poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
হাতে কোনো কাজ নেই,
নওগাঁর তিনকড়ি
সময় কাটিয়ে দেয়
ঘরে ঘরে ঋণ করি।
ভাঙা খাট কিনেছিল,
ছ পয়সা খরচা–
শোয় না সে হয় পাছে
কুঁড়েমির চর্চা।
বলে, “ঘরে এত ঠাসা
কিঙ্কর কিঙ্করী,
তাই কম খেয়ে খেয়ে
দেহটারে ক্ষীণ করি।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
সরল সরস স্নিগ্ধ তরুণ হৃদয়,
কী গুণে তোমারে আমি করিয়াছি জয়
তাই ভাবি মনে। উৎফুল্ল উত্তান চোখে
চেয়ে আছ মুখপানে প্রীতির আলোকে
আমারে উজ্জ্বল করি। তারুণ্য তোমার
আপন লাবণ্যখানি লয়ে উপহার
পরায় আমার কণ্ঠে, সাজায় আমারে
আপন মনের মতো দেবতা-আকারে
ভক্তির উন্নত লোকে প্রতিষ্ঠিত করি।
সেথায় একাকী আমি সসংকোচে মরি।
সেথা নিত্য ধূপে দীপে পূজা-উপচারে
অচল আসন-’পরে কে রাখে আমারে?
গেয়ে গেয়ে ফিরি পথে আমি শুধু কবি—
নহি আমি ধ্রুবতারা, নহি আমি রবি। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
ঘাসি কামারের বাড়ি সাঁড়া,
গড়েছে মন্ত্রপড়া খাঁড়া।
খাপ থেকে বেরিয়ে সে
উঠেছে অট্টহেসে;
কামার পালায় যত
বলে, “দাঁড়া দাঁড়া।’
দিনরাত দেয় তার
নাড়ীটাতে নাড়া। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে
আমি যদি পারি বাসা নিতে—
তবে আমি একবার
জগতের পানে তার
চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে।
তার রবি শশী তারা
জানি নে কেমনধারা
সভা করে আকাশের তলে,
আমার খোকার সাথে
গোপনে দিবসে রাতে
শুনেছি তাদের কথা চলে।
শুনেছি আকাশ তারে
নামিয়া মাঠের পারে
লোভায় রঙিন ধনু হাতে,
আসি শালবন -' পরে
মেঘেরা মন্ত্রণা করে
খেলা করিবারে তার সাথে।
যারা আমাদের কাছে
নীরব গম্ভীর আছে,
আশার অতীত যারা সবে,
খোকারে তাহারা এসে
ধরা দিতে চায় হেসে
কত রঙে কত কলরবে।
খোকার মনের ঠিক মাঝখান ঘেঁষে
যে পথ গিয়েছে সৃষ্টিশেষে
সকল-উদ্দেশ-হারা
সকল-ভূগোল-ছাড়া
অপরূপ অসম্ভব দেশে—
যেথা আসে রাত্রিদিন
সর্ব-ইতিহাস-হীন
রাজার রাজত্ব হতে হাওয়া,
তারি যদি এক ধারে
পাই আমি বসিবারে
দেখি কারা করে আসা-যাওয়া।
তাহারা অদ্ভুত লোক,
নাই কারো দুঃখ শোক,
নেই তারা কোনো কর্মে কাজে,
চিন্তাহীন মৃত্যুহীন
চলিয়াছে চিরদিন
খোকাদের গল্পলোক-মাঝে।
সেথা ফুল গাছপালা
নাগকন্যা রাজবালা
যাহা খুশি তাই করে,
সত্যেরে কিছু না ডরে,
সংশয়েরে দিয়ে যায় ফাঁকি। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কুসুমের শোভা
কুসুমের অবসানে
মধুরস হয়ে
লুকায় ফলের প্রাণে (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,
কোন্ স্বর্গপুরী তুমি ক’রে থাকো আলো।
আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়,
অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
কিনু গোয়ালার গলি।দোতলা বাড়িরলোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘরপথের ধারেই।লোনা-ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,মাঝে মাঝে স্যাঁতা-পড়া দাগ। মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবিসিদ্ধিদাতা গণেশেরদরজার ‘পরে আঁটা।আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীবএক ভাড়াতেই,সেটা টিকটিকি।তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,নেই তার অন্নের অভাব।বেতন পঁচিশ টাকা,সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।খেতে পাই দত্তদের বাড়িছেলেকে পড়িয়ে।শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,সন্ধেটা কাটিয়ে আসি,আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।এঞ্জিনের ধস্ ধস্,বাঁশির আওয়াজ,যাত্রীর ব্যস্ততা,কুলি-হাঁকাহাঁকি।সাড়ে দশ বেজে যায়,তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার। ধলেশ্বরীনদীতীরে পিসিদের গ্রাম।তাঁর দেওরের মেয়ে,অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল–সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,আমি তথৈবচ।ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া–পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। বর্ষা ঘন ঘোর।ট্রামের খরচা বাড়ে,মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।গলিটার কোণে কোণেজমে ওঠে পচে ওঠেআমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,মাছের কান্কা,মরা বেড়ালের ছানা,ছাইপাঁশ আরো কত কী যে!ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়ামাইনের মতো,বহু ছিদ্র তার।আপিসের সাজগোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।বাদলের কালো ছায়াস্যাঁৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকেকলে-পড়া জন্তুর মতনমূর্ছায় অসাড়।দিন রাত মনে হয়, কোন্ আধমরাজগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি। গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু,যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,বড়ো বড়ো চোখ,শৌখিন মেজাজ।কর্নেট বাজানো তার শখ।মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠেএ গলির বীভৎস বাতাসে–কখনো গভীর রাতে,ভোরবেলা আধো অন্ধকারে,কখনো বৈকালেঝিকিমিকি আলোয় ছায়ায়।হঠাৎ সন্ধ্যায়সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,সমস্ত আকাশে বাজেঅনাদি কালের বিরহবেদনা।তখনি মুহূর্তে ধরা পড়েএ গলিটা ঘোর মিছে,দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো।হঠাৎ খবর পাই মনেআকবর বাদশার সঙ্গেহরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।বাঁশির করুণ ডাক বেয়েছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছেএক বৈকুণ্ঠের দিকে।এ গান যেখানে সত্যঅনন্ত গোধূলিলগ্নেসেইখানেবহি চলে ধলেশ্বরী;তীরে তমালের ঘন ছায়া;আঙিনাতেযে আছে অপেক্ষা ক’রে, তারপরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আজি এই মেঘমুক্ত সকালের স্নিগ্র্ধ নিরালায়
অচেনা গাছের যত ছিন্ন ছিন্ন ছায়ার ডালায়
রৌদ্রপুঞ্জ আছে ভরি।
সারাবেলা ধরি
কোন্ পাখি আপনারি সুরে কুতূহলী
আলস্যের পেয়ালায় ঢেলে দেয় অস্ফুট কাকলি।
হঠাৎ কী হল মতি,
সোনালি রঙের প্রজাপতি
আমার রুপালি চুলে
বসিয়া রয়েছে পথ ভূলে।
সাবধানে থাকি, লাগে ভয়,
পাছে ওর জাগাই সংশয়-
ধরা পড়ে যায় পাছে, আমি নই গাছের দলের,
আমার বাণী সে নহে ফুলের ফলের।
চেয়ে দেখি, ঘন হয়ে কোথা নেমে গেচে ঝোপঝাড়;
সম্মুখে পাহাড়
আপনার আচলতা ভূলে থাকে বেলা-অবেলায়,
হামাগুড়ি দিয়ে চলে দলে দলে মেঘের খেলায়।
হোথা শুষ্ক জলধারা
শব্দহীন রচিছে ইশারা
শরিশ্রান্ত নিদ্রিত বর্ষার। নুড়িগুলি
বনের ছায়ার মধ্যে অস্থিসার প্রেতের অঙ্গুলি
নির্দেশ করিছে তারে যাহা নিরর্থক,
নির্ঝরিণী-সর্পিণীর দেহচ্যুত ত্বক্।
এখনি এ আমার দেখাতে
মিলায়েছে শৈলশ্রেণী তরঙ্গিত নীলিম রেখাতে
আপন অদৃশ্য লিপি। বাড়ির সিঁড়ির 'পরে
স্তরে স্তরে
বিদেশীফুলের টব, সেথা জেরেনিয়মের গন্ধ
শ্বসিয়া নিয়েছে মোর ছন্দ
এ চারিদিকের এই-সব নিয়ে সাথে
বর্ণে গন্ধে বিচিত্রিত একটি দিনের ভূমিকাতে
এটুকু রচনা মোর বাণীর যাত্রায় হোক পার
যে কদিন তার ভাগ্যে সময়ের আছে অধিকার।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমার মাঝারে যে আছে কে গো সে
কোন্ বিরহিণী নারী?
আপন করিতে চাহিনু তাহারে,
কিছুতেই নাহি পারি।
রমণীরে কে বা জানে–
মন তার কোন্খানে।
সেবা করিলাম দিবানিশি তার,
গাঁথি দিনু গলে কত ফুলহার,
মনে হল সুখে প্রসন্নমুখে
চাহিল সে মোর পানে।
কিছু দিন যায়,একদিন হায়
ফেলিল নয়নবারি–
“তোমাতে আমার কোনো সুখ নাই’
কহে বিরহিণী নারী।রতনে জড়িত নূপুর তাহারে
পরায়ে দিলাম পায়ে,
রজনী জাগিয়া ব্যজন করিনু
চন্দন-ভিজা বায়ে।
রমণীরে কে বা জানে–
মন তার কোন্খানে।
কনকখচিত পালঙ্ক’পরে
বসানু তাহারে বহু সমাদরে,
মনে হল হেন হাসিমুখে যেন
চাহিল সে মোর পানে।
কিছু দিন যায়, লুটায়ে ধুলায়
ফেলিল নয়নবারি–
“এ-সবে আমার কোনো সুখ নাই’
কহে বিরহিণী নারী।বাহিরে আনিনু তাহারে, করিতে
হৃদয়দিগ্বিজয়।
সারথি হইয়া রথখানি তার
চালানু ধরণীময়।
রমণীরে কে বা জানে–
মন তার কোন্খানে।
দিকে দিকে লোক সঁপি দিল প্রাণ,
দিকে দিকে তার উঠে চাটুগান,
মনে হল তবে দীপ্ত গরবে
চাহিল সে মোর পানে।
কিছু দিন যায়,মুখ সে ফিরায়,
ফেলে সে নয়নবারি–
“হৃদয় কুড়ায়ে কোনো সুখ নাই’
কহে বিরহিণী নারী।আমি কহিলাম,”কারে তুমি চাও
ওগো বিরহিণী নারী।’
সে কহিল,”আমি যারে চাই,তার
নাম না কহিতে পারি।’
রমণীরে কে বা জানে–
মন তার কোন্খানে।
সে কহিল,”আমি যারে চাই তারে
পলকে যদি গো পাই দেখিবারে,
পুলকে তখনি লব তারে চিনি
চাহি তার মুখপানে।’
দিন চলে যায়, সে কেবল হায়
ফেলে নয়নের বারি–
অজানারে কবে আপন করিব’
কহে বিরহিণী নারী। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ঝিনেদার জ্ঞাদনার
ছেলেটার জন্যে
ত্রিচিনাপল্লী গিয়ে
খুঁজে পেল কন্যে।শহরেতে সব-সেরা
ছিল যেই বিবেচক
দেখে দেখে বললে সে,–
“কিবে নাক, কিবে চোখ;
চুলের ডগার খুঁত
বুঝবে না অন্যে।’কন্যেকর্তা শুনে
ঘটকের কানে কয়,–“ওটুকু ত্রুটির তরে
করিস্নে কোনো ভয়;
ক’খানা মেয়েকে বেছে
আরো তিনজন নে,
তাতেও না ভরে যদি
ভরি কয় পণ নে।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তুমি বসন্তের পাখি বনের ছায়ারে
করো ভাষা দান।
আকাশ তোমার কণ্ঠে চাহে গাহিবারে
আপনারি গান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আকাশের আলো মাটির তলায়
লুকায় চুপে,
ফাগুনের ডাকে বাহিরিতে চায়
কুসুমরূপে।(স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মনে পড়ে , ছেলেবেলায় যে বই পেতুম হাতে
ঝুঁকে পড়ে যেতুম পড়ে তাহার পাতে পাতে ।
কিছু বুঝি , নাই বা কিছু বুঝি ,
কিছু না হোক পুঁজি ,
হিসাব কিছু না থাক্ নিয়ে লাভ অথবা ক্ষতি ,
অল্প তাহার অর্থ ছিল , বাকি তাহার গতি ।
মনের উপর ঝরনা যেন চলেছে পথ খুঁড়ি ,
কতক জলের ধারা আবার কতক পাথর নুড়ি ।
সব জড়িয়ে ক্রমে ক্রমে আপন চলার বেগে
পূর্ণ হয়ে নদী ওঠে জেগে ।
শক্ত সহজ এ সংসারটা যাহার লেখা বই
হালকা ক ' রে বুঝিয়ে সে দেয় কই ।
বুঝছি যত খুজছি তত , বুঝছি নে আর ততই —
কিছু বা হাঁ , কিছু বা না , চলছে জীবন স্বতই ।কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা ,
দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা ।
আলগা মলিন পাতাগুলি , দাগি তাহার মলাট
দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট ।
মায়ের ঘরের চৌকাঠেতে বারান্দার এক কোণে
দিন-ফুরানো ক্ষীণ আলোতে পড়েছি একমনে ।
অনেক কথা হয় নি তখন বোঝা ,
যেটুকু তার বুঝেছিলাম মোট কথাটা সোজা —
ভালোমন্দে লড়াই অনিঃশেষ ,
প্রকাণ্ড তার ভালোবাসা , প্রচণ্ড তার দ্বেষ ।
বিপরীতের মল্লযুদ্ধ ইতিহাসের রূপ
সামনে এল , রইনু বসে চুপ ।শুরু হতে এইটে গেল বোঝা ,
হয়তো বা এক বাঁধা রাস্তা কোথাও আছে সোজা ,
যখন-তখন হঠাৎ সে যায় ঠেকে ,
আন্দাজে যায় ঠিকানাটা বিষম এঁকেবেঁকে ।
সব-জানা দেশ এ নয় কভু , তাই তো তেপান্তরে
রাজপুত্তুর ছোটায় ঘোড়া না-জানা কার তরে ।
সদাগরের পুত্র সেও যায় অজানার পার
খোঁজ নিতে কোন্ সাত-রাজা-ধন গোপন মানিকটার ।
কোটালপুত্র খোঁজে এমন গুহায়-থাকা চোর
যাকে ধরলে সকল চুরির কাটবে বাঁধন-ডোর ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
দূর সাগরের পারের পবন
আসবে যখন কাছের কূলে
রঙিন আগুন জ্বালবে ফাগুন,
মাতবে অশোক সোনার ফুলে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কোথায় যেতে ইচ্ছে করে
শুধাস কি মা , তাই ?
যেখান থেকে এসেছিলেম
সেথায় যেতে চাই ।
কিন্তু সে যে কোন্ জায়গা
ভাবি অনেকবার ।
মনে আমার পড়ে না তো
একটুখানি তার ।
ভাবনা আমার দেখে বাবা
বললে সেদিন হেসে ,
' সে - জায়গাটি মেঘের পারে
সন্ধ্যাতারার দেশে । '
তুমি বল , ' সে - দেশখানি
মাটির নিচে আছে ,
যেখান থেকে ছাড়া পেয়ে
ফুল ফোটে সব গাছে । '
মাসি বলে , ' সে - দেশ আমার
আছে সাগরতলে ,
যেখানেতে আঁধার ঘরে
লুকিয়ে মানিক জ্বলে । '
দাদা আমার চুল টেনে দেয় ,
বলে , ' বোকা ওরে ,
হাওয়ায় সে - দেশ মিলিয়ে আছে
দেখবি কেমন করে ?'
আমি শুনে ভাবি , আছে
সকল জায়গাতেই ।
সিধু মাস্টার বলে শুধু
' কোনোখানেই নেই । ' (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হে তরু, এ ধরাতলে
রহিব না যবে
তখন বসন্তে নব
পল্লবে পল্লবে
তোমার মর্মরধ্বনি
পথিকেরে কবে,
"ভালো বেসেছিল কবি
বেঁচে ছিল যবে।" (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
"এ তবে স্বপন শুধু, বিম্বের মতন
আবার মিলায়ে গেল নিদ্রার সমুদ্রে!
সারারাত নিদ্রার করিনু আরাধনা--
যদি বা আইল নিদ্রা এ শ্রান্ত নয়নে,
মরীচিকা দেখাইয়া গেল গো মিলায়ে!
হা স্বপ্ন, কি শক্তি তোর, এ হেন মূরতি
মুহূর্ত্তের মধ্যে তুই ভাঙ্গিলি, গড়িলি?
হা নিষ্ঠুর কাল, তোর এ কিরূপ খেলা--
সত্যের মতন গড়িলি প্রতিমা,
স্বপ্নের মতন তাহা ফেলিলি ভাঙ্গিয়া?
কালের সমুদ্রে এক বিম্বের মতন
উঠিল, আবার গেল মিলায়ে তাহাতে?
না না, তাহা নয় কভু, নলিনী, সে কি গো
কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত!
যাহার মোহিনী মূর্ত্তি হৃদয়ে হৃদয়ে
শিরায় শিরায় আঁকা শোণিতের সাথে,
যত কাল রব বেঁচে যার ভালবাসা
চিরকাল এ হৃদয়ে রহিবে অক্ষয়,
সে বালিকা, সে নলিনী, সে স্বর্গপ্রতিমা,
কালের সমুদ্রে শুধু বিম্বটির মত
তরঙ্গের অভিঘাতে জন্মিল মিশিল?
না না, তাহা নয় কভু, তা যেন না হয়!
দেহকারাগারমুক্ত সে নলিনী এবে
সুখে দুখে চিরকাল সম্পদে বিপদে
আমারই সাথে সাথে করিছে ভ্রমণ।
চিরহাস্যময় তার প্রেমদৃষ্টি মেলি
আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া।
রক্ষক দেবতা সম আমারি উপরে
প্রশান্ত প্রেমের ছায়া রেখেছে বিছায়ে।
দেহকারাগারমুক্ত হইলে আমিও
তাহার হৃদয়সাথে মিশাব হৃদয়।
নলিনী, আছ কি তুমি, আছ কি হেথায়?
একবার দেখা দেও, মিটাও সন্দেহ!
চিরকাল তরে তোরে ভুলিতে কি হবে?
তাই বল্ নলিনী লো, বল্ একবার!
চিরকাল আর তোরে পাব না দেখিতে,
চিরকাল আর তোর হৃদয়ে হৃদয়
পাব না কি মিশাইতে, বল্ একবার।
মরিলে কি পৃথিবীর সব যায় দূরে?
তুই কি আমারে ভুলে গেছিস্ নলিনি?
তা হোলে নলিনি, আমি চাই না মরিতে।
তোর ভালবাসা যেন চিরকাল মোর
হৃদয়ে অক্ষয় হোয়ে থাকে গো মুদ্রিত--
কষ্ট পাই পাব, তবু চাই না ভুলিতে!
তুমি নাহি থাক যদি তোমার স্মৃতিও
থাকে যেন এ হৃদয় করিয়া উজ্জ্বল!
এই ভালবাসা যাহা হৃদয়ে মরমে
অবশিষ্ট রাখে নাই এক তিল স্থান,
একটি পার্থিব ক্ষুদ্র নিশ্বাসের সাথে
মুহূর্ত্তে না পালটিতে আঁখির পলক
ক্ষণস্থায়ী কুসুমের সুরভের মত
শূন্য এই বায়ুস্রোতে যাইবে মিশায়ে?
হিমাদ্রির এই স্তব্ধ আঁধার গহ্বরে
সময়ের পদক্ষেপ গণিতেছি বসি,
ভবিষ্যৎ ক্রমে হইতেছে বর্ত্তমান,
বর্ত্তমান মিশিতেছে অতীতসমুদ্রে।
অস্ত যাইতেছে নিশি, আসিছে দিবস,
দিবস নিশার কোলে পড়িছে ঘুমায়ে।
এই সময়ের চক্র ঘুরিয়া নীরবে
পৃথিবীরে মানুষেরে অলক্ষিতভাবে
পরিবর্ত্তনের পথে যেতেছে লইয়া,
কিন্তু মনে হয় এই হিমাদ্রীর বুকে
তাহার চরণ-চিহ্ন পড়িছে না যেন।
কিন্তু মনে হয় যেন আমার হৃদয়ে
দুর্দ্দাম সময়স্রোত অবিরামগতি,
নূতন গড়ে নি কিছু, ভাঙ্গে নি পুরাণো।
বাহিরের কত কি যে ভাঙ্গিল চূরিল,
বাহিরের কত কি যে হইল নূতন,
কিন্তু ভিতরের দিকে চেয়ে দেখ দেখি--
আগেও আছিল যাহা এখনো তা আছে,
বোধ হয় চিরকাল থাকিবে তাহাই!
বরষে বরষে দেহ যেতেছে ভাঙ্গিয়া,
কিন্তু মন আছে তবু তেমনি অটল।
নলিনী নাইকো বটে পৃথিবীতে আর,
নলিনীরে ভালবাসি তবুও তেমনি।
যখন নলিনী ছিল, তখন যেমন
তার হৃদয়ের মূর্ত্তি ছিল এ হৃদয়ে,
এখনো তেমনি তাহা রয়েছে স্থাপিত।
এমন অন্তরে তারে রেখেছি লুকায়ে,
মরমের মর্ম্মস্থলে করিতেছি পূজা,
সময় পারে না সেথা কঠিন আঘাতে
ভাঙ্গিবারে এ জনমে সে মোর প্রতিমা,
হৃদয়ের আদরের লুকানো সে ধন!
ভেবেছিনু এক বার এই-যে বিষাদ
নিদারুণ তীব্র স্রোতে বহিছে হৃদয়ে
এ বুঝি হৃদয় মোর ভাঙ্গিবে চূরিবে--
পারে নি ভাঙ্গিতে কিন্তু এক তিল তাহা,
যেমন আছিল মন তেমনি রয়েছে!
বিষাদ যুঝিয়াছিল প্রাণপণে বটে,
কিন্তু এ হৃদয়ে মোর কি যে আছে বল,
এ দারুণ সমরে সে হইয়াচে জয়ী।
গাও গো বিহগ তব প্রমোদের গান,
তেমনি হৃদয়ে তার রবে প্রতিধ্বনি!
প্রকৃতি! মাতার মত সুপ্রসন্ন দৃষ্টি
যেমন দেখিয়াছিনু ছেলেবেলা আমি,
এখনো তেমনি যেন পেতেছি দেখিতে।
যা কিছু সুন্দর, দেবি, তাহাই মঙ্গল,
তোমার সুন্দর রাজ্যে হে প্রকৃতিদেবি
তিল অমঙ্গল কভু পারে না ঘটিতে।
অমন সুন্দর আহা নলিনীর মন,
জীবন সৌন্দর্য্য, দেবি তোমার এ রাজ্যে
অনন্ত কালের তরে হবে না বিলীন।
যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবে তা দেবি,
এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়।
তোমার আশ্বাসবাক্যে হে প্রকৃতিদেবি,
সংশয় কখনো আমি করি না স্বপনে!
বাজাও রাখাল তব সরল বাঁশরী!
গাও গো মনের সাধে প্রমোদের গান!
পাখীরা মেলিয়া যবে গাইতেছে গীত,
কানন ঘেরিয়া যবে বহিতেছে বায়ু,
উপত্যকাময় যবে ফুটিয়াছে ফুল,
তখন তোদের আর কিসের ভাবনা?
দেখি চিরহাস্যময় প্রকৃতির মুখ,
দিবানিশি হাসিবারে শিখেছিস্ তোরা!
সমস্ত প্রকৃতি যবে থাকে গো হাসিতে,
সমস্ত জগৎ যবে গাহে গো সঙ্গীত,
তখন ত তোরা নিজ বিজন কুটীরে
ক্ষুদ্রতম আপনার মনের বিষাদে
সমস্ত জগৎ ভুলি কাঁদিস না বসি!
জগতের, প্রকৃতির ফুল্ল মুখ হেরি
আপনার ক্ষুদ্র দুঃখ রহে কি গো আর?
ধীরে ধীরে দূর হোতে আসিছে কেমন
বসন্তের সুরভিত বাতাসের সাথে
মিশিয়া মিশিয়া এই সরল রাগিণী।
একেক রাগিণী আছে করিলে শ্রবণ
মনে হয় আমারি তা প্রাণের রাগিণী--
সেই রাগিণীর মত আমার এ প্রাণ,
আমার প্রাণের মত যেন সে রাগিণী!
কখন বা মনে হয় পুরাতন কাল
এই রাগিণীর মত আছিল মধুর,
এমনি স্বপনময় এমনি অস্ফুট--
পাই শুনি ধীরি ধীরি পুরাতন স্মৃতি
প্রাণের ভিতরে যেন উথলিয়া উঠে!"
ক্রমে কবি যৌবনের ছাড়াইয়া সীমা,
গম্ভীর বার্দ্ধক্যে আসি হোলো উপনীত!
সুগম্ভীর বৃদ্ধ কবি, স্কন্ধে আসি তার
পড়েছে ধবল জটা অযত্নে লুটায়ে!
মনে হোতো দেখিলে সে গম্ভীর মুখশ্রী
হিমাদ্রি হোতেও বুঝি সমুচ্চ মহান্!
নেত্র তাঁর বিকীরিত কি স্বর্গীয় জ্যোতি,
যেন তাঁর নয়নের শান্ত সে কিরণ
সমস্ত পৃথিবীময় শান্তি বরষিবে।
বিস্তীর্ণ হইয়া গেল কবির সে দৃষ্টি,
দৃষ্টির সম্মুখে তার, দিগন্তও যেন
খুলিয়া দিত গো নিজ অভেদ্য দুয়ার।
যেন কোন দেববালা কবিরে লইয়া
অনন্ত নক্ষত্রলোকে কোরেছে স্থাপিত--
সামান্য মানুষ যেথা করিলে গমন
কহিত কাতর স্বরে ঢাকিয়া নয়ন,
"এ কি রে অনন্ত কাণ্ড, পারি না সহিতে!"
সন্ধ্যার আঁধারে হোথা বসিয়া বসিয়া,
কি গান গাইছে কবি, শুন কলপনা।
কি "সুন্দর সাজিয়াছে ওগো হিমালয়
তোমার বিশালতম শিখরের শিরে
একটি সন্ধ্যার তারা! সুনীল গগন
ভেদিয়া, তুষারশুভ্র মস্তক তোমার!
সরল পাদপরাজি আঁধার করিয়া
উঠেছে তাহার পরে; সে ঘোর অরণ্য
ঘেরিয়া হুহুহু করি তীব্র শীতবায়ু
দিবানিশি ফেলিতেছে বিষণ্ণ নিশ্বাস!
শিখরে শিখরে ক্রমে নিভিয়া আসিল
অস্তমান তপনের আরক্ত কিরণে
প্রদীপ্ত জলদচূর্ণ। শিখরে শিখরে
মলিন হইয়া এল উজ্জ্বল তুষার,
শিখরে শিখরে ক্রমে নামিয়া আসিল
আঁধারের যবনিকা ধীরে ধীরে ধীরে!
পর্ব্বতের বনে বনে গাঢ়তর হোলো
ঘুমময় অন্ধকার। গভীর নীরব!
সাড়াশব্দ নাই মুখে, অতি ধীরে ধীরে
অতি ভয়ে ভয়ে যেন চলেছে তটিনী
সুগম্ভীর পর্ব্বতের পদতল দিয়া!
কি মহান্! কি প্রশান্ত! কি গম্ভীর ভাব!
ধরার সকল হোতে উপরে উঠিয়া
স্বর্গের সীমায় রাখি ধবল জটায়
জড়িত মস্তক তব ওগো হিমালয়
নীরব ভাষায় তুমি কি যেন একটি
গম্ভীর আদেশ ধীরে করিছ প্রচার!
সমস্ত পৃথিবী তাই নীরব হইয়া
শুনিছে অনন্যমনে সভয়ে বিস্ময়ে।
আমিও একাকী হেথা রয়েছি পড়িয়া,
আঁধার মহা-সমুদ্রে গিয়াছি মিশায়ে,
ক্ষুদ্র হোতে ক্ষুদ্র নর আমি, শৈলরাজ!
অকূল সমুদ্রে ক্ষুদ্র তৃণটির মত
হারাইয়া দিগ্বিদিক্, হারাইয়া পথ,
সভয়ে বিস্ময়ে, হোয়ে হতজ্ঞানপ্রায়
তোমার চরণতলে রয়েছি পড়িয়া।
ঊর্দ্ধ্বমুখে চেয়ে দেখি ভেদিয়া আঁধার
শূন্যে শূন্যে শত শত উজ্জ্বল তারকা,
অনিমিষ নেত্রগুলি মেলিয়া যেন রে
আমারি মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া।
ওগো হিমালয়, তুমি কি গম্ভীর ভাবে
দাঁড়ায়ে রয়েছ হেথা অচল অটল,
দেখিছ কালের লীলা, করিছ গননা,
কালচক্র কত বার আইল ফিরিয়া!
সিন্ধুর বেলার বক্ষে গড়ায় যেমন
অযুত তরঙ্গ, কিছু লক্ষ্য না করিয়া
কত কাল আইল রে, গেল কত কাল
হিমাদ্রি তোমার ওই চক্ষের উপরি।
মাথার উপর দিয়া কত দিবাকর
উলটি কালের পৃষ্ঠা গিয়াছে চলিয়া।
গম্ভীর আঁধারে ঢাকি তোমার ও দেহ
কত রাত্রি আসিয়াছে গিয়াছে পোহায়ে।
কিন্তু বল দেখি ওগো হিমালয়গিরি
মানুষসৃষ্টির অতি আরম্ভ হইতে
কি দেখিছ এইখানে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে?
যা দেখিছ যা দেখেছ তাতে কি এখনো
সর্ব্বাঙ্গ তোমার গিরি উঠে নি শিহরি?
কি দারুণ অশান্তি এই মনুষ্যজগতে--
রক্তপাত, অত্যাচার , পাপ কোলাহল
দিতেছে মানবমনে বিষ মিশাইয়া!
কত কোটি কোটি লোক, অন্ধকারাগারে
অধীনতাশৃঙ্খলেতে আবদ্ধ হইয়া
ভরিছে স্বর্গের কর্ণ কাতর ক্রন্দনে,
অবশেষে মন এত হোয়েছে নিস্তেজ,
কলঙ্কশৃঙ্খল তার অলঙ্কাররূপে
আলিঙ্গন ক'রে তারে রেখেছে গলায়!
দাসত্বের পদধূলি অহঙ্কার কোরে
মাথায় বহন করে পরপ্রত্যাশীরা!
যে পদ মাথায় করে ঘৃণার আঘাত
সেই পদ ভক্তিভরে করে গো চুম্বন!
যে হস্ত ভ্রাতারে তার পরায় শৃঙ্খল,
সেই হস্ত পরশিলে স্বর্গ পায় করে।
স্বাধীন, সে অধীনেরে দলিবার তরে,
অধীন, সে স্বাধীনেরে পূজিবারে শুধু!
সবল, সে দুর্ব্বলেরে পীড়িতে কেবল--
দুর্ব্বল, বলের পদে আত্ম বিসর্জ্জিতে!
স্বাধীনতা কারে বলে জানে সেই জন
কোথায় সেই অসহায় অধীন জনের
কঠিন শৃঙ্খলরাশি দিবে গো ভাঙ্গিয়া,
না, তার স্বাধীন হস্ত হোয়েছে কেবল
অধীনের লৌহপাশ দৃঢ় করিবারে।
সবল দুর্ব্বলে কোথা সাহায্য করিবে--
দুর্ব্বলে অধিকতর করিতে দুর্ব্বল
বল তার-- হিমগিরি, দেখিছ কি তাহা?
সামান্য নিজের স্বার্থ করিতে সাধন
কত দেশ করিতেছে শ্মশান অরণ্য,
কোটি কোটি মানবের শান্তি স্বাধীনতা
রক্তময়পদাঘাতে দিতেছে ভাঙ্গিয়া,
তবুও মানুষ বলি গর্ব্ব করে তারা,
তবু তারা সভ্য বলি করে অহঙ্কার!
কত রক্তমাখা ছুরি হাসিছে হরষে,
কত জিহ্বা হৃদয়েরে ছিঁড়িছে বিঁধিছে!
বিষাদের অশ্রুপূর্ণ নয়ন হে গিরি
অভিশাপ দেয় সদা পরের হরষে,
উপেক্ষা ঘৃণায় মাখা কুঞ্চিত অধর
পরঅশ্রুজলে ঢালে হাসিমাখা বিষ!
পৃথিবী জানে না গিরি হেরিয়া পরের জ্বালা,
হেরিয়া পরের মর্ম্মদুখের উচ্ছ্বাস,
পরের নয়নজলে মিশাতে নয়নজল--
পরের দুখের শ্বাসে মিশাতে নিশ্বাস!
প্রেম? প্রেম কোথা হেথা এ অশান্তিধামে?
প্রণয়ের ছদ্মবেশ পরিয়া যেথায়
বিচরে ইন্দ্রিয়সেবা, প্রেম সেথা আছে?
প্রেমে পাপ বলে যারা, প্রেম তারা চিনে?
মানুষে মানুষে যেথা আকাশ পাতাল,
হৃদয়ে হৃদয়ে যেথা আত্ম-অভিমান,
যে ধরায় মন দিয়া ভাল বাসে যারা
উপেক্ষা বিদ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদে
তারাই অধিক সহে বিষাদ যন্ত্রণা,
সেথা যদি প্রেম থাকে তবে কোথা নাই--
তবে প্রেম কলুষিত নরকেও আছে!
কেহ বা রতনময় কনকভবনে
ঘুমায়ে রয়েছে সুখে বিলাসের কোলে,
অথচ সুমুখ দিয়া দীন নিরালয়
পথে পথে করিতেছে ভিক্ষান্নসন্ধান!
সহস্র পীড়িতদের অভিশাপ লোয়ে
সহস্রের রক্তধারে ক্ষালিত আসনে
সমস্ত পৃথিবী রাজা করিছে শাসন,
বাঁধিয়া গলায় সেই শাসনের রজ্জু
সমস্ত পৃথিবী তাহার রহিয়াছে দাস!
সহস্র পীড়ন সহি আনত মাথায়
একের দাসত্বে রত অযুত মানব!
ভাবিয়া দেখিলে মন উঠে গো শিহরি--
ভ্রমান্ধ দাসের জাতি সমস্ত মানুষ।
এ অশান্তি কবে দেব হবে দূরীভূত!
অত্যাচার-গুরুভারে হোয়ে নিপীড়িত
সমস্ত পৃথিবী, দেব, করিছে ক্রন্দন!
সুখ শান্তি সেথা হোতে লয়েছে বিদায়!
কবে, দেব, এ রজনী হবে অবসান?
স্নান করি প্রভাতের শিশিরসলিলে
তরুণ রবির করে হাসিবে পৃথিবী!
অযুত মানবগণ এক কণ্ঠে, দেব,
এক গান গাইবেক স্বর্গ পূর্ণ করি!
নাইক দরিদ্র ধনী অধিপতি প্রজা--
কেহ কারো কুটীরেতে করিলে গমন
মর্য্যাদার অপমান করিবে না মনে,
সকলেই সকলের করিতেছে সেবা,
কেহ কারো প্রভু নয়, নহে কারো দাস!
নাই ভিন্ন জাতি আর নাই ভিন্ন ভাষা
নাই ভিন্ন দেশ, ভিন্ন আচার ব্যাভার!
সকলেই আপনার আপনার লোয়ে
পরিশ্রম করিতেছে প্রফুল্ল-অন্তরে।
কেহ কারো সুখে নাহি দেয় গো কণ্টক,
কেহ কারো দুখে নাহি করে উপহাস!
দ্বেষ নিন্দা ক্রূরতার জঘন্য আসন
ধর্ম্ম-আবরণে নাহি করে গো সজ্জিত!
হিমাদ্রি, মানুষসৃষ্টি-আরম্ভ হইতে
অতীতের ইতিহাস পড়েছ সকলি,
অতীতের দীপশিখা যদি হিমালয়
ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পারে গো ভেদিতে
তবে বল কবে, গিরি, হবে সেই দিন
যে দিন স্বর্গই হবে পৃথ্বীর আদর্শ!
সে দিন আসিবে গিরি, এখনিই যেন
দূর ভবিষ্যৎ সেই পেতেছি দেখিতে
যেই দিন এক প্রেমে হইয়া নিবদ্ধ
মিলিবেক কোটি কোটি মানবহৃদয়।
প্রকৃতির সব কার্য্য অতি ধীরে ধীরে,
এক এক শতাব্দীর সোপানে সোপানে--
পৃথ্বী সে শান্তির পথে চলিতেছে ক্রমে,
পৃথিবীর সে অবস্থা আসে নি এখনো
কিন্তু এক দিন তাহা আসিবে নিশ্চয়।
আবার বলি গো আমি হে প্রকৃতিদেবি
যে আশা দিয়াছ হৃদে ফলিবেক তাহা,
এক দিন মিলিবেক হৃদয়ে হৃদয়।
এ যে সুখময় আশা দিয়াছ হৃদয়ে
ইহার সঙ্গীত, দেবি, শুনিতে শুনিতে
পারিব হরষচিতে ত্যজিতে জীবন!"
সমস্ত ধরার তরে নয়নের জল
বৃদ্ধ সে কবির নেত্র করিল পূর্ণিত!
যথা সে হিমাদ্রি হোতে ঝরিয়া ঝরিয়া
কত নদী শত দেশ করয়ে উর্ব্বরা।
উচ্ছ্বসিত করি দিয়া কবির হৃদয়
অসীম করুণা সিন্ধু পোড়েছে ছড়ায়ে
সমস্ত পৃথিবীময়। মিলি তাঁর সাথে
জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী ভারতী
কাঁদিলেন আর্দ্র হোয়ে পৃথিবীর দুখে,
ব্যাধশরে নিপতিত পাখীর মরণে
বাল্মীকির সাথে যিনি করেন রোদন!
কবির প্রাচীননেত্রে পৃথিবীর শোভা
এখনও কিছু মাত্র হয় নি পুরাণো?
এখনো সে হিমাদ্রির শিখরে শিখরে
একেলা আপন মনে করিত ভ্রমণ।
বিশাল ধবল জটা, বিশাল ধবল শ্মশ্রু,
নেত্রের স্বর্গীয় জ্যোতি, গম্ভীর মূরতি,
প্রশস্ত ললাটদেশ, প্রশান্ত আকৃতি তার
মনে হোত হিমাদ্রির অধিষ্ঠাতৃদেব!
জীবনের দিন ক্রমে ফুরায় কবির!
সঙ্গীত যেমন ধীরে আইসে মিলায়ে,
কবিতা যেমন ধীরে আইসে ফুরায়ে,
প্রভাতের শুকতারা ধীরে ধীরে যথা
ক্রমশঃ মিশায়ে আসে রবির কিরণে,
তেমনি ফুরায়ে এল কবির জীবন।
প্রতিরাত্রে গিরিশিরে জোছনায় বসি
আনন্দে গাইত কবি সুখের সঙ্গীত।
দেখিতে পেয়েছে যেন স্বর্গের কিরণ,
শুনিতে পেয়েছে যেন দূর স্বর্গ হোতে,
নলিনীর সুমধুর আহ্বানের গান।
প্রবাসী যেমন আহা দূর হোতে যদি
সহসা শুনিতে পায় স্বদেশ-সঙ্গীত,
ধায় হরষিত চিতে সেই দিক্ পানে,
একদিন দুইদিন যেতেছে যেমন
চলেছে হরষে কবি সেই দেশ হোতে
স্বদেশসঙ্গীতধ্বনি পেতেছে শুনিতে।
এক দিন হিমাদ্রির নিশীথ বায়ুতে
কবির অন্তিম শ্বাস গেল মিশাইয়া!
হিমাদ্রি হইল তার সমাধিমন্দির,
একটি মানুষ সেথা ফেলে নি নিশ্বাস!
প্রত্যহ প্রভাত শুধু শিশিরাশ্রুজলে
হরিত পল্লব তার করিত প্লাবিত!
শুধু সে বনের মাঝে বনের বাতাস,
হুহু করি মাঝে মাঝে ফেলিত নিশ্বাস!
সমাধি উপরে তার তরুলতাকুল
প্রতিদিন বরষিত কত শত ফুল!
কাছে বসি বিহগেরা গাইত গো গান,
তটিনী তাহার সাথে মিশাইত তান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
নাটক লিখেছি একটি।
বিষয়টা কী বলি।
অর্জুন গিয়েছেন স্বর্গে,
ইন্দ্রের অতিথি তিনি নন্দনবনে।
উর্বশী গেলেন মন্দারের মালা হাতে
তাঁকে বরণ করবেন ব'লে।
অর্জুন বললেন, ``দেবী, তুমি দেবলোকবাসিনী,
অতিসম্পূর্ণ তোমার মহিমা,
অনিন্দিত তোমার মাধুরী,
প্রণতি করি তোমাকে।
তোমার মালা দেবতার সেবার জন্যে।উর্বশী বললেন, ``কোনো অভাব নেই দেবলোকের,
নেই তার পিপাসা।
সে জানেই না চাইতে,
তবে কেন আমি হলেম সুন্দর!
তার মধ্যে মন্দ নেই,
তবে ভালো হওয়া কার জন্যে!
আমার মালার মূল্য নেই তার গলায়।
মর্তকে প্রয়োজন আমার,
আমাকে প্রয়োজন মর্তের।
তাই এসেছি তোমার কাছে,
তোমার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে করো আমাকে বরণ,
দেবলোকের দুর্লভ সেই আকাঙ্ক্ষা
মর্তের সেই অমৃত-অশ্রুর ধারা।
ভালো হয়েছে আমার লেখা।
`ভালো হয়েছে' কথাটা কেটে দেব কি চিঠি থেকে?
কেন, দোষ হয়েছে কী?
সত্য কথাই বেরিয়েছে কলমের মুখে।
আশ্চর্য হয়েছ আমার অবিনয়ে,
বলছ, ``ভালো যে হয়েইছে জানলে কী ক'রে?
আমার উত্তর এই, নিশ্চিত নাই বা জানলেম।
এক কালের ভালোটা
হয়তো হবে না অন্য কালের ভালো।
তাই তো এক নিশ্বাসে বলতে পারি
`ভালো হয়েছে'।
চিরকালের সত্য নিয়ে কথা হত যদি
চুপ করে থাকতেম ভয়ে।
কত লিখেছি কতদিন,
মনে মনে বলেছি `খুব ভালো'।
আজ পরম শত্রুর নামে
পারতেম যদি সেগুলো চালাতে
খুশি হতেম তবে।
এ লেখারও একদিন হয়তো হবে সেই দশা---
সেইজন্যেই, দোহাই তোমার,
অসংকোচে বলতে দাও আজকের মতো---
এ লেখা হয়েছে ভালো।
এইখানটায় একটুখানি তন্দ্রা এল।
হঠাত্-বর্ষণে চারি দিক থেকে ঘোলা জলের ধারা
যেমন নেমে আসে, সেইরকমটা।
তবু ঝেঁকে ঝেঁকে উঠে টলমল ক'রে কলম চলছে,
যেমনটা হয় মদ খেয়ে নাচতে গেলে।
তবু শেষ করব এ চিঠি,
কুয়াশার ভিতর দিয়েও জাহাজ যেমন চলে,
কল বন্ধ করে না।
বিষয়টা হচ্ছে আমার নাটক।
বন্ধুদের ফর্মাশ, ভাষা হওয়া চাই অমিত্রাক্ষর।
আমি লিখেছি গদ্যে।
পদ্য হল সমুদ্র,
সাহিত্যের আদিযুগের সৃষ্টি।
তার বৈচিত্র্য ছন্দতরঙ্গে,
কলকল্লোলে!
গদ্য এল অনেক পরে।
বাঁধা ছন্দের বাইরে জমালো আসর।
সুশ্রী-কুশ্রী ভালো-মন্দ তার আঙিনায় এল
ঠেলাঠেলি করে।
ছেঁড়া কাঁথা আর শাল-দোশালা
এল জড়িয়ে মিশিয়ে।
সুরে বেসুরে ঝনাঝন্ ঝংকার লাগিয়ে দিল।
গর্জনে ও গানে, তাণ্ডবে ও তরল তালে
আকাশে উঠে পড়ল গদ্যবাণীর মহাদেশ।
কখনো ছাড়লে অগ্নিনিশ্বাস,
কখনো ঝরালে জলপ্রপাত।
কোথাও তার সমতল, কোথাও অসমতল;
কোথাও দুর্গম অরণ্য, কোথাও মরুভূমি।
একে অধিকার যে করবে তার চাই রাজপ্রতাপ;
পতন বাঁচিয়ে শিখতে হবে
এর নানারকম গতি অবগতি।
বাইরে থেকে এ ভাসিয়ে দেয় না স্রোতের বেগে,
অন্তরে জাগাতে হয় ছন্দ
গুরু লঘু নানা ভঙ্গিতে।
সেই গদ্যে লিখেছি আমার নাটক,
এতে চিরকালের স্তব্ধতা আছে
আর চলতি কালের চাঞ্চল্য।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
গাছগুলি মুছে-ফেলা,
গিরি ছায়া-ছায়া—
মেঘে আর কুয়াশায়
রচে একি মায়া।
মুখঢাকা ঝরনার
শুনি আকুলতা—
সব যেন বিধাতার
চুপিচুপি কথা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হেথায় তিনি কোল পেতেছেন
আমাদের এই ঘরে।
আসনটি তাঁর সাজিয়ে দে ভাই,
মনের মতো করে।
গান গেয়ে আনন্দমনে
ঝাঁটিয়ে দে সব ধুলা।
যত্ন করে দূর করে দে
আবর্জনাগুলা।
জল ছিটিয়ে ফুলগুলি রাখ
সাজিখানি ভরে--
আসনটি তাঁর সাজিয়ে দে ভাই,
মনের মতো করে। দিনরজনী আছেন তিনি
আমাদের এই ঘরে,
সকালবেলায় তাঁরি হাসি
আলোক ঢেলে পড়ে।
যেমনি ভোরে জেগে উঠে
নয়ন মেলে চাই,
খুশি হয়ে আছেন চেয়ে
দেখতে মোরা পাই।
তাঁরি মুখের প্রসন্নতায়
সমস্ত ঘর ভরে।
সকালবেলায় তাঁর হাসি
আলোক ঢেলে পড়ে।
একলা তিনি বসে থাকেন
আমাদের এই ঘরে
আমরা যখন অন্য কোথাও
চলি কাজের তরে,
দ্বারের কাছে তিনি মোদের
এগিয়ে দিয়ে যান--
মনের সুখে ধাই রে পথে,
আনন্দে গাই গান।
দিনের শেষে ফিরি যখন
নানা কাজের পরে,
দেখি তিনি একলা বসে
আমাদের এই ঘরে। তিনি জেগে বসে থাকেন
আমাদের এই ঘরে
আমরা যখন অচেতনে
ঘুমাই শয্যা-'পরে।
জগতে কেউ দেখতে না পায়
লুকানো তাঁর বাতি,
আঁচল দিয়ে আড়াল ক'রে
জ্বালান সারা রাতি।
ঘুমের মধ্যে স্বপন কতই
আনাগোনা করে,
অন্ধকারে হাসেন তিনি
আমাদের এই ঘরে। ( পৌষ, ১৩১৬)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
নারীর দুখের দশা অপমানে জড়ানো
এই দেখি দিকে দিকে ঘরে ঘরে ছড়ানো।
জানো কি এ অন্যায় সমাজের হিসাবে
নিমেষে নিমেষে কত হলাহল মিশাবে?
পুরুষ জেনেছে এটা বিধিনির্দিষ্ট
তাদের জীবন-ভোজে নারী উচ্ছিষ্ট।
রোগ-তাপে সেবা পায়, লয় তাহা অলসে--
সুধা কেন ঢালে বিধি ছিদ্র এ কলসে!
সমসম্মান হেথা নাহি মানে পুরুষে,
নিজ প্রভুপদমদে তুলে রয় ভুরু সে।
অর্ধেক কাপুরুষ অর্ধেক রমণী
তাতেই তো নাড়ীছাড়া এ দেশের ধমণী।
বুঝিতে পারে না ওরা-- এ বিধানে ক্ষতি কার।
জানি না কী বিপ্লবে হবে এর প্রতিকার।
একদা পুরুষ যদি পাপের বিরুদ্ধে
দাঁড়ায়ে নারীর পাশে নাহি নামে যুদ্ধে
অর্ধেক-কালি-মাখা সমাজের বুকটা
খাবে তবে বারে বারে শনির চাবুকটা।
এত কথা বৃথা বলা--যে পেয়েছে ক্ষমতা
নিঃসহায়ের প্রতি নাই তার মমতা,
আপনার পৌরুষ করি দিয়া লাঞ্ছিত
অবিচার করাটাই হয় তার বাঞ্ছিত।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারো,
তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।
তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে। '
আমি শুধু হাসি চুপটি করে।
যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে
সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।
স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে
আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,
দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।
দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে
যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে
তখন আমি ফুলের খেলা খেলে
টুপ্ করে মা , পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।
আবার আমি তোমার খোকা হব,
‘গল্প বলো' তোমায় গিয়ে কব।
তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা। '
আমি বলব, ‘ বলব না সে কথা। '(শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
যতকাল তুই শিশুর মতো
রইবি বলহীন,
অন্তরেরি অন্তঃপুরে
থাক্ রে ততদিন।
অল্প ঘায়ে পড়বি ঘুরে,
অল্প দাহে মরবি পুড়ে,
অল্প গায়ে লাগলে ধুলা
করবে যে মলিন--
অন্তরেরি অন্তঃপুরে
থাক্ রে ততদিন। যখন তোমার শক্তি হবে
উঠবে ভরে প্রাণ
আগুন-ভরা সুধা তাঁহার
করবি যখন পান--
বাইরে তখন যাস রে ছুটে,
থাকবি শুচি ধুলায় লুটে,
সকল বাঁধন অঙ্গে নিয়ে
বেড়াবি স্বাধীন--
অন্তরেরি অন্তঃপুরে
থাক্ রে ততদিন।
১৪ শ্রাবণ, ১৩১৭
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি,
নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ ।
দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি,
হাসিলে ফুটিয়া পড়ে উষার আভাস ।
হৃদয় উড়িতে চায় হোথায় একাকী
আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস ।
ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি,
হোথায় হারাতে চায় এ গীত-উচ্ছ্বাস ।
তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন,
বিমল নীলিমা তার শান্ত সুকুমার,
যদি নিয়ে যাই ওই শূন্য হয়ে পার
আমার দুখানি পাখা কনকবরন --
হৃদয় চাতক হয়ে চাবে অশ্রুধার,
হৃদয়চকোর চাবে হাসির কিরণ ।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
রজনী একাদশী
পোহায় ধীরে ধীরে,
রঙিন মেঘমালা
উষারে বাঁধে ঘিরে।
আকাশে ক্ষীণ শশী
আড়ালে যেতে চায়,
দাঁড়ায়ে মাঝখানে
কিনারা নাহি পায়।
এ-হেন কালে যেন
মায়ের পানে মেয়ে
রয়েছে শুকতারা
চাঁদের মুখে চেয়ে।
কে তুমি মরি মরি
একটুখানি প্রাণ।
এনেছ কী না জানি
করিতে ওরে দান।
মহিমা যত ছিল
উদয়-বেলাকার
যতেক সুখসাথি
এখনি যাবে যার,
পুরানো সব গেল—
নূতন তুমি একা
বিদায়-কালে তারে
হাসিয়া দিলে দেখা।
ও চাঁদ যামিনীর
হাসির অবশেষ,
ও শুধু অতীতের
সুখের স্মৃতিলেশ।
তারারা দ্রুতপদে
কোথায় গেছে সরে—
পারে নি সাথে যেতে,
পিছিয়ে আছে পড়ে।
তাদেরই পানে ও যে
নয়ন ছিল মেলি,
তাদেরই পথে ও যে
চরণ ছিল ফেলি,
এমন সময়ে কে
ডাকিলে পিছু-পানে
একটি আলোকেরই
একটু মৃদু গানে।
গভীর রজনীর
রিক্ত ভিখারিকে
ভোরের বেলাকার
কী লিপি দিলে লিখে।
সোনার-আভা-মাখা
কী নব আশাখানি
শিশির-জলে ধুয়ে
তাহারে দিলে আনি।
অস্ত-উদয়ের
মাঝেতে তুমি এসে
প্রাচীন নবীনেরে
টানিছ ভালোবেসে—
বধূ ও বর-রূপে
করিলে এক-হিয়া
করুণ কিরণের
গ্রন্থি বাঁধি দিয়া। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
এই দেহটির ভেলা নিয়ে দিয়েছি সাঁতার গো,
এই দু-দিনের নদী হব পার গো।
তার পরে যেই ফুরিয়ে যাবে বেলা,
ভাসিয়ে দেব ভেলা,
তার পরে তার খবর কী যে ধারি নে তার ধার গো,
তার পরে সে কেমন আলো, কেমন অন্ধকার গো।
আমি যে অজানার যাত্রী সেই আমার আনন্দ।
সেই তো বাধায় সেই তো মেটায় দ্বন্দ্ব।
জানা আমায় যেমনি আপন ফাঁদে শক্ত করে বাঁধে
অজানা সে সামনে এসে হঠাৎ লাগায় ধন্দ,
এক-নিমেষে যায় গো ফেঁসে অমনি সকল বন্ধ।
অজানা মোর হালের মাঝি, অজানাই তো মুক্তি
তার সনে মোর চিরকালের চুক্তি।
ভয় দেখিয়ে ভাঙায় আমার ভয়
প্রেমিক সে নির্দয়।
মানে না সে বুদ্ধিসুদ্ধি বৃদ্ধজনার যুক্তি,
মুক্তারে সে মুক্ত করে ভেঙে তাহার শুক্তি।
ভাবিস বসে যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরবে।
সেই কূলে কি এই তরী আর ভিড়বে।
ফিরবে না রে, ফিরবে না আর, ফিরবে না,
সেই কূলে আর ভিড়বে না।
সামনেকে তুই ভয় করেছিস, পিছন তোরে ঘিরবে
এমনি কি তুই ভাগ্যহারা? ছিঁড়বে বাঁধন ছিঁড়বে।
ঘন্টা যে ওই বাজল কবি, হোক রে সভাভঙ্গ,
জোয়ার-জলে উঠেছে তরঙ্গ।
এখনো সে দেখায় নি তার মুখ,
তাই তো দোলে বুক।
কোন্ রূপে যে সেই অজানার কোথায় পাব সঙ্গ,
কোন্ সাগরের কোন্ কূলে গো কোন্ নবীনের রঙ্গ।
পদ্মাতীরে, ২৬ মাঘ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
ছাতা বলে, ধিক্ ধিক্ মাথা মহাশয়,
এ অন্যায় অবিচার আমারে না সয়।
তুমি যাবে হাটে বাটে দিব্য অকাতরে,
রৌদ্র বৃষ্টি যতকিছু সব আমা-’পরে।
তুমি যদি ছাতা হতে কী করিতে দাদা?
মাথা কয়, বুঝিতাম মাথার মর্যাদা,
বুঝিতাম তার গুণে পরিপূর্ণ ধরা,
মোর একমাত্র গুণ তারে রক্ষা করা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আজু সখি , মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু ,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
দোঁহার পানে চায় ।
যুবনমদবিলসিত
পুলকে হিয়া উলসিত ,
অবশ তনু অলসিত
মূরছি জনু যায় ।
আজু মধু চাঁদনী
প্রাণউনমাদনী ,
শিথিল সব বাঁধনী ,
শিথিল ভই লাজ ।
বচন মৃদু মরমর,
কাঁপে রিঝ থরথর ,
শিহরে তনু জরজর
কুসুমবনমাঝ ।
মলয় মৃদু কলয়িছে ,
চরণ নহি চলয়িছে ,
বচন মুহু খলয়িছে ,
অঞ্চল লুটায় ।
আধফুট শতদল
বায়ুভরে টলমল
আঁখি জনু ঢলঢল
চাহিতে নাহি চায় ।
অলকে ফুল কাঁপয়ি
কপোলে পড়ে ঝাঁপয়ি ,
মধু-অনলে তাপয়ি ,
খসয়ি পড়ু পায় ।
ঝরই শিরে ফুলদল ,
যমুনা বহে কলকল ,
হাসে শশি ঢলঢল —
ভানু মরি যায় ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
গীতিগাথা
|
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে
মৈত্র মহাশয় যাবেন সাগরসংগমে
তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি
কত বালবৃদ্ধ নরনারী; নৌকা দুটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে। পুণ্য লোভাতুর
মোক্ষদা কহিল আসি, "হে দাদাঠাকুর,
আমি তব হব সাথি।' বিধবা যুবতী,
দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি,
কেবল মিনতি করে--অনুরোধ তার
এড়ানো কঠিন বড়ো--"স্থান কোথা আর'
মৈত্র কহিলেন তারে। "পায়ে ধরি তব'
বিধবা কহিল কাঁদি, "স্থান করি লব
কোনোমতে এক ধারে।' ভিজে গেল মন,
তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালো ব্রাহ্মণ,
"নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?'
উত্তর করিল নারী, "রাখাল? সে রবে
আপন মাসির কাছে। তার জন্মপরে
বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে,
বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন
আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন
মানুষ করেছে যত্নে--সেই হতে ছেলে
মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে।
দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন
মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন
কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে
মার চেয়ে আপনার মাসির বুকে।'সম্মত হইল বিপ্র। মোক্ষদা সত্বর
প্রস্তুত হইল বাঁধি জিনিস-পত্তর,
প্রণমিয়া গুরুজনে, সখীদলবলে
ভাসাইয়া বিদায়ের শোক-অশ্রুজলে।
ঘাটে আসি দেখে--সেথা আগেভাগে ছুটি
রাখাল বসিয়া আছে তরী-'পরে উঠি
নিশ্চিন্ত নীরবে। "তুই হেথা কেন ওরে'
মা শুধালো; সে কহিল, "যাইব সাগরে।'
"যাইবি সাগরে! আরে, ওরে দস্যু ছেলে,
নেমে আয়।' পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে
সে কহিল দুটি কথা, "যাইব সাগরে।'
যত তার বাহু ধরি টানাটানি করে
রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে
ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে,
"থাক্ থাক্ সঙ্গে যাক্।' মা রাগিয়া বলে
"চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!'
যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে
অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে
বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন
"নারায়ণ নারায়ণ' করিল স্মরণ।
পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্বদেহে
করুণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে।
মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়,
"ছি ছি ছি এমন কথা বলিবার নয়।'রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা--
অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা
ছুটে আসি বলে, "বাছা, কোথা যাবি ওরে!'
রাখাল কহিল হাসি, "চলিনু সাগরে,
আবার ফিরিব মাসি!' পাগলের প্রায়
অন্নদা কহিল ডাকি, "ঠাকুরমশায়,
বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,
কে তাহারে সামালিবে? জন্ম হতে তার
মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও--
কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।'
রাখাল কহিল, "মাসি, যাইব সাগরে,
আবার ফিরিব আমি।' বিপ্র স্নেহভরে
কহিলেন, "যতক্ষণ আমি আছি ভাই,
তোমার রাখাল লাগি কোনো ভয় নাই।
এখন শীতের দিন শান্ত নদীনদ,
অনেক যাত্রীর মেলা, পথের বিপদ
কিছু নাই; যাতায়াত মাস দুই কাল,
তোমারে ফিরায়ে দিব তোমার রাখাল।'শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি,
দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী
অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাতশিশিরে
ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে।যাত্রীদল ফিরে আসে; সাঙ্গ হল মেলা।
তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্নবেলা
জোয়ারের আশে। কৌতূহল অবসান,
কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ
মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।
মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর,
লোলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রূর
খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা
ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা
মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।
হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমূক,
অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন,
সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন
শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে
অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে
অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে
দিগন্তবিস্তৃত তব শান্ত বক্ষ-পানে!চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
অধীর উৎসুক কণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে,
"ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার?
সহসা স্তিমিত জলে আবেগসঞ্চার
দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে।
ফিরিল তরীর মুখ, মৃদু আর্তনাদে
কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দ গীতে
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে--
আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি
ত্বরিত উত্তর-মুখে খুলে দিল তরী।
রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে,
"দেশে পঁহুছিতে আর কত দিন আছে?'সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে
উত্তর-বায়ুর বেগ ক্রমে ওঠে বেড়ে।
রূপনারানের মুখে পড়ি বালুচর
সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর
জোয়ারের স্রোতে আর উত্তরমীরে
উত্তাল উদ্দাম। "তরণী ভিড়াও তীরে'
উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল।
কোথা তীর? চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল
আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি
লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি
ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা
অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা,
অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি
প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি
উদ্ধতবিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল,
ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল
মূঢ়সম। তীব্র শীতপবনের সনে
মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে
কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক্,
কেহ বা ক্রন্দন করে ছাড়ে ঊর্ধ্বডাক
ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে
চক্ষু মুদি করে জপ। জননীর বুকে
রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে।
তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে,
"বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তোমাদের কেউ--
যা মেনেছে দেয় নাই, তাই এত ঢেউ,
অসময়ে এ তুফান! শুন এই বেলা,
করহ মানত রক্ষা; করিয়ো না খেলা
ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।' যার যত ছিল
অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল
না করি বিচার। তবু তখনি পলকে
তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে।
মাঝি কহে পুনর্বার, "দেবতার ধন
কে যায় ফিরায়ে লয়ে এই বেলা শোন্।'
ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি
মোক্ষদারে লক্ষ্য করি, "এই সে রমণী
দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে
চুরি করে নিয়ে যায়।' "দাও তারে ফেলে'
এক বাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর
যাত্রী সবে। কহে নারী, "হে দাদাঠাকুর,
রক্ষা করো, রক্ষা করো!' দুই দৃঢ় করে
রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে।
র্ভৎসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ,
"আমি তোর রক্ষাকর্তা! রোষে নিশ্চেতন
মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে,
শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে!
শোধ্ দেবতার ঋণ; সত্য ভঙ্গ করে
এতগুলি প্রাণী তুই ডুবাবি সাগরে!'মোক্ষদা কহিল, "অতি মূর্খ নারী আমি,
কী বলেছি রোষবশে--ওগো অন্তর্যামী,
সেই সত্য হল? সে যে মিথ্যা কতদূর
তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর?
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা?
শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা?'
বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাঁড়ি
বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি
মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি
ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি
দন্তে দন্তে চাপি বলে। কে তারে সহসা
মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা,
দংশিল বৃশ্চিকদংশ। "মাসি! মাসি! মাসি!'
বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি
নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক।
চীৎকারি উঠিল বিপ্র, "রাখ্ রাখ্ রাখ্!'
চকিতে হেরিল চাহি মূর্ছি আছে প'ড়ে
মোক্ষদা চরণে তাঁর, মুহূর্তের তরে
ফুটন্ত তরঙ্গমাঝে মেলি আর্ত চোখ
"মাসি' বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক
অনন্ততিমিরতলে; শুধু ক্ষীণ মুঠি
বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি
আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
"ফিরায়ে আনিব তোরে' কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে
ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে--
আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
যাহা-কিছু বলি আজি সব বৃথা হয়,
মন বলে মাথা নাড়ি—এ নয়, এ নয়।
যে কথায় প্রাণ মোর পরিপূর্ণতম
সে কথা বাজে না কেন এ বীণায় মম।
সে শুধু ভরিয়া উঠি অশ্রুর আবেগে
হৃদয়আকাশ ঘিরে ঘনঘোর মেঘে;
মাঝে মাঝে বিদ্যুতের বিদীর্ণ রেখায়
অন্তর করিয়া ছিন্ন কী দেখাতে চায়?
মৌন মূক মূঢ়-সম ঘনায়ে আঁধারে
সহসা নিশীথরাত্রে কাঁদে শত ধারে।
বাক্যভারে রুদ্ধকণ্ঠ, রে স্তম্ভিত প্রাণ,
কোথায় হারায়ে এলি তোর যত গান।
বাঁশি যেন নাই, বৃথা নিশ্বাস কেবল—
রাগিনীর পরিবর্তে শুধু অশ্রুজল।
(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আছি আমি বিন্দুরূপে, হে অন্তরযামী
আছি আমি বিশ্বকেন্দ্রস্থলে। “আছি আমি’
এ কথা স্মরিলে মনে মহান্ বিস্ময়
আকুল করিয়া দেয়,স্তব্ধ এ হৃদয়
প্রকাণ্ড রহস্যভারে। “আছি আর আছে’
অন্তহীন আদি প্রহেলিকা, কার কাছে
শুধাইব অর্থ এর! তত্ত্ববিদ্ তাই
কহিতেছে,”এ নিখিলে আর কিছু নাই,
শুধু এক আছে।’ করে তারা একাকার
অস্তিত্বরহস্যরাশি করি অস্বীকার।
একমাত্র তুমি জান এ ভবসংসারে
যে আদি গোপন তত্ত্ব, আমি কবি তারে
চিরকাল সবিনয়ে স্বীকার করিয়া
অপার বিস্ময়ে চিত্ত রাখিব ভরিয়া। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মাস্টারি-শাসনদুর্গে সিঁধকাটা ছেলে
ক্লাসের কর্তব্য ফেলে
জানি না কী টানে
ছুটিতাম অন্দরের উপেক্ষিত নির্জন বাগানে ।
পুরোনো আমড়াগাছ হেলে আছে
পাঁচিলের কাছে ,
দীর্ঘ আয়ু বহন করিছে তার
পুঞ্জিত নিঃশব্দ স্মৃতি বসন্তবর্ষার ।
লোভ করি নাই তার ফলে ,
শুধু তার তলে
সে সঙ্গরহস্য আমি করিতাম লাভ
যার আবির্ভাব
অলক্ষ্যে ব্যাপিয়া আছে সর্ব জলে স্থলে ।
পিঠ রাখি কুঞ্চিত বল্কলে
যে পরশ লভিতাম
জানি না তাহার কোনো নাম ;
হয়তো সে আদিম প্রাণের
আতিথ্যদানের
নিঃশব্দ আহ্বান ,
যে প্রথম প্রাণ
একই বেগ জাগাইছে গোপন সঞ্চারে
রসরক্তধারে
মানবশিরায় আর তরুর তন্তুতে ,
একই স্পন্দনের ছন্দ উভয়ের অণুতে অণুতে ।
সেই মৌনী বনস্পতি
সুবৃহৎ আলস্যের ছদ্মবেশে অলক্ষিতগতি
সূক্ষ্ম সম্বন্ধের জাল প্রসারিছে নিত্যই আকাশে ,
মাটিতে বাতাসে ,
লক্ষ লক্ষ পল্লবের পাত্র লয়ে
তেজের ভোজের পানালয়ে ।
বিনা কাজে আমিও তেমনি বসে থাকি
ছায়ায় একাকী ,
আলস্যের উৎস হতে
চৈতন্যের বিবিধ দিগ্বাহী স্রোতে
আমার সম্বন্ধ চরাচরে
বিস্তারিছে অগোচরে
কল্পনার সূত্রে বোনা জালে
দূর দেশে দূর কালে ।
প্রাণে মিলাইতে প্রাণ
সে বয়সে নাহি ছিল ব্যবধান ;
নিরুদ্ধ করে নি পথ ভাবনার স্তূপ ;
গাছের স্বরূপ
সহজে অন্তর মোর করিত পরশ ।
অনাদৃত সে বাগান চায় নাই যশ
উদ্যানের পদবীতে ।
তারে চিনাইতে
মালীর নিপুণতার প্রয়োজন কিছু ছিল নাকো ।
যেন কী আদিম সাঁকো
ছিল মোর মনে
বিশ্বের অদৃশ্য পথে যাওয়ার আসার প্রয়োজনে । কুলগাছ দক্ষিণে কুয়োর ধারে ,
পুবদিকে নারিকেল সারে সারে ,
বাকি সব জঙ্গল আগাছা ।
একটা লাউয়ের মাচা
কবে যত্ন ছিল কারো , ভাঙা চিহ্ন রেখে গেছে পাছে ।
বিশীর্ণ গোলকচাঁপা-গাছে
পাতাশূন্য ডাল
অভুগ্নের ক্লিষ্ট ইশারার মতো । বাঁধানো চাতাল ;
ফাটাফুটো মেঝে তার , তারি থেকে
গরিব লতাটি যেত চোখে-না-পড়ার ফুলে ঢেকে ।
পাঁচিল ছ্যাৎলা-পড়া
ছেলেমি খেয়ালে যেন রূপকথা গড়া
কালের লেখনি-টানা নানামতো ছবির ইঙ্গিতে ,
সবুজে পাটলে আঁকা কালো সাদা রেখার ভঙ্গিতে ।
সদ্য ঘুম থেকে জাগা
প্রতি প্রাতে নূতন করিয়া ভালো-লাগা
ফুরাত না কিছুতেই ।
কিসে যে ভরিত মন সে তো জানা নেই ।
কোকিল দোয়েল টিয়ে এ বাগানে ছিল না কিছুই ,
কেবল চড়ুই ,
আর ছিল কাক ।
তার ডাক
সময় চলার বোধ
মনে এনে দিত । দশটা বেলার রোদ
সে ডাকের সঙ্গে মিশে নারিকেল-ডালে
দোলা খেত উদাস হাওয়ার তালে তালে ।
কালো অঙ্গে চটুলতা , গ্রীবাভঙ্গি , চাতুরী সতর্ক আঁখিকোণে ,
পরস্পর ডাকাডাকি ক্ষণে ক্ষণে —
এ রিক্ত বাগানটিরে দিয়েছিল বিশেষ কী দাম ।
দেখিতাম , আবছায়া ভাবনায় ভালোবাসিতাম ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কমল ফুটে অগম জলে,
তুলিবে তারে কেবা।
সবার তরে পায়ের তলে
তৃণের রহে সেবা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ফুরিয়ে গেল পৌষের দিন;
কৌতূহলী ভোরের আলো
কুয়াশার আবরণ দিলে সরিয়ে।
হঠাৎ দেখি শিশিরে-ভেজা বাতাবি গাছে
ধরেছে কচি পাতা;
সে যেন আপনি বিস্মিত।
একদিন তমসার কূলে বাল্মীকি
আপনার প্রথম নিশ্বসিত ছন্দে
চকিত হয়েছিলেন নিজে,--
তেমনি দেখলেম ওকে।
অনেকদিনকার নিঃশব্দ অবহেলা থেকে
অরুণ-আলোতে অকুণ্ঠিত বাণী এনেছে
এই কয়টি কিশলয়;
সে যেন সেই একটুখানি কথা
তুমিই বলতে পারতে,
কিন্তু না ব'লে গিয়েছ চলে।
সেদিন বসন্ত ছিল অনতিদূরে;
তোমার আমার মাঝখানে ছিল
আধ-চেনার যবনিকা
কেঁপে উঠল সেটা মাঝে মাঝে;
মাঝে মাঝে তার একটা কোণ গেল উড়ে;
দুরন্ত হয়ে উঠল দক্ষিণ বাতাস,
তবু সরাতে পারেনি অন্তরাল।
উচ্ছৃঙ্খল অবকাশ ঘটল না;
ঘণ্টা গেল বেজে,
সায়াহ্নে তুমি চলে গেলে অব্যক্তের অনালোকে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
এবার নীরব করে দাও হে তোমার
মুখর কবিরে।
তার হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে
বাজাও গভীরে।
নিশীথরাতের নিবিড় সুরে
বাঁশিতে তান দাও হে পুরে
যে তান দিয়ে অবাক কর’
গ্রহশশীরে।যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে
জীবন-মরণে,
গানের টানে মিলুক এসে
তোমার চরণে।
বহুদিনের বাক্যরাশি
এক নিমেষে যাবে ভাসি,
একলা বসে শুনব বাঁশি
অকূল তিমিরে।৩০ চৈত্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আসনতলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব।
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।
কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ,
চিরজনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো,
অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব।
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।আমি তোমার যাত্রীদলের রব পিছে,
স্থান দিয়ো হে আমায় তুমি সবার নীচে।
প্রসাদ লাগি কত লোকে আসে ধেয়ে,
আমি কিছুই চাইব না তো রইব চেয়ে;
সবার শেষে বাকি যা রয় তাহাই লব।
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।শান্তিনিকেতন, ১০ পৌষ, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
উজ্জ্বলে ভয় তার,
ভয় মিট্মিটেতে,
ঝালে তার যত ভয়
তত ভয় মিঠেতে।ভয় তার পশ্চিমে,
ভয় তার পূর্বে,
যে দিকে তাকায় ভয়
সাথে সাথে ঘুরবে।
ভয় তার আপনার
বাড়িটার ইঁটেতে,
ভয় তার অকারণে
অপরের ভিটেতে।ভয় তার বাহিরেতে,
ভয় তার অন্তরে,
ভয় তার ভূত-প্রেতে,
ভয় তার মন্তরে।
দিনের আলোতে ভয়
সামনের দিঠেতে,
রাতের আঁধারে ভয়
আপনারি পিঠেতে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ,
জনমেছি দু দিনের তরে--
যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে
গান গাই আনন্দের ভরে।
এ আমার গানগুলি দু দণ্ডের গান
রবে না রবে না চিরদিন--
পুরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস,
পশ্চিমেতে হইবে বিলীন।তোরা ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ,
জগতের আনন্দ যে তোরা,
জগতের বিষাদ-পাসরা।
পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী
তোরা তার একেকটি ঢেউ,
কখন উঠিলি আর কখন মিলালি
জানিতেও পারিল না কেউ। নাই তোর নাই রে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা
ভেসে আসে, সাগরে মিশায়--
জান না কোথায় তারা যায়!
একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর
রচিছে বিশাল মহাদেশ,
না জানি কবে তা হবে শেষ!
মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান,
জান না তো কোথায় তা যায়!
আকাশের সাগরসীমায়!
আকাশ-সমুদ্র-তলে গোপনে গোপনে
গীতরাজ্য হতেছে সৃজন,
যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে
সেইখানে করিছে গমন।
আকাশ পুরিয়া যাবে শেষ,
উঠিবে গানের মহাদেশ। নাই তোর নাই রে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল
দুটি ভাই গলাগলি করি
দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল
দুটি সখা হাতে হাতে ধরি,
দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে
ঘুমায়ে করিছে স্তনপান,
ঘুমন্ত মুখের ‘পরে বরষিছে স্নেহধারা
স্নেহমাখা নত দু’নয়ান,
দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক
বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি--
কত কী যে দেখেছিনু, হয়তো সে-সব ছবি
আজ আমি গিয়েছি পাসরি।
তা বলে নাহি কি তাহা মনে?
ছবিগুলি মেশেনি জীবনে?
স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি
রচিতেছে জীবন আমার--
কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে
চিনিতে পারি নে তাহা আর।
হয়তো অনেকদিন দেখেছিনু ছবি এক
দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে--
তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি
সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে।
হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু পাখি এক
আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি,
সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি
প্রাণ মন উঠিছে উথুলি।
সকলি মিশেছে আসি হেথা,
জীবনে কিছু না যায় ফেলা--
এই-যে যা-কিছু চেয়ে দেখি
এ নহে কেবলি ছেলেখেলা।এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে
নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি,
চারি দিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম
জীবনের স্রোত মিশে আসি।
সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা,
কোটি কোটি তারা হতে ঝরে,
জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ
ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে--
মেশে আসি সেই সিন্ধু-’পরে।
পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম
সেই মহাসাগর-উদ্দেশে,
আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি
অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে--
সাগরে পড়িব অবশেষে।
জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে
রচিত হতেছে পলে পলে
অনন্ত-জীবন মহাদেশ,
কে জানে হবে কি তাহা শেষ!তাই বলি, প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি--
তুই যাবি, গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে
তুই আর তোর গানগুলি।
মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে,
একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ,
তুই আর তোর এই গান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে , কন্ঠে বিমলিন মালা ।
বিরহবিষে দহি বহি গল রয়নী ,
নহি নহি আওল কালা ।
বুঝনু বুঝনু সখি বিফল বিফল সব ,
বিফল এ পীরিতি লেহা —
বিফল রে এ মঝু জীবন যৌবন ,
বিফল রে এ মঝু দেহা !
চল সখি গৃহ চল , মঞ্চ নয়নজল ,
চল সখি চল গৃহকাজে ,
মালতিমালা রাখহ বালা ,
ছি ছি সখি মরু মরু লাজে ।
সখি লো দারুণ আধিভরাতুর
এ তরুণ যৌবন মোর ,
সখি লো দারুণ প্রণয়হলাহল
জীবন করল অঘোর ।
তৃষিত প্রাণ মম দিবসযামিনী
শ্যামক দরশন আশে ,
আকুল জীবন থেহ ন মানে ,
অহরহ জ্বলত হুতাশে ।
সজনি , সত্য কহি তোয় ,
খোয়াব কব হম শ্যামক প্রেম
সদা ডর লাগয়ে মোয় ।
হিয়ে হিয়ে অব রাখত মাধব ,
সো দিন আসব সখি রে -
বাত ন বোলবে , বদন ন হেরবে ,
মরিব হলাহল ভখি রে ।
ঐস বৃথা ভয় না কর বালা ,
ভানু নিবেদয় চরণে ,
সুজনক পীরিতি নৌতুন নিতি নিতি ,
নহি টুটে জীবনমরণে ।(ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
বাক্যের যে ছন্দোজাল শিখেছি গাঁথিতে
সেই জালে ধরা পড়ে
অধরা যা চেতনার সতর্কতা ছিল এড়াইয়া
আগোচরে মনের গহনে।
নামে বাঁধিবারে চাই, না মানে নামের পরিচয়।
মূল্য তার থাকে যদি
দিনে দিনে হয় তাহা জানা
হাতে হাতে ফিরে।
অকস্মাৎ পরিচয়ে বিস্ময় তাহার
ভুলায় যদি বা,
লোকালয়ে নাহি পায় স্থান,
মনের সৈকততটে বিকীর্ণ সে রহে কিছুকাল,
লালিত যা গোপনের
প্রকাশ্যের অপমানে
দিনে দিনে মিশায় বালুতে।
পণ্যহাটে অচিহ্নিত পরিত্যক্ত রিক্ত এ জীর্ণতা
যুগে যুগে কিছু কিছু দিয়ে গেছে অখ্যাতের দান
সাহিত্যের ভাষা-মহাদ্বীপে
প্রাণহীন প্রবালের মতো। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চরে
চখাচখির মেলা।
ওরে যাবো না আজ ঘরে রে ভাই,
যাবো না আজ ঘরে!
ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ
নেব রে লুঠ করে।
যেন জোয়ার জলে ফেনার রাশি
বাতাসে আজ ফুটেছে হাসি,
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
কাটবে সারা বেলা।
sসালঃ ১৩১৩
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
পাখি যবে গাহে গান,
জানে না, প্রভাতরবিরে সে তার
প্রাণের অর্ঘ্যদান।
ফুল ফুটে বন-মাঝে—
সেই তো তাহার পূজানিবেদন,
আপনি সে জানে না যে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
গোধূলিতে নামল আঁধার ,
ফুরিয়ে গেল বেলা ,
ঘরের মাঝে সাঙ্গ হল
চেনা মুখের মেলা ।
দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা
নয়ন ছলোছলো ,
এবার তবে ঘরের প্রদীপ
বাইরে নিয়ে চলো ।
মিলনরাতে সাক্ষী ছিল যারা
আজো জ্বলে আকাশে সেই তারা ।
পাণ্ডু-আঁধার বিদায়রাতের শেষে
যে তাকাত শিশিরসজল শূন্যতা-উদ্দেশে
সেই তারকাই তেমনি চেয়েই আছে
অস্তলোকের প্রান্তদ্বারের কাছে ।
অকারণে তাই এ প্রদীপ জ্বালাই আকাশ-পানে —
যেখান হতে স্বপ্ন নামে প্রাণে ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা-
বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।
সেখানে নিভৃত অবকাশে তুমি
সংগ্রহ করছিলে দুর্গমের রহস্য,
চিনছিলে জলস্থল-আকাশের দুর্বোধ সংকেত,
প্রকৃতির দৃষ্টি-অতীত জাদু
মন্ত্র জাগাচ্ছিল তোমার চেতনাতীত মনে।
বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে
বিরূপের ছদ্মবেশে,
শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে
আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচণ্ড মহিমায়
তাণ্ডবের দুন্দুভিনিনাদে।। হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিণ্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তেই তাদের পাড়ায় পাড়ায়
মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা
সকালে সন্ধ্যায়, দয়াময় দেবতার নামে;
শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে;
কবির সংগীতে বেজে উঠছিল
সুন্দরের আরাধনা।। আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তরের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো 'ক্ষমা কর'-
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আমার মা না হয়ে তুমি
আর - কারো মা হলে
ভাবছ তোমায় চিনতেম না ,
যেতেম না ঐ কোলে ?
মজা আরো হত ভারি ,
দুই জায়গায় থাকত বাড়ি ,
আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে ,
তুমি পারের গাঁয়ে ।
এইখানেতেই দিনের বেলা
যা - কিছু সব হত খেলা
দিন ফুরোলেই তোমার কাছে
পেরিয়ে যেতেম নায়ে ।
হঠাৎ এসে পিছন দিকে
আমি বলতেম , ' বল্ দেখি কে ?'
তুমি ভাবতে , চেনার মতো
চিনি নে তো তবু ।
তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি বলতেম গলা ধরে —
' আমায় তোমার চিনতে হবেই ,
আমি তোমার অবু !'
ঐ পারেতে যখন তুমি
আনতে যেতে জল ,
এই পারেতে তখন ঘাটে
বল্ দেখি কে বল্ ?
কাগজ - গড়া নৌকোটিকে
ভাসিয়ে দিতেম তোমার দিকে ,
যদি গিয়ে পৌঁছোত সে
বুঝতে কি , সে কার ?
সাঁতার আমি শিখিনি যে
নইলে আমি যেতেম নিজে ,
আমার পারের থেকে আমি
যেতেম তোমার পার ।
মায়ের পারে অবুর পারে
থাকত তফাত , কেউ তো কারে
ধরতে গিয়ে পেত নাকো ,
রইত না একসাথে ।
দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে
দেখা - দেখি দূরে দূরে —
সন্ধেবেলায় মিলে যেত
অবুতে আর মাতে ।
কিন্তু হঠাৎ কোনোদিনে
যদি বিপিন মাঝি
পার করতে তোমার পারে
নাই হত মা রাজি ।
ঘরে তোমার প্রদীপ জ্বেলে
ছাতের ‘পরে মাদুর মেলে
বসতে তুমি , পায়ের কাছে
বসত ক্ষান্তবুড়ি ,
উঠত তারা সাত ভায়েতে ,
ডাকত শেয়াল ধানের খেতে ,
উড়ো ছায়ার মতো বাদুড়
কোথায় যেত উড়ি ।
তখন কি মা , দেরি দেখে
ভয় হত না থেকে থেকে
পার হয়ে মা , আসতে হতই
অবু যেথায় আছে ।
তখন কি আর ছাড়া পেতে ?
দিতেম কি আর ফিরে যেতে ?
ধরা পড়ত মায়ের ওপার
অবুর পারের কাছে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আঁধার কুঁড়ির বাঁধন টুটে চাঁদের ফুল উঠেছে ফুটে॥
তার গন্ধ কোথায়, গন্ধ কোথায় রে।
গন্ধ আমার গভীর ব্যথায় হৃদয়-মাঝে লুটে॥
ও কখন যাবে সরে, আকাশ হতে পড়বে ঝরে।
ওরে রাখব কোথায়, রাখব কোথায় রে।
রাখব ওরে আমার ব্যথায় গানের পত্রপুটে॥
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কঠিন পাথর কাটি
মূর্তিকর গড়িছে প্রতিমা।
অসীমেরে রূপ দিক্
জীবনের বাধাময় সীমা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
অনেক তিয়াষে করেছি ভ্ৰমণ
জীবন কেবলি খোঁজা।
অনেক বচন করেছি রচন,
জমেছে অনেক বোঝা।
যা পাই নি তারি লইয়া সাধনা
যাব কি সাগরপার।
যা গাই নি তারি বহিয়া বেদনা
ছিঁড়িবে বীণার তার? (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ছিন্ন করে লও হে মোরে
আর বিলম্ব নয়
ধুলায় পাছে ঝরে পড়ি
এই জাগে মোর ভয়।
এ ফুল তোমার মালার মাঝে
ঠাঁই পাবে কি, জানি না যে,
তবু তোমার আঘাতটি তার
ভাগ্যে যেন রয়।
ছিন্ন করো ছিন্ন করো
আর বিলম্ব নয়।কখন যে দিন ফুরিয়ে যাবে,
আসবে আঁধার করে,
কখন তোমার পূজার বেলা
কাটবে অগোচরে।
যেটুকু এর রঙ ধরেছে,
গন্ধে সুধায় বুক ভরেছে,
তোমার সেবায় লও সেটুকু
থাকতে সুসময়।
ছিন্ন করো ছিন্ন করো
আর বিলম্ব নয়।৩ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
হেলাভরে ধুলার 'পরে
ছড়াই কথাগুলো।
পায়ের তলে পলে পলে
গুঁড়িয়ে সে হয় ধুলো। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
শ্যামল সুন্দর সৌম্য, হে অরণ্যভূমি,
মানবের পুরাতন বাসগৃহ তুমি।
নিশ্চল নির্জীব নহ সৌধের মতন—
তোমার মুখশ্রীখানি নিত্যই নূতন
প্রাণে প্রেমে ভাবে অর্থে সজীব সচল।
তুমি দাও ছায়াখানি, দাও ফুল ফল,
দাও বস্ত্র, দাও শয্যা, দাও স্বাধীনতা;
নিশিদিন মর্মরিয়া কহ কত কথা
অজানা ভাষার মন্ত্র; বিচিত্র সংগীতে
গাও জাগরণগাথা; গভীর নিশীথে
পাতি দাও নিস্তব্ধতা অঞ্চলের মতো
জননীবক্ষের; বিচিত্র হিল্লোলে কত
খেলা কর শিশুসনে; বৃদ্ধের সহিত
কহ সনাতন বাণী বচন-অতীত। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
বয়স তখন ছিল কাঁচা; হালকা দেহখানা
ছিল পাখির মতো, শুধু ছিল না তার ডানা।
উড়ত পাশের ছাদের থেকে পায়রাগুলোর ঝাঁক,
বারান্দাটার রেলিং-'পরে ডাকত এসে কাক।
ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত গলির ওপার থেকে,
তপসিমাছের ঝুড়ি নিত গামছা দিয়ে ঢেকে।
বেহালাটা হেলিয়ে কাঁধে ছাদের 'পরে দাদা,
সন্ধ্যাতারার সুরে যেন সুর হত তাঁর সাধা।
জুটেছি বৌদিদির কাছে ইংরেজি পাঠ ছেড়ে,
মুখখানিতে-ঘের-দেওয়া তাঁর শাড়িটি লালপেড়ে।
চুরি ক'রে চাবির গোছা লুকিয়ে ফুলের টবে
স্নেহের রাগে রাগিয়ে দিতেম নানান উপদ্রবে।
কঙ্কালী চাটুজ্জে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে;
বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে।
দ্রুত লয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া;
থাকত আমার খাতা লেখা, পড়ে থাকত পড়া--
মনে মনে ইচ্ছে হত, যদিই কোনো ছলে
ভর্তি হওয়া সহজ হত এই পাঁচালির দলে
ভাব্না মাথায় চাপত নাকো ক্লাসে ওঠার দায়ে,
গান শুনিয়ে চলে যেতুম নতুন নতুন গাঁয়ে।
স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে বাড়ির কাছে এসে
হঠাৎ দেখি, মেঘ নেমেছে ছাদের কাছে ঘেঁষে।
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, রাস্তা ভাসে জলে,
ঐরাবতের শুঁড় দেখা দেয় জল-ঢালা সব নলে।
অন্ধকারে শোনা যেত রিম্ঝিমিনি ধারা,
রাজপুত্র তেপান্তরে কোথা সে পথহারা।
ম্যাপে যে-সব পাহাড় জানি, জানি যে-সব গাঙ
কুয়েন্লুন আর মিসিসিপি ইয়াংসিকিয়াং,
জানার সঙ্গে আধেক-জানা, দূরের থেকে শোনা,
নানা রঙের নানা সুতোয় সব দিয়ে জাল-বোনা,
নানারকম ধ্বনির সঙ্গে নানান চলাফেরা
সব দিয়ে এক হালকা জগৎ মন দিয়ে মোর ঘেরা,
ভাব্নাগুলো তারই মধ্যে ফিরত থাকি থাকি,
বানের জলে শ্যাওলা যেমন, মেঘের তলে পাখি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে।যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তোমার সাথে নিত্য বিরোধ
আর সহে না–
দিনে দিনে উঠছে জমে
কতই দেনা।
সবাই তোমায় সভার বেশে
প্রণাম করে গেল এসে,
মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই
মান রহে না। কী জানাব চিত্তবেদন,
বোবা হয়ে গেছে যে মন,
তোমার কাছে কোনো কথাই
আর কহে না।
ফিরায়ো না এবার তারে
লও গো অপমানের পারে,
করো তোমার চরণতলে
চির-কেনা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
নীরব বাঁশরিখানি বেজেছে আবার ।
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্তকানন-মাঝে বসন্তসমীরে ।
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত ।
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে
পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত ।
তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা
জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো ।
জগৎ-কমলবনে কমল-আসনা
কত দিন পরে বুঝি তাই এল ফিরে ।
সে এল না -- এল তার মধুর মিলন,
বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর!
দৃষ্টি তার ফিরে এল, কোথা সে নয়ন!
চুম্বন এসেছে তার, কোথা সে অধর!
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
হয় কি না হয় দেখা , ফিরি কি না ফিরি ,
দূরে গেলে এই মনে হয় ;
দুজনার মাঝখানে অন্ধকারে ঘিরি
জেগে থাকে সতত সংশয় ।
এত লোক , এত জন , এত পথ গলি ,
এমন বিপুল এ সংসার —
ভয়ে ভয়ে হাতে হাতে বেঁধে বেঁধে চল , ি
ছাড়া পেলে কে আর কাহার ।
তারায় তারায় সদা থাকে চোখে চোখে
অন্ধকারে অসীম গগনে ।
ভয়ে ভয়ে অনিমেষে কম্পিত আলোকে
বাঁধা থাকে নয়নে নয়নে ।
চৌদিকে অটল স্তব্ধ সুগভীর রাত্রি ,
তরুহীন মরুময় ব্যোম —
মুখে মুখে চেয়ে তাই চলে যত যাত্রী
চলে গ্রহ রবি তারা সোম ।
নিমেষের অন্তরালে কী আছে কে জানে ,
নিমেষে অসীম পড়ে ঢাকা —
অন্ধ কালতুরঙ্গম রাশ নাহি মানে ,
বেগে ধায় অদৃষ্টের চাকা ।
কাছে কাছে পাছে পাছে চলিবারে চাই ,
জেগে জেগে দিতেছি পাহারা ,
একটু এসেছে ঘুম — চমকি তাকাই
গেছে চলে কোথায় কাহারা !
ছাড়িয়ে চলিয়া গেলে কাঁদি তাই একা
বিরহের সমুদ্রের তীরে ।
অনন্তের মাঝখানে দু - দন্ডের দেখা
তাও কেন রাহু এসে ঘিরে !
মৃত্যু যেন মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যায় ,
পাঠায় সে বিরহের চর ।
সকলেই চলে যাবে , পড়ে রবে হায়
ধরণীর শূন্য খেলাঘর ।
গ্রহ তারা ধূমকেতু কত রবি শশী
শূন্য ঘেরি জগতের ভিড় ,
তারি মাঝে যদি ভাঙে , যদি যায় খসি
আমাদের দু - দন্ডের নীড় —
কোথায় কে হারাইব! কোন্ রাত্রিবেলা
কে কোথায় হইব অতিথি !
তখন কি মনে রবে দু - দিনের খেলা ,
দরশের পরশের স্মৃতি !
তাই মনে করে কি রে চোখে জল আসে
একটুকু চোখের আড়ালে !
প্রাণ যারে প্রাণের অধিক ভালোবাসে
সেও কি রবে না এক কালে !
আশা নিয়ে এ কি শুধু খেলাই কেবল —
সুখ দুঃখ মনের বিকার !
ভালোবাসা কাঁদে , হাসে , মোছে অশ্রুজল ,
চায় , পায় , হারায় আবার । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা - কাটা বুড়ি
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশো হাজার কুড়ি ।
সাদা সুতোয় জাল বোনে সে
হয় না বুনন সারা
পণ ছিল তার ধরবে জালে
লক্ষ কোটি তারা ।
হেনকালে কখন আঁখি
পড়ল ঘুমে ঢুলে ,
স্বপনে তার বয়সখানা
বেবাক গেল ভুলে ।
ঘুমের পথে পথ হারিয়ে ,
মায়ের কোলে এসে
পূর্ণ চাঁদের হাসিখানি
ছড়িয়ে দিল হেসে ।
সন্ধেবেলায় আকাশ চেয়ে
কী পড়ে তার মনে ।
চাঁদকে করে ডাকাডাকি ,
চাঁদ হাসে আর শোনে ।
যে - পথ দিয়ে এসেছিল
স্বপন - সাগর - তীরে
দু - হাত তুলে সে - পথ দিয়ে
চায় সে যেতে ফিরে ।
হেনকালে মায়ের মুখে
যেমনি আঁখি তোলে
চাঁদে ফেরার পথখানি যে
তক্খনি সে ভোলে ।
কেউ জানে না কোথায় বাসা ,
এল কী পথ বেয়ে ,
কেউ জানে না , এই মেয়ে সেই
আদ্যিকালের মেয়ে ।
বয়সখানার খ্যাতি তবু
রইল জগৎ জুড়ি —
পাড়ার লোকে যে দেখে সেই
ডাকে , ' বুড়ি বুড়ি ' ।
সব - চেয়ে যে পুরানো সে ,
কোন্ মন্ত্রের বলে
সব - চেয়ে আজ নতুন হয়ে
নামল ধরাতলে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
প্রভাতরবির ছবি আঁকে ধরা
সূর্যমুখীর ফুলে।
তৃপ্তি না পায়, মুছে ফেলে তায়,
আবার ফুটায়ে তুলে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়;
আর তো কিছুই নড়ে না রে
ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়।
ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,
চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,
ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা
অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।
আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,
দেখে না যে বাণ ডেকেছে
জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।
চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে
মাটির ‘পরে চরণ ফেলে ফেলে,
আছে অচল আসনখানা মেলে
যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়,
আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।
হঠাৎ আলো দেখবে যখন
ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা।
সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,
শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,
সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে
লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।
আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী
চিরকাল কি রইবে খাড়া।
পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি।
ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে
অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে,
ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে
ভুলগুলো সব আন্ রে বাছা-বাছা।
আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা।আন্ রে টেনে বাঁধা-পথের শেষে।
বিবাগী কর্ অবাধপানে,
পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে।
আপদ আছে, জানি অঘাত আছে,
তাই জেনে তো বক্ষে পরান নাচে,
ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি-পোড়োর কাছে
পথে চলার বিধিবিধান যাচা।
আয় প্রমুক্ত, আয় রে আমার কাঁচা।চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।
সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা,
ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা,
বসন্তেরে পরাস আকুল-করা
আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা,
আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কেন মার’ সিঁধ-কাটা ধূর্তে।
কাজ ওর দেয়ালটা খুঁড়তে।
তোমার পকেটটাকে করেছ কি ডোবা হে–
চিরদিন বহমান অর্থের প্রবাহে
বাধা দেবে অপরের পকেটটি পূরতে?
আর, যত নীতিকথা সে তো ওর চেনা না–
ওর কাছে অর্থনীতিটা নয় জেনানা;
বন্ধ ধনেরে তাই দেয় সদা ঘুরতে,
হেথা হতে হোথা তারে চালায় মুহূর্তে। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
যখন ছিলেম পথেরই মাঝখানে
মনটা ছিল কেবল চলার পানে
বোধ হত তাই, কিছুই তো নাই কাছে—
পাবার জিনিস সামনে দূরে আছে।
লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছব এই ঝোঁকে
সমস্ত দিন চলেছি একরোখে।
দিনের শেষে পথের অবসানে
মুখ ফিরে আজ তাকাই পিছু-পানে।
এখন দেখি পথের ধারে ধারে
পাবার জিনিস ছিল সারে সারে।
সামনে ছিল যে দূর সুমধুর
পিছনে আজ নেহারি সেই দূর। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
মুরগি পাখির ‘পরে
অন্তরে টান তার,
জীবে তার দয়া আছে
এই তো প্রমাণ তার।
বিড়াল চাতুরী ক’রে
পাছে পাখি নেয় ধরে
এই ভয়ে সেই দিকে
সদা আছে কান তার–
শেয়ালের খলতায়
ব্যথা পায় প্রাণ তার। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
সাঙ্গ হয়েছে রণ।
অনেক যুঝিয়া অনেক খুঁজিয়া
শেষ হল আয়োজন।
তুমি এসো এসো নারী,
আনো তব হেমঝারি।
ধুয়ে-মুছে দাও ধূলির চিহ্ন,
জোড়া দিয়ে দাও ভগ্ন-ছিন্ন,
সুন্দর করো সার্থক করো
পুঞ্জিত আয়োজন।
এসো সুন্দরী নারী,
শিরে লয়ে হেমঝারি।হাটে আর নাই কেহ।
শেষ করে খেলা ছেড়ে এনু মেলা,
গ্রামে গড়িলাম গেহ।
তুমি এসো এসো নারী,
আনো গো তীর্থবারি।
স্নিগ্ধহসিত বদন-ইন্দু,
সিঁথায় আঁকিয়া সিঁদুর-বিন্দু
মঙ্গল করো সার্থক করো
শূন্য এ মোর গেহ।
এসো কল্যাণী নারী,
বহিয়া তীর্থবারি।বেলা কত যায় বেড়ে।
কেহ নাহি চাহে খররবিদাহে
পরবাসী পথিকেরে।
তুমি এসো এসো নারী,
আনো তব সুধাবারি।
বাজাও তোমার নিষ্কলঙ্ক
শত-চাঁদে-গড়া শোভন শঙ্খ,
বরণ করিয়া সার্থক করো
পরবাসী পথিকেরে।
আনন্দময়ী নারী,
আনো তব সুধাবারি।স্রোতে যে ভাসিল ভেলা।
এবারের মতো দিন হল গত
এল বিদায়ের বেলা।
তুমি এসো এসো নারী,
আনো গো অশ্রুবারি।
তোমার সজল কাতর দৃষ্টি
পথে করে দিক করুণাবৃষ্টি,
ব্যাকুল বাহুর পরশে ধন্য
হোক বিদায়ের বেলা।
অয়ি বিষাদিনী নারী,
আনো গো অশ্রুবারি।আঁধার নিশীথরাতি।
গৃহ নির্জন, শূন্য শয়ন,
জ্বলিছে পূজার বাতি।
তুমি এসো এসো নারী,
আনো তর্পণবারি।
অবারিত করি ব্যথিত বক্ষ
খোলো হৃদয়ের গোপন কক্ষ,
এলো-কেশপাশে শুভ্র-বসনে
জ্বালাও পূজার বাতি।
এসো তাপসিনী নারী,
আনো তর্পণবারি। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
পাখি বলে ‘আমি চলিলাম',
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না',
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না'।
কিশলয় মাথাটি না তুলে
মরিয়া পড়িয়া গেল ঝরি,
সায়াহ্ন ধুমলঘন বাস
টানি দিল মুখের উপরি।
পাখি কেন গেল গো চলিয়া,
কেন ফুল কেন সে ফুটে না।
চপল মলয় সমীরণ
বনে বনে কেন সে ছুটে না।
শীতের হৃদয় গেছে চলে,
অসাড় হয়েছে তার মন,
ত্রিবলিবলিত তার ভাল
কঠোর জ্ঞানের নিকেতন।
জ্যোৎস্নার যৌবন-ভরা রূপ,
ফুলের যৌবন পরিমল,
মলয়ের বাল্যখেলা যত,
পল্লবের বাল্য - কোলাহল—
সকলি সে মনে করে পাপ,
মনে করে প্রকৃতির ভ্রম,
ছবির মতন বসে থাকা
সেই জানে জ্ঞানীর ধরম।
তাই পাখি বলে ‘চলিলাম',
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না'।
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না'।
আশা বলে ‘বসন্ত আসিবে',
ফুল বলে ‘আমিও আসিব',
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব',
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব'।
বসন্তের নবীন হৃদয়
নূতন উঠেছে আঁখি মেলে—
যাহা দেখে তাই দেখে হাসে,
যাহা পায় তাই নিয়ে খেলে।
মনে তার শত আশা জাগে,
কী যে চায় আপনি না বুঝে—
প্রাণ তার দশ দিকে ধায়
প্রাণের মানুষ খুঁজে খুঁজে।
ফুল ফুটে, তারো মুখ ফুটে—
পাখি গায়, সেও গান গায়—
বাতাস বুকের কাছে এলে
গলা ধ'রে দুজনে খেলায়।
তাই শুনি ‘বসন্ত আসিবে'
ফুল বলে ‘আমিও আসিব' ,
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব',
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব'।
শীত, তুমি হেথা কেন এলে।
উত্তরে তোমার দেশ আছে—
পাখি সেথা নাহি গাহে গান,
ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে।
সকলি তুষারমরুময়,
সকলিআঁধার জনহীন—
সেথায় একেলা বসি বসি
জ্ঞানী গো, কাটায়ো তব দিন।(শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
যে তোরে বাসেরে ভালো , তারে ভালোবেসে বাছা ,
চিরকাল সুখে তুই রোস্ ।
বিদায়! মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই ,
এখন তাহারি তুই হোস্ ।
আমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তুই যা রে
এক পরিবার হতে অন্য পরিবারে ।
সুখ শান্তি নিয়ে যাস্ তোর পাছে পাছে ,
দুঃখ জ্বালা রেখে যাস্ আমাদের কাছে ।
হেথা রাখিতেছি ধরে , সেথা চাহিতেছে তোরে ,
দেরী হ ' ল , যা ' তাদের কাছে ।
প্রাণের বাছাটি মোর , লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই ,
দুইটি কর্তব্য তোর আছে ।
একটু বিলাপ যাস আমাদের দিয়ে ,
তাহাদের তরে আশা যাস সাথে নিয়ে ;
এক বিন্দু অশ্রু দিস আমাদের তরে ,
হাসিটি লইয়া যাস তাহাদের ঘরে । — Victor Hugo (অনূদিত কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
বিশ্বলক্ষ্মী,
তুমি একদিন বৈশাখে
বসেছিলে দারুণ তপস্যায়
রুদ্রের চরণতলে।
তোমার তনু হল উপবাসে শীর্ণ,
পিঙ্গল তোমার কেশপাশ।
দিনে দিনে দুঃখকে তুমি দগ্ধ করলে
দুঃখেরি দহনে,
শুষ্ককে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলে
পূজার পুণ্যধূপে।
কালোকে আলো করলে,
তেজ দিলে নিস্তেজকে,
ভোগের আবর্জনা লুপ্ত হল
ত্যাগের হোমাগ্নিতে।
দিগন্তে রুদ্রের প্রসন্নতা
ঘোষণা করলে মেঘগর্জনে,
অবনত হল দাক্ষিণ্যের মেঘপুঞ্জ
উৎকণ্ঠিতা ধরণীর দিকে।
মরুবক্ষে তৃণরাজি
শ্যাম আস্তরণ দিল পেতে,
সুন্দরের করুণ চরণ
নেমে এল তার 'পরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
মনের আকাশে তার
দিক্সীমানা বেয়ে
বিবাগি স্বপনপাখি
চলিয়াছে ধেয়ে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
গানগুলি মোর বিষে ঢালা
কী হবে আর তাহা বই?
ফুটন্ত এ প্রাণের মাঝে
বিষ ঢেলেছে বিষময়ী!
গানগুলি মোর বিষেঢালা,
কী হবে আর তাহা বই?
বুকের মধ্যে সর্প আছে,
তুমিও সেথা আছে অয়ি!Heinrich Hein
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানত।
তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
জীবন বহে যেত অশান্ত।
তুমি ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
যেন আমার আপন সখার মতো,
হেসে তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে
সেদিন কত-না বন-বনান্ত।ওগো, সেদিন তুমি গাইতে যে সব গান
কোনো অর্থ তাহার কে জানত।
শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,
সদা নাচত হৃদয় অশান্ত।
হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি -
স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
তোমার চরণপানে নয়ন করি নত
ভুবন দাঁড়িয়ে গেছে একান্ত।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে
সেদিন তুমি কী ধন দিবে উহারে।
ভরা আমার পরানখানি
সম্মুখে তার দিব আনি,
শূন্য বিদায় করব না তো উহারে–
মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে। কত শরৎ-বসন্ত-রাত,
কত সন্ধ্যা, কত প্রভাত
জীবনপাত্রে কত যে রস বরষে;
কতই ফলে কতই ফুলে
হৃদয় আমার ভরি তুলে
দুঃখসুখের আলোছায়ার পরশে।
যা-কিছু মোর সঞ্চিত ধন
এতদিনের সব আয়োজন
চরমদিনে সাজিয়ে দিব উহারে–
মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আজ প্রভাতের আকাশটি এই
শিশির-ছলছল,
নদীর ধারের ঝাউগুলি ওই
রৌদ্রে ঝলমল,
এমনি নিবিড় করে
এরা দাঁড়ায় হৃদয় ভরে
তাই তো আমি জানি
বিপুল বিশ্বভুবনখনি
অকূল মানস-সাগরজলে
কমল টলমল।
তাই তো আমি জানি
আমি বাণীর সাথে বাণী,
আমি গানের সাথে গান,
আমি প্রাণের সাথে প্রাণ,
আমি অন্ধকারের হৃদয়-ফাটা
আলোক জ্বলজ্বল।
শ্রীনগর। কাশ্মীর, ৭ কার্তিক, ১৩২২
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।বাসনা বসে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে।সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ
তুমি আছ তার আছে তব কেহ
নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও
সেও আছে তব ভবনে।তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর
সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার,
কাল পারাপার করিতেছ পার
কেহ নাহি জানে কেমনে।জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি
যতো জানি ততো জানি নে।জানি আমি তোমায় পাবো নিরন্তন
লোক লোকান্তরে যুগ যুগান্তর
তুমি আর আমি, মাঝে কেহ নাই
কোনো বাঁধা নাই ভুবনে।নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে।নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।বাসনা বসে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে।সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ
তুমি আছ তার আছে তব কেহ
নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও
সেও আছে তব ভবনে।তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর
সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার,
কাল পারাপার করিতেছ পার
কেহ নাহি জানে কেমনে।জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি
যতো জানি ততো জানি নে।জানি আমি তোমায় পাবো নিরন্তন
লোক লোকান্তরে যুগ যুগান্তর
তুমি আর আমি, মাঝে কেহ নাই
কোনো বাঁধা নাই ভুবনে।নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
সজনি সজনি রাধিকালো
দেখ অবহুঁ চাহিয়া,
মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে
মৃদুল গান গাহিয়া।
পিনহ ঝটিত কুমুম হার,
পিনহ নীল আঙিয়া।
সুন্দরি সিন্দূর দেকে
সীঁথি করছ রাঙিয়া।
সহচরি সব নাচ নাচ
মধুর গীত গাওরে,
চঞ্চল মঞ্জীর রাব
কুঞ্জ গগন ছাওরে।সজনি অব উজার মঁদির
কনক দীপ জ্বালিয়া,
সুরভি করছ কুঞ্জ ভবন
গন্ধ সলিল ঢালিয়া ।
মল্লিকা চমেলি বেলি
কুসুম তুলহ বালিকা,
গাঁথ যূঁথি, গাঁথ জাতি,
গাঁথ বকুল মালিকা ।
তৃষিত-নয়ন ভানুসিংহ
কুঞ্জ-পথম চাছিয়া
মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে,
মৃদুল গান গাহিয়া। (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
দামামা ওই বাজে,
দিন-বদলের পালা এল
ঝোড়ো যুগের মাঝে।
শুরু হবে নির্মম এক নূতন অধ্যায়,
নইলে কেন এত অপব্যয়--
আসছে নেমে নিষ্ঠুর অন্যায়,
অন্যায়েরে টেনে আনে অন্যায়েরই ভূত
ভবিষ্যতের দূত।
কৃপণতার পাথর-ঠেলা বিষম বন্যাধারা
লোপ করে দেয় নিঃস্ব মাটির নিষ্ফলা চেহারা।
জমে-ওঠা মৃত বালির স্তর
ভাসিয়ে নিয়ে ভর্তি করে লুপ্তির গহ্বর
পলিমাটির ঘটায় অবকাশ,
মরুকে সে মেরে মেরেই গজিয়ে তোলে ঘাস।
দুব্লা খেতের পুরানো সব পুনরুক্তি যত
অর্থহারা হয় সে বোবার মতো।
অন্তরেতে মৃত
বাইরে তবু মরে না যে অন্ন ঘরে করেছে সঞ্চিত--
ওদের ঘিরে ছুটে আসে অপব্যয়ের ঝড়,
ভাঁড়ারে ঝাঁপ ভেঙে ফেলে, চালে ওড়ায় খড়।
অপঘাতের ধাক্কা এসে পড়ে ওদের ঘাড়ে,
জাগায় হাড়ে হাড়ে।
হঠাৎ অপমৃত্যুর সংকেতে
নূতন ফসল চাষের তরে আনবে নূতন খেতে।
শেষ পরীক্ষা ঘটাবে-- দুর্দৈবে--
জীর্ণ যুগে সঞ্চয়েতে কী যাবে,কী রইবে।
পালিশ-করা জীর্ণতাকে চিনতে হবে আজি,
দামামা তাই ওই উঠেছে বাজি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
সেতারের তারে
ধানশি
মিড়ে মিড়ে উঠে
বাজিয়া।
গোধূলির রাগে
মানসী
স্বরে যেন এল
সাজিয়া। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
তুমি যে তুমিই, ওগো
সেই তব ঋণ
আমি মোর প্রেম দিয়ে
শুধি চিরদিন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
রজনী গোপনে বনে ডালপালা ভ’রে
কুঁড়িগুলি ফুটাইয়া নিজে যায় স’রে।
ফুল জাগি বলে, মোরা প্রভাতের ফুল—
মুখর প্রভাত বলে, নাহি তাহে ভুল। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
শীতের হাওয়ার লাগল নাচনআমলকীর এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শির্শিরিয়েঝরিয়ে দিল তালে তালে।
উড়িয়ে দেবার মাতন এসেকাঙাল তারে করল শেষে,তখন তাহার ফলের বাহার
রইল না আর অন্তরালে।
শূন্য করে ভরে-দেওয়াযাহার খেলাতারি লাগি রইনু বসেসারা বেলা।
শীতের পরশ থেকে থেকেযায় বুঝি ঐ ডেকে ডেকে,সব খোওয়াবার সময় আমারহবে কখন কোন্ সকালে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
হৃদয় , কেন গো মোরে ছলিছ সতত ,
আপনার ভাষা তুমি শিখাও আমায় ।
প্রত্যহ আকুল কন্ঠে গাহিতেছি কত ,
ভগ্ন বাঁশরিতে শ্বাস করে হায় হায় !
সন্ধ্যাকালে নেমে যায় নীরব তপন
সুনীল আকাশ হতে সুনীল সাগরে ।
আমার মনের কথা , প্রাণের স্বপন
ভাসিয়া উঠিছে যেন আকাশের ‘পরে ।
ধ্বনিছে সন্ধ্যার মাঝে কার শান্ত বাণী ,
ও কি রে আমারি গান ? ভাবিতেছি তাই ।
প্রাণের যে কথাগুলি আমি নাহি জানি
সে – কথা কেমন করে জেনেছে সবাই ।
মোর হৃদয়ের গান সকলেই গায় ,
গাহিতে পারি নে তাহা আমি শুধু হায় । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আমার পাচকবর গদাধর মিশ্র,
তারি ঘরে দেখি মোর কুন্তলবৃষ্য।
কহিনু তাহারে ডেকে,–
“এ শিশিটা এনেছে কে,
শোভন করিতে চাও হেঁশেলের দৃশ্য?’সে কহিল, “বরিষার
এই ঋতু; সরিষার
কহে, “কাঠমুণ্ডার
নেপালের গুণ্ডার
এই তেলে কেটে যায় জঠরের গ্রীষ্ম।
লোকমুখে শুনেছি তো, রাজা-গোলকুণ্ডার
এই সাত্ত্বিক তেলে পূজার হবিষ্য।
আমি আর তাঁরা সবে চরকের শিষ্য।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
তারা দিনের বেলা এসেছিল
আমার ঘরে,
বলেছিল, একটি পাশে
রইব প’ড়ে।
বলেছিল, দেবতা সেবায়
আমরা হব তোমার সহায়–
যা কিছু পাই প্রসাদ লব
পূজার পরে।এমনি করে দরিদ্র ক্ষীণ
মলিন বেশে
সংকোচেতে একটি কোণে
রইল এসে।
রাতে দেখি প্রবল হয়ে
পশে আমার দেবালয়ে,
মলিন হাতে পূজার বলি হরণ করে।বোলপুর, ২৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ফুলদানি হতে একে একে
আয়ুক্ষীণ গোলাপের পাপড়ি পড়িল ঝরে ঝরে।
ফুলের জগতে
মৃত্যুর বিকৃতি নাহি দেখি।
শেষ ব্যঙ্গ নাহি হানে জীবনের পানে অসুন্দর।
যে মাটির কাছে ঋণী
আপনার ঘৃণা দিয়ে অশুচি করে না তারে ফুল,
রূপে গন্ধে ফিরে দেয় ম্লান অবশেষ।
বিদায়ের সকরুণ স্পর্শ আছে তাহে;
নাইকো ভর্ৎসনা।
জন্মদিনে মৃত্যুদিনে দোঁহে যবে করে মুখোমুখি
দেখি যেন সে মিলনে
পূর্বাচলে অস্তাচলে
অবসন্ন দিবসের দৃষ্টিবিনিময়--
সমুজ্জ্বল গৌরবের প্রণত সুন্দর অবসান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
তোমার কাছে চাই নি কিছু,জানাই নি মোর নাম–তুমি যখন বিদায় নিলেনীরব রহিলাম।একলা ছিলেম কুয়ার ধারেনিমের ছায়াতলে,কলস নিয়ে সবাই তখনপাড়ায় গেছে চলে।আমায় তারা ডেকে গেল,“আয় গো, বেলা যায়।’কোন্ আলসে রইনু বসেকিসের ভাবনায়। পদধ্বনি শুনি নাইকোকখন তুমি এলে।কইলে কথা ক্লান্তকণ্ঠেকরুণ চক্ষু মেলে–“তৃষাকাতর পান্থ আমি’–শুনে চমকে উঠেজলের ধারা দিলেম ঢেলেতোমার করপুটে।মর্মরিয়া কাঁপে পাতা,কোকিল কোথা ডাকে,বাবলা ফুলের গন্ধ ওঠেপল্লীপথের বাঁকে। যখন তুমি শুধালে নামপেলেম বড়ো লাজ,তোমার মনে থাকার মতোকরেছি কোন্ কাজ।তোমায় দিতে পেরেছিলেমএকটু তৃষার জল,এই কথাটি আমার মনেরহিল সম্বল।কুয়ার ধারে দুপুরবেলাতেমনি ডাকে পাখি,তেমনি কাঁপে নিমের পাতা–আমি বসেই থাকি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
নিদ্রা-ব্যাপার কেন
হবেই অবাধ্য,
চোখ-চাওয়া ঘুম হোক
মানুষের সাধ্য–
এম.এস্সি বিভাগের ব্রিলিয়ান্ট্ ছাত্র
এই নিয়ে সন্ধান করে দিনরাত্র,
বাজায় পাড়ার কানে
নানাবিধ বাদ্য,
চোখ-চাওয়া ঘটে তাহে,
নিদ্রার শ্রাদ্ধ। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
গাড়িতে মদের পিপে ছিল তেরো-চোদ্দো,
এঞ্জিনে জল দিতে দিল ভুলে মদ্য।
চাকাগুলো ধেয়ে করে ধানখেত-ধ্বংসন,
বাঁশি ডাকে কেঁদে কেঁদে “কোথা কানু জংশন’–
ট্রেন করে মাতলামি নেহাত অবোধ্য,
সাবধান করে দিতে কবি লেখে পদ্য। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
একলা হোথায় বসে আছে, কেই বা জানে ওকে--
আপন-ভোলা সহজ তৃপ্তি রয়েছে ওর চোখে।
খাটুলিটা বাইরে এনে আঙিনাটার কোণে
টানছে তামাক বসে আপন-মনে।
মাথার উপর বটের ছায়া, পিছন দিকে নদী
বইছে নিরবধি।
আয়োজনের বালাই নেইকো ঘরে,
আমের কাঠের নড়্নড়ে এক তক্তপোষের 'পরে
মাঝখানেতে আছে কেবল পাতা
বিধবা তার মেয়ের হাতের সেলাই করা কাঁথা।
নাতনি গেছে, রাখে তারি পোষা ময়নাটাকে,
ছেলের গাঁথা ঘরের দেয়াল, চিহ্ন আছে তারি
রঙিন মাটি দিয়ে আঁকা সিপাই সারি সারি।
সেই ছেলেটাই তালুকদারের সর্দারি পদ পেয়ে
জেলখানাতে মরছে পচে দাঙ্গা করতে যেয়ে।
দুঃখ অনেক পেয়েছে ও, হয়তো ডুবছে দেনায়,
হয়তো ক্ষতি হয়ে গেছে তিসির বেচাকেনায়।
বাইরে দারিদ্র্যের
কাটা-ছেঁড়ার আঁচড় লাগে ঢের,
তবুও তার ভিতর-মনে দাগ পড়ে না বেশি,
প্রাণটা যেমন কঠিন তেমনি কঠিন মাংসপেশী।
হয়তো গোরু বেচতে হবে মেয়ের বিয়ের দায়ে,
মাসে দুবার ম্যালেরিয়া কাঁপন লাগায় গায়ে,
ডাগর ছেলে চাকরি করতে গঙ্গাপারের-দেশে
হয়তো হঠাৎ মারা গেছে ঐ বছরের শেষে--
শুকনো করুণ চক্ষু দুটো তুলে উপর-পানে
কার খেলা এই দুঃখসুখের, কী ভাবলে সেই জানে।
বিচ্ছেদ নেই খাটুনিতে, শোকের পায় না ফাঁক,
ভাবতে পারে স্পষ্ট ক'রে নেইকো এমন বাক্।
জমিদারের কাছারিতে নালিশ করতে এসে
কী বলবে যে কেমন ক'রে পায় না ভেবে শেষে।খাটুলিতে এসে বসে যখনি পায় ছুটি,
ভাব্নাগুলো ধোঁয়ায় মেলায়, ধোঁয়ায় ওঠে ফুটি।
ওর যে আছে খোলা আকাশ, ওর যে মাথার কাছে
শিষ দিয়ে যায় বুলবুলিরা আলোছায়ার নাচে,
নদীর ধারে মেঠো পথে টাট্টু চলে ছুটে,
চক্ষু ভোলায় খেতের ফসল রঙের হরির-লুটে--
জন্মমরণ ব্যেপে আছে এরা প্রাণের ধন
অতি সহজ ব'লেই তাহা জানে না ওর মন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে॥
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে॥
সবুজ প্রাণের গানের লেখা রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,
মাতে রে কোন্ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।
ধানের শিষে পুলক ছোটে-- সকল ধরা হেসে ওঠে
অঘ্রানেরই সোনার রোদে, পূর্ণিমারই চন্দ্রে॥(রচনাকাল: 1911)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আরবার ফিরে এল উৎসবের দিন।
বসন্তের অজস্র সম্মান
ভরি দিল তরুশাখা কবির প্রাঙ্গণে
নব জন্মদিনের ডালিতে।
রুদ্ধ কক্ষে দূরে আছি আমি--
এ বৎসরে বৃথা হল পলাশবনের নিমন্ত্রণ।
মনে করি,গান গাই বসন্তবাহারে।
আসন্ন বিরহস্বপ্ন ঘনাইয়া নেমে আসে মনে।
জানি জন্মদিন
এক অবিচিত্র দিনে ঠেকিবে এখনি,
মিলে যাবে অচিহ্নিত কালের পর্যায়ে।
পুষ্পবীথিকার ছায়া এ বিষাদে করে না করুণ,
বাজে না স্মৃতির ব্যথা অরণ্যের মর্মরে গুঞ্জনে
নির্মম আনন্দ এই উৎসবের বাজাইবে বাঁশি
বিচ্ছেদের বেদনারে পথপার্শ্বে ঠেলিয়া ফেলিয়া।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দুঃস্বপন কোথা হতে এসে
জীবনে বাধায় গণ্ডগোল।
কেঁদে উঠে জেগে দেখি শেষে
কিছু নাই আছে মার কোল।
ভেবেছিনু আর-কেহ বুঝি,
ভয়ে তাই প্রাণপণে যুঝি,
তব হাসি দেখে আজ বুঝি
তুমিই দিয়েছ মোরে দোল।এ জীবন সদা দেয় নাড়া
লয়ে তার সুখ দুখ ভয়;
কিছু যেন নাই গো সে ছাড়া,
সেই যেন মোর সমুদয়।
এ ঘোর কাটিয়া যাবে চোখে
নিমেষেই প্রভাত-আলোকে,
পরিপূর্ণ তোমার সম্মুখে
থেমে যাবে সকল কল্লোল।৮ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
দুয়ারে তোমার ভিড় ক’রে যারা আছে,
ভিক্ষা তাদের চুকাইয়া দাও আগে।
মোর নিবেদন নিভৃতে তোমার কাছে–
সেবক তোমার অধিক কিছু না মাগে।
ভাঙিয়া এসেছি ভিক্ষাপাত্র,
শুধু বীণাখানি রেখেছি মাত্র,
বসি এক ধারে পথের কিনারে
বাজাই সে বীণা দিবসরাত্র।দেখো কতজন মাগিছে রতনধূলি,
কেহ আসিয়াছে যাচিতে নামের ঘটা–
ভরি নিতে চাহে কেহ বিদ্যার ঝুলি,
কেহ ফিরে যাবে লয়ে বাক্যের ছটা।
আমি আনিয়াছি এ বীণাযন্ত্র,
তব কাছে লব গানের মন্ত্র,
তুমি নিজ-হাতে বাঁধো এ বীণায়
তোমার একটি স্বর্ণতন্ত্র।নগরের হাটে করিব না বেচাকেনা,
লোকালয়ে আমি লাগিব না কোনো কাজে।
পাব না কিছুই,রাখিব না কারো দেনা,
অলস জীবন যাপিব গ্রামের মাঝে।
তরুতলে বসি মন্দ-মন্দ
ঝংকার দিব কত কী ছন্দ,
যত গান গাব তব বাঁধা তারে
বাজিবে তোমার উদার মন্দ্র। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
যখন গগনতলে
অাঁধারের দ্বার গেল খুলি
সোনার সংগীতে উষা
চয়ন করিল তারাগুলি। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
শ্রীমতী রানী দেবী কল্যাণীয়াসু ১
আমি বদল করেছি আমার বাসা।
দুটিমাত্র ছোটো ঘর আমার আশ্রয়।
ছোটো ঘরই আমার মনের মতো।
তার কারণ বলি তোমাকে।
বড়ো ঘর বড়োর ভান করে মাত্র,
আসল বড়োকে বাইরে ঠেকিয়ে রাখে অবজ্ঞায়।
আমার ছোটো ঘর বড়োর ভান করে না।
অসীমের প্রতিযোগিতার স্পর্ধা তার নেই
ধনী ঘরের মূঢ় ছেলের মতো।
আকাশের শখ ঘরে মেটাতে চাইনে;
তাকে পেতে চাই তার স্বস্থানে,
পেতে চাই বাইরে পূর্ণভাবে।
বেশ লাগছে।
দূর আমার কাছেই এসেছে।
জানলার পাশেই বসে বসে ভাবি--
দূর ব'লে যে পদার্থ সে সুন্দর।
মনে ভাবি সুন্দরের মধ্যেই দূর।
পরিচয়ের সীমার মধ্যে থেকেও
সুন্দর যায় সব সীমাকে এড়িয়ে।
প্রয়োজনের সঙ্গে লেগে থেকেও থাকে আলগা,
প্রতিদিনের মাঝখানে থেকেও সে চিরদিনের।
মনে পড়ে এক দিন মাঠ বেয়ে চলেছিলেম
পালকিতে অপরাহ্নে;
কাহার ছিল আটজন।
তার মধ্যে একজনকে দেখলেম
যেন কালো পাথরে কাটা দেবতার মূর্তি;
আপন কর্মের অপমানকে প্রতিপদে সে চলছিল পেরিয়ে
ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে পাখি যেমন যায় উড়ে।
দেবতা তার সৌন্দর্যে তাকে দিয়েছেন সুদূরতার সম্মান।
এই দূর আকাশ সকল মানুষেরই অন্তরতম;
জানলা বন্ধ, দেখতে পাইনে।
বিষয়ীর সংসার, আসক্তি তার প্রাচীর,
যাকে চায় তাকে রুদ্ধ করে কাছের বন্ধনে।
ভুলে যায় আসক্তি নষ্ট করে প্রেমকে,
আগাছা যেমন ফসলকে মারে চেপে।
আমি লিখি কবিতা, আঁকি ছবি।
দূরকে নিয়ে সেই আমার খেলা;
দূরকে সাজাই নানা সাজে,
আকাশের কবি যেমন দিগন্তকে সাজায়
সকালে সন্ধ্যায়।
কিছু কাজ করি তাতে লাভ নেই, তাতে লোভ নেই,
তাতে আমি নেই।
যে কাজে আছে দূরের ব্যাপ্তি
তাতে প্রতিমুহূর্তে আছে আমার মহাকাশ।
এই সঙ্গে দেখি মৃত্যুর মধুর রূপ, স্তব্ধ নিঃশব্দ সুদূর,
জীবনের চারদিকে নিস্তরঙ্গ মহাসমুদ্র;
সকল সুন্দরের মধ্যে আছে তার আসন, তার মুক্তি। ২
অন্য কথা পরে হবে।
গোড়াতেই বলে রাখি তুমি চা পাঠিয়েছ, পেয়েছি।
এতদিন খবর দিইনি সেটা আমার স্বভাবের বিশেষত্ব।
যেমন আমার ছবি আঁকা, চিঠি লেখাও তেমনি।
ঘটনার ডাকপিওনগিরি করে না সে।
নিজেরই সংবাদ সে নিজে।
জগতে রূপের আনাগোনা চলছে,
সেই সঙ্গে আমার ছবিও এক-একটি রূপ,
অজানা থেকে বেরিয়ে আসছে জানার দ্বারে।
সে প্রতিরূপ নয়।
মনের মধ্যে ভাঙাগড়া কত, কতই জোড়াতাড়া;
কিছু বা তার ঘনিয়ে ওঠে ভাবে,
কিছু বা তার ফুটে ওঠে চিত্রে;
এতদিন এই সব আকাশবিহারীদের ধরেছি কথার ফাঁদে।
মন তখন বাতাসে ছিল কান পেতে,
যে ভাব ধ্বনি খোঁজে তারি খোঁজে।
আজকাল আছে সে চোখ মেলে।
রেখার বিশ্বে খোলা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে, দেখবে ব'লে।
সে তাকায়, আর বলে, দেখলেম।
সংসারটা আকারের মহাযাত্রা।
কোন্ চির-জাগরূকের সামনে দিয়ে চলেছে,
তিনিও নীরবে বলছেন, দেখলেম।
আদি যুগে রঙ্গমঞ্চের সম্মুখে সংকেত এল,
"খোলো আবরণ।"
বাষ্পের যবনিকা গেল উঠে,
রূপের নটীরা এল বাহির হয়ে;
ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু, তিনি দেখলেন।
তাঁর দেখা আর তাঁর সৃষ্টি একই।
চিত্রকর তিনি।
তাঁর দেখার মহোৎসব দেশে দেশে কালে কালে। ৩
অসীম আকাশে কালের তরী চলেছে
রেখার যাত্রী নিয়ে,
অন্ধকারের ভূমিকায় তাদের কেবল
আকারের নৃত্য;
নির্বাক অসীমের বাণী
বাক্যহীন সীমার ভাষায়, অন্তহীন ইঙ্গিতে।--
অমিতার আনন্দসম্পদ
ডালিতে সাজিয়ে নিয়ে চলেছে সুমিতা,
সে ভাব নয়, সে চিন্তা নয়, বাক্য নয়,
শুধু রূপ, আলো দিয়ে গড়া।
আজ আদিসৃষ্টির প্রথম মুহূর্তের ধ্বনি
পৌঁছল আমার চিত্তে,--
যে ধ্বনি অনাদি রাত্রির যবনিকা সরিয়ে দিয়ে
বলেছিল, "দেখো।"
এতকাল নিভৃতে
আপনি যা বলেছি আপনি তাই শুনেছি,
সেখান থেকে এলেম আর-এক নিভৃতে,
এখানে আপনি যা আঁকছি, দেখছি তাই আপনি।
সমস্ত বিশ্ব জুড়ে দেবতার দেখবার আসন,
আমিও বসেছি তাঁরই পাদপীঠে,
রচনা করছি দেখা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
সাতটি চাঁপা সাতটি গাছে,
সাতটি চাঁপা ভাই—
রাঙা - বসন পারুলদিদি,
তুলনা তার নাই।
সাতটি সোনা চাঁপার মধ্যে
সাতটি সোনা মুখ,
পারুলদিদির কচি মুখটি
করতেছে টুক্টুক্।
ঘুমটি ভাঙে পাখির ডাকে,
রাতটি যে পোহালো—
ভোরের বেলা চাঁপায় পড়ে
চাঁপার মতো আলো।
শিশির দিয়ে মুখটি মেজে
মুখখানি বের করে
কী দেখছে সাত ভায়েতে
সারা সকাল ধ'রে।
দেখছে চেয়ে ফুলের বনে
গোলাপ ফোটে - ফোটে,
পাতায় পাতায় রোদ পড়েছে,
চিক্চিকিয়ে ওঠে।
দোলা দিয়ে বাতাস পালায়
দুষ্টু ছেলের মতো,
লতায় পাতায় হেলাদোলা
কোলাকুলি কত।
গাছটি কাঁপে নদীর ধারে
ছায়াটি কাঁপে জলে—
ফুলগুলি সব কেঁদে পড়ে
শিউলি গাছের তলে।
ফুলের থেকে মুখ বাড়িয়ে
দেখতেছে ভাই বোন—
দুখিণী এক মায়ের তরে
আকুল হল মন।
সারাটা দিন কেঁপে কেঁপে
পাতার ঝুরুঝুরু,
মনের সুখে বনের যেন
বুকের দুরুদুরু।
কেবল শুনি কুলুকুলু
একি ঢেউয়ের খেলা।
বনের মধ্যে ডাকে ঘুঘু
সারা দুপুরবেলা।
মৌমাছি সে গুনগুনিয়ে
খুঁজে বেড়ায় কাকে,
ঘাসের মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ করে
ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে।
ফুলের পাতায় মাথা রেখে
শুনতেছে ভাই বোন—
মায়ের কথা মনে পড়ে,
আকুল করে মন।
মেঘের পানে চেয়ে দেখে—
মেঘ চলেছে ভেসে,
রাজহাঁসেরা উড়ে উড়ে
চলেছে কোন্ দেশে।
প্রজাপতির বাড়ি কোথায়
জানে না তো কেউ,
সমস্ত দিন কোথায় চলে
লক্ষ হাজার ঢেউ।
দুপুর বেলা থেকে থেকে
উদাস হল বায়,
শুকনো পাতা খ'সে প'ড়ে
কোথায় উড়ে যায়!
ফুলের মাঝে দুই গালে হাত
দেখতেছে ভাই বোন—
মায়ের কথা পড়ছে মনে,
কাঁদছে পরান মন।
সন্ধে হলে জোনাই জ্বলে
পাতায় পাতায়,
অশথ গাছে দুটি তারা
গাছের মাথায়।
বাতাস বওয়া বন্ধ হল,
স্তব্ধ পাখির ডাক,
থেকে থেকে করছে কা - কা
দুটো - একটা কাক।
পশ্চিমেতে ঝিকিমিকি,
পুবে আঁধার করে—
সাতটি ভায়ে গুটিসুটি
চাঁপা ফুলের ঘরে।
‘গল্প বলো পারুলদিদি'
সাতটি চাঁপা ডাকে,
পারুলদিদির গল্প শুনে
মনে পড়ে মাকে।
প্রহর বাজে, রাত হয়েছে,
ঝাঁ ঝাঁ করে বন—
ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে প'ল
আটটি ভাই বোন।
সাতটি তারা চেয়ে আছে
সাতটি চাঁপার বাগে,
চাঁদের আলো সাতটি ভায়ের
মুখের পরে লাগে।
ফুলের গন্ধ ঘিরে আছে
সাতটি ভায়ের তনু—
কোমন শয্যা কে পেতেছে
সাতটি ফুলের রেণু।
ফুলের মধ্যে সাত ভায়েতে
স্বপ্ন দেখে মাকে—
সকাল বেলা ‘জাগো জাগো'
পারুলদিদি ডাকে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
ঘটিজল বলে, ওগো মহাপারাবার,
আমি স্বচ্ছ সমুজ্জ্বল, তুমি অন্ধকার।
ক্ষুদ্র সত্য বলে, মোর পরিষ্কার কথা,
মহাসত্য তোমার মহান্ নীরবতা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
নক্ষত্র খসিল দেখি দীপ মরে হেসে।
বলে, এত ধুমধাম, এই হল শেষে!
রাত্রি বলে, হেসে নাও, বলে নাও সুখে,
যতক্ষণ তেলটুকু নাহি যায় চুকে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
যারে চাই তার কাছে আমি দিই ধরা ,
সে আমার না হইতে আমি হই তার ।
পেয়েছি বলিয়ে মিছে অভিমান করা ,
অন্যেরে বাঁধিতে গিয়ে বন্ধন আমার ।
নিরখিয়া দ্বারমুক্ত সাধের ভাণ্ডার
দুই হাতে লুটে নিই রত্ন ভূরি ভূরি —
নিয়ে যাব মনে করি , ভারে চলা ভার ,
চোরা দ্রব্য বোঝা হয়ে চোরে করে চুরি ।
চিরদিন ধরণীর কাছে ঋণ চাই ,
পথের সম্বল ব ‘ লে জমাইয়া রাখি ,
আপনারে বাঁধা রাখি সেটা ভুলে যাই —
পাথেয় লইয়া শেষে কারাগারে থাকি ।
বাসনার বোঝা নিয়ে ডোবে – ডোবে তরী —
ফেলিতে সরে না মন , উপায় কী করি! (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
যখনি যেমনি হোক জিতেনের মর্জি
কথায় কথায় তার লাগে আশ্চর্যি।অডিটর ছিল জিতু হিসাবেতে টঙ্ক,
আপিসে মেলাতেছিল বজেটের অঙ্ক;
শুনলে সে, গেছে দেশে রামদীন দর্জি,
শুনতে না-শুনতেই বলে “আশ্চর্যি’।যে দোকানি গাড়ি তাকে করেছিল বিক্রি
কিছুতে দাম না পেয়ে করেছে সে ডিক্রি,
বিস্তর ভেবে জিতু উঠল সে গর্জি–
“ভারি আশ্চর্যি।শুনলে, জামাইবাড়ি ছিল বুড়ি ঝিনাদায়,
ছ বছর মেলেরিয়া ভুগে ভুগে চিনা দায়,
সেদিন মরেছে শেষে পুরোনো সে ওর ঝি,
জিতেন চশমা খুলে বলে “আশ্চর্যি’। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার?
শীত নাই গ্রীষ্ম নাই, বসন্ত শরৎ নাই,
দিন নাই রাত্রি নাই — অবিরাম অনিবার
ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার?
বিরলে বিজন বনে বসিয়া আপন মনে
ভূমি-পানে চেয়ে চেয়ে, একই গান গেয়ে গেয়ে–
দিন যায়, রাত যায়, শীত যায়, গ্রীষ্ম যায়,
তবু গান ফুরায় না আর?
মাথায় পড়িছে পাতা, পড়িছে শুকানো ফুল,
পড়িছে শিশিরকণা, পড়িছে রবির কর,
পড়িছে বরষা-জল ঝরঝর ঝরঝর,
কেবলি মাথার ‘পরে করিতেছে সমস্বরে
বাতাসে শুকানো পাতা মরমর মরমর–
বসিয়া বসিয়া সেথা, বিশীর্ণ মলিন প্রাণ
গাহিতেছে একই গান একই গান একই গান।
পারি নে শুনিতে আর একই গান একই গান।
কখন থামিবি তুই, বল্ মোরে বল্ প্রাণ!
একেলা ঘুমায়ে আছি–
সহসা স্বপন টুটি
সহসা জাগিয়া উঠি
সহসা শুনিতে পাই
হৃদয়ের এক ধারে
সেই স্বর ফুটিতেছে,
সেই গান উঠিতেছে–
কেহ শুনিছে না যবে
চারি দিকে স্তব্ধ সবে
সেই স্বর সেই গান অবিরাম অবিশ্রাম
অচেতন আঁধারের শিরে শিরে চেতনা সঞ্চারে।
দিবসে মগন কাজে, চারি দিকে দলবল,
চারি দিকে কোলাহল।
সহসা পাতিলে কান শুনিতে পাই সে গান,
নানাশব্দময় সেই জনকোলাহল।
তাহারি প্রাণের মাঝে একমাত্র শব্দ বাজে–
এক সুর, এক ধ্বনি, অবিরাম অবিরল–
যেন সে কোলাহলের হৃদয়ম্পন্দন-ধ্বনি–
সমস্ত ভুলিয়া যাই, বসে বসে তাই গনি।
ঘুমাই বা জেগে থাকি, মনের দ্বারের কাছে
কে যেন বিষণ্ণ প্রাণী দিনরাত বসে আছে–
চিরদিন করিতেছে বাস,
তারি শুনিতেছি যেন নিশ্বাস-প্রশ্বাস।
এ প্রাণের ভাঙা ভিতে স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে
ঘুঘু এক বসে বসে গায় একস্বরে,
কে জানে কেন সে গান গায়।
বলি সে কাতর স্বরে স্তব্ধতা কাঁদিয়া মরে,
প্রতিধ্বনি করে হায়-হায়।
হৃদয় রে, আর কিছু শিখিলি নে তুই,
শুধু ওই গান!
প্রকৃতির শত শত রাগিণীর মাঝে
শুধু ওই তান!
তবে থাম্ থাম্ ওরে প্রাণ,
পারি নে শুনিতে আর একই গান, একই গান।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আজি ফাল্গুনে দোলপূর্ণিমারাত্রি,
উপছায়া-চলা বনে বনে মন
আবছা পথের যাত্রী।
ঘুম-ভাঙানিয়া জোছনা--
কোথা থেকে যেন আকাশে কে বলে,
"একটুকু কাছে বোসো না।'
ফিস্ফিস্ করে পাতায় পাতায়,
উস্খুস্ করে হাওয়া।
ছায়ার আড়ালে গন্ধরাজের
তন্দ্রাজড়িত চাওয়া।
চন্দনিদহে থইথই জল
ঝিক্ঝিক্ করে আলোতে,
জামরুলগাছে ফুলকাটা কাজে
বুনুনি সাদায় কালোতে।
প্রহরে প্রহরে রাজার ফটকে
বহুদূরে বাজে ঘণ্টা।
জেগে উঠে বসে ঠিকানা-হারানো
শূন্য-উধাও মনটা।
বুঝিতে পারি নে কত কী শব্দ--
মনে হয় যেন ধারণা,
রাতের বুকের ভিতরে কে করে
অদৃশ্য পদচারণা।
গাছগুলো সব ঘুমে ডুবে আছে,
তন্দ্রা তারায় তারায়,
কাছের পৃথিবী স্বপ্নপ্লাবনে
দূরের প্রান্তে হারায়।
রাতের পৃথিবী ভেসে উঠিয়াছে
বিধির নিশ্চেতনায়,
আভাস আপন ভাষার পরশ
খোঁজে সেই আনমনায়।
রক্তের দোলে যে-সব বেদনা
স্পষ্ট বোধের বাহিরে
ভাবনাপ্রবাহে বুদ্বুদ্ তারা,
স্থির পরিচয় নাহি রে।
প্রভাত-আলোক আকাশে আকাশে
এ চিত্র দিবে মুছিয়া,
পরিহাসে তব অবচেতনার
বঞ্চনা যাবে ঘুচিয়া।
চেতনার জালে এ মহাগহনে
বস্তু যা-কিছু টিঁকিবে,
সৃষ্টি তারেই স্বীকার করিয়া
স্বাক্ষর তাহে লিখিবে।
তবু কিছু মোহ, কিছু কিছু ভুল
জাগ্রত সেই প্রাপণার
প্রাণতন্তুতে রেখায় রেখায়
রঙ রেখে যাবে আপনার।
এ জীবনে তাই রাত্রির দান
দিনের রচনা জড়ায়ে
চিন্তা-কাজের ফাঁকে ফাঁকে সব
রয়েছে ছড়ায়ে ছড়ায়ে।
বুদ্ধি যাহারে মিছে বলে হাসে
সে যে সত্যের মূলে
আপন গোপন রসসঞ্চারে
ভরিছে ফসলে ফুলে।
অর্থ পেরিয়ে নিরর্থ এসে
ফেলিছে রঙিন ছায়া--
বাস্তব যত শিকল গড়িছে,
খেলেনা গড়িছে মায়া।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
বোলপুর, আষাঢ়, ১৩১৬
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.