poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কতদিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর
খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে; — সন্ধ্যার ধূসর সজল
মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে — বাদুড় কেবল
করিতেছে আসা-যাওয়া আকাশের মৃদু পথে — ছিন্ন ভিজে খড়
বুকে নিয়ে সনকার মতো যেন পড়ে আছে নরম প্রান্তর;
বাঁকা চাঁদ চেয়ে আছে — কুয়াশায় গা ভাসায়ে দেয় অবিরল
নিঃশব্দ গুবরে পোকা — সাপমাসী — ধানী শ্যামাপোকাদের দল;
দিকে দিকে চালধোয়া গন্ধ মৃদু — ধূসর শাড়ির ক্ষীণ স্বরশোনা যায় — মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব
বেদনার গন্ধ ভাসে — খড়ের চালের নিচে তুমি আর আমি
কতদিন মলিন আলোয় বসে দেখেছি বুঝেছি এই সব;
সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি
খড়ের চালের নিচে মুখোমুখি বসে থেকে তুমি আর আমি
ধূসর আলোয় বসে কতদিন দেখেছি বুঝেছি এইসব।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস – প্রান্তরের পারে
নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে-নীল বুকে আছে তাহাদের
গঙ্গাফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের,
হিজলের ক্লান- পাতা,- বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে
তাহাদের শ্যাম বুকে,-পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে
বেতের নরম ফল, নাটা ফল খেতে আসে, ধুন্দুল বীজের
খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে-বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের
শালিখ খঞ্জনা তাহা; লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু’ধারেনরম কান্তারে এই পাড়াগার বুকে শুয়ে সে কোন্ দিনের
কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শুকায়নি, মজেনি আকাশ,
বল্লাল সেনের ঘোড়া-ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের
শব্দ হত এই পথে আরো আগে রাজপুত্র কতো দিন রাশ
টেনে টেনে এই পথে কি যেন খুঁজেছে, আহা হয়েছে উদাস,
আজ আর খোঁজাখুজি নাই কিছু- নাটাফলে মিটিতেছে আশ-
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমরা কিছু চেয়েছিলাম প্রিয়;
নক্ষত্র মেঘ আশা আলোর ঘরে
ঐ পৃথিবীর সূর্যসাগরে দেখেছিলাম ফেনশীর্ষ আলোড়নের পথে
মানুষ তাহার ছায়ান্ধকার নিজের জগতে
জন্ম নিল- এগিয়ে গেল; - কত আগুন কত তুষার যুগ
শেষ করে সে আলোর লক্ষ্যে চলার কোন্ শেষ
হবে না আর জেনে নিয়ে নির্মল নির্দেশ
পেয়ে যাবে গভীর জ্ঞানের, - ভেবেছিলাম,
পেয়ে যাবে প্রেমের স্পষ্ট গতি
সত্য সূর্যালোকের মতন; - ব’লে গেল মৃত
অন্ধকারে জীবিতদের প্রতি।জীবিত, মানে আজ সময়ের পথে
বালি শিশির ধুলোর মতো কণা
মিলিয়ে তাদের প্রাণের প্রেরণা
ক্রমেই চরিতার্থ হতে চায়।
চারদিকে নীল অপার্থিবতায়
সোনার মতন চিলের ডানায় কোনো
খাদ মেশানো নেই, তবু তার প্রাণে
কোটি বছর পরে কোনো মানে
বার করেছে মন কি প্রকৃতির?
মানুষ তবু পাখির চেয়ে ঢের
অমৃতলোক হাতের কাছে পেয়ে
তবু কি অমৃতের?মানুষ আমি,- মানুষ আমার পাশে
হৃদয়ে তার হৃদয় মেশালেও
ব্যক্তি আমি ব্যক্তিপুরুষ সে-ও;
দ্বীপের মতন একা আমি তুমি;
অনন্ত সব পৃথক দ্বীপের একক মরুভূমি:
যে যার পরিপূর্ণ অবিশ্বাসে
র’য়ে গেছে;- সেখান থেকে ব্যাজস্তূতি কপট প্রণয় ভয়
দেখ কেমন উৎসারিত হয়;
প্রাণের প্রয়াস রয়েছে তবু, তাই
দেখেছি মানুষ অনর্গল অন্ধকারে মরে
মানবকে তার প্রতিনিধি রেখে গেছে, - হয়তো একদিন
সফলতা পেয়ে যাবে ইতিহাসের ভোরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলি আমার দেখা হয়:
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে;
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর সাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি;
কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,
সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলেছে সে।
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
তারপর অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে
সমন্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়।
ওইখানে একজন শুয়ে আছে — দিনরাত দেখা হত কত কত দিন
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
গল্পে আমি পড়িয়াছি কাঞ্চী কাশী বিদিশার কথা
কোনদিন চোখে দেখি নাই
একদিন ভাবিলাম মাঠে মাঠে কুয়াশায়
যদি আমি কোনোদিন বিদিশায় যাই—মাঠে মাঠে কুয়াশায় ভাবিলাম এই কথা
বহু দিন বহু বহু রাত ধ’রে আমি
যদি আমি—কোনোদিন যদি আমি
অবন্তীর পথে গিয়ে নামি—পউষের কুয়াশায় সাপের খোলস, পাতা, ডিম
প’ড়ে আছে ঘাসে,
কেন যে করুণ চোখ পথ ভুলে ভেসে গেল
ময়জানি নদীটির পাশে—এসেছে এ কার বজরা ?
চারিদিকে শীত নদী : যেন মরুভূমি
বজরার জানালায় কার মুখ
এই পথে এত দিন পরে কেন তুমি ?কবেকার মাঠ—পথ—মন্দির কুয়াশার ফাঁকে দিল দেখা
হৃদয়ে তাতাল বালির মতো তৃষা
নদীর আঁধার জলে ভ’রে গেল
আমি যে গো দেখেছি বিদিশা।সব কথা মনে পড়ে
জলসিড়ি নদী আর জানে না সে কথা
নীলাভ ঘাসের পথে জ্যোৎস্নায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
গাঢ় অন্ধকার থেকে আমরা এ-পৃথিবীর আজকের মুহূর্তে এসেছি।
বীজের ভেতর থেকে কী ক’রে অরণ্য জন্ম নেয়,-
জলের কণার থেকে জেগে ওঠে নভোনীল মহান সাগর,
কী ক’রে এ-প্রকৃতিতে—পৃথিবীতে, আহা,
ছায়াচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে মানব প্রথম এসেছিল,
আমরা জেনেছি সব,—অনুভব করেছি সকলই।
সূর্য জেলে,—কল্লোল সাগর জল কোথাও দিগন্তে আছে, তাই
শুভ্র অপলক সব শঙ্খের মতন
আমাদের শরীরের সিন্ধু-তীর।এই সব ব্যাপ্ত অনুভব থেকে মানুষের স্মরণীয় মন
জেগে ব্যথা বাধা ভয় রক্তফেনশীর্ষ ঘিরে প্রাণে
সঞ্চারিত ক’রে গেছে আশা আর আশা;
সকল অজ্ঞান কবে জ্ঞান আলো হবে,
সকল লোভের চেয়ে সৎ হবে না কি
সব মানুষের তরে সব মানুষের ভালোবাসা।আমরা অনেক যুগ ইতিহাসে সচকিত চোখ মেলে থেকে
দেখেছি আসন্ন সূর্য আপনাকে বলয়িত ক’রে নিতে জানে
নব নব মৃত সূর্যে শীতে;
দেখেছি নির্ঝর নদী বালিয়াড়ি মরুর উঠানে
মরণের-ই নামরূপ অবিরল কী যে।তবু শ্মশান থেকে দেখেছি চকিত রৌদ্রে কেমন জেগেছে শালিধান;
ইতিহাস-ধূলো-বিষ উৎসারিত ক’রে নব নবতর মানুষের প্রাণ
প্রতিটি মৃত্যুর স্তর ভেদ ক’রে এক তিল বেশি
চেতনার আভা নিয়ে তবু
খাঁচার পাখির কাছে কী নীলাভ আকাশ-নির্দেশী!
হয়তো এখনো তাই;—তবু
রাত্রি শেষ হলে রোজ পতঙ্গ-পালক-পাতা
শিশির-নিঃসৃত শুভ্র ভোরে
আমরা এসেছি আজ অনেক হিংসার খেলা অবসান ক’রে;
অনেক দ্বেসের ক্লান্তি মৃত্যু দেখে গেছি।
আজো তবু
আজো ঢের গ্লানি-কলঙ্কিত হয়ে ভাবিঃ
রক্তনদীদের পারে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির
শোকাবহ অঙ্ক কঙ্কালে কি মাছি তোমাদের মৌমাছির নীড়
অল্পায়ু সোনালি রৌদ্রে;
প্রেমের প্রেরণা নেই—শুধু নির্ঝ্রিত শ্বাস
পণ্যজাত শরীরের মৃত্যু-ম্লান পণ্য ভালোবেসে;
তবুও হয়তো আজ তোমার উড্ডীন নব সূর্যের উদ্দেশ্য।ইতিহাসে-সঞ্চারিত হে বিভিন্ন জাতি, মন, মানব-জীবন,
এই পৃথিবীর মুখ যত বেশি চেনা যায়—চলা যায় সময়ের পথে,
তত বেশি উওরণ সত্য নয়;—জানি; তবু জ্ঞানের বিষণ্ণলোকী আলো
অধিক নির্মল হলে নটীর প্রেমের চেয়ে ভালো
সফল মানব প্রেমে উৎসারিত হয় যদি, তবে
নব নদী নব নীড় নগরী নীলিমা সৃষ্টি হবে।
আমরা চলেছি সেই উজ্জ্বল সূর্যের অনুভবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সুদর্শনা মিশে যায় অন্ধকার রাতে
নদীর এ পারে বসে একদিনও দেখে নি ওপার
প্রকৃতি চায় নি সেই মেয়েটি এ আলো আর রাত্রির আঘাতে
পৃথিবীকে কূট চোখে দেখে নেবে- বুঝে নেবে জীবনের গ্লানি অন্ধকারচায় নি সে কলমীর ফুলভরা রক্তাক্ত প্রান্তরে
অথবা চিন্তায় রূঢ় ক্ষম সৎ পাণ্ডূলিপি যা খণ্ডন করে
মৃত্যুকে দেবার আগে এইসব একবার তুলে নেবে হাতেপ্রথম ঢেউয়ের থেকে দূর সুচনার মতো নদীর ভিতরে
অরবে সে চলে যায়-এক খণ্ড রাত্রি মনে হয়
পৃথিবীর রাত্রিকে যেন তার অনন্তের কাছে
সব হাঁস ঘুমালেও নক্ষত্রালোকিত হংসী আছে
সমুদ্রের পারে এসে বড়ো চাঁদ- এর চেয়ে নির্জন বিস্ময়
দেখেনিকো কোনোদিন; অনেক পবনে মৌমাছিদের ভিড়
যদিও খেয়েছে ঢের আকাশের বাতাসের মতন শরীর
তবু সে শরীর নয়- মাংসের চোখে দেখা নক্ষত্রেরা নয় তার তরে।।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সূর্যগরিমার নিচে মানুষের উচ্ছ্রিত জীবন
শুরু হ’ল- যখন সে শিশুর মতন;
নদীর জলের মত আশা দিয়ে উচ্চারিত হয়ে
তবুও সে মানুষের মন।
রঙীন খেলনা, ঘোড়া, জাপানী লাটিম,
আরব্যোপন্যাসের সেই পরী জিন উড্ডীন বক
নিয়ে খেলে বিবেচনা ক’রে হয়ে যায়
ক্রমেই নিঃস্বার্থ বিবেচক।
অপরা বিদ্যার দিন ছাত্রের,
কলেজিয়ানের পুরস্কার,
অধ্যায়নবিলাসীর
দু চারটে পেপারকাটার
প’ড়ে থেকে তার পর মলিন টেবিল;
বাজেটের কমিটি মিটিঙে;-
ভুলের ভিতর থেকে ভুলে-
গরিমার থেকে আরো গরিমার পানে,-
যেখানে আসন্ন কাল চিরকাল আগামীপ্রসবাঃ
আজো যা হয়নি সেই চরিত্রের পানে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক — পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে
কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, — চলে গেল কবে যে নীরবে,
তাও আর জানি নাকো; ঠোট ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে
রোজ ভোরে দেখা দিত — অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে
তারে আর দেখি নাকো — কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে,
জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল — হৃদয়ের গভীর উৎসবে
খেলা করে গেছে তারা কত দিন — ফড়িঙ কীটের দিন যত দিন চলেতাহারা নিকটে ছিলো — রোদের আনন্দে মেতে — অন্ধকারে শান্ত ঘুম খুঁজে
বহুদিন কাছে ছিলো; — অনেক কুকুর আজ পথে ঘাটে নড়াচড়া করে
তবুও আঁধারে ঢের মৃত কুকুরের মুখ — মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে;
কোথায় গিয়েছে তারা? ওই দূর আকাশেল নীল লাল তারার ভিতরে
অথবা মাটির বুকে মাটি হয়ে আছে শুধু — ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে?
শুধালাম — উত্তর দিল না কেউ উদাসীন অসীম আকাশে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন :
মস্ত বড় ময়দান — দেবদারু পামের নিবিড় মাথা — মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
জানালায় জানালায় অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মাতা ধান ভানে — গান
গায়- গান গায়-
এই দুপুরের বাতাস।
এক একটা দুপুরে এক একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন।
বিকেলে নরম মুহুর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা- যাওয়া;
একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া
আতার ধূসর ক্ষীরে গড়া মুর্তির মতো
নদীর জলে
সমস্ত বিকেলবেলা ধরে
স্থির ।
মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,
আগুণের — ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষন্নতা।
ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে
পিয়াশাল পিয়াল আমলকি দেবদারু–
বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;
শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াওড়ি জ্যোৎস্নায়–ছায়ায়,
রাত্রি;
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা!
মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
শীতের কুয়াশা মাঠে; অন্ধকারে এইখানে আমি।
আগত ও অনাগত দিন যেন নক্ষত্রবিশাল শূন্যতার
এই দিক- অথবা অপর দিক; দুয়েরি প্রাণের
বিচিত্র বিষয়জ্ঞানে মিলে গেছে- তবুও প্রেমের
অমর সম্মতিক্রমে। পৃথিবীর যে কোনো মানব
দেশ কাল যে কোনো অপর দেশ সময় ও মানুষের তরে
সেবা জ্ঞান শৃঙ্খলা অবতার হয়ে সব বাধ্যব্যথাহারা
নবীন ভূগোললোকে মিশে গেছে;- দিকভ্রান্তিহীন
সারসের মত,- নীল আকাশকে ঈষৎ ক্রেংকারে
খুলে ফেলে। যা হয়েছে যা হয়নি সবই নক্ষত্রবীথির
একজন অথবা অপর জন;- নিজেদের হৃদয়যন্ত্রের
নিকটে সত্যের মত প্রতিভাত হয়ে উঠে তারা
অনন্ত অমার পটভূমির ভিতরে
অনিমেষ সময়ের মত জ্বলে;- মনে হয় আশা
অথবা নিরাশা যদি শতান্দীর জীবনকে খেয়ে শেষ করে
পবিত্রতায় তবু দিক ও সম্য মিলে একজন অমলিন তারা
অমিলের ঊর্ণা ধোঁয়া ছায়া কেটে মিলনের পথে
জ্ব'লে যায়; যায় না কি?- নিভু নিভু হয়ে শীতকালের দেয়ালে
ফুটে ওঠে; কথায় কারণে কামে অগণন ক্লেদে কনফারেন্সে
বাতির অভাব হ'লে পৃথিবীর মানচিত্রে অন্ধকারে পথ
দেখবার মত কোনো কাউকে না পেলে ঐ তারাবলী তারা
প্রাণের ভিতর জড় মূল্যের অধিক ব্যাপ্তি;- চারিদিকে এই
অবিচ্ছিন্ন পাতা ছায়া শিশিরের নগরের হৃদয়কম্পনে ব'সে আমি
তোমাকে জাগায়ে দিয়ে, প্রিয়, সব কালীন জননী
মানুষের এক জাতি এক দেশ এক মৃত্যু একটি জীবন এক
গহন আলোকে দেখি না কি? প্রেতের রোলের ভিতরে বাঙালীর
ঘর ভেঙে ঝ'রে গেলে জেনিভার অমেয় প্রাসাদ
ম'রে যায়;- ফ্ল্যান্ডাস, ভাডুন, ভিমি রিজ, উক্রেইন
হোংয়াহো নীপার রাইন চিনদুইনের পরে সব শব
কলকাতা হাওড়া মেদিনীপুর ডায়মনহারবারে বাংলায়,
অগণন মানবের মৃতদেহ প্রমাণিত হয়ে
কিরকম শুভ্র সৌভ্রাত্রের মত, চেয়ে দেখ, ছড়ায়ে র'য়েছে।
নতুন মৃত্যুর বীজ নয়- ওরা নতুন নেশন-
বীজ নতুন বঞ্চনা-ধ্বংস-মৃগতৃষ্ণাবীজ নয়; নব নব প্রাণনের
সংযমে পৃথিবী গ'ড়ে সফলতা পাবে মনে হয়-
মানুষের ইতিহাসভনিতার দিন শেষ ক'রে তার স্থির
প্রকৃতিস্থ আত্মার আলোর বাতায়নে।আমার ব্যাহত ঘরে এ ছাড়া অপর কোনো বাতি
নেই আর, আমার হৃদয়ে নেই, এইখানে মৃত পোল্যান্ডের
সীমানা রাইনের রোলে মিশে গিয়ে মরণকর্কশ জামের্নির
হৃদয়ের পরে হিমধূমোজ্জ্বল অলিভ-বনের
আন্দোলনে এম্পিডোক্লেসের স্মৃতি বরাবর জয় ক'রে নিয়ে
নবীন লক্ষ্যের গ্রীস্, নতুন প্রাণের চীন আফ্রিক্ ভারত প্যালেস্টাইন।
পৃথিবীর ভয়াবহ রাষ্ট্রকূট অন্ধকারে অন্তহীন বিদ্যুৎ-বৃষ্টির
জ্যোর্তিময় ব্রেজিল পাথরে আমি নবীন ভূগোল
এরকম মানবীয় হয়ে যেতে দেখি;- ইতিহাস
মানবিক হয়ে ওঠে;- যাযাবর শ্রীজ্ঞানের মত
এখন অকুতোভয় উদাত্ত আবেগে
সঞ্চারিত হয়ে যাওয়া অর্বাচীন জেনে নিয়ে তবু
নতুন প্রাণের নব উদ্দেশের অভিসারী হতে
চায় নাকি- চায় না কি জনসাধারণ পৃথিবীর?
দেয়ালে ট্রামের পথে নর্দমায় ট্রাকের বিঘোর হনিতের
অস্ফুট সিংহের শব্দে সবিস্ময় উত্তরচরিত্রে
ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে যেতে পারে বাংলার লোকশ্রুত বিবর্ণ চরিত।
আমার চোখের পথে আবর্তিত পৃথিবীর আঁকাবাঁকা রেখে
যতদূর চ'লে গেছেঃ কলকাতা নতুন দিল্লী ইয়াঙ্কী আফ্রিক্
দান্তের ইটালী শেক্স্পীরিয় ইংল্যান্ড মেঘ-পাতাল মর্ত্যের গল্পের
বিভিন্ন পর্বের থেকে উঠে এসে রবীন্দ্র লেনিন মার্কস ফ্রয়েড রোলাঁর
আলোকিত হ'য়ে ওঠে; মুমুক্ষার অবতার বুদ্ধের চেয়েও
সমুৎসুক চোখ মেলে আপামর মানবীয় ঋণ-রিরাংসা-অন্যায়-মৃত্যু-আঁধারে উজ্জ্বল
পথিকৃত সাঁকোর মতন সব শতকের ভগ্নাংশকে শেষ
ক’রে দিয়ে পবিত্র সময়পথে মিশে গেছে;- সব অতীতের
মথিত বিষের মত শুদ্ধ হয়ে সহজ কঠিন দক্ষিণ-ভবিষ্যতে
মিলে গিয়ে মানবের হৃদয়ের গভীর অশোক
ধ্বনিময়তার মত তুমি হে জোবন, আজ রাতে অন্ধকারে আনন্দসূর্যের
আলোড়নে আলোকিত ব’লেই তো মানব চ’লেছে।।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আকাশে জ্যোৎস্না- বনের পথে চিতা বাঘের গায়ের ঘ্রাণ;
হৃদয় আমার হরিণ যেনঃ
রাত্রি এই নীরবতার ভিতর কোন্ দিকে চলেছি!
রূপালি পাতার ছায়া আমার শরীরে,
কোথাও কোনো হরিণ নেই আর;
যত দূর যাই কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
শেষ সোনালি হরিণ-শস্য কেটে নিয়েছে যেন;
তারপর ধীরে-ধীরে ডুবে যাচ্ছে
শত-শত মৃগীদের চোখের ঘুমের অন্ধকারের ভিতর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ’লো না :
কেবল সে দূরের থেকে আমার দিকে একবার তাকালো
আমি বুঝলাম
চকিত হয়ে মাথা নোয়ালো সে
কিন্তু তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন – সপ্রতিভ হয়ে
সাত-দিন আট-দিন ন-দিন দশ-দিন
সপ্রতিভ হয়ে — সপ্রতিভ হয়ে
সমস্ত চোখ দিয়ে আমাকে নির্দিষ্ট করে
অপেক্ষা করে — অপেক্ষা ক’রে
সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ’লো না
কারণ, আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়
যদি হ’ত
সেই মাঘের নীল আকাশে
(আমি তাকে নিয়ে) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম
গাঙশালিখের মতো আমরা দু’টিতে
আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো
আমাদের মনে হবে
হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; – আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!
হঠাৎ কখন সন্ধ্যা মেয়েটির হাতের আঘাতে
সকল সমুদ্র সূর্য সত্বর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি হতে পারে
সে এসে এগিয়ে দেয়;
শিয়রে আকাশ দূর দিকে
উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র গ্রহের আলোড়নে
অঘ্রানের রাত্রি হয়;
এ-রকম হিরন্ময় রাত্রি ইতিহাস ছাড়া আর কিছু রেখেছে কি মনে।
শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন
জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;
চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়;
সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে
যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর
পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা
অশান্ত সন্তান ওগো,- বিপ্লবিনী পদ্মা ছিল তব নদী-মাতা।
কালবৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইতে রক্তপুঞ্জ তব
উত্তাল ঊর্মির তালে,-বক্ষে তবু লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব
উদ্যত ফণার নৃত্যে আষ্ফালিত ধূর্জটির কন্ঠ-নাগ জিনি,
ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শঙ্কাকুল ছিল সদা শত্রু অক্ষৌহিণী।
স্পর্শে তব পুরোহিত, ক্লেদে প্রাণ নিমেষেতে উঠিত সঞ্চারি,
এসেছিলে বিষ্ণুচক্র মর্মন্তুদ,–ক্লৈব্যের সংহারী।
ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর,
ভেঙেছিলে ধূলিশ্লিষ্ট শঙ্কিতের শৃঙ্খলের ডোর,
ভেঙেছিলে বিলাসের সুরাভান্ড তীব্র দর্পে,- বৈরাগের রাগে,
দাঁড়ালে সন্ন্যাসী যবে প্রাচীমঞ্চে-পৃথী-পুরোভাগে।
নবীন শাক্যের বেশে, কটাক্ষেতে কাম্য পরিহরি
ভাসিয়া চলিলে তুমি ভারতের ভাব-গঙ্গোত্তরী
আর্ত অর্স্পশ্যের তরে, পৃথিবীর পঞ্চমার লাগি;
বাদলের মন্দ্র সম মন্ত্র তব দিকে দিকে তুলিলে বৈরাগী।
এনেছিলে সঙ্গে করি অবিশ্রাম প্লাবনের দুন্দুভিনিনাদ,
শান্তি-প্রিয় মুমূর্ষুর শ্মশানেতে এনেছিলে আহব-সংবাদ,
গান্ডীবের টঙ্কারেতে মুহুর্মুহু বলেছিলে,- ‘আছি, আমি আছি!
কল্পশেষে ভারতের কুরুক্ষেত্রে আসিয়াছি নব সব্যসাচী।’
ছিলে তুমি দধীচির অস্থিময় বাসবের দম্ভেলির সম,
অলঙ্ঘ্য, অজেয়, ওগো লোকোত্তর, পুরুষোত্তম।
ছিলে তুমি রূদ্রের ডম্বরুরূপে, বৈষ্ণবের গুপীযন্ত্র মাঝে,
অহিংসার তপোবনে তুমি ছিলে চক্রবর্তী ক্ষত্রিয়ের সাজে,-
অক্ষয় কবচধারী শালপ্রাংশু রক্ষকের বেশে।
ফেরুকুল-সঙ্কুলিত উঞ্ছবৃত্তি ভিক্ষুকের দেশে
ছিলে তুমি সিংহশিশু, যোজনান্ত বিহরি একাকী
স্তব্ধ শিলাসন্ধিতলে ঘন ঘন গর্জনের প্রতিধ্বনি মাখি।
ছিলে তুমি নীরবতা-নিষ্পেষিত নির্জীবের নিদ্রিত শিয়রে
উন্মত্ত ঝটিকা সম, বহ্নিমান বিপ্লবের ঘোরে;
শক্তিশেল অপঘাতে দেশবক্ষে রোমাঞ্চিত বেদনার ধ্বনি
ঘুচাতে আসিয়াছিলে মৃত্যুঞ্জয়ী বিশল্যকরণী।
ছিলে তুমি ভারতের অমাময় স্পন্দহীন বিহ্বল শ্মশানে
শব-সাধকের বেশে,-সঞ্জীবনী অমৃত সন্ধানে।
রণনে রঞ্জনে তব হে বাউল, মন্ত্রমুগ্ধ ভারত, ভারতী;
কলাবিৎ সম হায় তুমি শুধু দগ্ধ হলে দেশ-অধিপতি।
বিধিবশে দূরাগত বন্ধু আজ, ভেঙে গেছে বসুধা-নির্মোক,
অন্ধকার দিবাভাগে বাজে তাই কাজরীর শ্লোকে।
মল্লারে কাঁদিছে আজ বিমানের বৃন্তহারা মেঘছত্রীদল,
গিরিতটে, ভূমিগর্ভ ছায়াচ্ছন্ন-উচ্ছ্বাসউচ্ছল।
যৌবনের জলরঙ্গ এসেছিল ঘনস্বনে দরিয়ার দেশে,
তৃষ্ণাপাংশু অধরেতে এসেছিল ভোগবতী ধারার আশ্লেষে।
অর্চনার হোমকুন্ডে হবি সম প্রাণবিন্দু বারংবার ঢালি,
বামদেবতার পদে অকাতরে দিয়ে গেল মেধ্য হিয়া ডালি।
গৌরকানি শঙ্করের অম্বিকার বেদীতলে একা
চুপে চুপে রেখে এল পূঞ্জীভূত রক্তস্রোত-রেখা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
দরদালানের ভিড়- পৃথিবীর শেষে
যেইখানে প'ড়ে আছে- শব্দহীন- ভাঙ্গা-
সেইখানে উঁচু-উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল- রাঙা-চুপে-চুপে ডুবে যায়- জ্যোৎস্নায়।
পিপুলের গাছে ব'সে পেঁচা শুধু একা
চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর
রূপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।হরীতকী শাখাদের নিচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ
আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাসঃ
নৃমুণ্ডের আবছায়া- নিস্তব্ধতা-
বাদামী পাতার ঘ্রাণ- মধুকুপী ঘাস।কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতোঃ
পুরুষ তাদেরঃ কৃতকর্ম নবীন;
খোঁপার ভিতরে চুলেঃ নরকের নবজাত মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।সেখানে গোপন জল ম্লান হ'য়ে হীরে হয় ফের,
পাতাদের উৎসরণে কোন শব্দ নাই;
তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে
বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।সেইখানে যুথচারী কয়েকটি নারী
ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে
মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের
তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে
স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে
ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে- বরুণে
ক্রুর পথ নিয়ে যায় হরীতকী বনে- জ্যোৎস্নায়।
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হ'য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বাচন মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক কর্কট- তুলা- মীন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ
কেমন সবুজ পাতা—জামীর সবুজ আরও—ঘাস যে হাসির মতো—রোদ যে সোনার মতো ঘাসে
সোনার রেখার মতো—সোনার রিঙের মতো—রোদ যে মেঘের কোলে—তোমার গালের টোলে রোদ
তোমার চুলে যে রোদ—মেঘের মতন চুলে—তোমার চোখে যে রোদ—সেও যে মেঘের মতো চোখ
আকাশে সোনালি চিল পাখনা ছড়ায়ে কাঁদে—(এমন সোনালি চিল)—সোনালি রেণুর মতো ঝরিছে কান্না আহা, মিশরে শুনেছি যেন কবে
আকাশে এমন ছেঁড়া ময়লা মেঘের রাশ—পড়েছে তাদের ছায়া নীলের ঘোলা জলে নিঝুম পিরামিডে
এমনই সোনালি রোদ—সোনার থামের মতো—ঘিয়ের শিখার মতো রয়েছে আকাশ ছিঁড়ে তবু
কেঁদেছে সোনালি চিল এমনই আকাশ ঘুরে—শুনেছি মিশরে আমি হাজার হাজার যুগ আগে
তোমার চুলে যে রোদ—মেঘের মতন চুলে—তোমার চোখে যে রোদ—সেও যে মেঘের মতো চোখ
কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আমার এ- গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে,-
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,-
তবুও হৃদয়ে গান আসে!
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি,-
তবু ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে !
পৃথিবীর কানে
নক্ষত্রের কানে
তবু গাই গান!
কোনোদিন শুনিবে না তাহা,-জানি আমি-
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,-
তবুও হৃদয়ে গান আসে!
তুমি জল-তুমি ঢেউ – সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন
তোমার দেহের বেগ- তোমার সহজ মন
ভেসে যায় সাগরের জলের আবেগে!
কোন অন্ধকারে
জানে না সে !- কোন ঢেউ তারে
অন্ধকারে খুঁজিছে কেবল
জানে না সে !- রাত্রির সিন্ধুর জল,
রাত্রির সিন্ধুর ঢেউ
তুমি এক! তোমারে কে ভালোবাসে ! – তোমারে কি কেউ
বুকে ক’রে রাখে!
জলের আবেগে তুমি চ’লে যাও,-
জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধূ ধূ জল তোমারে যে ডাকে!
তুমি শুধু একদিন,-এক রজনীর!-
মানুষের- মানুষীর ভিড়
তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে, - কত দূরে!
কোন সমুদ্রের পারে ,- বনে- মাঠে – কিংবা যে আকাশ জুড়ে
উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে!-
কিংবা যে আকাশে
কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
জেগে ওঠে, - ডুবে যায়,- তোমার প্রাণের সাধ
তাহাদের তরে!
যেখানে গাছের শাখা নড়ে
শীতরাতে,- মরার হাতের শাদা হারের মতন ! –
যেইখানে বন
আদিম রাত্রির ঘ্রান
বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান !-
তুমি সেইখানে!
নিঃসঙ্গ বুকের গানে
নিশীথের বাতাসের মতো
একদিন এসেছিলে,-
দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি — ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্নে ভরে;
সোনালি রোদের রঙ দেখিয়াছি — দেহের প্রথম কোন প্রেমের মতন
রূপ তার — এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছ ঢেকে গূঢ় রূপ — আনারস বন;
ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝরে
মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়; দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ করে,
নির্জন আমের ডালে দুলে যায় — দুলে যায় — বাতাসের সাথে বহুক্ষণ,
শুধু কথা, গান নয় — নীরবতা রচিতেছে আমাদের সবার জীবন
বুঝিয়াছি; শুপুরীর সারিগুলো দিনরাত হাওয়ায় যে উঠিতেছে নড়ে,দিনরাত কথা নয়, ক্ষীরের মতন ফুল বুকে ধরে, তাদের উৎসব
ফুরায় না; মাছরাঙাটির সাথী মরে গেছে — দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে
তবু ওই পাখিটির নীল লাল কমলা রঙের ডানা স্ফুট হয়ে ভাসে
আম নিম জামরুলে; প্রসন্ন প্রাণের স্রোত — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই কিছু,
ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু,
চেয়ে দেখি ঘুম নাই — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই বটফলগন্ধ মাখা ঘাসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
(আবহমান ইতিহাসচেতনা একটি পাখির মতো যেন)কে পাখি সূর্যের থেকে সূর্যের ভিতরে
নক্ষত্রের থেকে আরো নক্ষত্রের রাতে
আজকের পৃথিবীর আলোড়ন হৃদয়ে জাগিয়ে
আরো বড়ো বিষয়ের হাতে
সে সময় মুছে ফেলে দিয়ে
কি এক গভীর সুসময়!
মকরক্রান্তির রাত অন্তহীন তারায় নবীন:
–তবুও তা পৃথিবীর নয়;
এখন গভীর রাত, হে কালপুরুষ,
তবু পৃথিবীর মনে হয়।শতাব্দীর যে-কোনো নটীর ঘরে
নীলিমার থেকে কিছু নীচে
বিশুদ্ধ মুহূর্ত তার মানুষীর ঘুমের মতন;
ঘুম ভালো–মানুষ সে নিজে
ঘুমাবার মতন হৃদয়
হারিয়ে ফেলেছে তবু।
অবরুদ্ধ নগরী কি? বিচূর্ণ কি? বিজয়ী কি? এখন সময়
অনেক বিচিত্র রাত মানুষের ইতিহাস শেষ ক’রে তবু
রাতের স্বাদের মতো সপ্রতিভ বলে মনে হয়।
মানুষের মৃত্যু, ক্ষয়, প্রেম বিপ্লবের ঢের নদীর নগরে
এই পাখি আর এই নক্ষত্রেরা ছিলো মনে পড়ে।মকরক্রান্তির রাতে গভীর বাতাস।
আকাশের প্রতিটি নক্ষত্র নিজ মুখ চেনাবার
মতন একান্ত ব্যাপ্ত আকাশকে পেয়ে গেছে আজ।
তেমনি জীবনপথে চলে যেতে হ’লে তবে আর
দ্বিধা নেই–পৃথিবী ভঙ্গুর হ’য়ে নিচে রক্তে নিভে যেতে চায়;
পৃথিবী প্রতিভা হ’য়ে আকাশের মতো এক শুভ্রতায় নেমে
নিজেকে মেলাতে গিয়ে বেবিলন লণ্ডন
দিল্লি কলকাতার নক্টার্নে
অভিভূত হয়ে গেলে মানুষের উত্তরণ মাঝপথে থেমে
মহান তৃতীয় অঙ্কেঃ গর্ভাঙ্কে তবুও লপ্ত হ’য়ে যাবে না কি!–
সূর্যে আরো নব সূর্যে দীপ্ত হ’য়ে প্রাণ দাও–প্রাণ দাও পাখি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
মাঝে-মাঝে মনে হয় এ-জীবন হংসীর মতন-
হয়তো-বা কোনো-এক কৃপণের ঘরে;
প্রভাতে সোনার ডিম রেখে যায় খড়ের ভিতরে;
পরিচিত বিস্ময়ের অনুভবে ক্রমে-ক্রমে দৃঢ় হয় গৃহস্থের মন।
তাই সে হংসীরে আর চায় নাকো দুপুরে নদীর ঢালু জ’লে
নিজেকে বিম্বিত ক’রে;- ক্রমে দূরে-দূরে
হয়তো-বা মিশে যাবে অশিষ্ট মুকুরেঃ
ছবির বইয়ের দেশে চিরকাল- ক্রুর মায়াবীর জাদুবলে।
তবুও হংসীই আভা;- হয়তো-বা পতঞ্জলি জানে।
সোনায়-নিটোল-করা ডিম তার বিমর্ষ প্রসব।
দুপুরে সূর্যের পানে বজ্রের মতন কলরব
কন্ঠে তুলে ভেসে যায় অমেয় জলের অভিযানে।
কেয়াফুলস্নিগ্ধ হাওয়া স্থির তুলা দণ্ড প্রদক্ষিণ
ক’রে যায়;- লোকসমাগমহীন, হিম কান্তারের পার
ক’রে নাকো ভীতি আর মরণের অর্থ প্রত্যাহারঃ
তবুও হংসীর পাখা তুষারের কোলাহলে আঁধারে উড্ডীন।
তবুও হংসীর প্রিয় আলোকসামান্য সুর, শূন্যতার থেকে আমি ফেঁশে
এইখানে প্রান্তরের অন্ধকারে দাঁড়ায়েছি এসে;
মধ্য নিশীথের এই আসন্ন তারকাদের সঙ্গ ভালোবেসে।
মরঁখুটে ঘোড়া ওই ঘাস খায়,– ঘাড়ে তার ঘায়ের উপরে
বিনবিনে ডাঁশগুলো শিশিরের মতো শব্দ করে।
এই স্থান, হ্রদ আর, বরফের মতো শাদা ঘোড়াদের তরে
ছিলো তবু একদিন? র’বে তবু একদিন? হে কালপুরুষ,
ধ্রুব, স্বাতী, শতভিষা,
উচ্ছৃঙ্খল প্রবাহের মতো যারা তাহাদের দিশা
স্থির করে কর্ণধার?- ভূতকে নিরস্ত করে প্রশান্ত সরিষা।
ভূপৃষ্ঠের অই দিকে- জানি আমি- আমার নতুন ব্যাবিলন
উঠেছে অনেক দূর;- শোনা যায় কর্নিশে সিঙ্ঘের গর্জন।
হয়তো-বা ধূলোসাৎ হ’ইয়ে গেছে এত রাতে ময়ূরবাহন।
এই দিকে বিকলাঙ্গ নদীটির থেকে পাঁচ-সাত ধনু দূরে
মানুষ এখনও নীল , আদিম সাপুড়েঃ
রক্ত আর মৃত্যু ছাড়া কিছু পার নাকো তারা খনিজ, অমূল্য মাটি খুঁড়ে।
এই সব শেষ হ’ইয়ে যাবে তবু একদিন;- হয়তো-বা ক্রান্ত ইতিহাস
শানিত সাপের মতো অন্ধকারে নিজেকে করেছে প্রায় গ্রাস।
ক্রমে এক নিস্তব্ধতাঃ নীলাভ ঘাসের ফুলে সৃষ্টির বিন্যাস
আমাদের হৃদয়কে ক্রমেই নীরব হ’তে বলে।
যে-টেবিল শেষ্রাতে দোভাষীর- মাঝ্রাতে রাষ্ট্রভাষাভাষীর দখলে
সেই সব বহু ভাষা শিখে তবু তারকার সন্তপ্ত অনলে
হাতের আয়ুর রেখা আমাদের জ্বলে আজো ভৌতিক মুখের মতন;
মাথার সকল চুল হ’য়ে যায় ধূসর- ধূসরতম শণ;
লোষ্ট্র, আমি, জীব আর নক্ষত্র অনাদি বিবর্ণ বিবরণ
বিদূষ্ক বামনের মতো হেসে একবার চায় শুধু হৃদয় জুড়াতে।
ফুরফুরে আগুনের থান তবু কাঁচিছাঁটা জামার মতন মুক্ত হাতে
তাহার নগ্নতা ঘিরে জ্ব’লে যায়- সে কোথাও পারে না দাঁড়াতে।
নীলিমাকে যতদূর শান্ত নির্মল মনে হয়
হয়তো-বা সে-রকম নেই তার মহানুভবতা।
মানুষ বিশেষ-কিছু চায় এই পৃথিবীতে এসে
অতীব গরিমাভরে ব’লে যায় কথা;
যেন কোমো ইন্দ্রধনু পেয়ে গেলে খুশি হ’তো মন।
পৃথিবীর ছোট-বড়ো দিনের ভিতর দিয়ে অবিরাম চ’লে
অনেক মুহূর্ত আমি এ-রকম মনোভাব করেছি পোষণ।
দেখেছি সে-সব দিনে নরকের আগুনের মতো অহরহ রক্তপাত;
সে-আগুন নিভে গেলে সে-রকম মহৎ আঁধার,
সে-আঁধারে দুহিতারা গেয়ে যায় নীলিমার গান;
উঠে আসে প্রভাতের গোধূলির রক্তচ্ছটা-রঞ্জিত ভাঁড়।
সে-আলোকে অরণ্যের সিংহকে ফিকে মরুভূমি মনে হয়;
মধ্য সমুদ্রের রোল-মনে হয়—দয়াপরবশ;
এরাও মহৎ- তবু মানুষের মহাপ্রতিভার মতো নয়।
আজ এই শতাব্দীর পুনরায় সেই সব ভাস্বর আগুন
কাজ ক’রে যায় যদি মানুষ ও মনীষী ও বৈহাসিক নিয়ে-
সময়ের ইশারায় অগণন ছায়া-সৈনিকেরা
আগুনের দেয়ালকে প্রতিষ্ঠিত করে যদি উনুনের অতলে দাঁড়িয়ে,
দেওয়ালের ’পরে যদি বানর, শেয়াল, শনি, শকুনের ছায়ার জীবন
জীবঙ্কে টিটকারি দিয়ে যায় আগুনের রঙ আরো বিভাসিত হ’লে-
গর্ভাঙ্কে ও অঙ্কে কান কেটে-কেটে নাটকের হয় তবু শ্রুতিবিশোধন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হ'য়ে নিভে যায়- তবু
ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হ'য়ে গেছেঃ
হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে;
সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাশাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে;
স্বচ্ছল কঙ্কাল হ'য়ে গেছে তারপর;
বিলোচন গিয়েছিলো বিবাহ-ব্যাপারে;
প্রেমিকেরা সারাদিন কাটায়েছে গণিকার বারে
সভাকবি দিয়ে গেছে বাক্বিভূতিকে গালাগাল।
সমস্ত আচ্ছন্ন সুর একটি ওংকার তুলে বিস্মৃতির দিকে উড়ে যায়।
এ-বিকেল মানুষ না মাছিদের গুঞ্জরণময়!
যুগে-যুগে মানুষের অধ্যবসায়
অপরের সুযোগের মতো মনে হয়।
কুইসলিং বানানো কি নিজ নাম- হিটলার সাত কানাকড়ি
দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হ'য়ে গেল লালঃ
মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল;
পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।
এ-কেমন পরিবেশে র'য়ে গেছি সবে-
বাক্পতি জন্ম নিয়েছিলো যেই কালে,
অথবা সামান্য লোক হেঁটে যেতে চেয়েছিলো স্বাভাবিক ভাবে পথ দিয়ে,
কী ক'রে তাহ'লে এ-রকম ফিচেল পাতালে
হৃদয়ের জন- পরিজন নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে?
অথবা যে-সব লোক নিজের সুনাম ভালোবেসে
দুয়ার ও পরচুলা না এঁটে জানে না কোনো লীলা,
অথবা যে-সব নাম ভালো লেগে গিয়েছিলোঃ আপিলা চাপিলা
-রুটি খেতে গিয়ে তারা ব্রেডবাস্কেট খেলো শেষে।
এরা সব নিজেদের গণিকা, দালাল, রেস্ত, শত্রুর খোঁজে
সাত-পাঁচ ভেবে সনির্বন্ধতায় নেমে আসে;
যদি বলি, তারা সব তোমাদের চেয়ে ভালো আছে;
অসৎপাত্রের কাছে তবে তারা অন্ধ বিশ্বাসে
কথা বলেছিলো ব'লে দুই হাত সতর্কে গুটায়ে
হ'য়ে ওঠে কী যে উচাটন!
কুকুরের ক্যানারির কান্নার মতনঃ
তাজা ন্যাকড়ার ফালি সহসা ঢুকেছে নালি ঘায়ে।
ঘরের ভিতরে কেউ খোয়ারি ভাঙছে ব'লে কপাটের জং
নিরস্ত হয় না তার নিজের ক্ষয়ের ব্যবসায়ে,
আগাগোড়া গৃহকেই চৌচির করেছে বরং;
অরেঞ্জপিকোর ঘ্রাণ নরকের সরায়ের চায়ে
ক্রমেই অধিক ফিকে হ'য়ে আসে; নানারূপ জ্যামিতিক টানের ভিতরে
স্বর্গ মর্ত্য পাতালের কুয়াশায় মতন মিলনে
একটি গভীর ছায়া জেগে ওঠে মনে;
অথবা তা' ছায়া নয়- জীব নয় সৃষ্টির দেয়ালের 'পরে।
আপাদমস্তক আমি আর দিকে তাকায়ে রয়েছি;
গগ্যাঁ ছবির মতো- তবু গগ্যাঁ চেয়ে গুরু হাত থেকে
বেরিয়ে সে নাকচোখে ক্কচিৎ ফুটেছে টায়ে-টায়ে;
নিভে যায়- জ্বলে ওঠে, ছায়া, ছাই, দিব্যযোনি মনে হয় তাকে।
স্বাতিতারা শুকতারা সূর্যের ইস্কুল খুলে
সে-মানুষ নরক বা মর্ত্যে বহাল
হ'তে গিয়ে বৃষ মেষ বৃশ্চিক সিংহের প্রাতঃকাল
ভালোবেসে নিয়ে যায় কন্যা মীন মিথুনের কূলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
অনেক রাত্রির শেষে তারপর এই পৃথিবীকে
ভালো ব’লে মনে হয়;—সময়ের অমেয় আঁধারে
জ্যোতির তারণকণা আসে,
গভীর নারীর চেয়ে অধিক গভীরতর ভাবে
পৃথিবীর পতিতকে ভালোবাসে, তাই
সকলেরই হৃদয়ের ’পরে এসে নগ্ন হাত রাখে;
আমরাও আলো পাই—প্রশান্ত অমল অন্ধকার
মনে হয় আমাদের সময়ের রাত্রিকেও।একদিন আমাদের মর্মরিত এই পৃথিবীর
নক্ষত্র শিশির রোদ ধূলিকণা মানুষের মন
অধিক সহজ ছিল—শ্বেতাশ্বতর যম নচিকেতা বুদ্ধদেবের।
কেমন সফল এক পর্বতের সানুদেশ থেকে
ঈশা এসে কথা ব’লে চ’লে গেল—মনে হল প্রভাতের জল
কমনীয় শুশ্রূষার মতো বেগে এসেছে এ পৃথিবীতে মানুষের প্রাণ
আশা ক’রে আছে ব’লে—চায় ব’লে,-
নিরাময় হ’তে চায় ব’লে।পৃথিবীর সেই সব সত্য অনুসন্ধানের দিনে
বিশ্বের কারণশিল্পের অপরূপ আভার মতন
আমাদের পৃথিবীর হে আদিম ঊষাপুরুষেরা,
তোমারা দাঁড়িয়েছিলে, মনে আছে, মহাত্মার ঢের দিন আগে;
কোথাও বিজ্ঞান নেই, বেশি নেই, জ্ঞান আছে তবু;
কোথাও দর্শন নেই, বেশি নেই; তবুও নিবিড় অন্তভের্দী
দৃষ্টিশক্তি র’য়ে গেছেঃ মানুষকে মানুষের কাছে
ভালো স্নিগ্ধ আন্তরিক হিত
মানুষের মতো এনে দাঁড় করাবার;
তোমাদের সে-রকম প্রেম ছিল,বহ্নি ছিল, সফলতা ছিল।
তোমাদের চারপাশে সাম্রাজ্য রাজ্যের কোটি দীন সাধারণ
পীড়িত এবং রক্তাক্ত হয়ে টের পেত কোথাও হৃদয়বত্তা নিজে
নক্ষত্রের অনুপম পরিসরে হেমন্তের রাত্রির আকাশ
ভ’রে ফেলে তারপর আত্মঘাতী মানুষের নিকটে নিজের
দয়ার দানের মতো একজন মানবীয় মহানুভবকে
পাঠাতেছে,—প্রেম শান্তি আলো
এনে দিতে,—মানুষের ভয়াবহ লৌকিক পৃথিবী
ভেদ ক’রে অন্তঃশীলা করুণার প্রসারিত হাতের মতন।তারপর ঢের দিন কেটে গেছে;-
আজকের পৃথিবীর অবদান আরেক রকম হয়ে গেছে;
যেই সব বড়-বড় মানবেরা আগেকার পৃথিবীতে ছিল
তাদের অন্তর্দান সবিশেষ সমুজ্জ্বল ছিল, তবু আজ
আমাদের পৃথিবী এখন ঢের বহিরাশ্রয়ী।
যে সব বৃহৎ আত্মিক কাজ অতীতে হয়েছে-
সহিষ্ণুতায় ভেবে সে-সবের যা দাম তা সিয়ে
তবু আজ মহাত্মা গান্ধীর মতো আলোকিত মন
মুমুক্ষার মাধুরীর চেয়ে এই আশ্রিত আহত পৃথিবীর
কল্যাণের ভাবনায় বেশি রত; কেমন কঠিন
ব্যাপক কাজের দিনে নিজেকে নিয়োগ ক’রে রাখে
আলো অন্ধকারে রক্তে—কেমন শান্ত দৃঢ়তায়।এই অন্ধ বাত্যাহত পৃথিবীকে কোনো দূর স্নিগ্ধ অলৌকিক
তনুবাত শিখরের অপরূপ ঈশ্বরের কাছে
টেনে নিয়ে নয়—ইহলোক মিথ্যা প্রমাণিত ক’রে পরকাল
দীনত্মা বিশ্বাসীদের নিধান স্বর্গের দেশ ব’লে সম্ভাষণ ক’রে নয়-
কিন্তু তার শেষ বিদায়ের আগে নিজেকে মহাত্মা
জীবনের ঢের পরিসর ভ’রে ক্লান্তিহীন নিয়োজনে চালায়ে নিয়েছে
পৃথিবীরই সুধা সূর্য নীড় জল স্বাধীনতা সমবেদনাকে
সকলকে—সকলের নিচে যারা সকলকে সকলকে দিতে।আজ এই শতাব্দীতে মহাত্মা গান্ধীর সচ্ছলতা
এ-রকম প্রিয় এক প্রতিভাদীপন এনে সকলের প্রাণ
শতকের আঁধারের মাঝখানে কোনো স্থিরতর
নির্দেশের দিকে রেখে গেছে;
রেখে চ’লে গেছে-ব’লে গেছেঃ শান্তি এই, সত্য এই।হয়তো-বা অন্ধকারই সৃষ্টির অন্তিমতম কথা;
হয়তো-বা রক্তেরই পিপাসা ঠিক, স্বাভাবিক-
মানুষও রক্তাক্ত হতে চায়;-
হয়তো-বা বিপ্লবের মানে শুধু পরিচিত অন্ধ সমাজের
নিজেকে নবীন ব’লে—অগ্রগামী(অন্ধ) উত্তেজের
ব্যাপ্তি ব’লে প্রচারিত করার ভিতর;
হয়তো-বা শুভ পৃথিবীর কয়েকটি ভালো ভাবে লালিত জাতির
কয়েকটি মানুষের ভালো থাকা—সুখে থাকা—রিরংসারক্তিম হয়ে থাকা;
হয়তো-বা বিজ্ঞানের, অগ্রসর, অগ্রস্মৃতির মানে এই শুধু, এই!চারিদিকে অন্ধকার বেড়ে গেছে—মানুষের হৃদয় কঠিনতর হয়ে গেছে;
বিজ্ঞান নিজেকে এসে শোকাবহ প্রতারণা ক’রেই ক্ষমতাশালী দেখ;
কবেকার সরলতা আজ এই বেশি শীত পৃথিবীতে—শীত;
বিশ্বাসের পরম সাগররোল ঢের দূরে স’রে চ’লে গেছে;
প্রীতি প্রেম মনের আবহমান বহতার পথে
যেই সব অভিজ্ঞতা বস্তুত শান্তির কল্যাণের
সত্যিই আনন্দসৃষ্টির
সে-সব গভীর জ্ঞান উপেক্ষিত মৃত আজ, মৃত,
জ্ঞানপাপ এখন গভীরতর ব’লে;
আমরা অজ্ঞান নই—প্রতিদিনই শিখি, জানি, নিঃশেষে প্রচার করি, তবু
কেমন দুরপনেয় স্খলনের রক্তাক্তের বিয়োগের পৃথিবী পেয়েছি।তবু এই বিলম্বিত শতাব্দীর মুখে
যখন জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানের প্রশ্রয় ঢের বেড়ে গিয়েছিল,
যখন পৃথিবী পেয়ে মানুষ তবুও তার পৃথিবীকে হারিয়ে ফেলেছে,
আকাশে নক্ষত্র সূর্য নীলিমার সফলতা আছে,-
আছে, তবু মানুষের প্রাণে কোনো উজ্জ্বলতা নেই,
শক্তি আছে, শান্তি নেই, প্রতিভা রয়েছে, তার ব্যবহার নেই।প্রেম নেই, রক্তাক্ততা অবিরল,
তখন তো পৃথিবীতে আবার ঈশার পুনরুদয়ের দিন
প্রার্থনা করার মতো বিশ্বাসের গভীরতা কোনো দিকে নেই;
তবুও উদয় হয়—ঈশা নয়—ঈশার মতন নয়—আজ এই নতুন দিনের
আর-এক জনের মতো;
মানুষের প্রাণ থেকে পৃথিবীর মানুষের প্রতি
যেই আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ফিরে আসে, মহাত্মা গান্ধীকে
আস্থা করা যায় ব’লে;
হয়তো-বা মানবের সমাজের শেষ পরিণতি গ্লানি নয়;
হয়তো-বা মৃত্যু নেই, প্রেম আছে, শান্তি আছে—মানুষের অগ্রসর আছে;
একজন স্থবির মানুষ দেখ অগ্রসর হয়ে যায়
পথ থেকে পথান্তরে—সময়ের কিনারার থেকে সময়ের
দূরতর অন্তঃস্থলে;—সত্য আছে, আলো আছে; তবুও সত্যের
আবিষ্কারে।
আমরা আজকে এই বড় শতকের
মানুষেরা সে-আলোর পরিধির ভিতরে পড়েছি।
আমাদের মৃত্যু হয়ে গেলে এই অনিমেষ আলোর বলয়
মানবীয় সময়কে হৃদয়ে সফলকাম সত্য হতে ব’লে
জেগে র’বে; জয়, আলো সহিষ্ণুতা স্থিরতার জয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ইতিহাসপথ বেয়ে অবশেষে এই
শতাব্দীতে মানুষের কাজ
আশায় আলোয় শুরু হয়েছিল বুঝি- শুভ্র কথা
বলা হতেছিল;- রৌদ্রে জলে ভালোলেগেছিল
শরীরকে- জীবনকে।কিন্তু তবু সবি প্রিয় মানুষের হাতে
অপ্রিয় প্রহার হয়ে মূল্যহীন মানুষের গায়ে
আশ্চর্য মৃত্যুর মত মূল্য হয়- হিম হয়।মানুষের সভ্যতার বয়ঃসন্ধি দোষ
হয়তো কাটেনি আজো, তাই
এরকমই হতে হবে আরো রাত্রি দিন;-
নক্ষত্র সূর্যের সাথে সঞ্চালিত হয়ে তবু আলোকের পথে
মৃত ম্যামথের কাছে কুহেলিত ঋণ
শেষ ক'রে মানুষ সফল হতে পারে
উৎসাহ সংকল্প প্রেমে মূল্যের অক্ষুন্ন সংস্কারে;
আশা করা যাক।সুধীরাও সেই কথা ভাবে,
আপ্রাণ নির্দেশ দান করে।
ইতিহাসে ঘুরপথ ভুল পথ গ্লানি হিংসা অন্ধকার ভয়
আরো ঢের আছে, তবু মানুষকে সেতু থেকে সেতুলোক পার হতে হয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে:
ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন;
মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী,
রেশম, মদের সার্থবাহ,
দুধের মতন শাদা নারী।
অন্তত রৌদ্রের থেকে তারা
শাশ্বত রাত্রির দিকে তবে
সহসা বিকেলবেলা শেষ হয়ে গেলে
চলে যেত কেমন নীরবে।
চারি দিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র;
মধ্যযুগের অবসান
স্থির করে দিতে গিয়ে ইউরোপ গ্রীস
হতেছে উজ্জ্বল খৃষ্টান।
তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা–
সিন্ধুর রাত্রির জল জানে–
আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে;
কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে
আমরা অকূল হয়ে উঠে
মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে
জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায়
যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে।
এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে;
কী এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন!
তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে
কবেকার সমুদ্রের নুন;
তোমার মুখের রেখা আজো
মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান সিন্ধুর
অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন;
কত আছে — তবু কত দূরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
রৌদ্র ঝিল্মিল,
উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
-উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
-মরীচিকা-ঢাকা!
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার,- পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল-
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল
তোমার ও- মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী।
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
-শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
পুরনো সময় সুর ঢের কেটে গেল।
যদি বলা যেত:
সমুদ্রের পারে কেটে গেছে
সোনার বলের মতো সুর্য ছিল পুবের আকাশে–
সেই পটভূমিকায় ঢের
ফেনশীর্ষ ঢেউ,
উড়ন্ত ফেনার মতো অগণন পাখি।
পুরনো বছর দেশ ঢের কেটে গেল
রোদের ভিতরে ঘাসে শুয়ে;
পুকুরের জল থেকে কিশোরের মতো তৃপ্ত হাতে
ঠান্ডা পানিফল, জল ছিড়ে নিতে গিয়ে;
চোখের পলকে তবু যুবকের মতো
মৃগনাভিঘন বড় নগরে পথে
কোনো এক সুর্যের জগতে
চোখের নিমেষ পড়েছিল।
সেইখানে সুর্য তুব অস্ত যায়।
পুনরুদয়ের ভোরে আসে
মানুষের হৃদয়ের অগোচর
গম্বুজের উপরে আকাশে।
এ ছাড়া দিনের কোনো সুর
নেই;
বসন্তের অন্য সাড়া নেই।
প্লেন আছে;
অগণন প্লেন
অগণ্য এয়োরোড্রাম
রয়ে গেছে
চারি দিকে উঁচুনিচু অন্তহীন নীড়–
হলেও বা হয়ে যেত পাখির মতন কাকলি
আনন্দে মুখর;সেইখানে ক্লান্তি তবু–
ক্লান্তি–ক্লান্তি;
কেন ক্লান্তি
তা ভেবে বিস্ময়;
সেইখানে মৃত্যু তবু;
এই শুধু–
এই;
চাঁদ আসে একলাটি;
নক্ষত্রেরা দল বেঁধে আসে;
দিগন্তের সমুদ্রের থেকে হাওয়া প্রথম আবেগে
এসে তবু অস্ত যায়;
উদয়ের ভোরে ফিলে আসে
আপামর মানুষের হৃদয়ের অগোচর
রক্ত হেডলাইনের–রক্তের উপরে আকাশে।
এ ছাড়া পাখির কোনো সুর–
বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই।
নিখিল ও নীড় জনমানবের সমস্ত নিয়মে
সজন নির্জন হয়ে থাকে
ভয় প্রেম জ্ঞান ভুল আমাদের মানবতা রোল
উত্তরপ্রবেশ করে আরো বড় চেতনার লোকে;
অনন্ত সূর্যের অস্ত শেষ করে দিয়ে
বীতশোক হে অশোক সঙ্গী ইতিহাস,
এ ভোর নবীন বলে মেনে নিতে হয়;
এখন তৃতীয় অঙ্ক অতএব; আগুনে আলোয় জ্যোতির্ময়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
চারিদিকে সৃজনের অন্ধকার র’য়ে গেছে, নারী,
অবতীর্ণ শরীরের অনুভূতি ছাড়া আরো ভালো
কোথাও দ্বিতীয় সূর্য নেই, যা জ্বালালে
তোমার শরীর সব অলোকিত ক’রে দিয়ে স্পষ্ট ক’রে দেবে কোনো কালে
শরীর যা র’য়ে গেছে।
এই সব ঐশী কাল ভেঙে ফেলে দিয়ে
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
জীর্ণ শীর্ণ মাকু নিয়ে এখন বাতাসে
তামাসা চালাতে আছে পুনরায় সময় একাকী।
তবুও সে ভোরবেলা হরিয়াল পাখি
ধূসর চিতল মাছে- নির্ঝরের ফাঁসে
খেলা ক'রে কাকে দিয়েছিল তবে ফাঁকি?
বসন্তবউরী দুটো এই ব'লে হা-হা ক'রে হাসে।সেই হাসি জ্ব'লে ওঠে নির্ঝরের পরে;
গড়ায়ে গড়ায়ে গোল নুড়ি
উজ্জ্বল মাছের সাথে ভোরের নির্ঝরে
সময়ের মাকুটাকে করে দিল উড়্খুড়্ খুড়ি।
বিরক্ত সময় তাই খুঁজে নিতে গেল কোন বিষয়ান্তরে
নিজের নিয়মাধীন হৃদয়ের জুড়ি।আলো যদি নিভে যায় সময়ের ফুঁয়ে
তা'হ্লে কাহার ক্ষতি- তাহলে কাহার ক্ষতি হবে।
এই কথা ভেবে যায় কালো পাথরের পরে নুয়ে
মৈত্রেয়ী- নাগার্জুন- কৌটিল্য নীরবে।
তিন হয়, চার হয়, পাঁচ হয় তবুও তো দুয়ে আর দুয়ে।
হেঁয়ালী ও নিরসন নির্ঝরের নিক্কণের মত বেঁচে রবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কখনো বা মৃত জনমানবের দেশে
দেখা যাবে বসেছে কৃষাণঃ
মৃত্তিকা-ধূসর মাথা
আপ্ত বিশ্বাসে চক্ষুষ্মান।কখনো ফুরুনো ক্ষেতে দাঁড়ায়েছে
সজারুর গর্তের কাছে;
সেও যেন বাবলার কান্ড এক
অঘ্রাণের পৃথিবীর কাছে।সহসা দেখেছি তারে দিনশেষেঃ
মুখে তার সব প্রশ্ন সম্পূর্ণ নিহত;
চাঁদের ও-পিঠ থেকে নেমেছে এ পৃথিবীর
অন্ধকার ন্যুব্জতার মতো।সে যেন প্রস্তরখন্ড…স্থির-
নড়িতেছে পৃথিবীর আহ্নিক আবর্তের সাথে;
পুরাতন ছাতকুড়ো ঘ্রাণ দিয়ে
নবীন মাটির ঢেউ মাড়াতে-মাড়াতে।তুমি কি প্রভাতে জাগ?
সন্ধ্যায় ফিরে যাও ঘরে?
আস্তীর্ণ শতাব্দী ব’হে যায়নি কি
তোমার মৃত্তিকাঘন মাথার উপরে?কী তারা গিয়েছে দিয়ে-
নষ্ট ধান? উজ্জীবিত ধান?
সুষুম্না নাড়ীর গতি-অজ্ঞাত;
তবু আমি আরো অজ্ঞান
যখন দেখেছি চেয়ে কৃষাণকে
বিশীর্ণ পাগড়ী বেঁধে অস্তাক্ত আলোকে
গঙ্গাফড়িঙের মতো উদ্বাহু
মুকুর উঠেছে জেগে চোখে;-যেন এই মৃত্তিকার গর্ভ থেকে
অবিরাম চিন্তারাশি- নব-নব নগরীর আবাসের থাম
জেগে অঠে একবার;
আর একবার ঐ হৃদয়ের হিম প্রাণায়াম।সময়ঘড়ির কাছে রয়েছে অক্লান্তি শুধুঃ
অবিরল গ্যাসে আলো, জোনাকীতে আলো;
কর্কট, মিথুন, মীন, কন্যা, তুলা ঘুরিতেছে;-
আমাদের অমায়িক ক্ষুধা তবে কোথায় দাঁড়ালো
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কূষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল;
অথবা সে-হাইড্র্যান্ট হয়তো না গিয়েছিলো ফেঁসে।
এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে।
একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশেঅস্থির পেট্রল ঝেঁড়ে; সতত সতর্ক থেকে তবু
কেউ যেন ভয়াবহভাবে প'ড়ে গেছে জলে।
তিনটি রিক্শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাসল্যাম্পে
মায়াবীর মতো জাদুবলে।আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে- হঠকারিতায়
মাইল-মাইল পথ হেঁটে- দেয়ালের পাশে
দাঁড়ালাম বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে- টেরিটি বাজারে;
চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে।মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে।
কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ
ডাইনামোর গুঞ্জনের সাথে মিশে গিয়ে
ধনুকের ছিলা রাখে টান।টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পৃথিবীকে।
টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা।
শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে;
রাজ্য জয় ক'রে গেছে অমর আত্তিলা।নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে
গান গায় আধো জেগে ইহুদী রমণী;
পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান-
আর কাকে, সোনা, তেল, কাগজের খনি।ফিরিঙ্গি যুবক ক'টি চ'লে যায় ছিমছাম।
থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে;
হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার ক'রে
বূড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে।নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব অতিবৈতনিক,
বস্তুর কাপড় পরে লজ্জাবশত।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে-
বলিলামঃ ‘ একদিন এমন সময়
আবার আসিও তুমি- আসিবার ইচ্ছা যদি হয়;
পঁচিশ বছর পরে ।‘
এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;
তারপর, কতবার চাঁদ আর তারা,
মাঠে- মাঠে মরে গেল, ইঁদুর – পেঁচারা
জ্যোৎস্নায় ধানক্ষেত খুঁজে
এল-গেল ! – চোখ বুজে
কতবার ডানে আর বাঁয়ে
পড়িল ঘুমায়ে
কত- কেউ !- রহিলাম জেগে
আমি একা- নক্ষত্র যে বেগে
ছুটিছে আকাশ,
তার চেয়ে আগে চ’লে আসে
যদিও সময়,-
পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয় !-
তারপর- একদিন
আবার হলদে তৃণ
ভ’রে আছে মাঠে –
পাতায় , শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে- দিকে, - চড়ুয়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে, - পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা , ঠাণ্ডা – কড়কড় !
শসাফুল , - দু-একটা নষ্ট শাদা শসা,-
মাকড়ের ছেঁড়া জাল, - শুকনো মাকড়সা
লতায়- পাতায়;-
ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায়,- ইঁদুর – পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে – মাঠে , ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজো মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
তুমি কেন বহু দূরে — ঢের দূর — আরো দূরে — নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ
তুমি কেন কোনদিন পৃথিবীর ভিড়ে এসে বলো নাকো একটিও কথা;
আমরা মিনার গড়ি — ভেঙে পড়ে দুদিনেই — স্বপনের ডানা ছিড়ে ব্যথা
রক্ত হয়ে ঝরে শুধু এইখানে — ক্ষুধা হয়ে ব্যথা দেয় — নীল নাভিশ্বাস;
ফেনায়ে তুলিছে শুধু পৃথিবীতে পিরামিড যুগ থেকে আজো বারোমাস;
আমাদের সত্য, আহা রক্ত হযে ঝরে শুধু; — আমাদের প্রাণের মমতা
ফড়িঙের ডানা নিয়ে ওড়ে, আহা: চেয়ে দেখে অন্ধকার কঠিন ক্ষমতা
ক্ষমাহীন — বার বার পথ আটকায়ে ফেলে বার বার করে তারে গ্রাস;তারপর চোখ তুলে দেখি ঐ কোন দূর নক্ষত্রের ক্লান্ত আয়োজন
ক্লানি — র ভুলিতে বলে — ঘিয়ের সোনার দীপে লাল নীল শিখা
জ্বলিতেছে যেন দূর রহস্যের কুয়াশায়, — আবার স্বপ্নের গন্ধে মন
কেঁদে ওঠে — তবু জানি আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রু ক্লানি — রক্তের কণিকা
ঝরে শুধু — স্বপ্ন কি দেখেনি বুদ্ধ — নিউসিডিয়ায় বসে দেখেনি মণিকা?
স্বপ্ন কি দেখেনি রোম, এশিরিয়া, উজ্জায়িনী, গৌড় বাংলা, দিল্লী, বেবিলন?
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কেমন আশার মতো মনে হয় রোদের পৃথিবী,
যতদূর মানুষের ছায়া গিয়ে পড়ে
মৃত্যু আর নিরুৎসাহের থেকে ভয় আর নেই
এ-রকম ভোরের ভিতরে।যতদূর মানুষের চোখ চ’লে যায়
ঊর ময় হরপ্পা আথেন্স্ রোম কলকাতা রোদের সাগরে
অগণন মানুষের শরীরের ভিতরে বন্দিনী
মানবিকতার মতোঃ তবুও তো উৎসাহিত করে?সে অনেক লোক লক্ষ্য অসম্ভব ভাবে ম’রে গেছে
ঢের আলোড়িত লোক বেঁচে আছে তবু।
আরো স্মরণীয় উপলদ্ধি জন্মাতেছে।
যা হবে তা আজকের নরনারীদের নিয়ে হবে।
যা হল তা কালকের মৃতদের নিয়ে হয়ে গেছে।*কঠিন অমেয় দিন রাত এই সব।
চারিদিকে থেকে-থেকে মানব ও অমানবিকতা
সময় সীমার ঢেউয়ে অধোমুখ হয়ে
চেয়ে দেখে শুধু-মরণের
কেমন অপরিমেয় ছটা।
তবু এই পৃথিবীর জীবনই গভীর।
এক- দুই- শত বছরের
পাথর নুড়ির পথে স্রোতের মতন
কোথায় যে চ’লে গেছে কোন্ সব মানুষের দেহ,
মানুষের মন।
আজ ভোরে সূর্যালোকিত জল তবু
ভাবনালোকিত সব মানুষের ক্রম,-
তোমারা শতকী নও;
তোমারা তো ঊনিশ শো অনন্তের মতন সুগম।
আলো নেই? নরনারী কলরোল আলোর আবহ
প্রকৃতির? মানুষেরও; অনাদির ইতিহাসসহ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
‘মমী’র দেহ বালুর তিমির জাদুর ঘরে লীন,-
‘স্ফীঙ্ক্স’-দানবীর অরাল ঠোঁটের আলাপ আজি চুপ!
ঝাঁ ঝাঁ মরুর ‘লু’য়ের ‘ফুঁ’য়ে হছে বিলীন-ক্ষীণ
মিশর দেশের কাফন্ পাহাড়-পিরামিডের স্তূপ!
নিভে গেছে ‘ঈশিশে’রি বেদীর থেকে ধূমা,
জুড়িয়ে গেছে লক্লকে সেই রক্তজিভার চুমা!
এদ্দিনেতে ফুরিয়ে গেছে কুমিরপূজার ঘটা,
দুলছে মরুমশান- শিরে মহাকালের জটা!
ঘুমন্তদের কানে কানে কয় সে,-‘ঘুমা,- ঘুমা!’
ঘুমিয়ে গেছে বালুর তলে ফ্যারাও,- ফ্যারাও ছেলে,-
তাদের বুকে যাচ্ছে আকাশ বর্শা ঠেলে ঠেলে!
হাওয়ার সেতার দেয় ফুঁপিয়ে ‘মেম্ননে’রি বুক,
ডুবে গেছে মিশররবি-বিরাট ‘বেলে’র ভুখ
জিহ্বা দিয়ে জঠর দিয়ে গেছে তোমার জ্বেলে!
পিরাপিডের পাশাপাশি লালচে বালুর কাছে
স্থবির মরণ-ঘুমের ঘোরে মিশর শুয়ে আছে!
সোনার কাঠি নেই কি তাহার? জাগবে নাকি আর!
মৃত্যু,- সে কি শেষের কথা?- শেষ কি শবাধার?
সবাই কি গো ঢালাই হবে চিতার কালির ছাঁচে!
নীলার ঘোলা জলের দোলায় লাফায় কালো সাপ।
কুমিরগুলোর খুলির খিলান,- করাত দাঁতের খাপ
উর্ধ্বমুখে রৌদ্র পোহায়;- ঘুমপাড়ানির ঘুম
হানছে আঘাত,-আকাশবাতাস হচ্ছে যেন গুম্!
ঘুমের থেকে উপচে পড়ে মৃতের মনস্তাপ!
নীলা, নীলা,- ধুক্ধুকিয়ে মিশরকবর- পারে
রইলে জেগে বোবাবুকের বিকল হাহাকারে
লাল আলেয়ার খেয়া ভাসায় ‘রামেসেসে’র দেশ!
অতীত অভিশাপের নিশা এলিয়ে এলোকেশ
নিভিয়ে দেছে দেউটি তোমার দেউল-কিনারে!
কলসি কোলে নীলনদেতে যেতেছে ঐ নারী,
ঐ পথেতে চলতে আছে নিগ্রো সারি সারি;
ইয়াঙ্কী ঐ,- ঐ য়ুরোপী,-চীনে-তাতার মুর
তোমার বুকের পাঁজর দ’লে টলতেছে হুড়মুড়্,-
ফেনিয়ে তুলে খুন্খারাবি্- খেলাপ,- খবরদারি!
দিনের আলো ঝিমিয়ে গেল,-আকাশে ঐ চাঁদ!
-চপল হাওয়ায় কাঁকন কাঁদায় নীলনদেরি বাঁধ!
মিশর- ছুঁড়ি গাইছে মিঠা শুঁড়িখানার সুরে
বালুর খাতে, প্রিয়ের সাথে,- খেজুরবনে দূরে!
আফ্রিকা এই,- এই যে মিশর,-জাদুর এ যে ফাঁদ!
‘ওয়েসিসে’র ঠান্ডা ছায়ায় চৈতিচাঁদের তলে
মিশরবালার বাঁশির গলা কিসের কথা বলে!
চলছে বালুর চড়াই ভেঙে উটের পরে উট,-
এই যে মিশর,-আফ্রিকার এই কুহকপাখাপুট!
-কী এক মোহ এই হাওয়াতে,- এই দরিয়ার জলে!
শীতল পিরামিডের মাথা,-‘গীজে’র মূরতি
অঙ্কবিহীন যুগসমাধির মূক মমতা মথি
আবার যেন তাকায় অদূর উদয়গিরির পানে!
মেম্ননে’র ঐ কন্ঠ ভরে চারণ-বীনার গানে!
আবার জাগে ঝান্ডাঝালর,- জ্যান্ত আলোর জ্যোতি!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে
ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে যায়
কোথায় দূরে বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে?
বর্ষণ অনেকক্ষণ হয় থেমে গেছে;
যত দূর চোখ যায় কালো আকাশ
মাটির শেষ তরঙ্গকে কোলে ক’রে চুপ ক’রে রয়েছে যেন;
নিস্তব্ধ হ’ইয়ে দূর উপসাগরের ধ্বনি শুনছে।
মনে হয়
কারা যেন বড়ো-বড়ো কপাট খুলছে,
বন্দ ক’রে ফেলেছে আবার;
কোন্ দূর- নীরব- আকাশরেখার সীমানায়।
বালিশের মাথা রেখে যারা ঘুমিয়ে আছে
তারা ঘুমিয়ে থাকে;
কাল ভোরে জাগাবার জন্য।
যে-সব ধূসর হাসি, গল্প, প্রেম, মধুরেখা
পৃথিবীর পাথরে কঙ্কালে অন্ধকারে মিশেছিলো
ধীরে-ধীরে জেগে ওঠে তারা;
পৃথিবীর অবিচলিত পঞ্জর থেকে খশিয়ে আমাকে খুঁজে বা’র ক’রে।
সমস্ত বঙ্গোপসাগরের উচ্ছ্বাস থেমে যায় যেন;
মাইলের পর মাইল মৃত্তিকা নীরব হ’য়ে থাকে।
কে যেন বলেঃ
আমি যদি সেই সব কপাট স্পর্শ করতে পারতাম
তাহ’লে এই রকম গভীর নিস্তব্ধ রাতে স্পর্শ করতাম গিয়ে।–
আমার কাঁধের উপর ঝাপসা হাত রেখে ধীরে-ধীরে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে।
চোখ তুলে আমি
দুই স্তর অন্ধকারের ভিতর ধূসর মেঘের মতো প্রবেশ করলামঃ
সেই মুখের ভিতরে প্রবেশ করলাম।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
অনেক রাত হয়েছে- অনেক গভীর রাত হয়েছে;
কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে- ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে-
কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো
এই-যে ট্র্যামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ
অনুভব ক’রে হাঁটছি আমি।
গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, কেমন যেন ঠাণ্ডা বাতাস;
কোন দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার,-
তারা কোথায়?
তারা কি হারিয়ে গেছে?
পায়ের তলে লিকলিকে ট্র্যামের লাইন,- মাথার ওপরে
অসংখ্য জটিল তারের জাল
শাসন করছে আমাকে।
এই ঠাণ্ডা বাতাসের মুখে এই কলকাতা শহরে এই গভীর রাতে
কোনো নীল শিরার বাসাকে কাঁপতে দেখবে না তুমি;
জলপাইয়ের পল্লবে ঘুম ভেঙে গেলো ব’লে কোনো ঘুঘু তার
কোমল নীলাভ ভাঙা ঘুমের আস্বাদ তোমাকে জানাতে আসবে না।
হলুদ পেঁপের পাতাকে একটা আচমকা পাখি ব’লে ভুল হবে না তোমার,
সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা ব’লে বুঝতে পেরে চোখ নিবিড় হ’য়ে
উঠবে না তোমার!
প্যাঁচা তার ধূসর পাখা আমলকীর ডালে ঘষবে না এখানে,
আমলকীর শাখা থেকে নীল শিশির ঝ’রে পড়বে না,
তার সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খশিয়ে আনবে না এখানে,
রাত্রিকে নীলাভতম ক’রে তুলবে না!
সবুজ ঘাসের ভিতর অসংখ্য দেয়ালি পোকা ম’রে রয়েছে
দেখতে পাবে না তুমি এখানে
পৃথিবীকে মৃত সবুজ সুন্দর কোমল একটি দেয়ালি পোকার মতো
মনে হবে না তোমার,
জীবনকে মৃত সবুজ সুন্দর শীতল একটি দেয়ালি পোকার মতো
মনে হবে না;
প্যাঁচার সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খশিয়ে আনবে না এখানে,
শিশিরের সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খশিয়ে আনবে না,
সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা ব’লে বুঝতে পেরে চোখ
নিবিড় হ’য়ে উঠবে না তোমার।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন,
বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
তুমি নাই বনলতা সেন।তোমার মতন কেউ ছিল কি কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও।
কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবের আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন,
কবেকার বনলতা সেন।
কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে,
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে,
কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে
হিজল জামের
বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন,
নিশুথির বনলতা সেন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
যেখানে রূপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর,
যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর;
যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে-খুঁটে খায়
সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়?
নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ
পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ;
কান্তারের একপাশে যে-নদীর জল
বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে-শুয়ে দেখিছে কেবল
বিকালের লাল মেঘ; নক্ষত্রের রাতের আঁধারে
বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে
পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী
রাঙা মেঘ- হ্লুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি;
অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো;
লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো
এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব
ভাসিতেছে চিরদিনঃ নীল লাল রূপালি নীরব।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
নিরাশার খাতে ততোধিক লোক উৎসাহ বাঁচায়ে রেখেছে;
অগ্নিপরীক্ষার মতো কেবলি সময় এসে দ’হে ফেলে দিতেছে সে-সব।
তোমার মৃত্যুর পরে আগুনের একতিল বেশি অধিকার
সিংহ মেষ কন্যা মীন করেছে প্রত্যক্ষ অনুভব।
পৃথিবী ক্রমশ তার আগেকার ছবি
বদলায়ে ফেলে দিয়ে তবুও পৃথিবী হ’য়ে আছে;
অপরিচিতের মতো সমাজ সংসার শত্রু সবই
পরিচিত বুনোনির মতো তবু হৃদয়ের কাছে
ক্রমশই মনে হয় নিজ সজীবতা নিয়ে চমৎকার;
আবর্তিত হ’য়ে যায় দানবের মায়াবলে তবুও সে-সব।
তোমার মৃত্যুর পরে মনিবের একতিল বেশি অধিকার
দীর্ঘ কালকেতু তুলে বাধা দিতে চেয়েছে রাসভ।
তোমার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলে তুমি চ’লে গেলে কবে।
সেই থেকে অন্য প্রকৃতির অনুভবে
মাঝে-মাঝে উৎকন্ঠিত হ’য়ে জেগে উঠেছে হৃদয়।
না-হ’লে নিরুৎসাহিত হ’তে হয়।
জীবনের, মরণের, হেমন্তের এ-রকম আশ্চর্য নিয়ম;
ছায়া হ’য়ে গেছো ব’লে তোমাকে এমন অসম্ভ্রম।
শত্রুর অভাব নেই, বন্ধুও বিরল নয়- যদি কেঊ চায়;
সেই নারী ঢের দিন আগে এই জীবনের থেকে চ’লে গেছে।
ঢের দিন প্রকৃতি ও বইয়ের নিকট থেকে সদুত্তর চেয়ে
হৃদয় ছায়ার সাথে চালাকি করছে।
তারপর অনুভব ক’রে গেছে রমণীর ছায়া বা শরীর
অথবা হৃদয়,-
বেড়ালের বিকশিত হাসির মতন রাঙা গোধূলির মেঘে;
প্রকৃতির প্রমাণের, জীবনের দ্বারস্থ দুঃখীর মতো নয়।
তোমার সংকল্প থেকে খ’সে গিয়ে ঢের দূরে চ’লে গেলে তুমি;
হ’লেও-বা হ’য়ে যেতো এ জীবনঃ দিনরাত্রির মতো মরুভুমি;-
তবুও হেমন্তকাল এসে পড়ে পৃথিবীতে, এমন স্তব্ধতা;
জীবনেও নেই কো অন্যথা
হেমন্তের সহোদর র’য়ে গেছে, সব উত্তেজের প্রতি উদাসীন;
সকলের কাছ থেকে সুস্থির মনের ভাবে নিয়ে আসে ঋণ,
কাউকে দেয় না কিছু, এমনই কঠিন;
সরল সে নয়, তবু ভয়াবহভাবে শাদা, সাধারণ কথা
জনমানুষীর কাছে ব’লে যায়- এমনই নিয়ত সফলতা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে কালো নদী,-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝঝুম বিছানার’ পরে
মেঘ-বৌ’র খোঁপাখসা জ্যোৎস্নাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
চেয়ে থাকি চোখ তুলে -যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!
সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে ফিরে ফিরে
মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,
দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,
কোথা পিরামিডতলে,- ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন্ মন-ভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর সনে
আমারে দেখেছে জ্যোৎস্না,-চোর চোখে-অলস নয়নে!
আমারে দেখেছে সে যে আসীরীয় সম্রাটের বেশে
প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে,-
হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!
ভোরগেলাসের সুরা,-তহুরা,- করেছি মোরা চুপে চুপে পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,
নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!
নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ,-
চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস,-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের,- রাতের নির্জনে!
আমি ছিনু ‘ত্রুবেদুর’ কোন্ দূর ‘প্রভেন্স’-প্রান্তরে!
-দেউলিয়া পায়দল্,-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!
আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!
-‘অলিভ’ পাতার ফাঁকে চুনচোখে চেয়েছিল চাঁদ,
মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক,- গোক্ষুরাফণা,- বিষের বিস্বাদ!
স্পেইনের ‘সিয়েরা’য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-
নির্মম-কৃতান্ত-কাল,-তবু কী যে কাতর- বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!
বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা,- জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে,-মুখ চুন হ’য়ে যায় একেলা বসি!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে
পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছে ভেসে;
তা না হ'লে সকলি হারায়ে যেতো ক্ষমাহীন রক্তের- নিরুদ্দেশে।
হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর;
তারপর হ'য়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের।
ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই,
নেই কোনো নিস্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে।
বানরী ছাগল নিয়ে যে- ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে-
আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে-
খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে।
চামচিকা যার হয় নিরালোকে ওপারের বায়ুসন্তরণে;
প্রান্তরের অমরতা জেগে ওঠে একরাশ প্রাদেশিক ঘাসের উন্মেষে;
জীর্ণতম সমাধির ভাঙ্গা ইঁট অসম্ভব পরগাছা ঘেঁষে
সবুজ সোনালিচোখ ঝিঁঝিঁ-দম্পতির ক্ষুধা করে আবিষ্কার
একটি বাদুড় দূর স্বোপার্জিত জ্যোৎস্নার মনীষায় ডেকে নিয়ে যায়
যাহাদের যতদূর চক্রবাল আছে লভিবার।
হে আকাশ, হে আকাশ,
একদিন ছিলে তুনি মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের মতো;
তারপর হ'য়ে গেছ প্রভাতের নদীটির মতো প্রতিভার!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
দূর পৃথিবীর গন্ধে ভরে ওঠে আমার এ বাঙালির মন
আজ রাতে; একদিন মৃত্যু এসে যদি দূর নক্ষত্রের তলে
অচেনা ঘাসের বুকে আমারে ঘুমায়ে যেতে বলে
তবুও সে ঘাস এই বাংলার অবিরল ঘাসের মতন
মউরীর মৃদু গন্ধে ভরে রবে, — কিশোরীর স্তন
প্রথম জননী হয়ে যেমন নরম দুধে গলে
পৃথিবীর সব দেশে–সব চেয়ে ঢের দূর নক্ষত্রের তলে
সব পথে এই সব শানি — আছে: ঘাস — চোখ — শাদা হাত — স্তন —কোথাও আসিবে মৃত্যু — কোথাও সবুজ মৃদু ঘাস
আমারে রাখিবে ঢেকে — ভোরে, রাতে, দু’পহরে পাখির হৃদয়
ঘাসের মতন সাধে ছেয়ে রবে রাতের আকাশ
নক্ষত্রের নীল ফুলে ফুটে রবে — বাংলার নক্ষত্র কি নয়?
জানি নাকো; তবুও তাদের বুকে স্থির শান্তি– শান্তি লেগে যায়;
আকাশের বুকে তারা যেন চোখ — শাদা হাত যেন স্তন — ঘাস — |
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
ঘাটশিলা—ঘটশিলা—
কলকাতা ছেড়ে বল ঘাটশিলা কে যায় মিছাই
চিরদিন কলতাকা থাকি আমি,
ঘাটশিলা ছাই।চিঠির উপরে তবু চিঠি
কয়েকটা দিন
এইখানে এসে তুমি থেকে যাও
চিঠিগুনো হয়ে গেল পুরোনো মলিনতবু আমি গেলাম না
যদিও দেখেছি আমি কলকাতা থেকে
কত দিন কত রাত
ঘাটশিলা গিয়েছে অনেকেএকদিন তারপর—বহুদিন পরে
অনেক অসাধ অনিচ্ছায়
ঘাটশিলা চলিলাম
ঘাটশিলা দেখিলাম হায়আবার এসেছি ফিরে—ধোঁয়ায় ধুলায় ভিড়ে
ফুটপাথে—ট্রামের জগতে
পথ থেকে পথে ফিরি
পথ থেকে ক্লান্ত পথে পথে।কী হল তোমার, আহা,
আমার হৃদয়
তোমারে যে গোধূলির তেপান্তরে
মায়াবীর মতো মনে হয়,যেই এই পৃথিবীর বেলা শেষ হয়ে গেছে
ম্না ঘোড়া নিয়ে একা তুমি
কড়ির পাহাড় খুঁজে ঘুরিতেছ
ঘুরিছ হাড়ের মরুভূমি।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে
বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;
এক-দুই-তিন- চার-অজস্র-অপার-
রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।
তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব — পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেল পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কোথায় গিয়েছে আজ সেইসব পাখি-আর সেইসব ঘোড়া-
সেই শাদা দালানের নারী?
বাবলা ফুলের গন্ধে-সোনালি রোদের রঙ্গে ওড়া
সেইসব পাখি-আর সেইসব ঘোড়া
চলে গেছে আমাদের এ পৃথিবী ছেড়ে;
হৃদয় কোথায় বলো-কোথায় গিয়েছে আজ সব
অন্ধকার; মৃত নাসপাতিটির মতন নীরব।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে,
পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;
বিকেলের শিশুসুর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে
করুণ হয়েছে ঝাউবন।
নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতো কলবরে
ভেসে নারকোলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রূণ;
বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: ‘শান্ত হতে হবে–’
অকূল সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে এক মাইল শান্তি কল্যাণ
হয়ে আছে। তার মুখ মনে পড়ে এ-রকম স্নিগ্ধ পৃথিবীর
পাতাপতঙ্গের কাছে চলে এসে; চারিদিকে রাত্রি নক্ষত্রের আলোড়ন
এখন দয়ার মতো; তবুও দয়ার মানে মৃত্যুতে স্থির
হয়ে থেকে ভুলে যাওয়া মানুষের সনাতন মন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে
আমার মুখের দিকে,- ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি-খড় – নাড়া- মাঠের ফাটল ,
শিশিরের জল !
মেঠো চাঁদ- কাস্তের মতো বাঁকা , চোখা –
চেয়ে আছে;- এমনি সে তাকায়েছে কত রাত – নাই লেখা- জোখা ।
মেঠো চাঁদ বলে :
‘আকাশের তলে
ক্ষেতে – ক্ষেতে লাঙলের ধার
মুছে গেছে, - ফসল কাটার
সময় আসিয়া গেছে ,- চ’লে গেছে কবে!-
শস্য ফলিয়া গেছে, - তুমি কেন তবে
রয়েছ দাঁড়ায়ে
একা-একা ! – ডাইনে আর বাঁয়ে
খড় –নাড়া – পোড়ো জমি- মাঠের ফাটল ,-
শিশিরের জল !’
আমি তারে বলি :
‘ ফসল গিয়েছে ঢের ফলি,
শস্য গিয়েছে ঝ’রে কত ,-
বুড়ো হয়ে গেছ তুমি এই বুড়ি পৃথিবীর মতো !
ক্ষেতে-ক্ষেতে লাঙলের ধার
মুছে গেছে কতবার ,- কতবার ফসল- কাটার
সময় আসিয়া গেছে, - চ’লে গেছে কবে !-
শস্য ফলিয়া গেছে ,-তুমি কেন তবে
রয়েছ দাঁড়ায়ে
একা-একা ! ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি- খড়- নাড়া – মাঠের ফাটল ,-
শিশিরের জল !’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সূর্যের উদয় সহসা সমস্ত নদী
চমকিত ক'রে ফেলে- অকস্মাৎ দ্যাখা দিয়ে-
চ'লে যায়; হাড়ের ভিতরে মেঘেদের
অন্ধকার; স্তম্ভিত বন্ধুর মতো ভোর
এইখানে সাধু রাত্রির হাত ধ'রে
তাকে শ্রেয়তর চালানির মূল জেনে
নিখিলের- মৃত মাংসের স্তুপ
চারিদিকে; তার মাঝে ধন্বন্তরি, কালনেমি
কিছু চায়;
দুস্তর চাদর গায়ে অন্ধ বাতাসের।
সূর্য তবু- সূর্য যেন জ্যোতি
প্রতিবিম্ব রেখে গেছে তরবারে- ভাঁড়ের হৃদয়ে,
ধর্মোশোকের মনে।করজোড়ে ভাবে তারা;
ঝলিছে সারস শব ঢের
বৈতরনী তরঙ্গের দিকে ভেসে যেতে- যেতে
লোকোত্তর সূর্যের আমোদে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
হেমন্ত ফু্রায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে ;
এ-রকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে
সময়ের কুয়াশায় ;
মাঠের ফসলগুলো বার বার ঘরে
তোলা হ’তে গিয়ে তবু সমুদ্রের পারের বন্দরে
পরিচ্ছন্নভাবে চলে গেছে।
মৃত্তিকার ওই দিক আকাশের মুখোমুখি যেমন সাদা মেঘের প্রতিভা ;
এই দিকে ঋণ, রক্ত, লোকসান, ইতর, খাতক ;
কিছু নেই তবু – তবুও অপেক্ষাতুর ;
হৃদয়স্পন্দন আছে – তাই অহরহ
বিপদের দিকে অগ্রসর ;
পাতালের মত দেশ পিছে ফেলে রেখে
নরকের মত শহরে
কিছু চায় ;
কী যে চায়।
যেন কেঊ দেখেছিল খণ্ডাকাশ যতবার পরিপূর্ণ নীলিমা হয়েছে,
যতবার রাত্রির আকাশ ঘিরে স্মরনীয় নক্ষত্র এসেছে,
আর তাহাদের মতো নরনারী যতবার
তেমন জীবন চেয়েছিলো,
যত নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গেছে রৌদ্রের আকাশে,
নদীর ও নগরীর
মানুষের প্রতিশ্রুতির পথে যত
নিরুপম সূর্যলোক জ্ব’লে গেছে – তার
ঋণ শোধ ক’রে দিতে গিয়ে এই অনন্ত রৌদ্রের অন্ধকার।
মানবের অভিজ্ঞতা এ-রকম।
অভিজ্ঞতা বেশি ভাল হ’লে তবু ভয়
পেতে হ’তো ?
মৃত্যু তবে ব্যসনের মতো মনে হ’তো ?
এখন ব্যসন কিছু নেই।
সকলেই আজ এই বিকেলের পরে এক তিমির রাত্রির
সমুদ্রের যাত্রীর মতন
ভালো-ভালো নাবিক ও জাহাজের দিগন্তর খুঁজে
পৃথিবীর ভিন্ন-ভিন্ন নেশনের নিঃসহায় প্রতিভূর মতো
পরস্পরকে বলে, ‘হে নাবিক, হে নাবিক তুমি -
সমুদ্র এমন সাধু, নীল হ’য়ে – তবুও মহান মরুভূমি ;
আমরাও কেউ নেই -‘
তাহাদের শ্রেণী যোনি ঋণ রক্ত রিরংসা ও ফাঁকি
উঁচু – নিচু নর নারী নিক্তিনিরপেক্ষ হ’য়ে আজ
মানবের সমাজের মতন একাকী
নিবিড় নাবিক হ’লে ভাল হয় ;
হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় নাকি!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমার শরীর ,-
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার;- তারপর,- মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন দিকে জানিনি তা,- হয়েছে মলিন
চক্ষু এই;- ছিঁড়ে গেছি- ফেড়ে গেছি ,- পৃথিবীর পথ হেঁটে হেঁটে
কত দিন রাত্রি গেছে কেটে !
কত দেহ এল,- গেল, - হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব;- সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
ব’সে আছি,- সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া !
তোমার শরীর,-
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার;- তারপর,- মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন দিকে,-ফ’লে গেছে কতবার, ঝ’রে গেছে তৃণ !
আমারে চাও না তুমি আজ আর,- জানি ;
তোমার শরীর ছানি
মিটায় পিপাসা
কে সে আজ ! – তোমার রক্তের ভালোবাসা
দিয়েছ কাহারে !
কে বা সেই !- আমি এই সমুদ্রের পারে
ব’সে আছি একা আজ ,- ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে
আজ আর প্রশ্ন নাই ,- মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে
চক্ষে তার ,- এলোমেলো রয়েছে আকাশ !
উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা !- তারি তলে পৃথিবীর ঘাস
ফ’লে ওঠে ,- পৃথিবীর তৃণ
ঝ’রে পড়ে ,- পৃথিবীর রাত্রি আর দিন
কেটে যায় !
উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা,- তারি তলে হায় !
জানি আমি – আমি যাব চ’লে
তোমার অনেক আগে;
তারপর ,- সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন,-
আকাশে আকাশে যাবে জ্ব’লে
নক্ষত্র অনেক রাত আরো
নক্ষত্র অনেক রাত আরো !-
( যদিও তোমারো
রাত্রি আর দিন শেষ হবে
একদিন কবে ! )
আমি চ’লে যাব,- তবু,- সমুদ্রের ভাষা
রয়ে যাবে,- তোমার পিপাসা
ফুরাবে না,- পৃথিবীর ধুলো – মাটি – তৃণ
রহিবে তোমার তরে , রাত্রি আর দিন
রয়ে যাবে ;- রয়ে যাবে তোমার শরীর ,
আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড় ।
আমারে খুঁজিয়াছিলে তুমি একদিন,-
কখন হারায়ে যাই – এই ভয়ে নয়ন মলিন
করেছিলে তুমি !-
জানি আমি;- তবু ,এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি
আকাশের তারার মতন
ফলিয়া ওঠে না রোজ ; দেহ ঝরে , ঝ’রে যায় মন
তার আগে !
এই বর্তমান ,- তার দু’পায়ের দাগে
মুছে যায় পৃথিবীর’পর
একদিন হয়েছে যা – তার রেখা ,- ধূলার অক্ষর !
আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি,-
জানি আমি ;- পৃথিবীর ফসলের ভূমি
আকাশের তারার মতন
ফলিয়া ওঠে না রোজ ;-
দেহ ঝরে ,তার আগে আমাদের ঝ’রে যায় মন!
আমার পায়ের তলে ঝ’রে যায় তৃণ ,-
তার আগে এই রাত্রি দিন পড়িতেছে ঝ’রে!
এই রাত্রি,- এই দিন রেখেছিলে ভ’রে
তোমার পায়ের শব্দে ,- শুনেছি তা আমি !
কখন গিয়েছে তবু থামি
সেই শব্দ !- গেছ তুমি চ’লে
সেই দিন-সেই রাত্রি ফুরায়েছে ব’লে!
আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ ,-
তবু সেই রাত্রি আর দিন
প’ড়ে গেল ঝ’রে!-
সেই রাত্রি- সেই দিন- তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভ’রে !
জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে
তুমি আর ;- নক্ষত্রের পারে
যদি আমি চ’লে যাই,
পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই
যদি আমি ,-
আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ;
তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি
আমার এ নক্ষত্রের তলে ।-
জানি তবু- নদীর জলের মতো পা তোমার চলে;-
তোমার শরীর আজ ঝরে
রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে !
যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই
যদি আমি চলে যাই
নক্ষত্রের পারে,-
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে !
তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে !-
নক্ষত্র সরিয়া যায়,- তবু যদি তোমার দুপায়ে
হারায়ে ফেলিতে পথ-চলার পিপাসা !-
একবার ভালোবেসে – যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালবাসা!
আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি !-
কিন্তু তুমি চ’লে গেছ, তবু কেন আমি
রয়েছি দাঁড়ায়ে !
নক্ষত্র সরিয়া যায়,-তবু কেন আমার এ পায়ে
হারায়ে ফেলেছি পথ-চলার পিপাসা !
একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা !
চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন
আমার এ-পথে ,- কারণ , তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন ।
জানি আমি,- আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই ।
তারপর,- কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি !- তাই আস নাই
আমার এখানে তুমি আর!
একদিন কত কথা বলেছিলে ,- তবু বলিবার
সেইদিনো ছিল না তো কিছু ;- তবু সেদিন
আমার এ পথে তুমি এসেছিলে ,- বলেছিলে যত কথা,-
কারণ , তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন ;
আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই ;
তারপর- কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি,- তাই আস নাই!
তোমার দু’চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে ।
আলো –অন্ধকারে
তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি !
নিকটে – নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন,-
আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি এই দূর সমুদ্রের জলে!
যে-নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন , দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে !
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক,- তারপর,- গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে ,
নক্ষত্রের তলে !
রাত্রে,- অন্দজকারে !
-তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ,- জানি আমি,-
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে !
তোমার শরীর ,-
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার;- তারপর,- মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন দিকে জানিনি তা,- হয়েছে মলিন
চক্ষু এই;- ছিঁড়ে গেছি- ফেড়ে গেছি ,- পৃথিবীর পথ হেঁটে হেঁটে
কত দিন রাত্রি গেছে কেটে !
কত দেহ এল,- গেল, - হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব;- সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
ব’সে আছি,- সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
পটভূমির ভিতরে গিয়ে কবে তোমার দেখেছিলাম আমি
দশ-পনেরো বছর আগে;—সময় তখন তোমার চুলে কালো
মেঘের ভিতর লুকিয়ে থেকে বিদ্যুৎ জ্বালালো
তোমার নিশিত নারীমুখের;—জানো তো অন্তর্যামী।
তোমার মুখঃ চারিদিকে অন্ধকারে জলের কোলহল,
কোথাও কোনো বেলাভূমির নিয়ন্তা নেই,—গভীর বাতাসে
তবুও সব রণক্লান্ত অবসন্ন নাবিক ফিরে আসে;তারা যুবা, তারা মৃত; মৃত্যু অনেক পরিশ্রমের ফল।
সময় কোথাও নিবারিত হয় না, তবু, তোমার মুখের পথে
আজো তাকে থামিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছ, নারি,-
হয়তো ভোরে আমরা সবাই মানুষ ছিলাম, তারি
নিদর্শনের সূর্যবলয় আজকের এই অন্ধ জগতে।
চারিদিকে অলীক সাগর—জ্যাসন ওডিসিয়ুস ফিনিশিয়
সার্থবাহের অধীর আলো,—ধর্মাশোকের নিজের তো নয়, আপতিতকাল
আমরা আজো বহন ক’রে, সকল কঠিন সমুদ্রে প্রবাল
মুটে তোমার চোখের বিষাদ ভৎর্সনা…প্রেম নিভিয়ে দিলাম, প্রিয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
দু-এক মুহূর্তে শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি
হে সিন্ধুসারস,
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি
নাচিতেছে টারান্টেলা- রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি
চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দু’টি আকাশের গায়
ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।
মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান,
আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ
নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ
পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান
শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান।
জানো লি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধার ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে- হারায়েছি আনন্দের গতি;
ইচ্ছা, ছিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান- এই বর্তমান
হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের- বেদনার আমার সন্তান?
জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেলার সন্তান,
তুমি পিছে চাহো নাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই,
বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর
পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে
ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।
যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পণার নিঃসঙ্গ প্রভাত
নেই তব; নেই নিম্নভূমি- নেই আনন্দের অন্তরালে
প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।
স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো- পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা
বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা
রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতো রেখা
প্রাণে তার- ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;
একবার স্বপনে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো
নিভে গেছে যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, ক’রে না বুনন
মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে শালিকের মন,
মেঘের দুপুর ভাসে- সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন
মেঘের দুপুরে, তাহা, ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে;
সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে।
তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনো নাকো; অথাবা রক্তের পথে
পৃথিবীর ধূলির ভিতরে
জানো নাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;
সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;
গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের- ইন্দ্রধনূ ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন
হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।
এইসব জানো নাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডাজান উল্লাসে;
রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডানা শাদা ফেনা- শিশুদের পাশে
হেলিওট্রোপের মতো দুপুরের অসীম আকাশ!
ঝিকমিক করে রৌদ্রের বরফের মতো শাদা ডানা,
যদিও এ-পৃথিবীর স্বপ্ন ছিন্তা সব তার অচেনা অজানা।
চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি- জম্ন তুমি নিয়েছিলে কবে,
বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে স’বে
আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে- দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে।
শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে
নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে।
ধানের রসের গল্প পৃথিবীর- পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ
পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই- আর তার প্রেমিকের ম্লান
নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ,
জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায়
শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
যতোদিন পৃথিবীতে জীবন রয়েছে
দুই চোখ মেলে রেখে স্থির
মৃত্যু আর বঞ্চনার কুয়াশার পায়ে
সত্য সেবা শান্তি যুক্তিরনির্দেশের পথ ধ'রে চ'লে
হয়তো-বা ক্রমে আরো আলো
পাওয়া যাবে বাহিরে- হৃদয়ে;
মানব ক্ষয়িত হয় না জাতির ব্যক্তির ক্ষয়ে।ইতিহাস ঢের প্রমাণ করেছে
মানুষের নিরন্তর প্রয়াণের মানে
হয়তো-বা অন্ধকার সময়ের থেকে
বিশৃঙ্খল সমাজের পানে
চ'লে যাওয়া; -গোলকধাঁধার
ভুলের ভিতর থেকে আরো বেশি ভুলে;
জীবনের কালোরঙা মানে কি ফুরুবে
শুধু এই সময়ের সাগর ফুরুলে।জেগে ওঠে তবুও মানুষ রাত্রিদিনের উদয়ে;
চারিদিকে কলরোল করে পরিভাষা
দেশের জাতির দ্ব্যর্থ পৃথিবীর তীরে;
ফেণিল অস্ত্র পাবে আশা?
যেতেছে নিঃশেষ হ'য়ে সব?
কি তবে থাকবে?
আধার ও মননের আজকের এই নিস্ফল রীতি
মুছে ফেলে আবার সচেষ্ট হ'য়ে উঠবে প্রকৃতি?ব্যর্থ উত্তরাধিকারে মাঝে- মাঝে তবু
কোথাকার স্পষ্ট সূর্য-বিন্দু এসে পড়ে
কিছু নেই উত্তেজিত হ'লে;
কিছু নেই স্বার্থের ভিতরে;
ধনের অদেয় কিছু নেই, সেই সবি
জানে এ খন্ডিত রক্ত বণিক পৃথিবী;
অন্ধকারে সবচেয়ে সে শরণ ভালো
যে- প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অন্ধভাবে আলোকিত হয়েছিলো তারা
জীবনের সাগরে-সাগরেঃ
বঙ্গোপসাগরে,
চীনের সমুদ্রে- দ্বীপপুঞ্জের সাগরে।
নিজের মৎসর নিয়ে নিশানের 'পরে সূর্য এঁকে
চোখ মেরেছিলো তারা নীলিমার সূর্যের দিকে।
তারা সব আজ রাতে বিলোড়িত জাহাজের খোল
সাগরকীটের মৃত শরীরের আলেয়ার মতো
সময়ের দোলা খেয়ে নড়ে;
'এশিয়া কি এশিয়াবাসীর
কোপ্রস্পেরেটির
সূর্যদেবীর নিজ প্রতীতির তরে?'
ব'লে সে পুরোনো যুগ শেষ হ'য়ে যায়।
কোথাও নতুন দিন আসে;
কে জানে সেখানে সৎ নবীনতা র'য়ে গেছে কিনা;
সূর্যের চেয়েও বেশি বালির উত্তাপে
বহুকাল কেটে গেছে বহুতর শ্লোগানের পাপে।
এ-রকম ইতিহাস উৎস রক্ত হ'য়ে
এই নব উত্তরাধিকারে
স্বর্গতি না হোক- তবু মানুষের চরিত্র সংহত হয় না কি?
ভাবনা ব্যাহত হ'য়ে বেড়ে যায়- স্থির হয় না কি?
হে সাগর সময়ের,
হে মানুষ,- সময়ের সাগরের নিরঞ্জন-ফাঁকি
চিনে নিয়ে বিমলিন নাবিকের মতন একাকী
হ'লেও সে হ'তো, তবু পৃথিবী বড়ো রৌদ্রে-
আরো প্রিয়তর জনতায়
'নেই' এই অনুভব জয় ক'রে আনন্দে ছড়ায়ে যেতে চায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অন্ধ সাগরের বেগে উৎসারিত রাত্রির মতন
আলোড়ন মানুষের প্রিয়তর দিক নির্ণয়ের
পথ আজ প্রতিহত; তবুও কোথাও
নির্মল সন্ততি দেশ সময়ের নব নব তীর-
পেতে পায়ে হয়তো বা মানব হৃদয়;মহাপতনের দিনে আজ অবহিত হয়ে নিতে হয়।
যদিও অধীর লক্ষ্যে অন্ধকারে মানুষ চলেছে
ধ্বংস আশা বেদনায়বন্য মরালের মত চেতনায় নীল কুয়াশায়,-
কুহেলি সরিয়ে তবু মানুষের কাহিনীর পথে
ভাস্বরতা এসে পড়ে মাঝে মাঝে-
স্বচ্ছ ক্রান্তিবলয়ের মতন জগতে।মনে হয় মহানিশীথের স্তন্যপায়ী
মানুষ তবুও শিশুসূর্যের সন্তান,
স্থিরতর বিষয়ী সে,-
যদিও হৃদয়ে রক্তে আজো ভুল অকূলের গান।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
(অগণন সাধারণের)সে এক বিচ্ছিন্ন দিনে আমাদের জন্ম হয়েছিলো
ততোধিক অসুস্থ সময়ে
আমাদের মৃত্যু হয়ে যায়।
দূরে কাছ শাদা উঁচু দেয়ালের ছায়া দেখে ভয়ে
মনে করে গেছি তাকে- ভালোভাবে মনে ক'রে নিলে-
এইখানে জ্ঞান হতে বেদনার সুরু-
অথবা জ্ঞানের থেকে ছুটি নিয়ে সান্ত্বনার হিম হ্রদে একাকী লুকালে
নির্জন স্ফটিকস্তম্ভ খুলে ফেলে মানুষের অভিভূত ঊরু
ভেঙে যাবে কোনো এক রম্য যোদ্ধা এসে।
নরকেও মৃত্যু নেই- প্রীতি নেই স্বর্গের ভিতরে;
মর্ত্যে সেই স্বর্গ নরকের প্রতি সৎ অবিশ্বাস
নিস্তেজ প্রতীতি নিয়ে মনীষীরা প্রচারিত করে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
ঘাসের ভিতরে সেই চড়ায়ের শাদা ডিম ভেঙে আছে — আমি ভালোবাসি
নিস্তব্ধ করুণ মুখ তার এই — কবে যেন ভেঙেছিল — ঢের ধুলো খড়
লেগে আছে বুকে তার — বহুক্ষণ চেয়ে থাকি; — তারপর ঘাসের ভিতর
শাদা শাদা ধুলোগুলো পড়ে আছে, দেখা যায় খইধান দেখি একরাশি
ছড়ায়ে রয়েছে চুপে; নরম বিষন্ন গন্ধ পুকুরের জল থেকে উঠিতেছে ভাসি;
কান পেতে থাকি যদি, শোনা যায়, সরপুটি চিতলের উদ্ভাসিত স্বর
মীনকন্যাদের মতো, সবুজ জলের ফাঁকে তাদের পাতালপুরী ঘর
দেখা যায় — রহস্যের কুয়াশায় অপরূপ — রূপালি মাছের দেহ গভীর উদাসীচলে যায় মন্ত্রিকুমারের মতো, কোটাল ছেলের মতো রাজার ছেলের মতো মিলে
কোন এক আকাঙ্খার উদঘাটনে কত দূরে; বহুক্ষণ চেয়ে থাকি একা
অপরাহ্ন এল বুঝি? — রাঙা রৌদ্রে মাছরাঙা উড়ে যায় — ডানা ঝিলমিলে;
এক্ষুনি আসিবে সন্ধ্যা, — পৃথিবীতে ম্রিয়মাণ গোধূলি নামিলে
নদীর নরম মুখ দেখা যাবে — মুখে তার দেহে তার কতো মৃদু রেখা
তোমারি মুখের মতো: তবুও তোমার সাথে কোনোদিন হবে নাকো দেখা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ডানা ভেঙে ঘুরে-ঘুরে প’ড়ে গেলো ঘাসের উপর;
কে তার ভেঙেছে ডানা জানে না সে ;- আকাশের ঘরে
কোনোদিন-কোনোদিন আর তার হবে না প্রবেশ ?
জানে না সে; কোনো-এক অন্ধকার হিম নিরুদ্দেশ
ঘনায়ে এসেছে তার ? জানে না সে, আহা,
সে যে আর পাখি নয়- রঙ নয়- তাহা
জানে না সে; ঈর্ষা নয়- হিংসা নয়- বেদনা নিয়েছে তারে কেড়ে!
সাধ নয়- স্বপ্ন নয়- একবার দুই ডানা ঝেড়ে
বেদনারে মুছে ফেলে দিতে চায় ; - রুপালি বৃষ্টির গান, রৌদ্রের অাস্বাদ
মুছে যায় শুধু তার,- মুছে যায় বেদনারে মুছিবার সাধ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
গুবরে ফড়িং শুধু উড়ে যায় আজ এই সন্ধ্যার বাতাসে,
খড়কুটা ঝড়ে শুধু শাইকের মুখ থেকে চুপে।
আবার শালিখা, সেই খড়গুনো কুড়ায় নিশ্চুপে।
সন্ধ্যার লাল শিরা মৃদু চোখে ঘরে ফিরে আসে
ঘুঘুর নরম ডাকে—নীরব আকাশে
নক্ষত্রেরা শান্তি পায়—পউষের কুয়াশায় ধূপে
পুঁয়ের সবুজ রাঙা লতা আছে ডুবে।
এ কোমল স্নিগ্ধ হিম সান্ত্বনার মাসে
চোখে তার শান্তি শুধু—লাল লাল ফলে বুক আছে দেখ ভ’রে।
গুবরে ফড়িং কই উড়ে যায় আজ এই সন্ধ্যার বাতসে,
খড়কুটা ঝরে শুধু শালিখের মুখ থেকে চুপে
আবার শালিখ অই খড়গুনো কুড়ায় নিশ্চুপে।
সন্ধ্যার লাল শিরা মৃদু চোখে ঘরে ফিরে আসে
তবুও তোমারে আমি কোনোদিন পাব নাকো অসীম আকাশে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।
পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ ,-
পাহাড়ের মতো ওই মেঘ
সঙ্গে লয়ে আসে
মাঝরাতে কিংবা শেষরাতের আকাশে
যখন তোমারে !-
মৃত সে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে !
ছেঁড়া- ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে
তরাসে ছেলের মতো ,- আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে
অনেক সময়,-
তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে ,-চাঁদ ;-
পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,
একদিন হয়েছে যা,- তারপর হাতছাড়া হয়ে
হারায়ে ফুরায়ে গেছে,- আজো তুমি তার স্বাদ লয়ে
আর একবার তবু দাঁড়ায়েছে এসে !
নিড়নো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চারদিকে,
শস্যের ক্ষেত চষে- চষে
গেছে চাষা চ’লে;
তাদের মাটির গল্প- তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হ’লে
অনেক তবুও থাকে বাকি,-
তুমি জান – এ- পৃথিবী আজ জানে তা কি !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আমরা মৃত্যুর দিকে জেগে উঠে দেখি
চারিদিকে ছায়া ভরা ভিড়
কুলোর বাতাসে উড়ে ক্ষুদের মতন
পেয়ে যায়- পেয়ে যায়- অণুপরমাণুর শরীরএকটি কি দু’টি মুখ- তাদের ভিতরে
যদিও আমি দেখিনি কোনোদিন- তবুও বাতাসে
প্রথম গার্গীর মতো- জানকীর মতো হয়ে ক্রমে
অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তারপর একদিন উজ্জ্বল মৃত্যৃর দূত এসে
কহিবেঃতোমারে চাই- তোমারেই,নারী;
এইসব সোনা রূপা মসলিন যুবাদের ছাড়ি
চ’লে যেতে হবে দূর আবিষ্কারে ভেসে।বলিলাম;শুনিল সেঃ’তুমি তবু মৃত্যুর দূত নও-তুমি-‘
‘নগর-বন্দর ঢের খুঁজিয়াছি আমি;
তারপর তোমার এই জানালায় থামি
ধোঁয়া সব;-তুমি যেন মরীচিকা-আমি মরুভূমি-‘শীতের বাতাস নাকে চলে গেলো জানালার দিকে
পড়িল আধেক শাল বুক থেকে খসে
সুন্দর জন্তুর মতো তার দেহকোষে
রক্ত শুধু দেহ শুধু শুধু হরিণীকেবাঘের বিক্ষোভ বুকে নিয়ে নদীর কিনারে-নিম্নে-রাতে?
তবে তুমি ফিরে যাও ধোঁয়ায় আবার;
উজ্জ্বল মৃত্যুর দূত বিবর্ণ এবার-
বরং নারীকে ছেড়ে কঙ্কালের হাতে
তোমারে তুলিয়া লবে কুয়াশা-ঘোড়ায়।
তুমি এই পৃথিবীর অনাদি স্থবির;-
সোনালি মাছের মতো তবু করে ভিড়
নীল শৈবালের নিচে জলের মায়ায়প্রেম-স্বপ্ন-পৃথিবীর স্বপ্ন প্রেম তোমার হৃদয়ে।
হে স্থবির, কী চাও বলো তো-
শাদা ডানা কোনো এক সারসের মতো?
হয়তো সে মাংস নয়-এই নারী; তবু মৃত্যু পড়ে নাই আজ তার মোহে।তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে
কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে।
কোকিল কুকুর জ্যেৎস্না ধুলো হয়ে গেছে কত ভেসে?
মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কামানের ক্ষোভে চূর্ণ হ’য়ে
আজ রাতে ঢের মেঘ হিম হ’য়ে আছে দিকে-দিকে!
পাহাড়ের নিচে- তাহাদের কারু- কারু মণিবন্ধে ঘড়ি
সময়ের কাঁটা হয়তো বা ধীরে-ধীরে ঘুরাতেছে;
চাঁদের আলোর নিচে এই সব অদ্ভুত প্রহরী
কিছুক্ষণ কথা কবে;-
হৃদয়যন্ত্রের যেন প্রীত আকাঙ্ক্ষার মতো ন’ড়ে,
সমুজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো গিলে।
জলপাই পল্লবের তলে ঝরা বিন্দু-বিন্দু শিশিরের রাশি
দূর সমুদ্রের শব্দ
শাদা চাদরের মতো- জনহীন- বাতাসের ধ্বনি
দু;-এক মুহূর্ত আরো ইহাদের গড়িবে জীবনী।
স্তিমিত- স্তিমিত আরো ক’রে দিয়ে ধীরে
ইহারা উঠিবে জেগে অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমিরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে যখন হয়েছে পূর্ণ সময়ের অভিপ্রায়-
আগাগোড়া জীবনের দিক চেয়ে কে আবার আয়ু চায়?
যদিও চোখের ঘুম ভুলে গিয়ে মননের অহঙ্কারে চর্বি জ্বালায়অপ্রেমিক, কোনো কিছু শেষ সত্য জেনে নেবে বিষয়ের থেকে।
তবু কোনো জাদুকর পুরানো স্ফটিক তার যায় নাই রেখে।
সময় কাটাতে হয় ব্যবহৃত হস্তাক্ষরে চীবরের ছায়াপাত দেখে। অথবা উদ্রিক্ত যারা হয় নাক'- চিরকাল থাকে সমীচীন,-
তাহাদের মুণ্ড যেন কালো হাঁড়ি- মাচার উপরে সমাসীন;
মৃত্যু নাই তাহাদের;- জানে সব দেবী, পরী, জিন। আর যারা বহুদিন পৃথিবীতে মেধে- মনে- ছিল কর্মক্ষম,
তারপর বুড়ো হয়ে স্মরণ করিতে চায় অবলুপ্ত মলয়াচলমঃ
তাদের হৃদয়ে ঢের মেষ আছে নাই কোনো শুভ্রঘ্রাণ গম। পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে যখন হয়েছে পূর্ণ সময়ের অভিপ্রায়-
আগাগোড়া জীবনের দিক চেয়ে কে আবার আয়ু চায়?
কন্যা তুলা কর্কটের বৃশ্চিকের আবার ঘটুক সমবায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
আগার তাহার বিভীষিকাভরা,- জীবন মরণময়!
সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে, – সে যে ব্যাধি,- সে যে ক্ষয়;
প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগার
রচিয়াছে সে যে,-দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার!
সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,
কালনাগিনীর ফনার মতন নাচে সে বুকের’ পর!
চক্ষে তাহার কালকুট ঝরে,- বিষপঙ্কিল শ্বাস,
সারাটি জীবন মরীচিকা তার,- প্রহসন-পরিহাস!
ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হ’য়ে যায় শশীতারকার শিখা,
আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা!
সে যে মন্বন্তর,- মৃত্যুর দূত,- অপঘাত,- মহামারী,-
মানুষ তবু সে,- তার চেয়ে বড়, – সে যে নারী, সে যে নারী!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সেই শৈশবের থেকে এ-সব আকাশ মাঠ রৌদ্র দেখেছি;
এই সব নক্ষত্র দেখেছি।
বিস্ময়র চোখে চেয়ে কতবার দেখা গেছে মানুষের বাড়ি
রোদের ভিতরে যেন সমুদ্রের পারে পাখিদের
বিষণ্ণ শক্তির মতো আয়োজনে নির্মিত হতেছে;
কোলাহলে-কেমন নিশীথ উৎসবে গ’ড়ে ওঠে।
একদিন শূন্যতায় স্তব্ধতায় ফিরে দেখি তারা
কেউ আর নেই।
পিতৃপুরুষেরা সব নিজ স্বার্থ ছেড়ে দিয়ে অতীতের দিকে
স’রে যায়- পুরানো গাছের সাথে সহমর্মী জিনিসের মতো
হেমন্তের রৌদ্রে-দিনে-অন্ধকারে শেষবার দাঁড়ায়ে তবুও
কখনো শীতের রাতে যখন বেড়েছে খুব শীত
দেখেছি পিপুল গাছ
আর পিতাদের ঢেউ
আর সব জিনিষ : অতীত।তারপর ঢের দিন চ’লে গেলে আবার জীবনোৎসব
যৌনমত্তার চেয়ে ঢের মহীয়ান, অনেক করুণ।
তবুও আবার মৃত্যু।-তারপর একদিন মউমাছিদের
অনুরণনের বলে রৌদ্র বিচ্ছুরিত হ’ইয়ে গেলে নীল
আকাশ নিজের কন্ঠে কেমন নিঃসৃত হয়ে ওঠে;- হেমন্তের
অপরাহ্নে পৃথিবী মাঠের দিকে সহসা তাকালে
কোথাও শনের বনে- হলুদ রঙের খড়ে- চাষার আঙুলে
গালে-কেমন নিমীল সনা পশ্চিমের
অদৃশ্য সূর্যের থেকে চুপে নামে আসে;
প্রকৃতি ও পাখির শরীর ছুঁয়ে মৃতোপম মানুষের হাড়ে
কি যেন কিসের সৌরব্যবহারে এসে লেগে থাকে।
অথবা কখনো সূর্য- মনে পড়ে- অবহিত হয়ে
নীলিমার মাঝপথে এসে থেমে র’য়ে গেছে- বড়ো
গোল-রাহুর আভাস বেই-এমনই পবিত্র নিরুদ্বেল।
এই সব বিকেলের হেমন্তের সূর্যছবি- তবু
দেখাবার মতো আজ কোনো দিকে কেউ
নেই আর, অনেকেই মাটির শয়ানে ফুরাতেছে।
মানুষেরা এই সব পথে এসে চ’লে গেছে,- ফিরে
ফিরে আসে;- তাদের পায়ের রেখায় পথ
কাটে কারা, হাল ধরে, বীজ বোনে, ধান
সমুজ্বল কী অভিনিবেশে সোনা হয়ে ওঠে- দেখে;
সমস্ত দিনের আঁচ শেষ হলে সমস্ত রাতের
অগণন নক্ষত্রেও ঘুমাবার জুড়োবার মতো
কিছু নেই;- হাতুড়ি করাত দাঁত নেহাই তুর্পুন্
পিতাদের হাত থেকে ফিরেফির্তির মতো অন্তহীন
সন্ততির সন্ততির হাতে
কাজ ক’রে চ’লে গেছে কতো দিন।
অথবা এদের চেয়ে আরেক রকম ছিলো কেউ-কেউ;
ছোটা বা মাঝারি মধ্যবিত্তদের ভিড়;-
সেইখানে বই পড়া হত কিছু- লেখা হত;
ভয়াবহ অন্ধকারে সরুসলতের
রেড়ীর আলোয় মতো কী যেন কেমন এক আশাবাদ ছিল
তাহাদের চোখে মুখে মনের নিবেশে বিমনস্কতায়;
সাংসারে সমাজে দেশে প্রত্যন্তও পরাজিত হলে
ইহাদের মনে হত দীনতা জয়ের চেয়ে বড়;
অথবা বিজয় পরাজয় সব কোনো- এক পলিত চাঁদের
এ-পিঠ ও-পিঠ শুধু;- সাধনা মৃত্যুর পরে লোকসফলতা
দিয়ে দেবে; পৃথিবীতে হেরে গেলে কোনো ক্ষোভ নেই।* * *মাঝে-মাঝে প্রান্ত্রের জ্যোৎস্নায় তারা সব জড়ো হয়ে যেত-
কোথাও সুন্দর প্রেতসত্য আছে জেনে তবু পৃথিবীর মাটির কাঁকালে
কেমন নিবিড়ভাবে হয়ে ওঠে, আহা।
সেখানে স্থবির যুবা কোনো- এক তন্বী তরুণীর
নিজের জিনিস হতে স্বীকার পেয়েছে ভাঙ্গা চাঁদে
অর্ধ সত্যে অর্ধ নৃত্যে আধেক মৃত্যুর অন্ধকারেঃ
অনেক তরুণী যুবা- যৌবরাজ্যে যাহাদের শেষ
হয়ে গেছে- তারাও সেখানে অগণন
চৈত্রের কিরণে কিংবা হেমন্তের আরো।
অনবলুন্ঠিত ফিকে মৃগতৃষ্ণিকার
মতন জ্যোৎস্নায় এসে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে প্রান্তরের পথে
চাঁদকে নিখিল ক’রে দিয়ে তবু পরিমেয় কলঙ্কে নিবিড়
ক’রে দিতে চেয়েছিল,- মনে মনে- মুখে নয়- দেহে
নয়; বাংলার মানসসাধনশীত শরীরের চেয়ে আরো বেশি
জয়ী হয়ে শুক্ল রাতে গ্রামীণ উৎসব
শেষ ক’রে দিতে গিয়ে শরীরের কবলে তো তবুও ডুবেছে বার-বার
অপরাধী ভীরুদের মতো প্রাণে।
তারা সব মৃত আজ।
তাহাদের সন্ততির সন্ততিরা অপরাধী ভীরুদের মতন জীবিত।
‘ঢের ছবি দেখা হল- ঢের দিন কেটে গেল- ঢের অভিজ্ঞতা
জীবনে জড়িত হয়ে গেল, তবু, হাতে খননের
অস্ত্র নেই- মনে হয়- চারিদিকে ঢিবি দেয়ালের
নিরেট নিঃসঙ্গ অন্ধকার’- ব’লে যেন কেউ যেন কথা বলে।
হয়তো সে বাংলার জাতীয় জীবন।
সত্যের নিজের রূপ তবুও সবের চেয়ে নিকট জিনিস
সকলের; অধিগত হলে প্রাণ জানালার ফাঁক দিয়ে চোখের মতন
অনিমেষ হয়ে থাকে নক্ষত্রের আকাশে তাকালে।
আমাদের প্রবীণেরা আমাদের আচ্ছন্নতা দিয়ে গেছে?
আমাদের মনীষীরা আমাদের অর্ধসত্য ব’লে গেছে
অর্ধমিথ্যার? জীবন তবুও অবিস্মরণীয় সততাকে
চায়; তবু ভয়- হয়তো বা চাওয়ার দীনতা ছাড়া আর কিছু নেই।
ঢের ছবি দেখা হল- ঢের দিনে কেটে গেল-ঢের অভিজ্ঞতা
জীবলে জড়িত হয়ে গেল, তবু, নক্ষত্রের রাতের মতন
সফলতা মানুষের দূরবীনে র’য়ে গেছে,- জ্যোতির্গ্রন্থে;
জীবনের জন্যে আজো নেই।
অনেক মানুষী খেলা দেখা হলো, বই পড়া সাঙ্গ হলো-ত বু
কে বা কাকে জ্ঞান দেবে- জ্ঞান বড় দূর- দূরতর আজ।
সময়ের ব্যাপ্তি যেই জ্ঞান আনে আমাদের প্রাণে
তা তো নেই; স্থবিরতা আছে- জরা আছে।
চারিদিক থেকে ঘিরে কেবলি বিচিত্র ভয় ক্লান্তি অবসাদ
র’য়ে গেছে। নিজেকে কেবলি আত্মকীড় করি; নীড়
গড়ি। নীড় ভেঙে অন্ধকারে এই যৌথ মন্ত্রণার
মাল্যিন এড়ায়ে উৎক্রান্ত হতে ভয়
পাই। সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যশব্দ এসে
ভয়াবহ ডাইনীর মতো নাচে- ভয় পাই- গুহার লুকাই;
লীন হতে চাই- লীন- ব্রহ্মশব্দে লীন হয়ে যেতে
চাই। আমাদের দু’হাজার বছরের জ্ঞান এ-রকম।
নচিকেতা ধর্মধনে উপবাসী হয়ে গেলে যম
প্রীত হয়। তবুও ব্রহ্মে লীন হওয়াও কঠিন।
আমারা এখনও লুপ্ত হই নি তো।
এখনও পৃথিবী সূর্যে হয়ে রৌদ্রে অন্ধকারে
ঘুরে যায়। থামালেই ভালো হত- হয়তো বা;
তবুও সকলই উৎস গতি যদি,- রৌদ্রশুভ্র সিন্ধুর উৎসবে
পাখির প্রমাথা দীপ্তি সাগরের সূর্যের স্পর্শে মানুষের
হৃদয়ে প্রতীক ব’লে ধরা দেয় জ্যাতির পথের থেকে যদি,
তাহলে যে আলো অর্ঘ্য ইতিহাসে আছে, তবু উৎসাহ নিবেশ
যেই জনমানসের অনির্বচনীয় নিঃসঙ্কোচ
এখনও আসে নি তাকে বর্তমান অতীতের দিকচক্রবালে বার-বার
নেভাতে জ্বালাতে গিয়ে মনে হয় আজকের চেয়ে আরো দূর
অনাগত উত্তরণলোক ছাড়া মানুষের তরে
সেই প্রীতি, স্বর্গ নেই, গতি আছে;- তবু
গতির ব্যসন থেকে প্রগতি অনেক স্থিরতর;
সে অনেক প্রতারণাপ্রতিভার সেতুলোক পার
হল ব’লে স্থির;-হতে হবে ব’লে দীন, প্রমাণ কঠিন;
তবুও প্রেমিক- তাকে হতে হবে; সময় কোথাও
পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজন জেনে বিরচিত নয়; তবু
সে তার বহিমুর্খ চেতনার দান সব দিয়ে গেছে ব’লে
মনে হয়; এর পর আমাদের অন্তর্দীপ্ত হবার সময়।কাব্যগ্রন্থ - বেলা অবেলা কালবেলা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
-ওগো দরদিয়া,
তোমারে ভুলিবে সবে,- যাবে সবে তোমারে ত্যজিয়া;
ধরণীর পসরায় তোমারে পাবে না কেহ দিনান্তেও খুঁজে,
কে জানে রহিবে কোথা নিশিভোরে নেশাখোর আঁখি তব বুজে!
-হয়তো সিন্ধুর পারে শ্বেতশঙ্খ ঝিনুকের পাশে
তোমার কঙ্কালখানা শুয়ে রবে নিদ্রাহারা উর্মির নিশ্বাসে!
চেয়ে রবে নিষ্পলক অতি দূরে লহরীর পানে,
গীতিহারা প্রাণ তব হয়তো বা তৃপ্তি পাবে তরঙ্গের গানে!
হয়তো বা বনচ্ছায়া লতাগুল্ম পল্লবের তলে
ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীলশষ্পে শিশিরের দলে;
হয়তো বা প্রান্তরের পারে তুমি র’বে শুয়ে প্রতিধ্বনিহারা,-
তোমারে হেরিবে শুধু হিমানীর শীর্ণাকাশ,-নীহারিকা,-তারা,
তোমারে চিনিবে শুধু প্রেত- জ্যোৎস্না,-বধির জোনাকি!
তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি!
তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ-মৌন,-আলোহারা,
তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা!
কিংবা কেহ চিনিবে না,- হয়তো বা জানিবে না কেহ
কোথায় লুটায়ে আছে হেমন্তের দিবাশেষে ঘুমন্তের দেহ!
-হয়েছিল পরিচয় ধরণীর পান্তশালে যাহাদের সনে,
তোমার বিষাদহর্ষ গেঁথেছিলে একদিন যাহাদের মনে,
যাহাদের বাতায়নে একদিন গিয়েছিলে পথিক-অতিথি,
তোমারে ভুলিবে তারা,- ভুলে যাবে সব কথা,- সবটুকু স্মৃতি!
নাম তব মুছে যাবে মুসাফের,-অঙ্গারের পান্ডুলিপিখানি
নোনাধরা দেয়ালের বুক থেকে খ’সে যাবে কখন না জানি!
তোমার পানের পাত্রে নিঃশেষে শুকায়ে যাবে শেষের তলানি,
দন্ড দুই মাছিগুলো করে যাবে মিছে কানাকানি!
তারপর উড়ে যাবে দূরে দূরে জীবনের সুরার তল্লাসে,
মৃত এক অলি শুধু পড়ে রবে মাতালের বিছানার পাশে!
পেয়ালা উপুড় করে হয়তো বা রেখে যাবে কোনো একজন,
কোথা গেছে ইয়োসোফ্ জানে না সে,- জানে না সে গিয়েছে কখন।
জানে না যে,- অজানা সে,- আরবার দাবি নিয়ে আসিবে না ফিরে,-
জানে না যে চাপা পড়ে গেছে সে যে কবেকার কোথাকার ভিড়ে!
-জানিতে চাহে না কিছু,-ঘাড় নিচু ক’রে কে বা রাখে আঁখি বুজে
অতীত স্মৃতির ধ্যানে, অন্ধকার গৃহকোণে একখানা শূন্য পাত্র খুঁজে!
-যৌবনের কোন্ এক নিশীথে সে কবে
তুমি যে আসিয়াছিলে বনরাণী। জীবনের বাসন্তী-উৎসবে
তুমি যে ঢালিয়াছিলে ফাগরাগ,-আপনার হাতে মোর সুরাপাত্রখানি
তুমি যে ভরিয়াছিলে,-জুড়ায়েছে আজ তার ঝাঁঝ,- গেছে ফুরায়ে তলানি।
তবু তুমি আসিলে না,- বারেকের তরে দেখা দিলে নাকো হায়!
চুপে চুপে কবে আমি বসুধার বুক থেকে নিয়েছি বিদায়-
তুমি তাহা জানিলে না,-চলে গেছে মুসাফের,
কবে ফের দেখা হবে আহা
কে বা জানে! কবরের’ পরে তার পাতা ঝরে,-হাওয়া কাঁদে হা হা!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
হায় পাখি, একদিন কালীদহে ছিল না কি – দহের বাতাসে
আষাঢ়ের দু’পহরে কলরব কর নি কি এই বাংলায়!
আজ সারাদিন এই বাদলের কোলাহলে মেঘের ছায়ায়
চাঁদ সদাগর: তার মধুকর ডিঙাটির কথা মনে আসে,
কালীদহে কবে তারা পড়েছিলো একদিন ঝড়ের আকাশে,-
সেদিনো অসংখ্য পাখি উড়েছিলো না কি কালো বাতাসের গায়,
আজ সারাদিন এই বাদলের জলে ধলেশ্বরীর চরায়
গাংশালিখের ঝাঁক, মনে হয়, যেন সেই কালীদহে ভাসে;এই সব পাখিগুলো কিছুতেই আজিকার নয় যেন-নয়-
এ নদীও ধলেশ্বরী নয় যেন-এ আকাশ নয় আজিকার:
ফণীমনসার বনে মনসা রয়েছে নাকি? আছে; মনে হয়,
এ নদী কি কালীদহ নয়? আহা, ঐ ঘাটে এলানো খোঁপার
সনকার মুখ আমি দেখি না কি? বিষন্ন মলিন ক্লান- কি যে
সত্য সব; তোমার এ স্বপ্ন সত্য, মনসা বলিয়া গেল নিজে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিলো
সব চেয়ে আগে; জানি আমি।
সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই।
তুমি যে এ-পৃথিবীতে র’য়ে গেছো।
আমাকে বলেনি কেউ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
তোমরা স্বপ্নের হাতে ধরা দাও—আকাশের রৌদ্র ধুলো ধোঁয়া থেকে স’রে
এইখানে চ’লে এসো; পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন তোমাদের কথা
শুনিয়াছি—তোমাদের ম্লান-মুখ দেখিয়াছি—তোমাদের ক্লান্ত রক্তাক্ততা
দেখিয়াছি কত দিন—ব্যথিত ধানের মতো বুক থেকে পড়িতেছে ঝ’রে
তোমাদের আশা শান্তি, ম্লান মেঘে সোনালি চিলের মতো কলরব ক’রে
মিছে কেন ফেরো আহা—পৃথিবীর পথ থেকে হে বিষণ্ন, হে ক্লান্ত জনতা
তোমরা স্বপ্নের ঘরে চ’লে এসো—এখানে মুছিয়া যাবে হৃদয়ের ব্যথা
সন্ধ্যার বকের মতো চ’লে এসো ধূসর স্তনের মতো শান্ত পথ ধরে।চারিদিকে রাত্রিদিন কলরব ক’রে যায় দাঁড়কাক বাদুরের মতো
পৃথিবীর পথে ওই—সেখানে কি ক’রে তবে শান্তি পা’বে মানুষ বলো তো ?
এখানে গোধূলি নষ্ট হয় নাকো কোনোদিন;—কয়লার মতো রং—ম্লান
পশ্চিমের মেঘে ওই লেগে আছে চিরদিন; কড়ির মতন শাদা করুণ উঠান
প’ড়ে আছে চিরকাল; গোধূলি নদীর জলে রূপসীর মতো মুখখানা দেখে
ধীরে—ধীরে—আরো ধীরে শান্তি ঝরে, স্বপ্ন ঝরে আকাশের থেকে।।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
যেই সব শেয়ালেরা জন্ম- জন্ম শিকারের তরে,
দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে
নীরবে প্রবেশ করে,- বার হয়- চেয়ে দেখে বরফের রাশি
জ্যোৎস্নায় প’ড়ে আছে;- উঠিতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি
সেই সব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্মায়ঃ
তা’হলে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময়
জন্ম নিতো;- সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে
আমারও নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে
মাঠে মাঠে ফিরি একা: মনে হয় বাংলার জীবনে সঙ্কট
শেষ হয়ে গেছে আজ; — চেয়ে দেখ কতো শত শতাব্দীর বট
হাজার সবুজ পাতা লাল ফল বুকে লয়ে শাখার ব্যজনে
আকাঙ্খার গান গায় — অশ্বত্থেরও কি যেন কামনা জাগে মনে :
সতীর শীতল শব বহু দিন কোলে লয়ে যেন অকপট
উমার প্রেমের গল্প পেয়েছে সে, চন্দ্রশেখরের মতো তার জট
উজ্জ্বল হতেছে তাই সপ্তমীর চাঁদের আজ পুনরাগমনে;মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পাড়ে গৌরী বাংলার
এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি — রায়গুণাকর
আসিবে না — দেশবন্ধু আসিয়াছে ক্ষুরধার পদ্মায় এবার,
কালীগহে ক্লান্ত গাঙশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়,
আসিয়াছে চন্ডীদাস — রামপ্রসাদের শ্যামা সাথে সাথে তার;
শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা : মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের স্বর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সরাইখানার গোলমাল আসে কানে,
ঘরের শার্শি বাজে তাহাদের গানে,
পর্দা যে উড়ে যায়
তাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়!
-মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে!
আজো মন ওঠে রেঙে
দিলদারদের দরাজ গলায় রবে,
সরায়ের উৎসবে!
কোন্ কিশোরীর চুড়ির মতন হায়
পেয়ালা তাদের থেকে থেকে বেজে যায়
বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!
সারা জনমের শুষে-নেওয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!
পান্ডুর দু’টি ঠোঁটে
ডালিমফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে!
মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসি ভরা লাল গাল,
ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যত কিছু জঞ্জাল!
আখেরের ভয় ভুলে
দিলওয়ার প্রাণ খুলে
জীবন-রবাবে টানিছে ক্ষিপ্ত ছড়ি!
অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি,-
নিভিছে দিনের আলো,
-জীবন- মরণ দুয়ারে আমার, কারে যে বাসিব ভালো
একা একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন!
পূর্ণ হয় নি পিপাসী প্রাণের একটি আকিঞ্চন,
খুলেনি একটি দল,-
যৌবন- শতদলে মোর হায় ফোটে নাই পরিমল!
উৎসবলোভী অলি
আসে নি হেথায়,-
কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি!
-সারাটি জীবন বাতায়নখানি খুলে
তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন্ যায় দুলে
আশা-নিরাশার বালু-পারাবার বেয়ে,
সুদূর মরুদ্যানের পানেতে চেয়ে!
সুখ-দুঃখের দোদুল ঢেউঢের তালে
নেচেছে তাহারা,- মায়াবীর জাদুজালে
মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি,
মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি!
মস্তানা সেজে ভেঙে গেছ ঘর-দোর,
লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর!
কারার ধুলায় লুন্ঠিত হ’য়ে বান্দার মতো হায়
কেঁদেছে বুকের বেদুঈন মোর দুরাশার পিপাসায়!
জীবনপথের তাতার দস্যুগুলি
হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি
মোর গবাক্ষে কবে!
কন্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্তব্ধ নভে!
আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে,
সারাটি নিশীথ খুন- রোশনাই প্রদীপে মনটি রেঙে
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
পাই নি যে তাহা টের!
-দূর দিগন্তে- চ’লে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!
কোন্ সুদূরের তুরাণী প্রিয়ার তরে,
বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
দীর্ঘ দিবস ব’য়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা
চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের ‘রোজা’;
আমার গগনে ‘ঈদরাত’ কভু দেয় নি হায় দেখা,
পরানে কখনও জাগে নি ‘রোজা’র ঠেকা!
কী যে মিঠা এই সুখের দুখের ফেনিল জীবনখানা!
এই যে নিষেধ, এই যে বিধান,-আইন-কানুন, এই যে শাসন মানা,
ঘরদোর- ভাঙা তুমুল প্রলয়ধ্বনি
নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি
যুবানবীনের নটনর্তন তালে,
ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে দেশে কালে কালে,
এই যে তৃষ্ণা-দৈন্য-দুরাশা-জয়-সংগ্রাম-ভুল
সফেন সুরার ঝাঁঝের মতন ক’রে দেয় মজ্গুল
দিওয়ানা প্রাণের নেশা!
ভগবান,- ভগবান,- তুমি যুগ যুগ থেকে ধরেছ শুঁড়ির পেশা!
-লাখো জীবনের শূণ্য পেয়ালা ভরি দিয়া বারবার
জীবন-পান্থশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝঙ্কার,-
মাতালের চিৎকার !
অনাদি কালের থেকে;
মরণশিয়রে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে!
হেরিলাম দূরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ প্রায়
জীবনের নদী কলরোলে ব’য়ে যায়!
কোটি শুঁড় দিয়ে দুখের মরুভূ নিতেছে তাহারে শুষে,
ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রাণের খেয়াল-খুশে!
মরণ-সাহারা আসি
নিতে চায় তারে গ্রাসি।-
তবু সে হয় না হারা
ব্যথার রুধির-ধারা
জীবন-মদের পাত্র জুড়িয়া তার
যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গড়িছে মশালাদার!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
একবার নক্ষত্রের দিকে চাই — একবার প্রান্তরের দিকে
আমি অনিমিখে।
ধানের ক্ষেতের গন্ধ মুছে গেছে কবে
জীবনের থেকে যেন; প্রান্তরের মতন নীরবে
বিচ্ছিন্ন খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার;
নক্ষত্রেরা বাতি জ্বেলে জ্বেলে — জ্বেলে — ‘নিভে গেলে — নিভে গেলে?’
বলে তারে জাগায় আবার;জাগায় আবার।
বিক্ষত খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে — বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার,
ঘুম পায় তার।অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে এই সন্ধ্যার আকাশ — এই রাতের আকাশ;
এইখানে ফাল্গুনের ছায়া-মাখা ঘাসে শুয়ে আছি;
এখন মরণ ভালো — শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস;
অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।কে যেন উঠিল হেঁচে–হামিদের মরখুটে কানা ঘোড়া বুঝি!
সারা দিন গাড়ি টানা হল ঢের — ছুটি পেয়ে জ্যোৎস্নায় নিজ মনে
খেয়ে যায় ঘাস;
যেন কোনো ব্যথা নাই? পৃথিবীতে — আমি কেন তবে মৃত্যু খুঁজি?
‘কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?’ চাপা ঠোঁটে বলে দূর কৌতুকী আকাশ।ঝাউফুলে ঘাস ভরে — এখানে ঝাউয়ের নিচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;
কাশ আর চোরকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।
সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্ পথে কোন্ ঘরে যাব!
কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই — চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে
শান্তি আমি পাব?
রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্ পথে যাব?‘তোমারই নিজের ঘরে চলে যাও’ — বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে–
‘অথবা ঘাসের ’পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালোবেসে;
অথবা তাকায়ে দ্যাখো গরুর গাড়িটি ধীরে চ’লে যায় অন্ধকারে
সোনালি খড়ের বোঝা বুকে;
পিছে তার সাপের খোলস, নালা খলখল অন্ধকার — শান্তি তার
রয়েছে সমুখে;
চলে যায় চুপে চুপে সোনালি খড়ের বোঝা বুকে–
যদিও মরেছে ঢের গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, –তবু তার মৃত্যু নাই মুখে।’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে;
তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা — আমার তরুণ দিন
তখনো হয়নি শেষ- সেই ভালো — ঘুম আসে-বাংলার তৃণ
আমার বুকের নিচে চোখ বুজে-বাংলার আমের পাতাতে
কাঁচপোকা ঘুমায়েছে — আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সাথে,
ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে — এই ঘাসে — কথাভাষাহীন
আমার প্রাণের গল্প ধীরে-ধীরে যাবে-অনেক নবীন
নতুন উৎসব রবে উজানের-জীবনের মধুর আঘাতেতোমাদের ব্যস্ত মনে; — তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে
যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চলে যাবে — যখন মানিকমালা ভোরে
লাল-লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে–
যখন হলুদ বোঁটা শেফালি কোনো এক নরম শরতে
ঝরিয়ে ঘাসের পরে, — শালিখ খঞ্জনা আজ কতো দূরে ওড়ে–
কতোখানি রোদ-মেঘ — টের পাবে শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আঁধারে হিমের আকাশের তলে
এখন জ্যোতিষ্কে কেউ নেই।
সে কারা কাদের এসে বলেঃ
এখন গভীর পবিত্র অন্ধকার;
হে আকাশ, হে কালশিল্পী, তুমি আর
সূর্য জাগিয়ো না;
মহাবিশ্বকারুকার্য, শক্তি, উৎস, সাধঃ
মহনীয় আগুনের কি উচ্ছিত সোনা?
তবুও পৃথিবী থেকে-
আমরা সৃষ্টির থেকে নিভে যাই আজঃ
আমরা সূর্যের আলো পেয়ে
তরঙ্গ কম্পনে কালো নদী
আলো নদী হয়ে যেতে চেয়ে
তবুও নগরে যুদ্ধে বাজারে বন্দরে
জেনে গেছি কারা ধন্য,
কারা স্বর্ণ প্রাধান্যের সূত্রপাত করে।তাহাদের ইতিহাস-ধারা
ঢের আগে শুরু হয়েছিলো;
এখনি সমাপ্ত হতে পারে,
তবুও আলেয়াশিখা আজো জ্বালাতেছে
পুরাতন আলোর আঁধারে।আমাদের জানা ছিলো কিছু;
কিছু ধ্যান ছিলো;
আমাদের উৎস-চোখে স্বপ্নছটা প্রতিভার মতো
হয়তো-বা এসে পড়েছিলো;
আমাদের আশা সাধ প্রেম ছিলো;- নক্ষত্রপথের
অন্তঃশূন্যে অন্ধ হিম আছে জেনে নিরে
তবুও তো ব্রহ্মান্ডের অপরূপ অগ্নিশিল্প জাগে;
আমাদেরো গেছিলো জাগিয়ে
পৃথিবীতে;
আমরা জেগেছি-তবু জাগাতে পারি নি;
আলো ছিলো- প্রদীপের বেষ্টনী নেই;
কাজ ছিল- শুরু হলো না তো;
হাহলে দিনের সিঁড়ি কি প্রয়োজনের?
নিঃস্বত্ব সূর্যকে নিয়ে কার তবে লাভ!
সচ্ছল শাণিত নদী, তীরে তার সারস-দম্পতি
ঐ জল ক্লান্তিহীন উৎসানল অনুভব ক’রে ভালোবাসে;
তাদের চোখের রং অনন্ত আকৃতি পায় নীলাভ আকাশে;
দিনের সূর্যের বর্ণে রাতের নক্ষত্র মিশে যায়;
তবু তারা প্রণয়কে সময়কে চিনেছে কি আজো?
প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কে এসে চেনায়!
মারা মানুষ ঢের ক্ররতর অন্ধকূপ থেকে
অধিক আয়ত চোখে তবু ঐ অমৃতের বিশ্বকে দেখেছি;
শান্ত হয়ে স্তব্ধ হয়ে উদ্বেলিত হয়ে অনুভব ক’রে গেছি
প্রশান্তিই প্রাণরণনের সত্য শেষ কথা, তাই
চোখ বুজে নীরবে থেমেছি।
ফ্যাক্টরীর সিটি এসে ডাকে যদি,
ব্রেন কামানের শব্দ হয়,
লরিতে বোঝাই করা হিংস্র মানবিকী
অথবা অহিংস নিত্য মৃতদের ভিড়
উদ্দাম বৈভবে যদি রাজপথ ভেঙে চ’লে যায়,
ওরা যদি কালোবাজারের মোহে মাতে,
নারীমূল্যে অন্ন বিক্রি ক’রে,
মানুষের দাম যদি জল হয়, আহা,
বহমান ইতিহাস মরুকণিকার
পিপাসা মেটাতে
ওরা যদি আমাদের ডাক দিয়ে যায়-
ডাক দেবে, তবু তার আগে
আমরা ওদের হাতে রক্ত ভুল মৃত্যু হয়ে হারায়ে গিয়েছি?জানি ঢের কথা কাজ স্পর্শ ছিলো, তবু
নগরীর ঘন্টা-রোল যদি কেঁদে ওঠে,
বন্দরে কুয়াশা বাঁশি বাজে,
আমরা মৃত্যুর হিম ঘুম থেকে তবে
কী ক’রে আবার প্রাণকম্পনলোকের নীড়ে নভে
জ্বলন্ত তিমিরগুলো আমাদের রেণুসূর্যশিখা
বুখে নিয়ে হে উড্ডীন ভয়াবহ বিশ্বশিল্পলোক,
মরণে ঘুমোতে বাধা পাব?-
নবীন নবীন জঞ্জাতকের কল্লোলের ফেনশীর্ষে ভেসে
আর একবার এসে এখানে দাঁড়াব।
যা হয়েছে- যা হতেছে- এখন যা শুভ্র সূর্য হবে
সে বিরাট অগ্নিশিল্প কবে এসে আমাদের ক্রোড়ে ক’রে লবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
হেঁয়ালি রেখো না কিছু মনে;
হৃদয় রয়েছে ব’লে চাতকের মতন আবেগ
হৃদয়ের সত্য উজ্জ্বল কথা নয়,-
যদিও জেগেছে তাতে জলভারানত কোনো মেঘ;
হে প্রেমিক, আত্মরতিমদির কি তুমি?
মেঘ;মেঘ, হৃদয়ঃ হৃদয়, আর মরুভূমি শুধু মরুভূমিএই বিশ্বের এই শুধু আর্য সমাধান;
বাকি সব অনিয়ম, শূন্য, অন্ধকার;
নিখিলের পাশাপাশি দ্বিতীয় আধার
অন্য এক নিখিলের- অন্য এক নিখিলের তুমি;
মেঘঃ মেঘ,হৃদয়ঃ হৃদয়, আর মরুতৃণোজ্জ্বল মরুভূমি
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই- তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি
আজো এই পৃথিবীতে র'য়ে গেছি।
কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ;
বহুদিন থেকে শান্তি নেই।
নীড় নেই
পাখিরো মতন কোনো হৃদয়ের তর।
পাখি নেই।
মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে
ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল ব’লেআজ তার মানবকে কী ক’রে চানাতে পারে কেউ।
চারিদিকে অগণন মেশিন ও মেশিনের দেবতার কাছে
নিজেকে স্বাধীন ব’লে মনে ক’রে নিতে গিয়ে তবু
মানুষ এখনও বিশৃঙ্খল।
দিনের আলোর দিকে তাকালেয় দেখা যায় লোক
কেবলি আহত হ’য়ে মৃত হ’য়ে স্তব্ধ হয়;
এ ছাড়া নির্মল কোনো জননীতি নেই।
যে-মানুষ- যেই দেশে টিঁকে থাকে সে-ই
ব্যক্তি হয়- রাজ্য গড়ে- সাম্রাজ্যের মতো কোনো ভূমি
চায়। ব্যক্তির দাবিতে তাই সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে
তারই পিপাসায়
গ’ড়ে ওঠে।
এ ছাড়া অমল কোনো রাজনীতি পেতে হ’লে তবে
উজ্জ্বল সময়স্রোতে চ’লে যেতে হয়।
সেই স্রোত আজো এই শতাব্দীর তরে নয়।
সকলের তরে নয়।
পঙ্গপালের মতো মানুষেরা চরে;
ঝ’রে পড়ে।
এই সব দিনমান মৃত্যু আশা আলো গুনে নিতে
ব্যাপ্ত হ’তে হয়।
নবপ্রস্থানের দিকে হৃদয় চলেছে।
চোখ না এড়ায়ে তবু অকস্মাৎ কখনো ভোরের জনান্তিকে
চোখে থেকে যায়
আরো-এক আভাঃ
আমাদের এই পৃথিবীর এই ধৃষ্ট শতাব্দীর
হৃদয়ের নয়- তবু হৃদয়ের নিজের জিনিস
হ’য়ে তুমি র’য়ে গেছ।তোমার মাথাত চুলে কেবলই রাত্রের মতো চুল
তারকার অনটনে ব্যাপক বিপুল
রাতের মতন তার একটি নির্জন নক্ষত্রকে
ধ’রে আছে।
তোমার হৃদয়ে গায়ে আমাদের জনমানবিক
রাত্রি নেই। আমাদের প্রাণে এক তিল
বেশি রাত্রির মতো আমাদের মানব্জীবন
প্রাচারিত হ’য়ে গেছে ব’লে-
নারি,
সেই এক তিল কম।
আর্ত রাত্রি তুমি।
শুধু অন্তহীন ঢল, মানব-খচিত সাঁকো, শুধু অমানব নদীদের
অপর নারীর কন্ঠ তোমার নারীর দেহ ঘিরে;
অতএব তার সেই সপ্রতিভ অমেয় শরীরে
আমাদের আজকের পরিভাষা ছাড়া আরো নারী
আছে। আমাদের যুগের অতীত এক কাল
র’য়ে গেছে।
নিজের নুড়ির ’পরে সারাদিন নদী
সূর্যের- সুরের বীথি, তবু
নিমেষে উপল নেই- জলও কোন্ অতীতে মরেছে;
তবু নবীন নুড়ি- নতুন উজ্জ্বল জল নিয়ে আসে নদী;
জানি আমি জানি আদি নারী শরীরিণীকে স্মৃতির
(আজকে হেমন্ত ভোরে) সে কবের আঁধার অবধি;
সৃষ্টির ভীষণ অমা ক্ষমাহীনতায়
মানবের হৃদয়ের ভাঙা নীলিমায়
বকুলের বনে মনে অপার রক্তের ঢলে গ্লেশিয়ারে জলে
অসতী না হয় তবু স্মরণীয় অনন্ত উপলে
প্রিয়াকে পীড়ন ক’রে কোথায় নভের দিকে চলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে
আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি- খড়- নাড়া- মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল।
মেঠো চাঁদ- কাস্তের মত বাঁকা, চোখা-
চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কতো রাত- নাই লেখা-জোখা।
মেঠো চাঁদ বলেঃ
‘আকাশের তলে
খেতে-খেতে লাঙ্গলের ধার
মুছে গেছে- ফসল- কাটার
সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে!
শস্য ফলিয়া গেছে- তুমি কেন তবে
রয়েছো দাঁড়ায়ে
একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে
নড়-নাড়া- পোড়া জমি- মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল!’……
আমি তারে বলিঃ
‘ফসল গিয়াছে ঢের ফলি,
শস্য গিয়েছে ঝ’রে কতো-
বড়ো হ’য়ে গেছো তুমি এই বুড়ী পৃথিবীর মতো!
খেতে-খেতে লাঙ্গলের ধার
মুছে গেছে কতোবার- কতোবার ফসল-কাটার
সময় আসিয়া গেছে, চ’লে গেছে কবে!
শস্য ফলিয়া গেছে- তুমি কেন তবে
রয়েছো দাঁড়ায়ে
একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি- খড়-নাড়া-মাঠের ফাটল,
শিশিরের জল!’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
কোনো হ্রদে
কোথাও নদীর ঢেউয়ে
কোনো এক সমুদ্রের জলে
পরস্পরের সাথে দু'-দণ্ড জলের মতো মিশে
সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে
আমাদের জীবনের আলোড়ন-
হয়তো বা জোবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।
অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে
আমরা হেসেছি,
আমরা খেলেছি;
স্মরণীয় উত্তরাধিকারে কোনো গ্লানি নেই ভেবে
একদিন ভালোবেসে গেছি।
সেই সব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু
তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক।
হেমন্তের প্রান্তরে তারার আলোক।
সেই জের টেনে আজো খেলি।
সূর্যালোক নেই- তবু-
সূর্যালোক মনোরম মনে হ'লে হাসি।
স্বতই বিমর্ষ হ'য়ে ভদ্র সাধারণ
চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে
আরো বেশি কালো-কালো ছায়া
লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে
মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে
নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজের উঠে
নর্দমায় নেমে-
ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে
নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম'রে যাতে জানে।
এরা সব এই পথে;
ওরা সব ওই পথে- তবু
মধ্যবিত্তমদির জগতে
আমরা বেদনাহীন- অন্তহীন বেদনার পথে।
কিছু নেই- তবু এই জের টেনে খেলি;
সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ'লে হাসি;
জীবিত বা মৃত রমণীওর মতো ভেবে- অন্ধকারে-
মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।
তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ'য়ে
আমরা কি তিমিরবিলাসো?
আমরা তো তিমিরবিনাশী
হ'তে চাই।
আমরা তো তিমিরবিনাশী।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
এখন রজনীগন্ধা-প্রথম-নতুন-
একটি নক্ষত্র শুধু বিকেলের সমস্ত আকাশে;
অন্ধকার ভালো বলে শান্ত পৃথিবীর
আলো নিভে আসে।অনেক কাজের পরে এইখানে থেমে থাকা ভালো;
রজনীগন্ধার ফুলে মৌমাছির কাছে
কেউ নেই, কিছু নেই, তবু মুখোমুখি
এক আশাতীত ফুল আছে
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি- বিকেলের এই রঙ- রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম- ঢালু মাঠ- বিবর্ণ বাদামি পাখি- হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে-ঘাসে- কুড়ুনির মুখে তাই নাই কোনো কথা,ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে- জীবনেরে জেনেছে সে- কুয়াশায় খালি
তাই তার ঘুম পায়- খেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে- খেতের ভিতর
এখনি সে নেই যেন- ঝ'রে পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ণ সোনালিতুলিটুকু;- মুছে যায়;- কেউ ছবি আঁকিবে না মাঠে-মাঠে যেন তারপর,
আঁকিতে চায় না কেউ,- এখন অঘ্রাণ এসে পৃথিবীর ধরেছে হৃদয়;
একদিন নীল ডিম দেখিনি কি?- দুটো পাখি তাদের নীড়ের মৃদু খড়সেইখানে চুপে চুপে বিছায়েছে;- তবু নীড়- তবু ডিম,- ভালোবাসা
সাধ শেষ হয়
তারপর কেউ তাহা চায় নাকো- জীবনের অনেক দেয়- তবুও জীবন
আমাদের ছুটি দেয় তারপর- একখানা আধখানা লুকানো বিস্ময়অথবা বিস্ময় নয়- শুধু শান্তি- শুধু হিম কোথায় যে রয়েছে গোপন
অঘ্রাণ খুলেছে তারে- আমার মনের থেকে কুড়ায়ে করেছে আহরণ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আলো –অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে !
স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,-পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা – প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয় !
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো !তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর!- কোনো নিশয়তা
কে জানিতে পারে আর? – শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর?- প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই!- ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে ,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর’পরে ?
স্বপ্ন নয়,- শান্তি নয়,- কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!
পথে চ’লে পারে- পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে!
তবু সে চোখের চারিপাশে!
তবু সে বুকের চারিপাশে !
আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে !
আমি থামি,-
সে-ও থেমে যায় ;
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধাঁ ?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হয়ে,-
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে-জন্ম দেবে ব’লে
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি?- তাহাদের মন
আমার মনের মতো না কি ?-
তবু কেন এমন একাকী ?
তবু আমি এমন একাকী !
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল ?
বালটিতে টানিনি কি জল ?
কাস্তে হাতে কতবার যাইনি কি মাঠে ?
মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি ;
পুকুরের পানা শ্যালা- আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে ;
-এইসব স্বাদ ;
-এসব পেয়েছি আমি; - বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন ,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
একদিন;
এইসব সাধ
জানিয়াছি একদিন ,- অবাধ- অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে ;-
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে ,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে ,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছে মেয়েমানুষেরে ;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে ,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে ,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে- যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে ;
তবুও সাধনা ছিল একদিন ,-এই ভালোবাসা ;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি ; যে নক্ষত্র – নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি ;
তবু এই ভালোবাসা – ধুলো আর কাদা - ।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয় – প্রেম নয় – কোনো এক বোধ কাজ করে ।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি ,
বলি আমি এই হৃদয়েরে :
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয় !
অবসাদ নাই তার ? নাই তার শান্তির সময় ?
কোনোদিন ঘুমাবে না ? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি ? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!
এই বোধ – শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ – অগাধ !
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে ? – করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ ?
চোখে কালোশিরার অসুখ ,
কানে যেঁই বধিরতা আছে ,
যে কুজ – গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা – পচা চালকুমড়ার ছাঁচে ,
যে সব হৃদয় ফলিয়াছে
-সেই সব ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
সারাদিন একটি বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলি আমার দ্যাখা হয়;
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে
কোথায় কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হ'য়ে আছে দেখি;
কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচুড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,
সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে।
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তারে
তারপর অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতো লুফিয়ে আনলো সে,
সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল;
তবুও এ-জল কোথা থেকে এক নিমিষে এসে
কোথায় চ'লে যায়;
বুঝেছি আমি তোমাকে ভালোবেসে
রাত ফুরোলে পদ্মের পাতায়।আমার মনে অনেক জন্ম ধ'রে ছিলো ব্যথা
বুঝে তুমি এই জন্মে হয়েছো পদ্মপাতা;
হয়েছো তুমি রাতের শিশির-
শিশির ঝরার স্বর
সারাটি রাত পদ্মপাতার পর;
তবুও পদ্মপত্রে এ-জল আটকে রাখা দায়।নিত্য প্রেমের ইচ্ছা নিয়ে তবুও চঞ্চল
পদ্মপাতায় তোমার জলে মিশে গেলাম জল,
তোমার আলোয় আলো হলাম
তোমার গুণে গুণ;
অনন্তকাল স্থায়ী প্রেমের আশ্বাসে করুণ
জীবন ক্ষণস্থায়ী তবু হায়।এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল
পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল
আকাশ নীল, পৃথিবী এই মিঠে
রোদ ভেসেছে, ঢেঁকিতে পাড় পড়ে;
পদ্মপত্র জল নিয়ে তার- জল নিয়ে তার নড়ে;
পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
নিজেকে নিয়মে ক্ষয় ক’রে ফেলে রোজই
চ’লেছে সময়;
তবুও স্থিরতা এক র’য়ে গেছে,
সময় ক্ষয়ের মতো নয়।
অঘ্রাণের সকালের আব্ছা আভার
মতন অসংখ্য কুয়াশায়,
আশ্বিনে আকাশ রোদ মাঠের ভিতরে,
নদীর বিস্তীর্ণ জলে, অথবা ঝড়ের বড় ভোরে,
শীতকালে সুস্থির বিকেলে,
মনে হয় আজ
পৃথিবী অনেক মূল্য, সত্য ভুলে গেছে;
সত্যে স্থির হয়ে আছে টের পাই তবুঃ
তোমার আমার নীড় প্রকৃতির পর্দার থেকে ভেসে চোখে
একটি অমেয় মূল্যে যতদিন আলো ক্ষয় হতেছে আলোকে।কাব্যগ্রন্থ - আলোপৃথিবী
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,-
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা,- আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ,- আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন,
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,-স্বপ্নে-কত দিন!
মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে-
তখন শুকনবধূ যেতেছিল শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে!
মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তচাঁদ দিয়েছিল উঁকি,
সে কোন্ বালিকা একা অন্তঃপুরে এল অধোমুখী!
পাথারের পারে মোর প্রাসাদের আঙিনার’ পরে
দাঁড়াল সে,- বাসররাত্রির বধূ,-মোর তরে, যেন মোর তরে!
তখন নিভিয়া গেছে মণিদীপ,-চাঁদ শুধু খেলে লুকোচুরি,-
ঘুমের শিয়রে শুধু ফুটিতেছে-ঝরিতেছে ফুলঝুরি,- স্বপনের কুঁড়ি!
অলস আঢুল হাওয়া জানালায় থেকে থেকে ফুঁপায় উদাসী!
কাতর নয়ন কার হাহাকারে চাঁদিনীতে জাগে গো উপাসী!
কিঙ্খাব -গালিচাখাটে রাজবধূ-ঝিয়ারীর বেশে
কভু সে দেয় নি দেখা,- মোর তোরণের তলে দাঁড়াল সে এসে!
দাঁড়াল সে হেঁটমুখে,- চোখ তার ভ’রে গেছে নীল অশ্রুজলে!
মীনকুমারীর মতো কোন দূর সিন্ধুর অতলে
ঘুরেছে সে মোর লাগি!-উড়েছে সে অসীমের সীমা!
অশ্রুর অঙ্গারে তার নিটোল ননীর গলা,- নরম লালিমা
জ্বলে গেছে,-নগ্ন হাত,- নাই শাখা,- হারায়েছে রুলি,
এলোমেলো কালো চুলে খ’সে গেছে খোঁপা তার,- বেণী গেছে খুলি!
সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ,
ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,-হিম স্তন,- হিম রোমকূপ!
আমি দেখিয়াছি তারে, ক্ষুধিত প্রেতের মতো চুমিয়াছি আমি
তারই পেয়ালায় হায়!- পৃথিবীর উষা ছেড়ে আসিয়াছি নামি
কান্তারে;- ঘুমের ভিড়ে বাঁধিয়াছি দেউলিয়া বাউলের ঘর,
আমি দেখিয়াছি ছায়া, শুনিয়াছি একাকিনী কুহকীর স্বর!
বুকে মোর, কোলে মোর- কঙ্কালের কাঁকালের চুমা!
-গঙ্গার তরঙ্গ কানে গায়,- ঘুমা,- ঘুমা!
ডাকিয়া কহিল মোর রাজার দুলাল-
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার,- রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন;
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে,- স্বপ্নে-কত দিন!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড়
কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে
জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলা রঙের আলোয়
জ্বলে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে।
যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে-
মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে
কোথায় আছে জানি না তোঃ
কোথায় সমাজ, অর্থনীতি?- স্বর্গগামী সিঁড়ি
ভেঙ্গে গিয়ে পায়ের নিচে রক্তনদীর মতো
মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী
হয়ে কি আজ চারি দিকে গণনাহীন ধূসর দেয়ালে
ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল করে’?
পুরাণপুরুষ, গনমানুষ, নারীপুরুষ,্মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব
অর্থবিহীন হয়ে গেলে-তবুও আরেক নবীনতর ভোরে
সার্থকতা পাওয়া যাবে, ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হয়ে
পথে পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে
তবুও কেবল দ্বীপ বানালো যে যার অবক্ষয়ের জলে।
প্রাচীন কথা নতুন করে’ এই পৃথিবীর বোন-ভায়ে
ভাবছে একাএকা বসে’
যুদ্ধ রক্ত রিরংসা ভয় কলরোলের ফাঁকেঃ
আমাদের এই আকাশ সাগর আধাঁর আলোয় আজ
যে দৌড় কঠিন; নেই মনে হয়- সে দ্বার খুলে দিয়ে যেতে হবে
আবার আলোয়, অসাড় আলোর ব্যাসন ছাড়িয়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থাকে আমাদের আয়ু
এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান।
হৃদয়কে চোখঠার দিয়ে ঘুমে রেখে
হয়তো দুর্যোগে তৃপ্তি পেতে পারে কান;
এ রকম একদিন মনে হয়েছিলো;
অনেক নিকটে তবু সেই ঘোর ঘনায়েছে আজ;
আমাদের উঁচু-নিচু দেয়ালের ভিতরে খোড়লে
ততোধিক গুনাগার আপনার কাজ
ক'রে যায়;- ঘরের ভিতর থেকে খ'সে গিয়ে সন্তুতির মন
বিভীষণ, নৃসিংহের আবেদন পরিপাক ক'রে
ভোরের ভিতর থেকে বিকেলের দিকে চ'লে যায়,
রাতকে উপেক্ষা ক'রে পুনরায় ভোরে
ভিরে আসে;- তবুও তাদের কোনো বাসস্থান নেই,
যদিও বিশ্বাসে চোখ বুজে ঘর করেছি নির্মাণ
ঢের আগে একদিন;- গ্রাসাচ্ছাদন নেই তবুও তাদের,
যদিও মাটির দিকে মুখ রেখে পৃথিবীর ধান
রুয়ে গেছি একদিন;- অন্যসব জিনিস হারায়ে,
সমস্ত চিন্তার দেশ ঘুরে তবু তাহাদের মন
আলোকসামন্য ভাবে সুচিন্তাকে অধিকার ক'রে
কোথাও সম্মুখে পথ, পশ্চাদ্গমন
হারায়েছে- উতরোল নিরবতা আমাদের ঘরে।
আমরা তো বহুদিন লক্ষ্য চেয়ে নগরীর পথে
হেঁটে গেছি;- কাজ ক'রে চ'লে গেছি অর্থভোগ করে;
ভোট দিয়ে মিশে গেছি জনমতামতে।
গ্রন্থকে বিশ্বাস ক'রে প'ড়ে গেছি;
সহধর্মীদের সাথে জীবনের আখড়াই, সাক্ষরের অক্ষরের কথা
মনে ক'রে নিয়ে ঢের পাপ ক'রে, পাপকথা উচ্চারণ ক'রে,
তবুও বিশ্বাসভ্রষ্ট হ'য়ে গয়ে জীবনের যৌন একাগ্রতা
হারাইনি; তবুও কোথাও কোনো প্রীতি নেই এতদিন পরে।
নগরীর রাজপথে মোড়ে-মোড়ে চিহ্ন প'ড়ে আছে;
একটি মৃতের দেহ অপরের শবকে জড়ায়ে
তবুও আতঙ্কে হিম- হয়তো দ্বিতীয় কোনো মরণের কাছে।
আমাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, নারী, হেমন্তের হলুদ ফসল
ইতস্তত চ'লে যায় যে যাহার স্বর্গের সন্ধানে;
কারু মুখে তবুও দ্বিরুক্তি নেই- পথ নেই ব'লে,
যথাস্থান থেকে খ'সে তবুও সকলি যথাস্থানে
র'য়ে যায়;- শতাব্দীর শেষ হ'লে এ-রকম আবিষ্ট নিয়ম
নেমে আসে;- বিকেলের বারান্দার থেকে সব জীর্ণ নরনারী
চেয়ে আছে পড়ন্ত রোদের পারে সূর্যের দিকেঃ
খণ্ডহীন মণ্ডলের মতো বেলোয়ারি।২নিকটে মরুর মতো মহাদেশ ছড়ায়ে রয়েছেঃ
যতদূর চোখ যায়- অনুভব করি;
তবু তাকে সমুদ্রের তিতীর্ষু আলোর মতো মনে ক'রে নিয়ে
আমাদের জানালায় অনেক মানুষ,
চেয়ে আছে দিনমান হেঁয়ালির দিকে।
তাদের মুখের পানে চেয়ে মনে হয়
হয়তো বা সমুদ্রের সুর শোনে তারা,
ভীত মুখশ্রীর সাথে এ-রকম অনন্য বিস্ময়
মিশে আছে;- তাহারা অনেক কাল আমাদের দেশে
ঘুরে-ফিরে বেড়িয়েছে শারীরিক জিনিসের মতো;
পুরুষের পরাজয় দেখে গেছে বাস্তব দৈবের সাথে রণে;
হয়তো বস্তুর বল জিতে গেছে প্রজ্ঞাবশত;
হয়তো বা দৈবের অজেয় ক্ষমতা-
নিজের ক্ষমতা তার এত বেশি ব'লে
শুনে গেছে ঢের দিন আমাদের মুখের ভণিতা;
তবুও বক্তৃতা শেষ হ'য়ে যায় বেশি করতালি শুরু হ'লে।
এরা তাহা জানে সব।
আমাদের অন্ধকারে পরিত্যক্ত ক্ষেতের ফসল
ঝাড়ে-গোছে অপরূপ হ'য়ে ওঠে তবু
বিচিত্র ছবির মায়াবল।
ঢের দূরে নগরীর নাভির ভিতরে আজ ভোরে
যাহারা কিছুই সৃষ্টি করে নাই তাহাদের অবিকার মন
শৃঙ্খলায় জেগে উঠে কাজ করে,- রাত্রে ঘুমায়
পরিচিত স্মৃতির মতন।
সেই থেকে কলরব, কাড়াকাড়ি, অপমৃত্যু, ভ্রাতৃবিরোধ,
অন্ধকার সংসার, ব্যাজস্তুতি, ভয়, নিরাশার জন্ম হয়।
সমুদ্রের পরপার থেকে তাই স্মিতচক্ষু নাবিকেরা আসে;
ঈশ্বরের চেয়ে স্পর্শময়
আক্ষেপে প্রস্তুত হ'য়ে অর্ধনারীশ্বর
তরাইয়ের থেকে লুব্ধ বঙ্গোপসাগরে
সুকুমার ছায়া ফেলে সূর্যিমামার
নাবিকের লিবিডোকে উদ্বোধিত করে।৩ঘাসের উপর দিয়ে ভেসে যায় সবুজ বাতাস।
অথবা সবুজ বুঝি ঘাস।
অথবা নদীর নাম মনে ল'রে নিতে গেলে চারদিকে প্রতিভাত হ'য়ে উঠে নদী
দেখা দেয় বিকেল অবধি;
অসংখ্য সূর্যের চোখে তরঙ্গের আনন্দে গড়ায়ে
ডাইনে আর বাঁয়ে
চেয়ে দ্যাখে মানুষের দুঃখ, ক্লান্তি, দীপ্তি, অধঃপতনের সীমা;
ঊনিশশো বেয়াল্লিশ সালে ঠেকে পুনরায় নতুন গরিমা
পেতে চায় ধোঁইয়া, রক্ত, অন্ধ আঁধারের খাত বেয়ে;
ঘাসের চেয়েও বেশী মেয়ে;
নদীর চেয়েও বেশি ঊনিশশো তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ উৎক্রান্ত পুরুষের হাল;
কামানের ঊর্ধ্বে রৌদ্রে নীলাকাশে অমল মরাল
ভারতসাগর ছেড়ে উড়ে যায় অন্য এক সমুদ্রের পানে-
মেঘের ফোঁটার মতো স্বচ্ছ, গড়ানে;
সুবাতাস কেটে রাতা পালকের পাখি তবু;
ওরা এলে সহসা রোদের পথে অনন্ত পারুলে
ইস্পাতের সূচীমুখ ফুটে ওঠে ওদের কাঁধের 'পরে, নীলিমার তলে;
অবশেষে জাগরূক জনসাধারণ আজ চলে?
রিরাংসা, অন্যায়, রক্ত, উৎকোচ, কানাঘুষো, ভয়
চেয়েছে ভাবের ঘরে চুরি বিনে জ্ঞান ও প্রণয়?
মহাসাগরের জল কখমো কি সৎবিজ্ঞতার মতো হয়েছিলো স্থির-
নিজের জলের ফেনশির
নীড়কে কি চিনেছিলো তনুবাত নীলিমার নীচে?
না হ'লে উচ্ছল সিন্ধু মিছে?
তবুও মিথ্যা নয়ঃ সাগরের বালি পাতালের কালি ঠেলে
সময়সুখ্যাত গুণে অন্ধ হ'য়ে, পরে আলোকিত হ'য়ে গেলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার ; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপ দাঁড়ায়েছে চাঁদ – কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত- রাত্রিটিরে ভালো ,
খড়ের চালের’পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার ;
পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ ;- অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো !
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ ,- মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে – ডালে ডাকিয়াছে বক ;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক;
আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের’পরে হাত,
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ , মাছরাঙা , নক্ষত্র , আকাশ
আমরা পেয়েছি যারা ঘুরে-ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারো-মাস;
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু’বেলা
নির্জন মাছের চোখে;- পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ – মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;
মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে বার-বার তরীটিরে মাখে ,
খড়ের চালের ছায়া গাড় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে ;
বাতাসে ঝিঁঝিঁর গন্ধ- বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাড় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে ;
আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল
প’ড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে ;
যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর’পরে ;
আমরা দেখেছি যারা শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ ,
প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;
আমরা বুঝেছি যারা বহু দিন মাস ঋতু শেষ হলে পর
পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
ক’য়ে গেছে ;- আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো এক আলো আছে :দেহে তার বিকেলবেলার ধূসরতা ;
চোখের –দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির :
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর ;
আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর ? জানি না কি আহা,
সব রঙ কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ ;- একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল – সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়;- যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে ।
কি বুঝিতে চাই আর ? ... রৌদ্র নিভে গেলে পাখি – পাখালির ডাক
শুনিনি কি ? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ও. কে.একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিলো;
একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে;
একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিলো;
তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিলো দশজন মূর্থের বিক্ষোভে।বুকের উপরে হাত রেখে দিয়ে তা’রা
নিজেদের কাজ ক’রে গিয়েছিলো সব।অবশেষে তা’রা আজ মাটির ভিতরে
অপরের নিয়মে নীরব।মাটির আহ্নিক গতি সে-নিয়ম নয়;
সূর্য তার স্বাভাবিক চোখে
সে-নিয়ম নয়— কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়;
সব দিক ও. কে.।সাবলীলআকাশে সূৰ্যের আলো থাকুক না— তবু—
দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে।
আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই।
মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে।মাঝে-মাঝে পুরুষাৰ্থ উত্তেজিত হ’লে—
(এ রকম উত্তেজিত হয়;)
উপস্থাপয়িতার মতন
অামাদের চায়ের সময়এসে প’ড়ে আমাদের স্থির হ’তে বলে।
সকলেই স্নিগ্ধ হ’য়ে আত্মকর্মক্ষম;
এক পৃথিবীর দ্বেষ হিংসা কেটে ফেলে
চেয়ে দ্যাখে স্তূপাকারে কেটেছে রেশম।এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে
পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল:
প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়—
অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল।মানুষ সর্বদা যদিমানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিতো—
(স্বর্গে পৌঁছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিলো ভুলে),
অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিতো,
পরচুলা এঁটে নিতো স্বাভাবিক চুলে,
সর্বদা এ-সব কাজ ক’রে যেত যদি
যেমন সে প্রায়শই করে,
পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হ’তো, আহা,
অথবা মুখোশ খুলে খুশি হ’তো কে নিজের মুখের রগড়ে।চার্বাক প্রভৃতি—‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়,
মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন
একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব
বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের
কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়।
তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে
মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল,
চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর;
অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা—
অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর।সমুদ্রতীরেপৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে
জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব
বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে
মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব।এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের অালোর পথে এসে
জুহুর সমুদ্রপারে, অগণন ঘোড়া ও ঘেসেড়াদের ভিড়ে।
এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে;
তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে। (মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ)
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
দুর্গের গৌরবে ব'সে প্রাংশু আত্মা ভাবিতেছে টের পূর্বপুরুষের কথাঃ
যারা তারে জঙ্ঘা দিল,- তবু আজ তরবার পরিত্যাগ করার ক্ষমতা
যারা দিল;- প্রাচীন পাথর তারা এনেছিল পর্বতের থেকে
স্থির কিছু গড়িবার প্রয়োজনে; তারপর ধূসর কাপড়ে মুখ ঢেকে
চ'লে গেছে;- পিছন পেঁচা যা ওড়ে জ্যোৎস্নায়- সেইখানে তাদের মমতাঘুরিতেছে- ঘুরিতেছে- শত্রু মঙ্গলের মত;- আমার এ শাদা শাটিনের
শেমিজও পেতেছে সেই মনস্বিনী শৃঙ্খলাকে টের।
এই দুর্গ আজো তাই- ক্রিয়াবান সপ্তমীর চাঁদের শিঙের নিচে হিম
লোল- বক্র- নিরুত্তর;- আজই রাতে আমার মৃত্যুর পর নতুন রক্তিম
সূর্য এসে প্রয়োজন মেগে নেবে এইখানে লোকশ্রুত ভূমিকম্পের।পূর্যসূরীদের ইচ্ছা অনুশাসনের মত করিতেছে কাজ।
প্রাচীন লেখের থেকে অন্ধকারে বিক্ষুব্ধ সমাজ
করতালি দিয়ে হাসে; দূরবীনে দেখা যায় যাই সব জ্যোতির্ময় কণা
অনন্ত মোমের তেজ নিয়ে নাচে,- সেই সব উচ্চতর রসিক দ্যোতনা
মৃত্যুকে বামনের করতলে হরিতকী অন্তত ক'রে দিক আজ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আঁধারে শিশির ঝরে
ঘুমোনো মাঠের পানে চেয়ে চেয়ে চোখ দুটো ঘুমে ভরে
আজিকে বাতাসে ভাসিয়া আসিছে হলুদ পাতার ঘ্রাণ
কাশের গুচ্ছ ঝ’রে পড়ে হায়
খ’সে প’ড়ে যায় ধান
বিদায় জানাই-গেয়ে যাই আমি ঝরা ফসলের গান,-
নিভায়ে ফেলিও দেয়ালি আমার খেয়ালের খেলাঘরে!ওগো পাখি, ওগো নদী,
এতোকাল ধরে দেখেছ আমারে- মোরে চিনে থাকো যদি,
আমারে হারায়ে তোমাদের বুকে ব্যথা যদি জাগে ভাই,-
যেন আমি এক দুখ-জাগানিয়া, -বেদনা জাগাতে চাই!
পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই
গেয়ে যাই আমি,- মরণেরে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।।ঝরা ফসলের ভাষা
কে শুনিবে হায়!- হিমের হাওয়ায় বিজন গাঁয়ের চাষা
হয়তো তাহার সুরটুকু বুকে গেঁথে ফিরে যায় ঘরে
হয়তো সাঁঝের সোনার বরণ গোপন মেঘের তরে
সুরটুকু তার রেখে যায় সব,-বুকখানা তবু ভরে
ঘুমের নেশায়,-চোখে চুমো খায় স্বপনের ভালোবাসা!ওগো নদী, ওগো পাখি,
আমি চলে গেলে আমারে আবার ফিরিয়া ডাকিবে নাকি!
আমারে হারায়ে তোমাদের বুকে ব্যথা যদি জাগে ভাই,-
জেনো আমি এক দুখ-জাগানিয়া, -বেদনা জাগাতে চাই;
পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই,
গেয়ে যাই আমি, – গাহিতে গাহিতে ঘুমে বুজে আসে আঁখি
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.