poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
অভিভূত ধরণীর দীপ-নেভা তোরণদুয়ারে আসে রাত্রি, আধা অন্ধ, আধা বোবা, বিরাট অস্পষ্ট মূর্তি, যুগারম্ভসৃষ্টিশালে অসমাপ্তি পুঞ্জীভূত যেন নিদ্রার মায়ায়। হয় নি নিশ্চিত ভাগ সত্যের মিথ্যার, ভালোমন্দ-যাচাইয়ের তুলাদণ্ডে বাটখারা ভুলের ওজনে। কামনার যে পাত্রটি দিনে ছিল আলোয় লুকানো আঁধার তাহারে টেনে আনে-- ভরে দেয় সুরা দিয়ে রজনীগন্ধার গন্ধে, ঝিমিঝিমি ঝিল্লির ঝননে, আধ-দেখা কটাক্ষে ইঙ্গিতে। ছায়া করে আনাগোনা সংশয়ের মুখোশ-পরানো, মোহ আসে কালো মূর্তি লালরঙে এঁকে, তপস্বীরে করে সে বিদ্রূপ। বেড়াজাল হাতে নিয়ে সঞ্চরে আদিম মায়াবিনী যবে গুপ্ত গুহা হতে গোধূলির ধূসর প্রান্তরে দস্যু এসে দিবসের রাজদণ্ড কেড়ে নিয়ে যায়। বিশ্বনাট্যে প্রথম অঙ্কের অনিশ্চিত প্রকাশের যবনিকা ছিন্ন করে এসেছিল দিন, নির্বারিত করেছিল বিশ্বের চেতনা আপনার নিঃসংশয় পরিচয়। আবার সে আচ্ছাদন মাঝে-মাঝে নেমে আসে স্বপ্নের সংকেতে। আবিল বুদ্ধির স্রোতে ক্ষণিকের মতো মেতে ওঠে ফেনার নর্তন। প্রবৃত্তির হালে ব'সে কর্ণধার করে উদ্‌ভ্রান্ত চালনা তন্দ্রাবিষ্ট চোখে। নিজেরে ধিক্কার দিয়ে মন ব'লে ওঠে, "নহি নহি আমি নহি অপূর্ণ সৃষ্টির সমুদ্রের পঙ্কলোকে অন্ধ তলচর অর্ধস্ফুট শক্তি যার বিহ্বলতা-বিলাসী মাতাল তরলে নিমগ্ন অনুক্ষণ। আমি কর্তা, আমি মুক্ত, দিবসের আলোকে দীক্ষিত, কঠিন মাটির 'পরে প্রতি পদক্ষেপ যার আপনারে জয় করে চলা।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে, যেন সিন্ধুপারের পাখি তারা, যা   য়     যা   য়     যায় চলে॥ আলোছায়ার সুরে অনেক কালের সে কোন্‌ দূরে ডাকে আ   য়     আ   য়     আয় ব’লে॥ যেথায় চলে গেছে আমার হারা ফাগুনরাতি সেথায় তারা ফিরে ফিরে খোঁজে আপন সাথি। আলোছায়ায় যেথা অনেক দিনের সে কোন্‌ ব্যথা কাঁদে হা   য়     হা   য়     হায় ব’লে॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
একটি একটি করে তোমার পুরানো তার খোলো, সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো। ভেঙে গেছে দিনের মেলা, বসবে সভা সন্ধ্যাবেলা, শেষের সুর যে বাজাবে তার আসার সময় হল– সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।দুয়ার তোমার খুলে দাও গো আঁধার আকাশ-‘পরে, সপ্তলোকের নীরবতা আসুক তোমার ঘরে। এতদিন যে গেয়েছ গান আজকে তারি হোক অবসান, এ যন্ত্র যে তোমার যন্ত্র সেই কথাটাই ভোলো। সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।তিনধরিয়া, ৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
অমন করে আছিস কেন মা গো, খোকারে তোর কোলে নিবি না গো? পা ছড়িয়ে ঘরের কোণে কী যে ভাবিস আপন মনে, এখনো তোর হয় নি তো চুল বাঁধা। বৃষ্টিতে যায় মাথা ভিজে, জানলা খুলে দেখিস কী যে— কাপড়ে যে লাগবে ধুলোকাদা। ওই তো গেল চারটে বেজে, ছুটি হল ইস্কুলে যে— দাদা আসবে মনে নেইকো সিটি। বেলা অম্‌নি গেল বয়ে, কেন আছিস অমন হয়ে— আজকে বুঝি পাস নি বাবার চিঠি। পেয়াদাটা ঝুলির থেকে সবার চিঠি গেল রেখে— বাবার চিঠি রোজ কেন সে দেয় না? পড়বে বলে আপনি রাখে, যায় সে চলে ঝুলি - কাঁখে, পেয়াদাটা ভারি দুষ্টু স্যায়না। মা গো মা, তুই আমার কথা শোন্‌, ভাবিস নে মা, অমন সারা ক্ষণ। কালকে যখন হাটের বারে বাজার করতে যাবে পারে কাগজ কলম আনতে বলিস ঝিকে। দেখো ভুল করব না কোনো— ক খ থেকে মূর্ধন্য ণ বাবার চিঠি আমিই দেব লিখে। কেন মা, তুই হাসিস কেন। বাবার মতো আমি যেন অমন ভালো লিখতে পারি নেকো, লাইন কেটে মোটা মোটা বড়ো বড়ো গোটা গোটা লিখব যখন তখন তুমি দেখো। চিঠি লেখা হলে পরে বাবার মতো বুদ্ধি করে ভাবছ দেব ঝুলির মধ্যে ফেলে? কক্‌খনো না, আপনি নিয়ে যাব তোমায় পড়িয়ে দিয়ে, ভালো চিঠি দেয় না ওরা পেলে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ফাগুন এল দ্বারে, কেহ যে ঘরে নাই— পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আজি মেঘমুক্ত দিন; প্রসন্ন আকাশ হাসিছে বন্ধুর মতো; সুন্দর বাতাস মুখে চক্ষে বক্ষে আসি লাগিছে মধুর-- অদৃশ্য অঞ্চল যেন সুপ্ত দিগ্‌বধূর উড়িয়া পড়িছে গায়ে। ভেসে যায় তরী প্রশান্ত পদ্মার স্থির বক্ষের উপরি তরল কল্লোলে। অর্ধমগ্ন বালুচর দূরে আছে পড়ি, যেন দীর্ঘ জলচর রৌদ্র পোহাইছে শুয়ে। ভাঙা উচ্চতীর; ঘনচ্ছায়াপূর্ণ তরু; প্রচ্ছন্ন কুটির; বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে শস্যক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়াছে স্রোতে তৃষার্ত জিহ্বার মতো। গ্রামবধূগণ অঞ্চল ভাসায়ে জলে আকণ্ঠমগন করিছে কৌতুকালাপ। উচ্চ মিষ্ট হাসিজলকলস্বরে মিশি পশিতেছে আসি কর্ণে মোর। বসি এক বাঁকা নৌকা-'পরি বৃদ্ধ জেলে গাঁথে জাল নতশির করি রৌদ্রে পিঠ দিয়া। উলঙ্গ বালক তার আনন্দে ঝাঁপায়ে জলে পড়ে বারম্বার কলহাস্যে; ধৈর্যময়ী মাতার মতন পদ্মা সহিতেছে তার স্নেহ-জ্বালাতন। তরী হতে সম্মুখেতে দেখি দুই পার-- স্বচ্ছতম নীলাভ্রের নির্মল বিস্তার; মধ্যাহ্ন-আলোকপ্লাবে জলে স্থলে বনে বিচিত্র বর্ণের রেখা; আতপ্ত পবনে তীর উপবন হতে কভু আসে বহি আম্রমুকুলের গন্ধ, কভু রহি রহি বিহঙ্গের শ্রান্ত স্বর।          আজি বহিতেছে প্রাণে মোর শান্তিধারা-- মনে হইতেছে সুখ অতি সহজ সরল, কাননের প্রস্ফুট ফুলের মতো, শিশু-আননের হাসির মতন, পরিব্যাপ্ত বিকশিত-- উন্মুখ অধরে ধরি চুম্বন-অমৃত চেয়ে আছে সকলের পানে বাক্যহীন শৈশববিশ্বাসে চিররাত্রি চিরদিন। বিশ্ববীণা হতে উঠি গানের মতন রেখেছে নিমগ্ন করি নিথর গগন। সে সংগীত কী ছন্দে গাঁথিব, কী করিয়া শুনাইব, কী সহজ ভাষায় ধরিয়া দিব তারে উপহার ভালোবাসি যারে, রেখে দিব ফুটাইয়া কী হাসি আকারে নয়নে অধরে, কী প্রেমে জীবনে তারেকরিব বিকাশ। সহজ আনন্দখানি কেমনে সহজে তারে তুলে ঘরে আনি প্রফুল্ল সরস। কঠিন আগ্রহভরে ধরি তারে প্রাণপণে-- মুঠির ভিতরে টুটি যায়। হেরি তারে তীব্রগতি ধাই-- অন্ধবেগে বহুদূরে লঙ্ঘি চলি যাই, আর তার না পাই উদ্দেশ।              চারি দিকে দেখে আজি পূর্ণপ্রাণে মুগ্ধ অনিমিখে এই স্তব্ধ নীলাম্বর স্থির শান্ত জল, মনে হল সুখ অতি সহজ সরল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বদেশমূলক
এসো এসো ভ্রাতৃগণ! সরল অন্তরে সরল প্রীতির ভরে সবে মিলি পরস্পরে আলিঙ্গন করি আজ বহুদিন পরে । এসেছে জাতীয় মেলা ভারতভূষণ , ভারত সমাজে তবে হৃদয় খুলিয়া সবে এসো এসো এসো করি প্রিয়সম্ভাষণ । দূর করো আত্মভেদ বিপদ-অঙ্কুর , দূর করো মলিনতা বিলাসিতা অলসতা , হীনতা ক্ষীণতা দোষ করো সবে দূর । ভীরুতা বঙ্গীয়জন-কলঙ্ক-প্রধান — সে-কলঙ্ক দূর করো , সাহসিক তেজ ধরো , স্বকার্যকুশল হও হয়ে একতান । হল না কিছুই করা যা করিতে এলে — এই দেখো হিন্দুমেলা , তবে কেন কর হেলা ? কী হবে কী হবে আর তুচ্ছ খেলা খেলে ? সাগরের স্রোতসম যাইছে সময় । তুচ্ছ কাজে কেন রও , স্বদেশহিতৈষী হও — স্বদেশের জনগণে দাও রে অভয় । নাহি আর জননীর পূর্বসুতগণ — হরিশ্চন্দ্র যুধিষ্ঠির ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীর , অনন্তজলধিতলে হয়েছে মগন । নাহি সেই রাম আদি সম্রাট প্রাচীন , বিক্রম-আদিত্যরাজ , কালিদাস কবিরাজ , পরাশর পারাশর পণ্ডিত প্রবীণ । সকলেই জল বায়ু তেজ মৃত্তিকায় মিশাইয়া নিজদেহ অনন্ত ব্রহ্মের গেহ পশেছে কীর্তিরে শুধু রাখিয়ে ধরায় । আদরে সে প্রিয় সখী আচ্ছাদি গগনে সে লোকবিশ্রুত নাম সে বিশ্ববিজয়ী ধাম নির্ঘোষে ঘুষিছে সদা অখিল ভুবনে । যবনের রাজ্যকালে কীর্তির আধার চিতোর-নগর নাম অতুলবীরত্বধাম , কেমন ছিল রে মনে ভাবো একবার । এইরূপ কত শত নগর প্রাচীন সুকীর্তি-তপন-করে ভারত উজ্জ্বল ক ' রে অনন্ত কালের গর্ভে হয়েছে বিলীন । নাহি সেই ভারতের একতা-বিভব , পাষাণ বাঁধিয়া গলে সকলের পদতলে লুটাইছে আর্যগণ হইয়া নীরব । গেল , হায় , সব সুখ অভাগী মাতার — ছিল যত মনোআশা নিল কাল সর্বনাশা , প্রসন্ন বদন হল বিষণ্ন তাঁহার । কী আর হইবে মাতা খুলিয়া বদন । দীপ্তভানু অস্ত গেল , এবে কালরাত্রি এল , বসনে আবরি মুখ কাঁদো সর্বক্ষণ । বিশাল অপার সিন্ধু , গভীর নিস্বনে যেখানে যেখানে যাও কাঁদিতে কাঁদিতে গাও — ডুবিল ভারতরবি অনন্ত জীবনে । সুবিখ্যাত গৌড় যেই বঙ্গের রতন — তার কীর্তিপ্রতিভায় খ্যাতাপন্ন এ ধরায় হয়েছিল একদিন বঙ্গবাসিগণ । গেল সে বঙ্গের জ্যোতিঃ কিছুকাল পরে — কোনো চিহ্ন নাহি তার , পরিয়া হীনতাহার , ডুবিয়াছে এবে বঙ্গ কলঙ্কসাগরে । হিন্দুজনভ্রাতৃগণ! করি হে বিনয় — একতা উৎসাহ ধরো , জাতীয় উন্নতি করো , ঘুষুক ভুবনে সবে ভারতের জয় । জগদীশ! তুমি , নাথ , নিত্য-নিরাময় করো কৃপা বিতরণ , অধিবাসিজনগণ , করুক উন্নতি — হোক্‌ ভারতের জয়!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
কালুর খাবার শখ সব চেয়ে পিষ্টকে। গৃহিণী গড়েছে যেন চিনি মেখে ইষ্টকে। পুড়ে সে হয়েছে কালো, মুখে কালু বলে “ভালো’, মনে মনে খোঁটা দেয় দগ্ধ অদৃষ্টকে। কলিক্‌-ব্যথায় ডাকে ক্রুসে-বেঁধা খ্রীস্টকে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
‘কুয়াশা, নিকটে থাকি, তাই হেলা মোরে— মেঘ ভায়া দূরে রন, থাকেন গুমরে!’ কবি কুয়াশারে কয়, শুধু তাই না কি? মেঘ দেয় বৃষ্টিধারা, তুমি দাও ফাঁকি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
প্রভাতের ফুল ফুটিয়া উঠক সুন্দর পরিমলে। সন্ধ্যাবেলায় হোক সে ধন্য মধুরসে-ভরা ফলে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জীবনের দীপে তব আলোকের আশীর্বচন আঁধারের অচৈতন্যে সঞ্চিত করুক জাগরণ।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
যেন তার আঁখি দুটি নবনীল ভাসে ফুটিয়া উঠিছে আজি অসীম আকাশে। বৃষ্টিধৌত প্রভাতের আলোকহিল্লোলে অশ্রুমাখা হাসি তার বিকাশিয়া তোলে। তার সেই স্নেহলীলা সহস্র আকারে সমস্ত জগৎ হতে ঘিরিছে আমারে। বরষার নদী-’পরে ছলছল আলো, দূরতীরে কাননের ছায়া কালো কালো, দিগন্তের শ্যামপ্রান্তে শান্ত মেঘরাজি— তারি মুখখানি যেন শতরূপ সাজি। আঁখি তার কহে যেন মোর মুখে চাহি— “আজ প্রাতে সব পাখি উঠিয়াছে গাহি, শুধু মোর কণ্ঠস্বর এ প্রভাতবায়ে অনন্ত জগৎমাঝে গিয়েছে হারায়ে।”   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে, ঐ একটা অনেক কালের বুড়ো, আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে। আজ আমি ওকে জানাচ্ছি-- পৃথক হব আমরা। ও এসেছে কতলক্ষ পূর্বপুরুষের রক্তের প্রবাহ বেয়ে; কত যুগের ক্ষুধা ওর, কত তৃষ্ণা; সে সব বেদনা বহু দিনরাত্রিকে মথিত করেছে সুদীর্ঘ ধারাবাহী অতীতকালে; তাই নিয়ে ও অধিকার ক'রে বসল নবজাত প্রাণের এই বাহনকে, ঐ প্রাচীন, ঐ কাঙাল। আকাশবাণী আসে ঊর্ধ্বলোক হতে, ওর কোলাহলে সে যায় আবিল হয়ে। নৈবেদ্য সাজাই পূজার থালায়, ও হাত বাড়িয়ে নেয় নিজে। জীর্ণ করে ওকে দিনে দিনে পলে পলে, বাসনার দহনে, ওর জরা দিয়ে আচ্ছন্ন করে আমাকে যে-আমি জরাহীন। মুহূর্তে মুহূর্তে ও জিতে নিয়েছে আমার মমতা, তাই ওকে যখন মরণে ধরে ভয় লাগে আমার যে-আমি মৃত্যুহীন। আমি আজ পৃথক হব। ও থাক্‌ ঐ খানে দ্বারের বাহিরে, ঐ বৃদ্ধ, ঐ বুভুক্ষু। ও ভিক্ষা করুক, ভোগ করুক, তালি দিক্‌ বসে বসে ওর ছেঁড়া চাদরখানাতে; জন্মমরণের মাঝখানটাতে যে আল-বাঁধা খেতটুকু আছে সেইখানে করুক উঞ্ছবৃত্তি। আমি দেখব ওকে জানলায় ব'সে, ঐ দূরপথের পথিককে, দীর্ঘকাল ধরে যে এসেছে বহু দেহমনের নানা পথের বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর নানা খেয়া পার হয়ে। উপরের তলায় বসে দেখব ওকে ওর নানা খেয়ালের আবেশে, আশা-নৈরাশ্যের ওঠা-পড়ায় সুখদুঃখের আলো-আঁধারে। দেখব যেমন করে পুতুলনাচ দেখে; হাসব মনে মনে। মুক্ত আমি, স্বচ্ছ আমি, স্বতন্ত্র আমি, নিত্যকালের আলো আমি, সৃষ্টি-উৎসের আনন্দধারা আমি, অকিঞ্চন আমি, আমার কোনো কিছুই নেই অহংকারের প্রাচীরে ঘেরা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
গানআজি   বরষনমুখরিতশ্রাবণরাতি। স্মৃতিবেদনার মালাএকেলা গাঁথি। আজি কোন্‌ ভুলে ভুলি আঁধার ঘরেতে রাখিদুয়ার খুলি–মনে হয়, বুঝি আসিবে যেমোর দুখরজনীরমরমসাথি। আসিছে সে ধারাজলে সুর লাগায়েনীপবনে পুলক জাগায়ে। যদিও বা নাহি আসেতবু বৃথা আশ্বাসেমিলন-আসনখানিরয়েছে পাতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তাই  তোমার আনন্দ আমার ‘পর তুমি  তাই এসেছ নীচে। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার     প্রেম হত যে মিছে। আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা, আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা, মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে তোমার     ইচ্ছা তরঙ্গিছে।তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে তবু         আমার হৃদয় লাগি ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে প্রভু        নিত্য আছ জাগি। তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে, তোমারি প্রেম ভক্ত প্রাণের প্রেমে, মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে সেথায়       পূর্ণ প্রকাশিছে।জানিপুর। গোরাই, ২৮ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
১ যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায়, লভিবে সুযশ কীর্তি গৌরব যেথায়, কিন্তু গো একটি কথা, কহিতেও লাগে ব্যথা, উঠিবে যশের যবে সমুচ্চ সীমায়, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়– সুখ্যাতি অমৃত রবে, উৎফুল্ল হইবে যবে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়। ২ কত যে মমতা-মাখা, আলিঙ্গন পাবে সখা, পাবে প্রিয় বান্ধবের প্রণয় যতন, এ হতে গভীরতর, কতই উল্লাসকর, কতই আমোদে দিন করিবে যাপন, কিন্তু গো অভাগী আজি এই ভিক্ষা চায়, যখন বান্ধব-সাথ, আমোদে মাতিবে নাথ, তখন অভাগী বলে স্মরিয়ো আমায়। ৩ সুচারু সায়াহ্নে যবে ভ্রমিতে ভ্রমিতে, তোমার সে মনোহরা, সুদীপ্ত সাঁজের তারা, সেখানে সখা গো তুমি পাইবে দেখিতে– মনে কি পড়িবে নাথ, এক দিন আমা সাথ, বনভ্রমি ফিরে যবে আসিতে ভবনে– ওই সেই সন্ধ্যাতারা, দুজনে দেখেছি মোরা, আরো যেন জ্বল জ্বল জ্বলিত গগনে। ৪ নিদাঘের শেষাশেষি, মলিনা গোলাপরাশি, নিরখি বা কত সুখী হইতে অন্তরে, দেখি কি স্মরিবে তায়, সেই অভাগিনী হায় গাঁথিত যতনে তার মালা তোমা তরে! যে-হস্ত গ্রথিত বলে তোমার নয়নে হত তা সৌন্দর্য-মাখা, ক্রমেতে শিখিলে সখা গোলাপে বাসিত ভালো যাহারি কারণে– তখন সে দুঃখিনীকে কোরো নাথ মনে। ৫ বিষণ্ণ হেমন্তে যবে, বৃক্ষের পল্লব সবে শুকায়ে পড়িবে খসে খসে চারি ধারে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে। নিদারুণ শীত কালে, সুখদ আগুন জ্বেলে, নিশীথে বসিবে যবে অনলের ধারে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে। সেই সে কল্পনাময়ী সুখের নিশায়, বিমল সংগীত তান, তোমার হৃদয় প্রাণ। নীরবে সুধীরে ধীরে যদি গো জাগায়– আলোড়ি হৃদয়-তল, এক বিন্দু অশ্রুজল, যদি আঁখি হতে পড়ে সে তান শুনিলে, তখন করিয়ো মনে, এক দিন তোমা সনে, যে যে গান গাহিয়াছি হৃদি প্রাণ খুলে, তখন স্মরিয়ো হায় অভাগিনী বলে।Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
পথিক আমি। পথ চলতে চলতে দেখেছি পুরাণে কীর্তিত কত দেশ আজ কীর্তি-নিঃস্ব। দেখেছি দর্পোদ্ধত প্রতাপের অবমানিত ভগ্নশেষ, তার বিজয় নিশান বজ্রাঘাতে হঠাৎ স্তব্ধ অট্টহাসির মতো গেছে উড়ে; বিরাট অহংকার হয়েছে সাষ্টাঙ্গে ধুলায় প্রণত, সেই ধুলার 'পরে সন্ধ্যাবেলায় ভিক্ষুক তার জীর্ণ কাঁথা মেলে বসে, পথিকের শ্রান্ত পদ সেই ধুলায় ফেলে চিহ্ন,-- অসংখ্যের নিত্য পদপাতে সে চিহ্ন যায় লুপ্ত হয়ে। দেখেছি সুদূর যুগান্তর বালুর স্তরে প্রচ্ছন্ন, যেন হঠাৎ ঝঞ্ঝার ঝাপটা লেগে কোন্‌ মহাতরী হঠাৎ ডুবল ধূসর সমুদ্রতলে, সকল আশা নিয়ে, গান নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে। এই অনিত্যের মাঝখান দিয়ে চলতে চলতে অনুভব করি আমার হৃৎস্পন্দনে অসীমের স্তব্ধতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
মনে হচ্ছে শূন্য বাড়িটা অপ্রসন্ন, অপরাধ হয়েছে আমার তাই আছে মুখ ফিরিয়ে। ঘরে ঘরে বেড়াই ঘুরে, আমার জায়গা নেই-- হাঁপিয়ে বেরিয়ে চলে আসি। এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে যাব দেরাদুনে। অমলির ঘরে ঢুকতে পারি নি বহুদিন মোচড় যেন দিত বুকে। ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক'রে, তাই খুললেম ঘরের তালা। একজোড়া আগ্রার জুতো, চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশি শেলফে তার পড়বার বই, ছোটো হার্মোনিয়ম। একটা অ্যালবাম, ছবি কেটে কেটে জুড়েছে তার পাতায়। আলনায় তোয়ালে, জামা, খদ্দরের শাড়ি। ছোটো কাঁচের আলমারিতে নানা রকমের পুতুল, শিশি, খালি পাউডারের কৌটো। চুপ করে বসে রইলেম চৌকিতে। টেবিলের সামনে। লাল চামড়ার বাক্স, ইস্কুলে নিয়ে যেত সঙ্গে। তার থেকে খাতাটি নিলেম তুলে, আঁক কষবার খাতা। ভিতর থেকে পড়ল একটি আখোলা চিঠি, আমারি ঠিকানা লেখা অমলির কাঁচা হাতের অক্ষরে। শুনেছি ডুবে মরবার সময় অতীত কালের সব ছবি এক মুহূর্তে দেখা দেয় নিবিড় হয়ে-- চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনে অনেক কথা এক নিমেষে। অমলার মা যখন গেলেন মারা তখন ওর বয়স ছিল সাত বছর। কেমন একটা ভয় লাগল মনে, ও বুঝি বাঁচবে না বেশি দিন। কেননা বড়ো করুণ ছিল ওর মুখ, যেন অকালবিচ্ছেদের ছায়া ভাবীকাল থেকে উল্টে এসে পড়েছিল ওর বড়ো বড়ো কালো চোখের উপরে। সাহস হ'ত না ওকে সঙ্গছাড়া করি। কাজ করছি আপিসে বসে, হঠাৎ হ'ত মনে যদি কোনো আপদ ঘটে থাকে। বাঁকিপুর থেকে মাসি এল ছুটিতে-- বললে, "মেয়েটার পড়াশুনো হল মাটি। মুর্খু মেয়ের বোঝা বইবে কে আজকালকার দিনে।' লজ্জা পেলেম কথা শুনে তার, বললেম "কালই দেব ভর্তি করে বেথুনে'। ইস্কুলে তো গেল, কিন্তু ছুটির দিন বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে। কতদিন স্কুলের বাস্‌ অমনি যেত ফিরে। সে চক্রান্তে বাপেরও ছিল যোগ। ফিরে বছর মাসি এল ছুটিতে; বললে, "এমন করে চলবে না। নিজে ওকে যাব নিয়ে, বোর্ডিঙে দেব বেনারসের স্কুলে, ওকে বাঁচানো চাই বাপের স্নেহ থেকে।' মাসির সঙ্গে গেল চলে। অশ্রুহীন অভিমান নিয়ে গেল বুক ভরে যেতে দিলেম বলে। বেরিয়ে পড়লেম বদ্রিনাথের তীর্থযাত্রায় নিজের কাছ থেকে পালাবার ঝোঁকে। চার মাস খবর নেই। মনে হল গ্রন্থি হয়েছে আলগা গুরুর কৃপায়। মেয়েকে মনে মনে সঁপে দিলেম দেবতার হাতে, বুকের থেকে নেমে গেল বোঝা। চার মাস পরে এলেম ফিরে। ছুটেছিলেম অমলিকে দেখতে কাশীতে-- পথের মধ্যে পেলেম চিঠি-- কী আর বলব, দেবতাই তাকে নিয়েছে। যাক সে-সব কথা। অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি, তাতে লেখা-- "তোমাকে দেখতে বড্‌ডো ইচ্ছে করছে'। আর কিছুই নেই। ----------------------------- ৩১ শ্রাবণ, ১৩৩৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জন্মেছিনু সূক্ষ্ম তারে বাঁধা মন নিয়া , চারি দিক হতে শব্দ উঠিত ধ্বনিয়া নানা কম্পে নানা সুরে নাড়ীর জটিল জালে ঘুরে ঘুরে । বালকের মনের অতলে দিত আনি পাণ্ডুনীল আকাশের বাণী চিলের সুতীক্ষ্ণ সুরে নির্জন দুপুরে , রৌদ্রের প্লাবনে যবে চারি ধার সময়েরে করে দিত একাকার নিষ্কর্ম তন্দ্রার তলে । ওপাড়ার কুকুরের সুদূর কলকোলাহলে মনেরে জাগাত মোর অনির্দিষ্ট ভাবনার পারে অস্পষ্ট সংসারে । ফেরিওলাদের ডাক সূক্ষ্ম হয়ে কোথা যেত চলি , যে-সকল অলিগলি জানি নি কখনো তারা যেন কোনো বোগদাদের বসোরার পরদেশী পসরার স্বপ্ন এনে দিত বহি । রহি রহি রাস্তা হতে শোনা যেত সহিসের ডাক ঊর্ধ্বস্বরে , অন্তরে অন্তরে দিত সে ঘোষণা কোন্‌ অস্পষ্ট বার্তার , অসম্পন্ন উধাও যাত্রার । একঝাঁক পাতিহাঁস টলোমলো গতি নিয়ে উচ্চকলভাষ পুকুরে পড়িত ভেসে । বটগাছ হতে বাঁকা রৌদ্ররশ্মি এসে তাদের সাঁতার-কাটা জলে সবুজ ছায়ার তলে চিকন সাপের মতো পাশে পাশে মিলি খেলাত আলোর কিলিবিলি । বেলা হলে হলদে গামছা কাঁধে হাত দোলাইয়া যেত চলে কোন্‌খানে কে যে । ইস্কুলে উঠিত ঘণ্টা বেজে । সে ঘণ্টার ধ্বনি নিরর্থ আহ্বানঘাতে কাঁপাইত আমার ধমনী । রৌদ্রক্লান্ত ছুটির প্রহরে আলস্যে-শিথিল শান্তি ঘরে ঘরে ; দক্ষিণে গঙ্গার ঘাট থেকে গম্ভীরমন্দ্রিত হাঁক হেঁকে বাষ্পশ্বাসী সমুদ্র-খেয়ার ডিঙা বাজাইত শিঙা , রৌদ্রের প্রান্তর বহি ছুটে যেত দিগন্তে শব্দের অশ্বারোহী । বাতায়নকোণে নির্বাসনে যবে দিন যেত বয়ে না-চেনা ভুবন হতে ভাষাহীন নানা ধ্বনি লয়ে প্রহরে প্রহরে দূত ফিরে ফিরে আমারে ফেলিত ঘিরে । জনপূর্ণ জীবনের যে আবেগ পৃথ্বীনাট্যশালে তালে ও বেতালে করিত চরণপাত , কভু অকস্মাৎ কভু মৃদুবেগে ধীরে ধ্বনিরূপে মোর শিরে স্পর্শ দিয়ে চেতনারে জাগাইত ধোঁয়ালি চিন্তায় , নিয়ে যেত সৃষ্টির আদিম ভূমিকায় । চোখে দেখা এ বিশ্বের গভীর সুদূরে রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে ছন্দের মন্দিরে বসি রেখা-জাদুকর কাল আকাশে আকাশে নিত্য প্রসারে বস্তুর ইন্দ্রজাল । যুক্তি নয় , বুদ্ধি নয় , শুধু যেথা কত কী যে হয় — কেন হয় কিসে হয় সে প্রশ্নের কোনো নাহি মেলে উত্তর কখনো । যেথা আদিপিতামহী পড়ে বিশ্ব-পাঁচালির ছড়া ইঙ্গিতের অনুপ্রাসে গড়া — কেবল ধ্বনির ঘাতে বক্ষস্পন্দে দোলন দুলায়ে মনেরে ভুলায়ে নিয়ে যায় অস্তিত্বের ইন্দ্রজাল যেই কেন্দ্রস্থলে , বোধের প্রত্যুষে যেথা বুদ্ধির প্রদীপ নাহি জ্বলে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জীবনে তব প্রভাত এল নব-অরুণকান্তি। তোমারে ঘেরি মেলিয়া থাক শিশিরে-ধোওয়া শান্তি। মাধুরী তব মধ্যদিনে শক্তিরূপ ধরি কর্মপটু কল্যাণের করুক দূর ক্লান্তি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
মাধব , না কহ আদরবাণী , না কর প্রেমক নাম । জানয়ি মুঝকো অবলা সরলা ছলনা না কর শ্যাম । কপট , কাহ তুঁহু ঝূট বোলসি , পীরিত করসি তু মোয় ? ভালে ভালে হম অলপে চিহ্ননু , না পতিয়াব রে তোয় । ছিদল তরীসম কপট প্রেম'পর ডারনু যব মনপ্রাণ , ডুবনু ডুবনু রে ঘোর সায়রে অব কুত নাহিক ত্রাণ । মাধব , কঠোর বাত হমারা মনে লাগল কি তোর ? মাধব , কাহ তু মলিন করলি মুখ , ক্ষমহ গো কুবচন মোর ! নিদয় বাত অব কবহুঁ ন বোলব , তুঁহু মম প্রাণক প্রাণ । অতিশয় নির্মম ব্যথিনু হিয়া তব ছোড়য়ি কুবচনবাণ মিটল মান অব — ভানু হাসতহি হেরই পীরিতলীলা । কভু অভিমানিনী , আদরিণী কভু পীরিতিসাগর বালা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
কোন্‌ ছায়াখানি সঙ্গে তব ফেরে লয়ে স্বপ্নরুদ্ধ বাণী তুমি কি আপনি তাহা জানো। চোখের দৃষ্টিতে তব রয়েছে বিছানো। আপনাবিস্মৃত তারি। স্তম্ভিত স্তিমিত অশ্রুবারি।একদিন জীবনের প্রথম ফাল্গুনী এসেছিল, তুমি তারি পদধ্বনি শুনি কম্পিত কৌতুকী যেমনি খুলিয়া দ্বার দিলে উঁকি আম্রমঞ্জরির গন্ধে মধুপগুঞ্জনে হৃদয়স্পন্দনে এক ছন্দে মিলে গেল বনের মর্মর। অশোকের কিশলয়স্তর উৎসুক যৌবনে তব বিস্তারিল নবীন রক্তিমা। প্রাণোচ্ছ্বাস নাহি পায় সীমা তোমার আপনা-মাঝে, সে-প্রাণেরই ছন্দ বাজে দূর নীল বনান্তের বিহঙ্গসংগীতে, দিগন্তে নির্জনলীন রাখালের করুণ বংশীতে। তব বনচ্ছায়ে আসিল অতিথি পান্থ, তৃণস্তরে দিল সে বিছায়ে উত্তরী-অংশুকে তার সুবর্ণ পূর্ণিমা চম্পকবর্ণিমা। তারি সঙ্গে মিশে প্রভাতের মৃদু রৌদ্র দিশে দিশে তোমার বিধুর হিয়া দিল উচ্ছ্বাসিয়া।তার পর সসংকোচে বদ্ধ করি দিলে তব দ্বার, উচ্ছৃঙ্খল সমীরণে উদ্দাম কুন্তলভার লইলে সংযত করি-- অশান্ত তরুণ প্রেম বসন্তের পন্থ অনুসরি স্খলিত কিংশুক-সাথে জীর্ণ হল ধূসর ধুলাতে।      তুমি ভাবো সেই রাত্রিদিন চিহ্নহীন মল্লিকাগন্ধের মতো নির্বিশেষে গত। জানো না কি যে-বসন্ত সম্বরিল কায়া তারি মৃত্যুহীন ছায়া অহর্নিশি আছে তব সাথে সাথে তোমার অজ্ঞাতে। অদৃশ্য মঞ্জরি তার আপনার রেণুর রেখায় মেশে তব সীমন্তের সিন্দূরলেখায়। সুদূর সে ফাল্গুনের স্তব্ধ সুর তোমার কণ্ঠের স্বর করি দিল উদাত্ত মধুর। যে চাঞ্চল্য হয়ে গেছে স্থির তারি মন্ত্রে চিত্ত তব সকরুণ, শান্ত, সুগম্ভীর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
চলে গেল , আর কিছু নাই কহিবার । চলে গেল , আর কিছু নাই গাহিবার । শুধু গাহিতেছে আর শুধু কাঁদিতেছে দীনহীন হৃদয় আমার , শুধু বলিতেছে , “ চলে গেল সকলেই চলে গেল গো , বুক শুধু ভেঙে গেল দলে গেল গো । ” বসন্ত চলিয়া গেলে বর্ষা কেঁদে কেঁদে বলে , “ ফুল গেল , পাখি গেল -- আমি শুধু রহিলাম , সবই গেল গো । ” দিবস ফুরালে রাতি স্তব্ধ হয়ে রহে , শুধু কেঁদে কহে , “ দিন গেল , আলো গেল , রবি গেল গো -- কেবল একেলা আমি , সবই গেল গো । ” উত্তরবায়ুর সম প্রাণের বিজনে মম কে যেন কাঁদিছে শুধু “ চলে গেল , চলে গেল , সকলেই চলে গেল গো । ” উৎসব ফুরায়ে গেলে ছিন্ন শুষ্ক মালা পড়ে থাকে হেথায় হোথায় -- তৈলহীন শিখাহীন ভগ্ন দীপগুলি ধুলায় লুটায় -- একবার ফিরে কেহ দেখে নাকো ভুলি , সবে চলে যায় । পুরানো মলিন ছিন্ন বসনের মতো মোরে ফেলে গেল , কাতর নয়নে চেয়ে রহিলাম কত -- সাথে না লইল । তাই প্রাণ গাহে শুধু , কাঁদে শুধু , কহে শুধু , “ মোরে ফেলে গেল , সকলেই মোরে ফেলে গেল , সকলেই চলে গেল গো । ” একবার ফিরে তারা চেয়েছিল কি ? বুঝি চেয়েছিল । একবার ভুলে তারা কেঁদেছিল কি ? বুঝি কেঁদেছিল । বুঝি ভেবেছিল -- লয়ে যাই -- নিতান্ত কি একেলা কাঁদিবে ? তাই বুঝি ভেবেছিল । তাই চেয়েছিল । তার পরে ? তার পরে ! তার পরে বুঝি হেসেছিল । একফোঁটা অশ্রুবারি মুহূর্তেই শুকাইল । তার পরে ? তার পরে ! চলে গেল । তার পরে ? তার পরে ! ফুল গেল , পাখি গেল , আলো গেল , রবি গেল , সবই গেল , সবই গেল গো -- হৃদয় নিশ্বাস ছাড়ি কাঁদিয়া কহিল , “ সকলেই চলে গেল গো , আমারেই ফেলে গেল গো । ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
দিনের আলো নিবে এল, সুয্যি ডোবে - ডোবে। আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে। মেঘের উপর মেঘ করেছে— রঙের উপর রঙ, মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা। বাজল ঠঙ ঠঙ। ও পারেতে বিষ্টি এল, ঝাপসা গাছপালা। এ পারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা। বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলার গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান। ' আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা, কোথায় বা সীমানা! দেশে দেশে খেলে বেড়ায়, কেউ করে না মানা। কত নতুন ফুলের বনে বিষ্টি দিয়ে যায়, পলে পলে নতুন খেলা কোথায় ভেবে পায়। মেঘের খেলা দেখে কত খেলা পড়ে মনে, কত দিনের নুকোচুরি কত ঘরের কোণে। তারি সঙ্গে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান। ' মনে পড়ে ঘরটি আলো মায়ের হাসিমুখ, মনে পড়ে মেঘের ডাকে গুরুগুরু বুক। বিছানাটির একটি পাশে ঘুমিয়ে আছে খোকা, মায়ের ‘পরে দৌরাত্মি সে না যায় লেখাজোখা। ঘরেতে দুরন্ত ছেলে করে দাপাদাপি, বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে— সৃষ্টি ওঠে কাঁপি। মনে পড়ে মায়ের মুখে শুনেছিলেম গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান। মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা, মনে পড়ে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা। মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো, একটা দিকের দেয়ালেতে ছায়া কালো কালো। বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ ঝুপ্‌— দস্যি ছেলে গল্প শোনে একেবারে চুপ। তারি সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান। ' কবে বিষ্টি পড়েছিল, বান এল সে কোথা। শিবঠাকুরের বিয়ে হল, কবেকার সে কথা। সেদিনও কি এম্‌নিতরো মেঘের ঘটাখানা। থেকে থেকে বাজ বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা। তিন কন্যে বিয়ে করে কী হল তার শেষে। না জানি কোন্‌ নদীর ধারে, না জানি কোন্‌ দেশে, কোন্‌ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান— ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
নেই বা হলেম যেমন তোমার অম্বিকে গোঁসাই । আমি তো , মা , চাই নে হতে পণ্ডিতমশাই । নাই যদি হই ভালো ছেলে , কেবল যদি বেড়াই খেলে তুঁতের ডালে খুঁজে বেড়াই গুটিপোকার গুটি , মুর্খু হয়ে রইব তবে ? আমার তাতে কীই বা হবে , মুর্খু যারা তাদেরই তো সমস্তখন ছুটি । তারাই তো সব রাখাল ছেলে গোরু চরায় মাঠে । নদীর ধারে বনে বনে তাদের বেলা কাটে । ডিঙির ' পরে পাল তুলে দেয় , ঢেউয়ের মুখে নাও খুলে দেয় , ঝাউ কাটতে যায় চলে সব নদীপারের চরে । তারাই মাঠে মাচা পেতে পাখি তাড়ায় ফসল - খেতে , বাঁকে করে দই নিয়ে যায় পাড়ার ঘরে ঘরে । কাস্তে হাতে চুবড়ি মাথায় , সন্ধে হলে পরে ফেরে গাঁয়ে কৃষাণ ছেলে , মন যে কেমন করে । যখন গিয়ে পাঠশালাতে দাগা বুলোই খাতার পাতে , গুরুমশাই দুপুরবেলায় বসে বসে ঢোলে , হাঁকিয়ে গাড়ি কোন্ গাড়োয়ান মাঠের পথে যায় গেয়ে গান , শুনে আমি পণ করি যে মুর্খু হব বলে । দুপুরবেলায় চিল ডেকে যায় ; হঠাৎ হাওয়া আসি বাঁশ - বাগানে বাজায় যেন সাপ - খেলাবার বাঁশি । পুবের দিকে বনের কোলে বাদল - বেলার আঁচল দোলে , ডালে ডালে উছলে ওঠে শিরীষফুলের ঢেউ । এরা যে পাঠ - ভোলার দলে পাঠশালা সব ছাড়তে বলে , আমি জানি এরা তো , মা , পণ্ডিত নয় কেউ । যাঁরা অনেক পুঁথি পড়েন তাঁদের অনেক মান । ঘরে ঘরে সবার কাছে তাঁরা আদর পান । সঙ্গে তাঁদের ফেরে চেলা , ধুমধামে যায় সারা বেলা , আমি তো , মা , চাই নে আদর তোমার আদর ছাড়া । তুমি যদি মুর্খু বলে আমাকে মা না নাও কোলে তবে আমি পালিয়ে যাব বাদলা মেঘের পাড়া । সেখান থেকে বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেব চুল । ঘাটে যখন যাবে , আমি করব হুলুস্থূল । রাত থাকতে অনেক ভোরে আসব নেমে আঁধার করে , ঝড়ের হাওয়ায় ঢুকব ঘরে দুয়ার ঠেলে ফেলে , তুমি বলবে মেলে আঁখি , ' দুষ্টু দেয়া খেপল না কি ?' আমি বলব , ' খেপেছে আজ তোমার মুর্খু ছেলে । ' (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
“হে পথিক, কোন্‌খানে চলেছ কাহার পানে।’ গিয়েছে রজনী, উঠে দিনমণি, চলেছি সাগরস্নানে। উষার আভাসে তুষারবাতাসে পাখির উদার গানে শয়ন তেয়াগি উঠিয়াছি জাগি, চলেছি সাগরস্নানে।“শুধাই তোমার কাছে সে সাগর কোথা আছে।’ যেথা এই নদী বহি নিরবধি নীল জলে মিশিয়াছে। সেথা হতে রবি উঠে নবছবি, লুকায় তাহারি পাছে– তপ্ত প্রাণের তীর্থস্নানের সাগর সেথায় আছে।“পথিক তোমার দলে যাত্রী ক’জন চলে।’ গণি তাহা ভাই শেষ নাহি পাই, চলেছে জলে স্থলে। তাহাদের বাতি জ্বলে সারারাতি তিমির-আকাশ-তলে। তাহাদের গান সারা দিনমান ধ্বনিছে জলে স্থলে।“সে সাগর, কহো,তবে আর কত দূরে হবে।’ “আর কত দূরে’ “আর কত দূরে’ সেই তো শুধাই সবে। ধ্বনি তার আসে দখিন বাতাসে ঘনভৈরবরবে। কভু ভাবি “কাছে’, কভু “দূরে আছে’– আর কত দূরে হবে।“পথিক, গগনে চাহো, বাড়িছে দিনের দাহ।’ বাড়ে যদি দুখ হব না বিমুখ, নিবাব না উৎসাহ। ওরে ওরে ভীত তৃষিত তাপিত জয়সংগীত গাহো। মাথার উপরে খররবিকরে বাড়ুক দিনের দাহ।“কী করিবে চলে চলে পথেই সন্ধ্যা হলে।’ প্রভাতের আশে স্নিগ্ধ বাতাসে ঘুমাব পথের কোলে। উদিবে অরুণ নবীন করুণ বিহঙ্গকলরোলে। সাগরের স্নান হবে সমাধান নূতন প্রভাত হলে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
কাল বলে,আমি সৃষ্টি করি এই ভব। ঘড়ি বলে, তা হলে আমিও স্রষ্টা তব।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
কহিলা হবু, `শুন গো গোবুরায়, কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র--- মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায় ধরণী-মাঝে চরণ-ফেলা মাত্র! তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি, রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি। আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি, রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি! শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার, নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।' শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন, দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে। পণ্ডিতের হইল মুখ চুন, পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে। রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি, কান্নাকাটি পড়িল বাড়িমধ্যে, অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে, `যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে, পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!' শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি, কহিল শেষে, `কথাটা বটে সত্য--- কিন্তু আগে বিদায় করো ধুলি, ভাবিয়ো পরে পদধুলির তত্ত্ব। ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে, কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে? আগের কাজ আগে তো তুমি সারো, পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।' আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি, যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী। বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি, ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য। অনেক ভেবে কহিল, `গেলে মাটি ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?' কহিল রাজা, `তাই যদি না হবে, পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?' সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ, ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে ভরিয়ে দিল রাজার মুখ বক্ষ। ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ, ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য। ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক, ধুলার মাঝে নগর হল উহ্য। কহিল রাজা, `করিতে ধুলা দূর, জগত্‍‌ হল ধুলায় ভরপুর!' তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি। পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিক চলে কিস্তি। জলের জীব মরিল জল বিনা, ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা--- পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা, সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা। কহিল রাজা, `এমনি সব গাধা ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!' আবার সবে ডাকিল পরামর্শে; বসিল পুন যতেক গুণবন্ত--- ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে, ধুলার হায় নাহিক পায় অন্ত। কহিল, `মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো, ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।' কহিল কেহ, `রাজারে ঘরে রাখো, কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র। ধুলার মাঝে না যদি দেন পা তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না।' কহিল রাজা, `সে কথা বড়ো খাঁটি, কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ, মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।' কহিল সবে, `চামারে তবে ডাকি চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী। ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি।' কহিল সবে, `হবে সে অবহেলে, যোগ্যমতো চামার যদি মেলে।' রাজার চর ধাইল হেথা হোথা, ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম। যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা, না মিলে তত উচিত-মতো চর্ম। তখন ধীরে চামার-কুলপতি কহিল এসে ঈষত্‍‌ হেসে বৃদ্ধ, `বলিতে পারি করিলে অনুমতি, সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ। নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।' কহিল রাজা, `এত কি হবে সিধে, ভাবিয়া ম'ল সকল দেশ-শুদ্ধ!' মন্ত্রী কহে, `বেটারে শূল বিঁধে কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।' রাজার পদ চর্ম-আবরণে ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে। মন্ত্রী কহে, `আমারো ছিল মনে কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।' সেদিন হতে চলিল জুতা পরা--- বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বদেশমূলক
অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে প্রেমহার হয় গাঁথা। জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।। পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী। হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি। দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে সঙ্কটদুঃখত্রাতা। জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।। ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে। দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে স্নেহময়ী তুমি মাতা। জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।। রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে – গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে। তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে তব চরণে নত মাথা। জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
সাতাশ, হলে না কেন এক-শো সাতাশ, থলিটি ভরিত, হাড়ে লাগিত বাতাস। সাতাশ কহিল, তাহে টাকা হত মেলা, কিন্তু কী করিতে বাপু বয়সের বেলা?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
পাশ দিয়ে গেল চলি চকিতের প্রায় , অঞ্চলের প্রান্তখানি ঠেকে গেল গায় , শুধু দেখা গেল তার আধখানি পাশ — শিহরি পরশি গেল অঞ্চলের বায় । অজানা হৃদয়বনে উঠেছে উচ্ছ্বাস , অঞ্চলে বহিয়া এল দক্ষিণবাতাস , সেথা যে বেজেছে বাঁশি তাই শুনা যায় , সেথায় উঠিছে কেঁদে ফুলের সুবাস । কার প্রাণখানি হতে করি হায় – হায় বাতাসে উড়িয়া এল পরশ – আভাস ! ওগো কার তনুখানি হয়েছে উদাস , ওগো কে জানাতে চাহে মরম বারতা ! দিয়ে গেল সর্বাঙ্গের আকুল নিশ্বাস , বলে গেল সর্বাঙ্গের কানে কানে কথা ।।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
মায়ায় রয়েছে বাঁধা প্রদোষ – আঁধার ; চিত্রপটে সন্ধ্যাতারা অস্ত নাহি যায় । এলাইয়া ছড়াইয়া গুচ্ছ কেশভার বাহুতে মাথাটি রেখে রমণী ঘুমায় । চারি দিকে পৃথিবীতে চিরজাগরণ , কে ওরে পাড়ালে ঘুম তারি মাঝখানে ! কোথা হতে আহরিয়া নীরব গুঞ্জন চিরদিন রেখে গেছে ওরই কানে কানে ! ছবির আড়ালে কোথা অনন্ত নির্ঝর নীরব ঝর্ঝর – গানে পড়িছে ঝরিয়া । চিরদিন কাননের নীরব মর্মর , লজ্জা চিরদিন আছে দাঁড়ায়ে সমুখে — যেমনি ভাঙিবে ঘুম , মরমে মরিয়া বুকের বসনখানি তুলে দিবে বুকে ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
হয়েছে কি তবে সিংহদুয়ার বন্ধ রে? এখনো সময় আছে কি, সময় আছে কি? দূরে কলরব ধ্বনিছে মন্দ মন্দ রে--- ফুরালো কি পথ? এসেছি পুরীর কাছে কি? মনে হয় সেই সুদূর মধুর গন্ধ রে রহি রহি যেন ভাসিয়া আসিছে বাতাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি--- এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। ঐ কি প্রদীপ দেখা যায় পুরমন্দিরে? ও যে দুটি তারা দূর পশ্চিমগগনে। ও কি শিঞ্জিত ধ্বনিছে কনকমঞ্জীরে? ঝিল্লির রব বাজে বনপথে সঘনে। মরীচিকালেখা দিগন্তপথ রঞ্জি রে সারাদিন আজি ছলনা করেছে হতাশে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি--- এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। এতদিনে সেথা বনবনান্ত নন্দিয়া নব বসন্তে এসেছে নবীন ভূপতি। তরুণ আশার সোনার প্রতিমা বন্দিয়া নব আনন্দে ফিরিছে যুবক যুবতী। বীণার তন্ত্রী আকুল ছন্দে ক্রন্দিয়া ডাকিছে সবারে আছে যারা দূর প্রবাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি--- এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। আজিকে সবাই সাজিয়াছে ফুলচন্দনে, মুক্ত আকাশে যাপিবে জ্যোত্‍‌স্নাযামিনী। দলে দলে চলে বাঁধাবাঁধি বাহুবন্ধনে--- ধ্বনিছে শূন্যে জয়সংগীতরাগিণী। নূতন পতাকা নূতন প্রাসাদপ্রাঙ্গণে দক্ষিণবায়ে উড়িছে বিজয়বিলাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি--- এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। সারা নিশি ধরে বৃথা করিলাম মন্ত্রণা, শরত্‍‌-প্রভাত কাটিল শূন্যে চাহিয়া। বিদায়ের কালে দিতে গেনু কারে সান্ত্বনা, যাত্রীরা হোথা গেল খেয়াতরী বাহিয়া। আপনারে শুধু বৃথা করিলাম বঞ্চনা, জীবন-আহুতি দিলাম কী আশা-হুতাশে! বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি--- এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। প্রভাতে আমায় ডেকেছিল সবে ইঙ্গিতে, বহুজনমাঝে লয়েছিল মোরে বাছিয়া--- যবে রাজপথ ধ্বনিয়া উঠিল সংগীতে তখনো বারেক উঠেছিল প্রাণ নাচিয়া। এখন কি আর পারিব প্রাচীর লঙ্ঘিতে--- দাঁড়ায়ে বাহিরে ডাকিব কাহারে বৃথা সে! বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি--- এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে। দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে, শান্তিসমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে। দুয়ার-প্রান্তে দাঁড়ায়ে বাহির-প্রান্তরে ভেরী বাজাইব মোর প্রাণপণ প্রয়াসে! বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি--- এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিছে আকাশে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
চিন্তাহরণ দালালের বাড়ি গিয়ে একশো টাকার একখানি নোট দিয়ে তিনখানা নোট আনে সে দশ টাকার। কাগজ্‌-গন্‌তি মুনফা যতই বাড়ে টাকার গন্‌তি লক্ষ্মী ততই ছাড়ে, কিছুতে বুঝিতে পারে না দোষটা কার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বাণীর মুরতি গড়ি একমনে নির্জন প্রাঙ্গণে পিণ্ড পিণ্ড মাটি তার যায় ছড়াছড়ি, অসমাপ্ত মূক শূন্যে চেয়ে থাকে নিরুৎসুক। গর্বিত মূর্তির পদানত মাথা করে থাকে নিচু, কেন আছে উত্তর না দিতে পারে কিছু বহুগুণে শোচনীয় হায় তার চেয়ে এক কালে যাহা রূপ পেয়ে কালে কালে অর্থহীনতায় ক্রমশ মিলায়। নিমন্ত্রণ ছিল কোথা শুধাইলে তারে উত্তর কিছু না দিতে পারে—কোন্‌ স্বপ্ন বাঁধিবারে বহিয়া ধূলির ঋণ দেখা দিল মানবের দ্বারে। বিস্মৃত স্বর্গের কোন্‌ উর্বশীর ছবি ধরণীর চিত্তপটে বাঁধিতে চাহিয়াছিল কবি, তোমারে বাহনরূপে ডেকেছিল, চিত্রশালে যত্নে রেখেছিল, কখন সে অন্যমনে গেছে ভুলি আদিম আত্মীয় তব ধূলি, অসীম বৈরাগ্যে তার দিক্‌বিহীন পথে তুলি নিল বাণীহীন রথে। এই ভালো, বিশ্বব্যাপী ধূসর সম্মানে আজ পঙ্গু আবর্জনা নিয়ত গঞ্জনাকালের চরণক্ষেপে পদে পদে বাধা দিতে জানে, পদাঘাতে পদাঘাতে জীর্ণ অপমানে শান্তি পায় শেষে আবার ধূলিতে যবে মেশে।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
সখী,    ভাবনা কাহারে বলে। সখী,    যাতনা কাহারে বলে ।        তোমরা যে বলো দিবস-রজনী    ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’— সখী,    ভালোবাসা কারে কয়!  সে কি   কেবলই যাতনাময় । সে কি   কেবলই চোখের জল?   সে কি   কেবলই দুখের শ্বাস ? লোকে তবে করে   কী সুখেরই তরে   এমন দুখের আশ ।        আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল,    সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন, বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো । তারা  কেবলই হাসে, কেবলই গায়,   হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়— না জানে বেদন, না জানে রোদন,   না জানে সাধের যাতনা যত । ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,   জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়, হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে   আকাশের তারা তেয়াগে কায় । আমার মতন সুখী কে আছে।   আয় সখী, আয় আমার কাছে— সুখী হৃদয়ের সুখের গান   শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ । প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল    একদিন নয় হাসিবি তোরা— একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া    সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।।("ভগ্নহৃদয়" গ্রন্থ থেকে)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
মাস্টার বলে, “তুমি দেবে ম্যাট্রিক, এক লাফে দিতে চাও হবে না সে ঠিক। ঘরে দাদামশায়ের দেখো example, সত্তর বৎসরও হয়নিকো ample। একদা পরীক্ষায় হবে উত্তীর্ণ যখন পাকবে চুল, হাড় হবে জীর্ণ।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
আমি    ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেমগ্রামের পথে পথে,তুমি তখন চলেছিলেতোমার স্বর্ণরথে। অপূর্ব এক স্বপ্ন-সমলাগতেছিল চক্ষে মম–কী বিচিত্র শোভা তোমার,কী বিচিত্র সাজ। আমি মনে ভাবেতেছিলেম,এ কোন্‌ মহারাজ।  আজি   শুভক্ষণে রাত পোহালোভেবেছিলেম তবে,আজ আমারে দ্বারে দ্বারেফিরতে নাহি হবে। বাহির হতে নাহি হতেকাহার দেখা পেলেম পথে,চলিতে রথ ধনধান্যছড়াবে দুই ধারে–মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব,নেব ভারে ভারে।  দেখি    সহসা রথ থেমে গেলআমার কাছে এসে,আমার মুখপানে চেয়েনামলে তুমি হেসে। দেখে মুখের প্রসন্নতাজুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা,হেনকালে কিসের লাগিতুমি অকস্মাৎ“আমায় কিছু দাও গো’ বলেবাড়িয়ে দিলে হাত।  মরি,    এ কী কথা রাজাধিরাজ,“আমায় দাও গো কিছু’!শুনে ক্ষণকালের তরেরইনু মাথা-নিচু। তোমার কী-বা অভাব আছেভিখারী ভিক্ষুকের কাছে। এ কেবল কৌতুকের বশেআমায় প্রবঞ্চনা। ঝুলি হতে দিলেম তুলেএকটি ছোটো কণা।  যবে       পাত্রখানি ঘরে এনেউজাড় করি– এ কী!ভিক্ষামাঝে একটি ছোটোসোনার কণা দেখি। দিলেম যা রাজ-ভিখারীরেস্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,তখন কাঁদি চোখের জলেদুটি নয়ন ভরে–তোমায় কেন দিই নি আমারসকল শূন্য করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
অবরুদ্ধ ছিল বায়ু; দৈত্য সম পুঞ্জ মেঘভার ছায়ার প্রহরীব্যূহে ঘিরে ছিল সূর্যের দুয়ার; অভিভূত আলোকের মূর্ছাতুর ম্লান অসম্মানে দিগন্ত আছিল বাষ্পাকুল। যেন চেয়ে ভূমিপানে অবসাদে-অবনত ক্ষীণশ্বাস চির প্রাচীনতা স্তব্ধ হয়ে আছে বসে দীর্ঘকাল, ভুলে গেছে কথা, ক্লান্তিভারে আঁখিপাতা বদ্ধপ্রায়। শূন্যে হেনকালে জয়শঙ্খ উঠিল বাজিয়া। চন্দন তিলক ভালে শরৎ উঠিল হেসে চমকিত গগন প্রাঙ্গণে; পল্লবে পল্লবে কাঁপি বনলক্ষ্মী কিঙ্কিণী কঙ্কণেবিচ্ছুরিল দিকে দিকে জ্যোতিষ্কণা। আজি হেরি চোখে কোন্‌ অনির্বচনীয় নবীনেরে তরুণ আলোকে। যেন আমি তীর্থযাত্রী অতিদূর ভাবী কাল হতে মন্ত্রবলে এসেছি ভাসিয়া। উজান স্বপ্নের স্রোতে অকস্মাৎ উত্তরিনু বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে যেন এই মুহূর্তেই। চেয়ে চেয়ে বেলা মোর কাটে। আপনারে দেখি আমি আপন বাহিরে, যেন আমি অপর যুগের কোনো অজানিত, সদ্য গেছে নামি’ সত্তা হতে প্রত্যহের আচ্ছাদন; অক্লান্ত বিস্ময় যার পানে চক্ষু মেলি তারে যেন আঁকড়িয়া রয় পুষ্পলগ্ন ভ্রমরের মতো। এই তো ছুটির কাল, সর্ব দেহ মন হতে ছিন্ন হোলো অভ্যাসের জাল, নগ্ন চিত্ত মগ্ন হোলো সমস্তের মাঝে। মনে ভাবি, পুরানোর দুর্গদ্বারে মৃত্যু যেন খুলে দিল চাবি, নূতন বাহিরি’ এল; তুচ্ছতার জীর্ণ উত্তরীয় ঘুচালো সে; অস্তিত্বের পূর্ণ মূল্যে কী অভাবনীয় প্রকাশিত তার স্পর্শে, রজনীর মৌন সুবিপুলপ্রভাতের গানে সে মিশায়ে দিল; কালো তার চুল পশ্চিম দিগন্ত পারে নামহীন বন-নীলিমায় বিস্তারিল রহস্য নিবিড়। আজি মুক্তিমন্ত্র গায় আমার বক্ষের মাঝে দূরের পথিকচিত্ত মম, সংসার যাত্রার প্রান্তে সহমরণের বধূ সম।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
প্রেমের হাতে ধরা দেব তাই রয়েছি বসে; অনেক দেরি হয়ে গেল, দোষী অনেক দোষে। বিধিবিধান-বাঁধনডোরে ধরতে আসে, যাই সে সরে, তার লাগি যা শাস্তি নেবার নেব মনের তোষে। প্রেমের হাতে ধরা দেব তাই রয়েছি বসে। লোকে আমায় নিন্দা করে, নিন্দা সে নয় মিছে, সকল নিন্দা মাথায় ধরে রব সবার নীচে। শেষ হয়ে যে গেল বেলা, ভাঙল বেচা-কেনার মেলা, ডাকতে যারা এসেছিল ফিরল তারা রোষে। প্রেমের হাতে ধরা দেব তাই রয়েছি বসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
বয়স আমার হবে তিরিশ , দেখতে আমায় ছোটো , আমি নই মা , তোমার শিরিশ , আমি হচ্ছি নোটো । আমি যে রোজ সকাল হলে যাই শহরের দিকে চলে তমিজ মিঞার গোরুর গাড়ি চড়ে । সকাল থেকে সারা দুপর ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর খেয়ালমতো দেয়াল তুলি গড়ে । ভাবছ তুমি নিয়ে ঢেলা ঘর - গড়া সে আমার খেলা , কক্‌খনো না সত্যিকার সে কোঠা । ছোটো বাড়ি নয় তো মোটে , তিনতলা পর্যন্ত ওঠে , থামগুলো তার এমনি মোটা মোটা । কিন্তু যদি শুধাও আমায় ওইখানেতেই কেন থামায় ? দোষ কী ছিল ষাট - সত্তর তলা ? ইঁট সুরকি জুড়ে জুড়ে একেবারে আকাশ ফুঁড়ে হয় না কেন কেবল গেঁথে চলা ? গাঁথতে গাঁথতে কোথায় শেষে ছাত কেন না তারায় মেশে ? আমিও তাই ভাবি নিজে নিজে । কোথাও গিয়ে কেন থামি যখন শুধাও , তখন আমি জানি নে তো তার উত্তর কী যে । যখন খুশি ছাতের মাথায় উঠছি ভারা বেয়ে । সত্যি কথা বলি , তাতে মজা খেলার চেয়ে । সমস্ত দিন ছাত - পিটুনি গান গেয়ে ছাত পিটোয় শুনি , অনেক নিচে চলছে গাড়িঘোড়া । বাসনওআলা থালা বাজায় ; সুর করে ওই হাঁক দিয়ে যায় আতাওআলা নিয়ে ফলের ঝোড়া । সাড়ে চারটে বেজে ওঠে , ছেলেরা সব বাসায় ছোটে হো হো করে উড়িয়ে দিয়ে ধুলো । রোদ্ দুর    যেই আসে পড়ে পুবের মুখে কোথায় ওড়ে দলে দলে ডাক দিয়ে কাকগুলো । আমি তখন দিনের শেষে ভারার থেকে নেমে এসে আবার ফিরে আসি আপন গাঁয়ে । জান তো , মা , আমার পাড়া যেখানে ওই খুঁটি গাড়া পুকুরপাড়ে গাজনতলার বাঁয়ে । তোরা যদি শুধাস মোরে খড়ের চালায় রই কী করে ? কোঠা যখন গড়তে পারি নিজে ; আমার ঘর যে কেন তবে সব - চেয়ে না বড়ো হবে ? জানি নে তো তার উত্তর কী যে ! (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বিধাতা দিলেন মান বিদ্রোহের বেলা। অন্ধ ভক্তি দিনু যবে করিলেন হেলা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
সভাতলে ভুঁয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে নাক ডাকাইছে সুল্‌তান, পাকা দাড়ি নেড়ে গলা দিয়ে ছেড়ে মন্ত্রী গাহিছে মূলতান। এত উৎসাহ দেখি গায়কের জেদ হল মনে সেনানায়কের– কোমরেতে এক ওড়না জড়িয়ে নেচে করে সভা গুলতান। ফেলে সব কাজ বরকন্দাজ বাঁশিতে লাগায় ভুল তান।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
দুঃখশিখার প্রদীপ জ্বেলে খোঁজো আপন মন, হয়তো সেথা হঠাৎ পাবে চিরকালের ধন।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
মোর চেতনায় আদিসমুদ্রের ভাষা ওঙ্কারিয়া যায়; অর্থ তার নাহি জানি, আমি সেই বাণী। শুধু ছলছল কলকল; শুধু সুর, শুধু নৃত্য, বেদনার কলকোলাহল; শুধু এ সাঁতার-- কখনো এ পারে চলা, কখনো ও পার, কখনো বা অদৃশ্য গভীরে, কভু বিচিত্রের তীরে তীরে। ছন্দের তরঙ্গদোলে কত যে ইঙ্গিত ভঙ্গি জেগে ওঠে, ভেসে যায় চলে। স্তব্ধ মৌনী অচলের বহিয়া ইশারা নিরন্তর স্রোতোধারা অজানা সম্মুখে ধায়, কোথা তার শেষ কে জানে উদ্দেশ। আলোছায়া ক্ষণে ক্ষণে দিয়ে যায় ফিরে ফিরে স্পর্শের পর্যায়। কভু দূরে কখনো নিকটে প্রবাহের পটে মহাকাল দুই রূপ ধরে পরে পরে কালো আর সাদা। কেবলি দক্ষিণে বামে প্রকাশ ও প্রকাশের বাধা অধরার প্রতিবিম্ব গতিভঙ্গে যায় এঁকে এঁকে, গতিভঙ্গে যায় ঢেকে ঢেকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
নগাধিরাজের দূর নেবু-নিকুঞ্জের রসপাত্রগুলি আনিল এ শয্যাতলে জনহীন প্রভাতের রবির মিত্রতা, অজানা নির্ঝরিণীর বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটার হিরন্ময় লিপি, সুনিবিড় অরণ্যবীথির নিঃশব্দ মর্মরে বিজড়িত স্নিগ্ধ হৃদয়ের দৌত্যখানি। রোগপঙ্গু লেখনীর বিরল ভাষার ইঙ্গিতে পাঠায় কবি আর্শীবাদ তার।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
হার-মানা হার পরাব তোমার গলে- দূরে রব কত আপন বলের ছলে। জানি আমি জানি ভেসে যাবে আভিমান- নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ, শূন্য হিঁয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান, পাষাণ তখন গলিবে নয়নজলে।শতদলদল খুলে যাবে থরে থরে, লুকানো রবে না মধু চিরদিন-তরে। আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি, ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি, কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি- পরম মরণ লভিব চরনতলে।রচনা: শান্তিনিকেতন ৭ বৈশাখ ১৩১৯ রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী ১৩৮৯ সং খণ্ড ১১, পৃ ১৫৩ থেকে সংগৃহীত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গীতিগাথা
মা কেঁদে কয়, “‘মঞ্জুলী মোর ঐ তো কচি মেয়ে,ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে?–বয়সে ওর চেয়েপাঁচগুনো সে বড়ো;–তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়সড়।এমন বিয়ে ঘটতে দেব নাকো।” বাপ বললে, “কান্না তোমার রাখো!পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে,জান না কি মস্ত কুলীন ও যে।সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কি কেউ ভাব।ওকে ছাড়লে পাত্র কোথায় পাব।” মা বললে, “কেন ঐ যে চাটুজ্যেদের পুলিন,নাই বা হল কুলীন,–দেখতে যেমন তেমনি স্বভাবখানি,পাস করে ফের পেয়েছে জলপানি,সোনার টুকরো ছেলে।এক-পাড়াতে থাকে ওরা–ওরি সঙ্গে হেসে খেলেমেয়ে আমার মানুষ হল; ওকে যদি বলি আমি আজইএক্‌খনি হয় রাজি।” বাপ বললে, “থামো,আরে আরে রামোঃ।ওরা আছে সমাজের সব তলায়।বামুন কি হয় পৈতে দিলেই গলায়?দেখতে শুনতে ভালো হলেই পাত্র হল! রাধে!স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে।” যেদিন ওরা গিনি দিয়ে দেখলে কনের মুখসেদিন থেকে মঞ্জুলিকার বুকপ্রতি পলের গোপন কাঁটায় হল রক্তে মাখা।মায়ের স্নেহ অন্তর্যামী, তার কাছে তো রয় না কিছুই ঢাকা;মায়ের ব্যথা মেয়ের ব্যথা চলতে খেতে শুতেঘরের আকাশ প্রতিক্ষণে হানছে যেন বেদনা-বিদ্যুতে। অটলতার গভীর গর্ব বাপের মনে জাগে,–সুখে দুঃখে দ্বেষে রাগেধর্ম থেকে নড়েন তিনি নাই হেন দৌর্বল্য।তাঁর জীবনের রথের চাকা চলললোহার বাঁধা রাস্তা দিয়ে প্রতিক্ষণেই,কোনোমতেই ইঞ্চিখানেক এদিক-ওদিক একটু হবার জো নেই। তিনি বলেন, তাঁর সাধনা বড়োই সুকঠোর,আর কিছু নয়, শুধুই মনের জোর,অষ্টাবক্র জমদগ্নি প্রভৃতি সব ঋষির সঙ্গে তুল্য,মেয়েমানুষ বুঝবে না তার মূল্য। অন্তঃশীলা অশ্রুনদীর নীরব নীরেদুটি নারীর দিন বয়ে যায় ধীরে।অবশেষে বৈশাখে এক রাতেমঞ্জুলিকার বিয়ে হল পঞ্চাননের সাথে।বিদায়বেলায় মেয়েকে বাপ বলে দিলেন মাথায় হস্ত ধরি“হও তুমি সাবিত্রীর মতো এই কামনা করি।” কিমাশ্চর্যমতঃপরং, বাপের সাধন-জোরেআশীর্বাদের প্রথম অংশ দু-মাস যেতেই ফলল কেমন করে–পঞ্চাননকে ধরল এসে যমে;কিন্তু মেয়ের কপালক্রমেফলল না তার শেষের দিকটা, দিলে না যম ফিরে,মঞ্জুলিকা বাপের ঘরে ফিরে এল সিঁদুর মুছে শিরে। দুঃখে সুখে দিন হয়ে যায় গতস্রোতের জলে ঝরে-পড়া ভেসে-যাওয়া ফুলের মতো,অবশেষে হলমঞ্জুলিকার বয়স ভরা ষোলো।কখন শিশুকালেহৃদয়-লতার পাতার অন্তরালেবেরিয়েছিল একটি কুঁড়িপ্রাণের গোপন রহস্যতল ফুঁড়ি;জানত না তো আপনাকে সে,শুধায় নি তার নাম কোনোদিন বাহির হতে খেপা বাতাস এসে,সেই কুঁড়ি আজ অন্তরে তার উঠছে ফুটেমধুর রসে ভরে উঠে’।সে যে প্রেমের ফুলআপনি রাঙা পাপড়িভারে আপনি সমাকুল।আপনাকে তার চিনতে যে আর নাইকো বাকি,তাইতো থাকি থাকিচমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে।আকাশপারের বাণী তারে ডাক দিয়ে যায় আলোর ঝরনা বেয়ে;রাতের অন্ধকারেকোন্‌ অসীমের রোদনভরা বেদন লাগে তারে।বাহির হতে তারঘুচে গেছে সকল অলংকার;অন্তর তার রাঙিয়ে ওঠে স্তরে স্তরে,তাই দেখে সে আপনি ভেবে মরে।কখন কাজের ফাঁকেজানলা ধরে চুপ করে সে বাইরে চেয়ে থাকে–যেখানে ওই শজনে গাছের ফুলের ঝুরি বেড়ার গায়েরাশি রাশি হাসির ঘায়েআকাশটারে পাগল করে দিবসরাতি। যে ছিল তার ছেলেবেলার খেলাঘরের সাথিআজ সে কেমন করেজলস্থলের হৃদয়খানি দিল ভরে।অরূপ হয়ে সে যেন আজ সকল রূপে রূপেমিশিয়ে গেল চুপে চুপে।পায়ের শব্দ তারিমরমরিত পাতায় পাতায় গিয়েছে সঞ্চারি।কানে কানে তারি করুণ বাণীমৌমাছিদের পাখার গুনগুনানি। মেয়ের নীরব মুখেকী দেখে মা, শেল বাজে তার বুকে।না-বলা কোন্‌ গোপন কথার মায়ামঞ্জুলিকার কালো চোখে ঘনিয়ে তোলে জলভরা এক ছায়া;অশ্রু-ভেজা গভীর প্রাণের ব্যথাএনে দিল অধরে তার শরৎনিশির স্তব্ধ ব্যাকুলতা।মায়ের মুখে অন্ন রোচে নাকো–কেঁদে বলে, “হায় ভগবান, অভাগীরে ফেলে কোথায় থাক।” একদা বাপ দুপুরবেলায় ভোজন সাঙ্গ করেগুড়গুড়িটার নলটা মুখে ধরে,ঘুমের আগে, যেমন চিরাভ্যাস,পড়তেছিলেন ইংরেজি এক প্রেমের উপন্যাস।মা বললেন, বাতাস করে গায়ে,কখনো বা হাত বুলিয়ে পায়ে,“যার খুশি সে নিন্দে করুক, মরুক বিষে জ্বরেআমি কিন্তু পারি যেমন ক’রেমঞ্জুলিকার দেবই দেব বিয়ে।” বাপ বললেন, কঠিন হেসে, “তোমরা মায়ে ঝিয়েএক লগ্নেই বিয়ে ক’রো আমার মরার পরে,সেই কটা দিন থাকো ধৈর্য ধরে।”এই বলে তাঁর গুড়গুড়িতে দিলেন মৃদু টান।মা বললেন, “‘উঃ কী পাষাণ প্রাণ,স্নেহমায়া কিচ্ছু কি নেই ঘটে।”বাপ বললেন, “আমি পাষাণ বটে।ধর্মের পথ কঠিন বড়ো, ননির পুতুল হলেএতদিনে কেঁদেই যেতেম গলে।” মা বললেন, “হায় রে কপাল। বোঝাবই বা কারে।তোমার এ সংসারেভরা ভোগের মধ্যখানে দুয়ার এঁটেপলে পলে শুকিয়ে মরবে ছাতি ফেটেএকলা কেবল একটুকু ঐ মেয়ে,ত্রিভুবনে অধর্ম আর নেই কিছু এর চেয়ে।তোমার পুঁথির শুকনো পাতায় নেই তো কোথাও প্রাণ,দরদ কোথায় বাজে সেটা অন্তর্যামী জানেন ভগবান।” বাপ একটু হাসল কেবল, ভাবলে, “মেয়েমানুষহৃদয়তাপের ভাপে-ভরা ফানুস।জীবন একটা কঠিন সাধন–নেই সে ওদের জ্ঞান।”এই বলে ফের চলল পড়া ইংরেজি সেই প্রেমের উপাখ্যান। দুখের তাপে জ্বলে জ্বলে অবশেষে নিবল মায়ের তাপ;সংসারেতে একা পড়লেন বাপ।বড়ো ছেলে বাস করে তার স্ত্রীপুত্রদের সাথেবিদেশে পাটনাতে।দুই মেয়ে তার কেউ থাকে না কাছে,শ্বশুরবাড়ি আছে।একটি থাকে ফরিদপুরে,আরেক মেয়ে থাকে আরো দূরেমাদ্রাজে কোন্‌ বিন্ধ্যগিরির পার।পড়ল মঞ্জুলিকার ‘পরে বাপের সেবাভার।রাঁধুনে ব্রাহ্মণের হাতে খেতে করেন ঘৃণা,স্ত্রীর রান্না বিনাঅন্নপানে হত না তার রুচি।সকালবেলায় ভাতের পালা, সন্ধ্যাবেলায় রুটি কিংবা লুচি;ভাতের সঙ্গে মাছের ঘটাভাজাভুজি হত পাঁচটা-ছটা;পাঁঠা হত রুটি-লুচির সাথে।মঞ্জুলিকা দুবেলা সব আগাগোড়া রাঁধে আপন হাতে।একাদশী ইত্যাদি তার সকল তিথিতেইরাঁধার ফর্দ এই।বাপের ঘরটি আপনি মোছে ঝাড়েরৌদ্রে দিয়ে গরম পোশাক আপনি তোলে পাড়ে।ডেস্কে বাক্সে কাগজপত্র সাজায় থাকে থাকে,ধোবার বাড়ির ফর্দ টুকে রাখে।গয়লানী আর মুদির হিসাব রাখতে চেষ্টা করে,ঠিক দিতে ভুল হলে তখন বাপের কাছে ধমক খেয়ে মরে।কাসুন্দি তার কোনোমতেই হয় না মায়ের মতো,তাই নিয়ে তার কতনালিশ শুনতে হয়।তা ছাড়া তার পান-সাজাটা মনের মতো নয়।মায়ের সঙ্গে তুলনাতে পদেপদেই ঘটে যে তার ত্রুটি।মোটামুটি–আজকালকার মেয়েরা কেউ নয় সেকালের মতো।হয়ে নীরব নত,মঞ্জুলী সব সহ্য করে, সর্বদাই সে শান্ত,কাজ করে অক্লান্ত।যেমন করে মাতা বারংবারশিশু ছেলের সহস্র আবদারহেসে সকল বহন করেন স্নেহের কৌতুকে,তেমনি করেই সুপ্রসন্ন মুখেমঞ্জুলী তার বাপের নালিশ দন্ডে দন্ডে শোনে,হাসে মনে মনে।বাবার কাছে মায়ের স্মৃতি কতই মূল্যবানসেই কথাটা মনে ক’রে গর্বসুখে পূর্ণ তাহার-প্রাণ।“আমার মায়ের যত্ন যে-জন পেয়েছে একবারআর-কিছু কি পছন্দ হয় তার।” হোলির সময় বাপকে সেবার বাতে ধরল ভারি।পাড়ায় পুলিন করছিল ডাক্তারি,ডাকতে হল তারে।হৃদয়যন্ত্র বিকল হতে পারেছিল এমন ভয়।পুলিনকে তাই দিনের মধ্যে বারেবারেই আসতে যেতে হয়।মঞ্জুলী তার সনেসহজভাবেই কইবে কথা যতই করে মনেততই বাধে আরো।এমন বিপদ কারোহয় কি কোনোদিন।গলাটি তার কাঁপে কেন, কেন এতই ক্ষীণ,চোখের পাতা কেনকিসের ভারে জড়িয়ে আসে যেন।ভয়ে মরে বিরহিণীশুনতে যেন পাবে কেহ রক্তে যে তা’র বাজে রিনিরিনি।পদ্মপাতায় শিশির যেন, মনখানি তার বুকেদিবারাত্রি টলছে কেন এমনতরো ধরা-পড়ার মুখে। ব্যামো সেরে আসছে ক্রমে,গাঁঠের ব্যথা অনেক এল কমে।রোগী শয্যা ছেড়েএকটু এখন চলে হাত-পা নেড়ে।এমন সময় সন্ধ্যাবেলাহাওয়ায় যখন যূথীবনের পরানখানি মেলা,আঁধার যখন চাঁদের সঙ্গে কথা বলতে যেয়েচুপ ক’রে শেষ তাকিয়ে থাকে চেয়ে,তখন পুলিন রোগী-সেবার পরামর্শ-ছলেমঞ্জুলিরে পাশের ঘরে ডেকে বলে–“জান তুমি তোমার মায়ের সাধ ছিল এই চিতেমোদের দোঁহার বিয়ে দিতে।সে ইচ্ছাটি তাঁরিপুরাতে চাই যেমন করেই পারি।এমন করে আর কেন দিন কাটাই মিছিমিছি।” “না না, ছি ছি, ছি ছি।”এই ব’লে সে মঞ্জুলিকা দু-হাত দিয়ে মুখখানি তার ঢেকেছুটে গেল ঘরের থেকে।আপন ঘরে দুয়ার দিয়ে পড়ল মেঝের ‘পরে–ঝরঝরিয়ে ঝরঝরিয়ে বুক ফেটে তার অশ্রু ঝরে পড়ে।ভাবলে, “পোড়া মনের কথা এড়ায় নি ওঁর চোখ।আর কেন গো। এবার মরণ হ’ক।” মঞ্জুলিকা বাপের সেবায় লাগল দ্বিগুণ ক’রেঅষ্টপ্রহর ধরে।আবশ্যকটা সারা হলে তখন লাগে অনাবশ্যক কাজে,যে-বাসনটা মাজা হল আবার সেটা মাজে।দু-তিন ঘন্টা পরএকবার যে-ঘর ঝেড়েছে ফের ঝাড়ে সেই ঘর।কখন যে স্নান, কখন যে তার আহার,ঠিক ছিল না তাহার।কাজের কামাই ছিল নাকো যতক্ষণ না রাত্রি এগারোটায়শ্রান্ত হয়ে আপনি ঘুমে মেঝের ‘পরে লোটায়।যে দেখল সে-ই অবাক হয়ে রইল চেয়ে,বললে, “ধন্যি মেয়ে।” বাপ শুনে কয় বুক ফুলিয়ে, “গর্ব করি নেকো,কিন্তু তবু আমার মেয়ে সেটা স্মরণ রেখো।ব্রহ্মচর্য- ব্রতআমার কাছেই শিক্ষা যে ওর। নইলে দেখতে অন্যরকম হ’ত।আজকালকার দিনেসংযমেরি কঠোর সাধন বিনেসমাজেতে রয় না কোনো বাঁধ,মেয়েরা তাই শিখছে কেবল বিবিয়ানার ছাঁদ।” স্ত্রীর মরণের পরে যবেসবেমাত্র এগারো মাস হবে,গুজব গেল শোনাএই বাড়িতে ঘটক করে আনাগোনা।প্রথম শুনে মঞ্জুলিকার হয় নিকো বিশ্বাস,তার পরে সব রকম দেখে ছাড়লে নিশ্বাস।ব্যস্ত সবাই, কেমনতরো ভাবআসছে ঘরে নানা রকম বিলিতি আসবাব।দেখলে বাপের নতুন করে সাজসজ্জা শুরু,হঠাৎ কালো ভ্রমরকৃষ্ণ ভুরু,পাকাচুল সব কখন হল কটা,চাদরেতে যখন-তখন গন্ধ মাখার ঘটা। মার কথা আজ মঞ্জুলিকার পড়ল মনেবুকভাঙা এক বিষম ব্যথার সনে।হ’ক না মৃত্যু, তবুএ-বাড়ির এই হাওয়ার সঙ্গে বিরহ তাঁর ঘটে নাই তো কভু।কল্যাণী সেই মূর্তিখানি সুধামাখাএ সংসারের মর্মে ছিল আঁকা;সাধ্বীর সেই সাধনপুণ্য ছিল ঘরের মাঝে,তাঁরি পরশ ছিল সকল কাজে।এ সংসারে তাঁর হবে আজ পরম মৃত্যু, বিষম অপমান–সেই ভেবে যে মঞ্জুলিকার ভেঙে পড়ল প্রাণ। ছেড়ে লজ্জাভয়কন্যা তখন নিঃসংকোচে কয়বাপের কাছে গিয়ে,–“তুমি নাকি করতে যাবে বিয়ে।আমরা তোমার ছেলেমেয়ে নাতনী-নাতি যতসবার মাথা করবে নত?মায়ের কথা ভুলবে তবে?তোমার প্রাণ কি এত কঠিন হবে।” বাবা বললে শুষ্ক হাসে,“কঠিন আমি কেই বা জানে না সে?আমার পক্ষে বিয়ে করা বিষম কঠোর কর্ম,কিন্তু গৃহধর্মস্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয়মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয়।সহজ তো নয় ধর্মপথে হাঁটা,এ তো কেবল হৃদয় নিয়ে নয়কো কাঁদাকাটা।যে করে ভয় দুঃখ নিতে দুঃখ দিতেসে কাপুরুষ কেনই আসে পৃথিবীতে।” বাখরগঞ্জে মেয়ের বাপের ঘর।সেথায় গেলেন বরবিয়ের কদিন আগে, বৌকে নিয়ে শেষেযখন ফিরে এলেন দেশেঘরেতে নেই মঞ্জুলিকা। খবর পেলেন চিঠি পড়েপুলিন তাকে বিয়ে করেগেছে দোঁহা ফরাক্কাবাদ চলে,সেইখানেতে ঘর পাতবে ব’লে।আগুন হয়ে বাপবারে বারে দিলেন অভিশাপ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
মূঢ় পশু ভাষাহীন নির্বাক্‌হৃদয়, তার সাথে মানবের কোথা পরিচয়! কোন্‌ আদি স্বর্গলোকে সৃষ্টির প্রভাতে হৃদয়ে হৃদয়ে যেন নিত্য যাতায়াতে পথচিহ্ন পড়ে গেছে, আজো চিরদিনে লুপ্ত হয় নাই তাহা, তাই দোঁহে চিনে। সেদিনের আত্মীয়তা গেছে বহুদূরে; তবুও সহসা কোন্‌ কথাহীন সুরে পরানে জাগিয়া উঠে ক্ষীণ পূর্বস্মৃতি, অন্তরে উচ্ছলি উঠে সুধাময়ী প্রীতি, মুগ্ধ মূঢ় স্নিগ্ধ চোখে পশু চাহে মুখে— মানুষ তাহারে হেরে স্নেহের কৌতুকে। যেন দুই ছদ্মবেশে দু বন্ধুর মেলা— তার পরে দুই জীবে অপরূপ খেলা।(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
তুই কি ভাবিস , দিনরাত্তির খেলতে আমার মন ? কক্‌খনো তা সত্যি না মা — আমার কথা শোন্‌ । সেদিন ভোরে দেখি উঠে বৃষ্টিবাদল গেছে ছুটে , রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে বাঁশের ডালে ডালে ; ছুটির দিনে কেমন সুরে পুজোর সানাই বাজছে দূরে , তিনটে শালিখ ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে — খেলনাগুলো সামনে মেলি কী যে খেলি , কী যে খেলি , সেই কথাটাই সমস্তখন ভাবনু আপন মনে । লাগল না ঠিক কোনো খেলাই , কেটে গেল সারাবেলাই , রেলিঙ ধরে রইনু বসে বারান্দাটার কোণে । খেলা - ভোলার দিন মা , আমার আসে মাঝে মাঝে । সেদিন আমার মনের ভিতর কেমনতরো বাজে । শীতের বেলায় দুই পহরে দূরে কাদের ছাদের ‘পরে ছোট্ট মেয়ে রোদদুরে   দেয় বেগনি রঙের শাড়ি । চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই , তেপান্তরের পার বুঝি ঐ , মনে ভাবি ঐখানেতেই আছে রাজার বাড়ি । থাকত যদি মেঘে - ওড়া পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া তক্‌খুনি যে যেতেম তারে লাগাম দিয়ে কষে । যেতে যেতে নদীর তীরে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে পথ শুধিয়ে নিতেম আমি গাছের তলায় বসে । এক - এক দিন যে দেখেছি , তুই বাবার চিঠি হাতে চুপ করে কী ভাবিস বসে ঠেস দিয়ে জানলাতে মনে হয় তোর মুখে চেয়ে তুই যেন কোন্‌ দেশের মেয়ে , যেন আমার অনেক কালের অনেক দূরের মা । কাছে গিয়ে হাতখানি ছুঁই হারিয়ে - ফেলা মা যেন তুই , মাঠ - পারে কোন্‌ বটের তলার বাঁশির সুরের মা । খেলার কথা যায় যে ভেসে , মনে ভাবি কোন্‌ কালে সে কোন্‌ দেশে তোর বাড়ি ছিল কোন্‌ সাগরের কূলে । ফিরে যেতে ইচ্ছে করে অজানা সেই দ্বীপের ঘরে তোমায় আমায় ভোরবেলাতে নৌকোতে পাল তুলে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
মোর গান এরা সব শৈবালের দল, যেথায় জন্মেছে সেথা আপনারে করে নি অচল। মূল নাই, ফুল আছে, শুধু পাতা আছে, আলোর আনন্দ নিয়ে জলের তরঙ্গে এরা নাচে। বাসা নাই, নাইকো সঞ্চয়, অজানা অতিথি এরা কবে আসে নাইকো নিশ্চয়। যেদিন-শ্রাবণ নামে দুর্নিবার মেঘে, দুই কূল ডোবে স্রোতোবেগে, আমার শৈবালদল উদ্দাম চঞ্চল, বন্যার ধারায় পথ যে হারায় দেশে দেশে দিকে দিকে যায় ভেসে ভেসে। সুরুল, ২৭ পৌষ, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জীবনরহস্য যায় মরণরহস্য-মাঝে নামি, মুখর দিনের আলো নীরব নক্ষত্রে যায় থামি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
নারী তুমি ধন্যা– আছে ঘর, আছে ঘরকন্না। তারি মধ্যে রেখেছ একটুখানি ফাঁক। সেথা হতে পশে কানে বাহিরের দুর্বলের ডাক। নিয়ে এসো শুশ্রূষার ডালি, স্নেহ দাও ঢালি। যে জীবলক্ষ্মীর মনে পালনের শক্তি বহমান, নারী তুমি নিত্য শোন তাহারি আহ্বান। সৃষ্টিবিধাতার নিয়েছ কর্মের ভার, তুমি নারী তাঁহারি আপন সহকারী। উন্মুক্ত করিতে থাকো আরোগ্যের পথ, নবীন করিতে থাকো জীর্ণ যে-জগৎ, শ্রীহারা যে তার ‘পরে তোমার ধৈর্যের সীমা নাই, আপন অসাধ্য দিয়ে দয়া তব টানিছে তারাই। বুদ্ধিভ্রষ্ট অসহিষ্ঞু অপমান করে বারে বারে, চক্ষু মুছে ক্ষমা কর তারে। অকৃতজ্ঞতার দ্বারে আঘাত সহিছ দিনরাতি, লও শির পাতি। যে অভাগ্য নাহি লাগে কাজে, প্রাণলক্ষ্মী ফেলে যারে আবর্জনা-মাঝে, তুমি তারে আনিছ কুড়ায়ে, তার লাঞ্ছনার তাপ স্নিগ্ধ হস্তে দিতেছ জুড়ায়ে। দেবতারে যে পূজা দেবার দুর্ভাগারে কর দান সেই মূল্য তোমার সেবার। বিশ্বের পালনী শক্তি নিজ বীর্যে বহ চুপে চুপে মাধুরীর রূপে। ভ্রষ্ট যেই, ভগ্ন যেই, বিরূপ বিকৃত, তারি লাগি সুন্দরের হাতের অমৃত।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা, সুকুমারী শৈলবালা অমল সলিলা গঙ্গা অই বহি যায় রে। প্রদীপ্ত তুষাররাশি, শুভ্র বিভা পরকাশি ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে গোমুখীর শিখরে। ফুটিয়াছে কমলিনী অরুণের কিরণে। নির্ঝরের এক ধারে, দুলিছে তরঙ্গ-ভরে ঢুলে ঢুলে পড়ে জলে প্রভাত পবনে। হেলিয়া নলিনী-দলে প্রকৃতি কৌতুকে দোলে গঙ্গার প্রবাহ ধায় ধুইয়া চরণ। ধীরে ধীরে বায়ু আসি দুলায়ে অলকরাশি কবরী কুসুমগন্ধ করিছে হরণ।বিজনে খুলিয়া প্রাণ, সপ্তমে চড়ায়ে তান, শোভনা প্রকৃতিদেবী গা'ন ধীরে ধীরে। নলিনী-নয়নদ্বয়, প্রশান্ত বিষাদময় মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বহিল গভীরে।-- "অভাগী ভারত হায় জানিতাম যদি -- বিধবা হইবি শেষে, তা হলে কি এত ক্লেশে তোর তরে অলংকার করি নিরমাণ। তা হলে কি হিমালয়, গর্বে-ভরা হিমালয়, দাঁড়াইয়া তোর পাশে, পৃথিবীরে উপহাসে, তুষারমুকুট শিরে করি পরিধান। তা হলে কি শতদলে তোর সরোবরজলে হাসিত অমন শোভা করিয়া বিকাশ, কাননে কুসুমরাশি, বিকাশি মধুর হাসি, প্রদান করিত কি লো অমন সুবাস। তা হলে ভারত তোরে, সৃজিতাম মরু করে তরুলতা-জন-শূন্য প্রান্তর ভীষণ। প্রজ্বলন্ত দিবাকর বর্ষিত জ্বলন্ত কর মরীচিকা পান্থগণে করিত ছলনা।' থামিল প্রকৃতি করি অশ্রু বরিষন গলিল তুষারমালা, তরুণী সরসী-বালা ফেলিল নীহারবিন্দু নির্ঝরিণীজলে। কাঁপিল পাদপদল,উথলে গঙ্গার জল তরুস্কন্ধ ছাড়ি লতা লুটায় ভূতলে। ঈষৎ আঁধাররাশি, গোমুখী শিখর গ্রাসি আটক করিল নব অরুণের কর। মেঘরাশি উপজিয়া, আঁধারে প্রশ্রয় দিয়া, ঢাকিয়া ফেলিল ক্রমে পর্বতশিখর। আবার গাইল ধীরে প্রকৃতিসুন্দরী।-- "কাঁদ্‌ কাঁদ্‌ আরো কাঁদ্‌ অভাগী ভারত। হায় দুখনিশা তোর, হল না হল না ভোর, হাসিবার দিন তোর হল না আগত। লজ্জাহীনা! কেন আর! ফেলে দে-না অলংকার প্রশান্ত গভীর অই সাগরের তলে। পূতধারা মন্দাকিনী ছাড়িয়া মরতভূমি আবদ্ধ হউক পুন ব্রহ্ম-কমণ্ডলে। উচ্চশির হিমালয়, প্রলয়ে পাউক লয়, চিরকাল দেখেছে যে ভারতের গতি। কাঁদ্‌ তুই তার পরে, অসহ্য বিষাদভরে অতীত কালের চিত্র দেখাউক স্মৃতি। দেখ্‌ আর্য-সিংহাসনে, স্বাধীন নৃপতিগণে স্মৃতির আলেখ্যপটে রয়েছে চিত্রিত। দেখ্‌ দেখি তপোবনে, ঋষিরা স্বাধীন মনে, কেমন ঈশ্বর ধ্যানে রয়েছে ব্যাপৃত। কেমন স্বাধীন মনে, গাইছে বিহঙ্গগণে, স্বাধীন শোভায় শোভে কুসুম নিকর। সূর্য উঠি প্রাতঃকালে, তাড়ায় আঁধারজালে কেমন স্বাধীনভাবে বিস্তারিয়া কর। তখন কি মনে পড়ে,ভারতী মানস-সরে কেমন মধুর স্বরে বীণা ঝংকারিত। শুনিয়া ভারত পাখি, গাইত শাখায় থাকি, আকাশ পাতাল পৃথ্বী করিয়া মোহিত। সে-সব স্মরণ করে কাঁদ্‌ লো আবার! আয় রে প্রলয় ঝড়, গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর্‌, ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার। প্রভঞ্জন ভীমবল, খুলে দেও বায়ুদল, ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক ভারতের বেশ। ভারত-সাগর রুষি, উগরো বালুকারাশি, মরুভূমি হয়ে থাক্‌ সমস্ত প্রদেশ।' বলিতে নারিল আর প্রকৃতিসুন্দরী, ধ্বনিয়া আকাশ ভূমি, গরজিল প্রতিধ্বনি, কাঁপিয়া উঠিল বেগে ক্ষুদ্ধ হিমগিরি। জাহ্নবী উন্মত্তপারা, নির্ঝর চঞ্চল ধারা, বহিল প্রচণ্ড বেগে ভেদিয়া প্রস্তর। প্রবল তরঙ্গভরে, পদ্ম কাঁপে থরে থরে, টলিল প্রকৃতি-সতী আসন-উপর। সুচঞ্চল সমীরণে, উড়াইল মেঘগণে, সুতীব্র রবির ছটা হল বিকীরিত। আবার প্রকৃতি-সতী আরম্ভিল গীত।-- "দেখিয়াছি তোর আমি সেই বেশ। অজ্ঞাত আছিলি যবে মানব নয়নে। নিবিড় অরণ্য ছিল এ বিস্তৃত দেশ। বিজন ছায়ায় নিদ্রা যেত পশুগণে। কুমারী অবস্থা তোর সে কি পড়ে মনে? সম্পদ বিপদ সুখ, হরষ বিষাদ দুখ কিছুই না জানিতিস সে কি পড়ে মনে? সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ - যখন মানবগণ, করে নাই নিরীক্ষণ, তোর সেই সুদুর্গম অরণ্য প্রদেশ। না বিতরি গন্ধ হায়, মানবের নাসিকায় বিজনে অরণ্যফুল যাইত শুকায়ে - তপনকিরণ-তপ্ত, মধ্যাহ্নের বায়ে। সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ। সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল। না দেখি মনুষ্যমুখ, না জানিয়া দুঃখ সুখ, না করিয়া অনুভব মান অপমান। অজ্ঞান শিশুর মতো, আনন্দে দিবস যেত, সংসারের গোলমালে থাকিয়া অজ্ঞান। তা হলে তো ঘটিত না এ-সব জঞ্জাল। সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল। সৌভাগ্যে হানিয়া বাজ, তা হলে তো তোরে আজ অনাথা ভিখারীবেশে কাঁদিতে হত না। পদাঘাতে উপহাসে, তা হলে তো কারাবাসে সহিতে হত না শেষে এ ঘোর যাতনা। অরণ্যেতে নিরিবিলি, সে যে তুই ভালো ছিলি, কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা। দেখি মরীচিকা হায় আনন্দে বিহ্বলপ্রায় না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না। আর্যরা আইল শেষে, তোর এ বিজন দেশে, নগরেতে পরিণত হল তোর বন। হরষে প্রফুল্ল মুখে হাসিলি সরলা সুখে, আশার দর্পণে মুখ দেখিলি আপন। ঋষিগণ সমস্বরে অই সামগান করে চমকি উঠিছে আহা হিমালয় গিরি। ওদিকে ধনুর ধ্বনি, কাঁপায় অরণ্যভূমি নিদ্রাগত মৃগগণে চমকিত করি। সরস্বতী নদীকূলে, কবিরা হৃদয় খুলে গাইছে হরষে আহা সুমধুর গীত। বীণাপাণি কুতূহলে, মানসের শতদলে, গাহেন সরসী-বারি করি উথলিত। সেই-এক অভিনব, মধুর সৌন্দর্য তব, আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে। আঁধার সাগরতলে একটি রতন জ্বলে একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে। সুবিস্তৃত অন্ধকূপে, একটি প্রদীপ-রূপে জ্বলিতিস তুই আহা, নাহি পড়ে মনে? কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে? এই অমানিশা তোর, আর কি হবে না ভোর কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে। অনন্তকালের মতো, সুখসূর্য অস্তগত ভাগ্য কি অনন্তকাল রবে এই রূপে। তোর ভাগ্যচক্র শেষে থামিল কি হেতা এসে, বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার। আয় রে প্রলয় ঝড়, গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর, ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার। প্রভঞ্জন ভীমবল, খুলে দেও বায়ুদল, ছিন্নভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ। ভারতসাগর রুষি, উগরো বালুকারাশি মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
বুঝেছি গো বুঝেছি সজনি,কী ভাব তোমার মনে জাগে,বুক-ফাটা প্রাণ-ফাটা মোর ভালোবাসাএত বুঝি ভালো নাহি লাগে। এত ভালোবাসা বুঝি পার না সহিতে,এত বুঝি পার না বহিতে। যখনি গো নেহারি তোমায়–মুখ দিয়া আঁখি দিয়া   বাহিরিতে চায় হিয়া, শিরার শৃঙ্খলগুলি ছিঁড়িয়া ফেলিতে চায়,ওই মুখ বুকে ঢাকে, ওই হাতে হাত রাখে,কী করিবে ভাবিয়া না পায়,যেন তুমি কোথা আছ  খুঁজিয়া না পায়। মন মোর পাগলের হেন  প্রাণপণে শুধায় যেন,“প্রাণের  প্রাণের মাঝে কী করিলে তোমারে গো পাই,যে ঠাঁই রয়েছে  শূন্য, কী করিলে সে শূন্য পুরাই।” এইরূপে দেহের দুয়ারেমন যবে থাকে যুঝিবারে,তুমি চেয়ে দেখ মুখ-বাগে–এত বুঝি ভালো নাহি লাগে। তুমি চাও যবে মাঝে মাঝেঅবসর পাবে তুমি কাজেআমারে ডাকিবে একবার–কাছে গিয়া বসিব তোমার,মৃদু মৃদু সুমধুর বাণীকব তব কানে কানে রানী। তুমিও কহিবে মৃদু ভাষ,তুমিও হাসিবে মৃদু হাস,হৃদয়ের মৃদু খেলাখেলি–ফুলেতে ফুলেতে হেলাহেলি। চাও তুমি দুঃখহীন প্রেমছুটে যেথা ফুলের সুবাস,উঠে যেথা জোছনালহরী,বহে যেথা বসন্তবাতাস। নাহি চাও আত্মহারা প্রেমআছে যেথা অনন্ত পিয়াস,বহে যেথা চোখের সলিল,উঠে যেথা দুখের নিশ্বাস। প্রাণ যেথা কথা ভুলে যায়,আপনারে ভুলে যায় হিয়া,অচেতন চেতনা যেথায়,চরাচর, ফেলে হারাইয়া। এমন কি কেহ নাই, বল্‌ মোরে বল্‌ আশা,মার্জনা করিবে মোর অতি–অতি ভালোবাসা!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান । দাঁড় ধরে আজ বোস্ রে সবাই টান রে সবাই টান্ । বোঝা যতই বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী, ঢেউয়ের 'পরে ধরব পাড়ি যায় যদি যাক প্রাণ । আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান । কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা, ভয়ের কথা কে বলে আজ -- ভয় আছে সব জানা । কোন্ শাপে কোন্ গ্রহের দোষে সুখের ডাঙায় থাকব বসে; পালের রশি ধরবো কষি, চলব গেয়ে গান । আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ভয় নেই, আমি আজ রান্নাটা দেখছি। চালে জলে মেপে, নিধু, চড়িয়ে দে ডেকচি। আমি গণি কলাপাতা, তুমি এসো নিয়ে হাতা, যদি দেখ, মেজবউ, কোনোখানে ঠেকছি। রুটি মেখে বেলে দিয়ো, উনুনটা জ্বেলে দিয়ো, মহেশকে সাথে নিয়ে আমি নয় সেঁকছি।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে। দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান। পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে। প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে। শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে। সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।কাব্যগ্রন্থঃ চৈতালি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
সময় আসন্ন হলে আমি যাব চলে, হৃদয় রহিল এই শিশু চারাগাছে— এর ফুলে, এর কচি পল্লবের নাচে অনাগত বসন্তের আনন্দের আশা রাখিলাম আমি হেথা নাই থাকিলাম।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
আতার বিচি নিজে পুঁতে পাব তাহার ফল, দেখব ব'লে ছিল মনে বিষম কৌতূহল। তখন আমার বয়স ছিল নয়, অবাক লাগত কিছুর থেকে কেন কিছুই হয়। দোতলাতে পড়ার ঘরের বারান্দাটা বড়ো, ধুলো বালি একটা কোণে করেছিলুম জড়ো। সেথায় বিচি পুঁতেছিলুম অনেক যত্ন করে, গাছ বুঝি আজ দেখা দেবে, ভেবেছি রোজ ভোরে। জানলাটার পূর্বধারে টেবিল ছিল পাতা, সেইখানেতে পড়া চলত; পুঁথিপত্র খাতা রোজ সকালে উঠত জমে দুর্ভাবনার মতো; পড়া দিতেন, পড়া নিতেন মাস্টার মন্মথ। পড়তে পড়তে বারে বারে চোখ যেত ঐ দিকে, গোল হত সব বানানেতে, ভুল হত সব ঠিকে। অধৈর্য অসহ্য হত, খবর কে তার জানে কেন আমার যাওয়া-আসা ঐ কোণটার পানে। দু মাস গেল, মনে আছে, সেদিন শুক্রবার-- অঙ্কুরটি দেখা দিল নবীন সুকুমার। অঙ্ক-কষার বারান্দাতে চুনসুরকির কোণে অপূর্ব সে দেখা দিল, নাচ লাগালো মনে। আমি তাকে নাম দিয়েছি আতা গাছের খুকু, ক্ষণে ক্ষণে দেখতে যেতেম, বাড়ল কতটুকু। দুদিন বাদেই শুকিয়ে যেত সময় হলে তার, এ জায়গাতে স্থান নাহি ওর করত আবিষ্কার; কিন্তু যেদিন মাস্টার ওর দিলেন মৃত্যুদণ্ড, কচিকচি পাতার কুঁড়ি হল খণ্ড খণ্ড, আমার পড়ার ত্রুটির জন্যে দায়ী করলেন ওকে, বুক যেন মোর ফেটে গেল, অশ্রু ঝরল চোখে। দাদা বললেন, কী পাগলামি, শান-বাঁধানো মেঝে, হেথায় আতার বীজ লাগানো ঘোর বোকামি এ যে। আমি ভাবলুম সারা দিনটা বুকের ব্যথা নিয়ে, বড়োদের এই জোর খাটানো অন্যায় নয় কি এ। মূর্খ আমি ছেলেমানুষ, সত্য কথাই সে তো, একটু সবুর করলেই তা আপনি ধরা যেত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
আদর ক’রে মেয়ের নাম রেখেছে ক্যালিফর্নিয়া, গরম হল বিয়ের হাট ঐ মেয়েরই দর নিয়া। মহেশদাদা খুঁজিয়া গ্রামে গ্রামে পেয়েছে ছেলে ম্যাসাচুসেট্‌স্‌ নামে, শাশুড়ি বুড়ি ভীষণ খুশি নামজাদা সে বর নিয়া– ভাটের দল চেঁচিয়ে মরে নামের গুণ বর্ণিয়া।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি, ওই যে আসে, আসে, আসে। যুগে যুগে পলে পলে দিনরজনী সে যে আসে, আসে, আসে। গেয়েছি গান যখন যত আপন-মনে খ্যাপার মতো সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী- সে যে আসে, আসে, আসে।কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে সে যে আসে, আসে, আসে। কত শ্রাবণ অন্ধকারে মেঘের রথে সে যে আসে, আসে, আসে।দুখের পরে পরম দুখে, তারি চরণ বাজে বুকে, সুখে কখন্‌ বুলিয়ে সে দেয় পরশমণি। সে যে আসে, আসে, আসে।কলিকাতা, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আয় রে বসন্ত, হেথা কুসুমের সুষমা জাগা রে শান্তিস্নিগ্ধ মুকুলের হৃদয়ের গোপন আগারে। ফলেরে আনিবে ডেকে সেই লিপি যাস রেখে, সুবর্ণের তুলিখানি পর্ণে পর্ণে যতনে লাগা রে।  (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
এই সে পরম মূল্য আমার পুজার— না পূজা করিলে তবু শাস্তি নাই তার।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
কী পাই, কী জমা করি, কী দেবে, কে দেবে, দিন মিছে কেটে যায় এই ভেবে ভেবে। চ'লে তো যেতেই হবে— কী যে দিয়ে যাব বিদায় নেবার অাগে এই কথা ভাবো!   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
মহীয়সী মহিমার আগ্নেয় কুসুম সূর্য , ধায় লভিবারে বিশ্রামের ঘুম । ভাঙা এক ভিত্তি- ' পরে ফুল শুভ্রবাস , চারি দিকে শুভ্রদল করিয়া বিকাশ মাথা তুলে চেয়ে দেখে সুনীল বিমানে অমর আলোকময় তপনের পানে , ছোটো মাথা দুলাইয়া কহে ফুল গাছে — “ লাবণ্য-কিরণ ছটা আমারো তো আছে । ”                             — Victor Hugo (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তুমি প্রভাতের শুকতারা আপন পরিচয় পালটিয়ে দিয়ে কখনো বা তুমি দেখা দাও গোধূলির দেহলিতে, এই কথা বলে জ্যোতিষী। সূর্যাস্তবেলায় মিলনের দিগন্তে রক্ত-অবগুণ্ঠনের নিচে শুভদৃষ্টির প্রদীপ তোমার জ্বাল শাহানার সুরে। সকালবেলায় বিরহের আকাশে শূন্য বাসরঘরের খোলা দ্বারে ভৈরবীর তানে লাগাও বৈরাগ্যের মূর্ছনা। সুপ্তিসমুদ্রের এপারে ওপারে, চিরজীবন, সুখদুঃখের আলোয় অন্ধকারে মনের মধ্যে দিয়েছ আলোকবিন্দুর স্বাক্ষর। যখন নিভৃতপুলকে রোমাঞ্চ লেগেছে মনে গোপনে রেখেছ তার 'পরে সুরলোকের সম্মতি, ইন্দ্রাণীর মালার একটি পাপড়ি, তোমাকে এমনি করেই জেনেছি আমাদের সকালসন্ধ্যার সোহাগিনী। পণ্ডিত তোমাকে বলে শুক্রগ্রহ; বলে, আপন সুদীর্ঘ কক্ষে তুমি বৃহৎ, তুমি বেগবান, তুমি মহিমান্বিত; সূর্যবন্দনার প্রদক্ষিণপথে তুমি পৃথিবীর সহযাত্রী, রবিরশ্মিগ্রথিত দিনরত্নের মালা দুলছে তোমার কণ্ঠে। যে মহাযুগের বিপুল ক্ষেত্রে তোমার নিগূঢ় জগদ্ব্যাপার সেখানে তুমি স্বতন্ত্র, সেখানে সুদূর, সেখানে লক্ষকোটিবৎসর আপনার জনহীন রহস্যে তুমি অবগুণ্ঠিত। আজ আসন্ন রজনীর প্রান্তে কবিচিত্তে যখন জাগিয়ে তুলেছ নিঃশব্দ শান্তিবাণী। সেই মুহূর্তেই আমাদের অজ্ঞাত ঋতুপর্যায়ের আবর্তন তোমার জলে স্থলে বাষ্পমণ্ডলীতে রচনা করছে সৃষ্টিবৈচিত্র৻। তোমার সেই একেশ্বর যজ্ঞে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, আমাদের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ। হে পণ্ডিতের গ্রহ, তুমি জ্যোতিষের সত্য সে-কথা মানবই, সে সত্যের প্রমাণ আছে গণিতে। কিন্তু এও সত্য, তার চেয়েও সত্য যেখানে তুমি আমাদেরি আপন শুকতারা, সন্ধ্যাতারা, যেখানে তুমি ছোটো, তুমি সুন্দর, যেখানে আমাদের হেমন্তের শিশিরবিন্দুর সঙ্গে তোমার তুলনা, যেখানে শরতের শিউলি ফুলের উপমা তুমি, যেখানে কালে কালে প্রভাতে মানব-পথিককে নিঃশব্দে সংকেত করেছ জীবনযাত্রার পথের মুখে, সন্ধ্যায় ফিরে ডেকেছ চরম বিশ্রামে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
গাথাতরল জলদে বিমল চাঁদিমা সুধার ঝরণা দিতেছে ঢালি। মলয় ঢলিয়া কুসুমের কোলে নীরবে লইছে সুরভিডালি। যমুনা বহিছে নাচিয়া নাচিয়া গাহিয়া গাহিয়া অফুট গান— থাকিয়া থাকিয়া বিজনে পাপিয়া কানন ছাপিয়া তুলিছে তান। পাতায় পাতায় লুকায়ে কুসুম, কুসুমে কুসুমে শিশির দুলে— শিশিরে শিশিরে জোছনা পড়েছে মুকুতা-গুলিন সাজায়ে ফুলে। তটের চরণে তটিনী ছুটিছে, ভ্রমর লুটিছে ফুলের বাস— সেঁউতি ফুটিছে, বকুল ফুটিছে ছড়ায়ে ছড়ায়ে সুরভিশ্বাস। কুহরি উঠিছে কাননে কোকিল, শিহরি উঠিছে দিকের বালা— তরল লহরী গাঁথিছে আঁচলে ভাঙা ভাঙা যত চাঁদের মালা। ঝোপে ঝোপে ঝোপে লুকায়ে আঁধার, হেথা হোথা চাঁদ মারিছে উঁকি— সুধীরে আঁধার-ঘোমটা হইতে কুসুমের থোলো হাসে মুচুকি। এস কল্‌পনে! এ মধুর রেতে দুজনে বীণায় পূরিব তান। সকল ভুলিয়া হৃদয় খুলিয়া আকাশে তুলিয়া করিব গান। হাসি কহে বালা, “ফুলের জগতে যাইবে আজিকে কবি? দেখিবে কত কি অভূত ঘটনা, কত কি অভূত ছবি! চারি দিকে যেথা ফুলে ফুলে আলা উড়িছে মধুপকুল। ফুলদলে-দলে ভ্রমি ফুলবালা ফুঁ দিয়া ফুটায় ফুল। দেখিবে কেমনে শিশিরসলিলে মুখ মাজি ফুলবালা কুসুমরেণুর সিঁদুর পরিয়া ফুলে ফুলে করে খেলা। দেহখানি ঢাকি ফুলের বসনে প্রজাপতি-’পরে চড়ি কমলকাননে কুসুমকামিনী ধীরে ধীরে যায় উড়ি। কমলে বসিয়া মুচুকি হাসিয়া দুলিছে লহরীভরে, হাসিমুখখানি দেখিছে নীরবে সরসী-আরসি-’পরে। ফুলকোল হ’তে পাপড়ি খসায়ে সলিলে ভাসায়ে দিয়া চড়ি সে পাতায় ভেসে ভেসে যায় মিরে ডাকিয়া নিয়া। কোলে ক’রে লয়ে মিরে তখন গাহিবারে কহে গান। গান গাওয়া হলে হরষে মোহিনী ফুলমধু করে দান। দুই চারি বালা হাত ধরি ধরি কামিনী-পাতায় বসি চুপি চুপি চুপি ফুলে দেয় দোল, পাপড়ি পড়য়ে খসি। দুই ফুলবালা মিলি বা কোথায় গলা-ধরাধরি করি ঘাসে ঘাসে ঘাসে ছুটিয়া বেড়ায় প্রজাপতি ধরি ধরি কুসুমের ‘পরে দেখিয়া মিরে আবরি পাতার দ্বার ফুলফাঁদে ফেলি পাখায় মাখায় কুসুমরেণুর ভার। ফাঁফরে পড়িয়া মির উড়িয়া বাহির হইতে চায়, কুসমরমণী হাসিয়া অমনি ছুটিয়ে পালিয়ে যায়। ডাকিয়া আনিয়া সবারে তখনি প্রমোদে হইয়া ভোর কহে হাসি হাসি করতালি দিয়া ‘কেমন পরাগচোর!” এত বলি ধীরে কলপনা-রাণী বীণায় আভানি তান বাজাইল বীণা আকাশ ভরিয়া অবশ করিয়া প্রাণ! গভীর নিশীথে সুদূর আকাশে মিশিল বীণার রব, ঘুমঘোরে আঁখি মুদিয়া রহিল দিকের বালিকা সব। ঘুমায়ে পড়িল আকাশ পাতাল, ঘুমায়ে পড়িল স্বরগবালা, দিগন্তের কোলে ঘুমায়ে পড়িল জোছনা-মাখানো জলদমালা। একি একি ওগো কলপনা সখি! কোথায় আনিলে মোরে! ফুলের পৃথিবী— ফুলের জগৎ— স্বপন কি ঘুমঘোরে? হাসি কলপনা কহিল শোভনা, “মোর সাথে এস কবি! দেখিবে কত কি অভূত ঘটনা কত কি অভূত ছবি! ওই দেখ ওই ফুলবালাগুলি ফুলের সুরভি মাখিয়া গায় শাদা শাদা ছোট পাখাগুলি তুলি এ ফুলে ও ফুলে উড়িয়া যায়! এ ফুলে লুকায়, ও ফুলে লুকায়— এ ফুলে ও ফুলে মারিছে উঁকি, গোলাপের কোলে উঠিয়া দাঁড়ায়— ফুল টলমল পড়িছে ঝুঁকি। ওই হোথা ওই ফুলশিশু-সাথে বসি ফুলবালা অশোক ফুলে দুজনে বিজনে প্রেমের আলাপ কহে চুপিচুপি হৃদয় খুলে।” কহিল হাসিয়া কলপনাবালা দেখায়ে কত কি ছবি, “ফুলবালাদের প্রেমের কাহিনী শুনিবে এখন কবি?” এতেক শুনিয়া আমরা দুজনে বসিনু চাঁপার তলে, সুমুখে মোদের কমলকানন নাচে সরসীর জলে। এ কি কলপনা, এ কি লো তরুণী, দুরন্ত কুসুমশিশু ফুলের মাঝারে লুকায়ে লুকায়ে হানিছে ফুলের ইষু। চারি দিক হতে ছুটিয়া আসিয়া শৈশবসঙ্গীত হেরিয়া নূতন প্রাণী চারি ধার ঘিরি রহিল দাঁড়ায়ে যতেক কুসুমরাণী! গোলাপ মালতী, শিউলি সেঁউতি, পারিজাত নরগেশ, সব ফুলবাস মিলি এক ঠাঁই ভরিল কাননদেশ। চুপি চুপি আসি কোন ফুলশিশু ঘা মারে বীণার ‘পরে, ঝন্‌ করি যেই বাজি উঠে তার চমকি পলায় ডরে। অমনি হাসিয়া কলপনাসখী বীণাটি লইয়া করে, ধীরি ধীরি ধীরি মৃদুল মৃদুল বাজায় মধুর স্বরে অবাক্‌ হইয়া ফুলবালাগণ মোহিত হইয়া তানে নীরব হইয়া চাহিয়া রহিল শোভনার মুখপানে। ধীরি ধীরি সবে বসিয়া পড়িল হাতখানি দিয়া গালে, ফুলে বসি বসি ফুলশিশুগণ দুলিতেছে তালে তালে। হেন কালে এক আসিয়া মির কহিল তাদের কানে, “এখনো রয়েছে বাকী কত কাজ, ব’সে আছ এইখানে? রঙ দিতে হবে কুসুমের দলে, ফুটাতে হইবে কুঁড়ি— মধুহীন কত গোলাপকলিকা রয়েছে কানন জুড়ি!” অমনি যেন রে চেতন পাইয়া যতেক কুসুমবালা, পাখাটি নাড়িয়া উড়িয়া উড়িয়া পশিল কুসুমশালা। মুখ ভারী করি ফুলশিশুদল তুলিকা লইয়া হাতে মাখাইয়া দিল কত কি বরণ কুসুমের পাতে পাতে। চারি দিকে দিকে ফুলশিশুদল ফুলের বালিকা কত নীরব হইয়া রয়েছে বসিয়া, সবাই কাজেতে রত। চারি দিক এবে হইল বিজন, কানন নীরব ছবি— ফুলবালাদের প্রেমের কাহিনী কহে কলপনাদেবী। — আজি পূরণিমা নিশি, তারকাকাননে বসি অলসনয়নে শশী মৃদুহাসি হাসিছে। পাগল পরাণে ওর লেগেছে ভাবের ঘোর, যামিনীর পানে চেয়ে কি যেন কি ভাষিছে! কাননে নিঝর ঝরে মৃদু কলকল স্বরে, অলি ছুটাছুটি করে গুন্‌ গুন্‌ গাহিয়া! সমীর অধীরপ্রাণ গাহিয়া উঠিছে গান, তটিনী ধরেছে তান, ডাকি উঠে পাপিয়া। সুখের স্বপন-মত পশিছে সে গান যত ঘুমঘোরে জ্ঞানহত দিক্‌বধূ-শ্রবণে— সমীর সভয়হিয়া মৃদু মৃদু পা টিপিয়া উঁকি মারি দেখে গিয়া লতাবধূ-ভবনে! কুসুম-উৎসবে আজি ফুলবালা ফুলে সাজি, কত না মধুপরাজি এক ঠাঁই কাননে! ফুলের বিছানা পাতি হরষে প্রমোদে মাতি কাটাইছে সুখরাতি নৃত্যগীতবাদনে! ফুলবাস পরিয়া হাতে হাতে ধরিয়া নাচি নাচি ঘুরি আসে কুসুমের রমণী। চুলগুলি এলিয়ে উড়িতেছে খেলিয়ে, ফুলরেণু ঝরি ঝরি পড়িতেছে ধরণী। ফুলবাঁশী ধরিয়ে মৃদু তান ভরিয়ে বাজাইছে ফুলশিশু বসি ফুল-আসনে। ধীরে ধীরে হাসিয়া নাচি নাচি আসিয়া তালে তালে করতালি দেয় কেহ সঘনে। কোনো ফুলরমণী চুপি চুপি অমনি ফুলবালকের কানে কথা যায় বলিয়ে। কোথাও বা বিজনে বসি আছে দুজনে, পৃথিবীর আর সব গেছে যেন ভুলিয়ে! কোনো ফুলবালিকা গাঁথি ফুলমালিকা ফুলবালকের কথা একমনে শুনিছে, বিব্রত শরমে হরষিত-মরমে আনত আননে বালা ফুলদল গুণিছে!দেখেছ হোথায় অশোকবালক মালতীর পাশে গিয়া কহিছে কত কি মরমকাহিনী, খুলিয়া দিয়াছে হিয়া। ভ্রূকুটি করিয়া নিদয়া মালতী যেতেছে সুদূরে চলি, মৃদু-উপহাসে সরল প্রেমের কোমলহৃদয় দলি। অধীর অশোক যদি বা কখনো মালতীর কাছে আসে, ছুটিয়া অমনি পলায় মালতী বসে বকুলের পাশে। থাকিয়া থাকিয়া সরোষ ভ্রূকুটি অশোকের পানে হানে— ভ্রূকুটি সেগুলি বাণের মতন বিঁধিল অশোকপ্রাণে। হাসিতে হাসিতে কহিল মালতী বকুলের সাথে কথা, মলিন অশোক রহিল বসিয়া হৃদয়ে বহিয়া ব্যথা। দেখ দেখি চেয়ে মালতীহৃদয়ে কাহারে সে ভালবাসে! বল দেখি মোরে হৃদয় তাহার রয়েছে কাহার পাশে? ওই দেখ তার হৃদয়ের পটে অশোকেরই নাম লিখা! অশোকেরি তরে জ্বলিছে তাহার প্রণয়-অনলশিখা! এই যে নিদয় চাতুরী সতত দলিছে অশোকপ্রাণ— অশোকের চেয়ে মালতীহৃদয়ে বিঁধিছে তাহার বাণ। মনে মনে করে কত বার বালা, অশোকের কাছে গিয়া, কহিবে তাহারে মরমকাহিনী হৃদয় খুলিয়া দিয়া। ক্ষমা চাবে গিয়া পায়ে ধরে তার, খাইয়া লাজের মাথা পরাণ ভরিয়া লইবে কাঁদিয়া, কহিবে মনের ব্যথা। তবুও কি যেন আটকে চরণ, সরমে সরে না বাণী, বলি বলি করি বলিতে পারে না মনোকথা ফুলরাণী। মন চাহে এক ভিতরে ভিতরে, প্রকাশ পায় যে আর— সামালিতে গিয়া নারে সামালিতে এমন জ্বালা সে তার! মলিন অশোক ম্রিয়মাণ মুখে একেলা রহিল সেথা, নয়নের বারি নয়নে নিবারি হৃদয়ে হৃদয়ব্যথা। দেখে নি কিছুই, শোনে নি কিছুই কে গায় কিসের গান, রহিয়াছে বসি বহি আপনার হৃদয়ে-বিঁধানো বাণ। কিছুই নাহি রে পৃথিবীতে যেন, সব সে গিয়েছে ভুলি, নাহি রে আপনি— নাহি রে হৃদয়— রয়েছে ভাবনাগুলি। ফুলবালা এক, দেখিয়া অশোকে আদরে কহিল তারে, “কেন গো অশোক, মলিন হইয়া ভাবিছ বসিয়া কারে?” এত বলি তার ধরি হাতখানি আনিল সভার ‘পরে— “গাও না অশোক— গাও” বলি তারে কত সাধাসাধি করে। নাচিতে লাগিল ফুলবালা-দল— মির ধরি তান— মৃদু মৃদু মৃদু বিষাদের স্বরে অশোক গাহিল গান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
একটি কাঠের বাক্স শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু স্নেহ-উপহার এনেছি রে দিতে লিখেও এনেছি দু-তিন ছত্তর । দিতে কত কী যে সাধ যায় তোরে দেবার মতো নেই জিনিস-পত্তর! টাকাকড়িগুলো ট্যাঁকশালে আছে ব্যাঙ্কে আছে সব জমা , ট্যাঁকে আছে খালি গোটা দুত্তিন , এবার করো বাছ ক্ষমা! হীরে জহরাৎ যত ছিল মোর পোঁতা ছিল সব মাটিতে , জহরী যে যেত সন্ধান পেয়ে নে গেছে যে যার বাটীতে! দুনিয়া শহর জমিদারি মোর , পাঁচ ভূতে করে কাড়াকাড়ি , হাতের কাছেতে যা-কিছু পেলুম , নিয়ে এনু তাই তাড়াতাড়ি! স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত চোখে যদি দেখা যেত রে , বাজারে-জিনিস কিনে নিয়ে এসে বল্ দেখি দিত কে তোরে! জিনিসটা অতি যৎসামান্য রাখিস ঘরের কোণে , বাক্সখানি ভরে স্নেহ দিনু তোরে এইটে থাকে যেন মনে! বড়োসড়ো হবি ফাঁকি দিয়ে যাবি , কোন্খেনে রবি নুকিয়ে , কাকা-ফাকা সব ধুয়ে-মুছে ফেলে দিবি একেবারে চুকিয়ে । তখন যদি রে এই কাঠখানা মনে একটুকু তোলে ঢেউ — একবার যদি মনে পড়ে তোর ‘ বুজি ' বলে বুঝি ছিল কেউ! এই-যে সংসারে আছি মোরা সবে এ বড়ো বিষম দেশটা! ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চলে যেতে ভুলে যেতে সবার চেষ্টা! ভয়ে ভয়ে তাই সবারে সবাই কত কী যে এনে দিচ্ছে , এটা-ওটা দিয়ে স্মরণ জাগিয়ে বেঁধে রাখিবার ইচ্ছে! মনে রাখতে যে মেলাই কাঠ-খড় চাই , ভুলে যাবার ভারি সুবিধে , ভালোবাস যারে কাছে রাখ তারে যাহা পাস তারে খুবি দে! বুঝে কাজ নেই এত শত কথা , ফিলজফি হোক ছাই! বেঁচে থাকো তুমি সুখে থাকো বাছা বালাই নিয়ে মরে যাই! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিবে যায় বারে বারে। আমার জীবনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে। যে লতাটি আছে শুকায়েছে মূল কুঁড়ি ধরে শুধু, নাহি ফোটে ফুল, আমার জীবনে তব সেবা তাই বেদনার উপহারে। পূজাগৌরব পুণ্যবিভব কিছু নাহি, নাহি লেশ, এ তব পূজারি পরিয়া এসেছে লজ্জার দীন বেশ। উৎসবে তার আসে নাই কেহ, বাজে নাই বাঁশি, সাজে নাই গেহ– কাঁদিয়া তোমায় এনেছে ডাকিয়া ভাঙা মন্দির-দ্বারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বাতায়নে বসি ওরে হেরি প্রতিদিন ছোটো মেয়ে খেলাহীন, চপলতাহীন, গম্ভীর কর্তব্যরত, তৎপরচরণে আসে যায় নিত্যকাজে; অশ্রুভরা মনে ওর মুখপানে চেয়ে হাসি স্নেহভরে। আজি আমি তরী খুলি যাব দেশান্তরে; বালিকাও যাবে কবে কর্ম-অবসানে আপন স্বদেশে; ও আমারে নাহি জানে, আমিও জানি নে ওরে—দেখিবারে চাহি কোথা ওর হবে শেষ জীবসূত্র বাহি। কোন্‌ অজানিত গ্রামে কোন্‌ দূরদেশে কার ঘরে বধূ হবে, মাতা হবে শেষে, তার পরে সব শেষ—তারো পরে, হায়, এই মেয়েটির পথ চলেছে কোথায়!   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আমার এ ভাগ্যরাজ্যে পুরানো কালের যে প্রদেশ, আয়ুহারাদের ভগ্নশেষ সেথা পড়ে আছে পূর্বদিগন্তের কাছে। নিঃশেষ করেছে মূল্য সংসারের হাটে, অনাবশ্যকের ভাঙা ঘাটে জীর্ণ দিন কাটাইছে তারা অর্থহারা। ভগ্ন গৃহে লগ্ন ঐ অর্ধেক প্রাচীর; আশাহীন পূর্ব আসক্তির কাঙাল শিকড়জাল বৃথা আঁকড়িয়া ধরে প্রাণপণে বর্তমান কাল। আকাশে তাকায় শিলালেখ, তাহার প্রত্যেক অস্পষ্ট অক্ষর আজ পাশের অক্ষরে ক্লান্ত সুরে প্রশ্ন করে, "আরো কি রয়েছে বাকি কোনো কথা, শেষ হয়ে যায় নি বারতা।" এ আমার ভাগ্যরাজ্যে অন্যত্র হোথায় দিগন্তরে অসংলগ্ন ভিত্তি-'পরে করে আছে চুপ অসমাপ্ত আকাঙক্ষার অসম্পূর্ণ রূপ। অকথিত বাণীর ইঙ্গিতে চারিভিতে নীরবতা-উৎকণ্ঠিত মুখ রয়েছে উৎসুক। একদা যে যাত্রীদের সংকল্পে ঘটেছে অপঘাত, অন্য পথে গেছে অকস্মাৎ, তাদের চকিত আশা, স্থকিত চলার স্তব্ধ ভাষা জানায়, হয় নি চলা সারা-- দুরাশার দূরতীর্থ আজো নিত্য করিছে ইশারা। আজিও কালের সভা-মাঝে তাদের প্রথম সাজে পড়ে নাই জীর্ণতার দাগ, লক্ষ্যচ্যুত কামনায় রয়েছে আদিম রক্তরাগ। কিছু শেষ করা হয় নাই, হেরো, তাই সময় যে পেল না নবীন কোনোদিন পুরাতন হতে-- শৈবালে ঢাকে নি তারে বাঁধা-পড়া ঘাটে-লাগা স্রোতে; স্মৃতির বেদনা কিছু, কিছু পরিতাপ, কিছু অপ্রাপ্তির অভিশাপ তারে নিত্য রেখেছে উজ্জ্বল; না দেয় নীরস হতে মজ্জাগত গুপ্ত অশ্রুজল। যাত্রাপথ-পাশে আছ তুমি আধো-ঢাকা ঘাসে-- পাথরে খুদিতেছিনু, হে মূর্তি, তোমারে কোন্‌ ক্ষণে কিসের কল্পনে। অপূর্ণ তোমার কাছে পা না উত্তর। মনে যে কী ছিল মোর যেদিন ফুটিত তাহা শিল্পের সম্পূর্ণ সাধনাতে শেষ-রেখাপাতে, সেদিন তা জানিতাম আমি; তার আগে চেষ্টা গেছে থামি। সেই শেষ না-জানার নিত্য নিরুত্তরখানি মর্ম-মাঝে রয়েছে আমার; স্বপ্নে তার প্রতিবিম্ব ফেলি সচকিত আলোকের কটাক্ষে সে করিতেছে কেলি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
আমি      নিশি - নিশি কত রচিব শয়ন আকুলনয়ন রে ! কত       নিতি - নিতি বনে করিব যতনে কুসুমচয়ন রে ! কত       শারদ যামিনী হইবে বিফল , বসন্ত যাবে চলিয়া ! কত       উদিবে তপন আশার স্বপন , প্রভাতে যাইবে ছলিয়া ! এই       যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া , মরিব কাঁদিয়া রে ! সেই      চরণ পাইলে মরণ মাগিব সাধিয়া সাধিয়া রে । আমি      কার পথ চাহি এ জনম বাহি , কার দরশন যাচি রে ! যেন      আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া , তাই আমি বসে আছি রে । তাই      মালাটি   গাঁথিয়া পরেছি মাথায় নীলবাসে তনু ঢাকিয়া , তাই      বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে একেলা রয়েছি জাগিয়া । ওগো     তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি , তাই কেঁদে যায় প্রভাতে । ওগো     তাই ফুলবনে মধুসমীরণে ফুটে ফুল কত শোভাতে ! ওই       বাঁশিস্বর তার আসে বার বার , সেই   শুধু কেন আসে না ! এই       হৃদয় - আসন শূন্য যে থাকে , কেঁদে মরে শুধু বাসনা । মিছে     পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায় , বহে যমুনার লহরী , কেন      কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে — যামিনী যে ওঠে শিহরি । ওগো     যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে , মোর হাসি আর রবে কি ! এই       জাগরণে ক্ষীণ বদন মলিন আমারে হেরিয়া কবে কী ! আমি      সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা প্রভাতে চরণে ঝরিব , ওগো     আছে সুশীতল যমুনার জল — দেখে তারে আমি মরিব । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
কুমার, তোমার প্রতীক্ষা করে নারী, অভিষেক-তরে এনেছে তীর্থবারি। সাজাবে অঙ্গ উজ্জ্বল বরবেশে, জয়মাল্য-যে পরাবে তোমার কেশে, বরণ করিবে তোমারে সে-উদ্দেশে দাঁড়ায়েছে সারি সারি।দৈত্যের হাতে স্বর্গের পরাভবে বারে বারে, বীর, জাগ ভয়ার্ত ভবে। ভাই ব'লে তাই নারী করে আহ্বান, তোমারে রমণী পেতে চাহে সন্তান, প্রিয় ব'লে গলে করিবে মাল্য দান আনন্দে গৌরবে।হেরো, জাগে সে যে রাতের প্রহর গণি, তোমার বিজয়শঙ্খ উঠুক ধ্বনি। গর্জিত তব তর্জনধিক্কারে লজ্জিত করো কুৎসিত ভীরুতারে, মন্দ্রিত হোক বন্দীশালার দ্বারে মুক্তির জাগরণী।তুমি এসে যদি পাশে নাহি দাও স্থান, হে কিশোর, তাহে নারীর অসম্মান। তব কল্যাণে কুঙ্কুম তার ভালে, তব প্রাঙ্গণে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে, তব বন্দনে সাজায় পূজার থালে প্রাণের শ্রেষ্ঠ দান।তুমি নাই, মিছে বসন্ত আসে বনে বিরহবিকল চঞ্চল সমীরণে। দুর্বল মোহ কোন আয়োজন করে যেথা অরাজক হিয়া লজ্জায় মরে-- ওই ডাকে, রাজা, এসো এ শূন্য ঘরে হৃদয়সিংহাসনে।চেয়ে আছে নারী, প্রদীপ হয়েছে জ্বালা-- বিফল কোরো না বীরের বরণডালা। মিলনলগ্ন বারে বারে ফিরে যায় বরসজ্জার ব্যর্থতাবেদনায়, মনে মনে সদা ব্যথিত কল্পনায় তোমারে পরায় মালা।তব রথ তারা স্বপ্নে দেখিছে জেগে, ছুটিছে অশ্ব বিদ্যুৎকশা লেগে। ঘুরিছে চক্র বহ্নিবরন সে যে, উঠিছে শূন্যে ঘর্ঘর তার বেজে, প্রোজ্জ্বল চূড়া প্রভাতসূর্যতেজে, ধ্বজা রঞ্জিত রাঙা সন্ধ্যার মেঘে।উদ্দেশহীন দুর্গম কোন্‌খানে চল দুঃসহ দুঃসাহসের টানে। দিল আহ্বান আলসনিদ্রা-নাশা উদয়কূলের শৈলমূলের বাসা, অমরালোকের নব আলোকের ভাষা দীপ্ত হয়েছে দৃপ্ত তোমার প্রাণে।অদূরে সুনীল সাগরে ঊর্মিরাশি উত্তালবেগে উঠিছে সমুচ্ছ্বাসি। পথিক ঝটিকা রুদ্রের অভিসারে উধাও ছুটিছে সীমাসমুদ্রপারে, উল্লোল কলগর্জিত পারাবারে ফেনগর্গরে ধ্বনিছে অট্টহাসি।আত্মলোপের নিত্যনিবিড় কারা, তুমি উদ্দাম সেই বন্ধনহারা। কোনো শঙ্কার কার্মূকটংকারে পারে না তোমারে বিহ্বল করিবারে, মৃত্যুর ছায়া ভেদিয়া তিমিরপারে নির্ভয়ে ধাও যেথা জ্বলে ধ্রুবতারা।চাহে নারী তব রথসঙ্গিনী হবে, তোমার ধনুর তূণ চিহ্নিয়া লবে। অবারিত পথে আছে আগ্রহভরে তব যাত্রায় আত্মদানের তরে, গ্রহণ করিয়ো সম্মানে সমাদরে-- জাগ্রত করি রাখিয়ো শঙ্খরবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
রাজধানী কলিকাতা; তেতালার ছাতে কাঠের কুঠরি এক ধারে; আলো আসে পূর্ব দিকে প্রথম প্রভাতে, বায়ু আসে দক্ষিণের দ্বারে।মেঝেতে বিছানা পাতা,      দুয়ারে রাখিয়া মাথা বাহিরে আঁখিরে দিই ছুটি, সৌধ-ছাদ শত শত          ঢাকিয়া রহস্য কত আকাশেরে করিছে ভ্রূকুটি। নিকটে জানালা-গায়        এক কোণে আলিসায় একটুকু সবুজের খেলা, শিশু অশথের গাছ           আপন ছায়ার নাচ সারা দিন দেখিছে একেলা। দিগন্তের চারি পাশে        আষাঢ় নামিয়া আসে, বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো, সমস্ত আকাশজোড়া        গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া চিকমিকে বিদ্যুতের আলো। চারি দিকে অবিরল         ঝরঝর বৃষ্টিজল এই ছোটো প্রান্ত-ঘরটিরে দেয় নির্বাসিত করি         দশ দিক অপহরি সমুদয় বিশ্বের বাহিরে। বসে বসে সঙ্গীহীন         ভালো লাগে কিছুদিন পড়িবারে মেঘদূতকথা— বাহিরে দিবস রাতি        বায়ু করে মাতামাতি বহিয়া বিফল ব্যাকুলতা; বহুপূর্ব আষাঢ়ের           মেঘাচ্ছন্ন ভারতের নগ-নদী-নগরী বাহিয়া কত শ্রুতিমধু নাম         কত দেশ কত গ্রাম দেখে যাই চাহিয়া চাহিয়া। ভালো করে দোঁহে চিনি,  বিরহী ও বিরহিণী জগতের দু পারে দুজন— প্রাণে প্রাণে পড়ে টান,    মাঝে মহা ব্যবধান, মনে মনে কল্পনা সৃজন। যক্ষবধূ গৃহকোণে         ফুল নিয়ে দিন গণে দেখে শুনে ফিরে আসি চলি। বর্ষা আসে ঘন রোলে,   যত্নে টেনে লই কোলে গোবিন্দদাসের পদাবলী। সুর করে বার বার       পড়ি বর্ষা-অভিসার— অন্ধকার যমুনার তীর, নিশীথে নবীনা রাধা     নাহি মানে কোনো বাধা, খুঁজিতেছে নিকুঞ্জ-কুটির। অনুক্ষণ দর দর         বারি ঝরে ঝর ঝর, তাহে অতি দূরতর বন; ঘরে ঘরে রুদ্ধ দ্বার,    সঙ্গে কেহ নাহি আর শুধু এক কিশোর মদন।আষাঢ় হতেছে শেষ,   মিশায়ে মল্লার দেশ রচি 'ভরা বাদরের' সুর। খুলিয়া প্রথম পাতা,    গীতগোবিন্দের গাথা গাহি 'মেঘে অম্বর মেদুর'। স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে     ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ বৃষ্টি পড়ে— শুয়ে শুয়ে সুখ-অনিদ্রায় ‘রজনী শাঙন ঘন ঘন  দেয়া গরজন’ সেই গান মনে পড়ে যায়। ‘পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে   বিগলিত চীর অঙ্গে’ মনসুখে নিদ্রায় মগন— সেই ছবি জাগে মনে  পুরাতন বৃন্দাবনে রাধিকার নির্জন স্বপন। মৃদু মৃদু বহে শ্বাস,    অধরে লাগিছে হাস, কেঁপে উঠে মুদিত পলক; বাহুতে মাথাটি থুয়ে  একাকিনী আছে শুয়ে, গৃহকোণে ম্লান দীপালোক। গিরিশিরে মেঘ ডাকে,   বৃষ্টি ঝরে তরুশাখে দাদুরী ডাকিছে সারারাতি— হেনকালে কী না ঘটে,   এ সময়ে আসে বটে একা ঘরে স্বপনের সাথি। মরি মরি স্বপ্নশেষে     পুলকিত রসাবেশে যখন সে জাগিল একাকী, দেখিল বিজন ঘরে      দীপ নিবু নিবু করে প্রহরী প্রহর গেল হাঁকি। বাড়িছে বৃষ্টির বেগ,     থেকে থেকে ডাকে মেঘ, ঝিল্লিরব পৃথিবী ব্যাপিয়া, সেই ঘনঘোরা নিশি     স্বপ্নে জাগরণে মিশি না জানি কেমন করে হিয়া।লয়ে পুঁথি দু-চারিটি     নেড়ে চেড়ে ইটি সিটি এইমতো কাটে দিনরাত। তার পরে টানি লই      বিদেশী কাব্যের বই, উলটি পালটি দেখি পাত— কোথা রে বর্ষার ছায়া    অন্ধকার মেঘমায়া ঝরঝর ধ্বনি অহরহ, কোথায় সে কর্মহীন      একান্তে আপনে-লীন জীবনের নিগূঢ় বিরহ! বর্ষার সমান সুরে         অন্তর বাহির পুরে সংগীতের মুষলধারায়, পরানের বহুদূর           কূলে কূলে ভরপুর, বিদেশী কাব্যে সে কোথা হায়! তখন সে পুঁথি ফেলি,    দুয়ারে আসন মেলি বসি গিয়ে আপনার মনে, কিছু করিবার নাই        চেয়ে চেয়ে ভাবি তাই দীর্ঘ দিন কাটিবে কেমনে। মাথাটি করিয়া নিচু       বসে বসে রচি কিছু বহু যত্নে সারাদিন ধরে— ইচ্ছা করে অবিরত        আপনার মনোমত গল্প লিখি একেকটি করে। ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা নিতান্তই সহজ সরল, সহস্র বিস্মৃতিরাশি         প্রত্যহ যেতেছে ভাসি তারি দু-চারিটি অশ্রুজল। নাহি বর্ণনার ছটা          ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে       সাঙ্গ করি’ মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ। জগতের শত শত         অসমাপ্ত কথা যত, অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল, অজ্ঞাত জীবনগুলা,       অখ্যাত কীর্তির ধুলা, কত ভাব, কত ভয় ভুল— সংসারের দশদিশি        ঝরিতেছে অহর্নিশি ঝরঝর বরষার মতো— ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি      পড়িতেছে রাশি রাশি শব্দ তার শুনি অবিরত। সেই-সব হেলাফেলা,     নিমেষের লীলাখেলা চারি দিকে করি স্তূপাকার, তাই দিয়ে করি সৃষ্টি      একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি জীবনের শ্রাবণনিশার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে; যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড় পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার। সর্বজন সর্বক্ষণ চলে যেই পথে তৃণগুল্ম সেথা নাহি জন্মে কোনোমতে; যে জাতি চলে না কভু তারি পথ-’পরে তন্ত্র-মন্ত্র-সংহিতায় চরণ না সরে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ভাবি বসে বসে গত জীবনের কথা , কাঁচা মনে ছিল কী বিষম মূঢ়তা । শেষে ধিক্‌কারে বলি হাত নেড়ে , যাক গে সে কথা যাক গে । তরুণ বেলাতে যে খেলা খেলাতে ভয় ছিল হারবার , তারি লাগি , প্রিয়ে , সংশয়ে মোরে ফিরিয়েছ বার বার । কৃপণ কৃপার ভাঙা কণা একটুক মনে দেয় নাই সুখ । সে যুগের শেষে আজ বলি হেসে , কম কি সে কৌতুক যতটুকু ছিল ভাগ্যে , দুঃখের কথা থাক্‌ গে । পঞ্চমী তিথি বনের আড়াল থেকে দেখা দিয়েছিল ছায়া দিয়ে মুখ ঢেকে । মহা আক্ষেপে বলেছি সেদিন , এ ছল কিসের জন্য । পরিতাপে জ্বলি আজ আমি বলি , সিকি চাঁদিনীর আলো দেউলে নিশার অমাবস্যার চেয়ে যে অনেক ভালো । বলি আরবার , এসো পঞ্চমী , এসো , চাপা হাসিটুকু হেসো , আধখানি বেঁকে ছলনায় ঢেকে না জানিয়ে ভালোবেসো । দয়া , ফাঁকি নামে গণ্য , আমারে করুক ধন্য । আজ খুলিয়াছি পুরানো স্মৃতির ঝুলি , দেখি নেড়েচেড়ে ভুলের দুঃখগুলি । হায় হায় এ কী , যাহা কিছু দেখি সকলি যে পরিহাস্য । ভাগ্যের হাসি কৌতুক করি সেদিন সে কোন্‌ ছলে আপনার ছবি দেখিতে চাহিল আমার অশ্রুজলে । এসো ফিরে এসো সেই ঢাকা বাঁকা হাসি , পালা শেষ করো আসি । মূঢ় বলিয়া করতালি দিয়া যাও মোরে সম্ভাষি । আজ করো তারি ভাষ্য যা ছিল অবিশ্বাস্য । বয়স গিয়েছে , হাসিবার ক্ষমতাটি বিধাতা দিয়েছে , কুয়াশা গিয়েছে কাটি । দুখদুর্দিন কালো বরনের মুখোশ করেছে ছিন্ন । দীর্ঘ পথের শেষ গিরিশিরে উঠে গেছে আজ কবি । সেথা হতে তার ভূতভবিষ্য সব দেখে যেন ছবি । ভয়ের মূর্তি যেন যাত্রার সঙ্‌ , মেখেছে কুশ্রী রঙ । দিনগুলি যেন পশুদলে চলে , ঘণ্টা বাজায়ে গলে । কেবল ভিন্ন ভিন্ন সাদা কালো যত চিহ্ন ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
ভোলানাথের খেলার তরে খেলনা বানাই অামি। এই বেলাকার খেলাটি তার ওই বেলা যায় থামি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে । আবার বাজিছে বাঁশি, আবার উঠিছে হাসি, বসন্তের বাতাস বয়েছে । সুনীল আকাশ-'পরে শুভ্র মেঘ থরে থরে শ্রান্ত যেন রবির আলোকে, পাখিরা ঝাড়িছে পাখা, কাঁপিছে তরুর শাখা, খেলাইছে বালিকা-বালকে।। সমুখের সরোবরে আলো ঝিকিমিকি করে, ছায়া কাঁপিতেছে থরথর-- জলের পানেতে চেয়ে ঘাটে বসে আছে মেয়ে, শুনিছে পাতার মরমর । কী জানি কত কী আশে চলিয়াছে চারি পাশে কত লোক কত সুখে দুখে, সবাই তো ভুলে আছে, কেহ হাসে কেহ নাচে-- তুমি কেন দাঁড়াও সমুখে! বাতাস যেতেছে বহি তুমি কেন রহি রহি তারি মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস! সুদূরে বাজিছে বাঁশি, তুমি কেন ঢাল আসি তারি মাঝে বিলাপ-উচ্ছ্বাস! উঠিছে প্রভাতরবি, আঁকিছে সোনার ছবি, তুমি কেন ফেল তাহে ছায়া! বারেক যে চলে যায় তারে তো কেহ না চায়, তবু তার কেন এত মায়া! তবু কেন সন্ধ্যাকালে জলদের অন্তরালে লুকায়ে ধরার পানে চায়, নিশীথের অন্ধকারে পুরানো ঘরের দ্বারে কেন এসে পুন ফিরে যায়! কী দেখিতে আসিয়াছ-- যাহা-কিছু ফেলে গেছ কে তাদের করিবে যতন! স্মরণের চিহ্ন যত ছিল পড়ে দিন-কত ঝ'রে-পড়া পাতার মতন-- আজি বসন্তের বায় একেকটি করে হায় উড়ায়ে ফেলিছে প্রতিদিন, ধূলিতে মাটিতে রহি হাসির কিরণে দহি ক্ষণে ক্ষণে হতেছে মলিন । ঢাকো তবে ঢাকো মুখ, নিয়ে যাও দুঃখ সুখ, চেয়ো না, চেয়ো না ফিরে ফিরে-- হেথায় আলয় নাহি-- অনন্তের পানে চাহি আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা-জালে, হে ছলনাময়ী। মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে। এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত; তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি। তোমার জ্যোতিষ্ক তারে যে পথ দেখায় সে যে তার অন্তরের পথ, সে যে চিরস্বচ্ছ , সহজ বিশ্বাসে সে যে করে তারে চিরসমুজ্জল। বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু, এই নিয়ে তাহার গৌরব। লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত। সত্যেরে সে পায় আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে, শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভাণ্ডারে। অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
মেঘের মধ্যে মা গো, যারা থাকে তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে। বলে, ‘আমরা কেবল করি খেলা, সকাল থেকে দুপুর সন্ধেবেলা। সোনার খেলা খেলি আমরা ভোরে, রুপোর খেলা খেলি চাঁদকে-ধরে। ' আমি বলি, ‘যাব কেমন করে। ' তারা বলে, ‘এসো মাঠের শেষে। সেইখানেতে দাঁড়াবে হাত তুলে, আমরা তোমায় নেব মেঘের দেশে। ' আমি বলি, ‘মা যে আমার ঘরে বসে আছে চেয়ে আমার তরে, তারে ছেড়ে থাকব কেমন করে। ' শুনে তারা হেসে যায় মা, ভেসে। তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ; তুমি যেন হবে আমার চাঁদ— দু হাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে, আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ। ঢেউয়ের মধ্যে মা গো যারা থাকে, তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে। বলে, ‘আমরা কেবল করি গান সকাল থেকে সকল দিনমান। ' তারা বলে, ‘কোন্‌ দেশে যে ভাই, আমরা চলি ঠিকানা তার নাই। ' আমি বলি, ‘কেমন করে যাই। ' তারা বলে, ‘এসো ঘাটের শেষে। সেইখানেতে দাঁড়াবে চোখ বুজে, আমরা তোমায় নেব ঢেউয়ের দেশে। ' আমি বলি, ‘মা যে চেয়ে থাকে, সন্ধে হলে নাম ধরে মোর ডাকে, কেমন করে ছেড়ে থাকব তাকে। ' শুনে তারা হেসে যায় মা, ভেসে। তার চেয়ে মা, আমি হব ঢেউ, তুমি হবে অনেক দূরের দেশ। লুটিয়ে আমি পড়ব তোমার কোলে, কেউ আমাদের পাবে না উদ্দেশ। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
ভোলানাথ লিখেছিল, তিন-চারে নব্বই– গণিতের মার্কায় কাটা গেল সর্বই। তিন চারে বারো হয়, মাস্টার তারে কয়; “লিখেছিনু ঢের বেশি” এই তার গর্বই।  (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
গগন ঢাকা ঘন মেঘে, পবন বহে খর বেগে। অশনি ঝনঝন ধ্বনিছে ঘন ঘন, নদীতে ঢেউ উঠে জেগে। পবন বহে খর বেগে। তীরেতে তরুরাজি দোলে আকুল মর্মর-রোলে। চিকুর চিকিমিকে চকিয়া দিকে দিকে তিমির চিরি যায় চলে। তীরেতে তরুরাজি দোলে। ঝরিছে বাদলের ধারা বিরাম-বিশ্রামহারা। বারেক থেমে আসে, দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে আবার পাগলের পারা ঝরিছে বাদলের ধারা। মেঘেতে পথরেখা লীন, প্রহর তাই গতিহীন। গগন-পানে চাই, জানিতে নাহি পাই গেছে কি নাহি গেছে দিন; প্রহর তাই গতিহীন। তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী, রয়েছি সারা দিন ধরি। এখনো পথ নাকি অনেক আছে বাকি, আসিছে ঘোর বিভাবরী। তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী। বসিয়া তরণীর কোণে একেলা ভাবি মনে মনে– মেঝেতে শেজ পাতি সে আজি জাগে রাতি, নিদ্রা নাহি দুনয়নে। বসিয়া ভাবি মনে মনে। মেঘের ডাক শুনে কাঁপে, হৃদয় দুই হাতে চাপে। আকাশ-পানে চায়, ভরসা নাহি পায়, তরাসে সারা নিশি যাপে, মেঘের ডাক শুনে কাঁপে। কভু বা বায়ুবেগভরে দুয়ার ঝনঝনি পড়ে। প্রদীপ নিবে আসে, ছায়াটি কাঁপে ত্রাসে, নয়নে আঁখিজল ঝরে, বক্ষ কাঁপে থরথরে। চকিত আঁখি দুটি তার মনে আসিছে বার বার। বাহিরে মহা ঝড়, বজ্র কড়মড়, আকাশ করে হাহাকার। মনে পড়িছে আঁখি তার। গগন ঢাকা ঘন মেঘে, পবন বহে খর বেগে। অশনি ঝনঝন ধ্বনিছে ঘন ঘন, নদীতে ঢেউ উঠে জেগে। পবন বহে আজি বেগে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গীতিগাথা
সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে কহিল কবির স্ত্রী 'রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো, রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো, মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো, তার খোঁজ রাখ কি! গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব--- মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম, মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব, না মিলে শস্যকণা। অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা, নিশিদিন ধ'রে এ কি ছেলেখেলা! ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা লক্ষ্মীর উপাসনা। ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী, যা করিতে হয় করহ এখনি। এত শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি কিসে কড়ি আসে দুটো!' দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া, পরিহাসছলে ঈষত্‍‌ হাসিয়া কহে জুড়ি করপুট, 'ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে, লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে, ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে এ কথা শুনিবে কেবা! আমার কপালে বিপরীত ফল--- চপলা লক্ষ্মী মোর অচপল, ভারতী না থাকে থির এক পল এতো করি তাঁর সেবা। তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল স্বর্গে মর্তে খুঁজিতেছি মিল, আনমনা যদি হই এক-তিল অমনি সর্বনাশ!' মনে মনে হাসি মুখ করি ভার কহে কবিজায়া, 'পারি নেকো আর, ঘরসংসার গেল ছারেখার, সব তাতে পরিহাস!' এতেক বলিয়া বাঁকায়ে মুখানি শিঞ্জিত করি কাঁকন-দুখানি চঞ্চল করে অঞ্চল টানি রোষছলে যায় চলি। হেরি সে ভুবন-গরব-দমন অভিমানবেগে অধীর গমন উচাটন কবি কহিল, 'অমন যেয়ো না হৃদয় দলি। ধরা নাহি দিলে ধরিব দু পায়, কী করিতে হবে বলো সে উপায়, ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায়--- বুদ্ধি জোগাও তুমি। একটুকু ফাঁকা যেখানে যা পাই তোমার মুরতি সেখানে চাপাই, বুদ্ধির চাষ কোনোখানে নাই--- সমস্ত মরুভূমি।' 'হয়েছে, হয়েছে, এত ভালো নয়' হাসিয়া রুষিয়া গৃহিণী ভনয়, 'যেমন বিনয় তেমনি প্রণয় আমার কপালগুণে। কথার কখনো ঘটে নি অভাব, যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব, একবার ওগো বাক্য-নবাব চলো দেখি কথা শুনে। শুভ দিন ক্ষন দেখো পাঁজি খুলি, সঙ্গে করিয়া লহো পুঁথিগুলি, ক্ষনিকের তরে আলস্য ভুলি চলো রাজসভা-মাঝে। আমাদের রাজা গুণীর পালক, মানুষ হইয়া গেল কত লোক, ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক লাগিবে কিসের কাজে!' কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ, ভাবিল--- বিপদ দেখিতেছি আজ, কখনো জানি নে রাজা মহারাজ, কপালে কী জানি আছে! মুখে হেসে বলে, 'এই বৈ নয়! আমি বলি, আরো কী করিতে হয়! প্রাণ দিতে পারি, শুধু জাগে ভয় বিধবা হইবে পাছে। যেতে যদি হয় দেরিতে কী কাজ, ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ--- হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ, কেয়ূর, কনকহার। বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে, কিঙ্করগণ সাথে যাবে কে কে আয়োজন করো তার।' ব্রাহ্মণী কহে, 'মুখাগ্রে যার বাধে না কিছুই, কী চাহে সে আর মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার না দেখি আবশ্যক। নানা বেশভূষা হীরা রুপা সোনা এনেছি পাড়ার করি উপাসনা, সাজ করে লও পুরায়ে বাসনা, রসনা ক্ষান্ত হোক।' এতেক বলিয়া ত্বরিতচরণ আনে বেশবাস নানান-ধরন, কবি ভাবে মুখ করি বিবরন--- আজিকে গতিক মন্দ। গৃহিণী স্বয়ং নিকটে বসিয়া তুলিল তাহারে মাজিয়া ঘষিয়া, আপনার হাতে যতনে কষিয়া পরাইল কটিবন্ধ। উষ্ণীষ আনি মাথায় চড়ায়, কণ্ঠী আনিয়া কণ্ঠে জড়ায়, অঙ্গদ দুটি বাহুতে পরায়, কুণ্ডল দেয় কানে। অঙ্গে যতই চাপায় রতন কবি বসি থাকে ছবির মতন, প্রেয়সীর নিজ হাতের যতন সেও আজি হার মানে। এইমতে দুই প্রহর ধরিয়া বেশভূষা সব সমাধা করিয়া গৃহিণী নিরখে ঈষত সরিয়া বাঁকায়ে মধুর গ্রীবা। হেরিয়া কবির গম্ভীর মুখ হৃদয়ে উপজে মহা কৌতুক; হাসি উঠি কহে ধরিয়া চিবূক, 'আ মরি, সেজেছ কিবা!' ধরিল সমুখে আরশি আনিয়া; কহিল বচন অমিয় ছানিয়া, 'পুরনারীদের পরান হানিয়া ফিরিয়া আসিবে আজি। তখন দাসীরে ভুলো না গরবে, এই উপকার মনে রেখো তবে, মোরেও এমন পরাইতে হবে রতনভূষণরাজি।' কোলের উপরে বসি বাহুপাশে বাঁধিয়া কবিরে সোহাগে সহাসে কপোল রাখিয়া কপোলের পাশে কানে কানে কথা কয়। দেখিতে দেখিতে কবির অধরে হাসিরাশি আর কিছুতে না ধরে, মুগ্ধ হৃদয় গলিয়া আদরে ফাটিয়া বাহির হয়। কহে উচ্ছ্বসি, 'কিছু না মানিব, এমনি মধুর শ্লোক বাখানিব রাজভাণ্ডার টানিয়া আনিব ও রাঙা চরণতলে!' বলিতে বলিতে বুক উঠে ফুলি, উষ্ণীষ-পরা মস্তক তুলি পথে বাহিরায় গৃহদ্বার খুলি, দ্রুত রাজগৃহে চলে। কবির রমণী কুতুহলে ভাসে, তাড়তাড়ি উঠি বাতায়নপাশে উঁকি মারি চায়, মনে মনে হাসে--- কালো চোখে আলো নাচে। কহে মনে মনে বিপুলপুলকে--- রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে, এমনটি আর পড়িল না চোখে আমার যেমন আছে॥ এ দিকে কবির উত্‍‌সাহ ক্রমে নিমেষে নিমেষে আসিতেছে কমে, যখন পশিল নৃপ-আশ্রমে মরিতে পাইলে বাঁচে। রাজসভাসদ্ সৈন্য পাহারা গৃহিণীর মতো নহে তো তাহারা, সারি সারি দাড়ি করে দিশাহারা--- হেথা কী আসিতে আছে! হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয় রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়, মন্ত্রী হইতে দ্বারীমহাশয় সবে গম্ভীরমুখ। মানুষে কেন যে মানুষের প্রতি ধরি আছে হেন যমের মুরতি তাই ভাবি কবি না পায় ফুরতি--- দমি যায় তার বুক। বসি মহারাজ মহেন্দ্ররায় মহোচ্চ গিরিশিখরের প্রায়, জন-অরণ্য হেরিছে হেলায় অচল-অটল ছবি। কৃপানির্ঝর পড়িছে ঝরিয়া শত শত দেশ সরস করিয়া, সে মহামহিমা নয়ন ভরিয়া চাহিয়া দেখিল কবি। বিচার সমাধা হল যবে, শেষে ইঙ্গিত পেয়ে মন্ত্রী-আদেশে জোড়করপুটে দাঁড়াইল এসে দেশের প্রধান চর। অতি সাধুমত আকার প্রকার, এক-তিল নাহি মুখের বিকার, ব্যবসা যে তাঁর মানুষ-শিকার নাহি জানে কোনো নর। ব্রত নানামত সতত পালয়ে, এক কানাকড়ি মুল্য না লয়ে ধর্মোপদেশ আলয়ে আলয়ে বিতরিছে যাকে তাকে। চোরা কটাক্ষ চক্ষে ঠিকরে--- কী ঘটিছে কার, কে কোথা কী করে পাতায় পাতায় শিকড়ে শিকড়ে সন্ধান তার রাখে। নামাবলি গায়ে বৈষ্ণবরূপে যখন সে আসি প্রণমিল ভূপে, মন্ত্রী রাজারে অতি চুপে চুপে কী করিল নিবেদন। অমনি আদেশ হইল রাজার, 'দেহো এঁরে টাকা পঞ্চ হজার।' 'সাধু সাধু' কহে সভার মাঝার যত সভাসদ্‌জন। পুলক প্রকাশে সবার গাত্রে--- 'এ যে দান ইহা যোগ্যপাত্রে, দেশের আবাল-বনিতা-মাত্রে ইথে না মানিবে দ্বেষ।' সাধু নুয়ে পড়ে নম্রতাভরে, দেখি সভাজন 'আহা আহা' করে, মন্ত্রীর শুধু জাগিল অধরে ঈষত্‍‌ হাস্যলেশ। আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ ধুলিভরা দুটি লইয়া চরণ চিহ্নিত করি রাজাস্তরণ পবিত্র পদপঙ্কে। ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম, বলি-অঙ্কিত শিথিল চর্ম, প্রখরমুর্তি অগ্নিশর্ম--- ছাত্র মরে আতঙ্কে। কোনো দিকে কোনো লক্ষ না ক'রে পড়ি গেল শ্লোক বিকট হাঁ ক'রে, মটর কড়াই মিশায়ে কাঁকরে চিবাইল যেন দাঁতে। কেহ তার নাহি বুঝে আগুপিছু, সবে বসি থাকে মাথা করি নিচু; রাজা বলে, 'এঁরে দক্ষিণা কিছু দাও দক্ষিণ হাতে।' তার পরে এল গনত্‍‌কার, গণনায় রাজা চমত্‍‌কার, টাকা ঝন্ ঝন্ ঝনত্‍‌কার বাজায়ে সে গেল চলি। আসে এক বুড়ো গণ্যমান্য করপুটে লয়ে দুর্বাধান্য, রাজা তাঁর প্রতি অতি বদান্য ভরিয়া দিলেন থলি। আসে নট ভাট রাজপুরোহিত--- কেহ একা কেহ শিষ্য-সহিত, কারো বা মাথায় পাগড়ি লোহিত কারো বা হরিত্‍‌বর্ণ। আসে দ্বিজগণ পরমারাধ্য--- কন্যার দায়, পিতার শ্রাদ্ধ--- যার যথামত পায় বরাদ্দ; রাজা আজি দাতাকর্ণ। যে যাহার সবে যায় স্বভবনে, কবি কী করিবে ভাবে মনে মনে, রাজা দেখে তারে সভাগৃহকোণে বিপন্নমুখছবি। কহে ভূপ, 'হোথা বসিয়া কে ওই, এস তো, মন্ত্রী, সন্ধান লই।' কবি কহি উঠে, 'আমি কেহ নই, আমি শুধু এক কবি।' রাজা কহে, 'বটে! এসো এসো তবে, আজিকে কাব্য-আলোচনা হবে।' বসাইলা কাছে মহাগৌরবে ধরি তার কর দুটি। মন্ত্রী ভাবিল, যাই এই বেলা, এখন তো শুরু  হবে ছেলেখেলা--- কহে, 'মহারাজ, কাজ আছে মেলা, আদেশ পাইলে উঠি।' রাজা শুধু মৃদু নাড়িলা হস্ত, নৃপ-ইঙ্গিতে মহা তটস্থ বাহির হইয়া গেল সমস্ত সভাস্থ দলবল--- পাত্র মিত্র অমাত্য আদি, অর্থী প্রার্থী বাদী প্রতিবাদী, উচ্চ তুচ্ছ বিবিধ-উপাধি বন্যার যেন জল॥ চলি গেল যবে সভ্যসুজন মুখোমুখি করি বসিলা দুজন; রাজা বলে, 'এবে কাব্যকূজন আরম্ভ করো কবি।' কবি তবে দুই কর জুড়ি বুকে বাণীবন্দনা করে নত মুখে, 'প্রকাশো জননী নয়নসমুখে প্রসন্ন মুখছবি। বিমল মানসসরস-বাসিনী শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী কমলকুঞ্জাসনা, তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন খ্যাপার মতন আছি চিরদিন উদাসীন আনমনা। চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া, আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া পেয়েছি স্বরগসুধা। সেই মোর ভালো, সেই বহু মানি, তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী--- সুরের খাদ্যে জানো তো মা, বাণী, নরের মিটে না ক্ষুধা। যা হবার হবে সে কথা ভাবি না, মা গো, একবার ঝংকারো বীণা, ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনী অমৃত-উত্‍‌স-ধারা। যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান মলিনমর্ত-মাঝে বহমান নিয়ত আত্মহারা। যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া হোমশিখাসম উঠিছে কাঁপিয়া, অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া বিশ্বতন্ত্রী হতে। যে রাগিণী চিরজন্ম ধরিয়া চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া--- অশ্রুহাসিতে জীবন ভরিয়া ছুটে সহস্র স্রোতে। কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায়, নিমেষে প্রকাশে, নিমেষে মিলায়--- বালুকার'পরে কালের বেলায় ছায়া-আলোকের খেলা। জগতের যত রাজা মহারাজ কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ, সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ--- টুটিছে সন্ধ্যাবেলা। শুধু তার মাঝে ধ্বনিতেছে সুর বিপুল বৃহত্‍‌ গভীর মধুর, চিরদিন তাহে আছে ভরপুর মগন গগনতল। যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয়তরণী--- জানে না আপনা, জানে না ধরণী, সংসারকোলাহল। সে জন পাগল, পরান বিকল--- ভবকূল হতে ছিঁড়িয়া শিকল কেমনে এসেছে ছাড়িয়া সকল, ঠেকেছে চরণে তব। তোমার অমল কমলগন্ধ হৃদয়ে ঢালিছে মহা-আনন্দ--- অপূর্ব গীত, আলোক ছন্দ শুনিছ নিত্য নব। বাজুক সে বীণা, মজুক ধরণী--- বারেকের তরে ভুলাও, জননী, কে বড়ো কে ছোটো, কে দীন কে ধনী, কেবা আগে কেবা পিছে--- কার জয় হল কার পরাজয়, কাহার বৃদ্ধি কার হল ক্ষয়, কেবা ভালো আর কেবা ভালো নয়, কে উপরে কেবা নীচে। গাঁথা হয়ে যাক এক গীতরবে ছোটো জগতের ছোটোবড়ো সবে, সুখে প'ড়ে রবে পদপল্লবে যেন মালা একখানি। তুমি মানসের মাঝখানে আসি দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি, কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি বীণা হাতে বীণাপাণি। ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা সারি সারি যত মানবের ধারা অনাদিকালের পান্থ যাহারা তব সংগীতস্রোতে। দেখিতে পাইব ব্যোমে মহাকাল ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল, দশ দিক্‌বধূ খুলি কেশজাল নাচে দশ দিক হতে।' এতেক বলিয়া ক্ষণপরে কবি করুণ কথায় প্রকাশিল ছবি পূণ্যকাহিনী রঘুকুলরবি রাঘবের ইতিহাস। অসহ দুঃখ সহি নিরবধি কেমনে জনম গিয়েছে দগধি, জীবনের শেষ দিবস অবধি অসীম নিরাশ্বাস। কহিল, 'বারেক ভাবি দেখো মনে সেই একদিন কেটেছে কেমনে যেদিন মলিন বাকলবসনে চলিলা বনের পথে--- ভাই লক্ষ্মণ বয়স নবীন, ম্লানছায়াসম বিষাদবিলীন নববধূ সীতা আভরণহীন উঠিলা বিদায়রথে। রাজপুরী-মাঝে উঠে হাহাকার, প্রজা কাঁদিতেছে পথে সারে-সার, এমন বজ্র কখনো কি আর পড়েছে এমন ঘরে! অভিষেক হবে, উত্‍‌সবে তার আনন্দময় ছিল চারি ধার--- মঙ্গলদীপ নিবিয়া আঁধার শুধু নিমেষের ঝড়ে। আর-একদিন, ভেবে দেখো মনে, যেদিন শ্রীরাম লয়ে লক্ষ্মণে ফিরিয়া নিভৃত কুটিরভবনে দেখিলা জানকী নাহি--- 'জানকী' 'জানকী' আর্ত রোদনে ডাকিয়া ফিরিলা কাননে কাননে, মহা-অরণ্য আঁধার-আননে রহিল নীরবে চাহি। তার পরে দেখো শেষ কোথা এর, ভেবে দেখো কথা সেই দিবসের--- এত বিষাদের এত বিরহের এত সাধনার ধন, সেই সীতাদেবী রাজসভা-মাঝে বিদায়বিনয়ে নমি রঘুরাজে দ্বিধা ধরাতলে অভিমানে লাজে হইলা অদর্শন। সে-সকল দিন সেও চলে যায়, সে অসহ শোক--- চিহ্ন কোথায়--- যায় নি তো এঁকে ধরণীর গায় অসীম দগ্ধরেখা। দ্বিধা ধরাভুমি জুড়েছে আবার, দণ্ডকবনে ফুটে ফুলভার, সরযূর কূলে দুলে তৃণসার প্রফুল্লশ্যামলেখা। শুধু সে দিনের একখানি সুর চিরদিন ধ'রে বহু বহু দূর কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর মধুর করুণ তানে। সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে আজিও সে গীত মহাসংগীতে বাজে মানবের কানে।' তার পরে কবি কহিল সে কথা, কুরুপাণ্ডবসমরবারতা--- গৃহবিবাদের ঘোর মত্ততা ব্যাপিল সর্ব দেশ; দুইটি যমজ তরু পাশাপাশি, ঘর্ষণে জ্বলে হুতাশনরাশি, মহাদাবানল ফেলে শেষে গ্রাসি অরণ্যপরিবেশ। এক গিরি হতে দুই-স্রোত-পারা দুইটি শীর্ণ বিদ্বেষধারা সরীসৃপগতি মিলিল তাহারা নিষ্ঠুর অভিমানে, দেখিতে দেখিতে হল উপনীত ভারতের যত ক্ষত্রশোণিত--- ত্রাসিত ধরণী করিল ধ্বনিত প্রলয়বন্যাগানে। দেখিতে দেখিতে ডুবে গেল কূল, আত্ম ও পর হয়ে গেল ভুল, গৃহবন্ধন করি নির্মূল ছুটিল রক্তধারা--- ফেনায়ে উঠিল মরণাম্বুধি, বিশ্ব রহিল নিশ্বাস রুধি কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি নিবায়ে সূর্যতারা। সমরবন্যা যবে অবসান সোনার ভারত বিপুল শ্মশান, রাজগৃহ যত ভূতলশয়ান পড়ে আছে ঠাঁই ঠাঁই। ভীষণা শান্তি রক্তনয়নে বসিয়া শোণিতপঙ্কশয়নে, চাহি ধরা-পানে আনতবয়নে মুখেতে বচন নাই। বহু দিন পরে ঘুচিয়াছে খেদ, মরণে মিটেছে সব বিচ্ছেদ, সমাধা যজ্ঞ মহা-নরমেধ বিদ্বেষহুতাশনে। সকল কামনা করিয়া পূর্ণ সকল দম্ভ করিয়া চূর্ণ পাঁচ ভাই গিয়া বসিলা শূন্য স্বর্ণসিংহাসনে। স্তব্ধ প্রাসাদ বিষাদ-আঁধার, শ্মশান হইতে আসে হাহাকার রাজপুরবধূ যত অনাথার মর্মবিদার রব। 'জয় জয় জয় পাণ্ডুতনয়' সারি সারি দ্বারী দাঁড়াইয়া কয়--- পরিহাস বলে আজ মনে হয়, মিছে মনে হয় সব। কালি যে ভারত সারা দিন ধরি অট্ট গরজে অম্বর ভরি রাজার রক্তে খেলেছিল হোরি ছাড়ি কুলভয়লাজে, পরদিনে চিতাভস্ম মাখিয়া সন্ন্যাসীবেশে অঙ্গ ঢাকিয়া বসি একাকিনী শোকার্তহিয়া শূন্যশ্মশানমাঝে। কুরুপাণ্ডব মুছে গেছে সব, সে রণরঙ্গ হয়েছে নীরব, সে চিতাবহ্নি অতি ভৈরব ভস্মও নাহি তার। যে ভূমি লইয়া এত হানাহানি সে আজি কাহার তাহাও না জানি, কোথা ছিল রাজা কোথা রাজধানী চিহ্ন নাহিকো আর। তবু কোথা হতে আসিছে সে স্বর--- যেন সে অমর সমরসাগর গ্রহণ করেছে নব কলেবর একটি বিরাট গানে। বিজয়ের শেষে সে মহাপ্রয়াণ, সফল আশার বিষাদ মহান্, উদাস শান্তি করিতেছে দান চিরমানবের প্রাণে। হায়, এ ধরায় কত অনন্ত বরষে বরষে শীত বসন্ত সুখে দুখে ভরি দিক্-দিগন্ত হাসিয়া গিয়াছে ভাসি। এমনি বরষা আজিকার মতো কতদিন কত হয়ে গেছে গত, নবমেঘভারে গগন আনত ফেলেছে অশ্রুরাশি। যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে, দুখিরা কেঁদেছে, সুখীরা হেসেছে, প্রেমিক যেজন ভালো সে বেসেছে আজি আমাদেরই মতো; তারা গেছে, শুধু তাহাদের গান দু হাতে ছড়ায়ে করে গেছে দান--- দেশে দেশে তার নাহি পরিমাণ, ভেসে ভেসে যায় কত। শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে, সমস্ত প্রাণে কেন-যে কে জানে ভরে আসে আঁখিজল--- বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা, বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা, লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা সুন্দর ধরাতল! এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ চাহি নে করিতে বাদ প্রতিবাদ, যে ক' দিন আছি মানসের সাধ মিটাব আপন-মনে--- যার যাহা আছে তার থাক্ তাই, কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই একটি নিভৃত কোণে। শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি, বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি, পুষ্পের মত সংগীতগুলি ফুটাই আকাশভালে। অন্তর হতে আহরি বচন আনন্দলোক করি বিরচন, গীতরসধারা করি সিঞ্চন সংসারধুলিজালে। অতিদুর্গম সৃষ্টিশিখরে অসীম কালের মহাকন্দরে সতত বিশ্বনির্ঝর ঝরে ঝর্ঝরসংগীতে, স্বরতরঙ্গ যত গ্রহতারা ছুটিছে শূন্যে উদ্দেশহারা--- সেথা হতে টানি লব গীতধারা ছোটো এই বাঁশরিতে। ধরণীর শ্যাম করপুটখানি ভরি দিব আমি সেই গীত আনি, বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী মধুর-অর্থ-ভরা। নবীন আষাঢ়ে রচি নব মায়া এঁকে দিয়ে যাব ঘনতর ছায়া, করে দিয়ে যাব বসন্তকায়া বাসন্তীবাস-পরা। ধরণীর তলে গগনের গায় সাগরের জলে অরণ্যছায় আরেকটুখানি নবীন আভায় রঙিন করিয়া দিব। সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর, দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর--- তার পরে ছুটি নিব। সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল, সুন্দর হবে নয়নের জল, স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল আরো আপনার হবে। প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে, আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-'পরে শিশিরের মত রবে। না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে--- কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে মাগিছে তেমনি সুর। কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা, কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা, বিদায়ের আগে দু-চারিটা কথা রেখে যাব সুমধুর। থাকো হৃদাসনে জননী ভারতী--- তোমারি চরণে প্রাণের আরতি, চাহি না চাহিতে আর কারো প্রতি, রাখি না কাহারো আশা। কত সুখ ছিল হয়ে গেছে দুখ, কত বান্ধব হয়েছে বিমুখ, ম্লান হয়ে গেছে কত উত্‍‌সুক উন্মুখ ভালোবাসা। শুধু ও চরণ হৃদয়ে বিরাজে, শুধু ওই বীণা চিরদিন বাজে, স্নেহসুরে ডাকে অন্তর-মাঝে--- আয় রে বত্‍‌স, আয়, ফেলে রেখে আয় হাসি ক্রন্দন, ছিঁড়ে আয় যত মিছে বন্ধন, হেথা ছায়া আছে চিরনন্দন চিরবসন্ত-বায়। সেই ভালো মা গো, যাক যাহা যায়, জন্মের মত বরিনু তোমায়--- কমলগন্ধ কোমল দু পায় বার বার নমোনম।' এত বলি কবি থামাইল গান, বসিয়া রহিল মুগ্ধনয়ান, বাজিতে লাগিল হৃদয় পরান বীণাঝংকার-সম। পুলকিত রাজা, আঁখি ছলছল্, আসন ছাড়িয়া নামিলা ভূতল--- দু বাহু বাড়ায়ে, পরান উতল, কবিরে লইলা বুকে। কহিলা 'ধন্য, কবি গো, ধন্য, আনন্দে মন সমাচ্ছন্ন, তোমারে কী আমি কহিব অন্য--- চিরদিন থাকো সুখে। ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে, করি পরিতোষ কোন্ উপহারে, যাহা-কিছু আছে রাজভাণ্ডারে সব দিতে পারি আনি।' প্রেমোচ্ছ্বসিত আনন্দজলে ভরি দু নয়ন কবি তাঁরে বলে, 'কণ্ঠ হইতে দেহো মোর গলে ওই ফুলমালাখানি।' মালা বাঁধি কেশে কবি যায় পথে, কেহ শিবিকায় কেহ ধায় রথে, নানা দিকে লোক যায় নানামতে কাজের অন্বেষণে। কবি নিজমনে ফিরিছে লুব্ধ, যেন সে তাহার নয়ন মুগ্ধ কল্পধেনুর অমৃতদুগ্ধ দোহন করিছে মনে। কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ সন্ধ্যার মতো পরি রাঙা বাস বসি একাকিনী বাতায়ন-পাশ--- সুখহাস মুখে ফুটে। কপোতের দল চারি দিকে ঘিরে নাচিয়া ডাকিয়া বেড়াইছে ফিরে--- যবের কণিকা তুলিয়া সে ধীরে দিতেছে চঞ্চুপুটে। অঙ্গুলি তার চলিছে যেমন কত কী-যে কথা ভাবিতেছে মন, হেনকালে পথে ফেলিয়া নয়ন সহসা কবিরে হেরি বাহুখানি নাড়ি মৃদু ঝিনিঝিনি বাজাইয়া দিল করকিঙ্কিণী, হাসিজালখানি অতুলহাসিনী ফেলিলা কবিরে ঘেরি। কবির চিত্ত উঠে উল্লাসি; অতি সত্বর সম্মুখে আসি কহে কৌতুকে মৃদু মৃদু হাসি, 'দেখো কী এনেছি বালা! নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন, আমি আনিয়াছি করিয়া যতন তোমার কণ্ঠে দেবার মতন রাজকণ্ঠের মালা।' এত বলি মালা শির হতে খুলি প্রিয়ার গলায় দিতে গেল তুলি, কবিনারী রোষে কর দিল ঠেলি ফিরায়ে রহিল মুখ। মিছে ছল করি মুখে করে রাগ, মনে মনে তার জাগিছে সোহাগ, গরবে ভরিয়া উঠে অনুরাগ, হৃদয়ে উথলে সুখ। কবি ভাবে বিধি অপ্রসন্ন, বিপদ আজিকে হেরি আসন্ন বসি থাকে মুখ করি বিষণ্ণ শূন্যে নয়ন মেলি। কবির ললনা আধখানি বেঁকে চোরা কটাক্ষে চাহে থেকে থেকে, পতির মুখের ভাবখানা দেখে মুখের বসন ফেলি উচ্চকণ্ঠে উঠিল হাসিয়া, তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া, চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া পড়িল তাহার বুকে। সেথায় লুকায়ে হাসিয়া কাঁদিয়া কবির কণ্ঠ বাহুতে বাঁধিয়া শতবার করি আপনি সাধিয়া চুম্বিল তার মুখে। বিস্মিত কবি বিহ্বলপ্রায় আনন্দে কথা খুঁজিয়া না পায়, মালাখানি লয়ে আপন গলায় আদরে পরিলা সতী। ভক্তি-আবেগে কবি ভাবে মনে চেয়ে সেই প্রেমপূর্ণ বদনে--- বাঁধা প'ল এক মাল্যবাঁধনে লক্ষ্মীসরস্বতী॥শাহাজাদপুর, ১৩ শ্রাবণ ১৩০০ সূত্রঃ সোনার তরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
দেখো চেয়ে গিরির শিরে মেঘ করেছে গগন ঘিরে, আর কোরো না দেরি। ওগো আমার মনোহরণ, ওগো স্নিগ্ধ ঘনবরন, দাঁড়াও, তোমায় হেরি। দাঁড়াও গো ওই আকাশ-কোলে, দাঁড়াও আমার হৃদয়-দোলে, দাঁড়াও গো ওই শ্যামল-তৃণ-‘পরে, আকুল চোখের বারি বেয়ে দাঁড়াও আমার নয়ন ছেয়ে, জন্মে জন্মে যুগে যুগান্তরে। অমনি করে ঘনিয়ে তুমি এসো, অমনি করে তড়িৎ-হাসি হেসো, অমনি করে উড়িয়ে দিয়ো কেশ। অমনি করে নিবিড় ধারা-জলে অমনি করে ঘন তিমির-তলে আমায় তুমি করো নিরুদ্দেশ।ওগো তোমার দরশ লাগি ওগো তোমার পরশ মাগি গুমরে মোর হিয়া। রহি রহি পরান ব্যেপে আগুন-রেখা কেঁপে কেঁপে যায় যে ঝলকিয়া। আমার চিত্ত-আকাশ জুড়ে বলাকা-দল যাচ্ছে উড়ে জানি নে কোন্‌ দূর-সমুদ্র-পারে। সজল বায়ু উদাস ছুটে, কোথায় গিয়ে কেঁদে উঠে পথবিহীন গহন অন্ধকারে। ওগো তোমার আনো খেয়ার তরী, তোমার সাথে যাব অকূল-‘পরি, যাব সকল বাঁধন-বাধা-খোলা। ঝড়ের বেলা তোমার স্মিতহাসি লাগবে আমার সর্বদেহে আসি, তরাস-সাথে হরষ দিবে দোলা।ওই যেখানে ঈশান কোণে তড়িৎ হানে ক্ষণে ক্ষণে বিজন উপকূলে– তটের পায়ে মাথা কুটে তরঙ্গদল ফেনিয়ে উঠে গিরির পদমূলে, ওই যেখানে মেঘের বেণী জড়িয়ে আছে বনের শ্রেণী– মর্মরিছে নারিকেলের শাখা, গরুড়সম ওই যেখানে ঊর্ধ্বশিরে গগন-পানে শৈলমালা তুলেছে নীল পাখা, কেন আজি আনে আমার মনে ওইখানেতে মিলে তোমার সনে বেঁধেছিলেম বহুকালের ঘর– হোথায় ঝড়ের নৃত্য-মাঝে ঢেউয়ের সুরে আজো বাজে যুগান্তরের মিলনগীতিস্বর।কে গো চিরজনম ভ’রে নিয়েছ মোর হৃদয় হ’রে উঠছে মনে জেগে। নিত্যকালের চেনাশোনা করছে আজি আনাগোনা নবীন-ঘন মেঘে। কত প্রিয়মুখের ছায়া কোন্‌ দেহে আজ নিল কায়া, ছড়িয়ে দিল সুখদুখের রাশি– আজকে যেন দিশে দিশে ঝড়ের সাথে যাচ্ছে মিশে কত জন্মের ভালোবাসাবাসি। তোমায় আমায় যত দিনের মেলা লোক-লোকান্তে যত কালের খেলা এক মুহূর্তে আজ করো সার্থক। এই নিমেষে কেবল তুমি একা জগৎ জুড়ে দাও আমারে দেখা, জীবন জুড়ে মিলন আজি হোক।পাগল হয়ে বাতাস এল, ছিন্ন মেঘে এলোমেলো হচ্ছে বরিষন, জানি না দিগ্‌দিগন্তরে আকাশ ছেয়ে কিসের তরে চলছে আয়োজন। পথিক গেছে ঘরে ফিরে, পাখিরা সব গেছে নীড়ে, তরণী সব বাঁধা ঘাটের কোলে। আজি পথের দুই কিনারে জাগিছে গ্রাম রুদ্ধ দ্বারে, দিবস আজি নয়ন নাহি খোলে। শান্ত হ রে, শান্ত হ রে প্রাণ– ক্ষান্ত করিস প্রগল্‌ভ এই গান, ক্ষান্ত করিস বুকের দোলাদুলি। হঠাৎ যদি দুয়ার খুলে যায়, হঠাৎ যদি হরষ লাগে গায় যায়, তখন চেয়ে দেখিস আঁখি তুলি।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
এসেছিনু দ্বারে ঘনবর্ষণ রাতে, প্রদীপ নিবালে কেন অঞ্চলাঘাতে। কালো ছায়াখানি মনে পড়ে গেল আঁকা, বিমুখ মুখের ছবি অন্তরে ঢাকা, কলঙ্করেখা যেন চিরদিন চাঁদ বহি চলে সাথে সাথে।কেন বাধা হল দিতে মাধুরীর কণা হায় হায়, হে কৃপণ্য। তব যৌবন-মাঝে লাবণ্য বিরাজে, লিপিখানি তার নিয়ে এসে তবু কেন যে দিলে না হাতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
চলিতে চলিতে চরণে উছলে চলিবার ব্যাকুলতা— নূপুরে নূপুরে বাজে বনতলে মনের অধীর কথা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে_ কে তুমি? মেলে নি উত্তর।বৎসর বৎসর চলে গেল। দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়_ কে তুমি? পেল না উত্তর।।  (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
হাজারিবাগের ঝোপে হাজারটা হাই তুলেছিল হাজারটা বাঘে, ময়মন্‌সিংহের মাসতুত ভাই গর্জি উঠিল তাই রাগে। খেঁকশেয়ালের দল শেয়ালদহর হাঁচি শুনে হেসে মরে অষ্টপ্রহর, হাতিবাগানের হাতি ছাড়িয়া শহর ভাগলপুরের দিকে ভাগে– গিরিডির গিরগিটি মস্ত-বহর পথ দেখাইয়া চলে আগে। মহিশূরে মহিষটা খায় অড়হর– খামকাই তেড়ে গিয়ে লাগে।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে! একটি ভুজঙ্গ-ভুজে আমারে জড়ায়ে আছে; আরেকটি শ্যাম-বাহু, শতেক মুকুতা ঝুলে, সোনার মদিরা পাত্র আকাশে রয়েছে তুলে। অলকের মেঘ মাঝে জ্বলিতেছে মুখখানি, রূপের মদিরা পিয়া আবেশে অবশ হিয়া, পড়েছে মাতাল হয়ে, কখন্‌ কিছু না জানি! রাখিয়া বক্ষের পরে অবশ চিবুক মোর, হাসিতেছি তার পানে, হৃদয়ে আঁধার ঘোর! বাতায়ন-যবনিকা, বাতাস, সরায়ে ধীরে বীজন করিছে আসি এ মোর তাপিত শিরে। সম্মুখেতে দেখা যায় পীতবর্ণ বালুকায় অস্তগামী রবিকর আদূর “নীলের’ তীরে। চেয়ে আছি, দেখিতেছি, নদীর সুদূর পারে, (কী জানি কিসের দুখ!) পশ্চিম দিকের মুখ বিষণ্ণ হইয়া আসে সন্ধ্যার আঁধার ভারে। প্রদোষ তারার মুখে হাসি আসি উঁকি মারে! রোমীয় স্বপন এক জাগিছে সম্মুখে মোর, ঘুরিছে মাথার মাঝে, মাথায় লেগেছে ঘোর। রোমীয় সমর-অস্ত্র ঝঞ্ঝনিয়া উঠে বাজি, বিস্ফারিত নাসা চাহে রণ-ধূম পিতে আজি। কিন্তু হায়! অমনি সে মুখ্‌ পানে হেসে চায়, কী জানি কী হয় মতি, হীন প্রমোদের প্রতি। বীরের ভ্রূকুটিগুলি তখনি মিলায়ে যায়! গরবিত, শূন্য হিয়া, জর্জর আবেশ-বাণে, যে প্রমোদ ঘৃণা করি হেসে চাই তারি পানে। অনাহূত হর্ষ এক জাগ্রতে স্বপনে আসি, শৌর্যের সমাধি-পরে ঢালে রবি-কর রাশি! কতবার ঘৃণি তারে! রমণী সে অবহেলে পৌরুষ নিতেছে কাড়ি বিলাসের জালে ফেলে! কিন্তু সে অধর হতে অমনি অজস্র স্রোতে ঝরে পড়ে মৃদু হাসি, চুম্বন অমৃত-মাখা আমারে করিয়া তুলে, ভাঙাঘর ফুলে ঢাকা। বীরত্বের মুখ খানি একবার মনে আনি, তার পরে ওই মুখে ফিরাই নয়ন মম, ওই মুখ! একখানি উজ্জ্বল কলঙ্ক সম! ওই তার শ্যাম বাহু আমারে ধরেছে হায়! অঙ্গুলির মৃদু স্পর্শে বল মোর চলে যায়! মুখ ফিরাইয়া লই– রমণী যেমনি ধীরি মৃদু কণ্ঠে মৃদু কহে, অমনি আবার ফিরি। রোমের আঁধার মেঘ দেখে যেই মুখ-‘পরে, অমনি দু বাহু দিয়ে কণ্ঠ জড়াইয়া ধরে, বরষে নয়নবারি আমার বুকের মাঝ, চুমিয়া সে অশ্রুবারি শুকানো বীরের কাজ। তার পরে ত্যজি মোরে চরণ পড়িছে টলে, থর থর কেঁপে বলে–“যাও, যাও, যাও চলে!’ ঢুলু ঢুলু আঁখিপাতা পুরে অশ্রু-মুকুতায়, শ্যামল সৌন্দর্য তার হিম-শ্বেত হয়ে যায়! জীবনের লক্ষ্য, আশা, ইচ্ছা, হারাইয়া ফেলি, চেয়ে দেখি তার পানে কাতর নয়ন মেলি। আবার ফিরাই মুখ, কটাক্ষেতে চেয়ে রই, কল&ড়বঁ;ঙ্ক প্রমোদে মাতি তাহারে টানিয়া লই! আরেকটি বার রোম, হইব সন্তান তোর একটি বাসনা এই বন্দী এ হৃদয়ে মোর। গৌরবে সম্মানে মরি এই এক আছে আশ, চাহি না করিতে ব্যয় চুম্বনে অন্তিম শ্বাস! বুঝি হায় সে আশাও পুরিবে না কোনো কালে রোমীয় মৃত্যুও বুঝি ঘটিবে না এ কপালে! রোমীয় সমাধি চাই তাও বুঝি ভাগ্যে নাই, ওই বুকে মরে যাব, বুঝি মরণের কালে!Robert Buchanan (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণ , গলায় পলার হারখানি । চেয়েছি অবাক মানি তার পানে । বড়ো বড়ো কাজল নয়ানে অসংকোচে ছিল চেয়ে নবকৈশোরের মেয়ে , ছিল তারি কাছাকাছি বয়স আমার । স্পষ্ট মনে পড়ে ছবি । ঘরের দক্ষিণে খোলা দ্বার , সকালবেলার রোদে বাদামগাছের মাথা ফিকে আকাশের নীলে মেলেছে চিকন ঘন পাতা । একখানি সাদা শাড়ি কাঁচা কচি গায়ে , কালো পাড় দেহ ঘিরে ঘুরিয়া পড়েছে তার পায়ে । দুখানি সোনার চুড়ি নিটোল দু হাতে , ছুটির মধ্যাহ্নে পড়া কাহিনীর পাতে ওই মূর্তিখানি ছিল । ডেকেছে সে মোরে মাঝে মাঝে বিধির খেয়াল যেথা নানাবিধ সাজে রচে মরীচিকালোক নাগালের পারে বালকের স্বপ্নের কিনারে । দেহ ধরি মায়া আমার শরীরে মনে ফেলিল অদৃশ্য ছায়া সূক্ষ্ম স্পর্শময়ী । সাহস হল না কথা কই । হৃদয় ব্যথিল মোর অতিমৃদু গুঞ্জরিত সুরে — ও যে দূরে , ও যে বহুদূরে , যত দূরে শিরীষের ঊর্ধ্বশাখা যেথা হতে ধীরে ক্ষীণ গন্ধ নেমে আসে প্রাণের গভীরে ।                         একদিন পুতুলের বিয়ে , পত্র গেল দিয়ে । কলরব করেছিল হেসে খেলে নিমন্ত্রিত দল । আমি মুখচোরা ছেলে একপাশে সংকোচে পীড়িত । সন্ধ্যা গেল বৃথা , পরিবেশনের ভাগে পেয়েছিনু মনে নেই কী তা । দেখেছিনু , দ্রুতগতি দুখানি পা আসে যায় ফিরে , কালো পাড় নাচে তারে ঘিরে । কটাক্ষে দেখেছি , তার কাঁকনে নিরেট রোদ দু হাতে পড়েছে যেন বাঁধা । অনুরোধ উপরোধ শুনেছিনু তার স্নিগ্ধ স্বরে । ফিরে এসে ঘরে মনে বেজেছিল তারি প্রতিধ্বনি অর্ধেক রজনী । তার পরে একদিন জানাশোনা হল বাধাহীন । একদিন নিয়ে তার ডাকনাম তারে ডাকিলাম । একদিন ঘুচে গেল ভয় , পরিহাসে পরিহাসে হল দোঁহে কথা-বিনিময় । কখনো বা গড়ে-তোলা দোষ ঘটায়েছে ছল-করা রোষ । কখনো বা শ্লেষবাক্যে নিষ্ঠুর কৌতুক হেনেছিল দুখ । কখনো বা দিয়েছিল অপবাদ অনবধানের অপরাধ । কখনো দেখেছি তার অযত্নের সাজ — রন্ধনে ছিল সে ব্যস্ত , পায় নাই লাজ । পুরুষসুলভ মোর কত মূঢ়তারে ধিক্‌কার দিয়েছে নিজ স্ত্রীবুদ্ধির তীব্র অহংকারে । একদিন বলেছিল , “ জানি হাত দেখা । ” হাতে তুলে নিয়ে হাত নতশিরে গ নে ছিল রেখা — বলেছিল , “ তোমার স্বভাব প্রেমের লক্ষণে দীন । ” দিই নাই কোনোই জবাব । পরশের সত্য পুরস্কার খণ্ডিয়া দিয়েছে দোষ মিথ্যা সে নিন্দার । তবু ঘুচিল না অসম্পূর্ণ চেনার বেদনা । সুন্দরের দূরত্বের কখনো হয় না ক্ষয় , কাছে পেয়ে না পাওয়ার দেয় অফুরন্ত পরিচয় ।        পুলকে বিষাদে মেশা দিন পরে দিন পশ্চিমে দিগন্তে হয় লীন । চৈত্রের আকাশতলে নীলিমার লাবণ্য ঘনাল , আশ্বিনের আলো বাজাল সোনার ধানে ছুটির সানাই । চলেছে মন্থর তরী নিরুদ্দেশে স্বপ্নেতে বোঝাই ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আজ তালের বনের করতালি কিসের তালে পূর্ণিমাচাঁদ মাঠের পারে ওঠার কালে॥ না-দেখা কোন্‌ বীণা বাজে আকাশ-মাঝে, না-শোনা কোন্‌ রাগ রাগিণী শূন্যে ঢালে॥ ওর খুশির সাথে কোন্‌ খুশির আজ মেলামেশা, কোন্‌ বিশ্বমাতন গানের নেশায় লাগল নেশা। তারায় কাঁপে রিনিঝিনি যে কিঙ্কিণী তারি কাঁপন লাগল কি ওর মুগ্ধ ভালে॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
কোন্‌ খ'সে-পড়া তারা মোর প্রাণে এসে খুলে দিল আজি সুরের অশ্রুধারা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
গহির নীদমে বিবশ শ্যাম মম, অধরে বিকশত হাস, মধুর বদনমে মধুর ভাব অতি কিয়ে পায় পরকাশ ! চুম্বনু শত শত চন্দ্ৰ বদন রে, তবহুঁ ন পূরল আশ, অতি ধীরে ময় হৃদয়ে রাখনু নহি নহি মিটল তিয়াষ। শ্যাম, সুখে তুঁহু নীদ যাও পহু মঝু এ প্রেমময় উরসে, অনিমিখ নয়নে সারা রজনী হেরব মুখ তব হরষে।শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে হাস বিকাশত কায়, কোন্‌ স্বপন অব দেখত মাধব, কহবে কোন্‌ হমায়! এ মুখ স্বপনে মৈক কি দেখত হরষে বিকশত হাসি? শ্যাম, শ্যাম মম, কৈসে শোধব তুঁহুক প্রেমঋণ রাশি! জনম জনম মম প্রাণ পূর্ণ করি থাক হৃদয় করি আলা, তুঁহুক পাশ রহি হাসয়ি হাসয়ি সহব সকল দুখ জ্বালা। বিহঙ্গ, কাহ তু বোলন লাগলি? শ্যাম ঘুমায় হমারা, রহ রহ চন্দ্রম, ঢাল ঢাল, তব শীতল. জোছন-ধারা!তারা-মালিনী মধুরা যামিনী ন যাও ন যাও বালা, নিরদয় রবি, অব কাহ তু আওলি আনলি বিরহক জ্বালা! হমার সারা জীবন জনি ইহ রজনী রহত সমান, হেরয়ি হেরয়ি শ্যামমুখচ্ছবি প্রাণ ভইত অবসান! ভানু কহত অব “রবি অতি নিষ্ঠুর, নলিন-মিলন অভিলাষে কত শত নারীক মিলন টুটাওত, ডারত বিরহ-হুতাশে!”(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার     গানের ও পারে। আমার    সুরগুলি পায় চরণ, আমি     পাই নে তোমারে। বাতাস বহে মরি মরি,     আর বেঁধে রেখো না তরী, এসো এসো পার হয়ে মোর     হৃদয়-মাঝারে।। তোমার সাথে গানের খেলা     দূরের খেলা যে - বেদনাতে বাঁশি বাজায়     সকল বেলা যে। কবে নিয়ে আমার বাঁশি     বাজাবে গো আপনি আসি আনন্দময় নীরব রাতের     নিবিড় আঁধারে?।শান্তিনিকেতন ২৮ ফাল্গুন ১৩২০(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শোকমূলক
কখনো কখনো কোনো অবসরে নিকটে দাঁড়াতে এসে; "এই যে' বলেই তাকাতেম মুখে, "বোসো' বলিতাম হেসে। দু-চারটে হত সামান্য কথা, ঘরের প্রশ্ন কিছু, গভীর হৃদয় নীরবে রহিত হাসিতামাশার পিছু। কত সে গভীর প্রেম সুনিবিড়, অকথিত কত বাণী, চিরকাল-তরে গিয়েছ যখন আজিকে সে কথা জানি। প্রতি দিবসের তুচ্ছ খেয়ালে সামান্য যাওয়া-আসা, সেটুকু হারালে কতখানি যায় খুঁজে নাহি পাই ভাষা। তব জীবনের বহু সাধনার যে পণ্যভারে ভরি মধ্যদিনের বাতাসে ভাসালে তোমার নবীন তরী, যেমনি তা হোক মনে জানি তার এতটা মূল্য নাই যার বিনিময়ে পাবে তব স্মৃতি আপন নিত্য ঠাঁই-- সেই কথা স্মরি বার বার আজ লাগে ধিক্‌কার প্রাণে-- অজানা জনের পরম মূল্য নাই কি গো কোনোখানে। এ অবহেলার বেদনা বোঝাতে কোথা হতে খুঁজে আনি ছুরির আঘাত যেমন সহজ তেমন সহজ বাণী। কারো কবিত্ব, কারো বীরত্ব, কারো অর্থের খ্যাতি-- কেহ-বা প্রজার সুহৃদ্‌ সহায়, কেহ-বা রাজার জ্ঞাতি-- তুমি আপনার বন্ধুজনেরে মাধুর্যে দিতে সাড়া, ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা সকল খ্যাতির বাড়া। ভরা আষাঢ়ের যে মালতীগুলি আনন্দমহিমায় আপনার দান নিঃশেষ করি ধুলায় মিলায়ে যায়-- আকাশে আকাশে বাতাসে তাহারা আমাদের চারি পাশে তোমার বিরহ ছড়ায়ে চলেছে সৌরভনিশ্বাসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
যেম্‌নি মা গো গুরু গুরু মেঘের পেলে সাড়া যেম্‌নি এল আষাঢ় মাসে বৃষ্টিজলের ধারা, পুবে হাওয়া মাঠ পেরিয়ে যেম্‌নি পড়ল আসি বাঁশ-বাগানে সোঁ সোঁ করে বাজিয়ে দিয়ে বাঁশি— অম্‌নি দেখ্‌ মা, চেয়ে— সকল মাটি ছেয়ে কোথা থেকে উঠল যে ফুল এত রাশি রাশি। তুই যে ভাবিস ওরা কেবল অম্‌নি যেন ফুল, আমার মনে হয় মা, তোদের সেটা ভারি ভুল। ওরা সব ইস্‌কুলের ছেলে, পুঁথি-পত্র কাঁখে মাটির নীচে ওরা ওদের পাঠশালাতে থাকে। ওরা পড়া করে দুয়োর-বন্ধ ঘরে, খেলতে চাইলে গুরুমশায় দাঁড় করিয়ে রাখে। বোশেখ-জষ্টি মাসকে ওরা দুপুর বেলা কয়, আষাঢ় হলে আঁধার করে বিকেল ওদের হয়। ডালপালারা শব্দ করে ঘনবনের মাঝে, মেঘের ডাকে তখন ওদের সাড়ে চারটে বাজে। অমনি ছুটি পেয়ে আসে সবাই ধেয়ে, হলদে রাঙা সবুজ সাদা কত রকম সাজে। জানিস মা গো, ওদের যেন আকাশেতেই বাড়ি, রাত্রে যেথায় তারাগুলি দাঁড়ায় সারি সারি। দেখিস নে মা, বাগান ছেয়ে ব্যস্ত ওরা কত! বুঝতে পারিস কেন ওদের তাড়াতাড়ি অত? জানিস কি কার কাছে হাত বাড়িয়ে আছে। মা কি ওদের নেইকো ভাবিস আমার মায়ের মতো? (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
হংকঙেতে সারাবছর আপিস করেন মামা , সেখান থেকে এনেছিলেন চীনের দেশের শ্যামা , দিয়েছিলেন মাকে, ঢাকার নীচে যখন-তখন শিস দিয়ে সে ডাকে। নিচিনপুরের বনের থেকে ঝুলির মধ্যে ক'রে ভজহরি আনত ফড়িঙ ধরে । পাড়ায় পাড়ায় যত পাখি খাঁচায় খাঁচায় ঢাকা আওয়াজ শুনেই উঠত নেচে , ঝাপট দিত পাখা । কাউকে ছাতু , কাউকে পোকা , কাউকে দিত ধান , অসুখ করলে হলুদজলে করিয়ে দিত স্নান । ভজু বলত , “ পোকার দেশে আমিই হচ্ছি দত্যি , আমার ভয়ে গঙ্গাফড়িঙ ঘুমোয় না একরত্তি । ঝোপে ঝোপে শাসন আমার কেবলই ধরপাকড় , পাতায় পাতায় লুকিয়ে বেড়ায় যত পোকামাকড় । ”একদিন সে ফাগুন মাসে মাকে এসে বলল , “ গোধূলিতে মেয়ের আমার বিয়ে হবে কল্য । ” শুনে আমার লাগল ভারি মজা , এই আমাদের ভজা , এরও আবার মেয়ে আছে , তারও হবে বিয়ে , রঙিন চেলির ঘোমটা মাথায় দিয়ে । শুধাই তাকে , “ বিয়ের দিনে খুব বুঝি ধুম হবে ?” ভজু বললে , “ খাঁচার রাজ্যে নইলে কি মান রবে । কেউবা ওরা দাঁড়ের পাখি , পিঁজরেতে কেউ থাকে , নেমন্তন্ন চিঠিগুলো পাঠিবে দেব ডাকে । মোটা মোটা ফড়িঙ দেব , ছাতুর সঙ্গে দই , ছোলা আনব ভিজিয়ে জলে , ছড়িয়ে দেব খই । এমনি হবে ধুম, সাত পাড়াতে চক্ষে কারও রইবে না আর ঘুম। ময়নাগুলোর খুলবে গলা, খাইয়ে দেব লঙ্কা; কাকাতুয়া চীৎকারে তার বাজিয়ে দেবে ডঙ্কা । পায়রা যত ফুলিয়ে গলা লাগাবে বক্‌বকম , শালিকগুলোর চড়া মেজাজ , আওয়াজ নানারকম । আসবে কোকিল , চন্দনাদের শুভাগমন হবে , মন্ত্র শুনতে পাবে না কেউ পাখির কলরবে । ডাকবে যখন টিয়ে বরকর্তা রবেন বসে কানে আঙুল দিয়ে । ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
তপন-উদয়ে হবে মহিমার ক্ষয় তবু প্রভাতের চাঁদ শান্তমুখে কয়, অপেক্ষা করিয়া আছি অস্তসিন্ধুতীরে প্রণাম করিয়া যাব উদিত রবিরে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
আকাশে চেয়ে দেখি অবকাশের অন্ত নেই কোথাও। দেশকালের সেই সুবিপুল আনুকূল্যে তারায় তারায় নিঃশব্দ আলাপ, তাদের দ্রুতবিচ্ছুরিত আলোক-সংকেতে তপস্বিনী নীরবতার ধ্যান কম্পমান। অসংখ্যের ভারে পরিকীর্ণ আমার চিত্ত; চারদিকে আশু প্রয়োজনের কাঙালের দল; অসীমের অবকাশকে খণ্ড খণ্ড করে ভিড় করেছে তারা উৎকণ্ঠ কোলাহলে। সংকীর্ণ জীবনে আমার স্বর তাই বিজড়িত, সত্য পৌঁছয় না অনুজ্জ্বল বাণীতে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত কথার মূল্য হল দীন; অর্থ গেল মুছে। আমার ভাষা যেন কুয়াশার জড়িমায় অবমানিত হেমন্তের বেলা, তার সুর পড়েছে চাপা। সুস্পষ্ট প্রভাতের মতো মন অনায়াসে মাথা তুলে বলতে পারে না-- "ভালোবাসি।" সংকোচ লাগে কণ্ঠের কৃপণতায়। তাই ওগো বনস্পতি, তোমার সম্মুখে এসে বসি সকালে বিকালে, শ্যামচ্ছায়ায় সহজ করে নিতে চাই আমার বাণী। দেখি চেয়ে, তোমার পল্লবস্তবক অনায়াসে পার হয়েছে শাখাব্যূহের জটিলতা, জয় করে নিয়েছে চারদিকে নিস্তব্ধ অবকাশ। তোমার নিঃশব্দ উচ্ছ্বাস সেই উদার পথে উত্তীর্ণ হয়ে যায় সূর্যোদয়-মহিমার মাঝে। সেই পথ দিয়ে দক্ষিণ বাতাসের স্রোতে অনাদি প্রাণের মন্ত্র তোমার নবকিশলয়ের মর্মে এসে মেলে-- বিশ্বহৃদয়ের সেই আনন্দমন্ত্র-- "ভালোবাসি।" বিপুল ঔৎসুক্য আমাকে বহন করে নিয়ে যায় সুদূরে; বর্তমান মুহূর্তগুলিকে অবলুপ্ত করে কালহীনতায়। যেন কোন্‌ লোকান্তরগত চক্ষু জন্মান্তর থেকে চেয়ে থাকে অমার মুখের দিকে,-- চেতনাকে নিষ্কারণ বেদনায় সকল সীমার পরপারে দেয় পাঠিয়ে। ঊর্ধ্বলোক থেকে কানে আসে সৃষ্টির শাশ্বতবাণী-- "ভালোবাসি।" যেদিন যুগান্তের রাত্রি হল অবসান আলোকের রশ্মিদূত বিকীর্ণ করেছিল এই আদিমবাণী আকাশে আকাশে। সৃষ্টিযুগের প্রথম লগ্নে প্রাণসমুদ্রের মহাপ্লাবনে তরঙ্গে তরঙ্গে দুলেছিল এই মন্ত্র-বচন। এই বাণীই দিনে দিনে রচনা করেছে স্বর্ণচ্ছটায় মানসী প্রতিমা আমার বিরহ-গগনে অস্তসাগরের নির্জন ধূসর উপকূলে। আজ দিনান্তের অন্ধকারে এজন্মের যত ভাবনা যত বেদনা নিবিড় চেতনায় সম্মিলিত হয়ে সন্ধ্যাবেলার একলা তারার মতো জীবনের শেষবাণীতে হোক উদ্ভাসিত-- "ভালোবাসি।"