poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
তুমি কি আমার গানের সুরের পূবালী বাতাস হবে, তুমি কি আমার মনের বনের বাঁশীটি হইয়া রবে! রাঙা অধরের রামধনুটিরে, ছড়াবে কি তুমি মোর মেঘ-নীড়ে, আমি কি তোমার কবি হব রাণী, তুমি কি কবিতা হবে; তুমি কি আমার মনের বনের বাঁশীটি হইয়া রবে! তুমি কি আমার মালার ফুলের ফিরিবে গন্ধ বয়ে, হাসিবে কি তুমি মোর কপালের চন্দন ফোঁটা হয়ে! তুমি কি আমার নীলাকাশ পরে, ফুটাবে কুসুম সারারাত ভরে, সাঁঝ-সকালের রাঙা মেঘ ধরে অঙ্গে জড়ায়ে লবে; তুমি কি আমার মনের বনের বাঁশীটি হইয়া রবে! ছিপ ছিপে তার পাতলা গঠন, রাঙা যে টুকটুক সোনা রূপায় ঝলমল দেখলে তাহার মুখ। সেই মেয়েটি বলল মোরে দিয়ে একখান খাতা, সেই মেয়েটি বলল মোরে দিয়ে একখান খাতা, লিখো কবি ইহার মাঝে যখন খুশী যা তা। উত্তরে তায় কইনু আমি, এই যে রূপের তরী, বেয়ে তুমি চলছ পথে আহা মরি মরি। যে পথ দিয়ে যাও সে পথে পথিক জনার বুকে, ঢেউ ভাঙিয়া এধার ওধার হয় যে কতই সুখে। রূপের ডালি চলছ বয়ে, শাড়ীর ভাজে ভাজে, কুসুম ফুলের মাঠখানি যে কতই রঙে রাজে। একটুখানি দাঁড়াও মেয়ে, অমন মুখের হাসি, খানিকটা তার ধরে রাখি দিয়ে কথার ফাঁসি। চলছ পথে ছড়িয়ে কতই রঙের রঙের ফুল, কিছুটা তার লই যে এঁকে দিয়ে ভাষার ভুল। রূপশালী ওই অঙ্গখানি, গয়না শাড়ীর ভাজে, আয়না খানা সামনে নিয়ে দেখছ কত সাজে। সত্যি করে বল কন্যে! সবার যেমন লাগে, তোমার কাছে লাগে কি তার হাজার ভাগের ভাগে? নিজের ভোগেই আসে না যা, কেনবা যতন ভরে, সাবধানেতে রাখছ তাহার সবার আড়াল করে! রূপ দেখে যার ভাল লাগে, রূপ যে শুধু তার, তার হুদয়ে উথলপাথল রূপের মহিমার। কেন তুমি কৃপণ এত! তোমার যাহা নয়, পরের ধনে পোদ্দারী কি তোমার শোভা পায়? সবই ত যায়, কিছুই ভবে রয় না চির তরে, বাসর রাতের শেষ না হতে রূপের প্রদীপ ঝরে। কি করে বা রাখবে তারে? বাহুর বাঁধনখানি, এতই শিথিল, পারেনা যে রাখতে তারে টানি। শুধু কথার সরিত সাগর, তাহার নিতল জলে, রূপের কমল রয় যে ফুটে মেলি হাজার দলে। কথার খাঁচায় বন্দী হতে এই ভঙ্গুর ধরা, কত কাল যে করছে সাধন হয়ে স্বয়ম্বরা। সেই কথাও চিরকালের হয় না চিরদিন, সেদিন তোমার আর আমারো রইবেনাক চিন।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(এক)বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী, উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি | --- রাখালী গানএই এক গাঁও, ওই এক গাঁও --- মধ্যে ধু ধু মাঠ, ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ | এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ ; গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ | ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া, ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া |এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে, কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে! মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল, বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল | এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে, জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে! কেউবা বলে --- আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি ; এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে, ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়, জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়ে | কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি, শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি | মাঠের মাঝের জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ, জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ ! বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি, মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি | সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানে ধায়, ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় | এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে |এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর --- শুধুই জলের ডাক, তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নেইকো কোন ফাঁক | ও-গাঁর বধু ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে, কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসে লাগে | এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে, ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে! এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান, ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান | এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে ; অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে |এ-গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও-গাঁর লোকের সনে, কাইজা ফ্যাসাদ্ করেছে যা জানেই জনে জনে | এ-গাঁর লোকেও করতে পরখ্ ও-গাঁর লোকের বল, অনেকবারই লাল করেছে জলীর বিলের জল | তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ, মাঝখানে তার ধূলায় দোলে দুখান দীঘল বাট ; দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা, এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা |
জসীম উদ্‌দীন
রূপক
জলের উপরে চলেছে জলের মেয়ে, ভাঙিয়া টুটিয়া আছড়িয়া পড়ে ঢেউগুলি তটে যেয়ে। জলের রঙের শাড়ীতে তাহার জড়ায়ে জড়ায়ে ঘুরি, মাতাল বাতাস অঙ্গের ঘ্রাণ ফিরিছে করিয়া চুরি। কাজলে মেখেছে নতুন চরের সবুজ ধানের কায়া, নয়নে ভরেছে ফটিকজলের গহন গভীর মায়া। তাহার উপর ছায়া-চুরি খেলা করিতে তটের বন, সুবাস ফুলের গন্ধ ছড়ায়ে হাসিতেছে সারাখন। জলের কন্যা চলেছে জলের রথে, খুশীতে ফুটিয়া শাপলা-পদ্ম হাসিতেছে পথে পথে। আগে আগে চলে কলজলধারা ভাসায়ে পানার তরী, চরণে তাহার আলতা পরাতে হিজল পড়িছে ঝরি। ডাহুক ডাহুকী ডাকে বন-পথে নতুন পানির সুরে, কোঁড়া আজ তার কুঁড়ীরে খুঁজিছে ঘন পাট-ক্ষেতে দূরে; পুরাতন জালে তালি দিতে দিতে ঢলিয়া জেলের গায়, জেলে বোর মন মিহিসুরী গানে উজানীর বাঁকে ধায়। পল্লীবধূরা উদাস নয়নে চেয়ে থাকে তটপানে, বাপের বাড়ির মমতায় আজ পরাণ কেন যে টানে। বাঙড়ের খালে সিনান করিতে কলসী ধরিয়া টানি, মায়েরে কহিছে মেয়ের কথাটি নয়া-জোয়ারের পানি! হোগরার ছই নতুন বাঁধিয়া গাব-জলে মাজা নায়, বাপ চলিয়াছে মেয়েরে আনিতে সুদূরের ভিন গাঁয়। বৈঠার ঘায়ে গলা জলে-ডোবা নাচিছে আমন ধান, কলমির লতা জড়াইয়া তারে ফুলহাসি করে দান! ঢ্যাপের মোয়ার চিত্রিত হাঁড়ি আবার ভরিয়া যায়, পিঠায় আঁকিয়া নতুন নকশা রাত ভোর করে মায়। জলের কন্যা চলেছে জলের পরে, মাছেরা চলছে দলে দলে আজ পথটি তাহার ধরে। রুহিত লাফায়, চিতল ফালায়, ভাটা মাছ সারি সারি, সাথে সাথে যায় আগে পিছে ধায় খুশী যেন ওরা তারি। শোল মাছ তার শিশুপোনাগুলি ছড়ায়ে লেজের ঘায়, টুবটুব করে আদরিয়া পুন জড়াইছে বুক-ছায়; নকসী কাঁথাটি মেলিয়া ধরিয়া গুমরে চাষার নারী, সযতনে যেন গুটায়ে ধরিছে বুকের নিকটে তারি। জলঘাসগুলি ঈষৎ কাঁপিছে তাদের চলার দোলে, মৃদুল বাতাসে ঝুমিতেছে বন জলের দুনিয়া কোলে। জলের কন্যা যায়, নতুন পানির লিখন বহিয়া বন্ধ বিলের ছায়। তটের বক্ষে আছাড়িয়া মাথা ক্ষতবিক্ষত করি, বন্দী-মাছেরা কাটাইত দিন জীয়নে- যেন মরি। অঙ্গ ভরিয়া শ্যাওলা জড়ান নির্জীব ঘুম-দোলে, রোগ-পান্ডুর অসাড় দেহ যে পড়িতে চাহিছে ঢলে। আজিকে নতুন জল-কল্লোল শুনিতে পেয়েছে তারা, সহসা অঙ্গে হিল্লোলি ওঠে উধাও গতির ধারা! কে যেন ঘোষিছে তাহাদের কানে সহস্র দিক হতে, ভাঙ্ ভাঙ্ কারা ভাঙ্ ভাঙ্ পাড় উদ্দাম জলস্রোতে। জলের কন্যা জল-পথ দিয়ে যায়, বকের ছানারা পাখার আড়াল রচিছে তাহার গায়। দুইধারে ঘন কেয়ার কুঞ্জ ছড়ায় সুবাস-রেণু মাতাল বাতাস রহিয়া রহিয়া চুমিছে বনের বেনু। তটে তটে কাঁদে শূন্য কলসী, কুটীরের দীপ ডাকে, আঙিনার বেলী মাটিতে লুটায়, কে কুড়ায়ে লবে তাকে?
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(দশ)নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর, বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর | মাঠের কাজেতে ব্যস্ত রূপাই, নয়া বউ গেহ কাজে, দুইখান হতে দুটি সুর যেন এ উহারে ডেকে বাজে | ঘর চেয়ে থাকে কেন মাঠ পানে, মাঠ কেন ঘর পানে, দুইখানে রহি দুইজন আজি বুঝিছে ইহার মানে |আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান, সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান | ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়, কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায় | আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে, মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে |আজকে রূপার বড় কাজ---কাজ---কোন অবসর নাই, মাঠে যেই ধান ধরেনাক আজি ঘরে দেবে তারে ঠাঁই | সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি, সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি |আজকে রূপার মনে পড়েনাক শাপলার লতা দিয়ে, নয়া গৃহিনীর খোঁপা বেঁধে দিত চুলগুলি তার নিয়ে | সিঁদুর লইয়া মান হয়নাক বাজে না বাঁশের বাঁশী, শুধু কাজ---কাজ, কি যাদু-মন্ত্র ধানেরা পড়িছে আসি |সারাটি বরষা কে কবি বসিয়া বেঁধেছে ধানের গান, কত সুদীর্ঘ দিবস রজনী করিয়া সে অবসান | আজকে তাহার মাঠের কাব্য হইয়াছে বুঝি সারা, ছুটে গেঁয়ো পাখি ফিঙে বুলবুল তারি গানে হয়ে হারা |কৃষাণীর গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো ; এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো ফুটো! আজকে তাহার পাড়া-বেড়ানর অবসর মোটে নাই, পার খাড়ুগাছি কোথা পড়ে আছে, কেবা খোঁজ রাখে ছাই!অর্ধেক রাত উঠোনেতে হয় ধানের মলন মলা, বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা | দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি, ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি | কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান, কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান | হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোত্স্নার জাল পাতি, টেনে টেনে তারে হয়রান হয়ে ডুবে যায় রাতারাতি |এমনি করিয়া ধানের কাব্য হইয়া আসিল সারা, গানের কাব্য আরম্ভ হল সারাটা কৃষাণ পাড়া! রাতেরে উহারা মানিবে না যেন, নতুন গলার গানে, বাঁশী বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে |আজিকে রূপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি, শিয়রে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী |সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি, ঘুম হতে তারে সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি |নতুন করিয়া আজকে উহারা চাহিছে এ ওর পানে, দীর্ঘ কাজের অবসর যেন কহিছে নতুন মানে! নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর, সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়নড়! বাঁশের বাঁশীতে ঘুণ ধরেছিল, এতদিন পরে আজ, তেলে জলে আর আদরে তাহার হইল নতুন সাজ | সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রূপাই বাজায় বাঁশী, মহাশূণ্যের পথে সে ভাসায় শূণ্যের সুররাশি! ক্রমে রাত বাড়ে, বউ বসে দূরে, দুটি চোখ ঘুমে ভার, 'পায়ে পড়ি ওগো চলো শুতে যাই, ভাল লাগে নাক আর |' রূপা ত সে কথা শোনেই নি যেন, বাঁশী বাজে সুরে সুরে, 'ঘরে দেখে যারে সেই যেন আজি ফেরে ওই দূরে দূরে |' বউ রাগ করে, 'দেখ, বলে রাখি, ভাল হবেনাক পরে, কালকের মত কর যদি তবে দেখিও মজাটি করে | ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাজাইবে যদি বাঁশী, সিঁদুর আজিকে পরিব না ভালে, কাজল হইবে বাসি | দেখ, কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল, আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল |' বেচারী রূপাই বাঁশী বাজাইতে এমনি অত্যাচার, কৃষাণের ছেলে! অত কিবা বোঝে, তখনই মানিল হার |কহে জোড় করে, 'শোন গো হুজুর, অধম বাঁশীর প্রতি, মৌন থাকার কঠোর দণ্ড অন্যায় এ যে অতি | আজকে ও-ভালে সিঁদুর দিবে না, খুলিবে কানের দুল, সন্ধ্যে হবে না সিঁদুরে রঙের---ভোরে হাসিবে না ফুল! এক বড় কথা! আচ্ছা দেখাই, ওরে ও অধম বাঁশী, এই তরুণীর অধরের গানে তোমার হইবে ফাঁসী!' হাতে লয়ে বাঁশী বাজাইল রূপা মাঠের চিকন সুরে, কভু দোলাইয়া বউটির ঠোঁটে কভু তারে ঘুরে ঘুরে | বউটি যেন গো হেসে হয়রান, কহে ঠোঁটে ঠোঁট চাপি, 'বাঁশীর দণ্ড হইল, কিন্তু যে বাজাল সে পাপী?' পুনঃ জোর করে রূপা কহে, 'এই অধমের অপরাধ, ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!' রূপার বলার এমনি ভঙ্গী বউ হেসে কুটি কুটি, কখনও পড়িছে মাটিতে ঢলিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি | পরে কহে, 'দেখো, আরও কাছে এসো, বাঁশীটি লও তো হাতে, এমনি করিয়া দোলাও ত দেখি নোলক দোলার সাথে!'বাঁশী বাজে আর নোলক যে দোলে, বউ কহে আর বার, 'আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী লতার হার? এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর,' তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাঁশী সুমধুর! দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, 'এরি মত, তোমার বাঁশীতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত |' চলে মেঠো বাঁশী দুটি ঠোঁট ছুঁয়ে কলমী ফুলের বুকে, ছোট চুমু রাখি চলে যেন বাঁশী, চলে সে যে কোন লোকে |এমনি করিয়া রাত কেটে যায় ; হাসে রবি ধীরি ধীরি, বেড়ার ফাঁকেতে উঁকি মেরে দেখি দুটি খেয়ালীর ছিরি | সেদিন রাত্রে বাঁশী শুনে শুনে বউটি ঘুমায়ে পড়ে, তারি রাঙা মুখে বাঁশী-সুরে রূপা বাঁকা চাঁদ এনে ধরে | তারপরে খুলে চুলের বেণীটি বার বার করে দেখে, বাহুখানি দেখে নাড়িয়া নাড়িয়া বুকের কাছেতে রেখে | কুসুম-ফুলেতে রাঙা পাও দুটি দেখে আরো রাঙা করি, মৃদু তালে তালে নিঃশ্বাস লয়, শুনে মুখে মুখ ধরি | ভাবে রূপা, ও-যে দেহ ভরি যেন এনেছে ভোরের ফুল, রোদ উঠিলেই শুকাইয়া যাবে, শুধু নিমিষের ভুল! হায় রূপা, তুই চোখের কাজলে আঁকিলি মোহন ছবি, এতটুকু ব্যথা না লাগিতে যেরে ধুয়ে যাবে তোর সবি!ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল, সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রূপার কূল! বাঁশী লয়ে রূপা বাজাতে বসিল বড় ব্যথা তার মনে, উদাসীয়া সুর মাথা কুটে মরে তাহার ব্যথার সনে |ধারায় ধারায় জল ছুটে যায় রূপার দুচোখ বেয়ে, বইটি তখন জাগিয়া উঠিল তাহার পরশ পেয়ে | 'ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল? একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল? ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?' বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল! বাহুখানা তার কাঁধ পরে রাখি রূপা কয় মৃদু সুরে, 'শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!''সে দূর কোথায়?' 'অনেক---অনেক---দেশ যেতে হয় ছেড়ে, সেথা কেউ নাই শুধু আমি তুমি আর সেই সে অচেনা ফেরে | তুমি ঘুমাইলে সে এসে আমায় কয়ে যায় কানে কানে, যাই---যাই---ওরে নিয়ে যাই আমি আমার দেশের পানে | বল, তুমি সেথা কখনও যাবে না, সত্যি করিয়া বল!' 'নয়! নয়! নয়!' বউ কহে তার চোখ দুটি ছল ছল |রূপা কয় 'শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর, তোমার রূপের উপহাস শুধু করে সারা দিনভর | তুমি ফুল! তব ফুলের গায়েতে বহে বিহানের বায়ু, আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু | আহা আহা সখি, তুমি যাহা কর, মোর মনে লয় তাই, তোমার ফুলের পরাণে কেবল দিয়া যায় বেদনাই |' এমন সময় বাহির হইতে বছির মামুর ডাকে, ধড়মড় করি উঠিয়া রূপাই চাহিল বেড়ার ফাঁকে |
জসীম উদ্‌দীন
চিন্তামূলক
তরুণ কিশোর ! তোমার জীবনে সবে এ ভোরের বেলা, ভোরের বাতাস ভোরের কুসুমে জুড়েছে রঙের খেলা। রঙের কুহেলী তলে, তোমার জীবন ঊষার আকাশে শিশু রবি সম জ্বলে। এখনো পাখিরা উঠেনি জাগিয়া, শিশির রয়েছে ঘুমে, কলঙ্কী চাঁদ পশ্চিমে হেলি কৌমুদী-লতা চুমে। বঁধুর কোলেতে বধুয়া ঘুমায়, খোলেনি বাহুর বাঁধ, দীঘির জলেতে নাহিয়া নাহিয়া মেটেনি তারার সাধ। এখনো আসেনি অলি, মধুর লোভেতে কোমল কুসুম দুপায়েতে দলি দলি। এখনো গোপন আঁধারের তলে আলোকের শতদল, মেঘে মেঘে লেগে বরণে বরণে করিতেছে টলমল। এখনো বসিয়া সেঁউতীর মালা গাঁথিছে ভোরের তারা, ঊষার রঙিন শাড়ীখানি তার বুনান হয়নি সারা। হায়রে করুণ হায়, এখনি যে সবে জাগিয়া উঠিবে প্রভাতের কিনারায়। এখন হইবে লোক জানাজানি, মুখ চেনাচেনি আর, হিসাব নিকাশ হইবে এখন কতটুকু আছে কার। বিহগ ছাড়িয়া ভোরের ভজন আহারের সন্ধ্যানে, বাতাসে বাঁধিয়া পাখা-সেতু-বাঁধ ছুটিবে সুদুর-পানে। শূন্য হাওয়ার শূন্য ভরিতে বুকখানি করি শুনো, ফুলের দেউল হবে না উজাড় আজিকে প্রভাতে পুন। তরুণ কিশোর ছেলে, আমরা আজিকে ভাবিয়া না পাই তুমি হেথা কেন এলে? তুমি ভাই সেই ব্রজের রাখাল, পাতার মুকুট পরি, তোমাদের রাজা আজো নাকি খেলে গেঁয়ো মাঠখানি ভরি। আজো নাকি সেই বাঁশীর রাজাটি তমাল-লতার ফাঁদে, চরণ জড়ায়ে নূপুর হারায়ে পথের ধূলায় কাঁদে কে এলে তবে ভাই, সোনার গোকুল আঁধার করিয়া এই মথুরার ঠাই। হেথা যৌবন মেলিয়া ধরিয়া জমা-খরচের খাতা, লাভ লেকাসান নিতেছে বুঝিয়া খুলিয়া পাতায় পাতা। ওপারে কিশোর, এপারে যুবক, রাজার দেউল বাড়ি, পাষাণের দেশে কেন এলে ভাই। রাখালের দেশ ছাড়ি? তুমি যে কিশোর তোমার দেশেতে হিসাব নিকাশ নাই, যে আসে নিকটে তাহারেই লও আপন বলিয়া তাই। আজিও নিজেরে বিকাইতে পার ফুলের মালার দামে, রূপকথা শুনি তোমাদের দেশে রূপকথা-দেয়া নামে। আজো কানে গোঁজ শিরীষ কুসুম কিংশুক-মঞ্জরী, অলকে বাঁধিয়া পাটল ফুলেতে ভরে লও উত্তরী! আজিও চেননি সোনার আদর, চেননি মুক্তাহার, হাসি মুখে তাই সোনা ঝরে পড়ে তোমাদের যারতার। সখালী পাতাও সখাদের সাথে, বিনামূলে দাও প্রাণ, এপারে মোদের মথুরার মত নাই দান-প্রতিদান। হেথা যৌবন যত কিছু এর খাতায় লিখিয়া লয়, পান হতে চুন খসেনাক-এমনি হিসাবময়। হাসিটি হেথায় বাজারে বিকায় গানের বেসাত করি, হেথাকার লোক সুরের পরাণ ধরে মানে লয় ভরি। হায়রে কিশোর হায়! ফুলের পরাণ বিকাতে এসেছ এই পাপ-মথুরায় কালিন্দী লতা গলায় জড়ায়ে সোনার গোকুল কাঁদে ব্রজের দুলাল বাঁধা নাহি পড়ে যেন মথুরার ফাঁদে। মাধবীলতার দোলনা বাঁধিয়া কদম্ব-শাখে শাখে, কিশোর! তোমার কিশোর সখারা তোমারে যে ওই ডাকে। ডাকে কেয়াবনে ফুল-মঞ্জরি ঘন-দেয়া সম্পাতে, মাটির বুকেতে তমাল তাহার ফুল-বাহুখানি পাতে। ঘরে ফিরে যাও সোনার কিশোর! এ পাপমথুরাপুরী, তোমার সোনার অঙ্গেতে দেবে বিষবান ছুঁড়ি ছুঁড়ি। তোমার গোকুল আজো শেখে নাই ভালবাসা বলে কারে, ভালবেসে তাই বুকে বেঁধে লয় আদরিয়া যারে তারে। সেথায় তোমার কিশোরী বধূটি মাটির প্রদীপ ধরি, তুলসীর মূলে প্রণাম যে আঁকে হয়ত তোমারে স্মরি। হয়ত তাহাও জানে না সে মেয়ে জানে না কুসুম-হার, এত যে আদরে গাঁথিছে সে তাহা গলায় দোলাবে কার? তুমিও হয়ত জান না কিশোর, সেই কিশোরীর লাগি, মনে মনে কত দেউল গেঁথেছে কত না রজনী জাগি। হয়ত তাহারি অলকে বাঁধিতে মাঠের কুসুম ফুল, কতদূর পথ ঘুরিয়া মরিছ কত পথ করি ভুল। কারে ভালবাস, কারে যে বাস না তোমরা শেখনি তাহা, আমাদের মত কামনার ফাঁদে চেননি উহু ও আহা! মোদের মথুরা টরমল করে পাপ-লালসার ভারে, ভোগের সমিধ জ্বালিয়া আমরা পুড়িতেছি বারে বারে। তোমাদের প্রেম নিকষিত হেম কামনা নাহিক তায় যুগে যুগে কবি গড়িয়াছে ছবি কত ব্রজের গাঁয়! তোমাদের সেই ব্রজের ধূলায় প্রেমের বেলাতি হয়, সেথা কেউ তার মূল্য জানে না, এই বড় বিস্ময়। সেই ব্রজধূলি আজো ত মুছেনি তোমার সোনার গায়, কেন তবে ভাই, চরণ বাড়ালে যৌবন মথুরায়! হায়রে প্রলাপী কবি! কেউ কভু পারে মুছিয়া লইতে ললাটেরলেখা সবি। মথুরার রাজা টানিছে যে ভাই! কালের রজ্জু ধরে, তরুণ কিশোর! কেউ পারিবে না ধরিয়া রাখিতে তোরে। ওপারে গোকুল এপারে মথুরা মাঝে যমুনার জল, নীল নয়নেতে তোর ব্যথা বুঝি বয়ে যায় অবিরল। তবু যে তোমারে যেতে হবে ভাই, সে পাষাণ মথুরায়, ফুলের বসতি ভাঙিয়া এখন যাইবি ফলের গাঁয়। এমনি করিয়া ভাঙা বরষায় ফুলের ভূষণ খুলি, কদম্ব-বধূ শিহরীয়া উঠে শরৎ হাওয়ায় দুলি। এমনি করিয়া ভোরের শিশির ফুরায় ভোরের ঘাসে, মাধবী হারায় বুকের সুরভি নিদাঘের নিম্বাস। তোরে যেতে হবে চলে এই গোকুলের ফুলের বাঁধন দুপায়েতে দলে দলে। তবু ফিরে চাও সোনার কিশোর বিদায় পথের ধার, কি ভূষণ তুমি ফেলে গেলে ব্রজে দেখে লই একবার। ওই সোনামুখে আজো লেগে আছে জননীর শত চুমো, দুটি কালো আঁখি আজো হতে পারে ঘুম-গানে ঘুম্ ঘুমো। বরণ তাদের আর পেলবতা লিখে গেছে নির্ভূল। কচি শিশু লয়ে ধরার মায়েরা যে আদর করিয়াছে, সোনা ভাইদের সোনা মুখে বোন যত চুমা রাখিয়াছে; সে সব আজিকে তোর ওই দেহে করিতেছে টলমল, নিখিল নারীর স্নেহের সলিলে তুই শিশু শতদল। রে কিশোর! এই মথুরার পথে সহসা দেখিয়া তোরে, মনে হয় যেন ওমনি কাহারে দেখেছিনু এক ভোরে। সে আমার এই কৈশোর-হিয়া, জীবনের একতীরে, কোথা হতে যেন সোনার পাখিটি উড়ে এসেছিল ধীরে। পাখায় তাহার বেঁধে এনেছিল দূর গগনের লেখা, আর এনেছিল রঙিন ঊষার একটু সিঁদুর-রেখা। সে পাখি কখন উড়িয়া গিয়াছে মোর বালুচর ছাড়ি, আজিও তাহারে ডাকিয়া ডাকিয়া শূন্যে দুহাত নাড়ি। সোনার কিশোর ভাই, তোর মুখ হেরী মনে হয় যেন কোথায় ভাসিয়া যাই। এত কাছে তুই, তবু মনে হয় আমাদের গেঁয়ো নদী, রোদ-মাখা সাদা বালু-চরখানি শুকাইছে নিরবধি; সেইখানে তুই দুটি রাঙা পায়ে আঁকিয়া পায়ের রেখা, চলেছিস একা বালুকার বুকে পড়িয়া টেউএর লেখা। সে চরে এখনো মাঠের কৃষাণ বাঁধে নাই ছোট ঘর, কৃষাণের বউ জাঙলা বাঁধেনি তাহার বুকের পর। লাঙল সেথায় মাটিরে ফুঁড়িয়া গাহেনি ধানের গান, জলের উপর ভাসিতেছে যেন মাটির ও মেটো-থান। বর্ষার নদী এঁকেছিল বুকে ঢেউ দিয়ে আলপনা, বর্ষা গিয়াছে, ওই বালুচর আজো তাহা মুছিল না। সেইখান দিয়ে চলেজ উধাও, চখা-চখি উড়ে আগ, কোমল পাখার বাতাস তোমার কমল মুখেতে লাগে। এপারে মোদের ভরের‘গেরাম’আমরা দোকানদার, বাটখারা লয়ে মাপিতে শিখেছি কতটা ওজন কার। তবুরে কিশোর, ওই পারে যবে ফিরাই নয়নখানি, এই কালো চোখে আজো এঁকে যায় অমরার হাতছানি। ওপারেতে চর এ পারেতে ভর মাঝে বহে গেঁয়ো নদী। কিশোর কুমার, দেখিতাম তোরে ফিরিয়া দাঁড়াতি যদি। তোর সোনা মুখে উড়িতেছে আজো নতুন চরের বালি, রাঙা দুটি পাও চলিয়া চলিয়া রাঙা ছবি আঁকে খালি। তুই আমাদের নদীটির মত দুপারে দুইটি তট, দুই মেয়ে যেন দুইধারে টানে বুড়াতে কাঁখের ঘট। ওপারে ডাকিছে নয়া বালুচর কিশোর কালের সাথী, এপারেতে ভর ভরা যৌবন কামনা-ব্যথায় ব্যথী। তুই হেথা ভাই ঘুমাইয়া থাক গেঁয়ো নদীটির মত, এপার ওপার দুটি পাও ধরে কাঁদুক বাসনা যত।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
আজ তুমি আসিবে যে মেয়ে, সেই ডোবা পুকুরের পানা পুকুরের, কলমীলতার জাল দিয়ে ঘেরা পানি- সেই সে পানিতে নেয়ে। মনে যদি হয় কলমী ফুলের কতকটা রঙ লইও অধরে মেখে, ঠোটেতে মাখিও আর একটুকু হাসি লাল সাপলার ফোটা ফুলগুলি দেখে। যদি মনে হয় সিক্ত বসনে একটু দাঁড়িও ও অঙ্গ বেয়ে ঝরিবে সজল সোনা, দোষ নিওনাক ডাহুকের ডাকে হয় যদি কিছু ছোট ছোট গীতি বোনা। দোষ দিওনাক হে লাজ-শোভনা! বক্ষে তোমার যুগল কমল ফুল, সিক্ত বসন শাসন না মানি যদি উকি দেয় নিমেষে করিয়া ভুল; যদি আকাশের সোনা সোনা রোদ সেখানে ছড়ায়ে পড়ে, তুমি খুব ভাল মেয়ে! কোন অপরাধ রাখিও না অন্তরে। রঙিন বসন আজ না পরিলে, পদ্ম পাতার সবুজ শাড়ীটি তোমারে মানায় ভাল। শ্রী অঙ্গ হতে তারি ভাজে ভাজে হাসিবে খেলিবে বিজলী লতার আলো। সামনে দেখিবে ধান খেতগুলি, অঙ্গ হইতে ছড়াইও কিছু সোনা, ধান ছড়াগুলি নাচিয়া উঠিবে বাতাসের দোলে হয়ে চঞ্চল মনা। সাবধানে তুমি চলিও কন্যা! সামনে রয়েছে মটরশুটির খেত; পাতায় পাতায় রাঙা বউগুলি ফুল হয়ে ওরা হেসে কুটি কুটি স্বপ্নের ঘোরে কোন সে বধুর পেয়ে যেন সঙ্কেত। এখনো রাতের শিশিরের ফোটা শুকায়নি কারো গায়ে, এখনো রাতের জড়িত জড়িমা লাগিয়া রয়েছে দুইটি আঁখির ছায়ে। অতি সাবধানে চলিও কন্যা দুপায়ে সোনার নূপুর যেন না বাজে; এ মধু-স্বপন ভাঙিলে তাদের কোথায় লুকাবে সে অপরাধের লাজে! আরো সাবধান হইও কন্যা! যদি কেউ ভুল ভরে, সে ফুলের মাঝে তুমিও একটি আর কোন কেহ লয় বা গননা করে। আরো একটুকা এগিয়ে গেলেই সরষে খেতের পরে, তোমারে আমার যত ভাল লাগে, সে অনুরাগের হলুদ বসন বিছাইয়া আছে দিক দিগন্ত ভরে। ক্ষণেক সেখানে দাঁড়াও যদি বা ভোমর ভোমরী ফুল হতে ফুলে ঘুরে, যে কথা তোমারে বলিবার ভাষা খুঁজিয়া পাইনা, সে সব তোমারে শোনাইবে সুরে সুরে। মাঝে মাঝে সেথা উতল পবন ফুলের সুবাসে ঢুলে, হেথায় সেথায় গড়ায়ে পড়িতে বিলি দেবে সুখে তাদের মাথার চুলে। মনে হবে তব, মাঠখানি যেন হেলিছে দুলিছে। হলুদ স্বপন ভরে, সাবধান হয়ো, সুগন্ধ বায়ে ছড়িয়ে যেয়ো না আর কোন দেশ পরে। যদি মনে লয় সেইখান হতে কিছুটা হলুদ মাখিও তোমার গায়, সারা মাঠখানি জীবন পাইবে তোমার অঙ্গে জড়াইয়া আপনায়। দুধারে অথই সরিষার বন মাঝখান দিয়ে সরু বাঁকা পথখানি, দোষ নিওনাক ফুলেরা তোমার ধরিলে আঁচল টানি। অতি সাবধানে ছাড়িও আঁচল, যেন তাহাদের সুকোমল দলগুলি; ভাঙিয়া না যায়, নিঠুর হয়োনা যদি বা তাহার স্বগোত্র বলি তোমরে বা ভাষে ভুলি। আরো কিছু পথ চলিতে পাইবে কুসুম ফুলের খেত, হলুদে লালেতে মেশামেশী যেন মাঠের কবির অলিখিত সঙ্কেত। যদি মনে লয় সেখানে হোছট খাইও ইচ্ছা ভরে, তোমার শাড়ীতে রঙ দিয়ে নিও, কুসুম ফুলের খেতখানি তুমি সারাটি অঙ্গে ধরে। সামনে দেখিবে আম কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কৃষাণীর ছোট বাড়ি, শাখায় শাখায় নানা পাখি ফেরে সুনাম গাহিয়া তারি। সেইখান দিয়ে চলিতে যদি বা আমার মনের বাসনা হইয়া কুটুম পাখিরা, তোমারে হেরিয়া কুটুম কটুম ডাকে, খানিক থামিও, তুমি ও এমন সুন্দর মেয়ে! কেমনে এড়াবে সেই ভালবাসাটাকে। চোখ গেল বলি কোন পাখি যদি কেঁদে ওঠে উভরায়, দোষ নিওনাক, আমিও দৃষ্টি কবে হারায়েছি ও রূপের ধূপছায়। যেদিন তোমারে দেখিছি কন্যা! আন কানো রূপ পশে না পরাণে আর, আমার স্বর্গ মর্ত্ত্য বেড়িয়া তোমার বালিকা কান্তির যেন স্নানশেষে বারিধার। আরা কিছুদূর চলিলে হেরিবে জাঙলা ভরিয়া কন্যা সাজানী সীমলতাগুলি হইয়া নীলাম্বরী, তোমার লাগিয়া অপেক্ষমাণ, যদি কোনদিন অঙ্গে লওব পরি। যেখানে কন্যা, খনেক দাঁড়িও! কিবা রূপ মরি মরি! দেহ রামধনু হতে বিছরিছে উছলিত রুপ ছিরি। সেখানে হয়ত কোন গেঁয়ো কবি সারিন্দা সুরে, কাহিনীর কোন নায়ীকার রূপ দিয়ে, তোমার নামটি বাজায়ে বাজায়ে নদী তীরে তীরে ফেরে যদি তার আপন ব্যথারে নিয়ে; কিছুটা তাহারে দিও প্রশ্রয় ইচ্ছা হইলে তাহার কাহিনী জালে; নিজেরে জড়ায়ে বাঁচিয়া রহিও অনাগত কোন দূর ভবিষৎ কালে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
গড়াই নদীর তীরে, কুটিরখানিরে লতা-পাতা-ফুল মায়ায় রয়েছে ঘিরে। বাতাসে হেলিয়া, আলোতে খেলিয়া সন্ধ্যা সকালে ফুটি, উঠানের কোণে বুনো ফুলগুলি হেসে হয় কুটি কুটি। মাচানের পরে সীম-লতা আর লাউ কুমড়ার ঝাড়, আড়া-আড়ি করি দোলায় দোলায় ফুল ফল যত যার। তল দিয়ে তার লাল নটেশাক মেলিছে রঙের ঢেউ, লাল শাড়ীখানি রোদ দিয়ে গেছে এ বাড়ির বধূ কেউ। মাঝে মাঝে সেথা এঁদো ডোবা হতে ছোট ছোট ছানা লয়ে, ডাহুক মেয়েরা বেড়াইতে আসে গানে গানে কথা কয়ে! গাছের শাখায় বনের পাখিরা নির্ভয়ে গান ধরে, এখনো তাহারা বোঝেনি হেথায় মানুষ বসত করে। মটরের ডাল, মসুরের ডাল, কালিজিড়া আর ধনে, লঙ্কা-মরিচ রোদে শুখাইছে উঠানেতে সযতনে। লঙ্কার রঙ মসুরের রঙ, মটরের রঙ আর, জিড়া ও ধনের রঙের পাশেতে আলপনা আঁকা কার। যেন একখানি সুখের কাহিনী নানান আখরে ভরি, এ বাড়ির যত আনন্দ হাসি আঁকা জীবন- করি। সাঁঝ সকালের রঙিন মেঘেরা এখানে বেড়াতে এসে, কিছুখন যেন থামিয়া রয়েছে এ বাড়িরে ভালবেসে। সামনে তাহার ছোট ঘরখানি ময়ূর পাখির মত, চালার দুখানা পাখনা মেলিয়া তারি ধ্যানে আছে রত। কুটিরখানির একধারে বন, শ্যাম-ঘন ছায়াতলে, মহা-রহস্য লুকাইয়া বুকে সাজিছে নানান ছলে। বনের দেবতা মানুষের ভয়ে ছাড়ি ভূমি সমতল, সেথায় মেলিছে অতি চুপি চুটি সৃষ্টির কৌশল; লতা-পাতা ফুল ফলের ভাষায় পাখিদের বুনো সুরে। তারি বুকখানি সারা বন বেড়ি ফিরিতেছে সদা ঘুরে। ইহার পাশেতে ছোট গেহ-খনি, এ বনের বন-রাণী, বনের খেলায় হয়রান হয়ে শিথিল বসনখানি; ইহার ছায়ায় মেলিয়া ধরিয়া শুয়ে ঘুম যাবে বলে, মনের মতন করিয়া ইহারে গড়িয়াছে নানা ছলে। সে ঘরের মাঝে দুটি পা মেলিয়া বসিয়া একটি মেয়ে , পিছনে তাহার কালো চুলগুলি মাটিতে পড়েছে বেয়ে। দুটি হাতে ধরি রঙিন শিকায় রচনা করিছে ফুল, বাতাসে সরিয়া মুখে উড়িতেছে কভু দু একটি চুল। কুপিত হইয়া চুলেরে সরাতে ছিড়িছে হাতের সূতো, চোখ ঘুরাইয়া সুতোরে শাসায় করিয়া রাগের ছুতো। তারপর শেষে আপনার মনে আপনি উঠিছে হাসি, আরো সরু সরু ফুল ফুটিতেছে শিকার জালেতে আসি। কালো মুখখানি, বন-লতা পাতা আদর করিয়া তায়, তাহাদের গার যত রঙ যেন মেখেছে তাহার গায়। বনের দুলালী ভাবিয়া ভাবিয়া বনের শ্যামল কায়া; জানে না, কখন ছড়ায়েছে তার অঙ্গে বনের ছায়া। আপনার মনে শিকা বুনাইছে, ঘরের দুখানা চাল, দুখানা রঙিন ডানায় তাহারে করিয়াছে আবডাল। আটনের গায়ে সুন্দীবেতের হইয়াছে কারুকাজ বাজারের সাথে পরদা বাঁধন মেলে প্রজাপতি সাজ। ফুস্যির সাথে রাঙতা জড়ায়ে গোখুরা বাঁধনে আঁটি, উলু ছোন দিয়ে ছাইয়াছে ঘর বিছায়ে শীতল পাটি। মাঝে মাঝে আছে তারকা বাঁধন, তারার মতন জ্বলে, রুয়ার গোড়ায় খুব ধরে ধরে ফুলকাটা শতদলে। তারি গায় গায় সিদুরের গুড়ো, হলুদের গুড়ো দিয়ে, এমনি করিয়া রাঙায়েছে যেন ফুলেরা উঠেছে জিয়ে। একপাশে আশে ফুলচাং ভাল বলা যায়নাক ত্বরা। তার সাথে বাঁধা কেলী কদম্ব ফুল-ঝুরি শিকা আর, আসমান-তারা শিকার রঙেতে সব রঙ মানে হার। শিকায় ঝুলানো চিনের বাসন, নানান রঙের শিশি, বাতাসের সাথে হেলিছে দুলিছে রঙে রঙে দিবানিশি। তাহার নীচেতে মাদুর বিছায়ে মেয়েটি বসিয়া একা, রঙিন শিকার বাঁধনে বাঁধনে রচিছে ফুলের লেখা। মাথার উপরে আটনে ছাটনে বেতের নানান কাজ, ফুলচাং আর শিকাগুলি ভরি দুলিতেছে নানা সাজ। বনের শাখায় পাখিদের গান, উঠানে লতার ঝাড় সবগুলো মিলে নির্জ্জনে যেন মহিমা রচিছে তার। মেয়েটি কিন্তু জানে না এ সব, শিকায় তুলিছে ফুল, অতি মিহি সুরে গান সে গাহিছে মাঝে মাঝে করি ভুল। বিদেশী তাহার স্বামীর সহিত গভীর রাতের কালে, পাশা খেলাইতে ভানুর নয়ন জড়াল ঘুমের জালে। ঘুমের ঢুলুনী, ঘুমের ভুলুনী-সকালে ধরিয়া তায়, পাল্কীর মাঝে বসাইয়া দিয়া পাঠাল স্বামীর গাঁয়। ঘুমে ঢুলু আঁখি, পাল্কী দোলায় চৈতন হল তার, চৈতন হয়ে দেখে সে ত আজ নহে কাছে বাপ-মার। এত দরদের মা-ধন ভানুর কোথায় রহিল হায়, মহিষ মানত করিত তাহার কাঁটা যে ফুটিলে পায়। হাতের কাঁকনে আঁচড় লাগিলে যেত যে সোনারু বাড়ি, এমন বাপেরে কোন দেশে ভানু আসিয়াছে আজ ছাড়ি। কোথা সোহাগের ভাই-বউ তার মেহেদী মুছিলে হায়, সাপন সীথার সিদুর লইত ঘষিতে ভানুর পায়। কোথা আদরের মৈফল-ভাই ভানুর আঁচল ছাড়ি, কি করে আজিকে দিবস কাটিছে একা খেলাঘরে তারি। এমনি করিয়া বিনায়ে বিনায়ে মেয়েটি করিছে গান, দূরে বন পথে বউ কথা কও পাখি ডেকে হয়রান। সেই ডাক আরো নিকটে আসিল, পাশের ধঞ্চে-খেতে তারপর এলো তেঁতুলতলায় কুটিরের কিনারেতে মেয়েটি খানিক শিকা তোলা রাখি অধরেতে হাসি আঁকি, পাখিটিরে সে যে রাগাইয়া দিল বউ কথা কও ডাকি। তারপর শেষে আগের মতই শিকায় বসাল মন, ঘরের বেড়ার অতি কাছাকাছি পাখি ডাকে ঘন ঘন। এবার সে হল আরও মনোযোগী, শিকা তোলা ছাড়া আর, তার কাছে আজ লোপ পেয়ে গেছে সব কিছু দুনিয়ার। দোরের নিকট ডাকিল এবার বউ কথা কও পাখি, বউ কথা কও, বউ কথা কও, বারেক ফিরাও আঁখি। বউ মিটি মিটি হাসে আর তার শিকায় যে ফুল তোলে, মুখপোড়া পাখি এবার তাহার কানে কানে কথা বলে। যাও ছাড়-লাগে, এবার বুঝিনু বউ তবে কথা কয়, আমি ভেবেছিনু সব বউ বুঝি পাখির মতন হয়। হয়ত এমনি পাখির মতন এ ডাল ও ডাল করি, বই কথা কও ডাকিয়া ডাকিয়া জনম যাইবে হরি, হতভাগা পাখি! সাধিয়া সাধিয়া কাঁদিয়া পাবে না কূল, মুখপোড়া বউ সারাদিন বসি শিকায় তুলিবে ফুল। ইস্যিরে মোর কথার নাগর! বলি ও কি করা হয়, এখনি আবার কুঠার নিলে যে, বসিতে মন না লয়? তুমি এইবার ভাত বাড় মোর, একটু খানিক পরে, চেলা কাঠগুলো ফাঁড়িয়া এখনি আসিতেছি ঝট করে। কখনো হবে না, আগে তুমি বস, বউটি তখন উঠি, ডালায় করিয়া হুড়ুমের মোয়া লইয়া আসিল ছুটি। একপাশে দিল তিলের পাটালী নারিকেল লাড়ু আর ফুল লতা আঁকা ক্ষীরের তক্তি দিল তারে খাইবার। কাঁসার গেলাসে ভরে দিল জল, মাজা ঘষা ফুরফুরে ঘরের যা কিছু মুখ দেখে বুঝি তার মাঝে ছায়া পূরে। হাতেতে লইয়া ময়ূরের পাখা বউটি বসিল পাশে, বলিল, এসব সাজায়ে রাখিনু কোন দেবতার আশে? তুমিও এসো না! হিন্দুর মেয়ে মুসলমানের সনে খাইতে বসিয়া জাত খোয়াইব তাই ভাবিয়াছ মনে? নিজেরই জাতিটা খোয়াই তাহলেবড় গম্ভীর হয়ে, টপটপ করে যা ছিল সোজন পুরিল অধরালয়ে। বউ ততখনে কলিকার পরে ঘন ঘন ফুঁক পাড়ি, ফুলকি আগুন ছড়াইতেছিল দুটি ঠোট গোলকরি। দুএক টুকরো ওড়া ছাই এসে লাগছিল চোখে মুখে, ঘটছিল সেথা রূপান্তর যে বুঝি না দুখে কি সুখে। ফুঁক দিতে দিতে দুটি গাল তার উঠছিল ফুলে ফুলে, ছেলেটি সেদিকে চেয়ে চেয়ে তার হাত ধোয়া গেল ভুলে। মেয়ে এবার টের পেয়ে গেছে, কলকে মাটিতে রাখি, ফিরিয়া বসিল ছেলেটির পানে ঘুরায়ে দুইটি আঁখি। তারপর শেষে শিকা হাতে লয়ে বুনাতে বসিল ত্বরা, মেলি বাম পাশে দুটি পাও তাতে মেহেদীর রঙ ভরা। নীলাম্বরীর নীল সায়রেতে রক্ত কমল দুটি, প্রথমভোরের বাতাস পাইয়া এখনি উঠিছে ফুটি। ছেলেটি সেদিক অনিমেষ চেয়ে, মেয়েটি পাইয়া টের, শাড়ীর আঁচলে চরণ দুইটি ঢাকিয়া লইল ফের। ছেলেটি এবার ব্যস্ত হইয়া কুঠার লইল করে, এখনি সে যেন ছুটিয়া যাইবে চেলা ফাড়িবার তরে। বউটি তখন পার আবরণ একটু লইল খুলি, কি যেন খুঁজিতে ছেলেটি আসিয়া বসিল আবার ভুলি। এবার বউটি ঢাকিল দুপাও শাড়ীর আঁচল দিয়ে, ছেলেটি সজোরে কলকে রাখিয়া টানিল হুকোটি নিয়ে। খালি দিনরাত শিকা ভাঙাইবে? হুকোয় ভরেছ জল? কটার মতন গন্ধ ইহার একেবারে অবিকল। এক্ষুণি জল ভরিণু হুকায়। দেখ! রাগায়ো না মোরে, নৈচা আজিকে শিক পুড়াইয়া দিয়েছিলে সাফ করে? কটর কটর শব্দ না যেন মুন্ড হতেছে মোর, রান্নাঘরেতে কেন এ দুপুরে দিয়ে দাও নাই দোর? এখনি খুলিলে? কথায় কথায় কথা কর কাটাকাটি, রাগি যদি তবে টের পেয়ে যাবে বলিয়া দিলাম খাঁটি! মিছেমিছি যদি রাগিতেই সখ, বেশ রাগ কর তবে, আমার কি তাতে, তোমারি চক্ষু রক্ত বরণ হবে। রাগিবই তবে? আচ্ছা দাঁড়াও মজাটা দেখিয়া লও, যখন তখন ইচ্ছা মাফিক যা খুশী আমারে কও! এইবার দেখ! না! না! তবে আর রাগিয়া কি মোর হবে, আমি ত তোমার কেউ কেটা নই খবর টবার লবে? বউটি বসিয়াশিকা ভাঙাইতেছে, আর হাসিতেছে খালি, প্রতিদিন সে ত বহুবার শোনে এমনি মিষ্ট গালি।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(তেরো)একটি বছর হইয়াছে সেই রূপাই গিয়াছে চলি, দিনে দিনে নব আশা লয়ে সাজুরে গিয়াছে ছলি | কাইজায় যারা গিয়াছিল গাঁয়, তারা ফিরিয়াছে বাড়ী, শহরের জজ, মামলা হইতে সবারে দিয়াছে ছাড়ি | স্বামীর বাড়ীতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে, তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে | একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত, প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত |ও-গাঁয়ে রূপার ভাঙা ঘরখানি মেঘ ও বাতাসে হায়, খুঁটি ভেঙে আজ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে পথের গায় | প্রতি পলে পলে খসিয়া পড়িছে তাহার চালের ছানি, তারও চেয়ে আজি জীর্ণ শীর্ণ সাজুর হৃদয়খানি | রাত দিন দুটি ভাই বোন যেন দুখেরই বাজায় বীণ | কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ, কি করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান! কেন বিধি তারে এত দুখ দিল, কেন, কেন, হায় কেন, মনের-মতন কাঁদায় তাহারে “পথের কাঙালী” হেন ?সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে, সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা, দুখের সাগরে ভাসিছে তেমনি সাজুর হৃদয়খানা | কোন্ জালুয়ার মাছ সে খেয়েছে নাহি দিয়ে তায় কড়ি, তারি অভিশাপ ফিরেছে কি তার সকল পরাণ ভরি ! কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিঁড়েছিল নিজ হাতে, তাহারি ছোঁয়া কি লাগিয়াছে আজ তার জীবনের পাতে ! তোর দেশে বুঝি দয়া মায়া নাই, হা-রে নিদারুণ বিধি কোন্ প্রাণে তুই কেড়ে নিয়ে গেলি তার আঁচলের নিধি | নয়ন হইতে উড়ে গেছে হায় তার নয়নের তোতা, যে ব্যাথারে সাজু বহিতে পারে না, আজ তা রাখিবে কোথা ?এমনি করিয়া কাঁদিয়া সাজুর সারাটি দিবস কাটে, আমেনে কভু একা চেয়ে রয় দীঘল গাঁয়ের বাটে | কাঁদিয়া কাঁদিয়া সকাল যে কাটে---দুপুর কাটিয়া যায়, সন্ধ্যার কোলে দীপ নিবু-নিবু সোনালী মেঘের নায়ে | তবু ত আসে না ! বুকখানি সাজু নখে নখে আজ ধরে, পারে যদি তবে ছিঁড়িয়া ফেলায় সন্ধ্যার কাল গোরে | মেয়ের এমন দশা দেখে মার সুখ নাই কোন মনে, রূপারে তোমরা দেখেছ কি কেউ, শুধায় সে জনে জনে | গাঁয়ের সবাই অন্ধ হয়েছে, এত লোক হাটে যায়, কোন দিন কিগো রূপাই তাদের চক্ষে পড়ে নি হায় ! খুব ভাল করে খোঁজে যেন তারে, বুড়ী ভাবে মনে মনে, রূপাই কোথাও পলাইয়া আছে হয়ত হাটের কোণে | ভাদ্র মাসেতে পাটের বেপারে কেউ কেউ যায় গাঁরষ নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার | জনে জনে বুড়ী বলে দেয়, “দেখ, যখন যখানে যাও, রূপার তোমরা তালাস লইও, খোদার কছম খাও |” বর্ষার শেষে আনন্দে তারা ফিরে আসে নায়ে নায়ে, বুড়ী ডেকে কয়,  “রূপারে তোমরা দেখ নাই কোন গাঁয়ে !” বুড়ীর কথার উত্তর দিতে তারা নাহি পায় ভাষা, কি করিয়া কহে, আর আসিবে না যে পাখি ছেড়েছে বাসা |চৈত্র মাসেতে পশ্চিম হতে জন খাটিবার তরে, মাথাল মাথায় বিদেশী চাষীরা সারা গাঁও ফেলে ভরে | সাজুর মায়ে যে ডাকিয়া তাদের বসায় বাড়ির কাছে, তামাক খাইতে হুঁকো এনে দ্যায়, জিজ্ঞাসা করে পাছে ; “তোমরা কি কেউ রূপাই বলিয়া দেখেছ কোথাও কারে, নিটল তাহার গঠন গাঠন, কথা কয় ভারে ভারে |” এমনি করিয়া বলে বুড়ী কথা, তাহারা চাহিয়া রয়,--- রুপারে যে তারা দেখে নাই কোথা, কেমন করিয়া কয় ! যে গাছ ভেঙেছে ঝড়িয়া বাতাসে কেমন করিয়া হায়, তারি ডালগুলো ভেঙে যাবে তারা কঠোর কুঠার-ঘায় ?কেউ কেউ বলে, “তাহারি মতন দেখেছিন একজনে, আমাদের সেই ছোট গাঁয় পথে চলে যেতে আনমনে |” “আচ্ছা তাহারে সুধাও নি কেহ, কখন আসিবে বাড়ী, পরদেশে সে যে কোম্ প্রাণে রয় আমার সাজুরে ছাড়ি ?” গাঙে-পড়া-লোক যেমন করে তৃণটি আঁকড়ি ধরে, তেমনি করিয়া চেয়ে রয় বুড়ী তাদের মুখের পরে | মিথ্যা করেই তারা বলে, “সে যে আসিবে ভাদ্র মাসে, খবর দিয়েছে, বুড়ী যেন আর কাঁদে না তাহার আশে |” এত যে বেদনা তবু তারি মাঝে একটু আশার কথা, মুহুর্তে যেন মুছাইয়া দেয় কত বরষের ব্যথা | মেয়েরে ডাকিয়া বার বার কহে, “ভাবিস না মাগো আর, বিদেশী চাষীরা কয়ে গেল মোর---খবর পেয়েছে তার |” মেয়ে শুধু দুটি ভাষা-ভরা আঁখি ফিরাল মায়ের পানে ; কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে | গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস, বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস |আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা, ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা | আজকে কত না কথা লয়ে যেন বাজিছে বুকের বীনে, সেই যে প্রথম দেখিল রূপারে বদনা-বিয়ের দিনে | তারপর সেই হাট-ফেরা পথে তারে দেখিবার তরে, ছল করে সাজু দাঁড়ায়ে থাকিত গাঁয়ের পথের পরে | নানা ছুতো ধরি কত উপহার তারে যে দিত আনি, সেই সব কথা আজ তার মনে করিতেছে কানাকানি | সারা নদী ভরি জাল ফেলে জেলে যেমনি করিয়া টানে, কখন উঠায়, কখন নামায়, যত লয় তার প্রাণে ; তেমনি সে তার অতীতেরে আজি জালে জালে জড়াইয়া টানে, যদি কোন কথা আজিকার দিনে কয়ে যায় নব-মানে |আর যেন তার কোন কাজ নাই, অতীত আঁধার গাঙে, ডুবারুর মত ডুবিয়া ডুবিয়া মানক মুকুতা মাঙে | এতটুকু মান, এতটুকু স্নেহ, এতটুকু হাসি খেলা, তারি সাথে সাজু ভাসাইতে চায় কত না সুখের ভেলা ! হায় অভাগিনী ! সে ত নাহি জানে আগে যারা ছিল ফুল, তারাই আজিকে ভুজঙ্গ হয়ে দহিছে প্রাণের মূল | যে বাঁশী শুনিয়া ঘুমাইত সাজু, আজি তার কথা স্মরি, দহন নাগের গলা জড়াইয়া একা জাগে বিভাবরী |মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রূপার বিদায় বাণী--- “মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি |” আরও মনে পড়ে, “দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই, সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই |”হায় হায় পতি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন ; সাজুর বেদনা সকলেই শোনে, শোনে না সে একজন | গাছের পাতারা ঝড়ে পরে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে, পাড়া প্রতিবেশী নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে | হায় রে বধির, তোর কানে আজ যায় না সাজুর কথা ; কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই বুক ভরা ব্যথা | হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূরের দেশে, আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে ! দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাই-এর লতা, পাতাগুলি তার উনিয়া পড়েছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা | হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলি বাকি, আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কতরূপ ফাঁকি | সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস, বলিতে বলিতে ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস |নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি, ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি | অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা, তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা | এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন সে একদিন, কৃষাণীর ঘরে আদরিনী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন | স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে, সিলাই করেছে সেজে ; গুন গুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে |সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই, সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই |খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রূপার বিদায় ছবি, খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা, আঁকিল সে তার সবি | আঁকিল কাঁথায়---আলু থালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ-নারী, দেখিছে তাহার স্বামী তারে যায় জনমের মত ছাড়ি | আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে, বুকে কর হানি, কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে | এমনি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে, তার চেয়ে সাজু অসহ্য ব্যথা আপনার বুকে বহে | তারপর শেষে এমনি হইল, বেদনার ঘায়ে ঘায়ে, এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝরিয়া-বায়ে | কি যে দারুণ রোগেতে ধরিল, উঠিতে পারে না আর ; শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়ন-ধার | হায় অভাগীর একটি মানিক ! খোদা তুমি ফিরে চাও, এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও ! ফিরে চাও তুমি আল্লা রসুল ! রহমান তব নাম, দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম !মেয়ে কয়, “মাগো ! তোমার বেদনা আমি সব জানি, তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি ! সোনা মা আমার ! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা, ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা ! একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূঁচ সুতা দাও হাতে, শেষ ছবি খানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে |” পাণ্ডুর হাতে সূঁচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে, আঁকিয়া আঁকিয়া আঁখিজল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে |কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি, তারি কাছে এক গেঁয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি ; রাত আন্ধার কবরের পাশে বসি বিরহী বেশে, অঝোরে বাজায় বাঁশের বাঁশীটি বুক যায় জলে ভেসে | মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বার বার করি, দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি | দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি, “সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি ; এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে, ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে ! সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল, জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল | হয়ত আমার কবরের ঘুম ভেঙে যাবে মাগো তাতে, হয়ত তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে | এ ব্যথা সে মাগো কেমনে সহিবে, বোলো তারে ভালো করে, তার আঁখি জল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে | মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই, আমি গেলে মোর কবরের গায়ে এরে মেলে দিও তাই ! মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে, জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে |” বলিতে বলিতে আর যে পারে না, জড়াইয়া আসে কথা, অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি দারুণ ব্যথা |কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়, “সাজু সাজু ! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয় ?” “আল্লা রসুল ! আল্লা রসুল !” বুড়ী বলে হাত তুলে, “দীন দুঃখীর শেষ কান্না এ, আজিকে যেয়ো না ভুলে !” দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে চায় আঁধার রাতের কালি, উতলা বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে যায়, সব খালি ! সব খালি !! “সোনা সাজুরে, মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে, তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একেলা ঘরে !”দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে, রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ার দাপে |
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত, সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত। ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে, ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে। কৃষাণ কনের বিয়ে হবে, তার হলদি কোটার শাড়ী, হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কটি রোদ রেখা নাড়ি। কলমী লতার গহনা তাহার গড়ার প্রতীক্ষায়, ভিনদেশী বর আসা যাওয়া করে প্রভাত সাঁঝের নায়। পথের কেনারে মোর ধান ক্ষেত, সবুজ পাতার পরে, সোনার ছড়ায় হেমন্তরাণী সোনা হাসিখানি ধরে। শরৎ সে কবে চরে গেছে তার সোনালী মেঘের ছটা, আজো উড়িতেছে মোর এই খেতে ধরিয়া ধানের জটা। মাঝে মাঝে এর পকিয়াছে ধান, কোনখানে পাকে নাই, সকুজ শাড়ীর অঞ্চলে যেন ছোপ লাগিয়াছে তাই। আজান গাঁয়ের কৃষাণকুমারী এইখান দিয়ে যেতে, সোনার পায়ের চিহ্নগুলিরে গেছে এর বুকে পেতে। মোর ধানক্ষেত, এইখানে এসে দাঁড়ালে উচচ শিরে, মাথা যেন মোর ছুঁইবারে পারে সুদূর আকাশটিরে! এইকানে এসে বুক ফুলাইয়া জোরে ডাক দিতে পারি, হেথা আমি করি যা খুশী তাহাই, কারো নাহি ধার ধারি। হেথায় নাহিক সমাজ-শাসন, নাহি প্রজা আর সাজা, মোর ক্ষেত ভরি ফসলেরা নাচে, আমি তাহাদের রাজা। এইখানে এসে দুঃখের কথা কহি তাহাদের সনে, চৈত্র দিনের ভীষণ খরায় আষাঢ়ের বরিষণে। কৃষাণী কনের কাঁকনের ঘায়ে ছিঁড়িয়া বুকের চাম, এই ধানক্ষেত নয়নের জলে ভাসিয়েছি অবিরাম। এইখানে বসে রাতের বেলায় বাঁশের বাঁশীর সুরে, মোর ব্যথাখানি ছড়ায়েছি তার সুদূর কৃষাণ-পুরে। এই ধানক্ষেত লুকাইয়া তার গোপন স্মৃতির চিন্, দেখিয়া দেখিয়া কাটিয়া গিয়াছে কত না দীর্ঘদিন। পথের কেনারে দাঁড়ায়ে রয়েছে আমার ধানের ক্ষেত, আমার বুকের আশা-নিরাশার বেদনার সঙ্গেত। বকের মেয়েরা গাঁথিয়া যতনে শ্বেত পালকের মালা, চারিধারে এর ঘুরিয়া ঘুরিয়া সাজায় সোনার ডালা। তাল বৃক্ষের উচু বাসা ছাড়ি বাবুই পাখির দল, কিসের মায়ায় সারা ক্ষেত ভরি ফিরিতেছে চঞ্চল। মাঝে মাঝে তারে জালে জড়াইয়া টেনে নিয়ে যেতে, চায়, সকাল-সাঁঝের আলো-ছায়া-ঘেরা সোনালী তটের ছায়! শিশির তাহারে মতির মালায় সাজায় সারাটি রাতি, জোনাকীরা তার পাতায় পাতায় দোলায় তারার বাতি।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
দশ বড় ঘর বান্দাছাও মোনাভাই বড় করছাও আশা রজনী প্রভাতের কালে পঙ্খী ছাড়বে বাসা | . — মুর্শীদা গান নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর, বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর | মাঠের কাজেতে ব্যস্ত রূপাই, নয়া বউ গেহ কাজে, দুইখান হতে দুটি সুর যেন এ উহারে ডেকে বাজে | ঘর চেয়ে থাকে কেন মাঠ পানে, মাঠ কেন ঘর পানে, দুইখানে রহি দুইজন আজি বুঝিছে ইহার মানে | আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান, সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান | ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়, কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায় | আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে, মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে | আজকে রূপার বড় কাজ—কাজ—কোন অবসর নাই, মাঠে যেই ধান ধরেনাক আজি ঘরে দেবে তারে ঠাঁই | সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি, সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি | আজকে রূপার মনে পড়েনাক শাপলার লতা দিয়ে, নয়া গৃহিনীর খোঁপা বেঁধে দিত চুলগুলি তার নিয়ে | সিঁদুর লইয়া মান হয়নাক বাজে না বাঁশের বাঁশী, শুধু কাজ—কাজ, কি যাদু-মন্ত্র ধানেরা পড়িছে আসি | সারাটি বরষা কে কবি বসিয়া বেঁধেছে ধানের গান, কত সুদীর্ঘ দিবস রজনী করিয়া সে অবসান | আজকে তাহার মাঠের কাব্য হইয়াছে বুঝি সারা, ছুটে গেঁয়ো পাখি ফিঙে বুলবুল তারি গানে হয়ে হারা | কৃষাণীর গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো ; এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো ফুটো! আজকে তাহার পাড়া-বেড়ানর অবসর মোটে নাই, পার খাড়ুগাছি কোথা পড়ে আছে, কেবা খোঁজ রাখে ছাই! অর্ধেক রাত উঠোনেতে হয় ধানের মলন মলা, বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা | দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি, ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি | কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান, কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান | হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোত্স্নার জাল পাতি, টেনে টেনে তারে হয়রান হয়ে ডুবে যায় রাতারাতি | এমনি করিয়া ধানের কাব্য হইয়া আসিল সারা, গানের কাব্য আরম্ভ হল সারাটা কৃষাণ পাড়া! রাতেরে উহারা মানিবে না যেন, নতুন গলার গানে, বাঁশী বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে | আজিকে রূপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি, শিয়রে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী | সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি, ঘুম হতে তারে সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি | নতুন করিয়া আজকে উহারা চাহিছে এ ওর পানে, দীর্ঘ কাজের অবসর যেন কহিছে নতুন মানে! নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর, সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়নড়! বাঁশের বাঁশীতে ঘুণ ধরেছিল, এতদিন পরে আজ, তেলে জলে আর আদরে তাহার হইল নতুন সাজ | সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রূপাই বাজায় বাঁশী, মহাশূণ্যের পথে সে ভাসায় শূণ্যের সুররাশি! ক্রমে রাত বাড়ে, বউ বসে দূরে, দুটি চোখ ঘুমে ভার, “পায়ে পড়ি ওগো চলো শুতে যাই, ভাল লাগে নাক আর |” রূপা ত সে কথা শোনেই নি যেন, বাঁশী বাজে সুরে সুরে, “ঘরে দেখে যারে সেই যেন আজি ফেরে ওই দূরে দূরে |” বউ রাগ করে, “দেখ, বলে রাখি, ভাল হবেনাক পরে, কালকের মত কর যদি তবে দেখিও মজাটি করে | ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাজাইবে যদি বাঁশী, সিঁদুর আজিকে পরিব না ভালে, কাজল হইবে বাসি | দেখ, কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল, আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল |” বেচারী রূপাই বাঁশী বাজাইতে এমনি অত্যাচার, কৃষাণের ছেলে! অত কিবা বোঝে, তখনই মানিল হার | কহে জোড় করে, “শোন গো হুজুর, অধম বাঁশীর প্রতি, মৌন থাকার কঠোর দণ্ড অন্যায় এ যে অতি | আজকে ও-ভালে সিঁদুর দিবে না, খুলিবে কানের দুল, সন্ধ্যে হবে না সিঁদুরে রঙের—ভোরে হাসিবে না ফুল! এক বড় কথা! আচ্ছা দেখাই, ওরে ও অধম বাঁশী, এই তরুণীর অধরের গানে তোমার হইবে ফাঁসী!” হাতে লয়ে বাঁশী বাজাইল রূপা মাঠের চিকন সুরে, কভু দোলাইয়া বউটির ঠোঁটে কভু তারে ঘুরে ঘুরে | বউটি যেন গো হেসে হয়রান, কহে ঠোঁটে ঠোঁট চাপি, “বাঁশীর দণ্ড হইল, কিন্তু যে বাজাল সে পাপী?” পুনঃ জোর করে রূপা কহে, “এই অধমের অপরাধ, ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!” রূপার বলার এমনি ভঙ্গী বউ হেসে কুটি কুটি, কখনও পড়িছে মাটিতে ঢলিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি | পরে কহে, “দেখো, আরও কাছে এসো, বাঁশীটি লও তো হাতে, এমনি করিয়া দোলাও ত দেখি নোলক দোলার সাথে!” বাঁশী বাজে আর নোলক যে দোলে, বউ কহে আর বার, “আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী লতার হার? এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর,” তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাঁশী সুমধুর! দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, “এরি মত, তোমার বাঁশীতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত |” চলে মেঠো বাঁশী দুটি ঠোঁট ছুঁয়ে কলমী ফুলের বুকে, ছোট চুমু রাখি চলে যেন বাঁশী, চলে সে যে কোন লোকে এমনি করিয়া রাত কেটে যায় ; হাসে রবি ধীরি ধীরি, বেড়ার ফাঁকেতে উঁকি মেরে দেখি দুটি খেয়ালীর ছিরি | সেদিন রাত্রে বাঁশী শুনে শুনে বউটি ঘুমায়ে পড়ে, তারি রাঙা মুখে বাঁশী-সুরে রূপা বাঁকা চাঁদ এনে ধরে | তারপরে খুলে চুলের বেণীটি বার বার করে দেখে, বাহুখানি দেখে নাড়িয়া নাড়িয়া বুকের কাছেতে রেখে | কুসুম-ফুলেতে রাঙা পাও দুটি দেখে আরো রাঙা করি, মৃদু তালে তালে নিঃশ্বাস লয়, শুনে মুখে মুখ ধরি | ভাবে রূপা, ও-যে দেহ ভরি যেন এনেছে ভোরের ফুল, রোদ উঠিলেই শুকাইয়া যাবে, শুধু নিমিষের ভুল! হায় রূপা, তুই চোখের কাজলে আঁকিলি মোহন ছবি, এতটুকু ব্যথা না লাগিতে যেরে ধুয়ে যাবে তোর সবি! ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল, সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রূপার কূল! বাঁশী লয়ে রূপা বাজাতে বসিল বড় ব্যথা তার মনে, উদাসীয়া সুর মাথা কুটে মরে তাহার ব্যথার সনে | ধারায় ধারায় জল ছুটে যায় রূপার দুচোখ বেয়ে, বইটি তখন জাগিয়া উঠিল তাহার পরশ পেয়ে | “ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল? একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল? ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?” বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল! বাহুখানা তার কাঁধ পরে রাখি রূপা কয় মৃদু সুরে, “শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!” “সে দূর কোথায়?” “অনেক—অনেক—দেশ যেতে হয় ছেড়ে, সেথা কেউ নাই শুধু আমি তুমি আর সেই সে অচেনা ফেরে | তুমি ঘুমাইলে সে এসে আমায় কয়ে যায় কানে কানে, যাই—যাই—ওরে নিয়ে যাই আমি আমার দেশের পানে বল, তুমি সেথা কখনও যাবে না, সত্যি করিয়া বল!” “নয়! নয়! নয়!” বউ কহে তার চোখ দুটি ছল ছল | রূপা কয় “শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর, তোমার রূপের উপহাস শুধু করে সারা দিনভর | তুমি ফুল! তব ফুলের গায়েতে বহে বিহানের বায়ু, আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু | আহা আহা সখি, তুমি যাহা কর, মোর মনে লয় তাই, তোমার ফুলের পরাণে কেবল দিয়া যায় বেদনাই |” এমন সময় বাহির হইতে বছির মামুর ডাকে, ধড়মড় করি উঠিয়া রূপাই চাহিল বেড়ার ফাঁকে |
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
কি করে আদিল সময় কাটাবে? নানা সন্দেহ ভার, দহন বিষের তীর বিঁধাইয়া হানিতেছে প্রাণে তার। সে যেন দেখিছে আকাশ বাতাস সবাই যুক্তি করি, সকিনারে তার পঙ্কিল পথে নিয়ে যায় হাত ধরি। যারে দেখে তারে সন্দেহ হয়, পাড়া প্রতিবেশী জন, সকিনার সাথে কথা কহিলেই শিহরায় তার মন। ঘরের বাহির হইতে সে নারে; পলকে আড়াল হলে, এই পাপিয়সী আবার ডুবিবে পঙ্কিল হলাহলে। হাতে লয়ে ছোরা চোরের মতন বাড়ির চারিটি ধারে, ঘুরে সে বেড়ায় যদি বা কাহারে ধরিতে কখন পারে। আহার-নিদ্রা ছাড়িল আদিল, ঘুম নাই তার রাতে, কোথাও একটু শব্দ হইলে ছোটে বাতাসের সাথে। সকিনার সেই সোনা দেহখানি সরষে ক্ষেতের মত, রঙে রঙে লয়ে তাহার পরাণে কাহিনী আনিত কত। সেই দেহে আজ কোন মোহ নাই, বাসর রাতের শেষে নিঃশেষিত যে পানের পাত্র পড়ে আছে দীন বেশে। যে কন্ঠস্বরে বীনাবেনু রব জাগাত তাহার প্রাণে, মাধুরী লুপ্ত সে স্বর এখন তীব্র আঘাত হানে। মোহহীন আর মধুরতাহীন দেহের কাঠাম ভরে, বিগত দিনের কঠোর কাহিনী বাজিয়ে তীব্র স্বরে। কোন মোহে তবে ইহারে লইয়া কাটিবে তাহার দিন, চিরতরে তবে মুছে যাক এই কুলটার সব চিন। গহন রাত্রে ঘুমায় সকিনা শিয়রের কাছে তার, হাঁটু গাড়া দিয়া বসিল আদিল হাত দুটি করি বার; খোদার নিকটে পঞ্চ রেকাত নামাজ আদায় করি, সাত বার সে যে মনে মনে নিল দরুদ সালাম পড়ি। রুমালে জড়ায়ে কি ওষুধ যেন ধরিল নাকের পরে, বহুখন ভরি নিশ্বাস তার দেখিল পরখ করে। তারপর সে যে অতীব নীরবে হাত দুটি সকিনার, বাঁধিল দড়িতে চরণ দুইটি পরেতে বাঁধিল তার। সন্তর্পণে দেহখানি তার তুলিয়া কাঁধের পরে, চলিল আদিল নীরব নিঝুম গাঁর পথখানি ধরে। সুদূরে কোথায় ভুতুমের ডাকে কাঁপিয়া উঠিছে রাত, ঘন পাট ক্ষেতে কোঁড়া আর কুঁড়ী করিছে আর্তনাদ। নিজেরি পায়ের শব্দ শুনিয়া প্রাণ তার শিহরায়, নিজ ছায়া যেন ছুল ধরে কার সাথে সাথে তার ধায়। বাঘার ভিটার ডনপাশ দিয়ে, ঘন আমবন শেষে, আঁকাবাঁকা পথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া নদীর ঘাটেতে মেশে। সেইখানে বাঁধা ডিঙ্গি তরনী, তার পাটাতন পরে, সকিনারে আনি শোয়াইয়া দিল অতি সযতনে ধরে। সামনে অথই পদ্মার নদী প্রসারিয়া জলধার, মৃদু ঢেউ সনে ফিসফিস কথা কহিতেছে পারাপার। সকল ধরনী স্তব্ধ নিঝুম জোছনা কাফন পরি, কোন সে করুণ মরণের বেশে সাজিয়াছে বিভাবরী। ধীরে নাও খুলি ভাসিল আদিল অথই নদীর পরে, পশ্চাতে ঢেউ বৈঠার ঘায়ে কাঁদে হায় হায় করে। রহিয়া রহিয়া চরের বিহগ চিৎকারি ওঠে ডেকে, চারি দিগন্ত কেঁপে কেঁপে ওঠে তাহার ধাক্কা লেগে। সুদূরের চরে ভিড়াল তরনী, ঘন কাশবনে পশি, নল খাগড়ায় আঘাত পাইয়া উঠিতেছে জল স্বসি। মাছগুলি দ্রুত ছুটিয়া পালায় গভীর জলের ছায়। আবার আদিল পঞ্চ রেকাত নফল নামাজ পড়ি, খোদার নিকট করে মোনাজাত দুই হাত জোড় করি। উতল বাতাস কাশবনে পশি আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদে, রাতেরে করিছে খন্ডিত কোন বিরহী পাখির নাদে। ডিঙ্গার তলে পদ্মার পানি দাপায়ে দাপায়ে ধায়, সুদূরের চরে রাতের উক্লা আগুন জ্বালায়ে যায়। না-না তবু এরে মরিতে হইবে! বাঁধিয়া কলসীখানি, সকিনার গলে, আদিল তাহারে পার্শ্বে আনিল টানি! শব্দ করিয়া হঠাৎ নায়ের বৈঠা পড়িল জলে, জাগিয়া সকিনা চারিদিকে চায় কোথা সে এসেছে চলে! স্বামীরে শুধায়, এ আমি কোথায়, এমন করিয়া চেয়ে কেন আছ তুমি? কন্ঠের স্বরে স্তব্ধতা ওঠে গেয়ে। না! না! এযে মায়া, কভু আদিলেরে ভুলাতে পাবে না আর, কেহ নাই কোথা টলাতে পারে প্রতিজ্ঞা হতে তার্ কর্কশ স্বরে কহে সকিারে, অকে চিন্তা করে, স্থির জানিয়াছি, নাহি অধিকার তোমার বাঁচার তরে। সকিনা কহিল, সোনার পতিরে! এত যদি তব দয়আ, তবে কেন এই অভাগীরে লবে পাতিলে সুখের ময়া। সোঁতের শেহলা ভেসে ফিরিতাম আপন সোঁতের মুখে, কেন তারে তবে কুড়ায়ে আনিয়া আশ্রয় দিলে বুকে! আমি ত তোমারে কত বলেছিনু, এ বুকে আগুন ভরা, যে আসে নিকটে তারে দেহ শুধু ইহারি দারুণ পোড়া। আশ্রয় নিতে গেলাম যে আমি বট বৃক্ষের ছায়ে, পাতা যে তাহার ঝরিয়া পড়িল মোর নিম্বাস ঘায়ে। এ কথা ত পতি, কত বলেছিনু তবে কেন হায় হায়, এ অভাগিনীরে জড়াইলে তব বুক-ভরা মমতায়! আমারে লইয়া বক্ষের মাঝে লিখেছিলে যত কথা, সে কথায় যে গো ফুল ফুটায়েছি রচিয়া সুঠাম লতা; সে লতারে আমি কি করিব আজ! গৃহহীন অভাগীরে, কেন ঘর দিলে স্নেহছায়া ভরা তোমার বুকের নীড়ে? আদিল কহিল, ভুল করেছিনু, ভেবেছিনু এই বুকে এত মায়া আছে তা দিয়ে স্বর্গ গড়িব সোনার সুখে। আজি হেরিলাম, আমার স্বর্গে হাবিয়া দোজখ জ্বলে, তোমার বিগত জীবন বাহিনী তার বহ্নির দোলে। ভাবিয়াছিলাম, এ বাহুতে আছে এত প্রসারিত মায়া, ঢাকিয়া রাখিব তব জীবনের যত কলঙ্ক-ছায়া। আজি হেরিলাম, সে পাপ-বহ্নি বাহুর ছায়ারে ছিঁড়ে, দিকে দিগনে- দাহন ছড়ায় সপ্ত আকাশ ঘিরে। এই বোধ হতে নিস্তার পেতে সাধ্য নাহিক আর, আমার আকাশ বাতাসে আজিকে জ্বলিতেছে হাহাকার। সেই হাহাকারে, তোমার জীবন ইন্ধন দিয়ে আজ, মিটাইব সাধ, দেখি যদি কমে সে কালি-দহের ঝাঁজ। সকিনা কহিল, পতি গো! তুমি যে আমারে মারিবে হায়, হাসিমুখে আমি সে মরণ নিব জড়ায়ে আঁচল ছায়। আমি যে অভাগী এ বুকে ধরেছি তোমার বংশধর, তার কিবা হবে, একবার তুমি কও মোরে সে খবর? থাপড়িয়া বুক আদিল কহিল, ওরে পাপীয়সী নারী, আর কি আঘাত আছে তোর তূণে দিবি মো পানে ছাড়ি! আর কি সাপের আছে দংশন, আছে কি অগ্নি জ্বালা, আর কি তীক্ষ্ম কন্টক দিয়ে গড়েছিস তুই মালা! মোর সন্তান আছে তোর বুকে হায়, হায়, ওরে হায়, বড় হলে তারে জানিতে হইবে, কুলটা তাহার মায়। তোর জীবনের যত ইতিহাস দহন সাপের মত, জড়ায়ে জড়ায়ে সেই সন্তানে করিবে নিতুই ক্ষত। পথ দিয়ে যেত কহিবে সকলে আঙুলে দেখায়ে তায়, চেয়ে দেখ তোরা, নষ্টা মায়ের সন্তান ওই যায়! আপন সে ছেলে শত ধিক্কার দিবে নাকি তার বাপে, গলবন্ধনে মরিবে না হায়, সে অপমানের তাপে? তার চেয়ে ভাল, ওরে কলঙ্কী! ভেসে-র সেই ফুল, তোর সনে যেয়ে লভুক আজিকে চির জনমের ভুল। ক্ষণেক থামিয়া রহিল আগিল, সারাটি অঙ্গে তার, কোন অদম্য হিংসা পশু যে নড়িতেছে অনিবার। জাহান্নামের লেলিহা বহ্নি অঙ্গভূষণ করে, উন্মাদিনী কে টানিছে তাহারে, অধরে রুধির ঝরে। না! না! না! সে ফুল চির নিষ্পাপ, হাঁকিয়া সে পুন কয়, ওরে কলঙ্কী!তোর সনে তার এক ঠাই কভু নয়। নল খাগড়ার ওই পথ দিয়ে খানিক এগিয়ে গেলে, ঘন পাট ক্ষেত, ওই ধারে গেলে চরের গেরাম মেলে! সেই পথ দিয়ে যতদূর খুশী হাটিয়া যাইবি পায়, মোর পরিচিত কেউ যেন কভু তোরে না খুঁজিয়া পায়। নীরবে সকিনা আদিলের পায়ে একটি সালাম রাখি, নল খাগড়ার ঘন জঙ্গলে নিজেরে ফেলিল ঢাকি। আদিলের তরী কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মানদীর গায়, সবল হাতের বৈঠার ঘায়ে কাঁদে ঢেউ হায় হায়।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
তুমি এই ঘাটে লাগায়ারে নাও লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি। তোমার ভাইটাল সুরের সাথে সাথে কান্দে গাঙের পানি, ও তার ঢেউ লাগিয়া যায় ভাসিয়া কাঙ্খের কলসখানি। পূবালী বাতাসে তোমার নায়ের বাদাম ওড়ে, আমার শাড়ীর অঞ্চল ধৈরয না ধরে। তোমার নি পরাণরে মাঝি হারিয়াছে কেউ; কলসী ভাসায়া জলে গণেছ নি ঢেউ।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে সেজন কি তোর পর, সে ত তোরি তরে কেন্দে কেন্দে বেড়ায় দেশান্তর; রে বন্ধু! তোরি তরে সাজাইলাম বন-ফুলের ঘর, রে বন্ধু মন-ফুলের ঘর, ও তুই ভোমর হয়া হানলি কাঁটা সেই না ফুলের পর; রে বন্ধু! এক ঘরেতে লাগলে আগুন পোড়ে অনেক ঘর, মনের আগুন মনই পোড়ায়-নাই কোন দোসর; রে বন্ধু! আগে যদি জানতামরে তোর রূপে আগুর জ্বলে, আমি রূপ থুইয়া আগুনের মালা পরতাম নিজ গলে, রে বন্ধু! চিতার অনলে ঝাঁপ দেই যেই জন, ও তার দেহও পোড়ে, মনও পোড়ে, পোড়ে তার ক্রন্দন; রে বন্ধু! রূপের আগুন মনেই লাগে, লাগে না কার গায়, ও সে মনে মনেই মন জ্বালা কেউ না জানে হায়, রে বন্ধু! তীর যদি বেন্ধে গায়ে, তাও তো তোলন যায়, ও তোর কথার আঘাত কোথায় লাগে কেউ নাহি টের পায়; রে বন্ধু!কাব্যগ্রন্থ: রঙিলা নায়ের মাঝি
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
চার কানা দেয়ারে, তুই না আমার ভাই, আরও ফুটিক ডলক দে, চিনার ভাত খাই — মেঘরাজার গান চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে, এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে | ডোলের বেছন ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে, লাঙল জোয়াল ধূলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে | কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাট আগুন লয়ে খেলে, বাউকুড়াণী উড়ছে তারি ঘূর্ণী ধূলী মেলে | মাঠখানি আজ শূণ্য খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে, জন্-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে : শুকনো চেলা কাঠের মত শুকনো মাঠের ঢেলা, আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা | দরগা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নি আসে ভারে : নৈলা গানের ঝঙ্কারে গাঁও কানছে বারে বারে | তবুও গাঁয়ে নামল না জল, গগনখানা ফাঁকা ; নিঠুর নীলের বক্ষে আগুন করছে যেনে খাঁ খাঁ | উচ্চে ডাকে বাজপক্ষি “আজরাইলে”র ডাক, “খর দরজাল” আসছে বুঝি শিঙায় দিয়ে হাঁক! এমন সময় ওই গাঁ হতে বদনা-বিয়ের গানে, গুটি কয়েক আসলো মেয়ে এই না গাঁয়ের পানে | আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে—পাঁচটি রঙে ফুল, মাঝের মেয়ে সোনার বরণ, নাই কোথা তার তুল | মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল, তেল হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল | মেয়ের দলে বেড়িয়ে তারে চিকন সুরের গানে, গাঁয়ের পথে যায় যে বলে বদনা-বিয়ের মানে | ছেলের দলে পড়ল সাড়া, বউরা মিঠে হাসে, বদনা বিয়ের গান শুনিতে সবাই ছুটে আসে | পাঁচটি মেয়ের মাঝের মেয়ে লাজে যে যায় মরি, বদনা হাতে ছলাৎ ছলাৎ জল যেতে চায় পড়ি | এ-বাড়ি যায় ও-বাড়ি যায়, গানে মুখর গাঁ, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন-রাম-শালিকের ছা | কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো, ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো! কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই, আরও ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই! কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া, তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া! আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি, নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি | কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়, আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়! দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো | দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো | ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল ; দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড় | ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল ; দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো | বারো মেঘের নামে নামে এমনি ডাকি ডাকি, বাড়ি বাড়ি চলল তারা মাঙন হাঁকি হাঁকি কেউবা দিল এক পোয়া চাল, কেউবা ছটাকখানি, কেউ দিল নুন, কেউ দিল ডাল, কেউ বা দিল আনি | এমনি ভাবে সবার ঘরে মাঙন করি সারা, রূপাই মিয়ার রুশাই-ঘরের সামনে এল তারা | রূপাই ছিল ঘর বাঁধিতে, পিছন ফিরে চায়, পাঁটি মেয়ের রূপ বুঝি ওই একটি মেয়ের গায়! পাঁচটি মেয়ে, গান যে গায়, গানের মতই লাগে, একটি মেয়ের সুর ত নয় ও বাঁশী বাজায় আগে | ওই মেয়েটির গঠন-গাঠন চলন-চালন ভালো, পাঁচটি মেয়ের রূপ হয়েছে ওরই রূপে আলো | রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান, রূপাই বলে, “এই দিলে মা থাকবে না আর মান |” ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল, সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল | মাঙন সেরে মেয়ের দল চলল এখন বাড়ি, মাঝের মেয়ের মাথার ঝোলা লাগছে যেন ভারি | বোঝার ভারে চলতে নারে, পিছন ফিরে চায় ; রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়! ***** ডলক = বৃষ্টি বেছন = বীজ বাউকুড়াণী = ঘূর্ণি বায়ু জাহান্নাম = নরক নৈলা গান = বৃষ্টি নামাবার জন্য চাষীরা এই গান গেয়ে থাকে খর-দরজাল = প্রলয়ের দিনে ইনি বেহেস্ত ও দোযখ মাথায় করে আসবেন | (খাড়া দর্জাল) রুশাই-ঘরের = রান্না ঘরের
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
“রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! বারেক ফিরে চাও, বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?” ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ, কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা, সেথায় আছে ছোট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া, সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর রঙে নাওয়া, সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা- সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।” “রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! আবার কোথা ধাও, পুব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।” “ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে, সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে। আমার সাথে করতো খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই, সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই। চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা, বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা।’ সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই। সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই।’ “রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! সারাটা দিন খেলা, এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।” কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙল দিয়ে খেলি নিড়িয়ে দেই ধানের ক্ষেতের সবুজ রঙের চেলী। রিষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হওয়ার সুখে। টির বোনের ঘোমটা খুলে চুমু দিয়ে যায় মুখে। ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশী পউষ-পাগল বুড়ী, আমরা সেথা চষতে লাঙল মুশীদা-গান জুড়ি। খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা-লাঙল-চষা, সারাটা দিন খেলতে জানি, জানিই নেক বসা’।
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
আমার খোদারে দেখিয়াছি আমি গরীবের কুঁড়ে ঘরে, দীন দুঃখীর নয়নের জল যেথায় অঝোরে ঝরে। অথ্যাচারীর পীড়নের ঘায়, কত ব্যথাতুর কাদে নিরালায়; তাদের অশ্রু গড়ায়ে পড়িছে খোদার মাটির পরে। তাইত আমরা পড়িনে নামাজ একা ঘরে নির্জনে, লোকালয়ে মোরা মসজিদ গড়ি সব ভাই একাসনে; জায়নামাজের পাটি আমাদের, আকাশের চেয়ে বিসতৃত ঢের, তাই ত আকাশ লুটায়েছে ছের দুনিয়া মসজিদ ঘরে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
সেলাই করিছে মেয়ে, জাম-দানী শাড়ী রেখায় হাসিছে সোনার অঙ্গ ছেয়ে। এক পাশ হইতে দেখিতেছি তারে, বাঁকাধনু নাসিকায় ভূরু-তীর দুটি সদা উদ্যত বধিতে কে অজানায়। আঁখি সরোবর স্তব্ধ নিঝুম, মৃদু পলকের ঘায়ে, ঢেউ-হংসীরা বিরাম লভিছে কাজল রেখায় গাঁয়ে। অধরখানিতে যুগল ঠোঁটের রঙিন বাঁধন খুলি, মাঝে মাঝে মৃদু হাসিটে ফুটিছে সুমধুর সুখে দুলি। খোঁপার ফিতার কুসুম বাঁধনে গোলাপ মেলিছে দল, বেনীর ভ্রমর সেথা জড় হয়ে রয়েছে অচঞ্চল। এক হাতে ধরি সরু সুইটিরে সেলাই করিছে বসে, আকাশ হইতে তারা-ফুলগুলি পড়িছে সেথায় খসে। রঙের রঙের আলপনা যত তার ভালবাসা হয়ে, জনমের মতো বন্দী হইছে কাঁথায় কুহকালয়ে। কে মাখিয়া দেছে হলুদের গুড়ো তাহার সারাটি গায়, রঙিন শাড়ীর ফাঁকে ফাঁকে তাহা আকাশ ধরনী বায়। অনাহত কোন গান বাজে তার দেহের বীনার তারে, কালের সারথি থামায়েছে চলা সেই সুর শনিবারে। সে সুর শুধুই হৃদয় গহনে কিছু অনুভব হয়, কাহারো নিকট ভাষার বসন কভু সে পরিল নয়। তাহারই একটু রেশ মেখে বুকে বাঁশী যে আত্মহারা, শূণ্য বুকের শূন্য ভরিতে কাঁদে তার সুর-ধারা। মোহের মতন স্বপনের মতো আবছা রঙিন মেঘে, যেমনি ছড়ায় মধুর সুষমা সিদুরিয়া রোদ লেগে; কোনসে মহান ভাস্কর যেন তাজমহলের থেকে, পাথর কাটিয়া অতি ধীরে ধীরে লইতেছে তারে এঁকে। বারবার করে ভেঙে যায় ছবি, হয় না মনের মত, আবার তাহারে গড়িবার লাগি হয় তপস্যা-রত। ওই বাহু দুটি মমতা হইয়া মেলিবে শাড়ীর মেঘে, ও অধরখানি ভালবাসা করে পাষাণে লইবে এঁকে। নাসিকার ওই স্বর্ণ দেউলে স্থাপি মন্মথ-ছবি। যুব-যুগান্ত রূপ-হোমানলে ঢলিবে জীবন-হবি। বসিয়া রয়েছে সীবন-রতা সে মেয়ে, রঙিন ফুলটি ভাসিয়া এসেছে রামধনু নদী বেয়ে। চরণ দুখানি যুগল হংসী শাড়ীর সাগর পাটে, সাঁতারি এখন আসিয়া বসেছে পাড়ের রঙিন ঘাটে, রাঙা টুকটুকে আলতা রেখার রঙিন তটের পানি, ভালবাসা-ফুল ফুটিছে টুটিছে ভরিয়া ধরণীখানি। সাবধান হাতে সরু সুই লয়ে নক্সা আঁকে সে ধরে, কাঁথা উপরে আরেক ধরণী হাসিতেছে খুশী ভরে। আরেক শিল্পী তাহারে লইয়া কালের খাতার পরে, আর এক কাঁথা বুনট করিছে সে রূপ মাধুরী ধরে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে, কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে। কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়, ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়! বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়, সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়। কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া! হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি, নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি! চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে, না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে! কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, - হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি! দিকে দিগেনে- যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল। গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, - গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়! কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি, কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি। কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল। মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে, আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে। লাঠির উপরে, ফুলের উপরে আঁকা হইতেছে ফুল, কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল। তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে- আমীর সাধুর নাও, বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজ গাঁও। ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হতে ওর হাতে, নানান রকম রসি বুনানও হইতেছে তার সাথে। বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে, এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে! যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষীরা, আর ওই রূপ-কথা, বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্প-লতা। বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি, সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি। কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি, তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি। বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে, মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে। আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে, বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(চৌদ্দ)আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে, নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে | মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি, ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি! নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি, কোন্ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি !বাতাসের পায়ে বাজেনা আজিকে ঝল মল মল গান, মাঠের ধূলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয় ম্লান! সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে, মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে! মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল, এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল | লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে, বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে | তবু এই-গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই-গাঁওটির পানে, কতদিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে | মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ ; সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ! এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধাঁ, যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাঁধা |সকলেই জানে সেই কোন্ কালে রূপা বলে এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি | বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা, খন্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা | রূপা একদিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে, তারি আশা-পথে চাহিয়া চাহিয়া বউটি মরিল শেষে | মরিবার কালে বলে গিয়েছিল --- তাহার নক্সী-কাঁথা, কবরের গায়ে মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা!বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে, শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে | প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়, রোগ পাণ্ডডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়! শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙীন শাড়ী, রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি!সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই নক্সী-কাঁথা,--- আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা |কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,--- মহা-শূণ্যেতে উড়িয়াছে কেবা নক্সী-কাথাটি ধরে ; হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশীটি বাজায় করুণ সুরে, তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে | সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ, ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ |
জসীম উদ্‌দীন
ছড়া
আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা, ফুল তুলিতে যাই ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই। মামার বাড়ি পদ্মপুকুর গলায় গলায় জল, এপার হতে ওপার গিয়ে নাচে ঢেউয়ের দল। দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে লাল শালুকের ফুল, রাতের বেলা চাঁদের সনে হেসে না পায় কূল। আম-কাঁঠালের বনের ধারে মামা-বাড়ির ঘর, আকাশ হতে জোছনা-কুসুম ঝরে মাথার ‘পর। রাতের বেলা জোনাক জ্বলে বাঁশ-বাগানের ছায়, শিমুল গাছের শাখায় বসে ভোরের পাখি গায়। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ পাকা জামের শাখায় উঠি রঙিন করি মুখ। কাঁদি-ভরা খেজুর গাছে পাকা খেজুর দোলে ছেলেমেয়ে, আয় ছুটে যাই মামার দেশে চলে।
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
শোন, শোন মেয়ে, কার ঘর তুমি জড়ায়েছ জোছনায়, রাঙা অনুরাগ ছড়ায়েছ তুমি কার মেহেদির ছায়! কার আঙিনার ধূলি রাঙা হল চুমি ওই পদতল, কারে দিলে তুমি সুশীতল ছায়া প্রসারিয়া অঞ্চল! তুমি আকাশের চাঁদ হয়েছিলে, কাহার ফুলের শরে, বিদ্ধ হইয়া হে নভচারিনী নেমেছ মাটির ঘরে! কোন্ সে তমাল মেঘের মায়ায় ওগো বিদ্যুৎলতা! ভুলিলে আজিকে বিরামবিহীন গতির চঞ্চলতা। চির সুদূরিকা! কহ কহ তুমি, কাহার বাঁশীর সুরে গ্রহতারকার অনাহত বাণী আনিয়াছ দেহপুরে। সে কি জানিয়াছে যুগান্তপারে মহামন্থর শেষে, নীলাম্বুদির তরঙ্গ পরে লক্ষ্মী দাঁড়াল এসে! সে কি জানিয়াছে, মানস-সরের রাঙা মরালীর বায়, সন্ধ্যা-সকাল এক দেহ ধরি দাঁড়ায়েছে নিরালায়! ওগো কল্যাণী! কহ কহ মোরে, সে কি জানিয়াছে হায়! ও ইন্দ্রধনু তনুখানি তব জড়াতে শ্যামল গায়, তপস্যা-রত জল-ভরা মেঘ গগনে গগনে ঘোরে, কামনা-যজ্ঞে লেলিহা বহ্নি মহাবিদ্যুতে পোড়ে! সে কি জানিয়াছে, বাণীর ভ্রমরী ও অধর ফুল হতে উড়িয়া আসিয়া হিয়ারে যে বেড়ে চিরজনমের ক্ষতে! সে কি শিখিয়াছে, বাসক শয়নে ওই তনুদীপ জ্বালি পতঙ্গ সম প্রতি পলে পলে আপনারে দিতে ঢালি! ও অধর ভরা লাল পেয়ালার দ্রাক্ষারসের তরে, জায়নামাজের বেচিয়াছে পাটি সুরা-বিক্রেতা ঘরে! সে কি জপিয়ায়ে ওই নাম তব তবসী-মালার সনে, সে কি ও নামের কোরান লিখিয়া পড়িয়াছে মনে মনে! ওগো কল্যাণী! কহ কহ তুমি কেবা দরবেশ, তোমার লাগিয়া মন-মোমবাতি পুড়ায়ে করিল শেষ! কত বড় তার প্রসারিত বুক, আকাশে যে নাহি ধরে, সেই বিদ্যুৎ বিহ্নরে আনি লুকাল বুকের ঘরে!
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(তিন)ওই গাঁখানি কালো কালো, তারি হেলান দিয়ে, ঘরখানি যে দাঁড়িয়ে হাসে ছোনের ছানি নিয়ে ; সেইখানে এক চাষীর মেয়ে নামটি তাহার সোনা, সাজু বলেই ডাকে সবে, নাম নিতে যে গোনা | লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী, ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি | মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে, রাঙা ঠোঁটের লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে | ফুল-ঝর-ঝর জন্তি গাছে জড়িয়ে কেবা শাড়ী, আদর করে রেখেছে আজ চাষীদের ওই বাড়ি | যে ফুল ফোটে সোণের খেতে, ফোটে কদম গাছে, সকল ফুলের ঝলমল গা-ভরি তার নাচে |কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা, তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা | গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি, চাষী মেয়ের রূপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি ? রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ, পাটের বনের বউ টুবাণী, নাইক দেখার লোভ | দেখেছি এই চাষী মেয়ের সহজ গেঁয়ো রূপ, তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ! দু একখানা গয়না গায়ে, সোনার দেবালয়ে, জ্বলছে সোনার পঞ্চ প্রদীপ কার বা পূজা বয়ে! পড়শীরা কয়---মেয়ে ত নয়, হলদে পাখির ছা, ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ |এমন মেয়ে---বাবা ত নেই, কেবল আছেন মা ; গাঁওবাসীরা তাই বলে তায় কম জানিত না | তাহার মতন চেরন 'সেওই' কে কাটিতে পারে, নক্সী করা পাকান পিঠায় সবাই তারে হারে | হাঁড়ির উপর চিত্র করা শিকেয় তোলা ফুল, এই গাঁয়েতে তাহার মত নাইক সমতুল | বিয়ের গানে ওরই সুরে সবারই সুর কাঁদে, 'সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে' --- বলে কি লোক সাধে?
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
এগার সাজ সাজ বলিয়ারে শহরে পৈল সাড়া, সাত হাজার বাজে ঢোল চৌদ্দ হাজার কাড়া | প্রথমে সাজিল মর্দ আহ্লাদি ডগরি, পাঁচ কাঠে ভুঁই জুইড়া বসে মর্দ এয়সা ভারি | তারপরে সাজিল মর্দ তুরক আমানি, সমুদ্দুরে নামলে তার হৈল আঁটুপানি | তারপরে সাজিল মর্দ নামে লোহাজুড়ী, আছড়াইয়া মারত সে হাতীর শুঁড় ধরি | তারপরে নামিল মর্দ নামে আইন্দ্যা ছাইন্দ্যা, বাইশ মণ তামাক নেয় তার লেংটির মধ্যে বাইন্ধ্যা | তারপরে সাজিল মর্দ নামে মদন ঢুলি, বাইশ মণ পিতল তার ঢোলের চারটা খুলী | আতালী পাতালী সাজে গগনেরি ঠাটা, মেঘনাল সাজিয়া আইল তাম তুরুকের বেটা | তুগুলি মুগুলি সাজে তারা দুই ভাই, ঐরাবতে সাইজা আইল আজদাহা সেপাই | বন্দুকি বন্দুকি চলে কামানে কামান, ময়ূর ময়ুরী চলে ধরিয়া পয়গাম | . — মহরমের জারী “ও রূপা তুই করিস কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে? বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে |” “কি বলিলা বছির মামু ?” উঠল রূপাই হাঁক ছাড়িয়া, আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া | পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে, বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি, আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে! লম্ফে রূপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা, ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা | কোথায় রল রহম চাচা, কলম শেখ আর ছমির মিঞা, সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া! বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরা গফর-গাঁয়ে, এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান গোরের ছায়ে? “আলী-আলী” হাঁকল রূপাই হুঙ্কারে তার গগন ফাটে, হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে! ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রূপার বাড়ি ; ডাক শুনে তার আসল ছুটে রহম চাচা, ছমির মিঞা, আসল হেঁকে কাজেম খুনী নখে নখে আঁচড় দিয়া | আসল হেঁকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পড়ি, এক নিমেষে গাঁয়ের লোকে রূপার বাড়ি ফেলল ভরি | লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে, এক লাঠিতে একশ লোকেরমাথা যে জন আস্ ল দলে | দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী, গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি | গর্জি উঠে গদাই ভূঁঞার ; মোহন ভূঁঞার ভাজন বেটা, যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা | সব গাঁর লোক এক হল আজ রূপার ছোট উঠান পরে, নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ-খেলানো বাঁশীর স্বরে! রূপা তখন বেরিয়ে তাদের বলল, “শোন ভাই সকলে, গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে |” বছির মামু বলছে খবর—মোল্লারা সব কাসকে নাকি ; আধেক জমির ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায় : আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায় |” থামল রূপাই—ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া, নাগ-নাগিনীর ফণায় যেমন তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া | গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ায় লাঠি, রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি | রূপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, “থাল বাজারে থাল বাজারে, থাল বাজায়ে সড়কি ঘুরা হানরে লাঠি এক হাজারে | হানরে লাঠি—হানরে কুঠার, গাছের ছ্যন্ আর রামদা ঘুরা, হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয় রে তোরা |” “আলী! আলী! আলী! আলী!!!” রূপার যেন কণ্ঠ ফাটি, ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে কাঁপছে আকাশ কাঁপছে মাটি | তারি সুরে সব লেঠেল লাঠির, পরে হানল লাঠি, “আলী-আলী” শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি | আগে আগে ছুটল রূপা—বৌঁ বৌঁ বৌঁ সড়কি ঘোরে, কাল সাপের ফণার মত বাবরী মাথায় চুল যে ওড়ে | লল পাছে হাজার লেঠেল “আলী-আলী” শব্দ করি, পায়ের ঘায়ে মাঠের ধূলো আকাশ বুঝি ফেলবে ভরি! চলল তারা মাঠ পেরিয়ে, চলল তারা বিল ডেঙিয়ে, কখন ছুটে কখন হেঁটে বুকে বুকে তাল ঠুকিয়ে | চলল যেমন ঝড়ের দাপে ঘোলাট মেঘের দল ছুটে যায়, বাও কুড়ানীর মতন তারা উড়িয়ে ধূল্ পথ ভরি হায়! দুপুর বেলা এল রূপাই গাজনা চরের মাঠের পরে, সঙ্গে এল হাজার লেঠেল সড়কি লাঠি হস্তে ধরে! লম্ফে রূপা শূণ্যে উঠি পড়ল কুঁদে মাটির পরে, থকল খানিক মাঠের মাটি দন্ত দিয়ে কামড়ে ধরে | মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে, “আলী! আলী!” শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে | হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয় “আলী আলী হজরত আলী,” সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি! তারাও সবে আসল জুটে দলে দলে ভীম পালোয়ান, “আলী আলী” শব্দে যেন পড়ল ভেঙে সকল গাঁখান! সামনে চেয়ে দেখল রূপা সার বেঁধে সব আসছে তারা, ওপার মাঠের কোল ঘেঁষে কে বাঁকা তীরে দিচ্ছে নাড়া | রূপার দলে এগোয় যখন, তারা তখন পিছিয়ে চলে, তারা আবার এগিয়ে এলে এরাও ইটে নানান কলে | এমনি করে সাত আটবারে এগোন পিছন হল যখন রূপা বলে, “এমন করে “কাইজা” করা হয় না কখন |” তাল ঠুকিয়ে ছুটল রূপাই, ছুটল পাছে হাজার লাঠি, “আলী-আলী — হজরত আলী” কণ্ঠ তাদের যয় যে ফাটি | তাল ঠুকিয়া পড়ল তারা বন-গেঁয়োদের দলের মাঝে, লাঠির আগায় লাগল লাঠি, লাঠির আগায় সড়কি বাজে | “মার মার মার” হাঁকল রূপা, — “মার মার মার” ঘুরায় লাঠি, ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি | আজ যেন সে মৃত্যু-জনম ইহার অনেক উপরে উঠে, জীবনের এক সত্য মহান্ লাঠির আগায় নিচ্ছে লুটে! মরণ যেন মুখোমুখি নাচছে তাহার নাচার তালে, মহাকালের বাজছে বিষাণ আজকে ধরার প্রলয় কালে | নাচে রূপা—নাচে রূপা— লোহুর গাঙে সিনান করি, মরণরে সে ফেলছে ছুড়ে রক্তমাখা হস্তে ধরি | নাচে রূপা—নাচে রুপা—মুখে তাহার অট্টহাসি, বক্ষে তাহার রক্ত নাচে, চক্ষে নাচে অগ্নিরাশি | —হাড়ে হাড়ে নাচন তাহার, রোমে রোমে লাগছে নাচন, কি যেন সে দেখেছে আজ, রুধতে নারে তারি মাতন | বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রূপার লোকও ফিরল বহু, রূপা তবু নাচছে, গায়ে তাজা-খুনের হাসছে লোহু | . ***** পো = ছেলে হজরত আলী = হজরত মুহাম্মদের (দঃ) জামাতা | তিনি মহাবীর ছিলেন | এদেশে মারামারির সময় সকলে মিলে আলী, আলী, শব্দ করে | কারও কারও মতে আলী, আল্লা শব্দের অপভ্রংশ | ঠাটা = অশনি ভাজন = ঔরসজাত কাঁচির = কাস্তের গাছের ছ্যান = খেজুর গাছের ডগা কাটার অস্ত্র
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
কমলা রাণীর দীঘি ছিল এইখানে, ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তটের পানে। আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী-বধূর দল, কমলা রাণীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল। আজ সেই দীঘি শুকায়েছে, এর কর্দমাক্ত বুকে, কঠিন পায়ের আঘাত হানিয়া গরুগুলি ঘাস টুকে। জলহীন এই শুষ্ক দেশের তৃষিত জনের তরে। কোন সে নৃপের পরাণ উঠিল করুণার জলে ভরে। সে করুণা ধারা মাটির পাত্রে ভরিয়া দেখার তরে, সাগর দীঘির মহা কল্পনা জাগিল মনের ঘরে। লক্ষ কোদালী হইল পাগল, কঠিন মাটিরে খুঁড়ি, উঠিল না হায় কল-জল-ধারা গহন পাতাল ফুঁড়ি। দাও, জল দাও, কাঁদে শিশু মার শুষ্ক কন্ঠ ধরি, ঘরে ঘরে কাঁদে শূন্য কলসী বাতাসে বক্ষ ভরি। লক্ষ কোদালী আরো জোরে চলে, কঠিন মাটির থেকে, শুষ্ক বালুর ধূলি উড়ে বায় উপহাস যেন হেঁকে। কোথায় রয়েছে ভাট ব্রাক্ষণ, কোথায় গণক দল, জলদী করিয়া গুনে দেখ কেন দীঘিতে ওঠে না জল? আকাশ হইতে গুণিয়া দেখিও শত-তারা আঁখি দিয়া, পাতালে গুণিও বাসকি-ফণার মণি-দীপ জ্বালাইয়া। ঈশানে গুণিও ঈশানী গলের নর-মুন্ডের সনে, দক্ষিনে গুনো, শাহ মান্দার যেথা সুন্দর বনে। আকাশ গণিল, পাতাল গণিল, গলিল দশটি দিক, দীঘিতে কেন যে জল ওঠেনাক বলিতে নারিল ঠিক। নিশির শয়নে জোড়মন্দিরে স্বপন দেখিছে রাণী, কে যেন আসিয়া শুনাইল তারে বড় নিদারুণ বানী; সাগর দীঘিতে তুমি যদি রাণী! দিতে পার প্রাণদান, পাতল হইতে শত ধারা-মেলি জাগিবে জলের বান। স্বপন দেখিয়া জাগিল যে রাণী, পূর্বের গগন-গায়, রক্ত লেপিয়া দাঁড়াইল রবি সুদূরের কিনারায়। শোন শোন ওহে পরাণের পতি ছাড় গো আমার মায়া, উড়ে চলে যায় আকাশের পাখি পড়ে রয় শুধু ছায়া। পেটরা খুলিয়া তুলে নিল রাণী অষ্ট অলঙ্কার, রাসমন্ডল শাড়ীর লহরে দেহটি জড়াল তার। কৌটা খুলিয়া সিঁদুর তুলিয়া পরিল কপাল ভরি, দুর্গা প্রতিমা সাজিল বুঝি বা দশমীর বাঁশী স্মরি। ধীরে ধীরে রাণী দাঁড়াইল আসি সাগর দীঘির মাঝে, লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী শুকনো তটের কাছে। পাতাল হইতে শতধারা মেলি নাচিয়া আসিল জল, রাণীর দুখানা চরণে পড়িয়া হেসে ওঠে খল খল। খাড়ু জলে রাণী খুলিয়া ফেলিল পায়ের নুপূর তার, কোমর জলেতে ছিড়িল যে রাণী কোমরে চন্দ্রহার। বুক-জলে রাণী কন্ঠে হইতে গজমতি হার খুলে, কোরের ছেলেটি জয়ধর কোথা দেখে রাণী আঁখি তুলে। গলাজলে রাণী খোঁপা হতে তার ভাসাল চাঁপার ফুল। চারিধার হতে কল-জলধারা ভরিল দীঘির কূল। সেই ধারা সনে মিশে গেল রাণী আর আসিল না ফিরে, লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী আকাশ বাতাস ঘিরে। *** কমলা রানীর এই সেই দীঘি, কার অভিশাপে আজ, খুলিয়া ফেলেছে অঙ্গ হইতে জল-কুমুদীর সাজ। পাড়ে পাড়ে আজ আছাড়ি পড়ে না চঞ্চল ঢেউদল, পল্লী-বধূর কলসীর ঘায়ে দোলে না ইহার জল। কমলা রাণীর কাহিনী এখন নাহিক কাহারো মনে, রাখালের বাঁশী হয় না করুণ নিশীথ উদাস বনে। শুধু এই গাঁর নূতন বধূরে বরিয়া আনিতে ঘরে, পল্লীবাসীরা বরণ কুলাটি রেখে যায় এর পরে। গভীর রাত্রে সেই কুলাখানি মাথায় করিয়া নাকি, আলেয়ার মত কে এক রূপসী হেসে ওঠে থাকি থাকি।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(দুই)এক কালা দতের কালি যা দ্যা কলম লেখি, আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি,       ---ও কালা, ঘরে রইতে দিলি না আমারে | --- মুর্শিদা গানএই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল, কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল! কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া, তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া | জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, গা-খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু | বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল, বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল | কচি ধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষী, মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি |কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি, কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি | জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভূবনময় ; চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয় |সোনায় যে জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার' রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার | কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন, তারি পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন | সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ, কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক | যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও! সেই কালোতে সিনান করি উজল তাহার গাও |আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী, খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি | জারীর গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে, 'শাল-সুন্দী-বেত' যেন ও, সকল কাজেই লাগে | বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল লোহা যেন, রূপাই যেমন বাপের বেটা, কেউ দেখেছ হেন? যদিও রূপা নয়কো রূপাই, রূপার চেয়ে দামী, এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামী |
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
রাত দুপুর মেঘে মেঘে কড়াৎ কড়াৎ শব্দ যখন হয়, দুই নখেতে আঁধার চিরি বিজলী যখন জ্বলে ভুবনময়; তুফান ছোটে জোর দাপটে, বৃষ্টি পড়ে মেঘের ঝাঁজর ঝরে, বছিরদ্দির ঘুম ভেঙে যায়-মুহূর্ত সে রইতে নারে ঘরে। বিলের জলে টাইটুবানি রোহিত কাতল মাছেরা দেয় ফাল, কই মাগুরের দলসাঁতারে আঁকাবাকাঁ ধরি গাঁয়ের খাল, এমন সময় বছিরদ্দি একহাতেতে তীক্ষ্ম টেটা ধরে, আর এক হাতে মশাল জ্বালি বীর দাপটে ছোটে মাটের পরে। বুড়ীর ভিটায় বেড়াল ডাকে, তাল-তলাতে গলায় দড়ি দিয়ে, মরেছিল তাঁতীর বধূ- এ সবে তার কাঁপায় নাক হিয়ে। শেওড়া বনে পেত্নী নাচে, হাজরাতলায় পিশাচে দেয় শিস, বিলের ধারে আগুন জ্বালি ভূতেরা সব ফিরছে নানান দিশ। ভয় নাহি তার কারও কাছে, রাতের আঁধার মশাল দিয়ে ঠেলে, একলা চলে বছিরদ্দি জোর দাপটে চরণ দুখান ফেলে। হাতে তাহার তীক্ষ্ম টেটা, গায়ে তাহার মোষের মত জোর, চোখ দুটিতে উল্কা জ্বলে যমদূতেরও দেখে লাগে ঘোর। রাত দুপুরে বিলের পথে বছিরদ্দি মাছ মারিতে যায়- দূর হতে তার মশাল জ্বলে ধকো ধকো রাতের কালো ছায়। বৃষ্টি-শীলা মাথায় পড়ে, তুফান চলে ক্ষিপ্ত ঘোড়ার মত, রয়ে রয়ে বিজলী জ্বলে ইন্দ্র ডাকে আঁধার করি ক্ষত; শ্মাশান-ঘাটায় পেত্নী নাচে, বটের শাখে পিশাচ দোলা খায়, রাত দুপুরে বিলের পথে বছিরদ্দি মাছ ধরিতে যায়।
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
গভীর রাতের কালে, কুহেলী আঁধার মূর্ছিত প্রায় জড়ায়ে ঘুমের জালে। হাসপাতালের নিবিয়াছে বাহি; দমকা হাওয়ার ঘায়, শত মুমূর্ষু রোগীর কাঁদন শিহরিছে বেদনায়। কে তুমি চলেছ সাবধান পদে বয়স-বৃদ্ধা-নারী! দুই পাশে তব রুগ্ন-ক্লিন্ন শুয়ে আছে সারি সারি। কাহার পাখাটি জোরে চলিতেছে, বালিশ সরেছে কার, বৃষ্টির হাওয়া লেগেকার গায়ে শিয়রে খুলিয়া দ্বার! ব্যান্ডেজ কার খুলিয়া গিয়াছে, কাহার চাই যে জল, স্বপন দেখিয়া কেঁদে ওঠে কেবা, আঁখি দুটি ছল ছল। এ সব খবর লইতে লইতে চলিয়াছ একাকিনী, দুঃখের কোন সান্ত্বনা তুমি, বেদনায় বিষাদিনী। গভীর নিশীথে, অনেক ঊর্ধ্বে জ্বলিছে আকাশে তারা, তোমার এ স্নেহ মমতার কাজ দেখিতে পাবে না তারা; রাত-জাগা পাখি উড়িছে আকাশে, জানিবে না সন্ধান, রাত জাগা ফুল ব্যস্ত বড়ই বাতাসে মিশাতে ঘ্রাণ। তারা কেহ আজ জানিতে পাবে না, তাহাদেরি মত কেহ, সারা নিশিজাগি বিলাইছে তার মায়েলী বুকের স্নেহ। এই বিভাবরী বড়ই ক্লান্ত, বড়ই স্তব্ধতম উতলা বাতাস জড়াইয়া কাঁদে আঁধিয়ার নির্মম। মৃত্যু চলেছে এলায়িত কেশে ভয়াল বদন ঢাকি, পরখ করিয়া কারে নিয়ে যাবে, কারে সে যাইবে রাখি। মহামরণের প্রতীক্ষাতুর রোগীদের মাঝখানে, মহীয়সী তুমি জননী মুরতি আসিলে কি সন্ধানে; জীবন মৃত্যু মহা-রহস্য তুমি কি যাইবে খুলি, ধরণীর কোন গোপন কুহেলী আজিকে লইবে তুলি। যে বৃদ্ধ কাল সাক্ষ্য হইয়া আছে মানুষের সাথে, তুমি কি তাহার বৃদ্ধা সাথিনী আসিয়াছ আজ রাতে? নিখিল নরের আদিম জননী আজিকে তোমার বেশে, রুগ্ন তাহার সন্তানদেরে দেখিয়া নিতেছ এসে। নিরালা আমার শয্যার পাশে তোমার আঁচল-ছায়, স্তব হয়ে আজ জড়ায়ে রহিতে বড় মোর সাধ যায়!
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(ছয়)ঘরেতে রূপার মন টেকে না যে, তরলা বাঁশীর পারা, কোন বাতাসেতে ভেসে যেতে চায় হইয়া আপন হারা | কে যেন তার মনের তরীরে ভাটির করুণ তানে, ভাটিয়াল সোঁতে ভাসাইয়া নেয় কোন্ সে ভাটার পানে | সেই চিরকেলে গান আজও গাহে, সুরখানি তার ধরি, বিগানা গাঁয়ের বিরহিয়া মেয়ে আসে যেন তরি! আপনার গানে আপনার প্রাণ ছিঁড়িয়া যাইতে চায়, তবু সেই ব্যথা ভাল লাগে যেন, একই গান পুনঃ গায় | খেত-খামারেতে মন বসেনাকো ; কাজে কামে নাই ছিরি, মনের তাহার কি যে হল আজ ভাবে তাই ফিরি ফিরি | গানের আসরে যায় না রূপাই সাথীরা অবাক মানে, সারাদিন বসি কি যে ভাবে তার অর্থ সে নিজে জানে! সময়ের খাওয়া অসময় খায়, উপোসীও কভু থাকে, 'দিন দিন তোর কি হল রূপাই' বার বার মায় ডাকে | গেলে কোনখানে হয়তো সেথাই কেটে যায় সারা দিন, বসিলে উঠেনা উঠিলে বসেনা, ভেবে ভেবে তনু ক্ষীণ | সবে হাটে যায় পথ বরাবর রূপা যায় ঘুরে বাঁকা, খালার বাড়ির কাছ দিয়ে পথ, বাঁশ-পাতা দিয়ে ঢাকা |পায়ে-পায় ছাই বাঁশ-পাতাগুলো মচ্ মচ্ করে বাজে ; কেউ সাথে নেই, তবু যে রূপাই মরে যায় যেন লাজে | চোরের মতন পথে যেতে যেতে এদিক ওদিক চায়, যদিবা হঠাৎ সেই মেয়েটির দুটি চোখে চোখ যায় | ফিরিবার পথে খালার বাড়ির নিকটে আসিয়া তার, কত কাজ পড়ে, কি করে রূপাই দেরি না করিয়া আর | কোনদিন কহে, 'খালামা, তোমার জ্বর নাকি হইয়াছে, ও-বাড়ির ওই কানাই আজিকে বলেছে আমার কাছে | বাজার হইতে আনিয়াছি তাই আধসেরখানি গজা |' 'বালাই! বালাই! জ্বর হবে কেন? রূপাই, করিলি মজা ; জ্বর হলে কিরে গজা খায় কেহ?' হেসে কয় তার খালা, 'গজা খায়নাক, যা হোক এখন কিনে ত হইল জ্বালা ; আচ্ছা না হয় সাজুই খাইবে |' ঠেকে ঠেকে রূপা কহে, সাজু যে তখন লাজে মরে যায়, মাথা নিচু করে রহে |কোন দিন কহে, 'সাজু কই ওরে, শোনো কিবা মজা, খালা! আজকের হাটে কুড়ায়ে পেয়েছি দুগাছি পুঁতির মালা ; এক ছোঁড়া কয়, 'রাঙা সূতো' নেবে? লাগিবে না কোন দাম ; নিলে কিবা ক্ষতি, এই ভেবে আমি হাত পেতে রইলাম | এখন ভাবছি, এসব লইয়া কিবা হবে মোর কাজ, ঘরেতে থাকিলে ছোট বোনটি সে ইহাতে করিত সাজ | সাজু ত আমার বোনেরই মতন, তারেই না দিয়ে যাই, ঘরে ফিরে যেতে একটু ঘুরিয়া এ-পথে আইনু তাই |'এমনি করিয়া দিনে দিনে যেতে দুইটি তরুণ হিয়া, এ উহারে নিল বরণ করিয়া বিনে-সূতী মালা দিয়া |এর প্রাণ হতে ওর প্রাণে যেয়ে লাগিল কিসের ঢেউ, বিভোর কুমার, বিভোর কুমারী, তারা বুঝিল না কেউ | ---তারা বুঝিল না, পাড়ার লোকেরা বুঝিল অনেকখানি, এখানে ওখানে ছেলে বুড়ো মিলে শুরু হল কানাকানি |সেদিন রূপাই হাট-ফেরা পথে আসিল খালার বাড়ি, খালা তার আজ কথা কয়নাক, মুখখানি যেন হাঁড়ি | 'রূপা ভাই এলে?' এই বলে সাজু কাছে আসছিল তাই, মায় কয়, 'ওরে ধাড়ী মেয়ে, তোর লজ্জা শরম নাই?' চুল ধরে তারে গুড়ুম গুড়ুম মারিল দু'তিন কিল, বুঝিল রূপাই এই পথে কোন হইয়াছে গরমিল |মাথার বোঝাটি না-নামায়ে রূপা যেতেছিল পথ ধরি, সাজুর মায়ে যে ডাকিল তাহারে হাতের ইশারা করি ; 'শোন বাছা কই, লোকের মুখেতে এমন তেমন শুনি, ঘরে আছে মোর বাড়ন্ত মেয়ে জ্বলন্ত এ আগুনি | তুমি বাপু আর এ-বাড়ি এসো না |' খালা বলে রোষে রোষে, 'কে কি বলে? তার ঘাড় ভেঙে দেব!' রূপা কহে দম কসে | 'ও-সবে আমার কাজ নাই বাপু, সোজা কথা ভালবাসি, সারা গাঁয়ে আজ ঢি ঢি পড়ে গেছে, মেয়ে হল কুল-নাশী |'সাজুর মায়ের কথাগুলি যেন বঁরশীর মত বাঁকা, ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে দিয়ে যায় তীব্র বিষের ধাকা | কে যেন বাঁশের জোড়-কঞ্চিতে তাহার কোমল পিঠে, মহারোষ-ভরে সপাং সপাং বাড়ি দিল গিঠে গিঠে | টলিতে টলিতে চলিল রূপাই একা গাঁর পথ ধরি, সম্মুখ হতে জোনাকীর আলো দুই পাশে যায় সরি |রাতের আঁধারে গালি-ভরা বিষে জমাট বেঁধেছে বুঝি, দুই হাতে তাহা ঠেলিয়া ঠেলিয়া চলে রূপা পথ খুঁজি | মাথার ধামায় এখনও রয়েছে দুজোড়া রেশমী চুরী, দুপায়ে তাহারে দলিয়া রূপাই ভাঙিয়া করিল গুঁড়ি | টের সদাই জলীর বিলেতে দুহাতে ছুঁড়িয়া ফেলি, পথ থুয়ে রূপা বেপথে চলিল, ইটা খেতে পাও মেলি | চলিয়া চলিয়া মধ্য মাঠেতে বসিয়া কাঁদিল কত, অষ্টমী চাঁদ হেলিয়া হেলিয়া ওপারে হইল গত |প্রভাতে রূপাই উঠিল যখন মায়ের বিছানা হতে, চেহারা তাহার আধা হয়ে গেছে, চেনা যায় কোন মতে | মা বলে, 'রূপাই কি হলরে তোর?' রূপাই কহে না কথা দুখিনী মায়ের পরাণে আজিকে উঠিল দ্বিগুণ ব্যথা | সাত নয় মার পাঁচ নয় এক রুপাই নয়ন তারা, এমনি তাহার দশা দেখে মায় ভাবিয়া হইল সারা | শানাল পীরের সিন্নি মানিল খেতে দিল পড়া-পানি, হেদের দৈন্য দেখিল জননী, দেখিলনা প্রাণখানি | সারা গায়ে মাতা হাত বুলাইল চোখে মুখে দিল জল, বুঝিল না মাতা বুকের ব্যথার বাড়ে যে ইহাতে বল |আজকে রূপার সকলি আঁধার, বাড়া-ভাতে ওড়ে ছাই, কলঙ্ক কথা সবে জানিয়াছে, কেহ বুঝি বাকি নাই | জেনেছে আকাশ, জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু ; উদাস-দৃষ্টি য়ত দিকে চাহে সব যেন শূনো মরু |চারিদিক হতে উঠিতেছে সুর, ধিক্কার! ধিক্কার!! শাঁখের করাত কাটিতেছে তারে লয়ে কলঙ্ক ধার | ব্যথায় ব্যথায় দিন কেটে গেল, আসিল ব্যথার সাঁজ, পূবে কলঙ্কী কালো রাত এল, চরণে ঝিঁঝির ঝাঁজ! অনেক সুখের দুখের সাক্ষী বাঁশের বাঁশীটি নিয়ে, বসিল রূপাই বাড়ির সামনে মধ্য মাঠেতে গিয়ে |মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি ; মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি | আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায় ; যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীতে কেমন দেখাব তায়? অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে, এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে ; সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান ; পেতে রহি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ! মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগবান করে খেলা, রাজা-বাদশার সুখ-দুখ দিয়ে গড়েছি কথার মালা | পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়, যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায় ; তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিতেছে দোল, কি করিয়া আ দেখাইব তাহা, কোথা পাব সেই বোল? ---সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই, ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই |বাজায় রূপাই বাঁশীটি বাজায় মনের মতন করে, যে ব্যথা সে বুকে ধরিতে পারেনি সে ব্যথা বাঁশীতে ঝরে | বাজে বাঁশী বাজে, তারি সাথে সাথে দুলিছে সাঁজের আলো ; নাচে তালে তালে জোনাকীর হারে কালো মেঘে রাত-কালো | বাজাইল বাঁশী ভাটিয়ালী সুরে বাজাল উদাস সুরে, সুর হতে সুর ব্যথা তার চলে যায় কোন দূরে! আপনার ভাবে বিভোল পরাণ, অনন্ত মেঘ-লোকে, বাঁশী হতে সুরে ভেসে যায় যেন, দেখে রূপা দুই চোখে | সেই সুর বয়ে চলেছে তরুণী, আউলা মাথার চুল, শিথিল দুখান বাহু বাড়াইয়াছিঁড়িছে মালার ফুল | রাঙা ভাল হতে যতই মুছিছে ততই সিঁদুর জ্বলে ; কখনও সে মেয়ে আগে আগে চলে, কখনও বা পাছে চলে | খানিক চলিয়া থামিল করুণী আঁচলে ঢাকিয়া চোখ, মুছিতে মুছিতে মুছিতে পারে না, কি যেন অসহ শোক! করুণ তাহার করুণ কান্না আকাশ ছাইয়া যায়, কি যে মোহের রঙ ভাসে মেঘে তাহার বেদনা-ঘায় | পুনরায় যেন খিল খিল করে একগাল হাসি হাসে, তারি ঢেউ লাগি গগনে গগনে তড়িতের রেখা ভাসে |কখনও আকাশ ভীষণ আঁধার, সব গ্রাসিয়াছে রাহু, মহাশূণ্যের মাঝে ভেসে উঠে যেন দুইখানি বাহু! দোলে-দোলে-বাহু তারি সাথে যেন দোলে-দোলে কত কথা, 'ঘরে ফিরে যাও, মোর তরে তুমি সহিও না আর ব্যথা |' মুহূর্ত পরে সেই বাহু যেন শূণ্যে মিলায় হায়--- রামধনু বেয়ে কে আসে ও মেয়ে, দেখে যেন চেনা যায়! হাসি হাসি মুখ গলিয়া গলিয়া হাসি যায় যেন পড়ে, সার গায়ে তার রূপ ধরেনাক, পড়িছে আঁচল ঝরে | কণ্ঠে তাহার মালার গন্ধে বাতাস পাগল পারা, পায়ে রিনি ঝিনি সোনার নূপুর বাজিয়া হইছে সারা ;হঠাৎ কে এল ভীষণ দস্যু---ধরি তার চুল মুঠি, কোন্ আন্ধার গ্রহপথ বেয়ে শূণ্যে সে গেল উঠি | বাঁশী ফেলে দিয়ে ডাক ছেড়ে রূপা আকাশের পানে চায়, আধা চাঁদখানি পড়িছে হেলিয়া সাজুদের ওই গাঁয় | শুনো মাঠে রূপা গড়াগড়ি যায়, সারা গায়ে ধূলো মাখে, দেহেরে ঢাকিছে ধূলো মাটি দিয়ে, ব্যথারে কি দিয়ে ঢাকে!
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
চৌধুরীদের রথ ডান ধারে তার ধূলায় ধূসর তালমা হাটের পথ। চামচিকে আর আরসূলারা নির্ভাবনায় বসি, করছে নানান কল-কোলাহল রথের মাঝে পশি! বাদুর সেথা ঝুলছে সুখে, বাহির জগৎখানি, অনেক দিনই ত্যাগ করেছে তাদের জানাজানি। গরুর বীরের মাথায় বসি পাঁকুড় গাছের চারা, মেলছে শিকড়, তবু ঠাকুর দেয়নি কোন সাড়া। কাঠের ঘোড়ার ঠ্যাং ভেঙেছে, খসছে রথের ছাদ, আজো তবু কেউ করেনি ইহার প্রতিবাদ। রাস্তা দিয়ে নানান রকম লোকের চলাচল; নানান রকম আলাপ বিলাপ, নানান কোলাহল। কেউ বা চাষী, কেউ বা ধনী, পরদেশী, কেউ দেশী, ভাবে তারা সবার চেয়ে কাজের কথাই বেশী। কেউ বা ভাবে, মোকদমায় হারিয়ে দিয়ে কার বসত-বাড়ি করবে নিলাম বাঁশ-গাড়ীতে তার। কেউ বা ভাবে, কি কৌশলে মেলি কথার জাল, এক আনিতে আনবে টেনে ছয়পয়সার মাল। যতই কেন ব্যস্ত থাকুক, যতই কাজের তাড়া; হেথায় এলে সব ভুলে চায় রথের পানে তারা। চাক ভাঙা আর বয়স মলিন চৌধুরীদের রথ, তাদের পানে করুন চেয়ে শুধায় যেন পথ;- শুধায় যেন, সেই অতীতের চৌধুরীদের কে, ছুতোর ডেকে রঙিন এ রথ গড়লপুলকে! আসল গাঁয়ের বৃদ্ধ পোটো, রঙিন তুলির সনে, রেখায় রেখায় বাঁধল সে কোন সোনার স্বপনে। রথের চূড়ায় উড়ল ধ্বজা, গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে, চলতে পথে থাকত খানিক রথের পানে চেয়ে। তারপরে সে রথের দিনে হাজার লোকের মেলা, দোকান পসার, ভোজবাজী আর ভানুমতীর খেলা, আসত গাঁয়ের বৌ ঝিরা সব, আসত ছেলে-মেয়ে, রঙিন হাসির দুলত লহর রঙিন কাপড় ছেয়ে। বুড়ো মাসীর স্কন্ধে উঠে ছোট্ট শিশু ছেলে; এই রথেরি ঠাকুরটিরে দেখত আঁখি মেলে। গাঁর বধূরা ভালের সিদুর মেলে পথের পরে সরল বুকের আঁকত পূজা এই ঠাকুরের তরে। আঁচল তাদের জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শিশুর দল, তালের পাতার বাজিয়ে বাঁশী করত কোলাহল। দৌড়ের নাও ভাসত গাঙে, রঙিন নিশান লয়ে, গলুই ভরি জ্বলত পিতল নব-রতন হয়ে। তাহার গলে পরিয়ে দিত রঙিন সোলার মালা, এমনি মত হাজার নায়ে গাঙটি হত আলা। সেই নায়েতে বাছ খেলাত গাঁয়ের যত চাষী; বৈঠা পরে বৈঠা হাঁকি চলত তারা ভাসি। তারি তালে গাইত তারা ভাটির সুরে গান, শুনে নদী উথল পাথাল, ঢেউ ভেঙে খান খান। কৌতুহলী দাঁড়িয়ে তীরে হাজার নয়-নারী, হাতে তাদের দুলত মালা গলায় দিতে তারি, যাহার তরী সব তরীরে পেরিয়ে যাবে আগে, তারে তারা করবে বরণ মনের অনুরাগে। সে সব আজি কোথায় গেল, চৌধুরীদের রথ, আজো যেন শুধায় সবে তাদের চলা-পথ। চাকাগুলো ভেঙেছে তার উই ধরেছে কাঠে, কোন অভিযোগ বক্ষে লয়ে সময় তাদের কাটে! ছবিগুলো যাচ্ছে মুছে, ভাঙা কদম ডাল, ত্যাগ করিয়া পালিয়ে গেছে নিঠুর বংশীয়াল। তলায় বসে একলা রাধা কাঁপছে পুলকে, জানতে আজো পায়নি তাহার বন্ধু নিল কে। মাঠের পথে চলছে ধেনু বিরাম নাহি হ্যয়, রাখাল কবে ঠ্যাং ভেঙেছে, কেউ না ফিরে চায়। দল বাঁধিয়া চলছে কোথায় গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে, মৃদঙ্গ আর ঢোল বাঁজায়ে বাঁশীতে গান গেয়ে। হয়ত কোন পরব গাঁয়ের করবে সমাপন, হাজার বরষ আগেই তাহার করছে আয়োজন। কারো কাঁধের ঢোল ভেঙেছে কাহারো একতারা, দলপতি যে নেইক সাথে, টের পায়নি তারা। এমনি কালের কঠোর ঘায়ে দিনের পরে দিন, এ সব ছবির একখানিকরও থাকবেনাক চিন। এর সাথে সেই গাঁয়ের পোটো, -তাহার কথাও সবে, ভুলে যাবে অজানা কোন দিনের মহোৎসবে। কোন সে অতীত আঁধার সাগর, তাহারপারে বসি, এঁকেছিল সোনার স্বপন বরণ ঘষি ঘষি। হয়ত তারি গাঁয়ের যত নর-নারীর দল, মনে তাহার ফুটিয়েছিল স্বপন শতদল; তারি একটি সোনার কলি আলোক- তরীর প্রায়, সপ্ত সাগর পার হইয়া ভিড়ছে রথের গায়! আজ হয়ত অনাদরেই অনেক অভিমানে, চলছে ফিরে প্রদীপ তরী সেই অতীতের পানে; সেখানে সেই বৃদ্ধ পোটো বনস্পতির প্রায়, হাজার শাখা এলিয়ে বায়ে ঢুলছে নিরালায়। চাক ভাঙা আর বয়স মিলন চৌধুরীদের রথ, আজো যেন চক্ষু মুদে খুঁজছে তাদের পথ। বনের লতায় গা ছেয়েছে, গাছের শাখা তারে, জড়িয়ে ধরে এ সব কথা শুনছে বারে বারে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(সাত)কান্-কানা-কান্ ছুটল কথা গুন্-গুনা-গুন তানে, শোন্-শোনা-শোন সবাই শোনে, কিন্তু কানে কানে | 'কি করগো রূপার মাতা? খাইছ কানের মাথা? ও-দিক যে তোর রূপার নামে রটছে গাঁয়ে যা তা! আমরা বলি রূপাই এমন সোনার কলি ছেলে, তার নামে হয় এমন কথা দেখব কি কাল গেলে?' এই বলিয়া বড়াই বুড়ি বসল বেড়ি দোর, রূপার মা কয়, 'বুঝিনে বোন কি তোর কথার ঘোর!' বুড়ি যেন আচমকা হায় আকাশ হতে পড়ে, 'সবাই জানে তুই না জানিস যে কথা তোর ঘরে?' ও-পাড়ার ও ডাগর ছুঁড়ী, সেখের বাড়ির 'সাজু' তারে নাকি তোর ছেলে সে গড়িয়ে দেছে বাজু | ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি, এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকি?' রূপার মা কয়, 'রূপা আমার এক-রত্তি ছেলে, আজও তাহার মুখ শুঁকিলে দুধের ঘিরাণ মেলে | তার নামে যে এমন কথা রটায় গাঁয়ে গাঁয়ে, সে যেন তার বেটার মাথা চিবায় বাড়ি যায় |'রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ, একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস | এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা, টুনির ফুপু আসল হাতে ডলতে তামাক পাতা | ক'জনকে আর থামিয়ে রাখে? বুঝল রূপার মা ; রূপা তাহার সত্যি করেই এতটুকুন না | বুঝল মায়ে কেন ছেলে এমন উদাস পারা, হেথায় হোথায় কেবল ঘোরে হয়ে আপন হারা | ও পাড়ার ও দুখাই মিয়া ঘটকালিতে পাকা, সাজুর সাথেই জুড়ুর বিয়ে যতকে লাগুক টাকা |শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকী-বেড়ার কাছে, দাঁড়িয়ে বলে, 'সাজুর মাগো, একটু কথা আছে |' সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে, ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, 'আস্তে টান ধীরে |' ঘটক বলে, 'সাজুর মাগো মেয়ে তোমার বড়, বিয়ের বয়স হল এখন ভাবনা কিছু কর |' সাজুর মা কয় 'তোমরা আছ ময়-মুরুব্বি ভাই, মেয়ে মানুষ অত শত বুঝি কি আর ছাই! তোমরা যা কও ঠেলতে কি আর সাধ্য আছে মোর?' ঘটক বলে, 'এই ত কথা, লাগবে না আর ঘোর | ও-পাড়ার ও রূপারে ত চেনই তুমি বোন্, তার সাথে দাও মেয়ের বিয়ে ঠিক করিয়ে মন |' সাজুর মা কয়, 'জান ত ভাই! রটছে গাঁয়ে যাতা, রূপার সাথে বিয়ে দিলে থাকবে না আর মাথা |'ঘটক বলে, 'কাঁটা দিয়েই তুলতে হবে কাঁটা, নিন্দা যারা করে তাদের পড়বে মুখে ঝাঁটা | রূপা ত আর নয় এ গাঁয়ে যেমন তেমন ছেলে, লক্ষ্মীরে দেই বউ বানায়ে অমন জামাই পেলে!' ঠাটে ঘটক কয় গো কথা ঠোঁট-ভরাভর হাসে ; সাজুর মায়ের পরাণ তারি জোয়ার-জলে ভাসে | 'দশ খান্দা জমি রূপার, তিনটি গরু হালে, ধানের-বেড়ী ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে |' সাজু তোমার মেয়ে যেমন, রূপাও ছেলে তেমন, সাত গেরামের ঘটক আমি জোড় দেখিনি এমন |'তার পরেতে পাড়ল ঘটক রূপার কুলের কথা, রূপার দাদার নাম গুনে লোক কাঁপত যথা তথা | রূপার নানা সোয়েদ-ঘেঁষা, মিঞাই বলা যায়--- কাজী বাড়ির প্যায়দা ছিল কাজল-তলার গাঁয় | রূপার বাপের রাখত খাতির গাঁয়ের চৌকিদারে, আসেন বসেন মুখের কথা---গান বজিত তারে | রূপার চাচা অছিমদ্দী, নাম শোন নি তার? ইংরেজী তার বোল শুনিলে সব মানিত হার | কথা ঘটক বলল এঁটে, বলল কখন ঢিলে, সাজুর মায়ে সবগুলি তার ফেলল যেন গিলে |মুখ দেখে বুঝল ঘটক---লাগছে অষুধ হাড়ে, বলল, 'তোমার সাজুর বিয়া ঠিক কর এই বারে |' সাজুর মা কয়,  ' যা বোঝ ভাই, তোমরা গ্যা তাই কর, দেখ যেন কথার আবার হয় না নড়চড় |''আউ ছি ছি!' ঘটক বলে, 'শোনই কথা বোন, তোমার সাজুর বিয়া দিতে লাগবে কত পণ? পোণে দিব কুড়ি দেড়েক বায়না দেব তেরো, চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় এই গে ধর বারো | সবদ্যা হল দুই কুড়ি এ নিতেই হবে বোন, চাইলে বেশী জামাইর তোমার বেজার হবে মন!' সাজুর মা কয়, 'ও-সব কথার কি-ইবা আমি জানি, তোমরা যা কও তাইত খোদার গুকুর বলে মানি |' সাধে বলে দুখাই ঘটক ঘটকালিতে পাকা, আদ্য মধ্য বিয়ের কথা সব করিল ফাঁকা |চল্-চলা-চল্ চলল দুখাই পথ বরাবর ধরি, তাগ্-ধিনা-ধিন্ নাচে যেন গুন্ গুনা গান করি | দুখাই ঘটক নেচে চলে নাচে তাহার দাড়ি, বুড়োর বটের শিকড় যেন চলছে নাড়ি নাড়ি ; লম্ফে লম্ফে চলে ঘটক দম্ভ করে চায়, লুটের মহল দখল করে চলছে যেন গাঁয়! ঘটকালিরই টাকা যেন ঝন্-ঝনা-ঝন্ বাজে, হন্-হানা-হন্ চলল ঘটক একলা পথের মাঝে | ধানের জমি বাঁয় ফেলিয়া ফেলিয়া, ডাইনে ঘন পাট, জলীর বিলে নাও বাঁধিয়া ধরল গাঁয়ের বাট | 'কি কর গো রূপার মাতা, ভবছ বসি কিবা, সাজুর সাথেই ঠিক কইরাছি তোমার ছেলের বিবা | সহজে কি হয় সে রাজি, একশ টাকা পণ, এর কমেতে বসেইনাক সাজুর মায়ের মন |আমিও আবার কুড়ি তিনেক উঠিনে তার পরে, সাজুর মায়ও নাছোড়-বান্দা, দিলাম তখন ধরে ; আরেক কুড়ি, তয় সে কথা কইল হাসি হাসি, আমি  ভাবি, বিয়ার বুঝি বাজল সানাই বাঁশী | এখন বলি রূপার মাতা, আড়াই কুড়ি টাকা, মোর কাছেতে দিবা, কথা হয় না যেন ফাঁকা! আসব দিয়ে গোপনে তায়, নইলে গাঁয়ের লোকে, মেজবানী দাও বলে তারে ধরবে চীনে জোঁকে | বিয়ের দিনে নিবে সে তাই তিরিশ টাকা যেচে, যারে তারে বলতে পার এই কথাটি নেচে | চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় তার লাগিবে ষোলো, এই ধরগ্যা রূপার বিয়া আজই যেন হল |'রূপার মায়ের আহ্লাদে প্রাণ ধরেইনাক আর, ইচ্ছে করে নেচে নেচে বেড়ায় বারে বার | 'ও রূপা তুই কোথায় গেলি? ভাবিসনাক মোটে, কপাল গুণি বিয়ে যে তোর সাজুর সাথেই জোটে!' এই বলিয়া রূপার মাতা ছুটল গাঁয়ের পানে, ঘটক গেল নিজের বাড়ি গুন্-গুনা-গুন্ গানে |
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
প্রভাত না হতে সারা গাঁওখানি কিল বিল করি ভরিল বেদের দলে, বেলোয়ারী চুড়ি চিনের সিদুর, রঙিন খেলনা হাঁকিয়া হাঁকিয়া চলে। ছোট ছোট ছেলে আর যত মেয়ে আগে পিছে ধায় আড়াআড়ি করি ডাকে, এ বলে এ বাড়ি, সে বলে ও বাড়ি, ঘিরিয়াছে যেন মধুর মাছির চাকে। কেউ কিনিয়াছে নতুন ঝাঁজর, সবারে দেখায়ে গুমরে ফেলায় পা; কাঁচা পিতলের নোলক পরিয়া, ছোট মেয়েটির সোহাগ যে ধরে না। দিদির আঁচল জড়ায়ে ধরিয়া ছোট ভাই তার কাঁদিয়া কাটিয়া কয়, “তুই চুড়ি নিলি আর মোর হাত খালি রবে বুঝি ? কক্ষনো হবে নয়।” “বেটা ছেলে বুঝি চুড়ি পরে কেউ ? তার চেয়ে আয় ডালিমের ফুল ছিঁড়ে. কাঁচা গাব ছেঁচে আঠা জড়াইয়া ঘরে বসে তোর সাজাই কপালটিরে।” দস্যি ছেলে সে মানে না বারণ, বেদেনীরে দিয়ে তিন তিন সের ধান, কি ছাতার এক টিন দিয়ে গড়া বাঁশী কিনে তার রাখিতে যে হয় মান। মেঝো বউ আজ গুমর করেছে, শাশুড়ী কিনেছে ছোট ননদীর চুড়ি, বড় বউ ডালে ফোড়ৎ যে দিতে মিছেমিছি দেয় লঙ্কা-মরিচ ছুঁড়ি। সেজো বউ তার হাতের কাঁকন ভাঙিয়া ফেলেছে ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান, মন কসাকসি, দর কসাকসি করিয়া বৃদ্ধা শাশুড়ী যে লবেজান। এমনি করিয়া পাড়ায় পাড়ায় মিলন-কলহ জাগাইয়া ঘরে ঘরে, চলে পথে পথে বেদে দলে দলে কোলাহলে গাঁও ওলট পালট করে। ইলি মিলি কিলি কথা কয় তারা রঙ-বেরঙের বসন উড়ায়ে বায়ে, ইন্দ্রজেলের জালখানি যেন বেয়ে যায় তারা গাঁও হতে আর গাঁয়ে। এ বাড়ি-ও বাড়ি-সে বাড়ি ছাড়িতে হেলাভরে তারা ছড়াইয়া যেন চলে, হাতে হাতে চুড়ি, কপালে সিঁদুর, কানে কানে দুল, পুঁতির মালা যে গলে। নাকে নাক-ছাবি, পায়েতে ঝাঁজর- ঘরে ঘরে যেন জাগায়ে মহোৎসব, গ্রাম-পথখানি রঙিন করিয়া চলে হেলে দুলে, বেদে-বেদেনীরা সব। “দুপুর বেলায় কে এলো বাদিয়া দুপুরের রোদে নাহিয়া ঘামের জলে, ননদীলো, তারে ডেকে নিয়ে আয়, বসিবারে বল কদম গাছের তলে।” “কদমের ডাল ফোটা ফুল-ভারে হেলিয়া পড়েছে সারাটি হালট ভরে।” “ননদীলো, তারে ডেকে নিয়ে আয়, বসিবার বল বড় মন্টব ঘরে।” “মন্টব ঘরে মস্ত যে মেঝে এখানে সেখানে ইঁদুরে তুলেছে মাটি।” “ননদীলো”, তারে বসিবারে বল উঠানের ধারে বিছায়ে শীতলপাটী।” “শোন, শোন ওহে নতুন বাদিয়া, রঙিন ঝাঁপির ঢাকনি খুলিয়া দাও, দেখাও, দেখাও মনের মতন সুতা সিন্দুর তুমি কি আনিয়াছাও। দেশাল সিঁদুর চাইনাক আমি কোটায় ভরা চিনের সিঁদুর চাই, দেশাল সিঁদুর খস্ খস্ করে, সীথায় পরিয়া কোন সুখ নাহি পাই। দেশাল সোন্দা নাহি চাহি আমি গায়ে মাখিবার দেশাল মেথি না চাহি, দেশাল সোন্দা মেখে মেখে আমি গরম ছুটিয়া ঘামজলে অবগাহি।” “তোমার লাগিয়া এনেছি কন্যা, রাম-লক্ষ্মণ দুগাছি হাতের শাঁখা, চীন দেশ হতে এনেছি সিঁদুর তোমার রঙিন মুখের মমতা মাখা।” “কি দাম তোমার রাম-লক্ষ্মণ শঙ্খের লাগে, সিঁদুরে কি দাম লাগে, বেগানা দেশের নতুন বাদিয়া সত্য করিয়া কহগো আমার আগে।” “আমার শাঁখার কোন দাম নাই, ওই দুটি হাতে পরাইয়া দিব বলে, বাদিয়ার ঝালি মাথায় লইয়া দেশে দেশে ফিরি কাঁদিয়া নয়ন-জলে। সিঁদুর আমার ধন্য হইবে, ওই ভালে যদি পরাইয়া দিতে পারি, বিগানা দেশের বাদিয়ার লাগি এতটুকু দয়া কর তুমি ভিন-নারী।” “ননদীলো, তুই উঠান হইতে চলে যেতে বল বিদেশী এ বাদিয়ারে। আর বলে দেলো, ওসব দিয়ে সে সাজায় যেন গো আপনার অবলারে।” “কাজল বরণ কন্যালো তুমি, ভিন-দেশী আমি, মোর কথা নাহি ধর, যাহা মনে লয় দিও দাম পরে আগে তুমি মোর শাঁখা-সিঁদুর পর।” “বিদেশী বাদিয়া নায়ে সাথে থাক, পসরা লইয়া ফের তুমি দেশে দেশে। এ কেমন শাঁখা পরাইছ মোরে, কাদিঁয়া কাঁদিয়া নয়নের জলে ভেসে? সীথায় সিঁদুর পরাইতে তুমি, সিঁদুরের গুঁড়ো ভিজালে চোখের জলে। ননদীলো, তুই একটু ওধারে ঘুরে আয়, আমি শুনে আসি, ও কি বলে।” “কাজল বরণ কণ্যালো তুমি, আর কোন কথা শুধায়ো না আজ মোরে, সোঁতের শেহলা হইয়া যে আমি দেশে দেশে ফিরি, কি হবে খবর করে। নাহি মাতা আর নাহি পিতা মোর আপন বলিতে নাহি বান্ধব জন, চলি দেশে দেশে পসরা বহিয়া সাথে সাথে চলে বুক-ভরা ক্রদন। সুখে থাক তুমি, সুখে থাক মেয়ে- সীথায় তোমার হাসে সিঁদুরের হাসি, পরাণ তোমর ভরুক লইয়া, স্বামীর সোহাগ আর ভালবাসাবাসি।” “কে তুমি, কে তুমি ? সোজন ! সোজন! যাও-যাও-তুমি। এক্ষুণি চলে যাও। আর কোনদিন ভ্রমেও কখনো উড়ানখালীতে বাড়ায়ো না তব পাও। ভুলে গেছি আমি, সব ভুলে গেছি সোজন বলিয়া কে ছিল কোথায় কবে, ভ্রমেও কখনো মনের কিনারে অনিনাক তারে আজিকার এই ভবে। এই খুলে দিনু শঙ্খ তোমার কৌটায় ভরা সিন্দুর নিয়ে যাও, কালকে সকালে নাহি দেখি যেন কুমার নদীতে তোমার বেদের নাও।” “দুলী-দুলী-তুমি এও পার আজ ! বুক-খুলে দেখ, শুধু ক্ষত আর ক্ষত, এতটুকু ঠাঁই পাবেনাক সেথা একটি নখের আঁচড় দেবার মত।” “সে-সব জানিয়া মোর কিবা হবে ? এমন আলাপ পর-পুরুষের সনে, যেবা নারী করে, শত বৎসর জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে নরকের কোণে। যাও-তুমি যাও এখনি চলিয়া তব সনে মোর আছিল যে পরিচয়, এ খবর যেন জগতের আর কখনো কোথাও কেহ নাহি জানি লয়।” “কেহ জানিবে না, মোর এ হিয়ার চির কুহেলিয়া গহন বনের তলে, সে সব যে আমি লুকায়ে রেখেছি জিয়ায়ে দুখের শাঙনের মেঘ-জলে। তুমি শুধু ওই শাঁখা সিন্দুর হাসিমুখে আজ অঙ্গে পরিয়া যাও। জনমের শেষ চলে যাই আমি গাঙে ভাসাইয়া আমার বেদের নাও।” “এই আশা লয়ে আসিয়াছ তুমি, ভাবিয়াছ, আমি কুলটা নারীর পারা, তোমার হাতের শাঁখা-সিন্দুরে মজাইব মোর স্বাসীর বংশধারা ?” “দুলী ! দুলী ! মোরে আরো ব্যথা দাও- কঠিন আঘাত-দাও-দাও আরো-আরো, ভেঙ্গে যাক বুক-ভেঙে যাক মন, আকাশ হইতে বাজেরে আনিয়া ছাড়। তোমারি লাগিয়া স্বজন ছাড়িয়া ভাই বান্ধব ছাড়ি মাতাপিতা মোর, বনের পশুর সঙ্গে ফিরেছি লুকায়ে রয়েছি খুঁড়িয়া মড়ার গোর। তোমারি লাগিয়া দশের সামনে আপনার ঘাড়ে লয়ে সব অপরাধ, সাতটি বছর কঠিন জেলের ঘানি টানিলাম না করিয়া প্রতিবাদ।” “যাও-তুমি যাও, ও সব বলিয়া কেন মিছেমিছি চাহ মোরে ভুলাইতে, আসমান-সম পতির গরব, আসিও না তাহে এতটুকু কালি দিতে। সেদিনের কথা ভুলে গেছি আমি, একটু দাঁড়াও ভাল কথা হল মনে- তুমি দিয়েছিলে বাঁক-খাড়ু পার, নথ দিয়েছিলে পরিতে নাকের সনে। এতদিনও তাহা রেখেছিনু আমি কপালের জোরে দেখা যদি হল আজ, ফিরাইয়া তবে নিয়ে যাও তুমি- দিয়েছিলে মোরে অতীতের যত সাজ। আর এক কথা-তোমার গলায় গামছায় আমি দিয়েছিনু আঁকি ফুল, সে গামছা মোর ফিরাইয়া দিও, লোকে দেখে যদি, করিবারে পারে ভুল। গোড়ায়ের ধারে যেখানে আমরা বাঁধিয়াছিলাম দুইজনে ছোট ঘর, মোদের সে গত জীবনের ছবি, আঁকিয়াছিলাম তাহার বেড়ার পর। সেই সব ছবি আজো যদি থাকে, আর তুমি যদি যাও কভু সেই দেশে ; সব ছবিগুলি মুছিয়া ফেলিবে, মিথ্যা রটাতে পারে কেহ দেখে এসে। সবই যদি আজ ভুলিয়া গিয়াছি, কি হবে রাখিয়া অতীতের সব চিন, স্মরণের পথে এসে মাঝে মাঝে- জীবনেরে এরা করিবারে পারে হীন ।” “দুলী, দুলী, তুমি ! এমনি নিঠুর ! ইহা ছাড়া আর কোন কথা বলে মোরে- জীবনের এই শেষ সীমানায় দিতে পারিতে না আজিকে বিদায় করে? ভুলে যে গিয়েছ, ভালই করেছ, - আমার দুখের এতটুকু ভাগী হয়ে, জনমের শেষ বিদায় করিতে পারিতে না মোরে দুটি ভাল কথা কয়ে ? আমি ত কিছুই চাহিতে আসিনি! আকাশ হইতে যার শিরে বাজ পড়ে, তুমি ত মানুষ, দেবের সাধ্য, আছে কি তাহার এতটুকু কিছু করে ? ললাটের লেখা বহিয়া যে আমি সায়রে ভাসিনু আপন করম লায়ে ; তারে এত ব্যথা দিয়ে আজি তুমি কি সুখ পাইলে, যাও-যাও মোরে কয়ে। কি করেছি আমি, সেই অন্যায় তোমার জীবনে কি এমন ঘোরতর। মরা কাষ্টেতে আগুন ফুঁকিয়া- কি সুখেতে বল হাসে তব অন্তর ? দুলী ! দুলী ! দুলী ! বল তুমি মোরে, কি লইয়া আজ ফিরে যাব শেষদিনে। এমনি নিঠুর স্বার্থ পরের রুপ দিয়ে হায় তোমারে লইয়া চিনে ? এই জীবনেরো আসিবে সেদিন মাটির ধরায় শেষ নিশ্বাস ছাড়ি, চিরবন্দী এ খাঁচার পাখিটি পালাইয়া যাবে শুণ্যে মেলিয়া পাড়ি। সে সময় মোর কি করে কাটিবে, মনে হবে যবে সারটি জনম হায় কঠিন কঠোর মিথ্যার পাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া খোয়ায়েছি আপনায়। হায়, হায়, আমি তোমারে খুঁজিয়া বাদিয়ার বেশে কেন ভাসিলাম জলে, কেন তরী মোর ডুবিয়া গেল না ঝড়িয়া রাতের তরঙ্গ হিল্লোলে ? কেন বা তোমারে খুঁজিয়া পাইনু, এ জীবনে যদি ব্যথার নাহিক শেষ পথ কেন মোর ফুরাইয়া গেল নাহি পৌঁছিতে মরণের কালো দেশ। পীর-আউলিয়া, কে আছ কোথায় তারে দিব আমি সকল সালাম ভার, যাহার আশীষে ভুলে যেতে পারি সকল ঘটনা আজিকার দিনটার। এ জীবনে কত করিয়াছি ভুল। এমন হয় না ? সে ভুলের পথ পরে, আজিকার দিন তেমনি করিয়া চলে যায় চির ভুল ভরা পথ ধরে। দুলী-দুলী আমি সব ভুলে যাব কোন অপরাধ রাখিব না মনে প্রাণে ; এই বর দাও, ভাবিবারে পারি তব সন্ধান মেলে নাই কোনখানে। ভাটীয়াল সোঁতে পাল তুলে দিয়ে আবার ভাসিবে মোর বাদিয়ার তরী, যাবে দেশে দেশে ঘাট হতে ঘাটে, ফিরিবে সে একা দুলীর তালাশ করি। বনের পাখিরে ডাকি সে শুধাবে, কোন দেশে আছে সোনার দুলীর ঘরম, দুরের আকাশ সুদুরে মিলাবে আয়নার মত সাদা সে জলের পর। চির একাকীয়া সেই নদী পথ, সরু জল রেখা থামে নাই কোনখানে ; তাহারি উপরে ভাসিবে আমার বিরহী বাদিয়া, বন্ধুর সন্ধানে। হায়, হায় আজ কেন দেখা হল কেন হল পুন তব সনে পরিচয় ? একটি ক্ষণের ঘটনা চলিল সারাটি জনম করিবারে বিষময় ।’ “নিজের কথাই ভাবিলে সোজন, মোর কথা আজ ? না-না- কাজ নাই বলে সকলি যখন শেষ করিয়াছি- কি হইবে আর পুরান সে কাদা ডলে। ওই বুঝি মোর স্বামী এলো ঘরে, এক্ষুনি তুমি চলে যাও নিজ পথে, তোমাতে-আমাতে ছিল পরিচয়- ইহা যেন কেহ নাহি জানে কোনমতে। আর যদি পার, আশিস করিও আমার স্বামীর সোহাগ আদর দিয়ে, এমনি করিয়া মুছে ফেলি যেন, যে সব কাহিনী তোমারে আমারে নিয়ে ।” “যেয়ো না-যেয়ো না শুধু একবার আঁখি ফিরাইয়া দেখে যাও মোর পানে, আগুন জ্বেলেছ যে গহন বনে, সে পুড়িছে আজ কি ব্যথা লইয়া প্রাণে? ধরায় লুটায়ে কাঁদিল সোজন, কেউ ফিরিল না, মুছাতে তাহার দুখ ; কোন সে সুধার সায়রে নাহিয়া জুড়াবে সে তার অনল পোড়া এ বুক ? জ্বলে তার জ্বালা খর দুপুরের রবি-রশ্মির তীব্র নিশাস ছাড়ি, জ্বলে-জ্বলে জ্বালা কারবালা পথে, দমকা বাতাসে তপ্ত বালুকা নাড়ি। জ্বলে-জ্বলে জ্বালা খর অশনীর ঘোর গরজনে পিঙ্গল মেঘে মেঘে, জ্বলে-জ্বলে জ্বালা মহাজলধীর জঠরে জঠরে ক্ষিপ্ত ঊর্মি বেগে। জ্বলে-জ্বলে জ্বালা গিরিকন্দরে শ্মশানে শ্মশানে জ্বলে জ্বালা চিতাভরে ; তার চেয়ে জ্বালা-জ্বলে জ্বলে জ্বলে হতাশ বুকের মথিত নিশাস পরে । জ্বালা-জ্বলে জ্বালা শত শিখা মেলি, পোড়ে জলবায়ু-পোড়ে প্রান্তর-বন ; আরো জ্বলে জ্বালা শত রবি সম, দাহ করে শুধু পোড়ায় না তবু মন। পোড়ে ভালবাসা-পোড়ে পরিণয় পোড়ে জাতিকুল-পোড়ে দেহ আশা ভাষা, পুড়িয়া পুড়িয়া বেঁচে থাকে মন, সাক্ষী হইয়া চিতায় বাঁধিয়া বাসা। জ্বলে-জ্বলে জ্বালা-হতাশ বুকের দীর্ঘনিশাস রহিয়া রহিয়া জ্বলে ; জড়ায়ে জড়ায়ে বেঘুম রাতের সীমারেখাহীন আন্ধার অঞ্চলে। হায়-হায়-সে যে কিজ দিয়ে নিবাবে কারে দেখাইবে কাহারে কহিবে ডাকি, বুক ভরি তার কি অনল জ্বালা শত শিখা মেলি জ্বলিতেছে থাকি থাকি। অনেক কষ্টে মাথার পসরা মাথায় লইয়া টলিতে টলিতে হায়, চলিল সোজন সমুখের পানে চরণ ফেলিয়া বাঁকা বন-পথ ছায়।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
আট “কি কর দুল্যাপের মালো ; বিভাবনায় বসিয়া, আসত্যাছে বেটির দামান ফুল পাগড়ি উড়ায়া নারে |” “আসুক আসুক বেটির দামান কিছু চিন্তা নাইরে, আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটি মারে | সেই ঘরেতে নাগায়া খুইছি মোমের সস্র বাতি, বাইর বাড়ি বান্দিয়া থুইছি গজমতি হাতি নারে |” . — মুসলমান মেয়েদের বিবাহের গান বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি, কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্ , লোক হয়েছে ভারি | গোয়াল-ঘরে ঝেড়ে পুছে বিছান দিল পাতি ; বসল গাঁয়ের মোল্লা মোড়ল গল্প-গানে মাতি | কেতাব পড়ার উঠল তুফান ; —চম্পা কালু গাজী, মামুদ হানিফ সোনবান ও জয়গুন বিবি আজি ; সবাই মিলে ফিরছে যেন হাত ধরাধর করি | কেতাব পড়ার সুরে সুরে চরণ ধরি ধরি | পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোড়ল নাচিয়ে ঘন দাড়ি, পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোল্লা মাঠ-ফাটা ডাক ছাড়ি | কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুনছে পেতে কান, জুমজুমেরি পানি যেন করছে তারা পান! দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়, লাল ঘোড়া তার উড়ছে যেন লাল পাখিটির প্রায় | কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ, মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ ! স্বপ্ন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে ; মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে ; আকাশেরি চাঁদ সূরুজে মুখ দেখে পায় লাজ, সেই কনেরে চোখের কাছে দেখছে চাষী আজ | দেখছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে, রক্ত যাহার জমছে আজো সন্ধ্যা মেঘের গোরে ; কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান ; সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান | উঠান পরে হল্লা-করে পাড়ার ছেলে মেয়ে, রঙিন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু ছেয়ে | কানা-ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে, ঘোর কলিকাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে ; তারাই এখন বিয়ের কাজে ফিরছে সবার আগে, ভাভা গড়ার সকল কাজেই তাদের সমান লাগে | বউ-ঝিরা সব রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সকল ক্ষণ ; সারা বাড়ি আনন্দ আজ খুশী সবার মন | বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখছে জনে জনে ; ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠছে রূপার মনে | ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার “জোড়া জামা” গায়, তেল-কুচ্-কাচ্ কালো রঙে ঝলক্ দিয়ে যায় | বউ-ঝিরা সব ঘরের বেড়ার খানিক করে ফাঁক, নতুন দুলার রূপ দেখি আজ চক্ষে মারে তাক | এমন সময় শোর উঠিল— “বিয়ের যোগাড় কর, জলদী করে দুলার মুখে পান শরবত ধর |” সাজুর মামা খটকা লাগায়, “বিয়ের কিছু গৌণ, সাদার পাতা আনেনি তাই বেজার সবার মন |” রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি ; সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আনল তাড়াতাড়ি | কনের খালু উঠিয়া বলে “সিঁদুর হল ঊনা!” রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা! কনের চাচার মন উঠে না, “খাটো হয়েছে শাড়ী |” রূপার চাচা দিল তখন “ইংরাজী বোল ছাড়ি”| “কিরে বেটা বকিস নাকি?” কনের চাচা হাঁকে, জালির কলার পাতার মত গা কাঁপে তার রাগে | “কোথায় গেলি ছদন চাচা, ছমির শেখের নাতি, দেখিয়ে দেই দুলার চাচার কতই বুকের ছাতি! বেরো বেটা নওশা নিয়ে, দিব না আজ বিয়া ;” বলতে যেন আগুন ছোটে চোখ দুটি তার দিয়া | বরপক্ষের লোকগুলি সব আর যে বরের চাচা, পালিয়ে যেতে খুঁজছে যেন রশুই ঘরের মাচা | মোড়ল এসে কনের চাচায় অনেক করে বলে, থামিয়ে তারে বিয়ের কথা পাতেন কুতূহলে | কনের চাচা বসল বরের চাচার কাছে, কে বলে ঝড় এদের মাঝে হয়েছে যে পাছে! মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল ডাকি, বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি! তার মাঝেতে এমন তেমন হয়নি কিছু গোল, কেবল একটি বিষয় নিয়ে উঠল হাসির রোল | এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে ; সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে ; রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর, হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড় | ভাবল রূপাই—অমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে, দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে | ***** সস্র = সহস্র জুমজুম = আরবের একটি পবিত্র কূপ দুলা = বর পান শরবত ধর = বিবাহের আগে বরকে পান শরবত খাওয়ান হয় সাদার পাতা = তামাক পাতা খালু = মেশোমশায় নওশা = বর সাক্ষী উকিল = মুসলমানদের বিবাহের সময় বর-কন্যা একস্থানে থাকে না | কন্যাপক্ষের একজন উকিল এবং দুইজন সাক্ষী থাকেন | বাড়ির ভিকরে গিয়ে বিবাহে কন্যার মত আছে কিনা জেনে আসেন | উকিল জিজ্ঞাসা করেন, সাক্ষীরা তা শুনে এসে বাইরে বৈঠকখানায় বিবাহ সভার সকলকে বলেন |
জসীম উদ্‌দীন
স্বদেশমূলক
পল্লী-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে, আকাশ যাহার বনের শীষে দিক-হারা মাঠ চরণ ঘেঁষে। দূর দেশীয়া মেঘ-কনেরা মাথায় লয়ে জলের ঝারি, দাঁড়ায় যাহার কোলটি ঘেঁষে বিজলী-পেড়ে আঁচল নাড়ি। বেতস কেয়ার মাথায় যেথায় ডাহুক ডাকে বনের ছায়ায়, পল্লী-দুলাল ভাইগো আমার, যাব আমি যাব সেথায়। তোমার দেশে যাব আমি, দিঘল বাঁকা পন্থখানি, ধান কাউনের খেতের ভেতর সরু সূতোর আঁচল টানি; গিয়াছে হে হাবা মেয়ের এলোমাথার সিঁথীর মত কোথাও সিধে, কোথায় বাঁকা, গরুর পায়ের রেখায় ক্ষত; গাজনতলির মাঠ পেরিয়ে, শিমূলতলীর বনের বাঁয়ে, কোথাও গায়ে রোদ মাখিয়া, ঘুম-ঘুমায়ে গাছের ছায়ে। তাহার পরে মুঠি মুঠি ছড়িয়ে দিয়ে কদম-কলি, কোথাও মেলে বনের লতা গ্রাম্য মেয়ে যায় যে চলি; সে পথ দিয়ে যাব আমি পল্লী-দুলাল তোমার দেশে, নাম-না জানা ফুলের সুবাস বাতাসেতে আসবে ভেসে। তোমার দেশে যাব আমি, পাড়ার যত দস্যি ছেলে, তাদের সাথে দল বাঁধিয়া হেথায় সেথায় ফিরব খেলে। থল-দীঘিতে সাঁতার কেটে আনব তুলে রক্ত-কমল, শাপলা লতায় জড়িয়ে চরণ ঢেউ এর সাথে খাব যে দোল। হিজল ঝরা জলের সাথে গায়ের বরণ রঙিন হবে, দীঘির জলে খেলবে লহর মোদের লীলাকালোসবে। তোমার দেশে যাব আমি পল্লী-দুলাল ভাইগো সোনার, সেথায় পথে ফেলতে চরণ লাগবে পরশ এই মাটি-মার! ডাকব সেথা পাখির ডাকে, ভাব করিব শাখীর সনে, অজান ফুলের রূপ দেখিয়া মানব তারে বিয়ের কনে; চলতে পথে ময়না কাঁটায় উত্তরীয় জড়িয়ে যাবে, অঢেল মাটির হোঁচট লেগে আঁচল হতে ফুল ছড়াবে। পল্লী-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে, তোমার কাঁধে হাত রাখিয়া-ফিরবো মোরা উদাস বেশে। বনের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখব মোরা সাঁঝ বাগানে, ফুল ফুটেছে হাজার রঙের মেঘ তুলিকার নিখুঁত টানে। গাছের শাখা দুলিয়ে আমি পাড়ব সে ফুল মনের আশে, উত্তরীয় ছড়িয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো বনের পাশে। যে ঘাটেতে ভরবে কলস গাঁয়ের বিভোল পল্লীবালা, সেই ঘাটেরি এক ধারেতে আসবো রেখে ফুলের মালা; দীঘির জলে ঘট বুড়াতে পথে পাওয়া মালাখানি, কুড়িয়ে নিয়ে ভাববে ইহা রাখিয়া গেছে কেউ না জানি। চেনে না তার হাতের মালা হয়তবা সে পরবে গলে, আমরা দুজন থাকব বসে ঢেউ দোলা সেই দীঘির কোলে। চার পাশেতে বনের সারি এলিয়ে শাখার কুন্তল-ভার, দীঘির জলে ঢেউ গণিবে ফুল শুঁকিবে পদ্ম-পাতার। বনের মাঝে ডাকবে ডাহুক, ফিরবে ঘুঘু আপন বাসে, দিনের পিদিম ঢুলবে ঘুমে রাত-জাগা কোন্ ফুলের বাসে। চার ধারেতে বন জুড়িয়া রাতের আঁধার বাঁধবে বেড়া, সেই কুহেলীর কালো কারায় দীঘির জলও পড়বে ঘেরা। সেই আঁধারে পাখায় ধরে চামচিকারা উচ্চে উঠি, দিকে দিকে দিগনে-রে ছড়িয়ে দেবে মুঠি মুঠি। তখন সেথা থাকবে না কেউ, সুদূর বনের গহন কোণে, কানাকুয়া ডাকবে শুধু পহরের পর পহর গণে। সেই নিরালার বুকটি চিরে পল্লী দুলাল আমরা দুজন, পল্লীমায়ের রূপটি যে কি, করব মোরা তার অন্বেষণ।
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
হিমালয় হতে আসিলে নামিয়া তুষার বসন ত্যাজি, হিমের স্বপন অঙ্গে মাখিয়া সাঁঝের বসনে সাজি। হে গিরি দুহিতা তোমার নয়নে অলকার মেঘগুলি, প্রতি সন্ধ্যায় পরাইয়া যেত মায়া-কাজলের তুলি। তুহিন তুষারে অঙ্গ মাজিতে দুগ্ধধবল কায়, রবির কিরণ পিছলি পিছলি লুটাত হিমানী বায়! রাঙা মাটি পথে চলিতে চলিতে পথ যেন মমতায়, আলতা রেকায় রঙিন হইয়া জড়াইত দুটি পায়। অলকে তোমার পাহাড়ী পবন ফুলের দেউল লুটি, গন্ধের বাসা রচনা করিত সারা রাত ছুটি ছুটি। গহিন গুহার কুহরে কুহরে কলকল্লোলে ঘুরি, ঝরণা তোমার চরণ বিছাত মণি-মানিকের নুড়ি! পাষাণের ভাষা শুনিতে যে তুমি ঝরণায় পাতি কান, শুনিতে শুনিতে কোন অজানায় ভেসে যেত তব প্রাণ! ঝরণার স্রোতে ভাসিয়া আসিত অলস সোনার ঘুম, তোমার মায়াবী নয়নে বিছাত দূর স্বপনের চুম। শিথিল দেহটি এলাইয়া দিয়া ঘন তুষারের গায়, ঘুমায়ে ঘুমায়ে ঘুমেরে যে ঘুম পাড়াইতে নিরালায়। তোমার দেহের বিম্ব আঁকিয়া আপন বুকের পরে, পরতের পর পরত বিছাত তুষার রজনী ভরে। তোমার ছাষায় যত সে লুকাত, চাঁদের কুমার তত তুষার পরত ভেদিয়া সেথায় একেলা উদয় হ। দূর গগনের সাত-ভাই তারা শিয়রে বিছায়ে ছায়া, পারুল বোনের নিশীথ শয়নে জ্বালতে আলোর মায়া। দিন রজনীর মোহনার সোঁতে শুক-তারকার তরী, চলিতে চলিতে পথ ভুলে যেন ঘাটের বাঁধন স্মরি। পূর্ব তোরণে দাঁড়ায়ে প্রভাত ছুঁড়িত আবীর ধূলি, তোমার নয়ন হইতে ফেলিত ঘুমের কাজল তুলি। কিশোর কুমার, প্রথম হেরিয়া তোমার কিশোরী কায়া, মেঘে আর মেঘে বরণে বরণে মাখাত রঙের মায়া। কি কুহকে ভুলে ওগো গিরিসুতা! এসেছ মরতে নামি, কে তোমার লাগি পূজার দেউল সাজায়েছে দিবা-যামি। হেথয় প্রখর মরীচি-মালীর জ্বলে হুতাশন জ্বালা, দহনে তোমার শুকাবে নিমেষে বুকে মন্দার মালা। মরতের জীব বৈকুন্ঠের নাহি জানে সন্ধান, ফুলের নেশায় ফুলেরে ছিঁড়িয়া ভেঙে করে শতখান। রূপের পূজারী রূপেরে লইয়া জ্বালায় ভোগের চিতা, প্রেমেরে করিয়া সেবাদাসী এরা রচে যে প্রেমের গীতা। হাত বাড়ালেই হেথা পাওয়া যায়, তৃষ্ণারে বড় করি, তপ-কৃষ তনু গৈরিকবাসে জাগেনাক বিভাবরী। হেথা সমতল, জোয়ারের পানি একধার হতে ভাসি, আরধারে এসে গড়াইয়া পড়ে ছল-কল-ধারে হাসি। হেথায় কাম সহজ লভ্য, পরিয়া যোগীর বাস, গহন গুহায় যোগাসনে কেউ করে না কাহারো আশ। হেথাকার লোক খোলা চিঠি পড়ে, বন-রহস্য আঁকি, বন্ধুর পথে চলে না তটিনী কারো নাম ডাকি ডাকি। তুমি ফিরে যাও হে গিরি-দুহিতা, তোমার পাষাণ পুরে, তোমারে খুঁজিয়া কাঁদিছে ঝরণা কুহরে কুহরে ঘুরে। তব মহাদেব যুগ যুগ ধরি ভস্ম লেপিয়া গায়, গহন গুহায় তোমার লাগিয়া রয়েছে তপস্যায়। অলকার মেয়ে! ফিরে যাও তুমি, তোমার ভবন-দ্বারে, চিত্রকূটের লেখন বহিয়া ফেরে মেঘ জলধারে। তোমার লাগিয়া বিরহী যক্ষ গিরি-দরী পথ-কোণে, পাষাণর গায়ে আপন ব্যথারে মদ্দিছে আনমনে; শোকে কৃশতনু, বিহবল মন, মৃণাল বাহুরে ছাড়ি, বার বার করে ভ্রষ্ট হইছে স্বর্ণ-বলয় তারি। বাণীর কুঞ্জে ময়ূর ময়ূরী ভিড়ায়েছে পাখা তরী, দর্ভ-কুমারী, নিবারের বনে তৃণ আছে বিস্মরি। তুমি ফিরে যাও তব আলকায়, গৌরী গিরির শিরে, চরণে চরণে তুষার ভাঙিও মন্দাকিনীর তীরে। কন্ঠে পরিও কিংশুকমালা, পাটল-পুষ্প কানে, নীপ-কেশরের রচিও কবরী নব আষাঢ়ের গানে। তীর্থ পথিক বহু পথ বাহি শ্রান্ত ক্লান্ত কায়, কোন এক প্রাতে যেয়ে পৌছিব শিঞ্চল গিরি ছায়। দিগ জোড়া ঘন কুয়াশার লোল অঞ্চলখানি, বায়ুরথে বসি কিরণ কুমার ফিরিবে সুদূরে টানি। আমরা হাজার নব নারী হেথা রহিব প্রতীক্ষায়, কোন শুভখনে গিরি-কন্যার ছায়া যদি দেখা যায়। দিবসের পর দিবস কাটিবে, মহাশূন্যের পথে, বরণের পর বরণ ঢালিবে উতল মেঘের রথে। কুহকী প্রকৃতি মেঘের গুচ্ছে বাঁধিয়া বাদল ঝড়, ঘন ঘোর রাতে মহাউল্লাসে নাচিবে মাথার পর। ভয়-বিহবল দিবস লুকাবে কপিল মেঘের বনে, খর বিদ্যুৎ অট্ট হাসিবে গগনের প্রাঙ্গণে। তীর্থ-পথিক তুব ফিরিবে না, কোন শুভদিন ধরি, বহুদূর পথে দাঁড়াবে আসিয়া গৌরী গিরির পরী। সোনার অঙ্গে জড়ায়ে জড়ায়ে বিজলীর লতাগুলি, ফুল ফোটাইবে, হাসি ছড়াইবে অধর দোলায় দুলি। কেউ বা দেখিবে, কেউ দেখিবে না, অনন্ত মেঘ পরে, আলোক প্রদীপ ভাসিয়া যাইবে শুধু ক্ষণিকের তরে। তারপর সেথা ঘন কুয়াশার অনন্ত আঁধিয়ার, আকাশ-ধরনী, বন-প্রান্তর করে দেবে একাকার। আমরা মানুষ-ধরার মানুষ এই আমাদের মন, যদি কোনদিন পরিতে না চাহে কুটীরের বন্ধন; যদি কোনদিন সুদূর হইতে আলেয়ার আলো-পরী, বেঘুম শয়ন করে চঞ্চল ডাকি মোর নাম ধরি। হয়ত সেদিন বাহির হইব, গৃহের তুলসী তলে, যে প্রদীপ জ্বলে তাহারে সেদিন নিবায়ে যাইব চলে। অঙ্গে পরিব গৈরিক বাস, গলায় অক্ষহার, নয়নে পরিব উদাস চাহনী মায়া মেঘ বলাকার। কাশীশ্বরের চরণ ছুঁইয়া পূতপবিত্র কায়, জীবনের যত পাপ মুছে যাব প্রয়াগের পথ গায়। হরিদ্বারের রঙিন ধূলায় ঘুমায়ে শ্রান্ত কায়, ত্রিগঙ্গা জলে সিনান করিয়া জুড়াইব আপনায়। কমন্ডলুতে ভরিয়া লইব তীর্থ নদীর বারি, লছমন ঝোলা পার হয়ে যাব পূজা-গান উচ্চারি। তাপসীজনের অঙ্গের বায়ে পবিত্র পথ ছায়ে, বিশ্রাম লভি সমুকের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে। বিশ্রাম লভি সমুখের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে। দেউলে দেউলে রাখিব প্রণাম, তীর্থ নদীর জলে পূজার প্রসূন ভাসাইয়া দিব মোর দেবতারে বলে। মাস-বৎসর কাটিয়া যাইবে, কেদার বদরী ছাড়ি, ঘন বন্ধুর পথে চলিয়াছে সন্যাসী সারি সারি, কঠোর তাপেতে ক্ষীন্ন শরীর শ্রান্তক্লান্ত কায়, সমুখের পানে ছুটে চলে কোন দুরন্ত তৃষ্ণায়। সহসা একদা মানস সরের বেড়িয়া কণক তীর, হোমের আগুন জ্বলিয়া উঠিবে হাজার সন্ন্যাসীর। শিখায় শিখায় লিখন লিখিয়া পাঠাবে শূন্যপানে, মন্ত্রে মন্ত্রে ছড়াবে কামনা মহা-ওঙ্কার গানে। তারি ঝঙ্কারে স্বর্গ হইতে বাহিয়া কণক রথ, হৈমবতীগো, নামিয়া আসিও ধরি মর্ত্ত্যের পথ। নীল কুবলয় হসে- ধরিও দাঁড়ায়ে সরসী নীরে, মরাল মরালী পাখার আড়াল রচিবে তোমার শিরে। প্রথম উদীতা-ঊষসী-জবার কুসুম মূরতি ধরি, গলিত হিরণ কিরণে নাহিও, হে গিরি দুহিতা পরি। অধর ডলিয়া রক্ত মৃণালে মুছিও বলাকা পাখে, অঙ্গ ঘেরিয়া লাবণ্য যেন লীলাতরঙ্গ আঁকে। চারিধার হতে ভকত কন্ঠে উঠিবে পূজার গান, তার সিঁড়ি বেয়ে স্বরগের পথে করো তুমি অভিযান। তীর্থ-পথিক, ফিরিয়া আসিব আবার মাটির ঘরে, গিরি গৌরীর বাহিনী আনিব কমন্ডলুতে ভরে। দেউলে দেউলে গড়িব প্রতিমা, পূজার প্রসূন করে, জনমে জনমে দেখা যেন পাই প্রণমিব ইহা স্মরে।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার মানিক আমার! উদয়তারা খোকন আমার! ঝিলিক মিলিক সাগর-ফেনার! ফিনকি হাসি ক্ষণিকজ্বলা বিজলী-মালার খোকন আমার! খোকন আমার দুলকি হাসি, ফুলকি হাসি জোছনা ধারার। তোমায় আমি দোলার উপর দুলিয়ে দিয়ে যাই যে দুলে, - যাই যে দুলে, সকল ভুলে, রাঙা মেঘের পালটি তুলে, দেই তোমারে দোলায় দুলে। খোকন তখন লাফিয়ে উঠে সাইকেলেতে যায় যে ছুটে, বল খেলিয়ে খেলার মাঠে সবার তারিফ লয় যে লুটে। মা বলিছে, খোকন আমার! মানিক আমার! এতটুকুন দস্যি আমার! লক্ষ্মী আমার! হলদে রঙের পক্ষী আমার! তোমায় আমি পোষ মানাব বুকের খাঁচায় ভরে তোমায় আমি মিষ্টি দেব, তোমায় আমি লজেন্স দেব, তোমায় আমি দুধ খাওয়াব সোনার ঝিনুক ভরে! খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, রান্না ঘরে যায় যে ছুটে, কলাই ভাজা চিবোয় সে যে পূর্ন দুটি মুঠো। মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার! মানিক আমার! ঈদের চাঁদের হাসি আমার! কেমন করে রাখি তোরে বুকের মাঝে ধরে? এতটুকুন আদর আমার! দূর্বা শিষের শিশির আমার! মেঘের বুকের বিজলী আমার! সকল সময় পরাণ যে মোর হারাই হারাই করে; এত করে আদর করি ভরসা না পাই তোরে আমার বুকের মাঝে ধরে। পাল-পাড়াতে কলেরাতে, মরছে লোকে দিনে রাতে, বোস পাড়াতে বসন্ত আজ দিচ্ছে বড়ই হানা, আমরা মাথার দিব্যি লাগে ঘরটি ছেড়ে- যাসনে কোথাও ভুলি মায়ের মানা। খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ওষুধ লয়ে যায় যে ছুটে, পাল-পাড়াতে দিনে রাতে রোগীর সেবা করে; মরণ-মুখো রোগী তখন অবাক হয়ে চেয়ে দেখে ফেরেস্তা কে বসে আছে তার শিয়রের পরে। মুখের পানে চাইলে, তাহার রোগের জ্বালা। যায় যে দূরে সরে। মা বলিছে, খোকন আমার! সোনা আমার! হীরে-মতির টুকরো আমার! টিয়ে পাখির বাচ্চা আমার! তোরে লয়ে মন যে আমার এমন ওমন কেমন যেন করে। পুতুল খেলার পুতুল আমার! বকুল ফুলের মালা আমার! তোরে আদর করে আমার পরাণ নাহি ভরে। ও পাড়াতে ওই যে ওধার, ঘরে আগুন লাগছে কাহার, আজকে ঘরের হোসনেরে বার, আমার মাথায় হাত দিয়ে আজ বল ত শপথ করে। খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ক্ষিপ্ত হয়ে যায় যে ছুটে, জ্বলন্ত সেই আগুন পানে সবার সাথে জুটে। দাউ দাউ দাউ আগুন ছোটে, কুন্ডলী যে পাকিয়ে ওঠে; ওই যে কুঁড়ে, ঘরের তলে, শিশু মুখের কাঁদন ঝলে, চীৎকারিয়ে উঠছে মাতা আঁকড়িয়ে তায় ধরে। জ্বলছে আগুন মাথার পরে কে তাহাদের রক্ষা করে। মুহূর্তে যে সকল কাঁদন যাবে নীরব হয়ে; সেই লেলিহা আগুন পরে খোকা মোদের লাফিয়ে পড়ে, একটু পরে বাইরে আসে তাদের বুকে করে। মা যে তখন খোকারে তার বুকের মাঝে ধরে, বলে আমার সোনা মানিক! লক্ষ্মী মানিক! ঘুমো দেখি আমার বুকের ঘরে। খোকা বলে, মাগো আমার সোনা মানিক। সকল শ্রানি- জুড়াব আজ তোমার কোলের পরে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
সাত “ঘটক চলিল চলিল সূর্য সিংহের বাড়িরে” | — আসমান সিংহের গান কান্-কানা-কান্ ছুটল কথা গুন্-গুনা-গুন তানে, শোন্-শোনা-শোন সবাই শোনে, কিন্তু কানে কানে | “কি করগো রূপার মাতা? খাইছ কানের মাথা? ও-দিক যে তোর রূপার নামে রটছে গাঁয়ে যা তা! আমরা বলি রূপাই এমন সোনার কলি ছেলে, তার নামে হয় এমন কথা দেখব কি কাল গেলে?” এই বলিয়া বড়াই বুড়ি বসল বেড়ি দোর, রূপার মা কয়, “বুঝিনে বোন কি তোর কথার ঘোর!” বুড়ি যেন আচমকা হায় আকাশ হতে পড়ে, “সবাই জানে তুই না জানিস যে কথা তোর ঘরে?” ও-পাড়ার ও ডাগর ছুঁড়ী, সেখের বাড়ির “সাজু” তারে নাকি তোর ছেলে সে গড়িয়ে দেছে বাজু | ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি, এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকি?” রূপার মা কয়, “রূপা আমার এক-রত্তি ছেলে, আজও তাহার মুখ শুঁকিলে দুধের ঘিরাণ মেলে | তার নামে যে এমন কথা রটায় গাঁয়ে গাঁয়ে, সে যেন তার বেটার মাথা চিবায় বাড়ি যায় |” রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ, একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস | এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা, টুনির ফুপু আসল হাতে ডলতে তামাক পাতা | ক’জনকে আর থামিয়ে রাখে? বুঝল রূপার মা ; রূপা তাহার সত্যি করেই এতটুকুন না | বুঝল মায়ে কেন ছেলে এমন উদাস পারা, হেথায় হোথায় কেবল ঘোরে হয়ে আপন হারা | ও পাড়ার ও দুখাই মিয়া ঘটকালিতে পাকা, সাজুর সাথেই জুড়ুর বিয়ে যতকে লাগুক টাকা | শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকী-বেড়ার কাছে, দাঁড়িয়ে বলে, “সাজুর মাগো, একটু কথা আছে |” সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে, ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, “আস্তে টান ধীরে |” ঘটক বলে, “সাজুর মাগো মেয়ে তোমার বড়, বিয়ের বয়স হল এখন ভাবনা কিছু কর |” সাজুর মা কয় “তোমরা আছ ময়-মুরুব্বি ভাই, মেয়ে মানুষ অত শত বুঝি কি আর ছাই! তোমরা যা কও ঠেলতে কি আর সাধ্য আছে মোর?” ঘটক বলে, “এই ত কথা, লাগবে না আর ঘোর | ও-পাড়ার ও রূপারে ত চেনই তুমি বোন্, তার সাথে দাও মেয়ের বিয়ে ঠিক করিয়ে মন |” সাজুর মা কয়, “জান ত ভাই! রটছে গাঁয়ে যাতা, রূপার সাথে বিয়ে দিলে থাকবে না আর মাথা |” ঘটক বলে, “কাঁটা দিয়েই তুলতে হবে কাঁটা, নিন্দা যারা করে তাদের পড়বে মুখে ঝাঁটা | রূপা ত আর নয় এ গাঁয়ে যেমন তেমন ছেলে, লক্ষ্মীরে দেই বউ বানায়ে অমন জামাই পেলে!” ঠাটে ঘটক কয় গো কথা ঠোঁট-ভরাভর হাসে ; সাজুর মায়ের পরাণ তারি জোয়ার-জলে ভাসে | “দশ খান্দা জমি রূপার, তিনটি গরু হালে, ধানের-বেড়ী ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে |” সাজু তোমার মেয়ে যেমন, রূপাও ছেলে তেমন, সাত গেরামের ঘটক আমি জোড় দেখিনি এমন |” তার পরেতে পাড়ল ঘটক রূপার কুলের কথা, রূপার দাদার নাম গুনে লোক কাঁপত যথা তথা | রূপার নানা সোয়েদ-ঘেঁষা, মিঞাই বলা যায়— কাজী বাড়ির প্যায়দা ছিল কাজল-তলার গাঁয় | রূপার বাপের রাখত খাতির গাঁয়ের চৌকিদারে, আসেন বসেন মুখের কথা—গান বজিত তারে | রূপার চাচা অছিমদ্দী, নাম শোন নি তার? ইংরেজী তার বোল শুনিলে সব মানিত হার | কথা ঘটক বলল এঁটে, বলল কখন ঢিলে, সাজুর মায়ে সবগুলি তার ফেলল যেন গিলে | মুখ দেখে বুঝল ঘটক—লাগছে অষুধ হাড়ে, বলল, “তোমার সাজুর বিয়া ঠিক কর এই বারে |” সাজুর মা কয়, ” যা বোঝ ভাই, তোমরা গ্যা তাই কর, দেখ যেন কথার আবার হয় না নড়চড় |” “আউ ছি ছি!” ঘটক বলে, “শোনই কথা বোন, তোমার সাজুর বিয়া দিতে লাগবে কত পণ? পোণে দিব কুড়ি দেড়েক বায়না দেব তেরো, চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় এই গে ধর বারো | সবদ্যা হল দুই কুড়ি এ নিতেই হবে বোন, চাইলে বেশী জামাইর তোমার বেজার হবে মন!” সাজুর মা কয়, “ও-সব কথার কি-ইবা আমি জানি, তোমরা যা কও তাইত খোদার গুকুর বলে মানি |” সাধে বলে দুখাই ঘটক ঘটকালিতে পাকা, আদ্য মধ্য বিয়ের কথা সব করিল ফাঁকা | চল্-চলা-চল্ চলল দুখাই পথ বরাবর ধরি, তাগ্-ধিনা-ধিন্ নাচে যেন গুন্ গুনা গান করি | দুখাই ঘটক নেচে চলে নাচে তাহার দাড়ি, বুড়োর বটের শিকড় যেন চলছে নাড়ি নাড়ি ; লম্ফে লম্ফে চলে ঘটক দম্ভ করে চায়, লুটের মহল দখল করে চলছে যেন গাঁয়! ঘটকালিরই টাকা যেন ঝন্-ঝনা-ঝন্ বাজে, হন্-হানা-হন্ চলল ঘটক একলা পথের মাঝে | ধানের জমি বাঁয় ফেলিয়া ফেলিয়া, ডাইনে ঘন পাট, জলীর বিলে নাও বাঁধিয়া ধরল গাঁয়ের বাট | “কি কর গো রূপার মাতা, ভবছ বসি কিবা, সাজুর সাথেই ঠিক কইরাছি তোমার ছেলের বিবা | সহজে কি হয় সে রাজি, একশ টাকা পণ, এর কমেতে বসেইনাক সাজুর মায়ের মন | আমিও আবার কুড়ি তিনেক উঠিনে তার পরে, সাজুর মায়ও নাছোড়-বান্দা, দিলাম তখন ধরে ; আরেক কুড়ি, তয় সে কথা কইল হাসি হাসি, আমি ভাবি, বিয়ার বুঝি বাজল সানাই বাঁশী | এখন বলি রূপার মাতা, আড়াই কুড়ি টাকা, মোর কাছেতে দিবা, কথা হয় না যেন ফাঁকা! আসব দিয়ে গোপনে তায়, নইলে গাঁয়ের লোকে, মেজবানী দাও বলে তারে ধরবে চীনে জোঁকে | বিয়ের দিনে নিবে সে তাই তিরিশ টাকা যেচে, যারে তারে বলতে পার এই কথাটি নেচে | চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় তার লাগিবে ষোলো, এই ধরগ্যা রূপার বিয়া আজই যেন হল |” রূপার মায়ের আহ্লাদে প্রাণ ধরেইনাক আর, ইচ্ছে করে নেচে নেচে বেড়ায় বারে বার | “ও রূপা তুই কোথায় গেলি? ভাবিসনাক মোটে, কপাল গুণি বিয়ে যে তোর সাজুর সাথেই জোটে!” এই বলিয়া রূপার মাতা ছুটল গাঁয়ের পানে, ঘটক গেল নিজের বাড়ি গুন্-গুনা-গুন্ গানে | ***** ফুপু = পিসী, বাপের বোন;দাদা = ঠাকুরদাদা সবদ্যা = সব দিয়া;বিবা = বিবাহ তয় = তবে মেজবানী = নিমন্ত্রণ দেওয়া
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
কিছুদিন বাদে আদিল কহিল, “গান ত হইল শেষ, সোনার বরণী সকিনা আমার চল আজ নিজ দেশ। তোমার জীবনে আমার জীবনে দুখের কাহিনী যত, শাখায় লতায় বিস্তার লভি এখন হয়েছে গত। চল, ফিরে যাই আপনার ঘরে শূন্য শয্যা তথা, শুষ্ক ফুলেরা ছাড়িছে নিশ্বাস স্মরিয়া তোমার কথা।” শুনিয়া সকিনা ফ্যাল ফ্যাল করি চাহিল স্বামীর পাানে, সে যেন আরেক দেশের মানুষ বোঝে না ইহার মানে। আদিল কহিল“সেথায় তোমার হলুদের পাটাখানি, সে শুভ দিনের রঙ মেখে গায় ডাকিছে তোমারে রাণী, উদাস বাতাস প্রবেশ করিয়া শূূনো কলসীর বুকে, তোমার জন্যে কাঁদিছে কন্যে শত বিরহের দুখে। মাটির চুলা যে দুরন্ত বায়ে উড়ায়ে ভস্মরাশ, ফাটলে ফাটরে চৌচির হয়ে ছাড়িছে বিরহ শ্বাস। কন্যা-সাজানী সীমলতা সেথা রোপেছিলে নিজ হাতে। রৌদ্রে-দাহনে মলিন আজিকে কেবা জল দিবে তাতে। চল, ফিরে যাই আপনার ঘরে, সেথায় সুখের মায়া। পাখির কুজনে ঝুমিছে সদাই গাছের শীতল ছায়া। ক্ষণেক নীরব রহিয়া সকিনা শুধাল স্বামীরে তার, “কোথা সেই ঘর আশ্রয়-ছায়া মিলিবে জীবনে আর ? অভাগিনী আমি প্রতি তিলে তিলে নিজেরে করিয়া দান, কত না দুঃখের দাহনে কিরনু সে ঘরের সন্ধান। সে ঘর আমার জনমের মত পুড়িয়া হয়েছে ছাই, আমার সমুখে শুষ্ক মরু যে ছাড়ে আগুনের হাই।” আদিল কহিল, “সে মরুতে আজি বহিছে মেঘের ধারা, তুমি সেথা চল নকসা করিয়া রচিবে তৃণের চারা। সেথা অনাগত শিশু কাকলীর ফুটিবে মধুর বোল, নাচিবে দখিন বসন্ত বায় দোলায়ে সুখের দোল।” “মিথ্যা লইয়া কতকাল পতি প্রবোধিব আপনায় ?” ম্লান হাসি হেসে শুধায় সকিনা, “দুঃখের দাহনায় অনেক সহিয়া শিখেছি বন্ধু, মিছার বেসাতি করি, ভবের নদীতে ফিরিছে কতই ভাগ্যবানের তরী। সেথায় আমার হলনাক ঠাঁই, দুঃখ নাহি যে তায়, সান্ত্বনা রবে, অসত্য লয়ে ঠকাইনি আপনায়। কোন ঘরে মোরে নিয়ে যাবে পতি?যেথায় সমাজনীতি, প্রতি তিলে তিলে শাসনে পিষিয়া মরিছে জীবন নিতি। না ফুটিতে যেথা প্রেমের কুসুম মরিছে নিদাঘ দাহে, না ফুটিতে কথা অধরে শুকায় বিভেদের কাঁটা রাহে। সাদ্দাদ সেথা নকল ভেস্ত গড়িয়া মোহের জালে, দম্ভে ফিরেছে টানিছে ছিঁড়িছে আজিকার এই কালে। সে দেশের মোহ হইতে যে আজি মুক্ত হয়েছি আমি, স্বার্থক যেন লাগিছে যে দুখ সয়েছি জীবনে, স্বামী। কোন ঘরে তুমি নিয়ে যাবে পতি, কুলটার দুর্নাম, যেথায় জ্বলিছে শত শিখা মেলি অফুরান অবিরাম। যেথায় আমার অপাপ-বিদ্ধ শিশু সন্তান তরে, দিনে দিনে শুধু রচে অপমান নানান কাহিনী করে। যেথায় থাপড়ে নিবিছে নিমেষে বাসরের শুভ বাতি. মিলন মালিকা শুকায় যেখানে শেষ না হইতে রাতি। যেথায় মিথ্যা সম্মান অর খ্যাতি আর কুলমান, প্রেম-ভালবাসা স্নেহ-মায়া পরে হানিছে বিষের বাণ। সেথায় আমার ঘর কোথা পতি ? মোরে ছায়া দিতে হায়, নাই হেন ঠাঁই রীতি নীতি ঘেরা তোমাদের দুনিয়ায়। এ জীবনে আমি ঘরই চেয়েছিনু সে ঘরের মোহ দিয়ে, কেউ নিল হাসি, কেউ নিল দেহ কেউ গেল মন নিয়ে। ঘর ত কেহই দিল না আমারে, মিথ্যা ছলনাজাল, পাতিয়া জীবনে নিজেরে ভুলায়ে রাখি আর কতকাল।” আদিল কহিল, “আমিও জীবনে অনেক দুঃখ সয়ে, নতুন অর্থ খুঁজিয়া পেয়েছি তোমার কাহিনী লয়ে। আর কোন খ্যাতি, কোন গৌরব, কোন যশ কুলমান, আমাদের মাঝে আনিতে নারিবে এতটুকু ব্যবধান। বিরহ দাহনে যশ কুলমান পোড়ায় করেছি ছাই, তোমার জীবন স্বর্ণ হইয়া উজলিছে সেথা তাই। চল ঘরে যাই, নতুন করিয়া গড়িব সমাজনীতি, আমাদের ভালবাসী দিয়ে সেথা রচিব নতুন প্রীতি, সে ঘর বন্ধু, এখনো রচিত হয় নাই কোনখানে, সে প্রীতি ফুটিবে আমারি মতন কোটি কোটি প্রাণদানে। তুমি ফিরে যাও আপনার ঘরে, রহিও প্রতীক্ষায়. হয়ত জীবনে আবার মিলন হইবে তোমা-আমায়।’ “কারে সাথে করে ফিরে যাব ঘরে ? শূন্য বাতাস তথা, ফুঁদিয়ে এ বুকে আগুন জ্বালাবে ইন্ধনি মোর ব্যথা।” “একা কেন যাবে ?”সকিনা যে কহে, “এই যে তোমার ছেলে, এরে সাথে করে লইও সেথায় নতুন জীবন মেলে। দিনে দিনে তারে ভুলে যেতে দিও জনম দুখিনী মায়, শিখাইও তারে, মরিয়াছে মাতা জীবনের ঝোড়ো বায়। কহিও, দারুণ বনের বাঘে যে খায়নি তাহারে ধরে, মনের বাঘের দংশনে সে যে মরিয়াছে পথে পড়ে। এতদিন পতি, তোমার আশায় ছিনু আমি পথ চেয়ে, আঁচলের ধন সঁপিলাম পায় আজিকে তোমারে পেয়ে। কতেকদিন সে কাঁদিবে হয়ত অভাগী মায়ের তবে, সে কাঁদব তুমি সহ্য করিও আর এক শুভ স্মরে। মোর জীবনের বিগত কাহিনী মোর সাথে সাথে ধায়, তাহারা আঘাত হানিবে না সেই অপাপ জীনটায়। বড় আদরের মোর তোতামণি তারে যাও সাথে নিয়ে, আমারি মতন পালিও তাহারে বুকের আদর দিয়ে।” এই কথা বলি অভাগী সকিনা ছেলেরে স্বামীর হাতে, সঁপিয়া যে দিতে নয়নের জল লুকাইল নিরালাতে। তোতামণি কয়, “মাগো, মা আমার লক্ষী আমার মা, তোমারে ছাড়িয়া কোথাও যে মোর পরাণ টিকিবে না। কোন বনবাসে আমারে মা তুমি আজিকে সঁপিয়া দিয়া, কি করিয়া তুমি জীবন কাটাবে একেলা পরাণ নিয়া।” “বাছারে! সে সব শুধাসনে মোরে, এটুকু জানিস সার, ছেলের শুভের লাগিয়া সহিতে বহু দুখ হয় মার। রজনী প্রভাতে মা বোল বলিয়া আর না জুড়াবি বুক, শতেক দুখের দাহন জুড়াতে হেরিব না চাঁদ মুখ। তবু বাছা তোরে ছাড়িতে হইবে, জনম দুখিনী মার, সাধ্য হল না বক্ষে রাখিতে আপন ছেলেরে তার।” ছেলেরে আঁচলে জড়ায়ে সকিনা কাঁদিল অনেকক্ষণ, তারপর কোন দৃঢতায় যেন বাঁধিয়া লইল মন। উসাদ কন্ঠে কহিল স্বামীকে, “ফিরে যাও, নিজ ঘরে, মোদের মিলন বাহিরে হল না রহিল হৃদয় ভরে। আমার লাগিয়া উদাসী হইয়া ফিরিয়াছ গাঁয় গাঁয়, এই সান্ত্বনা রহিল আমার সমুখ জীবনটায়। যাহার লাগিয়া এমন করিয়া অমন পরাণ করে, আজি জানিলাম, তাহারো পরাণ আমারো লাগিয়া ঝরে। এ সুখ আমার দুখ-জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, সারাটি জনম তপস্যা করি শোধ নাহি হবে তার। এই স্মরণের শক্তি আমারে চালাবে সমুখ পানে, যে অজানা সুর মোহ বিস্তারি নিশিদিন মোর টানে।” “প্রাণের সকিনা ?” আদিল শুধায়, “সে তব জীবনটায়, আমার তরেতে এতটুকু ঠাই নাহি কোন তরুছায় ?” “আছে, আছে পতি, “সকিনা যে কহে, “হায়রে যাহারে পাই, তাহারে আবার হারাইতে সখা, বড় যে আরাম তাই। ফুলেরে ডাকিয়া পুছিনু সেদিন, “ফুল ! তুমি বল কার ? ফুলে কহে, যারে কিছু না দিলাম আমি যে সবটা তার। শুধালাম পুন; বল বল ফুল ! সব তুমি দিলে যারে, সেকি আজ হাসে বরণে সুবাসে তোমার দানের ভাবে ? “সে আমার কাছে কিছু পায় নাই। ফুল কহে ম্লান হাসি, ‘পদ্মের বনে ফিরিছে সারসী কুড়ায়ে শামুক রাশি। পুছিলাম পুন ফুল !তুমি বল কোথায় সবতি তব ? ফুল কহে, যারে কিছু দেই নাই সেথা মোর চিরভব। এ জীবনে মোর এই অভিশাপ যারে কিছু দিতে যাই, কর্পুর সম উবে যায় তাহা, হাতে না লইতে তাই। যে আমারে চাহে যতটা করিয়া আমি হই তত তার, ইচ্ছা করিয়া আমি যে জীবনে কিছু নারি হতে কার। যে আমারে পায় তাহার নিশীথে চির অনিদ্রা জাগে, ফুলশয্যা যে কন্টকক্ষত তাহার জীবনে লাগে। সাপের মাথায় চরণ রাখিয়া চলে সে আঁধার রাতে, দুখের মুকুট মাথায় পরিয়া বিষের ভান্ড হাতে। নিকটে করিয়া যে আমারে চাহে আমি তার বহুদূর, দূরের বাঁশীতে বেজে ওঠে নিতি প্রীতি মিলনের সুর। ফুলের কাহিনী স্মরিযা পতি গো, অনেক শিখেছি আজ, স্বেচ্ছায় তাই হাসিয়া নিলাম বিরহ মেঘের বাজ। নিকটে তোমারে পেতে চেয়েছিনু, সাধ হল না তাই, দূরের বাঁশীরে দূরে রেখে দেখি বুকে তারে যদি পাই। গলে না লইতে শুকাল মালিকা, মিলন রাতের মোহে, চিরশূণ্যতা ভরেছি এ বুকে দোঁহে আকড়িয়া দোঁহে। আজ তাই পতি, বড় আশা করে তোমারে পাঠাই দূরে, সেই শূন্যতা ভরে যদি ওঠে আমার বুকের সুরে। আদিল কহিল, প্রাণের সকিনা, সারাটি জনম ভরে, দুখের সাগরে সাঁতার কেটেছ কেবলি আমার তরে। আজকে তোমার কোন সাধ হতে তোমারে না দিব বাধা, স্বেচ্ছায় আমি বরিয়া নিলাম এই বিরহের কাঁদা। বিদায়ের কালে বল অভাগিনী, কোথায় বাঁধিবে ঘর, কোন ছায়াতরু শীতলিত সেই সুদূর তেপান্তর? ম্লান হাসি হেসে কহিল সকিনা, আমার মতন হায়, অনেক সহিয়া ঘুমায়েছে সারা জীবনে ঝড়িয়ায়; কবর খুঁড়িয়া বাহির করিয়া তাদের কাহিনী মালা, বক্ষে পরিয়া প্রতি পলে পলে বুঝিব তাদের জ্বালা। যত ভাঙা ঘর শুষ্ক কুসুম, দলিত তৃষিত মন, সেথায় আমার যোগ সাধনের রচিব যে ধানাসন। সেইখানে পতি বরষ বরষ রহিব তপস্যায়, খুঁজিব নতুন কথা যা শুনিলে সব দুখ দূরে যায়। জানি না সে কোন কথা-অমৃত, কোন সে মধুর ভাষা, তবু আজ মোর নিশিদিশি ভরি জাগিতেছে মনে আশা; সে কথার আমি পাব সন্ধান, দুঃখ দাহন মাঝে, হয়ত বেদন-নাশন কখন গোপনে সেখা রোজে। একান্ত মনে বসি ধ্যানাসনে একটি একটি ধরি, মোর ব্যথাগুলি সবার ব্যথার সঙ্গে মিশাল করি; পরতে পরতে খুলিয়া খুলিয়া দিনের পরেতে দিন, খুঁজিয়া দেখিব কোথা আছে সেই কথামৃতের চিন। যদি কোন কোন সন্ধান মেলে, সে মধুর সুর নিয়া, নতুন করিয়া গড়িব আবার আমাদের এ দুনিয়া। সেইদিন পতি ফিরিয়া যাইব আবার তোমার ঘরে, অভাগীরে যদি ভালবাস সখা, থেকো প্রতীক্ষা করে। বিদায়ের আগে ও চরণে শেষ ছালাম জানায়ে যাই, দোয়া করো মোরে, এই সাধনায় সিদ্ধি যেন গো পাই। আর যদি কভু ফিরে নাহি আসি, ব্যথার দাহনানলে, জানিও, অভাগী মরিয়াছে সেথা নিরাশায় জ্বলে জ্বলে। আজি এ জীবন বিষে বিষায়িত, প্রেম, ভালবাসা, মায়া, বেড়িয়া নাচিছে গোর কুজঝট কদাকার প্রেত ছায়া। জ্বলিছে বহ্নি দিকে দিগনে-, তীব্র লেলিহা তার, খোদার আরশ কুরছির পরে মূর্চ্ছিছে বারবার। দিন রজনীর দুইটি ভান্ড পোরা যে তীব্র বিষে, মাটির পেয়ালা পূর্ণ করিয়া উঠেছে গগন দিশে। তারকা-চন্দ্রে জ্বলিছে তাহার তীব্র যে হুতাশন, তারি জ্বালা হতে নিস্তার মোর না হইল কোনক্ষণ। সন্ধ্যা সকাল তারি শিখা লয়ে আকাশের দুই কোলে, মারণ মন্ত্র ফুকারি ফুকারি যুগল চিতা যে জ্বলে। তাই এ জীবন সরায়ে লইনু তোমার জীবন হতে, আমারে ভাসিতে দাও পতি, সেই কালিয়-দহের স্রোতে। *** *** বাপের সঙ্গে চলিয়াছে ছেলে, ফিরে চায় বারে বারে, পারিত সে যদি দুটি চোখ বরি টেনে নিয়ে যেত মারে। পাথরের মত দাঁড়ায়ে সকিনা, স্তব্ধ যে মহাকাল, খুঁজিয়া না পায় অভাগিনী তরে সান্ত্বনা ভাষাজাল। চরণ হইতে চলার চক্র খসিয়া খসিয়া পড়ে, নয়ন হইতে অশ্রুর ধারা নিশির শিশিরে ঝরে। তিনু ফকিরের সারিন্দা বাজে, আয়রে দুষ্কু আয়, পাতাল ফুঁড়িয়া দুনিয়া ঘুরিয়া আকাশের নিরালায়। আয়রে দুস্কু, কবরের ঘরে হাজার বছর ঘুরে, ছিলি অচেতন আজকে আয়রে আমার গানের সুরে।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
গহন বনের মাঝে, বুড়ো বটগাছ শিকড়ে- বাকলে জড়ায়েছে নানা সাজে। জীর্ণ শীর্ণ বুকের পাঁজর গিয়াছে হইয়া ফাঁক, তাহার মধ্যে বাসা বাঁধিয়াছে কোকিল শালিক কাক। সাপের খোলস ঝুলে আছে কোথা, কোথাও শুকনো ডাল, মহাযোগী বট ধ্যানে নিমগ্ন কত যুগ কত কাল। সেদিন প্রভাতে বেড়াতে বেড়াতে হেরিলাম তার তলে, বানরের দল ঘুমায়ে রয়েছে ধরিয়া এওর গলে। কোন বা জননী, সন্তান মুখে চুমু দিয়ে দিয়ে আর, সাধ মেটেনাক, নানাভাবে তারে আদরিছে বারবার! কোন বা জননী ঘুমায়ে নিঝুম, সন্তানগুলি উঠে, স্বেচ্ছায় দুধ করিতেছে পান মার স্তন হতে লুটে। কোন বা দুষ্ট সন্তান তার চোখে ঘুমন্ত মার, আঙ্গুল মাতা হয়ত এখনো স্বপ্ন জড়িত চোখে, ছেলেদের তরে কোন সুখ-নীড় আঁকিছে বা আশা-লোকে। কোন কোন মাতা ছোট ছেলেটিরে জাগায়ে দিতেছে মাই, আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদে হিংসায় পাশে তার বড় ভাই। মাঘের প্রভাত, কনকনে হাওয়া বহিতেছে শীত করি, শুয়ে আছে ওরা আদরে সোহাগে কাছাকাছি জড়াজড়ি স্নেহ মমতার এমন দৃশ্য নির্জনে আঁকি আর শত ফুল আঁখি মেলিয়া ইহারে দেখিতেছে বারবার। প্রভাতের রবি আসিতে আসিতে থেমে যায় পথ ধারে; কুয়াশা চাদরে রশ্মিরে ঢাকি রাখে যতখন পারে। বন তার শাখা-বাহু বাড়াইয়া দিনেরে আড়াল করে, যিশুর জননী এখানে আসিয়া দাঁড়াক গাছের তলে, বৃন্দাবনের যশোদা আসুক গোপাল লইয়া কোলে; ফাতেমা জননী আসুক বুকেতে হাসান হোসেন টানি; দেখে যাক এই নির্জন বনে মমতার ছবিখানি। ধীরে ধীরে ধীরে কুয়াশা আঁধার মুছিল রবির গায়, বিহগ কুসুম সহস্রসুরে ফুটিল বনের ছায়। গাছের পাতায় ফাঁকা পথ দিয়ে রবির আলোর ঢেলা; ঘুমন্ত এই স্নেহপুরী মাঝে জুড়িল নিঠুর খেলা। ধীরে ধীরে তারা জাগিয়া উঠিল, ছেলেরে স্কন্ধে করি, আহারের খোঁজে চলিল জননী শাখাপথগুলি ধরি। চলে দম্পতি ডাল হতে ডালে হতে ধরি পাকা ফল, এ ওরে খাওয়ায় গান করে আর নেচে ফেরে চঞ্চল। বৃদ্ধ এ বট, শূণ্য বুকেতে কত কি যে কথা ভরে, উতলা বাতাসে কারে কি কহিছে বুঝি ফিস ফিস করে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
ফুলদিয়ে গেলে মেয়ে! এরে রাখিব কেমন ছলে, এরে মালায় পরিলে জ্বালা গলে শৃঙ্খল হযে দোলে। এরে ধরিতে ছুঁইতে করে এ যে, ভোরের শিশির ফোঁটা এ যে, খনেক জীবন ধরে। এরে, পাইয়া কপাল পোড়া, কাঁদিয়া জনম যায়, এরে, আঁখির জলের ধারে খনেক বাঁচান দায়। ফুল ত দিলে না বালা দিলে, স্মৃতির বিরহ মালা, নিরালা গহন রাতে বুকে দহন বিজলী জ্বালা। *** ফুল নাহি দিয়ে মেয়ে, ফুল কেন নাহি হলে, মোর ভালবাসা দিয়ে ফুটাতাম শতদলে। ফুল জানোক হেলা, জানেনা আপন পর, যে যতটা তারে চায় সে তার তেমনতর। ফুল দিলে তুমি মেয়ে যদি ফুলের না দিলে রিতি, তবে বৃথাই বীনার তারে বাজিছে সুরলা গীতি। তবে বৃথাই আকাশে মেলা দুলিছে মেঘের ভেলা, তবে বৃথাই পটুয়া সেথা করে নানা রঙে লয়ে খেলা। ফুল দিয়ে গেলে বালা এরে রাখিব কেমন ছলে এরে মালায় পরিলে জ্বালা গলে শৃঙ্খল হয়ে দোলে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
ঘুমপাড়ানী ঘুমের দেশে ঘুমিয়ে দুটি আঁখি, মুখেতে তার কে দিয়েছে চাঁদের হাসি মাখি। পা মেজেছে চাঁদের চুমোয়, হাতের ঘুঠোয় চাঁদ, ঠোঁট দুটিতে হাসির নদীর ভাঙবে বুঝি বাঁধ। মাথায় কালো চুলের লহর পড়ছে এসে মুখে, ঝাঁকে ঝাঁকে ভোমর যেন উড়ছে ফুলের বুকে। এই খুকীটির সঙ্গে আমার আলাপ যদি হয়, সাগর-পারের ঝিনুক হয়ে ভাসব সাগরময় ; রঙিন পাখির পালক হয়ে ঝরব বালুর চরে, শঙ্খমোতির মালা হয়ে দুলব টেউএর পরে। তবে আমি ছড়ার সুরে ছড়িয়ে যাব বায়, তবে আমি মালা হয়ে জড়াব তার গায়। এই খুকীটি আমায় যদি একটু আদর করে, একটি ছোট কথা শোনায় ভালবাসায় ভরে ; তবে আমি বেগুন গাছে টুনটুনীদের ঘরে, যত নাচন ছড়িয়ে আছে আনব হরণ করে : তবে আমি রুপকথারি রুপের নদী দিয়ে, চলে যাব সাত-সাগরে রতন মানিক নিয়ে ; তবে আমি আদর হয়ে জড়াব্ তার গায়, নুপুর হয়ে ঝুমুর ঝুমুর বাজব দুটি পায়।
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়, হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে খ্যাতি লেখা তার। সন্ধ্যা বেলায় দেখিবে তাহারে পটি বাঁধি পায়ে হাতে, মালিশ মাখিছে প্রতি গিঠে গিঠে কাত হয়ে বিছানাতে। মেসের চাকর হয় লবেজান সেঁক দিতে ভাঙ্গা হাড়ে, সারা রাত শুধু ছটফট করে কেঁদে কেঁদে ডাক ছাড়ে। আমরা তো ভাবি ছমাসের তরে পঙ্গু সে হল হায়, ফুটবল-টিমে বল লয়ে কভু দেখিতে পাব না তায়। প্রভাত বেলায় খবর লইতে ছুটে যাই তার ঘরে, বিছানা তাহার শূন্য পড়িয়া ভাঙা খাটিয়ার পরে। টেবিলের পরে ছোট বড় যত মালিশের শিশিগুলি, উপহাস যেন করিতেছে মোরে ছিপি- পরা দাঁত তুলি। সন্ধ্যা বেলায় খেলার মাঠেতে চেয়ে দেখি বিস্ময়ে, মোদের মেসের ইমদাদ হক আগে ছোটে বল লয়ে! বাপ পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা, ভাঙা কয়খানা হাতে পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা। চালাও চালাও আরও আগে যাও বাতাসের মত ধাও, মারো জোরে মারো- গোলের ভেতরে বলেরে ছুঁড়িয়া দাও। গোল-গোল-গোল, চারিদিক হতে ওঠে কোলাহলকল, জীবনের পণ, মরণের পণ, সব বাঁধা, পায়ে দল। গোল-গোল-গোল-মোদের মেসের ইমদাদ হক কাজি, ভাঙা দুটি পায়ে জয়ের ভাগ্য লুটিয়া আনিল আজি। দর্শকদল ফিরিয়া চলেছে মহা-কলবর করে, ইমদাদ হক খোড়াতে খোড়াতে আসে যে মেসের ঘরে। মেসের চাকর হয়রান হয় পায়েতে মালিশ মাখি, বে-ঘুম রাত্র কেটে যায় তার চীৎকার করি ডাকি। সকালে সকালে দৈনিক খুলি মহা-আনন্দে পড়ে, ইমদাদ হক কাল যা খেলেছে কমই তা নজরে পড়ে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
আর একদিন আসিও বন্ধু-আসিও এ বালুচরে, বাহুতে বাঁধিয়া বিজলীর লতা রাঙা মুখে চাঁদ ভরে। তটিনী বাজাবে পদ-কিঙ্কিণী, পাখিরা দোলবে ছায়া, সাদা মেঘ তব সোনার অঙ্গে মাখাবে মোমের মায়া। আসিও সজনি, এই বালুচলে, আঁকা-বাঁকা পথখানি; এধারে ওধারে ধান ক্ষেত তারে লয়ে করে টানাটানি। কখনো সে গেছে ওধারে বাঁকিয়া কখনো এধারে আসি, এরে ওরে লয়ে জড়াজড়ি করে ছড়ায় ধুলার হাসি। এহ পথ দিয়ে আসিও সজনি, প্রভাতে ও সন্ধ্যায়, দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেতের গন্ধ মাখিয়া গায়। চরের বাতাস বাতাস করিয়া শীতল করিছে যারে, সেই পথে তুমি চরণ ফেলিয়া আসিও এ নদী পারে। আর একদিন আসিও সজনি, এ মোর কামনাখানি, মুখ বালুচরে আখর এঁকেছি নখরে নখর হানি। লিখিয়াছি তাহা পাখির পাখায় মোর নিঃশ্বাস ঘায়ে, আর লিখিয়াছি দুর গগনের কনক মেঘের ছায়ে। সেই সব তুমি পড়িয়া পড়িয়া অলস অবশ কায়, এইখানে এসে থামিও বন্ধু মোর বেনুবন-ছায়া। এই বেনুবন মোর সাথে সাথে কাঁদিয়াছে বহুরাতি, পাতায় পাতায় জড়াজড়ি করি উতল পবনে মাতি। এইখানে সখি। সাক্ষ্য হইয়া রাতের প্রহরগুলি, কত যে কঠোর বেদনা আমার তোমারে বলিবে খুলি। রাত-জাগা পাখি কহিবে তোমারে, আমার বে-ঘুম রাতি, কাটিতে কাটিতে কি করে নিবেছে একে একে সব বাতি। সেইখানে তুমি বসিও সজনি।মনে না রাখিও ডর, সেদিন আমার যত কথা সখি। এই মুক মাটি তলে, মোর সাথে সাথে ঘুমায়ে রহিবে মহা-মৃত্যুর কোলে। এই নদী তটে বরষ বরষ ফুলের মহোৎসবে; আসিবে যাহারা তাহাদের মাঝে মোর নাম নাহি রবে। সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে, অভাগা গাঁয়ের কবি, জীবনের কোন কনক বেলায় দেখেছিল কার ছবি। ফুলের মালায় কে লিখিল তারে গোরের নিমন্ত্রণ, কে দিল তাহারে ধুপের ধোঁয়ায় নিদারুণ হুতাশণ। সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে কথা এই অভাগার, জনিবে না কেউ কত বড় আশা জীবনে আছিল তার। ধরণীর বুকে প্রদীপ রাখি সে, আকাশের ডাক দিত- মাটির কলসে জল ভরে সে যে তটিনীরে বুকে নিত। এত বড় আশা কি করে ভাঙিল, কি করে জীবন ভোরে, রঙ-কুহেলির সোনার স্বপন ভাঙিল সিঁধেল চোরে। এসব সেদিন স্মরিবে না কেহ, দুঃখ নাহিক তায় ; যে গেল তাহারে ফিরায়ে আনিতে পিছু-ডাকে নাহি হায়। যে দুখে আমার জীবন দহিল সে দুখের স্মৃতি রাখি, সবার মাঝারে রহিব যে বেঁচে, এর চেয়ে নাই ফাঁকি। তুমিও আমারে ভেবো না সেদিন, আমার দুঃখ ভার। এতটুকু ব্যথা নাহি আনে যেন কোনদিন মনে কার। এ মোর জীবনে তোমার হাতের পেয়েছিনু অবহেলা, এই গৌরব রহিল আমার ভরিতে জীবন ভেলা। তুমি দিয়াছিলে আমারে আঘাত, তারি মহা-মহিমায় সবার আঘাত দলিয়া এসেছি এ মোর চরণ ঘায়। তোমারে আমার লেগেছিল ভাল, আর সব ভাল তাই। আমার জীবনে এতটুকু দাগ কেহ কভু আঁকে নাই। তোমার নিকটে পেয়েছিনু ব্যথা তারি গেীরব ভরে, আর সব ব্যথা খড়কুটা সম ছিঁড়িয়াছি নখে ধরে। তুমি দিয়েছিলে ক্ষুধা, অবহেলে তাই ছাড়িয়া এসেছি জগতের যত সুধা। এ জীবনে মোর এই গৌরব, তোমারে যে পাই নাই, আর কারো কাছে না পাওয়ার ব্যথা সহিতে হয়নি তাই। তোমার নিকটে কণিকা না পেয়ে আমি হয়েছিনু ধনী- আমার কুটীরে ছড়াছড়ি যেত রতন মানিক মণি। তাই আজ শুভখনে- মোর পরে তব যত অন্যায় আনিও না কভু মনে। আমারে যে ব্যথা দিয়েছিলে তুমি, তাতে নাহি মোর দুখ, তুমি সুখে ছিলে, মোর সাথে রবে সেই স্মরণের সুখ। আর একদিন আসিও সজনি। মোর কন্ঠের ডাক। যতদিন তুমি না আসিবে যেন নাহি হয় নির্ব্বাক। এ মোর কামনা পাখি হয়ে যেন এই বালুচরে ফেরে, যেন বাজ হয়ে গগনে গগনে মেঘের বসন ছেঁড়ে। এই কথা আমি ভরে রেখে যাই খর-তটিনীর জলে, যেন দুই কুল ভাঙিয়া সে চলে আপনার কল্লোলে। আর একদিন আসিও সজনি। এ আমার অভিশাপ। যত দিন যাবে পলে পলে এর বাড়িবে ভীষণ তাপ। এই বাসনার ইন্ধন জ্বালি সাজালেম যেই হোম, কাল-নটেশের চরণের তালে জ্বলে যেন নির্স্মম। যেন তারি দাহ সপ্ত আকাশ ভেদিয়া উপরে ধায়, চন্দ্র-সুর্য মুরছিয়া পড়ে তারি নিশ্বাস ঘায়। যেন সে বহ্নি শত ফণা মেলি করে বিষ উদগার, তারি দাহ হতে তুমি যেন কভু নাহি পাও উদ্ধার। যতদিনে তুমি এই বালুচলে নাহি আস পুন ফিরে, আজি এই কথা লিখে রেখে যাই বালুকার বুকে চিলে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
এক বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী, উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি | — রাখালী গান এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও — মধ্যে ধু ধু মাঠ, ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ | এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ ; গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলি সব দাঁড়ায় তারি পাছ | ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া, ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া | এ-গাঁও চেয়ে ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে, কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে! মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল, বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল | এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে, জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে! কেউবা বলে — আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি ; এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে, ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে! এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়, জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়ে | কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি, শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি | মাঠের মাঝের জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ, জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ ! বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি, মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি | সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি ও-গাঁর পানে ধায়, ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল ছায় | এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকেও আসে জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে | এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর — শুধুই জলের ডাক, তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নেইকো কোন ফাঁক | ও-গাঁর বধু ঘট ভরিতে যে ঢেউ জলে জাগে, কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয় এসে লাগে | এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে, ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে! এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান, ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান | এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে ; অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে | এ-গাঁর লোকে দল বাঁধিয়া ও-গাঁর লোকের সনে, কাইজা ফ্যাসাদ্ করেছে যা জানেই জনে জনে | এ-গাঁর লোকেও করতে পরখ্ ও-গাঁর লোকের বল, অনেকবারই লাল করেছে জলীর বিলের জল | তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ, মাঝখানে তার ধূলায় দোলে দুখান দীঘল বাট ; দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা, এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা |
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
ছয় ও তুই ঘরে রইতে দিলি না আমারে | . — রাখালী গান ঘরেতে রূপার মন টেকে না যে, তরলা বাঁশীর পারা, কোন বাতাসেতে ভেসে যেতে চায় হইয়া আপন হারা | কে যেন তার মনের তরীরে ভাটির করুণ তানে, ভাটিয়াল সোঁতে ভাসাইয়া নেয় কোন্ সে ভাটার পানে | সেই চিরকেলে গান আজও গাহে, সুরখানি তার ধরি, বিগানা গাঁয়ের বিরহিয়া মেয়ে আসে যেন তরি! আপনার গানে আপনার প্রাণ ছিঁড়িয়া যাইতে চায়, তবু সেই ব্যথা ভাল লাগে যেন, একই গান পুনঃ গায় | খেত-খামারেতে মন বসেনাকো ; কাজে কামে নাই ছিরি, মনের তাহার কি যে হল আজ ভাবে তাই ফিরি ফিরি | গানের আসরে যায় না রূপাই সাথীরা অবাক মানে, সারাদিন বসি কি যে ভাবে তার অর্থ সে নিজে জানে! সময়ের খাওয়া অসময় খায়, উপোসীও কভু থাকে, “দিন দিন তোর কি হল রূপাই” বার বার মায় ডাকে | গেলে কোনখানে হয়তো সেথাই কেটে যায় সারা দিন, বসিলে উঠেনা উঠিলে বসেনা, ভেবে ভেবে তনু ক্ষীণ | সবে হাটে যায় পথ বরাবর রূপা যায় ঘুরে বাঁকা, খালার বাড়ির কাছ দিয়ে পথ, বাঁশ-পাতা দিয়ে ঢাকা | পায়ে-পায় ছাই বাঁশ-পাতাগুলো মচ্ মচ্ করে বাজে ; কেউ সাথে নেই, তবু যে রূপাই মরে যায় যেন লাজে | চোরের মতন পথে যেতে যেতে এদিক ওদিক চায়, যদিবা হঠাৎ সেই মেয়েটির দুটি চোখে চোখ যায় | ফিরিবার পথে খালার বাড়ির নিকটে আসিয়া তার, কত কাজ পড়ে, কি করে রূপাই দেরি না করিয়া আর | কোনদিন কহে, “খালামা, তোমার জ্বর নাকি হইয়াছে, ও-বাড়ির ওই কানাই আজিকে বলেছে আমার কাছে | বাজার হইতে আনিয়াছি তাই আধসেরখানি গজা |” “বালাই! বালাই! জ্বর হবে কেন? রূপাই, করিলি মজা ; জ্বর হলে কিরে গজা খায় কেহ?” হেসে কয় তার খালা, “গজা খায়নাক, যা হোক এখন কিনে ত হইল জ্বালা ; আচ্ছা না হয় সাজুই খাইবে |” ঠেকে ঠেকে রূপা কহে, সাজু যে তখন লাজে মরে যায়, মাথা নিচু করে রহে | কোন দিন কহে, “সাজু কই ওরে, শোনো কিবা মজা, খালা! আজকের হাটে কুড়ায়ে পেয়েছি দুগাছি পুঁতির মালা ; এক ছোঁড়া কয়, “রাঙা সূতো” নেবে? লাগিবে না কোন দাম ; নিলে কিবা ক্ষতি, এই ভেবে আমি হাত পেতে রইলাম | এখন ভাবছি, এসব লইয়া কিবা হবে মোর কাজ, ঘরেতে থাকিলে ছোট বোনটি সে ইহাতে করিত সাজ | সাজু ত আমার বোনেরই মতন, তারেই না দিয়ে যাই, ঘরে ফিরে যেতে একটু ঘুরিয়া এ-পথে আইনু তাই |” এমনি করিয়া দিনে দিনে যেতে দুইটি তরুণ হিয়া, এ উহারে নিল বরণ করিয়া বিনে-সূতী মালা দিয়া | এর প্রাণ হতে ওর প্রাণে যেয়ে লাগিল কিসের ঢেউ, বিভোর কুমার, বিভোর কুমারী, তারা বুঝিল না কেউ | —তারা বুঝিল না, পাড়ার লোকেরা বুঝিল অনেকখানি, এখানে ওখানে ছেলে বুড়ো মিলে শুরু হল কানাকানি | সেদিন রূপাই হাট-ফেরা পথে আসিল খালার বাড়ি, খালা তার আজ কথা কয়নাক, মুখখানি যেন হাঁড়ি | “রূপা ভাই এলে?” এই বলে সাজু কাছে আসছিল তাই, মায় কয়, “ওরে ধাড়ী মেয়ে, তোর লজ্জা শরম নাই?” চুল ধরে তারে গুড়ুম গুড়ুম মারিল দু’তিন কিল, বুঝিল রূপাই এই পথে কোন হইয়াছে গরমিল | মাথার বোঝাটি না-নামায়ে রূপা যেতেছিল পথ ধরি, সাজুর মায়ে যে ডাকিল তাহারে হাতের ইশারা করি ; “শোন বাছা কই, লোকের মুখেতে এমন তেমন শুনি, ঘরে আছে মোর বাড়ন্ত মেয়ে জ্বলন্ত এ আগুনি | তুমি বাপু আর এ-বাড়ি এসো না |” খালা বলে রোষে রোষে, “কে কি বলে? তার ঘাড় ভেঙে দেব!” রূপা কহে দম কসে | “ও-সবে আমার কাজ নাই বাপু, সোজা কথা ভালবাসি, সারা গাঁয়ে আজ ঢিঢি পড়ে গেছে,মেয়ে হল কুল-নাশী |” সাজুর মায়ের কথাগুলি যেন বঁরশীর মত বাঁকা, ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে দিয়ে যায় তীব্র বিষের ধাকা | কে যেন বাঁশের জোড়-কঞ্চিতে তাহার কোমল পিঠে, মহারোষ-ভরে সপাং সপাং বাড়ি দিল গিঠে গিঠে | টলিতে টলিতে চলিল রূপাই একা গাঁর পথ ধরি, সম্মুখ হতে জোনাকীর আলো দুই পাশে যায় সরি | রাতের আঁধারে গালি-ভরা বিষে জমাট বেঁধেছে বুঝি, দুই হাতে তাহা ঠেলিয়া ঠেলিয়া চলে রূপা পথ খুঁজি | মাথার ধামায় এখনও রয়েছে দুজোড়া রেশমী চুরী, দুপায়ে তাহারে দলিয়া রূপাই ভাঙিয়া করিল গুঁড়ি | টের সদাই জলীর বিলেতে দুহাতে ছুঁড়িয়া ফেলি, পথ থুয়ে রূপা বেপথে চলিল, ইটা খেতে পাও মেলি | চলিয়া চলিয়া মধ্য মাঠেতে বসিয়া কাঁদিল কত, অষ্টমী চাঁদ হেলিয়া হেলিয়া ওপারে হইল গত | প্রভাতে রূপাই উঠিল যখন মায়ের বিছানা হতে, চেহারা তাহার আধা হয়ে গেছে, চেনা যায় কোন মতে | মা বলে, “রূপাই কি হলরে তোর?” রূপাই কহে না কথা দুখিনী মায়ের পরাণে আজিকে উঠিল দ্বিগুণ ব্যথা | সাত নয় মার পাঁচ নয় এক রুপাই নয়ন তারা, এমনি তাহার দশা দেখে মায় ভাবিয়া হইল সারা | শানাল পীরের সিন্নি মানিল খেতে দিল পড়া-পানি, হেদের দৈন্য দেখিল জননী, দেখিলনা প্রাণখানি | সারা গায়ে মাতা হাত বুলাইল চোখে মুখে দিল জল, বুঝিল না মাতা বুকের ব্যথার বাড়ে যে ইহাতে বল | আজকে রূপার সকলি আঁধার, বাড়া-ভাতে ওড়ে ছাই, কলঙ্ক কথা সবে জানিয়াছে, কেহ বুঝি বাকি নাই | জেনেছে আকাশ, জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু ; উদাস-দৃষ্টি য়ত দিকে চাহে সব যেন শূনো মরু | চারিদিক হতে উঠিতেছে সুর, ধিক্কার! ধিক্কার!! শাঁখের করাত কাটিতেছে তারে লয়ে কলঙ্ক ধার | ব্যথায় ব্যথায় দিন কেটে গেল, আসিল ব্যথার সাঁজ, পূবে কলঙ্কী কালো রাত এল, চরণে ঝিঁঝির ঝাঁজ! অনেক সুখের দুখের সাক্ষী বাঁশের বাঁশীটি নিয়ে, বসিল রূপাই বাড়ির সামনে মধ্য মাঠেতে গিয়ে | মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি ; মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি | আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায় ; যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীতে কেমন দেখাব তায়? অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে, এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে ; সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান ; পেতে রহি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ! মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগবান করে খেলা, রাজা-বাদশার সুখ-দুখ দিয়ে গড়েছি কথার মালা | পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়, যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায় ; তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিতেছে দোল, কি করিয়া আ দেখাইব তাহা, কোথা পাব সেই বোল? —সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই, ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই | বাজায় রূপাই বাঁশীটি বাজায় মনের মতন করে, যে ব্যথা সে বুকে ধরিতে পারেনি সে ব্যথা বাঁশীতে ঝরে “আমি কেনে বা পিরীতিরে করলাম | ( আমার ভাবতে জনম গেলরে, আমার কানতে জনম গেলরে | ) সে ত সিন্তার সিন্দুর নয় তারে আমি কপালে পরিব, সে ত ধান নয় চাউল নয় তারে আমি ডোলেতে ভরিবরে, আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম | আগে যদি জানতাম আমি প্রেমের এত জ্বালা, ঘর করতাম কদম্বতলা, রহিতাম একেলারে ; আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম |” — মুর্শিদা গান বাজে বাঁশী বাজে, তারি সাথে সাথে দুলিছে সাঁজের আলো ; নাচে তালে তালে জোনাকীর হারে কালো মেঘে রাত-কালো | বাজাইল বাঁশী ভাটিয়ালী সুরে বাজাল উদাস সুরে, সুর হতে সুর ব্যথা তার চলে যায় কোন দূরে! আপনার ভাবে বিভোল পরাণ, অনন্ত মেঘ-লোকে, বাঁশী হতে সুরে ভেসে যায় যেন, দেখে রূপা দুই চোখে | সেই সুর বয়ে চলেছে তরুণী, আউলা মাথার চুল, শিথিল দুখান বাহু বাড়াইয়াছিঁড়িছে মালার ফুল | রাঙা ভাল হতে যতই মুছিছে ততই সিঁদুর জ্বলে ; কখনও সে মেয়ে আগে আগে চলে, কখনও বা পাছে চলে | খানিক চলিয়া থামিল করুণী আঁচলে ঢাকিয়া চোখ, মুছিতে মুছিতে মুছিতে পারে না, কি যেন অসহ শোক! করুণ তাহার করুণ কান্না আকাশ ছাইয়া যায়, কি যে মোহের রঙ ভাসে মেঘে তাহার বেদনা-ঘায় | পুনরায় যেন খিল খিল করে একগাল হাসি হাসে, তারি ঢেউ লাগি গগনে গগনে তড়িতের রেখা ভাসে | কখনও আকাশ ভীষণ আঁধার, সব গ্রাসিয়াছে রাহু, মহাশূণ্যের মাঝে ভেসে উঠে যেন দুইখানি বাহু! দোলে-দোলে-বাহু তারি সাথে যেন দোলে-দোলে কত কথা, “ঘরে ফিরে যাও, মোর তরে তুমি সহিও না আর ব্যথা |” মুহূর্ত পরে সেই বাহু যেন শূণ্যে মিলায় হায়— রামধনু বেয়ে কে আসে ও মেয়ে, দেখে যেন চেনা যায়! হাসি হাসি মুখ গলিয়া গলিয়া হাসি যায় যেন পড়ে, সার গায়ে তার রূপ ধরেনাক, পড়িছে আঁচল ঝরে | কণ্ঠে তাহার মালার গন্ধে বাতাস পাগল পারা, পায়ে রিনি ঝিনি সোনার নূপুর বাজিয়া হইছে সারা ; হঠাৎ কে এল ভীষণ দস্যু—ধরি তার চুল মুঠি, কোন্ আন্ধার গ্রহপথ বেয়ে শূণ্যে সে গেল উঠি | বাঁশী ফেলে দিয়ে ডাক ছেড়ে রূপা আকাশের পানে চায়, আধা চাঁদখানি পড়িছে হেলিয়া সাজুদের ওই গাঁয় | শুনো মাঠে রূপা গড়াগড়ি যায়, সারা গায়ে ধূলো মাখে, দেহেরে ঢাকিছে ধূলো মাটি দিয়ে, ব্যথারে কি দিয়ে ঢাকে! ***** সদাই = সওদা ইটা খেত = চষা খেত শানাল = পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত পীর শাহলাল
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
রাতের বেলায় আসে যে রাতের পরী, রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধে সকল বাতাস ভরি। চরণের ঘায়ে রাতের প্রদীপ নিভিয়া নিভিয়া যায়, হাসপাতালের ঘর ভরিয়াছে চাঁদিমার জোছনায়। মানস সরের তীর হতে যেন ধবল বলাকা আসে, ধবল পাখায় ঘুম ভরে আনে ধবল ফুলের বাসে। নয়ন ভরিয়া আনে সে মদিরা, সুদূর সাগর পারে, ধবল দ্বীপের বালু-বেলাতটে শঙ্খ ছড়ায় ভারে। তাহাদেরি সাথে লক্ষ বছর ঘুমাইয়া নিরালায়, ধবল বালুর স্বপন আনিয়া মাখিয়াছে সারা গায়। আজ ঘুম ভেঙে আসিয়াছে হেথা, দেহ লাবনীর পরে, কত না কামনা ডুবিছে ভাসিছে আপন খুশীর ভরে। বসনে তাহার একে একে আসি আকাশের তারাগুলি, জ্বলিছে নিবিছে আপনার মনে রাতের বাতাসে দুলি। রাতের বেলায় আসে যে রাতের পরী চরণে বাজিছে ঝিঁঝির নূপুর দোলে ধরা মরি মরি! তাহারি দোলায় বনপথে পথে ফুটিছে জোনাকী ফুল, রাত-জাগা পাখি রহিয়া রহিয়া ছড়ায় গানের ভুল! তারি তালে তালে স্বপনের পরী ঘুমের দুয়ার খুলে, রামধনু রাঙা সোনা দেশেতে ডেকে যায় হাত তুলে। হলুদ মেঘের দোলায় দুলিয়া হলদে রাজার মেয়ে, তার পাছে পাছে হলুদ ছড়ায়ে চলে যায় গান গেয়ে। রাতের বেলায় ঝুমিছে রাতের পরী, মোহ মদিরার জড়াইছে ঘুম সোনার অঙ্গ ভরি। চেয়ারের গায়ে এলাইল দেহ খানিক শ্রানি-ভরে, কেশের ছায়ায় মায়া ঘনায়েছে অধর লাবনী পরে। যেন লুবানের ধূঁয়ার আড়ালে মোমের বাতির রেখা, কবরের পামে জ্বালাইয়া কেবা রচিতেছে কোন লেখা। পাশে মুমূর্ষু রোগীর প্রদীপ নিবু নিবু হয়ে আসে, উতল বাতাস ঘুরিয়া ফিরিয়া কাঁদিছে দ্বারের পাশে। মরণের দূত আসিতে আসিতে থমকিয়া থেমে যায়, শিথিল হস্ত হতে তরবারি লুটায় পথের গায়। যুক্ত করেতে রচি অঞ্জলি বার বার ক্ষমা মাগে, রাত্রের পরী মেলি দেহভার ঝিমায় ঘুমের রাগে। ভোরের শিশির পদ্ম পাতায় রচিয়া শীতল চুম, তাহার দুইটি নয়ন হইতে মুছাইয়া দিবে ঘুম। রক্তোৎপল হইতে সিদুর মানাইতে তার ঠোঁটে, শুক-তারকার সোনার তরনী দীঘির জলে যে লোটে।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
হলুদ বাঁটিছে হলুদ বরণী মেয়ে, হলুদের পাটা হাসিয়া গড়ায় রাঙা অনুরাগে নেয়ে। দুই হাতে ধরি কঠিন পুতারে ঘসিছে পাটার পরে, কাঁচের চুড়ী যে রিনিক ঝিনিকি নাচিছে খুশীর ভরে। দুইটি জঙ্ঘা দুইধারে মেলা কাঠ-গড়া কামনার, তাহার উপর উঠিতে নামিতে সোনার দেহটি তার; মর্দ্দিত দুটি যুগল সারসী শাড়ী সরসীর নীরে, ডুবিতে ভাসিতে পুষ্প ধনুরে স্মরিতেছে ঘুরে ফিরে। হলুদ বাঁটিছে হলুদ বরণী মেয়ে, রঙিন ঊষার আবছা হাসিতে আকাশ ফেলিল ছেয়ে। মিহি-সুরী গান গুন গুন করে ঘুরিছে হাসিল ঠোঁটে, খুশীর ভোমরী উড়িয়া শ্রীমুখ-পদ্মের দল লোটে। বিগত রাতের বভস-সুখের মদিরা জড়িত স্মৃতি, সারাটি পাটারে হলুদে জড়ায়ে গড়ায়ে রঙিছে ক্ষিতি। গাছের ডালে যে বুলবুলী বসি ভরিয়া দুখানা পাখ, লিখিয়া হইতে তারি একটুকু মেলিছে সুরেলা ডাক। হলুদ বাঁটিছে হলুদ বরণী মেয়ে, হলুদে লিখিত রঙিন কাহিনী গড়াইছে পাটা বেয়ে। ডোল-ভরা ধান, কোল ভরা শিশু, বুক-ভরা মিঠে গান, কোকিল ডাকান আম্র ছায়ায় পাতার কুটীর খান; চাঁদিনী রাতের জোছনা আসিয়া গড়ায় বেড়ার ফাঁকে কৃষাণ কন্ঠে বাঁশীটি বাজিয়া আকাশেতে প্রীতি আঁকে। অর্দ্ধেক রাত নক্সী-কাঁথাটি মেলন করিয়া ধরি, অতি সযতনে আঁকে ফুল-লতা মনের মমতা ভরি। সুখ যেন আসি গড়াইয়া পড়ে, সূতার লতালী ফাঁদে, মাটির ধরায় টেনে নিয়ে আসে গগন বিহারী চাঁদে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
কালকে সে নাকি আসিবে মোদের ওপারের বালুচরে, এ পারের ঢেউ ওপারে লাগিছে বুঝি তাই মনে করে। বুঝি তাই মনে করে, বাউল বাতাস টানাটানি করে বালুর আঁচল ধরে। কাল সে আসিবে, মুখখানি তার নতুন চরের মত, চখা আর চখী নরম ডানায় মুছায়ে দিয়েছে কত। চরের চাষীর ধানের খেতের মতই তাহার গা, কোথাবা হলুদ, আব্ছা হলুদ, কোথাবা হলুদ না। কাল সে আসিবে, হাসিয়া হাসিয়া রাঙা মুখখানি ভরি, এপারে আমার পাতার কুটিরে আমি কি বা আজ করি! কাল সে আসিবে, ওই বালুচরে, ওপারে আমার ঘর, তাজ পরে নদী-ঘাটের ডিঙা কাঁপে নদীটির পর। কাল সে আসিবে, নোঙর ছিঁড়িল, দুলিছে নায়ের পাল, কারে হারায়েছি, কারে যেন আমি দেখি নাই কতকাল। ওপারেতে চর বালু লয়ে খেলে, উড়ায় বালুর রথ, ওখানে সে কাল দুটি রাঙা পায়ে ভাঙিয়া যাইবে পথ। কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, আমি কি আবার হায়, আসমান-তারা শাড়ীখানি আজ উড়াব সারাটি গায়? রামলক্ষ্মণ শঙ্খ দুগাছি পরিব আবার হাতে, খোঁপায় জড়াব কিংশুক-কলি, কাজল চোখের পাতে; গলায় কি আজ পরিতে হইবে পদ্ম-রাগের মালা, কানাড়া ছান্দে বাঁধিব কি বেনী কপালে সিঁদুর জ্বালা? কাল সে আসিবে, মিছাই ছিঁড়িছি আঁধারের কালো কেশ, আজকের রাত পথ ভুলে বুঝি হারাল ঊষার দেশ। এই বালুচরে আসিবে সে কাল, তরে রাঙা মুখে ভরি, অফুট ঊষার সোনার কমল আসিবে সোহাগে ধরি। সে আসিবে কাল, গলায় পরিয়া কুসুম ফুলের হার, দুখানি নূপুর মুখর হইবে চরণে জড়ায়ে তার। মাথায় বাঁধিবে দুধালীর লতা কচি সীমপাতা কানে, বেণুর অধর চুমিয়া চুমিয়া মুখর করিবে গানে। কাল সে আসিবে, রাই সরিষাল হলদী কোটার শাড়ী, মটর কনেরে সাথে করে যেন খুলে দেখে নাড়ি নাড়ি। কাল সে আসিবে ওই বালুচরে, ধারে তার এই নদী, তারি কূলে মোর ভাঙা কুঁড়ে ঘর, বহুদূরে নয় যদি; তবু কি তাহার সময় হইবে হেথায় চরণ ধরি, মোর কুঁড়ে ঘর দিয়ে যাবে হায়, মণি-মানিকেতে ভরি। সে কি ওই চরে দাঁড়ায়ে দেখিবে বরষার তরুগুলি, শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি? হয়ত দেখিবে, হয় দেখিবে না; কাল সে আসিবে চরে, এপারে আমার ভাঙা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে প্রাণ বিনোদিয়া; আমি আর কতকাল রইব আমার মনেরে বুঝাইয়ারে; প্রাণ বিনোদিয়া। কি ছিলাম, কি হইলাম সইরে, কি রূপ হেরিয়া, আমি নিজেই যাহা বুঝলাম না সই, কি কব বুঝাইয়ারে; প্রাণ বিনোদিয়া। চোখে তারে দেখলাম সইরে! পুড়ল তবু হিয়া, আমার নয়নে লাগিলে আনল নিবাইতাম কাঁদিয়ারে; প্রাণ বিনোদিয়া। মরিব মরিব সইরে যাইব মরিয়া, আমার সোনা বন্ধুর রূপ দিও গরলে গুলিয়ারে; প্রাণ বিনোদিয়া। আগে যদি জানতাম বন্ধু যাইবা ছাড়িয়া, আমি ছাপাইয়া রাখতাম তোমার পাঁজর চিরিয়ারে; প্রাণ বিনোদিয়া।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
কমলা রাণীর দীঘি ছিল এইখানে, ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তটের পানে। আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী-বধূর দল, কমলা রাণীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল। আজ সেই দীঘি শুকায়েছে, এর কর্দমাক্ত বুকে, কঠিন পায়ের আঘাত হানিয়া গরুগুলি ঘাস টুকে। জলহীন এই শুষ্ক দেশের তৃষিত জনের তরে। কোন সে নৃপের পরাণ উঠিল করুণার জলে ভরে। সে করুণা ধারা মাটির পাত্রে ভরিয়া দেখার তরে, সাগর দীঘির মহা কল্পনা জাগিল মনের ঘরে।লক্ষ কোদালী হইল পাগল, কঠিন মাটিরে খুঁড়ি, উঠিল না হায় কল-জল-ধারা গহন পাতাল ফুঁড়ি। দাও, জল দাও, কাঁদে শিশু মার শুষ্ক কন্ঠ ধরি, ঘরে ঘরে কাঁদে শূন্য কলসী বাতাসে বক্ষ ভরি। লক্ষ কোদালী আরো জোরে চলে, কঠিন মাটির থেকে, শুষ্ক বালুর ধূলি উড়ে বায় উপহাস যেন হেঁকে।কোথায় রয়েছে ভাট ব্রাক্ষণ, কোথায় গণক দল, জলদী করিয়া গুনে দেখ কেন দীঘিতে ওঠে না জল? আকাশ হইতে গুণিয়া দেখিও শত-তারা আঁখি দিয়া, পাতালে গুণিও বাসকি-ফণার মণি-দীপ জ্বালাইয়া। ঈশানে গুণিও ঈশানী গলের নর-মুন্ডের সনে, দক্ষিনে গুনো, শাহ মান্দার যেথা সুন্দর বনে। আকাশ গণিল, পাতাল গণিল, গলিল দশটি দিক, দীঘিতে কেন যে জল ওঠেনাক বলিতে নারিল ঠিক।নিশির শয়নে জোড়মন্দিরে স্বপন দেখিছে রাণী, কে যেন আসিয়া শুনাইল তারে বড় নিদারুণ বানী; সাগর দীঘিতে তুমি যদি রাণী! দিতে পার প্রাণদান, পাতল হইতে শত ধারা-মেলি জাগিবে জলের বান। স্বপন দেখিয়া জাগিল যে রাণী, পূর্বের গগন-গায়, রক্ত লেপিয়া দাঁড়াইল রবি সুদূরের কিনারায়। শোন শোন ওহে পরাণের পতি ছাড় গো আমার মায়া, উড়ে চলে যায় আকাশের পাখি পড়ে রয় শুধু ছায়া।পেটরা খুলিয়া তুলে নিল রাণী অষ্ট অলঙ্কার, রাসমন্ডল শাড়ীর লহরে দেহটি জড়াল তার। কৌটা খুলিয়া সিঁদুর তুলিয়া পরিল কপাল ভরি, দুর্গা প্রতিমা সাজিল বুঝি বা দশমীর বাঁশী স্মরি। ধীরে ধীরে রাণী দাঁড়াইল আসি সাগর দীঘির মাঝে, লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী শুকনো তটের কাছে। পাতাল হইতে শতধারা মেলি নাচিয়া আসিল জল, রাণীর দুখানা চরণে পড়িয়া হেসে ওঠে খল খল। খাড়ু জলে রাণী খুলিয়া ফেলিল পায়ের নুপূর তার, কোমর জলেতে ছিড়িল যে রাণী কোমরে চন্দ্রহার। বুক-জলে রাণী কন্ঠে হইতে গজমতি হার খুলে, কোরের ছেলেটি জয়ধর কোথা দেখে রাণী আঁখি তুলে। গলাজলে রাণী খোঁপা হতে তার ভাসাল চাঁপার ফুল। চারিধার হতে কল-জলধারা ভরিল দীঘির কূল। সেই ধারা সনে মিশে গেল রাণী আর আসিল না ফিরে, লক্ষ লক্ষ কাঁদে নরনারী আকাশ বাতাস ঘিরে। *** কমলা রানীর এই সেই দীঘি, কার অভিশাপে আজ, খুলিয়া ফেলেছে অঙ্গ হইতে জল-কুমুদীর সাজ। পাড়ে পাড়ে আজ আছাড়ি পড়ে না চঞ্চল ঢেউদল, পল্লী-বধূর কলসীর ঘায়ে দোলে না ইহার জল। কমলা রাণীর কাহিনী এখন নাহিক কাহারো মনে, রাখালের বাঁশী হয় না করুণ নিশীথ উদাস বনে। শুধু এই গাঁর নূতন বধূরে বরিয়া আনিতে ঘরে, পল্লীবাসীরা বরণ কুলাটি রেখে যায় এর পরে। গভীর রাত্রে সেই কুলাখানি মাথায় করিয়া নাকি, আলেয়ার মত কে এক রূপসী হেসে ওঠে থাকি থাকি।কাব্যগ্রন্থ: মাটির কান্না
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
মেনা শেখের খবর জান?-সাত গাঁয়ে তার নাম, ছেলে বুড়ো যাকেই শুধাও, কোন খানে তার ধাম? আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, আলীপুরের মোড়ে, আকাশ ছোঁয়া খড়ের পালা চোখের পাতা পড়ে। দুপুর রোদে ধাঁধিয়ে দেওয়া টিনের ঘরের চাল, গগন-গাঙে উড়ছে যেন সাদা পাখির পাল। সাত গাঁর লোক গর্ব করে ফুলিয়ে বুকের ছাতা, মেনা শেখের গাঁয়ের মানুষ নইক মোরা যাতা। জানিসনে ভাই! সেবার যে ওই দিগ-নগরের হাট। দবির ছেলে শোকের মামুদ কিনতে গিয়ে পাট। বরই ডাঙার সাদের সাথে লাগল মারামারি, মেনা শেখের নাম শুনে সব তুলেই পালা দাড়ি, -দে ছুট সেই বন-বাদাড়ে যেথায় চলে পাও, একলা মেনা হারিয়ে দিল একশ জনা সাও। কথা যাদের টাকায় বিকায় সেই যে উকিল বাবু। মেনা শেখের রাখতে খাতির সে-ও হয়ে যায় কাবু, সদর থানার বড় বাবু-যম কাঁপে যার ডরে, শালার চেয়ে ইতরামি গাল মুখে সদাই ঝরে। তারেও মেনা-কান-কথাতে করতে পারে গুণ। মনে নেই সেই দবির জোলার পুতের বৌ-এর খুন? লেখা পড়া জানে না সে? সিটকিও না দাঁত ; না পড়েছে আজি ক খ দুখান কলার পাত। পড়েছে ত সাতটি গাঁয়ের সাতশ বাড়ির লোক, কেমন করে ব্যথায়-গানে লয়ে হাজার শোক। মেঠো মায়ের অবোধ ছেলে মাটির সাথে মিশে, কোলখানি তার সোনায় সাজায় সোনা ধানের শীষে। সে ত জানে সাত ঋতুতে সাতটি রঙের আলা, ছবির পরে ছবি এঁকে সাজায় মাঠের থালা। তারি সাথে হাজার চাষীর কি কাজ হবে রোজ, কোন মাঠে কে করবে বা কি-জানে সে তার খোঁজ। বানে ফসল ডোবার আগে ডোবে তাহার চোখ, মায়ের ছেলে মরার আগে তাহার বুকে শোক। বিয়ের বেলায় কলমা পড়ায়, মরলে সে দ্যা্য় গোর সুখের বেলা সাথের সাথী, দুখীর দুখে ভোর। কেতাব পড়ে পায়নি খেতাব ? পেয়েছে এক ডাকে, হাজার চাষীর হাজার লাঠি উঠবস তার হাঁকে। তোমরা বল অত্যাচারী ?-জিভ কাটিব চুপ করে থাক, শেখের পোরে ডাক দিয়ে তোর পিঠেতে নয় পিটাব ঢাক। দোষে গুণে পয়দা মানুষ চাঁদের বুকে রয়েছে দাগ, যেই মেঘেতে বর্ষে বাদল সেই মেঘেতেই ঝড়েরি রাগ। মানি আমি, আছে তাহার অনেক রকম অত্যাচারও, তবু সে কেন মোড়ল মোদের ভেবেছ কি কেউ একবারও? খুন করিলে বুক দিয়ে সে আগে দাঁড়ায় খুনীর হয়ে, চোর-ধরিবাজ সবার কুনাম লয় সে আপন মাথায় বয়ে। একটি ভিটেয় চরছে ঘুঘু তাহার নাকি অত্যাচারে। জানি আমি কলম-পেষা। এই নিয়ে আজ দুষছ তারে। হাজার ভিটের চরত ঘুঘু সে না থাকলে মোদের গাঁয়ে, হাজার চালের খসত ছানি তোমাদের ওই কলম ঘায়ে। লাঠি তাহার মারে যদি মাথায় তাহা বইতে পারি। কলম দিয়ে যে মার মারো ব্যথা তাহার বুঝতে নারি। লাঠির আঘাত সারবে জানি দুদিন কিবা ছদিন পরে, কলম দিয়ে কর আঘাত সারবে না সে গেলেও গোরে। জানিনে ওই ছাতার কলম কি দিয়ে বা লও গড়িয়ে, খোদার কলম রদ করেছো ওরই একটা আঁচড় দিয়ে। মাঠে মাঠে জমি মোদের খোদ জমিদার খোদার লেখায়, আলের পরে আল গাঁথিয়া সীমানা তার যায় দেখা যায়। তোমরা লেখ কাগজে আল, সীমানা তার বুঝতে নারি। খোদার দেওয়া খাস মহালের তারি মায়ায় দখল ছাড়ি। সেই কলমের খোরাক দিতে মাঠে মাঠে লাঙল ঠেলি, মাটি খুঁড়ে যে সোনা পাই চরণতলে দেই যে মেলি। তবু তাহার মেটে না ভুখ ইচ্ছে করে দনে- পিষে কলমগুলো দিই জ্বালিয়ে জাহান্নামের আগুন শীষে। আমরা মাঠের মুক্ত শিশু ভয় করি না ঝঞঝা বাদল, জাহান্নামের মতন জ্বালা চৈত্র রোদে বাজাই লাঙল। শুনো মাঠও মন্ত্র শুনে দোলায় তরুণ তৃণের আঁচল, কচি গায়ে পুলক দিতে কাজলী মেঘও হয়রে সজল। বর্ষা বুকে ভাসাই মোরা সবুজ ধানের মাদুরখানি, ছল ছল জলের উপর অন্ন মায়ের আসন টানি। বাঁশীর সুরে শরৎ-চাঁদের কুচি কুচি সোনার হাসি, কাঁচা ধানের পাতায় পাতায় মেলতে পারি রাশি রাশি। মাঠে যে ধান ধরেই নাক, পারি সে ধান ভরতে ডোলে, এটা কেবল জানিনে ওই কলম ধরে সে কোন কলে। ঝড় এসে ঘর উড়িয়ে নিলে ঝড়েই ঘরে দেই যে ছানি, ভয় করিনে বৃষ্টি শীলা- শীরালীদের মন্ত্র জানি। ভয় করিনে হাঙর কুমীর- দেবতা আছেন খোয়াজ খিজির, বনের বাঘে ভয় করিনে গাজী মাদার হাঁকছে জিকির। ভয় শুধু ওই কলমটারে, আঘাত তাহার গায় না লাগে, শেলের মত বক্ষখানির ব্যথার জাগায় ভীষণ দাগে। মেনা শেখের হাতের লাঠি ভাঙতে পারে সবার মাথা, কি দিয়ে ওই গড়ছ কলম, হাজার মারে ভাঙে না তা।
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে, তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে। পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়, সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার। মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি। পরণে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস, সোনালী তার গার বরণের করছে উপহাস। ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি, সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি। বাঁশীর মত সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে, হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে। আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে। ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে, সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে। পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার, বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর। খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে, কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?
জসীম উদ্‌দীন
প্রকৃতিমূলক
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়, গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়; মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি, মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়, তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়, ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া, কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া; ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী পারের খবর টানাটানি করি; বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া; বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া। তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়, গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়। সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া, বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়, বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়! তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে – নরম ঘাসের পাতে চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে। তেলাকুচা – লতা গলায় পরিয়া মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া, হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে, তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে। তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী। মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া তোর সনে দেই মিতালী করিয়া ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি, সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি। তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে, সীম আর সীম – হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে। তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে, খাব আর যত গেঁঢো – চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে, হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে। তুমি যদি যাও – শালুক কুড়ায়ে, খুব – খুব বড় করে, এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে, কারেও দেব না, তুমি যদি চাও আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও, মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে, ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে; সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়, মতলব কিছু আঁটির যাহাতে খুশী তারে করা যায়! লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়, বলিব – কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়। খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে, কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে ডানকিনে মাছ কিলবিল করে; কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে। ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ, কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ। ওরে মুখ – পোড়া ওরে রে বাঁদর। গালি – ভরা মার অমনি আদর, কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ; যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ। যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়। ঘন কালো বন – মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়। গাছের ছায়ায় বনের লতায় মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়! আজি সে – সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়, যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়। তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে। মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে, হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে; অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে, সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।
জসীম উদ্‌দীন
প্রেমমূলক
ফুল নেয়া ভাল নয় মেয়ে। ফুল নিলে ফুল দিতে হয়, – ফুলের মতন প্রাণ দিতে হয়। যারা ফুল নিয়ে যায়, যারা ফুল দিয়ে যায়, তারা ভুল দিয়ে যায়, তারা কুল নিয়ে যায়। তুমি ফুল, মেয়ে! বাতাসে ভাঙিয়া পড় বাতাসের ভরে দলগুলি নড়নড়। ফুলের ভার যে পাহাড় বহিতে নারে দখিনা বাতাস নড়ে উঠে বারে বারে। ফুলের ভারে যে ধরণী দুলিয়া ওঠে, ভোমর পাখার আঘাতে মাটিতে লোটে। সেই ফুল তুমি কেমনে বহিবে তারে, ফুল তো কখনো ফুলেরে বহিতে নারে।
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
কে যাসরে রঙিলা মাঝি! সামের আকাশরে দিয়া; আমার বাজানরে বলিস খবর নাইওরের লাগিয়ারে। অভাগিনীর বুকের নিশ্বাস পালে নাও ভরিয়া, ছয়মাসের পন্থ যাইবা একদন্ডে উড়িয়া; গলুইতে লিখিলাম লেখন সিন্তার সিন্দুর দিয়া, আমার বাপের দেশে দিয়া আইস গিয়ারে। পরবাসে পাঠাইল বাজান যারে সঁইপা দিয়া, সে যে শিশিরের গয়না দিল দূর্বাশীষে নিয়া; কুয়াশার শাড়ী দিল বাতাসে ভরিয়া অঙ্গে না পরিতে তাহা গেল যে উড়িয়ারে। সাগরের ফেনায় পতি বানল বাসর-ঘর, দুস্কের দাগাতে তাহা দাপায় জনমভর; অবলা ভাঁরাইল যে সে কাঞ্চা পিতল দিয়া, এমন ঠকের ঘরে রহি কি করিয়ারে। পরের ছেলের সঙ্গে বাজান আমায় দিল বিয়া, জনমের মত গেল বনবাস দিয়া; একদিনের তরে আইসা না গ্যাল দেখিয়া, এবার জুড়াইব মনের দুস্কু সায়রে ডুবিয়ারে।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
পূর্নিমাদের আবাস ছিল টেপাখোলার গাঁয়, একধারে তার পদ্মনদী কলকলিয়ে যায়। তিনধারেতে উধাও হাওয়া দুলতো মাঠের কোলে, তৃণফুলের গন্ধে কভু পড়তো ঢলে ঢলে। সেখান দিয়ে পুর্ণিমারা ফিরতো খেলে নিতি, বাঁকাপথে বাজতো তাদের মুখর পায়ের গীতি। পদ্মানদীর মাঝিরে কেউ ডাকত ছড়ার সুরে, শিশুমুখের কাকলিতে গ্রামটি যেত ভরে। সেদিন হঠাৎ পত্র এলো বাবার থেকে তার, পূর্ণিমারা কলকাত্তা আসবে শনিবার। গীতা কানু সবাই খুশী, ফিসফিসিয়ে কয়, ট্রামের গাড়ী, মোটর গাড়ী কলিকাতাময়। গড়গড়িয়ে গড়ের মাঠে যখন তখন যাব, ইলেকট্রিকের কল টিপিলে যা চাব তা পাব। হাওড়া পুলের উপর দিয়ে আসব হাওয়া খেয়ে, গঙ্গানদী করব উথল মস্ত জাহাজ বেয়ে। এসব কথায় সবাই খুশী, তবু যাবার দিন ঘনিয়ে যত আসছে, কোথায় বাজছে ব্যথার বীণ। বাবলা বনের যেখানটিতে হত পুতুল বিয়ে, পূর্ণিমা যে ঘুরে বেড়ায় সেইখানটি দিয়ে। শিকের উপর দুলছে আজো খেলার হাঁড়িগুলি, দাঁড়কাকটি বসে আছে সেথায় ঠোকর তুলি। চড়ুইভাতির চুলোগুলি তেমনি আছে পড়ে, এখানটিতে খেলবে না আর আগের মতন করে। পোষা বিড়াল কেন যে তার সঙ্গ নাহি ছাড়ে, যদিও বুকে পিষছে তারে স্নেহের অত্যাচারে। পূর্ণিমারা এসেছে আজ শহর কলিকাতা, অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পেলেম তাদের পাতা। শ্যামবাজারের বামধারেতে অন্ধগলির কোণে, একতলা এক বন্ধ ঘরে থাকে অনেক জনে। জানলা দিয়ে বয় না বাতাস, সারাটি ঘর ভরে, ভ্যাঁপসামত গন্ধে সদাই দম আটকে ধরে। ভাই-বোনেতে কদিন আগে জলবসন্ত হতে ভাল হয়ে উঠেছে আজ এই তো কোনো মতে। চোখ দুটি তার কোটরাগত, ফুলের মত মুখে হাসির প্রদীপ জ্বলে না আর শিশুকালের সুখে। কোথায় তাহার খেলাঘরটি, কোথায় খোলা মাঠ! বাবলাশাখায় বাতাস যেথায় করতো ছড়া পাঠ। বন্ধগলির অন্ধ কোণের কয়েদখানার ঘরে, কোন্ দোষের সে বন্ধ হয় কোন্ অপরাদ করে? কোন দস্যু করল হরণ আলো- বাতাস তার, কে হরিল খেলার পুতুল নাচের নূপুর পার কে হরিল ঝুমঝুমি তার শিশুহাতের থেকে, ঊষার গায়ে কে দিলরে মেঘের কালি মেখে? কোথায় আমার রাজার কুমার! শুয়ে মায়ের কোলে, তোমার কি ঘুম ভাঙবে না এই শিশু-চোখের জলে। শান্ত্রী সিপাই লয়ে এসো সপ্তা-ডিঙা করে, আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠুক জয়ডঙ্কার স্বরে। ভাঙতে হবে বন্ধগলি, রুদ্ধ ঘরের দ্বার- ভাঙতে হবে লক্ষযুগের অন্ধ কারাগার। এমন নগর গড়বে তুমি সকল কোণেই তার, সমান হয়ে উদাস বাতাস বইবে অনিবার। চন্দ্র-রবির সোনার প্রদীপ জ্বলবে সবার ঘরে, সকল ঘরের পূর্ণিমাদের হাসিমুখের তরে। সেই আলো কেউ বন্ধ করে রাখতে যদি চায়, তাহার সাথে যুদ্ধ মোদের সকল দুনিয়ায়!
জসীম উদ্‌দীন
শোকমূলক
খেলা না ভাঙিতে খেলা ছেড়ে গেলি কার ডাক শুনে ভাই, এখনো যে তোর পূবালীর ঠোঁটে রঙ লেখা মুছে নাই! আজো এই মাঠে বাঁশের বাঁশীতে বাজে যে মাঠের গান, কালিন্দী-জল আজো দুলে ওঠে শুনিয়া মেয়ের শাড়ী, মেছো বাঁশী শুনে আজো ঢেউ খেলে কাঁখের কলসে তারি। কারে অভিমান করিয়া বন্ধু! ছেড়ে গেলি আমাদেরে, এই ব্রজধামে আজো আসে নাই মথুরার দূত যে-রে। কাঞ্চা বয়সে কে দিলরে তোরে আঙিয়ার শ্বেতবাস, কোন দরবেশে তোর কানে কানে খুলিল মন্ত্রপাশ। হায় মুসাফির, কে তোরে বাতাল গোরের কুহেলি পথ, সেই একাকিয়া দূরে দেশে তুই ছাড়িলি জীবন-রথ। অভিমানী ছেলে, কার চেয়েছিলি? কারে তুই পাস নাই? কোন নিদাঘের নিঃশ্বাসে তোর ফুল শুকাইল ভাই? ওরে বুলবুল, যারে শুনাইতে বেঁধেছিলি তুই গান, সে ফুল-বনের কাঁটা দিয়ে কেউ বিঁধেছিল তোর প্রাণ/ তাই ছেড়ে গেলি-হায় পলাতক! শূণ্য পথের বাঁকে, তোর গাঁথা গান আমাদের বুকে উভরিয়া আজ ডাকে। আমাদের খেলা জমে না যে ভাই! তোর সে আদর ছাড়া, আজি মনে হয়, কেউ নাহি জানে হেন মমতার ধারা। একদিন মোরা ভুলে যাব তোরে, এ মায়ার দেশপরে, কেউ কারো স্মৃতি চিরদিন ভরি রাখিতে পারে না ধরে। তোর দেশে ভাই! হয়ত এমন মায়ার কুহক নাহি, জীবনের গাঙে ঘটনার তরী যায় না এমন বাহি। সেই দেশে তাই লিখে রাখিলাম আমাদের দিনগুলি, এই খেলা-মাঠ, এই হাসি গান, যেন যাসনাক ভুলি। রোজ কেয়ামতে যাদি দেখা হয়, বিস্ময়ে তব বুকে হেরিব মোদের সকল কাহিনী স্পষ্ট রেখেছ টুকে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(আট)বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি, কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্ , লোক হয়েছে ভারি | গোয়াল-ঘরে ঝেড়ে পুছে বিছান দিল পাতি ; বসল গাঁয়ের মোল্লা মোড়ল গল্প-গানে মাতি | কেতাব পড়ার উঠল তুফান ; ---চম্পা কালু গাজী, মামুদ হানিফ সোনবান ও জয়গুন বিবি আজি ; সবাই মিলে ফিরছে যেন হাত ধরাধর করি | কেতাব পড়ার সুরে সুরে চরণ ধরি ধরি | পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোড়ল নাচিয়ে ঘন দাড়ি, পড়ে কেতাব গাঁয়ের মোল্লা মাঠ-ফাটা ডাক ছাড়ি |কৌতুহলী গাঁয়ের লোকে শুনছে পেতে কান, জুমজুমেরি পানি যেন করছে তারা পান! দেখছে কখন মনের সুখে মামুদ হানিফ যায়, লাল ঘোড়া তার উড়ছে যেন লাল পাখিটির প্রায় | কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ, মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ ! স্বপ্ন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে ; মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে ; আকাশেরি চাঁদ সূরুজে মুখ দেখে পায় লাজ, সেই কনেরে চোখের কাছে দেখছে চাষী আজ | দেখছে চোখে কারবালাতে ইমাম হোসেন মরে, রক্ত যাহার জমছে আজো সন্ধ্যা মেঘের গোরে ; কারবালারি ময়দানে সে ব্যথার উপাখ্যান ; সারা গাঁয়ের চোখের জলে করিয়া গেল সান |উঠান পরে হল্লা-করে পাড়ার ছেলে মেয়ে, রঙিন বসন উড়ছে তাদের নধর তনু ছেয়ে | কানা-ঘুষা করত যারা রূপার স্বভাব নিয়ে, ঘোর কলিকাল দেখে যাদের কানত সদা হিয়ে ; তারাই এখন বিয়ের কাজে ফিরছে সবার আগে, ভাভা গড়ার সকল কাজেই তাদের সমান লাগে | বউ-ঝিরা সব রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সকল ক্ষণ ; সারা বাড়ি আনন্দ আজ খুশী সবার মন | বাহিরে আজ এই যে আমোদ দেখছে জনে জনে ; ইহার চেয়ে দ্বিগুণ আমোদ উঠছে রূপার মনে | ফুল পাগড়ী মাথায় তাহার 'জোড়া জামা' গায়, তেল-কুচ্-কাচ্ কালো রঙে ঝলক্ দিয়ে যায় |বউ-ঝিরা সব ঘরের বেড়ার খানিক করে ফাঁক, নতুন দুলার রূপ দেখি আজ চক্ষে মারে তাক | এমন সময় শোর উঠিল--- 'বিয়ের যোগাড় কর, জলদী করে দুলার মুখে পান শরবত ধর |' সাজুর মামা খটকা লাগায়, 'বিয়ের কিছু গৌণ, সাদার পাতা আনেনি তাই বেজার সবার মন |' রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি ; সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আনল তাড়াতাড়ি | কনের খালু উঠিয়া বলে 'সিঁদুর হল ঊনা!' রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা!কনের চাচার মন উঠে না, 'খাটো হয়েছে শাড়ী |' রূপার চাচা দিল তখন 'ইংরাজী বোল ছাড়ি'| 'কিরে বেটা বকিস নাকি?' কনের চাচা হাঁকে, জালির কলার পাতার মত গা কাঁপে তার রাগে | 'কোথায় গেলি ছদন চাচা, ছমির শেখের নাতি, দেখিয়ে দেই দুলার চাচার কতই বুকের ছাতি! বেরো বেটা নওশা নিয়ে, দিব না আজ বিয়া ;' বলতে যেন আগুন ছোটে চোখ দুটি তার দিয়া |বরপক্ষের লোকগুলি সব আর যে বরের চাচা, পালিয়ে যেতে খুঁজছে যেন রশুই ঘরের মাচা |মোড়ল এসে কনের চাচায় অনেক করে বলে, থামিয়ে তারে বিয়ের কথা পাতেন কুতূহলে | কনের চাচা বসল বরের চাচার কাছে, কে বলে ঝড় এদের মাঝে হয়েছে যে পাছে! মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল ডাকি, বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি!তার মাঝেতে এমন তেমন হয়নি কিছু গোল, কেবল একটি বিষয় নিয়ে উঠল হাসির রোল | এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে ; সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে ; রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর, হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড় | ভাবল রূপাই---অমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে, দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে |
জসীম উদ্‌দীন
ভক্তিমূলক
নদীর কূল নাই-কিনার নাইরে; আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাব কাহারে শুধাইরে? ওপারে মেঘের ঘটা, কনক বিজলী ছটা, মাঝে নদী বহে সাঁই সাঁইরে; আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাইরে; আমি দেখিতে দেখিতে সে রূপ আবার দেখি নাইরে। বেসম নদীর পানি, ঢেউ করে হানাহানি, ভাঙা এ তরনী তবু বাইরে, আমার অকূলের কূল দয়াল বন্ধুর যদি দেখা পাইরে।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
(চার)চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে, এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামল না গাঁর বাটে | ডোলের বেছন ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে, লাঙল জোয়াল ধূলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে | কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাট আগুন লয়ে খেলে, বাউকুড়াণী উড়ছে তারি ঘূর্ণী ধূলী মেলে | মাঠখানি আজ শূণ্য খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে, জন্-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে : শুকনো চেলা কাঠের মত শুকনো মাঠের ঢেলা, আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা | দরগা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নি আসে ভারে : নৈলা গানের ঝঙ্কারে গাঁও কানছে বারে বারে | তবুও গাঁয়ে নামল না জল, গগনখানা ফাঁকা ; নিঠুর নীলের বক্ষে আগুন করছে যেনে খাঁ খাঁ |উচ্চে ডাকে বাজপক্ষি 'আজরাইলে'র ডাক, 'খর দরজাল' আসছে বুঝি শিঙায় দিয়ে হাঁক! এমন সময় ওই গাঁ হতে বদনা-বিয়ের গানে, গুটি কয়েক আসলো মেয়ে এই না গাঁয়ের পানে | আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে---পাঁচটি রঙে ফুল, মাঝের মেয়ে সোনার বরণ, নাই কোথা তার তুল | মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল, তেল হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল | মেয়ের দলে বেড়িয়ে তারে চিকন সুরের গানে, গাঁয়ের পথে যায় যে বলে বদনা-বিয়ের মানে | ছেলের দলে পড়ল সাড়া, বউরা মিঠে হাসে, বদনা বিয়ের গান শুনিতে সবাই ছুটে আসে | পাঁচটি মেয়ের মাঝের মেয়ে লাজে যে যায় মরি, বদনা হাতে ছলাৎ ছলাৎ জল যেতে চায় পড়ি | এ-বাড়ি যায় ও-বাড়ি যায়, গানে মুখর গাঁ, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন-রাম-শালিকের ছা |কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো, ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো! কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই, আরও ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই!কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া, তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া! আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি, নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি | কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়, আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়!দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো | দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো | ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল ; দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড় | ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল ; দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো |বারো মেঘের নামে নামে এমনি ডাকি ডাকি, বাড়ি বাড়ি চলল তারা মাঙন হাঁকি হাঁকি কেউবা দিল এক পোয়া চাল, কেউবা ছটাকখানি, কেউ দিল নুন, কেউ দিল ডাল, কেউ বা দিল আনি | এমনি ভাবে সবার ঘরে মাঙন করি সারা, রূপাই মিয়ার রুশাই-ঘরের সামনে এল তারা | রূপাই ছিল ঘর বাঁধিতে, পিছন ফিরে চায়, পাঁটি মেয়ের রূপ বুঝি ওই একটি মেয়ের গায়! পাঁচটি মেয়ে, গান যে গায়, গানের মতই লাগে, একটি মেয়ের সুর ত নয় ও বাঁশী বাজায় আগে | ওই মেয়েটির গঠন-গাঠন চলন-চালন ভালো, পাঁচটি মেয়ের রূপ হয়েছে ওরই রূপে আলো |রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান, রূপাই বলে, 'এই দিলে মা থাকবে না আর মান |' ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল, সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল | মাঙন সেরে মেয়ের দল চলল এখন বাড়ি, মাঝের মেয়ের মাথার ঝোলা লাগছে যেন ভারি | বোঝার ভারে চলতে নারে, পিছন ফিরে চায় ; রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়!
জসীম উদ্‌দীন
স্বদেশমূলক
পুতুল, তুমি পুতুল ওগো ! কাদের খেলা-ঘরের ছোট খুকু, কাদের ঘরের ময়না পাখি ! সোহাগ-করা কাদের আদরটুকু। কার আঁচলের মানিক তুমি। কার চোখেতে কাজললতা হয়ে, এসেছ এই সোনার দেশে রামধনুকের রঙের হাসি লয়ে। ভোর বেলাকার শিশির তুমি, কে রেখেছে শিউলী ফুলের পরে, খোকা-ভোরের হাসিখানি কে রেকেছে পদ্মপাতায় ধরে। পুতুল! তুমি মাটির পুতুল! নানাজনের স্নেহের অত্যাচার, হাসিমুখে সইতে পার আপন পরের তাই ধার না ধার। তাই ত তুমি পুতুল লয়ে সারাটা দিন খেলাও খেলাঘরে, তুমি পুতুল, তাই ত পুতুল খেলার সাথী তোমার স্নেহের বরে। পুতুল! আমার সোনার পুতুল! আমি পুতুল হব তোমার বরে, তুমি হবে আমার পুতুল সারাটা দিন কাটবে আদর করে। তোমায় আমি চাঁদ বলিব, জোছনা দিয়ে মুছিয়ে দিও মুখ, তোমায় আমি বলব মানিক, মালা হয়ে জুড়িয়ে দিও বুক। তুমি আমার উদয়-তারা, হাতে পায়ে জ্বলবে সোনার ফুল, তুমি আমার রূপের সাগর রূপকথা যার খুঁজে না পায় কূল। আমি তোমার কি হব ভাই? পুতুল! আমার রাঙা পুতুল-খুকু, ঘুমপাড়ানী মাসী-পিসীর ঘুমের দেশের ঘুমানীটুকু।
জসীম উদ্‌দীন
মানবতাবাদী
ওধারের বেডে আসিল বালক, মটরের ধাক্কায়, ক্ষতবিক্ষত, রক্তমাখান কচি তার দেহটায়। চিৎকার করি কাঁদিত কেবল, আম্মাগো কোথা গেলে, একেলা যে আমি থাকিতে পারি না তোমারে কাছে না পেলে? কাঁচা মুখখানি মমতা জড়ানো, জননী স্নেহের ভরে, যে-চুমায় তারে জাগায়েছে ভোরে আছে তা অধর ভরে। ঘায়েতে তাহার ওষুধ মাখাতে, চীৎকারি কেঁদে ওঠে, মায়ের আগেতে নালিশ জানায়, বোঝে না কিছুই মোটে। আম্মাগো, তুই কোথা গেলি আজ, ওরা যে আমারে মারে, ক্ষতবিক্ষত অঙ্গে আমার ব্যথা দেয় বারে বারে। আমি বাড়ি যাব- আমি বাড়ি যাব, তোরে শুধু কাছে পেলে, সব যন্ত্রণা জুড়াইবে মাগো তোর বুকে বুকে মেলে। সারাদিন ভরি কতই সে কাঁদে, বড় ভাই তার আসে, অশ্রুসিক্ত নয়নে বসিয়া রহে বিছানার পাশে। ডাকিয়া সেদিন বলিলাম তারে, মায়েরে সঙ্গে করে, আনেন না কেন? সারাদিন খোকা কাঁদে যে তাহার তরে। ম্লান হাসি হেসে কহিল ভাইটি, আমরা যে খানদান, আমাদের মেয়ে হেথায় আসিলে ভীষণ অসম্মান। রাতের বেলায় সকল বেডের রোগীরা ঘুমায়ে পড়ে, খোকাটি কেবল চীৎকারি কাঁদে মায়েরে তাহার স্মরে। প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো কাছে আয়, এত ডাক ডাকি তবু না আসিস আমার যে জান যায়। প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো, মোর ঘুড়ি, পূবের ঘরেতে রেখে দিস যেন কেউ নাহি করে চুরি। মারবল আর পেন্সিল দুটো, কখানা টুকরো কাঁচ, সাবধানে তুই রাখিস যেন না কেউ পায় তার আঁচ। প্রহরের পর প্রহর চলেছে, আম্মাগো, কাছে আয়, কে যেন আমারে ধরিতে আসিছে ভীষণ চেহারা হায়, আম্মাগো কারা আমারে মারিছে। প্রহর চলেছে বেয়ে, কাঁদিছে উতল রাতের পবন বড় যেন ব্যথা পেয়ে। আমি দেখিতেছি বেঘুম শয়নে, সুদূর হেরেম কোণে, জাগিছে জননী, নিশির প্রদীপ জাগিছে তাহার সনে। জাগিছে জননী, রাত-জাগা পাখি, রহিয়া রহিয়া জাগে, রাত কুসুমের উদাস গন্ধ চিরিতেছে বুকটাকে। জাগিছে জননী, দুই হাতে যদি পারিত ছিড়িয়া দিতে, ছেলে হতে তার কোন ব্যবধান রাখিত না ধরনীতে। পরদা প্রথার যে মিথ্যা আজি দুলালের তার হায়, এমনি করিয়া করেছে পৃথক ভাঙিত সে আজি তায়। আহারে মায়ের দীরঘ নিশাস কোথায় নাহিক লাগে, ঘুরিয়া ঘুরিয়া আপনারি বুকে আরও ব্যথা হয়ে দাগে। ধীরে ধীরে দীপ নিবিয়া আসিল ম্লান হয়ে এল আলো, নিবিড় নীরব নিথর পাথারে জড়ালো রাতের কালো। সব অভিযোগ ব্যথাতুর সেই বালকের মুখ হতে, ধীরে ধীরে ধীরে ভেসে গেল কোন মহানীরবতা স্রোতে। কোথা সেই স্বর থামিল যাইয়া, বহু বহুযুগ আগে- যারা মরিয়াছে কঠিন পীড়নে সমাজনীতির দাগে; যারা সহিয়াছে সহস্র ব্যথা ভাষাহীন বেদনায়, মূক বালকের বেদনা মিলিল সে মহা নীরবতায়।
জসীম উদ্‌দীন
কাহিনীকাব্য
দুখের সায়রে সাঁতারিয়া আজ সকিনার তরীখানি, ভিড়েছে যেখানে, সেতা নাই কূল, শুধুই অগাধ পানি। গরীবের ঘরে জন্ম তাহার, বয়স বাড়িতে হায়, কিছু বাড়িল না, একরাশ রূপ জড়াইল শুধু গায়। সেই রূপই তার শত্রু হইল, পন্যের মত তারে, বিয়ে দিল বাপ দুই মুঠি ভরি টাকা আধুলির ভারে! খসম তাহার দাগী-চোর, রাতে রহিত না ঘরে, হেথায় হোথায় ঘুরিয়া ফিরিত সিদকাঠি হাতে করে। সারাটি দিবস পড়িয়া ঘুমাত, সকিনার সনে তার, দেখা যে হইত ক্ষনেকের তরে, মাসে দুই একবার। সেই কোন তার কল্পিত এক এপরাধ ভেবে মনে, মারিবার যবে হত প্রয়োজন অতীব ক্রোধের সনে। এমন স্বামীর বন্ধন ছাড়ি বহু হাত ঘুরি ফিরি, দুঃখের জাল মেলে সে চলিল জীবনের নদী ঘিরি। সে সব কাহিনী বড় নিদারুন, মোড়লের দরবার, উকিলের বাড়ি, থানার হাজত, রাজার কাছারী আর; ঘন পাট ক্ষেত, দূর বেত ঝাড়, গহন বনের ছায়, সাপের খোড়লে, বাঘের গুহায় কাটাতে হয়েছে তায়; দিনেরে লুকায়ে, রাতেরে লুকায়ে সে সব কাহিনী তার, লিখে সে এসেছে, কেউ কোন দিন জানিবে না সমাচার। সে কেচ্ছা কোন কবি গাহিবে না কোন দেশে কোন কালে, সকিনারি শুদা সারাটি জনম দহিবে যে জঞ্জালে। এত যে আঘাত, এত অপমান, এত লাঞ্ছনা তার, সবই তার মনে, এতটুকু দাগ লাগে নাই দেহে তার। দেহ যে তার পদ্মের পাতা, ঘটনার জল-দল, গড়ায়ে পড়িতে রূপেরে করেছে আরো সে সমুজ্জল। সে রূপ যাদের টানিয়া আনিল তারা দুই হাত দিয়ে, জগতের যত জঞ্জাল আনিল জড়াইল তারে নিয়ে। কেউ দিল তারে বিষের ভান্ড, কেউ বা প্রবঞ্চনা, কেউ দিল ঘৃণা, কলঙ্ক কালি এনে দিল কোন জনা। সে রূপের মোহে পতঙ্গ হয়ে যাহারা ভিড়িল হায়, তারা পুড়িল না অমর করিয়া বিষে বিষাইল তায়। তাদেরি সঙ্গে আসিল যুবক, তরুণ সে জমিদার, হাসিখুশী মুখ, সৌম্য মুরতি দেশ-জোড়া খ্যাতি তার। সে আসি বলিল, সব গ্লানি হতে তোমারে মুক্ত করি, মোর গৃহে নিয়ে রাণীর বেশেতে সাজাইব এই পরী। করিলও তাই, যে জাল পাতিয়া রূপ-পিয়াসীর দল, রেখেছিল তারে বন্দী করিয়া রচিয়া নানান ছল; সে সব হইতে টানিয়া তাহারে নিয়ে এলো করি বার, গত জীবনের মুছিয়া ঘটনা জীবন হইতে তার! মেঘ-মুক্ত সে আকাশের মত দাঁড়াল যখন এসে, রূপ যেন তারে করিতেছে স্তব সারাটি অঙ্গে ভেসে।
জসীম উদ্‌দীন
গীতিগাথা
ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর, কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর। সূক্ষ্ম হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি, কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিল পরিপাটি। রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কত কাল হতে, ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে। তারপর এলো নিপুণ পটুয়া, সূক্ষ্ম তুলির ঘায়, স্বর্গ হতে কত দেবদেবী আনিয়া রথের গায়। রঙের রেখার মায়ায় বাঁধিয়া চির জনমের তরে, মহা সান্ত্বনা গড়িয়া রেখেছে ভঙ্গুর ধরা পরে। কৃষ্ণ চলেছে মথুরার পথে, গোপীরা রথের তলে, পড়িয়া কহিছে, যেওনা বন্ধু মোদের ছাড়িয়া চলে। অভাগিনী রাধা, আহা তার ব্যথা যুগ যুগ পার হয়ে, অঝোরে ঝরিছে গ্রাম্য পোটোর কয়েকটি রেখা লয়ে। সীতারে হরিয়া নেছে দশানন, নারীর নির্যাতন সারা দেশ ভরি হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বালায়েছে হুতাশন। রাম-লক্ষ্মণ সুগ্রীব আর নর বানরের দল, দশমুন্ড সে রাবণে বধিয়া বহালো লহুর ঢল। বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী কাঁদে, এ অপমানের দাদ, লইবারে সাজে দেশে দেশে বীর করিয়া ভীষণ নাদ। কত বীর দিল আত্ম-আহুতী, ভগ্ন শঙ্খ শাঁখা। বোঝায় বোঝায় পড়িয়া কত যে নারীর বিলাপ মাথা। শ্মশান ঘাটা যে রহিয়া রহিয়া মায়েদের ক্রদনে, শিখায় শিখায় জ্বলিছে নির্বিছে নব নব ইন্ধনে। একদল মরে, আর দল পড়ে ঝাপায়ে শক্র মাঝে, আকাশ ধরণী সাজিল সে-দিন রক্তাশ্বর সাজে। তারপর সেই দুর্যধনের সবংশ নিধনিয়া, ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত যে হলো সারা দেশ নিয়া। এই ছবিগুলি রথের কাঠের লিলায়িত রেখা হতে, কালে কালে তাহা রুপায়িত হতো জীবন দানের ব্রতে। নারীরা জানিত, এমনি ছেলেরা সাজিবে যুদ্ধ সাজে, নারী-নির্যাতন-কারীদের মহানিধনের কাজে। বছরে দু-বার বসিত হেথায় রথ-যাত্রার মেলা, কত যে দোকান পসারী আসিত কত সার্কাস খেলা। কোথাও গাজীর গানের আসরে খোলের মধুর সুরে। কত যে বাদশা বাদশাজাদীরা হেথায় যাইত ঘুরে। শ্রোতাদের মনে জাগায়ে তুলিত কত মহিমার কথা, কত আদর্শ নীতির ন্যায়ের গাঁথিয়া সুরের লতা। পুতুলের মত ছেলেরা মেয়েরা পুতুল লইয়া হাতে। খুশীর কুসুম ছড়ায়ে চলিত বাপ ভাইদের সাথে। কোন যাদুকর গড়েছিল রথ তুচ্ছ কি কাঠ নিয়া, কি মায়া তাহাতে মেখে দিয়েছিল নিজ হৃদি নিঙাড়িয়া। তাহারি মায়ায় বছর বছর কোটী কোটী লোক আসি, রথের সামনে দোলায়ে যাইত প্রীতির প্রদীপ হাসি। পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ, এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ। শিল্পী হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে, একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
খানিকটা পাথর দাও আর একটু বুক-খোলা মাঠ হে কলকাতা, হে আমার রুগ্ন জীর্ণ মুহ্যমান শিল্পের সম্রাট রক্তে নাচে ছেণী বাতাসে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে যুবতীর বেপরোয়া বেশী কিংবা কারো কালো চুলে অকষ্মাৎ কালবৈশাখী একটু পাথর পেলে আঁকি মেঘ কিংবা ঝড় পাড়াগাঁর অন্ধকারে রোদে জলে হিম রাতে স্থির আলো জ্বালে ধুলোর সংসারে বসে যে সকল নিঃসম্বল পার্বতী ও পরমেশ্বর কিংবা গাছ, গাছই ভালো, গাছের অরণ্যমুখী হাঁটা আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘকায়, দৃপ্ত পদক্ষেপ, রোদমাখা ঋষি ফুলের মশাল হাতে, বাকলে ফাটল, গায়ে কাঁটা অথবা গাছের মতো কিছু সুর্যের নিকটবর্তী, নক্ষত্রলোকের চেয়ে যৎসামান্য নীচু মানুষ বা মানুষের বুকের নদীর মহোৎসব ভালোবাসা ফুটে আছে, হাড় মাংসে আলোড়িত টব অথবা জীবন, এই জীবনের নিশ্বাস-প্রশ্বাস রক্ত স্বেদ ক্ষুধা, তৃষ্ণা, খেদ সাহস, সংগ্রাম, অট্রহাসি, আর্তনাদ, গান অনেক আগুনে পুড়ে তবুও বজ্রের ভঙ্গী যার অঙ্গ নয়, শুধু অঙ্গ নয় আমার ছেণীতে নাচে চৈতন্যের প্রতি অঙ্গীকার। একটু পাথর দাও হে কলকাতা রক্তে আকুলতা বাতাসে উড়িয়ে দিই যুবতীর আঁচলের মতো কোনো প্রিয় সত্য কথা।
পূর্ণেন্দু পত্রী
ভক্তিমূলক
আমাকে একটু আলোক দাও: রোদ মাতাল ভোর একটু দাও মুক্ত হাওয়া রুদ্ধশ্বাস এ বুকে, আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে শক্তিমান তোমাকে দিই কখানা ভাঙা পাঁজরে যত জ্বালা। আমাকে একটু বর্ষা দাও: দুমুঠো কাটি ধান একটু দাও ফাল্গুনে রোদ আঁধার ঘোর ঘরে আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে মহাব্রতী তোমাকে দিই কোটরাগত দুচোখে যত দাহ। আমাকে একটু শক্তি দাও: শারের মতো ঋজু একটু দাও সুখের ছোঁয়া খসা মনে আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে মহাপ্রাণ তোমাকে দিই ঘৃণার ক্ষতে রক্তজবার ঝাড়। আমাকে একটু শান্তি দাও: ফুলের মতো স্বাদ একটু দাও অবসরের উদয়মুখী আশা। আমি কী দেব, কি দিতে পারি তোমাকে জ্যোতির্ময় তোমাকে দিই আকাশ মাটি কাঁপানো কন্ঠস্বর।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
দরজা ভেঙে দেয়াল ভেঙে ভেঙে ঘর করেছি খালি। এখন শুধু অপেক্ষমান মেঘ শোনাবে মন্দ্রিত গান ঝড়ের করতালি। মনের মধ্যে অসংখ্য ঝোপ-ঝাড় নরুন, ছুঁরি, কাঁচি কুড়োল কাটে গাছের গুড়ি ফুল শুকিয়ে পাথর নুড়ি তার ভিতরেই বাঁচি। দরজা ভেঙে, দেয়াল ভেঙে ভেঙে ঘর করেছি খালি। এখন শুধু ঝড়ের হাসি উড়বে আবর্জনারাশি নোংরা ধুলোবালি। মেঘের ঝুঁটি ঝড়ের কালো জটায় দেখবো কেমন ওলটপালট ঘটায়।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রকৃতিমূলক
কার ডাকে জেগে উঠে মেঘের গলায় গাঢ় মালকোষ শুনে আবার ঘুমিয়ে গেছে এই নদীজল। অথচ নদীর পাড়ে অবিরল চড়-ইভাতির পেয়ালার পিরীচের ফ্রাই-প্যান কাঁটা-চামচের মাছের মাংসের স্যালাডের মাছ ও মাংসের মতো উত্তেজক জানালের ভিডিও টেপের জিনস মিডি হাইহল মাসকারার গ্লো-গ্লীটারের হাই-ফাই জমাট সিম্ফনী। দেশে দেশে দিকপাল ক্ষমতালোভীর মতো প্রতিযোগিতায় দাঁতালো কামড় ছুঁড়ে সারা বেলা পরস্পর যুদ্ধে নাজেহাল হাড়গিলে কুকুরের ঝাঁক। খাক বা না খাক চিকেনের মিহি হাড়ে পেয়ে গেছে অবিকল পাটলিপুত্রের সোনার যুগের স্বাদু ঘ্রাণ। তাজা বিরিয়ানী থেকে যেন কিছু জাফরান খুঁটে নেবে বলে গাছের নরম ডালে নেমে আসে কাঙাল দুপুর। আহ্নিক গতিতে সূর্য বাঁকে। সূর্য যত বাঁকে তত মানুষের ছায়া দীর্ঘ হয় কোনো কোনো মানুষের ছায়া ফুলে-ফেঁপে ক্রমে পাহাড়-পর্বত কোনো কোনো মানুষের ছায়া বহু গোল চৌকো নক্‌শার উল্লাসে বাগদাদের উড়ন্ত কার্পেট। কার ডাকে জেগে উঠে মেঘের গলায় গাঢ় মালকোষ শুনে অষ্টাদশ শতকের মতো ঘুমে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ছে এই নদীজল।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। শোনো। পাহাড়টা, আগেই বলেছি ভালোবেসেছিল মেঘকে আর মেঘ কী ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা সে তো আগেই শুনেছো। সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন। পাহাড় মেঘেকে বললে আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে। মেঘ পাহাড়কে বললে আজ তোমাকে স্মান করিয়ে দেবো চন্দন জলে। ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ। সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনেরআগুনে পাহাড় ছিল মেঘের ঢেউ-জলে। হঠাৎ, আকাশ জুড়ে বেজে উঠল ঝড়ের জগঝম্প ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাইয়ের ভঙ্গিতে ছুটে এল এক ঝাঁক হাওয়া মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে ওঠ্ ছুড়ি! তোর বিয়ে। এখনো শেষ হয়নি গল্পটা। বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিনই ভুলতে পারল না। বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতো পারো পাহাড়টার হাড় পাঁজর, ভিতরে থৈ থৈ করছে শত ঝর্ণার জল।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
আয়নার পাশে একটু অন্ধকার ছায়া এঁকে দাও। ব্যথিত দৃশ্যের পট জুড়ে থাক চিত্রিক আঁধার। দেয়ালের ছবিটাকে একটু সরাতে হবে ভাই। ওটা নয়, এই ছবিটাকে। জুলিয়েট জ্যেৎস্নার ভিতরে রক্তে উচ্চকিত তৃষ্ণা রোমিওর উষ্ণ ওষ্ঠাধরে। ব্যাস, ব্যাস। লাইটস্ বার্ণিং। মাধবী, আসুন। একটা ক্লোজআপ নেব। এখানে দাঁড়ান, একটু বা দিক ঘেষে প্লীজ। মনিটার… মাধবী বলুন- কিছু লাভ আছে মনে রেখে? না। অত স্পষ্ট নয়। আরেকটু নির্জন স্বরে নিজের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন। যেন মনে হয় ওষ্ঠ হতে উচ্চারিত কয়েকটি শীতল বাক্য নয়। মনে হবে সন্ধ্যাবেলা সারা ধরাতলে অবসন্ন কুসুমের ঝরিতেছে বনবীথিতলে নীরব রোদনে। মনে হবে নীরব বোদনে যেন আপনি বলতে চান মনে রেখো, মনে রেখা সখা, যেন কেহ কোনোদিন মনে রাখে নাই মনে আর রাখিবে না। জ্যেৎস্নার ভিতরে কোথাও আহ্বান নেই আর, উষ্ণ ওষ্ঠাধর দুটি গোলাপের মহিমায় ফুটে এখন অপেক্ষমান কবে পাখি বলে যাবে, রাত্রি হলো অবসান বনবীথিতলে। দৃষ্টি আরও নত হবে সম্মূখে কোথাও কোনো দেখিবার মতো দৃশ্য নাই। নিবন্ত ধূপের সাদা ছাই রজনী পোয়ানো কিছু মৃত গোলাপের দীর্ঘশ্বাস হাঁ-করা নেকড়ের মুখে দগ্ধ সিগারেট এইটুকু দৃশ্যে শুধু পড়ে আছে কাঠের টেবিলে। লাইটস্ বার্ণিং। মাধবী, মেক-আপ্, আলো, এবার টেকিং মাধবী, নিশ্চয় মনে আছে সংক্ষিপ্ত সংলাপটুকু কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
কলকাতা শহরে মাত্র একটি দুটি তিনটি মানুষ এখনো যুবক হয়ে আছে স্বেচ্ছাচারে। ফুটবলের মতো তারা কারো পায়ে থাকে না কখনো। ক্রিকেট ব্যাটের মতো ঘূর্ণি বলে যৌবনের জৌলুস হাঁকায়। একেকটি শীত আসে একেকটি যুবক খসে পড়ে। উল্কাবৃন্তচ্যুত তারা আকাশের কিনারা হারিয়ে সরপুটি, চাঁদা পুটি, অল্প জলে অতিকায় খেলা। হে গভীর! এখানে এসো না। কলকাতার ক্ষণপ্রভ ভিড়ে এলে তুমিও হারাবে আতরদানের শিশি, চশমা ও উষ্ণীষ। তৃণীর মরচেয় গুড়ো হবে। কিংবা এসো, এসে দেখে যাও করাতকলের পাশে একটি দুটি তিনটি যুবকের অগ্নিসাক্ষী রাখা অহঙ্কার।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে। মাথায় আঁটা বটের পাতার মুকুট, খোলামকুচি ধুলোর তেপান্তরে ছুটছে তার পক্ষীরাজ ছুটুক। রাজার ছেলে ময়লা পেন্টুলুন তল্‌তাবাঁশের কঞ্চি ধনুর্গুণ ধুলোয় তার বিপুল রাজ্যপাট বুকের মধ্যে রাজকুমারীর খাট। কাজল চোখে বিস্ময়ের ঘোর আকাশে আঁকা মনের ঘর-দোর। পালক পড়ে পিছন পানে পলক পিছন পানে যেই কত সকাল সাঁঝের দেখি বর্ণ গেছে হিমে ভিজে বর্ণমালা নেই। তখন ছিল পিদিম জ্বালা ঘর বয়স ছিল সোহাগে তৎপর। বয়সে ছিল মৌমাছিদের ক্ষুধা মুড়ির সঙ্গে গুড় মিশলেই সুধা। চোখের সঙ্গে চোখ মিললেই ঝড়। প্রতিদিনই পালকী-চাপা বর। তখন ছিল নিত্য খোঁজাখু্বঁজি আকাশ-পাতাল সিন্দুকের চাবি কড়ির বয়েম। কেবল ভাবাভাবি ভীষণ কিছু হারিয়ে যাচ্ছে বুঝি। গাছ খুঁজতে ফুলের থোকা থোকা ফুল খুঁজতে গিয়ে বিষম বোকা ফুলের মতো ফুটল কবে ঐ কাল যে ছিল এক সাঁতারের সই। হরিণ কবে চাউনি দিল ওকে? ঘুমিয়ে পড়ি হরিণ-হারা শোকে? জলে সাঁতার জলে শালুক জলের মধ্যে গুলি-সুতোয় গোপন টেলিফোন। এখন শুধু ডাঙায় হাঁটা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে জ্বলের নিকেতন। স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে। হারিয়েছিলাম ঈশানকোণী ঝড়ে বিদ্যুতের বিপুল টর্চ জেলে পৌঁছে দিয়ে গেছে আকাশ ঘরে। তখন ছিল হারিয়ে যাওয়ার সুখ হারিয়ে গিয়ে বনের মধ্যে বন পাতায় পাতা। দিগন্তে উৎসুক দিন দুবেলার সবুজ নিমন্ত্রণ। নরম মাটি, শক্ত গাছের ঘাড়ে কাঠের বেঞ্চে, বাজবরণের ঝাড়ে খোদাই করে লিখেছিলাম নাম । সরলতার ছুরিতে ক্ষুরধার। চোখের ভাঁজে ভালো মানুষ ভান রক্তে নাচে রঙীন অত্যাচার। খাতার পাতা আকাশে ঘুড়ি খাতার পাতা হালকা জলে নৌকা হয়ে নাচে দুপুর রোদে গা ডুবিয়ে খাতার পাতা পৌঁছে দেওয়া ঝড়-বাদলের কাছে। তখন ছিল নানান না-এর বেড়া দেউড়ি-দালান নিষেধ দিয়ে ঘেরা। না যেখানে সেইখানেতেই ঘাঁটি পাঁচিল ভেঙে সরল হাঁটাহাঁটি। আঁচল দিয়ে আড়াল যত কিছু চোখের চলা কেবল তারই পিছু। ছুঁতে গিয়ে সরলো যদি কেউ সাপের ফণা অভিমানের ঢেউ। অভিমানের সকল জাগা জুড়ে ক্রমশ বাড়ে একলা হতে থাকা সন্ন্যাসীর রাগের রোদে পুড়ে সরল তৃণ খড়্গসম ক্রোধ একলা হওয়ার দুঃখজনক বোধ। একলা গাছে একলা পাখি ডাকে। একলা গাছে একলা ফোটায় ফুল ছায়ার মধ্যে ছড়িয়ে এলোচুল একলা এক রুপসী শুয়ে থাকে বাগানজুড়ে, বসতবাটি, ভুঁই। তাকে পেলেই একলা আমি দুই। হারিকেনের আলোয় কাঁপে সজনে পাতায় শিরশিরোনো একলা হিমের রাত পদ্য লেখার পাতায় কেবল জ্যেৎস্না হয়ে ফুটতে থাকে সকল অসাক্ষাৎ। স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে। কাঁসর-ঘন্টা বিপুল ঐকতান হ্যাজাক-জালা চাতালে চত্বরে রাসমঞ্চ, গাজন, পালাগান। গানের মধ্যে গর্জে ওঠে মন ভাঙতে হবে শিকল ঝনাৎঝন খুলতে হবে গুপ্তধনের তালা। বুকের মধ্যে ব্যখার ডালপালা হাঁকিয়ে তোলে ঝাঁকড়া চুলের ঝড়। ভিক্ষা নয়, ঘোষণা অতঃপর। কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি মুঠো ভালোবাসার সামান্য খড়কুটো। কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি ক্ষুধা স্পর্শ, গন্ধ, পরিতৃপ্তির সুধা। কে দেবে দাও মেলেছি জাগরণ সার্থকতা, সোনার সিংহাসন। দিল কি কেউ?দেয়নি বুঝি সব। ঘোচেনি আজো মনের আর্তরব। প্রতিধ্বনি, প্রতিধ্বনি, তুমি তো ছিলে আবাল্যকাল সঙ্গী রাত্রিদিন। কার কাছে কি পাওনা আছে জানিয়ে দিও, কার কাছে কি ঋণ।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রকৃতিমূলক
রাজকোষের মতো বোঝেই কুঁড়িতে, পাতায়, শতপুষ্পে, গন্ধের পেখমে। তবু শিকড়ের চোখে আত্মগোপনকারী যোদ্ধার আত্মসমালোচনা। নিজের ভিতরে গভীর কোনো জল-উৎস খুঁজতে খুঁজতে খুঁড়তে খুঁড়তে ক্লান্ত এবং বিপদাপন্ন। কখনো কখনো সোনালি মেঘের শিরা-উপশিরাও তার কাছে করাতের দাঁত। কখনো কখনো মেঘ সে নিজেই। মেঘের ভিতরে নিজেকে দীর্ণ করতেই বানিয়ে চলেছে বজ্র-ডমরুর গুরুগুরু।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
এও এক ধরনের অসুখ এ বোধ, অতৃপ্তির আর অসর্ম্পূতার। এর জ্বরও ওঠে, নামে, কাঁপায়। গভীর বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ফেরার পর এও হয়ে যায় হাড়-পাঁজরের কফ-কাশি। ভীষণ টঙ্কারের মতো মুহূর্তগুলো যা বাজে তার ভিতরকার গণনাহীন কাঁপনগুলোকে চিনিয়ে দিতে, আর ধরার আগেই মিলিয়ে যায় ক্রমশ দূর প্রতিধ্বনিহীনতায় হৃতসর্বস্ব হতে হতে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
(জ্যাক প্রেভেরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে) আমি গেলাম পাখির বাজারে তোমার জন্যে পাখি কিনতে ও আমার প্রিয়া। পাখির বাজারে পাখি নেই। থিক খিক করছে লোহা-লক্কড়ের খাঁচা আর সরু মোটা শিকলি আর সেই সব দাঁড়িপাল্লা যাতে রক্ত ওজন হয় সেরা জাতের পাখিদের সবুজ হৃৎপিণ্ড। আমি গেলাম ফুলের বাজারে তোমার জন্যে ফুল কিনতে ও আমার প্রিয়া। ফুলের বাজারে ফুল নেই। থিক থিক করছে নীল মাছি হলুদ ডানা আর চিমসে পোকামাকড় আর বেশ্যার দালারদের সেই সব ফলন্ত মগজ রাংতাকে সোনার দামে বেচতে বেচতে যারা লাট-বেলাট। আমি গেলাম গয়নার বাজারে তোমার জন্যে গয়না কিনতে ও আমার প্রিয়া। গয়নার বাজারে গয়না নেই। গিজ্ গিজ্ করছে লম্বা ঠ্যাঙের কাঁটা কম্পাস আর খরখরে দাঁতের করাত কুড়োল, কাটারি, কর্নিক। আর পরোপকারী সেই সব তুখোড় কম্পিউটার যারা এক নিশ্বাসে বলে দিতে পারে পৃথিবীর যাবতীয় গুপ্তহত্যা অথবা ষড়যন্ত্রকে কত দিয়ে ভাগ অথবা কি কি দিয়ে গুণ করলে ফলাফল হবে অমায়িক একটা মুখোশ। আমি গেলাম বইয়ের বাজারে তোমার জন্যে বই কিনতে ও আমার পিয়া। বইয়ের বাজারে বই নেই। ঝলমল করছে শাড়ি শায়া ব্লাউজ সেন্ট সাবান আর কত রকমের চিকন লেস আর সেই সব অলৌকিক রুমাল যাদের বশীকরণ মন্ত্রে খুন-জখমের রক্ত-ছাপ অন্ধকারকেও মনে হয় পরমাশ্চর্য ঘুম।
পূর্ণেন্দু পত্রী
রূপক
আমার অনেক বন্ধুবান্ধুব। কেউ লাল, কেউ নীল, কেউ সবুজ। লাল বন্ধুরা দশদিগন্তের পাহাড়-পাথর ঠেলে হাঁটে সমস্ত রক্তপাত ডিঙিয়ে আসবে এক অভ্রভেদী ভোরবেলা তাকে স্বাগত জানাবে যে, সেই শাঁখের ঠিকানায়। নীল বন্ধুরা নগ্ন হয়ে নেমে যায় সপ্তসিন্ধুর জলে সমুদ্রগর্ত থেকে নক্ষত্রলোকের ঘাটে বেড়াতে যাবে মানুষ তাকে পারাপার করবে যে, সেই অলৌকিক নৌকোর খোঁজে। আর সবুজ বন্ধুরা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীর মুখে সেকালের মোমমাখা ঝাড়লন্ঠন স্তম্ভ ও গম্বুজ দেখা যায়। দেখে হিংসা জাগে। মানুষ এখন যেন কোনো এক বড় উনোনের ভাত-ডাল-তরকারির তলপেটে ডাইনীর চুলের আগুনকে অহরহ জ্বালিয়ে রাখার চেলা কাঠ, কাঠ-কয়লা-ঘুটে। মানুষ এখন তার আগেকার মানুষ-জন্মের কবচ, কুণ্ডল, হার, শিরস্ত্রাণ, বর্ম ও মুকুট বৃষের মতন কাঁধ, সিংহ-কটি, অশ্বের কদম পিঠে তৃণ, চোখে অহংকার সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা গগলস্ পেয়ে খুশি। প্লাসটিকের মানিব্যাগ, নাইলনের জামা পেয়ে খুশি। বোবা টেলিফোন পুষে তরতাজা বিল পেয়ে খুশি। চারকোণা সংসারের চতুর্দিকে গ্রীল এটেঁ খুশি। বনহংসী উড়ে যায়, সে বাতাসে কাশের কথুক এয়ারকুলারে সেই বাতাসের বাসী গন্ধ পেয়ে বড় খুশি। একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীকে দেখে অতীতের রাজশ্রীর, হর্ষবর্ষনের মতো লাগে। দেখে হিংসা জাগে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন? তোমার দুধের মধ্যে এত ঘন বিশৃঙ্খলা কেন? রক্ত-ঝড়ে না ভেজালে কোনো সুখ দরজা খোলে না। ময়ূরও নাচে না তাকে দু-নম্বরী সেলামী না দিলে। হাতুড়ির ঘায়ে না ফাটালে রাজার ভাঁড়ার থেকে এক মুঠো খুদ খেতে পায় না চড়-ই। স্বপ্নে যারা পেয়ে গেছে সচেতন ফাউন্টেনপেন তাদেরও কলমে দেখ সুর্যকিরণের মতো কোনো কালি নেই। হে স্তন্যদায়িনী তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন? তোমার দুধের মধ্যে প্রতিশ্রুত ভাস্কর্যের পাথর কেবল।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
মৃত্যুর মুহুর্ত আগে ‘সভাতার সংকট’ এর মতো তীব্র রক্তাক্ত আগুন নিজের পাঁজনে যিনি জালিয়েছিলেন, আমরা তাঁহারই যোগ্য বংশধরগুলি দৈনিকের মাসিকের বার্ষিকের নিউজপ্রিন্টের হলুদ মাঠের পরে গান্ডীবের ভাঙা বাঁট নিয়ে খেলিতেছি অপূর্ব ডাংগুলি।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
তোমাকেই দৃশ্য মনে হয়। তোমার ভিতরে সব দৃশ্য ঢুকে গেছে। কাচের আলমারি যেন, থাকে থাকে, পরতে পরতে শরতের, হেমন্তের, বসন্তের শাড়ি গয়না দুল, নদীর নবীন বাঁকা, বৃষ্টির নুপুর, জল, জলদ উদ্ভিদ। সাঁচীস্তুপে, কোনারকে যায় যারা, গিয়ে ফিরে আসে দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে ক্ষীর করা স্বাদ জিভে নিয়ে তোমার ভিতরে সেই ভাস্কর্যেরও লাবণ্য রয়েছে। কোন্‌খানে আছে? চুলে না গ্রীবায়, নাকি স্তনে? হাজারিবাগের গাঢ় জঙ্গলের গন্ধ পাই তোমার জঙ্ঘায়। ভয়াবহ খাদ থেকে নাচের মাদল, বাঁশী ডাকে। বহুদূর ভেসে যেতে যতখানি ঝর্নাজল লাগে তাও আছে, কোনখানে আছে? চোখে, না চিবুকে? দুমকায় তোমারই মতো একটি পাহাড়ী টিলা মেঘের আয়নায় মুখ রেখে খোঁপায় গুজছিল লাল গোধূলির ফুল। তুমি কালএমন তাকালে মনে হলো বীরভুমের দিগন্তের দাউ দাউ পলাশ। জয়পুরের জালি কাটা ঝুল-বারান্দার মতো সমৃদ্ধ খিলান, তাও আছে। কোন্‌খানে আছে? ভূরুতে, না ঠোঁটে? জলপাইগুড়ির কোনো ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙঘার যতটুকু আলো, ওড়না, নীলরশ্মি সেই সবও তুমি।
পূর্ণেন্দু পত্রী
মানবতাবাদী
আর কী দিয়ে পূর্ণ করবে তুমি শূণ্য আমার খাঁচা? যার সমস্ত লুট হয়েছে তারও ফুরোয়নি সব বাঁচা। কলসী থেকে খেয়েছো শুষে জল আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছো মখমল বিছানা থেকে কেড়েছো কম্বল দুধের থেকে সর আকাশে-মেঘে রটিয়ে বেড়াও তবু -আমিই তো ঈশ্বর। নিজের ঘাস চিবিয়ে খাও নিজে আমি আছি আমার শস্যে, বীজে তোমাকে আর দরকারই বা কী যে দগ্ধ এ উদ্যানে। সর্বস্বান্ত হয়েও তো কেউ কেউ বাঁচার মন্ত্র জানে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
ছটাক খানেক বুকে, একটা গোটা আকাশ এবং জলের স্থলের গা ভর্তি রং সব পড়েছে ঝুঁকে। কাকে কোথায় রাখি? বুকের মধ্যে হেসে উঠল শিকল-পরা পাখি। কতটা গভীর হলে নিরন্তর বেগবান নদী হওয়া যায়। তুমি তার মাপ জানো নাকি? মহান বৃক্ষের কাছে একটি মানুষ এসে একদিন প্রশ্ন করেছিল। কতটা আগুন লাগে নিখিলদহনে পুড়ে পরিশুদ্ধ মানুষের অবয়ব পেতে তুমি তার পরিমাণ জানো? মানুষের কাছে এসে এই প্রশ্ন করেছিল কোনো এক ক্ষুধিত পাহাড়।
পূর্ণেন্দু পত্রী
রূপক
অলৌকিক এইভাবে ঘটে। হঠাৎ একদিন ফাঁক হয়ে যায় সাদাসিধে ঝিনুক, ভিতর থেকে ঠিকরে বেরোয় সাদা জ্যোৎস্না। সেদিন মুক্তোর মতো গড়িয়ে এলে আমার হাতে। অমনি বদলে গেল দৃশ্য। আমার ডান দিকে ছিল মেঘলা দিন হয়ে গেল ডালিম-ফাটানো রোদ। আর বাঁদিকে ছিল ইটের পাঁজা হয়ে গেল লাল টালির ডাকবাংলো। অলৌকিক এইভাবে ঘটে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
আজ সব খুলে দিও, কোনো ফুল রেখোনা আড়ালে ভূমধ্যসাগরও যদি চাই, দিও দু'হাত বাড়ালে । দ্বিপ্রহরে যদি চাই গোধূলি বেলার রাঙা ঠোঁট গোধূলিতে জ্যোৎস্না যদি চাই কাঠের চেয়ারে বসে যদি বলি হতে চাই কীর্তিনাশা নদী সমস্ত কল্লোল দিও কোনো ঢেউ রেখোনা আড়ালে । ভূমধ্যসাগরও যদি চাই, দিও দু'হাত বাড়ালে ।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
আমি খুব চিকেন খেতে ভালোবাসি চিকেনগুলো নালা-নর্দমা খেতে ভালোবাসে নালা নর্দমাগুলো ভালোবাসে কলকাতার চিতল-পেটি অ্যাভিনিউ অ্যাভিনিউগুলো ভালোবাসে সমুদ্র-কাঁকড়ার মতো ঝাঁকড়া গাছের কাবাব। তবে কলকাতার এখন ডায়াবেটিস। কলকাতার ইউরিনে এখন বিরানব্বই পার্সেন্ট সুগার। কলকাতার গলব্লাডারে ডাঁই ডাঁই পাথর গাছপালা খেয়ে আগের মতো হজম করতে পারে না বলে কলকাতা এখন মানুষ খায়। আগে বছরে একবার কোটালের হাঁক পেড়ে নদীগুলো ঢুকে পড়তো গ্রাম-গঞ্জের তলপেটে ভাঙা তক্তাপোষ থেকে ঘুমন্ত বৌ-বাচ্চাদের তুলে নিয়েই লাল-ঘূর্ণীর হেঁসেলে। এখন নদীর দেখাদেখি বড় বড় হাইওয়ে হাইওয়ের গন্ডারদের দেখাদেখি ইলেকট্রিক ট্রেনের চিতাবাঘ ডাঙার চিতাবাঘের দেখাদেখি আকাশের পেট্রোল চালিত ঈগল সকলেরই মানুষ খাওয়ার খিদে বেড়ে গেছে সাই সাই। কেবল কলকাতা নয় পৃথিবীর সমস্ত বৈদ্যুতিক শহর এখন মানুষ পেলে আর ইলিশমাছ খায় না। তরতাজা যৌবন পেলে ছুড়ে দেয় হ্যামবার্গারের ডিস পোর্সেলিনের বাটিতে হাড়-মাস-ভাসানো তরল স্যূপ পেলে মাদ্রিদ থেকে মোরাদাবাদ তেহেরান থেকে ত্রিপুরা গের্নিকা থেকে গৌহাটির শিয়াল-শকুনের মুখে বিসর্জনের রঘুপতি খিলখিল করে হেসে ওঠেন যেন।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
একটি নারীর মাঝে অকস্মাৎ খুঁজে পায় কেউ আশ্চর্যের নীলিমাকে। দৃশ্যহীন ঘন অন্ধকারে নক্ষত্ররাজিরা গেছে আকাশে সোনালী শিল্প রুয়ে তার স্নিগ্ধ সুষমার মোহাচ্ছন্ন ঘ্রাণ নিতে নিতে ঘুমের মতন জাগে। ঘুমোতে দেয় না স্তব্ধতারে। একে একে আবরণ পূজার ফুলের মতো ঝরে। তারপর সেই দুটি অপরুপ লজ্জার ভঙ্গিমা একে অপরের বন্য বাসনাকে বাহু দিয়ে বেঁধে একে অপরের মুখে নিজের দেহের অন্ন দিয়ে যে শয্যা স্রোতের মতো তাতেই নিদ্রিত থাকে শুয়ে। একটি নারীর মাঝে অকস্মাৎ খুঁজে পায় কেউ ক্ষণিকের নীলিমাকে। কঠিন প্রভাত খর রোদে রজনীর খেলাধুলা দ্রুতহাতে যত দেয় ধুয়ে, আবার পুষ্পিত হয়ে ওঠে তবু পৃথিবীর রাত।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও ওষ্ঠপুটে রাখি। ভীষণ বৃষ্টির শব্দ সারাদিন স্মৃতির ভিতরে। একাকিনী বসে আছ বৃষ্টির ভিতরে বালুকাবেলায় কবেকার উইয়ে-খাওয়া ছবি। তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও ওষ্ঠপুটে রাখি। মানুষের ভীষণ বিষাদ একদিন বেজেছে মন্দিরে শঙ্খ-ঘন্টা রবে। মানুষের মহান বিষাদ ভাষ্কর্যখচিত স্তম্ভে একদিন ছুঁয়েছে আকাশ। আজ ভীষণ নীরব। জলের ভিতরে ছুরি ঢুকে গেলে আর্তনাদহীন। রক্তের ভিতরে কান্না ঢুকে গেলে প্রতিবাদহীন। যে যার উদ্যানে ছায়াতলে পুষ্পের ভিতরে অগ্নি জ্বলে সুগন্ধ শোকের সম্মূখীন। তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও করতলে রাখি। আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়। আরম্ভে সকল গাছই সুসাস্থ্য সবুজ। আরম্ভে সকল মুখে কলমীলতার ছাঁদে সাদা আলপনা সব কথা রাখালের বাঁশি আরম্ভে সকল চোখ চশমা ও কাজল ছাড়া সরল হরিণ। আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়। অতিশয় বিচক্ষণ হতে গিয়ে যত কিছু অদল-বদল চোখে ছানি, গালে ব্রণ, বুকে লোম নখে রক্তপাত লালসা ও লোভ ডুমুর ফলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ এটেঁ যার দাঁতের মাড়িতে। অতিরিক্ত লালসায় গাছ দীর্ঘ হয়। আরও উচু হলে আরও অনেক আকাশ এই ভেবে জিরাফের গ্রীবা ছুঁড়ে গাছ দীর্ঘ হয়। বাতাসে হলুদ পাতা বাসী ফুল পতনে মূর্ছায় স্তুপাকার, জলে-স্থলে শোকধ্বনিময়। অন্যখানে আরও বেশি ভালোবাসা সোনার সিন্দুকে এই লোভে শৈশবের রূপকথা রাজপুরী ভাঙে ডুরে শাড়ী বদলে যায়, বিনুনীতে সাপের গড়ন ঈর্ষার কাজল চোখে, দাঁতের হাসি ধবল করাত। যে যতই দূরে যাক অবশেষে সকলেরই ফিরে আসা স্মৃতির ভিতরে বৃষ্টিপাতে অনুশোচনায় বালি ঘাঁটাঘাঁটি বালুকাবেলায়। তোমার বিষাদগুলি করতরে তুলে নিতে দাও ওষ্ঠপুটে রাখি। সমস্ত আরম্ভ জুড়ে মানুষের আলুথালু কত ছোটাছুটি কুসুম-কুড়ানো কত ভোরবেলা, কুসুমের মতন কাঁকরও পকেটে কত কি ছবি, আয়নাভাঙা, আতশবাজীর ফুলঝুরি দোলের আবীর, বাঁকা রেকর্ডের গান, আঁচলে কত কি মনোহর মন্ত্রধ্বনি, পালকি যায় পাখী যেতে পারে যত দূর। আরম্ভের সব কিছু এইরূপ প্রতিশ্রুতিময়। ক্রমে, ভীষণ নীরবে প্রতিশ্রুতি, গাছ ও মানুষ একযোগে হরিতাভ হয়। ক্রমে, ভীষণ নীরবে চোখের কাজল, বেণী, বিত্রিত আঁচল সোনার সিন্দুক, সব সতকর্তা, সাফল্যের স্ফীতকায় ঘাড় স্তম্ভ, দম্ভ, জঙ্ঘা, ঊরু, গর্ব অহংকার সবকিছু থেকে, চেয়ানো ঘামের মত অদ্ভুত বিষাদ। অবশেষে বৃষ্টিপাত স্মৃতির ভিতরে বালুকাবেলায়। তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও করতলে রাখি। সভ্যতা সময় কিংবা মানুষের মহাইতিহাস এত শোকে তবুও মরেনি। কারণ মানুষ এখনো নিজের করতলে তুলে নেয় অন্যের বিষাদ। আকাশ পাতাল থেকে এত বিষ, বারুদ ও জীবানু সত্ত্বেও এখনো মানুষ অন্য কিছু মহত্তম সুধার আশায় ওপরের ওষ্ঠ থেকে তার সব মলিন বিষাদ শুষে নিতে চায় এখনো বিষাদ পাবে বলে পুরুষ নারীর কাছে যায় নারীরা নদীর কাছে যায় নদীরা মাটির কাছে যায় মাটি আকাশের দিকে চায়। তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে চাও ওষ্ঠপুটে রাখি।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
রাজার দুলাল ভেবে ফিরায়ো না। মাথার মুকুট গলে জয়মালা দেখে ফিরায়ো না। আমি সেই প্রাচীন ভিক্ষুক। শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা শিরায় বিলাপ নাভিতটে দংশনের লোভী ফণা, বিষধর সাপ যথাযথ সকলই প্রাচীন। মাথায় মুকুট গলে জয়মালা দেখে ফিরায়ো না। গম্বুজ খিলান কিংবা মখমলে প্লাবিত মদিরা বৃক্ষশাখে হারেমের উচ্চকিত হাসির মতন পুষ্পশোভা দেখে ফিরায়ো না। সকলই চিকন চতুরালি। ফুলের আড়ালে শাখা শাখার আড়ালে ফুল পরস্পর ঢেকে আছে নিঃস্বতার শিরাগ্রস্থ রুপ। মুলত সে প্রাচীন ভিক্ষুক। পুরাতন নামে ডাকো ছায়াময় আশ্রয়ে তোমার স্মতিসুরভিত শয্যা, লজ্জায় আঁচলে ঢাকা থালা বাটি পানীয়ের জল খুলে দাও ঈশ্বরের বিখ্যাত বাগান। রৌদ্রতাপে জর্জরিত দেহ চায় সুশীতল স্নান। পুনরায় ক্লান্ত করো মায়াবী হাসির কোলাহলে লুকোচুরি খেলা নীল রজনীর গোপন আলোয়। কতকাল নির্জনতা, বিষন্নতা, অবাধ্যতা ছেড়ে বেঁচে আছি। যে অন্যায়ে কাঁচ ভাঙে, কতকাল সেরকম ক্ষামাহীন কোনো খেলা নেই। রাজ্যে বড় সমারোহ, শঙ্খ ঘন্টা, শোভাযাত্রা, পতাকা রঙীন রাজ্যে শুধু প্রথাগত, নীতিগত, শৃঙ্কলিত সুখ। ভিখারিনী, ফিরায়ো না আমি সেই প্রাচীন ভিক্ষুক।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
পুরুলিয়ার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরী মেঘ বাঁকুড়ার জন্য সবচেয়ে জরুরী বৃষ্টি আর আমার ভাঙা দেরাজের জন্য সেই রমণীর ভালোবাসা। অমনোযোগের চড়বড়ে রোদে পুড়ছি আমরা তিনজন যেন যজ্ঞের কাঠ। পুরুলিয়াকে বাঁচালে পুরুলিয়া আবার ছৌ-নাচের ময়ুর। বাঁকুড়াকে বাঁচালে বাঁকুড়া আবার লক্ষীর ঝাঁপি। আমাকে বাঁচালে খরার বুকে সুড়ো জালিয়ে ভাঙা দেরাজে মেরামতির কাজ দীর্ঘশ্বাসের ঘুণ সরিয়ে নতুন ঝাঁট-পাট, লেপা-পোঁছা, পুজো-পার্বণের মতো পরিপাটি চুনকাম মনের এপিঠ ওপিঠ। পাড়া-পড়শীদের চোখ তখন চড়ক গাছে- আ মরণ। সেই ঘাটের মড়াটা পুণ্যিমের চাঁদ হয়ে উঠল যে আবার।
পূর্ণেন্দু পত্রী
রূপক
মাথায় মুকুটটা পরিয়ে দিতেই রাজা হয়ে গেলেন তিনি। আর সিংহাসনে পাছা রেখেই হাঁক পাড়লেন হালুম। অমনি মন্ত্রীরা ছুটলো ঘুরঘুট্টি বনে হরিণের মাংস সেকতে সেনাপতিরা ছুটলো খলখলে সমুদ্রে ফিস-ফ্রাইয়ের খোঁজে কোতোয়ালরা ছুটলো হাটে-বাজারে যেখান থেকে যা আনা যায় উপড়ে বরকন্দাজেরা ক্ষেত খামার ল্ড ভণ্ড করে বানালো ফ্রুটল্যলাড। রাজা সরলেন ব্রেক ফাস্ট। তারপরেই সিং-দুয়ারে বেজে উঠলো সাত-মণ সোনার ঘন্টা। এবার রাজদরবার। আসমুদ্র-হিমাচরের ন্যাংটো, আধ-ন্যাংটো জন্তু-জানোয়ারের ঝাঁক পিলপিলিয়ে জড়ো হল রাজ-চত্বরে। মন্ত্রী জানালো, প্রভু! জনতা হাজির। ওরা প্রসাদ পেতে চায় আপনার অমৃত ভাষণের। অমনি উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে, ঈশানে, নৈঋতে, গাছে, পাতায়, শিশিরে, শ্মশানে, ধুলোয়, ধোয়ায়, কুয়াশায় আকাশে, বাতাসে, হাড়ে, মাসে, পেটে, পাঁজরে গর্জন করে উঠলো, সাড়ে সাতমো অ্যামপ্লিফায়ার -হালুম।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
আক্রান্ত পাখির মতো ঘুরে ঘুরে বিপুল রোদনে চিত্রাঙ্গাদার কন্ঠে এই আর্ত গান। একি শুধু নাটমঞ্চে ক্ষণিকের খণ্ডদৃশ্য নয়নাভিরাম? একি শুধু ব্রতচারী অর্জুনের পায়ের পাথরে কোন এক রমনীর সনির্বদ্ধ পা্রার্থনা, প্রণাম? এই স্পষ্ট উচ্চারণ আমাদেরও কথা নয় বুঝি? সামান্য নারীর মধ্যে সর্বান্তঃকরণে যারা খুঁজি রাজেন্দ্রনন্দিনী, যারা জানি পৃথিবীর কোনোখানে রয়ে গেছে] করো দুটি প্রদীপের চোখ আলো কিংবা আলিঙ্গন দিয়ে অথবা সকল আলো নিঃশেষে নিভিয়ে ধুয়ে মুছে দিতে পারে আমাদের নশ্বরতা, সর্বাঙ্গের শোক। একটি ওষ্ঠের পদ্ম একবার যদি যায় খুলে এই সব ট্রাম, ট্রেন, টিভি, টেরিলিন এই সব ধুরব্ধর মাকড়সার মিহিজাল লালায় মৃসৃণ এই সব আস্তাকুড়, অবিবেচনার ব্যাপ্ত ডামাডোল ভুলে যারা জানি পেয়ে যাবো শুকনো ঠোঁটে সরবতের স্বাদ এতো আমাদেরই আর্তনাদ। আমাদেরও কন্ঠনালী সারেঙ্গীর কিছু সুর জানে, আমাদেরও বহু কান্না জলন্ত উল্কা পিণ্ড, ঝরে গেছে শুন্যের শ্মশানে। দুঃখের উদ্ভিদগুলো ক্রমাগত কঠিন শিকড়ে বুক চিরে নামে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্রমাগত দীর্ঘ অপেক্ষায় সাজানো মঞ্চের মতো জেগে আছি পরিপুর্ণ আলোকসজ্জায় তবু দৃশ্য ফোটে না সেখানে যেহেতু জানি না কেউ চিত্রাঙ্গদা থাকে কোনখানে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
রূপক
সূর্য নামের ছোকরাটা বড় জ্বলতে শিখেছে, তাই না হে? আজ্ঞ হ্যাঁ। গনগণে চোখ, জ্বলজ্বলে ভূরু, উরু ভেঙে দিলে কেমন হয়? আজ্ঞ হ্যাঁ। আজকাল আর চাঁদে সে রকম রাবড়ির মতো জেল্লা নেই আজ্ঞে হ্যাঁ। টুনি বালবদের ফোলাপে ফাঁপালেপ্রতিভা ছড়াবে হাজার গুণ। আজ্ঞে হ্যাঁ। নিজের লালার সরু সুতোর দিয়ে বেনারসী বোনে মাকড়সা। আজ্ঞে হ্যাঁ। আমারও তেমনি, থুতু ছিটোলেই হীরে-জহরত আকাশময়। আজ্ঞে হ্যাঁ। কানেই শুনেছো, দেখনি কখনো ঈশ্বর নামে লোকটাকে। আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল এসেছিলো, বেচতে চাইছে ধড়া-চূড়োসহ সিংহাসন। আজ্ঞে হ্যাঁ। ঈশ্বর হয়ে প্রথমেই আমি বুনবো কঠিন শৃঙ্খলা। আজ্ঞে হ্যাঁ। পাহাড়গুলোকে পিঁপড়ে বানাবো, সব গাছ হবে ভেরেন্ডা। আজ্ঞে হ্যাঁ।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
আমরা কথা বলি ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত। আমরা বলি শাক সবজির মতো সরল সাদামাঠা কথাবার্তা। যে-সব রাজবাড়ি ভেঙে পড়ছে তার ইটগুলো কারা কিনবে, পুরনো বন্ধুরা মারা যাওয়ার আগে কে স্বপ্ন দেখেছিল কেমন, কাঁকড়া বিছে এবং মাকড়শার মধ্যে কে বেশি বিষাক্ত, পৃথিবীর সমস্ত বসন্তকালকেই শীত ঠেলে ঠেলে আসতে হয় কেন এইরকম সব পাতলা ঝিরঝিরে ঝাউপাতার মতো কথাবার্তা। আমরা কথা বলি ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত। যে কবিতা ভালোবাসে সে মনের মেঘ-বৃষ্টি নিয়ে কথা বলে। যে হাসপাতাল ভালোবাসে সে মৃত্যুর দক্ষিণ দিকের জানলা নিয়ে কথা বলে। যে ্লেক-লুডো ভালোবাসে সে নানারকম সন্ত্রাসের কথা। কথার মধ্যে জেগে ওঠে আমাদের হারানো ছেলেবেলা গোল আয়নার মতো ঝকঝকে যার চিবুক, আর সেইসব পুরনো ঘন্টার ধ্বনি যার শব্দে নুয়ে পড়ে মহানিমের ডাল, আর সেইসব ময়লা ফটোগ্রাফের মতো ভালোবাসা যার গল্প শুনতে এখনো সমুদ্রের জল ছুটে আসে তটরেখায়। আমরা কথা বলি ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত। কথার মধ্যে রঙিন মলাটে ঝলসে ওঠে আমাদের সমস্ত না ছাপা বই কথার মধ্যে আমরা রিপু করে নিই গত বছরের জামা পাজামার ফাটল। কথার মধ্যে ভুলে যাই আমাদের ছেড়া জুতোর পেরেক শোবার ঘরের ভাঙা বালব। আর কথার মধ্যেই পৌছে যাই এমন সব জঙ্গলে গত রাত্রেও নরবলি হয়েছে যেখানে। আমরা কথা বলি ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত। একটা চিয়ারে তিনজন এক চিলতে ঘরে একশো হয়ে যাই আমরা কথা বলতে বলতে। তখন আমাদের তোবড়ানো গালের খোঁদলগুলো ভরে যায় জলোচ্ছ্বাসে, জ্যোৎস্নায়। নক্ষত্র ফোটাতে ফোটাতে মরচে-পড়া আকাশ এক গাল হাসি নিয়ে নেমে আসে জানলার কাছে। তখন আমাদের মাথা উসকো খুসকো চুলগুলো এমন সব শিকড় জল হাওয়া পেলে এখুনি হয়ে উঠবে হিজলের ঝাঁকড়া বন। আমরা কথা বলি ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত। আমরা কথা বলছি আর গর্ভকেশরগুরো ফেটে পড়ছে বনে বনে হাওয়ার ভিতরে পাখির মতো ওড়াউড়ি করছে নতুন নতুন বীজকোষ। আমরা কথা বলছি আর ঘা পড়ছে সমস্ত ভেজানো সিংদরোজায় সাত শতাব্দীর অন্ধকার ঝিনুকের ডালা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে ইস্পাতের চাড়ে। আমরা কথা বলছি খুবই আসে-, ধীরে, মোমবাতির মতো জ্বলে, গাছপাতার মতো সংযমে। অথচ পাহাড় থেকে পাহাড়ে আকাশের এপার ওপার ছুয়ে, আদিম কোনো দৈববানীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে তারা, মর্মানি-ক আর প্রতিধ্বনিময়। আমরা কথা বলি ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত।
পূর্ণেন্দু পত্রী
রূপক
একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার। একমুঠো জোনাকীর আলো পেয়ে এক একটা যুবক হয়ে যাচ্ছে জলটুঙি পাহাড় যুবতীরা সুবর্ণরেখা। সাপুড়ের ঝাঁপি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী পুজো সংখ্যা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী। একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার। ময়দানের মঞ্চে একমুঠো জোনাকী উড়িয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল যেন কারা। রবীন্দ্রসদনে তিরিশজন কবি তিরিশদিন ধরে আউড়ে গেল একমুঠো জোনাকীর সঙ্গে তাদের ভাব-ভালোবাসা। ইউনেসকোর গোল টেবিল ঘিরে বসে গেছে মহামান্যদের সভা একমুঠো জোনাকীর আলোয় আফ্রিকা থেকে আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত হোগলা বন আর ফাটা দেয়ালে সাজিয়ে দেবে কোনারক কিংবা এথেন্সের ভাস্কর্য। সাত শতাব্দীর অন্ধকার এইভাবে ফাঁকা মাঠে ম্যাজি দেখিয়ে চলেছে একমুঠো জোনাকীর আলোয়।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
নতজানু হয়ে কারো পদতলে বসি, ইচ্ছে করে অকপটে সব কথা তার সাথে বলাবলি হোক। খুলে দিই কপাটের খিল পর্দার আড়াল, ঘন বনবীথি ছায়া, ভিজে ছায়া নোনাধরা পুরনো পাঁচিন দেয়ালে কামড়ে থাকা সুপ্রাচীন ঘন অন্ধকার স্যাঁতলার নানাবিধ মুখভঙ্গী, ফাটলের দাগ তেল ও জলের দাগ, পান পিক, পিপাসার দাগ সব চিহ্ন, সব ছারখার সমস্ত গোপন দুঃখ শোক অকপটে বলাবলি হোক। আমাদের কতটুকু প্রয়োজন ছিল পৃথিবীর? নিজস্ব জননী ছাড়া আমরা কি আর কারও সাধের সন্তান? আর কারও প্রিয় প্রয়োজন? সদ্ভাবে ও স্নেহে কারো ভ্রাতা? আমরা অসুস্থ হলে কোনখানে খুঁজে পাব ত্রাতা? অবশ্য এ পৃথিবীর বহু জল, মাটি, ধুলো, রোদ, বৃষ্টি, ঘাস টেনে ছিঁড়ে লুটেপুটে আমরা করেছি ক্ষয়, অপচয় গ্রাস। তখন ধারণা ছিল আমাদেরই করতলে ভুবনের সব চাষ-বাস। পৃথিবীর বুকের ভিতরে উজ্জয়িনী আরেক পৃথিবী আমাদেরই গড়ে দিতে হবে চমৎকার। আরেক রকম দেশ, রাজধানী, সমৃদ্ধ নগর আটচালা, পাঠশালা, স্কুল খালে জল, মাঠে ধান, ব্রীজ, সাঁকো, বিদ্যুৎ, বাজার স্টেশনের ডান দিকে শিরীষ গাছের ডালে লুটোপুটি ফুল উৎসবের মতো দিন মন্ত্রোচ্চারণের মতো মানুষের মুগ্ধ কন্ঠস্বর সারা ভু-মণ্ডল জুড়ে একখানি ঘর। মাটির আঁতুড় ঘরে জন্মলগ্নে ছিল ম্লান প্রদীপের শিখা আকাশে জ্যোৎস্নার অহমিকা। শৈশবে ছিল না রথ ছিল রুক্ষ, রুঢ় তেপান্তর শৈশবেই জেনে গেছি ঝড়ে ওড়ে কতখানি খড় ক’খানা সংসার ভাসে কোটালের বানে। কারা ভাত খাবে বলে কারা ধান ভানে। অনেক ভিখারী ছিল পথে পথে, কালো কালো হাত চর্তুর্দিকে হাতড়ায়, যদি পায় কোনখানে সুখের সাক্ষাৎ। অনেক ভিখারী ছিল, তারা ভিন্ন লোক ভিন্ন ক্ষুধা, ভিন্নতর সন্ধান ও শোক ভিন্ন প্রতিজ্ঞায় তারা বেঁধেছিল হাতে রক্তরাখী যতক্ষণ স্বাধীনতা বাকি ততক্ষণ রণ। মৃত্যুতে মহিমাময় হয়ে গেছে তাদের জীবন। সেই সব মৃত্যুঞ্জয়ী ভিখারীর বংশধরগণ আজ সোফা, সিগারেট, এয়ারকুলার, সিমেন্টের সুগন্ধী সেন্টের, পেট্‌রোলের, ইনকাম ট্র্যাক্সের দুমুখো খাতায় অম্লান, অপরিসীম কত সুখ পায়। বহু সুখী দৃশ্যপট দেখা হল, বহু গৌরবের মানুষও গাছের মতো কত গন্ধ ছড়ানো আকাশে গ্রহে, উপগ্রহে, শুন্যে, মহাশুন্যে মরুভুমিতলে কল্পনার, কৃতিত্বের সার্থকতা আর সৌরভের। কত রক্তপাতময় দৃশপটও দেখা হল বিমুঢ় লজ্জায়। হাড়ের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল চুরি স্বাভাবিক মানবতা তামার তারের মতো রোজই হল চুরি। কত ট্রেন থেমে গেল অনাদৃত, অজ্ঞাত স্টেশনে। অচরিতার্থতাবোধ প্রসব ব্যথার মতো রয়ে গেল স্থির মানুষের চেতনার গর্ভের আঁধারে। আমার সকলই আছে জামা জুতো, ছাতা, টেরিলিন মেডেল ও মেডেলকে ঝোলাবার সরু সেফটিপিন মাসান্তে মাসান্তে পে-প্যাকেট তাতে কেনা হয়ে যায় গ্রীষ্মের বাতাবিলেবু, শীতের জ্যাকেট। ভিখারীর হাত পেতে আরও কিছু পেয়ে যাই একানি দুয়ানি বিভিন্ন দয়ালু ব্যক্তি ছুঁয়ে দেয় ছেঁড়া কাঁথাকানি। নিজের ঘামের নুনও চেটে খাই, পরিতৃপ্ত গাল, বাহিরে যে থাকে সে তো অসি’সার আজন্ম কাঙাল। বাহিরে ভিখারী কিন্তু সম্রাট রয়েছে অভ্যন্তরে লুব্ধ চুরি রক্তে খেলা করে। উচ্চাকাঙ্খী আঙ্গুলের গাঁটে গাঁটে ছিনতায়ের লোভ পান থেকে চুন গেলে প্রচণ্ড বিক্ষোভ। যে দিকে সুন্দর আছে, সুষমামন্ডিত শিল্পলোক যে দিকে নদীর মুখ, পর্বত চুড়ার অভ্যুদয় ঊর্ধ্বলোক চিনে নিয়ে যে-দৃষ্টিভঙ্গিতে বীজ বনস্পতি হয় যে সিন্দুকে ভরা আছে পূর্বপুরুষের রাত্নাগার যে ওষ্ঠের মন্ত্রপাঠে ধ্রুবপদ বাজে বারবার বাতাসকে গন্ধ দেয় যে সকল আত্ম ও শরীর সব চাই, সব তার চাই আগুনের সব শিখ, সব দগ্ধ ছাই। কাকে পাপ বলে আমি জানি কাকে পুণ্যজল বলে জানি মুকুটের কাঁটা কয়খানি। অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ, আবেগে বালক, জাত গোত্রহীন হয়ে ভেসে আছি সময়ের নাড়ীর ভিতরে উলঙ্গ পালক।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
রঙীন রুমালে চোখ দুটো বাঁধা নিজের সঙ্গে নিজের অষ্টপ্রহর- কানামাছি খেলা ভারী চমৎকার ধাঁধা। যাকে ছোঁবার তাকে না ছুঁয়ে আকাশ ধরতে হাত বাড়িয়ে আমি ধুলো মাটির ভূয়ে। হাত বাড়ালে হাতে জলের বদলে শামুক অথচ ভেতরটা পরাগসুদ্ধ ফুলের জন্যে আপাদমস্তক কামুক। সিদুর রঙের কিছু দেখলেই মন উসখুস, ইচ্ছেয় আগুন বিশ্বাসের বাকলে সত্যিই এল ফাল্গুন? কাছে যাই, কাছে গেলেই সব অদলবদল, যথেচ্ছাচার কান্ড রক্তপাতের শব্দে শিউরে ওঠে গাছপালা নদীনালাময় দেশ চেনা ব্রক্ষ্মণ্ড। তবু তো ছুতে হবে কিছু, কাউকে-না কাউকে পুকুরপাড়ের নিমগাছ কি সাগরপারের ঝাউকে। পা নিয়েই সমস্যা, কোথায় রাখি, হয় পাঁক নয় অনিশ্চিতের বালি ভিক্ষের ঝুলিটা তবু যা হোক ভরছে নানারকম ভালো এবং মন্দে সমৃদ্ধ কাঙালী। মনে হচ্ছে কোথাও নেই অথচ আমার চেয়ার টেবিলে আমি ঠিকই আছি রঙীন রুমালে চোখ দুটো বাঁধা নিজের সঙ্গে পাওয়া না-পাওয়ার কানামাছি।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
ফুলের আলোয় রাঙা দিগন্তে দুয়ারহীন ছুটে অভ্রের কুচির মতো সফলতা মাটি থেকে খুঁটে অমল-বরণ রাতে সকল অমরাবতী লুটে মানুষ কত কী পায় রৌদ্রে ও জ্যোৎস্নায় সমস্ত পাওয়ার পরও তবু তার বাকী থেকে যায় একটি চুম্বন। কন্ঠে, কর্ণে, নির্বাচিত মুক্তামালা গাঁথা শিরোপরে স্বর্ণময় ছাতা কে বসেছ রাজার আসনে? পৃথিবীর ঘাসে ঘাসে অবিরত ক্ষত খুঁড়ে খুঁড়ে কার ঘোড়া ছুটে চলে পৃথিবী শাসনে? ও কার গোপন শয্যা সোমত্ত গোপিনী দিয়ে সাজানো বাগান? হাউইয়ের মতো এক পরিতৃপ্ত হাই তুলে কে যেন আকাশে গায় গান? এইরূপে মানুষের যাবতীয় অভিলাষগুলি রৌদ্র ও জ্যোৎস্নার মধ্যে ডালিম ফলের মতো পাকে। সমস্ত পাওয়ার পরও মানুষের তবু বাকী থাকে কোনোখানে একটি চুম্বন। যখন সকল জামা পরা শেষ, মাথায় মুকুট, যখন সকল সুখে পুষ্ট ওষ্ঠপুট তৃষ্ণার কলসুগুলি ভরে গেছে চরিতার্থতায় অকষ্মাৎ মানুষের মনে পড়ে যায় বিসর্জনে ডুবে গেছে কবে কত প্রতিমা ও পরম লগন মনে পড়ে বাকী আছে, মনে পড়ে বাকী রয়ে গেছে কোনোখানো একটি চুম্বন।
পূর্ণেন্দু পত্রী
চিন্তামূলক
মানুষের কথা ভেবে গাছ দীর্ঘ হয়। মানুষের সমাজের ধুরন্ধর নাচা-কোঁদা দেখে মানুষের স্বভাবের মড়ক দুর্ভিক্ষ দেখে দেখে মানুষের চেতনায় খঙ্গের আঘাত দেখে দেখে অবোধ শিশুর মতো বহু প্রশ্ন গাছগুলি নিজেদের দীর্ণ করেছিল ভীষণ লজ্জিত হয়ে গাছগুলি নুয়ে পড়েছিল গাছের সমস্ত পাতা জলের ফোঁটার মতো ঝরে গাছের সমস্ত ছাল বেদনায় ফেটে গিয়েছিল। আকাশের এত কাছে তবুও মানুষ কেন আকাশের মতো সুস্থ নয়? নক্ষত্রের এত কাছে তবু তার রক্তশিরা আঁধার জঙ্গল থেকে কেন শুধু খুঁটে নেয় ক্ষয়? সমুদ্রের এত কাছে তবু কেন এদোঁজল ঘাঁটবার প্রবণতাময়? এইসব তীক্ষ্ণ প্রশ্নে বহুদিন দীর্ণ হতে হতে অবশেষে মানুষের উন্নয়নের কথা ভেবে মানুষের চোখে এক মূল্যবান দৃষ্টান্তের অমরতা এঁকে পুনরায় গাছগুলি আলোকরেখায় দীর্ঘ হয়।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
আমারই ভুলে আজ প্রত্যুষে সুর্য ওঠেনি, পাঁশুটে আকাশে আলোর আকাল আমারই ভুলে মুর্ছিত মেঘ, খোঁপা-ভাঙা চুল, জলে একাকার যাবজ্জীবন আমারই ভুলে স্বেচ্ছাচারীর মতন বাতাস লুটপাট করে যেখানে সেখানে আমারই ভুলে ঝরে অরন্য, ঝরে অরণ্যে পুরনো চিঠির মতো মৃত পাতা আমারই ভুলে ভুলপথে নদী ভাসিয়ে দিয়েছে শতাধিক সুখ, সাজানো বিছানা আমারই ভুলে একটি রমনী একাকী এখন কৌটোবন্দী কাতর ভ্রমর আমারই ভুলে আমি ফিরে আসি রাজগৃহ থেকে, ভিজি স্মতিজলে, নোংরা বালিশে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
অতিক্রম করে যাওয়া শিল্পের নিয়ম ঘুটের ছাপের মতো ক্ষতচিহ্নে ছেয়ে গেছে জীবন, সময় রক্তের জানালা ভেঙে তবু সূর্যকরোজ্জাল বাঁশি ডেকে যায় ঝড়ের রাতের অভিসারে। অতিক্রম করে যাওয়া জীবনেরও নিশ্চিত নিয়ম। পাহাড়ের চুড়োগুলো অতিক্রম করে গেছে মেঘ। কোনার্ক-রথের চাকা বিংশ শতাব্দীর সীমা অতিক্রম করে চলে যায় আরো দূর শতাব্দীর কাছে। তুমি খুব ভালোবেসেছিলে তুমি খুব কাছে এসেছিলে। এখন তোমারও সৌধ ভেদ করে চলে যেতে হবে আরো বড় বেদনার আরো বড় আগুনের আরতির দিকে।
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রেমমূলক
মেঘ দেখেছে, ঢেউ দেখেছে আর দেখেছে কাছের অন্ধকার পাড়া-পড়শী কেউ দেখেনি, সবটা গোপন বৃক্ষরোপন সেদিন তোমার মর্মমূলে। ভীষণ ভূমিকম্পে দুলে হঠাৎ যেদিন ছিটকে যাবে সকল খেলা লুকোচুরির মস্ত ছুরির একক ঘায়ে ভাঙবে যখন দখলদারির দালান-কোঠা রঙীন সুতোর সমস্ত ফুল এবং বোঁটা প্রকাশ্য রোদ বৃষ্টি তাপে, তখনো দুই স্পর্শকাতর মনের খাপে বৃক্ষরোপণ সেদিন তোমার মর্মমূলে।