপ্ত হাহাকার-ত্রাসে!
কস’রী হরিণ-সম
আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেলে গন্ধ-অন্ধ মন-মৃগ মম!
আপনারই ভালোবাসা
আপনি পিইয়া চাহে মিটাইতে আপনার আশা!
অনন- অগস-্য-তৃষাকুল বিশ্ব-মাগা যৌবন আমার
এক সিন্ধু শুষি’ বিন্দু-সম, মাগে সিন্ধু আর!
ভগবান! ভগবান! এ কি তৃষ্ণা অনন- অপার!
কোথা তৃপ্তি? তৃপ্তি কোথা? কোথা মোর তৃষ্ণা-হরা প্রেম-সিন্ধু
অনাদি পাথার!
মোর চেয়ে স্বে”ছাচারী দুরন- দুর্বার!
কোথা গেলে তারে পাই,
যার লাগি’ এত বড় বিশ্বে মোর নাই শানি- নাই!
ভাবি আর চলি শুধু, শুধু পথ চলি,
পথে কত পথ-বালা যায়,
তারি পাছে হায় অন্ধ-বেগে ধায়
ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন,
পিছু ফিরে কেহ যদি চায়, ‘ভিক্ষা লহ’ ব’লে কেহ আসে দ্বার-পাশে।
প্রাণ আরো কেঁদে ওঠে তাতে,
গুমরিয়া ওঠে কাঙালের লজ্জাহীন গুর” বেদনাতে!
প্রলয়-পয়োধি-নীরে গর্জে-ওঠা হুহুঙ্কার-সম
বেদনা ও অভিমানে ফুলে’ ফুলে’ দুলে’ ওঠে ধূ-ধূ
ক্ষোভ-ক্ষিপ্ত প্রাণ-শিখা মম!
পথ-বালা আসে ভিক্ষা-হাতে,
লাথি মেরে চুর্ণ করি গর্ব তার ভিক্ষা-পাত্র সাথে।
কেঁদে তারা ফিরে যায়, ভয়ে কেহ নাহি আসে কাছে;
‘অনাথপিন্ডদ’-সম
মহাভিক্ষু প্রাণ মম
প্রেম-বুদ্ধ লাগি’ হায় দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে,
“ভিক্ষা দাও, পুরবাসি!
বুদ্ধ লাগি’ ভিক্ষা মাগি, দ্বার হ’তে প্রভু ফিরে যায় উপবাসী!’’
কত এল কত গেল ফিরে,-
কেহ ভয়ে কেহ-বা বিস্ময়ে!
ভাঙা-বুকে কেহ,
কেহ অশ্র”-নীরে-
কত এল কত গেল ফিরে!
আমি যাচি পূর্ণ সমর্পণ,
বুঝিতে পারে না তাহা গৃহ-সুখী পুরনারীগণ।
তারা আসে হেসে;
শেষে হাসি-শেষে
কেঁদে তারা ফিরে যায়
আপনার গৃহ স্নেহ”ছায়ে।
বলে তারা, “হে পথিক! বল বল তব প্রাণ কোন্ ধন মাগে?
সুরে তব এত কান্না, বুকে তব কা’র লাগি এত ক্ষুধা জাগে?
কি যে চাই বুঝে না ক’ কেহ,
কেহ আনে প্রাণ মম কেহ- বা যৌবন ধন,
কেহ রূপ দেহ।
গর্বিতা ধনিকা আসে মদমত্তা আপনার ধনে
আমারে বাঁধিতে চাহে রূপ-ফাঁদে যৌবনের বনে।….
সর্ব ব্যর্থ, ফিরে চলে নিরাশায় প্রাণ
পথে পথে গেয়ে গেয়ে গান-
“কোথা মোর ভিখারিনী পূজারিণী কই?
যে বলিবে-‘ভালোবেসে সন্ন্যাসিনী আমি
ওগো মোর স্বামি!
রিক্তা আমি, আমি তব গরবিনী,বিজয়িনী নই!”
মর” মাঝে ছুটে ফিরি বৃথা,
হু হু ক’রে জ্ব’লে ওঠে তৃষা-
তারি মাঝে তৃষ্ণা-দগ্ধ প্রাণ
ক্ষণেকের তরে কবে হারাইল দিশা।
দূরে কার দেখা গেল হাতছানি যেন-
ডেকে ডেকে সে-ও কাঁদে-
‘আমি নাথ তব ভিখারিনী,
আমি তোমা’ চিনি,
তুমি মোরে চেন।’
বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা ছাষা!
‘ভিক্ষা দাও’ ব’লে আমি এনু তার দ্বারে,
কোথা ভিখারিনী? ওগো এ যে মিথ্যা মায়াবিনী,
ঘরে ডেকে মারে।
এ যে ক্রূর নিষাদের ফাঁদ,
এ যে ছলে জিনে নিতে চাহে ভিখারীর ঝুলির প্রসাদ।
হ’ল না সে জয়ী,
আপনার জালে প’ড়ে আপনি মরিল মিথ্যাময়ী।
কাঁটা-বেঁধা রক্ত মাথা প্রাণ নিয়ে এনু তব পুরে,
জানি নাই ব্যথাহত আমার ব্যথায়
তখনো তোমার প্রাণ পুড়ে।
তবু কেন কতবার মনে যেন হ’ত,
তব স্নিগ্ধ মদিন পরশ মুছে নিতে পারে মোর
সব জ্বালা সব দগ্ধ ক্ষত।
মনে হ’ত প্রাণে তব প্রাণে যেন কাঁদে অহরহ-
‘হে পথিক! ঐ কাঁটা মোরে দাও, কোথা তব ব্যথা বাজে
কহ মোরে কহ!
নীরব গোপন তুমি মৌন তাপসিনী,
তাই তব চির-মৌন ভাষা
শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই ঐ ক্ষুদ্র চাপা-বুকে
কাঁদে কত ভালোবাসা আশা!
এরি মাঝে কোথা হ’তে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার
সে ঝড়ের রাতে,
কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে।
কোথা গেল পথ-
কোথা গেল রথ-
ডুবে গেল সব শোক-জ্বালা,
জননীর ভালোবাসা এ ভাঙা দেউলে যেন দুলাইল দেয়ালীর আলা!
গত কথা গত জন্ম হেন
হারা-মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন।
গৃহহারা গৃহ পেনু, অতি শান- সুখে
কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভ’রে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে।
শেষ হ’ল পথ-গান গাওয়া,
ডেকে ডেকে ফিরে গেল হা-হা স্বরে পথসাথী তুফানের হাওয়া।
আবার আবার বুঝি ভুলিলাম পথ-
বুঝি কোন্ বিজয়িনী-দ্বার প্রানে- আসি’ বাধা পেল পার্থ-পথ-রথ।
ভুলে গেনু কারে মোর পথে পথ খোঁজা,-
ভুলে গেনু প্রাণ মোর নিত্যকাল ধ’রে অভিসারী
মাগে কোন্ পূজা,
ভুলে গেনু যত ব্যথা শোক,-
নব সুখ-অশ্র”ধারে গ’লে গেল হিয়া, ভিজে গেল অশ্র”হীন চোখ।
যেন কোন্ রূপ-কমলেতে মোর ডুবে গেল আঁখি,
সুরভিতে মেতে উঠে বুক,
উলসিয়া বিলসিয়া উথলিল প্রাণে
এ কী ব্যগ্র উগ্র ব্যথা-সুখ।
বাঁচিয়া নূতন ক’রে মরিল আবার
সীধু-লোভী বাণ-বেঁধা পাখী।….
…. ভেসে গেল রক্তে মোর মন্দিরের বেদী-
জাগিল না পাষাণ-প্রতিমা,
অপমানে দাবানল-সম তেজে
র”খিয়া উঠিল এইবার যত মোর ব্যথা-অর”নিমা।
হুঙ্কারিয়া ছুটিলাম বিদ্রোহের রক্ত-অশ্বে চড়ি’
বেদনার আদি-হেতু স্রষ্টা পানে মেঘ অভ্রভেদী,
ধূমধ্বজ প্রলয়ের ধূমকেতু-ধুমে
হিংসা হোমশিখা জ্বালি’ সৃজিলাম বিভীষিকা স্নেহ-মরা শুষ্ক মর”ভূমে।
…. এ কি মায়া! তার মাঝে মাঝে
মনে হ’ত কতদূরে হ’তে, প্রিয় মোর নাম ধ’রে যেন তব বীণা বাজে!
সে সুদূর গোপন পথের পানে চেয়ে
হিংসা-রক্ত-আঁখি মোর অশ্র”রাঙা বেদনার রসে যেত ছেয়ে।
সেই সুর সেই ডাক স্মরি’ স্মরি’
ভুলিলাম অতীতের জ্বালা,
বুঝিলাম তুমি সত্য-তুমি আছে,
অনাদৃতা তুমি মোর, তুমি মোরে মনে প্রাণে যাচ’,
একা তুমি বনবালা
মোর তরে গাঁথিতেছ মালা
আপনার মনে
লাজে সঙ্গোপনে।
জন্ম জন্ম ধ’রে চাওয়া তুমি মোর সেই ভিখারিনী।
অন-রের অগ্নি-সিন্ধু ফুল হ’য়ে হেসে উঠে কহে- ‘চিনি, চিনি।
বেঁচে ওঠ্ মরা প্রাণ! ডাকে তোরে দূর হ’তে সেই-
যার তরে এত বড় বিশ্বে তোর সুখ-শানি- নেই!’
তারি মাঝে
কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বাজে?
কে যেন রে পিছু ডেকে চীৎকারিয়া কয়-
‘বন্ধু এ যে অবেলায়! হতভাগ্য, এ যে অসময়!
শুনিনু না মানা, মানিনু না বাধা,
প্রাণে শুধু ভেসে আসে জন্মন-র হ’তে যেন বিরহিণী ললিতার কাঁদা!
ছুটে এনু তব পাশে
উর্ধ্বশ্বাসে,
মৃত্যু-পথ অগ্নি-রথ কোথা প’ড়ে কাঁদে, রক্ত-কেতু গেল উড়ে পুড়ে,
তোমার গোপান পূজা বিশ্বের আরাম নিয়া এলো বুক জুড়ে।
তারপর যা বলিব হারায়েছি আজ তার ভাষা;
আজ মোর প্রাণ নাই, অশ্র” নাই, নাই শক্তি আশা।
যা বলিব আজ ইহা গান নহে, ইহা শুধু রক্ত-ঝরা প্রাণ-রাঙা
অশ্র”-ভাঙা ভাষা।
ভাবিতেছ, লজ্জাহীন ভিখারীর প্রাণ-
সে-ও চাহে দেওয়ার সম্মান!
সত্য প্রিয়া, সত্য ইহা, আমিও তা স্মরি’
আজ শুধু হেসে হেসে মরি!
তবু শুধু এইটুকু জেনে রাখো প্রিয়তমা, দ্বার হ’তে দ্বারান-রে
ব্যর্থ হ’য়ে ফিরে
এসেছিনু তব পাশে, জীবনের শেষ চাওয়া চেয়েছিনু তোমা’,
প্রাণের সকল আশা সব প্রেম ভালোবাসা দিয়া
তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বে-দরদী পূজারিণী প্রিয়া!
ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই তুমি নেবে তার ভার হেসে,
বিশ্ব-বিদ্রোহীরে তুমি করিবে শাসন
অবহেলে শুধু ভালোবাসে।
ভেবেছিনু, দুর্বিনীত দুর্জয়ীরে জয়ের গরবে
তব প্রাণে উদ্ভাসিবে অপরূপ জ্যোতি, তারপর একদিন
তুমি মোর এ বাহুতে মহাশক্তি সঞ্চারিয়া
বিদ্রোহীর জয়লক্ষ্মী হবে।
ছিল আশা, ছিল শক্তি, বিশ্বটারে টেনে
ছিঁড়ে তব রাঙা পদতলে ছিন্ন রাঙা পদ্মসম পূজা দেব এনে!
কিন’ হায়! কোথা সেই তুমি? কোথা সেই প্রাণ?
কোথা সেই নাড়ী-ছেঁড়া প্রাণে প্রাণে টান?
এ-তুমি আজ সে-তুমি তো নহ;
আজ হেরি-তুমিও ছলনাময়ী,
তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী!
কিছু মোরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,-
দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?
মোর বুকে জাগিছেন অহরহ সত্য ভগবান,
তাঁর দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ন, এ দৃষ্টি যাহারে দেখে,
তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখে তার প্রাণ!
লোভে আজ তব পূজা কলুষিত, প্রিয়া,
আজ তারে ভুলাইতে চাহ,
যারে তুমি পূজেছিলে পূর্ণ মন-প্রাণ সমর্পিয়া।
তাই আজি ভাবি, কার দোষে-
অকলঙ্ক তব হৃদি-পুরে
জ্বলিল এ মরণের আলো কবে প’শে?
তবু ভাবি, এ কি সত্য? তুমিও ছলনাময়ী?
যদি তাই হয়, তবে মায়াবিনী অয়ি!
ওরে দুষ্ট, তাই সত্য হোক।
জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক।
আমি তুমি সুর্য চন্দ্র গ্রহ তারা
সব মিথ্যা হোক;
জ্বালো ওরে মিথ্যাময়ী, জ্বালো তবে ভালো ক’রে
জ্বালো মিথ্যালোক।
তব মুখপানে চেয়ে আজ
বাজ-সম বাজে মর্মে লাজ;
তব অনাদর অবহেলা স্মরি’ স্মরি’
তারি সাথে স্মরি’ মোর নির্লজ্জতা
আমি আজ প্রাণে প্রাণে মরি।
মনে হয়-ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও!
ঘৃণাহত মাটিমাখা ছেলেরে তোমার
এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও!
তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’,
কিন’ হায়, যখনই ও-মুখ পানে চাহি-
মনে হয়,-হায়,হায়, কোথা সেই পূজারিণী,
কোথা সেই রিক্ত সন্ন্যাসিনী?
এ যে সেই চির-পরিচিত অবহেলা,
এ যে সেই চির-ভাবহীন মুখ!
পূর্ণা নয়, এ যে সেই প্রাণ নিয়ে ফাঁকি-
অপমানে ফেটে যায় বুক!
প্রাণ নিয়া এ কি নিদার”ণ খেলা খেলে এরা হায়!
রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দ’লে অলক্তক পরে এরা পায়!
এর দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি!
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীর” বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি।
নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো!
ইহাদের অতিলোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহু জন।..
যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে।
বুঝিয়াছি, শেষবার ঘিরে আসে সাথী মোর মৃত্যু-ঘন আঁখি,
রিক্ত প্রাণ তিক্ত সুখে হুঙ্কারিয়া উঠে তাই,
কার তরে ওরে মন, আর কেন পথে পথে কাঁদি?
জ্বলে’ ওঠ্ এইবার মহাকাল ভৈরবের নেত্রজ্বালা সম ধ্বক্-ধ্বক্,
হাহাকার-করতালি বাজা! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্তশিখা অনন- পাবক।
আন্ তোর বহ্নি-রথ, বাজা তোর সর্বনাশী তূরী!
হান্ তোর পরশু-ত্রিশুল! ধ্বংস কর্ এই মিথ্যাপুরী।
রক্ত-সুধা-বিষ আন্ মরণের ধর টিপে টুটি!
এ মিথ্যা জগৎ তোর অভিশপ্ত জগদ্দল চাপে হোক্ কুটি-কুটি!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুই আঁখি তারা
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।
যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী
যায় গো বয়ে নিরবধি
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।।
বুলবুল আর কোকিল পাখী
এক কাননে যায় গো ডাকি,
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।।
ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে
এক জননীর কোল লয়ে
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।।
পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী,
অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী।
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী
একই মায়ের বুকে খেলি,
পাগলা তা'রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
আমি কি আড়াল করিয়া রেখেছি তব বন্ধুর মুখ?
না জানিয়া আমি না জানি কতই দিয়াছি তোমায় দুখ।
তোমার কাননে দখিনা পবন
এনেছিল ফুল পূজা-আয়োজন,
আমি এনু ঝড় বিধাতার ভুল – ভণ্ডুল করি সব,
আমার অশ্রু-মেঘে ভেসে গেল তব ফুল-উৎসব।
মম উৎপাতে ছিঁড়েছে কি প্রিয়, বক্ষের মণিহার?
আমি কি এসেছি তব মন্দিরে দস্যু ভাঙিয়া দ্বার?
আমি কি তোমার দেবতা-পূজার
ছড়ায়ে ফেলেছি ফুল-সম্ভার?
আমি কি তোমার স্বর্গে এসেছি মর্ত্যের অভিশাপ
আমি কি তোমার চন্দ্রের বুকে কালো কলঙ্ক-ছাপ?
ভুল করে যদি এসে থাকি ঝড়, ছিঁড়িয়া থাকি মুকুল,
আমার বরষা ফুটায়েছে অনেক অধিক ফুল!
পরায়ে কাজল ঘন বেদনার
ডাগর করেছি নয়ন তোমার,
কূলের আশায়, ভাঙিয়া করেছি সাত সাগরের রানি,
সে দিয়াছে মালা, আমি সাজায়েছি নিখিল সুষমা-ছানি।দস্যুর মতো হয়তো খুলেছি লাজ-অবগুণ্ঠন,
তব তরে আমি দস্যু, করেছি ত্রিভুবন লুণ্ঠন!
তুমি তো জান না, নিখিল বিশ্ব
কার প্রিয়া লাগি আজিকে নিঃস্ব?
কার বনে ফুল ফোটাবার লাগি ঢালিয়াছি এত নীর,
কার রাঙা পায়ে সাগর বাঁধিয়া করিয়াছি মঞ্জীর।
তুমি না চাহিতে আসিয়াছি আমি – সত্য কি এইটুক?
ফুল ফোটা-শেষে ঝরিবার লাগি ছিলে না কি উৎসুক?
নির্মম-প্রিয়-নিষ্ঠুর হাতে
মরিতে চাহনি আঘাতে আঘাতে?
মরিতে চাহনি আঘাতে আঘাতে?
তুমি কি চাহনি কেহ এসে তব ছিঁড়ে দেয় গাঁথা-মালা?
পাষাণের মতো চাপিয়া থাকিনি তোমার উৎস-মুখে,
আমি শুধু এসে মুক্তি দিয়াছি আঘাত হানিয়া বুকে!
তোমার স্রোতেরে মুক্তি দানিয়া
স্রোতমুখে আমি গেলাম ভাসিয়া।
রহিবার যে – সে রয়ে গেল কূলে, সে রচুক সেথা নীড়!
মম অপরাধে তব স্রোত হল পুণ্য তীর্থ-নীর!
রূপের দেশের স্বপন-কুমার স্বপনে আসিয়াছিনু,
বন্দিনী! মম সোনার ছোঁয়ায় তব ঘুম ভাঙাইনু।
দেখ মোরে পাছে ঘুম ভাঙিয়াই,
ঘুম না টুটিতে তাই চলে যাই,
যে আসিল তব জাগরণ-শেষে মালা দাও তারই গলে,
সে থাকুক তব বক্ষে – রহিব আমি অন্তর-তলে।
সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালায়ে যখন দাঁড়াবে আঙিনা-মাঝে,
শুনিয়ো কোথায় কোন তারা-লোকে কার ক্রন্দন বাজে!
আমার তারার মলিন আলোকে
ম্লান হয়ে যাবে দীপশিখা চোখে,
হয়তো অদূর গাহিবে পথিক আমারই রচিত গীত –
যে গান গাইয়া অভিমান তব ভাঙাতাম সাঁঝে নিতি।
গোধূলি-বেলায় ফুটিবে উঠানে সন্ধ্যামণির ফুল,
তুলসী-তলায় করিতে প্রণাম খুলে যাবে বাঁধা চুল।
কুন্তল-মেঘ-ফাঁকে অবিরল
অকারণে চোখে ঝরিবে গো জল,
সারা শর্বরী বাতায়নে বসি নয়ন-প্রদীপ জ্বালি
খুঁজিবে আকাশে কোন তারা কাঁপে তোমারে চাহিয়া খালি।
নিষ্ঠুর আমি – আমি অভিশাপ, ভুলিতে দিব না, তাই
নিশ্বাস মম তোমারে ঘিরিয়া শ্বসিবে সর্বদাই।
তোমারে চাহিয়া রচিনু যে গান
কণ্ঠে কণ্ঠে লভিবে তা প্রাণ,
আমার কণ্ঠে হইবে নীরব, নিখিল-কণ্ঠ-মাঝে
শুনিবে আমারই সেই ক্রন্দন সে গান প্রভাতে সাঁঝে! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রকৃতিমূলক
|
ভাব-বিলাসী অপরূপ সে দুরন্ত,
বাঁধন-হারা মন সদা তার উড়ন্ত!
সে ঘুরে বেড়ায় নীল আকাশে।
চাঁদের সাথে মুচকি হাসে,
গুঞ্জরে সে মউ-মক্ষীর গুঞ্জনে,
সে ফুলের সাথে ফোটে, ঝরে পরাগ হয়ে অঙ্গনে।
তার চোখের পলক ভোরের তারায় ঝলে,
ধুমকেতু তার ফুলঝুরি, সে উল্কা হয়ে চলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।সে প্রথম-ফোটা গোলাপ-কুঁড়ির সনে–
হিঙুল হয়ে ওঠে লাজে হঠাৎ অকারণে।
ধরা তারে ধরতে নারে ঘরের প্রদীপ দিয়ে,
সে শিশির হয়ে কাঁদে, খেলে পাখির পালক নিয়ে।
সে ঝড়ের সাথে হাসে
সে সাগর-স্রোতে ভাসে,
সে উদাস মনে বসে থাকে জংলা পথের পাশে
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!সে বৃষ্টিধারার সাথে পড়ে গলে,
অস্ত-রবির আড়াল টেনে লুকায় গগন-তলে।
দীপ্ত রবির মুকুরে সে আপন ছায়া দেখে,
সে পথে যেতে যায় যেন কি মায়ার মোহ এঁকে।
ঝরা তারার তির হানে সে নিশুত রাতের নভে,
ঘুমন্তরে জাগিয়ে সে দেয় বিপুল বজ্র-রবে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!সে রঙিন প্রজাপতি
কভু ফুলের দিকে মতি
কভু ভুলের দিকে গতি
তার রুধির-ধারা নদীর স্রোতের মতো
দেহের কূলে বদ্ধ তবু মুক্ত অবিরত।
রূপকে বলে সঙ্গিনী সে, প্রেমকে বলে প্রিয়া,
রূপ ঘুমালে ঊর্ধ্বে ওঠে আত্মাতে প্রেম নিয়া।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।
মরণকে সে ভয় করে না, জ্ঞানীর সভায় ভয়,–
ভাবের সাথে ভাব করে সে অভাব করে জয়।
তার তরল হাসি সরল ভাবে মুগ্ধ সবার মন,
মন ভরে না জ্ঞানীর, করে অর্থ অন্বেষণ।
চোখ আছে যার, তারই চোখের পাতা টিপে ধরে,
হাতিশালায় যায় না, যায় ফুল ফোটে যে-ঘরে।
তার পথের পথিক সাথি,
তার বন্ধু নীরব রাতি,
খ্যাতির খাতায় চায় না চাঁদা, চাঁদের সাথে খেলে,
সে কথা কহে, মুক্ত-পাখা পাখির দেখা পেলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
তারে জ্ঞান-বিলাসী ডাকে না, তায় গাঁয়ের চাষি ডাকে,
তৃষার জলের পাত্র-সম জড়িয়ে ধরে তাকে।
সে রয় না আন্দোলনে,
যেথা আনন্দ হয় আন্দোলিত যায় সে গোপন বনে।
সে চাঁদের আলো, বর্ষা-মেঘের জল,
আপনার খুশিতে ঝরে আপনি সে চঞ্চল।
সে চায় না ফুলের মালা, সে ফুলের মধু চায়,
সে চায় না তাহার নাম,
দান দিয়ে সে পালিয়ে বেড়ায়
চায় না তাহার দাম।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
কেউ যদি তায় ভালো বলে, আলোর বুকে হয় সে লয়,
বলে, ‘ওগো সুন্দর মোর, তোমায় বলে, আমায় নয়!’
ছন্দ তাহার স্বচ্ছন্দ, দ্বন্দ্ব মাঝে রয় না সে,
যে বড়ো তাঁর সুনাম নিয়ে ক্ষুদ্র কথা কয় না সে।
তার মন্দ শোনার নাইকো সময়,
রসের সাথে নিত্য প্রলয়,
তারে নিন্দা দিলে চন্দন দেয়
সে নন্দন-জাদুকর,
সুন্দর সে, তাই দেখে না কাহারেও সে অসুন্দর।
তারে লোভ দেখিয়ে যায় না ধরা,
আপনাকে যে দিতে চায়–
প্রেম-ভিক্ষু দুরন্ত সে লুটিয়ে পড়ে তাহার পায়।
পূর্ণের সে প্রতিচ্ছায়া, অপরূপ সে দুরন্ত,
মন কাঁদে মোর তারই তরে, মন সদা যার উড়ন্ত!(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
অন্তরে আর বাহিরে সমান নিত্য প্রবল হও!
যত দুর্দিন ঘিরে আসে, তত অটল হইয়া রও!
যত পরাজয়-ভয় আসে, তত দুর্জয় হয়ে ওঠো।
মৃত্যুর ভয়ে শিথিল যেন হয় তলোয়ার-মুঠো।
সত্যের তরে দৈত্যের সাথে করে যাও সংগ্রাম,
রণক্ষেত্রে মরিলে অমর হইয়া রহিবে নাম।
এই আল্লার হুকুম – ধরায় নিত্য প্রবল রবে,
প্রবলেই যুগে যুগে সম্ভব করেছে অসম্ভবে।
ভালোবাসেন না আল্লা, অবিশ্বাসী ও দুর্বলেরে,
‘শেরে-খোদা’ সেই হয়, যে পেয়েছে অটল বিশ্বাসেরে!
ধৈর্য ও বিশ্বাস হারায়, সে মুসলিম নয় কভু,
বিশ্বে কারেও করে নাকো ভয় আল্লাহ্ যার প্রভু!
নিন্দাবাদের মাঝে ‘আল্লাহ্ জিন্দাবাদ’-এর ধ্বনি
বীর শুধু শোনে, কোনো নিন্দায় কোনো ভয় নাহি গণি।
আল্লা পরম সত্য, ভয় সে ভ্রান্তির কারসাজি,
প্রচণ্ড হয় তত পৌরুষ, যত দেখে দাগাবাজি!
ভুলে কি গিয়াছ অসম সাহস নির্ভীক আরবির?
পারস্য আর রোমক সম্রাটের কাটিয়াছে শির!
কতজন ছিল সেনা তাহাদের? অস্ত্র্র কী ছিল হাতে?
তাদের পরম নির্ভর ছিল শুধু এক আল্লাতে।
জয় পরাজয় সমান গণিয়া করেছিল শুধু রণ,
তাদের দাপটে কেঁপে উঠেছিল পৃথিবীর প্রাঙ্গণ!
তারা দুনিয়ার বাদশাহি করেছিল ভিক্ষুক হয়ে,
তারা পরাজিত হয়নি কখনও ক্ষণিকের পরাজয়ে।
হাসিয়া মরেছে করেনি কখনও পৃষ্ঠপ্রদর্শন,
ইসলাম মানে বুঝেছিল তারা অসত্য সাথে রণ।
তারা জেনেছিল, দুনিয়ায় তারা আল্লার সৈনিক,
অর্জন করেছিল স্বাধীনতা নেয়নি মাগিয়া ভিখ!
জয়ী হতে হলে মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ হইতে হয়,
শত্রু-সৈন্য দেখে কাঁপে ভয়ে, সে তো সেনাপতি নয়!
শত্রু-সৈন্য যত দেখে তত রণ-তৃষ্ণা তার বাড়ে,
দাবানল সম তেজ জ্বলে ওঠে শিরায় শিরায় হাড়ে!
তলোয়ার তার তত তেজ ফোটে যত সে আঘাত খায়,
তত বধ করে শত্রুর সেনা, রসদ যত ফুরায়।
নিরাশ হোয়ো না! নিরাশা ও অদৃষ্টবাদীরা যত
যুদ্ধ না করে হয়ে আছে কেউ আহত ও কেউ হত!যে মাথা নোয়ায়ে সিজদা করেছ এক প্রভু আল্লারে,
নত করিয়ো না সে মাথা কখনও কোনো ভয়ে কোনো মারে!
আল্লার নামে নিবেদিত শির নোয়ায় সাধ্য কার।
আল্লা সে শির বুকে তুলে নেন, কাটে যদি তলোয়ার!
ভীরু মানবেরে প্রবল করিতে চাহেন যে দুনিয়াতে
তাঁরেই ইমাম নেতা বলি আমি, প্রেম মোর তারই সাথে।
আড়ষ্ট নরে বলিষ্ঠ করে যাঁর কথা যাঁর কাজ,
তাঁরই তরে সেনা সংগ্রহ করি, গড়ি তাঁরই শির-তাজ!
গরিবের ঈদ আসিবে বলিয়া যে আত্মা রোজা রাখে,
পরমাত্মার পরমাত্মীয় বলে আমি মানি তাঁকে।
অকল্যাণের দূত যারা, যারা মানুষের দুশমন,
তাদের সঙ্গে যে দুরন্তেরা করিবে ভীষণ রণ –
মোর আল্লার আদেশে তাদেরে ডাক দিই জমায়েতে,
অচেতন ছিল যারা, তারা আসিতেছে সে তীর্থপথে।
আমি তকবীর-ধ্বনি করি শুধু কর্ম-বধির কানে,
সত্যের যারা সৈনিক তারা জমা হবে ময়দানে!
অনাগত ‘নবযুগ’-সূর্যের তুর্য বাজায়ে যাই,
মৃত্যু বা কারাগারের কোনো ভয় দ্বিধা নাই।
একা ‘নবযুগ’-মিনারে দাঁড়ায়ে কাঁদিয়া সকলে ডাকি,
দরমার হাঁস না আসে, আসিবে মুক্তপক্ষ পাখি।
এ পথে ভীষণ বাজপাখি আর নিঠুর ব্যাধের ভীতি,
আলোক-পিয়াসি পাখিরা তবুও আসিছে গাহিয়া গীতি।মৃত্যু-ভয়াক্রান্ত আজিকে বাংলার নরনারী,
তাদের অভয় দিতেই আমরা ধরিয়াছি তরবারি।
আমরা শুনেছি ভীত আত্মার সকরুণ ফরয়্যাদ,
আমরা তাদেরে রক্ষা করিব, এ যে আল্লার সাধ!
আমরা হুকুম-বর্দার তাঁর পাইয়াছি ফরমান,
ভীত নর-নারী তরে অকাতরে দানিব মোদের প্রাণ!
বাজাই বিষাণ উড়াই নিশান ঈশান-কোণের মেঘে,
প্রেম-বৃষ্টি ও বজ্র-প্রহারে আত্মা উঠিবে জেগে!
রাজনীতি করে তৈরি মোদের কুচকাওয়াজের পথ,
এই পথ দিয়ে আসিবে দেখিয়ো আবার বিজয়-রথ।
প্রবল হওয়ার সাধ ও সাধনা যাহাদের প্রাণে আছে,
তাদেরই দুয়ারে হানা দিই আমি, আসি তাহাদেরই কাছে।
সঙ্ঘবদ্ধ হতেছে তাহারা বঙ্গভূমির কোলে,
আমি দেখিয়াছি পূর্ণচন্দ্র তাদেরই ঊর্ধ্বে দোলে! (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
চারিদিকে এই গুণ্ডা এবং বদমায়েসির আখ্ড়া দিয়ে
রে অগ্রদূত, চ’লতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?
পারবি যেতে ভেদ ক’রে এই বক্র-পথের চক্রব্যুহ?
উঠবি কি তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ?
আজকে প্রাণের গো-ভাগাড়ে উড়ছে শুধু চিল-শকুনি,
এর মাঝে তুই আলোকে-শিশু কোন্ অভিযান ক’রবি, শুনি?
ছুঁড়ছে পাথর, ছিটায় কাদা, কদর্যের এই হোরি-খেলায়
শুভ্র মুখে মাখিয়ে কালি ভোজপুরীদের হট্ট-মেলায়
বাঙলা দেশও মাত্ল কি রে? তপস্যা তার ভুললো অরুণ?
তাড়িখানার চীৎকারে কি নাম্ল ধুলায় ইন্দ্র বরুণ?
ব্যগ্র-পরান অগ্রপথিক,কোন্ বাণী তোর শুনাতে সাধ?
মন্ত্র কি তোর শুন্তে দেবে নিন্দাবাদীর ঢক্কা-নিনাদ?
নর-নারী আজ কন্ঠ ছেড়ে কুৎসা-গানের কোরাস্ ধ’রে
ভাবছে তা’রা সুন্দরেরই জয়ধ্বনি ক’রছে জোরে?
এর মাঝে কি খবর পেলি নব-বিপ্লব-ঘোড়সাওয়ারী
আসছে কেহ? টুট্ল তিমির, খুল্ল দুয়ার পুব-দয়ারী?
ভগবান আজ ভূত হ’ল যে প’ড়ে দশ-চক্র ফেরে,
যবন এবং কাফের মিলে হায় বেচারায় ফিরছে তেড়ে!
বাঁচাতে তায় আসছে কি রে নতুন যুগের মানুষ কেহ?
ধুলায় মলিন, রিক্তাভরণ, সিক্ত আঁখি, রক্ত দেহ?
মসজিদ আর মন্দির ঐ শয়তানদের মন্ত্রণাগার,
রে অগ্রদূত, ভাঙতে এবার আসছে কি জাঠ কালাপাহাড়?
জানিস যদি, খবর শোনা বন্ধ খাঁচার ঘেরাটোপে,
উড়ছে আজো ধর্ম-ধ্বজা টিকির গিঁঠে দাড়ির ঝোপে!
নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান,
থাকতে নারি দেখে শুনে সুন্দরের এই হীন অপমান।
ক্রুদ্ধ রোষে রুদ্ধ ব্যথায় ফোঁপায় প্রাণে ক্ষুদ্ধ বাণী,
মাতালদের ঐ ভাঁটিশালায় নটিনী আজ বীণাপাণি!
জাতির পারণ-সিন্ধু মথি’ স্বার্থ-লোভী পিশাচ যারা
সুধার পাত্র লক্ষ্মীলাভের ক’রতেছে ভাগ-বাঁটোয়ারা,
বিষ যখন আজ উঠল শেষে তখন কারুর পাইনে দিশা,
বিষের জ্বালায় বিশ্ব পুড়ে, স্বর্গে তাঁরা মেটান তৃষা!
শ্মাশন-শবের ছাইয়ের গাদায় আজকে রে তাই বেড়াই খুঁজে,
ভাঙন-দেব আজ ভাঙের নেশায় কোথায় আছে চক্ষু বুঁজে!
রে অগ্রদূত, তরুণ মনের গহন বনের রে সন্ধানী,
আনিস্ খবর, কোথায় আমার যুগান্তরের খড়্পপাণি!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক
গাহে তোমারই জয়।
আকাশ-বাতাস রবি-গ্রহ তারা চাঁদ,
হে প্রেমময়।।
সমুদ্র-কল্লোল নির্ঝর-কলতান-
হে বিরাট, তোমারই উদার জয়গান;
ধ্যান গম্ভীর কত শত হিমালয়
গাহে তোমারই জয়।।
তব নামের বাজায় বীণা বনের পল্লব
জনহীন প্রান্তর স্তব করে, নীরব।
সকল জাতির কোটি উপাসনালয়
গাহে তোমারই জয়।।
আলোকের উল্লাসে, আঁধারের তন্দ্রায়
তব জয়গান বাজে অপরূপ মহিমায়,
কোটি যুগ-যুগান্ত সৃষ্টি প্রলয়
গাহে তোমারই জয়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
আপনার ঘরে আছে যে শত্রু
তারে আগে করো জয়,
ভাঙো সে দেয়াল, প্রদীপের আলো
যাহা আগুলিয়া রয়।
অনাত্বীয়রে আত্বীয় করো,
তোমার বিরাট প্রাণ
করে না কো যেন কোনোদিন কোনো
মানুষে অসম্মান।
সংসারের মিথ্যা বাঁধন
ছিন্ন হোক আগে,
কবে সে তোমার সকল দেউল
রাঙিবে আলোর রাগে।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
.
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
'পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ'ল!'
স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ'য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, 'দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক' সাত দিন!'
সহসা বন্ধ হ'ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!
ভুখারি ফুকারি' কয়,
'ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!'
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্
বলে 'বাবা, আমি ভুকা-ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'
তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা - 'ভ্যালা হ'ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?'
ভুখারী কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল - 'তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারি ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
'আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা'বলে বন্ধ করনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!'
কোথা চেঙ্গিস্, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি'
ও' কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি' মরি'
ও' মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক'রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশি ক'রে প্রতি ধমনীতে রাজে!
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্ উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে!
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে! ও কে? চন্ডাল? চম্কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!
ওই হ'তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চন্ডাল, কাল হ'তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ।
রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!
চাষা ব'লে কর ঘৃণা!
দে'খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,
তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র'বে চিরকাল।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি!
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে,
দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে।
সে মার রহিল জমা-
কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা!
বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু'চোখে স্বার্থ-ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ'য়েছে কুলি।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা,
তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্খানে!
তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি'।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রকৃতিমূলক
|
এস হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া
বেণুকুঞ্জ ছায়ায় এস
তাল তমাল বনে এস শ্যামল
ফুটাইয়া যূঁথী-কুন্দ-নীপ-কেয়া।বারিধারে এস চারিধার ভাসায়ে
বিদ্যুৎ-ইঙ্গিতে দশ দিক হাসায়ে
বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া
ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।শ্রাবণ বরিষণ হরষণ ঘনায়ে
এস নব ঘনশ্যাম নূপুর শোনায়ে
হিজল তমাল ডালে ঝুলন ঝুলায়ে
তাপিতা ধরার চোখে অঞ্জন বুলায়ে
যমুনা স্রোতে ভাসায়ে প্রেমের খেয়া
ঘন দেয়া মোহনিয়া শ্যাম পিয়া।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
মহান তুমি প্রিয়
এই কথাটির গৌরবে মোর চিত্ত ভরে দিয়ো।
অনেক আশায় বসে আছি যাত্রা-শেষের পর
তোমায় নিয়েই পথের পারে বাঁধব আমার ঘর –
হে চির-সুন্দর!
পথ শেষ সেই তোমায় যেন করতে পারি ক্ষমা,
হে মোর কলঙ্কিনী প্রিয়তমা!
সেদিন যেন বলতে পারি, ‘এসো এসো প্রিয়,
বক্ষে এসো এসো আমার পূত কমনীয়!’
হায় হারানো লক্ষ্মী আমার! পথ ভুলেছ বলে
চির-সাথি যাবে তোমার মুখ ফিরিয়ে চলে?
জান ওঠে হায় মোচড় খেয়ে চলতে পড়ি টলে –
অনেক জ্বালায় জ্বলে প্রিয় অনেক ব্যথায় গলে!
বারে বারে নানান রূপে ছলতে আমায় শেষে,
কলঙ্কিনী! হাতছানি দাও সকল পথে এসে
কুটিল হাসি হেসে?
ব্যথায় আরো ব্যথা হানাই যে সে!
তুমি কি চাও তোমার মতোই কলঙ্কী হই আমি?
তখন তুমি সুদূর হতে আসবে ঘরে নামি –
হে মোর প্রিয়, হে মোর বিপথগামী!
পথের আজও অনেক বাকি,
তাই যদি হয় প্রিয় –
পথের শেষে তোমায় পাওয়ার যোগ্য করেই নিয়ো॥ (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে,
নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্ত সে মরিয়াছে ।
শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে,
পরান গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে!থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রোগ শোক লাঞ্ছনা,
যুদ্ধ না করে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিয়ো না।
ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি, মিথ্যা ও অহেতুক
নিরাশায় হয় পরাজয় যার, তাহার নিত্য দুখ।‘হয়তো কী হবে’ এই ভেবে যারা ঘরে বসে কাঁপে ভয়ে,
জীবনের রণে নিত্য তারাই আছে পরাজিত হয়ে।
তারাই বন্দি হয়ে আছে গ্লানি-অধীনতা কারাগারে;
তারাই নিত্য জ্বালায় পিত্ত অসহায় অবিচারে!এরা অকারণ ভয়ে ভীত, এরা দুর্বল নির্বোধ,
ইহাদের দেখে দুঃখের চেয়ে জাগে মনে বেশি ক্রোধ।
এরা নির্বোধ, না করে কিছুই জিভ মেলে পড়ে আছে
গোরস্তানেও ফুল ফোটে, ফুল ফোটে না এ মরা গাছে।এদের যুক্তি অদৃষ্টবাদ, বসে বসে ভাবে একা,
‘এ মোর নিয়তি, বদলানো নাহি যায় কপালের লেখা!’
পৌরুষ এরা মানে না, নিজেরে দেয় শুধু ধিক্কার,
দুর্ভাগ্যের সাথে নাহি লড়ে মেনেছে ইহারা হার।এরা জড়, এরা ব্যাধিগ্রস্ত, মিশো না এদের সাথে,
মৃত্যুর উচ্ছিষ্ট আবর্জনা এরা দুনিয়াতে।
এদের ভিতরে ব্যাধি, ইহাদের দশদিক তমোময়,
চোখ বুজে থাকে, আলো দেখিয়াও বলে, ‘ইহা আলো নয়’।প্রবল অটল বিশ্বাস যার নিশ্বাস প্রশ্বাসে,
যৌবন আর জীবনের ঢেউ কল-তরঙ্গে আসে,
মরা মৃত্তিকা করে প্রাণায়িত শস্যে কুসুমে ফলে,
কোনো বাধা তার রুধে নাকো পথ, কেবল সুমুখে চলে,
চির-নির্ভয়; পরাজয় তার জয়ের স্বর্গ-সিঁড়ি,
আশার আলোক দেখে তত, যত আসে দুর্দিন ঘিরি।
সেই পাইয়াছে পরম আশার আলো, যেয়ো তারই কাছে,
তাহারই নিকটে মৃত্যুঞ্জয়ী অভয়-কবচ আছে।যারা বৃহতের কল্পনা করে, মহৎ স্বপ্ন দেখে,
তারাই মহৎ কল্যাণ এই ধরায় এনেছে ডেকে।
অসম্ভবের অভিযান-পথ তারাই দেখায় নরে,
সর্বসৃষ্টি ফেরেশ্তারেও তারা বশীভূত করে।আত্মা থাকিতে দেহে যারা সহে আত্ম-নির্যাতন,
নির্যাতকেরে বধিতে যাহারা করে না পরান-পণ,
তাহারা বদ্ধ জীব পশু সম, তাহারা মানুষ নয়,
তাদেরই নিরাশা মানুষের আসা ভরসা করিছে লয়।হাত-পা পাইয়া কর্ম করে না কূর্মধর্মী হয়ে,
রহে কাদা-জলে মুখ লুকাইয়া আঁধার বিবরে ভয়ে,
তাহারা মানব-ধর্ম ত্যজিয়া জড়ের ধর্ম লয়,
তাহারা গোরস্তান, শ্মশানের, আমাদের কেহ নয়!আমি বলি, শোনো মানুষ! পূর্ণ হওয়ার সাধনা করো,
দেখিবে তাহারই প্রতাপে বিশ্ব কাঁপিতেছে থরথর।
ইহা আল্লার বাণী যে, মানুষ যাহা চায় তাহা পায়,
এই মানুষের হাত পা চক্ষু আল্লার হয়ে যায়!চাওয়া যদি হয় বৃহৎ, বৃহৎ সাধনাও তার হয়,
তাহারই দুয়ারে প্রতীক্ষা করে নিত্য সর্বজয়।
অধৈর্য নাহি আসে কোনো মহাবিপদে সে সেনানীর,
অটল শান্ত সমাহিত সেই অগ্রনায়ক বীর।নিরানন্দের মাঝে আল্লার আনন্দ সেই আনে,
চাঁদের মতন তার প্রেম জনগণ-সমুদ্রে টানে।
অসম সাহস আসে বুকে তার অভয় সঙ্গ করে,
নিত্য জয়ের পথে চলো সেই পথিকের হাত ধরে!পূর্ণ পরম বিশ্বাসী হও, যাহা চাও পাবে তাই,
তাহারে ছুঁয়ো না, সেই মরিয়াছে, বিশ্বাস যার নাই! (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
শুধুগুণ্ডামি, ভণ্ডামি আর গোঁড়ামি ধর্ম নয়,
এই গোঁড়াদের সর্বশাস্ত্রে শয়তানি চেলা কয়।
এক সে স্রষ্টা সব সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু,
একের অধিক স্রষ্টা কোনো সে ধর্ম কহে না কভু।
তবু অজ্ঞানে যদি শয়তানে শরিকি স্বত্ব আনে,
তার বিচারক এক সে আল্লা –লিখিত আল-কোরানে।
মানুষ তাহার বিচার করিতে পারে না, নরকে তারে
অথবা স্বর্গে কোন মানুষের শক্তি পাঠাতে পারে?
‘উপদেশ শুধু দিবে অজ্ঞানে’ – আল্লার সে হুকুম,
নিষেধ কোরানে – বিধর্মীপরে করিতে কোনো জুলুম।
কেন পাপ করে, ভুল পথে যায় মানবজন্ম লয়ে,
কেন আসে এই ধরাতে জন্ম-অন্ধ পঙ্গু হয়ে,
কেন কেহ হয় চিরদরিদ্র, কেহ চিরধনী হয়,
কেন কেউ অভিশপ্ত, কাহারও জীবন শান্তিময়?
কোন শাস্ত্রী বা মৌলানা বলো, জেনেছে তাহার ভেদ?
গাধার মতন বয়েছে ইহারা শাস্ত্র কোরান বেদ!জীবনে যে তাঁরে ডাকেনিকো, প্রভু ক্ষুধার অন্ন তার
কখনো বন্ধ করেননি কেন, কে করে তার বিচার?
তাঁর সৃষ্টির উদার আকাশ সকলেরে থাকে ঘিরে,
তাঁর বায়ু মসজিদে মন্দিরে সকলের ঘরে ফিরে।
তাঁহার চন্দ্র সূর্যের আলো করে না ধর্ম ভেদ,
সর্বজাতির ঘরে আসে, কই আনে না তো বিচ্ছেদ!
তাঁর মেঘবারি সব ধর্মীর মাঠে ঘাটে ঘরে ঝরে,
তাঁহার অগ্নি জ্বলে, বায়ু বহে সকলেরে সেবা করে।
তাঁর মৃত্তিকা ফল ফুল দেয় সর্বজাতির মাঠে,
কে করে প্রচার বিদ্বেষ তবু তাঁর এ প্রেমের হাটে?
কোনো ‘ওলি’ কোনো দরবেশ যোগী কোনো পয়গম্বর,
অন্য ধর্মে, দেয়নিকো গালি, – কে রাখে তার খবর?
যাহারা গুণ্ডা, ভণ্ড, তারাই ধর্মের আবরণে
স্বার্থের লোভে খ্যাপাইয়া তোলে অজ্ঞান জনগণে।
জাতিতে জাতিতে ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ এরা আনি
আপনার পেট ভরায়, তখ্ত চায় এরা শয়তানি।
ধর্ম-আন্দোলনের ছদ্মবেশে এরা কুৎসিত,
বলে এরা, হয়ে মন্ত্রী, করিবে স্বধর্মীদের হিত।
এরা জমিদার মহাজন ধনী নওয়াবি খেতাব পায়,
কারও কল্যাণ চাহে না ইহারা, নিজ কল্যাণ চায়।
ধনসম্পদ এত ইহাদের, করেছে কি কভু দান?
আশ্রয় দেয় গরিবে কি কভু এদের ঘর দালান?
ধর্ম জাতির নাম লয়ে এরা বিষাক্ত করে দেশ,
এরা বিষাক্ত সাপ, ইহাদেরে মেরে করো সব শেষ।
নাই পরমত-সহিষ্ণুতা সে কভু নহে ধার্মিক,
এরা রাক্ষস-গোষ্ঠী ভীষণ অসুর-দৈত্যাধিক।
উৎপীড়ন যে করে, নাই তার কোনো ধর্ম ও জাতি,
জ্যোতির্ময়েরে আড়াল করেছে, এরা আঁধারের সাথি!
মানবে মানবে আনে বিদ্বেষ, কলহ ও হানাহানি,
ইহারা দানব, কেড়ে খায় সব মানবের দানাপানি।
এই আক্ষেপ জেনো তাহাদের মৃত্যুর যন্ত্রণা,
মরণের আগে হতেছে তাদের দুর্গতি লাঞ্ছনা।
এক সে পরম বিচারক, তাঁর শরিক কেহই নাই,
কাহারে শাস্তি দেন তিনি, দেখো দুদিন পরে তা ভাই!
মোরা দরিদ্র কাঙাল নির্যাতিত ও সর্বহারা,
মোদের ভ্রান্ত দ্বন্দ্বের পথে নিতে চায় আজ যারা
আনে অশান্তি উৎপাত আর খোঁজে স্বার্থের দাঁও,
কোরানে আল্লা এদেরই কন – ‘শাখা-মৃগ হয়ে যাও।’ (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া।
যাও রে বইয়া এই গরীবের সালামখানি লইয়া।।কাবার জিয়ারতের আমার নাই সম্বল ভাই,
সারা জনম সাধ ছিল যে, মদিনাতে যাই ( রে ভাই)।
মিটল না সাধ, দিন গেল মোর দুনিয়ার বোঝা বইয়া।।তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি,
লইয়া যাওরে এই নিরাশের দীর্ঘ নিশ্বাসখানি।
নবীজীর রওজায় কাঁদিও ভাই রে আমার হইয়া।।মা ফাতেমা হযরত আলীর মাজার যেথায় আছে,
আমার সালাম দিয়া আইস তাঁদের পায়ের কাছে।
কাবায় মোজানাজাত করিও আমার কথা কইয়া।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
রৌদ্রোজ্জ্বল দিবসে তোমার আসিনি সজল মেঘের ছায়া,
তৃষ্ণা-আতুর হরিণী চোখে কী হবে হানিয়া মরীচি-মায়া!
আমি কালো মেঘ – নামি যদি তব বাতায়ন-পাশে বৃষ্টিধারে,
বন্ধ করিয়া দিবে বাতায়ন, যদি ভিজে যাও নয়নাসারে!
সুখবিলাসিনী পারাবত তুমি, বাদল রাতের পাপিয়া নহ,
তব তরে নয় বাদলের ব্যথা – নয়নের জল দুর্বিষহ।
ফাল্গুন-বনে মাধবী-বিতানে যে পিক নিয়ত ফুকারি ওঠে,
তুমি চাও সেই কোকিলের ভাষা তোমার রৌদ্রতপ্ত ঠোঁটে।
জানি না সে ভাষা, হয়তো বা জানি, ছল করে তাই হাসিতে চাহি,
সহসা নিরখি – নেমেছে বাদল রৌদ্রোজ্জ্বল গগন বাহি।
ইরানি-গোলাব-আভা আনিয়াছ চুরি করি ভরি ও রাঙা তনু,
আমি ভাবি বুঝি আমারই বাদল-মেঘশেষে এল ইন্দ্রধনু।
ফণীর ডেরায় কাঁটার কুঞ্জে ফোটে যে কেতকী, তাহার ব্যথা
বুঝিবে না তুমি, ধরণি তো তব ঘর নহে, এলে ভ্রমিতে হেথা।
ভ্রম করে তুমি ভ্রমিতে ধরায় এসেছ, ফুলের দেশের পরি,
জানিতে না হেথা সুখদিন শেষে আসে দুখ-রাতি আঁধার করি।
রাঙা প্রজাপতি উড়িয়া এসেছ, চপলতা-ভরা চিত্র-পাখা,
জানিতে না হেথা ফুল ফুটে ফুল ঝরে যায়, কাঁদে কানন ফাঁকা।
যে লোনা জলের সাত সমুদ্র গ্রাস করিয়াছে বিপুল ধরা,
সেই সমুদ্রে জনম আমার, আমি সেই মেঘ সলিল ভরা।
ভাসিতে যে আসে আমার সলিলে, তাহারে ভাসায়ে লইয়া চলি
সেই অশ্রুর সপ্ত পাথারে, পারায়ে ব্যথার শতেক গলি।
ভুল করে প্রিয়া এ ফুল-কাননে এসেছিলে, জানা ছিল না তব
এ বন-বেদনা অশ্রুমুখীরে; এ নহে মাধবীকুঞ্জ নব।
মাটির করুণাসিক্ত এ মন, হেথা নিশিদিন যে ফুল ঝরে
তারই বেদনায় ভরে আছে মন, হাসিতে তাদেরই অশ্রু ক্ষরে।
সেই বেদনায় এসেছিলে তুমি ক্ষণিক স্বপন, ভুলের মেলা,
জাগিয়া তাহারই স্মৃতি লয়ে কাটে আমার সকাল সন্ধ্যাবেলা।
এ মোর নিয়তি, অপরাধ নহে আমারও তোমারও – স্বপন-রানি!
আমার বাণীতে তোমার মুরতি বীণাপাণি নয় বেদনাপাণি।
তোমার নদীতে নিতি কত তরি এপার হইতে ওপারে চলে;
কাণ্ডারিহীন ভাঙা তরি মোর ডুবে গেল তব অতল তলে।
ওরা শুধু তব মুখ চেয়ে যায়, সুখের আশার বণিক ওরা,
আমি ডুবে তব দেখিলাম তল জলশেষে চোরা বালুতে ভরা।
ভয় নাই প্রিয়, মগ্ন এ তরি তব বিস্মৃতি-বালুকাতলে
দু-দিনে পড়িবে ঢাকা, উদাসীন, তুমি বয়ে যাবে চলার ছলে।
কুড়াতে এসেছে দুখের ঝিনুক ব্যথার আকুল সিন্ধুকূলে,
আঁচল ভরিয়া কুড়ায়ে হয়তো ফেলে দেবে কোথা মনের ভুলে।
তোমাদের ব্যথা-কাঁদন যেটুকু, সে শুধু বিলাস, পুতুলখেলা,
পুতুল লইয়া কাটে চিরদিন, আদর করিয়া ভাঙিয়া ফেলা।
মোর দেহমনে নয়নে ও প্রেমে অশ্রুজল নীরদ মাখা,
কী হবে ভিজিয়া এ বাদলে, রানি, তব ধ্যান ওই চন্দ্র তারকা।
সে চাঁদ উঠেছে গগনে তোমার-আমার সন্ধ্যাতিমির শেষে,
আমি যাই সেই নিশীথিনী-পারে যেথায় সকল আঁধার মেশে।
আমার প্রেমের বরষায় ধুয়ে তব হৃদি হল সুনীলতর –
সে গগনে যবে উঠিবে গো চাঁদ উজ্জ্বলতর তাহারে করো।
যদি সে-চন্দ্রহসিত নিশীথে বিস্বাদ লাগে তোমার চোখে,
তোমার অতীত তোমারে খুঁজিয়ো আমার বিধুর গানের লোকে।
সেথা ব্যথা রবে, রবে সান্তনা, রবে চন্দন-সুশীতলতা,
যে-ফুল জীবনে ঝরে না সে-ফুল হইয়া ফুটিবে তোমার ব্যথা।
আমার গানের চির-দাহ যাহা সে আছে গো নীলকন্ঠে মম,
চিরশেষে এল যে অমৃতবাণী, দিনু তা তোমারে হে প্রিয়তম!
আমার শাখায় কন্টক থাক, কাঁটার ঊর্ধ্বে তুমি যে ফুল –
আমি ফুটায়েছি তোমারে কুসুম করিয়া, সে মোর সুখ অতুল।
বিদায়-বেলায় এই শুধু চাই, হে মোর মানস-কানন-পরি,
তোমার চেয়েও তব বন্ধুরে ভালোবাসি যেন অধিক করি। (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
তুমি মোরে ভুলিয়াছ তাই সত্য হোক! –
সেদিন যে জ্বলেছিল দীপালি-আলোক
তোমার দেউল জুড়ি – ভুল তাহা ভুল!
সেদিন ফুটিয়াছিল ভুল করে ফুল
তোমার অঙ্গনে প্রিয়! সেদিন সন্ধ্যায়
ভুলে পেরেছিলে ফুল নোটন-খোঁপায়!ভুল করে তুলি ফুল গাঁথি বর-মালা
বেলাশেষে বারে বারে হয়েছ উতলা
হয়তো বা আর কারও লাগি!…আমি ভুলে
নিরুদ্দেশ তরি মোর তব উপকূলে
না চাহিতে বেঁধেছিনু, গেয়েছিনু গান,
নীলাভ তোমার আঁখি হয়েছিল ম্লান
হয়তো বা অকারণে! গোধূলি বেলায়
তোমার ও-আঁখিতলে! হয়তো তোমার
পড়ে মনে, কবে যেন কোন লোকে কার
বধূ ছিলে ; তারই কথা শুধু মনে পড়ে!
–ফিরে যাও অতীতের লোক-লোকান্তরে
এমনই সন্ধ্যায় বসি একাকিনী গেহে!
দুখানি আঁখির দীপ সুগভীর স্নেহে
জ্বালাইয়া থাক জাগি তারই পথ চাহি!
সে যেন আসিছে দূর তারা-লোক বাহি
পারাইয়া অসীমের অনন্ত জিজ্ঞাসা,
সে দেখেছে তব দীপ, ধরণির বাসা!শাশ্বত প্রতীক্ষমানা অনন্ত সুন্দরী!
হায়, সেথা আমি কেন বাঁধিলাম তরি,
কেন গাহিলাম গান আপনা পাসারি?
হয়তো সে গান মম তোমার ব্যথায়
বেজেছিল। হয় তো বা লেগেছিল তার পায়
আমার তরির ঢেউ। দিয়াছিল ধুয়ে
চরণ-অলক্ত তব। হয়তো বা ছুঁয়ে
গিয়েছিল কপোলের আকুল কুন্তল
আমার বুকের শ্বাস। ও-মুখ-কমল
উঠেছিল রাঙা হয়ে। পদ্মের কেশর
ছুঁইলে দখিনা বায়, কাঁপে থরথর
যেমন কমল-দল ভঙ্গুর মৃণালে
সলাজ সংকোচে সুখে পল্লব-আড়ালে,
তেমনই ছোঁয়ায় মোর শিহরি শিহরি
উঠেছিল বারে বারে সারা দেহ ভরি!চেয়েছিলে আঁখি তুলি, ডেকেছিল যেন
প্রিয় নাম ধরে মোর – তুমি জান, কেন!
তরি মম ভেসেছিল যে নয়ন-জলে
কূল ছাড়ি নেমে এলে সেই সে অতলে।
বলিলে,– “অজানা বন্ধু, তুমি কী গো সেই,
জ্বালি দীপ গাঁথি মালা যার আশাতেই
কূলে বসে একাকিনী যুগ যুগ ধরি
নেমে এসো বন্ধু মোর ঘাটে বাঁধ তরি!”বিস্ময়ে রহিনু চাহি ও-মুখের পানে
কী যেন রহস্য তুমি – কী যেন কে জানে –
কিছুই বুঝিতে নারি! আহ্বানে তোমার
কেন জাগে অভিমান, জোয়ার দুর্বার
আমার আঁখির এই গঙ্গা যমুনায়!–
নিরুদ্দেশ যাত্রী, হায়, আসিলি কোথায়?
একি তোর ধেয়ানের সেই জাদুলোক,
কল্পনার ইন্দ্রপুরী? একি সেই চোখ
ধ্রুবতারাসম যাহা জ্বলে নিরন্তর
ঊর্ধ্বে তোর? সপ্তর্ষির অনন্ত বাসর?
কাব্যের অমরাবতী? একি সে ইন্দিরা,তোরই সে কবিতা-লক্ষ্মী? –বিরহ-অধীরা
একি সেই মহাশ্বেতা, চন্দ্রপীড়-প্রিয়া?
উন্মাদ ফরহাদ যারে পাহাড় কাটিয়া
সৃজিতে চাহিয়াছিল – একি সেই শিঁরী?
লায়লি এই কি সেই, আসিয়াছে ফিরি
কায়েসের খোঁজে পুনঃ? কিছু নাহি জানি!
অসীম জিজ্ঞাসা শুধু করে কানাকানি
এপারে ওপারে, হায়!…তুমি তুলি আঁখি
কেবলই চাহিতেছিলে! দিনান্তের পাখি
বনান্তে কাঁদিতেছিল – ‘কথা কও বউ!’
ফাগুন ঝুরিতেছিল ফেলি ফুল-মউ!কাহারে খুঁজিতেছিলে আমার এ চোখে
অবসান-গোধূলির মলিন আলোকে?
জিজ্ঞাসার, সন্দেহের শত আলো-ছায়া
ও-মুখে সৃজিতেছিল কী যেন কি মায়া!
কেবলই রহস্য হায়, রহস্য কেবল,
পার নাই সীমা নাই অগাধ অতল!
এ যেন স্বপনে-দেখা কবেকার মুখ,
এ যেন কেবলই সুখ কেবলই এ দুখ!
ইহারই স্ফুলিঙ্গ যেন হেরি রূপে রূপে,
এ যেন মন্দার-পুষ্প দেব-অলকায়!
যখন সবারে ভুলি। ধরার বন্ধন
যখন ছিঁড়িতে চাহি, স্বর্গের স্বপন
কেবলই ভুলাতে চায়, এই সে আসিয়া
রূপে রসে গন্ধে গানে কাঁদিয়া হাসিয়া
আঁকড়ি ধরিতে চাহে,–মাটির মমতা!
পরান-পোড়েনি শুধু, জানে নাকো কথা !
বুকে এর ভাষা নেই, চোখে নাই জল,
নির্বাক ইঙ্গিত শুদু শান্ত অচপল!
এ বুঝি গো ভাস্করের পাষাণ-মানসী
সুন্দর, কঠিন, শুভ্র। ভোরের ঊষসী,
দিনের আলোর তাপ সহিতে না জানে।
মাঠের উদাসী সুরে বাঁশরির তানে,
বাণী নাই, শুধু সুর, শুধু আকুলতা!
ভাষাহীন আবেদন দেহ-ভরা কথা।
এ যেন চেনার সাথে অচেনার মিশা, –
যত দেখি তত হায় বাড়ে শুধু তৃষা।আসিয়া বসিলে কাছে দৃপ্ত মুক্তানন,
মনে হল – আমি দিঘি, তুমি পদ্মবন!
পূর্ণ হইলাম আজি, হয় হোক ভুল,
যত কাঁটা তত ফুল, কোথা এর তুল?
তোমারে ঘিরিয়া রব আমি কালো জল,
তরঙ্গের ঊর্ধ্বে রবে তুমি শতদল,
পুজারির পুষ্পাঞ্জলিসম। নিশিদিন
কাঁদিব ললাট হানি তীরে তৃপ্তিহীন!
তোমার মৃণাল-কাঁটা আমার পরানে
লুকায়ে রাখিব, যেন কেহ নাহি জানে।
…কত কী যে কহিলাম অর্থহীন কথা,
শত যুগ-যুগান্তের অন্তহীন ব্যথা।শুনিলে সেসব জাগি বসিয়া শিয়রে,
বলিলে, “বন্ধু গো হের দীপ পুড়ে মরে
তিলে তিলে আমাদের সাথে! আর নিশি
নাই বুঝি, দিবা এলে দূরে যাব মিশি!
আমি শুধু নিশীথের।” যখন ধরণি
নীলিমা-মঞ্জুষা খুলি হেরে মুক্তামণি
বিচিত্র নক্ষত্রমালা – চন্দ্র-দীপ জ্বালি,
একাকী পাপিয়া কাঁদে ‘চোখ গেল’খালি,
আমি সেই নিশিথের। – আমি কই কথা,
যবে শুধু ফোটে ফুল, বিশ্ব তন্দ্রাহতা।
হয়তো দিবসে এলে নারিব চিনিতে,
তোমারে করিব হেলা, তব ব্যথা-গীতে
কেবলই পাইবে হাসি সবার সুমুখে,
কাঁদিলে হাসিব আমি সরল কৌতুকে,
মুছাব না আঁখি-জল। বলিব সবায়,
“তুমি শাঙনের মেঘ –যথায় তথায়
কেবলই কাঁদিয়া ফের, কাঁদাই স্বভাব!
আমি তো কেতকী নহি, আমার কি লাভ
ওই শাঙনের জলে? কদম্ব যূথীর
সখারে চাহি না আমি। শ্বেত-করবীর
সখী আমি। হেমন্তের সান্ধ্য-কুহেলিতে
দাঁড়াই দিগন্তে আসি, নিরশ্রু-সংগীতে
ভরে ওঠে দশ দিক! আমি উদাসিনী।
মুসাফির! তোমারে তো আমি নাহি চিনি!”ডাকিয়া উঠিল পিক দূরে আম্রবনে
মুহুমুহু কুহুকুহু আকুল নিঃস্বনে।
কাঁদিয়া কহিনু আমি, “শুন, সখী শুন,
কাতরে ডাকিছে পাখি কেন পুনঃ পুনঃ!
চলে যাব কোন দূরে, স্বরগের পাখি
তাই বুঝি কেঁদে ওঠে হেন থাকি থাকি।
তোমারই কাজল আঁখি বেড়ায় উড়িয়া,
পাখি নয় – তব আঁখি ওই কোয়েলিয়া!”হাসিয়া আমার বুকে পড়িলে লুটায়ে,
বলিলে, –“পোড়ারমুখি আম্রবনচ্ছায়ে
দিবানিশি ডাকে, শুনে কান ঝালাপালা!
জানি না তো কুহু-স্বরে বুকে ধরে জ্বালা!
উহার স্বভাব এই, তোমারই মতন
অকারণে গাহে গান, করে জ্বালাতন!নিশি না পোহাতে বসি বাতায়ন-পাশে
হলুদ-চাঁপার ডালে, কেবলই বাতাসে
উহু উহু উহু করি বেদনা জানায়!
বুঝিতে নারিনু আমি পাখি ও তোমায়!”নয়নের জল মোর গেল তলাইয়া
বুকের পাষাণ-তলে। উৎসারিত হিয়া
সহসা হারাল ধারা তপ্ত মরু-মাঝে।
আপনারে অভিশাপি ক্ষমাহীন লাজে!
কহিনু, “কে তুমি নারী, এ কি তব খেলা?
অকারণে কেন মোর ডুবাইলে ভেলা,
এ অশ্রু-পাথারে একা দিলে ভাসাইয়া?
দুহাতে আন্দোলি জল কূলে দাঁড়াইয়া,
অকরুণা, হাস আর দাও করতালি!অদূরে নৌবতে বাজে ইমন-ভূপালি
তোমার তোরণ-দ্বারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া,
– তোমার বিবাহ বুঝি? ওই বাঁশুরিয়া
ডাকিছে বন্ধুরে তব?” যুঝি ঢেউ সনে
শুধানু পরান-পণে।…তুমি আনমনে
বারেক পশ্চাতে চাহি পড়িলে লুটায়ে
স্রোতজলে, সাঁতরিয়া আসি মম পাশে
‘আমিও ডুবিব সাথে’বলিয়া তরাসে
জড়ায়ে ধরিলে মোরে বাহুর বন্ধনে!…
হইলাম অচেতন!… কিছু নাই মনে
কেমনে উঠিনু কূলে!… কবে সে কখন
জড়াইয়া ধরেছিলে মালার মতন
নিশীথে পাথার-জলে, – শুধু এইটুকু
সুখ-স্মৃতি ব্যথা সম চির-জাগরূক
রহিল বুকের তলে!… আর কিছু নাই!…
তোমারে খুঁজিয়া ফিরি এ কূলে বৃথাই,
হে চীর রহস্যময়ী!ও কূলে দাঁড়ায়ে
তেমনই হাসিছ তুমি সান্ধ্য-বনচ্ছায়ে
চাহিয়া আমার মুখে! তোমার নয়ন
বলিছে সদাই যেন, ‘ডুবিয়া মরণ
এবার হল না, সখা! আজও যায় সাধ
বাঁচিতে ধরার পরে। স্বপনের চাঁদ
হয়তো বা দিবে ধরা জাগ্রত এলোকে,
হয়তো নামিবে তুমি অশ্রু হয়ে চোখে,
আসিবে পথিক-বন্ধু হয়ে প্রিয়তম
বুকের ব্যাথায় মোর – পুষ্পে গন্ধ সম!
অঞ্জলি হইতে নামি তোমার পূজার
জড়াইয়া রব বক্ষে হয়ে কণ্ঠহার!’নিশীথের বুক-চেরা তব সেই স্বর,
সেই মুখ সেই চোখ করুণা-কাতর
পদ্মা-তীরে-তীরে রাতে আজও খুঁজে ফিরি!
কত নামে ডাকি তোমা, – “মহাশ্বেতা, শিঁরী,
লায়লি, বকৌলি, তাজ, দেবী, নারী, প্রিয়া!”
– সাড়া নাহি মিলে কারও! ফুলিয়া ফুলিয়া
বয়ে যায় মেঘনার তরঙ্গ বিপুল,
কখনও এ-কূল ভাঙে কখনও ও-কূল!পার হতে নারি এই তরঙ্গের বাধা,
ও যেন ‘এসো না’ বলে পায়ে ধরে-কাঁদা
তোমার নয়ন-স্রোত! ও যেন নিষেধ,
বিধাতার অভিশাপ, অনন্ত বিচ্ছেদ,
স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝে যেন যবনিকা!…
আমাদের ভাগ্যে বুঝি চিররাত্রি লিখা!
নিশীথের চখাচখি, দুইপারে থাকি
দুইজনে দুইজন ফিরি সদা ডাকি!
কোথা তুমি? তুমি কোথা? যেন মনে লাগে,
কত যুগ দেখি নাই! কত জন্ম আগে
তোমারে দেখেছি কোন নদীকূলে গেহে,
জ্বালো দীপ বিষাদিনী ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে!
বারে বারে কাঁপে, আকাশ-দীপিকা
কাঁপে তারারাজি – যেন আঁখি-পাতা তব,–
এইটুকু পড়ে মনে! কবে অভিনব
উঠিলে বিকশি তুমি আমার মাঝে,
দেখি নাই! দেখিব না – কত বিনা কাজে
নিজেরে আড়াল করি রাখিছ সতত
অপ্রকাশ সুগোপন বেদনার মতো।
আমি হেথা কূলে কূলে ফিরি আর কাঁদি,
কুড়ায়ে পাব না কিছু? বুকে যাহা বাঁধি
তোমার পরশ পাব – একটু সান্ত্বনা!
চরণ-অলক্ত-রাঙা দুটি বালুকণা,
একটি নূপুর, ম্লান বেণি-খসা ফুল,
করবীর সোঁদা-ঘষা পরিমল-ধুল,
আধখানি ভাঙা চুড়ি রেশমি কাচের,
দলিত বিশুষ্ক মালা নিশি-প্রভাতের,
তব হাতে লেখা মম প্রিয় ডাক-নাম
লিখিয়া ছিঁড়িয়া-ফেলা আধখানি খাম,
অঙ্গের সুরভি-মাখা ত্যক্ত তপ্ত বাস,
মহুয়ার মদ সম মদির নিশ্বাস
পুরবের পরিস্থান হতে ভেসে-আসা, –
কিছুই পাব না খুঁজি? কেবলই দুরাশা।
কাঁদিবে পরান ঘিরি? নিরুদ্দেশ পানে
কেবলই ভাসিয়া যাব শ্রান্ত ভাটি-টানে?
তুমি বসি রবে ঊর্ধ্বে মহিম-শিখরে
নিষ্প্রাণ পাষাণ-দেবী? কভু মোর তরে
নিষ্প্রাণ পাষাণ-দেবী? কভু মোর তরে
নামিবে না প্রিয়া-রূপে ধরার ধুলায়?
লো কৌতুকময়ী! শুধু কৌতুক-লীলায়
খেলিবে আমারে লয়ে? –আর সবই ভুল?
ভুল করে ফুটেছিল আঙিনায় ফুল?
ভুল করে বলেছিলে সুন্দর? অমনি –
ঢেকেছ দুহাতে মুখ ত্বরিতে তখনই!
বুঝি কেহ শুনিয়াছে, দেখিয়াছে কেহ
ভাবিয়া আঁধার কোণে লীলায়িত দেহ
লুকাওনি সুখে লাজে? কোন শাড়িখানি
পরেছিলে বাছি বাছি সে সন্ধ্যায় রানি?হয়তো ভুলেছ তুমি, আমি ভুলি নাই!
যত ভাবি ভুল তাহা – তত সে জড়াই
সে ভুলে সাপিনিসম বুকে ও গলায়!
বাসি লাগে ফুলমেলা। – ভুলের খেলায়
এবার খোয়াব সব, করিয়াছি পণ।
হোক ভুল, হোক মিথ্যা, হোক এ স্বপন,
–এইবার আপনারে শূন্য রিক্ত করি
দিয়া যাব মরণের আগে! পাত্র ভরি
করে যাব সুন্দরের করে বিষপান!
তোমারে অমর করি করিব প্রয়াণ
মরণের তীর্থযাত্রী!
ওগো, বন্ধু প্রিয়,
এমনই করিয়া ভুল দিয়া ভুলাইয়ো
বারে বারে জন্মে জন্মে গ্রহে গ্রহান্তরে!
ও-আঁখি-আলোক যেন ভুল করে পড়ে
আমার আঁখির পরে। গোধূলি-লগনে
ভুল করে হই বর, তুমি হও কনে
ক্ষণিকের লীলা লাগি! ক্ষণিকের চমকি
অশ্রুর শ্রাবণ-মেঘে হারাইয়া সখী!…তুমি মোরে ভুলিয়াছ, তাই সত্য হোক!
নিশি-শেষে নিভে গেছে দীপালি-আলোক!
সুন্দর কঠিন তুমি পরশ-পাথর
তোমার পরশ লভি হইনু সুন্দর –
– তুমি তাহা জানিলে না!
…সত্য হোক প্রিয়া
দীপালি জ্বলিয়াছিল – গিয়াছে নিভিয়া! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
ওই নীল-গগনের নয়ন-পাতায়
নামল কাজল-কালো মায়া।
বনের ফাঁকে চমকে বেড়ায়
তারই সজল আলোছায়া।
ওই তমাল তালের বুকের কাছে
ব্যথিত কে দাঁড়িয়ে আছে
দাঁড়িয়ে আছে।
ভেজা পাতায় ওই কাঁপে তার
আদুল ঢলঢল কায়া।
যার শীতল হাতের পুলক-ছোঁয়ায়
কদমকলি শিউরে ওঠে,
জুইকুঁড়ি সব নেতিয়ে পড়ে
কেয়াবধূর ঘোমটা টুটে।
আহা! আজ কেন তার চোখের ভাষা
বাদল-ছাওয়া ভাসা-ভাসা –
জলে-ভাসা?
দিগন্তরে ছড়িয়েছে সেই
নিতল আঁখির নীল আবছায়া।
ও কার ছায়া দোলে অতল কালো
শালপিয়ালের শ্যামলিমায়?
আমলকি-বন থামল ব্যথায়
থামল কাঁদন গগন-সীমায়।
আজ তার বেদনাই ভরেছে দিক,
ঘরছাড়া হায় এ কোন পথিক,
এ কোন পথিক?
এ কীস্তব্ধতারই আকাশ-জোড়া
অসীম রোদন-বেদন-ছায়া।(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
জাগরণের লাগল ছোঁয়াচ মাঠে মাঠে তেপান্তরে,
এমন বাদল ব্যর্থ হবে তন্দ্রাকাতর কাহার ঘরে?
তড়িৎ ত্বরা দেয় ইশারা, বজ্র হেঁকে যায় দরজায়,
জাগে আকাশ, জাগে ধরা−ধরার মানুষ কে সে ঘুমায়?
মাটির নীচে পায়ের তলায় সেদিন যারা ছিল মরি,
শ্যামল তৃণাঙ্কুরে তারা উঠল বেঁচে নতুন করি;
সবুজ ধরা দেখছে স্বপন আসবে কখন ফাগুন-হোলি,
বজ্রাঘাতে ফুটল না যে, ফুটবে আনন্দে সে কলি! (জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
ওরে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী!
অলিখিত যত গল্প-কাহিনি তোরা যে নায়ক তারই॥
শক্তিময়ী সে এক জননির
স্নেহ-সুত সব তোরা যে রে বীর,
পরস্পরের আশা যে রে তোরা, মার সন্তাপ-হারী॥
নিদ্রোত্থিত কেশরীর মতো
ওঠ ঘুম ছাড়ি নব জাগ্রত!
আয় রে অজেয় আয় অগণিত দলে দলে মরুচারী॥
ঘুমঘোরে ওরে যত শৃঙ্খল
দেহ মন বেঁধে করেছে বিকল,
ঝেড়ে ফেল সব, সমীরে যেমন ঝরায় শিশির বারি।
উহারা কজন? তোরা অগণন সকল শক্তি-ধারী॥ (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
১
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!
২
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!
৩
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
৪
গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!
৫
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।
৬
ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!
কৃষ্ণনগর; ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত।
ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার দেখানো পথ ॥ ক্ষমা কর হজরত।বিলাস-বিভব দলিয়াছ পায় ধূলি সম তুমি, প্রভু,
তুমি চাহ নাই আমরা হইব বাদশা-নবাব কভু।
এই ধরণীর ধন-সম্ভার - সকলের তাহে সম অধিকার;
তুমি বলেছিলে ধরণীতে সবে সমান পুত্র-বৎ ॥ ক্ষমা কর হজরত।তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি ক’রে
আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।
ভিন্ ধর্মীর পূজা-মন্দির, ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর,
আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনাকো পর-মত ॥ ক্ষমা কর হজরত।তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি,
তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী।
মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা
সার করিয়াছি ধর্মন্ধতা,
বেহেশ্ত্ হ’তে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত ॥
তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত।
ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার দেখানো পথ ॥ ক্ষমা কর হজরত।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়।
আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখ্বি যদি আয়।।
ধূলির ধরা বেহেশ্তে আজ, জয় করিল দিল রে লাজ।
আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।।
দেখ্ আমিনা মায়ের কোলে, দোলে শিশু ইসলাম দোলে।
কচি মুখে শাহাদাতের বাণী সে শোনায়।।
আজকে যত পাপী ও তাপী, সব গুনাহের পেল মাফী।
দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী জুলুম নিল বিদায়।।
নিখিল দরুদ পড়ে লয়ে নাম, সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম।
জীন পরী ফেরেশ্তা সালাম জানায় নবীর পায়।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
(শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।বল, আল্লাহ এক! প্রভু ইচ্ছাময়,
নিষ্কাম নিরপেক্ষ, অন্য কেহ নয়।
করেন না কাহারেও তিনি যে জনন,
কাহারও ঔরস-জাত তিনি নন।
সমতুল তাঁর
নাই কেহ আর।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
জলের সাগরে আসিনু বাহিতে তরি,
‘জল দাও’ বলে কাঁদে সর্বহারার দল –
চারিদিকে জল, জলের তৃষায় মরি!
টাকা নাই নাকি শুনি টাঁকশালে এসে,
টাকার সঙ্গে মাখামাখি, বলে – ‘টাকা থাকে কোন দেশে?’
লক্ষ্মী-বাহন প্যাঁচারা আসিয়া সারা দেশ ভরিয়াছে,
বিধাতার দেওয়া ঐশ্বর্যরে রক্ষিতা করিয়াছে!
টাকার সাকার আকার এসেই হয়ে যায় যেন পাখি,
এত টাকা আসে, উড়ে যায় সব, পাখা গজাইল নাকি?
কোথা বাসা বাঁধে এই সে টাকার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি?
কোথা ডিম পাড়ে, ছানা হয় তার কোন সে ব্যাংকে জমি?
মহাকাল-ব্যাধ দেখিতে পেয়েছে তাদের টাকার বাসা,
মৃত্যু-শায়ক লইয়া এসেছে– যত টাকা ট্যাঁকে ঠাসা!
এই চাকতির খাঁকতি ছিল না এ জীবনে কোনোদিন,
টাকার মহিমা বুঝিনু, যেদিন আকন্ঠ হল ঋণ।
যত শোধ করি, তত সুদ বাড়ে! ঋণ, না কচুরিপানা?
শিলমোহরের ভয়ে চাইনিকো মোহরের মিহি-দানা!
ধন্না দিইনি টাকাওয়ালাদের পাকা ইমারতে কভু,
আল্লাহ্ ছাড়া কারেও কখনও বলিনি হুজুর, প্রভু!
টাকাওয়ালাদের দেখে এই জ্ঞান হইয়াছে সঞ্চয়,
টাকাওয়ালাদের চেয়ে ঝাঁকাওয়ালা অনেক মহৎ হয়!সোনা যারা পায়, তাহারাই হয় সোনার পাথর-বাটি,
আশরফি পেয়ে আশরাফ হয় চালায়ে মদের ভাঁটি!
মানুষের রূপে এরা রাক্ষস রাবণ-বংশধর,
পৃথিবীতে আজ বড়ো হইয়াছে যত ভোগী বর্বর!
এদের ব্যাংক ‘রিভার-ব্যাংক’ হইবে দুদিন পরে,
বোঝে না লোভীরা, ভীষণ মৃত্যু আসিছে এদেরই তরে!
জমানো অর্থ যত অনর্থ আনিয়াছে পৃথিবীতে,
পরমার্থের প্রভু আসিয়াছে তাহার হিসাব নিতে!
রবে না এ টাকা, বংশেও বাতি দিতে রহিবে না কেউ,
তবু কমিল না নিত্য লোভীর ভুঁড়ির ঢেকুর-ঢেউ!
ইহাদের লোভ নিরন্ন দেশবাসী করিবে না ক্ষমা,
বহু আক্রোশ বহু ক্রোধ বহু প্রহরণ আছে জমা।
রুটি কাগজের হয়ে যায়, তবু কাগজের টাকা লয়ে,
পাতালের জীব পৃথিবীতে আজও বেড়ায় মাতাল হয়ে।
কোন অপরাধে প্রায়শ্চিত্ত করিতে আসিনু কোথা?
অক্টোপাসের মতো কেন মোরে জড়াল স্বর্ণলতা?
ভিখারি হওয়ার ভিক্ষা চাহিয়াছিনু আল্লার কাছে,
আজ দেখি মোর চারপাশে যত ভূত প্রেত যেন নাচে!
আল্লাহ্! মোরে এ শাস্তি হতে ফিরাইয়া লয়ে যাও!
টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে ফাঁকা আকাশের তলে নাও! (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর।
যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাহি নীচতার।।
ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র-পর।
নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
ক্ষুদ্র আত্মা তার।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
(শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।বল, আমি তাঁরি কাছে মাগি গো শরণ
সকল মানবে যিনি করেন পালন।
কেবল তাঁহারি কাছে - ত্রিভুবন মাঝ
সবার উপাস্য যিনি রাজ- অধিরাজ।
কুমন্ত্রণা দানকারী "খান্নাস" শয়তান
মানব দানব হ'তে চাহি পরিত্রাণ।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
রূপক
|
আর পারিনে সাধতে লো সই এক ফোঁটা এই ছুঁড়িকে।
ফুটবে না যে ফোটাবে কে বলল সে ফুল-কুঁড়িকে।
ঘোমটা-চাঁপা পারুল-কলি,
বৃথাই তারে সাধল অলি
পাশ দিয়ে হায় শ্বাস ফেলে যায় হুতাশ বাতাস ঢলি।
আ মলো ছিঃ! ওর হল কী?
সুতোর গুঁতো শ্রান্ত-শিথিল টানতে ও মন-ঘুড়িকে।
আর শুনেছিস সই?
ও লো হিমের চুমু হার মেনেছে এইটুকু আইবুড়িকে!!
সন্ধে সকাল ছুঁয়ে কপাল রবির যাওয়া-আসাই সার,
ব্যর্থ হল পথিক-কবির গভীর ভালোবাসার হার।
জল ঢেলে যায় জংলা বধু,
মৌমাছি দেয় কমলা মধু,
শরম-চাদর খুলবে না সে আদর শুধু শুধু।
কে জানে বোন পথভোলা কোন্
তরুণ-চোখের করুণ-চাওয়ায় চোখ ঠেরেছে ছুঁড়িকে –
বসে আছে লো
এইলজ্জাবতীর বধির বুকের সিংহ-আসন জুড়ি কে? (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রকৃতিমূলক
|
ঘোম্টা-পরা কাদের ঘরের বৌ তুমি ভাই সন্ধ্যাতারা?
তোমার চোখে দৃষ্টি জাগে হারানো কোন্ মুখের পারা।।
সাঁঝের প্রদীপ আঁচল ঝেঁপে
বঁধুর পথে চাইতে বেঁকে
চাউনিটি কার উঠছে কেঁপে
রোজ সাঁঝে ভাই এমনি ধারা।।
কারা হারানো বধূ তুমি অস-পথে মৌন মুখে
ঘনাও সাঁঝে ঘরের মায়া গৃহহীনের শূন্য বুকে।
এই যে নিতুই আসা-যাওয়া,
এমন কর”ণ মলিন চাওয়া,
কার তরে হায় আকাশ-বধু
তুমিও কি আজ প্রিয়-হারা।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
বড়োলোকদের ‘বড়োদিন’ গেল, আমাদের দিন ছোটো,
আমাদের রাত কাটিতে চায় না, ক্ষিদে বলে, ‘নিধে! ওঠো!’
খেটে খুটে শুতে খাটিয়া পাই না, ঘরে নাই ছেঁড়া কাঁথা,
বড়োদের ঘরে কত আসবাব, বালিশ বিছানা পাতা!
অর্ধনগ্ন-নৃত্য করিয়া বড়োদের রাত কাটে,
মোদের রক্ত খেয়ে মশা বাড়ে, গায়ে আরশুলা হাঁটে।
আঁচিলের মতো ছারপোকা লয়ে পাঁচিল ধরিয়া নাচি,
মাল খেয়ে ওরা বেসামাল হয়, মোরা কাশি আর হাঁচি!
নানারূপ খানা খেতেছে, ষণ্ড অণ্ড ভেড়ার টোস্ট,
কুলুকুলু করে আমাদের পেট, যেন ‘হনলুলু কোস্ট’।
চৌরঙ্গিতে বড়োদিন হইয়াছে কী চমৎকার,
গৌরজাতির ক্ষৌরকর্ম করেছে! অমত কার?
মদ খেয়ে বদহজম হইয়া বাঙালির মেয়ে ধরে,
শিক্ষাও পায় শিখ-বাঙালির থাপ্পড় লাথি চড়ে!
এ কি সৈনিক-ধর্ম, এরাই রক্ষী কি এদেশের?
সর্বলোকের ঘৃণ্য ইহারা, কলঙ্ক ব্রিটিশের।
যে সৈনিকের হাত চাহে অসহায় নারী পরশিতে,চাহে নারীর ধর্ম নিতে,
বীর ব্রিটিশের কামান যে নাই সেই হাত উড়াইতে।
হায় রে বাঙালি, হায় রে বাংলা, ভাত-কাঙালের দেশ,
মারের বদলে মার দেয় নাকো, তারা বলদ ও মেষ!
মান বাঁচাইতে প্রাণ দিতে নারে, পলাইয়া যায় ঘরে,
ঊর্ধ্বের মার আগুন আসিছে সেই ভীরুদের তরে!
পলাইয়া এরা বাঁচিবে না কেউ! হাড় খাবে, মাস খাবে,
শেষে ইহাদের চামড়ায় দেখো ডুগডুগিও বাজাবে!
পথের মাতাল মাতা-ভগ্নীর সম্মান নেয় কেড়ে,
শাস্তি না দিয়ে মাতালের, এরা পলায় সে পথ ছেড়ে।
কোন ফিল্মের দর্শক ওরা, ঝোপের ইঁদুর বেজি,
ইহাদের চেয়ে ঘরের কুকুর, সেও কত বেশি তেজি!
মানবজাতির ঘৃণ্য ভীরুরা, কাঁপে মৃত্যুর ডরে,
প্রাণ লয়ে ঢুকে খোপের ভিতর, দিনে দশবার মরে!
বড়োদিন দেখে ছোটো মন হায় হতে চাহে নাকো বড়ো,
হ্যাট কোট দেখে পথ ছেড়ে দেয় ভয়ে হয়ে জড়সড়!
পচে মরে হায় মানুষ, হায় রে পঁচিশে ডিসেম্বর!
কত সম্মান দিতেছে প্রেমিক খ্রিস্টে ধরার নর!
ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষশিশু?
আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছ জিশু! (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
(শুরু করিলাম) ল'য়ে নাম আল্লার
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।ধ্বংস হোক্ আবু লাহাবের বাহুদ্বয়,
হইবে বিধ্বস্ত তাহা হইবে নিশ্চয়।
করেছে অর্জ্জন ধন সম্পদ সে যাহা
কিছু নয়, কাজে তার লাগিবে না তাহা।
শিখাময় অনলে সে পশিবে ত্বরায়
সাথে তার সে অনল-কুন্ডে যাবে হায়
জায়া তার - অপবাদ-ইন্ধন বাহিনী,
তাহার গলায় দড়ি বহিবে আপনি।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন–
ঝন রনরন রন ঝনঝন!
সেকি দমকি দমকি
ধমকি ধমকি
দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি গমকি
ওঠে চোটে চোটে,
ছোটে লোটে ফোটে
বহ্নি-ফিনিকি চমকি চমকি
ঢাল-তলোয়ারে খনখন!
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন
রণ ঝনঝন ঝন রণরণ!হৈ হৈ রব
ঐ ভৈরব
হাঁকে, লাখে লাখে
ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে
লাল গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে
ওই পালে পালে,
ধরা কাঁপে দাপে।
জাঁকে মহাকাল কাঁপে থরথর!
রণে কড়কড় কাড়া-খাঁড়া-ঘাত,
শির পিষে হাঁকে রথ-ঘর্ঘর-ধ্বনি ঘররর!
'গুরু গরগর' বোলে ভেরী তূরী,
'হর হর হর'
করি চীৎকার ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন!
ওঠে ঝন্ঝা ঝাপটি দাপটি সাপটি
হু-হু-হু-হু-হু-হু-শনশন!
ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন!তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ খল খল খল
নাচে রণ-রঙ্গিণী সঙ্গিনী সাথে,
ধকধক জ্বলে জ্বলজ্বল
বুকে মুখে চোখে রোষ-হুতাশন!
রোস্ কোথা শোন্!ঐ ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,
ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,
মম-বরুণ কী কল-কল্লোলে চলে উতরোলে
ধ্বংসে মাতিয়া তাথিয়া তাথিয়া
নাচিয়া রঙ্গে! চরণ-ভঙ্গে
সৃষ্টি সে টলে টলমল!ওকি বিজয়-ধ্বনি সিন্ধু গরজে কলকল কল কলকল!
ওঠে কোলাহল,
কূট হলাহল
ছোটে মন্থনে পুন রক্ত-উদধি,
ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল!
টলে নির্বিকার সে বিধাত্রীরো গো
সিংহ-আসন টলমল!
কার আকাশ-জোড়া ও আনত-নয়ানে
করুণা-অশ্রু ছলছল!বাজে মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁজর ঝম্ঝম,
নাচে ধূর্জটি সাথে প্রমথ ববম্ বম্বম্!
লাল লালে-লাল ওড়ে ঈশানে নিশান যুদ্ধের,
ওঠে ওঙ্কার রণ-ডঙ্কার,
নাদে ওম্ ওম্ মহাশঙ্খ বিষাণ রুদ্রের!
ছোটে রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান রে!
কোটি বীর-প্রাণ
ক্ষণে নির্বাণ
তবু শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ
গমকে শিরায় গম্গম্!
ভয়ে রক্ত-পাগল প্রেত পিশাচেরও
শিরদাঁড়া করে চন্চন্!
যত ডাকিনী যোগিনী বিস্ময়াহতা,
নিশীথিনী ভয়ে থম্থম্!
বাজে মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝম্ঝম্!ঐ অসুর-পশুর মিথ্যা দৈত্য-সেনা যত
হত আহত করে রে দেবতা সত্য!
স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, মাতাল রক্ত-সুরায়;
ত্রস্ত বিধাতা,
মস্ত পাগল পিনাক-পাণি স-ত্রিশূল প্রলয়-হস্ত ঘুরায়!
ক্ষিপ্ত সবাই রক্ত-সুরায়! চিতার উপরে চিতা সারি সারি,
চারিপাশে তারি
ডাকে কুক্কুর গৃহিনী শৃগাল!
প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!
প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!!
আজ রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!
পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংস-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে–
শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!
'নাই দানব
নাই অসুর,–
চাইনে সুর,
চাই মানব!'–
বরাভয়-বাণী ঐ রে কার
শুনি, নহে হৈ রৈ এবার! ওঠ্ রে ওঠ্,
ছোট্ রে ছোট্!
শান্ত মন,
ক্ষান্ত রণ!– খোল্ তোরণ,
চল্ বরণ
করব্ মা'য়;
ডর্ব কায়?
ধরব পা'য় কার্ সে আর,
বিশ্ব-মা'ই পার্শ্বে যার?
আজ আকাশ-ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া,
ঐ শেফালিকা-তলে কে বালিকা চলে?
কেশের গন্ধ আনিছে আশিন-হাওয়া!
এসেছে রে সাথে উৎপলাক্ষী চপলা কুমারী কমলা ঐ,
সরসিজ-নিভ শুভ্র বালিকা
এল বীণা-পাণি অমলা ঐ! এসেছে গনেশ,
এসেছে মহেশ,
বাস্রে বাস্!
জোর উছাস্!!
এল সুন্দর সুর-সেনাপতি,
সব মুখ এ যে চেনা-চেনা অতি!
বাস্ রে বাস্ জোর উছাস্!! হিমালয়! জাগো! ওঠো আজি,
তব সীমা লয় হোক।
ভুলে যাও শোক– চোখে জল ব'ক
শান্তির– আজি শান্তি-নিলয় এ আলয় হোক!
ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক!
মা'র আবাহন-গীত্ চলুক!
দীপ জ্বলুক!
গীত চলুক!!
আজ কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম্!
স্বা-গতম্!
স্বা-গতম্!!
মা-তরম্!
মা-তরম্!!
ঐ ঐ ঐ বিশ্ব কণ্ঠে
বন্দনা- বাণী লুণ্ঠে-'বন্দে মাতরম্!!!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন-সহচরী
লো আমার অনাগত প্রিয়া,
আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!
তোমারে বন্দনা করি….
হে আমার মানস-রঙ্গিণী,
অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
তোমারে বন্দনা করি….
নাম-নাহি-জানা ওগো আজো-নাহি-আসা!
আমার বন্দনা লহ, লহ ভালবাসা….
গোপণ-চারিণী মোর, লো চির-প্রেয়সী!
সৃষ্টি-দিন হ’তে কাঁদ’ বাসনার অন্তরালে বসি’-
ধরা নাহি দিলে দেহে।
তোমার কল্যাণ-দীপ জ্বলিলে না
দীপ-নেভা বেড়া-দেওয়া গেহে।
অসীমা! এলে না তুমি সীমারেখা-পারে!
স্বপনে পাইয়া তোমা’ স্বপনে হারাই বারে বারে
অরুপা লো! রহি হ’য়ে এলে মনে,
সতী হ’য়ে এলে না ক’ ঘরে।
প্রিয় হ’য়ে এলে প্রেমে,
বধূ হয়ে এলে না অধরে!
দ্রাক্ষা-বুকে রহিলে গোপনে তুমি শিরীন্ শরাব,
পেয়ালায় নাহি এলে!-
‘উতারো নেকার’-
হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা!
সুদুরিকা! দূরে থাক’-ভালোবাসা-নিকটে এসো না।
তুমি নহ নিভে যাওয়া আলো, নহ শিখা।
তুমি মরীচিকা,
তুমি জ্যোতি।-
জন্ম-জন্মান্তর ধরি’ লোকে-লোকান্তরে তোমা’ করেছি আরতি,
বারে বারে একই জন্মে শতবার করি!
যেখানে দেখেছি রূপ,-করেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি’।
রূপে রূপে, অপরূপা, খুঁজেছি তোমায়,
পবনের যবনিকা যত তুলি তত বেড়ে যায়!
বিরহের কান্না-ধোওয়া তৃপ্ত হিয়া ভরি’
বারে বারে উদিয়াছ ইন্দ্রধনুসমা,
হাওয়া-পরী
প্রিয় মনোরমা!
ধরিতে গিয়োছি-তুমি মিলায়েছ দূর দিগ্বলয়ে
ব্যথা-দেওয়া রাণী মোর, এলে না ক’ কথা কওয়া হ’য়ে।
চির-দূরে থাকা ওগো চির-নাহি-আসা!
তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা
গ্রহ হ’তে গ্রহান্তরে ল’য়ে যায় মোরে!
বাসনার বিপুল আগ্রহে-
জন্ম লভি লোকে-লোকান্তরে!
উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা
উদগ্র কামনা,
জন্ম তাই লভি বারে বারে,
না-পাওয়ার করি আরাধনা!….
যা-কিছু সুন্দর হেরি’ ক’রেছি চুম্বন,
যা-কিছু চুম্বন দিয়া ক’রেছি সুন্দর-
সে-সবার মাঝে যেন তব হরষণ
অনুভব করিয়াছি!-ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে তিলে!
তোমারে যে করেছি চুম্বন
প্রতি তরুণীর ঠোঁটে
প্রকাশ গোপন।
যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে,
রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-লাগা ঘুম-পাওয়া প্রাতে,
সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’
সকলের ঠোঁটে যেন, হে নিখিল-প্রিয়া প্রিয়তমা!
তরু, লতা, পশু, পাখী, সকলের কামনার সাথে
আমার কামনা জাগে,-আমি রমি বিশ্ব-কামনাতে!
বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি-
সকলের মাঝে আমি-সকলের প্রেমে মোর গতি!
যে-দিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম,
সেই দিন স্রষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম।
আমি কাম, তুমি হ’লে রতি,
তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি!
কী যে তুমি, কী যে নহ, কত ভাবি-কত দিকে চাই!
নামে নামে, অ-নামিকা, তোমারে কি খুঁজিনু বৃথাই?
বৃথাই বাসিনু ভালো? বৃথা সবে ভালোবাসে মোরে?
তুমি ভেবে যারে বুকে চেপে ধরি সে-ই যায় স’রে।
কেন হেন হয়, হায়, কেন লয় মনে-
যারে ভালো বাসিলাম, তারো চেয়ে ভালো কেহ
বাসিছে গোপনে।
সে বুঝি সুন্দরতর-আরো আরো মধু!
আমারি বধূর বুকে হাসো তুমি হ’য়ে নববধূ।
বুকে যারে পাই, হায়,
তারি বুকে তাহারি শয্যায়
নাহি-পাওয়া হ’য়ে তুমি কাঁদ একাকিনী,
ওগো মোর প্রিয়ার সতিনী।….
বারে বারে পাইলাম-বারে বারে মন যেন কহে-
নহে, এ সে নহে!
কুহেলিকা! কোথা তুমি? দেখা পাব কবে?
জন্মেছিলে জন্মিয়াছ কিম্বা জন্ম লবে?
কথা কও, কও কথা প্রিয়া,
হে আমার যুগে-যুগে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!
কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়,
প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়।
জন্ম যার কামনার বীজে
কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে।
দিকে দিকে শাখা তার করে অভিযান,
ও যেন শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ।
আকাশ ঢেকেছে তার পাখা
কামনার সবুজ বলাকা!
প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু-আগণন,
তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।
মদ সত্য, পাত্র সত্য নয়!
যে-পাত্রে ঢালিয়া খাও সেই নেশা হয়!
চির-সহচরী!
এতদিনে পরিচয় পেনু, মরি মরি!
আমারি প্রেমের মাঝে রয়েছ গোপন,
বৃথা আমি খুঁজে মরি’ জন্মে জন্মে করিনু রোদন।
প্রতি রূপে, অপরূপা, ডাক তুমি,
চিনেছি তোমায়,
যাহারে বাসিব ভালো-সে-ই তুমি,
ধরা দেবে তায়!
প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,
বহু পাত্রে ঢেলে পি’ব সেই প্রেম-
সে শরাব লোহু।
তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়,
ভৃঙ্গারে, গোলাসে কভু, কভু পেয়ালায়!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
[গান]ধ্বংস করো এই কচুরিপানা!
(এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুরছানা॥ (ধুয়া)
ইহাদের সবংশে করো করো নাশ,
এদের দগ্ধ করে করো ছাই পাঁশ,
(এরা) জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস,
(এরা) দৈত্যের দাঁত, রাক্ষসের ডানা।–
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(এরা) ম্যালেরিয়া আনে, আনে অভাব নরক,
(এরা) অমঙ্গলের দূত, ভীষণ মড়ক!
(এরা) একে একে গ্রাস করে নদী ও নালা।
(যত) বিল ঝিল মাঠ ঘাট ডোবা ও খানা।
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(এরা) বাংলার অভিশাপ, বিষ, এরা পাপ,
(এসো) সমূলে কচুরিপানা করে ফেলি সাফ!
(এরা) শ্যামল বাংলা দেশ করিল শ্মশান,
(এরা) শয়তানি দূত দুর্ভিক্ষ-আনা।
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(কাল) সাপের ফণা এর পাতায় পাতায়,
(এরা) রক্তবীজের ঝাড়, মরিতে না চায়,
(ভাই) এরা না মরিলে মোরা মরিব সবাই
(এরে) নির্মূল করে ফেলো, শুনো না মানা।
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া) (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
তিলক দিলে কি শ্যাম ত্রিলোক ভুলাতে?
কে দিল বনমালী বনমালা গলাতে?আঁখি যেন ঢলঢল আধফোটা শতদল
কে শিখাল ও চাহনি গোপিনী ছলিতে?
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্-পেশী,
দু’কানে চশ্মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী!কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!আমি বলি, ওরে কথা শোন্ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্ খোশ্-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্, এবার এ দাঁও ফস্কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে!ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
রাজ্যে যাদের সূর্য অস্ত যায় না কখনও, শুনিস হায়,
মেরে মেরে যারা ভাবিছে অমর, মরিবে না কভু মৃত্যু-ঘায়,
তাদের সন্ধ্যা ওই ঘনায়!
চেয়ে দেখ ওই ধূম্র-চূড়
অসন্তোষের মেঘ-গরুড়
সূর্য তাদের গ্রাসিল প্রায়!
ডুবেছে যে পথে রোম গ্রিক প্যারি – সেই পথে যায় অস্ত যায়
ওদের সূর্য! – দেখবি আয়!
২
অর্ধ পৃথিবী জুড়ে হাহাকার, মড়ক, বন্যা, মৃত্যুত্রাস,
বিপ্লব, পাপ, অসূয়া, হিংসা, যুদ্ধ, শোষণ-রজ্জুপাশ,
অনিল যাদের ক্ষুধিত গ্রাস –
তাদের সে লোভ-বহ্নি-শিখ
জ্বালায়ে জগৎ, দিগ্বিদিক,
ঘিরেছে তাদেরই গৃহ, সাবাস!
যে আগুনে তারা জ্বালাল ধরা তা এনেছে তাদেরই সর্বনাশ!
আপনার গলে আপন ফাঁস!
৩
এবার মাথায় দংশেছে সাপে, তাগা আর কোথা বাঁধবে বল?
আপনার পোষা নাগিনি তাহার আপনার শিরে দিল ছোবল।
ওঝা ডেকে আর বল কী ফল?
ঘরে আজ তার লেগেছে আগুন,
ভাগাড়ে তাহার পড়েছে শকুন,
রে ভারতবাসী, চল রে চল!
এই বেলা সবে ঘর ছেয়ে নেয়, তোরাই বসে কি রবি কেবল?
আসে ঘনঘটা ঝড়-বাদল!৪
ঘর সামলে নে এই বেলা তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন!
আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন!
ধর্ম-কলহ রাখ দুদিন!
নখ ও দন্ত থাকুক বাঁচিয়া,
গণ্ডূষ ফের করিবি কাঁচিয়া,
আসিবে না ফিরে এই সুদিন!
বদনা-গাড়ুতে কেন ঠোকাঠুকি, কাছা কোঁচা টেনে শক্তি ক্ষীণ,
সিংহ যখন পঙ্ক-লীন।
৫
ভায়ে ভায়ে আজ হাতাহাতি করে কাঁচা হাত যদি পাকিয়েছিস
শত্রু যখন যায় পরে পরে – নিজের গণ্ডা বাগিয়ে নিস!
ভুলে যা ঘরোয়া দ্বন্দ্ব-রিষ।
কলহ করার পাইবি সময়,
এ সুযোগ দাদা হারাবার নয়!
হাতে হাত রাখ, ফেল হাতিয়ার, ফেলে দে বুকের হিংসা-বিষ!
নব-ভারতের এই আশিষ!
৬
নারদ নারদ! জুতো উলটে দে! ঝগড়েটে ফল খুঁজিয়া আন।
নখে নখ বাজা! এক চোখ দেখা! দুকাটি বাজিয়ে লাগাও গান!
শত্রুর ঘরে ঢুকেছে বান!
ঘরে ঘরে তার লেগেছে কাজিয়া,
রথ টেনে আন আনরে তাজিয়া,
পূজা দেরে তোরা, দেরে কোরবান!
শত্রুর গোরে গলাগলি কর আবার হিন্দু-মুসলমান!
বাজাও শঙ্খ, দাও আজান!(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,
কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,
বরষের পরে আসিলে ঈদ!
ভুখারীর দ্বারে সওগাত ব'ইয়ে রিজওয়ানের,
কন্টক-বনে আশ্বাস এনে গুল- বাগের,
সাকীরে "জা'মের দিলে তাগিদ!খুশীর পাপিয়া পিউ পিউ গাহে দিগ্বিদিক
বধূ জাগে আজ নিশীথ-বাসরে নির্নিমিখ!
কোথা ফুলদানী, কাঁদিছে ফুল,
সুদূর প্রবাসে ঘুম নাহি আসে কার সখার,
মনে পড়ে শুধু সোঁদা-সোঁদা বাস এলো খোঁপার,
আকুল কবরী উলঝলুল!ওগো কাল সাঁঝে দ্বিতীয়া চাঁদের ইশারা কোন
মুজদা এনেছে, সুখে ডগমগ মুকুলী মন!
আশাবরী- সুরে ঝুরে সানাই।
আতর-সুবাসে কাতর হ'ল গো পাথর-দিল,
দিলে দিলে আজ বন্ধকী দেনা-নাই দলিল,
কবুলিয়তের নাই বালাই।।আজিকে এজিদে হাসেনে হোসেনে গলাগলি,
দোযখে বেহেশতে সুল ও আগুনে ঢলাঢলি,
শিরী ফরহাদে জড়াহড়ি!
সাপিনীর মত বেঁধেছে লায়লী কায়েসে গো,
বাহুর বন্ধে চোখ বুঁজে বঁধু আয়েসে গো,
গালে গালে চুমু গরাগড়ি।।দাউ- দাউ জ্বলে আজি স্ফূর্তির জাহান্নাম,
শয়তান আজ বেহেশতে বিলায় শরাব-জাম,
দুশম্ন দস্ত এক-জামাত!
আজি আরফাত-ময়দান পাতা গাঁয়ে- গাঁয়ে,
কোলাকুলি করে বাদশা ফকীরে ভায়ে-ভায়ে,
কা'বা ধ'রে নাচে 'লাত-মানাত'।।আজি ইসলামী ডঙ্কা গরজে ভরি' জাহান,
নাই বড় ছোট-সকল মানুষ এক সমান,
রাজা প্রজা নয় কারো কেহ।
কে আমীর তুমি নওয়াব বাদশা বালাখানায়?
সকল কালের কলঙ্ক তুমি; জাগালে হায়
ইসলামে তুমি সন্দেহ।।ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দু'জনার হবে বুলন্দ-নসীব, লাখে লাঝে হবে বদ-নসীব?
এ নহে বিধান ইসলামের।।ঈদ-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও-পেয়ালাতে,
দিয়া ভোগ কর, বীর দেদার।।বুক খালি ক'রে আপনারে আজ দাও জাকাত,
করো না হিসাবী, আজি হিসাবের অঙ্কপাত!
একদিন করো ভুল হিসাব।
দিলে দিলে আজ খুন্সুড়ি করে দিললগী,
আজিকে ছায়েলা-লায়েলা-চুমায় লাল যোগী!
জামশেদ বেঁচে চায় শরাব।।পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু, ঈদ মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম!
বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ!
আমার দানের অনুরাগে-রাঙা 'ঈদগা'রে!
সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে-
দেহ নয়, দিল হবে শহীদ।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
রূপক
|
ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা
চোরাবালির চর,
ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস
সেই চরে তোর ঘর?
শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা,
হাট তুলে দে সর্বহারা,
মেঘ-জননীর অশ্র”ধারা
ঝ’রছে মাথার’ পর,
দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি
দুলিয়ে তর”-কর।।
কন্যারা তোর বন্যাধারায়
কাঁদছে উতরোল,
ডাক দিয়েছে তাদের আজি
সাগর-মায়ের কোল।
নায়ের মাঝি! নায়ের মাঝি!
পাল তু’লে তুই দে রে আজি
তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী
তরঙ্গে খায় দোল।
নায়ের মাঝি! আর কেন ভাই?
মায়ার নোঙর তোল্।
ভাঙন-ভরা ভাঙনে তোর
যায় রে বেলা যায়।
মাঝি রে! দেখ্ কুরঙ্গী তোর
কূলের পানে চায়।
যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী
ঘনায় গহন শাঙন-রাতি
মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি’
ঘুমুস্ নে আর, হায়!
ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া
এতই কি রে দায়?
হীরা-মানিক চাসনি ক’ তুই,
চাস্নি ত সাত ক্রোর,
একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র-
ভরা অভাব তোর,
চাইলি রে ঘুম শ্রানি–হরা
একটি ছিন্ন মাদুর-ভরা,
একটি প্রদীপ-আলো-করা
একটু-কুটীর-দোর।
আস্ল মৃত্যু আস্ল জরা,
আস্ল সিঁদেল-চোর।
মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে
মাটির বুকে চল্!
শক্তমাটির ঘায়ে হউক
রক্ত পদতল।
প্রলয়-পথিক চ’ল্বি ফিরি
দ’লবি পাহাড়-কানন-গিরি!
হাঁকছে বাদল, ঘিরি’ ঘিরি’
নাচছে সিন্ধুজল।
চল্ রে জলের যাত্রী এবার
মাটির বুকে চল্ ।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
শোকমূলক
|
এল শোকের সেই মোহররম কারবালার স্মৃতি লয়ে।
আজি বে-তাব বিশ্বমুসলিম সেই শোকে রোয়ে রোয়ে।।মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুশের বাচ্চায়
পানি চাহিয়া পেল শাহাদাত হোসেনের বক্ষে রয়ে।।এক হাতে বিবাহের কাঙ্গন এক হাতে কাসেমের লাশ,
বেহুঁশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা সয়ে।।ঝরিছে আঁখিতে খুন হায় জয়নাল বেহুঁশ কেঁদে
মানুষ ব'লে সহে এত পাথরও যেত ক্ষয়ে।।শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হযরত হোসেন শহীদ,
আসমানে শোকের বারেষ, মরে আজি খুন হয়ে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
পাষাণের ভাঙালে ঘুম
কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়
গলিয়া সুরের তুষার
গীতিনির্ঝর বয়ে যায়।উদাসী বিবাগী মন
যাচে আজ বাহুর বাঁধন
কত জনমের কাঁদন
ও পায়ে লুটাতে চায়।ওগো তোমার চরণ ছন্দে মোর
মুঞ্জরিল গানের মুকুল
তোমার বেণীর বন্ধে গো
মরিতে চায় সুরের বকুল।
চমকে ওঠে মোর গগণ
ঐ হরিণ চোখের চাওয়ায়।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ছড়া
|
[ছন্দ :- “এই পথটা কা-টবো
পাথর ফেলে মা-রবো”]ছোট্ট বোনটি লক্ষ্মী
ভো ‘জটায়ু পক্ষী’!
য়্যাব্বড়ো তিন ছত্র
পেয়েছি তোর পত্র।
দিইনি চিঠি আগে,
তাইতে কি বোন রাগে?
হচ্ছে যে তোর কষ্ট
বুঝতেছি খুব পষ্ট।
তাইতে সদ্য সদ্য
লিখতেছি এই পদ্য।
দেখলি কী তোর ভাগ্যি!
থামবে এবার রাগ কি?
এবার হতে দিব্যি
এমনি করে লিখবি!
বুঝলি কী রে দুষ্টু
কী যে হলুম তুষ্টু
পেয়ে তোর ওই পত্র –
যদিও তিন ছত্র!
যদিও তোর অক্ষর
হাত পা যেন যক্ষর,
পেটটা কারুর চিপসে,
পিঠটে কারুর ঢিপসে,
ঠ্যাংটা কারুর লম্বা,
কেউ বা দেখতে রম্ভা!
কেউ যেন ঠিক থাম্বা,
কেউ বা ডাকেন হাম্বা!
থুতনো কারুর উচ্চে,
কেউ বা ঝুলেন পুচ্ছে!
এক একটা যা বানান
হাঁ করে কী জানান!
কারুর গা ঠিক উচ্ছের,
লিখলি এমনি গুচ্ছের!
না বোন, লক্ষ্মী, বুঝছ?
করব না আর কুচ্ছো!
নইলে দিয়ে লম্ফ
আনবি ভূমিকম্প!
কে বলে যে তুচ্ছ!
ওই যে আঙুর গুচ্ছ!
শিখিয়ে দিল কোন্ ঝি
নামটি যে তোর জন্টি?
লিখবে এবার লক্ষ্মী
নাম ‘জটায়ু পক্ষী!’
শিগগির আমি যাচ্চি,
তুই বুলি আর আচ্ছি
রাখবি শিখে সব গান
নয় ঠেঙিয়ে – অজ্ঞান!
এখনও কি আচ্ছু
খাচ্ছে জ্বরে খাপচু?
ভাঙেনি বউদির ঠ্যাংটা।
রাখালু কি ন্যাংটা?
বলিস তাকে, রাখালী!
সুখে রাখুন মা কালী!
বৌদিরে কোস দোত্তি
ধরবে এবার সত্যি।
গপাস করে গিলবে
য়্যাব্বড়ো দাঁত হিলবে!
মা মাসিমায় পেন্নাম
এখান হতেই করলাম!
স্নেহাশিস এক বস্তা,
পাঠাই, তোরা লস তা!
সাঙ্গ পদ্য সবিটা?
ইতি। তোদের কবি-দা। (ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
[কীর্তন]
(আমি) চাইনে হতে ভ্যাবাগঙ্গারাম
ও দাদা শ্যাম!
তাই গান গাই আর যাই নেচে যাই
ঝম্ঝমা্ঝম্ অবিশ্রাম ॥
আমি সাইক্লোন আর তুফান
আমি দামোদরের বান
খোশখেয়ালে উড়াই ঢাকা, ডুবাই বর্ধমান।
আর শিবঠাকুরকে কাঠি করে বাজাই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-ড্রাম॥
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।
উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।
ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী,
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।
মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।
উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।
হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।
তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে।
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়।
যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।
মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের,
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ।
পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো,
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো।
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।
দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!
তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।
বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।
নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান!
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
বাংলার অগ্নি-নাগিনি মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কুল-গৌরব
আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা
মিসেস এম. রহমান সাহেবার
পবিত্র চরণারবিন্দে –এমনই প্লাবন-দুন্দুভি-বাজা ব্যাকুল শ্রাবণ মাস –
সর্বনাশের ঝান্ডা দুলায়ে বিদ্রোহ-রাঙা-বাস
ছুটিতে আছিনু মাভৈঃ-মন্ত্র ঘোষি অভয়কর,
রণ-বিপ্লব-রক্ত-অশ্ব কশাঘাত-জর্জর!
সহসা থমকি দাঁড়ানু আমার সর্পিল-পথ-বাঁকে,
ওগো নাগমাতা, বিষ-জর্জর তব গরজন-ডাকে!
কোথা সে অন্ধ অতল পাতাল-বন্ধ গুহার তলে,
নির্জিত তব ফণা-নিঙড়ানো গরলের ধারা গলে;
পাতাল-প্রাচীর চিরিয়া তোমার জ্বালা-ক্রন্দন-চূর
আলোর জগতে এসে বাজে যেন বিষ-মদ-চিক্কুর!
আঁধার-পীড়িত রোষ-দোদুল সে তব ফণা-ছায়া-দোল
হানিছে গৃহীরে অশুভ শঙ্কা, কাঁপে ভয়ে সুখ-কোল।
ধূমকেতু-ধ্বজ বিপ্লব-রথ সম্ভ্রমে অচপল,
নোয়াইল শির শ্রদ্ধা-প্রণত রথের অশ্বদল!
ধূমকেতু-ধূম-গহ্বরে যত সাগ্নিক শিশু-ফণী
উল্লাসে ‘জয় জয় নাগমাতা’ হাঁকিল জয়-ধ্বনি!
বন্দিল, উর নাগ-নন্দিনী ভেদিয়া পাতাল-তল!
দুলিল গগনে অশুভ-অগ্নি পতাকা জ্বালা-উজল!
তারপর মা গো কোথা গেলে তুমি, আমি কোথা হনু হারা,
জাগিয়া দেখিনু, আমারে গ্রাসিয়া রাহু রাক্ষস-কারা!
শৃঙ্খলিতা সে জননীর ব্যথা বাজিয়া এ ক্ষীণ বুকে
অগ্নি হয়ে মা জ্বলেছিল খুন, বিষ উঠেছিল মুখে,
শৃঙ্খল-হানা অত্যাচারীর বুকে বাজপাখি সম
পড়িয়া তাহারে ছিঁড়িতে চেয়েছি হিংসা-নখরে মম, –
সে আক্রমণ ব্যর্থ কখন করেছে কারার ফাঁদ,
বন্দিনী দেশ-জননীর সাথে বেঁধেছে আমারে বাঁধ।
হাতে পায়ে কটি-গর্দানে মোর বাজে শত শৃঙ্খল,
অনাহারে তনু ক্ষুধা-বিশীর্ণ, তৃষায় মেলে না জল,
কত যুগ যেন এক অঞ্জলি পাইনিকো আলো বায়ু,
তারই মাঝে আসি রক্ষী-দানব বিদ্যুতে বেঁধে স্নায়ু –
এত যন্ত্রণা তবু সব যেন বুকে ক্ষীর হয়ে ওঠে,
শত্রুর হানা কণ্টক-ক্ষত প্রাণে ফুল হয়ে ফোটে!–
এরই মাঝে তুমি এলে নাগমাতা পাতাল-বন্ধ টুটি
অচেতন মম ক্ষত তনু পড়ে তব ফণা-তলে লুটি!
তোমার মমতা-মানিক-আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,
তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্বজননী! তোমার আঁচল পাতা
নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে; বিষ শুধু তোমা দহে
ফণা তব মা গো পীড়িত নিখিল ধরণির ভার বহে ! –
আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে,
সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে,
নহে তার তরে, – সব সন্তানে তুমি যে বেসেছ ভালো,
তোমার মানিক সকলের মুখে দেয় যে সমান আলো,
শুধু মাতা নহ, জগন্মাতার আসনে বসেছ তুমি, –
সেই গৌরবে জননী আমার, তোমার চরণ চুমি! (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
নতুন পথের যাত্রা-পথিক
চালাও অভিযান !
উচ্চ কণ্ঠে উচ্চার আজ -
“মানুষ মহীয়ান !”
চারদিকে আজ ভীরুর মেলা ,
খেলবি কে আর নতুন খেলা ?
জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা
বাইবি কি উজান ?
পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল
স্বর্গে দিবি টান্ ।।
সরল সাজের নাইরে সময়
বেরিয়ে তোরা আয় ,
আজ বিপদের পরশ নেব
নাঙ্গা আদুল গায় ।
আসবে রণ-সজ্জা করে ,
সেই আশায়ই রইলি সবে !
রাত পোহাবে প্রভাত হবে
গাইবে পাখি গান ।
আয় বেরিয়, সেই প্রভাতে
ধরবি যারা তান ।।
আঁধার ঘোরে আত্নঘাতী
যাত্র-পথিক সব
এ উহারে হানছে আঘাত
করছে কলরব !
অভিযানে বীর সেনাদল !
জ্বালাও মশাল, চল্ আগে চল্ ।
কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল ,
গাও প্রভাতের গান !
ঊষার দ্বারে পৌছে গাবি
‘জয় নব উত্থান !’
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারনি
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে
আমি গান গাহি আপনার দুখে
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে
আলেয়ার মত ডাকিও না আর
নিশিথ অন্ধকারে
দোয়া কর, মোরে দোয়া কর
আর আমারে লইয়া খেলোনা নিঠুর খেলা
শত কাঁদিলেঅ ফিরিবেনা
সেই শুভ লগনের বেলা
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি
তব চোখে কেন সজল মিনতী
আমি কি কোনদিন এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
হে আনন্দ-প্রেম-রসঘন, মধুরম, মনোহর!
একী মদিরার আবেশে নেশায় কাঁপে তনু থরথর!
হৃদি-পদ্মিনী নিঙাড়িয়া বঁধু –
আনিতে চাও কি অমৃতমধু,
উদাসীন মনে আন একী সুরভিত বন-মর্মর!
ঘন অরণ্য-আড়ালে কে হাস প্রিয় জ্যোতিসুন্দর!কৃষ্ণা তিথির আড়ালে আমার চাঁদ লুকাইয়াছিলে!
আমি ভেবেছিনু, আমি কালো, তুমি তাই প্রেম নাহি দিলে।
বুঝি নাই, রসময়, তব খেলা
ভয় হত, যদি কর অবহেলা।
বেণুকা বাজায়ে পথে এনে হায় কোথা তুমি লুকাইলে?
দেখেছ কি দেহে কাদা, অন্তরে রাধারে নাহি দেখিলে?তব অভিসার-পথ রুধিয়াছে কে যেন ভয়ংকর!
দিগ্দিগন্তে অন্ধ করেছে বাধার তুফান ঝড়।
সীতার মতন কে যেন গো কেশ ধরে
আঁধার পাতালে লইয়া গিয়াছে মোরে।
জড়াইয়া যেন শত শত নাগ বিষাক্ত অজগর
দংশেছে মোরে, বিষে জরজর! – তবু, ওগো মনোহর –ডাকিনি তোমায়, যদি এই বিষ তব শ্রীঅঙ্গে লাগে!
এই পঙ্ক, এ মালিন্য যদি বাধা আনে অনুরাগে।
বলেছি, ‘বন্ধু, সরে যাও, সরে যাও,
আমার এ ক্লেশে আমারে কাঁদিতে দাও।’
আমার দুখ ‘লু’ হাওয়ার জ্বালা না আনে গোলাপ-বাগে!
ক্ষমা কোরো মোরে, ভুল বুঝিয়ো না, যদি অভিমান জাগে!জানি তুমি মোরে জড়ায়ে ধরেছ প্রকাশ-ব্রহ্মরূপে,
আমার বক্ষে চেতনানন্দ হয়ে কাঁদ চুপে চুপে!
হৃদি-শতদল কাঁপে মোর টলমল,
মোর চোখে ঝরে তোমার অশ্রুজল!
বক্ষে জড়ায়ে আন প্রেমলোকে, নামিয়া অন্ধকূপে,
অমৃত স্বরূপে হে প্রিয়তম আনন্দ-স্বরূপে!আঁধারে আলোকে যখন যে পথ টানে, তুমি থাক কাছে।
অরণ্যপথে তব আনন্দ কুরঙ্গ হয়ে নাচে!
আমার তীর্থ-মরুপথে ছায়া হয়ে
সাথে সাথে চলো আঙুরের রস লয়ে,
পথের বালুকা পাখির পালক ফুল হয়ে ফুটিয়াছে!
চোখে জল, বুকে মধু বলে – ‘বঁধু, আছে আছে, সাথে আছে!’ (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
হাস্যরসাত্মক
|
ও মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা- নাক ড্যাঙ্গা-ড্যাং- ড্যাং!ওঁর নাকতাকে কে করল খ্যাঁদ্যা রাঁদা বুলিয়ে?
চামচিকে- ছা ব'সে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে।
বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং।
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।ওঁর খ্যাঁদা নাকের ছ্যাঁদা দিয়ে টুকি কে দেয় 'টু'!
ছোড়দি বলে সর্দি ওটা, এ রাম! ওয়াক! থুঃ!
কাছিম যেন উপুড় হয়ে ছড়িয়ে আছেন ঠ্যাং!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।দাদু বুঝি চিনাম্যান মা, নাম বুঝি চাং চু,
তাই বুঝি ওঁর মুখটা অমন চ্যাপটা সুধাংশু।
জাপান দেশের নোটীশ উনি নাকে এঁটেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।দাদুর নাকি ছিল না মা অমন বাদুড়- নাক
ঘুম দিলে ঐ চ্যাপটা নাকেই বাজতো সাতটা শাঁখ।
দিদিমা তাই থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।লম্ফানন্দে লাফ দিয়ে মা চলতে বেঁজির ছা
দাড়ির জালে প'ড়ে দাদুর আটকে গেছে গা,
বিল্লি- বাচ্চা দিল্লি যেতে নাসিক এসেছেন!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।দিদিমা কি দাদুর নাকে টাঙাতে 'আলমানাক'
গজাল ঠুঁকে দেছেন ভেঙ্গে বাঁকা নাকের কাঁখ?
মুচি এসে দাদুর আমার নাক করেছেন 'ট্যান'!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।বাঁশির মতন নাসিকা মা মেলে নাসিকে,
সেথায় নিয়ে চল দাদু দেখন -হাসিকে!
সেথায় গিয়ে করুন দাদু গরুড় দেবের ধ্যান,
খাঁদু দাদু নাকু হবেন, নাক ডেঙ্গাডেং ড্যাং।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
চন্দ্র- সূর্য রাত্রি দিবা
বিচিত্র সে আবেগ ভরে
ওগো প্রিয়, দেখি- তোমার
ধূলির 'পরে প্রণাম করে!
হৃদয় আঁখির সাধ হতে মোর
করো না গো নিরাশ মোরে,
রইবে ন্দূরে- বসিয়ে আমায়,
প্রতীক্ষার ঐ অগ্নি পরে?
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
কার তরে? ছাই এ পোড়ামুখ আয়নাতে আর দেখব না;
সুর্মা-রেখার কাজল-হরফ নয়নাতে আর লেখব না!
লাল-রঙিলা করব না কর মেহেদি-হেনার ছাপ ঘষে;
গুলফ চুমি কাঁদবে গো কেশ চিরুণ-চুমার আপশোশে!কপোল-শয়ান অলক-শিশুর উদাস ঘুম আর ভাঙবে না;
চুমহারা ঠোঁট পানের পিকের হিঙুল রঙে রাঙবে না!
কার তরে ফুলশয্যা বাসর, সজ্জা নিজেই লজ্জা পায়;
পীতম আমার দূর প্রবাসে, দেখবে কে সাজ-সজ্জা হায়!চাঁচর চুলে ধূম্র ওড়ে, অঙ্গ রাঙায় আগুন-রাগ,
যেমনি ফোটে মন-নিকষে পিয়ার ফাগুন-স্মৃতির দাগ।
সবাই বলে, চিনির চেয়েও শিরিন জীবন, – হায় কপাল!
পীতম-হারা নিম-তেতো প্রাণ কেঁদেই কাটায় সাঁঝ সকাল।যেথায় থাকো খোশহালে রও, বন্ধু আমার – শোকের বল!
তুমি তোমার সুখ নিয়ে রও, – থাকুক আমার চোখের জল! (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
আমার সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভূ উদার
হে প্রভু, শেখাও- নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর।
যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ- যুগান্ত নরকেও ঝাঁপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাই নীচত...ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমা
হৃদয়ের পরিসর
হৃদয়ে আমার সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র পর।নিন্দা না করি ঈর্ষা করো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুখি
ক্ষুদ্র আত্মা যার।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
স্বাগত বঙ্গে মুক্তিকাম!
সুপ্ত বঙ্গে জাগুক আবার লুপ্ত স্বাধীন সপ্তগ্রাম!
শোনাও সাগর-জাগর সিন্ধু-ভৈরবী গান ভয়-হরণ, –
এ যে রে তন্দ্রা, জেগে ওঠ তোরা, জেগে ঘুম দেওয়া নয় মরণ!
সপ্ত-কোটি কু-সন্তান তোরা রাখিতে নারিলি সপ্তগ্রাম?
খাসনি মায়ের বুকের রুধির? হালাল খাইয়া হলি হারাম !
মৃত্যু-ভূতকে দেখিলি রে শুধু, দেখিলি না তোরা ভবিষ্যৎ,
অস্ত-আঁধার পার হয়ে আসে নিত্য প্রভাতে রবির রথ!
অহোরাত্রিকে দেখেছে যাহারা সন্ধ্যাকে তারা করে না ভয়,
তারা সোজা জানে রাত্রির পরে আবার প্রভাত হবে উদয়।
দিন-কানা তোরা আঁধারের প্যাঁচা, দেখেছিস শুধু মৃত্যু-রাত,
ওরে আঁখি খোল, দেখ তোরও দ্বারে এসেছে জীবন নব-প্রভাত!
মৃত্যুর ‘ভয়’ মেরেছে তোদেরে, মৃত্যু তোদেরে মারেনি, ভাই!
তোরা মরে তাই হয়েছিস ভূত, আলোকের দূত হলিনে তাই!
জীবন থাকিতে ‘মরে আছি’ বলে পড়িয়া আছিস মড়া-ঘাটে,
সিন্ধু-শকুন নেমেছে রে তাই তোদের প্রাণের রাজ-পাটে!
রক্ত মাংস খেয়েছে তোদের, কঙ্কাল শুধু আছে বাকি,
ওই হাড় নিয়ে উঠে দাঁড়া তোরা ‘আজও বেঁচে আছি’ বল ডাকি!
জীবনের সাড়া যেই পাবে, ভয়ে সিন্ধু-শকুন পালাবে দূর,
ওই হাড়ে হবে ইন্দ্র-বজ্র, দগ্ধ হবে রে বৃত্রাসুর!
এ মৃতের দেশে, অমৃত-পুত্র, আনিবে কি সেই অমৃত-ঢল –
যাতে প্রাণ পেয়ে মৃত সগরের দেশ এ বঙ্গ হবে সচল?
জ্যান্তে-মরা এ ভীরুর ভারতে চাই নাকো মৃত-সঞ্জীবন,
ক্লীবের জীবন-সুধা আনো, করো ভূতের ভবিষ্যৎ সৃজন!
(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
ফিরনু যেদিন দ্বারে দ্বারে কেউ কি এসেছিল?
মুখের পানে চেয়ে এমন কেউ কি হেসেছিল?
অনেক তো সে ছিল বাঁশি,
অনেক হাসি, অনেক ফাঁসি,
কই কেউ কি ডেকেছিল আমায়, কেউ কি যেচেছিল?
ওগো এমন করে নয়ন-জলে কেউ কি ভেসেছিল?
তোমরা যখন সবাই গেলে হেলায় ঠেলে পায়ে,
আমার সকল সুধাটুকুন পিয়ে,
সেই তো এসে বুকে করে তুলল আপন নায়ে
আচমকা কোন্ না-চাওয়া পথ দিয়ে।
আমার যত কলঙ্কে সে
হেসে বরণ করলে এসে
আহা বুক-জুড়ানো এমন ভালো কেউ কি বেসেছিল?
ওগো জানত কে যে মনের মানুষ সবার শেষে ছিল। (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
নিত্য কথায় কুহেলিকায় আড়াল করি আপনারে।
সবাই যখন মত্ত হেথায় পান ক’রে মোর সুরের সুরা
সব-চেয়ে মোর আপন যে জন স-ই কাঁদে গো তৃষ্ণাতুরা।
আমার বাদল-মেঘের জলে ভর্ল নদী সপ্ত পাথার,
ফটিক-জলের কণ্ঠে কাঁদে তৃপ্তি-হারা সেই হাহাকার!
হায় রে, চাঁদের জ্যোৎস্না-ধারায় তন্দ্রাহারা বিশ্ব-নিখিল,
কলঙ্ক তার নেয় না গো কেউ, রইল জু’ড়ে চাঁদেরি দিল!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ
এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত।পয়জা তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে
আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে
সেই চিহ্ন বুকে পুরে
পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে
সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারতমা ফাতেমা খেলত এসে আমার ধূলি লয়ে
আমি পড়তাম তার পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে
হাসান হোসেন হেসে হেসে
নাচত আমার বক্ষে এসে
চক্ষে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত।আমার বুকে পা ফেলে রে বীর আসহাব যত
রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর ক্ষত
কুল মুসলিম আসত কাবায়
চলতে পায়ে দলত আমায়
আমি চাইতাম খোদার দীদার শাফায়ত জিন্নত।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
(‘ফি সবিলিল্লাহ্’)মোর পরম-ভিক্ষু আল্লার নামে চাই
ভিক্ষা দাও গো মাতা পিতা বোন ভাই,
দাও ভিখারিরে ভিক্ষা দাও।
মোর পরম-ডাকাত ঘরের দুয়ার খুলি
হরিয়া আমার সর্বস্ব সে
দিয়াছে ভিক্ষাঝুলি,
তাঁর মহাদান সেই ঝুলি কাঁধে তুলি
এসেছি ভিখারি, হে ধনী, ফিরিয়া চাও।
আল্লার নামে ভিক্ষা দাও।
হে ধনিক, তাঁর পাইয়াছ বহু দান,
রত্ন মানিক ভোগ যশ সম্মান,
তব প্রাসাদের চারিদিকে ভিখারিরা
প্রসাদ মেগেছে ক্ষুধার অন্ন,
চায়নি তোমার হিরা।
বলো, বলো, সেই নিরন্নদের মুখে
অন্ন দিয়াছ? কেঁদেছ তাদের দুখে?
লজ্জা ঢাকিয়া নগ্ন দেহের তার
মুক্তি, পেয়েছে তোমার মুক্তি-হার?
তব আত্মার আত্মীয় যারা,
তারা ক্ষুধা তৃষ্ণায়
কাঙালের বেশে কাঁদে তব দরজায় –
তাড়ায় তাদেরে গাল দিয়ে দরওয়ান,
তুমিও মানুষ, কাঁদে না তোমার প্রাণ?
হিরা মানিকের পাষাণ পরিয়া
তুমি কি পাষাণ হলে?
তোমার আত্মা কাঁদে না তোমার দুয়ারে
মানুষ মলে?
পাওনি শান্তি, আনন্দ প্রেম –
জানি আমি তাহা জানি,
তোমার অর্থ ঢাকিয়া রেখেছে
তোমার চোখের পানি!
কাঙালিনি মা-র বুকে ক্ষুধাতুর শিশু
তোমার দুয়ারে কাঁদে শোনো, ওই শোনো।
ভিক্ষা দাও না, রাশি রাশি হিরা মণি
তুলে রাখো আর গোনো।
এ টাকা তোমার রবে না, বন্ধু জানি,
এ লোভ তোমারে নরকে লইবে টানি।
‘আর্শ’ আসন টলিয়াছে আল্লার,
শুনি ক্ষুধিতের কাঙালের হাহাকার।
তাই সে পরম-ভিক্ষু ভিক্ষা চায়
ভিখারির মারফতে তব দরজায়।
ক্ষমা পাবে তুমি, আজিও সময় আছে,
ভিক্ষা না দিলে পুড়িবে অগ্নি-আঁচে।
মৃত্যুর আর দেরি নাই তব –
ফিরে চাও ফিরে চাও,
পরম-ভিক্ষু মোর আল্লার নামে –
দরিদ্র উপবাসীরে ভিক্ষা দাও।
ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি,
তোমরা দেখেছ ঊর্ধ্বের শশী রবি।
তোমরা তাঁহার সুন্দর সৃষ্টিরে
রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে।
তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপ-মালা
করে নাকো কেন কাঙালের ঘর আলা?
এত জ্ঞান এত শক্তি, বিলাস সে কি?
আলো তার দূর কুটিরে যায় না
কোন সে শিলায় ঠেকি?যাহারা বুদ্ধিজীবী, সৈনিক
হবে না তাহারা কভু,
তারা কল্যাণ আনেনি কখনও
তারা বুদ্ধির প্রভু।
তাহাদের রস দেবার তরে কি
লেখনী করিছ ক্ষয়?
শতকরা নিরানব্বই জন
তারা তব কেহ নয়?
এই দরিদ্র ভিখারিরা আজ
অসহায় গৃহহারা
‘আলো দাও’ বলে কাঁদিছে দুয়ারে –
ভিক্ষা পাবে না তারা?
অজ্ঞান-তিমিরান্ধকারের
ইহারা বদ্ধ জীব,
উৎপীড়কের পীড়নে পীড়িত
দলিত বদ্-নসিব।
তোমাদের আছে বিপুল শক্তি,
কৃপণ হইয়া তবে
কেন সহ মানুষের অপমান,
মানুষ কি দাস রবে?
আমার পিছনে পীড়িত আত্মা
অগণন জনগণ
অসহ জুলুম যন্ত্রণা পেয়ে
করিতেছে ক্রন্দন।
পরম-ভিক্ষু আদেশ দিলেন,
ভিক্ষা চাহিতে, তাই
এই অগণন জনগণ তরে
আসিয়াছি দ্বারে, ভাই!
ভোলো ভয়, দূর করো কৃপণতা,
পাষাণে প্রাণ জাগাও,
ভিখারির ঝুলি পূর্ণ হইবে,
তোমরা ভিক্ষা দাও।
তোমরা কি দলপতি,
তোমরা কি নেতা?
শুনেছি, তোমরা কল্যাণকামী
মহান উদারচেতা।
তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাহিব
চরম আত্মদান,
চাহিব তোমার অভিনন্দন-মালা,
যশ,খ্যাতি, প্রাণ।চাহিব তোমার গোপন ইচ্ছা
আত্ম-প্রতিষ্ঠার,
চাহিব ভিক্ষা তোমার সর্ব
লোভ ও অহংকার।
পরম ভিক্ষু পাঠায়েছে মোরে,
দাও সে ভিক্ষা দাও।
আপনার সব লোভ ও তৃষ্ণা
তাঁহারে বিলায়ে দাও!
তিনি নিরভাব, পূর্ণ। ভিক্ষা
চাহেন, এ তাঁর সাধ,
শালুক ফুটায়ে যেমন তাহারই
প্রেম-প্রীতি চায় চাঁদ।
যশ খ্যাতি আর অহংকারের
লোভ তাঁরে দিলে ভিখ,
ফিরে পাবে তাঁর মহাদান,
হবে মহানেতা নির্ভীক!
নিজেরা আত্মা ত্যাগ করে মহা
ত্যাগের পথ দেখাও!
ভিক্ষা চাহে এ ভিখারি, ভিক্ষা
দাও গো ভিক্ষা দাও!
তুমি কে? তুমি মদোন্মত্ত
মানবের যৌবন,
তুমি বারিদের ধারাজল, মহা
গিরির প্রস্রবণ।
তুমি প্রেম, তুমি আনন্দ, তুমি
ছন্দ মূর্তিমান,
তুমিই পূর্ণ প্রাণের প্রকাশ,
রুদ্রের অভিযান!
যুগে যুগে তুমিই অকল্যাণেরে
করিয়াছ সংহার,
তুমিই বৈরাগী, বক্ষের প্রিয়া
ত্যজি ধরো তলোয়ার!
জরাজীর্ণের যুক্তি শোন না,
গতি শুধু সম্মুখে,
মৃত্যুরে প্রিয় বন্ধুর সম
জড়াইয়া ধরো বুকে।
তোমরাই বীর সন্তান, যুগে
যুগে এই পৃথিবীর,
হাসিয়া তোমরা ফুলের মতন
লুটায়েছ নিজ শির।দেহেরে ভেবেছ ঢেলার মতন,
প্রাণ নিয়ে কর খেলা,
তোমারই রক্তে যুগে যুগে আসে
অরুণ-উদয়-বেলা।
তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাহিতে
আঁখি ভরে উঠে জলে,
তোমরা যে পথে চল, কেঁদে আমি
লুটাই সে পথতলে।
তোমাদেরই প্রাণ ভিক্ষা চাহিতে
এসেছি ভিখারি আমি,
ভিক্ষা চাহিতে পাঠাল সর্ব–
জাতির পরম স্বামী।
তোমরা শহিদ, তোমরা অমর,
নিতি আনন্দধামে
তোমরা খেলিবে, তোমাদের তরে
তাঁর কৃপা নিতি নামে।
তোমরাই আশা-ভরসা জাতির
স্বদেশের সেনাদল,
তোমরা চলিলে, আনন্দে ধরা
কেঁপে ওঠে টলমল।
তোমরা প্রবাহ, তোমরা শক্তি,
তোমরা জীবনধারা,
তোমাদেরই স্রোত যুগে যুগে ভাঙে
সব বন্ধন-কারা।
তুষার হইয়া কেন আছ আজও,
আগুন উঠেছে জ্বলে,
দিগ্দিগন্ত কাঁপাইয়া, ছুটে
এসো সবে দলে দলে।
তোমরা জাগিলে ঘুচে যাবে সব
ক্লৈব্য ও অবসাদ,
পরম-ভিক্ষু এক আল্লার
পুরিবে সেদিন সাধ।
আর কেহ ভিখ দিক বা না দিক
তোমরা ভিক্ষা দাও,
সাম্য শান্তি আসিবে না যদি
তোমরা ফিরে না চাও।
নহি নেতা, রাজনৈতিক, প্রেম-
ভিক্ষা আমার নীতি।
পৃথিবী স্বর্গ, পৃথিবীতে ফের
জাগুক স্বর্গ-প্রীতি।
অসম্ভবেরে সম্ভব করা
জাগো নবযৌবন।
ভিক্ষা দাও গো, এ ধরা হউক
আল্লার গুলশন। (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
[কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "আজি হতে শতবর্ষ পরে" পড়িয়া]
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে!
কে কবি, স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদেরে শত আনুরাগে,
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে।
ধেয়ানী গো, রহস্য-দুলাল!
উতারি’ ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে
কবে এল সুদূর আড়াল?
আনাগত আমাদের দখিন-দূয়ারী
বাতায়ন খুলি তুমি, হে গোপন হে স্বপ্ন-চারী,
এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে,
শত বর্ষ পরে যেথা তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি রাতে।
নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি-নীরে,
আনমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়
উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে।
আজি মোরা শত বর্ষ পরে
যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে ।।
জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে
শুনিতেছি প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিত গান সজল নয়নে।
আজো হায়
বারে বারে খুলে যায়
দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন,
গুমরি গুমরি কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন
মনে মনে বনে বনে পল্লব মর্মরে,
কবরীর অশ্রুজল বেশী-খসা ফুল-দল পড়ে ঝ’রে ঝ’রে!
ঝিরি ঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব,
মধুপের মুখ হতে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ আসব!
কপোতের চষ্ণুপুটে কপোতীর হারায় কূজন
পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন।
রহিয়া রহিয়া আজো ধরনীর হিয়া
সমীর উচ্ছ্বাস্ব যেন উঠে নিঃশ্বসিয়া!
তোমা হ’তে শত বর্ষ পরে--
তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি,
হে কবীন্দ্র, অনুরাগ ভরে!
আজি এই মদালসা ফাগুন-নিশীথে
তোমার ইঙ্গিত জাগে তোমার সঙ্গীতে!
চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরী।
করি' চুরি
আসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে,
কাব্য হ’য়ে, গান হ’য়ে, সিক্তকন্ঠে রঙ্গীলা স্বপনে।
আজিকার যত ফুল- বিহঙ্গের যত গান যত রক্ত-রাগ
তব অনুরাগ হ’তে হে চির-কিশোর কবি,
আনিয়াছে ভাগ !
আজি নব-বসন্তের প্রভাত-বেলায়
গান হ’য়ে মাতিয়াছে আমাদের যৌবন-মেলায়।
আনন্দ দুলাল ওগো হে চির অমর।
তরুণ তরুণি মোরা জাগিতেছি আজ তব মাধবী বাসর।
যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে--
সবগুলি তার
একবার--তা’ পর আবার
প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে।
গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি
কাঁদে প্রিয়া, “ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী--”
স্বপ্ন যায় থামি',
দেখি, বন্ধু, আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে অশ্রু হ’য়ে নামি'।
মনে লাগে, শত বর্ষ আগে
তুমি জাগো--তব সাথে আরো কেহ জাগে
দূরে কোন্ ঝিলিমিলি-তলে
লুলিত-অঞ্চলে।
তোমার ইঙ্গিতখানি সঙ্গীতের করুণ পাখায়
উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়,
ছুঁয়ে যায় আখি-জল রেখা,
নুয়ে যায় অলক-কুসুম,
তারপর যায় হারাইয়া,--তুমি একা বসিয়া নিঝ্ঝুম।
সে কাহার আঁখিনীর- শিশির লাগিয়া,
মুকুলিকা বাণী তব কোনটি বা ওঠে মঞ্জুরিয়া,
কোনটি বা তখনো গুঞ্জরি ফেরে মনে
গোপনে স্বপনে।
সহসা খুলিয়া গেল দ্বার,
আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার।
শতবর্ষ আগেকার তোমারি সে বাসন্তিকা দূতি
আজি তব নবীনের জানায় আকুতি!...
হে কবি-শাহান-শাহ। তোমারে দেখিনি মোরা,
সৃজিয়াছ যে তাজমহল-
শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপালে ঝলমল--
বিস্ময়-বিমুগ্ধ মোরা তাই হেরি,
যৌবনেরে অভিশাপি-- “কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরী?”
হায়, মোরা আজ
মোম্তাজে দেখিনি, শুধু দেখিতেছি তাজ!
শতবর্ষ পরে আজি হে কবি-সম্রাট!
এসেছে নূতন কবি--করিতেছে তব নান্দীপাঠ!
উদয়াস্ত জুড়ি' আজো তব
কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিছে নব নব।
তোমারি সে হারা-সুরখানি
নববেণু-কুঞ্জে-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী।
আজি তব বরে
শতবেণু-বীণা বাজে আমাদের ঘরে।
তবুও পুরে না হিয়া ভরে না ক' প্রাণ,
শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান।
মনে হয়, কবি ,
আজো আছ অস্তপাট আলো করি' আমাদেরি রবি!
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে
যে অভিবাদন তুমি ক’রেছিলে নবীনেরে রাঙা অনুরাগে,
সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে
প্রণামী-কমল হ’য়ে তব পদতলে!
মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্ণের রূপে
ওগো পূর্ণ আমাদেরি মাঝে চুপে চুপে।
আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কন্ঠস্বরে
তোমারি বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে--
তোমা হ’তে শতবর্ষ পরে!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
তারি আমি বান্দা গোলাম,
সৌখিন যে রস- পিয়াসী।
গলায় যাহার দোলায় বিধি
পাগল প্রেমের শিকলি ফাঁসি!
প্রেমের এবং প্রেম জানানোর
স্বাদ অ-রসিক বুঝবে কিসে?
পান করে এ সুরার ধারা,
সুর- লোকের রুপ- বিলাসী!!
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
যায় মহাকাল মূর্ছা যায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
যায় অতীত
কৃষ্ণ-কায়
যায় অতীত
রক্ত-পায়—
যায় মহাকাল মূর্ছা যায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
যায় প্রবীণ
চৈতি-বায়
আয় নবীন-
শক্তি আয়!
যায় অতীত
যায় পতিত,
‘আয় অতিথ,
আয় রে আয় –’
বৈশাখী-ঝড় সুর হাঁকায় –
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
ওই রে দিক্-
চক্রে কার
বক্রপথ
ঘুর-চাকার!
ছুটছে রথ,
চক্র-ঘায়
দিগ্বিদিক
মূর্ছা যায়!কোটি রবি শশী ঘুর-পাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
ঘোরে গ্রহ তারা পথ-বিভোল, –
‘কাল’-কোলে ‘আজ’খায় রে দোল!
আজ প্রভাত
আনছে কায়,
দূর পাহাড়-
চূড় তাকায়।
জয়-কেতন
উড়ছে কার
কিংশুকের
ফুল-শাখায়।
ঘুরছে রথ,
রথ-চাকায়
রক্ত-লাল
পথ আঁকায়।
জয়-তোরণ
রচছে কার
ওই উষার
লাল আভায়,
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়।গর্জে ঘোর
ঝড় তুফান
আয় কঠোর
বর্তমান।
আয় তরুণ
আয় অরুণ
আয় দারুণ,
দৈন্যতায়!
দৈন্যতায়!
ওই মা অভয়-হাত দেখায়
রামধনুর
লাল শাঁখায়!
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!
বর্ষ-সতী-স্কন্ধে ওই
নাচছে কাল
থই তা থই
কই সে কই
চক্রধর,
ওই মায়ায়
খণ্ড কর।
শব-মায়ায়
শিব যে যায়
ছিন্ন কর
ওই মায়ায় —
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়! (ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
জাগো আজ দণ্ড-হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী।
ডুবাল পাপ-চণ্ডাল তোদের বাংলা দেশের কাশী।
জাগো বঙ্গবাসী॥
তোরাহত্যা দিতিস যাঁর থানে, আজ সেই দেবতাই কেঁদে
ওরেতোদের দ্বারেই হত্যা দিয়ে মাগেন সহায় আপনি আসি।
জাগো বঙ্গবাসী॥
মোহের যার নাইকো অন্ত
পূজারী সেই মোহান্ত,
মা-বোনে সর্বস্বান্ত করছে বেদী-মূলে।
তোদেরেপূজার প্রসাদ বলে খাওয়ায় পাপ-পুঁজ সে গুলে।
তোরাতীর্থে গিয়ে আসিস পাপ-ব্যভিচার রাশি রাশি।
জাগো বঙ্গবাসী॥
এইসব ধর্ম-ঘাগী
দেব্তায় করছে দাগী,
মুখে কয় সর্বত্যাগী ভোগ-নরকে বসে।
সে যেপাপের ঘণ্টা বাজায় পাপী দেব-দেউলে পশে।
আরভক্ত তোরা পূজিস তারেই যোগাস খোরাক সেবা-দাসী!
জাগো বঙ্গবাসী॥
দিয়ে নিজ রক্তবিন্দু
ভরালি পাপের সিন্ধু—
ডুবলি তায় ডুবলি হিন্দু ডুবলি দেব্তারে।
দেখোভোগের বিষ্ঠা পুড়ছে তোদের বেদীর ধূপধারে।
পূজারীরকমণ্ডলুর গঙ্গা-জলে মদের ফেনা উঠছে ভাসি।
জাগো বঙ্গবাসী॥
দিতে যায় পূজা-আরতি
সতীত্ব হারায় সতী,
পুণ্য-খাতায় ক্ষতি লেখায় ভক্তি দিয়ে,
তার ভোগ-মহলের জ্বলছে প্রদীপ তোদের পুণ্য-ঘিয়ে।
তোদের ফাঁকা ভক্তির ভণ্ডামিতে মহাদেব আজ ঘোড়ার ঘাসী।
জাগো বঙ্গবাসী॥
তোরা সব শক্তিশালী
বুকে নয়, মুখে খালি!
বেড়ালকে বাছতে দিলি মাছের কাঁটা যে রে।
তোরাপূজারীকে করিস পূজা পূজার ঠাকুর ছেড়ে।
মার অসুর শোধরা সে ভুল, আদেশ দেন মা সর্বানাসী।
'জয় তারকেশ্বর' বলে পরবি রে নয় গলায় ফাঁসি।
জাগো বঙ্গবাসী॥
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
নীল সিয়া আসমা লালে লাল দুনিয়া,–
‘আম্মা ! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’।
কাঁদে কোন্ ক্রদসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া দামেশকে–
‘জয়নালে পরাল এ খুনিয়ারা বেশ কে?
‘হায় হায় হোসেনা’ ওঠে রোল ঝন্ঝায়,
তল্ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়!
উন্মাদ ‘দুলদুল্’ ছুটে ফেরে মদিনায়,
আলি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়!
মা ফাতেমা আস্মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস!
রণে যায় কাসিম্ ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদির রঙটুকু মুছে গেল সহসা!
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা–
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেলো সকিনা!’
কাঁদে কে রে কোলে করে কাসিমের কাটা-শির?
খান্খান্ খুন হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর!
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্মনও ‘সাব্বাস’!
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা!’
মা’র থনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্পায়!
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়্টায়?
দাউদাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু–’পানি দাও, মরে জাদু আস্গর!’
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ খাঁ করে কার্বালা, নাই পানি খর্জুর,
পেল না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, –পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্!
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাঁধনে!
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
‘দাদা! তেরি হর্ কিয়া বর্বাদ্ পয়মাল!’
হাইদরি-হাঁক হাঁকি দুল্দুল্-আস্ওয়ার
শম্শের চম্কায় দুশমনে ত্রাস্বার!
খসে পড়ে হাত হতে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার।
নিঃশেষ দুশ্মন্; ওকে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত?
কোথা বাবা আস্গর্? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসনের ফেটে যায় পাঁজরা!
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয়নি রে বাছাদের মুখে কম্জাত্রা!
অঞ্জলি হতে পানি পড়ে গেল ঝর্-ঝর্
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জর!
হল্কুমে হানে তেগ ও কে বসে ছাতিতে?–
আফ্তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে!
আস্মান ভরে গেল গোধূলিতে দুপরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে!
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্–
‘আরশের পায়া ধরে কাঁদে মাতা ফাতেমা,
‘এয়্ খোদা বদ্লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জনা করো গোনা পাপী কম্বখ্তের!’
কত মোহর্রম্ এল্ গেল চলে বহু কাল–
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুস্লিম্! তোরা আজ জয়নাল আবেদিন,
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এল আজ সেই মোহর্রম মাহিনা,–
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!
উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবির,
দুনিয়াতে নত নয় মুস্লিম কারো শির;–
তবে শোনো ঐ শোনো বাজে কোথা দামামা,
শম্শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তূর্য,
হুশিয়ার ইস্লাম, ডুবে তব সূর্য!
জাগো ওঠো মুস্লিম, হাঁকো হাইদরি হাঁক।
শহীদের দিনে সব-লালে-লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তিন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন।
হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের;
আস্গর সম দিব বাচ্চারে কোর্বান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান!
সকিনার শ্বেতবাস দেব মাতা কন্যায়,
কাসিমের মতো দেবো জান রুধি অন্যায়!
মোহর্রম্! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’
দেখো মরু-সূর্যে এ খুন যেন শোষে না!
———————————–
আরশ–খোদার সিংহাসন।
আম্মা –মা।
লা’ল–জাদু।
মাতম –হাহা ক্রন্দন।
দুনিয়া-দামেশকে– দামেশক-রূপ দুনিয়ায়।
আমামা–শিরস্ত্রাণ।
বানু –আসগরের মাতা।
আসগর –ইমাম হোসেনের শিশুপুত্র।
জয়নাল –ইমাম হোসেনের পুত্র।
বরবাদ –নষ্ট।
পয়মাল –ধ্বংস।
দুলদুল-আসওয়ার –’দুলদুল’ ঘোড়ার সওয়ার ইমাম হোসেন।
এক কাৎরা –এক বিন্দু।
কমজাতরা –নীচমনাগণ।
হলকুম –কণ্ঠ।
তেগ –তরবারি।
আফতাব –সূর্য।
কমবখ্ত –হতভাগ্য
মর্সিয়া –শোক-গীতি।
শম্শের –তরবারি।
নকিব –তূর্যবাদক।
জহর –বিষ।
কহর –অভিশাপ।
দাদ –প্রতিশোধ।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
নাম-হারা তুই পথিক-শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে।
কোন্ নামের আজ প’রলি কাঁকনম বাঁধনহারায় কোন্ কারা এ।।
আবার মনের মতন ক’রে
কোন্ নামে বল ডাক্ব তোরে!
পথ-ভোলা তুই এই সে ঘরে
ছিলি ওরে এলি ওরে
বারে বারে নাম হারায়ে।।
ওরে যাদু ওরে মাণিক, আঁধার ঘরের রতণ-মাণি!
ক্ষুধিত ঘর ভ’রলি এনে ছোট্ট হাতের একটু ননী।
আজ যে শুধু নিবিড় সুখে
কান্না-সায়র উথলে বুকে,
নতুন নামে ডাকতে তোকে
ওরে ও কে কন্ঠ র”খে’
উঠছে কেন মন ভারায়ে!
অস্ত হ’তে এলে পথিক উদয় পানে পা বাড়ায়ে।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
পদ্ম-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা-বিধৌত পূর্ব-দিগন্তে
তরুণ অরুণ বীণা বাজে তিমির বিভাবরী-অন্তে।
ব্রাহ্ম মুহুর্তের সেই পুরবাণী
জাগায় সুপ্ত প্রাণ জাগায় – নব চেতনা দানি
সেই সঞ্জীবনী বাণী শক্তি তার ছড়ায়
পশ্চিমে সুদূর অনন্তে॥
ঊর্মিছন্দা শত-নদীস্রোত-ধারায় নিত্য পবিত্র –
সিনান-শুদ্ধ-পুরববঙ্গ
ঘন-বন-কুন্তলা প্রকৃতির বক্ষে সরল সৌম্য
শক্তি-প্রবুদ্ধ পুরববঙ্গ
আজি শুভলগ্নে তারই বাণীর বলাকা
অলখ ব্যোমে মেলিল পাখা
ঝংকার হানি যায় তারই পুরবাণী
জীবন্ত হউক হিম-জর্জর ভারত
নবীন বসন্তে॥ (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।।
আপন জেনে হাত বাড়ালো-
আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
পুবের অরুণ রবি,-
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?
আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
তুমিই আমার মাঝে আসি’
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি,
আমার পূজার যা আয়োজন
তোমার প্রাণের হবি।
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।।
তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।।
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।।
আপন জেনে হাত বাড়ালো-
আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
পুবের অরুণ রবি,-
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?
আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
তুমিই আমার মাঝে আসি’
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি,
আমার পূজার যা আয়োজন
তোমার প্রাণের হবি।
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।।
তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
হাতে হাত দিয়ে আগে চলো, হাতে
নাই থাক হাতিয়ার!
জমায়েত হও, আপনি আসিবে
শক্তি জুলফিকার॥আনো আলির শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,
ওমরের মতো কর্মানুরাগ,
খালেদের মতো সব অসাম্য
ভেঙে করো একাকার॥
ইসলামে নাই ছোটো বড়ো আর
আশরাফ আতরাফ;
এই ভেদ-জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে
করো মিসমার সাফ! চাকর সৃজিতে চাকরি করিতে
ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে;
মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,
কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন,
এ-জুলুম সহেনিকো ইসলাম –
সহিবে না আজও আর॥(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
শুরু করিলাম নামে সেই আল্লার,
আকর যে সব দয়া কৃপা করুণার।বল, হে বিধর্মীগন, তোমরা যাহার
পূজা কর, - আমি পূজা করি না তাহার।
তোমরা পূজ না তাঁরে আমি পূজি যাঁরে,
তোমরা যাহারে পূজ - আমিও তাহারে
পূজিতে সম্মত নই। তোমরাও নহ
প্রস্তুত পূজিতে, যাঁরে পূজি অহরহ।
তোমার ধর্ম যাহা তোমাদের তরে,
আমার যে ধর্ম র'বে আমারি উপরে।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
আমার হাতে কালি মুখে কালি
আমার কালিমাখা মুখ দেখে মা
পাড়ার লোকে হাসে খালি।মোর লেখাপড়া হল না মা
আমি ম দেখিতেই দেখি শ্যামা।
আমি ক লিখিতেই কালী বলে
(মা) নাচি দিয়ে করতালি।কালো আঁক দেখে মা ধারাপাতের
ধারা নামে আঁখিপাতে।
আমার বর্ণপরিচয় হল না মা
তোর বর্ণ বিনা কালী।যা লিখিস মা বনের পাতায়
সাগর জলে আকাশ খাতায়
আমি সে লেখা তোর পড়তে পারি
(লোকে) মূর্খ বলে দিক না গালি।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
নব-জীবনের নব-উত্থান-আজান ফুকারি এসো নকিব।
জাগাও জড়! জাগাও জীব!
জাগে দুর্বল, জাগে ক্ষুধা-ক্ষীণ,
জাগিছে কৃষাণ ধুলায়-মলিন,
জাগে গৃহহীন, জাগে পরাধীন
জাগে মজলুম বদ-নসিব!
মিনারে মিনারে বাজে আহ্বান –
‘আজ জীবনের নব উত্থান!’
শঙ্কাহরণ জাগিছে জোয়ান
জাগে বলহীন জাগিছে ক্লীব,
নব জীবনের নব উত্থান –
আজান ফুকারি এসো নকিব!
হুগলি,
১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
(আজ) ভারত-ভাগ্য-বিধাতার বুকে গুরু-লাঞ্ছনা-পাষাণ-ভার,
আর্ত-নিনাদে হাঁকিছে নকিব, – কে করে মুশকিল আসান তার?
মন্দির আজি বন্দির ঘানি,
নির্জিত ভীত সত্য, বদ্ধ রুদ্ধ স্বাধীন আত্মার বাণী,
সন্ধি-মহলে ফন্দির ফাঁদ, গভীর আন্ধি-অন্ধকার!
হাঁকিছে নকিব – হে মহারুদ্র চূর্ণ করো এ ভণ্ডাগার॥
রক্তে-মদের বিষ পান করি
আর্ত মানব; স্রষ্টা কাতর সৃষ্টির তাঁর নির্বাণ স্মরি!
ক্রন্দন-ঘন বিশ্বে স্বনিছে প্রলয়-ঘটার হুহুংকার, –
হাঁকিছে নকিব – অভয়-দেবতা, এ মহাপাথার করহ পার॥
কোলাহল-ঘাঁটা হলাহল-রাশি
কে নীলকণ্ঠ গ্রাসিবে রে আজ দেবতার মাঝে দেবতা সে আসি?
উরিবে কখন ইন্দিরা, ক্রোড়ে শান্তির ঝারি সুধার ভাঁড়?
হাঁকিছে নকিব – আনো ব্যথা-ক্লেশ-মন্থন-ধন অমৃত-ধার॥
কণ্ঠ ক্লিষ্ট ক্রন্দন-ঘাতে,
অমৃত-অধিপ নর-নারায়ণ দারুময় ঘন মনোবেদনাতে।
দশভুজে গলে শৃঙ্খল-ভার দশপ্রহরণধারিণী মার –
হাঁকিছে নকিব – ‘আবিরাবির্ম এধি’ হে নব যুগাবতার!
মৃত্যু-আহত মৃত্যুঞ্জয়,
কে শোনাবে তাঁরে চেতন-মন্ত্র? কে গাহিবে জয় জীবনের জয়?
নয়নের নীরে কে ডুবাবে বলো বলদর্পীর অহংকার? –
হাঁকিছে নকিব – সে দিন বিশ্বে খুলিবে আরেক তোরণ-দ্বার॥ (বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
তখ্তে তখ্তে দুনিয়ায় আজি কমবখ্তের মেলা,
শক্তি-মাতাল দৈত্যেরা সেথা করে মাতলামি খেলা।
ভয় করিয়ো না, হে মানবাত্মা, ভাঙিয়া পোড়ো না দুখে,
পাতালের এই মাতাল রবে না আর পৃথিবীর বুকে।
তখ্তে তাহার কালি পড়িয়াছে অবিচারে আর পাপে,
তলোয়ারে তার মরিচা ধরেছে নির্যাতিতের শাপে।
ঘন গৈরিকে আকাশ রাঙায়ে বৈশাখী ঝড় আসে,
ভাবে লোভান্ধ মানব, তাহার গোধূলি-লগন হাসে!
যে আগুন ছড়ায়েছে এ বিশ্বে, তারই দাহ ফিরে এসে
ভীম দাবানল-রূপে জ্বলিতেছে তাহাদেরই দেশে দেশে।
সত্যপথের তীর্থ-পথিক! ভয় নাই, নাহি ভয়,
শান্তি যাদের লক্ষ্য, তাদের নাই নাই পরাজয়!
অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে,
অবশেষে চিরলাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে!
পথের ঊর্ধ্বে ওঠে ঝোড়ো বায়ে পথের আবর্জনা,
তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে উঠেছে – কেহ কভু ভাবিয়ো না!
ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরই পথে হয় ওরা বাধা,
পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় নাকো কাদা!
জয়ে পরাজয়ে সমান শান্ত রহিব আমরা সবে,
জয়ী যদি হই, এক আল্লার মহিমার জয় হবে!
লাঞ্ছিত হলে বাঞ্ছিত হব পরলোকে আল্লার,
রণভূমে যদি হত হই মোরা হব চির-প্রিয় তাঁর!
হয়তো কখনও জয়ী হবে ওরা, হটিব না মোরা তবু,
বুঝিব মোদের পরীক্ষা করে মোদের পরম প্রভু!
বিদ্বেষ লয়ে ডাকিলে কি প্রভু পথভ্রান্ত ফিরে?
ভালোবাসা দিয়ে তাদেরে ডাকিতে হয় বক্ষের নীড়ে।
সজ্ঞানে যারা করে নিপীড়ন, মানুষের অধিকার
কেড়ে নিতে চায়, তাহাদেরই তরে আল্লার তলোয়ার।
অজ্ঞান যারা ভুল পথে চলে, মারিয়ো না তাহাদেরে,
ভালোবাসা পেলে ভ্রান্ত মানুষ সত্যের পথে ফেরে।
সকল জাতির সকল মানুষে এক তাঁর নামে ডাকো,
বুকে রাখো তাঁর ভক্তি ও প্রেম, হাতে তলোয়ার রাখো।
সর্ববিশ্ব প্রসন্ন হয় তিনি প্রসন্ন হলে,
সত্যপথের সর্বশত্রু ছাই হয়ে যায় জ্বলে!
আমাদেরও মাঝে যার বুকে আছে লুকাইয়া প্রলোভন,
তারেও কঠিন সাজা দিতে হবে, আল্লার প্রয়োজন!
আগে চলো, আগে চলো দুর্জয় নব অভিযান-সেনা,
আমাদের গতি-প্রবাহ কাহারও কোনো বাধা মানিবে না।
বিশ্বাস আর ধৈর্য হউক আমাদের চির-সাথি,
নিত্য জ্বলিবে আমাদের পথে সূর্য চাঁদের বাতি।
ভয় নাহি, নাহি ভয়!
মিথ্যা হইবে ক্ষয়!
সত্য লভিবে জয়!
ভক্তে দেখায় রক্তচক্ষু যারা, তারা হবে লয়!
বলো, এ পৃথিবী মানুষের, ইহা কাহারও তখ্ত্ নয়!
পুণ্য তখ্তে বসিয়া যে করে তখ্তের অসম্মান,
রাজার রাজা যে, তাঁর হুকুমেই যায় তার গর্দান!
ভিস্তিওয়ালার রাজত্ব, ভাই, হয়ে এল ওই শেষ,
বিশ্বের যিনি সম্রাট তাঁরই হইবে সর্বদেশ!
রক্তচক্ষু রক্ষ যক্ষ, সাবধান! সাবধান!
ভুল বুঝাইয়া, বুঝেছ ভুলাবে আল্লার ফরমান?
এক আল্লারে ভয় করি মোরা, কারেও করি না ভয়,
মোদের পথের দিশারি এক সে সর্বশক্তিময়।
সাক্ষী থাকিবে আকাশ, পৃথিবী, রবি শশী গ্রহ তারা,
কাহারা সত্যপথের পথিক, পথভ্রষ্ট কারা!
ভয় নাহি, নাহি ভয়!
মিথ্যা হইবে ক্ষয়!
সত্য লভিবে জয়! (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
স্বদেশমূলক
|
মনে পড়ে আজ পলাশির প্রান্তর –
আসুরিক লোভে কামানের গোলা বারুদ লইয়া যথা
আগুন জ্বালিল স্বাধীন এ বাংলায়।
সেই আগুনের লেলিহান শিখা শ্মশানের চিতা সম
আজও জ্বলিতেছে ভারতের বুকে নিষ্ঠুর আক্রোশে।
দুই শতাব্দী নিপীড়িত এই দেশের নর ও নারী
আঁখিজল ঢালি নিভাতে নারিল সেই আগুনের শিখা।
এ কোন করালী রাক্ষুসি তার রক্তরসনা মেলি
মজ্জা অস্থি রক্ত শুষিয়া শক্তি হরিয়া যেন
চল্লিশ কোটি শবের উপরে নাচিছে তাথই থই!
অক্ষমা অভিশপ্তা শকতি তামসী ভয়ংকরী।
চল্লিশ কোটি নরকঙ্কাল লয়ে এই অকরুণা
জাদুকরি নিশিদিন খেলিতেছে জাদু ও ভেলকি, হায়!
যত যন্ত্রণা পাইয়াছি তত তার ভূত-প্রেত সেনা
হাসিয়া অট্টহাসি বিদ্রুপ করেছে শক্তিহীনে!এ কাহার অভিশাপ সর্পিণী হয়ে জড়াইয়া আছে,
সারা দেহ মন প্রাণ জরজর করি কালকূট বিষে
লয়ে যায় যমলোকে! – হায়, যথা গঙ্গা যমুনা বহে –
যথায় অমৃত-মধুরসধারা বর্ষণ হত নিতি,
যে ভারতে ছিল নিত্য শান্তি সাম্য প্রেম ও প্রীতি,
যে ভারতের এই আকাশ হইতে ঝরিত স্নিগ্ধ জ্যোতি
সে আকাশ আজ মলিন হয়েছে বোমা বারুদের ধূমে।
যে দেশে জ্বলিত হোমাগ্নি, সেথা বোমার আগুন এল,
ক্ষুধিত দৈত্য-শক্তি শকুনি হয়ে আজ ঝাঁকে ঝাঁকে
উড়িয়া বেড়ায় আমাদের পচা গলা মাংসের লোভে।হে পরম পুরুষোত্তম! বলো, বলো, আর কতদিন
উদাসীন হয়ে রহিবে? – তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নর
নিদারুণ যাতনায় নিশিদিন করিছে আর্তনাদ!
নিরস্ত্র দেশে লয়ে তব জ্যোতি সুন্দর তরবারি
দুর্বল নিপীড়িতের বন্ধু হইয়া প্রকাশ হও!
বন্দি আত্মা কাঁদে কারাগারে, ‘দ্বার খোলো, খোলো দ্বার!
পরাধীনতার এই শৃঙ্খল খুলে দাও, খুলে দাও!
নিপীড়িত যেন নতুন পীড়ার যন্ত্রণা নাহি পায়,
প্রভু হয়ে নয়, বন্ধু হইয়া এসো বন্দির দেশে।’ (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
শোকমূলক
|
আজ আষাঢ়-মেঘের কালো কাফনের আড়ালে মু-খানি ঢাকি
আহা কে তুমি জননি কার নাম ধরে বারে বারে যাও ডাকি?
মাগো কর হানি দ্বারে দ্বারে
তুমি কোন হারামণি খুঁজিতে আসিলে ঘুম-সাগরের পারে?
‘কই রে সত্য, সত্যেন কই’ কাতর কান্না শুধু
গগন-মরুর প্রাঙ্গণে হানে সাহারার হাহা ধুধু!
সত্য অমর, কেঁদো না জননি, আসিবে আবার রবি,
গিয়াছে বাণীর কমল-বনে মা, কমল তুলিতে কবি!ও কে ক্রন্দসী হায় মুরছিয়া পড়ে অশ্রু-সিন্ধুতীরে
গেল সহসা নিশীথে বাণীর হাতের বেয়ালার তার ছিঁড়ে।
আহা, কোন ভিখারিনি এরে
কাহারে হারায়ে নিখিলের দ্বারে ফরিয়াদ করে ফেরে?
সতীর কাঁদনে চোখ খুলে চায় ঊর্ধ্বে অরুন্ধতী,
নিবিড় বেদনা ম্লান করে আনে রবির কনক-জ্যোতি।
সত্য অমর, কাঁদিয়ো না সতী, আসিবে আবার রবি,
গিয়াছে বাণীর কমল-কাননে কমল তুলিতে কবি!আজ সারথি হারায়ে বিষাদে অন্ধ ছন্দ-সরস্বতী,
ওগো পুরোহিত-হারা ভারতী-দেউলে বন্ধ পূজা-আরতি
ওরে মৃত্যু-নিষাদ ক্রূর
বিষাদ-শায়ক বিঁধিয়া করেছে বাংলার বুক চুর!
নিভে গেল মঙ্গল-দীপশিখা, বঙ্গবাণীর আলো,
দুলে দশদিকে শুধু দিশেহারা অশ্রু অতল কালো!
‘সত্য’ অমর! কাঁদিয়া না কবি, আসিবে আবার রবি,
গিয়াছে বাণীর কমল-কাননে কমল তুলিতে কবি।শ্বেত বৈজয়ন্তী উড়ে চলে যায় মৃত্যুরও আগে আগে,
ওরে সে চির-অমর, মৃত্যু আপনি তারই পায়ে প্রাণ মাগে।
তাই ওই বাজে জয়-ভেরি
স্বর্গ-দুয়ারে, ওঠে জয়ধ্বনি, ‘জয় সুত অমৃতেরই!’
কাঁদিসনে মাগো, ওই তোর ছেলে মাতা সারদার কোলে
শিশু হয়ে পুনঃ দুধ-হাসি হেসে তোরে ডেকে ডেকে দোলে!
‘সত্য’ অমর, কাঁদিয়ো না কেহ, আসিবে আবার রবি,
মা বীণাপাণির সোহাগ আনিতে স্বর্গে গিয়াছে কবি।(ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
ভক্তিমূলক
|
বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার
ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।।মুখেতে কালেমা হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর
চল আগে চল বাজে বিষান।
ভয় নাই তর গলায় তাবিজ
বাঁধা যে রে তোর পাক কোরান।।নহি মোরা জীব ভোগ- বিলাসের,
শাহাদাত ছিল কাম্য মোদের,
ভিখারির সাজে খলীফা যাদের
শাসন করিল আধা জাহান-
তারা আজ পড়ে ঘুমায়ে বেহুঁশ
বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান।।ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,
তখনো জাগিনি যখন যোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের আজ শুনি আজান।
জামাত শামিল হওরে এশাতে
এখনো জমাতে আছে স্থান।।শুকনো রুটিকে সম্বল ক’রে
যে ঈমান আর যে প্রানের জোরে
ফিরেছে জগত মন্থন ক’রে
সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।
আল্লাহ আকবর রবে পুনঃ
কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
ওগো ও কর্ণফুলী,
উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।
যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা,
আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা!
তুমি শুধু জল করো টলমল ; নাই তব প্রয়োজন
আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।
যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর
ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর
বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে!
কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে!
তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল,
দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল?
– বুঝি প্রিয় সব বুঝি,
তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি!* * *তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভোলে যাওয়া ভাগিরথী –
তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী?
দেশে দেশে ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহানায়,
স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়?
ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল এ গৃহ-হারারে বল,
এই স্রোত তোর কোন পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল?
বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়,
ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর,
সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান?
এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?তুই নারী, তুই বুঝিবি না নদী পাষাণ নরের ক্লেশ,
নারী কাঁদে – তার সে-আঁখিজলের একদিন শেষ।
পাষাণ ফাটিয়া যদি কোনোদিন জলের উৎস বহে,
সে জলের ধারা শাশ্বত হয়ে রহে রে চির-বিরহে!
নারীর অশ্রু নয়নের শুধু ; পুরুষের আঁখি-জল
বাহিরায় গলে অন্তর হতে অন্তরতম তল!
আকাশের মতো তোমাদের চোখে সহসা বাদল নেমে
রৌদ্রের তাত ফুটে ওঠে সখী নিমেষে সে মেঘ থেমে!সারা গিরি হল শিরী-মুখ হায়, পাহাড় গলিল প্রেমে,
গলিল না শিরী! সেই বেদনা কি নদী হয়ে এলে নেমে?
ওই গিরি-শিরে মজনুন কি গো আজিও দিওয়ানা হয়ে
লায়লির লাগি নিশিদিন জাগি ফিরিতেছে রোয়ে রোয়ে?
পাহাড়ের বুক বেয়ে সেই জল বহিতেছ তুমি কি গো? –
দুষ্মন্তের খোঁজ-আসা তুমি শকুন্তলার মৃগ?
মহাশ্বেতা কি বসিয়াছে সেথা পুণ্ডরীকের ধ্যানে? –
তুমি কি চলেছ তাহারই সে প্রেম নিরুদ্দেশের পানে? –
যুগে যুগে আমি হারায়ে প্রিয়ারে ধরণির কূলে কূলে
কাঁদিয়াছি যত, সে অশ্রু কি গো তোমাতে উঠেছে দুলে?* * *– ওগো চির উদাসিনী!
তুমি শোনো শুধু তোমারই নিজের বক্ষের রিনিরিনি।
তব টানে ভেসে আসিল যে লয়ে ভাঙা ‘সাম্পান’ তরি,
চাহনি তাহার মুখ-পানে তুমি কখনও করুণা করি।
জোয়ারে সিন্ধু ঠেলে দেয় ফেলে তবু নিতি ভাটি-টানে
ফিরে ফিরে যাও মলিন বয়ানে সেই সিন্ধুরই পানে!
বন্ধু, হৃদয় এমনই অবুঝ কারও সে অধীন নয়!
যারে চায় শুধু তাহারেই চায়– নাহি মনে লাজ ভয়।
বারে বারে যায় তারই দরজায়, বারে বারে ফিরে আসে!
যে আগুনে পুড়ে মরে পতঙ্গ – ঘোরে সে তাহারই পাশে!* * *–ওগো ও কর্ণফুলী!
তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি?
তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে,
‘সাম্পান’-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?
আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি,
সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী ?যে গিরি গলিয়া তুমি বও নদী, সেথা কি আজিও রহি
কাঁদিছে বন্দী চিত্রকূটের যক্ষ চির-বিরহী?
তব এত জল একি তারই সেই মেঘদূত-গলা বাণী?
তুমি কি গো তার প্রিয়-বিরহের বিধুর স্মরণখানি?
ওই পাহাড়ে কি শরীরে স্মরিয়া ফারেসের ফরহাদ,
আজিও পাথর কাটিয়া করিছে জিন্দেগি বরবাদ?তব জলে আমি ডুবে মরি যদি, নহে তব অপরাধ,
তোমার সলিলে মরিব ডুবিয়া, আমারই সে চির-সাধ!
আপনার জ্বালা মিটাতে এসেছি তোমার শীতল তলে,
তোমারে বেদনা হানিতে আসিনি আমার চোখের জলে!
অপরাধ শুধু হৃদয়ের সখী, অপরাধ কারও নয়!
ডুবিতে যে আসে ডুবে সে একাই, তটিনী তেমনই বয়!* * *সারিয়া এসেছি আমার জীবনে কূলে ছিল যত কাজ,
এসেছি তোমার শীতল নিতলে জুড়াইতে তাই আজ!
ডাকনিকো তুমি, আপনার ডাকে আপনি এসেছি আমি
যে বুকের ডাক শুনেছি শয়নে স্বপনে দিবস-যামি।
হয়তো আমারে লয়ে অন্যের আজও প্রয়োজন আছে,
মোর প্রয়োজন ফুরাইয়া গেছে চিরতরে মোর কাছে!
– সে কবে বাঁচিতে চায়,
জীবনের সব প্রয়োজন যার জীবনে ফুরায়ে যায়!জীবন ভরিয়া মিটায়েছি শুধু অপরের প্রয়োজন,
সবার খোরাক জোগায়ে নেহারি উপবাসী মোরই মন!
আপনার পানে ফিরে দেখি আজ – চলিয়া গেছে সময়,
যা হারাবার তা হারাইয়া গেছে, তাহা ফিরিবার নয়!
হারায়েছি সব, বাকি আছি আমি, শুধু সেইটুকু লয়ে
বাঁচিতে পারিনা, যত চলি পথে তত উঠি বোঝা হয়ে!বহিতে পারি না আর এই বোঝা, নামানু সে ভার হেথা;
তোমার জলের লিখনে লিখিনু আমার গোপন ব্যথা!
ভয় নাই প্রিয়, নিমেষে মুছিয়া যাইবে এ জল-লেখা,
তুমি জল – হেথা দাগ কেটে কভু থাকে না কিছুরই রেখা!
আমার ব্যথায় শুকায়ে যাবে না তব জল কাল হতে,
ঘূর্ণাবর্ত জাগিবে না তব অগাধ গভীর স্রোতে।
হয়তো ঈষৎ উঠিবে দুলিয়া, তারপর উদাসিনী,
বহিয়া চলিবে তব পথে তুমি বাজাইয়া কিঙ্কিণি!
শুধু লীলাভরে তেমনই হয়তো ভাঙিয়া চলিবে কূল,
তুমি রবে, শুধু রবে নাকো আর এ গানের বুলবুল!তুষার-হৃদয় অকরুণা ওগো, বুঝিয়াছি আমি আজি –
দেওলিয়া হয়ে কেন তব তীরে কাঁদে ‘সাম্পান’-মাঝি! (চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
চিন্তামূলক
|
কুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে
এই তো নদীর খেলা (রে ভাই)
এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই
ফকীর সন্ধ্যাবেলা।সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা।এই দেহ ভেঙ্গে হয় রে মাটি
মাটিতে হয় দেহ
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ
তার খোঁজ নিল না কেহ।রাতে রাজা সাজে নট-মহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে
শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে
সবই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই
ভব-নদীর খেলা।।
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
মানবতাবাদী
|
ওরা কয়, ‘আগে ফুল ফুটাইতে, এখন ফুটাও হুল!’
আমি কই, ‘যদি হুল না ফুটাই ফুটিবে কি তবে fool?’
বন্ধু, মিথ্যা অপত্য-স্নেহে আপত্তি নাহি করি
ধর্ম লয়েছে অধর্ম নাম, সত্য গিয়াছে মরি!
গাঁয়ের বউঝি জল নিতে যায় মেছুড়ে বুঝিতে নারে,
গাল দেয় রেগে – ইহাদেরই দোষে মাছ বসে নাকো চারে!
ভোগী বলে, ‘বাবা, কেন কাঁদ তুমি, মামা নহে তব চাষা,
ধনীর দুঃখ দেখ নাকো, একী একঘেয়ে ভালোবাসা!’
‘আল্লা বলান’ বলি। ওরা বলে – ‘দালানে তা আসে কেন?
টাকাওয়ালাদের কী করে চিনিলে, তুমি তো আল্লা চেন!’
ওরা বলে, ‘মোরা টাকার পুকুর দুয়ারে খুঁড়িয়া রাখি,
উহারাই তার দু-এক কলশি জল ভরে নেয় নাকি?’
আরও বলে, ‘দিই কলশিতে জল দিই না তো সাথে দড়ি,
আমরা কী জানি, কেন এ পুকুরে ওরা ডুবে যায় মরি?’
ওরা বলে, ‘চাষা খাইতে পায় না– আর জন্মের পাপ,
পাওনা সুদের নালিশ করিলে ওরা কেন দেয় শাপ?’
মোরা যত দিই উত্তর তার ওরা ‘দুত্তোর’ কহে,
বলে ‘জমিদারি স্বত্ব আমার, তোমার মামার নহে।’
মোরা বলি, ‘কত ইম্পিরিয়াল ব্যাংকে তোমার টাকা!’
ওরা বলে, ‘কোনো কাজে তা লাগে না, (বাবা) ফিক্স্ড ডিপোজিটে রাখা!’
মোরা বলি, ‘মোরা যাব না, মোদের প্রাপ্য যা তা না পেলে!’
ওরা বলে, ‘কেন জেলে যাবে, বাবা, ভদ্রলোকের ছেলে!’
আমি বলি, ‘জাগ, দৈত্যরে মার, দা নিয়ে দুয়ার খুল।’
ওরা বলে, ‘বাঘ হলে কেন বন- বাগিচার বুলবুল?’
আমি বলি, ‘কেন অসত্য বল, ভ্রান্ত পথ দেখাও?’
ওরা বলে, ‘আহ্, চুপ করো কবি, ফুল শোঁকো, মধু খাও!’
আমি বলি, ‘চোর ঢুকিয়াছে ঘরে, মারো তারে পায়ে দলে!’
ওরা বলে, ‘বাঁশুরিয়া! বাঁশি কেন বংশদণ্ড হলে!’
ওরা বলে, ‘দাদা, এতদিন তুমি বেশ তো ঘুমায়ে ছিলে!
কখন হইল ‘ইনসমনিয়া’? সারা দেশ জাগাইলে!’
আমি বলি, ‘দেশ জাগে যদি, কেন তোমাদের ডর লাগে?’
ওরা বলে, ‘আসে রাম-দা লইয়া। রামদা বলিত আগে!’
কে যে বলে ঠিক, কে বলে বেঠিক, ঠিকে ভুল হয় কার?
চাষা ও মজুরে ঠকাইয়া খায় দুনিয়ার ঠিকাদার!
‘ওরা তো বলে না, তুমি কেন বল, কেন তব মাথাব্যথা?’
জিজ্ঞাসে সাধু। – আমি বলি, ‘কহে ওদেরই আত্মা কথা!’
হায় রে দুনিয়া দেখি মৌলানা মৌলবিতে একাকার,
আমি একা হেথা কাফের রে দাদা আমি একা গুনাগার!
গুনাগারি দেয় বণিকেরা নাকি, চাষারাই করে লাভ,
ধনী যেন সদা তৃষিত, এবং চাষা সদা কচি ডাব!
শুনেছি সেদিন ধনিক-সভায়– নতুন আইন হবে,
চাষাদের দা, দাঁত আর নখ খেঁটে লাঠি নাহি রবে।
আমি বলি, ‘হয়ে অভাবে স্বভাব নষ্ট, হয়েছে চোর!’
ওরা বলে, ‘তাই বল, তাই চুরি হয় না বাড়িতে তোর!’
আমি বলি, ‘খেয়ো না এ কদন্ন, হালালি অন্ন খাও!’
ওরা বলে, ‘তুমি এদেরই দালালি করে বুঝি টাকা পাও?’
‘যার যত তলা দালান, সে তত আল্লা-তালার প্রিয়–’
ওরা কয়। আমি বলি, ‘বেশ করে সে তালায় তালা দিয়ো!’
আমি ভিক্ষুক কাঙালের দলে – কে বলে ওদের নীচ?
ভোগীরা স্বর্গে যাবে, যদি খায় ওদের পানের পিচ!
ওরা হাসে, ‘এ কি কবিতার ভাষা? বস্তিতে থাক বুঝি?’
আমি কই, ‘আজও পাইনি পুণ্য- বস্তির পথ খুঁজি!
দোওয়া করো, যেন ওই গরিবের কর্দমাক্ত পথে
যেতে পারি, এই ভোগ-বিলাসীর পাপ-নর্দমা হতে!’ (শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)
|
কাজী নজরুল ইসলাম
|
প্রেমমূলক
|
চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে
ছোটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে।হেরিছে রজনী রজনী জাগিয়া
চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া
কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া
কুমুদীরে কাঁদাইতে।না জানি সজনী কত সে রজনী
কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া
হেরেছে শশীরে সরসী মুকুরে
ভীরু ছায়া তরু কাঁপিয়া।কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী
চিরবিরহিণী রোহিণী ভরণী
অবশ আকাশ বিবশা ধরণী
কাঁদানীয়া চাঁদিনীতে।।
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.