poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ওগো মা,
রাজার দুলাল যাবে আজি মোর
ঘরের সমুখপথে,
আজি এ প্রভাতে গৃহকাজ লয়ে
রহিব বলো কী মতে।
বলে দে আমায় কী করিব সাজ,
কী ছাঁদে কবরী বেঁধে লব আজ,
পরিব অঙ্গে কেমন ভঙ্গে
কোন্ বরনের বাস।
মা গো, কী হল তোমার, অবাক নয়নে
মুখপানে কেন চাস।
আমি দাঁড়াব যেথায় বাতায়নকোণে
সে চাবে না সেথা জানি তাহা মনে--
ফেলিতে নিমেষ দেখা হবে শেষ,
যাবে সে সুদূর পুরে,
শুধু সঙ্গের বাঁশি কোন্ মাঠ হতে
বাজিবে ব্যাকুল সুরে।
তবু রাজার দুলাল যাবে আজি মোর
ঘরের সমুখপথে,
শুধু সে নিমেষ লাগি না করিয়া বেশ
রহিব বলো কী মতে।ওগো মা,
রাজার দুলাল গেল চলি মোর
ঘরের সমুখপথে,
প্রভাতের আলো ঝলিল তাহার
স্বর্ণশিখর রথে।
ঘোমটা খসায়ে বাতায়নে থেকে
নিমেষের লাগি নিয়েছি মা দেখে,
ছিঁড়ি মণিহার ফেলেছি তাহার
পথের ধুলার 'পরে।
মা গো, কী হল তোমার, অবাক নয়নে
চাহিস কিসের তরে!
মোর হার-ছেঁড়া মণি নেয় নি কুড়ায়ে,
রথের চাকায় গেছে সে গুঁড়ায়ে
চাকার চিহ্ন ঘরের সমুখে
পড়ে আছে শুধু আঁকা।
আমি কী দিলেম কারে জানে না সে কেউ--
ধুলায় রহিল ঢাকা।
তবু রাজার দুলাল গেল চলি মোর
ঘরের সমুখপথে--
মোর বক্ষের মণি না ফেলিয়া দিয়া
রহিব বলো কী মতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
নৌকো বেঁধে কোথায় গেল, যা ভাই মাঝি ডাকতে
মহেশগঞ্জে যেতে হবে শীতের বেলা থাকতে।
পাশের গাঁয়ে ব্যাবসা করে ভাগ্নে আমার বলাই,
তার আড়তে আসব বেচে খেতের নতুন কলাই।
সেখান থেকে বাদুড়ঘাটা আন্দাজ তিনপোয়া,
যদুঘোষের দোকান থেকে নেব খইয়ের মোয়া।
পেরিয়ে যাব চন্দনীদ' মুন্সিপাড়া দিয়ে,
মালসি যাব, পুঁটকি সেথায় থাকে মায়ে ঝিয়ে।
ওদের ঘরে সেরে নেব দুপুরবেলার খাওয়া;
তারপরেতে মেলে যদি পালের যোগ্য হাওয়া
একপহরে চলে যাব মুখ্লুচরের ঘাটে,
যেতে যেতে সন্ধে হবে খড়কেডাঙার হাটে।
সেথায় থাকে নওয়াপাড়ায় পিসি আমার আপন,
তার বাড়িতে উঠব গিয়ে, করব রাত্রিযাপন।
তিন পহরে শেয়ালগুলো উঠবে যখন ডেকে
ছাড়ব শয়ন ঝাউয়ের মাথায় শুকতারাটি দেখে।
লাগবে আলোর পরশমণি পুব আকাশের দিকে,
একটু ক'রে আঁধার হবে ফিকে।
বাঁশের বনে একটি-দুটি কাক
দেবে প্রথম ডাক।
সদর পথের ঐ পারেতে গোঁসাইবাড়ির ছাদ
আড়াল করে নামিয়ে নেবে একাদশীর চাঁদ।
উসুখুসু করবে হাওয়া শিরীষ গাছের পাতায়,
রাঙা রঙের ছোঁয়া দেবে দেউল-চুড়োর মাথায়। বোষ্টমি সে ঠুনুঠুনু বাজাবে মন্দিরা,
সকালবেলার কাজ আছে তার নাম শুনিয়ে ফিরা।
হেলেদুলে পোষা হাঁসের দল
যেতে যেতে জলের পথে করবে কোলাহল।
আমারও পথ হাঁসের যে-পথ, জলের পথে যাত্রী,
ভাসতে যাব ঘাটে ঘাটে ফুরোবে যেই রাত্রি।
সাঁতার কাটব জোয়ার-জলে পৌঁছে উজিরপুরে,
শুকিয়ে নেব ভিজে ধুতি বালিতে রোদ্দুরে।
গিয়ে ভজনঘাটা
কিনব বেগুন পটোল মুলো, কিনব সজনেডাঁটা।
পৌঁছব আটবাঁকে,
সূর্য উঠবে মাঝগগনে, মহিষ নামবে পাঁকে।
কোকিল-ডাকা বকুল-তলায় রাঁধব আপন হাতে,
কলার পাতায় মেখে নেব গাওয়া ঘি আর ভাতে।
মাখনাগাঁয়ে পাল নামাবে, বাতাস যাবে থেমে;
বনঝাউ-ঝোপ রঙিয়ে দিয়ে সূর্য পড়বে নেমে।
বাঁকাদিঘির ঘাটে যাব যখন সন্ধে হবে
গোষ্ঠে-ফেরা ধেনুর হাম্বারবে।
ভেঙে-পড়া ডিঙির মতো হেলে-পড়া দিন
তারা-ভাসা আঁধার-তলায় কোথায় হবে লীন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
সব চেয়ে ভক্তি যার
অস্ত্রদেবতারে
অস্ত্র যত জয়ী হয়
আপনি সে হারে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
সকল আকাশ , সকল বাতাস ,
সকল শ্যামল ধরা ,
সকল কান্তি , সকল শান্তি
সন্ধ্যাগগন - ভরা ,
যত - কিছু সুখ যত সুধামুখ ,
যত মধুমাখা হাসি ,
যত নব নব বিলাসবিভব ,
প্রমোদমদিরারাশি ,
সকল পৃথ্বী , সকল কীর্তি ,
সকল অর্ঘ্যভার ,
বিশ্বমথন সকল যতন ,
সকল রতনহার ,
সব পাই যদি তবু নিরবধি
আরো পেতে চায় মন —
যদি তারে পাই তবে শুধু চাই
একখানি গৃহকোণ । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
ফেলো গো বসন ফেলো — ঘুচাও অঞ্চল ।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুরবালিকার বেশ কিরণবসন ।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল ,
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা ।
বিচিত্র বিশ্বের মাঝে দাঁড়াও একেলা ।
সর্বাঙ্গে পড়ুক তব চাঁদের কিরণ ,
সর্বাঙ্গে মলয় – বায়ু করুক সে খেলা ।
অসীম নীলিমা – মাঝে হও নিমগন
তারাময়ী বিবসনা প্রকৃতির মতো ।
অতনু ঢাকুক মুখ বসনের কোণে
তনুর বিকাশ হেরি লাজে শির নত ।
আসুক বিমল উষা মানবভবনে ,
লাজহীনা পবিত্রতা — শুভ্র বিবসনে । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে?
কেন নয়নের জল ঝরিছে বিফল
নয়নে!
এ বেশভূষণ লহ সখী, লহ,
এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ–
এমন যামিনী কাটিল বিরহ
শয়নে।
আজি যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে।
আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে
এসেছি।
বহি বৃথা মনোআশা এত ভালোবাসা
বেসেছি।
শেষে নিশিশেষে বদন মলিন,
ক্লান্ত চরণ, মন উদাসীন,
ফিরিয়া চলেছি কোন্ সুখহীন
ভবনে!
হায়, যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে?
কত উঠেছিল চাঁদ নিশীথ-অগাধ
আকাশে!
বনে দুলেছিল ফুল গন্ধব্যাকুল
বাতাসে।
তরুমর্মর নদীকলতান
কানে লেগেছিল স্বপ্নসমান,
দূর হতে আসি পশেছিল গান
শ্রবণে।
আজি সে রজনী যায়, ফিরাইব তায়
কেমনে।
মনে লেগেছিল হেন, আমারে সে যেন
ডেকেছে।
যেন চিরযুগ ধরে মোরে মনে করে
রেখেছে।
সে আনিবে বহি ভরা অনুরাগ,
যৌবননদী করিবে সজাগ,
আসিবে নিশীথে, বাঁধিবে সোহাগ-
বাঁধনে।
আহা, সে রজনী যায়, ফিরাইব তায়
কেমনে।
ওগো, ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কী হবে
মিছে আর?
যদি যেতে হল হায়, প্রাণ কেন চায়
পিছে আর?
কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো
রজনীপ্রভাতে বসে রব কত!
এবারের মতো বসন্ত গত
জীবনে।
হায় যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
দিয়েছ প্রশ্রয় মোরে, করুণানিলয়,
হে প্রভু, প্রত্যহ মোরে দিয়েছ প্রশ্রয়।
ফিরেছি আপন-মনে আলসে লালসে
বিলাসে আবেশে ভেসে প্রবৃত্তির বশে
নানা পথে, নানা ব্যর্থ কাজে– তুমি তবু
তখনো যে সাথে সাথে ছিলে মোর প্রভু,
আজ তাহা জানি। যে অলস চিন্তা-লতা
প্রচুরপল্লবাকীর্ণ ঘন জটিলতা
হৃদয়ে বেষ্টিয়া ছিল, তারি শাখাজালে
তোমার চিন্তার ফুল আপনি ফুটালে
নিগূঢ় শিকড়ে তার বিন্দু বিন্দু সুধা
গোপনে সিঞ্চন করি। দিয়ে তৃষ্ণা-ক্ষুধা,
দিয়ে দণ্ড-পুরস্কার সুখ-দুঃখ-ভয়
নিয়ত টানিয়া কাছে দিয়েছ প্রশ্রয়। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
শ্যামরে, নিপট কঠিন মন তোর।
রোয়ত রোয়ত সজনী রাধা
রজনী করত স ভোর।
একলি বিরল কুটীরে বৈঠত
চাহত যমুনা পানে,—
ছল ছল নয়ন, বচন নহি নিকসত,
পরাণ থেহ ন মানে ।
ঘোর গহন নিশি একলি রাধা
যায় কদম তৰুমূলে,
ভূমি শয়ন পর আকুল কুন্তল,
কাঁদই আপন ভূলে।
সহসা চমকয়ি চায় সখী কভু
মগন যখন গৃহ কাজে—ছূটি আসয়ি বোলে “শুনলো, ,
শ্যামক বাঁশরি বাজে।”
আনমনে সো অবলা বালা
বৈসয়ি গুৰুজন মাঝে,
তুয়া নাম বঁধু লিখত ভূমি পর,
চমকি মুছই পুন লাজে।
নিঠুর শ্যামরে, কৈসে অব তুঁহুঁ
রহত দূর মথুরায়—
ঘোর রজনী কৈস গোঁয়ায়সি
কৈস দিবস তব যায় !
কৈস মিটাওসি প্রেম পিপাসা
কঁহা বজাওসি বাঁশি?
পীতবাস তুঁহু কথিরে ছোড়লি,
কথি সো বঙ্কিম হাসি?
কনক হার অব পহিরলি কণ্ঠে,
কথি ফেকলি বন মালা?গোপী হৃদয় অঁধার করলিরে,
সিংহাসন কর অালা;
এ দুখ চিরদিন রহি গল মনমে,
ভানু কহে, ছি ছি কালা!
ঝটিতি আও তুহুঁ হমারি সাথে,
বিরহ ব্যাকুলা বালা । (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
অপরাহ্নে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে
পাহাড়িয়া যত।
একে একে দিল মোরে পুষ্পের মঞ্জরি
নমস্কারসহ।
ধরণী লভিয়াছিল কোন্ ক্ষণে
প্রস্তর আসনে বসি
বহু যুগ বহ্নিতপ্ত তপস্যার পরে এই বর,
এ পুষ্পের দান,
মানুষের জন্মদিনে উৎসর্গ করিবে আশা করি।
সেই বর, মানুষেরে সুন্দরের সেই নমস্কার
আজি এল মোর হাতে
আমার জন্মের এই সার্থক স্মরণ।
নক্ষত্রে-খচিত মহাকাশে
কোথাও কি জ্যোতিঃসম্পদের মাঝে
কখনো দিয়েছে দেখা এ দুর্লভ আশ্চর্য সম্মান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
সতীলোকে বসি আছে কত পতিব্রতা,
পুরাণে উজ্জ্বল আছে যাঁহাদের কথা।
আরো আছে শত লক্ষ অজ্ঞাতনামিনী
খ্যাতিহীনা কীর্তিহীনা কত-না কামিনী—
কেহ ছিল রাজসৌধে কেহ পর্ণঘরে,
কেহ ছিল সোহাগিনী কেহ অনাদরে;
শুধু প্রীতি ঢালি দিয়া মুছি লয়ে নাম
চলিয়া এসেছে তারা ছাড়ি মর্তধাম।
তারি মাঝে বসি আছে পতিতা রমণী
মর্তে কলঙ্কিনী, স্বর্গে সতীশিরোমণি।
হেরি তারে সতীগর্বে গরবিনী যত
সাধ্বীগণ লাজে শির করে অবনত।
তুমি কী জানিবে বার্তা, অন্তর্যামী যিনি
তিনিই জানেন তার সতীত্বকাহিনী। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
বরষে বরষে শিউলিতলায়
ব’স অঞ্জলি পাতি,
ঝরা ফুল দিয়ে মালাখানি লহ গাঁথি
এ কথাটি মনে জান’—
দিনে দিনে তার ফুলগুলি হবে মান,
মালার রূপটি বুঝি
মনের মধ্যে রবে কোনোখানে
যদি দেখ তারে খুঁজি।সিন্দুকে রহে বন্ধ,
হঠাৎ খুলিলে আভাসেতে পাও
পুরানো কালের গন্ধ। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
মোর কিছু ধন আছে সংসারে,
বাকি সব ধন স্বপনে
নিভৃতস্বপনে।
ওগো কোথা মোর আশার অতীত,
ওগো কোথা তুমি পরশচকিত,
কোথা গো স্বপনবিহারী।
তুমি এসো এসো গভীর গোপনে,
এসো গো নিবিড় নীরব চরণে
বসনে প্রদীপ নিবারি,
এসো গো গোপনে।
মোর কিছু ধন আছে সংসারে
বাকি সব আছে স্বপনে
নিভৃত স্বপনে।রাজপথ দিয়ে আসিয়ো না তুমি,
পথ ভরিয়াছে আলোকে
প্রখর আলোকে।
সবার অজানা, হে মোর বিদেশী,
তোমারে না যেন দেখে প্রতিবেশী,
হে মোর স্বপনবিহারী।
তোমারে চিনিব প্রাণের পুলকে,
চিনিব সজল আঁখির পলকে,
চিনিব বিরলে নেহারি
পরমপুলকে।
এসো প্রদোষের ছায়াতল দিয়ে,
এসো না পথের আলোকে
প্রখরআলোকে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
রক্তমাখা দন্তপংক্তি হিংস্র সংগ্রামের
শত শত নগরগ্রামের
অন্ত্র আজ ছিন্ন ছিন্ন করে;
ছুটে চলে বিভীষিকা মূর্ছাতুর দিকে দিগন্তরে।
বন্যা নামে যমলোক হতে,
রাজ্যসাম্রাজ্যের বাঁধ লুপ্ত করে সর্বনাশা স্রোতে।
যে লোভ-রিপুরে
লয়ে গেছে যুগে যুগে দূরে দূরে
সভ্য শিকারীর দল পোষমানা শ্বাপদের মতো,
দেশবিদেশের মাংস করেছে বিক্ষত,
লোলজিহ্বা সেই কুকুরের দল
অন্ধ হয়ে ছিঁড়িল শৃঙ্খল,
ভুলে গেল আত্মপর;
আদিম বন্যতা তার উদ্বারিয়া উদ্দাম নখর
পুরাতন ঐতিহ্যের পাতাগুলা ছিন্ন করে,
ফেলে তার অক্ষরে অক্ষরে
পঙ্কলিপ্ত চিহ্নের বিকার।
অসন্তুষ্ট বিধাতার
ওরা দূত বুঝি,
শত শত বর্ষের পাপের পুঁজি
ছড়াছড়ি করে দেয় এক সীমা হতে সীমান্তরে,
রাষ্ট্রমদমত্তদের মদ্যভান্ড চূর্ণ করে
আবর্জনাকুণ্ডতলে।
মানব আপন সত্তা ব্যর্থ করিয়াছে দলে দলে,
বিধাতার সংকল্পের নিত্যই করেছে বিপর্যয়
ইতিহাসময়।
সেই পাপে
আত্মহত্যা-অভিশাপে
আপনার সাধিছে বিলয়।
হয়েছে নির্দয়
আপন ভীষণ শত্রু আপনার 'পরে,
ধূলিসাৎ করে
ভুরিভোজী বিলাসীর
ভাণ্ডারপ্রাচীর।
শ্মশানবিহারবিলাসিনী
ছিন্নমস্তা,মুহূর্তেই মানুষের সুখস্বপ্ন জিনি
বক্ষ ভেদি দেখা দিল আত্মহারা,
শতস্রোতে নিজ রক্তধারা
নিজে করি পান।
এ কুৎসিত লীলা যবে হবে অবসান,
বীভৎস তান্ডবে
এ পাপযুগের অন্ত হবে,
মানব তপস্বীবেশে
চিতাভস্মশয্যাতলে এসে
নবসৃষ্টি-ধ্যানের আসনে
স্থান লবে নিরাসক্তমনে--
আজি সেই সৃষ্টির আহ্বান
ঘোষিছে কামান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোক-ভূলোকে
তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া ।
দিকে দিকে আজি টুটিয়া সকল বন্ধ
মুরতি ধরিয়া জাগিয়া উঠে আনন্দ ;
জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া ।চেতনা আমার কল্যাণ-রস-সরসে
শতদল-সম ফুটিল পরম হরষে
সব মধু তার চরণে তোমার ধরিয়া ।
নীরব আলোকে জাগিল হৃদয়প্রান্তে
উদার উষার উদয়-অরুণ কান্তি,
অলস আঁখির আবরণ গেল সরিয়া ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
কে তুমি ফিরিছ পরি প্রভুদের সাজ।
ছদ্মবেশে বাড়ে না কি চতুর্গুণ লাজ!
পরবস্ত্র অঙ্গে তব হয়ে অধিষ্ঠান
তোমারেই করিছে না নিত্য অপমান?
বলিছে না, “ওরে দীন, যত্নে মোরে ধরো,
তোমার চর্মের চেয়ে আমি শ্রেষ্ঠতর?”
চিত্তে যদি নাহি থাকে আপন সম্মান,
পৃষ্ঠে তবে কালো বস্ত্র কলঙ্কনিশান।
ওই তুচ্ছ টুপিখানা চড়ি তব শিরে
ধিক্কার দিতেছে না কি তব স্বজাতিরে।
বলিতেছে, “যে মস্তক আছে মোর পায়
হীনতা ঘুচেছে তার আমারি কৃপায়।”
সর্বাঙ্গে লাঞ্ছনা বহি এ কী অহংকার!
ওর কাছে জীর্ণ চীর জেনো অলংকার। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
চলেছে তরণী মোর শান্ত বায়ুভরে।
প্রভাতের শুভ্র মেঘ দিগন্তশিয়রে।
বরষার ভরা নদী তৃপ্ত শিশুপ্রায়
নিস্তরঙ্গ পুষ্ট-অঙ্গ নিঃশব্দে ঘুমায়।
দুই কূলে স্তব্ধ ক্ষেত্র শ্যামশস্যে ভরা,
আলস্যমন্থর যেন পূর্ণগর্ভা ধরা।
আজি সর্ব জলস্থল কেন এত স্থির?
নদীতে না হেরি তরী, জনশূন্য তীর।
পরিপূর্ণ ধরা-মাঝে বসিয়া একাকী
চিরপুরাতন মৃত্যু আজি ম্লান-আঁখি
সেজেছে সুন্দরবেশে, কেশে মেঘভার,
পড়েছে মলিন আলো ললাটে তাহার।
গুঞ্জরিয়া গাহিতেছে সকরুণ তানে,
ভুলায়ে নিতেছে মোর উতলা পরানে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
সাগরতীরে পাথরপিণ্ড ঢুঁ মারতে চায় কাকে,
বুঝি আকাশটাকে।
শান্ত আকাশ দেয় না কোনো জবাব,
পাথরটা রয় উঁচিয়ে মাথা, এমনি সে তার স্বভাব।
হাতের কাছেই আছে সমুদ্রটা,
অহংকারে তারই সঙ্গে লাগত যদি ওটা,
এমনি চাপড় খেত, তাহার ফলে
হুড়্মুড়িয়ে ভেঙেচুরে পড়ত অগাধ জলে।
ঢুঁ-মারা এই ভঙ্গীখানা কোটি বছর থেকে
ব্যঙ্গ ক'রে কপালে তার কে দিল ঐ এঁকে।
পণ্ডিতেরা তার ইতিহাস বের করেছেন খুঁজি;
শুনি তাহা, কতক বুঝি, নাইবা কতক বুঝি। অনেক যুগের আগে
একটা সে কোন্ পাগলা বাষ্প আগুন-ভরা রাগে
মা ধরণীর বক্ষ হতে ছিনিয়ে বাঁধন-পাশ
জ্যোতিষ্কদের ঊর্ধ্বপাড়ায় করতে গেল বাস।
বিদ্রোহী সেই দুরাশা তার প্রবল শাসন-টানে
আছাড় খেয়ে পড়ল ধরার পানে।
লাগল কাহার শাপ,
হারালো তার ছুটোছুটি, হারালো তার তাপ।
দিনে দিনে কঠিন হয়ে ক্রমে
আড়ষ্ট এক পাথর হয়ে কখন গেল জমে।
আজকে যে ওর অন্ধ নয়ন, কাতর হয়ে চায়
সম্মুখে কোন্ নিঠুর শূন্যতায়।
স্তম্ভিত চীৎকার সে যেন, যন্ত্রণা নির্বাক,
যে যুগ গেছে তার উদ্দেশে কণ্ঠহারার ডাক।
আগুন ছিল পাখায় যাহার আজ মাটি-পিঞ্জরে
কান পেতে সে আছে ঢেউয়ের তরল কলস্বরে;
শোনার লাগি ব্যগ্র তাহার ব্যর্থ বধিরতা
হেরে-যাওয়া সে-যৌবনের ভুলে-যাওয়া কথা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
১
জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার ।
অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা ,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয় ।২
তোমার বাঁশরি স্বরে বিমোহিত মন —
মানবেরা , ওই স্বর লক্ষ্য করি হায় ,
যত অগ্রসর হয় ততই যেমন
কোথায় বাজিছে তাহা বুঝিতে না পারে ।৩
চলিল মানব দেখো বিমোহিত হয়ে ,
পর্বতের অত্যুন্নত শিখর লঙ্ঘিয়া ,
তুচ্ছ করি সাগরের তরঙ্গ ভীষণ ,
মরুর পথের ক্লেশ সহি অনায়াসে ।৪
হিমক্ষেত্র , জনশূন্য কানন , প্রান্তর ,
চলিল সকল বাধা করি অতিক্রম ।
কোথায় যে লক্ষ্যস্থান খুঁজিয়া না পায় ,
বুঝিতে না পারে কোথা বাজিছে বাঁশরি ।৫
ওই দেখো ছুটিয়াছে আর-এক দল ,
লোকারণ্য পথমাঝে সুখ্যাতি কিনিতে ;
রণক্ষেত্রে মৃত্যুর বিকট মূর্তি মাঝে ,
শমনের দ্বার সম কামানের মুখে ।৬
ওই দেখো পুস্তকের প্রাচীর মাঝারে
দিন রাত্রি আর স্বাস্থ্য করিতেছে ব্যয় ।
পহুঁছিতে তোমার ও দ্বারের সম্মুখে
লেখনীরে করিয়াছে সোপান সমান ।৭
কোথায় তোমার অন্ত রে দুরভিলাষ
‘ স্বর্ণঅট্টালিকা মাঝে ?' তা নয় তা নয় ।
‘ সুবর্ণখনির মাঝে অন্ত কি তোমার ?'
তা নয় , যমের দ্বারে অন্ত আছে তব ।৮
তোমার পথের মাঝে , দুষ্ট অভিলাষ ,
ছুটিয়াছে মানবেরা সন্তোষ লভিতে ।
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা ,
তোমার পথের মাঝে সন্তোষ থাকে না!৯
নাহি জানে তারা হায় নাহি জানে তারা
দরিদ্র কুটির মাঝে বিরাজে সন্তোষ ।
নিরজন তপোবনে বিরাজে সন্তোষ ।
পবিত্র ধর্মের দ্বারে সন্তোষ আসন ।১০
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
তোমার কুটিল আর বন্ধুর পথেতে
সন্তোষ নাহিকো পারে পাতিতে আসন ।
নাহি পশে সূর্যকর আঁধার নরকে ।১১
তোমার পথেতে ধায় সুখের আশয়ে
নির্বোধ মানবগণ সুখের আশয়ে ;
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
কটাক্ষও নাহি করে সুখ তোমা পানে ।১২
সন্দেহ ভাবনা চিন্তা আশঙ্কা ও পাপ
এরাই তোমার পথে ছড়ানো কেবল
এরা কি হইতে পারে সুখের আসন
এ-সব জঞ্জালে সুখ তিষ্ঠিতে কি পারে ।১৩
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
নির্বোধ মানবগন নাহি জানে ইহা
পবিত্র ধর্মের দ্বারে চিরস্থায়ী সুখ
পাতিয়াছে আপনার পবিত্র আসন ।১৪
ওই দেখো ছুটিয়াছে মানবের দল
তোমার পথের মাঝে দুষ্ট অভিলাষ
হত্যা অনুতাপ শোক বহিয়া মাথায়
ছুটেছে তোমার পথে সন্দিগ্ধ হৃদয়ে ।১৫
প্রতারণা প্রবঞ্চনা অত্যাচারচয়
পথের সম্বল করি চলে দ্রুতপদে
তোমার মোহন জালে পড়িবার তরে ।
ব্যাধের বাঁশিতে যথা মৃগ পড়ে ফাঁদে ।১৬
দেখো দেখো বোধহীন মানবের দল
তোমার ও মোহময়ী বাঁশরির স্বরে
এবং তোমার সঙ্গী আশা উত্তেজনে
পাপের সাগরে ডুবে মুক্তার আশয়ে ।১৭
রৌদ্রের প্রখর তাপে দরিদ্র কৃষক
ঘর্মসিক্ত কলেবরে করিছে কর্ষণ
দেখিতেছে চারি ধারে আনন্দিত মনে
সমস্ত বর্ষের তার শ্রমের যে ফল ।১৮
দুরাকাঙ্ক্ষা হায় তব প্রলোভনে পড়ি
কর্ষিতে কর্ষিতে সেই দরিদ্র কৃষক
তোমার পথের শোভা মনোময় পটে
চিত্রিতে লাগিল হায় বিমুগ্ধ হৃদয়ে ।১৯
ওই দেখো আঁকিয়াছে হৃদয়ে তাহার
শোভাময় মনোহর অট্টালিকারাজি
হীরক মাণিক্য পূর্ণ ধনের ভাণ্ডার
নানা শিল্পে পরিপূর্ণ শোভন আপণ ।২০
মনোহর কুঞ্জবন সুখের আগার
শিল্প-পারিপাট্যযুক্ত প্রমোদভবন
গঙ্গা সমীরণ স্নিগ্ধ পল্লীর কানন
প্রজাপূর্ণ লোভনীয় বৃহৎ প্রদেশ ।২১
ভাবিল মুহূর্ত-তরে ভাবিল কৃষক
সকলই এসেছে যেন তারি অধিকারে
তারি ওই বাড়ি ঘর তারি ও ভাণ্ডার
তারি অধিকারে ওই শোভন প্রদেশ ।২২
মুহূর্তেক পরে তার মুহূর্তেক পরে
লীন হল চিত্রচয় চিত্তপট হতে
ভাবিল চমকি উঠি ভাবিল তখন
‘ আছে কি এমন সুখ আমার কপালে ?'২৩
‘ আমাদের হায় যত দুরাকাঙ্ক্ষাচয়
মানসে উদয় হয় মুহূর্তের তরে
কার্যে তাহা পরিণত না হতে না হতে
হৃদয়ের ছবি হায় হৃদয়ে মিশায় । '২৪
ওই দেখো ছুটিয়াছে তোমার ও পথে
রক্তমাখা হাতে এক মানবের দল
সিংহাসন রাজদণ্ড ঐশ্বর্য মুকুট
প্রভুত্ব রাজত্ব আর গৌরবের তরে ।২৫
ওই দেখো গুপ্তহত্যা করিয়া বহন
চলিতেছে অঙ্গুলির ‘ পরে ভর দিয়া
চুপি চুপি ধীরে ধীরে অলক্ষিত ভাবে
তলবার হাতে করি চলিয়াছে দেখো ।২৬
হত্যা করিতেছে দেখো নিদ্রিত মানবে
সুখের আশয়ে বৃথা সুখের আশয়ে
ওই দেখো ওই দেখো রক্তমাখা হাতে
ধরিয়াছে রাজদণ্ড সিংহাসনে বসি ।২৭
কিন্তু হায় সুখলেশ পাবে কি কখন ?
সুখ কি তাহারে করিবেক আলিঙ্গন ?
সুখ কি তাহার হৃদে পাতিবে আসন ?
সুখ কভু তারে কিগো কটাক্ষ করিবে ?২৮
নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
বৃষ্টি বজ্র সহ্য করি যে সুখের তরে
ছুটিয়াছে আপনার অভীষ্ট সাধনে ?২৯
কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়
পাপের কী ফল কভু সুখ হতে পারে
পাপের কী শাস্তি হয় আনন্দ ও সুখ
কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়৩০
প্রজ্বলিত অনুতাপ হুতাশন কাছে
বিমল সুখের হায় স্নিগ্ধ সমীরণ
হুতাশনসম তপ্ত হয়ে উঠে যেন
তখন কি সুখ কভু ভালো লাগে আর ।৩১
নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
ছুটেছে না মানি বাধা অভীষ্ট সাধনে
মনস্তাপে পরিণত হয়ে উঠে শেষে ।৩২
হৃদয়ের উচ্চাসনে বসি অভিলাষ
মানবদিগকে লয়ে ক্রীড়া কর তুমি
কাহারে বা তুলে দাও সিদ্ধির সোপানে
কারে ফেল নৈরাশ্যের নিষ্ঠুর কবলে ।৩৩
কৈকেয়ী হৃদয়ে চাপে দুষ্ট অভিলাষ!
চতুর্দশ বর্ষ রামে দিলে বনবাস ,
কাড়িয়া লইলে দশরথের জীবন ,
কাঁদালে সীতায় হায় অশোক-কাননে ।৩৪
রাবণের সুখময় সংসারের মাঝে
শান্তির কলস এক ছিল সুরক্ষিত
ভাঙিল হঠাৎ তাহা ভাঙিল হঠাৎ
তুমিই তাহার হও প্রধান কারণ ।৩৫
দুর্যোধন-চিত্ত হায় অধিকার করি
অবশেষে তাহারেই করিলে বিনাশ
পাণ্ডুপুত্রগণে তুমি দিলে বনবাস
পাণ্ডবদিগের হৃদে ক্রোধ জ্বালি দিলে ।৩৬
নিহত করিলে তুমি ভীষ্ম আদি বীরে
কুরুক্ষেত্র রক্তময় করে দিলে তুমি
কাঁপাইলে ভারতের সমস্ত প্রদেশ
পাণ্ডবে ফিরায়ে দিলে শূন্য সিংহাসন ।৩৭
বলি না হে অভিলাষ তোমার ও পথ
পাপেতেই পরিপূর্ণ পাপেই নি র্মি ত
তোমার কতকগুলি আছয়ে সোপান
কেহ কেহ উপকারী কেহ অপকারী ।৩৮
উচ্চ অভিলাষ! তুমি যদি নাহি কভু
বিস্তারিতে নিজ পথ পৃথিবীমণ্ডলে
তাহা হ ' লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে ?৩৯
সকলেই যদি নিজ নিজ অবস্থায়
সন্তুষ্ট থাকিত নিজ বিদ্যা বুদ্ধিতেই
তাহা হ ' লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল-মাঝে ?
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে
প্রথম দিনের উষা নেমে এল যবে
প্রকাশপিয়াসি ধরিত্রী বনে বনে
শুধায়ে ফিরিল, সুর খুঁজে পাবে কবে।
এসো এসো সেই নব সৃষ্টির কবি
নবজাগরণ-যুগপ্রভাতের রবি।
গান এনেছিলে নব ছন্দের তালে
তরুণী উষার শিশিরস্নানের কালে,
আলো-আঁধারের আনন্দবিপ্লবে।
সে গান আজিও নানা রাগরাগিণীতে
শুনাও তাহারে আগমনীসংগীতে
যে জাগায় চোখে নূতন দেখার দেখা।
যে এসে দাঁড়ায় ব্যাকুলিত ধরণীতে
বননীলিমার পেলব সীমানাটিতে,
বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা।
অবাক আলোর লিপি যে বহিয়া আনে
নিভৃত প্রহরে কবির চকিত প্রাণে,
নব পরিচয়ে বিরহব্যথা যে হানে
বিহ্বল প্রাতে সংগীতসৌরভে,
দূর-আকাশের অরুণিম উৎসবে।
যে জাগায় জাগে পূজার শঙ্খধ্বনি,
বনের ছায়ায় লাগায় পরশমণি,
যে জাগায় মোছে ধরার মনের কালি
মুক্ত করে সে পূর্ণ মাধুরী-ডালি।
জাগে সুন্দর, জাগে নির্মল, জাগে আনন্দময়ী--
জাগে জড়ত্বজয়ী।
জাগো সকলের সাথে
আজি এ সুপ্রভাতে,
বিশ্বজনের প্রাঙ্গণতলে লহো আপনার স্থান--
তোমার জীবনে সার্থক হোক
নিখিলের আহ্বান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আজ কোনো কাজ নয়– সব ফেলে দিয়ে
ছন্দ বন্ধ গ্রন্থ গীত– এসো তুমি প্রিয়ে,
আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার
কবিতা, কল্পনালতা। শুধু একবার
কাছে বোসো। আজ শুধু কূজন গুঞ্জন
তোমাতে আমাতে; শুধু নীরবে ভুঞ্জন
এই সন্ধ্যা-কিরণের সুবর্ণ মদিরা–
যতক্ষণ অন্তরের শিরা-উপশিরা
লাবণ্যপ্রবাহভরে ভরি নাহি উঠে,
যতক্ষণে মহানন্দে নাহি যায় টুটে
চেতনাবেদনাবন্ধ, ভুলে যাই সব–
কী আশা মেটে নি প্রাণে, কী সংগীতরব
গিয়েছে নীরব হয়ে, কী আনন্দসুধা
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা
না মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি,
এই মধুরতা, দিক সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের দুঃখ দৈন্য অতৃপ্তির ‘পর
করুণকোমল আভা গভীর সুন্দর।
বীণা ফেলে দিয়ে এসো, মানসসুন্দরী–
দুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও– মৃণাল-পরশে
রোমাঞ্চ অঙ্কুরি উঠে মর্মান্ত হরষে,
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল,
মুগ্ধ তনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের সীমান্ত-প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে।
অর্ধেক অঞ্চল পাতি বসাও যতনে
পার্শ্বে তব; সমধুর প্রিয়সম্বোধনে
ডাকো মোরে, বলো, প্রিয়, বলো, “প্রিয়তম’–
কুন্তল-আকুল মুখ বক্ষে রাখি মম
হৃদয়ের কানে কানে অতি মৃদু ভাষে
সংগোপনে বলে যাও যাহা মুখে আসে
অর্থহারা ভাবে-ভরা ভাষা। অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে
সম্পূর্ণ চুম্বন এক, হাসি স্তরে স্তরে
সরস সুন্দর; নবষ্ফুট পুষ্প-সম
হেলায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম
মুখখানি তুলে ধোরো; আনন্দ-আভায়
বড়ো বড়ো দুটি চক্ষু পল্লবপ্রচ্ছায়
রেখো মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে,
নিতান্ত নির্ভরে। যদি চোখে জল আসে
কাঁদিব দুজনে; যদি ললিত কপোলে
মৃদু হাসি ভাসি উঠে, বসি মোর কোলে,
বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়ো নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি।
যদি কথা পড়ে মনে তবে কলস্বরে
বলে যেয়ো কথা, তরল আনন্দভরে
নির্ঝরের মতো, অর্ধেক রজনী ধরি
কত-না কাহিনী স্মৃতি কল্পনালহরী–
মধুমাখা কণ্ঠের কাকলি। যদি গান
ভালো লাগে, গেয়ো গান। যদি মুগ্ধপ্রাণ
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া
বসিয়া থাকিতে চাও, তাই রব প্রিয়া।
হেরিব অদূরে পদ্মা, উচ্চতটতলে
শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
প্রসারিয়া তনুখানি, সায়াহ্ন-আলোকে
শুয়ে আছে; অন্ধকার নেমে আসে চোখে
চোখের পাতার মতো; সন্ধ্যাতারা ধীরে
সন্তর্পণে করে পদার্পণ, নদীতীরে
অরণ্যশিয়রে; যামিনী শয়ন তার
দেয় বিছাইয়া, একখানি অন্ধকার
অনন্ত ভুবনে। দোঁহে মোরা রব চাহি
অপার তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি,
শুধু মোর করে তব করতলখানি,
শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী,
অসীম নির্জনে; বিষণ্ণ বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি–
শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয় মগন
বাকি আছে একখানি শঙ্কিত মিলন,
দুটি হাত, ত্রস্ত কপোতের মতো দুটি
বক্ষ দুরুদুরু, দুই প্রাণে আছে ফুটি
শুধু একখানি ভয়, একখানি আশা,
একখানি অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা।
আজিকে এমনি তবে কাটিবে যামিনী
আলস্য-বিলাসে। অয়ি নিরভিমানিনী,
অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর ভাগ্য-গগনের সৌন্দর্যের শশী,
মনে আছে কবে কোন্ ফুল্ল যূথীবনে,
বহু বাল্যকালে, দেখা হত দুই জনে
আধো-চেনাশোনা? তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির
এক বালকের সাথে কী খেলা খেলাতে
সখী, আসিতে হাসিয়া, তরুণ প্রভাতে
নবীন বালিকামূর্তি, শুভ্রবস্ত্র পরি
উষার কিরণধারে সদ্য স্নান করি
বিকচ কুসুম-সম ফুল্ল মুখখানি
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি
উপবনে কুড়াতে শেফালি। বারে বারে
শৈশব-কর্তব্য হতে ভুলায়ে আমারে,
ফেলে দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি,
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি
পাঠশালা-কারা হতে; কোথা গৃহকোণে
নিয়ে যেতে নির্জনেতে রহস্যভবনে;
জনশূন্য গৃহছাদে আকাশের তলে
কী করিতে খেলা, কী বিচিত্র কথা ব’লে
ভুলাতে আমারে, স্বপ্ন-সম চমৎকার
অর্থহীন, সত্য মিথ্যা তুমি জান তার।
দুটি কর্ণে দুলিত মুকুতা, দুটি করে
সোনার বলয়, দুটি কপোলের ‘পরে
খেলিত অলক, দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে
কাঁপিত আলোক, নির্মল নির্ঝর-স্রোতে
চূর্ণরশ্মি-সম। দোঁহে দোঁহা ভালো করে
চিনিবার আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে
খেলাধুলা ছুটাছুটি দুজনে সতত–
কথাবার্তা বেশবাস বিথান বিতত।
তার পরে একদিন– কী জানি সে কবে–
জীবনের বনে যৌবনবসন্তে যবে
প্রথম মলয়বায়ু ফেলেছে নিশ্বাস,
মুকুলিয়া উঠিতেছে শত নব আশ,
সহসা চকিত হয়ে আপন সংগীতে
চমকিয়া হেরিলাম– খেলা-ক্ষেত্র হতে
কখন অন্তরলক্ষ্মী এসেছ অন্তরে,
আপনার অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে
বসি আছ মহিষীর মতো। কে তোমারে
এনেছিল বরণ করিয়া। পুরদ্বারে
কে দিয়াছে হুলুধ্বনি! ভরিয়া অঞ্চল
কে করেছে বরিষন নবপুষ্পদল
তোমার আনম্র শিরে আনন্দে আদরে!
সুন্দর সাহানা-রাগে বংশীর সুস্বরে
কী উৎসব হয়েছিল আমার জগতে,
যেদিন প্রথম তুমি পুষ্পফুল্ল পথে
লজ্জামুকুলিত মুখে রক্তিম অম্বরে
বধূ হয়ে প্রবেশিলে চিরদিনতরে
আমার অন্তর-গৃহে– যে গুপ্ত আলয়ে
অন্তর্যামী জেগে আছে সুখ দুঃখ লয়ে,
যেখানে আমার যত লজ্জা আশা ভয়
সদা কম্পমান, পরশ নাহিকো সয়
এত সুকুমার! ছিলে খেলার সঙ্গিনী
এখন হয়েছ মোর মর্মের গেহিনী,
জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই
অমূলক হাসি-অশ্রু, সে চাঞ্চল্য নেই,
সে বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধ দৃষ্টি সুগম্ভীর
স্বচ্ছ নীলাম্বর-সম; হাসিখানি স্থির
অশ্রুশিশিরেতে ধৌত; পরিপূর্ণ দেহ
মঞ্জরিত বল্লরীর মতো; প্রীতি স্নেহ
গভীর সংগীততানে উঠিছে ধ্বনিয়া
স্বর্ণবীণাতন্ত্রী হতে রনিয়া রনিয়া
অনন্ত বেদনা বহি। সে অবধি প্রিয়ে,
রয়েছি বিস্মিত হয়ে–তোমারে চাহিয়ে
কোথাও না পাই অন্ত। কোন্ বিশ্বপার
আছে তব জন্মভূমি। সংগীত তোমার
কত দূরে নিয়ে যাবে, কোন্ কল্পলোকে
আমারে করিবে বন্দী গানের পুলকে
বিমুগ্ধ কুরঙ্গসম। এই যে বেদনা,
এর কোনো ভাষা আছে? এই যে বাসনা,
এর কোনো তৃপ্তি আছে? এই যে উদার
সমুদ্রের মাঝখানে হয়ে কর্ণধার
ভাসায়েছ সুন্দর তরণী, দশ দিশি
অস্ফুট কল্লোলধ্বনি চির দিবানিশি
কী কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে,
এর কোনো কূল আছে? সৌন্দর্য পাথারে
যে বেদনা-বায়ুভরে ছুটে মন-তরী
সে বাতাসে, কত বার মনে শঙ্কা করি,
ছিন্ন হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল;
অভয় আশ্বাসভরা নয়ন বিশাল
হেরিয়া ভরসা পাই বিশ্বাস বিপুল
জাগে মনে– আছে এক মহা উপকূল
এই সৌন্দর্যের তটে, বাসনার তীরে
মোদের দোঁহের গৃহ।
হাসিতেছ ধীরে
চাহি মোর মুখে, ওগো রহস্যমধুরা!
কী বলিতে চাহ মোরে প্রণয়বিধুরা
সীমান্তিনী মোর, কী কথা বুঝাতে চাও।
কিছু বলে কাজ নাই– শুধু ঢেকে দাও
আমার সর্বাঙ্গ মন তোমার অঞ্চলে,
সম্পূর্ণ হরণ করি লহ গো সবলে
আমার আমারে; নগ্ন বক্ষে বক্ষ দিয়া
অন্তর রহস্য তব শুনে নিই প্রিয়া।
তোমার হৃদয়কম্প অঙ্গুলির মতো
আমার হৃদয়তন্ত্রী করিবে প্রহত,
সংগীত-তরঙ্গধ্বনি উঠিবে গুঞ্জরি
সমস্ত জীবন ব্যাপী থরথর করি।
নাই বা বুঝিনু কিছু, নাই বা বলিনু,
নাই বা গাঁথিনু গান, নাই বা চলিনু
ছন্দোবদ্ধ পথে, সলজ্জ হৃদয়খানি
টানিয়া বাহিরে। শুধু ভুলে গিয়ে বাণী
কাঁপিব সংগীতভরে, নক্ষত্রের প্রায়
শিহরি জ্বলিব শুধু কম্পিত শিখায়,
শুধু তরঙ্গের মতো ভাঙিয়া পড়িব
তোমার তরঙ্গ-পানে, বাঁচিব মরিব
শুধু, আর কিছু করিব না। দাও সেই
প্রকাণ্ড প্রবাহ, যাহে এক মুহূর্তেই
জীবন করিয়া পূর্ণ, কথা না বলিয়া
উন্মত্ত হইয়া যাই উদ্দাম চলিয়া।
মানসীরূপিণী ওগো, বাসনাবাসিনী,
আলোকবসনা ওগো, নীরবভাষিণী,
পরজন্মে তুমি কে গো মূর্তিমতী হয়ে
জন্মিবে মানব-গৃহে নারীরূপ লয়ে
অনিন্দ্যসুন্দরী? এখন ভাসিছ তুমি
অনন্তের মাঝে; স্বর্গ হতে মর্তভূমি
করিছ বিহার; সন্ধ্যার কনকবর্ণে
রাঙিছ অঞ্চল; উষার গলিত স্বর্ণে
গড়িছ মেখলা; পূর্ণ তটিনীর জলে
করিছ বিস্তার, তলতল ছলছলে
ললিত যৌবনখানি, বসন্তবাতাসে,
চঞ্চল বাসনাব্যথা সুগন্ধ নিশ্বাসে
করিছ প্রকাশ; নিষুপ্ত পূর্ণিমা রাতে
নির্জন গগনে, একাকিনী ক্লান্ত হাতে
বিছাইছ দুগ্ধশুভ্র বিরহ-শয়ন;
শরৎ-প্রত্যুষে উঠি করিছ চয়ন
শেফালি, গাঁথিতে মালা, ভুলে গিয়ে শেষে,
তরুতলে ফেলে দিয়ে, আলুলিত কেশে
গভীর অরণ্য-ছায়ে উদাসিনী হয়ে
বসে থাক; ঝিকিমিকি আলোছায়া লয়ে
কম্পিত অঙ্গুলি দিয়ে বিকালবেলায়
বসন বয়ন কর বকুলতলায়;
অবসন্ন দিবালোকে কোথা হতে ধীরে
ঘনপল্লবিত কুঞ্জে সরোবর-তীরে
করুণ কপোতকণ্ঠে গাও মুলতান;
কখন অজ্ঞাতে আসি ছুঁয়ে যাও প্রাণ
সকৌতুকে; করি দাও হৃদয় বিকল,
অঞ্চল ধরিতে গেলে পালাও চঞ্চল
কলকণ্ঠে হাসি’, অসীম আকাঙক্ষারাশি
জাগাইয়া প্রাণে, দ্রুতপদে উপহাসি’
মিলাইয়া যাও নভোনীলিমার মাঝে।
কখনো মগন হয়ে আছি যবে কাজে
স্খলিতবসন তব শুভ্র রূপখানি
নগ্ন বিদ্যুতের আলো নয়নেতে হানি
চকিতে চমকি চলি যায়। জানালায়
একেলা বসিয়া যবে আঁধার সন্ধ্যায়,
মুখে হাত দিয়ে, মাতৃহীন বালকের
মতো বহুক্ষণ কাঁদি স্নেহ-আলোকের
তরে– ইচ্ছা করি, নিশার আঁধারস্রোতে
মুছে ফেলে দিয়ে যায় সৃষ্টিপট হতে
এই ক্ষীণ অর্থহীন অস্তিত্বের রেখা,
তখন করুণাময়ী দাও তুমি দেখা
তারকা-আলোক-জ্বালা স্তব্ধ রজনীর
প্রান্ত হতে নিঃশব্দে আসিয়া; অশ্রুনীর
অঞ্চলে মুছায়ে দাও; চাও মুখপানে
স্নেহময় প্রশ্নভরা করুণ নয়ানে;
নয়ন চুম্বন কর, স্নিগ্ধ হস্তখানি
ললাটে বুলায়ে দাও; না কহিয়া বাণী,
সান্ত্বনা ভরিয়া প্রাণে, কবিরে তোমার
ঘুম পাড়াইয়া দিয়া কখন আবার
চলে যাও নিঃশব্দ চরণে।
সেই তুমি
মূর্তিতে দিবে কি ধরা? এই মর্তভূমি
পরশ করিবে রাঙা চরণের তলে?
অন্তরে বাহিরে বিশ্বে শূন্যে জলে স্থলে
সর্ব ঠাঁই হতে সর্বময়ী আপনারে
করিয়া হরণ, ধরণীর একধারে
ধরিবে কি একখানি মধুর মুরতি?
নদী হতে লতা হতে আনি তব গতি
অঙ্গে অঙ্গে নানা ভঙ্গে দিবে হিল্লোলিয়া–
বাহুতে বাঁকিয়া পড়ি, গ্রীবায় হেলিয়া
ভাবের বিকাশভরে? কী নীল বসন
পরিবে সুন্দরী তুমি? কেমন কঙ্কণ
ধরিবে দুখানি হাতে? কবরী কেমনে
বাঁধিবে, নিপুণ বেণী বিনায়ে যতনে?
কচি কেশগুলি পড়ি শুভ্র গ্রীবা-‘পরে
শিরীষকুসুম-সম সমীরণভরে
কাঁপিবে কেমন? শ্রাবণে দিগন্তপারে
যে গভীর স্নিগ্ধ দৃষ্টি ঘন মেঘভারে
দেখা দেয় নব নীল অতি সুকুমার,
সে দৃষ্টি না জানি ধরে কেমন আকার
নারীচক্ষে! কী সঘন পল্লবের ছায়,
কী সুদীর্ঘ কী নিবিড় তিমির-আভায়
মুগ্ধ অন্তরের মাঝে ঘনাইয়া আনে
সুখবিভাবরী! অধর কী সুধাদানে
রহিবে উন্মুখ, পরিপূর্ণ বাণীভরে
নিশ্চল নীরব! লাবণ্যের থরে থরে
অঙ্গখানি কী করিয়া মুকুলি বিকশি
অনিবার সৌন্দর্যেতে উঠিবে উচ্ছ্বসি
নিঃসহ যৌবনে?
জানি, আমি জানি সখী,
যদি আমাদের দোঁহে হয় চোখোচোখি
সেই পরজন্ম-পথে, দাঁড়াব থমকি;
নিদ্রিত অতীত কাঁপি উঠিবে চমকি
লভিয়া চেতনা। জানি মনে হবে মম,
চিরজীবনের মোর ধ্রুবতারা-সম
চিরপরিচয়ভরা ওই কালো চোখ।
আমার নয়ন হতে লইয়া আলোক,
আমার অন্তর হতে লইয়া বাসনা,
আমার গোপন প্রেম করেছে রচনা
এই মুখখানি। তুমিও কি মনে মনে
চিনিবে আমারে? আমাদের দুই জনে
হবে কি মিলন? দুটি বাহু দিয়ে, বালা,
কখনো কি এই কণ্ঠে পরাইবে মালা
বসন্তের ফুলে? কখনো কি বক্ষ ভরি
নিবিড় বন্ধনে, তোমারে হৃদয়েশ্বরী,
পারিব বাঁধিতে? পরশে পরশে দোঁহে
করি বিনিময় মরিব মধুর মোহে
দেহের দুয়ারে? জীবনের প্রতিদিন
তোমার আলোক পাবে বিচ্ছেদবিহীন,
জীবনের প্রতি রাত্রি হবে সুমধুর
মাধুর্যে তোমার, বাজিবে তোমার সুর
সর্ব দেহে মনে? জীবনের প্রতি সুখে
পড়িবে তোমার শুভ্র হাসি, প্রতি দুখে
পড়িবে তোমার অশ্রুজল। প্রতি কাজে
রবে তব শুভহস্ত দুটি, গৃহ-মাঝে
জাগায়ে রাখিবে সদা সুমঙ্গল–জ্যোতি।
এ কি শুধু বাসনার বিফল মিনতি,
কল্পনার ছল? কার এত দিব্যজ্ঞান,
কে বলিতে পারে মোরে নিশ্চয় প্রমাণ–
পূর্বজন্মে নারীরূপে ছিলে কি না তুমি
আমারি জীবন-বনে সৌন্দর্যে কুসুমি,
প্রণয়ে বিকশি। মিলনে আছিলে বাঁধা
শুধু এক ঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাধা
আজি বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ প্রিয়ে,
তোমারে দেখিতে পাই সর্বত্র চাহিয়ে।
ধূপ দগ্ধ হয়ে গেছে, গন্ধবাষ্প তার
পূর্ণ করি ফেলিয়াছে আজি চারি ধার।
গৃহের বনিতা ছিলে, টুটিয়া আলয়
বিশ্বের কবিতারূপে হয়েছ উদয়–
তবু কোন্ মায়া-ডোরে চিরসোহাগিনী,
হৃদয়ে দিয়েছ ধরা, বিচিত্র রাগিণী
জাগায়ে তুলিছ প্রাণে চিরস্মৃতিময়।
তাই তো এখনো মনে আশা জেগে রয়
আবার তোমারে পাব পরশবন্ধনে।
এমনি সমস্ত বিশ্ব প্রলয়ে সৃজনে
জ্বলিছে নিবিছে, যেন খদ্যোতের জ্যোতি,
কখনো বা ভাবময়, কখনো মুরতি।
রজনী গভীর হল, দীপ নিবে আসে;
পদ্মার সুদূর পারে পশ্চিম আকাশে
কখন যে সায়াহ্নের শেষ স্বর্ণরেখা
মিলাইয়া গেছে; সপ্তর্ষি দিয়েছে দেখা
তিমিরগগনে; শেষ ঘট পূর্ণ ক’রে
কখন বালিকা-বধূ চলে গেছে ঘরে;
হেরি কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি, একাদশী তিথি,
দীর্ঘ পথ, শূন্য ক্ষেত্র, হয়েছে অতিথি
গ্রামে গৃহস্থের ঘরে পান্থ পরবাসী;
কখন গিয়েছে থেমে কলরবরাশি
মাঠপারে কৃষিপল্লী হতে; নদীতীরে
বৃদ্ধ কৃষাণের জীর্ণ নিভৃত কুটিরে
কখন জ্বলিয়াছিল সন্ধ্যাদীপখানি,
কখন নিভিয়া গেছে– কিছুই না জানি।
কী কথা বলিতেছিনু, কী জানি, প্রেয়সী,
অর্ধ-অচেতনভাবে মনোমাঝে পশি
স্বপ্নমুগ্ধ-মতো। কেহ শুনেছিলে সে কি,
কিছু বুঝেছিলে প্রিয়ে, কোথাও আছে কি
কোনো অর্থ তার? সব কথা গেছি ভুলে,
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু-পারাবার
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গম্ভীর নিস্বনে।
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি,
এসো প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে মোরে লহো টানি– শোয়াও যতনে
মরণসুস্নিগ্ধ শুভ্র বিস্মৃতিশয়নে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি ।
প্রভাত হল যেই কী জানি হল একি,
আকাশ-পানে চাই কী জানি কারে দেখি ।।পুরবমেঘমুখে পড়েছে রবিরেখা,
অরূণরথচূড়া আধেক যায় দেখা ।
তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব,
মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব ।।আকাশ, 'এসো এসো' ডাকিছ বুঝি ভাই--
গেছি তো তোরি বুকে, আমি তো হেথা নাই ।
প্রভাত-আলো-সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর,
আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর ।।ওঠো হে ওঠো রবি, আমারে তুলে লও,
অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও ।
আকাশপারাবার বুঝি হে পার হবে--
আমারে লও তবে, আমারে লও তবে ।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
যেদিন তুমি আপনি ছিলে একা
আপনাকে তো হয় নি তোমার দেখা।
সেদিন কোথাও কারো লাগি ছিল না পথ-চাওয়া;
এপার হতে ওপার বেয়ে
বয় নি ধেয়ে
কাঁদন-ভরা বাঁধন-ছেঁড়া হাওয়া।
আমি এলেম, ভাঙল তোমার ঘুম,
শূন্যে শূন্যে ফুটল আলোর আনন্দ-কুসুম।
আমায় তুমি ফুলে ফুলে
ফুটিয়ে তুলে
দুলিয়ে দিলে নানা রূপের দোলে।
আমায় তুমি তারায় তারায় ছড়িয়ে দিয়ে কুড়িয়ে নিলে কোলে।
আমায় তুমি মরণমাঝে লুকিয়ে ফেলে
ফিরে ফিরে নূতন করে পেলে।
আমি এলেম, কাঁপল তোমার বুক,
আমি এলেম, এল তোমার দুখ,
আমি এলেম, এল তোমার আগুনভরা আনন্দ,
জীবন-মরণ তুফান-তোলা ব্যাকুল বসন্ত।
আমি এলেম, তাই তো তুমি এলে,
আমার মুখে চেয়ে
আমার পরশ পেয়ে
আপন পরশ পেলে।
আমার চোখে লজ্জা আছে, আমার বুকে ভয়,
আমার মুখে ঘোমটা পড়ে রয়;
দেখতে তোমায় বাধে ব'লে পড়ে চোখের জল।
ওগো আমার প্রভু,
জানি আমি তবু
আমায় দেখবে ব'লে তোমার অসীম কৌতূহল,
নইলে তো এই সূর্যতারা সকলি নিস্ফল।
পদ্মাতীরে, ২৫ মাঘ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
যেও না! যেও না!
দুয়ারে আঘাত করে কে ও পান্থবর?
‘কে ওগো কুটীরবাসি !
দ্বার খুলে দাও আসি! ’
তবুও কেন রে কেউ দেয় না উত্তর?
আবার পথিকবর আঘাতিল ধীরে!
“বিপন্ন পথিক আমি, কে আছে কুটিরে?”
তবুও উত্তর নাই,
নীরব সকল ঠাঁই—
তটিনী বহিয়া যায় আপনার মনে!
পাদপ আপন মনে
প্রভাতের সমীরণে
দুলিছে, গাইছে গান সরসর স্বনে!
সমীরে কুটীরশিরে
লতা দুলে ধীরে ধীরে
বিতরিয়া চারি দিকে পুষ্পপরিমল!
আবার পথিকবর
আঘাতে দুয়ার-‘পর—
ধীরে ধীরে খুলে গেল শিথিল অর্গল।
বিস্ফারিয়া নেত্রদ্বয়
পথিক অবাক্ রয়,
বিস্ময়ে দাঁড়ায়ে আছে ছবির মতন।
কেন পান্থ, কেন পান্থ,
মৃগ যেন দিক্ভ্রান্ত
অথবা দরিদ্র যেন হেরিয়া রতন!
কেন গো কাহার পানে
দেখিছ বিস্মিত প্রাণে—
অতিশয় ধীরে ধীরে পড়িছে নিশ্বাস?
দারুণ শীতের কালে
ঘর্মবিন্দু ঝরে ভালে,
তুষারে করিয়া দৃঢ় বহিছে বাতাস!
ক্রমে ক্রমে হয়ে শান্ত
সুধীরে এগোয় পান্থ,
থর থর করি কাঁপে যুগল চরণ—
ধীরে ধীরে তার পরে
সভয়ে সংকোচভরে
পথিক অনুচ্চ স্বরে করে সম্বোধন—
‘সুন্দরি! সুন্দরি!’ হায়।
উত্তর নাহিক পায়!
আবার ডাকিল ধীরে “সুন্দরি! সুন্দরি!”
শব্দ চারি দিকে ছুটে,
প্রতিধ্বনি জাগি উঠে,
কুটীর গম্ভীরে কহে ‘সুন্দরি! সুন্দরি! ’
তবুও উত্তর নাই,
নীরব সকল ঠাঁই,
এখনো পৃথিবী ধরা নীরবে ঘুমায়!
নীরব পরণশালা,
নীরব ষোড়শী বালা,
নীরবে সুধীর বায়ু লতারে দুলায়!
পথিক চমকি প্রাণে
দেখিল চৌদিক-পানে—
কুটীরে ডাকিছে কেও “কমলা! কমলা!’
অবাক্ হইয়া রহে,
অস্ফুটে কে ওগো কহে?
সুমধুর স্বরে যেন বালকের গলা!
পথিক পাইয়া ভয়,
চমকি দাঁড়ায়ে রয়,
কুটীরের চারি ভাগে নাই কোনজন!
এখনো অস্ফুটস্বরে
‘কমলা! কমলা!’ ক'রে
কুটীর আপনি যেন করে সম্ভাষণ!
কে জানে কাহাকে ডাকে,
কে জানে কেন বা ডাকে,
কেমনে বলিব কেবা ডাকিছে কোথায়?
সহসা পথিকবর
দেখে দণ্ডে করি ভর
‘কমলা! কমলা!’
বলি শুক গান গায়!
আবার পথিকবর
হন ধীরে অগ্রসর,
‘সুন্দরি! সুন্দরি!’
বলি ডাকিয়া আবার!
আবার পথিক হায়
উত্তর নাহিক পায়,
বসিল ঊরুর ‘পরে সঁপি দেহভার!
সঙ্কোচ করিয়া কিছু
পান্থবর আগুপিছু
একটু একটু করে হন অগ্রসর!
আনমিত করি শিরে
পথিকটি ধীরে ধীরে
বালার নাসার কাছে সঁপিলেন কর!
হস্ত কাঁপে থরথরে,
বুক ধুক্ ধুক্ করে,
পড়িল অবশ বাহু কপোলের ‘পর—
লোমাঞ্চিত কলেবরে
বিন্দু বিন্দু ঘর্ম ঝরে,
কে জানে পথিক কেন টানি লয় কর!
আবার কেন কি জানি
বালিকার হস্তখানি
লইলেন আপনার করতল-'পরি—
তবুও বালিকা হায়
চেতনা নাহিক পায়—
অচেতনে শোক জ্বালা রয়েছে পাশরি!
রুক্ষ রুক্ষ কেশরাশি
বুকের উপরে আসি
থেকে থেকে কাঁপি উঠে নিশ্বাসের ভরে!
বাঁহাত আঁচল-'পরে
অবশ রয়েছে পড়ে
এলো কেশরাশি মাঝে সঁপি ডান করে।
ছাড়ি বালিকার কর
ত্রস্ত উঠে পান্থবর
দ্রুতগতি চলিলেন তটিনীর ধারে,
নদীর শীতল নীরে
ভিজায়ে বসন ধীরে
ফিরি আইলেন পুন কুটীরের দ্বারে।
বালিকার মুখে চোখে
শীতল সলিল-সেকে
সুধীরে বালিকা পুন মেলিল নয়ন।
মুদিতা নলিনীকলি
মরমহুতাশে জ্বলি
মুরছি সলিলকোলে পড়িল যেমন—
সদয়া নিশির মন
হিম সেঁচি সারাক্ষণ
প্রভাতে ফিরায়ে তারে দেয় গো চেতন।
মেলিয়া নয়নপুটে
বালিকা চমকি উঠে
একদৃষ্টে পথিকেরে করে নিরীক্ষণ।
পিতা মাতা ছাড়া কারে
মানুষে দেখে নি হা রে,
বিস্ময়ে পথিকে তাই করিছে লোকন!
আঁচল গিয়াছে খ'সে,
অবাক্ রয়েছে ব'সে
বিস্ফারি পথিক-পানে যুগল নয়ন!
দেখেছে কভু কেহ কি
এহেন মধুর আঁখি?
স্বর্গের কোমল জ্যোতি খেলিছে নয়নে—
মধুর-স্বপনে-মাখা
সারল্য-প্রতিমা-আঁকা
‘কে তুমি গো?’ জিজ্ঞাসিছে যেন প্রতিক্ষণে।
পৃথিবী-ছাড়া এ আঁখি
স্বর্গের আড়ালে থাকি
পৃথ্বীরে জিজ্ঞাসে ‘কে তুমি?কে তুমি?'
মধুর মোহের ভুল,
এ মুখের নাই তুল—
স্বর্গের বাতাস বহে এ মুখটি চুমি!
পথিকের হৃদে আসি
নাচিছে শোণিত রাশি,
অবাক্ হইয়া বসি রয়েছে সেথায়!
চমকি ক্ষণেক-পরে
কহিল সুধীর স্বরে
বিমোহিত পান্থবর কমলাবালায়,
‘সুন্দরি, আমি গো পান্থ
দিক্ভ্রান্ত পথশ্রান্ত
উপস্থিত হইয়াছি বিজন কাননে!
কাল হতে ঘুরি ঘুরি
শেষে এ কুটীরপুরী
আজিকার নিশিশেষে পড়িল নয়নে!
বালিকা! কি কব আর,
আশ্রয় তোমার দ্বার
পান্থ পথহারা আমি করি গো প্রার্থনা।
জিজ্ঞাসা করি গো শেষে
মৃতে লয়ে ক্রোড়দেশে
কে তুমি কুটীরমাঝে বসি সুধাননা?’
পাগলিনীপ্রায় বালা
হৃদয়ে পাইয়া জ্বালা
চমকিয়া বসে যেন জাগিয়া স্বপনে।
পিতার বদন-‘পরে
নয়ন নিবিষ্ট ক'রে
স্থির হ'য়ে বসি রয় ব্যাকুলিত মনে।
নয়নে সলিল ঝরে,
বালিকা সমুচ্চ স্বরে
বিষাদে ব্যাকুলহৃদে কহে ‘পিতা— পিতা’ ।
কে দিবে উত্তর তোর,
প্রতিধ্বনি শোকে ভোর
রোদন করিছে সেও বিষাদে তাপিতা।
ধরিয়া পিতার গলে
আবার বালিকা বলে
উচ্চৈস্বরে “পিতা— পিতা” , উত্তর না পায়!
তরুণী পিতার বুকে
বাহুতে ঢাকিয়া মুখে,
অবিরল নেত্রজলে বক্ষ ভাসি যায়।
শোকানলে জল ঢালা
সাঙ্গ হ'লে উঠে বালা,
শূন্য মনে উঠি বসে আঁখি অশ্রুময়!
বসিয়া বালিকা পরে
নিরখি পথিকবরে
সজল নয়ন মুছি ধীরে ধীরে কয়,
‘কে তুমি জিজ্ঞাসা করি,
কুটীরে এলে কি করি—
আমি যে পিতারে ছাড়া জানি না কাহারে!
পিতার পৃথিবী এই,
কোনদিন কাহাকেই
দেখি নি তো এখানে এ কুটীরের দ্বারে!
কোথা হতে তুমি আজ
আইলে পৃথিবীমাঝ?
কি ব'লে তোমারে আমি করি সম্বোধন?
তুমি কি তাহাই হবে
পিতা যাহাদের সবে
‘মানুষ’ বলিয়া আহা করিত রোদন?
কিংবা জাগি প্রাতঃকালে
যাদের দেবতা ব'লে
নমস্কার করিতেন জনক আমার?
বলিতেন যার দেশে
মরণ হইলে শেষে
যেতে হয়, সেথাই কি নিবাস তোমার?—
নাম তার স্বর্গভূমি,
আমারে সেথায় তুমি
ল'য়ে চল, দেখি গিয়া পিতায় মাতায়!
ল'য়ে চল দেব তুমি আমারে সেথায়।
যাইব মায়ের কোলে,
জননীরে মাতা ব'লে
আবার সেখানে গিয়া ডাকিব তাঁহারে।
দাঁড়ায়ে পিতার কাছে
জল দিব গাছে গাছে,
সঁপিব তাঁহার হাতে গাঁথি ফুলহারে!
হাতে ল'য়ে শুকপাখি
বাবা মোর নাম ডাকি
‘কমলা’ বলিতে আহা শিখাবেন তারে!
লয়ে চল, দেব, তুমি সেথায় আমারে!
জননীর মৃত্যু হ'লে,
ওই হোথা গাছতলে
রাখিয়াছিলেন তাঁরে জনক তখন!
ধবলতুষার ভার
ঢাকিয়াছে দেহ তাঁর,
স্বরগের কুটীরেতে আছেন এখন!
আমিও তাঁহার কাছে করিব গমন!’
বালিকা থামিল সিক্ত হয়ে আঁখিজলে
পথিকেরও আঁখিদ্বয়
হ'ল আহা অশ্রুময়,
মুছিয়া পথিক তবে ধীরে ধীরে বলে,
‘আইস আমার সাথে,
স্বর্গরাজ্য পাবে হাতে,
দেখিতে পাইবে তথা পিতায় মাতায়।
নিশা হল অবসান,
পাখীরা করিছে গান,
ধীরে ধীরে বহিতেছে প্রভাতের বায়!
আঁধার ঘোমটা তুলি
প্রকৃতি নয়ন খুলি
চারি দিক ধীরে যেন করিছে বীক্ষণ—
আলোকে মিশিল তারা,
শিশিরের মুক্তাধারা
গাছ পালা পুষ্প লতা করিছে বর্ষণ!
হোথা বরফের রাশি,
মৃত দেহ রেখে আসি
হিমানীক্ষেত্রের মাঝে করায়ে শয়ান,
এই লয়ে যাই চ'লে,
মুছে ফেল অশ্রুজলে—
অশ্রুবারিধারে আহা পূরেছে নয়ান!’
পথিক এতেক কয়ে
মৃত দেহ তুলে লয়ে
হিমানীক্ষেত্রের মাঝে করিল প্রোথিত।
কুটীরেতে ধীরি ধীরি
আবার আইল ফিরি,
কত ভাবে পথিকের চিত্ত আলোড়িত।
ভবিষ্যৎ-কলপনে
কত কি আপন মনে
দেখিছে, হৃদয়পটে আঁকিতেছে কত—
দেখে পূর্ণচন্দ্র হাসে
নিশিরে রজতবাসে
ঢাকিয়া, হৃদয় প্রাণ করি অবারিত—
জাহ্নবী বহিছে ধীরে,
বিমল শীতল নীরে
মাখিয়া রজতরশ্মি গাহি কলকলে—
হরষে কম্পিত কায়,
মলয় বহিয়া যায়
কাঁপাইয়া ধীরে ধীরে কুসুমের দলে—
ঘাসের শয্যার 'পরে
ঈষৎ হেলিয়া পড়ে
শীতল করিছে প্রাণ শীত সমীরণ—
কবরীতে পুষ্পভার
কে ও বাম পাশে তার,
বিধাতা এমন দিন হবে কি কখন?
অদৃষ্টে কি আছে আহা!
বিধাতাই জানে তাহা
যুবক আবার ধীরে কহিল বালায়,
‘কিসের বিলম্ব আর?
ত্যজিয়া কুটীরদ্বার
আইস আমার সাথে, কাল বহে যায়!’
তুলিয়া নয়নদ্বয়
বালিকা সুধীরে কয়,
বিষাদে ব্যাকুল আহা কোমল হৃদয়—
‘কুটীর! তোদের সবে
ছাড়িয়া যাইতে হবে,
পিতার মাতার কোলে লইব আশ্রয়।
হরিণ! সকালে উঠি
কাছেতে আসিত ছুটি,
দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে আঁচল চিবায়—
ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি
মুখেতে দিতাম তুলি
তাকায়ে রহিত মোর মুখপানে হায়!
তাদের করিয়া ত্যাগ যাইব কোথায়?
যাইব স্বরগভূমে,
আহা হা! ত্যজিয়া ঘুমে
এতক্ষণে উঠেছেন জননী আমার—
এতক্ষণে ফুল তুলি
গাঁথিছেন মালাগুলি,
শিশিরে ভিজিয়া গেছে আঁচল তাঁহার—
সেথাও হরিণ আছে,
ফুল ফুটে গাছে গাছে,
সেখানেও শুক পাখি ডাকে ধীরে ধীরে!
সেথাও কুটীর আছে,
নদী বহে কাছে কাছে,
পূর্ণ হয় সরোবর নির্ঝরের নীরে।
আইস! আইস দেব! যাই ধীরে ধীরে!
আয় পাখি! আয় আয়!
কার তরে রবি হায়,
উড়ে যা উড়ে যা পাখি! তরুর শাখায়!
প্রভাতে কাহারে পাখি!
জাগাবি রে ডাকি ডাকি
‘কমলা!’ ‘কমলা!’ বলি মধুর ভাষায়?
ভুলে যা কমলা নামে,
চলে যা সুখের ধামে,
‘কমলা!’ ‘কমলা!’ ব'লে ডাকিস নে আর।
চলিনু তোদের ছেড়ে, যা শুক শাখায় উড়ে—
চলিনু ছাড়িয়া এই কুটীরের দ্বার।
তবু উড়ে যাবি নে রে,
বসিবি হাতের ‘পরে?
আয় তবে, আয় পাখি, সাথে সাথে আয়,
পিতার হাতের ‘পরে
আমার নামটি ধ'রে—
আবার আবার তুই ডাকিস সেথায়।
আইস পথিক তবে কাল বহে যায়”।
সমীরণ ধীরে ধীরে
চুম্বিয়া তটিনীনীরে
দুলাইতে ছিল আহা লতায় পাতায়—
সহসা থামিল কেন প্রভাতের বায়?
সহসা রে জলধর
নব অরুণের কর
কেন রে ঢাকিল শৈল অন্ধকার করে?
পাপিয়া শাখার ‘পরে ললিত সুধীর স্বরে
তেমনি কর-না গান, থামিলি কেন রে?
ভুলিয়া শোকের জ্বালা
ওই রে চলিছে বালা।
কুটীর ডাকিছে যেন ‘যেয়ো না— যেয়ো না!’
তটিনীতরঙ্গকুল
ভিজায়ে গাছের মূল
ধীরে ধীরে বলে যেন ‘যেয়ো না! যেয়ো না’ —
বনদেবী নেত্র খুলি
পাতার আঙ্গুল তুলি
যেন বলিছেন আহা ‘যেয়ো না!— যেয়ো না!’ —
নেত্র তুলি স্বর্গ-পানে
দেখে পিতা মেঘযানে
হাত নাড়ি বলিছেন ‘যেয়ো না!— যেয়ো না!’ —
বালিকা পাইয়া ভয়
মুদিল নয়নদ্বয়,
এক পা এগোতে আর হয় না বাসনা—
আবার আবার শুন
কানের কাছেতে পুন
কে কহে অস্ফুট স্বরে ‘যেয়ো না!— যেয়ো না!’ (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমাতে আমাতে আছে তো প্রভেদ
জানি তা বন্ধু, জানি,
বিচ্ছেদ তবু অন্তরে নাহি মানি।
এক জ্যোৎস্নায় জেগেছি দুজনে
সারারাত-জাগা পাখির কূজনে,
একই বসন্তে দোঁহাকার মনে
দিয়েছে আপন বাণী।তুমি চেয়ে আছ আলোকের পানে,
পশ্চাতে মোর মুখ--
অন্তরে তবু গোপন মিলনসুখ।
প্রবল প্রবাহে যৌবনবান
ভাসায়েছে দুটি দোলায়িত প্রাণ,
নিমেষে দোঁহারে করেছে সমান
একই আবর্তে টানি।সোনার বর্ণ মহিমা তোমার
বিশ্বের মনোহর,
আমি অবনত পাণ্ডুর কলেবর।
উদাস বাতাসে পরান কাঁপায়ে
অগৌরবের শরম ছাপায়ে
আমারে তোমার বসাইল বাঁয়ে,
একাসনে দিল আনি।
নবারুণরাগে রাঙা হয়ে গেল
কালো ভেদরেখাখানি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
প্রাইমারি ইস্কুলে
প্রায়-মারা পণ্ডিত
সব কাজ ফেলে রেখে
ছেলে করে দণ্ডিত।
নাকে খত দিয়ে দিয়ে
ক্ষয়ে গেল যত নাক,
কথা-শোনবার পথ
টেনে টেনে করে ফাঁক;
ক্লাসে যত কান ছিল
সব হল খণ্ডিত,
বেঞ্চিটেঞ্চিগুলো
লণ্ডিত ভণ্ডিত। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
শ্মশানগভীর আঁধার রাত্রি শ্মশান ভীষণ!
ভয় যেন পাতিয়াছে আপনার আঁধার আসন!
সর সর মরমরে সুধীরে তটিনী বহে যায়।
প্রাণ আকুলিয়া বহে ধূমময় শ্মশানের বায়!গাছপালা নাই কোথা প্রান্তর গম্ভীর!
শাখাপত্রহীন বৃক্ষ, শুষ্ক, দগ্ধ, উঁচু করি শির
দাঁড়াইয়া দূরে— দূরে নিরখিয়া চারি দিক-পান
পৃথিবীর ধ্বংসরাশি, রহিয়াছে হোয়ে ম্রিয়মাণ?শ্মশানের নাই প্রাণ যেন আপনার,
শুষ্ক তৃণরাজি তার ঢাকিয়াছে বিশাল বিস্তার!
তৃণের শিশির চুমি বহে নাকো প্রভাতের বায়
কুসুমের পরিমল ছড়াইয়া হেথায় হোথায়।শ্মশানে আঁধার ঘোর ঢালিয়াছে বুক!
হেথা হোথা অস্থিরাশি ভস্মমাঝে লুকাইয়া মুখ!
পরশিয়া অস্থিমালা তটিনী আবার সরি যায়
ভস্মরাশি ধুয়ে ধুয়ে, নিভাইয়া অঙ্গারশিখায়!বিকট দশন মেলি মানবকপাল—
ধ্বংসের স্মরণস্তূপ, ছড়াছড়ি দেখিতে ভয়াল!
গভীর আঁখিকোটর আঁধারেরে দিয়েছে আবাস,
মেলিয়া দশনপাঁতি পৃথিবীরে করে উপহাস!মানবকঙ্কাল শুয়ে ভসেমর শয্যায়—
কাণের কাছেতে গিয়া বায়ু কত কথা ফুসলায়!
তটিনী কহিছে কাণে ‘উঠ! উঠ! উঠ নিদ্রা হোতে’
ঠেলিয়া শরীর তার ফিরে ফিরে তরঙ্গ-আঘাতে!উঠ গো কঙ্কাল! কত ঘুমাইবে আর!
পৃথিবীর বায়ু এই বহিতেছে উঠ আরবার!
উঠ গো কঙ্কাল! দেখ স্রোতস্বিনী ডাকিছে তোমায়
ঘুমাইবে কত আর বিসর্জ্জন দিয়া চেতনায়!বল না, বল না তুমি ঘুমাও কি বোলে?
কাল যে প্রেমের মালা পরাইয়াছিল এই গলে
তরুণী ষোড়শী বালা! আজ তুমি ঘুমাও কি বলে!
অনাথারে একাকিনী সঁপিয়া এ পৃথিবীর কোলে!উঠ গো— উঠ গো— পুনঃ করিনু আহ্বান!
শুন, রজনীর কাণে ওই সে করিছে খেদ গান!
সময় তোমার আজো ঘুমাবার হয় নাই ত রে!
কোল বাড়াইয়া আছে পৃথিবীর সুখ তোমা-তরে!তুমি গো ঘুমাও, আমি বলি না তোমারে!
জীবনের রাত্রি তব ফুরায়েছে নেত্রধারে-ধারে!
এক বিন্দু অশ্রুজল বরষিতে কেহ নাই তোর,
জীবনের নিশা আহা এত দিনে হইয়াছে ভোর!ভয় দেখাইয়া আহা নিশার তামসে—
একটি জ্বলিছে চিতা, গাঢ় ঘোর ধূমরাশি শ্বসে!
একটি অনলশিখা জ্বলিতেছে বিশাল প্রান্তরে,
অসংখ্য স্ফুলিঙ্গকণা নিক্ষেপিয়া আকাশের পরে।কার চিতা জ্বলিতেছে কাহার কে জানে?
কমলা! কেন গো তুমি তাকাইয়া চিতাগ্নির পানে?
একাকিনী অন্ধকারে ভীষণ এ শ্মশানপ্রদেশে
ভূষণবিহীনদেহে, শুষ্কমুখে, এলোথেলো কেশে?কার চিতা জান কি গো কমলে জিজ্ঞাসি!
দেখিতেছ কার চিতা শ্মশানেতে একাকিনী আসি?
নীরদের চিতা? নীরদের দেহ অগ্নিমাঝে জ্বলে?
নিবায়ে ফেলিবে অগ্নি, কমলে, কি নয়নের জলে?নীরব নিস্তব্ধ ভাবে কমলা দাঁড়ায়ে!
গভীর নিশ্বাসবায়ু উচ্ছ্বাসিয়া উঠে!
ধূমময় নিশীথের শ্মশানের বায়ে
এলোথেলো কেশরাশি চারি দিকে ছুটে!ভেদি অমা নিশীথের গাঢ় অন্ধকার
চিতার অনলোত্থিত অস্ফুট আলোক
পড়িয়াছে ঘোর মলান মুখে কমলার,
পরিস্ফুট করিতেছে সুগভীর শোক!নিশীথে শ্মশানে আর নাই জন প্রাণী,
মেঘান্ধ অমান্ধকারে মগ্ন চরাচর!
বিশাল শ্মশানক্ষেত্রে শুধু একাকিনী
বিষাদপ্রতিমা বামা বিলীন-অন্তর!তটিনী চলিয়া যায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
নিশীথশ্মশানবায়ু স্বনিছে উচ্ছ্বাসে!
আলেয়া ছুটিছে হোথা আঁধার ভেদিয়া!
অস্থির বিকট শব্দ নিশার নিশ্বাসে!শৃগাল চলিয়া গেল সমুচ্চে কাঁদিয়া
নীরব শ্মশানময় তুলি প্রতিধ্বনি!
মাথার উপর দিয়া পাখা ঝাপটিয়া
বাদুড় চলিয়া গেল করি ঘোরধ্বনি!এ-হেন ভীষণ স্থানে দাঁড়ায়ে কমলা!
কাঁপে নাই কমলার একটিও কেশ!
শূন্যনেত্রে শূন্যহৃদে চাহি আছে বালা
চিতার অনলে করি নয়ননিবেশ!কমলা চিতায় নাকি করিবে প্রবেশ?
বালিকা কমলা নাকি পশিবে চিতায়?
অনলে সংসারলীলা করিবি কি শেষ?
অনলে পুড়াবি নাকি সুকুমার কায়?সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম হায়—
ছুটিতিস্ ফুল তুলে কাননে কাননে
ফুলে ফুল সাজাইয়া ফুলসম কায়—
দেখাতিস্ সাজসজ্জা পিতার সদনে!দিতিস হরিণশৃঙ্গে মালা জড়াইয়া!
হরিণশিশুরে আহা বুকে লয়ে তুলি
সুদূর কাননভাগে যেতিস্ ছুটিয়া,
ভ্রমিতিস্ হেথা হোথা পথ গিয়া ভুলি!সুধাময়ী বীণাখানি লোয়ে কোল-পরে
সমুচ্চ হিমাদ্রিশিরে বসি শিলাসনে
বীণার ঝঙ্কার দিয়া মধুময় স্বরে
গাহিতিস্ কত গান আপনার মনে!হরিণেরা বন হোতে শুনিয়া সে স্বর
শিখরে আসিত ছুটি তৃণাহার ভুলি!
শুনিত,ঘিরিয়া বসি ঘাসের উপর
বড় বড় আঁখিদুটি মুখ-পানে তুলি!সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম বনে
চিতার অনলে আজ হবে তোর শেষ?
সুখের যৌবন হায় পোড়াবি আগুনে?
সুকুমার দেহ হবে ভস্ম-অবশেষ!না, না, না, সরলা বালা, ফিরে যাই চল্
এসেছিলি যেথা হোতে সেই সে কুটীরে!
আবার ফুলের গাছে ঢালিবি লো জল!
আবার ছুটিবি গিয়ে পর্ব্বতের শিরে!পৃথিবীর যাহা কিছু ভুলে যা লো সব,
নিরাশযন্ত্রণাময় পৃথ্বীর প্রণয়!
নিদারুণ সংসারে ঘোর কলরব,
নিদারুণ সংসারের জ্বালা বিষ্ময়।তুই স্বরগের পাখী পৃথিবীতে কেন!
সংসারকণ্টকবনে পারিজাত ফুল!
নন্দনের বনে গিয়া গাইবি খুলিয়া হিয়া,
নন্দনমলয়বায়ু করিবি আকুল।আয় তবে ফিরে যাই বিজন শিখরে—
নির্ঝর ঢালিছে যেথা স্ফটিকের জল,
তটিনী বহিছে যথা কলকলস্বরে,
সুবাস নিশ্বাস ফেলে বনফুলদল!বন-ফুল ফুটেছিলি ছায়াময় বনে,
শুকাইলি মানবের নিশ্বাসের বায়ে!
দয়াবয়ী বনদেবী শিশিরসেচনে
আবার জীবন তোরে দিবেন ফিরায়ে।এখনো কমলা ওই রয়েছে দাঁড়িয়ে
জ্বলন্ত চিতার পরে মেলিয়ে নয়ন!
ওই রে সহসা ওই মূর্চ্ছিয়ে পড়িয়ে
ভসেমর শয্যার পরে করিল শয়ন!এলায়ে পড়িল ভসেম সুনিবিড় কেশ!
অঞ্চলবসন ভসেম পড়িল এলায়ে!
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আলুথালু বেশ
কমলার বক্ষ হোতে, শ্মশানের বায়ে!নিবে গেল ধীরে ধীরে চিতার অনল!
এখনো কমলা বালা মূর্চ্ছায় মগন!
শুকতারা উজলিল গগনের তল,
এখনো কমলা বালা স্তব্ধ অচেতন!ওই রে কুমারী উষা বিলোল চরণে
উঁকি মারি পূর্ব্বাশার সুবর্ণ তোরণে
রক্তিম অধরখানি হাসিতে ছাইয়া
সিঁদুর প্রকৃতিভালে দিল পরাইয়া।এখনো কমলা বালা ঘোর অচেতন,
কমলা-কপোল চুমে অরুণকিরণ!
গণিছে কুন্তলগুলি প্রভাতের বায়,
চরণে তটিনী বালা তরঙ্গ দুলায়!কপোলে, আঁখির পাতে পড়েছে শিশির!
নিস্তেজ সুবর্ণকরে পিতেছে মিহির!
শিথিল অঞ্চলখানি লোয়ে ঊর্ম্মিমালা
কত কি— কত কি কোরে করিতেছে খেলা!ক্রমশঃ বালিকা ওই পাইছে চেতন!
ক্রমশঃ বালিকা ওই মেলিছে নয়ন!
বক্ষোদেশ আবরিয়া অঞ্চলবসনে
নেহারিল চারি দিক বিস্মিত নয়নে।ভস্মরাশিসমাকুল শ্মশানপ্রদেশ!
মলিনা কমলা ছাড়া যেদিকে নেহারি
বিশাল শ্মশানে নাই সৌন্দর্য্যের লেশ,
জন প্রাণী নাই আর কমলারে ছাড়ি!সূর্য্যকর পড়িয়াছে শুষ্কমলানপ্রায়,
ভস্মমাখা ছুটিতেছে প্রভাতের বায়!
কোথাও নাই রে যেন আঁখির বিশ্রাম,
তটিনী ঢালিছে কাণে বিষাদের গান!বালিকা কমলা ক্রমে করিল উত্থান
ফিরাইল চারি দিকে নিস্তেজ নয়ান।
শ্মশানের-ভস্ম-মাখা অঞ্চল তুলিয়া
যেদিকে চরণ চলে যাইল চলিয়া! (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যাত্রী আমি ওরে।
পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে।
দুঃখসুখের বাঁধন সবই মিছে,
বাঁধা এ-ঘর রইবে কোথায় পিছে,
বিষয়বোঝা টানে আমায় নীচে,
ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে যাবে পড়ে।
যাত্রী আমি ওরে।
চলতে পথে গান গাহি প্রাণ ভরে।
দেহ-দুর্গে খুলবে সকল দ্বার,
ছিন্ন হবে শিকল বাসনার,
ভালোমন্দ কাটিয়ে হব পার
চলতে রব লোকে লোকান্তরে।
যাত্রী আমি ওরে।
যা-কিছু ভার যাবে সকাল সরে।
আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে
ভাষাবিহীন অজানিতের গানে,
সকাল-সাঁঝে পরান মম টানে
কাহার বাঁশি এমন গভীর স্বরে।
যাত্রী আমি ওরে--
বাহির হলেম না জানি কোন্ ভোরে।
তখন কোথাও গায় নি কোনো পাখি,
কী জানি রাত কতই ছিল বাকি
নিমেষহারা শুধুই একটি আঁখি
জেগেছিল অন্ধকারের 'পরে।
যাত্রী আমি ওরে।
কোন্ দিনান্তে পৌঁছব কোন্ ঘরে।
কোন্ তারকা দীপ জ্বালে সেইখানে,
বাতাস কাঁদে কোন্ কুসুমের ঘ্রাণে,
কে গো সেথায় স্নিগ্ধ দু-নয়ানে
অনাদিকাল চাহে আমার তরে।
(গোরাই নদী, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ক্ষণিক ধ্বনির স্বত-উচ্ছ্বাসে
সহসা নির্ঝরিণী
আপনারে লয় চিনি।
চকিত ভাবের ক্বচিৎ বিকাশে
বিস্মিত মোর প্রাণ
পায় নিজ সন্ধান। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
গতকাল পাঁচটায়তেলে ভেজে মাছটায়বাবু রেখেছিল পাতে,ছিল সাথে ছেঁচ্কি।
নেয়ে এসে দেখে চেয়েবিড়ালে গিয়েছে খেয়ে–চোঁ চোঁ করে ওঠে পেটআর ওঠে হেঁচ্কি।
মহা রোষে তিনুরায়যেতে চায় আগ্রায়,পাঁজিতে রয়েছে লেখাদিন আছে কল্য।
রান্না চড়াতে গেলেপাছে ট্রেন নাই মেলেভোরে উঠে তাই আজহাওড়ায় চলল।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দিদিমণি–
অফুরান সান্ত্বনার খনি।
কোনো ক্লান্তি কোনো ক্লেশ
মুখে চিহ্ন দেয় নাই লেশ।
কোনো ভয় কোনো ঘৃণা কোনো কাজে কিছুমাত্র গ্লানি
সেবার মাধুর্যে ছায়া নাহি দেয় আনি।
এ অখণ্ড প্রসন্নতা ঘিরে তারে রয়েছে উজ্জ্বলি,
রচিতেছে শান্তির মণ্ডলী;
ক্ষিপ্র হস্তক্ষেপে
চারি দিকে স্বস্তি দেয় ব্যেপে;
আশ্বাসের বাণী সুমধুর
আবসাদ করি দেয় দূর।
এ স্নেহমাধুর্যধারা
অক্ষম রোগীরে ঘিরে আপনার রচিছে কিনারা;
অবিরাম পরশ চিন্তার
বিচিত্র ফসলে যেন উর্বর করিছে দিন তার।
এ মাধুর্য করিতে সার্থক
এতখানি নির্বলের ছিল আবশ্যক।
অবাক হইয়া তারে দেখি,
রোগীর দেহের মাঝে অনন্ত শিশুরে দেখেছে কি। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
এই ঘরে আগে পাছে
বোবা কালা বস্তু যত আছে
দলবাঁধা এখানে সেখানে ,
কিছু চোখে পড়ে , কিছু পড়ে না মনের অবধানে ।
পিতলের ফুলদানিটাকে
বহে নিয়ে টিপাইটা এক কোণে মুখ ঢেকে থাকে ।
ক্যাবিনেটে কী যে আছে কত ,
না জানার ই মতো ।
পর্দায় পড়েছে ঢাকা সাসির দুখানা কাঁচ ভাঙা ;
আজ চেয়ে অকস্মাৎ দেখা গেল পর্দাখানা রাঙা —
চোখে পড়ে পড়েও না ;
জাজিমেতে আঁকে আলপনা
সাতটা বেলার আলো সকালে রোদ্দুরে ।
সবুজ একটি শাড়ি ডুরে
ঢেকে আছে ডেস্কোখানা ; কবে তারে নিয়েছিনু বেছে ,
রঙ চোখে উঠেছিল নেচে ,
আজ যেন সে রঙের আগুনেতে পড়ে গেছে ছাই ,
আছে তবু ষোলো-আনা নাই ।
থাকে থাকে দেরাজের
এলোমেলো ভরা আছে ঢের
কাগজপত্তর নানামতো ,
ফেলে দিতে ভুলে যাই কত ,
জানি নে কী জানি কোন্ আছে দরকার ।
টেবিলে হেলানো ক্যালেণ্ডার ,
হঠাৎ ঠাহর হল আটই তারিখ । ল্যাভেণ্ডার
শিশিভরা রোদ্দুরের রঙে । দিনরাত
টিক্টিক্ করে ঘড়ি , চেয়ে দেখি কখনো দৈবাৎ ।
দেয়ালের কাছে
আলমারিভরা বই আছে ;
ওরা বারো-আনা
পরিচয়-অপেক্ষায় রয়েছে অজানা ।
ওই যে দেয়ালে
ছবিগুলো হেথা হোথা , রেখেছিনু কোনো-এক কালে ;
আজ তারা ভুলে-যাওয়া ,
যেন ভূতে-পাওয়া ,
কার্পেটের ডিজাইন
স্পষ্টভাষা বলেছিল একদিন ;
আজ অন্যরূপ ,
প্রায় তারা চুপ ।
আগেকার দিন আর আজিকার দিন
পড়ে আছে হেথা হোথা একসাথে সম্বন্ধবিহীন । এইটুকু ঘর ।
কিছু বা আপন তার , অনেক কিছুই তার পর ।
টেবিলের ধারে তাই
চোখ-বোজা অভ্যাসের পথ দিয়ে যাই ।
দেখি যারা অনেকটা স্পষ্ট দেখি নাকো ।
জানা অজানার মাঝে সরু এক চৈতন্যের সাঁকো ,
ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনা
তারি'পরে চলে আনাগোনা ।
আয়না-ফ্রেমের তলে ছেলেবেলাকার ফোটোগ্রাফ
কে রেখেছে , ফিকে হয়ে গেছে তার ছাপ ।
পাশাপাশি ছায়া আর ছবি ।
মনে ভাবি , আমি সেই রবি ,
স্পষ্ট আর অস্পষ্টের উপাদানে ঠাসা
ঘরের মতন ; ঝাপ্সা পুরানো ছেঁড়া ভাষা
আসবাবগুলো যেন আছে অন্যমনে ।
সামনে রয়েছে কিছু , কিছু লুকিয়েছে কোণে কোণে ।
যাহা ফেলিবার
ফেলে দিতে মনে নেই । ক্ষয় হয়ে আসে অর্থ তার
যাহা আছে জমে ।
ক্রমে ক্রমে
অতীতের দিনগুলি
মুছে ফেলে অস্তিত্বের অধিকার । ছায়া তারা
নূতনের মাঝে পথহারা ;
যে অক্ষরে লিপি তারা লিখিয়া পাঠায় বর্তমানে
সে কেহ পড়িতে নাহি জানে ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার মাঝে তোমার লীলা হবে,
তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।
এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,
ঘুচে যাবে সকল অহংকার,
আনন্দময় তোমার এ সংসার
আমার কিছু আর বাকি না রবে।মরে গিয়ে বাঁচব আমি, তবে
আমার মাঝে তোমার লীলা হবে।
সব বাসনা যাবে আমার থেমে
মিলে গিয়ে তোমারি এক প্রেমে,
দুঃখসুখের বিচিত্র জীবনে
তুমি ছাড়া আর কিছু না রবে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমি বেসেছিলেম ভালো
সকল দেহে মনে
এই ধরণীর ছায়া আলো
আমার এ জীবনে।
সেই যে আমার ভালোবাসা
লয়ে আকুল অকূল আশা
ছড়িয়ে দিল আপন ভাষা
আকাশনীলিমাতে।
রইল গভীর সুখে দুখে,
রইল সে-যে কুঁড়ির বুকে
ফুল-ফোটানোর মুখে মুখে
ফাগুনচৈত্ররাতে।
রইল তারি রাখি বাঁধা
ভাবী কালের হাতে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
রানী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি
রানী, তোর মধুখানা দিঠি
রানী, তুই মণি তুই ধন,
তোর কথা ভাবি সারাক্ষণ।
দীর্ঘ সন্ধ্যা কাটে কী করিয়া?
সাধ যায় তোর কাছে গিয়া
চুপিচাপি বসি এক ভিতে
ছোটোছোটো সেই ঘরটিতে।
ছোটো হাতখানি হাতে করে
অধরেতে রেখে দিই ধরে।
ভিজাই ফেলিয়া আঁখিজল
ছোট সে কোমল করতল।Heinrich Hein
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা!
দিবেরাত্রি আহার নিদ্রে ছেড়ে,
তপিস্যে আর লড়াই করে শেষে
বশিষ্টের গাইটি নিলে কেড়ে।
বিশ্বামিত্র তোমার মতো গোরু
দুটি এমন দেখি নি বিশ্বে!
নইলে একটি গাভী পাবার তরে
এত যুদ্ধ এত তপিস্যে!Heinrich Hein
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
মরণ রে ,
তুঁহু মম শ্যামসমান ।
মেঘবরণ তুঝ , মেঘজটাজুট ,
রক্ত কমল কর , রক্ত অধর - পুট ,
তাপ - বিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু - অমৃত করে দান ।
তুঁহু মম শ্যামসমান ।
মরণ রে ,
শ্যাম তোঁহারই নাম !
চির বিসরল যব নিরদয় মাধব
তুঁহু ন ভইবি মোয় বাম ,
আকুল রাধা - রিঝ অতি জরজর ,
ঝরই নয়ন দউ অনুখন ঝরঝর ।
তুঁহু মম মাধব , তুঁহু মম দোসর ,
তুঁহু মম তাপ ঘুচাও ,
মরণ , তু আও রে আও ।
ভুজপাশে তব লহ সম্বোধয়ি ,
আঁখিপাত মঝু আসব মোদয়ি ,
কোরউপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি ,
নীদ ভরব সব দেহ ।
তুঁহু নহি বিসরবি , তুঁহু নহি ছোড়বি ,
রাধাহৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি ,
হিয় হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন ,
অতুলন তোঁহার লেহ ।
দূর সঙে তুঁহু বাঁশি বজাওসি ,
অনুখন ডাকসি , অনুখন ডাকসি
রাধা রাধা রাধা ।
দিবস ফুরাওল , অবহুঁ ম যাওব ,
বিরহতাপ তব অবহুঁ ঘুচাওব ,
কুঞ্জবাট'পর অবহুঁ ম ধাওব ,
সব কছু টুটইব বাধা ।
গগন সঘন অব , তিমিরমগন ভব ,
তড়িত চকিত অতি , ঘোর মেঘরব ,
শালতালতরু সভয় তবধ সব ,
পন্থ বিজন অতি ঘোর —
একলি যাওব তুঝ অভিসারে ,
যাক পিয়া তুঁহু কি ভয় তাহারে ,
ভয় বাধা সব অভয় মুরতি ধরি ,
পন্থ দেখাওব মোর ।
ভানুসিংহ কহে — ছিয়ে ছিয়ে রাধা ,
চঞ্চল হৃদয় তোহারি ,
মাধব পহু মম , পিয় স মরণসে
অব তুঁহু দেখ বিচারি ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক—
সবার তরে নহে সবাই।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
পরের ভোগে থাকবে বাকি,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম—
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গ
ঝগড়া করে মরতে হবে?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো।
এটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই—
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।নিজের ছায়া মস্ত করে
অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে,
বিধির সঙ্গ বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গ এক রকমে
করে নে ভাই, বোঝাপড়া।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো—
ভুলে যা ভাই, কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ওগো এত প্রেম - আশা প্রাণের তিয়াষা
কেমনে আছে সে পাসরি !
তবে সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী ,
সেথা কি বাজে না বাঁশরি !
সখী , হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন ,
সেথা কি পবন বহে না !
সে যে তার কথা মোরে কহে অনুক্ষণ
মোর কথা তারে কহে না !
যদি আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী
আমারে ভুলাল কেন সে !
ওগো এ চির জীবন করিব রোদন
এই ছিল তার মানসে !
যবে কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে
কেটেছিল সুখরাতি রে ,
তবে কে জানিত তার বিরহ আমার
হবে জীবনের সাথী রে !
যদি মনে নাহি রাখে , সুখে যদি থাকে ,
তোরা একবার দেখে আয় —
এই নয়নের তৃষা পরানের আশা
চরণের তলে রেখে আয় ।
আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার ,
কত আর ঢেকে রাখি বল্ ।
আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে
এক - ফোঁটা তার আঁখিজল ।
না না , এত প্রেম সখী ভুলিতে যে পারে
তারে আর কেহ সেধো না ।
আমি কথা নাহি কব , দুখ লয়ে রব ,
মনে মনে স ' ব বেদনা ।
ওগো মিছে , মিছে সখী , মিছে এই প্রেম ,
মিছে পরানের বাসনা ।
ওগো সুখদিন হায় যবে চলে যায়
আর ফিরে আর আসে না ।। (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ;
পাশে তোমার হবে কি আজ স্থান।
দেখতে পাব অপূর্ব সেই মুখ,
রইবে চেয়ে হৃদয় উৎসুক,
বারে বারে চরণ ঘিরে ঘিরে
ফিরবে আমার অশ্রুভরা গান?সাহস করে তোমার পদমূলে
আপনারে আজ ধরি নাই যে তুলে,
পড়ে আছি মাটিতে মুখ রেখে,
ফিরিয়ে পাছে দাও হে আমার দান।
আপনি যদি আমার হাতে ধরে
কাছে এসে উঠতে বল মোরে,
তবে প্রাণের অসীম দরিদ্রতা
এই নিমেষেই হবে অবসান।বোলপুর, ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি
মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা।
আমি দেখলেম নবীনকে,
প্রতিদিনের ক্লান্ত চোখ
যার দর্শন হারিয়েছে।
কল্পনা করছি,--
অনাগত যুগ থেকে
তীর্থযাত্রী আমি
ভেসে এসেছি মন্ত্রবলে।
উজান স্বপ্নের স্রোতে
পৌঁছলেম এই মুহূর্তেই
বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে।
কেবলি তাকিয়ে আছি উৎসুক চোখে।
আপনাকে দেখছি আপনার বাইরে,--
অন্যযুগের অজানা আমি
অভ্যস্ত পরিচয়ের পরপারে।
তাই তাকে নিয়ে এত গভীর কৌতূহল।
যার দিকে তাকাই
চক্ষু তাকে আঁকড়িয়ে থাকে
পুষ্পলগ্ন ভ্রমরের মতো।
আমার নগ্নচিত্ত আজ মগ্ন হয়েছে
সমস্তের মাঝে।
জনশ্রুতির মলিন হাতের দাগ লেগে
যার রূপ হয়েছে অবলুপ্ত,
যা পরেছে তুচ্ছতার মলিন চীর
তার সে জীর্ণ উত্তরীয় আজ গেল খ'সে।
দেখা দিল সে অস্তিত্বের পূর্ণ মূল্যে।
দেখা দিল সে অনির্বচনীয়তায়।
যে বোবা আজ পর্যন্ত ভাষা পায়নি
জগতের সেই অতি প্রকাণ্ড উপেক্ষিত
আমার সামনে খুলেছে তার অচল মৌন,
ভোর-হয়ে-ওঠা বিপুল রাত্রির প্রান্তে
প্রথম চঞ্চল বাণী জাগল যেন।
আমার এতকালের কাছের জগতে
আমি ভ্রমণ করতে বেরিয়েছি দূরের পথিক।
তার আধুনিকের ছিন্নতার ফাঁকে ফাঁকে
দেখা দিয়েছে চিরকালের রহস্য।
সহমরণের বধূ
বুঝি এমনি ক'রেই দেখতে পায়
মৃত্যুর ছিন্নপর্দার ভিতর দিয়ে
নূতন চোখে
চিরজীবনের অম্লান স্বরূপ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা,
তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা—
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।তাই কি আমার ঘুম ছুটেছে, বাঁধ টুটেছে মনে,
খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে,
কাঁপে আমার দিবানিশার সকল আঁধার আলা!
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।রাতের বাসা হয়নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি,
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি।
শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে,
অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।
নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা—
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা?।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
রাতের বাদল মাতে
তমালের শাখে;
পাখির বাসায় এসে
"জাগো জাগো" ডাকে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়,
কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায়-হায়।
পাকা চুল বলে, মান সব লও বাছা,
আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
চলার পথের যত বাধা
পথবিপথের যত ধাঁধা
পদে পদে ফিরে ফিরে মারে,
পথের বীণার তারে তারে
তারি টানে সুর হয় বাঁধা।
রচে যদি দুঃখের ছন্দ
দুঃখের-অতীত আনন্দ
তবেই রাগিণী হবে সাধা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
ঈশ্বরের হাস্যমুখ দেখিবারে পাই
যে আলোকে ভাইকে দেখিতে পায় ভাই।
ঈশ্বর প্রণামে তবে হাতজোড় হয়
যখন ভাইয়ের প্রেমে মিলাই হৃদয়। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
চিত্ত আমার হারাল আজ
মেঘের মাঝখানে,
কোথায় ছুটে চলেছে সে
কোথায় কে জানে।
বিজুলি তা’র বীণার তারে
আঘাত করে বারে বারে,
বুকের মাঝে বজ্র বাজে
কী মহাতানে।পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে
নিবিড় নীল অন্ধকারে
জড়াল রে অঙ্গ আমার,
ছড়াল প্রাণে।
পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি
হল আমার সাথের সাথি,
অট্টহাসে ধায় কোথা সে–
বারণ না মানে।তিনধরিয়া, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বসন্তের হাওয়া যবে অরণ্য মাতায়
নৃত্য উঠে পাতায় পাতায়।
এই নৃত্যে সুন্দরকে অৰ্ঘ্য দেয় তার,
"ধন্য তুমি" বলে বার বার। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
একদিন তুচ্ছ আলাপের ফাঁক দিয়ে
কোন্ অভাবনীয় স্মিতহাস্যে
আমার আত্মবিহ্বল যৌবনটাকে
দিলে তুমি দোলা;
হঠাৎ চমক দিয়ে গেল তোমার মুখে
একটি অমৃতরেখা;
আর কোনোদিন তার দেখা মেলেনি।
জোয়ারের তরঙ্গলীলায় গভীর থেকে উৎক্ষিপ্ত হল
চিরদুর্লভের একটি রত্নকণা
শতলক্ষ ঘটনার সমুদ্র-বেলায়।
এমনি এক পলকে বুকে এসে লাগে
অপরিচিত মুহূর্তের চকিত বেদনা
প্রাণের আধখোলা জালনায়
দূর বনান্ত থেকে
পথ-চলতি গানে।
অভূতপূর্বের অদৃশ্য অঙ্গুলি বিরহের মীড় লাগিয়ে যায়
হৃদয়-তারে
বৃষ্টিধারামুখর নির্জন প্রবাসে,
সন্ধ্যাযূথীর করুণ স্নিগ্ধ গন্ধে,
রেখে দিয়ে যায় কোন্ অলক্ষ্যে আকস্মিক
আপন স্খলিত উত্তরীয়ের স্পর্শ।
তার পরে মনে পড়ে
একদিন সেই বিস্ময়-উন্মনা নিমেষটিকে
অকারণে অসময়ে;
মনে পড়ে শীতের মধ্যাহ্নে,
যখন গোরুচরা শস্যরিক্ত মাঠের দিকে
চেয়ে চেয়ে বেলা যায় কেটে;
মনে পড়ে, যখন সঙ্গহারা সায়াহ্নের অন্ধকারে
সূর্যাস্তের ওপার থেকে বেজে ওঠে
ধ্বনিহীন বীণার বেদনা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে ॥
নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে--
অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে ॥
ক্ষণে ক্ষণে আমি না জেনে করেছি দান
তোমায় আমার গান।
পরানের সাজি সাজাই খেলার ফুলে,
জানি না কখন নিজে বেছে লও তুলে--
তুমি অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে
প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে ॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
রাস্তার ওপারে
বাড়িগুলি ঘেঁষাঘেঁষি সারে সারে।
ওখানে সবাই আছে
ক্ষীণ যত আড়ালের আড়ে-আড়ে কাছে-কাছে।
যা-খুশী প্রসঙ্গ নিয়ে
ইনিয়ে-বিনিয়ে
নানা কণ্ঠে বকে যায় কলস্বরে।
অকারণে হাত ধরে;
যে যাহারে চেনে
পিঠেতে চাপড় দিয়ে নিয়ে যায় টেনে
লক্ষ্যহীন অলিতে গলিতে,
কথা-কাটাকাটি চলে গলাগলি চলিতে চলিতে।
বৃথাই কুশলবার্তা জানিবার ছলে
প্রশ্ন করে বিনা কৌতূহলে।
পরস্পরে দেখা হয়,
বাঁধা ঠাট্টা করে বিনিময়।
কোথা হতে অকস্মাৎ ঘরে ঢুকে
হেসে ওঠে অহেতু কৌতুকে।
"আনন্দবাজার' হতে সংবাদ-উচ্ছিষ্ট ঘেঁটে ঘেঁটে
ছুটির মধ্যাহ্নবেলা বিষম বিতর্কে যায় কেটে।
সিনেমা-নটীর ছবি নিয়ে দুই দলে
রূপের তুলনা-দ্বন্দ্ব চলে,
উত্তাপ প্রবল হয় শেষে
বন্ধুবিচ্ছেদের কাছে এসে।
পথপ্রান্তে দ্বারের সম্মুখে বসি
ফেরিওয়ালাদের সাথে হুঁকো-হাতে দর-কষাকষি।
একই সুরে দম দিয়ে বার বার
গ্রামোফোনে চেষ্টা চলে থিয়েটরি গান শিখিবার।
কোথাও কুকুরছানা ঘেউ-ঘেউ আদরের ডাকে
চমক লাগায় বাড়িটাকে।
শিশু কাঁদে মেঝে মাথা হানি,
সাথে চলে গৃহিণীর অসহিষ্ণু তীব্র ধমকানি।
তাস-পিটোনির শব্দ, নিয়ে জিত হার
থেকে থেকে বিষম চিৎকার।
যেদিন ট্যাক্সিতে চ'ড়ে জামাই উদয় হয় আসি
মেয়েতে মেয়েতে হাসাহাসি,
টেপাটেপি, কানাকানি,
অঙ্গরাগে লাজুকেরে সাজিয়ে দেবার টানাটানি।
দেউরিতে ছাতে বারান্দায়
নানাবিধ আনাগোনা ক্ষণে ক্ষণে ছায়া ফেলে যায়।
হেথা দ্বার বন্ধ হয় হোথা দ্বার খোলে,
দড়িতে গামছা ধুতি ফর্ফর্ শব্দ করি ঝোলে।
অনির্দিষ্ট ধ্বনি চারি পাশে
দিনে রাত্রে কাজের আভাসে।
উঠোনে অনবধানে-খুলে-রাখা কলে
জল বহে যায় কলকলে;
সিঁড়িতে আসিতে যেতে
রাত্রিদিন পথ স্যাঁত্সেঁতে।
বেলা হলে ওঠে ঝন্ঝনি
বাসন-মাজার ধ্বনি।
বেড়ি হাতা খুন্তি রান্নাঘরে
ঘরকরনার সুরে ঝংকার জাগায় পরস্পরে।
কড়ায় সর্ষের তেল চিড়্বিড়্ ফোটে,
তারি মধ্যে কইমাছ অকস্মাৎ ছ্যাঁক্ করে ওঠে।
বন্দেমাতরম্-পেড়ে শাড়ি নিয়ে তাঁতিবউ ডাকে
বউমাকে।
খেলার ট্রাইসিকেলে
ছড়্ ছড়্ খড়্ খড়্ আঙিনায় ঘোরে কার ছেলে।
যাদের উদয় অস্ত আপিসের দিক্চক্রবালে
তাদের গৃহিণীদের সকালে বিকালে
দিন পরে দিন যায়
দুইবার জোয়ার-ভাঁটায়
ছুটি আর কাজে।
হোথা পড়া-মুখস্থের একঘেয়ে অশ্রান্ত আওয়াজে
ধৈর্য হারাইছে পাড়া,
এগ্জামিনেশনে দেয় তাড়া।
প্রাণের প্রবাহে ভেসে
বিবিধ ভঙ্গীতে ওরা মেশে।
চেনা ও অচেনা
লঘু আলাপের ফেনা
আবর্তিয়া তোলে
দেখাশোনা আনাগোনা গতির হিল্লোলে।
রাস্তার এপারে আমি নিঃশব্দ দুপুরে
জীবনের তথ্য যত ফেলে রেখে দূরে
জীবনের তত্ত্ব যত খুঁজি
নিঃসঙ্গ মনের সঙ্গে যুঝি,
সারাদিন চলেছে সন্ধান
দুরূহের ব্যর্থ সমাধান।
মনের ধূসর কূলে
প্রাণের জোয়ার মোরে একদিন দিয়ে গেছে তুলে।
চারি দিকে তীক্ষ্ণ আলো ঝক্ঝক্ করে
রিক্তরস উদ্দীপ্ত প্রহরে।
ভাবি এই কথা--
ওইখানে ঘনীভূত জনতার বিচিত্র তুচ্ছতা
এলোমেলো আঘাতে সংঘাতে
নানা শব্দ নানা রূপ জাগিয়ে তুলিছে দিনরাতে।
কিছু তার টেঁকে নাকো দীর্ঘকাল,
মাটিগড়া মৃদঙ্গের তাল
ছন্দটারে তার
বদল করিছে বারংবার।
তারি ধাক্কা পেয়ে মন
ক্ষণে-ক্ষণ
ব্যগ্র হয়ে ওঠে জাগি
সর্বব্যাপী সামান্যের সচল স্পর্শের লাগি।
আপনার উচ্চতট হতে
নামিতে পারে না সে যে সমস্তের ঘোলা গঙ্গাস্রোতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে
মরছে সে এই নামের কারাগারে।
সকল ভুলে যতই দিবারাতি
নামটারে ওই আকাশপানে গাঁথি,
ততই আমার নামের অন্ধকারে
হারাই আমার সত্য আপনারে।জড়ো করে ধূলির ‘পরে ধূলি
নামটারে মোর উচ্চ করে তুলি।
ছিদ্র পাছে হয় রে কোনোখানে
চিত্ত মম বিরাম নাহি মানে,
যতন করি যতই এ মিথ্যারে
ততই আমি হারাই আপনারে।২১ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
জানি জানি কোন্ আদি কাল হতে
ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে,
সহসা হে প্রিয়, কত গৃহে পথে
রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন।
কতবার তুমি মেঘের আড়ালে
এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে,
অরুণ-কিরণে চরণ বাড়ালে,
ললাটে রাখিলে শুভ পরশন।সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে
কত কালে কালে কত লোকে লোকে
কত নব নব আলোকে আলোকে
অরূপের কত রূপদরশন।
কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে
ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে
কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে
অমৃতের কত রসবরষন।বোলপুর, ১০ ভাদ্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
চারি দিকে খেলিতেছে মেঘ ,
বায়ু আসি করিছে চুম্বন --
সীমাহারা নভস্তল দুই বাহু পসারিয়া
হৃদয়ে করিছে আলিঙ্গন ।
অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার !
যবে আমি আসিব হেথায়
মন্ত্র পড়ি ডাকিব তোমায় ।
বাতাসে উড়িবে তোর বাস ,
ছড়ায়ে পড়িবে কেশপাশ ,
ঈষৎ মেলিয়া আঁখি - পাতা
মৃদু হাসি পড়িবে ফুটিয়া --
হৃদয়ের মৃদুল কিরণ
অধরেতে পড়িবে লুটিয়া ।
এলো থেলো কেশপাশ লয়ে
বসে বসে , খেলিবি হেথায় ,
উষার অলক দুলাইয়া
সমীরণ যেমন খেলায় ।
চুমিয়া চুমিয়া ফুটাইব
আধোফোটা হাসির কুসুম ,
মুখ লয়ে বুকের মাঝারে
গান গেয়ে পাড়াইব ঘুম ।
কৌতুকে করিয়া কোলাকুলি
আসিবে মেঘের শিশুগুলি ,
ঘিরিয়া দাঁড়াবে তারা সবে
অবাক হইয়া চেয়ে রবে ।
মেঘ হতে নেমে ধীরে ধীরে
আয় লো কবিতা , মোর বামে --
চম্পক - অঙ্গুলি দুটি দিয়ে
অন্ধকার ধীরে সরাইয়ে
যেমন করিয়া উষা নামে ।
বায়ু হতে আয় লো কবিতা ,
আসিয়া বসিবি মোর পাশে --
কে জানে , বনের কোথা হতে
ভেসে ভেসে সমীরণস্রোতে
সৌরভ যেমন করে আসে ।
হৃদয়ের অন্তঃপুর হতে
বধূ মোর , ধীরে ধীরে আয় --
ভীরু প্রেম যেমন করিয়া
ধীরে উঠে হৃদয় ধরিয়া ,
বঁধুর পায়ের কাছে গিয়ে
অমনি মুরছি পড়ে যায় ।
অথবা শিথিল কলেবরে
এসো তুমি , বোসো মোর পাশে --
মরণ যেমন করে আসে ,
শিশির যেমন করে ঝরে ,
পশ্চিমের আঁধারসাগরে
তারাটি যেমন করে যায়
অতি ধীরে মৃদু হেসে সিঁদুর সীমন্তদেশে
দিবা সে যেমন করে আসে
মরিবারে স্বামীর চিতায়
পশ্চিমের জ্বলন্ত শিখায় ।
পরবাসী ক্ষীণ - আয়ু একটি মুমূর্ষু বায়ু
শেষ কথা বলিতে বলিতে
তখনি যেমন মরে যায়
তেমনি , তেমনি করে এসো --
কবিতা রে , বধূটি আমার ,
দুটি শুধু পড়িবে নিশ্বাস ,
দুটি শুধু বাহিরিবে বাণী ,
বাহু দুটি হৃদয়ে জড়ায়ে
মরমে রাখিব মুখখানি ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
স্বর্গ কোথায় জানিস কি তা ভাই।
তার ঠিক-ঠিকানা নাই।
তার আরম্ভ নাই,নাই রে তাহার শেষ,
ওরে নাই রে তাহার দেশ,
ওরে নাই রে তাহার দিশা,
ওরে নাই রে দিবস, নাই রে তাহার নিশা।
ফিরেছি সেই স্বর্গে শূন্যে শূন্যে
ফাঁকির ফাঁকা ফানুস
কত যে যুগ-যুগান্তরের পুণ্যে
জন্মেছি আজ মাটির 'পরে ধুলামাটির মানুষ।
স্বর্গ আজি কৃতার্থ তাই আমার দেহে,
আমার প্রেমে, আমার স্নেহে,
আমার ব্যাকুল বুকে,
আমার লজ্জা, আমার সজ্জা, আমার দুঃখে সুখে।
আমার জন্ম-মৃত্যুরি তরঙ্গে
নিত্যনবীন রঙের ছটায় খেলায় সে-যে রঙ্গে।
আমার গানে স্বর্গ আজি
ওঠে বাজি,
আমার প্রাণে ঠিকানা তার পায়,
আকাশভরা আনন্দে সে আমারে তাই চায়।
দিগঙ্গনার অঙ্গনে আজ বাজল যে তাই শঙ্খ,
সপ্ত সাগর বাজায় বিজয়-ডঙ্ক
তাই ফুটেছে ফুল,
বনের পাতায় ঝরনাধারায় তাই রে হুলুস্থুল।
স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটি-মায়ের কোলে
বাতাসে সেই খবর ছোটে আনন্দ-কল্লোলে।
শিলাইদা, কুঠিবাড়ি, ২০ মাঘ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
মরু কহে, অধমেরে এত দাও জল,
ফিরে কিছু দিব হেন কী আছে সম্বল?
মেঘ কহে, কিছু নাহি চাই, মরুভূমি,
আমারে দানের সুখ দান করো তুমি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
নিন্দা দুঃখে অপমানে
যত আঘাত খাই
তবু জানি কিছুই সেথা
হারাবার তো নাই।
থাকি যখন ধুলার ‘পরে
ভাবতে না হয় আসনতরে,
দৈন্যমাঝে অসংকোচে
প্রসাদ তব চাই। লোকে যখন ভালো বলে,
যখন সুখে থাকি,
জানি মনে তাহার মাঝে
অনেক আছে ফাঁকি।
সেই ফাঁকিরে সাজিয়ে লয়ে
ঘুরে বেড়াই মাথায় বয়ে,
তোমার কাছে যাব এমন
সময় নাহি পাই।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
মোরে হিন্দুস্থান
বারবার করেছে আহ্বান
কোন্ শিশুকাল হতে পশ্চিমদিগন্ত-পানে
ভারতের ভাগ্য যেথা নৃত্যলীলা করেছে শ্মশানে,
কালে কালে
তাণ্ডবের তালে তালে,
দিল্লিতে আগ্রাতে
মঞ্জীরঝংকার আর দূর শকুনির ধ্বনি-সাথে;
কালের মন্থনদণ্ডঘাতে
উচ্ছলি উঠেছে যেথা পাথরের ফেনস্তূপে
অদৃষ্টের অট্টহাস্য অভ্রভেদী প্রাসাদের রূপে।
লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর দুই বিপরীত পথে
রথে প্রতিরথে
ধূলিতে ধূলিতে যেথা পাকে পাকে করেছে রচনা
জটিল রেখার জালে শুভ-অশুভের আল্পনা।
নব নব ধ্বজা হাতে নব নব সৈনিকবাহিনী
এক কাহিনীর সূত্র ছিন্ন করি আরেক কাহিনী
বারংবার গ্রন্থি দিয়ে করেছে যোজন।
প্রাঙ্গণপ্রাচীর যার অকস্মাৎ করেছে লঙ্ঘন
দস্যুদল,
অর্ধরাত্রে দ্বার ভেঙে জাগিয়েছে আর্ত কোলাহল,
করেছে আসন-কাড়াকাড়ি,
ক্ষুধিতের অন্নথালি নিয়েছে উজাড়ি।
রাত্রিরে ভুলিল তারা ঐশ্বর্যের মশাল-আলোয়--
পীড়িত পীড়নকারী দোঁহে মিলি সাদায় কালোয়
যেখানে রচিয়াছিল দ্যূতখেলাঘর,
অবশেষে সেথা আজ একমাত্র বিরাট কবর
প্রান্ত হতে প্রান্তে প্রসারিত;
সেথা জয়ী আর পরাজিত
একত্রে করেছে অবসান
বহু শতাব্দীর যত মান অসম্মান।
ভগ্নজানু প্রতাপের ছায়া সেথা শীর্ণ যমুনায়
প্রেতের আহ্বান বহি চলে যায়,
বলে যায়--
আরো ছায়া ঘনাইছে অস্তদিগন্তের
জীর্ণ যুগান্তের।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
শক্তি যার নাই নিজে বড়ো হইবারে
বড়োকে করিতে ছোটো তাই সে কি পারে? (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
জাগার থেকে ঘুমোই , আবার
ঘুমের থেকে জাগি —
অনেক সময় ভাবি মনে
কেন , কিসের লাগি ?
আমাকে , মা , যখন তুমি
ঘুম পাড়িয়ে রাখ
তখন তুমি হারিয়ে গিয়ে
তবু হারাও নাকো ।
রাতে সূর্য , দিনে তারা
পাই নে , হাজার খুঁজি ।
তখন তা'রা ঘুমের সূর্য ,
ঘুমের তারা বুঝি ?
শীতের দিনে কনকচাঁপা
যায় না দেখা গাছে ,
ঘুমের মধ্যে নুকিয়ে থাকে
নেই তবুও আছে ।
রাজকন্যে থাকে , আমার
সিঁড়ির নিচের ঘরে ।
দাদা বলে , ' দেখিয়ে দে তো । '
বিশ্বাস না করে ।
কিন্তু , মা , তুই জানিস নে কি
আমার সে রাজকন্যে
ঘুমের তলায় তলিয়ে থাকে ,
দেখি নে সেইজন্যে ।
নেই তবুও আছে এমন
নেই কি কত জিনিস ?
আমি তাদের অনেক জানি ,
তুই কি তাদের চিনিস ?
যেদিন তাদের রাত পোয়াবে
উঠবে চক্ষু মেলি
সেদিন তোমার ঘরে হবে
বিষম ঠেলাঠেলি ।
নাপিত ভায়া , শেয়াল ভায়া ,
ব্যাঙ্গমা বেঙ্গুমী
ভিড় ক'রে সব আসবে যখন
কী যে করবে তুমি !
তখন তুমি ঘুমিয়ে পোড়ো
আমিই জেগে থেকে
নানারকম খেলায় তাদের
দেব ভুলিয়ে রেখে ।
তার পরে যেই জাগবে তুমি
লাগবে তাদের ঘুম ,
তখন কোথাও কিচ্ছুই নেই
সমস্ত নিজ্ঝুম । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
অতিথিবৎসল,
ডেকে নাও পথের পথিককে
তোমার আপন ঘরে,
দাও ওর ভয় ভাঙিয়ে।
ও থাকে প্রদোষের বস্তিতে,
নিজের কালো ছায়া ওর সঙ্গে চলে
কখনো সমুখে কখনো পিছনে,
তাকেই সত্য ভেবে ওর যত দুঃখ যত ভয়।
দ্বারে দাঁড়িয়ে তোমার আলো তুলে ধরো,
ছায়া যাক মিলিয়ে,
থেমে যাক ওর বুকের কাঁপন। বছরে বছরে ও গেছে চলে
তোমার আঙিনার সামনে দিয়ে,
সাহস পায় নি ভিতরে যেতে,
ভয় হয়েছে পাছে ওর বাইরের ধন
হারায় সেখানে।
দেখিয়ে দাও ওর আপন বিশ্ব
তোমার মন্দিরে,
সেখানে মুছে গেছে কাছের পরিচয়ের কালিমা,
ঘুচে গেছে নিত্যব্যবহারের জীর্ণতা,
তার চিরলাবণ্য হয়েছে পরিস্ফুট। পান্থশালায় ছিল ওর বাসা,
বুকে আঁকড়ে ছিল তারই আসন, তারই শয্যা,
পলে পলে যার ভাড়া জুগিয়ে দিন কাটালো
কোন্ মুহূর্তে তাকে ছাড়বে ভয়ে
আড়াল তুলেছে উপকরণের।
একবার ঘরের অভয় স্বাদ পেতে দাও তাকে
বেড়ার বাইরে।আপনাকে চেনার সময় পায় নি সে,
ঢাকা ছিল মোটা মাটির পর্দায়;
পর্দা খুলে দেখিয়ে দাও যে, সে আলো, সে আনন্দ,
তোমারই সঙ্গে তার রূপের মিল।
তোমার যজ্ঞের হোমাগ্নিতে
তার জীবনের সুখদুঃখ আহুতি দাও,
জ্বলে উঠুক তেজের শিখায়,
ছাই হোক যা ছাই হবার। হে অতিথিবৎসল,
পথের মানুষকে ডেকে নাও ঘরে,
আপনি যে ছিল আপনার পর হয়ে
সে পাক্ আপনাকে।
শান্তিনিকেতন, ২৪ অক্টোবর ১৯৩৫
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
যাওয়া-আসার একই যে পথ
জান না তা কি অন্ধ।
যাবার পথ রোধিতে গেলে
আসার পথ বন্ধ । (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
গাছের পাতায় লেখন লেখে
বসন্তে বর্ষায়—
ঝ'রে পড়ে, সব কাহিনী
ধুলায় মিশে যায়। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এই তো তোমার প্রেম, ওগো
হৃদয়হরণ।
এই-যে পাতায় আলো নাচে
সোনার বরন।
এই-যে মধুর আলসভরে
মেঘ ভেসে যায় আকাশ-‘পরে,
এই-যে বাতাস দেহে করে
অমৃত ক্ষরণ।
এই তো তোমার প্রেম,ওগো
হৃদয়হরণ।প্রভাত-আলোর ধারায় আমার
নয়ন ভেসেছে।
এই তোমারি প্রেমের বাণী
প্রাণে এসেছে।
তোমারি মুখ ওই নুয়েছে,
মুখে আমার চোখ থুয়েছে,
আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে
তোমারি চরণ।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
চলে গেছে মোর বীণাপাণি
কতদিন হল সে না জানি ।
কী জানি কী অনাদরে বিস্মৃত ধূলির পরে
ফেলে রেখে গেছে বীণাখানি ।
ফুটেছে কুসুমরাজি — নিখিল জগতে আজি
আসিয়াছে গাহিবার দিন ,
মুখরিত দশ দিক , অশ্রান্ত পাগল পিক ,
উচ্ছ্বসিত বসন্তবিপিন ।
বাজিয়া উঠেছে ব্যথা , প্রাণ - ভরা ব্যাকুলতা ,
মনে ভরি উঠে কত বাণী ,
বসে আছি সারাদিন গীতিহীন স্তুতিহীন —
চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।
আর সে নবীন সুরে বীণা উঠিবে না পুরে ,
বাজিবে না পুরানো রাগিণী ;
যৌবনে যোগিনীমত , লয়ে নিত্য মৌনব্রত
তুই বীণা রবি উদাসিনী ।
কে বসিবে এ আসনে মানসকমলবনে ,
কার কোলে দিব তোরে আনি —
থাক্ পড়ে ওইখানে চাহিয়া আকাশপানে —
চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।
কখনো মনের ভুলে যদি এরে লই তুলে
বাজে বুকে বাজাইতে বীণা ;
যদিও নিখিল ধরা বসন্তে সংগীত ভরা ,
তবু আজি গাহিতে পারি না ।
কথা আজি কথাসার , সুর তাহে নাহি আর ,
গাঁথা ছন্দ বৃথা বলে মানি —
অশ্রুজলে ভরা প্রাণ , নাহি তাহে কলতান —
চলে গেছে মোর বীণাপাণি । ভাবিতাম সুরে বাঁধা এ বীণা আমারি সাধা ,
এ আমার দেবতার বর ;
এ আমারি প্রাণ হতে মন্ত্রভরা সুধাস্রোতে
পেয়েছে অক্ষয় গীতস্বর ।
একদিন সন্ধ্যালোকে অশ্রুজল ভরি চোখে
বক্ষে এরে লইলাম টানি —
আর না বাজিতে চায় , তখনি বুঝিনু হায়
চলে গেছে মোর বীণাপাণি । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
লিপিমূলক
|
শ্রীমান্ দামু বসু এবং চামু বসু
সম্পাদক সমীপেষু । দামু বোস আর চামু বোসে
কাগজ বেনিয়েছে
বিদ্যেখানা বড্ড ফেনিয়েছে!
(আমার দামু আমার চামু!)
কোথায় গেল বাবা তোমার
মা জননী কই!
সাত-রাজার-ধন মানিক ছেলের
মুখে ফুটছে খই!
(আমার দামু আমার চামু!)
দামু ছিল একরত্তি
চামু তথৈবচ ,
কোথা থেকে এল শিখে
এতই খচমচ!
(আমার দামু আমার চামু!)
দামু বলেন ‘ দাদা আমার '
চামু বলেন ‘ ভাই ',
আমাদের দোঁহাকার মতো
ত্রিভুবনে নাই!
(আমার দামু আমার চামু!)
গায়ে পড়ে গাল পাড়ছে
বাজার সরগরম ,
মেছুনি-সংহিতায় ব্যাখ্যা
হিঁদুর ধরম!
(দামু আমার চামু!)
দামুচন্দ্র অতি হিঁদু
আরো হিঁদু চামু
সঙ্গে সঙ্গে গজায় হিঁদু
রামু বামু শামু
(দামু আমার চামু!)
রব উঠেছে ভারতভূমে
হিঁদু মেলা ভার ,
দামু চামু দেখা দিয়েছেন
ভয় নেইকো আর ।
(ওরে দামু , ওরে চামু!)
নাই বটে গোতম অত্রি
যে যার গেছে সরে ,
হিঁদু দামু চামু এলেন
কাগজ হাতে করে ।
(আহা দামু আহা চামু!)
লিখছে দোঁহে হিঁদুশাস্ত্র
এডিটোরিয়াল ,
দামু বলছে মিথ্যে কথা
চামু দিচ্ছে গাল ।
(হায় দামু হায় চামু!)
এমন হিঁদু মিলবে না রে
সকল হিঁদুর সেরা ,
বোস বংশ আর্যবংশ
সেই বংশের এঁরা!
(বোস দামু বোস চামু!)
কলির শেষে প্রজাপতি
তুলেছিলেন হাই ,
সুড়সুড়িয়ে বেড়িয়ে এলেন
আর্য দুটি ভাই ;
(আর্য দামু চামু!)
দন্ত দিয়ে খুঁড়ে তুলছে
হিঁদু শাস্ত্রের মূল ,
মেলাই কচুর আমদানিতে
বাজার হুলুস্থুল ।
(দামু চামু অবতার!)
মনু বলেন ‘ মনু আমি '
বেদের হল ভেদ ,
দামু চামু শাস্ত্র ছাড়ে ,
রইল মনে খেদ!
(ওরে দামু ওরে চামু!)
মেড়ার মত লড়াই করে
লেজের দিকটা মোটা ,
দাপে কাঁপে থরথর
হিঁদুয়ানির খোঁটা!
(আমার হিঁদু দামু চামু!)
দামু চামু কেঁদে আকুল
কোথায় হিঁদুয়ানি!
ট্যাকে আছে গোঁজ ' যেথায়
সিকি দুয়ানি ।
(থলের মধ্যে হিঁদুয়ানি!)
দামু চামু ফুলে উঠল
হিঁদুয়ানি বেচে ,
হামাগুড়ি ছেড়ে এখন
বেড়ায় নেচে নেচে!
(ষেটের বাছা দামু চামু!)
আদর পেয়ে নাদুস নুদুস
আহার করছে কসে ,
তরিবৎটা শিখলে নাকো
বাপের শিক্ষাদোষে!
(ওরে দামু চামু!)
এসো বাপু কানটি নিয়ে ,
শিখবে সদাচার ,
কানের যদি অভাব থাকে
তবেই নাচার!
(হায় দামু হায় চামু!)
পড়াশুনো করো , ছাড়ো
শাস্ত্র আষাঢ়ে ,
মেজে ঘষে তোল্ রে বাপু
স্বভাব চাষাড়ে ।
(ও দামু ও চামু!)
ভদ্রলোকের মান রেখে চল্
ভদ্র বলবে তোকে ,
মুখ ছুটোলে কুলশীলটা
জেনে ফেলবে লোকে!
(হায় দামু হায় চামু!)
পয়সা চাও তো পয়সা দেব
থাকো সাধুপথে ,
তাবচ্চ শোভতে কেউ কেউ
যাবৎ ন ভাষতে!
(হে দামু হে চামু!) (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
জননী, কন্যারে আজ বিদায়ের ক্ষণে
আপন অতীতরূপ পড়িয়াছে মনে
যখন বালিকা ছিলে।
মাতৃক্রোড় হতে
তোমারে ভাসালো ভাগ্য দূরতর স্রোতে
সংসারের।
তার পর গেল কত দিন
দুঃখে সুখে,
বিচ্ছেদের ক্ষত হল ক্ষীণ।এ-জন্মের আরম্ভভূমিকা-- সংকীর্ণ সে
প্রথম উষার মতো-- ক্ষণিক প্রদোষে
মিলাইল লয়ে তার স্বর্ণ কুহেলিকা।
বাল্যে পরেছিলে শুভ্র মাঙ্গল্যের টিকা,
সিন্দূররেখায় হল লীন।
সে-রেখাটি
জীবনের পূর্বভাগ দিল যেন কাটি।
আজ সেই ছিন্নখণ্ড ফিরে এল শেষে
তোমার কন্যার মাঝে অশ্রুর আবেশে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হে আদিজননী সিন্ধু,বসুন্ধরা সন্তান তোমার,
একমাত্র কন্যা তব কোলে। তাই তন্দ্রা নাহি আর
চক্ষে তব, তাই বক্ষ জুড়ি সদা শঙ্কা,সদা আশা,
সদা আন্দোলন; তাই উঠে বেদমন্ত্রসম ভাষা
নিরন্তর প্রশান্ত অম্বরে, মহেন্দ্রমন্দির-পানে
অন্তরের অনন্ত প্রার্থনা, নিয়ত মঙ্গলগানে
ধ্বনিত করিয়া দিশি দিশি; তাই ঘুমন্ত পৃথ্বীরে
অসংখ্য চুম্বন কর আলিঙ্গনে সর্ব অঙ্গ ঘিরে
তরঙ্গবন্ধনে বাঁধি, নীলাম্বর অঞ্চলে তোমার
সযত্নে বেষ্টিয়া ধরি সন্তর্পণে দেহখানি তার
সুকোমল সুকৌশলে। এ কী সুগম্ভীর স্নেহখেলা
অম্বুনিধি, ছল করি দেখাইয়া মিথ্যা অবহেলা
ধীরি ধীরি পা টিপিয়া পিছু হটি যাও দূরে,
যেন ছেড়ে যেতে চাও; আবার আনন্দপূর্ণ সুরে
উল্লসি ফিরিয়া আসি কল্লোলে ঝাঁপায়ে পড় বুকে–
রাশি রাশি শুভ্রহাস্যে, অশ্রুজলে, স্নেহগর্বসুখে
আর্দ্র করি দিয়ে যাও ধরিত্রীর নির্মল ললাট
আশীর্বাদে। নিত্যবিগলিত তব অন্তর বিরাট,
আদি অন্ত স্নেহরাশি– আদি অন্ত তাহার কোথা রে!
কোথা তার তল! কোথা কূল! বলো কে বুঝিতে পারে
তাহার অগাধ শান্তি, তাহার অপার ব্যাকুলতা,
তার সুগভীর মৌন, তার সমুচ্ছল কলকথা,
তার হাস্য, তার অশ্রুরাশি!– কখনো-বা আপনারে
রাখিতে পার না যেন, স্নেহপূর্ণস্ফীতস্তনভারে
উন্মাদিনী ছুটে এসে ধরণীরে বক্ষে ধর চাপি
নির্দয় আবেগে; ধরা প্রচণ্ড পীড়নে উঠে কাঁপি,
রুদ্ধশ্বাসে ঊর্ধ্বশ্বাসে চীৎকারি উঠিতে চাহে কাঁদি,
উন্মত্ত স্নেহক্ষুধায় রাক্ষসীর মতো তারে বাঁধি
পীড়িয়া নাড়িয়া যেন টুটিয়া ফেলিয়া একেবারে
অসীম অতৃপ্তিমাঝে গ্রাসিতে নাশিতে চাহ তারে
প্রকাণ্ড প্রলয়ে। পরক্ষণে মহা অপরাধীপ্রায়
পড়ে থাকে তটতলে স্তব্ধ হয়ে বিষণ্ণ ব্যথায়
নিষণ্ন নিশ্চল– ধীরে ধীরে প্রভাত উঠিয়া এসে
শান্তদৃষ্টি চাহে তোমাপানে; সন্ধ্যাসখী ভালোবেসে
স্নেহকরস্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা করিয়ে চুপেচুপে
চলে যায় তিমিরমন্দিরে; রাত্রি শোনে বন্ধুরূপে
গুমরি ক্রন্দন তব রুদ্ধ অনুতাপে ফুলে ফুলে।
আমি পৃথিবীর শিশু বসে আছি তব উপকূলে,
শুনিতেছি ধ্বনি তব। ভাবিতেছি, বুঝা যায় যেন
কিছু কিছু মর্ম তার– বোবার ইঙ্গিতভাষা-হেন
আত্মীয়ের কাছে। মনে হয়, অন্তরের মাঝখানে
নাড়ীতে যে-রক্ত বহে, সেও যেন ওই ভাষা জানে,
আর কিছু শেখে নাই। মনে হয়, যেন মনে পড়ে
যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে
অজাত ভুবনভ্রূণ-মাঝে, লক্ষকোটি বর্ষ ধ’রে
ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে
মুদ্রিত হইয়া গেছে; সেই জন্মপূর্বের স্মরণ,
গর্ভস্থ পৃথিবী’পরে সেই নিত্য জীবনস্পন্দন
তব মাতৃহৃদয়ের– অতি ক্ষীণ আভাসের মতো
জাগে যেন সমস্ত শিরায়, শুনি যবে নেত্র করি নত
বসি জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি।
দিক্ হতে দিগন্তরে যুগ হতে যুগান্তর গণি
তখন আছিলে তুমি একাকিনী অখণ্ড অকূল
আত্মহারা, প্রথম গর্ভের মহা রহস্য বিপুল
না বুঝিয়া। দিবারাত্রি গূঢ় এক স্নেহব্যাকুলতা,
গর্ভিণীর পূর্বরাগ, অলক্ষিতে অপূর্ব মমতা,
অজ্ঞাত আকাঙক্ষারাশি, নিঃসন্তান শূন্য বক্ষোদেশে
নিরন্তর উঠিত ব্যাকুলি। প্রতি প্রাতে উষা এসে
অনুমান করি যেত মহাসন্তানের জন্মদিন,
নক্ষত্র রহিত চাহি নিশি নিশি নিমেষবিহীন
শিশুহীন শয়ন-শিয়রে। সেই আদিজননীর
জনশূন্য জীবশূন্য স্নেহচঞ্চলতা সুগভীর,
আসন্ন প্রতীক্ষাপূর্ণ সেই তব জাগ্রত বাসনা,
অগাধ প্রাণের তলে সেই তব অজানা বেদনা
অনাগত মহাভবিষ্যৎ লাগি হৃদয়ে আমার
যুগান্তরস্মৃতিসম উদিত হতেছে বারম্বার।
আমারো চিত্তের মাঝে তেমনি অজ্ঞাতব্যথাভরে,
তেমনি অচেনা প্রত্যাশায়, অলক্ষ্য সুদূর-তরে
উঠিছে মর্মর স্বর। মানবহৃদয়-সিন্ধুতলে
যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে,
আপনি সে নাহি জানে। শুধু অর্ধ-অনুভব তারি
ব্যাকুল করেছে তারে, মনে তার দিয়েছে সঞ্চারি
আকারপ্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা–
প্রমাণের অগোচর, প্রত্যক্ষের বাহিরেতে বাসা।
তর্ক তারে পরিহাসে, মর্ম তারে সত্য বলি জানে,
সহস্র ব্যাঘাত-মাঝে তবুও সে সন্দেহ না মানে,
জননী যেমন জানে জঠরের গোপন শিশুরে,
প্রাণে যবে স্নেহ জাগে, স্তনে যবে দুগ্ধ উঠে পূরে।
প্রাণভরা ভাষাহরা দিশাহারা সেই আশা নিয়ে
চেয়ে আছি তোমা পানে; তুমি সিন্ধু, প্রকাণ্ড হাসিয়ে
টানিয়া নিতেছ যেন মহাবেগে কী নাড়ীর টানে
আমার এ মর্মখানি তোমার তরঙ্গ-মাঝখানে
কোলের শিশুর মতো।
হে জলধি, বুঝিবে কি তুমি
আমার মানবভাষা। জান কি তোমার ধরাভূমি
পীড়ায় পীড়িত আজি ফিরিতেছে এ-পাশ ও-পাশ,
চক্ষে বহে অশ্রুধারা, ঘন ঘন বহে উষ্ণ শ্বাস।
নাহি জানে কী যে চায়, নাহি জানে কিসে ঘুচে তৃষা,
আপনার মনোমাঝে আপনি সে হারায়েছে দিশা
বিকারের মরীচিকা-জালে। অতল গম্ভীর তব
অন্তর হইতে কহ সান্ত্বনার বাক্য অভিনব
আষাঢ়ের জলদমন্দ্রের মতো; স্নিগ্ধ মাতৃপাণি
চিন্তাতপ্ত ভালে তার তালে তালে বারম্বার হানি,
সর্বাঙ্গে সহস্রবার দিয়া তারে স্নেহময় চুমা,
বলো তার “শান্তি, শান্তি’, বলো তারে “ঘুমা, ঘুমা, ঘুমা’।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে
পরাও যারে মণিরতন-হার--
খেলাধুলা আনন্দ তার সকলি যায় ঘুরে,
বসন-ভুষণ হয় যে বিষম ভার।
ছেঁড়ে পাছে আঘাত লাগি,
পাছে ধুলায় হয় সে দাগি,
আপনাকে তাই সরিয়ে রাখে সবার হতে দূরে,
চলতে গেলে ভাবনা ধরে তার--
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,
পরাও যারে মণিরতন-হার।কী হবে মা অমনতরো রাজার মতো সাজে,
কী হবে ওই মণিরতন-হারে।
দুয়ার খুলে দাও যদি তো ছুটি পথের মাঝে
রৌদ্রবায়ু-ধুলাকাদার পাড়ে।
যেথায় বিশ্বজনের মেলা
সমস্ত দিন নানান খেলা,
চারি দিকে বিরাট গাথা বাজে হাজার সুরে,
সেথায় সে যে পায় না অধিকার,
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,
পরাও যারে মণিরতন-হার।
( বোলপুর, ২ শ্রাবণ, ১৩১৭)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
শুনেছি আমারে ভালোই লাগে না, নাই বা লাগিল তোর ।
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লোহার শিকল-ডোর ।
তুই তো আমার বন্দী অভাগী, বাঁধিয়াছি কারাগারে,
প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে, দেখি কে খুলিতে পারে ।
জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি,
যেথায় বসিবি, যেথায় দাঁড়াবি,
বসন্তে শীতে দিবসে নিশীথে
সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে
এ পাষাণপ্রাণ চিরশৃঙ্খল চরণ জড়ায়ে ধ'রে--
একবার তোরে দেখেছি যখন কেমনে এড়াবি মোরে?
চাও নাহি চাও, ডাকো নাই ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব সাথে সাথে, রব পায় পায়, রব গায় গায় মিশি--
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ, এ অশ্রুজল, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্যের মতন বাজিবে সাথে সাথে দিবানিশি।।নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া--
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে
কভু সম্মুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া ।
গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিনপ্রাণে
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখপানে ।
যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান,
যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার আঁধার মুরতি আঁকা--
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে, জগৎ পড়িবে ঢাকা ।
দুঃস্বপনের মতো চিরকাল তোমারে রহিব ঘিরে,
দিবসরজনী এ মুখ দেখিব তোমার নয়ননীরে
চিরভিক্ষার মতন দাঁড়ায়ে রব সম্মুখে তোর ।
'দাও দাও' বলে কেবলি ডাকিব, ফেলিব নয়নলোর ।
কেবলি সাধিব, কেবলি কাঁদিব, কেবলি ফেলিব শ্বাস,
কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে করিব রে হাহুতাশ ।
মোর এক নাম কেবলি বসিয়া জপিব কানেতে তব,
কাঁটার মতন দিবসরজনী পায়েতে বিঁধিয়ে রব ।
গত জনমের অভিশাপ-সম রব আমি কাছে কাছে,
ভাবী জনমের অদৃষ্ট-হেন বেড়াইব পাছে পাছে।।যেন রে অকূল সাগর মাঝারে ডুবেছে জগৎ-তরী,
তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী--
রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি,
যুঝিস ছাড়াতে, ছাড়িব না তবু মহাসমুদ্র-'পরি ।
পলে পলে তোর দেহ হয় ক্ষীণ,
পলে পলে তোর বাহু বলহীন--
দোহে অনন্তে ডুবি নিশিদিন, তবু আছি তোরে ধরি।।রোগের মতন বাঁধিব তোমারে দারুণ আলিঙ্গনে--
মোর যাতনায় হইবি অধীর,
আমারি অনলে দহিবে শরীর,
অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর কিছু রহিবে না মনে।।ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি, কেবল দেখিবি মোরে--
এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি চাহিয়া দেখিছে তোরে ।
নিশীতে বসিয়া থেকে থেকে তুই শুনিবি আঁধারঘোরে
কোথা হতে এক ঘোর উন্মাদ ডাকে তোর নাম ধ'রে ।
নিরজন পথে চলিতে চলিতে সহসা সভয় গণি
সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি আমার হাসির ধ্বনি।। হেরো অমোঘন মরুময়ী নিশা--
আমার পরান হারায়েছে দিশা,
অনন্ত ক্ষুদা অনন্ত তৃষা করিতেছে হাহাকার ।
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে,
এ ঘোর পিপাসা যুগযুগান্তে মিটিবে কি কভু আর!
বুকের ভিতরে ছুরির মতন,
মনের মাঝারে বিষের মতন,
রোগের মতন, শোকের মতন রব আমি অনিবার।।জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে, আশার পিছনে ভয়--
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরাময় ।
যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া এই তো নিয়ম ভবে--
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই এ ক্ষুদা জাগিয়া রবে।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বাহির হতে বহিয়া আনি
সুখের উপাদান।
আপনা-মাঝে আনন্দের
আপনি সমাধান। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে
এখন তুমি যা-খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ অন্তরে
বাহির হতে সকলি মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ কর প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর। এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালোবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালেম বুঝি,
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হম যব না রব, সজনী,
নিভৃত বসন্তনিকুঞ্জবিতানে আসবে নির্মল রজনী—
মিলনপিপাসিত আসবে যব, সখি, শ্যাম হমারি আশে,
ফুকারবে যব ‘রাধা রাধা’ মুরলি ঊরধ শ্বাসে,
যব সব গোপিনী আসবে ছুটই যব হম আওব না,
যব সব গোপিনী জাগবে চমকই যব হম জাগব না,
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে হেরবে আকুল শ্যাম।
বন বন ফেরই সো কি ফুকারবে ‘রাধা রাধা’ নাম।
না যমুনা, সো এক শ্যাম মম, শ্যামক শত শত নারী—
হম যব যাওব শত শত রাধা চরণে রহবে তারি।
তব্ সখি যমুনে, যাই নিকুঞ্জে, কাহে তয়াগব দে।
হমারি লাগি এ বৃন্দাবনমে কহ, সখি, রোয়ব কে।
ভানু কহে চুপি, মানভরে রহে, আও বনে ব্রজনারী—
মিলবে শ্যামক থরথর আদর, ঝরঝর লোচনবারি॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
পশ্চাতের নিত্যসহচর, অকৃতার্থ হে অতীত,
অতৃপ্ত তৃষ্ণার যত ছায়ামূর্তি প্রেতভূমি হতে
নিয়েছ আমার সঙ্গ, পিছু-ডাকা অক্লান্ত আগ্রহে
আবেশ-আবিল সুরে বাজাইছ অস্ফুট সেতার,
বাসাছাড়া মৌমাছির গুন গুন গুঞ্জরণ যেন
পুষ্পরিক্ত মৌনী বনে। পিছু হতে সম্মুখের পথে
দিতেছ বিস্তীর্ণ করি’ অস্ত শিখরের দীর্ঘ ছায়া
নিরন্ত ধূসর পাণ্ডু বিদায়ের গোধূলি রচিয়া।
পশ্চাতের সহচর, ছিন্ন করো স্বপ্নের বন্ধন;
রেখেছ হরণ করি’ মরণের অধিকার হতেবেদনার ধন যত, কামনার রঙিন ব্যর্থতা,
মৃত্যুরে ফিরায়ে দাও। আজি মেঘমুক্ত শরতের
দূরে-চাওয়া আকাশেতে ভারমুক্ত চির পথিকের
বাঁশিতে বেজেছে ধ্বনি, আমি তারি হব অনুগামী। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ভুত হয়ে দেখা দিল
বড়ো কোলাব্যাঙ,
এক পা টেবিলে রাখে,
কাঁধে এক ঠ্যাঙ।
বনমালী খুড়ো বলে, —
“করো মোরে রক্ষে,
শীতল দেহটি তব
বুলিয়ো না বক্ষে।’
উত্তর দেয় না সে,
দেয় শুধু “ক্যাঙ’। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
শত বার ধিক্ আজি আমারে, সুন্দরী,
তোমারে হেরিতে চাহি এত ক্ষুদ্র করি।
তোমার মহিমাজ্যোতি তব মূর্তি হতে
আমার অন্তরে পড়ি ছড়ায় জগতে।
যখন তোমার ‘পরে পড়ে নি নয়ন
জগৎ-লক্ষ্মীর দেখা পাই নি তখন।
স্বর্গের অঞ্জন তুমি মাখাইলে চোখে,
তুমি মোরে রেখে গেছ অনন্ত এ লোকে।
এ নীল আকাশ এত লাগিত কি ভালো,
যদি না পড়িত মনে তব মুখ-আলো।
অপরূপ মায়াবলে তব হাসি-গান
বিশ্বমাঝে লভিয়াছে শত শত প্রাণ।
তুমি এলে আগে-আগে দীপ লয়ে করে,
তব পাছে পাছে বিশ্ব পশিল অন্তরে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
পাড়ায় আছে ক্লাব,
আমার একতলার ঘরখানা
দিয়েছি ওদের ছেড়ে।
কাগজে পেয়েছি প্রশংসাবাদ,
ওরা মীটিং করে আমাকে পরিয়েছে মালা।
আজ আট বছর থেকে
শূন্য আমার ঘর।
আপিস থেকে ফিরে এসে দেখি
সে ঘরের একটা ভাগে
টেবিলে পা তুলে
কেউ পড়ছে খবরের কাগজ,
কেউ খেলছে তাস,
কেউ করছে তুমুল তর্ক।
তামাকের ধোঁয়ায়
ঘনিয়ে ওঠে বদ্ধ হাওয়া,
ছাইদানিতে জমতে থাকে,
ছাই, দেশলাইকাঠি,
পোড়া সিগারেটের টুকরো।
এই প্রচুর পরিমাণ ঘোলা আলাপের
গোলামাল দিয়ে
দিনের পর দিন
আমার সন্ধ্যার শূন্যতা দিই ভরে।
আবার রাত্তির দশটার পরে
খালি হয়ে যায়
উপুড়-করা একটা উচ্ছিষ্ট অবকাশ।
বাইরে থেকে আসে ট্র৻ামের শব্দ,
কোনোদিন আপন মনে শুনি
গ্রামোফোনের গান,
যে কয়টা রেকর্ড আছে
ঘুরে ফিরে তারি আবৃত্তি।
আজ ওরা কেউ আসে নি;
গেছে হাবড়া স্টেশনে
অভ্যর্থনায়;
কে সদ্য এনেছে
সমুদ্রপারের হাততালি
আপন নামটার সঙ্গে বেঁধে।
নিবিয়ে দিয়েছি বাতি।
যাকে বলে "আজকাল'
অনেকদিন পরে
সেই আজকালটা, সেই প্রতিদিনের নকীব
আজ নেই সন্ধ্যায় আমার ঘরে।
আটবছর আগে
এখানে ছিল হাওয়ায়-ছড়ানো যে স্পর্শ,
চুলের যে অস্পষ্ট গন্ধ,
তারি একটা বেদনা লাগল
ঘরের সব কিছুতেই।
যেন কী শুনব বলে
রইল কান পাতা;
সেই ফুলকাটা ঢাকাওয়ালা
পুরোনো খালি চৌকিটা
যেন পেয়েছে কার খবর।
পিতামহের আমলের
পুরোনো মুচকুন্দ গাছ
দাঁড়িয়ে আছে জানলার সামনে
কৃষ্ণ রাতের অন্ধকারে।
রাস্তার ওপারের বাড়ি
আর এই গাছের মধ্যে যেটুকু আকাশ আছে
সেখানে দেখা যায়
জ্বলজ্বল করছে একটি তারা।
তাকিয়ে রইলেম তার দিকে চেয়ে,
টনটন করে বুকের ভিতরটা।
যুগল জীবনের জোয়ার জলে
কত সন্ধ্যায় দুলেছে ঐ তারার ছায়া।
অনেক কথার মধ্যে
মনে পড়ছে ছোট্ট একটি কথা।
সেদিন সকালে
কাগজ পড়া হয়নি কাজের ভিড়ে;
সন্ধ্যেবেলায় সেটা নিয়ে
বসেছি এই ঘরেতেই,
এই জানলার পাশে
এই কেদারায়।
চুপি চুপি সে এল পিছনে
কাগজখানা দ্রুত কেড়ে নিল হাত থেকে।
চলল কাড়াকাড়ি
উচ্চ হাসির কলরোলে।
উদ্ধার করলুম লুঠের জিনিস,
স্পর্ধা করে আবার বসলুম পড়তে।
হঠাৎ সে নিবিয়ে দিল আলো।
আমার সেদিনকার
সেই হার-মানা অন্ধকার
আজ আমাকে সর্বাঙ্গে ধরেছে ঘিরে,
যেমন করে সে আমাকে ঘিরেছিল
দুয়ো-দেওয়া নীরব হাসিতে ভরা
বিজয়ী তার দুই বাহু দিয়ে,
সেদিনকার সেই আলো-নেবা নির্জনে।
হঠাৎ ঝরঝরিয়ে উঠল হাওয়া
গাছের ডালে ডালে,
জানলাটা উঠল শব্দ করে,
দরজার কাছের পর্দাটা
উড়ে বেড়াতে লাগল অস্থির হয়ে।
আমি বলে উঠলেম,
"ওগো, আজ তোমার ঘরে তুমি এসেছ কি
মরণলোক থেকে
তোমার বাদামি রঙের শাড়িখানি পরে?"
একটা নিঃশ্বাস লাগল আমার গায়ে,
শুনলেম অশ্রুতবাণী,
"কার কাছে আসব?"
আমি বললেম,
"দেখতে কি পেলে না আমাকে?"
শুনলেম,
"পৃথিবীতে এসে
যাকে জেনেছিলেম একান্তই,
সেই আমার চিরকিশোর বঁধু
তাকে তো আর পাইনে দেখতে
এই ঘরে।"
শুধালেম, "সে কি নেই কোথাও?"
মৃদু শান্তসুরে বললে,
"সে আছে সেইখানেই
যেখানে আছি আমি।
আর কোথাও না।"
দরজার কাছে শুনলেম উত্তেজিত কলরব,
হাবড়া স্টেশন থেকে
ওরা ফিরেছে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
বহু দিন ধরে' বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি,বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।(স্ফুলিঙ্গ হতে সংগৃহীত)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।
এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে।
এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে,
এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে,
এসো মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে।
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত,
এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত,
এসো এসো হে বিচিত্র বিধানে।
এসো দুঃখে সুখে, এসো মর্মে,
এসো নিত্য নিত্য সব কর্মে;
এসো সকল-কর্ম-অবসানে।
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।অগ্রহায়ণ, ১৩১৪?
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নূতন জন্মদিনে
পুরাতনের অন্তরেতে
নূতনে লও চিনে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেরি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়--
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো--কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতিপ্রদোষে হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নাম-হারা স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়। হে বন্ধু, বিদায়।
তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা,
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ-বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।আজো তুমি নিজে হয়তো-বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু, বিদায়। মোর লাগি করিয়ো না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই--
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান--
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
নৌকাযাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিয়া লিখিতসুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন স্থলচরবরেষুজলে বাসা বেঁধেছিলেম , ডাঙায় বড়ো কিচিমিচি ।
সবাই গলা জাহির করে , চেঁচায় কেবল মিছিমিছি ।
সস্তা লেখক কোকিয়ে মরে , ঢাক নিয়ে সে খালি পিটোয় ,
ভদ্রলোকের গায়ে পড়ে কলম নেড়ে কালি ছিটোয় ।
এখানে যে বাস করা দায় ভনভনানির বাজারে ,
প্রাণের মধ্যে গুলিয়ে উঠে হট্টগোলের মাঝারে ।
কানে যখন তালা ধরে , উঠি যখন হাঁপিয়ে
কোথায় পালাই , কোথায় পালাই — জলে পড়ি ঝাঁপিয়ে
গঙ্গাপ্রাপ্তির আশা করে গঙ্গাযাত্রা করেছিলেম ।
তোমাদের না বলে কয়ে আস্তে আস্তে সরেছিলেম ।দুনিয়ার এ মজলিসেতে এসেছিলেম গান শুনতে ,
আপন মনে গুনগুনিয়ে রাগ – রাগিণীর জাল বুনতে ।
গান শোনে সে কাহার সাধ্যি , ছোঁড়াগুলো বাজায় বাদ্যি ,
বিদ্যেখানা ফাটিয়ে ফেলে থাকে তারা তুলো ধুনতে ।
ডেকে বলে , হেঁকে বলে , ভঙ্গি করে বেঁকে বলে —
‘‘ আমার কথা শোনো সবাই , গান শোনো আর নাই শোনো।
গান যে কাকে বলে সেইটে বুঝিয়ে দেব , তাই শোনে । ”টীকে করেন ব্যখ্যা করেন , জেঁকে ওঠে বক্তিমে —
কে দেখে তার হাত – পা নাড়া , চক্ষু দুটোর রক্তিমে !
চন্দ্রসূর্য জ্বলছে মিছে আকাশখানার চালাতে —
তিনি বলেন , ‘‘ আমিই আছি জ্বলতে এবং জ্বালাতে । ”’
কুঞ্জবনের তানপুরোতে সুর বেঁধেছে বসন্ত ,
সেটা শুনে নাড়েন কর্ণ , হয় নাকো তাঁর পছন্দ ।
তাঁরি সুরে গাক – না সবাই টপ্পা খেয়াল ধুরবোধ —
গায় না যে কেউ , আসল কথা নাইকো কারো সুর – বোধ !
কাগজওয়ালা সারি সারি নাড়ছে কাগজ হাতে নিয়ে —
বাঙলা থেকে শান্তি বিদায় তিনশো কুলোর বাতাস দিয়ে ।
কাগজ দিয়ে নৌকা বানায় বেকার যত ছেলেপিলে ,
কর্ণ ধরে পার করবেন দু – এক পয়সা খেয়া দিলে ।
সস্তা শুনে ছুটে আসে যত দীর্ঘকর্ণগুলো —
বঙ্গদেশের চতুর্দিকে তাই উড়ছে এত ধুলো ।
খুদে খুদে ‘আর্য’ গুলো ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে ,
ছুঁচোলো সব জিবের ডগা কাঁটার মতো পায়ে ফোটে ।
তাঁরা বলেন , ‘‘ আমিই কল্কি” — গাঁজার কল্কি হবে বুঝি !
অবতারে ভরে গেল যত রাজ্যের গলিঘুঁজি ।পাড়ার এমন কত আছে কত কব তার !
বঙ্গদেশে মেলাই এল বরা ‘- অবতার ।
দাঁতের জোরে হিন্দুশাস্ত্র তুলবে তারা পাঁকের থেকে ,
দাঁতকপাটি লাগে তাদের দাঁত – খিঁচুনির ভঙ্গি দেখে ।
আগাগোড়াই মিথ্যে কথা , মিথ্যেবাদীর কোলাহল ,
জিব নাচিয়ে বেড়ায় যত জিহ্বাওয়ালা সঙের দল ।
বাক্যবন্যা ফেনিয়ে আসে , ভাসিয়ে নে যায় তোড়ে —
কোনোক্রমে রক্ষে পেলাম মা – গঙ্গারই ক্রোড়ে ।হেথায় কিবা শান্তি – ঢালা কুলুকুলু তান !
সাগর – পানে বহন করে গিরিরাজের গান ।
ধীরি ধীরি বাতাসটি দেয় জলের গায়ে কাঁটা ।
আকাশেতে আলো – আঁধার খেলে জোয়ারভাঁটা ।
তীরে তীরে গাছের সারি পল্লবেরই ঢেউ ।
সারা দিবস হেলে দোলে , দেখে না তো কেউ ।
পূর্বতীরে তরুশিরে অরুণ হেসে চায় —
পশ্চিমেতে কুঞ্জমাঝে সন্ধ্যা নেমে যায় ।
তীরে ওঠে শঙ্খধ্বনি , ধীরে আসে কানে ,
সন্ধ্যাতারা চেয়ে থাকে ধরণীর পানে ।
ঝাউবনের আড়ালেতে চাঁদ ওঠে ধীরে ,
ফোটে সন্ধ্যাদীপগুলি অন্ধকার তীরে ।
এই শান্তি – সলিলেতে দিয়েছিলেম ডুব ,
হট্টগোলটা ভুলেছিলেম , সুখে ছিলেম খুব ।জান তো ভাই আমি হচ্ছি জলচরের জাত ,
আপন মনে সাঁতরে বেড়াই — ভাসি যে দিনরাত ।
রোদ পোহাতে ডাঙায় উঠি , হাওয়াটি খাই চোখ বুজে ,
ভয়ে ভয়ে কাছে এগোই তেমন তেমন লোক বুঝে ।
গতিক মন্দ দেখলে আবার ডুবি অগাধ জলে ,
এমনি করেই দিনটা কাটাই লুকোচুরির ছলে ।
তুমি কেন ছিপ ফেলেছ শুকনো ডাঙায় বসে ?
বুকের কাছে বিদ্ধ করে টান মেরেছ কষে ।
আমি তোমায় জলে টানি , তুমি ডাঙায় টানো —
অটল হয়ে বসে আছ , হার তো নাহি মানো ।
আমারি নয় হার হয়েছে , তোমারি নয় জিত —
খাবি খাচ্ছি ডাঙায় পড়ে হয়ে পড়ে চিত ।
আর কেন ভাই , ঘরে চলো ছিপ গুটিয়ে নাও ,
রবীন্দ্রনাথ পড়ল ধরা ঢাক পিটিয়ে দাও । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
দূর হতে কী শুনিস মৃত্যুর গর্জন, ওরে দীন,
ওরে উদাসীন--
ওই ক্রন্দনের কলরোল,
লক্ষ বক্ষ হতে মুক্ত রক্তের কল্লোল।
বহ্নিবন্যা-তরঙ্গের বেগ,
বিষশ্বাস-ঝটিকার মেঘ,
ভূতল গগন
মূর্ছিত বিহ্বল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন;
ওরি মাঝে পথ চিরে চিরে
নূতন সমুদ্রতীরে
তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি,
ডাকিছে কাণ্ডারী
এসেছে আদেশ--
বন্দরে বন্ধনকাল এবারের মতো হল শেষ,
পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা
আর চলিবে না।
বঞ্চনা বাড়িয়া ওঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি,
কাণ্ডারী ডাকিছে তাই বুঝি--
"তুফানের মাঝখানে
নূতন সমুদ্রতীরপানে
দিতে হবে পাড়ি।"
তাড়াতাড়ি
তাই ঘর ছাড়ি
চারি দিক হতে ওই দাঁড়-হাতে ছুটে আসে দাঁড়ী।
"নূতন উষার স্বর্ণদ্বার
খুলিতে বিলম্ব কত আর।"
এ কথা শুধায় সবে
ভীত আর্তরবে
ঘুম হতে অকস্মাৎ জেগে।
ঝড়ের পুঞ্জিত মেঘে
কালোয় ঢেকেছে আলো--জানে না তো কেউ
রাত্রি আছে কি না আছে; দিগন্তে ফেনায়ে উঠে ঢেউ--
তারি মাঝে ফুকারে কাণ্ডারী--
"নূতন সমুদ্রতীরে তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি।"
বাহিরিয়া এল কা'রা। মা কাঁদিছে পিছে,
প্রেয়সী দাঁড়ায়ে দ্বারে নয়ন মুদিছে।
ঝড়ের গর্জনমাঝে
বিচ্ছেদের হাহাকার বাজে;
ঘরে ঘরে শূন্য হল আরামের শয্যাতল;
"যাত্রা করো, যাত্রীদল"
উঠেছে আদেশ,
"বন্দরের কাল হল শেষ।"
মৃত্য ভেদ করি
দুলিয়া চলেছে তরী।
কোথায় পৌঁছিবে ঘাটে, কবে হবে পার,
সময় তো নাই শুধাবার।
এই শুধু জানিয়াছে সার
তরঙ্গের সাথে লড়ি
বাহিয়া চলিতে হবে তরী।
টানিয়া রাখিতে হবে পাল,
আঁকড়ি ধরিতে হবে হাল;
বাঁচি আর মরি
বাহিয়া চলিতে হবে তরী।
এসেছে আদেশ--
বন্দরের কাল হল শেষ।
অজানা সমুদ্রতীর, অজানা সে-দেশ--
সেথাকার লাগি
উঠিয়াছে জাগি
ঝটিকার কণ্ঠে কণ্ঠে শূন্যে শূন্যে প্রচণ্ড আহ্বান।
মরণের গান
উঠেছে ধ্বনিয়া পথে নবজীবনের অভিসারে
ঘোর অন্ধকারে।
যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল,
যত অশ্রুজল,
যত হিংসা হলাহল,
সমস্ত উঠিছে তরঙ্গিয়া,
কূল উল্লঙ্ঘিয়া,
ঊর্ধ্ব আকাশেরে ব্যঙ্গ করি।
তবু বেয়ে তরী
সব ঠেলে হতে হবে পার,
কানে নিয়ে নিখিলের হাহাকার,
শিরে লয়ে উন্মত্ত দুর্দিন,
চিত্তে নিয়ে আশা অন্তহীন,
হে নির্ভীক, দুঃখ অভিহত।
ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি। মাথা করো নত।
এ আমার এ তোমার পাপ।
বিধাতার বক্ষে এই তাপ
বহু যুগ হতে জমি বায়ুকোণে আজিকে ঘনায়--
ভীরুর ভীরুতাপুঞ্জ, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়,
লোভীর নিষ্ঠুর লোভ,
বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ,
জাতি-অভিমান,
মানবের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার বহু অসম্মান,
বিধাতার বক্ষ আজি বিদীরিয়া
ঝটিকার দীর্ঘশ্বাসে জলে স্থলে বেড়ায় ফিরিয়া।
ভাঙিয়া পড়ুক ঝড়, জাগুক তুফান,
নিঃশেষ হইয়া যাক নিখিলের যত বজ্রবাণ।
রাখো নিন্দাবাণী, রাখো আপন সাধুত্ব আভিমান,
শুধু একমনে হও পার
এ প্রলয়-পারাবার
নূতন সৃষ্টির উপকূলে
নূতন বিজয়ধ্বজা তুলে।
দুঃখেরে দেখেছি নিত্য, পাপেরে দেখেছি নানা ছলে;
অশান্তির ঘূর্ণি দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে;
মৃত্যু করে লুকোচুরি
সমস্ত পৃথিবী জুড়ি।
ভেসে যায় তারা সরে যায়
জীবনেরে করে যায়
ক্ষণিক বিদ্রূপ।
আজ দেখো তাহাদের অভ্রভেদী বিরাট স্বরূপ।
তার পরে দাঁড়াও সম্মুখে,
বলো অকম্পিত বুকে--
"তোরে নাহি করি ভয়,
এ সংসারে প্রতিদিন তোরে করিয়াছি জয়।
তোর চেয়ে আমি সত্য, এ বিশ্বাসে প্রাণ দিব, দেখ্।
শান্তি সত্য, শিব সত্য, সত্য সেই চিরন্তন এক।"
মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে,
সত্য যদি নাহি মেলে দুঃখ সাথে যুঝে,
পাপ যদি নাহি মরে যায়
আপনার প্রকাশ-লজ্জায়,
অহংকার ভেঙে নাহি পড়ে আপনার অসহ্য সজ্জায়,
তবে ঘরছাড়া সবে
অন্তরের কী আশ্বাস-রবে
মরিতে ছুটিছে শত শত
প্রভাত-আলোর পানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মতো।
বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।
স্বর্গ কি হবে না কেনা।
বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না
এত ঋণ?
রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন।
নিদারুণ দুঃখরাতে
মৃত্যুঘাতে
মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা
তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?
কলিকাতা, ২৩ কার্তিক, ১৩২২
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কোটি কোটি ছোটো ছোটো মরণেরে লয়ে
বসুন্ধরা ছুটিছে আকাশে,
হাসে খেলে মৃত্যু চারিপাশে।
এ ধরণী মরণের পথ,
এ জগৎ মৃত্যুর জগৎ।যতটুকু বর্তমান, তারেই কি বল’ প্রাণ?
সে তো শুধু পলক, নিমেষ।
অতীতের মৃত ভার পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার,
না জানি কোথায় তার শেষ।
যত বর্ষ বেঁচে আছি তত বর্ষ মরে গেছি,
মরিতেছি প্রতি পলে পলে,
জীবন্ত মরণ মোরা মরণের ঘরে থাকি
জানি নে মরণ কারে বলে।একমুঠা মরণেরে জীবন বলে কি তবে,
মরণের সমষ্টি কেবল?
একটি নিমেষ তুচ্ছ শত মরণের গুচ্ছ,
নাম নিয়ে এত কোলাহল।
মরণ বাড়িবে যত জীবন বাড়িবে তত,
পলে পলে উঠিব আকাশে
নক্ষত্রের কিরণনিবাসে।মরণ বাড়িবে যত কোথায় কোথায় যাব,
বাড়িবে প্রাণের অধিকার--
বিশাল প্রাণের মাঝে কত গ্রহ কত তারা
হেথা হোথা করিবে বিহার ।
উঠিবে জীবন মোর কত-না আকাশ ছেয়ে,
ঢাকিয়া ফেলিবে রবি শশী--
যুগ-যুগান্তর যাবে, নব নব রাজ্য পাবে
নব নব তারায় প্রবেশি।কবে রে আসিবে সেই দিন
উঠিব সে আকাশের পথে,
আমার মরণ-ডোর দিয়ে
বেঁধে দেব জগতে জগতে।
আমাদের মরণের জালে
জগৎ ফেলিব আবরিয়া,
এ অনন্ত আকাশসাগরে
দশ দিক রহিব ঘেরিয়া।জয় হোক জয় হোক মরণের জয় হোক--
আমাদের অনন্ত মরণ,
মরণের হবে না মরণ।
এ ধরায় মোরা সবে শতাব্দীর ক্ষুদ্র শিশু
লইলাম তোমার শরণ।
এসো তুমি এসো কাছে, স্নেহ-কোলে লও তুমি,
পিয়াও তোমার মাতৃস্তন,
আমাদের করো হে পালন।
আনন্দে পুরেছে প্রাণ, হেরিতেছি এ জগতে
মরণের অনন্ত উৎসব।
কার নিমন্ত্রণে মোরা মহাযজ্ঞে এসেছি রে,
উঠেছে বিপুল কলরব।যে ডাকিছে ভালোবেসে, তারে চিনিস নে শিশু?
তার কাছে কেন তোর ডর?
জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম,
মরণ তো নহে তোর পর।
আয়, তারে অলিঙ্গন কর্-
আয়, তার হাতখানি ধর্।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ ,
শুনিতে পেয়েছি ওই —
সবাই এসেছে লইয়া নিশান ,
কই রে বাঙালি কই !
সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায়
বঙ্গসাগরের তীরে ,
‘ বাঙালির ঘরে কে আছিস আয়‘
ডাকিতেছে ফিরে ফিরে ।
ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানো ,
পথে কেন নাই লোক ,
সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন —
বেঁচে আছে শুধু শোক ।
গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে ,
চেয়ে থাকে হিমগিরি ,
রবি শশী উঠে অনন্ত গগনে
আসে যায় ফিরি ফিরি ।
কত - না সংকট , কত - না সন্তাপ
মানবশিশুর তরে ,
কত - না বিবাদ কত - না বিলাপ
মানবশিশুর ঘরে !
কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস ,
কেহ কারে নাহি মানে ,
ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস
হৃদয়ের মাঝখানে ।
হৃদয়ে লুকানো হৃদয়বেদনা ,
সংশয় - আঁধারে যুঝে ,
কে কাহারে আজি দিবে গো সান্ত্বনা —
কে দিবে আলয় খুঁজে !
মিটাতে হইবে শোক তাপ ত্রাস ,
করিতে হইবে রণ ,
পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস —
শোনো শোনো সৈন্যগণ !
পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে ,
বাতাস ছুটেছে তাই —
গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে
চলিয়াছে কত ভাই ।
বঙ্গের কুটিরে এসেছে বারতা ,
শুনেছে কি তাহা সবে ?
জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা
জালদগম্ভীর রবে ?
হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি ?
আঁখি খুলেছে কি কেহ ?
ভেঙেছে কি কেহ সাধের পুতলি ?
ছেড়েছে খেলার গেহ ?
কেন কানাকানি , কেন রে সংশয় ?
কেন মরো ভয়ে লাজে ?
খুলে ফেলো দ্বার , ভেঙে ফেলো ভয় ,
চলো পৃথিবীর মাঝে ।
ধরাপ্রান্তভাগে ধুলিতে লুটায়ে ,
জড়িমাজড়িত তনু ,
আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে
ঘুমায় কীটের অণু ।
চারি দিকে তার আপন - উল্লাসে
জগৎ ধাইছে কাজে ,
চারি দিকে তার অনন্ত আকাশে
স্বরগসংগীত বাজে !
চারি দিকে তার মানবমহিমা
উঠিছে গগনপানে ,
খুঁজিছে মানব আপনার সীমা
অসীমের মাঝখানে !
সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস ,
আপনারে জানে বড়ো —
আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস ,
ধুলা করিতেছে জড়ো ।
সুখদুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম ,
জগতের রঙ্গভূমি —
হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম ,
কেন গো ঘুমাও তুমি ।
ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে ,
শুনিতেছ হাহাকার —
তীর কোথা আছে দেখো মুখ তুলে ,
এ সমুদ্র করো পার ।
মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে ,
তুমি এসো , দাও যোগ —
বাধার মতন জড়াও চরণ
এ কী রে করম - ভোগ ।
তা যদি না পারো সরো তবে সরো ,
ছড়ে দাও তবে স্থান ,
ধুলায় পড়িয়া মরো তবে মরো —
কেন এ বিলাপগান !
ওরে চেয়ে দেখ্ মুখ আপনার ,
ভেবে দেখ্ তোরা কারা ,
মানবের মতো ধরিয়া আকার ,
কেন রে কীটের পারা ?
আছে ইতিহাস , আছে কুলমান ,
আছে মহত্ত্বের খনি —
পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান
শোন্ তার প্রতিধ্বনি ।
খুঁজেছেন তাঁরা চাহিয়া আকাশে
গ্রহতারকার পথ ,
জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে
উড়াতেন মনোরথ ।
চাতকের মতো সত্যের লাগিয়া
তৃষিত - আকুল - প্রাণে
দিবসরজনী ছিলেন জাগিয়া
চাহিয়া বিশ্বের পানে ।
তবে কেন সবে বধির হেথায় ,
কেন অচেতন প্রাণ —
বিফল উচ্ছ্বাসে কেন ফিরে যায়
বিশ্বের আহ্বানগান !
মহত্ত্বের গাথা পশিতেছে কানে ,
কেন রে বুঝি নে ভাষা ?
তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে
কেন রে জাগে না আশা ?
উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে ,
কেন রে নাচে না প্রাণ ?
নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে ,
কেন রে জাগে না গান ?
কেন আছি শুয়ে , কেন আছি চেয়ে ,
পড়ে আছি মুখোমুখি —
মানবের স্রোত চলে গান গেয়ে ,
জগতের সুখে সুখী !
চলো দিবালোকে , চলো লোকালয়ে ,
চলো জনকোলাহলে —
মিশাব হৃদয় মানবহৃদয়ে
অসীম আকাশতলে ।
তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের'পরে ,
নৃত্যগীত নব নব —
বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠস্বরে
এককণ্ঠ হয়ে কব ।
মানবের সুখ মানবের আশা
বাজিবে আমার প্রাণে ,
শত লক্ষ কোটি মানবের ভাষা
ফুটিবে আমার গানে ।
মানবের কাজে মানবের মাঝে
আমরা পাইব ঠাঁই ,
বঙ্গের দুয়ারে তাই শিঙা বাজে —
শুনিতে পেয়েছি ভাই !
মুছে ফেলো ধুলা , মুছ অশ্রুজল ,
ফেলো ভিখারির চীর —
পরো নব সাজ , ধরো নব বল ,
তোলো তোলো নত শির ।
তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে
জগতের নিমন্ত্রণ —
দীনহীন বেশ ফেলে যেয়ো পাছে ,
দাসত্বের আভরণ ।
সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন ,
হাসিয়া চাহিবে ধীরে ,
পুরবরবির হিরণ কিরণ
পড়িবে তোমার শিরে ।
বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া
হৃদয়ের শতদল ,
জগতমাঝারে যাইবে লুটিয়া
প্রভাতের পরিমল ।
উঠ বঙ্গকবি , মায়ের ভাষায়
মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ —
জগতের লোক সুধার আশায়
সে ভাষা করিবে পান ।
চাহিবে মোদের মায়ের বদনে ,
ভাসিবে নয়নজলে —
বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে
মায়ের চরণতলে ।
বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই বলে
কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি ,
গান গেয়ে কবি জগতের তলে
স্থান কিনে দাও তুমি ।
এক বার কবি মায়ের ভাষায়
গাও জগতের গান —
সকল জগৎ ভাই হয়ে যায় ,
ঘুচে যায় অপমান । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সাড়ে নটা বেজেছে ঘড়িতে;
সকালের মৃদু শীতে
তন্দ্রাবেশে হাওয়া যেন রোদ পোহাইতেছে
পাহাড়ের উপত্যকা-নিচে
বনের মাথায়
সবুজের আমন্ত্রণ-বিছানো পাতায়।
বৈঠকখানার ঘরের রেড়িয়োতে
সমুদ্রপারের দেশ হতে
আকাশে প্লাবন আনে সুরের প্রবাহে,
বিদেশিনী বিদেশের কণ্ঠে গান গাহে
বহু যোজনের অন্তরালে।
সব তার লুপ্ত হয়ে মিলেছে কেবল সুরে তালে।
দেহহীন পরিবেশহীন
গীতস্পর্শ হতেছে বিলীন
সমস্ত চেতনা ছেয়ে।
যে বেলাটি বেয়ে
এল তার সাড়া
সে আমার দেশের সময়-সূত্র-ছাড়া।
একাকিনী, বহি রাগিণীর দীপশিখা
আসিছে অভিসারিকা
সর্বভারহীনা;
অরূপা সে, অলক্ষিত আলোকে আসীনা।
গিরিনদীসমুদ্রের মানে নি নিষেধ,
করিয়াছে ভেদ
পথে পথে বিচিত্র ভাষার কলরব,
পদে পদে জন্ম-মৃত্যু বিলাপ-উৎসব।
রণক্ষেত্রে নিদারুণ হানাহানি,
লক্ষ লক্ষ গৃহকোণে সংসারের তুচ্ছ কানাকানি,
সমস্ত সংসর্গ তার
একান্ত করেছে পরিহার।
বিশ্বহারা
একখানি নিরাসক্ত সংগীতের ধারা।
যক্ষের বিরহগাথা মেঘদূত
সেও জানি এমনিই অদ্ভুত।
বাণীমূর্তি সেও একা।
শুধু নামটুকু নিয়ে কবির কোথাও নেই দেখা।
তার পাশে চুপ
সেকালের সংসারের সংখ্যাহীন রূপ।
সেদিনের যে প্রভাতে উজ্জয়িনী ছিল সমুজ্জ্বল
জীবনে উচ্ছল
ওর মাঝে তার কোনো আলো পড়ে নাই।
রাজার প্রতাপ সেও ওর ছন্দে সম্পূর্ণ বৃথাই।
যুগ যুগ হয়ে এল পার
কালের বিপ্লব বেয়ে, কোনো চিহ্ন আনে নাই তার।
বিপুল বিশ্বের মুখরতা
উহার শ্লোকের পটে স্তব্ধ করে দিল সব কথা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ব্যঙ্গাত্মক
|
হাত দিয়ে পেতে হবে কী তাহে আনন্দ–
হাত পেতে পাওয়া যাবে সেটাই পছন্দ।
আপিসেতে খেটে মরা তার চেয়ে ঝুলি ধরা
ঢের ভালো– এ কথায় নাই কোনো সন্দ। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এই করেছ ভালো, নিঠুর,
এই করেছ ভালো।
এমনি করে হৃদয়ে মোর
তীব্র দহন জ্বালো।
আমার এ ধূপ না পোড়ালে
গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে
দেয় না কিছুই আলো।যখন থাকে অচেতনে
এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব
সেই তো পুরস্কার।
অন্ধকারে মোহে লাজে
চোখে তোমায় দেখি না যে,
বজ্রে তোলো আগুন করে
আমার যত কালো।৪ আষাঢ়,১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
আমার শেষবেলাকার ঘরখানি
বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে,
তার নাম দেব শ্যামলী।
ও যখন পড়বে ভেঙে
সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো,
মাটির কোলে মিশবে মাটি;
ভাঙা থামে নালিশ উঁচু করে
বিরোধ করবে না ধরণীর সঙ্গে;
ফাটা দেয়ালের পাঁজর বের ক'রে
তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না
মৃতদিনের প্রেতের বাসা।
সেই মাটিতে গাঁথব
আমার শেষ বাড়ির ভিত
যার মধ্যে সব বেদনার বিস্মৃতি,
সব কলঙ্কের মার্জনা,
যাতে সব বিকার সব বিদ্রূপকে
ঢেকে দেয় দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে;
যার মধ্যে শত শত শতাব্দীর
রক্তলোলুপ হিংস্র নির্ঘোষ
গেছে নিঃশব্দ হয়ে।
সেই মাটির ছাদের নিচে বসব আমি
রোজ সকালে শৈশবে যা ভরেছিল
আমার গাঁটবাঁধা চাদরের কোনা
এক-একমুঠো চাঁপা আর বেল ফুলে।
মাঘের শেষে যার আমের বোল
দক্ষিণের হাওয়ায়
অলক্ষ্য দূরের দিকে ছড়িয়েছিল
ব্যথিত যৌবনের আমন্ত্রণ।
আমি ভালোবেসেছি
বাংলাদেশের মেয়েকে;
যে-দেখায় সে আমার চোখ ভুলিয়েছে
তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন,
ওর কচি ধানের চিকন আভা।
তাদের কালো চোখের করুণ মাধুরীর উপমা দেখেছি
ঐ মাটির দিগন্তে
নীল বনসীমায় গোধূলির শেষ আলোটির
নিমীলনে।
প্রতিদিন আমার ঘরের সুপ্ত মাটি
সহজে উঠবে জেগে
ভোরবেলাকার সোনার কাঠির
প্রথম ছোঁওয়ায়;
তার চোখ-জুড়ানো শ্যামলিমায়
স্মিত হাসি কোমল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে
চৈত্ররাতের চাঁদের
নিদ্রাহারা মিতালিতে।
চিরদিন মাটি আমাকে ডেকেছে
পদ্মার ভাঙনলাগা
খাড়া পাড়ির বনঝাউবনে,
গাঙশালিকের হাজার খোপের বাসায়;
সর্ষে-তিসির দুইরঙা খেতে
গ্রামের সরু বাঁকা পথের ধারে,
পুকুরের পাড়ির উপরে।
আমার দু-চোখ ভ'রে
মাটি আমায় ডাক পাঠিয়েছে
শীতের ঘুঘুডাকা দুপুরবেলায়,
রাঙা পথের ও পারে,
যেখানে শুকনো ঘাসের হলদে মাঠে
চরে বেড়ায় দুটি-চারটি গোরু
নিরুৎসুক আলস্যে,
লেজের ঘায়ে পিঠের মাছি তাড়িয়ে;
যেখানে সাথীবিহীন
তালগাছের মাথায়
সঙ্গ-উদাসীন নিভৃত চিলের বাসা।
আজ আমি তোমার ডাকে
ধরা দিয়েছি শেষবেলায়।
এসেছি তোমার ক্ষমাস্নিগ্ধ বুকের কাছে,
যেখানে একদিন রেখেছিলে অহল্যাকে,
নবদূর্বাশ্যামলের
করুণ পদস্পর্শে
চরম মুক্তি-জাগরণের প্রতীক্ষায়,
নবজীবনের বিস্মিত প্রভাতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
অরুণময়ী তরুণী উষা
জাগায়ে দিল গান।
পুরব মেঘে কনকমুখী
বারেক শুধু মারিল উঁকি,
অমনি যেন জগৎ ছেয়ে
বিকশি উঠে প্রাণ।
কাহার হাসি বহিয়া এনে
করিলি সুধা দান।
ফুলেরা সব চাহিয়া আছে
আকাশপানে মগন-মনা,
মুখেতে মৃদু বিমল হাসি
নয়নে দুটি শিশির-কণা।
আকাশ-পারে কে যেন ব'সে,
তাহারে যেন দেখিতে পায়,
বাতাসে দুলে বাহুটি তুলে
মায়ের কোলে ঝাঁপিতে যায়।
কী যেন দেখে, কী যেন শোনে--
কে যেন ডাকে, কে যেন গায়--
ফুলের সুখ, ফুলের হাসি
দেখিবি তোরা আয় রে আয়।
আ মরি মরি অমনি যদি
ফুলের মতো চাহিতে পারি।
বিমল প্রাণে বিমল সুখে
বিমল প্রাতে বিমল মুখে
ফুলের মতো অমনি যদি
বিমল হাসি হাসিতে পারি।
দুলিছে, মরি, হরষ-স্রোতে,
অসীম স্নেহে আকাশ হতে
কে যেন তারে খেতেছে চুমো,
কোলেতে তারি পড়িছে লুটে।
কে যেন তারি নামটি ধ’রে
ডাকিছে তারে সোহাগ ক'রে
শুনিতে পেয়ে ঘুমের ঘোরে
মুখটি ফুটে হাসিটি ফোটে,
শিশুর প্রাণে সুখের মতো
সুবাসটুকু জাগিয়া ওঠে।
আকাশ পানে চাহিয়া থাকে,
না জানি তাহে কী সুখ পায়।
বলিতে যেন শেখে নি কিছু,
কী যেন তবু বলিতে চায়।
আঁধার কোণে থাকিস তোরা,
জানিস কি রে কত সে সুখ,
আকাশপানে চাহিলে পরে
আকাশপানে তুলিলে মুখ।
সুদূর দূর, সুনীল নীল,
সুদূরে পাখি উড়িয়া যায়।
সুনীল দূরে ফুটিছে তারা,
সুদূর হতে আসিছে বায়।
প্রভাতকরে করি রে স্নান
ঘুমাই ফুলবাসে,
পাখির গান লাগে রে যেন
দেহের চারি পাশে।
বাতাস যেন প্রাণের সখা,
প্রবাসে ছিল, নতুন দেখা,
ছুটিয়া আসে বুকের কাছে
বারতা শুধাইতে।
চাহিয়া আছে আমার মুখে,
কিরণময় আমারি সুখে
আকাশ যেন আমারি তরে
রয়েছে বুক পেতে।
মনেতে করি আমারি যেন
আকাশ-ভরা প্রাণ,
আমারি প্রাণ হাসিতে ছেয়ে
জাগিছে উষা তরুণ মেয়ে,
করুণ আঁখি করিছে প্রাণে
অরুণসুধা দান।
আমারি বুকে প্রভাতবেলা
ফুলেরা মিলি করিছে খেলা,
হেলিছে কত, দুলিছে কত,
পুলকে ভরা মন,
আমারি তোরা বালিকা মেয়ে
আমারি স্নেহধন।
আমারি মুখে চাহিয়া তোর
আঁখিটি ফুটিফুটি।
আমারি বুকে আলয় পেয়ে
হাসিয়া কুটিকুটি।
কেন রে বাছা, কেন রে হেন
আকুল কিলিবিলি,
কী কথা যেন জানাতে চাস
সবাই মিলি মিলি।
হেথায় আমি রহিব বসে
আজি সকালবেলা
নীরব হয়ে দেখিব চেয়ে
ভাইবোনের খেলা।
বুকের কাছে পড়িবি ঢলে
চাহিবি ফিরে ফিরে,
পরশি দেহে কোমলদল
স্নেহেতে চোখে আসিবে জল,
শিশিরসম তোদের ‘পরে
ঝরিবে ধীরে ধীরে।হৃদয় মোর আকাশ-মাঝে
তারার মতো উঠিতে চায়,
আপন সুখে ফুলের মতো
আকাশপানে ফুটিতে চায়।
নিবিড় রাতে আকাশে উঠে
চারি দিকে সে চাহিতে চায়,
তারার মাঝে হারায়ে গিয়ে
আপন মনে গাহিতে চায়।
মেঘের মতো হারায় দিশা
আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়--
কোথায় যাবে কিনারা নাই,
দিবসনিশি চলেছে তাই
বাতাস এসে লাগিছে গায়ে,
জোছনা এসে পড়িছে পায়ে,
উড়িয়া কাছে গাহিছে পাখি,
মুদিয়া যেন এসেছে আঁখি,
আকাশ-মাঝে মাথাটি থুয়ে
আরামে যেন ভাসিয়া যায়,
হৃদয় মোর মেঘের মতো
আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়।
ধরার পানে মেলিয়া আঁখি
উষার মতো হাসিতে চায়।
জগৎ-মাঝে ফেলিতে পা
চরণ যেন উঠিছে না,
শরমে যেন হাসিছে মৃদু হাস,
হাসিটি যেন নামিল ভুঁয়ে,
জাগায়ে দিল ফুলেরে ছুঁয়ে,
মালতীবধূ হাসিয়া তারে
করিল পরিহাস।
মেঘেতে হাসি জড়ায়ে যায়,
বাতাসে হাসি গড়ায়ে যায়,
উষার হাসি--ফুলের হাসি--
কানন-মাঝে ছড়ায়ে যায়।
হৃদয় মোর আকাশে উঠে
উষার মতো হাসিতে চায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমি হেথায় থাকি শুধু
গাইতে তোমার গান,
দিয়ো তোমার জগৎসভায়
এইটুকু মোর স্থান।
আমি তোমার ভুবন-মাঝে
লাগি নি নাথ, কোনো কাজে–
শুধু কেবল সুরে বাজে
অকাজের এই প্রাণ।নিশায় নীরব দেবালয়ে
তোমার আরাধন,
তখন মোরে আদেশ কোরো
গাইতে হে রাজন্।
ভোরে যখন আকাশ জুড়ে
বাজবে বীণা সোনার সুরে
আমি যেন না রই দূরে
এই দিয়ো মোর মান।১৬ ভাদ্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ইস্টিমারের ক্যাবিনটাতে কবে নিলেম ঠাঁই ,
স্পষ্ট মনে নাই ।
উপরতলার সারে
কামরা আমার একটা ধারে ।
পাশাপাশি তারি
আরো ক্যাবিন সারি সারি
নম্বরে চিহ্নিত ,
একই রকম খোপ সেগুলোর দেয়ালে ভিন্নিত ।
সরকারী যা আইনকানুন তাহার যাথাযথ্য
অটুট , তবু যাত্রীজনের পৃথক বিশেষত্ব
রুদ্ধদুয়ার ক্যাবিনগুলোয় ঢাকা ;
এক চলনের মধ্যে চালায় ভিন্ন ভিন্ন চাকা ,
ভিন্ন ভিন্ন চাল ।
অদৃশ্য তার হাল ,
অজানা তার লক্ষ্য হাজার পথেই ,
সেথায় কারো আসনে ভাগ হয় না কোনোমতেই ।
প্রত্যেকেরই রিজার্ভ করা কোটর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ;
দরজাটা খোলা হলেই সম্মুখে সমুদ্র
মুক্ত চোখের'পরে
সমান সবার তরে ,
তবুও সে একান্ত অজানা ,
তরঙ্গতর্জনী-তোলা অলঙ্ঘ্য তার মানা ।
মাঝে মাঝে ঘণ্টা পড়ে । ডিনার-টেবিলে
খাবার গন্ধ , মদের গন্ধ , অঙ্গরাগের সুগন্ধ যায় মিলে —
তারি সঙ্গে নানা রঙের সাজে
ইলেক্ট্রিকের আলো-জ্বালা কক্ষমাঝে
একটু জানা অনেকখানি না-জানাতেই মেশা
চক্ষু-কানের স্বাদের ঘ্রাণের সম্মিলিত নেশা
কিছুক্ষণের তরে
মোহাবেশে ঘনিয়ে সবায় ধরে ।
চেনাশোনা হাসি-আলাপ মদের ফেনার মতো
বুদ্বুদিয়া ওঠে আবার গভীরে হয় গত ।
বাইরে রাত্রি তারায় তারাময় ,
ফেনিল সুনীল তেপান্তরে মরণ-ঘেরা ভয় ।
হঠাৎ কেন খেয়াল গেল মিছে ,
জাহাজখানা ঘুরে আসি উপর থেকে নীচে ।
খানিক যেতেই পথ হারালুম , গলির আঁকেবাঁকে
কোথায় ওরা কোন্ অফিসার থাকে ।
কোথাও দেখি সেলুন-ঘরে ঢুকে ,
ক্ষুর বোলাচ্ছে নাপিত সে কার ফেনায়-মগ্ন মুখে ।
হোথায় রান্নাঘর ;
রাঁধুনেরা সার বেঁধেছে পৃথুল-কলেবর ।
গা ঘেঁষে কে গেল চলে ড্রেসিং-গাউন-পরা ,
স্নানের ঘরে জায়গা পাবার ত্বরা ।
নীচের তলার ডেকের ‘ পরে কেউ বা করে খেলা ,
ডেক-চেয়ারে কারো শরীর মেলা ,
বুকের উপর বইটা রেখে কেউ বা নিদ্রা যায় ,
পায়চারি কেউ করে ত্বরিত পায় ।
স্টুয়ার্ড্ হোথায় জুগিয়ে বেড়ায় বরফী শর্বৎ ।
আমি তাকে শুধাই আমার ক্যাবিন-ঘরের পথ
নেহাত থতোমতো ।
সে শুধাল , নম্বর তার কত ।
আমি বললেম যেই ,
নম্বরটা মনে আমার নেই —
একটু হেসে নিরুত্তরে গেল আপন কাজে ,
ঘেমে উঠি উদ্বেগে আর লাজে ।
আবার ঘুরে বেড়াই আগে পাছে ,
চেয়ে দেখি কোন্ ক্যাবিনের নম্বর কী আছে ।
যেটাই দেখি মনেতে হয় , এইটে হতে পারে ;
সাহস হয় না ধাক্কা দিতে দ্বারে ।
ভাবছি কেবল , কী যে করি , হল আমার এ কী —
এমন সময় হঠাৎ চমকে দেখি ,
নিছক স্বপ্ন এ যে ,
এক যাত্রার যাত্রী যারা কোথায় গেল কে যে ।
গভীর রাত্রি ; বাতাস লেগে কাঁপে ঘরের সাসি ,
রেলে গাড়ি অনেক দূরে বাজিয়ে গেল বাঁশি ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
এ ধূসর জীবনের গোধূলী,
ক্ষীণ তার উদাসীন স্মৃতি,
মুছে-আসা সেই ম্লান ছবিতে
রঙ দেয় গুঞ্জনগীতি।ফাগুনের চম্পকপরাগে
সেই রঙ জাগে,
ঘুমভাঙা কোকিলের কূজনে
সেই রঙ লাগে,
সেই রঙ পিয়ালের ছায়াতে
ঢেলে দেয় পুর্ণিমাতিথি।এই ছবি ভেরবী-আলাপে
দোলে মোর কম্পিত বক্ষে,
সেই ছবি সেতারের প্রলাপে
মরীচিকা এনে দেয় চক্ষে,
বুকের লালিম-রঙে রাঙানো
সেই ছবি স্বপ্নের অতিথি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে,
বাঁকা পথের ডাহিন পাশে, ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে।
কে জানে এই গ্রাম,
কে জানে এর নাম,
খেতের ধারে মাঠের পারে বনের ঘন ছায়ে–
শুধু আমার হৃদয় জানে সে ছিল এই গাঁয়ে।বেণুশাখারা আড়াল দিয়ে চেয়ে আকাশ-পানে
কত সাঁঝের চাঁদ-ওঠা সে দেখেছে এইখানে।
কত আষাঢ় মাসে
ভিজে মাটির বাসে
বাদলা হাওয়া বয়ে গেছে তাদের কাঁচা ধানে।
সে-সব ঘনঘটার দিনে সে ছিল এইখানে।এই দিঘি, ওই আমের বাগান, ওই-যে শিবালয়,
এই আঙিনা ডাক-নামে তার জানে পরিচয়।
এই পুকুরে তারি,
সাঁতার-কাটা বারি,
ঘাটের পথরেখা তারি চরণ-লেখা-ময়।
এই গাঁয়ে সে ছিল কে সেই জানে পরিচয়।এই যাহারা কলস নিয়ে দাঁড়ায় ঘাটে আসি
এরা সবাই দেখেছিল তারি মুখের হাসি।
কুশল পুছি তারে
দাঁড়াত তার দ্বারে
লাঙল কাঁধে চলছে মাঠে ওই-যে প্রাচীন চাষি।
সে ছিল এই গাঁয়ে আমি যারে ভালোবাসি।পালের তরী কত-যে যায় বহি দখিনবায়ে,
দূর প্রবাসের পথিক এসে বসে বকুলছায়ে।
পারের যাত্রিদলে
খেয়ার ঘাটে চলে,
কেউ গো চেয়ে দেখে না ওই ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে।
আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ভাঙা দেউলের দেবতা,
তব বন্দনা রচিতে ছিন্ন বীণার তন্ত্রী বিরতা -
সন্ধ্যাগগনে ঘোষে না শঙ্খ তোমার আরতিবারতা
তব মন্দির স্থিরগম্ভীর ভাঙা দেউলের দেবতা। তব জনহীন ভবনে
থেকে থেকে আসে ব্যাকুল গন্ধ নববসন্তপবনে
যে ফুল রচে নি পূজার অর্ঘ, রাখে নি ও রাঙা চরনে
সে ফুল ফোটার আসে সমাচার জনহীন ভাঙা ভবনে। পূজাহীন তব পূজারী
কোথা সারাদিন ফিরে উদাসীন কার প্রসাদের ভিখারি
গোধূলিবেলায় বনের ছায়ায় চির-উপবাস-ভূখারি!
ভাঙা মন্দিরে আসে ফিরে ফিরে পূজাহীন তব পূজারি। ভাঙা দেউলের দেবতা,
কত উৎসব হইল নীরব, কত পূজানিশা বিগতা
কত বিজয়ায় নবীন প্রতিমা কত যায় কত কব তা,
শুধু চিরদিন থাকে সেবাহীন ভাঙা দেউলের দেবতা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
ভারতসমুদ্র তার বাষ্পোচ্ছ্বাস নিশ্বসে গগনে
আলোক করিয়া পান, উদাস দক্ষিণসমীরণে
অনির্বচনীয় যেন আনন্দের অব্যক্ত আবেগ।
উর্ধ্ববাহু হিমাচল, তুমি সেই উদ্বাহিত মেঘ
শিখরে শিখরে তব ছায়াচ্ছন্ন গুহায় গুহায়
রাখিছ নিরুদ্ধ করি– পুনর্বার উন্মুক্ত ধারায়
নূতন আনন্দস্রোতে নব প্রাণে ফিরাইয়া দিতে
অসীমজিজ্ঞাসারত সেই মহাসমুদ্রের চিতে।
সেইমতো ভারতের হৃদয়সমুদ্র এতকাল
করিয়াছে উচ্চারণ ঊর্ধ্ব-পানে যে বাণী বিশাল,
অনন্তের জ্যোতিস্পর্শে অনন্তেরে যা দিয়েছে ফিরে,
রেখেছ সঞ্চয় করি হে হিমাদ্রি, তুমি স্তব্ধশিরে।
তব মৌন শৃঙ্গ-মাঝে তাই আমি ফিরি অন্বেষণে
ভারতের পরিচয় শান্ত-শিব-অদ্বৈতের সনে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
যেদিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই
আমি ছিলেম অন্যমনে |
আমার সাজিয়ে সাজি তারে আনি নাই
সে যে রইল সঙ্গোপনে |
মাঝে মাঝে হিয়া আকুলপ্রায়
স্বপন দেখে চম্ কে উঠে চায়,
মন্দ মধুর গন্ধ আসে হায়
কোথায় দখিন সমীরণে |ওগো সেই সুগন্ধে ফিরায় উদাসিয়া
আমায় দেশে দেশান্তে |
যেন সন্ধানে তার উঠে নিঃশ্বাসিয়া
ভুবন নবীন বসন্তে |
কে জানিত দূরে ত নেই সে
আমারি গো আমারি সেই যে,
এ মাধুরী ফুটেছে হায়রে
আমার হৃদয় উপবনে |শিলাইদহ ২৬ চৈত্র ১৩১৮
গীতিমাল্য - ১৭, গীতাঞ্জলি
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
তৃষিত গর্দভ গেল সরোবরতীরে,
‘ছিছি কালো জল!’ বলি চলি এল ফিরে।
কহে জল, জল কালো জানে সব গাধা,
যে জন অধিক জানে বলে জল সাদা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
দিনান্তবেলায় শেষের ফসল দিলেম তরী 'পরে,
এ-পারে কৃষি হল সারা,
যাব ও-পারের ঘাটে।
হংসবলাকা উড়ে যায়
দূরের তীরে, তারার আলোয়,
তারি ডানার ধ্বনি বাজে মোর অন্তরে।
ভাঁটার নদী ধায় সাগরপানে কলতানে,
ভাবনা মোর ভেসে যায় তারি টানে।
যা-কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয়
সুখ নয় সে, দুঃখ সে নয়, নয় সে কামনা,
শুনি শুধু মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
অচলবুড়ি, মুখখানি তার হাসির রসে ভরা
স্নেহের রসে পরিপক্ক অতিমধুর জরা।
ফুলো ফুলো দুই চোখে তার, দুই গালে আর ঠোঁটে
উছলে-পড়া হৃদয় যেন ঢেউ খেলিয়ে ওঠে।
পরিপুষ্ট অঙ্গটি তার, হাতের গড়ন মোটা,
কপালে দুই ভুরুর মাঝে উল্কি-আঁকা ফোঁটা।
গাড়ি-চাপা কুকুর একটা মরতেছিল পথে,
সেবা ক'রে বাঁচিয়ে তারে তুলল কোনোমতে।
খোঁড়া কুকুর সেই ছিল তার নিত্যসহচর;
আধপাগলি ঝি ছিল এক, বাড়ি বালেশ্বর।
দাদাঠাকুর বলত, 'বুড়ি, জমল কত টাকা,
সঙ্গে ওটা যাবে না তো, বাক্সে রইল ঢাকা,
ব্রাহ্মণে দান করতে না চাও নাহয় দাও-না-ধার,
জানোই তো এই অসময়ে টাকার কী দরকার।'
বুড়ি হেসে বলে, 'ঠাকুর, দরকার তো আছেই,
সেইজন্যে ধার না দিয়ে রাখি টাকা কাছেই।'সাঁৎরাপাড়ার কায়েতবাড়ির বিধবা এক মেয়ে,
এককালে সে সুখে ছিল বাপের আদর পেয়ে।
বাপ মরেছে, স্বামী গেছে, ভাইরা না দেয় ঠাঁই--
দিন চালাবে এমনতরো উপায় কিছু নাই।
শেষকালে সে ক্ষুধার দায়ে, দৈন্যদশার লাজে
চলে গেল হাঁসপাতালে রোগীসেবার কাজে।
এর পিছনে বুড়ি ছিল, আর ছিল লোক তার
কংসারি শীল বেনের ছেলে মুকুন্দ মোক্তার।
গ্রামের লোকে ছি-ছি করে, জাতে ঠেলল তাকে,
একলা কেবল অচল বুড়ি আদর করে ডাকে।
সে বলে, 'তুই বেশ করেছিস যা বলুক-না যেবা,
ভিক্ষা মাগার চেয়ে ভালো দুঃখী দেহের সেবা।'জমিদারের মায়ের শ্রাদ্ধ, বেগার খাটার ডাক--
রাই ডোম্নির ছেলে বললে, কাজের যে নেই ফাঁক,
পারবে না আজ যেতে। শুনে কোতলপুরের রাজা
বললে, ওকে যে ক'রে হোক দিতেই হবে সাজা।
মিশনরির স্কুলে প'ড়ে, কম্পোজিটরের
কাজ শিখে সে শহরেতে আয় করেছে ঢের--
তাই হবে কি ছোটোলোকের ঘাড়-বাঁকানো চাল।
সাক্ষ্য দিল হরিশ মৈত্র, দিল মাখনলাল--
ডাকলুঠের এক মোকদ্দমায় মিথ্যে জড়িয়ে ফেলে
গোষ্ঠকে তো চালান দিল সাত বছরের জেলে।
ছেলের নামের অপমানে আপন পাড়া ছাড়ি
ডোম্নি গেল ভিন গাঁয়েতে পাততে নতুন বাড়ি।
প্রতি মাসে অচলবুড়ি দামোদরের পারে
মাসকাবারের জিনিস নিয়ে দেখে আসত তারে।
যখন তাকে খোঁটা দিল গ্রামের শম্ভু পিসে
'রাই ডোম্নির 'পরে তোমার এত দরদ কিসে'
বুড়ি বললে, 'যারা ওকে দিল দুঃখরাশি
তাদের পাপের বোঝা আমি হালকা করে আসি।'পাতানো এক নাতনি বুড়ির একজ্বরি জ্বরে
ভুগতেছিল স্বরূপগঞ্জে আপন শ্বশুরঘরে।
মেয়েটাকে বাঁচিয়ে তুলল দিন রাত্রি জেগে,
ফিরে এসে আপনি পড়ল রোগের ধাক্কা লেগে।
দিন ফুরলো, দেব্তা শেষে ডেকে নিল তাকে,
এক আঘাতে মারল যেন সকল পল্লীটাকে।
অবাক হল দাদাঠাকুর, অবাক স্বরূপকাকা,
ডোম্নিকে সব দিয়ে গেছে বুড়ির জমা টাকা।
জিনিসপত্র আর যা ছিল দিল পাগল ঝিকে,
সঁপে দিল তারই হাতে খোঁড়া কুকুরটিকে।
ঠাকুর বললে মাথা নেড়ে, 'অপাত্রে এই দান।
পরলোকের হারালো পথ, ইহলোকের মান।'
শান্তিনিকেতন,
আষাঢ়, ১৩৪৪
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.