poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
অতি দূরে আকাশের সুকুমার পান্ডুর নীলিমা।
অরণ্য তাহারি তলে ঊর্ধ্বে বাহু মেলি
আপন শ্যামল অর্ঘ্য নিঃশব্দে করিছে নিবেদন।
মাঘের তরুণ রৌদ্র ধরণীর ‘পরে
বিছাইল দিকে দিকে স্বচ্ছ আলোকের উত্তরীয়।
এ কথা রাখিনু লিখে
উদাসীন চিত্রকর এই ছবি মুছিবার আগে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
জানি আমার পায়ের শব্দ রাত্রে দিনে শুনতে তুমি পাও,
খুশি হয়ে পথের পানে চাও।
খুশি তোমার ফুটে ওঠে শরৎ-আকাশে
অরুণ-আভাসে।
খুশি তোমার ফাগুনবনে আকুল হয়ে পড়ে
ফুলের ঝড়ে ঝড়ে।
আমি যতই চলি তোমার কাছে
পথটি চিনে চিনে
তোমার সাগর অধিক করে নাচে
দিনের পরে দিনে।
জীবন হতে জীবনে মোর পদ্মটি যে ঘোমটা খুলে খুলে
ফোটে তোমার মানস-সরোবরে--
সূর্যতারা ভিড় ক'রে তাই ঘুরে ঘুরে বেড়ায় কূলে কূলে
কৌতূহলের ভরে।
তোমার জগৎ আলোর মঞ্জরী
পূর্ণ করে তোমার অঞ্জলি।
তোমার লাজুক স্বর্গ আমার গোপন আকাশে
একটি করে পাপড়ি খোলে প্রেমের বিকাশে।
পদ্মা, ২৭ মাঘ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ভেসে-যাওয়া ফুল
ধরিতে নারে,
ধরিবারই ঢেউ
ছুটায় তারে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
এখনো তো বড়ো হই নি আমি,
ছোটো আছি ছেলেমানুষ বলে।
দাদার চেয়ে অনেক মস্ত হব
বড়ো হয়ে বাবার মতো হলে।
দাদা তখন পড়তে যদি না চায়,
পাখির ছানা পোষে কেবল খাঁচায়,
তখন তারে এমনি বকে দেব!
বলব, ‘তুমি চুপটি করে পড়ো। '
বলব, ‘তুমি ভারি দুষ্টু ছেলে'—
যখন হব বাবার মতো বড়ো।
তখন নিয়ে দাদার খাঁচাখানা
ভালো ভালো পুষব পাখির ছানা।
সাড়ে দশটা যখন যাবে বেজে
নাবার জন্যে করব না তো তাড়া।
ছাতা একটা ঘাড়ে করে নিয়ে
চটি পায়ে বেড়িয়ে আসব পাড়া।
গুরুমশায় দাওয়ায় এলে পরে
চৌকি এনে দিতে বলব ঘরে,
তিনি যদি বলেন ‘সেলেট কোথা?
দেরি হচ্ছে, বসে পড়া করো'
আমি বলব, ‘খোকা তো আর নেই,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। '
গুরুমশায় শুনে তখন কবে,
‘বাবুমশায়, আসি এখন তবে। '
খেলা করতে নিয়ে যেতে মাঠে
ভুলু যখন আসবে বিকেল বেলা,
আমি তাকে ধমক দিয়ে কব,
‘ কাজ করছি, গোল কোরো না মেলা। '
রথের দিনে খুব যদি ভিড় হয়
একলা যাব, করব না তো ভয়—
মামা যদি বলেন ছুটে এসে
‘ হারিয়ে যাবে, আমার কোলে চড়ো'
বলব আমি, ‘দেখছ না কি মামা,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। '
দেখে দেখে মামা বলবে, ‘তাই তো,
খোকা আমার সে খোকা আর নাই তো। '
আমি যেদিন প্রথম বড়ো হব
মা সেদিনে গঙ্গাস্নানের পরে
আসবে যখন খিড়কি - দুয়োর দিয়ে
ভাববে ‘কেন গোল শুনি নে ঘরে। '
তখন আমি চাবি খুলতে শিখে
যত ইচ্ছে টাকা দিচ্ছি ঝিকে,
মা দেখে তাই বলবে তাড়াতাড়ি,
‘ খোকা, তোমার খেলা কেমনতরো। '
আমি বলব, ‘মাইনে দিচ্ছি আমি,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো।
ফুরোয় যদি টাকা, ফুরোয় খাবার,
যত চাই মা, এনে দেব আবার। '
আশ্বিনেতে পুজোর ছুটি হবে,
মেলা বসবে গাজনতলার হাটে,
বাবার নৌকো কত দূরের থেকে
লাগবে এসে বাবুগঞ্জের ঘাটে।
বাবা মনে ভাববে সোজাসুজি,
খোকা তেমনি খোকাই আছে বুঝি,
ছোটো ছোটো রঙিন জামা জুতো
কিনে এনে বলবে আমায় ‘পরো'।
আমি বলব, ‘দাদা পরুক এসে,
আমি এখন তোমার মতো বড়ো।
দেখছ না কি যে ছোটো মাপ জামার—
পরতে গেলে আঁট হবে যে আমার। ' (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
ওরে আশা, কেন তোর হেন দীনবেশ!নিরাশারই মতো যেন বিষণ্ণ বদন কেন–যেন অতি সংগোপনেযেন অতি সন্তর্পণেঅতি ভয়ে ভয়ে প্রাণে করিস প্রবেশ।ফিরিবি কি প্রবেশিবি ভাবিয়া না পাস,কেন, আশা,কেন তোর কিসের তরাস।আজ আসিয়াছ দিতে যে সুখ-আশ্বাস,নিজে তাহা কর না বিশ্বাস,তাই হেন মৃদু গতি,তাই উঠিতেছে ধীরে দুখের নিশ্বাস।বসিয়া মরমস্থলে কহিছ চোখের জলে–“বুঝি হেন দিন রহিবে না,আজ যাবে, আসিবে তো কাল,দুঃখ যাবে, ঘুচিবে যাতনা।”কেন, আশা, মোরে কেন হেন প্রতারণা।দুঃখক্লেশে আমি কি ডরাই,আমি কি তাদেব চিনি নাই।তারা সবে আমারি কি নয়।তবে, আশা, কেন এত ভয়।তবে কেন বসি মোর পাশমোরে, আশা, দিতেছ আশ্বাস।বলো, আশা, বসি মোর চিতে,“আরো দুঃখ হইবে বহিতে,হৃদয়ের যে প্রদেশ হয়েছিল ভস্মশেষআর যারে হত না সহিতে,আবার নূতন প্রাণ পেয়েসেও পুন থাকিবে দহিতে।করিয়ো না ভয়,দুঃখ-জ্বালা আমারি কি নয়?তবে কেন হেন ম্লান মুখতবে কেন হেন দীন বেশ?তবে কেন এত ভয়ে ভয়েএ হৃদয়ে করিস প্রবেশ?
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে--
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ--
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে--
একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্ স্বর্গ হতে ভাসি
নিখিলের মর্মে আসি লাগে--
নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন
উন্মত্ত অধীর--
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর--
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে
তোমাদের শতবর্ষ আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,
কবি এক জাগে--
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে
একদিন শতবর্ষ আগে।
আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্ নূতন কবি
তোমাদের ঘরে?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব
পল্লবমর্মরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
কত দেশ দেশান্তরে ভ্রমিল সে কবি!
তুষারস্তম্ভিত গিরি করিল লঙ্ঘন, সুতীক্ষ্নকণ্টকময় অরণ্যের বুক মাড়াইয়া গেল চলি রক্তময় পদে। কিন্তু বিহঙ্গের গান, নির্ঝরের ধ্বনি, পারে না জুড়াতে আর কবির হৃদয়। বিহগ, নির্ঝর-ধ্বনি প্রকৃতির গীত-- মনের যে ভাগে তার প্রতিধ্বনি হয় সে মনের তন্ত্রী যেন হোয়েছে বিকল। একাকী যাহাই আগে দেখিত সে কবি তাহাই লাগিত তার কেমন সুন্দর, এখন কবির সেই একি হোলো দশা-- যে প্রকৃতি-শোভা-মাঝে নলিনী না থাকে ঠেকে তা শূন্যের মত কবির নয়নে, নাইক দেবতা যেন মন্দিরমাঝারে। বালার মুখের জ্যোতি করিত বর্দ্ধন প্রকৃতির রূপচ্ছটা দ্বিগুণ করিয়া; সে না হোলে অমবস্যানিশির মতন সমস্ত জগৎ হোত বিষণ্ণ আঁধার। --
জ্যোৎস্নায় নিমগ্ন ধরা, নীরব রজনী। অরণ্যের অন্ধকারময় গাছগুলি মাথার উপরে মাখি রজত জোছনা, শাখায় শাখায় ঘন করি জড়াজড়ি, কেমন গম্ভীরভাবে রোয়েছে দাঁড়ায়ে। হেথায় ঝোপের মাঝে প্রচ্ছন্ন আঁধার, হোথায় সরসীবক্ষে প্রশান্ত জোছনা। নভপ্রতিবিম্বশোভী ঘুমন্ত সরসী চন্দ্র তারকার স্বপ্ন দেখিতেছে যেন! লীলাময় প্রবাহিণী চলেছে ছুটিয়া, লীলাভঙ্গ বুকে তার পাদপের ছায়া ভেঙ্গে চুরে কত শত ধরিছে মূরতি। গাইছে রজনী কিবা নীরব সঙ্গীত! কেমন নীরব বন নিস্তব্ধ গম্ভীর-- শুধু দূর-শৃঙ্গ হোতে ঝরিছে নির্ঝর, শুধু একপাশ দিয়া সঙ্কুচিত অতি তটিনীটি সর সর যেতেছে চলিয়া। অধীর বসন্তবায়ু মাঝে মাঝে শুধু ঝরঝরি কাঁপাইছে গাছের পল্লব। এহেন নিস্তব্ধ রাত্রে কত বার আমি গম্ভীর অরণ্যে একা কোরেছি ভ্রমণ। স্নিগ্ধ রাত্রে গাছপালা ঝিমাইছে যেন, ছায়া তার পোড়ে আছে হেথায় হোথায়। দেখিয়াছি নীরবতা যত কথা কয় প্রাণের মরম-তলে, এত কেহ নয়। দেখি যবে অতি শান্ত জোছনায় মজি নীরবে সমস্ত ধরা রয়েছে ঘুমায়ে, নীরবে পরশে দেহ বসন্তের বায়, জানি না কি এক ভাবে প্রাণের ভিতর উচ্ছ্বসিয়া উথলিয়া উঠে গো কেমন! কি যেন হারায়ে গেছে খুঁজিয়া না পাই, কি কথা ভুলিয়া যেন গিয়েছি সহসা, বলা হয় নাই যেন প্রাণের কি কথা, প্রকাশ করিতে গিয়া পাই না তা খুঁজি! কে আছে এমন যার এ হেন নিশীথে, পুরাণো সুখের স্মৃতি উঠে নি উথলি! কে আছে এমন যার জীবনের পথে এমন একটি সুখ যায় নি হারায়ে, যে হারা-সুখের তরে দিবা নিশি তার হৃদয়ের এক দিক শূন্য হোয়ে আছে। এমন নীরব-রাত্রে সে কি গো কখনো ফেলে নাই মর্ম্মভেদী একটি নিশ্বাস? কর স্থানে আজ রাত্রে নিশীথপ্রদীপে উঠিছে প্রমোদধ্বনি বিলাসীর গৃহে। মুহূর্ত্ত ভাবে নি তারা আজ নিশীথেই কত চিত্ত পুড়িতেছে প্রচ্ছন্ন অনলে। কত শত হতভাগা আজ নিশীথেই হারায়ে জন্মের মত জীবনের সুখ মর্ম্মভেদী যন্ত্রণায় হইয়া অধীর একেলাই হা হা করি বেড়ায় ভ্রমিয়া! --
ঝোপে-ঝাপে ঢাকা ওই অরণ্যকুটীর। বিষণ্ণ নলিনীবালা শূন্য নেত্র মেলি চাঁদের মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া! জানি না কেমন কোরে বালার বুকের মাঝে সহসা কেমন ধারা লেগেছে আঘাত-- আর সে গায় না গান, বসন্ত ঋতুর অন্তে পাপিয়ার কণ্ঠ যেন হোয়েছে নীরব। আর সে লইয়া বীণা বাজায় না ধীরে ধীরে, আর সে ভ্রমে না বালা কাননে কাননে। বিজন কুটীরে শুধু মরণশয্যার 'পরে একেলা আপন মনে রয়েছে শুইয়া। যে বালা মুহূর্ত্তকাল স্থির না থাকিত কভু, শিখরে নির্ঝরে বনে করিত ভ্রমণ—কখনো তুলিত ফুল, কখনো গাঁথিত মালা, কখনো গাইত গান, বাজাইত বীণা-- সে আজ এমন শান্ত, এমন নীরব স্থির! এমন বিষণ্ণ শীর্ণ সে প্রফুল্ল মুখ! এক দিন, দুই দিন, যেতেছে কাটিয়া ক্রমে-- মরণের পদশব্দ গণিছে সে যেন! আর কোন সাধ নাই, বাসনা রয়েছে শুধু কবিরে দেখিয়া যেন হয় গো মরণ। এ দিকে পৃথিবী ভ্রমি সহিয়া ঝটিকা কত ফিরিয়া আসিছে কবি কুটীরের পানে, মধ্যাহ্নের রৌদ্রে যথা জ্বলিয়া পুড়িয়া পাখী সন্ধ্যায় কুলায়ে তার আইসে ফিরিয়া। বহুদিন পরে কবি পদার্পিল বনভূমে, বৃক্ষলতা সবি তার পরিচিত সখা! তেমনি সকলি আছে, তেমনি গাইছে পাখী, তেমনি বহিছে বায়ু ঝর ঝর করি। অধীরে চলিল কবি কুটীরের পানে-- দুয়ারের কাছে গিয়া দুয়ারে আঘাত দিয়া ডাকিল অধীর স্বরে, নলিনী! নলিনী! কিছু নাই সাড়া শব্দ, দিল না উত্তর কেহ, প্রতিধ্বনি শুধু তারে করিল বিদ্রূপ। কুটীরে কেহই নাই, শূন্য তা রয়েছে পড়ি-- বেষ্টিত বিতন্ত্রী বীণা লূতাতন্তুজালে। ভ্রমিল আকুল কবি কাননে কাননে, ডাকিয়া সমুচ্চ স্বরে, নলিনী! নলিনী! মিলিয়া কবির স্বরে বনদেবী উচ্চস্বরে ডাকিল কাতরে আহা, নলিনী! নলিনী! কেহই দিল না সাড়া, শুধু সে শব্দ শুনি সুপ্ত হরিণেরা ত্রস্ত উঠিল জাগিয়া। অবশেষে গিরিশৃঙ্গে উঠিল কাতর কবি, নলিনীর সাথে যেথা থাকিত বসিয়া। দেখিল সে গিরি-শৃঙ্গে, শীতল তুষার-'পরে, নলিনী ঘুমায়ে আছে ম্লানমুখচ্ছবি। কঠোর তুষারে তার এলায়ে পড়েছে কেশ, খসিয়া পড়েছে পাশে শিথিল আঁচল। বিশাল নয়ন তার অর্দ্ধনিমীলিত, হাত দুটি ঢাকা আছে অনাবৃত বুকে। একটি হরিণশিশু খেলা করিবার তরে কভু বা অঞ্চল ধরি টানিতেছে তার, কভু শৃঙ্গ দুটি দিয়া সুধীরে দিতেছে ঠেলি, কভু বা অবাক্ নেত্রে রহিছে চাহিয়া! তবু নলিনীর ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গিছে না, নীরবে নিস্পন্দ হোয়ে রয়েছে ভূতলে। দূর হোতে কবি তারে দেখিয়া কহিল উচ্চে, "নলিনী, এয়েছি আমি দেখ্সে বালিকা।" তবুও নলিনী বালা না দিয়া উত্তর শীতল তুষার-'পরে রহিল ঘুমায়ে। কবি সে শিখর-'পরে করি আরোহণ শীতল অধর তার করিল চুম্বন—শিহরিয়া চমকিয়া দেখিল সে কবি না নড়ে হৃদয় তার, না পড়ে নিশ্বাস। দেখিল না, ভাবিল না, কহিল না কিছু, যেমন চাহিয়া ছিল রহিল চাহিয়া। নিদারুণ কি যেন কি দেখিছে তরাসে নয়ন হইয়া গেল অচল পাষাণ। কতক্ষণে কবি তবে পাইল চেতন, দেখিল তুষারশুভ্র নলিনীর দেহ হৃদয়জীবনহীন জড় দেহ তার অনুপম সৌন্দর্য্যের কুসুম-আলয়, হৃদয়ের মরমের আদরের ধন—তৃণ কাষ্ঠ সম ভূমে যায় গড়াগড়ি! বুকে তারে তুলে লয়ে ডাকিল "নলিনী", হৃদয়ে রাখিয়া তারে পাগলের মত কবি কহিল কাতর স্বরে "নলিনী" "নলিনী"! স্পন্দহীন, রক্তহীন অধর তাহার অধীর হইয়া ঘন করিল চুম্বন। --
তার পর দিন হোতে সে বনে কবিরে আর পেলে না দেখিতে কেহ, গেছে সে কোথায়! ঢাকিল নলিনীদেহ তুষারসমাধি-- ক্রমে সে কুটীরখানি কোথা ভেঙ্গে চুরে গেল, ক্রমে সে কানন হোলো গ্রাম লোকালয়, সে কাননে--কবির সে সাধের কাননে অতীতের পদচিহ্ন রহিল না আর। (কবি-কাহিনী কাব্যোপন্যাস)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
এ-পারে চলে বর, বধূ সে পরপারে,
সেতুটি বাঁধা তার মাঝে।
তাহারি 'পরে দান আসিছে ভারে ভারে,
তাহারি 'পরে বাঁশি বাজে।
যাত্রা দুজনার
লক্ষ্য একই তার,
তবুও যত কাছে আসে
সতত যেন থাকে
বিরহ ফাঁকে ফাঁকে
তৃপ্তিহারা অবকাশে।সে-ফাঁক গেলে ঘুচে থেমে যে যাবে গান,
দৃষ্টি হবে বাধাময়,
যেথায় দূর নাহি সেথায় যত দান
কাছেতে ছোটো হয়ে রয়।
বিরহনদীজলে
খেয়ার তরী চলে,
বায় সে মিলনেরই ঘাটে।
হৃদয় বারবার
করিবে পারাপার
মিলিতে উৎসবনাটে।বেলা যে পড়ে এল, সূর্য নামে ধীরে,
আলোক ম্লান হয়ে আসে।
ভাঙিয়া গেছে হাট, জনতাহীন তীরে
নৌকা বাঁধা পাশে পাশে।
এ-পারে বর চলে
পুরানো বটতলে,
নদীটি বহি চলে মাঝে,
বধূরে দেখা যায়
মাঠের কিনারায়,
সেতুর 'পরে বাঁশি বাজে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে, তাই হেরো আজি
তোমার সর্বাঙ্গ ঘেরি পুলকিছে শ্যাম শস্পরাজি
প্রস্ফুটিত পুষ্পজালে; বনস্পতি শত বরষার
আনন্দবর্ষণকাব্য লিখিতেছে পত্রপুঞ্জে তার
বল্কলে শৈবালে জটে; সুদুর্গম তোমার শিখর
নির্ভয় বিহঙ্গ যত কলোল্লাসে করিছে মুখর।
আসি নরনারীদল তোমার বিপুল বক্ষপটে
নিঃশঙ্ক কুটিরগুলি বাঁধিয়াছে নির্ঝরিণীতটে।
যেদিন উঠিয়াছিলে অগ্নিতেজে স্পর্ধিতে আকাশ,
কম্পমান ভূমণ্ডলে, চন্দ্রসূর্য করিবারে গ্রাস —
সেদিন হে গিরি, তব এক সঙ্গী আছিল প্রলয়;
যখনি থেমেছ তুমি, বলিয়াছ “আর নয় নয়’,
চারি দিক হতে এল তোমা’পরে আনন্দনিশ্বাস,
তোমার সমাপ্তি ঘেরি বিস্তারিল বিশ্বের বিশ্বাস। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
ওরে পদ্মা, ওরে মোর রাক্ষসী প্রেয়সী,
লুব্ধ বাহু বাড়াইয়া উচ্ছ্বসি উল্লসি
আমারে কি পেতে চাস চির আলিঙ্গনে।
শুধু এক মুহূর্তের উন্মত্ত মিলনে
তোর বক্ষোমাঝে চাস করিতে বিলয়
আমার বক্ষের যত সুখ দুঃখ ভয়?
আমিও তো কতদিন ভাবিয়াছি মনে
বসি তোর তটোপান্তে প্রশান্ত নির্জনে,
বাহিরে চঞ্চলা তুই প্রমত্তমুখরা,
শানিত অসির মতো ভীষণ প্রখরা,
অন্তরে নিভৃত স্নিগ্ধ শান্ত সুগম্ভীর–
দীপহীন রুদ্ধদ্বার অর্ধরজনীর
বাসরঘরের মতো নিষুপ্ত নির্জন–
সেথা কার তরে পাতা সুচির শয়ন। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
পাখিওয়ালা বলে, “এটা
কালোরঙ চন্দনা।’
পানুলাল হালদার
বলে, “আমি অন্ধ না–
কাক ওটা নিশ্চিত,
হরিনাম ঠোঁটে নাই।’
পাখিওয়ালা বলে, “বুলি
ভালো করে ফোটে নাই–
পারে না বলিতে বাবা,
কাকা নামে বন্দনা।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যখন এ দেহ হতে রোগে ও জরায়
দিনে দিনে সামর্থ্য ঝরায়,
যৌবন এ জীর্ণ নীড় পিছে ফেলে দিয়ে যায় ফাঁকি,
কেবল শৈশব থাকে বাকি।
বদ্ধ ঘরে কর্মক্ষুব্ধ সংসার–বাহিরে
অশক্ত সে শিশুচিত্ত মা খুঁজিয়া ফিরে।
বিত্তহারা প্রাণ লুব্ধ হয়
বিনা মূল্যে স্নেহের প্রশ্রয়
কারো কাছে করিবারে লাভ,
যার আবির্ভাব
ক্ষীণজীবিতেরে করে দান
জীবনের প্রথম সম্মান।
“থাকো তুমি’ মনে নিয়ে এইটুকু চাওয়া
কে তারে জানাতে পারে তার প্রতি নিখিলের দাওয়া
শুধু বেঁচে থাকিবার।
এ বিস্ময় বারবার
আজি আসে প্রাণে
প্রাণলক্ষ্মী ধরিত্রীর গভীর আহ্বানে
মা দাঁড়ায় এসে
যে মা চিরপুরাতন নূতনের বেশে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
সাধু যবে স্বর্গে গেল, চিত্রগুপ্তে ডাকি
কহিলেন, “আনো মোর পুণ্যের হিসাব।”
চিত্রগুপ্ত খাতাখানি সম্মুখেতে রাখি
দেখিতে লাগিল তার মুখের কী ভাব।
সাধু কহে চমকিয়া, “মহা ভুল এ কী!
প্রথমের পাতাগুলো ভরিয়াছ আঁকে,
শেষের পাতায় এ যে সব শূন্য দেখি—
যতদিন ডুবে ছিনু সংসারের পাঁকে
ততদিন এত পুণ্য কোথা হতে আসে!”
শুনি কথা চিত্রগুপ্ত মনে মনে হাসে।
সাধু মহা রেগে বলে, “যৌবনের পাতে
এত পুণ্য কেন লেখ দেবপূজা-খাতে।”
চিত্রগুপ্ত হেসে বলে, “বড়ো শক্ত বুঝা।
যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।” (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
শোকমূলক
|
ছোট্ট আমার মেয়ে
সঙিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে
সিঁড়ি দিয়ে নীচের তলায় যাচ্ছিল সে নেমে
অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে, থেমে থেমে।
হাতে ছিল প্রদীপখানি,
আঁচল দিয়ে আড়াল ক'রে চলছিল সাবধানী।।আমি ছিলাম ছাতে
তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে।
হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে, উঠে
দেখতে গেলাম ছুটে।
সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিভে গেছে বাতাসেতা।
শুধাই তারে, 'কী হয়েছে বামি?'
সে কেঁদে কয় নীচে থেকে, 'হারিয়ে গেছি আমি!’তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে
ফিরে গেছি ছাতে
মনে হল আকাশ-পানে চেয়ে,
আমার বামির মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে
নীলাম্বরের আঁচলখানি ঘিরে
দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চিলছে ধীরে ধীরে।
নিবত যদি আলো, যদি হঠাৎ যেত থামি,
আকাশ ভরে উঠত কেঁদে, "হারিয়ে গেছি আমি!'
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
সারাদিন কাটাইয়া সিংহাসন পরে
সন্ধ্যায় পশিল রাম শয়নের ঘরে।
শয্যার আধেক অংশ শূন্য বহুকাল,
তারি পরে রাখিলেন পরিশ্রান্ত ভাল।
দেবশূন্য দেবালয়ে ভক্তের মতন
বসিলেন ভূমি-পরে সজলনয়ন,
কহিলেন নতজানু কাতর নিশ্বাসে—
“যতদিন দীনহীন ছিনু বনবাসে
নাহি ছিল স্বর্ণমণি মাণিক্যমুকতা,
তুমি সদা ছিলে লক্ষ্মী প্রত্যক্ষ দেবতা।
আজি আমি রাজ্যেশ্বর, তুমি নাই আর,
আছে স্বর্ণমাণিক্যের প্রতিমা তোমার।”
নিত্যসুখ দীনবেশে বনে গেল ফিরে,
স্বর্ণময়ী চিরব্যথা রাজার মন্দিরে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
বিড়ালে মাছেতে হল সখ্য।
বিড়াল কহিল, “ভাই ভক্ষ্য,
বিধাতা স্বয়ং জেনো সর্বদা কন তোরে–
ঢোকো গিয়ে বন্ধুর রসময় অন্তরে,
সেখানে নিজেরে তুমি সযতনে রক্ষ।
ঐ দেখো পুকুরের ধারে আছে ঢালু ডাঙা,
ঐখানে সয়তান বসে থাকে মাছরাঙা,
কেন মিছে হবে ওর চঞ্চুর লক্ষ্য! (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
এ কথা সে কথা মনে আসে,
বর্ষাশেষে শরতের মেঘ যেন ফিরিছে বাতাসে।
কাজের বাঁধনহারা শূন্যে করে মিছে আনাগোনা;
কখনো রুপালি আঁকে, কখনো ফুটায়ে তোলে সোনা।
অদ্ভুত মূর্তি সে রচে দিগন্তের কোণে,
রেখার বদল করে পুনঃ পুনঃ যেন অন্যমনে।
বাষ্পের সে শিল্পকাজ যেন আনন্দের অবহেলা–
কোনোখানে দায় নেই, তাই তার অর্থহীন খেলা।
জাগার দায়িত্ব আছে, কাজ নিয়ে তাই ওঠাপড়া।
ঘুমের তো দায় নেই, এলোমেলো স্বপ্ন তাই গড়া।
মনের স্বপ্নের ধাত চাপা থাকে কাজের শাসনে,
বসিতে পায় না ছুটি স্বরাজ-আসনে।
যেমনি সে পায় ছাড়া খেয়ালে খেয়ালে করে ভিড়,
স্বপ্ন দিয়ে রচে যেন উড়ুক্ষু পাখির কোন্ নীড়।
আপনার মাঝে তাই পেতেছি প্রমাণ–
স্বপ্নের এ পাগলামি বিশ্বের আদিম উপাদান।
তাহারে দমনে রাখে, ধ্রুব করে সৃষ্টির প্রণালী
কর্তৃত্ব প্রচণ্ড বলশালী।
শিল্পের নৈপুণ্য এই উদ্দামেরে শৃঙ্খলিত করা,
অধরাকে ধরা। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
বাবলাশাখারে বলে আম্রশাখা, ভাই,
উনানে পুড়িয়া তুমি কেন হও ছাই?
হায় হায়, সখী, তব ভাগ্য কী কঠোর!
বাবলার শাখা বলে, দুঃখ নাহি মোর।
বাঁচিয়া সফল তুমি, ওগো চূতলতা,
নিজেরে করিয়া ভস্ম মোর সফলতা। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
চলিয়াছি রণক্ষেত্রে সংগ্রামের পথে।
সংসারবিপ্লবধ্বনি আসে দূর হতে।
বিদায় নেবার আগে, পারি যতক্ষণ
পরিপূর্ণ করি লই মোর প্রাণমন
নিত্য-উচ্চারিত তব কলকণ্ঠস্বরে
উদার মঙ্গলমন্ত্রে—হৃদয়ের ‘পরে
লই তব শুভস্পর্শ, কল্যাণসঞ্চয়।
এই আশীর্বাদ করো, জয়পরাজয়
ধরি যেন নম্রচিত্তে করি শির নত
দেবতার আশীর্বাদী কুসুমের মতো।
বিশ্বস্ত স্নেহের মূর্তি দুঃস্বপ্নের প্রায়
সহসা বিরূপ হয়—তবু যেন তায়
আমার হৃদয়সুধা না পায় বিকার,
আমি যেন আমি থাকি নিত্য আপনার। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
ইদিলপুরেতে বাস নরহরি শর্মা,
হঠাৎ খেয়াল গেল যাবেই সে বর্মা।
দেখবে-শুনবে কে যে তাই নিয়ে ভাবনা,
রাঁধবে বাড়বে, দেবে গোরুটাকে জাবনা–
সহধর্মিণী নেই, খোঁজে সহধর্মা।
গেল তাই খণ্ডালা, গেল তাই অণ্ডালে,
মহা রেগে গাল দেয় রেলগাড়ি-চণ্ডালে,
সাথি খুঁজে সে বেচারা কী গলদ্ঘর্মা–
বিস্তর ভেবে শেষে গেল সে কোডর্মা। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
শুন কলপনা বালা, ছিল কোন কবি
বিজন কুটীর-তলে। ছেলেবেলা হোতে
তোমার অমৃত-পানে আছিল মজিয়া।
তোমার বীণার ধ্বনি ঘুমায়ে ঘুমায়ে
শুনিত, দেখিত কত সুখের স্বপন।
একাকী আপন মনে সরল শিশুটি
তোমারি কমল-বনে করিত গো খেলা,
মনের কত কি গান গাহিত হরষে,
বনের কত কি ফুলে গাঁথিত মালিকা।
একাকী আপন মনে কাননে কাননে
যেখানে সেখানে শিশু করিত ভ্রমণ;
একাকী আপন মনে হাসিত কাঁদিত।
জননীর কোল হতে পালাত ছুটিয়া,
প্রকৃতির কোলে গিয়া করিত সে খেলা--
ধরিত সে প্রজাপতি, তুলিত সে ফুল,
বসিত সে তরুতলে, শিশিরের ধারা
ধীরে ধীরে দেহে তার পড়িত ঝরিয়া।
বিজন কুলায়ে বসি গাহিত বিহঙ্গ,
হেথা হোথা উঁকি মারি দেখিত বালক
কোথায় গাইছে পাখী। ফুলদলগুলি,
কামিনীর গাছ হোতে পড়িলে ঝরিয়া
ছড়ায়ে ছড়ায়ে তাহা করিত কি খেলা!
প্রফুল্ল উষার ভূষা অরুণকিরণে
বিমল সরসী যবে হোত তারাময়ী,
ধরিতে কিরণগুলি হইত অধীর।
যখনি গো নিশীথের শিশিরাশ্রু-জলে
ফেলিতেন উষাদেবী সুরভি নিশ্বাস,
গাছপালা লতিকার পাতা নড়াইয়া
ঘুম ভাঙাইয়া দিয়া ঘুমন্ত নদীর
যখনি গাহিত বায়ু বন্য-গান তার,
তখনি বালক-কবি ছুটিত প্রান্তরে,
দেখিত ধান্যের শিষ দুলিছে পবনে।
দেখিত একাকী বসি গাছের তলায়,
স্বর্ণময় জলদের সোপানে সোপানে
উঠিছেন উষাদেবী হাসিয়া হাসিয়া।
নিশা তারে ঝিল্লীরবে পাড়াইত ঘুম,
পূর্ণিমার চাঁদ তার মুখের উপরে
তরল জোছনা-ধারা দিতেন ঢালিয়া,
স্নেহময়ী মাতা যথা সুপ্ত শিশুটির
মুখপানে চেয়ে চেয়ে করেন চুম্বন।
প্রভাতের সমীরণে, বিহঙ্গের গানে
উষা তার সুখনিদ্রা দিতেন ভাঙ্গায়ে।
এইরূপে কি একটি সঙ্গীতের মত,
তপনের স্বর্ণময়-কিরণে প্লাবিত
প্রভাতের একখানি মেঘের মতন,
নন্দন বনের কোন অপ্সরা-বালার
সুখময় ঘুমঘোরে স্বপনের মত
কবির বালক-কাল হইল বিগত।
--
যৌবনে যখনি কবি করিল প্রবেশ,
প্রকৃতির গীতধ্বনি পাইল শুনিতে,
বুঝিল সে প্রকৃতির নীরব কবিতা।
প্রকৃতি আছিল তার সঙ্গিনীর মত।
নিজের মনের কথা যত কিছু ছিল
কহিত প্রকৃতিদেবী তার কানে কানে,
প্রভাতের সমীরণ যথা চুপিচুপি
কহে কুসুমের কানে মরমবারতা।
নদীর মনের গান বালক যেমন
বুঝিত, এমন আর কেহ বুঝিত না।
বিহঙ্গ তাহার কাছে গাইত যেমন,
এমন কাহারো কাছে গাইত না আর।
তার কাছে সমীরণ যেমন বহিত
এমন কাহারো কাছে বহিত না আর।
যখনি রজনীমুখ উজলিত শশী,
সুপ্ত বালিকার মত যখন বসুধা
সুখের স্বপন দেখি হাসিত নীরবে,
বসিয়া তটিনীতীরে দেখিত সে কবি--
স্নান করি জোছনায় উপরে হাসিছে
সুনীল আকাশ, হাসে নিম্নে স্রোতস্বিনী;
সহসা সমীরণের পাইয়া পরশ
দুয়েকটি ঢেউ কভু জাগিয়া উঠিছে।
ভাবিত নদীর পানে চাহিয়া চাহিয়া,
নিশাই কবিতা আর দিবাই বিজ্ঞান।
দিবসের আলোকে সকলি অনাবৃত,
সকলি রয়েছে খোলা চখের সমুখে--
ফুলের প্রত্যেক কাঁটা পাইবে দেখিতে।
দিবালোকে চাও যদি বনভূমি-পানে,
কাঁটা খোঁচা কর্দ্দমাক্ত বীভৎস জঙ্গল
তোমার চখের 'পরে হবে প্রকাশিত;
দিবালোকে মনে হয় সমস্ত জগৎ
নিয়মের যন্ত্রচক্রে ঘুরিছে ঘর্ঘরি।
কিন্তু কবি নিশাদেবী কি মোহন-মন্ত্র
পড়ি দেয় সমুদয় জগতের 'পরে,
সকলি দেখায় যেন স্বপ্নের মতন;
ঐ স্তব্ধ নদীজলে চন্দ্রের আলোকে
পিছলিয়া চলিতেছে যেমন তরণী,
তেমনি সুনীল ঐ আকাশসলিলে
ভাসিয়া চলেছে যেন সমস্ত জগৎ;
সমস্ত ধরারে যেন দেখিয়া নিদ্রিত,
একাকী গম্ভীর-কবি নিশাদেবী ধীরে
তারকার ফুলমালা জড়ায়ে মাথায়,
জগতের গ্রন্থ কত লিখিছে কবিতা।
এইরূপে সেই কবি ভাবিত কত কি।
হৃদয় হইল তার সমুদ্রের মত,
সে সমুদ্রে চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারকার
প্রতিবিম্ব দিবানিশি পড়িত খেলিত,
সে সমুদ্র প্রণয়ের জোছনা-পরশে
লঙ্ঘিয়া তীরের সীমা উঠিত উথলি,
সে সমুদ্র আছিল গো এমন বিস্তৃত
সমস্ত পৃথিবীদেবী, পারিত বেষ্টিতে
নিজ স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে। সে সিন্ধু-হৃদয়ে
দুরন্ত শিশুর মত মুক্ত সমীরণ
হু হু করি দিবানিশি বেড়াত খেলিয়া।
নির্ঝরিণী, সিন্ধুবেলা, পর্ব্বতগহ্বর,
সকলি কবির ছিল সাধের বসতি।
তার প্রতি তুমি এত ছিলে অনুকূল
কল্পনা! সকল ঠাঁই পাইত শুনিতে
তোমার বীণার ধ্বনি, কখনো শুনিত
প্রস্ফুটিত গোলাপের হৃদয়ে বসিয়া
বীণা লয়ে বাজাইছ অস্ফুট কি গান।
কনককিরণময় উষার জলদে
একাকী পাখীর সাথে গাইতে কি গীত
তাই শুনি যেন তার ভাঙ্গিত গো ঘুম!
অনন্ত-তারা-খচিত নিশীথগগনে
বসিয়া গাইতে তুমি কি গম্ভীর গান,
তাহাই শুনিয়া যেন বিহ্বলহৃদয়ে
নীরবে নিশীথে যবে একাকী রাখাল
সুদূর কুটীরতলে বাজাইত বাঁশী
তুমিও তাহার সাথে মিলাইতে ধ্বনি,
সে ধ্বনি পশিত তার প্রাণের ভিতর।
নিশার আঁধার-কোলে জগৎ যখন
দিবসের পরিশ্রমে পড়িত ঘুমায়ে
তখন সে কবি উঠি তুষারমন্ডিত
সমুচ্চ পর্ব্বতশিরে গাইত একাকী
প্রকৃতিবন্দনাগান মেঘের মাঝারে।
সে গম্ভীর গান তার কেহ শুনিত না,
কেবল আকাশব্যাপী স্তব্ধ তারকারা
এক দৃষ্টে মুখপানে রহিত চাহিয়া।
কেবল, পর্ব্বতশৃঙ্গ করিয়া আঁধার,
সরল পাদপরাজি নিস্তব্ধ গম্ভীর
ধীরে ধীরে শুনিত গো তাহার সে গান;
কেবল সুদূর বনে দিগন্তবালায়
হৃদয়ে সে গান পশি প্রতিধ্বনিরূপে
মৃদুতর হোয়ে পুন আসিত ফিরিয়া।
কেবল সুদূর শৃঙ্গে নির্ঝরিণী বালা
সে গম্ভীর গীতি-সাথে কণ্ঠ মিশাইত,
নীরবে তটিনী যেত সমুখে বহিয়া,
নীরবে নিশীথবায়ু কাঁপাত পল্লব।
গম্ভীরে গাইত কবি--"হে মহাপ্রকৃতি,
কি সুন্দর, কি মহান্ মুখশ্রী তোমার,
শূন্য আকাশের পটে হে প্রকৃতিদেবি
কি কবিতা লিখেছে যে জ্বলন্ত অক্ষরে,
যত দিন রবে প্রাণ পড়িয়া পড়িয়া
তবু ফুরাবে না পড়া; মিটিবে না আশ!
শত শত গ্রহ তারা তোমার কটাক্ষে
কাঁপি উঠে থরথরি, তোমার নিশ্বাসে
ঝটিকা বহিয়া যায় বিশ্বচরাচরে।
কালের মহান্ পক্ষ করিয়া বিস্তার,
অনন্ত আকাশে থাকি হে আদি জননি,
শাবকের মত এই অসংখ্য জগৎ
তোমার পাখার ছায়ে করিছ পালন!
সমস্ত জগৎ যবে আছিল বালক,
দুরন্ত শিশুর মত অনন্ত আকাশে
করিত গো ছুটাছুটি না মানি শাসন,
স্তনদানে পুষ্ট করি তুমি তাহাদের
অলঙ্ঘ্য সখ্যের ডোরে দিলে গো বাঁধিয়া।
এ দৃঢ় বন্ধন যদি ছিঁড়ে একবার,
সে কি ভয়ানক কাণ্ড বাঁধে এ জগতে,
কক্ষচ্ছিন্ন কোটি কোটি সূর্য্য চন্দ্র তারা
অনন্ত আকাশময় বেড়ায় মাতিয়া,
মণ্ডলে মণ্ডলে ঠেকি লক্ষ সূর্য্য গ্রহ
চূর্ণ চূর্ণ হোয়ে পড়ে হেথায় হোথায়;
এ মহান্ জগতের ভগ্ন অবশেষ
চূর্ণ নক্ষত্রের স্তূপ, খণ্ড খণ্ড গ্রহ
বিশৃঙ্খল হোয়ে রহে অনন্ত আকাশে!
অনন্ত আকাশ আর অনন্ত সময়,
যা ভাবিতে পৃথিবীর কীট মানুষের
ক্ষুদ্র বুদ্ধি হোয়ে পড়ে ভয়ে সঙ্কুচিত,
তাহাই তোমার দেবি সাধের আবাস।
তোমার মুখের পানে চাহিতে হে দেবি
ক্ষুদ্র মানবের এই স্পর্ধিত জ্ঞানের
দুর্ব্বল নয়ন যায় নিমীলিত হোয়ে।
হে জননি আমার এ হৃদয়ের মাঝে
অনন্ত-অতৃপ্তি-তৃষ্ণা জ্বলিছে সদাই,
তাই দেবি পৃথিবীর পরিমিত কিছু
পারে না গো জুড়াইতে হৃদয় আমার,
তাই ভাবিয়াছি আমি হে মহাপ্রকৃতি,
মজিয়া তোমার সাথে অনন্ত প্রণয়ে
জুড়াইব হৃদয়ের অনন্ত পিপাসা!
প্রকৃতি জননি ওগো, তোমার স্বরূপ
যত দূর জানিবারে ক্ষুদ্র মানবেরে
দিয়াছ গো অধিকার সদয় হইয়া,
তত দূর জানিবারে জীবন আমার
করেছি ক্ষেপণ আর করিব ক্ষেপণ।
ভ্রমিতেছি পৃথিবীর কাননে কাননে--
বিহঙ্গও যত দূর পারে না উড়িতে
সে পর্ব্বতশিখরেও গিয়াছি একাকী;
দিবাও পশে নি দেবি যে গিরিগহ্বরে,
সেথায় নির্ভয়ে আমি করেছি প্রবেশ।
যখন ঝটিকা ঝঞ্ঝা প্রচণ্ড সংগ্রামে
অটল পর্ব্বতচূড়া করেছে কম্পিত,
সুগম্ভীর অম্বুনিধি উন্মাদের মত
করিয়াছে ছুটাছুটি যাহার প্রতাপে,
তখন একাকী আমি পর্ব্বত-শিখরে
দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি সে ঘোর বিপ্লব,
মাথার উপর দিয়া অজস্র অশনি
সুবিকট অট্টহাসে গিয়াছে ছুটিয়া,
প্রকাণ্ড শিলার স্তূপ পদতল হোতে
পড়িয়াছে ঘর্ঘরিয়া উপত্যকা-দেশে,
তুষারসঙ্ঘাতরাশি পড়েছে খসিয়া
শৃঙ্গ হোতে শৃঙ্গান্তরে উলটি পালটি।
অমানিশীথের কালে নীরব প্রান্তরে
বসিয়াছি, দেখিয়াছি চৌদিকে চাহিয়া,
সর্ব্বব্যাপী নিশীথের অন্ধকার গর্ভে
এখনো পৃথিবী যেন হতেছে সৃজিত।
স্বর্গের সহস্র আঁখি পৃথিবীর 'পরে
নীরবে রয়েছে চাহি পলকবিহীন,
স্নেহময়ী জননীর স্নেহ-আঁখি যথা
সুপ্ত বালকের পরে রহে বিকসিত।
এমন নীরবে বায়ু যেতেছে বহিয়া,
নীরবতা ঝাঁ ঝাঁ করি গাইছে কি গান--
মনে হয় স্তব্ধতার ঘুম পাড়াইছে।
কি সুন্দর রূপ তুমি দিয়াছ উষায়,
হাসি হাসি নিদ্রোত্থিতা বালিকার মত
আধঘুমে মুকুলিত হাসিমাখা আঁখি!
কি মন্ত্র শিখায়ে দেছ দক্ষিণ-বালারে--
যে দিকে দক্ষিণবধূ ফেলেন নিঃশ্বাস,
সে দিকে ফুটিয়া উঠে কুসুম-মঞ্জরী,
সে দিকে গাহিয়া উঠে বিহঙ্গের দল,
সে দিকে বসন্ত-লক্ষ্মী উঠেন হাসিয়া।
কি হাসি হাসিতে জানে পূর্ণিমাশর্ব্বরী--
সে হাসি দেখিয়া হাসে গম্ভীর পর্ব্বত,
সে হাসি দেখিয়া হাসে উথল জলধি,
সে হাসি দেখিয়া হাসে দরিদ্র কুটীর।
হে প্রকৃতিদেবি তুমি মানুষের মন
কেমন বিচিত্র ভাবে রেখেছ পূরিয়া,
করুণা, প্রণয়, স্নেহ, সুন্দর শোভন--
ন্যায়, ভক্তি, ধৈর্য্য আদি সমুচ্চ মহান্--
ক্রোধ, দ্বেষ, হিংসা আদি ভয়ানক ভাব,
নিরাশা মরুর মত দারুণ বিষণ্ণ--
তেমনি আবার এই বাহির জগৎ
বিচিত্র বেশভূষায় করেছ সজ্জিত।
তোমার বিচিত্র কাব্য-উপবন হোতে
তুলিয়া সুরভি ফুল গাঁথিয়া মালিকা,
তোমারি চরণতলে দিব উপহার!"
এইরূপে সুনিস্তব্ধ নিশীথ-গগনে
প্রকৃতি-বন্দনা-গান গাইত সে কবি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
তুমি আছ হিমাচল ভারতের অনন্তসঞ্চিত
তপস্যার মতো। স্তব্ধ ভূমানন্দ যেন রোমাঞ্চিত
নিবিড় নিগূঢ়-ভাবের পথশূন্য তোমার নির্জনে,
নিষ্কলঙ্ক নীহারের অভ্রভেদী আত্মবিসর্জনে।
তোমার সহস্র শৃঙ্গ বাহু তুলি কহিছে নীরবে
ঋষির আশ্বাসবাণী, “শুন শুন বিশ্বজন সবে,
জেনেছি, জেনেছি আমি।’ যে ওঙ্কার আনন্দ-আলোতে
উঠেছিল ভারতের বিরাট গভীর বক্ষ হতে
আদি-অন্ত-বিহীনের অখণ্ড অমৃতলোক-পানে,
সে আজি উঠিছে বাজি, গিরি, তব বিপুল পাষাণে।
একদিন এ ভারতে বনে বনে হোমাগ্নি-আহুতি
ভাষাহারা মহাবার্তা প্রকাশিতে করেছে আকূতি,
সেই বহ্নিবাণী আজি অচল প্রস্তরশিখারূপে
শৃঙ্গে শৃঙ্গে কোন্ মন্ত্র উচ্ছ্বাসিছে মেঘধুম্রস্তূপে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
স্মৃতিকাপালিনী পূজারতা, একমনা,
বর্তমানেরে বলি দিয়া করে
অতীতের অর্চনা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
হাসিমুখে শুকতারা
লিখে গেল ভোররাতে
আলোকের আগমনী
অাঁধারের শেষপাতে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ওড়ার আনন্দে পাখি
শূন্যে দিকে দিকে
বিনা অক্ষরের বাণী
যায় লিখে লিখে।
মন মোর ওড়ে যবে
জাগে তার ধ্বনি,
পাখার আনন্দ সেই
বহিল লেখনী। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার
জনমের মতো দেখা হবে না কো আর।
মর্মভেদী অশ্রু দিয়ে, পূজিব তোমারে প্রিয়ে
দুখের নিশ্বাস আমি দিব উপহার।
সে তো তবু আছে ভালো, একটু আশার আলো
জ্বলিতেছে অদৃষ্টের আকাশে যাহার।
কিন্তু মোর আশা নাই, যে দিকে ফিরিয়া চাই
সেই দিকে নিরাশার দারুণ আঁধার!
ভালো যে বেসেছি তারে দোষ কী আমার?
উপায় কী আছে বলো উপায় কী তার?
দেখামাত্র সেই জনে, ভালোবাসা আসে মনে
ভালো বাসিলেই ভুলা নাহি যায় আর!
নাহি বাসিতাম যদি এত ভালো তারে
অন্ধ হয়ে প্রেমে তার মজিতাম না রে
যদি নাহি দেখিতাম, বিচ্ছেদ না জানিতাম
তা হলে হৃদয় ভেঙে যেত না আমার!
আমারে বিদায় দাও যাই গো সুন্দরী,
যাই তবে হৃদয়ের প্রিয় অধীশ্বরী,
থাকো তুমি থাকো সুখে, বিমল শান্তির বুকে
সুখ, প্রেম, যশ, আশা থাকুক তোমার
একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার।Robert Burns
(অনুবাদ কবিতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
কোথা হতে দুই চক্ষে ভরে নিয়ে এলে জল হে প্রিয় আমার।
হে ব্যথিত, হে অশান্ত, বলো আজি গাব গান
কোন্ সান্ত্বনার।
হেথায় প্রান্তরপারে
নগরীর এক ধারে
সায়াহ্নের অন্ধকারে
জ্বালি দীপখানি
শূন্য গৃহে অন্যমনে
একাকিনী বাতায়নে
বসে আছি পুষ্পাসনে
বাসরের রানী--
কোথা বক্ষে বিঁধি কাঁটা ফিরিলে আপন নীড়ে
হে আমার পাখি।
ওরে ক্লিষ্ট, ওরে ক্লান্ত, কোথা তোর বাজে ব্যথা,
কোথা তোরে রাখি।চারি দিকে তমস্বিনী রজনী দিয়েছে টানি
মায়ামন্ত্র-ঘের--
দুয়ার রেখেছি রুধি, চেয়ে দেখো কিছু হেথা
নাহি বাহিরের।
এ যে দুজনের দেশ,
নিখিলের সব শেষ,
মিলনের রসাবেশ
অনন্ত ভবন--
শুধু এই এক ঘরে
দুখানি হৃদয় ধরে,
দুজনে সৃজন করে
নূতন ভুবন।
একটি প্রদীপ শুধু এ আঁধারে যতটুকু
আলো করে রাখে
সেই আমাদের বিশ্ব, তাহার বাহিরে আর
চিনি না কাহাকে।একখানি বীণা আছে, কভু বাজে মোর বুকে
কভু তব কোরে।
একটি রেখেছি মালা, তোমারে পরায়ে দিলে
তুমি দিবে মোরে।
এক শয্যা রাজধানী,
আধেক আঁচলখানি
বক্ষ হতে লয়ে টানি
পাতিব শয়ন।
একটি চুম্বন গড়ি
দোঁহে লব ভাগ করি--
এ রাজত্বে, মরি মরি,
এত আয়োজন।
একটি গোলাপফুল রেখেছি বক্ষের মাঝে,
তব ঘ্রাণশেষে
আমারে ফিরায়ে দিলে অধরে পরশি তাহা
পরি লব কেশে।আজ করেছিনু মনে তোমারে করিব রাজা
এই রাজ্যপাটে,
এ অমর বরমাল্য আপনি যতনে তব
জড়াব ললাটে।
মঙ্গলপ্রদীপ ধ'রে
লইব বরণ করে,
পুষ্পসিংহাসন-'পরে
বসাব তোমায়--
তাই গাঁথিয়াছি হার,
আনিয়াছি ফুলভার,
দিয়েছি নূতন তার
কনকবীণায়।
আকাশে নক্ষত্রসভা নীরবে বসিয়া আছে
শান্ত কৌতূহলে--
আজি কি এ মালাখানি সিক্ত হবে, হে রাজন্,
নয়নের জলে।রুদ্ধকণ্ঠ, গীতহারা, কহিয়ো না কোনো কথা,
কিছু শুধাব না--
নীরবে লইব প্রাণে তোমার হৃদয় হতে
নীরব বেদনা।
প্রদীপ নিবায়ে দিব,
বক্ষে মাথা তুলি নিব,
স্নিগ্ধ করে পরশিব
সজল কপোল--
বেণীমুক্ত কেশজাল
স্পর্শিবে তাপিত ভাল,
কোমল বক্ষের তাল
মৃদুমন্দ দোল।
নিশ্বাসবীজনে মোর কাঁপিবে কুন্তল তব,
মুদিবে নয়ন--
অর্ধরাতে শান্তবায়ে নিদ্রিত ললাটে দিব
একটি চুম্বন।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
পশ্চিমে রবির দিন
হলে অবসান
তখনো বাজুক কানে
পুরবীর গান। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
ভাগ্য তাহার ভুল করেছে-- প্রাণের তানপুরার
গানের সাথে মিল হল না, বেসুরো ঝংকার।
এমন ত্রুটি ঘটল কিসে
আপনিও তা বোঝে নি সে,
অভাব কোথাও নেই-যে কিছুই এই কি অভাব তার।ঘরটাকে তার ছাড়িয়ে গেল ঘরেরই আসবাবে।
মনটাকে তার ঠাঁই দিল না ধনের প্রাদুর্ভাবে।
যা চাই তারো অনেক বেশি
ভিড় করে রয় ঘেঁষাষেঁষি,
সেই ব্যাঘাতের বিরুদ্ধে তাই বিদ্রোহ তার নাবে।সব চেয়ে যা সহজ সেটাই দুর্লভ তার কাছে।
সেই সহজের মূর্তি যে তার বুকের মধ্যে আছে।
সেই সহজের খেলাঘরে
ওই যারা সব মেলা করে
দূর হতে ওর বদ্ধ জীবন সঙ্গ তাদের যাচে।প্রাণের নিঝর স্বভাব-ধারায় বয় সকলের পানে,
সেটাই কি কেউ ফিরিয়ে দিল উলটো দিকের টানে।
আত্মদানের রুদ্ধ বাণী
বক্ষকপাট বেড়ায় হানি,
সঞ্চিত তার সুধা কি তাই ব্যথা জাগায় প্রাণে।আপনি যেন আর কেহ সে এই লাগে তার মনে,
চেনা ঘরের অচল ভিতে কাটায় নির্বাসনে।
বসন ভূষণ অঙ্গরাগে
ছদ্মবেশের মতন লাগে,
তার আপনার ভাষা যে হায় কয় না আপন জনে।আজকে তারে নিজের কাছে পর করেছে কা'রা,
আপন-মাঝে বিদেশে বাস হায় এ কেমনধারা।
পরের খুশি দিয়ে সে যে
তৈরি হল ঘ'ষে মেজে,
আপনাকে তাই খুঁজে বেড়ায় নিত্য আপন-হারা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আনন্দ-গান উঠুক তবে বাজি
এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে।
অশ্রুজলের ঢেউয়ের 'পরে আজি
পারের তরী থাকুক ভাসিতে।
যাবার হাওয়া ওই যে উঠেছে--ওগো
ওই যে উঠেছে,
সারারাত্রি চক্ষে আমার
ঘুম যে ছুটেছে।
হৃদয় আমার উঠছে দুলে দুলে
অকূল জলের অট্টহাসিতে,
কে গো তুমি দাও দেখি তান তুলে
এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে।
হে অজানা, অজানা সুর নব
বাজাও আমার ব্যথার বাঁশিতে,
হঠাৎ এবার উজান হাওয়ায় তব
পারের তরী থাক্ না ভাসিতে।
কোনো কালে হয় নি যারে দেখা--ওগো
তারি বিরহে
এমন করে ডাক দিয়েছে,
ঘরে কে রহে।
বাসার আশা গিয়েছে মোর ঘুরে,
ঝাঁপ দিয়েছি আকাশরাশিতে;
পাগল, তোমার সৃষ্টিছাড়া সুরে
তান দিয়ো মোর ব্যথার বাঁশিতে।
রেলগাড়ি, ২৯ পৌষ, ১৩২১
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
যে যায় তাহারে অার
ফিরে ডাকা বৃথা।
অশ্রুজলে স্মৃতি তার
হোক পল্লবিতা। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায়,
আঁধারেতে চলে যায় বাহিরে।
ভাবে মনে, বৃথা এই আসা আর যাওয়া,
অর্থ কিছুই এর নাহি রে।
কেন আসি, কেন হাসি,
কেন আঁখিজলে ভাসি,
কার কথা বলে যাই, কার গান গাহি রে–
অর্থ কিছুই তার নাহি রে।ওরে মন, আয় তুই সাজ ফেলে আয়,
মিছে কী করিস নাট-বেদীতে।
বুঝিতে চাহিস যদি বাহিরেতে আয়,
খেলা ছেড়ে আয় খেলা দেখিতে।
ওই দেখ্ নাটশালা
পরিয়াছে দীপমালা,
সকল রহস্য তুই চাস যদি ভেদিতে
নিজে না ফিরিলে নাট-বেদীতে।নেমে এসে দূরে এসে দাঁড়াবি যখন–
দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি,
এই হাসি-রোদনের মহানাটকের
অর্থ তখন কিছু বুঝিবি।
একের সহিত একে
মিলাইয়া নিবি দেখে,
বুঝে নিবি, বিধাতার সাথে নাহি যুঝিবি–
দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
জন্মেছি তোমার মাঝে ক্ষণিকের তরে
অসীম প্রকৃতি! সরল বিশ্বাসভরে
তবু তোরে গৃহ ব’লে মাতা ব’লে মানি।
আজ সন্ধ্যাবেলা তোর নখদন্ত হানি
প্রচন্ড পিশাচরূপে ছুটিয়া গর্জিয়া,
আপনার মাতৃবেশ শূন্যে বিসর্জিয়া
কুটি কুটি ছিন্ন করি বৈশাখের ঝড়ে
ধেয়ে এলি ভয়ংকরী ধূলিপক্ষ-’পরে,
তৃণসম করিবারে প্রাণ উৎপাটন।
সভয়ে শুধাই আজি, হে মহাভীষণ,
অনন্ত আকাশপথ রুধি চারি ধারে
কে তুমি সহস্রবাহু ঘিরেছ আমারে?
আমার ক্ষণিক প্রাণ কে এনেছে যাচি?
কোথা মোরে যেতে হবে, কেন আমি আছি? (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
ডুবারি যে সে কেবল
ডুব দেয় তলে।
যেজন পারের যাত্রী
সেই ভেসে চলে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল, ওরে ফল,
কত দূরে রয়েছিস বল্ মোরে বল্।
ফল কহে, মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি,
তোমারি অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
বাণী কহে, তোমারে যখন দেখি, কাজ,
আপনার শূণ্যতায় বড়ো পাই লাজ।
কাজ শুনি কহে, অয়ি পরিপূর্ণা বাণী,
নিজেরে তোমার কাছে দীন ব’লে জানি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি ।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি ।
যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর
মর্ম গভীরতম —
উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া
সকল উচ্চে মম ।
মোর কল্পনা শত
রঙিন মেঘের মতো
তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে ,
সোহাগে হতেছে নত ।
আমার শ্যামল তরুলতাগুলি
ফুলপল্লবভারে
সরস কোমল বাহুবেষ্টনে
বাঁধিতে চাহিছে তারে ।
শিখর গগনলীন
দুর্গম জনহীন ,
বাসনাবিহগ একেলা সেথায়
ধাইছে রাত্রিদিন ।
চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া ,
কত গীত , কত কথা —
মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন
নিশ্চল নীরবতা ।
দূরে গেলে তবু , একা
সে শিখর যায় দেখা —
চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার
নিত্যনীহাররেখা ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে,
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
দুই তীরে দুই গ্রাম আছে জানাশোনা,
সকাল হইতে সন্ধ্যা করে আনাগোনা।
পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব কত সর্বনাশ,
নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস,
রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে
সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে,
সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা,
উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা—
শুধু হেথা দুই তীরে, কেবা জানে নাম,
দোঁহাপানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে,
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা -
খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।
কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে
গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে
লয়ে তার ভীরু দীপশিখা!
দিগন্তের কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।।(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কাকা বলেন , সময় হলে
সবাই চ ' লে
যায় কোথা সেই স্বর্গ - পারে ।
বল্ তো কাকী
সত্যি তা কি
একেবারে ?
তিনি বলেন , যাবার আগে
তন্দ্রা লাগে
ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি ,
দ্বারের পাশে
তখন আসে
ঘাটের মাঝি ।
বাবা গেছেন এমনি করে
কখন ভোরে
তখন আমি বিছানাতে ।
তেমনি মাখন
গেল কখন
অনেক রাতে ।
কিন্তু আমি বলছি তোমায়
সকল সময়
তোমার কাছেই করব খেলা ,
রইব জোরে
গলা ধরে
রাতের বেলা ।
সময় হলে মানব না তো ,
জানব না তো ,
ঘণ্টা মাঝির বাজল কবে ।
তাই কি রাজা
দেবেন সাজা
আমায় তবে ?
তোমরা বল , স্বর্গ ভালো
সেথায় আলো
রঙে রঙে আকাশ রাঙায় ,
সারা বেলা
ফুলের খেলা
পারুলডাঙায় !
হোক - না ভালো যত ইচ্ছে —
কেড়ে নিচ্ছে
কেই বা তাকে বলো , কাকী ?
যেমন আছি
তোমার কাছেই
তেমনি থাকি !
ওই আমাদের গোলাবাড়ি ,
গোরুর গাড়ি
পড়ে আছে চাকা - ভাঙা ,
গাবের ডালে
পাতার লালে
আকাশ রাঙা ।
সেথা বেড়ায় যক্ষীবুড়ি
গুড়িগুড়ি
আসশেওড়ার ঝোপে ঝাপে
ফুলের গাছে
দোয়েল নাচে
ছায়া কাঁপে ।
নুকিয়ে আমি সেথা পলাই ,
কানাই বলাই
দু - ভাই আসে পাড়ার থেকে ।
ভাঙা গাড়ি
দোলাই নাড়ি
ঝেঁকে ঝেঁকে ।
সন্ধেবেলায় গল্প বলে
রাখ কোলে ,
মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি ।
চালতা - শাখে
পেঁচা ডাকে ,
বাড়ে রাতি ।
স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি
বলছি , কাকী ,
দেখব আমায় কে কী করে ।
চিরকালই
রইব খালি
তোমার ঘরে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আমার নৌকো বাঁধা ছিল পদ্মানদীর পারে,
হাঁসের পাঁতি উড়ে যেত মেঘের ধারে ধারে--
জানিনে মন-কেমন-করা লাগত কী সুর হাওয়ার
আকাশ বেয়ে দূর দেশেতে উদাস হয়ে যাওয়ার।
কী জানি সেই দিনগুলি সব কোন্ আঁকিয়ের লেখা,
ঝিকিমিকি সোনার রঙে হালকা তুলির রেখা।
বালির 'পরে বয়ে যেত স্বচ্ছ নদীর জল,
তেমনি বইত তীরে তীরে গাঁয়ের কোলাহল--
ঘাটের কাছে, মাঠের ধারে, আলো-ছায়ার স্রোতে;
অলস দিনের উড়্নিখানার পরশ আকাশ হতে
বুলিয়ে যেত মায়ার মন্ত্র আমার দেহে-মনে।
তারই মধ্যে আসত ক্ষণে ক্ষণে
দূর কোকিলের সুর,
মধুর হত আশ্বিনে রোদ্দুর।
পাশ দিয়ে সব নৌকো বড়ো বড়ো
পরদেশিয়া নানা খেতের ফসল ক'রে জড়ো
পশ্চিমে হাট বাজার হতে, জানিনে তার নাম,
পেরিয়ে আসত ধীর গমনে গ্রামের পরে গ্রাম
ঝপ্ঝপিয়ে দাঁড়ে।
খোরাক কিনতে নামত দাঁড়ি ছায়ানিবিড় পাড়ে।
যখন হত দিনের অবসান
গ্রামের ঘাটে বাজিয়ে মাদল গাইত হোলির গান।
ক্রমে রাত্রি নিবিড় হয়ে নৌকো ফেলত ঢেকে,
একটি কেবল দীপের আলো জ্বলত ভিতর থেকে।
শিকলে আর স্রোতে মিলে চলত টানের শব্দ;
স্বপ্নে যেন ব'কে উঠত রজনী নিস্তব্ধ।
পুবে হাওয়ায় এল ঋতু, আকাশ-জোড়া মেঘ;
ঘরমুখো ওই নৌকোগুলোয় লাগল অধীর বেগ।
ইলিশমাছ আর পাকা কাঁঠাল জমল পারের হাটে,
কেনাবেচার ভিড় লাগল নৌকো-বাঁধা ঘাটে।
ডিঙি বেয়ে পাটের আঁঠি আনছে ভারে ভারে,
মহাজনের দাঁড়িপাল্লা উঠল নদীর ধারে।
হাতে পয়সা এল, চাষি ভাব্না নাহি মানে,
কিনে নতুন ছাতা জুতো চলেছে ঘর-পানে।
পরদেশিয়া নৌকোগুলোর এল ফেরার দিন,
নিল ভরে খালি-করা কেরোসিনের টিন;
একটা পালের 'পরে ছোটো আরেকটা পাল তুলে
চলার বিপুল গর্বে তরীর বুক উঠেছে ফুলে।
মেঘ ডাকছে গুরু গুরু, থেমেছে দাঁড় বাওয়া,
ছুটছে ঘোলা জলের ধারা, বইছে বাদল হাওয়া।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
খ্যাতি নিন্দা পার হয়ে জীবনের এসেছি প্রদোষে,
বিদায়ের ঘাটে আছি বসে।
আপনার দেহটারে অসংশয়ে করেছি বিশ্বাস,
জরার সুযোগ পেয়ে নিজেরে সে করে পরিহাস,
সকল কাজেই দেখি কেবলি ঘটায় বিপর্যয়,
আমার কর্তৃত্ব করে ক্ষয়;
সেই অপমান হতে বাঁচাতে যাহারা
অবিশ্রাম দিতেছে পাহারা,
পাশে যারা দাঁড়ায়েছে দিনান্তের শেষ আয়োজনে,
নাম না’ই বলিলাম তাহারা রহিল মনে মনে।
তাহারা দিয়েছে মোরে সৌভাগ্যের শেষ পরিচয়,
ভুলায়ে রাখিছে তারা দুর্বল প্রাণের পরাজয়;
এ কথা স্বীকার তারা করে
খ্যাতি প্রতিপত্তি যত সুযোগ্য সক্ষমদের তরে;
তাহারাই করিছে প্রমাণ
অক্ষমের ভাগ্যে আছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সেই দান।
সমস্ত জীবন ধরে খ্যাতির খাজনা দিতে হয়,
কিছু সে সহে না অপচয়;
সব মূল্য ফুরাইলে যে দৈন্য প্রেমের অর্ঘ্য আনে
অসীমের স্বাক্ষর সেখানে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কল্যাণীয় শ্রীসুরেন্দ্রনাথ করবহু লোক এসেছিল জীবনের প্রথম প্রভাতে —
কেহ বা খেলার সাথী, কেহ কৌতূহলী,
কেহ কাজে সঙ্গ দিতে, কেহ দিতে বাধা।
আজ যারা কাছে আছ এ নিঃস্ব প্রহরে,
পরিশ্রান্ত প্রদোষের অবসন্ন নিস্তেজ আলোয়
তোমরা আপন দীপ আনিয়াছ হাতে,
খেয়া ছাড়িবার আগে তীরের বিদায়স্পর্শ দিতে।
তোমরা পথিকবন্ধু,
যেমন রাত্রির তারা
অন্ধকারে লুপ্তপথ যাত্রীর শেষের ক্লিষ্ট ক্ষণে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
একা আমি ফিরব না আর
এমন করে–
নিজের মনে কোণে কোণে
মোহের ঘোরে।তোমায় একলা বাহুর বাঁধন দিয়ে
ছোটো করে ঘিরতে গিয়ে
আপনাকে যে বাঁধি কেবল
আপন ডোরে।যখন আমি পাব তোমায়
নিখিলমাঝে
সেইখনে হৃদয় পাব
হৃদয়রাজে।
এই চিত্ত আমার বৃন্ত কেবল
তারি ‘পরে বিশ্বকমল;
তারি ‘পরে পূর্ণ প্রকাশ
দেখাও মোরে।২ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শীতের রোদ্দুর।
সোনা-মেশা সবুজের ঢেউ
স্তম্ভিত হয়ে আছে সেগুন বনে।
বেগনি-ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা
ঝুরি-নামা বৃদ্ধ বট
ডাল মেলেছে রাস্তার ওপার পর্যন্ত।
ফলসাগাছের ঝরা পাতা
হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে
ধুলোর সাঙাত হয়ে।
কাজ-ভোলা এই দিন
উধাও বলাকার মতো
লীন হয়ে চলেছে নিঃসীম নীলিমায়।
ঝাউগাছের মর্মরধ্বনিতে মিশে
মনের মধ্যে এই কথাটি উঠছে বেজে,
"আমি আছি।"
কুয়োতলার কাছে
সামান্য ঐ আমের গাছ;
সারা বছর ও থাকে আত্মবিস্মৃত,
বনের সাধারণ সবুজের আবরণে
ও থাকে ঢাকা।
এমন সময় মাঘের শেষে
হঠাৎ মাটির নিচে
শিকড়ে শিকড়ে তার শিহর লাগে,
শাখায় শাখায় মুকুলিত হয়ে ওঠে বাণী--
"আমি আছি,"
চন্দ্রসূর্যের আলো আপন ভাষায়
স্বীকার করে তার সেই ভাষা।
অলস মনের শিয়রে দাঁড়িয়ে
হাসেন অন্তর্যামী,
হঠাৎ দেন ঠেকিয়ে সোনার কাঠি
প্রিয়ার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি দিয়ে,
কবির গানের সুর দিয়ে,
তখন যে-আমি ধূলিধূসর সামান্য দিনগুলির
মধ্যে মিলিয়ে ছিল,
সে দেখা দেয় এক নিমেষের অসমান্য আলোকে।
সে-সব দুর্মূল্য নিমেষ
কোনো রত্নভাণ্ডারে থেকে যায় কি না জানিনে;
এইটুকু জানি--
তারা এসেছে আমার আত্মবিস্মৃতির মধ্যে,
জাগিয়েছে আমার মর্মে
বিশ্বমর্মের নিত্যকালের সেই বাণী
"আমি আছি।"
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
অনেক হাজার বছরের
মরু-যবনিকার আচ্ছাদন
যখন উৎক্ষিপ্ত হল,
দেখা দিল তারিখ-হারানো লোকালয়ের
বিরাট কঙ্কাল;--
ইতিহাসের অলক্ষ্য অন্তরালে
ছিল তার জীবনক্ষেত্র।
তার মুখরিত শতাব্দী
আপনার সমস্ত কবিগান
বাণীহীন অতলে দিয়েছে বিসর্জন।
আর, যে-সব গান তখনো ছিল অঙ্কুরে, ছিল মুকুলে,
যে বিপুল সম্ভাব্য
সেদিন অনালোকে ছিল প্রচ্ছন্ন
অপ্রকাশ থেকে অপ্রকাশেই গেল মগ্ন হয়ে--
যা ছিল অপ্রজ্বল ধোঁওয়ার গোপন আচ্ছাদনে
তাও নিবল।
যা বিকাল, আর যা বিকাল না,--
দুই-ই সংসারের হাট থেকে গেল চলে
একই মূল্যের ছাপ নিয়ে।
কোথাও রইল না তার ক্ষত,
কোথাও বাজল না তার ক্ষতি।
ঐ নির্মল নিঃশব্দ আকাশে
অসংখ্য কল্প-কল্পান্তরের
হয়েছে আবর্তন।
নূতন নূতন বিশ্ব
অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে
জন্ম নিয়েছে আলোকে,
ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে;
অবশেষে যুগান্তে তারা তেমনি করেই গেছে
যেমন গেছে বর্ষণশান্ত মেঘ,
যেমন গেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গ।
মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি।
তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে
উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি
আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে।
প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য,
তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে
তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে।
হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা।
জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে
যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি
সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম
স্তিমিত নিভৃতে
দাও আমাকে আশ্রয়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ভাই ভাই।
নভশ্চর ব’লে তার মনের বিশ্বাস,
শূণ্যপানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতা-ডোরে।
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি,
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
সখিরে— পিরী ত বুঝবে কে ?
অঁধার হৃদয়ক দুঃখ কাহিনী
বোলব , শুনবে কে ?
রাধিকার অতি অন্তর বেদন
কে বুঝবে অয়ি সজনী
কে বুঝবে সখি রোয়ত রাধা
কোন দুখে দিন রজনী ?
কলঙ্ক রটায়ব জনি সখি রটাও
কলঙ্ক নাহিক মানি ,
সকল তয়াগব লভিতে শ্যামক
একঠো আদর বাণী ।
মিনতি করিলো সখি শত শত বার , তু
শ্যামক না দিহ গারি ,
শীল মান কুল , অপনি সজনি হম
চরণে দেয়নু ডারি ।
সখিলো—
বৃন্দাবনকো দুরুজন মানুখ
পিরীত নাহিক জানে ,
বৃথাই নিন্দা কাহ রটায়ত
হমার শ্যামক নামে ?
কলঙ্কিনী হম রাধা , সখিলো
ঘৃণা করহ জনি মনমে
ন আসিও তব্ কবহুঁ সজনিলো
হমার অঁধা ভবনমে ।
কহে ভানু অব— বুঝবে না সখি
কোহি মরমকো বাত ,
বিরলে শ্যামক কহিও বেদন
বৃক্ষে রাখয়ি মাথ ।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা
নিশীথবেলা।
সঘন বরষা, গগন আঁধার
হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার---
ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা;
বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা॥ওগো, পবনে গগনে সাগরে আজিকে কী কল্লোল!
দে দোল্ দোল্।
পশ্চাত্ হতে হাহা ক'রে হাসি
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর অট্টরোল।
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে হট্টগোল!
দে দোল্ দোল্।আজি জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার বসিয়া আছে
বুকের কাছে।
থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,
ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া,
নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে হৃদয় নাচে;
ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার ব্যাকুলিয়াছে
বুকের কাছে॥হায়, এতকাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে
শয়ন-'পরে।
ব্যথা পাছে লাগে---- দুখ পাছে জাগে
নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
বাসরশয়ন করেছি রচন কুসুমথরে;
দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে গোপন ঘরে
যতনভরে॥কত সোহাগ করেছি চুম্বন করি নয়নপাতে
স্নেহের সাথে।
শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
কত প্রিয়নাম মৃদুমধুভাষে,
গুঞ্জরতান করিয়াছি গান জ্যোত্স্নারাতে;
যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার দুখানি হাতে
স্নেহের সাথে॥শেষে সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান আলসরসে
আবেশবশে।
পরশ করিলে জাগে না সে আর,
কুসুমের হার লাগে গুরুভার,
ঘুমে, জাগরণে মিশি একাকার নিশিদিবসে
বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ মরমে পশে
আবেশবশে॥ঢালি মধুরে মধুর বধূরে আমার হারাই বুঝি,
পাই নে খুঁজি।
বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে,
ব্যাকুল নয়ন হেরি চারি পাশে
শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম হয়েছে পুঁজি;
অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া মরি যে যুঝি
কাহারে খুঁজি॥তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে নূতন খেলা
রাত্রিবেলা
মরণদোলায় ধরি রশিগাছি
বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি,
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা;
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা
নিশীথবেলা॥ দে দোল্ দোল্।
দে দোল্ দোল্।
এ মহাসাগরে তুফান তোল্
বধূরে আমার পেয়েছি আবার, ভরেছে কোল।
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে প্রলয়রোল।
বক্ষশোণিতে উঠেছে আবার কী হিল্লোল!
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার কী কল্লোল!
উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল,
উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল,
বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী--- মত্তরোল।
দে দোল্ দোল্। আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর
আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন-বসন খোল্।
দে দোল্ দোল্। প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ
চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয়-লাজ,
বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে ভাবে বিভোল।
দে দোল্ দোল্।
স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরিছে আজ দুটি পাগল।
দে দোল্ দোল্।রামপুর বোয়ালিয়া, ১৫ চৈত্র ১২৯৯
সূত্রঃ সোনার তরী
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
সব ঠাঁই মোর ঘর আছে,আমি
সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।
দেশে দেশে মোর দেশ আছে,আমি
সেই দেশ লব যুঝিয়া।
পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই–
তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই,
কোথা দিয়া সেথা প্রবেশিতে পাই
সন্ধান লব বুঝিয়া।
ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়,
তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।রহিয়া রহিয়া নব বসন্তে
ফুলসুগন্ধ গগনে
কেঁদে ফেরে হিয়া মিলনবিহীন
মিলনের শুভ লগনে।
আপনার যারা আছে চারি ভিতে
পারি নি তাদের আপন করিতে,
তারা নিশিদিশি জাগাইছে চিতে
বিরহবেদনা সঘনে।
পাশে আছে যারা তাদেরই হারায়ে
ফিরে প্রাণ সারা গগনে।তৃণে পুলকিত যে মাটির ধরা
লুটায় আমার সামনে–
সে আমায় ডাকে এমন করিয়া
কেন যে,কব তা কেমনে।
মনে হয় যেন সে ধূলির তলে
যুগে যুগে আমি ছিনু তৃণে জলে,
সে দুয়ার খুলি কবে কোন্ ছলে
বাহির হয়েছি ভ্রমণে।
সেই মূক মাটি মোর মুখ চেয়ে
লুটায় আমার সামনে।নিশার আকাশ কেমন করিয়া
তাকায় আমার পানে সে।
লক্ষযোজন দূরের তারকা
মোর নাম যেন জানে সে।
যে ভাষায় তারা করে কানাকানি
সাধ্য কী আর মনে তাহা আনি;
চিরদিবসের ভুলে-যাওয়া বাণী
কোন্ কথা মনে আনে সে।
অনাদি উষায় বন্ধু আমার
তাকায় আমার পানে সে।এ সাত-মহলা ভবনে আমার
চির-জনমের ভিটাতে
স্থলে জলে আমি হাজার বাঁধনে
বাঁধা যে গিঁঠাতে গিঁঠাতে।
তবু হায় ভুলে যাই বারে বারে,
দূরে এসে ঘর চাই বাঁধিবারে,
আপনার বাঁধা ঘরেতে কি পারে
ঘরের বাসনা মিটাতে।
প্রবাসীর বেশে কেন ফিরি হায়
চির-জনমের ভিটাতে।যদি চিনি,যদি জানিবারে পাই,
ধুলারেও মানি আপনা।
ছেটো বড়ো হীন সবার মাঝারে
করি চিত্তের স্থাপনা।
হই যদি মাটি,হই যদি জল,
হই যদি তৃণ,হই ফুলফল,
জীব-সাথে যদি ফিরি ধরাতল
কিছুতেই নাই ভাবনা।
যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে
অন্তবিহীন আপনা।বিশাল বিশ্বে চারি দিক হতে
প্রতি কণা মোরে টানিছে।
আমার দুয়ারে নিখিল জগৎ
শত কোটি কর হানিছে।
ওরে মাটি, তুই আমারে কি চাস।
মোর তরে জল দু হাত বাড়াস?
নিশ্বাসে বুকে পশিয়া বাতাস
চির-আহ্বান আনিছে।
পর ভাবি যারে তারা বারে বারে
সবাই আমারে টানিছে।আছে আছে প্রেম ধুলায় ধুলায়,
আনন্দ আছে নিখিলে।
মিথ্যায় ঘেরে,ছোটো কণাটিরে
তুচ্ছ করিয়া দেখিলে।
জগতের যত অণু রেণু সব
আপনার মাঝে অচল নীরব
বহিছে একটি চিরগৌরব–
এ কথা না যদি শিখিলে
জীবনে মরণে ভয়ে ভয়ে তবে
প্রবাসী ফিরিবে নিখিলে।ধুলা-সাথে আমি ধুলা হয়ে রব
সে গৌরবের চরণে।
ফুলমাঝে আমি হব ফুলদল
তাঁর পূজারতি-বরণে।
যেথা যাই আর যেথায় চাহি রে
তিল ঠাঁই নাই তাঁহার বাহিরে,
প্রবাস কোথাও নাহি রে নাহি রে
জনমে জনমে মরণে।
যাহা হই আমি তাই হয়ে রব
সে গৌরবের চরণে।ধন্য রে আমি অনন্ত কাল,
ধন্য আমার ধরণী।
ধন্য এ মাটি,ধন্য সুদূর
তারকা হিরণ-বরনী।
যেথা আছি আমি আছি তাঁরি দ্বারে,
নাহি জানি ত্রাণ কেন বল কারে।
আছে তাঁরি পারে তাঁরি পারাবারে
বিপুল ভুবনতরণী।
যা হয়েছি আমি ধন্য হয়েছি,
ধন্য এ মোর ধরণী। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সংসারেতে দারুণ ব্যথা
লাগায় যখন প্রাণে
"আমি যে নাই" এই কথাটাই
মনটা যেন জানে।
যে আছে সে সকল কালের,
এ কাল হতে ভিন্ন—
তাহার গায়ে লাগে না তো
কোনো ক্ষতের চিহ্ন। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া
ধরণীতে,
এখন চল্ রে ঘাটে কলসখানি
ভরে নিতে।
জলধারার কলস্বরে
সন্ধ্যাগগন আকুল করে,
ওরে ডাকে আমায় পথের ‘পরে
সেই ধ্বনিতে।
চল্ রে ঘাটে কলসখানি
ভরে নিতে।এখন বিজন পথে করে না কেউ
আসা-যাওয়া,
ওরে প্রেম-নদীতে উঠেছে ঢেউ,
উতল হাওয়া।
জানি নে আর ফিরব কিনা,
কার সাথে আজ হবে চিনা,
ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা
তরণীতে।
চল্ রে ঘাটে কলসখানি
ভরে নিতে।১৩ ভাদ্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
খোকা থাকে জগৎ-মায়ের
অন্তঃপুরে—
তাই সে শোনে কত যে গান
কতই সুরে।
নানান রঙে রাঙিয়ে দিয়ে
আকাশ পাতাল
মা রচেছেন খোকার খেলা-
ঘরের চাতাল।
তিনি হাসেন, যখন তরু-
লতার দলে
খোকার কাছে পাতা নেড়ে
প্রলাপ বলে।
সকল নিয়ম উড়িয়ে দিয়ে
সূর্য শশী
খোকার সাথে হাসে, যেন
এক-বয়সী।
সত্যবুড়ো নানা রঙের
মুখোশ পরে
শিশুর সনে শিশুর মতো
গল্প করে।
চরাচরের সকল কর্ম
করে হেলা
মা যে আসেন খোকার সঙ্গে
করতে খেলা।
খোকার জন্যে করেন সৃষ্টি
যা ইচ্ছে তাই—
কোনো নিয়ম কোনো বাধা-
বিপত্তি নাই।
বোবাদেরও কথা বলান
খোকার কানে,
অসাড়কেও জাগিয়ে তোলেন
চেতন প্রাণে।
খোকার তরে গল্প রচে
বর্ষা শরৎ,
খেলার গৃহ হয়ে ওঠে
বিশ্বজগৎ।
খোকা তারি মাঝখানেতে
বেড়ায় ঘুরে,
খোকা থাকে জগৎ-মায়ের
অন্তঃপুরে।
আমরা থাকি জগৎ-পিতার
বিদ্যালয়ে—
উঠেছে ঘর পাথর-গাঁথা
দেয়াল লয়ে।
জ্যোতিষশাস্ত্র-মতে চলে
সূর্য শশী,
নিয়ম থাকে বাগিয়ে ল'য়ে
রশারশি।
এম্নি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে
বৃক্ষ লতা,
যেন তারা বোঝেই নাকো
কোনোই কথা।
চাঁপার ডালে চাঁপা ফোটে
এম্নি ভানে
যেন তারা সাত ভায়েরে
কেউ না জানে।
মেঘেরা চায় এম্নিতরো
অবোধ ভাবে,
যেন তারা জানেই নাকো
কোথায় যাবে।
ভাঙা পুতুল গড়ায় ভুঁয়ে
সকল বেলা,
যেন তারা কেবল শুধু
মাটির ঢেলা।
দিঘি থাকে নীরব হয়ে
দিবারাত্র,
নাগকন্যের কথা যেন
গল্পমাত্র।
সুখদুঃখ এম্নি বুকে
চেপে রহে,
যেন তারা কিছুমাত্র
গল্প নহে।
যেমন আছে তেম্নি থাকে
যে যাহা তাই—
আর যে কিছু হবে এমন
ক্ষমতা নাই।
বিশ্বগুরু-মশায় থাকেন
কঠিন হয়ে,
আমরা থাকি জগৎ-পিতার
বিদ্যালয়ে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
মানবতাবাদী
|
আজ তুমি ছোটো বটে, যার সঙ্গে গাঁঠছড়া বাঁধা
যেন তার আধা।
অধিকারগর্বভরে
সে তোমারে নিয়ে চলে নিজঘরে।
মনে জানে তুমি তার ছায়েবানুগতা--
তমাল সে, তার শাখালগ্ন তুমি মাধবীর লতা।
আজ তুমি রাঙাচেলি দিয়ে মোড়া
আগাগোড়া,
জড়োসড়ো ঘোমটায়-ঢাকা
ছবি যেন পটে আঁকা। আসিবে-যে আর-একদিন,
নারীর মহিমা নিয়ে হবে তুমি অন্তরে স্বাধীন
বাহিরে যেমনি থাক্।
আজিকে এই-যে বাজে শাঁখ
এরি মধ্যে আছে গূঢ় তব জয়ধ্বনি।
জিনি লবে তোমার সংসার, হে রমণী,
সেবার গৌরবে।
যে-জন আশ্রয় তব তোমারি আশ্রয় সেই লবে।
সংকোচের এই আবরণ দূর ক'রে
সেদিন কহিবে-- দেখো মোরে!
সে দেখিবে ঊর্ধ্বে মুখ তুলি
সৃপ্ত হয়ে পড়ে গেছে ধূসর সে কুণ্ঠিত গোধূলি--
দিগন্তের 'পরে স্মিতহাসে
পূর্ণচন্দ্র একা জাগে বসন্তের বিস্মিত আকাশে।
বুঝিবে সে দেহে মনে।
প্রচ্ছন্ন হয়েছে তরু পুষ্পিত লতার আলিঙ্গনে
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আইডিয়াল নিয়ে থাকে, নাহি চড়ে হাঁড়ি।
প্রাক্টিক্যাল লোকে বলে, এ যে বাড়াবাড়ি।
শিবনেত্র হল বুঝি, এইবার মোলো–
অক্সিজেন নাকে দিয়ে চাঙ্গা ক’রে তোলো। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
শেষ কহে, একদিন সব শেষ হবে,
হে আরম্ভ, বৃথা তব অহংকার তবে।
আরম্ভ কহিল ভাই, যেথা শেষ হয়
সেইখানে পুনরায় আরম্ভ-উদয়। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
অনিত্যের যত আবর্জনা
পূজার প্রাঙ্গণ হতে
প্রতি ক্ষণে করিয়ো মার্জনা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম–
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।
গিয়েছে আশ্বিন– পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে। ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে।
ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে; যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা। আমি বলি, “এ কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে যাই
কিছু লই সাথে।’
সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনো জন। “কী জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে?
সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান;
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল;
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল;
আমসত্ত্ব আমচুর; সের দুই দুধ–
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,
মাথা খাও, ভুলিয়ো না, খেয়ো মনে করে।’
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়।
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায়।
তাকানু ঘড়ির পানে, তার পরে ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে; কহিলাম ধীরে,
“তবে আসি’। অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু-‘পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন।
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের। এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার। এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন। শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল। কহিনু যখন
“মা গো, আসি’ সে কহিল বিষণ্ণ-নয়ন
ম্লান মুখে, “যেতে আমি দিব না তোমায়।’
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায়,
ধরিল না বাহু মোর, রুধিল না দ্বার,
শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল–“যেতে আমি দিব না তোমায়’।
তবুও সময় হল শেষ, তবু হায়
যেতে দিতে হল।
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
কে রে তুই, কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা, এত স্পর্ধাভরে–
“যেতে আমি দিব না তোমায়’? চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনী, সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ।
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
এ জগতে, শুধু বলে রাখা “যেতে দিতে
ইচ্ছা নাহি’। হেন কথা কে পারে বলিতে
“যেতে নাহি দিব’! শুনি তোর শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববাণী, সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে,
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভ’রে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন,
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন।
চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে। তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে, চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে। বহে খরবেগ
শরতের ভরা গঙ্গা। শুভ্র খণ্ডমেঘ
মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে। দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস।
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
“যেতে আমি দিব না তোমায়’। ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
“যেতে নাহি দিব। যেতে নাহি দিব।’ সবে
কহে “যেতে নাহি দিব’। তৃণ ক্ষুদ্র অতি
তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে “যেতে নাহি দিব’।
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,
আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
কহিতেছে শত বার “যেতে দিব না রে’।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন–“যেতে নাহি দিব’। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
“দিব না দিব না যেতে’ ডাকিতে ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
“দিব না দিব না যেতে’– নাহি শুনে কেউ
নাহি কোনো সাড়া।
চারি দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে; শিশুর মতন
বিশ্বের অবোধ বাণী। চিরকাল ধরে
যাহা পায় তাই সে হারায়, তবু তো রে
শিথিল হল না মুষ্টি, তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
“যেতে নাহি দিব’। ম্লান মুখ, অশ্রু-আঁখি,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব,
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
“যেতে নাহি দিব’। যত বার পরাজয়
তত বার কহে, “আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।
আমার আকাঙক্ষা-সম এমন আকুল,
এমন সকল-বাড়া, এমন অকূল,
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর!’
এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
“যেতে নাহি দিব’। তখনি দেখিতে পায়,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন,
ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির। তবু প্রেম বলে,
“সত্যভঙ্গ হবে না বিধির। আমি তাঁর
পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির-অধিকার-লিপি।’– তাই স্ফীত বুকে
সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
বলে, “মৃত্যু তুমি নাই।– হেন গর্বকথা!
মৃত্যু হাসে বসি। মরণপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার, বিষণ্ণ নয়ন-‘পরে
অশ্রুবাষ্প-সম, ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
চির-কম্পমান। আশাহীন শ্রান্ত আশা
টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
বিশ্বময়। আজি যেন পড়িছে নয়নে–
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে,
স্তব্ধ সকাতর। চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া–
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্ মেঘের সে মায়া।
তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
এত ব্যাকুলতা; অলস ঔদাস্যভরে
মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র লয়ে; বেলা ধীরে যায় চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে; শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন; মুখে নাহি বাণী।
দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন, স্তব্ধ মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আমারে বলে যে ওরা রোম্যাণ্টিক।
সে কথা মানিয়া লই
রসতীর্থ-পথের পথিক।
মোর উত্তরীয়ে
দুয়ার-বাহিরে তব আসি যবে
সুর করে ডাকি আমি ভোরের ভৈরবে।
বসন্তবনের গন্ধ আনি তুলে
রজনীগন্ধার ফুলে
নিভৃত হাওয়ায় তব ঘরে।
কবিতা শুনাই মৃদুস্বরে,
ছন্দ তাহে থাকে,
তার ফাঁকে ফাঁকে
শিল্প রচে বাক্যের গাঁথুনি--
তাই শুনি
নেশা লাগে তোমার হাসিতে।
আমার বাঁশিতে
যখন আলাপ করি মুলতান
মনের রহস্য নিজ রাগিণীর পায় না সন্ধান।
যে-কল্পলোকের কেন্দ্রে তোমারে বসাই
ধূলি-আবরণ তার সযত্নে খসাই--
আমি নিজে সৃষ্টি করি তারে।
ফাঁকি দিয়ে বিধাতারে
কারুশালা হতে তাঁর চুরি করে আনি রঙ-রস,
আনি তাঁরি জাদুর পরশ।
জানি, তার অনেকটা মায়া,
অনেকটা ছায়া।
আমারে শুধাও যবে "এরে কভু বলে বাস্তবিক?'
আমি বলি, "কখনো না, আমি রোম্যাণ্টিক।'
যেথা ঐ বাস্তব জগৎ
সেখানে আনাগোনার পথ
আছে মোর চেনা।
সেথাকার দেনা
শোধ করি--সে নহে কথায় তাহা জানি--
তাহার আহ্বান আমি মানি।
দৈন্য সেথা, ব্যাধি সেথা, সেথায় কুশ্রীতা,
সেথায় রমণী দস্যুভীতা--
সেথায় উত্তরী ফেলি পরি বর্ম;
সেথায় নির্মম কর্ম;
সেথা ত্যাগ, সেথা দুঃখ, সেথা ভেরি বাজুক "মাভৈঃ';
শৌখিন বাস্তব যেন সেথা নাহি হই।
সেথায় সুন্দর যেন ভৈরবের সাথে
চলে হাতে-হাতে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রকৃতিমূলক
|
জগতেরে জড়াইয়া শত পাকে যামিনীনাগিনী
আকাশ – পাতাল জুড়ি ছিল পড়ে নিদ্রায় মগনা ,
আপনার হিম দেহে আপনি বিলীনা একাকিনী ।
মিটিমিটি তারকায় জ্বলে তার অন্ধকার ফণা ।
উষা আসি মন্ত্র পড়ি বাজাইল ললিত রাগিণী ।
রাঙা আঁখি পাকালিয়া সাপিনী উঠিল তাই জাগি —
একে একে খুলে পাক , আঁকিবাঁকি কোথা যায় ভাগি ।
পশ্চিমসাগরতলে আছে বুঝি বিরাট গহ্বর ,
সেথায় ঘুমাবে বলে ডুবিতেছে বাসুকিভগিনী
মাথায় বহিয়া তার শত লক্ষ রতনের কণা ।
শিয়রেতে সারা দিন জেগে রবে বিপুল সাগর —
নিভৃতে স্তিমিত দীপে চুপি চুপি কহিয়া কাহিনী
মিলি কত নাগবালা স্বপ্নমালা করিবে রচনা । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কে বলে সব ফেলে যাবি
মরণ হাতে ধরবে যবে।
জীবনে তুই যা নিয়েছিস
মরণে সব নিতে হবে।
এই ভরা ভাণ্ডারে এসে
শূন্য কি তুই যাবি শেষে।
নেবার মতো যা আছে তোর
ভালো করে নেই তুই তবে।আবর্জনার অনেক বোঝা
জমিয়েছিস যে নিরবধি,
বেঁচে যাবি, যাবার বেলা
ক্ষয় করে সব যাস রে যদি।
এসেছি এই পৃথিবীতে,
হেথায় হবে সেজে নিতে,
রাজার বেশে চল্ রে হেসে
মৃত্যুপারের সে উৎসবে।শিলাইদহ, ২৫ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
সম্মুখে রয়েছে পড়ি যুগ - যুগান্তর ।
অসীম নীলিমে লুটে ধরণী ধাইবে ছুটে ,
প্রতিদিন আসিবে , যাইবে রবিকর ।
প্রতিদিন প্রভাতে জাগিবে নরনারী ,
প্রতিসন্ধ্যা শ্রান্তদেহে ফিরিয়া আসিবে গেহে ,
প্রতিরাত্রে তারকা ফুটিবে সারি সারি ।
কত আনন্দের ছবি , কত সুখ আশা
আসিবে যাইবে হায় , সুখ - স্বপনের প্রায়
কত প্রাণে জাগিবে , মিলাবে ভালোবাসা ।
তখনো ফুটিবে হেসে কুসুম - কানন ,
তখনো রে কত লোকে কত স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে
আঁকিবে আকাশ - পটে সুখের স্বপন ।
নিবিলে দিনের আলো , সন্ধ্যা হলে , নিতি
বিরহী নদীর ধারে না জানি ভাবিবে কারে ,
না - জানি সে কী কাহিনী , কী সুখ , কী স্মৃতি ।
দূর হতে আসিতেছে , শুন কান পেতে —
কত গান , সেই মহা - রঙ্গভূমি হতে
কত যৌবনের হাসি , কত উৎসবের বাঁশি ,
তরঙ্গের কলধ্বনি প্রমোদের স্রোতে ।
কত মিলনের গীত , বিরহের শ্বাস ,
তুলেছে মর্মর তান বসন্ত - বাতাস ,
সংসারের কোলাহল ভেদ করি অবিরল
লক্ষ নব কবি ঢালে প্রাণের উচ্ছ্বাস ।
ওই দূর খেলাঘরে খেলাইছ কারা !
উঠেছে মাথার'পরে আমাদেরি তারা ।
আমাদেরি ফুলগুলি সেথাও নাচিছে দুলি ,
আমাদেরি পাখিগুলি গেয়ে হল সারা ।
ওই দূর খেলাঘরে করে আনাগোনা
হাসে কাঁদে কত কে যে নাহি যায় গণা ।
আমাদের পানে হায় ভুলেও তো নাহি চায় ,
মোদের ওরা তো কেউ ভাই বলিবে না
ওই - সব মধুমুখ অমৃত - সদন ,
না জানি রে আর কারা করিবে চুম্বন ।
শরমময়ীর পাশে বিজড়িত আধ - ভাষে
আমরা তো শুনাব না প্রাণের বেদন ।
আমাদের খেলাঘরে কারা খেলাইছ !
সাঙ্গ না হইতে খেলা চলে এনু সন্ধেবেলা ,
ধূলির সে ঘর ভেঙে কোথা ফেলাইছ ।
হোথা , যেথা বসিতাম মোরা দুই জন ,
হাসিয়া কাঁদিয়া হত মধুর মিলন ,
মাটিতে কাটিয়া রেখা কত লিখিতাম লেখা ,
কে তোরা মুছিলি সেই সাধের লিখন ।
সুধাময়ী মেয়েটি সে হোথায় লুটিত ,
চুমো খেলে হাসিটুকু ফুটিয়া উঠিত ।
তাই রে মাধবীলতা মাথা তুলেছিল হোথা ,
ভেবেছিনু চিরদিন রবে মুকুলিত ।
কোথায় রে , কে তাহারে করিলি দলিত ।
ওই যে শুকানো ফুল ছুঁড়ে ফেলে দিলে
উহার মরম - কথা বুঝিতে নারিলে ।
ও যেদিন ফুটেছিল নব রবি উঠেছিল ,
কানন মাতিয়াছিল বসন্ত - অনিলে ।
ওই যে শুকায় চাঁপা পড়ে একাকিনী ,
তোমরা তো জানিবে না উহার কাহিনী ।
কবে কোন্ সন্ধেবেলা ওরে তুলেছিল বালা
ওরি মাঝে বাজে কোন্ পূরবীরাগিণী ।
যারে দিয়েছিল ওই ফুল উপহার
কোথায় সে গেছে চলে , সে তো নেই আর ।
একটু কুসুমকণা তাও নিতে পারিল না ,
ফেলে রেখে যেতে হল মরণের পার ;
কত সুখ , কত ব্যথা , সুখের দুখের কথা
মিশিছে ধূলির সাথে ফুলের মাঝার ।
মিছে শোক , মিছে এই বিলাপ কাতর ,
সম্মুখে রয়েছে পড়ে যুগ - যুগান্তর । (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
যদি প্রেম দিল না প্রাণে
কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?
কেন তারার মালা গাঁথা,
কেন ফুলের শয়ন পাতা,
কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?। যদি প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন আকাশ তবে এমন চাওয়া চায় এ মুখের পানে?
তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন
আমার হৃদয় পাগল হেন,
তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে?।শান্তিনিকেতন
২৮ আশ্বিন ১৩২০(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
ওই দেহ-পানে চেয়ে পড়ে মোর মনে
যেন কত শত পূর্ব-জনমের স্মৃতি ।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে,
জন্মজন্মান্তের যেন বসন্তের গীতি ।
যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ,
অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক,
কত নব জগতের কুসুমকানন,
কত নব আকাশের চাঁদের আলোক ।
কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যথা,
কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ --
সেই হাসি সেই অশ্রু সেই-সব কথা
মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ ।
তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন ।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
আজি এ প্রভাতে প্রভাতবিহগ
কী গান গাইল রে!
অতিদূর দূর আকাশ হইতে
ভাসিয়া আইল রে!
না জানি কেমনে পশিল হেথায়
পথহারা তার একটি তান,
আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া
গভীর গুহায় নামিয়া নামিয়া
আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ছুঁয়েছে আমার প্রাণ।
আজি এ প্রভাতে সহসা কেন রে
পথহারা রবিকর
আলয় না পেয়ে পড়েছে আসিয়ে
আমার প্রাণের ‘পর!
বহুদিন পরে একটি কিরণ
গুহায় দিয়েছে দেখা,
পড়েছে আমার আঁধার সলিলে
একটি কনকরেখা।
প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি
থর থর করি কাঁপিছে বারি,
টলমল জল করে থল থল,
কল কল করি ধরেছে তান।
আজি এ প্রভাতে কী জানি কেন রে
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।
জাগিয়া দেখিনু, চারিদিকে মোর
পাষাণে রচিত কারাগার ঘোর,
বুকের উপরে আঁধার বসিয়া
করিছে নিজের ধ্যান।
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।
জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা,
আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাঁধা।
রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে,
ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ-’পরে।
দূর দূর দূর হতে ভেদিয়া আঁধার কারা
মাঝে মাঝে দেখা দেয় একটি সন্ধ্যার তারা।
তারি মুখ দেখে দেখে আঁধার হাসিতে শেখে,
তারি মুখ চেয়ে চেয়ে করে নিশি অবসান।
শিহরি উঠে রে বারি,দোলে রে দোলে রে প্রাণ,
প্রাণের মাঝারে ভাসি দোলে রে দোলে রে হাসি,
দোলে রে প্রাণের ‘পরে আশার স্বপন মম,
দোলে রে তারার ছায়া সুখের আভাস-সম।মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো,
পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো।
আঁধার সলিল- ‘পরে ঝর ঝর বারি ঝরে
ঝর ঝর ঝর ঝর,দিবানিশি অবিরল--
বরষার দুখ-কথা,বরষার আঁখিজল।
শুয়ে শুয়ে আনমনে দিবানিশি তাই শুনি
একটি একটি ক’রে দিবানিশি তাই গুনি,
তারি সাথে মিলাইয়া কল কল গান গাই--
ঝর ঝর কল কল--দিন নাই, রাত নাই।
এমনি নিজেরে লয়ে রয়েছি নিজের কাছে,
আঁধার সলিল -‘পরে আঁধার জাগিয়া আছে।
এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ,
এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান। আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত-পাখির গান।
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়,
বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়
কোথায় কারার দ্বার।
প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া
আকাশেরে যেন ফেলিতে ছিঁড়িয়া
উঠে শূন্যপানে---পড়ে আছাড়িয়া
করে শেষে হাহাকার।
প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায়
ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়,
আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি
আকাশের পানে উঠিতে চায়।প্রভাতকিরণে পাগল হইয়া
জগৎ-মাঝারে লুটিতে চায়।
কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারি দিকে তার বাঁধন কেন?
ভাঙ্ রে হৃদয় ভাঙ্ রে বাঁধন,
সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পর আঘাত কর।
মাতিয়া যখন উঠিছে পরান
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ !উথলি যখন উঠিছে বাসনা,
জগতে তখন কিসের ডর!সহসা আজি এ জগতের মুখ
নূতন করিয়া দেখিনু কেন?
একটি পাখির আধখানি তান
জগতের গান গাহিল যেন!
জগৎ দেখিতে হইব বাহির
আজিকে করেছি মনে,
দেখিব না আর নিজেরি স্বপন
বসিয়া গুহার কোণে।
আমি ঢালিব করুণাধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা;
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,
দিব রে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব
হেসে খলখল গেয়ে কলকল
তালে তালে দিব তালি।
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া--
যাইব বহিয়া--যাইব বহিয়া--
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া
গাহিয়া গাহিয়া গান,
যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না আর প্রাণ।
এত কথা আছে এত গান আছে
এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।এত সুখ কোথা এত রূপ কোথা
এত খেলা কোথা আছে!
যৌবনের বেগে বহিয়া যাইব
কে জানে কাহার কাছে!
অগাধ বাসনা অসীম আশা
জগৎ দেখিতে চাই!
জাগিয়াছে সাধ চরাচরময়
প্লাবিয়া বহিয়া যাই।
যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি,
যত কাল আছে বহিতে পারি,
যত দেশ আছে ডুবাতে পারি,
তবে আর কিবা চাই!
পরানের সাধ তাই।কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান--
‘পাষাণ-বাঁধন টুটি, ভিজায়ে কঠিন ধরা,
বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা,
সারাপ্রাণ ঢালি দিয়া,
জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া--
আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা!’আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে, কোন্ দেশ--
জগতে ঢালিব প্রাণ,
গাহিব করুণাগান,
উদ্বেগ-অধীর হিয়া
সুদূর সমুদ্রে গিয়া
সে প্রাণ মিশাব আর সে গান করিব শেষ। ওরে, চারি দিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর !
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্ !
ওরে,আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এয়েছে রবির কর !
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ—
কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
বনেতে যাই দোঁহে মিলে।
খাঁচার পাখি বলে-- বনের পাখি, আয়
খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।'
বনের পাখি বলে-- "না,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।'
খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি কেমনে বনে বাহিরিব!'
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি
বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার--
দোঁহার ভাষা দুইমতো।
বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
বনের গান গাও দিখি।
খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই,
খাঁচার গান লহো শিখি।
বনের পাখি বলে-- না,
আমি শিখানো গান নাহি চাই।'
খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি কেমনে বন-গান গাই।'
বনের পাখি বলে, "আকাশ ঘননীল,
কোথাও বাধা নাহি তার।'
খাঁচার পাখি বলে, "খাঁচাটি পরিপাটি
কেমন ঢাকা চারি ধার।'
বনের পাখি বলে, "আপনা ছাড়ি দাও
মেঘের মাঝে একেবারে।'
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে
বাঁধিয়া রাখো আপনারে!'
বনের পাখি বলে-- "না,
সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!'
খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই!'
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে
তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,
নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,
কাতরে কহে, "কাছে আয়!'
বনের পাখি বলে--না,
কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
খাঁচার পাখি বলে--হায়,
মোর শকতি নাহি উড়িবার।
শাহাজাদপুর ১৯ আষাঢ় ১২৯৯
কাব্যগ্রন্থ - সোনার তরী
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
আপনি ফুল লুকায়ে বনছায়ে
গন্ধ তার ঢালে দখিনবায়ে। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
সংসার কহিল, মোর নাহি কপটতা,
জন্মমৃত্যু, সুখদুঃখ, সবই স্পষ্ট কথা।
আমি নিত্য কহিতেছি যথাসত্য বাণী,
তুমি নিত্য লইতেছ মিথ্যা অর্থখানি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
আমারে যদি জাগালে আজি নাথ,
ফিরো না তবে ফিরো না, করো
করুণ আঁখিপাত।
নিবিড় বন-শাখার ‘পরে
আষাঢ়-মেঘে বৃষ্টি ঝরে,
বাদলভরা আলসভরে
ঘুমায়ে আছে রাত।
ফিরো না তুমি ফিরো না, করো
করুণ আঁখিপাত।বিরামহীন বিজুলিঘাতে
নিদ্রাহারা প্রাণ
বরষা-জলধারার সাথে
গাহিতে চাহে গান।
হৃদয় মোর চোখের জলে
বাহির হল তিমিরতলে,
আকাশ খোঁজে ব্যাকুল বলে
বাড়ায়ে দুই হাত।
ফিরো না তুমি ফিরো না, করো
করুণ আঁখিপাত।৩ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আমার খোলা জানালাতে
শব্দবিহীন চরণপাতে
কে এলে গো, কে গো তুমি এলে।
একলা আমি বসে আছি
অস্তলোকের কাছাকাছি
পশ্চিমেতে দুটি নয়ন মেলে।
অতিসুদূর দীর্ঘ পথে
আকুল তব আঁচল হতে
আঁধারতলে গন্ধরেখা রাখি
জোনাক-জ্বালা বনের শেষে
কখন এলে দুয়ারদেশে
শিথিল কেশে ললাটখানি ঢাকি।তোমার সাথে আমার পাশে
কত গ্রামের নিদ্রা আসে–
পান্থবিহীন পথের বিজনতা,
ধূসর আলো কত মাঠের,
বধূশূন্য কত ঘাটের
আঁধার কোণে জলের কলকথা।
শৈলতটের পায়ের ‘পরে
তরঙ্গদল ঘুমিয়ে পড়ে,
স্বপ্ন তারি আনলে বহন করি।
কত বনের শাখে শাখে
পাখির যে গান সুপ্ত থাকে
এনেছ তাই মৌন নূপুর ভরি।মোর ভালে ওই কোমল হস্ত
এনে দেয় গো সূর্য-অস্ত,
এনে দেয় গো কাজের অবসান–
সত্যমিথ্যা ভালোমন্দ
সকল সমাপনের ছন্দ,
সন্ধ্যানদীর নিঃশেষিত তান।
আঁচল তব উড়ে এসে
লাগে আমার বক্ষে কেশে,
দেহ যেন মিলায় শূন্য’পরি,
চক্ষু তব মৃত্যুসম
স্তব্ধ আছে মুখে মম
কালো আলোয় সর্বহৃদয় ভরি।যেমনি তব দখিন-পাণি
তুলে নিল প্রদীপখানি,
রেখে দিল আমার গৃহকোণে,
গৃহ আমার এক নিমেষে
ব্যাপ্ত হল তারার দেশে
তিমিরতটে আলোর উপবনে।
আজি আমার ঘরের পাশে
গগনপারের কারা আসে
অঙ্গ তাদের নীলাম্বরে ঢাকি।
আজি আমার দ্বারের কাছে
অনাদি রাত স্তব্ধ আছে
তোমার পানে মেলি তাহার আঁখি।এই মুহূর্তে আধেক ধরা
লয়ে তাহার আঁধার-ভরা
কত বিরাম, কত গভীর প্রীতি,
আমার বাতায়নে এসে
দাঁড়ালো আজ দিনের শেষে–
শোনায় তোমায় গুঞ্জরিত গীতি।
চক্ষে তব পলক নাহি,
ধ্রুবতারার দিকে চাহি
তাকিয়ে আছ নিরুদ্দেশের পানে।
নীরব দুটি চরণ ফেলে
আঁধার হতে কে গো এলে
আমার ঘরে আমার গীতে গানে।–কত মাঠের শূন্যপথে,
কত পুরীর প্রান্ত হতে,
কত সিন্ধুবালুর তীরে তীরে,
কত শান্ত নদীর পারে,
কত স্তব্ধ গ্রামের ধারে,
কত সুপ্ত গৃহদুয়ার ফিরে,
কত বনের বায়ুর ‘পরে
এলো চুলের আঘাত ক’রে
আসিলে আজ হঠাৎ অকারণে।
বহু দেশের বহু দূরের
বহু দিনের বহু সুরের
আনিলে গান আমার বাতায়নে। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায় ।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই --
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক্,
ও তো আমার সহযাত্রিণী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝক্ঝক্ করছে যেন।
সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে ভাবি একটা কোনো সংকট দেখা দেয় না কেন,
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি --
রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত,
কোনো-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা।
এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে।
কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে --
না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের।
একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়।
কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে।
এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললুম, ‘ ফেলো চুরোট। ‘
যেন পেলেই না শুনতে,
ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ ক’রে --
আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।
বোধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,
বেশ একটু চওড়া গোছের নাম।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।
আপিসের বাবুরা বললে, ‘বেশ করেছেন মশায়। ‘
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।
ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে,
আমাকে কোনো দরকারই ছিল না।
আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডোবা --
বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে
কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো।
ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে।খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।
সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার।
ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া --
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে
গাছের আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শোনা গেল আসবে না এবার।
ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,
মোহনলাল --
রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশম,
দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।
সে বললে, ‘তনুকা আমার বোন,
কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে। ‘
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু --
যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের ‘পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি --
মনে করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া।
হায় রে ভাগ্যের খেলা!যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,
‘একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা --
একটি ফুলের গাছ। ‘
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।
তনুকা বললে, ‘দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে। ‘
জিগেস করলেম, ‘নামটা কী?’
সে বললে ‘ক্যামেলিয়া’।
চমক লাগল --
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বললেম, ‘ ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে না। ‘
তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে,
খুশিও হল।
চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে।
দেখা গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়।
একটা দো-কামরা গাড়িতে
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।
থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।পুজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল
সাঁওতাল পরগনায়।
জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে --
বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না।
কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেছেন
শালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়।
সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে,
মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায় --
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসাবাড়ি কোথাও নেই,
তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে।
সঙ্গী ছিল না কেউ,
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া।
কমলা এসেছে মাকে নিয়ে।
রোদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে।
মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,
কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ও পারে,
সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে।
আর আমাকে সে যে চিনেছে
তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই।একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা।
ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।
আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে --
পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক --
শর্ট্-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা,
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে
হাভানা চুরোট খাচ্ছে।
আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে
একটা শ্বেতজবার পাপড়ি,
পাশে পড়ে আছে
বিলিতি মাসিক পত্র।মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।
তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর।সময় হয়েছে আজ।
যে আনে আমার রান্নার কাঠ
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, ‘বাবু, ডেকেছিস কেনে। ‘
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেছে।
সে আবার জিগেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে। ‘
আমি বললেম, ‘ এইজন্যেই। ‘
তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
ঘোষালের বক্তৃতা
করা কর্তব্যই,
বেঞ্চি চৌকি আদি
আছে সব দ্রব্যই।
মাতৃভূমির লাগি
পাড়া ঘুরে মরেছে,
একশো টিকিট বিলি
নিজ হাতে করেছে।
চোখ বুজে ভাবে, বুঝি
এল সব সভ্যই।
চোখ চেয়ে দেখে, বাকি
শুধু নিরেনব্বই। (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়
দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি
নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ, নিয়ে তার বিচিত্রবেদনা,
চিত্রকরা আচ্ছাদনে আজন্মের স্মৃতির সঞ্চয়,
নিয়ে তার বাঁশিখানি। দূর হতে দূরে যেতে যেতে
ম্লান হয়ে আসে তার রূপ, পরিচিত তীরে তীরে
তরুচ্ছায়া-আলিঙ্গিত লোকালয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে
সন্ধ্যা-আরতির ধ্বনি, ঘরে ঘরে রুদ্ধ হয় দ্বার,
ঢাকা পড়ে দীপশিখা, নৌকা বাঁধা পড়ে ঘাটে।
দুই তটে ক্ষান্ত হোলো পারাপার, ঘনাল রজনী,
বিহঙ্গের মৌনগান অরণ্যের শাখায় শাখায়
মহানিঃশব্দের পায়ে রচি দিল আত্মবলি তার।এক কৃষ্ণ অরূপতা নামে বিশ্ববৈচিত্র্যের পরে
স্থলে জলে। ছায়া হয়ে বিন্দু হয়ে মিলে যায় দেহ
অন্তহীন তমিস্রায়। নক্ষত্রবেদীর তলে আসি
একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড় হাতে—
হে পূষন, সংহরণ করিয়াছ তব রশ্মিজাল,
এবার প্রকাশ করো তোমার কল্যাণতমরূপ,
দেখি তারে যে পুরুষ তোমার আমার মাঝে এক। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
কালো অশ্ব অন্তরে যে সারারাত্রি ফেলেছে নিশ্বাস
সে আমার অন্ধ অভিলাষ।
অসাধ্যের সাধনায় ছুটে যাবে ব'লে
দুর্গমেরে দ্রুত পায়ে দ'লে
খুরে খুরে খুঁড়েছে ধরণী,
করেছে অধীর হ্রেষাধ্বনি।ও যেন রে যুগান্তের কালো অগ্নিশিখা,
কালো কুজ্ঝটিকা।
অকস্মাৎ নৈরাশ্য-আঘাতে
দ্বার মুক্ত পেয়ে রাতে
দুর্দাম এসেছে বাহিরিয়া।
যারে নিয়ে এল সে-যে ব্যথায় মূর্তিত মোর প্রিয়া,
বাহিরে না স্থান পেয়ে
ধ্যানের আসন ছিল ছেয়ে। এ-অমাবস্যায়
বল্গাহারা কালো অশ্ব ঊর্ধ্বশ্বাসে ধায়।
কালো চিন্তা মম
আত্মঘাতী ঝঞ্ঝাসম
বিস্মৃতির চিরবিলুপ্তিতে
চলে ঝাঁপ দিতে
নিরঙ্কিত পথ বেয়ে।
যাক ধেয়ে।
সৃষ্টিহীন দৃষ্টিহীন রাত্রিপারে
ব্যর্থ দুরাশারে
নিয়ে যাক্--
অন্তিম শূন্যের মাঝে নিশ্চল নির্বাক্।
তার পরে বিরহের অগ্নিস্নানে শুভ্র মন
রৌদ্রস্নাত আশ্বিনের বৃষ্টিশূন্য মেঘের মতন
উন্মুক্ত আলোকে
দীপ্তি পাক্ সুনির্মল শোকে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
বসন্তের আসরে ঝড়
যখন ছুটে আসে
মুকুলগুলি না পায় ডর,
কচি পাতারা হাসে।
কেবল জানে জীর্ণ পাতা
ঝড়ের পরিচয়—
ঝড় তো তারি মুক্তিদাতা,
তারি বা কিসে ভয়। (স্ফুলিঙ্গ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
বজাও রে মোহন বাঁশি ।
সারা দিবসক বিরহদহনদুখ ,
মরমক তিয়াষ নাশি ।
রিঝমনভেদন বাঁশরিবাদন
কঁহা শিখলি রে কান ?
হানে থিরথির মরমঅবশকর
লহু লহু মধুময় বাণ ।
ধসধস করতহ উরহ বিয়াকুলু ,
ঢুলু ঢুলু অবশনয়ান ;
কত কত বরষক বাত সোঁয়ারয় ,
অধীর করয় পরান ।
কত শত আশা পূরল না বঁধু ,
কত সুখ করল পয়ান ।
পহু গো কত শত পীরিতযাতন
হিয়ে বিঁধাওল বাণ ।
হৃদয় উদাসয় , নয়ন উছাসয়
দারুণ মধুময় গান ।
সাধ যায় বঁধূ , যমুনাবারিম
ডারিব দগধপরান ।
সাধ যায় পহু , রাখি চরণ তব
হৃদয়মাঝ হৃদয়েশ ,
হৃদয়জুড়াওন বদনচন্দ্র তব
হেরব জীবনশেষ ।
সাধ যায়, ইহ চন্দ্রমকিরণে
কুসুমিত কুঞ্জবিতানে
বসন্তবায়ে প্রাণ মিশায়ব
বাঁশিক সুমধুর গানে ।
প্রাণ ভৈবে মঝু বেণুগীতময় ,
রাধাময় তব বেণু ।
জয় জয় মাধব , জয় জয় রাধা ,
চরণে প্রণমে ভানু । (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
গিন্নির কানে শোনা ঘটে অতি সহজেই
“গিনি সোনা এনে দেব’ কানে কানে কহ যেই।
না হলে তোমারি কানে দুর্গ্রহ টেনে আনে,
অনেক কঠিন শোনা– চুপ করে রহ যেই।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
হাস্যরসাত্মক
|
নীলুবাবু বলে, “শোনো
নেয়ামৎ দর্জি,
পুরোনো ফ্যাশানটাতে
নয় মোর মর্জি।’
শুনে নিয়ামৎ মিঞা যতনে পঁচিশটে
সম্মুখে ছিদ্র, বোতাম দিল পৃষ্ঠে।
লাফ দিয়ে বলে নীলু, “এ কী আশ্চর্যি!’
ঘরের গৃহিণী কয়, “রয় না তো ধর্যি।’ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
.
কাঁকন-জোড়া এনে দিলেম যবে,
ভেবেছিলেম, হয়তো খুশি হবে।
তুলে তুমি নিলে হাতের 'পরে,
ঘুরিয়ে তুমি দেখলে ক্ষণেক-তরে,
পরেছিলে হয়তো গিয়ে ঘরে -
হয়তো বা তা রেখেছিলে খুলে।
এলে যেদিন বিদায় নেবার রাতে
কাঁকনদুটি দেখি নাই তো হাতে,
হয়তো এলে ভুলে।। দেয় যে জনা কী দশা পায় তাকে,
দেওয়ার কথা কেনই মনে রাখে!
পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে
শাখা আবার চায় কি তাহার পানে।
বাতাসেতে-উড়িয়ে-দেওয়া গানে
তারে কি আর স্মরণ করে পাখি?
দিতে যারা জানে এ সংসারে
এমন ক'রেই তারা দিতে পারে
কিছু না রয় বাকি।। নিতে যারা জানে তারাই জানে,
বোঝে তারা মূল্যটি কোনখানে।
তারাই জানে, বুকের রত্নহারে
সেই মণিটি কজন দিতে পারে
হৃদয় দিতে দেখিতে হয় যারে -
যে পায় তারে সে পায় অবহেলে।
পাওয়ার মতন পাওয়া যারে কহে
সহজ ব'লেই সহজ তাহা নহে,
দৈবে তারে মেলে।। ভাবি যখন ভেবে না পাই তবে
দেবার মতো কী আছে এই ভবে।
কোন্ খনিতে কোন্ ধনভান্ডারে,
সাগর-তলে কিম্বা সাগর-পারে,
যক্ষরাজের লক্ষমণির হারে
যা আছে তা কিছুই তো নয় প্রিয়ে!
তাই তো বলি যা-কিছু মোর দান
গ্রহণ করেই করবে মূল্যবান
আপন হৃদয় দিয়ে।।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
কিশোরগাঁয়ের পুবের পাড়ায় বাড়ি
পিস্নি বুড়ি চলেছে গ্রাম ছাড়ি।
একদিন তার আদর ছিল, বয়স ছিল ষোলো,
স্বামী মরতেই বাড়িতে বাস অসহ্য তার হল।
আর-কোনো ঠাঁই হয়তো পাবে আর-কোনো এক বাসা,
মনের মধ্যে আঁকড়ে থাকে অসম্ভবের আশা।
অনেক গেছে ক্ষয় হয়ে তার, সবাই দিল ফাঁকি,
অল্প কিছু রয়েছে তার বাকি।
তাই দিয়ে সে তুলল বেঁধে ছোট্ট বোঝাটাকে,
জড়িয়ে কাঁথা আঁকড়ে নিল কাঁখে।
বাঁ হাতে এক ঝুলি আছে, ঝুলিয়ে নিয়ে চলে,
মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে বসে ধূলির তলে।
শুধাই যবে, কোন্ দেশেতে যাবে,
মুখে ক্ষণেক চায় সকরুণ ভাবে;
কয় সে দ্বিধায়, "কী জানি ভাই, হয়তো আলম্ডাঙা,
হয়তো সান্কিভাঙা,
কিংবা যাব পাটনা হয়ে কাশী।"
গ্রাম-সুবাদে কোন্কালে সে ছিল যে কার মাসি,
মণিলালের হয় দিদিমা, চুনিলালের মামি--
বলতে বলতে হঠাৎ যে যায় থামি,
স্মরণে কার নাম যে নাহি মেলে।
গভীর নিশাস ফেলে
চুপটি ক'রে ভাবে,
এমন করে আর কতদিন যাবে।
দূরদেশে তার আপন জনা, নিজেরই ঝঞ্ঝাটে
তাদের বেলা কাটে।
তারা এখন আর কি মনে রাখে
এতবড়ো অদরকারি তাকে।
চোখে এখন কম দেখে সে, ঝাপসা যে তার মন,
ভগ্নশেষের সংসারে তার শুকনো ফুলের বন।
স্টেশন-মুখে গেল চলে পিছনে গ্রাম ফেলে,
রাত থাকতে, পাছে দেখে পাড়ায় মেয়ে ছেলে।
দূরে গিয়ে, বাঁশবাগানের বিজন গলি বেয়ে
পথের ধারে বসে পড়ে, শূন্যে থাকে চেয়ে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
নারদ কহিল আসি, হে ধরণী দেবী,
তব নিন্দা করে নর তব অন্ন সেবি।
বলে মাটি, বলে ধূলি, বলে জড় স্থুল,
তোমারে মলিন বলে অকৃতজ্ঞকুল।
বন্ধ করো অন্নজল, মুখ হোক চুন,
ধুলামাটি কী জিনিস বাছারা বুঝুন।
ধরণী কহিলা হাসি, বালাই, বালাই!
ওরা কি আমার তুল্য, শোধ লব তাই?
ওদের নিন্দায় মোর লাগিবে না দাগ,
ওরা যে মরিবে যদি আমি করি রাগ। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
এ জীবনে সুন্দরের পেয়েছি মধুর আশীর্বাদ,
মানুষের প্রীতিপাত্রে পাই তাঁরি সুধার আস্বাদ!
দুঃসহ দুঃখের দিনে
অক্ষত অপরাজিত আত্মারে লয়েছি আমি চিনে।
আসন্ন মৃত্যুর ছায়া যেদিন করেছি অনুভব
সেদিন ভয়ের হাতে হয় নি দুর্বল পরাভব।
মহত্তম মানুষের স্পর্শ হতে হই নি বঞ্চিত,
তাঁদের অমৃতবাণী অন্তরেতে করেছি সঞ্চিত।
জীবনের বিধাতার যে দাক্ষিণ্য পেয়েছি জীবনে
তাহারি স্মরণলিপি রাখিলাম সকৃতজ্ঞমনে। (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ছড়া
|
আমার খোকা করে গো যদি মনে
এখনি উড়ে পারে সে যেতে
পারিজাতের বনে ।
যায় না সে কি সাধে।
মায়ের বুকে মাথাটি থুয়ে
সে ভালোবাসে থাকিতে শুয়ে,
মায়ের মুখ না দেখে যদি
পরান তার কাঁদে।
আমার খোকা সকল কথা জানে।
কিন্তু তার এমন ভাষা,
কে বোঝে তার মানে।
মৌন থাকে সাধে ?
মায়ের মুখে মায়ের কথা
শিখিতে তার কী আকুলতা,
তাকায় তাই বোবার মতো
মায়ের মুখচাঁদে।
খোকার ছিল রতনমণি কত—
তবু সে এল কোলের ‘পরে
ভিখারীটির মতো।
এমন দশা সাধে ?
দীনের মতো করিয়া ভান
কাড়িতে চাহে মায়ের প্রাণ,
তাই সে এল বসনহীন
সন্ন্যাসীর ছাঁদে।
খোকা যে ছিল বাঁধন-বাধা-হারা—
যেখানে জাগে নূতন চাঁদ
ঘুমায় শুকতারা।
ধরা সে দিল সাধে?
অমিয়মাখা কোমল বুকে
হারাতে চাহে অসীম সুখে,
মুকতি চেয়ে বাঁধন মিঠা
মায়ের মায়া-ফাঁদে।
আমার খোকা কাঁদিতে জানিত না,
হাসির দেশে করিত শুধু
সুখের আলোচনা ।
কাঁদিতে চাহে সাধে?
মধুমুখের হাসিটি দিয়া
টানে সে বটে মায়ের হিয়া,
কান্না দিয়ে ব্যথার ফাঁসে
দ্বিগুণ বলে বাঁধে। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত,
এ যে অজাগর-গরজে সাগর ফুলিছে;
এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত,
ফেনহিল্লোল কলকল্লোলে দুলিছে।
কোথা রে সে তীর ফুলপল্লবপুঞ্জিত,
কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা—
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী,
ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত-অচলে;
বিশ্বজগৎ নিশ্বাসবায়ু সম্বরি
স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে;
সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি
দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা—
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
ঊর্ধ্ব আকাশে তারাগুলি মেলি অঙ্গুলি
ইঙ্গিত করি তোমা-পানে আছে চাহিয়া;
নিম্নে গভীর অধীর মরণ উচ্ছলি
শত তরঙ্গে তোমা-পানে উঠে ধাইয়া;
বহুদূর তীরে কারা ডাকে বাঁধি অঞ্জলি
‘এসো এসো’ সুরে করুণ-মিনতি-মাখা—
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহমোহবন্ধন;
ওরে আশা নাই, আশা শুধু মিছে ছলনা।
ওরে ভাষা নাই, নাই বৃথা ব’সে ক্রন্দন;
ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজ-রচনা।
আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ-অঙ্গন
উষা-দিশাহারা নিবিড়-তিমির-আঁকা—
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
আরো একবার যদি পারি
খুঁজে দেব সে আসনখানি
যার কোলে রয়েছে বিছানো
বিদেশের আদরের বাণী।অতীতের পালানো স্বপন
আবার করিবে সেথা ভিড়,
অস্ফুট গুঞ্জনস্বরে
আরবার রচি দিবে নীড়।সুখস্মৃতি ডেকে ডেকে এনে
জাগরণ করিবে মধুর,
যে বাঁশি নীরব হয়ে গেছে
ফিরায়ে আনিবে তার সুর।বাতায়নে রবে বাহু মেলি
বসন্তের সৌরভের পথে,
মহানিঃশব্দের পদধ্বনি
শোনা যাবে নিশীথজগতে।বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে
যে প্রেয়সী পেতেছে আসন
চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া
কানে কানে তাহারি ভাষণ।ভাষা যার জানা ছিল নাকো,
আঁখি যার কয়েছিল কথা,
জাগায়ে রাখিবে চিরদিন
সকরুণ তাহারি বারতা। (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
চিন্তামূলক
|
শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ চৌধুরী কল্যাণীয়েষুতখন আমার আয়ুর তরণী
যৌবনের ঘাট গেছে পেরিয়ে।
যে-সব কাজ প্রবীণকে প্রাজ্ঞকে মানায়
তাই নিয়ে পাকা করছিলেম
পাকা চুলের মর্যাদা।
এমন সময়ে আমাকে ডাক দিলে
তোমার সবুজপত্রের আসরে।
আমার প্রাণে এনে দিলে পিছুডাক,
খবর দিলে
নবীনের দরবারে আমার ছুটি মেলেনি।
দ্বিধার মধ্যে মুখ ফিরালেম
পেরিয়ে-আসা পিছনের দিকে।
পর্যাপ্ত তারুণ্যের পরিপূর্ণ মূর্তি
দেখা দিল আমার চোখের সম্মুখে।
ভরা যৌবনের দিনেও
যৌবনের সংবাদ
এমন জোয়ারের বেগে এসে লাগেনি আমার লেখনীতে।
আমার মন বুঝল
যৌবনকে না ছাড়ালে
যৌবনকে যায় না পাওয়া।;
আজ এসেছি জীবনের শেষ ঘাটে।
পুবের দিক থেকে হাওয়ায় আসে
পিছুডাক,
দাঁড়াই মুখ ফিরিয়ে।
আজ সামনে দেখা দিল
এ জন্মের সমস্তটা।
যাকে ছেড়ে এলেম
তাকেই নিচ্ছি চিনে।
সরে এসে দেখছি
আমার এতকালের সুখদুঃখের ঐ সংসার,
আর তার সঙ্গে
সংসারকে পেরিয়ে কোন্ নিরুদ্দিষ্ট।
ঋষি-কবি প্রাণপুরুষকে বলেছেন--
"ভুবন সৃষ্টি করেছ
তোমার এক অর্ধেককে দিয়ে,--
বাকি আধখানা কোথায়
তা কে জানে।"
সেই একটি-আধখানা আমার মধ্যে আজ ঠেকেছে
আপন প্রান্তরেখায়;
দুইদিকে প্রসারিত দেখি দুই বিপুল নিঃশব্দ,
দুই বিরাট আধখানা,--
তারি মাঝখানে দাঁড়িয়ে
শেষকথা ব'লে যাব--
দুঃখ পেয়েছি অনেক,
কিন্তু ভালো লেগেছে,
ভালোবেসেছি।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কী জন্যে রয়েছ, সিন্ধু তৃণশস্যহীন—
অর্ধেক জগৎ জুড়ি নাচো নিশিদিন।
সিন্ধু কহে, অকর্মণ্য না রহিত যদি
ধরণীর স্তন হতে কে টানিত নদী? (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
স্বদেশমূলক
|
হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে
শুন এ কবির গান।
তোমার চরণে নবীন হর্ষে
এনেছি পূজার দান।
এনেছি মোদের দেহের শকতি
এনেছি মোদের মনের ভকতি,
এনেছি মোদের ধর্মের মতি,
এনেছি মোদের প্রাণ।
এনেছি মোদের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য
তোমারে করিতে দান।কাঞ্চন-থালি নাহি আমাদের,
অন্ন নাহিকো জুটে
যা আছে মোদের এনেছি সাজায়ে
নবীন পর্ণপুটে।
সমারোহে আজ নাই প্রয়োজন,
দীনের এ পূজা, দীন আয়োজন,
চিরদারিদ্র৻ করিব মোচন
চরণের ধুলা লুটে।
সুরদুর্লভ তোমার প্রসাদ
লইব পর্ণপুটে।রাজা তুমি নহ, হে মহাতাপস,
তুমিই প্রাণের প্রিয়।
ভিক্ষাভূষণ ফেলিয়া পরিব
তোমারি উত্তরীয়।
দৈন্যের মাঝে আছে তব ধন,
মৌনের মাঝে রয়েছে গোপন
তোমার মন্ত্র অগ্নিবচন–
তাই আমাদের দিয়ো।
পরের সজ্জা ফেলিয়া পরিব
তোমার উত্তরীয়।দাও আমাদের অভয়মন্ত্র
অশোকমন্ত্র তব।
দাও আমাদের অমৃতমন্ত্র,
দাও গো জীবন নব।
যে জীবন ছিল তব তপোবনে
যে জীবন ছিল তব রাজাসনে
মুক্ত দীপ্ত সে মহাজীবন
চিত্ত ভরিয়া লব।
মৃত্যুতরণ শঙ্কাহরণ
দাও সে মন্ত্র তব। (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
তবু কি ছিল না তব সুখদুঃখ যত,
আশা নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব আমাদেরি মতো,
হে অমর কবি! ছিল না কি অনুক্ষণ
রাজসভা-ষড়্চক্র, আঘাত গোপন?
কখনো কি সহ নাই অপমানভার,
অনাদর, অবিশ্বাস, অন্যায় বিচার,
অভাব কঠোর ক্রূর—নিদ্রাহীন রাতি
কখনো কি কাটে নাই বক্ষে শেল গাঁথি?
তবু সে সবার ঊর্ধ্বে নির্লিপ্ত নির্মল
ফুটিয়াছে কাব্য তব সৌন্দর্যকমল
আনন্দের সূর্য-পানে; তার কোনো ঠাঁই
দুঃখদৈন্যদুর্দিনের কোনো চিহ্ন নাই।
জীবনমন্থনবিষ নিজে করি পান
অমৃত যা উঠেছিল করে গেছ দান। (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।
যায় যেন মোর সকল গভীর আশা
প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে। চিত্ত মম যখন যেথায় থাকে,
সাড়া যেন দেয় সে তোমার ডাকে,
যত বাধা সব টুটে যায় যেন
প্রভু, তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে। বাহিরের এই ভিক্ষাভরা থালি
এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি,
অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে
প্রভু, তোমার দানে, তোমার দানে, তোমার দানে। হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,
এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর
সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
সনেট
|
যাবার সময় হোলো বিহঙ্গের। এখনি কুলায়
রিক্ত হবে। স্তব্ধ গীতি ভ্রষ্ট নীড় পড়িবে ধুলায়
অরণ্যের আন্দোলনে। শুষ্ক পত্র জীর্ণ পুষ্প সাথে
পথচিহ্নহীন শূন্যে যাবে উড়ে রজনী প্রভাতে
অস্তসিন্ধু পরপারে। কতকাল এই বসুন্ধরা
আতিথ্য দিয়েছে; কভু আম্রমুকুলের গন্ধে ভরা
পেয়েছি আহ্বানবাণী ফাল্গুনের দাক্ষিণ্যে মধুর,
অশোকের মঞ্জরী সে ইঙ্গিতে চেয়েছে মোর সুর,
দিয়েছি তা প্রীতিরসে ভরি’; কখনো বা ঝঞ্ঝাঘাতে
বৈশাখের, কণ্ঠ মোর রুধিয়াছে উত্তপ্ত ধুলাতে,
পক্ষ মোর করেছে অক্ষম; সব নিয়ে ধন্য আমি
প্রাণের সম্মানে। এ পারের ক্লান্ত যাত্রা গেলে থামি
ক্ষণ তরে পশ্চাতে ফিরিয়া মোর নম্র নমস্কারে
বন্দনা করিয়া যাব এ জন্মের অধিদেবতারে। (প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
রূপক
|
কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে–
কাঁদিছে আপন মনে,
কুসুমের দলে বন্ধ হয়ে
করুণ কাতর স্বনে।
কহিছে সে,”হায় হায়,
বেলা যায় বেলা যায় গো
ফাগুনের বেলা যায়।’
ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে ভয় নাই,
কিছু নাই তোর ভাবনা।
কুসুম ফুটিবে, বাঁধন টুটিবে,
পুরিবে সকল কামনা।
নিঃশেষ হয়ে যাবি যবে তুই
ফাগুন তখনো যাবে না।কুঁড়ির ভিতরে ফিরিছে গন্ধ কিসের আশে–
ফিরিছে আপনমাঝে,
বাহিরিতে চায় আকুল শ্বাসে
কী জানি কিসের কাজে।
কহিছে সে,”হায় হায়,
কোথা আমি যাই,কারে চাই গো
না জানিয়া দিন যায়।’
ভয় নাই তোর,ভয় নাই ওরে, ভয় নাই,
কিছু নাই তোর ভাবনা।
দখিনপবন দ্বারে দিয়া কান
জেনেছে রে তোর না কামনা।
আপনারে তোর না করিয়া ভোর
দিন তোর চলে যাবে না।কুঁড়ির ভিতরে আকুল গন্ধ ভাবিছে বসে–
ভাবিছে উদাসপারা,
“জীবন আমার কাহার দোষে
এমন অর্থহারা।’
কহিছে সে,”হায় হায়,
কেন আমি বাঁচি,কেন আছি গো
অর্থ না বুঝা যায়।’
ভয় নাই তোর, ভয় নাই ওরে, ভয় নাই,
কিছু নাই তোর ভাবনা।
যে শুভ প্রভাতে সকলের সাথে
মিলিবি, পুরাবি কামনা,
আপন অর্থ সেদিন বুঝিবি–
জনম ব্যর্থ যাবে না।
(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
গান গাওয়ালে আমায় তুমি
কতই ছলে যে,
কত সুখের খেলায়, কত
নয়নজলে হে।
ধরা দিয়ে দাও না ধরা,
এস কাছে, পালাও ত্বরা,
পরান কর ব্যথায় ভরা
পলে পলে হে।
গান গাওয়ালে এমনি করে
কতই ছলে যে।কত তীব্র তারে, তোমার
বীণা সাজাও যে,
শত ছিদ্র করে জীবন
বাঁশি বাজাও হে।
তব সুরের লীলাতে মোর
জনম যদি হয়েছে ভোর,
চুপ করিয়ে রাখো এবার
চরণতলে হে,
গান গাওয়ালে চিরজীবন
কতই ছলে যে।রেলপথে, ২৫ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
চকোরী ফুকারি কাঁদে, ওগো পূর্ণ চাঁদ,
পণ্ডিতের কথা শুনি গনি পরমাদ!
তুমি নাকি একদিন রবে না ত্রিদিবে,
মহাপ্রলয়ের কালে যাবে নাকি নিবে!
হায় হায় সুধাকর, হায় নিশাপতি,
তা হইলে আমাদের কী হইবে গতি!
চাঁদ কহে, পণ্ডিতের ঘরে যাও প্রিয়া,
তোমার কতটা আয়ু এসো শুধাইয়া। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
ভক্তিমূলক
|
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
রয়েছে দীপ না আছে শিখা,
এই কি ভালে ছিল রে লিখা–
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।বেদনাদূতী গাহিছে, “ওরে প্রাণ,
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।
নিশীথে ঘন অন্ধকারে
ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে,
দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।
তোমার লাগি জাগেন ভগবান।’গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।
এ ঘোর রাতে কিসের লাগি
পরান মম সহসা জাগি
এমন কেন করিছে মরি মরি।
বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি।বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে,
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।
জানি না কোথা অনেক দূরে
বাজিল প্রাণ গভীর সুরে,
সকল গান টানিছে পথপানে।
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,
সময় গেলে হবে না যাওয়া,
নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
‘সংসারে জিনেছি’ ব’লে দুরন্ত মরণ
জীবন বসন তার করিছে হরণ।
যত বস্ত্রে টান দেয়, বিধাতার বরে।
বস্ত্র বাড়ি চলে তত নিত্যকাল ধ’রে। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
কাহিনীকাব্য
|
কত দেশ দেশান্তরে ভ্রমিল সে কবি!
তুষারস্তম্ভিত গিরি করিল লঙ্ঘন,
সুতীক্ষ্নকণ্টকময় অরণ্যের বুক
মাড়াইয়া গেল চলি রক্তময় পদে।
কিন্তু বিহঙ্গের গান, নির্ঝরের ধ্বনি,
পারে না জুড়াতে আর কবির হৃদয়।
বিহগ, নির্ঝর-ধ্বনি প্রকৃতির গীত--
মনের যে ভাগে তার প্রতিধ্বনি হয়
সে মনের তন্ত্রী যেন হোয়েছে বিকল।
একাকী যাহাই আগে দেখিত সে কবি
তাহাই লাগিত তার কেমন সুন্দর,
এখন কবির সেই একি হোলো দশা--
যে প্রকৃতি-শোভা-মাঝে নলিনী না থাকে
ঠেকে তা শূন্যের মত কবির নয়নে,
নাইক দেবতা যেন মন্দিরমাঝারে।
বালার মুখের জ্যোতি করিত বর্দ্ধন
প্রকৃতির রূপচ্ছটা দ্বিগুণ করিয়া;
সে না হোলে অমবস্যানিশির মতন
সমস্ত জগৎ হোত বিষণ্ণ আঁধার।
--
জ্যোৎস্নায় নিমগ্ন ধরা, নীরব রজনী।
অরণ্যের অন্ধকারময় গাছগুলি
মাথার উপরে মাখি রজত জোছনা,
শাখায় শাখায় ঘন করি জড়াজড়ি,
কেমন গম্ভীরভাবে রোয়েছে দাঁড়ায়ে।
হেথায় ঝোপের মাঝে প্রচ্ছন্ন আঁধার,
হোথায় সরসীবক্ষে প্রশান্ত জোছনা।
নভপ্রতিবিম্বশোভী ঘুমন্ত সরসী
চন্দ্র তারকার স্বপ্ন দেখিতেছে যেন!
লীলাময় প্রবাহিণী চলেছে ছুটিয়া,
লীলাভঙ্গ বুকে তার পাদপের ছায়া
ভেঙ্গে চুরে কত শত ধরিছে মূরতি।
গাইছে রজনী কিবা নীরব সঙ্গীত!
কেমন নীরব বন নিস্তব্ধ গম্ভীর--
শুধু দূর-শৃঙ্গ হোতে ঝরিছে নির্ঝর,
শুধু একপাশ দিয়া সঙ্কুচিত অতি
তটিনীটি সর সর যেতেছে চলিয়া।
অধীর বসন্তবায়ু মাঝে মাঝে শুধু
ঝরঝরি কাঁপাইছে গাছের পল্লব।
এহেন নিস্তব্ধ রাত্রে কত বার আমি
গম্ভীর অরণ্যে একা কোরেছি ভ্রমণ।
স্নিগ্ধ রাত্রে গাছপালা ঝিমাইছে যেন,
ছায়া তার পোড়ে আছে হেথায় হোথায়।
দেখিয়াছি নীরবতা যত কথা কয়
প্রাণের মরম-তলে, এত কেহ নয়।
দেখি যবে অতি শান্ত জোছনায় মজি
নীরবে সমস্ত ধরা রয়েছে ঘুমায়ে,
নীরবে পরশে দেহ বসন্তের বায়,
জানি না কি এক ভাবে প্রাণের ভিতর
উচ্ছ্বসিয়া উথলিয়া উঠে গো কেমন!
কি যেন হারায়ে গেছে খুঁজিয়া না পাই,
কি কথা ভুলিয়া যেন গিয়েছি সহসা,
বলা হয় নাই যেন প্রাণের কি কথা,
প্রকাশ করিতে গিয়া পাই না তা খুঁজি!
কে আছে এমন যার এ হেন নিশীথে,
পুরাণো সুখের স্মৃতি উঠে নি উথলি!
কে আছে এমন যার জীবনের পথে
এমন একটি সুখ যায় নি হারায়ে,
যে হারা-সুখের তরে দিবা নিশি তার
হৃদয়ের এক দিক শূন্য হোয়ে আছে।
এমন নীরব-রাত্রে সে কি গো কখনো
ফেলে নাই মর্ম্মভেদী একটি নিশ্বাস?
কর স্থানে আজ রাত্রে নিশীথপ্রদীপে
উঠিছে প্রমোদধ্বনি বিলাসীর গৃহে।
মুহূর্ত্ত ভাবে নি তারা আজ নিশীথেই
কত চিত্ত পুড়িতেছে প্রচ্ছন্ন অনলে।
কত শত হতভাগা আজ নিশীথেই
হারায়ে জন্মের মত জীবনের সুখ
মর্ম্মভেদী যন্ত্রণায় হইয়া অধীর
একেলাই হা হা করি বেড়ায় ভ্রমিয়া!
--
ঝোপে-ঝাপে ঢাকা ওই অরণ্যকুটীর।
বিষণ্ণ নলিনীবালা শূন্য নেত্র মেলি
চাঁদের মুখের পানে রয়েছে চাহিয়া!
জানি না কেমন কোরে বালার বুকের মাঝে
সহসা কেমন ধারা লেগেছে আঘাত--
আর সে গায় না গান, বসন্ত ঋতুর অন্তে
পাপিয়ার কণ্ঠ যেন হোয়েছে নীরব।
আর সে লইয়া বীণা বাজায় না ধীরে ধীরে,
আর সে ভ্রমে না বালা কাননে কাননে।
বিজন কুটীরে শুধু মরণশয্যার 'পরে
একেলা আপন মনে রয়েছে শুইয়া।
যে বালা মুহূর্ত্তকাল স্থির না থাকিত কভু,
শিখরে নির্ঝরে বনে করিত ভ্রমণ--
কখনো তুলিত ফুল, কখনো গাঁথিত মালা,
কখনো গাইত গান, বাজাইত বীণা--
সে আজ এমন শান্ত, এমন নীরব স্থির!
এমন বিষণ্ণ শীর্ণ সে প্রফুল্ল মুখ!
এক দিন, দুই দিন, যেতেছে কাটিয়া ক্রমে--
মরণের পদশব্দ গণিছে সে যেন!
আর কোন সাধ নাই, বাসনা রয়েছে শুধু
কবিরে দেখিয়া যেন হয় গো মরণ।
এ দিকে পৃথিবী ভ্রমি সহিয়া ঝটিকা কত
ফিরিয়া আসিছে কবি কুটীরের পানে,
মধ্যাহ্নের রৌদ্রে যথা জ্বলিয়া পুড়িয়া পাখী
সন্ধ্যায় কুলায়ে তার আইসে ফিরিয়া।
বহুদিন পরে কবি পদার্পিল বনভূমে,
বৃক্ষলতা সবি তার পরিচিত সখা!
তেমনি সকলি আছে, তেমনি গাইছে পাখী,
তেমনি বহিছে বায়ু ঝর ঝর করি।
অধীরে চলিল কবি কুটীরের পানে--
দুয়ারের কাছে গিয়া দুয়ারে আঘাত দিয়া
ডাকিল অধীর স্বরে, নলিনী! নলিনী!
কিছু নাই সাড়া শব্দ, দিল না উত্তর কেহ,
প্রতিধ্বনি শুধু তারে করিল বিদ্রূপ।
কুটীরে কেহই নাই, শূন্য তা রয়েছে পড়ি--
বেষ্টিত বিতন্ত্রী বীণা লূতাতন্তুজালে।
ভ্রমিল আকুল কবি কাননে কাননে,
ডাকিয়া সমুচ্চ স্বরে, নলিনী! নলিনী!
মিলিয়া কবির স্বরে বনদেবী উচ্চস্বরে
ডাকিল কাতরে আহা, নলিনী! নলিনী!
কেহই দিল না সাড়া, শুধু সে শব্দ শুনি
সুপ্ত হরিণেরা ত্রস্ত উঠিল জাগিয়া।
অবশেষে গিরিশৃঙ্গে উঠিল কাতর কবি,
নলিনীর সাথে যেথা থাকিত বসিয়া।
দেখিল সে গিরি-শৃঙ্গে, শীতল তুষার-'পরে,
নলিনী ঘুমায়ে আছে ম্লানমুখচ্ছবি।
কঠোর তুষারে তার এলায়ে পড়েছে কেশ,
খসিয়া পড়েছে পাশে শিথিল আঁচল।
বিশাল নয়ন তার অর্দ্ধনিমীলিত,
হাত দুটি ঢাকা আছে অনাবৃত বুকে।
একটি হরিণশিশু খেলা করিবার তরে
কভু বা অঞ্চল ধরি টানিতেছে তার,
কভু শৃঙ্গ দুটি দিয়া সুধীরে দিতেছে ঠেলি,
কভু বা অবাক্ নেত্রে রহিছে চাহিয়া!
তবু নলিনীর ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গিছে না,
নীরবে নিস্পন্দ হোয়ে রয়েছে ভূতলে।
দূর হোতে কবি তারে দেখিয়া কহিল উচ্চে,
"নলিনী, এয়েছি আমি দেখ্সে বালিকা।"
তবুও নলিনী বালা না দিয়া উত্তর
শীতল তুষার-'পরে রহিল ঘুমায়ে।
কবি সে শিখর-'পরে করি আরোহণ
শীতল অধর তার করিল চুম্বন--
শিহরিয়া চমকিয়া দেখিল সে কবি
না নড়ে হৃদয় তার, না পড়ে নিশ্বাস।
দেখিল না, ভাবিল না, কহিল না কিছু,
যেমন চাহিয়া ছিল রহিল চাহিয়া।
নিদারুণ কি যেন কি দেখিছে তরাসে
নয়ন হইয়া গেল অচল পাষাণ।
কতক্ষণে কবি তবে পাইল চেতন,
দেখিল তুষারশুভ্র নলিনীর দেহ
হৃদয়জীবনহীন জড় দেহ তার
অনুপম সৌন্দর্য্যের কুসুম-আলয়,
হৃদয়ের মরমের আদরের ধন--
তৃণ কাষ্ঠ সম ভূমে যায় গড়াগড়ি!
বুকে তারে তুলে লয়ে ডাকিল "নলিনী",
হৃদয়ে রাখিয়া তারে পাগলের মত কবি
কহিল কাতর স্বরে "নলিনী" "নলিনী"!
স্পন্দহীন, রক্তহীন অধর তাহার
অধীর হইয়া ঘন করিল চুম্বন।
--
তার পর দিন হোতে সে বনে কবিরে আর
পেলে না দেখিতে কেহ, গেছে সে কোথায়!
ঢাকিল নলিনীদেহ তুষারসমাধি--
ক্রমে সে কুটীরখানি কোথা ভেঙ্গে চুরে গেল,
ক্রমে সে কানন হোলো গ্রাম লোকালয়,
সে কাননে--কবির সে সাধের কাননে
অতীতের পদচিহ্ন রহিল না আর।
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
নীতিমূলক
|
কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি।—
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি। (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
প্রেমমূলক
|
শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এল
গানের বেলা শেষ না হতে হতে?
মনের কথা ছড়িয়ে এলোমেলো
ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে।
মনের কথা যত
উজান তরীর মতো;
পালে যখন হাওয়ার বলে
মরণ-পারে নিয়ে চলে,
চোখের জলের স্রোত যে তাদের টানে
পিছু ঘাটের পানে —
যেথায় তুমি, প্রিয়ে,
একলা বসে আপন-মনে
আঁচল মাথায় দিয়ে।
ঘোরে তারা শুকনো পাতার পাকে
কাঁপন-ভরা হিমের বায়ুভরে।
ঝরা ফুলের পাপড়ি তাদের ঢাকে —
লুটায় কেন মরা ঘাসের ‘পরে।
হল কি দিন সারা।
বিদায় নেবে তারা?
এবার বুঝি কুয়াশাতে
লুকিয়ে তারা পোউষ-রাতে
ধুলার ডাকে সাড়া দিতে চলে —
যেথায় ভূমিতলে
একলা তুমি, প্রিয়ে,
বসে আছ আপন-মনে
আঁচল মাথায় দিয়ে?
মন যে বলে, নয় কখনোই নয় —
ফুরায়নি তো, ফুরাবার এই ভান।
মন যে বলে — শুনি আকাশময়
যাবার মুখে ফিরে আসার গান।
শীর্ণ শীতের লতা
আমার মনের কথা
হিমের রাতে লুকিয়ে রাখে
নগ্ন শাখার ফাঁকে ফাঁকে,
ফাল্গুনেতে ফিরিয়ে দেবে ফুলে
তোমার চরণমূলে —
যেথায় তুমি, প্রিয়ে,
একলা বসে আপন মনে
আঁচল মাথায় দিয়ে।
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.