poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
পথের ধারে অশথতলে মেয়েটি খেলা করে ; আপন-মনে আপনি আছে সারাটি দিন ধরে । উপর-পানে আকাশ শুধু , সমুখ-পানে মাঠ , শরৎকালে রোদ পড়েছে , মধুর পথঘাট । দুটি-একটি পথিক চলে , গল্প করে , হাসে । লজ্জাবতী বধূটি গেল ছায়াটি নিয়ে পাশে । আকাশ-ঘেরা মাঠের ধারে বিশাল খেলাঘরে একটি মেয়ে আপন-মনে কতই খেলা করে । মাথার'পরে ছায়া পড়েছে , রোদ পড়েছে কোলে , পায়ের কাছে একটি লতা বাতাস পেয়ে দোলে । মাঠের থেকে বাছুর আসে , দেখে নূতন লোক , ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়ে থাকে ড্যাবা ড্যাবা চোখ । কাঠবিড়ালি উসুখুসু আশেপাশে ছোটে , শব্দ পেলে লেজটি তুলে চমক খেয়ে ওঠে । মেয়েটি তাই চেয়ে দেখে কত যে সাধ যায় — কোমল গায়ে হাত বুলায়ে চুমো খেতে চায় ! সাধ যেতেছে কাঠবিড়ালি তুলে নিয়ে বুকে , ভেঙে ভেঙে টুকুটুকু খাবার দেবে মুখে । মিষ্টি নামে ডাকবে তারে গালের কাছে রেখে , বুকের মধ্যে রেখে দেবে আঁচল দিয়ে ঢেকে । ‘‘ আয় আয়''' ডাকে সে তাই — করুণ স্বরে কয় , ‘‘ আমি কিছু বলব না তো আমায় কেন ভয় ! '' মাথা তুলে চেয়ে থাকে উঁচু ডালের পানে — কাঠবিড়ালি ছুটে পালায় ব্যথা সে পায় প্রাণে । রাখাল ছেলের বাঁশি বাজে সুদূর তরুছায় , খেলতে খেলতে মেয়েটি তাই খেলা ভুলে যায় । তরুর মূলে মাথা রেখে চেয়ে থাকে পথে , না জানি কোন্ পরীর দেশে ধায় সে মনোরথে । একলা কোথায় ঘুরে বেড়ায় মায়াদ্বীপে গিয়ে — হেনকালে চাষী আসে দুটি গোরু নিয়ে । শব্দ শুনে কেঁপে ওঠে , চমক ভেঙে চায় । আঁখি হতে মিলায় মায়া , স্বপন টুটে যায় ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
১ গোলাপ হাসিয়া বলে, “আগে বৃষ্টি যাক চলে, দিক দেখা তরুণ তপন– তখন ফুটাব এ যৌবন।’ গেল মেঘ, এল উষা, আকাশের আঁখি হতে মুছে দিল বৃষ্টিবারিকণা– সে তো রহিল না। কোকিল ভাবিছে মনে, “শীত যাবে কত ক্ষণে, গাছপালা ছাইবে মুকুলে– তখন গাহিব মন খুলে।’ কুয়াশা কাটিয়া যায়, বসন্ত হাসিয়া চায়, কানন কুসুমে ভরে গেল– সে যে মরে গেল!২ এত শীঘ্র ফুটিলি কেন রে! ফুটিলে পড়িতে হয় ঝরে– মুকুলের দিন আছে তবু, ফোটা ফুল ফোটে না তো আর। বড়ো শীঘ্র গেলি মধুমাস, দু দিনেই ফুরালো নিশ্বাস। বসন্ত আবার আসে বটে, গেল যে সে ফেরে না আবার।Augusta Webster (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ম্লান হয়ে এল কণ্ঠে মন্দারমালিকা, হে মহেন্দ্র, নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা মলিন ললাটে। পুণ্যবল হল ক্ষীণ, আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন, হে দেব, হে দেবীগণ। বর্ষ লক্ষশত যাপন করেছি হর্ষে দেবতার মতো দেবলোকে। আজি শেষ বিচ্ছেদের ক্ষণে লেশমাত্র অশ্রুরেখা স্বর্গের নয়নে দেখে যাব এই আশা ছিল। শোকহীন হৃদিহীন সুখস্বর্গভূমি, উদাসীন চেয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ বর্ষ তার চক্ষের পলক নহে; অশ্বত্থশাখার প্রান্ত হতে খসি গেলে জীর্ণতম পাতা যতটুকু বাজে তার, ততটুকু ব্যথা স্বর্গে নাহি লাগে, যবে মোরা শত শত গৃহচ্যুত হতজ্যোতি নক্ষত্রের মতো মুহূর্তে খসিয়া পড়ি দেবলোক হতে ধরিত্রীর অন্তহীন জন্মমৃত্যুস্রোতে। সে বেদনা বাজিত যদ্যপি, বিরহের ছায়ারেখা দিত দেখা, তবে স্বরগের চিরজ্যোতি ম্লান হত মর্তের মতন কোমল শিশিরবাষ্পে-- নন্দনকানন মর্মরিয়া উঠিত নিশ্বসি, মন্দাকিনী কূলে কূলে গেয়ে যেত করুণ কাহিনী কলকণ্ঠে, সন্ধ্যা আসি দিবা-অবসানে নির্জন প্রান্তর-পারে দিগন্তের পানে চলে যেত উদাসিনী, নিস্তব্ধ নিশীথ ঝিল্লিমন্ত্রে শুনাইত বৈরাগ্যসংগীত নক্ষত্রসভায়। মাঝে মাঝে সুরপুরে নৃত্যপরা মেনকার কনকনূপুরে তালভঙ্গ হত। হেলি উর্বশীর স্তনে স্বর্ণবীণা থেকে থেকে যেন অন্যমনে অকস্মাৎ ঝংকারিত কঠিন পীড়নে নিদারুণ করুণ মূর্ছনা। দিত দেখা দেবতার অশ্রুহীন চোখে জলরেখা নিষ্কারণে। পতিপাশে বসি একাসনে সহসা চাহিত শচী ইন্দ্রের নয়নে যেন খুঁজি পিপাসার বারি। ধরা হতে মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসি আসিত বায়ুস্রোতে ধরণীর সুদীর্ঘ নিশ্বাস-- খসি ঝরি পড়িত নন্দনবনে কুসুমমঞ্জরী। থাকো স্বর্গ হাস্যমুখে, করো সুধাপান দেবগণ। স্বর্গ তোমাদেরি সুখস্থান-- মোরা পরবাসী। মর্তভূমি স্বর্গ নহে, সে যে মাতৃভূমি-- তাই তার চক্ষে বহে অশ্রুজলধারা, যদি দু দিনের পরে কেহ তারে ছেড়ে যায় দু দণ্ডের তরে। যত ক্ষুদ্র, যত ক্ষীণ, যত অভাজন, যত পাপীতাপী, মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায়-- ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায় জননীর। স্বর্গে তব বহুক অমৃত, মর্তে থাক্‌ সুখে দুঃখে অনন্তমিশ্রিত প্রেমধারা-- অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি।                  হে অপ্সরী, তোমার নয়নজ্যোতি প্রেমবেদনায় কভু না হউক ম্লান-- লইনু বিদায়। তুমি কারে কর না প্রার্থনা, কারো তরে নাহি শোক। ধরাতলে দীনতম ঘরে যদি জন্মে প্রেয়সী আমার, নদীতীরে কোনো-এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে অশ্বত্থছায়ায়, সে বালিকা বক্ষে তার রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভাণ্ডার আমারি লাগিয়া সযতনে। শিশুকালে নদীকূলে শিবমূর্তি গড়িয়া সকালে আমারে মাগিয়া লবে বর। সন্ধ্যা হলে জ্বলন্ত প্রদীপখানি ভাসাইয়া জলে শঙ্কিত কম্পিত বক্ষে চাহি একমনা করিবে সে আপনার সৌভাগ্যগণনা একাকী দাঁড়ায়ে ঘাটে। একদা সুক্ষণে আসিবে আমার ঘরে সন্নত নয়নে চন্দনচর্চিত ভালে রক্তপট্টাম্বরে, উৎসবের বাঁশরীসংগীতে। তার পরে সুদিনে দুর্দিনে, কল্যাণকঙ্কণ করে, সীমন্তসীমায় মঙ্গলসিন্দূরবিন্দু, গৃহলক্ষ্মী দুঃখে সুখে, পূর্ণিমার ইন্দু সংসারের সমুদ্রশিয়রে। দেবগণ, মাঝে মাঝে এই স্বর্গ হইবে স্মরণ দূরস্বপ্নসম, যবে কোনো অর্ধরাতে সহসা হেরিব জাগি নির্মল শয্যাতে পড়েছে চন্দ্রের আলো, নিদ্রিতা প্রেয়সী লুণ্ঠিত শিথিল বাহু, পড়িয়াছে খসি গ্রন্থি শরমের-- মৃদু সোহাগচুম্বনে সচকিতে জাগি উঠি গাঢ় আলিঙ্গনে লতাইবে বক্ষে মোর-- দক্ষিণ অনিল আনিবে ফুলের গন্ধ, জাগ্রত কোকিল গাহিবে সুদূর শাখে।                অয়ি দীনহীনা, অশ্রু-আঁখি দুঃখাতুর জননী মলিনা, অয়ি মর্ত্যভূমি। আজি বহুদিন পরে কাঁদিয়া উঠেছে মোর চিত্ত তোর তরে। যেমনি বিদায়দুঃখে শুষ্ক দুই চোখ অশ্রুতে পুরিল, অমনি এ স্বর্গলোক অলস কল্পনাপ্রায় কোথায় মিলালো ছায়াচ্ছবি। তব নীলাকাশ, তব আলো, তব জনপূর্ণ লোকালয়, সিন্ধুতীরে সুদীর্ঘ বালুকাতট, নীল গিরিশিরে শুভ্র হিমরেখা, তরুশ্রেণীর মাঝারে নিঃশব্দ অরুণোদয়, শূন্য নদীপারে অবনতমুখী সন্ধ্যা-- বিন্দু-অশ্রুজলে যত প্রতিবিম্ব যেন দর্পণের তলে পড়েছে অসিয়া।              হে জননী পুত্রহারা, শেষ বিচ্ছেদের দিনে যে শোকাশ্রুধারা চক্ষু হতে ঝরি পড়ি তব মাতৃস্তন করেছিল অভিষিক্ত, আজি এতক্ষণ সে অশ্রু শুকায়ে গেছে। তবু জানি মনে যখনি ফিরিব পুন তব নিকেতনে তখনি দুখানি বাহু ধরিবে আমায়, বাজিবে মঙ্গলশঙ্খ, স্নেহের ছায়ায় দুঃখে-সুখে-ভয়ে-ভরা প্রেমের সংসারে তব গেহে, তব পুত্রকন্যার মাঝারে আমারে লইবে চিরপরিচিতসম-- তার পরদিন হতে শিয়রেতে মম সারাক্ষণ জাগি রবে কম্পমান প্রাণে, শঙ্কিত অন্তরে, ঊর্ধ্বে দেবতার পানে মেলিয়া করুণ দৃষ্টি, চিন্তিত সদাই যাহারে পেয়েছি তারে কখন হারাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
হে বিশ্বদেব, মোর কাছে তুমি দেখা দিলে আজ কী বেশে। দেখিনু তোমারে পূর্বগগনে, দেখিনু তোমারে স্বদেশে। ললাট তোমার নীল নভতল বিমল আলোকে চির-উজ্জ্বল নীরব আশিস-সম হিমাচল তব বরাভয় কর। সাগর তোমার পরশি চরণ পদধূলি সদা করিছে হরণ, জাহ্নবী তব হার-আভরণ দুলিছে বক্ষ’পর। হৃদয় খুলিয়া চাহিনু বাহিরে, হেরিনু আজিকে নিমেষে– মিলে গেছ ওগো বিশ্বদেবতা, মোর সনাতন স্বদেশে।শুনিনু তোমার স্তবের মন্ত্র অতীতের তপোবনেতে– অমর ঋষির হৃদয় ভেদিয়া ধ্বনিতেছে ত্রিভুবনেতে। প্রভাতে হে দেব,তরুণ তপনে দেখা দাও যবে উদয়গগনে মুখ আপনার ঢাকি আবরণে হিরণ-কিরণে গাঁথা– তখন ভারতে শুনি চারি ভিতে মিলি কাননের বিহঙ্গগীতে প্রাচীন নীরব কণ্ঠ হইতে উঠে গায়ত্রীগাথা। হৃদয় খুলিয়া দাঁড়ানু বাহিরে শুনিনু আজিকে নিমেষে, অতীত হইতে উঠিছে হে দেব, তব গান মোর স্বদেশে।নয়ন মুদিয়া শুনিনু, জানি না কোন্‌ অনাগত বরষে তব মঙ্গলশঙ্খ তুলিয়া বাজায় ভারত হরষে। ডুবায়ে ধরার রণহুংকার ভেদি বণিকের ধনঝংকার মহাকাশতলে উঠে ওঙ্কার কোনো বাধা নাহি মানি। ভারতের শ্বেত হৃদিশতদলে, দাঁড়ায়ে ভারতী তব পদতলে, সংগীততানে শূন্যে উথলে অপূর্ব মহাবাণী। নয়ন মুদিয়া ভাবীকালপানে চাহিনু, শুনিনু নিমেষে তব মঙ্গলবিজয়শঙ্খ বাজিছে আমার স্বদেশে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
১ বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা , বিধির মানস-বালা , মানস-সরসী ওই নাচিছে হরষে । প্রদীপ্ত তুষাররাশি , শুভ্র বিভা পরকাশি , ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে হিমাদ্রি উরসে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
এসো হে এসো, সজল ঘন, বাদলবরিষনে– বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে এ জীবনে। এসো হে গিরিশিখর চুমি, ছায়ায় ঘিরি কাননভূমি– গগন ছেয়ে এসো হে তুমি গভীর গরজনে।ব্যথিয়ে উঠে নীপের বন পুলকভরা ফুলে। উছলি উঠে কলরোদন নদীর কূলে কূলে। এসো হে এসো হৃদয়ভরা, এসো হে এসো পিপাসা-হরা, এসো হে আঁখি-শীতল-করা ঘনায়ে এসো মনে।১৭ ভাদ্র, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
কো তুঁহু বোলবি মোয় ! হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন , আঁখউপর তুঁহু রচলহি আসন , অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম নিমিখ ন অন্তর হোয় । কো তুঁহু বোলবি মোয় ! হৃদয়কমল তব চরণে টলমল , নয়নযুগল মম উছলে ছলছল , প্রেমপূর্ণ তনু পুলকে ঢলঢল চাহে মিলাইতে তোয় । কো তুঁহু বোলবি মোয় ! বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয় গরল রে , হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে , আকুল কাকলি ভুবন ভরল রে , উতল প্রাণ উতরোয় । কো তুঁহু বোলবি মোয় ! হেরি হাসি তব মধুঋতু ধাওল , শুনয়ি বাঁশি তব পিককুল গাওল , বিকল ভ্রমরসম ত্রিভুবন আওল , চরণকমলযুগ ছোঁয় । কো তুহু বোলবি মোয় ! গোপবধূজন বিকশিতযৌবন , পুলকিত যমুনা , মুকুলিত উপবন , নীলনীর'পর ধীর সমীরণ , পলকে প্রাণমন খোয় কো তুঁহু বোলবি মোয় ! তৃষিত আঁখি , তব মুখ'পর বিহরই , মধুর পরশ তব রাধা শিহরই , প্রেমরতন ভরি হৃদয় প্রাণ লই পদতলে অপনা থোয় । কো তুঁহু বোলবি মোয় ! কো তুঁহু কো তুঁহু সব জন পুছয়ি , অনুদিন সঘন নয়নজল মুছয়ি , যাচে ভানু , সব সংশয় ঘুচয়ি , জনম চরণ'পর গোয় । কো তুঁহু বোলবি মোয় !
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
আপন শোভার মূল্য পুষ্প নাহি বোঝে, সহজে পেয়েছে যাহা দেয় তা সহজে।  (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে। হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা— কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
চাই গো আমি তোমারে চাই তোমায় আমি চাই– এই কথাটি সদাই মনে বলতে যেন পাই। আর যা-কিছু বাসনাতে ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো তোমায় আমি চাই।রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে আলোর প্রার্থনাই– তেমনি গভীর মোহের মাঝে তোমায় আমি চাই। শান্তিরে ঝড় যখন হানে শান্তি তবু চায় সে প্রাণে, তেমনি তোমায় আঘাত করি তবু তোমায় চাই।৩ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এ কী অকৃতজ্ঞতার বৈরাগ্য প্রলাপ ক্ষণে ক্ষণে বিকারের রোগীসম অকস্মাৎ ছুটে যেতে চাওয়া আপনার আবেষ্টন হতে। ধন্য এ জীবন মোর— এই বাণী গাব আমি, প্রভাতে প্রথম-জাগা পাখি যে সুরে ঘোষণা করে আপনাতে আনন্দ আপন। দুঃখ দেখা দিয়েছিল, খেলায়েছি দুঃখ-নাগিনীরে ব্যথার বাঁশির সুরে। নানা রন্ধ্রে প্রাণের ফোয়ারা করিয়াছি উৎসারিত অন্তরের নানা বেদনায়। এঁকেছি বুকের রক্তে মানসীর ছবি, বারবার ক্ষণিকের পটে, মুছে গেছে রাত্রির শিশির জলে,মুছে গেছে আপনার আগ্রহ স্পর্শনে,—তবু আজো আছে তারা সূক্ষ্ম রেখা স্বপনের চিত্রশালা জুড়ে, আছে তারা অতীতের শুষ্ক মাল্যগন্ধে বিজড়িত। কালের অঞ্জলি হতে ভ্রষ্ট কত অব্যক্ত মাধুরী রসে পূর্ণ করিয়াছে থরে থরে মনের বাতাস, প্রভাত আকাশ যথা চেনা অচেনার বহু সুরে কূজনে গুঞ্জনে ভরা। অনভিজ্ঞ নব কৈশোরের কম্পমান হাত হতে স্খলিত প্রথম বরমালা কণ্ঠে ওঠে নাই, তাই আজিও অক্লিষ্ট অমলিন আছে তার অস্ফুট কলিকা। সমস্ত জীবন মোর তাই দিয়ে পুষ্প-মুকুটিত। পেয়েছি যা অযাচিত প্রেমের অমৃতরস , পাইনি যা বহু সাধনায় দুই মিশেছিল মোর পীড়িত যৌবনে। কল্পনায় বাস্তবে মিশ্রিত, সত্যে ছলনায়, জয়ে পরাজয়ে বিচিত্রিত নাট্যধারা বেয়ে, আলোকিত রঙ্গমঞ্চে প্রচ্ছন্ন নেপথ্যভূমে, সুগভীর সৃষ্টিরহস্যের যে প্রকাশ পর্বে পর্বে পর্যায়ে পর্যায়ে উদ্বারিতআমার জীবন রচনায়, তাহারে বাহন করি, স্পর্শ করেছিল মোরে কতদিন জাগরণক্ষণে অপরূপ অনিবর্চনীয়। আজি বিদায়ের বেলা স্বীকার করিব তারে, সে আমার বিপুল বিস্ময়। গাব আমি, হে জীবন, অস্তিত্বের সারথী আমার , বহু রণক্ষেত্র তুমি করিয়াছ পার, আজি লয়ে যাও মৃত্যুর সংগ্রামশেষে নবতর বিজয়যাত্রায়।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ট্রাম্‌-কন্‌ডাক্টার, হুইসেলে ফুঁক দিয়ে শহরের বুক দিয়ে বারো-আনা বাকি তার মাথাটার তেলো যে, চিরুনির চালাচালি শেষ হয়ে এল যে। বিধাতার নিজ হাতে ঝাঁট-দেওয়া ফাঁকটার কিছু চুল দুপাশেতে ফুটপাত আছে পেতে, মাঝে বড়ো রাস্তাটা বুক জুড়ে টাকটার।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
সৃষ্টিলীলাপ্রাঙ্গণের প্রান্তে দাঁড়াইয়া দেখি ক্ষণে ক্ষণে তমসের পরপার, যেথা মহা-অব্যক্তের অসীম চৈতন্যে ছিনু লীন। আজি এ প্রভাতকালে ঋষিবাক্য জাগে মোর মনে। করো করো অপাবৃত হে সূর্য,আলোক-আবরণ, তোমার অন্তরতম পরম জ্যোতির মধ্যে দেখি আপনার আত্মার স্বরূপ। যে আমি দিনের শেষে বায়ুতে মিশায় প্রাণবায়ু, ভস্মে যার দেহ অন্ত হবে, যাত্রাপথে সে আপন না ফেলুক ছায়া সত্যের ধরিয়া ছদ্মবেশ। এ মর্তের লীলাক্ষেত্রে সুখে দুঃখে অমৃতের স্বাদ পেয়েছি তো ক্ষণে ক্ষণে, বারে বারে অসীমেরে দেখেছি সীমার অন্তরালে। বুঝিয়াছি,এ জন্মের শেষ অর্থ ছিল সেইখানে, সেই সুন্দরের রূপে, সে সংগীতে অনির্বচনীয়। খেলাঘরে আজ যবে খুলে যাবে দ্বার ধরণীর দেবালয়ে রেখে যাব আমার প্রণাম, দিয়ে যাব জীবনের সে নৈবেদ্যগুলি মূল্য যার মৃত্যুর অতীত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
বিদেশমুখো মন যে আমার কোন্‌ বাউলের চেলা, গ্রাম-ছাড়ানো পথের বাতাস সর্বদা দেয় ঠেলা। তাই তো সেদিন ছুটির দিনে টাইমটেবিল প'ড়ে প্রাণটা উঠল নড়ে। বাক্সো নিলেম ভর্তি করে, নিলেম ঝুলি থলে, বাংলাদেশের বাইরে গেলেম গঙ্গাপারে চ'লে। লোকের মুখে গল্প শুনে গোলাপ-খেতের টানে মনটা গেল এক দৌড়ে গাজিপুরের পানে। সামনে চেয়ে চেয়ে দেখি, গম-জোয়ারির খেতে নবীন অঙ্কুরেতে বাতাস কখন হঠাৎ এসে সোহাগ করে যায় হাত বুলিয়ে কাঁচা শ্যামল কোমল কচি গায়। আটচালা ঘর, ডাহিন দিকে সবজি-বাগানখানা শুশ্রূষা পায় সারা দুপুর, জোড়া-বলদটানা আঁকাবাঁকা কল্‌কলানি করুণ জলের ধারায়-- চাকার শব্দে অলস প্রহর ঘুমের ভারে ভারায়। ইঁদারাটার কাছে বেগনি ফলে তুঁতের শাখা রঙিন হয়ে আছে। অনেক দূরে জলের রেখা চরের কূলে কূলে, ছবির মতো নৌকো চলে পাল-তোলা মাস্তুলে। সাদা ধুলো হাওয়ায় ওড়ে, পথের কিনারায় গ্রামটি দেখা যায়। খোলার চালের কুটীরগুলি লাগাও গায়ে গায়ে মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আমকাঁঠালের ছায়ে। গোরুর গাড়ি পড়ে আছে মহানিমের তলে, ডোবার মধ্যে পাতা-পচা পাঁক-জমানো জলে গম্ভীর ঔদাস্যে অলস আছে মহিষগুলি এ ওর পিঠে আরামে ঘাড় তুলি। বিকেল-বেলায় একটুখানি কাজের অবকাশে খোলা দ্বারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার তরুণ মেয়ে আপন-মনে অকারণে বাহির-পানে চেয়ে অশথতলায় বসে তাকাই ধেনুচারণ মাঠে, আকাশে মন পেতে দিয়ে সমস্ত দিন কাটে। মনে হ'ত, চতুর্দিকে হিন্দি ভাষায় গাঁথা একটা যেন সজীব পুঁথি, উলটিয়ে যাই পাতা-- কিছু বা তার ছবি-আঁকা কিছু বা তার লেখা, কিছু বা তার আগেই যেন ছিল কখন্‌ শেখা। ছন্দে তাহার রস পেয়েছি, আউড়িয়ে যায় মন। সকল কথার অর্থ বোঝার নাইকো প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী-- পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন। সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা। কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না, সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা, বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার, চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার। লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ, তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন। পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা-- অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা। ২৮ চৈত্র, ১৩০২ (চৈতালি)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
আমায় রেখো না ধরে আর, আর হেথা ফুল নাহি ফুটে। হেমন্তের পড়িছে নীহার, আমায় রেখো না ধরে আর। যাই হেথা হতে যাই উঠে, আমার স্বপন গেছে টুটে। কঠিন পাষাণপথে যেতে হবে কোনোমতে পা দিয়েছি যবে। একটি বসন্তরাতে ছিলে তুমি মোর সাথে– পোহালো তো, চলে যাও তবে।Ernest Myers (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়। দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়। সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে, সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা, তরিতে পারি শকতি যেন রয়। আমার ভার লাঘব করি নাই বা দিলে সান্ত্বনা, বহিতে পারি এমনি যেন হয়। নম্রশিরে সুখের দিনে তোমারি মুখ লইব চিনে, দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা তোমারে যেন না করি সংশয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে।ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো রসের ভারে নম্র নত একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত মন পড়িয়া থাক্‌ তব ভবন-দ্বারে।নানা সুরের আকুল ধারা মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত গান সমাপ্ত হোক নীরব পারাবারে।হংস যেমন মানসযাত্রী, তেমনি সারা দিবসরাত্রি একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ-পারে।২৩ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে, ইংলণ্ডে দিকপ্রান্ত পেয়েছিল সেদিন তোমারে আপন বক্ষের কাছে, ভেবেছিল বুঝি তারি তুমি কেবল আপন ধন; উজ্জ্বল ললাট তব চুমি রেখেছিল কিছুকাল অরণ্যশাখার বাহুজালে, ঢেকেছিল কিছুকাল কুয়াশা-অঞ্চল-অন্তরালে বনপুষ্প-বিকশিত তৃণঘন শিশির-উজ্জ্বল পরীদের খেলার প্রাঙ্গণে। দ্বীপের নিকুঞ্জতল তখনো ওঠে নি জেগে কবিসূর্য-বন্দনাসংগীতে। তার পরে ধীরে ধীরে অনন্তের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে দিগন্তের কোল ছাড়ি শতাব্দীর প্রহরে প্রহরে উঠিয়াছ দীপ্তজ্যোতি মাধ্যাহ্নের গগনের 'পরে; নিয়েছ আসন তব সকল দিকের কেন্দ্রদেশে বিশ্বচিত্ত উদ্ভাসিয়া; তাই হেরো যুগান্তর-শেষে ভারতসমুদ্রতীরে কম্পমান শাখাপুঞ্জে আজি নারিকেলকুঞ্জবনে জয়ধ্বনি উঠিতেছে বাজি। শিলাইদহ, ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩২২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
চতুর্দিকে বহ্নিবাষ্প শূন্যাকাশে ধায় বহুদূরে, কেন্দ্রে তার তারাপুঞ্জ মহাকাল-চক্ররথে ঘুরে। কত বেগ, কত তাপ, কত ভার, কত আয়তন, সূক্ষ্ম অঙ্কে করেছে গণন পণ্ডিতেরা লক্ষ কোটি ক্রোশ দূর হতে দুর্লক্ষ্য আলোতে। আপনার পানে চাই, লেশমাত্র পরিচয় নাই। এ কি কোনো দৃশ্যাতীত জ্যোতি। কোন্‌ অজানারে ঘিরি এই অজানার নিত্য গতি। বহুযুগে বহুদূরে স্মৃতি আর বিস্মৃতি-বিস্তার, যেন বাষ্পপরিবেশ তার ইতিহাসে পিণ্ড বাঁধে রূপে রূপান্তরে। "আমি' উঠে ঘনাইয়া কেন্দ্র-মাঝে অসংখ্য বৎসরে। সুখদুঃখ ভালোমন্দ রাগদ্বেষ ভক্তি সখ্য স্নেহ এই নিয়ে গড়া তার সত্তাদেহ; এরা সব উপাদান ধাক্কা পায়, হয় আবর্তিত, পুঞ্জিত, নর্তিত। এরা সত্য কী যে বুঝি নাই নিজে। বলি তারে মায়া-- যাই বলি শব্দ সেটা, অব্যক্ত অর্থের উপচ্ছায়া। তার পরে ভাবি, এ অজ্ঞেয় সৃষ্টি "আমি' অজ্ঞেয় অদৃশ্যে যাবে নাবি। অসীম রহস্য নিয়ে মুহূর্তের নিরর্থকতায় লুপ্ত হবে নানারঙা জলবিম্বপ্রায়, অসমাপ্ত রেখে যাবে তার শেষকথা আত্মার বারতা। তখনো সুদূরে ঐ নক্ষত্রের দূত ছুটাবে অসংখ্য তার দীপ্ত পরমাণুর বিদ্যুৎ অপার আকাশ-মাঝে, কিছুই জানি না কোন্‌ কাজে। বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর, ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
প্রতিকূল বায়ুভরে, ঊর্মিময় সিন্ধু-‘পরে তরীখানি যেতেছিল ধীরি, কম্পমান কেতু তার, চেয়েছিল কতবার সে দ্বীপের পানে ফিরি ফিরি। যারে আহা ভালোবাসি, তারে যবে ছেড়ে আসি যত যাই দূর দেশে চলি, সেইদিক পানে হায়, হৃদয় ফিরিয়া চায় যেখানে এসেছি তারে ফেলি। বিদেশেতে দেখি যদি, উপত্যকা, দ্বীপ, নদী, অতিশয় মনোহর ঠাঁই, সুরভি কুসুমে যার, শোভিত সকল ধার শুধু হৃদয়ের ধন নাই, বড়ো সাধ হয় প্রাণে, থাকিতাম এইখানে, হেথা যদি কাটিত জীবন, রয়েছে যে দূরবাসে, সে যদি থাকিত পাশে কী যে সুখ হইত তখন। পূর্বদিক সন্ধ্যাকালে, গ্রাসে অন্ধকার জালে ভীত পান্থ চায় ফিরে ফিরে, দেখিতে সে শেষজ্যোতি, সুষ্ঠুতর হয়ে অতি এখনো যা জ্বলিতেছে ধীরে, তেমনি সুখের কাল, গ্রাসে গো আঁধার-জাল অদৃষ্টের সায়াহ্নে যখন, ফিরে চাই বারে বারে, শেষবার দেখিবারে সুখের সে মুমূর্ষু কিরণ।Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
যতক্ষণ স্থির হয়ে থাকি ততক্ষণ জমাইয়া রাখি যতকিছু বস্তুভার। ততক্ষণ নয়নে আমার নিদ্রা নাই; ততক্ষণ এ বিশ্বেরে কেটে কেটে খাই কীটের মতন; ততক্ষণ চারি দিকে নেমে নেমে আসে আবরণ; দুঃখের বোঝাই শুধু বেড়ে যায় নূতন নূতন; এ জীবন সতর্ক বুদ্ধির ভারে নিমেষে নিমেষে বৃদ্ধ হয় সংশয়ের শীতে, পক্ককেশে। যখন চলিয়া যাই সে-চলার বেগে বিশ্বের আঘাত লেগে আবরণ আপনি যে ছিন্ন হয়, বেদনার বিচিত্র সঞ্চয় হতে থাকে ক্ষয়। পুণ্য হই সে-চলার স্নানে, চলার অমৃত পানে নবীন যৌবন বিকশিয়া ওঠে প্রতিক্ষণ। ওগো আমি যাত্রী তাই-- চিরদিন সম্মুখের পানে চাই। কেন মিছে আমারে ডাকিস পিছে আমি তো মৃত্যুর গুপ্ত প্রেমে রব না ঘরের কোণে থেমে। আমি চিরযৌবনেরে পরাইব মালা, হাতে মোর তারি তো বরণডালা। ফেলে দিব আর সব ভার, বার্ধক্যের স্তূপাকার আয়োজন। ওরে মন, যাত্রার আনন্দগানে পুর্ণ আজি অনন্ত গগন। তোর রথে গান গায় বিশ্বকবি, গান গায় চন্দ্র তারা রবি। সুরুল, ২৯ পৌষ, ১৩২১-প্রাতঃকাল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
আমরা চলি সমুখপানে, কে আমাদের বাঁধবে। রইল যারা পিছুর টানে কাঁদবে তারা কাঁদবে। ছিঁড়ব বাধা রক্ত-পায়ে, চলব ছুটে রৌদ্রে ছায়ে, জড়িয়ে ওরা আপন গায়ে কেবলি ফাঁদ ফাঁদবে। কাঁদবে ওরা কাঁদবে। রুদ্র মোদের হাঁক দিয়েছে বাজিয়ে আপন তূর্য। মাথার 'পরে ডাক দিয়েছে মধ্যদিনের সূর্য। মন ছড়াল আকাশ ব্যেপে, আলোর নেশায় গেছি খেপে, ওরা আছে দুয়ার ঝেঁপে, চক্ষু ওদের ধাঁধবে। কাঁদবে ওরা কাঁদবে। সাগর-গিরি করব রে জয়, যাব তাদের লঙ্ঘি। একলা পথে করি নে ভয়, সঙ্গে ফেরেন সঙ্গী। আপন ঘোরে আপনি মেতে আছে ওরা গণ্ডী পেতে, ঘর ছেড়ে আঙিনায় যেতে বাধবে ওদের বাধবে। কাঁদবে ওরা কাঁদবে। রামগড়, ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
মধু মাঝির ওই যে নৌকোখানা বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে , কারো কোনো কাজে লাগছে না তো , বোঝাই করা আছে কেবল পাটে । আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি আমি তবে একশোটা দাঁড় আঁটি , পাল তুলে দিই চারটে পাঁচটা ছটা — মিথ্যে ঘুরে বেড়াই নাকো হাটে । আমি কেবল যাই একটিবার সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার । তখন তুমি কেঁদো না মা , যেন বসে বসে একলা ঘরের কোণে — আমি তো মা , যাচ্ছি নেকো চলে রামের মতো চোদ্দ বছর বনে । আমি যাব রাজপুত্রু হয়ে নৌকো - ভরা সোনামানিক বয়ে , আশুকে আর শ্যামকে নেব সাথে , আমরা শুধু যাব মা তিন জনে । আমি কেবল যাব একটিবার সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার । ভোরের বেলা দেব নৌকো ছেড়ে , দেখতে দেখতে কোথায় যাব ভেসে । দুপুরবেলা তুমি পুকুর - ঘাটে , আমরা তখন নতুন রাজার দেশে । পেরিয়ে যাব তির্‌পুর্নির ঘাট , পেরিয়ে যাব তেপান্তরের মাঠ , ফিরে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে , গল্প বলব তোমার কোলে এসে । আমি কেবল যাব একটিবার সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার । (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা। যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে, যে নদী মরুপথে হারালো ধারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে, জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে। আমার অনাগত আমার অনাহত তোমার বীণা-তারে বাজিছে তারা– জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।২৩ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
আমার খোকার কত যে দোষ সে-সব আমি জানি, লোকের কাছে মানি বা নাই মানি। দুষ্টামি তার পারি কিম্বা নারি থামাতে, ভালোমন্দ বোঝাপড়া তাতে আমাতে। বাহির হতে তুমি তারে যেমনি কর দুষী যত তোমার খুশি, সে বিচারে আমার কী বা হয়। খোকা বলেই ভালোবাসি, ভালো বলেই নয়। খোকা আমার কতখানি সে কি তোমরা বোঝ। তোমরা শুধু দোষ গুণ তার খোঁজ। আমি তারে শাসন করি বুকেতে বেঁধে , আমি তারে কাঁদাই যে গো আপনি কেঁদে। বিচার করি, শাসন করি, করি তারে দুষী আমার যাহা খুশি। তোমার শাসন আমরা মানি নে গো। শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে গো। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
বিরহবৎসর-পরে মিলনের বীণা তেমন উন্মাদ-মন্দ্রে কেন বাজিলি না। কেন তোর সপ্তস্বর সপ্তস্বর্গপানে ছুটিয়া গেল না ঊর্ধ্বে উদ্দাম-পরানে বসন্তে-মানস-যাত্রী বলাকার মতো। কেন তোর সর্ব তন্ত্র সবলে প্রহত মিলিত ঝংকার-ভরে কাঁপিয়া কাঁদিয়া আনন্দের আর্তরবে চিত্ত উন্মাদিয়া উঠিল না বাজি। হতাশ্বাস মৃদুস্বরে গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া লাজে শঙ্কাভরে কেন মৌন হল। তবে কি আমারি প্রিয়া সে পরশ-নিপুণতা গিয়াছে ভুলিয়া। তবে কি আমারি বীণা ধূলিচ্ছন্ন-তার সেদিনের মতো ক’রে বাজে নাকো আর।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি , ছুটি নে কাহারো পিছুতে । মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই কিছুতে । নির্ভয়ে ধাই সুযোগ - কুযোগ বিছুরি , খেয়াল - খবর রাখি নে তো কোনো - কিছুরি— উপরে চড়িতে যদি নাই পাই সুবিধা সুখে পড়ে থাকি নিচুতেই , থাকি নিচুতে । হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি ছুটি নে কাহারো পিছুতে— মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই কিছুতে । যেথা - সেথা ধাই , যাহা - তাহা পাই— ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে । তাই ব'লে কিছু কাড়াকাড়ি ক'রে কাড়ি নে । যাহা যেতে চায় ছেড়ে দিই তারে তখুনি , বকি নে কারেও , শুনি নে কাহারো বকুনি— কথা যত আছে মনের তলায় তলিয়ে ভুলেও কখনো সহসা তাদের নাড়ি নে । যেথা - সেথা ধাই , যাহা - তাহা পাই— ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে । তাই ব'লে কিছু তাড়াতাড়ি ক'রে কাড়ি নে । মন - দে'য়া - নে'য়া অনেক করেছি , মরেছি হাজার মরণে— নূপুরের মতো বেজেছি চরণে চরণে । আঘাত করিয়া ফিরেছি দুয়ারে দুয়ারে , সাধিয়া মরেছি ইঁহারে তাঁহারে উঁহারে— অশ্রু গাঁথিয়া রচিয়াছি কত মালিকা , রাঙিয়াছি তাহা হৃদয় - শোণিত— বরনে । মন - দে'য়া - নে'য়া অনেক করেছি , মরেছি হাজার মরণে নূপুরের মতো বেজেছি চরণে চরণে । এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি , মন ফেলে তাই ছুটেছি ; তাড়াতাড়ি ক'রে খেলাঘরে এসে জুটেছি । বুকভাঙা বোঝা নেব না রে আর তুলিয়া , ভুলিবার যাহা একেবারে যাব ভুলিয়া— যাঁর বেড়ি তাঁরে ভাঙা বেড়িগুলি ফিরায়ে বহুদিন পরে মাথা তুলে আজ উঠেছি । এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি , মন ফেলে তাই ছুটেছি । তাড়াতাড়ি ক'রে খেলাঘরে এসে জুটেছি । কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত আগে পড়িত না নয়নে— তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম চয়নে । মধুকরসম ছিনু সঞ্চয়প্রয়াসী ; কুসুমকান্তি দেখি নাই , মধু - পিয়াসী— বকুল কেবল দলিত করেছি আলসে ছিলাম যখন নিলীন বকুল— শয়নে । কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত আগে পড়িত না নয়নে — তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম চয়নে । দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি , মন নাহি মোর কিছুতে ; তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি পিছুতে । সবলে কারেও ধরি নে বাসনা - মুঠিতে , দিয়েছি সবারে আপন বৃন্তে ফুটিতে— যখনি ছেড়েছি উচ্চে উঠার দুরাশা হাতের নাগালে পেয়েছি সবারে নিচুতে । দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি, মন নাহি মোর কিছুতে— তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি পিছুতে ।কাব্যগ্রন্থ - ক্ষণিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ , যবে ভাবিনু মনে , একা একা কোথা চলিতেছিলাম নিষ্কারণে । শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের শিরে , খর বিদ্যুৎ রাতের বক্ষ দিতেছে চিরে , দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব । এমনি রাত্রে কতবার , মোর বাহুতে মাথা , শুনেছিল সে যে কবির ছন্দে কাজরি-গাথা । রিমিঝিমি ঘন বর্ষণে বন রোমাঞ্চিত , দেহে আর মনে এক হয়ে গেছে যে-বাঞ্ছিত এল সেই রাতি বহি শ্রাবণের সে-বৈভব — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব । দূরে চলে যাই নিবিড় রাতের অন্ধকারে , আকাশের সুর বাজিছে শিরায় বৃষ্টিধারে । যূথীবন হতে বাতাসেতে আসে সুধার স্বাদ , বেণীবাঁধনের মালায় পেতেম যে-সংবাদ এই তো জেগেছে নবমালতীর সে সৌরভ — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব । ভাবনার ভুলে কোথা চলে যাই অন্যমনে পথসংকেত কত জানায়েছে যে-বাতায়নে । শুনিতে পেলেম সেতারে বাজিছে সুরের দান অশ্রুজলের আভাসে জড়িত আমারি গান । কবিরে ত্যজিয়া রেখেছ কবির এ গৌরব — মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
একদিন দেখিলাম উলঙ্গ সে ছেলে ধুলি-’পরে বসে আছে পা-দুখানি মেলে। ঘাটে বসি মাটি ঢেলা লইয়া কুড়ায়ে দিদি মাজিতেছে ঘটি ঘুরায়ে ঘুরায়ে। অদূরে কোমললোম ছাগবৎস ধীরে চরিয়া ফিরিতেছিল নদী-তীরে-তীরে। সহসা সে কাছে আসি থাকিয়া থাকিয়া বালকের মুখ চেয়ে উঠিল ডাকিয়া। বালক চমকি কাঁপি কেঁদে ওঠে ত্রাসে, দিদি ঘাটে ঘটি ফেলে ছুটে চলে আসে। এক কক্ষে ভাই লয়ে অন্য কক্ষে ছাগ দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ! পশুশিশু, নরশিশু—দিদি মাঝে প’ড়ে দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয়ডোরে।  (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বীর কহে, হে সংসার, হায় রে পৃথিবী, ভাবিস নে মোরে কিছু ভুলাইয়া নিবি— আমি যাহা দিই তাহা দিই জেনে-শুনে ফাঁকি দিয়ে যা পেতিস তার শতগুণে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
যেথা দূর যৌবনের প্রান্তসীমা সেথা হতে শেষ অরুণিমা শীর্ণপ্রায় আজি দেখা যায়। সেথা হতে ভেসে আসে চৈত্রদিবসে দীর্ঘশ্বাসে অস্ফুট মর্মর কোকিলের ক্লান্ত স্বর, ক্ষীণস্রোত তটিনীর অলস কল্লোল,-- রক্তে লাগে মৃদুমন্দ দোল। এ আবেশ মুক্ত হ'ক; ঘোরভাঙা চোখ শুভ্র সুস্পষ্টের মাঝে জাগিয়া উঠুক রঙকরা দুঃখ সুখ সন্ধ্যার মেঘের মতো যাক সরে আপনারে পরিহাস করে। মুছে যাক সেই ছবি-- চেয়ে থাকা পথপানে, কথা কানে কানে, মৌনমুখে হাতে হাত ধরা, রজনীগন্ধায় সাজি ভরা, চোখে চোখে চাওয়া দুরু দুরু বক্ষ নিয়ে আসা আর যাওয়া। যে-খেলা আপনা সাথে সকালে বিকালে ছায়া-অন্তরালে, সে খেলার ঘর হতে হল আসিবার বেলা বাহির-আলোতে। ভাঙিব মনের বেড়া কুসুমিত কাঁটালতা ঘেরা যেথা স্বপনেরা মধুগন্ধে মরে ঘুরে ঘুরে গুণ গুণ সুরে। নেব আমি বিপুল বৃহৎ আদিম প্রাণের দেশ-- তেপান্তর মাঠের সে-পথ সাত সমুদ্রের তটে তটে যেখানে ঘটনা ঘটে, নাই তার দায়, যেতে যেতে দেখা যায়, শোনা যায়, দিনরাত্রি যায় চলে নানা ছন্দে নানা কলরোলে। থাক্‌ মোর তরে আপক্ক ধানের খেত অঘ্রানের দীপ্ত দ্বিপ্রহরে; সোনার তরঙ্গদোলে মুগ্ধ দৃষ্টি যার 'পরে ভেসে যায় চলে কথাহীন ব্যথাহীন চিন্তাহীন সৃষ্টির সাগরে যেথায় অদৃশ্য সাথি লীলাবরে সারাদিন ভাষায় প্রহর যত খেলার নৌকার মতো। দূরে চেয়ে রব আমি স্থির ধরণীর বিস্তীর্ণ বক্ষের কাছে যেথা শাল গাছে সহস্র বর্ষের প্রাণ সমাহিত রয়েছে নীরবে নিস্তব্ধ গৌরবে। কেটে যাক আপনা-ভোলানো মোহ, কেটে যাক আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রতি বৎসরের আয়ুকর্তব্যের আবর্জনাভার না করুক স্তূপাকার,-- নির্ভাবনা তর্কহীন শাস্ত্রহীন পথ বেয়ে বেয়ে যাই চলে অর্থহীন গান গেয়ে। প্রাণে আর চেতনায় এক হয়ে ক্রমে অনায়াসে মিলে যাব মৃত্যুমহাসাগর-সংগমে, আলো-অঁধধারের দ্বন্দ্ব হয়ে ক্ষীণ গোধূলি নিঃশব্দ রাত্রে যেমন অতলে হয় লীন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
সফলতা লভি যবে মাথা করি নত, জাগে মনে আপনার অক্ষমতা যত।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই - যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই। এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে     যে শতদল পদ্ম রাজে তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই। যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে, অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে। পরশ যাঁরে যায় না করা     সকল দেহে দিলেন ধরা, এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই - যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।২০ শ্রাবণ ১৩১৭ (কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
সতিমির রজনী , সচকিত সজনী, শূন্য নিকুঞ্জঅরণ্য । কলয়িত মলয়ে , সুবিজন নিলয়ে বালা বিরহবিষণ্ন ! নীল আকাশে তারক ভাসে , যমুনা গাওত গান , পাদপ মরমর , নির্ঝর ঝরঝর, কুসুমিত বল্লিবিতান । তৃষিত নয়ানে বনপথপানে নিরখে ব্যাকুল বালা , দেখ না পাওয়ে , আঁখ ফিরাওয়ে, গাঁথে বনফুলমালা । সহসা রাধা চাহল সচকিত, দূরে খেপল মালা , কহল - সজনি শুন , বাঁশরি বাজে, কুঞ্জে আওল কালা । চকিত গহন নিশি , দূর দূর দিশি বাজত বাঁশি সুতানে । কন্ঠ মিলাওল ঢলঢল যমুনা কল কল কল্লোলগানে । ভণে ভানু , অব শুন গো কানু পিয়াসিত গোপিনী প্রাণ । তোঁহার পীরিত বিমল অমৃতরস হরষে করবে পান ।(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া, বাতাসেতে দেবদারু উঠছে শ্বসিয়া। দিবসের পরে বসি রাত্রি মুদে আঁখি, নীড়েতে বসিয়া যেন পাহাড়ের পাখি। শ্রান্ত পদে ভ্রমি আমি নগরে নগরে বিজন অরণ্য দিয়া পর্বতে সাগরে। উড়িয়া গিয়াছে সেই পাখিটি আমার, খুঁজিয়া বেড়াই তারে সকল সংসার। দিন রাত্রি চলিয়াছি, শুধু চলিয়াছি — ভুলে যেতে ভুলিয়া গিয়াছি।আমি যত চলিতেছি রৌদ্র বৃষ্টি বায়ে হৃদয় আমার তত পড়িছে পিছায়ে। হৃদয় রে, ছাড়াছাড়ি হল তোর সাথে — এক ভাব রহিল না তোমাতে আমাতে। নীড় বেঁধেছিনু যেথা যা রে সেইখানে, একবার ডাক্ গিয়ে আকুল পরানে। কে জানে, হতেও পারে, সে নীড়ের কাছে হয়তো পাখিটি মোর লুকাইয়ে আছে। কেঁদে কেঁদে বৃষ্টিজলে আমি ভ্রমিতেছি — ভুলে যেতে ভুলিয়ে গিয়েছি।দেশের সবাই জানে কাহিনী আমার। বলে তারা, ‘এত প্রেম আছে বা কাহার!' পাখি সে পলায়ে গেছে কথাটি না ব'লে, এমন তো সব পাখি উড়ে যায় চলে। চিরদিন তারা কভু থাকে না সমান এমন তো কত শত রয়েছে প্রমাণ। ডাকে আর গায় আর উড়ে যায় পরে, এ ছাড়া বলো তো তারা আর কী বা করে? পাখি গেল যার, তার এক দুঃখ আছে — ভুলে যেতে ভুলে সে গিয়াছে!সারা দিন দেখি আমি উড়িতেছে কাক, সারা রাত শুনি আমি পেচকের ডাক। চন্দ্র উঠে অস্ত যায় পশ্চিমসাগরে, পূরবে তপন উঠে জলদের স্তরে। পাতা ঝরে, শুভ্র রেণু উড়ে চারি ধার — বসন্তমুকুল এ কি? অথবা তুষার? হৃদয়, বিদায় লই এবে তোর কাছে — বিলম্ব হইয়া গেল, সময় কি আছে? শান্ত হ'রে, একদিন সুখী হবি তবু — মরণ সে ভুলে যেতে ভোলে না তো কভু!  (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা, আমি চাহি বন্ধুজন যারা তাহাদের হাতের পরশে মর্তের অন্তিম প্রীতিরসে নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ, নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ। শূন্য ঝুলি আজিকে আমার; দিয়েছি উজাড় করি যাহা কিছু আছিল দিবার, প্রতিদানে যদি কিছু পাই— কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা— তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই পারের খেয়ায় যাব যবে ভাষাহীন শেষের উৎসবে ।  (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি–অন্তরে নিয়েছি আমি তুলিএই মহামন্ত্রখানি,চরিতার্থ জীবনের বাণী।দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা-কিছু উপহারমধুরসে ক্ষয় নাই তার।তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে–সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দ বিরাজে।শেষ স্পর্শ নিয়ে যাব যবে ধরণীরব’লে যাব তোমার ধূলিরতিলক পরেছি ভালে,দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে।সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মুরতি,এই জেনে এ ধুলায় রাখিনু প্রণতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্‌, সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা। এখন আমি তোমার ঘরে বসে করব শুধু পড়া-পড়া খেলা। তুমি বলছ দুপুর এখন সবে, নাহয় যেন সত্যি হল তাই, একদিনও কি দুপুরবেলা হলে বিকেল হল মনে করতে নাই? আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে সুয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে, বাগ্‌দি-বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে শাক তুলেছে পুকুর-ধারে এসে। আঁধার হল মাদার-গাছের তলা, কালি হয়ে এল দিঘির জল, হাটের থেকে সবাই এল ফিরে, মাঠের থেকে এল চাষির দল। মনে কর্‌-না উঠল সাঁঝের তারা, মনে কর্‌-না সন্ধে হল যেন। রাতের বেলা দুপুর যদি হয় দুপুর বেলা রাত হবে না কেন।(শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আজি হেরিতেছি আমি, হে হিমাদ্রি, গভীর নির্জনে পাঠকের মতো তুমি বসে আছ অচল আসনে, সনাতন পুঁথিখানি তুলিয়া লয়েছ অঙ্ক’পরে। পাষাণের পত্রগুলি খুলিয়া গিয়াছে থরে থরে, পড়িতেছ একমনে। ভাঙিল গড়িল কত দেশ, গেল এল কত যুগ– পড়া তব হইল না শেষ। আলোকের দৃষ্টিপথে এই-যে সহস্র খোলা পাতা ইহাতে কি লেখা আছে ভব-ভবানীর প্রেম-গাথা– নিরাসক্ত নিরাকাঙক্ষ ধ্যানাতীত মহাযোগীশ্বর কেমনে দিলেন ধরা সুকোমল দুর্বল সুন্দর বাহুর করুণ আকর্ষণে – কিছু নাহি চাহি যাঁর তিনি কেন চাহিলেন– ভালোবাসিলেন নির্বিকার– পরিলেন পরিণয়পাশ। এই-যে প্রেমের লীলা ইহারই কাহিনী বহে হে শৈল, তোমার যত শিলা।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
যখন কুসুমবনে ফির একাকিনী , ধরায় লুটায়ে পড়ে পূর্ণিমাযামিনী , দক্ষিণবাতাসে আর তটিনীর গানে শোন যবে আপনার প্রাণের কাহিনী — যখন শিউলি ফুলে কোলখানি ভরি দুটি পা ছড়ায়ে দিয়ে আনতবয়ানে ফুলের মতন দুটি অঙ্গুলিতে ধরি মালা গাঁথ ভোরবেলা গুন্ গুন্ তানে — মধ্যাহ্নে একেলা যবে বাতয়নে ব ‘ সে নয়নে মিলাতে চায় সুদূর আকাশ , কখন আঁচলখানি প ‘ ড়ে যায় খ ‘ সে , কখন হৃদয় হতে উঠে দীর্ঘশ্বাস , কখন অশ্রুটি কাঁপে নয়নের পাতে — তখন আমি কি , সখী , থাকি তব সাথে !  (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বাতাসে তাহার প্রথম পাপড়ি খসায়ে ফেলিল যেই, অমনি জানিয়ো, শাখায় গোলাপ থেকেও আর সে নেই।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
অনেকদিনের এই ডেস্কো — আনমনা কলমের কালিপড়া ফ্রেস্কো দিয়েছে বিস্তর দাগ ভুতূড়ে রেখার । যমজ সোদর ওরা যে সব লেখার — ছাপার লাইনে পেল ভদ্রবেশে ঠাঁই , তাদের স্মরণে এরা নাই । অক্সফোর্ড ডিক্সনারি , পদকল্পতরু , ইংরেজ মেয়ের লেখা ‘ সাহারার মরু ' ভ্রমণের বই , ছবি আঁকা , এগুলোর একপাশে চা রয়েছে ঢাকা পেয়ালায় মডার্‌ন্‌ রিভিয়ুতে চাপা । পড়ে আছে সদ্যছাপা প্রুফগুলো কুঁড়েমির উপেক্ষায় । বেলা যায় , ঘড়িতে বেজেছে সাড়ে পাঁচ , বৈকালী ছায়ার নাচ মেঝেতে হয়েছে শুরু , বাতাসে পর্দায় লেগে দোলা । খাতাখানি আছে খোলা । — আধঘণ্টা ভেবে মরি , প্যান্থীজ্‌ম্‌ শব্দটাকে বাংলায় কী করি ।           পোষা বেজি হেনকালে দ্রুতগতি এখানে সেখানে টেবিল চৌকির নীচে ঘুরে গেল কিসের সন্ধানে — দুই চক্ষু ঔৎসুক্যের দীপ্তিজ ্ব লা , তাড়াতাড়ি দেখে গেল আলমারির তলা দামি দ্রব্য যদি কিছু থাকে ; ঘ্রাণ কিছু মিলিল না তীক্ষ্ণ নাকে ঈপ্সিত বস্তুর । ঘুরে ফিরে অবজ্ঞায় গেল চলে , এ ঘরে সকলি ব্যর্থ আরসুলার খোঁজ নেই ব ' লে ।                            আমার কঠিন চিন্তা এই , প্যান্থীজ্‌ম্‌ শব্দটার বাংলা বুঝি নেই ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
আমি আজ কানাই মাস্টার, পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি। আমি ওকে মারি নে মা, বেত, মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি। রোজ রোজ দেরি করে আসে, পড়াতে দেয় না ও তো মন, ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই যত আমি বলি ‘শোন্‌ শোন্‌'। দিনরাত খেলা খেলা খেলা, লেখায় পড়ায় ভারি হেলা। আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ', ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ'। প্রথম   ভাগের পাতা খুলে আমি ওরে বোঝাই মা, কত— চুরি করে খাস নে কখনো, ভালো হোস গোপালের মতো। যত বলি সব হয় মিছে, কথা যদি একটিও শোনে— মাছ যদি দেখেছে কোথাও কিছুই থাকে না আর মনে। চড়াই পাখির দেখা পেলে ছুটে যায় সব পড়া ফেলে। যত বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ', দুষ্টুমি করে বলে ‘মিয়োঁ'। আমি ওরে বলি বার বার, ‘পড়ার সময় তুমি পোড়ো— তার পরে ছুটি হয়ে গেলে খেলার সময় খেলা কোরো। ' ভালোমানুষের মতো থাকে, আড়ে আড়ে চায় মুখপানে, এম্‌নি সে ভান করে যেন যা বলি বুঝেছে তার মানে। একটু সুযোগ বোঝে যেই কোথা যায় আর দেখা নেই। আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ', ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ'। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে প্রেমিক যেমন চায় কাতর নয়ানে তেমনি যে তোমা-পানে নাহি চায় গ্রীস্‌ তাহার হৃদয় মন পাষাণ কুলিশ ইংরাজেরা ভাঙিয়াছে প্রাচীর তোমার দেবতাপ্রতিমা লয়ে গেছে [সিন্ধুপার] এ দেখে কার না হবে হবে ॥। ধূমকেতু সম তারা কী কুক্ষণে হায় ছাড়িয়া সে ক্ষুদ্র দ্বীপ আইল হেথায় অসহায় বক্ষ তব রক্তময় করি দেবতা প্রতিমাগুলি লয়ে গেল হরি।George Gordon Byron (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
কবি হয়ে দোল-উৎসবে কোন্‌ লাজে কালো সাজে আসি, এ নিয়ে রসিকা তোরা সবে করেছিলি খুব হাসাহাসি। চৈত্রের দোল-প্রাঙ্গণে আমার জবাবদিহি চাই এ দাবি তোদের ছিল মনে, কাজ ফেলে আসিয়াছি তাই। দোলের দিনে, সে কী মনের ভুলে, পরেছিলাম যখন কালো কাপড়, দখিন হাওয়া দুয়ারখানা খুলে হঠাৎ পিঠে দিল হাসির চাপড়। সকল বেলা বেড়াই খুঁজি খুঁজি কোথা সে মোর গেল রঙের ডালা, কালো এসে আজ লাগালো বুঝি শেষ প্রহরে রঙহরণের পালা। ওরে কবি, ভয় কিছু নেই তোর-- কালো রঙ যে সকল রঙের চোর। জানি যে ওর বক্ষে রাখে তুলি হারিয়ে-যাওয়া পূর্ণিমা ফাল্গুনী-- অস্তরবির রঙের কালো ঝুলি, রসের শাস্ত্রে এই কথা কয় শুনি। অন্ধকারে অজানা-সন্ধানে অচিন লোকে সীমাবিহীন রাতে রঙের তৃষা বহন করি প্রাণে চলব যখন তারার ইশারাতে, হয়তো তখন শেষ-বয়সের কালো করবে বাহির আপন গ্রন্থি খুলি যৌবনদীপ--জাগাবে তার আলো ঘুমভাঙা সব রাঙা প্রহরগুলি। কালো তখন রঙের দীপালিতে সুর লাগাবে বিস্মৃত সংগীতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ধীরে সন্ধ্যা আসে, একে একে গ্রন্থি যত যায় স্খলি প্রহরের কর্মজাল হতে। দিন দিল জলাঞ্জলি খুলি পশ্চিমের সিংহদ্বার সোনার ঐশ্বর্য তার অন্ধকার আলোকের সাগরসংগমে। দূর প্রভাতের পানে নত হয়ে নিঃশব্দে প্রণমে। চক্ষু তার মুদে আসে,এসেছে সময় গভীর ধানের তলে আপনার বাহ্য পরিচয় করিতে মগন। নক্ষত্রের শান্তিক্ষেত্র অসীম গগন যেথা ঢেকে রেখে দেয় দিনশ্রীর অরূপ সত্তারে, সেথায় করিতে লাভ সত্য আপনারে খেয়া দেয় রাত্রি পারাবারে।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
তোমরা রচিলে যারে নানা অলংকারে তারে তো চিনি নে আমি, চেনেন না মোর অন্তর্যামী তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর নামের প্রতিমা। বিধাতার সৃষ্টিসীমা তোমাদের দৃষ্টির বাহিরে। কালসমুদ্রের তীরে বিরলে রচেন মূর্তিখানি বিচিত্রিত রহস্যের যবনিকা টানি রূপকার আপন নিভৃতে। বাহির হইতে মিলায়ে আলোক অন্ধকার কেহ এক দেখে তারে, কেহ দেখে আর। খণ্ড খণ্ড রূপ আর ছায়া, আর কল্পনার মায়া, আর মাঝে মাঝে শূন্য, এই নিয়ে পরিচয় গাঁথে অপরিচয়ের ভূমিকাতে। সংসারখেলার কক্ষে তাঁর যে-খেলেনা রচিলেন মূর্তিকার মোরে লয়ে মাটিতে আলোতে, সাদায় কালোতে, কে না জানে সে ক্ষণভঙ্গুর কালের চাকার নিচে নিঃশেষে ভাঙিয়া হবে চুর। সে বহিয়া এনেছে যে-দান সে করে ক্ষণেকতরে অমরের ভান-- সহসা মুহূর্তে দেয় ফাঁকি, মুঠি-কয় ধূলি রয় বাকি, আর থাকে কালরাত্রি সব-চিহ্ন-ধুয়ে-মুছে-ফেলা। তোমাদের জনতার খেলা রচিল যে পুতুলিরে সে কি লুব্ধ বিরাট ধূলিরে এড়ায়ে আলোতে নিত্য রবে। এ কথা কল্পনা কর যবে তখন আমার আপন গোপন রূপকার হাসেন কি আঁখিকোণে, সে কথাই ভাবি আজ মনে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বিরাট সৃষ্টির ক্ষেত্রে আতশবাজির খেলা আকাশে আকাশে, সূর্য তারা ল’য়ে যুগযুগান্তের পরিমাপে। অনাদি অদৃশ্য হতে আমিও এসেছি ক্ষুদ্র অগ্নিকণা নিয়ে এক প্রান্তে ক্ষুদ্র দেশে কালে। প্রস্থানের অঙ্কে আজ এসেছি যেমনি দীপশিখা ম্লান হয়ে এল, ছায়াতে পড়িল ধরা এ খেলার মায়ার স্বরূপ, শ্লথ হয়ে এল ধীরে সুখ দুঃখ নাট্যসজ্জাগুলি। দেখিলাম, যুগে যুগে নটনটী বহু শত শত ফেলে গেছে নানারঙা বেশ তাহাদের রঙ্গশালা-দ্বারের বাহিরে। দেখিলাম চাহি শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্যপ্রাঙ্গণে নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।(উদয়ন, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ – বিকাল)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
আজি       শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায় ! ওই        শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগবিহগী কী যে গায় ! আজি       মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে , রহে না আবাসে মন হায় ! কোন্     কুসুমের আশে , কোন্ ফুলবাসে সুনীল আকাশে মন ধায় ! আজি       কে যেন গো নাই , এ প্রভাতে তাই জীবন বিফল হয় গো ! তাই       চারি দিকে চায় , মন কেঁদে গায় — ‘ এ নহে , এ নহে , নয় গো ! ' কোন্     স্বপনের দেশে আছে এলোকেশে কোন্ ছায়াময়ী অমরায় ! আজি       কোন্ উপবনে বিরহবেদনে আমারি কারণে কেঁদে যায় ! আমি       যদি গাঁথি গান অথির - পরান সে গান শুনাব কারে আর ! আমি       যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা কাহারে পরাব ফুলহার ! আমি       আমার এ প্রাণ যদি করি দান দিব প্রাণ তবে কার পায় ! সদা       ভয় হয় মনে পাছে অযতনে মনে মনে কেহ ব্যথা পায় ! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বদেশমূলক
কিনু গোয়ালার গলি। দোতলা বাড়ির লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর পথের ধারেই। লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি, মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ। মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি সিদ্ধিদাতা গণেশের দরজার 'পরে আঁটা। আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব এক ভাড়াতেই, সেটা টিকটিকি। তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু, নেই তার অন্নের অভাব॥         বেতন পঁচিশ টাকা, সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি। খেতে পাই দত্তদের বাড়ি ছেলেকে পড়িয়ে। শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই, সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি, আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে। এঞ্জিনের ধস্ ধস্, বাঁশির আওয়াজ, যাত্রীর ব্যস্ততা, কুলি-হাঁকাহাঁকি। সাড়ে-দশ বেজে যায়, তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥  ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম--- তাঁর দেওরের মেয়ে, অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক। লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল--- সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে। মেয়েটা তো রক্ষে পেলে, আমি তথৈবচ। ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া--- পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥                          বর্ষা ঘনঘোর। ট্রামের খরচা বাড়ে, মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়। গলিটার কোণে কোণে জমে ওঠে, পচে ওঠে আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি, মাছের কান্‌কা, মরা বেড়ালের ছানা--- ছাইপাঁশ আরো কত কী যে। ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া মাইনের মতো, বহু ছিদ্র তার। আপিসের সাজ গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন, সর্বদাই রসসিক্ত থাকে। বাদলের কালো ছায়া স্যাঁত্‍‌সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে কলে পড়া জন্তুর মতন মূর্ছায় অসাড়! দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।               গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু--- যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল, বড়ো বড়ো চোখ, শৌখিন মেজাজ। কর্নেট বাজানো তার শখ। মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে এ গলির বীভত্‍‌স বাতাসে--- কখনো গভীর রাতে, ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে, কখনো বৈকালে ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়। হঠাত্‍‌ সন্ধ্যায় সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান, সমস্ত আকাশে বাজে অনাদি কালের বিরহবেদনা। তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে এ গলিটা ঘোর মিছে দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো। হঠাত্‍‌ খবর পাই মনে, আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই। বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে॥         এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধুলিলগ্নে সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী, তীরে তমালের ঘন ছায়া--- আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥২৫ আষাঢ় ১৩৩৯ সূত্রঃ পরিশেষ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এ প্রাণ, রাতের রেলগাড়ি, দিল পাড়ি-- কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম। অসীম আঁধারে কালি-লেপা কিছুনয় মনে হয় যারে নিদ্রার পারে রয়েছে সে পরিচয়হারা দেশে। ক্ষণ-আলো ইঙ্গিতে উঠে ঝলি, পার হয়ে যায় চলি অজানার পরে অজানায়, অদৃশ্য ঠিকানায়। অতিদূর-তীর্থের যাত্রী, ভাষাহীন রাত্রি, দূরের কোথা যে শেষ ভাবিয়া না পাই উদ্দেশ। চালায় যে নাম নাহি কয়; কেউ বলে, যন্ত্র সে, আর কিছু নয়। মনোহীন বলে তারে, তবু অন্ধের হাতে প্রাণমন সঁপি দিয়া বিছানা সে পাতে। বলে, সে অনিশ্চিত, তবু জানে অতি নিশ্চিত তার গতি। নামহীন যে অচেনা বার বার পার হয়ে যায় অগোচরে যারা সবে রয়েছে সেথায়, তারি যেন বহে নিশ্বাস, সন্দেহ-আড়ালেতে মুখ-ঢাকা জাগে বিশ্বাস। গাড়ি চলে, নিমেষ বিরাম নাই আকাশের তলে। ঘুমের ভিতরে থাকে অচেতনে কোন্‌ দূর প্রভাতের প্রত্যাশা নিদ্রিত মনে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
হে বিরাট নদী, অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল অবিচ্ছিন্ন অবিরল চলে নিরবধি। স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে; বস্তুহীন প্রবাহের প্রচণ্ড আঘাত লেগে পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে; ক্রন্দসী কাঁদিয়া ওঠে বহ্নিভরা মেঘে। আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে ধাবমান অন্ধকার হতে; ঘুর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে স্তরে স্তরে সুর্যচন্দ্রতারা যত বুদ্‌বুদের মতো। হে ভৈরবী, ওগো বৈরাগিণী, চলেছ যে নিরুদ্দেশ সেই চলা তোমার রাগিণী, শব্দহীন সুর। অন্তহীন দূর তোমারে কি নিরন্তর দেয় সাড়া। সর্বনাশা প্রেমে তার নিত্য তাই তুমি ঘরছাড়া। উন্মত্ত সে-অভিসারে তব বক্ষোহারে ঘন ঘন লাগে দোলা--ছড়ায় অমনি নক্ষত্রের  মণি; আঁধারিয়া ওড়ে শূন্যে ঝোড়ো এলোচুল; দুলে উঠে বিদ্যুতের দুল; অঞ্চল আকুল গড়ায় কম্পিত তৃণে, চঞ্চল পল্লবপুঞ্জে বিপিনে বিপিনে; বারম্বার ঝরে ঝরে পড়ে ফুল জুঁই চাঁপা বকুল পারুল পথে পথে তোমার ঋতুর থালি হতে। শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও উদ্দাম উধাও; ফিরে নাহি চাও, যা কিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও। কুড়ায়ে লও না কিছু, কর না সঞ্চয়; নাই শোক, নাই ভয়, পথের আনন্দবেগে অবাধে পাথেয় করো ক্ষয়। যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্তে কিছু তব নাই, তুমি তাই পবিত্র সদাই। তোমার চরণস্পর্শে বিশ্বধূলি মলিনতা যায় ভুলি পলকে পলকে-- মৃত্যু ওঠে প্রাণ হয়ে ঝলকে ঝলকে। যদি তুমি মুহূর্তের তরে ক্লান্তিভরে দাঁড়াও থমকি, তখনি চমকি উচ্ছ্রিয়া উঠিবে বিশ্ব পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুর পর্বতে; পঙ্গু মুক কবন্ধ বধির আঁধা স্থুলতনু ভয়ংকরী বাধা সবারে ঠেকায়ে দিয়ে দাঁড়াইবে পথে; অণুতম পরমাণু আপনার ভারে সঞ্চয়ের অচল বিকারে বিদ্ধ হবে আকাশের মর্মমূলে কলুষের বেদনার শূলে। ওগো নটী, চঞ্চল অপ্সরী, অলক্ষ্য সুন্দরী তব নৃত্যমন্দাকিনী নিত্য ঝরি ঝরি তুলিতেছে শুচি করি মৃত্যস্নানে বিশ্বের জীবন। নিঃশেষে নির্মল নীলে বিকাশিছে নিখিল গগন। ওরে কবি, তোরে আজ করেছে উতলা ঝংকারমুখরা এই ভুবনমেখলা, অলক্ষিত চরণের অকারণ অবারণ চলা। নাড়ীতে নাড়ীতে তোর চঞ্চলের শুনি পদধ্বনি, বক্ষ তোর উঠে রনরনি। নাহি জানে কেউ রক্তে তোর নাচে আজি সমুদ্রের ঢেউ, কাঁপে আজি অরণ্যের ব্যাকুলতা; মনে আজি পড়ে সেই কথা-- যুগে যুগে এসেছি চলিয়া, স্খলিয়া স্খলিয়া চুপে চুপে রূপ হতে রূপে প্রাণ হতে প্রাণে। নিশীথে প্রভাতে যা কিছু পেয়েছি হাতে এসেছি করিয়া ক্ষয় দান হতে দানে, গান হতে গানে। ওরে দেখ্‌ সেই স্রোত হয়েছে মুখর, তরণী কাঁপিছে থরথর। তীরের সঞ্চয় তোর পড়ে থাক্‌ তীরে, তাকাস নে ফিরে। সম্মুখের বাণী নিক তোরে টানি মহাস্রোতে পশ্চাতের কোলাহল হতে অতল আঁধারে -- অকূল আলোতে। এলাহাবাদ, ৩ পৌষ, ১৩২১-রাত্রি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তোমার দয়া যদি চাহিতে নাও জানি তবুও দয়া করে চরণে নিয়ো টানি। আমি যা গড়ে তুলে আরামে থাকি ভুলে সুখের উপাসনা করি গো ফলে ফুলে– সে ধুলা-খেলাঘরে রেখো না ঘৃণাভরে, জাগায়ো দয়া করে বহ্নি-শেল হানি।সত্য মুদে আছে দ্বিধার মাঝখানে, তাহারে তুমি ছাড়া ফুটাতে কে বা জানে। মৃত্যু ভেদ করি’ অমৃত পড়ে ঝরি’, অতল দীনতার শূন্য উঠে ভরি’ পতন-ব্যথা মাঝে চেতনা আসি বাজে, বিরোধ কোলাহলে গভীর তব বাণী।২২ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
সিংহলে সেই দেখেছিলেম ক্যান্ডিদলের নাচ; শিকড়গুলোর শিকড় ছিঁড়ে যেন শালের গাছ পেরিয়ে এল মুক্তিমাতাল খ্যাপা, হুংকার তার ছুটল আকাশ-ব্যাপা। ডালপালা সব দুড়্‌দাড়িয়ে ঘূর্ণি হাওয়ায় কহে-- নহে, নহে, নহে-- নহে বাধা, নহে বাঁধন, নহে পিছন-ফেরা, নহে আবেগ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, নহে মৃদু লতার দোলা, নহে পাতার কাঁপন-- আগুন হয়ে জ্বলে ওঠা এ যে তপের তাপন। ওদের ডেকে বলেছিল সমুদ্দরের ঢেউ, "আমার ছন্দ রক্তে আছে এমন আছে কেউ।' ঝঞ্ঝা ওদের বলেছিল, "মঞ্জীর তোর আছে ঝংকারে যার লাগাবে লয় আমার প্রলয়নাচে।' ঐ যে পাগল দেহখানা, শূন্যে ওঠে বাহু, যেন কোথায় হাঁ করেছে রাহু-- লুব্ধ তাহার ক্ষুধার থেকে চাঁদকে করবে ত্রাণ, পূর্ণিমাকে ফিরিয়ে দেবে প্রাণ। মহাদেবের তপোভঙ্গে যেন বিষম বেগে নন্দী উঠল জেগে; শিবের ক্রোধের সঙ্গে উঠল জ্বলে দুর্দাম তার প্রতি অঙ্গে অঙ্গে নাচের বহ্নিশিখা নিদয়া নির্ভীকা। খুঁজতে ছোটে মোহমদের বাহন কোথায় আছে দাহন করবে এই নিদারুণ আনন্দময় নাচে। নটরাজ যে পুরুষ তিনি, তাণ্ডবে তাঁর সাধন, আপন শক্তি মুক্ত ক'রে ছেঁড়েন আপন বাঁধন; দুঃখবেগে জাগিয়ে তোলেন সকল ভয়ের ভয়; জয়ের নৃত্যে আপনাকে তাঁর জয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এসেছিল বহু আগে যারা মোর দ্বারে, যারা চলে গেছে একেবারে, ফাগুন-মধ্যাহ্নবেলা শিরীষছায়ায় চুপে চুপে তারা ছায়ারূপে আসে যায় হিল্লোলিত শ্যাম দুর্বাদলে। ঘন কালো দিঘিজলে পিছনে-ফিরিয়া-চাওয়া আঁখি জ্বলো জ্বলো করে ছলোছলো। মরণের অমরতালোকে ধূসর আঁচল মেলি ফিরে তারা গেরুয়া আলোকে।যে এখনো আসে নাই মোর পথে, কখনো যে আসিবে না আমার জগতে, তার ছবি আঁকিয়াছি মনে-- একেলা সে বাতায়নে বিদেশিনী জন্মকাল হতে। সে যেন শেঁউলি ভাসে ক্ষীণ মৃদু স্রোতে, কোথায় তাহার দেশ নাই সে উদ্দেশ।         চেয়ে আছে দূর-পানে কার লাগি আপনি সে নাহি জানে। সেই দূরে ছায়ারূপে রয়েছে সে বিশ্বের সকল-শেষে যে আসিতে পারিত তবুও এল না কভুও। জীবনের মরীচিকাদেশে মরুকন্যাটির আঁখি ফিরে ভেসে ভেসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে, ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
মৃত্যুদূত এসেছিল হে প্রলয়ংকর, অকস্মাৎ তব সভা হতে। নিয়ে গেল বিরাট প্রাঙ্গণে তব; চক্ষে দেখিলাম অন্ধকার; দেখিনি অদৃশ্য আলো আঁধারের স্তরে স্তরে অন্তরে অন্তরে, যে আলোক নিখিল জ্যোতির জ্যোতি; দৃষ্টি মোর ছিল আচ্ছাদিয়া আমার আপন ছায়া। সেই আলোকের সামগান মন্দ্রিয়া উঠিবে মোর সত্তার গভীর গুহা হতে সৃষ্টির সীমান্ত জ্যোতির্লোকে, তারি লাগি ছিল মোর আমন্ত্রণ। লব আমি চরমের কবিত্বমর্যাদা জীবনের রঙ্গভূমে, এরি লাগি সেধেছিনু তান।বাজিল না রুদ্রবীণা নিঃশব্দ ভৈরব নবরাগে, জাগিল না মর্মতলে ভীষণের প্রসন্ন মুরতি তাই ফিরাইয়া দিলে। আসিবে আরেক দিন যবে তখন কবির বাণী পরিপক্ব ফলের মতন নিঃশব্দে পড়িবে খসি’ আনন্দের পূর্ণতার ভারে অনন্তের অর্ঘ্যডালি পরে। চরিতার্থ হবে শেষে জীবনের শেষমূল্য, শেষযাত্রা, শেষনিমন্ত্রণ।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে সত্য হবে– ওগো সত্য,আমার এমন সুদিন ঘটবে কবে। সত্য সত্য সত্য জপি, সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি, সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব নিখিল ভবে, সত্য, তোমার পূর্ণ প্রকাশ দেখব কবে।তোমায় দূরে সরিয়ে, মরি আপন অসত্যে। কী যে কাণ্ড করি গো সেই ভূতের রাজত্বে। আমার আমি ধুয়ে মুছে তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে, সত্য, তোমায় সত্য হব বাঁচব তবে, তোমার মধ্যে মরণ আমার মরবে কবে।১৫ শ্রাবণ, ১৩১৭
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
যে-মাসেতে আপিসেতে হল তার নাম ছাঁটা স্ত্রীর শাড়ি নিজে পরে, স্ত্রী পরিল গামছাটা। বলে, “আমি বৈরাগী, ছেড়ে দেব শিগ্‌গির, ঘরে মোর যত আছে বিলাস-সামিগ্‌গির।’ ছিল তার টিনে-গড়া চা-খাওয়ার চাম্‌চাটা, কেউ তা কেনে না সেটা যত করে দাম-ছাঁটা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
কুজ্‌ঝটিজাল যেই সরে গেল মংপু-র নীল শৈলের গায়ে দেখা দিল রঙপুর। বহুকেলে জাদুকর, খেলা বহুদিন তার, আর কোনো দায় নেই, লেশ নেই চিন্তার। দূর বৎসর-পানে ধ্যানে চাই যদ্‌দূর দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রোদ্‌দুর। কত রাজা এল গেল, ম'ল এরই মধ্যে, লড়েছিল বীর, কবি লিখেছিল পদ্যে। কত মাথা-কাটাকাটি সভ্যে অসভ্যে, কত মাথা-ফাটাফাটি সনাতনে নব্যে। ঐ গাছ চিরদিন যেন শিশু মস্ত, সূর্য-উদয় দেখে, দেখে তার অস্ত। ঐ ঢালু গিরিমালা, রুক্ষ ও বন্ধ্যা, দিন গেলে ওরই 'পরে জপ করে সন্ধ্যা। নিচে রেখা দেখা যায় ঐ নদী তিস্তার, কঠোরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার। হেনকালে একদিন বৈশাখী গ্রীষ্মে টানাপাখা-চলা সেই সেকালের বিশ্বে রবিঠাকুরের দেখা সেইদিন মাত্তর, আজি তো বয়স তার কেবল আটাত্তর-- সাতের পিঠের কাছে একফোঁটা শূন্য-- শত শত বরষের ওদের তারুণ্য। ছোটো আয়ু মানুষের, তবু একি কাণ্ড, এটুকু সীমায় গড়া মনোব্রহ্মাণ্ড-- কত সুখে দুখে গাঁথা, ইষ্টে অনিষ্টে, সুন্দর কুৎসিতে, তিক্তে ও মিষ্টে, কত গৃহ-উৎসবে, কত সভাসজ্জায়, কত রসে মজ্জিত অস্থি ও মজ্জায়, ভাষার-নাগাল-ছাড়া কত উপলব্ধি, ধেয়ানের মন্দিরে আছে তার স্তব্ধি। অবশেষে একদিন বন্ধন খণ্ডি অজানা অদৃষ্টের অদৃশ্য গণ্ডি অন্তিম নিমেষেই হবে উত্তীর্ণ। তখনি অকস্মাৎ হবে কি বিদীর্ণ এত রেখা এত রঙে গড়া এই সৃষ্টি, এত মধু-অঞ্জনে রঞ্জিত দৃষ্টি। বিধাতা আপন ক্ষতি করে যদি ধার্য নিজেরই তবিল-ভাঙা হয় তার কার্য, নিমেষেই নিঃশেষ করি ভরা পাত্র বেদনা না যদি তার লাগে কিছুমাত্র, আমারই কী লোকসান যদি হই শূন্য-- শেষক্ষয় হলে কারে কে করিবে ক্ষুণ্ন। এ জীবনে পাওয়াটারই সীমাহীন মূল্য, মরণে হারানোটা তো নহে তার তুল্য। রবিঠাকুরের পালা শেষ হবে সদ্য, তখনো তো হেথা এক অখণ্ড অদ্য জাগ্রত রবে চির-দিবসের জন্যে এই গিরিতটে, এই নীলিম অরণ্যে। তখনো চলিবে খেলা নাই যার যুক্তি-- বার বার ঢাকা দেওয়া, বার বার মুক্তি। তখনো এ বিধাতার সুন্দর ভ্রান্তি-- উদাসীন এ আকাশে এ মোহন কান্তি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস , বহিয়া আনিতেছিল ফুলের সুবাস । রাত্রি হ ' ল , আঁধারের ঘনীভূত ছায়ে পাখিগুলি একে একে পড়িল ঘুমায়ে । প্রফুল্ল বসন্ত ছিল ঘেরি চারি ধার আছিল প্রফুল্লতর যৌবন তোমার , তারকা হাসিতেছিল আকাশের মেয়ে , ও আঁখি হাসিতেছিল তাহাদের চেয়ে । দুজনে কহিতেছিনু কথা কানে কানে , হৃদয় গাহিতেছিল মিষ্টতম তানে । রজনী দেখিনু অতি পবিত্র বিমল , ও মুখ দেখিনু অতি সুন্দর উজ্জ্বল । সোনার তারকাদের ডেকে ধীরে ধীরে , কহিনু , “ সমস্ত স্বর্গ ঢালো এর শিরে! ” বলিনু আঁখিরে তব “ ওগো আঁখি-তারা , ঢালো গো আমার ' পরে প্রণয়ের ধারা । ”                     — Victor Hugo (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
পসারিনী, ওগো পসারিনী, কেটেছে সকালবেলা হাটে হাটে লয়ে বিকিকিনি। ঘরে ফিরিবার খনে কী জানি কী হল মনে, বসিলি গাছের ছায়াতলে-- লাভের জমানো কড়ি ডালায় রহিল পড়ি, ভাবনা কোথায় ধেয়ে চলে।      এই মাঠ, এই রাঙা ধূলি, অঘ্রানের-রৌদ্র-লাগা চিক্কণ কাঁঠালপাতাগুলি শীতবাতাসের শ্বাসে এই শিহরন ঘাসে-- কী কথা কহিল তোর কানে। বহুদূর নদীজলে আলোকের রেখা ঝলে, ধ্যানে তোর কোন্‌ মন্ত্র আনে।      সৃষ্টির প্রথম স্মৃতি হতে সহসা আদিম স্পন্দ সঞ্চরিল তোর রক্তস্রোতে। তাই এ তরুতে তৃণে প্রাণ আপনারে চিনে হেমন্তের মধ্যাহ্নের বেলা-- মৃত্তিকার খেলাঘরে কত যুগযুগান্তরে হিরণে হরিতে তোর খেলা।      নিরালা মাঠের মাঝে বসি সাম্প্রতের আবরণ মন হতে গেল দ্রুত খসি। আলোকে আকাশে মিলে যে-নটন এ নিখিলে দেখ তাই আঁখির সম্মুখে, বিরাট কালের মাঝে যে ওঙ্কারধ্বনি বাজে গুঞ্জরি উঠিল তোর বুকে।      যত ছিল ত্বরিত আহ্বান পরিচিত সংসারের দিগন্তে হয়েছে অবসান। বেলা কত হল, তার বার্তা নাহি চারিধার, না কোথাও কর্মের আভাস। শব্দহীনতার স্বরে খররৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করে, শূন্যতার উঠে দীর্ঘশ্বাস।      পসারিনী, ওগো পসারিনী, ক্ষণকাল-তরে আজি ভুলে গেলি যত বিকিকিনি। কোথা হাট, কোথা ঘাট, কোথা ঘর, কোথা বাট, মুখর দিনের কলকথা-- অনন্তের বাণী আনে সর্বাঙ্গে সকল প্রাণে বৈরাগ্যের স্তব্ধ ব্যাকুলতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
তুমি মোরে পার না বুঝিতে? প্রশান্তবিষাদভরে                  দুটি আঁখি প্রশ্ন করে অর্থ মোর চাহিছে খুঁজিতে, চন্দ্রমা যেমন-ভাবে স্থিরনতমুখে চেয়ে দেখে সমুদ্রের বুকে।।               কিছু আমি করি নি গোপন। যাহা আছে সব আছে               তোমার আঁখির কাছে প্রসারিত অবারিত মন। দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা, তাই মোরে বুঝিতে পার না?               এ যদি হইত শুধু মণি, শত খন্ড করি তারে            সযত্নে বিবিধাকারে একটি একটি করি গণি একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার পরাতেম গলায় তোমার।।              এ যদি হইত শুধু ফুল, সুগোল সুন্র ছোট,           উষালোকে ফোটো-ফোটো, বসন্তের পবনে দোদুল- বৃন্দ হতে সযত্নে আনিতাম তুলে, পরায়ে দিতাম কালো চুলে।।             এ যে সখী ,সমস্ত হৃদয়। কোথা জল কোথা কূল,        দিক হয়ে যায় ভুল, অন্তহীন রহস্যনিলয়। এ রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জান রানী, এ তবু তোমার রাজধানী।।                কী তোমারে চাহি বুঝাইতে? গভীর হৃদয়-মাঝে             নাহি জানি কী যে বাজে নিশিদিন নীরব সংগীতে, শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন রজনীর ধ্বনির মতন।। এ যে সুখ হইত শুধু সুখ, কেবল একটি হাসি               অধরের প্রান্তে আসি আনন্দ করিত জাগরূক। মুহূর্তে বুঝিয়া নিতে হৃদয়বারতা, বলিতে হতো না কোনো কথা।।                এ যদি হইত শুধু দুখ দুটি বিন্দু অশ্রুজল           দুই চক্ষে ছলছল, বিষন্ন অধর , স্নায়ুমুখ- প্রত্যেক্ষ দেখিতে পেতে অন্তরের ব্যথা, নীরবে প্রকাশ হত কথা।। এ যে সখী,হৃদয়ের প্রেম- সুখদুখবেদনার          আদি অন্ত নাহি যার, চিরদৈন্য,চিরপূর্ণ হেম। নব নব ব্যাকুলতা জাগে   নূতন - নূতনালোকে পাঠ করো রাত্রিদিন ধরে। বুঝা যায় আধো প্রেম,আধখানা মন- সমস্ত কে বুঝেছে কখন।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
খোঁপা আর এলোচুলে বিবাদ হামাশা, পাড়ার লোকেরা জোটে দেখিতে তামাশা। খোঁপা কয় এলোচুল, কী তোমার ছিরি! এলো কয়, খোঁপা তুমি রাখো বাবুগিরি। খোঁপা কহে, টাক ধরে হই তবে খুশি। তুমি যেন কাটা পড়ো, এলো কয় রুষি। কবি মাঝে পড়ি বলে, মনে ভেবে দেখ্‌ দুজনেই এক তোরা, দুজনেই এক। খোঁপা গেলে চুল যায়, চুলে যদি টাক— খোঁপা, তবে কোথা রবে তব জয়ঢাক।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
একদা রাতে নবীন যৌবনে স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া, বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার--- ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া । শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা, পূর্বতটে হতেছে নিশিভোর । আকাশকোণে বিকাশে জাগরণ, ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর । সমুখে প'ড়ে দীর্ঘ রাজপথ, দু ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার, নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে আপন-মনে ভাবিনু একবার--- অরুণ-রাঙা আজি এ নিশিশেষে ধরার মাঝে নূতন কোন্ দেশে দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা ।।অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু, কত যে দেশ বিদেশ হনু পার ! একদা এক ধূসরসন্ধ্যায় ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার । সবাই সেথা অচল অচেতন, কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী, নদীর তীরে জলের কলতানে ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি । ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি, নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে । প্রাসাদ মাঝে পশিনু সাবধানে, শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে । ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা, কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা । একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা, ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা ।। কমলফুল বিমল শেজখানি, নিলীন তাহে কোমল তনুলতা । মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে, বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা । মেঘের মত গুচ্ছ কেশরাশি শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে । একটি বাহু বক্ষ-'পরে পড়ি, একটি বাহু লুটায় এক ধারে । আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে, কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি--- পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি । দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি--- ঘুমের দেশে স্বপন একখানি, পালঙ্কেতে মগন রাজবালা আপন ভরা লাবণ্যে নিরালা ।।ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু, না মানে বাধা হৃদয়কম্পন । ভূতলে বসি আনত করি শির মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন । পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি, তাহারি পানে চাহিনু একমনে--- দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে । ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়ে লিখিয়া দিনু আপন নামধাম । লিখিনু, 'অয়ি নিদ্রানিমগনা, আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম ।' যতন করে কনক-সুতে গাঁথি রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি--- ঘুমের দেশে ঘুমায়ে রাজবালা, তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা ।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
স্বপ্নে দেখি নৌকো আমার নদীর ঘাটে বাঁধা; নদী কিম্বা আকাশ সেটা লাগল মনে ধাঁধাঁ। এমন সময় হঠাৎ দেখি, দিক্‌সীমানায় গেছে ঠেকি একটুখানি ভেসে-ওঠা ত্রয়োদশীর চাঁদা। “নৌকোতে তোর পার করে দে’ এই ব’লে তার কাঁদা। আমি বলি, “ভাবনা কী তায়, আকাশপারে নেব মিতায়– কিন্তু আমি ঘুমিয়ে আছি এই যে বিষম বাধা, দেখছ আমার চতুর্দিকটা স্বপ্নজালে ফাঁদা।’   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
যেদিন চৈতন্য মোর মুক্তি পেল লুপ্তিগুহা হতে নিয়ে এল দুঃসহ বিস্ময়ঝড়ে দারুণ দুর্যোগে কোন্‌ নরকাগ্নিগিরিগহ্বরের তটে; তপ্তধূমে গর্জি উঠি ফুঁসিছে সে মানুষের তীব্র অপমান, অমঙ্গলধ্বনি তার কম্পান্বিত করে ধরাতল, কালিমা মাখায় বায়ুস্তরে। দেখিলাম একালের আত্মঘাতী মূঢ় উন্মত্ততা, দেখিনু সর্বাঙ্গে তার বিকৃতির কদর্য বিদ্রূপ। একদিকে স্পর্ধিত ক্রূরতা, মত্ততার নির্লজ্জ হুংকার, অন্যদিকে ভীরুতার দ্বিধাগ্রস্ত চরণ-বিক্ষেপ, বক্ষে আলিঙ্গিয়া ধরি কৃপণের সতর্ক সম্বল; সন্ত্রস্ত প্রাণীর মতো ক্ষণিক গর্জন অন্তে ক্ষীণস্বরে তখনি জানায় নিরাপদ নীরব নম্রতা। রাষ্ট্রপতি যত আছেপ্রৌঢ় প্রতাপের, মন্ত্রসভাতলে আদেশ নির্দেশ রেখেছে নিষ্পিষ্ট করি রুদ্ধ ওষ্ঠ অধরের চাপে সংশয়ে সংকোচে। এদিকে দানব-পক্ষী ক্ষুব্ধশূন্যে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বৈতরণী নদী পার হতে যন্ত্রপক্ষ হুংকারিয়া নরমাংসক্ষুধিত শকুনি, আকাশেরে করিল অশুচি। মহাকাল-সিংহাসনে সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে, কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী কুৎসিত বিভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন নিত্যকাল র’বে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধকণ্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে।   (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
হে প্রিয়, দুঃখের বেশে অাস যবে মনে তোমারে আনন্দ ব'লে চিনি সেই ক্ষণে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
নহে নহে এ মনে মরণ। সহসা এ প্রাণপূর্ণ নিশ্বাসবাতাস নীরবে করে যে পলায়ন, আলোতে ফুটায় আলো এই আঁখিতারা নিবে যায় একদা নিশীথে, বহে না রুধিরনদী, সুকোমল তনু ধূলায় মিলায় ধরণীতে, ভাবনা মিলায় শূন্যে, মৃত্তিকার তলে রুদ্ধ হয় অময় হৃদয়– এই মৃত্যু? এ তো মৃত্যু নয়। কিন্তু রে পবিত্র শোক যায় না যে দিন পিরিতির স্মিরিতিমন্দিরে, উপেক্ষিত অতীতের সমাধির ‘পরে তৃণরাজি দোলে ধীরে ধীরে, মরণ-অতীত চির-নূতন পরান স্মরণে করে না বিচরণ– সেই বটে সেই তো মরণ!Hood (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো , সখা , তাই ‘আমি বড়ো’ ‘আমি বড়ো’ করিছে সবাই । সকলেই উঁচু হয়ে দাঁড়ায়ে সমুখে বলিতেছে , ‘ এ জগতে আর কিছু নাই । ‘ নাথ , তুমি একবার এসো হাসিমুখে এরা সবে ম্লান হয়ে লুকাক লজ্জায় — সুখদুঃখ টুটে যাক তব মহাসুখে , যাক আলো-অন্ধকার তোমার প্রভায় । নহিলে ডুবেছি আমি , মরেছি হেথায় , নহিলে ঘুচে না আর মর্মের ক্রন্দন — শুষ্ক ধূলি তুলি শুধু সুধাপিপাসায় , প্রেম ব’লে পরিয়াছি মরণবন্ধন । কভু পড়ি কভু উঠি , হাসি আর কাঁদি — খেলাঘর ভেঙে প’ড়ে রচিবে সমাধি ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব, কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব। ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি— যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
নাম তার চিনুলাল হরিরাম মোতিভয়, কিছুতে ঠকায় কেউ এই তার অতি ভয়। সাতানব্বই থেকে তেরোদিন ব’কে ব’কে বারোতে নামিয়ে এনে তবু ভাবে, গেল ঠকে। মনে মনে আঁক কষে, পদে পদে ক্ষতি-ভয়। কষ্টে কেরানি তার টিঁকে আছে কতিপয়।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
পরম সুন্দর আলোকের স্নানপুণ্য প্রাতে। অসীম অরূপ রূপে রূপে স্পর্শমণি রসমূর্তি করিছে রচনা, প্রতিদিন চিরনূতনের অভিষেক চিরপুরাতন বেদীতলে। মিলিয়া শ্যামলে নীলিমায় ধরণীর উত্তরীয় বুনে চলে ছায়াতে আলোতে। আকাশের হৃৎস্পন্দন পল্লবে পল্লবে দেয় দোলা। প্রভাতের কন্ঠ হতে মণিহার করে ঝিলিমিলি বন হতে বনে। পাখিদের অকারণ গান সাধুবাদ দিতে থাকে জীবনলক্ষ্মীরে। সবকিছু সাথে মিশে মানুষের প্রীতির পরশ অমৃতের অর্থ দেয় তারে, মধুময় করে দেয় ধরণীর ধূলি, সর্বত্র বিছায়ে দেয় চিরমানবের সিংহাসন।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ওই-যে তোমার মানস-প্রজাপতি ঘরছাড়া সব ভাবনা যত, অলস দিনে কোথা ওদের গতি। দখিন হাওয়ার সাড়া পেয়ে চঞ্চলতার পতঙ্গদল ভিতর থেকে বাইরে আসে ধেয়ে। চেলাঞ্চলে উতল হল তারা, চক্ষে মেলে চপল পাখা আকাশে পথহারা। বকুলশাখায় পাখির হঠাৎ ডাকে চমকে-যাওয়া চরণ ঘিরে ঘুরে বেড়ায় শাড়ির ঘূর্ণিপাকে। কাটায় ব্যর্থ বেলা অঙ্গে অঙ্গে অস্থিরতার চকিত এই খেলা।       মনে তোমার ফুল-ফোটানো মায়া অস্ফুট কোন্‌ পূর্বরাগের রক্তরঙিন ছায়া। ঘিরল তারা তোমায় চারি পাশে ইঙ্গিতে আভাসে ক্ষণে ক্ষণে চমকে ঝলকে। তোমার অলকে দোলা দিয়ে বিনা ভাষায় আলাপ করে কানে কানে, নাই কোনো যার মানে। মরীচিকার ফুলের সাথে মরীচিকার প্রজাপতির মিলন ঘটে ফাল্গুনপ্রভাতে। আজি তোমার যৌবনেরে ঘেরি যুগলছায়ার স্বপনখেলা তোমার মধ্যে হেরি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
পূরবীপাতায় পাতায় দুলিছে শিশির গাহিছে বিহগগণ, ফুলবন হতে সুরভি হরিয়া বহিতেছে সমীরণ সাঁঝের আকাশ মাঝারে এখনো মৃদুল কিরণ জ্বলে। নলিনীর সাথে বসিয়া তখন কত-না হরষে কাটাইনু ক্ষণ, কে জানিত তবে বালিকা নিদয় রেখেছিল ঢাকি কপট-হৃদয় সরল হাসির তলে! এই তো সেথায় ভ্রমি, গো, যেথায় থাকিত সে মোর কাছে, প্রকৃতি জানে না পরিবরতন সকলি তেমনি আছে! তেমনি গোলাপ রূপ-হাসি-ময় জ্বলিছে শিশির-ভরে, যে হাসি-কিরণে আছিল প্রকৃতি দ্বিগুণ দ্বিগুণ মধুর আকৃতি, সে হাসি নাইকো আর!Irish Song (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
কালো অন্ধকারের তলায় পাখির শেষ গান গিয়েছে ডুবে। বাতাস থমথমে, গাছের পাতা নড়ে না, স্বচ্ছরাত্রের তারাগুলি যেন নেমে আসছে পুরাতন মহানিম গাছের ঝিল্লি-ঝংকৃত স্তব্ধ রহস্যের কাছাকাছি। এমন সময়ে হঠাৎ আবেগে আমার হাত ধরলে চেপে; বললে, "তোমাকে ভুলব না কোনোদিনই।" দীপহীন বাতায়নে আমার মূর্তি ছিল অস্পষ্ট, সেই ছায়ার আবরণে তোমার অন্তরতম আবেদনের সংকোচ গিয়েছিল কেটে। সেই মুহূর্তে তোমার প্রেমের অমরাবতী ব্যাপ্ত হল অনন্ত স্মৃতির ভূমিকায়। সেই মুহূর্তের আনন্দবেদনা বেজে উঠল কালের বীণায়, প্রসারিত হল আগামী জন্মজন্মান্তরে। সেই মুহূর্তে আমার আমি তোমার নিবিড় অনুভবের মধ্যে পেল নিঃসীমতা। তোমার কম্পিত কণ্ঠের বাণীটুকুতে সার্থক হয়েছে আমার প্রাণের সাধনা, সে পেয়েছে অমৃত। তোমার সংসারে অসংখ্য যা-কিছু আছে তার সবচেয়ে অত্যন্ত ক'রে আছি আমি, অত্যন্ত বেঁচে। এই নিমেষটুকুর বাইরে আর যা-কিছু সে গৌণ। এর বাইরে আছে মরণ, একদিন রূপের আলো-জ্বালা রঙ্গমঞ্চ থেকে সরে যাব নেপথ্যে। প্রত্যক্ষ সুখদুঃখের জগতে মূর্তিমান অসংখ্যতার কাছে আমার স্মরণচ্ছায়া মানবে পরাভব। তোমার দ্বারের কাছে আছে যে কৃষ্ণচূড়া যার তলায় দুবেলা জল দাও আপন হাতে, সেও প্রধান হয়ে উঠে' তার ডালপালার বাইরে সরিয়ে রাখবে আমাকে বিশ্বের বিরাট অগোচরে। তা হোক, এও গৌণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
ওগো মৌন, না যদি কও না-ই কহিলে কথা। বক্ষ ভরি বইব আমি তোমার নীরবতা। স্তব্ধ হয়ে রইব পড়ে, রজনী রয় যেমন করে জ্বালিয়ে তারা নিমেষহারা ধৈর্যে অবনতা।হবে হবে প্রভাত হবে আঁধার যাবে কেটে। তোমার বাণী সোনার ধারা পড়বে আকাশ ফেটে। তখন আমার পাখির বাসায় জাগবে কি গান তোমার ভাষায়। তোমার তানে ফোটাবে ফুল আমার বনলতা?তিনধরিয়া, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি যাব   অকারণে ভেসে কেবল ভেসে, ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী কোথায়     যেতেছি কোন্‌ দেশে সে কোন্‌ দেশে। কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে শোনাব গান একলা তোমার কানে, ঢেউয়ের মতন ভাষা-বাঁধন-হারা আমার সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে।আজো সময়  হয় নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি। ওগো  ওই-যে সন্ধ্যা নামে সাগরতীরে। মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধুপারের পাখি আপন      কুলায়-মাঝে সবাই এল ফিরে। কখন তুমি আসবে ঘাটের ‘পরে বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে। অস্তরবির শেষ আলোটির মতো তরী    নিশীথমাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।বোলপুর, ৩০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
ডাকো ডাকো ডাকো আমারে, তোমার স্নিগ্ধ শীতল গভীর পবিত্র আঁধারে। তুচ্ছ দিনের ক্লান্তি গ্লানি দিতেছে জীবন ধুলাতে টানি, সারাক্ষণের বাক্যমনের সহস্র বিকারে।মুক্ত করো হে মুক্ত করো আমারে, তোমার নিবিড় নীরব উদার অনন্ত আঁধারে। নীরব রাত্রে হারাইয়া বাক্‌ বাহির আমার বাহিরে মিশাক, দেখা দিক মম অন্তরতম অখণ্ড আকারে।৭ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
জননী, তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে। জননী, তোমার মরণহরণ বাণী নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে। তোমারে নমি হে সকল ভুবন-মাঝে, তোমারে নমি হে সকল জীবন-কাজে; তনু মন ধন করি নিবেদন আজি ভক্তিপাবন তোমার পূজার ধূপে। জননী, তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে।১৩১৫ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
স্বপ্ন কহে, আমি মুক্ত, নিয়মের পিছে নাহি চলি। সত্য কহে, তাই তুমি মিছে। স্বপ্ন কয়, তুমি বদ্ধ অনন্ত শৃঙ্খলে। সত্য কয়, তাই মোরে সত্য সবে বলে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
দুখের দশা শ্রাবণরাতি— বাদল না পায় মানা, চলেছে একটানা। সুখের দশা যেন সে বিদ্যুৎ ক্ষণহাসির দূত।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
একদিন কোন্‌ তুচ্ছ আলাপের ছিন্ন অবকাশে সে কোন্‌ অভাবনীয় স্মিতহাসে অন্যমনা আত্মভোলা যৌবনেরে দিয়ে ঘন দোলা মুখে তব অকস্মাৎ প্রকাশিল কী অমৃত-রেখা কভু যার পাই নাই দেখা, দুর্লভ সে প্রিয় অনির্বচনীয়। হে মহা অপরিচিত এক পলকের লাগি হয় সচকিত গভীর অন্তরতর প্রাণে কোন্‌ দূরে বনান্তের পথিকের গানে; সে অপূর্ব আসে ঘরে পথহারা মুহূর্তের তরে। বৃষ্টিধারামুখরিত নির্জন প্রবাসে সন্ধ্যাবেলা যূথিকার সকরুণ স্নিগ্ধ গন্ধশ্বাসে, চিত্তে রেখে দিয়ে গেল চিরস্পর্শ স্বীয় তাহারি স্খলিত উত্তরীয়। সে বিস্মিত ক্ষণিকেরে পড়ে মনে কোনোদিন অকারণে ক্ষণে ক্ষণে শীতের মধ্যাহ্নকালে গোরুচরা শস্যরিক্ত মাঠে চেয়ে চেয়ে বেলা যবে কাটে। সঙ্গহারা সায়াহ্নের অন্ধকারে সে স্মৃতির ছবি সূর্যাস্তের পার হতে বাজায় পূরবী। পেয়েছি যে-সব ধন যার মূল্য আছে ফেলে যাই পাছে সেই যার মূল্য নাই, জানিবে না কেও সঙ্গে থাকে অখ্যাত পাথেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
ইতিহাসবিশারদ গণেশ ধুরন্ধর ইজারা নিয়েছে একা বম্বাই বন্দর। নিয়ে সাতজন জেলে দেখে মাপকাঠি ফেলে– সাগরমথনে কোথা উঠেছিল চন্দর, কোথা ডুব দিয়ে আছে ডানাকাটা মন্দর।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
বসন্ত বালক মুখ-ভরা হাসিটি, বাতাস ব'য়ে ওড়ে চুল— শীত চলে যায়, মারে তার গায় মোটা মোটা গোটা ফুল। আঁচল ভরে গেছে শত ফুলের মেলা, গোলাপ ছুঁড়ে মারে টগর চাঁপা বেলা— শীত বলে, ‘ভাই, এ কেমন খেলা, যাবার বেলা হল, আসি। ' বসন্ত হাসিয়ে বসন ধ'রে টানে, পাগল করে দেয় কুহু কুহু গানে, ফুলের গন্ধ নিয়ে প্রাণের ‘পরে হানে— হাসির ‘পরে হানে হাসি। ওড়ে ফুলের রেণু, ফুলের পরিমল, ফুলের পাপড়ি উড়ে করে যে বিকল— কুসুমিত শাখা, বনপথ ঢাকা, ফুলের ‘পরে পড়ে ফুল। দক্ষিনে বাতাসে ওড়ে শীতের বেশ, উড়ে উড়ে পড়ে শীতের শুভ্র কেশ; কোন্‌ পথে যাবে না পায় উদ্দেশ, হয়ে যায় দিক ভুল। বসন্ত বালক হেসেই কুটিকুটি, টলমল করে রাঙা চরণ দুটি, গান গেয়ে পিছে ধায় ছুটিছুটি— বনে লুটোপুটি যায়। নদী তালি দেয় শত হাত তুলি, বলাবলি করে ডালপালাগুলি, লতায় লতায় হেসে কোলাকুলি— অঙ্গুলি তুলি চায়। রঙ্গ দেখে হাসে মল্লিকা মালতী, আশেপাশে হাসে কতই জাতী যূথী, মুখে বসন দিয়ে হাসে লজ্জাবতী— বনফুলবধূগুলি। কত পাখি ডাকে কত পাখি গায়, কিচিমিচিকিচি কত উড়ে যায়, এ পাশে ও পাশে মাথাটি হেলায়— নাচে পুচ্ছখানি তুলি। শীত চলে যায়, ফিরে ফিরে চায়, মনে মনে ভাবে ‘এ কেমন বিদায়'— হাসির জ্বালায় কাঁদিয়ে পালায়, ফুলঘায় হার মানে। শুকনো পাতা তার সঙ্গে উড়ে যায়, উত্তরে বাতাস করে হায়-হায়— আপাদমস্তক ঢেকে কুয়াশায় শীত গেল কোন্‌খানে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
যা রাখি আমার তরে মিছে তারে রাখি, আমিও রব না যবে সেও হবে ফাঁকি। যা রাখি সবার তরে সেই শুধু রবে— মোর সাথে ডোবে না সে, রাখে তারে সবে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
কেমনে কী হল পারি নে বলিতে, এইটুকু শুধু জানি– নবীন কিরণে ভাসিছে সে দিন প্রভাতের তনুখানি। বসন্ত তখনো কিশোর কুমার, কুঁড়ি উঠে নাই ফুটি, শাখায় শাখায় বিহগ বিহগী বসে আছে দুটি দুটি। কী যে হয়ে গেল পারি নে বলিতে, এইটুকু শুধু জানি– বসন্তও গেল, তাও চলে গেল একটি না কয়ে বাণী। যা-কিছু মধুর সব ফুরাইল, সেও হল অবসান– আমারেই শুধু ফেলে রেখে গেল সুখহীন ম্রিয়মাণ।Christina Rossetti (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
তুমি একটি ফুলের মতো মণি এম্‌নি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর! মুখের পানে তাকাই যখনি ব্যথায় কেন কাঁদায় অন্তর! শিরে তোমার হস্ত দুটি রাখি পড়ি এই আশীষ মন্তর, বিধি তোরে রাখুন চিরকাল এমনি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর!Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
পলাশ আনন্দমূর্তি জীবনের ফাগুনদিনের, আজ এই সম্মানহীনের দরিদ্র বেলায় দিলে দেখা যেথা আমি সাথিহীন একা উৎসবের প্রাঙ্গণ-বাহিরে শস্যহীন মরুময় তীরে। যেখানে এ ধরণীর প্রফুল্ল প্রাণের কুঞ্জ হতে অনাদৃত দিন মোর নিরুদ্দেশ স্রোতে ছিন্নবৃন্ত চলিয়াছে ভেসে বসন্তের শেষে। তবুও তো কৃপণতা নাই তব দানে, যৌবনের পূর্ণ মূল্য দিলে মোর দীপ্তিহীন প্রাণে, অদৃষ্টের অবজ্ঞারে কর নি স্বীকার — ঘুচাইলে অবসাদ তার; জানাইলে চিত্তে মোর লভি অনুক্ষণ সুন্দরের অভ্যর্থনা, নবীনের আসে নিমন্ত্রণ।   (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
একি আকুলতা ভুবনে! একি চঞ্চলতা পবনে॥ একি মধুরমদির রসরাশি আজি শূন্যতলে চলে ভাসি, ঝরে চন্দ্রকরে একি হাসি, ফুল- গন্ধ লুটে গগনে॥ একি প্রাণভরা অনুরাগে আজি বিশ্বজগতজন জাগে, আজি নিখিল নীলগগনে সুখ- পরশ কোথা হতে লাগে। সুখে শিহরে সকল বনরাজি, উঠে মোহনবাঁশরি বাজি, হেরো পূর্ণবিকশিত আজি মম অন্তর সুন্দর স্বপনে॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আজি এ আঁখির শেষদৃষ্টির দিনে ফাগুনবেলার ফুলের খেলার দানগুলি লব চিনে। দেখা দিয়েছিল মুখর প্রহরে দিনের দুয়ার খুলি, তাদের আভায় আজি মিলে যায় রাঙা গোধূলির শেষতুলিকায় ক্ষণিকের রূপ-রচনলীলায় সন্ধ্যার রঙগুলি। যে অতিথিদেহে ভোরবেলাকার রূপ নিল ভৈরবী, অস্তরবির দেহলিদুয়ারে বাঁশিতে আজিকে আঁকিল উহারে মুলতানরাগে সুরের প্রতিমা গেরুয়া রঙের ছবি। খনে খনে যত মর্মভেদিনী বেদনা পেয়েছে মন নিয়ে সে দুঃখ ধীর আনন্দে বিষাদকরুণ শিল্পছন্দে অগোচর কবি করেছে রচনা মাধুরী চিরন্তন। একদা জীবনে সুখের শিহর নিখিল করেছে প্রিয়। মরণপরশে আজি কুণ্ঠিত অন্তরালে সে অবগুণ্ঠিত, অদেখা আলোকে তাকে দেখা যায় কী অনির্বচনীয়। যা গিয়েছে তার অধরারূপের অলখ পরশখানি যা রয়েছে তারি তারে বাঁধে সুর, দিক্‌সীমানার পারের সুদূর কালের অতীত ভাষার অতীত শুনায় দৈববাণী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
জীবনযাত্রার পথে ক্লান্তি ভুলি, তরুণ পথিক, চলো নির্ভীক। আপন অন্তরে তব আপন যাত্রার দীপালোক অনির্বাণ হোক।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
ফসল কাটা হলে সারা মাঠ হয়ে যায় ফাঁক; অনাদরের শস্য গজায়, তুচ্ছ দামের শাক। আঁচল ভরে তুলতে আসে গরিব-ঘরের মেয়ে, খুশি হয়ে বাড়িতে যায়, যা জোটে তাই পেয়ে। আজকে আমার চাষ চলে না, নাই লাঙলের বালাই; পোড়ো মাঠের কুঁড়েমিতে মন্থর দিন চালাই। জমিতে রস কিছু আছে, শক্ত যায় নি আঁটি; ফলায় না সে ফল তবুও সবুজ রাখে মাটি। শ্রাবণ আমার গেছে চলে, নাই বাদলের ধারা; অঘ্রান সে সোনার ধানের দিন করেছে সারা। চৈত্র আমার রোদে পোড়া, শুকনো যখন নদী, বুনো ফলের ঝোপের তলায় ছায়া বিছায় যদি, জানব আমার শেষের মাসে ভাগ্য দেয় নি ফাঁকি, শ্যামল ধরার সঙ্গে আমার বাঁধন রইল বাকি।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
মনে করি এইখানে শেষ কোথা বা হয় শেষ আবার তোমার সভা থেকে আসে যে আদেশ। নূতন গানে নূতন রাগে নূতন করে হৃদয় জাগে, সুরের পথে কোথা যে যাই না পাই সে উদ্দেশ।সন্ধ্যাবেলার সোনার আভায় মিলিয়ে নিয়ে তান পূরবীতে শেষ করেছি যখন আমার গান– নিশীথ রাতের গভীর সুরে আবার জীবন উঠে পুরে, তখন আমার নয়নে আর রয় না নিদ্রালেশ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
কুড়াল কহিল, ভিক্ষা মাগি ওগো শাল, হাতল নাহিকো, দাও একখানি ডাল। ডাল নিয়ে হাতল প্রস্তুত হল যেই, তার পরে ভিক্ষুকের চাওয়া-চিন্তা নেই— একেবারে গোড়া ঘেঁষে লাগাইল কোপ, শাল বেচারার হল আদি অন্ত লোপ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
লুটিয়ে পড়ে জটিল জটা, ঘন পাতার গহন ঘটা, হেথা হোথায় রবির ছটা, পুকুর-ধারে বট। দশ দিকেতে ছড়িয়ে শাখা কঠিন বাহু আঁকাবাঁকা স্তব্ধ যেন আছে আঁকা, শিরে আকাশ-পট। নেবে নেবে গেছে জলে শিকড়গুলো দলে দলে, সাপের মতো রসাতলে আলয় খুঁজে মরে। শতেক শাখা-বাহু তুলি বায়ুর সাথে কোলাকুলি, আনন্দেতে দোলাদুলি গভীর প্রেমভরে। ঝড়ের তালে নড়ে মাথা, কাঁপে লক্ষকোটি পাতা, আপন-মনে গায় সে গাথা, দুলায় মহাকায়া। তড়িৎ পাশে উঠে হেসে, ঝড়ের মেঘ ঝটিৎ এসে দাঁড়িয়ে থাকে এলোকেশে, তলে গভীর ছায়া। নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ মাথার লয়ে জট, ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে ওগো প্রাচীন বট! কতই পাখি তোমার শাখে বসে যে চলে গেছে, ছোটো ছেলেরে তাদেরই মতো ভুলে কি যেতে আছে? তোমার মাঝে হৃদয় তারি বেঁধেছিল যে নীড়। ডালেপালায় সাধগুলি তার কত করেছে ভিড়। মনে কি নেই সারাটা দিন বসিয়ে বাতায়নে, তোমার পানে রইত চেয়ে অবাক দুনয়নে? ভাঙা ঘাটে নাইত কারা, তুলত কারা জল, পুকুরেতে ছায়া তোমার করত টলমল। জলের উপর রোদ পড়েছে সোনা-মাখা মায়া, ভেসে বেড়ায় দুটি হাঁস দুটি হাঁসের ছায়া। ছোটো ছেলে রইত চেয়ে, বাসনা অগাধ— মনের মধ্যে খেলাত তার কত খেলার সাধ। বায়ুর মতো খেলত যদি তোমার চারি ভিতে, ছায়ার মতো শুত যদি তোমার ছায়াটিতে, পাখির মতো উড়ে যেত উড়ে আসত ফিরে, হাঁসের মতো ভেসে যেত তোমার তীরে তীরে। মনে হত, তোমার ছায়ে কতই যে কী আছে, কাদের যেন ঘুম পাড়াতে ঘুঘু ডাকত গাছে। মনে হত, তোমার মাঝে কাদের যেন ঘর। আমি যদি তাদের হতেম! কেন হলেম পর। ছায়ার মতো ছায়ায় তারা থাকে পাতার ‘পরে, গুন্‌গুনিয়ে সবাই মিলে কতই যে গান করে। দূর লাগে মূলতানে তান, পড়ে আসে বেলা, ঘাটে বসে দেখে জলে আলোছায়ার খেলা। সন্ধে হলে খোঁপা বাঁধে তাদের মেয়েগুলি, ছেলেরা সব দোলায় বসে খেলায় দুলি দুলি। তোমার পানে রইত চেয়ে অবাক দুনয়নে? তোমার তলে মধুর ছায়া তোমার তলে ছুটি, তোমার তলে নাচত বসে শালিখ পাখি দুটি। গহিন রাতে দখিন বাতে নিঝুম চারি ভিত, চাঁদের আলোয় শুভ্র তনু, ঝিমি ঝিমি গীত। ওখানেতে পাঠশালা নেই, পণ্ডিতমশাই— বেত হাতে নাইকো বসে মাধব গোসাঁই। সারাটা দিন ছুটি কেবল, সারাটা দিন খেলা— পুকুর-ধারে আঁধার-করা বটগাছের তলা। আজকে কেন নাইকো তারা। আছে আর-সকলে, তারা তাদের বাসা ভেঙে কোথায় গেছে চলে। ছায়ার মধ্যে মায়া ছিল ভেঙে দিল কে। ছায়া কেবল রইল প'ড়ে, কোথায় গেল সে। ডালে বসে পাখিরা আজ কোন্‌ প্রাণেতে ডাকে। রবির আলো কাদের খোঁজে পাতার ফাঁকে ফাঁকে। গল্প কত ছিল যেন তোমার খোপে-খাপে, পাখির সঙ্গে মিলে-মিশে ছিল চুপে-চাপে, দুপুর বেলা নূপুর তাদের বাজত অনুক্ষণ, ছোটো দুটি ভাই-ভগিনীর আকুল হত মন। ছেলেবেলায় ছিল তারা, কোথায় গেল শেষে। গেছে বুঝি ঘুম-পাড়ানি মাসিপিসির দেশে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শোকমূলক
বেঁচেছিল, হেসে হেসে খেলা করে বেড়াত সে– হে প্রকৃতি, তারে নিয়ে কী হল তোমার! শত রঙ-করা পাখি, তোর কাছে ছিল না কি– কত তারা, বন, সিন্ধু, আকাশ অপার! জননীর কোল হতে কেন তবে কেড়ে নিলি! লুকায়ে ধরার কোলে ফুল দিয়ে ঢেকে দিলি! শত-তারা-পুষ্প-ময়ী মহতী প্রকৃতি অয়ি, নাহয় একটি শিশু নিলি চুরি ক’রে– অসীম ঐশ্বর্য তব তাহে কি বাড়িল নব? নূতন আনন্দকণা মিলিল কি ওরে? অথচ তোমারি মতো বিশাল মায়ের হিয়া সব শূন্য হয়ে গেল একটি সে শিশু গিয়া।Victor Hugo (অনূদিত কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
নামটা যেদিন ঘুচাবে, নাথ, বাঁচব সেদিন মুক্ত হয়ে- আপনগড়া স্বপন হতে তোমার মধ্যে জনম লয়ে। ঢেকে তোমার হাতের লেখা কাটি নিজের নামের রেখা, কতদিন আর কাটবে জীবন এমন ভীষণ আপদ বয়ে।  সবার সজ্জা হরণ করে আপনাকে সে সাজাতে চায়। সকল সুরকে ছাপিয়ে দিয়ে আপনাকে সে বাজাতে চায়। আমার এ নাম যাক না চুকে, তোমারি নাম নেব মুখে, সবার সঙ্গে মিলব সেদিন বিনা-নামের পরিচয়ে। ( ২১ শ্রাবণ, ১৩১৭)