poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
‘Withches in Macbeth are part of the landscape’- Jan Kott
এপারের জঙ্গলগন্ধ অন্ধকারে আমাদের নামিয়ে
অল্প দূরের ব্রিজে বিসর্জনের তুমুল তাসায় এক ঝলক নেচে
রেলগাড়িটার লম্বা দৌড় ওপারের দিকচিহ্নহীনতায়
তারপর সমস্ত শব্দের ঢলে-পড়া ঘুম।
আমরা কেউ ওভারব্রিজের খোঁজে ঘাড় ঘোরাই
কেউ আকাশে যেমন-তেমন একট চাঁদ অথবা চেনা নক্ষত্রের খোঁজে।
আকাশের যে জায়গাটায় চাঁদ থাকার কথা।
নিদেনপক্ষে ছুটকো-ছাটকা ইনভার্টারে জ্বালানো লন্ঠন
ইসকেমিয়ার ঘোলাটে চাউনীতে সব লেপাপোঁছা।
পাহাড়টা কোন্ দিকে? উত্তরে না দক্ষিণে/
কেউ একজন প্রশ্ন করে।
পাহাড়ের আগে শাল-মিছিলে ঘেরা হ্রদ। দক্ষিণে, না উত্তরে?
অন্য কারো জানার ইচ্ছে।
ওভারব্রিজটা সামনে, না পিছনে?
কেউ একজন শুনিয়ে দেয় জবাব:
সব স্টেশনের ওভারব্রিজ থাকে না কিন্তু
অনেক স্টেশন কার্ড-বোর্ডে কাটা মানুষের মতো সমতল।
কে কার সঙ্গে কথা বলছি
বুঝতে পারি শুধু কন্ঠনালীর সৌজন্যে।
দুর্গদেয়ালের মতো অন্ধাকারে আমরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন।
আমাদের বলে দিয়েছিল স্টেশন থেকে নামলেই
লাল মাটির সোজা রাস্তা।
হয়তো আছে, কিন্তু অন্ধকারের দরজায় তো ফুটো নেই কোনোখানে।
আমাদের বলে দিয়েছিল স্টেশনে নামলেই
এক দৌড়ে পৌঁছে দেওয়ার এক্কা।
হয়তো ছিল, কিন্তু এখন তো মূছিত চেতনার মাঝরাত।
হঠাৎ কার যেন মনে পড়ে যায় টর্চের কথা।
টর্চ, টর্চ। টর্চ জ্বালাচ্ছিস না কেন?
নেমে আসি বালি কাঁকরের ঢালু প্রান্তরে,
পথপ্রদর্শক, টর্চের আলোর প্রেতচক্ষু।
ডাইনে আলো পড়ে টর্চের। ওটা কি?
ঝাঁঝরা কঙ্কাল, কোনো এক সময়ের সাতমহল অমরাবতীর।
টর্চের আলো ঘোরে বাঁয়ে। ওটা কি?
সমুদ্র-জাহাজের ভাঙচুর কাঠকাটরা আর নষ্ট নোঙর।
পথ আর পৌছনার মাঝখানে
কী দুঃস্বপ্ন শাসিত ব্যবধান!
মন্ত্র আর আরতির মাঝখানে
গণনাহীন বলির রক্তরেখা।
জন্ম থেকেই তো আমরা এই রকম, ঠিকানাহীন,
কেউ একজন বাতাসে ভাসিয়ে দেয় তার দীর্ঘশ্বাস।
সমস্ত রেলগাড়িই আমাদের বেলায় ছত্রিশ ঘন্টা লেট,
কেউ একজন বুক থেকে নিংড়ে আনে তার কুয়াশা।
হঠাৎ ঝড় উঠলে হয়তো সাড়া পাওয়া যেত লোকালয়ের,
কে যেন ঘাই মেরে উঠল তার বিষন্নতার বুদবুদ সরিয়ে।
রমনীসুলভ হ্রদের কোমর জড়িয়ে শালবনের মাতাল যৌবন
তাকে পেরোলেই সম্রাট মহিমার পাহাড়
আমাদের পৌছনোর কথা সেইখানে।
সেইখানেই বিশ্বস্ত লাল রোদের কেন্দ্রে
আমাদের সবুজ বাংলো রক্তকরবীর বেড়া দিয়ে ঘেরা।
ছেলেবেলার পানের ডাবর থেকে লাফিয়ে-ওঠা কেয়াখয়েরের উল্লাস নিয়ে
বাতাস বুনছে বীজানুহীন অভ্যর্থনা।
টর্চের আলো ঘোরে উত্তরে। ওটা কি?
ঝড়ে উলটোনো মহান বটের মাথামুন্ডুহীণ আধখানা।
টর্চের আলো ঘোরে দক্ষিণে। ওটা কি?
ভূল স্রোতের ফাঁদে-পড়া নদীর অকাল-ধ্বস।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
শোকাভিভূতের ন্যায় বেলা বয়ে যায়।
বিশুদ্ধ গন্ধের মতো কোনো নারী দেখেছো কোথাও?
তার করতলে নাকি কয়ে গেছে মানুষের শোকের ওষুধ?
বাতাসকে এই কথা বলা মাত্র সমস্ত বাতাস
হো-হো হেসে লুটোপুটি খায়
বাগানবিহীন এই কলকাতার দেয়ালে-চাতালে।
ভীষণ ভ্রমের মতো কোনো স্বপ্ন দেখেছো কোথাও?
তার ছায়াতলে নাকি রয়ে গেছে মানুষের সুখের ওষুধ?
মানুষকে এই কথা বলা মাত্র সমস্ত মানুষ
টেরি কেটে ছুটে যায় যে যার নিজের গর্তে
নির্দিষ্ট শ্মশানে।
শোকাভিভূতের ন্যায় বেলা বয়ে যায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
মানুষগুলো ফাঁকা টেবিল পেয়ে গিয়ে
ভর্তি চৌবাচ্চার মতো টলমল।
গেলাসগুলো মানুষগুলো পেয়ে গিয়ে
সাবানের ফেনায় টইটম্বুর।
আসে- আসে- মানুষগুলো হয়ে যায় ফিনফিনে গেলাস
গেলাসগুরো শ্যাগালের ছবির উড়ন্ত ছাগল।
আর টেবিলগুলো মেঘপুঞ্জময় অরন্যের গাছ।
ওয়েটারগুলো ছুটে আসে।
উড়ন্ত গেলাসগুলোকে তারা পেড়ে আনে
চাঁদনীরাতের মগডাল থেকে।
জঙ্গলের গাছ কড়া ধমকানি খেয়ে
আবার হয়ে যায় করাত-কাটা কাঠের টেবিল।
আর মানুষগুলো, যারা এতক্ষণ ছিল গেলাসের,
সোনালী মাছের মতো সাঁতার কাটে
পৃথিবীর হাড়হাভাতে হাওয়ায়।
আগুন নেভানো দমকলের ঘন্টাগুলো চেঁচিয়ে ওঠে
-কে যায়?
-আজ্ঞে আমরা,
জলজ্যান্ত দিনের বেলাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল
খুঁজতে বেরিয়েছি গোটাকতক রাতপেঁচা।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
মানবতাবাদী
|
অনেক বিষয় নিয়ে লেখা হল। তাহলে কি বাকী?
আজকাল ফুলেরাও লজ্জা পায় স্তবস্তুতি শুনে।
আগেকার চেয়ে মশা মাছি মোসাহেব বেড়েছে এখন।
নদী কি বেড়েছে একটিও? অথবা পাহাড়?
বরং আগের চেয়ে স্নেহ ভালোবাসাহীন হয়ে গেছে জল।
বেয়াড়া হয়েছে বটে সাম্প্রতিক দিনকালগুলি।
হৃতসর্বস্বের মতো পার্লামেন্ট ফাঁকা করে রেখে
তার সব চেয়ারেরা মাঠে চড়ে। এবং চনচনে
ভোরের আলোর মধ্যে নেমে আসে চক্রান্ত-গোধূলি।
আমরা মাছটি খাবো। আঁশ খাবে জনসাধারণ।
মহামান্যদের মুখে এই সবচেয়ে শুদ্ধতম সংলাপ এখন।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তুমি বললে, রৌদ্র যাও, রৌদ্রে তো গেলাম
তুমি বললে, অগ্নিকুণ্ড জ্বালো, জ্বালালাম।
সমস্ত জমানো সুখ-তুমি বললে, বেচে দেওয়া ভালো
ডেকেছি নীলাম।
তবু আমি একা।
আমাকে করেছ তুমি একা।
একাকিত্বটুকুতেও ভেঙে চুরে শত টুকরো করে
বীজ বপনের মতো ছড়িয়ে দিয়েছ জলে-স্থলে।
তুমি বলেছিলে বলে সাজসজ্জা ছেড়েছি, ছুঁড়েছি।
যে অরণ্য দেখিয়েছ, তারই ডাল কেটেছি, খুঁড়েছি।
যখনই পেতেছ হাত দিয়েছি উপুড় করে প্রাণ
তবু আমি একা।
তবুও আমার কেউ নও তুমি
আমিও তোমার কেউ নই।
আমাদের অভ্যন্তরে স্রোতস্বিনী আছে, সেতু নেই।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
মানবতাবাদী
|
বাবু মশাইরা
গাঁ গেরাম থেকে ধুলো মাটি ঘসটে ঘসটে
আপনাদের কাছে এয়েছি।
কি চাক্ চিকান শহর বানিয়েছেন গো বাবুরা।
রোদ পড়লে জোছনা লাগলে মনে হয়
কাল-কেউটের গাঁ থেকে খসে পড়া
রুপোর তৈরী একখান লম্বা খোলস।
মনের উনোনে ভাতের হাঁড়ি হাঁ হয়ে আছে খিদেয়
চালডাল তরিতরকারি শাকপাতা কিছু নেই
কিন্তু জল ফুটছে টগবগিয়ে।
বাবু মশাইরা,
লোকে বলেছিলো,ভালুকের নাচ দেখালে
আপনারা নাকি পয়সা দেন।
যখন যেমন বললেন, নেচে নেচে হদ্দ
পয়সা দেবেন নি?
লোকে বলেছিলো ভানুমতির খেল দেখালে
আপনারা নাকি সোনার মেডেল দেন।
নিজের করাতে নিজেকে দু খান করে
আবার জুড়ে দেখালুম,
আকাশ থেকে সোনালী পাখির ডিম পেড়ে
ভেজে খাওয়ালুম গরম ওমলেট,
বাঁজা গাছে বাজিয়ে দিলুম ফুলের ঘুঙুর
সোনার মেডেল দিবেন নি?
বাবু মশাইরা
সেই ল্যাংটোবেলা থেকে বড়ো শখ
ঘরে ফিরবো বুকে সোনার মেডেল টাঙিয়ে।
আর বৌ বাচ্চাদের মুখে
ফাঁটা কার্পাসতুলোর হাসি ফুটিয়ে বলবো-
দেখিস! আমি মারা গেলে
আমার গা থেকে গজাবে
চন্দন গন্ধের বন।
সোনার মেডেল দিবেন নি?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ!
এখন থেকে আমার কবিতায় তুমুল ওলোট-পালট।
আপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন
দমকলের ঘন্টায় বেহদ্দ বেজে বেজে
বহু শব্দের গা থেকে খসে পড়েছে প্লাস্টার এবং পালিশ।
একদিন সোফিয়া লোরেনের মতো মার কাটারি ছিল যে সব শব্দ
এখন গ্রন্থাবলীর অলিতে গলিতে তাদের হিঁজড়ে-নাচ।
অনেক সম্ভাবনাময় শব্দ এখন পয়লা নম্বেরের বখাটে
সেইসব আনুনো কলমের পাল্লায় পড়ে,
শব্দের পালকিতে চেপে
যারা কোনোদিন বেড়াতে যায়নি ময়ূরভঞ্জের মেঘে।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ!
এখন থেকে আমার কবিতায় বাগান দেখলেই বুঝবেন,
আমি বলতে চাইছি সূর্যসম্ভব সেই ভবিষ্যতেই কথা
যার ব্লু-প্রিন্ট এখনো অন্ধকারের লালায় জবজবে।
আমি কাঁকড়া লিখলেই বুঝবেন
আমার আক্রমণের লক্ষ্য সেই সব মানুষ
কুলকুচির পরও রক্তকণা লেগে থাকে যাদের মাড়িতে।
শোষণের বদলে আমি লিখতে চাই গন্ডুষ
কবির বদলে নুলিয়া
এবং নারীর বদলে চন্দনকাঠ।
আগুনের খর-চাপে মানুষের মগজ থেকে গলে পড়ছে মেধা
অথবা অতিরিক্ত মেধার চাপেই
রক্তছাপে ভরে যাচ্ছে পৃথিবীর গুহসে’র সাদা দেয়াল।
এই নষ্ট ভূ-দৃশ্যমালার দিকে তাকিয়ে আমাদের উচিত
ভাগাড় শব্দটিকে এমন সম্ভ্রান্ত ভঙ্গীতে উচ্চারণ করা
যেন কঠোপনিষদের কোনো মন্ত্র।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
শিল্পের শৃঙ্খলা ভেঙে, নৈতিকতা ভেঙে
তুমি যদি বায়ুমুখ নৈরাজ্যের কুহকে বাঁকিয়ে
নিজের সিদ্ধিকে ভাবো সভ্যতারই আরও উত্তরণ
বিরুদ্ধাচরণ ব্রত হবে।
যে গেলাসই জল দেয়
ছুঁড়ে ভাযো, অথচ তোমার
জল চাই মুহুর্মুহু,
জল চাই, জলস্তম্ভ চাই।
সমস্ত গেলাস ভেঙে, জলাধার ভেঙে
যদি চাও নিরাপদ সমুদ্র-শোষণ,
বিরুদ্ধাচরণ ব্রত হবে।
তোমার মোহর থেকে ঝলসানো সাফল্য ও সুখ
যে কেনে কিনুক।
আমি শ্রমে অকাতর, আমার নির্মাণ
পেশী পক্ষপাতী।
আমি জানি সৃজনের ভিতরের নিঃশব্দ দহন।
তুমি যদি আগুনের শিখা ও শিকড়
পুষতে চাও পকেটে, লাইটারে
বিরুদ্ধাচরণ ব্রত হবে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
বইয়ের উপর থেকে ধুলো মুছে নিলে
আরো ধুলো রয়ে যায় অক্ষরের স্থাপত্যকে ঘিরে।
ফলে ব্যাঙই সাপ খায় গিলে।
মানুষ যেযার মতো চোখে-ধুলো ব্যাখ্যা দিতে জানে,
সূর্য, শিল্প, শ্রম, শান্তি, শস্য বা সংহতি
আগুন-বীজের মতো এইসব মহাপ্রাণ শব্দেরও সহজতর মানে।
মঞ্চ থেকে যে-মুহূর্তে প্রেরণার যোগ্য সম্ভাষণ
বসন্তের বিস্ফোরণ বাতাসের শিরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
কুঠার চিহ্নকে মুছে যুবক-যুবতী সাজে বন।
সে শুধু ঋতুর মতো আসা-যাওয়া, থেকে যাওয়া নয়।
সময়ের ঝাঁট দেওয়া ধুলোর পরত জমে জমে
মানচিত্র পোকা-খাওয়া, বিশ্বাসের অবিশ্বাস্য ক্ষয়।
পাহাড় গন্তব্য ছিল, অবশেষে নুড়ি ঘেঁটে ফেরা।
বিকেলের চশমায় নিশুতি রাতের কালো ছোপ,
অভিযানযোগ্য পথ ইজারা নিয়েছে গহ্বরেরা।
আলো আসে, আলো চলে যায়।
জল থাকে, খুঁটি ধরে টেনে রাখে উচ্ছৃঙ্খল জল,
নিরীক্ষণ স্থির হতে পারে না ডাঙায়।
ফুল্লরার বারমাস্যা, চতুর্দিকে সংকটই সম্রাট।
এত যে রচনাপর্ব, দোয়াতে রক্তের কালি, রক্তিম বিষয়ে আলোচনা
এসবই কি ধুলোর মলাট?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
মানবতাবাদী
|
একটি কিশোর তার চ্যাটালো হাতের টানে আগাছা উপােয়
তার বৌ মরাছেলে কাঁখে নিয়ে ধান ভানে তিনবেলা উপোসের পর
একটা মাটির হাঁড়ি একমুঠো চাল পেয়ে দশজনের ফ্যান-ভাত রাঁধে
এই দৃশ্য ৭নং শারদীয় উপন্যাস হবে না কখনো।
৭নং শারদীয় উপন্যাস হতে গেলে কি কি থাকা চাই
৭নং শারদীয় উপন্যাস লিখতে পারে কে কে কুসি-গীর
তার জন্য কমিটি ও কমিটির প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ম্যানেজার আছে
কার্পেট-রাঙানো ঘরে ক্লোজ-ডোর কনফারেন্স আছে।
মানুষ ভীষণ দুঃখে আছে, আহা, বড় কষ্টে আছে
বদ্যিনাথবাবু, আপনি রামধনু গুলে এই দুঃখ কষ্ট ঘোচাতে পারেন?
আপনার খিচুড়িটা শশীবাবু, গতবারে ঈষৎ আনুনো হয়েছিল।
আপনি কি সেকসের মধ্যে ধম্মোটম্মো মেশাবেন সখারামবাবু?
মধুবাবু, আপনি তো কেল্লা ফতে করেছেন গতবারে ন্যাংটো নাচ নেচে।
পাঁচকড়িবাবু, আপনি এবারে পাড়-ন তো একটা ইয়া বড় মাকড়সার ডিম।
এমন ক্লাসিক কিছু রচনা করুন যাতে কোনোরূপ মোদ্দাকথা নেই।
একটি শ্রমিক তার ফাটা প্যান্ট খুলে রেখে ছেঁড়া লুঙি পরে
তার বৌ একমাথা উকুন চুলকিয়ে নিয়ে বেচতে যায় ঘুঁটে
উনোনের পাড়ে বসে একগুচ্ছ মরা হাড় আগুনের স্বাদ খুঁটে খায়
৭নং উপন্যাস জীবনের এইসব ভাঙচুর লিখে ফেলে যদি
৭নং উপন্যাসে হঠাৎ ঘামের সঙ্গে রক্ত মিশে অগ্নিকাণ্ড ঘটে যায় যদি
৭নং উপন্যাস যদি সব জাহাবাজ ঈশ্বরের খড়ে ও দড়িতে মারে টান
সেই ভয়ে ছয়খানা উপন্যাসে তৃপ্ত হয়ে আছে পুরু শারদীয়াগুলো।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
ধুপকাঠি বেচতে বেচতে কতদুর যেতে পারে একাকী মানুষ?
তাকে তো পেরোতে হবে বহু বন, বহু অগ্নি খাণ্ডব দাহন।
কিছু বন চিনি আমি, পেঁচারা যেখানে বসে কেবলই ধ্বংসের কথা বলে
মগডালে পা ঝুলিয়ে মড়কের হাসি হাসে উলঙ্গ বাদুড়।
দ্বাদশী চাঁদের চেয়ে কয়েকটা চিতাবাঘ পেলে তারা বড় খুশী হয়।
কিছু গাছ চিনি আমি, যাদের মজ্জায় রক্তে রয়ে গেছে আদিম সকাল।
বাইসনের মুন্ডু ছাড়া আর কোনো উৎসবের নাচ যারা দেখেনি কখনো
কিছু গাছ চিনি, যারা এখনো শোনেনি কিংবা শুনে ভুলে গেছে
পৃথিবীতে প্রেম নামে একটা শব্দের চাবি কত দরজা খোলে
অহংকার শব্দটিকে ঘিরে কত বাউন্ডুলে নক্ষত্রেরা আগুন পোহায়
বিষাদ শব্দের মধ্যে বয়ে যায় কি রকম আত্মঘাতী সাদা ঝর্ণাজল।
তারা শুধু কয়েকটি চৌকিদার ও দারোগাকে চেনে চেনে
কিছু শিকারীকে, বন্দুকের নল, কিছু আহত পাখির সরু ডাক।
কাড়া নাকাড়ার চেয়ে আর কোনো মর্মস্পর্শী সুর তারা শোনেনি কখনো।
মানুষ একাকী হেঁটে পার হবে অরন্যের আগুনে গহবর
প্রতিভার মতো আলো, মেধার মতন খর রোদে
পৃথিবীকে প্রসারিত করে দেবে বহুদুর পর্বত সিন্ধুর পরপারে
এমন পথিক তারা কখনো দেখেনি, দেখে অট্রহাসি হাসে।
এই সব আহাম্মক গাছ মারা গেলে
কাঠ হয়, ইস্কুলের বেঞ্চি হয়, ব্ল্যাক বোর্ড, জলচৌকী হয়।
ইলেকট্রিক টাঙানোর খুঁটি হয় মাঠে খালে বিলে
ঘুণে জর্জরিত হয়, খসে খসে পচে মাটি হয়।
ধুপকাঠি বেচতে বেচতে যারা একা পৃথিবীর আঁশটে গন্ধ কাদাজলে হাঁটে
মৃত্যুর পরেও তারা কিছুকাল, চিরকাল বেঁচে থাকে স্মরণীয়তায়
মৃত্যুর পরেও বুদ্ধ যেরকম বেঁচে আছে বোধে, সাঁচীস্তুপে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে যেন কিসের গল্প বলবো বলেছিলাম?
গাছের, না মানুষের?
মানুষের, না সাপের?
ওঃ, হ্যাঁ মনে পড়েছে।
গাছের মতো একটা মানুষ।
আর সাপের মতো একটা নারী
কুয়াশা যেমন খামচা মেরে জড়িয়ে ধরে কখনো কখনো
দুধকুমারী আকাশকে
সাপটা তেমনি সাতপাকে জড়িয়ে ধরেছিল গাছটাকে।
আর গাছটাও বেহায়া।
লাজ-লজ্জা, লোক-লৌকিকতা ভুলে গিয়ে
নৌকা ডুবে যাচ্ছে, এখুনি ঝাঁপ দিতে হবে
নদীর নাইকুন্ডুতে,
এমনি ভাবেই সর্বস্ব ভাসিয়ে দিল সাপের হাতে।
আর তারপরেই ঘটল আজব কাণ্ডটা।
সাপের ছোবলে ছিল বিষ। নীল।
গাছের শিকড়ে ছিল তৃষ্ণা। লাল।
ছোবল খেতে খেতে ছোবল খেতে খেতে
নীলপদ্মে ভরে উঠল গাছ।
আর গাছের আলিঙ্গনে
গুড়ো হতে হতে গুড়ো হতে হতে
সেই শঙ্খচুড় সাপটা
আলতা-সিদুরে রাঙা বিয়ের কনে।
আর এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে
আকাশের আইবুড়ো নক্ষত্রগুলো
হেসে গলে গা ঢলাঢলি করে বলে উঠল
আজ সারা রাত জাগব ওদের বাসর।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
চৌকো অ্যাসট্রের ভিতরে
মাঝে মাঝে ঘটে যায় গোল অগ্নিকাণ্ড।
একটা আধমরা সিগারেট
দশটা মরা সিগারেটের সঙ্গে ফিসফিস
তারপরই এগারো নুর সিগারেট
আগুনের জামা পরে
রক্তমাখা সেনাপতির মতো জেগে ওঠে
ছাই ভম্মের ময়দানে।
সোফায় হেলান দেওয়া মানুষটি
অথবা
গম্মুজে হেলন দেওয়া মানুষগুলো
কোনো না কোনো সময়ে ভুল করবেই।
আর তখনই
চৌকো অ্যাসট্রের ভিতরে
গোল অগ্নিকাণ্ড।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
তোমাদের মনে হতে পারে ছেলেখেলা, ইয়ার্কি ফাজলেমির নশ্বরতাও হয়তো বা,
কিন্তু এই বুদবুদগুলো প্রকৃতপক্ষে আমার নিজস্ব অহঙ্কার!
হাওয়া, যে-কোনো ওড়াউড়িময় সৃষ্টির সম্পর্কে বিরুদ্ধতার জন্যে যে বিখ্যাত,
সরাসরি তার সঙ্গে এক গোপন পাঞ্জার লড়াইও বলতে পারো এটাকে।
সেই কারণেই আমার হাতের এনামেল বাটিতে সাবান জল
আর এখন আমি এই পাহাড়-সদৃশ হাসপাতালের খৃষ্টপূর্ব প্রাচীনতার সামনে
যার খোপে খোপে মৃত্যুর শৈশবের দিকে
শৈশবের মৃত্যুর দিকে যবনিকাহীন যাতায়াত।
এই বুদবুদগুলো শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌছবে আমার জানা নেই
কিন্তু এদের উদ্দেশ্য এবং উপকারিতা সম্বন্ধে আমি শতকরা নিরানব্বই ভাগ সজাগ।
এই রঙীন অহঙ্কারময় খেলাটি আমি আশ্চর্যভাবে শিখে যাই বাল্যকালে
বাল্যকালের পক্ষে যে-সব গল্প প্রবন্ধ কবিতা উপন্যাস ছবি এবং গান অপরাধমূলক
তার প্রত্যেকটির মধ্যেই আমি দেখতে পাই এই সাবান জল
আর সাবানা জলের উপরে ঝুকে পড়া সেই সব মানুষদের
যাদের ক্ষতবিক্ষত মুকের ভাস্কর্য-রেখার উপরে, সমকালীন নয়,
ভবিষ্যৎ শতাব্দীর সুর্যরশ্মি অভ্যর্থনার আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত।
বস্তুত এই সাবান জল আমি পেয়ে গেছি একপ্রকার উত্তরাধিকারসূত্রেই
এখনকার এই বুদবুদগুলোই শুধু আমার।
ভ্রাম্যমান অক্ষর!
যাও, আকাশে একটা নতুন এলাচ-গন্ধের দ্বীপ গড়ে এসো।
ভ্রাম্যমান অক্ষর!
ঐ বিশ্বাসহীন যুবকটিকে বলে এসো আকাঙ্খারই অন্য নাম জীবন।
ভ্রাম্যমান অক্ষর!
অসহ্য রক্ত-প্রবাহের পিছনে যে বিশ্বাসঘাতক অস্ত্র
তাকে জানিয়ে দাও একদিনএর প্রতিশোধ নেবে যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর সব গোলাপ ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আকাশে বাতাসে তুমুল দ্বন্দ্ব
কে আগে কাড়বে যূথীর গন্ধ
কার হাতে বড় নখ।
স্বর্গে মর্তে যে যার গর্তে
যূথীকে গলার মালায় পরতে
ভীষণ উত্তেজক।।
মেঘের ভঙ্গী গোঁয়ার মহিষ
রোদ রাগী ঘোড়া, সুর্ঘ সহিস,
বজ্র বানায় বোমা।
বিদ্যুৎ চায় বিদীর্ণ মাটি
গাছে গাছে খাড়া সড়কি ও লাঠি
নদী গিরি বন ভয়ে অচেতন
থ্রম্বসিসের কোম।।
আকাশে বাতাসে তুমুল যুদ্ধ
যে যার গর্তে ভীষণ ক্ষুদ্ধ
নখে ধার, মুখে গ্রাস।
কেবল যূথীই জানে না সঠিক
কে তার পরমাশ্চর্য প্রেমিক
চোখে জল, বুকে ত্রাস।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমার কাছে চেয়েছিলাম অনির্বচনীয়তা
দাওনি।
আকাশ ভর্তি মেঘ করেছে, মেঘের হাতে তানপুরা
গাওনি।
পায়ের কাছে পৌঁছে দিলাম নৌকা বোঝাই বন্দনা
দাওনি।
গোপন কথা জানিয়েছিলাম, দুত ছিল রাজহংসেরা
পাওনি।
চাইবে বল রক্তকমল ভিজিয়ে দিলাম চন্দনে
চাওনি।
তোমার কাছে চেয়েছিলাম অনির্বচনীয়তা
দাওনি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূণ্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।
অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসন ঘন্টা শাঁখের উলু
একশ বনেরবাতাস এস একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।
তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি।
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীল।
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
ব্যঙ্গাত্মক
|
একটি উজ্জ্বল ষাঁড় লিফটে চেপে উর্ধ্বে উঠে যান,
তখনই বন্দনা গান গেয়ে ওঠে, একপাল কৃতার্থ ছাগল।
জুলিয়াস সীজারের মতো তিনি, মিশরের ফারাও এর মতো
যেন এই শতাব্দীর তরুণ-বয়সী এক নবতম আলোকজান্ডার
পাতলা ক্রীমের মতো বুদ্ধের মহন হাসি মুখে
চেঙ্গিস খানের মতো চোখে বহুদূর
স্বপ্নের রক্তাক্ত সিড়ি, যেন জেনে দিয়েছেন তিনি
ভূ-মধ্যসাগর এসে পায়ে পড়ে হবে পুষ্করিনী।
প্রভু! কোনো দৈববাণী দেবেন কি আজ?
কোনো ধন্য সার্কুলার? অথবা সুসমাচার টাইপরাইটারে?
বিশ্বস্ত বাদুড়বৃন্দ এইভাবে নিজেদের ল্যাজের চামরে
নিভৃতে আরতি করে যায়।
একটি উজ্জ্বল ষাঁড় মেহগনি কাছের মস্ত সিংহাসনে, একগুচ্ছ চাবি
খুলে যান সারি সারি প্রয়ার, ফাইল, খোপ-ঝোপ
যুদ্ধের ম্যাপের মতো দেগে যান রণক্ষেত্র আর আক্রমণ
তুরী-ভেরী জগঝম্প বাজে টেলিফোনে।
আমি চাই না লাল কালিদিয়ে কেউ কবিতা লিখুক।
আমি চাই না কারো ঘাড়ে আলোকশিখার মতো দর্পিত কেশর।
ধ্রুবতারা ভালোবেসে, ভালোবেসে বেহুলার ভেলা
গাছের শিকড় থেকে খোলা হাওয়া পেড়ে আনে যারা,
যাদের হৃৎপিণ্ড জুড়ে জেগে আছে সমুদ্রের শাঁখ
আমি চাই তারা সব ইদুরের গর্তে বসে খঞ্জনী বাজাক।
একটি উজ্জ্বল ষাঁড় এইভাবে পেয়ে গেছে তুরুরে সবকটি তাস।
শুনেছি এবার তিনি নক্ষত্রমণ্ডলে
সত্তর বিঘের মতো জমি কিনে করবেন আলু-কুমড়ো পটলের চাষ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
মানবতাবাদী
|
তোমাদের প্রত্যাশাকে এখনো পরিয়ে দিতে পারিনি
ঠিক রঙের জামা,
দিগন্তের যেদিকে আঙুল দেখিয়েছিলে
তোমাদের পতাকা
এখনো পৌঁছিয়ে দিতে পারিনি সেখানে।
হাঁটতে হাঁটতে হাঁপ ধরেছে বুকে
গোপন চুরির ঘাগুলো এখনো দগদগে।
একটু জিরোচ্ছি।
এইতো ঘুম ভাঙল আকাশের
চোখে এখনো পিচুটি।
মুখ ধুয়ে, দাঁত মেজে, আলোয় কুলকুচি করে
ঠিকঠাক হয়ে নিক।
অরশ্যের শাঁখ বাজুক বাতাসে।
এইখানে, এই মুখো-ঘাসের মাদুরে
নিজেকে উলঙ্গ করে দিয়েছি আমি।
প্রত্যেক রোমকুপের ভিতর দিয়ে ঢুকে যাক
সাদা শিশির আর
লাল রোদ।
তারপর তোমাদের পতাকা এবং প্রত্যাশাকে
পৌঁছে দেবো।
ঠিক-মানুষের দরজায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
১
কে ডাকল? দরজা খুলি। কেউ নেই। পাতাবাহারের
ডালে-ডালে লুটোপুটি হাওয়ার হাসির খিলখিল।
হঠাৎ তোমার মুখ। বুকভর্তি দুপুরের খাঁ খাঁ।
বলো, কেন ভাঙলে নির্বাসন?
২
নিজের ব্যথার ছুঁচে নিজে আমি সেলায়ে-সেলায়ে
নকশি কাঁথার মতো। চতুর্দিকে প্রাণের প্রাণীর
প্রাত্যহিক দিনলিপি। প্রত্যেকের নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে
মুহূর্তে-মুহূর্তে কাঁপা। একেই কি বলে সংলগ্নতা?
৩
উত্তরবঙ্গের জল, স্বদেশে ভাসানো বন্যজল!
রিলিফের নৌকো, দেখতে এত সাধ? সর্বস্ব হারানো
এক বাটি অন্নে নুয়ে, এ দৃশ্যে তো খল খল হেসেছ অনেক।
আর কোন ধ্বংসদৃশ্য, বলো, দেখে জিঘাংসা জুড়োবে?
৪
উড়ছে খরার ভস্ম উত্তরভারতে। ট্রেনে ট্রেনে
নিদ্রাহীন দেখে ক্লিষ্ট যার চোখ, সে কবিকে বলো
কিছু লিখে দিতে। জানি। প্রতিবেশী তারাও জানুক
কত খরা মুছে মুছে ছিড়ে গেছে আমাদেরও আঁচলের পাড়।
৫
শীতের পোশাকহীন বালিকার নগ্নশরীরের
হিহি কাঁপা, এই দৃশ্যে মানুষের দিনলিপি পড়ে নেওয়া যায়।
মাইকেলএঞ্জেলো এত গড়ে গেল পাথরে-পাথরে,
তবুও মানুষ তাঁর ভাস্কর্যের চেয়ে ঢের ম্লান রয়ে গেল।
৬
মেঘ-পঞ্চায়েত থেকে রিলিফের দুর্গত অঞ্চলে
রোদের কম্বল, খান, ত্রিপল কত কী পৌছে গেল।
ডাকবাকসে উপছে পড়ে খাম তবু, পোস্টকার্ড তবু।
অক্ষরের পরিবর্তে আর্তস্বর। বলো, কী লিখেছে?
৭
ডাকো, কাছে ডাকো, ডেকে বলো কী কী চাই।
বৃষ্টি চাও? বৃষ্টি পাবে জুই ফুল খসানো খরায়।
নাকি চাও কলমের কান্না মুছতে ব্লটিং পেপার?
শীতের চাদর? আমি কাঁথা বুনছি শোকের সুতোয়।
৮
মৃত্যু এসেছিল। তাকে একটু বোসো বলে সত্যবান
কাঠ কাটতে চলে গেল। আমিও তোমাকে সেইভাবে
চেয়ার এগিয়ে দিয়ে চলে যাবো চিরন্তন শিমূল-ছায়ায়।
তুমি কী সাবিত্রী হবে? ভালোবাসা? বলো, শুনে বাঁচি।।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিলো মেঘকে
আর মেঘ কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।
সেদিন ছিলো পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে
– আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।মেঘ পাহাড়কে বললে
– আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।
ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনের আগুনে
পাহাড় ছিলো মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠলো ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাই এর ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
– ওঠ্ ছুঁড়ি! তোর বিয়ে ।এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেলো ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিন ভুলতে পারলনা।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতে পারো
পাহাড়টার হাড়-পাঁজর,
ভিতরে থৈথৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
অন্ধকার ছিলে বুঝি?
গাছের আড়ালে ছিলে, গর্তে ছিলে
ভিজে খড়ে জড়াজড়ি ছিলে?
মাথাভর্তি লণ্ডভণ্ড চুল।
সারা গায়ে রক্তের আঁকচারা।
যুদ্ধে ছিলে, সেনাপতি ছিলে?
এখনও তোমার চোখে আগুনের ছাই
প্রকাণ্ড কপাল জুড়ে থাকে থাকে
গুপ্ত অস্ত্রাগার।
বহুদিন পরে দেখা তবুও তোমাকে ঠিক অভিমন্য বলে
চেনা যায়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
রাত্রিবেলা বুকের মধ্যে একগোছা বৈদ্যুতিক তার
আর নীল রঙের একটা বালব টাঙিয়ে রাখা ভালো।
অন্ধকারে গায়ে নীল রঙের জামা পরিয়ে দিলে
স্বপ্ন দেখার দরজা খুলে দেয় সে।মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক খাটে
স্বপ্ন দেখার আলাদা কোনো বিছানা-বালিশ নেই।
অবিকল স্বপ্নের মতো নারীরও শুয়ে নেই কোনো খাটে।স্বপ্নের মধ্যে ছাড়া আর কোথায়
আকাশময় উলুউলু?
গায়ে-হলুদের গন্ধে আকাশ পাতাল জুড়ে ফুলশয্যা?
স্বপ্নের মধ্যেই বুক-পিঠের অসুখ-বিসুখে সরিয়ে
অবিরল জলপ্রপাতে অবিবেচকের মতো কেবল ঝরে যাওয়া
নানান নদীতে।স্বপ্নেই শুধু দ্বিতীয়বার ফিরে পাওয়া যায় শৈশব।
সব ধুলোবালি খোলামকুচি, সব উড়ে-যাওয়া আঁচল
রঙীন পরকলা জুড়ে জুড়ে আঁকা সব মুখচ্ছবি
বৃষ্টি বাদলের ভিজে গন্ধের ভিতরে লুকিয়ে কাঁদার সুখ।
স্বপ্নেই শুধু আরেকবার অগাধ জলের ভিতর থেকে
মুখ তুলে তাকায় ছেলেবেলার লাল শালুক।মোহিনী কলসগুলি যতদূর ভেসে যেতে চায়
ততদূর স্বপ্নের বিছানা।আরও দেখুনঃ পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল।
যাচ্ছি যাব, যাচ্ছি যাব এই গড়িমসি করে চূড়ো ভাঙা চাকা ভাঙা রথ
যে রকম ঘাড় গুজে ধুলোয় কাতর, সে রকমই শুয়ে বসে আছে।
খেয়াঘাটে পারাপার ভুলে-যাওয়া, নৌকার মতন, সময় এখন।মনে হয় সময়ের পায়ে ফুটে গেছে দীর্ঘ পেরেক বা মনসার কাঁটা
ছিড়ে গেছে স্ম্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ কিংবা জুতোর গোড়ালি
মনে হয় তার সব কোটপ্যান্ট ধোবার ভাটিতে
হয়তো বা কোনও এক লেকা্যাল ট্রেনের হু হু ভিড়ে
চুরি হয়ে গেছে পার্স, পার্সে ছিল অগ্রিম টিকিট।প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নিয়ে যাবে পাহাড়ের সোনালী চূড়োয়
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আকাশের সিথি থেকে সিদুরের টিপ এনে দেবে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নক্ষত্রের ক্যামেরায় ছবি তুলে উপহার দেবে অ্যলবাম
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কলকাতায় এন দেবে শঙ্খের সাগর।প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়াবার ছিটোবার কথ, থুতু, মলমুত্র নয়
প্রতিশ্রুতি লাল নীল পতাকার ব্যতিব্যস্ত ওড়াউড়ি নয়
প্রতিশ্রুতি প্রেসনোট, দৈববাণী, দেয়ারের লিপিচিত্র নয়।
প্রতিশ্রুতি শীতের চাদর
প্রতিশ্রুতি ভাঙা চালে খড়
প্রতিশ্রুতি সাদা ভাত, ভাতে দুধ, দুধে ঘন সর
প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।হে সময়, হে বিকলাঙ্গ বিভ্রান্ত সময়
কানা কুকুরের মতো এটো-কাটা ঘাঁটাঘাঁটি ভুলে
পৃথিবীর আয়নায় মুখ রেখে জামা জুতো পরে
সূর্যের বল্লম হাতে, একবার অশ্বারোহী হও।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
একমুঠো জোনাকীর আলো পেয়ে
এক একটা যুবক হয়ে যাচ্ছে জলটুঙি পাহাড়
যুবতীরা সুবর্ণরেখা।
সাপুড়ের ঝাঁপি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী
পুজো সংখ্যা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী।
একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
ময়দানের মঞ্চে একমুঠো জোনাকী উড়িয়ে
জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল যেন কারা।
রবীন্দ্রসদনে তিরিশজন কবি তিরিশদিন ধরে আউড়ে গেল
একমুঠো জোনাকীর সঙ্গে তাদের ভাব-ভালোবাসা।
ইউনেসকোর গোল টেবিল ঘিরে বসে গেছে মহামান্যদের সভা
একমুঠো জোনাকীর আলোয়
আফ্রিকা থেকে আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত হোগলা বন আর ফাটা দেয়ালে
সাজিয়ে দেবে কোনারক কিংবা এথেন্সের ভাস্কর্য।
সাত শতাব্দীর অন্ধকার এইভাবে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজি দেখিয়ে চলেছে একমুঠো জোনাকীর আলোয়।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
বৃষ্টি এলে ষোলো বছর বয়সটা ভিজতে ভিজতে
ফিরে আসে আবার।
পায়ের তলায় বন্যার জল, রুপোর মল পরা ঢেউ
মখমল মাটি, শামুক, কাটা, পায়ের রক্তের দাগ,
সব ফিরে আসে আবার।
কার যেন ভিজে চুলের ডাকাডাকি, আকাশময়
যেন একটাই কাজর-পরা চোখ।
চাঁপা ফুলের গন্ধ পুড়তে থাকে দুপুরবেলার রোদে
আমি তার হাহাকারের হাত ধরে ঘুরে বেড়াই।
সেই হাহাকার কতবার তোমার ভেজানো ঘরের দরজার
শিকল ধরে দিয়েছে টান
আঁচলটুকু ধরতে দিয়ে বাকি সব লুকিয়ে রাখতে
লজ্জার কৌটোয়,
চোখের আয়নায় একটু মুখ দেখতে দিয়ে বাকি সব।
সেন্টমাখানো রুমাল কোমরে গুঁজে
স্বপ্নে বেড়াতে আসতে রোজ ।
স্বপ্নে আঁচলহীন ছিলে তুমি।
স্বপ্নে লজ্জাহীন ছিল গোপন চিঠির খসড়াগুলো।
দিনের আলোয় তাদের অশ্নীলতা
ছেঁড়া পাতা হয়ে উড়ে যেতো বাজবরণের ঝোপে।
বৃষ্টি এলে ষোলো বছর বয়সটা ফিরে আসে আবার
আবার আকাশময় এক কাজলপরা চোখ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
গত মাসের কাগজে আমাকে ঘোষণা করা হয়েছে
মৃত।
একাধিক ময়না তদন্তের রিপোর্ট ঘেটে ঘেটে
ওরা খুজেছে লেবুপাতার গন্ধ
আর রুপোলী ডট পেন।
যেহেতু লেবুপাতার গন্ধেই আমি প্রথম পেয়েছিলাম
পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার স্বাদ।
আর ঐ রুপোলী ডট্ পেন আমাকে শিখিয়েছিল
অক্ষর দিয়ে কিভাবে গড়তে হয় শাখা-প্রশাখাময় জীবন।
গত মাসের কাগজে মৃত ঘোষনার পরেও
ওরা কিন্তু তন্ন তন্ন খুঁজে বেড়াচ্ছে
পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত দামাল শালবন।
ওদের বুট জুতোয় থ্যেৎলে যাচ্ছে
সুর্যকিরণে জেগে ওঠা জল,
মানুষের মধ্যে যাতায়াতকারী সাঁকো।
আমি এখন উদয় এবং অন্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।
সাত বছর সাঁতার কাটিনি সমুদ্রের নীল শাড়ির আমিষ অন্ধকারে
দশ বছর আগে শেষ ছুয়েছি পাহাড়ের স্তনচূড়া
মাদল বাজিয়ে কতবার ডেকেছে হৈ-হল্লার জঙ্গল, যাইনি।
আলজিভে উপুড় করে দিয়েছে মাতাল-হওয়ার কলসী, খাইনি।
যাবার মধ্যে গত ডিসেম্বরে সাঁচী
হাজার বছর পরে আবার দেখা যক্ষিনীদের সঙ্গে, হাসি ঠাট্টা-গল্পো।
কিন্তু নেলকাটার তো তারা নেবেনা।
সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।
বেনারসী পরে মেধ নামবে ছাঁদনাতলায়
সর্বাঙ্গে আলোর গয়না,
অথচ আমার আলিঙ্গন করা বারণ।
ছুলেই তো রক্তের ফিনকি, করকরে ঘা।
যে শাঁখ বাজিয়ে কাল বলেছে-এসো
সে ঢাক বাজিয়ে আজ বলবে- যা।
আমাকে এবার খুঁজতে হবে একটা ন্যড়া মাথা নদী
তারই বালিতে বাঘছালের মতো বিছিয়ে দিতে হবে শুকনো স্মৃতি।
তারই উপরেই শোয়া-বসা, জপ-তপ, বাসন-কোসন, কাপড় কাচা
এবং নিজের নখে নিজেকে ছিড়তে বাঁচা।
সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল।
যাচ্ছি যাব, যাচ্ছি যাব এই গড়িমসি করে চূড়ো ভাঙা চাকা ভাঙা রথ
যে রকম ঘাড় গুজে ধুলোয় কাতর, সে রকমই শুয়ে বসে আছে।
খেয়াঘাটে পারাপার ভুলে-যাওয়া, নৌকার মতন, সময় এখন।
মনে হয় সময়ের পায়ে ফুটে গেছে দীর্ঘ পেরেক বা মনসার কাঁটা
ছিড়ে গেছে স্ম্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ কিংবা জুতোর গোড়ালি
মনে হয় তার সব কোটপ্যান্ট ধোবার ভাটিতে
হয়তো বা কোনও এক লেকা্যাল ট্রেনের হু হু ভিড়ে
চুরি হয়ে গেছে পার্স, পার্সে ছিল অগ্রিম টিকিট।
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নিয়ে যাবে পাহাড়ের সোনালী চূড়োয়
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আকাশের সিথি থেকে সিদুরের টিপ এনে দেবে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নক্ষত্রের ক্যামেরায় ছবি তুলে উপহার দেবে অ্যলবাম
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কলকাতায় এন দেবে শঙ্খের সাগর।
প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়াবার ছিটোবার কথ, থুতু, মলমুত্র নয়
প্রতিশ্রুতি লাল নীল পতাকার ব্যতিব্যস্ত ওড়াউড়ি নয়
প্রতিশ্রুতি প্রেসনোট, দৈববাণী, দেয়ারের লিপিচিত্র নয়।
প্রতিশ্রুতি শীতের চাদর
প্রতিশ্রুতি ভাঙা চালে খড়
প্রতিশ্রুতি সাদা ভাত, ভাতে দুধ, দুধে ঘন সর
প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।
হে সময়, হে বিকলাঙ্গ বিভ্রান্ত সময়
কানা কুকুরের মতো এটো-কাটা ঘাঁটাঘাঁটি ভুলে
পৃথিবীর আয়নায় মুখ রেখে জামা জুতো পরে
সূর্যের বল্লম হাতে, একবার অশ্বারোহী হও।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আমরা যারা চল্লিশের চৌকাঠ পেরিয়ে পঞ্চাশের দিকে
সেদিন আঠারো বছরের উথাল-পাথাল বাউগুলে সেজে
সারারাত তুমুল হৈ-হল্লা।
আগুনের পিন্ডি গিলে গিলে, আগুনের পিন্ডি গিলে গিলে
প্রত্যেকে এক-একজন তালেবর।
‘বুঝেছি, পৃথিবীটাকে উচ্ছন্নে পাঠাবে ছোঁড়াগুলো ।
নিজের মনে গজ গজ জানলা খুলে পালিয়ে গেল হাওয়া।
‘বুঝেছি, একটা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারী না ঘটিয়ে এরা ছাড়বে না।
ভয়ে এক ঝটকায় নিভে গেল সমস্ত টিউব লাইট।
আমাদের উড়ো চুলগুলো তখন মনুমেন্ট-মুখো মিছিলের পতাকা
আমাদের শরীরের খাঁজে খাঁজে তখন বিরজু মহারাজের কথক
গলায় আমীর খাঁকে বসিয়ে কোরাস ধরেছি
-জগতে আনন্দ যজ্ঞে
গান থামতেই, যেন রেডিওতে শোকসংবাদ, এমনি গলায়
শান্তি বলে উঠল-
‘জানিস, আর মাত্র কুড়ি বছর পরে খতম হয়ে যাচ্ছে
পৃথিবীর সমস্ত পেট্রোল আর তারপরেই কয়লা-,
অমনি মরা আগুনে ঘি পড়ার মতো দাউ দাউ
আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা।
শান্তি থামতেই নীলামদারের মতো হাঁক পাড়ল সুনীল-
‘মেরামতের অযোগ্য এই পৃথিবীটার অন্যে আমি কিনতে চাই
একটা ব্রক্ষাণ্ডজোড়া ডাস্টবিন।
অমনি একশোটা ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ্উল্লাসে
আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা।
তার পরই রক্তাক্ত যীশুর ভঙ্গীতে টেবিলের উপর উঠে দাঁড়াল পৃথীশ।
‘বন্ধুগণ!
যে-যার হাফ প্যান্টগুলো কাচিয়ে রাখুন
খোঁড়া তৈমুর আবার জেগে উঠছে কবর ফুঁড়ে
গেরিলা যুদ্ধের সময় দারুণ কাজে লাগবে।
অমনি আমাদের তুমুল হৈ-হল্লা
মিলিটারি ব্যান্ডের মতো ঝমঝমিয়ে।
হিমালয় থেকে গড়াতে গড়াতে
প্রকণ্ড বোল্ডারের মতো জেগে উঠল শক্তি।
‘এবার আমি কিছু বলতে চাই।
গাছ এবং পাথর এমনকি ফুলের ছেঁড়া পাপড়ির সম্বন্ধে
সাংঘাতিক কিছু কথাবার্র্তা জেনে গেছি আমি,
বুড়ো শালিকগুলোর ঘাড়ের রোঁয়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে
এখন আকুপাংচারের মতো ঢুকিয়ে দিতে হবে সেগুলো।’
অমনি শান্তির গলা জড়িয়ে আমি
আমার কোমর জড়িয়ে সুনীল
সুনীলের পায়ের তলায় পৃথীশ
পৃথীশের পাকস্থলীতে শক্তি
শক্তির নাইকুণ্ডলীতে সুনীল, সুনীলের জুলফিতে আমি
আমার ঊরু কিংবা ভুরুতে শান্তি
এইভাবে দলা পাকাতে পাকাতে
আমাদের তুমুল হৈ-হল্লার রাতটাকে
নদীনালার দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
নক্ষত্রের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
কলকাতার অন্ধকুপের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে
কী যে দুর্দান্ত কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েছি, কিচ্ছু মনে নেই।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
মানবতাবাদী
|
বাবুমশাইরা
গাঁগেরাম থেকে ধুলোমাটি ঘসটে ঘসটে
আপনাদের কাছে এয়েচি।
কি চাকচিকন শহর বানিয়েছেন গো বাবুরা
রোদ পড়লে জোছনা লাগলে মনে হয়
কাল-কেউটের গা থেকে খসেপড়া
রুপোর তৈরি একখান্ লম্বা খোলস।
মনের উনোনে ভাতের হাঁড়ি হাঁ হয়ে আছে খিদেয়
চালডাল তরিতরকারি শাকপাতা কিছু নেই
কিন্তু জল ফুটছে টগবগিয়ে।
বাবুমশাইয়া,
লোকে বলেছিল, ভালুকের নাচ দেখালে
আপনারা নাকি পয়সা দেন!
যখন যেমন বললেন, নেচে নেচে হদ্দ।
পয়সা দিবেন নি?
লোকে বলেছিল ভানুমতীর খেল দেখালে
আপনারা নাকি সোনার ম্যাডেল দেন।
নিজের করাতে নিজেকে দুখান করে
আবার জুড়ে দেখালুম,
আকাশ থেকে সোনালি পাখির ডিম পেড়ে
আপনাদের ভেজে খাওয়ালুম গরম ওমলেট,
বাঁজা গাছে বাজিয়ে দিলুম ফুলের ঘুঙুর।
সোনার ম্যাডেল দিবেন নি?
বাবুমশাইরা
সেই ল্যাংটোবেলা থেকে বড় শখ
ঘরে ফিরবো বুকে সোনার ম্যাডেল টাঙিয়ে
আর বৌ-বাচ্চাদের মুখে
ফাটা কাপাসতুলোর হাসি ফুটিয়ে বলবো
দেখিস্! আমি মারা গেলে
আমার গা থেকে গজাবে
চন্দন-গন্ধের বন।
সোনার ম্যাডেল দিবেন নি?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমার ওষ্ঠ করবী গাছ
বাল্যকালের শিউলিতলা
পরিব্রাজক
কোঁচড় ভর্তি কুড়িয়ে নিলেও
অনেক থাকে আঁচল পাতার
উচ্চাভিলাষ।
মেঘ কখনো ফুরোয় নাকো
হাজার দাঁতে কামড়ে খেলেও
আক্রমণে
বৃষ্টি থেকে আঁজলা নিলে
বৃষ্টি থাকে সেই যুবতী
উচ্ছৃসিত।
তোমার থেকে যা কিছু নিই
জলন্ত মোম সব গলে যায়
আগুন থাকে।
হিংসে করে, হিংস্র করে
তোমাকে কোনো ধুপের রাতে
ধ্বংস করি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
শুনেছি বসন্তকালে বনভূমি অহঙ্কারী হয়।
অথচ আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই।
বসন্তকালেই সেই কপোতাক্ষী রমনীর কুষ্ঠ হয়েছিল
যে আমাকে বলেছিল তার সব নদী, গিরি, অরন্যের আমি অধীশ্বর।
খুদ-কুড়ো খুঁটে খাওয়া গরীবের ছিটেবেড়া থেকে
তোমাদের মোজেইক বাগান-পার্টিতে এসে ফলার খাওয়ার
সনিবন্ধ অনুরোধ এসেছিল বসন্তকালেই।
বসন্তকালেই আমি প্রধান অতিথি হয়ে পুরুলিয়া গেছি
বসন্তকালেই আমি ভূবনেশ্বরে গিয়ে কবিতা পড়েছি
বসন্তকালেই আমি আকাশের ছেঁড়া জামা সেলাই করেছি।
অথচ আমার সব সোনাদানা, জমি জমা, কাপড়-চোপড়
স্মৃতি দিয়ে মাজা-ঘষা গোপনতা, অমর পরাগ
এবং বেসরকারী অস্ত্রাগার থেকে লুঠ গোলা ও বারুদ
ভিজে, ভেঙে, গলে, পচে, খসে, ঝরে, নষ্ট হচ্ছে
বসন্তকালেই।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
সে আছে সৃজন-সুখে
নিজস্ব কর্ষণে
তাকে অত ভীড়ে, অত লোকালয়ে, খররৌদ্রপাতে
তোমাদের দু-বেলার সংঘাতে ও সঙ্গের চত্বরে
সহসা ডেকো না।
যেহেতু সে তোমাদেরই একান্ত আপন
শুভাকাঙ্গী, সমর্থনকারী
তোমাদেরই রক্তচিহ্ন
রেখেছে সে কপালের ত্রিশূল-রেখায়।
সে আছে সৃজন-সুখে
সুখ মানে উলুধ্বনি নয়!
সে নিমগ্ন হয়ে আছে
সময়ের বিনষ্ট ফাটলে।
পরিপক্ক দ্রাক্ষা নয়
তার প্রিয় অন্বেষণ দ্রাক্ষার গভীর অগ্নিমূল।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
ছিঃ ছিঃ।
ছেঁড়া-খোঁড়া এক ফালি সবুজ রুমালের জন্যে আমাদের হা-পিত্যেশ,
আর তুই মাছরাঙা রঙের সাত-সাতটা পাহাড়
আর মিছিলের মতো লম্বা আঠারো মাইল শাল-মহুয়ার বন
আর গায়ে হলুদের কনের মতো একটা গোটা নদী আঁকড়িয়ে?
আবার নীল মেঘের খোঁপায় কি গুজেছিস ওটা?
সূর্যাসে-র লাল পালক?
চলতে-ফিরতে পায়ে বাজছে রুপোর মল
ভিতরে একশো গন্ডা পাখির স্বর।
আদরখাকী, বেশ আছিস তুই রাজবাড়ি বিছিয়ে।
তোর কাছে এলে সোনালী কুকুরের মতো লাফিয়ে ওঠে জন্মজন্মান্তর
মনে পড়ে যায় পুরনো শতাব্দীর সেই সব খেলাধুলো
যখন আমরাই ছিলাম দিগদিগন্তের রাজাধিরাজ
হাজার হাজার বর্গমাইল জুড়ে আমাদের মুক্তাঞ্চল
আমরাই পদ্মপাতায় ওলোট-পালট হাওয়া
মেঘের ভিতরে আমাদের কাশবন, বাঁশবন, নাগরদোলা
জলের ভিতরে অফুরন্ত মৃগয়া
সন্ধের চাঁদকে আমরাই জাগিয়ে দিয়ে বলতাম, যা, বেড়িয়ে আয়।
এখন আমরা কলের গানের মতো এটেঁ গেছি কাঠের চৌকো বাক্সে
আমাদের ঘর আছে কিন্তু জানলা নেই
জানলা আছে কিন্তু নিসর্গ নেই।
শক্তিশালী করাতে প্রত্যহ আমাদের কাট-ছাঁট
কত্তার মার্জিমাফিক কখনো দৈত্য দানবের মতো লম্বা
কখনো ভিখিরির দুপয়সার মতো চ্যাপ্টা।
গরবিনী, হঠাৎ ছুটি-ছাটায় চলে এলে
তোর মায়াকাননের অন্তর্বাস খুলে দিবি তো ঘুমের আগে?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
আমরা যেখানে বসেছিলাম
তার পায়ের তলায় ছিল নদী
নদীতে ছিল নৌকা
আর দূরে একটা বিষন্ন জাহাজ।
আমি যখন তোমার
তুমি যখন আমার ঠোঁটে বুনে দিচ্ছিলে
যাবজ্জীবনের সুখ
ঠিক সেই সময়ে ডুকরে কেঁদে উঠল জাহাজটা
ভোঁ বাজিয়ে।
তারপর থেকে রোজ
আমাদের যাবজ্জীবন সুখের ভিতরে
একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে সেই বিষন্ন জাহাজ
তার সেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদ বাজিয়ে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আমার বয়স ৪৮।
আমার মাথার প্রথম পাকা চুলের বয়স ২০।
এবং আমার স্নায়ুতন্ত্রীর ভিতরে স্তবকে স্তবকে সাজানো যে-সব স্মৃতি
তারা খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০০ বছরের চেয়ে পুরনো।
সর্বক্ষণ পাঁজবার আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকে যে-বিষাদ
একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, কত বয়স হলো হে?
বললে, ২০০৬ এর কাছাকাছি এলে কানায় কানায় ৭০০ বছর।
কেননা দীর্ঘ বিদীর্ণ দান্তে নিজের রক্তে কলম ডুবিয়েছিলেন
আনুমানিক ১৩০৬ এ, লা দিভিনা কোমমেদিআ-র জন্যে ।
স্তম্ভ এবং তরবারির বিরুদ্ধে
আমি নয়, কেননা আমি খুব বিনীত, প্রায় লতানে গাছের মতো নম্র
এমন কি যে-কেউ যখন খুশী মচকে দিতে পারে এমনই রোগা পটকা,
স্তম্ভ এবং তরবারি এবং যে কোনা সুপারসোনিক গর্জনের বিরুদ্ধে
আমি নয়, আমার ভিতর থেকে তেড়ে ফুঁড়ে জেগে ওঠে
কামান বন্দুকের মতো শক্ত সমর্থ এক যুবক।
ঐ যুবকটির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিলো চতুর্দশ লুয়ের আমলে
১৭৮৯ এর প্যারিসে, বাস্তিল দুর্গের দরজার সামনে।
আমার বয়স ৪৮ কিংবা ৪৯।
কিন্তু আমার ভালোবাসার বয়স ১৮।
যেহেতু আকাশের সমস্ত নীল নক্ষত্রের প্রগাঢ় উদ্দীপনার বয়স ১৮।
যেহেতু পৃথিবীর সমস্ত রুপসী নারীর
জ্যোৎস্না এবং অগ্ন্যুৎপাতের বয়স ১৮।
এক একদিন ঘুম ভাঙার পর
মাথায় বেঠোফেনের অগ্নিজটাময় চুল।
আর মুখের দুপাশে মায়াকভস্কির হাঁড়িকাঠের মতো চোয়াল।
এক একদিন ঘাড়ের উপর আচমকা লাফিয়ে
কুরে কুরে খায় কান্না, দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে
যেন ইভান দি টেরিবলের দুমড়োনো চেরকাশভ।
ভাগ্যরেখাহীন রাজপথের আলকাতরায় উপুড় হয়ে আছে
আগামীকালের শোক-তাপ, আর সেই সব চিৎকার
রক্তপাতের রাতের গোলাপ হওয়ার জন্যে যারা উন্মূখ।
ঐ রাজপথের দুপাশে দিনে দশবার হাঁটতে হাঁটতে
যখন মাংসের কিমার মতো থেতো,
হঠাৎ নিজেকে মনে হয় ম্যাকস্ ভন সিদো
বার্গম্যানের সেভেনথ সীল এর সেই মৃত্যুভেদী নায়ক
যার লম্বা মুখের বিষণ্নতায় পৃথিবীর দগদগে মানচিত্র।
এক একদিন ঘুম ভাঙার পর
চোখের ভিতরে বোদলেয়ারের প্রতিহিংসাপরায়ণ চোখ,
মনের ভিতরে জীবনানন্দের প্রেমিক চিলপুরুষের মন,
আর হাসির ভিতরে রেমব্রান্টের হিসেব না-মেলানো হাসির চুরমার।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
রূপক
|
নতুন জামা-জুতো পরলে পরিচয়হীন অন্যলোক হয়ে যাই আমি।
তখন নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কেমন আছেন ? ভালো?
একবার বিদেশে গিয়েছিলাম অন্য লোকের ওভারকোট পরে
সকালসন্ধে সেই ওভারকোট পরা মানুষটাকে দেখে মনে হতো
মিলিটারি-কামড়ানো কোন রাজ্যের পলাতক রাষ্ট্রপতি।
এইসব দেখেশুনেই আমার ধারণা, মানুষের কোন ধরা-বাঁধা পোশাক
না থাকাই ভালো।
স্বাধীন চডুই-এর মতো যখন যে-রকম খুশী পোশাক-পরিচ্ছদে ঢুকে পডুক।
রমণীদের এত ভালো লাগে এ জন্যেই । প্রতিনি নতুন। আলাদা আলাদা।
যেদিন সবুজ শাড়ি, যেন ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে-পড়া লতানো জুই-এর ডাল
হাত ধরে ডেকে নিয়ে যাবে ঝাউবনের গোপন আঁধারে,
আগুনের উল্কি এঁকে দেবে হাতে, বুকে। দাঁতে চিবোতে দেবে লাল লবঙ্গ।
যেদিন লাল শাড়ি, কোমরের ঢাল থেকে উকি মারে তুর্কি ছোরার বাঁট।
কমলারঙের ছাপা শাড়ি যেদিন, বুঝতে পারি এই সেই চিতাবাঘ
মোলায়েম ঊরুর উপর শুইয়ে যে আমাকে চেটে-পুটে খাবে এখন ।
বেশ মজা পাই, নিজেকে নানান পোশাক-পরিচ্ছদে পুরে।
মাঝে মাঝে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে তাগড়াই ঘোড়ার কেশরে,
মাঝে মাঝে টিয়া টুনটুনির পালকে।
একবার এক বিকলাঙ্গ জটায়ুর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম
তার রক্তক্ষতময় ডানা,
একবার এক মৃত হরিণের কাছে তার ভ্রমনবিলাশী সোনালী ছাল।
বাঘের চেযে আমার অনেক ভালো লাগে জিরাফের ডোরা।
কিন্তু জিরাফের চেয়ে ভালো লাগে বাঘের সম্রাট-সুলভ চালচলন।
এক-একদিন খেলতে খেলতে হেরে গিয়ে শামুক-গুগলির মতো ছোট হয়ে যাই
তখন সর্বাঙ্গ কাতর হয়ে ওঠে শজারুর বর্শাফলকের জন্যে।
এক-একদিন কারখানা কিংবা কারখানার ম্যানেজারবাবু
বুকের বোতলে প্লাস্টিকের সরু স্ট্র ঢুকিয়ে লম্বা চুমুকে শুষে নেন
সমস্ত জল, জলস্তম্ভ, জোয়ার।
তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, বন্ধগণ।
গণ্ডারের চামড়া এনে দিতে পারেন কেউ? অথবা বাইসনের সিং?
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
রাত গাঢ় হলেই আমি নিজেকে ছিঁড়ে নিতে পারি
পৃথিবীর রক্তাক্ত নাড়ির খামচা থেকে।
রাত গাঢ় হলেই বুঝতে পারি সমস্ত শব্দের ঠিক ঠিক মানে,
সমস্ত ঘটনার ছাল ছাড়িয়ে পৌঁছতে পারি তার হৃৎপিন্ডে।
যত রকম জিজ্ঞাসা আছে তার সব কিছুকে জুড়লে একটা মানুষ।
মানুষের জিজ্ঞাসা মানুষকে টেনে নিয়ে যায়।
মাটির থেকে উপরে, খানাখন্দ সাঁকো সুড়াঙ্েগর উপরে
ফিনফিনে শান্তি, এমনকি ধপধপে কাচা নিরাপত্তার উপরে
এমন সৌরলোকে, যেখানে আলোর বর্শা থাক থাক করে সাজানো।
রাত গাঢ় হলেই নক্ষত্রগুলো উজ্জল হয়ে ওঠে
তপঃ ক্লিষ্ট ঋষিদের মতো,
এবং তাঁরা নেমে আসেন পৃথিবীর খরখরে অন্ধকারের অলিতে গলিতে।
আর সেই সুযোগে আমার দেখা হয়ে যায়।
প্রত্যেকটি স্তম্ভের ভিতরকার ফাটল
প্রত্যেকটি হিতৈষী পুরুষের ছোরার মতো চোরা হাসি
প্রত্যেকটি ঘড়ির কাঁটায় বিস্ফোরনের গোপন নির্দেশ।
রাত গাঢ় হলেই নিজের পৃথিবীকে কাছে পাই আমি।
হাজার মাইল ফলন্ত শশ্যের ক্ষেত হয়ে যায় আমার ভাবনাগুলো।
আর উন্মাদ পুরুষ যেভাবে নারীকে ভালোবাসে নিংড়ে নিংড়ে
সেই ভাবে সময়ের সঙ্গে আমার
তুমুল ভালোবাসাবাসির সংঘর্ষ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রকৃতিমূলক
|
কোমরে লাল ঘুনসি বাঁধা
পোড়া বিড়ির টুকরোর মতো
আমরা চতুর্দিকে ছড়ানো।
কেউ মুথোঘাসের তলপেটে
কেউ বুড়ো বটের গোড়ালির আড়ালে
কেউ নর্দমার এটোঁ শালপাতার ডিঙিতে।
নেশাখোরের মতো হাওয়া
একবার দৌড়চ্ছে ডাইনে, একবার বাঁয়ে।
এক জায়গায় জুটবো
মন-খোলা জোৎস্নায় আড্ডা জমবে সারারাত
হৈ হৈ গল্পের মাদল বাজিয়ে,
তালা খুলব, যে যার খুপরির
পাটে পাটে ভাঁজ করা স্মৃতি, জামা-পাজামা
কোনোটায় বেনারসীর জরির নকশা
কোনোটায় রক্তপুজের ছেটে,
ভালোবাসা ন্যপথলিনের গন্ধের মতো
জড়িয়ে থাকবে আমাদের ধুতি-পাঞ্জাবী রুমালে
তার উপায় নেই।
সময়টা খারাপ।
আকাশের ময়লা মেঘে বাঘছালের ডোরা।
মেঘে একবার বাজে দুন্দুভি
আরেকবার তাসা-পার্টির ন্যাকরা।
গাছপালাও ছন্নছাড়া।
যেখানে শিরদাঁড়া সোজা করার, সেখানে দুলছে,
যেখানে যজ্ঞের মন্ত্র সেখানে ঢুলছে
ঘুমে।
বোধিদ্রুমে
ধরেছে হতবুদ্ধির ঘুণ।
মুখ চুন করে আকাশের বারান্দায় নক্ষত্রেরা দাঁড়িয়ে।
নাম ভাঁড়িয়ে
ছিচকে জোনাকীরাই মস্তানী করে গেল সারারাত।
সূর্য
নিজের আগুনে নিজে পুড়ছে।
এখনো তারই দিকে চোখ রেখে জলবার ইচ্ছে
খিল্ আঁটা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে,
এইটেই আশ্চর্য।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম তিলক কামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মতো বহু ক্ষত রয়ে গেছে ভিতর দেয়ালে
কিছু কিচু অভিমান
ইমনকল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভালো হতো।
পুরুষ কিভাবে কাঁদে সেই শুধু জানে।
কার্পেটে সাজানো প্রিয় অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।
মুহুর্মুহু নৌকাডুবি, ভেসে যায় বিরুদ্ধ নোঙর।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমিকের সপ্তডিঙা ডুবেছে যেখানে
সেখানে নারীর মতো পদ্ম ফুটে থাকে।
জল হাসে, জল তার চুড়িপরা হাতে,
নর্তকীর মতো নেচে ঘুরে ঘুরে ঘাগরার ছোবলে
সব কিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের ভরে দেয়
বাসি হয়ে যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ, প্রকাশ্য উদ্যন।
এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরে দোরে চাঁপা এই চুনকাম
দরবারী কানাড়া এরই নাম?
সরোদ কাজাতে জানলে বড় ভালো হতো।
পুরুষ কীভাবে বাঁচে সেই শুধু জানে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
পাগুলো কাঠের
আর নূপুরগুলো সোনার
এইভাবেই সাজানো মঞ্চে নাচতে এসেছি আমরা
একটু আগে ছুটে গেল যে হলুদ বনহরিনী
ওর পায়ের চেটোয় সাড়ে তিনশো কাঁটা।
সারাটা বিকেল ও শুয়েছিল রক্তপাতের ভিতরে
সারাটা বিকেল ওকে ক্ষতবিক্ষত করেছে
স্মৃতির লম্বা লম্বা পেরেক।
অথচ নাচের ঘন্টা বাজতেই
এক দৌড়ে আগুনের ঠিক মাঝখানে।
বাইরে যখন জলজ্যান্ত দিন
সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে তখন কালশিটে অন্ধকার।
যে-সব জানলার উপরে আমাদের গভীর বিশ্বাস
তাদের গা ছুয়েই যতো রাজ্যের ঝড়-বৃষ্টির মেঘ।
অথচ এইসব ভয়-ভাবনার ভিতরেই আমাদের মহড়া
আমাদের ক্লারিওনেট
আমাদের কাঠের পায়ে সোনার নুপুর
আমাদের ডোন্ট-কেয়ার নাচ।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
প্রেমমূলক
|
তোমার হাতে ছুঁচ-সুতোটি
আমার হাতে ফুল
দেখতে পেয়েই আকাশ জুড়ে হিংসা হুলুস্থুল।
তোমার হাতে রঙের বাটি
আমার হাতে তুলি
দেখতে পেয়েই শুকনো মড়া চোখে জ্বালায় চুলি।
তোমার হাতে ধান-দুর্বো
আমার হাতে শাঁখ
দেখতে পেয়েই আকাশ চিরে শকুন পাড়ে হাঁক।
তোমার হাতে জলের ঘাট
আমার ঠোঁটে জল
দেখতে পেয়েই দৈববাণী: এ কি অমঙ্গল!
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
কবিতা লেখার রাত
ভিজে গেছে অঘ্রাণের উদাসীনতায়।
সব ক্ষীপ্র অত্যুৎসাহে
উদ্যোগে ও কর্মকান্ডে আজ লেগে আছে
শিশিরের সাদা ফোঁটা
জল বসন্তের গুচ্ছ বীজ।
সাদা বালি, লাল বালি
বারুদ গুড়োর গুঢ় বালি
চরাচর থেকে উড়ে আমাদের জানালার গায়।
বিস্ফোরণে পুড়ে পুড়ে বাতাসের নীল কন্ঠনালী
তবু ন্যায়-নীতি মেনে কি জানাতে চায়
শুনে রাখা ভাল।
পায়ে রক্তদাগ,
সূর্যে রাহুর দাঁতের কালো ছায়া।
সন্ত্রাসের মেঘ চিরে
প্রসবব্যাথার চোখে নক্ষত্রেরা তাকিয়ে রয়েছে
কবিতার দিকে,
গায়ত্রী মন্ত্রের আলো চেয়ে।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
ওহে দেখতো দেখতো
লোকটা চলে যাওয়ার সময় কি রেখে গেল?
ভারী লুকনো স্বভাবের ছিল মানুষটা।
ঘাড় গুজে, হাঁটু ভেঙে, চোখ জ্বালিয়ে
বন-বাদাড়, নুড়ি পাথর, আগুন অন্ধকার, ঘেঁটে ঘেঁটে
কী সব কুড়িয়ে বেড়াত দিনরাত।
দেখতো কী রেখে গেল যাওয়ার সময়?
সিন্ধুকটা খোল।
ভিতরে কি?
আজ্ঞে পান্ডুলিপি।
ভল্টটা ভাঙো।
ভিতরে কি?
আজ্ঞে পান্ডুলিপি।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
চিন্তামূলক
|
তোমার মুকুট ঘিরে থাক কাঁটাতারে
বিদ্ধ করুক পেরেকের অপমান।
জানবে তোমার খোঁজ নেয় রোজ গারো পর্বতমালা
কেমন আছেন শামসুর রাহমান?
তোমার তূনীর ভরা থাক বিশ্বাসে
শব্দ বুনুক বজ্রের বীজধান।
হয়তো একদা মেঘে শোনা যাবে মেঘনার তোলপাড়
আমি হতে চাই শামসুর রহমান।
ছেনী ও হাতুড়ী ধরা যাক দৃঢ় হাতে
রূঢ় প্রস্তর খুঁজে পাক গূঢ় প্রাণ।
আজ সকালেই সোনার কলমে সূর্য লিখল রোদে
ইতিহাস হোক শামসুর রাহমান।
|
পূর্ণেন্দু পত্রী
|
ভক্তিমূলক
|
প্রণাম করব। কিন্তু পা কই? আগুনে ও হিমজলে পা ডুবিয়ে
এখনো তো তাঁর অফুরাণ হাঁটা
বরণ করব। কিন্তু কই সে শব্দদল যা ছুঁতে পারে
তাঁর বোধের এলাকা?
তাহলে?
জ্বলন্ত সিড়ি ভেঙে ভেঙে শিখরের দিকে যাঁর এগিয়ে চলা,
অনুজের অভ্যর্থনা কীভাবে পৌঁছবে সে অগ্রজে?
তবে কি বিশেষণ-বিড়ম্বিত স্তব কোলাহলেই শেষ হবে সে আরতি?
না। ভীষণ নীরবে চাইব এই খবরটুকু পৌঁছে দিতে শুধু-
আরো দীর্ঘতর প্রতীক্ষায় আমরা প্রস্তুত।
আরো নতুনতর বিস্ফোরণের আলোয়
উত্তাপে আবীরে ঘোর লাল হয়ে উঠুক আমাদের আকাশ।
আমরা তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তুমি মুখ ঘুরিও না।
যজ্ঞাগ্নির সামনে কী দিব্য তোমার দহন!
|
মোহাম্মদ রফিক
|
স্বদেশমূলক
|
তোমার দেহের মতো খর-কৃপাণের মতো
দীর্ঘ ও উদ্যত ঋজু
সারি সারি
শাল-তরু শ্রেণী
দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই পাশে;
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চুমু খেলে
ভয়ে ও বিহ্বলতায়
যেমন কম্পন জাগে
তোমার দু’গালে ঠোঁটে, আজকে রাত্রেও তেমনি
উদগ্রীব অপেক্ষার
রুদ্ধ শিহরন সাড়া
শাখে শাখে; শকুনের ডানার ঝাপটে যেন
ঢেউ উঠে ভয়াল সাগরে;
তোমার গায়ের রং যেন
তপ্ত কাঞ্চনের মতো
লেগে আছে সড়কের প্রতি ধুলিকণা সাথে,
চোখের মণির মতো সজল নিবিড় কালো
জমছে খণ্ড খণ্ড মেঘ
সারাটা আকাশময়
হয়তো নামবে বৃষ্টি একটু পরে,
যেমন শোনিত চুঁয়ে চুঁয়ে
পড়ছে তোমার পথে পথে
তাল ও তমাল শাখে,
শত্রুর সৈন্যের বেয়নেটে
তোমার প্রাণের মতো
উষ্ঞ লাল রক্ত
যেমন ঝরছে
মাঠে মাঠে গঞ্জে বাটে;ক’জন চলেছি আমরা
সড়কের ‘পর দিয়ে এই
একটি ট্রাকে ঠাসাঠাসি
উচিঁয়ে সঙীন দৃপ্ত
আমরা চলেছি এই
নীরন্ধ্র রাতের মাঝামাঝি
তোমার প্রেমের ঋণ
রক্ত ঋণ
রক্ত দিয়ে শোধ করে দিতে;শুধু আলো হাওয়া চাঁদ
বা সূর্যকিরণ নয়
তোমার শরীরে মাগো
বিকট দুর্গন্ধ আছে,
ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন সব
কচি কচি যোদ্ধাদের
ঘামে ভেজা ছেঁড়া গেঞ্জি
ময়লা বিছানা হ’তে
বিবমিষা ছুটে আসে;
তোমার দেহের সাথে
এ দুর্গন্ধে মাগো
আমাদের ভবিষ্যত যেন
নবজাতকের মতো
হাত পা বাতাসে ছুঁড়ে খেলা করছে;শুধু খালে বিলে মাঠে
নদীতে নালায় জলে
বা সীতাকুণ্ডুর
পর্বতমালায় নয়,
এইসব বৃষ্টিভেজা
কাঁদামাখা তাঁবুতে তাঁবুতে যেন
তোমার মানচিত্রখানি
কতগুলি
ছোট ছোট জারুল চারার মতো
উষ্ঞ তাজা
হৃদয়ের সাথে লেপ্টে আছে।বিভিন্ন টিলায় ট্রেঞ্চে
রাইফেলে ট্রিগারে হাত চেপে
দেখছি প্রতিদিন
হাজার হাজার জীর্ণ অবসন্ন ধর্ষিতা নারী
পুরুষের সাথে
শত্রুর সন্ত্রাস গুলি বেয়নেট বেড়াজাল
কি করে এড়িয়ে মা আমার
হেঁটে চলেছে দল থেকে দলে
দৃপ্ত পায়ে
কুয়াশার আস্তরণ ছিঁড়ে
ভেঙেপড়া
প্রথম সূর্যের ক্ষীণ
আলোর রেখার মতো
কম্পমান সম্ভাবনার দিকে!বহু পরে
অনেক রাতের শেষে
আঁধারের আস্তরণ ভেঙে
নির্দয় নিশ্চিত সূর্য
জরাজীর্ণ
দেয়াল ফাটলে বট
বৃক্ষের চারার মতো
যখন বেরিয়ে আসবে
ফেটে পড়বে
বহু প্রতীক্ষিত
সেই আনন্দিত ক্ষণে
হয়তো দেখবে
তোমার ঘরের পাশে
উজ্জ্বল পৈঠার ‘পর
দু’একটি ফোঁটা
পুরনো মলিন রক্ত
লেগে আছে,তখন কি
মনে পড়বে
প্রিয়তমা
আমরা ক’জন মিলে
অবিচল প্রত্যাশায়
তোমার প্রেমের ঋণ
রক্ত-ঋণ
সহস্র সহস্র কোটি
হায়েনার চিৎকারের মতো
সেই এক
পৈশাচিক অন্ধকার রাতে
চলে গেছি
রক্ত দিয়ে
শোধ করে!
|
টুটুল দাস
|
প্রকৃতিমূলক
|
উচ্ছে বেগুন, সজনে ডাঁঠা
শ্যামাপদ’র থলি
ছুটির সকাল টানা ঘোমটা
রাতের পদাবলি।বৃষ্টি হঠাৎ, তুমুল ভিজে
ফুচকা’লার গাড়ি
পিছলে পড়া পাথর মেঝে
ঝাঁ চকচক বাড়ি।কাব্যি কাব্যি রাত্রি যাপন
বাক্সে বন্দি থাক
ঝড়োহাওয়া, আলগা বাঁধন
বিনুনি উড়ে যাক।হারমোনিয়াম অবহেলায়
ধূলোবালির ফাঁদে
পর-স্ত্রীর ‘হঠাৎ দেখা’য়
রবীন্দ্রনাথ কাঁদে।এই শহরে সকাল নামে
রাত্রিজাগা চোখে
মাহাত্মা ছাপা বদ্ধ খামে
রাতবেঁচা দুর্ভিক্ষে।টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
ঝালমুড়ি ঠোঙায়
ছোটবেলার মুখস্থ না হওয়া ছড়া
একযুগ বয়স কমিয়ে দেয়-
নীল ফ্রকের হাত ধরে হাঁটতে থাকা লাল গেঞ্জি
যেন বৃন্দাবন উঠে আসে পাড়ার গলিতে।যে শহরে প্রজাপতি ওড়ার জায়গা নেই
সেখানে কীটপোকা থাকবেই।পুরুষ লাঙ্গল কাঁধে ভোরবেলা বেরিয়ে গেছে
তার টিফিনবক্সে দু’মুটো পান্তা ভাত, আলু সেদ্ধর সাথে
এক চামচ ভালোবাসা
মাটির স্পর্শ পেলেই শুক্লপক্ষের চাঁদ।যার অাঙ্গুলের গন্ধ এখনো লেগে আছে
নাকে মুখে বুকে
তাকে ভুলে যাবার নাম টর্চ জ্বালিয়ে চাঁদ দেখা।মুখস্থ না হওয়া ছড়াগুলো অমুখস্থই থাক সব ছড়া মুখস্ত করতে নেই।যাকে ভালোবেসে ঠোঁট দিয়েছো, বুক দিয়েছো
আগুনের তার দরকারই বা কি?টুটুল দাসের পাতায় যেতেঃ এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
হঠাৎ করে বৃষ্টি নামে
অফিস ফেরৎ গলি
চুপিচুপি ভিজলো সাথে
স্মৃতির শহরতলি।রোদ ডুকেছে ড্রয়িংরুমে
স্মৃতির তখন মনখারাপ
রোদের সাথে ঘুরতে গিয়ে
মেঘের সাথে প্রথামালাপ।নাম জানি না মেঘের
ভাব বাচ্যে ডাকি
বুকের ভিতর মেঘ গলিয়ে
সমুদ্র নিয়ে থাকি।সমুদ্র থাকে পড়ার ঘরে
উথাল-পাথাল ঢেউ
কবিতা ওড়ে বালিশ ওড়ে
জ্যোৎস্নায় ভিজে কেউ।জ্যোৎস্না হঠাৎ বুকপকেটে
অচেনা রিংটোনে
আঁধার বয়ে বসন্ত নামে
ওয়ালপেপার আর ফোনে।বসন্ত তখন ছাতার তলায়
হলুদ ওড়ানায় ঢাকা
বাইরে শুধু একটা আকাশ
ওড়ার জন্য ফাঁকা।উড়তে উড়তে কতই খেলা
সমস্ত শহর জুড়ে
আকাশ ভেঙ্গে মেঘ ঢুকেছে
হাঁটতে হাঁটতেই সুদূরে।হাঁটার পথে শহরতলি
মুখথুবড়িয়ে আছে
হারিয়ে গেছে কবিতা খাতাও
মেঘের বাড়ির কাছে।মেঘের বাড়ি খুঁজতে গেছি
ভুল করেছি গলি
সেসব কথা ফিসফিসিয়ে
কেনই বা স্মৃতির কানে বলি?টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
মৃত্যুর আরেক নাম বৃত্ত
বৃহত্তম জ্যা’তে টাঙিয়ে দাও পুরানো অন্তর্বাস।বুকের গভীরতা খুঁজতে যে হাত ঢুকেছে
সরস্বতীপূজার ব্লাউজে
সে হাতের জলন্ত মোমবাতিতে আর যাই পুড়ুক
শব্দগুচ্ছ পুড়বে না।শীত, বর্ষা, হেমন্ত, দুর্গাপূজা, ১৫ই আগষ্ট
একেকটা রাতের দর একেক রকম;
দর জানা না থাকলেও আমরা দর কষতে ভালোবাসি।দুটো ফুলের একসাথে মোহনার দিকে ভেসে যাবার নামই – প্রেম।
উজানের দিকে তো অনাহার।কাকভোরে খিদে পায়নি, কাম পেয়েছে।একবার বাসন্তি রঙা ঠোঁট ছুঁয়েছিলাম
সেই থেকে আমার এলার্জি,
সমস্ত আমিষের মধ্যেই অধিকারের দুর্গন্ধ পাই। টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রকৃতিমূলক
|
বান্ধবীদের কফির কাপে পৌষ বিকেলের ছায়া
দাস্তানাতে নাক ঢেকেছে, কুয়াশা দিয়ে মায়া।
সন্ধ্যেগুলো বিষমখাওয়া ভীষণ এলোমেলো
কবিকে ছোঁয়ার ভান করে সব আঁধার ছুঁয়ে গেল।
আঁধার মানে মফঃস্বলের রেডিও বাজা রাত
মেসেজ বেয়ে চুইয়ে নামে শীতঘুম অকস্মাৎ।
শীত পেরিয়ে বান্ধবীদের অবাধ যাওয়া-আসা
গান্ধর্ব মতে পুড়তে থাকে পলাশবনের বাসা।
আগুন দিলাম বান্ধবীদের ব্যালকোনি- কার্নিশে
আগুন ছড়াক শহর জুড়ে পলাশ-বকুল মিশে।ছাই ঢেলে দাও হিসেবছাড়া অঙ্কখাতার নামে
শীতাকাশে জ্বলুক-নিভুক হাজার নীহারিকা
রাস্তাগুলো বিষণ্ণ হোক, শহর কিংবা গ্রামে
স্কার্ফ ঝুলিয়ে কবিতাখাতায় হাঁটবে আধুনিকা।টুটুল দাসের পাতায় যেতেঃ এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
মন খারাপের এই যে আকাশ
কান্না মুছে যেদিকে তাকাস, কুয়াশা পাবি খুঁজে।অল্পস্বল্প দিনের আলোয়
রাস্তা জুড়ে মন্দ ভালোয়, হাঁটিস বুঝে সুঝে।একটা বিকেল ফালতু গেলে
হাডুডু আর কাবাডি খেলে, সন্ধ্যে বেলা যাই।পার্কে তখন নেমেছে রাত
ছাতার তলে আর দুটো হাত, কোথায় খুঁজে পাই?জ্যোৎস্না নামে শহর জুড়ে
একলা হাঁটি লোকের ভিড়ে, কেউ দিলো না ডাকএমনি তেই ভুল ঠিকানা
বিশটাকাতে রোল খাবোনা, পকেটে খিদে থাক।শান্ত মেয়ের বাদামবিলাস
চোখের নিচে একটু জেলাস, চুরি করবোই আজনুপুর পায়ে অনেক দামি
তার বদলে জাহান্নাম-ই, কবিতা দিয়েই সাজ।এই যে আমেজ মধ্যরাতে
জোনাকি বসা মেহেন্দি হাতে, লুটিয়ে পড়ে চাঁদবৃষ্টি নামে দিন ফুরালে
চাঁদের সাথে ভিজবি বলে, ফাঁকাই আছে ছাদ। টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
রূপক
|
গীষ্ম সকাল জানলা খোলা রোদে
খাক হয়েছে পুড়ে খুচরো অভিমান
মেঘের দেখা নাই তো চৌহদ্দে
জমিয়ে রাখা বৃষ্টি জলে স্নান।স্নানের নামে গায়ে মাখছি ধূলো
ধূলো কোথায়? কাদা-ই বলা যায়
বললেই বা কি এমন এসে গেল
না বলা কথা ঝুলছে বারান্দায়।বারান্দাতে দাঁড়ায় এসে কবি
ঝোলার ভিতর একটাও নেই সাপ
ভুলের পাশে ভুল ঠিকানার ছবি
প্রেমের নামে অালিঙ্গন নিষ্পাপ।পাপের কথা বলতে এমন আছে?
শহর জুড়ে বিছিয়ে রাখা ফুল
রক্ত চাবো কোন মুখোশের কাছে?
পায়ের তলায় পিষছে জুঁই-বকুল।বকুল তলায় বাঁধছে দেখো মাইক
রবীন্দ্রনাথ গাইবে এসে গান
পাড়ার দাদা পকেটে নিয়ে পাইক
জন্মদিনের রাখবেন না সম্মান?সম্মান আর কোথায় রাখি বলো
মহামারিতে তলিয়ে গেছে গ্রাম
রবীন্দ্রনাথ পায়েশ খেয়ে যেও
মেঘ বৃষ্টি নিয়ে গেছে প্রণাম।টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
মানবতাবাদী
|
পায়ের তলায় আগুন রাখা
শহর জুড়ে রক্তচোষার বাস;
দাবানলে ফুল ফুটেছে কটা
সে ফুলে কি রক্ত খুঁজে পাস?খুঁজতে খুঁজতে অন্ধগলির
রাতে, আরেকটা মোমবাতি
জিন্স ভিজলো আবেগ দিয়ে
আর, ভিজলো যে চাপাতি।ভেজার মতো বৃষ্টি কোথায়?
শহরটাকে গ্রাস করেছে খরা
ঘামের জলেই চুমুক দিয়ে
তৃষ্ণা মেটায় জনম সর্বহারা।সর্বহারা হারাবে কি আর
মৌলবাদে মৌলিকতাই বাদ
অনাবৃষ্টি সব বাড়িতে আছে
আকাশপানে ধর্ম’ঢাকা’ছাদ।ছাদের তলায় পঙ্গু কবির
কলম নাকি হয়েছে নিষ্ফল
কলম ছেড়ে আয় তুলে নিই
হাতে , শান দেওয়া পিস্তল।টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
তোর স্নানঘরের টিকটিকি আর
আমার ছাতার নিচে জমে থাকা মৃত অন্ধকার
পাশাপাশি বসলেই একটা রামধনু‘বেগুনী’
শুষ্ক শ্রাবণের মাথার উপর
তোর ফেলে দেওয়া চুড়িদারের ছাউনি;
আর আমি মেঘ বন্দক রেখে আলগোছে বৃষ্টি খুঁজি
ধেপসে যাওয়া নেলপালিশে। ‘নীল’
ভালোলাগা গুলো সামুদ্রিক মাছের মতো
চোখ দিয়েই স্বাদ নিতে হয়
ঠোঁট ছোঁয়ালেই লবন।
বাকি স্বাদগুলো কবিতার জন্য বরাদ্দ।‘আকাশি’
দিগন্তরেখার ঠিক এক চুমুক আগে
কয়েকটা নিয়মমাফিক বিকেল
তোর সকালের সাথে সমানুপাতিক না হলেই
পাড়ার লোকে ট্রাপিজিয়াম বলে।‘সবুজ’
শৈবাল খুঁড়ে খুঁড়ে পিচরাস্তা।
এখনো মাঠে নামলে পর্ণমোচীরা মাথা নুইয়ে দাঁড়ায়;
শুধু দূর্বাঘাসটুকুই জানে
কতটা আগুন লেগে আছে পদক্ষেপের আড়ালে।‘হলুদ’
শাড়ি ব্লাউজের সাথে কাচতে দেওয়া শার্ট
যতটা রং চুষেছে ততটা আবেগ ঢাললে
বুনোমহিষও আদ্যিখেতায় বুঁদ হয়ে
রোদ্দুর ডেকে আনবে মেঘলা বারান্দায়।‘কমলা’
চিবুকে কাঁচা রোদ, চাতকের সূর্যস্নান
ভৌকাট্টা ঘুড়ির সাথে মেঘের পরকিয়া;
সব কবিতাই বৃষ্টির জলে ধোয়া
তবুও ভ্রমরা বসে অনুভবে।‘লাল’
যে হাতে মেহেন্দি লেগেছে
সে হাতে খুলতে নেই প্রাক্তন প্রেমিকের চিঠি।
ব্যালকোনির আনাচে কানাচে বিষাদ;
মনকেমনের দাগ শুকাবে না ন্যাপকিনে।টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
যেদিকে চোখ ফেরালে মরুভূমি
যেখানে হাত বাড়ালে কাঁটাতার
সেদিকে মানুষ হেঁটেছে কমই
জমেছে অগোছালো আবদার।জমেছে খুচরো-খাচরা নালিশ
ভেসে যায় বাসি ফুলের মালা
আমার বৃষ্টিতেই মজলিশ
তোর আবার বৃষ্টির ঘরে তালা।ঘর বলতেই সিঙ্গেল চৌকি
মশারি জুড়ে অভিমানের দাগ
দুরত্বের নাম অভিমান কি?
যোগ ছেড়ে তুই বেছে নিলি ভাগ।ভাগ দিয়ে কি রাত কষা যায়?
রাতের ভিতর পোড়া শব্দের বাস
পোড়ার মতো আগুন কোথায়
আগুন দিয়েই কবিতা করি চাষ।চাষের জমি পতিত পরে আছে
অনাবৃষ্টি , স্মৃতির গায়ে কালি
বৃষ্টি পেলে রাখবো কার কাছে?
ফাটল জুড়ে অজৈব প্রেম ঢালি।টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
(শ্রদ্ধেয় পূর্নেন্দু পত্রীর অনুপস্থিতির অবলম্বনে)শুভঙ্কর, কতদিন তোমার চিঠির আশায় আশায় বসে আছি
সে খেয়াল কি তোমার আছে?
পুরানো চিঠি আর কত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়বো শুভঙ্কর?
ময়দানে বসে হাতে হাত রেখে বলেছিলে-
নন্দিনী, যেখানেই থাকি
রোজ রাতে ঘুমাতে যাবার আগে একখানি চিঠি লিখবো।
আজ অবধি একটাওও পেলাম না।
মাঝে মাঝে অভিসারিণী সেজে, মায়ের বেনারসি পরে
সেই রেস্টুরেন্টের কেবিনে গিয়ে বসতে ইচ্ছে হয় খুব;
কোথায় সে রেস্টুরেন্ট? সেটা তো মস্ত এক শপিংমল।
আর মায়ের বেনারসিটা?
সে তো কবেই আস্ত চটের বস্তা হয়ে গেছে।
কবিরা জ্যোতিষীও হয় আগে জানতাম না-
সেই সাপটা, গায়ে বালুচরীর নক্সা
সুখের অববাহিকায় সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
আমার বিছানায়, আমার পাশেই শুয়ে থাকে
বৃষ্টি নামলে আমায় জড়িয়ে ধরে কবিতা শুনতে চায়
আমি খাইয়ে দিই তোমার পুরানো চিঠি।
লক্ষীটি
নিজে হাতে গড়া ভাস্কর্য এবার ভেঙ্গে দিয়ে যাও
তোমার ছেনী-হাতুরি কবিতার ডাকাতেপোনায়
আমি আজও ঘুমাতে পারি না।টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
টুটুল দাস
|
প্রেমমূলক
|
যে ছেলেটার মুদির দোকান
বাড়িতে পোষে বিড়ালছানা
কে বলেছে? ফকতা পেলে
সে ছেলেটা প্রেম কেনে না।প্রেমের মদে মাতাল সবাই
মহুয়াও নাকি পাথর দানা
পাথর ঘষে আগুনই পাবি
ঝলসে বাঁচার উন্মাদনা।বাঁচতে গেলে মৃত্যুও চাই
মৃত্যু নাকি ভুল করে না
শোবার ঘরে লুকানো মেঘ
মেঘের বাড়ি আর যাবোনা।যাবার নামে আত্মগোপন
তেমন কোন পথ ছিল না
পথের পরে নীল সমুদ্দুর
উপত্যকায় একা যেওনা।একা কোথায়, কবিও আছে
সাজিয়ে রাখা মুদিখানা
যে ছেলেটা কবিতা বেচে
তার কি কোন প্রেম ছিলনা?টুটুল দাসের কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন
|
হুগো ফন হফমান্সথাল
|
চিন্তামূলক
|
গভীর দু চোখ নিয়ে শিশু বড়ো হয়
কিছুই জানে না তারা, বড়ো হয়, ফের মরে যায়।
মানুষেরা চলে যায় যে-যার রাস্তায় ।
তেতো ফল একদিন মিষ্টি হয়ে ওঠে
মরা পাখিদের মতো ঝরে যায় রাতে
কয়েকদিন পড়ে থাকে, ফের মরে যায় ।
হাওয়া আছে সব সময়, তবু বার বার
কত কথা শুনি আমরা কত কথা বলি
শরীরের যন্ত্রপাতি সুখ আর দুঃখ ভোগ করে ।
ঘাসের ভিতর দিয়ে রাস্তা হয়, গ্রাম ও শহর
এখানে ওখানে ভরা পুকুর ও গাছপালা, আলো
কিছু আছে বিশ্রী লোক, কিছু আছে মড়ার মতন ।
কেন এরা বেড়ে ওঠে ? কেন পরম্পর
দুজন সমান হয় না ? কেন এরা এত সংখ্যাহীন ?
কেন একবার হাসি, তার পরই কান্না, শুকনো হাওয়া ?
এই সব ছেলেখেলা— আমাদের কাছে আর কতটুকু দামী
আমরা ক’জন তবু রয়েছি অসাধারণ, অনন্ত একাকী
চিরকাল ভ্ৰাম্যমাণ, কখনো খুঁজিনি কোনো শেষ ।
এত সব বিচিত্রকে লক্ষ্য করা কেন প্রয়োজন ?
যা হোক, সেই তো সব কিছু বলে, যে বলে সায়াহ্ন
এই এক শব্দ থেকে ভেসে ওঠে গভীর কাতর স্বর, দুঃখ নিরবধি
শূন্য মৌচাক থেকে যে-রকম প্রবাহিত মধু।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন।শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা।শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
স্পর্শসুখে লিখা হবে অজস্র কবিতা।শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ।শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
তারপর হব ইতিহাস।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
মানবতাবাদী
|
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উল্ঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছো পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও।
তোমার পরমায়ু বৃদ্ধি পাক আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে,
প্রাত্যহিক বাহুর পেশীতে, জীবনের রাজপথে,
মিছিলে মিছিলে; তুমি বেঁচে থাকো, তুমি দীর্ঘজীবী হও।
তোমার হা-করা মুখে প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে
সূর্যাস্ত অবধি হরতাল ছিল একদিন,
ছিল ধর্মঘট, ছিলো কারখানার ধুলো।
তুমি বেঁচেছিলে মানুষের কলকোলাহলে,
জননীর নাভিমূলে ক্ষতচিহ্ন রেখে
যে তুমি উল্ঙ্গ শিশু রাজপথে বেরিয়ে এসেছো,
সে-ই তুমি আর কতদিন ‘স্বাধীনতা, স্বাধীনতা’ বলে
ঘুরবে উলঙ্গ হয়ে পথে পথে সম্রাটের মতো?
জননীর নাভিমূল থেকে ক্ষতচিহ্ন মুছে দিয়ে
উদ্ধত হাতের মুঠোয় নেচে ওঠা, বেঁচে থাকা
হে আমার দূঃখ, স্বাধীনতা, তুমিও পোশাক পরো;
ক্ষান্ত করো উলঙ্গ ভ্রমণ, নয়তো আমারো শরীরি থেকে
ছিঁড়ে ফেলো স্বাধীনতা নামের পতাকা।
বলো উলঙ্গতা স্বাধীনতা নয়,
বলো দূঃখ কোনো স্বাধীনতা নয়,
বলো ক্ষুধা কোন স্বাধীনতা নয়,
বলো ঘৃণা কোন স্বাধীনতা নয়।
জননীর নাভিমূল ছিন্ন-করা রক্তজ কিশোর তুমি
স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তুমি বেঁচে থাকো
আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে, প্রেমে, বল পেন্সিলের
যথেচ্ছ অক্ষরে,
শব্দে,
যৌবনে,
কবিতায়।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
চিন্তামূলক
|
ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে
মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না
ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে
ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না৷
ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না
নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি এখানে ছিলে না
এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না
নীল নবঘন গগনে ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না৷
এবারই প্রথম তুমি৷
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাত পাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না।
আমি জানি এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুকঃ
আমার জল লাগবে কিনা, আমার নুন লাগবে কিনা,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরোও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কিনা।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভেতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুকঃ "তোমার চোখ এতো লাল কেন?"
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
চিন্তামূলক
|
বাইরের পৃথিবীটা বড় বেশি ছোটো,
তার চারপাশে চাঁদ-তারা, গ্রহর দেয়াল।
আমি বাঁচি আমার মনের পৃথিবী নিয়ে।বাইরের পৃথিবীটা বড় বেশি কুৎসিত,
তার মৃগনাভি কৃমি-কীটে ভরা।
আমি বাঁচি আমার মনের পৃথিবী নিয়ে।বাইরের পৃথিবীটা বড় বেশি কর্কশ, নিষঠুর,
আত্মমুগ্ধ অহংকারে সাধা,
আমি বাঁচি আমার মনের পৃথিবী নিয়ে।বাইরের পৃথিবীটা বড় বেশি স্বার্থপর,
শস্ত্রজীবী, হিংসাপরায়ণ,
আমি বাঁচি আমার মনের পৃথিবী নিয়ে।বাইরের পৃথিবীটা দুঃখজরাব্যাধিমৃত্যুময়,
বাইরের পৃথিবীটা বড় বেশি স্বাধীনতহীন,
আমি বাঁচি আমার মনের পৃথিবী নিয়ে।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
মানবতাবাদী
|
আসুন আমরা আগুন সম্পর্কে বৃথা বাক্য
ব্যয় না করে একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি
জ্বালিয়ে দিয়ে বলিঃ 'এই হচ্ছে প্রকৃত আগুন ।
মীটসেফ খোলা রেখে, বিড়ালকে উপদেশ দিয়ে
অযথা সময় নষ্ট ক'রে লাভ নেই, আসুন
আমরা মীটসেফের দরোজাটা বন্ধ করে দেই ।'পুঁজিবাদী শোষণের পথ খোলা রেখে
সম্ভব নয় প্রকৃত মুক্তির স্বপ্ন দেখানো ।
ফুঁটো চৌবাচ্চায় জল থাকবার কথা নয়,
সে বেরিয়ে যাবেই; ওটাই জলের ধর্ম ।
আমাদের ধর্ম ভিন্ন হলেও টাকার ধর্ম একই ।বুদ্ধিমান কৃষক তাই আগাছা উপড়ে ফেলে সময়মত,
নইলে তার কষ্ট-কর্ষিত জমিতে কি ফলতো ফসল?
পরগাছার আক্রমণ থেকে ফলবান বৃক্ষকে
রক্ষা করতে হয় পরগাছার গোড়া কেটে দিয়ে ।
রক্তচোষা জোঁকের মুখে দিতে হয় থুথু, অথবা চুন,
প্রচন্ড আঘাত ছাড়া
পৃথিবীতে কবে কোন দেয়ার ভেঙেছে?
পরশ্রমভোগী ধনিক শ্রেণীর সর্বনাশ ছাড়া দরিদ্রের
পুষ্টিসাধনের সংকল্প হচ্ছে চমৎকার অলীক কল্পনা ।সুফল লাভ কি সম্ভব সুকর্ম ব্যতিরেকে?
কিংবা শস্য ভূমিকর্ষণ ছাড়া?
হাতুড়ে বৈদ্য গাংরিন সারাতে চান
ক্ষতস্থানে পুরনো ঘি মালিশ করে,
শিক্ষিত ডাক্তার পরামর্শ দেন অপারেশনের ।
তাতে কিছু রক্তপাত হয় বটে,
হয়তো কেটে ফেলতে হয় কোন প্রিয় অঙ্গ--
কিন্তু ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য ওটা এমন কিছু নয় ।
এর কোনো সহজ বিকল্প নেই । এটাই নিয়ম ।কথার ফুলঝুড়িতে চিড়ে ভিজানোর ব্যর্থ চেষ্টায়
সময় নষ্ট না করে আসুন আমরা জলের কথাই বলি ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
চিন্তামূলক
|
চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই
সদ্য-রজঃস্বলা এক কিশোরীরে−
যে জানে না, কী কারণে হঠাৎ এমন
তীব্র তুমুল আনন্দ-কাতরতা
ছড়িয়ে পড়েছে তার নওল শরীরে।মনুর ভাষায় গৌরী, এইটুকুনু মেয়ে
চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে−
দেখে তার অঙ্গজুড়ে ফুলের উৎসব।
মনে হয় ছড়িয়ে পড়েছে মর্ত্যে
নার্গিস আর বার্গিসের স্বর্গপুষ্পঘ্রাণ।
মাকে ডেকে মেয়েটি শুধায়−
‘আমার শরীরে ফুলের সৌরভ কেন?
মেয়েরা বুঝি ফুলের উদ্যান?’মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা বলেন,
‘বোকা মেয়ে, কিচ্ছু বোঝে না,−আয়,
আজ আমি কুসুমগরমজলে
তোকে নিজ হাতে গোসল করাব।’
মা’র বুকে মাথা পেতে মেয়েটি তখন
নিজেই কখন যেন মা হয়ে যায়।এই লাভাস্রোত, এই সঙ্গকাতরতা
তাকে শেষে কোথায় ভাসিয়ে নেবে
জানে না সে; বোঝে না সে
তার বৃক্ষপত্রে কার হাওয়া লাগে?
অগ্নিকুন্ডে বায়ুর মতন ছুটে এসে
কে তাকে জড়াবে আদরে, সোহাগে?জানে না সে, বোঝে না সে তার চোখে,
ঠোঁটে, তলপেটে, ঘুমভাঙা স্তনে
জেগেছে যে ঢেউ তার গন্তব্য কোথায়?
আনন্দ পুরুষে? নাকি আনন্দ সন্তানে?এইসব দেহতত্ত্ব জানার আগেই,
এইসব গূঢ় গোপন রহস্যভেদ
হওয়ার আগেই
আষাঢ়ের এক বৃষ্টিভেজা রাতে
মোনালিসার বিয়ে হয়ে গেল−
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সাথে।লিওনার্দো অতঃপর দীর্ঘ রাত্রি জেগে
জীবনের শেষ রং দিয়ে
তাঁর প্রিয়তমা তরুণী ভার্যা
মোনালিসাকে ক্যানভাসে আঁকলেন।শিল্পের ঔরসে মোনালিসা গর্ভবতী হলে
স্বর্গ থেকে মখলুকাতে পুষ্পবৃষ্টি হলো।
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে−
শান্ত হলো ক্ষিপ্তোন্মত্ত সমুদ্রের জল।মোনালিসা, য়ুরোপের প্রথম রমণী−
পুরুষের কান্ড দেখে হাসে।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
স্বদেশমূলক
|
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’
এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না৷
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হদৃয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প৷
সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর৷
না পার্ক না ফুলের বাগান, — এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়৷
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে৷
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক৷
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে৷
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: “কখন আসবে কবি?’ “কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের৷
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
চিন্তামূলক
|
এখন আমার বয়স কত হবে? একশ? নব্বই? আশি?
হায়রে আমার বেশি-বয়সের স্বপ্ন, আমার একশ হবে না ।
আমি ময়মনসিংহের কবি, নীরার একান্ত বাধ্য স্বামী,
আমার বয়স পঁয়ত্রিশ, আমি ঢাকায় এসেছি স্বরচিত
কবিতা পড়তে । আমার বড় ভাই পশ্চিম বাংলার,
আমি স্বদেশের মায়ায় জড়ানো কবি ।আয়াতুল্লা খোমিনির মতো আমার মাথার চুলে ব্রহ্মজীবী
শুভ্র-কাশদল, ফাল্গুনের হাওয়ায় মাতাল শাল-গজারীর
সবুজ পাতার ঝিলিমিলি আমার দু’চোখে ।
আমার দু’হাতে ধর্ম, দাঙ্গা,
আর প্রলম্বিত সামরিক শাসনের কালো শৃঙ্খলের দাগ ।
পায়ে এঁটেল মাটির মায়া, বুকে প্রিয়-নিধনের ক্ষত ।
আমি মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ, আমি জন্মযোদ্ধা ।
আমি যুদ্ধে-যুদ্ধে, বিপ্লবে-বিপ্লবে…,আমার পেছনে দগ্ধ
ইতিহাসের ট্রাজিক উল্লাস; তবু জানি আমার সম্মুখে আছে
পৃথিবী কাঁপানো স্বপ্ন, আছে নব-ভৌগোলিক শিখা ।আমার বয়স যখন বাড়বে, তখন প্রতিটি সূর্যোদয়ে
সূর্যমুখীর মতন একটি-একটি ক’রে পাপড়ি মেলবে
আমার প্রতিটি কবিতার ভিতর-বেলার বর্ণ ।আজ যে আঙুরগুলো আমি মাটির ভিতরে পুঁতে রেখে যাচ্ছি,
একদিন তার নেশায় মাতাল হবে ভবিষ্যতের বাংলা আমার ।
তখন আমার বয়স কত হবে?
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে,
মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর,
পাতা ঝরা, স্বচক্ষে স্বকর্ণে দেখা চাঁদ, জ্যোৎস্নাময়
রাতের উল্লাসে কালো বিষ । এ না হলে বসন্ত কিসের ?গাছের জরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়েছে অপিচ্ছিল বোধ,
ওর মুখে কুমারীর খুন, প্রসূতির প্রসন্ন প্রসূন ।
কন্ঠ ভরে করি পান পরিপূর্ণ সে-পাত্র বিষের,
চাই পূর্ণ শিশিরে নির্ঘুম । এ না হলে বসন্ত কিসের?নিজের জলেই টলমল করে আঁখি,
তাই নিয়ে খুব বিব্রত হয়ে থাকি।চেষ্টা করেও রাখতে পারি না ধরে-
ভয় হয় আহা, এই বুঝি যায় পড়ে।এমনিই আছি নদীমাতৃক দেশে,
অশ্রুনদীর সংখ্যা বাড়াবো শেষে?
আমার গঙ্গা আমার চোখেই থাক্
আসুক গ্রীষ্ম মাটি-ফাটা বৈশাখ।দোষ নেই যদি তখন যায় সে ঝরে,
ততদিন তাকে রাখতেই হবে ধরে।সেই লক্ষেই প্রস্তুতি করে সারা,
লুকিয়েছিলাম গোপন অশ্রুধারা।কিন্তু কবির বিধি যদি হন বাম,
কিছুতে পূর্ণ হয় না মনস্কাম।
মানুষ তো নয় চির-সংযমে সাধা,
তাই তো চোখের অশ্রু মানে না বাঁধা।আমার জলেই টলমল করে আঁখি,
তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
চিন্তামূলক
|
এখন আমার বয়স কত হবে? একশ? নব্বই? আশি?
হায়রে আমার বেশি-বয়সের স্বপ্ন, আমার একশ হবে না ।
আমি ময়মনসিংহের কবি, নীরার একান্ত বাধ্য স্বামী,
আমার বয়স পঁয়ত্রিশ, আমি ঢাকায় এসেছি স্বরচিত
কবিতা পড়তে । আমার বড় ভাই পশ্চিম বাংলার,
আমি স্বদেশের মায়ায় জড়ানো কবি ।আয়াতুল্লা খোমিনির মতো আমার মাথার চুলে ব্রহ্মজীবী
শুভ্র-কাশদল, ফাল্গুনের হাওয়ায় মাতাল শাল-গজারীর
সবুজ পাতার ঝিলিমিলি আমার দু'চোখে ।
আমার দু'হাতে ধর্ম, দাঙ্গা,
আর প্রলম্বিত সামরিক শাসনের কালো শৃঙ্খলের দাগ ।
পায়ে এঁটেল মাটির মায়া, বুকে প্রিয়-নিধনের ক্ষত ।
আমি মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ, আমি জন্মযোদ্ধা ।
আমি যুদ্ধে-যুদ্ধে, বিপ্লবে-বিপ্লবে...,আমার পেছনে দগ্ধ
ইতিহাসের ট্রাজিক উল্লাস; তবু জানি আমার সম্মুখে আছে
পৃথিবী কাঁপানো স্বপ্ন, আছে নব-ভৌগোলিক শিখা ।আমার বয়স যখন বাড়বে, তখন প্রতিটি সূর্যোদয়ে
সূর্যমুখীর মতন একটি-একটি ক'রে পাপড়ি মেলবে
আমার প্রতিটি কবিতার ভিতর-বেলার বর্ণ ।আজ যে আঙুরগুলো আমি মাটির ভিতরে পুঁতে রেখে যাচ্ছি,
একদিন তার নেশায় মাতাল হবে ভবিষ্যতের বাংলা আমার ।
তখন আমার বয়স কত হবে?
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন কর যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।তখন আমি একটু ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে।নায়ের মাঝে বসবো বটে,
না-এর মাঝে শোবো,
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
নিজের জলেই টলমল করে আঁখি,
তাই নিয়ে খুব বিব্রত হয়ে থাকি।চেষ্টা করেও রাখতে পারি না ধরে-
ভয় হয় আহা, এই বুঝি যায় পড়ে।এমনিই আছি নদীমাতৃক দেশে,
অশ্রুনদীর সংখ্যা বাড়াবো শেষে?
আমার গঙ্গা আমার চোখেই থাক্
আসুক গ্রীষ্ম মাটি-ফাটা বৈশাখ।দোষ নেই যদি তখন যায় সে ঝরে,
ততদিন তাকে রাখতেই হবে ধরে।সেই লক্ষেই প্রস্তুতি করে সারা,
লুকিয়েছিলাম গোপন অশ্রুধারা।কিন্তু কবির বিধি যদি হন বাম,
কিছুতে পূর্ণ হয় না মনস্কাম।
মানুষ তো নয় চির-সংযমে সাধা,
তাই তো চোখের অশ্রু মানে না বাঁধা।আমার জলেই টলমল করে আঁখি,
তোমার চোখের অশ্রু কোথায় রাখি।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই
আমার প্রতি তোমার অবহেলা৷কাব্যগ্রন্থঃ --প্রেমাংশুর রক্ত চাই
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
আমার কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু প্রাপ্য ছিল,
একখানা ঘর সবার মতো আপন করে পাবার,
একখানা ঘর বিবাহিত, স্বপ্ন ছিল রোজ সকালে
একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খাবার।সামনে বাগান, উঠোন চাইনি, চেয়েছিলাম
একজোড়া হাঁস, একজোড়া চোখ অপেক্ষমাণ
এই তো আমি চেয়েছিলাম।স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার, আর কিছু নয়,
তোমায় শুধু অনঙ্গ বউ ডাকার।
চেয়েছিলাম একখানি মুখ আলিঙ্গনে রাখার।অনঙ্গ বউ, অনঙ্গ বউ, এক জোড়া হাঁস,
এক জোড়া চোখ, কোথায়? তুমি কোথায়? কাব্যগ্রন্থঃ দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রকৃতিমূলক
|
হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র-সঙ্গীতে যতো আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে । আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা,–দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্তপথিক ।এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরণ,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায় । হায় কী আনন্দ জাগানিয়া ।এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ,
যতোই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য ।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্য খানি
নবীন পল্ববে, ফুলে ফুলে । বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে ।আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরুপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
ফুলের মতো দেয়ালটাতে
একটি প্রজাপতি,
দুঃসাহসে বসলো এসে
আলোর মুখোমুখি;
চিত্রিত নয় কালো রঙের
পাখনা দু'টি মেলে ।
এবার বুঝি এলে ?
দেয়াল জুড়ে লাগল তার
ঘরে ফেরার কাঁপন,
প্রাণের মাছে ফিরল বুঝি
চিরকালের আপন ।
ভালোবাসার অর্ঘ্য দিয়ে
মৃত্যুখানি কেনা,
শেষ করেছি প্রথম দিনে
হয়নি শুধু চেনা!
চোখের পাশে দেয়ালটিতে
বসলে তুমি যেই,
হঠাৎ-চেনা পাখার রেণু
আঙ্গুল ভরে নেই ।
এমন করে পরের ঘরে
দেয়ালে কেউ বসে?
হঠাৎ যদি ভালোবাসার
পলেস্তার খসে?
আলিঙ্গনে বন্দী করে
প্রতীক বাহুপাশে,
হঠাৎ যদি এই আমাকে
অন্যে ভালোবাসে?
রুপান্তরে পুড়িবে তোর
ক্লান্ত দু'টি ডানা,
চিত্রিত নয় কালো রঙের
পৃথিবী একটানা ।
আমি কেবল আমি কেবল
আমি কেবল দেখি,
ভালোবাসার দেয়াল জুড়ে
একটি প্রজাপতি ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
আবার একটা ফুঁ দিয়ে দাও,
মাথার চুল মেঘের মতো উড়ুক ।
আবার একটা ফুঁ দিয়ে দাও,
স্বপ্নগুলো ছায়ার মতো ঘুরুক ।আবার একটা ফুঁ দিয়ে দাও,
আটোমেটিক ঘড়ির মতো
চলতে থাকি একা ।আবার একটা ফুঁ দিয়ে দাও,
অন্ধকারে সলতে হয়ে
জ্বলতে থাকি একা ।আবার একটা ফুঁ দিয়ে দাও,
ফুসফুসে পাই হাওয়া ।আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ ‘ভালোবাসি’।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও
মূর্ছা যাবে,জাগাবো না,নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।‘ভালোবাসি’ বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
আকাশের তারা ছিঁড়ে ফেলি আক্রোশে,
বিরহের মুখে স্বপ্নকে করি জয়ী;
পরশমথিত ফেলে আসা দিনগুলি
ভুলে গেলে এতো দ্রুতো,হে ছলনাময়ী?পোড়াতে পোড়াতে চৌচির চিতা নদী
চন্দনবনে আগ্নির মতো জ্বলে,
ভূকম্পনের শিখরে তোমার মুখ
হঠাৎ স্মৃতির পরশনে গেছে গলে ।ফিরে গেলে তবু প্রেমাহত পাখি একা,
ঝড় কি ছিলো না সেই বিদায়ের রাতে >
ভুলে গেলে এতো দ্রুত, হে ছলনাময়ী,
পেয়েছিলে তাকে অনেক রাত্রিপাতে ।শব্দের চোখে করাঘাত করি ক্রোধে,
জাগাই দিনের ধূসর প্রতিচ্ছবি ।
না-পাওয়া মুখের মুখর সুষমা দিয়ে,
তবুও তোমার ছলনা-আহত কবি
তোমাকেই লেখে, তোমাকেই রচে প্রিয় !
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
স্বদেশমূলক
|
নিষিদ্ধ ভুবনগুলি অতিক্রম করে গেলো যারা,
রাতের আঁধার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যে ক্রুদ্ধ জীবন-জনতা
অতিক্রম করে গেল বাধা, অথবা
অতিক্রমণের মুখে যারা রোজ রোজ বাঁধা পড়ে,
সেইদিনও বাঁধা পড়েছিল এবং আগামী রাতেও
বিদ্ধ হবে যারা; বকনের মতো কাঁচা রমণীর প্রেম ভুলে গিয়ে,
ভালোবাসা, আনন্দের অভলাষ মিথ্যে ধরে নিয়ে
যারা রোজ সমর্পিত, বন্দী হয় বিরুদ্ধ-খোয়াড়ে,
সাজিয়ে সুরের সাথে মনের আঁধার প্রতিদিন;
আমি একা রমণীকে ভালবেসে-বেসে নিজেরি মুদ্রাদোষে
নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো রাত্রিদিন আলাদা হলেও
ছিলাম নদীর মতোই সমর্পিত সাগর মিছিরে সেইদিন।
তারও আগে বহুদিন, সেইসব মানুষের সাথে,
তাহাদেরই সাথে প্রতিদিন আমিও আমিও রয়েছি মিশে,
ছিলাম সেদিনও; এই পৃথিবীর, এই মানুষের
এই বাঙলার সূর্যমুখর শিশিরের প্রতিবাদে।আমাকে থাকতে হতো, আমাকে থাকতে হয়,
আমাকে থাকতে হবে, আমাকে থাকতেই হবে
লালশালুঘেরা স্টেজে, বক্তৃতায়, পল্টনের
মাউথ অর্গানে, গণসঙ্গীতের নির্যাতিত রাতে।
মারমুখো অন্যায়ের রাহুগ্রাসে আমাকেও দিতে হবে
প্রতিবাদে নৃশংস আগুন। লাঙ্গলের লাল ফালে,
বাস-ট্যাক্সি-লরীর আগুনে, হাসপাতালের উর্বর বেডে,
ইমার্জেন্সির নির্মম শয্যায়, মানুষের মৃত্যু-যন্ত্রণায়,
অনুর্বর বিমুখ ফাগুনে আমাকে থাকতে হবে,
আমাকে থাকতে হয় এইসব মানুষের সকল আগুনে।মানুষের কোলাহল ঘৃণা করে
জনতার চিৎকার থেকে দূরে, বহু দূরে
নিজেরি গোপন-ভ্রুণে কতবার হয়েছি শহীদ,
টোপে-গাঁথা মৎসের মতো একাকী রমণে কত
করেছি নিহত রাত্রিদিন অন্ধকারে শুধু রমণীকে।
এনেছি আকাশ থেকে নীলিমার পাপ
আর প্রাচুর্য বিশ্বাস, তবু কেনো কল্যাণী নিঃশ্বাস
বিনিময়ে দিয়েছি কি কেউ?কোনো কিছুতেই কোনোদিন কেউ কিছু
দেবে না জেনেও কতবার ভেবেছি একাকী
বাড়ির পাশের রোগা নদীটির কাছে বসে বসে;
মানুষ যেমন একা, অসহায় নিজের কাছেই
একদিন যদি ধরা পড়ে যায়, সে তখন কোন অজুহাতে,
কার নামে চোখ থেকে ফেরাবে মৃত্যুকে?
মানুষ কি করে পারে জীবন এবং মৃত্যুর মহিমাকে
রক্ত থেকে অস্বীকার করে শেফালির মৃতদেহ
কাঁধে নিয়ে মিছিলে দাঁড়াতে?
বহুদিন আসক্তিকে আরাধনা ভেবে
নীলিমার সারা দেহ সাজায়েছি মাধবীর স্তনে,
আর ঠিক সেইক্ষনে, বাইরে যখন
মানুষ এগিয়ে গেলো মানুষের দিকে-
(মানুষ এগিয়ে যাবে চিরকাল মানুষের দিকে?)
বন্দুক শোনালো তার অন্তিমের গান,
আগুন জানালো তার সর্বগ্রাসী ধ্বংসের আহ্বান,
এ্যাম্বুলেন্সের নীল হাসপাতাল
চলে এলো মৃত্যুর প্রতিরোধে, পথের বালক
যখন মৃত্যু-চিৎকারে আকাশে চৌচির হলো ফেটে,
কাঁদানে গ্যাসের সাথে থেকে থেকে
মানুষের শান্ত চোখগুলো
যখন টকটকে লাল হলো ফুলের মতন
আমি তো তখন মৃত্যু, আলিঙ্গন তুচ্ছ মনে করে
ডিমের খোলাশ ভেঙে পাখির মতন
রাজপথে বেড়িয়ে এসেছি, যেখানে মানুষ তার
জীবনের সব প্রাপ্য এসেছে মেটাতে।মানুষ যেদিন সঙ্গীতের মিহি সুর ভুলে গিয়ে
প্লাবনের কল্লোল দেখে প্রলয়ের চিৎকার দিয়েছিল,
অথবা মানুষ যেদিন নিছক বর্ষণে
ভিজে ভিজে হয়েছিল কাক, সেদিন আমিও ছিলাম;
মানুষের সাথে মিশে আমিও সেদিন
আটটি ফুঁটোর বাঁশি, উচ্চঙ্গের অবোধ সেতার
ভেঙেছি নির্জন রাতে দু'পায়ের চাপে,
সার্ট খুলে বুকে করে নিয়েছি বৃষ্টিকে
এবং বুঝেছি হয় চিৎকার কখনও সঙ্গীত।আমিও তোমাদের মতো প্রতিবাদে
বলেছি তখন, প্রেমাংশুর বুকের রক্ত চাই,
হন্তার সাথে আপোস কখনো নাই।
বুকের বোতাম খুলে প্রেমাংশুকে বলিনি কি দেখো,
আমার সাহসগুলি কেমন সতেজ বৃক্ষ;
বাড়ির পাশের রোগা নদীটির নীল জল থেকে
প্রতিদিন তুলে আনে লাল বিস্ফোরণ!কাব্যগ্রন্থ- প্রেমাংশুর রক্ত চাই।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
হাত ভেবে যেই ছুঁতে গেছি,
তুমি বললে, ছি!
ওটা আমার পা।একটুখানি থমকে গেলাম।
গুণে দেখলুম পাঁচটি আঙ্গুল,
পাঁচখানি নখ, পাঁচটি বকুল;
হাতের মতই ভাগ্যরেখা,
লাল টুকটুক গা।আমি যতই হাত বলছি,
তুমি বলছো “না”।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
প্রাণে জ্বলে ওঠে গগনচুম্বী
বাসনা ঢেউ,
তোমাকে পাবে না পরান ভরিয়া
আমি ছাড়া কেউ ।
তাই বুঝি এই ঘটনাটি কত
ধ্রুব, অবশ্য;
আমাকেও দ্রুত হতে হবে জানি
দৃঢ়, স্ববশ্য ।
আমি চলে যাব পার হয়ে নদী
থামব না মোটে,
দেখবে তোমার আকাশে তখন
কত তারা ফোটে-
হলুদ-সবুজ, কালো-লাল সব
প্রীতি-নমস্য ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
মানবতাবাদী
|
আসুন আমরা আগুন সম্পর্কে বৃথা বাক্য
ব্যয় না করে একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি
জ্বালিয়ে দিয়ে বলিঃ ‘এই হচ্ছে প্রকৃত আগুন ।
মীটসেফ খোলা রেখে, বিড়ালকে উপদেশ দিয়ে
অযথা সময় নষ্ট ক’রে লাভ নেই, আসুন
আমরা মীটসেফের দরোজাটা বন্ধ করে দিই ।’পুঁজিবাদী শোষণের পথ খোলা রেখে
সম্ভব নয় প্রকৃত মুক্তির স্বপ্ন দেখানো ।
ফুঁটো চৌবাচ্চায় জল থাকবার কথা নয়,
সে বেরিয়ে যাবেই; ওটাই জলের ধর্ম ।
আমাদের ধর্ম ভিন্ন হলেও টাকার ধর্ম একই ।বুদ্ধিমান কৃষক তাই আগাছা উপড়ে ফেলে সময়মত,
নইলে তার কষ্ট-কর্ষিত জমিতে কি ফলতো ফসল?
পরগাছার আক্রমণ থেকে ফলবান বৃক্ষকে
রক্ষা করতে হয় পরগাছার গোড়া কেটে দিয়ে ।
রক্তচোষা জোঁকের মুখে দিতে হয় থুথু, অথবা চুন,
প্রচন্ড আঘাত ছাড়া
পৃথিবীতে কবে কোন দেয়ার ভেঙেছে?
পরশ্রমভোগী ধনিক শ্রেণীর সর্বনাশ ছাড়া দরিদ্রের
পুষ্টিসাধনের সংকল্প হচ্ছে চমৎকার অলীক কল্পনা ।সুফল লাভ কি সম্ভব সুকর্ম ব্যতিরেকে?
কিংবা শস্য ভূমিকর্ষণ ছাড়া?
হাতুড়ে বৈদ্য গাংরিন সারাতে চান
ক্ষতস্থানে পুরনো ঘি মালিশ করে,
শিক্ষিত ডাক্তার পরামর্শ দেন অপারেশনের ।
তাতে কিছু রক্তপাত হয় বটে,
হয়তো কেটে ফেলতে হয় কোন প্রিয় অঙ্গ–
কিন্তু ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য ওটা এমন কিছু নয় ।
এর কোনো সহজ বিকল্প নেই । এটাই নিয়ম ।কথার ফুলঝুড়িতে চিড়ে ভিজানোর ব্যর্থ চেষ্টায়
সময় নষ্ট না করে আসুন আমরা জলের কথাই বলি ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল
আমাদের চারিধারে,
দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি
শিখার ভিতরে মুখ ।
গতকাল ছিল জীবনের কিছু
মরণের মতো সুখ ।গতকাল বড়ো যৌবন ছিল
শরীরে শরীর ঢালা,
ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল
উদাসীন গাছপালা ।আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে
লুকিয়েছিলাম প্রেম,
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল
বুঝিনি কী হারালাম !গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে
বাতাস তুলেছে গ্রিবা,
চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার
উজ্জ্বল মধুরিমা ।গতকাল বড়ো মুখোমুখি ছিল
সারাজীবনের চাওয়া,
চোখের নিমিষে চোখের ভিতরে
চোখের বাহিরে যাওয়া ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
এই বৃষ্টি আমাকে দেবেনা জলধারা, এইসব বৃক্ষপত্র
দূরাচারী দখিনা বাতাসে জানি হবে আত্মহারা।
পৃথিবীর স্নেহ পৃষ্ঠ থেকে রাত্রিভেজা প্রেমপুষ্পগুলি
তুলে নিয়ে বৃষ্টি বালিকারা তোমাকে অঞ্জলী দেবে।বেলা অবেলায় এই জলখেলা আমাকে দেবেনা কিছু জানি
আমি তবু ভালোবেসে আশাহত ভিক্ষাপাত্রখানি ধরে আছি
উর্ধ্বলোকে, মেঘদূতে কালিদাস কবি তুমি, উধাও নীলিমা।
পাবো না যে এ-কথাটি তুমি ছাড়া সবাই জানিত প্রিয়তমা।আষাঢ়ের ভাঙা বাঁশি হাতে তবু বসে থাকি তা,
জানে মৌন মহাকাল, আর অন্ধ আমার বিধাতা।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
চিন্তামূলক
|
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।
আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তাও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।
আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।
মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।
আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।
মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
রূপক
|
আমি জানি, সে তার প্রতিকৃতি কোনোদিন ফটোতে দেখেনি,
আয়নায়, অথবা সন্দ্বীপে বসে যেরকম
সর্বনাশা সমুদ্রে দেখা যায়, তার জলে
মুখ দেখে হঠাৎ লজ্জায় সে শুধুই ম্লান হতো একদিন ।আমি জানি পিঠ থেকে সুতোর কাপড়
কোনোদিন খোলেনি সে পুকুরের জলে, -লজ্জা,
সমস্ত কিছুতে লজ্জা ; কন্ঠে, চুলের খোঁপায়, চোখের তারায়।
আমি জানি আসন্নপ্রসব-অপরাধে, অপরাধবোধে
স্ফীতোদর সেই নারী কী রকম লজ্জাশীলা ছিল।অথচ কেমন আজ ভিনদেশী মানুষের চোখের সম্মুখে
নগ্ন সে, নির্লজ্জ হয়ে শুয়ে আছে
জলধারে পশু আর পুরুষের পাশে শুয়ে আছে।
তার ছড়ানো মাংশল বাহু নগ্ন,
কোমর, পায়ের পাতা, বুকের উথ্থান গুলো নগ্ন,
গ্রীবার লাজুক ভাঁজ নগ্ন; – কে যেন উন্মাদ হয়ে
তার সে নিঃশব্দ নগ্নতায় বসে আছে।তার সমস্ত শরীর জুড়ে প্রকৃতির নগ্ন পরিহাস,
শুধু গোপন অঙ্গের লজ্জা ঢেকে আছে সদ্য-প্রসূত-মৃত সন্তানের লাশ।তার প্রতিবাদহীন স্বাধীন নগ্নতা বন্দী করে এখন
সাংবাদিক, ঝুলন্ত ক্যামেরা নিয়ে ফটোগ্রাফার
ফিরে যাচ্ছে পত্রিকার বিভিন্ন পাতায়। অসহায়,
সূর্যের কাফনে মোড়ানো আমার বোনের মতো
এই লাশ আগের মতন আর বলছে না, বলবে না;
‘আমি কিছুতেই ছবি তুলবো না......।’যেন তার সমস্ত লজ্জার ভার এখন আমার।
কেবল আমার।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
চির অনাবৃতা হে নগ্নতমা
নদীর জল তোমাকে যেভাবে পেয়েছে
আমি সেভাবে পাই নি!
লাক্স সাবান যেভাবে তোমাকে ছুঁয়েছে
আমি সেভাবে ছুঁইনি।
মেডলিন লিপস্টিক যেভাবে তোমাকে চুমু খেয়েছে
আমি সে সুযোগ পাই নি।
প্রসাধন ঘরের চারদেয়াল তোমাকে যেভাবে দেখেছে
আমি সেভাবে তোমাকে দেখিনি।
গাঢ় অন্ধকার যেভাবে তোমাকে আলিঙ্গন করেছে
আমি তো তা পারি নি।
দিনের আলো যেভাবে তোমাকে দূরে সরিয়েছে
আমি সে প্রশ্রয় পাই নি
বেসিনের জল যেভাবে তোমার হাত ধরেছে
আমি সে সুযোগও পাই নি
তোমার হাতের বই বুক পর্যন্ত যেভাবে গড়িয়েছে
দেখে তো আমার ঈর্ষাই হয়েছে
এভাবে স্পর্শকাতর কবি ঈর্ষাকাতর হয়েছে
করেছে ভ্রমণ স্বপ্নের ভিতর
ঘুরেছে ঘোরে ঘোর ঘোরতর।
ম্যাক্সির ভিতর যেভাবে তুমি ঢুকেছো
আমার আলিঙ্গনে সেভাবে তুমি আসো নি
রাতের আকাশ যেভাবে তোমাকে দেখেছে
বৃষ্টির জল যেভাবে তোমাকে জড়িয়েছে
দিনের সূর্য যে উত্তাপ তোমাকে দিয়েছে
তোমার শরীরে পৃথিবীর পরে
আমি সে সুযোগ পাই নি।
ভোরের বায়ু তোমার এলায়িত চুলে
যেভাবে হাত বুলিয়েছে
এই কবি কি সে সুযোগ পেয়েছে?
ভিনদেশী পারফিউম তোমার গাঁয়ে যেভাবে গন্ধ মেখেছে
এই কবি কি তা পেরেছে?
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
কী ক'রে এমন তীক্ষ্ণ বানালে আখিঁ,
কী ক'রে এমন সাজালে সুতনু শিখা?
যেদিকে ফেরাও সেদিকে পৃথিবী পোড়ে ।
সোনার কাঁকন যখন যেখানে রাখো,
সেখানে শিহরে, ঝংকার ওঠে সুরে ।
সুঠাম সবুজ মরাল বাঁশের গ্রীবা
কঠিন হাতের কোমল পরশে জাগে,
চুম্বন ছাড়া কখনো বাঁচে না সে যে ।
পুরুষ চোখের আড়ালে পালাবে যদি,
কী লাভ তাহলে উর্বশী হয়ে সেজে?
বৈধ প্রেমের বাঁধন বোঝো না যদি,
কী ক'রে এমন শিথিল কবরী বাঁধো?
চতুর চোখের কামনা মিশায়ে চুলে
রক্তপলার পাথর-বাঁধানো হার
ছিঁড়ে ফেলে দাও, স্বপ্নে জড়াও ভুলে ।
কী ক'রে এমন কামনা-বাসনা-হারা
তাড়িত সাপের ত্বরিৎ-ফণার মতো
আপন গোপন গহনে মিলাও ধীরে?
বিজলি-উজ্জ্বল তিমির-বিনাশী শিখা
যেদিকে ফেরাও সেদিকে পৃথিবী পোড়ে ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
স্বদেশমূলক
|
তপ শেষে যখন বাল্মীকি তাঁর মুদিত নয়ন
খুলিলেন, দেখিলেন লব নেই; চোখের সমুখে
দিগন্তবিস্তৃত ধু-ধু শূন্য তপোবন প’ড়ে আছে৷
‘কোথা লব, কোথা লব? ফিরে আয়৷’ ডাকিলেন মুনি,
ফিরে এলো প্রতিধ্বনি, শিশু লব দিলো না উত্তর৷
এ কোন্ বিধির লীলা, ভাবিলেন চিন্তক্লীষ্ট মুনি:
‘শুন্য হাতে কী মুখে যাইব আজ সেই পূণ্যাশ্রমে,
– যেখানে অকল্পনীয় লব-হীন সীতার জীবন৷’
যোগসিদ্ধ ঋষি তিনি, দৈববিদ্যা করায়ত্ত তাঁর,
যদি সেই তপলব্ধ দৈবজ্ঞান করিলে প্রয়োগ
মাতৃকোল পূর্ণ হয়, তৃপ্ত করে সীতার হদৃয়–
তবে তাই হোক–, মহামন্ত্রে জন্ম নিল দেবশিশু৷
পেলো প্রাণ-চঞ্চলতা অবিকল লবের মতোন৷
যেহেতু নির্মিত কুশে, তার নাম রাখা হলো কুশ৷
না আমি নির্মিত নই বাল্মীকির কাল্পনিক কুশে,
আমাকে দিয়েছে জন্ম রক্তঝরা অমর একুশে৷
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি৷
তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি
সমস্ত বোধের উত্স গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও
ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও৷
আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।
এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,
-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,
ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয় ।অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্ফনি ;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
ভক্তিমূলক
|
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
হয় নিদ্রা আসুক, না হয় এক্ষুনি অবসান হোক
এই অসহ রাত্রির । আমি আর সইতে পারছি না ।
আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে নির্ঘুমতা ।
এই রাত্রি এখন আমার সহ্যসীমার বাইরে ।
দুঃখে-ক্ষোভে, অভিমানে আমার বুকের ভিতর থেকে
বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস, যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে
শূন্য হাতে উঠে আসা কোনো ব্যর্থ ডুবুরী ।চোখের ভিতরে হুল ফুটিয়ে বলি, একটু ঘুমাও,
আর কতক্ষণ, আর কতদিন এভাবে চলবে?
লক্ষীসোনা, মণি আমার, একটু ঘুমাও ।
মনকে বলি, এখন তো ছোট্ট ছেলেটি তুমি নও,
যে তোমাকে শোনাবে কেউ ঘুমপাড়ানিয়া গান ।
এখন তোমার ঘুমের জন্য কোন গান নেই ।
ভালোবাসার সাঁকো বেয়ে তুমি পৌছে গেছো এক
চির-নির্ঘুম দেশে, যেখানে দাউদাউ অগ্নিকুণ্ডে
জ্বলন্ত পৃথিবী; যেখানে নিদ্রা এক অচেনা প্রসঙ্গ ।একশ’ থেকে উল্টোদিকে শূণ্য পর্যন্ত গুনে
সেই কখন শেষ করেছি, তবু ঘুম আসে না ।
চিৎকার করে বলি, একশ এতো কম কেন?২
দুঃখ আমাকে জাগিয়ে রাখে ।
আনন্দের সাধ্য কী সে পাল্লা দেবে
দুঃখের সঙ্গে, দুঃখ খুব জাগরণ ভালোবাসে ।
হায় আমার দিনগুলি রাতের সঙ্গে, আর
রাতগুলি দিনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ।
একটি দিনকে অন্যদিন থেকে পৃথক করে যে-নিদ্রা,
সে-ই যদি অন্তর্হিত হয়, তবে কীভাবে আমি
অনুভব করি আমার সপ্রাণতা?
আমার কাঁধে চেপে বসেছে অখণ্ড সময়ের বোঝা ।
চিৎকার করে বলি, ‘এ বোঝা আমার নামাও ।’তুমি কি কিছু শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছো?
প্রত্যাশা করছো কেউ তোমাকে কিছু বলবে?
কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলবেনা, লক্ষীসোনা ভাই,
আমি বলছি, তুমি ঘুমাও । আরও একটু ভাবো,
বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করো তোমার অস্তিত্ব;
‘ভালোবাসা’ শব্দিটিকে নাড়াচাড়া করে দেখো ।হয়তো একটু হলেই রহস্যের সূত্র পেয়ে যাবে,
চোখের সামনেই খুলে যাবে অন্ধকারের তালা,
আর তুমি পেয়ে যাবে তোমার ঘুম-নগরীর চাবি ।
বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নকল নিদ্রা নয়,
তাকে তুমি ভিতর থেকে জাগাও ।৩
আমার খোলা আকাশের মতো চোখে
উড়ে বেড়ায় হরেক রঙের পাখি ।
আমার মস্তিষ্কের গভীর গোপন কুঠুরিতে
আজস্র পরীর দল প্রলয় নৃত্যে মাতে ।
স্বপ্ন-প্রেম, কামনা-বাসনা, স্মৃতি-বিস্মৃতির
জটাজলে বন্দী আমার রাত্রির পৃথিবী ।আমি সেই জট খুলতে খুলতে ক্লান্ত হই,
ক্লান্ত হই; কিন্তু আমার ঘুম আসে না ।
আমার আত্মার অন্তর্ভেদী আর্তনাদে
ঘরের দেয়ালগুলি কাঁপে ।রাতজাগা টিকটিকি ও আরশোলার মতো
আমি দেয়ালে-দেয়ালে অস্থির ছুটে যাই ।
শেষবারের মতো রাতের উদ্দেশে
আমার শেষ-তর্জনী তুলে বলি;
‘হয় অবসান হোক এই দুঃসহ রাত্রির,
না হয় নিদ্রা আসুক ।’
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
মানবতাবাদী
|
‘রাইতভর ঘুমুইতে পারি না,
ওরা আবার কহন আয়ে, কহন আয়ে।’আর কাঁন্দিস না মা, আমার কথা শোন,
তুই তোর হাতের শাঁখা খুলে ফেল,
মুছে ফেল তোর সিঁথির সিঁদুর।
মা-কালীর শেষকৃত্য দেখে-দেখে, শেষে
আমাদের শেষকৃত্য ডেকে আনবি নাকি?
চল মা, তোর ভগবান পুড়ছে, পুড়ুক।এই চন্দ্রমুগ্ধ মূর্খের উল্লাস থেমে গেলে
একাত্তরের মতো আবারও আমরা
ফিরে আসবো আমাদের অগ্নিশুদ্ধ ঘরে।
তখন তিনিই তোরে ফিরিয়ে দেবেন তোর
শাঁখা-সিঁদুর, তোর প্রতিমার ছিন্নভিন্ন দেহ।
তোর ভগবান কি অথর্ব, অন্ধ নাকি?তবে তাই কর বাবা, এই যে আমি
বন্ধ করলাম আমার চোখ, তুই ভেঙে দে
আমার শাঁখা, মুছে দে আমার সিঁদুর,
জ্বলে পুড়ে শুদ্ধ হোক আমার ঠাকুর।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
চিন্তামূলক
|
কাকের মুখে তুলে দিয়েছি নষ্ট ডিম,
এ নষ্ট জীবন আমি কার কাছে দেবো?
বাসন্তী কোকিল হতে গিয়ে
আমি ভুল করে হয়ে গেছি কাক।অথবা ছিলাম কাক, অপরাধে এই জন্মে
নষ্ট ডিমের মত হয়েছি মানুষ।এরকম নষ্ট মানুষ আমি কোথায় লুকাবো?
কার মুখে তুলে দেবো, জন্মান্তরে
ভুল হয়ে যাওয় এরকম মানুষিক কাক?
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
নাম ভুলে গেছি, দুর্বল মেধা
স্মরণে রেখেছি মুখ;
কাল রজনীতে চিনিব তোমায়
আপাতত স্মৃতিভুক ।ডাকিব না প্রিয়, কেবলি দেখিব
দু’চোখে পরান ভরে;
পূজারী যেমন প্রতিমার মুখে
প্রদীপ তুলিয়া ধরে ।তুমি ফিরে যাবে উড়ন্ত রথে
মাটিতে পড়িবে ছায়া,
মন্দির খুঁড়ে দেখিব তোমায়
মন্দ্রিত মহামায়া ।ভুলে যাব সব সময়-নিপাতে
স্মরণে জাগিয়ে প্রেম,
আঁধারে তখন জ্বলিবে তোমার
চন্দনে মাখা হেম ।
|
নির্মলেন্দু গুণ
|
প্রেমমূলক
|
যেকোনো বাগান থেকে যেটা ইচ্ছে সেই ফুল,
যেকোনো সময় আমি তুলে নিয়ে যদি কভু
তোমার খোঁপায়, আহা, অজগর তোমার খোঁপায়
সাজাবার সুজোগ পেতাম–; তাহলে দেখতে লীলা,
তোমার শরীর ছুঁয়ে লাবণ্যের লোভন ফুলেরা
উদ্বেল হৃদয়ে নিত্য বিপর্যস্ত হতো, মত্ত মমতায়
বলতো আশ্চর্য হয়ে, হতো বলতেইঃ
‘খোঁপার মতন কোনো ফুলদানি নেই৷’কাব্যগ্রন্থঃ--না প্রেমিক না বিপ্লবী
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.