poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খবর এল , সময় আমার গেছে ,
আমার-গড়া পুতুল যারা বেচে
বর্তমানে এমনতরো পসারী নেই ;
সাবেক কালের দালানঘরের পিছন কোণেই
ক্রমে ক্রমে
উঠছে জমে জমে
আমার হাতের খেলনাগুলো ,
টানছে ধুলো ।
হাল আমলের ছাড়পত্রহীন
অকিঞ্চনটা লুকিয়ে কাটায় জোড়াতাড়ার দিন ।
ভাঙা দেয়াল ঢেকে একটা ছেঁড়া পর্দা টাঙাই ;
ইচ্ছে করে , পৌষমাসের হাওয়ার তোড়টা ভাঙাই ;
ঘুমোই যখন ফড়্ফড়িয়ে বেড়ায় সেটা উড়ে ,
নিতান্ত ভুতুড়ে ।
আধপেটা খাই শালুক-পোড়া ; একলা কঠিন ভুঁয়ে
চেটাই পেতে শুয়ে
ঘুম হারিয়ে ক্ষণে ক্ষণে
আউড়ে চলি শুধু আপন-মনে —
“ উড়কি ধানের মুড়কি দেব , বিন্নে ধানের খই ,
সরু ধানের চিঁড়ে দেব , কাগমারে দই । ”
আমার চেয়ে কম-ঘুমন্ত নিশাচরের দল
খোঁজ নিয়ে যায় ঘরে এসে , হায় সে কী নিষ্ফল ।
কখনো বা হিসেব ভুলে আগে মাতাল চোর ,
শূন্য ঘরের পানে চেয়ে বলে , “ সাঙাত মোর ,
আছে ঘরে ভদ্র ভাষায় বলে যাকে দাওয়াই ?”
নেই কিছু তো , দু-এক ছিলিম তামাক সেজে খাওয়াই ।
একটু যখন আসে ঘুমের ঘোর
সুড়সুড়ি দেয় আরসুলারা পায়ের তলায় মোর ।
দুপুরবেলায় বেকার থাকি অন্যমনা ;
গিরগিটি আর কাঠবিড়ালির আনাগোনা
সেই দালানের বাহির ঝোপে ;
থামের মাথায় খোপে খোপে
পায়রাগুলোর সারাটা দিন বকম্-বকম্ ।
আঙিনাটার ভাঙা পাঁচিল , ফাটলে তার রকম-রকম
লতাগুল্ম পড়ছে ঝুলে ,
হলদে সাদা বেগনি ফুলে
আকাশ-পানে দিচ্ছে উঁকি ।
ছাতিমগাছের মরা শাখা পড়ছে ঝুঁকি
শঙ্খমণির খালে ,
মাছরাঙারা দুপুরবেলায় তন্দ্রানিঝুম কালে
তাকিয়ে থাকে গভীর জলের রহস্যভেদরত
বিজ্ঞানীদের মতো ।
পানাপুকুর , ভাঙনধরা ঘাট ,
অফলা এক চালতাগাছের চলে ছায়ার নাট ।
চক্ষু বুজে ছবি দেখি — কাৎলা ভেসেছে ,
বড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে ।
ঝাউগুঁড়িটার'পরে
কাঠঠোকরা ঠক্ঠকিয়ে কেবল প্রশ্ন করে ।
আগে কানে পৌঁছত না ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ,
এখন যখন পোড়ো বাড়ি দাঁড়িয়ে হতবাক্
ঝিল্লিরবের তানপুরা-তান স্তব্ধতা-সংগীতে
লেগেই আছে একঘেয়ে সুর দিতে ।
আঁধার হতে না হতে সব শেয়াল ওঠে ডেকে
কল্মদিঘির ডাঙা পাড়ির থেকে ।
পেঁচার ডাকে বাঁশের বাগান হঠাৎ ভয়ে জাগে ,
তন্দ্রা ভেঙে বুকে চমক লাগে ।
বাদুড়-ঝোলা তেঁতুলগাছে মনে যে হয় সত্যি ,
দাড়িওয়ালা আছে ব্রহ্মদত্যি ।
রাতের বেলায় ডোমপাড়াতে কিসের কাজে
তাক্ধুমাধুম বাদ্যি বাজে ।
তখন ভাবি , একলা ব ' সে দাওয়ার কোণে
মনে-মনে ,
ঝড়েতে কাত জারুলগাছের ডালে ডালে
পির্ভু নাচে হাওয়ার তালে ।
শহর জুড়ে নামটা ছিল , যেদিন গেল ভাসি
হলুম বনগাঁবাসী ।
সময় আমার গেছে ব ' লেই সময় থাকে পড়ে ,
পুতুল গড়ার শূন্য বেলা কাটাই খেয়াল গ ' ড়ে ।
সজনেগাছে হঠাৎ দেখি কমলাপুলির টিয়ে —
গোধূলিতে সুয্যিমামার বিয়ে ;
মামি থাকেন , সোনার বরন ঘোমটাতে মুখ ঢাকা ,
আলতা পায়ে আঁকা ।
এইখানেতে ঘুঘুডাঙার খাঁটি খবর মেলে
কুলতলাতে গেলে ।
সময় আমার গেছে ব ' লেই জানার সুযোগ হল
‘ কলুদ ফুল ' যে কাকে বলে , ওই যে থোলো থোলো
আগাছা জঙ্গলে
সবুজ অন্ধকারে যেন রোদের টুক্রো জ্বলে ।
বেড়া আমার সব গিয়েছে টুটে ;
পরের গোরু যেখান থেকে যখন খুশি ছুটে
হাতার মধ্যে আসে ;
আর কিছু তো পায় না , খিদে মেটায় শুকনো ঘাসে ।
আগে ছিল সাট্ন্ বীজে বিলিতি মৌসুমি ,
এখন মরুভূমি ।
সাত পাড়াতে সাত কুলেতে নেইকো কোথাও কেউ
মনিব যেটার , সেই কুকুরটা কেবল ই ঘেউ-ঘেউ
লাগায় আমার দ্বারে ; আমি বোঝাই তারে কত ,
আমার ঘরে তাড়িয়ে দেবার মতো
ঘুম ছাড়া আর মিলবে না তো কিছু —
শুনে সে লেজ নাড়ে , সঙ্গে বেড়ায় পিছু পিছু ।
অনাদরের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে পিঠের ‘ পরে
জানিয়ে দিলে , লক্ষ্মীছাড়ার জীর্ণ ভিটের ‘ পরে
অধিকারের দলিল তাহার দেহেই বর্তমান ।
দুর্ভাগ্যের নতুন হাওয়া-বদল করার স্থান
এমনতরো মিলবে কোথায় । সময় গেছে তারই ,
সন্দেহ তার নেইকো একেবারেই ।
সময় আমার গিয়েছে , তাই গাঁয়ের ছাগল চরাই ;
রবিশস্যে ভরা ছিল , শূন্য এখন মরাই ।
খুদকুঁড়ো যা বাকি ছিল ইঁদুরগুলো ঢুকে
দিল কখন ফুঁকে ।
হাওয়ার ঠেলায় শব্দ করে আগলভাঙা দ্বার ,
সারাদিনে জনামাত্র নেইকো খরিদ্দার ।
কালের অলস চরণপাতে
ঘাস উঠেছে ঘরে আসার বাঁকা গলিটাতে ।
ওরই ধারে বটের তলায় নিয়ে চিঁড়ের থালা
চড়ুইপাখির জন্যে আমার খোলা অতিথশালা ।
সন্ধে নামে পাতাঝরা শিমূলগাছের আগায় ,
আধ-ঘুমে আধ-জাগায়
মন চলে যায় চিহ্নবিহীন পস্টারিটির পথে
স্বপ্নমনোরথে ;
কালপুরুষের সিংহদ্বারের ওপার থেকে
শুনি কে কয় আমায় ডেকে —
“ ওরে পুতুলওলা
তোর যে ঘরে যুগান্তরের দুয়ার আছে খোলা ,
সেথায় আগাম-বায়না-নেওয়া খেলনা যত আছে
লুকিয়ে ছিল গ্রহণ-লাগা ক্ষণিক কালের পাছে ;
আজ চেয়ে দেখ্ , দেখতে পাবি ,
মোদের দাবি
ছাপ-দেওয়া তার ভালে ।
পুরানো সে নতুন আলোয় জাগল নতুন কালে ।
সময় আছে কিংবা গেছে দেখার দৃষ্টি সেই
সবার চক্ষে নেই —
এই কথাটা মনে রেখে ওরে পুতুলওলা ,
আপন-সৃষ্টি-মাঝখানেতে থাকিস আপন-ভোলা ।
ওই যে বলিস , বিছানা তোর ভুঁয়ে চেটাই পাতা ,
ছেঁড়া মলিন কাঁথা —
ওই যে বলিস , জোটে কেবল সিদ্ধ কচুর পথ্যি —
এটা নেহাত স্বপ্ন কি নয় , এ কি নিছক সত্যি ।
পাস নি খবর , বাহান্ন জন কাহার
পাল্কি আনে — শব্দ কি পাস তাহার ।
বাঘনাপাড়া পেরিয়ে এল ধেয়ে ,
সখীর সঙ্গে আসছে রাজার মেয়ে ।
খেলা যে তার বন্ধ আছে তোমার খেলনা বিনে ,
এবার নেবে কিনে ।
কী জানি বা ভাগ্যি তোমার ভালো ,
বাসরঘরে নতুন প্রদীপ জ্বালো ;
নবযুগের রাজকন্যা আধেক রাজ্যসুদ্ধ
যদি মেলে , তা নিয়ে কেউ বাধায় যদি যুদ্ধ ,
ব্যাপারখানা উচ্চতলায় ইতিহাসের ধাপে
উঠে পড়বে মহাকাব্যের মাপে ।
বয়স নিয়ে পণ্ডিত কেউ তর্ক যদি করে
বলবে তাকে , একটা যুগের পরে
চিরকালের বয়স আসে সকল-পাঁজি-ছাড়া
যমকে লাগায় তাড়া । ” এতক্ষণ যা বকা গেল এটা প্রলাপমাত্র —
নবীন বিচারপতি ওগো , আমি ক্ষমার পাত্র ;
পেরিয়ে মেয়াদ বাঁচে তবু যে-সব সময়হারা
স্বপ্নে ছাড়া সান্ত্বনা আর কোথায় পাবে তারা ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মনে পড়ে, শৈলতটে তোমাদের নিভৃত কুটির;
হিমাদ্রি যেথায় তার সমুচ্চ শান্তির
আসনে নিস্তব্ধ নিত্য, তুঙ্গ তার শিখরের সীমা
লঙ্ঘন করিতে চায় দূরতম শূন্যের মহিমা।
অরণ্য যেতেছে নেমে উপত্যকা বেয়ে;
নিশ্চল সবুজবন্যা, নিবিড় নৈ:শব্দ্যে রাখে ছেয়ে
ছায়াপুঞ্জ তার। শৈলশৃঙ্গ-অন্তরালে
প্রথম অরুণোদয়-ঘোষণার কালে
অন্তরে আনিতে স্পন্দ বিশ্বজীবনের
সদ্যস্ফূর্ত চঞ্চলতা। নির্জন বনের
গূঢ় আনন্দের যত ভাষাহীন বিচিত্র সংকেতে
লভিতাম হৃদয়েতে
যে বিস্ময় ধরণীর প্রাণের আদিম সূচনায়।
সহসা নাম-না-জানা পাখিদের চকিত পাখায়
চিন্তা মোর যেত ভেসে
শুভ্রহিমরেখাঙ্কিত মহানিরুদ্দেশে।
বেলা যেত,লোকালয়
তুলিত ত্বরিত করি সুপ্তোত্থিত শিথিল সময়।
গিরিগাত্রে পথ গেছে বেঁকে,
বোঝা বহি চলে লোক,গাড়ি ছুটে চলে থেকে থেকে।
পার্বতী জনতা
বিদেশী প্রাণযাত্রার খন্ড খন্ড কথা
মনে যায় রেখে,
রেখা-রেখা অসংলগ্ন ছবি যায় এঁকে।
শুনি মাঝে মাঝে
অদূরে ঘণ্টার ধ্বনি বাজে,
কর্মের দৌত্য সে করে
প্রহরে প্রহরে।
প্রথম আলোর স্পর্শ লাগে,
আতিথ্যের সখ্য জাগে
ঘরে ঘরে। স্তরে স্তরে দ্বারের সোপানে
নানারঙা ফুলগুলি অতিথির প্রাণে।
গৃহিণীর যত্ন বহি প্রকৃতির লিপি নিয়ে আসে
আকাশে বাতাসে।
কলহাস্যে মানুষের স্নেহের বারতা
যুগযুগান্তের মৌনে হিমাদ্রির আনে সার্থকতা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
হায় ধরিত্রী, তোমার আঁধার পাতালদেশে
অন্ধ রিপু লুকিয়েছিল ছদ্মবেশে--
সোনার পুঞ্জ যেথায় রাখ,
আঁচলতলে যেথায় ঢাক
কঠিন লৌহ, মৃত্যুদূতের চরণধূলির
পিণ্ড তারা, খেলা জোগায়
যমালয়ের ডাণ্ডাগুলির।
উপর তলায় হাওয়ার দোলায় নবীন ধানে
ধানশ্রীসুর মূর্ছনা দেয় সবুজ গানে।
দুঃখে সুখে স্নেহে প্রেমে
স্বর্গ আসে মর্তে নেমে,
ঋতুর ডালি ফুল-ফসলের অর্ঘ্য বিলায়,
ওড়না রাঙে ধূপছায়াতে
প্রাণনটিনীর নৃত্যলীলায়।
অন্তরে তোর গুপ্ত যে পাপ রাখলি চেপে
তার ঢাকা আজ স্তরে স্তরে উঠল কেঁপে।
যে বিশ্বাসের আবাসখানি
ধ্রুব ব'লেই সবাই জানি
এক নিমেষে মিশিয়ে দিলি ধূলির সাথে,
প্রাণের দারুণ অবমানন
ঘটিয়ে দিলি জড়ের হাতে।
বিপুল প্রতাপ থাক্-না যতই বাহির দিকে
কেবল সেটা স্পর্ধাবলে রয় না টিঁকে।
দুর্বলতা কুটিল হেসে
ফাটল ধরায় তলায় এসে--
হঠাৎ কখন দিগ্ব্যাপিনী কীর্তি যত
দর্পহারীর অট্টহাস্যে
যায় মিলিয়ে স্বপ্নমতো।
হে ধরণী, এই ইতিহাস সহস্রবার
যুগে যুগে উদঘাটিলে সামনে সবার।
জাগল দম্ভ বিরাট রূপে,
মজ্জায় তার চুপে চুপে
লাগল রিপুর অলক্ষ্য বিষ সর্বনাশা--
রূপক নাট্যে ব্যাখ্যা তারি
দিয়েছ আজ ভীষণ ভাষায়।
যে যথার্থ শক্তি সে তো শান্তিময়ী,
সৌম্য তাহার কল্যাণরূপ বিশ্বজয়ী।
অশক্তি তার আসন পেতে
ছিল তোমার অন্তরেতে--
সেই তো ভীষণ, নিষ্ঠুর তার বীভৎসতা,
নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠাহীন
তাই সে এমন হিংসারতা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময়
মুহূর্তে নিখিল তবে হয়ে যেত লয়।
তুমি পরিপূর্ণ রূপ, তব বক্ষে কোলে
জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
মিছে হাসি , মিছে বাঁশি , মিছে এ যৌবন ,
মিছে এই দরশের পরশের খেলা ।
চেয়ে দেখো , পবিত্র এ মানবজীবন ,
কে ইহারে অকাতরে করে অবহেলা !
ভেসে ভেসে এই মহা চরাচরস্রোতে
কে জানে গো আসিয়াছে কোন্খান হতে ,
কোথা হতে নিয়ে এল প্রেমের আভাস ,
কোন্ অন্ধকার ভেদি উঠিল আলোতে !
এ নহে খেলার ধন , যৌবনের আশ —
বোলো না ইহার কানে আবেশের বাণী !
নহে নহে এ তোমার বাসনার দাস ,
তোমার ক্ষুধার মাঝে আনিয়ো না টানি !
এ তোমার ঈশ্বরের মঙ্গল – আশ্বাস ,
স্বর্গের আলোক তব এই মুখখানি । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কোন্ ক্ষণে
সৃজনের সমুদ্রমন্থনে
উঠেছিল দুই নারী
অতলের শয্যাতল ছাড়ি।
একজনা উর্বশী, সুন্দরী,
বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,
স্বর্গের অপ্সরী।
অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,
বিশ্বের জননী তাঁরে জানি,
স্বর্গের ঈশ্বরী।
একজন তপোভঙ্গ করি
উচ্চহাস্য-অগ্নিরসে ফাল্গুনের সুরাপাত্র ভরি
নিয়ে যায় প্রাণমন হরি,
দু-হাতে ছড়ায় তারে বসন্তের পুষ্পিত প্রলাপে,
রাগরক্ত কিংশুকে গোলাপে,
নিদ্রাহীন যৌবনের গানে।
আরজন ফিরাইয়া আনে
অশ্রুর শিশির-স্নানে
স্নিগ্ধ বাসনায়;
হেমন্তের হেমকান্ত সফল শান্তির পূর্ণতায়;
ফিরাইয়া আনে
নিখিলের আশীর্বাদপানে
অচঞ্চল লাবণ্যের স্মিতহাস্যসুধায় মধুর।
ফিরাইয়া আনে ধীরে
জীবনমৃত্যুর
পবিত্র সংগমতীর্থতীরে
অনন্তের পূজার মন্দিরে।
পদ্মাতীরে, ২০ মাঘ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
যখন জলের কল
হয়েছিল পলতায়
সাহেবে জানালো খুদু,
ভরে দেবে জল তায়।
ঘড়াগুলো পেত যদি
শহরে বহাত নদী,
পারেনি যে সে কেবল
কুমোরের খলতায়। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
চিরকাল একি লীলা গো–
অনন্ত কলরোল।
অশ্রুত কোন্ গানের ছন্দে
অদ্ভুত এই দোল।
দুলিছ গো, দোলা দিতেছ।
পলকে আলোকে তুলিছ, পলকে
আঁধারে টানিয়া নিতেছ।
সমুখে যখন আসি
তখন পুলকে হাসি,
পশ্চাতে যবে ফিরে যায় দোলা
ভয়ে আঁখিজলে ভাসি।
সমুখে যেমন পিছেও তেমন,
মিছে করি মোরা গোল।
চিরকাল একই লীলা গো–
অনন্ত কলরোল।ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
বাম হাত হতে ডানে।
নিজধন তুমি নিজেই হরিয়া
কী যে কর কে বা জানে।
কোথা বসে আছ একেলা–
সব রবিশশী কুড়ায়ে লইয়া
তালে তালে কর এ খেলা।
খুলে দাও ক্ষণতরে,
ঢাকা দাও ক্ষণপরে–
মোরা কেঁদে ভাবি, আমারি কী ধন
কে লইল বুঝি হ’রে!
দেওয়া-নেওয়া তব সকলি সমান
সে কথাটি কে বা জানে।
ডান হাত হতে বাম হাতে লও,
বাম হাত হতে ডানে।এইমতো চলে চির কাল গো
শুধু যাওয়া, শুধু আসা।
চির দিনরাত আপনার সাথ
আপনি খেলিছ পাশা।
আছে তো যেমন যা ছিল–
হারায় নি কিছু, ফুরায় নি কিছু
যে মরিল যে বা বাঁচিল।
বহি সব সুখদুখ
এ ভুবন হাসিমুখ,
তোমারি খেলার আনন্দে তার
ভরিয়া উঠেছে বুক।
আছে সেই আলো, আছে সেই গান,
আছে সেই ভালোবাসা।
এইমতো চলে চির কাল গো
শুধু যাওয়া, শুধু আসা। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
দিগ্বলয়ে
নব শশীলেখা
টুকরো যেন
মানিকের রেখা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
রাজা বসেছেন ধ্যানে,
বিশজন সর্দার
চীৎকাররবে তারা
হাঁকিছে– “খবরদার’।সেনাপতি ডাক ছাড়ে,
মন্ত্রী সে দাড়ি নাড়ে,
যোগ দিল তার সাথে
ঢাকঢোল-বর্দার।ধরাতল কম্পিত,
পশুপ্রাণী লম্ফিত,
রানীরা মূর্ছা যায়
আড়ালেতে পর্দার। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
নারীকে দিবেন বিধি পুরুষের অন্তরে মিলায়ে
সেই অভিপ্রায়ে
রচিলেন সূক্ষ্মশিল্পকারুময়ী কায়া —
তারি সঙ্গে মিলালেন অঙ্গের অতীত কোন্ মায়া
যারে নাহি যায় ধরা ,
যাহা শুধু জাদুমন্ত্রে ভরা ,
যাহারে অন্তরতম হৃদয়ের অদৃশ্য আলোকে
দেখা যায় ধ্যানাবিষ্ট চোখে ,
ছন্দোজালে বাঁধে যার ছবি
না-পাওয়া বেদনা দিয়ে কবি ।
যার ছায়া সুরে খেলা করে
চঞ্চল দিঘির জলে আলোর মতন থরথরে ।
‘ নিশ্চিত পেয়েছি ' ভেবে যারে
অবুঝ আঁকড়ি রাখে আপন ভোগের অধিকারে ,
মাটির পাত্রটা নিয়ে বঞ্চিত সে অমৃতের স্বাদে ,
ডুবায় সে ক্লান্তি-অবসাদে
সোনার প্রদীপ শিখা-নেভা ।
দূর হতে অধরাকে পায় যে বা
চরিতার্থ করে সে ' ই কাছের পাওয়ারে ,
পূর্ণ করে তারে । নারীস্তব শুনালেম । ছিল মনে আশা —
উচ্চতত্ত্বে-ভরা এই ভাষা
উৎসাহিত করে দেবে মন ললিতার ,
পাব পুরস্কার ।
হায় রে , দুর্গ্রহগুণে
কাব্য শুনে
ঝক্ঝকে হাসিখানি হেসে
কহিল সে , “ তোমার এ কবিত্বের শেষে
বসিয়েছ মহোন্নত যে-কটা লাইন
আগাগোড়া সত্যহীন ।
ওরা সব-কটা
বানানো কথার ঘটা ,
সদরেতে যত বড়ো অন্দরেতে ততখানি ফাঁকি ।
জানি না কি —
দূর হতে নিরামিষ সাত্ত্বিক মৃগয়া ,
নাই পুরুষের হাড়ে অমায়িক বিশুদ্ধ এ দয়া । ”
আমি শুধালেম , “ আর , তোমাদের ?”
সে কহিল , “ আমাদের চারি দিকে শক্ত আছে ঘের
পরশ-বাঁচানো ,
সে তুমি নিশ্চিত জান । ”
আমি শুধালেম , “ তার মানে ?”
সে কহিল , “ আমরা পুষি না মোহ প্রাণে ,
কেবল বিশুদ্ধ ভালোবাসি । ”
কহিলাম হাসি ,
“ আমি যাহা বলেছিনু সে কথাটা সমস্ত বড়ো বটে ,
কিন্তু তবু লাগে না সে তোমার এ স্পর্ধার নিকটে ।
মোহ কি কিছুই নেই রমণীর প্রেমে । ”
সে কহিল একটুকু থেমে ,
“ নেই বলিলেই হয় । এ কথা নিশ্চিত —
জোর করে বলিবই —
আমরা কাঙাল কভু নই । ”
আমি কহিলাম , “ ভদ্রে , তা হলে তো পুরুষের জিত । ”
“ কেন শুনি ”
মাথাটা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলিল তরুণী ।
আমি কহিলাম , “ যদি প্রেম হয় অমৃতকলস ,
মোহ তবে রসনার রস ।
সে সুধার পূর্ণ স্বাদ থেকে
মোহহীন রমণীরে প্রবঞ্চিত বলো করেছে কে ।
আনন্দিত হই দেখে তোমার লাবণ্যভরা কায়া ,
তাহার তো বারো-আনা আমারি অন্তরবাসী মায়া ।
প্রেম আর মোহে
একেবারে বিরুদ্ধ কি দোঁহে ।
আকাশের আলো
বিপরীতে-ভাগ-করা সে কি সাদা কালো ।
ওই আলো আপনার পূর্ণতারে চূর্ণ করে
দিকে দিগন্তরে ,
বর্ণে বর্ণে
তৃণে শস্যে পুষ্পে পর্ণে ,
পাখির পাখায় আর আকাশের নীলে ,
চোখ ভোলাবার মোহ মেলে দেয় সর্বত্র নিখিলে ।
অভাব যেখানে এই মন-ভোলাবার
সেইখানে সৃষ্টিকর্তা বিধাতার হার ।
এমন লজ্জার কথা বলিতেও নাই —
তোমরা ভোল না শুধু ভুলি আমরাই ।
এই কথা স্পষ্ট দিনু কয়ে ,
সৃষ্টি কভু নাহি ঘটে একেবারে বিশুদ্ধেরে লয়ে ।
পূর্ণতা আপন কেন্দ্রে স্তব্ধ হয়ে থাকে ,
কারেও কোথাও নাহি ডাকে ।
অপূর্ণের সাথে দ্বন্দ্বে চাঞ্চল্যের শক্তি দেয় তারে ,
রসে রূপে বিচিত্র আকারে ।
এরে নাম দিয়ে মোহ
যে করে বিদ্রোহ
এড়ায়ে নদীর টান সে চাহে নদীরে ,
পড়ে থাকে তীরে ।
পুরুষ সে ভাবের বিলাসী ,
মোহতরী বেয়ে তাই সুধাসাগরের প্রান্তে আসি
আভাসে দেখিতে পায় পরপারে অরূপের মায়া
অসীমের ছায়া ।
অমৃতের পাত্র তার ভরে ওঠে কানায় কানায়
স্বল্প জানা ভূরি অজানায় । ”
কোনো কথা নাহি ব ' লে
সুন্দরী ফিরায়ে মুখ দ্রুত গেল চলে ।
পরদিন বটের পাতায়
গুটিকত সদ্যফোটা বেলফুল রেখে গেল পায় ।
বলে গেল , “ ক্ষমা করো , অবুঝের মতো
মিছেমিছি বকেছিনু কত । ”
ঢেলা আমি মেরেছিনু চৈত্রে-ফোটা কাঞ্চনের ডালে ,
তারি প্রতিবাদে ফুল ঝরিল এ স্পর্ধিত কপালে ।
নিয়ে এই বিবাদের দান
এ বসন্তে চৈত্র মোর হল অবসান ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
তোমারে পাছে সহজে বুঝি
তাই কি এত লীলার ছল,
বাহিরে যবে হাসির ছটা
ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব
ছলনা,
যে কথা তুমি বলিতে চাও
সে কথা তুমি বল না।তোমারে পাছে সহজে ধরি
কিছুরই তব কিনারা নাই–
দশের দলে টানি গো পাছে
বিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব
ছলনা,
যে পথে তুমি চলিতে চাও
সে পথে তুমি চল না।সবার চেয়ে অধিক চাহ
তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও–
হেলার ভরে খেলার মতো
ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও।
বুঝেছি আমি বুঝেছি তব
ছলনা,
সবার যাহে তৃপ্তি হল
তোমার তাহে হল না। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
বার বার, সখি, বারণ করনু ন যাও মথুরাধাম
বিসরি প্রেমদুখ রাজভোগ যথি করত হমারই শ্যাম।
ধিক্ তুঁহু দাম্ভিক, ধিক্ রসনা ধিক্, লইলি কাহারই নাম।
বোল ত সজনি, মথুরা‐অধিপতি সো কি হমারই শ্যাম।
ধনকো শ্যাম সো, মথুরাপুরকো, রাজ্যমানকো হোয়।
নহ পীরিতিকো, ব্রজকামিনীকো, নিচয় কহনু ময় তোয়।
যব তুঁহু ঠারবি সো নব নরপতি জনি রে করে অবমান—
ছিন্নকুসুমসম ঝরব ধরা‐’পর, পলকে খোয়ব প্রাণ।
বিসরল বিসরল সো সব বিসরল বৃন্দাবনসুখসঙ্গ—
নব নগরে, সখি, নবীন নাগর— উপজল নব নব রঙ্গ।
ভানু কহত, অয়ি বিরহকাতরা, মনমে বাঁধহ থেহ—
মুগুধা বালা, বুঝই বুঝলি না হমার শ্যামক লেহ॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ক্ষুদ্র এই তৃণদল ব্রহ্মান্ডের মাঝে
সরল মাহাত্ম্য লয়ে সহজে বিরাজে।
পূরবের নবসূর্য, নিশীথের শশী,
তৃণটি তাদেরি সাথে একাসনে বসি।
আমার এ গান এও জগতের গানে
মিশে যায় নিখিলের মর্মমাঝখানে;
শ্রাবণের ধারাপাত, বনের মর্মর
সকলের মাঝে তার আপনার ঘর।
কিন্তু, হে বিলাসী, তব ঐশ্বর্যের ভার
ক্ষুদ্র রুদ্ধদ্বারে শুধু একাকী তোমার।
নাহি পড়ে সূর্যালোক, নাহি চাহে চাঁদ,
নাহি তাহে নিখিলের নিত্য আশীর্বাদ।
সম্মুখে দাঁড়ালে মৃত্যু মুহূর্তেই হায়
পাংশুপান্ডু শীর্ণম্লান মিথ্যা হয়ে যায়। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে ,
হে ছলনাময়ী ।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে ।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত ;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি ।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ ,
সে যে চিরস্বচ্ছ ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল ।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু ,
এই নিয়ে তাহার গৌরব ।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত ।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে ।
কিছুতে পারে না তা ' রে প্রবঞ্চিতে ,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভান্ডারে ।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কত দিবা কত বিভাবরী
কত নদী নদে লক্ষ স্রোতের
মাঝখানে এক পথ ধরি,
কত ঘাটে ঘাটে লাগায়ে,
কত সারিগান জাগায়ে,
কত অঘ্রানে নব নব ধানে
কতবার কত বোঝা ভরি
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে কত স্বর্ণভার
কোন্ গ্রামে আজ সাধিতে কী কাজ
বাঁধিয়া ধরিলে তব তরী।হেথা বিকিকিনি কার হাটে।
কেন এত ত্বরা লইয়া পসরা,
ছুটে চলে এরা কোন্ বাটে।
শুন গো থাকিয়া থাকিয়া
বোঝা লয়ে যায় হাঁকিয়া,
সে করুণ স্বরে মন কী যে করে–
কী ভেবে আমার দিন কাটে।
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে লও স্বর্ণভার–
হেথা কারা রয় লহো পরিচয়,
কারা আসে যায় এই ঘাটে।যেথা হতে যাই, যাই কেঁদে।
এমনটি আর পাব কি আবার
সরে না যে মন সেই খেদে।
সে-সব কাঁদন ভুলালে,
কী দোলায় প্রাণ দুলালে।
হোথা যারা তীরে আনমনে ফিরে
আমি তাহাদের মরি সেধে।
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে লও স্বর্ণভার।
এই হাটে নামি দেখে লব আমি–
এক বেলা তরী রাখো বেঁধে।গান ধর তুমি কোন্ সুরে।
মনে পড়ে যায় দূর হতে এনু,
যেতে হবে পুন কোন্ দূরে।
শুনে মনে পড়ে, দুজনে
খেলেছি সজনে বিজনে,
সে যে কত দেশ নাহি তার শেষ–
সে যে কতকাল এনু ঘুরে।
কর্ণধার হে কর্ণধার,
বেচে কিনে লও স্বর্ণভার।
বাজিয়াছে শাঁখ, পড়িয়াছে ডাক
সে কোন্ অচেনা রাজপুরে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
নাম তার ডাক্তার ময়জন।
বাতাসে মেশায় কড়া পয়জন।
গণিয়া দেখিল, বড়ো বহরের
একখানা রীতিমতো শহরের
টিঁকে আছে নাবালক নয়জন।
খুশি হয়ে ভাবে, এই গবেষণা
না জানি সবার কবে হবে শোনা,
শুনিতে বা বাকি রবে কয়জন। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার,
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে,
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে,
পারিস নে কত বার — 'কই অন্ন কই '
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ।
জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ—
যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় ,
সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক ,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়—
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
সন্ধ্যারবি মেঘে দেয়
নাম সই করে।
লেখা তার মুছে যায়,
মেঘ যায় সরে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে–
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি
পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে
নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।
এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ,
এসেছে এসেছে উঠিতেছে এই গান,
নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে।
আবার আষাঢ় এসেছে আকাশ ছেয়ে।১০ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
আজ তুমি কবি শুধু, নহ আর কেহ—
কোথা তব রাজসভা, কোথা তব গেহ,
কোথা সেই উজ্জয়িনী—কোথা গেল আজ
প্রভু তব, কালিদাস, রাজ-অধিরাজ।
কোনো চিহ্ন নাহি কারো। আজ মনে হয়
ছিলে তুমি চিরদিন চিরানন্দময়
অলকার অধিবাসী। সন্ধ্যাভ্রশিখরে
ধ্যান ভাঙি উমাপতি ভূমানন্দভরে
নৃত্য করিতেন যবে, জলদ সজল
গর্জিত মৃদঙ্গরবে, তড়িৎ চপল
ছন্দে ছন্দে দিত তাল, তুমি সেই ক্ষণে
গাহিতে বন্দনাগান—গীতিসমাপনে
কর্ণ হতে বর্হ খুলি স্নেহহাস্যভরে
পরায়ে দিতেন গৌরী তব চূড়া-’পরে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শেষের অবগাহন সাঙ্গ করো, কবি, প্রদোষের
নির্মল তিমির তলে। ভৃতি তব সেবার শ্রমের
সংসার যা দিয়েছিল আঁকড়িয়া রাখিয়ো না বুকে;
এক প্রহরের মূল্য আরেক প্রহরে ফিরে নিতে
কুণ্ঠা কভু নাহি তার; বাহির দ্বারের যে দক্ষিণা
অন্তরে নিয়ো না টেনে এ মুদ্রার স্বর্ণলেপটুকু
দিনে দিনে হাতে হাতে ক্ষয় হয়ে লুপ্ত হয়ে যাবে,
উঠিবে কলঙ্কলেখা ফুটি। ফল যদি ফলায়েছ বনে
মাটিতে ফেলিয়া তার হোক অবসান। সাঙ্গ হোলো
ফুল ফোটাবার ঋতু, সেই সঙ্গে সাঙ্গ হয়ে যাক
লোকমুখবচনের নিশ্বাসপবনে দোল খাওয়া।
পুরস্কার প্রত্যাশায় পিছু ফিরে বাড়ায়ো না হাতযেতে যেতে; জীবনে যা-কিছু তব সত্য ছিল দান
মূল্য চেয়ে অপমান করিয়ো না তারে; এ জনমে
শেষ ত্যাগ হোক তব ভিক্ষাঝুলি, নব বসন্তের
আগমনে অরণ্যের শেষ শুষ্ক পত্রগুচ্ছ যথা।
যার লাগি আশাপথ চেয়ে আছ সে নহে সম্মান,
সে যে নব জীবনের অরুণের আহ্বান-ইঙ্গিত,
নব জাগ্রতের ভালে প্রভাতের জ্যোতির তিলক। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
যে আঁধারে ভাইকে দেখিতে নাহি পায়
সে আঁধারে অন্ধ নাহি দেখে আপনায়। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল--যেন খাপে-ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাঁটার শেষে রাত্রির জোয়ার
এল তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার তরু সারে সারে;
মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি,
অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।
সহসা শুনিনু সেই ক্ষণে
সন্ধ্যার গগনে
শব্দের বিদ্যুৎছটা শূন্যের প্রান্তরে
মুহূর্তে ছুটিয়া গেল দূর হতে দূরে দূরান্তরে।
হে হংস-বলাকা,
ঝঞ্ঝা-মদরসে মত্ত তোমাদের পাখা
রাশি রাশি আনন্দের অট্টহাসে
বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে।
ওই পক্ষধ্বনি,
শব্দময়ী অপ্সর-রমণী
গেল চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি।
উঠিল শিহরি
গিরিশ্রেণী তিমির-মগন
শিহরিল দেওদার-বন।
মনে হল এ পাখার বাণী
দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
বেগের আবেগ।
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;
তরুশ্রেণী চাহে, পাখা মেলি
মাটির বন্ধন ফেলি
ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা,
আকাশের খুঁজিতে কিনারা।
এ সন্ধ্যার স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি
সুদূরের লাগি,
হে পাখা বিবাগী।
বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে--
"হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোন্খানে।"
হে হংস-বলাকা,
আজ রাত্রে মোর কাছে খুলে দিলে স্তব্ধতার ঢাকা।
শুনিতেছি আমি এই নিঃশব্দের তলে
শূন্যে জলে স্থলে
অমনি পাখার শব্দ উদ্দাম চঞ্চল।
তৃণদল
মাটির আকাশ-'পরে ঝাপটিছে ডানা,
মাটির আঁধার-নীচে কে জানে ঠিকানা
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।
দেখিতেছি আমি আজি
এই গিরিরাজি,
এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়
দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়।
নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে
চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে।
শুনিলাম মানবের কত বাণী দলে দলে
অলক্ষিত পথে উড়ে চলে
অস্পষ্ট অতীত হতে অস্ফষ্ট সুদূর যুগান্তরে!
শুনিলাম আপন অন্তরে
অসংখ্য পাখির সাথে
দিনেরাতে
এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে
কোন্ পার হতে কোন্ পারে।
ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে--
"হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে।"
শ্রীনগর, কার্তিক, ১৩২২
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
বিপ্র কহে, রমণী মোর আছিল যেই ঘরে
নিশীথে সেথা পশিল চোর ধর্মনাশ-তরে।
বেঁধেছি তারে, এখন কহো চোরে কী দেব সাজা।'
'মৃত্যু' শুধু কহিলা তারে রতনরাও রাজা।
ছুটিয়া আসি কহিল দূত, 'চোর সে যুবরাজ--
বিপ্র তাঁরে ধরেছে রাতে, কাটিল প্রাতে আজ।
ব্রাহ্মণেরে এনেছি ধরে, কী তারে দিব সাজা?'
'মুক্তি দাও' কহিলা শুধু রতনরাও রাজা।৪ কার্তিক, ১৩০৬
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমারে দিই নি সুখ, মুক্তির নৈবেদ্য গেনু রাখি
রজনীর শুভ্র অবসানে ;কিছু আর নাহি বাকি,
নাইকো প্রার্থনা, নাই প্রতি মুহূর্তের দৈন্যরাশি,
নাই অভিমান, নাই দীনকান্না, নাই গর্বহাসি,
নাই পিছে ফিরে দেখা। শুধু সে মুক্তির ডালিখানি
ভরিয়া দিলাম আজি আমার মহৎ মৃত্যু আনি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
গিরিবক্ষ হতে আজি
ঘুচুক কুজ্ঝটি-আবরণ,
নূতন প্রভাতসূর্য
এনে দিক্ নবজাগরণ।
মৌন তার ভেঙে যাক,
জ্যোতির্ময় ঊর্ধ্ব লোক হতে
বাণীর নির্ঝরধারা
প্রবাহিত হোক শতস্রোতে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
গব্বুরাজার পাতে
ছাগলের কোর্মাতে
যবে দেখা গেল তেলা-
পোকাটা
রাজা গেল মহা চ’টে,
চীৎকার করে ওঠে,–
“খানসামা কোথাকার
বোকাটা।’
মন্ত্রী জুড়িয়া পাণি
কহে, “সবই এক প্রাণী।’
রাজার ঘুচিয়া গেল
ধোঁকাটা।
জীবের শিবের প্রেমে
একদম গেল থেমে
মেঝে তার তলোয়ার
ঠোকাটা। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আধবুড়ো ঐ মানুষটি মোর নয় চেনা--
একলা বসে ভাবছে কিংবা ভাবছে না,
মুখ দেখে ওর সেই কথাটাই ভাবছি,
মনে মনে আমি যে ওর মনের মধ্যে নাবছি। বুঝিবা ওর মেঝোমেয়ে পাতা ছয়েক ব'কে
মাথার দিব্যি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল ওকে।
উমারানীর বিষম স্নেহের শাসন,
জানিয়েছিল, চতুর্থীতে খোকার অন্নপ্রাসন--
জিদ ধরেছে, হোক-না যেমন ক'রেই
আসতে হবে শুক্রবার কি শনিবারের ভোরেই।
আবেদনের পত্র একটি লিখে
পাঠিয়েছিল বুড়ো তাদের কর্তাবাবুটিকে।
বাবু বললে, "হয় কখনো তা কি,
মাসকাবারের ঝুড়িঝুড়ি হিসাব লেখা বাকি,
সাহেব শুনলে আগুন হবে চটে,
ছুটি নেবার সময় এ নয় মোটে।'
মেয়ের দুঃখ ভেবে
বুড়ো বারেক ভেবেছিল কাজে জবাব দেবে।
সুবুদ্ধি তার কইল কানে রাগ গেল যেই থামি,
আসন্ন পেন্সনের আশা ছাড়াটা পাগলামি।
নিজেকে সে বললে, "ওরে, এবার না হয় কিনিস
ছোটোছেলের মনের মতো একটা-কোনো জিনিস।'
যেটার কথাই ভেবে দেখে দামের কথায় শেষে
বাধায় ঠেকে এসে।
কেইবা জানবে দামটা যে তার কত,
বাইরে থেকে ঠিক দেখাবে খাঁটি রুপোর মতো।
এমনি করে সংশয়ে তার কেবলই মন ঠেলে,
হাঁ-না নিয়ে ভাব্নাস্রোতে জোয়ার-ভাঁটা খেলে।
রোজ সে দেখে টাইম্টেবিলখানা,
ক'দিন থেকে ইস্টিশনে প্রত্যহ দেয় হানা।
সামনে দিয়ে যায় আসে রোজ মেল,
গাড়িটা তার প্রত্যহ হয় ফেল।
চিন্তিত ওর মুখের ভাবটা দেখে
এমনি একটা ছবি মনে নিয়েছিলেম এঁকে। কৌতূহলে শেষে
একটুখানি উসখুসিয়ে একটুখানি কেশে,
শুধাই তারে ব'সে তাহার কাছে,
"কী ভাবতেছেন, বাড়িতে কি মন্দ খবর আছে।"
বললে বুড়ে, "কিচ্ছুই নয়, মশায়,
আসল কথা, আছি শনির দশায়।
তাই ভাবছি কী করা যায় এবার
ঘৌড়দৌড়ে দশটি টাকা বাজি ফেলে দেবার।
আপনি বলুন, কিনব টিকিট আজ কি।"
আমি বললেম, "কাজ কী।"
রাগে বুড়োর গরম হল মাথা;
বললে, "থামো, ঢের দেখেছি পরামর্শদাতা!
কেনার সময় রইবে না আর আজিকার এই দিন বই!
কিনব আমি, কিনব আমি, যে ক'রে হোক কিনবই।"
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
বহুদিন পরে আজি মেঘ গেছে চলে ,
রবির কিরণসুধা আকাশে উথলে ।
স্নিগ্ধ শ্যাম পত্রপুটে আলোক ঝলকি উঠে
পুলক নাচিছে গাছে গাছে ।
নবীন যৌবন যেন প্রেমের মিলনে কাঁপে ,
আনন্দ বিদ্যুৎ - আলো নাচে ।
জুঁই সরোবরতীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে
ঝরিয়া পড়িতে চায় ভুঁয়ে ,
অতি মৃদু হাসি তার , বরষার বৃষ্টিধার
গন্ধটুকু নিয়ে গেছে ধুয়ে ।
আজিকে আপন প্রাণে না জানি বা কোন্খানে
যোগিয়া রাগিণী গায় কে রে ।
ধীরে ধীরে সুর তার মিলাইছে চারি ধার ,
আচ্ছন্ন করিছে প্রভাতেরে ।
গাছপালা চারি ভিতে সংগীতের মাধুরীতে
মগ্ন হয়ে ধরে স্বপ্নছবি ।
এ প্রভাত মনে হয় আরেক প্রভাতময় ,
রবি যেন আর কোনো রবি ।
ভাবিতেছি মনে মনে কোথা কোন্ উপবনে
কী ভাবে সে গান গাইছে না জানি ,
চোখে তার অশ্রুরেখা একটু দেছে কি দেখা ,
ছড়ায়েছে চরণ দুখানি ।
তার কি পায়ের কাছে বাঁশিটি পড়িয়া আছে —
আলোছায়া পড়েছে কপোলে ।
মলিন মালাটি তুলি ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি
ভাসাইছে সরসীর জলে ।
বিষাদ - কাহিনী তার সাধ যায় শুনিবার
কোন্খানে তাহার ভবন ।
তাহার আঁখির কাছে যার মুখ জেগে আছে
তাহারে বা দেখিতে কেমন ।
এ কী রে আকুল ভাষা ! প্রাণের নিরাশ আশা
পল্লবের মর্মরে মিশালো ।
না জানি কাহারে চায় তার দেখা নাহি পায়
ম্লান তাই প্রভাতের আলো ।
এমন কত - না প্রাতে চাহিয়া আকাশপাতে
কত লোক ফেলেছে নিশ্বাস ,
সে - সব প্রভাত গেছে , তারা তার সাথে গেছে
লয়ে গেছে হৃদয় - হুতাশ !
এমন কত না আশা কত ম্লান ভালোবাসা
প্রতিদিন পড়িছে ঝরিয়া ,
তাদের হৃদয় - ব্যথা তাদের মরণ - গাথা
কে গাইছে একত্র করিয়া ,
পরস্পর পরস্পরে ডাকিতেছে নাম ধরে ,
কেহ তাহা শুনিতে না পায় ।
কাছে আসে , বসে পাশে , তবুও কথা না ভাষে ,
অশ্রুজলে ফিরে ফিরে যায় ।
চায় তবু নাহি পায় , অবশেষে নাহি চায় ,
অবশেষে নাহি গায় গান ,
ধীরে ধীরে শূন্য হিয়া বনের ছায়ায় গিয়া
মুছে আসে সজল নয়ান । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা
গেঁথেছি শেফালিমালা।
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে
সাজিয়ে এনেছি ডালা।
এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার
শুভ্র মেঘের রথে,
এসো নির্মল নীল পথে,
এসো ধৌত শ্যামল
আলো-ঝলমল
বনগিরিপর্বতে।
এসো মুকুটে পরিয়া শ্বেত শতদল
শীতল-শিশির-ঢালা।ঝরা মালতীর ফুলে
আসন বিছানো নিভৃত কুঞ্জে
ভরা গঙ্গার কূলে
ফিরিছে মরাল ডানা পাতিবারে
তোমার চরণমূলে।
গুঞ্জরতান তুলিয়ো তোমার
সোনার বীণার তারে
মৃদু মধু ঝংকারে,
হাসিঢালা সুর গলিয়া পড়িবে
ক্ষণিক অশ্রুধারে।
রহিয়া রহিয়া যে পরশমণি
ঝলকে অলককোণে,
পলকের তরে সকরুণ করে
বুলায়ো বুলায়ো মনে–
সোনা হয়ে যাবে সকল ভাবনা,
আঁধার হইবে আলা।শান্তিনিকেতন, ৩ ভাদ্র, ১৩১৫
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
চাই না জ্ঞেয়ান, চাই না জানিতে
সংসার, মানুষ কাহারে বলে।
বনের কুসুম ফুটিতাম বনে
শুকায়ে যেতাম বনের কোলে!—দীপনির্বাণনিশার আঁধার রাশি করিয়া নিরাস
রজতসুষমাময়,
প্রদীপ্ত তুষারচয়
হিমাদ্রি-শিখর-দেশে পাইছে প্রকাশ
অসংখ্য শিখরমালা বিশাল মহান্;
ঝর্ঝরে নির্ঝর ছুটে, শৃঙ্গ হ'তে শৃঙ্গ উঠে
দিগন্তসীমায় গিয়া যেন অবসান!
শিরোপরি চন্দ্র সূর্য ,
পদে লুটে পৃথ্বীরাজ্য
মস্তকে স্বর্গের ভার করিছে বহন;
তুষারে আবরি শির
ছেলেখেলা পৃথিবীর
ভুরুক্ষেপে যেন সব করিছে লোকন।
কত নদী কত নদ
কত নির্ঝরিণী হ্রদ
পদতলে পড়ি তার করে আস্ফালন!
মানুষ বিস্ময়ে ভয়ে
দেখে রয় স্তব্ধ হয়ে,
অবাক্ হইয়া যায় সীমাবদ্ধ মন!চৌদিকে পৃথিবী ধরা নিদ্রায় মগন,
তীব্র শীতসমীরণে
দুলায়ে পাদপগণে
বহিছে নির্ঝরবারি করিয়া চুম্বন,
হিমাদ্রিশিখরশৈল করি আবরিত
গভীর জলদরাশি
তুষার বিভায় নাশিস্থির ভাবে হেথা সেথা রহেছে নিদ্রিত।
পর্বতের পদতলে
ধীরে ধীরে নদী চলে
উপলরাশির বাধা করি অপগত,
নদীর তরঙ্গকুল
সিক্ত করি বৃক্ষমূল
নাচিছে পাষাণতট করিয়া প্রহত!
চারি দিকে কত শত কলকলে অবিরত
পড়ে উপত্যকা-মাঝে নির্ঝরের ধারা।
আজি নিশীথিনী কাঁদে
আঁধারে হারায়ে চাঁদে
মেঘ-ঘোমটায় ঢাকি কবরীর তারা।
কল্পনে! কুটীর কার তটিনীর তীরে
তরুপত্র-ছায়ে-ছায়ে পাদপের গায়ে- গায়ে
ডুবায়ে চরণদেশ স্রোতস্বিনীনীরে?
চৌদিকে মানববাস নাহিক কোথায়,
নাহি জনকোলাহল
গভীর বিজনস্থল
শান্তির ছায়ায় যেন নীরবে ঘুমায়!
কুসুমভূষিত বেশে
কুটীরের শিরোদেশে
শোভিছে লতিকামালা প্রসারিয়া কর,
কুসুমস্তবকরাশি
দুয়ার-উপরে আসি
উঁকি মারিতেছে যেন কুটীরভিতর!
কুটীরের এক পাশে
শাখাদীপ[১] ধূমশ্বাসে
স্তিমিত আলোকশিখা করিছে বিস্তার।
অস্পষ্ট আলোক, তায়
আঁধার মিশিয়া যায়—
ম্লান ভাব ধরিয়াছে গৃহ-ঘর-দ্বার!
গভীর নীরব ঘর,
শিহরে যে কলেবর!
হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে বয়—
বিষাদের অন্ধকারে
গভীর শোকের ভারে
গভীর নীরব গৃহ অন্ধকারময়!
কে ওগো নবীনা বালা
উজলি পরণশালা
বসিয়া মলিনভাবে তৃণের আসনে?
কোলে তার সঁপি শির কে শুয়ে হইয়া স্থিরথেক্যে থেক্যে দীর্ঘশ্বাস টানিয়া সঘনে—
সুদীর্ঘ ধবল কেশ
ব্যাপিয়া কপোলদেশ,
শ্বেতশ্মশ্রু ঢাকিয়াছে বক্ষের বসন—
অবশ জ্ঞেয়ানহারা,
স্তিমিত লোচনতারা,
পলক নাহিক পড়ে নিস্পন্দ নয়ন!
বালিকা মলিনমুখে
বিশীর্ণা বিষাদদুখে,
শোকে ভয়ে অবশ সে সুকোমল-হিয়া।
আনত করিয়া শির
বালিকা হইয়া স্থির
পিতার-বদন-পানে রয়েছে চাহিয়া।
এলোথেলো বেশবাস,
এলোথেলো কেশপাশ
অবিচল আঁখিপার্শ্ব করেছে আবৃত!
নয়নপলক স্থির,
হৃদয় পরাণ ধীর,
শিরায় শিরায় রহে স্তব্ধ শোণিত।
হৃদয়ে নাহিক জ্ঞান,
পরাণে নাহিক প্রাণ,
চিন্তার নাহিক রেখা হৃদয়ের পটে!
নয়নে কিছু না দেখে,
শ্রবণে স্বর না ঠেকে,
শোকের উচ্ছ্বাস নাহি লাগে চিত্ততটে!
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলি,
সুধীরে নয়ন মেলি
ক্রমে ক্রমে পিতা তাঁর পাইলেন জ্ঞান!
সহসা সভয়প্রাণে
দেখি চারিদিক পানে
আবার ফেলিল শ্বাস ব্যাকুলপরান —
কি যেন হারায়ে গেছে,
কি যেন আছে না আছে,
শোকে ভয়ে ধীরে ধীরে মুদিল নয়ন—
সভয়ে অস্ফুট স্বরে সরিল বচন,
"কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী!"
চমকি উঠিল যেন নীরব রজনী!
চমকি উঠিল যেন নীরব অবনী!
ঊর্মিহীন নদী যথা ঘুমায় নীরবে—
সহসা করণক্ষেপে
সহসা উঠে রে কেঁপে,
সহসা জাগিয়া উঠে চলঊর্মি সবে!
কমলার চিত্তবাপী
সহসা উঠিল কাঁপি
পরানে পরান এলো হৃদয়ে হৃদয়!
স্তব্ধ শোণিতরাশি
আস্ফালিল হৃদে আসি,
আবার হইল চিন্তা হৃদয়ে উদয়!
শোকের আঘাত লাগি
পরাণ উঠিল জাগি,
আবার সকল কথা হইল স্মরণ!
বিষাদে ব্যাকুল হৃদে
নয়নযুগল মুদে
আছেন জনক তাঁর, হেরিল নয়ন।
স্থির নয়নের পাতে পড়িল পলক,
শুনিল কাতর স্বরে ডাকিছে জনক,
"কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী!"
বিষাদে ষোড়শী বালা চমকি অমনি
(নেত্রে অশ্রুধারা ঝরে)
কহিল কাতর স্বরে
পিতার নয়ন-‘পরে রাখিয়া নয়ন,
"কেন পিতা! কেন পিতা!
এই-যে রয়েছি হেতা" —
বিষাদে নাহিক আর সরিল বচন!
বিষাদে মেলিয়া আঁখি
বালার বদনে রাখি
এক দৃষ্টে স্থিরনেত্রে রহিল চাহিয়া!
নেত্রপ্রান্তে দরদরে,
শোক-অশ্রুবারি ঝরে,
বিষাদে সন্তাপে শোকে আলোড়িত হিয়া!
গভীরনিশ্বাসক্ষেপে
হৃদয় উঠিল কেঁপে,
ফাটিয়া বা যায় যেন শোণিত-আধার!
ওষ্ঠপ্রান্ত থরথরে
কাঁপিছে বিষাদভরে
নয়নপলক-পত্র কাঁপে বার বার—
শোকের স্নেহের অশ্রু করিয়া মোচন
কমলার পানে চাহি কহিল তখন,
‘আজি রজনীতে মা গো!
পৃথিবীর কাছে
বিদায় মাগিতে হবে,
এই শেষ দেখা ভবে!
জানি না তোমার শেষে অদৃষ্টে কি আছে—
পৃথিবীর ভালবাসা
পৃথিবীর সুখ আশা,
পৃথিবীর স্নেহ প্রেম ভক্তি সমুদায়,
দিনকর নিশাকর
গ্রহ তারা চরাচর,
সকলের কাছে আজি লইব বিদায়!
গিরিরাজ হিমালয়!
ধবল তুষারচয়!
অয়ি গো কাঞ্চনশৃঙ্গ মেঘ-আবরণ!
অয়ি নির্ঝরিণীমালা!
স্রোতস্বিনী শৈলবালা!
অয়ি উপত্যকে! অয়ি হিমশৈলবন!
আজি তোমাদের কাছে
মুমূর্ষু বিদায় যাচে,
আজি তোমাদের কাছে অন্তিম বিদায়।
কুটীর পরণশালা
সহিয়া বিষাদজ্বালা
আশ্রয় লইয়াছিনু যাহার ছায়ায়—
স্তিমিত দীপের প্রায়
এত দিন যেথা হায়
অন্তিমজীবনরশ্মি করেছি ক্ষেপণ,
আজিকে তোমার কাছে
মুমূর্ষু বিদায় যাচে,
তোমারি কোলের পরে সঁপিব জীবন!
নেত্রে অশ্রুবারি ঝরে,
নহে তোমাদের তরে,
তোমাদের তরে চিত্ত ফেলিছে না শ্বাস—
আজি জীবনের ব্রত
উদ্যাপন করিব তো,
বাতাসে মিশাবে আজি অন্তিম নিশ্বাস!
কাঁদি না তাহার তরে,
হৃদয় শোকের ভরে
হতেছে না উৎপীড়িত তাহারো কারণ।
আহা হা! দুখিনী বালা
সহিবে বিষাদজ্বালা
আজিকার নিশিভোর হইবে যখন?
কালি প্রাতে একাকিনী
অসহায়া অনাথিনী
সংসারসমুদ্র-মাঝে ঝাঁপ দিতে হবে!
সংসারযাতনাজ্বালা
কিছু না জানিস্, বালা,
আজিও!— আজিও তুই চিনিস নে ভবে!
ভাবিতে হৃদয় জ্বলে,—
মানুষ কারে যে বলে
জানিস্ নে কারে বলে মানুষের মন।
কার দ্বারে কাল প্রাতে
দাঁড়াইবি শূন্যহাতে,
কালিকে কাহার দ্বারে করিবি রোদন!
অভাগা পিতার তোর
জীবনের নিশা ভোর—
বিষাদ নিশার শেষে উঠিবেক রবি
আজ রাত্রি ভোর হলে!
কারে আর পিতা বলে
ডাকিবি, কাহার কোলে হাসিবি খেলিবি?
জীবধাত্রী বসুন্ধরে!
তোমার কোলের ‘পরে
অনাথা বালিকা মোর করিনু অর্পণ!
দিনকর! নিশাকর!
আহা এ বালার ‘পর
তোমাদের স্নেহদৃষ্টি করিও বর্ষণ!
শুন সব দিক্বালা!
বালিকা না পায় জ্বালা
তোমরা জননীস্নেহে করিও পালন!
শৈলবালা! বিশ্বমাতা!
জগতের স্রষ্টা পাতা!
শত শত নেত্রবারি সঁপি পদতলে—
বালিকা অনাথা বোলে
স্থান দিও তব কোলে,
আবৃত করিও এরে স্নেহের আঁচলে!
মুছ মা গো অশ্রুজল!
আর কি কহিব বলো!
অভাগা পিতারে ভোলো জন্মের মতন!
আটকি আসিছে স্বর!—
অবসন্ন কলেবর।
ক্রমশ মুদিয়া, মা গো, আসিছে নয়ন!
মুষ্টিবদ্ধ করতল, শোণিত হইছে জল,
শরীর হইয়া আসে শীতল পাষাণ!
এই— এই শেষবার—
কুটিরের চারি ধার
দেখে লই! দেখে লই মেলিয়া নয়ান!
শেষবার নেত্র ভোরে
এই দেখে লই তোরে
চিরকাল তরে আঁখি হইবে মুদ্রিত!
সুখে থেকো চিরকাল!—
সুখে থেকো চিরকাল!
শান্তির কোলেতে বালা থাকিও নিদ্রিত!’
স্তবধ হৃদয়োচ্ছ্বাস! স্তবধ হইল শ্বাস!
স্তবধ লোচনতারা! স্তবধ শরীর!
বিষম শোকের জ্বালা—
মুর্চ্ছিয়া পড়িল বালা,
কোলের উপরে আছে জনকের শির!
গাইল নির্ঝরবারি বিষাদের গান,
শাখার প্রদীপ ধীরে হইল নির্বাণ!পাদটীকা
ঝাঁপ দাও ↑ হিমালয়ে এক প্রকার বৃক্ষ আছে, তাহার শাখা অগ্নিসংযুক্ত হইলে দীপের ন্যায় জ্বলে, তথাকার লোকেরা উহা প্রদীপের পরিবর্তে ব্যবহার করে। (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মিছে ডাক'–মন বলে, আজ না—
গেল উৎসবরাতি,
ম্লান হয়ে এল বাতি,
বাজিল বিসর্জন-বাজনা।
সংসারে যা দেবার
মিটিয়ে দিমু এবার,
চুকিয়ে দিয়েছি তার খাজনা।
শেষ আলো, শেষ গান,
জগতের শেষ দান
নিয়ে যাব—আজ কোনো কাজ না।
বাজিল বিসর্জন-বাজনা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আজ আমি কথা কহিব না।
আর আমি গান গাহিব না।
হেরো আজি ভোরবেলা এসেছে রে মেলা লোক,
ঘিরে আছে চারি দিকে
চেয়ে আছে অনিমিখে,
হেরে মোর হাসিমুখ ভুলে গেছে দুখশোক।
আজ আমি গান গাহিব না।সকাতরে গান গেয়ে পথপানে চেয়ে চেয়ে
এদের ডেকেছি দিবানিশি।
ভেবেছিনু মিছে আশা, বোঝে না আমার ভাষা,
বিলাপ মিলায় দিশি দিশি।
কাছে এরা আসিত না, কোলে বসে হাসিত না,
ধরিতে চকিতে হত লীন।
মরমে বাজিত ব্যথা--সাধিলে না কহে কথা--
সাধিতে শিখি নি এতদিন।
দিত দেখা মাঝে মাঝে, দূরে যেন বাঁশি বাজে,
আভাস শুনিনু যেন হায়।
মেঘে কভু পড়ে রেখা, ফুলে কভু দেয় দেখা,
প্রাণে কভু বহে চলে যায়। আজ তারা এসেছে রে কাছে
এর চেয়ে শোভা কিবা আছে।
কেহ নাহি করে ডর, কেহ নাহি ভাবে পর,
সবাই আমাকে ভালোবাসে
আগ্রহে ঘিরিছে চারি পাশে। এসেছিস তোরা যত জনা,
তোদের কাহিনী আজি শোনা।
যার যত কথা আছে খুলে বল্ মোর কাছে,
আজ আমি কথা কহিব না ।আয় তুই কাছে আয়, তোরে মোর প্রাণ চায়,
তোর কাছে শুধু বসে রই।
দেখি শুধু, কথা নাহি কই।
ললিত পরশে তোর পরানে লাগিছে ঘোর,
চোখে তোর বাজে বেণুবীণা--
তুই মোরে গান শুনাবি না?
জেগেছে নূতন প্রাণ, বেজেছে নূতন গান,
ওই দেখ পোহায়েছে রাতি।
আমারে বুকেতে নে রে, কাছে আয়--আমি যে রে
নিখিলের খেলাবার সাথী।
চারি দিকে সৌরভ, চারি দিকে গীতরব,
চারি দিকে সুখ আর হাসি,
চারি দিকে শিশুগুলি মুখে আধো আধো বুলি,
চারি দিকে স্নেহপ্রেমরাশি!
আমারে ঘিরেছে কারা, সুখেতে করেছে সারা,
জগতে হয়েছে হারা প্রাণের বাসনা।
আর আমি কথা কহিব না--
আর আমি গান গাহিব না।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খুব তার বোলচাল, সাজ ফিট্ফাট্,
তক্রার হলে আর নাই মিট্মাট্।
চশমায় চম্কায়, আড়ে চায় চোখ–
কোনো ঠাঁই ঠেকে নাই কোনো বড়ো লোক।– (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মনে মনে দেখলুম
সেই দূর অতীত যুগের নিঃশব্দ সাধনা
যা মুখর ইতিহাসকে নিষিদ্ধ রেখেছে
আপন তপস্যার আসন থেকে।
দেখলেম দুর্গম গিরিব্রজে
কোলাহলী কৌতূহলী দৃষ্টির অন্তরালে
অসূর্যম্পশ্য নিভৃতে
ছবি আঁকছে গুণী
গুহাভিত্তির 'পরে,
যেমন অন্ধকার পটে
সৃষ্টিকার আঁকছেন বিশ্বছবি।
সেই ছবিতে ওরা আপন আনন্দকেই করেছে সত্য,
আপন পরিচয়কে করেছে উপেক্ষা,
দাম চায়নি বাইরের দিকে হাত পেতে,
নামকে দিয়েছে মুছে।
হে অনামা, হে রূপের তাপস,
প্রণাম করি তোমাদের।
নামের মায়াবন্ধন থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছি
তোমাদের এই যুগান্তরের কীর্তিতে।
নাম-ক্ষালন যে পবিত্র অন্ধকারে ডুব দিয়ে
তোমাদের সাধনাকে করেছিলে নির্মল,
সেই অন্ধকারের মহিমাকে
আমি আজ বন্দনা করি।
তোমাদের নিঃশব্দ বাণী
রয়েছে এই গুহায়,
বলছে--নামের পূজার অর্ঘ্য,
ভাবীকালের খ্যাতি,
সে তো প্রেতের অন্ন;
ভোগশক্তিহীন নিরর্থকের কাছে উৎসর্গ-করা।
তার পিছনে ছুটে
সদ্য বর্তমানের অন্নপূর্ণার
পরিবেষণ এড়িয়ে যেয়ো না, মোহান্ধ।
আজ আমার দ্বারের কাছে
শজনে গাছের পাতা গেল ঝ'রে,
ডালে ডালে দেখা দিয়েছে
কচি পাতার রোমাঞ্চ;
এখন প্রৌঢ় বসন্তের পারের খেয়া
চৈত্রমাসের মধ্যস্রোতে;
মধ্যাহ্নের তপ্ত হাওয়ায়
গাছে গাছে দোলাদুলি;
উড়তি ধুলোয় আকাশের নীলিমাতে
ধূসরের আভাস,
নানা পাখির কলকাকলিতে
বাতাসে আঁকছে শব্দের অস্ফুট আলপনা।
এই নিত্য-বহমান অনিত্যের স্রোতে
আত্মবিস্মৃত চলতি প্রাণের হিল্লোল;
তার কাঁপনে আমার মন ঝলমল করছে
কৃষ্ণচূড়ার পাতার মতো।
অঞ্জলি ভরে এই তো পাচ্ছি
সদ্য মুহূর্তের দান,
এর সত্যে নেই কোনো সংশয়, কোনো বিরোধ।
যখন কোনোদিন গান করেছি রচনা,
সেও তো আপন অন্তরে
এইরকম পাতার হিল্লোল,
হাওয়ার চাঞ্চল্য,
রৌদ্রের ঝলক,
প্রকাশের হর্ষবেদনা।
সেও তো এসেছে বিনা নামের অতিথি,
গর-ঠিকানার পথিক।
তার যেটুকু সত্য
তা সেই মুহূর্তেই পূর্ণ হয়েছে,
তার বেশি আর বাড়বে না একটুও,
নামের পিঠে চড়ে।
বর্তমানের দিগন্তপারে
যে-কাল আমার লক্ষ্যের অতীত
সেখানে অজানা অনাত্মীয় অসংখ্যের মাঝখানে
যখন ঠেলাঠেলি চলবে
লক্ষ লক্ষ নামে নামে,
তখন তারি সঙ্গে দৈবক্রমে চলতে থাকবে
বেদনাহীন চেতনাহীন ছায়ামাত্রসার
আমারো নামটা,
ধিক থাক্ সেই কাঙাল কল্পনার মরীচিকায়।
জীবনের অল্প কয়দিনে
বিশ্বব্যাপী নামহীন আনন্দ
দিক আমাকে নিরহংকার মুক্তি।
সেই অন্ধকারকে সাধনা করি
যার মধ্যে স্তব্ধ বসে আছেন
বিশ্বচিত্রের রূপকার, যিনি নামের অতীত,
প্রকাশিত যিনি আনন্দে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
গান১মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে,
হে প্রবল প্রাণ।
ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে,
হে কোমল প্রাণ।
মৌনী মাটির মর্মের গান কবে
উঠিবে ধ্বনিয়া মর্মর তব রবে,
মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে,
হে মোহন প্রাণ।পথিকবন্ধু, ছায়ার আসন পাতি
এসো শ্যাম সুন্দর,
এসো বাতাসের অধীর খেলার সাথী,
মাতাও নীলাম্বর।
উষায় জাগাও শাখায় গানের আশা,
সন্ধ্যায় আনো বিরামগভীর ভাষা,
রচি দাও রাতে সুপ্তগীতের বাসা,
হে উদার প্রাণ।২আয় আমাদের অঙ্গনে,
অতিথি বালক তরুদল,
মানবের স্নেহসঙ্গ নে,
চল্, আমাদের ঘরে চল্।
শ্যামবঙ্কিম ভঙ্গিতে
চঞ্চল কলসংগীতে
দ্বারে নিয়ে আয় শাখায় শাখায়
প্রাণ-আনন্দ-কোলাহল। তোদের নবীন পল্লবে
নাচুক আলোক সবিতার,
দে পবনে বনবল্লভে
মর্মর গীত উপহার।
আজি শ্রাবণের বর্ষণে
আশীর্বাদের স্পর্শ নে,
পড়ুক মাথায় পাতায় পাতায়
অমরাবতীর ধারাজল।ক্ষিতিবক্ষের ধন হে ধরণী,ধরো
ফিরে নিয়ে তব বক্ষে।
শুভদিনে এরে দীক্ষিত করো
আমাদের চিরসখ্যে।
অন্তরে পাক কঠিন শক্তি,
কোমলতা ফুলে পত্রে,
পক্ষিসমাজে পাঠাক পত্রী
তোমার অন্নসত্রে।অপহে মেঘ, ইন্দ্রের ভেরি বাজাও গম্ভীর মন্দ্রস্বনে
মেদুর অম্বরতলে। আনন্দিত প্রাণের স্পন্দনে
জাগুক এ শিশুবৃক্ষ। মহোৎসবে লহো এরে ডেকে।
বনের সৌভাগ্যদিনে ধরণীর বর্ষা অভিষেকে।তেজসৃষ্টির প্রথম বাণী তুমি, হে আলোক;
এ নব তরুতে তব শুভদৃষ্টি হোক।
একদা প্রচুর পুষ্পে হবে সার্থকতা
উহার প্রচ্ছন্ন প্রাণে রাখো সেই কথা।
স্নিগ্ধ পল্লবের তলে তব তেজ ভরি
হোক তব জয়ধ্বনি শতবর্ষ ধরি।মরুৎহে পবন কর নাই গৌণ,
আষাঢ়ে বেজেছে তব বংশী।
তাপিত নিকুঞ্জের মৌন
নিশ্বাসে দিলে তুমি ধ্বংসি।
এ তরু খেলিবে তব সঙ্গে,
সংগীত দিয়ো এরে ভিক্ষা।
দিয়ো তব ছন্দের রঙ্গে
পল্লবহিল্লোল শিক্ষা।ব্যোমআকাশ, তোমার সহাস উদার দৃষ্টি
মাটির গভীরে জাগায় রূপের সৃষ্টি।
তব আহ্বানে এই তো শ্যামলমূর্তি
আলোক-অমৃতে খুঁজিছে প্রাণের পূর্তি।
দিয়েছ সাহস, তাই তব নীলবর্ণে
বর্ণ মিলায় আপন হরিৎপর্ণে।
তরুতরুণেরে করুণায় করো ধন্য,
দেবতার স্নেহ পায় যেন এই বন্য।মাঙ্গলিকপ্রাণের পাথেয় তব পূর্ণ হোক হে শিশু চিরায়ু,
বিশ্বের প্রসাদস্পর্শে শক্তি দিক সুধাসিক্ত বায়ু।
হে বালকবৃক্ষ, তব উজ্জ্বল কোমল কিশলয়
আলোক করিয়া পান ভান্ডারেতে করুক সঞ্চয়
প্রচ্ছন্ন প্রশান্ত তেজ। লয়ে তব কল্যাণকামনা
শ্রাবণবর্ষণযজ্ঞে তোমারে করিনু অভ্যর্থনা।--
থাকো প্রতিবেশী হয়ে, আমাদের বন্ধু হয়ে থাকো।
মোদের প্রাঙ্গণে ফেলো ছায়া, পথের কঙ্কর ঢাকো
কুসুমবর্ষণে; আমাদের বৈতালিক বিহঙ্গমে
শাখায় আশ্রয় দিয়ো; বর্ষে বর্ষে পুষ্পিত উদ্যমে
অভিনন্দনের গন্ধ মিলাইয়ো বর্ষাগীতিকায়
সন্ধ্যাবন্দনার গানে। মোদের নিকুঞ্জবীথিকায়
মঞ্জুল মর্মরে তব ধরিত্রীর অন্তঃপুর হতে
প্রাণমাতৃকায় মন্ত্র উচ্ছ্বসিবে সূর্যের আলোতে।
শত বর্ষ হবে গত, রেখে যাব আমাদের প্রীতি
শ্যামল লাবণ্যে তব। সে যুগের নূতন অতিথি
বসিবে তোমার ছায়ে। সেদিন বর্ষণমহোৎসবে
আমাদের নিমন্ত্রণ পাঠাইয়ো তোমার সৌরভে
দিকে দিকে বিশ্বজনে। আজি এই আনন্দের দিন
তোমার পল্লবপুঞ্জে পুষ্পে তব হোক মৃত্যুহীন।
রবীন্দ্রের কন্ঠ হতে এ সংগীত তোমার মঙ্গলে
মিলিল মেঘের মন্দ্রে, মিলিল কদম্বপরিমলে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ
আকস্মিক চেতনার নিবিড়তায়
চঞ্চল হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
তখন কোন্ কথা জানাতে তার এত অধৈর্য।
--যে কথা দেহের অতীত।
খাঁচার পাখির কণ্ঠে যে বাণী
সে তো কেবল খাঁচারি নয়,
তার মধ্যে গোপনে আছে সুদূর অগোচরের অরণ্য-মর্মর,
আছে করুণ বিস্মৃতি।
সামনে তাকিয়ে চোখের দেখা দেখি--
এ তো কেবলি দেখার জাল-বোনা নয়।--
বসুন্ধরা তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষে
দেশ-পারানো কোন্ দেশের দিকে,
দিগ্বলয়ের ইঙ্গিতলীন
কোন্ কল্পলোকের অদৃশ্য সংকেতে।
দীর্ঘপথ ভালোমন্দয় বিকীর্ণ,
রাত্রিদিনের যাত্রা দুঃখসুখের বন্ধুর পথে।
শুধু কেবল পথ চলাতেই কি এ পথের লক্ষ্য?
ভিড়ের কলরব পেরিয়ে আসছে গানের আহ্বান,
তার সত্য মিলবে কোন্খানে?
মাটির তলায় সুপ্ত আছে বীজ।
তাকে স্পর্শ করে চৈত্রের তাপ,
মাঘের হিম, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা।
অন্ধকারে সে দেখছে অভাবিতের স্বপ্ন।
স্বপ্নেই কি তার শেষ?
উষার আলোয় তার ফুলের প্রকাশ;
আজ নেই, তাই বলে কি নেই কোনোদিনই?
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
যখন যেমন মনে করি
তাই হতে পাই যদি
আমি তবে একখানি হই
ইচ্ছামতী নদী ।
রইবে আমার দখিন ধারে
সূর্য ওঠার পার ,
বাঁয়ের ধারে সন্ধেবেলায়
নামবে অন্ধকার ।
আমি কইব মনের কথা
দুই পারেরই সাথে ,
আধেক কথা দিনের বেলায় ,
আধেক কথা রাতে ।
যখন ঘুরে ঘুরে বেড়াই
আপন গাঁয়ের ঘাটে
ঠিক তখনি গান গেয়ে যাই
দূরের মাঠে মাঠে ।
গাঁয়ের মানুষ চিনি , যারা
নাইতে আসে জলে ,
গোরু মহিষ নিয়ে যারা
সাঁতরে ওপার চলে ।
দূরের মানুষ যারা তাদের
নতুনতরো বেশ ,
নাম জানি নে , গ্রাম জানি নে
অদ্ভুতের একশেষ ।
জলের উপর ঝলোমলো
টুকরো আলোর রাশি ।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন ,
হাততালি আর হাসি ।
নিচের তলায় তলিয়ে যেথায়
গেছে ঘাটের ধাপ
সেইখানেতে কারা সবাই
রয়েছে চুপচাপ ।
কোণে কোণে আপন মনে
করছে তারা কী কে ।
আমারই ভয় করবে কেমন
তাকাতে সেই দিকে ।
গাঁয়ের লোকে চিনবে আমার
কেবল একটুখানি ।
বাকি কোথায় হারিয়ে যাবে
আমিই সে কি জানি ?
একধারেতে মাঠে ঘাটে
সবুজ বরন শুধু ,
আর - এক ধারে বালুর চরে
রৌদ্র করে ধূ ধূ ।
দিনের বেলায় যাওয়া আসা ,
রাত্তিরে থম্ থম্ !
ডাঙার পানে চেয়ে চেয়ে
করবে গা ছম্ ছম্ । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,চিনবে না আমাকে।তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,“বাসি ফুলের মালা’।তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিলপঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে–জিতিয়ে দিলে তাকে। নিজের কথা বলি।বয়স আমার অল্প।একজনের মন ছুঁয়েছিলআমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে–ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি।আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে। তোমাকে দোহাই দিই,একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।বড়ো দুঃখ তার।তারও স্বভাবের গভীরেঅসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাওকেমন করে প্রমাণ করবে সে,এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,মন যায় না সত্যের খোঁজে,আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে। কথাটা কেন উঠল তা বলি।মনে করো তার নাম নরেশ।সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,না করব যে এমন জোর কই। একদিন সে গেল বিলেতে।চিঠিপত্র পাই কখনো বা।মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে,এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!আর তারা কি সবাই অসামান্য–এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকেস্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে। গেল মেলের চিঠিতে লিখেছেলিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে–বাঙালি কবির কবিতা ক’ লাইন দিয়েছে তুলেসেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে–তার পরে বালির ‘পরে বসল পাশাপাশি–সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,“এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;ঝিনুকের দুটি খোলা,মাঝখানটুকু ভরা থাক্একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে–দুর্লভ, মূল্যহীন।’কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি।সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে,“কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,কিন্তু চমৎকার–হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়।’বুঝতেই পারছএকটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতোআমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়–আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিইএমন ধন নেই আমার হাতে।ওগো, নাহয় তাই হল,নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন। পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প–যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে–অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,হার হয়েছে আমার।কিন্তু তুমি যার কথা লিখবেতাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে। তাকে নাম দিয়ো মালতী।ওই নামটা আমার।ধরা পড়বার ভয় নেই।এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,তারা সবাই সামান্য মেয়ে।তারা ফরাসি জর্মান জানে না,কাঁদতে জানে। কী করে জিতিয়ে দেবে।উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।দয়া কোরো আমাকে।নেমে এসো আমার সমতলে।বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারেদেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি–সে বর আমি পাব না,কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে,বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,আদরে থাক্ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম| এ|কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।কিন্তু ওইখানেই যদি থামতোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।আমার দশা যাই হোকখাটো কোরো না তোমার কল্পনা।তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে–শুধু বিদুষী ব’লে নয়, নারী ব’লে।ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছেধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়–যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি।মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না,বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়–ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি,সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্রমিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।(এইখানে জনান্তিকে বলে রাখিসৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।বলতে হল নিজের মুখেই,এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞেরসাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।)নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল। আর তার পরে?তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,স্বপ্ন আমার ফুরোল।হায় রে সামান্য মেয়ে!হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
বশীরহাটেতে বাড়ি
বশ-মানা ধাত তার,
ছেলে বুড়ো যে যা বলে
কথা শোনে যার-তার।
দিনরাত সর্বথা
সাধে নিজ খর্বতা,
মাথা আছে হেঁট-করা,
সদা জোড়-হাত তার,
সেই ফাঁকে কুকুরটা
চেটে যায় পাত তার। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
শিল্পীর ছবিতে যাহা মূর্তিমতী,
গানে যাহা ঝরে ঝরনায়,
সে বাণী হারায় কেন জ্যোতি,
কেন তা আচ্ছন্ন হয়ে যায়মুখের কথায়
সংসারের মাঝে
নিরন্তর প্রয়োজনে জনতার কাজে?
কেন আজ পরিপূর্ণ ভাষা দিয়ে
পৃথিবীর কানে কানে বলিতে পারিনে "প্রিয়ে
ভালোবাসি"?
কেন আজ সুরহারা হাসি
যেন সে কুয়াশা মেলা
হেমন্তের বেলা?
অনন্ত অম্বর
অপ্রয়োজনের সেথা অখণ্ড প্রকাণ্ড অবসর,
তারি মাঝে কে তারা অন্য তারকারে
জানাইতে পারে
আপনার কানে কানে কথা।
তপস্বিনী নীরবতা
আসন বিস্তীর্ণ যার অসংখ্য যোজন দূর ব্যেপে
অন্তরে অন্তরে উঠে কেঁপে
আলোকের নিগূঢ় সংগীতে।
খণ্ড খণ্ড দণ্ডে পলে ভারাকীর্ণ চিতে
নাই সেই অসীমের অবসর;
তাই অবরুদ্ধ তার স্বর,
ক্ষীণসত্য ভাষা তার।
প্রত্যহের অভ্যস্ত কথার
মূল্য যার ঘুচে,
অর্থ যায় মুছে।
তাই কানে কানে
বলিতে সে নাহি জানে
সহজে প্রকাশি'
"ভালোবাসি"।
আপন হারানো বাণী, খুঁজিবারে,
বনস্পতি, আসি তব দ্বারে।
তোমার পল্লবপুঞ্জ শাখাব্যূহভার
অনায়াসে হয়ে পার
আপনার চতুর্দিকে মেলেছে নিস্তব্ধ অবকাশ।
সেথা তব নিঃশব্ধ উচ্ছ্বাস
সূর্যোদয় মহিমার পানে
আপনারে মিলাইতে জানে।
অজানা সাগর পার হতে
দক্ষিণের বায়ুস্রোতে
অনাদি প্রাণের যে বারতা
তব নব কিশলয়ে রেখে যায় কানে কানে কথা,--
তোমার অন্তরতম--
সে কথা জাগুক প্রাণে মম;--
আমার ভাবনা ভরি উঠুক বিকাশি
"ভালোবাসি"।
তোমার ছায়ায় বসে বিপুল বিরহ মোরে ঘেরে;
বর্তমান মূহূর্তেরে
অবলুপ্ত করি দেয় কালহীনতায়।
জন্মান্তর হতে যেন লোকান্তরগত আঁখি চায়
মোর মুখে।
নিষ্কারণ দুখে
পাঠাইয়া দেয় মোর চেতনারে
সকল সীমার পারে।
দীর্ঘ অভিসারপথে সংগীতের সুর
তাহারে বহিয়া চলে দূর হতে দূর।
কোথায় পাথেয় পাবে তার
ক্ষুধা পিপাসার,
এ সত্য বাণীর তরে তাই সে উদাসী
"ভালোবাসি"।
ভোর হয়েছিল যবে যুগান্তের রাতি
আলোকের রশ্মিগুলি খুঁজি সাথি
এ আদিম বাণী
করেছিল কানাকানি
গগনে গগনে।
নব সৃষ্টি যুগের লগনে
মহাপ্রাণ-সমুদ্রের কূল হতে কূলে
তরঙ্গ দিয়েছে তুলে
এ মন্ত্রবচন।
এই বাণী করেছে রচন
সুবর্ণকিরণ বর্ণে স্বপন-প্রতিমা
আমার বিরহাকাশে যেথা অস্তশিখরের সীমা।
অবসাদ-গোধূলির ধূলিজাল তারে
ঢাকিতে কি পারে?
নিবিড় সংহত করি এ-জন্মের সকল ভাবনা
সকল বেদনা
দিনান্তের অন্ধকারে মম
সন্ধ্যাতারা সম
শেষবাণী উঠুক উদ্ভাসি--
"ভালোবাসি"।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
সুয়োরাণী কহে, রাজা দুয়োরাণীটার
কত মতলব আছে বুঝে ওঠা ভার।
গোয়াল্-ঘরের কোণে দিলে ওরে বাসা,
তবু দেখো অভাগীর মেটে নাই আশা।
তোমারে ভুলায়ে শুধু মুখের কথায়
কালো গরুটিরে তব দুয়ে নিতে চায়।
রাজা বলে, ঠিক ঠিক, বিষম চাতুরী—
এখন কী ক’রে ওর ঠেকাইব চুরি!
সুয়ো বল, একমাত্র রয়েছে ওষুধ,
গোরুটা আমারে দাও, আমি খাই দুধ। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে
বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে ।
তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি ,
" পরিচয় কোনো আছে নাকি,
যাবে কোনখানে ? "
আমি শুধু বলেছি, " কে জানে !"নদীতে লাগিল দোলা ,বাঁধনে পড়িল টান----
একা বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান।
সেই গান শুনি
কুসুমিত তরুতলে তরূন তরূণী
তুলিল অশোক---
মোর হাতে দিয়ে তারা কহিল ," এ আমাদেরই লোক "।
আর কিছু নয়,
সে মোর প্রথম পরিচয় ।।তার পরে জোয়ারের বেলা সাঙ্গ হল.
সাঙ্গ হল তরঙ্গের খেলা ;
কোকিলের ক্লান্ত গানে বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে ;
কনকচাঁপার দল পড়ে ঝুরে;
ভেসে যায় দূরে,
ফাল্গুনের উৎসবরাতির নিমন্ত্রণলিখনপাঁতির
ছিন্ন অংশ তারা অর্থহারা ।ভাঁটার গভীর টানে
তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে ।
নুতন কালের নব যাত্রী ছেলেমেয়ে
শুধাইছে দূর হতে চেয়ে,
' সন্ধ্যার তারার দিকে
বহিয়া চলেছে তরণী কে ?"
সেতারেতে বাঁধিলাম তার,
গাহিলাম আরবার,
' মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক,
আর কিছু নয়-----
এই হোক শেষ পরিচয় ।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।
বেদনায় যে বান ডেকেছে
রোদনে যায় ভেসে গো।
রক্ত-মেঘে ঝিলিক মারে,
বজ্র বাজে গহন-পারে,
কোন্ পাগোল ওই বারে বারে
উঠছে অট্টহেসে গো।
এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।
জীবন এবার মাতাল মরণ-বিহারে।
এইবেলা নে বরণ ক'রে
সব দিয়ে তোর ইহারে।
চাহিস নে আর আগুপিছু,
রাখিস নে তুই লুকিয়ে কিছু,
চরণে কর্ মাথা নিচু
সিক্ত আকুল কেশে গো।
এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।
পথটাকে আজ আপন করে নিয়ো রে।
গৃহ আঁধার হল, প্রদীপ
নিবল শয়ন-শিয়রে।
ঝড় এসে তোর ঘর ভরেছে,
এবার যে তোর ভিত নড়েছে,
শুনিস নি কি ডাক পড়েছে
নিরুদ্দেশের দেশে গো।
এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।
ছি ছি রে ওই চোখের জল আর ফেলিস নে।
ঢাকিস নে মুখ ভয়ে ভয়ে
কোণে আঁচল মেলিস নে।
কিসের তরে চিত্ত বিকল,
ভাঙুক না তোর দ্বারের শিকল,
বাহিরপানে ছোট্ না, সকল
দুঃখসুখের শেষে গো।
এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।
কণ্ঠে কি তোর জয়ধ্বনি ফুটবে না।
চরণে তোর রুদ্র তালে
নূপুর বেজে উঠবে না?
এই লীলা তোর কপালে যে
লেখা ছিল-- সকল ত্যেজে
রক্তবাসে আয় রে সেজে
আয় না বধূর বেশে গো।
ওই বুঝি তোর এল সর্বনেশে গো।
রামগড়, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম,
তোমার উত্তরবায়ু দুরন্ত দুর্দম
অরণ্যের বক্ষ হানে। বনস্পতি যত
থর থর কম্পমান, শীর্ষ করি নত
আদেশ-নির্ঘোষ তব মানে। “জীর্ণতার
মোহবন্ধ ছিন্ন করো’ এ বাক্য তোমার
ফিরিছে প্রচার করি জয়ডঙ্কা তব
দিকে দিকে। কুঞ্জে কুঞ্জে মৃত্যুর বিপ্লব
করিছে বিকীর্ণ শীর্ণ পর্ণ রাশি রাশি
শূন্য নগ্ন করি শাখা, নিঃশেষে বিনাশি
অকাল-পুষ্পের দুঃসাহস।
হে নির্মল,
সংশয়-উদ্বিগ্ন চিত্তে পূর্ণ করো বল।
মৃত্যু-অঞ্জলিতে ভরো অমৃতের ধারা,
ভীষণের স্পর্শঘাতে করো শঙ্কাহারা,
শূন্য করি দাও মন; সর্বস্বান্ত ক্ষতি
অন্তরে ধরুক শান্ত উদাত্ত মুরতি,
হে বৈরাগী। অতীতের আবর্জনাভার,
সঞ্চিত লাঞ্ছনা গ্লানি শ্রান্তি ভ্রান্তি তার
সম্মার্জন করি দাও। বসন্তের কবি
শূন্যতার শুভ্র পত্রে পূর্ণতার ছবি
লেখে আসি’, সে-শূন্য তোমারি আয়োজন,
সেইমতো মোর চিত্তে পূর্ণের আসন
মুক্ত করো রুদ্র-হস্তে; কুজ্ঝটিকারাশি
রাখুক পুঞ্জিত করি প্রসন্নের হাসি।
বাজুক তোমার শঙ্খ মোর বক্ষতলে
নিঃশঙ্ক দুর্জয়। কঠোর উদগ্রবলে
দুর্বলেরে করো তিরস্কার; অট্টহাসে
নিষ্ঠুর ভাগ্যেরে পরিহাসো; হিমশ্বাসে
আরাম করুক ধূলিসাৎ। হে নির্মম,
গর্বহরা, সর্বনাশা, নমো নমো নমঃ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
তিনটে কাঁচা আম পড়ে ছিল গাছতলায়
চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্দুরে ।
যখন-দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়
হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে ।
তখন চা খেতে খেতে মনে ভাবলুম ,
বদল হয়েছে পালের হাওয়া
পুব দিকের খেয়ার ঘাট ঝাপসা হয়ে এলে ।
সেদিন গেছে যেদিন দৈবে-পাওয়া দুটি-একটি কাঁচা আম
ছিল আমার সোনার চাবি ,
খুলে দিত সমস্ত দিনের খুশির গোপন কুঠুরি ;
আজ সে তালা নেই , চাবিও লাগে না ।
গোড়াকার কথাটা বলি ।
আমার বয়সে এ বাড়িতে যেদিন প্রথম আসছে বউ
পরের ঘর থেকে ,
সেদিন যে-মনটা ছিল নোঙর-ফেলা নৌকো
বান ডেকে তাকে দিলে তোলপাড় করে ।
জীবনের বাঁধা বরাদ্দ ছাপিয়ে দিয়ে
এল অদৃষ্টের বদান্যতা ।
পুরোনো ছেঁড়া আটপৌরে দিনরাত্রিগুলো
খসে পড়ল সমস্ত বাড়িটা থেকে ।
কদিন তিনবেলা রোশনচৌকিতে
চার দিকের প্রাত্যহিক ভাষা দিল বদলিয়ে ;
ঘরে ঘরে চলল আলোর গোলমাল
ঝাড়ে লণ্ঠনে ।
অত্যন্ত পরিচিতের মাঝখানে
ফুটে উঠল অত্যন্ত আশ্চর্য ।
কে এল রঙিন সাজে সজ্জায় ,
আলতা-পরা পায়ে পায়ে —
ইঙ্গিত করল যে , সে এই সংসারের পরিমিত দামের মানুষ নয় —
সেদিন সে ছিল একলা অতুলনীয় ।
বালকের দৃষ্টিতে এই প্রথম প্রকাশ পেল —
জগতে এমন কিছু যাকে দেখা যায় কিন্তু জানা যায় না ।
বাঁশি থামল , বাণী থামল না —
আমাদের বধূ রইল
বিস্ময়ের অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে ঘেরা ।
তার ভাব , তার আড়ি , তার খেলাধুলো ননদের সঙ্গে ।
অনেক সংকোচে অল্প একটু কাছে যেতে চাই ,
তার ডুরে শাড়িটি মনে ঘুরিয়ে দেয় আবর্ত ;
কিন্তু , ভ্রূকুটিতে বুঝতে দেরি হয় না , আমি ছেলেমানুষ ,
আমি মেয়ে নই , আমি অন্য জাতের ।
তার বয়স আমার চেয়ে দুই-এক মাসের
বড়োই হবে বা ছোটোই হবে ।
তা হোক , কিন্তু এ কথা মানি ,
আমরা ভিন্ন মসলায় তৈরি ।
মন একান্তই চাইত , ওকে কিছু একটা দিয়ে
সাঁকো বানিয়ে নিতে ।
একদিন এই হতভাগা কোথা থেকে পেল
কতকগুলো রঙিন পুথি ;
ভাবলে , চমক লাগিয়ে দেবে ।
হেসে উঠল সে ; বলল ,
“ এগুলো নিয়ে করব কী । ”
ইতিহাসের উপেক্ষিত এই-সব ট্র্যাজেডি
কোথাও দরদ পায় না ,
লজ্জার ভারে বালকের সমস্ত দিনরাত্রির
দেয় মাথা হেঁট করে ।
কোন্ বিচারক বিচার করবে যে , মূল্য আছে
সেই পুঁথিগুলোর ।
তবু এরই মধ্যে দেখা গেল , শস্তা খাজনা চলে
এমন দাবিও আছে ওই উচ্চাসনার —
সেখানে ওর পিড়ে পাতা মাটির কাছে ।
ও ভালোবাসে কাঁচা আম খেতে
শুল্পো শাক আর লঙ্কা দিয়ে মিশিয়ে ।
প্রসাদলাভের একটি ছোট্ট দরজা খোলা আছে
আমার মতো ছেলে আর ছেলেমানুষের জন্যেও ।
গাছে চড়তে ছিল কড়া নিষেধ ।
হাওয়া দিলেই ছুটে যেতুম বাগানে ,
দৈবে যদি পাওয়া যেত একটিমাত্র ফল
একটুখানি দুর্লভতার আড়াল থেকে ,
দেখতুম , সে কী শ্যামল , কী নিটোল , কী সুন্দর ,
প্রকৃতির সে কী আশ্চর্য দান ।
যে লোভী চিরে চিরে ওকে খায়
সে দেখতে পায় নি ওর অপরূপ রূপ । একদিন শিলবৃষ্টির মধ্যে আম কুড়িয়ে এনেছিলুম ;
ও বলল , “ কে বলেছে তোমাকে আনতে । ”
আমি বললুম , “ কেউ না । ”
ঝুড়িসুদ্ধ মাটিতে ফেলে চলে গেলুম ।
আর-একদিন মৌমাছিতে আমাকে দিলে কামড়ে ;
সে বললে , “ এমন করে ফল আনতে হবে না । ”
চুপ করে রইলুম ।
বয়স বেড়ে গেল ।
একদিন সোনার আংটি পেয়েছিলুম ওর কাছ থেকে ;
তাতে স্মরণীয় কিছু লেখাও ছিল ।
স্নান করতে সেটা পড়ে গেল গঙ্গার জলে —
খুঁজে পাই নি ।
এখনো কাঁচা আম পড়ছে খসে খসে
গাছের তলায় , বছরের পর বছর ।
ওকে আর খুঁজে পাবার পথ নেই ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
বর্ষণগৌরব তার
গিয়েছে চুকি,
রিক্তমেঘ দিকপ্রান্তে
ভয়ে দেয় উঁকি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ওহে নবীন অতিথি,
তুমি নূতন কি তুমি চিরন্তন।
যুগে যুগে কোথা তুমি ছিলে সংগোপন।
যতনে কত কী আনি বেঁধেছিনু গৃহখানি,
হেথা কে তোমারে বলো করেছিল নিমন্ত্রণ।
কত আশা ভালোবাসা গভীর হৃদয়তলে
ঢেকে রেখেছিনু বুকে, কত হাসি অশ্রুজলে!
একটি না কহি বাণী তুমি এলে মহারানী,
কেমনে গোপনে মনে করিলে হে পদার্পণ। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
জ্যোতির্ময় তীর হতে আঁধার সাগরে
ঝাঁপায়ে পড়িল এক তারা ,
একেবারে উন্মাদের পারা ।
চৌদিকে অসংখ্য তারা রহিল চাহিয়া
অবাক হইয়া --
এই - যে জ্যোতির বিন্দু আছিল তাদের মাঝে
মুহুর্তে সে গেল মিশাইয়া ।
যে সমূদ্রতলে
মনোদুঃখে আত্মঘাতী
চির - নির্বাপিত - ভাতি
শত মৃত তারকার
মৃতদেহ রয়েছে শয়ান
সেথায় সে করেছে পয়ান ।
কেন গো , কী হয়েছিল তার ।
একরার শুধালে না কেহ --
কী লাগি সে তেয়াগিল দেহ ।
যদি কেহ শুধাইত
আমি জানি কী যে সে কহিত ।
যতদিন বেঁচে ছিল
আমি জানি কী তারে দহিত ।
সে কেবল হাসির যন্ত্রণা ,
আর কিছু না !
জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ড ঢাকিতে আঁধার হৃদি
অনিবার হাসিতেই রহে ,
যত হাসে ততই সে দহে ।
তেমনি , তেমনি তারে হাসির অনল
দারুণ উজ্জল --
দহিত , দহিত তারে , দহিত , কেবল ।
জ্যোতির্ময় তারাপূর্ণ বিজন তেয়াগি
তাই আজ ছুটেছে সে নিতান্ত মনের ক্লেশে
আঁধারের তারাহীন বিজনের লাগি ।
কেন গো তোমরা যত তারা
উপহাস করি তারে হাসিছ অমন ধারা ।
তোমাদের হয় নি তো ক্ষতি ,
যেমন আছিল আগে তেমনি রয়েছে জ্যোতি ।
সে কি কভু ভেবেছিল মনে -
( এত গর্ব আছিল কি তার ) ।
আপনারে নিবাইয়া তোমাদের করিবে আঁধার ।
গেল , গেল , ডুবে গেল , তারা এক ডুবে গেল ,
আঁধারসাগরে --
গভীর নিশীথে
অতল আকাশে ।
হৃদয় , হৃদয় মোর , সাধ কি রে যায় তোর
ঘুমাইতে ওই মৃত তারাটির পাশে
ওই আঁধারসাগরে
এই গভীর নিশীথে
ওই অতল আকাশে ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
‘কমলা ভুলিবে সেই শিখর কানন,
কমলা ভুলিবে সেই বিজন কুটীর—
আজ হতে নেত্র! বারি কোরো না বর্ষণ,
আজ হতে মন প্রাণ হও গো সুস্থির।অতীত ও ভবিষ্যত হইব বিসমৃত।
জুড়িয়াছে কমলার ভগন হৃদয়!
সুখের তরঙ্গ হৃদে হয়েছে উত্থিত,
সংসার আজিকে হোতে দেখি সুখময়।বিজয়েরে আর করিব না তিরস্কার
সংসারকাননে মোরে আনিয়াছে বলি।
খুলিয়া দিয়াছে সে যে হৃদয়ের দ্বার,
ফুটায়েছে হৃদয়ের অস্ফুটিত কলি!জমি জমি জলরাশি পর্ব্বতগুহায়
একদিন উথলিয়া উঠে রে উচ্ছ্বাসে,
একদিন পূর্ণ বেগে প্রবাহিয়া যায়,
গাহিয়া সুখের গান যায় সিন্ধুপাশে।—আজি হতে কমলার নূতন উচ্ছ্বাস,
বহিতেছে কমলার নূতন জীবন।
কমলা ফেলিবে আহা নূতন নিশ্বাস,
কমলা নূতন বায়ু করিবে সেবন।কাঁদিতে ছিলাম কাল বকুলতলায়,
নিশার আঁধারে অশ্রু করিয়া গোপন!
ভাবিতে ছিলাম বসি পিতায় মাতায়—
জানি না নীরদ আহা এয়েছে কখন।সেও কি কাঁদিতে ছিল পিছনে আমার?
সেও কি কাঁদিতে ছিল আমারি কারণ?
পিছনে ফিরিয়া দেখি মুখপানে তার,
মন যে কেমন হল জানে তাহা মন।নীরদ কহিল হৃদি ভরিয়া সুধায়—
‘শোভনে! কিসের তরে করিছ রোদন?’
আহা হা! নীরদ যদি আবার শুধায়,
‘কমলে! কিসের তরে করিছ রোদন?’বিজয়েরে বলিয়াছি প্রাতঃকালে কাল—
একটি হৃদয়ে নাই দুজনের স্থান!
নীরদেই ভালবাসা দিব চিরকাল,
প্রণয়ের করিব না কভু অপমান।ওই যে নীরজা আসে পরাণ-সজনী,
একমাত্র বন্ধু মোর পৃথিবীমাঝার!
হেন বন্ধু আছে কি রে নির্দ্দয় ধরণী!
হেন বন্ধু কমলা কি পাইবেক আর?ওকি সখি কোথা যাও? তুলিবে না ফুল?
নীরজা, আজিকে সই গাঁথিবে না মালা?
ওকি সখি আজ কেন বাঁধ নাই চুল?
শুকনো শুকনো মুখ কেন আজি বালা?মুখ ফিরাইয়া কেন মুছ আঁখিজল?
কোথা যাও, কোথা সই, যেও না, যেও না!
কি হয়েছে? বল্বি নে— বল্ সখি বল্!
কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা?’‘কি হয়েছে, কে দিয়েছে, বলি গো সকল।
কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা—
ফেলিব যে চিরকাল নয়নের জল
নিভায়ে ফেলিতে বালা মরমবেদনা!কে দিয়েছে মনমাঝে জ্বালায়ে অনল?
বলি তবে তুই সখি তুই! আর নয়—
কে আমার হৃদয়েতে ঢেলেছে গরল?
কমলারে ভালবাসে আমার বিজয়!কেন হলুম না বালা আমি তোর মত,
বন হতে আসিতাম বিজয়ের সাথে—
তোর মত কমলা লো মুখ আঁখি যত
তা হলে বিজয়-মন পাইতাম হাতে!পরাণ হইতে অগ্নি নিভিবে না আর
বনে ছিলি বনবালা সে ত বেশ ছিলি—
জ্বালালি!— জ্বলিলি বোন! খুলি মর্ম্মদ্বার—
কাঁদিতে করিগে যত্ন যেথা নিরিবিলি’।কমলা চাহিয়া রয়, নাহি বহে শ্বাস।
হৃদয়ের গূঢ় দেশে অশ্রুরাশি মিলি
ফাটিয়া বাহির হতে করিল প্রয়াস—
কমলা কহিল ধীরে “জ্বালালি জ্বলিলি!”আবার কহিল ধীরে, আবার হেরিল নীরে
যমুনাতরঙ্গে খেলে পূর্ণ শশধর—
তরঙ্গের ধারে ধারে রঞ্জিয়া রজতধারে
সুনীল সলিলে ভাসে রজন্ময় কর!হেরিল আকাশ-পানে সুনীল জলদযানে
ঘুমায়ে চন্দ্রিমা ঢালে হাসি এ নিশীথে।
কতক্ষণ চেয়ে চেয়ে পাগল বনের মেয়ে
আকুল কত কি মনে লাগিত ভাবিতে!‘ওই খানে আছে পিতা, ওই খানে আছে মাতা,
ওই জ্যোৎসনাময় চাঁদে করি বিচরণ
দেখিছেন হোথা হোতে দাঁড়ায়ে সংসারপথে
কমলা নয়নবারি করিছে মোচন।একি রে পাপের অশ্রু? নীরদ আমার—
নীরদ আমার যথা আছে লুক্কায়িত,
সেই খান হোতে এই অশ্রুবারিধার
পূর্ণ উৎস-সম আজ হল উৎসারিত।এ ত পাপ নয় বিধি! পাপ কেন হবে?
বিবাহ করেছি বলে নীরদে আমার
ভাল বাসিব না? হায় এ হৃদয় তবে
বজ্র দিয়া দিক বিধি করে চুরমার!এ বক্ষে হৃদয় নাই, নাইক পরাণ,
একখানি প্রতিমূর্ত্তি রেখেছি শরীরে—
রহিবে, যদিন প্রাণ হবে বহমান
রহিবে, যদিন রক্ত রবে শীরে শীরে!সেই মূর্ত্তি নীরদের! সে মূর্ত্তি মোহন
রাখিলে বুকের মধ্যে পাপ কেন হবে?
তবুও সে পাপ— আহা নীরদ যখন
বলেছে, নিশ্চয় তারে পাপ বলি তবে!তবু মুছিব না অশ্রু এ নয়ান হোতে,
কেন বা জানিতে চাব পাপ কারে বলি?
দেখুক জনক মোর ওই চন্দ্র হোতে
দেখুন জননী মোর আঁখি দুই মেলি! নীরজা গাইত ‘চল্ চন্দ্রলোকে রবি।
সুধাময় চন্দ্রলোক, নাই সেথা দুখ শোক,
সকলি সেথায় নব ছবি!ফুলবক্ষে কীট নাই, বিদ্যুতে অশনি নাই,
কাঁটা নাই গোলাপের পাশে!
হাসিতে উপেক্ষা নাই, অশ্রুতে বিষাদ নাই,
নিরাশার বিষ নাই শ্বাসে।নিশীথে আঁধার নাই, আলোকে তীব্রতা নাই,
কোলাহল নাইক দিবায়!
আশায় নাইক অন্ত, নূতনত্বে নাই অন্ত,
তৃপ্তি নাই মাধুর্য্যশোভায়।লতিকা কুসুমময়, কুসুম সুরভিময়,
সুরভি মৃদুতাময় যেথা!
জীবন স্বপনময়, স্বপন প্রমোদময়,
প্রমোদ নূতনময় সেথা!সঙ্গীত উচ্ছ্বাসময়, উচ্ছ্বাস মাধুর্য্যময়,
মাধুর্য্য মত্ততাময় অতি।
প্রেম অস্ফুটতামাখা, অস্ফুটতা স্বপ্নমাখা,
স্বপ্নে-মাখা অস্ফুটিত জ্যোতি!গভীর নিশীথে যেন, দূর হোতে স্বপ্ন-হেন
অস্ফুট বাঁশীর মৃদু রব—
সুধীরে পশিয়া কানে শ্রবণ হৃদয় প্রাণে
আকুল করিয়া দেয় সব।এখানে সকলি যেন অস্ফুট মধুর-হেন,
উষার সুবর্ণ জ্যোতি-প্রায়।
আলোকে আঁধার মিশে মধু জ্যোছনায় দিশে
রাখিয়াছে ভরিয়া সুধায়!দূর হোতে অপ্সরার মধুর গানের ধার,
নির্ঝরের ঝর ঝর ধ্বনি।
নদীর অস্ফুট তান মলয়ের মৃদুগান
একত্তরে মিশেছে এমনি!সকলি অস্ফুট হেথা মধুর স্বপনে-গাঁথা
চেতনা মিশান’ যেন ঘুমে।
অশ্রু শোক দুঃখ ব্যথা কিছুই নাহিক হেথা
জ্যোতির্ম্ময় নন্দনের ভূমে!’আমি যাব সেই খানে পুলকপ্রমত্ত প্রাণে
সেই দিনকার মত বেড়াব খেলিয়া—
বেড়াব তটিনীতীরে, খেলাব তটিনীনীরে,
বেড়াইব জ্যোছনায় কুসুম তুলিয়া!শুনিছি মৃত্যুর পিছু পৃথিবীর সব-কিছু
ভুলিতে হয় নাকি গো যা আছে এখানে!
ওমা! সে কি করে হবে? মরিতে চাই না তবে
নীরদে ভুলিতে আমি চাব কোন্ প্রাণে?’কমলা এতেক পরে হেরিল সহসা
নীরদ কাননপথে যাইছে চলিয়া—
মুখপানে চাহি রয় বালিকা বিবশা,
হৃদয়ে শোণিতরাশি উঠে উথলিয়া।নীরদের স্কন্ধে খেলে নিবিড় কুন্তল,
দেহ আবরিয়া রহে গৈরিক বসন,
গভীর ঔদাস্যে যেন পূর্ণ হৃদিতল—
চলিছে যে দিকে যেন চলিছে চরণ।যুবা কমলারে দেখি ফিরাইয়া লয় আঁখি,
চলিল ফিরায়ে মুখ দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
যুবক চলিয়া যায় বালিকা তবুও হায়!
চাহি রয় একদৃষ্টে আঁখিদ্বয় মেলি।ঘুম হতে যেন জাগি সহসা কিসের লাগি
ছুটিয়া পড়িল গিয়া নীরদের পায়।
যুবক চমকি প্রাণে হেরি চারি দিক-পানে
পুনঃ না করিয়া দৃষ্টি ধীরে চলি যায়।‘কোথা যাও— কোথা যাও— নীরদ! যেও না!
একটি কহিব কথা শুন একবার!
মুহূর্ত্ত— মুহূর্ত্ত রও— পুরাও কামনা!
কাতরে দুখিনী আজি কহে বার বার!জিজ্ঞাসা করিবে নাকি আজি যুবাবর
‘কমলা কিসের তরে করিছ রোদন?’
তা হলে কমলা আজি দিবেক উত্তর,
কমলা খুলিবে আজি হৃদয়বেদন।দাঁড়াও— দাঁড়াও যুবা! দেখি একবার,
যেথা ইচ্ছা হয় তুমি যেও তার পর!
কেন গো রোদন করি শুধাও আবার,
কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর!কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর,
কমলা হৃদয় খুলি দেখাবে তোমায়—
সেথায় রয়েছে লেখা দেখো তার পর
কমলা রোদন করে কিসের জ্বালায়!’‘কি কব কমলা আর কি কব তোমায়,
জনমের মত আজ লইব বিদায়!
ভেঙ্গেছে পাষাণ প্রাণ, ভেঙ্গেছে সুখের গান—
এ জন্মে সুখের আশা রাখি নাক আর!এ জন্মে মুছিব নাক নয়নের ধার!
কত দিন ভেবেছিনু যোগীবেশ ধরে
ভ্রমিব যেথায় ইচ্ছা কানন-প্রান্তরে।তবু বিজয়ের তরে এত দিন ছিনু ঘরে
হৃদয়ের জ্বালা সব করিয়া গোপন—
হাসি টানি আনি মুখে এত দিন দুখে দুখে
ছিলাম, হৃদয় করি অনলে অর্পণ!কি আর কহিব তোরে— কালিকে বিজয় মোরে
কহিল জন্মের মত ছাড়িতে আলয়!
জানেন জগৎস্বামী— বিজয়ের তরে আমি
প্রেম বিসর্জ্জিয়াছিনু তুষিতে প্রণয়।’এত বলি নীরবিল ক্ষুব্ধ যুবাবর!
কাঁপিতে লাগিল কমলার কলেবর,
নিবিড় কুন্তল যেন উঠিল ফুলিয়া—
যুবারে সম্ভাষে বালা, এতেক বলিয়া—‘কমলা তোমারে আহা ভালবাসে বোলে
তোমারে করেছে দূর নিষ্ঠুর বিজয়!
প্রেমেরে ডুবাব আজি বিসমৃতির জলে,
বিসমৃতির জলে আজি ডুবাব হৃদয়!তবুও বিজয় তুই পাবি কি এ মন?
নিষ্ঠুর! আমারে আর পাবি কি কখন?
পদতলে পড়ি মোর দেহ কর ক্ষয়—
তবু কি পারিবি চিত্ত করিবারে জয়?
তুমিও চলিলে যদি হইয়া উদাস—কেন গো বহিব তবে এ হৃদি হতাশ?
আমিও গো আভরণ ভূষণ ফেলিয়া
যোগিনী তোমার সাথে যাইব চলিয়া।যোগিনী হইয়া আমি জন্মেছি যখন
যোগিনী হইয়া প্রাণ করিব বহন।
কাজ কি এ মণি মুক্তা রজত কাঞ্চন—
পরিব বাকলবাস ফুলের ভূষণ।নীরদ! তোমার পদে লইনু শরণ—
লয়ে যাও যেথা তুমি করিবে গমন!
নতুবা যমুনাজলে এখনই অবহেলে
ত্যজিব বিষাদদগ্ধ নারীর জীবন!’পড়িল ভূতলে কেন নীরদ সহসা?
শোণিতে মৃত্তিকাতল হইল রঞ্জিত!
কমলা চমকি দেখে সভয়ে বিবশা
দারুণ ছুরিকা পৃষ্ঠে হয়েছে নিহিত!কমলা সভয়ে শোকে করিল চিৎকার।
রক্তমাখা হাতে ওই চলিছে বিজয়!
নয়নে আঁচল চাপি কমলা আবার —
সভয়ে মুদিয়া আঁখি স্থির হয়ে রয়।আবার মেলিয়া আঁখি মুদিল নয়নে,
ছুটিয়া চলিল বালা যমুনার জলে—
আবার আইল ফিরি যুবার সদনে,
যুমনা-শীতল জলে ভিজায়ে আঁচলে।যুবকের ক্ষত স্থানে বাঁধিয়া আঁচল
কমলা একেলা বসি রহিল তথায়—
এক বিন্দু পড়িল না নয়নের জল,
এক বারো বহিল না দীর্ঘশ্বাস-বায়।তুলি নিল যুবকের মাথা কোল-পরে—
একদৃষ্টে মুখপানে রহিল চাহিয়া।
নির্জ্জীব প্রতিমা-প্রায় না নড়ে না চড়ে,
কেবল নিশ্বাস মাত্র যেতেছে বহিয়া।চেতন পাইয়া যুবা কহে কমলায়,
‘যে ছুরীতে ছিঁড়িয়াছে জীবনবন্ধন
অধিক সুতীক্ষ্ম ছুরী তাহা অপেক্ষায়
আগে হোতে প্রেমরজ্জু করেছে ছেদন।বন্ধুর ছুরিকা-মাখা দ্বেষহলাহলে
করেছে হৃদয়ে দেহে আঘাত ভীষণ,
নিবেছে দেহের জ্বালা হৃদয়-অনলে—
ইহার অধিক আর নাইক মরণ!বকুলের তলা হোক্ রক্তে রক্তময়!
মৃত্তিকা রঞ্জিত হোক্ লোহিত বরণে!
বসিবে যখন কাল হেথায় বিজয়
আচ্ছন্ন বন্ধুতা পুনঃ উদিবে না মনে?মৃত্তিকার রক্তরাগ হোয়ে যাবে ক্ষয়—
বিজয়ের হৃদয়ের শোণিতের দাগ
আর কি কখনো তার হবে অপচয়?
অনুতাপ-অশ্রুজলে মুছিবে সে রাগ?বন্ধুতার ক্ষীণ জ্যোতি প্রেমের কিরণে
(রবিকরে হীনভাতি নক্ষত্র যেমন)
বিলুপ্ত হয়েছে কি রে বিজয়ের মনে?
উদিত হইবে না কি আবার কখন?একদিন অশ্রুজল ফেলিবে বিজয়!
একদিন অভিশাপ দিবে ছুরিকারে!
একদিন মুছিবারে হইতে হৃদয়
চাহিবে সে রক্তধারা অশ্রুবারিধারে!কমলে! খুলিয়া ফেল আঁচল তোমার!
রক্তধারা যেথা ইচ্ছা হোক প্রবাহিত!
বিজয় শুধেছে আজি বন্ধুতার ধার
প্রেমেরে করায়ে পান বন্ধুর শোণিত!চলিনু কমলা আজ ছাড়িয়া ধরায়—
পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িয়া বন্ধন,
জলাঞ্জলি দিয়া পৃথিবীর মিত্রতায়,
প্রেমের দাসত্ব রজ্জু করিয়া ছেদন!”অবসন্ন হোয়ে পঞ্চল যুবক তখনি,
কমলার কোল হোতে পড়িল ধরায়!
উঠিয়া বিপিনবালা সবেগে অমনি
ঊর্দ্ধহস্তে কহে উচ্চ সুদৃঢ় ভাষায়—‘জলন্ত জগৎ! ওগো চন্দ্র সূর্য্য তারা!
দেখিতেছ চিরকাল পৃথিবীর নরে!
পৃথিবীর পাপ পুণ্য, হিংসা, রক্তধারা
তোমরাই লিখে রাখ জ্বলদ্ অক্ষরে!সাক্ষী হও তোমরা গো করিও বিচার!—
তোমরা হও গো সাক্ষী পৃথ্বী চরাচর!
বহে যাও!— বহে যাও যমুনার ধার,
নিষ্ঠুর কাহিনী কহি সবার গোচর!এখনই অস্তাচলে যেও না তপন!
ফিরে এসো, ফিরে এসো তুমি দিনকর!
এই, এই রক্তধারা করিয়া শোষণ
লয়ে যাও, লয়ে যাও স্বর্গের গোচর!ধুস্ নে যমুনাজল! শোণিতের ধারে!
বকুল তোমার ছায়া লও গো সরিয়ে!
গোপন করো না উহা নিশীথ! আঁধারে!
জগৎ! দেখিয়া লও নয়ন ভরিয়ে!অবাক হউক্ পৃথ্বী সভয়ে, বিস্ময়ে!
অবাক হইয়া যাক্ আঁধার নরক!
পিশাচেরা লোমাঞ্চিত হউক সভয়ে!
প্রকৃতি মুদুক ভয়ে নয়নপলক!রক্তে লিপ্ত হয়ে যাক্ বিজয়ের মন!
বিসমৃতি! তোমার ছায়ে রেখো না বিজয়ে;
শুকালেও হৃদিরক্ত এ রক্ত যেমন
চিরকাল লিপ্ত থাকে পাষাণ হৃদয়ে!বিষাদ! বিলাসে তার মাখি হলাহল
ধরিও সমুখে তার নরকের বিষ!
শান্তির কুটীরে তার জ্বালায়ো অনল!
বিষবৃক্ষবীজ তার হৃদয়ে রোপিস্!দূর হ— দূর হ তোরা ভূষণ রতন!
আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা!
আবার কবরি! তোরে করিনু মোচন!
আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা!কি বলিস্ যমুনা লো! কমলা বিধবা!
জাহ্নবীরে বল্ গিয়ে ‘কমলা বিধবা’!
পাখী! কি করিস্ গান ‘কমলা বিধবা!
দেশে দেশে বল্ গিয়ে ‘কমলা বিধবা!আয়! শুক ফিরে যা লো বিজন শিখরে,
মৃগদের বল্ গিয়া উঁচু করি গলা—
কুটীরকে বল্ গিয়ে, তটিনী,নির্ঝরে—
‘বিধবা হয়েছে সেই বালিকা কমলা!’উহুহু! উহুহু— আর সহিব কেমনে?
হৃদয়ে জ্বলিছে কত অগ্নিরাশি মিলি।
বেশ ছিনু বনবালা, বেশ ছিনু বনে!—
নীরজা বলিয়া গেছে ‘জ্বালালি! জ্বলিলি!’ (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি
প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ;
আপন আগুনে শোক দগ্ধ করি দিল আপনারে
উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে।
সায়াহ্নবেলার ভালে অস্তসূর্য দেয় পরাইয়া
রক্তোজ্জল মহিমার টিকা,
স্বর্ণময়ী করে দেয় আসন্ন রাত্রির মুখশ্রীরে,
তেমনি জ্বলন্ত শিখা মৃত্যু পরাইল মোরে
জীবনের পশ্চিমসীমায়।
আলোকে তাহার দেখা দিল
অখন্ড জীবন, যাহে জন্মমৃত্যু এক হয়ে আছে;
সে মহিমা উদ্বারিল যাহার উজ্জ্বল অমরতা
কৃপণ ভাগ্যের দৈন্যে দিনে দিনে রেখেছিল ঢেকে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
একটা খোঁড়া ঘোড়ার ‘পরে
চড়েছিল চাটুর্জে,পড়ে গিয়ে কী দশা তার
হয়েছিল হাঁটুর যে!
বলে কেঁদে, “ব্রাহ্মণেরে
বইতে ঘোড়া পারল না যে
সইত তাও, মরি আমি
তার থেকে এই অধিক লাজে–
লোকের মুখের ঠাট্টা যত
বইতে হবে টাটুর যে!’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ওরে মোর শিশু ভোলানাথ ,
তুলি দুই হাত
যেখানে করিস পদপাত
বিষম তাণ্ডবে তোর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব ;
আপন বিভব
আপনি করিস নষ্ট হেলাভরে ;
প্রলয়ের ঘূর্ণচক্র -' পরে
চূর্ণ খেলেনার ধূলি উড়ে দিকে দিকে ;
আপন সৃষ্টিকে
ধ্বংস হতে ধ্বংসমাঝে মুক্তি দিস অনর্গল ,
খেলারে করিস রক্ষা ছিন্ন করি খেলেনা - শৃঙ্খল ।
অকিঞ্চন , তোর কাছে কিছুরই তো কোনো মূল্য নাই ,
রচিস যা তোর ইচ্ছা তাই
যাহা খুশি তাই দিয়ে ,
তার পর ভুলে যাস যাহা ইচ্ছা তাই নিয়ে ।
আবরণ তোরে নাহি পারে সম্বরিতে দিগম্বর ,
স্রস্ত ছিন্ন পড়ে ধূলি -' পর ।
লজ্জাহীন সজ্জাহীন বিত্তহীন আপনা - বিস্মৃত ,
অন্তরে ঐশ্বর্য তোর , অন্তরে অমৃত ।
দারিদ্র্য করে না দীন , ধূলি তোরে করে না অশুচি ,
নৃত্যের বিক্ষোভে তোর সব গ্লানি নিত্য যায় ঘুচি ।
ওরে শিশু ভোলানাথ , মোরে ভক্ত ব'লে
নে রে তোর তাণ্ডবের দলে ;
দে রে চিত্তে মোর
সকল - ভোলার ওই ঘোর ,
খেলেনা - ভাঙার খেলা দে আমারে বলি ।
আপন সৃষ্টির বন্ধ আপনি ছিঁড়িয়া যদি চলি
তবে তোর মত্ত নর্তনের চালে
আমার সকল গান ছন্দে ছন্দে মিলে যাবে তালে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
চক্ষু কর্ণ বুদ্ধি মন সব রুদ্ধ করি,
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি’,
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে?
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হেরি অহরহ তোমারি বিরহ
ভুবনে ভুবনে রাজে হে।
কত রূপ ধ’রে কাননে ভূধরে
আকাশে সাগরে সাজে হে।
সারা নিশি ধরি তারায় তারায়
অনিমেষ চোখে নীরবে দাঁড়ায়,
পল্লবদলে শ্রাবণধারায়
তোমারি বিরহ বাজে হে। ঘরে ঘরে আজি কত বেদনায়
তোমারি গভীর বিরহ ঘনায়,
কত প্রেমে হায় কত বাসনায়
কত সুখে দুখে কাজে হে।
সকল জীবন উদাস করিয়া
কত গানে সুরে গলিয়া ঝরিয়া
তোমারি বিরহ উঠিছে ভরিয়া
আমার হিয়ার মাঝে হে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
দূর স্বর্গে বাজে যেন নীরব ভৈরবী।
ঊষার করুণ চাঁদ শীর্ণমুখচ্ছবি।
ম্লান হয়ে এল তারা; পূর্বদিগ্বধূর
কপোল শিশিরসিক্ত, পান্ডুর, বিধুর।
ধীরে ধীরে নিবে গেল শেষ দীপশিখা,
খসে গেল যামিনীর স্বপ্নযবনিকা।
প্রবেশিল বাতায়নে পরিতাপসম
রক্তরশ্মি প্রভাতের আঘাত নির্মম।
সেইক্ষণে গৃহদ্বারে সত্বর সঘন
আমাদের সর্বশেষ বিদায়-চুম্বন।
মুহূর্তে উঠিল বাজি চারি দিক হতে
কর্মের ঘর্ঘরমন্দ্র সংসারের পথে।
মহারবে সিংহদ্বার খুলে বিশ্বপুরে—
অশ্রুজল মুছে ফেলি চলি গেনু দূরে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা —
সলিল রয়েছে প'ড়ে, শুধু দেহ নাই।
এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা
সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই - চাই।
দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল
কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!
মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল —
বিশ্ব যেন চিত্রপট, আমি যেন আঁকা!
চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন
আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে,
মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন
আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে।
কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!
কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময়!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
নীল বায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল
রাঙা গোলাপ গাল দুখানি, সুধায় মাখা সুকোমল।
শুভ্র বিমল করকমল ফুটে আছে চিরদিন!
হৃদয়টুকু শুষ্ক শুধু পাষাণসম সুকঠিন!Heinrich Hein
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যে রত্ন সবার সেরা
তাহারে খুঁজিয়া ফেরা
ব্যর্থ অন্বেষণ।
কেহ নাহি জানে, কিসে
ধরা দেয় আপনি সে
এলে শুভক্ষণ। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খোকার চোখে যে ঘুম আসে
সকল - তাপ - নাশা —
জান কি কেউ কোথা হতে যে
করে সে যাওয়া - আসা ।
শুনেছি রূপকথার গাঁয়ে
জোনাকি - জ্বলা বনের ছায়ে
দুলিছে দুটি পারুল - কুঁড়ি ,
তাহারি মাঝে বাসা —
সেখান থেকে খোকার চোখে
করে সে যাওয়া - আসা ।
খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি
চমকে ঘুমঘোরে —
কোন্ দেশে যে জনম তার
কে কবে তাহা মোরে ।
শুনেছি কোন্ শরৎ - মেঘে
শিশু - শশীর কিরণ লেগে
সে হাসিরুচি জনমি ছিল
শিশিরশুচি ভোরে —
খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি
চমকে ঘুমঘোরে ।
খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে
যে কচি কোমলতা —
জান কি সে যে এতটা কাল
লুকিয়ে ছিল কোথা ।
মা যবে ছিল কিশোরী মেয়ে
করুণ তারি পরান ছেয়ে
মাধুরীরূপে মুরছি ছিল
কহে নি কোনো কথা —
খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে
যে কচি কোমলতা ।
আশিস আসি পরশ করে
খোকারে ঘিরে ঘিরে —
জান কি কেহ কোথা হতে সে
বরষে তার শিরে ।
ফাগুনে নব মলয়শ্বাসে ,
শ্রাবণে নব নীপের বাসে ,
আশিনে নব ধান্যদলে ,
আষাড়ে নব নীরে —
আশিস আসি পরশ করে
খোকারে ঘিরে ঘিরে ।
এই - যে খোকা তরুণতনু
নতুন মেলে আঁখি —
ইহার ভার কে লবে আজি
তোমরা জান তা কি ।
হিরণময় কিরণ - ঝোলা
যাঁহার এই ভুবন - দোলা
তপন - শশী - তারার কোলে
দেবেন এরে রাখি —
এই - যে খোকা তরুণতনু
নতুন মেলে আঁখি । (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মুক্তি এই—সহজে ফিরিয়া আসা সহজের মাঝে,
নহে কৃচ্ছ্রসাধনায় ক্লিষ্ট কৃশ বঞ্চিত প্রাণের
আত্ম অস্বীকারে। রিক্ততায় নিঃস্বতায়, পূর্ণতার
প্রেতচ্ছবি ধ্যান করা অসম্মান জগৎলক্ষ্মীর।
আজ আমি দেখিতেছি, সম্মুখে মুক্তির পূর্ণরূপ
ওই বনস্পতি মাঝে, ঊর্ধ্বে তুলি’ ব্যগ্র শাখা তার
শরৎ প্রভাতে আজি স্পর্শিছে সে মহা অলক্ষ্যেরে
কম্পমান পল্লবে পল্লবে; লভিল মজ্জার মাঝে
সে মহা আনন্দ যাহা পরিব্যাপ্ত লোকে লোকান্তরে,
বিচ্ছুরিত সমীরিত আকাশে আকাশে, স্ফুটোন্মুখ
পুষ্পে পুষ্পে, পাখিদের কণ্ঠে কণ্ঠে স্বত উৎসারিত।সন্ন্যাসীর গৈরিক বসন লুকায়েছে তৃণতলে
সর্ব আবর্জনাগ্রাসী বিরাট ধুলায়, জপমন্ত্র
মিলে গেছে পতঙ্গ-গুঞ্জনে। অনিঃশেষ যে-তপস্যা
প্রাণরসে উচ্ছ্বসিত, সব দিতে সব নিতে
যে বাড়াল কমণ্ডলু দ্যুলোকে ভূলোকে, তারি বর
পেয়েছি অন্তরে মোর, তাই সর্ব দেহমন প্রাণ
সূক্ষ্ম হয়ে প্রসারিল আজি ওই নিঃশব্দ প্রান্তরে
ছায়ারৌদ্রে হেথাহোথা যেথায় রোমন্থরত ধেনু
আলস্যে শিথিল অঙ্গ, তৃপ্তিরস-সম্ভোগ তাদের
সঞ্চারিছে ধীরে মোর পুলকিত সত্তার গভীরে।
দলে দলে প্রজাপতি রৌদ্র হতে নিতেছে কাঁপায়ে
নীরব আকাশবাণী শেফালীর কানে কানে বলা,
তাহারি বীজন আজি শিরায় শিরায় রক্তে মোর
মৃদু স্পর্শে শিহরিত তুলিছে হিল্লোল।
হে সংসার
আমাকে বারেক ফিরে চাও; পশ্চিমে যাবার মুখে
বর্জন কোরো না মোরে উপেক্ষিত ভিক্ষুকের মতো।জীবনের শেষপাত্র উচ্ছলিয়া দাও পূর্ণ করি’,
দিনান্তের সর্বদানযজ্ঞে যথা মেঘের অঞ্জলি
পূর্ণ করি দেয় সন্ধ্যা, দান করি’ চরম আলোর
অজস্র ঐশ্বর্যরাশি সমুজ্জ্বল সহস্র রশ্মির,—
সর্বহর আঁধারের দস্যুবৃত্তি ঘোষণার আগে। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সত্য মোর অবলিপ্ত সংসারের বিচিত্র প্রলেপে,
বিবিধের বহু হস্তক্ষেপে, অযত্নে অনবধানে
হারালো প্রথম রূপ, দেবতার আপন স্বাক্ষর
লুপ্ত প্রায়; ক্ষয়-ক্ষীণ জ্যোতির্ময় আদি মূল্য তার।
চতুষ্পথে দাঁড়াল সে ললাটে পণ্যের ছাপ নিয়ে
আপনারে বিকাইতে, অঙ্কিত হতেছে তার স্থান
পথে-চলা সহস্রের পরীক্ষা-চিহ্নিত তালিকায়।
হেনকালে একদিন আলো-আঁধারের সন্ধি-স্থলে
আরতি শঙ্খের ধ্বনি যে-লগ্নে বাজিল সিন্ধুপারে,
মনে হোলো, মুহূর্তেই থেমে গেল সব বেচাকেনা,
শান্ত হল আশা-প্রত্যাশার কোলাহল। মনে হোলো,
পরের মুখের মূল্য হতে মুক্ত, সব চিহ্ন-মোছাঅসজ্জিত আদি-কৌলীন্যের শান্ত পরিচয় বহি
যেতে হবে নীরবের ভাষাহীন সংগীত-মন্দিরে
একাকীর একতারা হাতে। আদিম সৃষ্টির যুগে
প্রকাশের যে আনন্দ রূপ নিল আমার সত্তায়
আজ ধূলিমগ্ন তাহা, নিদ্রাহারা রুগ্ন বুভুক্ষার
দীপধূমে কলঙ্কিত। তারে ফিরে নিয়ে চলিয়াছি
মৃত্যুস্নানতীর্থতটে সেই আদি নির্ঝরতলায় ।
বুঝি এই যাত্রা মোর স্বপ্নের অরণ্যবীথিপারে
পূর্ব ইতিহাসধৌত অকলঙ্ক প্রথমের পানে।
যে প্রথম বারে বারে ফিরে আসে বিশ্বের সৃষ্টিতে
কখনো বা অগ্নিবর্ষী প্রচণ্ডের প্রলয় হুংকারে,
কখনো বা অকস্মাৎ স্বপ্নভাঙা পরম বিস্ময়ে
শুকতারানিমন্ত্রিত আলোকের উৎসব প্রাঙ্গণে। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
দূরে অশথতলায়
পুঁতির কণ্ঠিখানি গলায়
বাউল দাঁড়িয়ে কেন আছ ?
সামনে আঙিনাতে
তোমার একতারাটি হাতে
তুমি সুর লাগিয়ে নাচো !
পথে করতে খেলা
আমার কখন হল বেলা
আমায় শাস্তি দিল তাই ।
ইচ্ছে হোথায় নাবি
কিন্তু ঘরে বন্ধ চাবি
আমার বেরোতে পথ নাই ।
বাড়ি ফেরার তরে
তোমায় কেউ না তাড়া করে
তোমার নাই কোনো পাঠশালা ।
সমস্ত দিন কাটে
তোমার পথে ঘাটে মাঠে
তোমার ঘরেতে নেই তালা ।
তাই তো তোমার নাচে
আমার প্রাণ যেন ভাই বাঁচে —
আমার মন যেন পায় ছুটি ।
ওগো তোমার নাচে
যেন ঢেউয়ের দোলা আছে ,
ঝড়ে গাছের লুটোপুটি ।
অনেক দূরের দেশ
আমার চোখে লাগায় রেশ ,
যখন তোমায় দেখি পথে ।
দেখতে পায় যে মন
যেন নাম - না - জানা বন
কোন্ পথহারা পর্বতে ।
হঠাৎ মনে লাগে ,
যেন অনেক দিনের আগে ,
আমি অমনি ছিলেম ছাড়া ।
সেদিন গেল ছেড়ে ,
আমার পথ নিল কে কেড়ে ,
আমার হারাল একতারা ।
কে নিল গো টেনে ,
আমায় পাঠশালাতে এনে ,
আমার এল গুরুমশায় ।
মন সদা যার চলে
যত ঘরছাড়াদের দলে
তারে ঘরে কেন বসায় ?
কও তো আমায় ভাই ,
তোমার গুরুমশায় নাই ?
আমি যখন দেখি ভেবে
বুঝতে পারি খাঁটি ,
তোমার বুকের একতারাটি ,
তোমায় ঐ তো পড়া দেবে ।
তোমার কানে কানে
ওরই গুনগুনানি গানে
তোমায় কোন্ কথা যে কয় !
সব কি তুমি বোঝ ?
তারই মানে যেন খোঁজ
কেবল ফিরে ভুবনময় ।
ওরই কাছে বুঝি
আছে তোমার নাচের পুঁজি ,
তোমার খেপা পায়ের ছুটি ?
ওরই সুরের বোলে
তোমার গলার মালা দোলে
তোমার দোলে মাথার ঝুঁটি ।
মন যে আমার পালায়
তোমার একতারা - পাঠশালায় ,
আমায় ভুলিয়ে দিতে পার ?
নেবে আমায় সাথে ?
এ - সব পণ্ডিতেরই হাতে
আমায় কেন সবাই মার ?
ভুলিয়ে দিয়ে পড়া
আমায় শেখাও সুরে - গড়া
তোমার তালা - ভাঙার পাঠ ।
আর কিছু না চাই ,
যেন আকাশখানা পাই ,
আর পালিয়ে যাবার মাঠ ।
দূরে কেন আছ ?
দ্বারের আগল ধরে নাচো ,
বাউল আমারই এইখানে ।
সমস্ত দিন ধ ' রে
যেন মাতন ওঠে ভ ' রে
তোমার ভাঙন - লাগা গানে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
টেরিটি বাজারে তার
সন্ধান পেনু–
গোরা বোষ্টমবাবা,
নাম নিল বেণু।
শুদ্ধ নিয়ম-মতে
মুরগিরে পালিয়া,
গঙ্গাজলের যোগে
রাঁধে তার কালিয়া–
মুখে জল আসে তার
চরে যবে ধেনু।
বড়ি ক’রে কৌটায়
বেচে পদরেণু। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি -
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না। জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় -
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না। না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।বোলপুর, ১১ ভাদ্র ১৩১৬
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ২৩
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
তিনকড়ি। তোল্পাড়িয়ে উঠল পাড়া,
তবু কর্তা দেন না সাড়া! জাগুন শিগ্গির জাগুন্।
কর্তা। এলারামের ঘড়িটা যে
চুপ রয়েছে, কই সে বাজে–
তিনকড়ি। ঘড়ি পরে বাজবে, এখন ঘরে লাগল আগুন।
কর্তা। অসময়ে জাগলে পরে
ভীষণ আমার মাথা ধরে–
তিনকড়ি। জানলাটা ঐ উঠল জ্বলে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ভাগুন।
কর্তা। বড্ড জ্বালায় তিনকড়িটা–
তিনকড়ি। জ্বলে যে ছাই হল ভিটা,
ফুটপাথে ঐ বাকি ঘুমটা শেষ করতে লাগুন। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ব্যঙ্গাত্মক
|
স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ —
অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ।
শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাদঁরে
উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে —
একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় ,
চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় ।
সহসা মিলালো তারা , এল এক বেদে,
‘পাখি উড়ে গেছে ‘ ব‘লে মরে কেঁদে কেঁদে।
সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে ,
ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচু এক দাঁড়ে।
নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়থুড়ি
হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি।
রাজা বলে ‘কী আপদ ‘ কেহ নাহি ছাড়ে—
পা দুটা তুলিতে চাহে , তুলিতে না পারে ।
পাখির মত রাজা করে ঝটপট্
বেদে কানে কানে বলে —- হিং টিং ছট্।
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান।।হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয় –সাত
চোখে কারো নিদ্রা নাই, পেটে নাই ভাত।
শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির
রাজ্যসুদ্ধ বালকবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির ।
ছেলেরা ভুলেছে খেলা, পন্ডিতেরা পাঠ,
মেয়েরা করেছে চুপ এতই বিভ্রাট।
সারি সারি বসে গেছে, কথা নাহি মুখে,
চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে ।
ভুঁইফোঁড় তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে,
সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে।
মাঝে মঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট
হঠাৎ ফুকারি উঠে-হিং টিং ছট্।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।চারি দিক হতে এল পন্ডিতের দল—
অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল।
উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস
কালিদাস কবীন্দ্রের ভাগিনেয় বংশ।
মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা,
ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা।
বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত
বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ- সমেত।
কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি, কেহ-বা পুরাণ,
কেহ ব্যাকারণ দেখে, কেহ অভিধান ।
কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ,
বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ।
চুপ করে বসে থাকে, বিষম সংকট,
থেকে থেকে হেঁকে ওঠে -হিং টিং ছট্।
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ,
ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পন্ডিত সমাজ–
তাহাদের ডেকে আন যে যেখানে আছে,
অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে।‘
কটা-চুল নীলচক্ষু কপিশকপোল
যবন পন্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল ॥
গায়ে কলো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি-
গ্রীষ্ম তাপে উষ্মা বাড়ে, ভারি উগ্রমূর্তি।
ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয়,
‘সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময়—-
কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্পট্।‘
সভাসুদ্ধ বলি উঠে - হিং টিং ছট্।
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান ।।
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে,
আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে ।
কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান ,
যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান ।
অর্থ চাই? রাজ কোষে আছে ভূরি ভূরি –
রাজ স্বপ্নে অর্থ নাই যত মাথা খুড়ি ।
নাই অর্থ, কিন্তু তবু কহি অকপট
শুনিতে কী মিষ্ট আহা –হিং টিং ছট্।’
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুন্যবান।।শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্-ধিক ,
কোথাকার গন্ডমূর্খ পাষন্ড নাস্তিক!
স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন মাত্র মস্তিষ্ক বিকার
এ কথা কেমন করে করিব স্বীকার !
জগৎ বিখ্যাত মোরা ‘ধর্মপ্রাণ‘ জাতি–
স্বপ্ন উড়াইয়ে দিবে! দুপুরে ডাকাতি!
হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখে,
‘গবুচন্দ্র, এদের উচিত শিক্ষা হোক ।
হেঁটোয় কন্টক দাও , উপরে কন্টক,
ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বন্টক‘।
সতেরো মিনিট—কাল না হইতে শেষ
ম্লেচ্ছ পন্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ।
সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে,
ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে।
পন্ডিতেরা মুখচক্ষু করিয়া বিকট
পুনর্বার উচ্চারিল —- হিং টিং ছট্
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা
যবন পন্ডিতদের গুরু মারা চেলা।
নগ্নশির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে—-
কাছা কোঁচা শতবার খ‘সে খ‘সে পড়ে।
অস্তিত্ব আছে না আছে , ক্ষীণখর্ব দেহ,
বাক্য যবে বহিরায় না থাকে সন্দেহ।
এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়
দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময়।
না জানে অভিবাদন, না পুছে কুশল ,
পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যতমুষল।
সগর্বে জিজ্ঞাসা করে, কী লয়ে বিচার!
শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই- চার,
ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট্পালট।‘
সমস্বরে কহে সবে –হিং টিং ছট্
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।স্বপ্ন কথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া ,
‘নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিস্কার—
বহু পুরাতন ভাব, নব আবিস্কার ।
ত্র্যম্বকের ত্রিয়ন ত্রিকাল ত্রিগুন
শক্তিভেদে ব্যাক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ।
বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।
আকর্ষন বিকর্ষন পুরুষ প্রকৃতি।
আণব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভুদ।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট,
সংক্ষেপে বলিতে গেলে—হিং টিং ছট্
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।‘ সাধু সাধু সাধু ‘ রবে কাঁপে চারি ধার–
সবে বলে , ‘পরিস্কার, অতি পরিস্কার!‘
দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল,
শন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল।
হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ,
আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ
পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে—
ভারে তার মাথা টুকৃ পড়ে বুঝি ছিড়ে।
বহু দিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে,
হাবুডুবু হবুরাজ্য নড়িচড়ি ওঠে।
ছেলেরা ধরিল খেলা, বৃদ্ধেরা তামুক-
এক দন্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ।
দেশ-জোড়া মাথা-ধরা ছেড়ে গেল চট্,
সবাই বুঝিয়া গেল-হিং টিং ছট্
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।।যে শুনিবে এই স্বপ্ন মঙ্গলের কথা
সর্বভ্রম ঘুচে যবে, নহিবে অন্যথা।
বিশ্বে কভূ বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে,
সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে।
যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে,
এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে ।
সবাই সরল ভাবে দেখিবে যা-কিছু
সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু।
এসো ভাই, তোল হাই, শুয়ে পড়ো চিত,
অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত—
জগতে সকলেই মিথ্যা, সব মায়াময়,
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়।
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।শান্তিনিকেতন
১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯
সোনার তরী (কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়--
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়--
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥(রচনাকাল: 1885)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি
তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে, ফুটে না।
কখন বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে
সহসা সরমে বাধে, মন উঠে উঠে না।
অভিমানে যাই দূরে, কথা তার নাহি ফুরে,
চরণ বারণ-তরে উঠে উঠে, উঠে না।
কাতর নিশ্বাস ফেলি আকুল নয়ন মেলি
চেয়ে থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না।
যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি
চাহি দেখে, দেখি দেখি সাধ যেন মিটে না।
সহসা উঠিলে জাগি, তখন কিসের লাগি
মরমেতে ম'রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না!
লাজময়ি তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে
প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু ছুটে না!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝল্কানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন্ সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেন্ড্রন্ গুচ্ছ।নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,
নাই রে ঘরের লালনললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ কিরণে দীপ্ত। বাঙ্গালোর, আষাঢ়, ১৩৩৫
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি
চরিতার্থ হোক আজি, মরণের প্রসাদবহ্নিতে
কামনার আবর্জনা যত, ক্ষুধিত অহমিকার
উঞ্ছবৃত্তি-সঞ্চিত জঞ্জালরাশি দগ্ধ হয়ে গিয়ে
ধন্য হোক আলোকের দানে, এ মর্ত্যের প্রান্ত-পথ
দীপ্ত ক’রে দিক, অবশেষে নিঃশেষে মিলিয়া যাক
পূর্ব সমুদ্রের পারে অপূর্ব উদয়াচল চূড়ে
অরুণ কিরণ তলে একদিন অমর্ত্য প্রভাতে। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মৃত্যু দিয়ে যে প্রাণের
মূল্য দিতে হয়
সে প্রাণ অমৃতলোকে
মৃত্যু করে জয়। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
উত্তরকূট পার্বত্য প্রদেশ। সেখানকার উত্তরভৈরব-মন্দিরে যাইবার পথ। দূরে আকাশে একটা অভ্রভেদী লৌহযন্ত্রের মাথাটা দেখা যাইতেছে এবং তাহার অপরদিকে ভৈরবমন্দিরচূড়ার ত্রিশূল। পথের পার্শ্বে আমবাগানে রাজা রণজিতের শিবির। আজ অমাবস্যায় ভৈরবের মন্দিরে আরতি, সেখানে রাজা পদব্রজে যাইবেন, পথে শিবিরে বিশ্রাম করিতেছেন। তাঁহার সভার যন্ত্ররাজ বিভূতি বহুবৎসরের চেষ্টায় লৌহযন্ত্রের বাঁধ তুলিয়া মুক্তধারা ঝরনাকে বাঁধিয়াছেন। এই অসামান্য কীর্তিকে পুরস্কৃত করিবার উপলক্ষ্যে উত্তরকূটের সমস্ত লোক ভৈরব-মন্দির-প্রাঙ্গণে উৎসব করিতে চলিয়াছে। ভৈরব-মন্ত্রে দীক্ষিত সন্ন্যাসিদল সমস্তদিন স্তবগান করিয়া বেড়াইতেছে। তাহাদের কাহারও হাতে ধূপাধারে ধূপ জ্বলিতেছে, কাহারও হাতে শঙ্খ, কাহারও ঘন্টা। গানের মাঝে মাঝে তালে তালে ঘন্টা বাজিতেছে।গানজয় ভৈরব, জয় শংকর,
জয় জয় জয় প্রলয়ংকর,
শংকর শংকর।
জয় সংশয়ভেদন,
জয় বন্ধন-ছেদন,
জয় সংকট-সংহর
শংকর শংকর।[সন্ন্যাসিদল গাহিতে গাহিতে প্রস্থান করিল ]পূজার নৈবেদ্য লইয়া একজন বিদেশী পথিকের প্রবেশ উত্তরকূটের নাগরিককে সে প্রশ্ন করিলপরবর্তী অংশ পড়ুন উত্তরকূট পার্বত্য প্রদেশ। সেখানকার উত্তরভৈরব-মন্দিরে যাইবার পথ। দূরে আকাশে একটা অভ্রভেদী লৌহযন্ত্রের মাথাটা দেখা যাইতেছে এবং তাহার অপরদিকে ভৈরবমন্দিরচূড়ার ত্রিশূল। পথের পার্শ্বে আমবাগানে রাজা রণজিতের শিবির। আজ অমাবস্যায় ভৈরবের মন্দিরে আরতি, সেখানে রাজা পদব্রজে যাইবেন, পথে শিবিরে বিশ্রাম করিতেছেন। তাঁহার সভার যন্ত্ররাজ বিভূতি বহুবৎসরের চেষ্টায় লৌহযন্ত্রের বাঁধ তুলিয়া মুক্তধারা ঝরনাকে বাঁধিয়াছেন। এই অসামান্য কীর্তিকে পুরস্কৃত করিবার উপলক্ষ্যে উত্তরকূটের সমস্ত লোক ভৈরব-মন্দির-প্রাঙ্গণে উৎসব করিতে চলিয়াছে। ভৈরব-মন্ত্রে দীক্ষিত সন্ন্যাসিদল সমস্তদিন স্তবগান করিয়া বেড়াইতেছে। তাহাদের কাহারও হাতে ধূপাধারে ধূপ জ্বলিতেছে, কাহারও হাতে শঙ্খ, কাহারও ঘন্টা। গানের মাঝে মাঝে তালে তালে ঘন্টা বাজিতেছে।গানজয় ভৈরব, জয় শংকর,
জয় জয় জয় প্রলয়ংকর,
শংকর শংকর।
জয় সংশয়ভেদন,
জয় বন্ধন-ছেদন,
জয় সংকট-সংহর
শংকর শংকর।[সন্ন্যাসিদল গাহিতে গাহিতে প্রস্থান করিল ]পূজার নৈবেদ্য লইয়া একজন বিদেশী পথিকের প্রবেশ উত্তরকূটের নাগরিককে সে প্রশ্ন করিলপরবর্তী অংশ পড়ুন
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
শূন্য ঝুলি নিয়ে হায়
ভিক্ষু মিছে ফেরে,
আপনারে দেয় যদি
পায় সকলেরে।
(স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বিশ্বজগৎ যখন করে কাজ
স্পর্ধা ক'রে পরে ছুটির সাজ।
আকাশে তার আলোর ঘোড়া চলে,
কৃতিত্বেরে লুকিয়ে রাখে পরিহাসের ছলে।
বনের তলে গাছে গাছে শ্যামল রূপের মেলা,
ফুলে ফলে নানান্ রঙে নিত্য নতুন খেলা।
বাহির হতে কে জানতে পায়, শান্ত আকাশতলে
প্রাণ বাঁচাবার কঠিন কর্মে নিত্য লড়াই চলে।
চেষ্টা যখন নগ্ন হয়ে শাখায় পড়ে ধরা,
তখন খেলার রূপ চলে যায়, তখন আসে জরা।
বিলাসী নয় মেঘগুলো তো জলের ভারে ভরা,
চেহারা তার বিলাসিতার রঙের ভূষণ পরা।
বাইরে ওরা বুড়োমিকে দেয় না তো প্রশ্রয়--
অন্তরে তাই চিরন্তনের বজ্রমন্দ্র রয়।
জল-ঝরানো ছেলেখেলা যেমনি বন্ধ করে
ফ্যাকাশে হয় চেহারা তার, বয়স তাকে ধরে।
দেহের মাঝে হাজার কাজে বহে প্রাণের বায়ু--
পালের তরীর মতন যেন ছুটিয়ে চলে আয়ু,
বুকের মধ্যে জাগায় নাচন, কণ্ঠে লাগায় সুর,
সকল অঙ্গ অকারণে উৎসাহে ভরপুর।
রক্তে যখন ফুরোবে ওর খেলার নেশা খোঁজা
তখনি কাজ অচল হবে, বয়স হবে বোঝা।
ওগো তুমি কী করছ, ভাই, স্তব্ধ সারাক্ষণ--
বুদ্ধি তোমার আড়ষ্ট যে, ঝিমিয়ে-পড়া মন।
নবীন বয়স যেই পেরোল খেলাঘরের দ্বারে
মরচে-পড়া লাগল তালা, বন্ধ একেবারে।
ভালোমন্দ বিচারগুলো খোঁটায় যেন পোঁতা।
আপন মনের তলায় তুমি তলিয়ে গেলে কোথা।
চলার পথে আগল দিয়ে বসে আছ স্থির--
বাইরে এসো, বাইরে এসো, পরমগম্ভীর।
কেবলই কি প্রবীণ তুমি, নবীন নও কি তাও।
দিনে দিনে ছি ছি কেবল বুড়ো হয়েই যাও।
আশি বছর বয়স হবে ওই যে পিপুলগাছ,
এ আশ্বিনের রোদ্দুরে ওর দেখলে বিপুল নাচ?
পাতায় পাতায় আবোল-তাবোল, শাখায় দোলাদুলি,
পান্থ হাওয়ার সঙ্গে ও চায় করতে কোলাকুলি।
ওগো প্রবীণ, চলো এবার সকল কাজের শেষে
নবীন হাসি মুখে নিয়ে চরম খেলার বেশে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
কেন গো এমন স্বরে বাজে তব বাঁশি ,
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া ,
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি
পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া !
কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায় ,
ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে ,
হায় যদি এত লজ্জা কথায় কথায় ,
হায় যদি এত শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে !
কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল ,
কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া ,
আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল —
এরি তরে এত তৃষ্ণা , এ কাহার মায়া !
মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা ,
খেলা যদি , কেন হেন মর্মভেদী খেলা ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
শেষ বসন্তরাত্রে
যৌবনরস রিক্ত করিনু
বিরহবেদনপাত্রে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তব দক্ষিণ হাতের পরশ
কর নি সমর্পন।
লেকে আর মেছে তব আলো ছায়া
ভাবনার প্রাঙ্গণে
খনে খনে আলিপন।বৈশাখে কৃশ নদী
পূর্ণ স্রোতের প্রসাদ না দিল যদি
শুধু কুণ্ঠিত বিশীর্ণ ধারা
তীরের প্রান্তে
জাগালো পিয়াসী মন।যতটুকু পাই ভীরু বাসনার
অঞ্জলিতে
নাই বা উচ্ছলিল,
সারা দিবসের দৈন্যের শেসে
সঞ্চয় সে যে
সারা জীবনের স্বপ্নের আয়োজন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
লেজ নড়ে, ছায়া তারি নড়িছে মুকুরে
কোনোমতে সেটা সহ্য করে না কুকুরে।
দাস যবে মনিবেরে দোলায় চামর
কুকুর চটিয়া ভাবে, এ কোন্ পামর?
গাছ যদি নড়ে ওঠে, জলে ওঠে ঢেউ,
কুকুর বিষম রাগে করে ঘেউ-ঘেউ।
সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে
ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারি প্রভু-কোলে।
মনিবের পাতে ঝোল খাবে চুকুচুকু,
বিশ্বে শুধু নড়িবেক তারি লেজটুকু। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
রান্নার সব ঠিক,
পেয়েছি তো নুনটা–
অল্প অভাব আছে,
পাইনি বেগুনটা।
পরিবেষণের তরে
আছি মোরা সব ভাই,
যাদের আসার কথা
অনাগত সব্বাই।
পান পেলে পুরো হয়,
জুটিয়েছি চুনটা–
একটু-আধটু বাকি,
নাই তাহে কুণ্ঠা। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিনাটিকা
|
(কাব্যনাট্য)কর্ণ। পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার
বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার
অধিরথসূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত
সেই আমি-- কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ!কুন্তী। বৎস, তোর জীবনের প্রথম প্রভাতে
পরিচয় করায়েছি তোরে বিশ্ব-সাথে
সেই আমি, আসিয়াছি ছাড়ি সর্ব লাজ
তোরে দিতে আপনার পরিচয় আজ।কর্ণ। দেবী, তব নতনেত্রকিরণসম্পাতে
চিত্ত বিগলিত মোর, সূর্যকরঘাতে
শৈলতুষারের মতো। তব কণ্ঠস্বর
যেন পূর্বজন্ম হতে পশি কর্ণ-'পর
জাগাইছে অপূর্ব বেদনা। কহো মোরে
জন্ম মোর বাঁধা আছে কী রহস্য-ডোরে
তোমা সাথে হে অপরিচিতা!কুন্তী। ধৈর্য ধর্,
ওরে বৎস, ক্ষণকাল। দেব দিবাকর
আগে যাক অস্তাচলে। সন্ধ্যার তিমির
আসুক নিবিড় হয়ে।-- কহি তোরে বীর,
কুন্তি আমি।কর্ণ। তুমি কুন্তী! অর্জুনজননী!
কুন্তী। অর্জুনজননী বটে! তাই মনে গণি
দ্বেষ করিয়ো না বৎস। আজো মনে পড়ে
অস্ত্রপরীক্ষার দিন হস্তিনানগরে
তুমি ধীরে প্রবেশিলে তরুণকুমার
রঙ্গস্থলে, নক্ষত্রখচিত পূর্বাশার
প্রান্তদেশে নবোদিত অরুণের মতো।
যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত
তার মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী
অতৃপ্ত স্নেহক্ষুধার সহস্র নাগিনী
জাগায়ে জর্জর বক্ষে-- কাহার নয়ন
তোমার সর্বাঙ্গে দিল আশিস্-চুম্বন।
অর্জুনজননী সে যে। যবে কৃপ আসি
তোমারে পিতার নাম শুধালেন হাসি,
কহিলেন "রাজকুলে জন্ম নহে যার
অর্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার'--
আরক্ত আনত মুখে না রহিল বাণী,
দাঁড়ায়ে রহিলে, সেই লজ্জা-আভাখানি
দহিল যাহার বক্ষ অগ্নিসম তেজে
কে সে অভাগিনী। অর্জুনজননী সে যে।
পুত্র দুর্যোধন ধন্য, তখনি তোমারে
অঙ্গরাজ্যে কৈল অভিষেক। ধন্য তারে।
মোর দুই নেত্র হতে অশ্রুবারিরাশি
উদ্দেশে তোমারি শিরে উচ্ছ্বসিল আসি
অভিষেক-সাথে। হেনকালে করি পথ
রঙ্গমাঝে পশিলেন সূত অধিরথ
আনন্দবিহ্বল। তখনি সে রাজসাজে
চারি দিকে কুতূহলী জনতার মাঝে
অভিষেকসিক্ত শির লুটায়ে চরণে
সূতবৃদ্ধে প্রণমিলে পিতৃসম্ভাষণে।
ক্রূর হাস্যে পাণ্ডবের বন্ধুগণ সবে
ধিক্কারিল; সেইক্ষণে পরম গরবে
বীর বলি যে তোমারে ওগো বীরমণি
আশিসিল, আমি সেই অর্জুনজননী।কর্ণ। প্রণমি তোমারে আর্যে। রাজমাতা তুমি,
কেন হেথা একাকিনী। এ যে রণভূমি,
আমি কুরুসেনাপতি।কুন্তী। পুত্র, ভিক্ষা আছে--
বিফল না ফিরি যেন।কর্ণ। ভিক্ষা, মোর কাছে!
আপন পৌরুষ ছাড়া, ধর্ম ছাড়া আর
যাহা আজ্ঞা কর দিব চরণে তোমার।কুন্তী। এসেছি তোমারে নিতে।
কর্ণ। কোথা লবে মোরে!
কুন্তী। তৃষিত বক্ষের মাঝে-- লব মাতৃক্রোড়ে।
কর্ণ। পঞ্চপুত্রে ধন্য তুমি, তুমি ভাগ্যবতী,
আমি কুলশীলহীন ক্ষুদ্র নরপতি--
মোরে কোথা দিবে স্থান।
কুন্তী। সর্ব-উচ্চভাগে
তোমারে বসাব মোর সর্বপুত্র-আগে
জ্যেষ্ঠ পুত্র তুমি।
কর্ণ। কোন্ অধিকার-মদে
প্রবেশ করিব সেথা। সাম্রাজ্যসম্পদে
বঞ্চিত হয়েছে যারা মাতৃস্নেহধনে
তাহাদের পূর্ণ অংশ খণ্ডিব কেমনে
কহো মোরে। দ্যূতপণে না হয় বিক্রয়,
বাহুবলে নাহি হারে মাতার হৃদয়--
সে যে বিধাতার দান।
কুন্তী। পুত্র মোর, ওরে,
বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে
এসেছিলি একদিন-- সেই অধিকারে
আয় ফিরে সগৌরবে, আয় নির্বিচারে_
সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম
লহো আপনার স্থান।কর্ণ। শুনি স্বপ্নসম,
হে দেবী, তোমার বাণী। হেরো, অন্ধকার
ব্যাপিয়াছে দিগ্বিদিকে, লুপ্ত চারি ধার--
শব্দহীনা ভাগীরথী। গেছ মোরে লয়ে
কোন্ মায়াচ্ছন্ন লোকে, বিস্মৃত আলয়ে,
চেতনাপ্রত্যুষে। পুরাতন সত্যসম
তব বাণী স্পর্শিতেছে মুগ্ধচিত্ত মম।
অস্ফুট শৈশবকাল যেন রে আমার,
যেন মোর জননীর গর্ভের আঁধার
আমারে ঘেরিছে আজি। রাজমাতঃ অয়ি,
সত্য হোক, স্বপ্ন হোক, এসো স্নেহময়ী
তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে
রাখো ক্ষণকাল। শুনিয়াছি লোকমুখে
জননীর পরিত্যক্ত আমি। কতবার
হেরেছি নিশীথস্বপ্নে জননী আমার
এসেছেন ধীরে ধীরে দেখিতে আমায়,
কাঁদিয়া কহেছি তাঁরে কাতর ব্যথায়
"জননী, গুণ্ঠন খোলো, দেখি তব মুখ'--
অমনি মিলায় মূর্তি তৃষার্ত উৎসুক
স্বপনেরে ছিন্ন করি। সেই স্বপ্ন আজি
এসেছে কি পাণ্ডবজননীরূপে সাজি
সন্ধ্যাকালে, রণক্ষেত্রে, ভাগীরথীতীরে।
হেরো দেবী, পরপারে পাণ্ডবশিবিরে
জ্বলিয়াছে দীপালোক, এ পারে অদূরে
কৌরবের মন্দুরায় লক্ষ অশ্বখুরে
খর শব্দ উঠিছে বাজিয়া। কালি প্রাতে
আরম্ভ হইবে মহারণ। আজ রাতে
অর্জুনজননীকণ্ঠে কেন শুনিলাম
আমার মাতার স্নেহস্বর। মোর নাম
তাঁর মুখে কেন হেন মধুর সংগীতে
উঠিল বাজিয়া-- চিত্ত মোর আচম্বিতে
পঞ্চপাণ্ডবের পানে "ভাই' ব'লে ধায়।
কুন্তী। তবে চলে আয় বৎস, তবে চলে আয়।
কর্ণ। যাব মাতঃ, চলে যাব, কিছু শুধাব না--
না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা।
দেবী, তুমি মোর মাতা! তোমার আহ্বানে
অন্তরাত্মা জাগিয়াছে-- নাহি বাজে কানে
যুদ্ধভেরী, জয়শঙ্খ-- মিথ্যা মনে হয়
রণহিংসা, বীরখ্যাতি, জয়পরাজয়।
কোথা যাব, লয়ে চলো।
কুন্তী। ওই পরপারে
যেথা জ্বলিতেছে দীপ স্তব্ধ স্কন্ধাবারে
পাণ্ডুর বালুকাতটে।
কর্ণ। হোথা মাতৃহারা
মা পাইবে চিরদিন! হোথা ধ্রুবতারা
চিররাত্রি রবে জাগি সুন্দর উদার
তোমার নয়নে! দেবী, কহো আরবার
আমি পুত্র তব।কুন্তী। পুত্র মোর!
কর্ণ। কেন তবে
আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে
কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন
অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে। কেন চিরদিন
ভাসাইয়া দিলে মোরে অবজ্ঞার স্রোতে--
কেন দিলে নির্বাসন ভ্রাতৃকুল হতে।
রাখিলে বিচ্ছিন্ন করি অর্জুনে আমারে--
তাই শিশুকাল হতে টানিছে দোঁহারে
নিগূঢ় অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে
দুর্নিবার আকর্ষণে। মাতঃ, নিরুত্তর?
লজ্জা তব ভেদ করি অন্ধকার স্তর
পরশ করিছে মোরে সর্বাঙ্গে নীরবে--
মুদিয়া দিতেছে চক্ষু। থাক্, থাক্ তবে--
কহিয়ো না কেন তুমি ত্যজিলে আমারে।
বিধির প্রথম দান এ বিশ্বসংসারে
মাতৃস্নেহ, কেন সেই দেবতার ধন
আপন সন্তান হতে করিলে হরণ
সে কথার দিয়ো না উত্তর। কহো মোরে
আজি কেন ফিরাইতে আসিয়াছ ক্রোড়ে।
কুন্তী। হে বৎস, ভর্ৎসনা তোর শতবজ্রসম
বিদীর্ণ করিয়া দিক এ হৃদয় মম
শত খণ্ড করি। ত্যাগ করেছিনু তোরে
সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে ক'রে
তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন--তবু হায়,
তোরি লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মোর ধায়,
খুঁজিয়া বেড়ায় তোরে। বঞ্চিত যে ছেলে
তারি তরে চিত্ত মোর দীপ্ত দীপ জ্বেলে
আপনারে দগ্ধ করি করিছে আরতি
বিশ্বদেবতার। আমি আজি ভাগ্যবতী,
পেয়েছি তোমার দেখা। যবে মুখে তোর
একটি ফুটে নি বাণী তখন কঠোর
অপরাধ করিয়াছি-- বৎস, সেই মুখে
ক্ষমা কর্ কুমাতায়। সেই ক্ষমা বুকে
ভর্ৎসনার চেয়ে তেজে জ্বালুক অনল,
পাপ দগ্ধ ক'রে মোরে করুক নির্মল।
কর্ণ। মাতঃ, দেহো পদধূলি, দেহো পদধূলি--
লহো অশ্রু মোর।
কুন্তী। তোরে লব বক্ষে তুলি
সে সুখ-আশায় পুত্র আসি নাই দ্বারে।
ফিরাতে এসেছি তোরে নিজ অধিকারে।
সূতপুত্র নহ তুমি, রাজার সন্তান--
দূর করি দিয়া বৎস, সর্ব অপমান
এসো চলি যেথা আছে তব পঞ্চ ভ্রাতা।
কর্ণ। মাতঃ, সূতপুত্র আমি, রাধা মোর মাতা,
তার চেয়ে নাহি মোর অধিক গৌরব।
পাণ্ডব পাণ্ডব থাক্, কৌরব কৌরব--
ঈর্ষা নাহি করি কারে।
কুন্তী। রাজ্য আপনার
বাহুবলে করি লহো, হে বৎস, উদ্ধার।
দুলাবেন ধবল ব্যজন যুধিষ্ঠির,
ভীম ধরিবেন ছত্র, ধনঞ্জয় বীর
সারথি হবেন রথে, ধৌম্য পুরোহিত
গাহিবেন বেদমন্ত্র-- তুমি শত্রুজিৎ
অখণ্ড প্রতাপে রবে বান্ধবের সনে
নিঃসপত্ন রাজ্যমাঝে রত্নসিংহাসনে।
কর্ণ। সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহ পাশ--
তাহারে দিতেছ, মাতঃ, রাজ্যের আশ্বাস।
একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত
সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত।
মাতা মোর, ভ্রাতা মোর, মোর রাজকুল
এক মুহূর্তেই মাতঃ,করেছ নির্মূল
মোর জন্মক্ষণে। সূতজননীরে ছলি
আজ যদি রাজজননীরে মাতা বলি,
কুরুপতি কাছে বদ্ধ আছি যে বন্ধনে
ছিন্ন ক'রে ধাই যদি রাজসিংহাসনে,
তবে ধিক্ মোরে।
কুন্তী। বীর তুমি, পুত্র মোর,
ধন্য তুমি। হায় ধর্ম, এ কী সুকঠোর
দণ্ড তব। সেইদিন কে জানিত হায়,
ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়
সে কখন বলবীর্য লভি কোথা হতে
ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে,
আপনার জননীর কোলের সন্তানে
আপন নির্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে।
এ কী অভিশাপ!
কর্ণ। মাতঃ, করিয়ো না ভয়।
কহিলাম, পাণ্ডবের হইবে বিজয়।
আজি এই রজনীর তিমিরফলকে
প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলোকে
ঘোর যুদ্ধ-ফল। এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে
অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে
জয়হীন চেষ্টার সংগীত, আশাহীন
কর্মের উদ্যম-- হেরিতেছি শান্তিময়
শূন্য পরিণাম। যে পক্ষের পরাজয়
সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান।
জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান--
আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে।
জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে
নামহীন, গৃহহীন-- আজিও তেমনি
আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো জননী
দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব-'পরে।
শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ননীলাল বাবু যাবে লঙ্কা;
শ্যালা শুনে এল, তার
ডাক-নাম টঙ্কা।বলে, “হেন উপদেশ তোমারে দিয়েছে সে কে,
আজও আছে রাক্ষস, হঠাৎ চেহারা দেখে
রামের সেবক ব’লে করে যদি শঙ্কা।আকৃতি প্রকৃতি তব হতে পারে জম্কালো,
দিদি যা বলুন, মুখ নয় কভু কম কালো —
খামকা তাদের ভয় লাগিবে আচমকা।
হয়তো বাজাবে রণডঙ্কা।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বিবাহের পঞ্চম বরষে
যৌবনের নিবিড় পরশে
গোপন রহস্যভরে
পরিণত রসপুঞ্জ অন্তরে অন্তরে
পুষ্পের মঞ্জরি হতে ফলের স্তবকে
বৃন্ত হতে ত্বকে
সুবর্ণবিভায় ব্যাপ্ত করে।
সংবৃত সুমন্দ গন্ধ অতিথিরে ডেকে আনে ঘরে
সংযত শোভায়
পথিকের নয়ন লোভায়।
পাঁচ বৎসরের ফুল্ল বসন্তের মাধবীমঞ্জরি
মিলনের স্বর্ণপাত্রে সুধা দিল ভরি;
মধু সঞ্চয়ের পর
মধুপেরে করিল মুখর।
শান্ত আনন্দের আমন্ত্রণে
আসন পাতিয়া দিল রবাহূত অনাহূত জনে।বিবাহের প্রথম বৎসরে
দিকে দিগন্তরে
শাহানায় বেজেছিল বাঁশি,
উঠেছিল কল্লোলিত হাসি,
আজ স্মিতহাস্য ফুটে প্রভাতের মুখে
নিঃশব্দ কৌতুকে।
বাঁশি বাজে কানাড়ায় সুগম্ভীর তানে
সপ্তর্ষির ধ্যানের আহ্বানে!
পাঁচ বৎসরের ফুল্ল বিকশিত সুখস্বপ্নখানি
সংসারের মাঝখানে পূর্ণতার স্বর্গ দিল আনি।
বসন্তপঞ্চম রাগ আরম্ভেতে উঠেছিল বাজি,
সুরে সুরে তালে তালে পূর্ণ হয়ে উঠিয়াছে আজি,
পুষ্পিত অরণ্যতলে প্রতি পদক্ষেপে
মঞ্জীরে বসন্তরাগ উঠিতেছে কেঁপে। (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আবার এরা ঘিরেছে মোর মন।
আবার চোখে নামে যে আবরণ।
আবার এ যে নানা কথাই জমে,
চিত্ত আমার নানা দিকেই ভ্রমে,
দাহ আবার বেড়ে ওঠে ক্রমে,
আবার এ যে হারাই শ্রীচরণ।তব নীরব বাণী হৃদয়তলে
ডোবে না যেন লোকের কোলাহলে।
সবার মাঝে আমার সাথে থাকো,
আমায় সদা তোমার মাঝে ঢাকো,
নিয়ত মোর চেতনা-‘পরে রাখো
আলোকে-ভরা উদার ত্রিভুবন।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
মাঝে মাঝে বিধাতার ঘটে একি ভুল–
ধান পাকাবার মাসে ফোটে বেলফুল।
হঠাৎ আনাড়ি কবি তুলি হাতে আঁকে ছবি,
অকারণে কাঁচা কাজে পেকে যায় চুল। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যৌবনের প্রান্তসীমায়
জড়িত হয়ে আছে অরুণিমার ম্লান অবশেষ;--
যাক কেটে এর আবেশটুকু;
সুস্পষ্টের মধ্যে জেগে উঠুক
আমার ঘোর-ভাঙা চোখ
স্মৃতিবিস্মৃতির নানা বর্ণে রঞ্জিত
দুঃখসুখের বাষ্পঘনিমা
স'রে যাক সন্ধ্যামেঘের মতো
আপনাকে উপেক্ষা ক'রে।
ঝরে-পড়া ফুলের ঘনগন্ধে আবিষ্ট আমার প্রাণ,
চারদিকে তার স্বপ্ন মৌমাছি
গুন গুন করে বেড়ায়,
কোন্ অলক্ষ্যের সৌরভে।
এই ছায়ার বেড়ায় বদ্ধ দিনগুলো থেকে
বেরিয়ে আসুক মন
শুভ্র আলোকের প্রাঞ্জলতায়।
অনিমেষ দৃষ্টি ভেসে যাক
কথাহীন ব্যথাহীন চিন্তাহীন
সৃষ্টির মহাসাগরে।
যাব লক্ষ্যহীন পথে,
সহজে দেখব সব দেখা,
শুনব সব সুর,
চলন্ত দিনরাত্রির
কলরোলের মাঝখান দিয়ে।
আপনাকে মিলিয়ে নেব
শস্যশেষ প্রান্তরের
সুদূরবিস্তীর্ণ বৈরাগ্যে।
ধ্যানকে নিবিষ্ট করব
ঐ নিস্তব্ধ শালগাছের মধ্যে
যেখানে নিমেষের অন্তরালে
সহস্রবৎসরের প্রাণ নীরবে রয়েছে সমাহিত।
কাক ডাকছে তেঁতুলের ডালে,
চিল মিলিয়ে গেল রৌদ্রপাণ্ডুর সুদূর নীলিমায়।
বিলের জলে বাঁধ বেঁধে
ডিঙি নিয়ে মাছ ধরছে জেলে।
বিলের পরপারে পুরাতন গ্রামের আভাস,
ফিকে রঙের নীলাম্বরের প্রান্তে
বেগনি রঙের আঁচলা।
গাঙচিল উড়ে বেড়াচ্ছে
মাছধরা জালের উপরকার আকাশে।
মাছরাঙা স্তব্ধ বসে আছে বাঁশের খোঁটায়,
তার স্থির ছায়া নিস্তরঙ্গ জলে।
ভিজে বাতাসে শ্যাওলার ঘন স্নিগ্ধগন্ধ।
চারদিক থেকে অস্তিত্বের এই ধারা
নানা শাখায় বইছে দিনেরাত্রে।
অতি পুরাতন প্রাণের বহুদিনের নানা পণ্য নিয়ে
এই সহজ প্রবাহ,--
মানব-ইতিহাসের নূতন নূতন
ভাঙনগড়নের উপর দিয়ে
এর নিত্য যাওয়া আসা।
চঞ্চল বসন্তের অবসানে
আজ আমি অলস মনে
আকণ্ঠ ডুব দেব এই ধারার গভীরে;
এর কলধ্বনি বাজবে আমার বুকের কাছে
আমার রক্তের মৃদুতালের ছন্দে।
এর আলো ছায়ার উপর দিয়ে
ভাসতে ভাসতে চলে যাক আমার চেতনা
চিন্তাহীন তর্কহীন শাস্ত্রহীন
মৃত্যু-মহাসাগরসংগমে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কলরবমুখরিত খ্যাতির প্রাঙ্গণে যে আসন
পাতা হয়েছিল কবে, সেথা হতে উঠে এসো, কবি,
পূজা সাঙ্গ করি দাও চাটুলুব্ধ জনতা-দেবীরে
বচনের অর্ঘ্য বিরচিয়া। দিনের সহস্র কণ্ঠ
ক্ষীণ হয়ে এল; যে প্রহরগুলি ধ্বনি-পণ্যবাহী
নোঙর ফেলেছে তারা সন্ধ্যার নির্জন ঘাটে এসে।
আকাশের আঙিনায় শান্ত যেথা পাখির কাকলী
সুরসভা হতে সেথা নৃত্যপরা অপ্সরকন্যার
বাষ্পে-বোনা চেলাঞ্চল উড়ে পড়ে, দেহ ছড়াইয়া
স্বর্ণোজ্জ্বল বর্ণরশ্মিচ্ছটা। চরম ঐশ্বর্য নিয়ে
অস্তলগনের, শূন্য পূর্ণ করি এল চিত্রভানু,
দিল মোরে করস্পর্শ, প্রসারিল দীপ্ত শিল্পকলাঅন্তরের দেহলিতে, গভীর অদৃশ্যলোক হতে
ইশারা ফুটিয়া পড়ে তুলির রেখায়। আজন্মের
বিচ্ছিন্ন ভাবনা যত, স্রোতের সেঁউলি-সম যারা
নিরর্থক ফিরেছিল অনিশ্চিত হাওয়ায় হাওয়ায় ,
রূপ নিয়ে দেখা দেবে ভাঁটার নদীর প্রান্ত তীরে
অনাদৃত মঞ্জরীর অজানিত আগাছার মতো,—
কেহ শুধাবে না নাম, অধিকারগর্ব নিয়ে তার
ঈর্ষা রহিবে না কারো, অনামিক স্মৃতি-চিহ্ন তারা
খ্যাতিশূন্য অগোচরে র’বে যেন অস্পষ্ট বিস্মৃতি। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ভোতনমোহন স্বপ্ন দেখেন, চড়েছেন চৌঘুড়ি।
মোচার খোলার গাড়িতে তাঁর ব্যাঙ দিয়েছেন জুড়ি।
পথ দেখালো মাছরাঙাটায়, দেখল এসে চিংড়িঘাটায়–
ঝুম্কো ফুলের বোঝাই নিয়ে মোচার খোলা ভাসে।
খোকনবাবু বিষম খুশি খিল্খিলিয়ে হাসে।উত্তরায়ণ, ৫। ৯। ৩৮
(খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
সুদূর প্রবাসে আজি কেন রে কী জানি
কেবল পড়িছে মনে তার হাসিখানি ।
কখন নামিয়া গেল সন্ধ্যার তপন ,
কখন থামিয়া গেল সাগরের বাণী ।
কোথায় ধরার ধারে বিরহবিজন
একটি মাধবীলতা আপন ছায়াতে
দুটি অধরের রাঙা কিশলয় – পাতে
হাসিটি রেখেছে ঢেকে কুঁড়ির মতন !
সারা রাত নয়নের সলিল সিঞ্চিয়া
রেখেছে কাহার তরে যতনে সঞ্চিয়া!
সে হাসিটি কে আসিয়া করিবে চয়ন ,
লুব্ধ এই জগতের সবারে বঞ্চিয়া !
তখন দুখানি হাসি মরিয়া বাঁচিয়া
তুলিবে অমর করি একটি চুম্বন । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই –
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা –
ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে –
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য –
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি –
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ –
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে –
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার – এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ –
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন –
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী – হলে দাসী।।বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি –
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন –
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব –
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।’
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ –
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ‘মারিয়া করিব খুন।’
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’
বাবু কহে হেসে, ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে –
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই –
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা –
ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে –
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য –
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি –
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ –
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে –
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার – এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ –
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন –
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী – হলে দাসী।।বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি –
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন –
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব –
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।’
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ –
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ‘মারিয়া করিব খুন।’
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’
বাবু কহে হেসে, ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে –
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
শেফালি কহিল, আমি ঝরিলাম, তারা!
তারা কহে, আমারো তো হল কাজ সারা—
ভরিলাম রজনীর বিদায়ের ডালি
আকাশের তারা আর বনের শেফালি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
জান না তো নির্ঝরিণী, আসিয়াছ কোথা হতে,
কোথায় যে করিছ প্রয়াণ,
মাতিয়া চলেছ তবু আপন আনন্দে পূর্ণ,
আনন্দ করিছ সবে দান।
বিজন-অরণ্য-ভূমি দেখিছে তোমার খেলা
জুড়াইছে তাহার নয়ান।
মেষ-শাবকের মতো তরুদের ছায়ে ছায়ে
রচিয়াছ খেলিবার স্থান।
গভীর ভাবনা কিছু আসে না তোমার কাছে,
দিনরাত্রি গাও শুধু গান।
বুঝি নরনারী মাঝে এমনি বিমল হিয়া
আছে কেহ তোমারি সমান।
চাহে না চাহে না তারা ধরণীর আড়ম্বর,
সন্তোষে কাটাতে চায় প্রাণ,
নিজের আনন্দ হতে আনন্দ বিতরে তারা
গায় তারা বিশ্বের কল্যাণ।Robert Buchanan
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে
নব বন্ধু নব হর্ষ নব সুখ আশে।
সুন্দরী রমণী কত, দেখিবে গো শত শত
ফেলে গেলে যারে তারে পড়িবে কি মনে?
তব প্রেম প্রিয়তম, অদৃষ্টে নাইকো মম
সে-সব দুরাশা সখা করি না স্বপনে
কাতর হৃদয় শুধু এই ভিক্ষা চায়
ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়।
স্মরিলে এ অভাগীর যাতনার কথা,
যদিও হৃদয়ে লাগে তিলমাত্র ব্যথা,
মরমের আশা এই, থাক্ রুদ্ধ মরমেই
কাজ নাই দুখিনীরে মনে করে আর।
কিন্তু দুঃখ যদি সখা, কখনো গো দেয় দেখা
মরমে জনমে যদি যাতনার ভার,
ও হৃদয় সান্ত্বনার বন্ধু যদি চায়
ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়।Mrs. Amelia Opie
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ভাবে শিশু, বড়ো হলে শুধু যাবে কেনা
বাজার উজাড় করি সমস্ত খেলেনা।
বড়ো হলে খেলা যত ঢেলা বলি মানে,
দুই হাত তুলে চায় ধনজন-পানে।
আরো বড়ো হবে না কি যবে অবহেলে
ধরার খেলার হাট হেসে যাবে ফেলে? (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
সে যে পাশে এসে বসেছিল
তবু জাগি নি।
কী ঘুম তোরে পেয়েছিল
হতভাগিনী।
এসেছিল নীরব রাতে
বীণাখানি ছিল হাতে,
স্বপনমাঝে বাজিয়ে গেল
গভীর রাগিণী। জেগে দেখি দখিন-হাওয়া
পাগল করিয়া
গন্ধ তাহার ভেসে বেড়ায়
আঁধার ভরিয়া।
কেন আমার রজনী যায়–
কাছে পেয়ে কাছে না পায়
কেন গো তার মালার পরশ
বুকে লাগি নি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
এসো , ছেড়ে এসো , সখী , কুসুমশয়ন ।
বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে ।
কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে
আকাশকুসুমবনে স্বপন চয়ন ।
দেখো ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা ,
স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে ।
দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা
দহিবে আঁধার নিদ্রা বিমল অনলে ।
চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে ,
সুখদুঃখ লয়ে সবে গাঁথিছে আলয় —
হাসি – কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে
সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয় ।
সুখরৌদ্রমরীচিকা নহে বাসস্থান ,
মিলায় মিলায় বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খবর পেলেম কল্য,
তাঞ্জামেতে চ’ড়ে রাজা
গাঞ্জামেতে চলল।
সময়টা তার জলদি কাটে;
পৌঁছল যেই হলদিঘাটে
একটা ঘোড়া রইল বাকি,
তিনটে ঘোড়া মরল।
গরানহাটায় পৌঁছে সেটা
মুটের ঘাড়ে চড়ল। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
জ্যোতিষীরা বলে,
সবিতার আত্মদান-যজ্ঞের হোমাগ্নিবেদিতলে
যে জ্যোতি উৎসর্গ হয় মহারুদ্রতপে
এ বিশ্বের মন্দিরমণ্ডপে,
অতিতুচ্ছ অংশ তার ঝরে
পৃথিবীর অতিক্ষুদ্র মৃৎপাত্রের 'পরে।
অবশিষ্ট অমেয় আলোকধারা
পথহারা,
আদিম দিগন্ত হতে
অক্লান্ত চলেছে ধেয়ে নিরুদ্দেশ স্রোতে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছে অপার তিমির-তেপান্তরে
অসংখ্য নক্ষত্র হয়ে রশ্মিপ্লাবী নিরন্ত নির্ঝরে
সর্বত্যাগী অপব্যয়,
আপন সৃষ্টির 'পরে বিধাতার নির্মম অন্যায়।
কিংবা এ কি মহাকাল কল্পকল্পান্তের দিনে রাতে
এক হাতে দান ক'রে ফিরে ফিরে নেয় অন্য হাতে।
সঞ্চয়ে ও অপচয়ে যুগে যুগে কাড়াকাড়ি যেন--
কিন্তু, কেন।
তার পরে চেয়ে দেখি মানুষের চৈতন্যজগতে
ভেসে চলে সুখদুঃখ কল্পনাভাবনা কত পথে।
কোথাও বা জ্ব'লে ওঠে জীবন-উৎসাহ,
কোথাও বা সভ্যতার চিতাবহ্নিদাহ
নিভে আসে নিঃস্বতার ভস্ম-অবশেষে।
নির্ঝর ঝরিছে দেশে দেশে--
লক্ষ্যহীন প্রাণস্রোতে মৃত্যুর গহ্বরে ঢালে মহী
বাসনার বেদনার অজস্র বুদ্বুদপুঞ্জ বহি।
কে তার হিসাব রাখে লিখি।
নিত্য নিত্য এমনি কি
অফুরান আত্মহত্যা মানবসৃষ্টির
নিরন্তর প্রলয়বৃষ্টির
অশ্রান্ত প্লাবনে।
নিরর্থক হরণে ভরণে
মানুষের চিত্ত নিয়ে সারাবেলা
মহাকাল করিতেছে দ্যূতখেলা
বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে যেন--
কিন্তু, কেন।
প্রথম বয়সে কবে ভাবনার কী আঘাত লেগে
এ প্রশ্নই মনে উঠেছিল জেগে--
শুধায়েছি, এ বিশ্বের কোন্ কেন্দ্রস্থলে
মিলিতেছে প্রতি দণ্ডে পলে
অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের উল্লোল গর্জন,
ঝটিকার মন্দ্রস্বন,
দিবসনিশার
বেদনাবীণার তারে চেতনার মিশ্রিত ঝংকার,
পূর্ণ করি ঋতুর উৎসব
জীবনের মরণের নিত্যকলরব,
আলোকের নিঃশব্দ চরণপাত
নিয়ত স্পন্দিত করি দ্যুলোকের অস্তহীন রাত।
কল্পনায় দেখেছিনু, প্রতিধ্বনিমণ্ডল বিরাজে
ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরকন্দর-মাঝে।
সেথা বাঁধে বাসা
চতুর্দিক হতে আসি জগতের পাখা-মেলা ভাষা।
সেথা হতে পুরানো স্মৃতিরে দীর্ণ করি
সৃষ্টির আরম্ভবীজ লয় ভরি ভরি
আপনার পক্ষপুটে ফিরে-চলা যত প্রতিধ্বনি।
অনুভব করেছি তখনি,
বহু যুগযুগান্তের কোন্ এক বাণীধারা
নক্ষত্রে নক্ষত্রে ঠেকি পথহারা
সংহত হয়েছে অবশেষে
মোর মাঝে এসে।
প্রশ্ন মনে আসে আরবার,
আবার কি ছিন্ন হয়ে যাবে সূত্র তার--
রূপহারা গতিবেগ প্রেতের জগতে
চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্য যাত্রাপথে?
উজাড় করিয়া দিবে তার
পান্থের পাথেয়পত্র আপন স্বল্পায়ু বেদনার--
ভোজশেষে উচ্ছিষ্টের ভাঙা ভাণ্ড হেন?
কিন্তু, কেন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
বাদশাহের হুকুম,--
সৈন্যদল নিয়ে এল আফ্রাসায়েব খাঁ, মুজফ্ফর খাঁ,
মহম্মদ আমিন খাঁ,
সঙ্গে এল রাজা গোপাল সিং ভদৌরিয়া,
উদইৎ সিং বুন্দেলা।
গুরুদাসপুর ঘেরাই করল মোগল সেনা।
শিখদল আছে কেল্লার মধ্যে,
বন্দা সিং তাদের সর্দার।
ভিতরে আসে না রসদ,
বাইরে যাবার পথ সব বন্ধ।
থেকে থেকে কামানের গোলা পড়ছে
প্রাকার ডিঙিয়ে--
চারদিকের দিক্সীমা পর্যন্ত
রাত্রির আকাশ মশালের আলোয় রক্তবর্ণ।
ভাণ্ডারে না রইল গম, না রইল যব,
না রইল জোয়ারি;--
জ্বালানি কাঠ গেছে ফুরিয়ে।
কাঁচা মাংস খায় ওরা অসহ্য ক্ষুধায়,
কেউ বা খায় নিজের জঙ্ঘা থেকে মাংস কেটে।
গাছের ছাল, গাছের ডাল গুঁড়ো ক'রে
তাই দিয়ে বানায় রুটি।
নরক-যন্ত্রণায় কাটল আট মাস,
মোগলের হাতে পড়ল
গুরদাসপুর গড়।
মৃত্যুর আসর রক্তে হল আকণ্ঠ পঙ্কিল,
বন্দীরা চীৎকার করে
"ওয়াহি গুরু, ওয়াহি গুরু,"
আর শিখের মাথা স্খলিত হয়ে পড়ে
দিনের পর দিন।
নেহাল সিং বালক;
স্বচ্ছ তরুণ সৌম্যমুখে
অন্তরের দীপ্তি পড়েছে ফুটে।
চোখে যেন স্তব্ধ আছে
সকালবেলার তীর্থযাত্রীর গান।
সুকুমার উজ্জ্বল দেহ,
দেবশিল্পী কুঁদে বের করেছে
বিদ্যুতের বাটালি দিয়ে।
বয়স তার আঠারো কি উনিশ হবে,
শালগাছের চারা,
উঠেছে ঋজু হয়ে,
তবু এখনো
হেলতে পারে দক্ষিণের হাওয়ায়।
প্রাণের অজস্রতা
দেহে মনে রয়েছে
কানায় কানায় ভরা।
বেঁধে আনলে তাকে।
সভার সমস্ত চোখ
ওর মুখে তাকাল বিস্ময়ে করুণায়।
ক্ষণেকের জন্যে
ঘাতকের খড়্গ যেন চায় বিমুখ হতে
এমন সময় রাজধানী থেকে এল দূত,
হাতে সৈয়দ আবদুল্লা খাঁয়ের
স্বাক্ষর-করা মুক্তিপত্র।
যখন খুলে দিলে তার হাতের বন্ধন,
বালক শুধাল, আমার প্রতি কেন এই বিচার?
শুনল, বিধবা মা জানিয়েছে
শিখধর্ম নয় তার ছেলের,
বলেছে, শিখেরা তাকে জোর করে রেখেছিল
বন্দী ক'রে।
ক্ষোভে লজ্জায় রক্তবর্ণ হল
বালকের মুখ।
বলে উঠল, "চাইনে প্রাণ মিথ্যার কৃপায়,
সত্যে আমার শেষ মুক্তি,
আমি শিখ।"
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.