poet
stringclasses
137 values
category
stringclasses
21 values
poem
stringlengths
9
18.7k
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
গুণের মধ্যে নাকের বাহার। তার যে গাধা বাহন, সেটা যেমন পেটুক তেমনি ঢ্যাঁটা। ডাইনে বল্‌লে যায় সে বামে তিন পা যেতে দুবার থামে । চল্‌তে চল্‌তে থেকে থেকে খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে। ব্যাপার দেখে এম্নিতরো সাহেব বললে “সবুর করো- মাম্‌দোবাজি আমার কাছে? এ রোগেরও ওষুধ আছে।” এই না বলে ভীষন ক্ষেপে গাধার পিঠে বস্‌ল চেপে মুলোর ঝুটি ঝুলিয়ে নাকে আর কি গাধা ঝিমিয়ে থাকে? মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে - যতই ছোটে “ধরব” ব’লে ততই মুলো এগিয়ে চলে ! খাবার লোভে উদাস প্রাণে কেবল ছোটে মুলোর টানে - ডাইনে বাঁয়ে মুলোর তালে ফেরেন গাধা নাকের চালে।
সুকুমার রায়
ছড়া
শুন্‌ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে , সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে? শুন্‌ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে ? চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে ? চলতে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভুয়েঁর পরে ঠেকে? কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে? শোয় নাকি সে মুন্ডুটাকে শিয়র পানে দিয়ে? হয় না কি হয় সত্যি মিথ্যা চল না দেখি গিয়ে!
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
'এক যে রাজা'–'থাম্ না দাদা, রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা৷' 'তার যে মাতুল'–'মাতুল কি সে?— সবাই জানে সে তার পিশে৷' 'তার ছিল এক ছাগল ছানা'— 'ছাগলের কি গজায় ডানা?' 'একদিন তার ছাতের 'পরে'— 'ছাত কোথা হে টিনের ঘরে?' 'বাগানের এক উড়ে মালী'— 'মালী নয়তো! মেহের আলী৷' 'মনের সাধে গাইছে বেহাগ'— 'বেহাগ তো নয়! বসন্ত রাগ৷''থও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি'— 'আচ্ছা বল, চুপ করেছি৷' 'এমন সময় বিছনা ছেড়ে, হঠাৎ মামা আস্‌ল তেড়ে, ধর্‌ল সে তার ঝুঁটির গোড়া'— 'কোথায় ঝুঁটি? টাক যে ভরা৷' 'হোক না টেকো তোর তাতে কি? লক্ষীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি! ধর্‌ব ঠেসে টুঁটির 'পরে, পিটব তোমার মুণ্ড ধ'রে— কথার উপর কেবল কথা, এখন বাপু পালাও কোথা?'
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
কিসে কিসে ভাব নেই? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে- বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে। শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি, সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী! আদা আর কাঁচকলা মেলে কোনোদিন্ সে? কোকিলের ডাক শুনে কাক জ্বলে হিংসেয়। তেলে দেওয়া বেগুনের ঝগড়াটা দেখিনি? ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ রাগ যেন খেতে আসে এখনি। তার চেয়ে বেশি আড়ি আমি পারি কহিতে- তোমাদের কারো কারো, কেতাবের সহিতে।
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
কানে খাটো বংশীধর যায় মামাবাড়ি, গুনগুন গান গায় আর নাড়ে দাড়ি।। চলেছে সে একমনে ভাবে ভরপুর, সহসা বাজিল কানে সুমধুর সুর।। বংশীধর বলে, 'আহা, না জানি কি পাখি সুদুরে মধুর গায় আড়ালেতে থাকি।। দেখ, দেখ সুরে তার কত বাহাদুরি, কালোয়াতি গলা যেন খেলে কারিকুরি।।' এদিকে বেড়াল ভাবে, 'এযে বড় দায়, প্রাণ যদি থাকে তবে ল্যাজখানি যায়।। গলা ছেড়ে এত চেঁচামেচি এত করি হায় তবু যে ছাড়ে না বেটা, কি করি উপায়।। আর তো চলে না সহা এত বাড়াবাড়ি, যা থাকে কপালে, দেই এক থাবা মারি।।' বংশীধর ভাবে, 'একি! বেসুরা যে করে, গলা গেছে ভেঙে তাই 'ফ্যাঁস্‌' সুর ধরে।।' হেনকালে বেরসিক বেড়ালের চাঁটি, একেবারে সব গান করে দিল মাটি।
সুকুমার রায়
ছড়া
মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার— সবাই বলে “মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার!” অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব? বলবে সবাই, “মুখ্যু ছেলে”, বলবে আমায় “গো-গর্দভ!” কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর? বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর? গাধার কেন শিং থাকে না? হাতির কেন পালক নেই? গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তা ধেই-ধেই? সোডার বোতল খুল্লে কেন ফঁসফঁসিয়ে রাগ করে? কেমন করে রাখবে টিকি মাথায় যাদের টাক পড়ে? ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়? মাথায় যাদের গোল বেধেছে তাদের কেন “পাগোল” কয়? কতই ভাবি এ-সব কথা, জবাব দেবার মানুষ কই? বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই।
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
হাঁস ছিল, সজারুও, (ব্যাকরণ মানি না), হয়ে গেল 'হাঁসজারু' কেমনে তা জানি না ৷ বক কহে কচ্ছপে—'বাহবা কি ফুর্তি ! অতি খাসা আমাদের 'বকচ্ছপ মূর্তি' ৷' টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা— পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা ? ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি, চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি ! জিরাফের সাধ নাই মাঠে–ঘাটে ঘুরিতে, ফড়িঙের ঢং ধরি সেও চায় উড়িতে ৷ গরু বলে, 'আমারেও ধরিল কি ও রোগে ? মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে ?' 'হাতিমি'র দশা দেখ–তিমি ভাবে জলে যাই হাতি বলে, 'এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই ৷' সিংহের শিং নাই এই বড় কষ্ট— হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট ৷
সুকুমার রায়
ছড়া
কি ভেবে যে আপন মনে হাসি আসে ঠোঁটের কোণে,-আধ আধ ঝাপসা বুলি কোন কথা কয়না খুলি ।বসে বসে একলা নিজে লোভী ছেলে ভাবেন কি যে-শুধু শুধু চামচ চেটে মনে মনে সাধ কি মেটে ?একটুখানি মিষ্টি দিয়ে রাখ আমায় চুপ করিয়ে,নইলে পরে চেঁচিয়ে জোরে তুলব বাড়ি মাথায় ক'রে ।
সুকুমার রায়
চিন্তামূলক
চশমা-আঁটা পণ্ডিতে কয় শিশুর দেহ দেখে- 'হাড়ের পরে মাংস দিয়ে, চামড়া দিয়ে ঢেকে, শিরার মাঝে রক্ত দিয়ে, ফুসফুসেতে বায়ু, বাঁধল দেহ সুঠাম করে পেশী এবং স্নায়ু।' কবি বলেন, 'শিশুর মুখে হেরি তরুণ রবি, উৎসারিত আনন্দে তার জাগে জগৎ ছবি। হাসিতে তার চাঁদের আলো, পাখির কলকল, অশ্রুকণা ফুলের দলে শিশির ঢলঢল।' মা বলেন, 'এই দুরুদুরু মোর বুকেরই বাণী, তারি গভীর ছন্দে গড়া শিশুর দেহখানি। শিশুর প্রাণে চঞ্চলতা আমার অশ্রুহাসি, আমার মাঝে লুকিয়েছিল এই আনন্দরাশি। গোপনে কোন্‌ স্বপ্নে ছিল অজানা কোন আশা, শিশুর দেহে মূর্তি নিল আমার ভালবাসা।'
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
"হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল, সাদাকে বলছিলি লাল? (আর) সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে, নাক ডেকেছিস্ বিশ্রী সুরে? (আর) তোদের পোষা বেড়ালগুলো, শুন্‌ছি নাকি বেজায় হুলো? (আর) এই যে শুনি তোদের বাড়ি, কেউ নাকি রাখে না দাড়ি? ক্যান্ রে ব্যাটা ইসটুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট্!" "চোপরাও তুম্ স্পিকটি নট্, মার্‌ব রেগে পটাপট্- ফের যদি ট্যারাবি চোখ, কিম্বা আবার কর্‌বি রোখ, কিম্বা যদি অম্‌নি ক'রে, মিথ্যেমিথ্যি চ্যাঁচাস জোরে- আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি- জানিস্ আমি স্যান্ডো করি?" "ফের লাফাচ্ছিস্! অল্‌রাইট, কামেন্ ফাইট ! কামেন্ ফাইট!" "ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি! আজকে যদি থাক্‌ত মামা, পিটিয়ে তোমায় করত ধামা।" "আরে! আরে! মার্‌বি নাকি? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি!" "হাঁহাঁহাঁহাঁ! রাগ করো না, করতে চাও কি তাই বল না!" "হাঁ হাঁ তাতো সত্যি বটেই, আমি তো চটিনি মোটেই! মিথ্যে কেন লড়তে যাবি? ভেরি- ভেরি সরি মশলা খাবি?" "শেক্হ্যান্ড আর দাদা বল, সব শোধ বোধ ঘরে চল।" "ডোন্ট পরোয়া অল্ রাইট্, হাউ ডু য়ু ডু গুড্ নাইট।"
সুকুমার রায়
ছড়া
বাহবা বাবুলাল ! গেলে যে হেসে ! বগলে কাতুকুতু কে দিল এসে ? এদিকে মিটিমিটি দেখ কি চেয়ে ? হাসি যে ফেটে পড়ে দু'গাল বেয়ে ! হাসে যে রাঙা ঠোঁট দন্ত মেলে চোখের কোণে কোণে বিজলী খেলে । হাসির রসে গ'লে ঝরে যে লালা কেন এ খি-খি-খি-খি হাসির পালা ? যে দেখে সেই হাসে হাহাহা হাহা বাহবা বাবুলাল বাহবা বাহা !
সুকুমার রায়
প্রকৃতিমূলক
হে পর্বত, যত নদী করি নিরীক্ষণ তোমাতেই করে তারা জনম গ্রহণ। ছোট বড় ঢেউ সব তাদের উপরে কল্ কল্ শব্দ করি সদা ক্রীড়া করে, সেই নদী বেকে চুরে যায় দেশে দেশে, সাগরেতে পড়ে গিয়া সকলের শেষে। পথে যেতে যেতে নদী দেখে কত শোভা, কি সুন্দর সেই সব কিবা মনোলোভা। কোথাও কোকিলে দেখে বসি সাথী সনে, কি সুন্দর কুহু গান গায় নিজ মনে। কোথাও ময়ূর দেখে পাখা প্রসারিয়া বনধারে দলে দলে আছে দাড়াইয়া! নদীতীরে কত লোক শ্রান্তি নাশ করে, কত শত পক্ষী আসি তথা বিচারে। দেখিতে দেখিতে নদী মহাবেগে ধায় কভুও সে পশ্চাতেতে ফিরে নাহি চায়।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ)
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
চণ্ডীপুরের ইংরাজি স্কুলে আমাদের ক্লাশে একটি নূতন ছাত্র আসিয়াছে। তার বয়স বারো-চোদ্দোর বেশি নয়। সে স্কুলে আসিয়া প্রথম দিনই সকলকে জানাইল, “আমি পোইট্রি লিখতে পারি!” এ কথা শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ সকলে অবাক হইয়া গেল; কেবল দু-একজন হিংসা করিয়া বলিল, “আমরাও ছেলেবেলায় ঢের ঢের কবিতা লিখেছি।” নূতন ছাত্রটি বোধ হয় ভাবিয়াছিল, সে কবিতা লিখিতে পারে, শুনিয়া ক্লাশে খুব হুলুস্থল পড়িয়া যাইবে, এবং কবিতার নমুনা শুনিবার জন্য সকলে হাঁ হাঁ করিয়া উঠিবে। যখন সেরূপ কিছুরই লক্ষণ দেখা গেল না, তখন বেচারা, যেন আপন মনে কি কথা বলিতেছে, এরূপভাবে, যাত্রার মত সুর করিয়া একটা কবিতা আওড়াইতে লাগিল- “ওহে বিহঙ্গম তুমি কিসের আশায় বসিয়াছ উচ্চ ডালে সুন্দর বাসায়? নীল নভোমণ্ডলেতে উড়িয়া উড়িয়া কত সুখ পাও, আহা ঘুরিয়া ঘুরিয়া! যদ্যপি থাকিত মম পুচ্ছ এবং ডানা উড়ে যেতাম তব সনে নাহি শুনে মানা-” কবিতা শেষ হইতে না হইতেই ভবেশ অদ্ভুত সুর করিয়া এবং মুখভঙ্গি করিয়া বলিল- “আহা যদি থাকত তোমার ল্যাজ এবং ডানা উড়ে গেলেই আপদ যেত- করত না কেউ মানা!” শুনিয়া সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। নূতন ছাত্র তাহাতে রাগিয়া বলিল, “দেখ বাপু, নিজেরা যা পার না, তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেওয়া ভারি সহজ। শৃগাল ও দ্রাক্ষাফলের গল্প শোন নি বুঝি?” একজন ছেলে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, “শৃগাল অবং দ্রাক্ষাফল! সে আবার কি গল্প?” অমনি নূতন ছাত্রটি আবার সুর ধরিল- “বৃক্ষ হ’তে দ্রাক্ষাফল ভক্ষণ করিতে লোভী শৃগাল প্রবেশ করে দ্রাক্ষাক্ষেতে কিন্তু হায় দ্রাক্ষা যে অত্যন্ত উচ্চে থাকে শৃগাল নাগাল পাবে কিরূপে তাহাকে? বারম্বার চেষ্টায় হয়ে অকৃতকার্য ‘দ্রাক্ষা টক’ বলিয়া পালাল ছেড়ে (সেই) রাজ্য-” সেই হইতে আমাদের হরেরাম একেবারে তাহার চেলা হইয়া গেল। হরেরামের কাছে আমরা শুনিলাম যে ছোকরার নাম শ্যামলাল। সে নাকি এত কবিতা লিখিয়াছে যে একখানা দু’পয়সার খাতা প্রায় ভর্তি হইয়াছে- আর আট-দশটি কবিতা হইলেই তাহার একশোটা পুরা হয়, তখন সে নাকি বই ছাপাইবে। শুনিয়া কেহ কেহ আরো অবাক হইয়া গেল- কাহারো কাহারো হিংসা আরো দ্বিগুণ জ্বলিয়া উঠিল। ইহার মধ্যে একদিন এক কাণ্ড হইল। গোপাল বলে একটি ছেলে স্কুল ছাড়িয়া যাইবে, এই উপলক্ষে শ্যামলাল এক প্রকাণ্ড কবিতা লিখিয়া ফেলিল! তাহার মধ্যে ‘বিদায় বিদায়’ বলিয়া অনেক ‘অশ্রুজল’ ‘দুঃখশোক’ ইত্যাদি কথা ছিল। গোপাল কবিতার আধখানা শুনিয়াই একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, “হতভাগা, ফের আমার নামে পোইট্রি লিখবি তো এক থাপ্পড় মারব। কেন রে বাপু দুনিয়ায় কি কবিতা লিখবার আর কোনো জিনিস পাও নি?” হরেরাম বলিল, “আহা, বুঝলে না? তুমি ইস্কুল ছেড়ে যাচ্ছ কিনা, তাই ও লিখেছে।” গোপাল বলিল, “ছেড়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি, তোর তাতে কি রে? ফের জ্যাঠামি করবি তো তোর কবিতার খাতা ছিঁড়ে দেব।” দেখিতে দেখিতে স্কুলময় রাষ্ট্র হয়ে পড়িল। ছেলেরা, বিশেষত নিচের ক্লাশের ছেলেরা, দলে দলে শ্যামলালের কবিতা শুনিতে আসিতে লাগিল! ক্রমে কবিত লেখার বাতিকটা ভয়ানক রকমের ছোঁয়াচে হইয়া স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছেলেকে পাইয়া বসিল। ছোটো-ছোটো ছেলেদের পকেটে ছোটো-ছোটো কবিতার খাতা দেখা দিল- বড়োদের মধ্যে কেহ কেহ ‘শ্যামলালের চেয়ে ভালো কবিতা’ লিখিবার জন্য কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গেল! স্কুলের দেয়ালে, পড়ার কেতাবে, পরীক্ষার খাতায়, চারিদিকে কবিতা গজাইয়া উঠিল। পাঁড়েজির বৃদ্ধ ছাগল যেদিন শিং নাড়িয়া দড়ি ছিঁড়িয়া স্কুলের উঠানে দাপাদাপি করিয়াছিল, আর শ্যামলালকে তাড়া করিয়া খানায় ফেলিয়াছিল, তাহার পরদিন ভারতবর্ষের বড়ো ম্যাপের উপর বড়ো-বড়ো অক্ষরে লেখা বাহির হইল- পাঁড়েজির ছাগলের একহাত দাড়ি, অপরূপ রূপ তার যাই বলিহারি! উঠানে দাপট করি নেচেছিল কাল- তার পর কি হইল জানে শ্যামলাল। শ্যামলালের রঙটি কালো, কিন্তু কবিতা পড়িয়া সে যথার্থই চটিয়া লাল হইল, এবং তখনই তাহার নীচে একটা কড়া জবাব লিখিতে লাগিল। সে সবেমাত্র লিখিয়াছে, ‘রে অধম দুরাচার, পাষণ্ড বর্বর!’ এমন সময় গুরুগম্ভীর গলায় কে যেন ডাকিল, “শ্যামলাল!” ফিরিয়া দেখি হেডমাস্টার মহাশয়! “ম্যাপের ওপর কি লেখা হচ্ছে?” শ্যামলাল একেবারে থতমত খাইয়া বলিল, “আজ্ঞে, আমি আগে লিখি নি, আগে ওরা লিখেছিল।” “ওরা কারা?” শ্যামলাল বোকার মত একবার আমাদের দিকে একবার কড়িকাঠের দিকে তাকাইতে লাগিল, কাহার নাম করিবে বুঝিতে পারিল না। মাস্টার- মহাশয় আবার বলিলেন, “ওরা যদি পরের বাড়ী সিঁদ কাটতে যায়, তুমিও কাটবে? ওরা যদি নিজের গলায় ছুরি বসায়, দেখাদেখি তুমিও বসাবে?” যাহা হউক, সেদিন অল্পের উপর দিয়াই গেল, শ্যামলাল একটু ধমক-ধামক খাইয়াই খালাস পাইল। ইহার মধ্যে আমাদের নূতন শিক্ষকমহাশয় গল্প করিলেন যে তাহার সঙ্গে যাহারা এক ক্লাশে পড়িত, তাহাদের মধ্যে একজন নাকি অতি সুন্দর কবিতা লিখিত। একবার ইনস্পেকটার স্কুল দেখিতে আসিয়া তাহার কবিতা শুনিয়া তাহাকে সুন্দর ছবিওয়ালা বই উপহার দিয়েছিলেন। এই গল্পটি মনে হয় অনেকেরই মনে লাগিয়াছিল! বোধ হয় অনেকেই মনে মনে স্থির করিয়াছিল, ‘ইনস্পেকটার আসিলে তাহাকে কবিতা শুনাইতে হইবে।’ ইহার মাসখানেক পরেই ইনস্পেকটার স্কুল দেখিতে আসিলেন। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটি ছেলে সাবধানে পকেটের মধ্যে লুকাইয়া কবিতার কাগজ আনিয়াছে- বড়ো হলের মধ্যে সমস্ত স্কুলর ছেলেদের দাঁড় করানো হইয়াছে- হেডমাস্টার মহাশয় ইনস্পেকটারকে লইয়া ঘরে ধুকিতেছেন, এমন সময় শ্যামলাল আস্তে-আস্তে পকেট হইতে একটি কাগজ বাহির করিল। আর কোথা যায়! পাছে, শ্যামলাল আগেই তাহার কবিতা পড়িয়া ফেলে, এই ভয়ে ছোটো-বড়ো পঁচিশ-ত্রিশটি কবিতাওয়ালা একসঙ্গে সাংঘাতিক রকম বিকট চিত্কার করিয়া যে যার কবিতা হাঁকিয়া উঠিল। মনে হইল, সমস্ত বাড়িটা করতালের মতো ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল- ইনস্পেকটার মহাশয় মাথা ঘুরিয়া মাঝপথেই মেঝের উপর বসিয়া পড়িলেন- ছাদের উপর একটা বেড়াল ঘুমাইতেছিল সেটা হঠাত্‍‌ হাত-পা ছুঁড়িয়া তিনতলা হইতে পড়িয়া গেল- স্কুলের দরোয়ান হইতে অফিসের কেশিয়ার বাবু পর্যন্ত হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল! সকলে সুস্থ হইলে পর মাস্টারমহাশয় বলিলেন, “এত চেঁচাইলে কেন?” সকলে চুপ করিয়া রহিল। আবার জিজ্ঞাসা হইল। “কে কে চেঁচাইয়াছিলে?” পাঁচ-সাতটি ছেলে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, “শ্যামলাল।” শ্যামলাল যে একা অত মারাত্মক রকম চেঁচাইতে পারে এ কথা কেহই বিশ্বাস করিল না- সুতরাং স্কুলসুদ্ধ ছেলেকে সেদিন স্কুলের পর আটকাইয়া রাখা হইল! অনেক তম্বিতাম্বার পর একে একে সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িল। হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কবিতা লেখার রোগ হয়েছে? ও রোগের ওষুধ কি?” বৃদ্ধ পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “বিষস্য বিষমৌষধম্- বিষের ওষুধ বিষ। বসন্তের ওষুধ যেমন বসন্তের টিকা, কবিতার ওষুধ তস্য টিকা। তোমরা যে যা কবিতা লিখেছ তার টিকা করে দিচ্ছি। তোমরা একমাস প্রতিদিন পঞ্চাশবার করে এটা লিখে এনে রোজ আমায় দেখাবে।” এই বলে তিনি টিকা দিলেন- পদে পদে মিল খুঁজি, গুনে দেখি চোদ্দো মনে করি লিখিতেছি ভয়ানক পদ্য! হয় হব ভবভূতি নয় কালিদাস কবিতার ঘাস খেয়ে চরি বারোমাস। একমাস তিনি আমাদের কাছে এই লেখা প্রতিদিন পঞ্চাশবার আদায় না করিয়া ছাড়িলেন না। এ কবিতার কি আশ্চর্য গুণ তার পর হইতে কবিতা লেখার ফ্যাশান স্কুল হইতে একেবারেই উঠিয়া গেল।
সুকুমার রায়
ছড়া
কাগজ কলম লয়ে বসিয়াছি সদ্য, আষাঢ়ে লিখিতে হবে বরষার পদ্য। কি যে লিখি কি যে লিখি ভাবিয়া না পাই রে, হতাশে বসিয়া তাই চেয়ে থাকি বাইরে। সারাদিন ঘনঘটা কালো মেঘ আকাশে, ভিজে ভিজে পৃথিবীর মুখ খানা ফ্যাকাশে। বিনা কাজে ঘরে বাঁধা কেটে যায় বেলাটা, মাটি হল ছেলেদের ফুটবল খেলাটা। আপিসের বাবুদের মুখে নাই ফুর্তি, ছাতা কাঁধে জুতা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি। কোনখানে হাটু জল কোথা ঘন কর্দম - চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হর্‌দম। ব্যাঙেদের মহাসভা আহ্লাদে গদ্‌গদ্, গান করে সারারাত অতিশয় বদ্‌খদ্।
সুকুমার রায়
ছড়া
শিবঠাকুরের আপন দেশে , আইন কানুন সর্বনেশে! কেউ যদি যায় পিছলে প'ড়ে, প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে , কাজির কাছে হয় বিচার- একুশ টাকা দন্ড তার।। সেথায় সন্ধে ছটার আগে হাঁচতে হলে টিকিট লাগে হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে দম‌্দমাদম্ লাগায় পিঠে , কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে- একুশ দফা হাচিয়ে মারে।। কারুর যদি দাতটি নড়ে, চার্‌টি টাকা মাশুল ধরে , কারুর যদি গোঁফ গজায় , একশো আনা ট্যাক্সো চায়- খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়, সেলাম ঠোকায় একুশ বার।। চলতে গিয়ে কেউ যদি চায় এদিক্ ওদিক্ ডাইনে বাঁয়, রাজার কাছে খবর ছোটে, পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে , দুপুরে রোদে ঘামিয়ে তায়- একুশ হাতা জল গেলায়।। যে সব লোকে পদ্য লেখে, তাদের ধরে খাঁচায় রেখে, কানের কাছে নানান্ সুরে নামতা শোনায় একশো উড়ে, সামনে রেখে মুদীর খাতা- হিসেব কষায় একুশ পাতা।। হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে, অম্‌‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে, গোবর গুলে বেলের কষে, একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে- একুশ ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখে।।
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহাদের মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে না চিনে। যে লোক আর কাহাকেও জানে না, সেও সকলের আগে দাশুকে চিনিয়া ফেলে। সেবার এক নতুন দারোয়ান আসিল, একেবারে আন্‌‌কোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু প্রথম যখন সে পাগলা দাশুর নাম শুনিল, তখনই আন্দাজে ঠিক করিয়া লইল যে, এই ব্যক্তিই পাগলা দাশু। কারণ মুখের চেহারায়, কথাবার্তায়, চাল-চলনে বোঝা যাইত যে তাহার মাথায় একটু 'ছিট' আছে। তাহার চোখ দুটি গোল গোল, কান দুটি অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় একবস্তা ঝাঁকড়া চুল। চেহারাটা দেখিলেই মনে হয়— ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ডু তাহে ভারি যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারি।সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে, তখন তাহার হাত পা ছোঁড়ার ভঙ্গী দেখিয়া হঠাৎ কেন জানি চিংড়িমাছের কথা মনে পড়ে।সে যে বোকা ছিল তাহা নয়। অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা লম্বা গুণ-ভাগের বেলায় তাহার আশ্চর্য মাথা খুলিত। আবার এক এক সময় সে আমাদের বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য এমন সকল ফন্দি বাহির করিত যে, আমরা তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া থাকিতাম।'দাশু' অর্থাৎ দাশরথি, যখন প্রথম আমাদের ইস্কুলে ভরতি হয়, তখন জগবন্ধুকে আমাদের 'ক্লাশের ভালো ছেলে' বলিয়া সকলে জানিত। সে পড়াশোনায় ভালো হইলেও, তাহার মতো অমন একটি হিংসুটে ভিজেবেড়াল আমরা আর দেখি নাই। দাশু একদিন জগবন্ধুর কাছে কি একটা ইংরাজি কথার মানে জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াছিল। জগবন্ধু তাহাকে খামখা দুকথা শুনাইয়া বলিল, "আমার বুঝি আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই ? আজ একে ইংরাজি বোঝাব, কাল ওর অঙ্ক কষে দেব, পরশু আর একজন আসবেন আর এক ফরমাইস নিয়ে— ঐ করি আর কি !" দাশু সাংঘাতিক চটিয়া বলিল, "তুমি তো ভারি ছ্যাঁচড়া ছোটলোক !" জগবন্ধু পণ্ডিত মশায়ের কাছে নালিশ করিল, "ঐ নতুন ছেলেটা আমায় গালাগালি দিচ্ছে।" পণ্ডিত মহাশয় দাশুকে এমনি ধমক দিয়া দিলেন যে বেচারা একেবারে দমিয়া গেল।আমাদের ইংরাজি পড়াইতেন বিষ্টুবাবু। জগবন্ধু তাঁহার প্রিয় ছাত্র। পড়াইতে পড়াইতে যখনই তাঁহার বই দরকার হয়, তিনি জগবন্ধুর কাছে বই চাহিয়া লন। একদিন তিনি পড়াইবার সময় 'গ্রামার' চাহিলেন, জগবন্ধু তাড়াতাড়ি তাহার সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া 'গ্রামার' খানা বাহির করিয়া দিল। মাস্টার মহাশয় বইখানি খুলিয়াই হঠাৎ গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "বইখানা কার ?" জগবন্ধু বুক ফুলাইয়া বলিল, "আমার"। মাস্টার মহাশয় বলিলেন, "হুঁ— নতুন সংস্করণ বুঝি ? বইকে-বই একেবারে বদলে গেছে।" এই বলিয়া তিনি পড়িতে লাগিলেন— 'যশোবন্ত দারোগা— লোমহর্ষক ডিটেকটিভ নাটক।' জগবন্ধু ব্যাপারখানা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মতো তাকাইয়া রহিল। মাস্টার মহাশয় বিকট রকম চোখ পাকাইয়া বলিলেন, "এই সব জ্যাঠামি বিদ্যে শিখছ বুঝি ?" জগবন্ধু আম্‌তা আম্‌তা করিয়া কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু মাস্টার মহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, "থাক্‌ থাক্‌, আর ভালমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই— ঢের হয়েছে।" লজ্জায় অপমানে জগবান্ধুর দুই কান লাল হইয়া উঠিল— আমরা সকলেই তাহাতে বেশ খুশি হইলাম। পরে জানা গেল যে, এটিও দাশু ভায়ার কীর্তি, সে মজা দেখিবার জন্য উপক্রমণিকার জায়গায় ঠিক ঐরূপ মলাট দেওয়া একখানা বই রাখিয়া দিয়াছিল।দাশুকে লইয়া আমরা সর্বদাই ঠাট্টাতামাশা করিতাম এবং তাহার সামনেই তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অপ্রীতিকর সমালোচনা করিতাম। তাহাতে একদিনও তাহাকে বিরক্ত হইতে দেখি নাই। এক এক সময়ে সে নিজেই আমাদের মন্তব্যের উপর রঙ চড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত গল্প বলিত। একদিন সে বলিল, "ভাই, আমাদের পাড়ায় যখন কেউ আমসত্ত্ব বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস ?" আমরা বলিলাম, "খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি ?" সে বলিল, "তা নয়। যখন আমতত্ত্ব শুকোতে দেয়, আমি সেইখানে ছাদের উপর বার দুয়েক চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই, ত্রিসীমানার যত কাক সব ত্রাহি ত্রাহি করে ছুটে পালায় কাজেই আর আমসত্ত্ব পাহারা দিতে হয় না।"একবার সে হঠাৎ পেন্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢল্‌ঢলে পায়জামার মতো পেন্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং তাহার কাছে ভারি একটা ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, "পেন্টেলুন পরেছিস্‌ কেন ?" দাশু এক গাল হাসিয়া বলিল, "ভালো ইংরাজি শিখব ব'লে।" আর একবার সে খামখা নেড়া মাথায় এক পট্টি বাঁধিয়া ক্লাশে আরম্ভ করিল এবং আমরা সকলে তাহা লইয়া ঠাট্টা তামাশা করায় যারপরনাই খুশি হইয়া উঠিল। দাশু আদপেই গান গাহিতে পারে না, তাহার যে তালজ্ঞান বা সুরজ্ঞান একেবারে নাই, একথা সে বেশ জানে। তবু সেবার ইনস্পেক্টার সাহেব যখন ইস্কুল দেখিতে আসেন, তখন আমাদের খুশি করিবার জন্য চিৎকার করিয়া গান শুনাইয়াছিল। আমরা কেহ ওরূপ করিলে সেদিন রীতিমত শাস্তি পাইতাম, কিন্তু দাশু 'পাগলা' বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।একবার ছুটির পরে দাশু অদ্ভুত এক বাক্স লইয়া ক্লাসে হাজির হইল। মাস্টার মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, "কি দাশু, ও বাক্সের মধ্যে কি আছে ?" দাশু বলিল, "আজ্ঞে, আমার জিনিসপত্র।" জিনিসপত্রটা কিরূপ হইতে পারে, এই লইয়া আমাদের মধ্যে বেশ একটা তর্ক হইয়া গেল। দাশুর সঙ্গে বই, খাতা, পেনসিল, ছুরি সবই তো আছে, তবে আবার জিনিসপত্র কি বাপু? দাশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে সোজাসুজি কোনো উত্তর না দিয়া বাক্সটিকে আঁকড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, "খবরদার, আমার বাক্স তোমরা কেউ ঘেঁটো না।" তাহার পর চাবি দিয়া বাক্সটাকে একটুখানি ফাঁক করিয়া, সে তাহার ভিতর দিয়া কি যেন দেখিল, এবং 'ঠিক আছে' বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বিড় বিড় করিয়া হিসাব করিতে লাগিল। আমি একটুখানি দেখিবার জন্য উঁকি মারিতে গিয়াছিলাম— অমনি পাগলা মহা ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরাইয়া বাক্স বন্ধ করিয়া ফেলিল।ক্রমে আমাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইল। কেহ বলিল, "ওটা ওর টিফিনের বাক্স— ওর মধ্যে খাবার আছে।" কিন্তু একদিনও টিফিনের সময় তাহাকে বাক্স খুলিয়া কিছু খাইতে দেখিলাম না। কেহ বলিল, "ওটা বোধ হয় ওর মানি-ব্যাগ— ওর মধ্যে টাকা পয়সা আছে, তাই ও সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায়। আর একজন বলিল, "টাকা পয়সার জন্য অত বড় বাক্স কেন ? ও কি ইস্কুলে মহাজনী কারবার খুলবে নাকি ?"একদিন টিফিনের সময় দাশু হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া, বাক্সের চাবিটা আমার কাছে রাখিয়া গেল আর বলিল, "ওটা এখন তোমার কাছে রাখো, দেখো হারায় না যেন। আর আমার আসতে যদি একটু দেরি হয়, তবে তোমরা ক্লাশে যাবার আগে ওটা দারোয়ানের কাছে দিও।" এই বলিয়া বাক্সটি দারোয়ানের জিম্মায় রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন আমাদের উৎসাহ দেখে কে! এতদিনে সুবিধা পাওয়া গিয়াছে, এখন দারোয়ানটা একটু তফাৎ গেলেই হয়। খানিক বাদে দারোয়ান তাহার রুটি পাকাইবার লোহার উনানটি ধরাইয়া, কতকগুলি বাসনপত্র লইয়া কলতলার দিকে গেল। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, দারোয়ান আড়াল হওয়া মাত্র, আমরা পাঁচ-সাতজনে তাহার ঘরের কাছে সেই বাক্সের উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তাহার পর আমি চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া দেখি বাক্সের মধ্যে বেশ ভারি একটা কাগজের পোঁটলা ন্যাকড়ার ফালি দিয়া খুব করিয়া জড়ানো। তাড়াতাড়ি পোঁটলার প্যাঁচ খুলিয়া দেখা গেল, তাহার মধ্যে একখানা কাগজের বাক্স— তাহার ভিতর আর একটা ছোট পোঁটলা। সেটি খুলিয়া একখানা কার্ড বাহির হইল, তাহার এক পিঠে লেখা, 'কাঁচকলা খাও' আর একটি পিঠে লেখা 'অতিরিক্ত কৌতুহল ভালো নয়।' দেখিয়া আমরা এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। সকলের শেষে একজন বলিয়া উঠিল, "ছোকরা আচ্ছা যা হোক, আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।" আর একজন বলিল, "যেমন ভাবে বাঁধা ছিল তেমনি করে রেখে দাও, সে যেন টেরও না পায় যে আমরা খুলেছিলাম। তাহলে সে নিজেই জব্দ হবে।" আমি বলিলাম, "বেশ কথা। ও আস্‌‌লে পরে তোমরা খুব ভালোমানুষের মতো বাক্সটা দেখাতে বলো আর ওর মধ্যে কি আছে, সেটা বার বার করে জানতে চেয়ো।" তখন আমরা তাড়াতাড়ি কগজপত্রগুলি বাঁধিয়া, আগেকার মতো পোঁটলা পাকাইয়া বাক্সে ভরিয়া ফেলিলাম।বাক্সে চাবি দিতে যাইতেছি, এমন সময় হো হো করিয়া একটা হাসির শব্দ শোনা গেল— চাহিয়া দেখি পাঁচিলের উপরে বসিয়া পাগলা দাশু হাসিয়া কুটিকুটি। হতভাগা এতক্ষণ চুপি চুপি তামাশা দেখিতেছিল। তাখন বুঝিলাম আমার কাছে চাবি দেওয়া, দারোয়ানের কাছে বাক্স রাখা, টিফিনের সময় বাহিরে যাওয়ার ভান করা এ সমস্ত তাহার শয়তানি। খামখা আমাদের আহাম্মক বানাইবার জন্যই সে মিছিমিছি এ কয়দিন ক্রমাগত একটা বাক্স বহিয়া বেড়াইতেছে।সাধে কি বলি 'পাগলা দাশু ?'
সুকুমার রায়
ছড়া
“অবাক কান্ড!” বল্‌লে পিসী, “এক চাঙাড়ি মেঠাই এল- এই ছিল সব খাটের তলায়, এক নিমিষে কোথায় গেল?” সত্যি বটে বললে খুড়ী, “আনলো দু’সের মিঠাই কিনে- হঠাৎ কোথায় উপসে গেল? ভেল্কিবাজি দুপুর দিনে?” “দাঁড়াও দেখি” বল্‌লে দাদা, “কর্‌ছি আমি এর কিনারা- কোথায় গেল পটলা ট্যাঁপা – পাচ্ছিনে যে তাদের সাড়া?” পর্দাঘেরা আড়াল দেওয়া বারান্দাটার ঐ কোণেতে চল্‌ছে কি সব ফিস্ ফ্সি্ ফিস্ শুনলে দাদা কানটি পেতে। পটলা ট্যাঁপা ব্যস্ত দুজন ট্প্‌টপাটপ্ মিঠাই ভোজে, হঠাৎ দেখে কার দুটো হাত এগিয়ে তাদের কানটি খোঁজে। কানের উপর প্যাঁচ্ ঘুরাতেই দু চোখ বেয়ে অশ্রু ছোটে, গিলবে কি ছাই মুখের মিঠাই ,কান বুঝি যায় টানের চোটে। পটল বাবুর হোম্‌রা গলা মিল্‌ল ট্যাঁপার চিকন সুরে জাগ্‌ল করুন রাগরাগিণী বিকট তানে আকাশ জুড়ে।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ)
সুকুমার রায়
ছড়া
এই নেয়েছ, ভাত খেয়েছ, ঘন্টাখানেক হবে- আবার কেন হঠাৎ হেন নামলে এখন টবে? একলা ঘরে ফুর্তি ভরে লুকিয়ে দুপুরবেলা, স্নানের ছলে ঠান্ডা জলে জল ছপ্‌ছপ্ খেলা। জল ছিটিয়ে, টব পিটিয়ে, ভাবছ, 'আমোদ ভারি- কেউ কাছে নাই, যা খুশি তাই করতে এখন পারি।' চুপ্ চুপ্ চুপ্- ঐ দুপ্ দুপ্! ঐ জেগেছে মাসি, আসছে ধেয়ে, শুনতে পেয়ে দুষ্ট মেয়ের হাসি।
সুকুমার রায়
ছড়া
ঢপ্ ঢপ্ ঢাক ঢোল ভপ্ ভপ্ বাঁশি ঝন্ ঝন্ করতাল্ ঠন্ ঠন্ কাঁসি। ধুমধাম বাপ্ বাপ্ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা।।   (অন্যান্য ছড়াসমূহ)
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ মানুষটি নই বাঁকা! যা বলি তা ভেবেই বলি, কথায় নেইক ফাঁকা। এখনকার সব সাহেবসুবো, সবাই আমায় চেনে দেখ্তে চাও ত দিতে পারি সাটিফিকেট এনে। ভাগ্য আমায় দেয়নি বটে করতে বি-এ পাশ, তাই বলে কি সময় কাটাই কেটে ঘোড়ার ঘাস? লোকে যে কয় বিদ্যে আমার 'কথামালা'ই শেষ- এর মধ্যে সত্যি কথা নেইক বিন্দুলেশ। ওদের পাড়ার লাইব্রেরিতে কেতাব আছে যত কেউ পড়েছে তন্নতন্ন করে আমায় মতো? আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ এমনি পড়ার যম পড়াশুনো নয়ক আমার কারুর চেয়ে কম। কতকটা এই দেখেশিখে কতক পড়েশুনে, কতক হয়ত স্বাভাবিকী প্রতিভারই গুণে উন্নতিটা করছি যেমন আশ্চর্য তা ভারি, নিজের মুখে সব কথা তার বলতে কি আর পারি? বলে গেছেন চন্ডীপতি কিংবা অন্য কেউ "আকাশ জুড়ে মেঘের বাসা, সাগরভরা ঢেউ, জীবনটাও তেমনি ঠাসা কেবল বিনা কাজে- যেদিক দিয়ে খরচ করি সেই খরচই বাজে!" আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ চলতে ফিরতে শুতে জীবনটাকে হাঁকাই নেকো মনের রথে জুতে।হাইড্রোজেনের দুই বাবাজি অক্সিজেনের এক নৃত্য কবেন গলাগলি কান্ডখানা দেখ্, আহাদেতে এক্‌সা হলে গলে হলেন জল এই সুযোগে সুবোধ শিশু "শ্রীগোবিন্দ" বল্।
সুকুমার রায়
ছড়া
সন্দেশের গন্ধে বুঝি দৌড়ে এল মাছি? কেন ভন্ ভন্ হাড় জ্বালাতন ছেড়ে দেওনা বাঁচি! নাকের গোড়ায় সুড়সুড়ি দাও শেষটা দিবে ফাঁকি? সুযোগ বুঝে সুড়–ৎ করে হুল ফোটাবে নাকি?
সুকুমার রায়
কাহিনীকাব্য
কুরুকুলে পিতামহ ভীষ্মমহাশয় ভুবন বিজয়ী বীর, শুন পরিচয়- শান্তনু রাজার পুত্র নাম সত্যব্রত জগতে সার্থক নাম সত্যে অনুরত। স্বয়ং জননী গঙ্গা বর দিলা তাঁরে- নিজ ইচ্ছা বিনা বীর না মরে সংসারে। বুদ্বিভ্রংশ ঘটে হায় শান্তনু রাজার, বিবাহের লাগি বুড়া করে আবদার। মৎস্যরাজকন্যা আছে নামে সত্যবতী, তারে দেখি শান্তনুর লুপ্ত হল মতি। মৎস্যরাজ কহে, 'রাজা, কর অবধান, কিসের আশায় কহ করি কন্যাদান? সত্যব্রত জ্যেষ্ঠ সেই রাজ্য অধিকারী, আমার নাতিরা হবে তার আজ্ঞাচারি, রাজমাতা কভু নাহি হবে সত্যবতী, তেঁই এ বিবাহ- কথা অনুচিত অতি।' ভগ্ন মনে হস্তিনায় ফিরিল শান্তনু অনাহারে অনিদ্রয় জীর্ন তার তনু। মন্ত্রী মুখে সত্যব্রত শুনি সব কথা মৎস্যরাজপুরে গিয়া কহিল বারতা- রাজ্যে মম সাধ নাহি, করি অঙ্গীকার জন্মিলে তোমার নাতি রাজ্য হবে তার।' রাজা কহে, 'সাধুতুমি, সত্য তব বাণী, তোমার সন্তান হতে তবু ভয় মানি। কে জানে ভবিষ্যকথা, দৈবগতিধারা- প্রতিবাদী হয় যদি রাজ্যলাভে তারা?' সত্যব্রত কহে, 'শুন প্রতিজ্ঞা আমার, বংশ না রহিবে মম পৃথিবী মাঝার। সাক্ষী রহ চন্দ্র সূর্য লোকে লোকান্তরে এই জন্মে সত্যব্রত বিবাহ না করে।' শুনিয়া অদ্ভুত বাণী ধন্য কহে লোকে, স্বর্গ হতে পুষ্পধারা ঝরিল পলকে। সেই হতে সত্যব্রত খ্যাত চরাচরে ভীষণ প্রতিজ্ঞাবলে ভীষ্ম নাম ধরে। ঘুচিল সকল বাধা, আনন্দিত চিতে সত্যবতী রাণী হয় হস্তিনাপুরীতে। ক্রমে হলে বর্ষ গত শান্তনুর ঘরে জন্ম নিল নব শিশু, সবে সমাদরে। রাখিল বিচিত্রবীর্য নামটি তাহার শান্তনু মরিল তারে দিয়া রাজ্যভার। অকালে বিচিত্রবীর্য মুদিলেন আঁখি পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্র দুই পুত্র রাখি।। হস্তিরায় চন্দ্রবংশ কুরুরাজকুল রাজত্ব করেন সুখে বিক্রমে অতুল। সেই কুলে জন্মি তবু দৈববশে হায় অন্ধ বলি ধৃতরাস্ট্র রাজ্য নাহি পায়। কনিষ্ঠ তাহার পাণ্ডু, রাজত্ব সে করে, পাঁচটি সন্তান তার দেবতার বরে। জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির ধীর শান্ত মন 'সাক্ষাৎ ধর্মের পুত্র' কহে সর্বজন। দ্বিতীয় সে মহাবলী ভীম নাম ধরে, পবন সমান তেজ পবনের বরে। তৃতীয় অর্জুন বীর, ইন্দ্রের কৃপায় রুপেগুণে শৌর্যেবীর্যে অতুল ধরায়। এই তিন সহোদর কুন্তীর কুমার, বিমাতা আছেন মাদ্রী দুই পুত্র তাঁর- নকুল ও সহদেব সুজন সুশীল এক সাথে পাঁচজনে বাড়ে তিল তিল। অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্র তার, অভিমানী দুর্যোধন জ্যেষ্ঠ সবাকার। পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই নষ্ট হয় কিসে, এই চিন্তা করে দুষ্ট জ্বলি হিংসাবিষে। হেনকালে সর্বজনে ভাসাইয়া শোকে মাদ্রীসহ পান্ডরাজা যায় পরলোকে। 'পান্ডু গেল', মনে মনে ভাবে দুর্যোধন, এই বারে যুধিষ্ঠির পাবে সিংহাসন! ইচ্ছা হয় এই দণ্ডে গিয়া তারে মারি- ভীমের ভয়েতে কিছু করিতে না পারি। আমার কৌশলে পাকে ভীম যদি মরে অনায়াসে যুধিষ্ঠিরে মারি তারপরে।' কুচক্র করিয়া তবে দুষ্ট দুর্যোধন নদীতীরে উৎসবের করে আয়োজন- একশত পাঁচ ভাই মিলি একসাথে আমোদ আহ্লাদে ভোজে মহানন্দে মাতে। হেন ফাঁকে দুর্যোধন পরম যতনে বিষের মিষ্টান্ন দেয় ভীমের বদনে। অচেতন হল ভীম বিষের নেশায়, সুযোগ বুঝিয়া দুষ্ট ধরিল তাহায়, গোপনে নদীর জলে দিল ভাসাইয়া, কেহ না জানিল কিছু উৎসবে মাতিয়া।। এদিকে নদীর জলে ডুবিয়া অতল তলে ভীমের অবশ দেহে ,কেমনে জানে না কেহ, কোথায় ঠেকিল শেষে বাসুকী নাগের দেশে। ভীমের বিশাল চাপে নাগের বসতি কাঁপে দেহ ভারে কত মরে, কত পলাইল ডরে , কত নাগ দলে বলে ভীমেরে মারিতে চলে দংশিয়া ভীমের গায় মহাবিষ ঢালে তায়। অদ্ভুত ঘটিল তাহে ভীম চক্ষু মেলি চাহে , বিষে হয় বিষক্ষয় মুহুর্তে চেতনা হয়, দেখে ভীম চারিপাশে নাগেরা ঘেরিয়া আসে দেখিয়া ভীষণ রাগে ধরি শত শত নাগে চূর্ণ করে বাহুবলে, মহাভয়ে নাগে দলে ছুটে যায় হাহাকরে বাসুকী রাজার দ্বারে। বাসুকী কহেন, 'শোন আর ভয় নাহি কোন, তুষি তারে সুবচনে আন হেথা সযতনে।' রাজার আদেশে তবে আবার ফিরিয়া সবে করে গিয়া নিবেদন বাসুকীর নিমন্ত্রণ ! শুনি ভীম কুতুহলে রাজার পুরীতে চলে , সেথায় ভরিয়া প্রাণ ,করিয়া অমৃত পান বিষের যাতনা আর কিছু না রহিল তার , মহাঘুমে ভরপুর সব ক্লান্তি হল দুর তখন বাসুকী তারে স্নেহভরে বারে বারে আশিস করিয়া তায় পাঠাইল হস্তিনায় । সেথা ভাই চারিজনে আছে শোকাকুল মনে কুন্তীর নয়নজল ঝরে সেথা অবিরল , মগন গভীর দুখে ফিরে সবে ম্লান মুখে । হেন কালে হারানিধি সহসা মিলালো বিধি বিষাদ হইল দুর জাগিল হস্তিনাপুর , উলসিত কলরবে আনন্দে মাতিল সবে।।
সুকুমার রায়
ছড়া
চলে হনহন ছোটে পনপনঘোরে বনবন কাজে ঠনঠনবায়ু শনশন শীতে কনকনকাশি খনখন ফোঁড়া টনটনমাছি ভনভন থালা ঝন ঝন।কাব্যগ্রন্থঃ- হ য ব র ল
সুকুমার রায়
হাস্যরসাত্মক
আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা— ছয়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা । ছায়া ধরার ব্যাবসা করি তাও জানোনা বুঝি ? রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি ! শিশির ভেজা সদ্য ছায়া, সকাল বেলায় তাজা, গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া ভীষণ রোদে ভাজা । চিলগুলো যায় দুপুরবেলায় আকাশ পথে ঘুরে, ফাঁদ ফেলে তার ছায়ার উপর খাঁচায় রাখি পুরে । কাগের ছায়া বগের ছায়া কত ঘেঁটে হাল্কা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখেছি চেটে। কেউ জানে না এ–সব কথা কেউ বোঝে না কিছু, কেউ ঘোরে না আমার মত ছায়ার পিছুপিছু। তোমরা ভাব গাছের ছায়া অমনি লুটায় ভূঁয়ে, অমনি শুধু ঘুমায় বুঝি শান্ত মত শুয়ে; আসল ব্যাপার জানবে যদি আমার কথা শোনো, বলছি যা তা সত্যি কথা, সন্দেহ নাই কোনো। কেউ যবে তার রয়না কাছে, দেখতে নাহি পায়, গাছের ছায়া ফটফটিয়ে এদিক ওদিক চায়। সেই সময়ে গুড়গুড়িয়ে পিছন হতে এসে ধামায় চেপে ধপাস করে ধরবে তারে ঠেসে। পাতলা ছায়া, ফোকলা ছায়া, ছায়া গভীর কালো— গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভাল।গাছ গাছালি শেকড় বাকল মিথ্যে সবাই গেলে, বাপ্‌রে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে। নিমের ছায়া ঝিঙের ছায়া তিক্ত ছায়ার পাক, যেই খাবে ভাই অঘোর ঘুমে ডাকবে তাহার নাক। চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পারো, শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো। আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়, লাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নেই তায়। আষাঢ় মাসের বাদলা দিনে বাঁচতে যদি চাও, তেঁতুল তলার তপ্ত ছায়া হপ্তা তিনেক খাও। মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া 'ব্লটিং' দিয়ে শুষে, ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে! পাক্কা নতুন টাট্‌কা ওষুধ এক্কেবারে দিশি— দাম করেছি সস্তা বড় চোদ্দ আনা শিশি।
সুকুমার রায়
প্রকৃতিমূলক
জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত- অফুরান্‌ নামতায় বাদলের ধারাপাত । আকাশের মুখ ঢাকা, ধোঁয়ামাখা চারিধার, পৃথিবীর ছাত পিটে ঝামাঝম্‌ বারিধার । স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়, নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায় । উৎসব ঘনঘোর উন্মাদ শ্রাবণের শেষ নাই শেষ নাই বরষার প্লাবনের । জলেজলে জলময় দশদিক্‌ টলমল্‌, অবিরাম একই গান, ঢালো জল ঢালো জল । ধুয়ে যায় যত তাপ জর্জর গ্রীষ্মের, ধুয়ে যায় রৌদ্রের স্মৃতিটুকু বিশ্বের । শুধু যেন বাজে কোথা নিঃঝুম ধুক্‌ধুক্‌, ধরণীর আশাভয় ধরণীর সুখদুখ ।
সুকুমার রায়
ছড়া
খেলার ছলে ষষ্ঠিচরণ হাতী লোফেন যখন তখন, দেহের ওজন উনিশটি মন, শক্ত যেন লোহার গঠন। একদিন এক গুন্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মারল বেগে- ভাঙল সে বাঁশ শোলার মত মট্ ক'রে তার কনুই লেগে। এইত সে দিন রাস্তা দিয়ে চল্‌‌‌তে গিয়ে দৈব বশে, উপর থেকে প্রকান্ড ইট পড়্ল তাহার মাথায় খ'সে। মুন্ডুতে তার যেম্‌‌নি ঠেকা অম্‌‌নি সে ইট এক নিমিষে গুঁড়িয়ে হ'ল ধুলোর মত, ষষ্ঠি চলেন মুচকি হেসে। ষষ্ঠি যখন ধমক হাঁকে কাঁপ্‌‌‌তে থাকে দালান বাড়ী, ফুঁয়ের জোরে পথের মোড়ে উল্টে পড়ে গরুর গাড়ী। ধুম্‌‌সো কাঠের তক্তা ছেঁড়ে মোচড় মেরে মুহূর্তেকে, একশো জালা জল ঢালে রোজ স্নানের সময় পুকুর থেকে। সকাল বেলার জল পানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া, সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়কি দেওয়া । দুপুর হ'লে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেক্‌‌চি ভ'রে, বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ণা হরে। বিকাল বেলা খায়না কিছু গন্ডা দশেক মন্ডা ছাড়া, সন্ধ্যা হলে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া । রাত্রে সে তার হাত পা টেপায় দশটি চেলা মজুত থাকে, দুম্‌দুমাদুম্ সবাই মিলে মুগুর দিয়ে পেটায় তাকে। বললে বেশি ভাব্‌‌বে শেষে এসব কথা ফেনিয়ে বলা- দেখবে যদি আপন চোখে যাওনা কেন বেনিয়াটোলা।
কালীপ্রসন্ন ঘোষ
নীতিমূলক
‘পারিব না’ একথাটি বলিও না আর, কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার; পাঁচজনে পারে যাহা, তুমিও পারিবে তাহা, পার কি না পার কর যতন আবার একবার না পারিলে দেখ শতবার।পারিবে না বলে মুখ করিও না ভার, ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার। অলস অবোধ যারা কিছুই পারে না তারা, তোমায় তো দেখি নাক তাদের আকার তবে কেন ‘পারিব না’ বল বার বার ?জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার, হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়, সাঁতার শিখিতে হলে আগে তবে নাম জলে, আছাড়ে করিয়া হেলা ‘হাঁট’ আর বার; পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসার।
রথো রাফি
স্বদেশমূলক
মানুষ সবচেয়ে সুন্দর মানুষের জিভ যখন উচ্চারণ করে তার মহৎ হৃদয় মানুষ সবচেয়ে সুন্দর ন্যায়ের দাবিতে অটল হয়ে ওঠে যখন লক্ষ লক্ষ দ্রোহী হাত মানুষ সবচেয়ে সুন্দর সত্যের শ্লোগানে শ্লোগানে হয়ে ওঠে যখন অন্তহীন উত্তাল শাহবাগ প্রিয় শাহবাগ এখন সেইসব অতুলনীয় মানুষের উত্তাল সাগর সমস্ত মরচে পড়া মানুষ দেখেছি সত্য-প্রেমী এই জনসমুদ্রের অন্তহীন ঢেউ হয়ে উঠেছে আবার শাহবাগ প্রিয় শাহবাগ গেয়ে উঠেছে আবারও সেই সত্য-প্রেমী অপূর্ব গানসমস্ত সম্মিলিত মানুষের দাবি পৃথিবীর সর্বোচ্চ দাবি সমস্ত সম্মিলিত মানুষের গান সবচেয়ে মহৎ গান সমস্ত সম্মিলিত মানুষের দাবি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আইন সমস্ত সম্মিলিত মানুষের দাবি সর্বোচ্চ মঙ্গল পৃথিবীরশাহবাগ প্রিয় শাহবাগ গেয়ে উঠেছে আবারও সেই সত্য-প্রেমী অপূর্ব গান মুহম্মদ চিরজীবী হয়েছেন কারণ ন্যায়ের দাবিতে মাথা উঁচু ছিলেন পুরোটা জীবন মুহম্মদ আনন্দে হাসছেন এখন এই শাহবাগ থেকে ভেসে আসা ন্যায়ের দাবির গর্জন শোনে মুহম্মদ আমাদের শিখিয়েছেন যতোক্ষণ ন্যায়ের দাবিতে মানুষ অনড় এগিয়ে চলে ততক্ষণ মানুষ বিপ্লবী তার প্রতিটি পদক্ষেপই বিপ্লবী পদক্ষেপ মরে যাননি সক্রেটিস কারণ ন্যায়ের দাবিতে অটল ছিলেন তিনি তার মৃত্যুক্ষণেও এমনকি মৃত্যুর মুহূর্তে মোরগের দেনাটাও মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি তাই হেমলকেরই মৃত্যু ঘটেছে ওই সক্রেটিসের ঠোঁটে সক্রেটিস এসেছেন এসেছেন আবার আমাদের এই শাহবাগ চত্বরে যিশুর মৃত্যু হয়নি কখনো কারণ সত্যের দাবিতে ছিলেন অটল ক্রুশের উপর ডানা মেলে উড়ছেন এখন আর আনন্দে হাসছেন এই শাহবাগের দিকে চেয়েই হাসছেন তার মাথার উপর অসংখ্য নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা দেখে আর তার পায়ের নিচে অগণন মানুষের নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠা দেখে বুদ্ধ মরে যান্ নি কারণ ন্যায়ের দাবিতে তার আত্মা এক চির-উৎসারিত নদী তার আত্মা থেকে ন্যায়বিচার আর প্রেমের অনিঃশেষ স্রোতধারা বয়ে আসছে এই শাহবাগে বুদ্ধ হাসছেন খুশিতে এখন এই শাহবাগের দিকেই চেয়ে চেয়ে মরে যাননি মার্কস কারণ ন্যায়ের দাবিতে ছিলেন অটল এক হিমালয় শাহবাগের দিকে তাকিয়ে তার মুখ প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে আবার তিনিও শিখিয়েছেন আমাদের মানুষ ততক্ষণই বিপ্লবী যতোক্ষণ সে সত্য উদঘাটন করে আর প্রতিষ্ঠা করে ওই সত্যের সৌন্দর্যটুকু আর অবিচার মেনে নেননি বলেই তার চিরকালের দেবতা জীবনে শিব মরে যাননি কখনোই অগণন তরুণের রূপ ধরে তিনি এখন নেচে চলেছেন এই শাহবাগ চত্বরেই শ্লোগানে শ্লোগানে ফেটে পড়ছেনকারণ সত্য কোন মৌসুমি পাখি নয় যে ভিন দেশ থেকে উড়ে এসে আবার ভিন দেশেই উড়ে যাবে সত্যতো জন্মায় একটা জাতির ইতিহাসের অন্তহীন রক্তধারার গভীর থেকে সত্যতো জন্মায় একটা জাতির বিস্মৃতির বিরুদ্ধে অপরাজেয় এক লড়াই থেকে সত্য কোন মৌসুমি পাখি নয় যে-শীত শেষ হলে ফিরে যাবে দূর সাইবেরিয়ায় আমাদের ন্যায়ের দাবি উঠে এসেছে আমাদেরই ইতিহাসের অতল থেকে তুলনাহীন হাসি ফুটে উঠেছে আমাদের অগণন শহীদের মুখে মুখে আবার কারণ তাদের তরুণ-উত্তরসূরিরা ন্যায়ের দাবিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে আবারএদেশের প্রতিটি নদী এখন ন্যায়ের নদী এদেশের প্রতিটি গাছ এখন সত্যের আকাশের দিকে তার সবুজ হাত তুলে ধরেছে প্রতিটি নতুন শিশু সত্যের রোদে এখন স্নান করে নিচ্ছে এদেশের প্রতিটি বৃদ্ধ আবার নিজের বংশধারা নিয়ে গর্বে ফুলিয়ে নিচ্ছে বুক প্রতিটি নারী এখন প্রতিটি তরুণের জন্য প্রেমের সমুদ্র তার উন্মুক্ত করে দিয়েছে আবার এদেশের প্রতিটি নারী প্রতিটি পুরুষ প্রতিটি শিশু প্রতিটি বুড়ো তাদের আত্মা থেকে আজ তাদের প্রেম আর স্নেহে সিক্ত সমস্ত রক্তিম ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছে ছিটিয়ে দিচ্ছে শাহবাগের প্রতিটি তরুণের মাথার উপর কারণ শাহবাগ প্রিয় শাহবাগ গেয়ে উঠেছে আবারও সেই সত্য-প্রেমী অপূর্ব গানএই আশ্চর্য সৌন্দর্য দেখে আমার হতাশ আত্মা গান গেয়ে উঠেছে আবার আমার হতাশ আত্মমগ্ন আত্মার দশদিকে একে একে খুলে গেছে পনের শ লক্ষ জানালা আমিও করেছি অনুভব আবার চিন্তার আছে লক্ষ লক্ষ নিজস্ব ডানা ন্যায়ের শক্তিতে ওইসব বর্ণিল ডানা চির অপরাজেয় কোনদিনই কেউ ছেটে দিতে পারে নি ওই সুন্দর ডানা আমাদের চেতনার আকাশ জুড়ে ওইসব অনুপম লক্ষ লক্ষ স্বপ্নের সারস দেখেছি আবারো কী অপূর্ব ভঙ্গিমায় দিয়েছে উড়াল কী নিপুণ ভাবে তাদের পাহাড়া দিচ্ছে রাতের পর রাত আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা দুঃস্বপ্নের জামা খুলে হতাশার কাফন ছিঁড়ে মানুষ সুন্দর হয়ে উঠেছে আবার প্রেম, সত্য আর সৌন্দর্যের দাবিতে উতরোল মানুষ একেকটা নক্ষত্র হয়ে উঠেছে আবারবহুবছর পর আবারো বসন্ত আসছে বসন্ত আসছে এই শীত শেষে সমস্ত জড়সড় আত্মাকে ঝাঁকি দিয়ে ঝরাপাতা ঝরিয়ে সমস্ত রঙ সমস্ত আগুন সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে মানুষগুলোর সবচেয়ে সুন্দর চেতনা পলাশে পলাশে শিমুলে শিমুলে ফেটে পড়বে বলে তাই শাহবাগ শাহবাগই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা শাহবাগ শাহবাগই এই পৃথিবীর মানুষের মাথা উচুঁ করার সর্বোচ্চ চূড়া শাহবাগ প্রিয় শাহবাগই মানুষের গর্বের সেই সর্বোচ্চ চূড়া ওই চূড়া থেকে তাকালেই দেখতে পাবে এই পৃথিবী মানুষের সবচেয়ে মহৎ হৃদয় কারণ শাহবাগ প্রিয় শাহবাগ আবারো গেয়ে উঠেছে সেই সত্য-প্রেমী অপূর্ব গানশাহবাগ প্রিয় শাহবাগ আবারো হয়ে উঠেছে তারুণ্যে তীব্র উজ্জ্বল আর সৌন্দর্য আর সুস্থতার দিকে অপূর্ব যাত্রা শুরু করেছে সমস্ত মানুষ বাংলার সমস্ত মানুষের হৃদয়ে তাই পলাশের লাল শিখার মতো ফুটে উঠেছে অতুলনীয় এই শাহবাগ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অনুপম এই শাহবাগ সম্মিলিত মানুষের দাবিতেই ফুটে উঠেছে পলাশের মতো শ্রেষ্ঠ সত্য কারণ শাহবাগ প্রিয় শাহবাগ আবারো গেয়ে উঠেছে সেই সত্য-প্রেমী অপূর্ব গান সেই গান শুনে আমাদের এই হতাশ আত্মা আশ্চর্য আশার উল্কা হয়ে জ্বলে উঠেছে আবার পানকৌড়ির মতো ডুব দিয়েছে সত্যের সন্ধানে ইতিহাসের গহীন স্রোতে নিজের অজান্তেই শিখে নিয়েছে মানুষের ভুলে যাওয়া সব মহৎ অধ্যায়সমস্ত সম্মিলিত মানুষের দাবি পৃথিবীর সর্বোচ্চ দাবি সমস্ত সম্মিলিত মানুষের গান সবচেয়ে মহৎ গান সমস্ত সম্মিলিত মানুষের দাবি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আইন সমস্ত সম্মিলিত মানুষের দাবি সর্বোচ্চ মঙ্গল পৃথিবীরশাহবাগ প্রিয় শাহবাগ গেয়ে উঠেছে আবারও সেই সত্য-প্রেমী অপূর্ব গানবাংলাদেশ সময় : ১৪০৯ ঘণ্টা, ০৫ মার্চ ২০১৩
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
অনুবাদ: ইমন জুবায়েরসাদা মৌমাছি, তুমি আমার ভিতরে গুনগুন কর- তুমি মধু পান করে মাতাল ধোঁওয়ার ধীর কুন্ডলীতে তুমি ঘুরে ঘুরে উড়ছ আমি দিশেহারা, প্রতিধ্বনিশূন্য শব্দ, সকলই হারিয়েছে যে- অথচ যার সকলই ছিল। সর্বশেষ বাঁধন, আমার আকাঙ্খায় তুমি তোল ঝড় আমার বিরানভূমিতে তুমিই সর্বশেষগোলাপ। আহ্, তুমি কী নিশ্চুপ! তোমার গভীর চোখ বন্ধ কর। রাত্রি নামছে ওহ্, তোমার শরীর এক সুগন্ধী ভাস্কর্য, নগ্ন। তোমার গভীর চোখে রাত্রি নামে ফুলের শীতল হাত আর গোলাপের কোল। সাদা শামুকের মতন তোমার স্তন তোমার নাভীর ওপর ছায়ার প্রজাপতিরা ঘুমাতে এসেছে। আহ্, তুমি কী নিশ্চুপ! এই নির্জনতায় তুমি নেই। বৃষ্টি ঝরছে। সমুদ্রবাতাস শঙ্খচিলদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ভেজা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটছে জল গাছের পাতারা বলছে ওদের শরীর খারাপ সাদা মৌমাছি, যখন তুমি আমার ভিতরে গুনগুন কর তুমি আবার সময়ে বাঁচ, তন্বি-নীরব। আহ্ তুমি কী নিশ্চুপ!
পাবলো নেরুদা
রূপক
অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিবআজকে শুয়েছিলাম এক খাটি তরুনির পাশে সাদা সাগরের তিরে জ্বলন্ত তারাদের ঠিক মাঝখানে সব ঘটছিল খুব আস্তে আস্তে টানা সবুজ চাহনিতে ঝলসানো আলোতে শুকনো পানির দাগ টলটলে গভির গোল্লাছুটের তিব্র আর তাজা আবেগ বুকের বোটায় দুটি দুমুখি মশাল জ্বলছে খাড়া দুই দুটি অঞ্চলেঃ জ্বলতে জ্বলতে গলেছিল নদিপথে পরিস্কার পায়ের পাতায় মৌসুমি বাতাসে সবে ফলন ধরেছে শরিরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা নিজেকে ভরে তুলেছে গাছপাকা ফলে গোপন অনলে ।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদঃ শিরীষরাতের আঁধার থেকে স্মৃতির কুহকে ভেসে যাই নদীর আর্তনাদ মিশে গেছে সমুদ্রের বুকে ভোরের একলা তৃণের মত আমি আর কেউ নেই কিছু নেই মৃত পুষ্পের বরষায় ধ্বংস কূপের গভীরে গভীরে ঢুকে যাই ধ্বংস আর উড্ডয়নে মিশে আছ তুমি তোমার বুকের কিনার থেকে উড়ে উড়ে চলে গেছে গানপাখি দল এই অন্তরালের মত ডুবিয়ে দিয়েছ সব সমুদ্র অথবা সময়ের মত সবকিছু ডুবে গেছে তোমার গভীরে সে এক অন্য প্রহর ছিল রক্তের, চুম্বনের জাদুর প্রহরে যেন জ্বলে ওঠা বাতিঘর তোমাতেই ডুবে গেছে উচ্ছন্নের প্রেম, নাবিকের ভয় শিশিরের শৈশবে আমার আত্মার জাগরণ, তার আলীন উড়াল আহত পাখা – সবকিছু নিমগ্ন করেছ তুমি কষ্ট জড়িয়ে ধরে ইচ্ছে ছুঁয়েছ তুমি বিষণ্নতায় নির্বাক তোমার সুকরুণ বুকে ডুবে গেছে সব যত কামনা আর পৃথিবীর কাজ পিছু ফেলে বানিয়েছি ছায়ার দেয়াল – চলে যাই হায় আমার শরীর, হায় হারানো কিশোরী! শুনে নাও বৃষ্টিপ্রহরের সব গান কাঁচের বয়ামে তুমি অসীম মমতা রেখেছিলে আর অবাক বিস্মরণে চৌচির হয়ে গেছ তুমি সেই মমতার কাঁচ সুদূর দ্বীপের কোন আঁধার নির্জনতায় ডেকে নিয়েছিলে তৃষ্ণা ক্ষুধায় ছিলে ধ্বংসে ব্যথায় ছিলে, তুমি বিস্ময়। কী করে ধারণ করেছিলে বল আত্মার নিগড়ে, আলিঙ্গনে! কতটা অঘোর অথবা ক্ষণস্থায়ী প্রার্থনা ছিলো আমার কতটা দুঃসাধ্য মাতাল, উদ্বিগ্ন লোভাতুর চাওয়া ছিলো তা ! সোহাগশ্মশান, তোমার সমাধিতে এখনও প্রদীপ জ্বলে পুষ্প ফলের শাখা পুড়ে পুড়ে যায় পাখিরা ঠুকরে খায় হায় এই দংশিত মুখ, চুম্বনসিক্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আগ্রাসী দাঁত, জড়ানো শরীর হায় আশা আর পীড়নের শংখজড়াজড়ি যেইখানে মিশে গেছি, নিঃশেষ হয়েছিতুমি আমি আলো আর জলের মত ছড়িয়ে গিয়েছে মমতারা সব ধীরলয়ে কথা ফোটা ঠোঁটে এই ছিলো আমার নিয়তি ঐ একটাই কাঙ্খিত ভ্রমণ সব চাওয়ারা মিশে গেছে সেইখানে, তোমাতেই নিমজ্জিত হয়েছে সব! হায় ধ্বংসস্তূপের কূপ, সব ডুবেছেতোমাতে কোন্ ব্যথাটা আশা করনি তুমি, ডোবনি কোন্ বেদনায়? কোনো এক নাবিকের মত জাহাজের মাস্তুল থেকে ঢেউ থেকে ঢেউয়ে তুমি ডেকে গেছ, গেয়ে গেছ— তুমি এখনো গানের প্রসূন, স্রোত বেঁধে রাখ ওহ ধ্বংস আমার বেদনা তীব্র কর অন্ধ ডুবুরী, ব্যর্থ শিকারী পথহারা নাবিক – সবাই যে ডুবে গেছে তোমার শরীরে রাত যেই ক্ষণ বেঁধে দিয়েছে সমস্তদিনপঞ্জিকায় চলে যাওয়ার সেই শীতল প্রহর এসে গেছে অবাধ্য ঢেউ সব মিলে গেছে সমুদ্রতীরে শীত নক্ষত্র জেগে ওঠে, রাত্রি পাখিরা চলে যায় রাতভোরের নিঃসঙ্গ জেটির মত আমি আমার তালুতে মুচড়ে ওঠে কম্পিত ছায়া দূর থেকে দূরে, সুদূরে সুদূরে এখন বিদায় হে বন্ধু বিদায়!
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদ: ইমন জুবায়েরও আলোর স্তম্ভ, বিষন্ন সুন্দর ঐ বৃহদায়তন কন্ঠহার আর সমুদ্রের মূর্তি চুনাপাথর-চোখ, বিপুলা জলধির সম্মান, শোকার্ত সমুদ্র-পাখির কান্না, সমুদ্রের দাঁত, প্রশান্ত বাতাসের স্ত্রী, ও অতলের নিষ্পেষিত ঝোপের দীর্ঘ কান্ড থেকে উত্থিত পৃথক গোলাপ রুপান্তরিত দীপপুঞ্জমালা ও প্রাকৃতিক নক্ষত্র, সবুজাভ উষ্ণীষ একা তোমার নিঃসঙ্গ সাম্রাজ্যে এখনও অর্জনশূন্য, পলায়নপর, জনমানবশূন্য একটি বিন্দুর মতন, একটি আঙ্গুরেরমতন, সমুদ্রের মতন।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিবদুপুরের বুকে ঝুকে পড়ে বিষন্নতার জাল ছুড়েছিলাম তোমার সাগর-নিল চোখের জলে ওখানে গনগনে হলকায় আমার একাকিত্ত্ব বাড়ে ডুবন্তের হাত তড়পায় বানের জলের তোড়ে তোমার অন্যমনস্ক চোখে আমি লাল সংকেত পাঠিয়েছি চাহনি দুলেছিল সাগরবেলাতে দাঁড়ানো বাতিঘরে দুরের নারি তুমি কেবল অন্ধকার ধরো শঙ্কাপারে আশঙ্কা থরো থরো দুপুরের বুকে ঝুকে বিশ্ননতার জাল ছুড়েছিলাম সেই সাগরে আছড়ে পড়ে তোমারই সাগর-নিল চোখ তোমার সাথে সঙ্গম অনেকটা রাতচরা পাখিদের দানা খুটে খুটে খাওয়া রাত সওয়ার এখন ছায়াবতি ঘোড়ার জিনে রাত মাটিতে বুনেছে রাতের নিল টাসেল ।
পাবলো নেরুদা
রূপক
অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিবএবং ঐ বয়সটাতে…কবিতা এসেছিল আমার খোজে।আমি জানতাম না, জানতাম না কোথ্যেকে, শিতকাল না কি নদি থেকে, কিভাবে কখন জানতে পারি নি, না, কোনরকম শব্দও শুনিনি, নিশব্দও না, কিন্তু রাস্তা থেকে ও আমাকে ডেকেছিল, পুড়তে পুড়তে, ভয়ঙ্কর আগুনের হলকায় হুটোপুটি করতে করতে, রাতের ডালপালারা ডেকেছিল ইশারায়ঃ ভিড় থেকে দুরে সরে যেতে বলেছিল আমার তখন কোন চেহারাই ছিলনা কিন্তু কবিতা ঠিক ঠিক আমার চেহারাকেই ছুয়েছিল জানতাম না ঠিক কি বলতে হবে, আমার মুখে নাম ধাম তেমন আসেনা, চোখ তখন অন্ধ, ভেতরে কেমন একটা তোলপাড়, জ়্বর জ্বর ভাব য্যনো পথ হারানো ডানা-ভাঙ্গা পাখি, কিন্তু ঠিকই পথ বের করে ফেলেছিলাম ঐ ভয়ঙ্কর আগুনের গোপন সংকেতের পাঠ শিখে নিয়েছিলাম, প্রথম অস্পষ্ট লাইনটি হুট করেই চলে এসেছিল, অস্পষ্ট , বড় কোন অর্থ নেই, কিন্তু খাটি, আগামাথা নেই, বকুনি, কিন্তু নির্ভেজাল জ্বান, অগ্বানের গ্বান আর কি হঠাত স্বর্গ দেখে ফেলেছিলাম, স্বর্গের দুয়ার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে তারারা পিট পিট করছে ছায়ারা ছিড়ছে খুড়ছে ছায়াতে, তারাতে তির ধনুকে, আগুন এবং ফুলদের ধাধা, রাত আর পৃথিবি এলানো বিশ্রামে। এবং আমার অস্তিত্বের শেষ নেই, মহান তারাদের শুন্যতায় মাতাল,রহস্যের ছবি ও ছায়ায় নিখোজ নিজের ভেতরের গোলক ধাধায় কিন্তু খাটি বাদলা বাতাসে তারাদের মেলায় ।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদঃ অসিত সরকারনির্জন কবরখানা স্মৃতিস্তম্ভগুলো নিঃশব্দ অস্থিতে পরিপূর্ণ, অন্ধকার সংকীর্ণ গুহার মধ্যে দিয়ে হৃদয় আসে যায়ঃ যেন জন্মলগ্ন এক জাহাজের খোলের মধ্যে আমরা মারা গেলাম যেন হৃদয়ের অতলান্তে আমরা তলিয়ে গেলাম যেন সত্তার আপন অস্তিত্বে আমরা মিশে গেলাম। অজস্র মৃতদেহ ক্লেদাক্ত হিমেল পা, পাঁজরে পাঁজরে জড়ানো মৃত্যু, পবিত্র একটা শব্দের মতো কুকুরবিহীন তীক্ষ্ণ চিতকারের মতো অশ্রু কিংবা বৃষ্টির আর্দ্রতায় ফুলে ওঠা কবরে নানা ঘন্টাধ্বনির মতো। কখনও কখনও, একা, আমি দেখি কফিনগুলো খোলা পালে বিবর্ণ মৃতদের বয়ে নিয়ে চলেছে, মৃত কুন্তলে জড়ানো নারী, দেবদূতের মতো শুভ্র রুটিওয়ালা, বিষণ্ন কেরানীবধূ, কফিনগুলো নেমে গেলো মৃত্যুর খাড়াই নদীতে, মদিরার মতো রক্তবর্ণ গাঢ় নদী, দারুণ খরস্রোতা, মৃত্যুর শব্দে পালগুলো ফুলে উঠছে পালগুলো ফুলে উঠছে মৃত্যুর নিঃশব্দ ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে। মৃত্যু এসে পৌঁছালো কলশব্দমুখর নদীবেলায় পা-বিহীন একটা জুতোর মতো, মানুষবিহীন একটা পোশাকের মতো আংটি আর আঙুলবিহীন হাতে কড়া নাড়বে বলে সে এসে পৌঁছালো এসে পৌঁছালো মুখবিহীন জিভবিহীন কন্ঠস্বরবিহীন কন্ঠে চিতকার করবে বলে। কখনও প্রতিধ্বনিত হয় না তার পদপাতের শব্দ। গাছের পাতার মতো তার পোশাকের খস্‌খস্‌ শব্দ। আমি ঠিক জানি না, আমি খুব অল্পই বুঝি, আমি খুব কমই দেখি তবু আমার মনে হয় তার গানের রঙ তরল বেগুনে, যে রঙ মাটির সঙ্গে মিশে যায়, কেননা মৃত্যুর মুখ মৃত্যুর অপলক চোখের দৃষ্টি অবিকল সবুজ, বেগুনে পাতার বিদীর্ণ আর্দ্রতায় উন্মত্ত শীতের রঙ বিষণ্ন ধূসর। অথচ পল্লবের ছদ্মবেশে মৃত্যু পৃথিবীর মধ্য দিয়ে চলে যায় মৃতের খোঁজে মাটি থেকে লাফিয়ে ওঠে, মৃত্যু পল্লবে মুখ ঢাকে, মৃত্যুর জিভ খোঁজে শবদেহ, মৃত্যুর ছুঁচ খোঁজে সুতো। মৃত্যু আমাদের দোলনার আশেপাশে সস্তা মাদুরে, কালো কম্বলে মৃত্যু মাথা গুঁজে থাকে, তারপর সহসা উধাও- বিষণ্ন শব্দে চাদর দুলিয়ে সে চলেযায় আর বিছানাগুলো পাল তুলে ভেসে যায়বন্দরের দিকে যেখানে সম্রাটের মতো সুসজ্জিত পোশাকে অপেক্ষা করে থাকে মৃত্যু।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদ: ইমন জুবায়েরপিঙ্গলবর্ণের উচ্ছ্বল শিশু, সূর্য -যা সৃজন করে ফল আর শষ্যকে করে পরিপক্ক, সমুদ্রশ্যাওলাকে করে আন্দোলিত তোমার সুখি শরীর আর তোমার উজ্জ্বল চোখ করেছে নির্মান আর তোমার মুখে দিয়েছে জলের হাসি। কৃষ্ণকায় এক যন্ত্রণাকাতর সূর্যকচি পাতায় জড়ানো তোমার কালো কেশরে যখন তুমি বাড়িয়ে দাও হাত তুমি সূর্যালোকে খেলে বেড়াও যেনবা জোয়ারের নদী আর তা তোমার চোখে কালো দুটি জলাশয় রেখে যায়। পিঙ্গলবর্ণের উচ্ছ্বল শিশু, তোমার দিকে আমাকে নেয় না কিছুই এই অপরাহ্নে সবই আমাকে টেনে সরিয়ে দিচ্ছে। তুমি মৌমাছির উদ্দাম যৌবন, ঢেউয়ের মাতলামি, তাপের শক্তি। আমার ঘোর লাগা হৃদয় সবর্দা তোমায় খোঁজে আমি তোমার সুখি শরীর ভালোবাসি, তোমার ঐশ্বর্যময় নম্র কন্ঠস্বর। গোধূলির প্রজাপতি, মিষ্টি ও নিশ্চিত গমক্ষেতের মতো, সূর্য, পপিফুল,আর তোমার জল।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
আর কিছু নয় সত্যের সাথে আমার চুক্তি এ পৃথিবীর জন্যে সঞ্চয় করবো আলো আমি যা চাই তা হলো রুটি সংগ্রাম কোনো দিনই অভাব অনুভব করবে না আমার অথচ এখানে যাকিছু ভালোবাসি সবই পেয়েছি যা হারিয়েছি তা হলো নির্জনতা। এখন আমি আর ওই পাথরের ছায়ায় বিশ্রাম নিই না সমুদ্র কাজ করে চলেছে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে আমার সত্বায়।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিবখাস কলিজায় পাক সাফ চোখে আমি তোমার সৌন্দর্জ উদজাপন করি অঝরে ঝরা রক্তপাত ধরে রাখি যাতে তা লাগাম পরাতে পারে আমার কবিতায় শোয়া তোমার শরিরের বাকে জংগল ঘেরা জমিতে অথবা সমুদ্রে সার্ফিংঃ সুগন্ধি ফেনায় সাগরের বাজনায়। ও নেংটো সুন্দরিঃ সমান তালে তালে সুন্দর তোমার পায়ের পাতা প্রাচিন বাতাস আর শব্দের কারুকাজ আঙ্গুলের ভাজেঃ কানের লতি আমেরিকান সাগর সেচা ছোট ছোট শামুকের খোল; পুরুষ্ঠ বুক জোড়ায় জ্যন্ত জ্যন্ত আলোর কলরোল উড়ন্ত পাপড়িরা খুলছে আর ঢাকছে চোখের দুই গভির মহাদেশ তোমার ঘাড়ের বাক যেখানে দু’ভাগে হারিয়েছে ধুসর পায়ের চামড়ায় সেখানেই গলেছে মাঝখানে সমান করে কাটা আপেলের জমকালো দুটি টুকরো, তোমার সৌন্দর্জ দু’ভাগে নেমে যায় সোনায় মোড়ানো দুটি থাম্বায়- আমরা যাদের বলি রান বা উরু ধিরে ধিরে ডূবে যায় আঙ্গুরের থোকায় ঢাকা পায়ের পাতায়, ওখানে তোমার জমজ গাছ আবার পোড়ে এবং আবারো ওড়েঃ আগুন ঝরায়, ঝাড়বাতি দোলায়, গাছপাকা ফল সাগরের সাথে পৃথিবির মিতালি পাতায় কি খনিজে, কি ভেষজে তৈরি তোমার দেহা- মনকা পাথরে, সোলেমানি আকিকে, সিলিকা বালুকনায়, গমের একহারা দানায়, তান্দুরিতে ফুলে ওঠা পাউরুটি সংকেত পাঠাচ্ছে রুপালি পাহাড়কে, মিষ্টি ফলের ভেতর নরম মখমল, ততক্ষন হাশফাশ যতক্ষন আশ তুলতুলে আর পেটোয়া নারির গড়ন? শুধুমাত্র আলোই পৃথিবিতে ঝরে না, তোমার দেহের ভেতর ছড়াচ্ছে দম আটকানো তুষার ধরেই নিয়েছে ওরা ভিতর বাড়িতে তুমি পুড়ে খাক বাহির বাড়িতে চামড়ার ভাজে ভাজে চাদের সর্বনাশ ।
পাবলো নেরুদা
মানবতাবাদী
অনুবাদ:ইমন জুবায়েরআমার জন্মের সঙ্গে জেগে ওঠ ভাই আমার গভীর থেকে বাড়িয়ে দাও তোমার মলিনহাত । এইসব পাথরের দৃঢ় শাসন থেকে ফিরবেনা তুমি। পাতালের সময় থেকে উঠবে না জেগে । ফিরে আসবে না তোমার খসখসে কন্ঠস্বর, কোটর থেকে তোমার বিস্ফারিত চোখ দুটি উঠে আসবে না। মৃত্তিকার গভীর থেকে এই আমাকে দ্যাখো, ফসলের মাঠের কর্মি, তাঁতী, মৌন মেষপালক, টোটেমিয় প্রাণির রক্ষক, উচুঁ ঝুঁকিপূর্ন ভারার রাজমিস্ত্রি আন্দেজের কান্নার বরফমানুষ থেঁতলানো আঙুলের স্বর্ণকার কচি ফসলের মাঠে উদ্বিগ্ন চাষা অপচয়ী কাদায় কুমাড় পাত্রে নতুন এই জীবন আনে তোমার প্রাচীন সমাহিত দুঃখ। দেখাও তোমার রক্ত, দেখাও তোমার ক্ষত; আমাকে বল: এখানে আমি নির্যাতিত হয়েছিলাম কারণ, নিম্নমানের রত্নপাথর কিংবা পৃথিবী সময়মতো শষ্য ও রত্নপাথর দিতে পারেনি। আমাকে দেখাও কোন্ পাথরের ওপর তুমি ছটফট করেছ কোন অরণ্যের কাঠে তারা তোমায় করেছে ক্রশবিদ্ধ। পুরনো পাথর ঘষ জ্বালাও প্রাচীন প্রদীপ, আলোকিত কর চাবুক শতাব্দী ধরে তোমার ক্ষতে আঠার মতন লেগে আছে আর আলোকিত কর তোমার রক্তে ভেজা কুঠার । আমি তোমার মৃত মুখের ভাষা দিতে এসেছি। বিশ্বজুড়ে মৃত ঠোঁট একত্রিত হও, গভীর থেকে উঠে এসে এই দীর্ঘ রাত্রি আমার সঙ্গে ঘূর্নায়মান হোক যেন আমি তোমার সঙ্গে নোঙরে বাধা। আর আমাকে সব বল, স্তর থেকে স্তরে বল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বল, ধাপে ধাপে বল। যে ছোরাটি লুকিয়ে রেখেছ সেটিতে ধার দাও বিদ্ধ কর আমার পাঁজরে, আমার হাতে, সূর্যবিস্ফোরনের ঝঞ্ছার মতো সমাহিত জাগুয়ারের আমাজন এবং আমাকে কাঁদতে দাও, ঘন্টা, দিনও বছর অন্ধ সময়, সৌর শতাব্দী। আর আমায় স্তব্দতা দাও, জল দাও, আশা দাও। সংগ্রাম দাও, লৌহ, আগ্নেয়গিরি। শরীরগুলি আমার শরীরে চুম্বুকের মতন আটকে আমার শিরায় আমার মুখে আসুক দ্রুত কথা বলুক আমার ভাষায় আমার রক্তে ।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদ: ইমন জুবায়েরপ্রায়শ এমন হয়-নিজেকে মানুষ ভাবলে বমনেচ্ছা হয় হেঁটে যাই দর্জির দোকান আর সিনেমাহলের ভিতর দিয়ে শুকিয়ে ওঠা, জলনিরোধক, পশমী কাপড়ের তৈরি একটি রাজহাঁস নিয়ন্ত্রণ করছে আমার পথ ছাই আর জরায়ূর জলে। নাপিতের দোকানের গন্ধ আমাকে ঠেলে দেয় ঘোড়ার কান্নার ভিতরে আমি কেবল পাথর কি পশমের মতন স্থির শুয়ে থাকতে চাই আর আমি দোকান আর আমি বাগান দেখতেচাই না দেখতে চাই না পন্য, চশমা, লিফট। প্রায়শ এমন হয়- আমার পা ও নখের ওপর ঘেন্না ধরে যায় আর আমার চুল আর আমার ছায়ায় বমনেচ্ছা হয় । প্রায়শ এমন হয়-নিজেকে মানুষ ভাবলে বমনেচ্ছা হয়। এখনও বিষয়টি চমৎকার হতে পারে সুন্দর লিলি ফুল দিয়ে একজন আইনেরকেরানিকে ভয় দেখানো অথবা কানে আঘাত করে সন্ন্যাসিনীকে খুন করা বেশ হয় সবুজ চাকু নিয়ে হেঁটে গেলে রাস্তায় ঠান্ডায় মরার আগে তারস্বরে চিৎকার করলে। অন্ধকারে শিকড় হতে আমি চাইনা অনিশ্চিত, ছড়ানো, ঘুমের সঙ্গে শিউরানো নীচে নেমে যাওয়া, একেবারে পৃথিবীর ভেজা-ভেজা নাড়িভুঁড়িতে ভিতরে নিতে নিতে ভাবা, প্রতিদিন খাওয়া। আমি এত দুঃখযাতনা চাইনা। সমাধি ও শিকড়ের মতো আমি হয়ে যেতেচাই না, ভূতলের নীচে একা, গুদাম ভর্তি মৃতদেহ, অর্ধ-দিগন্ত, ক্ষোভে মরে যাওয়া। এই জন্যই সোমবার, যখন আমায় আসতে দেখে আমার দন্ডিত মুখ, গ্যাসোলিনের মতো জ্বলন্ত, আর আহত চাকার মতো চিৎকার করছে পথে আর রাত্রির অভিমুখে ছেড়ে যায় উষ্ণ রক্তভর্তি ট্রাক । আর আমায় ঠেলছে বিশেষ কোণে, আর্দ্র ঘরে হাসপাতালে- যেখানে হাড় উড়ে যায় জানালায়, ভিনেগারের গন্ধওয়ালা জুতার দোকানে, আর চামড়ায় অতি কুৎসিত দাগ লাগা বিশেষ রাস্তায়। ওখানে বাড়ি দরজায় ঝুলে আছে সালফার-রঙা পাখি, আর কদাকার অন্ত্র -যা আমি ঘৃনা করি, আর, কফিপটে ভুলে ফেলে রাখা কৃত্রিম দাঁত, আয়না লজ্জ্বায় আতঙ্কে কাঁদা উচিত সবখানে ছাতা, সর্পবিষ, আর জন্মের নাড়ি। একা ঘুরছি সমাহিত ভঙ্গিতে, আমার চোখ, আমার জুতা আমার ক্রোধ, সবই ভুলে যাচ্ছি, হাঁটছি, অফিস ভবনের ভিতর দিয়ে অর্থোপেডিক দোকান, এবং চত্তরে লাইন ধরে কাপড় শুকোতেদিয়েছে, অর্ন্তবাস, তোয়ালে আর শার্ট থেকেধীরে ময়লা কান্না ঝরছে।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
আমার কাছ থেকে দূরে থেকো না, দয়া করো একটা দিন অনেক অনেক দীর্ঘ সময়, অনেক দূরে ঘুমে থাকা ট্রেনের আশায় নীরব ইস্টিশানের জন্যে, আমার জন্যে। একদন্ড আমায় ছেড়ে যেয়ো না, কারণ- ভয়ের শীতল স্রোত ঘিরে ফেলে আমায়, অথবা ঘর খোঁজা ধোঁয়া এসে চেপে বসে বুকের উপরে, গলা টিপে ধরে আমার। হারিওনা তুমি ছায়া হয়ে সমুদ্র তীরে; তোমার চোখের পাতায় হারিওনা দূরে। এক মুহূর্ত আমার ছেড়ে থেকোনা প্রিয়, এক মুহুর্তে তুমি খুব দূরে চলে যাবে আমি উদ্ভ্রান্ত ভেবে যাব, তুমি আসবে? নাকি আমি আমৃত্যু রয়ে যাব একা?
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
অনুবাদ:ইমন জুবায়েরএকটি কথা আমি তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই । তুমি কি জান আমি যখন আমার জানালার বাইরে মন্থর হেমন্তের লাল ডালে স্ফটিক চাঁদটির দিকে তাকাই, যদি ছুঁয়ে দিই আগুনের কাছটিতে অবোধগম্য কিছু ছাই কিংবা কাটা গুঁড়ির বৃত্তাকার শরীর- এসবই তোমার নিকটে আমায় বহন করে নিয়ে যায়, যেনবা- যা কিছু অস্তিত্বশীল, সুগন্ধ, আলো, কিংবা ধাতুসমূহ, যেনবা ছোট্ট নৌকা যা বইছে আমার জন্য অপেক্ষমান তোমার দ্বীপ অভিমূখে ঠিক আছে, এখন, যদি অল্প অল্প করে আমায় ভালোবাসাকমিয়ে দাও আমিও অল্প অল্প করে তোমায় ভালোবাসা কমিয়ে দেব। সহসা তুমি আমায় ভুলে গিয়ে আমার দিয়ে চেও না, কেননা, এরই মধ্যে আমি তোমায় ভুলতে বসেছি। যদি তুমি অনেকক্ষণ ধরে এসব ভাব আর পাগল হয়ে যাও- পতাকার বাতাস যা বয় আমার জীবনের মধ্য দিয়ে, আর তুমি সিদ্ধান্ত নাও আমায় ছেড়ে যাবে হৃদয়ের পাড়ে যেখানে আমার শিকড়, মনে রেখ যে: ঐ দিনে, ঐ মুহূর্তে, আমি আমার হাত তুলব আর আমার শিকড় যাত্রা করবে অন্য কোনও ভূমির সন্ধানে। কিন্তু, প্রতি দিনে প্রতি প্রহরে তুমি অনুভব করবে আমিই তোমার নিষ্ঠুর মধুর নিয়তি … যদি প্রতিদিন একটি ফুল আমায় খুঁজতে বেড়ে ওঠে তোমার ঠোঁটের দিকে- আহ্ আমার প্রেম, আহ্ আমার আমি, আমার ভিতরে সমস্ত আগুন পুর্নবার হয় আবর্তিত আমার ভিতরে নিভে যায়নি কিছুই, কিংবা হয়নি বিস্মৃত আমার প্রেম তোমার প্রেম পেয়ে বাঁচে, প্রিয়তম, আর আমাকে পরিত্যাগ না করে যতদিন বাঁচবে তোমার আলিঙ্গনে রবে আমার প্রেম।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদ: অসিত সরকারমাঝে মাঝে যখন তোমার কথা ভাবি কি যে খারাপ লাগে! যেহেতু তুমি জানো না আমার সঙ্গে রয়েছে অগণন বিজয়ী মানুষের মুখ যা তুমি দেখতে পাও না, আমার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে অগণন পা আর হৃদয়, তাই আমি একা নই একা হিসেবে নিজের কোনো অস্তিত্বই নেই, আমি কেবল রয়েছি যারা আমার সঙ্গে চলেছে তাদের পুরোভাগে, তাই আমি দুর্বল নই কেননা আমি কেবল আমার ছোট্ট জীবনটাকেই বহন করে নিয়ে চলিনি চলেছি সমস্ত মানুষের হৃদয়কে বহন করে এবং এগিয়ে চলেছি দৃঢ় পায়ে কেননা আমার যে হাজারো চোখে, নিমেষে চূর্ণ করে ফেলি ভয়ঙ্কর সবপাথর কেননা আমার যে হাজারো হাত, তাই আমার কন্ঠস্বর প্রতিটা দেশের সমুদ্রতীর থেকেও শোনা যায় কেননা এ কন্ঠস্বর যারা কখনও কথা বলেনি তাদের, যারা কখনও গান গায়নি তাদের, আর আজ যারা গান গাইছে চুম্বনে তারা তোমাকে স্পর্শ করছে।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিবএকদম উদোম, তুমি তোমার হাতের মতন সাধারন তুলতুলে, সাদামাটা, ছোট্ট, স্বচ্ছ, গোলগাল, চাদের আলোতে, আপেল বাগানেঃ একদম উদোম, গমের দানার মত একহারা একদম উদোম, তুমি কিউবার রাতের মত নিল চুলজুড়ে আঙ্গুর আর তারাদের ভিড় বেশ খোলামেলা আর হলুদাভ গির্জার সোনালি গম্বুজ য্যমনটা গরমকালের আচ একদম উদোম, তুমি তোমার নখের মতই ছোট্ট- বাকানো, সুক্ষ, গোলাপি, দিনের আলোর জন্ম হ’লো মাত্র আর তুমি নিজেকে সরিয়ে নিলে পাতালে কাপড় চোপড়ে ঢাকা এক সুড়ংগপথে তোমার টলটলে আলো পোষাক পরছে-পাতা ঝরছে- আবার হয়ে উঠছে উদোম একটা সাধারন হাত
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদ: ইমন জুবায়েরলেবু ফুল থেকে ঢিলেঢালা ভাবে জ্যোস্নায়, প্রেমের সুদৃঢ় তৃষ্ণার সারৎসার, গন্ধে পরিপূর্ন, লেবু গাছের হলদে উত্থান, লেবুগুলো গাছের কৃত্রিমভবন থেকে নিচের দিকে নড়ছে সংবেদনশীল বানিজ্য! বন্দর এ নিয়ে বৃহৎ বাজার আলোর জন্য ও বর্বর স্বর্ণের জন্য। আমরা অলৌকিকের অর্ধেকটা খুলি, আর, নোনা স্তরের কিনারে জমাট এসিড: সৃষ্টির আদি রস, বিস্ময়কর, অপরিবর্তনীয়, জীবন্ত: কাজেই সজীবতা একটি লেবুর ভিতরে থাকে বেঁচে, খোলশের মিষ্টিগন্ধী আড়তে অনুপাত, অবোধ্য আর কটূ। লেবু কাটতে চাকু একটি ছোট গির্জে রেখে যায়: কুঞ্জকুঠিরগুলি চোখে আন্দাজহীন যা খোলে নোনতা কাচ আলোর দিকে: পোখরাজ ছোট বিন্দুর ওপর উঠছে, বেদিগুলি, সুগন্ধী তোরণ। কাজেই, হাত যখন কাটা লেবু ধরে, অর্ধ-পৃথিবী চামচের ওপর, ব্রহ্মান্ডের স্বর্ন উৎসারিত তোমার স্পর্শে: এক কাপ হলুদ অলৌকিকতায়, একটি স্তন ও স্তনবৃন্ত পৃথিবীকে সুগন্ধে ভরাচ্ছে; ফল উৎপাদনের জোয়ার একটি গ্রহের ছোট আগুন।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
আজ হারিয়ে যাওয়া অরণ্যের গভীরে সে শুনতে পাচ্ছে শত্রুর আওয়াজ, পালাচ্ছে ছুটে অন্যদের থেকে নয়, নিজেরই কাছ থেকে পালাচ্ছে সেইসব সংঘবদ্ধতা জড়িয়ে ছিল আমাদের জীবনের মানে থেকে কারণ শ্ধু একবার,শুধুই একবার একটাই অক্ষর বা নিঃস্তব্ধ খানিকটা বিরতি | অতৃপ্ত ঢেউয়ের শব্দ ঠেলে দেয় সত্যের মুখোমুখি আমায় ব্যাখ্যার কিছু নেই বলারও কিছু নেই, এই সব অরণ্যের দরজাগুলি বন্ধ সব সূর্য পরিক্রমা করে, জাগাতে গাছের পাতা চাঁদ উঠছে সাদা ফলের মতন মানুষ নিচু করছে মাথা ভবিতব্যের কাছে |
পাবলো নেরুদা
সনেট
অনুবাদ:জি.এম.তানিম শূন্যতা মানে তোমার না থাকা দুপুরকে একটা নীল ফুলের মতো চিরে তোমার না চলা, কুয়াশা ঘেরা বিকেলে নুড়িমাখা পথে তোমার না চলে যাওয়া, তোমার হাতে সোনালি সেই আলো না থাকা, যে আলো চোখে পড়ে না কারো, যে আলো সবার অগোচরে বেড়ে ওঠে লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন। সোজা কথায় তোমার না থাকা: ঝরো হাওয়ায় উড়ে আসা একগুচ্ছ গোলাপের মতন উৎসাহে উদ্দীপ্ত তোমার আমার পৃথিবী জানতে না আসা, তাই আমি আছি কেবল তুমি আছ বলে। তাই তুমি আছ, আমি আছি, আমরা আছি, এবং ভালোবেসে আমি থাকব, তুমি থাকবে, আমরা থাকব।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
এক. ভালবাসি সেই ভালবাসা যা হতে পারেশাশ্বত আবার হতে পারে ক্ষণস্হায়ী। ভালবাসি সেই ভালবাসা যা মুক্তি দিতে চায় আবার ভালবাসার জন্য। ভালবাসি সেই স্বর্গীয় ভালবাসা যা নিকটবর্তী হয় আবার যা দূরে চলে যায়।দুই. তোমার চোখে চোখ রেখে আমার চোখ আনন্দ পাবে না, আর আমার বেদনা তোমার সঙ্গে থেকে মনোরম হবে না। কিন্তু যেখানেই যাই তোমার দৃষ্টি বহন করি আর যেখানেই ঘুরে বেড়াও বহন কর আমার দুঃখ। তুমি আমার ছিলে,আমি তোমার। আর কি চাই? দুজনে গড়েছিলাম চলার পথে একটা বাঁক,যেখান দিয়ে চলে গিয়েছিল ভালবাসা। তুমি আমার ছিলে,আমি তোমার।তোমার ফলের বাগানে আমি যে বীজ পুঁতেছিলাম, তার থেকেই তুমি হবে আমার ভালববাসা। আমি চলে যাই। বিষন্ন আমি : কিন্তু সর্বদাই বিষন্ন আমি। তোমার দু’বাহু থেকে আমি আসি। জানি না কোথায় যাই। …তোমার হৃদয় থেকে আমাকে বিদায় জানায় এক শিশু এবং আমিও তাকে জানায় বিদায়।
পাবলো নেরুদা
শোকমূলক
আমি তাকে বাগানের মাঝামাঝি কবর দিয়েছি এখন আমাকে ভীষণ শক্তিহীন মনে হচ্ছে। তার সাথে বহুদিন সঠিক পথেই হেঁটেগেছি ঢেউখেলা চুলে যে হাঁটবে না আমার সাথে কোনদিন। আমি বাস্তবাদী, আকাশের শূন্যতাকে বিশ্বাস করি না জানি আমাদের মতো কারো জন্য কোন স্বর্গ নেই তবে কুকুরটি স্বর্গবাসি হলে আমিই সুখি হবো বেশি এবং জানি সে আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করবে প্রভূত্ব দেখাবে লেজ নেড়ে একমাত্র বন্ধুর জন্য। কুকুরটি কখনো দাসত্ব করেনি, জামার ওপর হাঁটেনি আয়ত্বে নেবার জন্য সে কখনও ছোঁয়ায়নি চুমু অন্যদের মতো যৌনতায় মাতেনি সে সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো বন্ধু হয়ে যতোটুকু প্রয়োজন, যতোটুকু দরকার সে আমাকে বুঝতে চাইতো মানুষের প্রয়োজনে মানুষ পারে না অথচ কুকুরটি পেরেছিল নষ্টপ্রহরে। স্বপ্নের চেয়েও শুদ্ধ মনে হতো তার দু’চোখ মিষ্টি এবং পশমি গন্ধময় সুন্দর দিনে কাছাকাছি প্রশ্নহীন, আমি তার লেজছুঁয়ে- সাগর সৈকতে হেঁটেছি বহুদিন শীতে যেখানে পাখিরা নির্জন আকাশ ভরে রাখে সেখানে আমার পশমি কুকুর সাগরে ঢেউয়ে লাফাতো আশ্চর্য কুকুর মুহুর্তেই তার সোনারং লেজ নিয়ে আবার দাঁড়াতো সাগরের সব জল নাড়তে। আনন্দ! কি যে আনন্দ তার! আমার কুকুর জেনেছিল সুখী হতে হয় কোন পথে মানুষের লজ্জাহীন দৌরাত্বের শাসন উপেক্ষা করে। সেই কুকুরের জন্য আজ কোন শোকবার্তা নেই সে এখন বহুদুরে, আমি তাকে মাটি চাপা দিয়েছি অথচ তার ভালোবাসা মাটি থেকে বের হয়ে আসছে যা বহনের ক্ষমতা আজ আমারও নেই।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
এক. তোমার অন্তস্হল থেকে, এবং হাটুঁ গেড়ে বসা এক বিষণ্ণ শিশু, আমার মত, দেখে আমাদের। সেই জীবনের জন্য যা পুড়িয়ে দেবে তার ধমনীগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গে বাধাঁ পড়তে বাধ্য হবে। সেই হাতগুলি দিয়ে, তোমার হাতগুলির কন্যারা আমার হাতগুলিকে হত্যা করতে বাধ্য হবে। ধরণীতে তাদের উন্মুক্ত চোখগুলিরভেতর দিয়ে একদিন দেখবে তোমার অশ্রুবিন্দুগুলি।দুই. আমি তাকে ভালবাসি না,আমাদা। যাতে কিছুই আমাদের বন্ধনে না জড়ায় যেন কোন কিছুই আমাদের নয়। নেই কোন শব্দ যা তোমার মুখ সুবাসিত করে নেই কোন কিছু যা বলেছিল শব্দগুলো। ভালবাসার কোন উৎসব ছিল না আমাদের, জানালার পাশে ছিল না তোমার দীর্ঘশ্বাস।তিন. নবিকদের ভালবাসাকে ভালবাসি যারা চুম্বন করে এবং চলে যায়। এক প্রতিজ্ঞা রেখে যায়। কিন্তু কখনও ফিরে আসে না। প্রতি দরজায় অপেক্ষা করে এক নারী, নাবিকেরা চুম্বন করে এএবং চলে যায়। এক রাত্রিতে তারা ঘুমাতে যায় মৃত্যুর সঙ্গে সমুদ্র শয্যায়। ভালবাসি সেই ভালবাসা যা তারা ভাগকরে নেয় চুম্বনে,শয্যায় এবং রুটিতে।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব তোমাকে পছন্দ করি এক্কেবারে স্থির এমনটা য্যনো তুমি আসলে নেই আমাকে শুনতে পাচ্ছ দুর থেকে, কিন্তু আমার গলার স্বর তোমাকে ছুচ্ছে না তোমার চোখগুলো কোথায় য্যনো উড়ে গেছে তোমার মুখ তালামারা চুমুর সিলগালায় সবকিছুতেই আমার আত্মা তুমি আবার আমার সবকিছুতেই আমার আত্মার স্বপ্নের প্রজাপতি এবং তুমি “বিশন্নতা” নামক শব্দটার ধারক ও বাহক আমি তোমাকে পছন্দ করি এক্কেবারে স্থির মনে হতে পারে তুমি শোকাহত প্রজাপতি কাতরাচ্ছে ঘুঘু পাখির মত দুর থেকে ঠিকই তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছ কিন্তু আমার গলা তোমার কাছে পৌছোচ্ছে না আমাকে তোমার নিরবতায় সুস্থির হতে দাও তোমার নিরবতার সাথে আমাকে কথা বলতে দাও সে-কথাগুলো পিদিমে জ্বলজ্বলে আংটিতে সাধারন , তারাদের ভিড়ে তুমি রাত তোমার নিরবতা অনেক দুরের তারাদের সিথানে কাত আমি তোমাকে চাই এক্কেবারে স্থির কিন্তু তুমি নেই, দুরে অনেক দুরে দুঃক্ষিত আর হবে হয়ত মরেই গিয়েছ একটু কথা, একটু হাসি-তাই যথেস্ট তাতেই আমি খুশি,খুশি যে এসবের কোনটাই সত্যি না ।
পাবলো নেরুদা
চিন্তামূলক
অনুবাদ: সমর গোসাইবলো আমাকে গোলাপ কি নগ্ন নাকি নগ্নতাই তার পোশাক ? কেন গাছেরা লুকায় মুলে মুলে দীপ্ত প্রভা ? কে শোনে হতাশার বাণী চোরের মত ছুটে চলা অটোমোবাইলের ? এর চেয়ে দু:খের কি কিছু দেখছ এ জগতে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা রেল গাড়ি ?
পাবলো নেরুদা
মানবতাবাদী
অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিবএক্কেবারে নেংটো মেয়েটি ঢোকবার সময় পানাশালাত বেশ ক’জন জোয়ান মর্দ বসে বসে পান করছিল। পান করতে করতে,ওরা মেয়েটির দিকে থু থু থু…করে থুতু ছিটাচ্ছিল। সবে সাগর থেকে উঠে আসা মেয়েটি এসবের কিছুই বুঝতে পারছিল না। মেয়েটি পথ হারানো মাছকন্যা । টিটকারি থু থুক্কার জ্বলজ্বলে মাংশ ছুয়ে পিছলে পিছলে খসে পড়ছিল। খিস্তি খেউড়ে ওর সোনালি দুধের মাই ঝলাসাচ্ছিল। কাদতে জানেনা বলে মাছকন্যা কাদে নি। কাপড় চেনেনা বলে মাছকন্যা পোষাক পরেনি। জ্বলন্ত সিগারেট ওরা মাছকন্যার গায়ে ঠেশে ধরছিল। শব্দ অপরিচিত বলে ও চিতকার করনি। দুরের ভালবাশার রঙ্গে ওর চোখ তবূও রঙ্গিন, ওর হাতগুলো মনকা পাথরে জ্বল জ্বল, প্রবালের আলোতে ওর ঠোট নড়ছিল, শেষমেশ মেয়েটি অবশ্য বেরোতে পেরেছিল। যে-নদি থেকে এসেছিল সে-নদিতে ফেরা মাত্র মাছকন্যা আবার পরিস্কার, আবার বৃষ্টি ধোয়া সাদা মার্বেলে টলটলে। একবারও পিছে না ফিরে ও সাতরে গিয়েছিল শুন্যতার দিকে, নিজের মরনের দিকে।
পাবলো নেরুদা
প্রেমমূলক
অনুবাদ: রহমান হেনরীতোমার প্রসঙ্গ উঠে আসে, পুষ্প-ফোটা উদ্যানে উদ্যানে আমি তো আহত হই, বসন্তের সুমিষ্ট সুবাসে। আমি তো গিয়েছি ভুলে ওই মুখ, আজ আর স্মরণে আসে না সেই হাত দুটি; কীভাবে ও দুটি ঠোঁট আমাকে গিলেছে, নেই মনে। মন গেছে তোমারই তো দিকে, ভালোবাসি শাদা শাদা পাষাণ মূর্তিকে উদ্যানে মলিন হয়ে আছে যারা, ওইসব শাদামূর্তি যাদের দৃষ্টিও নেই, বাকশক্তি নেই। ভুলে গেছি তোমার ও কণ্ঠস্বর, আনন্দিত সেই সব ধ্বনি; ভুলে গেছি ওই দুটি চোখ। পুষ্প যেমন বাঁধা আঘ্রাণের সাথে,বাঁধা পড়ে আছি আমি তোমারই তো অস্পষ্ট স্মৃতির ভেতরে। শুধু এক জখমের যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে বাঁচি; স্পর্শ করো না এতো তাড়াতাড়ি, অনারোগ্য হতে পারে এই টাটকা ক্ষতটি আমার। তোমার সুশ্রুষাগুলো আমার সমগ্র দেবে মেলে, যেরকম মলিন করুণ সব দেয়ালে দেয়ালে, বেয়ে ওঠে দ্রাক্ষালতাগুলি। তোমার প্রণয় আমি বিস্মৃত হয়েছি, আজও তবু প্রতিটি জানালাজুড়ে চোখে ভাসে তোমারই তো সেই প্রিয় মুখ। তোমারই কারণে, এই আসন্ন গ্রীষ্মের যত সুবাস মদিরা আমাকে যন্ত্রণা দেয়; তোমারই কারণে আমি পুনরায় পতিত প্রত্যাশা-চিহ্নে খুঁজে ফিরে আশার আলোক : নিক্ষিপ্ত তারকারাজি, বিক্ষিপ্তও পতন্মোখ যত বস্তুনিচয় সব ঘেঁটে, তোমারই অস্তিত্ব খুঁজেফিরি।
আহসান হাবীব
স্বদেশমূলক
এই যে নদী নদীর জোয়ার নৌকা সারে সারে, একলা বসে আপন মনে বসে নদীর ধারে এই ছবিটি চেনা। মনের মধ্যে যখন খুশি এই ছবিটি আঁকি এক পাশে তার জারুল গাছে দু’টি হলুদ পাখি,এমনি পাওয়া এই ছবিটি কড়িতে নয় কেনা। মাঠের পরে মাঠ চলেছে নেই যেন এর শেষ নানা কাজের মানুষগুলো আছে নানান বেশ, মাঠের মানুষ যায় মাঠে আর হাটের মানূষ হাটে, দেখে দেখে একটি ছেলের সারাটাদিন কাটে। এই ছেলেটির মুখ সারাদেশের সব ছেলেদের মুখেতে টুকটুক। কে তুমি ভাই, প্রশ্ন করি যখন, ভালবাসার শিল্পী আমি, বলবে হেসে তখন। এই যে ছবি এমনি আঁকা ছবির মত দেশ, দেশের মাটি দেশের মানুষ নানান রকম বেশ, বাড়ি বাগান পাখ-পাখালি সব মিলে এক ছবি, নেই তুলি নেই রং তবুও আঁকতে পারি সবই।
আহসান হাবীব
স্বদেশমূলক
জেলের সেলে বন্দী ছিলো মৃতের স্তুপের অন্ধকারে বন্দী ছিলো বন্দী ছিলো বন্ধ দুয়ার ভয় থমথম ঘরের মাঝে। শহর জুড়ে কারফ্যু তার কাফন ছড়ায় সেই কাফনে বন্দী ছিলো। ওরা তখন মন্ত্রপুত মশাল নিয়ে নামলো পথে মৃতের স্তুপে ফোটালো ফুল নতুন প্রাণে গাঁথলো নতুন দীপাবলি। আগুন জ্বলে। জ্বলতে থাকে পাশব আঁধার গ্রাম নগরে রাত পেরিয়ে, রাত পেরিয়ে রাত পেরিয়ে সূর্য নামে। তখন দেখি আলোর মুকুট মাথায় পরে ভুবন জুড়ে বাইরে এলো বন্দিনী মা বাংলা আমার স্বদেশ আমার।
আহসান হাবীব
প্রকৃতিমূলক
ফূল ফুল তুল তুল গা ভেজা শিশিরে, বুল বুল মশগুল, কার গান গাহিরে? তর বর উঠে পর রাত ভোর দেখ না? হাত তুলে প্রাণ খুলে স্রষ্টারে ডাক না.. ঝিক মিক দশ দিক নাই পিক পাপিয়া.. সাদা বক চক চক উড়ে যায় ডাকিয়া.. বিল ঝিল খিল খিল লাল নীল বরণে, গাছে গাছে ফিঙ্গে নাচে চঞ্জল চরনে। ভেজা ভেজা তাজা তাজা শেফালির সুবাসে, শিশুদল কোলাহল করে নানা হরষে। টিদার জরিপার শ্যাম শাড়ী অঙ্গে এ্যলো কেশে এলো হেসে শরত এ বঙ্গে..
আহসান হাবীব
প্রেমমূলক
মুখোমুখি ফ্ল্যাট একজন সিঁড়িতে, একজন দরজায় : আপনারা যাচ্ছেন বুঝি ? : চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব । : বছর দুয়েক হল, তাই নয় ? : তারো বেশী । আপনার ডাক নাম শানু, ভালো নাম ? : শাহানা, আপনার ? : মাবু । : জানি । : মাহবুব হোসেন । আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন । : কে বলেছে । আপনার তো অনার্স ফাইন্যাল, তাই নয় ? : এবার ফাইন্যাল । : ফিজিক্স-এ অনার্স । : কী আশ্চর্য ! আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ ? : মা চান না । মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে… : সে যাক গে, পা সেরেছে ? : কী করে জানলেন ? : এই আর কি ! সেরে গেছে ? : ও কিছুনা , প‌যাসেজটা পিছলে ছিল মানে… : সত্যি নয় । উচুঁ থেকে পড়ে গিয়ে… : ধ্যাৎ । খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো ? : মা বলেছে ? : শুনতে পাই । বছর দুয়েক হল, তাই নয় ? : তারো বেশী । আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে ? : নেবেন ? না থাক । রিকসা এল, মা এলেন , যাই । : আপনি সন্ধ্যে বেলা ওভাবে কখনও পড়বেননা, চোখ যাবে, যাই । : হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই । : যান, আপনার মা আসছেন । মা ডাকছেন, যাই।
আহসান হাবীব
ছড়া
খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে, স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে। এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর, চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর। এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের, আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর। পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল, প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল। তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের, এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত, সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত। কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর, ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর। এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই, নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই।
আহসান হাবীব
প্রকৃতিমূলক
তারা- একটি দুটি তিনটি করে এলো তখন- বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া বইছে এলোমেলো, তারা- একটি দু’টি তিনটি করে এলো। থই থই থই অন্ধকারে ঝাউয়ের শাখা দোলে সেই- অন্ধকারে শন শন শন আওয়াজ শুধু তোলে। ভয়েতে বুক চেপে ঝাউয়ের শাখা , পাখির পাখাউঠছে কেঁপে কেঁপে । তখন- একটি দু’টি তিনটি করে এসে এক শো দু শো তিন শো করে ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে তারা- বললে ও ভাই, ঝাউয়ের শাখা, বললে, ও ভাই পাখি, অন্ধকারে ভয় পেয়েছো নাকি ? যখন- বললে, তখন পাতার ফাঁকে কী যেন চমকালো। অবাক অবাক চোখের চাওয়ায় একটুখানি আলো। যখন- ছড়িয়ে গেলো ডালপালাতে সবাই দলে দলে তখন- ঝাউয়ের শাখায়- পাখির পাখায় হীরে-মানিক জ্বলে। যখন- হীরে-মানিক জ্বলে তখন- থমকে দাঁড়াঁয় শীতের হাওয়া চমকে গিয়ে বলে- খুশি খুশি মুখটি নিয়ে তোমরা এলে কারা? তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা ?আলোর পাখি নাম জোনাকি জাগি রাতের বেলা, নিজকে জ্বেলে এই আমাদের ভালোবাসার খেলা। তারা নইকো- নইকো তারা নই আকাশের চাঁদ ছোট বুকে আছে শুধুই ভালোবাসার সাধ।
আহসান হাবীব
স্বদেশমূলক
আসমানের তারা সাক্ষী সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি মাছরাঙা আমাকে চেনে আমি কোনো অভ্যাগত নই খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই আমি কোনো আগন্তুক নই আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে এখানেই থাকি আর এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা – সারা দেশে। আমি কোনো আগন্তুক নই। এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের পাখিরা আমাকে চেনে তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই। কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী সাক্ষী তার চিরোল পাতার টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা নিশিন্দার ছায়া অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী তার ক্লান্ত চোখের আঁধার আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি জমিলার মা’র শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি সে আমাকে চেনে হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস। আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই। দু’পাশে ধানের ক্ষেত সরু পথ সামনে ধু ধু নদীর কিনার আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর মুগ্ধ এক অবোধ বালক।
আহসান হাবীব
ছড়া
মনারে মনা কোথায় যাস? বিলের ধারে কাটব ঘাস। ঘাস কি হবে? বেচব কাল, চিকন সুতোর কিনব জাল। জাল কি হবে? নদীর বাঁকে মাছ ধরব ঝাঁকে ঝাঁকে। মাছ কি হবে? বেচব হাটে, কিনব শাড়ি পাটে পাটে। বোনকে দেব পাটের শাড়ি, মাকে দেব রঙ্গিন হাঁড়ি।
আহসান হাবীব
প্রকৃতিমূলক
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে আমি মেঘনা নদীর নেয়ে। মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে তালের নৌকা বেয়ে আমি বেড়াই হেসে খেলে- আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে। মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি ইচ্ছে হ’লেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি। তালে তালে তালের নৌকা দু’হাতে যাই বেয়ে আমি মেঘনা নদীর নেয়ে। পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকো আমার ভাসে মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে- মাথার ওপর মুচকি হাসে বিজলি নামের মেয়ে আমি মেঘনা নদীর নেয়ে। আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা ঝড়ের সঙ্গে লড়াই ক’রে কাটাই সারাবেলা। দেশ থেকে যাই দেশান্তরে মনের নৌকা বেয়ে- আমি মেঘনা নদীর ছেলে আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
আহসান হাবীব
স্বদেশমূলক
তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় ! সন্ধ্যায় পড়ার ঘরে একা বসতে ভয় পেত। নিজেই নিজের ছায়া দেখে কেঁপে উঠত। কনিষ্ঠকে সঙ্গী পেলে তবেই নির্ভয়ে বসত সে পড়ার ঘরে। আমার সন্তান যে আমার হাতের মুঠোয় হাত রেখে তবে নিশ্চিন্তে এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরেছে, গেছে মেলায় এবং নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করেছে আমাকে আজ তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় ! কোথায় বেরিয়ে যায় একা একা ব্যস্ত পায়ে একা একা ক্লান্ত হয়ে ফেরে, তার কোথায় কী কাজ, তার কেন ক্লান্তি? যখন বাড়িতে কেন সে দুধের সর না পেলেও এখন একবার ক্ষুব্ধ দৃষ্টি মেলে দিয়ে তাকায় না মার চোখে চোখে? যা পায় তা খায় কেন মুখ বুজে কেন সে হঠাৎ এমন উত্কর্ণ হয়ে বাইরে চোখ ফেরায়। খোকন কিছু যেন শুনতে চায়। ঘরে নয় বাইরে কিছু শুনবে বলে কান পাতে। কখনো না খেয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায় কোথায়, কোথায়? কী ভাবনায় আমার খোকন দুদিনেই এমন গম্ভীর হয়ে গেল এমন বিষন্ন কেন দীর্ণবুক দুঃখী মানুষের মতো হাঁটে কেন এমন বয়স্ক কেন মনে হয় আমার খোকাকে। কেন সে আমাকে কিছুই বলে না আর আমাকে আমার পূর্বপুরুষের ছেঁড়া মাদুরে বসিয়ে রেখে অসহায় হেঁটে যায় একাকী এমন রাজদর্পে এবং তখন তার রাজবেশে আহা সারা পথ এমন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে কেন। আর তার কিশোর দেহের কী আশ্চর্য মহিমা।দু চোখে প্রজ্ঞার আগুন যেন কণ্ঠস্বর যেন স্বর্গীয় সংকেতে ঋদ্ধ শব্দাবলি ছড়ায় দুপাশে। দেখে দেখে মনে হয় কোনো নব পয়গম্বর যেন। আমার সন্তান যায় হেঁটে যায় সামনে যায় দেহ তার দীর্ঘতর হয়। আরো দীর্ঘ সন্তানের দেহ পিতার গর্বিত বুক উঁচু কাঁধ প্রশস্ত ললাট ছাড়িয়ে সে আরো দীর্ঘ দীর্ঘতর হয়ে আমার হাতের নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে ছুটে যায়। আসন্ন সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভয় পেয়ে বুকফাটা চিত্কারেপখন জানতে চাই, এই অন্ধকারে কোথায় সে যেতে চায়, বলে সামনে যাব। সামনে কী ভয়াল অন্ধকার। বলে অন্ধকার পেরোলেই আলো। বলি তাকে ওপথে অনেক হিংস্র জন্তুর তীক্ষ্ণ নখর তোমাকে চায় উত্তরে খোকন নিচু হাত ঊর্ধ্বে তুলে ঘোরায় তলোয়ার। ওপথে নিশ্চিত মৃত্যু বলে আমি যখন আবার অসহায় শিশুর মতোই কাঁদতে থাকি তখন বয়স্ক কোনো পিতার কণ্ঠস্বরে খোকা বলে ‘মৃত্যুই জীবন’| এবং সে আরো বলে তুমি আর হাতের আড়ালে রেখো না আমার হাত ভয়ের কাফনে জড়িয়ে রেখো না আর অন্ধকার ছড়িয়ে রেখো না আমার দু চোখে পিতা তোমার চারপাশে বড় অন্ধকার তাই সামনে যাব আরো সামনে সূর্যোদয়ে যাব। ইতিহাস আয়োজিত সাজানো মেলায় আলোয় দাঁড়াবো বলে যখন খোকন যায় আরো দূরে যতদূরে আমার দুর্বল দৃষ্টি চলে না, তখন কেঁদে বলি, তুই চলে গেলে অন্ধকার অপমান নিঃসঙ্গতা এইসব রেখে তুই চলে গেলে খোকা আমার কী থাকে বল যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি হঠাৎ তখন সন্তানের সেই দৃষ্টি ফেরায় আমার চোখে, বলে ‘পিতার গৌরব !’
আহসান হাবীব
ছড়া
জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানেনা। যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানেনা। মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে? বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকিকাছে। দেখোনা, যখন কাল আমাদের আমবাগানের পুবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের- আমি গিয়ে চুপ চুপে কিছু দূরে বসেছি যখন, গান ভুলে বোকাগুলো একসাথে পালালো তখন। ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই ! আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়, কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়? সাদা কড়ি ওদের কি ভাল লাগে ? আমার যেমন ছোট লাল ঘুড়ি আছে, মাজা সূতো, ওদের তেমন আছে না কি ? কিছু নেই ? বেশ কথা, না-ই যদি থাকে বোকারা নিজেরা এসে বলে যেতে পারে ত আমাকে, আমি ত দিতেই চাই, বোকারা যে কখনো আসে না। জানি, ওরা পাখি কি-না, মানুষকে ভালোই বাসে না। বলোনা মা, কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে, কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।
আহসান হাবীব
প্রেমমূলক
একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। একবার বলেছি, তোমাকে আমি, তোমাকেই ভালোবাসি। বল এখন সে কথা আমি ফেরাব কেমনে ! আমি একবার বলেছি তোমাকে … এখন তোমাকে আমি ঘৃণা করি। এখন তোমার দৃষ্টির কবলে এলে ক্ষতস্থান জ্বলে জ্বলে ওঠে। তোমার সান্নিধ্যে এলে তুমি উষ্ণ নাভিমূল থেকে বাতাসে ছড়াও তীব্র সাপিনীর তরল নিঃস্বাস। আমি যতবার ছুটতে চাই, তোমার দৃষ্টির বাইরেযেতে চাই, তুমি দু চোখে কী ইন্দ্রজাল মেলে রাখ ! আমি ছুটতেও পারি না আমি ফেরাতে পারি না কথা আমি একবার বলেছি, তোমাকে … সম্রাজ্ঞীর বেশে আছ। নতজানু আমি দাসানুদাসের ভঙ্গি করপুটে, দেখি তোমার মুখের রেখা অবিচল, স্থির জঙ্ঘা তোলে না টঙ্কার, তুমি পবিত্রতা পবিত্রতা বলে অস্পষ্ট চিত্কার কর, তুমি কেবলি মালিন্য দেখ, অশ্লীলতা, ক্রমান্বয়ে ঘৃণা ক্রোধ বাড়ে, উত্তেজনা বাড়ে নামে উষ্ণ জলস্রোত। তুমি এইভাবে প্রবল ঘৃণায় আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে অহঙ্কার রাখতে চাওঅটুট। তবুও পৃথিবীতে আছে কিছু মানুষের অবস্থান, তারা অপমানে ধন্য হয় উপেক্ষায় ঋজু; তারা স্বভাব-কাঙাল ! যদি একবার বলে তবে ফেরাতে পারে না। আমি ফেরাতে পারি না। আমি একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা ! সে কেমন, কোন দীপ্র স্বর্গীয় প্রতাপ যার মৃত্যু নেই জন্মান্তর নেই?
আহসান হাবীব
চিন্তামূলক
আমি বড় অসুখী। আমার আজন্ম অসুখ। না না অসুখে আমার জন্ম। এই সব মোহন বাক্যের জাল ফেলে পৃথিবীর বালক-স্বভাব কিছু বয়স্ক চতুর জেলে মানব-সাগরে। সম্প্রতি উদ্দাম হাতে নৌকো বায়। আমরা বিমূঢ়। কয়েকটি যুবক এই অসুখ-অসুখ দর্শনের মিহি তারে গেঁথে নিয়ে কয়েকটি যুবতী হঠাৎ শৈশবে গেলো ফিরে এবং উন্মুক্ত মাঠে সভ্যতার কৃত্রিম ঢাকনায় দুঃসাহস-আগুন জ্বালিয়ে তারস্বরে কেবল চিৎকার করে : আমরা বড় অস্থির। কী চাই, আমাদের কী চাই, কী চাই! ওরা বলে : সন্ত্রাসতাড়িত আমরা সন্ত্রাসিত পৃথিবীতে তাই আমরা কেবল ছুটি। বলে আর ঊর্ধ্বশ্বাসেছোটে। কোথায় ছুটেছে যদি জানতে চাও ওরা অনায়াসে জবাবে জানায়, নেই ঠিকানা, অথবা কোনো ঠিকানার বাসনাও নেই। নৈরাশ্যের হাওয়া থেকে ক্রোধের আগুন জ্বেলে নিয়ে ওরা বলে : পুড়ুক পুড়ুক দু’পাশের শ্যামশোভা, পুরনো ঘরের পুরনো সম্ভার সব পোড়াবো এবং শূন্যতাকে একমাত্র সত্য বলে রেখে যাবো দুয়ারে সবার। আর এই উন্মাদ উৎসবে যদি হঠাৎ কখনো ব্যথিত প্রবীণ কোনও পথচারী প্রশ্ন করে : শূন্যতার বোঝা কে বয় এমন করে, কোন অর্থে, কী লাভ, কী লাভ! ওরা বলে : অর্থ নেই। অর্থ নেই এ জীবনে এই শুধু সার জেনেছি। জেনেছি কোনো লাভ নেই অর্থের সন্ধানে। লাভ নেই লাভের আশায় কালক্ষেপে অথবা শূন্যের কড়ি গুণে গুণে লাভ নেই অলিক ছায়ায়। তার চেয়ে উদ্দাম জোয়ারে ভেসে যাবো। এবং যেহেতু ভেসে ভেসে ডুবে যাওয়া একমাত্র সত্য পৃথিবীতে সত্যের সজ্জিত বৃদ্ধ গাধাটাকে ডুবিয়ে আমরাও কিছুকাল মত্ত হাতে নৌকা বেয়ে জোয়ারের জলে ভেসে যাবো। এবং একদা ডুবে যাবো।
আহসান হাবীব
ছড়া
ঝাউয়ের শাখায় শন শন শন মাটিতে লাটিম বন বন বন বাদলার নদী থৈ থৈ থৈ মাছের বাজার হৈ হৈ হৈ। ঢাকিদের ঢাক ডুমডুমাডুম মেঘে আর মেঘে গুড়ুমগুড়ুম দুধকলাভাত সড়াত সড়াত আকাশে বাজে চড়াৎ চড়াৎ। ঘাস বনে সাপ হিস হিস হিস কানে কানে কথা ফিস ফিস ফিস কড়কড়ে চটি চটাস চটাস রেগেমেগে চড় ঠাস ঠাস ঠাস। খোপের পায়রা বকম বকম বিয়েমজলিশ গম গম গম ঘাটের কলসি বুট বুট বুট আঁধাঁরে ইঁদুর কুট কুট কুট। বেড়ালের ছানা ম্যাও ম্যাও ম্যাও দু দিনের খুকু ওঁয়াও ওঁয়াও।
আহসান হাবীব
মানবতাবাদী
এইখানে নিরঞ্জনা নদী ছিলো এই ঘাটে হাজার গৌতম স্নান করে শুদ্ধ হয়েছেন। নদী আছে ঘাট আছে সেই শুদ্ধ জলের অভাব অশুদ্ধ মানুষ খুব বেড়ে গেছে সারিবদ্ধ স্নানার্থী মানুষ মরানদী মরাস্রোত ছাড়িয়ে এখন _ বলে দাও যেতে হবে অন্য কোনো নিরঞ্জনা নদীর সন্ধানে।
আরণ্যক বসু
প্রেমমূলক
আসলে কথারা সব বিলুপ্ত পাখির ঠোঁটে শিলালিপি হয়ে আছে আসলে কথারা সব নিঃশেষে মুছে গেছে আলোকবর্ষ দূরে তারাহীন নীল অন্ধকারে আসলে কথারা এসে ফিরে চলে গেছে সেই মটরশুঁটির ক্ষেতে, সবুজে সবুজেতুমি ফিরে এসে সেই শিলালিপি পাঠ করো প্রিয়বন্ধু কি কথা? কী কথা? এই শিলালিপি ভরে আছে পাথরের বুকে ঘুম হয়ে! মৃত তিতিরের ঠোঁটে কোন সে শব্দের রেশ লেগে আছে লক্ষ বছর ধরে-আমাকে শোনাও! চলো গিয়ে বসি সেই শব্দহীন তিরতির গ্রামীণ নদীর কাছে চলো, শুনি, কী কথা বলার ছিল তার সে-ও তো অনেক কথা উজানে, ভাঁটির টানে বলে ব’য়ে গেছেতুমি সেই অন্তহীন স্তব্ধতায় শব্দরাশি মুক্ত করে দাও প্রিয়মুখ তুমি সেই বৃষ্টিধোয়া নিরুচ্চার শব্দগুলো চালচিত্র করে দাও জীবনে আমার টুং টাং বেজে যাক অশ্রুত শব্দের কথামালা অপেক্ষার, প্রতিক্ষার টুকরো টুকরো যতো উন্মীলন বাগ্ময় হয়ে উঠে আমাকে কাঁদায় যেন আমাকে ভাসায় যেন বাঁধভাঙা উৎসের অনিবার্য স্রোতো সব শব্দ মিলে মিশে যেন বলে ওঠে-ভালোবাসি, ভালোবাসি….
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন: যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে, মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ূরশয্যার কথা ভুলে সকালের রূঢ় রৌদ্র ডুবে যেত কোথায় অকূলে। তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল, দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা, বিকেলের উপকন্ঠে সাগরের চিল, নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব– শ্যামলী, করেছি অনুভব। অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেল; মানুষকে স্থির- স্থিরতর হতে দেবে না সময়; সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্ত নদী। অন্ধকার প্রেরণার মতো মনে হয় দূর সাগরের শব্দ — শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে : কাল কিছু হয়েছিল; — হবে কি শাশ্বতকাল পরে।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
আকাশে সমস্ত দিন আলো; পাতায় পালকে রোদ ঝিকমিক করে; জলগুলো চ'লে গেছে চেনা পথ ধ'রে অবিরল আরো দূর জলের ভিতরে।যদিও গভীরভাবে সময়ের সাগর উজ্জ্বল- কি এক নিঃশব্দ নিবিড় আবেগে তাকে কালো দু'টি তুরঙ্গম যেন অনন্তের দিকে টেনে নেয়; নিরন্তর এ রকম অগ্রসর হ'য়ে যাওয়া ভালো।সারাদিন এঁকেবেঁকে নদীটির ঢেউ মিশে যায় শাদা কালো রঙের সাগরে; সারাদিন মেঘ পাখি উঁচু উঁচু গাছ যেন প্রায় সূর্য স্পর্শ করে।মৌমাছি রৌদ্র নারী শরীর ও মন মুহূর্ত ও মহাকাল দু'জনের কাছে বারবার ব্রহ্মাণ্ডের অপরূপ অগ্নি পরিধির ভিতরে নিবিড় অগ্নিশিল্প হয়ে আছে।সব শেষ হয়ে গেলে তারপর থাকে একদিন যা জেনেছি তার চেয়ে ভালো সমস্ত দিনের সূর্য- আর সেই সূর্যের বিদায়, আঁধারের রঙে মাখা নক্ষত্রের আলো।নগর বন্দর দিক জনতার পথে ক্ষতি রক্ত ভালোবাসা ব্যথা জ্ঞান-লাভ ভালো,- তবু- সেই সব স্থিরতর ক'রে নিতে হয়; প্রকৃতি মানুষ আর সময়ের নিজের স্বভাবজেনে নিতে হয় নদী প্রান্তরের ঘাসে; এ ছাড়া আর কি সত্য ইতিহাস জানে? কিছু গ্রন্থ রীতি চিন্তা- দু'একটী নক্ষত্র নারীর দিকে চেয়ে বোঝা যায় জীবন ও মৃত্যুর মানে।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
জীবন কি নীরক্ত সম্রাট এক সুধাখোর: কুট ব্যবসায়ী নীল পাশ্বচরগুলো তার মৃত্যুর উৎসব? মানুষের তরে তবে কোন পথ: কোন অন্তরীক্ষে তারে নিয়ে যাবে আসন্ন সময়? সেইখানে বালুঘড়ি, বলো, তবে স্তব্ধতার মতো: একদিন বাতাসের সাথে ঢের ধ্বনিবিনিময় করেছিলো;- তারপর হ'য়ে গেছে আঁখিহীন চুুপ। প্রান্তরের শুষ্ক ঘাসে যে সবুজ বাতাসের আশা একদিন বলেছিলো আবার করিবো আমি অমৃত সঞ্চয়- শত-শত মেঘশাবকের আঁখিতারকাও পেলো যেন ভয় শান্তি, শান্তি- উত্তেজিত শপথের উৎসারণ প্লীহা ঘিরে থাকে না সতত, বালুঘড়ি. হ'য়ে থাকে চিরদিন স্তব্ধতার মতো।
জীবনানন্দ দাশ
সনেট
জীবন অথবা মৃত্যু চোখে র’বে – আর এই বাংলার ঘাস র’বে বুকে; এই ঘাস:সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়- ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চ’লে যায়- এই ঘাস:এরি নিচে কস্কাবতী শঙ্খশালা করিতেছে বাস: তাদের দেহের গন্ধ,চাঁপা ফুল-মাখা স্নান চুলের বিন্যাস ঘাস আজো ঢেকে আছে : যখন হেমন- আসে গৌড় বাংলায় কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায় ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চ’লে যায় হাঁস,আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি – শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে- কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে ভেরেন্ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে – শাদা দুধ ঝরে করবীর : কোন্‌ এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল, তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে – ঘাসে : নরম ব্যাকুল।
জীবনানন্দ দাশ
প্রেমমূলক
আমার আকাশ কালো হ'তে চায় সময়ের মির্মম আঘাতে জানি, তবু ভোরে রাত্রে, এই মহাসময়ের কাছে নদী খেত বনানীর ঝাউয়ের ঝরা সোনার মতন সূর্য তারাবীথির সমস্ত অগ্নির শক্তি আছে। হে সুবর্ণ, হে গভীর গতির প্রবাহ, আমি মন সচেতন;- আমার শরীর ভেঙ্গে ফেলে নতুন শরীর করো -নারীকে যে উজ্জ্বল প্রাণনে ভালোবেসে আভা আলো শিশিরের উৎসের মতন সজ্জন স্বর্ণের মতো শিল্পীর হাতের থাকে নেমে হে আকাশ, হে সময়গ্রন্থি সনাতন, আমি জ্ঞান আলো গান মহিলাকে ভালোবেসে আজ; সকলের নীলকন্ঠ পাখি জল সূর্যের মতন। #বেলা অবেলা কালবেলা
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
হে মৃত্যু, তুমি আমাকে ছেড়ে চলেছো ব’লে আমি খুব গভীর খুশি? কিন্তু আরো-খানিকটা চেয়েছিলাম; চারিদিকে তুমি হাড়ের পাহাড় বানিয়ে রেখেছো;- যে-ঘোড়ায় চ’ড়ে আমি অতীত-ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাবো এইখানে মৃতবৎসা, মাতাল, ভিখারি ও কুকুরদের ভিড়ে কোথায় তাকে রেখে দিলে তুমি? এতদিন ব’সে পুরোনো বীজগণিতের শেষ পাতা শেষ করতে-না-করতেই সমস্ত মিথ্যা প্রমাণিত হ’য়ে গেলো; কোন-এক গভীর নতুন বীজগণিত যেন পরিহাসের চোখ নিয়ে অপেক্ষা করছে;- আবার মিথ্যা প্রমাণিত হবে ব’লে? সে-ই শেষ সত্য ব’লে? জীবনঃ ভারতের, চীনের, আফ্রিকার নদীপাহাড়ে বিচরণের মূঢ় আনন্দ নয় আর বরং নির্ভীক বীরদের রচিত পৃথিবীর ছিদ্রে-ছিদ্রে ইস্ক্রপের মতো আটকে থাকবার শৌর্য ও আমোদঃ তারপর চুম্বক পাহাড়ে গিয়ে নিস্তব্ধ হবার মতো আস্বাদ? জীবনঃ নির্ভীক নাদীদের সৌন্দর্যের আঘাতে নিগ্রো সঙ্গীতের বেদনার ধূলোরাশি? কিন্তু এ-বেদনা আত্মিক, তার ঝাপ্সা;- একাকীঃ তাই কিছু নয়ঃ- কিন্তু তিলে-তিলে আঁটকে থাকবার বেদনাঃ পৃথিবীর সমস্ত কুকুর ফুটপাতে বোধ করছে আজ। যেন এত দিনের বীজগণিত কিছু নয়, যেন নতুন বীজগণিত নিয়ে এসেছে আকাশ! বাংলার পাড়াগাঁয়ে শীতের জ্যোৎস্না আমি কত বার দেখলাম কত বালিকাকে নিয়ে গেলো বাঘ- জঙ্গলের অন্ধকারে; কতবার হটেনটট-জুলু দম্পতির প্রেমের কথাবার্তার ভিতর আফ্রিকার সিংহকে লাফিয়ে পড়তে দেখলাম; কিন্তু সেই সব মূঢ়তার দিন নেই আর সিংহদের; নীলিমার থেকে সমুদ্রের থেকে উঠে এসে পরিস্ফুট রোদের ভিতর উজ্জ্বল দেহ অদৃশ্য রাখে তারা; শাদা, হলদে, লাল কালো মানুষদের আর-কোনো শেষ বক্তব্য আছে কি না জিজ্ঞাসা করে। যে-ঘোড়ায় চ’ড়ে আমরা অতীত-ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাবে সেই সব শাদা-শাদা ঘোড়ার ভিড় যেন কোন জ্যোৎস্নার নদীতে ঘিরে নিস্তব্ধ হ’য়ে অপেক্ষা করছে কোথাও; আমার হৃদয়ের ভিতর সেই সুপক্ক রাত্রির গন্ধ পাই আমি।
জীবনানন্দ দাশ
সনেট
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতো ব্ড় পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দয়েলপাখি - চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ; ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে; মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপদেখেছিল; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে - কৃষ্ণা-দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় - সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়, শ্যামার নরম গান শুনেছিল - একদিন অমরায় গিয়ে ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায় বাংলার নদ-নদী-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
পাণ্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে; শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে; নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামিউড়ে গেলো কুয়াশায়,- কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো। তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি? অন্ধকার হাতড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি; যখন জ্বলিবে আলো কার মুখ দেখা যাবে বলতে কি পারো?কার মুখ?- আমলকী শাখার পিছনে শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো, আহা, সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে, পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন, মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
শস্যের ভিতরে রৌদ্রে পৃথিবীর সকালবেলায় কোনো এক কবি ব’সে আছে; অথবা সে কারাগারে ক্যাম্পে অন্ধকারে; তবুও সে প্রীত অবহিত হ’য়ে আছে।এই পৃথিবীর রোদে-এখানে রাত্রির গন্ধে-নক্ষত্রের তরে। তাই সে এখানকার ক্লান্ত মানবীয় পরিবেশ সুস্থ ক’রে নিতে চায় পরিচ্ছন্ন মানুষের মতো, সব ভবিতব্যতার অন্ধকারে দেশমিশে গেল;জীবনকে সকলের তরে ভালো ক’রে পেতে হ’লে এই অবসন্ন স্নান পৃথিবীর মতো অম্লান ,অক্লান্ত হ’য়ে বেঁচে থাকা চাই। একদিন স্বর্গে যেতে হ’তো।
জীবনানন্দ দাশ
প্রকৃতিমূলক
বারবার সেই সব কোলাহল সমারোহ রীতি রক্ত,- ক্লান্তি লাগে যেন; তাহারা অনেক জানে- এই দূর মাঠে আমি খুঁজি নাকো জীবনের মানে শুধু এই মাঠ- রাত- আমারে ডেকেছে, আহা, বলেছি- 'যাবোনা আর'- কেনকেন যাবো? এই ধুলো গাভী হাঁস জ্যোৎস্না ছেড়ে আমি যাবো কোনখানে সেখানে চিন্তার ব্যথা- ব্যথা না কি? আজ রাতে শুধু আমি শান্তির আকাশ চেয়েছি যে- সেই ভালো- কথা কাজ প্রশ্ন শুধু ভুল করে- ব্যথা বহে আনে,শান্তি ভালো;- বাদামি পাতার ঘ্রাণ ভালো না কি? পাখির সোনালি চোখ- ঘাস কোথায় বিবরে তার মাছরাঙা- তার রঙ তার নীড়- হৃদয়ের সাধ এই নিয়ে কথা ভাবা এইখানে- ছবি আঁকা- মৃদু ছবি- নরম উচ্ছ্বাস;ইঁদুর ধানের শিষ বেয়ে ওঠেঃ এই ছড়া এই সোনা আকাশের চাঁদ এরা যেন নীড় তার- আমারো হৃদয় আজ চুপ হ'য়ে শুধু রঙ ঘ্রাণ শুধু শান্তি- নিঃশব্দতা- আবিষ্কার;- এই সব এই সব সঞ্চয়ের স্বাধজীবনেরে এই ব'লে জানিতেছে- জ্যোৎস্না আরো শান্ত হ'য়ে ভরেছে উঠান রাত্রি আরো ছবি হ'য়ে রূপ হ'য়ে ঘাসের কীটের মুখে শুনিতেছে গান।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে; বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা, কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো। শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে – সার্কাসের ব্যথিত সিংহের। এদিকে কোকিল ডাকছে – পউষের মধ্য রাতে; কোনো-একদিন বসন্ত আসবে বলে? কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার? তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হয়ে যেতে দেখেছি, তারা কিশোর নয়, কিশোরী নয় আর; কোকিলের গান ব্যবহৃত হয়ে গেছে। সিংহ হুঙ্কার করে উঠছে, সার্কাসের ব্যথিত সিংহ, স্থবির সিংহ এক – আফিমের সিংহ – অন্ধ – অন্ধকার। চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব। সিংহ অরন্যকে পাবে না আর পাবে না আর পাবে না আর কোকিলের গান বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খশে খশে চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ। হে পৃথিবী, হে বিপাশামদির নাগপাশ, – তুমি পাশ ফিরে শোও, কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।
জীবনানন্দ দাশ
প্রেমমূলক
জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ — পাহাড়ের মতো অই মেঘ সঙ্গে লয়ে আসে মাঝরাতে কিংবা শেষরাতে আকাশে যখন তোমারে! — মৃত কে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে! ছেঁড়া ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চলে তরাসে ছেলের মতো– আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে অনেক সময়– তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে– চাঁদ– পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়, একদিন হয়েছে যা– তারপর হাতছাড়া হয়ে হারায়ে ফুরায়ে গেছে– আজও তুমি তার স্বাদ লয়ে আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছ এসে! নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চার দিকে, শস্যের ক্ষেত চেষে চেষে গেছে চাষা চ’লে; তাদের মাটির গল্প– তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হলে অনেক তবুও থাকে বাকি– তুমি জানো– এ পৃথিবীর আজ জানে তা কি!
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার; তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে। ধারসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে- কোনোদিন আর জাগব না জেনে কোনোদিন জাগব না আমি- কোনোদিন জাগব না আর- হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও, হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে রয়েছে যে অগাধ ঘুম সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই, তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও- জানো না কি চাঁদ, নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, জানো না কি নিশীথ, আমি অনেক দিন- অনেক অনেক দিন অন্ধকারের সারাৎসারে অন্তত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে বুঝতে পেরেছি আবার; ভয় পেয়েছি, পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা; দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছে; আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছে; সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে । হায়, উৎসব! হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি। কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি। হে নর, হে নারী, তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন; আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই। যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি, শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে, শত শত শূকরের প্রসববেদনার আড়ম্বর; এই সব ভয়াবহ আরতি! গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে কেন জাগাতে চাও? হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন। অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর; তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে। কোনদিন জাগব না জেনে- কোনোদিন জাগব না আমি-কোনোদিন আর।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
পাহাড়, আকাশ, জল অনন্ত প্রান্তরঃ সৃজনের কী ভীষণ উৎস থেকে জেগে কেমন নীরব হয়ে রয়েছে আবেগ; যেন বজ্রবাতাসের ঝড় ছবির ভিতরে স্থির- ছবির ভিতরে আরো স্থির।কোথাও উজ্জ্বল সূর্য আসে; জ্যোতিষ্কেরা জ্ব'লে ওঠে সপ্রতিভ রাতে আদি ধাতু অনাদির ধাতুর আঘাতে নারীশিক্ষা হত যদি পুরুষের পাশেঃ আকাশ প্রান্তর নীল পাহাড়ের মত নক্ষত্র সূর্যের মত বিশ্ব-অন্তর্লীন উজ্জ্বল শান্তির মত আমাদের রাত্রি আর দিন হবে নাকি ব্রহ্মান্ডের লীন কারুকার্যে পরিণত।
জীবনানন্দ দাশ
সনেট
এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি — আমি হৃষ্ট কবি আমি এক; — ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে; ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙা রোদ, ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে — ঘাসের আঁচলে ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি — দেখেছি কিশোরী এস হলুদ করবী ছিঁড়ে নেয় — বুকে তার লাল পেড়ে ভিজে শাড়ি করুন শঙ্খের মতো ছবি ফুটাতেছে — ভোরের আকাশখানা রাজহাস ভরে গেছে নব কোলাহলে নব নব সূচনার: নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে — তবু কথা বলে, তবু জানি তার কথা কুয়াশায় ফুরায় না — কেউ যেন শুনিতেছে সবিকোন্‌ রাঙা শাটিনের মেঘে বসে — অথবা শোনে না কেউ, শূণ্য কুয়াশায় মুছে যায় সব তার; একদিন বর্ণচ্ছটা মুছে যাবো আমিও এমন; তবু আজ সবুজ ঘাসের পরে বসে থাকি; ভালোবাসি; প্রেমের আশায় পায়ের ধ্বনির দিকে কান পেতে থাকি চুপে; কাঁটাবহরের ফল করি আহরণ কারে যেন এই গুলো দেবো আমি; মৃদু ঘাসে একা — একা বসে থাকা যায় এই সব সাধ নিয়ে; যখন আসিবে ঘুম তারপর, ঘুমাব তখন।
জীবনানন্দ দাশ
ভক্তিমূলক
আমাদের প্রভু বীক্ষণ দাওঃ মরি নাকি মোরা মহাপৃথিবীর তরে? পিরামিড যারা গড়েছিলো একদিন- আর যারা ভাঙে- গড়ে;- মশাল যাহারা জ্বালায় যেমন জেঙ্গিস যদি হালে দাঁড়ায় মদির ছায়ার মতন- যত অগণন মগজের কাঁচা মালে; যে-সব ভ্রমণ শুরু হ’লো শুধু মার্কোপোলোর কালে, আকাশের দিকে তাকায়ে মোরাও বুঝেছি যে-সব জ্যোতি দেশলাইকাঠি নয় শুধু আর- কালপুরুষের গতি; ডিনামাইট দিয়ে পর্বত কাটা না-হ’লে কী করে চলে,- আমাদের প্রভু বিরতি দিয়ো না; লাখো-লাখো যুগ রতিবিহারের ঘরে মনোবীজ দাওঃ পিরামিড গড়ে- পিরামিড ভাঙে গড়ে।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
সর্বদাই প্রবেশের পথ র'য়ে গেছে; এবং প্রবেশ ক'রে পুনরায় বাহির হবার;- অরণ্যের অন্ধকার থেকে এক প্রান্তরের আলোকের পথে; প্রান্তরের আলো থেকে পুনরায় রাত্রির আঁধারে; অথবা গৃহের তৃপ্তি ছেড়ে দিয়ে নারী, ভাঁড়, মক্ষিকার বারে।এই সব শরীরের বিচরণ। ঘুমায়ে সে যেতে পারে। (সচেতন যাত্রার পথ তবু আরো প্রসারিত। আলো অন্ধকার তার কাছে কিছু নয়।) উট পাখি সারাদিন দিবারৌদ্রে ফিরে বালির ভিতরে মাথা রেখে দিয়ে আপনার অন্ধ পরিচয় হয়তো ভা নিয়ে যায়,- তা' পাখির বিনয়। কোনো এক রমণীকে ভালোবেসে, কোনো এক মরকের দেশে গিয়ে জোর পেয়ে, কোন এক গ্রন্থ প'ড়ে প্রিয় সত্য পেয়ে গেছি ভেবে, অথবা আরেক সত্য সকলকে দিতে গিয়ে অভিভূত হয়ে, শরতের পরিষ্কার রাত পেয়ে সব চেয়ে পোষাকী, উজ্জ্বল- চিন্তা তবু বর্ষারাতে দ্বার থেকে দ্বারে ভিজে কুকুরের মত গাত্রদাহ ঝাড়ে। সমাধির ঢের নিচে- নদীর নিকটে সব উঁচু উঁচু গাছের শিকড় গিয়ে নড়ে।সেইখানে দার্শনিকের দাঁত ক্কাথ পান করে পরিত্যাক্ত মিঠে আলিউ, মরামাস, ইঁদুরের শবের ভিতরে;- জেনে নিয়ে আমরা প্রস্তুত ক'রে নিই নিজেদের; কেননা ভূমিকা ঢের র'য়ে গেছে- বোঝা যাবে (কিছুটা বিনয় যদি থেকে থাকে চোখে)- সূশ্রী ময়ূরও কেন উটপাখি সৃষ্টি ক'রেছিল টানাপোড়েনের সুরে- সূর্যের সপ্তকে।
জীবনানন্দ দাশ
প্রেমমূলক
পাড়ার মাঝারে সব চেয়ে সেই কুদুঁলি মেয়েটি কই! কতদিন পরে পল্লীর পথে ফিরিয়া এসেছি ফের সারাদিনমান মুখখানি জুড়ে ফুটিত যাহার খই কই কই বালা আজিকে তোমার পাই না কেন গো টের!তোমার নখের আঁচড় আজিও লুকায়ে যায় নি বুকে, কাঁকন-কাঁদানো কণ্ঠ তোমার আজিও বাজিছে কানে! যেই গান তুমি শিখায়ে দিছিলে মনের সারিকা শুকে তাহারই ললিত লহরী আজিও বহিয়া যেতেছে প্রাণে!কই বালা কই!-প্রণাম দিলে না!- মাথায় নিলে না ধূলি -বহুদিন পরে এসেছি আবার বনতুলসীর দেশে! কুটিরের পথে ফুটিয়া রয়েছে রাঙ্গা রাঙ্গা জবাগুলি- উজান নদীতে কোথায় আমার জবাটি গিয়েছে ভেসে!
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায়: স্থবিরতা সব চেয়ে ভালো; নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো। সেই আলো চিরদিন হয়ে থাকে স্থির, সব ছেড়ে একদিন আমিও স্থবির হয়ে যাব; সেদিন শীতের রাতে সোনালী জরির কাজ ফেলে প্রদীন নিভায়ে রবো বিছানায় শুয়ে: অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে রবো বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতো। স্থবিরতা, করে তুমি আসিবে বলো তো।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
সেইদিন এই মাঠ স্তব্ধহবে নাকো জানি---এই নদী নক্ষত্রের তলে সেদিনও দেখিবে স্বপ্ন---সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আ ঝরে ! আমি চলে যাব ব ’লে চালতাফুল কি অর ভিজিবে না শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে? লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে? সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !           চারি দিকে শান্ত বাতি---ভিজে গন্ধ---মৃদু কলরব; খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে; পৃথিবীর এই গল্প বেঁচে রবে চিরকাল; এশিরিয়া ধুলো আজ---বেবিলন ছাই হয়ে আছে ।
জীবনানন্দ দাশ
স্বদেশমূলক
সারাদিন ট্রাম-বাস-ফেরিওলাদের ডাক- কুষ্ঠরোগী পথের উপর- হাড়ভাঙা মহিষের গাড়িগুলো-বাজারের রুক্ষ শব্দ-বস্তির চিৎকার। আমার হৃদয়ে যেই শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিল ঘর তাহারে ফিরায়ে দেয় শহরের পথ থেকে পাড়াগাঁর কান্তারের পার-কবে যে কান্তার ছেড়ে আসিয়াছি নির্বাসিত আমি রাজপুত্রের মতন, কোথায় শিমের গন্ধ? শ্যামা পাখি? কিশোর গেল কি মরে বুকের ভেতর? দুপুর ঘনায়ে ওঠে ভিজা মেঘে- চিল কাঁদে-কই বলো? কই হীরামন?- আমার হৃদয়ে যে গো শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিলো ঘর।২আমি যে সংসারে মন দিতে চাই, আমি যে বাঁধিতে চাই পৃথিবীর মানুষের মতো বাসা এক; আমি যে বন্দরে যাই, অন্নের উপায় করি-স্বামী হই পিতা হই আমি; আমি যে ভিড়ের গন্ধ গায়ে মাখি দিনরাত; আঁধারে ঘুমাই, দিনে রৌদ্রে ইতস্তত ঘুরে ফিরি; সংসারের কাজ কথা হাটের ভিতরে আমি অলক্ষ্যে যে পড়িতেছি নামি- এইসব ছেড়ে দিয়ে, হে হৃদয়, চলে যাও অঘ্রাণের পাড়াগাঁর ম্লান তেপান্তরে, সেখানে বটের বুকে দাঁড়কাক বাঁধে বাসা-রাঙা পশমের মতো ফলগুলো ঝরে শুকনো পাতার 'পরে; সেখানে সন্ধ্যার বক শঙ্খের মতন শাদা পাখনা ভাসায় কামরাঙা-রক্তমেঘে-তিনশো বছর ধরে কোন্‌ অভিমানী মঠ দেখা যায়- খড়কুটা মুখে নিয়ে শালিখ উড়িয়া যায় কান্তারের ঘাস থেকে প্রান্তরের ঘাসে, এক তারা ফুটিতেই রূপসী প্রেতিনী সেই শঙ্খমালা দেখা দেয় মাঠের বাতাসে। ...৩ যেদিন আমি পৃথিবীর থেকে চলে যাব- হে শঙ্খমালা- অপরিসীম নক্ষত্র তুমি বিছিয়ে রেখো আকাশে, আকাশের অন্ধকার সমতলতা ঘিরে যুগান্তের লুপ্ত মানবীদের মতো কয়েকটি নির্জন নক্ষত্র- এর চেয়ে গভীর জিনিস কী আর থাকতে পারে কী আর থাকতে পারে শঙ্খমালা-আর আমার বিছানা করে দিয়ো সমতল দেশের শিয়রে সবুজ ঘাসের ছবির ভিতর ধানসিড়ি নদীর জলের গন্ধের কাছে এই বাংলায়।
জীবনানন্দ দাশ
সনেট
ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর — চিল একা নদীটির পাশে জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে; পায়রা গিয়েছে উড়ে তবু চরে, খোপে তার; — শসাতাটিকে, ছেড়ে গেছে মৌমাছি; — কালো মঘে জমিয়াছে মাঘের আকাশে, মরা প্রজাতিটির পাখার নরম রেণু ফেলে দিয়ে ঘাসে পিঁপড়েরা চলে যায়; — দুই দন্ড আম গাছে শালিখে — শালিখে ঝুটোপুটি, কোলাহল — বউকথাকও আর রাঙা বউটিকে ডাকে নাকো-হলুদ পাখনা তার কোন যেন কাঁঠালে পলাশেহারায়েছে; বউ উঠানে নাই — প’ড়ে আছে একখানা ঢেঁকি; ধান কে কুটবে বলো-কত দিন সে তো আর কোটে নাকো ধান, রোদেও শুকাতে সে যে আসে নাকো চুল তার — করে নাকে স্নান এ-পুকুরে — ভাঁড়ারে ধানের বীজ কলায়ে গিয়েছে তার দেখি, তবুও সে আসে নাকে; আজ এ দুপুরে এসে খই ভাজিবে কি? হে চিল, সোনালি চিল, রাঙা রাজকন্যা আর পাবে না কি প্রাণ?
জীবনানন্দ দাশ
সনেট
মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে — হাসির আস্বাদ পেয়ে গেছি; দেখেছি আকাশে দূরে কড়ির মতন শাদা মেঘের পাহাড়ে সূর্যের রাঙা ঘোড়া; পক্ষিরাজের মতো কমলা রঙের পাখা ঝাড়ে রাতের কুয়াশা ছিঁড়ে; দেখেছি শরের বনে শাদা রাজহাঁসদের সাধ উঠেছে আনন্দে জেগে — নদীর স্রোতের দিকে বাতাসের মতন অবাধ চলে গেছে কলরবে; — দেখেছি সবুজ ঘাস — যত দূর চোখ যেতে পারে; ঘাসের প্রকাশ আমি দেখিয়াছি অবিরল, — পৃথিবীর ক্লান্ত বেদনারে ঢেকে আছে; — দেখিয়াছি বাসমতী, কাশবন আকাঙ্খার রক্ত, অপরাধমুছায়ে দিতেছে যেন বার বার কোন এক রহস্যের কুয়াশার থেকে যেখানে জন্মে না কেউ, যেখানে মরে না কেউ, সেই কুহকের থেকে এসে রাঙা রোদ, শালিধান, ঘাস, কাশ, মরালেরা বার বার রাখিতেছে ঢেকে আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু — আমাদের বিস্মিত নীরব রেখে দেয় — পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আচঁড় ঢের, অশ্রু গেছি রেখে তবু ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব।
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড় কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলারঙের আলোয় জ্ব’লে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে। যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে,- মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে
জীবনানন্দ দাশ
চিন্তামূলক
সূর্য কখন পশ্চিমে ঢ’লে মশালের মত ভেঙে লাল হয়ে উঠে সমুদ্দুরের ভিতরে নিভছে গিয়ে; সে যে রোজ নেভে সকলেই জানে, তবু আজো ডুবে যায় সময়মতন সকলের অজানিতে। নারী সাপ যখ বণিক ভিখিরী পিশাচ সকলে মিলে ভোরবেলা থেকে মনের সূর্যনগরীর আলো খুঁজে পথের প্রমাণ সূর্যের ত্বকে রক্তে ঘুরছে কী যে। শিশুর মতন বানানের ভুলে মহাজীবনের ভাষা আধো শিখে আধো শেখার প্রয়াসে পরস্পরকে তারা দেখেছে কঠিন সিঁড়িকাটাপথে;- নরকের সিঁড়ি এঁকে বেঁকে ঘুরে বীতবর্ষণ কৃষ্ণ মেঘের মত নীলিমায় দূরে কোথায় মিশেছে। মানবহৃদয় তাকে পেতে চায় প্রেমে আর অনুমানে; ধূলো হাড় ঊর্ণায় ডাঙা বন্দরে চোরা নগরের রক্তনদীর ঢেউয়ে জেনে নিতে চায় কি সে ইতিহাসঠাসা বেদনার থেকে এ সিঁড়ি জেগেছে,- কোথায় গিয়েছে,- এত কঙ্কাল খুলি এত আবছায়া ফেনিল সাগর- জ্ঞান প্রেম প্রাণ একে ঘিরে আছে কেন; নরনারীদের নিরাশাসূচক মুখে কেন তবু আসে ভালো প্রভাতের মতন বিচ্ছুরণ? মুখে ভুল ভাষা পুরুষ নারীর; হৃদয়ের কোলাহলে কি কাম কারণ-কর্দম? তবুও নদীর রক্ত জল। সময় এখন মরুভূমি; সীমাঃ মৃগতৃষ্ণার মত, পান্থ বানাল মানুষ তোমাকে;- তোমার সাধনা গতি প্রাণনার ঢের হাড়গোড় ভেঙে প'ড়ে থাকে, তবু, মানবেতিহাস মানে আরো আলোকিত চেতনার স্বাদ;- মনের সূর্যনগরী জ্ঞানের কাছে প্রেমের নিজের নিবেদন;- তাই মহাঅঘটনে কালো ইতিহাসরাত গ্রহণ মুক্ত সূর্যের মত আলো।
জীবনানন্দ দাশ
প্রেমমূলক
‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর’ পরে- বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে; সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে; আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায় ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়; নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরে বুকে আজ …… হেঁটে চলি….. আজ কোনো কথা নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শড়ির ভিতরে, সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে; পতঙ্গ পালক্‌ জল-চারি দিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ; আলোয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ হয়ে যায়; সময়ও অপার-তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;-কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে-তাই-ই ঠিক;-ওখানে সিগ্ধ হয় সব। অপ্রেমে বা প্রেমে নয়- নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।
জীবনানন্দ দাশ
সনেট
একদিন যদি আমি কোনো দূর বিদেশের সমুদ্রের জলে ফেনার মতন ভাসি শীত রাতে — আসি নাকো তোমাদের মাঝে ফিরে আর — লিচুর পাতার ‘পরে বহুদিন সাঁঝে যেই পথে আসা-যাওয়া করিয়াছি, — একদিন নক্ষত্রের তলে কয়েকটা নাটাফল তুলে নিয়ে আনারসী শাড়ির আচঁলে ফিঙার মতন তুমি লঘু চোখে চলে যাও জীবনের কাজে, এই শুধু… বেজির পায়ের শব্দ পাতার উপড়ে যদি বাজে সারারাত… ডানার অস্পষ্ট ছায়া বাদুড়ের ক্লান্ত হয়ে চলেযদি সে পাতার ‘পরে, — শেষ রাতে পৃথিবীর অন্ধকারে শীতে তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ — ধূসর চিবুক, বাম হাত চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে, তবুও তোমার ঘুম ভেঙে যাবে একদিন চুপে অকস্মাৎ তুমি যে কড়ির মালা দিয়েছিলে — সে হার ফিরাযে দিয়ে দিতে যখন কে এক ছায়া এসেছিল… দরজায় করেনি আঘাত।
জীবনানন্দ দাশ
প্রেমমূলক
ক্লান্ত জনসাধারণ আমি আজ,- চিরকাল;- আমার হৃদয়ে পৃথিবীর দণ্ডীদের মত পরিমিত ভাষা নেই। রাত্রিবেলা বহুক্ষণ মোমের আলোর দিকে চেয়ে, তারপর ভোরবেলা যদি আমি হাত পেতে দিই সূর্যের আলো দিকে,- তবুও আমার সেই একটি ভাবনা অতীব সহজ ভাষা খুঁজে নিতে গিয়ে হৃদয়ঙ্গম করে সব আড়ষ্ট, কঠিন দেবতারা অপরূপ মদ খেয়ে মুখ মুছে নিয়ে পুনরায় তুলে নেয় অপূর্ব গেলাস; উত্তেজিত না-হ'য়েই অনায়াসে ব'লে যায় তারাঃ হেমন্তের ক্ষেতে কবে হলুদ ফসল ফলেছিলো, অথবা কোথায় কালো হ্রদ ঘিরে ফুটে আছে সবুজ সিঙাড়া। রক্তাতিপাতের দেশে ব'সেও তাদের সেই প্রাঞ্জলতায় দেখে যাই সেই সোনালি ফসল হ্রদ, সিঙাড়ার ছবি; আমার প্রেমিক সেই জলের কিনারে ঘাসে- দক্ষ প্রজাপতি; মানুষ-ও-ছাগমুণ্ড কেটে তাকে শুদ্ধ ক'রে দিয়ে যাবে অনাগত সবি, একদিন হয়তো বা;- আজ সব উত্তমর্ণ দেবতাকে আমার হৃদয় যে-সব পবিত্র মদ দিয়েছিলো- যে সব মদির আলোর রঙের মতো ম্লান মদ দিয়ে গিয়েছিলো,- যখনি চুমুক দিই হ'য়ে থাকি চর্মচক্ষুস্থির!
জীবনানন্দ দাশ
সনেট
একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফেলিয়াছি, আমার শরীর নরম ঘাসের পথে হাঁটিয়াছে; বসিয়াছে ঘাসে দেখিয়াছে নক্ষত্রের জোনাকিপোকার মতো কৌতুকের অমেয় আকাশে খেলা করে; নদীর জলের গন্ধে ভরে যায় ভিজে স্নিগ্ধ তীর অন্ধকারে; পথে পথে শব্দ পাই কাহাদের নরম শাড়ির, স্লান চুল দেখা যায়; সান্ত্বনার কথা নিয়ে কারা আসে – ধূসর কড়ির মতো হাতগুলো — নগ্ন হাত সন্ধ্যার বাতাসে দেখা যায়: হলুদ ঘাসের কাছে মরা হিম প্রজাপতিটিরসুন্দর করুণ পাখা পড়ে আছে — দেখি আমি; — চুপে থেমে থাকি; আকাশে কমলা রঙ ফুটে ওঠে সন্ধ্যায় — কাকগুলো নীল মনে হয়; অনেক লোকের ভিড়ে ডুবে যাই — কথা কই — হাতে হাত রাখি; করুণ বিষন্ন চুলে কার যেন কোথাকার গভীর বিষ্ময় লুকায়ে রয়েছে বুঝি… নক্ষত্রের নিচে আমি ঘুমাই একাকী; পেঁচার ধূসর ডানা সারারাত জোনাকির সাথে কথা কয়।
জীবনানন্দ দাশ
প্রেমমূলক
বাঙালি পাঞ্জাবি মারাঠি গুজরাটি বেহারি উৎকলি-আর সব সাগরপারের দেশের মানুষ এই কলকাতায় আমরা লক্ষ লক্ষ লোক, কোটি কোটি প্রাণ-রোজ ভোরে জাগি, অন্ধকারে ঘুমাই এই কি শুধু? এর প্রচণ্ড রহস্যের কথা তোমাদের মনে জাগে না? এক মুহুর্তের জন্যও কি মনে হয় না যেন সেই অতীতের এশিরিয়া মিশর আবার তাদের গল্প বলে যাচ্ছেএই কলকাতায় মনুমেন্টের দিকে তাকিয়ে বেবিলনের সেই বিরাট স্তম্ভের কথা মনে হয় না কি যার উপরে সিংহের মূর্তি ছিল? এই শহরটাকে বেবিলন মনে হয় না? মিশর বলে?আমার কাছে এই শহরের ধুলো হাজার হাজার বছরের পুরনো বলে মনে হয় জানালায় এই নারী, দিঘির জলে এর মাছ, আলিসায় এর পাখি, দেয়ালে এর কীট এক-এক সময় হেঁয়ালির মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।বনলতা সেন তুমি যখন নদীর ঘাটে স্নান করে ফিরে এলে মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য তোমার, অসংখ্য চিল, বেগুনের ফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ তখন থেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনো দিন কোনো প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনো দিন মৃত হয় না আমরা পথ থেকে পথ চলি শুধু-ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে- আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি দাঁড়াই; তুমি আর আমি।কখনো বা বেবিলনের সিংহের মূর্তির কাছে কখনো বা পিরামিডের নিস্তব্ধতায় কাঁখে তোমার মাদকতাময় মিশরীয় কলসি নীল জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ মাথার উপর সকালের জ্বলন্ত সূর্য তোমার, অসংখ্য চিল, বেগুনফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ।