poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
মাঠের শেষে গ্রাম,
সাতপুরিয়া নাম।
চাষের তেমন সুবিধা নেই কৃপণ মাটির গুণে,
পঁয়ত্রিশ ঘর তাঁতির বসত, ব্যাবসা জাজিম বুনে।
নদীর ধারে খুঁড়ে খুঁড়ে পলির মাটি খুঁজে
গৃহস্থেরা ফসল করে কাঁকুড়ে তরমুজে
ঐখানেতে বালির ডাঙা, মাঠ করছে ধু ধু,
ঢিবির 'পরে বসে আছে গাঁয়ের মোড়াল বুধু।
সামনে মাঠে ছাগল চরছে ক'টা--
শুকনো জমি, নেইকো ঘাসের ঘটা।
কী যে ওরা পাচ্ছে খেতে ওরাই সেটা জানে,
ছাগল ব'লেই বেঁচে আছে প্রাণে।
আকাশে আজ হিমের আভাস, ফ্যাকাশে তার নীল,
অনেক দূরে যাচ্ছে উড়ে চিল।
হেমন্তের এই রোদ্দুরটা লাগছে অতি মিঠে,
ছোটো নাতি মোগ্লুটা তার জড়িয়ে আছে পিঠে।
স্পর্শপুলক লাগছে দেহে, মনে লাগছে ভয়--
বেঁচে থাকলে হয়।
গুটি তিনটি মরে শেষে ঐটি সাধের নাতি,
রাত্রিদিনের সাথি!
গোরুর গাড়ির ব্যাবসা বুধুর চলছে হেসে-খেলেই,
নাড়ি ছেঁড়ে এক পয়সা খরচ করতে গেলেই।
কৃপণ ব'লে গ্রামে গ্রামে বুধুর নিন্দে রটে,
সকালে কেউ নাম করে না উপোস পাছে ঘটে।
ওর যে কৃপণতা সে তো ঢেলে দেবার তরে,
যত কিছু জমাচ্ছে সব মোগ্লু নাতির 'পরে।
পয়সাটা তার বুকের রক্ত, কারণটা তার ঐ--
এক পয়সা আর কারো নয় ঐ ছেলেটার বই।
না খেয়ে, না প'রে, নিজের শোষণ ক'রে প্রাণ
যেটুকু রয় সেইটুকু ওর প্রতি দিনের দান।
দেব্তা পাছে ঈর্ষাভরে নেয় কেড়ে মোগ্লুকে,
আঁকড়ে রাখে বুকে।
এখনো তাই নাম দেয়নি, ডাক নামেতেই ডাকে,
নাম ভাঁড়িয়ে ফাঁকি দেবে নিষ্ঠুর দেব্তাকে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গাথাকাব্য
|
ত্রিলোকেশ্বরের মন্দির।
লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বকর্মা তার ভিত-পত্তন করেছিলেন
কোন্ মান্ধাতার আমলে,
স্বয়ং হনুমান এনেছিলেন তার পাথর বহন করে।
ইতিহাসের পণ্ডিত বলেন, এ মন্দির কিরাত জাতের গড়া,
এ দেবতা কিরাতের।
একদা যখন ক্ষত্রিয় রাজা জয় করলেন দেশ
দেউলের আঙিনা পূজারিদের রক্তে গেল ভেসে,
দেবতা রক্ষা পেলেন নতুন নামে নতুন পূজাবিধির আড়ালে—
হাজার বৎসরের প্রাচীন ভক্তিধারার স্রোত গেল ফিরে।
কিরাত আজ অস্পৃশ্য, এ মন্দিরে তার প্রবেশপথ লুপ্ত।
কিরাত থাকে সমাজের বাইরে,
নদীর পূর্বপারে তার পাড়া।
সে ভক্ত, আজ তার মন্দির নেই, তার গান আছে।
নিপুণ তার হাত, অভ্রান্ত তার দৃষ্টি।
সে জানে কী করে পাথরের উপর পাথর বাঁধে,
কী করে পিতলের উপর রুপোর ফুল তোলা যায় —
কৃষ্ণশিলায় মূর্তি গড়বার ছন্দটা কী।
রাজশাসন তার নয়, অস্ত্র তার নিয়েছে কেড়ে ,
বেশে বাসে ব্যবহারে সম্মানের চিহ্ন হতে সে বর্জিত,
বঞ্চিত সে পুঁথির বিদ্যায়।
ত্রিলোকেশ্বর মন্দিরের স্বর্ণচূড়া পশ্চিম দিগন্তে যায় দেখা,
চিনতে পারে নিজেদেরই মনের আকল্প,
বহু দূরের থেকে প্রণাম করে।
কার্তিক পূর্ণিমা, পূজার উৎসব।
মঞ্চের উপরে বাজছে বাঁশি মৃদঙ্গ করতাল,
মাঠ জুড়ে কানাতের পর কানাত,
মাঝে মাঝে উঠেছে ধ্বজা।
পথের দুই ধারে ব্যাপারীদের পসরা —তামার পাত্র, রুপোর অলংকার, দেবমূর্তির পট, রেশমের কাপড়;
ছেলেদের খেলার জন্যে কাঠের ডমরু, মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি;
অর্ঘ্যের উপকরণ, ফল মালা ধূপ বাতি, ঘড়া ঘড়া তীর্থবারি।
বাজিকর তারস্বরে প্রলাপবাক্যে দেখাচ্ছে বাজি,
কথক পড়ছে রামায়ণকথা।
উজ্জ্বলবেশে সশস্ত্র প্রহরী ঘুরে বেড়ায় ঘোড়ায় চড়ে;
রাজ-অমাত্য হাতির উপর হাওদায়,
সম্মুখে বেজে চলেছে শিঙা।
কিংখাবে ঢাকা পাল্কিতে ধনীঘরের গৃহিণী,
আগে পিছে কিংকরের দল।
সন্ন্যাসীর ভিড় পঞ্চবটের তলায় —
নগ্ন, জটাধারী, ছাইমাখা;
মেয়েরা পায়ের কাছে ভোগ রেখে যায় —
ফল, দুধ, মিষ্টান্ন, ঘি, আতপতণ্ডুল।
থেকে থেকে আকাশে উঠছে চীৎকারধ্বনি
‘জয় ত্রিলোকেশ্বরের জয়'।
কাল আসবে শুভলগ্নে রাজার প্রথম পূজা,
স্বয়ং আসবেন মহারাজা রাজহস্তীতে চড়ে।
তাঁর আগমন-পথের দুই ধারে
সারি সারি কলার গাছে ফুলের মালা,
মঙ্গলঘটে আম্রপল্লব।
আর ক্ষণে ক্ষণে পথের ধুলায় সেচন করছে গন্ধবারি।
শুক্লত্রয়োদশীর রাত।
মন্দিরে প্রথম প্রহরের শঙ্খ ঘণ্টা ভেরী পটহ থেমেছে।
আজ চাঁদের উপরে একটা ঘোলা আবরণ,
জ্যোৎস্না আজ ঝাপসা —
যেন মূর্ছার ঘোর লাগল।
বাতাস রুদ্ধ —
ধোঁয়া জমে আছে আকাশে,
গাছপালাগুলো যেন শঙ্কায় আড়ষ্ট। কুকুর অকারণে আর্তনাদ করছে,
ঘোড়াগুলো কান খাড়া করে উঠছে ডেকে
কোন্ অলক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ গম্ভীর ভীষণ শব্দ শোনা গেল মাটির নীচে —
পাতালে দানবেরা যেন রণদামামা বাজিয়ে দিলে —
গুরু-গুরু গুরু-গুরু।
মন্দিরে শঙ্খ ঘণ্টা বাজতে লাগল প্রবল শব্দে।
হাতি বাঁধা ছিল,
তারা বন্ধন ছিঁড়ে গর্জন করতে করতে
ছুটল চার দিকে
যেন ঘূর্ণি-ঝড়ের মেঘ।
তুফান উঠল মাটিতে —
ছুটল উট মহিষ গোরু ছাগল ভেড়া
ঊর্ধ্বশ্বাসে পালে পালে।
হাজার হাজার দিশাহারা লোক
আর্তস্বরে ছুটে বেড়ায় —
চোখে তাদের ধাঁধা লাগে,
আত্মপরের ভেদ হারিয়ে কে কাকে দেয় দ'লে।
মাটি ফেটে ফেটে ওঠে ধোঁয়া, ওঠে গরম জল —
ভীম-সরোবরের দিঘি বালির নীচে গেল শুষে।
মন্দিরের চূড়ায় বাঁধা বড়ো ঘণ্টা দুলতে দুলতে
বাজতে লাগল ঢং ঢং।
আচম্কা ধ্বনি থামল একটা ভেঙে-পড়ার শব্দে।
পৃথিবী যখন স্তব্ধ হল
পূর্ণপ্রায় চাঁদ তখন হেলেছে পশ্চিমের দিকে।
আকাশে উঠছে জ্বলে-ওঠা কানাতগুলোর ধোঁয়ার কুণ্ডলী,
জ্যোৎস্নাকে যেন অজগর সাপে জড়িয়েছে।
পরদিন আত্মীয়দের বিলাপে দিগ্বিদিক যখন শোকার্ত
তখন রাজসৈনিকদল মন্দির ঘিরে দাঁড়ালো,
পাছে অশুচিতার কারণ ঘটে।
রাজমন্ত্রী এল, দৈবজ্ঞ এল, স্মার্ত পণ্ডিত এল।দেখলে বাহিরের প্রাচীর ধূলিসাৎ।
দেবতার বেদীর উপরের ছাদ পড়েছে ভেঙে।
পণ্ডিত বললে, সংস্কার করা চাই আগামী পূর্ণিমার পূর্বেই,
নইলে দেবতা পরিহার করবেন তাঁর মূর্তিকে।
রাজা বললেন, ‘সংস্কার করো। '
মন্ত্রী বললেন, ‘ওই কিরাতরা ছাড়া কে করবে পাথরের কাজ।
ওদের দৃষ্টিকলুষ থেকে দেবতাকে রক্ষা করব কী উপায়ে,
কী হবে মন্দিরসংস্কারে যদি মলিন হয় দেবতার অঙ্গমহিমা। '
কিরাতদলপতি মাধবকে রাজা আনলেন ডেকে।
বৃদ্ধ মাধব, শুক্লকেশের উপর নির্মল সাদা চাদর জড়ানো —
পরিধানে পীতধড়া, তাম্রবর্ণ দেহ কটি পর্যন্ত অনাবৃত,
দুই চক্ষু সকরুণ নম্রতায় পূর্ণ।
সাবধানে রাজার পায়ের কাছে রাখলে একমুঠো কুন্দফুল,
প্রণাম করলে স্পর্শ বাঁচিয়ে।
রাজা বললেন, ‘তোমরা না হলে দেবালয়-সংস্কার হয় না। '
‘ আমাদের ‘পরে দেবতার ওই কৃপা'
এই ব'লে দেবতার উদ্দেশে মাধব প্রণাম জানালে।
নৃপতি নৃসিংহরায় বললেন, ‘চোখ বেঁধে কাজ করা চাই,
দেবমূর্তির উপর দৃষ্টি না পড়ে। পারবে?'
মাধব বললে, ‘অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে কাজ করিয়ে নেবেন অন্তর্যামী।
যতক্ষণ কাজ চলবে, চোখ খুলব না। '
বাহিরে কাজ করে কিরাতের দল,
মন্দিরের ভিতরে কাজ করে মাধব,
তার দুই চক্ষু পাকে পাকে কালো কাপড়ে বাঁধা।
দিনরাত সে মন্দিরের বাহিরে যায় না —
ধ্যান করে, গান গায়, আর তার আঙুল চলতে থাকে।
মন্ত্রী এসে বলে, ‘ত্বরা করো, ত্বরা করো —
তিথির পরে তিথি যায়, কবে লগ্ন হবে উত্তীর্ণ।’
মাধব জোড়হাতে বলে, যাঁর কাজ তাঁরই নিজের আছে ত্বরা,
আমি তো উপলক্ষ।’ অমাবস্যা পার হয়ে শুক্লপক্ষ এল আবার।
অন্ধমাধব আঙুলের স্পর্শ দিয়ে পাথরের সঙ্গে কথা কয়,
পাথর তার সাড়া দিতে থাকে।
কাছে দাঁড়িয়ে থাকে প্রহরী।
পাছে মাধব চোখের বাঁধন খোলে।
পণ্ডিত এসে বললে, ‘একাদশীর রাত্রে প্রথম পূজার শুভক্ষণ।
কাজ কি শেষ হবে তার পূর্বে। '
মাধব প্রণাম করে বললে, ‘আমি কে যে উত্তর দেব।
কৃপা যখন হবে সংবাদ পাঠাব যথাসময়ে,
তার আগে এলে ব্যাঘাত হবে, বিলম্ব ঘটবে। '
ষষ্ঠী গেল, সপ্তমী পেরোল —
মন্দিরের দ্বার দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে
মাধবের শুক্লকেশে।
সূর্য অস্ত গেল। পাণ্ডুর আকাশে একাদশীর চাঁদ।
মাধব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে,
‘যাও প্রহরী, সংবাদ দিয়ে এসো গে
মাধবের কাজ শেষ হল আজ।
লগ্ন যেন বয়ে না যায়। '
প্রহরী গেল।
মাধব খুলে ফেললে চোখের বন্ধন।
মুক্ত দ্বার দিয়ে পড়েছে একাদশী-চাঁদের পূর্ণ আলো
দেবমূর্তির উপরে।
মাধব হাঁটু গেড়ে বসল দুই হাত জোড় করে,
একদৃষ্টে চেয়ে রইল দেবতার মুখে,
দুই চোখে বইল জলের ধারা।
আজ হাজার বছরের ক্ষুধিত দেখা দেবতার সঙ্গে ভক্তের।
রাজা প্রবেশ করলেন মন্দিরে।
তখন মাধবের মাথা নত বেদীমূলে।
রাজার তলোয়ারে মুহূর্তে ছিন্ন হল সেই মাথা।
দেবতার পায়ে এই প্রথম পূজা, এই শেষ প্রণাম।কাব্যগ্রন্থ - পুনশ্চ
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে।
সকল দ্বন্দ্ব ঘুচবে আমার তবে। আর-যাহারা আসে আমার ঘরে
ভয় দেখায়ে তারা শাসন করে,
দুরন্ত মন দুয়ার দিয়ে থাকে,
হার মানে না, ফিরায়ে দেয় সবে।সে এলে সব আগল যাবে ছুটে,
সে এলে সব বাঁধন যাবে টুটে,
ঘরে তখন রাখবে কে আর ধরে
তার ডাকে যে সাড়া দিতেই হবে। আসে যখন, একলা আসে চলে,
গলায় তাহার ফুলের মালা দোলে,
সেই মালাতে বাঁধবে যখন টেনে
হৃদয় আমার নেরব হয়ে রবে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
মানসকৈলাসশৃঙ্গে নির্জন ভুবনে
ছিলে তুমি মহেশের মন্দিরপ্রাঙ্গণে
তাঁহার আপন কবি, কবি কালিদাস।
নীলকণ্ঠদ্যুতিসম স্নিগ্ধনীলভাস
চিরস্থির আষাঢ়ের ঘনমেঘদলে,
জ্যোতির্ময় সপ্তর্ষির তপোলোকতলে।
আজিও মানসধামে করিছ বসতি;
চিরদিন রবে সেথা, ওহে কবিপতি,
শংকরচরিত গানে ভরিয়া ভুবন।—
মাঝে হতে উজ্জয়িনী-রাজনিকেতন,
নৃপতি বিক্রমাদিত্য, নবরত্নসভা,
কোথা হতে দেখা দিল স্বপ্ন ক্ষণপ্রভা।
সে স্বপ্ন মিলায়ে গেল, সে বিপুলচ্ছবি,
রহিলে মানসলোকে তুমি চিরকবি। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার মঙ্গলকার্য
তব ভূত্য-পানে
অযাচিত যে প্রেমেরে
ডাক দিয়ে আনে,
যে অচিন্ত্য শক্তি দেয়,
যে অক্লান্ত প্রাণ,
সে তাহার প্রাপ্য নহে—
সে তোমারি দান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস।
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,
পাগল ওগো, ধরায় আস।
এই অকুল সংসারে
দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
ঘোরবিপদ-মাঝে
কোন্ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস।
তুমি কাহার সন্ধানে
সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে।
এমন ব্যাকুল করে
কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস।
তোমার ভাবনা কিছু নাই--
কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই।
তুমি মরণ ভুলে
কোন্ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।
১৭ পৌষ, ১৩১৬
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে!
ছেলেবেলা ওই নামে আমায় ডাকিত–
তাড়াতাড়ি খেলাধুলা সব ত্যাগ করে
অমনি যেতেম ছুটে,
কোলে পড়িতাম লুটে।
রাশি-করা ফুলগুলি পড়িয়া থাকিত।
নীরব হইয়া গেছে যে স্নেহের স্বর–
কেবল স্তব্ধতা বাজে
আজি এ শ্মশান-মাঝে
কেবল ডাকি গো আমি “ঈশ্বর ঈশ্বর’!
মৃত কণ্ঠে আর যাহা শুনিতে না পাই
সে নাম তোমারি মুখে শুনিবারে চাই।
হাঁ সখা, ডাকিয়ো তুমি সেই নাম ধরে–
ডাকিলেই সাড়া পাবে,
কিছু না বিলম্ব হবে,
তখনি কাছেতে যাব সব ত্যাগ করে।Mrs. Browning (অনূদিত কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নদীর পালিত এই জীবন আমার।
নানা গিরিশিখরের দান
নাড়ীতে নাড়ীতে তার বহে,
নানা পলিমাটি দিয়ে ক্ষেত্র তার হয়েছে রচিত,
প্রাণের রহস্যরস নানা দিক হতে
শস্যে শস্যে লভিল সঞ্চার।
পূর্বপশ্চিমের নানা গীতস্রোতজালে
ঘেরা তার স্বপ্ন জাগরণ।
যে নদী বিশ্বের দূতী
দূরকে নিকটে আনে,
অজানার অভ্যর্থনা নিয়ে আসে ঘরের দুয়ারে।
সে আমার রচেছিল জন্মদিন--
চিরদিন তার স্রোতে
বাঁধন-বাহিরে মোর চলমান বাসা
ভেসে চলে তীর হতে তীরে।
আমি ব্রাত্য, আমি পথচারী,
অবারিত আতিথ্যের অন্নে পূর্ণ হয়ে ওঠে
বারে বারে নির্বিচারে মোর জন্মদিবসের থালি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
রৌদ্রতাপ ঝাঁঝাঁ করে
জনহীন বেলা দুপহরে।
শূন্য চৌকির পানে চাহি,
সেথায় সান্ত্বনালেশ নাহি।
বুক ভরা তার
হতাশের ভাষা যেন করে হাহাকার।
শূন্যতার বাণী ওঠে করুণায় ভরা,
মর্ম তার নাহি যায় ধরা।
কুকুর মনিবহারা যেমন করুণ চোখে চায়—
অবুঝ মনের ব্যথা করে হায়-হায়—
কী হল যে, কেন হল কিছু নাহি বোঝে,
দিনরাত ব্যর্থ চোখে চারি দিকে খোঁজে।
চৌকির ভাষা যেন আরো বেশি করুণ কাতর,
শূন্যতার মূক ব্যথা ব্যাপ্ত করে প্রিয়হীন ঘর। (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আজি কোন্ ধন হতে বিশ্ব আমারে
কোন্ জনে করে বঞ্চিত
তব চরণকমলরতনরেণুকা
অন্তরে আছে সঞ্চিত ।
কত নিঠুর কঠোর দরশে ঘরষে
মর্মমাঝারে শল্য বরষে
তবু প্রাণমন পীযূষপরশে
পলে পলে পুলকাঞ্চিত !
আজি কিসের পিপাসা মিটিল না , ওগো
পরম - পরান - বল্লভ ।
চিতে চিরসুধা করে সঞ্চার , তব
সকরুণ করপল্লব ।
হেথা কত দিনে রাতে অপমানঘাতে
আছি নতশির গঞ্জিত ,
তবু চিত্তললাট তোমারি স্বকরে
রয়েছে তিলকরঞ্জিত ।
হেথা কে আমার কানে কঠিন বচনে
বাজায় বিরোধঝঞ্ঝনা !
প্রাণে দিবসরজনী উঠিতেছে ধ্বনি
তোমারি বীণার গুঞ্জনা ।
নাথ , যার যাহা আছে তার তাই থাক্ ,
আমি থাকি চিরলাঞ্ছিত ।
শুধু তুমি এ জীবনে নয়নে নয়নে
থাকো থাকো চিরবাঞ্ছিত । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আজ গড়ি খেলাঘর,
কাল তারে ভুলি—
ধূলিতে যে লীলা তারে
মুছে দেয় ধূলি।(স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কালো মেঘ আকাশের তারাদের ঢেকে
মনে ভাবে, জিত হল তার।
মেঘ কোথা মিলে যায় চিহ্ন নাহি রেখে,
তারাগুলি রহে নির্বিকার। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
হে প্রেয়সী, হে শ্রেয়সী, হে বীণাবাদিনী,
আজি মোর চিত্তপদ্মে বসি একাকিনী
ঢালিতেছ স্বর্গসুধা; মাথার উপর
সদ্যস্নাত বরষার স্বচ্ছ নীলাম্বর
রাখিয়াছে স্নিগ্ধহস্ত আশীর্বাদে ভরা;
সম্মুখেতে শস্যপূর্ণ হিল্লোলিত ধরা
বুলায় নয়নে মোর অমৃতচুম্বন;
উতলা বাতাস আসি করে আলিঙ্গন;
অন্তরে সঞ্চার করি আনন্দের বেগ
বহে যায় ভরা নদী; মধ্যাহ্নের মেঘ
স্বপ্নমালা গাঁথি দেয় দিগন্তের ভালে।
তুমি আজি মুগ্ধমুখী আমারে ভুলালে,
ভুলাইলে সংসারের শতলক্ষ কথা—
বীণাস্বরে রচি দিলে মহা নীরবতা। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বিশ্বের হৃদয়-মাঝে
কবি আছে সে কে।
কুসুমের লেখা তার
বারবার লেখে—
অতৃপ্ত হৃদয়ে তাহা
বারবার মোছে,
অশান্ত প্রকাশব্যথা
কিছুতে না ঘোচে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার,
যূথভ্রষ্ট বাণবিদ্ধ হরিণী আমার,
এইখানে বিরাজিছে সেই চির হাসি,
আঁধারিতে পারিবে না তাহা মেঘরাশি।
এই হস্ত এ হৃদয় চিরকাল মতো
তোমার, তোমারি কাজে রহিবে গো রত!
কিসের সে চিরস্থায়ী ভালোবাসা তবে,
গৌরবে কলঙ্কে যাহা সমান না রবে?
জানি না, জানিতে আমি চাহি না, চাহি না,
ও হৃদয়ে এক তিল দোষ আছে কিনা,
ভালোবাসি তোমারেই এই শুধু জানি,
তাই হলে হল, আর কিছু নাহি মানি।
দেবতা সুখের দিনে বলেছ আমায়,
বিপদে দেবতা সম রক্ষিব তোমায়,
অগ্নিময় পথ দিয়া যাব তব সাথে,
রক্ষিব, মরিব কিংবা তোমারি পশ্চাতে।Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ,
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক।
তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া
কোলের 'পরে নিই তাহারে তুলে।আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে--
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি,
মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক--
তাদের বনের অনেক মধুমাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক।
তাদের ঘাটে পূজার জবামালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে,
তাদের পাড়ার কুসুম-ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে।আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে--
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।আমাদের এই গ্রামের গলি-'পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন,
তাদের খেতে যখন তিসি ধরে
মোদের খেতে তখন ফোটে শণ।
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে।
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণধারা,
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে।আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে--
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।কাব্যগ্রন্থ - ক্ষণিকা
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি,
ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে–
এবার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি
অতি নিবিড় ঘন তিমিরতলে
স্বপন দিয়ে গোপনে ধীরে ধীরে
যেমন করে ঢেকেছ ধরণীরে,
যেমন করে ঢেকেছ তুমি মুদিয়া-পড়া আঁখি,
ঢেকেছ তুমি রাতের শতদলে।পাথেয় যার ফুরায়ে আসে পথের মাঝখানে,
ক্ষতির রেখা উঠেছে যার ফুটে,
বসনভূষা মলিন হল ধুলায় অপমানে
শকতি যার পড়িতে চায় টুটে–
ঢাকিয়া দিক তাহার ক্ষতব্যথা
করুণাঘন গভীর গোপনতা,
ঘুচায়ে লাজ ফুটাও তারে নবীন উষাপানে
জুড়ায়ে তারে আঁধার সুধাজলে।কলিকাতা, ২৯ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব মথুরাপুর যব যায়
করল বিষম পণ মানিনী রাধা রোয়বে না সো, না দিবে বাধা,
কঠিন‐হিয়া সই হাসয়ি হাসয়ি শ্যামক করব বিদায়।
মৃদু মৃদু গমনে আওল মাধা, বয়ন‐পান তছু চাহল রাধা,
চাহয়ি রহল স চাহয়ি রহল— দণ্ড দণ্ড, সখি, চাহয়ি রহল—
মন্দ মন্দ, সখি— নয়নে বহল বিন্দু বিন্দু জলধার।
মৃদু মৃদু হাসে বৈঠল পাশে, কহল শ্যাম কত মৃদু মধু ভাষে।
টুটয়ি গইল পণ, টুটইল মান, গদগদ আকুল ব্যাকুল প্রাণ,
ফুকরয়ি উছসয়ি কাঁদিল রাধা— গদগদ ভাষ নিকাশল আধা—
শ্যামক চরণে বাহু পসারি কহল, শ্যাম রে, শ্যাম হমারি,
রহ তুঁহু, রহ তুঁহু, বঁধু গো রহ তুঁহু, অনুখন সাথ সাথ রে রহ পঁহু—
তুঁহু বিনে মাধব, বল্লভ, বান্ধব, আছয় কোন হমার!
পড়ল ভূমি‐’পর শ্যামচরণ ধরি, রাখল মুখ তছু শ্যামচরণ‐’পরি,
উছসি উছসি কত কাঁদয়ি কাঁদয়ি রজনি করল প্রভাত।
মাধব বৈসল, মৃদু মধু হাসল
কত অশোয়াস‐বচন মিঠ ভাষল, ধরইল বালিক হাত।
সখি লো, সখি লো, বোল ত সখি লো, যত দুখ পাওল রাধা,
নিঠুর শ্যাম কিয়ে আপন মনমে পাওল তছু কছু আধা।
হাসয়ি হাসয়ি নিকটে আসয়ি বহুত স প্রবোধ দেল,
হাসয়ি হাসয়ি পলটয়ি চাহয়ি দূর দূর চলি গেল।
অব সো মথুরাপুরক পন্থমে ইঁহ যব রোয়ত রাধা।
মরমে কি লাগল তিলভর বেদন, চরণে কি তিলভর বাধা।
বরখি আঁখিজল ভানু কহে, অতি দুখের জীবন ভাই।
হাসিবার তর সঙ্গ মিলে বহু কাঁদিবার কো নাই।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বাতাসে নিবিলে দীপ
দেখা যায় তারা,
আঁধারেও পাই তবে
পথের কিনারা।
সুখ-অবসানে আসে
সম্ভোগের সীমা,
দুঃখ তবে এনে দেয়
শান্তির মহিমা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কাঁচড়াপাড়াতে এক
ছিল রাজপুত্তুর,
রাজকন্যারে লিখে
পায় না সে উত্তর।
টিকিটের দাম দিয়ে
রাজ্য বিকাবে কি এ,
রেগেমেগে শেষকালে
বলে ওঠে–দুত্তোর!
ডাকবাবুটিকে দিল
মুখে ডালকুত্তোর। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মেঘের আড়ালে বেলা কখন যে যায়।
বৃষ্টি পড়ে সারাদিন থামিতে না চায় ।
আর্দ্র - পাখা পাখিগুলি গীতগান গেছে ভুলি ,
নিস্তব্ধে ভিজিছে তরুলতা ।
বসিয়া আঁধার ঘরে বরষার ঝরঝরে
মনে পড়ে কত উপকথা ।
কভু মনে লয় হেন এ - সব কাহিনী যেন
সত্য ছিল নবীন জগতে ।
উড়ন্ত মেঘের মতো ঘটনা ঘটিত কত ,
সংসার উড়িত মনোরথে ।
রাজপুত্র অবহেলে কোন্ দেশে যেত চলে
কত নদী কত সিন্ধু - পার ।
সরোবর - ঘাট আলা, মণি হাতে নাগবালা
বসিয়া বাঁধিত কেশভার ।
সিন্ধুতীরে কত দূরে কোন্ রাক্ষসের পুরে
ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারি ।
হাসি তার মণিকণা কেহ তাহা দেখিত না ,
মুকুতা ঢালিত অশ্রুবারি ।
সাত ভাই একত্তরে চাঁপা হয়ে ফুটিত রে ,
এক বোন ফুটিত পারুল ।
সম্ভব কি অসম্ভব একত্রে আছিল সব —
দুটি ভাই সত্য আর ভুল ।
বিশ্ব নাহি ছিল বাঁধা, না ছিল কঠিন বাধা ,
নাহি ছিল বিধির বিধান ,
হাসিকান্না লঘুকায়া শরতের আলোছায়া ,
কেবল সে ছুঁয়ে যেত প্রাণ !
আজি ফুরায়েছে বেলা , জগতের ছেলেখেলা
গেছে আলো - আঁধারের দিন ।
আর তো নাই রে ছুটি , মেঘরাজ্য গেছে টুটি ,
পদে পদে নিয়ম - অধীন ।
মধ্যাহ্নে রবির দাপে বাহিরে কে রবে তাপে,
আলয় গড়িতে সবে চায় ।
যবে হায় প্রাণপণ করে তাহা সমাপন
খেলারই মতন ভেঙে যায় । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক্ পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে---
দেবতা নাই ঘরে।তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ---
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বারো মাস।
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে;
তাঁরই মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয় রে ধুলার 'পরে।মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,
মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন প'রে
বাঁধা সবার কাছে।
রাখো রে ধ্যান, থাক্ রে ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি,
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে
ঘর্ম পড়ুক ঝরে।কয়া।গোরাই
২৭ আষাঢ় ১৩১৭
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
তোমার আনন্দগানে আমি দিব সুর
যাহা জানি দু-একটি প্রীতি-সুমধুর
অন্তরের ছন্দোগাথা; দুঃখের ক্রন্দনে
বাজিবে আমার কণ্ঠ বিষাদবিধুর
তোমার কণ্ঠের সনে; কুসুমে চন্দনে
তোমারে পূজিব আমি; পরাব সিন্দূর
তোমার সীমন্তে ভালে; বিচিত্র বন্ধনে
তোমারে বাঁধিব আমি, প্রমোদসিন্ধুর
তরঙ্গেতে দিব দোলা নব ছন্দে তানে।
মানব-আত্মার গর্ব আর নাহি মোর,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর।
জন্মেছি যে মর্ত-কোলে ঘৃণা করি তারে
ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
যত বড়ো হোক ইন্দ্ৰধনু সে
সুদূর-আকাশে-আঁকা,
অামি ভালোবাসি, মোর ধরণীর
প্রজাপতিটির পাখা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
রঙ্গমঞ্চে একে একে নিবে গেল যবে দীপশিখা
রিক্ত হোলো সভাতল, আঁধারের মসী-অবলেপে
স্বপ্নচ্ছবি-মুছেযাওয়া সুষুপ্তির মতো শান্ত হোলো
চিত্ত মোর নিঃশব্দের তর্জনী সংকেতে। এতকাল
যে সাজে রচিয়াছিনু আপনার নাট্য পরিচয়
প্রথম উঠিতে যবনিকা, সেই সাজ মুহূর্তেই
হোলো নিরর্থক। চিহ্নিত করিয়াছিনু আপনারে
নানা চিহ্নে, নানা বর্ণ প্রসাধনে সহস্রের কাছে,
মুছিল তা, আপনাতে আপনার নিগূঢ় পূর্ণতা
আমারে করিল স্তব্ধ, সূর্যাস্তের অন্তিম সৎকারে
দিনান্তের শূন্যতায় ধরার বিচিত্র চিত্রলেখা
যখন প্রচ্ছন্ন হয়, বাধামুক্ত আকাশ যেমন
নির্বাক বিস্ময়ে স্তব্ধ তারাদীপ্ত আত্মপরিচয়ে। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
বুদ্ধির আকাশ যবে সত্যে সমুজ্জ্বল,
প্রেমরসে অভিষিক্ত হৃদয়ের ভূমি—
জীবনতরুতে ফলে কল্যাণের ফল,
মাধুরীর পুষ্পগুচ্ছে উঠে সে কুসুমি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
পুজোর ছুটি আসে যখন
বকসারেতে যাবার পথে —
দূরের দেশে যাচ্ছি ভেবে
ঘুম হয় না কোনোমতে ।
সেখানে যেই নতুন বাসায়
হপ্তা দুয়েক খেলায় কাটে
দূর কি আবার পালিয়ে আসে
আমাদেরই বাড়ির ঘাটে !
দূরের সঙ্গে কাছের কেবল
কেনই যে এই লুকোচুরি ,
দূর কেন যে করে এমন
দিনরাত্তির ঘোরাঘুরি ।
আমরা যেমন ছুটি হলে
ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে
রেলে চড়ে পশ্চিমে যাই
বেরিয়ে পড়ি দেশের থেকে ,
তেমনিতরো সকালবেলা
ছুটিয়ে আলো আকাশেতে
রাতের থেকে দিন যে বেরোয়
দূরকে বুঝি খুঁজে পেতে ?
সে - ও তো যায় পশ্চিমেতেই ,
ঘুরে ঘুরে সন্ধে হলে ,
তখন দেখে রাতের মাঝেই
দূর সে আবার গেছে চলে ।
সবাই যেন পলাতকা
মন টেকে না কাছের বাসায় ।
দলে দলে পলে পলে
কেবল চলে দূরের আশায় ।
পাতায় পাতায় পায়ের ধ্বনি ,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকাডাকি ,
হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি
কেবল বাজে থাকি থাকি ।
আমায় এরা যেতে বলে ,
যদি বা যাই , জানি তবে
দূরকে খুঁজে খুঁজে শেষে
মায়ের কাছেই ফিরতে হবে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
নাম তার কমলা,দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।কোলে তার ছিল বই আর খাতা।যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না। এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই–সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,প্রায়ই হয় দেখা।মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক্,ও তো আমার সহযাত্রিণী।নির্মল বুদ্ধির চেহারাঝক্ঝক্ করছে যেন।সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।মনে ভাবি একটা কোনো সংকট দেখা দেয় না কেন,উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি–রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত,কোনো-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা।এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে।কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে–না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের।একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়। কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে।এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়েটানতে করলে শুরু।কাছে এসে বললুম, “ফেলো চুরোট।’যেন পেলেই না শুনতে,ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়।হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ ক’রে–আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।বোধ হয় আমাকে চেনে।আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,বেশ একটু চওড়া গোছের নাম।লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার।হাত কাঁপতে লাগল,কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।আপিসের বাবুরা বললে, “বেশ করেছেন মশায়।’একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে। পরদিন তাকে দেখলুম না,তার পরদিনও না,তৃতীয় দিনে দেখিএকটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে,আমাকে কোনো দরকারই ছিল না।আবার বললুম মনে মনে,ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডোবা–বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছেকোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো।ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে। খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার।ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া–রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণেগাছের আড়ালে,সামনে বরফের পাহাড়।শোনা গেল আসবে না এবার।ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,মোহনলাল–রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা,দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।সে বললে, “তনুকা আমার বোন,কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে।’মেয়েটি ছায়ার মতো,দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু–যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।ফুটবলের সর্দারের ‘পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি–মনে করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া।হায় রে ভাগ্যের খেলা! যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,“একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা–একটি ফুলের গাছ।’এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।তনুকা বললে, “দামি দুর্লভ গাছ,এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।’জিগেস করলেম, “নামটা কী?’সে বললে “ক্যামেলিয়া’।চমক লাগল–আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।হেসে বললেম, “ক্যামেলিয়া,সহজে বুঝি এর মন মেলে না।’তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে,খুশিও হল।চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে।দেখা গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়।একটা দো-কামরা গাড়িতেটবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা। পুজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠলসাঁওতাল পরগনায়।জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে–বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না।কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।এইখানে বাসা বেঁধেছেনশালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়।সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে,মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়–উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।বাসাবাড়ি কোথাও নেই,তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে।সঙ্গী ছিল না কেউ,কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া। কমলা এসেছে মাকে নিয়ে।রোদ ওঠবার আগেহিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে।মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে।অল্পজল নদী পায়ে হেঁটেপেরিয়ে যায় ও পারে,সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে।আর আমাকে সে যে চিনেছেতা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই। একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা।ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে–পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যেএকটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না। দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক–শট্-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা,কমলার পাশে পা ছড়িয়েহাভানা চুরোট খাচ্ছে।আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছেএকটা শ্বেতজবার পাপড়ি,পাশে পড়ে আছেবিলিতি মাসিক পত্র। মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণেআমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জলআর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর। সময় হয়েছে আজ।যে আনে আমার রান্নার কাঠ।ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।তার হাত দিয়ে পাঠাবশালপাতার পাত্রে।তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, “বাবু, ডেকেছিস কেনে।’বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়াসাঁওতাল মেয়ের কানে,কালো গালের উপর আলো করেছে।সে আবার জিগেস করলে, “ডেকেছিস কেনে।’আমি বললেম, “এইজন্যেই।’তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সকালে উঠেই দেখি
প্রজাপতি একি
আমার লেখার ঘরে,
শেলফের 'পরে
মেলেছে নিস্পন্দ দুটি ডানা--
রেশমি সবুজ রঙ, তার 'পরে সাদা রেখা টানা।
সন্ধ্যাবেলা বাতির আলোয় অকস্মাৎ
ঘরে ঢুকে সারারাত
কী ভেবেছে কে জানে তা--
কোনোখানে হেথা
অরণ্যের বর্ণ গন্ধ নাই,
গৃহসজ্জা ওর কাছে সমস্ত বৃথাই।
বিচিত্র বোধের এ ভুবন,
লক্ষকোটি মন
একই বিশ্ব লক্ষকোটি ক'রে জানে
রূপে রসে নানা অনুমানে।
লক্ষকোটি কেন্দ্র তারা জগতের,
সংখ্যাহীন স্বতন্ত্র পথের
জীবনযাত্রার যাত্রী,
দিনরাত্রি
নিজের স্বাতন্ত্র৻রক্ষা-কাজে
একান্ত রয়েছে বিশ্ব-মাঝে।
প্রজাপতি বসে আছে যে কাব্যপুঁথির 'পরে
স্পর্শ তারে করে,
চক্ষে দেখে তারে,
তার বেশি সত্য যাহা তাহা একেবারে
তার কাছে সত্য নয়--
অন্ধকারময়।
ও জানে কাহারে বলে মধু, তবু
মধুর কী সে-রহস্য জানে না ও কভু।
পুষ্পপাত্রে নিয়মিত আছে ওর ভোজ--
প্রতিদিন করে তার খোঁজ
কেবল লোভের টানে,
কিন্তু নাহি জানে
লোভের অতীত যাহা। সুন্দর যা, অনির্বচনীয়,
যাহা প্রিয়,
সেই বোধ সীমাহীন দূরে আছে
তার কাছে।
আমি যেথা আছি
মন যে আপন টানে তাহা হতে সত্য লয় বাছি।
যাহা নিতে নাহি পারে
তাই শূন্যময় হয়ে নিত্য ব্যাপ্ত তার চারি ধারে।
কী আছে বা নাই কী এ,
সে শুধু তাহার জানা নিয়ে।
জানে না যা, যার কাছে স্পষ্ট তাহা, হয়তো-বা কাছে
এখনি সে এখানেই আছে
আমার চৈতন্যসীমা অতিক্রম করি' বহুদূরে
রূপের অন্তরদেশে অপরূপপুরে।
সে আলোকে তার ঘর
যে আলো আমার অগোচর।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
সারা রাত তারা
যতই জ্বলে
রেখা নাহি রাখে
আকাশতলে (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
অনেক মালা গেঁথেছি মোর
কুঞ্জতলে,
সকালবেলার অতিথিরা
পরল গলে।
সন্ধেবেলা কে এল আজ
নিয়ে ডালা।
গাঁথব কি হায় ঝরা পাতায়
শুকনো মালা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কবির শেষ রচনা ৩০শে জুলাই ১৯৪১ সকাল সাড়ে নটা...তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী !
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে ।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বরে করেছ চিহ্নিত ;
তার তরে রাখোনি গোপন রাত্রি ।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চির স্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চির সমুজ্বল ।
বাহিরে কুটিল হোক, অন্তরে সে ঋজু
এই নিয়ে তাহার গৌরব ।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত ।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে ।
কিছুতে পারেনা তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক। রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্যনক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশের ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি’ ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি’ তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে; দূর যুগান্তর হতে
মহাকাল-যাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহূর্তেরে তব
শুভক্ষণে দিয়েছে সম্মান; তোমার সম্মুখদিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি’ অনন্তের পানে
সেথা তুমি একা যাত্রী, অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
পরিচিত সীমানার
বেড়াঘেরা থাকি ছোটো বিশ্বে;
বিপুল অপরিচিত
নিকটেই রয়েছে অদৃশ্যে।
সেথাকার বাঁশিরবে
অনামা ফুলের মৃতুগন্ধে
জানা না-জানার মাঝে
বাণী ফিরে ছায়াময় ছন্দে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে
এসো তুমি এ ক্ষুদ্র আলয়ে।
তাই তোমার মাধুর্যসুধা
ঘুচায় আমার আঁখির ক্ষুধা,
জলে স্থলে দাও যে ধরা
কত আকার লয়ে।বন্ধু হয়ে পিতা হয়ে জননী হয়ে
আপনি তুমি ছোটো হয়ে এসো হৃদয়ে।
আমিও কি আপন হাতে
করব ছোটো বিশ্বনাথে।
জানাব আর জানব তোমায়
ক্ষুদ্র পরিচয়ে?শিলাইদহ, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আরো আঘাত সইবে আমার
সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো।
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে
বাজে নি তা চরমতানে,
নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে
মূর্তি সঞ্চারো।লাগে না গো কেবল যেন
কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ
ব্যর্থ কোরো না।
জ্বলে উঠুক সকল হুতাশ,
গর্জি উঠুক সকল বাতাস,
জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ
পূর্ণতা বিস্তারো।৪ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
পাড়াতে এসেছে এক
নাড়িটেপা ডাক্তার,
দূর থেকে দেখা যায়
অতি উঁচু নাক তার।
নাম লেখে ওষুধের,
এ দেশের পশুদের
সাধ্য কী পড়ে তাহা
এই বড়ো জাঁক তার।
যেথা যায় বাড়ি বাড়ি
দেখে যে ছেড়েছে নাড়ী,
পাওনাটা আদায়ের
মেলে না যে ফাঁক তার।
গেছে নির্বাকপুরে
ভক্তের ঝাঁক তার। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা।
ওই যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড়
আকাশের নীড়;
ওই যে যারা দিনরাত্রি
অলো-হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী
গ্রহ তারা রবি
তুমি কি তাদেরি মতো সত্য নও।
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি।
চিরচঞ্চলের মাঝে তুমি কেন শান্ত হয়ে রও।
পথিকের সঙ্গ লও
ওগো পথহীন।
কেন রাত্রিদিন
সকলের মাঝে থেকে সবা হতে আছ এত দূরে
স্থিরতার চির অন্তঃপুরে।
এই ধূলি
ধূসর অঞ্চল তুলি
বায়ুভরে ধায় দিকে দিকে;
বৈশাখে সে বিধবার আভরণ খুলি
তপস্বিনী ধরণীরে সাজায় গৈরিকে;
অঙ্গে তার পত্রলিখা দেয় লিখে
বসন্তের মিলন-উষায়,
এই ধূলি এও সত্য হায়;
এই তৃণ
বিশ্বের চরণতলে লীন
এরা যে অস্থির, তাই এরা সত্য সবি--
তুমি স্থির, তুমি ছবি,
তুমি শুধু ছবি।
একদিন এই পথে চলেছিলে আমাদের পাশে।
বক্ষ তব দুলিত নিশ্বাসে;
অঙ্গে অঙ্গে প্রাণ তব
কত গানে কত নাচে
রচিয়াছে
আপনার ছন্দ নব নব
বিশ্বতালে রেখে তাল;
সে যে আজ হল কত কাল।
এ জীবনে
আমার ভুবনে
কত সত্য ছিলে।
মোর চক্ষে এ নিখিলে
দিকে দিকে তুমিই লিখিলে
রূপের তুলিকা ধরি রসের মুরতি।
সে-প্রভাতে তুমিই তো ছিলে
এ-বিশ্বের বাণী মূর্তিমতী।
একসাথে পথে যেতে যেতে
রজনীর আড়ালেতে
তুমি গেলে থামি।
তার পরে আমি
কত দুঃখে সুখে
রাত্রিদিন চলেছি সম্মুখে।
চলেছে জোয়ার-ভাঁটা আলোকে আঁধারে
আকাশ-পাথারে;
পথের দুধারে
চলেছে ফুলের দল নীরব চরণে
বরনে বরনে;
সহস্রধারায় ছোটে দুরন্ত জীবন-নির্ঝরিণী
মরণের বাজায়ে কিঙ্কিণী।
অজানার সুরে
চলিয়াছি দূর হতে দূরে--
মেতেছি পথের প্রেমে।
তুমি পথ হতে নেমে
যেখানে দাঁড়ালে
সেখানেই আছ থেমে।
এই তৃণ, এই ধূলি-- ওই তারা, ওই শশী-রবি
সবার আড়ালে
তুমি ছবি, তুমি শুধু ছবি।
কী প্রলাপ কহে কবি।
তুমি ছবি?
নহে নহে, নও শুধু ছবি।
কে বলে রয়েছ স্থির রেখার বন্ধনে
নিস্তব্ধ ক্রন্দনে।
মরি মরি, সে আনন্দ থেমে যেত যদি
এই নদী
হারাত তরঙ্গবেগ,
এই মেঘ
মুছিয়া ফেলিত তার সোনার লিখন।
তোমার চিকন
চিকুরের ছায়াখানি বিশ্ব হতে যদি মিলাইত
তবে
একদিন কবে
চঞ্চল পবনে লীলায়িত
মর্মর-মুখর ছায়া মাধবী-বনের
হত স্বপনের।
তোমায় কি গিয়েছিনু ভুলে।
তুমি যে নিয়েছ বাসা জীবনের মূলে
তাই ভুল।
অন্যমনে চলি পথে, ভুলি নে কি ফুল।
ভুলি নে কি তারা।
তবুও তাহারা
প্রাণের নিশ্বাসবায়ু করে সুমধুর,
ভুলের শূন্যতা-মাঝে ভরি দেয় সুর।
ভুলে থাকা নয় সে তো ভোলা;
বিস্মৃতির মর্মে বসি রক্তে মোর দিয়েছ যে দোলা।
নয়নসম্মুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই;
আজি তাই
শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।
আমার নিখিল
তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।
নাহি জানি, কেহ নাহি জানে
তব সুর বাজে মোর গানে;
কবির অন্তরে তুমি কবি,
নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি।
তোমারে পেয়েছি কোন্ প্রাতে,
তার পরে হারায়েছি রাতে।
তার পরে অন্ধকারে অগোচরে তোমারেই লভি।
নও ছবি, নও তুমি ছবি।
এলাহাবাদ, ৩ কার্তিক, ১৩২১-রাত্রি
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
তুমি নীচে পাঁকে পড়ি ছড়াইছ পাঁক,
যে জন উপরে আছে তারি তো বিপাক। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার একলা ঘরের আড়াল ভেঙে
বিশাল ভবে
প্রাণের রথে বাহির হতে
পারব কবে।
প্রবল প্রেমে সবার মাঝে
ফিরব ধেয়ে সকল কাজে,
হাটের পথে তোমার সাথে
মিলন হবে,
প্রাণের রথে বাহির হতে
পারব কবে।নিখিল আশা-আকাঙক্ষা-ময়
দুঃখে সুখে,
ঝাঁপ দিয়ে তার তরঙ্গপাত
ধরব বুকে।
মন্দভালোর আঘাতবেগে,
তোমার বুকে উঠব জেগে,
শুনব বাণী বিশ্বজনের
কলরবে।
প্রাণের রথে বাহির হতে
পারব কবে।১ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
সূর্য দুঃখ করি বলে নিন্দা শুনি স্বীয়,
কী করিলে হব আমি সকলের প্রিয়।
বিধি কহে, ছাড়ো তবে এ সৌর সমাজ,
দু-চারি জনেরে লয়ে করো ক্ষুদ্র কাজ। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আজ একেলা বসিয়া , আকাশে চাহিয়া ,
কী সাধ যেতেছে , মন!
বেলা চলে যায় — আছিস কোথায় ?
কোন্ স্বপনেতে নিমগন ?
বসন্তবাতাসে আঁখি মুদে আসে ,
মৃদু মৃদু বহে শ্বাস ,
গায়ে এসে যেন এলায়ে পড়িছে
কুসুমের মৃদু বাস ।
যেন সুদূর নন্দনকাননবাসিনী
সুখঘুমঘোরে মধুরহাসিনী ,
অজানা প্রিয়ার ললিত পরশ
ভেসে ভেসে বহে যায় ,
অতি মৃদু মৃদু লাগে গায় ।
বিস্মরণমোহে আঁধারে আলোকে
মনে পড়ে যেন তায় ,
স্মৃতি-আশা-মাখা মৃদু সুখে দুখে
পুলকিয়া উঠে কায় ।
ভ্রমি আমি যেন সুদূর কাননে ,
সুদূর আকাশতলে ,
আনমনে যেন গাহিয়া বেড়াই
সরযূর কলকলে ।
গহন বনের কোথা হতে শুনি
বাঁশির স্বর-আভাস ,
বনের হৃদয় বাজাইছে যেন
মরমের অভিলাষ ।
বিভোর হৃদয়ে বুঝিতে পারি নে
কে গায় কিসের গান ,
অজানা ফুলের সুরভি মাখানো
স্বরসুধা করি পান ।
যেন রে কোথায় তরুর ছায়ায়
বসিয়া রূপসী বালা ,
কুসুমশয়নে আধেক মগনা
বাকলবসনে আধেক নগনা,
সুখদুখগান গা ই ছে শুইয়া
গাঁথিতে গাঁথিতে মালা ।
ছায়ায় আলোকে , নিঝরের ধারে ,
কোথা কোন্ গুপ্ত গুহার মাঝারে ,
যেন হেথা হোথা কে কোথায় আছে
এখনি দেখিতে পাব —
যেন রে তাদের চরণের কাছে
বীণা লয়ে গান গাব ।
শুনে শুনে তারা আনত নয়নে
হাসিবে মুচুকি হাসি ,
শরমের আভা অধরে কপোলে
বেড়াইবে ভাসি ভাসি ।
মাথায় বাঁধিয়া ফুলের মালা
বেড়াইব বনে বনে ।
উড়িতেছে কেশ , উড়িতেছে বেশ ,
উদাস পরান কোথা নিরুদ্দেশ ,
হাতে লয়ে বাঁশি মুখে লয়ে হাসি ,
ভ্রমিতেছি আনমনে ।
চারি দিকে মোর বসন্ত হসিত ,
যৌবনকুসুম প্রাণে বিকশিত ,
কুসুমের'পরে ফেলিব চরণ
যৌবনমাধুরীভরে ।
চারি দিকে মোর মাধবী মালতী
সৌরভে আকুল করে ।
কেহ কি আমারে চাহিবে না ?
কাছে এসে গান গাহিবে না ?
পিপাসিত প্রাণে চাহি মুখপানে
কবে না প্রাণের আশা ?
চাঁদের আলোতে দখিন বাতাসে
কুসুমকাননে বাঁধি বাহুপাশে
শরমে সোহাগে মৃদুমধুহাসে
জানাবে না ভালোবাসা ?
আমার যৌবনকুসুমকাননে
ললিত চরণে বেড়াবে না ?
আমার প্রাণের লতিকা-বাঁধন
চরণে তাহার জড়াবে না ?
আমার প্রাণের কুসুম গাঁথিয়া
কেহ পরিবে না গলে ?
তাই ভাবিতেছি আপনার মনে
বসিয়া তরুর তলে ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
‘কালো তুমি’— শুনি জাম কহে কানে কানে,
যে আমারে দেখে সেই কালো বলি জানে,
কিন্তু সেটুকু জেনে ফের কেন জাদু?
যে আমারে খায় সেই জানে আমি স্বাদু। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নাট্যগীতি
|
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
হৃদয়ে আমার ।
যৌবনসমুদ্রমাঝে কোন্ পূর্ণিমায় আজি
এসেছে জোয়ার !
উচ্ছল পাগল নীরে তালে তালে ফিরে ফিরে
এ মোর নির্জন তীরে কী খেলা তোমার !
মোর সর্ব বক্ষ জুড়ে কত নৃত্যে কত সুরে
এসো কাছে যাও দূরে শতলক্ষবার ।
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
হৃদয়ে আমার ।
জাগরণসম তুমি আমার ললাট চুমি
উদিছ নয়নে ।
সুষুপ্তির প্রান্ততীরে দেখা দাও ধীরে ধীরে
নবীন কিরণে ।
দেখিতে দেখিতে শেষে সকল হৃদয়ে এসে
দাঁড়াও আকুল কেশে রাতুল চরণে —
সকল আকাশ টুটে তোমাতে ভরিয়া উঠে ,
সকল কানন ফুটে জীবনে যৌবনে ।
জাগরণসম তুমি আমার ললাট চুমি
উদিছ নয়নে ।
কুসুমের মতো শ্বসি পড়িতেছ খসি খসি
মোর বক্ষ -' পরে ।
গোপন শিশিরছলে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে
প্রাণ সিক্ত করে ।
নিঃশব্দ সৌরভরাশি পরানে পশিছে আসি
সুখস্বপ্ন পরকাশি নিভৃত অন্তরে ।
পরশপুলকে ভোর চোখে আসে ঘুমঘোর ,
তোমার চুম্বন , মোর সর্বাঙ্গে সঞ্চরে ।
কুসুমের মতো শ্বসি পড়িতেছ খসি খসি
মোর বক্ষ -' পরে । (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে;
পাকে পাকে ফেরে ফেরে
আমার জীবন দিয়ে জড়ায়েছি এরে;
প্রভাত-সন্ধ্যার
আলো-অন্ধকার
মোর চেতনায় গেছে ভেসে;
অবশেষে
এক হয়ে গেছে আজ আমার জীবন
আর আমার ভুবন।
ভালোবাসিয়াছি এই জগতের আলো
জীবনেরে তাই বাসি ভালো।
তবুও মরিতে হবে এও সত্য জানি।
মোর বাণী
একদিন এ-বাতাসে ফুটিবে না,
মোর আঁখি এ-আলোকে লুটিবে না,
মোর হিয়া ছুটিবে না
অরুণের উদ্দীপ্ত আহ্বানে;
মোর কানে কানে
রজনী কবে না তার রহস্যবারতা,
শেষ করে যেতে হবে শেষ দৃষ্টি, মোর শেষ কথা।
এমন একান্ত করে চাওয়া
এও সত্য যত
এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া
সেও সেই মতো।
এ দুয়ের মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল;
নহিলে নিখিল
এতবড়ো নিদারুণ প্রবঞ্চনা
হাসিমুখে এতকাল কিছুতে বহিতে পারিত না।
সব তার আলো
কীটে-কাটা পুষ্পসম এতদিনে হয়ে যেত কালো।
সুরুল, ২৯ পৌষ, ১৩২১-প্রাতঃকাল
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বহু কোটি যুগ পরে
সহসা বাণীর বরে
জলচর প্রাণীদের
কণ্ঠটা পাওয়া যেই
সাগর জাগর হল
কতমতো আওয়াজেই।
তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে;
চিঁ চিঁ করে চিংড়ি;
ইলিস বেহাগ ভাঁজে
যেন মধু নিংড়ি;
শাঁখগুলো বাজে, বহে
দক্ষিণে হাওয়া যেই;
গান গেয়ে শুশুকেরা
লাগে কুচ-কাওয়াজেই। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
লীলাময়ী নলিনী,
চপলিনী নলিনী,
শুধালে আদর করে
ভালো সে কি বাসে মোরে,
কচি দুটি হাত দিয়ে
ধরে গলা জড়াইয়ে,
হেসে হেসে একেবারে
ঢলে পড়ে পাগলিনী!
ভালো বাসে কি না, তবু
বলিতে চাহে না কভু
নিরদয়া নলিনী!
যবে হৃদি তার কাছে,
প্রেমের নিশ্বাস যাচে
চায় সে এমন করে
বিপাকে ফেলিতে মোরে,
হাসে কত, কথা তবু কয় না!
এমন নির্দোষ ধূর্ত
চতুর সরল,
ঘোমটা তুলিয়া চায়
চাহনি চপল
উজল অসিত-তারা-নয়না!
অমনি চকিত এক হাসির ছটায়
ললিত কপোলে তার গোলাপ ফুটায়,
তখনি পলায় আর রয় না!Alfred Tennyson
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
সর্দিকে সোজাসুজি
সর্দি ব’লেই বুঝি
মেডিকেল বিজ্ঞান না শিখে।
ডাক্তার দেয় শিষ,
টাকা নিয়ে পঁয়ত্রিশ
ভাবনায় গেল ঘুম,
ওষুধের লাগে ধুম,
শঙ্কা লাগালো পারিভাষিকে।
আমি পুরাতন পাপী,
শুনেই কাঁপি,
ডরিনেকো সাদাসিধে ফাঁসিকে।শূন্য তবিল যবে,
বলে “পাঁচনেই হবে’–
চেতাইল এ ভারতবাসীকে।
নর্স্কে ঠেকিয়ে দূরে
যাই বিক্রমপুরে,
সহায় মিলিল খাঁদুমাসিকে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
শুনিয়াছি নিম্নে তব, হে বিশ্বপাথার,
নাহি অন্ত মহামূল্য মণিমুকুতার।
নিশিদিন দেশে দেশে পন্ডিত ডুবারি
রত রহিয়াছে কত অন্বেষণে তারি।
তাহে মোর নাহি লোভ মহাপারাবার!
যে আলোক জ্বলিতেছে উপরে তোমার,
যে রহস্য দুলিতেছে তব বক্ষতলে,
যে মহিমা প্রসারিত তব নীল জলে,
যে সংগীত উঠে তব নিয়ত আঘাতে,
যে বিচিত্র লীলা তব মহানৃত্যে মাতে,
এ জগতে কভু তার অন্ত যদি জানি,
চিরদিনে কভু তাহে শ্রান্তি যদি মানি,
তোমার অতলমাঝে ডুবিব তখন
যেথায় রতন আছে অথবা মরণ। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কাশীর গল্প শুনেছিলুম যোগীনদাদার কাছে,
পষ্ট মনে আছে।
আমরা তখন ছিলাম না কেউ, বয়েস তাঁহার সবে
বছর-আষ্টেক হবে।
সঙ্গে ছিলেন খুড়ি,
মোরব্বা বানাবার কাজে ছিল না তাঁর জুড়ি।
দাদা বলেন, আমলকি বেল পেঁপে সে তো আছেই,
এমন কোনো ফল ছিল না এমন কোনো গাছেই
তাঁর হাতে রস জমলে লোকের গোল না ঠেকত--এটাই
ফল হবে কি মেঠাই।
রসিয়ে নিয়ে চালতা যদি মুখে দিতেন গুঁজি
মনে হত বড়োরকম রসগোল্লাই বুঝি।
কাঁঠাল বিচিত্র মোরব্বা যা বানিয়ে দিতেন তিনি
পিঠে ব'লে পৌষমাসে সবাই নিত কিনি।
দাদা বলেন, "মোরব্বাটা হয়তো মিছেমিছিই,
কিন্তু মুখে দিতে যদি, বলতে কাঁঠাল বিচিই।"
মোরব্বাতে ব্যাবসা গেল জ'মে
বেশ কিঞ্চিৎ টাকা জমল ক্রমে।
একদিন এক চোর এসেছে তখন অনেক রাত,
জানলা দিয়ে সাবধানে সে বাড়িয়ে দিল হাত।
খুড়ি তখন চাটনি করতে তেল নিচ্ছেন মেপে,
ধড়াস করে চোরের হাতে জানলা দিলেন চেপে।
চোর বললে, "উহু উহু'; খুড়ি বললেন, "আহা,
বাঁ হাত মাত্র, এইখানেতেই থেকে যাক-না তাহা।'
কেঁদে-কেটে কোনোমতে চোর তো পেল খালাস;
খুড়ি বললেন, "মরবি, যদি এ ব্যাবসা তোর চালাস।'দাদা বললেন, "চোর পালালো, এখন গল্প থামাই,
ছ'দিন হয়নি ক্ষৌর করা, এবার গিয়ে কামাই।"
আমরা টেনে বসাই; বলি, "গল্প কেন ছাড়বে।"
দাদা বলেন, "রবার নাকি, টানলেই কি বাড়বে।--
কে ফেরাতে পারে তোদের আবদারের এই জোর,
তার চেয়ে যে অনেক সহজ ফেরানো সেই চোর।
আচ্ছা তবে শোন্, সে মাসে গ্রহণ লাগল চাঁদে,
শহর যেন ঘিরল নিবিড় মানুষ বোনা ফাঁদে।
খুড়ি গেছেন স্নান করতে বাড়ির দ্বারের পাশে,
আমার তখন পূর্ণগ্রহণ ভিড়ের রাহুগ্রাসে।
প্রাণটা যখন কণ্ঠাগত, মরছি যখন ডরে,
গুণ্ডা এসে তুলে নিল হঠাৎ কাঁধের 'পরে।
তখন মনে হল, এ তো বিষ্ণুদূতের দয়া,
আর-একটু দেরি হলেই প্রাপ্ত হতেম গয়া।
বিষ্ণুদূতটা ধরল যখন যমদূতের মূর্তি
এক নিমেষেই একেবারেই ঘুচল আমার ফুর্তি।
সাত গলি সে পেরিয়ে শেষে একটা এঁধোঘরে
বসিয়ে আমায় রেখে দিল খড়ের আঁঠির 'পরে।
চৌদ্দ আনা পয়সা আছে পকেট দেখি ঝেড়ে,
কেঁদে কইলাম, "ও পাঁড়েজি, এই নিয়ে দাও ছেড়ে।'
গুণ্ডা বলে, "ওটা নেব, ওটা ভালো দ্রব্যই,
আরো নেব চারটি হাজার নয়শো নিরেনব্বই--
তার উপরে আর দু আনা, খুড়িটা তো মরবে,
টাকার বোঝা বয়ে সে কি বৈতরণী তরবে।
দেয় যদি তো দিক চুকিয়ে, নইলে--' পাকিয়ে চোখ
যে ভঙ্গিটা দেখিয়ে দিলে সেটা মারাত্মক।এমনসময়, ভাগ্যি ভালো, গুণ্ডাজির এক ভাগ্নি
মূর্তিটা তার রণচণ্ডী, যেন সে রায়বাঘ্নি,
আমার মরণদশার মধ্যে হলেন সমাগত
দাবানলের ঊর্ধ্বে যেন কালো মেঘের মতো।
রাত্তিরে কাল ঘরে আমার উঁকি মারল বুঝি,
যেমনি দেখা অমনি আমি রইনু চক্ষু বাজি।
পরের দিনে পাশের ঘরে, কী গলা তার বাপ,
মামার সঙ্গে ঠাণ্ডা ভাষায় নয় সে বাক্যালাপ।
বলছে, "তোমার মরণ হয় না, কাহার বাছনি ও,
পাপের বোঝা বাড়িয়ো না আর, ঘরে ফেরৎ দিয়ো--
আহা, এমন সোনার টুকরো--' শুনে আগুন মামা;
বিশ্রী রকম গাল দিয়ে কয়, "মিহি সুরটা থামা।'
এ'কেই বলে মিহি সুর কি, আমি ভাবছি শুনে।
দিন তো গেল কোনোমতে কড়ি বর্গা গুনে।
রাত্রি হবে দুপুর, ভাগ্নি ঢুকল ঘরে ধীরে;
চুপি চুপি বললে কানে, "যেতে কি চাস ফিরে।'
লাফিয়ে উঠে কেঁদে বললেম, "যাব যাব যাব।'
ভাগ্নি বললে, "আমার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নাবো--
কোথায় তোমার খুড়ির বাসা অগস্ত্যকুণ্ডে কি,
যে ক'রে হোক আজকে রাতেই খুঁজে একবার দেখি;
কালকে মামার হাতে আমার হবেই মুণ্ডপাত।'--
আমি তো, ভাই, বেঁচে গেলেম, ফুরিয়ে গেল রাত।হেসে বললেম যোগীনদাদার গম্ভীর মুখ দেখে,
ঠিক এমনি গল্প বাবা শুনিয়েছে বই থেকে।
দাদা বললেন, "বিধি যদি চুরি করেন নিজে
পরের গল্প, জানিনে ভাই, আমি করব কী যে।'
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
শুধাই অয়ি গো ভারতী তোমায়
তোমার ও বীণা নীরব কেন?
কবির বিজন মরমে লুকায়ে
নীরবে কেন গো কাঁদিছ হেন?
অযতনে, আহা, সাধের বীণাটি
ঘুমায়ে রয়েছে কোলের কাছে,
অযতনে, আহা, এলোথেলো চুল
এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে।
কেন গো আজিকে এ-ভাব তোমার
কমলবাসিনী ভারতী রানী--
মলিন মলিন বসন ভূষণ
মলিন বদনে নাহিকো বাণী।
তবে কি জননি অমৃতভাষিণি
তোমার ও বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও বীণা আর না বাজিবে তবে?
দেখো তবে মাতা দেখো গো চাহিয়া
তোমার ভারত শ্মশান-পারা,
ঘুমায়ে দেখিছে সুখের স্বপন
নরনারী সব চেতনহারা।
যাহা-কিছু ছিল সকলি গিয়াছে,
সে-দিনের আর কিছুই নাই,
বিশাল ভারত গভীর নীরব,
গভীর আঁধার যে-দিকে চাই।
তোমারো কি বীণা ভারতি জননী,
তোমারো কি বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও-বীণা আর না বাজিবে তবে?
না না গো, ভারতী, নিবেদি চরণে
কোলে তুলে লও মোহিনী বীণা।
বিলাপের ধ্বনি উঠাও জননি,
দেখিব ভারত জাগিবে কি না।
অযুত অযুত ভারতনিবাসী
কাঁদিয়া উঠিবে দারুণ শোকে,
সে রোদনধ্বনি পৃথিবী ভরিয়া
উঠিবে, জননি, দেবতালোকে।
তা যদি না হয় তা হলে, ভারতি,
তুলিয়া লও বিজয়ভেরী,
বাজাও জলদগভীর গরজে
অসীম আকাশ ধ্বনিত করি।
গাও গো হুতাশ-পূরিত গান,
জ্বলিয়া উঠুক অযুত প্রাণ,
উথলি উঠুক ভারত-জলধি--
কাঁপিয়া উঠুক অচলা ধরা।
দেখিব তখন প্রতিভাহীনা
এ ভারতভূমি জাগিবে কি না,
ঢাকিয়া বয়ান আছে যে শয়ান
শরমে হইয়া মরমে-মরা!
এই ভারতের আসনে বসিয়া
তুমিই ভারতী গেয়েছ গান,
ছেয়েছে ধরার আঁধার গগন
তোমারি বীণার মোহন তান।
আজও তুমি, মাতা, বীণাটি লইয়া
মরম বিঁধিয়া গাও গো গান--
হীনবল সেও হইবে সবল,
মৃতদেহ সেও পাইবে প্রাণ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
বেছে লব সব-সেরা,
ফাঁদ পেতে থাকি—
সব-সেরা কোথা হতে
দিয়ে যায় ফাঁকি।
আপনারে করি দান,
থাকি করজোড়ে—
সব-সেরা আপনিই
বেছে লয় মোরে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
দু-কানে ফুটিয়ে দিয়ে
কাঁকড়ার দাঁড়া
বর বলে, “কান দুটো
ধীরে ধীরে নাড়া।’
বউ দেখে আয়নায়,
জাপানে কি চায়নায়
হাজার হাজার আছে
মেছনীর পাড়া–
কোথাও ঘটেনি কানে
এত বড়ো ফাঁড়া। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হে প্রিয়, আজি এ প্রাতে
নিজ হাতে
কী তোমারে দিব দান।
প্রভাতের গান?
প্রভাত যে ক্লান্ত হয় তপ্ত রবিকরে
আপনার বৃন্তটির 'পরে;
অবসন্ন গান
হয় অবসান।
হে বন্ধু কী চাও তুমি দিবসের শেষে
মোর দ্বারে এসে।
কী তোমারে দিব আনি।
সন্ধ্যাদীপখানি?
এ-দীপের আলো এ যে নিরালা কোণের,
স্তব্ধ ভবনের।
তোমার চলার পথে এরে নিতে চাও জনতায়?
এ যে হায়
পথের বাতাসে নিবে যায়।
কী মোর শকতি আছে তোমারে যে দিব উপহার।
হোক ফুল, হোক-না গলার হার,
তার ভার
কেনই বা সবে,
একদিন যবে
নিশ্চিত শুকাবে তারা ম্লান ছিন্ন হবে।
নিজ হতে তব হাতে যাহা দিব তুলি
তারে তব শিথিল অঙ্গুলি
যাবে ভুলি--
ধূলিতে খসিয়া শেষে হয়ে যাবে ধূলি।
তার চেয়ে যবে
ক্ষণকাল অবকাশ হবে,
বসন্তে আমার পুষ্পবনে
চলিতে চলিতে অন্যমনে
অজানা গোপন গন্ধে পুলকে চমকি
দাঁড়াবে থমকি,
পথহারা সেই উপহার
হবে সে তোমার।
যেতে যেতে বীথিকায় মোর
চোখেতে লাগিবে ঘোর,
দেখিবে সহসা--
সন্ধ্যার কবরী হতে খসা
একটি রঙিন আলো কাঁপি থরথরে
ছোঁয়ায় পরশমণি স্বপনের 'পরে,
সেই আলো, অজানা সে উপহার
সেই তো তোমার।
আমার যা শ্রেষ্ঠধন সে তো শুধু চমকে ঝলকে,
দেখা দেয়, মিলায় পলকে।
বলে না আপন নাম, পথেরে শিহরি দিয়া সুরে
চলে যায় চকিতে নূপুরে।
সেথা পথ নাহি জানি,
সেথা নাহি যায় হাত, নাহি যায় বাণী।
বন্ধু, তুমি সেথা হতে আপনি যা পাবে
আপনার ভাবে,
না-চাহিতে না-জানিতে সেই উপহার
সেই তো তোমার।
আমি যাহা দিতে পারি সামান্য সে দান--
হোক ফুল, হোক তাহা গান।
শান্তিনিকেতন, ১০ পৌষ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ফল ধরেছে বটের ডালে ডালে;
অফুরন্ত আতিথ্যে তার সকালে বৈকালে
বনভোজনে পাখিরা সব আসছে ঝাঁকে ঝাঁক।
মাঠের ধারে আমার ছিল চড়িভাতির ডাক।
যে যার আপন ভাঁড়ার থেকে যা পেল যেইখানে
মালমসলা নানারকম জুটিয়ে সবাই আনে।
জাত-বেজাতের চালে ডালে মিশোল ক'রে শেষে
ডুমুরগাছের তলাটাতে মিলল সবাই এসে।
বারে বারে ঘটি ভ'রে জল তুলে কেউ আনে,
কেউ চলেছে কাঠের খোঁজে আমবাগানের পানে।
হাঁসের ডিমের সন্ধানে কেউ গেল গাঁয়ের মাঝে,
তিন কন্যা লেগে গেল রান্নাকরার কাজে।
গাঁঠ-পাকানো শিকড়েতে মাথাটা তার থুয়ে
কেউ পড়ে যায় গল্পের বই জামের তলায় শুয়ে।
সকল-কর্ম-ভোলা
দিনটা যেন ছুটির নৌকা বাঁধন-রশি-খোলা
চলে যাচ্ছে আপনি ভেসে সে কোন্ আঘাটায়
যথেচ্ছ ভাঁটায়।
মানুষ যখন পাকা ক'রে প্রাচীর তোলে নাই
মাঠে বনে শৈলগুহায় যখন তাহার ঠাঁই,
সেইদিনকার আল্গা-বিধির বাইরে-ঘোরা প্রাণ
মাঝে মাঝে রক্তে আজও লাগায় মন্ত্রগান।
সেইদিনকার যথেচ্ছ-রস আস্বাদনের খোঁজে
মিলেছিলেম অবেলাতে অনিয়মের ভোজে।
কারো কোনো স্বত্বদাবীর নেই যেখানে চিহ্ন,
যেখানে এই ধরাতলের সহজ দাক্ষিণ্য,
হালকা সাদা মেঘের নিচে পুরানো সেই ঘাসে,
একটা দিনের পরিচিত আমবাগানের পাশে,
মাঠের ধারে, অনভ্যাসের সেবার কাজে খেটে
কেমন ক'রে কয়টা প্রহর কোথায় গেল কেটে।
সমস্ত দিন ডাকল ঘুঘু দুটি।
আশে পাশে এঁটোর লোভে কাক এল সব জুটি,
গাঁয়ের থেকে কুকুর এল, লড়াই গেল বেধে--
একটা তাদের পালালো তার পরাভবের খেদে।রৌদ্র পড়ে এল ক্রমে, ছায়া পড়ল বেঁকে,
ক্লান্ত গোরু গাড়ি টেনে চলেছে হাট থেকে।
আবার ধীরে ধীরে
নিয়ম-বাঁধা যে-যার ঘরে চলে গেলেম ফিরে।
একটা দিনের মুছল স্মৃতি, ঘুচল চড়িভাতি,
পোড়াকাঠের ছাই পড়ে রয়, নামে আঁধার রাতি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
অলস শয্যার পাশে জীবন মন্থরগতি চলে,
রচে শিল্প শৈবালের দলে।
মর্যাদা নাইকো তার, তবু তাহে রয়
জীবনের স্বল্পমূল্য কিছু পরিচয়। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত, আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে;
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন আশ্বিনেতে ভোরে শিউলিবনেশিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের গন্ধ আসে,
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে ভাসে?
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে,পুজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে;
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকেমনে হয়, মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের 'পরে ধরে কবে দেখত আমায় চেয়ে,সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি, জাপানি সৈনিক
যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে যুদ্ধমন্দিরে
পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে,
ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।
হুংকৃত যুদ্ধের বাদ্য
সংগ্রহ করিবারে শমনের খাদ্য।
সাজিয়াছে ওরা সবে উৎকটদর্শন,
দন্তে দন্তে ওরা করিতেছে ঘর্ষণ,
হিংসার উষ্মায় দারুণ অধীর
সিদ্ধির বর চায় করুণানিধির--
ওরা তাই স্পর্ধায় চলে
বুদ্ধের মন্দিরতলে।
তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো।
গর্জিয়া প্রার্থনা করে--
আর্তরোদন যেন জাগে ঘরে ঘরে।
আত্মীয়বন্ধন করি দিবে ছিন্ন,
গ্রামপল্লীর রবে ভস্মের চিহ্ন,
হানিবে শূন্য হতে বহ্নি-আঘাত,
বিদ্যার নিকেতন হবে ধূলিসাৎ--
বক্ষ ফুলায়ে বর যাচে
দয়াময় বুদ্ধের কাছে।
তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো।
হত-আহতের গনি সংখ্যা
তালে তালে মন্দ্রিত হবে জয়ডঙ্কা।
নারীর শিশুর যত কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ
জাগাবে অট্টহাসে পৈশাচী রঙ্গ,
মিথ্যায় কলুষিবে জনতার বিশ্বাস,
বিষবাষ্পের বাণে রোধি দিবে নিশ্বাস--
মুষ্টি উঁচায়ে তাই চলে
বুদ্ধেরে নিতে নিজ দলে।
তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বিশুদাদা–
দীর্ঘবপু, দৃঢ়বাহু, দুঃসহ কর্তব্যে নাহি বাধা,
বুদ্ধিতে উজ্জ্বল চিত্ত তার
সর্বদেহে তৎপরতা করিছে বিস্তার।
তন্দ্রার আড়ালে
রোগক্লিষ্ট ক্লান্ত রাত্রিকালে
মূর্তিমান শক্তির জাগ্রত রূপ প্রাণে
বলিষ্ঠ আশ্বাস বহি আনে,
নির্নিমেষ নক্ষত্রের মাঝে
যেমন জাগ্রত শক্তি নিঃশব্দ বিরাজে
অমোঘ আশ্বাসে
সুপ্ত রাত্রে বিশ্বের আকাশে।
যখন শুধায় মোরে, দুঃখ কি রয়েছে কোনোখানে
মনে হয়, নাই তার মানে–
দুঃখ মিছে ভ্রম,
আপন পৌরুষে তারে আপনি করিব অতিক্রম।
সেবার ভিতরে শক্তি দুর্বলের দেহে করে দান
বলের সম্মান। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বলিয়াছিনু মামারে–
তোমারি ঐ চেহারাখানি কেন গো দিলে আমারে।
তখনো আমি জন্মিনি তো, নেহাত ছিনু অপরিচিত,
আগেভাগেই শাস্তি এমন, এ কথা মনে ঘা মারে।
হাড় ক’খানা চামড়া দিয়ে ঢেকেছে যেন চামারে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দিনান্তের মুখ চুম্বি রাত্রি ধীরে কয়—
আমি মৃত্যু তোর মাতা, নাহি মোরে ভয়।
নব নব জন্মদানে পুরাতন দিন
আমি তোরে ক’রে দিই প্রত্যহ নবীন। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
পণ্ডিত কুমিরকে
ডেকে বলে, “নক্র,
প্রখর তোমার দাঁত,
মেজাজটা বক্র।
আমি বলি নখ তব
করো তুমি কর্তন,
হিংস্র স্বভাব তবে
হবে পরিবর্তন
আমিষ ছাড়িয়া যদি
শুধু খাও তক্র।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
দরিদ্রা বলিয়া তোরে বেশি ভালোবাসি
হে ধরিত্রী, স্নেহ তোর বেশি ভালো লাগে,
বেদনাকাতর মুখে সকরুণ হাসি,
দেখে মোর মর্ম-মাঝে বড়ো ব্যথা জাগে।
আপনার বক্ষ হতে রস-রক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস সন্তানের দেহে,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস তাকিয়ে,
অমৃত নারিস দিতে প্রাণপণ স্নেহে।
কত যুগ হতে তুই বর্ণগন্ধগীতে
সৃজন করিতেছিস আনন্দ-আবাস,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে–
স্বর্গ নাই, রচেছিস স্বর্গের আভাস।
তাই তোর মুখখানি বিষাদ-কোমল,
সকল সৌন্দর্যে তোর ভরা অশ্রুজল।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
অশ্রুস্রোতে স্ফীত হয়ে বহে বৈতরণী ,
চৌদিকে চাপিয়া আছে আঁধার রজনী ।
পূর্ব তীর হতে হু হু আসিছে নিশ্বাস ,
যাত্রী লয়ে পশ্চিমেতে চলেছে তরণী ।
মাঝে মাঝে দেখা দেয় বিদ্যুৎ – বিকাশ ,
কেহ কারে নাহি চেনে ব’সে নতশিরে ।
গলে ছিল বিদায়ের অশ্রুকণা – হার ,
ছিন্ন হয়ে একে একে ঝ’রে পড়ে নীরে ।
ওই বুঝি দেখা যায় ছায়া – পরপার ,
অন্ধকারে মিটিমিটি তারা – দীপ জ্বলে ।
হোথায় কি বিস্মরণ , নিঃস্বপ্ন নিদ্রার
শয়ন রচিয়া দিবে ঝরা ফুলদলে !
অথবা অকূলে শুধু অনন্ত রজনী
ভেসে চলে কর্ণধারবিহীন তরণী ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
নাম রেখেছি বাব্লারানী,
একরত্তি মেয়ে।
হাসিখুশি চাঁদের আলো
মুখটি আছে ছেয়ে।
ফুট্ফুটে তার দাঁত কখানি,
পুট্পুটে তার ঠোঁট।
মুখের মধ্যে কথাগুলি সব
উলোটপালোট।
কচি কচি হাত দুখানি,
কচি কচি মুঠি,
মুখ নেড়ে কেউ কথা ক'লে
হেসেই কুটি-কুটি।
তাই তাই তাই তালি দিয়ে
দুলে দুলে নড়ে,
চুলগুলি সব কালো কালো
মুখে এসে পড়ে।
‘চলি চলি পা পা'
টলি টলি যায়,
গরবিনী হেসে হেসে
আড়ে আড়ে চায়।
হাতটি তুলে চুড়ি দুগাছি
দেখায় যাকে তাকে,
হাসির সঙ্গে নেচে নেচে
নোলক দোলে নাকে।
রাঙা দুটি ঠোঁটের কাছে
মুক্তো আছে ফ'লে,
মায়ের চুমোখানি-যেন
মুক্তো হয়ে দোলে।
আকাশেতে চাঁদ দেখেছে,
দু হাত তুলে চায়,
মায়ের কোলে দুলে দুলে
ডাকে ‘আয় আয়'।
চাঁদের আঁখি জুড়িয়ে গেল
তার মুখেতে চেয়ে,
চাঁদ ভাবে কোত্থেকে এল
চাঁদের মতো মেয়ে।
কচি প্রাণের হাসিখানি
চাঁদের পানে ছোটে,
চাঁদের মুখের হাসি আরো
বেশি ফুঠে ওঠে।
এমন সাধের ডাক শুনে চাঁদ
কেমন করে আছে—
তারাগুলি ফেলে বুঝি
নেমে আসবে কাছে!
সুধামুখের হাসিখানি
চুরি করে নিয়ে
রাতারাতি পালিয়ে যাবে
মেঘের আড়াল দিয়ে।
আমরা তারে রাখব ধরে
রানীর পাশেতে।
হাসিরাশি বাঁধা রবে
হাসিরাশিতে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
২১ আষাঢ়, ১৩১৭
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
বারেক ভালোবেসে যে জন মজে
দেবতাসম সেই ধন্য,
দ্বিতীয়বার পুন প্রেমে যে পড়ে
মূর্খের অগ্রগণ্য।
আমিও সে দলের মূর্খরাজ
দুবার প্রেমপাশে পড়ি;
তপন শশী তারা হাসিয়া মরে,
আমিও হাসি– আর মরি।Heinrich Hein
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
মুচকে হাসে অতুল খুড়ো,
কানে কলম গোঁজা।
চোখ টিপে সে বললে হঠাৎ,
“পরতে হবে মোজা।’
হাসল ভজা, হাসল নবাই–
“ভারি মজা’ ভাবল সবাই–
ঘরসুদ্ধ উঠল হেসে,
কারণ যায় না বোঝা। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
দামিনীর আঁখি কিবা
ধরে জ্বল’ জ্বল’ বিভা
কার তরে জ্বলিতেছে কেবা তাহা জানিবে?
চারি দিকে খর ধার
বাণ ছুটিতেছে তার
কার-‘পরে লক্ষ্য তার কেবা অনুমানিবে?
তার চেয়ে নলিনীর আঁখিপানে চাহিতে
কত ভালো লাগে তাহা কে পারিবে কহিতে?
সদা তার আঁখি দুটি
নিচু পাতে আছে ফুটি,
সে আঁখি দেখে নি কেহ উঁচু পানে তুলিতে!
যদি বা সে ভুলে কভু চায় কারো আননে,
সহসা লাগিয়া জ্যোতি
সে-জন বিস্ময়ে অতি
চমকিয়া উঠে যেন স্বরগের কিরণে!
ও আমার নলিনী লো, লাজমাখা নলিনী,
অনেকেরি আঁখি-‘পরে
সৌন্দর্য বিরাজ করে,
তোর আঁখি-‘পরে প্রেম নলিনী লো নলিনী!
দামিনীর দেহে রয়
বসন কনকময়
সে বসন অপসরী সৃজিয়াছে যতনে,
যে গঠন যেই স্থান
প্রকৃতি করেছে দান
সে-সকল ফেলিয়াছে ঢাকিয়া সে বসনে।
নলিনী বসন পানে দেখ দেখি চাহিয়া
তার চেয়ে কত ভালো কে পারিবে কহিয়া?
শিথিল অঞ্চল তার
ওই দেখো চারি ধার
স্বাধীন বায়ুর মতো উড়িতেছে বিমানে,
যেথা যে গঠন আছে
পূর্ণ ভাবে বিকাশিছে
যেখানে যা উঁচু নিচু প্রকৃতির বিধানে!
ও আমার নলিনী লো, সুকোমলা নলিনী
মধুর রূপের ভাস
তাই প্রকৃতির বাস,
সেই বাস তোর দেহে নলিনী লো নলিনী!
দামিনীর মুখ-আগে
সদা রসিকতা জাগে,
চারি ধারে জ্বলিতেছে খরধার বাণ সে,
কিন্তু কে বলিতে পারে
শুধু সে কি ধাঁধিবারে,
নহে তা কি খর ধারে বিঁধিবারি মানসে?
কিন্তু নলিনীর মনে
মাথা রাখি সঙ্গোপনে
ঘুমায়ে রয়েছে কিবা প্রণয়ের দেবতা।
সুকোমল সে শয্যার
অতি যা কঠিন ধার
দলিত গোলাপ তাও আর কিছু নহে তা!
ও আমার নলিনী লো, বিনয়িনী নলিনী
রসিকতা তীব্র অতি
নাই তার এত জ্যোতি
তোমার নয়নে যত নলিনী লো নলিনী।Thomas Moore
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
বিসর্জনআজিও পড়িছে ওই সেই সে নির্ঝর!
হিমাদ্রির বুকে বুকে
শৃঙ্গে শৃঙ্গে ছুটে সুখে,
সরসীর বুকে পড়ে ঝর ঝর ঝর।আজিও সে শৈলবালা
বিস্তারিয়া ঊর্ম্মিমালা,
চলিছে কত কি কহি আপনার মনে!
তুষারশীতল বায়
পুষ্প চুমি চুমি যায়,
খেলা করে মনোসুখে তটিনীর সনে।কুটীর তটিনীতীরে
লতারে ধরিয়া শিরে
মুখছায়া দেখিতেছে সলিলদর্পণে!
হরিণেরা তরুছায়ে
খেলিতেছে গায়ে গায়ে,
চমকি হেরিছে দিক পাদপকম্পনে।বনের পাদপপত্র
আজিও মানবনেত্র
হিংসার অনলময় করে নি লোকন!
কুসুম লইয়া লতা
প্রণত করিয়া মাথা
মানবেরে উপহার দেয় নি কখন!বনের হরিণগণে
মানবের শরাসনে
ছুটে ছুটে ভ্রমে নাই তরাসে তরাসে!
কানন ঘুমায় সুখে
নীরব শান্তির বুকে,
কলঙ্কিত নাহি হোয়ে মানবনিশ্বাসে।কমলা বসিয়া আছে উদাসিনী বেশে
শৈলতটিনীর তীরে এলোথেলো কেশে
অধরে সঁপিয়া কর,
অশ্রু বিন্দু ঝর ঝর
ঝরিছে কপোলদেশে— মুছিছে আঁচলে।
সম্বোধিয়া তটিনীরে ধীরে ধীরে বলে,
‘তটিনী বহিয়া যাও আপনার মনে!
কিন্তু সেই ছেলেবেলা
যেমন করিতে খেলা
তেমনি করিয়ে খেলো নির্ঝরের সনে!তখন যেমন স্বরে
কল কল গান করে
মৃদু বেগে তীরে আসি পড়িতে লো ঝাঁপি
বালিকা ক্রীড়ার ছলে
পাথর ফেলিয়া জলে
মারিতাম— জলরাশি উঠিত লো কাঁপিতেমনি খেলিয়ে চল্
তুই লো তটিনীজল!
তেমনি বিতরি সুখ নয়নে আমার।
নির্ঝর তেমনি কোরে
ঝাঁপিয়া সরসী-পরে
পড়্ লো উগরি শুভ্র ফেনরাশিভার!মুছিতে লো অশ্রুবারি এয়েছি হেথায়।
তাই বলি পাপিয়ারে!
গান কর্ সুধাধারে
নিবাইয়া হৃদয়ের অনলশিখায়!ছেলেবেলাকার মত
বায়ু তুই অবিরত
লতার কুসুমরাশি কর্ লো কম্পিত!
নদী চল্ দুলে দুলে!
পুষ্প দে হৃদয় খুলে!
নির্ঝর সরসীবক্ষ কর্ বিচলিত!সেদিন আসিবে আর
হৃদিমাঝে যাতনার
রেখা নাই, প্রমোদেই পূরিত অন্তর!
ছুটাছুটি করি বনে
বেড়াইব ফুল্লমনে,
প্রভাতে অরুণোদয়ে উঠিব শিখর!মালা গাঁথি ফুলে ফুলে
জড়াইব এলোচুলে,
জড়ায়ে ধরিব গিয়ে হরিণের গল!
বড় বড় দুটি আঁখি
মোর মুখপানে রাখি
এক দৃষ্টে চেয়ে রবে হরিণ বিহ্বল!সেদিন গিয়েছে হা রে—
বেড়াই নদীর ধারে
ছায়াকুঞ্জে শুনি গিয়ে শুকদের গান!
না থাক্, হেথায় বসি,
কি হবে কাননে পশি—
শুক আর গাবে নাকো খুলিয়ে পরাণ!
সেও যে গো ধরিয়াছে বিষাদের তান!জুড়ায়ে হৃদয়ব্যথা
দুলিবে না পুষ্পলতা,
তেমন জীবন্ত ভাবে বহিবে না বায়!
প্রাণহীন যেন সবি—
যেন রে নীরব ছবি—
প্রাণ হারাইয়া যেন নদী বহে যায়!তবুও যাহাতে হোক্
নিবাতে হইবে শোক,
তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল!
তবুও ত আপনারে
ভুলিতে হইবে হা রে!
তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!যাই তবে বনে বনে
ভ্রমিগে আপনমনে,
যাই তবে গাছে গাছে ঢালি দিই জল!
শুকপাখীদের গান
শুনিয়া জুড়াই প্রাণ,
সরসী হইতে তবে তুলিগে কমল!হৃদয় নাচে না ত গো তেমন উল্লাসে!
ভ্রমিত ভ্রমিই বনে
ম্রিয়মাণ শূন্যমনে,
দেখি ত দেখিই বোসে সলিল-উচ্ছ্বাসে!
তেমন জীবন্ত ভাব নাই ত অন্তরে—
দেখিয়া লতার কোলে
ফুটন্ত কুসুম দোলে,
কুঁড়ি লুকাইয়া আছে পাতার ভিতবে—নির্ঝরের ঝরঝরে
হৃদয়ে তেমন কোরে
উল্লাসে শোণিতরাশি উঠে না নাচিয়া!
কি জানি কি করিতেছি,
কি জানি কি ভাবিতেছি,
কি জানি কেমনধারা শূন্যপ্রায় হিয়া!তবুও যাহাতে হোক্
নিবাতে হইবে শোক,
তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল।
তবুও ত আপনারে
ভুলিতে হইবে হা রে,
তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!কাননে পশিগে তবে
শুক যেথা সুধারবে
গান করে জাগাইয়া নীরব কানন।
উঁচু করি করি মাথা
হরিণেরা বৃক্ষপাতা
সুধীরে নিঃশঙ্কমনে করিছে চর্ব্বণ!’সুন্দরী এতেক বলি
পশিল কাননস্থলী,
পাদপ রৌদ্রের তাপ করিছে বারণ।
বৃক্ষছায়ে তলে তলে
ধীরে ধীরে নদী চলে
সলিলে বৃক্ষের মূল করি প্রক্ষালন।হরিণ নিঃশঙ্কমনে
শুয়ে ছিল ছায়াবনে,
পদশব্দ পেয়ে তারা চমকিয়া উঠে।
বিস্তারি নয়নদ্বয়
মুখপানে চাহি রয়,
সহসা সভয় প্রাণে বনান্তরে ছুটে।ছুটিছে হরিণচয়,
কমলা অবাক্ রয়—
নেত্র হতে ধীরে ধীরে ঝরে অশ্রুজল।
ওই যায়— ওই যায়
হরিণ হরিণী হায়—
যায় যায় ছুটে ছুটে মিলি দলে দল।কমলা বিষাদভরে
কহিল সমুচ্চস্বরে—
প্রতিধ্বনি বন হোতে ছুটে বনান্তরে—
‘যাস্ নে— যাস্ নে তোরা, আয় ফিরে আয়!
কমলা— কমলা সেই ডাকিতেছে তোরে!সেই যে কমলা সেই থাকিত কুটীরে,
সেই যে কমলা সেই বেড়াইত বনে!
সেই যে কমলা পাতা ছিঁড়ি ধীরে ধীরে
হরষে তুলিয়া দিত তোদের আননে!কোথা যাস্— কোথা যাস্— আয় ফিরে আয়!
ডাকিছে তোদের আজি সেই সে কমলা!
কারে ভয় করি তোরা যাস্ রে কোথায়?
আয় হেথা দীর্ঘশৃঙ্গ! আয় লো চপলা!এলি নে— এলি নে তোরা এখনো এলি নে—
কমলা ডাকিছে যে রে,তবুও এলি নে!
ভুলিয়া গেছিস্ তোরা আজি কমলারে?
ভুলিয়া গেছিস্ তোরা আজি বালিকারে?খুলিয়া ফেলিনু এই কবরীবন্ধন,
এখনও ফিরিবি না হরিণের দল?
এই দেখ্— এই দেখ্ ফেলিয়া বসন
পরিনু সে পুরাতন গাছের বাকল!
যাক্ তবে, যাক্ চলে— যে যায় যেখানে—
শুক পাখী উড়ে যাক্ সুদূর বিমানে!
আয়— আয়— আয় তুই আয় রে মরণ!বিনাশশক্তিতে তোর নিভা এ যন্ত্রণা!
পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন!
বহিতে অনল হৃদে আর ত পারি না!
নীরদ স্বরগে আছে, আছেন জনক
স্নেহময়ী মাতা মোর কোল রাখি পাতি—
সেথায় মিলিব গিয়া, সেথায় যাইব—
ভোর করি জীবনের বিষাদের রাতি!
নীরদে আমাতে চড়ি প্রদোষতারায়
অস্তগামী তপনেরে করিব বীক্ষণ,
মন্দাকিনী তীরে বসি দেখিব ধরায়
এত কাল যার কোলে কাটিল জীবন।
শুকতারা প্রকাশিবে উষার কপোলে
তখন রাখিয়া মাথা নীরদের কোলে—
অশ্রুজলসিক্ত হয়ে কব সেই কথা
পৃথিবী ছাড়িয়া এনু পেয়ে কোন্ ব্যথা!নীরদের আঁখি হোতে ববে অশ্রুজল!
মুছিব হরষে আমি তুলিয়া আঁচল!
আয়— আয়— আয় তুই, আয় রে মরণ!
পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন!’এত বলি ধীরে ধীরে উঠিল শিখর!
দেখে বালা নেত্র তুলে—
চারি দিক গেছে খুলে
উপত্যকা, বনভূমি, বিপিন, ভূধর!তটিনীর শুভ্র রেখা—
নেত্রপথে দিল দেখা—
বৃক্ষছায়া দুলাইয়া বহে বহে যায়!ছোট ছোট গাছপালা—
সঙ্কীর্ণ নির্ঝরমালা—
সবি যেন দেখা যায় রেখা-রেখা-প্রায়।গেছে খুলে দিগ্বিদিক—
নাহি পাওয়া যায় ঠিক
কোথা কুঞ্জ— কোথা বন— কোথায় কুটীর!
শ্যামল মেঘের মত—
হেথা হোথা কত শত
দেখায় ঝোপের প্রায় কানন গভীর!তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!
মাথায় জলদ ঠেকে,
চরণে চাহিয়া দেখে
গাছপালা ঝোপে-ঝাপে ভূধর আবরি!ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখা-রেখা
হেথা হোথা যায় দেখাকে কোথা পড়িয়া আছে কে দেখে কোথায়!
বন, গিরি, লতা, পাতা আঁধারে মিশায়!অসংখ্য শিখরমালা ব্যাপি চারি ধার—
মধ্যের শিখর-পরে
(মাথায় আকাশ ধরে)
কমলা দাঁড়ায়ে আছে, চৌদিকে তুষার!চৌদিকে শিখরমালা—
মাঝেতে কমলা বালা
একেলা দাঁড়ায়ে মেলি নয়নযুগল!
এলোথেলো কেশপাশ,
এলোথেলো বেশবাস,
তুষারে লুটায়ে পড়ে বসন-আঁচল!যেন কোন্ সুরবালা
দেখিতে মর্ত্ত্যের লীলা
স্বর্গ হোতে নামি আসি হিমাদ্রিশিখরেচড়িয়া নীরদ-রথে—
সমুচ্চ শিখর হোতে
দেখিলেন পৃথ্বীতল বিস্মিত অন্তরে!তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!
হিমময় বায়ু ছুটে,
অন্তরে অন্তরে ফুটে
হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধপ্রায় করি!
শীতল তুষারদল
কোমল চরণতল
দিয়াছে অসাড় করে পাষাণের মত!
কমলা দাঁড়ায়ে আছে যেন জ্ঞানহত!
কোথা স্বর্গ— কোথা মর্ত্ত্য— আকাশ পাতাল!
কমলা কি দেখিতেছে!
কমলা কি ভাবিতেছে!
কমলার হৃদয়েতে ঘোর গোলমাল!চন্দ্র সূর্য্য নাই কিছু—
শূন্যময় আগু পিছু!
নাই রে কিছুই যেন ভূধর কানন!
নাইক শরীর দেহ,
জগতে নাইক কেহ—
একেলা রয়েছে যেন কমলার মন!
কে আছে— কে আছে— আজি কর গো বারণ!বালিকা ত্যজিতে প্রাণ করেছে মনন!
বারণ কর গো তুমি গিরি হিমালয়!
শুনেছ কি বনদেবী— করুণা-আলয়—
বালিকা তোমার কোলে করিত ক্রন্দন,
সে নাকি মরিতে আজ করেছে মনন?বনের কুসুমকলি
তপনতাপনে জ্বলি
শুকায়ে মরিবে নাকি করেছে মনন!
শীতল শিশিরধারে
জীয়াও জীয়াও তারে
বিশুষ্ক হৃদয়মাঝে বিতরি জীবন!উদিল প্রদোষতারা সাঁঝের আঁচলে—
এখনি মুদিবে আঁখি?
বারণ করিবে না কি?
এখনি নীরদকোলে মিশাবে কি বোলে?অনন্ত তুষারমাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!
মোহস্বপ্ন গেছে ছুটে—
হেরিল চমকি উঠে
চৌদিকে তুষাররাশি শিখর আবরি!উচ্চ হোতে উচ্চ গিরি
জলদে মস্তক ঘিরি
দেবতার সিংহাসন করিছে লোকন!
বনবালা থাকি থাকি
সহসা মুদিল আঁখি
কাঁপিয়া উঠিল দেহ! কাঁপি উঠে মন!অনন্ত আকাশমাঝে একেলা কমলা!
অনন্ত তুষারমাঝে একেলা কমলা!
সমুচ্চ শিখর-পরে একেলা কমলা!
আকাশে শিখর উঠে
চরণে পৃথিবী লুটে—
একেলা শিখর-পরে বালিকা কমলা!
ওই— ওই— ধর্— ধর্— পড়িল বালিকা!
ধবলতুষারচ্যুতা পড়িল বিহ্বল!—
খসিল পাদপ হোতে কুসুমকলিকা!
খসিল আকাশ হোতে তারকা উজ্জ্বল!প্রশান্ত তটিনী চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
ধরিল বুকের পরে কমলাবালায়!
উচ্ছ্বাসে সফেন জল উঠিল নাচিয়া!
কমলার দেহ ওই ভেসে ভেসে যায়!
কমলার দেহ বহে সলিল-উচ্ছ্বাস!
কমলার জীবনের হোলো অবসান!
ফুরাইল কমলার দুখের নিঃশ্বাস,
জুড়াইল কমলার তাপিত পরাণ!
কল্পনা! বিষাদে দুখে গাইনু সে গান!
কমলার জীবনের হোলো অবসান!
দীপালোক নিভাইল প্রচণ্ড পবন!
কমলার— প্রতিমার হল বিসর্জ্জন!
আকাশে শিখর উঠে
চরণে পৃথিবী লুটে—
একেলা শিখর-পরে বালিকা কমলা!
ওই— ওই— ধর্ — ধর্ — পড়িল বালিকা!
ধবলতুষারচ্যুতা পড়িল বিহ্বল!—
খসিল পাদপ হোতে কুসুমকলিকা!
খসিল আকাশ হোতে তারকা উজ্জ্বল!প্রশান্ত তটিনী চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
ধরিল বুকের পরে কমলাবালায়!
উচ্ছ্বাসে সফেন জল উঠিল নাচিয়া!
কমলার দেহ ওই ভেসে ভেসে যায়!
কমলার দেহ বহে সলিল-উচ্ছ্বাস!
কমলার জীবনের হোলো অবসান!
ফুরাইল কমলার দুখের নিঃশ্বাস,
জুড়াইল কমলার তাপিত পরাণ!
কল্পনা! বিষাদে দুখে গাইনু সে গান!
কমলার জীবনের হোলো অবসান!
দীপালোক নিভাইল প্রচণ্ড পবন!
কমলার— প্রতিমার হল বিসর্জ্জন! (বন-ফুল কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আমি যখন পাঠশালাতে যাই
আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে,
দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই
ফেরিওলা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে।
‘চুড়ি চা— ই, চুড়ি চাই' সে হাঁকে,
চীনের পুতুল ঝুড়িতে তার থাকে,
যায় সে চলে যে পথে তার খুশি,
যখন খুশি খায় সে বাড়ি গিয়ে।
দশটা বাজে, সাড়ে দশটা বাজে,
নাইকো তাড়া হয় বা পাছে দেরি।
ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে
অম্নি করে বেড়াই নিয়ে ফেরি।
আমি যখন হাতে মেখে কালি
ঘরে ফিরি, সাড়ে চারটে বাজে,
কোদাল নিয়ে মাটি কোপায় মালী
বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মাঝে।
কেউ তো তারে মানা নাহি করে
কোদাল পাছে পড়ে পায়ের ‘পরে।
গায়ে মাথায় লাগছে কত ধুলো,
কেউ তো এসে বকে না তার কাজে।
মা তারে তো পরায় না সাফ জামা,
ধুয়ে দিতে চায় না ধুলোবালি।
ইচ্ছে করে আমি হতেম যদি
বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মালী।
একটু বেশি রাত না হতে হতে
মা আমারে ঘুম পাড়াতে চায়।
জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে পথে
পাগড়ি পরে পাহারওলা যায়।
আঁধার গলি, লোক বেশি না চলে,
গ্যাসের আলো মিট্মিটিয়ে জ্বলে,
লণ্ঠনটি ঝুলিয়ে নিয়ে হাতে
দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির দরজায়।
রাত হয়ে যায় দশটা এগারোটা
কেউ তো কিছু বলে না তার লাগি।
ইচ্ছে করে পাহারওলা হয়ে
গলির ধারে আপন মনে জাগি। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা,
মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।
সারা জনম তোমার লাগি
প্রতিদিন যে আছি জাগি,
তোমার তরে বহে বেড়াই
দুঃখসুখের ব্যথা।
মরণ, আমার মরণ, তুমি
কও আমারে কথা।যা পেয়েছি, যা হয়েছি
যা-কিছু মোর আশা।
না জেনে ধায় তোমার পানে
সকল ভালোবাসা।
মিলন হবে তোমার সাথে,
একটি শুভ দৃষ্টিপাতে,
জীবনবধূ হবে তোমার
নিত্য অনুগতা;
মরণ, আমার মরণ, তুমি
কও আমারে কথা।বরণমালা গাঁথা আছে,
আমার চিত্তমাঝে,
কবে নীরব হাস্যমুখে
আসবে বরের সাজে।
সেদিন আমার রবে না ঘর,
কেই-বা আপন, কেই-বা অপর,
বিজন রাতে পতির সাথে
মিলবে পতিব্রতা।
মরণ, আমার মরণ, তুমি
কও আমারে কথা।শিলাইদহ, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ফুলের অক্ষরে প্রেম
লিখে রাখে নাম আপনার—
ঝ’রে যায়, ফেরে সে আবার।
পাথরে পাথরে লেখা
কঠিন স্বাক্ষর দুরাশার
ভেঙে যায়, নাহি ফেরে আর। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আজ বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে;
চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে।
হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা,
ধাইতে ধাইতে লোপ ক’রে চলে সীমা,
কোন্ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে,
বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।
বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।পুঞ্জে পুঞ্জে দূর সুদূরের পানে
দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে।
জানে না কিছুই কোন্ মহাদ্রিতলে
গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে,
নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে
কোন্ সে ভীষণ জীবন-মরণ রাজে।
বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।ঈশান কোণেতে ওই যে ঝড়ের বাণী
গুরু গুরু রবে কী করিছে কানাকানি।
দিগন্তরালে কোন্ ভবিতব্যতা
স্তব্ধ তিমিরে বহে ভাষাহীন ব্যথা,
কালো কল্পনা নিবিড় ছায়ার তলে
ঘনায়ে উঠিছে কোন্ আসন্ন কাজে।
বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে।১১ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে--
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো--
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে--
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে--
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে--
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে--
দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে--
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি ॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ফসল গিয়েছে পেকে,
দিনান্ত আপন চিহ্ন দিল তারে পাণ্ডূর আভায়।
আলোকের ঊর্ধ্বসভা হতে
আসন পড়িছে নুয়ে ভূতলের পানে।
যে মাটির উদ্বোধন বাণী
জাগায়েছে তারে একদিন,
শোনো আজি তাহারই আহ্বান
আসন্ন রাত্রির অন্ধকারে।
সে মাটির কোল হতে যে দান নিয়েছে এতকাল
তার চেয়ে বেশি প্রাণ কোথাও কি হবে ফিরে দেওয়া
কোনো নব জন্মদিনে নব সূর্যোদয়ে!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল -
তার পরে যদি তুমি ভোল
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার -
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
তবু ভালোবাস যদি বেসো।।বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,
ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী,
তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন
আমার স্মৃতির আঁখিজলে -
আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন
রবে তব বিস্মৃতিতলে।।দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে
যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে,
হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে -
নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।
মার্জনা কর যদি পাব তবে বল,
করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল -
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,
দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
দুঃখের মূল্য না মিলে।।দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি -
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন
চিরবিচ্ছেদ করি জয়।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আয় লো প্রমদা! নিঠুর ললনে
বার বার বল্ কী আর বলি!
মরমের তলে লেগেছে আঘাত
হৃদয় পরাণ উঠেছে জ্বলি!
আর বলিব না এই শেষবার
এই শেষবার বলিয়া লই
মরমের তলে জ্বলেছে আগুন
হৃদয় ভাঙিয়া গিয়াছে সই!
পাষাণে গঠিত সুকুমার ফুল!
হুতাশনময়ী দামিনী বালা!
অবারিত করি মরমের তল
কহিব তোরে লো মরম জ্বালা!
কতবার তোরে কহেছি ললনে!
দেখায়েছি খুলে হৃদয় প্রাণ!
মরমের ব্যথা,হৃদয়ের কথা,
সে-সব কথায় দিস্ নি কান।
কতবার সখি বিজনে বিজনে
শুনায়েছি তোরে প্রেমের গান,
প্রেমের আলাপক প্রেমের প্রলাপ
সে-সব প্রলাপে দিস্ নি কান!
কতবার সখি! নয়নের জল
করেছি বর্ষণ চরণতলে!
প্রতিশোধ তুই দিস্ নিকো তার
শুধু এক ফোঁটা নয়নজলে!
শুধা ওলো বালা! নিশার আঁধারে
শুধা ওলো সখি! আমার রেতে
আঁখিজল কত করেছে গোপন
মর্ত্য পৃথিবীর নয়ন হতে!
শুধা ওলো বালা নিশার বাতাসে
লুটিতে আসিয়া ফুলের বাস
হৃদয়ে বহন করেছে কিনা সে--
নিরাশ প্রেমীর মরম শ্বাস!
সাক্ষী আছ ওগো তারকা চন্দ্রমা!
কেঁদেছি যখন মরম শোকে--
হেসেছে পৃথিবী, হেসেছে জগৎ
কটাক্ষ করিয়া হেসেছে লোকে!
সহেছি সে-সব তোর তরে সখি!
মরমে মরমে জ্বলন্ত জ্বালা !
তুচ্ছ করিবারে পৃথিবী জগতে
তোমারি তরে লো শিখেছি বালা!
মানুষের হাসি তীব্র বিষমাখা
হৃদয় শোণিত করেছে ক্ষয়!
তোমারি তরে লো সহেছি সে-সব
ঘৃণা উপহাস করেছি জয়!
কিনিতে হৃদয় দিয়েছি হৃদয়
নিরাশ হইয়া এসেছি ফিরে;
অশ্রু মাগিবারে দিয়া অশ্রুজল
উপেক্ষিত হয়ে এয়েছি ফিরে।
কিছুই চাহি নি পৃথিবীর কাছে-
প্রেম চেয়েছিনু ব্যাকুল মনে।
সে বাসনা যবে হল না পূরণ
চলিয়া যাইব বিজন বনে!
তোর কাছে বালা এই শেষবার
ফেলিল সলিল ব্যাকুল হিয়া
ভিখারি হইয়া যাইব লো চলে
প্রেমের আশায় বিদায় দিয়া !
সেদিন যখন ধন, যশ, মান,
অরির চরণে দিলাম ঢালিসেইদিন আমি ভেবেছিনু মনে
উদাস হইয়া যাইব চলি।
তখনো হায় রে একটি বাঁধনে
আবদ্ধ আছিল পরাণ দেহ।
সে দৃঢ় বাঁধন ভেবেছিনু মনে
পারিবে না আহা ছিঁড়িতে কেহ!
আজ ছিঁড়িয়াছে, আজ ভাঙিয়াছে,
আজ সে স্বপন গিয়াছে চলি।
প্রেম ব্রত আজ করি উদ্যাপন
ভিখারি হইয়া যাইব চলি!
পাষাণের পটে ও মূরতিখানি
আঁকিয়া হৃদয়ে রেখেছি তুলি
গরবিনি! তোর ওই মুখখানি
এ জনমে আর যাব না ভুলি!
মুছিতে নারিব এ জনমে আর
নয়ন হইতে নয়নবারি
যতকাল ওই ছবিখানি তোর
হৃদয়ে রহিবে হৃদয় ভরি।
কী করিব বালা মরণের জলে
ওই ছবিখানি মুছিতে হবে!
পৃথিবীর লীলা ফুরাইবে আজ,
আজিকে ছাড়িয়া যাইব ভবে!
এ ভাঙা হৃদয় কত সবে আর!
জীর্ণ প্রাণ কত সহিবে জ্বালা!
মরণের জল ঢালিয়া অনলে
হৃদয় পরাণ জুড়াল বালা!
তোরে সখি এত বাসিতাম ভালো
খুলিয়া দেছিনু হৃদয়তল
সে-সব ভাবিয়া ফেলিবি না বালা
শুধু এক ফোঁটা নয়ন জল?
আকাশ হইতে দেখি যদি বালা
নিঠুর ললনে! আমার তরে
এক ফোঁটা আহা নয়নের জল
ফেলিস্ কখনো বিষাদভরে!
সেই নেত্রজলে-- এক বিন্দু জলে
নিভায়ে ফেলিব হৃদয় জ্বালা!
প্রদোষে বসিয়া প্রদোষ তারায়
প্রেম গান সুখে করিব বালা!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ঠাকুরমা দ্রুততালে ছড়া যেত প ' ড়ে —
ভাবখানা মনে আছে — “ বউ আসে চতুর্দোলা চ ' ড়ে
আম কাঁঠালের ছায়ে ,
গলায় মোতির মালা , সোনার চরণচক্র পায়ে । ”
বালকের প্রাণে
প্রথম সে নারীমন্ত্র আগমনীগানে
ছন্দের লাগাল দোল আধোজাগা কল্পনার শিহরদোলায় ,
আঁধার-আলোর দ্বন্দ্বে যে প্রদোষে মনেরে ভোলায় ,
সত্য-অসত্যের মাঝে লোপ করি সীমা
দেখা দেয় ছায়ার প্রতিমা ।
ছড়া-বাঁধা চতুর্দোলা চলেছিল যে-গলি বাহিয়া
চিহ্নিত করেছে মোর হিয়া
গভীর নাড়ীর পথে অদৃশ্য রেখায় এঁকেবেঁকে ।
তারি প্রান্ত থেকে
অশ্রুত সানাই বাজে অনিশ্চিত প্রত্যাশার সুরে
দুর্গম চিন্তার দূরে দূরে ।
সেদিন সে কল্পলোকে বেহারাগুলোর পদক্ষেপে
বক্ষ উঠেছিল কেঁপে কেঁপে ,
পলে পলে ছন্দে ছন্দে আসে তারা আসে না তবুও ,
পথ শেষ হবে না কভুও ।
সেকাল মিলাল । তার পরে , বধূ-আগমনগাথা
গেয়েছে মর্মরচ্ছন্দে অশোকের কচি রাঙা পাতা ;
বেজেছে বর্ষণঘন শ্রাবণের বিনিদ্র নিশীথে ;
মধ্যাহ্নে করুণ রাগিণীতে
বিদেশী পান্থের শ্রান্ত সুরে ।
অতিদূর মায়াময়ী বধূর নূপুরে
তন্দ্রার প্রত্যন্তদেশে জাগায়েছে ধ্বনি
মৃদু রণরণি ।
ঘুম ভেঙে উঠেছিনু জেগে ,
পূর্বাকাশে রক্ত মেঘে
দিয়েছিল দেখা
অনাগত চরণের অলক্তের রেখা ।
কানে কানে ডেকেছিল মোরে
অপরিচিতার কণ্ঠ স্নিগ্ধ নাম ধ ' রে —
সচকিতে
দেখে তবু পাই নি দেখিতে ।
অকস্মাৎ একদিন কাহার পরশ
রহস্যের তীব্রতায় দেহে মনে জাগাল হরষ ;
তাহারে শুধায়েছিনু অভিভূত মুহূর্তেই ,
“ তুমিই কি সেই ,
আঁধারের কোন্ ঘাট হতে
এসেছ আলোতে! ”
উত্তরে সে হেনেছিল চকিত বিদ্যুৎ ;
ইঙ্গিতে জানায়েছিল , “ আমি তারি দূত ,
সে রয়েছে সব প্রত্যক্ষের পিছে ,
নিত্যকাল সে শুধু আসিছে ।
নক্ষত্রলিপির পত্রে তোমার নামের কাছে
যার নাম লেখা রহিয়াছে
অনাদি অজ্ঞাত যুগে সে চড়েছে তার চতুর্দোলা ,
ফিরিছে সে চির-পথভোলা
জ্যোতিষ্কের আলোছায়ে ,
গলায় মোতির মালা , সোনার চরণচক্র পায়ে । ”
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নির্জন রোগীর ঘর।
খোলা দ্বার দিয়ে
বাঁকা ছায়া পড়েছে শয্যায়।
শীতের মধ্যাহ্নতাপে তন্দ্রাতুর বেলা
চলেছে মন্থরগতি
শৈবালে দুর্বলস্রোত নদীর মতন।
মাঝে মাঝে জাগে যেন দূর অতীতের দীর্ঘশ্বাস
শস্যহীন মাঠে।মনে পড়ে কতদিন
ভাঙা পাড়িতলে পদ্মা
কর্মহীন প্রৌঢ় প্রভাতের
ছায়াতে আলোতে
আমার উদাস চিন্তা দেয় ভাসাইয়া
ফেনায় ফেনায়।
স্পর্শ করি শূন্যের কিনারা
জেলেডিঙি চলে পাল তুলে,
যূথভ্রষ্ট শুভ্র মেঘ পড়ে থাকে আকাশের কোণে।
আলোতে ঝিকিয়া-ওঠা ঘট কাঁখে পল্লীমেয়েদের
ঘোমটায় গুন্ঠিত আলাপে
গুঞ্জরিত বাঁকা পথে আম্রবনচ্ছায়ে
কোকিল কোথায় ডাকে ক্ষণে ক্ষণে নিভৃত শাখায়,
ছায়ায় কুন্ঠিত পল্লীজীবনযাত্রার
রহস্যের আবরণ কাঁপাইয়া তোলে মোর মনে।
পুকুরের ধারে ধারে সর্ষেখেতে পূর্ণ হয়ে যায়
ধরণীর প্রতিদান রৌদ্রের দানের,
সূর্যের মন্দিরতলে পুষ্পের নৈবেদ্য থাকে পাতা।আমি শান্ত দৃষ্টি মেলি নিভৃত প্রহরে
পাঠায়েছি নিঃশব্দ বন্দনা,
সেই সবিতারে যাঁর জ্যোতীরূপে প্রথম মানুষ
মর্তের প্রাঙ্গণতলে দেবতার দেখেছে স্বরূপ।
মনে মনে ভাবিয়াছি, প্রাচীন যুগের
বৈদিক মন্ত্রের বাণী কন্ঠে যদি থাকিত আমার
মিলিত আমার স্তব স্বচ্ছ এই আলোকে আলোকে;
ভাষা নাই, ভাষা নাই;
চেয়ে দূর দিগন্তের পানে
মৌন মোর মেলিয়াছি পাণ্ডুনীল মধ্যাহ্ন-আকাশে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
পদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়,
মনে মনে দেখি তাকে।
এক পারে বালুর চর,
নির্ভীক কেননা নিঃস্ব, নিরাসক্ত,-
অন্য পারে বাঁশবন, আমবন,
পুরোনো বট, পোড়ো ভিটে,
অনেক দিনের গুড়ি-মোটা কাঁঠালগাছ-
পুকুরের ধারে সর্ষেখেত,
পথের ধারে বেতের জঙ্গল,
দেড়শো বছর আগেকার নীলকুঠির ভাঙা ভিত,
তার বাগানে দীর্ঘ ঝাউগাছে দিনরাত মর্মরধ্বনি।
ঐখানে রাজবংশীদের পাড়া,
ফাটল-ধরা খেতে ওদের ছাগল চরে,
হাটের কাছে টিনের ছাদওয়ালা গঞ্জ-
সমস্ত গ্রাম নির্মম নদীর ভয়ে কম্পান্বিত।পুরাণে প্রসিদ্ধ এই নদীর নাম,
মন্দাকিনীর প্রবাহ ওর নাড়ীতে।
ও স্বতন্ত্র। লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলে যায়,
তাদের সহ্য করে, স্বীকার করে না।
বিশুদ্ধ তার আভিজাতিক ছন্দে
এক দিকে নির্জন পর্বতের স্মৃতি, আর-এক দিকে নিঃসঙ্গ সমুদ্রের আহ্বান।একদিন ছিলেম ওরি চরের ঘাটে,
নিভৃতে, সবার হতে বহুদূরে।
ভোরের শুকতারাকে দেখে জেঘেছি,
ঘুমিয়েছি রাতে সপ্তর্ষির দৃষ্টির সম্মুখে
নৌকার ছাদের উপর।
আমার একলা দিন-রাতের নানা ভাবনার ধারে ধারে
চলে গেছে ওর উদাসীর ধারা-
পথিক যেমন চলে যায়
গৃহস্থের সুখদুঃখের পাশ দিয়ে, অথচ দূর দিয়ে।তার পরে যৌবনের শেষ এসেছি
তরুবিরল এই মাঠের প্রান্তে।
ছায়াবৃত সাঁওতাল-পাড়ার পুঞ্জিত সবুজ দেখা যায় অদূরে।এখানে আমার প্রতিবেশিনী কোপাই নদী।
প্রাচীন গোত্রের গরিমা নেই তার।
অনার্য তার নামখানি
কত কালের সাঁওতাল নারীর হাস্যমুখর
কলভাষার সঙ্গে জড়িত।
গ্রামের সঙ্গে তার গলাগলি
স্থলের সঙ্গে জলের নেই বিরোধ।
তার এ পারের সঙ্গে ও পারের কথা চলে সহজে।
শণের খেতে ফুল ধরেছে একেবারে তার গায়ে গায়ে,
জেগে উঠেছে কচি কচি ধানের চারা।
রাস্তা যেখানে থেমেছে তীরে এসে
সেখানে ও পথিককে দেয় পথ ছেড়ে
কলকল স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতের উপর দিয়ে।
অদূরে তালগাছ উঠেছে মাঠের মধ্যে,
তীরে আম জাম আমলকীল ঘেঁষাঘেঁষি।ওর ভাষা গৃহস্থপাড়ার ভাষা-
তাকে সাধুভাষা বলে না।
জল স্থল বাঁধা পড়েছে ওর ছন্দে,
রেষারেষি নেই তরলে শ্যামলে।
ছিপছিপে ওর দেহটি
বেঁকে বেঁকে চলে ছায়ায় আলোয়
হাততাল দিয়ে সহজ নাচে।
বর্ষায় ওর অঙ্গে অঙ্গে লাগে মাতলামি
মহুয়া-মাতাল গাঁয়ের মেয়ের মতো-
ভাঙে না, ডোবায় না,
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আবর্তের ঘাঘরা
দুই তীরকে ঠেলা দিয়ে দিয়ে
উচ্চ হেসে ধেয়ে চলে।শরতের শেষে স্বচ্ছ হয়ে আসে জল,
ক্ষীণ হয় তার ধারা,
তলার বালি চোখো পড়ে,
তখন শীর্ণ সমারোহের পাণ্ডুরতা
তাকে তো লজ্জা দিতে পারে না।
তার ধন নয় উদ্ধত, তার দৈন্য নয় মলিন;
এ দুইয়েই তার শোভা-
যেমন নটী যখন অলংকারের ঝংকার দিয়ে নাচে,
আর যখন সে নীরবে বসে থাকে ক্লান্ত হয়ে,
চোখের চাহনিতে আলস্য,
একটুকানি হাসির আভাস ঠোঁটের কোণে।
কোপাই আজ কবির ছন্দকে আপন সাথি করে নিলে,
সেই ছন্দের আপোস হয়ে গেল ভাষার স্থলে জলে.,
যেখানে ভাষার গান আর যেখানে ভাষার গৃহস্থালি।
তার ভাঙা তালে হে'টে চলে যাবে ধনুক হাতে সাঁওতাল ছেলে;
পার হয়ে যাবে গোরুর গাড়ি
আঁটি আঁটি খড় বোঝাই করে;
হাটে যাবে কুমোর
বাঁকে করে হাঁড়ি নিয়ে;
পিছন পিছন যাবে গাঁয়ের কুকুরটা;
আর, মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরু
ছেড়া ছাতি মাথায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
রায়বাহাদুর কিষনলালের স্যাকরা জগন্নাথ,
সোনারুপোর সকল কাজে নিপুণ তাহার হাত।
আপন বিদ্যা শিখিয়ে মানুষ করবে ছেলেটাকে
এই আশাতে সময় পেলেই ধরে আনত তাকে;
বসিয়ে রাখত চোখের সামনে, জোগান দেবার কাজে
লাগিয়ে দিত যখন তখন; আবার মাঝে মাঝে
ছোটো মেয়ের পুতুল-খেলার গয়না গড়াবার
ফরমাশেতে খাটিয়ে নিত; আগুন ধরাবার
সোনা গলাবার কর্মে একটুখানি ভুলে
চড়চাপড়টা পড়ত পিঠে, টান লাগাত চুলে।
সুযোগ পেলেই পালিয়ে বেড়ায় মাধো যে কোন্খানে
ঘরের লোকে খুঁজে ফেরে বৃথাই সন্ধানে।
শহরতলির বাইরে আছে দিঘি সাবেককেলে
সেইখানে সে জোটায় যত লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।
গুলিডাণ্ডা খেলা ছিল, দোলনা ছিল গাছে,
জানা ছিল যেথায় যত ফলের বাগান আছে।
মাছ ধরবার ছিপ বানাত, সিসুডালের ছড়ি;
টাট্টুঘোড়ার পিঠে চড়ে ছোটাত দড়্বড়ি।
কুকুরটা তার সঙ্গে থাকত, নাম ছিল তার বটু--
গিরগিটি আর কাঠবেড়ালি তাড়িয়ে ফেরায় পটু।
শালিখপাখির মহলেতে মাধোর ছিল যশ,
ছাতুর গুলি ছড়িয়ে দিয়ে করত তাদের বশ।
বেগার দেওয়ার কাজে পাড়ায় ছিল না তার মতো,
বাপের শিক্ষানবিশিতেই কুঁড়েমি তার যত।
বড়োলোকের ছেলে ব'লে গুমর ছিল মনে,
অত্যাচারে তারই প্রমাণ দিত সকলখনে।
বটুর হবে সাঁতারখেলা, বটু চলছে ঘাটে,
এসেছে যেই দুলালচাঁদের গোলা খেলার মাঠে
অকারণে চাবুক নিয়ে দুলাল এল তেড়ে;
মাধো বললে, "মারলে কুকুর ফেলব তোমায় পেড়ে।"
উঁচিয়ে চাবুক দুলাল এল, মানল নাকো মানা,
চাবুক কেড়ে নিয়ে মাধো করলে দুতিনখানা।
দাঁড়িয়ে রইল মাধো, রাগে কাঁপছে থরোথরো,
বললে, "দেখব সাধ্য তোমার, কী করবে তা করো।"
দুলাল ছিল বিষম ভীতু, বেগ শুধু তার পায়ে;
নামের জোরেই জোর ছিল তার, জোর ছিল না গায়ে।দশবিশজন লোক লাগিয়ে বাপ আনলে ধরে,
মাধোকে এক খাটের খুরোয় বাঁধল কষে জোরে।
বললে, "জানিসনেকো বেটা, কাহার অন্ন ধারিস,
এত বড়ো বুকের পাটা, মনিবকে তুই মারিস।
আজ বিকালে হাটের মধ্যে হিঁচড়ে নিয়ে তোকে,
দুলাল স্বয়ং মারবে চাবুক, দেখবে সকল লোকে।"
মনিববাড়ির পেয়াদা এল দিন হল যেই শেষ।
দেখলে দড়ি আছে পড়ি, মাধো নিরুদ্দেশ।
মাকে শুধায়, "এ কী কাণ্ড।" মা শুনে কয়, "নিজে
আপন হাতে বাঁধন তাহার আমিই খুলেছি যে।
মাধো চাইল চলে যেতে; আমি বললেম, যেয়ো,
এমন অপমানের চেয়ে মরণ ভালো সেও।"
স্বামীর 'পরে হানল দৃষ্টি দারুণ অবজ্ঞার;
বললে, "তোমার গোলামিতে ধিক্ সহস্রবার।"
ছেলে মেয়ে চলল বেড়ে, হল সে সংসারী;
কোন্খানে এক পাটকলে সে করতেছে সর্দারি।
এমন সময় নরম যখন হল পাটের বাজার
মাইনে ওদের কমিয়ে দিতেই, মজুর হাজার হাজার
ধর্মঘটে বাঁধল কোমর; সাহেব দিল ডাক;
বললে, "মাধো, ভয় নেই তোর, আলগোছে তুই থাক্।
দলের সঙ্গে যোগ দিলে শেষ মরবি-যে মার খেয়ে।"
মাধো বললে, "মরাই ভালো এ বেইমানির চেয়ে।"
শেষপালাতে পুলিশ নামল, চলল গুঁতোগাঁতা;
কারো পড়ল হাতে বেড়ি, কারো ভাঙল মাথা।
মাধো বললে, "সাহেব, আমি বিদায় নিলেম কাজে,
অপমানের অন্ন আমার সহ্য হবে না যে।"
চলল সেথায় যে-দেশ থেকে দেশ গেছে তার মুছে,
মা মরেছে, বাপ মরেছে, বাঁধন গেছে ঘুচে।
পথে বাহির হল ওরা ভরসা বুকে আঁটি,
ছেঁড়া শিকড় পাবে কি আর পুরোনো তার মাটি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
হা রে নিরানন্দ দেশ, পরি জীর্ণ জরা,
বহি বিজ্ঞতার বোঝা, ভাবিতেছ মনে
ঈশ্বরের প্রবঞ্চনা পড়িয়াছে ধরা
সুচতুর সূক্ষ্মদৃষ্টি তোমার নয়নে!
লয়ে কুশাঙ্কুর বুদ্ধি শাণিত প্রখরা
কর্মহীন রাত্রিদিন বসি গৃহকোণে
মিথ্যা ব'লে জানিয়াছ বিশ্ববসুন্ধরা
গ্রহতারাময় সৃষ্টি অনন্ত গগনে।
যুগযুগান্তর ধ'রে পশু পক্ষী প্রাণী
অচল নির্ভয়ে হেথা নিতেছে নিশ্বাস
বিধাতার জগতেরে মাতৃক্রোড় মানি;
তুমি বৃদ্ধ কিছুরেই কর না বিশ্বাস!
লক্ষ কোটি জীব লয়ে এ বিশ্বের মেলা
তুমি জানিতেছ মনে, সব ছেলেখেলা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
ওই তনুখানি তব আমি ভালোবাসি ।
এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী।
শিশিরেতে টলমল ঢলঢল ফুল
টুটে পড়ে থরে থরে যৌবন বিকাশি ।
চারি দিকে গুঞ্জরিছে জগৎ আকুল ,
সারানিশি সারাদিন ভ্রমর পিপাসী ।
ভালোবেসে বায়ু এসে দুলাইছে দুল ,
মুখে পড়ে মোহভরে পূর্ণিমার হাসি ।
পূর্ণ দেহখানি হতে উঠিছে সুবাস ।
মরি মরি কোথা সেই নিভৃত নিলয়
কোমল শয়নে যেথা ফেলিছে নিশ্বাস
তনুঢাকা মধুমাখা বিজন হৃদয় ।
ওই দেহখানি বুকে তুলে নেব বালা ,
পঞ্চদশ বসন্তের একগাছি মালা ।। (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয়
রূপের মোহনে আছিল মাতি,
প্রাণের স্বপন আছিল যখন
প্রেম প্রেম শুধু দিবস রাতি!
শান্ত আশা এ হৃদয়ে আমার
এখন ফুটিতে পারে,
সুবিমলতর দিবস আমার
এখন উঠিতে পারে।
বালক কালের প্রেমের স্বপন–
মধুর যেমন উজল যেমন
তেমন কিছুই আসিবে না,
তেমন কিছুই আসিবে না!
সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে
প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা,
স্মৃতি-মরু মোর উজল করিয়া
এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা!
সে প্রতিমা সেই পরিমল সম
পলকে যা লয় পায়,
প্রভাতকালের স্বপন যেমন
পলকে মিশায়ে যায়।
অলস প্রবাহ জীবনে আমার
সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর
সে কিরণ কভু ভাসিবে না,
সে কিরণ কভু ভাসিবে না!Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
একদিন জনহীন তোমার পুলিনে,
গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।
অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন
নতমুখী বধূসম শান্ত বাক্যহীন;
সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে
চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে।
সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
নানা কর্মে মোর কাছে আসে নানা জন,
নাহি জানে আমাদের পরানবন্ধন,
নাহি জানে কেন আসি সন্ধ্যা-অভিসারে
বালুকা শয়ন-পাতা নির্জন এ পারে।
যখন মুখর তব চক্রবাকদল
সুপ্ত থাকে জলাশয়ে ছাড়ি কোলাহল,
যখন নিস্তব্ধ গ্রামে তব পূর্বতীরে
রুদ্ধ হয়ে যায় দ্বার কুটিরে কুটিরে,
তুমি কোন্ গান কর আমি কোন্ গান
দুই তীরে কেহ তার পায় নি সন্ধান।
নিভৃতে শরতে গ্রীষ্মে শীতে বরষায়
শত বার দেখাশুনা তোমায় আমায়।
কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে
পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে,
যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে
তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে—
কত গ্রাম কত মাঠ কত ঝাউঝাড়
কত বালুচর কত ভেঙে-পড়া পাড়
পার হয়ে এই ঠাঁই আসিব যখন
জেগে উঠিবে না কোনো গভীর চেতন?
জন্মান্তরে শতবার যে নির্জন তীরে
গোপন হৃদয় মোর আসিত বাহিরে,
আর বার সেই তীরে সে সন্ধ্যাবেলায়
হবে না কি দেখাশুনা তোমায় আমায়? (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
রয়েছে দীপ না আছে শিখা,
এই কি ভালে ছিল রে লিখা–
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।বেদনাদূতী গাহিছে, “ওরে প্রাণ,
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।
নিশীথে ঘন অন্ধকারে
ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে,
দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।’গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।
এ ঘোর রাতে কিসের লাগি
পরান মম সহসা জাগি
এমন কেন করিছে মরি মরি।
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে,
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
জানি না কোথা অনেক দূরে
বাজিল প্রাণ গভীর সুরে,
সকল গান টানিছে পথপানে।
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,
সময় গেলে হবে না যাওয়া,
নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শুক্লা একাদশী।
লাজুক রাতের ওড়না পড়ে খসি
বটের ছায়াতলে,
নদীর কালো জলে।
দিনের বেলায় কৃপণ কুসুম কুণ্ঠাভরে
যে-গন্ধ তার লুকিয়ে রাখে নিরুদ্ধ অন্তরে
আজ রাতে তার সকল বাধা ঘোচে,
আপন বাণী নিঃশেষিয়া দেয় সে অসংকোচে। অনিদ্র কোকিল
দূর শাখাতে মুহুর্মুহু খুঁজতে পাঠায় কুহুগানের মিল।
যেন রে আর সময় তাহার নাই,
এক রাতে আজ এই জীবনের শেষ কথাটি চাই।
ভেবেছিলেম সইবে না আজ লুকিয়ে রাখা
বদ্ধ বাণীর অস্ফুটতায় যে-কথা মোর অর্ধাবরণ-ঢাকা।
ভেবেছিলেম বন্দীরে আজ মুক্ত করা সহজ হবে,
ক্ষুদ্র বাধায় দিনে দিনে রুদ্ধ যাহা ছিল অগৌরবে। সে যবে আজ এল ঘরে
জোৎস্নারেখা পড়েছে মোর 'পরে
শিরীষ-ডালের ফাঁকে ফাঁকে।
ভেবেছিলেম বলি তাকে--
"দেখো আমায়, জানো আমায়, সত্য ডাকে আমায় ডেকে লহো,
সবার চেয়ে গভীর যাহা নিবিড় ভাষায় সেই কথাটি কহো।
হয় নি মোদের চরম মন্ত্র পড়া,
হয় নি পূর্ণ অভিষেকের তীর্থজলের ঘড়া,
আজ হয়ে যাক মালাবদল যে-মালাটি অসীম রাত্রিদিন
রইবে অমলিন।' হঠাৎ বলে উঠল সে-যে, ক্রুদ্ধ নয়ন তার--
গড়ের মাঠে তাদের দলের হার হয়েছে, অন্যায় সেই হার।
বারে বারে ফিরে ফিরে খেলাহারের গ্লানি
জানিয়ে দিল ক্লান্তি নাহি মানি।
বাতায়নের সমুখ থেকে চাঁদের আলো নেমে গেল নীচে,
তখনো সেই নিদ্রাবিহীন কোকিল কুহরিছে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ঢাল্! ঢাল্ চাঁদ! আরো আরো ঢাল্!
সুনীল আকাশে রজতধারা!
হৃদয় আজিকে উঠেছে মাতিয়া
পরাণ হয়েছে পাগলপারা!
গাইব রে আজ হৃদয় খুলিয়া
জাগিয়া উঠিবে নীরব রাতি!
দেখাব জগতে হৃদয় খুলিয়া
পরাণ আজিকে উঠেছে মাতি!
হাসুক পৃথিবী, হাসুক জগৎ,
হাসুক হাসুক চাঁদিমা তারা!
হৃদয় খুলিয়া করিব রে গান
হৃদয় হয়েছে পাগলপারা!
আধ ফুটো-ফুটো গোলাপ-কলিকা
ঘাড়খানি আহা করিয়া হেঁট
মলয় পবনে লাজুক বালিকা
সউরভ রাশি দিতেছে ভেট!
আয় লো প্রমদা! আয় লো হেথায়
মানস আকাশে চাcর ধারা!
গোলাপ তুলিয়া পর্ লো মাথায়
সাঁঝের গগনে ফুটিবে তারা ।
হেসে ঢল্ ঢল্ পূর্ণ শতদল
ছড়িয়ে ছড়িয়ে সুরভিরাশি
নয়নে নয়নে, অধরে অধরে
জ্যোছনা উছলি পড়িছে হাসি!
চুল হতে ফুল খুলিয়ে খুলিয়ে
ঝরিয়ে ঝরিয়ে পড়িছে ভূমে!
খসিয়া খসিয়া পড়িছে আঁচল
কোলের উপর কমল থুয়ে!
আয় লো তরুণী! আয় লো হেথায়!
সেতার ওই যে লুটায় ভূমে
বাজা লো ললনে! বাজা একবার
হৃদয় ভরিয়ে মধুর ঘুমে!
নাচিয়া নাচিয়া ছুটিবে আঙুল!
নাচিয়া নাচিয়া ছুটিবে তান!
অবাক্ হইয়া মুখপানে তোর
চাহিয়া রহিব বিভল প্রাণ!
গলার উপরে সঁপি হাতখানি
বুকের উপরে রাখিয়া মুখ
আদরে অস্ফুটে কত কি যে কথা
কহিবি পরানে ঢালিয়া সুখ!
ওই রে আমার সুকুমার ফুল
বাতাসে বাতাসে পড়িছে দুলে
হৃদয়েতে তোরে রাখিব লুকায়ে
নয়নে নয়নে রাখিব তুলে।
আকাশ হইতে খুঁজিবে তপন
তারকা খুঁজিবে আকাশ ছেয়ে!
খুঁজিয়া বেড়াবে দিকবধূগণ
কোথায় লুকাল মোহিনী মেয়ে?
আয় লো ললনে ! আয় লো আবার
সেতারে জাগায়ে দে-না লো বালা!
দুলায়ে দুলায়ে ঘাড়টি নামায়ে
কপোলেতে চুল করিবে খেলা!
কী-যে মূরতি শিশুর মতন!
আধ ফুটো-ফুটো ফুলের কলি!
নীরব নয়নে কী-যে কথা কয়
এ জনমে আর যাব না ভুলি!
কী-যে ঘুমঘোরে ছায় প্রাণমন
লাজে ভরা ওই মধুর হাসি!
পাগলিনী বালা গলাটি কেমন
ধরিস্ জড়িয়ে ছুটিয়ে আসি!
ভুলেছি পৃথিবী ভুলেছি জগৎ
ভুলেছি, সকল বিষয় মানে!
হেসেছে পৃথিবী-- হেসেছে জগৎ
কটাক্ষ করিলি কাহারো পানে!
আয়! আয় বালা! তোরে সাথে লয়ে
পৃথিবী ছাড়িয়া যাই লো চলে!
চাঁদের কিরণে আকাশে আকাশে
খেলায়ে বেড়াব মেঘের কোলে!
চল্ যাই মোরা আরেক জগতে
দুজনে কেবল বেড়াব মাতি
কাননে কাননে, খেলাব দুজনে
বনদেবীকোলে যাপিব রাতি!
যেখানে কাননে শুকায় না ফুল!
সুরভি-পূরিত কুসুমকলি!
মধুর প্রেমেরে দোষে না যেথায়
সেথায় দুজনে যাইব চলি!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দুঃখ এড়াবার আশা
নাই এ জীবনে।
দুঃখ সহিবার শক্তি
যেন পাই মনে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
যদিও বসন্ত গেছে তবু বারে বারে
সাধ যায় বসন্তের গান গাহিবারে।
সহসা পঞ্চম রাগ আপনি সে বাজে,
তখনি থামাতে চাই শিহরিয়া লাজে।
যত-না মধুর হোক মধুরসাবেশ
যেখানে তাহার সীমা সেথা করো শেষ।
যেখানে আপনি থামে যাক থেমে গীতি,
তার পরে থাক্ তার পরিপূর্ণ স্মৃতি।
পূর্ণতারে পূর্ণতর করিবারে, হায়,
টানিয়া কোরো না ছিন্ন বৃথা দুরাশায়!
নিঃশব্দে দিনের অন্তে আসে অন্ধকার,
তেমনি হউক শেষ শেষ যা হবার।
আসুক বিষাদভরা শান্ত সান্ত্বনায়
মধুরমিলন-অন্তে সুন্দর বিদায়। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
একা তুমি নিঃসঙ্গ প্রভাতে,
অতীতের দ্বার রুদ্ধ তোমার পশ্চাতে।
সেথা হল অবসান
বসন্তের সব দান,
উৎসবের সব বাতি নিবে গেল রাতে। সেতারের তার হল চুপ,
শুষ্কমালা, ভষ্মশেষ দগ্ধ গন্ধধূপ।
কবরীর ফুলগুলি
ধূলিতে হইল ধূলি,
লজ্জিত সকল সজ্জা বিরস বিরূপ। সম্মুখে উদাস বর্ণহীন
ক্ষীণছন্দ মন্দগতি তব রাত্রিদিন।
সম্মুখে আকাশ খোলা,
নিস্তব্ধ, সকল-ভোলা--
মত্ততার কলরব শান্তিতে বিলীন। আভরণহারা তব বেশ,
কজ্জলবিহীন আঁখি, রুক্ষ তব কেশ।
শরতের শেষ মেঘে
দীপ্তি জ্বলে রৌদ্র লেগে,
সেইমতো শোকশুভ্র স্মৃতি-অবশেষ। তবু কেন হয় যেন বোধ
অদৃষ্ট পশ্চাৎ হতে করে পথরোধ।
ছুটি হল যার কাছে
কিছু তার প্রাপ্য আছে,
নিঃশেষে কি হয় নাই সব পরিশোধ। সূক্ষ্মতম সেই আচ্ছাদন,
ভাষাহারা অশ্রুহারা অজ্ঞাত কাঁদন।
দুর্লঙ্ঘ্য-যে সেই মানা
স্পষ্ট যারে নেই জানা,
সবচেয়ে সুকঠিন অবন্ধ বাঁধন। যদি বা ঘুচিল ঘুমঘোর,
অসাড় পাখায় তবু লাগে নাই জোর।
যদি বা দূরের ডাকে
মন সাড়া দিতে থাকে,
তবুও বারণে বাঁধে নিকটের ডোর। মুক্তিবন্ধনের সীমানায়
এমনি সংশয়ে তব দিন চলে যায়।
পিছে রুদ্ধ হল দ্বার,
মায়া রচে ছায়া তার,
কবে সে মিলাবে আছ সেই প্রতীক্ষায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
যদি ইচ্ছা কর তবে কটাক্ষে হে নারী,
কবির বিচিত্র গান নিতে পার কাড়ি
আপন চরণপ্রান্তে; তুমি মুগ্ধচিতে
মগ্ন আছ আপনার গৃহের সংগীতে।
স্তবে তব নাহি কান, তাই স্তব করি,
তাই আমি ভক্ত তব, অনিন্দ্যসুন্দরী।
ভুবন তোমারে পূজে, জেনেও জান না;
ভক্তদাসীসম তুমি কর আরাধনা
খ্যাতিহীন প্রিয়জনে। রাজমহিমারে
যে করপরশে তব পার’ করিবারে
দ্বিগুণ মহিমান্বিত, সে সুন্দর করে
ধূলি ঝাঁট দাও তুমি আপনার ঘরে।
সেই তো মহিমা তব, সেই তো গরিমা–
সকল মাধুর্য চেয়ে তারি মধুরিমা। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বউ নিয়ে লেগে গেল বকাবকি
রোগা ফণী আর মোটা পঞ্চিতে,
মণিকর্ণিকা-ঘাটে ঠকাঠকি
যেন বাঁশে আর সরু কঞ্চিতে।
দুজনে না জানে এই বউ কার,
মিছেমিছি ভাড়া বাড়ে নৌকার,
পঞ্চি চেঁচায় শুধু হাউহাউ,–
“পারবিনে তুই মোরে বঞ্চিতে।’
বউ বলে, “বুঝে নিই দাউদাউ
মোর তরে জ্বলে ঐ কোন্ চিতে।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শ্রীমান অমিয়চন্দ্র চক্রবতী কল্যাণীয়েষুপঁচিশে বৈশাখ চলেছে
জন্মদিনের ধারাকে বহন করে
মৃত্যুদিনের দিকে।
সেই চলতি আসনের উপর বসে
কোন্ কারিগর গাঁথছে
ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায়
নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।
রথে চড়ে চলেছে কাল;
পদাতিক পথিক চলতে চলতে
পাত্র তুলে ধরে,
পায় কিছু পানীয়;--
পান সারা হলে
পিছিয়ে পড়ে অন্ধকারে;
চাকার তলায়
ভাঙা পাত্র ধুলায় যায় গুঁড়িয়ে।
তার পিছনে পিছনে
নতুন পাত্র নিয়ে যে আসে ছুটে,
পায় নতুন রস,
একই তার নাম,
কিন্তু সে বুঝি আর-একজন।
একদিন ছিলেম বালক।
কয়েকটি জন্মদিনের ছাঁদের মধ্যে
সেই যে-লোকটার মূর্তি হয়েছিল গড়া
তোমরা তাকে কেউ জান না।
সে সত্য ছিল যাদের জানার মধ্যে
কেউ নেই তারা।
সেই বালক না আছে আপন স্বরূপে
না আছে কারো স্মৃতিতে।
সে গেছে চলে তার ছোটো সংসারটাকে নিয়ে;
তার সেদিনকার কান্না-হাসির
প্রতিধ্বনি আসে না কোনো হাওয়ায়।
তার ভাঙা খেলনার টুকরোগুলোও
দেখিনে ধুলোর 'পরে।
সেদিন জীবনের ছোটো গবাক্ষের কাছে
সে বসে থাকত বাইরের দিকে চেয়ে।
তার বিশ্ব ছিল
সেইটুকু ফাঁকের বেষ্টনীর মধ্যে।
তার অবোধ চোখ-মেলে চাওয়া
ঠেকে যেত বাগানের পাঁচিলটাতে
সারি সারি নারকেল গাছে।
সন্ধ্যেবেলাটা রূপকথার রসে নিবিড়;
বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে
বেড়া ছিল না উঁচু,
মনটা এদিক থেকে ওদিকে
ডিঙিয়ে যেত অনায়াসেই।
প্রদোষের আলো-আঁধারে
বস্তুর সঙ্গে ছায়াগুলো ছিল জড়িয়ে,
দুইই ছিল একগোত্রের।
সে-কয়দিনের জন্মদিন
একটা দ্বীপ,
কিছুকাল ছিল আলোতে,
কাল-সমুদ্রের তলায় গেছে ডুবে।
ভাঁটার সময় কখনো কখনো
দেখা যায় তার পাহাড়ের চূড়া,
দেখা যায় প্রবালের রক্তিম তটরেখা।
পঁচিশে বৈশাখ তার পরে দেখা দিল
আর-এক কালান্তরে,
ফাল্গুনের প্রত্যুষে
রঙিন আভার অস্পষ্টতায়।
তরুণ যৌবনের বাউল
সুর বেঁধে নিল আপন একতারাতে,
ডেকে বেড়াল
নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে
অনির্দেশ্য বেদনার খ্যাপা সুরে।
সেই শুনে কোনো-কোনোদিন বা
বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীর আসন টলেছিল,
তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন
তাঁর কোনো কোনো দূতীকে
পলাশবনের রঙমাতাল ছায়াপথে
কাজ-ভোলানো সকাল-বিকালে।
তখন কানে কানে মৃদু গলায় তাদের কথা শুনেছি,
কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি।
দেখেছি কালো চোখের পক্ষ্ণরেখায়
জলের আভাস;
দেখেছি কম্পিত অধরে নিমীলিত বাণীর
বেদনা;
শুনেছি ক্বণিত কঙ্কণে
চঞ্চল আগ্রহের চকিত ঝংকার।
তারা রেখে গেছে আমার অজানিতে
পঁচিশে বৈশাখের
প্রথম ঘুমভাঙা প্রভাতে
নতুন ফোটা বেলফুলের মালা;
ভোরের স্বপ্ন
তারি গন্ধে ছিল বিহ্বল।
সেদিনকার জন্মদিনের কিশোর জগৎ
ছিল রূপকথার পাড়ার গায়ে-গায়েই,
জানা না-জানার সংশয়ে।
সেখানে রাজকন্যা আপন এলোচুলের আবরণে
কখনো বা ছিল ঘুমিয়ে,
কখনো বা জেগেছিল চমকে উঠে'
সোনার কাঠির পরশ লেগে।
দিন গেল।
সেই বসন্তীরঙের পঁচিশে বৈশাখের
রঙ-করা প্রাচীরগুলো
পড়ল ভেঙে।
যে পথে বকুলবনের পাতার দোলনে
ছায়ায় লাগত কাঁপন,
হাওয়ায় জাগত মর্মর,
বিরহী কোকিলের
কুহুরবের মিনতিতে
আতুর হত মধ্যাহ্ন,
মৌমাছির ডানায় লাগত গুঞ্জন
ফুলগন্ধের অদৃশ্য ইশারা বেয়ে,
সেই তৃণ-বিছানো বীথিকা
পৌঁছল এসে পাথরে-বাঁধানো রাজপথে।
সেদিনকার কিশোরক
সুর সেধেছিল যে-একতারায়
একে একে তাতে চড়িয়ে দিল
তারের পর নতুন তার।
সেদিন পঁচিশে বৈশাখ
আমাকে আনল ডেকে
বন্ধুর পথ দিয়ে
তরঙ্গমন্দ্রিত জনসমুদ্রতীরে।
বেলা-অবেলায়
ধ্বনিতে ধ্বনিতে গেঁথে
জাল ফেলেছি মাঝদরিয়ায়;
কোনো মন দিয়েছে ধরা,
ছিন্ন জালের ভিতর থেকে
কেউ বা গেছে পালিয়ে।
কখনো দিন এসেছে ম্লান হয়ে,
সাধনায় এসেছে নৈরাশ্য,
গ্লানিভারে নত হয়েছে মন।
এমন সময়ে অবসাদের অপরাহ্নে
অপ্রত্যাশিত পথে এসেছে
অমরাবতীর মর্ত্যপ্রতিমা;
সেবাকে তারা সুন্দর করে,
তপঃক্লান্তের জন্যে তারা
আনে সুধার পাত্র;
ভয়কে তারা অপমানিত করে
উল্লোল হাস্যের কলোচ্ছ্বাসে;
তারা জাগিয়ে তোলে দুঃসাহসের শিখা
ভস্মে-ঢাকা অঙ্গারের থেকে;
তারা আকাশবাণীকে ডেকে আনে
প্রকাশের তপস্যায়।
তারা আমার নিবে-আসা দীপে
জ্বালিয়ে গেছে শিখা,
শিথিল-হওয়া তারে
বেঁধে দিয়েছে সুর,
পঁচিশে বৈশাখকে
বরণমাল্য পরিয়েছে
আপন হাতে গেঁথে।
তাদের পরশমণির ছোঁওয়া
আজো আছে
আমার গানে আমার বাণীতে।
সেদিন জীবনের রণক্ষেত্রে
দিকে দিকে জেগে উঠল সংগ্রামের সংঘাত
গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে।
একতারা ফেলে দিয়ে
কখনো বা নিতে হল ভেরী।
খর মধ্যাহ্নের তাপে
ছুটতে হল
জয়পরাজয়ের আবর্তনের মধ্যে।
পায়ে বিঁধেছে কাঁটা,
ক্ষত বক্ষে পড়েছে রক্তধারা।
নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ
আমার নৌকার ডাইনে বাঁয়ে,
জীবনের পণ্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে
নিন্দার তলায়, পঙ্কের মধ্যে।
বিদ্বেষে অনুরাগে
ঈর্ষায় মৈত্রীতে,
সংগীতে পরুষ কোলাহলে
আলোড়িত তপ্ত বাষ্পনিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে
আমার জগৎ গিয়েছে তার কক্ষপথে।
এই দুর্গমে, এই বিরোধ-সংক্ষোভের মধ্যে
পঁচিশে বৈশাখের প্রৌঢ় প্রহরে
তোমরা এসেছ আমার কাছে।
জেনেছ কি,
আমার প্রকাশে
অনেক আছে অসমাপ্ত
অনেক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন
অনেক উপেক্ষিত?
অন্তরে বাহিরে
সেই ভালো মন্দ,
স্পষ্ট অস্পষ্ট,
খ্যাত অখ্যাত,
ব্যর্থ চরিতার্থের জটিল সম্মিশ্রণের মধ্য থেকে
যে আমার মূর্তি
তোমাদের শ্রদ্ধায়, তোমাদের ভালোবাসায়,
তোমাদের ক্ষমায়
আজ প্রতিফলিত,
আজ যার সামনে এনেছ তোমাদের মালা,
তাকেই আমার পঁচিশে বৈশাখের
শেষবেলাকার পরিচয় বলে
নিলেম স্বীকার করে,
আর রেখে গেলেম তোমাদের জন্যে
আমার আশীর্বাদ।
যাবার সময় এই মানসী মূর্তি
রইল তোমাদের চিত্তে,
কালের হাতে রইল বলে
করব না অহংকার।
তার পরে দাও আমাকে ছুটি
জীবনের কালো-সাদা সূত্রে গাঁথা
সকল পরিচয়ের অন্তরালে;
নির্জন নামহীন নিভৃতে;
নানা সুরের নানা তারের যন্ত্রে
সুর মিলিয়ে নিতে দাও
এক চরম সংগীতের গভীরতায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমি একাকিনী যবে চলি রাজপথে
নব অভিসারসাজে,
নিশীথে নীরব নিখিল ভুবন,
না গাহে বিহগ, না চলে পবন,
মৌন সকল পৌর ভবন
সুপ্তনগরমাঝে--
শুধু আমার নূপুর আমারি চরণে
বিমরি বিমরি বাজে।
অধীর মুখর শুনিয়া সে স্বর
পদে পদে মরি লাজে।আমি চরণশব্দ শুনিব বলিয়া
বসি বাতায়নকাছে--
অনিমেষ তারা নিবিড় নিশায়,
লহরীর লেশ নাহি যমুনায়,
জনহীন পথ আঁধারে মিশায়,
পাতাটি কাঁপে না গাছে--
শুধু আমারি উরসে আমারি হৃদয়
উলসি বিলসি নাচে।
উতলা পাগল করে কলরোল,
বাঁধন টুটিলে বাঁচে।আমি কুসুমশয়নে মিলাই শরমে,
মধুর মিলনরাতি--
স্তব্ধ যামিনী ঢাকে চারিধার,
নির্বাণ দীপ, রুদ্ধ দুয়ার,
শ্রাবণগগন করে হাহাকার
তিমিরশয়ন পাতি--
শুধু আমার মানিক আমারি বক্ষে
জ্বালায়ে রেখেছে বাতি।
কোথায় লুকাই, কেমনে নিবাই
নিলাজ ভূষণভাতি।আমি আমার গোপন মরমের কথা
রেখেছি মরমতলে।
মলয় কহিছে আপন কাহিনী,
কোকিল গাহিছে আপন রাগিণী,
নদী বহি চলে কাঁদি একাকিনী
আপনার কলকলে--
শুধু আমার কোলের আমারি বীণাটি
গীতঝংকারছলে
যে কথা যখন করিব গোপন
সে কথা তখনি বলে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা
শুধু মিছে কথা ছলনা !
আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না ।
এ যে নয়নের জল , হতাশের শ্বাস ,
কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ ,
এ যে বুক - ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে
গভীর মরমবেদনা ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,
শুধু মিছে কথা ছলনা !
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি
কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি ,
মিছে কথা কয়ে মিছে যশ লয়ে
মিছে কাজে নিশিযাপনা !
কে জাগিবে আজ , কে করিবে কাজ ,
কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ —
কাতরে কাঁদিবে , মা ' র পায়ে দিবে
সকল প্রাণের কামনা ।
এ কি শুধু হাসিখেলা , প্রমোদের মেলা ,
শুধু মিছে কথা ছলনা ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
নাক বলে, কান কভু ঘ্রাণ নাহি করে,
রয়েছে কুণ্ডল দুটো পরিবার তরে।
কান বলে, কারো কথা নাহি শুনে নাক,
ঘুমোবার বেলা শুধু ছাড়ে হাঁকডাক। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
রুদ্র , তোমার দারুণ দীপ্তি
এসেছে দুয়ার ভেদিয়া ;
বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎবাণ
স্বপ্নের জাল ছেদিয়া ।
ভাবিতেছিলাম উঠি কি না উঠি ,
অন্ধ তামস গেছে কিনা ছুটি ,
রুদ্ধ নয়ন মেলি কি না মেলি
তন্দ্রা-জড়িমা মাজিয়া ।
এমন সময়ে , ঈশান , তোমার
বিষাণ উঠেছে বাজিয়া ।
বাজে রে গরজি বাজে রে
দগ্ধ মেঘের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে
দীপ্ত গগন-মাঝে রে ।
চমকি জাগিয়া পূর্বভুবন
রক্তবদন লাজে রে ।ভৈরব , তুমি কী বেশে এসেছ ,
ললাটে ফুঁসিছে নাগিনী ,
রুদ্র-বীণায় এই কি বাজিল
সুপ্রভাতের রাগিণী ?
মুগ্ধ কোকিল কই ডাকে ডালে ,
কই ফোটে ফুল বনের আড়ালে ?
বহুকাল পরে হঠাৎ যেন রে
অমানিশা গেল ফাটিয়া ;
তোমার খড়্গ আঁধার-মহিষে
দুখানা করিল কাটিয়া ।
ব্যথায় ভুবন ভরিছে ,
ঝর ঝর করি রক্ত-আলোক
গগনে-গগনে ঝরিছে ,
কেহ-বা জাগিয়া উঠিছে কাঁপিয়া
কেহ-বা স্বপনে ডরিছে ।তোমার শ্মশানকিঙ্করদল ,
দীর্ঘ নিশায় ভুখারি ।
শুষ্ক অধর লেহিয়া লেহিয়া
উঠিছে ফুকারি ফুকারি ।
অতিথি তারা যে আমাদের ঘরে
করিছে নৃত্য প্রাঙ্গণ- ‘ পরে ,
খোলো খোলো দ্বার ওগো গৃহস্থ ,
থেকো না থেকো না লুকায়ে —
যার যাহা আছে আনো বহি আনো ,
সব দিতে হবে চুকায়ে ।
ঘুমায়ো না আর কেহ রে ।
হৃদয়পিণ্ড ছিন্ন করিয়া
ভাণ্ড ভরিয়া দেহো রে ।
ওরে দীনপ্রাণ , কী মোহের লাগি
রেখেছিস মিছে স্নেহ রে ।উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ,
‘ ভয় নাই , ওরে ভয় নাই —
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই । ‘
হে রুদ্র , তব সংগীত আমি
কেমনে গাহিব কহি দাও স্বামী —
মরণনৃত্যে ছন্দ মিলায়ে
হৃদয়ডমরু বাজাব ,
ভীষণ দুঃখে ডালি ভরে লয়ে
তোমার অর্ঘ্য সাজাব ।
এসেছে প্রভাত এসেছে ।
তিমিরান্তক শিবশঙ্কর
কী অট্টহাস হেসেছে!
যে জাগিল তার চিত্ত আজিকে
ভীম আনন্দে ভেসেছে ।জীবন সঁপিয়া , জীবনেশ্বর ,
পেতে হবে তব পরিচয় ;
তোমার ডঙ্কা হবে যে বাজাতে
সকল শঙ্কা করি জয় ।
ভালোই হয়েছে ঝঞ্ঝার বায়ে
প্রলয়ের জটা পড়েছে ছড়ায়ে ,
ভালোই হয়েছে প্রভাত এসেছে
মেঘের সিংহবাহনে —
মিলনযঞ্ জে অগ্নি জ্বালাবে
বজ্রশিখার দাহনে ।
তিমির রাত্রি পোহায়ে
মহাসম্পদ তোমারে লভিব
সব সম্পদ খোয়ায়ে —
মৃত্যুর লব অমৃত করিয়া
তোমার চরণে ছোঁয়ায়ে ।('পূরবী' কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.