poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
ইস্কুল-এড়ায়নে
সেই ছিল বরিষ্ঠ,
ফেল-করা ছেলেদের
সবচেয়ে গরিষ্ঠ।
কাজ যদি জুটে যায়
দুদিনে তা ছুটে যায়,
চাকরির বিভাগে সে
অতিশয় নড়িষ্ঠ–
গলদ করিতে কাজে
ভয়ানক দ্রঢ়িষ্ঠ। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
এককালে এই অজয়নদী ছিল যখন জেগে
স্রোতের প্রবল বেগে
পাহাড় থেকে আনত সদাই ঢালি
আপন জোরের গর্ব ক'রে চিকন-চিকন বালি।
অচল বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে যখন ক্রমে ক্রমে
জোর গেল তার কমে,
নদীর আপন আসন বালি নিল হরণ করে,
নদী গেল পিছনপানে সরে;
অনুচরের মতো
রইল তখন আপন বালির নিত্য-অনুগত।
কেবল যখন বর্ষা নামে ঘোলা জলের পাকে
বালির প্রতাপ ঢাকে।
পূর্বযুগের আক্ষেপে তার ক্ষোভের মাতন আসে,
বাঁধনহারা ঈর্ষা ছোটে সবার সর্বনাশে।
আকাশেতে গুরুগুরু মেঘের ওঠে ডাক,
বুকের মধ্যে ঘুরে ওঠে হাজার ঘূর্ণিপাক।
তারপরে আশ্বিনের দিনে শুভ্রতার উৎসবে
সুর আপনার পায় না খুঁজে শুভ্র আলোর স্তবে।
দূরের তীরে কাশের দোলা, শিউলি ফুটে দূরে,
শুষ্ক বুকে শরৎ নামে বালিতে রোদ্দুরে।
চাঁদের কিরণ পড়ে যেথায় একটু আছে জল
যেন বন্ধ্যা কোন্ বিধবার লুটানো অঞ্চল।
নিঃস্ব দিনের লজ্জা সদাই বহন করতে হয়,
আপনাকে হায় হারিয়ে-ফেলা অকীর্তি অজয়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আজিকে হয়েছে শান্তি ,
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে ।
রাত্রিদিন ধুক্ধুক্
তরঙ্গিত দুঃখসুখ
থামিয়াছে বুকে ।
যত কিছু ভালোমন্দ
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
হয়ে যাক ছাই ।গুঞ্জরি করুক তান
ধীরে ধীরে করো গান
বসিয়া শিয়রে ।
যদি কোথা থাকে লেশ
জীবনস্বপ্নের শেষ
তাও যাক মরে ।
তুলিয়া অঞ্চলখানি
মুখ- ' পরে দাও টানি ,
ঢেকে দাও দেহ ।
করুণ মরণ যথা
ঢাকিয়াছে সব ব্যথা
সকল সন্দেহ ।বিশ্বের আলোক যত
দিগ্বিদিকে অবিরত
যাইতেছে বয়ে ,
শুধু ওই আঁখি- ' পরে
নামে তাহা স্নেহভরে
অন্ধকার হয়ে ।
জগতের তন্ত্রীরাজি
দিনে উচ্চে উঠে বাজি ,
রাত্রে চুপে চুপে
সে শব্দ তাহার ‘ পরে
চুম্বনের মতো পড়ে
নীরবতারূপে ।মিছে আনিয়াছ আজি
বসন্তকুসুমরাজি
দিতে উপহার ।
নীরবে আকুল চোখে
ফেলিতেছ বৃথা শোকে
নয়নাশ্রুধার ।
ছিলে যারা রোষভরে
বৃথা এতদিন পরে
করিছ মার্জনা ।
অসীম নিস্তব্ধ দেশে
চিররাত্রি পেয়েছে সে
অনন্ত সান্ত্বনা ।গিয়েছে কি আছে বসে
জাগিল কি ঘুমাল সে
কে দিবে উত্তর ।
পৃথিবীর শ্রান্তি তারে
ত্যজিল কি একেবারে
জীবনের জ্বর!
এখনি কি দুঃখসুখে
কর্মপথ-অভিমুখে
চলেছে আবার ।
অস্তিত্বের চক্রতলে
একবার বাঁধা প ' লে
পায় কি নিস্তার ।বসিয়া আপন দ্বারে
ভালোমন্দ বলো তারে
যাহা ইচ্ছা তাই ।
অনন্ত জনমমাঝে
গেছে সে অনন্ত কাজে ,
সে আর সে নাই ।
আর পরিচিত মুখে
তোমাদের দুখে সুখে
আসিবে না ফিরে ।
তবে তার কথা থাক্ ,
যে গেছে সে চলে যাক
বিস্মৃতির তীরে ।জানি না কিসের তরে
যে যাহার কাজ করে
সংসারে আসিয়া ,
ভালোমন্দ শেষ করি
যায় জীর্ণ জন্মতরী
কোথায় ভাসিয়া ।
দিয়ে যায় যত যাহা
রাখো তাহা ফেলো তাহা
যা ইচ্ছা তোমার ।
সে তো নহে বেচাকেনা —
ফিরিবে না , ফেরাবে না
জন্ম-উপহার ।কেন এই আনাগোনা ,
কেন মিছে দেখাশোনা
দু-দিনের তরে ,
কেন বুকভরা আশা ,
কেন এত ভালোবাসা
অন্তরে অন্তরে ,
আয়ু যার এতটুক ,
এত দুঃখ এত সুখ
কেন তার মাঝে ,
অকস্মাৎ এ সংসারে
কে বাঁধিয়া দিল তারে
শত লক্ষ কাজে —হেথায় যে অসম্পূর্ণ ,
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত ,
কোথাও কি একবার
সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত ,
জীবনে যা প্রতিদিন
ছিল মিথ্যা অর্থহীন
ছিন্ন ছড়াছড়ি
মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি
তারে গাঁথিয়াছে আজি
অর্থপূর্ণ করি —হেথা যারে মনে হয়
শুধু বিফলতাময়
অনিত্য চঞ্চল
সেথায় কি চুপে চুপে
অপূর্ব নূতন রূপে
হয় সে সফল —
চিরকাল এই-সব
রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ-ওষ্ঠাধর ।
জন্মান্তের নবপ্রাতে
সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তর ।সে হয়তো দেখিয়াছে
পড়ে যাহা ছিল পাছে
আজি তাহা আগে ,
ছোটো যাহা চিরদিন
ছিল অন্ধকারে লীন
বড়ো হয়ে জাগে ।
যেথায় ঘৃণার সাথে
মানুষ আপন হাতে
লেপিয়াছে কালি
নূতন নিয়মে সেথা
জ্যোতির্ময় উজ্জ্বলতা
কে দিয়াছে জ্বালি ।কত শিক্ষা পৃথিবীর
খসে পড়ে জীর্ণচীর
জীবনের সনে ,
সংসারের লজ্জাভয়
নিমেষেতে দগ্ধ হয়
চিতাহুতাশনে ।
সকল অভ্যাস-ছাড়া
সর্ব-আবরণ-হারা
সদ্যশিশুসম
নগ্নমূর্তি মরণের
নিষ্কলঙ্ক চরণের
সম্মুখে প্রণমো ।আপন মনের মতো
সংকীর্ণ বিচার যত
রেখে দাও আজ ।
ভুলে যাও কিছুক্ষণ
প্রত্যহের আয়োজন ,
সংসারের কাজ ।
আজি ক্ষণেকের তরে
বসি বাতায়ন- ' পরে
বাহিরেতে চাহো ।
অসীম আকাশ হতে
বহিয়া আসুক স্রোতে
বৃহৎ প্রবাহ ।উঠিছে ঝিল্লির গান ,
তরুর মর্মরতান ,
নদীকলস্বর —
প্রহরের আনাগোনা
যেন রাত্রে যায় শোনা
আকাশের'পর ।
উঠিতেছে চরাচরে
অনাদি অনন্ত স্বরে
সংগীত উদার —
সে নিত্য-গানের সনে
মিশাইয়া লহো মনে
জীবন তাহার ।ব্যাপিয়া সমস্ত বিশ্বে
দেখো তারে সর্বদৃশ্যে
বৃহৎ করিয়া ।
জীবনের ধূলি ধুয়ে
দেখো তারে দূরে থুয়ে
সম্মুখে ধরিয়া ।
পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে
ভাগ করি খণ্ডে খণ্ডে
মাপিয়ো না তারে ।
থাক্ তব ক্ষুদ্র মাপ
ক্ষুদ্র পুণ্য ক্ষুদ্র পাপ
সংসারের পারে ।আজ বাদে কাল যারে
ভুলে যাবে একেবারে
পরের মতন
তারে লয়ে আজি কেন
বিচার-বিরোধ হেন ,
এত আলাপন ।
যে বিশ্ব কোলের'পরে
চিরদিবসের তরে
তুলে নিল তারে
তার মুখে শব্দ নাহি ,
প্রশান্ত সে আছে চাহি
ঢাকি আপনারে ।বৃথা তারে প্রশ্ন করি ,
বৃথা তার পায়ে ধরি ,
বৃথা মরি কেঁদে ,
খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে —
কোন্ অঞ্চলের তলে
নিয়েছে সে বেঁধে ।
ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে ,
ফিরে নিতে চাহি মিছে ,
সে কি আমাদের ?
পলেক বিচ্ছেদে হায়
তখনি তো বুঝা যায়
সে যে অনন্তের ।চক্ষের আড়ালে তাই
কত ভয় সংখ্যা নাই ,
সহস্র ভাবনা ।
মুহূর্ত মিলন হলে
টেনে নিই বুকে কোলে ,
অতৃপ্ত কামনা ।
পার্শ্বে বসে ধরি মুঠি ,
শব্দমাত্রে কেঁপে উঠি ,
চাহি চারিভিতে ,
অনন্তের ধনটিরে
আপনার বুক চিরে
চাহি লুকাইতে ।হায় রে নির্বোধ নর ,
কোথা তোর আছে ঘর ,
কোথা তোর স্থান ।
শুধু তোর ওইটুকু
অতিশয় ক্ষুদ্র বুক
ভয়ে কম্পমান ।
ঊর্ধ্বে ওই দেখ্ চেয়ে
সমস্ত আকাশ ছেয়ে
অনন্তের দেশ —
সে যখন এক ধারে
লুকায়ে রাখিবে তারে
পাবি কি উদ্দেশ ?ওই হেরো সীমাহারা
গগনেতে গ্রহতারা
অসংখ্য জগৎ ,
ওরি মাঝে পরিভ্রান্ত
হয়তো সে একা পান্থ
খুঁজিতেছে পথ ।
ওই দূর-দূরান্তরে
অজ্ঞাত ভুবন- ' পরে
কভু কোনোখানে
আর কি গো দেখা হবে ,
আর কি সে কথা কবে ,
কেহ নাহি জানে ।যা হবার তাই হোক ,
ঘুচে যাক সর্ব শোক ,
সর্ব মরীচিকা ।
নিবে যাক চিরদিন
পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ
মর্তজন্মশিখা ।
সব তর্ক হোক শেষ ,
সব রাগ সব দ্বেষ ,
সকল বালাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
পুড়ে হোক ছাই ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
বন্ধন? বন্ধন বটে, সকলি বন্ধন–
স্নেহ প্রেম সুখতৃষ্ণা; সে যে মাতৃপাণি
স্তন হতে স্তনান্তরে লইতেছে টানি,
নব নব রসস্রোতে পূর্ণ করি মন
সদা করাইছে পান। স্তন্যের পিপাসা
কল্যাণদায়িনীরূপে থাকে শিশুমুখে–
তেমনি সহজ তৃষ্ণা আশা ভালোবাসা
সমস্ত বিশ্বের রস কত সুখে দুখে
করিতেছে আকর্ষণ, জনমে জনমে
প্রাণে মনে পূর্ণ করি গঠিতেছে ক্রমে
দুর্লভ জীবন; পলে পলে নব আশ
নিয়ে যায় নব নব আস্বাদে আশ্রমে।
স্তন্যতৃষ্ণা নষ্ট করি মাতৃবন্ধপাশ
ছিন্ন করিবারে চাস কোন্ মুক্তিভ্রমে!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো !
সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে,
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত । সে চলে গেল , বলে গেল না ,
সে কোথায় গেল ফিরে এল না ,
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল ,
কী যেন গেয়ে গেল--
তাই আপন মনে বসে আছি
কুসুম-বনেতে ।
সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে ,
চঁদের আলোর দেশে গেছে ,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে
হাসি তার রেখে গেছে রে ।
মনে হল আঁখির কোণে
আমায় যেন ডেকে গেছে সে ।
আমি কোথায় যাব কোথায় যাব ,
ভাবতেছি তাই একলা বসে ।
সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল
ঘুমের ঘোর ।
সে প্রাণের কোথা দুলিয়ে গেল
ফুলের ডোর ।
সে কুসুম-বনের উপর দিয়ে
কী কথা যে বলে গেল ,
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে
সঙ্গে তারি চলে গেল ।
হৃদয় আমার আকুল হল ,
নয়ন আমার মুদে এল ,
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
প্রাণ-ধারণের বোঝাখানা বাঁধা পিঠের 'পরে,
আকাল পড়ল, দিন চলে না, চলল দেশান্তরে।
দূর শহরে একটা কিছু যাবেই যাবে জুটে,
এই আশাতেই লগ্ন দেখে ভোরবেলাতে উঠে
দুর্গা ব'লে বুক বেঁধে সে চলল ভাগ্যজয়ে,
মা ডাকে না পিছুর ডাকে অমঙ্গলের ভয়ে।
স্ত্রী দাঁড়িয়ে দুয়ার ধরে দুচোখ শুধু মোছে,
আজ সকালে জীবনটা তার কিছুতেই না রোচে।
ছেলে গেছে জাম কুড়োতে দিঘির পাড়ে উঠি,
মা তারে আজ ভুলে আছে তাই পেয়েছে ছুটি।
স্ত্রী বলেছে বারে বারে, যে ক'রে হোক খেটে
সংসারটা চালাবে সে, দিন যাবে তার কেটে।
ঘর ছাইতে খড়ের আঁঠির জোগান দেবে সে যে,
গোবর দিয়ে নিকিয়ে দেবে দেয়াল পাঁচিল মেঝে।
মাঠের থেকে খড়কে কাঠি আনবে বেছে বেছে,
ঝাঁটা বেঁধে কুমোরটুলির হাটে আসবে বেচে।
ঢেঁকিতে ধান ভেনে দেবে বামুনদিদির ঘরে,
খুদকুঁড়ো যা জুটবে তাতেই চলবে দুর্বছরে।
দূর দেশেতে বসে বসে মিথ্যা অকারণে
কোনোমতেই ভাব্না যেন না রয় স্বামীর মনে।
সময় হল, ঐ তো এল খেয়াঘাটের মাঝি,
দিন না যেতে রহিমগঞ্জে যেতেই হবে আজি।
সেইখানেতে চৌকিদারি করে ওদের জ্ঞাতি,
মহেশখুড়োর মেঝো জামাই, নিতাই দাসের নাতি।
নতুন নতুন গাঁ পেরিয়ে অজানা এই পথে
পৌঁছবে পাঁচদিনের পরে শহর কোনোমতে।
সেইখানে কোন্ হালসিবাগান, ওদের গ্রামের কালো,
শর্ষেতেলের দোকান সেথায় চালাচ্ছে খুব ভালো।
গেলে সেথায় কালুর খবর সবাই বলে দেবে--
তারপরে সব সহজ হবে, কী হবে আর ভেবে।
স্ত্রী বললে, "কালুদাকে খবরটা এই দিয়ো,
ওদের গাঁয়ের বাদল পালের জাঠতুত ভাই প্রিয়
বিয়ে করতে আসবে আমার ভাইঝি মল্লিকাকে
উনত্রিশে বৈশাখে।"
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আপিস থেকে ঘরে এসে
মিলত গরম আহার্য,
আজকে থেকে রইবে না আর
তাহার জো।
বিধবা সেই পিসি ম’রে
গিয়েছে ঘর খালি করে,
বদ্দি স্বয়ং করেছে তার
সাহায্য। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কথা চাই, কথা চাই, হাঁকে
কথার বাজারে;
কথাওয়ালা অাসে ঝাঁকে ঝাঁকে
হাজারে হাজারে।
প্রাণে তোর বাণী যদি থাকে
মৌনে ঢাকিয়া রাখ্ তাকে
মুখর এ হাটের মাঝারে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
দেবে তুমি
কখন নেশায় পেয়ে
আপন-মনে
যাও চলে গান গেয়ে।
যে আকাশের সুরের লেখা লেখ
কুঝি না তা, কেবল রহি চেয়ে।
হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে,
প্রতিদিনের ঠিকঠিকানা ভোলে-
মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন
গন্ধের পথ বেয়ে।গানের টানা জালে
নিমেষ-ঘেরা বাঁধন হাতে
টানে অসীম কালে।
মাটির আড়ালে করি ভেদন
স্বর্গলোকের আনে বেদন,
পরান ফেলে ছেয়ে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
হে যক্ষ তোমার প্রেম ছিল বদ্ধ কোরকের মতো,
একান্তে প্রেয়সী তব সঙ্গে যবে ছিল অনিয়ত
সংকীর্ণ ঘরের কোণে, আপন বেষ্টনে তুমি যবে
রুদ্ধ রেখেছিলে তারে দু-জনের নির্জন উৎসবে
সংসারের নিভৃত সীমায়, শ্রাবণের মেঘজাল
কৃপণের মতো যথা শশাঙ্কের রচে অন্তরাল
আপনার আলিঙ্গনে আপনি হারায়ে ফেলে তারে,
সম্পূর্ণ মহিমা তার দেখিতে পায় না একেবারে
অন্ধ মোহাবেশে। বর তুমি পেলে যবে প্রভুশাপে,
সামীপ্যের বন্ধন ছিন্ন হ'ল, বিরহের দুঃখতাপে
প্রেম হ'ল পূর্ণ বিকশিত; জানিল সে আপনারে
বিশ্বধরিত্রীর মাঝে। নির্বাধে তাহার চারিধারে
সন্ধ্যা অর্ঘ্য করে দান বৃষ্টিজলে সিক্ত বনযূথী
গন্ধের অঞ্জলি; নীপনিকুঞ্জের জানাল আকুতি
রেণুভারে মন্থর পবন। উঠে গেল যবনিকা
আত্মবিস্মৃতির, দেখা দিল দিকে দিগন্তরে লিখা
উদার বর্ষার বাণী, যাত্রামন্ত্র বিশ্বপথিকের
মেঘধ্বজে আঁকা, দিগ্বধূ-প্রাঙ্গণ হতে নির্ভীকের
শূন্যপথে অভিসার। আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
দীক্ষা পেলে অশ্রুধৌত সৌম্য বিষাদের; নিত্যরসে
আপনি করিলে সৃষ্টি রূপসীর অপূর্ব মুরতি
অন্তহীন গরিমায় কান্তিময়ী। এক দিন ছিল সেই সতী
গৃহের সঙ্গিনী, তারে বসাইলে ছন্দশঙ্খ রবে
আলোক-আলোকদীপ্ত অলকার অমর গৌরবে
অনন্তের আনন্দ-মন্দিরে। প্রেম তব ছিল বাক্যহীন,
আজ সে পেয়েছে তার ভাষা, আজ তার রাত্রিদিন
সংগীত তরঙ্গে আন্দোলিত। তুমি আজ হলে কবি
মুক্ত তব দৃষ্টিপথে উদ্বারিত নিখিলের ছবি
শ্যামমেঘে স্নিগ্ধচ্ছায়া। বক্ষ ছাড়ি মর্মে অধ্যাসীনা
প্রিয়া তব ধ্যানোদ্ভবা লয়ে তার বিরহের বীণা।
অপরূপ রূপে রচি বিচ্ছেদের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে
তোমার প্রেমের সৃষ্টি উৎসর্গ করিলে বিশ্বজনে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যখন আমায় হাতে ধরে
আদর করে
ডাকলে তুমি আপন পাশে,
রাত্রিদিবস ছিলেম ত্রাসে
পাছে তোমার আদর হতে অসাবধানে কিছু হারাই,
চলতে গিয়ে নিজের পথে
যদি আপন ইচ্ছামতে
কোনো দিকে এক পা বাড়াই,
পাছে বিরাগ-কুশাঙ্কুরের একটি কাঁটা একটু মাড়াই।
মুক্তি, এবার মুক্তি আজি
উঠল বাজি
অনাদরের কঠিন ঘায়ে,
অপমানের ঢাকে ঢোলে সকল নগর সকল গাঁয়ে।
ওরে ছুটি, এবার ছুটি, এই যে আমার হল ছুটি,
ভাঙল আমার মানের খুঁটি,
খসল বেড়ি হাতে পায়ে;
এই যে এবার
দেবার নেবার
পথ খোলসা ডাইনে বাঁয়ে।
এতদিনে আবার মোরে
বিষম জোরে
ডাক দিয়েছে আকাশ পাতাল।
লাঞ্ছিতেরে কে রে থামায়।
ঘর-ছাড়ানো বাতাস আমায়
মুক্তি-মদে করল মাতাল।
খসে-পড়া তারার সাথে
নিশীথরাতে
ঝাঁপ দিয়েছি অতলপানে
মরণ-টানে।
আমি-যে সেই বৈশাখী মেঘ বাঁধনছাড়া,
ঝড় তাহারে দিল তাড়া;
সন্ধ্যারবির স্বর্ণকিরীট ফেলে দিল অস্তপারে,
বজ্রমানিক দুলিয়ে নিল গলার হারে;
একলা আপন তেজে
ছুটল সে-যে
অনাদরের মুক্তিপথের 'পরে
তোমার চরণধুলায়-রঙিন চরম সমাদরে।
গর্ভ ছেড়ে মাটির 'পরে
যখন পড়ে
তখন ছেলে দেখে আপন মাকে।
তোমার আদর যখন ঢাকে,
জড়িয়ে থাকি তারি নাড়ীর পাকে,
তখন তোমায় নাহি জানি।
আঘাত হানি
তোমারি আচ্ছাদন হতে যেদিন দূরে ফেলাও টানি
সে-বিচ্ছেদে চেতনা দেয় আনি,
দেখি বদনখানি।
শিলাইদা, কুঠিবাড়ি, ১৯ মাঘ, ১৩২১-রাত্রি
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিগাথা
|
গাহিছে কাশীনাথ নবীন যুবা, ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি,
কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর সাতটি যেন পোষা পাখি;
শানিত তরবারি গলাটি যেন নাচিয়া ফিরে দশ দিকে---
কখন কোথা যায় না পাই দিশা, বিজুলি-হেন ঝিকিমিকে।
আপনি গড়ি তোলে বিপদজাল, আপনি কাটি দেয় তাহা;
সভার লোকে শুনে অবাক মানে, সঘনে বলে `বাহা বাহা'।কেবল বুড়া রাজা প্রতাপরায় কাঠের মতো বসি আছে;
বরজলাল ছাড়া কাহারো গান ভালো না লাগে তার কাছে।
বালক-বেলা হতে তাহারি গীতে দিল সে এতকাল যাপি---
বাদল-দিনে কত মেঘের গান, হোলির দিনে কত কাফি।
গেয়েছে আগমনী শরত্প্রাতে, গেয়েছে বিজয়ার গান---
হৃদয় উছসিয়া অশ্রুজলে ভাসিয়া গিয়াছে দুনয়ান।
যখনি মিলিয়াছে বন্ধুজনে সভার গৃহ গেছে পূরে,
গেয়েছে গোকুলের গোয়াল-গাথা ভূপালি মূলতানি সুরে।
ঘরেতে বারবার এসেছে কত বিবাহ-উত্সব-রাতি---
পরেছে দাসদাসী লোহিত বাস, জ্বলেছে শত শত বাতি,
বসেছে নব বর সলাজ মুখে পরিয়া মণি-আভরণ,
করিছে পরিহাস কানের কাছে সমবয়সী প্রিয়জন,
সামনে বসি তার বরজলাল ধরেছে সাহানার সুর---
সে-সব দিন আর সে-সব গান হৃদয়ে আছে পরিপূর।
সে ছাড়া কারো গান শুনিলেই তাই মর্মে গিয়ে নাহি লাগে
অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে।
প্রতাপরায় তাই দেখিছে শুধু কাশীর বৃথা মাথা-নাড়া---
সুরের পরে সুর ফিরিয়া যায়, হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া।
থামিল গান যবে ক্ষণেক-তরে বিরাম মাগে কাশীনাথ;
বরজলাল-পানে প্রতাপ রায় হাসিয়া করে আঁখিপাত।
কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ কহিল, ``ওস্তাদজি,
গানের মতো গান শুনায়ে দাও, এরে কি গান বলে, ছি!
এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে, শিকারী বিড়ালের খেলা।
সেকালে গান ছিল, একালে হায় গানের বড়ো অবহেলা।বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ, শুভ্র উষ্ণীষ শিরে,
বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে।
শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে তুলিয়া নিল তানপুর,
ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি ইমনকল্যাণ সুর।
কাঁপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায় বৃহত্ সভাগৃহকোণে,
ক্ষুদ্র পাখি যথা ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে।
বসিয়া বাম পাশে প্রতাপরায়, দিতেছে শত উত্সাহ---
``আহাহা, বাহা বাহা কহিছে কানে, ``গলা ছাড়িয়া গান গাহ।
সভার লোকে সবে অন্যমনা, কেহ বা কানাকানি করে।
কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে, কেহ বা চ'লে যায় ঘরে।
``ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পান ভৃত্যে ডাকি কেহ কয়।
সঘনে পাখা নাড়ি কেহ বা বলে, ``গরম আজি অতিশয়।
করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক, ক্ষণেক নাহি রহে চুপ।
নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা শব্দ ওঠে শতরূপ।বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়, তুফান-মাঝে ক্ষীণ তরী---
কেবল দেখা যায় তানপুরায় আঙুল কাঁপে থরথরি।
হৃদয়ে যেথা হতে গানের সুর উছসি উঠে নিজসুখে
হেলার কলরব শিলার মতো চাপে সে উত্সের মুখে---
কোথায় গান আর কোথায় প্রাণ দু দিকে ধায় দুই জনে,
তবুও রাখিবারে প্রভুর মান বরজ গায় প্রাণপণে।গানের এক পদ মনের ভ্রমে হারায়ে গেল কী করিয়া,
আবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গাহে--- লইতে চাহে শুধরিয়া।
আবার ভুলে যায় পড়ে না মনে, শরমে মস্তক নাড়ি
আবার শুরু হতে ধরিল গান--- আবার ভুলি দিল ছাড়ি।
দ্বিগুণ থরথরি কাঁপিছে হাত, স্মরণ করে গুরুদেবে।
কণ্ঠ কাঁপিতেছে কাতরে, যেন বাতাসে দীপ নেবে-নেবে।
গানের পদ তবে ছাড়িয়া দিয়া রাখিল সুরটুকু ধরি,
সহসা হাহারবে উঠিল কাঁদি গাহিতে গিয়া হা-হা করি।
কোথায় দূরে গেল সুরের খেলা, কোথায় তাল গেল ভাসি,
গানের সুতা ছিঁড়ি পড়িল খসি, অশ্রু-মুকুতার রাশি।
কোলের সখী তানপুরার 'পরে রাখিল লজ্জিত মাথা---
ভুলিল শেখা গান, পড়িল মনে বাল্যক্রন্দনগাথা।
নয়ন ছলছল, প্রতাপরায় কর বুলায় তার দেহে---
``আইস হেথা হতে আমরা যাই কহিল সকরুণ স্নেহে।
শতেক-দীপ-জ্বালা নয়ন-ভরা ছাড়ি সে উত্সবঘর
বাহিরে গেল দুটি প্রাচীন সখা ধরিয়া দুঁহু দোঁহা-কর।
বরজ করজোড়ে কহিল, ``প্রভু, মোদের সভা হল ভঙ্গ।
এখন আসিয়াছে নূতন লোক, ধরায় নব নব রঙ্গ!
জগতে আমাদের বিজন সভা কেবল তুমি আর আমি---
সেথায় আনিয়ো না নূতন শ্রোতা, মিনতি তব পদে স্বামী!
একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুই জনে---
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে।
তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে---
বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে, তবে সে মর্মর ফুটে।
জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি যুগল মিলিয়াছে আগে---
যেখানে প্রেম নাই, বোবার সভা, সেখানে গান নাহি জাগে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
নবীন আগন্তুক,
নব যুগ তব যাত্রার পথে
চেয়ে আছে উৎসুক।
কী বার্তা নিয়ে মর্তে এসেছ তুমি;
জীবনরঙ্গভূমি
তোমার লাগিয়া পাতিয়াছে কী আসন।
নরদেবতার পূজায় এনেছ
কী নব সম্ভাষণ।
অমরলোকের কী গান এসেছ শুনে।
তরুণ বীরের তূণে
কোন্ মহাস্ত্র বেঁধেছ কটির 'পরে
অমঙ্গলের সাথে সংগ্রাম-তরে।
রক্তপ্লাবনে পঙ্কিল পথে
বিদ্বেষে বিচ্ছেদে
হয়তো রচিবে মিলনতীর্থ
শান্তির বাঁধ বেঁধে।
কে বলিতে পারে তোমার ললাটে লিখা
কোন্ সাধনার অদৃশ্য জয়টিকা।
আজিকে তোমার অলিখিত নাম
আমরা বেড়াই খুঁজি--
আগামী প্রাতের শুকতারা-সম
নেপথ্যে আছে বুঝি।
মানবের শিশু বারে বারে আনে
চির আশ্বাসবাণী--
নূতন প্রভাতে মুক্তির আলো
বুঝি-বা দিতেছে আনি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
ধুলা, করো কলঙ্কিত সবার শুভ্রতা
সেটা কি তোমারি নয় কলঙ্কর কথা? (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
বাহিরে যাহারে খুঁজেছিনু দ্বারে দ্বারে
পেয়েছি ভাবিয়া হারায়েছি বারে বারে—
কত রূপে রূপে কত-না অলংকারে
অন্তরে তারে জীবনে লইব মিলায়ে,
বাহিরে তখন দিব তার সুধা বিলায়ে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
যখন আমায় বাঁধ আগে পিছে,
মনে করি আর পাব না ছাড়া।
যখন আমায় ফেল তুমি নীচে,
মনে করি আর হব না খাড়া।
আবার তুমি দাও যে বাঁধন খুলে,
আবার তুমি নাও আমারে তুলে,
চিরজীবন বাহু-দোলায় তব
এমনি করে কেবলি দাও নাড়া।
ভয় লাগায়ে তন্দ্রা কর ক্ষয়,
ঘুম ভাঙায়ে তখন ভাঙ ভয়।
দেখা দিয়ে ডাক দিয়ে যাও প্রাণে,
তাহার পরে লুকাও যে কোন্খানে,
মনে করি এই হারালেম বুঝি,
কোথা হতে আবার যে দাও সাড়া।
১১ শ্রাবণ, ১৩১৭
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
ওরে নবীন , ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ ওরে অবুঝ ,
আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা ।
রক্ত আলোয় মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক'রে
পুচ্ছটি তোর উর্দ্ধে তুলে নাচা ।
আয় দুরন্ত ,আয় রে আমার কাঁচা ।খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়
আর তো কিছুই নড়ে না রে
ওদের ঘরে , ওদের ঘরের দাওয়ায় ।ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা--
চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা ,
ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা
অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায় ।
আয় জীবন্ত আয় রে আমার কাঁচা ।বাহির পানে তাকায় না যে কেউ
দেখে না যে বান ডেকেছে--
জোয়ার জলে উঠছে প্রবল ঢেউ ।
চলতে ওরা চায়না মাটির ছেলে
মাটির পরে চরণ ফেলে ফেলে ,
আছে অচল আসনখানা মেলে
যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায় ।
আয় অশান্ত ,আয় রে আমার কাঁচা ।তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।
হঠাৎ আলো দেখবে যখন
ভাববে একি বিষম কান্ডখানা ।
সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,
শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,
সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে
লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায় ।
আয় প্রচন্ড, আয় রে আমার কাঁচা ।শিকল দেবীর ঐ যে পূজাবেদি
চিরকাল কি রইবে খাড়া ?
পাগলামি তুই, আয় রে দুয়ার ভেদি।
ঝড়ের মাতন বিজয় কেতন নেড়ে
অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেরে
ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে
ভুলগুলো সব অানরে বাছা বাছা ।
আয় প্রমত্ত আয় রে আমার কাঁচা ।আন্ রে টেনে বাঁধা পথের শেষে।
বিবাগি কর্ অবাধ পানে,
পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে ।
আপদ আছে জানি আঘাত আছে,
তাই জেনে তো বক্ষে পরাণ নাচে---
ঘুচিয়ে দে ভাই, পুঁথিপোড়োর কাছে
পথে চলার বিধিবিধান যাচা ।
আয় প্রমুক্ত, অায় রে আমার কাঁচা ।চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি ।
সবুজ নেশায় ভোর করেছিস ধরা,
ঝড়ের মেঘে তোরই তড়িৎ ভরা,
বসন্তেরে পরাস অাকুল করা
আপন গলার বকূল মালাগাছা ।
আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
বুঝেছি বুঝেছি , সখা , কেন হাহাকার ,
আপনার’পরে মোর কেন সদা রোষ ।
বুঝেছি বিফল কেন জীবন আমার —
আমি আছি , তুমি নাই , তাই অসন্তোষ ।
সকল কাজের মাঝে আমারেই হেরি —
ক্ষুদ্র আমি জেগে আছে ক্ষুধা লয়ে তার ,
শীর্নবাহু – আলিঙ্গনে আমারেই ঘেরি
করিছে আমার হায় অস্থিচর্ম সার ।
কোথা নাথ , কোথা তব সুন্দর বদন —
কোথায় তোমার নাথ , বিশ্ব – ঘেরা হাসি ।
আমারে কাড়িয়া লও , করো গো গোপন —
আমারে তোমারে মাঝে করো গো উদাসী ।
ক্ষুদ্র আমি করিতেছে বড়ো অহংকার ,
ভাঙো নাথ , ভাঙো নাথ , অভিমান তার ।। (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এই মোর জীবনের মহাদেশে
কত প্রান্তরের শেষে,
কত প্লাবনের স্রোতে
এলেম ভ্রমণ করি শিশুকাল হতে--
কোথাও রহস্যঘন অরণ্যের ছায়াময় ভাষা,
কোথাও পাণ্ডুর শুষ্ক মরুর নৈরাশা,
কোথাও-বা যৌবনের কুসুমপ্রগল্ভ বনপথ,
কোথাও-বা ধ্যানমগ্ন প্রাচীন পর্বত
মেঘপুঞ্জে স্তব্ধ যার দুর্বোধ কী বাণী,
কাব্যের ভাণ্ডারে আনি
স্মৃতিলেখা ছন্দে রাখিয়াছি ঢাকি,
আজ দেখি, অনেক রয়েছে বাকি।
সুকুমারী লেখনীর লজ্জা ভয়
যা পুরুষ, যা নিষ্ঠুর, উৎকট যা, করে নি সঞ্চয়
আপনার চিত্রশালে;
তার সংগীতের তালে
ছন্দোভঙ্গ হল তাই,
সংকোচে সে কেন বোঝে নাই।
সৃষ্টিরঙ্গভূমিতলে
রূপ-বিরূপের নৃত্য একসঙ্গে নিত্যকাল চলে,
সে দ্বন্দ্বের করতালঘাতে
উদ্দাম চরণপাতে
সুন্দরের ভঙ্গী যত অকুণ্ঠিত শক্তিরূপ ধরে,
বাণীর সম্মোহবন্ধ ছিন্ন করে অবজ্ঞার ভরে।
তাই আজ বেদমন্ত্রে হে বজ্রী, তোমার করি স্তব--
তব মন্ত্ররব
করুক ঐশ্বর্যদান,
রৌদ্রী রাগিণীর দীক্ষা নিয়ে যাক মোর শেষগান,
আকাশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
রূঢ় পৌরুষের ছন্দে
জাগুক হুংকার,
বাণীবিলাসীর কানে ব্যপ্ত হোক ভর্ৎসনা তোমার।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
জন্মবাসরের ঘটে
নানা তীর্থে পুণ্যতীর্থবারি
করিয়াছি আহরণ, এ কথা রহিল মোর মনে।
একদা গিয়েছি চিন দেশে,
অচেনা যাহারা
ললাটে দিয়েছে চিহ্ন "তুমি আমাদের চেনা' ব'লে।
খসে পড়ে গিয়েছিল কখন পরের ছদ্মবেশ;
দেখা দিয়েছিল তাই অন্তরের নিত্য যে মানুষ;
অভাবিত পরিচয়ে
আনন্দের বাঁধ দিল খুলে।
ধরিনু চিনের নাম, পরিনু চিনের বেশবাস।
এ কথা বুঝিনু মনে,
যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।
আনে সে প্রাণের অপূর্বতা।
বিদেশী ফুলের বনে অজানা কুসুম ফুটে থাকে--
বিদেশী তাহার নাম, বিদেশে তাহার জন্মভূমি,
আত্মার আনন্দক্ষেত্রে তার আত্মীয়তা
অবারিত পায় অভ্যর্থনা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নববর্ষ এল আজি
দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;
আনে নি আশার বাণী,
দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়;
প্রতিকূল ভাগ্য আসে
হিংস্র বিভীষিকার আকারে—
তখনি সে অকল্যাণ
যখনি তাহারে করি ভয়।
যে জীবন বহিয়াছি
পূর্ণ মূল্যে আজ হোক কেনা;
দুর্দিনে নির্ভীক বীর্যে
শোধ করি তার শেষ দেনা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বসন্ত যে লেখা লেখে
বনে বনান্তরে
নামুক তাহারি মন্ত্র
লেখনীর 'পরে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
অয়ি তন্বী ইছামতী, তব তীরে তীরে
শান্তি চিরকাল থাক কুটিরে কুটিরে—
শস্যে পূর্ণ হোক ক্ষেত্র তব তটদেশে।
বর্ষে বর্ষে বরষায় আনন্দিত বেশে
ঘনঘোরঘটা-সাথে বজ্রবাদ্যরবে
পূর্ববায়ুকল্লোলিত তরঙ্গ-উৎসবে
তুলিয়া আনন্দধ্বনি দক্ষিণে ও বামে
আশ্রিত পালিত তব দুই-তট-গ্রামে
সমারোহে চলে এসো শৈলগৃহ হতে
সৌভাগ্যে শোভায় গর্বে উল্লসিত স্রোতে।
যখন রব না আমি, রবে না এ গান,
তখনো ধরার বক্ষে সঞ্চরিয়া প্রাণ,
তোমার আনন্দগাথা এ বঙ্গে, পার্বতী,
বর্ষে বর্ষে বাজিবেক অয়ি ইছামতী! (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
স্মৃতিরে আকার দিয়ে আঁকা ,
বোধে যার চিহ্ন পড়ে ভাষায় কুড়ায়ে তারে রাখা ,
কী অর্থ ইহার মনে ভাবি ।
এই দাবি
জীবনের এ ছেলেমানুষি ,
মরণেরে বঞ্চিবার ভান ক ' রে খুশি ,
বাঁচা-মরা খেলাটাতে জিতিবার শখ ,
তাই মন্ত্র প ' ড়ে আনে কল্পনার বিচিত্র কুহক ।
কালস্রোতে বস্তুমূর্তি ভেঙে ভেঙে পড়ে ,
আপন দ্বিতীয় রূপ প্রাণ তাই ছায়া দিয়ে গড়ে ।
“ রহিল ” বলিয়া যায় অদৃশ্যের পানে ;
মৃত্যু যদি করে তার প্রতিবাদ , নাহি আসে কানে ।
আমি বদ্ধ ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের জালে ,
আমার আপন-রচা কল্পরূপ ব্যাপ্ত দেশে কালে ,
এ কথা বিলয়দিনে নিজে নাই জানি
আর কেহ যদি জানে তাহারেই বাঁচা ব'লে মানি ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যা পায় সকলই জমা করে,
প্রাণের এ লীলা রাত্রিদিন।
কালের তাণ্ডবলীলাভরে
সকলই শূন্যেতে হয় লীন। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার প্রেম যে বইতে পারি
এমন সাধ্য নাই।
এ সংসারে তোমার আমার
মাঝখানেতে তাই
কৃপা করে রেখেছ নাথ
অনেক ব্যবধান–
দুঃখসুখের অনেক বেড়া
ধনজনমান।আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে
আভাসে দাও দেখা–
কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
রবির মৃদু রেখা।
শক্তি যারে দাও বহিতে
অসীম প্রেমের ভার
একেবারে সকল পর্দা
ঘুচায়ে দাও তার।না রাখ তার ঘরের আড়াল
না রাখ তার ধন,
পথে এনে নিঃশেষে তায়
কর অকিঞ্চন।
না থাকে তার মান অপমান,
লজ্জা শরম ভয়,
একলা তুমি সমস্ত তার
বিশ্বভুবনময়।এমন করে মুখোমুখি
সামনে তোমার থাকা,
কেবলমাত্র তোমাতে প্রাণ
পূর্ণ করে রাখা,
এ দয়া যে পেয়েছে তার
লোভের সীমা নাই–
সকল লোভে সে সরিয়ে ফেলে
তোমায় দিতে ঠাঁই।তিনধরিয়া, ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
অপরাহ্নে ধূলিচ্ছন্ন নগরীর পথে
বিষম লোকের ভিড়; কর্মশালা হতে
ফিরে চলিয়াছে ঘরে পরিশ্রান্ত জন
বাঁধমুক্ত তটিনীর স্রোতের মতন।
ঊর্ধ্বশ্বাসে রথ-অশ্ব চলিয়াছে ধেয়ে
ক্ষুধা আর সারথির কশাঘাত খেয়ে।
হেনকালে দোকানির খেলামুগ্ধ ছেলে
কাটা ঘুড়ি ধরিবারে চলে বাহু মেলে।
অকস্মাৎ শকটের তলে গেল পড়ি,
পাষাণকঠিন পথ উঠিল শিহরি।
সহসা উঠিল শূন্যে বিলাপ কাহার,
স্বর্গে যেন দয়াদেবী করে হাহাকার।
ঊর্ধ্বপানে চেয়ে দেখি স্খলিতবসনা
লুটায়ে লুটায়ে ভূমে কাঁদে বারাঙ্গনা। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
নামজাদা দানুবাবু
রীতিমতো খর্চে,
অথচ ভিটেয় তার
ঘুঘু সদা চরছে।
দানধর্মের ‘পরে
মন তার নিবিষ্ট,
রোজগার করিবার
বেলা জপে “শ্রীবিষ্ণু’,
চাঁদার খাতাটা তাই
দ্বারে দ্বারে ধরছে।
এই ভাবে পুণ্যের
খাতা তার ভরছে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া ,
কভু বা অবাক , কভু ভকতি-বিহ্বল হিয়া ।
নিজের প্রাণের মাঝে
একটি যে বীণা বাজে ,
সে বাণী শুনিতেছেন হৃদয় মাঝারে গিয়া ।
বনে যতগুলি ফুল আলো করি ছিল শাখা ,
কারো কচি তনুখানি নীল বসনেতে ঢাকা ,
কারো বা সোনার মুখ ,
কেহ রাঙা টুকটুক ,
কারো বা শতেক রঙ যেন ময়ূরের পাখা ,
কবিরে আসিতে দেখি হরষেতে হেলি দুলি
হাব ভাব করে কত রূপসী সে মেয়েগুলি ।
বলাবলি করে , আর ফিরিয়া ফিরিয়া চায় ,
“ প্রণয়ী মোদের ওই দেখ লো চলিয়া যায় । ”
সে অরণ্যে বনস্পতি মহান্ বিশাল-কায়া
হেথায় জাগিছে আলো , হোথায় ঘুমায় ছায়া ।
কোথাও বা বৃদ্ধবট —
মাথায় নিবিড় জট ;
ত্রিবলী অঙ্কিত দেহ প্রকাণ্ড তমাল শাল ;
কোথাও বা ঋষির মতো
অশথের গাছ যত
দাঁড়ায়ে রয়েছে মৌন ছড়ায়ে আঁধার ডাল ।
মহর্ষি গুরুরে হেরি অমনি ভকতিভরে
সসম্ভ্রমে শিষ্যগণ যেমন প্রণাম করে ,
তেমনি করিবে দেখি গাছেরা দাঁড়াল নুয়ে ,
লতা-শ্মশ্রুময় মাথা ঝুলিয়া পড়িল ভুঁয়ে ।
একদৃষ্টে চেয়ে দেখি প্রশান্ত সে মুখচ্ছবি ,
চুপি চুপি কহে তারা “ ওই সেই । ওই কবি । ” — Victor Hugo
(অনূদিত কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যাবার দিনে এই কথাটি
বলে যেন যাই---
যা দেখেছি যা পেয়েছি
তুলনা তার নাই।
এই জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে
যে শতদল পদ্ম রাজে
তারই মধু পান করেছি
ধন্য আমি তাই---
যাবার দিনে এই কথাটি
জানিয়ে যেন যাই।বিশ্বরূপের খেলাঘরে
কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম
দুটি নয়ন মেলে।
পরশ যাঁরে যায় না করা
সকল দেহে দিলেন ধরা।
এইখানে শেষ করেন যদি
শেষ করে দিন তাই---
যাবার বেলা এই কথাটি
জানিয়ে যেন যাই।
২০ শ্রাবণ, ১৩১৭
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
এখনো অঙ্কুর যাহা
তারি পথ-পানে
প্রত্যহ প্রভাতে রবি
আশীৰ্বাদ আনে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আয়না দেখেই চমকে বলে,
“মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে,
বেশিদিন আর বাঁচব না তো–‘
ভাবছে বসে একা সে।
ডাক্তারেরা লুটল কড়ি,
খাওয়ায় জোলাপ, খাওয়ায় বড়ি,
অবশেষে বাঁচল না সেই
বয়স যখন একাশি। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
শোকের বরষা দিন এসেছে আঁধারি—
ও ভাই গৃহস্থ চাষি, ছেড়ে আয় বাড়ি।
ভিজিয়া নরম হল শুষ্ক মরু মন,
এই বেলা শস্য তোর করে নে বপন। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বাছা রে মোর বাছা,
ধূলির ‘পরে হরষভরে
লইয়া তৃণগাছা
আপন মনে খেলিছ কোণে,
কাটিছে সারা বেলা।
হাসি গো দেখে এ ধূলি মেখে
এ তৃণ লয়ে খেলা।
আমি যে কাজে রত,
লইয়া খাতা ঘুরাই মাথা
হিসাব কষি কত,
আঁকের সারি হতেছে ভারী
কাটিয়া যায় বেলা—
ভাবিছ দেখি মিথ্যা একি
সময় নিয়ে খেলা।
বাছা রে মোর বাছা,
খেলিতে ধূলি গিয়েছি ভুলি
লইয়ে তৃণগাছা।
কোথায় গেলে খেলেনা মেলে
ভাবিয়া কাটে বেলা,
বেড়াই খুঁজি করিতে পুঁজি
সোনারূপার ঢেলা।
যা পাও চারি দিকে
তাহাই ধরি তুলিছ গড়ি
মনের সুখটিকে।
না পাই যারে চাহিয়া তারে
আমার কাটে বেলা,
আশাতীতেরই আশায় ফিরি
ভাসাই মোর ভেলা। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
রায়ঠাকুরানী অম্বিকা।
দিনে দিনে তাঁর বাড়ে বাণীটার লম্বিকা।
অবকাশ নেই তবুও তো কোনো গতিকে
নিজে ব’কে যান, কহিতে না দেন পতিকে।
নারীসমাজের তিনি তোরণের স্তম্ভিকা।
সয় নাকো তাঁর দ্বিতীয় কাহারো দম্ভিকা। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
একদিন শান্ত হলে আষাঢ়ের ধারা
বাতাবির চারা
আসন্ন-বর্ষণ কোন্ শ্রাবণ প্রভাতে
রোপন করিলে নিজহাতে
আমার বাগানে।
বহুকাল গেল চলি; প্রখর পৌষের অবসানে
কুহেলি ঘুচাল যবে কৌতূহলী ভোরের আলোকে,
সহসা পড়িল চোখ,--
হেরিনু শিশিরে ভেজা সেই গাছে
কচিপাতা ধরিয়াছে,
যেন কী আগ্রহে
কথা কহে,
যে-কথা আপনি শুনে পুলকেতে দুলে;
যেমন একদা কবে তমসার কূলে
সহসা বাল্মীকি মুনি
আপনার কণ্ঠ হতে আপন প্রথম ছন্দ শুনি'
আনন্দ সঘন
গভীর বিস্ময়ে নিমগন।
কোথায় আছ না-জানি এ সকালে
কী নিষ্ঠুর অন্তরালে, --
সেথা হতে কোনো সম্ভাষণ
পরশে না এ প্রান্তের নিভৃত আসন।
হেনকালে অকস্মাৎ নিঃশব্দের অবহেলা হতে
প্রকাশিল অরুণ আলোতে
এ কয়টি কিশলয়।
এরা যেন সেই কথা কয়
বলিতে পারিতে যাহা তবু না বলিয়া
চলে গেছে প্রিয়া।
সেদিন বসন্ত ছিল দূরে
আকাশ জাগেনি সুরে,
অচেনার যবনিকা কেঁপেছিল ক্ষণে ক্ষণে
তখনো যায়নি সরে দুরন্ত দক্ষিণ সমীরণে।
প্রকাশের উচ্ছৃঙ্খল অবকাশ না ঘটিতে
পরিচয় না রটিতে,
ঘণ্টা গেল বেজে
অব্যক্তের অনালোকে সায়াহ্নে গিয়েছ সভা ত্যেজে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
জমল সতেরো টাকা;
সুদে টাকা খেলাবার
শখ গেল, নবু তাই
গেল চলি ম্যালাবার।
ভাবনা বাড়ায় তার
মুনফার মাত্রা,
পাঁচ মেয়ে বিয়ে ক’রে
বাঁচল এ যাত্রা।
কাজ দিল কন্যারা
ঠেলাগাড়ি ঠেলাবার,
রোদ্দুরে ভার্যার
ভিজে চুল এলাবার। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও।
আমার দিকে ও মুখ ফিরাও।
পাশে থেকে চিনতে নারি,
কোন্ দিকে যে কী নেহারি,
তুমি আমার হৃদ্বিহারী
হৃদয়পানে হাসিয়া চাও।বলো আমায় বলো কথা,
গায়ে আমার পরশ করো।
দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে
আমায় তুমি তুলে ধরো।
যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে,
যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে–
হাসি মিছে,কান্না মিছে,
সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
প্রথমে আশাহত হয়েছিনু
ভেবেছিনু সবে না এ বেদনা;
তবু তো কোনোমতে সয়েছিনু,
কী করে যে সে কথা শুধায়ো না।Heinrich Hein
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
চিরদিন আছি আমি অকেজোর দলে;
বাজে লেখা, বাজে পড়া, দিন কাটে মিথ্যা বাজে ছলে।
যে গুণী কাটাতে পারে বেলা তার বিনা আবশ্যকে
তারে “এসো এসো” ব’লে যত্ন ক’রে বসাই বৈঠকে।
কেজো লোকদের করি ভয়,
কব্জিতে ঘড়ি বেঁধে শক্ত করে বেঁধেছে সময়–
বাজে খরচের তরে উদ্বৃত্ত কিছুই নেই হাতে,
আমাদের মতো কুঁড়ে লজ্জা পায় তাদের সাক্ষাতে।
সময় করিতে নষ্ট আমরা ওস্তাদ,
কাজের করিতে ক্ষতি নানামতো পেতে রাখি ফাঁদ।
আমার শরীরটা যে ব্যস্তদের তফাতে ভাগায়–
আপনার শক্তি নেই, পরদেহে মাশুল লাগায়।
সরোজদাদার দিকে চাই–
সব তাতে রাজি দেখি, কাজকর্ম যেন কিছু নাই,
সময়ের ভাণ্ডারেতে দেওয়া নেই চাবি,
আমার মতন এই অক্ষমের দাবি
মেটাবার আছে তার অক্ষুণ্ন উদার অবসর,
দিতে পারে অকৃপণ অক্লান্ত নির্ভর।
দ্বিপ্রহর রাত্রিবেলা স্তিমিত আলোকে
সহসা তাহার মূর্তি পড়ে যবে চোখে
মনে ভাবি, আশ্বাসের তরী বেয়ে দূত কে পাঠালে,
দুর্যোগের দুঃস্বপ্ন কাটালে।
দায়হীন মানুষের অভাবিত এই আবির্ভাব
দয়াহীন অদৃষ্টের বন্দীশালে মহামূল্য লাভ। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
সজনি গো ,
শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা
নিশীথযামিনী রে ।
কুঞ্জপথে সখি , কৈসে যাওব
অবলা কামিনী রে ।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত ,
ঘন ঘন গর্জিত মেহ ।
দমকত বিদ্যুত , পথতরু লুন্ঠত ,
থরহর কম্পত দেহ ।
ঘন ঘন রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্
বরখত নীরদপুঞ্জ ।
ঘোর গহন ঘন তালতমালে
নিবিড় তিমিরময় কুঞ্জ ।
বোল ত সজনী , এ দুরুযোগে
কুঞ্জে নিরদয় কান
দারুণ বাঁশী কাহ বজায়ত
সকরুণ রাধা নাম ।
সজনি ,
মোতিম হারে বেশ বনা দে ,
সীঁথি লগা দে ভালে ।
উরহি বিলোলিত শিথিল চিকুর মম
বাঁধহ মালত মালে
খোল দুয়ার ত্বরা করি সখি রে ,
ছোড় সকল ভয়লাজে —
হৃদয় বিহগসম ঝটপট করত হি
পঞ্জরপিঞ্জরমাঝে ।
গহন রয়নমে ন যাও বালা
নওলকিশোরক পাশ —
গরজে ঘন ঘন , বহু ডর পাওব ,
কহে ভানু তব দাস ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
এই জগতের শক্ত মনিব সয় না একটু ত্রুটি,
যেমন নিত্য কাজের পালা তেমনি নিত্য ছুটি।
বাতাসে তার ছেলেখেলা, আকাশে তার হাসি,
সাগর জুড়ে গদ্গদ ভাষ বুদ্বুদে যায় ভাসি।
ঝরনা ছোটে দূরের ডাকে পাথরগুলো ঠেলে--
কাজের সঙ্গে নাচের খেয়াল কোথার থেকে পেলে।
ঐ হোথা শাল, পাঁচশো বছর মজ্জাতে ওর ঢাকা--
গম্ভীরতায় অটল যেমন, চঞ্চলতায় পাকা।
মজ্জাতে ওর কঠোর শক্তি, বকুনি ওর পাতায়--
ঝড়ের দিনে কী পাগলামি চাপে যে ওর মাথায়।
ফুলের দিনে গন্ধের ভোজ অবাধ সারাক্ষণ,
ডালে ডালে দখিন হাওয়ার বাঁধা নিমন্ত্রণ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
এই যেন ভক্তের মন
বট-অশ্বত্থের বন।
রচে তার সমুদার কায়াটি
ধ্যানঘন গম্ভীর ছায়াটি,
মর্মরে বন্দন-মন্ত্র জাগায় রে
বৈরাগি কোন সমীরণ। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হম সখি দারিদ নারী !
জনম অবধি হম পীরিতি করনু
মোচনু লোচন - বারি ।
রূপ নাহি মম , কছুই নাহি গুণ
দুখিনী আহির জাতি ,
নাহি জানি কছু বিলাস - ভঙ্গিম
যৌবন গরবে মাতি ।
অবলা রমণী , ক্ষুদ্র হৃদয় ভরি
পীরিত করনে জানি ;
এক নিমিখ পল , নিরখি শ্যাম জনি
সোই বহুত করি মানি ।
কুঞ্জ পথে যব নিরখি সজনি হম ,
শ্যামক চরণক চীনা ,
শত শত বেরি ধূলি চুম্বি সখি ,
রতন পাই জনু দীনা ।
নুঠুর বিধাতা , এ দুখ - জনমে
মাঙব কি তুয়া পাশ !
জনম অভাগী , উপেখিতা হম ,
বহুত নাহি করি আশ ,—
দূর থাকি হম রূপ হেরইব ,
দূরে শুনইব বাঁশি ।
দূর দূর রহি সুখে নিরীখিব
শ্যামক মোহন হাসি ।
শ্যাম - প্রেয়সি রাধা ! সখিলো !
থাক' সুখে চিরদিন !
তুয়া সুখে হম রোয়ব না সখি
অভাগিনী গুণ হীন ।
অপন দুখে সখি , হম রোয়ব লো ,
নিভৃতে মুছইব বারি ।
কোহি ন জানব , কোন বিষাদে
তন - মন দহে হমারি ।
ভানু সিংহ ভনয়ে , শুন কালা
দুখিনী অবলা বালা—
উপেখার অতি তিখীনি বাণে
না দিহ না দিহ জ্বালা ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দুঃখ যেন জাল পেতেছে চারদিকে;
চেয়ে দেখি যার দিকে
সবাই যেন দুর্গ্রহদের মন্ত্রণায়
গুমরে কাঁদে যন্ত্রণায়।
লাগছে মনে এই জীবনের মূল্য নেই,
আজকে দিনের চিত্তদাহের তুল্য নেই।
যেন এ দুখ অন্তহীন,
ঘরছাড়া মন ঘুরবে কেবল পন্থহীন।
এমন সময় অকস্মাৎ
মনের মধ্যে হানল চমক তড়িদ্ঘাত,
এক নিমেষেই ভাঙল আমার বন্ধ দ্বার,
ঘুচল হঠাৎ অন্ধকার।
সুদূর কালের দিগন্তলীন বাগবাদিনীর পেলেম সাড়া
শিরায় শিরায় লাগল নাড়া।
যুগান্তরের ভগ্নশেষে
ভিত্তিছায়ায় ছায়ামূর্তি মুক্তকেশে
বাজায় বীণা; পূর্বকালের কী আখ্যানে
উদার সুরের তানের তন্তু গাঁথছে গানে;
দুঃসহ কোন্ দারুণ দুখে স্মরণ-গাঁথা
করুণ গাথা;
দুর্দাম কোন্ সর্বনাশের ঝঞ্ঝাঘাতের
মৃত্যুমাতাল বজ্রপাতের
গর্জরবে
রক্তরঙিন যে-উৎসবে
রুদ্রদেবের ঘূর্ণিনৃত্যে উঠল মাতি
প্রলয়রাতি,
তাহারি ঘোর শঙ্কাকাঁপন বারে বারে
ঝংকারিয়া কাঁপছে বীণার তারে তারে।
জানিয়ে দিলে আমায়, অয়ি
অতীতকালের হৃদয়পদ্মে নিত্য-আসীন ছায়াময়ী,
আজকে দিনের সকল লজ্জা সকল গ্লানি
পাবে যখন তোমার বাণী,
বর্ষশতের ভাসান-খেলার নৌকা যবে
অদৃশ্যেতে মগ্ন হবে,
মর্মদহন দুঃখশিখা
হবে তখন জ্বলনবিহীন আখ্যায়িকা,
বাজবে তারা অসীম কালের নীরব গীতেশান্ত গভীর মাধুরীতে;
ব্যথার ক্ষত মিলিয়ে যাবে নবীন ঘাসে,
মিলিয়ে যাবে সুদূর যুগের শিশুর উচ্চহাসে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
দেখিছ না অয়ি ভারত-সাগর,অয়ি গো হিমাদ্রি দেখিছ চেয়ে,
প্রলয়-কালের নিবিড় আঁধার, ভারতের ভাল ফেলেছে ছেয়ে।
অনন্ত সমুদ্র তোমারই বুকে, সমুচ্চ হিমাদ্রি তোমারি সম্মুখে,
নিবিড় আঁধারে, এ ঘোর দুর্দিনে, ভারত কাঁপিছে হরষ-রবে!
শুনিতেছি নাকি শত কোটি দাস, মুছি অশ্রুজল, নিবারিয়া শ্বাস,
সোনার শৃঙ্খল পরিতে গলায় হরষে মাতিয়া উঠেছে সবে?
শুধাই তোমারে হিমালয়-গিরি, ভারতে আজি কি সুখের দিন?
তুমি শুনিয়াছ হে গিরি-অমর, অর্জুনের ঘোর কোদণ্ডের স্বর,
তুমি দেখিয়াছ সুবর্ণ আসনে, যুধিষ্ঠির-রাজা ভারত শাসনে,
তুমি শুনিয়াছ সরস্বতী-কূলে, আর্য-কবি গায় মন প্রাণ খুলে,
তোমারে শুধাই হিমালয়-গিরি, ভারতে আজি কি সুখের দিন?
তুমি শুনিতেছ ওগো হিমালয়, ভারত গাইছে ব্রিটিশের জয়,
বিষণ্ণ নয়নে দেখিতেছ তুমি - কোথাকার এক শূন্যে মরুভূমি -
সেথা হতে আসি ভারত-আসন লয়েছে কাড়িয়া, করিছে শাসন,
তোমারে শুধাই হিমালয়-গিরি,ভারতে আজি কি সুখের দিন?
তবে এই-সব দাসের দাসেরা, কিসের হরষে গাইছে গান?
পৃথিবী কাঁপায়ে অযুত উচ্ছ্বাসে কিসের তরে গো উঠায় তান?
কিসের তরে গো ভারতের আজি, সহস্র হৃদয় উঠেছে বাজি?
যত দিন বিষ করিয়াছে পান,কিছুতে জাগে নি এ মহাশ্মশান,
বন্ধন শৃঙ্খলে করিতে সম্মান
ভারত জাগিয়া উঠেছে আজি?
কুমারিকা হতে হিমালয়-গিরি
এক তারে কভু ছিল না গাঁথা,
আজিকে একটি চরণ-আঘাতে, সমস্ত ভারত তুলেছে মাথা!
এসেছিল যবে মহম্মদ ঘোরি, স্বর্গ রসাতল জয়নাদে ভরি
রোপিতে ভারতে বিজয়ধ্বজা,
তখনো একত্রে ভারত জাগে নি, তখনো একত্রে ভারত মেলে নি,
আজ জাগিয়াছে, আজ মিলিয়াছে--
বন্ধনশৃঙ্খলে করিতে পূজা!
ব্রিটিশ-রাজের মহিমা গাহিয়া
ভূপগণ ওই আসিছে ধাইয়া
রতনে রতনে মুকুট ছাইয়া ব্রিটিশ-চরণে লোটাতে শির--
ওই আসিতেছে জয়পুররাজ, ওই যোধপুর আসিতেছে আজ
ছাড়ি অভিমান তেয়াগিয়া লাজ, আসিছে ছুটিয়া অযুত বীর!
হা রে হতভাগ্য ভারতভূমি,
কন্ঠে এই ঘোর কলঙ্কের হার
পরিবারে আজি করি অলংকার
গৌরবে মাতিয়া উঠেছে সবে?
তাই কাঁপিতেছে তোর বক্ষ আজি
ব্রিটিশ-রাজের বিজয়রবে?
ব্রিটিশ-বিজয় করিয়া ঘোষণা, যে গায় গাক্ আমরা গাব না
আমরা গাব না হরষ গান,
এসো গো আমরা যে ক'জন আছি, আমরা ধরিব আরেক তান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
পরান কহিছে ধীরে—হে মৃত্যু মধুর,
এই নীলাম্বর, এ কি তব অন্তঃপুর!
আজি মোর মনে হয়, এ শ্যামলা ভূমি
বিস্তীর্ণ কোমল শয্যা পাতিয়াছ তুমি।
জলে স্থলে লীলা আজি এই বরষার,
এই শান্তি, এ লাবণ্য, সকলই তোমার।
মনে হয়, যেন তব মিলন-বিহনে
অতিশয় ক্ষুদ্র আমি এ বিশ্বভুবনে।
প্রশান্ত করুণচক্ষে, প্রসন্ন অধরে,
তুমি মোরে ডাকিতেছ সর্ব চরাচরে।
প্রথমমিলনভীতি ভেঙেছে বধূর
তোমার বিরাট মূর্তি নিরখি মধুর।
সর্বত্র বিবাহবাঁশি উঠিতেছে বাজি,
সর্বত্র তোমার ক্রোড় হেরিতেছি আজি। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
অন্ধ মোহবন্ধ তব দাও মুক্ত করি—
রেখো না বসায়ে দ্বারে জাগ্রত প্রহরী
হে জননী, আপনার স্নেহ-কারাগারে
সন্তানেরে চিরজন্ম বন্দী রাখিবারে।
বেষ্টন করিয়া তারে আগ্রহ-পরশে,
জীর্ণ করি দিয়া তারে লালনের রসে,
মনুষ্যত্ব-স্বাধীনতা করিয়া শোষণ
আপন ক্ষুধিত চিত্ত করিবে পোষণ?
দীর্ঘ গর্ভবাস হতে জন্ম দিলে যার
স্নেহগর্ভে গ্রাসিয়া কি রাখিবে আবার?
চলিবে সে এ সংসারে তব পিছু-পিছু?
সে কি শুধু অংশ তব, আর নহে কিছু?
নিজের সে, বিশ্বের সে, বিশ্বদেবতার—
সন্তান নহে, গো মাতঃ, সম্পত্তি তোমার। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
মান অপমান উপেক্ষা করি দাঁড়াও,
কণ্টকপথ অকুণ্ঠপদে মাড়াও,
ছিন্ন পতাকা ধূলি হতে লও তুলি।
রুদ্রের হাতে লাভ করো শেষ বর,
আনন্দ হোক দুঃখের সহচর,
নিঃশেষ ত্যাগে আপনারে যাও ভুলি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
রাজা ভাবে, নব নব আইনের ছলে
ন্যায় সৃষ্টি করি আমি। ন্যায়ধর্ম বলে,
আমি পুরাতন, মোরে জন্ম কেবা দেয়—
যা তব নূতন সৃষ্টি সে শুধু অন্যায়। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
রূপনারানের কূলেজেগে উঠিলাম,জানিলাম এ জগৎস্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলামআপনার রূপ,চিনিলাম আপনারেআঘাতে আঘাতেবেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
শরতে শিশিরবাতাস লেগে
জল ভ'রে আসে উদাসি মেঘে।
বরষন তবু হয় না কেন,
ব্যথা নিয়ে চেয়ে রয়েছে যেন। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ, অভ্রভেদী তোমার সংগীত
তরঙ্গিয়া চলিয়াছে অনুদাত্ত উদাত্ত স্বরিত
প্রভাতের দ্বার হতে সন্ধ্যার পশ্চিমনীড়-পানে
দুর্গম দুরূহ পথে কী জানি কী বাণীর সন্ধানে!
দুঃসাধ্য উচ্ছ্বাস তব শেষ প্রান্তে উঠি আপনার
সহসা মুহূর্তে যেন হারায়ে ফেলেছে কণ্ঠ তার,
ভুলিয়া গিয়াছে সব সুর — সামগীত শব্দহারা
নিয়ত চাহিয়া শূন্যে বরষিছে নির্ঝরিণীধারা।হে গিরি,যৌবন তব যে দুর্দম অগ্নিতাপবেগে
আপনারে উৎসারিয়া মরিতে চাহিয়াছিল মেঘে
সে তাপ হারায়ে গেছে, সে প্রচণ্ড গতি অবসান —
নিরুদ্দেশ চেষ্টা তব হয়ে গেছে প্রাচীন পাষাণ।
পেয়েছ আপন সীমা, তাই আজি মৌন শান্ত হিয়া
সীমাবিহীনের মাঝে আপনারে দিয়েছ সঁপিয়া। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
ঘন্টা বাজে দূরে।
শহরের অভ্রভেদী আত্মঘোষণার
মুখরতা মন থেকে লুপ্ত হয়ে গেল,
আতপ্ত মাঘের রৌদ্রে অকারণে ছবি এল চোখে
জীবনযাত্রার প্রান্তে ছিল যাহা অনতিগোচর।গ্রামগুলি গেঁথে গেঁথে মেঠো পথ গেছে দূর-পানে
নদীর পাড়ির ‘পর দিয়ে।
প্রাচীন অশথতলা,
খেয়ার আশায় লোক ব’সে
পাশে রাখি হাটের পসরা।
গঞ্জের টিনের চালাঘরে
গুড়ের কলস সারি সারি,
চেটে যায় ঘ্রাণলুব্ধ পাড়ার কুকুর,
ভিড় করে মাছি।
রাস্তায় উপুড়মুখো গাড়ি
পাটের বোঝাই ভরা,
একে একে বস্তা টেনে উচ্চস্বরে চলেছে ওজন
আড়তের আঙিনায়।
বাঁধা-খোলা বলদেরা
রাস্তার সবুজ প্রান্তে ঘাস খেয়ে ফেরে,
লেজের চামর হানে পিঠে।
সর্ষে আছে স্তূপাকার
গোলায় তোলার অপেক্ষায়।
জেলেনৌকো এল ঘাটে,
ঝুড়ি কাঁখে জুটেছে মেছুনি;
মাথার উপরে ওড়ে চিল।
মহাজনী নৌকোগুলো ঢালুতটে বাঁধা পাশাপাশি।
মাল্লা বুনিতেছে জাল রৌদ্রে বসি চালের উপরে।
আঁকড়ি মোষের গলা সাঁতারিয়া চাষী ভেসে চলে
ওপারে ধানের খেতে।
অদূরে বনের ঊর্ধ্বে মন্দিরের চূড়া
ঝলিছে প্রভাত-রৌদ্রালোকে।
মাঠের অদৃশ্য পারে চলে রেলগাড়ি
ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর
ধ্বনিরেখা টেনে দিয়ে বাতাসের বুকে,
পশ্চাতে ধোঁয়ায় মেলি
দূরত্বজয়ের দীর্ঘ বিজয়পতাকা।মনে এল, কিছুই সে নয়, সেই বহুদিন আগে,
দু’পহর রাতি,
নৌকা বাঁধা গঙ্গার কিনারে।
জ্যোৎস্নায় চিক্কণ জল,
ঘনীভূত ছায়ামূর্তি নিষ্কম্প অরণ্যতীরে-তীরে,
ক্কচিৎ বনের ফাঁকে দেখা যায় প্রদীপের শিখা।
সহসা উঠিনু জেগে।
শব্দশূন্য নিশীথ-আকাশে
উঠিছে গানের ধ্বনি তরুণ কন্ঠের,
ছুটিছে ভাঁটির স্রোতে তন্বী নৌকা তরতর বেগে।
মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল;
দুই পারে স্তব্ধ বনে জাগিয়া রহিল শিহরণ;
চাঁদের-মুকুট-পরা অচঞ্চল রাত্রির প্রতিমা
রহিল নির্বাক্ হয়ে পরাভূত ঘুমের আসনে।পশ্চিমের গঙ্গাতীর, শহরের শেষপ্রান্তে বাসা,
দূর প্রসারিত চর
শূন্য আকাশের নীচে শূন্যতার ভাষ্য করে যেন।
হেথা হোথা চরে গোরু শস্যশেষ বাজরার খেতে;
তর্মুজের লতা হতে
ছাগল খেদায়ে রাখে কাঠি হাতে কৃষাণ-বালক।
কোথাও বা একা পল্লীনারী
শাকের সন্ধানে ফেরে ঝুড়ি নিয়ে কাঁখে।
কভু বহু দূরে চলে নদীর রেখার পাশে পাশে
নতপৃষ্ঠ ক্লিষ্টগতি গুণটানা মাল্লা একসারি।
জলে স্থলে সজীবের আর চিহ্ন নাই সারাবেলা।
গোলকচাঁপার গাছ অনাদৃত কাছের বাগানে;
তলায়-আসন-গাঁথা বৃদ্ধ মহানিম,
নিবিড় গম্ভীর তার আভিজাত্যচ্ছায়া।
রাত্রে সেথা বকের আশ্রয়।
ইঁদারায় টানা জল
নালা বেয়ে সারাদিন কুলুকুলু চলে
ভুট্টার ফসলে দিতে প্রাণ।
ভজিয়া জাঁতায় ভাঙে গম
পিতল-কাঁকন-পরা হাতে।
মধ্যাহ্ন আবিষ্ট করে একটানা সুর।পথে-চলা এই দেখাশোনা
ছিল যাহা ক্ষণচর
চেতনার প্রত্যন্ত প্রদেশে,
চিত্তে আজ তাই জেগে ওঠে;
এই-সব উপেক্ষিত ছবি
জীবনের সর্বশেষ বিচ্ছেদবেদনা
দূরের ঘণ্টার রবে এনে দেয় মনে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
সুশীলা আমার, জানালার ‘পরে
দাঁড়াও একটিবার!
একবার আমি দেখিয়া লইব
মধুর হাসি তোমার!
কত দুখ-জ্বালা সহি অকাতরে
ভ্রমি, গো, দূর প্রবাসে
যদি লভি মোর হৃদয়-রতন–
সুশীলারে মোর পাশে!
কালিকে যখন নাচ গান কত
হতেছিল সভা-‘পরে,
কিছুই শুনি নি, আছিনু মগন
তোমারি ভাবনা-ভরে
আছিল কত-না বালিকা, রমণী,
রূপসী প্রমোদ-হিয়া,
বিষাদে কহিনু, “তোমরা তো নহ
সুশীলা, আমার প্রিয়া!’
সুশীলে, কেমনে ভাঙ তার মন
হরষে মরিতে পারে যেই জন
তোমারি তোমারি তরে!
সুশীলে, কেমনে ভাঙ হিয়া তার
কিছু যে করি নি, এক দোষ যার
ভালোবাসে শুধু তোরে!
প্রণয়ে প্রণয় না যদি মিশাও
দয়া কোরো মোর প্রতি,
সুশীলার মন নহে তো কখনো
নিরদয় এক রতি!Robert Burns
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
জ্বালো নবজীবনেব
নির্মল দীপিকা,
মর্তের চোখে ধরো
স্বর্গের লিপিকা।
আঁধারগহনে রচো
আলোকের বীথিকা,
কলকোলাহলে আনো
অমৃতের গীতিকা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ব্যঙ্গাত্মক
|
বটে আমি উদ্ধত,
নই তবু ক্রুদ্ধ তো,
শুধু ঘরে মেয়েদের সাথে মোর যুদ্ধ তো।
যেই দেখি গুণ্ডায়
ক্ষমি হেঁটমুণ্ডায়,
দুর্জন মানুষেরে ক্ষমেছেন বুদ্ধ তো।
পাড়ায় দারোগা এলে দ্বার করি রুদ্ধ তো–
সাত্ত্বিক সাধকের এ আচার শুদ্ধ তো। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
বেলা আটটার কমে
খোলে না তো চোখ সে।
সামলাতে পারে না যে
নিদ্রার ঝোঁক সে।
জরিমানা হলে বলে,–
“এসেছি যে মা ফেলে,
আমার চলে না দিন
মাইনেটা না পেলে।
তোমার চলবে কাজ
যে ক’রেই হোক সে,
আমারে অচল করে
মাইনের শোক সে।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কী কথা বলিব বলে
বাহিরে এলেম চলে,
দাঁড়ালেম দুয়ারে তোমার–
ঊর্ধ্বমুখে উচ্চরবে
বলিতে গেলেম যবে
কথা নাহি আর।
যে কথা বলিতে চাহে প্রাণ
সে শুধু হইয়া উঠে গান।
নিজে না বুঝিতে পারি,
তোমারে বুঝাতে নারি,
চেয়ে থাকি উৎসুক-নয়ান।তবে কিছু শুধায়ো না–
শুনে যাও আনমনা,
যাহা বোঝ, যাহা নাই বোঝ।
সন্ধ্যার আঁধার-পরে
মুখে আর কণ্ঠস্বরে
বাকিটুকু খোঁজো।
কথায় কিছু না যায় বলা,
গান সেও উন্মত্ত উতলা।
তুমি যদি মোর সুরে
নিজ কথা দাও পুরে
গীতি মোর হবে না বিফলা। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
তারাগুলি সারারাতি
কানে কানে কয়।
সেই কথা ফুলে ফুলে
ফুটে বনময়। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খড়দয়ে যেতে যদি সোজা এস খুল্না
যত কেন রাগ কর, কে বলে তা ভুল না।
মালা গাঁথা পণ ক’রে আন যদি আমড়া,
রাগ করে বেত মেরে ফাটাও-না চামড়া,
তবুও বলতে হবে– ও জিনিস ফুল না।
বেঞ্চিতে বসে তুমি বল যদি “দোল দাও’,
চটে-মটে শেষে যদি কড়া কড়া বোল দাও,
পষ্ট বুঝিয়ে দেব– ওটা নয় ঝুল্না।
যদি বা মাথার গোলে ঘরে এসে বসবার
হাঁটুতে বুরুষ করো একমনে দশবার,
কী করি, বলতে হবে– ওখানে তো চুল না। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কহিল কঞ্চির বেড়া, ওগো পিতামহ
বাঁশবন, নুয়ে কেন পড় অহরহ?
আমরা তোমারি বংশে ছোটো ছোটো ডাল,
তবু মাথা উঁচু করে থাকি চিরকাল।
বাঁশ কহে, ভেদ তাই ছোটোতে বড়োতে,
নত হই, ছোটো নাহি হই কোনোমতে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
কোথা রে তরুর ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ।
তট-তরু কোলে কোলে সারাদিন কলরোলে
স্রোতস্বিনী যায় চলে সুদূরে সাধের গেহ ;
কোথা রে তরুর ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ ;
কোথা রে সুনীল দিশে বনান্ত রয়েছে মিশে
অনন্তের অনিমিষে নয়ন নিমেষ-হারা ।
দূর হতে বায়ু এসে চলে যায় দূর-দেশে
গীত - গান যায় ভেসে , কোন্ দেশে যায় তারা ।
হাসি , বাঁশি , পরিহাস , বিমল সুখের শ্বাস ,
মেলামেশা বারো মাস নদীর শ্যামল তীরে ;
কেহ খেলে , কেহ দোলে , ঘুমায় ছায়ার কোলে ,
বেলা শুধু যায় চলে কুলুকুলু নদীনীরে ।
বকুল কুড়োয় কেহ , কেহ গাঁথে মালাখানি ;
ছায়াতে ছায়ার প্রায় বসে বসে গান গায় ,
করিতেছে কে কোথায় চুপিচুপি কানাকানি ।
খুলে গেছে চুলগুলি , বাঁধিতে গিয়েছে ভুলি ,
আঙুলে ধরেছে তুলি আঁখি পাছে ঢেকে যায় ,
কাঁকন খসিয়া গেছে , খুঁজিছে গাছের ছায় ।
বনের মর্মের মাঝে বিজনে বাঁশরি বাজে ,
তারি সুরে মাঝে মাঝে ঘুঘু দুটি গান গায় ।
ঝুরু ঝুরু কত পাতা গাহিছে বনের গাথা ,
কত-না মনের কথা তারি সাথে মিশে যায় ।
লতাপাতা কত শত খেলে কাঁপে কত মতো
ছোটো ছোটো আলোছায়া ঝিকিমিকি বন ছেয়ে ,
তারি সাথে তারি মতো খেলে কত ছেলেমেয়ে ।
কোথায় সে গুন গুন ঝরঝর মরমর ,
কোথা সে মাথার'পরে লতাপাতা থরথর ।
কোথায় সে ছায়া আলো , ছেলেমেয়ে খেলাধূলি ,
কোথা সে ফুলের মাঝে এলোচুলে হাসিগুলি ।
কোথা রে সরল প্রাণ , গভীর আনন্দ - গান ,
অসীম শান্তির মাঝে প্রাণের সাধের গেহ ,
তরুর শীতল ছায়া , বনের শ্যামল স্নেহ । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
নিবিড়তিমির নিশা, অসীম কান্তার,
লক্ষ দিকে লক্ষ জন হইতেছে পার।
অন্ধকারে অভিসার, কোন্ পথপানে
কার তরে, পান্থ তাহা আপনি না জানে।
শুধু মনে হয় চিরজীবনের সুখ
এখনি দিবেক দেখা লয়ে হাসিমুখ।
কত স্পর্শ কত গন্ধ কত শব্দ গান
কাছ দিয়ে চলে যায় শিহরিয়া প্রাণ।
দৈবযোগে ঝলি উঠে বিদ্যুতের আলো,
যারেই দেখিতে পাই তারে বাসি ভালো—
তাহারে ডাকিয়া বলি—ধন্য এ জীবন,
তোমারি লাগিয়া মোর এতেক ভ্রমণ।
অন্ধকারে আর সবে আসে যায় কাছে,
জানিতে পারি নে তারা আছে কি না আছে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
ধীরু কহে শূন্যেতে মজো রে,
নিরাধার সত্যেরে ভজো রে।
এত বলি যত চায় শূন্যেতে ওড়াটা
কিছুতে কিছু-না-পানে পৌঁছে না ঘোড়াটা,
চাবুক লাগায় তারে সজোরে।
ছুটে মরে সারারাত, ছুটে মরে সারাদিন–
হয়রান হয়ে তবু আমিহীন ঘোড়াহীন
আপনারে নাহি পড়ে নজরে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে !
আমার ঘরে কেহ নাই যে !
তারে মনে পড়ে যারে চাই যে !
তার আকুল পরান বিরহের গান
বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে !
আমি আমার কথা তারে জানাব কী করে ,
প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে !
কুসুমের মালা গাঁথা হল না ,
ধূলিতে পড়ে শুকায় রে !
নিশি হয় ভোর , রজনীর চাঁদ
মলিন মুখ লুকায় রে !
সারা বিভাবরী কার পূজা করি
যৌবনডালা সাজায়ে !
ওই বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায় ,
আমি কেন থাকি হায় রে !
(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
দুই পারে দুই কূলের আকুল প্রাণ,
মাঝে সমুদ্র অতল বেদনাগান। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ
দুখের অশ্রুধার।
জননী গো, গাঁথব তোমার
গলার মুক্তাহার।
চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে
মালা হয়ে জড়িয়ে আছে,
তোমার বুকে শোভা পাবে আমার
দুখের অলংকার।ধন ধান্য তোমারি ধন,
দিতে চাও তো দিয়ো আমায়,
নিতে চাও তো লও।
দুঃখ আমার ঘরের জিনিস,
খাঁটি রতন তুই তো চিনিস–
তোর প্রসাদ দিয়ে তারে কিনিস,
এ মোর অহংকার।১৩১৫
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
' সাত - আটটে সাতাশ ', আমি
বলেছিলাম বলে
গুরুমশায় আমার ‘পরে
উঠল রাগে জ্বলে ।
মা গো , তুমি পাঁচ পয়সায়
এবার রথের দিনে
সেই যে রঙিন পুতুলখানি
আপনি দিলে কিনে
খাতার নিচে ছিল ঢাকা ;
দেখালে এক ছেলে ,
গুরুমশায় রেগেমেগে
ভেঙে দিলেন ফেলে ।
বললেন , ' তোর দিনরাত্তির
কেবল যত খেলা ।
একটুও তোর মন বসে না
পড়াশুনার বেলা! '
মা গো , আমি জানাই কাকে ?
ওঁর কি গুরু আছে ?
আমি যদি নালিশ করি
এক্খনি তাঁর কাছে ?
কোনোরকম খেলার পুতুল
নেই কি , মা , ওঁর ঘরে
সত্যি কি ওঁর একটুও মন
নেই পুতুলের ‘পরে ?
সকাল - সাঁজে তাদের নিয়ে
করতে গিয়ে খেলা
কোনো পড়ায় করেন নি কি
কোনোরকম হেলা ?
ওঁর যদি সেই পুতুল নিয়ে
ভাঙেন কেহ রাগে ,
বল দেখি মা , ওঁর মনে তা
কেমনতরো লাগে ? (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
অপরাজিতা ফুটিল,
লতিকার
গর্ব নাহি ধরে—
যেন পেয়েছে লিপিকা
আকাশের
আপন অক্ষরে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে
কানে আমার বাজে ,
মায়ের কথা মিলায় যেন
আমার খেলার মাঝে ।
মা বুঝি গান গাইত , আমার
দোলনা ঠেলে ঠেলে ;
মা গিয়েছে , যেতে যেতে
গানটি গেছে ফেলে ।
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু যখন আশ্বিনেতে
ভোরে শিউলিবনে
শিশির - ভেজা হাওয়া বেয়ে
ফুলের গন্ধ আসে ,
তখন কেন মায়ের কথা
আমার মনে ভাসে ?
কবে বুঝি আনত মা সেই
ফুলের সাজি বয়ে ,
পুজোর গন্ধ আসে যে তাই
মায়ের গন্ধ হয়ে ।
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু যখন বসি গিয়ে
শোবার ঘরের কোণে ;
জানলা থেকে তাকাই দূরে
নীল আকাশের দিকে ,
মনে হয় মা আমার পানে
চাইছে অনিমিখে ।
কোলের ‘পরে ধরে কবে
দেখত আমায় চেয়ে ,
সেই চাউনি রেখে গেছে
সারা আকাশ ছেয়ে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে।
তুই যে পারিস কাঁটাগাছের উচ্চ ডালের 'পরে
পুচ্ছ নাচাতে।
তুই পথহীন সাগরপারের পান্থ,
তোর ডানা যে অশান্ত অক্লান্ত,
অজানা তোর বাসার সন্ধানে রে
অবাধ যে তোর ধাওয়া;
ঝড়ের থেকে বজ্রকে নেয় কেড়ে
তোর যে দাবিদাওয়া।
যৌবন রে, তুই কি কাঙাল, আয়ুর ভিখারী।
মরণ-বনের অন্ধকারে গহন কাঁটাপথে
তুই যে শিকারি।
মৃত্যু যে তার পাত্রে বহন করে
অমৃতরস নিত্য তোমার তরে;
বসে আছে মানিনী তোর প্রিয়া
মরণ-ঘোমটা টানি।
সেই আবরণ দেখ্ রে উতারিয়া
মুগ্ধ সে মুখখানি।
যৌবন রে, রয়েছ কোন্ তানের সাধনে।
তোমার বাণী শুষ্ক পাতায় রয় কি কভু বাঁধা
পুঁথির বাঁধনে।
তোমার বাণী দখিন হাওয়ার বীণায়
অরণ্যেরে আপনাকে তার চিনায়,
তোমার বাণী জাগে প্রলয়মেঘে
ঝড়ের ঝংকারে;
ঢেউয়ের 'পরে বাজিয়ে চলে বেগে
বিজয়-ডঙ্কা রে।
যৌবন রে, বন্দী কি তুই আপন গণ্ডিতে।
বয়সের এই মায়াজালের বাঁধনখানা তোরে
হবে খণ্ডিতে।
খড়গসম তোমার দীপ্ত শিখা
ছিন্ন করুক জরার কুজ্ঝটিকা,
জীর্ণতারি বক্ষ দু-ফাঁক ক'রে
অমর পুষ্প তব
আলোকপানে লোকে লোকান্তরে
ফুটুক নিত্য নব।
যৌবন রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত।
আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে
রইবি কুণ্ঠিত?
প্রভাত যে তার সোনার মুকুটখানি
তোমার তরে প্রত্যুষে দেয় আনি,
আগুন আছে ঊর্ধ্ব শিখা জ্বেলে
তোমার সে যে কবি।
সূর্য তোমার মুখে নয়ন মেলে
দেখে আপন ছবি।
শান্তিনিকেতন, ৪ চৈত্র, ১৩২২
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
"এত কাল হে প্রকৃতি করিনু তোমার সেবা,
তবু কেন এ হৃদয় পূরিল না দেবি?
এখনো বুকের মাঝে রয়েছে দারুণ শূন্য,
সে শূন্য কি এ জনমে পূরিবে না আর?
মনের মন্দির মাঝে প্রতিমা নাহিক যেন,
শুধু এ আঁধার গৃহ রয়েছে পড়িয়া--
কত দিন বল দেবি রহিবে এমন শূন্য,
তা হোলে ভাঙিয়ে যাবে এ মনোমন্দির!
কিছু দিন পরে আর দেখিব সেখানে চেয়ে
পূর্ব্ব হৃদয়ের আছে ভগ্ন-অবশেষ,
সে ভগ্ন-অবশেষে-- সুখের সমাধি 'পরে
বসিয়া দারুণ দুখে কাঁদিতে কি হবে?
মনের অন্তর-তলে কি যে কি করিছে হুহু,
কি যেন আপন ধন নাইকো সেখানে,
সে শূন্য পূরাবে দেবি ঘুরিছে পৃথিবীময়
মরুভূমে তৃষাতুর মৃগের মতন।
কত মরীচিকা দেবী করেছে ছলনা মোরে,
কত ঘুরিয়াছি তার পশ্চাতে পশ্চাতে,
অবশেষে শ্রান্ত হয়ে তোমারে শুধাই দেবি
এ শূন্য পূরিবে না কি কিছুতে আমার?
উঠিছে তপন শশী, অস্ত যাইতেছে পুনঃ,
বসন্ত শরত শীত চক্রে ফিরিতেছে;
প্রতি পদক্ষেপে আমি বাল্যকাল হোতে দেবি
ক্রমে ক্রমে কত দূর যেতেছি চলিয়া--
বাল্যকাল গেছে চলে, এসেছে যৌবন এবে,
যৌবন যাইবে চলি আসিবে বার্দ্ধক্য--
তবু এ মনের শূন্য কিছুতে কি পূরিবে না?
মন কি করিবে হুহু চিরকাল তরে?
শুনিয়াছিলাম কোন্ উদাসী যোগীর কাছে--
"মানুষের মন চায় মানুষেরি মন;
গম্ভীর সে নিশীথিনী, সুন্দর সে উষাকাল,
বিষণ্ণ সে সায়াহ্নের ম্লান মুখচ্ছবি,
বিস্তৃত সে অম্বুনিধি, সমুচ্চ সে গিরিবর,
আঁধার সে পর্ব্বতের গহ্বর বিশাল,
তটিনীর কলধ্বনি, নির্ঝরের ঝর ঝর,
আরণ্য বিহঙ্গদের স্বাধীন সঙ্গীত,
পারে না পূরিতে তারা বিশাল মনুষ্য-হৃদি--
মানুষের মন চায় মানুষেরি মন।'
শুনিয়া, প্রকৃতিদেবি, ভ্রমিণু পৃথিবীময়;
কত লোক দিয়েছিল হৃদি-উপহার--
আমার মর্ম্মের গান যবে গাহিতাম দেবি
কত লোক কেঁদেছিল শুনিয়া সে গীত।
তেমন মনের মত মন পেলাম না দেবি,
আমার প্রাণের কথা বুঝিল না কেহ,
তাইতে নিরাশ হোয়ে আবার এসেছি ফিরে,
বুঝি গো এ শূন্য মন পূরিল না আর।"
এইরূপে কেঁদে কেঁদে কাননে কাননে কবি
একাকী আপন-মনে করিত ভ্রমণ।
সে শোক-সঙ্গীত শুনি কাঁদিত কাননবালা,
নিশীথিনী হাহা করি ফেলিত নিশ্বাস,
বনের হরিণগুলি আকুল নয়নে আহা
কবির মুখের পানে রহিত চাহিয়া।
"হাহা দেবি একি হোলো, কেন পূরিল না প্রাণ"
প্রতিধ্বনি হোতো তার কাননে কাননে।
শীর্ণ নির্ঝরিণী যেথা ঝরিতেছে মৃদু মৃদু,
উঠিতেছে কুলু কুলু জলের কল্লোল,
সেখানে গাছের তলে একাকী বিষণ্ণ কবি
নীরবে নয়ন মুদি থাকিত শুইয়া--
তৃষিত হরিণশিশু সলিল করিয়া পান
দেখি তার মুখপানে চলিয়া যাইত।
শীতরাত্রে পর্ব্বতের তুষারশয্যার 'পরে
বসিয়া রহিত স্তব্ধ প্রতিমার মত,
মাথার উপরে তার পড়িত তুষারকণা,
তীব্রতম শীতবায়ু যাইত বহিয়া।
দিনে দিনে ভাবনায় শীর্ণ হোয়ে গেল দেহ,
প্রফুল্ল হৃদয় হোলো বিষাদে মলিন,
রাক্ষসী স্বপ্নের তরে ঘুমালেও শান্তি নাই,
পৃথিবী দেখিত কবি শ্মশানের মত
এক দিন অপরাহ্নে বিজন পথের প্রান্তে
কবি বৃক্ষতলে এক রহিছে শুইয়া,
পথ-শ্রমে শ্রান্ত দেহ, চিন্তায় আকুল হৃদি,
বহিতেছে বিষাদের আকুল নিশ্বাস।
হেন কালে ধীরি ধীরি শিয়রের কাছে আসি
দাঁড়াইল এক জন বনের বালিকা,
চাহিয়া মুখের পানে কহিল করুণ স্বরে,
"কে তুমি গো পথশ্রান্ত বিষণ্ণ পথিক?
অধরে বিষাদ যেন পেতেছে আসন তার
নয়ন কহিছে যেন শোকের কাহিনী।
তরুণ হৃদয় কেন অমন বিষাদময়?
কি দুখে উদাস হোয়ে করিছ ভ্রমণ?"
গভীর নিশ্বাস ফেলি গম্ভীরে কহিল কবি,
"প্রাণের শূন্যতা কেন ঘুচিল না বালা?"
একে একে কত কথা কহিল বালিকা কাছে,
যত কথা রুদ্ধ ছিল হৃদয়ে কবির--
আগ্নেয় গিরির বুকে জ্বলন্ত অগ্নির মত
যত কথা ছিল কবি কহিলা গম্ভীরে।
"নদ নদী গিরি গুহা কত দেখিলাম, তবু
প্রাণের শূন্যতা কেন ঘুচিল না দেবি।"
বালার কপোল বাহি নীরবে অশ্রুর বিন্দু
স্বর্গের শিশির-সম পড়িল ঝরিয়া,
সেই এক অশ্রুবিন্দু অমৃতধারার মত
কবির হৃদয় গিয়া প্রবেশিল যেন;
দেখি সে করুণবারি নিরশ্রু কবির চোখে
কত দিন পরে হোল অশ্রুর উদয়।
শ্রান্ত হৃদয়ের তরে যে আশ্রয় খুঁজে খুঁজে
পাগল ভ্রমিতেছিল হেথায় হোথায়--
আজ যেন এইটুকু আশ্রয় পাইল হৃদি,
আজ যেন একটুকু জুড়ালো যন্ত্রণা।
যে হৃদয় নিরাশায় মরুভূমি হোয়েছিল
সেথা হোতে হল আজ অশ্রু উৎসারিত।
শ্রান্ত সে কবির মাথা রাখিয়া কোলের 'পরে,
সরলা মুছায়ে দিল অশ্রুবারিধারা।
কবি সে ভাবিল মনে, তুমি কোথাকার দেবী
কি অমৃত ঢালিলে গো প্রাণের ভিতর!
ললনা তখন ধীরে চাহিয়া কবির মুখে
কহিল মমতাময় করুণ কথায়,--
"হোথায় বিজন বনে দেখেছ কুটীর ওই,
চল পান্থ ওইখানে যাই দুজনায়।
বন হোতে ফল মূল আপনি তুলিয়া দিব,
নির্ঝর হইতে তুলি আনিব সলিল,
যতনে পর্ণের শয্যা দিব আমি বিছাইয়া,
সুখনিদ্রা-কোলে সেথা লভিবে বিরাম,
আমার বীণাটি লয়ে গান শুনাইব কত,
কত কি কথায় দিন যাইবে কাটিয়া।
হরিণশাবক এক আছে ও গাছের তলে,
সে যে আসি কত খেলা খেলিবে পথিক।
দূরে সরসীর ধারে আছে এক চারু কুঞ্জ,
তোমারে লইয়া পান্থ দেখাব সে বন।
কত পাখী ডালে ডালে সারাদিন গাইতেছে,
কত যে হরিণ সেথা করিতেছে খেলা।
আবার দেখাব সেই অরণ্যের নির্ঝরিণী,
আবার নদীর ধারে লয়ে যাব আমি,
পাখী এক আছে মোর সে যে কত গায় গান--
নাম ধোরে ডাকে মোরে "নলিনী' "নলিনী'।
যা আছে আমার কিছু সব আমি দেখাইব,
সব আমি শুনাইব যত জানি গান--
আসিবে কি পান্থ ওই বনের কুটীরমাঝে?"
এতেক শুনিয়া কবি চলিল কুটীরে।
কি সুখে থাকিত কবি, বিজন কুটীরে সেই
দিনগুলি কেটে যেত মুহূর্তের মত--
কি শান্ত সে বনভূমি, নাই লোক নাই জন,
শুধু সে কুটীরখানি আছে এক ধারে।
আঁধার তরুর ছায়ে-- নীরব শান্তির কোলে
দিবস যেন রে সেথা রহিত ঘুমায়ে।
পাখীর অস্ফুট গান, নির্ঝরের ঝরঝর
স্তব্ধতারে আরো যেন দিত মিষ্ট করি।
আগে এক দিন কবি মুগ্ধ প্রকৃতির রূপে
অরণ্যে অরণ্যে একা করিত ভ্রমণ,
এখন দুজনে মিলি ভ্রমিয়া বেড়ায় সেথা,
দুই জন প্রকৃতির বালক বালিকা।
সুদূর কাননতলে কবিরে লইয়া যেত
নলিনী, সে যেন এক বনেরি দেবতা।
শ্রান্ত হোলে পথশ্রমে ঘুমাত কবির কোলে,
খেলিত বনের বায়ু কুন্তল লইয়া,
ঘুমন্ত মুখের পানে চাহিয়া রহিত কবি--
মুখে যেন লিখা আছে আরণ্য কবিতা।
"একি দেবি কলপনা, এত সুখ প্রণয়ে যে
আগে তাহা জানিতাম না ত!
কি এক অমৃতধারা ঢেলেছ প্রাণের 'পরে
হে প্রণয় কহিব কেমনে?
অন্য এক হৃদয়েরে হৃদয় করা গো দান,
সে কি এক স্বর্গীয় আমোদ।
এক গান গায় যদি দুইটি হৃদয়ে মিলি,
দেখে যদি একই স্বপন,
এক চিন্তা এক আশা এক ইচ্ছা দুজনার,
এক ভাবে দুজনে পাগল,
হৃদয়ে হৃদয়ে হয় সে কি গো সুখের মিল--
এ জনমে ভাঙ্গিবে না তাহা।
আমাদের দুজনের হৃদয়ে হৃদয়ে দেবি
তেমনি মিশিয়া যায় যদি--
এক সাথে এক স্বপ্ন দেখি যদি দুই জনে
তা হইলে কি হয় সুন্দর!
নরকে বা স্বর্গে থাকি, অরণ্যে বা কারাগারে
হৃদয়ে হৃদয়ে বাঁধা হোয়ে--
কিছু ভয় করি নাকো--বিহ্বল প্রণয়ঘোরে
থাকি সদা মরমে মজিয়া।
তাই হোক্--হোক্ দেবি আমাদের দুই জনে
সেই প্রেম এক কোরে দিক্।
মজি স্বপনের ঘোরে হৃদয়ের খেলা খেলি
যেন যায় জীবন কাটিয়া।"
নিশীথে একেলা হোলে এইরূপ কত গান
বিরলে গাইত কবি বসিয়া বসিয়া।
সুখ বা দুখের কথা বুকের ভিতরে যাহা
দিন রাত্রি করিতেছে আলোড়িত-প্রায়,
প্রকাশ না হোলে তাহা,মরমের গুরুভারে
জীবন হইয়া পড়ে দারুণ ব্যথিত।
কবি তার মরমের প্রণয় উচ্ছ্বাস-কথা
কি করি যে প্রকাশিবে পেত না ভাবিয়া।
পৃথিবীতে হেন ভাষা নাইক, মনের কথা
পারে যাহা পূর্ণভাবে করিতে প্রকাশ।
ভাব যত গাঢ় হয়, প্রকাশ করিতে গিয়া
কথা তত না পায় খুঁজিয়া খুঁজিয়া।
বিষাদ যতই হয় দারুণ অন্তরভেদী,
অশ্রুজল তত যায় শুকায়ে যেমন!
মরমের ভার-সম হৃদয়ের কথাগুলি
কত দিন পারে বল চাপিয়া রাখিতে?
একদিন ধীরে ধীরে বালিকার কাছে গিয়া
অশান্ত বালক-মত কহিল কত কি!
অসংলগ্ন কথাগুলি, মরমের ভাব আরো
গোলমাল করি দিল প্রকাশ না করি।
কেবল অশ্রুর জলে, কেবল মুখের ভাবে
পড়িল বালিকা তার মনের কি কথা!
এই কথাগুলি যেন পড়িল বালিকা ধীরে--
"কত ভাল বাসি বালা কহিব কেমনে!
তুমিও সদয় হোয়ে আমার সে প্রণয়ের
প্রতিদান দিও বালা এই ভিক্ষা চাই।"
গড়ায়ে পড়িল ধীরে বালিকার অশ্রুজল,
কবির অশ্রুর সাথে মিশিল কেমন--
স্কন্ধে তার রাখি মাথা কহিল কম্পিত স্বরে,
"আমিও তোমারে কবি বাসি না কি ভাল?"
কথা না স্ফুরিল আর, শুধু অশ্রুজলরাশি
আরক্ত কপোল তার করিল প্লাবিত।
এইরূপ মাঝে মাঝে অশ্রুজলে অশ্রুজলে
নীরবে গাইত তারা প্রণয়ের গীত।
অরণ্যে দুজনে মিলি আছিল এমন সুখে
জগতে তারাই যেন আছিল দুজন--
যেন তারা সুকোমল ফুলের সুরভি শুধু,
যেন তারা অপ্সরার সুখের সঙ্গীত।
আলুলিত চুলগুলি সাজাইয়া বনফুলে
ছুটিয়া আসিত বালা কবির কাছেতে,
একথা ওকথা লয়ে কি যে কি কহিত বালা
কবি ছাড়া আর কেহ বুঝিতে নারিত।
কভু বা মুখের পানে সে যে কি রহিত চেয়ে,
ঘুমায়ে পড়িত যেন হৃদয় কবির।
কভু বা কি কথা লয়ে সে যে কি হাসিত হাসি,
তেমন সরল হাসি দেখ নি কেহই।
আঁধার অমার রাত্রে একাকী পর্ব্বতশিরে
সেও গো কবির সাথে রহিত দাঁড়ায়ে,
উনমত্ত ঝড় বৃষ্টি বিদ্যুৎ আশনি আর
পর্ব্বতের বুকে যবে বেড়াত মাতিয়া,
তাহারো হৃদয় যেন নদীর তরঙ্গ-সাথ
করিত গো মাতামাতি হেরি সে বিপ্লব--
করিত সে ছুটাছুটি, কিছুতে সে ডরিত না,
এমন দুরন্ত মেয়ে দেখি নি ত আর!
কবি যা কহিত কথা শুনিত কেমন ধীরে,
কেমন মুখের পানে রহিত চাহিয়া।
বনদেবতার মত এমন সে এলোথেলো,
কখনো দুরন্ত অতি ঝটিকা যেমন,
কখনো এমন শান্ত প্রভাতের বায়ু যথা
নীরবে শুনে গো যবে পাখীর সঙ্গীত।
কিন্তু, কলপনা, যদি কবির হৃদয় দেখ
দেখিবে এখনো তাহা পূর্ণ হয় নাই।
এখনো কহিছে কবি, "আরো দাও ভালবাসা,
আরো ঢালো' ভালবাসা হৃদয়ে আমার।"
প্রেমের অমৃতধারা এত যে করেছে পান,
তবু মিটিল না কেন প্রণয়পিপাসা?
প্রেমের জোছনাধারা যত ছিল ঢালি বালা
কবির সমুদ্র-হৃদি পারে নি পূরিতে।
স্বাধীন বিহঙ্গ-সম, কবিদের তরে দেবি
পৃথিবীর কারাগার যোগ্য নহে কভু।
অমন সমুদ্র-সম আছে যাহাদের মন
তাহাদের তরে দেবি নহে এ পৃথিবী।
তাদের উদার মন আকাশে উড়িতে যায়,
পিঞ্জরে ঠেকিয়া পক্ষ নিম্নে পড়ে পুনঃ,
নিরাশায় অবশেষে ভেঙ্গে চুরে যায় মন,
জগৎ পূরায় তার আকুল বিলাপে।
কবির সমুদ্র-বুক পূরাতে পারিবে কিসে
প্রেম দিয়া ক্ষুদ্র ওই বনের বালিকা।
কাতর ক্রন্দনে আহা আজিও কাঁদিল কবি,
"এখনও পূরিল না প্রাণের শূন্যতা।"
বালিকার কাছে গিয়া কাতরে কহিল কবি,
"আরো দাও ভালবাসা হৃদয়ে ঢালিয়া।
আমি যত ভালবাসি তত দাও ভালবাসা,
নহিলে গো পূরাবে না এ প্রাণের শূন্যতা।"
শুনিয়া কবির কথা কাতরে কহিল বালা,
"যা ছিল আমার কবি দিয়েছি সকলি--
এ হৃদয়, এ পরাণ, সকলি তোমার কবি,
সকলি তোমার প্রেমে দেছি বিসর্জ্জন।
তোমার ইচ্ছার সাথে ইচ্ছা মিশায়েছি মোর,
তোমার সুখের সাথে মিশায়েছি সুখ।"
সে কথা শুনিয়া কবি কহিল কাতর স্বরে,
"প্রাণের শূন্যতা তবু ঘুচিল না কেন?
ওই হৃদয়ের সাথে মিশাতে চাই এ হৃদি,
দেহের আড়াল তবে রহিল গো কেন?
সারাদিন সাধ যায় সুধাই মনের কথা,
এত কথা তব কেন পাই না খুঁজিয়া?
সারাদিন সাধ যায় দেখি ও মুখের পানে,
দেখেও মিটে না কেন আঁখির পিপাসা?
সাধ যায় এ জীবন প্রাণ ভোরে ভাল বাসি,
বেসেও প্রাণের শূন্য ঘুচিল না কেন?
আমি যত ভালবাসি তত দাও ভালবাসা,
নহিলে গো পূরিবে না প্রাণের শূন্যতা।
একি দেবি! একি তৃষ্ণা জ্বলিছে হৃদয়ে মোর,
ধরার অমৃত যত করিয়াছি পান,
প্রকৃতির কাছে যত তরল স্বর্গীয় গীতি,
সকলি হৃদয়ে মোর দিয়াছি ঢালিয়া--
শুধু দেবি পৃথিবীর হলাহল আছে যত
তাহাই করি নি পান মিটাতে পিপাসা!
শুধু দেবি ঐশ্বর্য্যের কনকশৃঙ্খল দিয়া
বাঁধি নাই আমার এ স্বাধীন হৃদয়!
শুধু দেবি মিটাইতে মনের বীরত্ব-গর্ব্ব
লক্ষ মানবের রক্তে ধুই নি চরণ!
শুধু দেবি এ জীবনে নিশাচর বিলাসেরে
সুখ-স্বাস্থ্য অর্ঘ্য দিয়া করি নাই সেবা!
তবু কেন হৃদয়ের তৃষা মিটিল না মোর,
তবু কেন ঘুচিল না প্রাণের শূন্যতা?
শুনেছি বিলাসসুরা বিহ্বল করিয়া হৃদি
ডুবাইয়া রাখে সদা বিস্মৃতির ঘুমে!
কিন্তু দেবি-- কিন্তু দেবি-- এত যে পেয়েছি কষ্ট,
বিস্মৃতি চাই নে তবু বিস্মৃতি চাই নে!--
সে কি ভয়ানক দশা, কল্পনাও শিহরে গো--
স্বর্গীয় এ হৃদয়ের জীবনে মরণ!
আমার এ মন দেবি হোক্ মরুভূমি-সম
তৃণলতা-জল-শূন্য জ্বলন্ত প্রান্তর,
তবুও তবুও আমি সহিব তা প্রাণপণে,
বহিব তা যত দিন রহিব বাঁচিয়া,
মিটাতে মনের তৃষা ত্রিভুবন পর্য্যটিব,
হত্যা করিব না তবু হৃদয় আমার।
প্রেম ভক্তি স্নেহ আদি মনের দেবতা যত
যতনে রেখেছি আমি মনের মন্দিরে,
তাঁদের করিতে পূজা ক্ষমতা নাইকো ব'লে
বিসর্জ্জন করিবারে পারিব না আমি।
কিন্তু ওগো কলপনা আমার মনের কথা
বুঝিতে কে পারিবেক বল দেখি দেবি?
আমার ব্যথার মর্ম্ম কারে বুঝাইবে বল--
বুঝাইতে না পারিলে বুক যায় ফেটে।
যদি কেহ বলে দেবি "তোমার কিসে দুখ,
হৃদয়ের বিনিময়ে পেয়েছ হৃদয়,
তবে কাল্পনিক দুখে এত কেন ম্রিয়মাণ?'
তবে কি বলিয়া আমি দিব গো উত্তর?
উপায় থাকিতে তবু যে সহে বিষাদজ্বালা
পৃথিবী তাহারি কষ্টে হয় গো ব্যথিত--
আমার এ বিষাদের উপায় নাইক কিছু,
কারণ কি তাও দেবি পাই না খুঁজিয়া।
পৃথিবী আমার কষ্ট বুঝুক্ বা না বুঝুক্,
নলিনীরে কি বলিয়া বুঝাইব দেবি?
তাহারে সামান্য কথা গোপন করিলে পরে
হৃদয়ে কি কষ্ট হয় হৃদয় তা জানে।
এত তারে ভালবাসি, তবু কেন মনে হয়
ভালবাসা হইল না আশ মিটাইয়া!
আঁধার সমুদ্রতলে কি যেন বেড়াই খুঁজে,
কি যেন পাইতেছি না চাহিতেছি যাহা।
বুকের যেখানে তারে রাখিতে চাই গো আমি
সেখানে পাই নে যেন রাখিতে তাহারে--
তাইতে অন্তর বুক এখনো পূরিতেছে না,
তাইতে এখনো শূন্য রয়েছে হৃদয়।"
কবির প্রণয়সিন্ধু ক্ষুদ্র বালিকার মন
রেখেছিল মগ্ন করি অগাধ সলিলে--
উপরে যে ঝড় ঝঞ্ঝা কত কি বহিয়া যেত
নিম্নে তার কোলাহল পেত না শুনিতে,
প্রণয়ের অবিচিত্র নিয়তনূতন তবু
তরঙ্গের কলধ্বনি শুনিত কেবল,
সেই একতান ধ্বনি শুনিয়া শুনিয়া তার
হৃদয় পড়িয়াছিল ঘুমায়ে কেমন!
বনের বালিকা আহা সে ঘুমে বিহ্বল হোয়ে
কবির হৃদয়ে রাখি অবশ মস্তক
স্বর্গের স্বপন শুধু দেখিত দিবস রাত,
হৃদয়ের হৃদয়ের অনন্ত মিলন।
বালিকার সে হৃদয়ে সে প্রণয়মগ্ন হৃদে,
অবশিষ্ট আছিল না এক তিল স্থান--
আর কিছু জানিত না, আর কিছু ভাবিত না,
শুধু সে বালিকা ভাল বাসিত কবিরে।
শুধু সে কবির গান কত যে লাগিত ভাল,
শুনে শুনে শুনা তার ফুরাত না আর।
শুধু সে কবির নেত্র কি এক স্বর্গীয় জ্যোতি
বিকীরিত, তাই হেরি হইত বিহ্বল!
শুধু সে কবির কোলে ঘুমাতে বাসিত ভাল,
কবি তার চুল লয়ে করিত কি খেলা।
শুধু সে কবিরে বালা শুনতে বাসিত ভাল
কত কি--কত কি কথা অর্থ নাই যার,
কিন্তু সে কথায় কবি কত যে পাইত অর্থ
গভীর সে অর্থ নাই কত কবিতার--
সেই অর্থহীন কথা, হৃদয়ের ভাব যত
প্রকাশ করিতে পারে না এমন কিছু না।
একদিন বালিকারে কবি সে কহিল গিয়া--
"নলিনি! চলিনু আমি ভ্রমিতে পৃথিবী!
আর একবার বালা কাশ্মীরের বনে বনে
যাই গো শুনিতে আমি পাখীর কবিতা!
রুসিয়ার হিমক্ষেত্রে আফ্রিকার মরুভূমে
আর একবার আমি করি গে ভ্রমণ!
এইখানে থাক তুমি, ফিরিয়া আসিয়া পুনঃ
ওই মধুমুখখানি করিব চুম্বন।"
এতেক কহিয়া কবি নীরবে চলিয়া গেল
গোপনে মুছিয়া ফেলি নয়নের জল।
বালিকা নয়ন তুলি নীরবে রহিল চাহি,
কি দেখিছে সেই জানে অনিমিষ চখে।
সন্ধ্যা হোয়ে এল ক্রমে তবুও রহিল চাহি,
তবুও ত পড়িল না নয়নে নিমেষ।
অনিমিষ নেত্র ক্রমে করিয়া প্লাবিত
একবিন্দু দুইবিন্দু ঝরিল সলিল।
বাহুতে লুকায়ে মুখ কাতর বালিকা
মর্ম্মভেদী অশ্রুজলে করিল রোদন।
হা-হা কবি কি করিলে,ফিরে দেখ, ফিরে এস,
দিও না বালার হৃদে অমন আঘাত--
নীরবে বালার আহা কি বজ্র বেজেছে বুকে,
গিয়াছে কোমল মন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া!
হা কবি অমন কোরে অনর্থক তার মনে
কি আঘাত করিলে যে বুঝিলে না তাহা?
এত কাল সুখস্বপ্ন ডুবায়ে রাখিয়া মন,
এত দিন পরে তাহা দিবে কি ভাঙ্গিয়া?
কবি ত চলিয়া যায়-- সন্ধ্যা হোয়ে এল ক্রমে,
আঁধারে কাননভূমি হইল গম্ভীর--
একটি নড়ে না পাতা, একটু বহে না বায়ু,
স্তব্ধ বন কি যেন কি ভাবিছে নীরবে!
তখন বনান্ত হোতে সুধীরে শুনিল কবি
উঠিছে নীরব শূন্যে বিষণ্ণ সঙ্গীত--
তাই শুনি বন যেন রয়েছে নীরবে অতি,
জোনাকি নয়ন শুধু মেলিছে মুদিছে।
একবার কবি শুধু চাহিল কুটীরপানে,
কাতরে বিদায় মাগি বনদেবী-কাছে
নয়নের জল মুছি-- যে দিকে নয়ন চলে
সে দিকে পথিক কবি যাইল চলিয়া। সঙ্গীত কেন ভালবাসিলে আমায়?
কিছুই নাইক গুণ, কিছুই জানি না আমি,
কি আছে? কি দিয়ে তব তুষিব হৃদয়!
যা আমার ছিল সাধ্য সকলি করেছি আমি
কিছুই করি নি দোষ চরণে তোমার,
শুধু ভাল বাসিয়াছি, শুধু এ পরান মন
উপহার সঁপিয়াছি তোমার চরণে।
তাতেও তোমার মন তুষিতে নারিনু যদি
তবে কি করিব বল, কি আছে আমার?
গেলে যদি, গেলে চলি, যাও যেথা ভাল লাগে--
একবার মনে কোরো দীন অধীনীরে।
ভ্রমিতে ধরার মাঝে যত ভালবাসা পাবে,
তাতে যদি ভাল থাক তাই হোক্ তবে--
তবু একবার যদি মনে কর নলিনীরে
যে দুখিনী, যে তোমারে এত ভালবাসে!
কি করিলে মন তব পারিতাম জুড়াইতে
যদি জানিতাম কবি করিতাম তাহা!
আমি অতি অভাগিনী জানি না বলিয়া যেন
বিরক্ত হোয়ো না কবি এই ভিক্ষা দাও!
না জানিয়া না শুনিয়া যদি দোষ করে থাকি,
ক্ষুদ্র আমি, ক্ষমা তবে করিয়ো আমারে--
তুমি ভাল থেকো কবি,ক্ষুদ্র এক কাঁটা যেন
ফুটে না তোমার পায়ে ভ্রমিতে পৃথিবী।
জননি, কোথায় তুমি রেখে গেলে দুহিতারে?
কত দিন একা একা কাটালাম হেথা,
একেলা তুলিয়া ফুল কত মালা গাঁথিতাম,
একেলা কাননময় করিতাম খেলা!
তোমার বীণাটি ল'য়ে, উঠিয়া পর্ব্বতশিরে
একেলা আপন মনে গাইতাম গান--
হরিণশিশুটি মোর বসিত পায়ের তলে,
পাখীটি কাঁধের 'পরে শুনিত নীরবে।
এইরূপ কত দিন কাটালেম বনে বনে,
কত দিন পরে তবে এলে তুমি কবি!
তখন তোমারে কবি কি যে ভালবাসিলাম
এত ভাল কাহারেও বাসি নাই কভু।
দূর স্বরগের এক জ্যোতির্ম্ময় দেব-সম
কত বার মনে মনে করেছি প্রণাম।
দূর থেকে আঁখি ভরি দেখিতাম মুখখানি,
দূর থেকে শুনিতাম মধুময় গান।
যে দিন আপনি আসি কহিলে আমার কাছে
ক্ষুদ্র এই বালিকারে ভালবাস তুমি,
সে দিন কি হর্ষে কবি কি আনন্দে কি উচ্ছ্বাসে
ক্ষুদ্র এ হৃদয় মোর ফেটে গেল যেন।
আমি কোথাকার কেবা! আমি ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র,
স্বর্গের দেবতা তুমি ভালবাস মোরে?
এত সৌভাগ্য, কবি, কখনো করি নি আশা--
কখনো মুহূর্ত্ত-তরে জানি নি স্বপনে।
যেথায় যাও-না কবি, যেথায় থাক-না তুমি,
আমরণ তোমারেই করিব অর্চ্চনা।
মনে রাখ নাই রাখ, তুমি যেন সুখে থাক
দেবতা! এ দুখিনীর শুন গো প্রার্থনা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
দুখানি চরণ পড়ে ধরণীর গায়,
দুখানি অলস রাঙা কোমল চরণ ।
শত বসন্তের স্মৃতি জাগিছে ধরায়,
শতলক্ষ কুসুমের পরশস্বপন ।
শত বসন্তের যেন ফুটন্ত অশোক
ঝরিয়া মিলিয়া গেছে দুটি রাঙা পায় ।
প্রভাতের প্রদোষের দুটি সূর্যলোক
অস্ত গেছে যেন দুটি চরণছায়ায় ।
যৌবনসংগীত পথে যেতেছে ছড়ায়ে,
নূপুর কাঁদিয়া মরে চরণ জড়ায়ে -
নৃত্য সদা বাঁধা যেন মধুর মায়ায় ।
হোথা যে নিঠুর মাটি, শুষ্ক ধরাতল -
এসো গো হৃদয়ে এসো, ঝুরিছে হেথায়
লাজরক্ত লালসার রাঙা শতদল ।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সন্ধ্যাসূর্যের প্রতিআমার এ গান তুমি যাও সাথে করে
নূতন সাগরতীরে দিবসের পানে ।
সায়াহ্নের কূল হতে যদি ঘুমঘোরে
এ গান উষার কূলে পশে কারো কানে!
সারা রাত্রি নিশীথের সাগর বাহিয়া
স্বপনের পরপারে যদি ভেসে যায় ,
প্রভাত – পাখিরা যবি উঠিবে গাহিয়া
আমার এ গান তারা যদি খুঁজে পায় ।
গোধূলির তীরে বসে কেঁদেছে যে জন ,
ফেলেছে আকাশে চেয়ে অশ্রুজল কত ,
তার অশ্রু পড়িবে কি হইয়া নূতন
নবপ্রভাতের মাঝে শিশিরের মতো ।
সায়াহ্নের কুঁড়িগুলি আপনা টুটিয়া
প্রভাতে কি ফুল হয়ে উঠে না ফুটিয়া ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।–নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে–
শুনি রে শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে,
পিককূজন পুষ্পবনে বিজনে,
মৃদু বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে
কলগীত সুললিত বাজে।
শ্যামল কান্তার-‘পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে,
নদীতীরে শরবনে উঠে ধ্বনি সরসর মরমর।
কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥আষাঢ়ে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি গম্ভীর, অতি গম্ভীর নীল অম্বরে ডম্বরু বাজে,
যেন রে প্রলয়ঙ্করী শঙ্করী নাচে।
করে গর্জন নির্ঝরিণী সঘনে,
হেরো ক্ষুব্ধ ভয়াল বিশাল নিরাল পিয়ালতমালবিতানে
উঠে রব ভৈরবতানে।
পবন মল্লারগীত গাহিছে আঁধার রাতে,
উন্মাদিনী সৌদামিনী রঙ্গভরে নৃত্য করে অম্বরতলে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥আশ্বিনে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি নির্মল, অতি নির্মল, অতি নির্মল উজ্জ্বল সাজে
ভুবনে নব শারদলক্ষ্ণী বিরাজে।
নব ইন্দুলেখা অলকে ঝলকে
অতি নির্মল হাসবিভাসবিকাশ আকাশনীলাম্বুজ-মাঝে
শ্বেত ভুজে শ্বেত বীণা বাজে–
উঠিছে আলাপ মৃদু মধুর বেহাগতানে,
চন্দ্রকরে উল্লসিত ফুল্লবনে ঝিল্লিরবে তন্দ্রা আনে রে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।–নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে–
শুনি রে শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে,
পিককূজন পুষ্পবনে বিজনে,
মৃদু বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে
কলগীত সুললিত বাজে।
শ্যামল কান্তার-‘পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে,
নদীতীরে শরবনে উঠে ধ্বনি সরসর মরমর।
কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥আষাঢ়ে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি গম্ভীর, অতি গম্ভীর নীল অম্বরে ডম্বরু বাজে,
যেন রে প্রলয়ঙ্করী শঙ্করী নাচে।
করে গর্জন নির্ঝরিণী সঘনে,
হেরো ক্ষুব্ধ ভয়াল বিশাল নিরাল পিয়ালতমালবিতানে
উঠে রব ভৈরবতানে।
পবন মল্লারগীত গাহিছে আঁধার রাতে,
উন্মাদিনী সৌদামিনী রঙ্গভরে নৃত্য করে অম্বরতলে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥আশ্বিনে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি নির্মল, অতি নির্মল, অতি নির্মল উজ্জ্বল সাজে
ভুবনে নব শারদলক্ষ্ণী বিরাজে।
নব ইন্দুলেখা অলকে ঝলকে
অতি নির্মল হাসবিভাসবিকাশ আকাশনীলাম্বুজ-মাঝে
শ্বেত ভুজে শ্বেত বীণা বাজে–
উঠিছে আলাপ মৃদু মধুর বেহাগতানে,
চন্দ্রকরে উল্লসিত ফুল্লবনে ঝিল্লিরবে তন্দ্রা আনে রে।
দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা ॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
শর কহে, আমি লঘু, গুরু তুমি গদা,
তাই বুক ফুলাইয়া খাড়া আছ সদা।
করো তুমি মোর কাজ, তর্ক যাক চুকে—
মাথা ভাঙা ছেড়ে দিয়ে বেঁধো গিয়ে বুকে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
জলহারা মেঘখানি বরষার শেষে
পড়ে আছে গগনের এক কোণ ঘেঁষে।
বর্ষাপূর্ণ সরোবর তারি দশা দেখে
সারাদিন ঝিকিমিকি হাসে থেকে থেকে।
কহে, ওটা লক্ষ্মীছাড়া, চালচুলাহীন,
নিজেরে নিঃশেষ করি কোথায় বিলীন।
আমি দেখো চিরকাল থাকি জলভরা,
সারবান, সুগম্ভীর, নাই নড়াচড়া।
মেঘ কহে, ওহে বাপু, কোরো না গরব,
তোমার পূর্ণতা সে তো আমারি গৌরব। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ওগো মোর নাহি যে বাণী
আকাশে হৃদয় শুধু বিছাতে জানি।
আমি অমাবিভাবরী আলোকহারা
মেলিয়া তারা
চাহি নিঃশেষ পথপানে
নিষ্ফল আশা নিয়ে প্রাণে।
বহুদূরে বাজে তব বাঁশি,
সকরুণ সুর আসে ভাসি
বিহ্বল বায়ে
নিদ্রাসমুদ্র পারায়ে।
তোমারি সুরের প্রতিধ্বনি
দিই যে ফিরায়ে-
সে কি তব স্বপ্নের তীরে
ভাঁটার স্রোতের মতো
লাগে ধীরে, অতি ধীরে থীরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবাপানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
নীচে সব নীচে এ ধূলির ধরণীতে
যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে,
যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নেই কিছু
যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে,
স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়,
যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়।
আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে,
এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে,
সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম
ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।১৫ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
পথিক দেখেছি আমি পুরাণে কীর্তিত কত দেশ
কীর্তি-নিঃস্ব আজি; দেখেছি অবমানিত ভগ্নশেষ
দর্পোদ্ধত প্রতাপের; অন্তর্হিত বিজয়-নিশান
বজ্রাঘাতে স্তব্ধ যেন অট্টহাসি; বিরাট সম্মান
সাষ্টাঙ্গে সে ধুলায় প্রণত, যে ধুলার পরে মেলে
সন্ধ্যাবেলা ভিক্ষু জীর্ণ কাঁথা, যে ধুলায় চিহ্ন ফেলে
শ্রান্ত পদ পথিকের, পুনঃ সেই চিহ্ন লোপ করে
অসংখ্যের নিত্য পদপাতে। দেখিলাম বালুস্তরে
প্রচ্ছন্ন সুদূর যুগান্তর, ধূসর সমুদ্রতলে
যেন মগ্ন মহাতরী অকস্মাৎ ঝঞ্ঝাবর্ত বলে
লয়ে তার সব ভাষা, সর্ব দিন রজনীর আশা,
মুখরিত ক্ষুধাতৃষ্ণা, বাসনা-প্রদীপ্ত ভালবাসা।
তবু করি অনুভব বসি’ এই অনিত্যের বুকে ,
অসীমের হৃৎস্পন্দন তরঙ্গিছে মোর দুঃখে সুখে । (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কার লাগি এই গয়না গড়াও
যতন-ভরে।
স্যাকরা বলে, একা আমার
প্রিয়ার তরে।শুধাই তারে, প্রিয়া তোমার
কোথায় আছে।
স্যাকরা বলে, মনের ভিতর
বুকের কাছে।আমি বলি, কিনে তো লয়
মহারাজাই।
স্যাকরা বলে, প্রেয়সীরে
আগে সাজাই।আমি শুধাই, সোনা তোমার
ছোঁয় কবে সে।
স্যাকরা বলে অলখ ছোঁওয়ায়
রূপ লভে সে।শুধাই, একি একলা তারি
চরণতলে।
স্যাকরা বলে, তারে দিলেই
পায় সকলে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে ,
বিসরি ত্রাস - লোকলাজে
সজনি , আও আও লো ।
অঙ্গে চারু নীল বাস ,
হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ ,
হরিণনেত্রে বিমল হাস ,
কুঞ্জবনমে আও লো ।
ঢালে কুসুম সুরভভার ,
ঢালে বিহগ সুরবসার ,
ঢালে ইন্দু অমৃতধার
বিমল রজত ভাতি রে ।
মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে ,
অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে ,
ফুটল সজনি , পুঞ্জে পুঞ্জে
বকুল যূথি জাতি রে ।
দেখ সজনি , শ্যামরায়
নয়নে প্রেম উথল যায় ,
মধুর বদন অমৃতসদন
চন্দ্রমায় নিন্দিছে ।
আও আও সজনিবৃন্দ ,
হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ,
শ্যামকো পদারবিন্দ
ভানুসিংহ বন্দিছে । (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গাথাকাব্য
|
নদীতীরে বৃন্দাবনে সনাতন একমনে
জপিছেন নাম,
হেনকালে দীনবেশে ব্রাহ্মণ চরণে এসে
করিল প্রণাম।
শুধালেন সনাতন, 'কোথা হতে আগমন,
কী নাম ঠাকুর?'
বিপ্র কহে, 'কিবা কব, পেয়েছি দর্শন তব
ভ্রমি বহুদূর।
জীবন আমার নাম, মানকরে মোর ধাম,
জিলা বর্ধমানে--
এতবড়ো ভাগ্যহত দীনহীন মোর মতো
নাই কোনোখানে।
জমিজমা আছে কিছু, করে আছি মাথা নিচু,
অল্পস্বল্প পাই।
ক্রিয়াকর্ম-যজ্ঞযাগে বহু খ্যাতি ছিল আগে,
আজ কিছু নাই।
আপন উন্নতি লাগি শিব-কাছে বর মাগি
করি আরাধনা।
একদিন নিশিভোরে স্বপ্নে দেব কন মোরে--
পুরিবে প্রার্থনা!
যাও যমুনার তীর, সনাতন গোস্বামীর
ধরো দুটি পায়!
তাঁরে পিতা বলি মেনো, তাঁরি হাতে আছে জেনো
ধনের উপায়।'শুনি কথা সনাতন ভাবিয়া আকুল হন--
'কী আছে আমার!
যাহা ছিল সে সকলি ফেলিয়া এসেছি চলি--
ভিক্ষামাত্র সার।'
সহসা বিস্মৃতি ছুটে, সাধু ফুকারিয়া উঠে,
'ঠিক বটে ঠিক।
একদিন নদীতটে কুড়ায়ে পেয়েছি বটে
পরশমানিক।
যদি কভু লাগে দানে সেই ভেবে ওইখানে
পুঁতেছি বালুতে--
নিয়ে যাও হে ঠাকুর, দুঃখ তব হবে দূর
ছুঁতে নাহি ছুঁতে।'বিপ্র তাড়াতাড়ি আসি খুঁড়িয়া বালুকারাশি
পাইল সে মণি,
লোহার মাদুলি দুটি সোনা হয়ে উঠে ফুটি,
ছুঁইল যেমনি।
ব্রাহ্মণ বালুর 'পরে বিস্ময়ে বসিয়া পড়ে--
ভাবে নিজে নিজে।
যমুনা কল্লোলগানে চিন্তিতের কানে কানে
কহে কত কী যে!
নদীপারে রক্তছবি দিনান্তের ক্লান্ত রবি
গেল অস্তাচলে--
তখন ব্রাহ্মণ উঠে সাধুর চরণে লুটে
কহে অশ্রুজলে,
'যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি
তাহারি খানিক
মাগি আমি নতশিরে।' এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মানিক।২৯ আশ্বিন, ১৩০৬
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরানসখা বন্ধু হে আমার।
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্ নদীর পারে,
গহন কোন্ অন্ধকারে
হতেছ তুমি পার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।“পদ্মা’ বোট, শ্রাবণ, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
নিমেষে টুটিয়া গেল সে মহাপ্রতাপ।
ঊর্ধ্ব হতে একদিন দেবতার শাপ
পশিল সে সুখরাজ্যে, বিচ্ছেদের শিখা
করিয়া বহন; মিলনের মরীচিকা,
যৌবনের বিশ্বগ্রাসী মত্ত অহমিকা
মুহূর্তে মিলায়ে গেল মায়াকুহেলিকা
খররৌদ্রকরে। ছয় ঋতু সহচরী
ফেলিয়া চামরছত্র, সভাভঙ্গ করি
সহসা তুলিয়া দিল রঙ্গযবনিকা—
সহসা খুলিয়া গেল, যেন চিত্রে লিখা,
আষাঢ়ের অশ্রুপ্লুত সুন্দর ভুবন।
দেখা দিল চারি দিকে পর্বত কানন
নগর নগরী গ্রাম—বিশ্বসভামাঝে
তোমার বিরহবীণা সকরুণ বাজে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে
অরুণ-বরণ পারিজাত লয়ে হাতে।
নিদ্রিত পুরী, পথিক ছিল না পথে,
একা চলি গেলে তোমার সোনার রথে,
বারেক থামিয়া মোর বাতায়নপানে
চেয়েছিলে তব করুণ নয়নপাতে।
সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে। স্বপন আমার ভরেছিল কোন্ গন্ধে
ঘরের আঁধার কেঁপেছিল কী আনন্দে,
ধুলায় লুটানো নীরব আমার বীণা
বেজে উঠেছিল অনাহত কী আঘাতে।
কতবার আমি ভেবেছিনু উঠি-উঠি
আলস ত্যজিয়া পথে বাহিরাই ছুটি,
উঠিনু যখন তখন গিয়েছ চলে–
দেখা বুঝি আর হল না তোমার সাথে।
সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
বিশ্বের বিপুল বস্তুরাশি
উঠে অট্টহাসি;
ধুলা বালি
দিয়ে করতালি
নিত্য নিত্য
করে নৃত্য
দিকে দিকে দলে দলে;
আকাশে শিশুর মতো অবিরত কোলাহলে।
মানুষের লক্ষ লক্ষ অলক্ষ্য ভাবনা,
অসংখ্য কামনা,
রূপে মত্ত বস্তুর আহ্বানে উঠে মাতি
তাদের খেলায় হতে সাথি।
স্বপ্ন যত অব্যক্ত আকুল
খুঁজে মরে কূল;
অস্পষ্টের অতল প্রবাহে পড়ি
চায় এরা প্রাণপণে ধরণীরে ধরিতে আঁকড়ি
কাষ্ঠ-লোষ্ট্র-সুদৃঢ় মুষ্টিতে,
ক্ষণকাল মাটিতে তিষ্ঠিতে।
চিত্তের কঠিন চেষ্টা বস্তুরূপে
স্তূপে স্তূপে
উঠিতেছে ভরি--
সেই তো নগরী।
এ তো শুধু নহে ঘর,
নহে শুধু ইষ্টক প্রস্তর।
অতীতের গৃহছাড়া কত যে অশ্রুত বাণী
শূন্যে শূন্যে করে কানাকানি;
খোঁজে তারা আমার বাণীরে
লোকালয়-তীরে-তীরে।
আলোকতীর্থের পথে আলোহীন সেই যাত্রীদল
চলিয়াছে অশ্রান্ত চঞ্চল।
তাদের নীরব কোলাহলে
অস্ফুট ভাবনা যত দলে দলে ছুটে চলে
মোর চিত্তগুহা ছাড়ি,
দেয় পাড়ি
অদৃশ্যের অন্ধ মরু ব্যগ্র ঊর্ধ্বশ্বাসে
আকারের অসহ্য পিয়াসে।
কী জানি কে তারা কবে
কোথা পার হবে
যুগান্তরে,
দূর সৃষ্টি-'পরে
পাবে আপনার রূপ অপূর্ব আলোতে।
আজ তারা কোথা হতে
মেলেছিল ডানা
সেদিন তা রহিবে অজানা।
অকস্মাৎ পাবে তারে কোন্ কবি,
বাঁধিবে তাহারে কোন্ ছবি
গাঁথিবে তাহারে কোন্ হর্ম্যচূড়ে,
সেই রাজপুরে
আজি যার কোনো দেশে কোনো চিহ্ন নাই।
তার তরে কোথা রচে ঠাঁই
অরচিত দূর যজ্ঞভূমে।
কামানের ধূমে
কোন্ ভাবী ভীষণ সংগ্রাম
রণশৃঙ্গে আহ্বান করিছে তার নাম!
সুরুল, ২৭ পৌষ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
শিশুকালের থেকে
আকাশ আমার মুখে চেয়ে একলা গেছে ডেকে। দিন কাটত কোণের ঘরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা
কাছের দিকে সর্বদা মুখ-ফেরা;
তাই সুদূরের পিপাসাতে
অতৃপ্ত মন তপ্ত ছিল। লুকিয়ে যেতেম ছাতে,
চুরি করতেম আকাশভরা সোনার বরন ছুটি,
নীল অমৃতে ডুবিয়ে নিতেম ব্যাকুল চক্ষু দুটি।
দুপুর রৌদ্রে সুদূর শূন্যে আর কোনো নেই পাখি,
কেবল একটি সঙ্গীবিহীন চিল উড়ে যায় ডাকি
নীল অদৃশ্যপানে;
আকাশপ্রিয় পাখি ওকে আমার হৃদয় জানে।
স্তব্ধ ডানা প্রখর আলোর বুকে
যেন সে কোন্ যোগীর ধেয়ান মুক্তি-অভিমুখে।
তীক্ষ্ণ তীব্র সুর
সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্ম হয়ে দূরের হতে দূর
ভেদ করে যায় চলে
বৈরাগী ঐ পাখির ভাষা মন কাঁপিয়ে তোলে। আলোর সঙ্গে আকাশ যেথায় এক হয়ে যায় মিলে
শুভ্রে এবং নীলে
তীর্থ আমার জেনেছি সেইখানে
অতল নীরবতার মাঝে অবগাহনস্নানে।
আবার যখন ঝঞ্ঝা, যেন প্রকাণ্ড এক চিল
এক নিমেষে ছোঁ মেরে নেয় সব আকাশের নীল,
দিকে দিকে ঝাপটে বেড়ায় স্পর্ধাবেগের ডানা,
মানতে কোথাও চায় না কারো মানা,
বারে বারে তড়িৎশিখার চঞ্চু-আঘাত হানে
অদৃশ্য কোন্ পিঞ্জরটার কালো নিষেধপানে,
আকাশে আর ঝড়ে
আমার মনে সব-হারানো ছুটির মূর্তি গড়ে।
তাই তো খবর পাই--
শান্তি সেও মুক্তি, আবার অশান্তিও তাই।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিগাথা
|
অ্যাক্ওয়ার্থ্ সাহেব কয়েকটি মারাঠি গাথার যে ইংরাজি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন তাহারই ভূমিকা হইতে বর্ণিত ঘটনা গৃহীত। শিবাজির গেরুয়া পতাকা "ভগোয়া ঝেণ্ডা' নামে খ্যাত।বসিয়া প্রভাতকালে সেতারার দুর্গভালে
শিবাজি হেরিলা এক দিন--
রামদাস গুরু তাঁর ভিক্ষা মাগি দ্বার দ্বার
ফিরিছেন যেন অন্নহীন।
ভাবিলা, এ কী এ কাণ্ড! গুরুজির ভিক্ষাভাণ্ড--
ঘরে যাঁর নাই দৈন্যলেশ!
সব যাঁর হস্তগত, রাজ্যেশ্বর পদানত,
তাঁরো নাই বাসনার শেষ!
এ কেবল দিনে রাত্রে জল ঢেলে ফুটা পাত্রে
বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।
কহিলা, "দেখিতে হবে কতখানি দিলে তবে
ভিক্ষাঝুলি ভরে একেবারে।'
তখনি লেখনী আনি কী লিখি দিলা কী জানি,
বালাজিরে কহিলা ডাকায়ে,
"গুরু যবে ভিক্ষা-আশে আসিবেন দুর্গ-পাশে
এই লিপি দিয়ো তাঁর পায়ে।'গুরু চলেছেন গেয়ে, সম্মুখে চলেছে ধেয়ে
কত পান্থ কত অশ্বরথ!--
"হে ভবেশ, হে শংকর, সবারে দিয়েছ ঘর,
আমারে দিয়েছ শুধু পথ।
অন্নপূর্ণা মা আমার লয়েছে বিশ্বের ভার,
সুখে আছে সর্ব চরাচর--
মোরে তুমি, হে ভিখারি, মার কাছ হতে কাড়ি
করেছ আপন অনুচর।'সমাপন করি গান সারিয়া মধ্যাহ্নস্নান
দুর্গদ্বারে আসিয়া যখন--
বালাজি নমিয়া তাঁরে দাঁড়াইল এক ধারে
পদমূলে রাখিয়া লিখন।
গুরু কৌতূহলভরে তুলিয়া লইলা করে,
পড়িয়া দেখিলা পত্রখানি--
বন্দি তাঁর পাদপদ্ম শিবাজি সঁপিছে অদ্য
তাঁরে নিজরাজ্য-রাজধানী।পরদিনে রামদাস গেলেন রাজার পাশ,
কহিলেন, "পুত্র, কহো শুনি,
রাজ্য যদি মোরে দেবে কী কাজে লাগিবে এবে--
কোন্ গুণ আছে তব গুণী?'
"তোমারি দাসত্বে প্রাণ আনন্দে করিব দান'
শিবাজি কহিলা নমি তাঁরে।
গুরু কহে, "এই ঝুলি লহ তবে স্কন্ধে তুলি,
চলো আজি ভিক্ষা করিবারে।'শিবাজি গুরুর সাথে ভিক্ষাপাত্র লয়ে হাতে
ফিরিলে পুরদ্বারে-দ্বারে।
নৃপে হেরি ছেলেমেয়ে ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে,
ডেকে আনে পিতারে মাতারে।
অতুল ঐশ্বর্যে রত, তাঁর ভিখারির ব্রত!
এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা!
ভিক্ষা দেয় লজ্জাভরে, হস্ত কাঁপে থরেথরে,
ভাবে ইহা মহতের লীলা।
দুর্গে দ্বিপ্রহর বাজে, ক্ষান্ত দিয়া কর্মকাজে
বিশ্রাম করিছে পুরবাসী।
একতারে দিয়ে তান রামদাস গাহে গান
আনন্দে নয়নজলে ভাসি,
"ওহে ত্রিভুবনপতি, বুঝি না তোমার মতি,
কিছুই অভাব তব নাহি--
হৃদয়ে হৃদয়ে তবু ভিক্ষা মাগি ফির, প্রভু,
সবার সর্বস্বধন চাহি।'অবশেষে দিবসান্তে নগরের এক প্রান্তে
নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি--
ভিক্ষা-অন্ন রাঁধি সুখে গুরু কিছু দিলা মুখে,
প্রসাদ পাইল শিষ্য তাঁরি।
রাজা তবে কহে হাসি, "নৃপতির গর্ব নাশি
করিয়াছ পথের ভিক্ষুক--
প্রস্তুত রয়েছে দাস, আরো কিবা অভিলাষ--
গুরু-কাছে লব গুরু দুখ।'গুরু কহে, "তবে শোন্,করিলি কঠিন পণ,
অনুরূপ নিতে হবে ভার--
এই আমি দিনু কয়ে মোর নামে মোর হয়ে
রাজ্য তুমি লহ পুনর্বার।
তোমারে করিল বিধি ভিক্ষুকের প্রতিনিধি,
রাজ্যেশ্বর দীন উদাসীন।
পালিবে যে রাজধর্ম জেনো তাহা মোর কর্ম,
রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন।'"বৎস, তবে এই লহো মোর আশীর্বাদসহ
আমার গেরুয়া গাত্রবাস--
বৈরাগীর উত্তরীয় পতাকা করিয়া নিয়ো'
কহিলেন গুরু রামদাস।
নৃপশিষ্য নতশিরে বসি রহে নদীতীরে,
চিন্তারাশি ঘনায়ে ললাটে।
থামিল রাখালবেণু, গোঠে ফিরে গেল ধেনু,
পরপারে সূর্য গেল পাটে।পূরবীতে ধরি তান একমনে রচি গান
গাহিতে লাগিলা রামদাস,
"আমারে রাজার সাজে বসায়ে সংসারমাঝে
কে তুমি আড়ালে কর বাস!
হে রাজা, রেখেছি আনি তোমারি পাদুকাখানি,
আমি থাকি পাদপীঠতলে--
সন্ধ্যা হয়ে এল ওই, আর কত বসে রই!
তব রাজ্যে তুমি এসো চলে।'
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
জামাই মহিম এল, সাথে এল কিনি–
হায় রে কেবলই ভুলি ষষ্ঠীর দিনই।
দেহটা কাহিল বড়ো, রাঁধবার নামে,
কে জানে কেন রে, বাপু, ভেসে যায় ঘামে।
বিধাতা জানেন আমি বড়ো অভাগিণী।
বেয়ানকে লিখে দেব, খাওয়াবেন তিনি। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আজিগন্ধবিধুর সমীরণে
কারসন্ধানে ফিরি বনে বনে।
আজি ক্ষুব্ধ নিলাম্বর-মাঝে
এ কি চঞ্চল ক্রন্দন বাজে।
সুদূর দিগন্তের সকরুণ সংগীত
লাগে মোর চিন্তায় কাজে--
আমি খুঁজি কারে অন্তরে মনে
গন্ধবিধুর সমীরণে।
ওগোজানি না কী নন্দনরাগে
সুখেউৎসুক যৌবন জাগে।
আজি আম্রমুকুলসৌগন্ধে,
নব- পল্লব-মর্মর ছন্দে,
চন্দ্র-কিরণ-সুধা-সিঞ্চিত অম্বরে
অশ্রু-সরস মহানন্দে
আমি পুলকিত কার পরশনে
গন্ধবিধুর সমীরণে।
বোলপুর, ফাল্গুন, ১৩১৬
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
দাও খুলে দাও, সখী, ওই বাহুপাশ —
চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান ।
কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস —
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান ।
কোথায় উষার আলো, কোথায় আকাশ —
এ চির পূর্ণিমারাত্রি হোক অবসান!
আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ,
তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ ।
আকুল অঙ্গুলিগুলি করি কোলাকুলি
গাঁথিছে সর্বাঙ্গে মোর পরশের ফাঁদ ।
ঘুমঘোরে শূন্যপানে দেখি মুখ তুলি
শুধু অবিশ্রামহাসি একখানি চাঁদ ।
স্বাধীন করিয়া দাও, বেঁধো না আমায় —
স্বাধীন হৃদয়খানি দিব তার পায় ।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
গণিতে রেলেটিভিটি প্রমাণের ভাবনায়
দিনরাত একা ব’সে কাটালো সে পাবনায়–
নাম তার চুনিলাল, ডাক নাম ঝোড়্কে।
১ গুলো সবই ১ সাদা আর কালো কি,
গণিতের গণনায় এ মতটা ভালো কি।
অবশেষে সাম্যের সামলাবে তোড় কে।একের বহর কভু বেশি কভু কম হবে,
এক রীতি হিসাবের তবুও কি সম্ভবে।
৭ যদি বাঁশ হয়, ৩ হয় খড়কে,
তবু শুধু ১০ দিয়ে জুড়বে সে জোড় কে।যোগ যদি করা যায় হিড়িম্বা কুন্তীতে,
সে কি ২ হতে পারে গণিতের গুন্তিতে।
যতই না কষে নাও মোচা আর থোড়কে
তার গুণফল নিয়ে আঁক যাবে ভড়কে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
শ্বশুরবাড়ির গ্রাম,
নাম তার কুলকাঁটা,
যেতে হবে উপেনের–
চাই তাই চুল-ছাঁটা।
নাপিত বললে, “কাঁচি
খুঁজে যদি পাই বাঁচি–
ক্ষুর আছে, একেবারে
করে দেব মূল-ছাঁটা।
জেনো বাবু, তাহলেই
বেঁচে যায় ভুল-ছাঁটা।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
শ্যাম , মুখে তব মধুর অধরমে
হাস বিকশিত কায় ?
কোন স্বপন অব দেখত মাধব ,
কহবে কোন হমায় !
নীদমেঘ'পর স্বপনবিজলিসম
রাধা বিলসত হাসি ।
শ্যাম , শ্যাম মম , কৈসে শোধব
তুঁহুক প্রেমঋণরাশি ।
বিহঙ্গ , কাহ তু বোলন লাগলি ?
শ্যাম ঘুমায় হমারা !
রহ রহ চন্দ্রম , ঢাল ঢাল তব
শীতল জোছনধারা ।
তারকমালিনী সুন্দর যামিনী
অবহুঁ ন যাও রে ভাগি ,
নিরদয় রবি , অব কাহ তু আওলি,
জ্বাললি বিরহক আগি ।
ভানু কহত—অব রবি অতি নিষ্ঠুর
নলিনমিলনঅভিলাষে
কত নরনারীক মিলন টুটাওত,
ডারত বিরহহুতাশে ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আকাশে সোনার মেঘ
কত ছবি আঁকে,
আপনার নাম তবু
লিখে নাহি রাখে।(স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
পাঁচদিন ভাত নেই, দুধ একরত্তি–
জ্বর গেল, যায় না যে তবু তার পথ্যি।
সেই চলে জলসাবু, সেই ডাক্তারবাবু,
কাঁচা কুলে আমড়ায় তেমনি আপত্তি।ইস্কুলে যাওয়া নেই সেইটে যা মঙ্গল–
পথ খুঁজে ঘুরিনেকো গণিতের জঙ্গল।
কিন্তু যে বুক ফাটে দূর থেকে দেখি মাঠে
ফুটবল-ম্যাচে জমে ছেলেদের দঙ্গল।কিনুরাম পণ্ডিত, মনে পড়ে, টাক তার–
সমান ভীষণ জানি চুনিলাল ডাক্তার।
খুলে ওষুধের ছিপি হেসে আসে টিপিটিপি–
দাঁতের পাটিতে দেখি, দুটো দাঁত ফাঁক তার।জ্বরে বাঁধে ডাক্তারে, পালাবার পথ নেই;
প্রাণ করে হাঁসফাঁস যত থাকি যত্নেই।
জ্বর গেলে মাস্টারে গিঁঠ দেয় ফাঁসটারে–
আমারে ফেলেছে সেরে এই দুটি রত্নেই।উদয়ন, শান্তিনিকেতন, ১৫। ৯। ৩৮
(খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি এত লীলার ছল -
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা -
যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।।তোমারে পাছে সহজে ধরি কিছুরই তব কিনারা নাই -
দশের দলে টানি গো পাছে কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা -
যে পথে তুমি চলিতে চাও সে পথে তুমি চল না।।সবার চেয়ে অধিক চাহ, তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও -
হেলার ভরে খেলার মতো ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?
বুঝেছি আমি, বুজেছি তব ছলনা -
সবার যাহে তৃপ্তি হল তোমার তাহে হল না।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যার খুশি রুদ্ধচক্ষে করো বসি ধ্যান,
বিশ্ব সত্য কিম্বা ফাঁকি লভ সেই জ্ঞান।
আমি ততক্ষণ বসি তৃপ্তিহীন চোখে
বিশ্বেরে দেখিয়া লই দিনের আলোকে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.