poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
জর্মন প্রোফেসার দিয়েছেন গোঁফে সার কত যে!
উঠেছে ঝাঁকড়া হয়ে খোঁচা-খোঁচা ছাঁটা ছাঁটা–
দেখে তাঁর ছাত্রের ভয়ে গায়ে দেয় কাঁটা,
মাটির পানেতে চোখ নত যে।
বৈদিক ব্যাখ্যায় বাণী তাঁর মুখে এসে
যে নিমেষে পা বাড়ান ওষ্ঠের দ্বারদেশে
চরণকমল হয় ক্ষত যে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
ঘন কাঠিন্য রচিয়া শিলাস্তূপে
দূর হতে দেখি আছে দুর্গমরূপে।
বন্ধুর পথ করিনু অতিক্রম—
নিকটে আসিনু, ঘুচিল মনের ভ্রম।
আকাশে হেথায় উদার আমন্ত্রণ,
বাতাসে হেথায় সখার আলিঙ্গন,
অজানা প্রবাসে যেন চিরজানা বাণী
প্রকাশ করিল আত্মীয়গৃহখানি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কী যে কোথা হেথা হোথা যায় ছড়াছড়ি,
কুড়িয়ে যতনে বাঁধি দিয়ে দড়াদড়ি।
তবুও কখন শেষে
বাঁধন যায় রে ফেঁসে,
ধুলায় ভোলার দেশে
যায় গড়াগড়ি—
হায় রে, রয় না তার দাম কড়াকড়ি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
হে জনসমুদ্র, আমি ভাবিতেছি মনে
কে তোমারে আন্দোলিছে বিরাট মন্থনে
অনন্ত বরষ ধরি। দেবদৈত্যদলে
কী রত্ন সন্ধান লাগি তোমার অতলে
অশান্ত আবর্ত নিত্য রেখেছে জাগায়ে
পাপে-পুণ্যে সুখে-দুঃখে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়
ফেনিল কল্লোলভঙ্গে। ওগো, দাও দাও
কী আছে তোমার গর্ভে– এ ক্ষোভ থামাও।
তোমার অন্তরলক্ষ্মী যে শুভ প্রভাতে
উঠিবেন অমৃতের পাত্র বহি হাতে
বিস্মিত ভুবন-মাঝে, লয়ে বরমালা
ত্রিলোকনাথের কণ্ঠে পরাবেন বালা,
সেদিন হইবে ক্ষান্ত এ মহামন্থন,
থেমে যাবে সমুদ্রের রুদ্র এ ক্রন্দন। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিগাথা
|
ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে।
কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে।
কেহ কহে 'মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো',
সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ।
কেহ বলে 'তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে',
কেহ কয় 'ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে'।কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে,
'দয়া করে হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে--
ভেবেছিনু কেহ আসিবেনা কাছে অপার কৃপায় তব,
সবার চোখের আড়ালে কেবল তোমায় আমায় রব।
একি কৌশল খেলেছ মায়াবী, বুঝি দিলে মোরে ফাঁকি।
বিশ্বের লোক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে নাকি!'ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি--
লোক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধুলার লাগি!
চারি পোওয়া কলি পুরিয়া আসিল পাপের বোঝায় ভরা,
এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা।
ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে--
গোপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল, কাঞ্চন দিল হাতে।বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে,
সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তারে।
কহিল,'রে শঠ, নিঠুর কপট, কহি নে কাহারো কাছে--
এমনি করে কি সরলা নারীরে ছলনা করিতে আছে!
বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালো,
অন্নবসন বিহনে আমার বরন হয়েছে কালো!'কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ,
'ভণ্ডতাপস, ধর্মের নামে করিছ ধর্মলোপ!
তুমি সুখে ব'সে ধুলা ছড়াইছ সরল লোকের চোখে,
অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অন্নশোকে!'
কহিল কবীর, 'অপরাধী আমি, ঘরে এসো নারী তবে--
আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী রবে?'দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি
কবীর কহিল, 'দীনের ভবনে তোমারে পাঠাল হরি।'
কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে,
'লোভে পড়ে আমি করিয়াছি পাপ, মরিব সাধুর শাপে।'
কহিল কবীর, 'ভয় নাই মাতঃ, লইব না অপরাধ--
এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপবাদ।'ঘুচাইল তার মনের বিকার, করিল চেতনা দান--
সঁপি দিল তার মধুর কণ্ঠে হরিনামগুণগান।
রটি গেল দেশে--কপট কবীর, সাধুতা তাহার মিছে।
শুনিয়া কবীর কহে নতশির, 'আমি সকলের নীচে।
যদি কূল পাই তরণী-গরব রাখিতে না চাহি কিছু--
তুমি যদি থাক আমার উপরে আমি রব সব-নিচু।'রাজার চিত্তে কৌতুক হল শুনিতে সাধুর গাথা।
দূত আসি তারে ডাকিল যখন সাধু নাড়িলেন মাথা।
কহিলেন, 'থাকি সবা হতে দূরে আপন হীনতা-মাঝে;
আমার মতন অভাজন জন রাজার সভায় সাজে!'
দূত কহে, 'তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ,
যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ।'রাজা বসে ছিল সভার মাঝারে, পারিষদ সারি সারি--
কবীর আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে লয়ে নারী।
কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটি, কেহ রহে নতশিরে,
রাজা ভাবে--এটা কেমন নিলাজ রমণী লইয়া ফিরে!
ইঙ্গিতে তাঁর সাধুরে সভার বাহির করিল দ্বারী,
বিনয়ে কবীর চলিল কুটিরে সঙ্গে লইয়া নারী।পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল, কৌতুকভরে হাসে--
শুনায়ে শুনায়ে বিদ্রূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে।
তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে--
কহিল, 'পাপের পঙ্ক হইতে কেন নিলে মোরে তুলে!
কেন অধমেরে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান!'
কহিল কবীর, 'জননী, তুমি যে আমার প্রভুর দান।'২৮ আশ্বিন, ১৩০৬
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
“কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে!
এতই যাতনা দুখিনী আমারে
দিতেছ কেমন করে?
গাঁথিয়া রেখেছি পরাতে মালিকা
তোমার গলার-‘পরে,
কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা,
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে!
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?
যে শপথ তুমি বলেছ আমারে
মনে করে দেখো তবে,
মনে করো সেই কুঞ্জ যেথায়
কহিলে আমারি হবে।
কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে,
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?’
এত বলি এক কাঁদিছে ললনা
ভাসিছে লোচন-লোরে
“কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে।
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?’William Chappel
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
প্রেমের আনন্দ থাকে
শুধু স্বল্পক্ষণ।
প্রেমের বেদন থাকে
সমস্ত জীবন। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কত কী যে আসে কত কী যে যায়
বাহিয়া চেতনাবাহিনী!
আঁধারে আড়ালে গোপনে নিয়ত
হেথা হোথা তারি পড়ে থাকে কত---
ছিন্নসূত্র বাছি শত শত
তুমি গাঁথ বসে কাহিনী।
ওগো একমনা, ওগো অগোচরা,
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী!
তব ঘরে কিছু ফেলা নাহি যায়
ওগো হৃদয়ের গেহিনী!
কত সুখ দুখ আসে প্রতিদিন,
কত ভুলি কত হয়ে আসে ক্ষীণ---
তুমি তাই লয়ে বিরামবিহীন
রচিছ জীবনকাহিনী।
আঁধারে বসিয়া কী যে কর কাজ
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী।
কত যুগ ধরে এমনি গাঁথিছ
হৃদিশতদলশায়িনী!
গভীর নিভৃতে মোর মাঝখানে
কী যে আছে কী যে নাই কে বা জানে,
কী জানি রচিলে আমার পরানে
কত-না যুগের কাহিনী---
কত জনমের কত বিস্মৃতি
ওগো স্মৃতি-অবগাহিনী।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,
আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে
থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি
তোমারি আশ্বাসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
তুমি যদি না দেখা দাও,
কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল-বেলা।
দূরের পানে মেলে আঁখি
কেবল আমি চেয়ে থাকি,
পরান আমার কেঁদে বেড়ায়
দুরন্ত বাতাসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
দেবতামন্দিরমাঝে ভকত প্রবীণ
জপিতেছে জপমালা বসি নিশিদিন।
হেনকালে সন্ধ্যাবেলা ধুলিমাখা দেহে
বস্ত্রহীন জীর্ণ দীন পশিল সে গেহে।
কহিল কাতরকণ্ঠে “গৃহ মোর নাই
এক পাশে দয়া করে দেহো মোরে ঠাঁই।”
সসংকোচে ভক্তবর কহিলেন তারে,
“আরে আরে অপবিত্র, দূর হয়ে যারে।”
সে কহিল, “চলিলাম”—চক্ষের নিমেষে
ভিখারি ধরিল মূর্তি দেবতার বেশে।
ভক্ত কহে, “প্রভু, মোরে কী ছল ছলিলে!”
দেবতা কহিল, “মোরে দূর করি দিলে।
জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়াতরে,
গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে।” (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
না-কোলাহলে-ঢাকা
নানা-আনাগোনা-আঁকা
দিনের মতন।
নানা-জনতায়-ফাঁকা
কর্মে-অচেতন
শূন্য ছিল মন।জানি না কখন এল নূপুরবিহীন
নিঃশব্দ গোধূলি।
দেখি নাই স্বর্ণরেখা
কী লিখিল শেষ লেখা
দিনান্তের তুলি।
আমি যে ছিলাম একা
তাও ছিনু ভুলি।
আইল গোধূলি।হেনকালে আকাশের বিস্ময়ের মতো
কোন্ স্বর্গ হতে
চাঁদখানি লয়ে হেসে
শুক্লসন্ধ্যা এল ভেসে
আঁধারের স্রোতে।
বুঝি সে আপনি মেশে
আপন আলোতে
এল কোথা হতে।অকস্মাৎ বিকশিত পুষ্পের পুলকে
তুলিলাম আঁখি।
আর কেহ কোথা নাই,
সে শুধু আমারি ঠাঁই
এসেছে একাকী।
সম্মুখে দাঁড়ালো তাই
মোর মুখে রাখি
অনিমেষ আঁখি।রাজহংস এসেছিল কোন্ যুগান্তরে
শুনেছি পুরাণে।
দময়ন্তী আলবালে
স্বর্ণঘটে জল ঢালে
নিকুঞ্জবিতানে,
কার কথা হেনকালে
কহি গেল কানে–
শুনেছি পুরাণে।জ্যোৎস্নাসন্ধ্যা তারি মতো আকাশ বাহিয়া
এল মোর বুকে।
কোন্ দূর প্রবাসের
লিপিখানি আছে এর
ভাষাহীন মুখে।
সে যে কোন্ উৎসুকের
মিলনকৌতুকে
এল মোর বুকে।দুইখানি শুভ্র ডানা ঘেরিল আমারে
সর্বাঙ্গে হৃদয়ে।
স্কন্ধে মোর রাখি শির
নিস্পন্দ রহিল স্থির
কথাটি না কয়ে।
কোন্ পদ্মবনানীর
কোমলতা লয়ে
পশিল হৃদয়ে?আর কিছু বুঝি নাই,শুধু বুঝিলাম
আছি আমি একা।
এই শুধু জানিলাম
জানি নাই তার নাম
লিপি যার লেখা।
এই শুধু বুঝিলাম
না পাইলে দেখা
রব আমি একা।ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় এ দিনরজনী,
এ মোর জীবন!
হায় হায়, চিরদিন
হয়ে আছে অর্থহীন
এ বিশ্বভুবন।
অনন্ত প্রেমের ঋণ
করিছে বহন
ব্যর্থ এ জীবন।ওগো দূত দূরবাসী, ওগো বাক্যহীন,
হে সৌম্য-সুন্দর,
চাহি তব মুখপানে
ভাবিতেছি মুগ্ধপ্রাণে
কী দিব উত্তর।
অশ্রু আসে দু নয়ানে,
নির্বাক্ অন্তর,
হে সৌম্য-সুন্দর। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খ্যাতি আছে সুন্দরী বলে তার,
ত্রুটি ঘটে নুন দিতে ঝোলে তার;
চিনি কম পড়ে বটে পায়সে
স্বামী তবু চোখ বুজে খায় সে–
যা পায় তাহাই মুখে তোলে তার,
দোষ দিতে মুখ নাহি খোলে তার। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
পঞ্চাশ বছরের কিশোর গুণী নন্দলাল বসুর প্রতি
সত্তর বছরের প্রবীণ যুবা রবীন্দ্রনাথের আশীর্ভাষণ নন্দনের কুঞ্জতলে রঞ্জনার ধারা,
জন্ম-আগে তাহার জলে তোমার স্নান সারা।
অঞ্জন সে কী মধুরাতে
লাগালো কে যে নয়নপাতে,
সৃষ্টি-করা দৃষ্টি তাই পেয়েছে আঁখিতারা। এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি,
রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।
অপ্সরীর নৃত্যগুলি
তুলির মুখে এনেছ তুলি,
রেখার বাঁশি লেখার তব উঠিল সুরে বাজি। যে মায়াবিনী আলিম্পনা সবুজে নীলে লালে
কখনো আঁকে কখনো মোছে অসীম দেশে কালে,
মলিন মেঘে সন্ধ্যাকাশে
রঙিন উপহাসি যে হাসে
রঙজাগানো সোনার কাঠি সেই ছোঁয়ালো ভালে। বিশ্ব সদা তোমার কাছে ইশারা করে কত,
তুমিও তারে ইশারা দাও আপন মনোমত।
বিধির সাথে কেমন ছলে
নীরবে তব আলাপ চলে,
সৃষ্টি বুঝি এমনিতরো ইশারা অবিরত। ছবির 'পরে পেয়েছ তুমি রবির বরাভয়,
ধূপছায়ার চপল মায়া করেছ তুমি জয়।
তব আঁকন-পটের 'পরে
জানি গো চিরদিনের তরে
নটরাজের জটার রেখা জড়িত হয়ে রয়। চিরবালক ভুবনছবি আঁকিয়া খেলা করে,
তাহারি তুমি সমবয়সী মাটির খেলাঘরে।
তোমার সেই তরুণতাকে
বয়স দিয়ে কভু কি ঢাকে,
অসীম-পানে ভাসাও প্রাণ খেলার ভেলা-'পরে। তোমারি খেলা খেলিতে আজি উঠেছে কবি মেতে,
নববালক জন্ম নেবে নূতন আলোকেতে।
ভাবনা তার ভাষায় ডোবা--
মুক্ত চোখে বিশ্বশোভা
দেখাও তারে, ছুটেছে মন তোমার পথে যেতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কারে দিব দোষ বন্ধু, কারে দিব দোষ!
বৃথা কর আস্ফালন, বৃথা কর রোষ।
যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ,
কেহ কভু তাহাদের করে নি সম্মান।
যতই কাগজে কাঁদি, যত দিই গালি,
কালামুখে পড়ে তত কলঙ্কের কালি।
যে তোমারে অপমান করে অহর্নিশ
তারি কাছে তারি 'পরে তোমার নালিশ!
নিজের বিচার যদি নাই নিজহাতে,
পদাঘাত খেয়ে যদি না পার ফিরাতে--
তবে ঘরে নতশিরে চুপ করে থাক্,
সাপ্তাহিকে দিগ্বিদিকে বাজাস নে ঢাক।
একদিকে অসি আর অবজ্ঞা অটল,
অন্য দিকে মসী আর শুধু অশ্রুজল।(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
২৬ চৈত্র, ১৩০২
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বাদল দিনের প্রথম কদমফুলআমায় করেছ দান,আমি তো দিয়েছি ভরা শ্রাবণেরমেঘমল্লারগান।সজল ছায়ার অন্ধকারেঢাকিয়া তারেএনেছি সুরের শ্যামল খেতেরপ্রথম সোনার ধান।আজ এনে দিলে যাহাহয়তো দিবে না কাল,রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।স্মৃতিবন্যার উছল প্লাবনেআমার এ গান শ্রাবণে শ্রাবণেফিরিয়া ফিরিয়া বাহিবে তরণীভরি তব সম্মান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
জিরাফের বাবা বলে,–
“খোকা তোর দেহ
দেখে দেখে মনে মোর
ক’মে যায় স্নেহ।
সামনে বিষম উঁচু,
পিছনেতে খাটো,
এমন দেহটা নিয়ে
কী করে যে হাঁটো।’
খোকা বলে, “আপনার
পানে তুমি চেহো,
মা যে কেন ভালোবাসে
বোঝে না তা কেহ।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।যখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সেদিন উঠবে ভরি,
চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ডুগডুগিটা বাজিয়ে দিয়ে
ধুলোয় আসর সাজিয়ে দিয়ে
পথের ধারে বসল জাদুকর।
এল উপেন, এল রূপেন,
দেখতে এল নৃপেন, ভূপেন,
গোঁদলপাড়ার এল মাধু কর।
দাড়িওয়ালা বুড়ো লোকটা,
কিসের-নেশায়-পাওয়া চোখটা,
চারদিকে তার জুটল অনেক ছেলে।
যা-তা মন্ত্র আউড়ে, শেষে
একটুখানি মুচকে হেসে
ঘাসের ‘পরে চাদর দিল মেলে।
উঠিয়ে নিল কাপড়টা যেই
দেখা দিল ধুলোর মাঝেই
দুটো বেগুন, একটা চড়ুইছানা,
জামের আঁঠি, ছেঁড়া ঘুড়ি,
একটিমাত্র গালার চুড়ি,
ধুঁইয়ে-ওঠা ধুনুচি একখানা,
টুকরো বাসন চিনেমাটির,
মুড়ো ঝাঁটা খড়কেকাঠির,
নলছে-ভাঙা হুঁকো, পোড়া কাঠটা–
ঠিকানা নেই আগুপিছুর,
কিছুর সঙ্গে যোগ না কিছুর,
ক্ষণকালের ভোজবাজির এই ঠাট্টা।শান্তিনিকেতন, ১৬ পৌষ, ১৩৪৩
(খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
'বউ কথা কও' 'বউ কথা কও'
যতই গায় সে পাখি
নিজের কথাই কুঞ্জবনের
সব কথা দেয় ঢাকি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
নানা গান গেয়ে ফিরি নানা লোকালয়;
হেরি সে মত্ততা মোর বৃদ্ধ আসি কয়,
“তাঁর ভৃত্য হয়ে তোর এ কী চপলতা।
কেন হাস্য-পরিহাস, প্রণয়ের কথা,
কেন ঘরে ঘরে ফিরি তুচ্ছ গীতরসে
ভুলাস এ সংসারের সহস্র অলসে।’
দিয়েছি উত্তর তাঁরে, “ওগো পক্ককেশ,
আমার বীণায় বাজে তাঁহারি আদেশ।
যে আনন্দে যে অনন্ত চিত্তবেদনায়
ধ্বনিত মানবপ্রাণ, আমার বীণায়
দিয়েছেন তারি সুর– সে তাঁহারি দান।
সাধ্য নাই নষ্ট করি সে বিচিত্র গান।
তব আজ্ঞা রক্ষা করি নাই সে ক্ষমতা,
সাধ্য নাই তাঁর আজ্ঞা করিতে অন্যথা।’ (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধভরা—
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যত কাল থাকি তুমিও থাকিয়ো। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
টাকা সিকি আধুলিতে
ছিল তার হাত জোড়া;
যে-সাহসে কিনেছিল
পান্তোয়া সাত ঝোড়া।
ফুঁকে দিয়ে কড়াকড়ি
শেষে হেসে গড়াগড়ি;
ফেলে দিতে হল সব–
আলুভাতে পাত-জোড়া। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তুমি আমার আপন, তুমি আছ আমার কাছে,
এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।
তোমার মাঝে মোর জীবনের সব আনন্দ আছে,
এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।আমায় দাও সুধাময় সুর,
আমার বাণী করো সুমধুর;
আমার প্রিয়তম তুমি, এই কথাটি
বলতে দাও হে বলতে দাও।এই নিখিল আকাশ ধরা
এই যে তোমায় দিয়ে ভরা,
আমার হৃদয় হতে এই কথাটি
বলতে দাও হে বলতে দাও।দুখি জেনেই কাছে আস,
ছোটো বলেই ভালোবাস,
আমার ছোটো মুখে এই কথাটি
বলতে দাও হে বলতে দাও।মাঘ, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,
আপন জেনে আদর করি নে।
পিতা বলে প্রণাম করি পায়ে,
বন্ধু বলে দু-হাত ধরি নে।
আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে
আমার হয়ে এলে যেথায় নেমে
সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধরে
সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে।ভাই তুমি যে ভায়ের মাঝে প্রভু,
তাদের পানে তাকাই না যে তবু,
ভাইয়ের সাথে ভাগ ক’রে মোর ধন
তোমার মুঠা কেন ভরি নে।
ছুটে এসে সবার সুখে দুখে
দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে,
সঁপিয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে
প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে।৫ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা–
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত,
এ যে অজাগরগরজে সাগর ফুলিছে।
এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত,
ফেনহিল্লোল কলকল্লোলে দুলিছে।
কোথা রে সে তীর ফুলপল্লবপুঞ্জিত,
কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা!
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী,
ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত-অচলে!
বিশ্বজগৎ নিশ্বাসবায়ু সম্বরি
স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে।
সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি
দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা।
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
ঊর্ধ্ব আকাশে তারাগুলি মেলি অঙ্গুলি
ইঙ্গিত করি তোমা-পানে আছে চাহিয়া।
নিম্নে গভীর অধীর মরণ উচ্ছলি
শত তরঙ্গ তোমা-পানে উঠে ধাইয়া।
বহুদূর তীরে কারা ডাকে বাঁধি অঞ্জলি
“এসো এসো’ সুরে করুণ মিনতি-মাখা।
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহমোহবন্ধন,
ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা।
ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা বসে ক্রন্দন,
ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজরচনা।
আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ-অঙ্গন
উষা-দিশা-হারা নিবিড়-তিমির-আঁকা–
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বৃষ্টি কোথায় নুকিয়ে বেড়ায়
উড়ো মেঘের দল হয়ে ,
সেই দেখা দেয় আর - এক ধারায়
শ্রাবণ - ধারার জল হয়ে ।
আমি ভাবি চুপটি করে
মোর দশা হয় ওই যদি !
কেই বা জানে আমি আবার
আর - একজনও হই যদি !
একজনারেই তোমরা চেন
আর - এক আমি কারোই না ।
কেমনতরো ভাবখানা তার
মনে আনতে পারোই না ।
হয়তো বা ওই মেঘের মতোই
নতুন নতুন রূপ ধরে
কখন সে যে ডাক দিয়ে যায় ,
কখন থাকে চুপ করে ।
কখন বা সে পুবের কোণে
আলো - নদীর বাঁধ বাঁধে ,
কখন বা সে আধেক রাতে
চাঁদকে ধরার ফাঁদ ফাঁদে ।
শেষে তোমার ঘরের কথা
মনেতে তার যেই আসে ,
আমার মতন হয়ে আবার
তোমার কাছে সেই আসে ।
আমার ভিতর লুকিয়ে আছে
দুই রকমের দুই খেলা ,
একটা সে ওই আকাশ - ওড়া ,
আরেকটা এই ভুঁই - খেলা । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
মিলন-সুলগনে,
কেন বল্,
নয়ন করে তোর
ছল্ছল্।
বিদায়দিনে যবে
ফাটে বুক
সেদিনও দেখেছি তো
হাসিমুখ। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
মহারাজা ভয়ে থাকে
পুলিশের থানাতে,
আইন বানায় যত
পারে না তা মানাতে।
চর ফিরে তাকে তাকে–
সাধু যদি ছাড়া থাকে
খোঁজ পেলে নৃপতিরে
হয় তাহা জানাতে,
রক্ষা করিতে তারে
রাখে জেলখানাতে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
যত ভালোবাসি, যত হেরি বড়ো ক’রে
তত, প্রিয়তমে, আমি সত্য হেরি তোরে।
যত অল্প করি তোরে, তত অল্প জানি—
কখনো হারায়ে ফেলি, কভু মনে আনি।
আজি এ বসন্তদিনে বিকশিতমন
হেরিতেছি আমি এক অপূর্ব স্বপন—
যেন এ জগৎ নাহি, কিছু নাহি আর,
যেন শুধু আছে এক মহাপারাবার,
নাহি দিন নাহি রাত্রি নাহি দন্ড পল,
প্রলয়ের জলরাশি স্তব্ধ অচঞ্চল;
যেন তারি মাঝখানে পূর্ণ বিকাশিয়া
একমাত্র পদ্ম তুমি রয়েছ ভাসিয়া;
নিত্যকাল মহাপ্রেমে বসি বিশ্বভূপ
তোমামাঝে হেরিছেন আত্মপ্রতিরূপ। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আকাশে যুগল তারা
চলে সাথে সাথে
অনন্তের মন্দিরেতে
আলোক মেলাতে।(স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
আরেক দিনের কথা পড়ি গেল মনে।
একদা মাঠের ধারে শ্যাম তৃণাসনে
একটি বেদের মেয়ে অপরাহ্নবেলা
কবরী বাঁধিতেছিল বসিয়া একেলা।
পালিত কুকুরশিশু আসিয়া পিছনে
কেশের চাঞ্চল্য হেরি খেলা ভাবি মনে
লাফায়ে লাফায়ে উচ্চে করিয়া চিৎকার
দংশিতে লাগিল তার বেণী বারম্বার।
বালিকা ভর্ৎসিল তারে গ্রীবাটি নাড়িয়া,
খেলার উৎসাহ তাহে উঠিল বাড়িয়া।
বালিকা মারিল তারে তুলিয়া তর্জনী,
দ্বিগুণ উঠিল মেতে খেলা মনে গণি।
তখন হাসিয়া উঠি লয়ে বক্ষ-’পরে
বালিকা ব্যথিল তারে আদরে আদরে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আশার আলোকে
জ্বলুক প্রাণের তারা,
আগামী কালের
প্রদোষ-আঁধারে
ফেলুক কিরণধারা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিগাথা
|
ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর—
যা‐কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্টা বেটাই চোর।”
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে।
যত পায় বেত না পায় বেতন, তবু না চেতন মানে।
বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ চীৎকার করি “কেষ্টা”—
যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে;
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা;
মহাকলরবে গালি দেই যবে “পাজি হতভাগা গাধা”—
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে, দেখে জ্বলে যায় পিত্ত।
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য।
ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি বলে, “আর পারি নাকো,
রহিল তোমার এ ঘর‐দুয়ার, কেষ্টারে লয়ে থাকো।
না মানে শাসন বসন বাসন অশন আসন যত
কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো যেতেছে জলের মতো।
গেলে সে বাজার সারা দিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার—
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর!”
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে, আনি তার টিকি ধরে;
বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজই, দূর করে দিনু তোরে।”
ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়; পরদিনে উঠে দেখি,
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি—
প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ, অতি অকাতর চিত্ত!
ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে— মোর পুরাতন ভৃত্য!
সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি।
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায়, বুঝায়ে বলিনু তারে—
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নহিলে খরচ বাড়ে।
লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি,
“পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে।”
আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম! নিবারণ সাথে যাবে।”
রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে—
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত, তামাক সাজিয়া আনে!
স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত বা সহিব নিত্য!
যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য!নামিনু শ্রীধামে— দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত।
জন‐ছয়‐সাতে মিলি এক‐সাথে পরমবন্ধুভাবে
করিলাম বাসা; মনে হল আশা, আরামে দিবস যাবে।
কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি!
কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ;
আমি একা ঘরে ব্যাধি‐খরশরে ভরিল সকল অঙ্গ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ, “কেষ্ট আয় রে কাছে।
এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।”
হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক, সে যেন পরম বিত্ত—
নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরতন ভৃত্য।
মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে দেয় মোর হাত;
দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত।
বলে বার বার, “কর্তা, তোমার কোনো ভয় নাই, শুন—
যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন।”
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম; তাহারে ধরিল জ্বরে;
নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ‐’পরে।
হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন, বন্ধ হইল নাড়ী;
এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি।
বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু সারিয়া তীর্থ;
আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই মোর পুরাতন ভৃত্য।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
যে গান আমি গাই
জানি নে সে
কার উদ্দেশ্যে।
যবে জাগে মনে
অকারণে
চপল হাওয়া
সুর যায় ভেসে
কার উদ্দেশ্যে।
ঐ মুখে চেয়ে দেখি,
জানি নে তুমিই সে কি
অতীত কালের মুরতি এসেছ
নতুন কালের বেশে।
কভূ জাগে মনে,
যে আসে নি এ জীবনে
ঘাট খুঁজি খুঁজি
গানের খেয়া সে মাগিতেছে বুঝি
আমার তীরেতে এসে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা,
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে-
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধরসংগমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে-
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে-
অধরেতে থরে থরে চুম্বনের খেলা।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ম-
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে !
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
যখন দেখা হল
তার সঙ্গে চোখে চোখে
তখন আমার প্রথম বয়েস;
সে আমাকে শুধাল,
"তুমি খুঁজে বেড়াও কাকে?"
আমি বললেম,
"বিশ্বকবি তাঁর অসীম ছড়াটা থেকে
একটা পদ ছিঁড়ে নিলেন কোন্ কৌতুকে,
ভাসিয়ে দিলেন
পৃথিবীর হাওয়ার স্রোতে,
যেখানে ভেসে বেড়ায়
ফুলের থেকে গন্ধ,
বাঁশির থেকে ধ্বনি।
ফিরছে সে মিলের পদটি পাবে ব'লে;
তার মৌমাছির পাখায় বাজে
খুঁজে বেড়াবার নীরব গুঞ্জরণ।"
শুনে সে রইল চুপ করে
অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে।
আমার মনে লাগল ব্যথা,
বললেম, "কী ভাবছ তুমি?"
ফুলের পাপড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে বললে,--
"কেমন করে জানবে তাকে পেলে কিনা,
তোমার সেই অসংখ্যের মধ্যে একটিমাত্রকে।"
আমি বললেম,
"আমি যে খুঁজে বেড়াই
সে তো আমার ছিন্ন জীবনের
সবচেয়ে গোপন কথা;
ও-কথা হঠাৎ আপনি ধরা পড়ে
যার আপন বেদনায়,
আমি জানি
আমার গোপন মিল আছে তারি ভিতর।"
কোনো কথা সে বলল না।
কচি শ্যামল তার রঙটি;
গলায় সরু সোনার হারগাছি,
শরতের মেঘে লেগেছে
ক্ষীণ রোদের রেখা।
চোখে ছিল
একটা দিশাহারা ভয়ের চমক
পাছে কেউ পালায় তাকে না ব'লে।
তার দুটি পায়ে ছিল দ্বিধা,
ঠাহর পায়নি
কোন্খানে সীমা
তার আঙিনাতে।
দেখা হল।
সংসারে আনাগোনার পথের পাশে
আমার প্রতীক্ষা ঐটুকু নিয়ে।
তার পরে সে চলে গেছে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা,
যেমন চলার অঙ্গ পা-তোলা পা-ফেলা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দিনের অালো নামে যখন
ছায়ার তাতলে
আমি আসি ঘট ভরিবার ছলে
একলা দিঘির জলে।
তাকিয়ে থাকি, দেখি, সঙ্গীহারা
একটি সন্ধ্যাতারা
ফেলেছে তার ছায়াটি এই
কমলসাগরে।ডোবে না সে, নেবে না সে,
ঢেউ দিলে সে যায় না তবু স’রে—
যেন আমার বিফল রাতের
চেয়ে থাকার স্মৃতিকালের কালো পটের 'পরে
রইল আঁকা নিতি।
মোর জীবনের ব্যর্থ দীপের
অগ্নিরেখার বাণী
ঐ যে ছায়াখানি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আপনারে তুমি করিবে গোপন
কী করি।
হৃদয় তোমার আঁখির পাতায়
থেকে থেকে পড়ে ঠিকরি।
আজ আসিয়াছ কৌতুকবেশে,
মানিকের হার পরি এলোকেশে,
নয়নের কোণে আধো হাসি হেসে
এসেছ হৃদয়পুলিনে।
ভুলি নে তোমার বাঁকা কটাক্ষে,
ভুলি নে চতুর নিঠুর বাক্যে
ভুলি নে।
করপল্লবে দিলে যে আঘাত
করিব কি তাহে আঁখিজলপাত।
এমন অবোধ নহি গো।
হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব
সহি গো।আজ এই বেশে এসেছ আমায়
ভুলাতে।
কভু কি আস নি দীপ্ত ললাটে
স্নিগ্ধ পরশ বুলাতে।
দেখেছি তোমার মুখ কথাহারা–
জলে-ছলছল ম্লান আঁখিতারা,
দেখেছি তোমার ভয়-ভরে সারা
করুণ পেলব মুরতি।
দেখেছি তোমার বেদনাবিধুর
পলকবিহীন নয়নে মধুর
মিনতি।
আজি হাসিমাখা নিপুণ শাসনে
তরাস আমি যে পাব মনে মনে
এমন অবোধ নহি গো
হাসো তুমি, আমি হাসিমুখে সব
সহি গো।(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তুমি দেবে, তুমি মোরে দেবে,
গেল দিন এই কথা নিত্য ভেবে ভেবে।
সুখে দুঃখে উঠে নেবে
বাড়ায়েছি হাত
দিনরাত;
কেবল ভেবেছি, দেবে, দেবে,
আরো কিছু দেবে।
দিলে, তুমি দিলে, শুধু দিলে;
কভু পলে পলে তিলে তিলে,
কভু অকস্মাৎ বিপুল প্লাবনে
দানের শ্রাবণে।
নিয়েছি, ফেলেছি কত, দিয়েছি ছড়ায়ে,
হাতে পায়ে রেখেছি জড়ায়ে
জালের মতন;
দানের রতন
লাগিয়েছি ধুলার খেলায়
অযত্নে হেলায়,
আলস্যের ভরে
ফেলে গেছি ভাঙা খেলাঘরে।
তবু তুমি দিলে, শুধু দিলে, শুধু দিলে,
তোমার দানের পাত্র নিত্য ভরে উঠিছে নিখিলে।
অজস্র তোমার
সে নিত্য দানের ভার
আজি আর
পারি না বহিতে।
পারি না সহিতে
এ ভিক্ষুক হৃদয়ের অক্ষয় প্রত্যাশা,
দ্বারে তব নিত্য যাওয়া-আসা।
যত পাই তত পেয়ে পেয়ে
তত চেয়ে চেয়ে
পাওয়া মোর চাওয়া মোর শুধু বেড়ে যায়;
অনন্ত সে দায়
সহিতে না পারি হায়
জীবনে প্রভাত-সন্ধ্যা ভরিতে ভিক্ষায়।
লবে তুমি, মোরে তুমি লবে, তুমি লবে,
এ প্রার্থনা পুরাইবে কবে।
শূন্য পিপাসায় গড়া এ পেয়ালাখানি
ধুলায় ফেলিয়া টানি,
সারা রাত্রি পথ-চাওয়া কম্পিত আলোর
প্রতীক্ষার দীপ মোর
নিমেষে নিবায়ে
নিশীথের বায়ে,
আমার কণ্ঠের মালা তোমার গলায় প'রে
লবে মোরে লবে মোরে
তোমার দানের স্তূপ হতে
তব রিক্ত আকাশের অন্তহীন নির্মল আলোতে।
শান্তিনিকেতন, ১৩ পৌষ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ছোটো ছেলে হওয়ার সাহস
আছে কি এক ফোঁটা,
তাই তো এমন বুড়ো হয়েই মরি।
তিলে তিলে জমাই কেবল
জমাই এটা ওটা,
পলে পলে বাক্স বোঝাই করি।
কালকে-দিনের ভাবনা এসে
আজ-দিনেরে মারলে ঠেসে
কাল তুলি ফের পরদিনের বোঝা।
সাধের জিনিস ঘরে এনেই
দেখি, এনে ফল কিছু নেই
খোঁজের পরে আবার চলে খোঁজা।
ভবিষ্যতের ভয়ে ভীত
দেখতে না পাই পথ,
তাকিয়ে থাকি পরশু দিনের পানে,
ভবিষ্যৎ তো চিরকালই
থাকবে ভবিষ্যৎ ,
ছুটি তবে মিলবে বা কোন্খানে?
বুদ্ধি-দীপের আলো জ্বালি
হাওয়ায় শিখা কাঁপছে খালি,
হিসেব করে পা টিপে পথ হাঁটি।
মন্ত্রণা দেয় কতজনা,
সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা,
পদে-পদে হাজার খুঁটিনাটি।
শিশু হবার ভরসা আবার
জাগুক আমার প্রাণে,
লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে,
ভবিষ্যতের মুখোশখানা
খসাব একটানে,
দেখব তারেই বর্তমানের কালে।
ছাদের কোণে পুকুরপারে
জানব নিত্য-অজানারে
মিশিয়ে রবে অচেনা আর চেনা;
জমিয়ে ধুলো সাজিয়ে ঢেলা
তৈরি হবে আমার খেলা,
সুখ রবে মোর বিনামূল্যেই কেনা।
বড়ো হবার দায় নিয়ে, এই
বড়োর হাটে এসে
নিত্য চলে ঠেলাঠেলির পালা।
যাবার বেলায় বিশ্ব আমার
বিকিয়ে দিয়ে শেষে
শুধুই নেব ফাঁকা কথার ডালা!
কোন্টা সস্তা, কোন্টা দামি
ওজন করতে গিয়ে আমি
বেলা আমার বইয়ে দেব দ্রুত,
সন্ধ্যা যখন আঁধার হবে
হঠাৎ মনে লাগবে তবে
কোনোটাই না হল মনঃপুত।
বাল্য দিয়ে যে-জীবনের
আরম্ভ হয় দিন
বাল্যে আবার হোক-না তাহা সারা।
জলে স্থলে সঙ্গ আবার
পাক-না বাঁধন-হীন,
ধুলায় ফিরে আসুক-না পথহারা।
সম্ভাবনার ডাঙা হতে
অসম্ভবের উতল স্রোতে
দিই-না পাড়ি স্বপন-তরী নিয়ে।
আবার মনে বুঝি না এই,
বস্তু বলে কিছুই তো নেই
বিশ্ব গড়া যা খুশি তাই দিয়ে।
প্রথম যেদিন এসেছিলেম
নবীন পৃথ্বীতলে
রবির আলোয় জীবন মেলে দিয়ে,
সে যেন কোন্ জগৎ-জোড়া
ছেলেখেলার ছলে,
কোথাত্থেকে কেই বা জানে কী এ!
শিশির যেমন রাতে রাতে,
কে যে তারে লুকিয়ে গাঁথে,
ঝিল্লি বাজায় গোপন ঝিনিঝিনি।
ভোরবেলা যেই চেয়ে দেখি,
আলোর সঙ্গে আলোর এ কী
ইশারাতে চলছে চেনাচিনি।
সেদিন মনে জেনেছিলেম
নীল আকাশের পথে
ছুটির হাওয়ায় ঘুর লাগাল বুঝি!
যা-কিছু সব চলেছে ওই
ছেলেখেলার রথে
যে-যার আপন দোসর খুঁজি খুঁজি।
গাছে খেলা ফুল-ভরানো
ফুলে খেলা ফল-ধরানো,
ফলের খেলা অঙ্কুরে অঙ্কুরে।
স্থলের খেলা জলের কোলে,
জলের খেলা হাওয়ার দোলে,
হাওয়ার খেলা আপন বাঁশির সুরে।
ছেলের সঙ্গে আছ তুমি
নিত্য ছেলেমানুষ,
নিয়ে তোমার মালমসলার ঝুলি।
আকাশেতে ওড়াও তোমার
কতরকম ফানুস
মেঘে বোলাও রঙ-বেরঙের তুলি।
সেদিন আমি আপন মনে
ফিরেছিলেম তোমার সনে,
খেলেছিলেম হাত মিলিয়ে হাতে।
ভাসিয়েছিলেম রাশি রাশি
কথায় গাঁথা কান্নাহাসি
তোমারই সব ভাসান-খেলার সাথে।
ঋতুর তরী বোঝাই কর
রঙিন ফুলে ফুলে,
কালের স্রোতে যায় তারা সব ভেসে।
আবার তারা ঘাটে লাগে
হাওয়ায় দুলে দুলে
এই ধরণীর কূলে কূলে এসে।
মিলিয়েছিলেম বিশ্ব-ডালায়
তোমার ফুলে আমার মালায়
সাজিয়েছিলেম ঋতুর তরণীতে,
আশা আমার আছে মনে
বকুল কেয়া শিউলি -সনে
ফিরে ফিরে আসবে ধরণীতে।
সেদিন যখন গান গেয়েছি
আপন মনে নিজে,
বিনা কাজে দিন গিয়েছে চলে,
তখন আমি চোখে তোমার
হাসি দেখেছি যে,
চিনেছিলে আমায় সাথি বলে।
তোমার ধুলো তোমার আলো
আমার মনে লাগত ভালো,
শুনেছিলেম উদাস-করা বাঁশি।
বুঝেছিলে সে-ফাল্গুনে
আমার সে-গান শুনে শুনে
তোমারও গান আমি ভালোবাসি।
দিন গেল ঐ মাঠে বাটে,
আঁধার নেমে প’ল;
এপার থেকে বিদায় মেলে যদি
তবে তোমার সন্ধেবেলার
খেয়াতে পাল তোলো,
পার হব এই হাটের ঘাটের নদী।
আবার ওগো শিশুর সাথি,
শিশুর ভুবন দাও তো পাতি,
করব খেলা তোমায় আমায় একা।
চেয়ে তোমার মুখের দিকে
তোমায়, তোমার জগৎটিকে
সহজ চোখে দেখব সহজ দেখা। (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্–
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্॥
এসো এসো উৎসস্রোতে গূঢ় অন্ধকার হতে
এসো হে নির্মল কলকল্ ছলছল্॥
রবিকর রহে তব প্রতীক্ষায়।
তুমি যে খেলার সাথি, সে তোমারে চায়।
তাহারি সোনার তান তোমাতে জাগায় গান,
এসো হে উজ্জ্বল, কলকল্ ছলছল্॥
হাঁকিছে অশান্ত বায়,
‘আয়, আয়, আয়।’ সে তোমায় খুঁজে যায়।
তাহার মৃদঙ্গরবে করতালি দিতে হবে,
এসো হে চঞ্চল, কলকল্ ছলছল্॥
মরুদৈত্য কোন্ মায়াবলে
তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে।
ভেঙে ফেলে দিয়ে কারা এসো বন্ধহীন ধারা,
এসো হে প্রবল, কলকল্ ছলছল্॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
আমারে ডেকো না আজি , এ নহে সময় —
একাকী রয়েছি হেথা গভীর বিজন ,
রুধিয়া রেখেছি আমি অশান্ত হৃদয় ,
দুরন্ত হৃদয় মোর করিব শাসন ।
মানবের মাঝে গেলে এ যে ছাড়া পায় ,
সহস্রের কোলাহলে হয় পথহারা ,
লুব্ধ মুষ্টি যাহা পায় আঁকড়িতে চায় ,
চিরদিন চিররাত্রি কেঁদে কেঁদে সারা ।
ভর্ৎসনা করিব তারে বিজনে বিরলে ,
একটুকু ঘুমাক সে কাঁদিয়া কাঁদিয়া ,
শ্যামল বিপুল কোলে আকাশ – অঞ্চলে
প্রকৃতি জননী তারে রাখুন বাঁধিয়া ।
শান্ত স্নেহকোলে বসে শিখুক সে স্নেহ ,
আমারে আজিকে তোরা ডাকিস নে কেহ । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বাছা রে, তোর চক্ষে কেন জল।
কে তোরে যে কী বলেছে
আমায় খুলে বল্।
লিখতে গিয়ে হাতে মুখে
মেখেছ সব কালি,
নোংরা ব ' লে তাই দিয়েছে গালি?
ছি ছি, উচিত এ কি।
পূর্ণশশী মাখে মসী—
নোংরা বলুক দেখি।
বাছা রে, তোর সবাই ধরে দোষ।
আমি দেখি সকল-তাতে
এদের অসন্তোষ।
খেলতে গিয়ে কাপড়খানা
ছিঁড়ে খুঁড়ে এলে
তাই কি বলে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।
ছি ছি, কেমন ধারা।
ছেঁড়া মেঘে প্রভাত হাসে,
সে কি লক্ষ্মীছাড়া।
কান দিয়ো না তোমায় কে কী বলে।
তোমার নামে অপবাদ যে
ক্রমেই বেড়ে চলে।
মিষ্টি তুমি ভালোবাস
তাই কি ঘরে পরে
লোভী বলে তোমার নিন্দে করে!
ছি ছি, হবে কী।
তোমায় যারা ভালোবাসে
তারা তবে কী। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসি।
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে,
ওগো প্রাণে মনে আমি যে তাহার
পরশ পাবার প্রয়াসী।
আমি সুদূরের পিয়াসি।
ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই,
সে কথা যে যাই পাসরি।আমি উৎসুক হে,
হে সুদূর, আমি প্রবাসী।
তুমি দুর্লভ দুরাশার মতো
কী কথা আমায় শুনাও সতত।
তব ভাষা শুনে তোমারে হৃদয়
জেনেছে তাহার স্বভাষী।
হে সুদূর,আমি প্রবাসী।
ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
নাহি জানি পথ, নাহি মোর রথ
সে কথা যে যাই পাসরি। ‘আমি উন্মনা হে,
হে সুদূর,আমি উদাসী।
রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায়
তরুমর্মরে, ছায়ার খেলায়,
কী মুরতি তব নীলাকাশশায়ী
নয়নে উঠে গো আভাসি।
হে সুদূর,আমি উদাসী।
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি।
কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার
সে কথা যে যাই পাসরি। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
অল্পেতে খুশি হবে
দামোদর শেঠ কি।
মুড়কির মোয়া চাই,
চাই ভাজা ভেটকি।আনবে কট্কি জুতো,
মট্কিতে ঘি এনো,
জলপাইগুঁড়ি থেকে
এনো কই জিয়োনো–
চাঁদনিতে পাওয়া যাবে
বোয়ালের পেট কি।চিনেবাজারের থেকে
এনো তো করমচা,
কাঁকড়ার ডিম চাই,
চাই যে গরম চা,
নাহয় খরচা হবে
মাথা হবে হেঁট কি।মনে রেখো বড়ো মাপে
করা চাই আয়োজন,
কলেবর খাটো নয়–
তিন মোন প্রায় ওজন।
খোঁজ নিয়ো ঝড়িয়াতে
জিলিপির রেট কী। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নূতন সে পলে পলে
অতীতে বিলীন,
যুগে যুগে বর্তমান
সেই তো নবীন।
তৃষ্ণা বাড়াইয়া তোলে
নূতনের সুরা,
নবীনের চিরসুধা
তৃপ্তি করে পুরা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপ রতন আশা করি;
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর
ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।
সময় যেন হয় রে এবার
ঢেউ খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার,
সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে
অমর হয়ে রব মরি।
যে গান কানে যায় না শোনা
সে গান সেথায় নিত্য বাজে,
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব
সেই অতলের সভামাঝে।
চিরদিনের সুরটি বেঁধে
শেষ গানে তার কান্না কেঁদে,
নীরব যিনি তাঁহার পায়ে
নীরব বীণা দিব ধরি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমার হৃদয় প্রাণ
সকলই করেছি দান,
কেবল শরমখানি রেখেছি।
চাহিয়া নিজের পানে
নিশিদিন সাবধানে
সযতনে আপনারে ঢেকেছি।
হে বঁধু, এ স্বচ্ছ বাস
করে মোরে পরিহাস,
সতত রাখিতে নারি ধরিয়া–
চাহিয়া আঁখির কোণে
তুমি হাস মনে মনে,
আমি তাই লাজে যাই মরিয়া।
দক্ষিণপবনভরে
অঞ্চল উড়িয়া পড়ে
কখন্ যে নাহি পারি লখিতে।
পুলকব্যাকুল হিয়া
অঙ্গে উঠে বিকশিয়া,
আবার চেতনা হয় চকিতে।
বদ্ধ গৃহে করি বাস
রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
বসি গিয়া বাতায়নে,
সুখসন্ধ্যাসমীরণে
ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া।
পূর্ণচন্দ্রকররাশি
মূর্ছাতুর পড়ে আসি
এই নবযৌবনের মুকুলে,
অঙ্গ মোর ভালোবেসে
ঢেকে দেয় মৃদু হেসে
আপনার লাবণ্যের দুকূলে–
মুখে বক্ষে কেশপাশে
ফিরে বায়ু খেলা-আশে,
কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে–
হেনকালে তুমি এলে
মনে হয় স্বপ্ন ব’লে,
কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে।
থাক্ বঁধু, দাও ছেড়ে,
ওটুকু নিয়ো না কেড়ে,
এ শরম দাও মোরে রাখিতে–
সকলের অবশেষ
এইটুকু লাজলেশ
আপনারে আধখানি ঢাকিতে।
ছলছল-দু’নয়ান
করিয়ো না অভিমান,
আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি;
বুঝাতে পারি নে যেন
সব দিয়ে তবু কেন
সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি–
কেন যে তোমার কাছে
একটু গোপন আছে,
একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে।
এ নহে গো অবিশ্বাস–
নহে সখা, পরিহাস,
নহে নহে ছলনার খেলা এ।
বসন্তনিশীথে বঁধু,
লহ গন্ধ, লহ মধু,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো।
দিয়ো দোল আশে-পাশে,
কোয়ো কথা মৃদু ভাষে–
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো।
সেটুকুতে ভর করি
এমন মাধুরী ধরি
তোমাপানে আছি আমি ফুটিয়া,
এমন মোহনভঙ্গে
আমার সকল অঙ্গে
নবীন লাবণ্য যায় লুটিয়া–
এমন সকল বেলা
পবনে চঞ্চল খেলা,
বসন্তকুসুম-মেলা দুধারি।
শুন বঁধু, শুন তবে,
সকলই তোমার হবে,
কেবল শরম থাক্ আমারি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আগুন জ্বলিত যবে
আপন আলোতে
সাবধান করেছিলে
মোরে দূর হতে।
নিবে গিয়ে ছাইচাপা
আছে মৃতপ্রায়,
তাহারি বিপদ হতে
বাঁচাও আমায়।(স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার যাইবি কি তুই,
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
পাদপের ছায়া মাথার ‘পরে,
পাখিরা গাইছে মধুর স্বরে
অথবা উড়িছে পাখা বিছায়ে
হরষে সে গিরি-কাননে!
রূপসী আমার প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার, যাইবি কি তুই
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
শিখর উঠেছে আকাশ-‘পরি,
ফেনময় স্রোত পড়িছে মরি,
সুরভি-কুঞ্জ ছায়া বিছায়ে
শোভিছে সে গিরি-কাননে!
রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার, যাইবি কি তুই
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
ধবল শিখর কুসুমে ভরা
সরসে ঝরিছে নিঝর-ধারা
উছসে উঠিয়া সলিল-কণা
শীতলিছে গিরি-কাননে!
রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার, যাইবি কি তুই
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
সুখ দুখ যাহা দিলেন, বিধি,
কিছুই মানিতে চায় না হৃদি,
তোমারে ও প্রেমে লইয়া পাশে
ভ্রমি যদি গিরি-কাননে!Robert Burns
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
আমার আমি সেইটুকু থাক্ বাকি।
তোমায় আমি হেরি সকল দিশি,
সকল দিয়ে তোমার মাঝে মিশি,
তোমারে প্রেম জোগাই দিবানিশি,
ইচ্ছা আমার সেইটুকু থাক্ বাকি–
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।তোমায় আমি কোথাও নাহি ঢাকি
কেবল আমার সেইটুকু থাক্ বাকি।
তোমার লীলা হবে এ প্রাণ ভরে
এ সংসারে রেখেছ তাই ধরে,
রইব বাঁধা তোমার বাহুডোরে
বাঁধন আমার সেইটুকু থাক্ বাকি–
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।১৫ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বিশ্বধরণীর এই বিপুল কুলায়
সন্ধ্যা-- তারি নীরব নির্দেশে
নিখিল গতির বেগ ধায় তারি পানে।
চৌদিকে ধূসরবর্ণ আবরণ নামে।
মন বলে, ঘরে যাব--
কোথা ঘর নাহি জানে।
দ্বার খোলে সন্ধ্যা নিঃসঙ্গিনী,
সম্মুখে নীরন্ধ্র অন্ধকার।
সকল আলোর অন্তরালে
বিস্মৃতির দূতী
খুলে নেয় এ মর্তের ঋণ-করা সাজসজ্জা যত--
প্রক্ষিপ্ত যা-কিছু তার নিত্যতার মাঝে
ছিন্ন জীর্ণ মলিন অভ্যাস।
আঁধারে অবগাহন-স্নানে
নির্মল করিয়া দেয় নবজন্ম নগ্ন ভূমিকারে।
জীবনের প্রান্তভাগে
অন্তিম রহস্যপথে দেয় মুক্ত করি
সৃষ্টির নূতন রহস্যেরে।
নব জন্মদিন তারে বলি
আঁধারের মন্ত্র পড়ি সন্ধ্যা যারে জাগায় আলোকে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
হাসির সময় বড়ো নেই,
দু দণ্ডের তরে গান গাওয়া।
নিমেষের মাঝে চুমো খেয়ে
মুহূর্তে ফুরাবে চুমো খাওয়া।
বেলা নাই শেষ করিবারে
অসম্পূর্ণ প্রেমের মন্ত্রণা–
সুখস্বপ্ন পলকে ফুরায়,
তার পরে জাগ্রত যন্ত্রণা।
কিছু ক্ষণ কথা কয়ে লও,
তাড়াতাড়ি দেখে লও মুখ,
দু দণ্ডের খোঁজ দেখাশুনা–
ফুরাইবে খুঁজিবার সুখ।
বেলা নাই কথা কহিবারে
যে কথা কহিতে ফাটে প্রাণ।
দেবতারে দুটো কথা ব’লে
পূজার সময় অবসান।
কাঁদিতে রয়েছে দীর্ঘ দিন–
জীবন করিতে মরুময়,
ভাবিতে রয়েছে চিরকাল–
ঘুমাইতে অনন্ত সময়।P. B. Marston (অনূদিত কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
দেখিনু যে এক আশার স্বপন
শুধু তা স্বপন, স্বপনময়–
স্বপন বই সে কিছুই নয়।
অবশ হৃদয় অবসাদময়
হারাইয়া সুখ শ্রান্ত অতিশয়–
আজিকে উঠিনু জাগি
কেবল একটি স্বপন লাগি!
বীণাটি আমার নীরব হইয়া
গেছে গীতগান ভুলি,
ছিঁড়িয়া টুটিয়া ফেলেছি তাহার
একে একে তারগুলি।
নীরব হইয়া রয়েছে পড়িয়া
সুদূর শ্মশান-‘পরে,
কেবল একটি স্বপন-তরে!
থাম্ থাম্ ওরে হৃদয় আমার,
থাম্ থাম্ একেবারে,
নিতান্তই যদি টুটিয়া পড়িবি
একেবারে ভেঙে যা রে–
এই তোর কাছে মাগি।
আমার জগৎ, আমার হৃদয়–
আগে যাহা ছিল এখন তা নয়
কেবল একটি স্বপন লাগি।Christina Rossetti (অনূদিত কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
যন্ত্রদানব, মানবে করিলে পাখি।
স্থল জল যত তার পদানত
আকাশ আছিল বাকি।
বিধাতার দান পাখিদের ডানাদুটি।
রঙের রেখায় চিত্রলেখায়
আনন্দ উঠে ফুটি;
তারা যে রঙিন পান্থ মেঘের সাথি।
নীল গগনের মহাপবনের
যেন তারা একজাতি।
তাহাদের লীলা বায়ুর ছন্দে বাঁধা;
তাহাদের প্রাণ, তাহাদের গান
আকাশের সুরে সাধা;
তাই প্রতিদিন ধরণীর বনে বনে
আলোক জাগিলে একতানে মিলে
তাহাদের জাগরণে।
মহাকাশতলে যে মহাশান্তি আছে
তাহাতে লহরী কাঁপে থরথরি
তাদের পাখার নাচে।
যুগে যুগে তারা গগনের পথে পথে
জীবনের বাণী দিয়েছিল আনি
অরণ্যে পর্বতে;
আজি একি হল, অর্থ কে তার জানে।
স্পর্ধা পতাকা মেলিয়াছে পাখা
শক্তির অভিমানে।
তারে প্রাণদেব করে নি আশীর্বাদ।
তাহারে আপন করে নি তপন,
মানে নি তাহারে চাঁদ।
আকাশের সাথে অমিল প্রচার করি
কর্কশস্বরে গর্জন করে
বাতাসেরে জর্জরি।
আজি মানুষের কলুষিত ইতিহাসে
উঠি মেঘলোকে স্বর্গ-আলোকে
হানিছে অট্টহাসে।
যুগান্ত এল বুঝিলাম অনুমানে--
অশান্তি আজ উদ্যত বাজ
কোথাও না বাধা মানে;
ঈর্ষা হিংসা জ্বালি মৃত্যুর শিখা
আকাশে আকাশে বিরাট বিনাশে
জাগাইল বিভীষিকা।
দেবতা যেথায় পাতিবে আসনখানি
যদি তার ঠাঁই কোনোখানে নাই
তবে, হে বজ্রপাণি,
এ ইতিহাসের শেষ অধ্যায়তলে
রুদ্রের বাণী দিক দাঁড়ি টানি
প্রলয়ের রোষানলে।
আর্ত ধরার এই প্রার্থনা শুন--
শ্যামবনবীথি পাখিদের গীতি
সার্থক হোক পুন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
আলো তার পদচিহ্ন
আকাশে না রাখে;
চলে যেতে জানে, তাই
চিরদিন থাকে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
সুখেতে আসক্তি যার
আনন্দ তাহারে করে ঘৃণা।
কঠিন বীর্যের তারে
বাঁধা আছে সম্ভোগের বীণা৷ (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্ররোষে
দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে
ধুলায় সে যায় বয়ে
সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান। যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার,
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।
তবু নত করি আঁখি
দেখিবারে পাও না কি
নেমেছে ধুলার তলে হীন পতিতের ভগবান,
অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে,
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
সবারে না যদি ডাক’,
এখনো সরিয়া থাক’,
আপনারে বেঁধে রাখ’ চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান–
মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
এক দিন গরজিয়া কহিল মহিষ,
ঘোড়ার মতন মোর থাকিবে সহিস।
একেবারে ছাড়িয়াছি মহিষি-চলন,
দুই বেলা চাই মোর দলন-মলন।
এই ভাবে প্রতিদিন, রজনী পোহালে,
বিপরীত দাপাদাপি করে সে গোহালে।
প্রভু কহে,চাই বটে! ভালো, তাই হোক!
পশ্চাতে রাখিল তার দশ জন লোক।
দুটো দিন না যাইতে কেঁদে কয় মোষ,
আর কাজ নেই প্রভু, হয়েছে সন্তোষ।
সহিসের হাত হতে দাও অব্যাহতি,
দলন-মলনটার বাড়াবাড়ি অতি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কুঁজো তিনকড়ি ঘোরে
পাড়া চারিদিককার,
সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে
নিয়ে ঝুলি ভিক্ষার।
বলে সিধু গড়গড়ি
রাগে দাঁত কড়মড়ি,
“ভিখ্ মেগে ফের’, মনে
হয় না কি ধিক্কার?’
ঝুলি নিজে কেড়ে বলে,
“মাহিনা এ শিক্ষার।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
রাস্তায় চলতে চলতে
বাউল এসে থামল
তোমার সদর দরজায়।
গাইল, "অচিন পাখি উড়ে আসে খাঁচায়;"
দেখে অবুঝ মন বলে--
অধরাকে ধরেছি।
তুমি তখন স্নানের পরে এলোচুলে
দাঁড়িয়েছিলে জানলায়।
অধরা ছিল তোমার দূরে-চাওয়া চোখের
পল্লবে,
অধরা ছিল তোমার কাঁকন-পরা নিটোল হাতের
মধুরিমায়।
ওকে ভিক্ষে দিলে পাঠিয়ে,
ও গেল চলে;
জানলে না এইগানে তোমারই কথা।
তুমি রাগিণীর মতো আস যাও
একতারার তারে তারে।
সেই যন্ত্র তোমার রূপের খাঁচা,
দোলে বসন্তের বাতাসে।
তাকে বেড়াই বুকে ক'রে;
ওতে রঙ লাগাই, ফুল কাটি
আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে।
যখন বেজে ওঠে, ওর রূপ যাই ভুলে,
কাঁপতে কাঁপতে ওর তার হয় অদৃশ্য।
অচিন তখন বেরিয়ে আসে বিশ্বভুবনে,
খেলিয়ে যায় বনের সবুজে
মিলিয়ে যায় দোলনচাঁপার গন্ধে।
অচিন পাখি তুমি,
মিলনের খাঁচায় থাক,
নানা সাজের খাঁচা।
সেখানে বিরহ নিত্য থাকে পাখির পাখায়,
স্থকিত ওড়ার মধ্যে।
তার ঠিকানা নেই,
তার অভিসার দিগন্তের পারে
সকল দৃশ্যের বিলীনতায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বাগানে ওই দুটো গাছে
ফুল ফুটেছে কত যে,
ফুলের গন্ধে মনে পড়ে
ছিল ফুলের মতো যে।
ফুল যে দিত ফুলের সঙ্গে
আপন সুধা মাখায়ে,
সকাল হত সকাল বেলায়
যাহার পানে তাকায়ে,
সেই আমাদের ঘরের মেয়ে
সে গেছে আজ প্রবাসে,
নিয়ে গেছে এখান থেকে
সকাল বেলার শোভা সে।
একটুখানি মেয়ে আমার
কত যুগের পুণ্য যে,
একটুখানি সরে গেছে
কতখানিই শূন্য যে।
বিষ্টি পড়ে টুপুর টুপুর,
মেঘ করেছে আকাশে,
উষার রাঙা মুখখানি আজ
কেমন যেন ফ্যাকাশে।
বাড়িতে যে কেউ কোথা নেই,
দুয়োরগুলো ভেজানো,
ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই
ঘরে আছে কে যেন।
ময়নাটি ওই চুপটি করে
ঝিমোচ্ছে সেই খাঁচাতে,
ভুলে গেছে নেচে নেচে
পুচ্ছটি তার নাচাতে।
ঘরের-কোণে আপন-মনে
শূন্য প'ড়ে বিছানা,
কার তরে সে কেঁদে মরে—
সে কল্পনা মিছা না।
বইগুলো সব ছড়িয়ে আছে,
নাম লেখা তায় কার গো।
এম্নি তারা রবে কি হায়,
খুলবে না কেউ আর গো।
এটা আছে সেটা আছে
অভাব কিছু নেই তো—
স্মরণ করে দেয় রে যারে
থাকে নাকো সেই তো। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।বাবু বলিলেন, “বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।’কহিলাম আমি, “তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই।চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’শুনি রাজা কহে, “বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানপেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা–ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণিসজল চক্ষে, “করুণ বক্ষে গরিবের ভিটেখানি।সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, “আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’ পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে–করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি–রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্যকত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য!ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমিতবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো-ষোলো–একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়ই বাসনা হল। নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি,ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল– নিশীথশীতল স্নেহ।বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে–মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে–কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে,রাখি হাটখোলা, নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছেতৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে। ধিক্ ধিক্ ওরে, শতধিক্ তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি!যখনি যাহার তখনি তাহার, এই কি জননী তুমি!সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতাআঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক পাতা!আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ–পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন–তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!ধনীর আদরে গরব না ধরে ! এতই হয়েছ ভিন্নকোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি!যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী, হলে দাসী। বিদীর্ণ হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি–প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ একি!বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক-কালের কথা।সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন–ভাবিলাম হায় আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা,স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা। হেনকালে হায় যমদূত-প্রায় কোথা হতে এল মালী,ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।কহিলাম তবে, “আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব–দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব!’চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ–বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ।শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, “মারিয়া করিব খুন!’বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।আমি কহিলাম, “শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’বাবু কহে হেসে, “বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।’আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে–তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
সেই আমাদের দেশের পদ্ম
তেমনি মধুর হেসে
ফুটেছে, ভাই, অন্য নামে
অন্য সুদূর দেশে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
দারুণ অগ্নিবাণে রে হৃদয় তৃষায় হানে রে॥
রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধ দিন
আরাম নাহি যে জানে রে॥
শুষ্ক কাননশাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে
করুণ কাতর গানে রে॥
ভয় নাহি, ভয় নাহি। গগনে রয়েছি চাহি।
জানি ঝঞ্ঝার বেশে দিবে দেখা তুমি এসে
একদা তাপিত প্রাণে রে॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে
শূন্যে আর ধরাতলে মন্ত্র বাঁধে ছন্দে আর মিলে।
বনেরে করায় স্নান শরতের রৌদ্রের সোনালি।
হলদে ফুলের গুচ্ছে মধু খোঁজে বেগুনি মৌমাছি।
মাঝখানে আমি আছি,
চৌদিকে আকাশ তাই দিতেছে নিঃশব্দ করতালি।
আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ,
জানে তা কি এ কালিম্পঙ।
ভান্ডারে সঞ্চিত করে পর্বতশিখর
অন্তহীন যুগ-যুগান্তর।
আমার একটি দিন বরমাল্য পরাইল তারে,
এ শুভ সংবাদ জানাবারে
অন্তরীক্ষে দুর হতে দুরে
অনাহত সুরে
প্রভাতে সোনার ঘণ্টা বাজে ঢঙ ঢঙ,
শুনিছে কি এ কালিম্পঙ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা,
খুকি তোমার ভারি ছেলেমানুষ।
ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি
আমরা যখন উড়েয়েছিলেম ফানুস।
আমি যখন খাওয়া - খাওয়া খেলি
খেলার থালে সাজিয়ে নিয়ে নুড়ি,
ও ভাবে বা সত্যি খেতে হবে
মুঠো করে মুখে দেয় মা, পুরি।
সামনেতে ওর শিশুশিক্ষা খুলে
যদি বলি, ‘খুকি, পড়া করো'
দু হাত দিয়ে পাতা ছিঁড়তে বসে—
তোমার খুকির পড়া কেমনতরো।
আমি যদি মুখে কাপড় দিয়ে
আস্তে আস্তে আসি গুড়িগুড়ি
তোমার খুকি অম্নি কেঁদে ওঠে,
ও ভাবে বা এল জুজুবুড়ি।
আমি যদি রাগ করে কখনো
মাথা নেড়ে চোখ রাঙিয়ে বকি—
তোমার খুকি খিল্খিলিয়ে হাসে।
খেলা করছি মনে করে ও কি।
সবাই জানে বাবা বিদেশ গেছে
তবু যদি বলি ‘আসছে বাবা'
তাড়াতাড়ি চার দিকেতে চায়—
তোমার খুকি এম্নি বোকা হাবা।
ধোবা এলে পড়াই যখন আমি
টেনে নিয়ে তাদের বাচ্ছা গাধা,
আমি বলি ‘আমি গুরুমশাই',
ও আমাকে চেঁচিয়ে ডাকে ‘দাদা'।
তোমার খুকি চাঁদ ধরতে চায়,
গণেশকে ও বলে যে মা গানুশ।
তোমার খুকি কিচ্ছু বোঝে না মা,
তোমার খুকি ভারি ছেলেমানুষ। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সকাল বিকাল ইস্টেশনে আসি,
চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি।
ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকিট কেনে,
ভাঁটির ট্রেনে কেউ-বা চড়ে
কেউ-বা উজান ট্রেনে।
সকাল থেকে কেউ-বা থাকে বসে,
কেউ-বা গাড়ি ফেল্ করে তার
শেষ-মিনিটের দোষে।
দিনরাত গড়্গড়্ ঘড়্ঘড়্,
গাড়িভরা মানুষের ছোটে ঝড়।
ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে
কভু পশ্চিমে, কভু পূর্বে।
চলচ্ছবির এই-যে মূর্তিখানি
মনেতে দেয় আনি
নিত্য-মেলার নিত্য-ভোলার ভাষা--
কেবল যাওয়া-আসা।
মঞ্চতলে দণ্ডে পলে
ভিড় জমা হয় কত--
পতাকাটা দেয় দুলিয়ে,
কে কোথা হয় গত।
এর পিছনে সুখদুঃখ-
ক্ষতিলাভের তাড়া
দেয় সবলে নাড়া।
সময়ের ঘড়িধরা অঙ্কেতে
ভোঁ ভোঁ ক'রে বাঁশি বাজে সংকেতে।
দেরি নাহি সয় কারো কিছুতেই
কেহ যায়, কেহ থাকে পিছুতেই।
ওদের চলা ওদের পড়ে-থাকায়
আর কিছু নেই, ছবির পরে
কেবল ছবি আঁকায়।
খানিকক্ষণ যা চোখে পড়ে
তার পরে যায় মুছে,
আত্ম-অবহেলার খেলা
নিত্যই যায় ঘুচে।
ছেঁড়া পটের টুকরো জমে
পথের প্রান্ত জুড়ে,
তপ্ত দিনের ক্লান্ত হাওয়ায়
কোন্খানে যায় উড়ে।
"গেল গেল' ব'লে যারা
ফুকরে কেঁদে ওঠে
ক্ষণেক-পরে কান্না-সমেত
তারাই পিছে ছোটে।
ঢং ঢং বেজে ওঠে ঘণ্টা,
এসে পড়ে বিদায়ের ক্ষণটা।
মুখ রাখে জানলায় বাড়িয়ে,
নিমেষেই নিয়ে যায় ছাড়িয়ে।
চিত্রকরের বিশ্বভুবনখানি--
এই কথাটাইনিলেম মনে মানি।
কর্মকারের নয় এ গড়া-পেটা--
আঁকড়ে ধরার জিনিস এ নয়,
দেখার জিনিস এটা।
কালের পরে যায় চলে কাল,
হয় না কভু হারা
ছবির বাহন চলাফেরার ধারা।
দুবেলা সেই এ সংসারের
চলতি ছবি দেখা,
এই নিয়ে রই যাওয়া-আসাআর
ইস্টেশনে একা।
এক তুলি ছবিখানা এঁকে দেয়,
আর তুলি কালি তাহে মেখে দেয়।
আসে কারা এক দিক হতে ঐ,
ভাসে কারা বিপরীত স্রোতে ঐ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
আম্র, তোর কী হইতে ইচ্ছা যায় বল্।
সে কহে, হইতে ইক্ষু সুমিষ্ট সরল।—
ইক্ষু, তোর কী হইতে মনে আছে সাধ?
সে কহে, হইতে আম্র সুগন্ধ সুস্বাদ। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
জীবনদেবতা তব
দেহে মনে অন্তরে বাহিরে
আপন পূজার ফুল
আপনি ফুটান ধীরে ধীরে
মাধুর্যে সৌরভে তারি
অহোরাত্র রহে যেন ভরি
তোমার সংসারখানি,
এই আমি আশীর্বাদ করি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
চাষের সময়ে
যদিও করি নি হেলা।
ভুলিয়া ছিলাম
ফসল কাটার বেলা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আর আমায় আমি নিজের শিরে
বইব না।
আর নিজের দ্বারে কাঙাল হয়ে
রইব না।
এই বোঝা তোমার পায়ে ফেলে
বেড়িয়ে পড়ব অবহেলে–
কোনো খবর রাখব না ওর,
কোনো কথাই কইব না।
আমায় আমি নিজের শিরে
বইব না।বাসনা মোর যারেই পরশ
করে সে,
আলোটি তার নিবিয়ে ফেলে
নিমেষে।
ওরে সেই অশুচি, দুই হাতে তার
যা এনেছে চাই নে সে আর,
তোমার প্রেমে বাজবে না যা
সে আর আমি সইব না
আমায় আমি নিজের শিরে
বইব না।১৫ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খ'সে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব'সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চলা করে ধরাইব আখা।
হল্ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে--
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কন্কনে শীত তাই
চাই তার দস্তানা;
বাজার ঘুরিয়ে দেখে,
জিনিসটা সস্তা না।
কম দামে কিনে মোজা
বাড়ি ফিরে গেল সোজা–
কিছুতে ঢোকে না হাতে,
তাই শেষে পস্তানা। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ওরে মাঝি, ওরে আমার
মানবজন্মতরীর মাঝি,
শুনতে কি পাস দূরের থেকে
পারের বাঁশি উঠছে বাজি।
তরী কি তোর দিনের শেষে
ঠেকবে এবার ঘাটে এসে।
সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে
দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি।যেন আমার লাগছে মনে,
মন্দমধুর এই পবনে
সিন্ধুপারের হাসিটি কার
আঁধার বেয়ে আসছে আজি।
আসার বেলায় কুসুমগুলি
কিছু এনেছিলেম তুলি,
যেগুলি তার নবীন আছে
এইবেলা নে সাজিয়ে সাজি।১৮ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
অবোধ হিয়া বুঝে না বোঝে,
করে সে একি ভুল—
তারার মাঝে কাঁদিয়া খোঁজে
ঝরিয়া-পড়া ফুল। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
অন্নের লাগি মাঠে
লাঙলে মানুষ মাটিতে আঁচড় কাটে।
কলমের মুখে আঁচড় কাটিয়া
খাতার পাতার তলে
মনের অন্ন ফলে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
রাহুর মতন মৃত্যু
শুধু ফেলে ছায়া,
পারে না করিতে গ্রাস জীবনের স্বর্গীয় অমৃত
জড়ের কবলে
এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।
প্রেমের অসীম মূল্য
সম্পূর্ণ বঞ্চনা করি লবে
হেন দস্যু নাই গুপ্ত
নিখিলের গুহা-গহ্বরেতে
এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।
সব-চেয়ে সত্য ক’রে পেয়েছিনু যারে
সব-চেয়ে মিথ্যা ছিল তারি মাঝে ছদ্মবেশ ধরি,
অস্তিত্বের এ কলঙ্ক কভু
সহিত না বিশ্বের বিধান
এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।
সব-কিছু চলিয়াছে নিরন্তর পরিবর্তবেগে,
সেই তো কালের ধর্ম।মৃত্যু দেখা দেয় এসে একান্তই অপরিবর্তনে,
এ বিশ্বে তাই সে সত্য নহে
এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।
বিশ্বেরে যে জেনেছিল আছে ব’লে
সেই তার আমি
অস্তিত্বের সাক্ষী সেই,
পরম আমির সত্যে সত্য তার
এ কথা নিশ্চিত মনে জানি । (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
সমুখে শান্তিপারাবার,
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথি,
লও লও হে ক্রোড় পাতি,
অসীমের পথে জ্বলিবে
জ্যোতি ধ্রুবতারকার।মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা, তোমার দয়া
হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার।হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয়,
বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়,
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়
মহা-অজানার। (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
জগৎ - পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে মেলা ।
অন্তহীন গগনতল
মাথার ‘পরে অচঞ্চল ,
ফেনিল ওই সুনীল জল
নাচিছে সারা বেলা ।
উঠিছে তটে কী কোলাহল —
ছেলেরা করে মেলা ।
বালুকা দিয়ে বাঁধিছে ঘর ,
ঝিনুক নিয়ে খেলা ।
বিপুল নীল সলিল -' পরি
ভাসায় তারা খেলার তরী
আপন হাতে হেলায় গড়ি
পাতায় - গাঁথা ভেলা ।
জগৎ - পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে খেলা ।
জানে না তারা সাঁতার দেওয়া ,
জানে না জাল ফেলা ।
ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে ,
বণিক ধায় তরণী বেয়ে ,
ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে
সাজায় বসি ঢেলা ।
রতন ধন খোঁজে না তারা ,
জানে না জাল ফেলা ।
ফেনিয়ে উঠে সাগর হাসে ,
হাসে সাগর - বেলা ।
ভীষণ ঢেউ শিশুর কানে
রচিছে গাথা তরল তানে ,
দোলনা ধরি যেমন গানে
জননী দেয় ঠেলা ।
সাগর খেলে শিশুর সাথে ,
হাসে সাগর - বেলা ।
জগৎ - পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে মেলা ।
ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে ,
তরণী ডুবে সুদূর জলে ,
মরণ - দূত উড়িয়া চলে ,
ছেলেরা করে খেলা ।
জগৎ - পারাবারের তীরে
শিশুর মহামেলা । (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে
সত্য হবে -
ওগো সত্য, আমার এখন সুদিন।
ঘটবে কবে।
সত্য সত্য সত্য জপি,
সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি,
সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব
নিখিল ভবে -
সত্য তোমার পূর্ণ প্রকাশ
দেখব কবে। তোমায় দূরে সরিয়ে মরি
আপন অসত্যে।
কী যে কান্ড করি গো সেই
ভূতের রাজত্বে।
আমার আমি ধুয়ে মুছে
তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে,
সত্য, তোমায় সত্য হব
বাঁচব তবে -
তোমার মধ্যে মরণ আমার
মরবে কবে।১৫ শ্রাবণ ১৩১৭
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ১৩৭
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
সিংহাসনতলচ্ছায়ে দূরে দূরান্তরে
য়ে রাজ্য জানায় স্পর্ধাভরে
রাজায় প্রজায় ভেদ মাপা,
পায়ের তলায় রাখে সর্বনাশ চাপা।
হতভাগ্য যে রাজ্যের সুবিস্তীর্ণ দৈন্যজীর্ণ প্রাণ
রাজমুকুটের নিত্য করিছে কুৎসিত অপমান।
অসহ্য তাহার দুঃখ তাপ
রাজারে না যদি লাগে,লাগে তারে বিধাতার শাপ।
মহা-ঐশ্বর্যের নিম্নতলে
অর্ধাশন অনশন দাহ করে নিত্য ক্ষুধানলে,
শুষ্কপ্রায় কলুষিত পিপাসার জল,
দেহে নাই শীতের সম্বল,
অবারিত মৃত্যুর দুয়ার,
নিষ্ঠুর তাহার চেয়ে জীবন্মৃত দেহ চর্মসার
শোষণ করিছে দিনরাত
রুদ্ধ আরোগ্যের পথে রোগের অবাধ অভিঘাত--
সেথা মুমূর্ষুর দল রাজত্বের হয় না সহায়,
হয় মহা দায়।
এক পাখা শীর্ণ যে পাখির
ঝড়ের সংকট দিনে রহিবে না স্থির,
সমুচ্চ আকাশ হতে ধুলায় পড়িবে অঙ্গহীন--
আসিবে বিধির কাছে হিসাব-চুকিয়ে-দেওয়া দিন।
অভ্রভেদী ঐশ্বর্যের চূর্ণীভূত পতনের কালে
দরিদ্রের জীর্ণ দশা বাসা তার বাঁধিবে কঙ্কালে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমার এই ছোটো কলসিটা পেতে রাখি
ঝরনাধারার নিচে।
বসে থাকি
কোমরে আঁচল বেঁধে,
সারা সকালবেলা,
শেওলা ঢাকা পিছল পাথরটাতে
পা ঝুলিয়ে।
এক নিমেষেই ঘট যায় ভরে
তার পরে কেবলি তার কানা ছাপিয়ে ওঠে,
জল পড়তে থাকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে
বিনা কাজে বিনা ত্বরায়;
ঐ যে সূর্যের আলোয়
উপচে-পড়া জলের চলে ছুটির খেলা,
আমার খেলা ঐ সঙ্গেই ছলকে ওঠে
মনের ভিতর থেকে।
সবুজ বনের মিনে-করা
উপত্যকার নীল আকাশের পেয়ালা,
তারি পাহাড়-ঘেরা কানা ছাপিয়ে
পড়ছে ঝরঝরানির শব্দ।
ভোরের ঘুমে তার ডাক শুনতে পায়
গাঁয়ের মেয়েরা।
জলের ধ্বনি
বেগনি রঙের বনের সীমানা যায় পেরিয়ে,
নেমে যায় যেখানে ঐ বুনোপাড়ার মানুষ
হাট করতে আসে,
তরাই গ্রামের রাস্তা ছেড়ে
বাঁকে বাঁকে উঠতে থাকে চড়াই পথ বেয়ে,
তার বলদের গলায়
রুনুঝুনু ঘণ্টা বাজে,
তার বলদের পিঠে
শুকনো কাঠের আঁটি বোঝাই-করা।
এমনি করে
প্রথম প্রহর গেল কেটে।
রাঙা ছিল সকালবেলাকার
নতুন রৌদ্রের রঙ,
উঠল সাদা হয়ে।
বক উড়ে চলেছে পাহাড় পেরিয়ে
জলার দিকে,
শঙ্খচিল উড়ছে একলা
ঘন নীলের মধ্যে,ঊর্ধ্বমুখ পর্বতের উধাও চিত্তে
নিঃশব্দ জপমন্ত্রের মতো।
বেলা হল,
ডাক পড়ল ঘরে।
ওরা রাগ করে বললে,
"দেরি করলি কেন?"
চুপ করে থাকি নিরুত্তরে।
ঘট ভরতে দেরি হয় না
সে তো সবাই জানে;
বিনাকাজে উপচে-পড়া-সময় খোওয়ানো,
তার খাপছাড়া কথা ওদের বোঝাবে কে?
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কীর্তি যত গড়ে তুলি
ধূলি তারে করে টানাটানি।
গান যদি রেখে যাই
তাহারে রাখেন বীণাপাণি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
ভিমরুলে মৌমাছিতে হল রেষারেষি,
দুজনায় মহাতর্ক শক্তি কার বেশি।
ভিমরুল কহে, আছে সহস্র প্রমাণ
তোমার দংশন নহে আমার সমান।
মধুকর নিরুত্তর ছলছল-আঁখি—
বনদেবী কহে তারে কানে কানে ডাকি,
কেন বাছা, নতশির! এ কথা নিশ্চিত
বিষে তুমি হার মানো, মধুতে যে জিত। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বর্ষা নেমেছে প্রান্তরে অনিমন্ত্রণে;
ঘনিয়েছে সার-বাঁধা তালের চূড়ায়,
রোমাঞ্চ দিয়েছে বাঁধের কালো জলে।
বর্ষা নামে হৃদয়ের দিগন্তে
যখন পারি তাকে আহ্বান করতে।
কিছুকাল ছিলেম বিদেশে।
সেখানকার শ্রাবণের ভাষা
আমার প্রাণের ভাষার সঙ্গে মেলেনি।
তার অভিষেক হল না
আমার অন্তরপ্রাঙ্গণে।
সজল মেঘ-শ্যামলের
সঞ্চরণ থেকে বঞ্চিত জীবনে
কিছু শীর্ণতা রয়ে গেল
বনস্পতির অঙ্গের আয়তি
ঐ তো দেয় বাড়িয়ে
বছরে বছরে;
তার কাষ্ঠফলকে চক্রচিহ্নে স্বাক্ষর যায় রেখে।
তেমনি ক'রে প্রতি বছরে বর্ষার আনন্দ
আমার মজ্জার মধ্যে রসসম্পদ
কিছু যোগ করে।
প্রতিবার রঙের প্রলেপ লাগে
জীবনের পটভূমিকায়
নিবিড়তর ক'রে;
বছরে বছরে শিল্পকারের
অঙ্গুরি-মুদ্রার গুপ্ত সংকেত
অঙ্কিত হয় অন্তর-ফলকে।
নিরালায় জানলার কাছে বসেছি যখন
নিষ্কর্মা প্রহরগুলো নিঃশব্দ চরণে
কিছু দান রেখে গেছে আমার দেহলিতে;
জীবনের গুপ্ত ধনের ভাণ্ডারে
পুঞ্জিত হয়েছে বিস্মৃত মুহূর্তের সঞ্চয়।
বহু বিচিত্রের কারুকলায় চিত্রিত
এই আমার সমগ্র সত্তা
তার সমস্ত সঞ্চয় সমস্ত পরিচয় নিয়ে
কোনো যুগে কি কোনো দিব্যদৃষ্টির সম্মুখে
পরিপূর্ণ অবারিত হবে?
তার সকল তপস্যায় সে চেয়েছে
গোচরতাকে;
বলেছে, যেমন বলে গোধূলির অস্ফুট তারা,
বলেছে, যেমন বলে নিশান্তের অরুণ আভাস,--
"এস প্রকাশ, এস।"
কবে প্রকাশ হবে পূর্ণ,
আপনি প্রত্যক্ষ হব আপনার আলোতে
বধূ যেমন সত্য ক'রে জানে আপনাকে,
সত্য ক'রে জানায়,
যখন প্রাণে জাগে তার প্রেম,
যখন দুঃখকে পারে সে গলার হার করতে,
যখন দৈন্যকে দেয় সে মহিমা,
যখন মৃত্যুতে ঘটে না তার অসমাপ্তি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আমি চলে গেলে ফেলে রেখে যাব পিছু
চিরকাল মনে রাখিবে, এমন কিছু,
মূঢ়তা করা তা নিয়ে মিথ্যে ভেবে।
ধুলোর খাজনা শোধ করে নেবে ধুলো,
চুকে গিয়ে তবু বাকি রবে যতগুলো
গরজ যাদের তারাই তা খুঁজে নেবে।
আমি শুধু ভাবি, নিজেরে কেমনে ক্ষমি--
পুঞ্জ পুঞ্জ বকুনি উঠেছে জমি,
কোন্ সৎকারে করি তার সদ্গতি।
কবির গর্ব নেই মোর হেন নয়--
কবির লজ্জা পাশাপাশি তারি রয়,
ভারতীর আছে এই দয়া মোর প্রতি।
লিখিতে লিখিতে কেবলি গিয়েছি ছেপে,
সময় রাখি নি ওজন দেখিতে মেপে,
কীর্তি এবং কুকীর্তি গেছে মিশে।
ছাপার কালিতে অস্থায়ী হয় স্থায়ী,
এ অপরাধের জন্যে যে-জন দায়ী
তার বোঝা আজ লঘু করা যায় কিসে।
বিপদ ঘটাতে শুধু নেই ছাপাখানা,
বিদ্যানুরাগী বন্ধু রয়েছে নানা--
আবর্জনারে বর্জন করি যদি
চারি দিক হতে গর্জন করি উঠে,
"ঐতিহাসিক সূত্র দিবে কি টুটে,
যা ঘটেছে তারে রাখা চাই নিরবধি।"
ইতিহাস বুড়ো, বেড়াজাল তার পাতা,
সঙ্গে রয়েছে হিসাবের মোটা খাতা--
ধরা যাহা পড়ে ফর্দে সকলি আছে।
হয় আর নয়, খোঁজ রাখে শুধু এই,
ভালোমন্দর দরদ কিছুই নেই,
মূল্যের ভেদ তুল্য তাহার কাছে।
বিধাতাপুরুষ ঐতিহাসিক হলে
চেহারা লইয়া ঋতুরা পড়িত গোলে,
অঘ্রাণ তবে ফাগুন রহিত ব্যেপে।
পুরানো পাতারা ঝরিতে যাইত ভুলে,
কচি পাতাদের আঁকড়ি রহিত ঝুলে,
পুরাণ ধরিত কাব্যের টুঁটি চেপে।
জোড়হাত করে আমি বলি, "শোনো কথা,
সৃষ্টির কাজে প্রকাশেরি ব্যগ্রতা,
ইতিহাসটারে গোপন করে সে রাখে।
জীবনলক্ষ্মী মেলিয়া রঙের রেখা
ধরার অঙ্গে আঁকিছে পত্রলেখা,
ভূতত্ত্ব তার কঙ্কালে ঢাকা থাকে।
বিশ্বকবির লেখা যত হয় ছাপা
প্রুফ্শিটে তার দশগুণ পড়ে চাপা,
নব এডিশনে নূতন করিয়া তুলে।
দাগি যাহা, যাহে বিকার, যাহাতে ক্ষতি,
মমতামাত্র নাহি তো তাহার প্রতি--
বাঁধা নাহি থাকে ভুলে আর নির্ভুলে।
সৃষ্টির কাজ লুপ্তির সাথে চলে,
ছাপাযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের বলে
এ বিধান যদি পদে পদে পায় বাধা--
জীর্ণ ছিন্ন মলিনের সাথে গোঁজা
কৃপণপাড়ার রাশীকৃত নিয়ে বোঝা
সাহিত্য হবে শুধু কি ধোপার গাধা।
যাহা কিছু লেখে সেরা নাহি হয় সবি,
তা নিয়ে লজ্জা না করুক কোনো কবি--
প্রকৃতির কাজে কত হয় ভুলচুক;
কিন্তু, হেয় যা শ্রেয়ের কোঠায় ফেলে
তারেও রক্ষা করিবার ভূতে পেলে
কালের সভায় কেমনে দেখাবে মুখ।
ভাবী কালে মোর কী দান শ্রদ্ধা পাবে,
খ্যাতিধারা মোর কত দূর চলে যাবে,
সে লাগি চিন্তা করার অর্থ নাহি।
বর্তমানের ভরি অর্ঘ্যের ডালি
অদেয় যা দিনু মাখায়ে ছাপার কালি
তাহারি লাগিয়া মার্জনা আমি চাহি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ওই জানালার কাছে বসে আছে
করতলে রাখি মাথা ।
তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে ,
সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা ।
শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় ,
তার কানে কানে কী যে কহে যায় ,
তাই আধো শুয়ে আধো বসিয়ে
কত ভাবিতেছে আনমনে ।
উড়ে উড়ে যায় চুল ,
কোথা উড়ে উড়ে পড়ে ফুল ,
ঝুরু ঝুরু কাঁপে গাছপালা
সমুখের উপবনে ।
অধরের কোণে হাসিটি
আধখানি মুখ ঢাকিয়া ,
কাননের পানে চেয়ে আছে
আধমুকুলিত আঁখিয়া ।
সুদূর স্বপন ভেসে ভেসে
চোখে এসে যেন লাগিছে ,
ঘুমঘোরময় সুখের আবেশ
প্রাণের কোথায় জাগিছে ।
চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায় ,
উড়ে উড়ে যায় পাখি ,
সারাদিন ধরে বকুলের ফুল
ঝরে পড়ে থাকি থাকি ।
মধুর আলস , মধুর আবেশ ,
মধুর মুখের হাসিটি ,
মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে
বাজিছে মধুর বাঁশিটি ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
বয়স বিংশতি হবে, শীর্ণ তনু তার
বহু বরষের রোগে অস্থিচর্মসার।
হেরি তার উদাসীন হাসিহীন মুখ
মনে হয় সংসারে লেশমাত্র সুখ
পারে না সে কোনোমতে করিতে শোষণ
দিয়ে তার সর্বদেহ সর্বপ্রাণমন।
স্বল্পপ্রাণ শীর্ণ দীর্ঘ জীর্ণ দেহভার
শিশুসম কক্ষে বহি জননী তাহার
আশাহীন দৃঢ়ধৈর্য মৌনম্লানমুখে
প্রতিদিন লয়ে আসে পথের সম্মুখে।
আসে যায় রেলগাড়ি, ধায় লোকজন—
সে চাঞ্চল্যে মুমূর্ষুর অনাসক্ত মন
যদি কিছু ফিরে চায় জগতের পানে,
এইটুকু আশা ধরি মা তাহারে আনে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আমি যখন ছোটো ছিলুম, ছিলুম তখন ছোটো;
আমার ছুটির সঙ্গী ছিল ছবি আঁকার পোটো।
বাড়িটা তার ছিল বুঝি শঙ্খী নদীর মোড়ে,
নাগকন্যা আসত ঘাটে শাঁখের নৌকো চ'ড়ে।
চাঁপার মতো আঙুল দিয়ে বেণীর বাঁধন খুলে
ঘন কালো চুলের গুচ্ছে কী ঢেউ দিত তুলে।
রৌদ্র-আলোয় ঝলক দিয়ে বিন্দুবারির মতো
মাটির 'পরে পড়ত ঝরে মুক্তা মানিক কত।
নাককেশরের তলায় ব'সে পদ্মফুলের কুঁড়ি
দূরের থেকে কে দিত তার পায়ের তলায় ছুঁড়ি।
একদিন সেই নাগকুমারী ব'লে উঠল, কে ও।
জবাব পেলে, দয়া ক'রে আমার বাড়ি যেয়ো।
রাজপ্রাসাদের দেউড়ি সেথায় শ্বেত পাথরে গাঁথা,
মণ্ডপে তার মুক্তাঝালর দোলায় রাজার ছাতা।
ঘোড়সওয়ারি সৈন্য সেথায় চলে পথে পথে,
রক্তবরন ধ্বজা ওড়ে তিরিশঘোড়ার রথে।
আমি থাকি মালঞ্চেতে রাজবাগানের মালী,
সেইখানেতে যূথীর বনে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালি।
রাজকুমারীর তরে সাজাই কনকচাঁপার ডালা,
বেণীর বাঁধন-তরে গাঁথি শ্বেতকরবীর মালা।
মাধবীতে ধরল কুঁড়ি, আর হবে না দেরি--
তুমি যদি এস তবে ফুটবে তোমায় ঘেরি।
উঠবে জেগে রঙনগুচ্ছ পায়ের আসনটিতে,
সামনে তোমার করবে নৃত্য ময়ূর-ময়ূরীতে।
বনের পথে সারি সারি রজনীগন্ধায়
বাতাস দেবে আকুল ক'রে ফাগুনি সন্ধ্যায়।
বলতে বলতে মাথার উপর উড়ল হাঁসের দল,
নাগকুমারী মুখের 'পরে টানল নীলাঞ্চল।
ধীরে ধীরে নদীর 'পরে নামল নীরব পায়ে।
ছায়া হয়ে গেল কখন চাঁপাগাছের ছায়ে।
সন্ধ্যামেঘের সোনার আভা মিলিয়ে গেল জলে।
পাতল রাতি তারা-গাঁথা আসন শূন্যতলে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
সারাদিন গিয়েছিনু বনে
ফুলগুলি তুলেছি যতনে ।
প্রাতে মধুপানে রত
মুগ্ধ মধুপের মতো
গান গাহিয়াছি আনমনে ।
এখন চাহিয়া দেখি , হায় ,
ফুলগুলি শুকায় শুকায় ।
যত চাপিলাম মুঠি
পাপড়িগুলি গেল টুটি —
কান্না ওঠে , গান থেমে যায় ।
কী বলিছ সখা হে আমার —
ফুল নিতে যাব কি আবার ।
থাক্ বঁধু , থাক্ থাক্ ,
আর কেহ যায় যাক ,
আমি তো যাব না কভু আর ।
শ্রান্ত এ হৃদয় অতি দীন ,
পরান হয়েছে বলহীন ।
ফুলগুলি মুঠা ভরি
মুঠায় রহিবে মরি ,
আমি না মরিব যত দিন ।Mrs. Browning (অনূদিত কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
পুষ্প ছিল বৃক্ষশাখে, হে নারী, তোমার অপেক্ষায়
পল্লবচ্ছায়ায়।
তোমার নিশ্বাস তারে লেগে
অন্তরে সে উঠিয়াছে জেগে,
মুখে তব কী দেখিতে পায়।সে কহিছে-- "বহু পূর্বে তুমি আমি কবে একসাথে
আদিম প্রভাতে
প্রথম আলোকে জেগে উঠি
এক ছন্দে বাঁধা রাখী দুটি
দুজনে পরিনু হাতে হাতে।"আধো আলো-অন্ধকারে উড়ে এনু মোরা পাশে পাশে
প্রাণের বাতাসে।
একদিন কবে কোন্ মোহে
দুই পথে চলে গেনু দোঁহে
আমাদের মাটির আবাসে।"বারে বারে বনে বনে জন্ম লই নব নব বেশে
নব নব দেশে।
যুগে যুগে রূপে রূপান্তরে
ফিরিনু সে কী সন্ধান-তরে
সৃজনের নিগূঢ় উদ্দেশে।"অবশেষে দেখিলাম কত জন্ম-পরে নাহি জানি
ওই মুখখানি।
বুঝিলাম আমি আজও আছি
প্রথমের সেই কাছাকাছি,
তুমি পেলে চরমের বাণী।"তোমার আমার দেহে আদিছন্দ আছে অনাবিল
আমাদের মিল।
তোমার আমার মর্মতলে
একটি সে মূল সুর চলে,
প্রবাহ তাহার অন্তঃশীল।"কী যে বলে সেই সুর, কোন্ দিকে তাহার প্রত্যাশা,
জানি নাই ভাষা।
আজ, সখী, বুঝিলাম আমি
সুন্দর আমাতে আছে থামি--
তোমাতে সে হল ভালোবাসা।'
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
নিভৃত যমুনাতীরে বসিয়া রয়েছে কি রে
কমলা নীরদ দুই জনে?
যেন দোঁহে জ্ঞানহত— নীরব চিত্রের মতো
দোঁহে দোঁহা হেরে একমনে।দেখিতে দেখিতে কেন অবশ পাষাণ হেন,
চখের পলক নাহি পড়ে।
শোণিত না চলে বুকে, কথাটি না ফুটে মুখে,
চুলটিও না নড়ে না চড়ে!মুখ ফিরাইল বালা, দেখিল জোছনামালা
খসিয়া পড়িছে নীল যমুনার নীরে—
অস্ফুট কল্লোলস্বর উঠিছে আকাশ-'পর
অর্পিয়া গভীর ভাব রজনী-গভীরে!দেখিছে লুটায় ঢেউ আবার লুটায়,
দিগন্তে খেলায়ে পুন দিগন্তে মিলায়!
দেখে শূন্য নেত্র তুলি— খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি
জোছনা মাখিয়া গায়ে উড়ে উড়ে যায়। একখণ্ড উড়ে যায় আর খণ্ড আসে
ঢাকিয়া চাঁদের ভাতি মলিন করিয়া রাতি
মলিন করিয়া দিয়া সুনীল আকাশে। পাখী এক গেল উড়ে নীল নভোতলে,
ফেনখণ্ড গেল ভেসে নীল নদীজলে,
দিবা ভাবি অতিদূরে আকাশ সুধায় পূরে
ডাকিয়া উঠিল এক প্রমুগ্ধ পাপিয়া।
পিউ, পিউ, শূন্যে ছুটে উচ্চ হতে উচ্চে উঠে—
আকাশ সে সূক্ষ্ম স্বরে উঠিল কাঁপিয়া।বসিয়া গণিল বালা কত ঢেউ করে খেলা,
কত ঢেউ দিগন্তের আকাশে মিলায়,
কত ফেন করি খেলা লুটায়ে চুম্বিছে বেলা,
আবার তরঙ্গে চড়ি সুদূরে পলায়।দেখি দেখি থাকি থাকি আবার ফিরায়ে আঁখি
নীরদের মুখপানে চাহিল সহসা—
আধেক মুদিত নেত্র অবশ পলকপত্র—
অপূর্ব মধুর ভাবে বালিকা বিবশা!নীরদ ক্ষণেক পরে উঠে চমকিয়া,
অপূর্ব স্বপন হতে জাগিল যেন রে।
দূরেতে সরিয়া গিয়া থাকিয়া থাকিয়া
বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে—
‘সে কী কথা শুধাইছ বিপিনরমণী!
ভালবাসি কিনা আমি তোমারে কমলে?
পৃথিবী হাসিয়া যে লো উঠিবে এখনি!
কলঙ্ক রমণী নামে রটিবে তা হলে?ও কথা শুধাতে আছে? ও কথা ভাবিতে আছে!
ও-সব কি স্থান দিতে আছে মনে মনে?
বিজয় তোমার স্বামী বিজয়ের পত্মী তুমি
সরলে! ও কথা তবে শুধাও কেমনে? তবুও শুধাও যদি দিব না উত্তর!—
হৃদয়ে যা লিখা আছে দেখাবো না কারো কাছে,
হৃদয়ে লুকান রবে আমরণ কাল!
রুদ্ধ অগ্নিরাশিসম দহিবে হৃদয় মম
ছিঁড়িয়া খুঁড়িয়া যাবে হৃদিগ্রন্থিজাল।যদি ইচ্ছা হয় তবে লীলা সমাপিয়া ভবে
শোণিতধারায় তাহা করিব নির্বাণ।
নহে অগ্নিশৈলসম জ্বলিবে হৃদয় মম
যত দিন দেহমাঝে রহিবেক প্রাণ!যে তোমারে বন হতে এনেছে উদ্ধারি
যাহারে করেছ তুমি পাণি সমর্পণ
প্রণয় প্রার্থনা তুমি করিও তাহারি—
তারে দিয়ো যাহা তুমি বলিবে আপন!চাই না বাসিতে ভালো, ভালবাসিব না।
দেবতার কাছে এই করিব প্রার্থনা—
বিবাহ করেছ যারে সুখে থাক লয়ে তারে
বিধাতা মিটান তব সুখের কামনা!’‘বিবাহ কাহারে বলে জানি না তা আমি’
কহিল কমলা তবে বিপিনকামিনী,
“কারে বলে পত্মী আর কারে বলে স্বামী,
কারে বলে ভালবাসা আজিও শিখি নি।এইটুকু জানি শুধু এইটুকু জানি,
দেখিবারে আঁখি মোর ভালবাসে যারে
শুনিতে বাসি গো ভাল যার সুধাবাণী—
শুনিব তাহার কথা দেখিব তাহারে!ইহাতে পৃথিবী যদি কলঙ্ক রটায়
ইহাতে হাসিয়া যদি উঠে সব ধরা
বল গো নীরদ আমি কি করিব তার?
রটায়ে কলঙ্ক তবে হাসুক না তারা।বিবাহ কাহারে বলে জানিতে চাহি না—
তাহারে বাসিব ভাল, ভালবাসি যারে!
তাহারই ভালবাসা করিব কামনা
যে মোরে বাসে না ভাল, ভালবাসি যারে”।নীরদ অবাক রহি কিছুক্ষণ পরে
বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে,
“সে কী কথা বল বালা, যে জন তোমারে
বিজন কানন হতে করিয়া উদ্ধার
আনিল, রাখিল যত্নে সুখের আগারে—
সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার?হৃদয় সঁপেছে যে লো তোমারে নবীনা
সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার?”
কমলা কহিল ধীরে, “আমি তা জানি না”।
নীরদ সমুচ্চ স্বরে কহিল আবার—‘ তবে যা লো দুশ্চারিণী! যেথা ইচ্ছা তোর
কর্ তাই যাহা তোর কহিবে হৃদয়—
কিন্তু যত দিন দেহে প্রাণ রবে মোর—
তোর এ প্রণয়ে আমি দিব না প্রশ্রয়!আর তুই পাইবি না দেখিতে আমারে
জ্বলিব যদিন আমি জীবন-অনলে—
স্বরগে বাসিব ভাল যা খুসী যাহারে
প্রণয়ে সেথায় যদি পাপ নাহি বলে!কেন বল্ পাগলিনী! ভালবাসি মোরে
অনলে জ্বালিতে চাস্ এ জীবন ভোরে!
বিধাতা যে কি আমার লিখেছে কপালে!
যে গাছে রোপিতে যাই শুকায় সমূলে।'ভর্ৎসনা করিবে ছিল নীরদের মনে—
আদরেতে স্বর কিন্তু হয়ে এল নত!
কমলা নয়নজল ভরিয়া নয়নে
মুখপানে চাহি রয় পাগলের মতো!নীরদ উদ্গামী অশ্রু করি নিবারিত
সবেগে সেখান হতে করিল প্রয়াণ।
উচ্ছ্বাসে কমলা বালা উন্মত্ত চিত
অঞ্চল করিয়া সিক্ত মুছিল নয়ান। (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
অনুগ্রহ দুঃখ করে, দিই, নাহি পাই।
করুণা কহেন, আমি দিই, নাহি চাই। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
গায়ে আমার পুলক লাগে,
চোখে ঘনায় ঘোর,
হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে
রাঙা রাখীর ডোর।
আজিকে এই আকাশতলে
জলে স্থলে ফুলে ফলে
কেমন করে মনোহরণ
ছড়ালে মন মোর।কেমন খেলা হল আমার
আজি তোমার সনে।
পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই
ভেবে না পাই মনে।
আনন্দ আজ কিসের ছলে
কাঁদিতে চায় নয়নজলে,
বিরহ আজ মধুর হয়ে
করেছে প্রাণ ভোর।শিলাইদহ, ২৫ আশ্বিন, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কাছের রাতি দেখিতে পাই
মানা।
দূরের চাঁদ চিরদিনের
জানা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি—
বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।
শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর
মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর
বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।
নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে
নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়
নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্ ধরায়।
সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন
আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।
দিক্-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি
দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি।
অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,
আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি।
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.