poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
রূপক
|
একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল
বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে,
ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়
আরো দু'তিনটি মুরগীর সঙ্গে।
আশ্রয় যদিও মিলল,
উপযুক্ত আহার মিলল না।
সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে
গলা ফাটাল সেই মোরগ
ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত-
তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত।
তারপর শুরু হল তাঁর আঁস্তাকুড়ে আনাগোনা;
আর্শ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল
ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার!
তারপর এক সময় আঁস্তাকুড়েও এল অংশীদার-
ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দু'তিনটে মানুষ;
কাজেই দুর্বলতার মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।
খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বার বার চেষ্টা ক'রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে-
'প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার'!
তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধব্ধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে ;
অবশ্য খাবার খেতে নয়
খাবার হিসেবে!
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা-
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
ছড়া
|
তোমরা আমায় নিন্দে ক’রে দাও না যতই গালি,
আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুনকালি,
কোনো কাজটাই পারি নাকো বলতে পারি ছড়া,
পাশের পড়া পড়ি না ছাই পড়ি ফেলের পড়া।
তোতো ওষুধ গিলি নাকো, মিষ্টি এবং টক
খাওয়ার দিকেই জেনো আমার চিরকালের সখ।
বাবা-দাদা সবার কাছেই গোঁয়ার এবং মন্দ,
ভাল হয়ে থাকার সঙ্গে লেগেই আছে দ্বন্দ্ব ।
পড়তে ব’সে থাকে আমার পথের দিকে চোখ,
পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক।
হুলের কেয়ার করি নাকো মধুর জন্য ছুটি,
যেখানে ভিড় সেখানেতেই লাগাই ছুটোছুটি।
পণ্ডিত এবং বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া,
ভাবি উপদেশের ষাঁড়ে করলে বুঝি তারা।
তাইতো ফিরি ভয়ে ভয়ে, দেখলে পরে তর্ক,
বুঝি কেবল গোময় সেটা,- নয়কো মধুপর্ক।
ভুল করি ভাই যখন তখন, শোধরাবার আহ্লাদে
খেয়ালমতো কাজ করে যাই, কস্ট পাই কি সাধে ?
সোজাসুজি যা হয় বুঝি, হায় অদৃস্ট চক্র!
আমার কথা বোঝে না কেউ পৃথিবীটাই বক্র।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
এমন মুহূর্ত এসেছিল
একদিন আমার জীবনে
যে মহূর্তে মনে হয়েছিল
সার্থক ভুবনে বেঁচে থাকাঃ
কালের আরণ্য পদপাত
ঘটেছিল আমার গুহায়।
জরাগ্রস্ত শীতের পাতারা
উড়ে এসেছিল কোথা থেকে,
সব কিছু মিশে একাকার
কাল-বোশেখীর পদার্পণে
সেদিন হাওয়ায় জমেছিল
অদ্ভুত রোমাঞ্চ দিকে দিকে;
আকাশের চোখে আশীর্বাদ,
চুক্তি ছিল আমৃত্যু জীবনে।
সে সব মুহূর্তগুলো আজো
প্রাণের অষ্পষ্ট প্রশাখায়
ফোটায় সবুজ ফুল,
উড়ে আসে কাব্যের মৌমাছি।
অসংখ্য মুহূর্তে গ’ড়ে তোলা
স্বপ্ন-দুর্গ মুহূর্তে চুরমার।
আজ কক্ষচ্যুত ভাবি আমি
মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা; –
যে মুহূর্ত অদৃশ্য প্লাবনে
টেনে নিয়ে যায় কান্তরে।
আজ আছি নক্ষত্রের দলে,
কাল জানি মুহূর্তের টানে
ভেসে যাব সূর্যের সভায়,
ক্ষুব্ধ কালো ঝড়ের জাহাজে।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়
তবুও পড়িবে মনে,
চঞ্চল হাওয়া যদি ফেরে হৃদয়ের আঙ্গিনায়
রজনীগন্ধা বনে,
তবুও পড়িবে মনে।
বলাকার পাখা আজও যদি উড়ে সুদূর দিগঞ্চলে
বন্যার মহাবেগে,
তবুও আমার স্তব্ধ বুকের ক্রন্দন যাবে মেলে
মুক্তির ঢেউ লেগে,
মুক্তির মহাবেগে।
বাসরঘরের প্রভাতের মতো স্বপ্ন মিলায় যদি
বিনিদ্র কলরবে
তবুও পথের শেষ সীমাটুকু চিরকাল নিরবধি
পার হয়ে যেতে হবে,
বিনিদ্র কলরবে।
মদিরাপাত্র শুষ্ক যখন উৎসবহীন রাতে
বিষণ্ণ অবসাদে
বুঝি বা তখন সুপ্তির তৃষা ক্ষুব্ধ নয়নপাতে
অস্থির হয়ে কাঁদে,
বিষণ্ণ অবসাদে।
নির্জন পথে হঠাৎ হাওয়ার আসক্তহীন মায়া
ধূলিরে উড়ায় দূরে,
আমার বিবাগী মনের কোণেতে কিসের গোপন ছায়া
নিঃশ্বাস ফেলে সুরে;
ধূলিরে উড়ায় দূরে।
কাহার চকিত-চাহনি-অধীর পিছনের পানে চেয়ে
কাঁদিয়া কাটায় রাতি,
আলেয়ার বুকে জ্যোৎস্নার ছবি সহসা দেখিতে পেয়ে
জ্বালে নাই তার বাতি,
কাঁদিয়া কাটায় রাতি।
বিরহিণী তারা আঁধারের বুকে সূর্যেরে কভু হায়
দেখেনিকো কোনো ক্ষণে।
আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়
হয়তো পড়িবে মনে,
রজনীগন্ধা বনে।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখলামঃ
ফুটপাতে এক মরা চিল!
চমকে উঠলাম ওর করুণ বীভৎস মূর্তি দেখে।
অনেক উঁচু থেকে যে এই পৃথিবীটাকে দেখেছে
লুণ্ঠনের অবাধ উপনিবেশ;
যার শ্যেন দৃষ্টিতে কেবল ছিল
তীব্র লোভ আর ছোঁ মারার দস্যু প্রবৃত্তি-
তাকে দেখলাম, ফুটপাতে মুখ গুঁজে প'ড়ে।
গম্বুজশিখরে বাস করত এই চিল,
নিজেকে জাহির করত সুতীক্ষ্ণ চীৎকারে;
হালকা হাওয়ায় ডানা মেলে দিত আকাশের নীলে-
অনেককে ছাড়িয়েঃ এককঃ
পৃথিবী থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে।
অনেকে আজ নিরাপদ;
নিরাপদ ইঁদুর ছানারা আর খাদ্য-হাতে ত্রস্ত পথচারী,
নিরাপদ- কারণ আজ সে মৃত।
আজ আর কেউ নেই ছোঁ মারার,
ওরই ফেলে-দেওয়া উচ্ছিষ্টের মতো
ও পড়ে রইল ফুটপাতে,
শুক্নো, শীতল, বিকৃত দেহে।
হাতে যাদের ছিল প্রাণধারণের খাদ্য
বুকের কাছে সযত্নে চেপে ধরা
তারা আজ এগিয়ে গেল নির্ভয়ে;
নিষ্ঠুর বিদ্রূপের মতো পিছনে ফেলে
আকাশচ্যুত এক উদ্ধত চিলকে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।
ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে,
হে নীড়-বিহারী সঙ্গী! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে। তবু আজো বিস্ময় আমার-
ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
তাদের করেছ মা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ।
তোমার ক্ষেতের শস্য
চুরি ক'রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায়
তাদেরি দু'পায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;
লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে
তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিস্ফল-
তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল।
তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে-
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে।
পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার!
সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড়
দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড়
সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার:
কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার-
এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার?
লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম।
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।
কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র
দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র,
লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে
বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে।
লোভের মাথায় পদাঘাত হানো-
আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো।
দৈত্যরাজের যত অনুচর
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর;
মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-
হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ।
তোমার ফসল, তোমার মাটি
তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি
তোমার চেতনা চালিত হাতে।
এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে?
স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি
মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি?
এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র?
করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্রঃ
শোন্ রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়-
হিসাব কি দিবি তার?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলতে পারি?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।
শোন্ রে মজুতদার,
ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
করব তোকে এবার।
তারপর বহুশত যুগ পরে
ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার।
তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার
মানুষ ছিল কি? জবাব মেলে না তার।
আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়;
আজকের নৈঃশব্দ হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি।
দুহাতে বাজাও প্রতিশোদের উন্মত্ত দামামা,
প্রার্থনা করোঃ
হে জীবন, যে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা-
আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার-গলানো উত্তাপ।
টুকরে টুকরো ক'রে ছেঁড়ো তোমার
অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী।
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
একত্রিত হোক আমাদের সংহতি।
তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি মানুষ নও-
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম,
হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম।
জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে
ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে,
কখনো কেউ কি ভূমিকম্পের আগে
হাতে শাঁখ নেয়, হঠাৎ সবাই জাগে?
যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী,
আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি।
ইতিহাস, জানি নীরব সাক্ষী তুমি,
আমরা চেয়েছি স্বাধীন স্বদেশভূমি,
অনেকে বিরূপ, কানে দেয় হাত চাপা,
তাতেই কি হয় আসল নকল মাপা?
বিদ্রোহী মন! আজকে ক'রো না মানা,
দেব প্রেম আর পাব কলসীর কণা,
দেব, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে,
জীন্ ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে।
কুয়াশা কাটছে, কাটবে আজ কি কাল,
ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল,
ততদিনে প্রাণ দেব শত্রুর হাতে
মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে।
ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ,
আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
ছড়া
|
কাশী গিয়ে হু হু ক’রে কাটলো কয়েক মাস তো,
কেমন আছে মেজাজ ও মন, কেমন আছে স্বাস্থ্য?
বেজায় রকম ঠাণ্ডা সবাই করছে তো বরদাস্ত?
খাচ্ছে সবাই সস্তা জিনিস, খাচ্ছে পাঁঠা আস্ত?সেলাই কলের কথাটুকু মেজদার দু’কান
স্পর্শ ক’রে গেছে বলেই আমার অনুমান৷
ব্যবস্থাটা হবেই, করি অভয় বর দান;
আশা করি, শুনে হবে উল্লসিত প্রাণ৷
এতটা কাল ঠাকুর ও ঝি লোভ সামলে আসতো,
এবার বুঝি লোভের দায়ে হয় তারা বরখাস্ত৷চারুটাও হয়ে গেছে বেজায় বেয়াড়া,
মাথার ওপরে ঝোলে যা খুশির খাঁড়া৷
নতেদা’র বেড়ে গেছে অঙ্গুলি হাড়া,
ঘেলুর পরীক্ষাও হয়ে গেছে সারা;
এবার খরচ ক’রে কিছু রেল-ভাড়া
মাতিয়ে তুলতে বলি রামধন পাড়া৷এবার বোধহয় ছাড়তে হল কাশী,
ছাড়তে হল শৈলর মা, ইন্দু ও ন’মাসি৷
দুঃখ কিসের, কেউ কি সেথায় থাকে বারোমাসই?
কাশী থাকতে চাইবে তারা যারা স্বর্গবাসী,
আমি কিন্তু কলকাতাতেই থাকতে ভালবাসি৷
আমার যুক্তি শুনতে গিয়ে পাচ্ছে কি খুব হাসি?
লেখা বন্ধ হোক তা হলে, এবার আমি আসি॥১৯৪৫ সালে সুকান্ত মেজবৌদি রেণু দেবীর সঙ্গে কাশী বেড়াতে যান৷ সুকান্ত ফিরে এসে শ্যামবাজারের বাড়ি থেকে এই চিঠিটি তাঁকে লিখেছিলেন৷ চিঠিটি রাখাল ভট্টাচার্য স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন৷
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
হাস্যরসাত্মক
|
বদ্যিনাথের সর্দি হল কলকাতাতে গিয়ে,
আচ্ছা ক’রে জোলাপ নিল নস্যি নাকে দিয়ে।
ডাক্তার এসে, বল্ল কেশে, “বড়ই কঠিন ব্যামো,
এ সব কি সুচিকিৎসা ? —আরে আরে রামঃ।
আমার হাতে পড়লে পড়ে ‘এক্সরে’ করে দেখি,
রোগটা কেমন, কঠিন কিনা–আসল কিংবা মেকি।
থার্মোমিটার মুখে রেখে সাবধানেতে থাকুক,
আইস–ব্যাগটা মাথায় দিয়ে একটা দিন তো রাখুক।
‘ইনজেক্শন’ নিতে হবে ‘অক্সিজেন’টা পরে
তারপরেতে দেখব এ রোগ থাকে কেমন ক’রে।”
পল্লীগ্রামের বদ্যিনাথ অবাক হল ভারী,
সর্দি হলেই এমনতর? ধন্য ডাক্তারী!!‘ভবিষ্যতে’ ও ‘সুচিকিৎসা’ — এই ছড়াদুটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’, ‘শারদীয়া বসুমতী’, ১৩৫৪-থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এগুলি ১৯৪০-এর আগের লেখা বলে অনুমিত।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
রঘুবীর একদিন দিতে গিয়ে আড্ডা,
হারিয়ে ফেলল ভুলে রেশনের কার্ডটা;
তারপর খোঁজাখুজি এখানে ও ওখানে,
রঘু ছুটে এল তার রেশনের দোকানে,
সেখানে বলল কেঁদে, হুজুর, চাই যে আটা-
দোকানী বলল হেঁকে, চলবে না কাঁদা-কাঁটা,
হাটে মাঠে-ঘাটে যাও, খোঁজো গিয়ে রাস্তায়
ছুটে যাও আড্ডায়, খোঁজো চারিপাশটায়;
কিংবা অফিসে যাও এ রেশন এলাকার,
আমার মামার পিসে, কাজ করে ছেলে তার,
তার কাছে গেলে পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে,
ছ’মাসের মধ্যেই নয়া এক কার্ড পাবে।
রঘুবীর বলে কেঁদে, ছ’মাস কি করব?
ছ’মাস কি উপবাস ক’রে ধুঁকে মরব?
আমি তার করব কী?- দোকানী উঠল রেগে-
যা খুশি তা করো তুমি- বলল সে অতি বেগে;
পয়সা থাকে তো খেও হোটেলে কি মেসেতে,
নইলে সটান্ তুমি যেতে পার দেশেতে।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে;
যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়া ছবি ভাসছে –
তাদেরই যে দুর্দিন পরিণামে আরো বেশী জানবে,
মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে।
আজকের দিন নয় কাব্যের –
আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের;
শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী,
কিন্তু বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোনো আসর-ই।
আকাশের প্রান্তে যে মৃত্যুর কালো পাখা বিস্তার –
মৃত্যু ঘরের কোণে, আজ আর নেই জেনো নিস্তার,
মৃত্যুর কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট
আজকের এই কথা জানি লাগবেই অস্পস্ট।
তবুও তোমার চাই চেতনা,
চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না,
আজকে রঙিন খেলা নিষ্ঠুর হাতে করো বর্জন,
আজকে যে প্রয়োজন প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন;
তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী
কোনখানে ভাঙে আর কোনখানে গড়ে তার ভিত্তি
কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব,
কোনখানে দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’ চলে নিত্য ;
পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে
হানবো বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক সঙ্গে;
সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির,
দিন নেই তর্ক ও যুক্তির।
আজকে শপথ করো সকলে
বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে;
তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,
একতাবদ্ধ হও এখনি।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক।
উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে
জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে
কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে
ভীরুরা থাক।
মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি,
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি
রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,
সাধ্য কার?
রুটি দেবে নাকো? দেবে না অন্ন?
এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন?
চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য
ধারি না ধার।
খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি,
গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি,
ছিঁড়ি দুহাতের শৃঙ্খলদড়ি,
মৃত্যুপণ।
দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে,
বসে থাকবার বেলা নেই মোটে,
রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে
পূর্বকোণ।
ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি,
বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি
খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি,
কোথায় প্রাণ!
দেখব, ওপারে আজো আছে কারা,
খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
ছড়াব দান।
জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
স্বাধীন হবে ভারতবর্ষ থাকবে না বন্ধন,
আমারা সবাই স্বরাজ-যজ্ঞে হব রে ইন্ধন!
বুকের রক্ত দিব ঢালি স্বাধীনতারে,
রক্ত পণে মুক্তি দের ভারত-মাতারে৷
মূর্খ যারা অজ্ঞ যারা যে জন বঞ্চিত
তাদের তরে মুক্তি-সুধা করব সঞ্চিত৷
চাষী মজুর দীন দরিদ্র সবাই মোদের ভাই,
একস্বরে বলব মোরা স্বাধীনতা চাই॥
থাকবে নাকো মতভেদ আর মিথ্যা সম্প্রদায়
ছিন্ন হবে ভেদের গ্রন্থি কঠিন প্রতিজ্ঞায়৷
আমরা সবাই ভারতবাসী শ্রেষ্ঠ পৃথিবীর
আমরা হব মুক্তিদাতা আমরা হব বীর॥‘ভবিষ্যতে’ ও ‘সুচিকিৎসা’ — এই ছড়াদুটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’, ‘শারদীয়া বসুমতী’, ১৩৫৪-থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এগুলি ১৯৪০-এর আগের লেখা বলে অনুমিত।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
কালো মৃত্যুরা ডেকেছে আজকে স্বয়ম্বরায়,
নানাদিকে নানা হাতছানি দেখি বিপুল ধরায়।
ভীত মন খোঁজে সহজ পন্থা, নিষ্ঠুর চোখ;
তাই বিষাক্ত আস্বাদময় এ মর্তলোক,
কেবলি এখানে মনের দ্বন্দ্ব আগুন ছড়ায়।অবশেষে ভুল ভেঙেছে, জোয়ার মনের কোণে,
তীব্র ভ্রূকুটি হেনেছি কুটিল ফুলের বনে;
আভিশাপময় যে সব আত্মা আজো অধীর,
তাদের সকাশে রেখেছি প্রাণের দৃঢ় শিবির;
নিজেকে মুক্ত করেছি আত্মসমর্পণে।চাঁদের স্বপ্নে ধুয়ে গেছে মন যে-সব দিনে,
তাদের আজকে শত্রু বলেই নিয়েছি চিনে,
হীন র্স্পধারা ধূর্তের মতো শক্তিশেলে
ছিনিয়ে আমায় নিতে পারে আজো সুযোগ পেলে
তাই সতর্ক হয়েছি মনকে রাখি নি ঋণে।অসংখ্য দিন কেটেছে প্রাণের বৃথা রোদনে
নরম সোফায় বিপ্লবী মন উদ্ধোধনে;
আজকে কিন্তু জনতা-জোয়ারে দোলে প্লাবন,
নিরন্ন মনে রক্তিম পথ অনুধাবন,
করছে পৃথিবী পূর্ব-পন্থা সংশোধনে।অস্ত্র ধরেছি এখন সমুখে শত্রু চাই,
মহামরণের নিষ্ঠুর ব্রত নিয়েছি তাই;
পৃথিবী জটিল, জটিল মনের সম্ভাষণ
তাদের প্রভাবে রাখিনি মনেতে কোনো আসন,
ভুল হবে জানি তাদের আজকে মনে করাই।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
ভক্তিমূলক
|
এক যে ছিল আপনভোলা কিশোর,
ইস্কুল তার ভাল লাগত না,
সহ্য হত না পড়াশুনার ঝামেলা
আমাদের চলতি লেখাপড়া সে শিখল না কোনোকালেই,
অথচ সে ছাড়িয়ে গেল সারা দেশের সবটুকু পাণ্ডিত্যকে।
কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।বড়মানুষীর মধ্যে গরীবের মতো মানুষ,
তাই বড় হয়ে সে বড় মানুষ না হয়ে
মানুষ হিসেব হল অনেক বড়।
কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।গানসাধার বাঁধা আইন সে মানে নি,
অথচ স্বর্গের বাগান থেকে সে চুরি করে আনল
তোমার আমার গান।
কবি সে, ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল না ছোট বয়সে,
অথচ শিল্পী ব’লে সে-ই পেল শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সম্মান।
কেমন ক’রে ? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।মানুষ হল না বলে যে ছিল তার দিদির আক্ষেপের বিষয়,
অনেক দিন, অনেক বিদ্রূপ যাকে করেছে আহত;
সে-ই একদিন চমক লাগিয়ে করল দিগ্বিজয়।
কেউ তাকে বলল, ‘বিশ্বকবি’, কেউ বা ‘কবিগুরু’
উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারদিক করল প্রণাম।
তাই পৃথিবী আজো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলছেঃ
কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না,
এ প্রশ্নের জবাব তোমাদের মতো আমিও খুঁজি।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন,
বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে
জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে,
উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন।
পরিচয়ভারে ন্যুব্জ অনেকের শোকগ্রস্ত মন,
বিস্ময়ের জাগরণে ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের
মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের।
কিছুকাল সন্তর্পণে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ।আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর
লাঞ্ছনার বেদনায়, ষ্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
অসহ্য দিন! স্নায়ু উদ্বেল। শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত
অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত।
মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত
হৃদয়গত।
ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে
দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে।
এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সমুদ্যত,
মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
নিয়ত দক্ষিণ হাওয়া স্তব্ধ হল একদা সন্ধ্যায়
অজ্ঞাতবাসের শেষে নিদ্রাভঙ্গে নির্বীর্য জনতা
সহসা আরণ্য রাজ্যে স্তম্ভিত সভয়ে;
নির্বায়ুমণ্ডল ক্রমে দুর্ভাবনা দৃঢ়তর করে।
দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন! মহামারী অন্তরে বিক্ষোভ,
সঞ্চারিত রক্তবেগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতেঃ
অবসন্ন বিলাসের সঙ্কুচিত প্রাণ।
বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ'রে পড়েঃ
মুহুর্মুহু রক্তপাতে স্বধর্ম সূচনা;
ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়।
নশ্বর পৌষদিন, চারিদিকে ধূর্তের সমতা
জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন;
শোকচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন
পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতেঃ
দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর-
দৃষ্টিপথ অন্ধকার, সন্দিহান আগামী দিনেরা।
গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান,
কণ্টকিত প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।
সহসা জানালায় দেখি দুর্ভিক্ষের স্রোতে
জনতা মিছিলে আসে সংঘবদ্ধ প্রাণ-
অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে সমুদ্র পর্বতে;
সে মিছিলে শোনা গেল
জনতার মৃত্যুজয়ী গান।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চুতুর্দিক,
আজো বেঁচে আছি মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক।
দুলে ওঠে দিন; শপথমুখর কিষাণ শ্রমিকপাড়া,
হাজারে হাজারে মাঠে বন্দরে আজকে দিয়েছে সাড়া।
জ'লে আলো আজ, আমাদের হাড়ে জমা হয় বিদ্যুৎ,
নিহত দিনের দীর্ঘ শাখায় ফোটে বসন্তদূত।
মূঢ় ইতিহাস; চল্লিশ কোটি সৈন্যের সেনাপতি।
সংহত দিন, রুখবে কে এই একত্রীভূত গতি?
জানি আমাদের অনেক যুগের সঞ্চিত স্বপ্নেরা
দ্রুত মুকুলিত তোমার দিন ও রাত্রি দিয়েই ঘেরা।
তাই হে আদিম, ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিস্ময়,
ছড়াও প্লাবন, দুঃসহ দিন আর বিলম্ব নয়।
সারা পৃথিবীর দুয়ারে মুক্তি, এখানে অন্ধকার,
এখানে কখন আসন্ন হবে বৈতরণীর পার?
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।
ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখ কাস্তে,
গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে।
আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত,
প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত।
আজকে মজুর হতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত,
আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত।
ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য!
সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব-দরজায়,
ফেনী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায়।
বন্ধু, তোমারা ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
ভেঙ্গেছে সাম্রাজ্যস্বপ্ন, ছত্রপতি হয়েছে উধাও;
শৃঙ্খল গড়ার দুর্গ ভূমিসাৎ বহু শতাব্দীর।
'সাথী আজ দৃঢ় হাতে হাতিয়ার নাও' -
রোমের প্রত্যেক পথে ওঠে ডাক ক্রমশ অস্থির।
উদ্ধত ক্ষমতালোভী দস্যুতার ব্যর্থ পরাক্রম
মুক্তির উত্তপ্ত স্পর্শে প্রকম্পিত যুগ যুগ অন্ধকার রোম।
হাজার বছর ধ'রে দাসত্ব বেঁদেছে বাসা রোমের দেউলে,
দিয়েছে অনেক রক্ত রোমের শ্রমিক-
তাদের শক্তির হাওয়া মুক্তির দুয়ার দিল খুলে,
আজকে রক্তাক্ত পথ; উদ্ভাসিত দিক।
শিল্পী আর মজুরের বহু পরিশ্রম
একদিন গড়েছিল রোম,
তারা আজ একে একে ভেঙে দেয় রোমের সে সৌন্দর্যসম্ভার,
ভগ্নস্তূপে ভবিষ্যৎ মুক্তির প্রচার।
রেমের বিপ্লবী হৃৎস্পন্দনে ধ্বনিত
মুক্তির সশস্ত্র ফৌজ আসে অগণিত,
দুচোখে সংহার স্বপ্ন, বুকে তীব্র ঘৃণা
শত্রুকে বিধ্বস্ত করা যেতে পারে কিনা
রাইফেলের মুখে এই সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসা।
যদিও উদ্বেগ মনে, তবু দীপ্ত আশা;
পথে পথে জনতার রক্তাক্ত উত্থান,
বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে ডেকে ওঠে বান।ভেঙে পড়ে দস্যুতার, পশুতার প্রথম প্রাসাদ
বিক্ষুব্ধ অগ্ন্যুৎপাতে উচ্চারিত শোষণের বিরুদ্ধে জেহাদ।
যে উদ্ধত একদিন দেশে দেশে দিয়েছে শৃঙ্খল
আবিসিনিয়ার চোখে আজ তার সে দম্ভ নিষ্ফল।এদিকে ত্বরিত সূর্য রোমের আকাশে
যদিও কুয়াশাঢাকা আকাশের নীল,
তবুও বিপ্লবী জানে, সোভিয়েট পাশে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
এদেশ বিপন্ন আজ; জানি আজ নিরন্ন জীবন-
মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ
রক্তের আল্পনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনাদ সুর;
তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষুধিত মজুর
আমার সম্মুখে আজ এক শত্রুঃ এক লাল পথ,
শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ।
কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়,
প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায়।
আমার হাতের স্পর্শে প্রতিদিন যন্ত্রের গর্জন
স্মরণ করায় পণ; অবসাদ দিই বিসর্জন।
বিক্ষুব্ধ যন্ত্রের বুকে প্রতিদিন যে যুদ্ধ ঘোষণা,
সে যুদ্ধ আমার যুদ্ধ, তারই পথে স্তব্ধ দিন গোনা।
অদূর দিগন্ত আসে ক্ষিপ্র দিন, জয়োন্মত্ত পাখা-
আমার দৃষ্টিতে লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা।
আমার বেগান্ধ হাত, অবিরাম যন্ত্রের প্রসব
প্রচুর প্রচুর সৃস্টি, শেষ বজ্র সৃষ্টির উৎসব।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
আজিকার দিন কেটে যায়,—
অনলস মধ্যাহ্ন বেলায়
যাহার অক্ষয় মূর্তি পেয়েছিনু খুঁজে
তারি পানে চেয়ে আছি চক্ষু বুজে৷
আমি সেই ধনুর্ধর যার শরাসনে
অস্ত্র নাই, দীপ্তি মনে মনে,
দিগন্তের স্তিমিত আলোকে
পূজা চলে অনিত্যের বহ্নিময় স্রোতে৷
চলমান নির্বিরোধ ডাক,
আজিকে অন্তর হতে চিরমুক্তি পাক৷
কঠিন প্রস্তরমূর্তি ভেঙে যাবে যবে
সেই দিন আমাদের অস্ত্র তার কোষমুক্ত হবে৷
সুতরাং রুদ্ধতায় আজিকার দিন
হোক মুক্তিহীন৷
প্রথম বাঁশির স্ফূর্তি গুপ্ত উৎস হতে
জীবন–সিন্ধুর বুকে আন্তরিক পোতে
আজিও পায় নি পথ তাই
আমার রুদ্রের পূজা নগণ্য প্রথাই
তবুও আগত দিন ব্যগ্র হয়ে বারংবার চায়
আজিকার দিন কেটে যায়॥এই কবিতাটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এটি ১৯৪০-এর আগের রচনা।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
নরম ঘুমের ঘোর ভাঙল?
দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য;
ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য
এখনো বিপদ অগ্রাহ্য?
পৃথিবী, এ পুরাতন পৃথিবী
দেখ আজ অবশেষে নিঃস্ব
স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা
একে একে সকলি অদৃশ্য।
রুক্ষ মরুর দুঃস্বপ্ন
হৃদয় আজকে শ্বাসরুদ্ধ,
একলা গহন পথে চলতে
জীবন সহসা বিক্ষুব্ধ।
জীবন ললিত নয় আজকে
ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা,
বিফল স্রোতের পিছুটানকে
শরণ করেছে ভীরু সত্তা।
তবু আজ রক্তের নিদ্রা,
তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য;
সহসা চমক লাগে চিত্তে
দুর্জয় হল প্রতিপক্ষ!
নিরুপায় ছিঁড়ে গেল দ্বৈদ
নির্জনে মুখ তোলে অঙ্কুর,
বুঝে নিল উদ্যোগী আত্মা
জীবন আজকে ক্ষণভঙ্গুর।
দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন
নতুন, নতুনতর বিশ্ব,
তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা
একে একে সকলি অদৃশ্য।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আজকে হঠাৎ সাত সমুদ্র তেরো নদী
পার হ’তে সাধ জাগে, মনে হয় তবু যদি
পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ,
চাষার ছেলের হাতে এসে যেত হঠাৎ আজ৷
তা হলে না হয় আকাশবিহার হ’ত সফল,
টুকরো মেঘেরা যেতে-যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল;
জনারণ্যে কি রাজকন্যার নেইকো ঠাঁই?
কাস্তেখানাকে বাগিয়ে আজকে ভাবছি তাই৷অসি নাই থাক, হাতে তো আমার কাস্তে আছে,
চাষার ছেলের অসিকে কি ভালবাসাতে আছে?
তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন,
যেখানে ঝলসে উঠবে কাস্তে দৃপ্ত-কিরণ৷
হে রাজকন্যা, দৈত্যপুরীতে বন্দী থেকে
নিজেকে মুক্ত করতে আমায় নিয়েছ ডেকে৷
হেমন্তে পাকা ফসল সামনে, তবু দিলে ডাক;
তোমাকে মুক্ত করব, আজকে ধান কাটা থাক৷রাজপুত্রের মতন যদিও নেই কৃপাণ,
তবু মনে আশা, তাই কাস্তেতে দিচ্ছি শান,
হে রাজকুমারী, আমাদের ঘরে আসতে তোমার
মন চাইবে তো? হবে কষ্টের সমুদ্র পার?
দৈত্যশালায় পাথরের ঘর, পালঙ্ক-খাট,
আমাদের শুধু পর্ণ-কুটির, ফাঁকা ক্ষেত-মাঠ;
সোনার শিকল নেই, আমাদের মুক্ত আকাশ,
রাজার ঝিয়ারী! এখানে নিদ্রাহীন বারো মাস৷এখানে দিন ও রাত্রি পরিশ্রমেই কাটে
সূর্য এখানে দ্রুত ওঠে, নামে দেরিতে পাটে৷
হে রাজকন্যা, চলো যাই, আজ এলাম পাশে,
পক্ষীরাজের অভাবে পা দেব কোমল ঘাসে৷
হে রাজকন্যা সাড়া দাও, কেন মৌন পাষাণ?
আমার সঙ্গে ক্ষেতে গিয়ে তুমি তুলবে না ধান?
হে রাজকন্যা, ঘুম ভাঙলো না? সোনার কাঠি
কোথা থেকে পাব, আমরা নিঃস্ব, ক্ষেতেই খাটি৷
সোনার কাঠির সোনা নেই, আছে ধানের সোনা,
তাতে কি হবে না? তবে তো বৃথাই অনুশোচনা॥ব্যর্থতা’ কবিতাটি আষাঢ় ১৩৫৩-র কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ কবিতাটি ‘মীমাংসা’ কবিতার প্রথম খসড়া বলে মনে হয়৷
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ
দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ,
যে সোনার মদ পান ক'রে ধন ক্ষেত
দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে
রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার,
সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল
প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা
রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো,
অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা
রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও।বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে
মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা,
প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে,
কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা !
রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল
ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে
শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা
স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের
প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব,
মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে
জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব।তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত?
কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়,
এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি-
দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া,
আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল
আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
রূপক
|
আমরা সিঁড়ি,
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে;
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।তবুও আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না।
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।
আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
Food-Problem
(একটি প্রাথমিক সম্পাদ্যের ছায়া অবলম্বনে)সিদ্ধান্ত :
আজকে দেশে রব উঠেছে, দেশেতে নেই খাদ্য;
‘আছে’, সেটা প্রমাণ করাই অধুনা ‘সম্পাদ্য’৷
*কল্পনা :
মনে করো, আসছে জাপান অতি অবিলম্বে,
সাধারণকে রাখতে হবে লৌহদৃঢ় ‘লম্বে’৷
“খাদ্য নেই” এর প্রথম পাওয়া খুব ‘সরল রেখা’তে’,
দেশরক্ষার ‘লম্ব’ তোলাই আজকে হবে শেখাতে৷
*অঙ্কন :
আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীর ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে,
প্রতিরোধের বিন্দুতে নাও ঐক্য-রেখা এঁকে!
‘হিন্দু’-‘মুসলমানে’র কেন্দ্রে, দুদিকের দুই ‘চাপে’,
যুক্ত করো উভয়কে এক প্রতিরোধের ধাপে৷
প্রতিরোধের বিন্দুতে দুই জাতি যদি মেলে,
সাথে সাথেই খাদ্য পাওয়ার হদিশ তুমি পেলে৷
*প্রমাণ :
খাদ্য এবং প্রতিরোধ উভয়েরই চাই,
হিন্দু এবং মুসলমানে মিলন হবে তাই৷
উভয়ের চাই স্বাধীনতা, উভয় দাবী সমান,
দিকে দিকে ‘খাদ্যলাভ’ একতারই প্রমাণ৷
প্রতিরোধের সঠিক পথে অগ্রসর যারা,
ঐক্যবদ্ধ পরস্পর খাদ্য পায় তারা॥‘নব জ্যামিতির ছড়া’ সাপ্তাহিক জনযুদ্ধের কিশোর বিভাগে প্রকাশের জন্যে রচিত হয়েছিল৷ রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪৩৷
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
হাস্যরসাত্মক
|
বরেনবাবু মস্ত জ্ঞানী, মস্ত বড় পাঠক,
পড়েন তিনি দিনরাত্তির গল্প এবং নাটক,
কবিতা আর উপন্যাসের বেজায় তিনি ভক্ত,
ডিটেক্টিভের কাহিনীতে গরম করেন রক্ত;
জানেন তিনি দর্শন আর নানা রকম বিজ্ঞান
জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি, তাইতো আছে দিক্-জ্ঞান;
ইতিহাস আর ভূগোলেতে বেজায় তিনি দক্ষ,-
এসব কথা ভাবলেই তাঁর ফুলতে থাকে বক্ষ।
সব সময়েই পড়েন তিনি, সকাল থেকে সন্ধ্যা,
ছুটির দিনে পড়েন তিনি, পড়েন পূজোর বন্ধে।
মাঝে মাঝে প্রকাশ করেন গূঢ় জ্ঞানের তত্ত্ব
বিদ্যাখানা জাহির করেন বরেন্দ্রনাথ দত্তঃ
হঠাৎ ঢুকে রান্না ঘরে বলেন, ওসব কী রে?
ভাইঝি গীতা হেসে বলে, এসব কালো জিরে।
বরেনবাবু রেগে বলেন, জিরে তো হয় সাদা,
তিলও কালো, জিরেও কালো? পেয়েছিস কি গাধা?
রান্না করার সময় কেবল পুড়িয়ে হাজার লঙ্কা,
হনুমতী হয়েছিস তুই, হচ্ছে আমার শঙ্কা।
হঠাৎ ছোট্ট খোকাটাকে কাঁদতে দেখে, দত্ত
খোলেন বিরাট বইয়ের পাতা নামটি “মনস্তত্ত্ব”।
খুঁজতে খুঁজতে বরেনবাবু হয়ে গেলেন সারা-
বুঝলেন না, কেন খোকা মাথায় করছে পাড়া।
হঠাৎ এসে ভাইঝি গীতা দুধের বাটি নিয়ে,
খাইয়ে দিয়ে পাঁচ মিনিটে দিল ঘুম পাড়িয়ে।
বরেনবাবু ভাবেন, ‘খোকার কেমনতর ধারা
আধ ঘণ্টার চেঁচামেচি পাঁচ মিনিটেই সারা?’
বরেনবাবুর কাছে আরো বিরাট একটি ধাঁধা,
হলদে চালের রঙ কেন হয় ভাত হলে পর সাদা?
পাথর বাটির গরম জিনিস ঠাণ্ডা হয় তা জানি,
পাহাড় দেশে গরম কেন এমন ছটফটানি?
পথ চলতে ভেবে এসব ভিজে ওঠেন ঘামে,
মানিকতলা যেতে চাপেন ধর্মতলার ট্রামে।
বরেনবাবু জানেন কিন্তু নানা রকম বিজ্ঞান,
জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি তাইতো এমন দিক্-জ্ঞান।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
নীল সমুদ্রের ইশারা-
অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ,
আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা;
নিঃশব্দ দিনের সেই ভীরু অন্তঃশীল
মত্ততাময় পদক্ষেপঃ
এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর
জীবনের ওপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয়
তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে
ডাক এল-
সভ্যতার ডাক
নিষ্ঠুর ক্ষুদার্ত পরোয়ানা
আমাকে চিহ্নিত ক'রে গেল।
আমার একক পৃথিবী
ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে।
মনের স্বচ্ছতার ওপর বিরক্তির শ্যাওলা
গভীরতা রচনা করে,
আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা
ইতস্ততঃ ধাবমান।
নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল
পূর্ণতায় মূর্তি চায়;
আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ,
আরো অনেকের বিরুদ্ধে বিবক্ষা
তাই পরাহত হল।
কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা
আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক!
দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস।
যে সব মুহূর্ত-পরমাণু
গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা,
সে সব মুহূর্ত আজ
প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায়
অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
রূপক
|
আমরা সিগারেট।
তোমরা আমাদের বাঁচতে দাও না কেন?
আমাদের কেন নিঃশেষ করো পুড়িয়ে?
কেন এত স্বল্প-স্থায়ী আমাদের আয়ু?
মানবতার কোন্ দোহাই তোমরা পাড়বে?
আমাদের দাম বড় কম এই পৃথিবীতে।
তাই কি তোমরা আমাদের শোষণ করো?
বিলাসের সামগ্রী হিসাবে ফেলো পুড়িয়ে?
তোমাদের শোষণের টানে আমরা ছাই হই:
তোমরা নিবিড় হও আরামের উত্তাপে।
তোমাদের আরামঃ আমাদের মৃত্যু।
এমনি ক'রে চলবে আর কত কাল?
আর কতকাল আমরা এমনি নিঃশব্দে ডাকব
আয়ু-হরণকারী তিল তিল অপঘাতকে?
দিন আর রাত্রি - রাত্রি আর দিন;
তোমরা আমাদের শোষণ করছ সর্বক্ষণ
আমাদের বিশ্রাম নেই, মজুরি নেই
নেই কোনো অল্প-মাত্রার ছুটি।
তাই, আর নয়;
আর আমরা বন্দী থাকব না
কৌটোয় আর প্যাকেটে;
আঙুলে আর পকেটে
সোনা-বাঁধানো 'কেসে' আমাদের নিঃশ্বাস হবে না রুদ্ধ।
আমরা বেরিয়ে পড়ব,
সবাই একজোটে, একত্রে-
তারপর তোমাদের অসতর্ক মুহূর্তে
জ্বলন্ত আমরা ছিট্কে পড়ব তোমাদের হাত থেকে
বিছানায় অথবা কাপড়ে;
নিঃশব্দে হঠাৎ জ্বলে উঠে
বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে মারব তোমাদের
যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
মৃত্যুর মৃত্তিকা ‘পরে ভিত্তি প্রতিকূল –
সেখানে নিয়ত রাত্রি ঘনায় বিপুল;
সহসা চৈত্রের হাওয়া ছড়ায় বিদায়ঃ
স্তিমিত সূর্যের চোখে অন্ধকার ছায়।
বিরহ-বন্যার বেগে প্রভাতের মেঘ
রাত্রির সীমায় এসে জানায় আবেগ,
ধূসর প্রপঞ্চ-বিশ্ব উন্মুক্ত আকাশে
অনেক বিপন্ন স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে।
তবু তো প্রাণের মর্মে প্রচ্ছন্ন জিজ্ঞাসা
অজস্র ফুলের রাজ্যে বাঁধে লঘু বাসা;
রাত্রির বিবর্ণ স্মৃতি প্রভাতের বুকে
ছড়ায় মলিন হাসি নিরর্থ-কৌতুকে।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।
আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
- আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।
সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,
কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।
বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,
দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে।
দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি
আজো যায় শোনা,
দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।
পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।
আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে
লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;
ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন,
যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।
অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ
অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;
দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,
অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত
বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ-
এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।
লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।
মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।
লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
স্বচ্ছ রাত্রি এনেছে প্লাবন, উষ্ণ নিবিড়
ধুলিদাপটের মরুচ্ছায়ায় ঘনায় নীল।
ক্লান্ত বুকের হৃৎস্পন্দন ক্রমেই ধীর
হয়ে আসে তাই শেষ সম্বল তোলো পাঁচিল।
ক্ষণভঙ্গুর জীবনের এই নির্বিরোধ
হতাশা নিয়েই নিত্য তোমার দাদন শোধ?
শ্রান্ত দেহ কি ভীরু বেদনার অন্ধকূপে
ডুবে যেতে কাঁদে মুক্তি মায়ায় ইতস্তত;
কত শিখণ্ডী জন্ম নিয়েছে নূতন রূপে?
দুঃস্বপ্নের প্রায়শ্চিত্ত চোরের মতো।
মৃত ইতিহাস অশুচি ঘুচায় ফল্গু-স্নানে;
গন্ধবিধুর রুধির তবুও জোয়ার আনে।
পথবিভ্রম হয়েছে এবার, আসন্ন মেঘ।
চলে ক্যারাভান ধূসর আঁধারে অন্ধগতি,
সরীসৃপের পথ চলা শুরু প্রমত্ত বেগ
জীবন্ত প্রাণ, বিবর্ণ চোখে অসম্মতি।
অরণ্য মাঝে দাবদাহ কিছু যায় না রেখে।
মনকে বাঁচাও বিপন্ন এই মৃত্যু থেকে।
সঙ্গীবিহনি দুর্জয় এই পরিভ্রমণ
রক্তনেশায় এনেছে কেবলই সুখাস্বাদ,
এইবারে করো মেরুদুর্গম পরিখা খনন
বাইরে চলুক অযথা অধীর মুক্তিবাদ।
দুর্গম পথে যাত্রী সওয়ার ভ্রান্তিবিহীন
ফুরিয়ে এসেছে তন্দ্রানিঝুম ঘুমন্ত দিন।
পালাবে বন্ধু? পিছনে তোমার ধূমন্ত ঝড়
পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে।
চলো, আরো দূরে? ক্ষুদিত মরণ নিরন্তর,
পুরনো পৃথিবী জেগেছে আবার মৃত্যুপারে,
অহেতুক তাই হয়নি তোমার পরিখা খনন,
থেমে আসে আজ বিড়ম্বনায় শ্রান্ত চরণ।
মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির-
পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ।
বারুদের দুম কালো ছায়া আনে, - তিক্ত রুধির ;
পৃথিবী এখনো নির্জন নয়- জ্বলন্ত ধূপ।
নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে
সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
বলতে পার বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?
বলতে পার ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে,
কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে?
ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা,
গরীব মেয়ে পায় না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা।
বলতে পার ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য,
ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য?
‘হিং-টিং-ছট্’ প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়,
বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে রানার!
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।
রানার! রানার!
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে,আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স'রে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ- বুঝি হয় লাল ও-পূর্বকোণ।
অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্মিট্ ক'রে চায়!
কেমন ক'রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!
কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে-
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠন্ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ, রানার! এখনো রাতের কালো।
এমনি ক'রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে 'মেলে'।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।
রানার! রানার!
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।
কত চিঠি লেখে লোকে-
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।
দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি, -
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-
রানার! রানার! কি হবে এ বোঝা ব'য়ে?
কি হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রানার!রানার ! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?
রানার! গ্রামের রানার!
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে-
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর
অগ্রগতির 'মেলে',
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-
নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।
আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।
আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
সনেট
|
দৃষ্টিহীন সন্ধ্যাবেলা শীতল কোমল অন্ধকার
স্পর্শ ক’রে গেল মোরে। স্বপনের গভীর চুম্বন,
ছন্দ-ভাঙা স্তব্ধতায় ভ্রান্তি এনে দিল চিরন্তন।
অহর্নিশি চিন্তা মোর বিক্ষুব্ধ হয়েছে; প্রতিবার
স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি অন্ধকারে মৃত্যুর বিস্তার।
মুহূর্ত-কম্পিত-আমি বন্ধ করি অলৌকিক গান,
প্রচ্ছন্ন স্বপন মোর আরিক মিথ্যার পাষাণ,
কঠিন প্রলুব্ধ চিন্তা নগরীতে নিষ্ফল আমার।
তবু চাই রুদ্ধতায় আলোকের আদিম প্রকাশ,
পৃথিবীর গন্ধ নেই এমন দিবস বারোমাস।
আবার জাগ্রত মোর দুষ্ট চিন্তা নিগূঢ় ইঙ্গিতে;
ভুঁইচাঁপা সুরভির মরণ অস্তিত্বময় নয়,
তার সাথে কল্পনার কখনো হবে না পরিচয় ;
তবু যেন আলো আর অন্ধকার মোর চারিভিতে।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
তোমরা এসেছ, বিপ্লবী বীর! অবাক অভ্যুদয়।
যদিও রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারা কলকাতাময়।
তবু দেখ আজ রক্তে রক্তে সাড়া-
আমরা এসেছি উদ্দাম ভয়হারা।
আমরা এসেছি চারিদিক থেকে, ভুলতে কখনো পারি!
একসূত্রে যে বাঁধা হয়ে গেছে কবে কোন্ যুগে নাড়ী।
আমরা যে বারে বারে
তোমাদের কথা পৌঁছে দিয়েছি এদেশের দ্বারে দ্বারে,
মিছিলে মিছিলে সভায় সভায় উদাত্ত আহ্বানে,
তোমাদের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছি জনতার উত্থানে,
উদ্দাম ধ্বনি মুখরিত পথেঘাটে,
পার্কের মোড়ে, ঘরে, ময়দানে, মাঠে
মুক্তির দাবি করেছি তীব্রতর
সারা কলকাতা শ্লোগানেই থরোথরো।
এই সেই কলকাতা।
একদিন যার ভয়ে দুরু দুরু বৃটিশ নোয়াত মাথা।
মনে পড়ে চব্বিশে?
সেদিন দুপুরে সারা কলকাতা হারিয়ে ফেলেছে দিশে;
হাজার হাজার জনসাধারণ ধেয়ে চলে সম্মুখে
পরিষদ-গেটে হাজির সকলে, শেষ প্রতিজ্ঞা বুকে
গর্জে উঠল হাজার হাজার ভাইঃ
রক্তের বিনিময়ে হয় হোক, আমরা ওদের চাই।
সফল! সফল! সেদিনের কলকাতা-
হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকদের মাথা।
জানি বিকৃত আজকের কলকাতা
বৃটিশ এখন এখানে জনত্রাতা!
গৃহযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে-
ডেকেছে এখানে কালো রক্তের বান;
সেদিনের কলকাতা এ আঘাতে ভেঙে চুরে খান্খান্।
তোমারা এসেছ বীরের মতন, আমরা চোরের মতো।
তোমরা এসেছ, ভেঙেছ অন্ধকার-
তোমরা এসেছ, ভয় করি নাকো আর।
পায়ের স্পর্শে মেঘ কেটে যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুর
ছড়িয়ে পড়বে বহুদুর-বহুদূর
তোমরা এসেছ, জেনো এইবার নির্ভয় কলকাতা-
অত্যাচারের হাত থেকে জানি তোমরা মুক্তিদাতা।
তোমরা এসেছ, শিহরণ ঘাসে ঘাসেঃ
পাখির কাকলি উদ্দাম উচ্ছ্বাসে,
মর্মরধ্বনি তরুপল্লবে শাখায় শাখায় লাগেঃ
হঠাৎ মৌন মহাসমুদ্র জাগে
অস্থির হাওয়া অরণ্যপর্বতে,
গুঞ্জন ওঠে তোমরা যাও যে-পথে।
আজ তোমাদের মুক্তিসভায় তোমদের সম্মুখে,
শপথ নিলাম আমরা হাজার মুখেঃ
যতদিন আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের সম্মান,
আমরা রুখব গৃহযুদ্ধের কালো রক্তের বান।
অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে
এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে।
তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে,
তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে।
তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়,
উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয়।
তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার,
পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার।
আবার জ্বালাব বাতি,
হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
ভারতবর্ষে পাথরের গুরুভারঃ
এহেন অবস্থাকেই পাষাণ বলো,
প্রস্তরীভুত দেশের নীরবতার
একফোঁটা নেই অশ্রুও সম্বলও।
অহল্যা হল এই দেশ কোন্ পাপে
ক্ষুদার কান্না কঠিন পাথরে ঢাকা,
কোনো সাড়া নেই আগুনের উত্তাপে
এ নৈঃশব্দ্য বেঙেছে কালের চাকা।
ভারতবর্ষ! কার প্রতীক্ষা করো,
কান পেতে কার শুনছ পদধ্বনি?
বিদ্রোহে হবে পাথরেরা থরোথরো,
কবে দেখা দেবে লক্ষ প্রাণের খনি?
ভারতী, তোমার অহল্যারূপ চিনি
রামের প্রতীক্ষাতেই কাটাও কাল,
যদি তুমি পায়ে বাজাও ও-কিঙ্কিনী,
তবে জানি বেঁচে উঠবেই কঙ্কাল।
কত বসন্ত গিয়েছে অহল্যা গো-
জীবনে ব্যর্থ তুমি তবু বার বার,
দ্বারে বসন্ত, একবার শুধু জাগো
দুহাতে সরাও পাষাণের গুরুভার।
অহল্যা-দেশ, তোমার মুখের ভাষা
অনুচ্চারিত, তবু অধৈর্যে ভরা;
পাষাণ ছদ্মবেশকে ছেঁড়ার আশা
ক্রমশ তোমার হৃদয় পাগল করা।
ভারতবর্ষ, তন্দ্রা ক্রমশ ক্ষয়
অহল্যা! আজ শাপমোচনের দিন;
তুষার-জনতা বুঝি জাগ্রত হয়-
গা-ঝাড়া দেবার প্রস্তাব দ্বিধাহীন।
অহল্যা, আজ কাঁপে কী পাসাণকায়!
রোমাঞ্চ লাগে পাথরের প্রত্যঙ্গে;
রামের পদস্পর্শ কি লাগে গায়?
অহল্যা, জেনো আমরা তোমার সঙ্গে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
শোকমূলক
|
ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে শোকোচ্ছ্বাস
(শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-কে)অকস্মাৎ মধ্যদিনে গান বন্ধ ক’রে দিল পাখি,
ছিন্নভিন্ন সন্ধ্যাবেলা প্রাত্যহিক মিলনের রাখী;
ঘরে ঘরে অনেকেই নিঃসঙ্গ একাকী৷ক্লাব উঠে গিয়েছে সফরে,
শূন্য ঘর, শূন্য মাঠ,
ফুল ফোটা মালঞ্চ প’ড়ে
ত্যক্ত এ ক্লাবের কক্ষে নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে৷
সূর্য অস্ত গিয়েছে কখন,
কারো আজ দেখা নেই—
কোথাও বন্ধুর দল ছড়ায় না হাসি,
নিষ্প্রভ ভোজের স্বপ্ন;
একটি কথাও শব্দ তোলে না বাতাসে—
ক্লাব-ঘরে ধুলো জমে,
বিনা গল্পে সন্ধ্যা হয়;
চাঁদ ওঠে উন্মুক্ত আকাশে৷খেলোয়াড় খেলে নাকো,
গায়কেরা গায় নাকো গান—
বক্তারা বলে না কথা
সাঁতারুর বন্ধ আজ স্নান৷
সর্বস্ব নিয়েছে গোরা তারা মারে ঊরুতে চাপড়,
যে পথে এ ক্লাব গেছে কে জানে সে পথের খবর?সন্ধ্যার আভাস আসে,
জ্বলে না আলোক ক্লাব কক্ষের কোলে,
হাতে হাতে নেই সিগারেট—
তর্কাতর্কি হয় নাকো বিভক্ত দু’দলে;
অযথা সন্ধ্যায় কোনো অচেনার পদশব্দে
মালীটি হাঁকে না৷মনে পড়ে লেকের সে পথ?
মনে পড়ে সন্ধ্যাবেলা হাওয়ার চাবুক৷
অনেক উজ্জ্বল দৃশ্য এই লেকে
করেছিল উৎসাহিত বুক৷
কেরানী, বেকার, ছাত্র, অধ্যাপক, শিল্পী ও ডাক্তার
সকলের কাছে ছিল অবারিত দ্বার,
কাজের গহ্বর থেকে পাখিদের মতো এরা নীড়
সন্ধানে, সন্ধ্যায় ডেকে এনেছিল এইখানে ভিড়৷
রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সিনেমার কথা,
এদের রসনা থেকে প্রত্যহ স্খলিত হ’তে অলক্ষ্যে অযথা;
মাঝে মাঝে অনর্থক উচ্ছ্বসিত হাসি,
বাতাসে ছড়াত নিত্য শব্দ রাশি রাশি৷তারপর অকস্মাৎ ভেঙে গেল রুদ্ধশ্বাস মন্ত্রমুগ্ধ সভা,
সহসা চৈতন্যোদয়; প্রত্যেকের বুকে ফোটে ক্ষুব্ধ রক্তজবা;
সমস্ত গানের শেষে যেন ভেঙে গেল এক গানের আসর,
যেমন রাত্রির শেষে নিঃশ্বেষে কাঙাল হয় বিবাহ-বাসর৷‘জীবন-রক্ষক’ এই সমাজের দারুণ অভাবে,
এদের ‘জীবন-রক্ষা’ হয়তো কঠিন হবে,
হয়তো অনেক প্রাণ যাবে॥‘ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে শোকোচ্ছ্বাস (শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)’—এই শিরোনামায় কবিতাটি লেখা হয়েছিল৷ দক্ষিণ কলকাতার লেক অঞ্চলের ‘ইণ্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটি’র সদস্য ছিলেন শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য৷ লেকে যুদ্ধকালীন মিলিটারী ক্যাম্প হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলে সুকান্ত এই কবিতাটি লিখেছিলেন৷
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী
এপারে মর্মরধ্বনি শুনি,
নিস্পন্দ শবের রাজ্য হতে
ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি।গোদূলি আকাশ ব’লে দিল
তোমার মরণ অতি কাছে,
তোমার বিশাল পৃথিবীতে
এখনো বসন্ত বেঁচে আছে।অদূরে নিবিড় ঝাউবনে
যে কালো ঘিরেছে নীরবতা,
চোখ তারই দীর্ঘায়িত পথে
অস্পষ্ট ভাষায় কয় কথা।আমার দিনান্ত নামে ধীরে
আমি তো সুদূর পরাহত,
অশত্থশাখায় কালো পাখি
দুশ্চিন্তা ছড়ায় অবিরত।সন্ধ্যাবেলা, আজ সন্ধ্যাবেলা
নিষ্ঠুর তমিস্রা ঘনাল কী!
মরণ পশ্চাতে বুঝি ছিল
সহসা উদার চোখাচোখি।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
এখন এই তো সময়-
কই? কোথায়? বেরিয়ে এসো ধর্মঘটভাঙা দালালরা;
সেই সব দালালরা-
ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়,
বেরিয়ে এসো!
জাহান্নামে যাওয়া মূর্খের দল,
বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য
পরাজয় আর মৃত্যুর দূত-
বেরিয়ে এসো!
বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীর দল
সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে।
গর্তের পোকারা!
এই তো তোমাদের শুভক্ষণ,
গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো
আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা
বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকো।
সময় হয়েছে,
আসরফি আর পুরনো অপমানের বদলে
সাদা যাদের পেট-
বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক,
এই তো তাদের সুযোগ।
মানুষ ভালো করেই জানে
অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনকে লাগানোর সেই
পুরনো কায়দা।
সামান্য কয়েকজন লোভী
অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে-
আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে
ক্ষয়ে-যাওয়ার দল।
সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা
তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা।
অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার।
কিন্তু এখন সেই সময়,
সচেতন মানুষ! এখন আর ভুল ক'রো না-
বিশ্বাস ক'রো না সেই সব সাপেদের
জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে,
বিপদে পড়লে যারা ডাকে
তাদের চেয়ে কম চটকদার বিষাক্ত অনুচরদের।
এতটুকু লজ্জা হয় না তাদের ধর্মঘট ভাঙতে
যে ধর্মঘট বেআব্রু ক্ষুদার চূড়ান্ত চিহ্ন।
- অবশ্য, এখনো কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠান হয় নি
যার অজ্ঞাত নামঃ
"দর্মঘট ভাঙার দল"
অন্তত দরজায় সে নাম লেখা থাকে না।
ঝড় আসছে- সেই ঝড়ঃ
যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে।
আর হুঁশিয়ার মজুরঃ
সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
দেখ, এই মোটা লোকটাকে দেখ
অভাব জানে না লোকটা,
যা কিছু পায় সে আঁকড়িয়ে ধরে
লোভে জ্বলে তার চোখটা।
মাথা উঁচু করা প্রাসাদের সারি
পাথরে তৈরি সব তার,
কত সুন্দর, পুরোনো এগুলো!
অট্রালিকা এ লোকটার।
উঁচু মাথা তার আকাশ ছুঁয়েছে
চেয়ে দেখে না সে নীচুতে,
কত জামির যে মালিক লোকটা
বুঝবে না তুমি কিছুতে।
দেখ, চিমনীরা কী ধোঁয়া ছাড়ছে
কলে আর কারখানাতে,
মেশিনের কপিকলের শব্দ
শোনো, সবাইকে জানাতে।
মজুরেরা দ্রুত খেটেই চলেছে-
খেটে খেটে হল হন্যে ;
ধনদৌলত বাড়িয়ে তুলছে
মোটা প্রভুটির জন্যে।
দেখ একজন মজুরকে দেখ
ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছে,
কেনা গোলামের মতই খাটুনি
তাই হাড়ভাঙা খাটছে।
ভাঙা ঘর তার নীচু ও আঁধার
স্যাঁতসেঁতে আর ভিজে তা,
এর সঙ্গে কি তুলনা করবে
প্রাসাদ বিশ্ব-বিজেতা?
কুঁড়েঘরের মা সারাদিন খাটে
কাজ করে সারা বেলা এ,
পরের বাড়িতে ধোয়া মোছা কাজ-
বাকিটা পোষায় সেলায়ে।
তবুও ভাঁড়ার শূন্যই থাকে,
থাকে বাড়ন্ত ঘরে চাল,
বাচ্চা ছেলেরা উপবাস করে
এমনি করেই কাটে কাল।
বাবু যত তারা মজুরকে তাড়া
করে চোখে চোখে রাখে,
ঘোঁৎ ঘোঁৎ ক’রে মজুরকে ধরে
দোকানে যাওয়ার ফাঁকে।
খাওয়ার সময় ভোঁ বাজলে তারা
ছুটে আসে পালে পাল,
খায় শুধু কড়কড়ে ভাত আর
হয়তো একটু ডাল।
কম-মজুরির দিন ঘুরে এলে
খাদ্য কিনতে গিয়ে
দেখে এ টাকায় কিছুই হয় না,
বসে গালে হাত দিয়ে।
পুরুত শেখায়, ভগবানই জেনো প্রভু
(সুতরাং চুপ; কথা বলবে না কভু)
সকলেরই প্রভু- ভালো আর খারাপের
তাঁরই ইচ্ছায় এ; চুপ করো সব ফের।
শিক্ষক বলে, শোন সব এই দিকে,
চালাকি ক’রো না, ভালো কথা যাও শিখে।
এদের কথায় ভরসা হয় না তবু?
সরে এসো তবে, দেখ সত্যি কে প্রভু।
ফ্যাকাশে শিশুরা, মুখে শাস্তির ভীতি,
আগের মতোই মেনে চলে সব নীতি।
যদি মজুরেরা কখনো লড়তে চায়
পুলিশ প্রহারে জেলে টেনে নিয়ে যায়।
মজুরের শেষ লড়াইয়ের নেতা যত
এলোমেলো সব মিলায় ইতস্তত-
কারাপ্রাচীরের অন্ধকারের পাশে।
সেখানেও স্বাধীনতার বার্তা আসে।
রাশিয়াই, শুধু রাশিয়া মহান্ দেশ,
যেখানে হয়েছে গোলামির দিন শেষ;
রাশিয়া, যেখানে মজুরের আজ জয়,
লেনিন গড়েছে রাশিয়া! কী বিস্ময়!
রাশিয়া যেখানে ন্যায়ের রাজ্য স্থায়ী,
নিষ্ঠুর ‘জার’ যেই দেশে ধরাশায়ী,
সোভিয়েট-‘তারা’ যেখানে দিচ্ছে আলো,
প্রিয়তম সেই মজুরের দেশ ভালো।
মজুরের দেশ, কল-কারখানা,
প্রাসাদ, নগর, গ্রাম,
মজুরের খাওয়া মজুরের হাওয়া,
শুধু মজুরের নাম।
মজুরের ছুটি, বিশ্রাম আর
গরমে সাগর-ধার,
মজুরের কত স্বাধীনতা! আর
অজস্র অধিকার।
মজুরের ছেলে ইস্কুলে যায়
জ্ঞানের পিপাসা নিয়ে,
ছোট ছোট মন ভরে নেয় শুধু
জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে।
মজুরের সেনা ‘লাল ফৌজ’ দেয়
পাহারা দিন ও রাত,
গরীবের দেশে সইবে না তারা
বড়লোকদের হাত।
শান্ত-স্নিগ্ধ, বিবাদ-বিহীন
জীবন সেখানে, তাই
সকলেই সুখে বাস করে আর
সকলেই ভাই-ভাই;
এক মনেপ্রাণে কাজ করে তারা
বাঁচাতে মাতৃভূমি,
তোমার জন্যে আমি, সেই দেশে,
আমার জন্যে তুমি।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
অজাতশত্রু, কতদিন কাল কাটলো :
চিরজীবন কি আবাদ-ই ফসল ফলবে?
ওগো ত্রিশঙ্কু, নামাবলী আজ সম্বল
টংকারে মূঢ় স্তব্ধ বুকের রক্ত৷কখনো সন্ধ্যা জীবনকে চায় বাঁধতে,
সাদা রাতগুলো স্বপ্নের ছায়া মনে হয়,
মাটির বুকেতে পরিচিত পদশব্দ,
কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি থেকেই অব্যয়৷ভীরু একদিন চেয়েছিল দূর অতীতে
রক্তের গড়া মানুষকে ভালবাসতে;
তাই বলে আজ পেশাদারী কোন মৃত্যু!
বিপদকে ভয়? সাম্যের পুনরুক্তি৷সখের শপথ গলিতে কালের গর্ভে—
প্রপঞ্চময় এই দুনিয়ার মুষ্ঠি,
তবু দিন চাই, উপসংহারে নিঃস্ব
নইলে চটুল কালের চপল দৃষ্টি৷পঙ্গু জীবন; পিচ্ছিল ভীত আত্মা,—
রাত্রির বুকে উদ্যত লাল চক্ষু;
শেষ নিঃশ্বাস পড়ুক মৌন মন্ত্রে,
যদি ধরিত্রী একটুও হয় রক্তিম॥‘পটভুমি’ কবিতাটির রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪২-৪৩৷
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি,
সহস্র বছর ধ'রে এসে আমি জানি পরিপাটি,
জানি এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা,
এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা।
যদিও দলিত দেশ, তবু মুক্তি কথা কয় কানে,
যুগ যুগ আমরা যে বেঁচে থাকি পতনে উত্থানে!
যে চাষী কেটেছে ধন, এ মাটিতে নিয়েছে কবর,
এখনো আমার মধ্যে ভেসে আসে তাদের খবর।
অদৃশ্য তাদের স্বপ্নের সমাচ্ছন্ন এদেশের ধূলি,
মাটিতে তাদের স্পর্শ, তাদের কেমন ক'রে ভুলি?
আমার সম্মুখে ক্ষেত, এ প্রান্তরে উদয়স্ত খাটি,
ভালবাসি এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি।
এখানে রক্তের দাগ রেখে গেছে চেঙ্গিস, তৈমুর,
সে চিহ্নও মুছে দিল কত উচ্চৈঃশ্রবাদের খুর।
কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, কত রাজ্য হয়েছে উজাড়,
উর্বর করেছে মাটি কত দিগ্বিজয়ীর হাড়।
তবুও অজেয় এই শতাব্দীগ্রথিত হিন্দুস্থান,
এরই মধ্যে আমাদের বিকশিত স্বপ্নের সন্ধান।
আজন্ম দেখেছি আমি অদ্ভুত নতুন এক চোখে,
আমার বিশাল দেশ আসমুদ্র ভারতবর্ষকে।
এ ধুলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘুর্ণিত চাবুক,
এখানে নিশ্চিহ্ন হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক।
এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধ'রে
রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক'রে।
আজকে যখন এই দিক্প্রান্তে ওঠে রক্ত-ঝড়,
কোমল মাটিতে রাখে শত্রু তার পায়ের স্বাক্ষর,
তখন চীৎকার ক' রক্ত ব' ওঠে 'ধিক্ ধিক্,
এখনো দিল না দেখা দেহে দেহে নির্ভয় সৈনিক!
দাসত্বের ছদ্মবেশ দীর্ণ ক'রে উন্মোচিত হোক
একবার বিশ্বরূপ- উদ্দাম, হে অধিনায়ক!’
এদিকে উৎকর্ণ দিন, মণিপুর, কাঁপে মণিপুর
চৈত্রের হাওয়ায় ক্লান্ত, উৎকণ্ঠায় অস্থির দুপুর-
কবে দেখা দেবে, কবে প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ
ছড়াবে ঐশ্বর্য পথে জনতার দুরন্ত যৌবন?
দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে অতর্কিতে শত্রু তার পদচিহ্ন রাখে-
এখনো শত্রু ক্ষমা? শত্রু কি করেছে ক্ষমা
বিধ্বস্ত বাংলাকে?
আজকের এ মুহূর্তে অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতা,
কেন তাই মনে মনে আমি প্রশ্ন করি সেই কথা।
তুমি কি ক্ষুদিত বন্ধু? তুমি কি ব্যাধিতে জরোজরো?
তা হোক , তবুও তুমি আর এক মৃত্যুকে রোধ করো।
বসন্ত লাগুক আজ আন্দোলিত প্রাণের শাখায়,
আজকে আসুক বেগ এ নিশ্চল রথের চাকায়,
এ মাটি উত্তপ্ত হোক, এ দিগন্তে আসুক বৈশাখ,
ক্ষুদার আগুনে আজ শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।
শত্রুরা নিয়েছে আজ দ্বিতীয় মৃত্যুর ছদ্মবেশ,
তবু কেন নিরুত্তর প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা দেশ?
এদেশে কৃষক আছে, এদেশে মজুর আছে জানি,
এদেশে বিপ্লবী আছে, জনরাজ্যে মুক্তির সন্ধানী।
দাসত্বের ধুলো ঝেড়ে তারা আজ আহ্বান পাঠাক
ঘোষণা করুক তারা এ মাটিতে আসন্ন বৈশাখ।
তাই এই অবরুদ্ধ স্বপ্নহীন নিবিড় বাতাসে
শব্দ হয়, মনে হয় রাত্রিশেষে ওরা যেন আসে।
ওরা আসে, কান পেতে আমি তার পদধ্বনি শুনি,
মৃত্যুকে নিহত ক'রে ওরা আসে উজ্জ্বল আরুণি,
পৃথিবী ও ইতিহাস কাঁপে আজ অসহ্য আবেগে,
ওদের পায়ের স্পর্শে মাটিতে সোনার দান, রঙ লাগে মেঘে।
এ আকাশ চন্দ্রাতপ, সূর্য আজ ওদের পতাকা,
মুক্তির প্রচ্ছদপটে ওদের কাহিনী আজ ঢাকা,
আগন্তুক ইতিহাসে ওরা আজ প্রথম অধ্যায়,
ওরা আজ পলিমাটি অবিরাম রক্তের বন্যায়;
ওদের দুচোখে আজ বিকশিত আমার কামনা,
অভিনন্দন গাছে, পথের দুপাশে অভ্যর্থনা।
ওদের পতাকা ওড়ে প্রামে গ্রামে নগরে বন্দরে,
মুক্তির সংগ্রাম সেরে ওরা ফেরে স্বপ্নময় ঘরে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ,
আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের।
হাতাশায় স্তব্ধ বাক্য; ভাষা চাই আমরা নির্বাক,
পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের।
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা
ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা,
আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা।
পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা।
আমি দিব্যচক্ষে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ;
দস্যুতায় দৃপ্তকণ্ঠ (বিগত দিনের)
ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত,
যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক, যে যন্ত্রণা সহায়হীনের।
বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা
মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরদার,
ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা;
তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার।
রবীন্দ্রনাথের সেই ভুলে যাওয়া বাণী
অকস্মাৎ করে কানাকানি ;
'দামামা ঐ বাজে, দিন বদলের পালা
এ ঝড়ো যুগের মাঝে'
নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন,
বিষ্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরুদ্ধ রায়ু ;
আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন
সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন
মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু।
ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন ,
পশ্চিম সীমান্তে শান্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু,
দিকে দিকে জয়ধ্বনি, কাঁপে দিন রক্তাক্ত আভায়।
রামরাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু
মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমূক।
পূর্বাঞ্চল দীপ্ত ক'রে বিশ্বজন-সমৃদ্ধ সভায়
রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক।
এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর
বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে কণ্ঠে গণ-সংগীতের সুর;
জনতার পাশে পাশে উজ্জ্বল পতাকা নিয়ে হাতে
চলুক নিন্দাকে ঠেলে গ্লানি মুছে আঘাতে আঘাতে।
যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক।
আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
ছড়া
|
ও পাড়ার শ্যাম রায়
কাছে পেলে কামড়ায়
এমনি সে পালোয়ান,
একদিন দুপুরে
ডেকে বলে গুপুরে
‘এক্ষুনি আলো আন্’৷
কী বিপদ তা হ’লে
মার খাব আমরা?
দিলে পরে উত্তর
রেগে বলে ‘দুত্তর,
যত সব দামড়া’৷
কেঁদে বলি, শ্রীপদে
বাঁচাও এ বিপদে—
অক্ষম আমাদের৷
হেসে বলে শাম-দা
নিয়ে আয় রামদা
ধুবড়ির রামাদের॥‘পরিচয়’ ছড়াটির রচনাকাল ১৯৩৯-৪০ সাল বলে মনে হয়৷
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
এক
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে
লিখি কথা।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার
স্বাধীনতা।দুই
সকালে বিকালে মনের খেয়ালে
ইঁদারায়
দাঁড়িয়ে থাকলে অর্থটা তার
কি দাঁড়ায়?তিন
কখন বাজল ছ’টা
প্রাসাদে প্রাসাদে ঝলসায় দেখি
শেষ সূর্যের ছটা –
স্তিমিত দিনের উদ্ধত ঘনঘটা।চার
বেজে চলে রেডিও
সর্বদা গোলমাল করতেই
‘রেডি’ ও।পাঁচ
জাপানী গো জাপানী
ভারতবর্ষে আসতে কি শেষ
ধরে গেল হাঁপানী?ছয়
জার্মানী গো জার্মানী
তুমি ছিলে অজেয় বীর
এ কথা আজ আর মানি!সাত
হে রাজকন্যে
তোমার জন্যে
এ জনারণ্যে
নেইকো ঠাঁই-
জানাই তাই।আট
আঁধিয়ারে কেঁদে কয় সল্তেঃ
‘চাইনে চাইনে আমি জ্বলতে।’ (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
শোকমূলক
|
আবার ফিরে এল বাইশে শ্রাবণ।
আজ বর্ষশেষে হে অতীত,
কোন সম্ভাষণ
জানাব অলক্ষ্য পানে?
ব্যথাক্ষুব্ধ গানে
ঝরাব শ্রাবণ বরিষণ!দিনে দিনে, তিলে তিলে যে বেদনা
উদাস মধুর
হয়েছে নিঃশব্দ প্রাণে
ভরেছে বিপুল টানে,
তারে আজ দেব কোন সুর?তোমার ধূসর স্মৃতি, তোমার কাব্যের সুরভিতে
লেগেছে সন্ধ্যার ছোঁওয়া, প্রাণ ভরে দিতে
হেমন্তের শিশিরের কণা
আমি পারিব না।প্রশান্ত সূর্যাস্ত পরে দিগন্তের যে রাগ-রক্তিমা,
লেগেছে প্রাণের ‘পরে,
সহসা স্মৃতির ঝড়ে
মুছিয়া যাবে কী তার সীমা!
তোমার সন্ধ্যার ছায়াখানি
কোন পথ হতে মোরে
কোন পথে নিয়ে যাবে টানি’
অমর্ত্যরে আলোক সন্ধানী
আমি নাহি জানি।
একদা শ্রাবণ দিনে গভীর চরণে,
নীরবে নিষ্ঠুর সরণিতে
পাদস্পর্শ দিতে
ভিক্ষুক মরণে।
পেয়েছে পথের মধ্যে দিয়েছ অক্ষয়
তব দান,
হে বিরাট প্রাণ!
তোমার চরণ স্পর্শে রোমাঞ্চিত পৃথিবীর ধূলি
উঠিছে আকুলি’,
আজিও স্মৃতির গন্ধে ব্যথিত জনতা
কহিছে নিঃশব্দ স্বরে একমাত্র কথা,
‘তুমি হেথা নাই’।
বিস্ময়ের অন্ধকারে মুহ্যমান জলস্থল তাই
আদো তন্দ্রা, আধো জাগরণে
দক্ষিণ হাওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে
ফেলিছে নিঃশ্বাস।
ক্লেদক্লিষ্ট পৃথিবীতে একী পরিহাস।
তুমি চলে গেছ তবু আজিও বহিছে বারোমাস
উদ্দাম বাতাস,
এখনো বসন্ত আসে
সকরুণ বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে,
এখনো শ্রাবণ ঝরোঝর
অবিশ্রান্ত মাতায় অন্তর।
এখনো কদম্ব বনে বনে
লাগে দোলা মত্ত সমীরণে,
এখনো উদাসি’
শরতে কাশের ফোটে হাসি।
জীবনে উচ্ছ্বাস, হাসি গান
এখনো হয় নি অবসান।
এখনো ফুটিছে চাঁপা হেনা,
কিছুই তো তুমি দেখিলে না।
তোমার কবির দৃষ্টি দিয়ে
কোন কিছু দিলে না চিনিয়ে
এখন আতঙ্ক দেখি পৃথিবীর অস্থিতে মজ্জায়,
সভ্যতা কাঁপিছে লজ্জায়;
স্বার্থের প্রাচীরতলে মানুষের সমাধি রচনা,
অযথা বিভেদ সৃষ্টি, হীন প্ররোচনা
পরস্পর বিদ্বেষ সংঘাতে,
মিথ্যা ছলনাতে –
আজিকার মানুষের জয়;
প্রসন্ন জীবন মাঝে বিসর্পিল, বিভীষিকাময়।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
পাখি সব করে রব, রাত্রি শেষ ঘোষণা চৌদিকে,
ভোরের কাকলি শুনি; অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে,
আমার ঘরেও রুদ্ধ অন্ধকার, ষ্পস্ট নয় আলো,
পাখিরা ভোরের বার্তা অকস্মাৎ আমাকে শোনালো।
স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি, অন্ধকারে খাড়া করি কান-
পাখিদের মাতামাতি, শুনি মুখরিত ঐকতান;
আজ এই রাত্রিশেষে বাইরে পাখির কলরবে
রুদ্ধ ঘরে ব'সে ভাবি, হয়তো কিছু বা শুরু হবে,
হয়তো এখনি কোনো মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল,
মুক্তির অবাদ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল;
স্বপ্নের কুসুমকলি হয়তো বা ফুটেছে কাননে,
আমি কি খবর রাখি? আমি বদ্ধ থাকি গৃহকোণে,
নির্বাসিত মন চিরকাল অন্ধকারে বাসা,
তাইতো মুক্তির স্বপ্ন আমাদের নিতান্ত দুরাশা।জন-পাখিদের কণ্ঠে তবুও আলোর অভ্যর্থনা.
দিকে দিকে প্রতিদিন অবিশ্রান্ত শুধু যায় শোনা;
এরা তো নগণ্য জানি, তুচ্ছ বলে ক'রে থাকি ঘৃণা,
আলোর খবর এরা কি ক'রে যে পায় তা জানি না।
এদের মিলিত সুরে কেন যেন বুক ওঠে দুলে,
অকস্মাৎ পূর্বদিকে মনের জানালা দিই খুলেঃ
হঠাৎ বন্দর ছাড়া বাঁশি বুঝি বাজায় জাহাজ,
চকিতে আমার মনে বিদ্যুৎ বিদীর্ণ হয় আজ।
অদূরে হঠাৎ বাজে কারখানার পঞ্চজন্যধ্বনি,
দেখি দলে দলে লোক ঘুম ভেঙে ছুটছে তখনি,
মনে হয়, যদি বাজে মুক্তি-কারখানার তীব্র শাঁখ
তবে কি হবে না জমা সেখানে জনতা লাখে লাখ?
জন-পাখিদের গানে মুখরিত হবে কি আকাশ?
- ভাবে নির্বাসিত মন, চিরকাল অন্ধকারে বাস।
পখিদের মাতামাতি; বুঝি মুক্তি নয় অসম্ভব,
যদিও ওঠে নি সূর্য, তবু আজ শুনি জনরব।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
ভক্তিমূলক
|
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি,
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি,
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি,
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি;
এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে,
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে,
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।
তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সম্রাজ্য গড়ে তোলে,
গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে;
যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।
তবুও নিশ্চিত উপবাস
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস-
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়,
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে,
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।
তাই আজ আমারো বিশ্বাস,
"শান্তির লালিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।"
তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে,
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
বন্ধুঃ
ঘরে আমার চাল বাড়ন্ত
তোমার কাছে তাই,
এলাম ছুটে, আমায় কিছু
চাল ধার দাও ভাই। মজুতদারঃ
দাঁড়াও তবে, বাড়ির ভেতর
একটু ঘুরে আসি,
চালের সঙ্গে ফাউও পাবে
ফুটবে মুখে হাসি। মজুদতারঃ
এই নাও ভাই, চালকুমড়ো
আমায় খাতির করো,
চালও পেলে কুমড়ো পেলে
লাভটা হল বড় ।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
ফেব্রুয়ারী মাসে ভাই, কলকাতা শহরে
ঘটল ঘটনা এক, লম্বা সে বহরে!
লড়াই লড়াই খেলা শুরু হল আমাদের,
কেউ রইল না ঘরে রামাদের শ্যামাদের;
রাস্তার কোণে কোণে জড়ো হল সকলে,
তফাৎ রইল নাকো আসলে ও নকলে,
শুধু শুনি ‘ধর’ ‘ধর’ ‘মার’ ‘মার’ শব্দ
যেন খাঁটি যুদ্ধ এ মিলিটারী জব্দ।
বড়রা কাঁদুনে গ্যাসে কাঁদে, চোখ ছল ছল
হাসে ছিঁচকাঁদুনেরা বলে, ‘সব ঢাল জল’।
ঐ বুঝি ওরা সব সঙ্গীন উঁচোলো,
ভয় নেই, যত হোক বেয়নেট ছুঁচোলো,
ইট-পাটকেল দেখি রাখে এরা তৈরি,
এইবার যাবে কোথা বাছাধন বৈরী!
ভাবো বুঝি ছোট ছেলে, একেবারে বাচ্চা!
এদের হাতেই পাবে শিক্ষাটা আচ্ছা;
ঢিল খাও, তাড়া খাও, পেট ভরে কলা খাও,
গালাগালি খাও আর খাও কানমলা খাও।
জালে ঢাকা গাড়ি চড়ে বীরত্ব কি যে এর
বুঝবে কে, হরদম সামলায় নিজেদের।
বার্মা-পালানো সব বীর এরা বঙ্গে
যুদ্ধ করছে ছোট ছেলেদের সঙ্গে;
ঢিলের ভয়েতে ওরা চালায় মেশিনগান,
“বিশ্ববিজয়ী” তাই রাখে জান, বাঁচে মান।
খালি হাত ছেলেদের তেড়ে গিয়ে করে খুন;
সাবাস! সাবাস! ওরা খেয়েছে রাজার নুন।
ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা,
রক্ত-রাঙানো পথে দু’পাশে ছেলের মেলা;
দুর্দম খেলা চলে, নিষেধে কে কান দেয়?
ও-বাড়ি ও ও-পাড়ার কালো, ছোটু প্রাণ দেয়।
স্বচে দেখলাম বস্তির আলী জান,
‘আংরেজ চলা যাও’ বলে ভাই দিল প্রাণ।
এমন বিরাট খেলা শেষ হল চটপট
বড়দের বোকামিতে আজো প্রাণ ছটফট;
এইবারে আমি ভাই হেরে গেছি খেলাতে,
ফিরে গেছি দাদাদের বকুনির ঠেলাতে;
পরের বারেতে ভাই শুনব না কারো মানা,
দেবই, দেবই আমি নিজের জীবনখানা ।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
খবর আসে!
দিগ্দিগন্ত থেকে বিদ্যুদ্বাহিনী খবর;
যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ঝড়
---এখানে সাংবাদিকতার নৈশ নৈঃশব্দ্য।
রাত গভীর হয় যন্ত্রের ঝঙ্কৃত ছন্দে- প্রকাশের ব্যগ্রতায়;
তোমাদের জীবনে যখন নিদ্রাভিভুত মধ্যরাত্রি
চোখে স্বপ্ন আর ঘরে অন্ধকার।
অতল অদৃশ্য কথার সমুদ্র থেকে নিঃশব্দ শব্দেরা উঠে আসে;
অভস্ত হাতে খবর সাজাই-
ভাষা থেকে ভাষান্তর করতে কখনো চমকে উঠি,
দেখি যুগ থেকে যুগান্তর।
কখনো হাত কেঁপে ওঠে খবর দিতে ;
বাইশে শ্রাবণ, বাইশে জুনে।
তোমাদের ঘুমের অন্ধকার পথ বেয়ে
খবর-পরীরা এখানে আসে তোমাদের আগে,
তাদের পেয়ে কখনো কণ্ঠে নামে ব্যথা, কখনো বা আসে গান ;
সকালে দিনের আলোয় যখন তোমাদের কাছে তারা পৌঁছোয়
তখন আমাদের চোখে তাদের ডানা ঝরে গেছে।
তোমরা খবর পাও,
শুধু খবর রাখো না কারো বিনিদ্র চোখ আর উৎকর্ণ কানের।
ঐ কম্পোজিটর কি কখনো চমকে ওঠে নিখুঁত যান্ত্রিকতার কোনো ফাঁকে?
পুরনো ভাঙা চশমায় ঝাপসা মনে হয় পৃথিবী
৯ই আগস্টে কি আসাম সীমান্ত আক্রমণে?
জ্বলে ওঠে কি স্তালিনগ্রাদের প্রতিরোধে, মহাত্মাজীর মুক্তিতে,
প্যারিসের অভ্যুত্থানে?
দুঃসংবাদকে মনে হয় না কি
কালো অক্ষরের পরিচ্ছদে শোকযাত্রা?
যে খবর প্রাণের পক্ষপাতিত্বে অভিষিক্ত
আত্মপ্রকাশ করে নাকি বড় হরফের সম্মানে?
এ প্রশ্ন অব্যক্ত অনুচ্চারিত থাকে
ভোরবেলাকার কাগজের পরিচ্ছন্ন ভাঁজে ভাঁজে।
শুদু আমরা দৈনন্দিন ইতিহাস লিখি!
তবু ইতিহাস মনে রাখবে না আমাদের-
কে আর মনে রাখে নবান্নের দিনে কাটা দানের গুচ্ছকে?
কিন্তু মনে রেখো তোমাদের আগেই আমরা খবর পাই
মদ্যরাত্রির অন্ধকারে
তোমাদের তন্দ্রার অগোচরেও।
তাই তোমাদের আগেই খবর-পরীরা এসেছে আমাদের
চেতনার পথ বেয়ে।
আমার হৃদ্যন্ত্রে ঘা লেগে বেজে উঠেছে কয়েকটি কথা-
পৃথিবী মুক্ত- জনগণ চূড়ান্ত সংগ্রামে জয়ী।
তোমাদের ঘরে আজো অন্ধকার, চোখে স্বপ্ন।
কিন্তু জানি একদিন সে সকাল আসবেই
যেদিন এই খবর পাবে প্রত্যেকের চোখেমুখে
সকালের আলোয়, ঘাসে ঘাসে পাতায় পাতায়।
আজ তোমরা এখনো ঘুমে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আর এক যুদ্ধ শেষ,
পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ।
উদ্দাম ঢাকের শব্দে
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়?
বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে,
নামে এক ক্লান্তির জড়তা।
রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে
নাড়া দেয় পৃথিবীকে,
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়?
তুষারখচিত মাঠে,
ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে
অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়,
ভাঙা কামানের মুখে
ধ্বংসস্তূপে উৎকীর্ণ জিজ্ঞাসাঃ
কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর?
দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন!
বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন
তুমি আছ দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন,
হাতে হিসেবের খাতা
উন্মুখর এই পৃথিবীঃ
আজ তার শোধ করো ঋণ।
অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার,
আজ হোক তোমার বিচার।
তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ,
তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান;
জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল,
পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল,
স্পীডোমিটারের মতো আমাদের হৃৎপিণ্ড উদ্দাম,
প্রাণে গতিবেগ আনে, ছেয়ে ফেলে জনপদ-গ্রাম,
বুঝেছি সবাই আমরা আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম,
দেখ ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম।
তবুও যে তুমি আজো সিংহাসনে আছ
সে কেবল আমাদের বিরাট মায়।
এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উৎকীর্ণ চারিদিক,
গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক;
এ সুযোগে খুলে দাও ক্রূর শাসনের প্রদর্শনী,
আমরা প্রহর শুধু গনি।
পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালাঃ
ভেবেছ তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য এ জয়মালা;
জানো না এখানে যুদ্ধ-শুরু দিনবদলের পালা।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়–
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পাতায় যেতেঃ এখানে ক্লিক করুন
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালীর শুভেচ্ছা কামনা
পেয়েছি, তবুও আমি নিরুৎসাহে আজ অন্যমনা,
আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুৎসব,
রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব।
এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি,
মুমূর্ষু কলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা, কাঁদে নোয়াখালী,
সভ্যতাকে পিষে ফেলে সাম্রাজ্য ছড়ায় বর্বরতঃ
এমন দুঃসহ দিনে ব্যর্থ লাগে শুভেচ্ছার কথা;
তবু তোর রঙচঙে সুমধুর চিঠির জবাবে
কিছু আজ বলা চাই, নইলে যে প্রাণের অভাবে
পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, ভেসে যাবে রক্তের প্লাবনে।
যদিও সর্বদা তোর শুভ আমি চাই মনে মনে,
তবুও নতুন ক'রে আজ চাই তোর শান্তিসুখ,
মনের আঁধারে তোর শত শত প্রদীপ জ্বলুক,
এ দুর্যোগ কেটে যাবে, রাত আর কতক্ষণ থাকে?
আবার সবাই মিলবে প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে,
আমার ঐশ্বর্য নেই, নেই রঙ, নেই রোশনাই-
শুধু মাত্র ছন্দ আছে, তাই দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাই।।(ভূপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য-কে উদ্দেশ্য করে লেখা)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
দ্বারে মৃত্যু,
বনে বনে লেগেছে জোয়ার,
পিছনে কি পথ নেই আর?
আমাদের এই পলায়ন
জেনেছে মরণ,
অনুগামী ধূর্ত পিছে পিছে,
প্রস্থানের চেষ্টা হল মিছে।
দাবানল!
ব্যর্থ হল শুষ্ক অশ্রুজল,
বেনামী কৌশল
জেনেছে যে আরণ্যক প্রাণী
তাই শেষে নির্মূল বনানী।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল,
মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল।
দুঃখ-যুগের দারায় দারায়
যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায়
তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল।
তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল-
কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল,
তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল।
আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা
হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা,
হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল
তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল-
আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল
জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল।
উধাও আলোর নিচে সমারোহ ,
মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ!
ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল!
সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল-
একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশে নীল,
দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল।
সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার,
থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়,
ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল।
আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
সন্ধ্যার আকাশতলে পীড়িত নিঃশ্বাসে
বিশীর্ণ পাণ্ডুর চাঁদ ম্লান হয়ে আসে।
বুভুক্ষু প্রেতেরা হাসে শাণিত বিদ্রূপে,
প্রাণ চায় শতাব্দীর বিলুপ্ত রক্তের–
সুষুপ্ত যরো নিত্য কাঁদিছে ক্ষুদায়
দূর্ত দাবাগ্নি আজ জ্বলে চুপে চুপে
প্রমত্ত কস্তুরীমৃগ ক্ষুব্ধ চেতনায়
বিপন্ন করুণ ডাকে তোলে আর্তনাদ।
ব্যর্থ আজ শব্দভেদী বাণ–
সহস্র তির্যকশৃঙ্গ করিছে বিবাদ –
জীবন-মৃত্যুর সীমানায়।
লাঞ্ছিত সম্মান।
ফিরে চায় ভীরু-দৃষ্টি দিয়ে।
দুর্বল তিতিক্ষা আজ দুর্বাশার তেজে
স্বপ্ন মাঝে উঠেছে বিষিয়ে।
দূর পূর্বাকাশে,
বিহ্বল বিষাণ উঠে বেজে
মরণের শিরায় শিরায়।
মুমূর্ষ বিবর্ণ যত রক্তহীন প্রাণ–
বিস্ফারিত হিংস্র-বেদনায়।
অসংখ্য স্পন্দনে চলে মৃত্যু অভিযান
লৌহের দুয়ারে পড়ে কুটিল আঘাত,
উত্তপ্ত মাটিতে ঝরে বর্ণহীন শোণিত প্রপাত।
সুপ্তোত্থিত পিরামিড দুঃসহ জ্বালায়
পৈশাচিক ক্রূর হাসি হেসে
বিস্তীর্ণ অরণ্য মাঝে কুঠার চালায়।
কালো মৃত্যু ফিরে যায় এসে।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি নাঃ
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ-
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
মনে আছে সেদিন হুলস্থূল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন-
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ
আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি।
এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?
মনে নেই? এই সেদিন-
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;
চমকে উঠেছিলে-
আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।
আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করেছ বারংবার;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে , গ্রামে- দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব-
সবাই শেষবারের মতো!
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আজকে হঠাৎ সাত-সমুদ্র তের-নদী
পার হতে সাধ জাগে মনে, হায় তবু যদি
পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ
প্রস্রবণের মতো এসে যেত হঠাৎ আজ-
তাহলে না হয় আকাশ বিহার হত সফল,
টুকরো মেঘেরা যেতে যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল।
আর আমি বুঝি দৈত্যদলনে সাগর পার
হতাম; যেখানে দানবের দায়ে সব আঁধার।
মত্ত যেখানে দৈত্যে দৈত্যে বিবাদ ভারি;
হানাহানি নিয়ে সুন্দরী এক রাজকুমারী।
(রাজকন্যার লোভ নেই, -লোভ অলঙ্কারে,
দৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা ক'রে চায় তাহারে।)
আমি একজন লুপ্তগর্ব রাজার তনয়
এত অন্যায় সহ্য করব কোনোমতে নয়-
তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন,
যেখানে ঝল্সে উঠবে আমার অসির কিরণ।
ভাঙাচোরা এক তলোয়ার আছে, (নয় দু'ধারী)
তাও হ'ত তবে পক্ষীরাজেরই অভাব ভারি।
তাই ভাবি আজ, তবে আমি খুঁজে নেব কৌপীন
নেব কয়েকটা বেছে জানা জানা বুলি সৌখিন।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে,
কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়?
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে?
মনের কথা ব্যক্ত করবে
ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে?
ক্ষুদিত পেটে ধুঁকে ধুঁকে চলবে কতদিন?
ঝুলে পড়া তোমার জিভ,
শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল?
মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে
কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুদা আর গলার শিকলকে?
কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ?
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে।
চলো, শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের,
তৈরী হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
আজ মনে হয় বসন্ত আমার জীবনে এসেছিল
উত্তর মহাসাগরের কূলে
আমার স্বপ্নের ফুলে
তারা কথা কয়েছিল
অস্পষ্ট পুরনো ভাষায়
অস্ফুট স্বপ্নের ফুল
অসহ্য সূর্যের তাপে
অনিবার্য ঝরেছিল
মরেছিল নিষ্ঠুর প্রগল্ভ হতাশায়।
হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া
সেদিন আর নেই-
নেই আর সূর্য-বিকিরণ
আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ!
শুনি নি স্বপ্নের ডাকঃ
থেকেছি আশ্চর্য নির্বাক
বিন্যস্ত করেছি প্রাণ বুভুক্ষার হাতে।
সহসা একদিন
আমার দরজায় নেমে এল
নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা।
সেইদিন বসন্তের পাখি
উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত ।
আজ মনে হয়
হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুরে,
কী ক'রে সম্ভব হল
আমার রক্তকে ভালবাসা!
সূর্যের কুয়াশা
এখনো কাটে নি
ঘোচে নি অকাল দুর্ভাবনা।
মুহূর্তের সোনা
এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়,
এরই মদ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর
কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর,
অন্যমনে এ কী দুর্ঘটনা-
হেমন্তেই বসন্তের প্রস্তাব রটনা।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
আজ রাত্রে ভেঙে গেল ঘুম,
চারিদিক নিস্তব্ধ নিঃঝুম,
তন্দ্রাঘোরে দেখিলাম চেয়ে
অবিরাম স্বপ্নপথ বেয়ে
চলিয়াছে দুরাশার স্রোত,
বুকে তার বহু ভগ্ন পোত।
বিফল জীবন যাহাদের,
তারাই টানিছে তার জের;
অবিশ্রান্ত পৃথিবীর পথে,
জলে স্থলে আকাশে পর্বতে।
একদিন পথে যেতে যেতে
উষ্ণ বক্ষ উঠেছিল মেতে
যাহাদের, তারাই সংঘাতে
মৃত্যুমুখী, ব্যর্থ রক্তপাতে।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো
আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়,
সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো,
শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায়।
নিভৃত-জীবন-পরিচর্যায় কাটে
যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব।
নিরন্ন প্রেম ফেরে নির্জন হাটে,
অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ?
জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা
কাল রাতে ছিল নিশীথ কুসুমগন্ধী,
আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলা
মনে হয় ভীরু মনের দুরভিসন্ধি।।
অনিশ্চিত পৃথিবীতে অরণ্যের ফুল
রচে গেল ভুল;
তারা তো জানত যারা পরম ঈশ্বর
তাদের বিভিন্ন নয় স্তর,
অনন্তর
তারাই তাদের সৃষ্টিতে
অনর্থক পৃথক দৃষ্টিতে
একই কারুকার্যে নিয়মিত
উত্তপ্ত গলিত
ধাতুদের পরিচয় দিত।
শেষ অধ্যায় এল অকস্মাৎ।
তখন প্রমত্ত প্রতিঘাত
শ্রেয় মেনে নিল ইতিহাস,
অকল্পেয় পরিহাস
সুদূর দিগন্তকোণে সকরুণ বিলাল নিঃশ্বাস।
যেখানে হিমের রাজ্য ছিল,
যেখানে প্রচ্ছন্ন ছিল পশুর মিছিলও
সেখানেও ধানের মঞ্জরী
প্রাণের উত্তাপে ফোটে, বিচ্ছিন্ন শর্বরী;
সূর্য-সহচরী!
তাই নিত্যবুভুক্ষিত মন
চিরন্তন
লোভের নিষ্ঠুর হাত বাড়াল চৌদিকে
পৃথিবীকে
একাগ্রতায় নিলো লিখে।
সহসা প্রকম্পিত সুষুপ্ত সত্তায়
কঠিন আঘাত লাগে সুনিরাপত্তায়।
ব্যর্থ হল গুপ্ত পরিপাক,
বিফল চীৎকার তোলে বুভুক্ষার কাক
- পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
চৈতীরাতের হঠাৎ হাওয়া
আমায় ডেকে বলে,
“বনানী আজ সজীব হ’ল
নতুন ফুলে ফলে৷
এখনও কি ঘুম-বিভোর?
পাতায় পাতায় জানায় দোল
বসন্তেরই হাওয়া৷
তোমার নবীন প্রাণে প্রাণে,
কে সে আলোর জোয়ার আনে?
নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া;
তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তেরই হাওয়া৷
ওঠ্ রে আজি জাগরে জাগ
সন্ধ্যাকাশে উড়ায় ফাগ
ঘুমের দেশের সুপ্তহীনা মেয়ে৷
তোমার সোনার রথে চ’ড়ে
মুক্তি-পথের লাগাম ধ’রে
ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে৷
রক্তস্রোতে তোমার দিন,
চলেছে ভেসে সীমানাহীন৷
তারে তুমি মহান্ ক’রে তোল,
তোমার পিছে মৃত্যুমাখা দিনগুলি ভোল॥”‘চৈত্রদিনের গান’ কবিতাটি বিজনকুমার গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ছোটদের ‘শিখা’ পত্রিকার জন্য রচিত৷ রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪০৷
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
সীমান্তে আজ আমি প্রহরী।
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে
আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি-
স্বদেশের সীমানায়।
ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো
দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে;
- ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।
আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক,
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।
আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি :
কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে?
কী ক'রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক?
যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,
গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক,
রাত্রে চাঁদ ওঠে : আমার চোখে ঘুম নেই।
তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে।
জানি না আজো, আছ কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
জানি না তাও।
তবু লিখছি তোমাকে আজ : লিখছি আত্মম্ভর আশায়
ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।
জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই
মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে;
জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,
মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার।
তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তোমার হৃদয়।
যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়
আর সামনে নয়,
এবার পেছনে ফেরার পালা।
পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক'রে পেলাম কী? উত্তর তার-
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায়
কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায়
ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়,
জানে না কেউ।
উদ্যমহীন মূঢ় কারায়
পুরনো বুলির মাছি তাড়ায়
যারা, তারা নিয়ে ঘোরে পাড়ায়
স্মৃতির ফেউ।।(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
রূপক
|
শোন একটা গোপন খবর দিচ্ছি আমি তোমায়,
কলকাতাটা যখন খাবি খাচ্ছিল রোজ বোমায়,
সেই সময়ে একটা বোমা গড়ের মাঠের ধারে,
মাটির ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে ছিল এক্কেবারে,
অনেক দিনের ঘটনা তাই ভুলে গেছ্ল লোকে,
মাটির ভেতর ছিল তাইতো দেখে নি কেউ চোখে,
অনেক বর্ষা কেটে গেল, গেল অনেক মাস,
যুদ্ধ থামায় ফেলল লোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস,
হাঠাৎ সেদিন একলা রাতে গড়ের মাঠের ধারে,
বেড়িয়ে ফেরার সময় হঠাৎ চমকে উঠিঃ আরে!
বৃষ্টি পেয়ে জন্মেছে এক লম্বা বোমার গাছ,
তারই মাথায় দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোর নাচ,
গাছের ডালে ঝুলছে কেবল বোমা-ই সারি সারি,
তাই না দেখে ভড়কে গিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি।
পরের দিনই সকাল বেলা গেলাম ময়দানে,
হায়রে!- গাছটা চুরি গেছে কোথায় কে তা জানে।
গাছটা ছিল। গড়ের মাঠে খুঁজতে আজো ঘুরি,
প্রমাণ আছে অনেক, কেবল গাছটা গেছে চুরি।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে,
মৃত্যুহীন ধমনীর জ্বলন্ত প্রলাপ;
অবরুদ্ধ বে তার উন্মাদ তড়িৎ;
নিত্য দেখে বিভীষিকা পূর্ব অভিশাপ।ভয়ার্ত শোণিত-চক্ষে নামে কালোছায়া,
রক্তাক্ত ঝটিকা আনে মূর্ত শিহরণ
দিক্প্রান্তে শোকাতুরা হাসে ক্রূর হাসি,
রোগগ্রস্ত সন্তানের অদ্ভুত মরণ।দৃষ্টিহীন আকাশের নিষ্ঠুর সান্ত্বনাঃ
ধূ-ধূ করে চেরাপুঞ্জি- সহিষ্ণু হৃদয়।
ক্লান্তিহারা পথিকের অরণ্য ক্রন্দনঃ
নিশীথে প্রেতের বুকে জাগে মৃত্যুভয়।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
ভাঙা কুঁড়ে ঘরে থাকি:
পাশে এক বিরাট প্রাসাদ
প্রতিদিন চোখে পড়ে;
সে প্রাসাদ কি দুঃসহ স্পর্ধায় প্রত্যহ
আকাশকে বন্ধুত্ব জানায়,
আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখি।
চেয়ে চেয়ে দেখি আর মনে মনে ভাবি-
এ অট্টালিকার প্রতি ইটের হৃদয়ে
অনেক কাহিনী আছে অত্যন্ত গোপনে,
ঘামের, রক্তের আর চোখের জলের।
তবু এই প্রাসাদকে প্রতিদিন হাজারে হাজারে
সেলাম জানায় লোকে, চেয়ে থাকে বিমূঢ় বিস্ময়ে।
আমি তাই এ প্রাসাদে এতকাল ঐশ্বর্য দেখেছি,
দেখেছি উদ্ধত এক বনিয়াদী কীর্তির মহিমা।
হঠাৎ সেদিন
চকিত বিস্ময়ে দেখি
অত্যন্ত প্রাচীন সেই প্রাসাদের কার্নিশের ধারে
অশ্বত্থ গাছের চারা।
অমনি পৃথিবী
আমার চোখের আর মনের পর্দায়
আসন্ন দিনের ছবি মেলে দিল একটি পলকে।
ছোট ছোট চারাগাছ-
রসহীন খাদ্যহীন কার্নিশের ধারে
বলিষ্ঠ শিশুর মতো বেড়ে ওঠে দুরন্ত উচ্ছাসে।
হঠাৎ চকিতে,
এ শিশুর মধ্যে আমি দেখি এক বৃদ্ধ মহীরুহ
শিকড়ে শিকড়ে আনে অবাধ্য ফাটল
উদ্ধত প্রাচীন সেই বনিয়াদী প্রাসাদের দেহে।
ছোট ছোট চারাগাছ-
নিঃশব্দে হাওয়ায় দোলে, কান পেতে শোনে:
প্রত্যেক ইটের নীচে ঢাকা বহু গোপন কাহিনী
রক্তের, ঘামের আর চোখের জলের।
তাই তো অবাক আমি, দেখি যত অশ্বত্থচারায়
গোপনে বিদ্রোহ জমে, জমে দেহে শক্তির বারুদ;
প্রাসাদ-বিদীর্ণ-করা বন্য আসে শিকড়ে শিকড়ে।
মনে হয়, এই সব অশ্বত্থ-শিশুর
রক্তের, ঘামের আর চোখের জলের
ধারায় ধারায় জন্ম,
ওরা তাই বিদ্রোহের দূত।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
এই হেমন্তে কাটা হবে ধান,
আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান-
পৌষপার্বণে প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান।
তবুও এ হাতে কাস্তে তুলতে কান্না ঘনায়ঃ
হালকা হাওয়ায় বিগত স্মৃতিকে ভুলে থাকা দায়;
গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই, ছেড়ে গেছে বোন,
পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন;
নিজের হাতের জমি ধান-বোনা,
বৃথাই ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা,
কারোরই ঘরেতে ধান তোলবার আসেনি শুভক্ষণ-
তোমার আমার ক্ষেত ফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জন।
এবার নতুন জোরালো বাতাসে
জয়যাত্রার ধ্বনি ভেসে আসে,
পিছে মৃত্যুর ক্ষতির নির্বাচন-
এই হেমন্তে ফসলেরা বলেঃ কোথায় আপন জন?
তারা কি কেবল লুকোনো থাকবে,
অক্ষমতার গ্লানিকে ঢাকবে,
প্রাণের বদলে যারা প্রতিবাদ করছে উচ্চারণ
এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ?
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
ক্ষুদার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম-
চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম!
বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা
আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে
বিদ্যুৎপ্রবাহ আনে, আনে আজ চেতনার দিন।
চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম!
এখনো নিস্তব্ধ তুমি
তাই আজো পাশবিকতার
দুঃসহ মহড়া চলে,
তাই আজো শত্রুরা সাহসী।
জানি আমি তোমার হৃদয়ে
অজস্র ঔদার্য আছে; জানি আছে সুস্থ শালীনতা
জানি তুমি আঘাতে আঘাতে
এখনও স্তিমিত নও, জানি তুমি এখনো উদ্দাম-
হে চট্টগ্রাম!
তাই আজো মনে পড়ে রক্তাক্ত তোমাকে
সহস্র কাজের ফাঁকে মনে পড়ে শার্দূলের ঘুম
অরণ্যের স্বপ্ন চোখে, দাঁতে নখে প্রতিজ্ঞা কঠোর।
হে অভুক্ত ক্ষুদিত শ্বাপদ-
তোমার উদ্যত থাবা, সংঘবদ্ধ প্রতিটি নখর
এখনো হয় নি নিরাপদ।
দিগন্তে দিগন্তে তাই ধ্বনিত গর্জন
তুমি চাও শোণিতের স্বাদ-
যে স্বাদ জেনেছে স্তালিনগ্রাদ।
তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ
এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস।
তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম!
আমার হৃৎপিণ্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
ধনপতি পাল, তিনি জমিদার মস্ত;
সূর্য রাজ্যে তাঁর যায় নাকো অস্ত
তার ওপর ফুলে উঠে কারখানা-ব্যাঙ্কে
আয়তনে হারালেন মোটা কোলা ব্যাঙকে।
সবার “হুজুর” তিনি, সকলের কর্তা,
হাজার সেলাম পান দিনে গড়পড়তা।
সদাই পাহারা দেয় বাইরে সেপাই তাঁর,
কাজ নেই, তাই শুধু ‘খাই-খাই’ বাই তাঁর।
এটা খান, সেটা খান, সব লাগে বিদ্ঘুটে,
টান মেরে ফেলে দেন একটু খাবার খুঁটে;
খাদ্যে অরুচি তাঁর, সব লাগে তিক্ত,
খাওয়া ফেলে ধমকান শেষে অতিরিক্ত।
দিনরাত চিৎকারঃ আরো বেশি টাকা চাই,
আরো কিছু তহবিলে জমা হয়ে থাকা চাই।
সব ভয়ে জড়োসড়ো, রোগ বড় প্যাঁচানো,
খাওয়া ফেলে দিনরাত টাকা ব’লে চেঁচানো।
ডাক্তার কবিরাজ ফিরে গেল বাড়িতে;
চিন্তা পাকালো জট নায়েবের দাড়িতে।
নায়েব অনেক ভেবে বলে হুজুরের প্রতিঃ
কী খাদ্য চাই? কী সে খেতে উত্তম অতি?
নায়েবের অনুরোধে ধনপতি চারিদিক
দেখে নিয়ে বার কয় হাসলেন ফিক-ফিক্;
তারপর বললেনঃ বলা ভারি শক্ত
সবচেয়ে ভালো খেতে গরীবের রক্ত। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে –
দুনিয়ায় ক্লান্তি আজ কোথা?
নিঃশব্দে তিমির স্রোত বিরক্ত-বিস্বাদে
প্রগল্ভ আলোর বুকে ফিরে যেতে চায়।
-তবে কেন কাঁপে ভীরু বুক?
স্বেদ-সিক্ত ললাটের শেষ বিন্দুটুকু
প্রখর আলোর সীমা হতে
বিচ্ছিন্ন করেছে যেন সাহারার নীরব ইঙ্গিতে।
কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক।
গোপনে নির্জনে
ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে
পেয়েছিল অতীত বারতা?
মেরুদণ্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায়
বার বার আর্তনাদ করে
আহত বিক্ষত দেহ, -মুমূর্ষু চঞ্চল,
তবুও বিরাম কোথা ব্যগ্র আঘাতের।প্রথম পৃথিবী আজ জ্বলে রাত্রিদিন
আবাল্যের সঞ্চিক দাহনে
চিরদিন দ্বন্দ্ব চলে জোয়ার ভাঁটায়,
আষাঢ়ের ক্ষুব্ধ-ছায়া বসন্তের বুকে
এসে পড়েছিল একদিন-
উদ্ভ্রান্ত পৃথিবী তাই ছুটেছে পিছনে
আলোরে পশ্চাতে ফেলি, দুরে- বহু দূরে
যত দূরে দৃষ্টি যায় –
চেয়ে দেখি ঘিরেছে কুয়াশা।
উড়ন্ত বাতাসে আজ কুমেরু কঠিন
কোথা হতে নিয়ে এল জড় অন্ধকার,
-এই কি পৃথিবী?
একদিন জ্বলেছিল বুকের জ্বালায় –
আজ তার শব দেহ নিঃস্পন্দ অসাড়।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
কাস্তে দাও আমার এ হাতে
সোনালী সমুদ্র সামনে, ঝাঁপ দেব তাতে।
শক্তির উন্মুক্ত হাওয়া আমার পেশীতে
স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি চেতনার বিদ্যুৎ বিকাশঃ
দু'পায়ে অস্থির আজ বলিষ্ঠ কদম;
কাস্তে দাও আমার এ হাতে।
দু'চোখে আমার আজ বিচ্ছুরিত মাঠের আগুন,
নিঃশব্দে বিস্তীর্ণ ক্ষেতে তরঙ্গিত প্রাণের জোয়ার
মৌসুমী হাওয়ায় আসে জীবনের ডাক;
শহরের চুল্লী ঘিরে পতঙ্গের কানে।
বহুদিন উপবাসী নিঃস্ব জনপদে,
মাঠে মাঠে আমাদের ছড়ানো সম্পদ;
কাস্তে দাও আমার এ হাতে।
মনে আছে একদিন তোমাদের ঘরে
নবান্ন উজাড় ক'রে পাঠিয়েছি সোনার বছরে,
নির্ভাবনার হাসি ছড়িয়েছি মুখে
তৃপ্তির প্রগাঢ় চিহ্ন এনেছি সম্মুখে,
সেদিনের অলক্ষ্য সেবার বিনিময়ে
আজ শুধু কাস্তে দাও আমার এ হাতে।
আমার পুরনো কাস্তে পুড়ে গেছে ক্ষুদার আগুনে,
তাই দাও দীপ্ত কাস্তে চৈতন্যপ্রখর-
যে কাস্তে ঝল্সাবে নিত্য উগ্র দেশপ্রেমে।
জানি আমি মৃত্যু আজ ঘুরে যায় তোমাদেরও দ্বারে,
দুর্ভিক্ষ ফেলেছে ছায়া তোমাদের দৈনিক ভাণ্ডারে;
তোমাদের বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা আমার,
শুখু আজ কাস্তে দাও আমার এ হাতে।
পরাস্ত অনেক চাষী; ক্ষিপ্রগতি নিঃশব্দ মরণ-
জ্বলন্ত মৃত্যুর হাতে দেখা গেল বুভুক্ষুর আত্মসমর্পণ,
তাদের ফসল পড়ে, দৃষ্টি জ্বলে সুদূরসন্ধানী
তাদের ক্ষেতের হাওয়া চুপিচুপি করে কানাকানি-
আমাকেই কাস্তে নিতে হবে।
নিয়ত আমার কানে গুঞ্জরিত ক্ষুদার যন্ত্রণা,
উদ্বেলিত হাওয়া আনে মাঠের সে উচ্ছ্বসিত ডাক,
সুস্পষ্ট আমার কাছে জীবনের সুতীব্র সংকেতঃ
তাই আজ একবার কাস্তে দাও আমার এ হাতে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা
ব্যর্থ নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা
দিকে দিকে উদ্যাপন করছে লগ্ন,
পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন।
আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন,
মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ
ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা,
ক্রমশ সফল স্বপ্নের দিন গোনা।
স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য,
বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ!
হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান?
দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান।
বন্ধু, আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী
আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি;
তারই সুত্রপাতকে করেছি সাধন
হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আশংকা নয় আসন্ন রাত্রিকে
মুক্তি-মগ্ন প্রতিজ্ঞায় চারিদিকে
হানবে এবার অজস্র মৃত্যুকে;
জঙ্গী-জনতা ক্রমাগত সম্মুখে৷শত্রুদল গোপনে আজ, হানো আঘাত
এসেছে দিন; পতেঙ্গার রক্তপাত
আনে নি ক্রোধ, স্বার্থবোধ দুর্দিনে?
উষ্ণমন শাণিত হোক সঙ্গীনে৷ক্ষিপ্ত হোক, দৃপ্ত হোক তুচ্ছ প্রাণ
কাস্তে ধরো, মুঠিতে এক গুচ্ছ ধান৷
মর্ম আজ বর্ম সাজ আচ্ছাদন
করুক : চাই এদেশে বীর উৎপাদন৷শ্রমিক দৃঢ় কারখানায়, কৃষক দৃঢ় মাঠে,
তাই প্রতীক্ষা, ঘনায় দিন স্বপ্নহীন হাটে৷
তীব্রতর আগুন চোখে, চরণপাত নিবিড়
পতেঙ্গার জবাব দেবে এদেশের জনশিবির॥
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
সান্ধ্য ভিড় জমে ওঠে রেস্তোরাঁর দুর্লভ আসরে,
অর্থনীতি, ইতিহাস, সিনেমার পরিচ্ছন্ন পথে –
খুঁজে ফেরে অনন্তের বিলুপ্ত পর্যায়।
গন্ধহীন আনন্দের অন্তিম নির্যাস
এক কাপ চা-এ আর রঙিন সজ্জায়।
সম্প্রতি নীরব হল; বিনিদ্র বাসরে
ধূমপান চলেঃ তবে ভবতরী তাস।
স্মৃতি-ভ্রষ্ট উঞ্ছজীবী চলে কোন মতে।জড়-ভরতের দল বসে আছে পার্কের বেঞ্চিতে,
পবিত্র জাহ্নবী-তীরে প্রার্থী যত বেকার যুবক।
কতক্ষণ? গঞ্জনার বড় তীব্র জ্বালা-
বিবাগী প্রাণের তবু গৃহগত টান।ক্রমে গোঠে সন্ধ্যা নামেঃ অন্তরও নিরালা,
এই বার ফিরে চলো, ভাগ্য সবই মিতে;
দূরে বাজে একটানা রেডিয়োর গান।
এখনো হয় নি শূন্য, ক্রমাগত বেড়ে চলে সখ।ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসে, আগমনী পশ্চিমা হাওয়ায়,
সুপ্রাচীন গুরুভক্তি আজো আনে উন্মুক্ত লালসা।
চুপ করে বসে থাকো অন্ধকার ঘরে এক কোণেঃ
রাম আর রাবণের উভয়েরই হাতে তীক্ষ্ণ কশা।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
হাত করে মহাজন, হাত করে জোতদার,
ব্ল্যাক-মার্কেট করে ধনী রাম পোদ্দার,
গরীব চাষীকে মেরে হাতখানা পাকালো
বালিগঞ্জেতে বাড়ি খান ছয় হাঁকালো।
কেউ নেই ত্রিভুবনে, নেই কিছু অভাবও
তবু ছাড়ল না তার লোক-মারা স্বভাবও।
একা থাকে, তাই হরি চাকরটা রক্ষী
ত্রিসীমানা মাড়ায় না তাই কাক-পক্ষী।
বিশ্বে কাউকে রাম কাছে পেতে চান না,
হরিই বাজার করে, সে-ই করে রান্না।
এমনি ক’রেই বেশ কেটে যাচ্ছিল কাল,
হঠাৎ হিসেবে রাম দেখলেন গোলমাল,
বললেন চাকরকেঃ কিরে ব্যাটা, কি ব্যাপার?
এত টাকা লাগে কেন বাজারেতে রোজকার?
আলু তিন টাকা সের? পটল পনেরো আনা?
ভেবেছিস বাজারের কিছু বুঝি নেই জানা?
রোজ রোজ চুরি তোর? হতভাগা, বজ্জাত!
হাসছিস? এক্ষুণি ভেঙে দেব সব দাঁত।
খানিকটা চুপ করে বলল চাকর হরিঃ
আপনারই দেখাদেখি ব্ল্যাক-মাকের্ট করি। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
গন্ধ এনেছে তীব্র নেশায়, ফেনিল মদির,
জোয়ার কি এল রক্ত নদীর?
নইলে কখনো নিস্তার নেই বন্দীশালায়।
সচারাচর কি সামনা সামনি ধূর্ত পালায়?
কাজ নেই আর বল্লাল সেন-ই আমলে,
মুক্তি পেয়েছি ধোঁয়াতে নিবিড় শ্যামলে,
তোমাতে আমাতে চিরদিন চলে দ্বন্দ্ব।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় তীব্র বাঁশির ছন্দ।
মনেরে জাগায় সাবধান হুঁশিয়ার।
খুঁজে নিতে হবে পুরাতন হাতিয়ার
পাণ্ডুর পৃথিবীতে।
আফিঙের ঘোর মেরু-বর্জিত শীতে
বিষাক্ত আর শিথিল আবেষ্টনে
তোমারে স্মরিছে মনে।
সন্ধান করে নিত্য নিভৃত রাতে
প্রতিদ্বন্দ্বী, -উচ্ছল মদিরাতে।। (পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
চিন্তামূলক
|
কাব্যকে জানিতে হয়, দৃষ্টিদোষে নতুবা পতিত
শব্দের ঝঙ্কার শুধু যাহা ক্ষীণ জ্ঞানের অতীত।
রাতকানা দেখে শুধু দিবসের আলোক প্রকাশ,
তার কাছে অর্থহীন রাত্রিকার গভীর আকাশ।
মানুষ কাব্যের স্রষ্টা, কাব্য কবি করে না সৃজন,
কাব্যের নতুন জন্ম, যেই পথ যখনই বিজন।
প্রগতির কথা শুনে হাসি মোর করুণ পর্যায়
নেমে এল (স্বেচ্ছাচার বুঝি বা গর্জায়)।
যখন নতুন ধারা এনে দেয় দুরন্ত প্লাবন
স্বেচ্ছাচার মনে করে নেমে আসে তখনি শ্রাবণ;
কাব্যের প্রগতি–রথ? (কারে কহে বুঝিতে অক্ষম,
অশ্বগুলি ইচ্ছামত চরে খায়, খুঁজিতে মোক্ষম!)
সুজীর্ণ প্রগতি–রথ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উইয়ের জ্বালায়
সারথি–বাহন ফেলি ইতস্তত বিপথে পালায়।
নতুন রথের পথে মৃতপ্রায় প্রবীণ ঘোটক,
মাথা নেড়ে বুঝে, ইহা অ–রাজযোটক॥এই কবিতাটি অরুণাচলকে সুকান্ত পত্রাকারে লিখেছিলেন। রচনার তারিখ ১৩ই কার্তিক ১৩৪৮।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,
জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে,
দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,
প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল।
আহার্যের অন্বেষণে প্রতি মনে আদিম আগ্রহ
রাস্তায় রাস্তায় আনে প্রতিদিন নগ্ন সমারোহ;
বুভুক্ষা বেঁধেছে বাসা পথের দু'পাশে,
প্রত্যহ বিষাক্ত বায়ু ইতস্তত ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে।
মধ্যবিত্ত ধূর্ত সুখ ক্রমে ক্রমে আবরণহীন
নিঃশব্দে ঘোষণা করে দারুণ দুর্দিন,
পথে পথে দলে দলে কঙ্কালের শোভাযাত্রা চলে,
দুর্ভিক্ষ গুঞ্জন তোলে আতঙ্কিত অন্দরমহলে!
দুয়ারে দুয়ারে ব্যগ্র উপবাসী প্রত্যাশীর দল,
নিষ্ফল প্রার্থনা-ক্লান্ত, তীব্র ক্ষুধা অন্তিম সম্বল;
রাজপথে মৃতদেহ উগ্র দিবালোকে,
বিস্ময় নিক্ষেপ করে অনভ্যস্ত চোখে।
পরন্তু এদেশে আজ হিংস্র শত্রু আক্রমণ করে,
বিপুল মৃত্যুর স্রোত টান দেয় প্রাণের শিকড়ে,
নিয়ত অন্যায় হানে জরাগ্রস্ত বিদেশী শাসন,
ক্ষীণায়ু কোষ্ঠীতে নেই ধ্বংস-গর্ভ সংকটনাশন।
সহসা অনেক রাত্রে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে
দেশপ্রেমে দৃপ্তপ্রাণ রক্ত ঢালে সূর্যের সাক্ষাতে।
তবুও প্রতিজ্ঞা ফেরে বাতাসে নিভৃত,
এখানে চল্লিশ কোটি এখনো জীবিত,
ভারতবর্ষের 'পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ-
দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ,
রক্তে আনো লাল,
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল।
উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখর আমার এ দেশ,
আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ।
আজকে মজুর ভাই দেশময় তুচ্ছ করে প্রাণ,
কারখানায় কারখানায় তোলে ঐক্যতান।
অভুক্ত কৃষক আজ সূচীমুখ লাঙলের মুখে
নির্ভয়ে রচনা করে জঙ্গী কাব্য এ মাটির বুকে।
আজকে আসন্ন মুক্তি দূর থেকে দৃষ্টি দেয় শ্যেন,
এদেশে ভাণ্ডার ভ'রে দেবে জানি নতুন য়ূক্রেন।
নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ,
টলোমলো এ দুর্দিন, থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ।
তাইতো রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি
বিক্ষুব্ধ টাইফুন-মত্ত চঞ্চল ধমনী:
বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক
আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠাক।
ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা,
ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের হানা।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
সনেট
|
আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বৎসর বৎসর;
ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টাও আজ অগভীর,
এখন পৃথিবী নয় অতিক্রান্ত প্রায়ান্ধ স্থবির;
নিভেছে প্রদূম্রজ্বালা, নিরঙ্কুশ সূর্য অনশ্বর ;
স্তব্ধতা নেমেছে রাত্রে থেমেছে নির্ভীক তীক্ষ্ণস্বর-
অথবা নিরন্ন দিন, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ;
উদ্ধত বজ্রের ভয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর আনাগোনা,
অনন্য মানবসত্তা ক্রমান্বয়ে স্বল্পপরিসর।
গলিত স্মৃতির বাস্প সেদিনের পল্লব শাখায়
বারম্বার প্রতারিত অস্ফুট কুয়াশা রচনায়;
বিলুপ্ত বজ্রের ঢেউ নিশ্চিত মৃত্যুতে প্রতিহত।
আমার অজ্ঞাত দিন নগণ্য উদার উপেক্ষাতে
অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্চিত করেছে অবিরত
তথাপি তা প্রস্ফুটিত মৃত্যুর অদৃশ্য দুই হাতে।।
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
হাস্যরসাত্মক
|
বিয়ে বাড়িঃ বাজছে সানাই, বাজছে নানান বাদ্য
একটি ধারে তৈরি হচ্ছে নানা রকম খাদ্য;
হৈ-চৈ আর চেঁচামেচি, আসছে লুচির গন্ধ,
আলোয় আলোয় খুশি সবাই, কান্নাকাটি বন্ধ,
বাসরঘরে সাজছে কনে, সকলে উৎফুল্ল,
লোকজনকে আসতে দেখে কর্তার মুখ খুললঃ
“আসুন, আসুন-বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য,
যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য;
মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি।
খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি।”
বর আসে নি, তাই সকলে ব্যস্ত এবং উৎসুক,
আনন্দে আজ বুক সকলের নাচছে কেবল ধুক্-ধুক্,
‘হুলু’ দিতে তৈরী সবাই, শাঁক হাতে সব প্রস্তুত,
সময় চলে যাচ্ছে ব’লে মনটা করছে খুঁত-খুঁত।
ভাবছে সবাই কেমন ক’রে বরকে করবে জব্দ;
হঠাৎ পাওয়া গেল পথের মোড়ে গাড়ির শব্দঃ
হুলুধ্বনি উঠল মেতে, শাঁক বাজলো জোরে,
বরকে সবাই এগিয়ে নিতে গেল পথের মোড়ে।
কোথায় বরের সাজসজ্জা? কোথায় ফুলের মালা?
সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, পালা, পালা, পালা।
বর নয়কো, লাল-পাগড়ি পুলিশ আসছে নেমে।
বিয়েবাড়ির লোকগুলো সব হঠাৎ উঠল ঘেমে,
বললে পুলিশঃ এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন?
পঞ্চাশ জন কোথায়? এ যে দেখছি হাজার জন!
এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে?
থানায় চলো, কাজ কি এখন এইখানে গোলমালে?
কর্তা হলেন কাঁদো-কাঁদো, চোখেতে জল আসে,
গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে।। (মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
স্বদেশমূলক
|
কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী;
আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে
বজ্রের কানাকানি।
সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে
শান্তি পালাল আজ।
দিন ও রাত্রি হল অস্থির
কাজ, আর শুধু কাজ!
জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর
হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর
ওঠে তার গর্জন-
প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!হাজার হাজার শহীদ ও বীর
স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর
ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন।
ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ
কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ঝন্;
প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার,
অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার
দ্বার ভাঙা আজ পণ;
এতদিন ধ’রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ঝন্।
ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
আজো রোমাঞ্চকর;
ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়
কে আছে আজকে ওদের ফিরায়
কে ভাবে ওদের পর?
ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়!
নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে
ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে
ওদের ফিরাব কবে?
কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে
কোটি মানুষের দুর্বার চাপে
শৃঙ্খল গত হবে?
কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে
কোটি জনতার জোয়ারের জলে
ভেসে যাবে কারাগার।
কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার?
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি;
ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে,
বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে
গোপনে করেছে ঋণী।
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি!
হে খাতক নির্বোধ,
রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ!
শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো,
শোনো স্বদেশের ভাই,
রক্তের বিনিময় হয় হোক
আমরা ওদের চাই।।ক্লিক করে দেখুনঃ সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার পাতা
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
মানবতাবাদী
|
বিভীষণের প্রতিআমরা সবাই প্রস্তুত আজ, ভীরু পলাতক !
লুপ্ত অধুনা এদেশে তোমার গুপ্তঘাতক,
হাজার জীবন বিকশিত এক রক্ত-ফুলে,
পথে-প্রান্তরে নতুন স্বপ্ন উঠেছে দুলে ।
অভিজ্ঞতার আগুনে শুদ্ধ অতীত পাতক,
এখানে সবাই সংঘবদ্ধ, যে নবজাতক ।ক্রমশ এদেশে গুচ্ছবদ্ধ রক্ত-কুসুম
ছড়ায় শত্রু-শবের গন্ধ, ভাঙে ভীত ঘুম ।
এখানে কৃষক বাড়ায় ফসল মিলিত হাতে,
তোমার স্বপ্ন চূর্ণ করার শপথ দাঁতে,
যদিও নিত্য মূর্খ বাধার ব্যর্থ জুলুম :
তবু শত্রুর নিধনে লিপ্ত বাসনার ধূম ।মিলিত ও ক্ষত পায়ের রক্ত গড়ে লালপথ,
তাইতো লক্ষ মুঠিতে ব্যক্ত দৃঢ় অভিমত ।
ক্ষুধিত প্রাণের অক্ষরে লেখা, "প্রবেশ নিষেধ,
এখানে সবাই ভুলেছে দ্বন্দ্ব, ভুলেছে বিভেদ ।"
দুর্ভিক্ষ ও শত্রুর শেষ হবে যুগপৎ,
শোণিত ধারার উষ্ণ ঐক্যে ঘনায় বিপদ ॥
|
বিনয় মজুমদার
|
প্রেমমূলক
|
পদ্মপাতার প’রে জল টলমল করে; কাছেকোনো ফুল তো দেখিনা,
সাধ জাগে, – বড়ো সাধ জাগে –
ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলে নিচে
আকাশের অভিমুখী উন্মুখ কুঁড়ি আছে কিনা।
হয়তো সে কুঁড়ি
ফোটবার ইচ্ছায় থেকে থেকে – থেকে থেকে
কোন কালে হয়ে গেছে বুড়ি;
কোন কালে তার সব রূপ গেছে প’চে;
হয়তো বা তার আর নেই কোন লেশ।
সাধ জাগে, বড়ো সাধ জাগে-
ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলে নিচে
এখনো রয়েছে কিনা কোন অবশেষ।
|
বিনয় মজুমদার
|
প্রেমমূলক
|
সময়ের সাথে এক বাজি ধরে পরাস্ত হয়েছি ।
ব্যর্থ আকাঙ্খায়, স্বপ্নে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে যেখানে
একদিন জল জমে, আকাশ বিস্বিত হয়ে আসে
সেখানে সত্বর দেখি ,মশা জন্মে; অমল প্রতূষে
ঘুম ভেঙ্গে দেখা যায় ; আমাদের মুখের ভিতর
স্বাদ ছিল, তৃপ্তি ছিল জে সব আহার্য প’চে
ইতিহাস সৃষ্টি করে; সুখ ক্রমে ব্যথা হয়ে উঠে ।
অঙ্গুরীয় নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো
অনুষ্ণো অনির্বাণ , জ্বলে যায় পিপাসার বেগে
ভয় হয় একদিন পালকের মত ঝরে যাব ।
|
বিনয় মজুমদার
|
চিন্তামূলক
|
X=0
এবং Y=0
বা X=0=Y
বা X=Y
শূন্য 0 থেকে প্রানী X ও Y সৃষ্টি হলো
এই ভাবে বিশ্ব সৃষতি শুরু হয়েছিলো।
|
বিনয় মজুমদার
|
প্রেমমূলক
|
আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো ।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো , তবে
তুমি আর হিন্দু নেই , খৃষ্টান হয়েছো ।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি ।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা ,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই ; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব ?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে ।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে ,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে ,
চিঠি লিখব না ।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায় ।
|
বিনয় মজুমদার
|
প্রেমমূলক
|
কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।
কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল।
সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা,
বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু।
দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়
তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত।
অথবা করেছে ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে।
জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদ্গম হবে না; বিমর্ষ ভাবনায়
রাত্রির মাছির মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা-
হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে।
মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝরে যাবে।
|
বিনয় মজুমদার
|
চিন্তামূলক
|
শিমুল গাছের নিচে গম ক্ষেত দেখলাম আজ।
পুরো গম ক্ষেতটিই বাদামি রঙের, তাতে অন্য রঙ নেই
দেখে দেখে মনে হয় ক্ষেতে গম পেকে গেছে প্রায়।
আমিও পথের মাঝে থেমে প’ড়ে গম গাছগুলি দেখলাম।
বুঝলাম ইউরোপে এবং আমেরিকায় শস্যক্ষেতগুলি এ প্রকার।
আমাদের বাঙলায় ধান ক্ষেত সমূহের ধরন যেমন
গমক্ষেত সমূহের ধরন তেমন নয়, স্পষ্টতই বিদেশি ধরন।
এ যেন ইউরোপের কিয়দংশ দেখছি এখানে
শিমুল গাছের নিচে; এইসব ধান গম মানুষের মেধার ফসল
ধান গম খেয়ে খেয়ে মানুষের হৃৎপিন্ড সচল থাকে এ কথা সকলেই জানি।
|
বিনয় মজুমদার
|
চিন্তামূলক
|
অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্র নয়
লিখিত বিশ্লিষ্ট রূপ গণিতের অআকখময়
হয় না, সে সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত গণিতসূত্রের
নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ ক’রেই বিশ্লেষণ
করা একমাত্র পথ, গণিতশাস্ত্রীয় দর্শনের
বহির্ভূত অতিরিক্ত দর্শন সম্ভবপর নয়।
সেহেতু ঈশ্বরী, দ্যাখো গণিতের ইউনিট
পাউন্ড সেকেন্ড ফুট থেমে থাকে চুপে,
এদের নিয়মাবদ্ধ সততা ও অসততা মনস্তত্ত্বে বর্তমান ইউনিট রূপে
আলোকিত ক’রে রাখে বিশ্বের ঘটনাবলী, চিন্তনীয় বিষয়গুলিকে
সিরিজের কতিপয় টার্মের চরিত্র ফুটে চরিত্র নির্দিষ্ট করে
আগামীর দিকে।
|
বিনয় মজুমদার
|
মানবতাবাদী
|
দেবভাষার ব্যাকরণ অনুসারে মানুষসৃষ্টি করা হয় । দেবভাষার ব্যাকরণ একখানা ‘সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী’ । পাঠক দেখুন দেবভাষায় একটি শব্দ নেই ‘মনোলীন’ শব্দটি নেই । শব্দরা সব দেবদেবী । দেবভাষায় মনোলীন শব্দদেবতাটি নেই । এইবার আমি মনোলীন শব্দটি লিখছি । তাহলে ভবিষ্যতে মনোলীন শব্দদেবতাটি সৃষ্টি হবে – দেখতেহবে মানুষের মতো ।
দেবভাষার ব্যাকারণে ‘গদাধর’ শব্দটি আছে । কিনতু ‘গদাধরা’ শব্দটি নেই । তাহলে ‘গদাধরা’ শব্দদেবীটিকে বানানো সম্ভব । গদাধরা শব্দদেবীটির চেহারা মেয়েমানুষের মতো ।
|
বিনয় মজুমদার
|
প্রেমমূলক
|
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত পস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেগনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল |
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পিভূত হ’য়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমত্স্য, তুমি…তুমি…
কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে ;
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা |
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.