poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বাদশার মুখখানা
গুরুতর গম্ভীর,
মহিষীর হাসি নাহি ঘুচে;
কহিলা বাদশা-বীর,–
“যতগুলো দম্ভীর
দম্ভ মুছিব চেঁচে-পুঁছে।’উঁচু মাথা হল হেঁট,
খালি হল ভরা পেট,
শপাশপ্ পিঠে পড়ে বেত।
কভু ফাঁসি কভু জেল,
কভু শূল কভু শেল,
কভু ক্রোক দেয় ভরা খেত।মহিষী বলেন তবে,–
“দম্ভ যদি না র’বে
কী দেখে হাসিব তবে, প্রভু।’
বাদশা শুনিয়া কহে,–
“কিছুই যদি না রহে
হসনীয় আমি র’ব তবু।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আধা রাতে গলা ছেড়ে
মেতেছিনু কাব্যে,
ভাবিনি পাড়ার লোকে
মনেতে কী ভাববে।
ঠেলা দেয় জানলায়,
শেষে দ্বার-ভাঙাভাঙি,
ঘরে ঢুকে দলে দলে
মহা চোখ-রাঙারাঙি–
শ্রাব্য আমার ডোবে
ওদেরই অশ্রাব্যে।
আমি শুধু করেছিনু
সামান্য ভনিতাই,
সামলাতে পারল না
অরসিক জনে তাই–
কে জানিত অধৈর্য
মোর পিঠে নাববে! (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
দিকে দিকে দেখা যায় বিদর্ভ, বিরাট,
অযোধ্যা, পাঞ্চাল, কাঞ্চী উদ্ধতললাট
স্পর্ধিছে অম্বরতল অপাঙ্গ-ইঙ্গিতে,
অশ্বের হ্রেষায় আর হস্তীর বৃংহিতে,
অসির ঝঞ্ঝনা আর ধনুর টংকারে,
বীণার সংগীত আর নূপুরঝংকারে,
বন্দীর বন্দনারবে, উৎসব-উচ্ছ্বাসে,
উন্নাদ শঙ্খের গর্জে, বিজয়-উল্লাসে,
রথের ঘর্ঘরমন্দ্রে, পথের কল্লোলে
নিয়ত ধ্বনিত ধ্মাত কর্মকলরোলে।
ব্রাহ্মণের তপোবন অদূরে তাহার,
নির্বাক্ গম্ভীর শান্ত সংযত উদার।
হেথা মত্ত স্ফীতস্ফূর্ত ক্ষত্রিয়গরিমা,
হোথা স্তব্ধ মহামৌন ব্রাহ্মণমহিমা। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক এতবড়ো এ ধরণী মহাসিন্ধু-ঘেরা
দুলিতেছে আকাশসাগরে —
দিন - দুই হেথা রহি মোরা মানবেরা
শুধু কি, মা, যাব খেলা করে ।
তাই কি ধাইছে গঙ্গা ছাড়ি হিমগিরি ,
অরণ্য বহিছে ফুল-ফল —
শত কোটি রবি তারা আমাদের ঘিরি
গণিতেছে প্রতি দণ্ড পল !
শুধু কি , মা , হাসিখেলা প্রতি দিন রাত
দিবসের প্রত্যেক প্রহর !
প্রভাতের পরে আসি নূতন প্রভাত
লিখিছে কি একই অক্ষর !
কানাকানি হাসাহাসি কোণেতে গুটায়ে ,
অলস নয়ননিমীলন ,
দণ্ড - দুই ধরণীর ধূলিতে লুটায়ে
ধূলি হয়ে ধূলিতে শয়ন !
নাই কি , মা , মানবের গভীর ভাবনা ,
হৃদয়ের সীমাহীন আশা !
জেগে নাই অন্তরেতে অনন্ত চেতনা ,
জীবনের অনন্ত পিপাসা !
হৃদয়েতে শুষ্ক কি , মা , উৎস করুণার ,
শুনি না কি দুখীর ক্রন্দন !
জগৎ শুধু কি , মা গো , তোমার আমার
ঘুমাবার কুসুম - আসন !
শুনো না কাহারা ওই করে কানাকানি
অতি তুচ্ছ ছোটো ছোটো কথা ।
পরের হৃদয় লয়ে করে টানাটানি ,
শকুনির মতো নির্মমতা।
শুনো না করিছে কারা কথা - কাটাকাটি
মাতিয়া জ্ঞানের অভিমানে ,
রসনায় রসনায় ঘোর লাঠালাঠি ,
আপনার বুদ্ধিরে বাখানে ।
তুমি এস দূরে এস , পবিত্র নিভৃতে ,
ক্ষুদ্র অভিমান যাও ভুলি ।
সযতনে ঝেড়ে ফেলো বসন হইতে
প্রতি নিমেষের যত ধূলি !
নিমেষের ক্ষুদ্র কথা ক্ষুদ্র রেণুজাল
আচ্ছন্ন করিছে মানবেরে ,
উদার অনন্ত তাই হতেছে আড়াল
তিল তিল ক্ষুদ্রতার ঘেরে ।
আছে মা , তোমার মুখে স্বর্গের কিরণ ,
হৃদয়েতে উষার আভাস ,
খুঁজিছে সরল পথ ব্যাকুল নয়ন —
চারি দিকে মর্ত্যের প্রবাস ।
আপনার ছায়া ফেলি আমরা সকলে
পথ তোর অন্ধকারে ঢাকি —
ক্ষুদ্র কথা , ক্ষুদ্র কাজে , ক্ষুদ্র শত ছলে ,
কেন তোরে ভুলাইয়া রাখি ।
কেন , মা , তোমারে কেহ চাহে না জানাতে
মানবের উচ্চ কুলশীল —
অনন্তজগৎ - ব্যাপী ঈশ্বরের সাথে
তোমার যে সুগভীর মিল ।
কেন কেহ দেখায় না — চারি দিকে তব
ঈশ্বরের বাহুর বিস্তার !
ঘেরি তোরে , ভোগসুখ ঢালি নব নব
গৃহ বলি রচে কারাগার ।
অনন্তের মাঝখানে দাঁড়াও , মা আসি ,
চেয়ে দেখো আকাশের পানে —
পড়ুক বিমলবিভা পূর্ণ রূপরাশি
স্বর্গমুখী কমলনয়ানে ।
আনন্দে ফুটিয়া ওঠো শুভ্র সূর্যোদয়ে
প্রভাতের কুসুমের মতো ,
দাঁড়াও সায়াহ্নমাঝে পবিত্র হৃদয়ে
মাথাখানি করিয়া আনত ।
শোনো শোনো উঠিতেছে সুগম্ভীর বাণী ,
ধ্বনিতেছে আকাশ পাতাল !
বিশ্ব - চরাচর গাহে কাহারে বাখানি
আদিহীন অন্তহীন কাল !
যাত্রী সবে ছুটিয়াছে শূন্যপথ দিয়া ,
উঠেছে সংগীতকোলাহল ,
ওই নিখিলের সাথে কণ্ঠ মিলাইয়া
মা , আমরা যাত্রা করি চল্ ।
যাত্রা করি বৃথা যত অহংকার হতে ,
যাত্রা করি ছাড়ি হিংসাদ্বেষ ,
যাত্রা করি স্বর্গময়ী করুণার পথে ,
শিরে ধরি সত্যের আদেশ ।
যাত্রা করি মানবের হৃদয়ের মাঝে
প্রাণে লয়ে প্রেমের আলোক ,
আয় , মা গো , যাত্রা করি জগতের কাজে
তুচ্ছ করি নিজ দুঃখশোক ।
জেনো , মা , এ সুখে - দুঃখে - আকুল সংসারে
মেটে না সকল তুচ্ছ আশ —
তা বলিয়া অভিমানে অনন্ত তাঁহারে
কোরো না , কোরো না অবিশ্বাস ।
সুখ ব ' লে যাহা চাই সুখ তাহা নয় ,
কী যে চাই জানি না আপনি —
আঁধারে জ্বলিছে ওই ওরে কোরো ভয় ,
ভুজঙ্গের মাথার ও মণি ।
ক্ষুদ্র সুখ ভেঙে যায় না সহে নিশ্বাস ,
ভাঙে বালুকার খেলাঘর —
ভেঙে গিয়ে বলে দেয় এ নহে আবাস ,
জীবনের এ নহে নির্ভর ।
সকলে শিশুর মতো কত আবদার
আনিছে তাঁহার সন্নিধান —
পূর্ণ যদি নাহি হল , অমনি তাহার
ঈশ্বরে করিছে অপমান !
কিছুই চাব না , মা গো , আপনার তরে ,
পেয়েছে যা শুধিব সে ঋণ —
পেয়েছি যে প্রেমসুধা হৃদয় - ভিতরে ,
ঢালিয়া তা দিব নিশিদিন ।
সুখ শুধু পাওয়া যায় সুখ না চাহিলে ,
প্রেম দিলে প্রেমে পুরে প্রাণ ,
নিশিদিশি আপনার ক্রন্দন গাহিলে
ক্রন্দনের নাহি অবসান ।
মধুপাত্রে হতপ্রাণ পিপীলির মতো
ভোগসুখে জীর্ণ হয়ে থাকা ,
ঝুলে থাকা বাদুড়ের মতো শির নত
আঁকড়িয়া সংসারের শাখা ,
জগতের হিসাবেতে শূন্য হয়ে হায়
আপনারে আপনি ভক্ষণ ,
ফুলে উঠে ফেটে যাওয়া জলবিম্ব প্রায় —
এই কি রে সুখের লক্ষণ ।
এই অহিফেনসুখ কে চায় ইহাকে !
মানবত্ব এ নয় এ নয় ।
রাহুর মতন সুখ গ্রাস করে রাখে
মানবের মানবহৃদয় ।
মানবেরে বল দেয় সহস্র বিপদ ,
প্রাণ দেয় সহস্র ভাবনা ,
দারিদ্র্যে খুঁজিয়া পাই মনের সম্পদ ,
শোকে পাই অনন্ত সান্ত্বনা ।
চিরদিবসের সুখ রয়েছে গোপন
আপনার আত্মার মাঝার ।
চারি দিকে সুখ খুঁজে শ্রান্ত প্রাণমন —
হেথা আছে , কোথা নেই আর ।
বাহিরের সুখ সে , সুখের মরীচিকা —
বাহিরেতে নিয়ে যায় ছ ' লে ,
যখন মিলায়ে যায় মায়াকুহেলিকা
কেন কাঁদি সুখ নেই ব ' লে ।
দাঁড়াও সে অন্তরের শান্তিনিকেতনে
চিরজ্যোতি চিরছায়াময় —
ঝড়হীন রৌদ্রহীন নিভৃত সদনে
জীবনের অনন্ত আলয় ।
পুণ্যজ্যোতি মুখে লয়ে পুণ্য হাসিখানি ,
অন্নপূর্ণা জননী - সমান ,
মহাসুখে সুখ দুঃখ কিছু নাহি মানি
কর সবে সুখশান্তি দান ।
মা , আমার এই জেনো হৃদয়ের সাধ
তুমি হও লক্ষ্মীর প্রতিমা —
মানবেরে জ্যোতি দাও , করো আশীর্বাদ ,
অকলঙ্ক মূর্তি মধুরিমা ।
কাছে থেকে এত কথা বলা নাহি হয় ,
হেসে খেলে দিন যায় কেটে ,
দূরে ভয় হয় পাছে না পাই সময় ,
বলিবার সাধ নাহি মেটে ।
কত কথা বলিবারে চাহি প্রাণপণে,
কিছুতে, মা, বলিতে না পারি —
স্নেহমুখখানি তোর পড়ে মোর মনে ,
নয়নে উথলে অশ্রুবারি ।
সুন্দর মুখেতে তোর মগ্ন আছে ঘুমে
একখানি পবিত্র জীবন;
ফলুক সুন্দর ফল সুন্দর কুসুমে
আশীর্বাদ করো , মা , গ্রহণ । ২
শ্রীমতী ইন্দিরা। প্রাণাধিকাসু । নাসিক
চারি দিকে তর্ক উঠে সাঙ্গ নাহি হয় ,
কথায় কথায় বাড়ে কথা ।
সংশয়ের উপরেতে চাপিছে সংশয় ,
কেবলি বাড়িছে ব্যাকুলতা ।
ফেনার উপরে ফেনা , ঢেউ -' পরে ঢেউ ,
গরজনে বধির শ্রবণ —
তীর কোন্ দিকে আছে নাহি জানে কেউ ,
হা হা করে আকুল পবন ।
এই কল্লোলের মাঝে নিয়ে এস কেহ
পরিপূর্ণ একটি জীবন ,
নীরবে মিটিয়া যাবে সকল সন্দেহ ,
থেমে যাবে সহস্র বচন ।
তোমার চরণে আসি মাগিবে মরণ
লক্ষ্যহারা শত শত মত ,
যে দিকে ফিরাবে তুমি দুখানি নয়ন
সে দিকে হেরিবে সবে পথ ।
অন্ধকার নাহি যায় বিবাদ করিলে ,
মানে না বাহুর আক্রমণ ।
একটি আলোকশিখা সমুখে ধরিলে
নীরবে করে সে পলায়ন ।
এস মা , উষার আলো , অকলঙ্ক প্রাণ ,
দাঁড়াও এ সংসার - আঁধারে ।
জাগাও জাগ্রত হৃদে আনন্দের গান ,
কূল দাও নিদ্রার পাথারে ।
চারি দিকে নৃশংসতা করে হানাহানি ,
মানবের পাষাণ পরান ।
শাণিত ছুরির মতো বিঁধাইয়া বাণী ,
হৃদয়ের রক্ত করে পান ।
তৃষিত কাতর প্রাণী মাগিতেছে জল ,
উল্কাধারা করিছে বর্ষণ —
শ্যামল আশার ক্ষেত্র করিয়া বিফল
স্বার্থ দিয়ে করিছে কর্ষণ ।
শুধু এসে একবার দাঁড়াও কাতরে
মেলি দুটি সকরুণ চোখ ,
পড়ুক দু - ফোঁটা অশ্রু জগতের'পরে
যেন দুটি বাল্মীকীর শ্লোক ।
ব্যথিত করুক স্নান তোমার নয়নে ,
করুণার অমৃতনির্ঝরে ,
তোমারে কাতর হেরি মানবের মনে
দয়া হবে মানবের'পরে ।
সমুদয় মানবের সৌন্দর্যে ডুবিয়া
হও তুমি অক্ষয় সুন্দর ।
ক্ষুদ্র রূপ কোথা যায় বাতাসে উবিয়া
দুই - চারি পলকের পর ।
তোমার সৌন্দর্যে হোক মানব সুন্দর ;
প্রেমে তব বিশ্ব হোক আলো ।
তোমারে হেরিয়া যেন মুগুধ - অন্তর
মানুষে মানুষ বাসে ভালো । ৩
শ্রীমতী ইন্দিরা । প্রাণাধিকাসু । নাসিক ।
আমার এ গান , মা গো , শুধু কি নিমেষে
মিলাইবে হৃদয়ের কাছাকাছি এসে ?
আমার প্রাণের কথা
নিদ্রাহীন আকুলতা
শুধু নিশ্বাসের মতো যাবে কি , মা , ভেসে !
এ গান তোমারে সদা ঘিরে যেন রাখে ,
সত্যের পথের'পরে নাম ধরে ডাকে ।
সংসারের সুখে দুখে
চেয়ে থাকে তোর মুখে ,
চির - আশীর্বাদ - সম কাছে কাছে থাকে ।
বিজনে সঙ্গীর মতো করে যেন বাস ,
অনুক্ষণ শোনে তোর হৃদয়ের আশ ।
পড়িয়া সংসারঘোরে
কাঁদিয়া হেরিলে তোরে
ভাগ করে নেয় যেন দুখের নিশ্বাস ।
সংসারের প্রলোভন যবে আসি হানে
মধুমাখা বিষবাণী দুর্বল পরানে ,
এ গান আপন সুরে
মন তোর রাখে পুরে ,
ইষ্টমন্ত্রসম সদা বাজে তোর কানে ।
আমার এ গান যেন সুদীর্ঘ জীবন
তোমার বসন হয় , তোমার ভূষণ ।
পৃথিবীর ধূলিজাল
করে দেয় অন্তরাল ,
তোমারে করিয়া রাখে সুন্দর শোভন ।
আমার এ গান যেন নাহি মানে মানা ,
উদার বাতাস হয়ে এলাইয়া ডানা
সৌরভের মতো তোরে
নিয়ে যায় চুরি করে —
খুঁজিয়া দেখাতে যায় স্বর্গের সীমানা ।
এ গান যেন রে হয় তোর ধ্রুবতারা ,
অন্ধকারে অনিমিষে নিশি করে সারা ।
তোমার মুখের'পরে
জেগে থাকে স্নেহভরে
অকূলে নয়ন মেলি দেখায় কিনারা ।
আমার এ গান যেন পশি তোর কানে
মিলায়ে মিশায়ে যায় সমস্ত পরানে ।
তপ্ত শোণিতের মতো
বহে শিরে অবিরত ,
আনন্দে নাচিয়া উঠে মহত্ত্বের গানে ।
এ গান বাঁচিয়া থাকে যেন তোর মাঝে ,
আঁখিতারা হয়ে তোর আঁখিতে বিরাজে ।
এ যেন রে করে দান
সতত নূতন প্রাণ ,
এ যেন জীবন পায় জীবনের কাজে ।
যদি যাই , মৃত্যু যদি নিয়ে যায় ডাকি ,
এই গানে রেখে যাব মোর স্নেহ - আঁখি ।
যবে হায় সব গান
হয়ে যাবে অবসান
এ গানের মাঝে আমি যেন বেঁচে থাকি । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
এক যদি আর হয় কী ঘটিবে তবে?
এখনো যা হয়ে থাকে, তখনো তা হবে।
তখন সকল দুঃখ ঘোচে যদি ভাই,
এখন যা সুখ আছে দুঃখ হবে তাই। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ভগবান , তুমি যুগে যুগে দূত , পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে ,
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে ‘, বলে গেল ‘ভালোবাসো —
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো ‘ ।
বরণীয় তারা , স্মরণীয় তারা , তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে ।আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে
হেনেছে নিঃসহায়ে ,
আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে ।
আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে । কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে , বাঁশি সংগীতহারা ,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে ,
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে —
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু , নিভাইছে তব আলো ,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ , তুমি কি বেসেছ ভালো ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বয়স আমার বুঝি হয়তো তখন হবে বারো,
অথবা কী জানি হবে দুয়েক বছর বেশি আরো।
পুরাতন নীলকুঠি-দোতলার 'পর
ছিল মোর ঘর।
সামনে উধাও ছাত--
দিন আর রাত
আলো আর অন্ধকারে
সাথিহীন বালকের ভাবনারে
এলোমেলো জাগাইয়া যেত,
অর্থশূন্য প্রাণ তারা পেত,
যেমন সমুখে নীচে
আলো পেয়ে বাড়িয়া উঠিছে
বেতগাছ ঝোপঝাড়ে
পুকুরের পাড়ে
সবুজের আলপনায় রঙ দিয়ে লেপে।
সারি সারি ঝাউগাছ ঝরঝর কেঁপে
নীলচাষ-আমলের প্রাচীন মর্মর
তখনো চলিছে বহি বৎসর বৎসর।
বৃদ্ধ সে গাছের মতো তেমনি আদিম পুরাতন
বয়স-অতীত সেই বালকের মন
নিখিল প্রাণের পেত নাড়া,
আকাশের অনিমেষ দৃষ্টির ডাকে দিত সাড়া,
তাকায়ে রহিত দূরে।
রাখালের বাঁশির করুণ সুরে
অস্তিত্বের যে বেদনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে,
নাড়ীতে উঠিত নেচে।
জাগ্রত ছিল না বুদ্ধি, বুদ্ধির বাহিরের যাহা তাই
মনের দেউড়ি-পারে দ্বারী-কাছে বাধা পায় নাই।
স্বপ্নজনতার বিশ্বে ছিল দ্রষ্টা কিংবা স্রষ্টা রূপে,
পণ্যহীন দিনগুলি ভাসাইয়া দিত চুপে চুপে
পাতার ভেলায়।
নিরর্থ খেলায়।
টাট্টু ঘোড়া চড়ি
রথতলা মাঠে গিয়ে দুর্দাম ছুটাত তড়বড়ি,
রক্তে তার মাতিয়ে তুলিতে গতি,
নিজেরে ভাবিত সেনাপতি
পড়ার কেতাবে যারে দেখে
ছবি মনে নিয়েছিল এঁকে।
যুদ্ধহীন রণক্ষেত্রে ইতিহাসহীন সেই মাঠে
এমনি সকাল তার কাটে।
জবা নিয়ে গাঁদা নিয়ে নিঙাড়িয়া রস
মিশ্রিত ফুলের রঙে কী লিখিত, সে লেখার যশ
আপন মর্মের মাঝে হয়েছে রঙিন--
বাহিরের করতালিহীন।
সন্ধ্যাবেলা বিশ্বনাথ শিকারীকে ডেকে
তার কাছ থেকে
বাঘশিকারের গল্প নিস্তদ্ধ সে ছাতের উপর,
মনে হ'ত, সংসারের সব চেয়ে আশ্চর্য খবর।
দম্ ক'রে মনে মনে ছুটিত বন্দুক,
কাঁপিয়া উঠিত বুক।
চারি দিকে শাখায়িত সুনিবিড় প্রায়োজন যত
তারি মাঝে এ বালক অর্কিড-তরুকার মতো
ডোরাকাটা খেয়ালের অদ্ভুত বিকাশে
দোলে শুধু খেলার বাতাসে।
যেন সে রচয়িতার হাতে
পুঁথির প্রথম শূন্য পাতে
অলংকরণ আঁকা,মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কী লেখা,
বাকি সব আঁকাবাঁকা রেখা।
আজ যবে চলিতেছে সাংঘাতিক হিসাবনিকাশ,
দিগ্দিগন্তে ক্ষমাহীন অদৃষ্টের দশনবিকাশ,
বিধাতার ছেলেমানুষির
খেলাঘর যত ছিল ভেঙে সব হল চৌচির।
আজ মনে পড়ে সেই দিন আর রাত,
প্রশস্ত সে ছাত,
সেই আলো সেই অন্ধকারে
কর্মসমুদ্রের মাঝে নৈষ্কর্ম্যদ্বীপের পারে
বালকের মনখানা মধ্যাহ্নে ঘুঘুর ডাক যেন।
এ সংসারে কী হতেছে কেন
ভাগ্যের চক্রান্তে কোথা কী যে,
প্রশ্নহীন বিশ্বে তার জিজ্ঞাসা করে নি কভু নিজে।
এ নিখিলে যে জগৎ ছেলেমানুষির
বয়স্কের দৃষ্টিকোণে সেটা ছিল কৌতুকহাসির,
বালকের জানা ছিল না তা।
সেইখানে অবাধ আসন তার পাতা।
সেথা তার দেবলোক,স্বকল্পিত স্বর্গের কিনারা,
বুদ্ধির ভর্ৎসনা নাই,নাই সেথা প্রশ্নের পাহারা,
যুক্তির সংকেত নাই পথে,
ইচ্ছা সঞ্চরণ করে বল্গামুক্ত রথে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
পাষাণে পাষাণে তব
শিখরে শিখরে
লিখেছ, হে গিরিরাজ,
অজানা অক্ষরে
কত যুগযুগাস্তের
প্রভাতে সন্ধ্যায়
ধরিত্রীর ইতিবৃত্ত
অনন্ত-অধ্যায়।
মহান সে গ্রন্থপত্র,
তারি এক দিকে
কেবল একটি ছত্রে
রাখিবে কি লিখে—তব শৃঙ্গশিলাতলে
দুদিনের খেলা,
অামাদের কজনের
আনন্দের মেলা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
এ শুধু অলস মায়া , এ শুধু মেঘের খেলা ,
এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন —
এ শুধু আপন মনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা
নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন ।
শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারাবেলা
আপনার ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি ,
এও সেই ছায়া – খেলা বসন্তের সমীরণে ।
কুহকের দেশে যেন সাধ করে পথ ভুলি
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারাদিন আনমনে ।
কারে যেন দেব ব’লে কোথা যেন ফুল তুলি ,
সন্ধ্যায় মলিন ফুল উড়ে যায় বনে বনে ।
এ খেলা খেলিবে হায় খেলার সাথি কে আছে ?
ভুলে ভুলে গান গাই — কে শোনে , কে নাই শোনে —
যদি কিছু মনে পড়ে , যদি কেহ আসে কাছে ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য সুহৃদ্বরেষুআমরা কি সত্যই চাই শোকের অবসান?
আমাদের গর্ব আছে নিজের শোককে নিয়েও।
আমাদের অতি তীব্র বেদনাও
বহন করে না স্থায়ী সত্যকে--
সান্ত্বনা নেই এমন কথায়;
এতে আঘাত লাগে আমাদের দুঃখের অহংকারে।
জীবনটা আপন সকল সঞ্চয়
ছড়িয়ে রাখে কালের চলাচলের পথে;
তার অবিরাম-ধাবিত চাকার তলায়
গুরুতর বেদনার চিহ্নও যায়
জীর্ণ হয়ে, অস্পষ্ট হয়ে।
আমাদের প্রিয়তমের মৃত্যু
একটিমাত্র দাবি করে আমাদের কাছে
সে বলে--"মনে রেখো।"
কিন্তু সংখ্যা নেই প্রাণের দাবির,
তার আহ্বান আসে চারিদিক থেকেই
মনের কাছে;
সেই উপস্থিত কালের ভিড়ের মধ্যে
অতীতকালের একটিমাত্র আবেদন
কখন হয় অগোচর।
যদি বা তার কথাটা থাকে
তার ব্যথাটা যায় চলে।
তবু শোকের অভিমান
জীবনকে চায় বঞ্চিত করতে।
স্পর্ধা ক'রে প্রাণের দূতগুলিকে বলে--
খুলব না দ্বার।
প্রাণের ফসলখেত বিচিত্র শস্যে উর্বর,
অভিমানী শোক তারি মাঝখানে
ঘিরে রাখতে চায় শোকের দেবত্র জমি,--
সাধের মরুভূমি বানায় সেখানটাতে,
তার খাজনা দেয় না জীবনকে।
মৃত্যুর সঞ্চয়গুলি নিয়ে
কালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ।
সেই অভিযোগে তার হার হতে থাকে দিনে দিনে।
কিন্তু চায় না সে হার মানতে;
মনকে সমাধি দিতে চায়
তার নিজকৃত কবরে।
সকল অহংকারই বন্ধন,
কঠিন বন্ধন আপন শোকের অহংকার।
ধন জন মান সকল আসক্তিতেই মোহ,
নিবিড় মোহ আপন শোকের আসক্তিতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
দাড়ীশ্বরকে মানত ক’রে
গোঁপ-গাঁ গেল হাবল–
স্বপ্নে শেয়ালকাঁটা-পাখি
গালে মারল খাবল।দেখতে দেখতে ছাড়ায় দাড়ি
ভদ্র সীমার মাত্রা–
নাপিত খুঁজতে করল হাবল
রাওলপিণ্ডি যাত্রা।
উর্দু ভাষায় হাজাম এসে
বক্ল আবল-তাবল।তিরিশটা খুর একে একে
ভাঙল যখন পটাৎ
কামারটুলি থেকে নাপিত
আনল তখন হঠাৎ
যা হাতে পায় খাঁড়া বঁটি
কোদাল করাত সাবল। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
যথার্থ আপনকুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান,
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে 'ভাই ভাই'।
নভশ্চর ব'লে তাঁর মনের বিশ্বাস,
শূন্য-পানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে, 'শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতাডোরে;
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।'
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি---
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।হাতে-কলমেবোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরই তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই॥গৃহভেদআম্র কহে, একদিন, হে মাকাল ভাই,
আছিনু বনের মাঝে সমান সবাই;
মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি---
মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি॥গরজের আত্মীয়তাকহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,
আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে?
থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে
আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে॥কুটুম্বিতাকেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই ব'লে ডাকো যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা;
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা॥উদারচরিতানাম্প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।
ধিক্-ধিক্ করে তারে কাননে সবাই;
সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছি ভাই?।অসম্ভব ভালোযথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,
কোন্ স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো?
আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়
অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়॥প্রত্যক্ষ প্রমাণবজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ
আমর গর্জনে বলে মেঘের গর্জন,
বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,
মাথায় পড়িলে তবে বলে--- 'বজ্র বটে!'ভক্তিভাজনরথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম---
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব'--- হাসে অন্তর্যামী॥ উপকারদম্ভশৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির॥সন্দেহের কারণ'কত বড়ো আমি' কহে নকল হীরাটি।
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি॥অকৃতজ্ঞধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে,
ধ্বনি-কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে॥নিজের ও সাধারণেরচন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,
কলঙ্ক যা আছে তাহা আছে মোর গায়ে॥মাঝারির সতর্কতাউত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে॥নতিস্বীকারতপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয়,
তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়,
অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে
প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে॥কর্তব্যগ্রহণকে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি---
শুনিয়া জগত্ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি॥ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তিরাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা॥মোহনদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ও পার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে---
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ও পারে॥ফুল ও ফলফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল,
কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্!
ফল কহে মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি---
তোমারই অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি॥প্রশ্নের অতীতহে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা?
সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা।
কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর?
হিমাদ্রি কহিল, মোর চিরনিরুত্তর॥মোহের আশঙ্কাশিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা---
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা;
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো॥চালকঅদৃষ্টেরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলেম থামি,
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কে নিল খোকার ঘুম হরিয়া।
মা তখন জল নিতে ও পাড়ার দিঘিটিতে
গিয়াছিল ঘট কাঁখে করিয়া।—
তখন রোদের বেলা সবাই ছেড়েছে খেলা,
ও পারে নীরব চখা-চখীরা;
শালিক থেমেছে ঝোপে, শুধু পায়রার খোপে
বকাবকি করে সখা-সখীরা;
তখন রাখাল ছেলে পাঁচনি ধুলায় ফেলে
ঘুমিয়ে পড়েছে বটতলাতে;
বাঁশ-বাগানের ছায়ে এক-মনে এক পায়ে
খাড়া হয়ে আছে বক জলাতে।
সেই ফাঁকে ঘুমচোর ঘরেতে পশিয়া মোর
ঘুম নিয়ে উড়ে গেল গগনে,
মা এসে অবাক রয়, দেখে খোকা ঘর-ময়
হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে সঘনে।
আমার খোকার ঘুম নিল কে।
যেথা পাই সেই চোরে বাঁধিয়া আনিব ধরে,
সে লোক লুকাবে কোথা ত্রিলোকে।
যাব সে গুহার ছায়ে কালো পাথরের গায়ে
কুলু কুলু বহে যেথা ঝরনা।
যাব সে বকুলবনে নিরিবিলি সে বিজনে
ঘুঘুরা করিছে ঘর-করনা।
যেখানে সে-বুড়া বট নামায়ে দিয়েছে জট,
ঝিল্লি ডাকিছে দিনে দুপুরে,
যেখানে বনের কাছে বনদেবতারা নাচে
চাঁদিনিতে রুনুঝুনু নূপুরে,
যাব আমি ভরা সাঁঝে সেই বেণুবন - মাঝে
আলো যেথা রোজ জ্বালে জোনাকি—
শুধাব মিনতি করে, ‘আমাদের ঘুমচোরে
তোমাদের আছে জানাশোনা কি। '
কে নিল খোকার ঘুম চুরায়ে।
কোনোমতে দেখা তার পাই যদি একবার
লই তবে সাধ মোর পুরায়ে।
দেখি তার বাসা খুঁজি কোথা ঘুম করে পুঁজি,
চোরা ধন রাখে কোন্ আড়ালে।
সব লুঠি লব তার, ভাবিতে হবে না আর
খোকার চোখের ঘুম হারালে
ডানা দুটি বেঁধে তারে নিয়ে যাব নদীপারে
সেখানে সে বসে এক কোণেতে
জলে শরকাঠি ফেলে মিছে মাছ-ধরা খেলে
দিন কাটাইবে কাশবনেতে।
যখন সাঁঝের বেলা ভাঙিবে হাটের মেলা
ছেলেরা মায়ের কোল ভরিবে,
সারা রাত টিটি-পাখি টিটকারি দিবে ডাকি—
‘ঘুমচোরা কার ঘুম হরিবে। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
সীমার মাঝে, অসীম, তুমি
বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাই এত মধুর।
কত বর্ণে কত গন্ধে,
কত গানে কত ছন্দে,
অরূপ তোমার রূপের লীলায়
জাগে হৃদয়পুর।
আমার মধ্যে তোমার শোভা
এমন সুমধুর। তোমায় আমায় মিলন হলে
সকলি যায় খুলে–
বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে
উঠে তখন দুলে।
তোমার আলোয় নাই তো ছায়া,
আমার মাঝে পায় সে কায়া,
হয় সে আমার অশ্রুজলে
সুন্দর বিধুর।
আমার মধ্যে তোমার শোভা
এমন সুমধুর।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে আসনের কাছে
যতক্ষণে সঙ্গ তার না করি স্বীকার
করস্পর্শ দিয়ে।
এটুকু স্বীকৃতি লাভ করি
সর্বাঙ্গে তরঙ্গি উঠে আনন্দপ্রবাহ।
বাক্যহীন প্রাণীলোক-মাঝে
এই জীব শুধু
ভালো মন্দ সব ভেদ করি
দেখেছে সম্পূর্ণ মানুষেরে;
দেখেছে আনন্দে যারে প্রাণ দেওয়া যায়
যারে ঢেলে দেওয়া যায় অহেতুক প্রেম,
অসীম চৈতন্যলোকে
পথ দেখাইয়া দেয় যাহার চেতনা।
দেখি যবে মূক হৃদয়ের
প্রাণপণ আত্মনিবেদন
আপনার দীনতা জানায়ে,
ভাবিয়া না পাই ও যে কী মূল্য করেছে আবিষ্কার
আপন সহজ বোধে মানবস্বরূপে;
ভাষাহীন দৃষ্টির করুণ ব্যাকুলতা
বোঝে যাহা বোঝাতে পারে না,
আমারে বুঝায়ে দেয়– সৃষ্টি-মাঝে মানবের সত্য পরিচয়। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
জন্মকালেই ওর লিখে দিল কুষ্ঠি,
ভালো মানুষের ‘পরে চালাবে ও মুষ্টি।
যতই প্রমাণ পায় বাবা বলে, “মোদ্দা,
কভু জন্মেনি ঘরে এত বড়ো যোদ্ধা।’
“বেঁচে থাকলেই বাঁচি’ বলে ঘোষগুষ্টি,–
এত গাল খায় তবু এত পরিপুষ্টি। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দ্বার খোলা ছিল মনে, অসর্তকে সেথা অকস্মাৎ
লেগেছিল কী লাগিয়া কোথা হতে দুঃখের আঘাত;
সে লজ্জায় খুলে গেল মর্মতলে প্রচ্ছন্ন যে বল
জীবনের নিহিত সম্বল।
ঊর্ধ্ব হতে জয়ধ্বনি
অন্তরে দিগন্তপথে নামিল তখনি,
আনন্দের বিচ্ছুরিত আলো
মুহূর্তে আঁধার-মেঘ দীর্ণ করি হৃদয়ে ছড়ালো।
ক্ষুদ্র কোটরের অসম্মান
লুপ্ত হল, নিখিলের আসনে দেখিনু নিজ স্থান,
আনন্দে আনন্দময়
চিত্ত মোর করি নিল জয়,
উৎসবের পথ
চিনে নিল মুক্তিক্ষেত্রে সগৌরবে আপন জগৎ।
দুঃখ-হানা গ্লানি যত আছে,
ছায়া সে, মিলালো তার কাছে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্ররোষে
দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে
ধূলায় সে যায় বয়ে -
সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার,
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।
তবু নত করি আঁখি
দেখিবার পাও না কি
নেমেছে ধূলার তলে হীনপতিতের ভগবান।
অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে -
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
সবারে না যদি ডাকো,
এখনো সরিয়া থাকো,
আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান -
মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
নব বৎসরে করিলাম পণ–
লব স্বদেশের দীক্ষা,
তব আশ্রমে তোমার চরণে
হে ভারত, লব শিক্ষা।
পরের ভূষণ পরের বসন
তেয়াগিব আজ পরের অশন;
যদি হই দীন, না হইব হীন,
ছাড়িব পরের ভিক্ষা।
নব বৎসরে করিলাম পণ–
লব স্বদেশের দীক্ষা।না থাকে প্রাসাদ, আছে তো কুটির
কল্যাণে সুপবিত্র।
না থাকে নগর, আছে তব বন
ফলে ফুলে সুবিচিত্র।
তোমা হতে যত দূরে গেছি সরে
তোমারে দেখেছি তত ছোটো করে;
কাছে দেখি আজ হে হৃদয়রাজ,
তুমি পুরাতন মিত্র।
হে তাপস, তব পর্ণকুটির
কল্যাণে সুপবিত্র।পরের বাক্যে তব পর হয়ে
দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা।
তোমারে ভুলিতে ফিরায়েছি মুখ,
পরেছি পরের সজ্জা।
কিছু নাহি গণি কিছু নাহি কহি
জপিছ মন্ত্র অন্তরে রহি–
তব সনাতন ধ্যানের আসন
মোদের অস্থিমজ্জা।
পরের বুলিতে তোমারে ভুলিতে
দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা।সে-সকল লাজ তেয়াগিব আজ,
লইব তোমার দীক্ষা।
তব পদতলে বসিয়া বিরলে
শিখিব তোমার শিক্ষা।
তোমার ধর্ম, তোমার কর্ম,
তব মন্ত্রের গভীর মর্ম
লইব তুলিয়া সকল ভুলিয়া
ছাড়িয়া পরের ভিক্ষা।
তব গৌরবে গরব মানিব,
লইব তোমার দীক্ষা। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
দেখ্ রে চেয়ে নামল বুঝি ঝড়,
ঘাটের পথে বাঁশের শাখা ঐ করে ধড়ফড়।
আকাশতলে বজ্রপাণির ডঙ্কা উঠল বাজি,
শীঘ্র তরী বেয়ে চল্ রে মাঝি।
ঢেউয়ের গায়ে ঢেউগুলো সব গড়ায় ফুলে ফুলে,
পুবের চরে কাশের মাথা উঠছে দুলে দুলে।
ঈশান কোণে উড়তি বালি আকাশখানা ছেয়ে
হু হু করে আসছে ছুটে ধেয়ে।
কাকগুলো তার আগে আগে উড়ছে প্রাণের ডরে,
হার মেনে শেষ আছাড় খেয়ে পড়ে মাটির 'পরে।
হাওয়ার বিষম ধাক্কা তাদের লাগছে ক্ষণে ক্ষণে
উঠছে পড়ছে, পাখার ঝাপট দিতেছে প্রাণপণে।
বিজুলি ধায় দাঁত মেলে তাঁর ডাকিনীটার মতো,
দিক্দিগন্ত চমকে ওঠে হঠাৎ মর্মাহত।
ওই রে মাঝি, খেপল গাঙের জল,
লগি দিয়ে ঠেকা নৌকো, চরের কোলে চল।
সেই যেখানে জলের শাখা, চখাচখির বাস,
হেথাহোথায় পলিমাটি দিয়েছে আশ্বাস
কাঁচা সবুজ নতুন ঘাসে ঘেরা।
তলের চরে বালুতে রোদ পোহায় কচ্ছপেরা।
হোথায় জলে বাঁশ টাঙিয়ে শুকোতে দেয় জাল,
ডিঙির ছাতে বসে বসে সেলাই করে পাল।
রাত কাটাব ওইখানেতেই করব রাঁধাবাড়া,
এখনি আজ নেই তো যাবার তাড়া।
ভোর থাকতেই কাক ডাকতেই নৌকো দেব ছাড়ি,
ইঁটেখোলার মেলায় দেব সকাল সকাল পাড়ি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আজ মনে হয় সকলেরই মাঝে
তোমারেই ভালোবেসেছি।
জনতা বাহিয়া চিরদিন ধরে
শুধু তুমি আমি এসেছি।
দেখি চারি দিক-পানে
কী যে জেগে ওঠে প্রাণে–
তোমার আমার অসীম মিলন
যেন গো সকল খানে।
কত যুগ এই আকাশে যাপিনু
সে কথা অনেক ভুলেছি।
তারায় তারায় যে আলো কাঁপিছে
সে আলোকে দোঁহে দুলেছি।তৃণরোমাঞ্চ ধরণীর পানে
আশ্বিনে নব আলোকে
চেয়ে দেখি যবে আপনার মনে
প্রাণ ভরি উঠে পুলকে।
মনে হয় যেন জানি
এই অকথিত বাণী,
মূক মেদিনীর মর্মের মাঝে
জাগিছে সে ভাবখানি।
এই প্রাণে-ভরা মাটির ভিতরে
কত যুগ মোরা যেপেছি,
কত শরতের সোনার আলোকে
কত তৃণে দোঁহে কেঁপেছি।প্রাচীন কালের পড়ি ইতিহাস
সুখের দুখের কাহিনী–
পরিচিতসম বেজে ওঠে সেই
অতীতের যত রাগিণী।
পুরাতন সেই গীতি
সে যেন আমার স্মৃতি,
কোন্ ভাণ্ডারে সঞ্চয় তার
গোপনে রয়েছে নিতি।
প্রাণে তাহা কত মুদিয়া রয়েছে
কত বা উঠিছে মেলিয়া–
পিতামহদের জীবনে আমরা
দুজনে এসেছি খেলিয়া।লক্ষ বরষ আগে যে প্রভাত
উঠেছিল এই ভুবনে
তাহার অরুণকিরণকণিকা
গাঁথ নি কি মোর জীবনে?
সে প্রভাতে কোন্খানে
জেগেছিনু কেবা জানে।
কী মুরতি-মাঝে ফুটালে আমারে
সেদিন লুকায়ে প্রাণে!
হে চির-পুরানো,চিরকাল মোরে
গড়িছ নূতন করিয়া।
চিরদিন তুমি সাথে ছিলে মোর,
রবে চিরদিন ধরিয়া। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
বড়োই সহজ
রবিরে ব্যঙ্গ করা,
অাপন আলোকে
আপনি দিয়েছে ধরা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি
বাহির মনে
চিরদিবস মোর জীবনে।
নিয়ে গেছে গান আমারে
ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে,
গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই
এই ভুবনে।কত শেখা সেই শেখালো,
কত গোপন পথ দেখালো,
চিনিয়ে দিল কত তারা
হৃদ্গগনে।
বিচিত্র সুখদুখের দেশে
রহস্যলোক ঘুরিয়ে শেষে
সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে এল
কোন্ ভবনে।৯ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কলকত্তামে চলা গয়ো রে সুরেনবাবু মেরা,
সুরেনবাবু, আসল বাবু, সকল বাবুকো সেরা।
খুড়া সাবকো কায়কো নহি পতিয়া ভেজো বাচ্ছা--
মহিনা-ভর্ কুছ খবর মিলে না ইয়ে তো নহি আচ্ছা!
টপাল্, টপাল্, কঁহা টপাল্রে, কপাল হমারা মন্দ,
সকাল বেলাতে নাহি মিলতা টপাল্কো নাম গন্ধ!
ঘরকো যাকে কায়কো বাবা, তুম্সে হম্সে ফর্খৎ।
দো-চার কলম লীখ্ দেওঙ্গে ইস্মে ক্যা হয় হর্কৎ!
প্রবাসকো এক সীমা পর হম্ বৈঠ্কে আছি একলা--
সুরিবাবাকো বাস্তে আঁখ্সে বহুৎ পানি নেক্লা।
সর্বদা মন কেমন কর্তা, কেঁদে উঠ্তা হির্দয়--
ভাত খাতা, ইস্কুল যাতা, সুরেনবাবু নির্দয়!
মন্কা দুঃখে হূহু কর্কে নিক্লে হিন্দুস্থানী--
অসম্পূর্ণ ঠেক্তা কানে বাঙ্গলাকো জবানী।
মেরা উপর জুলুম কর্তা তেরি বহিন বাই,
কী করেঙ্গা কোথায় যাঙ্গা ভেবে নাহি পাই!
বহুৎ জোরসে গাল টিপ্তা দোনো আঙ্গ্লি দেকে,
বিলাতী এক পৈনি বাজ্না বাজাতা থেকে থেকে,
কভী কভী নিকট আকে ঠোঁটমে চিম্টি কাটতা,
কাঁচিলে কর কোঁক্ড়া কোঁক্ড়া চুলগুলো সব ছাঁটতা,
জজসাহেব কুছ বোল্তা নহি রক্ষা করবে কেটা,
কঁহা গয়োরে কঁহা গয়োরে জজসাহেবকি বেটা!
গাড়ি চড়্কে লাঠিন পড়কে তুম্ তো যাতা ইস্কিল্
ঠোঁটে নাকে চিম্টি খাকে হমারা বহুৎ মুস্কিল!
এদিকে আবার party হোতা খেল্নেকোবি যাতা,
জিম্খানামে হিম্ঝিম্ এবং থোড়া বিস্কুট খাতা।
তুম ছাড়া কোই সম্জে না তো হম্রা দুরাবস্থা,
বহির তেরি বহুৎ merry খিল্খিল্ কর্কে হাস্তা!
চিঠি লিখিও মাকে দিও বহুৎ বহুৎ সেলাম,
আজকের মতো তবে বাবা বিদায় হোকে গেলাম।সুরেনবাবু = সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
টপাল্ = চিঠির ডাক ।
বহিন বাই = ইন্দিরা দেবী ।
জজসাহেব = অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর , সুরেন্দ্রনাথের পিতা ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হে কবীন্দ্র কালিদাস, কল্পকুঞ্জবনে
নিভৃতে বসিয়া আছ প্রেয়সীর সনে
যৌবনের যৌবরাজ্যসিংহাসন-’পরে।
মরকতপাদপীঠ-বহনের তরে
রয়েছে সমস্ত ধরা, সমস্ত গগন
স্বর্ণরাজছত্র ঊর্ধ্বে করেছে ধারণ
শুধু তোমাদের-’পরে; ছয় সেবাদাসী
ছয় ঋতু ফিরে ফিরে নৃত্য করে আসি;
নব নব পাত্র ভরি ঢালি দেয় তারা
নব নব বর্ণময়ী মদিরার ধারা
তোমাদের তৃষিত যৌবনে; ত্রিভুবন
একখানি অন্তঃপুর, বাসরভবন।
নাই দুঃখ, নাই দৈন্য, নাই জনপ্রাণী—
তুমি শুধু আছ রাজা, আছে তব রানী। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
নিষ্কাম পরহিতে কে ইহারে সামলায়–
স্বার্থেরে নিঃশেষে-মুছে-ফেলা মামলায়।
চলেছে উদারভাবে সম্বল-খোয়ানি–
গিনি যায়, টাকা যায়, সিকি যায় দোয়ানি,
হল সারা বাঁটোয়ারা উকিলে ও আমলায়।
গিয়েছে পরের লাগি অন্নের শেষ গুঁড়ো–
কিছু খুঁটে পাওয়া যায় ভূষি তুঁষ খুদকুঁড়ো
গোরুহীন গোয়ালের তলাহীন গামলায়। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বিচলিত কেন মাধবীশাখা,
মঞ্জরী কাঁপে থরথর।
কোন্ কথা তার পাতায় ঢাকা
চুপিচুপি করে মরমর। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
‘তোরে সবে নিন্দা করে গুণহীন ফুল’
শুনিয়া নীরবে হাসি কহিল শিমূল,
যতক্ষণ নিন্দা করে, আমি চুপে চুপে
ফুটে উঠি আপনার পরিপূর্ণ রূপে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
নিত্য তোমার পায়ের কাছে
তোমার বিশ্ব তোমার আছে
কোনোখানে অভাব কিছু নাই।
পূর্ণ তুমি, তাই
তোমার ধনে মানে তোমার আনন্দ না ঠেকে।
তাই তো একে একে
যা-কিছু ধন তোমার আছে আমার ক'রে লবে।
এমনি করেই হবে
এ ঐশ্বর্যে তব
তোমার আপন কাছে, প্রভু, নিত্য নব নব।
এমনি করেই দিনে দিনে
আমার চোখে লও যে কিনে
তোমার সূর্যোদয়।
এমনি করেই দিনে দিনে
আপন প্রেমের পরশমণি, আপনি যে লও চিনে
আমার পরান করি হিরন্ময়।
পদ্মা, ২৭ মাঘ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে,
হৃদয় মম থরোথরো কাঁপে তোমার গানে॥
আজিকে এই প্রভাতবেলা মেঘের সাথে রোদের খেলা,
জলে নয়ন ভরোভরো চাহি তোমার পানে॥
আলোর অধীর ঝিলিমিলি নদীর ঢেউয়ে ওঠে,
বনের হাসি খিলিখিলি পাতায় পাতায় ছোটে।
আকাশে ওই দেখি কী যে– তোমার চোখের চাহনি যে।
সুনীল সুধা ঝরোঝরো ঝরে আমার প্রাণে॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার মনের জানলাটি আজ হঠাৎ গেল খুলে
তোমার মনের দিকে।
সকালবেলার আলোয় আমি সকল কর্ম ভুলে
রইনু অনিমিখে।
দেখতে পেলেম তুমি মোরে
সদাই ডাক যে-নাম ধ'রে
সে-নামটি এই চৈত্রমাসের পাতায় পাতায় ফুলে
আপনি দিলে লিখে।
সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে
রইনু অনিমিখে।
আমার সুরের পর্দাটি আজ হঠাৎ গেল উড়ে
তোমার গানের পানে।
সকালবেলার আলো দেখি তোমার সুরে সুরে
ভরা আমার গানে।
মনে হল আমারি প্রাণ
তোমার বিশ্বে তুলেছে তান,
আপন গানের সুরগুলি সেই তোমার চরণমূলে
নেব আমি শিখে।
সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে
রইনু অনিমিখে।
সুরুল, ২১ চৈত্র, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্তোত্রমূলক
|
আজ আমার প্রণতি গ্রহন করো, পৃথিবী,
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।।
মহাবীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে,
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দু:সহ দ্বন্দ্বে।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চুর্ণ কর পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রূপে;
দু:সাধ্য কর বীরের জীবনকে মহত্ জীবনে যার অধিকার।
শ্রেয়কে কর দুরমূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।
তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছো প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম,
ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক।
জলে স্থলে তোমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি-
সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।
তোমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তোরণ
ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে।।
তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের ছিল দুর্জয়-
সে পুরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়।
তার অঙ্গুলি ছিল স্থুল, কলাকৌশলবর্জিত;
গদা-হাতে মুষল-হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত;
অগ্নিতে বাষ্পেতে দু:স্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশে।
জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি,
প্রাণের ‘পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা।।
দেবতা এলেন পরযুগে, মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের-
জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত;
জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে।
উষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়,
পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট।।
নম্র হল শিকলে-বাঁধা দানব,
তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস।
ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা-
তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে
হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে!
তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি।
দেবতার মন্ত্র উঠেছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে
দিনে রাত্রে উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে।
তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব
ক্ষণে ক্ষণে উঠেছে ফণা তুলে-
তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করেছ আঘাত,
ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে।।
শুভে-অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে
তোমার প্রচন্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে
আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্জিত জীবনের প্রণতি।
বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর, গুপ্তসঞ্চার তোমার যে মাটির তলায়
তাকে আজ স্পর্শ করি- উপলব্ধি করি সর্বদেহে মনে।
অগণিত যুগযুগান্তের অসংখ্য মানুষের লুপ্তদেহ পুঞ্জিত তার ধুলায়।
আমিও রেখে যাব কয়-মুষ্টি ধূলি, আমার সমস্ত সুখদু:খের শেষ পরিণাম-
রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল-পরিচয়-গ্রাসী
নি:শব্দ ধূলিরাশির মধ্যে।।
অচল অবরোধে আবদ্ধ পৃথিবী, মেঘলোকে উধাও পৃথিবী,
গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যাননিমগ্না পৃথিবী,
নীলাম্বুরাশির অতন্দ্র তরঙ্গে কলমন্দ্রমুখরা পৃথিবী,
অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তাতুমি ভীষণা।
একদিকে আপক্বধান্যভারনম্র তোমার শস্যত্রে-
সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু
কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে;
অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী
”আমি আনন্দিত”।
অন্যদিকে তোমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপান্ডুর মরুক্ষেত্র
পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনৃত্য।
বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুত্চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল
কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়-
সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ;
তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু করে
হতাশ বনস্পতি ধুলায় পড়ল উবুড় হয়ে;
হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল
শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো।
আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণে হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে
অকস্মাৎ কল্লোলোচ্ছ্বাসে।।
স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী তুমি নিত্যনবীনা,
অনাদি সৃষ্টির যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে
সংখ্যাগণনার-অতীত প্রত্যুষে;
তোমার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছে
শত শত ভাঙা ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ;
বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছে তোমার বর্জিত সৃষ্টি
অগণ্য বিস্মৃতির স্তরে স্তরে।।
জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ
তোমার খন্ডকালের ছোট ছোট পিঞ্জরে,
তারই মধ্যে সব খেলার সীমা, সব কীর্তির অবসান।।
আজ আমি কোন মোহ নিয়ে আসি নি তোমার সম্মুখে;
এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে
তার জন্য অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে।
তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে
যে বিপুল নিমেষগুলি উম্মীলিত নিমীলিতহতে থাকে
তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোন-একটি আসনের
সত্যমুল্য যদি দিয়ে থাকি,
জীবনের কোন-একটি ফলবান্ খন্ডকে
যদি জয় করে থাকি পরম দু:খে
তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে;
সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে
যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে।।
হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
এতদিন তারে বুঝিতে পারি নি,
দিন চলে গেছে কুঁজিতে।
শুভখনে কাছে ডাকিলে,
লজ্জা আমার ঢাকিলে,
তোমারে পেরেছি বুঝিতে।কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,
কে মোরে ডাকিবে কাচে,
কাহার প্রেমের বেদনার মাঝে
আমার মূল্য আছে,
এ নিরন্তর সংশয়ে আর
পারি না কেবলি যুঝিতে--
তোমারেই শুধু সত্য পেরেছি বুঝিতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আজকে আমি কতদূর যে
গিয়েছিলেম চলে !
যত তুমি ভাবতে পারো
তার চেয়ে সে অনেক আরো ,
শেষ করতে পারব না তা
তোমায় ব'লে ব'লে ।
অনেক দূর সে , আরো দূর সে ,
আরো অনেক দূর ।
মাঝখানেতে কত যে বেত ,
কত যে বাঁশ , কত যে খেত ,
ছাড়িয়ে ওদের ঠাকুরবাড়ি
ছাড়িয়ে তালিমপুর ।
পেরিয়ে গেলেম যেতে যেতে
সাত - কুশি সব গ্রাম ,
ধানের গোলা গুনব কত
জোদ্দারদের গোলার মতো ,
সেখানে যে মোড়ল কারা
জানি নে তার নাম ।
একে একে মাঠ পেরোলুম
কত মাঠের পরে ।
তার পরে , উঃ , বলি মা শোন্ ,
সামনে এল প্রকাণ্ড বন ,
ভিতরে তার ঢুকতে গেলে
গা ছ্ম্ছ্ম্ করে ।
জামতলাতে বুড়ি ছিল ,
বললে ' খবরদার '!
আমি বললেম বারণ শুনে
' ছ - পণ কড়ি এই নে গুনে ',
যতক্ষণ সে গুনতে থাকে
হয়ে গেলাম পার ।
কিছুরই শেষ নেই কোত্থাও
আকাশ পাতাল জুড়ি ।
যতই চলি যতই চলি
বেড়েই চলে বনের গলি ,
কালো মুখোশপরা আঁধার
সাজল জুজুবুড়ি ।
খেজুরগাছের মাথায় বসে
দেখছে কারা ঝুঁকি ।
কারা যে সব ঝোপের পাশে
একটুখানি মুচকে হাসে ,
বেঁটে বেঁটে মানুষগুলো
কেবল মারে উঁকি ।
আমায় যেন চোখ টিপছে
বুড়ো গাছের গুঁড়ি ।
লম্বা লম্বা কাদের পা যে
ঝুলছে ডালের মাঝে মাঝে ,
মনে হচ্ছে পিঠে আমার
কে দিল সুড়সুড়ি ।
ফিসফিসিয়ে কইছে কথা
দেখতে না পাই কে সে ।
অন্ধকারে দুদ্দাড়িয়ে
কে যে কারে যায় তাড়িয়ে ,
কী জানি কী গা চেটে যায়
হঠাৎ কাছ এসে । ফুরোয় না পথ ভাবছি আমি
ফিরব কেমন করে ।
সামনে দেখি কিসের ছায়া ,
ডেকে বলি , ' শেয়াল ভায়া ,
মায়ের গাঁয়ের পথ তোরা কেউ
দেখিয়ে দে - না মোরে । '
কয় না কিছুই , চুপটি করে
কেবল মাথা নাড়ে ।
সিঙ্গিমামা কোথা থেকে
হঠাৎ কখন এসে ডেকে
কে জানে মা , হালুম ক'রে
পড়ল যে কার ঘাড়ে ।
বল্ দেখি তুই , কেমন করে
ফিরে পেলেম মাকে ?
কেউ জানে না কেমন করে ;
কানে কানে বলব তোরে ?
যেমনি স্বপন ভেঙে গেল
সিঙ্গিমামার ডাকে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবা-পানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
নীচে সব-নীচে এ ধূলির ধরণীতে
যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে,
যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নাই কিছু,
যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে।
স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে।যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়,
যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়।
আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে
এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে,
সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম
ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে।
স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
কোমল দুখানি বাহু শরমে লতায়ে
বিকশিত স্তন দুটি আগুলিয়া রয়,
তারি মাঝখানে কি রে রয়েছে লুকায়ে
অতিশয়-সযতন-গোপন হৃদয়!
সেই নিরালায় সেই কোমল আসনে
দুইখানি স্নেহস্ফুট স্তনের ছায়ায়
কিশোর প্রেমের মৃদু প্রদোষকিরণে
আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায়!
কত-না মধুর আশা ফুটিছে সেথায় --
গভীর নিশীথে কত বিজন কল্পনা,
উদাশ নিশ্বাসবায়ু বসন্তসন্ধায়,
গোপনে চাঁদিনী রাতে দুটি অশ্রুকণা ।
তারি মাঝে আমারে কি রাখিবে যতনে,
হৃদয়ের সুমধুর স্বপনশয়নে ?।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
অধরা মাধুরী ধরা পড়িয়াছে
এ মোর ছন্দবন্ধনে।
বলাকাপাঁতির পিছিয়ে-পড়া ও পাখি,
বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে।
গত ফসলের পলাশের রাঙিমারে
ধরে রাখে ওর পাখা,
জরা শিরীষের পেলব আভাস
ওর কাকলিতে মাখা।
শুনে যাও বিদেশিনী,
তোমার ভাষায় ওরে
ডাকো দেখি নাম ধরে।ও জানে তোমারি দেশের আকাশ
তোমারি রাতের তারা,
তব যৌবন-উৎসবে ও যে
গানে গানে দেয় সাড়া,
ওর দুটি পাখা চঞ্চলি উঠে তব হৃৎকম্পনে।
ওর বাসাখানি তব কুঞ্জের
নিভৃত প্রাঙ্গনে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
যদি তোমার দেখা না পাই, প্রভু,
এবার এ জীবনে
তবে তোমায় আমি পাই নি যেন
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।
এ সংসারের হাটে
আমার যতই দিবস কাটে,
আমার যতই দু হাত ভরে ওঠে ধনে,
তবু কিছুই আমি পাই নি যেন
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।
যদি অলস ভরে
আমি পথের পরে
যদি ধুলায় শয়ন পাতি সযতনে,
যেন সকল পথই বাকি আছে
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।
যতই উঠে হাসি,
ঘরে যতই বাজে বাঁশি,
ওগো, যতই গৃহ সাজাই আয়োজনে,
যেন তোমায় ঘরে হয় নি আনা
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
লুকায়ে আছেন যিনি
জগতের মাঝে
আমি তাঁরে প্রকাশিব
সংসারের কাজে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আমি অতি পুরাতন,
এ খাতা হালের
হিসাব রাখিতে চাহে
নূতন কালের।
তবুও ভরসা পাই—
আছে কোনো গুণ,
ভিতরে নবীন থাকে
অমর ফাগুন।
পুরাতন চাঁপাগাছে
নূতনের আশা
নবীন কুসুমে আনে
অমৃতের ভাষা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এবার নীরব করে দাও হে তোমার
মুখর কবিরে।
তার হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে
বাজাও গভীরে।
নিশীথরাতের নিবিড় সুরে
বাঁশিতে তান দাও হে পুরে
যে তান দিয়ে অবাক কর’
গ্রহশশীরে।যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে
জীবন-মরণে,
গানের টানে মিলুক এসে
তোমার চরণে।
বহুদিনের বাক্যরাশি
এক নিমেষে যাবে ভাসি,
একলা বসে শুনব বাঁশি
অকূল তিমিরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
তখন আমার বয়স ছিল সাত।
ভোরের বেলায় দেখতেম জানলা দিয়ে
অন্ধকারের উপরকার ঢাকা খুলে আসছে,
বেরিয়ে আসছে কোমল আলো
নতুন-ফোটা কাঁটালিচাঁপার মতো।
বিছানা ছেড়ে চলে যেতেম বাগানে
কাক ডাকবার আগে,
পাছে বঞ্চিত হই
কম্পমান নারকেল শাখাগুলির মধ্যে
সূর্যোদয়ের মঙ্গলাচরণে।
তখন প্রতিদিনটি ছিল স্বতন্ত্র, ছিল নতুন।
যে প্রভাত পূর্বদিকের সোনার ঘাট থেকে
আলোতে স্নান করে আসত
রক্তচন্দনের তিলক এঁকে ললাটে,
সে আমার জীবনে আসত নতুন অতিথি,
হাসত আমার মুখে চেয়ে।--
আগেকার দিনের কোনো চিহ্ন ছিল না তার উত্তরীয়ে।
তারপরে বয়স হল
কাজের দায় চাপল মাথার 'পরে।
দিনের পরে দিন তখন হল ঠাসাঠাসি।
তারা হারাল আপনার স্বতন্ত্র মর্যাদা।
একদিনের চিন্তা আর-একদিনে হল প্রসারিত,
একদিনের কাজ আর-একদিনে পাতল আসন।
সেই একাকার-করা সময় বিস্তৃত হতে থাকে
নতুন হতে থাকে না।
একটানা বয়েস কেবলি বেড়ে ওঠে,
ক্ষণে ক্ষণে শমে এসে
চিরদিনের ধুয়োটির কাছে
ফিরে ফিরে পায় না আপনাকে।
আজ আমার প্রাচীনকে নতুন ক'রে নেবার দিন এসেছে।
ওঝাকে ডেকেছি, ভূতকে দেবে নামিয়ে।
গুণীর চিঠিখানির জন্যে
প্রতিদিন বসব এই বাগানটিতে,
তাঁর নতুন চিঠি
ঘুম-ভাঙার জানালাটার কাছে।
প্রভাত আসবে
আমার নতুন পরিচয় নিতে,
আকাশে অনিমেষ চক্ষু মেলে
আমাকে শুধাবে
"তুমি কে?"
আজকের দিনের নাম
খাটবে না কালকের দিনে।
সৈন্যদলকে দেখে সেনাপতি,
দেখে না সৈনিককে;--
দেখে আপন প্রয়োজন,
দেখে না সত্য,
দেখে না স্বতন্ত্র মানুষের
বিধাতাকৃত আশ্চর্যরূপ।
এতকাল তেমনি করে দেখেছি সৃষ্টিকে,
বন্দীদলের মতো
প্রয়োজনের এক শিকলে বাঁধা।
তার সঙ্গে বাঁধা পড়েছি
সেই বন্ধনে নিজে।
আজ নেব মুক্তি।
সামনে দেখছি সমুদ্র পেরিয়ে
নতুন পার।
তাকে জড়াতে যাব না
এ পারের বোঝার সঙ্গে।
এ নৌকোয় মাল নেব না কিছুই
যাব একলা
নতুন হয়ে নতুনের কাছে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
বুঝি গো সন্ধার কাছে শিখেছে সন্ধার মায়া
ওই আঁখিদুটি,
চাহিলে হৃদয়-পানে মরমেতে পড়ে ছায়া,
তারা উঠে ফুটি।
আগে কে জানিত বল কত কি লুকানো ছিল
হৃদয়নিভৃতে--
তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া
পাইনু দেখিতে।
কখনো গাও নি তুমি, কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান--
স্বপ্নময় শান্তিময় পূরবী রাগিণীতানে
বাঁধিয়াছ প্রাণ।
আকাশের পানে চাই সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া।
একে একে সুরগুলি অনন্তে হারায়ে যায়
আধারে পশিয়া।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।'
কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই -
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা -
ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে -
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য -
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি -
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ -
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে -
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার - এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ -
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন -
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী - হলে দাসী।।বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি -
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন -
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব -
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।'
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ -
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।'
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে -
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
নির্মল প্রত্যুষে আজি যত ছিল পাখি
বনে বনে শাখে শাখে উঠিয়াছে ডাকি।
দোয়েল শ্যামার কণ্ঠে আনন্দ-উচ্ছ্বাস,
গেয়ে গেয়ে পাপিয়ার নাহি মিটে আশ।
করুণ মিনতিস্বরে অশ্রান্ত কোকিল
অন্তরের আবেদনে ভরিছে নিখিল।
কেহ নাচে, কেহ গায়, উড়ে মত্তবৎ,
ফিরিয়া পেয়েছে যেন হারানো জগৎ।
পাখিরা জানে না কেহ আজি বর্ষশেষ,
বকবৃদ্ধ-কাছে নাহি শুনে উপদেশ।
যতদিন এ আকাশে এ জীবন আছে,
বরষের শেষ নাহি তাহাদের কাছে।
মানুষ আনন্দহীন নিশিদিন ধরি
আপনারে ভাগ করে শতখানা করি। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
তোমারে হেরিয়া চোখে,
মনে পড়ে শুধু, এই মুখখানি
দেখেছি স্বপ্নলোকে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নূতন কল্পে
সৃষ্টির আরম্ভে আঁকা হল অসীম আকাশে
কালের সীমানা
আলোর বেড়া দিয়ে।
সব চেয়ে বড়ো ক্ষেত্রটি
অযুত নিযুত কোটি কোটি বৎসরের মাপে।
সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে
জ্যোতিষ্কপতঙ্গ দিয়েছে দেখা,
গণনায় শেষ করা যায় না।
তারা কোন্ প্রথম প্রত্যুষের আলোকে
কোন্ গুহা থেকে উড়ে বেরোল অসংখ্য,
পাখা মেলে ঘুরে বেড়াতে লাগল চক্রপথে
আকাশ থেকে আকাশে।
অব্যক্তে তারা ছিল প্রচ্ছন্ন,
ব্যক্তের মধ্যে ধেয়ে এল
মরণের ওড়া উড়তে;--
তারা জানে না কিসের জন্যে
এই মৃত্যুর দুর্দান্ত আবেগ।
কোন্ কেন্দ্রে জ্বলছে সেই মহা আলোক
যার মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়বার জন্যে
হয়েছে উন্মত্তের মতো উৎসুক।
আয়ুর অবসান খুঁজছে আয়ুহীনের অচিন্ত্য রহস্যে।
একদিন আসবে কল্পসন্ধ্যা,
আলো আসবে ম্লান হয়ে,
ওড়ার বেগ হবে ক্লান্ত
পাখা যাবে খসে,
লুপ্ত হবে ওরা
চিরদিনের অদৃশ্য আলোকে।
ধরার ভূমিকায় মানব-যুগের
সীমা আঁকা হয়েছে
ছোটো মাপে
আলোক-আঁধারের পর্যায়ে
নক্ষত্রলোকের বিরাট দৃষ্টির
অগোচরে।
সেখানকার নিমেষের পরিমাণে
এখানকার সৃষ্টি ও প্রলয়।
বড়ো সীমানার মধ্যে মধ্যে
ছোটো ছোটো কালের পরিমণ্ডল
আঁকা হচ্ছে মোছা হচ্ছে।
বুদ্বুদের মতো উঠল মহেন্দজারো,
মরুবালুর সমুদ্রে, নিঃশব্দে গেল মিলিয়ে।
সুমেরিয়া, আসীরিয়া, ব্যাবিলন, মিসর,
দেখা দিল বিপুল বলে
কালের ছোটো-বেড়া-দেওয়া
ইতিহাসের রঙ্গস্থলীতে,
কাঁচা কালির লিখনের মতো
লুপ্ত হয়ে গেল
অস্পষ্ট কিছু চিহ্ন রেখে।
তাদের আকাঙক্ষাগুলো ছুটেছিল পতঙ্গের মতো
অসীম দুর্লক্ষ্যের দিকে।
বীরেরা বলেছিল
অমর করবে সেই আকাঙক্ষার কীর্তিপ্রতিমা;
তুলেছিল জয়স্তম্ভ।
কবিরা বলেছিল, অমর করবে
সেই আকাঙক্ষার বেদনাকে,
রচেছিল মহাকবিতা।
সেই মুহূর্তে মহাকাশের অগণ্য-যোজন পত্রপটে
লেখা হচ্ছিল
ধাবমান আলোকের জ্বলদক্ষরে
সুদূর নক্ষত্রের
হোমহুতাগ্নির মন্ত্রবাণী।
সেই বাণীর একটি একটি ধ্বনির
উচ্চারণ কালের মধ্যে
ভেঙে পড়েছে যুগের জয়স্তম্ভ,
নীরব হয়েছে কবির মহাকাব্য,
বিলীন হয়েছে আত্মগৌরবে স্পর্ধিত জাতির ইতিহাস।
আজ রাত্রে আমি সেই নক্ষত্রলোকের
নিমেষহীন আলোর নিচে
আমার লতাবিতানে বসে
নমস্কার করি মহাকালকে।
অমরতার আয়োজন
শিশুর শিথিল মুষ্টিগত
খেলার সামগ্রীর মতো
ধুলায় প'ড়ে বাতাসে যাক উড়ে।
আমি পেয়েছি ক্ষণে ক্ষণে অমৃতভরা
মুহূর্তগুলিকে,
তার সীমা কে বিচার করবে?
তার অপরিমেয় সত্য
অযুত নিযুত বৎসরের
নক্ষত্রের পরিধির মধ্যে
ধরে না;
কল্পান্ত যখন তার সকল প্রদীপ নিবিয়ে
সৃষ্টির রঙ্গমঞ্চ দেবে অন্ধকার করে
তখনো সে থাকবে প্রলয়ের নেপথ্যে
কল্পান্তরের প্রতীক্ষায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
দেখছ না কি , নীল মেঘে আজ
আকাশ অন্ধকার ।
সাত সমুদ্র তেরো নদী
আজকে হব পার ।
নাই গোবিন্দ , নাই মুকুন্দ ,
নাইকো হরিশ খোঁড়া ।
তাই ভাবি যে কাকে আমি
করব আমার ঘোড়া ।
কাগজ ছিঁড়ে এনেছি এই
বাবার খাতা থেকে ,
নৌকো দে - না বানিয়ে , অমনি
দিস , মা , ছবি এঁকে ।
রাগ করবেন বাবা বুঝি
দিল্লি থেকে ফিরে ?
ততক্ষণ যে চলে যাব
সাত সমুদ্র তীরে ।
এমনি কি তোর কাজ আছে , মা ,
কাজ তো রোজই থাকে ।
বাবার চিঠি এক্খুনি কি
দিতেই হবে ডাকে ?
নাই বা চিঠি ডাকে দিলে
আমার কথা রাখো ,
আজকে না হয় বাবার চিঠি
মাসি লিখুন - নাকো !
আমার এ যে দরকারি কাজ
বুঝতে পার না কি ?
দেরি হলেই একেবারে
সব যে হবে ফাঁকি ।
মেঘ কেটে যেই রোদ উঠবে
বৃষ্টি বন্ধ হলে ,
সাত সমুদ্র তেরো নদী
কোথায় যাবে চলে ! (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
শর ভাবে, ছুটে চলি, আমি তো স্বাধীন,
ধনুকটা একঠাঁই বদ্ধ চিরদিন।
ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা—
আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
ওরে তোরা কি জানিস কেউ
জলে কেন ওঠে এত ঢেউ ।
ওরা দিবস - রজনী নাচে ,
তাহা শিখেছে কাহার কাছে ।
শোন্ চলচল্ ছলছল্
সদাই গাহিয়া চলেছে জল ।
ওরা কারে ডাকে বাহু তুলে ,
ওরা কার কোলে ব'সে দুলে ।
সদা হেসে করে লুটোপুটি ,
চলে কোন্খানে ছুটোছুটি ।
ওরা সকলের মন তুষি
আছে আপনার মনে খুশি ।
আমি বসে বসে তাই ভাবি ,
নদী কোথা হতে এল নাবি ।
কোথায় পাহাড় সে কোন্খানে ,
তাহার নাম কি কেহই জানে ।
কেহ যেতে পারে তার কাছে ,
সেথায় মানুষ কি কেউ আছে ।
সেথা নাহি তরু নাহি ঘাস ,
নাহি পশুপাখিদের বাস ,
সেথা শবদ কিছু না শুনি ,
পাহাড় বসে আছে মহামুনি ।
তাহার মাথার উপরে শুধু
সাদা বরফ করিছে ধু ধু ।
সেথা রাশি রাশি মেঘ যত
থাকে ঘরের ছেলের মতো ।
শুধু হিমের মতন হাওয়া
সেথায় করে সদা আসা - যাওয়া ,
শুধু সারা রাত তারাগুলি
তারে চেয়ে দেখে আঁখি খুলি ।
শুধু ভোরের কিরণ এসে
তারে মুকুট পরায় হেসে ।
সেই নীল আকাশের পায়ে
সেথা কোমল মেঘের গায়ে
সেথা সাদা বরফের বুকে
নদী ঘুমায় স্বপনসুখে ।
কবে মুখে তার রোদ লেগে
নদী আপনি উঠিল জেগে ,
কবে একদা রোদের বেলা
তাহার মনে পড়ে গেল খেলা ।
সেখায় একা ছিল দিনরাতি ,
কেহই ছিল না খেলার সাথি ।
সেথায় কথা নাহি কারো ঘরে ,
সেথায় গান কেহ নাহি করে ।
তাই ঝুরু ঝুরু ঝিরি ঝিরি ।
নদী বাহিরিল ধীরি ধীরি ।
মনে ভাবিল , যা আছে ভবে
সবই দেখিয়া লইতে হবে ।
নীচে পাহাড়ের বুক জুড়ে
গাছ উঠেছে আকাশ ফুঁড়ে ।
তারা বুড়ো বুড়ো তরু যত
তাদের বয়স কে জানে কত ।
তাদের খোপে খোপে গাঁঠে গাঁঠে
পাখি বাসা বাঁধে কুটো - কাঠে ।
তারা ডাল তুলে কালো কালো
আড়াল করেছে রবির আলো ।
তাদের শাখায় জটার মতো
ঝুলে পড়েছে শেওলা যত ।
তারা মিলায়ে মিলায়ে কাঁধ
যেন পেতেছে আঁধার - ফাঁদ ।
তাদের তলে তলে নিরিবিলি
নদী হেসে চলে খিলিখিলি ।
তারে কে পারে রাখিতে ধরে ,
সে যে ছুটোছুটি যায় সরে ।
সে যে সদা খেলে লুকোচুরি ,
তাহার পায়ে পায়ে বাজে নুড়ি ।
পথে শিলা আছে রাশি রাশি ,
তাহা ঠেলে চলে হাসি হাসি ।
পাহাড় যদি থাকে পথ জুড়ে
নদী হেসে যায় বেঁকেচুরে ।
সেথায় বাস করে শিং - তোলা
যত বুনো ছাগ দাড়ি - ঝোলা ।
সেথায় হরিণ রোঁয়ায় ভরা
তারা কারেও দেয় না ধরা ।
সেথায় মানুষ নূতনতর ,
তাদের শরীর কঠিন বড়ো ।
তাদের চোখ দুটো নয় সোজা ,
তাদের কথা নাহি যায় বোঝা ।
তারা পাহাড়ের ছেলেমেয়ে
সদাই কাজ করে গান গেয়ে ।
তারা সারা দিনমান খেটে
আনে বোঝাভরা কাঠ কেটে ।
তারা চড়িয়া শিখর -' পরে
বনের হরিণ শিকার করে ।
নদী যত আগে আগে চলে
ততই সাথি জোটে দলে দলে ।
তারা তারি মতো , ঘর হতে
সবাই বাহির হয়েছে পথে ।
পায়ে ঠুনু ঠুনু বাজে নুড়ি ,
যেন বাজিতেছে মল চুড়ি ।
গায়ে আলো করে ঝিকিঝিক ,
যেন পরেছে হীরার চিক ।
মুখে কলকল কত ভাষে
এত কথা কোথা হতে আসে ।
শেষে সখীতে সখীতে মেলি
হেসে গায়ে গায়ে হেলাহেলি ।
শেষে কোলাকুলি কলরবে
তারা এক হয়ে যায় সবে ।
তখন কলকল ছুটে জল —
কাঁপে টলমল ধরাতল ,
কোথাও নীচে পড়ে ঝরঝর —
পাথর কেঁপে ওঠে থরথর ,
শিলা খান্ খান্ যায় টুটে —
নদী চলে পথ কেটে কুটে ।
ধারে গাছগুলো বড়ো বড়ো
তারা হয়ে পড়ে পড়ো - পড়ো ।
কত বড়ো পাথরের চাপ
জলে খসে পড়ে ঝুপঝাপ ।
তখন মাটি - গোলা ঘোলা জলে
ফেনা ভেসে যায় দলে দলে ।
জলে পাক ঘুরে ঘুরে ওঠে ,
যেন পাগলের মতো ছোটে ।
শেষে পাহাড় ছাড়িয়ে এসে
নদী পড়ে বাহিরের দেশে ।
হেথা যেখানে চাহিয়া দেখে
চোখে সকলি নূতন ঠেকে ।
হেথা চারি দিকে খোলা মাঠ ,
হেথা সমতল পথঘাট ।
কোথাও চাষিরা করিছে চাষ ,
কোথাও গোরুতে খেতেছে ঘাস ।
কোথাও বৃহৎ অশথ গাছে
পাখি শিস দিয়ে দিয়ে নাচে ।
কোথাও রাখাল ছেলের দলে
খেলা করিছে গাছের তলে ।
কোথাও নিকটে গ্রামের মাঝে
লোকে ফিরিছে নানান কাজে ।
কোথাও বাধা কিছু নাহি পথে ,
নদী চলেছে আপন মতে ।
পথে বরষার জলধারা
আসে চারি দিক হতে তারা ,
নদী দেখিতে দেখিতে বাড়ে ,
এখন কে রাখে ধরিয়া তারে ।
তাহার দুই কূলে উঠে ঘাস ,
সেথায় যতেক বকের বাস ।
সেথা মহিষের দল থাকে ,
তারা লুটায় নদীর পাঁকে ।
যত বুনো বরা সেথা ফেরে
তারা দাঁত দিয়ে মাটি চেরে ।
সেথা শেয়াল লুকায়ে থাকে ,
রাতে হুয়া হুয়া করে ডাকে ।
দেখে এইমতো কত দেশ ,
কে বা গনিয়া করিবে শেষ ।
কোথাও কেবল বালির ডাঙা ,
কোথাও মাটিগুলো রাঙা রাঙা ,
কোথাও ধারে ধারে উঠে বেত ,
কোথাও দুধারে গমের খেত ।
কোথাও ছোটোখাটো গ্রামখানি ,
কোথাও মাথা তোলে রাজধানী —
সেথায় নবাবের বড়ো কোঠা ,
তারি পাথরের থাম মোটা ।
তারি ঘাটের সোপান যত ,
জলে নামিয়াছে শত শত ।
কোথাও সাদা পাথরের পুলে
নদী বাঁধিয়াছে দুই কূলে ।
কোথাও লোহার সাঁকোয় গাড়ি
চলে ধকো ধকো ডাক ছাড়ি ।
নদী এইমতো অবশেষে
এল নরম মাটির দেশে ।
হেথা যেথায় মোদের বাড়ি
নদী আসিল দুয়ারে তারি ।
হেথায় নদী নালা বিল খালে
দেশ ঘিরেছে জলের জালে ।
কত মেয়েরা নাহিছে ঘাটে ,
কত ছেলেরা সাঁতার কাটে ;
কত জেলেরা ফেলিছে জাল ,
কত মাঝিরা ধরেছে হাল ,
সুখে সারিগান গায় দাঁড়ি ,
কত খেয়া - তরী দেয় পাড়ি ।
কোথাও পুরাতন শিবালয়
তীরে সারি সারি জেগে রয় ।
সেথায় দু - বেলা সকালে সাঁঝে
পূজার কাঁসর - ঘণ্টা বাজে ।
কত জটাধারী ছাইমাখা
ঘাটে বসে আছে যেন আঁকা ।
তীরে কোথাও বসেছে হাট ,
নৌকা ভরিয়া রয়েছে ঘাট ।
মাঠে কলাই সরিষা ধান ,
তাহার কে করিবে পরিমাণ ।
কোথাও নিবিড় আখের বনে
শালিক চরিছে আপন মনে ।
কোথাও ধু ধু করে বালুচর
সেথায় গাঙশালিকের ঘর ।
সেথায় কাছিম বালির তলে
আপন ডিম পেড়ে আসে চলে ।
সেথায় শীতকালে বুনো হাঁস
কত ঝাঁকে ঝাঁকে করে বাস ।
সেথায় দলে দলে চখাচখী
করে সারাদিন বকাবকি ।
সেথায় কাদাখোঁচা তীরে তীরে
কাদায় খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফিরে ।
কোথাও ধানের খেতের ধারে
ঘন কলাবন বাঁশঝাঁড়ে
ঘন আম - কাঁঠালের বনে
গ্রাম দেখা যায় এক কোণে ।
সেথা আছে ধান গোলাভরা ,
সেথা খড়গুলা রাশ - করা ।
সেথা গোয়ালেতে গোরু বাঁধা
কত কালো পাটকিলে সাদা ।
কোথাও কলুদের কুঁড়েখানি ,
সেথায় ক্যাঁ কোঁ ক'রে ঘোরে ঘানি ।
কোথাও কুমারের ঘরে চাক ,
দেয় সারাদিন ধরে পাক ।
মুদি দোকানেতে সারাখন
বসে পড়িতেছে রামায়ণ ।
কোথাও বসি পাঠশালা - ঘরে
যত ছেলেরা চেঁচিয়ে পড়ে ,
বড়ো বেতখানি লয়ে কোলে
ঘুমে গুরুমহাশয় ঢোলে ।
হেথায় এঁকে বেঁকে ভেঙে চুরে
গ্রামের পথ গেছে বহু দূরে ।
সেথায় বোঝাই গোরুর গাড়ি
ধীরে চলিয়াছে ডাক ছাড়ি ।
রোগা গ্রামের কুকুরগুলো
ক্ষুধায় শুঁকিয়া বেড়ায় ধুলো ।
যেদিন পুরনিমা রাতি আসে
চাঁদ আকাশ জুড়িয়া হাসে ।
বনে ও পারে আঁধার কালো ,
জলে ঝিকিমিকি করে আলো ।
বালি চিকিচিকি করে চরে ,
ছায়া ঝোপে বসি থাকে ডরে ।
সবাই ঘুমায় কুটিরতলে ,
তরী একটিও নাহি চলে ।
গাছে পাতাটিও নাহি নড়ে ,
জলে ঢেউ নাহি ওঠে পড়ে ।
কভু ঘুম যদি যায় ছুটে
কোকিল কুহু কুহু গেয়ে উঠে ,
কভু ও পারে চরের পাখি
রাতে স্বপনে উঠিছে ডাকি ।
নদী চলেছে ডাহিনে বামে ,
কভু কোথাও সে নাহি থামে ।
সেথায় গহন গভীর বন ,
তীরে নাহি লোক নাহি জন ।
শুধু কুমির নদীর ধারে
সুখে রোদ পোহাইছে পাড়ে ।
বাঘ ফিরিতেছে ঝোপে ঝাপে ,
ঘাড়ে পড়ে আসি এক লাফে ।
কোথাও দেখা যায় চিতাবাঘ ,
তাহার গায়ে চাকা চাকা দাগ ।
রাতে চুপিচুপি আসে ঘাটে ,
জল চকো চকো করি চাটে ।
হেথায় যখন জোয়ার ছোটে ,
নদী ফুলিয়ে ঘুলিয়ে ওঠে ।
তখন কানায় কানায় জল ,
কত ভেসে আসে ফুল ফল ।
ঢেউ হেসে ওঠে খলখল ,
তরী করি ওঠে টলমল ।
নদী অজগরসম ফুলে
গিলে খেতে চায় দুই কূলে ।
আবার ক্রমে আসে ভাঁটা পড়ে ,
তখন জল যায় সরে সরে ।
তখন নদী রোগা হয়ে আসে ,
কাদা দেখা দেয় দুই পাশে ।
বেরোয় ঘাটের সোপান যত
যেন বুকের হাড়ের মতো ।
নদী চলে যায় যত দূরে
ততই জল ওঠে পুরে পুরে ।
শেষে দেখা নাহি যায় কূল ,
চোখে দিক হয়ে যায় ভুল ।
নীল হয়ে আসে জলধারা ,
মুখে লাগে যেন নুন - পারা ।
ক্রমে নীচে নাহি পাই তল ,
ক্রমে আকাশে মিশায় জল ,
ডাঙা কোন্খানে পড়ে রয় —
শুধু জলে জলে জলময় ।
ওরে একি শুনি কোলাহল ,
হেরি একি ঘন নীল জল ।
ওই বুঝি রে সাগর হোথা ,
উহার কিনারা কে জানে কোথা ।
ওই লাখো লাখো ঢেউ উঠে
সদাই মরিতেছে মাথা কুটে ।
ওঠে সাদা সাদা ফেনা যত
যেন বিষম রাগের মতো ।
জল গরজি গরজি ধায় ,
যেন আকাশ কাড়িতে চায় ।
বায়ু কোথা হতে আসে ছুটে ,
ঢেউয়ে হাহা করে পড়ে লুটে ।
যেন পাঠশালা - ছাড়া ছেলে
ছুটে লাফায়ে বেড়ায় খেলে ।
হেথা যতদূর পানে চাই
কোথাও কিছু নাই , কিছু নাই ।
শুধু আকাশ বাতাস জল ,
শুধুই কলকল কোলাহল ,
শুধু ফেনা আর শুধু ঢেউ —
আর নাহি কিছু নাহি কেউ ।
হেথায় ফুরাইল সব দেশ ,
নদীর ভ্রমণ হইল শেষ ।
হেথা সারাদিন সারাবেলা
তাহার ফুরাবে না আর খেলা ।
তাহার সারাদিন নাচ গান
কভু হবে নাকো অবসান ।
এখন কোথাও হবে না যেতে ,
সাগর নিল তারে বুক পেতে ।
তারে নীল বিছানায় থুয়ে
তাহার কাদামাটি দিবে ধুয়ে ।
তারে ফেনার কাপড়ে ঢেকে ,
তারে ঢেউয়ের দোলায় রেখে ,
তার কানে কানে গেয়ে সুর
তার শ্রম করি দিবে দূর ।
নদী চিরদিন চিরনিশি
রবে অতল আদরে মিশি ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
গাবার মতো হয় নি কোনো গান,
দেবার মতো হয় নি কিছু দান।
মনে যে হয় সবি রইল বাকি
তোমায় শুধু দিয়ে এলেম ফাঁকি,
কবে হবে জীবন পূর্ণ করে
এই জীবনের পূজা অবসান।আর-সকলের সেবা করি যত
প্রাণপণে দিই অর্ঘ্য ভরি ভরি।
সত্য মিথ্যা সাজিয়ে দিই যে কত
দীন বলিয়া পাছে ধরা পড়ি।
তোমার কাছে গোপন কিছু নাই,
তোমার পূজায় সাহস এত তাই,
যা আছে তাই পায়ের কাছে আনি
অনাবৃত দরিদ্র এই প্রাণ।৭ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
ওই মহামানব আসে;
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত ধূলির ঘাসে ঘাসে।
সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক—
এল মহাজন্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।
উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব
নব জীবনের আশ্বাসে।
জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়,
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে। (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মাটিতে মিশিল মাটি,
যাহা চিরন্তন
রহিল প্রেমের স্বর্গে
অন্তরের ধন। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দেখলো সজনী চাঁদনি রজনী,
সমুজল যমুনা গাওত গান,
কানন কানন করত সমীরণ
কুসুমে কুসুমে চুম্বন দান।
কাহ লো যমুনা জোছন-ঢল ঢল
সুহাস সুনীল বারি?
আজু তোঁহারই উজল সলিল পর
নয়ন সলিল দিব ডারি।
কাহ সমীরণ লুটই কুসুম-বন
অলসি পড়সি যমুনায়?'
তোঁহার চম্পক-বাসিত লহরে
মিশাব নিশাস-বায়।জনম গোঁয়ায়নু রোয়ত রোয়ত
হম তর কোই ত কাঁদল না!
জনম গোঁয়ায়নু সাধত সাধত
হমকো কোইত সাধল না!
সকল তয়াগনু যো ধন আশে
সো বি তয়াগল মোয়
অপন ছোড়ি সব, অপন করনু যোয়
সো বি সজনি পর হোয়!
যমুনে হাস হাস লো হরখে
হম তর রোয়বে কে?
তোঁহারি সুহসিত নীল সলিল পরি
রাধা সঁপবে দে!
এক দিবস যব মাধ হমারা
আসবে কিনার তোর,—
যব সো পেখবে তোঁহার সলিলে
ভাসত তনুয়া মোর—তব্ কি শ্যাম সো মানস পাশে
তিল দুখ পাওবে না?
শ্যামক নয়নে বিন্দু নয়ন জল
তবহুঁ কি আওবে না?
রয়নে কুঞ্জে আসবে যব সখি
শ্যাম হমারই আশে,
ফুকারবে যব্ রাধা রাধা
মুরলি ঊরধ-শ্বাসে,
যব সব গোপিনী আসবে ছূটই
যব হম আসব না;
যব সব গোপিনী জাগবে চমকই
যব হম জগব না,
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে
হেরবে আকুল শ্যাম?
বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে
রাধা রাধা নাম?না যমুনা, সো এক শ্যাম মম
শ্যামক শত শত নারী;
হম যব যাওব শত শত রাধা
চরণে রহবে তারি!
তব সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে,
কাহ তয়াগব দে?
অভাগীর তর বৃন্দাবনমে
কহ সখি, রোয়ব কে!
ভানু কহে চুপি ‘মান ভরে রহ
আও বনে ব্রজ-নারী,
মিলবে শ্যামক শত শত অাদর
শত শত লোচন বারি। (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
চাও যদি সত্যরূপে
দেখিবারে মন্দ–
ভালোর আলোতে দেখো,
হোয়ো নাকো অন্ধ। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
মৃত্তিকা খোরাকি দিয়ে
বাঁধে বৃক্ষটারে,
আকাশ আলোক দিয়ে
মুক্ত রাখে তারে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শিমূল রাঙা রঙে চোখেরে দিল ভ’রে।
নাকটা হেসে বলে, “হায় রে যাই ম’রে।’
নাকের মতে, গুণ কেবলি আছে ঘ্রাণে,
রূপ যে রঙ খোঁজে নাকটা তা কি জানে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
একা ব’সে সংসারের প্রান্ত-জানালায়
দিগন্তের নীলিমায় চোখে পড়ে অনন্তের ভাষা।
আলো আসে ছায়ায় জড়িত
শিরীষের গাছ হতে শ্যামলের স্নিগ্ধ সখ্য বহি।
বাজে মনে– নহে দূর,নহে বহু দূর।
পথরেখা লীন হল অস্তগিরিশিখর-আড়ালে,
স্তব্ধ আমি দিনান্তের পান্থশালা-দ্বারে,
দূরে দীপ্তি দেয় ক্ষণে ক্ষণে
শেষতীর্থমন্দিরের চূড়া।
সেথা সিংহদ্বারে বাজে দিন-অবসানের রাগিণী
যার মূর্ছনায় মেশা এ জন্মের যা-কিছু সুন্দর,
স্পর্শ যা করেছে প্রাণ দীর্ঘ যাত্রাপথে
পূর্ণতার ইঙ্গিত জানায়ে।
বাজে মনে– নহে দূর,নহে বহু দূর। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভ'রে।
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহাদানেরই যোগ্য করে
অতি-ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।
আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি
তোমার পথের লক্ষ্য ধরে-
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে
যাও যে সরে।
এ যে তব দয়া জানি হায়,
নিতে চাও ব'লে ফিরাও আমায়,
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
তব মিলনেরই যোগ্য করে
আধা- ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
কেন এ কম্পিত প্রেম, অয়ি ভীরু, এনেছ সংসারে--
ব্যর্থ করি রাখিবে কি তারে।
আলোকশঙ্কিত তব হিয়া
প্রচ্ছন্ন নিভৃত পথ দিয়া
থেমে যায় প্রাঙ্গণের দ্বারে।হায়, সে যে পায় নাই আপন নিশ্চিত পরিচয়,
বন্দী তারে রেখেছে সংশয়।
বাহিরে সামান্য বাধা সেও
সে-প্রেমেরে কেন করে হেয়,
অন্তরেও তার পরাজয়।ওই শোনো কেঁপে ওঠে নিশীথরাত্রির অন্ধকার,
আহ্বান আসিছে বারম্বার।
থেকো না ভয়ের অন্ধ ঘেরে,
অবজ্ঞা করিয়ো দুর্গমেরে,
জিনি লহো সত্যেরে তোমার।নিষ্ঠুরকে মেনে লহো সুদুঃসহ দুঃখের উৎসাহে,
প্রেমের গৌরব জেনো তাহে।
দীপ্তি দেয় রুদ্ধ অশ্রুজল,
নষ্ট আশা হয় না নিষ্ফল,
সমুজ্জল করে চিত্তদাহে।শীর্ণ ফুল রৌদ্রে পুড়ে কালো হয়, হোক-না সে কালো--
দীন দীপে নিবুক-না আলো।
দুর্বল যে মিথ্যার খাঁচায়
নিত্যকাল কে তারে বাঁচায়,
মরে যাহা মরা তার ভালো।আঘাত বাঁচাতে গিয়ে বঞ্চিত হবে কি এ-জীবন,
শুধিবে না দুর্মূল্যের পণ।
প্রেম সে কি কৃপণতা জানে,
আত্মরক্ষা করে আত্মদানে--
ত্যাগবীর্যে লভে মুক্তিধন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তুমি যখন গান গাহিতে বল
গর্ব আমার ভ’রে উঠে বুকে;
দুই আঁখি মোর করে ছলছল,
নিমেষহারা চেয়ে তোমার মুখে।
কঠিন কটু যা আছে মোর প্রাণে
গলিতে চায় অমৃতময় গানে,
সব সাধনা আরাধনা মম
উড়িতে চায় পাখির মত সুখে। তৃপ্ত তুমি আমার গীতরাগে,
ভালো লাগে তোমার ভালো লাগে,
জানি আমি এই গানেরই বলে
বসি গিয়ে তোমারি সম্মুখে। মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই,
গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই,
সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে,
বন্ধু ব’লে ডাকি মোর প্রভুকে।(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
আপনারে নিবেদন
সত্য হয়ে পূর্ণ হয় যবে
সুন্দর তখনি মূর্তি লভে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
কেবল তব মুখের পানে
চাহিয়া,
বাহির হনু তিমির-রাতে
তরণীখানি বাহিয়া।
অরুণ আজি উঠেছে–
আশোক আজি ফুটেছে–
না যদি উঠে,না যদি ফুটে,
তবুও আমি চলিব ছুটে
তোমার মুখে চাহিয়া।নয়নপাতে ডেকেছ মোরে
নীরবে।
হৃদয় মোর নিমেষ-মাঝে
উঠেছে ভরি গরবে।
শঙ্খ তব বাজিল–
সোনার তরী সাজিল–
না যদি বাজে, না যদি সাজে,
গরব যদি টুটে গো লাজে
চলিব তবু নীরবে।কথাটি আমি শুধাব নাকো
তোমারে।
দাঁড়াব নাকো ক্ষণেক-তরে
দ্বিধার ভরে দুয়ারে।
বাতাসে পাল ফুলিছে–
পতাকা আজি দুলিছে–
না যদি ফুলে, না যদি দুলে,
তরণী যদি না লাগে কূলে
শুধাব নাকো তোমারে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি
আপন গন্ধে মম
কস্তুরীমৃগসম।
ফাল্গুনরাতে দক্ষিণবায়ে
কোথা দিশা খুঁজে পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।বক্ষ হইতে বাহির হইয়া
আপন বাসনা মম
ফিরে মরীচিকাসম।
বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে
বক্ষে ফিরিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।নিজের গানেরে বাঁধিয়া ধরিতে
চাহে যেন বাঁশি মম
উতলা পাগলসম।
যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর
রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে
মনটি আমার আমি গোলাপে রাখিনু ঢেকে —
সে বিছানা সুকোমল , বিমল নীহার চেয়ে ,
তারি মাঝে মনখানি রাখিলাম লুকাইয়ে ।
একটি ফুল না নড়ে , একটি পাতা না পড়ে —
তবু কেন ঘুমায় না , চমকি চমকি চায় —
ঘুম কেন পাখা নেড়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায় ?
আর কিছু নয় , শুধু গোপনে একটি পাখি
কোথা হতে মাঝে মাঝে উঠিতেছে ডাকি ডাকি ।
ঘুমা তুই , ওই দেখ বাতাস মুদেছে পাখা ,
রবির কিরণ হতে পাতায় আছিস ঢাকা —
ঘুমা তুই , ওই দেখ তো চেয়ে দুরন্ত বায়
ঘুমেতে সাগর- ' পরে ঢুলে পড়ে পায় পায় ।
দুখের কাঁটায় কি রে বিঁধিতেছে কলেবর ?
বিষাদের বিষদাঁতে করিছে কি জরজর ?
কেন তবে ঘুম তোর ছাড়িয়া গিয়াছে আঁখি ?
কে জানে , গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি ।শ্যামল কানন এই মোহমন্ত্রজালে ঢাকা ,
অমৃতমধুর ফল ভরিয়ে রয়েছে শাখা ,
স্বপনের পাখিগুলি চঞ্চল ডানাটি তুলি
উড়িয়া চলিয়া যায় আঁধার প্রান্তর- ' পরে —
গাছের শিখর হতে ঘুমের সংগীত ঝরে ।
নিভৃত কানন- ' পর শুনি না ব্যাধের স্বর ,
তবে কেন এ হরিণী চমকায় থাকি থাকি ।
কে জানে , গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি ।Swinburne (অনূদিত কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ফুলের কলিকা প্রভাতরবির
প্রসাদ করিছে লাভ,
কবে হবে তার হৃদয় ভরিয়া
ফলের আবির্ভাব। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী--
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে--
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।
জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমার প্রিয়ার সচল ছায়াছরি
সজল নীলাকাশে।
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার ভাসে।
বারিঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশহারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়,
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ,
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-'পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে। সেদিন অম্বর-মাঝে
শ্যামে নীলে মিশ্রমন্ত্রে স্বর্গলোকে জ্যোতিষ্কসমাজে
মর্তের মাহাত্ম্যগান করিলে ঘোষণা। যে জীবন
মরণতোরণদ্বার বারম্বার করি উত্তরণ
যাত্রা করে যুগে যুগে অনন্তকালের তীর্থপথে
নব নব পান্থশালে বিচিত্র নূতন দেহরথে,
তাহারি বিজয়ধ্বজা উড়াইলে নিঃশঙ্ক গৌরবে
অজ্ঞাতের সম্মুখে দাঁড়ায়ে। তোমার নিঃশব্দ রবে
প্রথম ভেঙেছে স্বপ্ন ধরিত্রীর, চমকি উল্লসি
নিজেরে পড়েছে তার মনে-- দেবকন্যা দুঃসাহসী
কবে যাত্রা করেছিল জ্যোতিঃস্বর্গ ছাড়ি দীনবেশে
পাংশুম্লান গৈরিকবসন-পরা,খণ্ড কালে দেশে
অমরার আনন্দেরে খণ্ড খণ্ড ভোগ করিবারে,
দুঃখের সংঘাতে তারে বিদীর্ণ করিয়া বারে বারে
নিবিড় করিয়া পেতে। মৃত্তিকার হে বীর সন্তান,
সংগ্রাম ঘোষিলে তুমি মৃত্তিকারে দিতে মুক্তিদান
মরুর দারুণ দুর্গ হতে;যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে;
সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে
শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায়,
দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়
বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে
ধূলিরে করিয়া মু্গ্ধ, চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে
ব্যাপিলে আপন পন্থা। বাণীশূন্য ছিল একদিন
জলস্থল শূন্যতল, ঋতুর উৎসবমন্ত্রহীন--
শাখায় রচিলে তব সংগীতের আদিম আশ্রয়,
যে গানে চঞ্চল বায়ু নিজের লভিল পরিচয়,
সুরের বিচিত্র বর্ণে আপনার দৃশ্যহীন তনু
রঞ্জিত করিয়া নিল, অঙ্কিল গানের ইন্দ্রধনু
উত্তরীর প্রান্তে প্রান্তে । সুন্দরের প্রাণমূর্তিখানি
মৃত্তিকার মর্তপটে দিলে তুমি প্রথম বাখানি
টানিয়া আপন প্রাণে রূপশক্তি সূর্যলোক হতে,
আলোকের গুপ্তধন বর্ণে বর্ণে বর্ণিলে আলোতে।
ইন্দ্রের অপ্সরী আসি মেঘে হানিয়া কঙ্কণ
বাষ্পপাত্র চূর্ণ করি লীলানৃত্যে করেছে বর্ষণ
যৌবন অমৃতরস, তুমি তাই নিলে ভরি ভরি
আপনার পুত্রপুষ্পপুটে, অনন্তযৌবনা করি
সাজাইলে বসুন্ধরা। হে নিস্তব্ধ, হে মহাগম্ভীর,
বীর্যেরে বাঁধিয়া ধৈর্যে শান্তিরূপ দেখালে শক্তির;
তাই আসি তোমার আশ্রয়ে শান্তিদীক্ষা লভিবারে
শুনিতে মৌনের মহাবানী; দুশ্চিন্তার গুরুভারে
নতশীর্ষ বিলুণ্ঠিতে শ্যামসৌম্যচ্ছায়াতলে তব--
প্রাণের উদার রূপ,রসরূপ নিত্য নব নব,
বিশ্বজয়ী বীররূপ ধরণীর, বাণীরূপ তার
লভিতে আপন প্রাণে। ধ্যানবলে তোমার মাঝার
গেছি আমি, জেনেছি, সূর্যের বক্ষে জ্বলে বহ্নিরূপে
সৃষ্টিযজ্ঞে যেই হোম, তোমার সত্তায় চুপে চুপে
ধরে তাই শ্যামস্নিগ্ধরূপ; ওগো সূর্যরশ্মিপায়ী,
শত শত শতাব্দীর দিনধেনু দুহিয়া সদাই
যে তেজে ভরিলে মজ্জা, মানবেরে তাই করি দান
করেছ জগৎজয়ী; দিলে তারে পরম সম্মান;
হয়েছে সে দেবতার প্রতিস্পর্ধী-- সে অগ্নিচ্ছটায়
প্রদীপ্ত তাহার শক্তি বিশ্বতলে বিস্ময় ঘটায়
ভেদিয়া দুঃসাধ্য বিঘ্নবাধা। তব প্রাণে প্রাণবান,
তব স্নেহচ্ছায়ায় শীতল, তব তেজে তেজীয়মান,
সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব, তারি দূত হয়ে
ওগো মানবের বন্ধু, আজি এই কাব্য-অর্ঘ্য ল'য়ে
শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি
অর্পিলাম তোমায় প্রণামী।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
১
গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে,
নিভৃত নিরালা ঠাঁই, লেশমাত্র আলো নাই,
লুকানো এ প্রেমসাধ গোপনে নিবসে,
শুদ্ধ যবে ভালোবাসা নয়নে তোমার,
ঈষৎ প্রদীপ্ত হয়, উচ্ছ্বসয়ে এ-হৃদয়,
ভয়ে ভয়ে জড়সড় তখনি আবার।
২
শূন্য এই মরমের সমাধি-গহ্বরে,
জ্বলিছে এ প্রেমশিখা চিরকাল-তরে,
কেহ না দেখিতে পায়, থেকেও না থাকা প্রায়,
নিভিবারও নাম নাই নিরাশার ঘোরে।
৩
যা হবার হইয়াছে– কিন্তু প্রাণনাথ!
নিতান্ত হইবে যবে এ শরীরপাত,
আমার সমাধি-স্থানে কোরো নাথ কোরো মনে,
রয়েছে এ এক দুঃখিনী হয়ে ধরাসাৎ।
৪
যত যাতনা আছে দলুক আমায়,
সহজে সহিতে নাথ সব পারা যায়,
কিন্তু হে তুমি-যে মোরে, ভুলে যাবে একেবারে
সে কথা করিতে মনে হৃদি ফেটে যায়।
৫
রেখো তবে এই মাত্র কথাটি আমার,
এই কথা শেষ কথা, কথা নাহি আর,
(এ দেহ হইলে পাত, যদি তুমি প্রাণনাথ,
প্রকাশো আমার তরে তিলমাত্র শোক,
ধর্মত হবে না দোষী দোষিবে না লোক–
কাতরে বিনয়ে তাই, এই মাত্র ভিক্ষা চাই,
কখনো চাহি নে আরো কোনো ভিক্ষা আর)
যবে আমি যাব ম’রে, চির এ দুঃখিনী তরে,
বিন্দুমাত্র অশ্রুজল ফেলো একবার–
আজন্ম এত যে ভালোবেসেছি তোমায়,
সে প্রেমের প্রতিদান একমাত্র প্রতিদান,
তা বই কিছুই আর দিয়ো না আমায়।George Gordon Byron
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
এই ছবি রাজপুতানার;
এ দেখি মৃত্যুর পৃষ্ঠে বেঁচে থাকিবার
দুর্বিষহ বোঝা।
হতবুদ্ধি অতীতের এই যেন খোঁজা
পথভ্রষ্ট বর্তমানে অর্থ আপনার,
শূন্যেতে হারানো অধিকার।
ঐ তার গিরিদুর্গে অবরুদ্ধ নিরর্থ ভ্রূকুটি
ঐ তার জয়স্তম্ভ তোলে ক্রুদ্ধ মুঠি
বিরুদ্ধ ভাগ্যের পানে।
মৃত্যুতে করেছে গ্রাস তবুও যে মরিতে না জানে,
ভোগ করে অসম্মান অকালের হাতে
দিনে রাতে,
অসাড় অন্তরে
গ্লানি অনুভব নাহি করে,
আপনারি চাটুবাক্যে আপনারে ভুলায় আশ্বাসে--
জানে না সে,
পরিপূর্ণ কত শতাব্দীর পণ্যরথ
উত্তীর্ণ না হতে পথ
ভগ্নচক্র পড়ে আছে মরুর প্রান্তরে,
ম্রিয়মাণ আলোকের প্রহরে প্রহরে
বেড়িয়াছে অন্ধ বিভাবরী
নাগপাশে; ভাষাভোলা ধূলির করুণা লাভ করি
একমাত্র শান্তি তাহাদের।
লঙ্ঘন যে করে নাই ভোলামনে কালের বাঁধের
অন্তিম নিষেধসীমা--
ভগ্নস্তূপে থাকে তার নামহীন প্রচ্ছন্ন মহিমা;
জেগে থাকে কল্পনার ভিতে
ইতিবৃত্তহারা তার ইতিহাস উদার ইঙ্গিতে।
কিন্তু এ নির্লজ্জ কারা! কালের উপেক্ষাদৃষ্টি-কাছে
না থেকেও তবু আছে।
একি আত্মবিস্মরণমোহ,
বীর্যহীন ভিত্তি-'পরে কেন রচে শূন্য সমারোহ।
রাজ্যহীন সিংহাসনে অত্যুক্তির রাজা,
বিধাতার সাজা।
হোথা যারা মাটি করে চাষ
রৌদ্রবৃষ্টি শিরে ধরি বারো মাস,
ওরা কভু আধামিথ্যা রূপে
সত্যেরে তো হানে না বিদ্রূপে।
ওরা আছে নিজ স্থান পেয়ে;
দারিদ্র৻ের মূল্য বেশি লুপ্তমূল্য ঐশ্বর্যের চেয়ে।
এদিকে চাহিয়া দেখো টিটাগড়।
লোষ্ট্রে লৌহে বন্দী হেথা কালবৈশাখীর পণ্যঝড়।
বণিকের দম্ভে নাই বাধা,
আসমুদ্র পৃথ্বীতলে দৃপ্ত তার অক্ষুণ্ন মর্যাদা।
প্রয়োজন নাহি জানে ওরা
ভূষণে সাজায়ে হাতিঘোড়া
সম্মানের ভান করিবার,
ভুলাইতে ছদ্মবেশী সমুচ্চ তুচ্ছতা আপনার।
শেষের পংক্তিতে যবে থামিবে ওদের ভাগ্যলিখা,
নামিবে অন্তিম যবনিকা,
উত্তাল রজতপিণ্ড-উদ্ধারের শেষ হবে পালা,
যন্ত্রের কিঙ্করগুলো নিয়ে ভস্মডালা
লুপ্ত হবে নেপথ্যে যখন,
পশ্চাতে যাবে না রেখে প্রেতের প্রগল্ভ প্রহসন।
উদাত্ত যুগের রথে বল্গাধরা সে রাজপুতানা
মরুপ্রস্তরের স্তরে একদিন দিল মুষ্টি হানা;
তুলিল উদ্ভেদ করি কলোল্লোলে মহা-ইতিহাস
প্রাণে উচ্ছ্বসিত, মৃত্যুতে ফেনিল; তারি তপ্তশ্বাস
স্পর্শ দেয় মনে, রক্ত উঠে আবর্তিয়া বুকে--
সে যুগের সুদূর সম্মুখে
স্তব্ধ হয়ে ভুলি এই কৃপণ কালের দৈন্যপাশে-
জর্জরিত, নতশির অদৃষ্টের অট্টহাসে,
গলবদ্ধ পশুশ্রেণীসম চলে দিন পরে দিন
লজ্জাহীন।
জীবনমৃত্যুর দ্বন্দ্ব-মাঝে
সেদিন যে দুন্দুভি মন্দ্রিয়াছিল তার প্রতিধ্বনি বাজে
প্রাণের কুহরে গুমরিয়া। নির্ভয় দুর্দান্ত খেলা,
মনে হয়, সেই তো সহজ, দূরে নিক্ষেপিয়া ফেলা
আপনারে নিঃসংশয় নিষ্ঠুর সংকটে। তুচ্ছ প্রাণ
নহে তো সহজ; মৃত্যুর বেদিতে যার কোনো দান
নাই কোনো কালে সেই তো দুর্ভর অতি,
আপনার সঙ্গে নিত্য বাল্যপনা দুঃসহ দুর্গতি।
প্রচণ্ড সত্যেরে ভেঙে গল্পে রচে অলস কল্পনা
নিষ্কর্মার স্বাদু উত্তেজনা,
নাট্যমঞ্চে ব্যঙ্গ করি বীরসাজে
তারস্বর আস্ফালনে উন্মত্ততা করে কোন্ লাজে।
তাই ভাবি হে রাজপুতানা,
কেন তুমি মানিলে না যথাকালে প্রলয়ের মানা,
লভিলে না বিনষ্টির শেষ স্বর্গলোক;
জনতার চোখ
দীপ্তিহীন
কৌতুকের দৃষ্টিপাতে পলে পলে করে যে মলিন।
শঙ্করের তৃতীয় নয়ন হতে
সম্মান নিলে না কেন যুগান্তের বহ্নির আলোতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
ওরে যাত্রী, যেতে হবে বহুদূরদেশে।
কিসের করিস চিন্তা বসি পথশেষে?
কোন্ দুঃখে কাঁদে প্রাণ? কার পানে চাহি
বসে বসে দিন কাটে শুধু গান গাহি
শুধু মুগ্ধনেত্র মেলি? কার কথা শুনে
মরিস জ্বলিয়া মিছে মনের আগুনে?
কোথায় রহিবে পড়ি এ তোর সংসার!
কোথায় পশিবে সেথা কলরব তার!
মিলাইবে যুগ যুগ স্বপনের মতো,
কোথা রবে আজিকার কুশাঙ্কুরক্ষত!
নীরবে জ্বলিবে তব পথের দু ধারে
গ্রহতারকার দীপ কাতারে কাতারে।
তখনো চলেছ একা অনন্ত ভুবনে—
কোথা হতে কোথা গেছ না রহিবে মনে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
পরি দ্যাবা পৃথিবী সদ্য আয়ম্
উপাতিষ্ঠে প্রথমজামৃতস্য।
--অথর্ববেদঋষি কবি বলেছেন--
ঘুরলেন তিনি আকাশ পৃথিবী,
শেষকালে এসে দাঁড়ালেন
প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে।
কে এই প্রথমজাত অমৃত,
কী নাম দেব তাকে?
তাকেই বলি নবীন,
সে নিত্যকালের।
কত জরা কত মৃত্যু
বারে বারে ঘিরল তাকে চারদিকে,
সেই কুয়াশার মধ্যে থেকে
বারে বারে সে বেরিয়ে এল,
প্রতিদিন ভোরবেলার আলোতে
ধ্বনিত হল তার বাণী--
"এই আমি প্রথমজাত অমৃত।"
দিন এগোতে থাকে,
তপ্ত হয়ে ওঠে বাতাস,
আকাশ আবিল হয়ে ওঠে ধুলোয়,
বৃদ্ধ সংসারের কর্কশ কোলাহল
আবর্তিত হতে থাকে
দূর হতে দূরে।
কখন দিন আসে আপন শেষপ্রান্তে,
থেমে যায় তাপ,
নেমে যায় ধুলো,
শান্ত হয় কর্কশ কণ্ঠের পরিণামহীন বচসা,
আলোর যবনিকা সরে যায়
দিক্সীমার অন্তরালে।
অন্তহীন নক্ষত্রলোকে,
ম্লানিহীন অন্ধকারে
জেগে ওঠে বাণী--
"এই আমি প্রথমজাত অমৃত।"
শতাব্দীর পর শতাব্দী
আপনাকে ঘোষণা করে
মানুষের তপস্যায়;
সে-তপস্যা
ক্লান্ত হয়,
হোমাগ্নি যায় নিবে,
মন্ত্র হয় অর্থহীন,
জীর্ণ সাধনার শতছিদ্র মলিন আচ্ছাদন
ম্রিয়মাণ শতাব্দীকে ফেলে ঢেকে।
অবশেষে কখন
শেষ সূর্যাস্তের তোরণদ্বারে
নিঃশব্দচরণে আসে
যুগান্তের রাত্রি,
অন্ধকারে জপ করে শান্তিমন্ত্র
শবাসনে সাধকের মতো।
বহুবর্ষব্যাপী প্রহর যায় চলে,
নবযুগের প্রভাত
শুভ্র শঙ্খ হাতে
দাঁড়ায় উদয়াচলের স্বর্ণশিখরে,
দেখা যায়,
তিমিরধারায় ক্ষালন করেছে কে
ধূলিশায়ী শতাব্দীর আবর্জনা;
ব্যাপ্ত হয়েছে অপরিসীম ক্ষমা
অন্তর্হিত অপরাধের
কলঙ্কচিহ্নের 'পরে।
পেতেছে শান্ত জ্যোতির আসন
প্রথমজাত অমৃত।
বালক ছিলেম,
নবীনকে তখন দেখেছি আনন্দিত চোখে
ধরণীর সবুজে,
আকাশের নীলিমায়।
দিন এগোল।
চলল জীবনযাত্রার রথ
এ-পথে ও-পথে।
ক্ষুব্ধ অন্তরের তাপতপ্ত নিঃশ্বাস।
শুকনো পাতা ওড়াল দিগন্তে।
চাকার বেগে
বাতাস ধুলায় হল নিবিড়।
আকাশচর কল্পনা
উড়ে গেল মেঘের পথে,
ক্ষুধাতুর কামনা
মহ্যাহ্নের রৌদ্রে
ঘুরে বেড়াল ধরাতলে
ফলের বাগানে ফসলের খেতে
আহূত অনাহূত।
আকাশে পৃথিবীতে
এ জন্মের ভ্রমণ হল সারা
পথে বিপথে।
আজ এসে দাঁড়ালেম
প্রথমজাত অমৃতের সম্মুখে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হিমাদ্রির ধ্যানে যাহা
স্তব্ধ হয়ে ছিল রাত্রিদিন,
সপ্তর্ষির দৃষ্টিতলে
বাক্যহীন শুভ্রতায় লীন,
সে তুষারনির্ঝরিণী
রবিকরস্পর্শে উচ্ছ্বসিতা
দিগ্ দিগন্তে প্রচারিছে
অন্তহীন আনন্দের গীতা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
পউষের পাতা-ঝরা তপোবনে
আজি কী কারণে
টলিয়া পড়িল আসি বসন্তের মাতাল বাতাস;
নাই লজ্জা, নাই ত্রাস,
আকাশে ছড়ায় উচ্চহাস
চঞ্চলিয়া শীতের প্রহর
শিশির-মন্থর।
বহুদিনকার
ভুলে-যাওয়া যৌবন আমার
সহসা কী মনে ক'রে
পত্র তার পাঠায়েছে মোরে
উচ্ছৃঙ্খল বসন্তের হাতে
অকস্মাৎ সংগীতের ইঙ্গিতের সাথে।
লিখেছে সে--
আছি আমি অনন্তের দেশে
যৌবন তোমার
চিরদিনকার।
গলে মোর মন্দারের মালা,
পীত মোর উত্তরীয় দূর বনান্তের গন্ধ-ঢালা।
বিরহী তোমার লাগি
আছি জাগি
দক্ষিণ-বাতাসে
ফাল্গুনের নিশ্বাসে নিশ্বাসে।
আছি জাগি চক্ষে চক্ষে হাসিতে হাসিতে
কত মধু মধ্যাহ্নের বাঁশিতে বাঁশিতে।
লিখেছে সে--
এসো এসো চলে এসো বয়সের জীর্ণ পথশেষে,
মরণের সিংহদ্বার
হয়ে এসো পার;
ফেলে এসো ক্লান্ত পুষ্পহার।
ঝরে পড়ে ফোটা ফুল, খসে পড়ে জীর্ণ পত্রভার,
স্বপ্ন যায় টুটে,
ছিন্ন আশা ধূলিতলে পড়ে লুটে।
শুধু আমি যৌবন তোমার
চিরদিনকার,
ফিরে ফিরে মোর সাথে দেখা তব হবে বারম্বার
জীবনের এপার ওপার।
সুরুল, ২৩ পৌষ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী,
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
বলিতে দিতেছ কই।
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই,
কোথা ভেসে যাই দূরে।
বলিতেছিলাম বসি এক ধারে
আপনার কথা আপন জনারে,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
ঘরের কাহিনী যত--
তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে
ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
গড়িলে মনের মতো।সে মায়ামুরতি কী কহিছে বাণী,
কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি--
আমি চেয়ে আছি বিস্ময়ে মানি
রহস্যে নিমগন।
এ যে সংগীত কোথা হতে উঠে,
এ যে লাবণ্য কোথা হতে ফুটে,
এ যে ক্রন্দন কোথা হতে টুটে
অন্তরবিদারণ।
নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায়
ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়,
নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়
নূতন রাগিণীভরে।
যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা,
জানি না এনেছি কাহার বারতা
কারে শুনাবার তরে।
কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার,
কেহ এক বলে কেহ বলে আর,
আমারে শুধায় বৃথা বার বার
দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে গো তুমি, কোথা রয়েছ গোপনে,
আমি মরিতেছি খুঁজি।এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী।
যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে
চলিতে দিতেছ কই।
গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে,
চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে,
গোঠে ধায় গোরু, বধূ জল আনে
শত বার যাতায়াতে,
একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায়--
মনে ছিল, দিন কাজে ও খেলায়
কাটায়ে ফিরিব রাতে।
পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক,
ক্লান্তহৃদয় ভ্রান্ত পথিক
এসেছি নূতন দেশে।
কখনো উদার গিরির শিখরে
কভু বেদনার তমোগহ্বরে
চিনি না যে পথ সে পথের 'পরে
চলেছি পাগল-বেশে।
কভু বা পন্থ গহন জটিল,
কভু পিচ্ছল ঘনপঙ্কিল,
কভু সংকটছায়াশঙ্কিল,
বঙ্কিম দুরগম--
খরকণ্টকে ছিন্ন চরণ,
ধুলায় রৌদ্রে মলিন বরন,
আশেপাশে হতে তাকায় মরণ
সহসা লাগায় ভ্রম।
তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায়,
কাঁপিছে বক্ষ সুখে ব্যথায়,
তীব্র তপ্ত দীপ্ত নেশায়
চিত্ত মাতিয়া উঠে।
কোথা হতে আসে ঘন সুগন্ধ,
কোথা হতে বায়ু বহে আনন্দ,
চিন্তা ত্যজিয়া পরান অন্ধ
মৃত্যুর মুখে ছুটে।খেপার মতন কেন এ জীবন,
অর্থ কী তার, কোথা এ ভ্রমণ,
চুপ করে থাকি শুধায় যখন--
দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে তুমি গোপনে চালাইছ মোরে
আমি যে তোমারে খুঁজি।রাখো কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী।
আমার অর্থ তোমার তত্ত্ব
বলে দাও মোরে অয়ি।
আমি কি গো বীণাযন্ত্র তোমার,
ব্যথায় পীড়িয়া হৃদয়ের তার
মূর্ছনাভরে গীতঝংকার
ধ্বনিছ মর্মমাঝে?
আমার মাঝারে করিছ রচনা
অসীম বিরহ, অপার বাসনা,
কিসের লাগিয়া বিশ্ববেদনা
মোর বেদনায় বাজে?
মোর প্রেমে দিয়ে তোমার রাগিণী
কহিতেছ কোন্ অনাদি কাহিনী,
কঠিন আঘাতে ওগো মায়াবিনী
জাগাও গভীর সুর।
হবে যবে তব লীলা-অবসান,
ছিঁড়ে যাবে তার, থেমে যাবে গান,
আমারে কি ফেলে করিবে প্রয়াণ
তব রহস্যপুর?
জ্বেলেছ কি মোরে প্রদীপ তোমার
করিবারে পূজা কোন্ দেবতাররহস্য-ঘেরা অসীম আঁধার
মহামন্দিরতলে?
নাহি জানি তাই কার লাগি প্রাণ
মরিছে দহিয়া নিশিদিনমান,
যেন সচেতন বহ্নিসমান
নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বলে।
অর্ধনিশীথে নিভৃতে নীরবে
এই দীপখানি নিবে যাবে যবে
বুঝিবে কি, কেন এসেছিনু ভবে,
কেন জ্বলিলাম প্রাণে?
কেন নিয়ে এলে তব মায়ারথে
তোমার বিজন নূতন এ পথে,
কেন রাখিলে না সবার জগতে
জনতার মাঝখানে?
জীবন-পোড়ানো এ হোম-অনল
সেদিন কি হবে সহসা সফল?
সেই শিখা হতে রূপ নির্মল
বাহিরি আসিবে বুঝি!
সব জটিলতা হইবে সরল
তোমারে পাইব খুঁজি।ছাড়ি কৌতুক নিত্যনূতন
ওগো কৌতুকময়ী,
জীবনের শেষে কী নূতন বেশে
দেখা দিবে মোরে অয়ি!
চিরদিবসের মর্মের ব্যথা,
শত জনমের চিরসফলতা,
আমার প্রেয়সী, আমার দেবতা,
আমার বিশ্বরূপী,মরণনিশায় উষা বিকাশিয়া
শ্রান্তজনের শিয়রে আসিয়া
মধুর অধরে করুণ হাসিয়া
দাঁড়াবে কি চুপিচুপি?
ললাট আমার চুম্বন করি
নব চেতনায় দিবে প্রাণ ভরি,
নয়ন মেলিয়া উঠিব শিহরি,
জানি না চিনিব কি না--
শূন্য গগন নীলনির্মল,
নাহি রবিশশী গ্রহমণ্ডল,
না বহে পবন, নাই কোলাহল,
বাজিছে নীরব বীণা--
অচল আলোকে রয়েছ দাঁড়ায়ে,
কিরণবসন অঙ্গ জড়ায়ে
চরণের তলে পড়িছে গড়ায়ে
ছড়ায়ে বিবিধ ভঙ্গে।
গন্ধ তোমার ঘিরে চারি ধার,
উড়িছে আকুল কুন্তলভার,
নিখিল গগন কাঁপিছে তোমার
পরশরসতরঙ্গে।
হাসিমাখা তব আনত দৃষ্টি
আমারে করিছে নূতন সৃষ্টি
অঙ্গে অঙ্গে অমৃতবৃষ্টি
বরষি করুণাভরে।
নিবিড় গভীর প্রেম-আনন্দ
বাহুবন্ধনে করেছে বন্ধ,
মুগ্ধ নয়ন হয়েছে অন্ধ
অশ্রুবাষ্পথরে।
নাহিকো অর্থ, নাহিকো তত্ত্ব,
নাহিকো মিথ্যা, নাহিকো সত্য,আপনার মাঝে আপনি মত্ত--
দেখিয়া হাসিবে বুঝি।
আমি হতে তুমি বাহিরে আসিবে,
ফিরিতে হবে না খুঁজি।যদি কৌতুক রাখ চিরদিন
ওগো কৌতুকময়ী,
যদি অন্তরে লুকায়ে বসিয়া
হবে অন্তরজয়ী,
তবে তাই হোক। দেবী, অহরহ
জনমে জনমে রহো তবে রহো,
নিত্যমিলনে নিত্যবিরহ
জীবনে জাগাও প্রিয়ে।
নব নব রূপে-- ওগো রূপময়,
লুণ্ঠিয়া লহো আমার হৃদয়,
কাঁদাও আমারে, ওগো নির্দয়,
চঞ্চল প্রেম দিয়ে।
কখনো হৃদয়ে কখনো বাহিরে,
কখনো আলোকে কখনো তিমিরে,
কভু বা স্বপনে কভু সশরীরে
পরশ করিয়া যাবে--
বক্ষোবীণায় বেদনার তার
এইমতো পুন বাঁধিব আবার,
পরশমাত্রে গীতঝংকার
উঠিবে নূতন ভাবে।
এমনি টুটিয়া মর্মপাথর
ছুটিবে আবার অশ্রুনিঝর,
জানি না খুঁজিয়া কী মহাসাগর
বহিয়া চলিবে দূরে।বরষ বরষ দিবসরজনী
অশ্রুনদীর আকুল সে ধ্বনি
রহিয়া রহিয়া মিশিবে এমনি
আমার গানের সুরে।
যত শত ভুল করেছি এবার
সেইমতো ভুল ঘটিবে আবার--
ওগো মায়াবিনী, কত ভুলাবার
মন্ত্র তোমার আছে!
আবার তোমারে ধরিবার তরে
ফিরিয়া মরিব বনে প্রান্তরে,
পথ হতে পথে, ঘর হতে ঘরে
দুরাশার পাছে পাছে।
এবারের মতো পুরিয়া পরান
তীব্র বেদনা করিয়াছি পান,
সে সুরা তরল অগ্নিসমান
তুমি ঢালিতেছ বুঝি!
আবার এমনি বেদনার মাঝে
তোমারে ফিরিব খুঁজি।
ভাদ্র, ১৩০১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
বিরাম কাজেরই অঙ্গ এক সাথে গাঁথা,
নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
অনন্ত দিবসরাত্রি কালের উচ্ছ্বাস —
তারি মাঝখানে শুধু একটি নিমেষ ,
একটি মধুর সন্ধ্যা , একটু বাতাস ,
মৃদু আলো – আঁধারের মিলন – আবেশ —
তারি মাঝখানে শুধু একটুকু জুঁই
একটুকু হাসিমাখা সৌরভের লেশ ,
একটু অধর তার ছুঁই কি না – ছুঁই ,
আপন আনন্দ লয়ে উঠিতেছে ফুটে
আপন আনন্দ লয়ে পড়িতেছে টুটে ।
সমগ্র অনন্ত ওই নিমেষের মাঝে
একটি বনের প্রান্তে জুঁই হয়ে উঠে ।
পলকের মাঝখানে অনন্ত বিরাজে ।
যেমনি পলক টুটে ফুল ঝরে যায় ,
অনন্ত আপনা – মাঝে আপনি মিলায় ।। (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
বালিশ নেই, সে ঘুমোতে যায় মাথার নিচে ইঁট দিয়ে।
কাঁথা নেই; সে প’ড়ে থাকে রোদের দিকে পিঠ দিয়ে।
শ্বশুর বাড়ি নেমন্তন্ন, তাড়াতাড়ি তারই জন্য
ছেঁড়া গামছা পরেছে সে তিনটে-চারটে গিঁঠ দিয়ে।
ভাঙা ছাতার বাঁটখানাতে ছড়ি ক’রে চায় বানাতে,
রোদে মাথা সুস্থ করে ঠাণ্ডা জলের ছিট দিয়ে।
হাসির কথা নয় এ মোটে, খেঁকশেয়ালিই হেসে ওঠে
যখন রাতে পথ করে সে হতভাগার ভিট দিয়ে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
পেঁচোটাকে মাসি তার
যত দেয় আস্করা,
মুশকিল ঘটে তত
এক সাথে বাস করা।
হঠাৎ চিমটি কাটে
কপালের চামড়ায়–
বলে সে, “এমনি ক’রে
ভিমরুল কামড়ায়।’
আমার বিছানা নিয়ে
খেলা ওর চাষ-করা–
মাথার বালিশ থেকে
তুলোগুলো হ্রাস-করা। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হে মোর সুন্দর,
যেতে যেতে
পথের প্রমোদে মেতে
যখন তোমার গায়
কারা সবে ধুলা দিয়ে যায়,
আমার অন্তর
করে হায় হয়।
কেঁদে বলি, হে মোর সুন্দর,
আজ তুমি হও দণ্ডধর,
করহ বিচার।
তার পরে দেখি,
এ কী,
খোলা তব বিচারঘরের দ্বার,
নিত্য চলে তোমার বিচার।
নীরবে প্রভাত-আলো পড়ে
তাদের কলুষরক্ত নয়নের 'পরে;
শুভ্র বনমল্লিকার বাস
স্পর্শ করে লালসার উদ্দীপ্ত নিশ্বাস;
সন্ধ্যাতাপসীর হাতে জ্বালা
সপ্তর্ষির পূজাদীপমালা
তাদের মত্ততাপানে সারারাত্রি চায়--
হে সুন্দর, তব গায়
ধুলা দিয়ে যারা চলে যায়।
হে সুন্দর,
তোমার বিচারঘর
পুষ্পবনে,
পুণ্যসমীরণে,
তৃণপুঞ্জে পতঙ্গগুঞ্জনে,
বসন্তের বিহঙ্গকূজনে,
তরঙ্গচুম্বিত তীরে মর্মরিত পল্লববীজনে।
প্রেমিক আমার,
তারা যে নির্দয় ঘোর, তাদের যে আবেগ দুর্বার।
লুকায়ে ফেরে যে তারা করিতে হরণ
তব আভরণ,
সাজাবারে
আপনার নগ্ন বাসনারে।
তাদের আঘাত যবে প্রেমের সর্বাঙ্গে বাজে,
সহিতে সে পারি না যে;
অশ্রু-আঁখি
তোমারে কাঁদিয়া ডাকি--
খড়গ ধরো, প্রেমিক আমার,
করো গো বিচার।
তার পরে দেখি
এ কী,
কোথা তব বিচার-আগার।
জননীর স্নেহ-অশ্রু ঝরে
তাদের উগ্রতা-'পরে;
প্রণয়ীর অসীম বিশ্বাস
তাদের বিদ্রোহশেল ক্ষতবক্ষে করি লয় গ্রাস।
প্রেমিক আমার,
তোমার সে বিচার-আগার
বিনিদ্র স্নেহের স্তব্ধ নিঃশব্দ বেদনামাঝে,
সতীর পবিত্র লাজে,
সখার হৃদয়রক্তপাতে,
পথ-চাওয়া প্রণয়ের বিচ্ছেদের রাতে,
অশ্রুপ্লুত করুণার পরিপূর্ণ ক্ষমার প্রভাতে।
হে রুদ্র আমার,
লুব্ধ তারা, মুগ্ধ তারা, হয়ে পার
তব সিংহদ্বার,
সংগোপনে
বিনা নিমন্ত্রণে
সিঁধ কেটে চুরি করে তোমার ভাণ্ডার।
চোরা ধন দুর্বহ সে ভার
পলে পলে
তাহাদের র্মম দলে,
সাধ্য নাহি রহে নামাবার।
তোমারে কাঁদিয়া তবে কহি বারম্বার--
এদের মার্জনা করো, হে রুদ্র আমার।
চেয়ে দেখি মার্জনা যে নামে এসে
প্রচণ্ড ঝঞ্ঝার বেশে;
সেই ঝড়ে
ধুলায় তাহারা পড়ে;
চুরির প্রকাণ্ড বোঝা খণ্ড খণ্ড হয়ে
সে-বাতাসে কোথা যায় বয়ে।
হে রুদ্র আমার,
মার্জনা তোমার
গর্জমান বজ্রাগ্নিশিখায়,
সুর্যাস্তের প্রলয়লিখায়,
রক্তের বর্ষণে,
অকস্মাৎ সংঘাতের ঘর্ষণে ঘর্ষণে।
শান্তিনিকেতন, ১২ পৌষ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
সে তো সে দিনের কথা, বাক্যহীন যবে
এসেছিনু প্রবাসীর মতো এই ভবে
বিনা কোনো পরিচয়, রিক্ত শূন্য হাতে,
একমাত্র ক্রন্দন সম্বল লয়ে সাথে।
আজ সেথা কী করিয়া মানুষের প্রীতি
কণ্ঠ হতে টানি লয় যত মোর গীতি।
এ ভুবনে মোর চিত্তে অতি অল্প স্থান
নিয়েছ, ভুবননাথ। সমস্ত এ প্রাণ
সংসারে করেছ পূর্ণ। পাদপ্রান্তে তব
প্রত্যহ যে ছন্দে-বাঁধা গীত নব নব
দিতেছি অঞ্জলি, তাও তব পূজাশেষে
লবে সবে তোমা সাথে মোরে ভালোবেসে
এই আশাখানি মনে আছে অবিচ্ছেদে।
যে প্রবাসে রাখ সেথা প্রেমে রাখো বেঁধে।নব নব প্রবাসেতে নব নব লোকে
বাঁধিবে এমনি প্রেমে। প্রেমের আলোকে
বিকশিত হব আমি ভুবনে ভুবনে
নব নব পুষ্পদলে; প্রেম-আকর্ষণে
যত গূঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে
উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে,
বাহিরে আসিবে ছুটি– অন্তহীন প্রাণে
নিখিল জগতে তব প্রেমের আহ্বানে
নব নব জীবনের গন্ধ যাব রেখে,
নব নব বিকাশের বর্ণ যাব এঁকে।
কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ অমরতাকূপে
এক ধরাতলমাঝে শুধু একরূপে
বাঁচিয়া থাকিতে। নব নব মৃত্যুপথে
তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দেশশূন্য কালশূন্য জ্যোতিঃশূন্য, মহাশূন্য-'পরি
চতুর্মুখ করিছেন ধ্যান,
মহা অন্ধ অন্ধকার সভয়ে রয়েছে দাঁড়াইয়া--
কবে দেব খুলিবে নয়ান।
অনন্ত হৃদয়-মাঝে আসন্ন জগৎ-চরাচর
দাঁড়াইয়া স্তম্ভিত নিশ্চল,
অনন্ত হৃদয়ে তাঁর ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান
ধীরে ধীরে বিকাশিছে দল।
লেগেছে ভাবের ঘোর, মহানন্দে পূর্ণ তাঁর প্রাণ
নিজের হৃদয়পানে চাহি,
নিস্তরঙ্গ রহিয়াছে অনন্ত আনন্দপারাবার--
কূল নাহি, দিগ্বিদিক নাহি।
পুলকে পূর্ণিত তাঁর প্রাণ,
সহসা আনন্দসিন্ধু হৃদয়ে উঠিল উথলিয়া,
আদিদেব খুলিলা নয়ান;
জনশূন্য জ্যোতিঃশূন্য অন্ধতম অন্ধকার-মাঝে
উচ্ছ্বসি উঠিল বেদগান।
চারি মুখে বাহিরিল বাণী
চারিদিকে করিল প্রয়াণ।
সীমাহারা মহা অন্ধকারে
সীমাশূন্য ব্যোমপারাবারে
প্রাণপূর্ণ ঝটিকার মতো,
ভাবপূর্ণ, ব্যাকুলতা-সম,
আশাপূর্ণ অতৃপ্তির প্রায়,
সঞ্চরিতে লাগিল সে ভাষা।
দূর দূর যত দূর যায়
কিছুতেই অন্ত নাহি পায়--
যুগ যুগ যুগ যুগান্তর
ভ্রমিতেছে আজিও সে বাণী,
আজিও সে অন্ত নাহি পায়।
ভাবের আনন্দে ভোর, গীতিকবি চারি মুখে
করিতে লাগিলা বেদগান।
আনন্দের আন্দোলনে ঘন ঘন বহে শ্বাস
অষ্ট নেত্রে বিস্ফুরিল জ্যোতি ।
জ্যোতির্ময় জটাজাল কোটিসূর্যপ্রভাসম,
দিগ্ বিদিকে পড়িল ছড়ায়ে,
মহান্ ললাটে তাঁর অযুত তড়িতস্ফূর্তি
অবিরাম লাগিল খেলিতে।
অনন্ত ভাবের দল, হৃদয়-মাঝারে তাঁর
হতেছিল আকুল ব্যাকুল--
মুক্ত হয়ে ছুটিল তাহারা,
জগতের গঙ্গোত্রীশিখর হতে
শত শত স্রোতে
উচ্ছ্বসিল অগ্নিময় বিশ্বের নির্ঝর,
বাহিরিল অগ্নিময়ী বাণী,
উচ্ছ্বসিল বাষ্পময় ভাব।
উত্তরে দক্ষিণে গেল,
পুরবে পশ্চিমে গেল,
চারি দিকে ছুটিল তাহারা,
আকাশের মহাক্ষেত্রে শৈশব-উচ্ছ্বাস বেগে
নাচিতে লাগিল মহোল্লাসে।
শব্দশূন্য শূন্যমাঝে সহসা সহস্র স্বরে
জয়ধ্বনি উঠিল উথলি,
হর্ষধ্বনি উঠিল ফুটিয়া,
স্তব্ধতার পাষাণহৃদয়
শত ভাগে গেল রে ফাটিয়া।
শব্দস্রোত ঝরিল চৌদিকে
এককালে সমস্বরে--
পুরবে উঠিল ধ্বনি, পশ্চিমে উঠিল ধ্বনি,
ব্যাপ্ত হল উত্তরে দক্ষিণে।
অসংখ্য ভাবের দল খেলিতে লাগিল যত
উঠিল খেলার কোলাহল।
শূন্যে শূন্যে মাতিয়া বেড়ায়--
হেথা ছোটে, হোথা ছুটে যায়।
কী করিবে আপনা লইয়া
যেন তাহা ভাবিয়া না পায়,
আনন্দে ভাঙিয়া যেতে চায়।
যে প্রাণ অনন্ত যুগ রবে
সেই প্রাণ পেয়েছে নূতন,
আনন্দে অনন্ত প্রাণ যেন
মুহূর্তে করিতে চায় ব্যয় ।
অবশেষে আকাশ ব্যাপিয়া
পড়িল প্রেমের আকর্ষণ ।
এ ধায় উহার পানে
এ চায় উহার মুখে,
আগ্রহে ছুটিয়া কাছে আসে।
বাষ্পে বাষ্পে করে ছুটাছুটি,
বাষ্পে বাষ্পে করে আলিঙ্গন।
অগ্নিময় কাতর হৃদয়
অগ্নিময় হৃদয়ে মিশিছে।
জ্বলিছে দ্বিগুণ অগ্নিরাশি
আঁধার হতেছে চুর চুর।
অগ্নিময় মিলন হইতে
জন্মিতেছে আগ্নেয় সন্তান,
অন্ধকার শূন্যমরুমাঝে
শত শত অগ্নি-পরিবার
দিশে দিশে করিছে ভ্রমণ।
নূতন সে প্রাণের উল্লাসে
নূতন সে প্রাণের উচ্ছ্বাসে
বিশ্ব যবে হয়েছে উন্মাদ,
চারি দিকে উঠিছে নিনাদ,
অনন্ত আকাশে দাঁড়াইয়া
চারি দিকে চারি হাত দিয়া
বিষ্ণু আসি মন্ত্র পড়ি দিলা,
বিষ্ণু আসি কৈলা আশীর্বাদ।
লইয়া মঙ্গলশঙ্খ করে,
কাঁপায়ে জগৎ চরাচরে
বিষ্ণু আসি কৈলা শঙ্খনাদ।
থেমে এল প্রচণ্ড কল্লোল,
নিবে এল জ্বলন্ত উচ্ছ্বাস,
গ্রহগণ নিজ অশ্রুজলে
নিবাইল নিজের হুতাশ।
জগতের বাঁধিল সমাজ,
জগতের বাঁধিল সংসার
বিবাহে বাহুতে বাহু বাঁধি
জগৎ হইল পরিবার।
বিষ্ণু আসি মহাকাশে, লেখনী ধরিয়া করে
মহান্ কালের পত্র খুলি
ধরিয়া ব্রহ্মার ধ্যানগুলি
একমনে পরম যতনে,
লিখি লিখি যুগ-যুগান্তর
বাঁধি দিলা ছন্দের বাঁধনে। জগতের মহা বেদব্যাস
গঠিলা নিখিল উপন্যাস,
বিশৃঙ্খল বিশ্বগীতি লয়ে
মহাকাব্য করিলা রচন।
জগতের ফুলরাশি লয়ে
গাঁথি মালা মনের মতন
নিজ গলে কৈলা আরোপণ।
জগতের মালাখানি জগৎ-পতির গলে
মরি কিবা সেজেছে অতুল
দেখিবারে হৃদয় আকুল।
বিশ্বমালা অসীম অক্ষয়,
কত চন্দ্র কত সূর্য কত গ্রহ কত তারা
কত বর্ণ কত গীত-ময়।
নিজ নিজ পরিবার লয়ে
ভ্রমে সবে নিজ নিজ পথে,
বিষ্ণুদেব চক্র হাতে লয়ে,
চক্রে চক্রে বাঁধিলা জগতে।
চক্রপথে ভ্রমে গ্রহ তারা,
চক্রপথে রবি শশী ভ্রমে,
শাসনের গদা হস্তে লয়ে
চরাচর রাখিলা নিয়মে।
দুরন্ত প্রেমেরে মন্ত্র পড়ি
বাঁধি দিলা বিবাহবন্ধনে।
মহাকায় শনিরে ঘেরিয়া
হাতে হাতে ধরিয়া ধরিয়া
নাচিতে লাগিল এক তালে
সুধামুখ চাঁদ শত শত।
পৃথিবীর সমুদ্রহৃদয়
চন্দ্রে হেরি উঠে উথলিয়া।
পৃথিবীর মুখপানে চেয়ে
চন্দ্র হাসে আনন্দে গলিয়া।
মিলি যত গ্রহ ভাইবোন
এক অন্নে হইল পালিত,
তারা-সহোদর যত ছিল
এক সাথে হইল মিলিত।
কত কত শত বর্ষ ধরি
দূর পথ অতিক্রম করি
পাঠাইছে বিদেশ হইতে
তারাগুলি আলোকের দূত
ক্ষুদ্র ওই দূরদেশবাসী
পৃথিবীর বারতা লইতে।
রবি ধায় রবির চৌদিকে
গ্রহ ধায় রবিরে ঘেরিয়া
চাঁদ হাসে গ্রহমুখ চেয়ে,
তারা হাসে তারায় হেরিয়া।
মহাছন্দ মহা অনুপ্রাস
চরাচরে বিস্তারিল পাশ। পশিয়া মানসসরোবরে
স্বর্ণপদ্ম করিলা চয়ন,
বিষ্ণুদেব প্রসন্ন আননে
পদ্মপানে মেলিল নয়ন।
ফুটিয়া উঠিল শতদল,
বাহিরিল কিরণ বিমল,
মাতিল রে দ্যুলোক ভূলোক
আকাশে পুরিল পরিমল।
চরাচরে উঠাইয়া গান
চরাচরে জাগাইয়া হাসি
কোমল কমলদল হতে
উঠিল অতুল রূপরাশি।
মেলি দুটি নয়ন বিহ্বল
ত্যজিয়া সে শতদলদল
ধীর ধীরে জগৎ-মাঝারে
লক্ষ্মী আসি ফেলিলা চরণ--
গ্রহে গ্রহে তারায় তারায়
ফুটিল রে বিচিত্র বরন।
জগৎ মুখের পানে চায়,
জগৎ পাগল হয়ে যায়,
নাচিতে লাগিল চারি দিকে--
আনন্দের অন্ত নাহি পায়।
জগতের মুখপানে চেয়ে
লক্ষ্মী যবে হাসিলেন হাসি
মেঘেতে ফুটিল ইন্দ্রধনু,
কাননে ফুটিল ফুলরাশি--
হাসি লয়ে করে কাড়াকাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ চারি ভিতে,
চাহে তাঁর চরণছায়ায়
যৌবনকুসুম ফুটাইতে।
জগতের হৃদয়ের আশা
দশ দিকে আকুল হইয়া
ফুল হয়ে পরিমল হয়ে
গান হয়ে উঠিল ফুটিয়া।
একি হেরি যৌবন-উচ্ছ্বাস,
একি রে মোহন ইন্দ্রজাল--
সৌন্দর্যকুসুমে গেল ঢেকে
জগতের কঠিন কঙ্কাল।
হাসি হয়ে ভাতিল আকাশে
তারকার রক্তিম নয়ান,
জগতের হর্ষকোলাহল
রাগিণীতে হল অবসান।
কোমলে কঠিন লুকাইল,
শক্তিরে ঢাকিল রূপরাশি,
প্রেমের হৃদয়ে মহা বল
অশনির মুখে দিল হাসি।
সকলি হইল মনোহর
সাজিল জগৎ-চরাচর।মহাছন্দে বাঁধা হয়ে যুগ যুগ যুগ যুগান্তর
পড়িল নিয়ম-পাঠশালে
অসীম জগৎ-চরাচর।
শ্রান্ত হয়ে এল কলেবর,
নিদ্রা আসে নয়নে তাহার,
আকর্ষণ হতেছে শিথিল,
উত্তাপ হতেছে একাকার।
জগতের প্রাণ হতে
উঠিল রে বিলাপসংগীত,
কাঁদিয়া উঠিল চারি ভিত ।
পুরবে বিলাপ উঠে, পশ্চিমে বিলাপ উঠে,
কাঁদিল রে উত্তর দক্ষিণ,
কাঁদে গ্রহ, কাঁদে তারা, শ্রান্তদেহে কাঁদে রবি--
জগৎ হইল শান্তিহীন।
চারি দিক হতে উঠিতেছে
আকুল বিশ্বের কণ্ঠস্বর,
‘‘জাগো জাগো জাগো মহাদেব,
কবে মোরা পাব অবসর?
অলঙ্ঘ্য নিয়মপথে ভ্রমি
হয়েছে হে শ্রান্ত কলেবর।
নিয়মের পাঠ সমাপিয়া
সাধ গেছে খেলা করিবারে,
একবার ছেড়ে দাও, দেব,
অনন্ত এ আকাশ-মাঝারে।’’
জগতের আত্মা কহে কাঁদি,
‘‘আমারে নূতন দেহ দাও—
প্রতিদিন বাড়িছে হৃদয়,
প্রতিদিন বাড়িতেছে আশা,
প্রতিদিন টুটিতেছে দেহ,
প্রতিদিন ভাঙিতেছে বল।
গাও দেব মরণসংগীত
পাব মোরা নূতন জীবন।’’
জগৎ কাঁদিল উচ্চরবে
জাগিয়া উঠিল মহেশ্বর,
তিন কাল ত্রিনয়ন মেলি,
হেরিলেন দিক দিগন্তর।
প্রলয়বিষাণ তুলি করে ধরিলেন শূলী,
পদতলে জগৎ চাপিয়া—
জগতের আদি অন্ত থরথর থরথর
একবার উঠিল কাঁপিয়া।
বিষাণেতে পুরিলা নিশ্বাস,
ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল
জগতের সমস্ত বাঁধন।
উঠিল রে মহাশূন্যে গরজিয়া তরঙ্গিয়া
ছন্দোমুক্ত জগতের উন্মত্ত আনন্দকোলাহল।
ছিঁড়ে গেল রবি শশী গ্রহ তারা ধূমকেতু,
কে কোথায় ছুটে গেল,
ভেঙে গেল, টুটে গেল,
চন্দ্রে সূর্যে গুঁড়াইয়া
চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল।
মহা অগ্নি জ্বলিল রে,
আকাশের অনন্ত হৃদয়
অগ্নি, অগ্নি, শুধু অগ্নিময়।
মহা অগ্নি উঠিল জ্বলিয়া
জগতের মহা চিতানল।
খণ্ড খণ্ড রবি শশী, চূর্ণ চূর্ণ গ্রহ তারা
বিন্দু বিন্দু আঁধারের মতো
বরষিছে চারি দিক হতে,
অনলের তেজোময় গ্রাসে
নিমেষেতে যেতেছে মিশায়ে।
সৃজনের আরম্ভসময়ে
আছিল অনাদি অন্ধকার,
সৃজনের ধ্বংসযুগান্তরে
রহিল অসীম হুতাশন।
অনন্ত আকাশগ্রাসী অনলসমুদ্রমাঝে
মহাদেব মুদি ত্রিনয়ান
করিতে লাগিলা মহাধ্যান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দিন পরে যায় দিন, স্তব্ধ বসে থাকি;
ভাবি মনে, জীবনের দান যত কত তার বাকি
চুকায়ে সঞ্চয় অপচয়।
অযত্নে কী হয়ে গেছে ক্ষয়,
কী পেয়েছি প্রাপ্য যাহা, কী দিয়েছি যাহা ছিল দেয়,
কী রয়েছে শেষের পাথেয়।
যারা কাছে এসেছিল, যারা চলে গিয়েছিল দূরে,
তাদের পরশখানি রয়ে গেছে মোর কোন্ সুরে।
অন্যমনে কারে চিনি নাই,
বিদায়ের পদধ্বনি প্রাণে আজি বাজিছে বৃথাই।
হয়তো হয় নি জানা ক্ষমা করে কে গিয়েছে চলে
কথাটি না ব’লে।
যদি ভুল করে থাকি তাহার বিচার
ক্ষোভ কি রাখিবে তবু যখন রব না আমি আর।
কত সূত্র ছিন্ন হল জীবনের আস্তরণময়,
জোড়া লাগাবারে আর রবে না সময়।
জীবনের শেষপ্রান্তে যে প্রেম রয়েছে নিরবধি
মোর কোনো অসম্মান তাহে ক্ষতচিহ্ন দেয় যদি,
আমার মৃত্যুর হস্ত আরোগ্য আনিয়া দিক তারে,
এ কথাই ভাবি বারে বারে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার কাছে রাজা আমার রইল অজানা।
তাই সে যখন তলব করে খাজানা
মনে করি পালিয়ে গিয়ে দেব তারে ফাঁকি,
রাখব দেনা বাকি।
যেখানেতেই পালাই আমি গোপনে
দিনে কাজের আড়ালেতে, রাতে স্বপনে,
তলব তারি আসে
নিশ্বাসে নিশ্বাসে।
তাই জেনেছি, আমি তাহার নইকো অজানা।
তাই জেনেছি ঋণের দায়ে
ডাইনে বাঁয়ে
বিকিয়ে বাসা নাইকো আমার ঠিকানা।
তাই ভেবেছি জীবন-মরণে
যা আছে সব চুকিয়ে দেব চরণে।
তাহার পরে
নিজের জোরে
নিজেরি স্বত্বে
মিলবে আমার আপন বাসা তাঁহার রাজত্বে।
পদ্মা, ২২ মাঘ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দিবসরজনী তন্দ্রাবিহীন
মহাকাল আছে জাগি—
যাহা নাই কোনোখানে,
যারে কেহ নাহি জানে,
সে অপরিচিত কল্পনাতীত
কোন আগামীর লাগি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে
এসেছে আমার দ্বারে;
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু
কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত—
অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার।যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস
ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।
এই হার-জিত-খেলা—জীবনের মিথ্যা এ কুহক—
শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা—
দুঃখের পরিহাসে ভরা।
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি—
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে। (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
মন উড়ুউড়ু, চোখ ঢুলুঢুলু,
ম্লান মুখখানি কাঁদুনিক–
আলুথালু ভাষা, ভাব এলোমেলো,
ছন্দটা নির্বাঁধুনিক।
পাঠকেরা বলে, “এ তো নয় সোজা,
বুঝি কি বুঝিনে যায় না সে বোঝা।’
কবি বলে, “তার কারণ, আমার
কবিতার ছাঁদ আধুনিক।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বড়ো কাজ নিজে বহে
আপনার ভার।
বড়ো দুঃখ নিয়ে আসে
সান্তনা তাহার।
ছোটো কাজ, ছোটো ক্ষতি,
ছোটো দুঃখ যত—
বোঝা হয়ে চাপে, প্রাণ
করে কণ্ঠাগত। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক’রে দিতে। (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।কর্ম যখন প্রবল-আকার
গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,
হৃদয়প্রান্তে হে নীরব নাথ,
শান্তচরণে এসো।আপনারে যবে করিয়া কৃপণ
কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন,
দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ,
রাজ-সমারোহে এসো।বাসনা যখন বিপুল ধুলায়
অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়
ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র,
রুদ্র আলোকে এসো।২৮ চৈত্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
মানিক কহিল, “পিঠ পেতে দিই দাঁড়াও।
আম দুটো ঝোলে, ওর দিকে হাত বাড়াও।
উপরের ডালে সবুজে ও লালে
ভরে আছে, কষে নাড়াও।
নিচে নেমে এসে ছুরি দিয়ে শেষে
ব’সে ব’সে খোসা ছাড়াও।
যদি আসে মালি চোখে দিয়ে বালি
পারো যদি তারে তাড়াও।
বাকি কাজটার মোর ‘পরে ভার,
পাবে না শাঁসের সাড়াও।
আঁঠি যদি থাকে দিয়ো মালিটাকে,
মাড়াব না তার পাড়াও।
পিসিমা রাগিলে তাঁর চড়ে কিলে
বাঁদরামি-ভূত তাড়াও।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
মনেতে সাধ যে দিকে চাই
কেবলি চেয়ে রব।
দেখিব শুধু, দেখিব শুধু,
কথাটি নাহি কব।
পরানে শুধু জাগিবে প্রেম,
নয়নে লাগে ঘোর,
জগতে যেন ডুবিয়া রব
হইয়া রব ভোর।
তটিনী যায়, বহিয়া যায়,
কে জানে কোথা যায়;
তীরেতে বসে রহিব চেয়ে,
সারাটি দিন যায়।
সুদূর জলে ডুবিছে রবি
সোনার লেখা লিখি,
সাঁঝের আলো জলেতে শুয়ে
করিছে ঝিকিমিকি।
সুধীর স্রোতে তরণীগুলি
যেতেছে সারি সারি,
বহিয়া যায়, ভাসিয়া যায়
কত-না নরনারী।
না জানি তারা কোথায় থাকে
যেতেছে কোন্ দেশে,
সুদূর তীরে কোথায় গিয়ে
থামিবে অবশেষে।
কত কী আশা গড়িছে বসে
তাদের মনখানি,
কত কী সুখ কত কী দুখ
কিছুই নাহি জানি।দেখিব পাখি আকাশে ওড়ে,
সুদূরে উড়ে যায়,
মিশায়ে যায় কিরণমাঝে,
আঁধাররেখাপ্রায়!
তাহারি সাথে সারাটি দিন
উড়িবে মোর প্রাণ,
নীরবে বসে তাহারি সাথে
গাহিব তারি গান।
তাহারি মতো মেঘের মাঝে
বাঁধিতে চাহি বাসা,
তাহারি মতো চাঁদের কোলে
গড়িতে চাহি আশা!
তাহারি মতো আকাশে উঠে,
ধরার পানে চেয়ে
ধরায় যারে এসেছি ফেলে
ডাকিব গান গেয়ে।
তাহারি মতো, তাহারি সাথে
উষার দ্বারে গিয়ে,
ঘুমের ঘোর ভাঙায়ে দিব
উষারে জাগাইয়ে।পথের ধারে বসিয়া রব
বিজন তরুছায়,
সমুখ দিয়ে পথিক যত
কত-না আসে যায়
ধুলায় বসে আপন-মনে
ছেলেরা খেলা করে,
মুখেতে হাসি সখারা মিলে
যেতেছে ফিরে ঘরে।পথের ধারে ঘরের দ্বারে
বালিকা এক মেয়ে,
ছোটো ভায়েরে পাড়ায় ঘুম
কত কী গান গেয়ে।
তাহার পানে চাহিয়া থাকি
দিবস যায় চলে,
স্নেহেতে ভরা করুণ আঁখি—
হৃদয় যায় গলে।
এতটুকু সে পরানটিতে
এতটা সুধারাশি ।
কাছেতে তাই দাঁড়ায়ে তারে
দেখিতে ভালোবাসি।কোথা বা শিশু কাঁদিছে পথে
মায়েরে ডাকি ডাকি,
আকুল হয়ে পথিকমুখে
চাহিছে থাকি থাকি।
কাতর স্বর শুনিতে পেয়ে
জননী ছুটে আসে,
মায়ের বুক জড়ায়ে শিশু
কাঁদিতে গিয়ে হাসে।
অবাক হয়ে তাহাই দেখি
নিমেষ ভুলে গিয়ে,
দুইটি ফোঁটা বাহিরে জল
দুইটি আঁখি দিয়ে।যায় রে সাধ জগৎ-পানে
কেবলি চেয়ে রই
অবাক হয়ে, আপনা ভুলে,
কথাটি নাহি কই।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে
জীবন হতেছে শেষ,
শিথিল কপোল মলিন নয়ন
তুষার-ধবল কেশ!
পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া
অযতনে বীণাখানি,
বাজাবার বল নাইকো এ হাতে
জড়িমা জড়িত বাণী!
গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা!
হইল বিদায় নিতে;
আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই
অমৃত আমার চিতে?
তবু একবার আর-একবার
ত্যজিবার আগে প্রাণ,
মরিতে মরিতে গাহিয়া লইব
সাধের সে-সব গান!
দুলিবে আমার সমাধি-উপরে
তরুগণ শাখা তুলি,
বনদেবতারা গাইবে তখন
মরণের গানগুলি! (অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
ওই যে তিনি, ও ই যে বাহির পথে।
আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি,
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি।
ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে
ঠাঁই করে তুই নে রে কোনোমতে।কোথায় কী তোর আছে ঘরের কাজ,
সে-সব কথা ভুলতে হবে আজ।
টান্ রে দিয়ে সকল চিত্তকায়া,
টান্ রে ছেড়ে তুচ্ছ প্রাণের মায়া,
চল্ রে টেনে আলোর অন্ধকারে
নগর গ্রামে অরণ্যে পর্বতে।ওই যে চাকা ঘুরছে ঝনঝনি,
বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি।
রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ।
গাইছে না মন মরণজয়ী গান?
আকাঙক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো
ছুটছে নাকি বিপুল ভবিষ্যতে।গোরাই, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে, ওগো,
দিক্-দিগন্ত ঢাকি।
আজিকে আমরা কাঁদিয়া শুধাই সঘনে, ওগো,
আমরা খাঁচার পাখি–
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি কি আসিল প্রলয়রাত্রি ঘোর।
চিরদিবসের আলোক গেল কি মুছিয়া।
চিরদিবসের আশ্বাস গেল ঘুচিয়া?
দেবতার কৃপা আকাশের তলে কোথা কিছু নাহি বাকি?–
তোমাপানে চাই, কাঁদিয়া শুধাই আমরা খাঁচার পাখি।ফাল্গুন এলে সহসা দখিনপবন হতে
মাঝে মাঝে রহি রহি
আসিত সুবাস সুদূরকুঞ্জভবন হতে
অপূর্ব আশা বহি।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
মাঝে মাঝে যবে রজনী হইত ভোর,
কী মায়ামন্ত্রে বন্ধনদুখ নাশিয়া
খাঁচার কোণেতে প্রভাত পশিত হাসিয়া
ঘনমসী-আঁকা লোহার শলাকা সোনার সুধায় মাখি।–
নিখিল বিশ্ব পাইতাম প্রাণে আমরা খাঁচার পাখি।আজি দেখো ওই পূর্ব-অচলে চাহিয়া, হোথা
কিছুই না যায় দেখা–
আজি কোনো দিকে তিমিরপ্রান্ত দাহিয়া, হোথা
পড়ে নি সোনার রেখা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকঠোর।
আজি পিঞ্জর ভুলাবারে কিছু নাহি রে–
কার সন্ধান করি অন্তরে বাহিরে।
মরীচিকা লয়ে জুড়াব নয়ন আপনারে দিব ফাঁকি
সে আলোটুকুও হারায়েছি আজি আমরা খাঁচার পাখি।ওগো আমাদের এই ভয়াতুর বেদনা যেন
তোমারে না দেয় ব্যথা।
পিঞ্জরদ্বারে বসিয়া তুমিও কেঁদো না যেন
লয়ে বৃথা আকুলতা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
তোমার চরণে নাহি তো লৌহডোর।
সকল মেঘের ঊর্ধ্বে যাও গো উড়িয়া,
সেথা ঢালো তান বিমল শূন্য জুড়িয়া–
“নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি’ কহো আমাদের ডাকি,
মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান আমরা খাঁচার পাখি। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মনে হয়েছিল আজ সব-কটা দুর্গ্রহ
চক্র ক'রে বসেছে দুর্মন্ত্রণায়।
অদৃষ্ট জাল ফেলে অন্তরের শেষ তলা থেকে
টেনে টেনে তুলছে নাড়ি-ছেঁড়া যন্ত্রণাকে।
মনে হয়েছিল, অন্তহীন এই দুঃখ;
মনে হয়েছিল, পন্থহীন নৈরাশ্যের বাধায়
শেষ পর্যন্ত এমনি ক'রে
অন্ধকার হাতড়িয়ে বেড়ানো।
ভিতসুদ্ধ বাসা গেছে ডুবে,
ভাগ্যের ভাঙনের অপঘাতে।
এমন সময়ে সদ্যবর্তমানের
প্রাকার ডিঙিয়ে দৃষ্টি গেল
দূর অতীতের দিগন্তলীন
বাগ্বাদিনীর বাণীসভায়
যুগান্তরের ভগ্নশেষের ভিত্তিচ্ছায়ায়
ছায়ামূর্তি বাজিয়ে তুলেছে রুদ্রবীণায়
পুরাণখ্যাত কালের কোন্ নিষ্ঠুর আখ্যায়িকা।
দুঃসহ দুঃখের স্মরণতন্তু দিয়ে গাঁথা
সেই দারুণ কাহিনী।
কোন্ দুর্দাম সর্বনাশের
বজ্রঝঞ্ঝনিত মৃত্যুমাতাল দিনের
হুহুংকার,
যার আতঙ্কের কম্পনে
ঝংকৃত করছে বীণাপাণি
আপন বীণার তীব্রতম তার।
দেখতে পেলেম
কতকালের দুঃখ লজ্জা গ্লানি,
কত যুগের জলৎধারা মর্মনিঃস্রাব
সংহত হয়েছে,
ধরেছে দহনহীন বাণীমূর্তি
অতীতের সৃষ্টিশালায়।
আর তার বাইরে পড়ে আছে
নির্বাপিত বেদনার পর্বতপ্রমাণ ভস্মরাশি,
জ্যোতির্হীন বাক্যহীন অর্থশূন্য।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
মা , যদি তুই আকাশ হতিস ,
আমি চাঁপার গাছ ,
তোর সাথে মোর বিনি - কথায়
হত কথার নাচ ।
তোর হাওয়া মোর ডালে ডালে
কেবল থেকে থেকে
কত রকম নাচন দিয়ে
আমায় যেত ডেকে ।
মা ব'লে তার সাড়া দেব
কথা কোথায় পাই ,
পাতায় পাতায় সাড়া আমার
নেচে উঠত তাই ।
তোর আলো মোর শিশির - ফোঁটায়
আমার কানে কানে
টলমলিয়ে কী বলত যে
ঝলমলানির গানে ।
আমি তখন ফুটিয়ে দিতেম
আমার যত কুঁড়ি ,
কথা কইতে গিয়ে তারা
নাচন দিত জুড়ি ।
উড়ো মেঘের ছায়াটি তোর
কোথায় থেকে এসে
আমার ছায়ায় ঘনিয়ে উঠে
কোথায় যেত ভেসে ।
সেই হত তোর বাদল - বেলার
রূপকথাটির মতো ;
রাজপুত্তুর ঘর ছেড়ে যায়
পেরিয়ে রাজ্য কত ;
সেই আমারে বলে যেত
কোথায় আলেখ - লতা ,
সাগরপারের দৈত্যপুরের
রাজকন্যার কথা ;
দেখতে পেতেম দুয়োরানীর
চক্ষু ভর - ভর ,
শিউরে উঠে পাতা আমার
কাঁপত থরোথরো ।
হঠাৎ কখন বৃষ্টি তোমার
হাওয়ার পাছে পাছে
নামত আমার পাতায় পাতায়
টাপুর - টুপুর নাচে ;
সেই হত তোর কাঁদন - সুরে
রামায়ণের পড়া ,
সেই হত তোর গুনগুনিয়ে
শ্রাবণ - দিনের ছড়া ।
মা , তুই হতিস নীলবরনী ,
আমি সবুজ কাঁচা ;
তোর হত , মা , আলোর হাসি ,
আমার পাতার নাচা ।
তোর হত , মা , উপর থেকে
নয়ন মেলে চাওয়া ,
আমার হত আঁকুবাঁকু
হাত তুলে গান গাওয়া ।
তোর হত , মা চিরকালের
তারার মণিমালা ,
আমার হত দিনে দিনে
ফুল - ফোটাবার পালা । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
চলে যাবে সত্তারূপ
সৃজিত যা প্রাণেতে কায়াতে,
রেখে যাবে মায়ারূপ
রচিত যা আলোতে ছায়াতে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
রসগোল্লার লোভে
পাঁচকড়ি মিত্তির
দিল ঠোঙা শেষ করে
বড়ো ভাই পৃথ্বির।
সইল না কিছুতেই
যকৃতের নিচুতেই
যন্ত্র বিগড়ে গিয়ে
ব্যামো হল পিত্তির।
ঠোঙাটাকে বলে, “পাজি
ময়রার কারসাজি।’
দাদার উপরে রাগে–
দাদা বলে, “চিত্তির!
পেটে যে স্মরণসভা
আপনারি কীর্তির।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.