poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান! মানুষের অধিকারে   বঞ্চিত করেছ যারে, সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান ।।মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে । বিধাতার রুদ্ররোষে   দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান । অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান ।।তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে । চরণে দলিত হয়ে   ধুলায় সে যায় বয়ে সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ । অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান ।যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে । অজ্ঞানের অন্ধকারে   আড়ালে ঢাকিছ যারে তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান । অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান ।।শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার, মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার। তবু নত করি আঁখি   দেখিবারে পাও না কি নেমেছে ধুলার তলে হীন পতিতের ভগবান, অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান ।।দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে - অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে। সবারে না যদি ডাকো,   এখনো সরিয়া থাকো, আপনারে বেঁধে রাখো  চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান — মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান ।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
তুমি গো পঞ্চদশী শুক্লা নিশার অভিসারপথে চরম তিথির শশী। স্মিত স্বপ্নের আভাস লেগেছে বিহ্বল তব রাতে। ক্বচিৎ চকিত বিহগকাকলি তব যৌবনে উঠিছে আকুলি নব আষাঢ়ের কেতকীগন্ধ- শিথিলিত নিদ্রাতে।যেন অশ্রুত বনমর্মর তোমার বক্ষে কাঁপে থরথর। অগোচর চেতনার অকারণ বেদনার ছায়া এসে পড়ে মনের দিগন্তে, গোপন অশান্তি উছলিয়া তুলে ছলছল জল কষ্জল-আঁখিপাতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
যাবার সময় হলে জীবনের সব কথা সেরে শেষবাক্যে জয়ধ্বনি দিয়ে যাব মোর অদৃষ্টেরে। বলে যাব, পরমক্ষণের আশীর্বাদ বারবার আনিয়াছে বিস্ময়ের অপূর্ব আস্বাদ। যাহা রুগ্ন, যাহা ভগ্ন, যাহা মগ্ন পঙ্কস্তরতলে আত্মপ্রবঞ্চনাছলে তাহারে করি না অস্বীকার। বলি, বারবার পতন হয়েছে যাত্রাপথে ভগ্ন মনোরথে; বারে বারে পাপ ললাটে লেপিয়া গেছে কলঙ্কের ছাপ; বারবার আত্মপরাভব কত দিয়ে গেছে মেরুদণ্ড করি নত; কদর্যের আক্রমণ ফিরে ফিরে দিগন্ত গ্লানিতে দিল ঘিরে। মানুষের অসম্মান দুর্বিষহ দুখে উঠেছে পুঞ্জিত হয়ে চোখের সম্মুখে, ছুটি নি করিতে প্রতিকার-- চিরলগ্ন আছে প্রাণে ধিক্কার তাহার। অপূর্ণ শক্তির এই বিকৃতির সহস্র লক্ষণ দেখিয়াছি চারি দিকে সারাক্ষণ, চিরন্তন মানবের মহিমারে তবু উপহাস করি নাই কভু। প্রত্যক্ষ দেখেছি যথা দৃষ্টির সম্মুখে মোর হিমাদ্রিরাজের সমগ্রতা, গুহাগহ্বরের যত ভাঙাচোরা রেখাগুলো তারে পারে নি বিদ্রূপ করিবারে-- যত-কিছু খণ্ড নিয়ে অখণ্ডেরে দেখেছি তেমনি, জীবনের শেষবাক্যে আজি তারে দিব জয়ধ্বনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
“শুনব হাতির হাঁচি’ এই ব’লে কেষ্টা নেপালের বনে বনে ফেরে সারা দেশটা। শুঁড়ে সুড়্‌সুড়ি দিতে নিয়ে গেল কঞ্চি, সাত জালা নস্যি ও রেখেছিল সঞ্চি, জল কাদা ভেঙে ভেঙে করেছিল চেষ্টা– হেঁচে দু-হাজার হাঁচি মরে গেল শেষটা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
আমার রাজার বাড়ি কোথায় কেউ জানে না সে তো; সে বাড়ি কি থাকত যদি লোকে জানতে পেত। রুপো দিয়ে দেয়াল গাঁথা, সোনা দিয়ে ছাত, থাকে থাকে সিঁড়ি ওঠে সাদা হাতির দাঁত। সাত মহলা কোঠায় সেথা থাকেন সুয়োরানী, সাত রাজার ধন মানিক – গাঁথা গলার মালাখানি। আমার রাজার বাড়ি কোথায় শোন্‌ মা, কানে কানে— ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে সেইখানে।রাজকন্যা ঘুমোয় কোথা সাত সাগরের পারে, আমি ছাড়া আর কেহ তো পায় না খুঁজে তারে। দু হাতে তার কাঁকন দুটি, দুই কানে দুই দুল, খাটের থেকে মাটির ‘পরে লুটিয়ে পড়ে চুল। ঘুম ভেঙে তার যাবে যখন সোনার কাঠি ছুঁয়ে হাসিতে তার মানিকগুলি পড়বে ঝ’রে ভুঁয়ে। রাজকন্যা ঘুমোয় কোথা শোন্‌ মা, কানে কানে— ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে যেইখানে।তোমরা যখন ঘাটে চল স্নানের বেলা হলে আমি তখন চুপি চুপি যাই সে ছাদে চলে। পাঁচিল বেয়ে ছায়াখানি পড়ে মা, যেই কোণে সেইখানেতে পা ছড়িয়ে বসি আপন মনে। সঙ্গে শুধু নিয়ে আসি মিনি বেড়ালটাকে, সেও জানে নাপিত ভায়া কোন্‌খানেতে থাকে। জানিস নাপিতপাড়া কোথায়? শোন্‌ মা কানে কানে— ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে যেইখানে।   (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
শরতে আজ কোন্‌ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে। আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে। নীল আকাশের নীরব কথা শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে।শস্যখেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তানে, ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারে। যে এসেছে তাহার মুখে দেখ্‌ রে চেয়ে গভীর সুখে, দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা রে। (শান্তিনিকেতন, ১৮ ভাদ্র, ১৩১৬)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ। বেণী নাহয় এলিয়ে রবে,        সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে, নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ। কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ। যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।।              এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে। ভয় কোরো না - অলক্তরাগ        মোছে যদি মুছিয়া যাক, নূপুর যদি খুলে পড়ে নাহয় রেখে এলে। খেদ কোরো না মালা হতে মুক্তা খসে গেলে। এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।          হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে। ও পার হতে দলে দলে        বকের শ্রেণী উড়ে চলে, থেকে থেকে শূন্য মাঠে বাতাস ওঠে জেগে। ওই রে গ্রামের গোষ্ঠমুখে ধেনুরা ধায় বেগে। হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।।            প্রদীপখানি নিবে যাবে, মিথ্যা কেন জ্বালো? কে দেখতে পায় চোখের কাছে        কাজল আছে কি না আছে, তরল তব সজল দিঠি মেঘের চেয়ে কালো। আঁখির পাতা যেমন আছে এমনি থাকা ভালো। কাজল দিতে প্রদীপখানি মিথ্যা কেন জ্বালো?।          এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ। গাঁথা যদি না হয় মালা        ক্ষতি তাহে নাই গো বালা, ভূষণ যদি না হয় সারা ভূষণে নাই কাজ। মেঘ মগন পূর্বগগন, বেলা নাই রে আজ। এসো হেসে সহজ বেশে, নাই-বা হল সাজ।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
পদ্মের পাতা পেতে অাছে অঞ্জলি রবির করের লিখন ধরিবে বলি। সায়াহে রবি অস্তে নামিবে যবে সে ক্ষণলিখন তখন কোথায় রবে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া ফুটিল প্রভাততারা। হেথা হোথা হতে পাখিরা গাহিল ঢালিয়া সুধার ধারা। মৃদুল প্রভাতসমীর পরশে কমল নয়ন খুলিল হরষে, হিমালয় শিরে অমল আভায় শোভিল ধবল তুষারজটা। খুলি গেল ধীরে পূরবদ্বার, ঝরিল কনককিরণধার, শিখরে শিখরে জ্বলিয়া উঠিল, রবির বিমল কিরণছটা। গিরিগ্রাম আজি কিসের তরে, উঠেছে নাচিয়া হরষভরে, অচল গিরিও হয়েছে যেমন অধীর পাগল-পারা। তটিনী চলেছে নাচিয়া ছুটিয়া, কলরব উঠে আকাশে ফুটিয়া , ঝর ঝর ঝর করিয়া ধ্বনি ঝরিছে নিঝরধারা। তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া মালা, চলিয়াছে গিরিবাসিনী বালা, অধর ভরিয়া সুখের হাসিতে মাতিয়া সুখের গানে। মুখে একটিও নাহিকো বাণী শবদচকিতা মেনকারানী তৃষিত নয়নে আকুল হৃদয়ে, চাহিয়া পথের পানে। আজ মেনকার আদরিণী উমা আসিবে বরষ-পরে। তাইতে আজিকে হরষের ধ্বনি উঠিয়াছে ঘরে ঘরে। অধীর হৃদয়ে রানী আসে যায়, কভু বা প্রাসাদশিখরে দাঁড়ায়, কভু বসে ওঠে, বাহিরেতে ছোটে এখনো উমা মা এলনা কেন? হাসি হাসি মুখে পুরবাসীগণে অধীরে হাসিয়া ভূধরভবনে, "কই উমা কই' বলে "উমা কই', তিলেক বেয়াজ সহে না যেন! বরষের পরে আসিবেন উমা রানীর নয়নতারা , ছেলেবেলাকার সহচরী যত হরষে পাগল-পারা। ভাবিছে সকলে আজিকে উমায় দেখিবে নয়ন ভ'রে, আজিকে আবার সাজাব তাহায় বালিকা উমাটি ক'রে। তেমনি মৃণালবলয়-যুগলে, তেমনি চিকন-চিকন বাকলে, তেমনি করিয়া পরাব গলায় বনফুল তুলি গাঁথিয়া মালা। তেমনি করিয়া পরায়ে বেশ তেমনি করিয়া এলায়ে কেশ, জননীর কাছে বলিব গিয়ে "এই নে মা তোর তাপসী বালা'। লাজ-হাসি-মাখা মেয়ের মুখ হেরি উথলিবে মায়ের সুখ, হরষে জননী নয়নের জলে চুমিবে উমার সে মুখখানি। হরষে ভূধর অধীর-পারা হরষে ছুটিবে তটিনীধারা, হরষে নিঝর উঠিবে উছসি, উঠিবে উছসি মেনকারানী। কোথা তবে তোরা পুরবাসী মেয়ে যেথা যে আছিস আয় তোরা ধেয়ে বনে বনে বনে ফিরিবি বালা, তুলিবি কুসুম, গাঁথিবি মালা, পরাবি উমার বিনোদ গলে। তারকা-খচিত গগন-মাঝে শারদ চাঁদিমা যেমন সাজে তেমনি শারদা অবনী শশী শোভিবে কেমন অবনীতলে! ওই বুঝি উমা, ওই বুঝি আসে, দেখো চেয়ে গিরিরানী! আলুলিত কেশ, এলোথেলো বেশ, হাসি-হাসি মুখখানি। বালিকারা সব আসিল ছুটিয়া দাঁড়াল উমারে ঘিরি। শিথিল চিকুরে অমল মালিকা পরাইয়া দিল ধীরি। হাসিয়া হাসিয়া কহিল সবাই উমার চিবুক ধ'রে, "বলি গো স্বজনী, বিদেশে বিজনে আছিলি কেমন করে? আমরা তো সখি সারাটি বরষ রহিয়াছি পথ চেয়ে -- কবে আসিবেক আমাদের সেই মেনকারানীর মেয়ে! এই নে, সজনী, ফুলের ভূষণ এই নে, মৃণাল বালা, হাসিমুখখানি কেমন সাজিবে পরিলে কুসুম-মালা।' কেহ বা কহিল,"এবার স্বজনি, দিব না তোমায় ছেড়ে ভিখারি ভবের সর্বস্ব ধন আমরা লইব কেড়ে। বলো তো স্বজনী, এ কেমন ধারা এয়েছ বরষ-পরে, কেমনে নিদিয়া রহিবে কেবল তিনটি দিনের তরে।' কেহ বা কহিল,"বলো দেখি,সখী, মনে পড়ে ছেলেবেলা? সকলে মিলিয়া এ গিরিভবনে কত-না করেছি খেলা! সেই মনে পড়ে যেদিন স্বজনী গেলে তপোবন-মাঝে-- নয়নের জলে আমরা সকলে সাজানু তাপসী-সাজে। কোমল শরীরে বাকল পরিয়া এলায়ে নিবিড় কেশ লভিবারে পতি মনের মতন কত-না সহিলে ক্লেশ। ছেলেবেলাকার সখীদের সব এখনো তো মনে আছে, ভয় হয় বড়ো পতির সোহাগে ভুলিস তাদের পাছে!' কত কী কহিয়া হরষে বিষাদে চলিল আলয়-মুখে, কাঁদিয়া বালিকা পড়িল ঝাঁপায়ে আকুল মায়ের বুকে। হাসিয়া কাঁদিয়া কহিল রানী, চুমিয়া উমার অধরখানি, "আয় মা জননি আয় মা কোলে, আজ বরষের পরে। দুখিনী মাতার নয়নের জল তুই যদি, মা গো, না মুছাবি বল্‌ তবে উমা আর ,কে আছে আমার এ শূন্য আঁধার ঘরে? সারাটি বরষ যে দুখে গিয়াছে কী হবে শুনে সে ব্যথা, বল্‌ দেখি, উমা, পতির ঘরের সকল কুশল-কথা।' এত বলি রানী হরষে আদরে উমারে কোলেতে লয়ে, হরষের ধারা বরষি নয়নে পশিল গিরি-আলয়ে। আজিকে গিরির প্রাসাদে কুটিরে উঠিল হরষ-ধ্বনি, কত দিন পরে মেনকা-মহিষী পেয়েছে নয়নমণি!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
পরম আত্মীয় বলে যারে মনে মানি তারে আমি কতদিন কতটুকু জানি! অসীম কালের মাঝে তিলেক মিলনে পরশে জীবন তার আমার জীবনে। যতটুকু লেশমাত্র চিনি দুজনায়, তাহার অনন্তগুণ চিনি নাকো হায়। দুজনের এক জন এক দিন যবে বারেক ফিরাবে মুখ, এ নিখিল ভবে আর কভু ফিরিবে না মুখোমুখি পথে, কে কার পাইবে সাড়া অনন্ত জগতে! এ ক্ষণমিলনে তবে, ওগো মনোহর, তোমারে হেরিনু কেন এমন সুন্দর! মুহূর্ত-আলোক কেন, হে অন্তরতম, তোমারে চিনিনু চিরপরিচিত মম?    (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর। আর পারি নে রাত জাগতে হে নাথ, ভাবতে অনিবার। আছি রাত্রিদিবস ধরে দুয়ার আমার বন্ধ করে, আসতে যে চায় সন্দেহে তায় তাড়াই বারে বারে। তাই তো কারো হয় না আসা আমার একা ঘরে। আনন্দময় ভুবন তোমার বাইরে খেলা করে। তুমিও বুঝি পথ নাহি পাও, এসে এসে ফিরিয়া যাও, রাখতে যা চাই রয় না তাও ধুলায় একাকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা, কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা। দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস— কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস। বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি? শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী, আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে, তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
বইছে নদী বালির মধ্যে, শূন্য বিজন মাঠ, নাই কোনো ঠাঁই ঘাট। অল্প জলের ধারাটি বয়, ছায়া দেয় না গাছে, গ্রাম নেইকো কাছে। রুক্ষ হাওয়ায় ধরার বুকে সূক্ষ্ম কাঁপন কাঁপে চোখ-ধাঁধানো তাপে। কোথাও কোনো শব্দ-যে নেই তারই শব্দ বাজে ঝাঁ-ঝাঁ ক'রে সারাদুপুর দিনের বক্ষোমাঝে। আকাশ যাহার একলা অতিথ শুষ্ক বালুর স্তূপে দিগ্‌বধূ রয় অবাক হয়ে বৈরাগিণীর রূপে। দূরে দূরে কাশের ঝোপে শরতে ফুল ফোটে, বৈশাখে ঝড় ওঠে। আকাশ ব্যেপে ভূতের মাতন বালুর ঘূর্ণি ঘোরে; নৌকো ছুটে আসে না তো সামাল সামাল ক'রে। বর্ষা হলে বন্যা নামে দূরের পাহাড় হতে, কূল-হারানো স্রোতে জলে স্থলে হয় একাকার; দমকা হাওয়ার বেগে সওয়ার যেন চাবুক লাগায় দৌড়-দেওয়া মেঘে। সারা বেলাই বৃষ্টিধারা ঝাপট লাগায় যবে মেঘের ডাকে সুর মেশে না ধেনুর হাম্বারবে। খেতের মধ্যে কল্‌কলিয়ে ঘোলা স্রোতের জল ভাসিয়ে নিয়ে আসে না তো শ্যাওলা-পানার দল। রাত্রি যখন ধ্যানে বসে তারাগুলির মাঝে তীরে তীরে প্রদীপ জ্বলে না যে-- সমস্ত নিঃঝুম জাগাও নেই কোনোখানে, কোথাও নেই ঘুম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
মন্ত্রেসে যে পূত রাখীররাঙা সুতো বাঁধন দিয়েছিনু হাতে, আজ কিআছে সেটি সাথে। বিদায়বেলা এল মেঘের মতো ব্যেপে, গ্রন্থি বেঁধে দিতে দু হাত গেল কেঁপে, সেদিন থেকে থেকে চক্ষুদুটি ছেপে ভরে যে এল জলধারা। আজকে বসে আছি পথের এক পাশে, আমের ঘন বোলে বিভোল মধুমাসে তুচ্ছ কথাটুকু কেবল মনে আসে ভ্রমর যেন পথহারা– সেই-যে বাম হাতে একটি সরু রাখী– আধেক রাঙা, সোনা আধা, আজো কি আছে সেটি বাঁধা।পথ যে কতখানি কিছুই নাহি জানি, মাঠের গেছে কোন্‌ শেষে চৈত্র-ফসলের দেশে। যখন গেলে চলে তোমার গ্রীবামূলে দীর্ঘ বেণী তব এলিয়ে ছিল খুলে, মাল্যখানি গাঁথা সাঁজের কোন্‌ ফুলে লুটিয়ে পড়েছিল পায়ে। একটুখানি তুমি দাঁড়িয়ে যদি যেতে! নতুন ফুলে দেখো কানন ওঠে মেতে, দিতেম ত্বরা করে নবীন মালা গেঁথে কনকচাঁপা-বনছায়ে। মাঠের পথে যেতে তোমার মালাখানি প’ল কি বেণী হতে খসে আজকে ভাবি তাই বসে।নূপুর ছিল ঘরে গিয়েছ পায়ে প’রে– নিয়েছ হেথা হতে তাই, অঙ্গে আর কিছু নাই। আকুল কলতানে শতেক রসনায় চরণ ঘেরি তব কাঁদিছে করুণায়, তাহারা হেথাকার বিরহবেদনায় মুখর করে তব পথ। জানি না কী এত যে তোমার ছিল ত্বরা, কিছুতে হল না যে মাথার ভূষা পরা, দিতেম খুঁজে এনে সিঁথিটি মনোহরা– রহিল মনে মনোরথ। হেলায়-বাঁধা সেই নূপুর-দুটি পায়ে আছে কি পথে গেছে খুলে সে কথা ভাবি তরুমূলে।অনেক গীতগান করেছি অবসান অনেক সকালে ও সাঁজে অনেক অবসরে কাজে। তাহারি শেষ গান আধেক লয়ে কানে দীর্ঘ পথ দিয়ে গেছ সুদূর-পানে, আধেক-জানা সুরে আধেক-ভোলা তানে গেয়েছ গুন্‌ গুন্‌ স্বরে। কেন না গেলে শুনি একটি গান আরো– সে গান শুধু তব, সে নহে আর কারো– তুমিও গেলে চলে সময় হল তারো, ফুটল তব পূজাতরে। মাঠের কোন্‌খানে হারালো শেষ সুর যে গান নিয়ে গেল শেষে, ভাবি যে তাই অনিমেষে।  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
জীবনে যা চিরদিন রয়ে গেছে আভাসে প্রভাতের আলোকে যা ফোটে নাই প্রকাশে, জীবনের শেষ দানে জীবনের শেষ গানে, হে দেবতা, তাই আজি দিব তব সকাশে, প্রভাতের আলোকে যা ফোটে নাই প্রকাশে।কথা তারে শেষ করে পারে নাই বাঁধিতে, গান তারে সুর দিয়ে পারে নাই সাধিতে। কী নিভৃতে চুপে চুপে মোহন নবীনরূপে নিখিল নয়ন হতে ঢাকা ছিল, সখা, সে। প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে।ভ্রমেছি তাহারে লয়ে দেশে দেশে ফিরিয়া, জীবনে যা ভাঙাগড়া সবি তারে ঘিরিয়া। সব ভাবে সব কাজে আমার সবার মাঝে শয়নে স্বপনে থেকে তবু ছিল একা সে। প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে।কত দিন কত লোকে চেয়েছিল উহারে, বৃথা ফিরে গেছে তারা বাহিরের দুয়ারে আর কেহ বুঝিবে না, তোমা সাথে হবে চেনা সেই আশা লয়ে ছিল আপনারি আকাশে, প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে।২৪ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
দিনের প্রহরগুলি হয়ে গেল পার বহি কর্মভার। দিনান্ত ভরিছে তরী রঙিন মায়ায় আলোয় ছায়ায়।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ইচ্ছে করে , মা , যদি তুই হতিস দুয়োরানী ! ছেড়ে দিতে এমনি কি ভয় তোমার এ ঘরখানি । ওইখানে ওই পুকুরপারে জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে ও যেন ঘোর বনের মধ্যে কেউ কোত্থাও নেই । ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে , শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে থাকব দুজনেই । বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে , আসবে না কেউ তোমার কাছে , দিনরাত্তির কোমর বেঁধে থাকব পাহারাতে । রাক্ষসেরা ঝোপে ঝাড়ে মারবে উঁকি আড়ে আড়ে , দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি ধনুক নিয়ে হাতে । আঁচলেতে খই নিয়ে তুই যেই দাঁড়াবি দ্বারে অমনি যত বনের হরিণ আসবে সারে সারে । শিঙগুলি সব আঁকাবাঁকা , গায়েতে দাগ চাকা চাকা , লুটিয়ে তারা পড়বে ভুঁয়ে পায়ের কাছে এসে । ওরা সবাই আমায় বোঝে , করবে না ভয় একটুও যে , হাত বুলিয়ে দেব গায়ে , বসবে কাছে ঘেঁষে । ফলসা - বনে গাছে গাছে ফল ধরে মেঘ করে আছে , ওইখানেতে ময়ূর এসে নাচ দেখিয়ে যাবে । শালিখরা সব মিছিমিছি লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি , কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে হাত থেকে ধান খাবে । দিন ফুরোবে , সাঁঝের আঁধার নামবে তালের গাছে । তখন এসে ঘরের কোণে বসব কোলের কাছে । থাকবে না তোর কাজ কিছু তো , রইবে না তোর কোনো ছুতো , রূপকথা তোর বলতে হবে রোজই নতুন করে । সীতার বনবাসের ছড়া সবগুলি তোর আছে পড়া ; সুর করে তাই আগাগোড়া গাইতে হবে তোরে । তার পরে যেই অশথবনে ডাকবে পেঁচা , আমার মনে একটুখানি ভয় করবে রাত্রি নিষুত হলে । তোমার বুকে মুখটি গুঁজে ঘুমেতে চোখ আসবে বুজে — তখন আবার বাবার কাছে যাস নে যেন চলে ! (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কল্যাণীয়েষু      ১ পড়েছি আজ রেখার মায়ায়। কথা ধনীঘরের মেয়ে, অর্থ আনে সঙ্গে করে, মুখরার মন রাখতে চিন্তা করতে হয় বিস্তর। রেখা অপ্রগল্‌ভা, অর্থহীনা, তার সঙ্গে আমার যে ব্যবহার সবই নিরর্থক। গাছের শাখায় ফুল ফোটানো ফল ধরানো, সে কাজে আছে দায়িত্ব; গাছের তলায় আলোছায়ার নাট-বসানো সে আর-এক কাণ্ড। সেইখানেই শুকনো পাতা ছড়িয়ে পড়ে, প্রজাপতি উড়তে থাকে, জোনাকি ঝিকমিক করে রাতের বেলা। বনের আসরে এরা সব রেখা-বাহন হাল্কা চালের দল, কারো কাছে জবাবদিহি নেই। কথা আমাকে প্রশ্রয় দেয় না, তার কঠিন শাসন; রেখা আমার যথেচ্ছাচারে হাসে, তর্জনী তোলে না। কাজকর্ম পড়ে থাকে, চিঠিপত্র হারিয়ে ফেলি, ফাঁক পেলেই ছুটে যাই রূপ-ফলানোর অন্দরমহলে। এমনি করে, মনের মধ্যে অনেকদিনের যে-লক্ষ্মীছাড়া লুকিয়ে আছে তার সাহস গেছে বেড়ে। সে আঁকছে, ভাবছে না সংসারের ভালোমন্দ, গ্রাহ্য করে না লোকমুখের নিন্দাপ্রশংসা।২ মনটা আছে আরামে। আমার ছবি-আঁকা কলমের মুখে খ্যাতির লাগাম পড়েনি। নামটা আমার খুশির উপরে সর্দারি করতে আসেনি এখনো, ছবি-আঁকার বুক জুড়ে আগেভাগে নিজের আসনটা বিছিয়ে বসেনি; ঠেলা দিয়ে দিয়ে বলছে না "নাম রক্ষা ক'রো।" অথচ ঐ নামটা নিজের মোটা শরীর নিয়ে স্বয়ং কোনো কাজই করে না। সব কীর্তির মুখ্য ভাগটা আদায় করবার জন্যে দেউড়িতে বসিয়ে রাখে পেয়াদা; হাজার মনিবের পিণ্ড-পাকানো ফরমাশটাকে বেদী বানিয়ে স্তূপাকার ক'রে রাখে কাজের ঠিক সামনে। এখনো সেই নামটা অবজ্ঞা করেই রয়েছে অনুপস্থিত;-- আমার তুলি আছে মুক্ত যেমন মুক্ত আজ ঋতুরাজের লেখনী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে জীবনবীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে। এই বেসুরো জটিলতায় পরান আমার মরে ব্যথায়, হঠাৎ আমার গান থেমে যায় বারে বারে। জীবনবীণা ঠিক সুরে আর বাজে না রে।এই বেদনা বইতে আমি পারি না যে, তোমার সভার পথে এসে মরি লাজে। তোমার যারা গুণী আছে বসতে নারি তাদের কাছে, দাঁড়িয়ে থাকি সবার পাছে বাহির-দ্বারে। জীবনবীণা ঠিক সুরে আর বাজে না রে।বোলপুর, ৩ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু, নয় তো হীনবল - শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে ফেলবে অশ্রুজল। মন্দমধুর সুখে শোভায় প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়। তোমার সাথে জাগতে সে চায় আনন্দে পাগল।নাচ' যখন ভীষণ সাজে তীব্র তালের আঘাত বাজে, পালায় ত্রাসে পালায় লাজে সন্দেহ বিহবল। সেই প্রচন্ড মনোহরে প্রেম যেন মোর বরণ করে, ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার দিক সে রসাতল।৪ আষাঢ় ১৩১৭ কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি রচনা সংখ্যাঃ ৮৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
কহিল গভীর রাত্রে সংসারে বিরাগী— “গৃহ তেয়াগিব আজি ইষ্টদেব লাগি। কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে?” দেবতা কহিলা, “আমি।”—শুনিল না কানে। সুপ্তিমগ্ন শিশুটিরে আঁকড়িয়া বুকে প্রেয়সী শয্যার প্রান্তে ঘুমাইছে সুখে। কহিল, “কে তোরা ওরে মায়ার ছলনা?” দেবতা কহিলা, “আমি।”—কেহ শুনিল না। ডাকিল শয়ন ছাড়ি, “তুমি কোথা প্রভু?” দেবতা কহিলা, “হেথা।”—শুনিল না তবু। স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি— দেবতা কহিলা, “ফির।”—শুনিল না বাণী। দেবতা নিশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, “হায়, আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?” (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
গান গাওয়ালে আমায় তুমি কতই ছলে যে, কত সুখের খেলায়, কত নয়নজলে হে। ধরা দিয়ে দাও না ধরা, এস কাছে, পালাও ত্বরা, পরান কর ব্যথায় ভরা পলে পলে হে। গান গাওয়ালে এমনি করে কতই ছলে যে। কত তীব্র তারে, তোমার বীণা সাজাও যে, শত ছিদ্র করে জীবন বাঁশি বাজাও হে। তব সুরের লীলাতে মোর জনম যদি হয়েছে ভোর, চুপ করিয়ে রাখো এবার চরণতলে হে, গান গাওয়ালে চিরজীবন কতই ছলে যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
অধিকার বেশি কার বনের উপর সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর। বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল, গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল। পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া, বর্ণে আমি দিগ্‌বিদিক রেখেছি কাড়িয়া। গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব, গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব। কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে, হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে। মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর, প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।  (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥ অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটার ভুবন দোলে নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥ ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে, ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে, ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি, জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ছোটো কাঠের সিঙ্গি আমার ছিল ছেলেবেলায়, সেটা নিয়ে গর্ব ছিল বীরপুরুষি খেলায়। গলায় বাঁধা রাঙা ফিতের দড়ি, চিনেমাটির ব্যাঙ বেড়াত পিঠের উপর চড়ি। ব্যাঙটা যখন পড়ে যেত ধম্‌কে দিতেম কষে, কাঠের সিঙ্গি ভয়ে পড়ত বসে। গাঁ গাঁ করে উঠছে বুঝি, যেমনি হত মনে, "চুপ করো" যেই ধম্‌কানো আর চম্‌কাত সেইখনে। আমার রাজ্যে আর যা থাকুক সিংহভয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিল না কখ্‌খোনো। মাংস ব'লে মাটির ঢেলা দিতেম ভাঁড়ের 'পরে, আপত্তি ও করত না তার তরে। বুঝিয়ে দিতেম, গোপাল যেমন সুবোধ সবার চেয়ে তেমনি সুবোধ হওয়া তো চাই যা দেব তাই খেয়ে। ইতিহাসে এমন শাসন করে নি কেউ পাঠ, দিবানিশি কাঠের সিঙ্গি ভয়েই ছিল কাঠ। খুদি কইত মিছিমিছি, "ভয় করছে, দাদা।" আমি বলতেম, "আমি আছি, থামাও তোমার কাঁদা-- যদি তোমায় খেয়েই ফেলে এমনি দেব মার দু চক্ষে ও দেখবে অন্ধকার।" মেজ্‌দিদি আর ছোড়্‌দিদিদের খেলা পুতুল নিয়ে, কথায় কথায় দিচ্ছে তাদের বিয়ে নেমন্তন্ন করত যখন যেতুম বটে খেতে, কিন্তু তাদের খেলার পানে চাইনি কটাক্ষেতে। পুরুষ আমি, সিঙ্গিমামা নত পায়ের কাছে, এমন খেলার সাহস বলো ক'জন মেয়ের আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো। এবার তুমি ফিরো না হে– হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো। যে দিন গেছে তোমা বিনা তারে আর ফিরে চাহি না, যাক সে ধুলাতে। এখন  তোমার আলোয় জীবন মেলে যেন  জাগি অহরহ।কী আবেশে কিসের কথায় ফিরেছি হে যথায় তথায় পথে প্রান্তরে, এবার  বুকের কাছে ও মুখ রেখে তোমার আপন বাণী কহো।কত কলুষ কত ফাঁকি এখনো যে আছে বাকি মনের গোপনে, আমায় তার লাগি আর ফিরায়ো না, তারে আগুন দিয়ে দহো।২৮ চৈত্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
রাগ কর নাই কর, শেষ কথা এসেছি বলিতে তোমার প্রদীপ আছে, নাইকো সলিতে। শিল্প তার মূল্যবান, দেয় না সে আলো, চোখেতে জড়ায় লোভ, মনেতে ঘনায় ছায়া কালো অবসাদে। তবু তারে প্রাণপণে রাখি যতনেই, ছেড়ে যাব তার পথ নেই। অন্দকারে অন্ধদৃষ্টি নানাবিধ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরে আচ্ছন্ন করিয়া বাস্তবেরে। অস্পষ্ট তোমারে যবে ব্যগ্রকণ্ঠ ডাক দিই অত্যুক্তির স্তবে তোমারে লঙ্ঘন করি সে-ডাক বাজিতে থাকে সুরে তারি উদ্দেশে আজো যে রয়েছে দূরে। হয়তো সে আসিবে না কভূ, তিমিরে আচ্ছন্ন তুমি তারেই নির্দেশ কর তবু। তোমার এ দূত অন্ধকার গোপনে আমার ইচ্ছারে করিয়া পঙ্গু গতি তার করেছে হরণ, জীবনের উৎসজলে মিশায়েছ মাদক মরণ। রক্তে মোর যে-দূর্বল আছে শঙ্কিত বক্ষের কাজে তারেই সে করেছে সহায়, পশুবাহনের মতো মোহভার তাহারে বহায়। সে যে একান্তই দীন, মূল্যহীন, নিগড়ে বাঁধিয়া তারে আপনারে বিড়ম্বিত করিতেছ পূর্ণ দান হতে, এ প্রমাদ কখনো কি দেখিবে আলোতে। প্রেম নাহি দিয়ে যারে টানিয়াছ উচ্ছিষ্টের লোভে সে-দীন কি পার্শ্বে তব শোভে। কভু কি জানিতে পাবে অসম্মানে নত এই প্রাণ বহন করিছে নিত্য তোমারি আপন অসম্মান। আমারে যা-পারিলে না দিতে সে-কার্পণ্য তোমারেই চিরদিন রহিল বঞ্চিতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
নিধু বলে আড়চোখে, “কুছ নেই পরোয়া।’– স্ত্রী দিলে গলায় দড়ি বলে, “এটা ঘরোয়া।’ দারোগাকে হেসে কয়, “খবরটা দিতে হয়’– পুলিস যখন করে ঘরে এসে চড়োয়া। বলে, “চরণের রেণু নাহি চাহিতেই পেনু।’– এই ব’লে নিধিরাম করে পায়ে-ধরোয়া।নিধু বাঁকা ক’রে ঘাড় ওড়নাটা উড়িয়ে বলে, “মোর পাকা হাড়, যাব নাকো বুড়িয়ে। যে যা খুশি করুক-না, মারুক-না, ধরুক-না, তাকিয়াতে দিয়ে ঠেস দেব সব তুড়িয়ে।’ গালি তারে দিল লোকে হাসে নিধু আড়চোখে; বলে, “দাদা, আরো বলো, কান গেল জুড়িয়ে।’পিসে হয় কুলদার, ভুলুদার কাকা সে– আড়চোখে হাসে আর করে ঘাড় বাঁকা সে। যবে গিয়ে শালিখায় সাহেবের গালি খায়, “কেয়ার করিনে’ ব’লে তুড়ি মারে আকাশে। যেদিন ফয়জাবাদে পত্নী ফুঁপিয়ে কাঁদে, “তবে আসি’ ব’লে হাসি চলে যায় ঢাকা সে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই, জানি আমি তার সাথে আমার আত্মার ভেদ নাই এক আদি জ্যোতি-উৎস হতে চৈতন্যের পুণ্যস্রোতে আমার হয়েছে অভিষেক, ললাটে দিয়েছে জয়লেখ, জানায়েছে অমৃতের আমি অধিকারী; পরম-আমির সাথে যুক্ত হতে পারি বিচিত্র জগতে প্রবেশ লভিতে পারি আনন্দের পথে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ। ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন্ মায়া গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান। নামিয়ে মুখ চুকিয়ে সুখ যাবার মুখে যায় যারা ফেরার পথে ফিরেও নাহি চায়, তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া--- সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়।সাঁজের বেলা ভাঁটার স্রোতে ও পার হতে একটানা একটি-দুটি যায় যে তরী ভেসে। কেমন করে চিনব ওরে ওদের মাঝে কোন্‌খানা আমার ঘাটে ছিল আমার দেশে। অস্তাচলে তীরের তলে ঘন গাছের কোল ঘেঁষে ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়, ডাকলে আমি ক্ষণেক থামি হেথায় পাড়ি ধরবে সে এমন নেয়ে আছে রে কোন্ নায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়।ঘরেই যারা যাবার তারা কখন গেছে ঘরপানে, পারে যারা যাবার গেছে পারে; ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে। ফুলের বার নাইকো আর, ফসল যার ফলল না--- চোখের জল ফেলতে হাসি পায়--- দিনের আলো যার ফুরালো, সাঁজের আলো জ্বলল না, সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়। ওরে আয় আমায় নিয়ে যাবি কে রে বেলাশেষের শেষ খেয়ায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আজি শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে গোপন তব চরণ ফেলে নিশার মতো নীরব ওহে সবার দিঠি এড়ায়ে এলে। প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি, বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি, নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে।কূজনহীন কাননভূমি, দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে, একেলা কোন্‌ পথিক তুমি পথিকহীন পথের ‘পরে। হে একা সখা, হে প্রিয়তম, রয়েছে খোলা এ ঘর মম, সমুখ দিয়ে স্বপনসম যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।।কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে, খুশি রই আপন মনে- বাতাস বহে সুমন্দ। সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা, শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা। ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে, ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ।।আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত। আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। রচনা: শিলাইদহ ১৭ চৈত্র ১৩১৮ গীতবিতান পূজা ৫৫৯, বিশ্বভারতী ১৩৮০ সং পৃ ২২০ থেকে সংগৃহীত।পাঠান্তর: গীতিমাল্যে (রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী ১৩৮৯ সং, খণ্ড ১১, পৃ ১৩৪) পঙ্‌ক্তি ৭ এ 'আপন-মনে' ছিল 'মনে মনে"।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
সে ছিল আরেক দিন এই তরী-’পরে, কন্ঠ তার পূর্ণ ছিল সুধাগীতিস্বরে। ছিল তার আঁখি দুটি ঘনপক্ষ্মচ্ছায়, সজল মেঘের মতো ভরা করুণায়। কোমল হৃদয়খানি উদ্‌বেলিত সুখে, উচ্ছ্বসি উঠিত হাসি সরল কৌতুকে। পাশে বসি ব’লে যেত কলকণ্ঠকথা, কত কী কাহিনী তার কত আকুলতা! প্রত্যুষে আনন্দভরে হাসিয়া হাসিয়া প্রভাত-পাখির মতো জাগাত আসিয়া। স্নেহের দৌরাত্ম্য তার নির্ঝরের প্রায় আমারে ফেলিত ঘেরি বিচিত্র লীলায়। আজি সে অনন্ত বিশ্বে আছে কোন্‌খানে তাই ভাবিতেছি বসি সজলনয়ানে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জন্মদিন আসে বারে বারে মনে করাবারে— এ জীবন নিত্যই নূতন প্রতি প্রাতে আলোকিত পুলকিত দিনের মতন।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
নম, নম, নম নম। নির্দয় অতি করুণা তোমার বন্ধু তুমি হে নির্মম, যা-কিছু জীর্ণ করিবে দীর্ণ দণ্ড তোমার দুর্দম। সর্বনাশার নিঃশ্বাস বায় লাগল ভালে। নাচল চরণ শীতের হাওয়ায় মরণতালে। করব বরণ, আসুক কঠোর, ঘুচুক অলস সুপ্তির ঘোর, যাক ছিঁড়ে মোর বন্ধনডোর যাবার কালে। ভয় যেন মোর হয় খান্‌খান্‌ ভয়েরি ঘায়ে, ভরে যেন প্রাণ ভেসে এসে দান ক্ষতির বায়ে। সংশয়ে মন না যেন দুলাই, মিছে শুচিতায় তারে না ভুলাই, নির্মল হব পথের ধুলাই লাগিলে পায়ে। শীত, যদি তুমি মোরে দাও ডাক দাঁড়ায়ে দ্বারে– সেই নিমেষেই যাব নির্বাক্‌ অজানা পারে। নাই দিল আলো নিবে-যাওয়া বাতি,– শুকনো গোলাপ ঝরা যূথী জাতী, নির্জন পথ হোক মোর সাথী অন্ধকারে। জানি জানি শীত, আমার যে-গীত বীণায় নাচে তারে হরিবার কভু কি তোমার সাধ্য আছে। দক্ষিণবায়ে করে যাব দান রবিরশ্মিতে কাঁপিবে সে তান, কসুমে কুসুমে ফুটিবে সে গান লতায় গাছে। যাহা-কিছু মোর তুমি, ওগো চোর, হরিয়া লবে, জেনো বারেবারে ফিরে ফিরে তারে ফিরাতে হবে। যা-কিছু ধুলায় চাহিবে চুকাতে ধুলা সে কিছুতে নারিবে লুকাতে, নবীন করিয়া নবীনের হাতে সঁপিবে কবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বিরাট সৃষ্টির ক্ষেত্রে আতশবাজির খেলা আকাশে আকাশে, সূর্য তারা ল’য়ে যুগযুগান্তের পরিমাপে। অনাদি অদৃশ্য হতে আমিও এসেছি ক্ষুদ্র অগ্নিকণা নিয়ে এক প্রান্তে ক্ষুদ্র দেশে কালে। প্রস্থানের অঙ্কে আজ এসেছি যেমনি দীপশিখা ম্লান হয়ে এল, ছায়াতে পড়িল ধরা এ খেলার মায়ার স্বরূপ, শ্লথ হয়ে এল ধীরে সুখ দুঃখ নাট্যসজ্জাগুলি। দেখিলাম, যুগে যুগে নটনটী বহু শত শত ফেলে গেছে নানারঙা বেশ তাহাদের রঙ্গশালা-দ্বারের বাহিরে। দেখিলাম চাহি শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্যপ্রাঙ্গণে নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ব্যঙ্গাত্মক
মর্মে যবে মত্ত আশা সর্পসম ফোঁষে অদৃষ্টের বন্ধনেতে দাপিয়া বৃথা রোষে তখনো ভালোমানুষ সেজে বাঁধানো হুঁকা যতনে মেজে মলিন তাস সজোরে ভেঁজে খেলিতে হবে কষে! অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব জন-দশেকে জটলা করি তক্তপোষে ব’সে। ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো, পোষ-মানা এ প্রাণ বোতাম-আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান। দেখা হলেই মিষ্ট অতি মুখের ভাব শিষ্ট অতি, অসল দেহ ক্লিষ্টগতি– গৃহের প্রতি টান। তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরা, মাথায় ছোটো বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান। ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন! চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন। ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি, জীবনস্রোত আকাশে ঢালি হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি চলেছি নিশিদিন। বর্শা হাতে, ভর্‌সা প্রাণে, সদাই নিরুদ্দেশ মরুর ঝড় যেমন বহে সকল বাধাহীন। বিপদ-মাঝে ঝাঁপায়ে প’ড়ে শোণিত উঠে ফুটে, সকল দেহে সকল মনে জীবন জেগে উঠে– অন্ধকারে সূর্যালোতে সন্তরিয়া মৃত্যুস্রোতে নৃত্যময় চিত্ত হতে মত্ত হাসি টুটে। বিশ্বমাঝে মহান যাহা সঙ্গী পরানের, ঝঞ্ঝামাঝে ধায় সে প্রাণ সিন্ধুমাঝে লুটে। নিমেষতরে ইচ্ছা করে বিকট উল্লাসে সকল টুটে যাইতে ছুটে জীবন-উচ্ছ্বাসে– শূন্য ব্যোম অপরিমাণ মদ্যসম করিতে পান মুক্ত করি রুদ্ধ প্রাণ ঊর্ধ্ব নীলাকাশে। থাকিতে নারি ক্ষুদ্র কোণে আম্রবনছায়ে সুপ্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে গুপ্ত গৃহবাসে। বেহালাখানা বাঁকায়ে ধরি বাজাও ওকি সুর– তবলা-বাঁয়া কোলেতে টেনে বাদ্যে ভরপুর! কাগজ নেড়ে উচ্চ স্বরে পোলিটিকাল তর্ক করে, জানলা দিয়ে পশিছে ঘরে বাতাস ঝুরুঝুর। পানের বাটা, ফুলের মালা, তবলা-বাঁয়া দুটো, দম্ভ-ভরা কাগজগুলো করিয়া দাও দূর! কিসের এত অহংকার! দম্ভ নাহি সাজে– বরং থাকো মৌন হয়ে সসংকোচ লাজে। অত্যাচারে মত্ত-পারা কভু কি হও আত্মহারা? তপ্ত হয়ে রক্তধারা ফুটে কি দেহমাঝে? অহর্নিশি হেলার হাসি তীব্র অপমান মর্মতল বিদ্ধ করি বজ্রসম বাজে? দাস্যসুখে হাস্যমুখ, বিনীত জোড়-কর, প্রভুর পদে সোহাগ-মদে দোদুল কলেবর! পাদুকাতলে পড়িয়া লুটি ঘৃণায় মাখা অন্ন খুঁটি ব্যগ্র হয়ে ভরিয়া মুঠি যেতেছ ফিরি ঘর। ঘরেতে ব’সে গর্ব কর পূর্বপুরুষের, আর্যতেজ-দর্প-ভরে পৃথ্বী থরথর। হেলায়ে মাথা, দাঁতের আগে মিষ্ট হাসি টানি বলিতে আমি পারিব না তো ভদ্রতার বাণী। উচ্ছ্বসিত রক্ত আসি বক্ষতল ফেলিছে গ্রাসি, প্রকাশহীন চিন্তারাশি করিছে হানাহানি। কোথাও যদি ছুটিতে পাই বাঁচিয়া যাই তবে– ভব্যতার গণ্ডিমাঝে শান্তি নাহি মানি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
এ কথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান, কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান। শুধু তব অন্তরবেদনা চিরন্তন হয়ে থাক্‌ সম্রাটের ছিল এ সাধনা। রাজশক্তি বজ্র সুকঠিন সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন, কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ এই তব মনে ছিল আশ। হীরা মুক্তামানিক্যের ঘটা যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক, শুধু থাক্‌ একবিন্দু নয়নের জল কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল। হায় ওরে মানবহৃদয়, বার বার কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই নাই। জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই ভুবনের ঘাটে ঘাটে-- এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে। দক্ষিণের মন্ত্রগুঞ্জরণে তব কুঞ্জবনে বসন্তের মাধবীমঞ্জরী যেই ক্ষণে দেয় ভরি মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল, বিদায় গোধূলি আসে ধুলায় ছড়ায়ে ছিন্নদল। সময় যে নাই; আবার শিশিররাত্রে তাই নিকুঞ্জে ফুটায়ে তোল নব কুন্দরাজি সাজাইতে হেমন্তের অশ্রুভরা আনন্দের সাজি। হায় রে হৃদয়, তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়। নাই নাই, নাই যে সময়। হে সম্রাট, তাই তব শঙ্কিত হৃদয় চেয়েছিল করিবারে সময়ের হৃদয় হরণ সৌন্দর্যে ভুলায়ে। কণ্ঠে তার কী মালা দুলায়ে করিলে বরণ রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে। রহে না যে বিলাপের অবকাশ বারো মাস, তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে চিরমৌন জাল দিয়ে বেঁধে দিলে কঠিন বন্ধনে। জ্যোৎস্নারাতে নিভৃত মন্দিরে প্রেয়সীরে যে-নামে ডাকিতে ধীরে ধীরে সেই কানে-কানে ডাকা রেখে গেলে এইখানে অনন্তের কানে। প্রেমের করুণ কোমলতা ফুটিল তা সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে। হে সম্রাট কবি, এই তব হৃদয়ের ছবি, এই তব নব মেঘদূত, অপূর্ব অদ্ভুত ছন্দে গানে উঠিয়াছে অলক্ষের পানে যেথা তব বিরহিণী  প্রিয়া রয়েছে মিশিয়া প্রভাতের অরুণ-আভাসে, ক্লান্তসন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিশ্বাসে, পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলির লাবণ্যবিলাসে, ভাষার অতীত তীরে কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে। তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি এড়াইয়া কালের প্রহরী চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া "ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া।" চলে গেছ তুমি আজ মহারাজ; রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে, সিংহাসন গেছে টুটে; তব সৈন্যদল যাদের চরনভরে ধরণী করিত টলমল তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে উড়ে যায় দিল্লীর পথের ধূলি-'পরে। বন্দীরা গাহে না গান; যমুনা-কল্লোলসাথে নহবত মিলায় না তান; তব পুরসুন্দরীর নূপুরনিক্কণ ভগ্ন প্রাসাদের কোণে ম'রে গিয়ে ঝিল্লীস্বনে কাঁদায় রে নিশার গগন। তবুও তোমার দূত অমলিন, শ্রান্তিক্লান্তিহীন, তুচ্ছ করি রাজ্য-ভাঙাগড়া, তুচ্ছ করি জীবনমৃত্যুর ওঠাপড়া, যুগে যুগান্তরে কহিতেছে একস্বরে চিরবিরহীর বাণী নিয়া "ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া।" মিথ্যা কথা-- কে বলে যে ভোল নাই। কে বলে রে খোল নাই স্মৃতির পিঞ্জরদ্বার। অতীতের চির অস্ত-অন্ধকার আজিও হৃদয় তব রেখেছে বাঁধিয়া? বিস্মৃতির মুক্তিপথ দিয়া আজিও সে হয় নি বাহির? সমাধিমন্দির এক ঠাঁই রহে চিরস্থির; ধরায় ধুলায় থাকি স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি। জীবনেরে কে রাখিতে পারে। আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে। তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে নব নব পূর্বাচলে  আলোকে আলোকে। স্মরণের গ্রন্থি টুটে সে যে যায় ছুটে বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন। মহারাজ, কোনো মহারাজ্য কোনোদিন পারে নাই তোমারে ধরিতে; সমুদ্রস্তনিত পৃথ্বী, হে বিরাট, তোমারে ভরিতে নাহি পারে-- তাই এ-ধরারে জীবন-উৎসব-শেষে দুই পায়ে ঠেলে মৃৎপাত্রের মতো যাও ফেলে। তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ, তাই তব জীবনের রথ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার বারম্বার। তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই। যে প্রেম সম্মুখপানে চলিতে চালাতে নাহি জানে, যে প্রেম পথের মধ্যে  পেতেছিল নিজ সিংহাসন, তার বিলাসের সম্ভাষণ পথের ধুলার মতো জড়ায়ে ধরেছে তব পায়ে, দিয়েছ তা ধূলিরে ফিরায়ে। সেই তব পশ্চাতের পদধূলি-'পরে তব চিত্ত হতে বায়ুভরে কখন সহসা উড়ে পড়েছিল বীজ জীবনের মাল্য হতে খসা। তুমি চলে গেছ দূরে সেই বীজ অমর অঙ্কুরে উঠেছে অম্বরপানে, কহিছে গম্ভীর গানে-- "যত দূর চাই নাই নাই সে পথিক নাই। প্রিয়া তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছেড়ে দিল পথ রুধিল না সমুদ্র পর্বত। আজি তার রথ চলিয়াছে রাত্রির আহ্বানে নক্ষত্রের গানে প্রভাতের সিংহদ্বার পানে। তাই স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে এখানে নাই।' এলাহাবাদ, ১৪ কার্তিক, ১৩২১-রাত্রি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
মনে ভাবিতেছি, যেন অসংখ্য ভাষার শব্দরাজি ছাড়া পেল আজি, দীর্ঘকাল ব্যাকরণদুর্গে বন্দী রহি অকস্মাৎ সারি সারি কুচকাওয়াজের পদক্ষেপে উঠেছে অধীর হয়ে খেপে। লঙ্ঘিয়াছে বাক্যের শাসন, নিয়েছে অবুদ্ধিলোকে অবদ্ধ ভাষণ, ছিন্ন করি অর্থের শৃঙ্খলপাশ সাধুসাহিত্যের প্রতি ব্যঙ্গহাস্যে হানে পরিহাসল সব ছেড়ে অধিকার করে শুধু শ্রুতি — বিচিত্র তাদের ভঙ্গি, বিচিত্র আকূতি। বলে তারা, আমরা যে এই ধরণীর নিশ্বসিত পবনের আদিম ধ্বনির জন্মেছি সন্তান, যখনি মানবকন্ঠে মনোহীন প্রাণ নাড়ীর দোলায় সদ্য জেগেছে নাচিয়া উঠেছি বাঁচিয়া। শিশুকন্ঠে আদিকাব্যে এনেছি উচ্ছলি অস্তিত্বের প্রথম কাকলি। গিরিশিরে যে পাগল-ঝোরা শ্রাবণের দূত, তারি আত্মীয় আমরা আসিয়াছি লোকালয়ে সৃষ্টির ধ্বনির মন্ত্র লয়ে। মর্মরমুখর বেগে যে ধ্বনির কলোৎসব অরণ্যের পল্লবে পল্লবে, যে ধ্বনি দিগন্তে করে ঝড়ের ছন্দের পরিমাপ, নিশান্তের জাগায় যাহা প্রভাতের প্রকান্ড প্রলাপ, সে ধ্বনির ক্ষেত্র হতে হরিয়া করেছে পদানত বন্য ঘোটকের মতো মানুষ শব্দেরে তার জটিল নিয়মসূত্রজালে বার্তাবহনের লাগি অনাগত দূর দেশে কালে। বল্গাবদ্ধ-শব্দ-অশ্বে চড়ি মানুষ করেছে দ্রুত কালের মন্থর যত ঘড়ি। জড়ের অচল বাধা তর্কবেগে করিয়া হরণ অদৃশ্য রহস্যলোকে গহনে করেছে সঞ্চরণ, ব্যূহে বঁধি শব্দ-অক্ষৌহিণী প্রতি ক্ষণে মূঢ়তার আক্রমণ লইতেছি জিনি। কখনো চোরের মতো পশে ওরা স্বপ্নরাজ্যতলে, ঘুমের ভাটার জলে নাহি পায় বাধা — যাহা-তাহা নিয়ে আসে, ছন্দের বাঁধনে পড়ে বাঁধা, তাই দিয়ে বুদ্ধি অন্যমনা করে সেই শিল্পের রচনা সূত্র যার অসংলগ্ন স্খলিত শিথিল, বিধির সৃষ্টির সাথে নারাখে একান্ত তার মিল; যেমন মাতিয়া উঠে দশ-বিশ কুকুরের ছানা — এ ওর ঘাড়েতে চড়ে, কোনো উদ্দ্যেশ্যের নাই মানা, কে কাহারে লাগায় কামড়, জাগায় ভীষণ শব্দে গর্জনের ঝড়, সে কামড়ে সে গর্জনে কোনো অর্থ নাই হিংস্রতার, উদ্দাম হইয়া উঠে শুধু ধ্নি শুধু ভঙ্গি তার। মনে মনে দেখিতেছি, সারা বেলা ধরি দলে দলে শব্দ ছোটে অর্থ ছিন্ন করি — আকাশে আকাশে যেন বাজে, আগ‌্ডুম বাগ‌্ডুম ঘোড়াডুম সাজে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি ওই কেটে গেল; ওরে যাত্রী। তোমার পথের 'পরে তপ্ত রৌদ্র এনেছে আহ্বান রুদ্রের ভৈরব গান। দূর হতে দূরে বাজে পথ শীর্ণ তীব্র দীর্ঘতান সুরে, যেন পথহারা কোন্‌ বৈরাগীর একতারা। ওরে যাত্রী, ধূসর পথের ধুলা সেই তোর ধাত্রী; চলার অঞ্চলে তোরে ঘূর্ণাপাকে বক্ষেতে আবরি ধরার বন্ধন হতে নিয়ে যাক হরি দিগন্তের পারে দিগন্তরে। ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে, নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক, নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ। পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্বাদ, শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ। পথে পথে কন্টকের অভ্যর্থনা, পথে পথে গুপ্তসর্প গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা। নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ এই তোর রুদ্রের প্রসাদ। ক্ষতি এনে দিবে পদে অমূল্য অদৃশ্য উপহার। চেয়েছিলি অমৃতের অধিকার-- সে তো নহে সুখ, ওরে, সে নহে বিশ্রাম, নহে শান্তি, নহে সে আরাম। মৃত্যু তোরে দিবে হানা, দ্বারে দ্বারে পাবি মানা, এই তোর নব বৎসরের আশীর্বাদ, এই তোর রুদ্রের প্রসাদ ভয় নাই, ভয় নাই, যাত্রী। ঘরছাড়া দিকহারা অলক্ষ্মী তোমার বরদাত্রী। পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী। এসেছে নিষ্ঠুর, হোক রে দ্বারের বন্ধ দূর, হোক রে মদের পাত্র চুর। নাই বুঝি, নাই চিনি, নাই তারে জানি, ধরো তার পাণি; ধ্বনিয়া উঠুক তব হৃৎকম্পনে তার দীপ্ত বাণী। ওরে যাত্রী গেছে কেটে, যাক কেটে পুরাতন রাত্রি। কলিকাতা, ৯ বৈশাখ, ১৩২৩
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
ভারতের কোন্‌ বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আচার্য জগদীশ। কী অদৃশ্য তপোভূমি বিরচিলে এ পাষাণনগরীর শুষ্ক ধূলিতলে। কোথা পেলে সেই শান্তি এ উন্মত্ত জনকোলাহলে যার তলে মগ্ন হয়ে মুহূর্তে বিশ্বের কেন্দ্র-মাঝে দাঁড়াইলে একা তুমি– এক যেথা একাকী বিরাজে সূর্যচন্দ্র পুষ্পপত্র-পশুপক্ষী-ধুলায়-প্রস্তরে– এক তন্দ্রাহীন প্রাণ নিত্য যেথা নিজ অঙ্ক-‘পরে দুলাইছে চরাচর নিঃশব্দ সংগীতে। মোরা যবে মত্ত ছিনু অতীতের অতিদূর নিষ্ফল গৌরবে– পরবস্ত্রে, পরবাক্যে, পরভঙ্গিমার ব্যঙ্গরূপে কল্লোল করিতেছিনু স্ফীতকন্ঠে ক্ষুদ্র অন্ধকূপে– তুমি ছিলে কোন্‌ দূরে। আপনার স্তব্ধ ধ্যানাসন কোথায় পাতিয়াছিলে। সংযত গম্ভীর করি মন ছিলে রত তপস্যায় অরূপরশ্মির অন্বেষণে লোকলোকান্তের অন্তরালে — যেথা পূর্ব ঋষিগণে বহুত্বের সিংহদ্বার উদ্‌ঘাটিয়া একের সাক্ষাতে দাঁড়াতেন বাক্যহীন স্তম্ভিত বিস্মিত জোড়হাতে। হে তপস্বী, ডাকো তুমি সামমন্ত্রে জলদগর্জনে, “উত্তিষ্ঠত নিবোধত!’ ডাকো শাস্ত্র-অভিমানী জনে পাণ্ডিত্যের পণ্ডতর্ক হতে। সুবৃহৎ বিশ্বতলে ডাকো মূঢ় দাম্ভিকেরে। ডাক দাও তব শিষ্যদলে, একত্রে দাঁড়াক তারা তব হোমহুতাগ্নি ঘিরিয়া। আরবার এ ভারত আপনাতে আসুক ফিরিয়া নিষ্ঠায়, শ্রদ্ধায়, ধ্যানে– বসুক সে অপ্রমত্তচিতে লোভহীন দ্বন্দ্বহীন শুদ্ধ শান্ত গুরুর বেদীতে  (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন। ধিক্‌ ধিক্‌ করে তারে কাননে সবাই— সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু স্টীমার ‘ রাজহংস ' । গঙ্গা চিঠি লিখব কথা ছিল , দেখছি সেটা ভারি শক্ত । তেমন যদি খবর থাকে লিখতে পারি তক্ত তক্ত । খবর বয়ে বেড়ায় ঘুরে খবরওয়ালা ঝাঁকা-মুটে । আমি বাপু ভাবের ভক্ত বেড়াই নাকো খবর খুঁটে । এত ধুলো , এত খবর কলকাতাটার গলিতে! নাকে চোকে খবর ঢোকে দু-চার কদম চলিতে । এত খবর সয় না আমার মরি আমি হাঁপোষে । ঘরে এসেই খবরগুলো মুছে ফেলি পাপোষে । আমাকে তো জানই বাছা! আমি একজন খেয়ালি । কথাগুলো যা বলি , তার অধিকাংশই হেঁয়ালি । আমার যত খবর আসে ভোরের বেলা পুব দিয়ে । পেটের কথা তুলি আমি পেটের মধ্যে ডুব দিয়ে । আকাশ ঘিরে জাল ফেলে তারা ধরাই ব্যাবসা । থাক্ গে তোমার পাটের হাটে মথুর কুণ্ডু শিবু সা । কল্পতরুর তলায় থাকি নই গো আমি খবুরে । হাঁ করিয়ে চেয়ে আছি মেওয়া ফলে সবুরে । তবে যদি নেহাত কর খবর নিয়ে টানাটানি । আমি বাপু একটি কেবল দুষ্টু মেয়ের খবর জানি! দুষ্টুমি তার শোনো যদি অবাক হবে সত্যি! এত বড়ো বড়ো কথা তার মুখখানি একরত্তি । মনে মনে জানেন তিনি ভারি মস্ত লোকটা । লোকের সঙ্গে না-হক কেবল ঝগড়া করবার ঝোঁকটা । আমার সঙ্গেই যত বিবাদ কথায় কথায় আড়ি । এর নাম কি ভদ্র ব্যাভার! বড্ড বাড়াবাড়ি । মনে করেছি তার সঙ্গে কথাবার্তা বন্দ করি । প্রতিজ্ঞা থাকে না পাছে সেইটে ভারি সন্দ করি । সে না হলে সকাল বেলায় চামেলি কি ফুটবে! সে নইলে কি সন্ধে বেলায় সন্ধেতারা উঠবে । সে না হলে দিনটা ফাঁকি আগাগোড়াই মস্কারা । পোড়ারমুখী জানে সেটা তাই এত তার আস্কারা । চুড়ি-পরা হাত দুখানি কতই জানে ফন্দি । কোনোমতে তার সাথে তাই করে আছি সন্ধি । নাম যদি তার জিগেস কর নামটি বলা হবে না । কী জানি সে শোনে যদি প্রাণটি আমার রবে না । নামের খবর কে রাখে তার ডাকি তারে যা খুশি । দুষ্টু বলো , দস্যি বলো , পোড়ারমুখী , রাক্ষুসী! বাপ মায়ে যে নাম দিয়েছে বাপ মায়েরি থাক্ সে । ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি তুলে রাখুন বাক্সে! এক জনেতে নাম রাখবে অন্নপ্রাশনে । বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে বিষম শাসন এ! নিজের মনের মত সবাই করুক নামকরণ । বাবা ডাকুন ‘ চন্দ্রকুমার ' খুড়ো ‘ রামচরণ ' ! ধার-করা নাম নেব আমি হবে না তো সিটি । জানই আমার সকল কাজে Originality । ঘরের মেয়ে তার কি সাজে সঙস্কৃত নাম । এতে কেবল বেড়ে ওঠে অভিধানের দাম । আমি বাপু ডেকে বসি যেটা মুখে আসে , যারে ডাকি সেই তা বোঝে আর সকলে হাসে! দুষ্টু মেয়ের দুষ্টুমি — তায় কোথায় দেব দাঁড়ি! অকূল পাথার দেখে শেষে কলমের হাল ছাড়ি! শোনো বাছা , সত্যি কথা বলি তোমার কাছে — ত্রিজগতে তেমন মেয়ে একটি কেবল আছে! বর্ণিমেটা কারো সঙ্গে মিলে পাছে যায় — তুমুল ব্যাপার উঠবে বেধে হবে বিষম দায়! হপ্তাখানেক বকাবকি ঝগড়াঝাঁটির পালা , একটু চিঠি লিখে , শেষে প্রাণটা ঝালাফালা । আমি বাপু ভালোমানুষ মুখে নেইকো রা । ঘরের কোণে বসে বসে গোঁফে দিচ্ছি তা । আমি যত গোলে পড়ি শুনি নানান বাক্যি । খোঁড়ার পা যে খানায় পড়ে আমিই তাহার সাক্ষী । আমি কারো নাম করি নি তবু ভয়ে মরি । তুই পাছে নিস গায়ে পেতে সেইটো বড়ো ডরি! কথা একটা উঠলে মনে ভারি তোরা জ্বালাস । আমি বাপু আগে থাকতে বলে হলুম খালাস!    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে । তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে, আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে । রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে ।     সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে । ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই কোনোখানে জনমানব নাই, তুমি যেন আপনমনে তাই ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা? আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো, ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা ।’চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে, মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে । গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে, সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে, আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে, অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো । তুমি যেন বললে আমায় ডেকে, ‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’     এমন সময় 'হারে রে রে রে রে’ ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে । তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে, বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো। আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে, ‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর।’ হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল । আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার! এক পা আগে আসিস যদি আর - এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার, টুকরো করে দেব তোদের সেরে ।’ শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।’     তুমি বললে, ‘যাস না খোকা ওরে’ আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে।’ ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে, ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে, শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা। কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে, কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে। আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’, তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে - বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল! কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’     রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা - এমন কেন সত্যি হয় না আহা। ঠিক যেন এক গল্প হত তবে, শুনত যারা অবাক হত সবে, দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে, খোকার গায়ে এত কি জোর আছে।’ পাড়ার লোকে বলত সবাই শুনে, ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।’(শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জানি দিন অবসান হবে, জানি তবু কিছু বাকি রবে। রজনীতে ঘুমহারা পাখি এক সুরে গাহিবে একাকী- যে শুনিবে, সে রহিবে জাগি সে জানিবে, তারি নীড়হারা স্বপন খুঁজিছে সেই তারা যেথা প্রাণ হয়েছে বিবাগী। কিছু পরে করে যাবে চুপ ছায়াঘন স্বপনের রূপ। ঝরে যাবে আকাশকুসুম, তখন কূজনহীন ঘুম এক হবে রাত্রির সাথে। যে-গান স্বপনে নিল বাসা তার ক্ষীণ গুঞ্জন-ভাষা শেষ হবে সব-শেষ রাতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে। তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে। কত কালের সকাল-সাঁঝে তোমার চরণধ্বনি বাজে, গোপনে দূত গৃহ-মাঝে গেছে আমায় ডেকে।ওগো পথিক, আজকে আমার সকল পরাণ ব্যেপে থেকে থেকে হরষ যেন উঠছে কেঁপে কেঁপে যেন সময় এসেছে আজ, ফুরালো মোর যা ছিল কাজ - বাতাস আসে, হে মহারাজ, তোমার গন্ধ মেখে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা, দেবদারুর কুঞ্জে ধেনু চরায় রাখালেরা। কোথা হতে চৈত্রমাসে হাঁসের শ্রেণী উড়ে আসে, অঘ্রানেতে আকাশপথে যায় যে তারা কোথা আমরা কিছুই জানি নেকো সেই সুদূরের কথা। আমরা জানি গ্রাম ক’খানি, চিনি দশটি গিরি– মা ধরণী রাখেন মোদের কোলের মধ্যে ঘিরি।সে ছিল ওই বনের ধারে ভুট্টাখেতের পাশে যেখানে ওই ছায়ার তলে জলটি ঝ’রে আসে। ঝর্না হতে আনতে বারি জুটত হোথা অনেক নারী, উঠত কত হাসির ধ্বনি তারি ঘরের দ্বারে– সকাল-সাঁঝে আনাগোনা তারি পথের ধারে। মিশত কুলুকুলুধ্বনি তারি দিনের কাজে, ওই রাগিনী পথ হারাত তারি ঘুমের মাঝে।সন্ধ্যাবেলায় সন্ন্যাসী এক, বিপুল জটা শিরে, মেঘে-ঢাকা শিখর হতে নেমে এলেন ধীরে। বিস্ময়েতে আমরা সবে শুধাই, “তুমি কে গো হবে।’ বসল যোগী নিরুত্তরে নির্ঝরিণীর কূলে নীরবে সেই ঘরের পানে স্থির নয়ন তুলে। অজানা কোন্‌ অমঙ্গলে বক্ষ কাঁপে ডরে– রাত্রি হল, ফিরে এলেম যে যার আপন ঘরে।পরদিনে প্রভাত হল দেবদারুর বনে, ঝর্নাতলায় আনতে বারি জুটল নারীগণে। দুয়ার খোলা দেখে আসি– নাই সে খুশি, নাই সে হাসি, জলশূন্য কলসখানি গড়ায় গৃহতলে, নিব-নিব প্রদীপটি সেই ঘরের কোণে জ্বলে। কোথায় সে যে চলে গেল রাত না পোহাতেই, শূন্য ঘরের দ্বারের কাছে সন্ন্যাসীও নেই।চৈত্রমাসে রৌদ্র বাড়ে, বরফ গ’লে পড়ে– ঝর্নাতলায় বসে মোরা কাঁদি তাহার তরে। আজিকে এই তৃষার দিনে কোথায় ফিরে নিঝর বিনে, শুষ্ক কলস ভরে নিতে কোথায় পাবে ধারা। কে জানে সে নিরুদ্দেশে কোথায় হল হারা। কোথাও কিছু আছে কি গো, শুধাই যারে তারে– আমাদের এই আকাশ-ঢাকা দশ পাহাড়ের পারে।গ্রীষ্মরাতে বাতায়নে বাতাস হু হু করে, বসে আছি প্রদীপ-নেবা তাহার শূন্য ঘরে। শুনি বসে দ্বারের কাছে ঝর্না যেন তারেই যাচে– বলে, “ওগো, আজকে তোমার নাই কি কোনো তৃষা। জলে তোমার নাই প্রয়োজন, এমন গ্রীষ্মনিশা?’ আমিও কেঁদে কেঁদে বলি, “হে অজ্ঞাতচারী, তৃষ্ণা যদি হারাও তবু ভুলো না এই বারি।’হেনকালে হঠাৎ যেন লাগল চোখে ধাঁধা, চারি দিকে চেয়ে দেখি নাই পাহাড়ের বাধা। ওই-যে আসে, কারে দেখি– আমাদের যে ছিল সে কি। ওগো, তুমি কেমন আছ, আছ মনের সুখে? খোলা আকাশতলে হেথা ঘর কোথা কোন্‌ মুখে? নাইকো পাহাড়, কোনোখানে ঝর্না নাহি ঝরে, তৃষ্ণা পেলে কোথায় যাবে বারিপানের তরে?সে কহিল, “যে ঝর্না বয় সেথা মোদের দ্বারে, নদী হয়ে সে’ই চলেছে হেথা উদার ধারে। সে আকাশ সেই পাহাড় ছেড়ে অসীম-পানে গেছে বেড়ে সেই ধরারেই নাইকো হেথা পাষাণ-বাঁধা বেঁধে।’ “সবই আছে, আমরা তো নেই’ কইনু তারে কেঁদে। সে কহিল করুণ হেসে, “আছ হৃদয়মূলে।’ স্বপন ভেঙে চেয়ে দেখি আছি ঝর্নাকূলে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তুমি বাঁধছ নূতন বাসা, আমার ভাঙছে ভিত। তুমি খুঁজছ লড়াই, আমার মিটেছে হার-জিত। তুমি বাঁধছ সেতারে তার, থামছি সমে এসে। চক্ররেখা পূর্ণ হল আরম্ভে আর শেষে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় যাত্রার সময় বুঝি এল, বিদায়দিনের-পরে আবরণ ফেলো অপ্রগল্‌ভ সূর্যাস্ত-আভার; সময় যাবার শান্ত হোক, স্তব্ধ হোক, স্মরণসভার সমারোহ না রচুক শোকের সম্মোহ। বনশ্রেণী প্রস্থানের দ্বারে ধরণীর শান্তিমন্ত্র দিক মৌন পল্লবসম্ভারে। নামিয়া আসুক ধীরে রাত্রির নিঃশব্দ আশীর্বাদ, সপ্তর্ষির জ্যোতির প্রসাদ।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
বসন্ত আওল রে !  মধুকর গুন গুন , অমুয়ামঞ্জরী কানন ছাওল রে । শুন শুন সজনী হৃদয় প্রাণ মম হরখে আকুল ভেল , জর জর রিঝসে দুখ জ্বালা সব দূর দূর চলি গেল । মরমে বহই বসন্তসমীরণ , মরমে ফুটই ফুল , মরমকুঞ্জ'পর বোলই কুহু কুহু অহরহ কোকিলকুল । সখি রে উছসত প্রেমভরে অব ঢলঢল বিহ্বল প্রাণ , নিখিল জগত জনু হরখ - ভোর ভই গায় রভসরসগান । বসন্তভূষণভূষিত ত্রিভুবন কহিছে দুখিনী রাধা , কঁহি রে সো প্রিয় , কঁহি সো প্রিয়তম , হৃদিবসন্ত সো মাধা ? ভানু কহত অতি গহন রয়ন অব , বসন্তসমীর শ্বাসে মোদিত বিহ্বল চিত্তকুঞ্জতল ফুল্ল বাসনা - বাসে । (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
উইলি পিয়র্‌সন্‌ বন্ধুবরেষু আপনারে তুমি সহজে ভুলিয়া থাক, আমরা তোমারে ভুলিতে পারি না তাই। সবার পিছনে নিজের গোপনে রাখ, আমরা তোমারে প্রকাশ করিতে চাই। ছোটোরে কখনো ছোট নাহি কর মনে, আদর করিতে জান অনাদৃত জনে, প্রীতি তব কিছু না চাহে নিজের জন্য, তোমারে আদরি আপনারে করি ধন্য। স্নেহাসক্ত শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ মে ১৯১৬  তোসা-মারু জাহাজ, বঙ্গসাগর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
হে হিমাদ্রি, দেবতাত্মা, শৈলে শৈলে আজিও তোমার অভেদাঙ্গ হরগৌরী আপনারে যেন বারম্বার শৃঙ্গে শৃঙ্গে বিস্তারিয়া ধরিছেন বিচিত্র মুরতি। ওই হেরি ধ্যানাসনে নিত্যকাল স্তব্ধ পশুপতি, দুর্গম দুঃসহ মৌন– জটাপুঞ্জতুষারসংঘাত নিঃশব্দে গ্রহণ করে উদয়াস্তরবিরশ্মিপাত পূজাস্বর্ণপদ্মদল। কঠিনপ্রস্তরকলেবর মহান্‌-দরিদ্র, রিক্ত, আভরণহীন দিগম্বর, হেরো তাঁরে অঙ্গে অঙ্গে এ কী লীলা করেছে বেষ্টন– মৌনেরে ঘিরেছে গান, স্তব্ধেরে করেছে আলিঙ্গন সফেন চঞ্চল নৃত্য, রিক্ত কঠিনেরে ওই চুমে কোমল শ্যামলশোভা নিত্যনব পল্লবে কুসুমে ছায়ারৌদ্রে মেঘের খেলায়। গিরিশেরে রয়েছেন ঘিরি পার্বতী মাধুরীচ্ছবি তব শৈলগৃহে হিমগিরি।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই। এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই! ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত, বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রু-ময় - মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়! তা যদি না পারি, তবে বাঁচি যত কাল তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই, তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই। হাসিমুখে নিয়া ফুল, তার পরে হায় ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সে কি সহজ গান। সেই সুরেতে জাগব আমি দাও মোরে সেই কান। ভুলব না আর সহজেতে, সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ। সে ঝড় যেন সই আনন্দে চিত্তবীণার তারে সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত নাচাও যে ঝংকারে। আরাম হতে ছিন্ন ক'রে সেই গভীরে লও গো মোরে অশান্তির অন্তরে যেথায় শান্তি সুমহান। ( তিনধরিয়া, ২১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
তপনের পানে চেয়ে সাগরের ঢেউ বলে, "ওই পুতলিরে এনে দে-না কেউ।"   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
পেন্‌সিল টেনেছিনু হপ্তায় সাতদিন, রবার ঘষেছি তাহে তিনমাস রাতদিন। কাগজ হয়েছে সাদা; সংশোধনের বাধা ঘুচে গেছে, এইবার শিক্ষক হাত দিন কিন্তু ছবির কোণে স্বাক্ষর বাদ দিন।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এই যে সবার সামান্য পথ, পায়ে হাঁটার গলি সে পথ দিয়ে আমি চলি সুখে দুঃখে লাভে ক্ষতিতে, রাতের আঁধার দিনের জ্যোতিতে। প্রতি তুচ্ছ মুহূর্তেরই আবর্জনা করি আমি জড়ো, কারো চেয়ে নইকো অমি বড়ো। চলতে পথে কখনো বা বিঁধছে কাঁটা পায়ে, লাগছে ধুলো গায়ে; দুর্বাসনার এলোমেলো হাওয়া, তারি মধ্যে কতই চাওয়া পাওয়া, কতই বা হারানো, খেয়া ধরে ঘাটে আঘাটায় নদী-পারানো। এমনি করে দিন কেটেছে, হবে সে-দিন সারা বেয়ে সর্বসাধারণের ধারা। শুধাও যদি সবশেষে তার রইল কী ধন বাকী, স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি তা কি! জানি, এমন নাই কিছু যা পড়বে কারো চোখে, স্মরণ-বিস্মরণের দোলায় দুলবে বিশ্বলোকে। নয় সে মানিক, নয় সে সোনা,-- যায় না তারে যাচাই করা, যায় না তারে গোনা। এই দেখো-না শীতের রোদের দিনের স্বপ্নে বোনা সেগুন বনে সবুজ-মেশা সোনা, শজনে গাছে লাগল ফুলের রেশ, হিমঝুরির হৈমন্তী পালা হয়েছে নিঃশেষ। বেগনি ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা স্তব্ধ বটের শাখা ঘোর রহস্যে ঢাকা। ফলসা গাছের ঝরা পাতা গাছের তলা জুড়ে হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে। গোরুর গাড়ি মেঠো পথের তলে উড়তি ধুলোয় দিকের আঁচল ধূসর ক'রে চলে। নীরবতার বুকের মধ্যখানে দূর অজানার বিধুর বাঁশি ভৈরবী সুর আনে। কাজভোলা এই দিন নীল আকাশে পাখির মতো নিঃসীমে হয় নীল। এরি মধ্যে আছি আমি, সব হতে এই দামি। কেননা আজ বুকের কাছে যায় না জানা, আরেকটি সেই দোসর আমি উড়িয়ে চলে বিরাট তাহার ডানা জগতে জগতে অন্তবিহীন ইতিহাসের পথে। এই যে আমার কুয়োতলার কাছে সামান্য ঐ আমের গাছে কখনো বা রৌদ্র খেলায়, কভু শ্রাবণধারা, সারা বয়ষ থাকে আপনহারা সাধারণ এই অরণ্যানীর সবুজ আবরণে, মাঘের শেষে অকারণে ক্ষণকালের গোপন মন্ত্রবলে গভীর মাটির তলে শিকরে তার শিহর লাগে, শাখায় শাখায় হঠাৎ বাণী জাগে,-- "আছি, আছি, এই যে আমি আছি।" পুষ্পোচ্ছ্বাসে ধায় সে বাণী স্বর্গলোকের কাছাকাছি দিকে দিগন্তরে। চন্দ্র সূর্য তারার আলো তারে বরণ করে। এমনি করেই মাঝে মাঝে সোনার কাঠি আনে কভু প্রিয়ার মুগ্ধ চোখে, কভু কবির গানে-- অলস মনের শিয়রেতে কে সে অন্তর্যামী; নিবিড় সত্যে জেগে ওঠে সামান্য এই আমি। যে আমিরে ধূসর ছায়ায় প্রতিদিনের ভিড়ের মধ্যে দেখা সেই আমিরে এক নিমেষের আলোয় দেখি একের মধ্যে একা। সে-সব নিমেষ রয় কি না রয় কোনোখানে, কেউ তাহাদের জানে বা না-ই জানে, তবু তারা জীবনে মোর দেয় তো আনি ক্ষণে ক্ষণে পরম বাণী অনন্তকাল যাহা বাজে বিশ্বচরাচরের মর্মমাঝে "আছি আমি আছি"-- যে বাণীতে উঠে নাচি মহাগগন-সভাঙ্গনে আলোক-অপ্সরী তারার মাল্য পরি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ভেবেছিলাম চেয়ে নেব , চাই নি সাহস করে— সন্ধেবেলায় যে মালাটি গলায় ছিলে পরে— আমি        চাই নি সাহস করে । ভেবেছিলাম সকাল হলে যখন পারে যাবে চলে ছিন্ন মালা শয্যাতলে রইবে বুঝি পড়ে । তাই আমি কাঙালের মতো এসেছিলেম ভোরে— তবু         চাই নি সাহস করে । এ তো মালা নয় গো , এ যে তোমার তরবারি । জ্বলে ওঠে আগুন যেন , বজ্র - হেন ভারী— এ যে         তোমার তরবারি । তরুণ আলো জানলা বেয়ে পড়ল তোমার শয়ন ছেয়ে , ভোরের পাখি শুধায় গেয়ে ‘ কী পেলি তুই নারী ' । নয় এ মালা , নয় এ থালা , গন্ধজলের ঝারি , এ যে        ভীষণ তরবারি । তাই তো আমি ভাবি বসে এ কী তোমার দান । কোথায় এরে লুকিয়ে রাখি নাই যে হেন স্থান । ওগো ,       এ কী তোমার দান ।  শক্তিহীনা মরি লাজে , এ ভূষণ কি আমায় সাজে । রাখতে গেলে বুকের মাঝে ব্যথা যে পায় প্রাণ । তবু আমি বইব বুকে এই বেদনার মান— নিয়ে         তোমারি এই দান । আজকে হতে জগৎমাঝে ছাড়ব আমি ভয় , আজ হতে মোর সকল কাজে তোমার হবে জয়— আমি       ছাড়ব সকল ভয় । মরণকে মোর দোসর করে রেখে গেছ আমার ঘরে , আমি তারে বরণ ক'রে রাখব পরান - ময় । তোমার তরবারি আমার করবে বাঁধন ক্ষয় । আমি        ছাড়ব সকল ভয় । তোমার লাগি অঙ্গ ভরি করব না আর সাজ । নাই - বা তুমি ফিরে এলে ওগো হৃদয়রাজ । আমি        করব না আর সাজ । ধুলায় বসে তোমার তরে কাঁদব না আর একলা ঘরে , তোমার লাগি ঘরে - পরে মানব না আর লাজ । তোমার তরবারি আমায় সাজিয়ে দিল আজ , আমি       করব না আর সাজ ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
অত চুপি চুপি কেন কথা কও ওগো মরণ, হে মোর মরণ। অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও, ওগো একি প্রণয়েরি ধরন। যবে সন্ধ্যাবেলায় ফুলদল পড়ে ক্লান্ত বৃন্তে নমিয়া, যবে ফিরে আসে গোঠে গাভীদল সারা দিনমান মাঠে ভ্রমিয়া, তুমি পাশে আসি বস অচপল ওগো অতি মৃদুগতি-চরণ। আমি বুঝি না যে কী যে কথা কও ওগো মরণ, হে মোর মরণ।হায় এমনি করে কি, ওগো চোর, ওগো মরণ, হে মোর মরণ, চোখে বিছাইয়া দিবে ঘুমঘোর করি হৃদিতলে অবতরণ। তুমি এমনি কি ধীরে দিবে দোল মোর অবশ বক্ষশোণিতে। কানে বাজাবে ঘুমের কলরোল তব কিঙ্কিণি-রণরণিতে? শেষে পসারিয়া তব হিম-কোল মোরে স্বপনে করিবে হরণ? আমি বুঝি না যে কেন আস-যাও ওগো মরণ, হে মোর মরণ।কহ মিলনের এ কি রীতি এই ওগো মরণ, হে মোর মরণ। তার সমারোহভার কিছু নেই– নেই কোনো মঙ্গলাচরণ? তব পিঙ্গলছবি মহাজট সে কি চূড়া করি বাঁধা হবে না। তব বিজয়োদ্ধত ধ্বজপট সে কি আগে-পিছে কেহ ববে না। তব মশাল-আলোকে নদীতট আঁখি মেলিবে না রাঙাবরন? ত্রাসে কেঁপে উঠিবে না ধরাতল ওগো মরণ,হে মোর মরণ?যবে বিবাহে চলিলা বিলোচন ওগো মরণ, হে মোর মরণ, তাঁর কতমতো ছিল আয়োজন, ছিল কতশত উপকরণ। তাঁর লটপট করে বাঘছাল তাঁর বৃষ রহি রহি গরজে, তাঁর বেষ্টন করি জটাজাল যত ভুজঙ্গদল তরজে। তাঁর ববম্‌ববম্‌ বাজে গাল, দোলে গলায় কপালাভরণ, তাঁর বিষাণে ফুকারি উঠে তান ওগো মরণ, হে মোর মরণ।শুনি শ্মশানবাসীর কলকল ওগো মরণ, হে মোর মরণ, সুখে গৌরীর আঁখি ছলছল, তাঁর কাঁপিছে নিচোলাবরণ। তাঁর বাম আঁখি ফুরে থরথর, তাঁর হিয়া দুরুদুরু দুলিছে, তাঁর পুলকিত তনু জরজর, তাঁর মন আপনারে ভুলিছে। তাঁর মাতা কাঁদে শিরে হানি কর খেপা বরেরে করিতে বরণ, তাঁর পিতা মনে মানে পরমাদ ওগো মরণ, হে মোর মরণ।তুমি চুরি করি কেন এস চোর ওগো মরণ, হে মোর মরণ। শুধু নীরবে কখন নিশি-ভোর, শুধু অশ্রু-নিঝর-ঝরন। তুমি উৎসব করো সারারাত তব বিজয়শঙ্খ বাজায়ে। মোরে কেড়ে লও তুমি ধরি হাত নব রক্তবসনে সাজায়ে। তুমি কারে করিয়ো না দৃক্‌পাত, আমি নিজে লব তব শরণ যদি গৌরবে মোরে লয়ে যাও ওগো মরণ, হে মোর মরণ।যদি কাজে থাকি আমি গৃহমাঝ ওগো মরণ, হে মোর মরণ, তুমি ভেঙে দিয়ো মোর সব কাজ, কোরো সব লাজ অপহরণ। যদি স্বপনে মিটায়ে সব সাধ আমি শুয়ে থাকি সুখশয়নে, যদি হৃদয়ে জড়ায়ে অবসাদ থাকি আধজাগরূক নয়নে, তবে শঙ্খে তোমার তুলো নাদ করি প্রলয়শ্বাস ভরণ– আমি ছুটিয়া আসিব ওগো নাথ, ওগো মরণ, হে মোর মরণ।আমি যাব যেথা তব তরী রয় ওগো মরণ, হে মোর মরণ, যেথা অকূল হইতে বায়ু বয় করি আঁধারের অনুসরণ। যদি দেখি ঘনঘোর মেঘোদয় দূর ঈশানের কোণে আকাশে, যদি বিদ্যুৎফণী জ্বালাময় তার উদ্যত ফণা বিকাশে, আমি ফিরিব না করি মিছা ভয়– আমি করিব নীরবে তরণ সেই মহাবরষার রাঙা জল ওগো মরণ, হে মোর মরণ।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
প্রাণের সাধন কবে নিবেদন করেছি চরণতলে, অভিষেক তার হল না তোমার করুণ নয়নজলে। রসের বাদল নামিল না কেন তাপের দিনে। ঝরে গেল ফুল মালা পরাই নি তোমার গলে।মনে হয়েছিল, দেখেছি করুণা আঁখির পাতে- উড়ে গেল কোথা শুকনো যূথীর সাথে। যদি এ মাটিতে চলিতে চলিতে পড়িত তোমার দান এ মাটি লভিত প্রাণ, একদা গোপনে ফিরে পেতে তারে অমৃত ফলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
প্রেম কহে, হে বৈরাগ্য, তব ধর্ম মিছে। প্রেম, তুমি মহামোহ—বৈরাগ্য কহিছে— আমি কহি, ছাড়্‌ স্বার্থ, মুক্তিপথ দেখ্‌। প্রেম কহে, তা হলে তো তুমি আমি এক।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাহিনীকাব্য
‘যমুনার জল করে থল্‌ থল্‌ কলকলে গাহি প্রেমের গান। নিশার আঁচোলে পড়ে ঢোলে ঢোলে সুধাকর খুলি হৃদয় প্রাণ! বহিছে মলয় ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে, নুয়ে নুয়ে পড়ে কুসুমরাশি! ধীরি ধীরি ধীরি ফুলে ফুলে ফিরি মধুকরী প্রেম আলাপে আসি! আয় আয় সখি! আয় দুজনায় ফুল তুলে তুলে গাঁথি লো মালা। ফুলে ফুলে আলা বকুলের তলা, হেথায় আয় লো বিপিনবালা। নতুন ফুটেছে মালতীর কলি, ঢলি ঢলি পড়ে এ ওর পানে! মধুবাসে ভুলি প্রেমালাপ তুলি অলি কত কি-যে কহিছে কানে! আয় বলি তোরে, আঁচলটি ভোরে কুড়া-না হোথায় বকুলগুলি! মাধবীর ভরে লতা নুয়ে পড়ে, আমি ধীরি ধীরি আনি লো তুলি। গোলাপ কত যে ফুটেছে কমলা, দেখে যা দেখে যা বনের মেয়ে! দেখ‍্‌সে হেথায় কামিনী পাতায় গাছের তলাটি পড়েছে ছেয়ে। আয় আয় হেথা, ওই দেখ্‌ ভাই, ভ্রমরা একটি ফুলের কোলে— কমলা, ফুঁ দিয়ে দে-না লো উড়িয়ে, ফুলটা আমি লো নেব যে তুলে। পারি না লো আর, আয় হেথা বসি ফুলগুলি নিয়ে দুজনে গাঁথি! হেথায় পবন খেলিছে কেমন তটিনীর সাথে আমোদে মাতি! আয় ভাই হেথা, কোলে রাখি মাথা শুই একটুকু ঘাসের 'পরে— বাতাস মধুর বহে ঝুরু ঝুর, আঁখি মুদে আসে ঘুমের তরে! বল্‌ বনবালা এত কি লো জ্বালা! রাত দিন তুই কাঁদিবি বসে! আজো ঘুমঘোর ভাঙ্গিল না তোর, আজো মজিলি না সুখের রসে! তবে যা লো ভাই! আমি একেলাই রাশ্‌ রাশ্‌ করি গাঁথিয়া মালা। তুই নদীতীরে কাঁদ‍্‌গে লো ধীরে যমুনারে কহি মরমজ্বালা! আজো তুই বোন! ভুলিবি নে বন? পরণকুটীর যাবি নে ভুলে? তোর ভাই মন কে জানে কেমন। আজো বলিলি নে সকল খুলে?’ ‘কি বলিব বোন! তবে সব শোন্‌!’ কহিল কমলা মধুর স্বরে, ‘লভেছি জনম করিতে রোদন রোদন করিব জীবন ভোরে! ভুলিব সে বন?— ভুলিব সে গিরি? সুখের আলয় পাতার কুঁড়ে? মৃগে যাব ভুলে— কোলে লয়ে তুলে কচি কচি পাতা দিতাম ছিঁড়ে। হরিণের ছানা একত্রে দুজনা খেলিয়ে খেলিয়ে বেড়াত সুখে! শিঙ ধরি ধরি খেলা করি করি আঁচল জড়িয়ে দিতাম মুখে! ভুলিব তাদের থাকিতে পরাণ? হৃদয়ে সে সব থাকিতে লেখা? পারিব ভুলিতে যত দিন চিতে ভাবনার আহা থাকিবে রেখা? আজ কত বড় হয়েছে তাহারা, হয়ত আমার না দেখা পেয়ে কুটীরের মাঝে খুঁজে খুঁজে খুঁজে বেড়াতেছে আহা ব্যাকুল হয়ে! শুয়ে থাকিতাম দুপরবেলায় তাহাদের কোলে রাখিয়ে মাথা, কাছে বসি নিজে গলপ কত যে করিতেন আহা তখন মাতা! গিরিশিরে উঠি করি ছুটাছুটি হরিণের ছানাগুলির সাথে তটিনীর পাশে দেখিতাম বসে মুখছায়া যবে পড়িত তাতে! সরসীভিতরে ফুটিলে কমল তীরে বসি ঢেউ দিতাম জলে, দেখি মুখ তুলে— কমলিনী দুলে এপাশে ওপাশে পড়িতে ঢলে! গাছের উপরে ধীরে ধীরে ধীরে জড়িয়ে জড়িয়ে দিতেম লতা, বসি একাকিনী আপনা-আপনি কহিতাম ধীরে কত কি কথা! ফুটিলে গো ফুল হরষে আকুল হতেম, পিতারে কতেম গিয়ে! ধরি হাতখানি আনিতাম টানি, দেখাতেম তাঁরে ফুলটি নিয়ে! তুষার কুড়িয়ে আঁচল ভরিয়ে ফেলিতাম ঢালি গাছের তলে— পড়িলে কিরণ, কত যে বরণ ধরিত, আমোদে যেতাম গলে! দেখিতাম রবি বিকালে যখন শিখরের শিরে পড়িত ঢলে করি ছুটাছুটি শিখরেতে উঠি দেখিতাম দূরে গিয়াছে চোলে! আবার ছুটিয়ে যেতাম সেখানে দেখিতাম আরও গিয়াছে সোরে! শ্রান্ত হয়ে শেষে কুটীরেতে এসে বসিতাম মুখ মলিন করে! শশধরছায়া পড়িলে সলিলে ফেলিতাম জলে পাথরকুচি— সরসীর জল উঠিত উথুলে, শশধরছায়া উঠিত নাচি। ছিল সরসীতে এক-হাঁটু জল, ছুটিয়া ছুটিয়া যেতেম মাঝে, চাঁদের ছায়ারে গিয়া ধরিবারে আসিতাম পুন ফিরিয়া লাজে। তটদেশে পুন ফিরি আসি পর অভিমানভরে ঈষৎ রাগি চাঁদের ছায়ায় ছুঁড়িয়া পাথর মারিতাম— জল উঠিত জাগি। যবে জলধর শিখরের ‘পর উড়িয়া উড়িয়া বেড়াত দলে, শিখরেতে উঠি বেড়াতাম ছুটি— কাপড়-চোপড় ভিজিত জলে! কিছুই— কিছুই— জানিতাম না রে, কিছুই হায় রে বুঝিতাম না। জানিতাম হা রে জগৎমাঝারে আমরাই বুঝি আছি কজনা! পিতার পৃথিবী পিতার সংসার একটি কুটীর পৃথিবীতলে জানি না কিছুই ইহা ছাড়া আর— পিতার নিয়মে পৃথিবী চলে! আমাদেরি তরে উঠে রে তপন, আমাদেরি তরে চাঁদিমা উঠে, আমাদেরি তরে বহে গো পবন, আমাদেরি তরে কুসুম ফুটে! চাই না জ্ঞেয়ান, চাই না জানিতে সংসার, মানুষ কাহারে বলে। বনের কুসুম ফুটিতাম বনে, শুকায়ে যেতেম বনের কোলে। জানিব আমারি পৃথিবী ধরা, খেলিব হরিণশাবক-সনে— পুলকে হরষে হৃদয় ভরা, বিষাদভাবনা নাহিক মনে। তটিনী হইতে তুলিব জল, ঢালি ঢালি দিব গাছের তলে। পাখিরে বলিব ‘কমলা বল্‌’, শরীরের ছায়া দেখিব জলে! জেনেছি মানুষ কাহারে বলে। জেনেছি হৃদয় কাহারে বলে! জেনেছি রে হায় ভালবাসিলে কেমন আগুনে হৃদয় জ্বলে! এখন আবার বেঁধেছি চুলে, বাহুতে পরেছি সোনার বালা। উরসেতে হার দিয়েছি তুলে, কবরীর মাঝে মণির মালা! বাকলের বাস ফেলিয়াছি দূরে— শত শ্বাস ফেলি তাহার তরে, মুছেছি কুসুম রেণুর সিঁদুরে আজো কাঁদে হৃদি বিষাদভরে! ফুলের বলয় নাইক হাতে, কুসুমের হার ফুলের সিঁথি— কুসুমের মালা জড়ায়ে মাথে স্মরণে কেবল রাখিনু গাঁথি! এলো এলো চুলে ফিরিব বনে রুখো রুখো চুল উড়িবে বায়ে। ফুল তুলি তুলি গহনে বনে মালা গাঁথি গাঁথি পরিব গায়ে! হায় রে সে দিন ভুলাই ভালো! সাধের স্বপন ভাঙিয়া গেছে! এখন মানুষে বেসেছি ভালো, হৃদয় খুলিব মানুষ-কাছে! হাসিব কাঁদিব মানুষের তরে, মানুষের তরে বাঁধিব চুলে— মাখিব কাজল আঁখিপাত ভরে, কবরীতে মণি দিব রে তুলে। মুছিনু নীরজা! নয়নের ধার, নিভালাম সখি হৃদয়জ্বালা! তবে সখি আয় আয় দুজনায় ফুল তুলে তুলে গাঁথি লো মালা! এই যে মালতী তুলিয়াছ সতি! এই যে বকুল ফুলের রাশি; জুঁই আর বেলে ভরেছ আঁচলে, মধুপ ঝাঁকিয়া পড়িছে আসি! এই হল মালা, আর না লো বালা— শুই লো নীরজা! ঘাসের 'পরে। শুন‍্‌ছিস বোন! শোন্‌ শোন্‌ শোন্‌! কে গায় কোথায় সুধার স্বরে! জাগিয়া উঠিল হৃদয় প্রাণ! স্মরণের জ্যোতি উঠিল জ্বলে! ঘা দিয়েছে আহা মধুর গান হৃদয়ের অতি গভীর তলে! সেই-যে কানন পড়িতেছে মনে সেই-যে কুটীর নদীর ধারে! থাক্‌ থাক্‌ থাক্‌ হৃদয়বেদন নিভাইয়া ফেলি নয়নধারে! সাগরের মাঝে তরণী হতে দূর হতে যথা নাবিক যত— পায় দেখিবারে সাগরের ধারে মেঘ্‌লা মেঘ্‌লা ছায়ার মত! তেমনি তেমনি উঠিয়াছে জাগি— অফুট অফুট হৃদয়-'পরে কী দেশ কী জানি, কুটীর দুখানি, মাঠের মাঝেতে মহিষ চরে! বুঝি সে আমার জনমভূমি সেখান হইতে গেছিনু চলে! আজিকে তা মনে জাগিল কেমনে এত দিন সব ছিলুম ভুলে। হেথায় নীরজা, গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনিব গান, যমুনাতীরেতে জ্যোছনার রেতে গাইছে যুবক খুলিয়া প্রাণ! কেও কেও ভাই? নীরদ বুঝি? বিজয়ের[১] আহা প্রাণের সখা! গাইছে আপন ভাবেতে মজি যমুনা পুলিনে বসিয়ে একা! যেমন দেখিতে গুণও তেমন, দেখিতে শুনিতে সকলি ভালো— রূপে গুণে মাখা দেখি নি এমন, নদীর ধারটি করেছে আলো! আপনার ভাবে আপনি কবি রাত দিন আহা রয়েছে ভোর! সরল প্রকৃতি মোহনছবি অবারিত সদা মনের দোর মাথার উপরে জড়ান মালা— নদীর উপরে রাখিয়া আঁখি জাগিয়া উঠেছে নিশীথবালা জাগিয়া উঠেছে পাপিয়া পাখি! আয় না লো ভাই গাছের আড়ালে আয় আর একটু কাছেতে সরে এই খানে আয় শুনি দুজনায় কি গায় নীরদ সুধার স্বরে!’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
মিলের চুমকি গাঁথি ছন্দের পাড়ের মাঝে মাঝে অকেজো অলস বেলা ভরে ওঠে শেলাইয়ের কাজে। অর্থভরা কিছুই-না চোখে ক’রে ওঠে ঝিল্‌মিল্‌ ছড়াটার ফাঁকে ফাঁকে মিল। গাছে গাছে জোনাকির দল করে ঝলমল; সে নহে দীপের শিখা, রাত্রি খেলা করে আঁধারেতে টুকরো আলোক গেঁথে গেঁথে। মেঠো গাছে ছোটো ছোটো ফুলগুলি জাগে; বাগান হয় না তাহে, রঙের ফুটকি ঘাসে লাগে। মনে থাকে, কাজে লাগে, সৃষ্টিতে সে আছে শত শত; মনে থাকবার নয়, সেও ছড়াছড়ি যায় কত। ঝরনায় জল ঝ’রে উর্বরা করিতে চলে মাটি; ফেনাগুলো ফুটে ওঠে, পরক্ষণে যায় ফাটি ফাটি। কাজের সঙ্গেই খেলা গাঁথা– ভার তাহে লঘু রয়, খুশি হন সৃষ্টির বিধাতা।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে , সে কথা হইলে বলা সব বলা হয় । কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে তারি পাছে পাছে , তারি তরে চেয়ে আছে সমস্ত হৃদয় । শত গান উঠিতেছে তারি অন্বেষণে , পাখির মতন ধায় চরাচরময় । শত গান ম'রে গিয়ে , নূতন জীবনে একটি কথায় চাহে হইতে বিলয় । সে কথা হইলে বলা নীরব বাঁশরি , আর বাজাব না বীণা চিরদিন - তরে । সে কথা শুনিতে সবে আছে আশা করি , মানব এখনো তাই ফিরিছে না ঘরে । সে কথায় আপনারে পাইব জানিতে , আপনি কৃতার্থ হব আপন বাণীতে ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
ওগো , শোনো কে বাজায় ! বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়। অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি         চুরি করে হাসিখানি , বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায় । ওগো শোনো কে বাজায় ! কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে , বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে । যমুনারই কলতান          কানে আসে , কাঁদে প্রাণ , আকাশে ঐ মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায় ! ওগো শোনো কে বাজায় !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
নিবেদিল রাজভৃত্য, "মহারাজ, বহু অনুনয়ে সাধুশ্রেষ্ঠ নরোত্তম তোমার সোনার দেবালয়ে না লয়ে আশ্রয় আজি পথপ্রান্তে তরুচ্ছায়াতলে করিছেন নামসংকীর্তন। ভক্তবৃন্দ দলে দলে ঘেরি তাঁরে দরদর-উদ্‌বেলিত আনন্দধারায় ধৌত ধন্য করিছেন ধরণীর ধূলি। শূন্যপ্রায় দেবাঙ্গন; ভৃঙ্গ যথা স্বর্ণময় মধুভান্ড ফেলি সহসা কমলগন্ধে মত্ত হয়ে দ্রুত পক্ষ মেলি ছুটে যায় গুঞ্জরিয়া উন্মীলিত পদ্ম-উপবনে উন্মুখ পিপাসাভরে, সেইমতো নরনারীগণে সোনার দেউল-পানে না তাকায়ে চলিয়াছে ছুটি যেথায় পথের প্রান্তে ভক্তের হৃদয়পদ্ম ফুটি বিতরিছে স্বর্গের সৌরভ। রত্নবেদিকার 'পরে একা দেব রিক্ত দেবালয়ে।'                             শুনি রাজা ক্ষোভভরে সিংহাসন হতে নামি গেলা চলি যেথা তরুচ্ছায়ে সাধু বসি তৃণাসনে; কহিলেন নমি তাঁর পায়ে, "হেরো প্রভু, স্বর্ণশীর্ষ নৃপতিনির্মিত নিকেতন অভ্রভেদী দেবালয়, তারে কেন করিয়া বর্জন দেবতার স্তবগান গাহিতেছ পথপ্রান্তে বসে?'"সে মন্দিরে দেব নাই' কহে সাধু।                             রাজা কহে রোষে, "দেব নাই! হে সন্ন্যাসী, নাস্তিকের মতো কথা কহ। রত্নসিংহাসন-'পরে দীপিতেছে রতনবিগ্রহ-- শূন্য তাহা?'          "শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ' সাধু কহে, "আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে।'ভ্রূ কুঞ্চিয়া কহে রাজা, "বিংশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়া রচিয়াছি অনিন্দিত যে মন্দির অম্বর ভেদিয়া, পূজামন্ত্রে নিবেদিয়া দেবতারে করিয়াছি দান, তুমি কহ সে মন্দিরে দেবতার নাহি কোনো স্থান!'শান্ত মুখে কহে সাধু, "যে বৎসর বহ্নিদাহে দীন বিংশতি সহস্র প্রজা গৃহহীন অন্নবস্ত্রহীন দাঁড়াইল দ্বারে তব, কেঁদে গেল ব্যর্থ প্রার্থনায় অরণ্যে, গুহার গর্ভে, পথপ্রান্তে তরুর ছায়ায়, অশ্বত্থবিদীর্ণ জীর্ণ মন্দিরপ্রাঙ্গণে, সে বৎসর বিংশ লক্ষ মুদ্রা দিয়া রচি তব স্বর্ণদীপ্ত ঘর দেবতারে সমর্পিলে। সে দিন কহিলা ভগবান-- "আমার অনাদি ঘরে অগণ্য আলোক দীপ্যমান অনন্তনীলিমা-মাঝে; মোর ঘরে ভিত্তি চিরন্তন সত্য, শান্তি, দয়া, প্রেম। দীনশক্তি যে ক্ষুদ্র কৃপণ নাহি পারে গৃহ দিতে গৃহহীন নিজ প্রজাগণে সে আমারে গৃহ করে দান!' চলি গেলা সেই ক্ষণে পথপ্রান্তে তরুতলে দীন-সাথে দীনের আশ্রয়। অগাধ সমুদ্র-মাঝে স্ফীত ফেন যথা শূন্যময় তেমনি পরম শূন্য তোমার মন্দির বিশ্বতলে, স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্‌বুদ্‌!'                   রাজা জ্বলি রোষানলে, কহিলেন, "রে ভন্ড পামর, মোর রাজ্য ত্যাগ করে এ মুহূর্তে চলি যাও।'                   সন্ন্যাসী কহিলা শান্ত স্বরে, "ভক্তবৎসলেরে তুমি যেথায় পাঠালে নির্বাসনে সেইখানে, মহারাজ, নির্বাসিত কর ভক্তজনে।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
তুমি             কোন্ কাননের ফুল , তুমি           কোন্ গগনের তারা ! তোমায়         কোথায় দেখেছি যেন            কোন্ স্বপনের পারা ! কবে তুমি গেয়েছিলে , আঁখির পানে চেয়েছিলে ভুলে গিয়েছি । শুধু           মনের মধ্যে জেগে আছে , ঐ নয়নের তারা ।। তুমি             কথা কয়ো না , তুমি           চেয়ে চলে যাও । এই              চাঁদের আলোতে তুমি        হেসে গলে যাও । আমি            ঘুমের ঘোরে চাঁদের পানে চেয়ে থাকি মধুর প্রাণে , তোমার         আঁখির মতন দুটি তারা ঢালুক কিরণ - ধারা ।। (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
দূর আকাশের পথ উঠিছে জলদরথ, নিমেন চাহি দেখে কবি ধরণী নিদ্রিত। অস্ফুট চিত্রের মত নদ নদী পরবত, পৃথিবীর পটে যেন রয়েছে চিত্রিত! সমস্ত পৃথিবী ধরি একটি মুঠায় অনন্ত সুনীল সিন্ধু সুধীরে লুটায়। হাত ধরাধরি করি দিক্‌বালাগণ দাঁড়ায়ে সাগরতীরে ছবির মতন। কেহ বা জলদময় মাখায়ে জোছানা। নীল দিগন্তের কোলে পাতিছে বিছানা। মেখের শয্যায় কেহ ছড়ায়ে কুন্তল নীরবে ঘুমাইতেছে নিদ্রায় বিহ্বল। সাগরতরঙ্গ তার চরণে মিলায়, লইয়া শিথিল কেশ পবন খেলায়। কোন কোন দিক্‌বালা বসি কুতূহলে আকাশের চিত্র আঁকে সাগরের জলে। আঁকিল জলদমালা চন্দ্রগ্রহ তারা, রঞ্জিল সাগর দিয়া জোছনার ধারা। পাপিয়ার ধ্বনি শুনি কেহ হাসিমুখে প্রতিধ্বনিরমণীরে জাগায় কৌতুকে! শুকতারা প্রভাতের ললাটে ফুটিল, পূরবের দিক্‌দেবী জাগিয়া উঠিল। লোহিত কমলকরে পূরবের দ্বার খুলিয়া, সিন্দূর দিল সীমন্তে উষার। মাজি দিয়া উদয়ের কনকসোপান, তপনের সারথিরে করিল আহ্বান। সাগর-ঊর্ম্মির শিরে সোনার চরণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে নেচে গেল দিক্‌বালাগণ। পূরবদিগন্ত-কোলে জলদ ঙ্গছায়ে ধরণীর মুখ হ’তে আঁধার মুছায়ে, বিমল শিশিরজলে ধুইয়া চরণ, নিবিড় কুন্তলে মাখি কনককিরণ, সোনার মেঘের মত আকাশের তলে, কনককমলসম মানসের জলে ভাসিতে লাগিল যত দিক্‌-বালাগণে— উলসিত তনুখানি প্রভাতপবনে। ওই হিমগিরি-’পরে কোন দিক্‌বালা রঞ্জিছে কনককরে নীহারিকামালা! নিভৃতে সরসীজলে করিতেছে স্নান, ভাসিছে কমলবনে কমলবয়ান। তীরে উঠি মালা গাঁথি শিশিরের জলে পরিছে তুষারশুভ্র সুকুমার গলে। ওদিকে দেখেছ ওই সাহারা-প্রান্তরে, মধ্যে দিক্‌দেবী শুভ্র বালুকার ‘পরে। অঙ্গ হতে ছুটিতেছে জ্বলন্ত কিরণ, চাহিতে মুখের পানে ঝলসে নয়ন। আঁকিছে বালুকাপুঞ্জে শত শত রবি, আঁকিছে দিগন্তপটে মরীচিকা-ছবি। অন্য দিকে কাশ্মীরের উপত্যকা-তলে পরি শত বরণের ফুলমালা গলে, শত বিহঙ্গের গান শুনিতে শুনিতে, সরসীলহরীমালা গুনিতে গুনিতে, এলায়ে কোমল তনু কমলকাননে আলসে দিকের বালা মগন স্বপনে। ওই হোথা দিক্‌দেবী বসিয়া হরষে ঘুরায় ঋতুর চক্র মৃদুল পরশে। ফুরায়ে গিয়েছে এবে শীতসমীরণ, বসন্ত পৃথিবীতলে অর্পিবে চরণ। পাখীরে গাহিতে কহি অরণ্যের গান মলয়ের সমীরণে করিয়া আহ্বান বনদেবীদের কাছে কাননে কাননে কহিল ফুটাতে ফুলদিক‍্‌দেবীগণে— বহিল মলয়বায়ু কাননে ফিরিয়া, পাখীরা গাহিল গান কানন ভরিয়া। ফুলবালা-সাথে আসি বনদেবীগণ ধীরে দিক‍্‌দেবীদের বন্দিল চরণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
হেথাও তো পশে সূর্যকর! ঘোর ঝটিকার রাতে দারুণ অশনিপাতে বিদীরিল যে গিরিশিখর, বিশাল পর্বত কেটে পাষাণহৃদয় ফেটে প্রকাশিল যে ঘোর গহ্বর, প্রভাতে পুলকে ভাসি বহিয়া নবীন হাসি হেথাও তো পশে সূর্যকর! দুয়ারেতে উঁকি মেরে ফিরে তো যায় না সে রে, শিহরি উঠে না আশঙ্কায়-- ভাঙা পাষাণের বুকে খেলা করে কোন্ সুখে, হেসে আসে, হেসে চলে যায় । হেরো হেরো, হায় হায়, যত প্রতিদিন যায়, কে গাঁথিয়া দেয় তৃণজাল-- লতাগুলি লতাইয়া বাহুগুলি বিথাইয়া ঢেকে ফেলে বিদীর্ণ কঙ্কাল । বজ্রদগ্ধ অতীতের নিরাশার অতিথের ঘোর স্তব্ধ সমাধি-আবাস ফুল এসে পাতা এসে কেড়ে নেয় হেসে হেসে, অন্ধকারে করে পরিহাস । এরা সব কোথা ছিল, কেই বা সংবাদ দিল, গৃহহারা আনন্দের দল-- বিশ্বে তিল শূন্য হলে অনাহূত আসে চলে, বাসা বেঁধে করে কোলাহল । আনে হাসি, আনে গান, আনে রে নূতন প্রাণ সঙ্গে করে আনে রবিকর-- অশোক শিশুর প্রায় এত হাসে এত গায়, কাঁদিতে দেয় না অবসর । বিষাদ বিশালকায়া ফেলেছে আঁধার ছায়া, তারে এরা করে না তো ভয়-- চারি দিক হতে তারে ছোটো ছোটো হাসি মারে, অবশেষে করে পরাজয়।। এই-যে রে মরুস্থল দাবদগ্ধ ধরাতল, এখানেই ছিল পুরাতন-- একদিন ছিল তার শ্যামল যৌবনভার, ছিল তার দক্ষিণপবন । যদি রে সে চলে গেল, সঙ্গে যদি নিয়ে গেল গীত গান হাসি ফুল ফল, শুষ্ক স্মৃতি কেন মিছে রেখে তবে গেল পিছে-- শুষ্ক শাখা, শুষ্ক ফুলদল । সে কি চায় শুষ্ক বনে গাহিবে বিহঙ্গগণে আগে তারা গাহিত যেমন, আগেকার মতো করে স্নেহে তার নাম ধরে উচ্ছ্বসিবে বসন্তপবন! নহে নহে, সে কি হয়! সংসার জীবনময়, নাহি হেথা মরণের স্থান । আয় রে নূতন, আয়, সঙ্গে করে নিয়ে আয় তোর সুখ তোর হাসি গান । ফোটা নব ফুলচয়, ওঠা নব কিশলয়, নবীন বসন্ত আয় নিয়ে । যে যায় সে চলে যাক-- সব তার নিয়ে যাক, নাম তার যাক মুছে দিয়ে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু প্রিয়করকমলে বন্ধু,যেদিন ধরণী ছিল ব্যথাহীন বাণীহীন মরু, প্রাণের আনন্দ নিয়ে, শঙ্কা নিয়ে, দুঃখ নিয়ে, তরু দেখা দিল দারুণ নির্জনে। কত যুগ-যুগান্তরে কান পেতে ছিল স্তব্ধ মানুষের পদশব্দ তরে নিবিড় গহনতলে। যবে এল মানব অতিথি, দিল তারে ফুল ফল, বিস্তারিয়া দিল ছায়াবীথি। প্রাণের আদিমভাষা গূঢ় ছিল তাহার অন্তরে, সম্পূর্ণ হয় নি ব্যক্ত আন্দোলনে ইঙ্গিতে মর্মরে। তার দিনরজনীর জীবযাত্রা বিশ্বধরাতলে চলেছিল নানা পথে শব্দহীন নিত্যকোলাহলে সীমাহীন ভবিষ্যতে; আলোকের আঘাতে তনুতে প্রতিদিন উঠিয়াছে চঞ্চলিত অণুতে অণুতে স্পন্দবেগে নিঃশব্দ ঝংকারগীতি; নীরব স্তবনে সূর্যের বন্দনাগান গাহিয়াছে প্রভাতপবনে। প্রাণের প্রথমবাণী এইমতো জাগে চারিভিতে তৃণে তৃণে বনে বনে, তবু তাহা রয়েছে নিভৃতে-- কাছে থেকে শুনি নাই; হে তপস্বী, তুমি একমনা নিঃশব্দেরে বাক্য দিলে; অরণ্যের অন্তরবেদনা শুনেছ একান্তে বসি; মূক জীবনের যে ক্রন্দন ধরণীর মাতৃবক্ষে নিরন্তর জাগাল স্পন্দন অঙ্কুরে অঙ্কুরে উঠি, প্রসারিয়া শত ব্যগ্র শাখা, পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া শিকড়ে শিকড়ে আঁকাবাঁকা জন্মমরণের দ্বন্দ্বে, তাহার রহস্য তব কাছে বিচিত্র অক্ষররূপে সহসা প্রকাশ লভিয়াছে। প্রাণের আগ্রহবার্তা নির্বাকের অন্তঃপুত হতে অন্ধকার পার করি আনি দিলে দৃষ্টির আলোতে। তোমার প্রতিভাদীপ্ত চিত্তমাঝে কহে আজি কথা তরুর মর্মর সাথে মানব-মর্মের আত্মীয়তা; প্রাচীন আদিমতম সম্বন্ধের দেয় পরিচয়। হে সাধকশ্রেষ্ঠ, তব দুঃসাধ্য সাধন লভে জয়-- সতর্ক দেবতা যেথা গুপ্তবাণী রেখেছেন ঢাকি সেথা তুমি দীপ্তহস্তে অন্ধকারে পশিলে একাকী, জাগ্রত করিলে তারে। দেবতা আপন পরাভবে যেদিন প্রসন্ন হন, সেদিন উদার জয়রবে ধ্বনিত অমরাবতী আনন্দে রচিয়া দেয় বেদি বীর বিজয়ীর তরে, যশের পতাকা অভ্রভেদী মর্তের চূড়ায় উড়ে।                        মনে আছে একদা যেদিন আসন প্রচ্ছন্ন তব, অশ্রদ্ধার অন্ধকারে লীন, ঈর্ষাকণ্টকিত পথে চলেছিলে ব্যথিত চরণে, ক্ষুদ্র শত্রুতার সাথে প্রতিক্ষণে অকারণ রণে হয়েছ পীড়িত শ্রান্ত। সে দুঃখই তোমার পাথেয়, সে অগ্নি জ্বেলেছে যাত্রাদীপ, অবজ্ঞা দিয়েছে শ্রেয়, পেয়েছ সম্বল তব আপনার গভীর অন্তরে। তোমার খ্যাতির শঙ্খ আজি বাজে দিকে দিগন্তরে সমুদ্রের এ কূলে ও কূলে; আপন দীপ্তিতে আজি বন্ধু, তূমি দীপ্যমান; উচ্ছ্বসি উঠিছে বাজি বিপুল কীর্তির মন্ত্র তোমার আপন কর্মমাঝে। জ্যোতিষ্কসভার তলে যেথা তব আসন বিরাজে সেথায় সহস্রদীপ জ্বলে আজি দীপালি-উৎসবে! আমারো একটি দীপ তারি সাথে মিলাইনু যবে চেয়ে দেখো তার পানে, এ দীপ বন্ধুর হাতে জ্বালা; তোমার তপস্যাক্ষেত্র ছিল যবে নিভৃত নিরালা। বাধায় বেষ্টিত রুদ্ধ, সেদিন সংশয়সন্ধ্যাকালে কবি-হাতে বরমাল্য সে-বন্ধু পরায়েছিল ভালে; অপেক্ষা করে নি সে তো জনতার সমর্থন তরে, দুর্দিনে জ্বেলেছে দীপ রিক্ত তব অর্ঘ্যথালি-'পরে। আজি সহস্রের সাথে ঘোষিল সে, "ধন্য ধন্য তুমি, ধন্য তব বন্ধুজন, ধন্য তব পুণ্য জন্মভূমি।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তব   সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে, মোরবিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে। একলা বসে আপন-মনে গাইতেছিলেম গান, তোমার কানে গেল সে সুর এলে তুমি নেমে, মোর   বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে।তোমার সভায় কত-না গান কতই আছেন গুণী; গুণহীনের গানখানি আজ বাজল তোমার প্রেমে। লাগল বিশ্বতানের মাঝে একটি করুণ সুর, হাতে লয়ে বরণমালা এলে তুমি নেমে, মোর  বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে।২৭ চৈত্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
কেন গো এমন স্বরে বাজে তার বাঁশি - মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া, রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া! কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায়, ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে - হায়, যদি এত লজ্জা কথায় কথায়, হায়, যদি এত শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে! কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল, কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া! আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল - এরই তরে এত তৃষ্ণা, এ কাহার মায়া! মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা - খেলা যদি, কেন হেন মর্মভেদী খেলা!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শোকমূলক
দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর পর বয়স না হতে হতে পুরা দু বছর। এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন স্বামীরেও হারালো মল্লিকা। বন্ধুজন বুঝাইল--- পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ, এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ। শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়া ফিরে। ব্রতধ্যান-উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে কাটে দিন ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে, পূজাগৃহে; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি; শুনে রামায়ণকথা; সন্ন্যাসী-সাধুরে ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে। বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্ব-নীচে সবার প্রসন্ন দৃষ্টি অভাগী মাগিছে আপন সন্তান-লাগি; সূর্য চন্দ্র হতে পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি--- কোনোমতে কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে, পাছে কেহ করে ক্ষোভ, অজানা কারণে পাছে কারো লাগে ব্যথা, সকলের কাছে আকুল বেদনা-ভরে দীন হয়ে আছে।যখন বছর-দেড় বয়স শিশুর--- যকৃতের ঘটিল বিকার; জ্বরাতুর দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে। দেবালয়ে মানিল মানত মাতা, পদামৃত লয়ে করাইল পান, হরিসংকীর্তন-গানে কাঁপিল প্রাঙ্গণ। ব্যাধি শান্তি নাহি মানে। কাঁদিয়া শুধালো নারী, ``ব্রাহ্মণঠাকুর, এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর! দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই, দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই! তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে! এত ক্ষুধা দেবতার! এত ভারে ভারে নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা, সর্বস্ব খাওয়ানু তবু ক্ষুধা মিটিল না!' ব্রাহ্মণ কহিল, 'বাছা, এ যে ঘোর কলি। অনেক করেছ বটে তবু এও বলি--- আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো? সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো? দানবীর কর্ণ-কাছে ধর্ম যবে এসে পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে, নিজ হস্তে সন্তানে কাটিল; তখনি সে শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে। শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে--- পাইল অক্ষয় দেহ। নিষ্ঠা এরে বলে। তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমণ্ডলে? মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি মার কাছে--- তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত মা-গঙ্গার কাছে। শেষে পুত্রজন্ম-পরে, অভাগী বিধবা হল; গেল সে সাগরে, কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা-গঙ্গারে ডেকে, 'মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে--- এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই, এ জন্মের তরে আর পুত্র-আশা নেই।' যেমনি জলেতে ফেলা, মাতা ভাগীরথী মকরবাহিনী-রূপে হয়ে মূর্তিমতী শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে মার কোলে সমর্পিল।--- নিষ্ঠা এরে বলে।'মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির ক'রে, আপনারে ধিক্কারিল--- 'এত দিন ধরে বৃথা ব্রত করিলাম, বৃথা দেবার্চনা--- নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।' ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন জ্বরাবেশে; অঙ্গ যেন অগ্নির মতন। ঔষধ গিলাতে যায় যত বার বার পড়ে যায়--- কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর। দন্তে দন্তে গেল আঁটি। বৈদ্য শির নাড়ি ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি। সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে একটি মলিন দীপ শয়নশিয়রে, একা শোকাতুরা নারী। শিশু একবার জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার খুঁজিল কাহারে। নারী কাঁদিল কাতর--- 'ও মানিক, ওরে সোনা, এই-যে মা তোর, এই-যে মায়ের কোল, ভয় কী রে বাপ।' বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার প্রাণপণে। সহসা বাতাসে গৃহদ্বার খুলে গেল; ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি; সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি পশিল গৃহের মাঝে। চমকিল নারী, দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্য়াতল ছাড়ি; কহিল, 'মায়ের ডাক ঐ শোনা যায়--- ও মোর দুখীর ধন, পেয়েছি উপায়--- তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল আছে ওরে বাছা।' জাগিয়াছে কলরোল অদূরে জাহ্নবীজলে, এসেছে জোয়ার পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্য ঘাট-পানে। কহিল, 'মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা, জুড়ায়ে। একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে একমনে।' এত বলি সমর্পিল জলে অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না। ধ্যানে নিরখিল বসি, মকরবাহনা জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে কোলে করে এসেছেন, রাখি তার শিরে একটি পদ্মের দল। হাসিমুখে ছেলে অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী-কোল ফেলে মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর। কহে দেবী, 'রে দুঃখিনী, এই তুই ধর্, তোর ধন তোরে দিনু।' রোমাঞ্চিতকায় নয়ন মেলিয়া কহে, 'কই মা... কোথায়!' পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী; গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি। চীত্‍‌কারি উঠিল নারী, 'দিবি নে ফিরায়ে!' মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
শ্রাবণের মোটা ফোঁটা বাজিল যূথীরে— কহিল, মরিনু হায় কার মৃত্যুতীরে! বৃষ্টি কহে, শুভ আমি নামি মর্তমাঝে, কারে সুখরূপে লাগে কারে দুঃখ বাজে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
শ্রাবণের কালো ছায়া নেমে আসে তমালের বনে যেন দিক্ললনার গলিত-কাজল-বরিষনে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বিশ্বের আলোকলুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল মৃত্যুদূত চুপে চুপে, জীবনের দিগন্ত আকাশে যত ছিল সূক্ষ্ম ধূলি স্তরে স্তরে দিল ধৌত করি ব্যথার দ্রাবক রসে দারুণ স্বপ্নের তলে তলে চলেছিল পলে পলে দৃঢ়হস্তে নিঃশব্দে মার্জনা । কোন্‌ক্ষণে নটলীলা-বিধাতার নব নাট্যভূমে উঠে গেল যবনিকা। শূন্য হতে জ্যোতির তর্জনী স্পর্শ দিল একপ্রান্তে স্তম্ভিত বিপুল অন্ধকারে, আলোকের থরহর শিহরণ চমকি চমকি ছুটিল বিদ্যুৎবেগে অসীম তন্দ্রার স্তূপে স্তূপে, দীর্ণ দীর্ণ করি’ দিল তারে। গ্রীষ্মরিক্ত অবলুপ্ত নদীপথে অকস্মাৎ প্লাবনের দুরন্ত ধারায় বন্যার প্রথম নৃত্য শুষ্কতার বক্ষে বিসর্পিয়া ধায় যথা শাখায় শাখায়;—সেইমতো জাগরণশূন্য আঁধারের গূঢ় নাড়ীতে নাড়ীতে, অন্তঃশীলা জ্যোতির্ধারা দিল প্রবাহিয়া। আলোকে আঁধারে মিলি চিত্তাকাশে অর্ধস্ফুট অস্পষ্টের রচিল বিভ্রম। অবশেষে দ্বন্দ্ব গেল ঘুচি’। পুরাতন সম্মোহের স্থূল কারা-প্রাচীর বেষ্টন, মুহূর্তেই মিলাইল কুহেলিকা। নূতন প্রাণের সৃষ্টি হোলো অবারিত স্বচ্ছ শুভ্র চৈতন্যের প্রথম প্রত্যূষ অভ্যুদয়ে। অতীতের সঞ্চয়-পুঞ্জিত দেহখানা, ছিল যাহা আসন্নের বক্ষ হতে ভবিষ্যের দিকে মাথা তুলি’ বিন্ধ্যগিরি ব্যবধান সম, আজ দেখিলাম প্রভাতের অবসন্ন মেঘ তাহা, স্রস্ত হয়ে পড়ে দিগন্ত বিচ্যুত। বন্ধমুক্ত আপনারে লভিলাম সুদূর অন্তরাকাশে ছায়াপথ পার হয়ে গিয়ে অলোক আলোকতীর্থে সূক্ষ্মতম বিলয়ের তটে।  (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
সে লড়াই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই যে যুদ্ধে ভাইকে মারে ভাই।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ, পড়িবে নয়ন-’পরে অন্তিম নিমেষ। পরদিনে এইমত পোহাইবে রাত, জাগ্রত জগৎ-’পরে জাগিবে প্রভাত। কলরবে চলিবেক সংসারের খেলা, সুখে দু:খে ঘরে ঘরে বহি যাবে বেলা। সে কথা স্মরণ করি নিখিলের পানে আমি আজি চেয়ে আছি উৎসুক নয়ানে। যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়, সকলই দুর্লভ ব’লে আজি মনে হয়। দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান, দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ। যা পাই নি তাও থাক্‌, যা পেয়েছি তাও, তুচ্ছ ব’লে যা চাই নি তাই মোরে দাও।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম, উঠিল কলস্বর । গাছের শাখে জাগিল পাখি, কুসুমে মধুকর । অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া, হস্তীশালে হাতি । মল্লশালে মল্ল জাগি ফুলায় পুন ছাতি । জাগিল পথে প্রহরীদল, দুয়ারে জাগে দ্বারী, আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা জাগিয়া নরনারী । উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রানীমাতা । কচলি আঁখি কুমার-সাথে জাগিল রাজভ্রাতা । নিভৃত ঘরে ধূপের বাস, রতন-দীপ জ্বালা, জাগিয়া উঠি শয্যাতলে শুধালো রাজবালা --- 'কে পরালে মালা ! 'খসিয়া-পড়া আঁচলখানি বক্ষে তুলে নিল । আপন-পানে নেহারি চেয়ে শরমে শিহরিল । ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে চাহিল চারি দিকে--- বিজন গৃহ, রতন-দীপ জ্বলিছে অনিমিখে । গলার মালা খুলিয়া লয়ে ধরিয়া দুটি করে সোনার সূতে যতনে গাঁথা লিখনখানি পড়ে। পড়িল নাম, পড়িল ধাম, পড়িল লিপি তার, কোলের 'পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার । শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা --- 'আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা, 'কে পরালে মালা !'নূতন-জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক, বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশ দিক । বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছাসে, নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে । জাগিয়া উঠে বৈতালিক গাহিছে জয়গান, প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান । শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি --- কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে, চলিছে পুরনারী । কাননপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা, আধেক মুদে নয়ন দুটি ভাবিছে রাজবালা --- 'কে পরালে মালা !'বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি--- দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি । শয়ন -'পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়, এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয় । জগতে আজ কত-না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে --- একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ নাহি বলে । বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হূহু, কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকছে কুহু কুহু । নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতালা, শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা--- 'কে পরালে মালা !'কেমন বীর-মুরতি তার মাধুরী দিয়ে মিশা ---- দীপ্তিভরা নয়ন-মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা । স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন এমনি মনে লয় --- ভুলিয়া গেছে রয়েছে শুধু অসীম বিস্ময় । পার্শ্বে যেন বসিয়াছিল, ধরিয়াছিল কর, এখনো তার পরশে যেন সরস কলেবর । চমকি মুখ দু হাতে ঢাকে, শরমে টুটে মন, লজ্জাহীন প্রদীপ কেন নিভে নি সেইক্ষণ ! কন্ঠ হতে ফেলিল হার যেন বিজুলিজ্বালা, শয়ন-'পরে লুটায়ে প'ড়ে ভাবিল রাজবালা --- 'কে পরালে মালা !'এমনি ধীরে একটি করে কাটিছে দিন রাতি । বসন্ত সে বিদায় নিল লইয়া যূথীজাতি । সঘন মেঘে বরষা আসে, বরষে ঝরঝর্, কাননে ফুটে নবমালতী কদম্বকেশর । স্বচ্ছহাসি শরৎ আসে পূর্ণিমামালিকা, সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা । আসিল শীত সঙ্গে লয়ে দীর্ঘ দুখনিশা, শিশির-ঝরা কুন্দফুলে হাসিয়া কাঁদে দিশা । ফাগুন-মাস আবার এল বহিয়া ফুলডালা, জানালা-পাশে একেলা বসে ভাবিছে রাজবালা --- 'কে পরালে মালা !'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
মাঝে মাঝে মনে হয়, শত কথা-ভারে হৃদয় পড়েছে যেন নুয়ে একেবারে। যেন কোন্‌ ভাবযজ্ঞ বহু আয়োজনে চলিতেছে অন্তরের সুদূর সদনে। অধীর সিন্ধুর মতো কলধ্বনি তার অতি দূর হতে কানে আসে বারম্বার। মনে হয় কত ছন্দ, কত-না রাগিণী, কত-না আশ্চর্য গাথা, অপূর্ব কাহিনী, যতকিছু রচিয়াছে যত কবিগণে সব মিলিতেছে আসি অপূর্ব মিলনে— এখনি বেদনাভরে ফাটি গিয়া প্রাণ উচ্ছ্বসি উঠিবে যেন সেই মহাগান। অবশেষে বুক ফেটে শুধু বলি আসি— হে চিরসুন্দর, আমি তোরে ভালবাসি।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
(১) স্বপ্ন আমার জোনাকি , দীপ্ত প্রাণের মণিকা , স্তব্ধ আঁধার নিশীথে উড়িছে আলোর কণিকা ॥ (২) আমার লিখন ফুটে পথধারে ক্ষণিক কালের ফুলে , চলিতে চলিতে দেখে যারা তারে চলিতে চলিতে ভুলে ॥ (৩) প্রজাপতি সেতো বরষ না গণে , নিমেষ গণিয়া বাঁচে , সময় তাহার যথেষ্ট তাই আছে ॥ (৪) দুঃখের আগুন কোন্ জ্যোতির্ময় পথরেখা টানে বেদনার পরপার পানে॥ (৫) দেবমন্দির-আঙিনাতলে শিশুরা করেছে মেলা। দেবতা ভোলেন পূজারি-দলে, দেখেন শিশুর খেলা॥ (৬) আকাশ ধরারে বাহুতে বেড়িয়া রাখে, তবুও আপনি অসীম সুদূরে থাকে॥ (৮) দূর এসেছিল কাছে– ফুরাইলে দিন, দূরে চলে গিয়ে আরো সে নিকটে আছে। (৯) দাঁড়ায়ে গিরি, শির মেঘে তুলে, দেখে না সরসীর বিনতি। অচল উদাসীর পদমূলে ব্যাকুল রূপসীর মিনতি॥ (১০) মেঘ সে বাষ্পগিরি, গিরি সে বাষ্পমেঘ, কালের স্বপ্নে যুগে যুগে ফিরি ফিরি এ কিসের ভাবাবেগ॥ (১১) দুই তীরে তার বিরহ ঘটায়ে সমুদ্র করে দান অতল প্রেমের অশ্রুজলের গান॥ (১২) পর্বতমালা আকাশের পানে চাহিয়া না কহে কথা, অগমের লাগি ওরা ধরণীর স্তম্ভিত ব্যাকুলতা॥ (১৩) একদিন ফুল দিয়েছিলে , হায় , কাঁটা বিঁধে গেছে তার । তবু , সুন্দর , হাসিয়া তোমায় করিনু নমস্কার ॥ (১৪) হে বন্ধু , জেনো মোর ভালোবাসা , কোনো দায় নাহি তার — আপনি সে পায় আপন পুরস্কার ॥ (১৫) স্বল্প সেও স্বল্প নয়, বড়োকে ফেলে ছেয়ে। দু-চারিজন অনেক বেশি বহুজনের চেয়ে॥ (১৬) মেঘের দল বিলাপ করে আঁধার হল দেখে , ভুলেছে বুঝি নিজেই তারা সূর্য দিল ঢেকে ॥ (১৭) অসীম আকাশ শূন্য প্রসারি রাখে, হোথায় পৃথিবী মনে মনে তার অমরার ছবি আঁকে॥ (১৮) আকর্ষণগুণে প্রেম এক ক’রে তোলে। শক্তি শুধু বেঁধে রাখে শিকলে শিকলে॥ (১৯) মহাতরু বহে বহু বরষের ভার। যেন সে বিরাট এক মুহূর্ত তার॥ (২০) স্তব্ধ অতল শব্দবিহীন মহাসমুদ্রতলে বিশ্ব ফেনার পুঞ্জ সদাই ভাঙিয়া জুড়িয়া চলে॥ (২১) মোর কাগজের খেলার নৌকা ভেসে চলে যায় সোজা বহিয়া আমার অকাজ দিনের অলস বেলার বোঝা॥ (২২) শিশির রবিরে শুধু জানে বিন্দুরূপে আপন বুকের মাঝখানে॥ (২৩) আপন অসীম নিষ্ফলতার পাকে মরু চিরদিন বন্দী হইয়া থাকে॥ (২৪) সাগরের কানে জোয়ার-বেলায় ধীরে কয় তটভূমি, “তরঙ্গ তব যা বলিতে চায় তাই লিখে দাও তুমি।’সাগর ব্যাকুল ফেন-অক্ষরে যতবার লেখে লেখা চির-চঞ্চল অতৃপ্তিভরে ততবার মোছে রেখা ॥ (২৫) স্তব্ধ হয়ে কেন্দ্র আছে, না দেখা যায় তারে চক্র যত নৃত্য করি ফিরিছে চারি ধারে ।। (২৬) জীবন-খাতার অনেক পাতাই এমনিতরো শূন্য থাকে; আপন মনের ধেয়ান দিয়ে পূর্ণ করে লও না তাকে। সেথায় তোমার গোপন কবি রচুক আপন স্বর্গছবি, পরশ করুক দৈববাণী সেথায় তোমার কল্পনাকে॥ (২৭) ভেবেছিনু গনি গনি লব সব তারা — গনিতে গনিতে রাত হয়ে যায় সারা , বাছিতে বাছিতে কিছু না পাইনু বেছে । আজ বুঝিলাম , যদি না চাহিয়া চাই তবেই তো একসাথে সব-কিছু পাই — সিন্ধুরে তাকায়ে দেখো , মরিয়ো না সেঁচে ॥ (২৮) আকাশ কভু পাতে না ফাঁদ কাড়িয়ে নিতে চাঁদে, বিনা বাঁধনে তাই তো চাঁদ, নিজেরে নিজে বাঁধে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
যে-ধরণী ভালোবাসিয়াছি তোমারে দেখিয়া ভাবি তুমি তারি আছ কাছাকাছি। হৃদয়ের বিস্তীর্ণ আকাশে উন্মুক্ত বাতাসে চিত্ত তব স্নিগ্ধ সুগভীর। হে শ্যামলা, তুমি ধীর, সেবা তব সহজ সুন্দর, কর্মেরে বেষ্টিয়া তব আত্মসমাহিত অবসর।                মাটির অন্তরে স্তরে স্তরে রবিরশ্মি নামে পথ করি, তারি পরিচয় ফুটে দিবসশর্বরী তরুলতিকায় ঘাসে, জীবনের বিচিত্র বিকাশে। তেমনি প্রচ্ছন্ন তেজ চিত্ততলে তব তোমার বিচিত্র চেষ্টা করে নব নব প্রাণমূর্তিময়, দেয় তারে যৌবন অক্ষয়।    প্রতিদিবসের সব কাজে সৃষ্টির প্রতিভা তব অক্লান্ত বিরাজে। তাই দেখি তোমার সংসার চিত্তের সজীব স্পর্শে সর্বত্র তোমার আপনার।           আষাঢ়ের প্রথম বর্ষণে মাটির যে-গন্ধ উঠে সিক্ত সমীরণে, ভাদ্রে যে-নদীটি ভরা কূলে কূলে, মাঘের শেষে যে-শাখা গন্ধঘন আমের মুকুলে, ধানের হিল্লোলে ভরা নবীন যে-খেত, অশ্বত্থের কম্পিত সংকেত, আশ্বিনে শিউলিতলে পূজাগন্ধ যে স্নিগ্ধ ছায়ার, জানি না এদের সাথে কী মিল তোমার।               দেখি ব'সে জানালার ধারে-- প্রান্তরের পারে নীলাভ নিবিড় বনে শীতসমীরণে চঞ্চল পল্লবঘন সবুজের 'পরে ঝিলিমিলি করে জনহীন মধ্যাহ্নের সূর্যের কিরণ, তন্দ্রাবিষ্ট আকাশের স্বপ্নের মতন। দিগন্তে মন্থর মেঘ, শঙ্খচিল উড়ে যায় চলি ঊর্ধ্বশূন্যে, কতমতো পাখির কাকলি, পীতবর্ণ ঘাস শুষ্ক মাঠে, ধরণীর বনগন্ধি আতপ্ত নিঃশ্বাস মৃদুমন্দ লাগে গায়ে, তখন সে-ক্ষণে অস্তিত্বের যে ঘনিষ্ঠ অনুভূতি ভরি উঠে মনে, প্রাণের যে প্রশান্ত পূর্ণতা, লভি তাই যখন তোমার কাছে যাই-- যখন তোমারে হেরি রহিয়াছ আপনারে ঘেরি গম্ভীর শান্তিতে, স্নিগ্ধ সুনিস্তব্ধ চিতে, চক্ষে তব অন্তর্যামী দেবতার উদার প্রসাদ সৌম্য আশীর্বাদ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আমার এই ছোটো কলসখানি সারা সকাল পেতে রাখি ঝরনাধারার নিচে। বসে থাকি একটি ধারে শেওলাঢাকা পিছল কালো পাথরটাতে। ঘট ভরে যায় বারে বারে-- ফেনিয়ে ওঠে, ছাপিয়ে পড়ে কেবলি। সবুজ দিয়ে মিনে-করা শৈলশ্রেণীর নীল আকাশে ঝর্‌ঝরানির শব্দ ওঠে দিনে রাতে। ভোরের ঘুমে ডাক শোনে তার গাঁয়ের মেয়েরা। জলের শব্দ যায় পেরিয়ে বেগনি রঙের বনের সীমানা, পাহাড়তলির রাস্তা ছেড়ে যেখানে ঐ হাটের মানুষ ধীরে ধীরে উঠছে চড়াইপথে, বলদ দুটোর পিঠে বোঝাই শুকনো কাঠের আঁটি; রুনুঝুনু ঘণ্টা গলায় বাঁধা। ঝর্‌ঝরানি আকাশ ছাপিয়ে ভাবনা আমার ভাসিয়ে নিয়ে কোথায় চলে পথহারানো দূর বিদেশে। রাঙা ছিল সকালবেলার প্রথম রোদের রং উঠল সাদা হয়ে। বক উড়ে যায় পাহাড় পেরিয়ে। বেলা হল ডাক পড়েছে ঘরে। ওরা আমায় রাগ ক'রে কয় "দেরি করলি কেন?" চুপ করে সব শুনি; ঘট ভরতে হয় না দেরি সবাই জানে, উপচে-পড়া জলের কথা বুঝবে না তো কেউ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, আউশের ক্ষেত জলে ভরভর, কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে। এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে। দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি, রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে। এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে। খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে। পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ, দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ, দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে। খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে। ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল, ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল, ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।                                  - শিলাইদহ ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৭
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
পাঠশালে হাই তোলে মতিলাল নন্দী; বলে, “পাঠ এগোয় না যত কেন মন দি।’ শেষকালে একদিন গেল চড়ি টঙ্গায়, পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাসালো মা-গঙ্গায়, সমাস এগিয়ে গেল, ভেসে গেল সন্ধি– পাঠ এগোবার তরে এই তার ফন্দি।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
লটারিতে পেল পীতু হাজার পঁচাত্তর, জীবনী লেখার লোক জুটিল সে-মাত্তর। যখনি পড়িল চোখে চেহারাটা চেক্‌টার “আমি পিসে’ কহে এসে ড্রেন্‌ইন্‌স্‌পেক্‌টার। গুরু-ট্রেনিঙের এক পিলেওয়ালা ছাত্তর অযাচিত এল তার কন্যার পাত্তর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
বেদনায় সারা মন করতেছে টনটন্‌ শ্যালী কথা বলল না সেই বৈরাগ্যে। মরে গেলে ট্রাস্‌টিরা করে দিক বণ্টন বিষয়-আশয় যত– সবকিছু যাক গে। উমেদারি-পথে আহা ছিল যাহা সঙ্গী– কোথা সে শ্যামবাজার কোথা চৌরঙ্গি– সেই ছেঁড়া ছাতা চোরে নেয় নাই ভাগ্যে– আর আছে ভাঙা ঐ হ্যারিকেন লণ্ঠন, বিশ্বের কাজে তারা লাগে যদি লাগ্‌ গে।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বসন্ত এসেছে বনে, ফুল ওঠে ফুটি, দিনরাত্রি গাহে পিক, নাহি তার ছুটি। কাক বলে, অন্য কাজ নাহি পেলে খুঁজি, বসন্তের চাটুগান শুরু হল বুঝি! গান বন্ধ করি পিক উঁকি মারি কয়, তুমি কোথা হতে এলে কে গো মহাশয়? আমি কাক স্পষ্টভাষী, কাক ডাকি বলে। পিক কয়, তুমি ধন্য, নমি পদতলে; স্পষ্টভাষা তব কণ্ঠে থাক বারো মাস, মোর থাক্‌ মিষ্টভাষা আর সত্যভাষ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বিদায়রথের ধ্বনি দূর হতে ওই আসে কানে। ছিন্নবন্ধনের শুধু কোনো শব্দ নাই কোনোখানে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
সন্ধেবেলায় বন্ধুঘরে জুটল চুপিচুপি গোপেন্দ্র মুস্তুফি। রাত্রে যখন ফিরল ঘরে সবাই দেখে তারিফ করে– পাগড়িতে তার জুতোজোড়া, পায়ে রঙিন টুপি। এই উপদেশ দিতে এল– সব করা চাই এলোমেলো, “মাথায় পায়ে রাখব না ভেদ’ চেঁচিয়ে বলে গুপি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
পথের পথিক করেছ আমায় সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। আলেয়া জ্বালালে প্রান্তরভালে সেই আলো মোর সেই আলো। ঘাটে বাঁধা ছিল খেয়াতরী, তাও কি ডুবালে ছল করি। সাঁতারিয়া পার হব বহি ভার সেই ভালো মোর সেই ভালো।ঝড়ের মুখে যে ফেলেছ আমায় সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। সব সুখজালে বজ্র জ্বালালে সেই আলো মোর সেই আলো। সাথি যে আছিল নিলে কাড়ি– কী ভয় লাগালে, গেল ছাড়ি– একাকীর পথে চলিব জগতে সেই ভালো মোর সেই ভালো।কোনো মান তুমি রাখ নি আমার সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। হৃদয়ের তলে যে আগুন জ্বলে সেই আলো মোর সেই আলো। পাথেয় যে ক’টি ছিল কড়ি পথে খসি কবে গেছে পড়ি, শুধু নিজবল আছে সম্বল সেই ভালো মোর সেই ভালো।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
থাকে সে কাহালগাঁয়; কলুটোলা আফিসে রোজ আসে দশটায় এক্কায় চাপি সে। ঠিক যেই মোড়ে এসে লাগাম গিয়েছে ফেঁসে, দেরি হয়ে গেল ব’লে ভয়ে মরে কাঁপি সে– ঘোড়াটার লেজ ধ’রে করে দাপাদাপি সে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
এক যে ছিল রাজা সেদিন   আমায় দিল সাজা । ভোরের রাতে উঠে আমি     গিয়েছিলুম ছুটে , দেখতে ডালিম গাছে বনের    পিরভু কেমন নাচে । ডালে ছিলেম চড়ে , সেটা     ভেঙেই গেল পড়ে । সেদিন হল মানা আমার   পেয়ারা পেড়ে আনা , রথ দেখতে যাওয়া , আমার   চিঁড়ের পুলি খাওয়া । কে দিল সেই সাজা , জান      কে ছিল সেই রাজা ? এক যে ছিল রানী আমি     তার কথা সব মানি । সাজার খবর পেয়ে আমায়   দেখল কেবল চেয়ে । বললে না তো কিছু , কেবল   মুখটি করে নিচু আপন ঘরে গিয়ে সেদিন   রইল আগল দিয়ে । হল না তার খাওয়া , কিংবা    রথ দেখতে যাওয়া । নিল আমায় কোলে সাজার   সময় সারা হলে । গলা ভাঙা - ভাঙা তার     চোখ - দুখানি রাঙা । কে ছিল সেই রানী আমি     জানি জানি জানি ।   (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
তোমার যে ছায়া তুমি দিলে আরশিরে হাসিমুখ মেজে, সেইক্ষণে অবিকল সেই ছায়াটিরে ফিরে দিল সে যে। রাখিল না কিছু আর, স্ফটিক সে নির্বিকার আকাশের মতো-- সেথা আসে শশী রবি, যায় চলে, তার ছবি কোথা হয় গত।একদিন শুধু মোরে ছায়া দিয়ে, শেষে সমাপিলে খেলা আত্মভোলা বসন্তের উন্মত্ত নিমেষে শুক্ল সন্ধ্যাবেলা। সে ছায়া খেলারই ছলে নিয়েছিনু হিয়াতলে হেলাভরে হেসে, ভেবেছিনু চুপে চুপে ফিরে দিব ছায়ারূপে তোমারি উদ্দেশে।সে ছায়া তো ফিরিল না, সে আমার প্রাণে হল প্রাণবান। দেখি, ধরা পড়ে গেল কবে মোর গানে তোমার সে দান। যদিবা দেখিতে তারে পারিতে না চিনিবারে অয়ি এলোকেশী-- আমার পরান পেয়ে সে আজি তোমারো চেয়ে বহুগুণে বেশি।কেমনে জানিবে তুমি তারে সুর দিয়ে দিয়েছি মহিমা। প্রেমের অমৃতস্নানে সে যে, অয়ি প্রিয়ে, হারায়েছে সীমা। তোমার খেয়াল ত্যেজে পূজার গৌরবে সে যে পেয়েছে গৌরব। মর্তের স্বপন ভুলে অমরাবতীর ফুলে লভিল সৌরভ। ৯ মাঘ, ১৩৩৮
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
কেউ চেনা নয় সব মানুষই অজানা। চলেছে আপনার রহস্যে আপনি একাকী। সেখানে তার দোসর নেই। সংসারের ছাপমারা কাঠামোয় মানুষের সীমা দিই বানিয়ে। সংজ্ঞার বেড়া-দেওয়া বসতির মধ্যে বাঁধা মাইনের কাজ করে সে। থাকে সাধারণের চিহ্ন নিয়ে ললাটে। এমন সময় কোথা থেকে ভালোবাসার বসন্ত-হাওয়া লাগে, সীমার আড়ালটা যায় উড়ে, বেরিয়ে পড়ে চির-অচেনা। সামনে তাকে দেখি স্বয়ংস্বতন্ত্র, অপূর্ব, অসাধারণ, তার জুড়ি কেউ নেই। তার সঙ্গে যোগ দেবার বেলায় বাঁধতে হয় গানের সেতু, ফুলের ভাষায় করি তার অভ্যর্থনা। চোখ বলে, যা দেখলুম, তুমি আছ তাকে পেরিয়ে। মন বলে চোখে-দেখা কানে-শোনার ওপারে যে রহস্য তুমি এসেছ সেই অগমের দূত,-- রাত্রি যেমন আসে পৃথিবীর সামনে নক্ষত্রলোক অবারিত ক'রে। তখন হঠাৎ দেখি আমার মধ্যেকার অচেনাকে, তখন আপন অনুভবের তল খুঁজে পাইনে, সেই অনুভব "তিলে তিলে নূতন হোয়।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
যদি       খোকা না হয়ে আমি     হতেম কুকুর-ছানা— তবে     পাছে তোমার পাতে আমি     মুখ দিতে যাই ভাতে তুমি     করতে আমায় মানা? সত্যি করে বল্‌ আমায়   করিস নে মা, ছল— বলতে আমায় ‘দূর দূর দূর। কোথা থেকে এল এই কুকুর'? যা মা, তবে যা মা, আমায়   কোলের থেকে নামা। আমি    খাব না তোর হাতে, আমি    খাব না তোর পাতে। যদি      খোকা না হয়ে আমি     হতেম তোমার টিয়ে, তবে     পাছে যাই মা, উড়ে আমায়   রাখতে শিকল দিয়ে? সত্যি করে বল্‌ আমায়   করিস নে মা, ছল— বলতে আমায় ‘হতভাগা পাখি শিকল কেটে দিতে চায় রে ফাঁকি'? তবে নামিয়ে দে মা, আমায়   ভালোবাসিস নে মা। আমি     রব না তোর কোলে, আমি     বনেই যাব চলে।   (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে এ বিস্ময় মনে আজ জাগে-- লক্ষকোটি নক্ষত্রের অগ্নিনির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা ছুটেছে অচিন্ত্য বেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া দিকে দিকে, তমোঘন অন্তহীন সেই আকাশের বক্ষস্তলে অকস্মাৎ করেছি উত্থান অসীম সৃষ্টির যজ্ঞে মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গের মতো ধারাবাহী শতাব্দীর ইতিহাসে। এসেছি সে পৃথিবীতে যেথা কল্প কল্প ধরি প্রাণপঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ হতে উঠি জড়ের বিরাট অঙ্কতলে উদ্‌ঘাটিল আপনার নিগূঢ় আশ্চর্য পরিচয় শাখায়িত রূপে রূপান্তরে। অসম্পূর্ণ অস্তিত্বের মোহাবিষ্ট প্রদোষের ছায়া আচ্ছন্ন করিয়া ছিল পশুলোক দীর্ঘ যুগ ধরি; কাহার একাগ্র প্রতীক্ষায় অসংখ্য দিবসরাত্রি-অবসানে মন্থরগমনে এল মানুষ প্রাণের রঙ্গভূমে; নূতন নূতন দীপ একে একে উঠিতেছে জ্বলে, নূতন নূতন অর্থ লভিতেছে বাণী; অপূর্ব আলোকে মানুষ দেখিছে তার অপরূপ ভবিষ্যের রূপ, পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের ধীরে ধীরে প্রকাশের পালা-- আমি সে নাট্যের পাত্রদলে পরিয়াছি সাজ। আমারো আহ্বান ছিল যবনিকা সরাবার কাজে, এ আমার পরম বিস্ময়। সাবিত্রী পৃথিবী এই, আত্মার এ মর্তনিকেতন, আপনার চতুর্দিকে আকাশে আলোকে সমীরণে ভূমিতলে সমুদ্রে পর্বতে কী গূঢ় সংকল্প বহি করিতেছে সূর্যপ্রদক্ষিণ-- সে রহস্যসূত্রে গাঁথা এসেছিনু আশি বর্ষ আগে, চলে যাব কয় বর্ষ পরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে দিবানিশি গাহে শুধু প্রেমের বিলাপ । নবীন চাঁদের করে একটি হরিণী আমাদের গৃহদ্বারে আরামে ঘুমায় । তার শান্ত নিদ্রাকালে নিশ্বাস পতনে প্রহর গণিতে পারি স্তব্ধ রজনীর । সুখের আবাসে সেই কাটাব জীবন , দুজনে উঠিব মোরা , দুজনে বসিব , নীল আকাশের নীচে ভ্রমিব দুজনে , বেড়াইব মাঠে মাঠে উঠিব পর্বতে সুনীল আকাশ যেথা পড়েছে নামিয়া । অথবা দাঁড়াব মোরা সমুদ্রের তটে , উপলমণ্ডিত সেই স্নিগ্ধ উপকূল তরঙ্গের চুম্বনেতে উচছ্বাসে মাতিয়া থর থর কাঁপে আর জ্বল ' জ্বল ' জ্বলে! যত সুখ আছে সেথা আমাদের হবে , আমরা দুজনে সেথা হব দুজনের , অবশেষে বিজন সে দ্বীপের মাঝারে ভালোবাসা , বেঁচে থাকা , এক হ ' য়ে যাবে । মধ্যাহ্নে যাইব মোরা পর্বতগুহায় , সে প্রাচীন শৈল-গুহা স্নেহের আদরে অবসান রজনীর মৃদু জোছনারে রেখেছে পাষাণ কোলে ঘুম পাড়াইয়া । প্রচ্ছন্ন আঁধারে সেথা ঘুম আসি ধীরে হয়তো হরিবে তোর নয়নের আভা । সে ঘুম অলস প্রেমে শিশিরের মতো । সে ঘুম নিভায়ে রাখে চুম্বন-অনল আবার নূতন করি জ্বালাবার তরে । অথবা বিরলে সেথা কথা কব মোরা , কহিতে কহিতে কথা , হৃদয়ের ভাব এমন মধুর স্বরে গাহিয়া উঠিবে আর আমাদের মুখে কথা ফুটিবে না । মনের সে ভাবগুলি কথায় মরিয়া আমাদের চোখে চোখে বাঁচিয়া উঠিবে! চোখের সে কথাগুলি বাক্যহীন মনে ঢালিবে অজস্র স্রোতে নীরব সংগীত , মিলিবেক চৌদিকের নীরবতা সনে । মিশিবেক আমাদের নিশ্বাসে নিশ্বাসে । আমাদের দুই হৃদি নাচিতে থাকিবে , শোণিত বহিবে বেগে দোঁহার শিরায় । মোদের অধর দুটি কথা ভুলি গিয়া ক ' বে শুধু উচছ্বসিত চুম্বনের ভাষা । দুজনে দুজন আর রব না আমরা , এক হয়ে যাব মোরা দুইটি শরীরে । দুইটি শরীর ? আহা তাও কেন হল ? যেমন দুইটি উল্কা জ্বলন্ত শরীর , ক্রমশ দেহের শিখা করিয়া বিস্তার স্পর্শ করে , মিশে যায় , এক দেহ ধরে , চিরকাল জ্বলে তবু ভস্ম নাহি হয় , দুজনেরে গ্রাস করি দোঁহে বেঁচে থাকে ; মোদের যমক-হৃদে একই বাসনা , দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে বাড়িয়া বাড়িয়া , তেমনি মিলিয়া যাবে অনন্ত মিলন । এক আশা রবে শুধু দুইটি ইচছার এই ইচছা রবে শুধু দুইটি হৃদয়ে , একই জীবন আর একই মরণ , একই স্বরগ আর একই নরক , এক অমরতা কিংবা একই নির্বাণ , হায় হায় এ কী হল এ কী হল মোর! আমার হৃদয় চায় উধাও উড়িয়া প্রেমের সুদূর রাজ্যে করিতে ভ্রমণ , কিন্তু গুরুভার এই মরতের ভাষা চরণে বেঁধেছে তার লোহার শৃঙ্খল । নামি বুঝি , পড়ি বুঝি , মরি বুঝি মরি ।                                — Shelley (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
আমি শুধু বলেছিলেম— ‘কদম গাছের ডালে পূর্ণিমা-চাঁদ আটকা পড়ে যখন সন্ধেকালে তখন কি কেউ তারে ধরে আনতে পারে। ' শুনে দাদা হেসে কেন বললে আমায়, ‘ খোকা, তোর মতো আর দেখি নাইকো বোকা। চাঁদ যে থাকে অনেক দূরে কেমন করে ছুঁই; আমি বলি, ‘দাদা, তুমি জান না কিচ্ছুই। মা আমাদের হাসে যখন ওই জানলার ফাঁকে তখন তুমি বলবে কি, মা অনেক দূরে থাকে। ' তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা, তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। ' দাদা বলে, ‘পাবি কোথায় অত বড়ো ফাঁদ। ' আমি বলি, ‘কেন দাদা, ওই তো ছোটো চাঁদ, দুটি মুঠোয় ওরে আনতে পারি ধরে। ' শুনে দাদা হেসে কেন বললে আমায়, ‘খোকা, তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। চাঁদ যদি এই কাছে আসত দেখতে কত বড়ো। ' আমি বলি, ‘কী তুমি ছাই ইস্কুলে যে পড়। মা আমাদের চুমো খেতে মাথা করে নিচু, তখন কি আর মুখটি দেখায় মস্ত বড়ো কিছু। ' তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা, তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। '(শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
গন্ধ চলে যায়, হায়, বন্ধ নাহি থাকে, ফুল তারে মাথা নাড়ি ফিরে ফিরে ডাকে। বায়ু বলে, যাহা গেল সেই গন্ধ তব, যেটুকু না দিবে তারে গন্ধ নাহি কব।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)