poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
অনেককালের একটিমাত্র দিন কেমন করে বাঁধা পড়েছিল একটা কোনো ছন্দে, কোনো গানে, কোনো ছবিতে। কালের দূত তাকে সরিয়ে রেখেছিল চলাচলের পথের বাইরে। যুগের ভাসান খেলায় অনেক কিছু চলে গেল ঘাট পেরিয়ে, সে কখন ঠেকে গিয়েছিল বাঁকের মুখে কেউ জানতে পারে নি। মাঘের বনে আমের কত বোল ধরল, কত পড়ল ঝরে; ফাল্গুনে ফুটল পলাশ, গাছতলার মাটি দিল ছেয়ে; চৈত্রের রৌদ্রে আর সর্ষের খেতে কবির লড়াই লাগল যেন মাঠে আর আকাশে। আমার সেই আটকে-পড়া দিনটির গায়ে কোনো ঋতুর কোনো তুলির চিহ্ন লাগেনি। একদা ছিলেম ঐ দিনের মাঝখানেই। দিনটা ছিল গা ছড়িয়ে নানা কিছুর মধ্যে; তারা সমস্তই ঘেঁষে ছিল আশেপাশে সামনে। তাদের দেখে গেছি সবটাই কিন্তু চোখে পড়েনি সমস্তটা। ভালোবেসেছি, ভালো করে জানিনি কতখানি বেসেছি। অনেক গেছে ফেলাছড়া; আনমনার রসের পেয়ালায় বাকি ছিল কত। সেদিনের যে পরিচয় ছিল আমার মনে আজ দেখি তার চেহারা অন্য ছাঁদের। কত এলোমেলো, কত যেমন-তেমন সব গেছে মিলিয়ে। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়েছে যে তাকে আজ দূরের পটে দেখছি যেন সেদিনকার সে নববধূ। তনু তার দেহলতা, ধূপছায়া রঙের আঁচলটি মাথায় উঠেছে খোঁপাটুকু ছাড়িয়ে। ঠিকমতো সময়টি পাই নি। তাকে সব কথা বলবার, অনেক কথা বলা হয়েছে যখন-তখন, সে-সব বৃথা কথা। হতে হতে বেলা গেছে চলে। আজ দেখা দিয়েছে তার মূর্তি,-- স্তব্ধ সে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া-আলোর বেড়ার মধ্যে, মনে হচ্ছে কী একটা কথা বলবে, বলা হল না,-- ইচ্ছে করছে ফিরে যাই পাশে, ফেরার পথ নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
আমি শুধু মালা গাঁথি ছোটো ছোটো ফুলে , সে ফুল শুকায়ে যায় কথায় কথায় ! তাই যদি , তাই হোক , দুঃখ নাহি তায় — তুলিব কুসুম আমি অনন্তের কূলে । যারা থাকে অন্ধকারে , পাষাণকারায় , আমার এ মালা যদি লহে গলে তুলে , নিমেষের তরে তারা যদি সুখ পায় , নিষ্ঠুর বন্ধনব্যথা যদি যায় ভুলে ! ক্ষুদ্র ফুল , আপনার সৌরভের সনে নিয়ে আসে স্বাধীনতা , গভীর আশ্বাস — মনে আনে রবিকর নিমেষস্বপনে , মনে আনে সমুদ্রের উদার বাতাস । ক্ষুদ্র ফুল দেখে যদি কারো পড়ে মনে বৃহৎ জগৎ , আর বৃহৎ আকাশ !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
যে-কথা বলিতে চাই, বলা হয় নাই, সে কেবল এই-- চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই দেখিনু সহস্রবার দুয়ারে আমার। অপরিচিতের এই চির পরিচয় এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয় সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী আমি নাহি জানি। শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে; নদীর এপারে ঢালু তটে চাষি করিতেছে চাষ; উড়ে চলিয়াছে হাঁস ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে। চলে কি না চলে ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত আধো-জাগা নয়নের মতো। পথখানি বাঁকা বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা, নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা। ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ, ওই খেয়াঘাট, ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি কতদিন দেখিয়াছে কবি। শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া, এই আলো, এই হাওয়া, এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ, ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে অকস্মাৎ নদীস্রোতে ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ, যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ। পদ্মা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
নিদাথের শেষ গোলাপ কুসুম একা বন আলো করিয়া, রূপসী তাহার সহচরীগণ শুকায়ে পড়েছে ঝরিয়া। একাকিনী আহা, চারি দিকে তার কোনো ফুল নাহি বিকাশে, হাসিতে তাহার মিশাইতে হাসি নিশাস তাহার নিশাসে। বোঁটার উপরে শুকাইতে তোরে রাখিব না একা ফেলিয়া– সবাই ঘুমায়, তুইও ঘুমাগে তাহাদের সাথে মিলিয়া। ছড়ায়ে দিলাম দলগুলি তোর কুসুমসমাধিশয়নে যেথা তোর বনসখীরা সবাই ঘুমায় মুদিত নয়নে। তেমনি আমার সখারা যখন যেতেছেন মোরে ফেলিয়া প্রেমহার হতে একটি একটি রতন পড়িছে খুলিয়া, প্রণয়ীহৃদয় গেল গো শুকায়ে প্রিয়জন গেল চলিয়া– তবে এ আঁধার আঁধার জগতে রহিব বলো কী বলিয়া।Moore (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
তালগাছ        এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ,      কালো মেঘ ফুঁড়ে যায় একেবারে উড়ে যায়; কোথা পাবে পাখা সে? তাই তো সে    ঠিক তার মাথাতে গোল গোল পাতাতে ইচ্ছাটি মেলে তার,-- মনে মনে       ভাবে, বুঝি ডানা এই, উড়ে যেতে মানা নেই বাসাখানি ফেলে তার। সারাদিন       ঝরঝর থত্থর কাঁপে পাতা-পত্তর, ওড়ে যেন ভাবে ও, মনে মনে       আকাশেতে বেড়িয়ে তারাদের এড়িয়ে যেন কোথা যাবে ও। তার পরে       হাওয়া যেই নেমে যায়, পাতা-কাঁপা থেমে যায়, ফেরে তার মনটি যেই ভাবে,     মা যে হয় মাটি তার ভালো লাগে আরবার পৃথিবীর কোণটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
এসেছিলু তবু আস নাই, তাই জানায়ে গেলে সমুখের পথে পলাতকা পদ-পতন ফেলে। তোমার সে উদাসীনতা উপহাসভরে জানালো কি মোর দীনতা। সে কি চল-করা অবহেলা, জানি না সে- চপল চরণ সত্য কি ঘাসে ঘাসে গেল উপেক্ষা মেলে। পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা ঝরে জল, ছলছল করে শ্যাম বনাস্ততল।তুমি কোথা দুরে কুঞ্জছায়াতে মিলে গেলে কলমুখর মায়াতে, পিছে পিছে তব ছায়ারৌদ্রের খেলা গেলে তুমি খেলে। বাহিরেতে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
দয়া বলে, কে গো তুমি মুখে নাই কথা? অশ্রুভরা আঁখি বলে, আমি কৃতজ্ঞতা।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
মানুষ কাঁদিয়া হাসে, পুনরায় কাঁদে গো হাসিয়া। পাদপ শুকায়ে গেলে, তবুও সে না হয় পতিত, তরণী ভাঙিয়া গেলে তবু ধীরে যায় সে ভাসিয়া, ছাদ যদি পড়ে যায়, দাঁড়াইয়া রহে তবু ভিত। বন্দী চলে যায় বটে, তবুও তো রহে কারাগার, মেঘে ঢাকিলেও সূর্য কোনোমতে দিন অস্ত হয়, তেমনি হৃদয় যদি ভেঙেচুরে হয় চুরমার, কোনোক্রমে বেঁচে থাকে তবুও সে ভগন হৃদয়। ভগন দর্পণ যথা, ক্রমশ যতই ভগ্ন হয়, ততই সে শত শত, প্রতিবিম্ব করয়ে ধারণ, তেমনি হৃদয় হতে, কিছুই গো যাইবার নয়। হোক না শীতল স্তব্ধ, শত খন্ডে ভগ্ন চূর্ণ মন, হউক-না রক্তহীন, হীনতেজ তবুও তাহারে, বিনিদ্র জ্বলন্ত জ্বালা, ক্রমাগত করিবে দাহন, শুকায়ে শুকায়ে যাবে, অন্তর বিষম শোকভারে, অথচ বাহিরে তার, চিহ্নমাত্র না পাবে দর্শন।George Gordon Byron (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তোমার শঙ্খ ধুলায় প'ড়ে, কেমন করে সইব। বাতাস আলো গেল মরে এ কী রে দুর্দৈব। লড়বি কে আয় ধ্বজা বেয়ে, গান আছে যার ওঠ-না গেয়ে, চলবি যারা চল্‌ রে ধেয়ে, আয় না রে নিঃশঙ্ক। ধুলয় পড়ে রইল চেয়ে ওই যে অভয় শঙ্খ। চলেছিলাম পূজার ঘরে সাজিয়ে ফুলের অর্ঘ্য। খুঁজি সারাদিনের পরে কোথায় শান্তি-শর্গ। এবার আমার হৃদয়-ক্ষত ভেবেছিলাম হবে গত, ধুয়ে মলিন চিহ্ন যত হব নিষ্কলঙ্ক। পথে দেখি ধুলায় নত তোমার মহাশঙ্খ। আরতি-দীপ এই কি জ্বালা। এই কি আমার সন্ধ্যা। গাঁথার রক্তজবার মালা? হায় রজনীগন্ধা। ভেবেছিলাম যোঝাযুঝি মিটিয়ে পাব বিরাম খুঁজি, চুকিয়ে দিয়ে ঋণের পুঁজি, লব তোমার অঙ্ক। হেনকালে ডাকল বুঝি নীরব তব শঙ্খ। যৌবনেরি পরশমণি করাও তবে স্পর্শ। দীপক-তানে উঠুক ধ্বনি দীপ্ত প্রাণের হর্ষ। নিশার বক্ষ বিদায় করে উদ্‌বোধনে গগন ভরে অন্ধ দিকে দিগন্তরে জাগাও-না আতঙ্ক। দুই হাতে আজ তুলব ধরে তোমার জয়শঙ্খ। জানি জানি তন্দ্রা মম রইবে না আর চক্ষে। জানি শ্রাবণধারা-সম বাণ বাজিয়ে বক্ষে। কেউ বা ছুটে আসবে পাশে, কাঁদবে বা কেউ দীর্ঘশ্বাসে, দুঃস্বপনে কাঁপবে ত্রাসে সুপ্তির পর্যঙ্ক। বাজবে যে আজ মহোল্লাসে তোমার মহাশঙ্খ। তোমার কাছে আরাম চেয়ে পেলাম শুধু লজ্জা। এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে পরাও রণসজ্জা। ব্যাঘাত আসুক নব নব, আঘাত খেয়ে অটল রব, বক্ষে আমার দুঃখে তব বাজবে জয়ডঙ্ক। দেব সকল শক্তি, লব অভয় তব শঙ্খ। রামগড়, ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ব্রিজটার প্ল্যান দিল বড়ো এন্‌জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্‌ট্‌ বোর্ডের সবচেয়ে সীনিয়ার। নতুন রকম প্ল্যান দেখে সবে অজ্ঞান, বলে, “এই চাই, এটা চিনি নাই-চিনি আর।’ব্রিজখানা গেল শেষে কোন্‌ অঘটন দেশে, তার সাথে গেছে ভেসে ন হাজার গিনি আর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
হে ভুবন আমি যতক্ষণ তোমারে না বেসেছিনু ভালো ততক্ষণ তব আলো খুঁজে খুঁজে পায় নাই তার সব ধন। ততক্ষণ নিখিল গগন হাতে নিয়ে দীপ তার শূন্যে শূন্যে ছিল পথ চেয়ে। মোর প্রেম এল গান গেয়ে; কী যে হল কানাকানি দিল সে তোমার গলে আপন গলার মালাখানি। মুগ্ধচক্ষে হেসে তোমারে সে গোপনে দিয়েছে কিছু যা তোমার গোপন হৃদয়ে তারার মালার মাঝে চিরদিন রবে গাঁথা হয়ে। সুরুল, ২৮ পৌষ, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
সোম মঙ্গল বুধ এরা সব আসে তাড়াতাড়ি , এদের ঘরে আছে বুঝি মস্ত হাওয়া - গাড়ি ? রবিবার সে কেন , মা গো , এমন দেরি করে ? ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে সকল বারের পরে । আকাশ - পারে তার বাড়িটি দূর কি সবার চেয়ে ? সে বুঝি মা তোমার মতো গরিব - ঘরের মেয়ে ? সোম মঙ্গল বুধের খেয়াল থাকবারই জন্যেই , বাড়ি - ফেরার দিকে ওদের একটুও মন নেই । রবিবারকে কে যে এমন বিষম তাড়া করে , ঘণ্টাগুলো বাজায় যেন আধ ঘণ্টার পরে । আকাশ - পারে বাড়িতে তার কাজ আছে সব - চেয়ে ? সে বুঝি , মা , তোমার মতো গরিব - ঘরের মেয়ে । সোম মঙ্গল বুধের যেন মুখগুলো সব হাঁড়ি ছোটো ছেলের সঙ্গে তাদের বিষম আড়াআড়ি । কিন্তু শনির রাতের শেষে যেমনি উঠি জেগে , রবিবারের মুখে দেখি হাসিই আছে লেগে । যাবার বেলায় যায় সে কেঁদে মোদের মুখে চেয়ে । সে বুঝি , মা , তোমার মতো গরিব ঘরের মেয়ে ? (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি, হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি। হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল, কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
কুসুমের গিয়েছে সৌরভ, জীবনের গিয়েছে গৌরব। এখন যা-কিছু সব ফাঁকি, ঝরিতে মরিতে শুধু বাকি।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তব চিত্তগগনের দূর দিক্‌সীমা বেদনার রাঙা মেঘে পেয়েছে মহিমা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
তম্বুরা কাঁধে নিয়ে শর্মা বাণেশ্বর ভেবেছিল, তীর্থেই যাবে সে থানেশ্বর। হঠাৎ খেয়াল চাপে গাইয়ের কাজ নিতে– বরাবর গেল চলে একদম গাজনিতে, পাঠানের ভাব দেখে ভাঙিল গানের স্বর।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে, গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে। সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে, ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে। ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ, রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া। অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ, সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা। প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি, ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা, বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি, মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
যোগীনদাদার জন্ম ছিল ডেরাস্মাইলখাঁয়ে। পশ্চিমেতে অনেক শহর অনেক গাঁয়ে গাঁয়ে বেড়িয়েছিলেন মিলিটারি জরিপ করার কাজে, শেষ বয়সে স্থিতি হল শিশুদলের মাঝে। "জুলুম তোদের সইব না আর" হাঁক চালাতেন রোজই, পরের দিনেই আবার চলতে ঐ ছেলেদের খোঁজই। দরবারে তাঁর কোনো ছেলের ফাঁক পড়বার জো কী-- ডেকে বলতেন, "কোথায় টুনু, কোথায় গেল খোঁকি।" "ওরে ভজু, ওরে বাঁদর, ওরে লক্ষ্মীছাড়া" হাঁক দিয়ে তাঁর ভারি গলায় মাতিয়ে দিতেন পাড়া। চারদিকে তাঁর ছোটো বড়ো জুটত যত লোভী কেউ বা পেত মার্বেল, কেউ গণেশমার্কা ছবি। কেউ বা লজঞ্জুস, সেটা ছিল মজলিসে তাঁর হাজরি দেবার ঘুষ। কাজলি যদি অকারণে করত অভিমান হেসে বলতেন "হাঁ করো তো", দিতেন ছাঁচি পান। আপনসৃষ্ট নাতনিও তাঁর ছিল অনেকগুলি, পাগলি ছিল, পটলি ছিল, আর ছিল জঙ্গুলি। কেয়া-খয়ের এনে দিত, দিত কাসুন্দিও, মায়ের হাতের জারকলেবু যোগীনদাদার প্রিয়।তখনো তাঁর শক্ত ছিল মুগুর-ভাঁজা দেহ, বয়স যে ষাট পেরিয়ে গেছে বুঝত না তা কেহ। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, চোখদুটি জ্বল্‌জ্বলে, মুখ যেন তাঁর পাকা আমটি, হয়নি সে থল্‌থলে। চওড়া কপাল, সামনে মাথায় বিরল চুলের টাক, গোঁফ জোড়াটার খ্যাতি ছিল, তাই নিয়ে তাঁর জাঁক।দিন ফুরোত, কুলুঙ্গিতে প্রদীপ দিত জ্বালি। বেলের মালা হেঁকে যেত মোড়ের মাথায় মালী। চেয়ে রইতেম মুখের দিকে শান্তশিষ্ট হয়ে, কাঁসর-ঘণ্টা উঠত বেজে গলির শিবালয়ে। সেই সেকালের সন্ধ্যা মোদের সন্ধ্যা ছিল সত্যি, দিন-ভ্যাঙানো ইলেকট্রিকের হয়নিকো উৎপত্তি। ঘরের কোণে কোণে ছায়া, আঁধার বাড়ত ক্রমে, মিট্‌মিটে এক তেলের আলোয় গল্প উঠত জমে। শুরু হলে থামতে তাঁরে দিতেম না তো ক্ষণেক, সতি মিথ্যে যা-খুশি তাই বানিয়ে যেতেন অনেক। ভূগোল হত উলটো-পালটা, কাহিনী আজগুবি, মজা লাগত খুবই। গল্পটুকু দিচ্ছি, কিন্তু দেবার শক্তি নাই তো বলার ভাবে যে রঙটুকু মন আমাদের ছাইত।হুশিয়ারপুর পেরিয়ে গেল ছন্দৌসির গাড়ি, দেড়টা রাতে সর্‌হরোয়ায় দিল স্টেশন ছাড়ি। ভোর থাকতেই হয়ে গেল পার বুলন্দশর আম্লোরিসর্সার। পেরিয়ে যখন ফিরোজাবাদ এল যোগীনদাদার বিষম খিদে পেল। ঠোঙায়-ভরা পকৌড়ি আর চলছে মটরভাজা এমন সময় হাজির এসে জৌনপুরের রাজা। পাঁচশো-সাতশো লোকলস্কর, বিশপঁচিশটা হাতি মাথার উপর ঝালর-দেওয়া প্রকাণ্ড এক হাতি। মন্ত্রী এসেই দাদার মাথায় চড়িয়ে দিল তাজ, বললে, "যুবরাজ, আর কতদিন রইবে প্রভু, মোতিমহল ত্যেজে।' বলতে বলতে রামশিঙা আর ঝাঁঝর উঠল বেজে।              ব্যাপারখানা এই-- রাজপুত্র তেরো বছর রাজভবনে নেই। সদ্য ক'রে বিয়ে, নাথদোয়ারার সেগুনবনে শিকার করতে গিয়ে তার পরে যে কোথায় গেল, খুঁজে না পায় লোক। কেঁদে কেঁদে অন্ধ হল রানীমায়ের চোখ| খোঁজ পড়ে যায় যেমনি কিছু শোনে কানাঘুষায়, খোঁজে পিণ্ডিদাদনখাঁয়ে, খোঁজে লালামুসায়। খুঁজে খুঁজে লুধিয়ানায় ঘুরেছে পঞ্জাবে, গুলজারপুর হয়নি দেখা, শুনছি পরে যাবে। চঙ্গামঙ্গা দেখে এল সবাই আলমগিরে, রাওলপিণ্ডি থেকে এল হতাশ হয়ে ফিরে। ইতিমধ্যে যোগীনদাদা হাৎরাশ জংশনে গেছেন লেগে চায়ের সঙ্গে পাঁউরুটি-দংশনে। দিব্যি চলছে খাওয়া, তারি সঙ্গে খোলা গায়ে লাগছে মিঠে হাওয়া-- এমন সময় সেলাম করলে জৌনপুরের চর; জোড় হাতে কয়, "রাজাসাহেব, কঁহা আপ্‌ কা ঘর।' দাদা ভাবলেন, সম্মানটা নিতান্ত জম্‌কালো, আসল পরিচয়টা তবে না দেওয়াই তো ভালো। ভাবখানা তাঁর দেখে চরের ঘনালো সন্দেহ, এ মানুষটি রাজপুত্রই, নয় কভু আর-কেহ। রাজলক্ষণ এতগুলো একখানা এই গায় ওরে বাস রে, দেখেনি সে আর কোনো জায়গায়। তার পরে মাস পাঁচেক গেছে দুঃখে সুখে কেটে, হারাধনের খবর গেল জৌনপুরের স্টেটে। ইস্টেশনে নির্ভাবনায় বসে আছেন দাদা, কেমন করে কী যে হল লাগল বিষম ধাঁধা। গুর্খা ফৌজ সেলাম করে দাঁড়ালো চারদিকে, ইস্টেশনটা ভরে গেল আফগানে আর শিখে। ঘিরে তাঁকে নিয়ে গেল কোথায় ইটার্সিতে, দেয় কারা সব জয়ধ্বনি উর্‌দুতে ফার্সিতে। সেখান থেকে মৈনপুরী, শেষে লছ্‌মন্‌-ঝোলায় বাজিয়ে সানাই চড়িয়ে দিল ময়ূরপংখি দোলায়। দশটা কাহার কাঁধে নিল, আর পঁচিশটা কাহার সঙ্গে চলল তাঁহার। ভাটিণ্ডাতে দাঁড় করিয়ে জোরালো দূরবীনে দখিনমুখে ভালো করে দেখে নিলেন চিনে বিন্ধ্যাচলের পর্বত। সেইখানেতে খাইয়ে দিল কাঁচা আমের শর্বৎ। সেখান থেকে এক পহরে গেলেন জৌনপুরে পড়ন্ত রোদ্‌দুরে।                    এইখানেতেই শেষে যোগীনদাদা থেমে গেলেন যৌবরাজ্যে এসে। হেসে বললেন, "কী আর বলব দাদা, মাঝের থেকে মটর-ভাজা খাওয়ায় পড়ল বাধা।" "ও হবে না, ও হবে না" বিষম কলরবে ছেলেরা সব চেঁচিয়ে উঠ্‌ল, "শেষ করতেই হবে।" যোগীনদা কয়, "যাক গে, বেঁচে আছি শেষ হয়নি ভাগ্যে। তিনটে দিন না যেতে যেতেই হলেম গলদ্‌ঘর্ম। রাজপুত্র হওয়া কি, ভাই, যে-সে লোকের কর্ম। মোটা মোটা পরোটা আর তিন পোয়াটাক ঘি বাংলাদেশের-হাওয়ায়-মানুষ সইতে পারে কি। নাগরা জুতায় পা ছিঁড়ে যায়, পাগড়ি মুটের বোঝা, এগুলি কি সহ্য করা সোজা। তা ছাড়া এই রাজপুত্রের হিন্দি শুনে কেহ হিন্দি বলেই করলে না সন্দেহ। যেদিন দূরে শহরেতে চলছিল রামলীলা পাহারাটা ছিল সেদিন ঢিলা। সেই সুযোগে গৌড়বাসী তখনি এক দৌড়ে ফিরে এল গৌড়ে। চলে গেল সেই রাত্রেই ঢাকা-- মাঝের থেকে চর পেয়ে যায় দশটি হাজার টাকা। কিন্তু, গুজব শুনতে পেলেম শেষে, কানে মোচড় খেয়ে টাকা ফেরত দিয়েছে সে।"     "কেন তুমি ফিরে এলে" চেঁচাই চারিপাশে, যোগীনদাদা একটু কেবল হাসে। তার পরে তো শুতে গেলেম, আধেক রাত্রি ধ'রে শহরগুলোর নাম যত সব মাথার মধ্যে ঘোরে। ভারতভূমির সব ঠিকানাই ভুলি যদি দৈবে, যোগীনদাদার ভূগোল-গোলা গল্প মনে রইবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
হালকা আমার স্বভাব, মেঘের মতো না হোক গিরিনদীর মতো। আমার মধ্যে হাসির কলরব আজও থামল না। বেদীর থেকে নেমে আসি, রঙ্গমঞ্চে বসে বাঁধি নাচের গান, তার বায়না নিয়েছি প্রভুর কাছে। কবিতা লিখি, তার পদে পদে ছন্দের ভঙ্গিমায় তারুণ্য ওঠে মুখর হয়ে, ঝিঁঝিট খাম্বাজের ঝংকার দিতে আজো সে সংকোচ করে না। আমি সৃষ্টিকর্তা পিতামহের রহস্য-সখা। তিনি অর্বাচীন নবীনদের কাছে প্রবীণ বয়সের প্রমাণ দিতে ভুলেই গেছেন। তরুণের উচ্ছৃঙ্খল হাসিতে উতরোল তাঁর কৌতুক, তাদের উদ্দাম নৃত্যে বাজান তিনি দ্রুততালের মৃদঙ্গ। তাঁর বজ্রমন্দিত গাম্ভীর্য মেঘমেদুর অম্বরে, অজস্র তাঁর পরিহাস বিকশিত কাশবনে, শরতের অকারণ হাস্যহিল্লোলে। তাঁর কোনো লোভ নেই প্রধানদের কাছে মর্যাদা পাবার; তাড়াতাড়ি কালো পাথর চাপা দেন না চাপল্যের ঝরনার মুখে। তাঁর বেলাভূমিতে ভঙ্গুর সৈকতের ছেলেমানুষি প্রতিবাদ করে না সমুদ্রের। আমাকে চান টেনে রাখতে তাঁর বয়স্যদলে, তাই আমার বার্ধক্যের শিরোপা হঠাৎ নেন কেড়ে ফেলে দেন ধুলোয়-- তার উপর দিয়ে নেচে নেচে চলে যায় বৈরাগী পাঁচ রঙের তালি-দেওয়া আলখাল্লা পরে। যারা আমার মূল্য বাড়াতে চায়, পরায় আমাকে দামি সাজ, তাদের দিকে চেয়ে তিনি ওঠেন হেসে, ও সাজ আর টিঁকতে পায় না আনমনার অনবধানে। আমাকে তিনি চেয়েছেন নিজের অবারিত মজলিসে, তাই ভেবেছি যাবার বেলায় যাব মান খুইয়ে, কপালের তিলক মুছে, কৌতুকে রসোল্লাসে। এস আমার অমানী বন্ধুরা মন্দিরা বাজিয়ে-- তোমাদের ধুলোমাখা পায়ে যদি ঘুঙুর বাঁধা থাকে লজ্জা পাব না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
দিনের প্রান্তে এসেছি গোধূলির ঘাটে। পথে পথে পাত্র ভরেছি অনেক কিছু দিয়ে। ভেবেছিলেম চিরপথের পাথেয় সেগুলি; দাম দিয়েছি কঠিন দুঃখে। অনেক করেছি সংগ্রহ মানুষের কথার হাটে, কিছু করেছি সঞ্চয় প্রেমের সদাব্রতে। শেষে ভুলেছি সার্থকতার কথা, অকারণে কুড়িয়ে বেড়ানোই হয়েছে অন্ধ অভ্যাসে বাঁধা; ফুটো ঝুলিটার শূন্য ভরাবার জন্যে বিশ্রাম ছিল না। আজ সামনে যখন দেখি ফুরিয়ে এল পথ, পাথেয়ের অর্থ আর রইল না কিছুই। যে প্রদীপ জ্বলেছিল মিলন-শয্যার পাশে সেই প্রদীপ এনেছিলেম হাতে ক'রে। তার শিখা নিবল আজ, সেটা ভাসিয়ে দিতে হবে স্রোতে। সামনের আকাশে জ্বলবে একলা সন্ধ্যার তারা। যে বাঁশি বাজিয়েছি ভোরের আলোয় নিশীথের অন্ধকারে, তার শেষ সুরটি বেজে থামবে রাতের শেষ প্রহরে। তার পরে? যে জীবনে আলো নিবল সুর থামল, সে যে এই আজকের সমস্ত কিছুর মতোই ভরা সত্য ছিল, সে-কথা একেবারেই ভুলবে জানি, ভোলাই ভালো। তবু তার আগে কোনো একদিনের জন্য কেউ একজন সেই শূন্যটার কাছে একটা ফুল রেখো বসন্তের যে ফুল একদিন বেসেছি ভালো আমার এতদিনকার যাওয়া-আসার পথে শুকনো পাতা ঝরেছে, সেখানে মিলেছে আলোক ছায়া, বৃষ্টিধারায় আমকাঁঠালের ডালে ডালে জেগেছে শব্দের শিহরণ, সেখানে দৈবে কারো সঙ্গে দেখা হয়েছিল জল-ভরা ঘট নিয়ে যে চলে গিয়েছিল চকিত পদে। এই সামান্য ছবিটুকু আর সব কিছু থেকে বেছে নিয়ে কেউ একজন আপন ধ্যানের পটে এঁকো কোনো একটি গোধূলির ধূসরমুহূর্তে। আর বেশি কিছু নয়। আমি আলোর প্রেমিক; প্রাণরঙ্গভূমিতে ছিলুম বাঁশি-বাজিয়ে। পিছনে ফেলে যাব না একটা নীরব ছায়া দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে। যে পথিক অস্তসূর্যের ম্লায়মান আলোর পথ নিয়েছে সে তো ধুলোর হাতে উজাড় করে দিলে সমস্ত আপনার দাবি; সেই ধুলোর উদাসীন বেদীটার সামনে রেখে যেয়ো না তোমার নৈবেদ্য; ফিরে নিয়ে যাও অন্নের থালি, যেখানে তাকিয়ে আছে ক্ষুধা, যেখানে অতিথি বসে আছে দ্বারে, যেখানে প্রহরে প্রহরে বাজছে ঘন্টা জীবনপ্রবাহের সঙ্গে কালপ্রবাহের মিলের মাত্রা রেখে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
দিগন্তে ওই বৃষ্টিহারা মেঘের দলে জুটি লিখে দিল—আজ ভুবনে আকাশভরা ছুটি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
স্তুতি নিন্দা বলে আসি, গুণ মহাশয়, আমরা কে মিত্র তব? গুণ শুনি কয়, দুজনেই মিত্র তোরা শত্রু দুজনেই— তাই ভাবি শত্রু মিত্র কারে কাজ নেই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আজ এই দিনের শেষে সন্ধ্যা যে ওই মানিকখানি পরেছিল চিকন কালো কেশে গেঁথে নিলেম তারে এই তো আমার বিনিসুতার গোপন গলার হারে। চক্রবাকের নিদ্রানীরব বিজন পদ্মাতীরে এই সে সন্ধ্যা ছুঁইয়ে গেল আমার নতশিরে নির্মাল্য তোমার আকাশ হয়ে পার; ওই যে মরি মরি তরঙ্গহীন স্রোতের 'পরে ভাসিয়ে দিল তারার ছায়াতরী; ওই যে সে তার সোনার চেলি দিল মেলি রাতের আঙিনায় ঘুমে অলস কায়; ওই যে শেষে সপ্তঋষির ছায়াপথে কালো ঘোড়ার রথে উড়িয়ে দিয়ে আগুন-ধূলি নিল সে বিদায়; একটি কেবল করুণ পরশ রেখে গেল একটি কবির ভালে; তোমার ওই অনন্ত মাঝে এমন সন্ধ্যা হয় নি কোনোকালে, আর হবে না কভু। এমনি করেই প্রভু এক নিমেষের পত্রপুটে ভরি চিরকালের ধনটি তোমার ক্ষণকালে লও যে নূতন করি। পদ্মা, ২৭ মাঘ, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
হেলাফেলা সারাবেলা এ কী খেলা আপন - সনে ! এই বাতাসে ফুলের বাসে মুখখানি কার পড়ে মনে ! আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি কে জানে গো কাহার হাসি ! দুটি ফোঁটা নয়নসলিল রেখে যায় এই নয়ন কোণে । কোন্ ছায়াতে কোন্ উদাসী দূরে বাজায় অলস বাঁশি , মনে হয় কার মনের বেদন কেঁদে বেড়ায় বাঁশির গানে । সারাদিন গাঁথি গান কারে চাহে , গাহে প্রাণ , তরুতলের ছায়ার মতন বসে আছি ফুলবনে । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
করিয়াছি বাণীর সাধনা দীর্ঘকাল ধরি, আজ তারে ক্ষণে ক্ষণে উপহাস পরিহাস করি। বহু ব্যবহার আর দীর্ঘ পরিচয় তেজ তার করিতেছে ক্ষয়। নিজেরে করিয়া অবহেলা নিজেরে নিয়ে সে করে খেলা। তবু জানি, অজানার পরিচয় আছিল নিহিত বাক্যে তার বাক্যের অতীত। সেই অজানার দূত আজি মোরে নিয়ে যায় দূরে, অকূল সিন্ধুরে নিবেদন করিতে প্রণাম, মন তাই বলিতেছে, আমি চলিলাম।সেই সিন্ধু-মাঝে সূর্য দিনযাত্রা করি দেয় সারা, সেথা হতে সন্ধ্যাতারা রাত্রিরে দেখায়ে আনে পথ যেথা তার রথ চলেছে সন্ধান করিবারে নূতন প্রভাত-আলো তমিস্রার পারে। আজ সব কথা, মনে হয়, শুধু মুখরতা। তারা এসে থামিয়াছে পুরাতন সে মন্ত্রের কাছে ধ্বনিতেছে যাহা সেই নৈঃশব্দ্যচূড়ায় সকল সংশয় তর্ক যে মৌনের গভীরে ফুরায়। লোকখ্যাতি যাহার বাতাসে ক্ষীণ হয়ে তুচ্ছ হয়ে আসে। দিনশেষে কর্মশালা ভাষা রচনার নিরুদ্ধ করিয়া দিক দ্বার। পড়ে থাক্‌ পিছে বহু আবর্জনা, বহু মিছে। বারবার মনে মনে বলিতেছি, আমি চলিলাম-- যেথা নাই নাম, যেখানে পেয়েছে লয় সকল বিশেষ পরিচয়, নাই আর আছে এক হয়ে যেথা মিশিয়াছে, যেখানে অখন্ড দিন আলোহীন অন্ধকারহীন, আমার আমির ধারা মিলে যেথা যাবে ক্রমে ক্রমে পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগরসংগমে। এই বাহ্য আবরণ, জানি না তো, শেষে নানা রূপে রূপান্তরে কালস্রোতে বেড়াবে কি ভেসে। আপন স্বাতন্ত্র৻ হতে নিঃসক্ত দেখিব তারে আমি বাহিরে বহুর সাথে জড়িত অজানা তীর্থগামী।আসন্ন বর্ষের শেষ। পুরাতন আমার আপন শ্লথবৃন্ত ফলের মতন ছিন্ন হয়ে আসিতেছে। অনুভব তারি আপনারে দিতেছে বিস্তারি আমার সকল-কিছু-মাঝে প্রচ্ছন্ন বিরাজে নিগূঢ় অন্তরে যেই একা, চেয়ে আছি পাই যদি দেখা। পশ্চাতের কবি মুছিয়া করিছে ক্ষীণ আপন হাতের আঁকা ছবি। সুদূর সম্মুখে সিন্ধু, নিঃশব্দ রজনী, তারি তীর হতে আমি আপনারি শুনি পদধ্বনি। অসীম পথের পান্থ, এবার এসেছি ধরা-মাঝে মর্তজীবনের কাজে। সে পথের 'পরে ক্ষণে ক্ষণে অগোচরে সকল পাওয়ার মধ্যে পেয়েছি অমূল্য উপাদেয় এমন সম্পদ যাহা হবে মোর অক্ষয় পাথেয়। মন বলে, আমি চলিলাম, রেখে যাই আমার প্রণাম তাঁদের উদ্দেশে যাঁরা জীবনের আলো ফেলেছেন পথে যাহা বারে বারে সংশয় ঘুচালো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
  যে-বসন্ত একদিন করেছিল কত কোলাহল লয়ে দলবল আমার প্রাঙ্গণতলে কলহাস্য তুলে দাড়িম্বে পলাশগুচ্ছে কাঞ্চনে পারুলে; নবীন পল্লবে বনে বনে বিহ্বল করিয়াছিল নীলাম্বর রক্তিম চুম্বনে; সে আজ নিঃশব্দে আসে আমার নির্জনে; অনিমেষে নিস্তব্ধ বসিয়া থাকে নিভৃত ঘরের প্রান্তদেশে চাহি সেই দিগন্তের পানে শ্যামশ্রী মূর্ছিত হয়ে নীলিমায় মরিছে যেখানে। পদ্মা, ২০ মাঘ, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
"এসে মোর কাছে" শুকতারা গাহে গান। প্রদীপের শিখা নিবে চ’লে গেল, মানিল সে আহ্বান।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
অয়ি প্রতিধ্বনি, বুঝি আমি তোরে ভালোবাসি, বুঝি আর কারেও বাসি না। আমারে করিলি তুই আকুল ব্যাকুল, তোর লাগি কাঁদে মোর বীণা। তোর মুখে পাখিদের শুনিয়া সংগীত, নির্ঝরের শুনিয়া ঝর্ঝর, গভীর রহস্যময় অরণ্যের গান, বালকের মধুমাখা স্বর, তোর মুখে জগতের সংগীত শুনিয়া, তোরে আমি ভালোবাসিয়াছি; তবু কেন তোরে আমি দেখিতে না পাই, বিশ্বময় তোরে খুঁজিয়াছি। চিরকাল---চিরকাল---- তুই কি রে চিরকাল সেই দূরে রবি, আধো সুরে গাবি শুধু গীতের আভাস, তুই চিরকবি। দেখা তুই দিবি না কি? নাহয় না দিলি একটি কি পুরাবি না আশ? কাছে হতে একবার শুনিবারে চাই তোর গীতোচ্ছ্বাস। অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের গান, ঝটিকার বজ্রগীতস্বর, দিবসের প্রদোষের রজনীর গীত, চেতনার নিদ্রার মর্মর, বসন্তের বরষার শরতের গান, জীবনের মরণের স্বর, আলোকের পদধ্বনি মহা অন্ধকারে ব্যাপ্ত করি বিশ্বচরাচর, পৃথিবীর চন্দ্রমার গ্রহ-তপনের, কোটি কোটি তারার সংগীত, তোর কাছে জগতের কোন্‌ মাঝখানে না জানি রে হতেছে মিলিত। সেইখানে একবার বসাইবি মোরে সেই মহা-আঁধার নিশায়, শুনিব রে আঁখি মুদি বিশ্বের সংগীত তোর মুখে কেমন শুনায়।জোছনায় ফুলবনে একাকী বসিয়া থাকি, আঁখি দিয়া অশ্রুবারি ঝরে-- বল্‌ মোরে বল্‌ অয়ি মোহিনী ছলনা, সে কি তোরি তরে? বিরামের গান গেয়ে সায়াহ্নের বায় কোথা বহে যায়-- তারি সাথে কেন মোর প্রাণ হু হু করে, সে কি তোরি তরে? বাতাসে সৌরভ ভাসে, আঁধারে কত-না তারা, আকাশে অসীম নীরবতা-- তখন প্রাণের মাঝে কত কথা ভেসে যায়, সে কি তোরি কথা? ফুলের সৌরভগুলি আকাশে খেলাতে এসে বাতাসেতে হয় পথহারা, চারিদিকে ঘুরে হয় সারা, মার কোলে ফিরে যেতে চায়, ফুলে ফুলে খুঁজিয়া বেড়ায়, তেমনি প্রাণের মাঝে অশরীরী আশাগুলি ভ্রমে কেন হেথায় হোথায়-- সেকি কি তোরে চায়? আঁখি যেন কার তরে পথ-পানে চেয়ে আছে দিন গনি গনি, মাঝে মাঝে কারো মুখে সহসা দেখে সে যেন        অতুল রূপের প্রতিধ্বনি, কাছে গেলে মিলাইয়া যায় নিরাশের হাসিটির প্রায়-- সৌন্দর্যে মরীচিকা এ কাহার মায়া, এ কি তোরি ছায়া!জগতের গানগুলি দূর-দূরান্তর হতে দলে দলে তোর কাছে যায়, যেন তারা বহ্নি হেরি পতঙ্গের মতো পদতলে মরিবারে চায়! জগতের মৃত গানগুলি তোর কাছে পেয়ে নব প্রাণ, সংগীতের পরলোক হতে গান যেন দেহমুক্ত গান। তাই তার নব কণ্ঠধ্বনি প্রভাতের স্বপনের প্রায়, কুসুমের সৌরভের সাথে এমন সহজে মিশে যায়।আমি ভাবিতেছি বসে গানগুলি তোরে না জানি কেমনে খুঁজে পায়-- না জানি কোথায় খুঁজে পায়। না জানি কী গুহার মাঝারে অস্ফুট মেঘের উপবনে, স্মৃতি ও আশায় বিজড়িত আলোক-ছায়ার সিংহাসনে, ছায়াময়ী মূর্তিখানি আপনে আপনি মিশি আপনি বিস্মিত আপনায়, কার পানে শূন্যপানে চায়! সায়াহ্নে প্রশান্ত রবি স্বর্ণময় মেঘমাঝে পশ্চিমের সমুদ্রসীমায় প্রভাতের জন্মভূমি শৈশব পুরব-পানে যেমন আকুল নেত্রে চায়, পুরবের শূন্যপটে প্রভাতের স্মৃতিগুলি এখনো দেখিতে যেন পায়, তেমনি সে ছায়াময়ী কোথা যেন চেয়ে আছে কোথা হতে আসিতেছে গান-- এলানো কুন্তলজালে সন্ধ্যার তারকাগুলি   গান শুনে মুদিছে নয়ান। বিচিত্র সৌন্দর্য জগতের হেথা আসি হইতেছে লয়। সংগীত, সৌরভ, শোভা জগতে যা-কিছু আছে সবি হেথা প্রতিধ্বনিময় । প্রতিধ্বনি, তব নিকেতন, তোমার সে সৌন্দর্য অতুল, প্রাণে জাগে ছায়ার মতন-- ভাষা হয় আকুল ব্যাকুল। আমরণ চিরদিন কেবলি খুঁজিব তোরে কখনো কি পাব না সন্ধান? কেবলি কি রবি দূরে, অতি দূর হতে শুনিব রে ওই আধো গান? এই বিশ্বজগতের মাঝখানে দাঁড়াইয়া বাজাইবি সৌন্দর্যের বাঁশি, অনন্ত জীবনপথে খুঁজিয়া চলিব তোরে, প্রাণমন হইবে উদাসী। তপনেরে ঘিরি ঘিরি যেমন ঘুরিছে ধরা, ঘুরিব কি তোর চারি দিকে? অনন্ত প্রাণের পথে বরষিবি গীতধারা, চেয়ে আমি রব অনিমিখে। তোরি মোহময় গান শুনিতেছি অবিরত, তোরি রূপ কল্পনায় লিখা-- করিস নে প্রবঞ্চনা সত্য করে বল্‌ দেখি তুই তো নহিস মরীচিকা? কত বার আর্ত স্বরে শুধায়েছি প্রাণপণে, অয়ি তুমি কোথায়--কোথায়-- অমনি সুদূর হতে কেন তুমি বলিয়াছ ‘কে জানে কোথায়’? আশাময়ী, ও কী কথা তুমি কি আপনহারা-- আপনি জান না আপনায়?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আসা-যাওয়ার পথ চলেছে উদয় হতে অস্তাচলে, কেঁদে হেসে নানান বেশে পথিক চলে দলে দলে। নামের চিহ্ন রাখিতে চায় এই ধরণীর ধুলা জুড়ে, দিন না যেতেই রেখা তাহার ধুলার সাথে যায় যে উড়ে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
মৃত্যু কহে, পুত্র নিব; চোর কহে ধন। ভাগ্য কহে, সব নিব যা তোর আপন। নিন্দুক কহিল, লব তব যশোভার। কবি কহে, কে লইবে আনন্দ আমার?  (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
যেখানে জ্বলিছে সূর্য, উঠিছে সহস্র তারা,          প্রজ্বলিত ধূমকেতু বেড়াইছে ছুটিয়া। অসংখ্য জগৎযন্ত্র, ঘুরিছে নিয়মচক্রে অসংখ্য উজ্জ্বল গ্রহ রহিয়াছে ফুটিয়া। গম্ভীর অচল তুমি, দাঁড়ায়ে দিগন্ত ব্যাপি, সেই আকাশের মাঝে শুভ্র শির তুলিয়া। নির্ঝর ছুটিছে বক্ষে, জলদ ভ্রমিছে শৃঙ্গে, চরণে লুটিছে নদী শিলারাশি ঠেলিয়া। তোমার বিশাল ক্রোড়ে লভিতে বিশ্রাম-সুখ ক্ষুদ্র নর আমি এই আসিয়াছি ছুটিয়া। পৃথিবীর কোলাহল, পারি না সহিতে আর , পৃথিবীর সুখ দুখ গেছে সব মিটিয়া । সারাদিন, সারারাত, সমুচ্চ শিখরে বসি, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহময় শূন্যপানে চাহিয়া। জীবনের সন্ধ্যাকাল কাটাইব ধীরে ধীরে, নিরালয় মরমের গানগুলি গাহিয়া। গভীর নীরব গিরি, জোছনা ঢালিবে চন্দ্র, দূরশৈলমালাগুলি চিত্রসম শোভিবে। ধীরে ধীরে ঝুরু ঝুরু, কাঁপিবেক গাছপালা একে একে ছোটো ছোটো তারাগুলি নিভিবে। তখন বিজনে বসি, নীরবে নয়ন মুদি, স্মৃতির বিষণ্ণ ছবি আঁকিব এ মানসে। শুনিব সুদূর শৈলে, একতানে নির্ঝারিণী, ঝর ঝর ঝর ঝর মৃদুধ্বনি বরষে। ক্রমে ক্রমে আসিবেক জীবনের শেষ দিন, তুষার শয্যার ' পরে রহিব গো শুইয়া। মর মর মর মর দুলিবে গাছের পাতা মাথার উপরে হুহু -- বায়ু যাবে বহিয়া।চোখের সামনে ক্রমে , নিভিবে রবির আলো বনগিরি নির্ঝরিণী অন্ধকারে মিশিবে। তটিনীর মৃদুধ্বনি, নিঝরের ঝর ঝর ক্রমে মৃদুতর হয়ে কানে গিয়া পশিবে। এতকাল যার বুকে, কাটিয়া গিয়াছে দিন, দেখিতে সে ধরাতল শেষ বার চাহিব। সারাদিন কেঁদে কেঁদে -- ক্লান্ত শিশুটির মতো অনন্তের কোলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়িব। সে ঘুম ভাঙিবে যবে, নূতন জীবন ল'য়ে, নূতন প্রেমের রাজ্যে পুন আঁখি মেলিব। যত কিছু পৃথিবীর দুখ,জ্বালা, কোলাহল, ডুবায়ে বিস্মৃতি-জলে মুছে সব ফেলিব। ওই যে অসংখ্য তারা, ব্যাপিয়া অনন্ত শূন্য নীরবে পৃথিবী-পানে রহিয়াছে চাহিয়া। ওই জগতের মাঝে, দাঁড়াইব এক দিন, হৃদয় বিস্ময়-গান উঠিবেক গাহিয়া। রবি শশি গ্রহ তারা, ধূমকেতু শত শত আঁধার আকাশ ঘেরি নিঃশবদে ছুটিছে। বিস্ময়ে শুনিব ধীরে, মহাস্তব্ধ প্রকৃতির অভ্যন্তর হতে এক গীতধ্বনি উঠিছে। গভীর আনন্দ-ভরে, বিস্ফারিত হবে মন হৃদয়ের ক্ষুদ্র ভাব যাবে সব ছিঁড়িয়া। তখন অনন্ত কাল, অনন্ত জগত-মাঝে ভুঞ্জিব অনন্ত প্রেম মনঃপ্রাণ ভরিয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
গাছ দেয় ফল ঋণ ব'লে তাহা নহে। নিজের সে দান নিজেরি জীবনে বহে। পথিক আসিয়া লয় যদি ফলভার প্রাপ্যের বেশি সে সৌভাগ্য তার।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ভাবনা নিয়ে মরিস কেন খেপে। দুঃখ-সুখের লীলা ভাবিস এ কি রইবে বক্ষে চেপে জগদ্দলন-শিলা। চলেছিস রে চলাচলের পথে কোন্‌ সারথির উধাও মনোরথে? নিমেষতরে যুগে যুগান্তরে দিবে না রাশ-ঢিলা। শিশু হয়ে এলি মায়ের কোলে, সেদিন গেল ভেসে। যৌবনেরি বিষম দোলার দোলে কাটল কেঁদে হেসে। রাত্রে যখন হচ্ছিল দীপ জ্বালা কোথায় ছিল আজকে দিনের পালা। আবার কবে কী সুর বাঁধা হবে আজকে পালার শেষে। চলতে যাদের হবে চিরকালই নাইকো তাদের ভার। কোথা তাদের রইবে থলি-থালি, কোথা বা সংসার। দেহযাত্রা মেঘের খেয়া বাওয়া, মন তাহাদের ঘূর্ণা-পাকের হাওয়া; বেঁকে বেঁকে আকার এঁকে এঁকে চলছে নিরাকার। ওরে পথিক, ধর্‌-না চলার গান, বাজা রে একতারা। এই খুশিতেই মেতে উঠুক প্রাণ-- নাইকো কূল-কিনারা। পায়ে পায়ে পথের ধারে ধারে কান্না-হাসির ফুল ফুটিয়ে যা রে, প্রাণ-বসন্তে তুই-যে দখিন হাওয়া গৃহ-বাঁধন-হারা! এই জনমের এই রূপের এই খেলা এবার করি শেষ; সন্ধ্যা হল, ফুরিয়ে এল বেলা, বদল করি বেশ। যাবার কালে মুখ ফিরিয়ে পিছু কান্না আমার ছড়িয়ে যাব কিছু, সামনে সে-ও প্রেমের কাঁদন ভরা চির-নিরুদ্দেশ। বঁধুর চিঠি মধুর হয়ে আছে সেই অজানার দেশে। প্রাণের ঢেউ সে এমনি করেই নাচে এমনি ভালোবেসে। সেখানেতে আবার সে কোন্‌ দূরে আলোর বাঁশি বাজবে গো এই সুরে কোন্‌ মুখেতে সেই অচেনা ফুল ফুটবে আবার হেসে। এইখানে এক শিশির-ভরা প্রাতে মেলেছিলেম প্রাণ। এইখানে এক বীণা নিয়ে হাতে সেধেছিলেম তান। এতকালের সে মোর বীণাখানি এইখানেতেই ফেলে যাব জানি, কিন্তু ওরে হিয়ার মধ্যে ভরি নেব যে তার গান। সে-গান আমি শোনাব যার কাছে নূতন আলোর তীরে, চিরদিন সে সাথে সাথে আছে আমার ভুবন ঘিরে। শরতে সে শিউলি-বনের তলে ফুলের গন্ধে ঘোমটা টেনে চলে, ফাল্গুনে তার বরণমালাখানি পরাল মোর শিরে। পথের বাঁকে হঠাৎ দেয় সে দেখা শুধু নিমেষতরে। সন্ধ্যা-আলোয় রয় সে বসে একা উদাস প্রান্তরে। এমনি করেই তার সে আসা-যাওয়া, এমনি করেই বেদন-ভরা হাওয়া হৃদয়-বনে বইয়ে সে যায় চলে মর্মরে মর্মরে। জোয়ার-ভাঁটার নিত্য চলাচলে তার এই আনাগোনা। আধেক হাসি আধেক চোখের জলে মোদের চেনাশোনা। তারে নিয়ে হল না ঘর বাঁধা, পথে পথেই নিত্য তারে সাধা এমনি করেই আসা-যাওয়ার ডোরে প্রেমেরি জাল-বোনা। শান্তিনিকেতন, ২৯ ফাল্গুন, ১৩২২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে, সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া-মাঝে। বাতাস জল আকাশ আলো সবারে কবে বাসিব ভালো, হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা বসিবে নানা সাজে।নয়নদুটি মেলিলে কবে পরান হবে খুশি, যে পথ দিয়া চলিয়া যাব সবারে যাব তুষি। রয়েছ তুমি, এ কথা কবে জীবন-মাঝে সহজ হবে, আপনি কবে তোমারি নাম ধ্বনিবে সব কাজে।বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস— বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।  (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
নিজের হাতে উপার্জনে সাধনা নেই সহিষ্ণুতার। পরের কাছে হাত পেতে খাই, বাহাদুরি তারি গুঁতার। কৃপণ দাতার অন্নপাকে ডাল যদি বা কমতি থাকে গাল-মিশানো গিলি তো ভাত– নাহয় তাতে নেইকো সুতার। নিজের জুতার পাত্তা না পাই, স্বাদ পাওয়া যায় পরের জুতার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
সুখশ্রমে আমি , সখী , শ্রান্ত অতিশয় ; পড়েছে শিথিল হয়ে শিরার বন্ধন । অসহ্য কোমল ঠেকে কুসুমশয়ন , কুসুমরেণুর সাথে হয়ে যাই লয় । স্বপনের জালে যেন পড়েছি জড়ায়ে । যেন কোন্ অস্তাচলে সন্ধ্যাস্বপ্নময় রবির ছবির মতো যেতেছি গড়ায়ে , সুদূরে মিলিয়া যায় নিখিলনিলয় । ডুবিতে ডুবিতে যেন সুখের সাগরে কোথাও না পাই ঠাঁই , শ্বাস রুদ্ধ হয় — পরান কাঁদিতে থাকে মৃত্তিকার তরে । এ যে সৌরভের বেড়া , পাষাণের নয় — কেমনে ভাঙিতে হবে ভাবিয়া না পাই , অসীম নিদ্রার ভারে পড়ে আছি তাই ।  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা, একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক, রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।আর-পারে আমবন তালবন চলে, গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে। তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে। বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে, বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে, ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে। দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া, বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
কাল যবে সন্ধ্যাকালে বন্ধুসভাতলে গাহিতে তোমার গান কহিল সকলে সহসা রুধিয়া গেল হৃদয়ের দ্বার– যেথায় আসন তব, গোপন আগার। স্থানভেদে তব গান– মূর্তি নব নব– সখাসনে হাস্যোচ্ছ্বাস সেও গান তব, প্রিয়াসনে প্রিয়ালাপ, শিশুসনে খেলা– জগতে যেথায় যত আনন্দের মেলা সর্বত্র তোমার গান বিচিত্র গৌরবে আপনি ধ্বনিতে থাকে সরবে নীরবে। আকাশে তারকা ফুটে, ফুলবনে ফুল, খনিতে মানিক থাকে– হয় নাকো ভুল। তেমনি আপনি তুমি যেখানে যে গান রেখেছ, কবিও যেন রাখে তার মান।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আজ বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা বাদরে। আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে। শালের বনে থেকে থেকে ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে, জল ছুটে যায় এঁকেবেঁকে মাঠের ‘পরে। আজ মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে।ওরে বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে ওই ঝড়ে, বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর কাহার পায়ে পড়ে। অন্তরে আজ কী কলরোল, দ্বারে দ্বারে ভাঙল আগল, হৃদয়-মাঝে জাগল পাগল আজি ভাদরে। আজ এমন করে কে মেতেছে বাহিরে ঘরে।১৪ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
বঁধুয়া, হিয়া পর আওরে, মিঠি মিঠি হাসয়ি, মৃদু মধু ভাষয়ি, হমার মুখ পর চাওরে! যুগ যুগ সম কত দিবস বহয়ি গল, শ্যাম তু আওলি না, চন্দ-উজর মধু-মধুর কুঞ্জপর মুরলি বজাওলি না! লয়ি গলি সাথ বয়ানক হাসরে, লয়ি গলি নয়ন-আনন্দ! শূন্য বৃন্দাবন, শূন্য হৃদয় মন, কঁহি ছিল ও মুখ চন্দ? ইথি ছিল আকুল গোপ নয়ন জল, কথি ছিল ও তব হাসি?ইথি ছিল নীরব বংশীবটতট, কথি ছিল ও তব বাঁশি! আওলি যদিরে ঠারলি কাহে, সরমে মলিন বয়ান! আপন দুখ কথা কছু নহি বোলব, নিয়ড় আও তুঁহু কান! তুঝ মুখ চাহয়ি শত-যুগ-ভর দুখ নিমিখে ভেল অবসান। এক হাসি তুঝ দূর করল রে সকল মান অভিমান! ধন্য ধন্য রে ভানু গাহিছে প্রেমক নাহিক ওর। হরখে পুলকিত জগত চরাচর দুহুঁক প্রেমরস ভোর।(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
বাদল-শেষের আবেশ আছে ছুঁয়ে তমালছায়াতলে, সজনে গাছের ডাল পড়েছে নুয়ে দিঘির প্রান্তজলে। অস্তরবির-পথ-তাকানো মেঘে কালোর বুকে আলোর বেদন লেগে-- কেন এমন খনে কে যেন সে উঠল হঠাৎ জেগে আমার শূন্য মনে।"কে গো তুমি, ওগো ছায়ায় লীন" প্রশ্ন পুছিলাম। সে কহিল, "ছিল এমন দিন জেনেছ মোর নাম। নীরব রাতে নিসুত দ্বিপ্রহরে প্রদীপ তোমার জ্বেলে দিলেম ঘরে, চোখে দিলেম চুমো; সেদিন আমায় দেখলে আলস-ভরে আধ-জাগা আধ-ঘুমো।আমি তোমার খেয়ালস্রোতে তরী, প্রথম-দেওয়া খেয়া-- মাতিয়েছিলেম শ্রাবণশর্বরী লুকিয়ে-ফোটা কেয়া। সেদিন তুমি নাও নি আমায় বুঝে, জেগে উঠে পাও নি ভাষা খুঁজে, দাও নি আসন পাতি-- সংশয়িত স্বপন-সাথে যুঝে কাটল তোমার রাতি।তার পরে কোন্‌ সব-ভুলিবার দিনে নাম হল মোর হারা! আমি যেন অকালে আশ্বিনে এক-পসলার ধারা। তার পরে তো হল আমার জয়-- সেই প্রদোষের ঝাপসা পরিচয় ভরল তোমার ভাষা, তার পরে তো তোমার ছন্দোময় বেঁধেছি মোর বাসা।চেনো কিম্বা নাই বা আমায় চেনো তবু তোমার আমি। সেই সেদিনের পায়ের ধ্বনি জেনো আর যাবে না থামি। যে-আমারে হারালে সেই কবে তারই সাধন করে গানের রবে তোমার বীণাখানি। তোমার বনে প্রোল্লোল পল্লবে তাহার কানাকানি।সেদিন আমি এসেছিলেম একা তোমার আঙিনাতে। দুয়ার ছিল পাথর দিয়ে ঠেকা নিদ্রাঘেরা রাতে। যাবার বেলা সে-দ্বার গেছি খুলে গন্ধ-বিভোল পবন-বিলোল ফুলে, রঙ-ছড়ানো বনে-- চঞ্চলিত কত শিথিল চুলে, কত চোখের কোণে।রইল তোমার সকল গানের সাথে ভোলা নামের ধুয়া। রেখে গেলেম সকল প্রিয়হাতে এক নিমেষের ছুঁয়া। মোর বিরহ সব মিলনের তলে রইল গোপন স্বপন-অশ্রুজলে-- মোর আঁচলের হাওয়া আজ রাতে ওই কাহার নীলাঞ্চলে উদাস হয়ে ধাওয়া।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ছবি আঁকার মানুষ ওগো পথিক চিরকেলে, চলছ তুমি আশেপাশে দৃষ্টির জাল ফেলে। পথ-চলা সেই দেখাগুলো লাইন দিয়ে এঁকে পাঠিয়ে দিলে দেশ-বিদেশের থেকে। যাহা-তাহা যেমন-তেমন আছে কতই কী যে, তোমার চোখে ভেদ ঘটে নাই চণ্ডালে আর দ্বিজে। ঐ যে গরিবপাড়া, আর কিছু নেই ঘেঁষাঘেঁষি কয়টা কুটীর ছাড়া। তার ওপারে শুধু চৈত্রমাসের মাঠ করছে ধু ধু। এদের পানে চক্ষু মেলে কেউ কভু কি দাঁড়ায়, ইচ্ছে ক'রে এ ঘরগুলোর ছায়া কি কেউ মাড়ায়। তুমি বললে, দেখার ওরা অযোগ্য নয় মোটে; সেই কথাটিই তুলির রেখায় তক্ষনি যায় রটে। হঠাৎ তখন ঝেঁকে উঠে আমরা বলি, তাই তো, দেখার মতোই জিনিস বটে, সন্দেহ তার নাই তো।    ঐযে কারা পথে চলে, কেউ করে বিশ্রাম, নেই বললেই হয় ওরা সব, পোঁছে না কেউ নাম-- তোমার কলম বললে, ওরা খুব আছে এই জেনো; অমনি বলি, তাই বটে তো, সবাই চেনো-চেনো। ওরাই আছে, নেইকো কেবল বাদশা কিংবা নবাব; এই ধরণীর মাটির কোলে থাকাই ওদের স্বভাব। অনেক খরচ ক'রে রাজা আপন ছবি আঁকায়, তার পানে কি রসিক লোকে কেউ কখনো তাকায়। সে-সব ছবি সাজে-সজ্জায় বোকার লাগায় ধাধাঁ, আর এরা সব সত্যি মানুষ সহজ রূপেই বাঁধা।    ওগো চিত্রী, এবার তোমার কেমন খেয়াল এ যে, এঁকে বসলে ছাগল একটা উচ্চশ্রবা ত্যেজে। জন্তুটা তো পায় না খাতির হঠাৎ চোখে ঠেকলে, সবাই ওঠে হাঁ হাঁ ক'রে সবজি-খেতে দেখলে। আজ তুমি তার ছাগলামিটা ফোটালে যেই দেহে এক মুহূর্তে চমক লেগে বলে উঠলেম, কে হে। ওরে ছাগলওয়ালা, এটা তোরা ভাবিস কার-- আমি জানি, একজনের এই প্রথম আবিষ্কার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
কল্লোলমুখর দিন ধায় রাত্রি-পানে। উচ্ছল নির্ঝর চলে সিন্ধুর সন্ধানে। বসন্তে অশান্ত ফুল পেতে চায় ফল। স্তব্ধ পূর্ণতার পানে চলিছে চঞ্চল।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বদেশমূলক
১ নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল , বিকশিত যৌবনের বসন্তসমীরে কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে , সৌরভসুধায় করে পরান পাগল । মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে । কী যেন বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয় , সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে — শরমে মরিতে চায় অঞ্চল – আড়ালে । প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয় , উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে । হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্মীর — হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির ।২ পবিত্র সুমেরু বটে এই সে হেথায় , দেবতা বিহারভূমি কনক – অচল । উন্নত সতীর স্তন স্বরগ প্রভায় মানবের মর্ত্যভূমি করেছে উজ্জ্বল । শিশু রবি হোথা হতে ওঠে সুপ্রভাতে , শ্রান্ত রবি সন্ধ্যাবেলা হোথা অস্ত যায় । দেবতার আঁখিতারা জেগে থাকে রাতে , বিমল পবিত্র দুটি বিজন শিখরে । চিরস্নেহ – উৎসধারে অমৃত নির্ঝরে সিক্ত করি তুলিতেছে বিশ্বের অধর । জাগে সদা সুখসুপ্ত ধরণীর’পরে , অসহায় জগতের অসীম নির্ভর । ধরণীর মাঝে থাকি স্বর্গ আছে চুমি , দেবশিশু মানবের ওই মাতৃভূমি ।  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আজি এই আকুল আশ্বিনে মেঘে-ঢাকা দুরন্ত দুর্দিনে হেমন্ত-ধানের খেতে         বাতাস উঠেছে মেতে, কেমনে চলিবে পথ চিনে? আজি এই দুরন্ত দুর্দিনে! দেখিছ না ওগো সাহসিকা, ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা! মনে ভেবে দেখো তবে      এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে কবরীর শেফালিমালিকা। ভেবে দেখো ওগো সাহসিকা! আজিকার এমন ঝঞ্ঝায় নূপুর বাঁধে কি কেহ পায়? যদি আজি বৃষ্টির জল       ধুয়ে দেয় নীলাঞ্চল গ্রামপথে যাবে কি লজ্জায় আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়?             হে উতলা শোনো কথা শোনো, দুয়ার কি খোলা আছে কোনো? এ বাঁকা পথের শেষে        মাঠ যেথা মেঘে মেশে বসে কেহ আছে কি এখনো? এ দুর্যোগে, শোনো ওগো শোনো! আজ যদি দীপ জ্বালে দ্বারে নিবে কি যাবে না বারে বারে? আজ যদি বাজে বাঁশি        গান কি যাবে না ভাসি আশ্বিনের অসীম আঁধারে ঝড়ের ঝাপটে বারে বারে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
পশ্চিমে বাগান বন চষা-খেত মিলে গেছে দূর বনান্তে বেগনি বাষ্পরেখায়; মাঝে আম জাম তাল তেঁতুলে ঢাকা সাঁওতালপাড়া; পাশ দিয়ে ছায়াহীন দীর্ঘ পথ গেছে বেঁকে রাঙা পাড় যেন সবুজ শাড়ির প্রান্তে কুটিল রেখায়। হঠাৎ উঠেছে এক-একটা যূথভ্রষ্ট তালগাছ, দিশাহারা অনির্দিষ্টকে যেন দিক দেখাবার ব্যাকুলতা। পৃথিবীর একটানা সবুজ উত্তরীয় তারি এক ধারে ছেদ পড়েছে উত্তর দিকে, মাটি গেছে ক্ষ’য়ে,               দেখা দিয়েছে উর্মিল লাল কাঁকরের নিস্তব্ধ তোলপাড়– মাঝে মাঝে মরচে-ধরা কালো মাটি মহিষাসুরের মুণ্ড যেন। পৃথিবী আপনার একটি কোণের প্রাঙ্গণে বর্ষাধারার আঘাতে বানিয়েছে ছোটো ছোটো অখ্যাত খেলার পাহাড়, বয়ে চলেছে তার তলায় তলায় নামহীন খেলার নদী।শরৎকালে পশ্চিম-আকাশে সূর্যাস্তের ক্ষণিক সমারোহে রঙের সঙ্গে রঙের ঠেলাঠেলি– তখন পৃথিবীর এই ধূসর ছেলেমানুষির উপরে দেখেছি সেই মহিমা যা একদিন পড়েছে আমার চোখে দুর্লভ দিনাবসানে রোহিত সমুদ্রের তীরে তীরে জনশূন্য তরুহীন পর্বতের রক্তবর্ণ শিখরশ্রেণীতে, রুষ্টরুদ্রের প্রলয়ভ্রূকুঞ্চনের মতো। এই পথে ধেয়ে এসেছে কালবৈশাখীর ঝড়, গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে ঘোড়সওয়ার বর্গি- সৈন্যের মতো– কাঁপিয়ে দিয়েছে শাল-সেগুনকে, নুইয়ে দিয়েছে ঝাউয়ের মাথা, হায়-হায় রব তুলেছে বাঁশের বনে, কলাবাগানে করেছে দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য। ক্রন্দিত আকাশের নীচে ওই ধূসর বন্ধুর কাঁকরের স্তূপগুলো দেখে মনে হয়েছে লাল সমুদ্রে তুফান উঠল, ছিটকে পড়ছে তার শীকরবিন্দু।এসেছিলেম বালককালে। ওখানে গুহাগহ্বরে ঝির্‌ ঝির্‌ ঝর্নার ধারায় রচনা করেছি মন-গড়া রহস্যকথা, খেলেছি নুড়ি সাজিয়ে নির্জন দুপুর বেলায় আপন-মনে একলা। তার পরে অনেক দিন হল, পাথরের উপর নির্ঝরের মতো আমার উপর দিয়ে বয়ে গেল অনেক বৎসর। রচনা করতে বসেছি একটা কাজের রূপ ওই আকাশের তলায় ভাঙামাটির ধারে, ছেলেবেলায় যেমন রচনা করেছি নুড়ির দুর্গ! এই শালবন, এই একলা-মেজাজের তালগাছ, ওই সবুজ মাঠের সঙ্গে রাঙামাটির মিতালি এর পানে অনেক দিন যাদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়েছি, যারা মন মিলিয়েছিল এখানকার বাদল-দিনে আর আমার বাদল-গানে, তারা কেউ আছে কেউ গেল চলে। আমারও যখন শেষ হবে দিনের কাজ, নিশীথরাত্রের তারা ডাক দেবে আকাশের ও পার থেকে– তার পরে? তার পরে রইবে উত্তর দিকে ওই বুক-ফাটা ধরণীর রক্তিমা, দক্ষিণ দিকে চাষের খেত, পুব দিকের মাঠে চরবে গোরু। রাঙামাটির রাস্তা বেয়ে গ্রামের লোক যাবে হাট করতে। পশ্চিমের আকাশপ্রান্তে আঁকা থাকবে একটি নীলাঞ্জনরেখা। ৩০ শ্রাবণ, ১৩৩৯পশ্চিমে বাগান বন চষা-খেত মিলে গেছে দূর বনান্তে বেগনি বাষ্পরেখায়; মাঝে আম জাম তাল তেঁতুলে ঢাকা সাঁওতালপাড়া; পাশ দিয়ে ছায়াহীন দীর্ঘ পথ গেছে বেঁকে রাঙা পাড় যেন সবুজ শাড়ির প্রান্তে কুটিল রেখায়। হঠাৎ উঠেছে এক-একটা যূথভ্রষ্ট তালগাছ, দিশাহারা অনির্দিষ্টকে যেন দিক দেখাবার ব্যাকুলতা। পৃথিবীর একটানা সবুজ উত্তরীয় তারি এক ধারে ছেদ পড়েছে উত্তর দিকে, মাটি গেছে ক্ষ’য়ে,               দেখা দিয়েছে উর্মিল লাল কাঁকরের নিস্তব্ধ তোলপাড়– মাঝে মাঝে মরচে-ধরা কালো মাটি মহিষাসুরের মুণ্ড যেন। পৃথিবী আপনার একটি কোণের প্রাঙ্গণে বর্ষাধারার আঘাতে বানিয়েছে ছোটো ছোটো অখ্যাত খেলার পাহাড়, বয়ে চলেছে তার তলায় তলায় নামহীন খেলার নদী।শরৎকালে পশ্চিম-আকাশে সূর্যাস্তের ক্ষণিক সমারোহে রঙের সঙ্গে রঙের ঠেলাঠেলি– তখন পৃথিবীর এই ধূসর ছেলেমানুষির উপরে দেখেছি সেই মহিমা যা একদিন পড়েছে আমার চোখে দুর্লভ দিনাবসানে রোহিত সমুদ্রের তীরে তীরে জনশূন্য তরুহীন পর্বতের রক্তবর্ণ শিখরশ্রেণীতে, রুষ্টরুদ্রের প্রলয়ভ্রূকুঞ্চনের মতো। এই পথে ধেয়ে এসেছে কালবৈশাখীর ঝড়, গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে ঘোড়সওয়ার বর্গি- সৈন্যের মতো– কাঁপিয়ে দিয়েছে শাল-সেগুনকে, নুইয়ে দিয়েছে ঝাউয়ের মাথা, হায়-হায় রব তুলেছে বাঁশের বনে, কলাবাগানে করেছে দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য। ক্রন্দিত আকাশের নীচে ওই ধূসর বন্ধুর কাঁকরের স্তূপগুলো দেখে মনে হয়েছে লাল সমুদ্রে তুফান উঠল, ছিটকে পড়ছে তার শীকরবিন্দু।এসেছিলেম বালককালে। ওখানে গুহাগহ্বরে ঝির্‌ ঝির্‌ ঝর্নার ধারায় রচনা করেছি মন-গড়া রহস্যকথা, খেলেছি নুড়ি সাজিয়ে নির্জন দুপুর বেলায় আপন-মনে একলা। তার পরে অনেক দিন হল, পাথরের উপর নির্ঝরের মতো আমার উপর দিয়ে বয়ে গেল অনেক বৎসর। রচনা করতে বসেছি একটা কাজের রূপ ওই আকাশের তলায় ভাঙামাটির ধারে, ছেলেবেলায় যেমন রচনা করেছি নুড়ির দুর্গ! এই শালবন, এই একলা-মেজাজের তালগাছ, ওই সবুজ মাঠের সঙ্গে রাঙামাটির মিতালি এর পানে অনেক দিন যাদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়েছি, যারা মন মিলিয়েছিল এখানকার বাদল-দিনে আর আমার বাদল-গানে, তারা কেউ আছে কেউ গেল চলে। আমারও যখন শেষ হবে দিনের কাজ, নিশীথরাত্রের তারা ডাক দেবে আকাশের ও পার থেকে– তার পরে? তার পরে রইবে উত্তর দিকে ওই বুক-ফাটা ধরণীর রক্তিমা, দক্ষিণ দিকে চাষের খেত, পুব দিকের মাঠে চরবে গোরু। রাঙামাটির রাস্তা বেয়ে গ্রামের লোক যাবে হাট করতে। পশ্চিমের আকাশপ্রান্তে আঁকা থাকবে একটি নীলাঞ্জনরেখা। ৩০ শ্রাবণ, ১৩৩৯পশ্চিমে বাগান বন চষা-খেত মিলে গেছে দূর বনান্তে বেগনি বাষ্পরেখায়; মাঝে আম জাম তাল তেঁতুলে ঢাকা সাঁওতালপাড়া; পাশ দিয়ে ছায়াহীন দীর্ঘ পথ গেছে বেঁকে রাঙা পাড় যেন সবুজ শাড়ির প্রান্তে কুটিল রেখায়। হঠাৎ উঠেছে এক-একটা যূথভ্রষ্ট তালগাছ, দিশাহারা অনির্দিষ্টকে যেন দিক দেখাবার ব্যাকুলতা। পৃথিবীর একটানা সবুজ উত্তরীয় তারি এক ধারে ছেদ পড়েছে উত্তর দিকে, মাটি গেছে ক্ষ’য়ে,               দেখা দিয়েছে উর্মিল লাল কাঁকরের নিস্তব্ধ তোলপাড়– মাঝে মাঝে মরচে-ধরা কালো মাটি মহিষাসুরের মুণ্ড যেন। পৃথিবী আপনার একটি কোণের প্রাঙ্গণে বর্ষাধারার আঘাতে বানিয়েছে ছোটো ছোটো অখ্যাত খেলার পাহাড়, বয়ে চলেছে তার তলায় তলায় নামহীন খেলার নদী।শরৎকালে পশ্চিম-আকাশে সূর্যাস্তের ক্ষণিক সমারোহে রঙের সঙ্গে রঙের ঠেলাঠেলি– তখন পৃথিবীর এই ধূসর ছেলেমানুষির উপরে দেখেছি সেই মহিমা যা একদিন পড়েছে আমার চোখে দুর্লভ দিনাবসানে রোহিত সমুদ্রের তীরে তীরে জনশূন্য তরুহীন পর্বতের রক্তবর্ণ শিখরশ্রেণীতে, রুষ্টরুদ্রের প্রলয়ভ্রূকুঞ্চনের মতো। এই পথে ধেয়ে এসেছে কালবৈশাখীর ঝড়, গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে ঘোড়সওয়ার বর্গি- সৈন্যের মতো– কাঁপিয়ে দিয়েছে শাল-সেগুনকে, নুইয়ে দিয়েছে ঝাউয়ের মাথা, হায়-হায় রব তুলেছে বাঁশের বনে, কলাবাগানে করেছে দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য। ক্রন্দিত আকাশের নীচে ওই ধূসর বন্ধুর কাঁকরের স্তূপগুলো দেখে মনে হয়েছে লাল সমুদ্রে তুফান উঠল, ছিটকে পড়ছে তার শীকরবিন্দু।এসেছিলেম বালককালে। ওখানে গুহাগহ্বরে ঝির্‌ ঝির্‌ ঝর্নার ধারায় রচনা করেছি মন-গড়া রহস্যকথা, খেলেছি নুড়ি সাজিয়ে নির্জন দুপুর বেলায় আপন-মনে একলা। তার পরে অনেক দিন হল, পাথরের উপর নির্ঝরের মতো আমার উপর দিয়ে বয়ে গেল অনেক বৎসর। রচনা করতে বসেছি একটা কাজের রূপ ওই আকাশের তলায় ভাঙামাটির ধারে, ছেলেবেলায় যেমন রচনা করেছি নুড়ির দুর্গ! এই শালবন, এই একলা-মেজাজের তালগাছ, ওই সবুজ মাঠের সঙ্গে রাঙামাটির মিতালি এর পানে অনেক দিন যাদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়েছি, যারা মন মিলিয়েছিল এখানকার বাদল-দিনে আর আমার বাদল-গানে, তারা কেউ আছে কেউ গেল চলে। আমারও যখন শেষ হবে দিনের কাজ, নিশীথরাত্রের তারা ডাক দেবে আকাশের ও পার থেকে– তার পরে? তার পরে রইবে উত্তর দিকে ওই বুক-ফাটা ধরণীর রক্তিমা, দক্ষিণ দিকে চাষের খেত, পুব দিকের মাঠে চরবে গোরু। রাঙামাটির রাস্তা বেয়ে গ্রামের লোক যাবে হাট করতে। পশ্চিমের আকাশপ্রান্তে আঁকা থাকবে একটি নীলাঞ্জনরেখা। ৩০ শ্রাবণ, ১৩৩৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বিরাট মানবচিত্তে অকথিত বাণীপুঞ্জ অব্যক্ত আবেগে ফিরে কাল হতে কালে মহাশূন্যে নীহারিকাসম। সে আমার মনঃসীমানার সহসা আঘাতে ছিন্ন হয়ে আকারে হয়েছে ঘনীভূত, আবর্তন করিতেছে আমার রচনাকক্ষপথে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
মত্ত সাগর দিল পাড়ি গহন রাত্রিকালে ওই যে আমার নেয়ে। ঝড় বয়েছে, ঝড়ের হাওয়া লাগিয়ে দিয়ে পালে আসছে তরী বেয়ে। কালো রাতের কালি-ঢালা ভয়ের বিষম বিষে আকাশ যেন মূর্ছি পড়ে সাগরসাথে মিশে, উতল ঢেউয়ের দল খেপেছে, না পায় তারা দিশে, উধাও চলে ধেয়ে। হেনকালে এ-দুর্দিনে ভাবল মনে কী সে কূলছাড়া মোর নেয়ে। এমন রাতে উদাস হয়ে কেমন অভিসারে আসে আমার নেয়ে। সাদা পালের চমক দিয়ে নিবিড় অন্ধকারে আসছে তরী বেয়ে। কোন্‌ ঘাটে যে ঠেকবে এসে কে জানে তার পাতি, পথহারা কোন্‌ পথ দিয়ে সে আসবে রাতারাতি, কোন অচেনা আঙিনাতে তারি পূজার বাতি রয়েছে পথ চেয়ে। অগৌরবার বাড়িয়ে গরব আপন সাথি বিরহী মোর নেয়ে। এই তুফানে এই তিমিরে খোঁজে কেমন খোঁজা বিবাগী মোর নেয়ে। নাহি জানি পুর্ণ ক'রে কোন্‌ রতনের বোঝা আসছে তরী বেয়ে। নহে নহে, নাইকো মানিক, নাই রতনের ভার, একটি ফুলের গুচ্ছ আছে রজনীগন্ধার, সেইটি হাতে আঁধার রাতে সাগর হবে পার আনমনে গান গেয়ে। কার গলাতে নবীন প্রাতে পরিয়ে দেবে হার নবীন আমার নেয়ে। সে থাকে এক পথের পাশে, অদিনে যার তরে বাহির হল নেয়ে। তারি লাগি পাড়ি দিয়ে সবার অগোচরে আসছে তরী বেয়ে। রুক্ষ অলক উড়ে পড়ে, সিক্ত-পলক আঁখি, ভাঙা ভিতের ফাঁক দিয়ে তার বাতাস চলে হাঁকি দীপের আলো বাদল-বায়ে কাঁপছে থাকি থাকি ছায়াতে ঘর ছেয়ে। তোমরা যাহার নাম জান না তাহারি নাম ডাকি ওই যে আসে নেয়ে। অনেক দেরি হয়ে গেছে বাহির হল কবে উন্মনা মোর নেয়ে। এখনো রাত হয় নি প্রভাত, অনেক দেরি হবে আসতে তরী বেয়ে। বাজবে নাকো তূরী ভেরী, জানবে নাকো কেহ, কেবল যাবে আঁধার কেটে, আলোয় ভরবে গেহ, দৈন্য যে তার ধন্য হবে, পুণ্য হবে দেহ পুলক-পরশ পেয়ে নীরবে তার চিরদিনের ঘুচিবে সন্দেহ কূলে আসবে নেয়ে। কলিকাতা, ৫ ভাদ্র, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব লোকের মাঝে; মোর আঁকা পটে দেখেছে তোমায় অনেকে অনেক সাজে। কত জনে এসে মোরে ডেকে কয় “কে গো সে’, শুধায় তব পরিচয়– “কে গো সে।’ তখন কী কই, নাহি আসে বাণী, আমি শুধু বলি,”কী জানি! কী জানি!’ তুমি শুনে হাস, তারা দুষে মোরে কী দোষে।তোমার অনেক কাহিনী গাহিয়াছি আমি অনেক গানে। গোপন বারতা লুকায়ে রাখিতে পারি নি আপন প্রাণে। কত জন মোরে ডাকিয়া কয়েছে, “যা গাহিছ তার অর্থ রয়েছে কিছু কি।’ তখন কী কই, নাহি আসে বাণী, আমি শুধু বলি,”অর্থ কী জানি!’ তারা হেসে যায়,তুমি হাস বসে মুচুকি।তোমায় জানি না চিনি না এ কথা বলো তো কেমনে বলি। খনে খনে তুমি উঁকি মারি চাও, খনে খনে যাও ছলি। জ্যোৎস্নানিশীথে পূর্ণ শশীতে দেখেছি তোমার ঘোমটা খসিতে, আঁখির পলকে পেয়েছি তোমায় লখিতে। বক্ষ সহসা উঠিয়াছে দুলি, অকারণে আঁখি উঠেছে আকুলি, বুঝেছি হৃদয়ে ফেলেছ চরণ চকিতে।তোমায় খনে খনে আমি বাঁধিতে চেয়েছি কথার ডোরে। চিরকাল-তরে গানের সুরেতে রাখিতে চেয়েছি ধরে। সোনার ছন্দে পাতিয়াছি ফাঁদ, বাঁশিতে ভরেছি কোমল নিখাদ, তবু সংশয় জাগে ধরা তুমি দিলে কি! কাজ নাই,তুমি যা খুশি তা করো– ধরা না’ই দাও মোর মন হরো, চিনি বা না চিনি প্রাণ উঠে যেন পুলকি।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার, তোমার কাছে রাখে নি আর সাজের অহংকার। অলংকার যে মাঝে পড়ে মিলনেতে আড়াল করে, তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার।তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা, মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা। জীবন লয়ে যতন করি’ যদি সকল বাঁশি গড়ি, আপন সুরে দিবে ভরি সকল ছিদ্র তার।কলিকাতা, ১ শ্রাবণ,  ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
কাঁধে মই, বলে “কই ভূঁইচাপা গাছ’, দইভাঁড়ে ছিপ ছাড়ে, খোঁজে কইমাছ, ঘুঁটেছাই মেখে লাউ রাঁধে ঝাউপাতা– কী খেতাব দেব তায় ঘুরে যায় মাথা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
একাকিনী বসে থাকে আপনারে সাজায়ে যতনে। বসনে ভূষণে যৌবনেরে করে মূল্যবান। নিজেরে করিবে দান যার হাতে সে অজানা তরুণের সাথে এই যেন দূর হতে তার কথা-বলা। এই প্রসাধনকলা, নয়নের এ-কজ্জললেখা, উজ্জ্বল বসন্তীরঙা অঞ্চলের এ-বঙ্কিমরেখা মণ্ডিত করেছে দেহ প্রিয়সম্ভাষণে। দক্ষিণপবনে অস্পষ্ট উত্তর আসে শিরীষের কম্পিত ছায়ায়। এইমতো দিন যায়, ফাগুনের গন্ধে ভরা দিন। সায়াহ্নিক দিগন্তের সীমন্তে বিলীন কুঙ্কুম-আভায় আনে উৎকণ্ঠিত প্রাণে তুলি' দীর্ঘশ্বাস-- অভাবিত মিলনের আরক্ত আভাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ওই দেখো মা, আকাশ ছেয়ে মিলিয়ে এল আলো, আজকে আমার ছুটোছুটি লাগল না আর ভালো। ঘণ্টা বেজে গেল কখন, অনেক হল বেলা। তোমায় মনে পড়ে গেল, ফেলে এলেম খেলা। আজকে আমার ছুটি, আমার শনিবারের ছুটি। কাজ যা আছে সব রেখে আয় মা তোর পায়ে লুটি। দ্বারের কাছে এইখানে বোস, এই হেথা চোকাঠ— বল্‌ আমারে কোথায় আছে তেপান্তরের মাঠ। ওই দেখো মা, বর্ষা এল ঘনঘটায় ঘিরে, বিজুলি ধায় এঁকেবেঁকে আকাশ চিরে চিরে। দেব্‌তা যখন ডেকে ওঠে থর্‌থরিয়ে কেঁপে ভয় করতেই ভালোবাসি তোমায় বুকে চেপে। ঝুপ্‌ঝুপিয়ে বৃষ্টি যখন বাঁশের বনে পড়ে কথা শুনতে ভালোবাসি বসে কোণের ঘরে। ওই দেখো মা, জানলা দিয়ে আসে জলের ছাট— বল্‌ গো আমায় কোথায় আছে তেপান্তরের মাঠ। কোন্‌ সাগরের তীরে মা গো, কোন্‌ পাহাড়ের পারে, কোন্‌ রাজাদের দেশে মা গো, কোন্‌ নদীটির ধারে। কোনোখানে আল বাঁধা তার নাই ডাইনে বাঁয়ে? পথ দিয়ে তার সন্ধেবেলায় পৌঁছে না কেউ গাঁয়ে? সারা দিন কি ধূ ধূ করে শুকনো ঘাসের জমি? একটি গাছে থাকে শুধু ব্যাঙ্গমা - বেঙ্গমী? সেখান দিয়ে কাঠকুড়ুনি যায় না নিয়ে কাঠ? বল্‌ গো আমায় কোথায় আছে তেপান্তরের মাঠ। এমনিতরো মেঘ করেছে সারা আকাশ ব্যেপে, রাজপুত্তুর যাচ্ছে মাঠে একলা ঘোড়ায় চেপে। গজমোতির মালাটি তার বুকের ‘পরে নাচে— রাজকন্যা কোথায় আছে খোঁজ পেলে কার কাছে। মেঘে যখন ঝিলিক মারে আকাশের এক কোণে দুয়োরানী - মায়ের কথা পড়ে না তার মনে? দুখিনা মা গোয়াল - ঘরে দিচ্ছে এখন ঝাঁট, রাজপুত্তুর চলে যে কোন্‌ তেপান্তরের মাঠ। ওই দেখো মা, গাঁয়ের পথে লোক নেইকো মোটে, রাখাল - ছেলে সকাল করে ফিরেছে আজ গোঠে। আজকে দেখো রাত হয়েছে দিস না যেতে যেতে, কৃষাণেরা বসে আছে দাওয়ায় মাদুর পেতে। আজকে আমি নুকিয়েছি মা, পুঁথিপত্তর যত— পড়ার কথা আজ বোলো না। যখন বাবার মতো। বড়ো হব তখন আমি পড়ব প্রথম পাঠ— আজ বলো মা, কোথায় আছে তেপান্তরের মাঠ। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
নাম তার সন্তোষ, জঠরে অগ্নিদোষ, হাওয়া খেতে গেল সে পচম্বা। নাকছাবি দিয়ে নাকে বাঘনাপাড়ায় থাকে বউ তার বেঁটে জগদম্বা। ডাক্তার গ্রেগ্‌সন দিল ইনজেক্‌শন– দেহ হল সাত ফুট লম্বা। এত বাড়াবাড়ি দেখে সন্তোষ কহে হেঁকে, “অপমান সহিব কথম্‌ বা। শুন ডাক্তার ভায়া, উঁচু করো মোর পায়া, স্ত্রীর কাছে কেন রব কম বা। খড়ম জোড়ায় ঘষে ওষুধ লাগাও কষে– শুনে ডাক্তার হতভম্বা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
মনে করো, তুমি থাকবে ঘরে, আমি যেন যাব দেশান্তরে। ঘাটে আমার বাঁধা আছে তরী, জিনিসপত্র নিয়েছি সব ভরি— ভালো করে দেখ্‌ তো মনে করি কী এনে মা, দেব তোমার তরে। চাস কি মা, তুই এত এত সোনা— সোনার দেশে করব আনাগোনা। সোনামতী নদীতীরের কাছে সোনার ফসল মাঠে ফ'লে আছে, সোনার চাঁপা ফোটে সেথায় গাছে— না কুড়িয়ে আমি তো ফিরব না। পরতে কি চাস মুক্তো গেঁথে হারে — জাহাজ বেয়ে যাব সাগর-পারে। সেখানে মা, সকালবেলা হলে ফুলের ‘পরে মুক্তোগুলি দোলে, টুপটুপিয়ে পড়ে ঘাসের কোলে— যত পারি আনব ভারে ভারে। দাদার জন্যে আনব মেঘে - ওড়া পক্ষিরাজের বাচ্ছা দুটি ঘোড়া। বাবার জন্যে আনব আমি তুলি কনক-লতার চারা অনেকগুলি— তোর তরে মা, দেব কৌটা খুলি সাত-রাজার - ধন মানিক একটি জোড়া। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ – তরে । প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন । হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ -‘ পরে । তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন , অধর মরিতে চায় তোমার অধরে । তৃষিত পরান আজি কাঁদিছে কাতরে তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন । হৃদয় লুকানো আছে দেহের সায়রে , চিরদিন তীরে বসি করি গো ক্রন্দন । সর্বাঙ্গ ঢালিয়া আজি আকুল অন্তরে দেহের রহস্য – মাঝে হইব মগন । আমার এ দেহমন চির রাত্রিদিন তোমার সর্বাঙ্গে যাবে হইয়া বিলীন !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ। ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন। নয়ন আমার রূপের পুরে সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে, শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন।তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার বাজাই আমি বাঁশি। গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি। এখন সময় হয়েছে কি। সভায় গিয়ে তোমায় দেখি জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন।শিলাইদহ, ৩০ আশ্বিন, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
মহাভারতের মধ্যে ঢুকেছেন কীট, কেটেকুটে ফুঁড়েছেন এপিঠ-ওপিঠ। পণ্ডিত খুলিয়া দেখি হস্ত হানে শিরে; বলে, ওরে কীট, তুই এ কী করিলি রে! তোর দন্তে শান দেয়, তোর পেট ভরে, হেন খাদ্য কত আছে ধূলির উপরে। কীট বলে, হয়েছে কী, কেন এত রাগ, ওর মধ্যে ছিল কী বা, শুধু কালো দাগ! আমি যেটা নাহি বুঝি সেটা জানি ছার, আগাগোড়া কেটেকুটে করি ছারখার।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায় - এমন মেঘস্বরে          বাদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়।।          সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারি ধার। দুজনে মুখোমুখি          গভীর দুখে দুখি, আকাশে জল ঝরে অনিবার - জগতে কেহ যেন নাহি আর।।          সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব। কেবল আঁখি দিয়ে          আঁখির সুধা পিয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব - আঁধারে মিশে গেছে আর সব।।          বলিতে ব্যথিবে না নিজ কান, চমকি উঠিবে না নিজ প্রাণ। সে কথা আঁখিনীরে          মিশিয়া যাবে ধীরে, বাদলবায়ে তার অবসান - সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ।।          তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার নামাতে পারি যদি মনোভার! শ্রাবণবরিষনে          একদা গৃহকোণে দু কথা বলি যদি কাছে তার তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।।          আছে তো তার পরে বারো মাস - উঠিবে কত কথা, কত হাস। আসিবে কত লোক,          কত-না দুখশোক, সে কথা কোনখানে পাবে নাশ - জগৎ চলে যাবে বারো মাস।।          ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়, বিজুলি থেকে থেকে চমকায়। যে কথা এ জীবনে          রহিয়া গেল মনে সে কথা আজি যেন বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান, আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে; তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবন-মাঝে। যাচি হে তোমার চরম শান্তি, পরানে তোমার পরম কান্তি, আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।১৩১৩ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
কহিল কাঁসার ঘটি খন্‌ খন্‌ স্বর— কূপ,তুমি কেন খুড়া হলে না সাগর? তাহা হলে অসংকোচে মারিতাম ডুব, জল খেয়ে লইতাম পেট ভরে খুব। কূপ কহে,সত্য বটে ক্ষুদ্র আমি কূপ, সেই দুঃখে চিরদিন করে আছি চুপ। কিন্তু বাপু, তার লাগি তুমি কেন ভাব! যতবার ইচ্ছা যায় ততবার নাবো— তুমি যত নিতে পার সব যদি নাও তবু আমি টিঁকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক, এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক! মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই, আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু, পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু॥ এই-যে হিয়া থরোথরো কাঁপে আজি এমনতরো এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥ এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু, পিছন-পানে তাকাই যদি কভু। দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পূজার থালায়, সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।       খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা ॥ যদি ঝ’রে পড়ে পড়ুক পাতা,       ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা, থাক্‌ জনহীন পথে পথে       মরীচিকাজাল ফেলা ॥ শুষ্ক ধুলায় খসে-পড়া ফুলদলে       ঘূর্ণী-আঁচল উড়াও আকাশতলে। প্রাণ যদি কর মরুসম       তবে তাই হোক– হে নির্মম, তুমি একা আর আমি একা,       কঠোর মিলনমেলা ॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
আমার যেতে ইচ্ছে করে নদীটির ওই পারে— যেথায় ধারে ধারে বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো বাঁধা সারে সারে। কৃষাণেরা পার হয়ে যায় লাঙল কাঁধে ফেলে; জাল টেনে নেয় জেলে, গোরু মহিষ সাঁৎরে নিয়ে যায় রাখালের ছেলে। সন্ধে হলে যেখান থেকে সবাই ফেরে ঘরে শুধু রাতদুপরে শেয়ালগুলো ডেকে ওঠে ঝাউডাঙাটার ‘পরে। মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি। শুনেছি ওর ভিতর দিকে আছে জলার মতো। বর্ষা হলে গত ঝাঁকে ঝাঁকে আসে সেথায় চখাচখী যত। তারি ধারে ঘন হয়ে জন্মেছে সব শর; মানিক - জোড়ের ঘর, কাদাখোঁচা পায়ের চিহ্ন আঁকে পাঁকের ‘পর। সন্ধ্যা হলে কত দিন মা, দাঁড়িয়ে ছাদের কোণে দেখেছি একমনে— চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়ে সাদা কাশের বনে। মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি। এ - পার ও - পার দুই পারেতেই যাব নৌকো বেয়ে। যত ছেলেমেয়ে স্নানের ঘাটে থেকে আমায় দেখবে চেয়ে চেয়ে। সূর্য যখন উঠবে মাথায় অনেক বেলা হলে— আসব তখন চলে ‘বড়ো খিদে পেয়েছে গো— খেতে দাও মা' বলে। আবার আমি আসব ফিরে আঁধার হলে সাঁঝে তোমার ঘরের মাঝে। বাবার মতো যাব না মা, বিদেশে কোন্‌ কাজে। মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি– অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি এই মহামন্ত্রখানি, চরিতার্থ জীবনের বাণী। দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা-কিছু উপহার মধুরসে ক্ষয় নাই তার। তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে– সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দ বিরাজে। শেষ স্পর্শ নিয়ে যাব যবে ধরণীর ব’লে যাব তোমার ধূলির তিলক পরেছি ভালে, দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে। সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মুরতি, এই জেনে এ ধুলায় রাখিনু প্রণতি।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
ইয়ারিং ছিল তার দু কানেই। গেল যবে স্যাকরার দোকানেই মনে প’ল, গয়না তো চাওয়া যায়, আরেকটা কান কোথা পাওয়া যায়– সে কথাটা নোটবুকে টোকা নেই! মাসি বলে, “তোর মত বোকা নেই।’  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাহিনীকাব্য
শুন কলপনা বালা, ছিল কোন কবি বিজন কুটীর-তলে। ছেলেবেলা হোতে তোমার অমৃত-পানে আছিল মজিয়া। তোমার বীণার ধ্বনি ঘুমায়ে ঘুমায়ে শুনিত, দেখিত কত সুখের স্বপন। একাকী আপন মনে সরল শিশুটি তোমারি কমল-বনে করিত গো খেলা, মনের কত কি গান গাহিত হরষে, বনের কত কি ফুলে গাঁথিত মালিকা। একাকী আপন মনে কাননে কাননে যেখানে সেখানে শিশু করিত ভ্রমণ; একাকী আপন মনে হাসিত কাঁদিত। জননীর কোল হতে পালাত ছুটিয়া, প্রকৃতির কোলে গিয়া করিত সে খেলা-- ধরিত সে প্রজাপতি, তুলিত সে ফুল, বসিত সে তরুতলে, শিশিরের ধারা ধীরে ধীরে দেহে তার পড়িত ঝরিয়া। বিজন কুলায়ে বসি গাহিত বিহঙ্গ, হেথা হোথা উঁকি মারি দেখিত বালক কোথায় গাইছে পাখী। ফুলদলগুলি, কামিনীর গাছ হোতে পড়িলে ঝরিয়া ছড়ায়ে ছড়ায়ে তাহা করিত কি খেলা! প্রফুল্ল উষার ভূষা অরুণকিরণে বিমল সরসী যবে হোত তারাময়ী, ধরিতে কিরণগুলি হইত অধীর। যখনি গো নিশীথের শিশিরাশ্রু-জলে ফেলিতেন উষাদেবী সুরভি নিশ্বাস, গাছপালা লতিকার পাতা নড়াইয়া ঘুম ভাঙাইয়া দিয়া ঘুমন্ত নদীর যখনি গাহিত বায়ু বন্য-গান তার, তখনি বালক-কবি ছুটিত প্রান্তরে, দেখিত ধান্যের শিষ দুলিছে পবনে। দেখিত একাকী বসি গাছের তলায়, স্বর্ণময় জলদের সোপানে সোপানে উঠিছেন উষাদেবী হাসিয়া হাসিয়া। নিশা তারে ঝিল্লীরবে পাড়াইত ঘুম, পূর্ণিমার চাঁদ তার মুখের উপরে তরল জোছনা-ধারা দিতেন ঢালিয়া, স্নেহময়ী মাতা যথা সুপ্ত শিশুটির মুখপানে চেয়ে চেয়ে করেন চুম্বন। প্রভাতের সমীরণে, বিহঙ্গের গানে উষা তার সুখনিদ্রা দিতেন ভাঙ্গায়ে। এইরূপে কি একটি সঙ্গীতের মত, তপনের স্বর্ণময়-কিরণে প্লাবিত প্রভাতের একখানি মেঘের মতন, নন্দন বনের কোন অপ্সরা-বালার সুখময় ঘুমঘোরে স্বপনের মত কবির বালক-কাল হইল বিগত।                -- যৌবনে যখনি কবি করিল প্রবেশ, প্রকৃতির গীতধ্বনি পাইল শুনিতে, বুঝিল সে প্রকৃতির নীরব কবিতা। প্রকৃতি আছিল তার সঙ্গিনীর মত। নিজের মনের কথা যত কিছু ছিল কহিত প্রকৃতিদেবী তার কানে কানে, প্রভাতের সমীরণ যথা চুপিচুপি কহে কুসুমের কানে মরমবারতা। নদীর মনের গান বালক যেমন বুঝিত, এমন আর কেহ বুঝিত না। বিহঙ্গ তাহার কাছে গাইত যেমন, এমন কাহারো কাছে গাইত না আর। তার কাছে সমীরণ যেমন বহিত এমন কাহারো কাছে বহিত না আর। যখনি রজনীমুখ উজলিত শশী, সুপ্ত বালিকার মত যখন বসুধা সুখের স্বপন দেখি হাসিত নীরবে, বসিয়া তটিনীতীরে দেখিত সে কবি-- স্নান করি জোছনায় উপরে হাসিছে সুনীল আকাশ, হাসে নিম্নে স্রোতস্বিনী; সহসা সমীরণের পাইয়া পরশ দুয়েকটি ঢেউ কভু জাগিয়া উঠিছে। ভাবিত নদীর পানে চাহিয়া চাহিয়া, নিশাই কবিতা আর দিবাই বিজ্ঞান। দিবসের আলোকে সকলি অনাবৃত, সকলি রয়েছে খোলা চখের সমুখে-- ফুলের প্রত্যেক কাঁটা পাইবে দেখিতে। দিবালোকে চাও যদি বনভূমি-পানে, কাঁটা খোঁচা কর্দ্দমাক্ত বীভৎস জঙ্গল তোমার চখের 'পরে হবে প্রকাশিত; দিবালোকে মনে হয় সমস্ত জগৎ নিয়মের যন্ত্রচক্রে ঘুরিছে ঘর্ঘরি। কিন্তু কবি নিশাদেবী কি মোহন-মন্ত্র পড়ি দেয় সমুদয় জগতের 'পরে, সকলি দেখায় যেন স্বপ্নের মতন; ঐ স্তব্ধ নদীজলে চন্দ্রের আলোকে পিছলিয়া চলিতেছে যেমন তরণী, তেমনি সুনীল ঐ আকাশসলিলে ভাসিয়া চলেছে যেন সমস্ত জগৎ; সমস্ত ধরারে যেন দেখিয়া নিদ্রিত, একাকী গম্ভীর-কবি নিশাদেবী ধীরে তারকার ফুলমালা জড়ায়ে মাথায়, জগতের গ্রন্থ কত লিখিছে কবিতা। এইরূপে সেই কবি ভাবিত কত কি। হৃদয় হইল তার সমুদ্রের মত, সে সমুদ্রে চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারকার প্রতিবিম্ব দিবানিশি পড়িত খেলিত, সে সমুদ্র প্রণয়ের জোছনা-পরশে লঙ্ঘিয়া তীরের সীমা উঠিত উথলি, সে সমুদ্র আছিল গো এমন বিস্তৃত সমস্ত পৃথিবীদেবী, পারিত বেষ্টিতে নিজ স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে। সে সিন্ধু-হৃদয়ে দুরন্ত শিশুর মত মুক্ত সমীরণ হু হু করি দিবানিশি বেড়াত খেলিয়া। নির্ঝরিণী, সিন্ধুবেলা, পর্ব্বতগহ্বর, সকলি কবির ছিল সাধের বসতি। তার প্রতি তুমি এত ছিলে অনুকূল কল্পনা! সকল ঠাঁই পাইত শুনিতে তোমার বীণার ধ্বনি, কখনো শুনিত প্রস্ফুটিত গোলাপের হৃদয়ে বসিয়া বীণা লয়ে বাজাইছ অস্ফুট কি গান। কনককিরণময় উষার জলদে একাকী পাখীর সাথে গাইতে কি গীত তাই শুনি যেন তার ভাঙ্গিত গো ঘুম! অনন্ত-তারা-খচিত নিশীথগগনে বসিয়া গাইতে তুমি কি গম্ভীর গান, তাহাই শুনিয়া যেন বিহ্বলহৃদয়ে নীরবে নিশীথে যবে একাকী রাখাল সুদূর কুটীরতলে বাজাইত বাঁশী তুমিও তাহার সাথে মিলাইতে ধ্বনি, সে ধ্বনি পশিত তার প্রাণের ভিতর। নিশার আঁধার-কোলে জগৎ যখন দিবসের পরিশ্রমে পড়িত ঘুমায়ে তখন সে কবি উঠি তুষারমন্ডিত সমুচ্চ পর্ব্বতশিরে গাইত একাকী প্রকৃতিবন্দনাগান মেঘের মাঝারে। সে গম্ভীর গান তার কেহ শুনিত না, কেবল আকাশব্যাপী স্তব্ধ তারকারা এক দৃষ্টে মুখপানে রহিত চাহিয়া। কেবল, পর্ব্বতশৃঙ্গ করিয়া আঁধার, সরল পাদপরাজি নিস্তব্ধ গম্ভীর ধীরে ধীরে শুনিত গো তাহার সে গান; কেবল সুদূর বনে দিগন্তবালায় হৃদয়ে সে গান পশি প্রতিধ্বনিরূপে মৃদুতর হোয়ে পুন আসিত ফিরিয়া। কেবল সুদূর শৃঙ্গে নির্ঝরিণী বালা সে গম্ভীর গীতি-সাথে কণ্ঠ মিশাইত, নীরবে তটিনী যেত সমুখে বহিয়া, নীরবে নিশীথবায়ু কাঁপাত পল্লব। গম্ভীরে গাইত কবি--"হে মহাপ্রকৃতি, কি সুন্দর, কি মহান্‌ মুখশ্রী তোমার, শূন্য আকাশের পটে হে প্রকৃতিদেবি কি কবিতা লিখেছে যে জ্বলন্ত অক্ষরে, যত দিন রবে প্রাণ পড়িয়া পড়িয়া তবু ফুরাবে না পড়া; মিটিবে না আশ! শত শত গ্রহ তারা তোমার কটাক্ষে কাঁপি উঠে থরথরি, তোমার নিশ্বাসে ঝটিকা বহিয়া যায় বিশ্বচরাচরে। কালের মহান্‌ পক্ষ করিয়া বিস্তার, অনন্ত আকাশে থাকি হে আদি জননি, শাবকের মত এই অসংখ্য জগৎ তোমার পাখার ছায়ে করিছ পালন! সমস্ত জগৎ যবে আছিল বালক, দুরন্ত শিশুর মত অনন্ত আকাশে করিত গো ছুটাছুটি না মানি শাসন, স্তনদানে পুষ্ট করি তুমি তাহাদের অলঙ্ঘ্য সখ্যের ডোরে দিলে গো বাঁধিয়া। এ দৃঢ় বন্ধন যদি ছিঁড়ে একবার, সে কি ভয়ানক কাণ্ড বাঁধে এ জগতে, কক্ষচ্ছিন্ন কোটি কোটি সূর্য্য চন্দ্র তারা অনন্ত আকাশময় বেড়ায় মাতিয়া, মণ্ডলে মণ্ডলে ঠেকি লক্ষ সূর্য্য গ্রহ চূর্ণ চূর্ণ হোয়ে পড়ে হেথায় হোথায়; এ মহান্‌ জগতের ভগ্ন অবশেষ চূর্ণ নক্ষত্রের স্তূপ, খণ্ড খণ্ড গ্রহ বিশৃঙ্খল হোয়ে রহে অনন্ত আকাশে! অনন্ত আকাশ আর অনন্ত সময়, যা ভাবিতে পৃথিবীর কীট মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধি হোয়ে পড়ে ভয়ে সঙ্কুচিত, তাহাই তোমার দেবি সাধের আবাস। তোমার মুখের পানে চাহিতে হে দেবি ক্ষুদ্র মানবের এই স্পর্ধিত জ্ঞানের দুর্ব্বল নয়ন যায় নিমীলিত হোয়ে। হে জননি আমার এ হৃদয়ের মাঝে অনন্ত-অতৃপ্তি-তৃষ্ণা জ্বলিছে সদাই, তাই দেবি পৃথিবীর পরিমিত কিছু পারে না গো জুড়াইতে হৃদয় আমার, তাই ভাবিয়াছি আমি হে মহাপ্রকৃতি, মজিয়া তোমার সাথে অনন্ত প্রণয়ে জুড়াইব হৃদয়ের অনন্ত পিপাসা! প্রকৃতি জননি ওগো, তোমার স্বরূপ যত দূর জানিবারে ক্ষুদ্র মানবেরে দিয়াছ গো অধিকার সদয় হইয়া, তত দূর জানিবারে জীবন আমার করেছি ক্ষেপণ আর করিব ক্ষেপণ। ভ্রমিতেছি পৃথিবীর কাননে কাননে-- বিহঙ্গও যত দূর পারে না উড়িতে সে পর্ব্বতশিখরেও গিয়াছি একাকী; দিবাও পশে নি দেবি যে গিরিগহ্বরে, সেথায় নির্ভয়ে আমি করেছি প্রবেশ। যখন ঝটিকা ঝঞ্ঝা প্রচণ্ড সংগ্রামে অটল পর্ব্বতচূড়া করেছে কম্পিত, সুগম্ভীর অম্বুনিধি উন্মাদের মত করিয়াছে ছুটাছুটি যাহার প্রতাপে, তখন একাকী আমি পর্ব্বত-শিখরে দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি সে ঘোর বিপ্লব, মাথার উপর দিয়া অজস্র অশনি সুবিকট অট্টহাসে গিয়াছে ছুটিয়া, প্রকাণ্ড শিলার স্তূপ পদতল হোতে পড়িয়াছে ঘর্ঘরিয়া উপত্যকা-দেশে, তুষারসঙ্ঘাতরাশি পড়েছে খসিয়া শৃঙ্গ হোতে শৃঙ্গান্তরে উলটি পালটি। অমানিশীথের কালে নীরব প্রান্তরে বসিয়াছি, দেখিয়াছি চৌদিকে চাহিয়া, সর্ব্বব্যাপী নিশীথের অন্ধকার গর্ভে এখনো পৃথিবী যেন হতেছে সৃজিত। স্বর্গের সহস্র আঁখি পৃথিবীর 'পরে নীরবে রয়েছে চাহি পলকবিহীন, স্নেহময়ী জননীর স্নেহ-আঁখি যথা সুপ্ত বালকের পরে রহে বিকসিত। এমন নীরবে বায়ু যেতেছে বহিয়া, নীরবতা ঝাঁ ঝাঁ করি গাইছে কি গান-- মনে হয় স্তব্ধতার ঘুম পাড়াইছে। কি সুন্দর রূপ তুমি দিয়াছ উষায়, হাসি হাসি নিদ্রোত্থিতা বালিকার মত আধঘুমে মুকুলিত হাসিমাখা আঁখি! কি মন্ত্র শিখায়ে দেছ দক্ষিণ-বালারে-- যে দিকে দক্ষিণবধূ ফেলেন নিঃশ্বাস, সে দিকে ফুটিয়া উঠে কুসুম-মঞ্জরী, সে দিকে গাহিয়া উঠে বিহঙ্গের দল, সে দিকে বসন্ত-লক্ষ্মী উঠেন হাসিয়া। কি হাসি হাসিতে জানে পূর্ণিমাশর্ব্বরী-- সে হাসি দেখিয়া হাসে গম্ভীর পর্ব্বত, সে হাসি দেখিয়া হাসে উথল জলধি, সে হাসি দেখিয়া হাসে দরিদ্র কুটীর। হে প্রকৃতিদেবি তুমি মানুষের মন কেমন বিচিত্র ভাবে রেখেছ পূরিয়া, করুণা, প্রণয়, স্নেহ, সুন্দর শোভন—ন্যায়, ভক্তি, ধৈর্য্য আদি সমুচ্চ মহান্‌-- ক্রোধ, দ্বেষ, হিংসা আদি ভয়ানক ভাব, নিরাশা মরুর মত দারুণ বিষণ্ণ-- তেমনি আবার এই বাহির জগৎ বিচিত্র বেশভূষায় করেছ সজ্জিত। তোমার বিচিত্র কাব্য-উপবন হোতে তুলিয়া সুরভি ফুল গাঁথিয়া মালিকা, তোমারি চরণতলে দিব উপহার!" এইরূপে সুনিস্তব্ধ নিশীথ-গগনে প্রকৃতি-বন্দনা-গান গাইত সে কবি।   (কবি-কাহিনী কাব্যোপন্যাস)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
এ মোহ ক'দিন থাকে, এ মায়া  মিলায়, কিছুতে পারে না আর বাঁধিয়া রাখিতে - কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায়, মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে । কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায় । ফুল ফোটা সাঙ্গ হলে গাহে না পাখিতে । কোথা সেই হাসিপ্রাপ্ত চুম্বনতৃষিত রাঙা পুষ্পটুকু যেন প্রস্ফুট অধর! কোথা কুসুমিত তনু পূর্ণবিকশিত - কম্পিত পুলকভরে, যৌবনকাতর! তখন কি মনে পড়ে সেই ব্যাকুলতা, সেই চিরপিপাসিত যৌবনের কথা, সেই প্রাণোপরিপূর্ণ মরণ-অনল - মনে প'ড়ে হাসি আসে? চোখে আসে জল?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
“হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা ওগো তপন তোমার স্বপন দেখি যে,করিতে পারি নে সেবা।’ শিশির কহিল কাঁদিয়া, “তোমারে রাখি যে বাঁধিয়া হে রবি,এমন নাহিকো আমার বল। তোমা বিনা তাই ক্ষুদ্র জীবন কেবলি অশ্রুজল।’“আমি বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো, তবু শিশিরটুকুরে ধরা দিতে পারি বাসিতে পারি যে ভালো।’ শিশিরের বুকে আসিয়া কহিল তপন হাসিয়া, “ছোটো হয়ে আমি রহিব তোমারে ভরি, তোমার ক্ষুদ্র জীবন গড়িব হাসির মতন করি।’  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
মালা গাঁথিবার কালে ফুলের বোঁটায় ছুঁচ নিয়ে মালাকর দুবেলা ফোটায়। ছুঁচ বলে মনদুঃখে, ওরে জুঁই দিদি, হাজার হাজার ফুল প্রতিদিন বিঁধি, কত গন্ধ কোমলতা যাই ফুঁড়ে ফুঁড়ে কিছু তার নাহি পাই এত মাথা খুঁড়ে। বিধি-পায়ে মাগি বর জুড়ি কর দুটি ছুঁচ হয়ে না ফোটাই, ফুল হয়ে ফুটি। জুঁই কহে নিশ্বসিয়া, আহা হোক তাই, তোমারো পুরুক বাঞ্ছা আমি রক্ষা পাই।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
গৌরবর্ণ নধর দেহ, নাম শ্রীযুক্ত রাখাল, জন্ম তাহার হয়েছিল, সেই যে-বছর আকাল। গুরুমশায় বলেন তারে, "বুদ্ধি যে নেই একেবারে; দ্বিতীয়ভাগ করতে সারা ছ'মাস ধরে নাকাল।" রেগেমেগে বলেন, "বাঁদর, নাম দিনু তোর মাকাল।"  নামটা শুনে ভাবলে প্রথম বাঁকিয়ে যুগল ভুরু; তারপর সে বাড়ি এসে নৃত্য করলে শুরু। হঠাৎ ছেলের মাতন দেখি সবাই তাকে শুধায়, এ কী! সকলকে সে জানিয়ে দিল, নাম দিয়েছেন গুরু-- নতুন নামের উৎসাহে তার বক্ষ দুরুদুরু।  কোলের 'পরে বসিয়ে দাদা বললে কানে-কানে, "গুরুমশায় গাল দিয়েছেন, বুঝিসনে তার মানে!" রাখাল বলে, "কখ্‌খোনো না, মা যে আমায় বলেন সোনা, সেটা তো গাল নয় সে কথা পাড়ার সবাই জানে। আচ্ছা, তোমায় দেখিয়ে দেব, চলো তো ঐখানে।"  টেনে নিয়ে গেল তাকে পুকুরপাড়ের কাছে, বেড়ার 'পরে লতায় যেথা মাকাল ফ'লে আছে। বললে, "দাদা সত্যি বোলো, সোনার চেয়ে মন্দ হল? তুমি শেষে বলতে কি চাও, গাল ফলেছে গাছে।" "মাকাল আমি" ব'লে রাখাল দু হাত তুলে নাচে।  দোয়াত কলম নিয়ে ছোটে, খেলতে নাহি চায়, লেখাপড়ায় মন দেখে মা অবাক হয়ে যায়। খাবার বেলায় অবশেষে দেখে ছেলের কাণ্ড এসে-- মেঝের 'পরে ঝুঁকে প'ড়ে খাতার পাতাটায় লাইন টেনে লিখছে শুধু-- মাকালচন্দ্র রায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
প্রতিদিন প্রাতে শুধু গুন্ গুন্ গান , লালসে অলস-পাখা অলির মতন । বিকল হৃদয় লয়ে পাগল পরান কোথায় করিতে যায় মধু অন্বেষণ । বেলা বহে যায় চলে — শ্রান্ত দিনমান , তরুতলে ক্লান্ত ছায়া করিছে শয়ন , মুরছিয়া পড়িতেছে বাঁশরির তান , সেঁউতি শিথিলবৃন্ত মুদিছে নয়ন । কুসুমদলের বেড়া , তারি মাঝে ছায়া , সেথা বসে করি আমি কল্পমধু পান — বিজনে সৌরভময়ী মধুময়ী মায়া , তাহারি কুহকে আমি করি আত্মদান — রেণুমাখা পাখা লয়ে ঘরে ফিরে আসি আপন সৌরভে থাকি আপনি উদাসী ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
দিন চলে না যে, নিলেমে চড়েছে খাট-টিপাই; ব্যাবসা ধরেছি গল্পেরে করা নাট্যি-fy। ক্রিটিক মহল করেছি ঠাণ্ডা, মুর্গি এবং মুর্গি-আণ্ডা খেয়ে করে শেষ, আমি হাড় দুটি- চারটি পাই– ভোজন-ওজনে লেখা ক’রে দেয় certify।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে, সাথে সাথে কে চলে মোর নীরব অন্ধকারে। ছাড়াতে চাই অনেক করে ঘুরে চলি, যাই যে সরে, মনে করি আপদ গেছে, আবার দেখি তারে।ধরণী সে কাঁপিয়ে চলে– বিষম চঞ্চলতা। সকল কথার মধ্যে সে চায় কইতে আপন কথা। সে যে আমার আমি, প্রভু, লজ্জা তাহার নাই যে কভু, তারে নিয়ে কোন্‌ লাজে বা যাব তোমার দ্বারে।১৪ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
পোড়ো বাড়ি শূন্য দালান-- বোবা স্মৃতির চাপা কাঁদন হুহু করে, মরা-দিনের-কবর-দেওয়া ভিতের অন্ধকার গুমরে ওঠে প্রেতের কন্ঠে সারা দুপুরবেলা। মাঠে মাঠে শুকনো পাতার ঘূর্ণিপাকে হাওয়ার হাঁপানি। হঠাৎ হানে বৈশাখী তার বর্বরতা ফাগুনদিনের যাবার পথে।সৃষ্টিপীড়া ধাক্কা লাগায় শিল্পকারের তুলির পিছনে। রেখায় রেখায় ফুটে ওঠে রূপের বেদনা সাথিহারার তপ্ত রাঙা রঙে। কখনো বা ঢিল লেগে যায় তুলির টানে; পাশের গলির চিক-ঢাকা ওই ঝাপসা আকাশতলে হঠাৎ যখন রণিয়ে ওঠে সংকেতঝংকার, আঙুলের ডগার 'পরে নাচিয়ে তোলে মাতালটাকে। গোধূলির সিঁদুর ছায়ায় ঝ'রে পড়ে পাগল আবেগের হাউই-ফাটা আগুনঝুরি।বাধা পায়, বাধা কাটায় চিত্রকরের তুলি। সেই বাধা তার কখনো বা হিংস্র অশ্লীলতায়, কখনো বা মন্দির অসংযমে। মনের মধ্যে ঘোলা স্রোতের জোয়ার ফুলে ওঠে, ভেসে চলে ফেনিয়ে-ওঠা অসংলগ্নতা। রূপের বোঝাই ডিঙি নিয়ে চলল রূপকার রাতের উজান স্রোত পেরিয়ে হঠাৎ-মেলা ঘাটে। ডাইনে বাঁয়ে সুর-বেসুরের দাঁড়ের ঝাপট চলে, তাল দিয়ে যায় ভাসান-খেলা শিল্পসাধনার।
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
বোনো তুমি, যত পারো বুনে চলো কৌটিল্যের জাল ক্রমশ সারল্য থেকে ছুটি নিয়ে আমিও আজকাল তোমার নিপুণ শিল্পে আত্মাহুতি দেয়ার আহ্লাদে আবিষ্ট মাছির মতো পড়তে চাই নানারূপ ফাঁদে-- কেননা চুড়ান্তে যাবো; নিরিবিলি জীবনের স্বাদ চেখেও দেখেছি--এর অন্তর্গত কী এক বিষাদ অদৃশ্য নরকে টানে। না এমন খণ্ডমৃত্যু নয়, আমূল নিশ্চিহ্ন করো কিংবা দাও চুড়ান্ত বিজয়।যে-রমণী নগ্ন শুয়ে সিসিলি’র সমুদ্রের পারে রোদের আমেজ মাখে, রাতে থাকে ওজার্ক পাহাড়ে; বগলে পুরুষবন্ধু, লোশনাদি এবং ক্যামেরা হয়তো উদ্দাম কোনো নৈশক্লাবে নর্তকীর সেরা তাকেও দেখেছি একা ভেসে যেতে যন্ত্রণার জলে; ভাঙাচোরা বর্তমান কিংবা কোনো স্মৃতির কবলে ভেতরে-ভেতরে ভাঙে ব্যক্তিগত তারও রাজ্যপাট অথচ লিঙ্কন থেকে ব্রুনাইয়ের সামন্ত সম্রাট একেই ফলাও করে নির্দ্বিধায় স্বাধীনতা বলে জীবনের বিষবৃক্ষ ঢেকে রেখে মোহন বল্কলে।এরচে’ অনেক ভালো মোহাবিষ্ট পতঙ্গের মতো তোমার কুটিল জালে টেনে নাও, আমিও সম্মত।দারুণ অসহ্য এই টুকরো-টুকরো অলিখিত ফাঁদ: কয়েদী ও দর্শনার্থী মাঝখানে লোহার গরাদ, কে যে কোন্ ভূমিকায় বস্তুতই শক্ত নিরূপণ-- দু’দিকেই কারাকক্ষ, চৌকিদার এবং জীবন।
আবিদ আনোয়ার
হাস্যরসাত্মক
তেঁতুল গাছে পেত্নী নাচে তবলা বাজায় ভূতে-- দুপুর রাতে ভিরমি খেলো ছিদাম মাঝির পুতে । ভূতকে ডেকে পেত্নী বলে: হ্যাঁগো, অই যে দেখো গাছের তলায় ভয় পেয়েছে কে গো!ভূত তো ভেবে পায় না কিছু: কী করা যায়, হাঁরে, এখন আমি রাত-বিরেতে বদ্যি ডাকি কারে? এরচে' বরং মন্ত্র পড়ে ঝেড়েই দেখি নিজে-- ধুত্তরি যা, ভুলেই গেছি ভূতের ঝাড়া কী যে!পেত্নী বলে: এই পেয়েছি, একটুখানি রসো, শেওড়া-পাতার কষ লাগিয়ে নাকের ডগায় ঘষো!
আবিদ আনোয়ার
প্রেমমূলক
আমি কোনো যক্ষ নই তবু কেন মনে হয় নির্বাসনে আছি, আমার বধূয়া থাকে সম্মত রক্ষিতা হয়ে দূর অলকায়-- কাকে তবে পত্র লিখি! যদিও উত্তরমেঘ দক্ষিণেও যায় এবং এখনও বুঝি: সতত ফোটায় হুল স্মৃতির মৌমাছি।আমার বিরহ নিয়ে কাব্য লিখে নেই আজ সেই কালিদাস-- তবু হে বিস্রস্ত মেঘ, যথাস্থানে পৌঁছে দিও আমার বারতা অথবা তোমার কাছে আমি চাই আরো একটু বেশি উদারতা: পারো তো ঝড়ের তেজে উড়িয়ে বাড়িতে নাও অধমের লাশ!
আবিদ আনোয়ার
নীতিমূলক
পলায়নপর তুমি অবশেষে ফিরে এলে নিজ ঘরে জেনে এসেছো কি পরম সত্য হারানো সহজ নয়? তোমার কুশল জানাবার আগে পথের খবর বলো; স্মৃতির ঝুড়িতে হাতড়িয়ে দেখো কী এনেছো সঞ্চয় ।শুনেছি সে-পথ কুয়াশায়-ঘেরা সাদা আঁধারের গলি; প্রেতেদের মতো নিজের ছায়াও হয় না দৃশ্যমান জোছনারহিত মৃত পূর্ণিমা একচোখে চেয়ে থাকে বিকারী আলোর সূর্য সেখানে পিতলের চেয়ে ম্লান!শুনেছি সেখানে হরিণের চেয়ে শিঙেল করোটি দামী, মানুষের চেয়ে প্রতিমা এবং গাছের চেয়েও বনসাই, মরদৈহিক গন্ধ ছড়ায় ক্লেদজ গোলাপকলি... আলোকেই ঘোর কালো বলে মানে, আঁধারকে রোশনাই!কাণ্ডবিহীন গাছে ব'সে ছিলে দেহহীন তোতাপাখি: দশকে-দশকে অনেক গেয়েছো পরের শেখানো বুলি; ফিরে এলে যদি এবার কিছুটা নিবিড় কণ্ঠে ডাকো-- গায়ে তুলে নাও নিজেরই ঠোকরে ঝরানো পালকগুলি ।
আবিদ আনোয়ার
রূপক
নিরালা বাড়ির পুকুরের ঘাটে স্নানরতা রাঙা নিবিড় বউয়ের মতো তোমার কবিতা ডুব দিয়ে ওঠে রূপনারাণের জলে, যদিও অমোঘ নিজেকেও ফাড়ো দ্বিধার করাতকলে।হয়তো বা খোঁজো কালের নালী-ঘা ঘেঁয়ো মাছিদের মতো, নিবিষ্ট মনে ঘেঁটে-ঘুঁটে দেখো শতকের পচা মল, তবু চাও পূত জলাঙ্গী থেকে ক’ফোঁটা ঝরুক চেতনার ক্ষতে বিশুদ্ধতার জল।তোমার কবিতা কংক্রিটে ঘাস, পাথরে গজানো ফুল, ভেনাসের কানে যত্নে পরানো খেঁদির কানের দুল।
আবিদ আনোয়ার
ব্যঙ্গাত্মক
পেটে গরগর বুকে ধড়ফড় নাভিতে চিনচিনানি এসবে ভুগছে বহুদিন ধরে ননীগোপালের নানী দিনেদিনে তার পেটটা বেড়েছে পরিধি এবং ব্যাসে হারু ডাক্তার বলেছেন ওটা ভরা নাকি শুধু গ্যাসে ।ননী বলে নানী, এ-রোগের কথা কাউকে বলো না, চুপ! প্রাণটা গেলেও উচ্চবাচ্য করবে না কোনোরূপ । গোপনে-গোপনে বড়ি খাও ঘরে, যাবে না হাসপাতালে জানাজানি হলে জড়াতেও পারো মহাবিপদের জালে । সকলেই জানে গ্যাসফিল্ডের তলদেশে থাকে তেল তোমাকে ঘিরেই শুরু হতে পারে আন্তঃদেশীয় খেল!নানী বলে হায়, এ-ক্যামন কথা গ্যাস কি হয় না কারো? তোর নানা ছিলো জোয়ান মর্দ্দ গ্যাস হয়েছিলো তারও । ননী বলে সেই দিনকাল নেই, আছে কি তমার হুশ! বুঝবে মজাটা এ-খবর যদি জানতে পারেন বুশ!
আবিদ আনোয়ার
মানবতাবাদী
বিষ্টি শ্যাষ - অহনও হওয়ার তোড়ে দানবের তেজ য্যানো কোনো বেলেহাজ কামুক ইতর নারাজি ছেমড়ির মত নাওডারে ঠেইল্লা নিবো জলিধান খেতের ভিতর! যতই বৈডা মারি, দুই ধার লগ্গি মারে তাগড়া দুই পোলা গলুই লড়ে না দেহি - জিনের আছরে নায়ে উল্ডা পাল-তোলা!নাওরে নাও, মনে নাই: হেই ভরা যৈবনের কালে হুঁতের উজানে বা'য়া তরতরায়া গেছি গিয়া মান্দারের খালে... ভরা-কাটালের দিনে আওলা-ঝাওলা অয়ে গেলে মন আচম্বিতে গলা মারতো মারফতির টান দেখিছি গাঙের ঘাটে ক্যামন ট্যারায়া চায় কলিমের বইন থিকা বেওয়া নূরজাহান । বেচইন মনের তারে টুনটুনায়া মরি' গেছে আরো কত গান য্যামুন লগ্গির ঘায়ে লুদের ভুরভুরি ওডে খইয়ের লাহান । গেছেগা গানের গলা, কী আছে কইতে আর করি না কসুর: নদীর মাছের লগে কই জানি চইল্লা গেছে নিকিরির সুর ।আমার কতা কী কমু, ঘুণে-ধরা দেহি তর নিজেরও যৈবন, ঝাড়েবংশে জেল্লাদার ফড়িয়া-পাইকার আর ধূর্ত মহাজন ।
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
আপনিও আল্লা’র নবী, মানব কল্যাণহেতু প্রেরিত পুরুষ-- যতক্ষণ এই দেহে প্রাণ আছে, না-হারাই হুঁশ আপনার মর্যাদাহানি করতে পারি নই আমি তেমন মুরতাদ, একটি শুধু সওয়ালের জওয়াব জানতে জাগে বড়ো সাধ। এজতেহাদে সত্য মিলে বলেছেন স্বয়ং মা’বুদ-- রুহের কন্দর থেকে অহরহ ওঠে তাই প্রশ্নের বুদবুদ।সেই কবে পৃথিবীতে এসেছিলো গজবের বান, আপনার কিস্তিতে শুধু ঠাঁই পেয়েছিলো কিছু সাধু পুণ্যবান নরনারী, পশুপাখি, এর সাথে বৃক্ষাদি ও ফসলের বীজ, নতুন পৃথিবী গড়তে যা কিছুর প্রয়োজন ইত্যাকার চিজ। পবিত্র মাটিতে ফের জেগেছিলো অনাবিল জীবন-স্পন্দন, পুণ্যবান মানুষেরা চুষেছিলো সতীসাধ্বী পৃথিবীর স্তন।তাহলে কী করে সেই বিমল ঔরস আর পবিত্র জরায়ু জালেমের জন্ম দিলো, দুনিয়াতে দুষ্টচক্র পেলো পরমায়ু? ভয় হয় ফের যদি অনুরূপ বান আসে এই পৃথিবীতে পুণ্যাত্মাকে জলে ফেলে ওরা নিজে ঠাঁই নেবে কালের কিস্তিতে!
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
দেখে নিয়ো এই মাতাল তরণি হারাবে না কোনো অপকুয়াশার ঘোরে: অবচেতনের গহীনেও দেখি প্রোজ্জ্বল বাতিঘর! ঘূর্ণির মহাসমুদ্রে ঘুরে-ঘুরে অবশেষে ঠিকই পেয়ে যাবে বন্দর।বাঁধা বৃত্তের পরিধি পেরোয় কেন্দ্রাপসারী ঘোড়া অসম্ভবের দড়ি ছেঁড়ে তবু সরল রেখায় ছোটে, এলোমেলো কিছু ডিগবাজি আর দুলকির নামও চাল; আপাত বেতাল ভাঁড়ের তামাশা অর্থের পায়ে লোটে।কালোয়াত, তুমি কতদূর যাবে কেন্দ্র তোমাকে টানে! বৃত্তাবদ্ধ জীবনের কিছু হলো কি সম্প্রসার? প্রবীণ ব্যাঙমা ছানি-পড়া চোখে বিস্ময়ে চেয়ে দেখে: নবীন পাখিরা চিরায়ত খড়ে গড়ে আজও সংসার।
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
জলমগ্ন বাঙলাদেশ: নাকি এক ল্যাগব্যাগে তরল ড্রাগন হিমালয় থেকে নেমে গিলেছে শস্যের মাঠ, বন-উপবন; নিঝুম দ্বীপের মতো ভাসমান শুধু কিছু ক্লিন্ন লোকালয় তাকেও জুজুর মতো লেলিহান জিহ্বা নেড়ে সে দেখায় ভয়, তবুও জীবনছন্দে মুখরিত ব্যস্ত জনপদ উজিয়ে সকল বাধা, পায়ে-পায়ে সমূহ বিপদ যে-যার কর্তব্যে যায়; অজানা আতঙ্কে কাঁপে দুরু দুরু জননীর প্রাণ কোমরে ঘুঙুর বেঁধে ছেড়ে দিয়ে হাঁটি-হাঁটি কোলের সন্তান: শব্দ শুনে বুঝে নেয় নানা কাজে ব্যস্ত প্রিয়জন কতদূর হেঁটে গেলো দুষ্টুমতি তাদের খোকন। * * * নুনুর কাছে  ঘণ্টি নড়ে, সাধ্যি কী যে খোকনসোনা খন্দে পড়ে! ভুবন জুড়ে বাজছে যেন একটিই সুর, একটি শুধু গান, ধ্যানীর মতো সারাটা বাড়ি শুনছে পেতে কান। * * * তাহলে কি উৎকন্ঠিত আমারও জননী কিংবা বুবু ও দাদীমা এভাবেই এঁকে দিতো এ আমার গন্তব্যের সীমা? * * * হয়তো সে শব্দময় অস্তিত্বের সীমানা পেরিয়ে নিঃশব্দেই জানি না কখন প’ড়ে গেছি বিকট পাতালে; চারপাশে খানাখন্দ: উপদংশ-কবলিত স্বৈরিণীর সুবর্ণ ব-দ্বীপে কাদা, আমাকে লোভায় তার সুগভীর ব্যক্তিগত খাড়ি; বিষম হা-করে থাকে পানপাত্র; বন্ধুর বাড়িয়ে-দেয়া অমসৃণ বাঁকা করতল, দ্রাবিড়ীয় কিশোরীর গালে-পড়া টোল আর চটুল হাসিতে খুব ফেটে-পড়া প্রেমিকার মুখের ব্যাদানকেও আজকাল বড় কোনো গর্ত মনে হয়--ক্রুর জল পাক খায় লাভার দাপটে; উন্মাতাল ঘূর্ণিজলে সুবোধ কুটোর মতো ভাসি-ডুবি বিবিধ মুদ্রায়...চুমুকে চুমুকে ডুবি...চুমুতে চুমুতে; নগরীর নানাস্থানে বিপদ-সরণি, মেয়রের পেতে-রাখা অ্যাশফল্টের চোরাবালি আমাকে ডোবায়।‘ আপদে ভরসা প্রাপ্তি’ এমন অভয়বাণী লেখেনি ঠিকুজি অতল পাতালে তবু ডুবে যেতে যেতে প্রায়শ কী যেন খুঁজি; পরাস্বপ্নে কেঁদে ওঠে আজও কিছু প্রত্যাশার ক্ষীয়মাণ রেশ. ঘুঙুর বাজাবো বলে হাতড়ে ফিরি কোমরের বিভিন্ন প্রদেশ!
আবিদ আনোয়ার
নীতিমূলক
অনেক দেখেছি পাঁকাল-বিলাসী কাদাজলে রাজহাঁস, মসৃণ পাখা রেশমখচিত ছোঁয় না পঙ্কিলতা! অথবা আমার বালকবেলার মোহময়ী মেথরানী রূপের ছটায় ভুলে গেছি তার গুয়ের রাজ্যে বাস।পট্টি যখন বাঙলা মদের উৎসবে গোলজার সে তখন ছিলো পট্টরানীর আসনে অধিষ্ঠিত― ঘাগড়ায়-লাগা শুদ্র অথবা ভদ্রপাড়ার মল; “লছমী নাকি রে!” কুশল শুধাতো তবু খোদ জমিদার।কাদায় পদ্ম, চাঁদে কলঙ্ক এ-কথা এখন ক্লিশে, ময়ূর নিজে কি পেখম গোটায় বিশ্রী পায়ের খেদে? রূপের দোহাই শুচিবায় ছেড়ে জৈবনিকতা শেখো― খ্যাতিমান বহু কবিও ভুগেছে উপদংশের বিষে।
আবিদ আনোয়ার
হাস্যরসাত্মক
মশাদের নেতা নর্দমারাজ বজ্রকণ্ঠ পুনিয়া ফুঁসে উঠলেন নগরপিতার পরিকল্পনা শুনিয়া: (কথায়-কথায় পূর্ণ করেছি অঙ্গীকারের ভাণ্ড; মশা মারাটাই হবে আমাদের প্রথম কর্মকাণ্ড)জরুরি সভায় নর্দমারাজ জানালেন: এ যে অন্যায়! এর প্রতিবাদে মহানগরীকে ভাসাবো রক্তবন্যায়; আমরা ঢাকার আদি অধিবাসী পূর্ব-পুরুষ বাজাতেন বাঁশি নওয়াব বাড়ির অন্দরে ঢুকে প্রতিটি কর্ণ-কুহরে ডিডিটি-কয়েল ঠেকাতে পারেনি, মানে নাই কোনো ব্যুহরে। বংশের মুখে কালি মেখে শেষে সমূলে কি পারি মরতে! মশক ভায়েরা এবং বোনেরা, বলো তো কী পারি করতে?মশকদলের তৃণমূল নেতা দাঁড়ালেন খাঁড়া দু’পায়ে, হাঁকিলেন: জয়! মশাদের জয়!! দেখি মারে কোন্ উপায়ে; দশকে-দশকে মশক বেড়েছে কে নগরপিতা কয়টা মেরেছে? নর্দমারাজ, আমরা বলি কী একটু ধরেন ধৈর্য্য, ঢাকা তো থাকবে ঢাকাতেই, সাথে নর্দমা আর বর্জ্য!
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
"আমি খুঁজি কোনো প্রকৃত কবিকে" বলেছিলে কবে চিরকুটে লিখে সেই থেকে আমি নিজে খুঁজে ফিরি প্রকৃত কবির সংজ্ঞা- ঘেঁটেছি অনেক কাব্যবোধিনি বাস্তবে বহু কবিকেও চিনি ফসল না-হোক কবি ফলিয়েছে উর্বরা মাতা গঙ্গা! নিজেও লিখেছি কম নয় - ঢের ওজনেই হবে দশ-বারো সের: আসলেই আমি প্রাচুর্যময়, চোখেই তোমার মঙ্গা!ঠাকুর জানতো প্রেম জমে ভালো সমিল মাত্রাবৃত্তে; চারিদিকে আজ গদ্যের ঝড় কাব্যকলার বাড়ি পড়োপড় তবুও তোমাকে দেখে কেন আজও দোলা লাগে এই চিত্তে? যা বলে বলুক শত দুর্জনে ভালোবাসা পেলে রবীন্দ্রায়ণে, আমি হতে রাজি তীব্র প্রদাহ সমালোচকের পিত্তে ।তুমি যদি চাও পাহাড় ডিঙাবো প্রয়োজনে ঘোর পাতালেও যাবো শঙ্খচূরের মণি এনে দেবো শুধুই তোমার জন্য- হতে যদি বলো আউল-বাউল চুড়ো করে তবে বেঁধে নেবো চুল শিরে তুলে নেবো মুকুটের মতো আধুনিকতার দৈন্য! কটুগন্ধের 'ক্লেদজ কুসুম' কেড়ে নিয়েছিলো কবিদের ঘুম- তুমি যদি চাও পুত-সৌরভে ভেসে যাক মেকি পণ্য ।
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
আকাশে চক্কর কেটে গিরিশৃঙ্গে বসে আছে বিশাল ঈগল শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে চষে আপন ব্রহ্মাণ্ড তার―ডাঙা থেকে জল: মীনরাজ্যে রাঘবেরা লেজ নাড়ে বিলে কিংবা খাদে, ছাগ-মেষ-মৃগশিশু অকারণে লাফায় আহ্লাদে, মায়ের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে কখনো যদি দূরে চলে যায় ইঙ্গিতে উঁচিয়ে গ্রীবা ডেকে আনে আপন ভাষায়; ক্ষুধার পীড়নে কারও কখনোবা মনে পড়ে মায়ের ওলান নিজদায়ে ফিরে এসে মাতৃসুধা অমৃতের মতো করে পান।বুলিয়ে লোলুপ দৃষ্টি মনে-মনে হেসে ওঠে অন্য একজন সুউচ্চ পৈঠায় বসে গোপনে-গোপনে করে দীর্ঘ নিরীক্ষণ; মাৎস্যন্যায়ে যে-বোয়াল সরপুঁটিকে করেছে হজম বিলের সম্রাট ভেবে বোঝে না সে তারও আছে যম।নধর ছাগলছানা এবং ঈগল দু’জনকেই গড়েছেন বিধি তবুও শেষোক্তজন গুণেমানে ঈশ্বরের যোগ্য প্রতিনিধি: দু’জনই আকাশচারী নিজ নিজ শিকারের দৃষ্টি থেকে দূরে অমোঘ থাবায় গেঁথে শেষে তাকে নিয়ে যায় নিজ অন্তঃপুরে― ক্ষুদ্রতম কীট থেকে পিপীলিকা, নর-নারী, শুণ্ডী-ঐরাবত সীমিত আয়ুর শেষে কেউবা নরকযানে কেউ চড়ে চারু স্বর্গরথ।জীবের সুখাদ্য জীব―এই মর্মে বোঝা যায় ঈগলের খাঁই, তিনি কেন সর্বভুক যার কোনো ক্ষুধা-তৃষ্ণা নাই?
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
কী করে বলবো ভুলে গেছি সব সঞ্চয়ে আর স্মৃতির কণাও নাই-- এখনও তো এই ধূসর মগজে বিচূর্ণিভূত স্বপ্নের ছাই ঝড় তোলে প্রতিদিন। ভেবে খুব হাসি পায়: নাগিনীর গ্রাসে অর্ধবিলীন ব্যাঙ যেন আমি কেউ আর্দ্র করুণ অন্তিম ডাকে জীবনকে ভেংচাই।মরণের আগে এমনি ক’দিন বাঁকা হেসেছিলো অমলের বউ গভীর নিশীথে ডাক দিতো যাকে কদমের ডাল-- দড়ি হাতে নিয়ে জোনাকির ভিড়ে বিভোর দাঁড়িয়ে সাত-পাঁচ ভেবে সম্বিতে ফিরে চমকে দেখতো আরেক সকাল!ফেরাতো কে তাকে? ঝিঁঝির কান্না নাকি জোনাকির প্রদীপ্ত আহ্বান: হয়তোবা শত গঞ্জনাতেও পেয়েছিলো কিছু সুখ, বিড়ালীর মতো চুক চুক ক’রে চেখেছিলো সেও স্বামীর সোহাগ-- হয়তো দেখেছে সিনেমা-নাটকে, পড়েছে গল্পে-উপন্যাসেও মরণার্থীকে ফিরিয়ে এনেছে  প্রাপ্তির দায়ভাগ।
আবিদ আনোয়ার
মানবতাবাদী
আমি সে সম্রাট নই স্তনাঢ্য রেলিঙ বেয়ে হেঁটে যাবো রাতের হেরেমে, যে-মধু মেলেনি কোনো সম্রাজ্ঞীতে তাকে পাবো বাঁদীদের প্রেমে । রঙিন সুরার সাথে পান ক'রে নূপুরের ধ্বনি উজ্জীবিত করে নিয়ে শিরা ও ধমনী আবারও ফিরবো ঘরে, টের পাবো রক্তকণিকায় স্বপ্নময় লাল ঘাগরা, নর্তকীর উরু-নাভি তখনও ঝলকায়; বেঘোর কাটবে রাত স্ত্রীকে ভেবে উষ্ণ পরনারী, দ্বারীর বাঁশির শব্দে বেজে উঠবে কানাড়া-দরবারি । টিভি'র কল্যাণে আজ মাঝেমাঝে মনে হয় আমিও সম্রাট: সাজানো ড্রয়িংরুমে তাকিয়া হেলান দিলে অবিকল সম্রাটের ঠাট রক্তে বেজে ওঠে । অজান্তেই বলে উঠি: ধন্যবাদ, জন! তোমার মহান যন্ত্রে ঘটে গেছে হেরেমের গণতন্ত্রায়ন!
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
নীলের ডোরাকাটা সবুজ মাছরাঙা গেঁথেছে লাল ঠোঁটে রুপালি মৌরলা বেরুবে ছাইরঙা গলিত বিষ্ঠায় তবু সে নিয়তিকে লেজের চাঁটি মারে অপার নিষ্ঠায়                    জানালা খুলে ব’সে প্রায়শ রাতে দেখি আকাশে দল বেঁধে মেঘেরা খেলা করে হা-করা কালো তিমি চাঁদকে গিলে খায় আঁধার পেট ফুঁড়ে তবুও প্রাণপণে জোছনা ঝলকায়নিবিড় চাষী জানে মাটির কোপনতা কতটা আড়চোখে তাকায় ব্যর্থতা ফসল খেয়ে ফেলে খরা ও বন্যায় খনাও বলেনি তো প্রকৃতি নিজে করে এতটা অন্যায়                    কিছুটা নিজে জানি বাকিটা মহাকাল দেয়ালে নোনা ধরে টেকে না জলরঙ (অজর পদাবলি বলে তো কিছু নাই) অন্ধ তুলি দিয়ে কালের ক্যানভাসে তবুও আঁচড়াই
আবিদ আনোয়ার
রূপক
আজ ভোরে সূর্য নয় দিগন্ত রাঙালো নিজে রবীন্দ্র ঠাকুর: শ্মশ্রুময় দেবকান্তি, অমিতাভ চিবুকের নূর ছড়ালো রৌদ্রের মতো যেন এই অপ্রাকৃত আকাশের নীল লক্ষকোটি জাগর জোনাকি নিয়ে করে ঝিলমিল! প্রশ্নচিহ্ন হয়ে জ্বলে চেতনার গভীর ভেতরে-- “কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে?”দিগন্তে তাকিয়ে দেখি ফ্যালফ্যাল চেয়ে আছে মহান কাঙাল-- কেঁপে ওঠে ইতস্তত ভ্রষ্ট মহাকাল।গীতাঞ্জলি হাতে নিই ঝেড়েমুছে ধুলা: হঠাৎ পালাতে গিয়ে লজ্জা পেলো গুটিকয় কালের আরশুলা।
আবিদ আনোয়ার
ব্যঙ্গাত্মক
কে যেন বলে: গান গাবো হে, সন্ন্যাসীরা গাজন থামা, তোদের সুরে মন ভরে না ফক্কা নাচে রঙিন জামা!রাখ তো বাপু ভয়-দেখানো তত্ত্বভরা এ-বুজরুকি নাচার শ্রোতা ঠকছে বড়ো দিতেই হবে সে-ভর্তুকি।তুলছে খাঁটি গানের দাবি আমীর থেকে খঞ্জনুলো; এবার তোরা সব খোয়াবি লোটার সাথে কমণ্ডুলু!লাভ কী টেনে বাড়বে না হে, মলিন জটা, উটকো দাড়ি-- তাই বলি কী: ছাঁটাই ভালো আগে তো কিছু উকুন ঝাড়ি!লাফিয়ে শেষে ক্লান্ত দেহে ফড়িং ভাবে পাতায় বসে: ফল্গুধারা মাটিতে বয়, বৃক্ষ বাঁচে মূলের রসে।
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
আমার ডাকনাম ধরে ডেকে ওঠে সুদূরের পাখি অমর্ত্য যমজ ভগ্নি সে আমার কালো সহোদরা জন্মলগ্নে এই হাতে বেঁধে দিয়ে রাখী অচেনা সুদূর কোন্ মায়ালোকে উড়ে গেছে অনঙ্গ অধরা।আমি একা বেড়ে উঠি রূপে-রসে মত্ত যুবরাজ পেরিয়ে মায়ের স্নেহ, লালচক্ষু পিতার শাসন স্বরচিত সংবিধানে গড়ে নিয়ে রঙিন স্বরাজ একে একে জয় করি যৌবনের গন্ধে-ভরা দারুচিনি বন।খেয়েছি নারীর মধু, এর চেয়ে বেশি তার ছলনার বিষ; মধ্যবিত্ত মনে গেঁথে স্বামীত্বের বিপুল ব্যর্থতা সুখের বিবর্ণ মুখে সাধ্যমতো মেরেছি পালিশ, দুঃখকে নিয়েছি মেনে অনিবার্য রূঢ় বাস্তবতা।এর মানে বলতে হবে সুখে-দুখে জীবন সুন্দর: কুষ্ঠরোগী হেসে ওঠে মিষ্টি কোনো স্মৃতির জোছনায়, নুলো ও ঠুঁটোর নারী সন্ততিতে ভরে তোলে পল্লবের ঘর; কামরুলের কিষানীরা নিরিবিলি বিলি কাটে চুলের বন্যায়।যা তুই ফিরে যা পাখি, কালো পাখি, এখন যাবো না-- আগে তো দু’হাত ভরে জীবনের লুটে নিই সোনা!
আবিদ আনোয়ার
চিন্তামূলক
স্বভাবে চঞ্চলমতি--অদম্য অপার তার ভাঙনের তৃষা দেহ তার “কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা” মুখের ব্যাদান সে-ও চর্মচক্ষে দৃশ্যমান নয়-- একটাই ব্রত তার: ক্ষমাহীন অনিবার্য ক্ষয়।মূলতই সর্বগ্রাসী, কিছুতেই নেই তার কোনোই অরুচি: জড় খায়, প্রাণী খায়, পাহাড়-পর্বত খায় ক’রে কুচিকুচি। জীবন ও যৌবন খায়, খেয়ে ফেলে পীনোন্নত যুবতীর স্তন, একে-একে পেটে গেছে নদী ও সমুদ্র থেকে বন-উপবন। মিশরীয় পিড়ামিড, গৌতমের মূর্তি থেকে রোমান খাম্বায়, খাজুরাহো-কোনারকে পাথুরে নিতম্বে তার কামড়ের চিহ্ন দেখা যায়।
আবিদ আনোয়ার
রূপক
জলেই থাকি কিন্তু তবু মাছের থেকে দূরে ঘর বেঁধেছি স্বচ্ছ বালি, জলজ ক্যাকটাসে; রুই-কাতল ও টাকির মেকি ফেনানো বুদ্বুদে মন মজেনি, ঘুচাতে চাই মীনের পরিচয়।আমার ঘরে নৈশব্দ্যও শব্দ থেকে দামী: ফ্রাই উপমা, সিদ্ধ ধ্বনি, কল্পনা চচ্চরি, প্রতীক-পরাস্বপ্নে চলে অলীক খাওয়া-দাওয়া; যুগান্তরের পোশাক প’রে ঢুকছে যুগের হাওয়া!আমার ঘরে আসলে তুমি পেরিয়ে কাচের বাধা দেখতে পাবে তেজস্ক্রিয় শাশ্বত এক নুড়ি, সান্দ্র আলোর ফিনকি দিয়ে সত্য করে ফেরি, একটু ছুঁ’লেই ছলকে ওঠে সমুদ্র-কল্লোলও।যুগের তালে কানকো নাড়ে তিন-পাখার এক মাছ পটভূমি স্বচ্ছ বালি, জলজ ক্যাকটাস...