poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
রঙিন খেলেনা দিলে ও রাঙা হাতে তখন বুঝি রে বাছা, কেন যে প্রাতে এত রঙ খেলে মেঘে           জলে রঙ ওঠে জেগে, কেন এত রঙ লেগে ফুলের পাতে— রাঙা খেলা দেখি যবে ও রাঙা হাতে। গান গেয়ে তোরে আমি নাচাই যবে আপন হৃদয়-মাঝে বুঝি রে তবে, পাতায় পাতায় বনে       ধ্বনি এত কী কারণে, ঢেউ বহে নিজমনে তরল রবে, বুঝি তা তোমারে গান শুনাই যবে। যখন নবনী দিই লোলুপ করে হাতে মুখে মেখেচুকে বেড়াও ঘরে, তখন বুঝিতে পারি       স্বাদু কেন নদীবারি, ফল মধুরসে ভারী কিসের তরে, যখন নবনী দিই লোলুপ করে। যখন চুমিয়ে তোর বদনখানি হাসিটি ফুটায়ে তুলি তখনি জানি আকাশ কিসের সুখে     আলো দেয় মোর মুখে, বায়ু দিয়ে যায় বুকে অমৃত আনি— বুঝি তা চুমিলে তোর বদনখানি। (শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
দিবসে চক্ষুর দম্ভ দৃষ্টিশক্তি লয়ে, রাত্রি যেই হল সেই অশ্রু যায় বয়ে! আলোরে কহিল—আজ বুঝিয়াছি ঠেকি তোমারি প্রসাদবলে তোমারেই দেখি।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
হাটেতে চল পথের বাঁকে বাঁকে, হে গোয়ালিনী, শিশুরে নিয়ে কাঁখে। হাটের সাথে ঘরের সাথে বেঁধেছ ডোর আপন হাতে পরুষ কলকোলাহলের ফাঁকে।হাটের পথে জানি না কোন্‌ ভুলে কৃষ্ণকলি উঠিছে ভরি ফুলে। কেনাবেচার বাহনগুলা যতই কেন উড়াক ধুলা তোমারি মিল সে ওই তরুমূলে।শালিখপাখি আহারকণা-আশে মাঠের 'পরে চরিছে ঘাসে ঘাসে। আকাশ হতে প্রভাতরবি দেখিছে সেই প্রাণের ছবি, তোমারে আর তাহারে দেখে হাসে।মায়েতে আর শিশুতে দোঁহে মিলে ভিড়ের মাঝে চলেছ নিরিবিলে। দুধের ভাঁড়ে মায়ের প্রাণ মাধুরী তার করিল দান, লোভের ভালে স্নেহের ছোঁওয়া দিলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ঝুঁটি - বাঁধা ডাকাত সেজে দল বেঁধে মেঘ চলেছে যে আজকে সারাবেলা । কালো ঝাঁপির মধ্যে ভরে সুর্যিকে নেয় চুরি করে , ভয় - দেখাবার খেলা । বাতাস তাদের ধরতে মিছে হাঁপিয়ে ছোটে পিছে পিছে , যায় না তাদের ধরা । আজ যেন ওই জড়োসড়ো আকাশ জুড়ে মস্ত বড়ো মন - কেমন - করা । বটের ডালে ডানা - ভিজে কাক বসে ওই ভাবছে কী যে , চড়ুইগুলো চুপ । বৃষ্টি হয়ে গেছে ভোরে শজনেপাতায় ঝরে ঝরে জল পড়ে টুপটুপ । লেজের মধ্যে মাথা থুয়ে খাঁদন কুকুর আছে শুয়ে কেমন একরকম । দালানটাতে ঘুরে ঘুরে পায়রাগুলো কাঁদন - সুরে ডাকছে বকবকম । কার্তিকে ওই ধানের খেতে ভিজে হাওয়া উঠল মেতে সবুজ ঢেউয়ের ‘পরে । পরশ লেগে দিশে দিশে হিহি করে ধানের শিষে শীতের কাঁপন ধরে । ঘোষাল - পাড়ার লক্ষ্মী বুড়ি ছেঁড়া কাঁথায় মুড়িসুড়ি গেছে পুকুরপাড়ে , দেখতে ভালো পায় না চোখে বিড়বিড়িয়ে বকে বকে শাক তোলে , ঘাড় নাড়ে । ঐ ঝমাঝম বৃষ্টি নামে মাঠের পারে দূরের গ্রামে ঝাপসা বাঁশের বন । গোরুটা কার থেকে থেকে খোঁটায় - বাঁধা উঠছে ডেকে ভিজছে সারাক্ষণ । গদাই কুমোর অনেক ভোরে সাজিয়ে নিয়ে উঁচু ক'রে হাঁড়ির উপর হাঁড়ি চলছে রবিবারের হাটে , গামছা মাথায় জলের ছাঁটে হাঁকিয়ে গোরুর গাড়ি । বন্ধ আমার রইল খেলা , ছুটির দিনে সারাবেলা কাটবে কেমন করে ? মনে হচ্ছে এমনিতরো ঝরবে বৃষ্টি ঝরোঝরো দিনরাত্তির ধরে ! এমন সময় পুবের কোণে কখন যেন অন্যমনে ফাঁক ধরে ওই মেঘে , মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে হঠাৎ চোখের পাতা মেলে আকাশ ওঠে জেগে । ছিঁড়ে - যাওয়া মেঘের থেকে পুকুরে রোদ পড়ে বেঁকে , লাগায় ঝিলিমিলি । বাঁশবাগানের মাথায় মাথায় তেঁতুলগাছের পাতায় পাতায় হাসায় খিলিখিলি । হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে ভুলিয়ে দিলে একনিমেষে বাদলবেলার কথা । হারিয়ে - পাওয়া আলোটিরে নাচায় ডালে ফিরে ফিরে বেড়ার ঝুমকোলতা । উপর নিচে আকাশ ভরে এমন বদল কেমন করে হয় , সে - কথাই ভাবি । উলটপালট খেলাটি এই , সাজের তো তার সীমানা নেই , কার কাছে তার চাবি ? এমন যে ঘোর মন - খারাপি বুকের মধ্যে ছিল চাপি সমস্ত খন আজি — হঠাৎ দেখি সবই মিছে নাই কিছু তার আগে পিছে এ যেন কার বাজি । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে হবে গো এইবার– আমার এই মলিন অহংকার। দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি, এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার। আমার এই মলিন অহংকার।এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে, হল রে তাঁর আসার সময় আশা এল প্রাণে। স্নান করে আয় এখন তবে প্রেমের বসন পরতে হবে, সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার। ওরে আয় সময় নেই যে আর।১৯ আশ্বিন, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
মুকুলের বক্ষোমাঝে কুসুম আঁধারে আছে বাঁধা, সুন্দর হাসিয়া বহে প্রকাশের সুন্দর এ বাধা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
হিংস্র রাত্রি আসে চুপে চুপে, গতবল শরীরের শিথিল অর্গল ভেঙে দিয়ে অন্তরে প্রবেশ করে, হরণ করিতে থাকে জীবনের গৌরবের রূপ কালিমার আক্রমণে হার মানে মন। এ পরাভবের লজ্জা এ অবসাদের অপমান যখন ঘনিয়ে ওঠে সহসা দিগন্তে দেখা দেয় দিনের পতাকাখানি স্বর্ণকিরণের রেখা-আঁকা; আকাশের যেন কোন্‌ দূর কেন্দ্র হতে উঠে ধ্বনি “মিথ্যা মিথ্যা’ বলি। প্রভাতের প্রসন্ন আলোকে দুঃখবিজয়ীর মূর্তি দেখি আপনার জীর্ণদেহদুর্গের শিখরে।  (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
সেদিন আমার জন্মদিন। প্রভাতের প্রণাম লইয়া উদয়দিগন্ত-পানে মেলিলাম আঁখি, দেখিলাম সদ্যস্নাত উষা আঁকি দিল আলোকচন্দনলেখা হিমাদ্রির হিমশুভ্র পেলব ললাটে। যে মহাদূরত্ব আছে নিখিল বিশ্বের মর্মস্থানে তারি আজ দেখিনু প্রতিমা গিরীন্দ্রের সিংহাসন-'পরে। পরম গাম্ভীর্যে যুগে যুগে ছায়াঘন অজানারে করিছে পালন পথহীন মহারণ্য-মাঝে, অভ্রভেদী সুদূরকে রেখেছে বেষ্টিয়া দুর্ভেদ্য দুর্গমতলে উদয়-অস্তের চক্রপথে। আজি এই জন্মদিনে দূরত্বের অনুভব অন্তরে নিবিড় হয়ে এল। যেমন সুদূর ওই নক্ষত্রের পথ নীহারিকা-জ্যোতির্বাষ্প-মাঝে রহস্যে আবৃত, আমার দূরত্ব আমি দেখিলাম তেমনি দুর্গমে- অলক্ষ্য পথের যাত্রী, অজানা তাহার পরিণাম। আজি এই জন্মদিনে দূরের পথিক সেই তাহারি শুনিনু পদক্ষেপ নির্জন সমুদ্রতীর হতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
সন্ধ্যা হয়ে আসে; সোনা-মিশোল ধূসর আলো ঘিরল চারিপাশে।নৌকোখানা বাঁধা আমার মধ্যিখানের গাঙে অস্তরবির কাছে নয়ন কী যেন ধন মাঙে। আপন গাঁয়ে কুটীর আমার দূরের পটে লেখা, ঝাপসা আভায় যাচ্ছে দেখা বেগনি রঙের রেখা। যাব কোথায় কিনারা তার নাই, পশ্চিমেতে মেঘের গায়ে একটু আভাস পাই। হাঁসের দলে উড়ে চলে হিমালয়ের পানে, পাখা তাদের চিহ্নবিহীন পথের খবর জানে। শ্রাবণ গেল, ভাদ্র গেল, শেষ হল জল-ঢালা, আকাশতলে শুরু হল শুভ্র আলোর পালা। খেতের পরে খেত একাকার প্লাবনে রয় ডুবে, লাগল জলের দোলযাত্রা পশ্চিমে আর পুবে। আসন্ন এই আঁধার মুখে নৌকোখানি বেয়ে যায় কারা ঐ, শুধাই, "ওগো নেয়ে, চলেছ কোন্‌খানে।" যেতে যেতে জবাব দিল, "যাব গাঁয়ের পানে।" অচিন শূন্যে ওড়া পাখি চেনে আপন নীড়, জানে বিজনমধ্যে কোথায় আপন জনের ভিড়। অসীম আকাশ মিলেছে ওর বাসার সীমানাতে, ঐ অজানা জড়িয়ে আছে জানাশোনার সাথে| তেমনি ওরা ঘরের পথিক ঘরের দিকে চলে যেথায় ওদের তুলসিতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে।    দাঁড়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে যায় ধীরে, মিলায় সুদূর নীরে। সেদিন দিনের অবসানে সজল মেঘের ছায়ে আমার চলার ঠিকানা নাই, ওরা চলল গাঁয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল প্রথম মেলিল আঁখি তার, প্রথম হেরিল চারি ধার। মধুকর গান গেয়ে বলে, ‘মধু কই, মধু দাও দাও। ' হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে ফুল বলে, ‘এই লও লও। ' বায়ু আসি কহে কানে কানে, ‘ফুলবালা, পরিমল দাও। ' আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল, ‘যাহা আছে সব লয়ে যাও। ' তরুতলে চ্যুতবৃন্ত মালতীর ফুল মুদিয়া আসিছে আঁখি তার, চাহিয়া দেখিল চারি ধার। মধুকর কাছে এসে বলে, ‘মধু কই, মধু চাই চাই। ' ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ফুল বলে, ‘কিছু নাই নাই। ' ‘ফুলবালা, পরিমল দাও' বায়ু আসি কহিতেছে কাছে। মলিন বদন ফিরাইয়া ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে। '(শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
কিসের হরষ কোলাহল শুধাই তোদের, তোরা বল্‌। আনন্দ-মাঝারে সব উঠিতেছে ভেসে ভেসে আনন্দে হতেছে কভু লীন-- চাহিয়া ধরণী-পানে নব আনন্দের গানে মনে পড়ে আর-এক দিন। সে তখন ছেলেবেলা--রজনী প্রভাত হলে, তাড়াতাড়ি শয্যা ছাড়ি ছুটিয়া যেতেম চলে; সারি সারি নারিকেল বাগানের এক পাশে, বাতাস আকুল করে আম্রমুকুলের বাসে। পথপাশে দুই ধারে বেলফুল ভারে ভারে ফুটে আছে, শিশুমুখে প্রথম হাসির প্রায়-- বাগানে পা দিতে দিতে গন্ধ আসে আচম্বিতে, নর‌্‌গেস্ কোথা ফুটে খুঁজে তারে পাওয়া দায়। মাঝেতে বাঁধানো বেদী, জুঁইগাছ চারি ধারে-- সূর্যোদয় দেখা দিত প্রাচীরের পরপারে। নবীন রবির আলো সে যে কী লাগিত ভালো, সর্বাঙ্গে সুবর্ণসুধা অজস্র পড়িত ঝরে-- প্রভাত ফুলের মতো ফুটায়ে তুলিত মোরে।      এখনো সে মনে আছে সেই জানালার কাছে বসে থাকিতাম একা জনহীন দ্বিপ্রহরে। অনন্ত আকাশ নীল, ডেকে চলে যেত চিল জানায়ে সুতীব্র তৃষা সুতীক্ষ্ণ করুণ স্বরে। পুকুর গলির ধারে, বাঁধা ঘাট এক পারে-- কত লোক যায় আসে, স্নান করে, তোলে জল-- রাজহাঁস তীরে তীরে সারাদিন ভেসে ফিরে, ডানা দুটি ধুয়ে ধুয়ে করিতেছে নিরমল। পূর্ব ধারে বৃদ্ধ বট মাথায় নিবিড় জট, ফেলিয়া প্রকাণ্ড ছায়া দাঁড়ায়ে রহস্যময়। আঁকড়ি শিকড়-মুঠে প্রাচীর ফেলেছে টুটে, খোপেখাপে ঝোপেঝাপে কত-না বিস্ময় ভয়। বসি শাখে পাখি ডাকে সারাদিন একতান- চারি দিক স্তব্ধ হেরি কী যেন করিত প্রাণ। মৃদু তপ্ত সমীরণ গায়ে লাগিত এসে, সেই সমীরণস্রোতে কত কি আসিত ভেসে কোন্‌ সমুদ্রের কাছে মায়াময় রাজ্য আছে, সেথা হতে উড়ে আসে পাখির ঝাঁকের মতো কত মায়া, কত পরী, রূপকথা কত শত।আরেকটি ছোটো ঘর মনে পড়ে নদীকূলে, সম্মুখে পেয়ারাগাছ ভরে আছে ফলে ফুলে। বসিয়া ছায়াতে তারি ভুলিয়া শৈশবখেলা, জাহ্নবীপ্রবাহ-পানে চেয়ে আছি সারাবেলা। ছায়া কাঁপে, আলো কাঁপে, ঝুরু ঝুরু বহে বায়-- ঝর ঝর মর মর পাতা ঝরে পড়ে যায়। সাধ যেত যাই ভেসে কত রাজ্যে কত দেশে, দুলায়ে দুলায়ে ঢেউ নিয়ে যাবে কত দূর-- কত ছোটো ছোটো গ্রাম নূতন নূতন নাম, অভ্রভেদী শুভ্র সৌধ, কত নব রাজপুর। কত গাছ, কত ছায়া জটিল বটের মূল-- তীরে বালুকার ‘পরে, ছেলেমেয়ে খেলা করে, সন্ধ্যায় ভাসায় দীপ, প্রভাতে ভাসায় ফুল। ভাসিতে ভাসিতে শুধু দেখিতে দেখিতে যাব কত দেশ, কত মুখ, কত-কী দেখিতে পাব। কোথা বালকের হাসি, কোথা রাখালের বাঁশি, সহসা সুদূর হতে অচেনা পাখির গান। কোথাও বা দাঁড় বেয়ে মাঝি গেল গান গেয়ে, কোথাও বা তীরে বসে পথিক ধরিল তান। শুনিতে শুনিতে যাই আকাশেতে তুলে আঁখি-- আকাশেতে ভাসে মেঘ, আকাশেতে ওড়ে পাখি। হয়তো বরষা কাল-- ঝর ঝর বারি ঝরে, পুলকরোমাঞ্চ ফুটে জাহ্নবীর কলেবরে-- থেকে থেকে ঝন্‌ ঝন্‌ ঘন বাজ-বরিষন, থেকে থেকে বিজলীর চমকিত চকমকি। বহিছে পুরব বায়, শীতে শিহরিছে কায়, গহন জলদে দিবা হয়েছে আঁধারমুখী।           সেই সেই ছেলেবেলা আনন্দে করেছি খেলা প্রকৃতি গো, জননী গো, কেবলি তোমারি কোলে। তার পরে কী যে হল-- কোথা যে গেলেম চলে। হৃদয় নামেতে এক বিশাল অরণ্য আছে, দিশে দিশে নাহিকো কিনারা, তারি মাঝে হ’নু, পথহারা। সে বন আঁধারে ঢাকা গাছের জটিল শাখা সহস্র স্নেহের বাহু দিয়ে আঁধার পালিছে বুকে নিয়ে। নাহি রবি, নাহি শশী, নাহি গ্রহ, নাহি তারা, কে জানে কোথায় দিগ‍্‌বিদিক। আমি শুধু একেলা পথিক। তোমারে গেলেম ফেলে, অরণ্যে গেলেম চলে, কাটালেম কত শত দিন ম্রিয়মাণ সুখশান্তিহীন।আজিকে একটি পাখি পথ দেখাইয়া মোরে আনিল এ অরণ্য-বাহিরে আনন্দের সমুদ্রের তীরে। সহসা দেখিনু রবিকর, সহসা শুনিনু কত গান। সহসা পাইনু পরিমল, সহসা খুলিয়া গেল প্রাণ। দেখিনু ফুটিছে ফুল, দেখিনু উড়িছে পাখি, আকাশ পুরেছে কলস্বরে।জীবনের ঢেউগুলি ওঠে পড়ে চারিদিকে, রবিকর নাচে তার ‘পরে। চারি দিকে বহে বায়ু, চারিদিকে ফুটে আলো, চারিদিকে অনন্ত আকাশ, চারি দিক-পানে চাই--চারিদিকে প্রাণ ধায়, জগতের অসীম বিকাশ। কেহ এসে বসে কোলে, কেহ ডাকে সখা ব’লে, কাছে এসে কেহ করে খেলা। কেহ হাসে, কেহ গায়, কেহ আসে, কেহ যায়-- এ কী হেরি আনন্দের মেলা! যুবক যুবতি হাসে, বালক বালিকা নাচে দেখে যে রে জুড়ায় নয়ন। ও কে হোথা গান গায়, প্রাণ কেড়ে নিয়ে যায়, ও কী শুনি অমিয়-বচন।        তাই আজি শুধাই তোমারে, কেন এ আনন্দ চারিধারে! বুঝেছি গো বুঝেছি গো, এতদিন পরে বুঝি ফিরে পেলে হারানো সন্তান। তাই বুঝি দুই হাতে জড়ায়ে লয়েছ বুকে, তাই বুঝি গাহিতেছ গান। ভালোবাসা খুঁজিবারে গেছিনু অরণ্যমাঝে, হৃদয়ে হইনু পথহারা, বরষিনু অশ্রুবারিধারা। ভ্রমিলাম দূরে দূরে--কে জানিত বল্‌ দেখি হেথা এত ভালোবাসা আছে। যেদিকেই চেয়ে দেখি সেইদিকে ভালোবাসা ভাসিতেছে নয়নের কাছে। মা আমার, আজ আমি কত শত দিন পরে যখনি রে দাঁড়ানু সম্মুখে, অমনি চুমিলি মুখ, কিছু নাই অভিমান, অমনি লইলি তুলে বুকে। ছাড়িব না তোর কোল, রব হেথা অবিরাম, তোর কাছে শিখিব রে স্নেহ, সবারে বাসিব ভালো--কেহ না নিরাশ হবে মোরে ভালো বাসিবে যে কেহ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
তোমাদের জানি, তবু তোমরা যে দূরের মানুষ। তোমাদের আবেষ্টন, চলাফেরা, চারি দিকে ঢেউ ওঠা-পড়া, সবই চেনা জগতের তবু তার আমন্ত্রণে দ্বিধা-- সবা হতে আমি দূরে, তোমাদের নাড়ীর যে ভাষা সে আমার আপন প্রাণের, বিষণ্ন বিস্ময় লাগে যবে দেখি স্পর্শ তার সসংকোচ পরিচয় নিয়ে আনে যেন প্রবাসীর পাণ্ডুবর্ণ শীর্ণ আত্মীয়তা। আমি কিছু দিতে চাই, তা না হলে জীবনে জীবনে মিল হবে কী করিয়া-- আসি না নিশ্চিত পদক্ষেপে-- ভয় হয়, রিক্ত পাত্র বুঝি, বুঝি তার রসস্বাদ হারায়েছে পূর্বপরিচয়, বুঝি আদানে-প্রদানে রবে না সম্মান। তাই আশঙ্কার এ দূরত্ব হতে এ নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গতা-মাঝে তোমাদের ডেকে বলি, যে জীবনলক্ষ্মী মোরে সাজায়েছে নব নব সাজে তার সাথে বিচ্ছেদের দিনে নিভায়ে উৎসবদীপ দারিদ্র৻ের লাঞ্ছনায় ঘটাবে না কভু অসম্মান, অলংকার খুলে নেবে,একে একে বর্ণসজ্জাহীন উত্তরীয়ে ঢেকে দিবে, ললাটে আঁকিবে শুভ্র তিলকের রেখা; তোমরাও যোগ দিয়ো জীবেনের পূর্ণ ঘট নিয়ে সে অন্তিম অনুষ্ঠানে, হয়তো শুনিবে দূর হতে দিগন্তের পরপারে শুভশঙ্খধ্বনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
ডাকাতের সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি ইজেরে চোক ঢেকে মুখ ঢেকে ঢাকা দিল নিজেরে। পেটে ছুরি লাগালো কি, প্রাণ তার ভাগালো কি, দেখতে পেল না কালু হল তার কী যে রে!   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
আমি অন্তঃপুরের মেয়ে, চিনবে না আমাকে। তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু, "বাসি ফুলের মালা'। তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে। পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি, দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে-- জিতিয়ে দিলে তাকে। নিজের কথা বলি। বয়স আমার অল্প। একজনের মন ছুঁয়েছিল আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া। তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে-- ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি। আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে, অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে। তোমাকে দোহাই দিই, একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি। বড়ো দুঃখ তার। তারও স্বভাবের গভীরে অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও কেমন করে প্রমাণ করবে সে, এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে। কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে, মন যায় না সত্যের খোঁজে, আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে। কথাটা কেন উঠল তা বলি। মনে করো তার নাম নরেশ। সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো। এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না, না করব যে এমন জোর কই। একদিন সে গেল বিলেতে। চিঠিপত্র পাই কখনো বা। মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে, এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়! আর তারা কি সবাই অসামান্য-- এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা। আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে। গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে-- বাঙালি কবির কবিতা ক' লাইন দিয়েছে তুলে সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে-- তার পরে বালির 'পরে বসল পাশাপাশি-- সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ, আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক। লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে, "এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে; ঝিনুকের দুটি খোলা, মাঝখানটুকু ভরা থাক্‌ একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে-- দুর্লভ, মূল্যহীন।' কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি। সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে, "কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী, কিন্তু চমৎকার-- হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়।' বুঝতেই পারছ একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়-- আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে। মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই এমন ধন নেই আমার হাতে। ওগো, নাহয় তাই হল, নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন। পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু, নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প-- যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয় অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে-- অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার। বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে, হার হয়েছে আমার। কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে, পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে। ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে। তাকে নাম দিয়ো মালতী। ওই নামটা আমার। ধরা পড়বার ভয় নেই। এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে, তারা সবাই সামান্য মেয়ে। তারা ফরাসি জর্মান জানে না, কাঁদতে জানে। কী করে জিতিয়ে দেবে। উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী। তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে, দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো। দয়া কোরো আমাকে। নেমে এসো আমার সমতলে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি-- সে বর আমি পাব না, কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা। রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে, বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়, আদরে থাক্‌ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে। ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম.এ. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে। কিন্তু ওইখানেই যদি থাম তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক। আমার দশা যাই হোক খাটো কোরো না তোমার কল্পনা। তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো। মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে। সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর, যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা, দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে। জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে-- শুধু বিদুষী ব'লে নয়, নারী ব'লে। ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়-- যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি, আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি। মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না, বড়ো বড়ো নামজাদার সভা। মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য, মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়-- ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো। ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি, সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে। (এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে। বলতে হল নিজের মুখেই, এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।) নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে, আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল। আর তার পরে? তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল, স্বপ্ন আমার ফুরোল। হায় রে সামান্য মেয়ে! হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়! ------------------ ২৯ শ্রাবণ ১৩৩৯ পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
স্থির জেনেছিলেম, পেয়েছি তোমাকে, মনেও হয়নি তোমার দানের মূল্য যাচাই করার কথা। তুমিও মূল্য করনি দাবি। দিনের পর দিন গেল, রাতের পর রাত, দিলে ডালি উজাড় ক'রে। আড়চোখে চেয়ে আনমনে নিলেম তা ভাণ্ডারে; পরদিনে মনে রইল না। নববসন্তের মাধবী যোগ দিয়েছিল তোমার দানের সঙ্গে, শরতের পূর্ণিমা দিয়েছিল তারে স্পর্শ। তোমার কালো চুলের বন্যায় আমার দুই পা ঢেকে দিয়ে বলেছিলে "তোমাকে যা দিই তোমার রাজকর তার চেয়ে অনেক বেশি; আরো দেওয়া হল না আরো যে আমার নেই।" বলতে বলতে তোমার চোখ এল ছলছলিয়ে। আজ তুমি গেছ চলে, দিনের পর দিন আসে, রাতের পর রাত, তুমি আস না। এতদিন পরে ভাণ্ডার খুলে দেখছি তোমার রত্নমালা, নিয়েছি তুলে বুকে। যে গর্ব আমার ছিল উদাসীন সে নুয়ে পড়েছে সেই মাটিতে যেখানে তোমার দুটি পায়ের চিহ্ন আছে আঁকা। তোমার প্রেমের দাম দেওয়া হল বেদনায়, হারিয়ে তাই পেলেম তোমায় পূর্ণ ক'রে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
পিলুবলো গো বালা, আমারি তুমি হইবে চিরকাল! অনিয়া দিব চরণতলে যা-কিছু আছে সাগরজলে পৃথিবী-‘পরে আকাশতলে অমূল মণি জাল! শুনি আশার মোহন-রব যা-কিছু ভালো লাগিবে তব আনিয়া দিব, হও গো, যদি আমারি চিরকাল! যেথায় মোরা বেড়াব দুটি, কুসুমগুলি উঠিবে ফুটি, নদীর জলে শুনিতে পাব দেবতাদের বাণী। তারকাগুলি দেখাবে যেন প্রেমিকদেরি জগতহেন, মধুর এক স্বপন সম দেখাবে ধরাখানি! আকাশ-ভেদী শিখর হতে পতনশীল নিঝর-স্রোতে নাহিয়া যথা কানন-ভূমি হরিত-বাসে সাজে, চির-প্রবাহী সুখের ধারে দোঁহার হৃদি হাসিবে হারে– যেই সুখের মূল লুকানো কলপনার মাঝে! প্রেম দেবের কুহক জালে হৃদয়ে যার অমৃত ঢালে, সেই সে জনে করেন প্রেম কত না সুখ-দান। ভবন তাঁর স্বরগ-‘পরে, যেথায় তাঁর চরণ পড়ে ধরার মাঝে স্বরগ শোভা ধরে, গো, সেইখান!Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
নিঝর মিশেছে তটিনীর সাথে তটিনী মিশেছে সাগর-‘পরে, পবনের সাথে মিশিছে পবন চির-সুমধুর প্রণয়-ভরে! জগতে কেহই নাইকো একেলা, সকলি বিধির নিয়ম-গুণে, একের সহিত মিশিছে অপরে আমি বা কেন না তোমার সনে? দেখো, গিরি ওই চুমিছে আকাশে, ঢেউ-‘পরে ঢেউ পড়িছে ঢলি, সে কুলবালারে কে বা না দোষিবে, ভাইটিরে যদি যায় সে ভুলি! রবি-কর দেখো চুমিছে ধরণী, শশি-কর চুমে সাগর জল, তুমি যদি মোরে না চুম’, ললনা, এ-সব চুম্বনে কী তবে ফল?P. B. Shelley (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
এবারে ফাল্গুনের দিনে সিন্ধুতীরের কুঞ্জবীথিকায় এই যে আমার জীবন-লতিকায় ফুটল কেবল শিউরে-ওঠা নতুন পাতা যত রক্তবরন হৃদয়ব্যথার মতো; দখিন হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে দিল কেবল দোল, উঠল কেবল মর্মর কল্লোল। এবার শুধু গানের মৃদু গুঞ্জনে বেলা আমার ফুরিয়ে গেল কুঞ্জবনের প্রাঙ্গণে। আবার যেদিন আসবে আমার রূপের আগুন ফাল্গুনদিনের কাল দখিন হাওয়ায় উড়িয়ে রঙিন পাল, সেবারে এই সিন্ধুতীরের কুঞ্জবীথিকায় যেন আমার জীবন-লতিকায় ফোটে প্রেমের সোনার বরন ফুল হয় যেন আকুল নবীন রবির আলোকটি তাই বনের প্রাঙ্গণে আনন্দ মোর জনম নিয়ে তালি দিয়ে তালি দিয়ে নাচে যেন গানের গুঞ্জনে। পদ্মা, ২২ মাঘ, ১৩২১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ওরা এসে আমাকে বলে, কবি, মৃত্যুর কথা শুনতে চাই তোমার মুখে। আমি বলি, মৃত্যু যে আমার অন্তরঙ্গ, জড়িয়ে আছে আমার দেহের সকল তন্তু। তার ছন্দ আমার হৃৎস্পন্দনে, আমার রক্তে তার আনন্দের প্রবাহ। বলছে সে,--চলো চলো, চলো বোঝা ফেলতে ফেলতে, চলো মরতে মরতে নিমেষে নিমেষে আমারি টানে, আমারি বেগে। বলছে, চুপ করে বস যদি যা-কিছু আছে সমস্তকে আঁকড়িয়ে ধরে তবে দেখবে, তোমার জগতে ফুল গেল বাসি হয়ে, পাঁক দেখা দিল শুকনো নদীতে, ম্লান হল তোমার তারার আলো। বলছে, "থেমো না, থেমো না, পিছনে ফিরে তাকিয়ো না, পেরিয়ে যাও পুরোনোকে জীর্ণকে ক্লান্তকে অচলকে। "আমি মৃত্যু-রাখাল সৃষ্টিকে চরিয়ে চরিয়ে নিয়ে চলেছি যুগ হতে যুগান্তরে নব নব চারণ-ক্ষেত্রে। "যখন বইল জীবনের ধারা আমি এসেছি তার পিছনে পিছনে, দিইনি তাকে কোনো গর্তে আটক থাকতে। তীরের বাঁধন কাটিয়ে কাটিয়ে ডাক দিয়ে নিয়ে গেছি মহাসমুদ্রে, সে সমুদ্র আমিই। "বর্তমান চায় বর্তিয়ে থাকতে। সে চাপাতে চায় তার সব বোঝা তোমার মাথায়, বর্তমান গিলে ফেলতে চায় তোমার সব-কিছু আপন জঠরে। তার পরে অবিচল থাকতে চায় আকণ্ঠপূর্ণ দানবের মতো জাগরণহীন নিদ্রায়। তাকেই বলে প্রলয়। এই অনন্ত অচঞ্চল বর্তমানের হাত থেকে আমি সৃষ্টিকে পরিত্রাণ করতে এসেছি, অন্তহীন নব নব অনাগতে।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
মনশ্চক্ষে হেরি যবে ভারত প্রাচীন পুরব পশ্চিম হতে উত্তর দক্ষিণ মহারণ্য দেখা দেয় মহাচ্ছায়া লয়ে। রাজা রাজ্য-অভিমান রাখি লোকালয়ে অশ্বরথ দূরে বাঁধি যায় নতশিরে গুরুর মন্ত্রণা লাগি— স্রোতস্বিনীতীরে মহর্ষি বসিয়া যোগাসনে, শিষ্যগণ বিরলে তরুর তলে করে অধ্যয়ন প্রশান্ত প্রভাতবায়ে, ঋষিকন্যাদলে পেলব যৌবন বাঁধি পরুষ বল্কলে আলবালে করিতেছে সলিল সেচন। প্রবেশিছে বনদ্বারে ত্যজি সিংহাসন মুকুটবিহীন রাজা পক্ককেশজালে ত্যাগের মহিমাজ্যোতি লয়ে শান্ত ভালে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
কৃতাঞ্জলি কর কহে, আমার বিনয়, হে নিন্দুক, কেবল নেবার বেলা নয়। নিই যবে নিই বটে অঞ্জলি জুড়িয়া, দিই যবে সেও দিই অঞ্জলি পুরিয়া।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
কেঁচো কয়, নীচ মাটি, কালো তার রূপ। কবি তারে রাগ ক’রে বলে, চুপ চুপ! তুমি যে মাটির কীট, খাও তারি রস, মাটির নিন্দায় বাড়ে তোমারি কি যশ!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ভৃত্যের না পাই দেখা প্রাতে । দুয়ার রয়েছে খোলা ,                স্নানজল নাই তোলা , মূর্খাধম আসে নাই রাতে । মোর ধৌত বস্ত্রখানি              কোথা আছে নাহি জানি , কোথা আহারের আয়োজন ! বাজিয়া যেতেছে ঘড়ি            বসে আছি রাগ করি — দেখা পেলে করিব শাসন । বেলা হলে অবশেষে              প্রণাম করিল এসে , দাঁড়াইল করি করজোড় । আমি তারে রোষভরে           কহিলাম , “ দূর হ রে , দেখিতে চাহি নে মুখ তোর । ” শুনিয়া মূঢ়ের মতো                ক্ষণকাল বাক্যহত মুখে মোর রহিল সে চেয়ে — কহিল গদ্‌গদস্বরে ,                 “ কালি রাত্রি দ্বিপ্রহরে মারা গেছে মোর ছোটো মেয়ে । ” এত কহি ত্বরা করি                গামোছাটি কাঁধে ধরি নিত্যকাজে গেল সে একাকী । প্রতি দিবসের মতো                ঘষা মাজা মোছা কত , কোনো কর্ম রহিল না বাকি ।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
তব জন্মদিবসের দানের উৎসবে বিচিত্র সজ্জিত আজি এই প্রভাতের উদয়-প্রাঙ্গণ। নবীনের দানসত্র কুসুমে পল্লবে অজস্র প্রচুর। প্রকৃতি পরীক্ষা করি দেখে ক্ষণে ক্ষণে আপন ভাণ্ডার, তোমারে সম্মুখে রাখি পেল সে সুযোগ। দাতা আর গ্রহীতার যে সংগম লাগি বিধাতার নিত্যই আগ্রহ আজি তা সার্থক হল, বিশ্বকবি তাহারি বিস্ময়ে তোমারে করেন আশীর্বাদ— তাঁর কবিত্বের তুমি সাক্ষীরূপে দিয়েছ দর্শন বৃষ্টিধৌত শ্রাবণের নির্মল আকাশে ।   (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ক্ষান্ত হও, ধীরে কও কথা। ওরে মন, নত করো শির। দিবা হল সমাপন, সন্ধ্যা আসে শান্তিময়ী। তিমিরের তীরে অসংখ্য-প্রদীপ-জ্বালা এ বিশ্বমন্দিরে এল আরতির বেলা। ওই শুন বাজে নিঃশব্দ গম্ভীর মন্দ্রে অনন্তের মাঝে শঙ্খঘণ্টাধ্বনি। ধীরে নামাইয়া আনো বিদ্রোহের উচ্চ কণ্ঠ পূরবীর ম্লান- মন্দ স্বরে। রাখো রাখো অভিযোগ তব, মৌন করো বাসনার নিত্য নব নব নিষ্ফল বিলাপ। হেরো মৌন নভস্তল, ছায়াচ্ছন্ন মৌন বন, মৌন জলস্থল স্তম্ভিত বিষাদে নম্র। নির্বাক্‌ নীরব দাঁড়াইয়া সন্ধ্যাসতী-- নয়নপল্লব নত হয়ে ঢাকে তার নয়নযুগল, অনন্ত আকাশপূর্ণ অশ্রু-ছলছল করিয়া গোপন। বিষাদের মহাশান্তি ক্লান্ত ভুবনের ভালে করিছে একান্তেসান্ত্বনা-পরশ। আজি এই শুভক্ষণে, শান্ত মনে, সন্ধি করো অনন্তের সনে সন্ধ্যার আলোকে। বিন্দু দুই অশ্রুজলে দাও উপহার-- অসীমের পদতলে জীবনের স্মৃতি। অন্তরের যত কথা শান্ত হয়ে গিয়ে, মর্মান্তিক নীরবতা করুক বিস্তার।        হেরো ক্ষুদ্র নদীতীরে সুপ্তপ্রায় গ্রাম। পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে, শিশুরা খেলে না; শূন্য মাঠ জনহীন; ঘরে-ফেরা শ্রান্ত গাভী গুটি দুই-তিন কুটির-অঙ্গনে বাঁধা, ছবির মতন স্তব্ধপ্রায়। গৃহকার্য হল সমাপন-- কে ওই গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি সম্মুখে দেখিছে চাহি, ভাবিছে কী জানি ধূসর সন্ধ্যায়।           অমনি নিস্তব্ধপ্রাণে বসুন্ধরা, দিবসের কর্ম-অবসানে, দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া আছে চাহি দিগন্তের পানে। ধীরে যেতেছে প্রবাহি সম্মুখে আলোকস্রোত অনন্ত অম্বরে নিঃশব্দ চরণে; আকাশের দূরান্তরে একে একে অন্ধকারে হতেছে বাহির একেকটি দীপ্ত তারা, সুদূর পল্লীর প্রদীপের মতো। ধীরে যেন উঠে ভেসে ম্লানচ্ছবি ধরণীর নয়ননিমেষে কত যুগ-যুগান্তের অতীত আভাস, কত জীবজীবনের জীর্ণ ইতিহাস।যেন মনে পড়ে সেই বাল্যনীহারিকা; তার পরে প্রজ্বলন্ত যৌবনের শিখা; তার পরে স্নিগ্ধশ্যাম অন্নপূর্ণালয়ে জীবধাত্রী জননীর কাজ বক্ষে লয়ে লক্ষ কোটি জীব-- কত দুঃখ, কত ক্লেশ, কত যুদ্ধ, কত মৃত্যু, নাহি তার শেষ।ক্রমে ঘনতর হয়ে নামে অন্ধকার, গাঢ়তর নীরবতা-- বিশ্বপরিবার সুপ্ত নিশ্চেতন। নিঃসঙ্গিনী ধরণীর বিশাল অন্তর হতে উঠে সুগম্ভীর একটি ব্যথিত প্রশ্ন, ক্লিষ্ট ক্লান্ত সুর, শূন্যপানে-- "আরো কোথা? আরো কত দূর?"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
দিন রাত্রি নাহি মানি, আয় তোরা আয় রে, চির সুখ-রসে রত আমরা হেথায় রে। বসন্তে মলয় বায় একটি মিলায়ে যায়, আরেকটি আসে পুনঃ মধুময় তেমনি, প্রেমের স্বপন হায় একটি যেমনি যায় আরেকটি সুস্বপন জাগি উঠে অমনি। নন্দন কানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে! তবে তা ইহাই রে। প্রেমের নিশ্বাস হেথা ফেলিতেছি বালিকা, সুরভি নিশ্বাস যথা ফেলে ফুল-কলিকা, তাহাদের আঁখিজল এমন সে সুবিমল এমন সে সমুজল মুকুতার পারা রে, তাদের চুম্বন হাসি দিবে কত সুধারাশি যাদের মধুর এত নয়নের ধারা রে। নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে। তবে তা ইহাই রে! থাকুক ও-সব সুখ চাই না, গো চাই না, যে সুখ-ভিখারী আমি তাহা যে গো পাই না। দুই হৃদি এক ঠাঁই প্রণয়ে মিলিতে চাই সুখে দুখে যে প্রেমের নাহি হবে শেষ রে। প্রেমে উদাসীন হৃদি শত যুগে যাপে যদি, তার চেয়ে কত ভালো এ সুখ নিমেষ রে! নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে তবে তা ইহাই রে।Thomas Moore (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
জননী জননী ব’লে ডাকি তোরে ত্রাসে, যদি জননীর স্নেহ মনে তোর আসে শুনি আর্তস্বর। যদি ব্যাঘ্রিনীর মতো অকস্মাৎ ভুলে গিয়ে হিংসা লোভ যত মানবপুত্রেরে কর স্নেহের লেহন। নখর লুকায়ে ফেলি পরিপূর্ণ স্তন যদি দাও মুখে তুলি, চিত্রাঙ্কিত বুকে যদি ঘুমাইতে দাও মাথা রাখি সুখে। এমনি দুরাশা! আছ তুমি লক্ষ কোটি গ্রহতারা চন্দ্রসূর্য গগনে প্রকটি হে মহামহিম! তুলি তব বজ্রমুঠি তুমি যদি ধর আজি বিকট ভ্রূকুটি, আমি ক্ষীণ ক্ষুদ্রপ্রাণ কোথা পড়ে আছি, মা বলিয়া ভুলাইব তোমারে পিশাচী!    (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
ফুল ছিঁড়ে লয় হাওয়া, সে পাওয়া মিথ্যে পাওয়া– আনমনে তার পুষ্পের ভার ধুলায় ছড়িয়ে যাওয়া।যে সেই ধুলার ফুলে হার গেঁথে লয় তুলেহেলার সে ধন হয় যে ভূষণ তাহারি মাথার চুলে।শুধায়ো না মোর গান কারে করেছিনু দান– পথধুলা-'পরে আছে তারি তরে যার কাছে পাবে মনি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ভোরের আলো-আঁধারে থেকে থেকে উঠছে কোকিলের ডাক যেন ক্ষণে ক্ষণে শব্দের আতশবাজি। ছেঁড়া মেঘ ছড়িয়েছে আকাশে একটু একটু সোনার লিখন নিয়ে। হাটের দিন, মাঠের মাঝখানকার পথে চলেছে গোরুর গাড়ি। কলসীতে নতুন আখের গুড়, চালের বস্তা, গ্রামের মেয়ে কাঁখের ঝুড়িতে নিয়েছে কচুশাক, কাঁচা আম, শজনের ডাঁটা। ছটা বাজল ইস্কুলের ঘড়িতে। ঐ ঘণ্টার শব্দ আর সকাল বেলাকার কাঁচা রোদ্দুরের রঙ মিলে গেছে আমার মনে। আমার ছোটো বাগানের পাঁচিলের গায়ে বসেছি চৌকি টেনে করবীগাছের তলায়। পুবদিক থেকে রোদ্দুরের ছটা বাঁকা ছায়া হানছে ঘাসের 'পরে। বাতাসে অস্থির দোলা লেগেছে পাশাপাশি দুটি নারকেলের শাখায়। মনে হচ্ছে যমজ শিশুর কলরবের মতো। কচি দাড়িম ধরেছে গাছে চিকন সবুজের আড়ালে। চৈত্রমাস ঠেকল এসে শেষ হপ্তায়। আকাশে ভাসা বসন্তের নৌকোয় পাল পড়েছে ঢিলে হয়ে। দূর্বাঘাস উপবাসে শীর্ণ; কাঁকর-ঢালা পথের ধারে বিলিতি মৌসুমি চারায় ফুলগুলি রঙ হারিয়ে সংকুচিত। হাওয়া দিয়েছে পশ্চিম দিক থেকে,-- বিদেশী হাওয়া চৈত্রমাসের আঙিনাতে। গায়ে দিতে হল আবরণ অনিচ্ছায়। বাঁধানো জলকুণ্ডে জল উঠছে শিরশিরিয়ে, টলমল করছে নালগাছের পাতা, লাল মাছ কটা চঞ্চল হয়ে উঠল। নেবুঘাস ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে খেলা-পাহাড়ের গায়ে। তার মধ্যে থেকে দেখা যায় গেরুয়া পাথরের চতুর্মুখ মূর্তি। সে আছে প্রবহমান কালের দূর তীরে উদাসীন; ঋতুর স্পর্শ লাগে না তার গায়ে। শিল্পের ভাষা তার, গাছপালার বাণীর সঙ্গে কোনো মিল নেই। ধরণীর অন্তঃপুর থেকে যে শুশ্রূষা দিনে রাতে সঞ্চারিত হচ্ছে সমস্ত গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায়, ঐ মূর্তি সেই বৃহৎ আত্মীয়তার বাইরে। মানুষ আপন গূঢ় বাক্য অনেক কাল আগে যক্ষের মৃত ধনের মতো ওর মধ্যে রেখেছে নিরুদ্ধ ক'রে, প্রকৃতির বাণীর সঙ্গে তার ব্যবহার বন্ধ। সাতটা বাজল ঘড়িতে। ছড়িয়ে-পড়া মেঘগুলি গেছে মিলিয়ে। সূর্য উঠল প্রাচীরের উপরে, ছোটো হয়ে গেল গাছের যত ছায়া। খিড়কির দরজা দিয়ে মেয়েটি ঢুকল বাগানে। পিঠে দুলছে ঝালরওআলা বেণী, হাতে কঞ্চির ছড়ি; চরাতে এনেছে একজোড়া রাজহাঁস, আর তার ছোটো ছোটো ছানাগুলিকে। হাঁস দুটো দাম্পত্য দায়িত্বের মর্যাদায় গম্ভীর, সকলের চেয়ে গুরুতর ঐ মেয়েটির দায়িত্ব জীবপ্রাণের দাবি স্পন্দমান ছোট ঐ মাতৃমনের স্নেহরসে। আজকের এই সকালটুকুকে ইচ্ছে করেছি রেখে দিতে। ও এসেছে অনায়াসে, অনায়াসেই যাবে চলে। যিনি দিলেন পাঠিয়ে তিনি আগেই এর মূল্য দিয়েছেন শোধ ক'রে আপন আনন্দ-ভাণ্ডার থেকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আমি থাকি একা, এই বাতায়নে বসে এক বৃন্তে যুগলকে দেখা-- সেই মোর সার্থকতা। বুঝিতে পারি সে কথা লোকে লোকে কী আগ্রহ অহরহ করিছে সন্ধান আপনার বাহিরেতে কোথা হবে আপনার দান। তা নিয়ে বিপুল দুঃখে বিশ্বচিত্ত জেগে উঠে, তারি সুখে পূর্ণ হয়ে ফুটে যা-কিছু মধুর। যত বাণী, যত সুর, যত রূপ, তপস্যার যত বহ্নিলিখা, সৃষ্টিচিত্তশিখা, আকাশে আকাশে লিখে দিকে দিকে অণুপরমাণুদের মিলনের ছবি। গ্রহ তারা রবি যে-আগুন জ্বেলেছে তা বাসনারই দাহ, সেই তাপে জগৎপ্রবাহ চঞ্চলিয়া চলিয়াছে বিরহমিলনদ্বন্দ্বঘাতে। দিনরাতে কালের অতীত পার হতে, অনাদি আহ্বানধ্বনি ফিরিতেছে ছায়াতে আলোতে। সেই ডাক শুনে কত সাজে সাজিয়েছে আজি এ-ফাল্গুনে বনে বনে অভিসারিকার দল, পত্রে পুষ্পে হয়েছে চঞ্চল-- সমস্ত বিশ্বের মর্মে যে-চাঞ্চল্য তারায় তারায় তরঙ্গিছে প্রকাশধারায়, নিখিল ভুবনে নিত্য যে-সংগীত বাজে মূর্তি নিল বনচ্ছায়ে যুগলের সাজে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
ভোরে উঠেই পড়ে মনে , মুড়ি খাবার নিমন্ত্রণে আসবে শালিখ পাখি । চাতালকোণে বসে থাকি , ওদের খুশি দেখতে লাগে ভালো । স্নিগ্ধ আলো এ অঘ্রানের শিশির-ছোঁওয়া প্রাতে , সরল লোভে চপল পাখির চটুল নৃত্য-সাথে শিশুদিনের প্রথম হাসি মধুর হয়ে মেলে — চেয়ে দেখি সকল কর্ম ফেলে । জাড়ের হাওয়ায় ফুলিয়ে ডানা একটুকু মুখ ঢেকে অতিথিরা থেকে থেকে লাল্‌চে-কালো সাদা রঙের পরিচ্ছন্ন বেশে দেখা দিচ্ছে এসে । খানিক পরেই একে একে জোটে পায়রাগুলো , বুক ফুলিয়ে হেলে-দুলে খুঁটে খুঁটে ধুলো খায় ছড়ানো ধান । ওদের সঙ্গে শালিখদলের পঙ্‌ক্তি-ব্যবধান একটুমাত্র নেই । পরস্পরে একসমানেই ব্যস্ত পায়ে বেড়ায় প্রাতরাশে । মাঝে মাঝে কী অকারণ ত্রাসে ত্রস্ত পাখা মেলে এক মুহূর্তে যায় উড়ে ধান ফেলে । আবার ফিরে আসে অহেতু আশ্বাসে । এমন সময় আসে কাকের দল , খাদ্যকণায় ঠোকর মেরে দেখে কী হয় ফল । একটুখানি যাচ্ছে সরে আসছে আবার কাছে , উড়ে গিয়ে বসছে তেঁতুলগাছে । বাঁকিয়ে গ্রীবা ভাবছে বারংবার , নিরাপদের সীমা কোথায় তার । এবার মনে হয় , এতক্ষণে পরস্পরের ভাঙল সমন্বয় । কাকের দলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিৎ মন সন্দেহ আর সতর্কতায় দুলছে সারাক্ষণ । প্রথম হল মনে , তাড়িয়ে দেব ; লজ্জা হল তারি পরক্ষণে — পড়ল মনে , প্রাণের যজ্ঞে ওদের সবাকার আমার মতোই সমান অধিকার । তখন দেখি , লাগছে না আর মন্দ সকালবেলার ভোজের সভায় কাকের নাচের ছন্দ । এই যে বহায় ওরা প্রাণস্রোতের পাগ্‌লাঝোরা , কোথা হতে অহরহ আসছে নাবি সেই কথাটাই ভাবি । এই খুশিটার স্বরূপ কী যে , তারি রহস্যটা বুঝতে নাহি পারি । চটুলদেহ দলে দলে দুলিয়ে তোলে যে আনন্দ খাদ্যভোগের ছলে , এ তো নহে এই নিমেষের সদ্য চঞ্চলতা , অগণ্য এ কত যুগের অতি প্রাচীন কথা । রন্ধ্রে রন্ধ্রে হাওয়া যেমন সুরে বাজায় বাঁশি , কালের বাঁশির মৃত্যুরন্ধ্রে সেই মতো উচ্ছ্বাসি উৎসারিছে প্রাণের ধারা । সেই প্রাণেরে বাহন করি আনন্দের এই তত্ত্ব অন্তহারা দিকে দিকে পাচ্ছে পরকাশ । পদে পদে ছেদ আছে তার , নাই তবু তার নাশ । আলোক যেমন অলক্ষ্য কোন্‌ সুদূর কেন্দ্র হতে অবিশ্রান্ত স্রোতে নানা রূপের বিচিত্র সীমায় ব্যক্ত হতে থাকে নিত্য নানা ভঙ্গে নানা রঙ্গিমায় তেমনি যে এই সত্তার উচ্ছ্বাস চতুর্দিকে ছড়িয়ে ফেলে নিবিড় উল্লাস — যুগের পরে যুগে তবু হয় না গতিহারা , হয় না ক্লান্ত অনাদি সেই ধারা । সেই পুরাতন অনির্বচনীয় সকালবেলায় রোজ দেখা দেয় কি ও আমার চোখের কাছে ভিড়-করা ওই শালিখগুলির নাচে । আদিমকালের সেই আনন্দ ওদের নৃত্যবেগে রূপ ধ ' রে মোর রক্তে ওঠে জেগে । তবুও দেখি কখন কদাচিৎ বিরূপ বিপরীত — প্রাণের সহজ সুষমা যায় ঘুচি , চঞ্চুতে চঞ্চুতে খোঁচাখুচি ; পরাভূত হতভাগ্য মোর দুয়ারের কাছে ক্ষত-অঙ্গে শরণ মাগিয়াছে । দেখেছি সেই জীবন-বিরুদ্ধতা , হিংসার ক্রুদ্ধতা — যেমন দেখি কুহেলিকার কুশ্রী অপরাধ , শীতের প্রাতে আলোর প্রতি কালোর অপবাদ — অহংকৃত ক্ষণিকতার অলীক পরিচয় , অসীমতার মিথ্যা পরাজয় । তাহার পরে আবার করে ছিন্নেরে গ্রন ্ থন সহজ চিরন্তন । প্রাণোৎসবে অতিথিরা আবার পাশাপাশি মহাকালের প্রাঙ্গণেতে নৃত্য করে আসি ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
কালের প্রবল আবর্তে প্রতিহত ফেনপুঞ্জের মতো, আলোকে আঁধারে রঞ্জিত এই মায়া, অদেহ ধরিল কায়া। সত্তা আমার,জানি না, সে কোথা হতে হল উত্থিত নিত্যধাবিত স্রোতে। সহসা অভাবনীয় অদৃশ্য এক আরম্ভ-মাঝে কেন্দ্র রচিল স্বীয়। বিশ্বসত্তা মাঝখানে দিল উঁকি, এ কৌতুকের পশ্চাতে আছে জানি না কে কৌতুকী। ক্ষণিকারে নিয়ে অসীমের এই খেলা, নববিকাশের সাথে গেঁথে দেয় শেষ-বিনাশের হেলা, আলোকে কালের মৃদঙ্গ উঠে বেজে, গোপনে ক্ষণিকা দেখা দিতে আসে মুখ-ঢাকা বধূ সেজে, গলায় পরিয়া হার বুদ্‌বুদ্‌ মণিকার। সৃষ্টির মাঝে আসন করে সে লাভ, অনন্ত তারে অন্তসীমায় জানায় অবির্ভাব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
হে সমুদ্র, চিরকাল কী তোমার ভাষা সমুদ্র কহিল, মোর অনন্ত জিজ্ঞাসা। কিসের স্তব্ধতা তব ওগো গিরিবর? হিমাদ্রি কহিল, মোর চির-নিরুত্তর।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে। একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে, সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল; সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল। আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন্‌ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি, কোন্‌ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।শিলাইদহ, আষাঢ়, ১৩১৬ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
নমো নমো, হে বৈরাগী। তপোবহ্নির শিখা জ্বালো জ্বালো, নির্বাণহীন নির্মল আলো অন্তরে থাক্‌ জাগি॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বদেশমূলক
১ হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন - ' পরি , গান ব্যাসঋষি বীণা হাতে করি — কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন , কাঁপায়ে নীহারশীতল বায় ।২ স্তব্ধ শিখর স্তব্ধ তরুলতা , স্তব্ধ মহীরূহ নড়েনাকো পাতা । বিহগ নিচয় নিস্তব্ধ অচল ; নীরবে নির্ঝর বহিয়া যায় ।৩ পূরণিমা রাত — চাঁদের কিরণ — রজতধারায় শিখর , কানন , সাগর-ঊরমি , হরিত-প্রান্তর , প্লাবিত করিয়া গড়ায়ে যায় ।৪ ঝংকারিয়া বীণা কবিবর গায় , ‘ কেন রে ভারত কেন তুই , হায় , আবার হাসিস্‌! হাসিবার দিন আছে কি এখনো এ ঘোর দুঃখে ।৫ দেখিতাম যবে যমুনার তীরে , পূর্ণিমা নিশীথে নিদাঘ সমীরে , বিশ্রামের তরে রাজা যুধিষ্ঠির , কাটাতেন সুখে নিদাঘ-নিশি ।৬ তখন ও - হাসি লেগেছিল ভালো , তখন ও - বেশ লেগেছিল ভালো , শ্মশান লাগিত স্বরগ সমান , মরু উরবরা ক্ষেতের মতো ।৭ তখন পূর্ণিমা বিতরিত সুখ , মধুর উষার হাস্য দিত সুখ , প্রকৃতির শোভা সুখ বিতরিত পাখির কূজন লাগিত ভালো ।৮ এখন তা নয় , এখন তা নয় , এখন গেছে সে সুখের সময় । বিষাদ আঁধার ঘেরেছে এখন , হাসি খুশি আর লাগে না ভালো ।৯ অমার আঁধার আসুক এখন , মরু হয়ে যাক ভারত-কানন , চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক্‌ ।১০ যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে , প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে , ডুবাক ভারতে সাগরের জলে , ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্‌ ।১১ চাই না দেখিতে ভারতেরে আর , চাই না দেখিতে ভারতেরে আর , সুখ-জন্মভূমি চির বাসস্থান , ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক ।১২ দেখেছি সে-দিন যবে পৃথ্বীরাজ , সমরে সাধিয়া ক্ষত্রিয়ের কাজ , সমরে সাধিয়া পুরুষের কাজ , আশ্রয় নিলেন কৃতান্ত-কোলে ।১৩ দেখেছি সে-দিন দুর্গাবতী যবে , বীরপত্নীসম মরিল আহবে বীরবালাদের চিতার আগুন , দেখেছি বিস্ময়ে পুলকে শোকে ।১৪ তাদের স্মরিলে বিদরে হৃদয় , স্তব্ধ করি দেয় অন্তরে বিস্ময় ; যদিও তাদের চিতাভস্মরাশি , মাটির সহিত মিশায়ে গেছে!১৫ আবার সে - দিন(ও) দেখিয়াছি আমি , স্বাধীন যখন এ-ভারতভূমি কী সুখের দিন! কী সুখের দিন! আর কি সেদিন আসিবে ফিরে ?১৬ রাজা যুধিষ্ঠির (দেখেছি নয়নে) স্বাধীন নৃপতি আর্য-সিংহাসনে , কবিতার শ্লোকে বীণার তারেতে , সেসব কেবল রয়েছে গাঁথা!১৭ শুনেছি আবার , শুনেছি আবার , রাম রঘুপতি লয়ে রাজ্যভার , শাসিতেন হায় এ-ভারতভূমি , আর কি সে-দিন আসিবে ফিরে!১৮ ভারত-কঙ্কাল আর কি এখন , পাইবে হায় রে নূতন জীবন ; ভারতের ভস্মে আগুন জ্বলিয়া , আর কি কখনো দিবে রে জ্যোতি ।১৯ তা যদি না হয় তবে আর কেন , হাসিবি ভারত! হাসিবি রে পুনঃ , সে-দিনের কথা জাগি স্মৃতিপটে , ভাসে না নয়ন বিষাদজলে ?২০ অমার আঁধার আসুক এখন , মরু হয়ে যাক ভারত-কানন , চন্দ্র সূর্য হোক মেঘে নিমগন , প্রকৃতি-শৃঙ্খলা ছিঁড়িয়া যাক ।২১ যাক ভাগীরথী অগ্নিকুণ্ড হয়ে , প্রলয়ে উপাড়ি পাড়ি হিমালয়ে , ডুবাক ভারতে সাগরের জলে , ভাঙিয়া চুরিয়া ভাসিয়া যাক্‌ ।২২ মুছে যাক মোর স্মৃতির অক্ষর , শূন্যে হোক লয় এ শূন্য অন্তর , ডুবুক আমার অমর জীবন , অনন্ত গভীর কালের জলে । '
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন সারাটি রজনী! শ্রান্ত জগত ঘুমে অচেতন সারাটি রজনী! অতি ধীরে ধীরে হৃদে কী লাগিয়া মধুময় ভাব উঠে গো জাগিয়া সারাটি রজনী! ঘুমায়ে তোমারি দেখি গো স্বপন সারাটি রজনী! জাগিয়া তোমারি দেখি গো বদন সারাটি রজনী! ত্যজিবে যখন দেহ ধূলিময় তখনি কি সখি তোমার হৃদয়, আমার ঘুমের শয়ন-‘পরে ভ্রমিয়া বেড়াবে প্রণয়-ভরে। সারাটি রজনী!(অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর, যবে আমার জনম হবে ভোর। চলে যাব নবজীবন-লোকে, নূতন দেখা জাগবে আমার চোখে, নবীন হয়ে নূতন সে আলোকে পরব তব নবমিলন-ডোর। তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই, বারে বারে নূতন লীলা তাই। আবার তুমি জানি নে কোন্‌ বেশে পথের মাঝে দাঁড়াবে, নাথ, হেসে, আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে, লাগবে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর। তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।১০ শ্রাবণ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
আজি   বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে। আজি   খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো, আজি   ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো, এই    সংগীতমুখরিত গগনে তব    গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো। এই    বাহিরভূবনে দিশা হারায়ে দিয়ো   ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।অতি   নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে আজি   পল্লবে পল্লবে বাজে রে - দূরে   গগনে কাহার পথ চাহিয়া আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে। মোর   পরানে দখিন বায়ু লাগিছে, কারে   দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে, এই    সৌরভবিহবল রজনী কার   চরণে ধরণীতলে জাগিছে। ওগো   সুন্দর, বল্লভ, কান্ত, তব   গম্ভীর আহবান কারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
গত দিবসের ব্যর্থ প্রাণের যত ধুলা, যত কালি, প্রতি উষা দেয় নবীন আশার আলো দিয়ে প্রক্ষালি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
একাদশী রজনী পোহায় ধীরে ধীরে — রাঙা মেঘ দাঁড়ায় উষারে ঘিরে ঘিরে । ক্ষীণ চাঁদ নভের আড়ালে যেতে চায় , মাঝখানে দাঁড়ায়ে কিনারা নাহি পায় । বড়ো ম্লান হয়েছে চাঁদের মুখখানি , আপনাতে আপনি মিশাবে অনুমানি । হেরো দেখো কে ওই এসেছে তার কাছে , শুকতারা চাঁদের মুখেতে চেয়ে আছে । মরি মরি কে তুমি একটুখানি প্রাণ , কী না জানি এনেছ করিতে ওরে দান । চেয়ে দেখো আকাশে আর তো কেহ নাই , তারা যত গিয়েছে যে যার নিজ ঠাঁই । সাথীহারা চন্দ্রমা হেরিছে চারি ধার , শূন্য আহা নিশির বাসর-ঘর তার! শরতের প্রভাতে বিমল মুখ নিয়ে তুমি শুধু রয়েছে শিয়রে দাঁড়াইয়ে । ও হয়তো দেখিতে পেলে না মুখ তোর! ও হয়তো তারার খেলার গান গায় , ও হয়তো বিরাগে উদাসী হতে চায়! ও কেবল নিশির হাসির অবশেষ! ও কেবল অতীত সুখের স্মৃতিলেশ! দ্রুতপদে তাহারা কোথায় চলে গেছে — সাথে যেতে পারে নি পিছনে পড় আছে! কত দিন উঠেছ নিশির শেষাশেষি , দেখিয়াছ চাঁদেতে তারাতে মেশামেশি! দুই দণ্ড চাহিয়া আবার চলে যেতে , মুখখানি লুকাতে উষার আঁচলেতে । পুরবের একান্তে একটু দিয়ে দেখা , কী ভাবিয়া তখনি ফিরিতে একা একা । আজ তুমি দেখেছ চাঁদের কেহ নাই , স্নেহময়ি , আপনি এসেছ তুমি তাই! দেহখানি মিলায় মিলায় বুঝি তার! হাসিটুকু রহে না রহে না বুঝি আর! দুই দণ্ড পরে তো রবে না কিছু হায়! কোথা তুমি , কোথায় চাঁদের ক্ষীণকায়! কোলাহল তুলিয়া গরবে আসে দিন , দুটি ছোটো প্রাণের লিখন হবে লীন । সুখশ্রমে মলিন চাঁদের একসনে নবপ্রেম মিলাবে কাহার রবে মনে!    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
গান গাহি বলে কেন অহংকার করা ! শুধু গাহি বলে কেন কাঁদি না শরমে ! খাঁচার পাখির মতো গান গেয়ে মরা , এই কি , মা , আদি অন্ত মানবজনমে ! সুখ নাই , সুখ নাই , শুধু মর্মব্যথা — মরীচিকা – পানে শুধু মরি পিপাসায় । কে দেখালে প্রলোভন , শূন্য অমরতা — প্রাণে ম’রে গানে কি রে বেঁচে থাকা যায় ! কে আছ মলিন হেথা , কে আছ দুর্বল , মোরে তোমাদের মাঝে করো গো আহ্বান — বারেক একত্রে বসে ফেলি অশ্রুজল , দূর করি হীন গর্ব , শূন্য অভিমান তার পরে একসাথে এস কাজ করি কেবলি বিলাপগান দূরে পরিহরি ।।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
তখন বয়স ছিল কাঁচা; কতদিন মনে মনে এঁকেছি নিজের ছবি, বুনো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার, জিন নেই, লাগাম নেই, ছুটেছি ডাকাত-হানা মাঠের মাঝখান দিয়ে ভরসন্ধ্যেবেলায়; ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধুলো ধরণী যেন পিছু ডাকছে আঁচল দুলিয়ে। আকাশে সন্ধ্যার প্রথম তারা দূরে মাঠের সীমানায় দেখা যায় একটিমাত্র ব্যগ্র বিরহী আলো একটি কোন্‌ ঘরে নিদ্রাহীন প্রতীক্ষায়। যে ছিল ভাবীকালে আগে হতে মনের মধ্যে ফিরছিল তারি আবছায়া, যেমন ভাবী আলোর আভাস আসে ভোরের প্রথম কোকিল-ডাকা অন্ধকারে। তখন অনেকখানি সংসার ছিল অজানা, আধ্‌জানা। তাই অপরূপের রাঙা রঙটা মনের দিগন্ত রেখেছিলে রাঙিয়ে; আসন্ন ভালোবাসা এনেছিল অঘটন-ঘটনার স্বপ্ন। তখন ভালোবাসার যে কল্পরূপ ছিল মনে তার সঙ্গে মহাকাব্যযুগের দুঃসাহসের আনন্দ ছিল মিলিত। এখন অনেক খবর পেয়েছি জগতের, মনে ঠাওরেছি সংসারের অনেকটাই মার্কামারা খবরের মালখানা। মনের রসনা থেকে অজানার স্বাদ গেছে মরে, অনুভবে পাইনে ভালোবাসায় সম্ভবের মধ্যে নিয়তই অসম্ভব, জানার মধ্যে অজানা, কথার মধ্যে রূপকথা। ভুলেছি প্রিয়ার মধ্যে আছে সেই নারী, যে থাকে সাত সমুদ্রের পারে, সেই নারী আছে বুঝি মায়ার ঘুমে, যার জন্যে খুঁজতে হবে সোনার কাঠি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বদেশমূলক
কেন     চেয়ে আছ , গো মা , মুখপানে ! এরা     চাহে না তোমারে চাহে না যে , আপন মায়েরে নাহি জানে ! এরা     তোমায় কিছু দেবে না , দেবে না — মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে ! তুমি তো দিতেছ মা , যা আছে তোমারি — স্বর্ণশস্য তব , জাহ্নবীবারি , জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী । এরা কী দেবে তোরে , কিছু না , কিছু না — মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে ! মনের বেদনা রাখো , মা , মনে , নয়নবারি নিবারো নয়নে , মুখ লুকাও , মা , ধূলিশয়নে — ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে । শূন্যপানে চেয়ে প্রহর গণি গণি দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী দুঃখ জানায়ে কী হবে ,   জননী , নির্মম চেতনহীন পাষাণে !   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
সোনায় রাঙায় মাখামাখি, রঙের বাঁধন কে দেয় রাখি পথিক রবির স্বপন ঘিরে। পেরোয় যখন তিমিরনদী তখন সে রঙ মিলায় যদি প্রভাতে পায় আবার ফিরে। অস্ত-উদয়-রথে রথে যাওয়া-আসার পথে পথে দেয় সে অাপন আলো ঢালি। পায় সে ফিরে মেঘের কোণে, পায় ফাগুনের পারুলবনে প্রতিদানের রঙের ডালি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
এ তো সহজ কথা , অঘ্রানে এই স্তব্ধ নীরবতা জড়িয়ে আছে সামনে আমার আমের গাছে ; কিন্তু ওটাই সবার চেয়ে দুর্গম মোর কাছে । বিকেল বেলার রোদ্‌দুরে এই চেয়ে থাকি , যে রহস্য ওই তরুটি রাখল ঢাকি গুঁড়িতে তার ডালে ডালে পাতায় পাতায় কাঁপনলাগা তালে সে কোন্‌ ভাষা আলোর সোহাগ শূন্যে বেড়ায় খুঁজি । মর্ম তাহার স্পষ্ট নাহি বুঝি , তবু যেন অদৃশ্য তার চঞ্চলতা রক্তে জাগায় কানে-কানে কথা , মনের মধ্যে বুলায় যে অঙ্গুলি আভাস-ছোঁওয়া ভাষা তুলি সে এনে দেয় অস্পষ্ট ইঙ্গিত বাক্যের অতীত । ওই যে বাকলখানি রয়েছে ওর পর্দা টানি ওর ভিতরের আড়াল থেকে আকাশ-দূতের সাথে বলা - কওয়া কী হয় দিনে রাতে , পরের মনের স্বপ্নকথার সম পৌঁছবে না কৌতূহলে মম । দুয়ার-দেওয়া যেন বাসরঘরে ফুলশয্যার গোপন রাতে কানাকানি করে , অনুমানেই জানি , আভাসমাত্র না পাই তাহার বাণী । ফাগুন আসে বছরশেষের পারে , দিনে-দিনেই খবর আসে দ্বারে । একটা যেন চাপা হাসি কিসের ছলে অবাক শ্যামলতার তলে শিকড় হতে শাখে শাখে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে । অবশেষে খুশির দুয়ার হঠাৎ যাবে খুলে মুকুলে মুকুলে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
খাল বলে, মোর লাগি মাথা-কোটাকুটি, নদীগুলা আপনি গড়ায়ে আসে ছুটি। তুমি খাল মহারাজ, কহে পারিষদ, তোমারে জোগাতে জল আছে নদীনদ।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
শূন্য পাতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে বাণী, কেমন করে আমি তারে বাইরে ডেকে আনি। যখন থাকি অন্যমনে দেখি তারে হৃদয়কোণে, যখন ডাকি দেয় সে ফাঁকি— পালায় ঘোমটা টানি।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আবার আবার কেন রে আমার সেই ছেলেবেলা আসে নি ফিরে, হরষে কেমন আবার তা হলে, সাঁতারিয়ে ভাসি সাগরের জলে, খেলিয়ে বেড়াই শিখরী শিরে! স্বাধীন হৃদয়ে ভালো নাহি লাগে, ঘোরঘটাময় সমাজধারা, না, না, আমি রে যাব সেই স্থানে, ভীষণ ভূধর বিরাজে যেখানে, তরঙ্গ মাতিছে পাগল পারা! অয়ি লক্ষ্মী, তুমি লহো লহো ফিরে, ধন ধান্য তুমি যাদেছ মোরে, জাঁকালো উপাধি নাহি আমি চাই, ক্রীতদাসে মম কোনো সুখ নাই, সেবকের দল যাক-না সোরে! তুলে দাও মোরে সেই শৈল-‘পরে, গরজি ওঠে যা সাগর-নাদে, অন্য সাধ নাই, এই মাত্র চাই, ভ্রমিব সেথায় স্বাধীন হৃদে! অধিক বয়স হয় নে তো মম, এখনি বুঝিতে পেরেছি হায়, এ ধরা নহে তো আমার কারণে, আর মম সুখ নাহি এ জীবনে, কবে রে এড়াব এ দেহ দায়! একদা স্বপনে হেরেছিনু আমি, সুবিমল এক সুখের স্থান, কেন রে আমার সে ঘুম ভাঙিল কেন রে আমার নয়ন মেলিল, দেখিতে নীরস এ ধরা খান! এক কালে আমি বেসেছিনু ভালো, ভালোবাসা-ধন কোথায় এবে, বাল্যসখা সব কোথায় এখন– হায় কী বিষাদে ডুবেছে এ মন, আশারও আলোক গিয়েছে নিবে! অমোদ-আসরে আমোদ-সাথীরা, মাতায় ক্ষণেক আমোদ রসে, কিন্তু এ হৃদয়, আমোদের নয়, বিরলে কাঁদি যে একেলা বসে! উঃ কী কঠোর, বিষম কঠোর, সেই সকলের আমোদ-রব, শত্রু কিম্বা সখা নহে যারা মনে, অথচ পদ বা বিভব কারণে, দাও ফিরে মোরে সেই সখাগুলি, বয়সে হৃদয়ে সমান যারা, এখনি যে আমি ত্যেজিব তা হলে, গভীর নিশীথ-আমোদীর দলে, হৃদয়ের ধার কি ধারে তারা! সর্বস্ব রতন, প্রিয়তমা ওরে, তোরেও সুধাই একটি কথা, বল দেখি কিসে আর মম সুখ, হেরিয়েও যবে তোর হাসি-মুখ, কমে না হৃদয়ে একটি ব্যথা! যাক তবে সব, দুঃখ নাহি তায়, শোকের সমাজ নাহিকো চাই, গভীর বিজনে মনের বিরাগে, স্বাধীন হৃদয়ে ভালো যাহা লাগে, সুখে উপভোগ করিব তাই! মানব-মন্ডলী ছেড়ে যাব যাব, বিরাগে কেবল, ঘৃণাতে নয়, অন্ধকারময় নিবিড় কাননে, থাকিব তবুও নিশ্চিন্ত মনে, আমারও হৃদয় আঁধারময়! কেন রে কেন রে হল না আমার, কপোতের মতো বায়ুর পাখা, তা হলে ত্যেজিয়ে মানব-সমাজ, গগনের ছাদ ভেদ করি আজ, থাকিতাম সুখে জলদে ঢাকা!George Gordon Byron (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
ক্লান্ত মোর লেখনীর এই শেষ আশা— নীরবের ধ্যানে তার ডুবে যাবে ভাষা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
পাবনায় বাড়ি হবে, গাড়ি গাড়ি ইঁট কিনি, রাঁধুনিমহল-তরে করোগেট-শীট্‌ কিনি। ধার ক’রে মিস্ত্রির সিকি বিল চুকিয়েছি, পাওনাদারের ভয়ে দিনরাত লুকিয়েছি, শেষে দেখি জানলায় লাগে নাকো ছিট্‌কিনি। দিনরাত দুড়্‌দাড়্‌ কী বিষম শব্দ যে, তিনটে পাড়ার লোক হয়ে গেল জব্দ যে, ঘরের মানুষ করে খিট্‌ খিট্‌ খিট্‌কিনি।কী করি না ভেবে পেয়ে মথুরায় দিনু পাড়ি, বাজে খরচের ভয়ে আরেকটা পাকাবাড়ি বানাবার মতলবে পোড়ো এক ভিট কিনি। তিনতলা ইমারত শোভা পায় নবাবেরই, সিঁড়িটা রইল বাকি চিহ্ন সে অভাবেরই, তাই নিয়ে গৃহিণীর কী যে নাক-সিট্‌কিনি।শান্তিনিকেতন, ৫ বৈশাখ, ১৩৪৪ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
কাল আমি তরী খুলি লোকালয়মাঝে আবার ফিরিয়া যাব আপনার কাজে— হে অন্তর্যামিনী দেবী, ছেড়ো না আমারে, যেয়ো না একেলা ফেলি জনতাপাথারে কর্মকোলাহলে। সেথা সর্ব ঝঞ্ঝনায় নিত্য যেন বাজে চিত্তে তোমার বীণায় এমনি মঙ্গলধ্বনি। বিদ্বেষের বাণে বক্ষ বিদ্ধ করি যবে রক্ত টেনে আনে, তোমার সান্ত্বনাসুধা অশ্রুবারিসম পড়ে যেন বিন্দু বিন্দু ক্ষতপ্রাণে মম। বিরোধ উঠিবে গর্জি শতফণা ফণী, তুমি মৃদুস্বরে দিয়ো শান্তিমন্ত্রধ্বনি— স্বার্থ মিথ্যা, সব মিথ্যা—বোলো কানে কানে— আমি শুধু নিত্য সত্য তোর মাঝখানে।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা-- কাহারে কাঁদিয়া বলে, 'যেয়ো না, যেয়ো না!' কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা, কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা! কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা, গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক-অক্ষরে । পরশে বহিয়া আনে মরমবারতা, মোহ মেখে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে । কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা দুইটি আঙুলে ধরি তুলি দেয় গলে । দুটি বাহু বহি আনে হৃদয়ের ডালা, রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে । লতায়ে থাকুক বুকে চির-আলিঙ্গন, ছিঁড়ো না, ছিঁড় না দুটি বাহুর বন্ধন ।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
মুহুর্ত মিলায়ে যায় তবু ইচ্ছা করে— আপন স্বাক্ষর রবে যুগে যুগান্তরে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
হেসো না, হেসো না তুমি বুদ্ধি-অভিমানী! একবার মনে আনো ওগো ভেদজ্ঞানী, সে মহাদিনের কথা, যবে শকুন্তলা বিদায় লইতেছিল স্বজনবৎসলা জন্মতপোবন হতে—সখা সহকার, লতাভগ্নী মাধবিকা, পশুপরিবার, মাতৃহারা মৃগশিশু, মৃগী গর্ভবতী, দাঁড়াইল চারি দিকে; স্নেহের মিনতি গুঞ্জরি উঠিল কাঁদি পল্লবমর্মরে, ছলছল মালিনীর জলকলস্বরে; ধ্বনিল তাহারি মাঝে বৃদ্ধ তপস্বীর মঙ্গলবিদায়মন্ত্র গদ্‌গদগম্ভীর। তরুলতা পশুপক্ষীনদনদীবন নরনারী সবে মিলি করুণ মিলন।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
নির্মল তরুণ উষা, শীতল সমীর, শিহরি শিহরি উঠে শান্ত নদীনীর। এখনো নামে নি জলে রাজহাঁসগুলি, এখনো ছাড়ে নি নৌকা সাদা পাল তুলি। এখনো গ্রামের বধূ আসে নাই ঘাটে, চাষি নাহি চলে পথে, গোরু নাই মাঠে। আমি শুধু একা বসি মুক্ত বাতায়নে তপ্ত ভাল পাতিয়াছি উদার গগনে। বাতাস সোহাগস্পর্শ বুলাইছে কেশে, প্রসন্ন কিরণখানি মুখে পড়ে এসে। পাখির আনন্দগান দশ দিক হতে দুলাইছে নীলাকাশ অমৃতের স্রোতে। ধন্য আমি হেরিতেছি আকাশের আলো, ধন্য আমি জগতেরে বাসিয়াছি ভালো।(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
বরের বাপের বাড়ি যেতেছে বৈবাহিক, সাথে সাথে ভাঁড় হাতে চলেছে দই-বাহিক। পণ দেবে কত টাকা লেখাপড়া হবে পাকা, দলিলের খাতা নিয়ে এসেছে সই-বাহিক।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
শ্রীযুক্ত রাজশেখর বসুসহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে। লেখার কথা মাথায় যদি জোটে তখন আমি লিখতে পারি হয়তো। কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে, যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো। যদি দেখ খোলসটা খসিয়াছে বৃদ্ধের, যদি দেখ চপলতা প্রলাপেতে সফলতা ফলেছে জীবনে সেই ছেলেমিতে-সিদ্ধের, যদি ধরা পড়ে সে যে নয় ঐকান্তিক ঘোর বৈদান্তিক, দেখ গম্ভীরতায় নয় অতলান্তিক, যদি দেখ কথা তার কোনো মানে-মোদ্দার হয়তো ধারে না ধার, মাথা উদ্‌ভ্রান্তিক, মনখানা পৌঁছয় খ্যাপামির প্রান্তিক, তবে তার শিক্ষার দাও যদি ধিক্কার– সুধাব, বিধির মুখ চারিটা কী কারণে। একটাতে দর্শন করে বাণী বর্ষণ, একটা ধ্বনিত হয় বেদ-উচ্চারণে। একটাতে কবিতা রসে হয় দ্রবিতা, কাজে লাগে মনটারে উচাটনে মারণে। নিশ্চিত জেনো তবে, একটাতে হো হো রবে পাগলামি বেড়া ভেঙে উঠে উচ্ছ্বাসিয়া। তাই তারি ধাক্কায় বাজে কথা পাক খায়, আওড় পাকাতে থাকে মগজেতে আসিয়া। চতুর্মুখের চেলা কবিটিরে বলিলে তোমরা যতই হাস, রবে সেটা দলিলে। দেখাবে সৃষ্টি নিয়ে খেলে বটে কল্পনা, অনাসৃষ্টিতে তবু ঝোঁকটাও অল্প না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরশান্তিনিকেতন, ৩ ভাদ্র, ১৩৪৩ (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
আলো আসে দিনে দিনে, রাত্রি নিয়ে আসে অন্ধকার। মরণসাগরে মিলে সাদা কালো গঙ্গাযমুনার।  (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
ঊর্মি, তুমি চঞ্চলা নৃত্যদোলায় দাও দোলা, বাতাস আসে কী উচ্ছ্বাসে— তরণী হয় পথভোলা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
কো তুঁহুঁ বোলবি মোয় । হৃদয়মাহ মঝু জাগসি অনুখন, আঁখউপর তুঁহুঁ রচলহি আসন।। অরুণ নয়ন তব মরমসঙে মম নিমিখ ন অন্তর হোয়।।হৃদয়কমল তব চরণে টলমল, নয়নযুগল মম উছলে ছলছল-- প্রেমপূর্ণ তনু পুলকে ঢলঢল চাহে মিলাইতে তোয়।।বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয়গরল রে, হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে, আকুল কাকলি ভুবন ভরল রে-- উতল প্রাণ উতরোয়।।হেরি হাসি তব মধুঋতু ধাওল, শুনয়ি বাঁশি তব পিককুল গাওল, বিকল ভ্রমরসম ত্রিভুবন আওল-- চরণকমলযুগ ছোঁয়।।গোপবধূজন বিকশিতযৌবন, পুলকিত যমুনা, মুকুলিত উপবন-- নীলনীর'পরে ধীর সমীরণ পলকে প্রাণমন খোয়।।তৃষিত আঁখি তব মুখ'পর বিহরই, মধুর পরশ তব রাধা শিহরই-- প্রেমরতন ভরি হৃদয় প্রাণ লই পদতলে আপনা থোয়।।কো তুঁহুঁ কো তুঁহুঁ সব জন পুছয়ি অনুদিন সঘন নয়নজল মুছয়ি-- যাচে ভানু, সব সংশয় ঘুচয়ি জনম চরণ'পর গোয়।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
যখন দিনের শেষে চেয়ে দেখি সমুখপানে সূর্য ডোবার দেশে মনের মধ্যে ভাবি অস্তসাগর-তলায় গেছে নাবি অনেক সূর্য-ডোবার সঙ্গে অনেক আনাগোনা, অনেক দেখাশোনা, অনেক কীর্তি, অনেক মূর্তি, অনেক দেবালয়, শক্তিমানের অনেক পরিচয়। তাদের হারিয়ে-যাওয়ার ব্যাথায় টান লাগে না মনে, কিন্তু যখন চেয়ে দেখি সামনে সবুজ বনে ছায়ায় চরছে গোরু, মাঝ দিয়ে তার পথ গিয়েছে সরু, ছেয়ে আছে শুক্‌নো বাঁশের পাতায়, হাট করতে চলে মেয়ে ঘাসের আঁঠি মাথায়, তখন মনে হঠাৎ এসে এই বেদনাই বাজে-- ঠাঁই রবে না কোনোকালেই ঐ যা-কিছুর মাঝে। ঐ যা-কিছুর ছবির ছায়া দুলেছে কোন্‌কালে শিশুর-চিত্ত-নাচিয়ে-তোলা ছড়াগুলির তালে-- তিরপূর্নির চরে বালি ঝুর্‌ঝুর্‌ করে, কোন্‌ মেয়ে সে চিকন-চিকন চুল দিচ্ছে ঝাড়ি, পরনে তার ঘুরে-পড়া ডুরে একটি শাড়ি। ঐ যা-কিছু ছবির আভাস দেখি সাঁঝের মুখে মর্ত্যধরার পিছু-ডাকা দোলা লাগায় বুকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বদেশমূলক
হে ধরণী , জীবের জননী , শুনেছি যে মা তোমায় বলে , তবে কেন তোর কোলে সবে কেঁদে আসে , কেঁদে যায় চলে । তবে কেন তোর কোলে এসে সন্তানের মেটে না পিয়াসা । কেন চায় , কেন কাঁদে সবে , কেন কেঁদে পায় না ভালোবাসা । কেন হেথা পাষাণ - পরান , কেন সবে নীরস নিষ্ঠুর , কেঁদে কেঁদে দুয়ারে যে আসে কেন তারে করে দেয় দূর । কাঁদিয়া যে ফিরে চলে যায় তার তরে কাঁদিস নে কেহ , এই কি মা , জননীর প্রাণ , এই কি মা , জননীর স্নেহ !    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
নিশীথে রয়েছি জেগে ; দেখি অনিমেখে , লক্ষ হৃদয়ে সাধ শূন্যে উড়ে যায় । কত দিক হতে তারা ধায় কত দিকে ! কত – না অদৃশ্যকায়া ছায়া – আলিঙ্গন বিশ্বময় কারে চাহে , করে হায় – হায় । কত স্মৃতি খুঁজিতেছে শ্মশানশয়ন — অন্ধকারে হেরো শত তৃষিত নয়ন ছায়াময় পাখি হয়ে কার পানে ধায় । ক্ষীণশ্বাস – মুমূর্ষুর অতৃপ্ত বাসনা ধরণীর কূলে কূলে ঘুরিয়া বেড়ায় । উদ্দেশে ঝরিছে কত অশ্রুবারিকণা , চরণ খুঁজিয়া তারা মরিবারে চায় । কে শুনিছে শত কোটি হৃদয়ের ডাক ! নিশীথিনী স্তব্ধ হয়ে রয়েছে অবাক ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এল বেলা পাতা ঝরাবারে; শীর্ণ বলিত কায়া, আজ শুধু ভাঙা ছায়া মেলে দিতে পারে। একদিন ডাল ছিল ফুলে ফুলে ভরা নানা-রঙ-করা। কুঁড়ি ধরা ফলে কার যেন কী কৌতূহলে উঁকি মেরে আসা খুঁজে নিতে আপনার বাসা। ঋতুতে ঋতুতে আকাশের উৎসবদূতে এনে দিত পল্লবপল্লীতে তার কখনো পা টিপে চলা হালকা হাওয়ার, কখনো-বা ফাল্গুনের অস্থির এলোমেলো চাল জোগাইত নাচনের তাল। জীবনের রস আজ মজ্জায় বহে, বাহিরে প্রকাশ তার নহে। অন্তরবিধাতার সৃষ্টিনির্দেশে যে অতীত পরিচিত সে নূতন বেশে সাজবদলের কাজে ভিতরে লুকালো-- বাহিরে নিবিল দীপ, অন্তরে দেখা যায় আলো। গোধূলির ধূসরতা ক্রমে সন্ধ্যার প্রাঙ্গণে ঘনায় আঁধার। মাঝে-মাঝে জেগে ওঠে তারা, আজ চিনে নিতে হবে তাদের ইশারা। সমুখে অজানা পথ ইঙ্গিত মেলে দেয় দূরে, সেথা যাত্রার কালে যাত্রীর পাত্রটি পুরে সদয় অতীত কিছু সঞ্চয় দান করে তারে পিপাসার গ্লানি মিটাবারে। যত বেড়ে ওঠে রাতি। সত্য যা সেদিনের উজ্জ্বল হয় তার ভাতি। এই কথা ধ্রুব জেনে, নিভৃতে লুকায়ে সারা জীবনের ঋণ একে একে দিতেছি চুকায়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ইঁটের গাদার নিচে ফটকের ঘড়িটা। ভাঙা দেয়ালের গায়ে হেলে-পড়া কড়িটা। পাঁচিলটা নেই, আছে কিছু ইঁট সুরকি। নেই দই সন্দেশ, আছে খই মুড়কি। ফাটা হুঁকো আছে হাতে, গেছে গড়গড়িটা। গলায় দেবার মতো বাকি আছে দড়িটা।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
ভক্তি আসে রিক্তহস্ত প্রসন্নবদন— অতিভক্তি বলে, দেখি কী পাইলে ধন। ভক্তি কয়, মনে পাই, না পারি দেখাতে।— অতিভক্তি কয়, আমি পাই হাতে হাতে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
যুগে যুগে জলে রৌদ্রে বায়ুতে গিরি হয়ে যায় ঢিবি। মরণে মরণে নুতন আয়ুতে তৃণ রহে চিরজীবী।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
হৃদয় পাষাণভেদী নির্ঝরের প্রায়, জড়জন্তু সবাপানে নামিবারে চায়। মাঝে মাঝে ভেদচিহ্ন আছে যত যার সে চাহে করিতে মগ্ন লুপ্ত একাকার। মধ্যদিনে দগ্ধদেহে ঝাঁপ দিয়ে নীরে মা ব’লে সে ডেকে ওঠে স্নিগ্ধ তটিনীরে। যে চাঁদ ঘরের মাঝে হেসে দেয় উঁকি সে যেন ঘরেরই মেয়ে শিশু সুধামুখী। যে-সকল তরুলতা রচি উপবন গৃহপার্শ্বে বাড়িয়াছে, তারা ভাইবোন। যে পশুরে জন্ম হতে আপনার জানি, হৃদয় আপনি তারে ডাকে ‘পুঁটুরানী’। বুদ্ধি শুনে হেসে ওঠে, বলে—কী মূঢ়তা! হৃদয় লজ্জায় ঢাকে হৃদয়ের কথা।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ আমার গর্জনে বলে মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে, মাথায় পড়িলে তবে বলে—বজ্র বটে!   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
সে তো সেদিনের কথা বাক্যহীন যবে এসেছিনু প্রবাসীর মতো এই ভবে বিনা কোন পরিচয়, রিক্ত শূন্য হাতে, একমাত্র ক্রন্দন সম্বল লয়ে সাথে। আজ সেথা কী করিয়া মানুষের প্রীতি কণ্ঠ হতে টানি লয় যত মোর গীতি। এ ভুবনে মোর চিত্তে অতি অল্প স্থান নিয়েছ ভুবননাথ! সমস্ত এ প্রাণ সংসারে করেছ পূর্ণ। পাদপ্রান্তে তব প্রত্যহ যে ছন্দে-বাঁধা গীত নব নব দিতেছি অঞ্জলী তাও তব পূজাশেষে লবে সবে তোমা-সাথে মোরে ভালোবেসে, এই আশাখানি মনে আছে অবিচ্ছেদে। যে প্রবাসে রাখো সেথা প্রেমে রাখো বেঁধে। নব নব প্রবাসেতে নব নব লোকে বাধিবে এমনি প্রেমে। প্রেমের আলোকে বিকিশিত হব আমি ভুবনে ভুবনে নব নব পুস্পদলে। প্রেম-আকর্ষণে যত গূঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে, বাহিরে আসিবে ছুটি - অন্তহীন প্রাণে নিখিল জগতে তব প্রেমের আহবানে নব নব জীবনে গন্ধ যাব রেখে, নব নব বিকাশের গন্ধ যাব এঁকে। কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ অমরতাকূপে এক ধরাতল-মাঝে শুধু এক রূপে বাঁচিয়া থাকিতে! নব নব মৃত্যুপথে তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
নিষ্ফল হয়েছি আমি সংসারের কাজে, লোকমাঝে আঁখি তুলে পারি না চাহিতে। ভাসায়ে জীবনতরী সাগরের মাঝে তরঙ্গ লঙ্ঘন করি পারি না বাহিতে। পুরুষের মতো যত মানবের সাথে যোগ দিতে পারি নাকো লয়ে নিজ বল, সহস্র সংকল্প শুধু ভরা দুই হাতে বিফলে শুকায় যেন লক্ষ্মণের ফল। আমি গাঁথি আপনার চারি দিক ঘিরে সূক্ষ্ম রেশমের জাল কীটের মতন। মগ্ন থাকি আপনার মধুর তিমিরে, দেখি না এ জগতের প্রকাণ্ড জীবন। কেন আমি আপনার অন্তরালে থাকি! মুদ্রিত পাতার মাঝে কাঁদে অন্ধ আঁখি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানবতাবাদী
ওরে তুই জগৎ-ফুলের কীট, জগৎ যে তোর শুকায়ে আসিল, মাটিতে পড়িল খসে-- সারা দিন রাত গুমরি গুমরি কেবলি আছিস বসে। মড়কের কণা,নিজ হাতে তুই রচিলি নিজের কারা, আপনার জালে জড়ায়ে পড়িয়া আপনি হইলি হারা। অবশেষে কারে অভিশাপ দিস হাহুতাশ করে সারা, কোণে বসে শুধু ফেলিস নিশাস, ঢালিস বিষের ধারা।জগৎ যে তোর মুদিয়া আসিল, ফুটিতে নারিল আর, প্রভাত হইলে প্রাণের মাঝারে ঝরে না শিশিরধার। ফেলিস নিশাস, মরুর বাতাস জ্বলিস জ্বালাস কত, আপন জগতে আপনি আছিস একটি রোগের মতো। হৃদয়ের ভার বহিতে পার না, আছ মাথা নত করে-- ফুটিবে না ফুল, ফলিবে না ফল, শুকায়ে পড়িবে মরে।রোদন,রোদন, কেবলি রোদন, কেবলি বিষাদশ্বাস-- লুকায়ে, শুকায়ে, শরীর গুটায়ে কেবলি কোটরে বাস। নাই কোনো কাজ--মাঝে মাঝে চাস মলিন আপনা-পানে, আপনার স্নেহে কাতর বচন কহিস আপন কানে। দিবস রজনী মরীচিকাসুরা কেবলি করিস পান। বাড়িতেছে তৃষা, বিকারের তৃষা-- ছট্‌ফট্‌ করে প্রাণ। ‘দাও দাও’ ব’লে সকলি যে চাস, জঠর জ্বলিছে ভুখে-- মুঠি মুঠি ধুলা তুলিয়া লইয়া কেবলি পুরিস মুখে। নিজের নিশাসে কুয়াশা ঘনায়ে ঢেকেছে নিজের কায়া, পথ আঁধারিয়া পড়েছে সমুখে নিজের দেহের ছায়া। ছায়ার মাঝারে দেখিতে না পাও, শব্দ শুনিলে ডর’-- বাহু প্রসারিয়া চলিতে চলিতে, নিজেরে আঁকড়ি ধর’। চারি দিকে শুধু ক্ষুধা ছড়াইছে যে দিকে পড়িছে দিঠ, বিষেতে ভরিলি জগৎ রে তুই কীটের অধম কীট।আজিকে বারেক ভ্রমরের মতো বাহির হইয়া আয়, এমন প্রভাতে এমন কুসুম কেন রে শুকায়ে যায়। বাহিরে আসিয়া উপরে বসিয়া কেবলি গাহিবি গান, তবে সে কুসুম কহিবে রে কথা, তবে সে খুলিবে প্রাণ। আকাশে হাসিবে তরুণ তপন, কাননে ছুটিবে বায়, চারি দিকে তোর প্রাণের লহরী উথলি উথলি যায়। বায়ুর হিল্লোলে ধরিবে পল্লব মরমর মৃদু তান, চারি দিক হতে কিসের উল্লাসে পাখিতে গাহিবে গান। নদীতে উঠিবে শত শত ঢেউ, গাবে তারা কল কল, আকাশে আকাশে উথলিবে শুধু হরষের কোলাহল। কোথাও বা হাসি কোথাও বা খেলা কোথাও বা সুখগান-- মাঝে বসে তুই বিভোর হইয়া, আকুল পরানে নয়ান মুদিয়া অচেতন সুখে চেতনা হারায়ে করিবি রে মধুপান। ভুলে যাবি ওরে আপনারে তুই ভুলে যাবি তোর গান। মোহ ছুটিবে রে নয়নেতে তোর, যে দিকে চাহিবি হয়ে যাবে ভোর, যাহারে হেরিবি তাহারে হেরিয়া মজিয়া রহিবে প্রাণ। ঘুমের ঘোরেতে গাহিবে পাখি এখনো যে পাখি জাগে নি, ভোরের আকাশ ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিবে বিভাসরাগিণী। জগৎ-অতীত আকাশ হইতে বাজিয়া উঠিবে বাঁশি, প্রাণের বাসনা আকুল হইয়া কোথায় যাইবে ভাসি। উদাসিনী আশা গৃহ তেয়াগিয়া অসীম পথের পথিক হইয়া সুদূর হইতে সুদূরে উঠিয়া আকুল হইয়া চায়, যেমন বিভোর চকোরের গান ভেদিয়া ভেদিয়া সুদূর বিমান চাঁদের মরণে মরিতে গিয়া মেঘেতে হারায়ে যায়। মুদিত নয়ান, পরান বিভল, স্তব্ধ হইয়া শুনিবি কেবল, জগতেরে সদা ডুবায়ে দিতেছে জগৎ-অতীত গান-- তাই শুনি যেন জাগিতে চাহিছে ঘুমেতে-মগন প্রাণ। জগৎ বাহিরে যমুনাপুলিনে কে যেন বাজায় বাঁশি, স্বপন-সমান পশিতেছে কানে ভেদিয়া নিশীথরাশি--এ গান শুনি নি,এ আলো দেখি নি, এ মধু করিনি পান, এমন বাতাস পরান পুরিয়া করে নি রে সুধা দান, এমন প্রভাত-কিরণ মাঝার কখনো করি নি স্নান, বিফলে জগতে লভিনু জনম, বিফলে কাটিল প্রাণ। দেখ্‌ রে সবাই চলেছে বাহিরে সবাই চলিয়া যায়, পথিকেরা সবে হাতে হাতে ধরি শোন্‌ রে কী গান গায়। জগৎ ব্যাপিয়া শোন্‌ রে সবাই ডাকিতেছে, আয়,আয়-- কেহ বা আগেতে কেহ বা পিছায়ে, কেহ ডাক শুনে ধায়।অসীম আকাশে স্বাধীন পরানে প্রাণের আবেগে ছোটে, এ শোভা দেখিলে জড়ের শরীরে পরান নাচিয়া ওঠে। তুই শুধু ওরে ভিতরে বসিয়া গুমরি মরিতে চাস! তুই শুধু ওরে করিস রোদন, ফেলিস দুখের শ্বাস! ভূমিতে পড়িয়া আঁধারে বসিয়া আপনা লইয়া রত আপনারে সদা কোলেতে তুলিয়া সোহাগ করিস কত! আর কতদিন কাটিবে এমন, সময় যে চলে যায়। ওই শোন্‌ ওই ডাকিছে সবাই, বাহির হইয়া আয়!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা। যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে, যে নদী মরুপথে হারালো ধারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা। জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে, জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে। আমার অনাগত আমার অনাহত তোমার বীণা-তারে বাজিছে তারা– জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাস্যরসাত্মক
ঘাসে আছে ভিটামিন, গোরু ভেড়া অশ্ব ঘাস খেয়ে বেঁচে আছে, আঁখি মেলে পশ্য। অনুকূল বাবু বলে, “ঘাস খাওয়া ধরা চাই, কিছুদিন জঠরেতে অভ্যেস করা চাই– বৃথাই খরচ ক’রে চাষ করা শস্য। গৃহিণী দোহাই পাড়ে মাঠে যবে চরে সে, ঠেলা মেরে চলে যায় পায়ে যবে ধরে সে– মানবহিতের ঝোঁকে কথা শোনে কস্য; দুদিনে না যেতে যেতে মারা গেল লোকটা, বিজ্ঞানে বিঁধে আছে এই মহা শোকটা, বাঁচলে প্রমাণ-শেষ হ’ত যে অবশ্য।   (খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
ছোটো কথা, ছোটো গীত, আজি মনে আসে। চোখে পড়ে যাহা-কিছু হেরি চারি পাশে। আমি যেন চলিয়াছি বাহিয়া তরণী, কূলে কূলে দেখা যায় শ্যামল ধরণী। সবই বলে, “যাই যাই” নিমেষে নিমেষে, ক্ষণকাল দেখি ব’লে দেখি ভালোবেসে। তীর হতে দুঃখ সুখ দুই ভাইবোনে মোর মুখপানে চায় করুণ নয়নে। ছায়াময় গ্রামগুলি দেখা যায় তীরে, মনে ভাবি কত প্রেম আছে তারে ঘিরে। যবে চেয়ে চেয়ে দেখি উৎসুক নয়ানে আমার পরান হতে ধরার পরানে— ভালোমন্দ দুঃখসুখ অন্ধকার-আলো, মনে হয়, সব নিয়ে এ ধরণী ভালো।   (চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
ওই যে তরী দিল খুলে। তোর বোঝা কে নেবে তুলে। সামনে যখন যাবি ওরে থাক্‌ না পিছন পিছে পড়ে, পিঠে তারে বইতে গেলি, একলা পড়ে রইলি কূলে।ঘরের বোঝা টেনে টেনে। পারের ঘাটে রাখলি এনে, তাই যে তোরে বারে বারে ফিরতে হল গেলি ভুলে। ডাক রে আবার মাঝিরে ডাক, বোঝা তোমার যাক ভেসে যাক, জীবনখানি উজাড় করে সঁপে দে তার চরণমূলে।তিনধরিয়া, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
ওই   যে রাতের তারা জানিস কি , মা , কারা ? সারাটিখন ঘুম না জানে চেয়ে থাকে মাটির পানে যেন কেমনধারা! আমার যেমন নেইকো ডানা , আকাশ - পানে উড়তে মানা , মনটা কেমন করে , তেমনি ওদের পা নেই বলে পারে না যে আসতে চলে এই পৃথিবীর ‘পরে । সকালে যে নদীর বাঁকে জল নিতে যাস কলসী কাঁখে সজনেতলার ঘাটে , সেথায় ওদের আকাশ থেকে আপন ছায়া দেখে দেখে সারা পহর কাটে । ভাবে ওরা চেয়ে চেয়ে ' হতেম যদি গাঁয়ের মেয়ে তবে সকাল - সাঁজে কলসিখানি ধরে বুকে সাঁতরে নিতেম মনের সুখে ভরা নদীর মাঝে ' । আর আমাদের ছাতের কোণে তাকায় , যেথা গভীর বনে রাক্ষসদের ঘরে রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে , সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তাকে জাগাই শয্যা‘পরে । ভাবে ওরা , আকাশ ফেলে হত যদি তোমার ছেলে , এইখানে এই ছাতে দিন কাটাত খেলায় খেলায় তার পরে সেই রাতের বেলায় ঘুমোত তোর সাথে । যেদিন আমি নিষুত রাতে হঠাৎ উঠি বিছানাতে স্বপন থেকে জেগে জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে তারাগুলি আকাশ ছেয়ে ঝাপসা আছে মেঘে । বসে বসে ক্ষণে ক্ষণে সেদিন আমার হয় যে মনে ওদের স্বপ্ন বলে । অন্ধকারের ঘুম লাগে যেই ওরা আসে সেই পহরেই , ভোরবেলা যায় চলে । আঁধার রাতি অন্ধ ও যে , দেখতে না পায় , আলো খোঁজে , সবই হারিয়ে ফেলে । তাই আকাশে মাদুর পেতে সমস্তখন স্বপনেতে দেখা - দেখা খেলে । (শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনেট
যা দিয়েছ আমার এ প্রাণ ভরি খেদ রবে না এখন যদি মরি। রজনীদিন কত দুঃখে সুখে কত যে সুর বেজেছে এই বুকে, কত বেশে আমার ঘরে ঢুকে কত রূপে নিয়েছ মন হরি, খেদ রবে না এখন যদি মরি। জানি তোমায় নিই নি প্রাণে বরি, পাই নি আমার সকল পূর্ণ কবে। যা পেয়েছি ভাগ্য বলে মানি, দিয়েছ তো তব পরশখানি, আছ তুমি এই জানা তো জানি– যাব ধরি সেই ভরসার তরী। খেদ রবে না এখন যদি মরি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
ফুল কোথা থাকে গোপনে, গন্ধ তাহারে প্রকাশে। প্রাণ ঢাকা থাকে স্বপনে, গান যে তাহারে প্রকাশে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপক
রাজসভাতে ছিল জ্ঞানী , ছিল অনেক গুণী । কবির মুখে কাব্যকথা শুনি ভাঙল দ্বিধার বাঁধ , সমস্বরে জাগল সাধুবাদ । উষ্ণীষেতে জড়িয়ে দিল মণিমালার মান , স্বয়ং রাজার দান । রাজধানীময় যশের বন্যাবেগে নাম উঠল জেগে । দিন ফুরাল । খ্যাতিক্লান্ত মনে যেতে যেতে পথের ধারে দেখল বাতায়নে , তরুণী সে , ললাটে তার কুঙ্কুমেরি ফোঁটা , অলকেতে সদ্য অশোক ফোটা । সামনে পদ্মপাতা , মাঝখানে তার চাঁপার মালা গাঁথা , সন্ধেবেলার বাতাস গন্ধে ভরে । নিশ্বাসিয়া বললে কবি , এই মালাটি নয় তো আমার তরে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
তুমি যে কাজ করছ, আমায় সেই কাজে কি লাগাবে না। কাজের দিনে আমায় তুমি আপন হাতে জাগাবে না? ভালোমন্দ ওঠাপড়ায় বিশ্বশালার ভাঙাগড়ায় তোমার পাশে দাঁড়িয়ে যেন তোমার সাথে হয় গো চেনা।ভেবেছিলেম বিজন ছায়ায় নাই যেখানে আনাগোনা, সন্ধ্যাবেলায় তোমায় আমায় সেথায় হবে জানাশোনা। অন্ধকারে একা একা সে দেখা যে স্বপ্ন দেখা, ডাকো তোমার হাটের মাঝে চলছে যেথায় বেচাকেনা।৬ আষাঢ়, ১৩১৭ (গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছড়া
খোকা মাকে শুধায় ডেকে — ‘ এলেম আমি কোথা থেকে , কোন্‌খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে । ' মা শুনে কয় হেসে কেঁদে খোকারে তার বুকে বেঁধে — ‘ ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে । ছিলি আমার পুতুল - খেলায় , প্রভাতে শিবপূজার বেলায় তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি । তুই আমার ঠাকুরের সনে ছিলি পূজার সিংহাসনে , তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি । আমার চিরকালের আশায় , আমার সকল ভালোবাসায় , আমার মায়ের দিদিমায়ের পরানে — পুরানো এই মোদের ঘরে গৃহদেবীর কোলের ‘পরে যে লুকিয়ে ছিলি কে জানে । যৌবনেতে যখন হিয়া উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া , তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে , আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে । সব দেবতার আদরের ধন নিত্যকালের তুই পুরাতন , তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সী — তুই জগতের স্বপ্ন হতে এসেছিস আনন্দ - স্রোতে নূতন হয়ে আমার বুকে বিলসি । নির্নিমেষে তোমায় হেরে তোর রহস্য বুঝি নে রে , সবার ছিলি আমার হলি কেমনে । ওই দেহে এই দেহ চুমি মায়ের খোকা হয়ে তুমি মধুর হেসে দেখা দিলে ভুবনে । হারাই হারাই ভয়ে গো তাই বুকে চেপে রাখতে যে চাই , কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে । জানি না কোন্‌ মায়ায় ফেঁদে বিশ্বের ধন রাখব বেঁধে আমার এ ক্ষীণ বাহু দুটির আড়ালে । '(শিশু কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
বাদরবরখন নীরদগরজন বিজুলী চমকন ঘোর , উপেখই কৈছে আও তু কুঞ্জে নিতি নিতি , মাধব মোর । ঘন ঘন চপলা চমকয় যব পহু , বজরপাত যব হোয় , তুঁহুক বাত তব সমরয়ি প্রিয়তম , ডর অতি লাগত মোয় । অঙ্গবসন তব ভীঁখত মাধব , ঘন ঘন বরখত মেহ — ক্ষুদ্র বালি হম , হমকো লাগয় কাহ উপেখবি দেহ ? বইস বইস পহু , কুসুমশয়ন'পর পদযুগ দেহ পসারি — সিক্ত চরণ তব মোছব যতনে — কুন্তলভার উঘারি । শ্রান্ত অঙ্গ তব হে ব্রজসুন্দর , রাখ বক্ষ -' পর মোর , তনু তব ঘেরব পুলকিত পরশে বাহুমৃণালক ডোর । ভানু কহে বৃকভানুনন্দিনী , প্রেমসিন্ধু মম কালা , তোঁহার লাগয় , প্রেমক লাগয় সব কছু সহবে জ্বালা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
না চেয়ে যা পেলে তার যত দায় পুরাতে পার না তাও, কেমনে বহিবে চাও যত কিছু সব যদি তার পাও!   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
‘ওগো বাঁশিওয়ালা, বাজাও তোমার বাঁশি, শুনি আমার নূতন নাম’- এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখেছি, মনে আছে তো? আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে। সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেন নি আমাকে মানুষ ক‘রে গড়তে, রেখেছেন আধাআধি করে। অন্তরে বাহিরে মিল হয় নি- সেকালে আর আজকের কালে, মিল হয় নি ব্যথায় আর বুদ্ধিতে, মিল হয় নি শক্তিতে আর ইচ্ছায়। আমাকে তুলে দেন নি এ যুগের পারানি নৌকোয়- চলা আটক করে ফেলে রেখেছেন, কালস্রোতের ও পারে বালুডাঙায়।            সেখান থেকে দেখি প্রখর আলোয় ঝাপসা দূরের জগৎ; বিনা কারণে কাঙাল মন অধীর হয়ে ওঠে; দুই হাত বাড়িয়ে দিই নাগাল পাই নে কিছুই কোন দিকে।।        বেলাতো কাটে না, বসে থাকি জোয়ার-জলের দিকে চেয়ে- ভেসে যায় মুক্তিপারের খেয়া, ভেসে যায় ধনপতির ডিঙা, ভেসে যায় চলতি বেলার আলোছায়া। এমন-সময় বাজে তোমার বাঁশি ভরা জীবনের সুরে, মরা দিনের নাড়ীর মধ্যে দব্দবিয়ে ফিরে আসে প্রাণের বেগ।।কী বাজাও তুমি, জানি নে সে সুর জাগায় কার মনে কী ব্যথা। বুঝি বাজাও পঞ্চম রাগে দক্ষিণ হাওয়ার নবযৌবনের ভাটিয়ারি। শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হয়- যে ছিল পাহাড়তলীর ঝিরঝিরে নদী তার বুকে হঠাৎ উঠেছে ঘনিয়ে শ্রাবণের বাদলরাত্রি। সকালে উঠে দেখা যায় পাড়ি গেছে ভেসে, একগুঁয়ে পাথরগুলোকে ঠেলা দিচ্ছে অসহ্য স্রোতের ঘূর্ণিমাতন।।আমার রক্তে নিয়ে আসে তোমার সুর ঝড়ের ডাক, বন্যার ডাক, আগুনের ডাক, পাঁজরের-উপরে-আছাড়-খাওয়া মরণসাগরের ডাক, ঘরের-শিকল-নাড়া উদাসী হাওয়ার ডাক। যেন হাঁক দিয়ে আসে অপূর্ণের সংকীর্ণ খাদে পূর্ণ স্রোতের ডাকাতি- ছিনিয়ে নেবে, ভাসিয়ে দেবে বুঝি। অঙ্গে অঙ্গে পাক দিয়ে ওঠে কালবৈশাখীর-ঘূর্ণি-মার-খাওয়া অরণ্যের বকুনি।।ডানা দেয় নি বিধাতা- তোমার গান দিয়েছে আমার স্বপ্নে ঝোড়ো আকাশে উড়ো প্রাণের পাগলামি।।ঘরে কাজ করি শান্ত হয়ে; সবাই বলে ‘ভালো’। তারা দেখে আমার ইচ্ছার নেই জোর, সাড়া নেই লোভের, ঝাপট লাগে মাথার উপর- ধূলোয় লুটোই মাথা। দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত ক’রে ফেলি নেই এমন বুকের পাটা; কঠিন করে জানি নে ভালোবাসতে, কাঁদতে শুধু জানি, জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে।।বাঁশিওয়ালা, বেজে ওঠে তোমার বাঁশি, ডাক পড়ে অমর্তলোকে; সেখানে আপন গরিমায় উপরে উঠেছে আমার মাথা। সেখানে কুয়াশার পর্দা-ছেঁড়া তরুণ সূর্য আমার জীবন। সেখানে আগুনের ডানা মেলে দেয় আমার বারণ-না-মানা আগ্রহ, উড়ে চলে অজানা শূন্যপথে প্রথম-ক্ষুধায়-অস্থির-গরুড়ের মতো। জেগে ওঠে বিদ্রোহিনী, তীক্ষè চোখের আড়ে জানায় ঘৃণা চারদিকে ভীরুর ভিড়কে- কৃশ কুটিলের কাপুরুষতাকে।।বাঁশিওয়ালা, হয়তো আমাকে দেখতে চেয়েছ তুমি। জানি নে, ঠিক জায়গাটি কোথায়, ঠিক সময় কখন, চিনবে কেমন ক’রে। দোসরহারা আষাঢ়ের ঝিল্লিঝণক রাত্রে সেই নারীতো ছায়ারূপে গেছে তোমার অভিসারে চোখ-এড়ানো পথে। সেই অজানাকে কত বসন্তে পরিয়েছ ছন্দের মালা- শুকোবে না তার ফুল।।তোমার ডাক শুনে একদিন ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এল ঘোমটা খসা নারী। যেন সে হঠাৎ-গাওয়া নতুন ছন্দ বাল্মীকির, চমক লাগালো তোমাকেই। সে নামবে না গানের আসন থেকে; সে লিখবে তোমাকে চিঠি রাগিনীর আবছায়ায় বসে- তুমি জানবে না তার ঠিকানা। ওগো বাঁশিওয়ালা, সে থাক তোমার বাঁশির সুরের দূরত্বে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
আপনি কণ্টক আমি , আপনি জর্জর । আপনার মাঝে আমি শুধু ব্যথা পাই । সকলের কাছে কেন যাচি গো নির্ভর — গৃহ নাই , গৃহ নাই , মোর গৃহ নাই ! অতি তীক্ষ্ম অতি ক্ষুদ্র আত্ম – অভিমান সহিতে পারে না হায় তিল অসম্মান । আগেভাগে সকলের পায়ে ফুটে যায় ক্ষুদ্র ব ‘ লে পাছে কেহ জানিতে না পায় । বরঞ্চ আঁধারে রব ধুলায় মলিন , চাহি না চাহি না এই দীন অহংকার — আপন দারিদ্র্যে আমি রহিব বিলীন , বেড়াব না চেয়ে চেয়ে প্রসাদ সবার । আপনার মাঝে যদি শান্তি পায় মন বিনীত ধুলার শয্যা সুখের শয়ন ।   (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
শ্যামল ঘন বকুলবন- ছায়ে ছায়ে যেন কী সুর বাজে মধুর পায়ে পায়ে। (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি দুখ জ্বালা সব যাই ভুলি। অধরে অধরে পরশিয়া প্রাণমন উঠে হরষিয়া। মাথা রাখি যবে ওই বুকে ডুবে যাই আমি মহা সুখে। যবে বল তুমি, “ভালবাসি’, শুনে শুধু আঁখিজলে ভাসি।Heinrich Hein (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
বাহির হইতে দেখো না এমন করে, আমায় দেখো না বাহিরে। আমায় পাবে না আমার দুখে ও সুখে, আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে, আমায় দেখিতে পাবে না আমার মুখে কবিরে খুঁজিছ যেথায় সেথা সে নাহি রে।সাগরে সাগরে কলরবে যাহা বাজে, মেঘগর্জনে ছুটে ঝঞ্ঝার মাঝে, নীরব মন্দ্রে নিশীথ-আকাশে রাজে আঁধার হইতে আঁধারে আসন পাতিয়া– আমি সেই এই মানবের লোকালয়ে বাজিয়া উঠেছি সুখে দুখে লাজে ভয়ে, গরজি ছুটিয়া ধাই জয়ে পরাজয়ে বিপুল ছন্দে উদার মন্দ্রে মাতিয়া।যে গন্ধ কাঁপে ফুলের বুকের কাছে, ভোরের আলোকে যে গান ঘুমায়ে আছে, শারদ-ধান্যে যে আভা আভাসে নাচে কিরণে কিরণে হসিত হিরণে হরিতে, সেই গন্ধই গড়েছে আমার কায়া, সে গান আমাতে রচিছে নূতন মায়া, সে আভা আমার নয়নে ফেলেছে ছায়া– আমার মাঝারে আমারে কে পারে ধরিতে।নর-অরণ্যে মর্মতান তুলি, যৌবনবনে উড়াই কুসুমধূলি, চিত্তগুহায় সুপ্ত রাগিণীগুলি, শিহরিয়া উঠে আমার পরশে জাগিয়া। নবীন উষার তরুণ অরুণে থাকি গগনের কোণে মেলি পুলকিত আঁখি, নীরব প্রদোষে করুণ কিরণে ঢাকি থাকি মানবের হৃদয়চূড়ায় লাগিয়া।তোমাদের চোখে অঁখিজল ঝরে যবে আমি তাহাদের গেঁথে দিই গীতরবে, লাজুক হৃদয় যে কথাটি নাহি কবে সুরের ভিতরে লুকাইয়া কহি তাহারে। নাহি জানি আমি কী পাখা লইয়া উড়ি, খেলাই ভুলাই দুলাই ফুটাই কুঁড়ি, কোথা হতে কোন্‌ গন্ধ যে করি চুরি সন্ধান তার বলিতে পারি না কাহারে।যে আমি স্বপন-মুরতি গোপনচারী, যে আমি আমারে বুঝিতে বুঝাতে নারি, আপন গানের কাছেতে আপনি হারি, সেই আমি কবি। কে পারে আমারে ধরিতে। মানুষ-আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে, ভূমিতে লুটায় প্রতি নিমেষের ভরে, যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে, কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে।   (উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
দিগন্তে পথিক মেঘ চলে যেতে যেতে ছায়া দিয়ে নামটুকু লেখে আকাশেতে।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমমূলক
অদৃষ্টের হাতে লেখা সূক্ষ্ম এক রেখা, সেই পথ বয়ে সবে হয় অগ্রসর। কত শত ভাগ্যহীন ঘুরে মরে সারাদিন প্রেম পাইবার আগে মৃত্যু দেয় দেখা, এত দূরে আছে তার প্রাণের দোসর! কখন বা তার চেয়ে ভাগ্য নিরদয়, প্রণয়ী মিলিল যদি–অতি অসময়! “হৃদয়টি?’ “দিয়াছি তা!’ কান্দিয়া সে কহে, “হাতখানি প্রিয়তম?’ “নহে, নহে, নহে!’   Matthew Arnold (অনুবাদ কবিতা)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীতিমূলক
ভিজা কাঠ অশ্রুজলে ভাবে রাত্রিদিবা, জ্বলন্ত কাঠের আহা দীপ্তি তেজ কিবা। অন্ধকার কোণে পড়ে মরে ঈর্ষারোগে— বলে, আমি হেন জ্যোতি পাব কী সুযোগে। জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, কাঁচা কাঠ ওগো, চেষ্টাহীন বাসনায় বৃথা তুমি ভোগো। আমরা পেয়েছি যাহা মরিয়া পুড়িয়া, তোমারি হাতে কি তাহা আসিবে উড়িয়া? ভিজা কাঠ বলে, বাবা, কে মরে আগুনে! জ্বলন্ত অঙ্গার বলে, তবে খাক ঘুণে।   (কণিকা কাব্যগ্রন্থ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
প্রথম আলোর আভাস লাগিল গগনে; তৃণে তৃণে উষা সাজালো শিশিরকণা৷ যারে নিবেদিল তাহারি পিপাসি কিরণে নিঃশেষ হল রবি-অভ্যর্থনা।   (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও? তারি রথ নিত্য উধাও। জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয় স্পন্দন চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন। ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল তুলে নিল দ্রুত রথে দু’সাহসী ভ্রমণের পথে তোমা হতে বহু দূরে। মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম। আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়; রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায় আমার পুরানো নাম। ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি পারিবে না চিনিতে আমায়। হে বন্ধু বিদায়।কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে বসন্ত বাতাসে অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস, ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ, সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে তোমার প্রাণের প্রাণে, বিস্মৃতি প্রাদোষে হয়তো দিবে সে জ্যোতি, হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি। তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় – সে আমার প্রেম। তারে আমি রাখিয়া এলাম অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে। পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে কালের যাত্রায়। হে বন্ধু বিদায়।তোমায় হয়নি কোন ক্ষতি। মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত মুরতি যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি হোক তবে সন্ধ্যা বেলা- পূজার সে খেলা ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে; তৃষার্ত আবেগ বেগে ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে। তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত’ষায় তার সাথে দিব না মিশায়ে যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে। আজও তুমি নিজে হয়তো বা করিবে বচন মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়। হে বন্ধু বিদায়।মোর লাগি করিয়ো না শোক- আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক। মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই, শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই। উৎকণ্ঠা আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে সে ধন্য করিবে আমাকে। শুক্লপক্ষ হতে আনি রজনীগন্ধার বৃন্তখানি যে পারে সাজাতে অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে সে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালমন্দ মিলায়ে সকলি, এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি। তোমারে যা দিয়েছিনু তার পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার। হেথা মোর তিলে তিলে দান, করুণ মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম, ওগো নিরূপম, হে ঐশ্বর্যবান তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। হে বন্ধু বিদায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভক্তিমূলক
অমলধারা ঝরনা যেমন স্বচ্ছ তোমার প্রাণ, পথে তোমার জাগিয়ে তুলুক আনন্দময় গান। সম্মুখেতে চলবে যত পূর্ণ হবে নদীর মতো, দুই কূলেতে দেবে ভ’রে সফলতার দান।    (স্ফুলিঙ্গ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিন্তামূলক
এ কথা জানিতে তুমি ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান, কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান। শুধু তব অন্তরবেদনা চিরন্তন হয়ে থাক্, সম্রাটের ছিল এ সাধনা রাজশক্তি বজ্রসুকঠিন সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস নিত্য-উচ্ছ্বসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ, এই তব মনে ছিল আশ। হীরামুক্তামানিক্যের ঘটা যেন শুন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক, শুধু থাক্ একবিন্দু নয়নের জল কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল॥           হায় ওরে মানবহৃদয়, বার বার কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই নাই। জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই ভুবনের ঘাটে ঘাটে--- এক হাতে লও বোঝা, শুন্য করে দাও অন্য হাটে। দক্ষিণের মন্ত্রগুঞ্জরণে তব কুঞ্জবনে বসন্তের মাধবীমঞ্জরি যেই ক্ষণে দেয় ভরি মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল--- বিদায়গোধুলি আসে ধুলায় ছড়ায়ে ছিন্ন দল। সময় যে নাই, আবার শিশিররাত্রে তাই নিকুঞ্জে ফুটায়ে তোল নব কুন্দরাজি সাজাইতে হেমন্তের অশ্রুভরা আনন্দের সাজি। হায় রে হৃদয়, তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়। নাই নাই, নাই যে সময়॥        হে সম্রাট্, তাই তব শঙ্কিত হৃদয় চেয়েছিল করিবারে সময়ের হৃদয়হরণ সৌন্দর্যে ভুলায়ে। কণ্ঠে তার কী মালা দুলায়ে করিলে বরণ রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে! রহে না যে বিলাপের অবকাশ বারো মাস, তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে চিরমৌনজাল দিয়ে বেঁধে দিলে কঠিন বন্ধনে। জ্যোত্‍‌স্নারাতে নিভৃত মন্দিরে প্রেয়সীরে যে নামে ডাকিতে ধীরে ধীরে সেই কানে-কানে ডাকা রেখে গেলে এইখানে অনন্তের কানে। প্রেমের করুণ কোমলতা, ফুটিল তা সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে॥                হে সম্রাট্ কবি, এই তব হৃদয়ের ছবি, এই তব নব মেঘদূত, অপূর্ব অদ্ভুত ছন্দে গানে উঠিয়াছে অলক্ষ্যের পানে--- যেথা তব বিরহিণী প্রিয়া রয়েছে মিশিয়া প্রভাতের অরুণ-আভাসে, ক্লান্তসন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিশ্বাসে, পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলীর লাবণ্যবিলাসে, ভাষার অতীত তীরে কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে। তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি এড়াইয়া কালের প্রহরী চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া--- `ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!'               চলে গেছ তুমি আজ, মহারাজ--- রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে, সিংহাসন গেছে টুটে, তব সৈন্যদল যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে উড়ে যায় দিল্লির পথের ধূলি-'পরে। বন্দীরা গাহে না গান, যমুনাকল্লোল-সাথে নহবত মিলায় না তান। তব পুরসুন্দরীর নূপুরনিক্কণ ভগ্ন প্রাসাদের কোণে ম'রে গিয়ে ঝিল্লিস্বনে কাঁদায় রে নিশার গগন। তবুও তোমার দূত অমলিন, শ্রান্তিক্লান্তিহীন, তুচ্ছ করি রাজ্য-ভাঙাগড়া, তুচ্ছ করি জীবনমৃত্যুর ওঠাপড়া, যুগে যুগান্তরে কহিতেছে একস্বরে চিরবিরহীর বাণী নিয়া--- `ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!'            মিথ্যা কথা! কে বলে যে ভোল নাই? কে বলে রে খোল নাই স্মৃতির পিঞ্জরদ্বার? অতীতের চির-অস্ত-অন্ধকার আজিও হৃদয় তব রেখেছে বাঁধিয়া? বিস্মৃতির মুক্তিপথ দিয়া আজিও সে হয়নি বাহির? সমাধিমন্দির এক ঠাঁই রহে চিরস্থির, ধরার ধূলায় থাকি স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি। জীবনেরে কে রাখিতে পারে! আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে। তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে। স্মরণের গ্রন্থি টুটে সে যে যায় ছুটে বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন। মহারাজ, কোনো মহারাজ্য কোনোদিন পারে নাই তোমারে ধরিতে। সমুদ্রস্তনিত পৃথ্বী, হে বিরাট, তোমারে ভরিতে নাহি পারে--- তাই এ ধরারে জীবন-উত্‍‌সব-শেষে দুই পায়ে ঠেলে মৃত্‍‌পাত্রের মত যাও ফেলে। তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহত্‍‌, তাই তব জীবনের রথ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার বারম্বার। তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই। যে প্রেম সম্মুখপানে চলিতে চালাতে নাহি জানে, যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজসিংহাসন, তার বিলাসের সম্ভাষণ পথের ধূলার মতো জড়ায়ে ধরেছে তব পায়ে--- দিয়েছ তা ধূলিরে ফিরায়ে। সেই তব পশ্চাতের পদধূলি-'পরে তব চিত্ত হতে বায়ুভরে কখন সহসা উড়ে পড়েছিল বীজ জীবনের মাল্য হতে খসা। তুমি চলে গেছ দূরে, সেই বীজ অমর অঙ্কুরে উঠেছে অম্বর-পানে, কহিছে গম্ভীর গানে--- `যত দূর চাই নাই নাই সে পথিক নাই। প্রিয়া তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছাড়ি দিল পথ, রুধিল না সমুদ্র পর্বত। আজি তার রথ চলিয়াছে রাত্রির আহ্বানে নক্ষত্রের গানে প্রভাতের সিংহদ্বার-পানে। তাই স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে এখানে নাই।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকৃতিমূলক
মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে,আঁধার করে আসে,আমায় কেন বসিয়ে রাখএকা দ্বারের পাশে।কাজের দিনে নানা কাজেথাকি নানা লোকের মাঝে,আজ আমি যে বসে আছিতোমারি আশ্বাসে।আমায় কেন বসিয়ে রাখএকা দ্বারের পাশে।তুমি যদি না দেখা দাও,কর আমায় হেলা,কেমন করে কাটে আমারএমন বাদল-বেলা।দূরের পানে মেলে আঁখিকেবল আমি চেয়ে থাকি,পরান আমার কেঁদে বেড়ায়দুরন্ত বাতাসে।আমায় কেন বসিয়ে রাখএকা দ্বারের পাশে।