poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে
সংবাদে ছিল না মুখরিত
নিস্তব্ধ খ্যাতির যুগে--
আজিকার এইমতো প্রাণযাত্রাকল্লোলিত প্রাতে
যাঁরা যাত্রা করেছেন
মরণশঙ্কিল পথে
আত্মার অমৃত-অন্ন করিবারে দান
দূরবাসী অনাত্মীয় জনে,
দলে দলে যাঁরা
উত্তীর্ণ হন নি লক্ষ্য, তৃষানিদারুণ
মরুবালুতলে অস্থি গিয়েছেন রেখে,
সমুদ্র যাঁদের চিহ্ন দিয়েছে মুছিয়া,
অনারদ্ধ কর্মপথে
অকৃতার্থ হন নাই তাঁরা--
মিশিয়া আছেন সেই দেহাতীত মহাপ্রাণ-মাঝে
শক্তি জোগাইছে যাহা অগোচরে চিরমানবেরে--
তাঁহাদের করুণার স্পর্শ লভিতেছি
আজি এই প্রভাত-আলোকে,
তাঁহাদের করি নমস্কার।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে–
এবার কিছু কি, কবি করেছ সঞ্চয়।
ভরেছ কি কল্পনার কনক-অঞ্চলে
চঞ্চলপবনক্লিষ্ট শ্যাম কিশলয়,
ক্লান্ত করবীর গুচ্ছ। তপ্ত রৌদ্র হতে
নিয়েছ কি গলাইয়া যৌবনের সুরা–
ঢেলেছ কি উচ্ছলিত তব ছন্দঃস্রোতে,
রেখেছ কি করি তারে অনন্তমধুরা।
এ বসন্তে প্রিয়া তব পূর্ণিমানিশীথে
নবমল্লিকার মালা জড়াইয়া কেশে
তোমার আকাঙক্ষাদীপ্ত অতৃপ্ত আঁখিতে
যে দৃষ্টি হানিয়াছিল একটি নিমেষে
সে কি রাখ নাই গেঁথে অক্ষয় সংগীতে।
সে কি গেছে পুষ্পচ্যুত সৌরভের দেশে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সেদিন আমাদের ছিল খোলা সভা
আকাশের নিচে
রাঙামাটির পথের ধারে।
ঘাসের 'পরে বসেছে সবাই।
দক্ষিণের দিকে শালের গাছ সারি সারি,
দীর্ঘ, ঋজু, পুরাতন,--
স্তব্ধ দাঁড়িয়ে,
শুক্লনবমীর মায়াকে উপেক্ষা ক'রে;--
দূরে কোকিলের ক্লান্ত কাকলিতে বনস্পতি উদাসীন।
ও যেন শিবের তপোবন-দ্বারের নন্দী,
দৃঢ় নির্মম ওর ইঙ্গিত।
সভার লোকেরা বললে,--
"একটা কিছু শোনাও, কবি,
রাত গভীর হয়ে এল।"
খুললেম পুঁথিখানা,
যত পড়ে দেখি
সংকোচ লাগে মনে।
এরা এত কোমল, এত স্পর্শকাতর,
এত যত্নের ধন।
এদের কণ্ঠস্বর এত মৃদু,
এত কুণ্ঠিত।
এরা সব অন্তঃপুরিকা,
রাঙা অবগুণ্ঠন মুখের 'পরে।
তার উপরে ফুলকাটা পাড়,
সোনার সুতোয়।
রাজহংসের গতি ওদের,
মাটিতে চলতে বাধা।
প্রাচীন কাব্যে এদের বলেছে ভীরু,
বলেছে, বরবর্ণিনী।
বন্দিনী ওরা বহু সম্মানে।
ওদের নূপুর ঝংকৃত হয় প্রাচীরঘেরা ঘরে,
অনেক দামের আস্তরণে।
বাধা পায় তার নৈপুণ্যের বন্ধনে।
এই পথের ধারের সভায়,
আসতে পারে তারাই
সংসারের বাঁধন যাদের খসেছে,
খুলে ফেলেছে হাতের কাঁকন
মুছে ফেলেছে সিঁদুর;
যারা ফিরবে না ঘরের মায়ায়,
যারা তীর্থযাত্রী;
যাদের অসংকোচ অক্লান্ত গতি,
ধূলিধূসর গায়ের বসন;
যারা পথ খুঁজে পায় আকাশের তারা দেখে;
কোনো দায় নেই যাদের
কারো মন জুগিয়ে চলবার;
কত রৌদ্রতপ্ত দিনে
কত অন্ধকার অর্ধরাত্রে
যাদের কণ্ঠ প্রতিধ্বনি জাগিয়েছে
অজানা শৈলগুহায়,--
জনহীন মাঠে, পথহীন অরণ্যে।
কোথা থেকে আনব তাদের
নিন্দা প্রশংসার ফাঁদে টেনে।
উঠে দাঁড়ালেম আসন ছেড়ে।
ওরা বললে, "কোথা যাও কবি?"
আমি বললেম,--
"যাব দুর্গমে, কঠোর নির্মমে,
নিয়ে আসব কঠিনচিত্ত উদাসীনের গান।"
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
অলসসময়ধারা বেয়ে
মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে।
সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে।
কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে
সুদীর্ঘ অতীতে
জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে।
এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল,
এসেছে মোগল;
বিজয়রথের চাকা
উড়ায়েছে ধূলিজাল, উড়িয়াছে বিজয়পতাকা।
শূন্যপথে চাই,
আজ তার কোনো চিহ্ন নাই।
নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো
যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো।
আরবার সেই শূন্যতলে
আসিয়াছে দলে দলে
লৌহবাঁধা পথে
অনলনিশ্বাসী রথে
প্রবল ইংরেজ,
বিকীর্ণ করেছে তার তেজ।
জানি তারও পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল,
কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশ-বেড়া জাল ।
জানি তার পণ্যবাহী সেনা
জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না।
মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে
দেখি সেথা কলকলরবে
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে
জীবনে মরণে।
ওরা চিরকাল
টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে -
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে।
রাজছত্র ভেঙে পড়ে; রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে;
জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে;
রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।
ওরা কাজ করে
দেশে দেশান্তরে,
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে,
পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে।
গুরুগুরু গর্জন - গুন্গুন্ স্বর -
দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর।
দুঃখ সুখ দিবসরজনী
মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি।
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-'পরে
ওরা কাজ করে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
উপর আকাশে সাজানো তড়িৎ-আলো--
নিম্নে নিবিড় অতিবর্বর কালো
ভূমিগর্ভের রাতে--
ক্ষুধাতুর আর ভূরিভোজীদের
নিদারুণ সংঘাতে
ব্যাপ্ত হয়েছে পাপের দুর্দহন,
সভ্যনামিক পাতালে যেথায়
জমেছে লুটের ধন।
দুঃসহ তাপে গর্জি উঠিল
ভূমিকম্পের রোল,
জয়তোরণের ভিত্তিভূমিতে
লাগিল ভীষণ দোল।
বিদীর্ণ হল ধনভাণ্ডারতল,
জাগিয়া উঠিছে গুপ্ত গুহার
কালীনাগিনীর দল।
দুলিছে বিকট ফণা,
বিষনিশ্বাসে ফুঁসিছে অগ্নিকণা।
নিরর্থ হাহাকারে
দিয়ো না দিয়ো না অভিশাপ বিধাতারে।
পাপের এ সঞ্চয়
সর্বনাশের পাগলের হাতে
আগে হয়ে যাক ক্ষয়।
বিষম দুঃখে ব্রণের পিণ্ড
বিদীর্ণ হয়ে, তার
কলুষপুঞ্জ ক'রে দিক উদগার।
ধরার বক্ষ চিরিয়া চলুক
বিজ্ঞানী হাড়গিলা,
রক্তসিক্ত লুব্ধ নখর
একদিন হবে ঢিলা।
প্রতাপের ভোজে আপনারে যারা বলি করেছিল দান
সে-দুর্বলের দলিত পিষ্ট প্রাণ
নরমাংসাশী করিতেছে কাড়াকাড়ি,
ছিন্ন করিছে নাড়ী।
তীক্ষ্ণ দশনে টানাছেঁড়া তারি দিকে দিকে যায় ব্যেপে
রক্তপঙ্কে ধরার অঙ্ক লেপে।
সেই বিনাশের প্রচণ্ড মহাবেগে
একদিন শেষে বিপুলবীর্য শান্তি উঠিবে জেগে।
মিছে করিব না ভয়,
ক্ষোভ জেগেছিল তাহারে করিব জয়।
জমা হয়েছিল আরামের লোভে
দুর্লভতার রাশি,
লাগুক তাহাতে লাগুক আগুন--
ভস্মে ফেলুক গ্রাসি।
ঐ দলে দলে ধার্মিক ভীরু
কারা চলে গির্জায়
চাটুবাণী দিয়ে ভুলাইতে দেবতায়।
দীনাত্মাদের বিশ্বাস, ওরা
ভীত প্রার্থনারবে
শান্তি আনিবে ভবে।
কৃপণ পূজায় দিবে নাকো কড়িকড়া।
থলিতে ঝুলিতে কষিয়া আঁটিবে
শত শত দড়িদড়া।
শুধু বাণীকৌশলে
জিনিবে ধরণীতলে।
স্তূপাকার লোভ
বক্ষে রাখিয়া জমা
কেবল শাস্ত্রমন্ত্র পড়িয়া
লবে বিধাতার ক্ষমা।
সবে না দেবতা হেন অপমান
এই ফাঁকি ভক্তির।
যদি এ ভুবনে থাকে আজো তেজ
কল্যাণশক্তির
ভীষণ যজ্ঞে প্রায়শ্চিত্ত
পূর্ণ করিয়া শেষে
নূতন জীবন নূতন আলোকে
জাগিবে নূতন দেশে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হে রাজন্, তুমি আমারে
বাঁশি বাজাবার দিয়েছ যে ভার
তোমার সিংহদুয়ারে–
ভুলি নাই তাহা ভুলি নাই,
মাঝে মাঝে তবু ভুলে যাই,
চেয়ে চেয়ে দেখি কে আসে কে যায়
কোথা হতে যায় কোথা রে।কেহ নাহি চায় থামিতে।
শিরে লয়ে বোঝা চলে যায় সোজা,
না চাহে দখিনে বামেতে।
বকুলের শাখে পাখি গায়,
ফুল ফুটে তব আঙিনায়–
না দেখিতে পায়,না শুনিতে চায়,
কোথা যায় কোন্ গ্রামেতে।বাঁশি লই আমি তুলিয়া।
তারা ক্ষণতরে পথের উপরে
বোঝা ফেলে বসে ভুলিয়া।
আছে যাহা চিরপুরাতন
তারে পায় যেন হারাধন,
বলে, “ফুল এ কী ফুটিয়াছে দেখি।
পাখি গায় প্রাণ খুলিয়া।’হে রাজন্,তুমি আমারে
রেখো চিরদিন বিরামবিহীন
তোমার সিংহদুয়ারে।
যারা কিছু নাহি কহে যায়,
সুখদুখভার বহে যায়,
তারা ক্ষণতরে বিস্ময়ভরে
দাঁড়াবে পথের মাঝারে
তোমার সিংহদুয়ারে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হে উষা, নিঃশব্দে এসো,
আকাশের তিমিরগুণ্ঠন
করে উন্মোচন।
হে প্রাণ, অন্তরে থেকে
মুকুলের বাহ্য আবরণ
করো উন্মোচন।
হে চিত্ত, জাগ্রত হও,
জড়ত্বের বাধা নিশ্চেতন
করে উন্মোচন।
ভেদবুদ্ধি-তামসের
মোহযবনিকা, হে আত্মন,
করে উন্মোচন। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এইক্ষণে
মোর হৃদয়ের প্রান্তে আমার নয়ন-বাতায়নে
যে-তুমি রয়েছ চেয়ে প্রভাত-আলোতে
সে-তোমার দৃষ্টি যেন নানা দিন নানা রাত্রি হতে
রহিয়া রহিয়া
চিত্তে মোর আনিছে বহিয়া
নীলিমার অপার সংগীত,
নিঃশব্দের উদার ইঙ্গিত।
আজি মনে হয় বারে বারে
যে মোর স্মরণের দূর পরপারে
দেখিয়াছ কত দেখা
কত যুগে, কত লোকে, কত জনতায়, কত একা।
সেই-সব দেখা আজি শিহরিছে দিকে দিকে
ঘাসে ঘাসে নিমিখে নিমিখে,
বেণুবনে ঝিলিমিলি পাতার ঝলক-ঝিকিমিকে।
কত নব নব অবগুণ্ঠনের তলে
দেখিয়াছ কত ছলে
চুপে চুপে
এক প্রেয়সীর মুখ কত রূপে রূপে
জন্মে জন্মে, নামহারা নক্ষত্রের গোধূলি-লগনে।
তাই আজি নিখিল গগনে
অনাদি মিলন তব অনন্ত বিরহ
এক পূর্ণ বেদনায় ঝংকারি উঠিছে অহরহ।
তাই যা দেখিছ তারে ঘিরেছে নিবিড়
যাহা দেখিছ না তারি ভিড়।
তাই আজি দক্ষিণ পবনে
ফাল্গুনের ফুলগন্ধে ভরিয়া উঠিছে বনে বনে
ব্যাপ্ত ব্যাকুলতা,
বহুশত জনমের চোখে-চোখে কানে-কানে কথা।
শিলাইদা, ৭ ফাল্গুন, ১৩২২
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
বাঁকাও ভুরু দ্বারে আগল দিয়া,
চক্ষু করো রাঙা,
ঐ আসে মোর জাত-খোয়ানো প্রিয়া
ভদ্র-নিয়ম-ভাঙা।
আসন পাবার কাঙাল ও নয় তো
আচার-মানা ঘরে-
আমি ওকে বসাব হয়তো
ময়লা কাঁথার 'পরে।
সাবধানে রয় বাজার-দরের খোঁজে
সাধু গাঁয়ের লোক.
ধুলার বরন ধূসর বেশে ও যে
এড়ায় তাদের চোখ।
বেশের আদর করতে গিয়ে ওরা
রূপের আদর ভোলে-
আমার পাশে ও মোর মনোচোরা,
একলা এসো চলে।
হঠাৎ কখন এসেছ ঘর ফেলে
তুমি পথিক বধূ,
মাটির ভাঁড়ে কোথায় থেকে পেলে
পদ্মাবনের মধু।
ভালোবাসি ভাবের সহজ খেলা
এসছ তাই শুনে-
মাটির পাত্রে নাইকো আমার হেলা
হাতের পরশগুণে।
পায়ে নূপুর নাই রহিল বাঁধা,
নাচেতে কাজ নাই,
যে-চলনটি রক্তে তোমার সাধা
মন ভোলাবে তাই।
লজ্জা পেতে লাগে তোমার লাজ
ভূষণ নেইকো বলে,
নষ্ট হবে নেই তো এমন সাজ
ধুলোর 'পরে চলে।
গাঁয়ের কুকুর ফেরে তোমার পাশে,
রাখালরা হয় জড়ো,
বেদের মেয়ের মতন অনায়াসে
টাট্টু ঘোড়ায় চড়ো।
ভিজে শাড়ি হাঁটুর 'পরে তুলে
পার হয়ে যাও নদী,
বামুনপাড়ার রাস্তা যে যাই ভুলে
তোমায় দেখি যদি।
হাটের দিনে শাক তুলে নাও ক্ষেতে
চুপড়ি নিয়ে কাঁধে,
মটর কলাই খাওয়াও আঁচল পেতে
পথের গাধাটাকে।
মান নাকো বাদল দিনের মানা,
কাদায়-মাখা পায়ে
মাথায় তুলে কচুর পাতাখানা
যাও চলে দূর গাঁয়ে।
পাই তোমারে যেমন খুশি তাই
যেতায় খুশি সেথা।
আয়োজনের বালাই কিছু নাই
জানবে বলো কে তা।
সতর্কতার দায় গুচায়ে দিয়ে
পাড়ার অনাদরে
এসো ও মোর জাত খোয়ানো প্রিয়ে,
মু্ক্ত পথের 'পরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির
পাঁচ বোন থাকে কাল্নায়,
শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়,
হাঁড়িগুলো রাখে আল্নায়।
কোনো দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে
নিজে থাকে তারা লোহাসিন্দুকে,
টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে ব’লে
রেখে দেয় খোলা জাল্নায়–
নুন দিয়ে তারা ছাঁচিপান সাজে,
চুন দেয় তারা ডাল্নায়। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
চিরজনমের বেদনা,
ওহে চিরজীবনের সাধনা।
তোমার আগুন উঠুক হে জ্বলে,
কৃপা করিয়ো না দুর্বল ব’লে,
যত তাপ পাই সহিবারে চাই,
পুড়ে হোক ছাই বাসনা।
অমোঘ যে ডাক সেই ডাক দাও
আর দেরি কেন মিছে।
যা আছে বাঁধন বক্ষ জড়ায়ে
ছিঁড়ে প’ড়ে যাক পিছে।
গরজি গরজি শঙ্খ তোমার
বাজিয়া বাজিয়া উঠুক এবার,
গর্ব টুটিয়া নিদ্রা ছুটিয়া
জাগুক তীব্র চেতনা। কলিকাতা, ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
আমি বিন্দুমাত্র আলো, মনে হয় তবু
আমি শুধু আছি আর কিছু নাই কভু।
পলক পড়িল দেখি আড়ালে আমার
তুমি আছ হে অনাদি আদি অন্ধকার! (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে
যাহাদের জীবনের ভিত্তি যায় বারংবার কেঁপে,
যারা অন্যমনা,তারা শোনো
আপনারে ভুলো না কখনো।
মৃত্যুঞ্জয় যাহাদের প্রাণ,
সব তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দীপ যারা জ্বালে অনির্বাণ,
তাহাদের মাঝে যেন হয়
তোমাদেরি নিত্য পরিচয়।
তাহাদের খর্ব কর যদি
খর্বতার অপমানে বন্দী হয়ে রবে নিরবধি।
তাদের সন্মানে মান নিয়ো
বিশ্বে যারা চিরস্মরণীয়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে,
আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে?
থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে
আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
নিশিদিন কাঁদি , সখী , মিলনের তরে
যে মিলন ক্ষুধাতুর মৃত্যুর মতন ।
লও লও বেঁধে লও কেড়ে লও মোরে —
লও লজ্জা , লও বস্ত্র , লও আবরণ ।
এ তরুণ তনুখানি লহ চুরি করে —
আঁখি হতে লও ঘুম , ঘুমের স্বপন ।
জাগ্রত বিপুল বিশ্ব লও তুমি হরে
অনন্তকালের মোর জীবন – মরণ ।
বিজন বিশ্বের মাঝে মিলনশ্মশানে
নির্বাপিতসূর্যালোক লুপ্ত চরাচর ,
লাজমুক্ত বাসমুক্ত দুটি নগ্ন প্রাণে
তোমাতে আমাতে হই অসীম সুন্দর ।
এ কী দুরাশার স্বপ্ন হায় গো ঈশ্বর ,
তোমা ছাড়া এ মিলন আছে কোন্খানে ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শ্রীমান ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কল্যাণীয়েষুআমার কাছে শুনতে চেয়েছ
গানের কথা;
বলতে ভয় লাগে,
তবু কিছু বলব।
মানুষের জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছে
আপন সার্থক ভাষা।
মানুষের বোধ অবুঝ, সে বোবা,
যেমন বোবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।
সেই বিরাট বোবা
আপনাকে প্রকাশ করে ইঙ্গিতে,
ব্যাখ্যা করে না।
বোবা বিশ্বের আছে ভঙ্গি, আছে ছন্দ,
আছে নৃত্য আকাশে আকাশে।
অণুপরমাণু অসীম দেশে কালে
বানিয়েছে আপন আপন নাচের চক্র,
নাচছে সেই সীমায় সীমায়;
গড়ে তুলছে অসংখ্য রূপ।
তার অন্তরে আছে বহ্নিতেজের দুর্দাম বোধ
সেই বোধ খুঁজছে আপন ব্যঞ্জনা,
ঘাসের ফুল থেকে শুরু ক'রে
আকাশের তারা পর্যন্ত।
মানুষের বোধের বেগ যখন বাঁধ মানে না,
বাহন করতে চায় কথাকে,--
তখন তার কথা হয়ে যায় বোবা,
সেই কথাটা খোঁজে ভঙ্গি, খোঁজে ইশারা,
খোঁজে নাচ, খোঁজে সুর,
দেয় আপনার অর্থকে উলটিয়ে,
নিয়মকে দেয় বাঁকা ক'রে।
মানুষ কাব্যে রচে বোবার বাণী।
মানুষের বোধ যখন বাহন করে সুরকে
তখন বিদ্যুচ্চঞ্চল পরমাণুপুঞ্জের মতোই
সুরসংঘকে বাঁধে সীমায়,
ভঙ্গি দেয় তাকে,
নাচায় তাকে বিচিত্র আবর্তনে।
সেই সীমায়-বন্দী নাচন
পায় গানে-গড়া রূপ।
সেই বোবা রূপের দল মিলতে থাকে।
সৃষ্টির অন্দরমহলে,
সেখানে যত রূপের নটী আছে
ছন্দ মেলায় সকলের সঙ্গে
নূপুর-বাঁধা চাঞ্চল্যের
দোলযাত্রায়।
আমি যে জানি
এ-কথা যে-মানুষ জানায়
বাক্যে হোক সুরে হোক, রেখায় হোক,
সে পণ্ডিত।
আমি যে রস পাই, ব্যথা পাই,
রূপ দেখি,
এ-কথা যার প্রাণ বলে
গান তারি জন্যে,
শাস্ত্রে সে আনাড়ি হলেও
তার নাড়িতে বাজে সুর।
যদি সুযোগ পাও
কথাটা নারদমুনিকে শুধিয়ো,
ঝগড়া বাধাবার জন্যে নয়,
তত্ত্বের পার পাবার জন্যে সংজ্ঞার অতীতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
জানার বাঁশি হাতে নিয়ে
না-জানা
বাজান তাঁহার নানা সুরের
বাজানা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল,
হাট ভ’রে দিই আমি কত শস্য ফল।
পর্বত দাঁড়ায়ে রন কী জানি কী কাজ,
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ।
বিধাতার অবিচার, কেন উঁচুনিচু
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে, সব হলে সমভূমি-পারা
নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গলধারা? (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খেলাধুলো সব রহিল পড়িয়া,
ছুটে চ ' লে আসে মেয়ে—
বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। '
আঁখির পাতায় হাসি চমকায়,
ঠোঁটে নেচে ওঠে হাসি—
হয়ে যায় ভুল, বাঁধে নাকো চুল,
খুলে পড়ে কেশরাশি।
দুটি হাত তার ঘিরিয়া ঘিরিয়া
রাঙা চুড়ি কয়গাছি,
করতালি পেয়ে বেজে ওঠে তারা;
কেঁপে ওঠে তারা নাচি।
মায়ের গলায় বাহু দুটি বেঁধে
কোলে এসে বসে মেয়ে।
বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। '
সোনালি রঙের পাখির পালক
ধোওয়া সে সোনার স্রোতে—
খসে এল যেন তরুণ আলোক
অরুণের পাখা হতে।
নয়ন-ঢুলানো কোমল পরশ
ঘুমের পরশ যথা—
মাখা যেন তায় মেঘের কাহিনী,
নীল আকাশের কথা।
ছোটোখাটো নীড়, শাবকের ভিড়,
কতমত কলরব,
প্রভাতের সুখ, উড়িবার আশা—
মনে পড়ে যেন সব।
লয়ে সে পালক কপোলে বুলায়,
আঁখিতে বুলায় মেয়ে,
বলে হেসে হেসে, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। '
মা দেখিল চেয়ে, কহিল হাসিয়ে,
‘কিবা জিনিসের ছিরি!'
ভূমিতে ফেলিয়া গেল সে চলিয়া,
আর না চাহিল ফিরি।
মেয়েটির মুখে কথা না ফুটিল,
মাটিতে রহিল বসি।
শূন্য হতে যেন পাখির পালক
ভূতলে পড়িল খসি।
খেলাধুলো তার হল নাকো আর,
হাসি মিলাইল মুখে,
ধীরে ধীরে শেষে দুটি ফোঁটা জল
দেখা দিল দুটি চোখে।
পালকটি লয়ে রাখিল লুকায়ে
গোপনের ধন তার—
আপনি খেলিত, আপনি তুলিত,
দেখাত না কারে আর। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
পেঁচা রাষ্ট্র করি দেয় পেলে কোনো ছুতা,
জান না আমার সাথে সূর্যের শত্রুতা! (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
অন্ধকারের পার হতে আনি
প্রভাতসূর্য মন্দ্রিল বাণী,
জাগালো বিচিত্রেরে
এক আলোকের আলিঙ্গনের ঘেরে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
সকলে আমার কাছে যত কিছু চায়
সকলেরে আমি তাহা পেরেছি কি দিতে !
আমি কি দিই নি ফাঁকি কত জনে হায় ,
রেখেছি কত – না ঋণ এই পৃথিবীতে ।
আমি তবে কেন বকি সহস্র প্রলাপ ,
সকলের কাছে চাই ভিক্ষা কুড়াইতে !
এক তিল না পাইলে দিই অভিশাপ ,
অমনি কেন রে বসি কাতরে কাঁদিতে !
হা ঈশ্বর , আমি কিছু চাহি নাকো আর ,
ঘুচাও আমার এই ভিক্ষার বাসনা ।
মাথায় বহিয়া লয়ে চির ঋণভার
‘ পাইনি’ ‘পাইনি’ বলে আর কাঁদিব না ।
তোমারেও মাগিব না , অলস কাঁদনি —
আপনারে দিলে তুমি আসিবে আপনি । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বাদল দিনের প্রথম কদমফুল
আমায় করেছ দান,
আমি তো দিয়েছি ভরা শ্রাবণের
মেঘমল্লার গান।
সজল ছায়ার অন্ধকারে
ঢাকিয়া তারে
এনেছি সুরে শ্যামল খেতের
প্রথম সোনার ধান।আজ এনে দিলে যাহা
হয়তো দিবে না কাল,
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
স্মৃতিবন্যার উছল প্লাবনে
আমার এ গান শ্রাবণে শ্রাবণে
ফিরিয়া ফিরিয়া বাহিবে তরণী
ভরি তব সম্মান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী,
অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।
সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,
সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে,
বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।মনে করি অমনি সুরে গাই,
কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই।
কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে;
হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে;
আমায় তুমি ফেলেছ কোন্ ফাঁদে
চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি!১০ ভাদ্র- রাত্রি, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
জটিল সংসার,
মোচন করিতে গ্রন্থি জড়াইয়া পড়ি বারংবার।
গম্য নহে সোজা,
দুর্গম পথের যাত্রা স্কন্ধে বহি দুশ্চিন্তার বোঝা।
পথে পথে যথাতথা
শত শত কৃত্রিম বক্রতা।
অণুক্ষণ
হতাশ্বাস হয়ে শেষে হার মানে মন।
জীবনের ভাঙা ছন্দে ভ্রষ্ট হয় মিল,
বাঁচিবার উৎসাহ ধূলিতলে লুটায়ে শিথিল।
ওগো আশাহারা,
শুষ্কতার 'পরে আনো নিখিলের রসবন্যাধারা।
বিরাট আকাশে,
বনে বনে, ধরণীর ঘাসে ঘাসে
সুগভীর অবকাশ পূর্ণ হয়ে আছে
গাছে গাছে,
অন্তহীন শান্তি-উৎসস্রোতে।
অন্তঃশীল যে রহস্য আঁধারে আলোতে
তারে সদ্য করুক আহ্বান
আদিম প্রাণের যজ্ঞে মর্মের সহজ সামগান।
আত্মার মহিমা যাহা তুচ্ছতায় দিয়েছে জর্জরি
ম্লান অবসাদে,তারে দাও দূর করি,
লুপ্ত হয়ে যাক শূন্যতলে
দ্যুলোকের ভূলোকের সন্মিলিত মন্ত্রণার বলে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বেণীর মোটরখানা
চালায় মুখুর্জে।
বেণী ঝেঁকে উঠে বলে,
“মরল কুকুর যে!’
অকারণে সেরে দিলে
দফা ল্যাম্-পোস্টার,
নিমেষেই পরলোকে
গতি হল মোষটার।
যেদিকে ছুটেছে সোজা
ওদিকে পুকুর যে–
আরে চাপা পড়ল কে?
জামাই খুকুর যে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
তবে আমি যাই গো তবে যাই
ভোরের বেলা শূন্য কোলে
ডাকবি যখন খোকা বলে,
বলব আমি, ‘নাই সে খোকা নাই। '
মা গো, যাই।
হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে
যাব মা, তোর বুকে বয়ে,
ধরতে আমায় পারবি নে তো হাতে।
জলের মধ্যে হব মা, ঢেউ,
জানতে আমায় পারবে না কেউ—
স্নানের বেলা খেলব তোমার সাথে।
বাদলা যখন পড়বে ঝরে
রাতে শুয়ে ভাববি মোরে,
ঝর্ঝরানি গান গাব ওই বনে।
জানলা দিয়ে মেঘের থেকে
চমক মেরে যাব দেখে,
অমার হাসি পড়বে কি তোর মনে।
খোকার লাগি তুমি মা গো,
অনেক রাতে যদি জাগ
তারা হয়ে বলব তোমায়, ‘ঘুমো!'
তুই ঘুমিয়ে পড়লে পরে
জ্যোৎস্না হয়ে ঢুকব ঘরে,
চোখে তোমার খেয়ে যাব চুমো।
স্বপন হয়ে আঁখির ফাঁকে
দেখতে আমি আসব মাকে,
যাব তোমার ঘুমের মধ্যিখানে।
জেগে তুমি মিথ্যে আশে
হাত বুলিয়ে দেখবে পাশে—
মিলিয়ে যাব কোথায় কে তা জানে।
পুজোর সময় যত ছেলে
আঙিনায় বেড়াবে খেলে,
বলবে ‘খোকা নেই রে ঘরের মাঝে'।
আমি তখন বাঁশির সুরে
আকাশ বেয়ে ঘুরে ঘুরে
তোমার সাথে ফিরব সকল কাজে।
পুজোর কাপড় হাতে করে
মাসি যদি শুধায় তোরে,
‘খোকা তোমার কোথায় গেল চলে। '
বলিস ‘খোকা সে কি হারায়,
আছে আমার চোখের তারায়,
মিলিয়ে আছে আমার বুকে কোলে। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
লাঠি গালি দেয়, ছড়ি, তুই সরু কাঠি!
ছড়ি তারে গালি দেয়, তুমি মোটা লাঠি! (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিগাথা
|
নিম্নে আবর্তিয়া ছুটে যমুনার জল--
দুই তীরে গিরিতট, উচ্চ শিলাতল।
সংকীর্ণ গুহার পথে মূর্ছি জলধার
উন্মত্ত প্রলাপে ওঠে গর্জি অনিবার।এলায়ে জটিল বক্র নির্ঝরের বেণী
নীলাভ দিগন্তে ধায় নীল গিরিশ্রেণী।
স্থির তাহা, নিশিদিন তবু যেন চলে--
চলা যেন বাঁধা আছে অচল শিকলে।মাঝে মাঝে শাল তাল রয়েছে দাঁড়ায়ে,
মেঘেরে ডাকিছে গিরি ইঙ্গিত বাড়ায়ে।
তৃণহীন সুকঠিন শতদীর্ণ ধরা,
রৌদ্রবন বনফুলে কাঁটাগাছ ভরা।দিবসের তাপ ভূমি দিতেছে ফিরায়ে--
দাঁড়ায়ে রয়েছে গিরি আপনার ছায়ে
পথশূন্য, জনশূন্য, সাড়া-শব্দ-হীন।
ডুবে রবি, যেমন সে ডুবে প্রতিদিন।রঘুনাথ হেথা আসি যবে উত্তরিলা
শিখগুরু পড়িছেন ভগবৎ লীলা।
রঘু কহিলেন নমি চরণে তাঁহার,
"দীন আনিয়াছে, প্রভু, হীন উপহার।'বাহু বাড়াইয়া গুরু শুধায়ে কুশল
আশিসিলা মাথায় পরশি করতল।
কনকে মাণিক্যে গাঁথা বলয়-দুখানি
গুরুপদে দিলা রঘু জুড়ি দুই পাণি।ভূমিতল হইতে বালা লইলেন তুলে,
দেখিতে লাগিলা প্রভু ঘুরায়ে অঙ্গুলে।
হীরকের সূচীমুখ শতবার ঘুরি
হানিতে লাগিল শত আলোকের ছুরি।ঈষৎ হাসিয়া গুরু পাশে দিলা রাখি,
আবার সে পুঁথি-'পরে নিবেশিলা আঁখি।
সহসা একটি বালা শিলাতল হতে
গড়ায়ে পড়িয়া গেল যমুনার স্রোতে।"আহা আহা" চীৎকার করি রঘুনাথ
ঝাঁপায়ে পড়িল জলে বাড়ায়ে দু হাত।
আগ্রহে সমস্ত তার প্রাণমনকায়
একখানি বাহু হয়ে ধরিবারে যায়।বারেকের তরে গুরু না তুলিলা মুখ,
নিভৃত অন্তরে তাঁর জাগে পাঠসুখ।
কালো জল কটাক্ষিয়া চলে ঘুরি ঘুরি,
যেন সে ছলনাভরা সুগভীর চুরি।দিবালোক চলে গেল দিবসের পিছু
যমুনা উতলা করি না মিলিল কিছু।
সিক্তবস্ত্রে রিক্তহাতে শ্রান্তনতশিরে
রঘুনাথ গুরু-কাছে আসিলেন ফিরে।"এখনো উঠাতে পারি' করজোড়ে যাচে,
"যদি দেখাইয়া দাও কোন্খানে আছে।'
দ্বিতীয় কঙ্কণখানি ছুঁড়ি দিয়া জলে
গুরু কহিলেন, "আছে ওই নদীতলে।'
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
কিসের অশান্তি এই মহাপারাবারে ,
সতত ছিঁড়িতে চাহে কিসের বন্ধন !
অব্যক্ত অস্ফুট বাণী ব্যক্ত করিবারে
শিশুর মতন সিন্ধু করিছে ক্রন্দন ।
যুগযুগান্তর ধরি যোজন যোজন
ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে উত্তাল উচ্ছ্বাস —
অশান্ত বিপুল প্রাণ করিছে গর্জন ,
নীরবে শুনিছে তাই প্রশান্ত আকাশ ।
আছাড়ি চূর্ণিতে চাহে সমগ্র হৃদয়
কঠিন পাষাণময় ধরণীর তীরে ,
জোয়ারে সাধিতে চায় আপন প্রলয় ,
ভাঁটায় মিলাতে চায় আপনার নীরে ।
অন্ধ প্রকৃতির হৃদে মৃত্তিকায় বাঁধা ।
সতত দুলিছে ওই অশ্রুর পাথার ,
উন্মুখী বাসনা পায় পদে পদে বাধা ,
কাঁদিয়া ভাসাতে চাহে জগৎ-সংসার ।
সাগরের কণ্ঠ হতে কেড়ে নিয়ে কথা
সাধ যায় ব্যক্ত করি মানবভাষায় —
শান্ত করে দিই ওই চির-ব্যাকুলতা ,
সমুদ্রবায়ুর ওই চির হায়-হায় ।
সাধ যায় মোর গীতে দিবস-রজনী
ধ্বনিবে পৃথিবী-ঘেরা সংগীতের ধ্বনি । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে।
বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে॥
তোমার মোহন এল ভীষণ বেশে, আকাশ ঢাকা জটিল কেশে–
বুঝি এল তোমার সাধনধন চরম সর্বনাশে॥
বাতাসে তোর সুর ছিল না, ছিল তাপে ভরা।
পিপাসাতে বুক-ফাটা তোর শুষ্ক কঠিন ধরা।
এবার জাগ্রে হতাশ, আয় রে ছুটে অবসাদের বাঁধন টুটে–
বুঝি এল তোমার পথের সাথি বিপুল অট্টহাসে॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কনের পণের আশে
চাকরি সে ত্যেজেছে।
বারবার আয়নাতে
মুখখানি মেজেছে।
হেনকালে বিনা কোনো কসুরে
যম এসে ঘা দিয়েছে শ্বশুরে,
কনেও বাঁকালো মুখ–
বুকে তাই বেজেছে।
বরবেশ ছেড়ে হীরু
দরবেশ সেজেছে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
তুমি এ মনের সৃষ্টি, তাই মনোমাঝে
এমন সহজে তব প্রতিমা বিরাজে।
যখন তোমারে হেরি জগতের তীরে
মনে হয় মন হতে এসেছ বাহিরে।
যখন তোমারে দেখি মনোমাঝখানে
মনে হয় জন্ম-জন্ম আছ এ পরানে।
মানসীরূপিণী তুমি, তাই দিশে দিশে
সকল সৌন্দর্যসাথে যাও মিলে মিশে।
চন্দ্রে তব মুখশোভা, মুখে চন্দ্রোদয়,
নিখিলের সাথে তব নিত্য বিনিময়।
মনের অনন্ত তৃষ্ণা মরে বিশ্ব ঘুরি,
মিশায় তোমার সাথে নিখিল মাধুরী।
তার পরে মনগড়া দেবতারে মন
ইহকাল পরকাল করে সমর্পণ। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
আম্র কহে, এক দিন, হে মাকাল ভাই,
আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই—
মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি,
মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মুক্তবাতায়নপ্রান্তে জনশূন্য ঘরে
বসে থাকি নিস্তব্ধ প্রহরে,
বাহিরে শ্যামল ছন্দে উঠে গান
ধরণীর প্রাণের আহ্বান;
অমৃতের উৎসস্রোতে
চিত্ত ভেসে চলে যায় দিগন্তের নীলিম আলোতে।
কার পানে পাঠাইবে স্তুতি
ব্যগ্র এই মনের আকূতি,
অমূল্যেরে মূল্য দিতে ফিরে সে খুঁজিয়া বাণীরূপ,
করে থাকে চুপ,
বলে,আমি আনন্দিত– ছন্দ যায় থামি–
বলে, ধন্য আমি। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে
বাঁধব না আজ তোড়ায়,
রঙ-বেরঙের সুতোগুলো থাক্,
থাক্ পড়ে ঐ জরির ঝালর।
শুনে ঘরের লোকে বলে,
"যদি না বাঁধ জড়িয়ে জড়িয়ে
ওদের ধরব কী করে,
ফুলদানিতে সাজাব কোন্ উপায়ে?"
আমি বলি,
"আজকে ওরা ছুটি-পাওয়া নটী,
ওদের উচ্চহাসি অসংযত,
ওদের এলোমেলো হেলাদোলা
বকুলবনে অপরাহ্নে,
চৈত্রমাসের পড়ন্ত রৌদ্রে।
আজ দেখো ওদের যেমন-তেমন খেলা,
শোনো ওদের যখন-তখন কলধ্বনি,
তাই নিয়ে খুশি থাকো।"
বন্ধু বললে,
"এলেম তোমার ঘরে
ভরা পেয়ালার তৃষ্ণা নিয়ে।
তুমি খ্যাপার মতো বললে,
আজকের মতো ভেঙে ফেলেছি
ছন্দের সেই পুরোনো পেয়ালাখানা
আতিথ্যের ত্রুটি ঘটাও কেন?"
আমি বলি, "চলো না ঝরনাতলায়,
ধারা সেখানে ছুটছে আপন খেয়ালে,
কোথাও মোটা, কোথাও সরু।
কোথাও পড়ছে শিখর থেকে শিখরে,
কোথাও লুকোল গুহার মধ্যে।
তার মাঝে মাঝে মোটা পাথর
পথ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বর্বরের মতো,
মাঝে মাঝে গাছের শিকড়
কাঙালের মতো ছড়িয়েছে আঙুলগুলো,
কাকে ধরতে চায় ঐ জলের ঝিকিমিকির মধ্যে?"
সভার লোকে বললে,
"এ যে তোমার আবাঁধা বেণীর বাণী,
বন্দিনী সে গেল কোথায়?"
আমি বলি, "তাকে তুমি পারবে না আজ চিনতে,
তার সাতনলী হারে আজ ঝলক নেই,
চমক দিচ্ছে না চুনি-বসানো কঙ্কণে।"
ওরা বললে, "তবে মিছে কেন?
কী পাবে ওর কাছ থেকে?"
আমি বলি, "যা পাওয়া যায় গাছের ফুলে
ডালে পালায় সব মিলিয়ে।
পাতার ভিতর থেকে
তার রঙ দেখা যায় এখানে সেখানে,
গন্ধ পাওয়া যায় হাওয়ার ঝাপটায়।
চারদিকের খোলা বাতাসে
দেয় একটুখানি নেশা লাগিয়ে।
মুঠোয় করে ধরবার জন্যে সে নয়,
তার অসাজানো আটপহুরে পরিচয়কে
অনাসক্ত হয়ে মানবার জন্যে
তার আপন স্থানে।"
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
শেষের মধ্যে অশেষ আছে
এই কথাটি মনে,
আজকে আমার গানের শেষে
জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।
সুর গিয়েছে থেমে তবু
থামতে যেন চায় না কভু,
নীরবতায় বাজছে বীণা
বিনা প্রয়োজনে।তারে যখন আঘাত লাগে,
বাজে যখন সুরে--
সবার চেয়ে বড়ো যে গান
সে রয় বহুদূরে।
সকল আলাপ গেলে থেমে
শান্ত বীণায় আসে নেমে,
সন্ধ্যা যেমন দিনের শেষে
বাজে গভীর স্বনে। কলিকাতা, ২৬ শ্রাবণ, ১৩১৭
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
আলো নাই, দিন শেষ হল, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
ঘন্টা বাজিল দূরে
ও পারের রাজপুরে,
এখনো যে পথে চলেছিস তুই
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।দেখ্ সবে ঘরে ফিরে এল, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
পূজা সারি দেবালয়ে
প্রসাদী কুসুম লয়ে,
এখন ঘুমের কর্ আয়োজন
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।রজনী আঁধার হয়ে আসে, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
ওই-যে গ্রামের ‘পরে
দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে–
দীপহীন পথে কী করিবি একা
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।এত বোঝা লয়ে কোথা যাস, ওরে
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
নামাবি এমন ঠাঁই
পাড়ায় কোথা কি নাই।
কেহ কি শয়ন রাখে নাই পাতি
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ।পথের চিহ্ন দেখা নাহি যায়
পান্থ, বিদেশী পান্থ।
কোন্ প্রান্তরশেষে
কোন্ বহুদূর দেশে
কোথা তোর রাত হবে যে প্রভাত
হায় রে পথশ্রান্ত
পান্থ, বিদেশী পান্থ। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার দয়া যদি
চাহিতে নাও জানি
তবুও দয়া করে
চরণে নিয়ো টানি।
আমি যা গড়ে তুলে
আরামে থাকি ভুলে
সুখের উপাসনা
করি গো ফলে ফুলে–
সে ধুলা-খেলাঘরে
রেখো না ঘৃণাভরে,
জাগায়ো দয়া করে
বহ্নি-শেল হানি। সত্য মুদে আছে
দ্বিধার মাঝখানে,
তাহারে তুমি ছাড়া
ফুটাতে কে বা জানে।
মৃত্যু ভেদ করি’
অমৃত পড়ে ঝরি’,
অতল দীনতার
শূন্য উঠে ভরি’
পতন-ব্যথা মাঝে
চেতনা আসি বাজে,
বিরোধ কোলাহলে
গভীর তব বাণী।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
মধুর সূর্যের আলো , আকাশ বিমল ,
সঘনে উঠিছে নাচি তরঙ্গ উজ্জ্বল ।
মধ্যাহ্নের স্বচ্ছ করে
সাজিয়াছে থরে থরে
ক্ষুদ্র নীল দ্বীপগুলি , শুভ্র শৈলশির ।
কাননে কুঁড়িরে ঘিরি
পড়িতেছে ধীরি ধীরি
পৃথিবীর অতি মৃদু নিশ্বাসসমীর ।
একই আনন্দে যেন গায় শত প্রাণ —
বাতাসের গান আর পাখিদের গান ।
সাগরের জলরব
পাখিদের কলরব
এসেছে কোমল হয়ে স্তব্ধতার সংগীত-সমান ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সংসার মোহিনী নারী কহিল সে মোরে,
তুমি আমি বাঁধা রব নিত্য প্রেমডোরে।
যখন ফুরায়ে গেল সব লেনা দেনা,
কহিল, ভেবেছ বুঝি উঠিতে হবে না! (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।
শূন্য ঝুলি আজিকে আমার;
দিয়েছি উজাড় করি
যাহা-কিছু আছিল দিবার,
প্রতিদানে যদি কিছু পাই
কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা
তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই
পারের খেয়ায় যাব যবে
ভাষাহীন শেষের উৎসবে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লহ করুণা করে।ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লহ করুণা করে।ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
গুপ্তিপাড়ায় জন্ম তাহার;
নিন্দাবাদের দংশনে
অভিমানে মরতে গেল
মোগলসরাই জংসনে।
কাছা কোঁচা ঘুচিয়ে গুপি
ধরল ইজের, পরল টুপি,
দু হাত দিয়ে লেগে গেল
কোফ্তা-কাবাব-ধ্বংসনে।
গুরুপুত্র সঙ্গে ছিল–
বললে তারে, “অংশ নে।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান-কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা--
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা॥একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা---
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা---
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা॥গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে---
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে॥ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও---
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥ যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে?--- আর নাই, দিয়েছি ভরে॥
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে---
এখন আমারে লহো করুণা ক'রে॥ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহি নু পড়ি---
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
জাল কহে, পঙ্ক আমি উঠাব না আর।
জেলে কহে, মাছ তবে পাওয়া হবে ভার। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
চাহিছ বারে বারে
আপনারে ঢাকিতে—
মন না মানে মানা,
মেলে ডানা আঁখিতে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী,
আমার মুখে তোমার নাম কি সাজে।
যখন সবাই উপহাসে তখন ভাবি আমি
আমার কণ্ঠে তোমার নাম কি বাজে।
তোমা হতে অনেক দূরে থাকি
সে যেন মোর জানতে না রয় বাকি,
নামগানের এই ছদ্মবেশে দিই পরিচয় পাছে
মনে মনে মরি যে সেই লাজে।অহংকারের মিথ্যা হতে বাঁচাও দয়া করে
রাখো আমায় যেথা আমার স্থান।
আর-সকলের দৃষ্টি হতে সরিয়ে দিয়ে মোরে
করো তোমার নত নয়ন দান।
আমার পূজা দয়া পাবার তরে,
মান যেন সে না পায় করো ঘরে,
নিত্য তোমায় ডাকি আমি ধুলার ‘পরে বসে
নিত্যনূতন অপরাধের মাঝে।রেলপথ। ই। বি। এস। আর, ২২ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
তরঙ্গের বাণী সিন্ধু
চাহে বুঝাবারে।
ফেনায়ে কেবলি লেখে,
মুছে বারে বারে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
শুনলো শুনলো বালিকা,
রাখ কুসুমমালিকা,
কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহিরে।
দুলই কুসুম মুঞ্জরী,
ভমর ফিরই গুঞ্জরি,
অলস যমুনা বহয়ি যায় ললিত গীত গাহিরে।
শশি-সনাথ যামিনী,
বিরহ-বিধুর কামিনী,
কুসুমহার ভইল ভার হৃদয় তার দাহিছে।
অধর উঠই কাঁপিয়া,
সখি-করে কর আপিয়া,
কুঞ্জভবনে পাপিয়া কাহে গীত গাহিছে। মৃদু সমীর সঞ্চলে
হরয়ি শিথিল অঞ্চলে,
বালি হৃদয় চঞ্চলে কানন-পথ চাহিরে;
কুঞ্জপানে হেরিয়া,
অশ্রুবারি ডারিয়া
ভানু গায় শূন্যকুঞ্জ শ্যামচন্দ্র নাহিরে! (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কহিলেন বসুন্ধরা, দিনের আলোকে
আমি ছাড়া আর কিছু পড়িত না চোখে,
রাত্রে আমি লুপ্ত যবে শূন্যে দিল দেখা
অনন্ত এ জগতের জ্যোতির্ময়ী লেখা।। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমার নয়ন-ভুলানো এলে।
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে।
শিউলিতলার পাশে পাশে
ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে
অরুণ-রাঙা-চরণ ফেলে
নয়ন-ভুলানো এলে।আলোছায়ার আঁচলখানি
লুটিয়ে পড়ে বনে বনে,
ফুলগুলি ওই মুখে চেয়ে
কী কথা কয় মনে মনে।
তোমায় মোরা করব বরণ,
মুখের ঢাকা করো হরণ,
ওই টুকু ওই মেঘাবরণ
দু হাত দিয়ে ফেলো ঠেলে।
নয়ন-ভুলানো এলে।বনদেবীর দ্বারে দ্বারে
শুনি গভীর শঙ্খধনি,
আকাশবীণার তারে তারে
জাগে তোমার আগমনী।
কোথায় সোনার নূপুর বাজে,
বুঝি আমার হিয়ার মাঝে,
সকল ভাবে সকল কাজে
পাষাণ-গালা সুধা ঢেলে–
নয়ন-ভুলানো এলে।শান্তিনিকেতন, ৭ ভাদ্র, ১৩১৫
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে
তব আনন্দ মহাসংগীতে বাজে।
তোমার আকাশ, উদার আলোকধারা,
দ্বার ছোটো দেখে ফেরে না যেন গো তারা,
ছয় ঋতু যেন সহজ নৃত্যে আসে
অন্তরে মোর নিত্য নূতন সাজে।তব আনন্দ আমার অঙ্গে মনে
বাধা যেন নাহি পায় কোনো আবরণে।
তব আনন্দ পরম দুঃখে মম
জ্বলে উঠে যেন পুণ্য আলোকসম,
তব আনন্দ দীনতা চূর্ণ করি’
ফুটে উঠে ফেটে আমার সকল কাজে।১৩ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
জীবনবহনভাগ্য নিত্য আশীর্বাদে
ললাট করুক স্পর্শ
অনাদি জ্যোতির দান-রূপে--
নব নব জাগরণে প্রভাতে প্রভাতে
মর্ত এ আয়ুর সীমানায়।
ম্লানিমার ঘন আবরণ
দিনে দিনে পড়ুক খসিয়া
অমর্তলোকের দ্বারে
নিদ্রায় জড়িত রাত্রিসম।
হে সবিতা,তোমার কল্যাণতম রূপ
কারো অপাবৃত,
সেই দিব্য আবির্ভাবে
হেরি আমি আপন আত্মারে
মৃত্যুর অতীত।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হেথায় তাহারে পাই কাছে —
যত কাছে ধরাতল , যত কাছে ফুলফল —
যত কাছে বায়ু জল আছে ।
যেমন পাখির গান , যেমন জলের তান ,
যেমনি এ প্রভাতের আলো ,
যেমনি এ কোমলতা , অরণ্যের শ্যামলতা ,
তেমনি তাহারে বাসি ভালো ।
যেমন সুন্দর সন্ধ্যা , যেমন রজনীগন্ধা ,
শুকতারা আকাশের ধারে ,
যেমন সে অকলুষা শিশিরনির্মলা উষা ,
তেমনি সুন্দর হেরি তারে ।
যেমন বৃষ্টির জল , যেমন আকাশতল ,
সুখসুপ্তি যেমন নিশার ,
যেমন তটিনীনীর , বটচ্ছায়া অটবীর ,
তেমনি সে মোর আপনার ।
যেমন নয়ন ভরি অশ্রুজল পড়ে ঝরি
তেমনি সহজ মোর গীতি —
যেমন রয়েছে প্রাণ ব্যাপ্ত করি মর্মস্থান
তেমনি রয়েছে তার প্রীতি । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
জ্বেলে দিয়ে যাও সন্ধ্যাপ্রদীপ
বিজন ঘরের কোণে।
নামিল শ্রাবণ, কালো ছায়া তার
ঘনাইল বনে বনে।বিস্ময় আনো ব্যগ্র হিয়ার পরশ-প্রতীক্ষায়
সজল পবনে নীল বসনের চঞ্চল কিনারায়,
দুয়ার-বাহির হতে আজি ক্ষণে ক্ষণে
তব কবরীর কবরীমালার বারতা আসুক মনে।বাতায়ন হতে উৎসুক উই আঁখি
তব মঞ্জীর-ধ্বনি পথ বেয়ে
তোমারে কি যায় ডাকি।কম্পিত এই মোর বক্ষের ব্যথা
অলকে তোমার আনে কি চঞ্চলতা
বকুলবনের মুখরিত সমীরণে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কোথা রাত্রি , কোথা দিন , কোথা ফুটে চন্দ্র সূর্য তারা ,
কে বা আসে কে বা যায় , কোথা বসে জীবনের মেলা ,
কে বা হাসে কে বা গায় , কোথা খেলে হৃদয়ের খেলা ,
কোথা পথ , কোথা গৃহ , কোথা পান্থ , কোথা পথহারা !
কোথা খ ‘ সে পড়ে পত্র জগতের মহাবৃক্ষ হতে ,
উড়ে উড়ে ঘুরে মরে অসীমেতে না পায় কিনারা ,
বহে যায় কালবায়ু অবিশ্রাম আকাশের পথে ,
ঝর ঝর মর মর শুষ্ক পত্র শ্যাম পত্রে মিলে !
এত ভাঙা এত গড়া , আনাগোনা জীবন্ত নিখিলে ,
এত গান এত তান এত কান্না এত কলরব —
কোথা কে বা , কোথা সিন্ধু , কোথা ঊর্মি , কোথা তার বেলা —
গভীর অসীম গর্ভে নির্বাসিত নির্বাপিত সব !
জনপূর্ণ সুবিজনে , জ্যোতির্বিদ্ধ আঁধারে বিলীন
আকাশমণ্ডপে শুধু বসে আছে এক ‘চিরদিন’ ।২
কী লাগিয়া বসে আছ , চাহিয়া রয়েছ কার লাগি ,
প্রলয়ের পরপারে নেহারিছ কার আগমন ,
কার দূর পদধ্বনি চিরদিন করিছ শ্রবণ ,
চিরবিরহীর মতো চিররাত্রি রহিয়াছ জাগি !
অসীম অতৃপ্তি লয়ে মাঝে মাঝে ফেলিছ নিশ্বাস ,
আকাশপ্রান্তরে তাই কেঁদে উঠে প্রলয়বাতাস ,
জগতের ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি !
অনন্ত আঁধার – মাঝে কেহ তব নাহিক দোসর ,
পশে না তোমার প্রাণে আমাদের হৃদয়ের আশ ,
পশে না তোমার কানে আমাদের পাখিদের স্বর ।
সহস্র জগতে মিলি রচে তব বিজন প্রবাস ,
সহস্র শবদে মিলি বাঁধে তব নিঃশব্দের ঘর —
হাসি , কাঁদি , ভালোবাসি , নাই তব হাসি কান্না মায়া —
আসি , থাকি , চলে যাই কত ছায়া কত উপছায়া !৩
তাই কি ? সকলি ছায়া ? আসে , থাকে , আর মিলে যায় ?
তুমি শুধু একা আছ , আর সব আছে আর নাই ?
যুগযুগান্তর ধরে ফুল ফুটে , ফুল ঝরে তাই ?
প্রাণ পেয়ে প্রাণ দিই , সে কি শুধু মরণের পায় ?
এ ফুল চাহে না কেহ ? লহে না এ পূজা – উপহার ?
এ প্রাণ , প্রাণের আশা , টুটে কি অসীম শূন্যতায় ।
বিশ্বের উঠিছে গান , বধিরতা বহি সিংহাসনে ?
বিশ্বের কাঁদিছে প্রাণ , শূন্যে ঝরে অশ্রুবারিধার ?
যুগযুগান্তের প্রেম কে লইবে , নাই ত্রিভুবনে ?
চরাচর মগ্ন আছে নিশিদিন আশার স্বপনে —
বাঁশি শুনি চলিয়াছে , সে কি হায় বৃথা অভিসার !
বলো না সকলি স্বপ্ন , সকলি এ মায়ার ছলন —
বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে , সে স্বপন কাহার স্বপন ?
সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার ?৪
ধ্বনি খুঁজে প্রতিধ্বনি , প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ ।
জগৎ আপনা দিয়ে খুঁজিছে তাহার প্রতিদান ।
অসীমে উঠিছে প্রেম শুধিবারে অসীমের ঋণ —
যত দেয় তত পায় , কিছুতে না হয় অবসান ।
যত ফুল দেয় ধরা তত ফুল পায় প্রতিদিন —
যত প্রাণ ফুটাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ ।
যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীনহীন ,
অসীমে জগতে একি পিরিতির আদান – প্রদান !
কাহারে পূজিছে ধরা শ্যামল যৌবন – উপহারে ,
নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন ।
প্রেমে টেনে আনে প্রেম , সে প্রেমের পাথার কোথা রে !
প্রাণ দিলে প্রাণ আসে , কোথা সেই অনন্ত জীবন !
ক্ষুদ্র আপনারে দিলে , কোথা পাই অসীম আপন —
সে কি ওই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকারে ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
তোমার সঙ্গে আমার মিলন
বাধল কাছেই এসে।
তাকিয়ে ছিলেম আসন মেলে—
অনেক দূরের থেকে এলে,
আঙিনাতে বাড়িয়ে চরণ
ফিরলে কঠিন হেসে—
তীরের হাওয়ায় তরী উধাও
পারের নিরুদ্দেশে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ভোরের পাখি ডাকে কোথায়
ভোরের পাখি ডাকে।
ভোর না হতে ভোরের খবর
কেমন করে রাখে।
এখনো যে আঁধার নিশি
জড়িয়ে আছে সকল দিশি
কালীবরন পুচ্ছ ডোরের
হাজার লক্ষ পাকে।
ঘুমিয়ে-পড়া বনের কোণে
পাখি কোথায় ডাকে।ওগো তুমি ভোরের পাখি,
ভোরের ছোটো পাখি,
কোন্ অরুণের আভাস পেয়ে
মেল’ তোমার আঁখি।
কোমল তোমার পাখার ‘পরে
সোনার রেখা স্তরে স্তরে,
বাঁধা আছে ডানায় তোমার
উষার রাঙা রাখি।
ওগো তুমি ভোরের পাখি,
ভোরের ছোটো পাখি।রয়েছে বট, শতেক জটা
ঝুলছে মাটি ব্যেপে,
পাতার উপর পাতার ঘটা
উঠছে ফুলে ফেঁপে।
তাহারি কোন্ কোণের শাখে
নিদ্রাহারা ঝিঁঝির ডাকে
বাঁকিয়ে গ্রীবা ঘুমিয়েছিলে
পাখাতে মুখ ঝেঁপে,
যেখানে বট দাঁড়িয়ে একা
জটায় মাটি ব্যেপে।ওগো ভোরের সরল পাখি,
কহো আমায় কহো–
ছায়ায় ঢাকা দ্বিগুণ রাতে
ঘুমিয়ে যখন রহ,
হঠাৎ তোমার কুলায়-‘পরে
কেমন ক’রে প্রবেশ করে
আকাশ হতে আঁধার-পথে
আলোর বার্তাবহ।
ওগো ভোরের সরল পাখি
কহো আমায় কহো!কোমল তোমার বুকের তলে
রক্ত নেচে উঠে,
উড়বে ব’লে পুলক জাগে
তোমার পক্ষপুটে।
চক্ষু মেলি পুবের পানে
নিদ্রা-ভাঙা নবীন গানে
অকুণ্ঠিত কণ্ঠ তোমার
উৎস-সমান ছুটে।
কোমল তোমার বুকের তলে
রক্ত নেচে উঠে।এত আঁধার-মাঝে তোমার
এতই অসংশয়!
বিশ্বজনে কেহই তোরে
করে না প্রত্যয়।
তুমি ডাক,”দাঁড়াও পথে,
সূর্য আসেন স্বর্ণরথে–
রাত্রি নয়, রাত্রি নয়,
রাত্রি নয় নয়।’
এত আঁধার-মাঝে তোমার
এতই অসংশয়!আনন্দেতে জাগো আজি
আনন্দেতে জাগো।
ভোরের পাখি ডাকে যে ওই
তন্দ্রা এখন না গো।
প্রথম আলো পড়ুক মাথায়,
নিদ্রা-ভাঙা আঁখির পাতায়,
জ্যোতির্ময়ী উদয়-দেবীর
আশীর্বচন মাগো।
ভোরের পাখি গাহিছে ওই,
আনন্দেতে জাগো। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
রূপে ও অরূপে গাঁথা
এ ভুবনখানি—
ভাব তারে সুর দেয়,
সত্য দেয় বাণী।
এসো মাঝখানে তার,
অানো ধ্যান আপনার
ছবিতে গানেতে যেথা
নিত্য কানাকানি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
দাঁয়েদের গিন্নিটি
কিপ্টে সে অতিশয়,
পান থেকে চুন গেলে
কিছুতে না ক্ষতি সয়।
কাঁচকলা-খোষা দিয়ে
পচা মহুয়ার ঘিয়ে
ছেঁচকি বানিয়ে আনে–
সে কেবল পতি সয়;
একটু করলে “উহুঁ’
যদি এক রতি সয়! (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
সর্বদেহের ব্যাকুলতা কী বলতে চায় বাণী,
তাই আমার এই নূতন বসনখানি।
নূতন সে মোর হিয়ার মধ্যে দেখতে কি পায় কেউ।
সেই নূতনের ঢেউ
অঙ্গ বেয়ে পড়ল ছেয়ে নূতন বসনখানি।
দেহ-গানের তান যেন এই নিলেম বুকে টানি।
আপনাকে তো দিলেম তারে, তবু হাজার বার
নূতন করে দিই যে উপহার।
চোখের কালোয় নূতন আলো ঝলক দিয়ে ওঠে,
নূতন হাসি ফোটে,
তারি সঙ্গে, যতনভরা নূতন বসনখানি
অঙ্গ আমার নূতন করে দেয়-যে তারি আনি।
চাঁদের আলো চাইবে রাতে বনছায়ার পানে
বেদনভরা শুধু চোখের গানে।
মিলব তখন বিশ্বমাঝে আমরা দোঁহে একা,
যেন নূতন দেখা।
তখন আমার অঙ্গ ভরি নূতন বসনখানি।
পাড়ে পাড়ে ভাঁজে ভাঁজে করবে কানাকানি।
ওগো, আমার হৃদয় যেন সন্ধ্যারি আকাশ,
রঙের নেশায় মেটে না তার আশ,
তাই তো বসন রাঙিয়ে পরি কখনো বা ধানী,
কখনো জাফরানী,
আজ তোরা দেখ্ চেয়ে আমার নূতন বসনখানি
বৃষ্টি-ধোওয়া আকাশ যেন নবীন আসমানী।
অকূলের এই বর্ণ, এ-যে দিশাহারার নীল,
অন্য পারের বনের সাথে মিল।
আজকে আমার সকল দেহে বইছে দূরের হাওয়া
সাগরপানে ধাওয়া।
আজকে আমার অঙ্গে আনে নূতন কাপড়খানি
বৃষ্টিভরা ঈশান কোণের নব মেঘের বাণী।
পদ্মা, ১২ অগ্রহায়ণ, ১৩২২
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কনে দেখা হয়ে গেছে, নাম তার চন্দনা;
তোমারে মানাবে ভায়া, অতিশয় মন্দ না।
লোকে বলে, খিট্খিটে, মেজাজটা নয় মিঠে–
দেবী ভেবে নেই তারে করিলে বা বন্দনা।
কুঁজো হোক, কালো হোক, কালাও না, অন্ধ না। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।পূবে বাতাস এল হঠাত্ ধেয়ে,
ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।এমনি করে কাজল কালো মেঘ
জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাত্ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
ফাল্গুনের সূর্য যবে
দিল কর প্রসারিয়া সঙ্গীহীন দক্ষিণ অর্ণবে,
অতল বিরহ তার যুগযুগান্তের
উচ্ছ্বসিয়া ছুটে গেল নিত্য-অশান্তের
সীমানার ধারে;
ব্যথার ব্যথিত কারে
ফিরিল খুঁজিয়া,
বেড়ালো যুঝিয়া
আপন তরঙ্গদল-সাথে।
অবশেষে রজনীপ্রভাতে,
জানে না সে কখন দুলায়ে গেল চলি
বিপুল নিশ্বাসবেগে একটুকু মল্লিকার কলি।
উদ্বারিল গন্ধ তার,
সচকিয়া লভিল সে গভীর রহস্য আপনার।
এই বার্তা ঘোষিল অম্বরে-
সমুদ্রের উদ্বোধন পূর্ণ আজি পুষ্পের অন্তরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আকাশতলে উঠল ফুটে
আলোর শতদল।
পাপড়িগুলি থরে থরে
ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে,
ঢেকে গেলো অন্ধকারের
নিবিড় কালো জল।
মাঝখানেতে সোনার কোষে
আনন্দে, ভাই, আছি বসে -
আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে
আলোর শতদল।আকাশেতে ঢেউ দিয়ে রে
বাতাস বহে যায়।
চার দিকে গান বেজে ওঠে,
চার দিকে প্রাণ নেচে ছোটে,
গগনভরা পরশখানি
লাগে সকল গায়।
ডুব দিয়ে এই প্রাণ-সাগরে
নিতেছি প্রাণ বক্ষ ভরে,
ফিরে ফিরে আমায় ঘিরে
বাতাস বহে যায়।দশ দিকেতে আঁচল পেতে
কোল দিয়েছে মাটি।
রয়েছে জীব যে যেখানে
সকলকে সে ডেকে আনে,
সবার হাতে সবার পাতে
অন্ন সে দেয় বাঁটি।
ভরেছে মন গীত গন্ধে,
বসে আছি মহানন্দে,
আমায় ঘিরে আঁচল পেতে
কোল দিয়েছে মাটি।আলো, তোমায় নমি, আমার
মিলাক অপরাধ।
ললাটেতে রাখো আমার
পিতার আশীর্বাদ।
বাতাস, তোমায় নমি, আমার
ঘুচুক অবসাদ।
সকল দেহে বুলিয়ে দাও
পিতার আশীর্বাদ।
মাটি, তোমায় নমি, আমার
মিটুক সর্ব সাধ।
গৃহ ভরে ফলিয়ে তোলো
পিতার আশীর্বাদ।পৌষ ১৩১৬
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৪৮
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
অলস সময়-ধারা বেয়ে
মন চলে শূন্য-পানে চেয়ে।
সে মহাশূন্যের পথে ছায়া-আঁকা ছবি পড়ে চোখে।
কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে
সুদীর্ঘ অতীতে
জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে।
এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল,
এসেছে মোগল;
বিজয়রথের চাকা
উড়ায়েছে ধূলিজাল,উড়িয়াছে বিজয়পতাকা।
শূন্যপথে চাই,
আজ তার কোনো চিহ্ন নাই।
নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো
যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো।
আরবার সেই শূন্যতলে
আসিয়াছে দলে দলে
লৌহবাঁধা পথে
অনলনিশ্বাসী রথে
প্রবল ইংরেজ,
বিকীর্ণ করেছে তার তেজ।
জানি তারো পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল,
কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশবেড়া জাল;
জানি তার পণ্যবাহী সেনা
জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না।মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে
দেখি সেথা কলকলরবে
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে
জীবনে মরণে।
ওরা চিরকাল
টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে।
রাজছত্র ভেঙে পড়ে,রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে,
জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে,
রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।
ওরা কাজ করে
দেশে দেশান্তরে,
অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে,
পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে।
গুরুগুরু গর্জন গুন্গুন্ স্বর
দিনরাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর।
দুঃখ সুখ দিবসরজনী
মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি।
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-‘পরে
ওরা কাজ করে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বাবা নাকি বই লেখে সব নিজে।
কিছুই বোঝা যায় না লেখেন কী যে!
সেদিন পড়ে শোনাচ্ছিলেন তোরে,
বুঝেছিলি? - বল্ মা, সত্যি করে।
এমন লেখায় তবে
বল্ দেখি কী হবে।।তোর মুখে মা, যেমন কথা শুনি
তেমন কেন লেখেন নাকো উনি।
ঠাকুরমা কি বাবাকে কক্খনো
রাজার কথা শোনায় নিকো কোনো?
সে-সব কথাগুলি
গেছেন বুঝি ভুলি?স্নান করতে বেলা হল দেখে
তুমি কেবল যাও, মা, ডেকে ডেকে -
খাবার নিয়ে তুমি বসেই থাকো,
সে কথা তাঁর মনেই থাকে নাকো।
করেন সারা বেলা
লেখা-লেখা খেলা।।বাবার ঘরে আমি খেলতে গেলে
তুমি আমায় বল 'দুষ্টু' ছেলে!
বকো আমায় গোল করলে পরে,
'দেখছিস নে লিখছে বাবা ঘরে!'
বল্ তো, সত্যি বল্ ,
লিখে কী হয় ফল।।আমি যখন বাবার খাতা টেনে
লিখি বসে দোয়াত কলম এনে -
ক খ গ ঘ ঙ হ য ব র,
আমার বেলা কেন, মা, রাগ কর!
বাবা যখন লেখে
কথা কও না দেখে।।বড়ো বড়ো রুল-কাটা কাগোজ
নষ্ট বাবা করেন না কি রোজ?
আমি যদি নৌকো করতে চাই
অম্নি বল 'নষ্ট করতে নাই'।
সাদা কাগজে কালো
করলে বুঝি ভালো ? (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
“সময় চ’লেই যায়’
নিত্য এ নালিশে
উদ্বেগে ছিল ভুপু
মাথা রেখে বালিশে।
কব্জির ঘড়িটার
উপরেই সন্দ,
একদম করে দিল
দম তার বন্ধ–
সময় নড়ে না আর,
হাতে বাঁধা খালি সে,
ভুপুরাম অবিরাম-
বিশ্রাম-শালী সে।
ঝাঁ-ঝাঁ করে রোদ্দুর,
তবু ভোর পাঁচটায়
ঘড়ি করে ইঙ্গিত
ডালাটার কাঁচটায়–
রাত বুঝি ঝক্ঝকে
কুঁড়েমির পালিশে।
বিছানায় প’ড়ে তাই
দেয় হাততালি সে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দয়া দিয়ে হবে গো মোর
জীবন ধুতে–
নইলে কি আর পারব তোমার
চরণ ছুঁতে।
তোমায় দিতে পূজার ডালি
বেড়িয়ে পড়ে সকল কালি,
পরান আমার পারি নে তাই
পায়ে থুতে।এতদিন তো ছিল না মোর
কোনো ব্যথা,
সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল
মলিনতা।
আজ ওই শুভ্র কোলের তরে
ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে
দিয়ো না গো, দিয়ো না আর
ধুলায় শুতে।কলিকাতা, ২৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই,
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই
চাহিতে গেলে মরি লাজে।
জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম,
তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে।তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া
মরণ আনে রাশি রাশি,
আমি যে প্রাণ ভরি তাদের ঘৃণা করি
তবুও তাই ভালোবাসি।
এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি,
কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি,
আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই
ভয় যে আসে মনোমাঝে।২২ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আকাশ-সিন্ধু-মাঝে এক ঠাঁই
কিসের বাতাস লেগেছে–
জগৎ-ঘূর্ণি জেগেছে।
ঝলকি উঠেছে রবি-শশাঙ্ক,
ঝলকি ছুটেছে তারা,
অযুত চক্র ঘুরিয়া উঠেছে
অবিরাম মাতোয়ারা।
স্থির আছে শুধু একটি বিন্দু
ঘূর্ণির মাঝখানে–
সেইখান হতে স্বর্ণকমল
উঠেছে শূন্যপানে।
সুন্দরী, ওগো সুন্দরী,
শতদলদলে ভুবনলক্ষ্ণী
দাঁড়ায়ে রয়েছ মরি মরি।
জগতের পাকে সকলি ঘুরিছে,
অচল তোমার রূপরাশি।
নানা দিক হতে নানা দিন দেখি–
পাই দেখিবারে ওই হাসি।জনমে মরণে আলোকে আঁধারে
চলেছি হরণে পূরণে,
ঘুরিয়া চলেছি ঘুরনে।
কাছে যাই যার দেখিতে দেখিতে
চলে যায় সেই দূরে,
হাতে পাই যারে পলক ফেলিতে
তারে ছুঁয়ে যাই ঘুরে।
কোথাও থাকিতে না পারি ক্ষণেক,
রাখিতে পারি নে কিছু–
মত্ত হৃদয় ছুটে চলে যায়
ফেনপুঞ্জের পিছু।
হে প্রেম, হে ধ্রুবসুন্দর,
স্থিরতার নীড় তুমি রচিয়াছ
ঘূর্ণার পাকে খরতর।
দ্বীপগুলি তব গীতমুখরিত,
ঝরে নির্ঝর কলভাষে,
অসীমের চির-চরম শান্তি
নিমেষের মাঝে মনে আসে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
হাস্যদমনকারী গুরু–
নাম যে বশীশ্বর,
কোথা থেকে জুটল তাহার
ছাত্র হসীশ্বর।
হাসিটা তার অপর্যাপ্ত,
তরঙ্গে তার বাতাস ব্যাপ্ত,
পরীক্ষাতে মার্কা যে তাই
কাটেন মসীশ্বর।
ডাকি সরস্বতী মাকে,–
“ত্রাণ করো এই ছেলেটাকে,
মাস্টারিতে ভর্তি করো
হাস্যরসীশ্বর।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
বিজয় নিভৃতে কী কহে নিশীথে?
কি কথা শুধায় নীরজা বালায়—
দেখেছ, দেখেছ হোথা?
ফুলপাত্র হতে ফুল তুলি হাতে
নীরজা শুনিছে, কুসুম গুণিছে,
মুখে নাই কিছু কথা।
বিজয় শুধায়— কমলা তাহারে
গোপনে, গোপনে ভালবাসে কি রে?
তার কথা কিছু বলে কি সখীরে?
যতন করে কি তাহার তরে।
আবার কহিল, “বলো কমলায়
বিজন কানন হইতে যে তায়
করিয়া উদ্ধার সুখের ছায়ায়
আনিল, হেলা কি করিবে তারে?
যদি সে ভাল না বাসে আমায়
আমি কিন্তু ভালবাসিব তাহায়
যত দিন দেহে শোণিত চলে”।
বিজয় যাইল আবাস ভবনে
নিদ্রায় সাধিতে কুসুমশয়নে।
বালিকা পড়িল ভূমির তলে।
বিবর্ণ হইল কপোল বালার,
অবশ হইয়ে এল দেহভার—
শোণিতের গতি থামিল যেন!
ও কথা শুনিয়া নীরজা সহসা
কেন ভূমিতলে পড়িল বিবশা?
দেহ থর থর কাঁপিছে কেন?
ক্ষণেকের পরে লভিয়া চেতন,
বিজয়-প্রাসাদে করিল গমন,
দ্বারে ভর দিয়া চিন্তায় মগন
দাঁড়ায়ে রহিল কেন কে জানে?
বিজয় নীরবে ঘুমায় শয্যায়,
ঝুরু ঝুরু ঝুরু বহিতেছে বায়,
নক্ষত্রনিচয় খোলা জানালায়
উঁকি মারিতেছে মুখের পানে!
খুলিয়া মেলিয়া অসংখ্য নয়ন
উঁকি মারিতেছে যেন রে গগন,
জাগিয়া ভাবিয়া দেখিলে তখন
অবশ্য বিজয় উঠিত কাঁপি!
ভয়ে, ভয়ে ধীরে মুদিত নয়ন
পৃথিবীর শিশু ক্ষুদ্র-প্রাণমন—
অনিমেষ আঁখি এড়াতে তখন
অবশ্য দুয়ার ধরিত চাপি!
ধীরে, ধীরে, ধীরে খুলিল দুয়ার,
পদাঙ্গুলি ‘পরে সঁপি দেহভার
কেও বামা ডরে প্রবেশিছে ঘরে
ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলিয়া ভয়ে!
একদৃষ্টে চাহি বিজয়ের মুখে
রহিল দাঁড়ায়ে শয্যার সমুখে,
নেত্রে বহে ধারা মরমের দুখে,
ছবিটির মত অবাক্ হয়ে!
ভিন্ন ওষ্ঠ হতে বহিছে নিশ্বাস—
দেখিছে নীরজা, ফেলিতেছে শ্বাস,
সুখের স্বপন দেখিয়ে তখন
ঘুমায় যুবক প্রফুল্লমুখে!
‘ঘুমাও বিজয়! ঘুমাও গভীরে—
দেখো না দুখিনী নয়নের নীরে
করিছে রোদন তোমারি কারণ—
ঘুমাও বিজয় ঘুমাও সুখে!
দেখো না তোমারি তরে একজন
সারা নিশি দুখে করি জাগরণ
বিছানার পাশে করিছে রোদন—
তুমি ঘুমাইছ ঘুমাও ধীরে!
দেখো না বিজয়! জাগি সারা নিশি
প্রাতে অন্ধকার যাইলে গো মিশি
আবাসেতে ধীরে যাইব গো ফিরে—
তিতিয়া বিষাদে নয়ননীরে
ঘুমাও বিজয়। ঘুমাও ধীরে!’ (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
যখন শুনালে, কবি, দেবদম্পতিরে
কুমারসম্ভবগান, চারি দিকে ঘিরে
দাঁড়ালো প্রমথগণ—শিখরের ‘পর
নামিল মন্থর শান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর
স্থগিত-বিদ্যুৎ-লীলা, গর্জনবিরত,
কুমারের শিখী করি পুচ্ছ অবনত
স্থির হয়ে দাঁড়াইল পার্বতীর পাশে
বাঁকায়ে উন্নত গ্রীবা। কভু স্মিতহাসে
কাঁপিল দেবীর ওষ্ঠ, কভু দীর্ঘশ্বাস
অলক্ষে বহিল, কভু অশ্রুজলোচ্ছ্বাস
দেখা দিল আঁখিপ্রান্তে—যবে অবশেষে
ব্যাকুল শরমখানি নয়ননিমেষে
নামিল নীরবে, কবি, চাহি দেবীপানে
সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
ব্যথাক্ষত মোর প্রাণ লয়ে তব ঘরে
অতিথিবৎসলা নদী কত স্নেহভরে
শুশ্রূষা করিলে আজি— স্নিগ্ধ হস্তখানি
দগ্ধ হৃদয়ের মাঝে সুধা দিল আনি।
সায়াহ্ন আসিল নামি, পশ্চিমের তীরে
ধান্যক্ষেত্রে রক্তরবি অস্ত গেল ধীরে।
পূর্বতীরে গ্রাম বন নাহি যায় দেখা,
জ্বলন্ত দিগন্তে শুধু মসীপুঞ্জরেখা;
সেথা অন্ধকার হতে আনিছে সমীর
কর্ম-অবসান-ধ্বনি অজ্ঞাত পল্লীর।
দুই তীর হতে তুলি দুই শান্তিপাখা
আমারে বুকের মাঝে দিলে তুমি ঢাকা।
চুপি চুপি বলি দিলে, “বৎস, জেনো সার,
সুখ দুঃখ বাহিরের, শান্তি সে আত্মার।” (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
স্বপ্ন হঠাৎ উঠল রাতে
প্রাণ পেয়ে,
মৌন হতে
ত্রাণ পেয়ে।
ইন্দ্রলোকের পাগ্লাগারদ
খুলল তারই দ্বার,
পাগল ভুবন দুর্দাড়িয়া
ছুটল চারিধার–
দারুণ ভয়ে মানুষগুলোর
চক্ষে বারিধার,
বাঁচল আপন স্বপন হতে
খাটের তলায় স্থান পেয়ে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বিমল আলোকে আকাশ সাজিবে,
শিশিরে ঝলিবে ক্ষিতি,
হে শেফালি, তব বীণায় বাজিবে
শুভ্রপ্রাণের গীতি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে।
লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপন, ওগো, তায় জাগাইনু রে॥
পোষ মেনেছে হাতের তলে যা বলাই সে তেমনি বলে--
দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে॥
অচল ছিল, সচল হয়ে ছুটেছে ওই জগৎ-জয়ে--
নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে॥(রচনাকাল: 1911)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিগাথা
|
পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ,
খড়কে দিয়ে উসকে দিচ্ছে থেকে থেকে।
হাতির দাঁতের মতো কোমল সাদা
পঙ্খের কাজ-করা মেজে;
তার উপরে খান-দুয়েক মাদুর পাতা।
ছোটো ছেলেরা জড়ো হয়েছি ঘরের কোণে
মিটমিটে আলোয়।
বুড়ো মোহন সর্দার
কলপ-লাগানো চুল বাবরি-করা,
মিশকালো রঙ
চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসছে,
শিথিল হয়েছে মাংস,
হাতের পায়ের হাড়গুলো দীর্ঘ,
কণ্ঠস্বর সরু-মোটায় ভাঙা।
রোমাঞ্চ লাগবার মতো তার পূর্ব-ইতিহাস।
বসেছে আমাদের মাঝখানে,
বলছে রোঘো ডাকাতের কথা।
আমরা সবাই গল্প আঁকড়ে বসে আছি।
দক্ষিণের হাওয়া-লাগা ঝাউডালের মতো
দুলছে মনের ভিতরটা।
খোলা জানলার সামনে দেখা যায় গলি,
একটা হলদে গ্যাসের আলোর খুঁটি
দাঁড়িয়ে আছে একচোখো ভূতের মতো।
পথের বাঁ ধারটাতে জমেছে ছায়া।
গলির মোড়ে সদর রাস্তায়
বেলফুলের মালা হেঁকে গেল মালী।
পাশের বাড়ি থেকে
কুকুর ডেকে উঠল অকারণে।
নটার ঘণ্টা বাজল দেউড়িতে।
অবাক হয়ে শুনছি রোঘোর চরিতকথা।
তত্ত্বরত্নের ছেলের পৈতে,
রোঘো বলে পাঠাল চরের মুখে,
"নমো নমো করে সারলে চলবে না ঠাকুর,
ভেবো না খরচের কথা।"
মোড়লের কাছে পত্র দেয়
পাঁচ হাজার টাকা দাবি ক'রে ব্রাহ্মণের জন্যে।
রাজার খাজনা-বাকির দায়ে
বিধবার বাড়ি যায় বিকিয়ে,
হঠাৎ দেওয়ানজির ঘরে হানা দিয়ে
দেনা শোধ ক'রে দেয় রঘু।
বলে--"অনেক গরিবকে দিয়েছ ফাঁকি,
কিছু হালকা হোক তার বোঝা।"
একদিন তখন মাঝরাত্তির,
ফিরছে রোঘো লুঠের মাল নিয়ে,
নদীতে তার ছিপের নৌকো
অন্ধকারে বটের ছায়ায়।
পথের মধ্যে শোনে--
পাড়ায় বিয়েবাড়িতে কান্নার ধ্বনি,
বর ফিরে চলেছে বচসা করে;
কনের বাপ পা আঁকড়ে ধরেছে বরকর্তার।
এমন সময় পথের ধারে
ঘন বাঁশ বনের ভিতর থেকে
হাঁক উঠল, রে রে রে রে রে রে।
আকাশের তারাগুলো
যেন উঠল থরথরিয়ে।
সবাই জানে রোঘো ডাকাতের
পাঁজর-ফাটানো ডাক।
বরসুদ্ধ পালকি পড়ল পথের মধ্যে;
বেহারা পালাবে কোথায় পায় না ভেবে।
ছুটে বেরিয়ে এল মেয়ের মা
অন্ধকারের মধ্যে উঠল তার কান্না--
"দোহাই বাবা, আমার মেয়ের জাত বাঁচাও।"
রোঘো দাঁড়াল যমদূতের মতো--
পালকি থেকে টেনে বের করলে বরকে,
বরকর্তার গালে মারল একটা প্রচণ্ড চড়,
পড়ল সে মাথা ঘুরে।
ঘরের প্রাঙ্গণে আবার শাঁখ উঠল বেজে,
জাগল হুলুধ্বনি;
দলবল নিয়ে রোঘো দাঁড়াল সভায়,
শিবের বিয়ের রাতে ভূতপ্রেতের দল যেন।
উলঙ্গপ্রায় দেহ সবার, তেলমাখা সর্বাঙ্গে,
মুখে ভুসোর কালি।
বিয়ে হল সারা।
তিন প্রহর রাতে
যাবার সময় কনেকে বললে ডাকাত
"তুমি আমার মা,
দুঃখ যদি পাও কখনো
স্মরণ ক'রো রঘুকে।"
তারপরে এসেছে যুগান্তর।
বিদ্যুতের প্রখর আলোতে
ছেলেরা আজ খবরের কাগজে
পড়ে ডাকাতির খবর।
রূপকথা-শোনা নিভৃত সন্ধ্যেবেলাগুলো
সংসার থেকে গেল চলে,
আমাদের স্মৃতি
আর নিবে-যাওয়া তেলের প্রদীপের সঙ্গে সঙ্গে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
স্নেহ-উপহার এনে দিতে চাই,
কী যে দেব তাই ভাবনা—
যত দিতে সাধ করি মনে মনে
খুঁজে - পেতে সে তো পাব না।
আমার যা ছিল ফাঁকি দিয়ে নিতে
সবাই করেছে একতা,
বাকি যে এখন আছে কত ধন
না তোলাই ভালো সে কথা।
সোনা রুপো আর হীরে জহরত
পোঁতা ছিল সব মাটিতে,
জহরি যে যত সন্ধান পেয়ে
নে গেছে যে যার বাটীতে।
টাকাকড়ি মেলা আছে টাকশালে,
নিতে গেলে পড়ি বিপদে।
বসনভূষণ আছে সিন্দুকে,
পাহারাও আছে ফি পদে।
এ যে সংসারে আছি মোরা সবে
এ বড়ো বিষম দেশ রে।
ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চ ' লে গিয়ে
ভুলে গিয়ে সব শেষ রে।
ভয়ে ভয়ে তাই স্মরণচিহ্ন
যে যাহারে পারে দেয় যে।
তাও কত থাকে, কত ভেঙে যায়,
কত মিছে হয় ব্যয় যে।
স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত,
চোখে যদি দেখা যেত রে,
কতগুলো তবে জিনিস-পত্র
বল্ দেখি দিত কে তোরে।
তাই ভাবি মনে কী ধন আমার
দিয়ে যাব তোরে নুকিয়ে,
খুশি হবি তুই, খুশি হব আমি,
বাস্, সব যাবে চুকিয়ে।
কিছু দিয়ে-থুয়ে চিরদিন-তরে
কিনে রেখে দেব মন তোর—
এমন আমার মন্ত্রণা নেই,
জানি নে ও হেন মন্তর।
নবীন জীবন, বহুদূর পথ
পড়ে আছে তোর সুমুখে;
স্নেহরস মোরা যেটুকু যা দিই
পিয়ে নিস এক চুমুকে।
সাথিদলে জুটে চলে যাস ছুটে
নব আশে নব পিয়াসে,
যদি ভুলে যাস, সময় না পাস,
কী যায় তাহাতে কী আসে।
মনে রাখিবার চির-অবকাশ
থাকে আমাদেরই বয়সে,
বাহিরেতে যার না পাই নাগাল
অন্তরে জেগে রয় সে।
পাষাণের বাধা ঠেলেঠুলে নদী
আপনার মনে সিধে সে
কলগান গেয়ে দুই তীর বেয়ে
যায় চলে দেশ-বিদেশে—
যার কোল হতে ঝরনার স্রোতে
এসেছে আদরে গলিয়া
তারে ছেড়ে দূরে যায় দিনে দিনে
অজানা সাগরে চলিয়া।
অচল শিখর ছোটো নদীটিরে
চিরদিন রাখে স্মরণে—
যতদূর যায় স্নেহধারা তার
সাথে যায় দ্রুতচরণে।
তেমনি তুমিও থাক না'ই থাক,
মনে কর মনে কর না,
পিছে পিছে তব চলিবে ঝরিয়া
আমার আশিস-ঝরনা।। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এই-যে রাঙা চেলি দিয়ে তোমায় সাজানো,
ওই-যে হোথায় দ্বারের কাছে সানাই বাজানো,
অদৃশ্য এক লিপির লিখায়
নবীন প্রাণের কোন্ ভূমিকায়
মিলছে, না জানো।শিশুবেলায় ধূলির 'পরে আঁচল এলিয়ে
সাজিয়ে পুতুল কাটল বেলা খেলা খেলিয়ে।
বুঝতে নাহি পারবে আজো
আজ কী খেলায় আপনি সাজো
হৃদয় মেলিয়ে।অখ্যাত এই প্রাণের কোণে সন্ধ্যাবেলাতে
বিশ্বখেলোয়াড়ের খেয়াল নামল খেলাতে।
দুঃখসুখের তুফান লেগে
পুতুল-ভাসান চলল বেগে
ভাগ্যভেলাতে।তার পরেতে ভোলার পালা, কথা কবে না--
অসীম কালের পটে ছবির চিহ্ন রবে না।
তার পরেতে জিতবে ধুলো,
ভাঙা খেলার চিহ্নগুলো
সঙ্গে লবে না।রাঙা রঙের চেলি দিয়ে কন্যে সাজানো,
দ্বারের কাছে বেহাগ রাগে সানাই বাজানো,
এই মানে তার বুঝতে পারি--
খেয়াল যাঁহার খুশি তাঁরি
জানো না-জানো।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আপনার রুদ্ধদ্বার-মাঝে
অন্ধকার নিয়ত বিরাজে।
আপন-বাহিরে মেলো চোখ,
সেইখানে অনন্ত আলোক। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে
দেখিলাম আপনারে বিচিত্র রূপের সমাবেশে।
একদা নূতন বর্ষ অতলান্ত সমুদ্রের বুকে
মোরে এনেছিল বহি
তরঙ্গের বিপুল প্রলাপে
দিক হতে যেথা দিগন্তরে
শূন্য নীলিমার 'পরে শূন্য নীলিমায়
তটকে করিছে অস্বীকার।
সেদিন দেখিনু ছবি অবিচিত্র ধরণীর--
সৃষ্টির প্রথম রেখাপাতে
জলমগ্ন ভবিষ্যৎ যবে
প্রতিদিন সূর্যোদয়-পানে
আপনার খুঁজিছে সন্ধান।
প্রাণের রহস্য-ঢাকা
তরঙ্গের যবনিকা-'পরে
চেয়ে চেয়ে ভাবিলাম,
এখনো হয় নি খোলা আমার জীবন-আবরণ--
সম্পূর্ণ যে আমি
রয়েছে গোপনে অগোচর।
নব নব জন্মদিনে
যে রেখা পড়িছে আঁকা শিল্পীর তুলির টানে টানে
ফোটে নি তাহার মাঝে ছবির চরম পরিচয়।
শুধু করি অনুভব,
চারি দিকে অব্যক্তের বিরাট প্লাবন
বেষ্টন করিয়া আছে দিবসরাত্রিরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
এসেছিনু নিয়ে শুধু আশা,
চলে গেনু দিয়ে ভালোবাসা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
নাম তার ভেলুরাম ধুনিচাঁদ শিরত্থ,
ফাটা এক তম্বুরা কিনেছে সে নিরর্থ।
সুরবোধ-সাধনায়
ধুরপদে বাধা নাই,
পাড়ার লোকেরা তাই হারিয়েছে ধীরত্ব–
অতি-ভালোমানুষেরও বুকে জাগে বীরত্ব॥ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বস্তুতে রয় রূপের বাঁধন,
ছন্দ সে রয় শক্তিতে,
অর্থ সে রয় ব্যক্তিতে (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
উপরে স্রোতের ভরে ভাসে চরাচর
নীল সমুদ্রের’পরে নৃত্য ক’রে সারা ।
কোথা হতে ঝরে যেন অনন্ত নির্ঝর ,
ঝরে আলোকের কণা রবি শশী তারা ।
ঝরে প্রাণ , ঝরে গান , ঝরে প্রেমধারা —
পূর্ণ করিবারে চায় আকাশ সাগর ।
সহসা কে ডুবে যায় জলবিম্বপারা —
দু – একটি আলো – রেখা যায় মিলাইয়া ,
তখন ভাবিতে বসি কোথায় কিনারা —
কোন্ অতলের পানে ধাই তলাইয়া !
নিম্নে জাগে সিন্ধুগর্ভ স্তব্ধ অন্ধকার ।
কোথা নিবে যায় আলো , থেমে যায় গীত —
কোথা চিরদিন তরে অসীম আড়াল !
কোথায় ডুবিয়া গেছে অনন্ত অতীত ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ভালোবাসা এসেছিল একদিন তরুণ বয়সে
নির্ঝরের প্রলাপকল্লোলে,
অজানা শিখর হতে
সহসা বিস্ময় বহি আনি
ভ্রূভঙ্গিত পাষাণের নিশ্চল নির্দেশ
লঙ্ঘিয়া উচ্ছল পরিহাসে,
বাতাসেরে করি ধৈর্যহারা,
পরিচয়ধারা-মাঝে তরঙ্গিয়া অপরিচয়ের
অভাবিত রহস্যের ভাষা,
চারি দিকে স্থির যাহা পরিমিত নিত্য প্রত্যাশিত
তারি মধ্যে মুক্ত করি ধাবমান বিদ্রোহের ধারা।আজ সেই ভালোবাসা স্নিগ্ধ সান্ত্বনার স্তব্ধতায়
রয়েছে নিঃশব্দ হয়ে প্রচ্ছন্ন গভীরে।
চারি দিকে নিখিলের বৃহৎ শান্তিতে
মিলেছে সে সহজ মিলনে,
তপস্বিনী রজনীর তারার আলোয় তার আলো,
পূজারত অরণ্যের পুষ্প অর্ঘ্যে তাহার মাধুরী। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কার পানে মা, চেয়ে আছ
মেলি দুটি করুণ আঁখি।
কে ছিঁড়েছে ফুলের পাতা,
কে ধরেছে বনের পাখি।
কে কারে কী বলেছে গো,
কার প্রাণে বেজেছে ব্যথা—
করুণায় যে ভরে এল
দুখানি তোর আঁখির পাতা।
খেলতে খেলতে মায়ের আমার
আর বুঝি হল না খেলা।
ফুলের গুচ্ছ কোলে প'ড়ে—
কেন মা এ হেলাফেলা।
অনেক দুঃখ আছে হেথায়,
এ জগৎ যে দুঃখে ভরা—
তোমার দুটি আঁখির সুধায়
জুড়িয়ে গেল নিখিল ধরা।
লক্ষ্মী আমায় বল্ দেখি মা,
লুকিয়ে ছিলি কোন্ সাগরে।
সহসা আজ কাহার পুণ্যে
উদয় হলি মোদের ঘরে।
সঙ্গে করে নিয়ে এলি
হৃদয়-ভরা স্নেহের সুধা,
হৃদয় ঢেলে মিটিয়ে যাবি
এ জগতের প্রেমের ক্ষুধা।
থামো, থামো, ওর কাছেতে
কোয়ো না কেউ কঠোর কথা,
করুণ আঁখির বালাই নিয়ে
কেউ কারে দিয়ো না ব্যথা।
সইতে যদি না পারে ও,
কেঁদে যদি চলে যায়—
এ-ধরণীর পাষাণ-প্রাণে
ফুলের মতো ঝরে যায়।
ও যে আমার শিশিরকণা,
ও যে আমার সাঁঝের তারা—
কবে এল কবে যাবে
এই ভয়তে হই রে সারা। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
হায় কোথা যাবে !
অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি ,
পথ কোথা পাবে !
হায় , কোথা যাবে !
কঠিন বিপুল এ জগৎ ,
খুঁজে নেয় যে যাহার পথ ।
স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে
কার মুখে চাবে ।
হায় , কোথা যাবে !
মোরা কেহ সাথে রহিব না ,
মোরা কেহ কথা কহিব না ।
নিমেষ যেমনি যাবে , আমাদের ভালোবাসা
আর নাহি পাবে ।
হায় , কোথা যাবে !
মোরা বসে কাঁদিব হেথায় ,
শূন্যে চেয়ে ডাকিব তোমায় ;
মহা সে বিজন মাঝে হয়তো বিলাপধ্বনি
মাঝে মাঝে শুনিবারে পাবে ,
হায় , কোথা যাবে !
দেখো , এই ফুটিয়াছে ফুল ,
বসন্তেরে করিছে আকুল ,
পুরানো সুখের স্মৃতি বাতাস আনিছে নিতি
কত স্নেহভাবে ,
হায় , কোথা যাবে !
খেলাধূলা পড়ে না কি মনে ,
কত কথা স্নেহের স্মরণে ।
সুখে দুখে শত ফেরে সে - কথা জড়িত যে রে ,
সেও কি ফুরাবে !
হায় , কোথা যাবে !
চিরদিন তরে হবে পর ,
এ - ঘর রবে না তব ঘর ।
যারা ওই কোলে যেত , তারাও পরের মতো ,
বারেক ফিরেও নাহি চাবে ।
হায় , কোথা যাবে !
হায় , কোথা যাবে !
যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও ,
এইখানে দুঃখ রেখে যাও ।
যে বিশ্রাম চেয়েছিলে , তাই যেন সেথা মিলে —
আরামে ঘুমাও ।
যাবে যদি , যাও । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
"এ তবে স্বপন শুধু, বিম্বের মতন
আবার মিলায়ে গেল নিদ্রার সমুদ্রে! সারারাত নিদ্রার করিনু আরাধনা-- যদি বা আইল নিদ্রা এ শ্রান্ত নয়নে, মরীচিকা দেখাইয়া গেল গো মিলায়ে! হা স্বপ্ন, কি শক্তি তোর, এ হেন মূরতি মুহূর্ত্তের মধ্যে তুই ভাঙ্গিলি, গড়িলি? হা নিষ্ঠুর কাল, তোর এ কিরূপ খেলা-- সত্যের মতন গড়িলি প্রতিমা, স্বপ্নের মতন তাহা ফেলিলি ভাঙ্গিয়া? কালের সমুদ্রে এক বিম্বের মতন উঠিল, আবার গেল মিলায়ে তাহাতে? না না, তাহা নয় কভু, নলিনী, সে কি গো কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত! যাহার মোহিনী মূর্ত্তি হৃদয়ে হৃদয়ে শিরায় শিরায় আঁকা শোণিতের সাথে, যত কাল রব বেঁচে যার ভালবাসা চিরকাল এ হৃদয়ে রহিবে অক্ষয়, সে বালিকা, সে নলিনী, সে স্বর্গপ্রতিমা, কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত তরঙ্গের অভিঘাতে জন্মিল মিশিল? না না, তাহা নয় কভু, তা যেন না হয়! দেহকারাগারমুক্ত সে নলিনী এবে সুখে দুখে চিরকাল সম্পদে বিপদে আমারই সাথে সাথে করিছে ভ্রমণ। চিরহাস্যময় তার প্রেমদৃষ্টি মেলি আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া। রক্ষক দেবতা সম আমারি উপরে প্রশান্ত প্রেমের ছায়া রেখেছে বিছায়ে। দেহকারাগারমুক্ত হইলে আমিও তাহার হৃদয়সাথে মিশাব হৃদয়। নলিনী, আছ কি তুমি, আছ কি হেথায়? একবার দেখা দেও, মিটাও সন্দেহ! চিরকাল তরে তোরে ভুলিতে কি হবে? তাই বল্ নলিনী লো, বল্ একবার! চিরকাল আর তোরে পাব না দেখিতে, চিরকাল আর তোর হৃদয়ে হৃদয় পাব না কি মিশাইতে, বল্ একবার। মরিলে কি পৃথিবীর সব যায় দূরে? তুই কি আমারে ভুলে গেছিস্ নলিনি? তা হোলে নলিনি, আমি চাই না মরিতে। তোর ভালবাসা যেন চিরকাল মোর হৃদয়ে অক্ষয় হোয়ে থাকে গো মুদ্রিত-- কষ্ট পাই পাব, তবু চাই না ভুলিতে! তুমি নাহি থাক যদি তোমার স্মৃতিও থাকে যেন এ হৃদয় করিয়া উজ্জ্বল! এই ভালবাসা যাহা হৃদয়ে মরমে অবশিষ্ট রাখে নাই এক তিল স্থান, একটি পার্থিব ক্ষুদ্র নিশ্বাসের সাথে মুহূর্ত্তে না পালটিতে আঁখির পলক ক্ষণস্থায়ী কুসুমের সুরভের মত শূন্য এই বায়ুস্রোতে যাইবে মিশায়ে? হিমাদ্রির এই স্তব্ধ আঁধার গহ্বরে সময়ের পদক্ষেপ গণিতেছি বসি, ভবিষ্যৎ ক্রমে হইতেছে বর্ত্তমান, বর্ত্তমান মিশিতেছে অতীতসমুদ্রে। অস্ত যাইতেছে নিশি, আসিছে দিবস, দিবস নিশার কোলে পড়িছে ঘুমায়ে। এই সময়ের চক্র ঘুরিয়া নীরবে পৃথিবীরে মানুষেরে অলক্ষিতভাবে পরিবর্ত্তনের পথে যেতেছে লইয়া, কিন্তু মনে হয় এই হিমাদ্রীর বুকে তাহার চরণ-চিহ্ন পড়িছে না যেন। কিন্তু মনে হয় যেন আমার হৃদয়ে দুর্দ্দাম সময়স্রোত অবিরামগতি, নূতন গড়ে নি কিছু, ভাঙ্গে নি পুরাণো। বাহিরের কত কি যে ভাঙ্গিল চূরিল, বাহিরের কত কি যে হইল নূতন, কিন্তু ভিতরের দিকে চেয়ে দেখ দেখি-- আগেও আছিল যাহা এখনো তা আছে, বোধ হয় চিরকাল থাকিবে তাহাই! বরষে বরষে দেহ যেতেছে ভাঙ্গিয়া, কিন্তু মন আছে তবু তেমনি অটল। নলিনী নাইকো বটে পৃথিবীতে আর, নলিনীরে ভালবাসি তবুও তেমনি। যখন নলিনী ছিল, তখন যেমন তার হৃদয়ের মূর্ত্তি ছিল এ হৃদয়ে, এখনো তেমনি তাহা রয়েছে স্থাপিত। এমন অন্তরে তারে রেখেছি লুকায়ে, মরমের মর্ম্মস্থলে করিতেছি পূজা, সময় পারে না সেথা কঠিন আঘাতে ভাঙ্গিবারে এ জনমে সে মোর প্রতিমা, হৃদয়ের আদরের লুকানো সে ধন! ভেবেছিনু এক বার এই-যে বিষাদ নিদারুণ তীব্র স্রোতে বহিছে হৃদয়ে এ বুঝি হৃদয় মোর ভাঙ্গিবে চূরিবে-- পারে নি ভাঙ্গিতে কিন্তু এক তিল তাহা, যেমন আছিল মন তেমনি রয়েছে! বিষাদ যুঝিয়াছিল প্রাণপণে বটে, কিন্তু এ হৃদয়ে মোর কি যে আছে বল, এ দারুণ সমরে সে হইয়াচে জয়ী। গাও গো বিহগ তব প্রমোদের গান, তেমনি হৃদয়ে তার রবে প্রতিধ্বনি! প্রকৃতি! মাতার মত সুপ্রসন্ন দৃষ্টি যেমন দেখিয়াছিনু ছেলেবেলা আমি, এখনো তেমনি যেন পেতেছি দেখিতে। যা কিছু সুন্দর, দেবি, তাহাই মঙ্গল, তোমার সুন্দর রাজ্যে হে প্রকৃতিদেবি তিল অমঙ্গল কভু পারে না ঘটিতে। অমন সুন্দর আহা নলিনীর মন, জীবন সৌন্দর্য্য, দেবি তোমার এ রাজ্যে অনন্ত কালের তরে হবে না বিলীন। যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবে তা দেবি, এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়। তোমার আশ্বাসবাক্যে হে প্রকৃতিদেবি, সংশয় কখনো আমি করি না স্বপনে! বাজাও রাখাল তব সরল বাঁশরী! গাও গো মনের সাধে প্রমোদের গান! পাখীরা মেলিয়া যবে গাইতেছে গীত, কানন ঘেরিয়া যবে বহিতেছে বায়ু, উপত্যকাময় যবে ফুটিয়াছে ফুল, তখন তোদের আর কিসের ভাবনা? দেখি চিরহাস্যময় প্রকৃতির মুখ, দিবানিশি হাসিবারে শিখেছিস্ তোরা! সমস্ত প্রকৃতি যবে থাকে গো হাসিতে, সমস্ত জগৎ যবে গাহে গো সঙ্গীত, তখন ত তোরা নিজ বিজন কুটীরে ক্ষুদ্রতম আপনার মনের বিষাদে সমস্ত জগৎ ভুলি কাঁদিস না বসি! জগতের, প্রকৃতির ফুল্ল মুখ হেরি আপনার ক্ষুদ্র দুঃখ রহে কি গো আর? ধীরে ধীরে দূর হোতে আসিছে কেমন বসন্তের সুরভিত বাতাসের সাথে মিশিয়া মিশিয়া এই সরল রাগিণী। একেক রাগিণী আছে করিলে শ্রবণ মনে হয় আমারি তা প্রাণের রাগিণী-- সেই রাগিণীর মত আমার এ প্রাণ, আমার প্রাণের মত যেন সে রাগিণী! কখন বা মনে হয় পুরাতন কাল এই রাগিণীর মত আছিল মধুর, এমনি স্বপনময় এমনি অস্ফুট-- পাই শুনি ধীরি ধীরি পুরাতন স্মৃতি প্রাণের ভিতরে যেন উথলিয়া উঠে!" ক্রমে কবি যৌবনের ছাড়াইয়া সীমা, গম্ভীর বার্দ্ধক্যে আসি হোলো উপনীত! সুগম্ভীর বৃদ্ধ কবি, স্কন্ধে আসি তার পড়েছে ধবল জটা অযত্নে লুটায়ে! মনে হোতো দেখিলে সে গম্ভীর মুখশ্রী হিমাদ্রি হোতেও বুঝি সমুচ্চ মহান্! নেত্র তাঁর বিকীরিত কি স্বর্গীয় জ্যোতি, যেন তাঁর নয়নের শান্ত সে কিরণ সমস্ত পৃথিবীময় শান্তি বরষিবে। বিস্তীর্ণ হইয়া গেল কবির সে দৃষ্টি, দৃষ্টির সম্মুখে তার, দিগন্তও যেন খুলিয়া দিত গো নিজ অভেদ্য দুয়ার। যেন কোন দেববালা কবিরে লইয়া অনন্ত নক্ষত্রলোকে কোরেছে স্থাপিত-- সামান্য মানুষ যেথা করিলে গমন কহিত কাতর স্বরে ঢাকিয়া নয়ন, "এ কি রে অনন্ত কাণ্ড, পারি না সহিতে!" সন্ধ্যার আঁধারে হোথা বসিয়া বসিয়া, কি গান গাইছে কবি, শুন কলপনা। কি "সুন্দর সাজিয়াছে ওগো হিমালয় তোমার বিশালতম শিখরের শিরে একটি সন্ধ্যার তারা! সুনীল গগন ভেদিয়া, তুষারশুভ্র মস্তক তোমার! সরল পাদপরাজি আঁধার করিয়া উঠেছে তাহার পরে; সে ঘোর অরণ্য ঘেরিয়া হুহুহু করি তীব্র শীতবায়ু দিবানিশি ফেলিতেছে বিষণ্ণ নিশ্বাস! শিখরে শিখরে ক্রমে নিভিয়া আসিল অস্তমান তপনের আরক্ত কিরণে প্রদীপ্ত জলদচূর্ণ। শিখরে শিখরে মলিন হইয়া এল উজ্জ্বল তুষার, শিখরে শিখরে ক্রমে নামিয়া আসিল আঁধারের যবনিকা ধীরে ধীরে ধীরে! পর্ব্বতের বনে বনে গাঢ়তর হোলো ঘুমময় অন্ধকার। গভীর নীরব! সাড়াশব্দ নাই মুখে, অতি ধীরে ধীরে অতি ভয়ে ভয়ে যেন চলেছে তটিনী সুগম্ভীর পর্ব্বতের পদতল দিয়া! কি মহান্! কি প্রশান্ত! কি গম্ভীর ভাব! ধরার সকল হোতে উপরে উঠিয়া স্বর্গের সীমায় রাখি ধবল জটায় জড়িত মস্তক তব ওগো হিমালয় নীরব ভাষায় তুমি কি যেন একটি গম্ভীর আদেশ ধীরে করিছ প্রচার! সমস্ত পৃথিবী তাই নীরব হইয়া শুনিছে অনন্যমনে সভয়ে বিস্ময়ে। আমিও একাকী হেথা রয়েছি পড়িয়া, আঁধার মহা-সমুদ্রে গিয়াছি মিশায়ে, ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র নর আমি, শৈলরাজ! অকূল সমুদ্রে ক্ষুদ্র তৃণটির মত হারাইয়া দিগ্বিদিক্, হারাইয়া পথ, সভয়ে বিস্ময়ে, হোয়ে হতজ্ঞানপ্রায় তোমার চরণতলে রয়েছি পড়িয়া। ঊর্দ্ধ্বমুখে চেয়ে দেখি ভেদিয়া আঁধার শূন্যে শূন্যে শত শত উজ্জ্বল তারকা, অনিমিষ নেত্রগুলি মেলিয়া যেন রে আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া। ওগো হিমালয়, তুমি কি গম্ভীর ভাবে দাঁড়ায়ে রয়েছ হেথা অচল অটল, দেখিছ কালের লীলা, করিছ গননা, কালচক্র কত বার আইল ফিরিয়া! সিন্ধুর বেলার বক্ষে গড়ায় যেমন অযুত তরঙ্গ, কিছু লক্ষ্য না করিয়া কত কাল আইল রে, গেল কত কাল হিমাদ্রি তোমার ওই চক্ষের উপরি। মাথার উপর দিয়া কত দিবাকর উলটি কালের পৃষ্ঠা গিয়াছে চলিয়া। গম্ভীর আঁধারে ঢাকি তোমার ও দেহ কত রাত্রি আসিয়াছে গিয়াছে পোহায়ে। কিন্তু বল দেখি ওগো হিমালয়গিরি মানুষসৃষ্টির অতি আরম্ভ হইতে কি দেখিছ এইখানে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে? যা দেখিছ যা দেখেছ তাতে কি এখনো সর্ব্বাঙ্গ তোমার গিরি উঠে নি শিহরি? কি দারুণ অশান্তি এই মনুষ্যজগতে-- রক্তপাত, অত্যাচার , পাপ কোলাহল দিতেছে মানবমনে বিষ মিশাইয়া! কত কোটি কোটি লোক, অন্ধকারাগারে অধীনতাশৃঙ্খলেতে আবদ্ধ হইয়া ভরিছে স্বর্গের কর্ণ কাতর ক্রন্দনে, অবশেষে মন এত হোয়েছে নিস্তেজ, কলঙ্কশৃঙ্খল তার অলঙ্কাররূপে আলিঙ্গন ক'রে তারে রেখেছে গলায়! দাসত্বের পদধূলি অহঙ্কার কোরে মাথায় বহন করে পরপ্রত্যাশীরা! যে পদ মাথায় করে ঘৃণার আঘাত সেই পদ ভক্তিভরে করে গো চুম্বন! যে হস্ত ভ্রাতারে তার পরায় শৃঙ্খল, সেই হস্ত পরশিলে স্বর্গ পায় করে। স্বাধীন, সে অধীনেরে দলিবার তরে, অধীন, সে স্বাধীনেরে পূজিবারে শুধু! সবল, সে দুর্ব্বলেরে পীড়িতে কেবল—দুর্ব্বল, বলের পদে আত্ম বিসর্জ্জিতে! স্বাধীনতা কারে বলে জানে সেই জন কোথায় সেই অসহায় অধীন জনের কঠিন শৃঙ্খলরাশি দিবে গো ভাঙ্গিয়া, না, তার স্বাধীন হস্ত হোয়েছে কেবল অধীনের লৌহপাশ দৃঢ় করিবারে। সবল দুর্ব্বলে কোথা সাহায্য করিবে-- দুর্ব্বলে অধিকতর করিতে দুর্ব্বল বল তার-- হিমগিরি, দেখিছ কি তাহা? সামান্য নিজের স্বার্থ করিতে সাধন কত দেশ করিতেছে শ্মশান অরণ্য, কোটি কোটি মানবের শান্তি স্বাধীনতা রক্তময়পদাঘাতে দিতেছে ভাঙ্গিয়া, তবুও মানুষ বলি গর্ব্ব করে তারা, তবু তারা সভ্য বলি করে অহঙ্কার! কত রক্তমাখা ছুরি হাসিছে হরষে, কত জিহ্বা হৃদয়েরে ছিঁড়িছে বিঁধিছে! বিষাদের অশ্রুপূর্ণ নয়ন হে গিরি অভিশাপ দেয় সদা পরের হরষে, উপেক্ষা ঘৃণায় মাখা কুঞ্চিত অধর পরঅশ্রুজলে ঢালে হাসিমাখা বিষ! পৃথিবী জানে না গিরি হেরিয়া পরের জ্বালা, হেরিয়া পরের মর্ম্মদুখের উচ্ছ্বাস, পরের নয়নজলে মিশাতে নয়নজল—পরের দুখের শ্বাসে মিশাতে নিশ্বাস! প্রেম? প্রেম কোথা হেথা এ অশান্তিধামে? প্রণয়ের ছদ্মবেশ পরিয়া যেথায় বিচরে ইন্দ্রিয়সেবা, প্রেম সেথা আছে? প্রেমে পাপ বলে যারা, প্রেম তারা চিনে? মানুষে মানুষে যেথা আকাশ পাতাল, হৃদয়ে হৃদয়ে যেথা আত্ম-অভিমান, যে ধরায় মন দিয়া ভাল বাসে যারা উপেক্ষা বিদ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদে তারাই অধিক সহে বিষাদ যন্ত্রণা, সেথা যদি প্রেম থাকে তবে কোথা নাই-- তবে প্রেম কলুষিত নরকেও আছে! কেহ বা রতনময় কনকভবনে ঘুমায়ে রয়েছে সুখে বিলাসের কোলে, অথচ সুমুখ দিয়া দীন নিরালয় পথে পথে করিতেছে ভিক্ষান্নসন্ধান! সহস্র পীড়িতদের অভিশাপ লোয়ে সহস্রের রক্তধারে ক্ষালিত আসনে সমস্ত পৃথিবী রাজা করিছে শাসন, বাঁধিয়া গলায় সেই শাসনের রজ্জু সমস্ত পৃথিবী তাহার রহিয়াছে দাস! সহস্র পীড়ন সহি আনত মাথায় একের দাসত্বে রত অযুত মানব! ভাবিয়া দেখিলে মন উঠে গো শিহরি-- ভ্রমান্ধ দাসের জাতি সমস্ত মানুষ। এ অশান্তি কবে দেব হবে দূরীভূত! অত্যাচার-গুরুভারে হোয়ে নিপীড়িত সমস্ত পৃথিবী, দেব, করিছে ক্রন্দন! সুখ শান্তি সেথা হোতে লয়েছে বিদায়! কবে, দেব, এ রজনী হবে অবসান? স্নান করি প্রভাতের শিশিরসলিলে তরুণ রবির করে হাসিবে পৃথিবী! অযুত মানবগণ এক কণ্ঠে, দেব, এক গান গাইবেক স্বর্গ পূর্ণ করি! নাইক দরিদ্র ধনী অধিপতি প্রজা-- কেহ কারো কুটীরেতে করিলে গমন মর্য্যাদার অপমান করিবে না মনে, সকলেই সকলের করিতেছে সেবা, কেহ কারো প্রভু নয়, নহে কারো দাস! নাই ভিন্ন জাতি আর নাই ভিন্ন ভাষা নাই ভিন্ন দেশ, ভিন্ন আচার ব্যাভার! সকলেই আপনার আপনার লোয়ে পরিশ্রম করিতেছে প্রফুল্ল-অন্তরে। কেহ কারো সুখে নাহি দেয় গো কণ্টক, কেহ কারো দুখে নাহি করে উপহাস! দ্বেষ নিন্দা ক্রূরতার জঘন্য আসন ধর্ম্ম-আবরণে নাহি করে গো সজ্জিত! হিমাদ্রি, মানুষসৃষ্টি-আরম্ভ হইতে অতীতের ইতিহাস পড়েছ সকলি, অতীতের দীপশিখা যদি হিমালয় ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পারে গো ভেদিতে তবে বল কবে, গিরি, হবে সেই দিন যে দিন স্বর্গই হবে পৃথ্বীর আদর্শ! সে দিন আসিবে গিরি, এখনিই যেন দূর ভবিষ্যৎ সেই পেতেছি দেখিতে যেই দিন এক প্রেমে হইয়া নিবদ্ধ মিলিবেক কোটি কোটি মানবহৃদয়। প্রকৃতির সব কার্য্য অতি ধীরে ধীরে, এক এক শতাব্দীর সোপানে সোপানে-- পৃথ্বী সে শান্তির পথে চলিতেছে ক্রমে, পৃথিবীর সে অবস্থা আসে নি এখনো কিন্তু এক দিন তাহা আসিবে নিশ্চয়। আবার বলি গো আমি হে প্রকৃতিদেবি যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবেক তাহা, এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়। এ যে সুখময় আশা দিয়াছ হৃদয়ে ইহার সঙ্গীত, দেবি, শুনিতে শুনিতে পারিব হরষচিতে ত্যজিতে জীবন!" সমস্ত ধরার তরে নয়নের জল বৃদ্ধ সে কবির নেত্র করিল পূর্ণিত! যথা সে হিমাদ্রি হোতে ঝরিয়া ঝরিয়া কত নদী শত দেশ করয়ে উর্ব্বরা। উচ্ছ্বসিত করি দিয়া কবির হৃদয় অসীম করুণা সিন্ধু পোড়েছে ছড়ায়ে সমস্ত পৃথিবীময়। মিলি তাঁর সাথে জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী ভারতী কাঁদিলেন আর্দ্র হোয়ে পৃথিবীর দুখে, ব্যাধশরে নিপতিত পাখীর মরণে বাল্মীকির সাথে যিনি করেন রোদন! কবির প্রাচীননেত্রে পৃথিবীর শোভা এখনও কিছু মাত্র হয় নি পুরাণো? এখনো সে হিমাদ্রির শিখরে শিখরে একেলা আপন মনে করিত ভ্রমণ। বিশাল ধবল জটা, বিশাল ধবল শ্মশ্রু, নেত্রের স্বর্গীয় জ্যোতি, গম্ভীর মূরতি, প্রশস্ত ললাটদেশ, প্রশান্ত আকৃতি তার মনে হোত হিমাদ্রির অধিষ্ঠাতৃদেব! জীবনের দিন ক্রমে ফুরায় কবির! সঙ্গীত যেমন ধীরে আইসে মিলায়ে, কবিতা যেমন ধীরে আইসে ফুরায়ে, প্রভাতের শুকতারা ধীরে ধীরে যথা ক্রমশঃ মিশায়ে আসে রবির কিরণে, তেমনি ফুরায়ে এল কবির জীবন। প্রতিরাত্রে গিরিশিরে জোছনায় বসি আনন্দে গাইত কবি সুখের সঙ্গীত। দেখিতে পেয়েছে যেন স্বর্গের কিরণ, শুনিতে পেয়েছে যেন দূর স্বর্গ হোতে, নলিনীর সুমধুর আহ্বানের গান। প্রবাসী যেমন আহা দূর হোতে যদি সহসা শুনিতে পায় স্বদেশ-সঙ্গীত, ধায় হরষিত চিতে সেই দিক্ পানে, একদিন দুইদিন যেতেছে যেমন চলেছে হরষে কবি সেই দেশ হোতে স্বদেশসঙ্গীতধ্বনি পেতেছে শুনিতে। এক দিন হিমাদ্রির নিশীথ বায়ুতে কবির অন্তিম শ্বাস গেল মিশাইয়া! হিমাদ্রি হইল তার সমাধিমন্দির, একটি মানুষ সেথা ফেলে নি নিশ্বাস! প্রত্যহ প্রভাত শুধু শিশিরাশ্রুজলে হরিত পল্লব তার করিত প্লাবিত! শুধু সে বনের মাঝে বনের বাতাস, হুহু করি মাঝে মাঝে ফেলিত নিশ্বাস! সমাধি উপরে তার তরুলতাকুল প্রতিদিন বরষিত কত শত ফুল! কাছে বসি বিহগেরা গাইত গো গান, তটিনী তাহার সাথে মিশাইত তান।
(কবি-কাহিনী কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া,
কাঁদে সে দু হাত তুলি।
হাসিছে আকাশ, বহিছে বাতাস,
পাখিরা গাহিছে সুখে।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে,
বিকালে ঘরের মুখে।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে।
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
'কে তুমি কাঁদিছ বসি । '
সে কেবল বলে নয়নের জলে,
'হাতে পাই নাই শশী।'
সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
অযাচিত ফুলদল,
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
দক্ষিণ করতল।
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
করিছে তাহার দেহে,
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
ঢাকিছে নীরব স্নেহে।
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি,
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
লইতে বন্ধু করি।
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা,
কত ভালোবাসাবাসি,
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
কত আসে যায় ভাসি,
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া,
কহে সে নয়নজলে,
'তোমাদের আমি চাহি না কারেও,
শশী চাই করতলে।'
শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল,
সেও ব'সে এক ঠাঁই।
অবশেষে যবে জীবনের দিন
আর বেশি বাকি নাই,
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
সুনীল সিন্ধুতীরে।
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান,
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায়,
মাঝি বসে গায় গান।
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর,
বধূরা চলেছে ঘাটে,
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
আসিছে গ্রামের হাটে।
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি,
কহে ম্রিয়মাণ মন,
'শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
আর বার এ জীবন।'
দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
চির-কল্লোলময়।
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে,
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
প্রতি দিবসের কাজে।
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
ঘরের ছেলের মতো,
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
নয়ন করিয়া নত।
ছোটো ছোটো ফুল, ছোটো ছোটো হাসি,
ছোটো কথা, ছোটো সুখ,
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি,
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি,
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি ফিরি।
দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
অতীত জীবন-রেখা,
অস্তরবির সোনার কিরণে
নূতন বরনে লেখা।
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
চাহে নি কখনো ফিরে,
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
স্মৃতিসাগরের তীরে।
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
পুরবীরাগিণী বাজে,
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
ওই জীবনের মাঝে।
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
তবু পিছে চেয়ে রহে—
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
তার বেশি কিছু নহে।
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
কোথা সে চলিল ভেসে।
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশীহীন দেশে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
চৈত্রের সেতারে বাজে
বসন্তবাহার,
বাতাসে বাতাসে উঠে
তরঙ্গ তাহার। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিনাটিকা
|
দুর্যোধন। প্রণমি চরণে তাত!
ধৃতরাষ্ট্র। ওরে দুরাশয়,
অভীষ্ট হয়েছে সিদ্ধ?
দুর্যোধন। লভিয়াছি জয়।
ধৃতরাষ্ট্র। এখন হয়েছ সুখী?
দুর্যোধন। হয়েছি বিজয়ী।
ধৃতরাষ্ট্র। অখণ্ড রাজত্ব জিনি সুখ তোর কই
রে দুর্মতি?
দুর্যোধন। সুখ চাহি নাই মহারাজ!
জয়, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।
ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা
কুরুপতি-- দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা
জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,
সদ্য করিয়াছি পান; সুখী নহি, তাত,
অদ্য আমি জয়ী। পিতঃ, সুখে ছিনু, যবে
একত্রে আছিনু বদ্ধ পাণ্ডবে কৌরবে,
কলঙ্ক যেমন থাকে শশাঙ্কের বুকে
কর্মহীন গর্বহীন দীপ্তিহীন সুখে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবের গাণ্ডীবটঙ্কারে
শঙ্কাকুল শত্রুদল আসিত না দ্বারে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবেরা জয়দৃপ্ত করে
ধরিত্রী দোহন করি' ভ্রাতৃপ্রীতিভরে
দিত অংশ তার-- নিত্য নব ভোগসুখে
আছিনু নিশ্চিন্তচিত্তে অনন্ত কৌতুকে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবের জয়ধ্বনি যবে
হানিত কৌরবকর্ণ প্রতিধ্বনিরবে।
পাণ্ডবের যশোবিম্ব-প্রতিবিম্ব আসি
উজ্জ্বল অঙ্গুলি দিয়া দিত পরকাশি
মলিন কৌরবকক্ষ। সুখে ছিনু, পিতঃ,
আপনার সর্বতেজ করি নির্বাপিত
পাণ্ডবগৌরবতলে স্নিগ্ধশান্তরূপে,
হেমন্তের ভেক যথা জড়ত্বের কূপে।
আজি পাণ্ডুপুত্রগণে পরাভব বহি
বনে যায় চলি-- আজ আমি সুখী নহি,
আজ আমি জয়ী।
ধৃতরাষ্ট্র। ধিক্ তোর ভ্রাতৃদ্রোহ।
পাণ্ডবের কৌরবের এক পিতামহ
সে কি ভুলে গেলি?
দুর্যোধন। ভুলিতে পারি নে সে যে--
এক পিতামহ, তবু ধনে মানে তেজে
এক নহি। যদি হত দূরবর্তী পর
নাহি ছিল ক্ষোভ; শর্বরীর শশধর
মধ্যাহ্নের তপনেরে দ্বেষ নাহি করে,
কিন্তু প্রাতে এক পূর্ব-উদয়শিখরে
দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক কিছুতে না ধরে।
আজ দ্বন্দ্ব ঘুচিয়াছে, আজি আমি জয়ী,
আজি আমি একা।
ধৃতরাষ্ট্র। ক্ষুদ্র ঈর্ষা! বিষময়ী
ভুজঙ্গিনী!
দুর্যোধন। ক্ষুদ্র নহে, ঈর্ষা সুমহতী।
ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। দুই বনস্পতি
মধ্যে রাখে ব্যবধান; লক্ষ লক্ষ তৃণ
একত্রে মিলিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন;
নক্ষত্র অসংখ্য থাকে সৌভ্রাত্রবন্ধনে--
এক সূর্য, এক শশী। মলিন কিরণে
দূর বন-অন্তরালে পাণ্ডুচন্দ্রলেখা
আজি অস্ত গেল, আজি কুরুসূর্য একা--
আজি আমি জয়ী!
ধৃতরাষ্ট্র। আজি ধর্ম পরাজিত।দুর্যোধন। লোকধর্ম রাজধর্ম এক নহে পিতঃ!
লোকসমাজের মাঝে সমকক্ষ জন
সহায় সুহৃদ্-রূপে নির্ভর বন্ধন।
কিন্তু রাজা একেশ্বর; সমকক্ষ তার
মহাশত্রু, চিরবিঘ্ন, স্থান দুশ্চিন্তার,
সম্মুখের অন্তরাল, পশ্চাতের ভয়,
অহর্নিশি যশঃশক্তিগৌরবের ক্ষয়,
ঐশ্বর্যের অংশ-অপহারী। ক্ষুদ্র জনে
বলভাগ ক'রে লয়ে বান্ধবের সনে
রহে বলী; রাজদণ্ড যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্বলতা, তত তার ক্ষয়।
একা সকলের ঊর্ধ্বে মস্তক আপন
যদি না রাখিবে রাজা, যদি বহুজন
বহুদূর হতে তাঁর সমুদ্ধত শির
নিত্য না দেখিতে পায় অব্যাহত স্থির,
তবে বহুজন--'পরে বহুদূরে তাঁর
কেমনে শাসনদৃষ্টি রহিবে প্রচার?
রাজধর্মে ভ্রাতৃধর্ম বন্ধুধর্ম নাই,
শুধু জয়ধর্ম আছে, মহারাজ, তাই
আজি আমি চরিতার্থ-- আজি জয়ী আমি--
সম্মুখের ব্যবধান গেছে আজি নামি
পাণ্ডবগৌরবগিরি পঞ্চচূড়াময়।
ধৃতরাষ্ট্র। জিনিয়া কপটদ্যূতে তারে কোস জয়,
লজ্জাহীন অহংকারী!
দুর্যোধন। যার যাহা বল
তাই তার অস্ত্র, পিতঃ, যুদ্ধের সম্বল।
ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান,
তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ
কোন্ নর লজ্জা পায়? মূঢ়ের মতন
ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুমাঝে আত্মসমর্পণ
যুদ্ধ নহে, জয়লাভ এক লক্ষ্য তার--
আজি আমি জয়ী পিতঃ, তাই অহংকার।
ধৃতরাষ্ট্র। আজি তুমি জয়ী, তাই তব নিন্দাধ্বনি
পরিপুর্ণ করিয়াছে অম্বর অবনী
সমুচ্চ ধিক্কারে।
দুর্যোধন। নিন্দা! আর নাহি ডরি,
নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি।
নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী
স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি
মোর পাদপীঠতলে। 'দুর্যোধন পাপী'
'দুর্যোধন ক্রূরমনা' 'দুর্যোধন হীন'
নিরুত্তরে শুনিয়া এসেছি এতদিন,
রাজদণ্ড স্পর্শ করি কহি মহারাজ,
আপামর জনে আমি কহাইব আজ--
'দুর্যোধন রাজা, দুর্যোধন নাহি সহে
রাজনিন্দা-আলোচনা, দুর্যোধন বহে
নিজ হস্তে নিজ নাম।'
ধৃতরাষ্ট্র। ওরে বৎস, শোন্,
নিন্দারে রসনা হতে দিলে নির্বাসন
নিম্নমুখে অন্তরের গূঢ় অন্ধকারে
গভীর জটিল মূল সুদূরে প্রসারে,
নিত্য বিষতিক্ত করি রাখে চিত্ততল।
রসনায় নৃত্য করি চপল চঞ্চল
নিন্দা শ্রান্ত হয়ে পড়ে; দিয়ো না তাহারে
নিঃশব্দে আপন শক্তি বৃদ্ধি করিবারে
গোপন হৃদয়দুর্গে। প্রীতিমন্ত্রবলে
শান্ত করো, বন্দী করো নিন্দাসর্পদলে
বংশীরবে হাস্যমুখে।
দুর্যোধন। অব্যক্ত নিন্দায়
কোনো ক্ষতি নাহি করে রাজমর্যাদায়;
ভ্রূক্ষেপ না করি তাহে। প্রীতি নাহি পাই
তাহে খেদ নাহি, কিন্তু স্পর্ধা নাহি চাই
মহারাজ! প্রীতিদান স্বেচ্ছার অধীন,
প্রীতিভিক্ষা দিয়ে থাকে দীনতম দীন--
সে প্রীতি বিলাক তারা পালিত মার্জারে,
দ্বারের কুক্কুরে, আর পাণ্ডবভ্রাতারে--
তাহে মোর নাহি কাজ। আমি চাহি ভয়,
সেই মোর রাজপ্রাপ্য-- আমি চাহি জয়
দর্পিতের দর্প নাশি। শুন নিবেদন
পিতৃদেব-- একাল তব সিংহাসন
আমার নিন্দুকদল নিত্য ছিল ঘিরে,
কণ্টকতরুর মতো নিষ্ঠুর প্রাচীরে
তোমার আমার মধ্যে রচি ব্যবধান--
শুনায়েছে পাণ্ডবের নিত্যগুণগান,
আমাদের নিত্য নিন্দা-- এইমতে, পিতঃ,
পিতৃস্নেহ হতে মোরা চিরনির্বাসিত।
এইমতে, পিতঃ, মোরা শিশুকাল হতে
হীনবল-- উৎসমুখে পিতৃস্নেহস্রোতে
পাষাণের বাধা পড়ি মোরা পরিক্ষীণ
শীর্ণ নদ, নষ্টপ্রাণ, গতিশক্তিহীন,
পদে পদে প্রতিহত; পাণ্ডবেরা স্ফীত,
অখণ্ড, অবাধগতি। অদ্য হতে পিতঃ,
যদি সে নিন্দুকদলে নাহি কর দূর
সিংহাসনপার্শ্ব হতে, সঞ্জয় বিদুর
ভীষ্মপিতামহে, যদি তারা বিজ্ঞবেশে
হিতকথা ধর্মকথা সাধু-উপদেশে
নিন্দায় ধিক্কারে তর্কে নিমেষে নিমেষে
ছিন্ন ছিন্ন করি দেয় রাজকর্মডোর,
ভারাক্রান্ত করি রাখে রাজদণ্ড মোর,
পদে পদে দ্বিধা আনে রাজশক্তি-মাঝে,
মুকুট মলিন করে অপমানে লাজে,
তবে ক্ষমা দাও পিতৃদেব-- নাহি কাজ
সিংহাসনকণ্টকশয়নে-- মহারাজ,
বিনিময় করে লই পাণ্ডবের সনে
রাজ্য দিয়ে বনবাস, যাই নির্বাসনে।
ধৃতরাষ্ট্র। হায় বৎস অভিমানী! পিতৃস্নেহ মোর
কিছু যদি হ্রাস হত শুনি সুকঠোর
সুহৃদের নিন্দাবাক্য, হইত কল্যাণ।
অধর্মে দিয়েছি যোগ, হারায়েছি জ্ঞান,
এত স্নেহ। করিতেছি সর্বনাশ তোর,
এত স্নেহ। জ্বালাতেছি কালানল ঘোর
পুরাতন কুরুবংশ-মহারণ্যতলে--
তবু পুত্র, দোষ দিস স্নেহ নাই ব'লে?
মণিলোভে কালসর্প করিলি কামনা,
দিনু তোরে নিজহস্তে ধরি তার ফণা
অন্ধ আমি।-- অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে
চিরদিন-- তোরে লয়ে প্রলয়তিমিরে
চলিয়াছি-- বন্ধুগণ হাহাকাররবে
করিছে নিষেধ, নিশাচর গৃধ্র-সবে
করিতেছে অশুভ চীৎকার, পদে পদে
সংকীর্ণ হতেছে পথ, আসন্ন বিপদে
কণ্টকিত কলেবর, তবু দৃঢ়করে
ভয়ংকর স্নেহে বক্ষে বাঁধি লয়ে তোরে
বায়ুবলে অন্ধবেগে বিনাশের গ্রাসে
ছুটিয়া চলেছি মূঢ় মত্ত অট্টহাসে
উল্কার আলোকে-- শুধু তুমি আর আমি,
আর সঙ্গী বজ্রহস্ত দীপ্ত অন্তর্যামী--
নাই সম্মুখের দৃষ্টি, নাই নিবারণ
পশ্চাতের, শুধু নিম্নে ঘোর আকর্ষণ
নিদারুণ নিপাতের। সহসা একদা
চকিতে চেতনা হবে, বিধাতার গদা
মুহূর্তে পড়িবে শিরে, আসিবে সময়--
ততক্ষণ পিতৃস্নেহে কোরো না সংশয়,
আলিঙ্গন করো না শিথিল, ততক্ষণ
দ্রুত হস্তে লুটি লও সর্ব স্বার্থধন--
হও জয়ী, হও সুখী, হও তুমি রাজা
একেশ্বর।-- ওরে, তোরা জয়বাদ্য বাজা।
জয়ধ্বজা তোল্ শূন্যে। আজি জয়োৎসবে
ন্যায় ধর্ম বন্ধু ভ্রাতা কেহ নাহি রবে--
না রবে বিদুর ভীষ্ম, না রবে সঞ্জয়,
নাহি রবে লোকনিন্দা লোকলজ্জা-ভয়
কুরুবংশরাজলক্ষ্ণী নাহি রবে আর--
শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার,
আর কালান্তক যম-- শুধু পিতৃস্নেহ
আর বিধাতার শাপ, আর নহে কেহ।
চর। মহারাজ, অগ্নিহোত্র দেব-উপাসনা
ত্যাগ করি বিপ্রগণ, ছাড়ি সন্ধ্যার্চনা,
দাঁড়ায়েছে চতুষ্পথে পাণ্ডবের তরে
প্রতীক্ষিয়া; পৌরগণ কেহ নাহি ঘরে,
পাণ্যশালা রুদ্ধ সব; সন্ধ্যা হল, তবু
ভৈরবমন্দির-মাঝে নাহি বাজে, প্রভু,
শঙ্খঘণ্টা সন্ধ্যাভেরী, দীপ নাহি জ্বলে;
শোকাতুর নরনারী সবে দলে দলে
চলিয়াছে নগরের সিংহদ্বার-পানে
দীনবেশে সজলনয়নে।
দুর্যোধন। নাহি জানে
জাগিয়াছে দুর্যোধন। মূঢ় ভাগ্যহীন!
ঘনায়ে এসেছে আজি তোদের দুর্দিন।
রাজায় প্রজায় আজি হবে পরিচয়
ঘনিষ্ঠ কঠিন। দেখি কতদিন রয়
প্রজার পরম স্পর্ধা-- নির্বিষ সর্পের
ব্যর্থ ফণা-আস্ফালন, নিরস্ত্র দর্পের
হুহুংকার।
[প্রতিহারীর প্রবেশ]
প্রতিহারী। মহারাজ, মহিষী গান্ধারী
দর্শনপ্রার্থিনী পদে।
ধৃতরাষ্ট্র। রহিনু তাঁহারি
প্রতীক্ষায়।
দুর্যোধন। পিতঃ, আমি চলিলাম তবে।
ধৃতরাষ্ট্র। করো পলায়ন। হায়, কেমনে বা সবে
সাধ্বী জননীর দৃষ্টি সমুদ্যত বাজ
ওরে পুণ্যভীত! মোরে তোর নাহি লাজ।
[গান্ধারীর প্রবেশ]
গান্ধারী। নিবেদন আছে শ্রীচরণে। অনুনয়
রক্ষা করো নাথ!
ধৃতরাষ্ট্র। কভু কি অপূর্ণ রয়
প্রিয়ার প্রার্থনা?
গান্ধারী। ত্যাগ করো এইবার--
ধৃতরাষ্ট্র। কারে হে মহিষী?
গান্ধারী। পাপের সংঘর্ষে যার
পড়িছে ভীষণ শান ধর্মের কৃপাণে,
সেই মূঢ়ে।
ধৃতরাষ্ট্র। কে সে জন? আছে কোন্খানে?
শুধু কহো নাম তার।
গান্ধারী। পুত্র দুর্যোধন।
ধৃতরাষ্ট্র। তাহারে করিব ত্যাগ!
গান্ধারী। এই নিবেদন
তব পদে।
ধৃতরাষ্ট্র। দারুণ প্রার্থনা, হে গান্ধারী
রাজমাতা!
গান্ধারী। এ প্রার্থনা শুধু কি আমারি
হে কৌরব? কুরুকুলপিতৃপিতামহ
স্বর্গ হতে এ প্রার্থনা করে অহরহ
নরনাথ! ত্যাগ করো, ত্যাগ করো তারে--
কৌরবকল্যাণলক্ষ্ণী যার অত্যাচারে
অশ্রুমুখী প্রতীক্ষিছে বিদায়ের ক্ষণ
রাত্রিদিন।
ধৃতরাষ্ট্র। ধর্ম তারে করিবে শাসন
ধর্মেরে যে লঙ্ঘন করেছে-- আমি পিতা--
গান্ধারী। মাতা আমি নহি? গর্ভভারজর্জরিতা
জাগ্রহ হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?
স্নেহবিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি
তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?
শাখাবন্ধে ফল যথা সেইমত করি
বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি
দুই ক্ষুদ্র বহুবৃন্ত দিয়ে-- লয়ে টানি
মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী,
প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি, মহারাজ,
সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ।
ধৃতরাষ্ট্র। কী রাখিব তারে ত্যাগ করি?
গান্ধারী। ধর্ম তব।
ধৃতরাষ্ট্র। কী দিবে তোমারে ধর্ম?
গান্ধারী। দুঃখ নব নব।
পুত্রসুখ রাজ্যসুখ অধর্মের পণে
জিনি লয়ে চিরদিন বহিব কেমনে
দুই কাঁটা বক্ষে আলিঙ্গিয়া?
ধৃতরাষ্ট্র। হায় প্রিয়ে,
ধর্মবশে একবার দিনু ফিরাইয়ে
দ্যূতবদ্ধ পাণ্ডবের হৃত রাজ্যধন।
পরক্ষণে পিতৃস্নেহ করিল গুঞ্জন
শত বার কর্ণে মোর, 'কী করিলি ওরে!
এক কালে ধর্মাধর্ম দুই তরী-'পরে
পা দিয়ে বাঁচে না কেহ। বারেক যখন
নেমেছে পাপের স্রোতে কুরুপুত্রগণ
তখন ধর্মের সাথে সন্ধি করা মিছে;
পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।
কী করিলি হতভাগ্য, বৃদ্ধ বুদ্ধিহত,
দুর্বল দ্বিধায় পড়ি? অপমানক্ষত
রাজ্য ফিরে দিলে তবু মিলাবে না আর
পাণ্ডবের মনে-- শুধু নব কাষ্ঠভার
হুতাশনে দান। অপমানিতের করে
ক্ষমতার অস্ত্র দেওয়া মরিবার তরে।
সক্ষমে দিয়ো না ছাড়ি দিয়ে স্বল্প পীড়া--
করহ দলন। কোরো না বিফল ক্রীড়া
পাপের সহিত; যদি ডেকে আন তারে,
বরণ করিয়া তবে লহো একেবারে।'
এইমত পাপবুদ্ধি পিতৃস্নেহরূপে
বিঁধিতে লাগিল মোর কর্ণে চুপে চুপে
কত কথা তীক্ষ্ণ সূচিসম। পুনরায়
ফিরানু পাণ্ডবগণে; দ্যূতছলনায়
বিসর্জিনু দীর্ঘ বনবাসে। হায় ধর্ম,
হায় রে প্রবৃত্তিবেগ! কে বুঝিবে মর্ম
সংসারের!
গান্ধারী। ধর্ম নহে সম্পদের হেতু,
মহারাজ, নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু--
ধর্মেই ধর্মের শেষ। মূঢ়-নারী আমি,
ধর্মকথা তোমারে কী বুঝাইব স্বামী,
জান তো সকলই। পাণ্ডবেরা যাবে বনে,
ফিরাইলে ফিরিবে না, বদ্ধ তারা পণে।
এখন এ মহারাজ্য একাকী তোমার
মহীপতি-- পুত্রে তব ত্যজ এইবার;
নিষ্পাপেরে দুঃখ দিয়ে নিজে পুর্ণ সুখ
লইয়ো না, ন্যায়ধর্মে কোরো না বিমুখ
পৌরবপ্রাসাদ হতে-- দুঃখ সুদুঃসহ
আজ হতে, ধর্মরাজ, লহো তুলি লহো,
দেহো তুলি মোর শিরে।
ধৃতরাষ্ট্র। হায় মহারানী,
সত্য তব উপদেশ, তীব্র তব বাণী।
গান্ধারী। অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি
আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি
সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে;
কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।
ছললব্ধ পাপস্ফীত রাজ্যধনজনে
ফেলে রাখি সেও চলে যাক নির্বাসনে,
বঞ্চিত পাণ্ডবদের সমদুঃখভার
করুক বহন।
ধৃতরাষ্ট্র। ধর্মবিধি বিধাতার--
জাগ্রত আছেন তিনি, ধর্মদণ্ড তাঁর
রয়েছে উদ্যত নিত্য; অয়ি মনস্বিনী,
তাঁর রাজ্যে তাঁর কার্য করিবেন তিনি।
আমি পিতা--
গান্ধারী। তুমি রাজা, রাজ-অধিরাজ,
বিধাতার বাম হস্ত; ধর্মরক্ষা-কাজ
তোমা-'পরে সমর্পিত। শুধাই তোমারে,
যদি কোনো প্রজা তব সতী অবলারে
পরগৃহ হতে টানি করে অপমান
বিনা দোষে-- কী তাহার করিবে বিধান?
ধৃতরাষ্ট্র। নির্বাসন।
গান্ধারী। তবে আজ রাজপদতলে
সমস্ত নারীর হয়ে নয়নের জলে
বিচার প্রার্থনা করি। পুত্র দুর্যোধন
অপরাধী প্রভু! তুমি আছ, হে রাজন,
প্রমাণ আপনি। পুরুষে পুরুষে দ্বন্দ্ব
স্বার্থ লয়ে বাধে অহরহ-- ভালোমন্দ
নাহি বুঝি তার; দণ্ডনীতি, ভেদনীতি,
কূটনীতি কত শত, পুরুষের রীতি
পুরুষেই জানে। বলের বিরোধে বল,
ছলের বিরোধে কত জেগে উঠে ছল,
কৌশলে কৌশল হানে-- মোরা থাকি দূরে
আপনার গৃহকর্মে শান্ত অন্তঃপুরে
যে সেথা টানিয়া আনে বিদ্বেষ-অনল,
যে সেথা সঞ্চার করে ঈর্ষার গরল
বাহিরের দ্বন্দ্ব হতে, পুরুষেরে ছাড়ি
অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া নিরুপায় নারী
গৃহধর্মচারিণীর পুণ্যদেহ- 'পরে
কলুষপরুষ স্পর্শে অসম্মানে করে
হস্তক্ষেপ-- পতি-সাথে বাধায়ে বিরোধ
যে নর পত্নীরে হানি লয় তার শোধ,
সে শুধু পাষণ্ড নহে, সে যে কাপুরুষ।
মহারাজ, কী তার বিধান? অকলুষ
পুরুবংশে পাপ যদি জন্মলাভ করে
সেও সহে; কিন্তু, প্রভু, মাতৃগর্বভরে
ভেবেছিনু গর্ভে মোর বীরপুত্রগণ
জন্মিয়াছে-- হায় নাথ, সেদিন যখন
অনাথিনী পাঞ্চালীর আর্তকণ্ঠরব
প্রাসাদপাষাণভিত্তি করি দিল দ্রব
লজ্জা-ঘৃণা-করুণার তাপে, ছুটি গিয়া
হেরিনু গবাক্ষে, তার বস্ত্র আকর্ষিয়া
খল খল হাসিতেছে সভা-মাঝখানে
গান্ধারীর পুত্র পিশাচেরা-- ধর্ম জানে
সেদিন চূর্ণিয়া গেল জন্মের মতন
জননীর শেষ গর্ব। কুরুরাজগণ,
পৌরুষ কোথায় গেছে ছাড়িয়া ভারত!
তোমরা, হে মহারথী, জড়মূর্তিবৎ
বসিয়া রহিলে সেথা চাহি মুখে মুখে,
কেহ বা হাসিলে, কেহ করিলে কৌতুকে
কানাকানি-- কোষমাঝে নিশ্চল কৃপাণ
বজ্রনিঃশেষিত লুপ্তবিদ্যুৎ-সমান
নিদ্রাগত-- মহারাজ, শুন মহারাজ,
এ মিনতি। দূর করো জননীর লাজ,
বীরধর্ম করহ উদ্ধার, পদাহত
সতীত্বের ঘুচাও ক্রন্দন; অবনত
ন্যায়ধর্মে করহ সম্মান-- ত্যাগ করো
দূর্যোধনে।
ধৃতরাষ্ট্র। পরিতাপদহনে জর্জর
হৃদয়ে করিছ শুধু নিষ্ফল আঘাত
হে মহিষী!
গান্ধারী। শতগুণ বেদনা কি, নাথ,
লাগিছে না মোরে? প্রভু, দণ্ডিতের সাথে
দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তারে প্রাণ
কোনো ব্যথা নাহি পায় তার দণ্ডদান
প্রবলের অত্যাচার। যে দণ্ডবেদনা
পুত্রেরে পার না দিতে সে কারে দিয়ো না;
যে তোমার পুত্র নহে তারো পিতা আছে,
মহা-অপরাধী হবে তুমি তার কাছে
বিচারক। শুনিয়াছি বিশ্ববিধাতার
সবাই সন্তান মোরা-- পুত্রের বিচার
নিয়ত করেন তিনি আপনার হাতে
নারায়ণ; ব্যথা দেন, ব্যথা পান সাথে;
নতুবা বিচারে তাঁর নাই অধিকার,
মূঢ় নারী লভিয়াছি অন্তরে আমার
এই শাস্ত্র। পাপী পুত্রে ক্ষমা কর যদি
নির্বিচারে, মহারাজ, তবে নিরবধি
যত দণ্ড দিলে তুমি যত দোষীজনে,
ধর্মাধিপ নামে, কর্তব্যের প্রবর্তনে,
ফিরিয়া লাগিবে আসি দণ্ডদাতা ভূপে--
ন্যায়ের বিচার তব নির্মমতারূপে
পাপ হয়ে তোমারে দাগিবে। ত্যাগ করো
পাপী দুর্যোধনে।
ধৃতরাষ্ট্র। প্রিয়ে, সংহর, সংহর
তব বাণী। ছিঁড়িতে পারি নে মোহডোর,
ধর্মকথা শুধু আসি হানে সুকঠোর
ব্যর্থ ব্যথা। পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার,
তাই তারে ত্যজিতে না পারি-- আমি তার
একমাত্র। উন্মত্ত-তরঙ্গ-মাঝখানে
যে পুত্র সঁপেছে অঙ্গ তারে কোন্ প্রাণে
ছাড়ি যাব? উদ্ধারের আশা ত্যাগ করি
তবু তারে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরি,
তারি সাথে এক পাপে ঝাঁপ দিয়া পড়ি
এক বিনাশের তলে তলাইয়া মরি
অকাতরে-- অংশ লই তার দুর্গতির,
অর্ধ ফল ভোগ করি তার দুর্মতির,
সেই তো সান্ত্বনা মোর-- এখন তো আর
বিচারের কাল নাই, নাই প্রতিকার,
নাই পথ-- ঘটেছে যা ছিল ঘটিবার,
ফলিবে যা ফলিবার আছে।
[প্রস্থান]
গান্ধারী। হে আমার
অশান্ত হৃদয়, স্থির হও। নতশিরে
প্রতীক্ষা করিয়া থাকো বিধির বিধিরে
ধৈর্য ধরি। যেদিন সুদীর্ঘ রাত্রি-'পরে
সদ্য জেগে উঠে কাল সংশোধন করে
আপনারে, সেদিন দারুণ দুঃখদিন।
দুঃসহ উত্তাপে যথা স্থির গতিহীন
ঘুমাইয়া পড়ে বায়ু-- জাগে ঝঞ্ঝাঝড়ে
অকস্মাৎ, আপনার জড়ত্বের 'পরে
করে আক্রমণ, অন্ধ বৃশ্চিকের মতো
ভীমপুচ্ছে আত্মশিরে হানে অবিরত
দীপ্ত বজ্রশূল, সেইমত কাল যবে
জাগে, তারে সভয়ে অকাল কহে সবে।
লুটাও লুটাও শির-- প্রণম, রমণী,
সেই মহাকালে; তার রথচক্রধ্বনি
দূর রুদ্রলোক হতে বজ্রঘর্ঘরিত
ওই শুনা যায়। তোর আর্ত জর্জরিত
হৃদয় পাতিয়া রাখ্ তার পথতলে।
ছিন্ন সিক্ত হৃৎপিণ্ডের রক্তশতদলে
অঞ্জলি রচিয়া থাক্ জাগিয়া নীরবে
চাহিয়া নিমেষহীন। তার পরে যবে
গগনে উড়িবে ধূলি, কাঁপিবে ধরণী,
সহসা উঠিবে শূন্যে ক্রন্দনের ধ্বনি--
হায় হায় হা রমণী, হায় রে অনাথা,
হায় হায় বীরবধূ; হায় বীরমাতা,
হায় হায় হাহাকার-- তখন সুধীরে
ধুলায় পড়িস লুটি অবনতশিরে
মুদিয়া নয়ন। তার পরে নমো নম
সুনিশ্চিত পরিণাম, নির্বাক্ নির্মম
দারুণ করুণ শান্তি! নমো নমো নম
কল্যাণ কঠোর কান্ত, ক্ষমা স্নিগ্ধতম!
নমো নমো বিদ্বেষের ভীষণা নির্বৃতি!
শ্মশানে ভস্মমাখা পরমা নিষ্কৃতি!
[দুর্যোধন-মহিষী ভানুমতীর প্রবেশ]
ভানুমতী। ইন্দুমুখী, পরভৃতে, লহো তুলি শিরে
মাল্যবস্ত্র অলংকার।
গান্ধারী। বৎসে, ধীরে, ধীরে।
পৌরব ভবনে কোন্ মহোৎসব আজি?
কোথা যাও নব বস্ত্র-অলংকারে সাজি
বধূ মোর?
ভানুমতী। শত্রুপরাভব-শুভক্ষণ
সমাগত।
গান্ধারী। শত্রু যার আত্মীয়স্বজন
আত্মা তার নিত্য শত্রু, ধর্ম শত্রু তার,
অজেয় তাহার শত্রু। নব অলংকার
কোথা হতে হে কল্যাণী?
ভানুমতী। জিনি বসুমতী
ভুজবলে, পাঞ্চালীরে তার পঞ্চপতি
দিয়েছিল যত রত্নমণি-অলংকার--
যজ্ঞদিনে যাহা পরি ভাগ্য-অহংকার
ঠিকরিত মাণিক্যের শত সূচীমুখে
দ্রৌপদীর অঙ্গ হতে, বিদ্ধ হত বুকে
কুরুকুলকামিনীর, সে রত্নভূষণে
আমারে সাজায়ে তারে যেতে হল বনে।
গান্ধারী। হা রে মূঢ়ে, শিক্ষা তবু হল না তোমার--
সেই রত্ন নিয়ে তবু এত অহংকার!
এ কী ভয়ংকরী কান্তি, প্রলয়ের সাজ।
যুগান্তের উল্কাসম দহিছে না আজ
এ মণিমঞ্জীর তোরে? রত্নললাটিকা
এ যে তোর সৌভাগ্যের বজ্রানলশিখা।
তোরে হেরি অঙ্গে মোর ত্রাসের স্পন্দন
সঞ্চারিছে, চিত্তে মোর উঠিছে ক্রন্দন--
আনিছে শঙ্কিত কর্ণে তোর অলংকার
উন্মাদিনী শংকরীর তাণ্ডবঝংকার।
ভানুমতী। মাতঃ, মোরা ক্ষত্রনারী, দুর্ভাগ্যের ভয়
নাহি করি। কভু জয়, কভু পরাজয়--
মধ্যাহ্নগগনে কভু, কভু অস্তধামে,
ক্ষত্রিয়মহিমা-সূর্য উঠে আর নামে।
ক্ষত্রবীরাঙ্গনা, মাতঃ, সেই কথা স্মরি
শঙ্কার বক্ষেতে থাকি সংকটে না ডরি
ক্ষণকাল। দুর্দিন দুর্যোগ যদি আসে,
বিমুখ ভাগ্যেরে তবে হানি উপহাসে
কেমনে মরিতে হয় জানি তাহা দেবী--
কেমনে বাঁচিতে হয় শ্রীচরণ সেবি
সে শিক্ষাও লভিয়াছি।
গান্ধারী। বৎসে, অমঙ্গল
একেলা তোমার নহে। লয়ে দলবল
সে যবে মিটায় ক্ষুধা, উঠে হাহাকার,
কত বীররক্তস্রোতে কত বিধবার
অশ্রুধারা পড়ে আসি-- রত্ন-অলংকার
বধূহস্ত হতে খসি পড়ে শত শত
চূতলতাকুঞ্জবনে মঞ্জরীর মতো
ঝঞ্ঝাবাতে। বৎসে, ভাঙিয়ো না বদ্ধ সেতু,
ক্রীড়াচ্ছলে তুলিয়ো না বিপ্লবের কেতু
গৃহমাঝে-- আনন্দের দিন নহে আজি।
স্বজনদুর্ভাগ্য লয়ে সর্ব অঙ্গে সাজি
গর্ব করিয়ো না মাতঃ! হয়ে সুসংযত
আজ হতে শুদ্ধচিত্তে উপবাসব্রত
করো আচরণ-- বেণী করি উন্মোচন
শান্ত মনে করো, বৎসে, দেবতা-অর্চন।
এ পাপসৌভাগ্যদিনে গর্ব-অহংকারে
প্রতিক্ষণে লজ্জা দিয়ো নাকো বিধাতারে।
খুলে ফেলো অলংকার, নব রক্তাম্বর;
থামাও উৎসববাদ্য, রাজ-আড়ম্বর;
অগ্নিগৃহে যাও, পুত্রী, ডাকো পুরোহিতে--
কালের প্রতীক্ষা করো শুদ্ধসত্ত্ব চিতে্।
যুধিষ্ঠির। আশীর্বাদ মাগিবারে এসেছি, জননী,
বিদায়ের কালে।
গান্ধারী। সৌভাগ্যের দিনমণি
দুঃখরাত্রি-অবসানে দ্বিগুণ উজ্জ্বল
উদিবে হে বৎসগণ! বায়ু হতে বল,
সূর্য হতে তেজ, পৃথ# হতে ধৈর্যক্ষমা
করো লাভ দুঃখব্রত পুত্র মোর! রমা
দৈন্য-মাঝে গুপ্ত থাকি দীন-ছদ্ম-রূপে
ফিরুন পশ্চাতে তব সদা চুপে চুপে,
দুঃখ হতে তোমা-তরে করুন সঞ্চয়
অক্ষয় সম্পদ। নিত্য হউক নির্ভয়
নির্বাসনবাস। বিনা পাপে দুঃখভোগ
অন্তরে জ্বলন্ত তেজ করুক সংযোগ
বহ্নিশিখাদগ্ধ দীপ্ত সুবর্ণের প্রায়।
সেই মহাদুঃখ হবে মহৎ সহায়
তোমাদের। সেই দুঃখে রহিবেন ঋণী
ধর্মরাজ বিধি, যবে শুধিবেন তিনি
নিজহস্তে আত্মঋণ তখন জগতে
দেব নর কে দাঁড়াবে তোমাদের পথে!
মোর পুত্র করিয়াছে যত অপরাধ
খণ্ডন করুক সব মোর আশীর্বাদ
পুত্রাধিক পুত্রগণ! অন্যায় পীড়ন
গভীর কল্যাণসিন্ধু করুক মন্থন।
(দ্রৌপদীকে আলিঙ্গনপূর্বক)
ভূলুণ্ঠিতা স্বর্ণলতা, হে বৎসে আমার,
হে আমার রাহুগ্রস্ত শশী, একবার
তোলো শির, বাক্য মোর করো অবধান।
যে তোমারে অবমানে তারি অপমান
জগতে রহিবে নিত্য, কলঙ্ক অক্ষয়।
তব অপমানরাশি বিশ্বজগন্ময়
ভাগ করে লইয়াছে সর্ব কুলাঙ্গনা--
কাপুরুষতার হস্তে সতীর লাঞ্ছনা।
যাও বৎসে, পতি-সাথে অমলিনমুখ
অরণ্যেরে করো স্বর্গ, দুঃখে করো সুখ।
বধূ মোর, সুদুঃসহ পতিদুঃখব্যথা
বক্ষে ধরি সতীত্বের লভো সার্থকতা।
রাজগৃহে আয়োজন দিবসযামিনী
সহস্র সুখের-- বনে তুমি একাকিনী
সর্বসুখ, সর্বসঙ্গ, সর্বৈশ্বর্যময়,
সকল সান্ত্বনা একা, সকল আশ্রয়,
ক্লান্তির আরাম, শান্তি, ব্যাধির শুশ্রূষা,
দুর্দিনের শুভলক্ষ্ণী, তামসীর ভূষা
উষা মূর্তিমতী। তুমি হবে একাকিনী
সর্বপ্রীতি, সর্বসেবা, জননী, গেহিনী--
সতীত্বের শ্বেতপদ্ম সম্পূর্ণ সৌরভে
শতদলে প্রস্ফুটিয়া জাগিবে গৌরবে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
পউষ প্রখর শীতে জর্জর, ঝিল্লিমুখর রাতি;
নিদ্রিত পুরী, নির্জন ঘর, নির্বাণদীপ বাতি।
অকাতর দেহে আছিনু মগন সুখনিদ্রার ঘোরে--
তপ্ত শয্যা প্রিয়ার মতন সোহাগে ঘিরেছে মোরে।
হেনকালে হায় বাহির হইতে কে ডাকিল মোর নাম--
নিদ্রা টুটিয়া সহসা চকিতে চমকিয়া বসিলাম।
তীক্ষ্ণ শাণিত তীরের মতন মর্মে বাজিল স্বর--
ঘর্ম বহিল ললাট বাহিয়া, রোমাঞ্চকলেবর।
ফেলি আবরণ, ত্যজিয়া শয়ন, বিরলসন বেশে
দুরু দুরু বুকে খুলিয়া দুয়ার বাহিরে দাঁড়ানু এসে।
দূর নদীপারে শূন্য শ্মশানে শৃগাল উঠিল ডাকি,
মাথার উপরে কেঁদে উড়ে গেল কোন্ নিশাচর পাখি।
দেখিনু দুয়ারে রমণীমুরতি অবগুণ্ঠনে ঢাকা--
কৃষ্ণ অশ্বে বসিয়া রয়েছে, চিত্রে যেন সে আঁকা।
আরেক অশ্ব দাঁড়ায়ে রয়েছে, পুচ্ছ ভূতল চুমে,
ধূম্রবরন, যেন দেহ তার গঠিত শ্মশানধূমে।
নড়িল না কিছু, আমারে কেবল হেরিল আঁখির পাশে--
শিহরি শিহরি সর্ব শরীর কাঁপিয়া উঠিল ত্রাসে।
পাণ্ডু আকাশে খণ্ড চন্দ্র হিমানীর গ্লানি-মাখা,
পল্লবহীন বৃদ্ধ অশথ শিহরে নগ্ন শাখা।
নীরব রমণী অঙ্গুলী তুলি দিল ইঙ্গিত করি--
মন্ত্রমুগ্ধ অচেতনসম চড়িনু অশ্ব-'পরি।বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় ঘোড়া-- বারেক চাহিনু পিছে,
ঘরদ্বার মোর বাষ্পসমান মনে হল সব মিছে।
কাতর রোদন জাগিয়া উঠিল সকল হৃদয় ব্যেপে,
কণ্ঠের কাছে সুকঠিন বলে কে তারে ধরিল চেপে।
পথের দুধারে রুদ্ধদুয়ারে দাঁড়ায়ে সৌধসারি,
ঘরে ঘরে হায় সুখশয্যায় ঘুমাইছে নরনারী।
নির্জন পথ চিত্রিতবৎ, সাড়া নাই সারা দেশে--
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে--
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘন্টা বাজে।অফুরান পথ, অফুরান রাতি, অজানা নূতন ঠাঁই--
অপরূপ এক স্বপ্নসমান, অর্থ কিছুই নাই।
কী যে দেখেছিনু মনে নাহি পড়ে, ছিল নাকো আগাগোড়া--
লক্ষ্যবিহীন তীরের মতন ছুটিয়া চলেছে ঘোড়া।
চরণে তাদের শব্দ বাজে না, উড়ে নাকো ধূলিরেখা--
কঠিন ভূতল নাই যেন কোথা, সকলি বাষ্পে লেখা।
মাঝে মাঝে যেন চেনা-চেনা-মতো মনে হয় থেকে থেকে--
নিমেষ ফেলিতে দেখিতে না পাই কোথা পথ যায় বেঁকে।
মনে হল মেঘ, মনে হল পাখি, মনে হল কিশলয়,
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয়।
দুই ধারে এ কি প্রাসাদের সারি? অথবা তরুর মূল?
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল?
মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখে--
নীরব নিদয় বসিয়া রয়েছে, প্রাণ কেঁপে ওঠে বুকে।
ভয়ে ভুলে যাই দেবতার নাম, মুখে কথা নাহি ফুটে;
হুহু রবে বায়ু বাজে দুই কানে ঘোড়া চলে যায় ছুটে।চন্দ্র যখন অস্তে নামিল তখনো রয়েছে রাতি,
পূর্ব দিকের অলস নয়নে মেলিছে রক্ত ভাতি।
জনহীন এক সিন্ধুপুলিনে অশ্ব থামিল আসি--
সমুখে দাঁড়ায়ে কৃষ্ণ শৈল গুহামুখ পরকাশি।
সাগরে না শুনি জলকলরব, না গাহে উষার পাখি,
বহিল না মৃদু প্রভাতপবন বনের গন্ধ মাখি।
অশ্ব হইতে নামিল রমণী, আমিও নামিনু নীচে,
আঁধার-ব্যাদান গুহার মাঝারে চলিনু তাহার পিছে।
ভিতরে খোদিত উদার প্রাসাদ শিলাস্তম্ভ-'পরে,
কনকশিকলে সোনার প্রদীপ দুলিতেছে থরে থরে।
ভিত্তির গায়ে পাষাণমূর্তি চিত্রিত আছে কত,
অপরূপ পাখি, অপরূপ নারী, লতাপাতা নানা-মতো।
মাঝখানে আছে চাঁদোয়া খাটানো, মুক্তা ঝালরে গাঁথা--
তারি তলে মণিপালঙ্ক-'পরে অমল শয়ন পাতা।
তারি দুই ধারে ধূপাধার হতে উঠিছে গন্ধধূপ,
সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ।
নাহি কোনো লোক, নাহিকো প্রহরী, নাহি হেরি দাসদাসী।
গুহাগৃহতলে তিলেক শব্দ হয়ে উঠে রাশি রাশি।
নীরবে রমণী আবৃত বদনে বসিলা শয্যা-'পরে,
অঙ্গুলি তুলি ইঙ্গিত করি পাশে বসাইল মোরে।
হিম হয়ে এল সর্বশরীর, শিহরি উঠিল প্রাণ--
শোণিতপ্রবাহে ধ্বনিতে লাগিল ভয়ের ভীষণ তান।সহসা বাজিয়া বাজিয়া উঠিল দশ দিকে বীণা-বেণু,
মাথার উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িল পুষ্পরেণু।
দ্বিগুণ আভায় জ্বলিয়া উঠিল দীপের আলোকরাশি--
ঘোমটা-ভিতরে হাসিল রমণী মধুর উচ্চহাসি।
সে হাসি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল বিজন বিপুল ঘরে--
শুনিয়া চমকি ব্যাকুল হৃদয়ে কহিলাম জোড়করে,
"আমি যে বিদেশী অতিথি, আমায় ব্যথিয়ো না পরিহাসে,
কে তুমি নিদয় নীরব ললনা, কোথায় আনিলে দাসে।'অমনি রমণী কনকদণ্ড আঘাত করিল ভূমে,
আঁধার হইয়া গেল সে ভবন রাশি রাশি ধূপধূমে।
বাজিয়া উঠিল শতেক শঙ্খ হুলুকলরব-সাথে--
প্রবেশ করিল বৃদ্ধ বিপ্র ধান্যদূর্বা হাতে।
পশ্চাতে তার বাঁধি দুই সার কিরাতনারীর দল
কেহ বহে মালা, কেহ বা চামর, কেহ বা তীর্থজল।
নীরবে সকলে দাঁড়ায়ে রহিল-- বৃদ্ধ আসনে বসি
নীরবে গণনা করিতে লাগিল গৃহতলে খড়ি কষি।
আঁকিতে লাগিল কত না চক্র, কত না রেখার জাল,
গণনার শেষে কহিল "এখন হয়েছে লগ্ন-কাল'।
শয়ন ছাড়িয়া উঠিল রমণী বদন করিয়া নত,
আমিও উঠিয়া দাঁড়াইনু পাশে মন্ত্রচালিতমত।
নারীগণ সবে ঘেরিয়া দাঁড়ালো একটি কথা না বলি
দোঁহাকার মাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি।
পুরোহিত শুধু মন্ত্র পড়িল আশিস করিয়া দোঁহে--
কী ভাষা কী কথা কিছু না বুঝিনু, দাঁড়ায়ে রহিনু মোহে।
অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর
হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর।
চলি গেল ধীরে বৃদ্ধ বিপ্র, পশ্চাতে বাঁধি সার
গেল নারীদল মাথায় কক্ষে মঙ্গল-উপচার।
শুধু এক সখী দেখাইল পথ হাতে লয়ে দীপখানি--
মোরা দোঁহে পিছে চলিনু তাহার, কারো মুখে নাহি বাণী।
কত না দীর্ঘ আঁধার কক্ষ সভয়ে হইয়া পার
সহসা দেখিনু সমুখে কোথায় খুলে গেল এক দ্বার।
কী দেখিনু ঘরে কেমনে কহিব, হয়ে যায় মনোভুল,
নানা বরনের আলোক সেথায়, নানা বরনের ফুল।
কনকে রজতে রতনে জড়িত বসন বিছানো কত,
মণিবেদিকায় কুসুমশয়ন স্বপ্নরচিত-মতো।
পাদপীঠ-'পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ--
আমি কহিলাম, "সব দেখিলাম, তোমারে দেখি নি শুধু।'চারি দিক হতে বাজিয়া উঠিল শত কৌতুকহাসি।
শত ফোয়ারায় উছসিল যেন পরিহাস রাশি রাশি।
সুধীরে রমণী দু-বাহু তুলিয়া, অবগুণ্ঠনখানি
উঠায়ে ধরিয়া মধুর হাসিল মুখে না কহিয়া বাণী।
চকিত নয়ানে হেরি মুখপানে পড়িনু চরণতলে,
"এখানেও তুমি জীবনদেবতা!' কহিনু নয়নজলে।
সেই মধুমুখ, সেই মৃদুহাসি, সেই সুধাভরা আঁখি--
চিরদিন মোরে হাসালো কাঁদালো, চিরদিন দিল ফাঁকি।
খেলা করিয়াছে নিশিদিন মোর সব সুখে সব দুখে,
এ অজানাপুরে দেখা দিল পুন সেই পরিচিত মুখে।
অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে--
বাধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে।
অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে বাজিতে লাগিল বাঁশি।
বিজন বিপুল ভবনে রমণী হাসিতে লাগিল হাসি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
১
ভয়ে ভয়ে ভ্রমিতেছি মানবের মাঝে
হৃদয়ের আলোটুকু নিবে গেছে ব’লে !
কে কী বলে তাই শুনে মরিতেছি লাজে ,
কী হয় কী হয় ভেবে ভয়ে প্রাণ দোলে !
‘ আলো’ ‘আলো’ খুঁজে মরি পরের নয়নে ,
‘ আলো’ ‘আলো’ খুঁজে খুঁজে কাঁদি পথে পথে ,
অবশেষে শুয়ে পড়ি ধূলির শয়নে —
ভয় হয় এক পদ অগ্রসর হতে !
বজ্রের আলোক দিয়ে ভাঙো অন্ধকার ,
হৃদি যদি ভেঙে যায় সেও তবু ভালো ।
যে গৃহে জানালা নাই সে তো কারাগার —
ভেঙে ফেলো , আসিবেক স্বরগের আলো ।
হায় হায় কোথা সেই অখিলের জ্যোতি !
চলিব সরল পথে অশঙ্কিতগতি !২
জ্বালায়ে আঁধার শূন্যে কোটি রবিশশী
দাঁড়ায়ে রয়েছ একা অসীমসুন্দর ।
সুগভীর শান্ত নেত্র রয়েছে বিকশি ,
চিরস্থির শুভ্র হাসি , প্রসন্ন অধর ।
আনন্দে আঁধার মরে চরণ পরশি ,
লাজ ভয় লাজে ভয়ে মিলাইয়া যায় —
আপন মহিমা হেরি আপনি হরষি
চরাচর শির তুলি তোমাপানে চায় ।
আমার হৃদয়দীপ আঁধার হেথায় ,
ধূলি হতে তুলি এরে দাও জ্বালাইয়া —
ওই ধ্রুবতারাখানি রেখেছ যেথায়
সেই গগনের প্রান্তে রাখো ঝুলাইয়া ।
চিরদিন জেগে রবে নিবিবে না আর ,
চিরদিন দেখাইবে আঁধারের পার । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
আগা বলে, আমি বড়ো, তুমি ছোটো লোক।
গোড়া হেসে বলে, ভাই, ভালো তাই হোক।
তুমি উচ্চে আছ ব’লে গর্বে আছ ভোর,
তোমারে করেছি উচ্চ এই গর্ব মোর। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.