poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
এই পৃথিবীর বুকের ভিতরে কোথাও শান্তি আছে;
অঘ্রাণ মাস রাত্রি হ’লে অনেক বিষয়াবিষের সমাধান
মাঠে জলে পাখির নীড়ে নক্ষত্রেতে থাকে;
অমেয় গোলকধাঁধাঁয় ঘুরে প্রাণ
চেষ্টা করে সমাজ জাতি সময় সৃষ্টি সঠিক বুঝে নিতে।
সকল প্রয়াণ সফল হবে গ্লাশিয়ারের দীপ্তি আসার আগে;
এখন রৌদ্রে আজন্মকাল অনুষ্ঠানের দিন;
সফল হতে ইতিহাসের অনেক দিন লাগে।
সে সফলতা এই পৃথিবী- হয়তো সৃশঠি চূর্ণ হ’লে হবে;
আমি অনেক দূরের থেকে তাহার কারণধ্বনি
নদীর জলে সমস্ত দিন ক্রন্দসী উজ্জ্বল;
তোমায় আমি ভালোবাসি- এই সত্য স্বভাবপৃথিবীর
দানের মতন নিজেরই ফলাফল।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
ভোর;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:
চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে :
পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো;
কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তা
আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল
হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি-
তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনো।
হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালিরা
সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে-
মোরগফুলের মতো লাল আগুন
শুকনো অশ্বত্থ পাতা দুমড়ে এখনো আগুন জ্বলছে তাদের;
সূর্যের আলোয় তার রঙ কুঙ্কুমের মতো নেই আর;
হয়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো।
সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ
ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে।
ভোর;
সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে
নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে
অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে
সুন্দর বাদামি হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল।
এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে;
কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধী ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে;
নদীর তীক্ষ্ম শীতল ঢেউয়ে সে নামল-
ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য
অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো
একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য,
এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে উঠে
সাহসে সাথে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হারিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।
একটা অদ্ভূত শব্দ।
নদীর জল মচকাফুলের মতো লাল।
আগুন জ্বলল আবার – উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এল।
নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরনো শিশিরভেজা গল্প;
সিগারেটের ধোঁয়া;
টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা;
এলোমেলো কয়েকটা বন্দুক – হিম – নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সর্বদাই এরকম নয়, তবু
মাঝে মাঝে মনে হয় কোন দূর উত্তরসাগরে কোনো ঢেউ
নেই;
তুমি আর আমি ছাড়া কেউ
সেখানে ঢোকার পথ হারিয়ে ফেলেছেনেই
নীলকণ্ঠ পাখিদের ডানা গুঞ্জরণ
ভালোবেসে আমাদের পৃথিবীর এই রৌদ্র;
কলকাতার আকাশে চৈত্রের ভোরে যেই
নীলিমা হঠাৎ এসে দেখা দেয় মিলাবার আগে
এইখানে সে আকাশ নেই;
রাতে নক্ষত্রেরা সে রকম আলোর গুঁড়ির মতো অন্ধকার অন্তহীন নয়।তবুও আকাশ আছেঃ
অনেক দূরের থেকে নির্নিমেষ হয়ে
নক্ষত্র দু’-একজন চেয়ে থাকে
চেয়ে থাকে আমাদের দিকে-
যেন টের পায়পৃথিবীর কাছে আমাদের সব কথা -সব কথা বলা
ডাভেন্ট্রিডোমেই টাসে স্টেফানিতে
যুদ্ধ শান্তি বিরতি নিয়তির ফাঁদে চিরদিন
বেধে গিয়ে ব্যহত রণনে
শব্দের অপরিমেয় অচল বালির
মরুভূমি সৃষ্টি করে গেছে;
-কোনো কথা কোনো গানকাউকেই বলে নাই;
কোন গান
পাখিরাও গায় নাই।তাই
এই পাখিহীন নীলিমাবিহীন শাদা স্তব্ধতার দেশে
তুমি আর আমি দুই বিভিন্ন রাত্রির দিক থেকে
যাত্রা করে উত্তরের সাগরের দীপ্তির ভিতরে
এখন মিশেছিএখন বাতাসে শব্দ নেই-তবু
শুধু বাতাসের শব্দ হয়
বাতাসের মত সময়ের
কোনো রৌদ্র নেই, তবু আছে
কোনো পাখি নেই, তবু রৌদ্রে সারাদিন
হংসের আলোর কণ্ঠ র’য়ে গেছে;
কোন রাণী নেই-তবু হংসীর আশার কণ্ঠ
এইখানে সাগরের রৌদ্রে সারা দিন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
যেখানে রয়েছে আলো পাহাড় জলের সমবায়-
তবুও সেখানে যদি আবিষ্কার করি প্যারাফিন
অনেক মাটির নীচে,- অথবা সেখানে যদি সংগ্রাম-বিলীন
অজস্র অস্পষ্ট মুণ্ড অনুকম্পা হৃদয়ে জাগায়,
তাহ'লে প্রভাত এলে মনিয়া পাখিরা পিছে কি করে' বালক
ভেসে যাবে উজ্জ্বল জলবিম্বের মত হেসে?
কি ক'রে বা নাগরিক নিজের নারীকে ভালোবেসে
জেনে নেবে হেমন্তের সন্ধ্যার আলোকে
গ্যাস আর নক্ষত্রের লিপ্সা থেকে জেগে
যারা চায় তাহাদের কাছে তবু স্মিত সমন্বয়?
মৃথেদ উপেক্ষিত পীত দেহ- বলো,- ক্ষমাময়।
বৃত্তের মতন- এসো,- ঘুরি মোরা বঙ্কিম আবেগে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত ধীরে
আমাদের দু’জনকে নিতে চায় সেই শব্দহীন মাটি ঘাসে
সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনোদিন সেদিকে যাবে না
তবুও পায়ের চিহ্ন সেদিকেই চলে যায় কি গভীর সহজ অভ্যাসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
দুপুররাতে ও কার আওয়াজ!
গান কে গাহে,- গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে,- গান না!
শার্শি ঘরের উঠছে বেজে,
উঠছে কেঁপে পর্দা!
বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে
জল-ডাহুরের বুকের কাছে;
এ কোন্ বাঁশি শার্শি বাজায়
এ কোন হাওয়া ফর্দা
দেয় কাঁপিয়ে পর্দা!
নূপুর কাহার বাজল রে ঐ!
কাঁকন কাহার কাঁদল!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে;
ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া
মায়ার মিলন ফাঁদল!
কাঁকন যে তার কাঁদল!
খসখসাল শাড়ি কাহার!
উস্খুসাল চুল গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে:
জুল্পি কাহার উঠল দুলে!
-দুলল কাহার দুল গো!
উস্খুসাল চুল গো!
আজকে রাতে কে ঐ এল
কালের সাগর সাতরি !
জীবন-ভোরের সঙ্গিনী সেই,-
মাঠে ঘাটে আজকে সে নেই !
কোন তিয়াশায় এল রে হায়
মরণপারের যাত্রী !
-কালের সাগর সাতরি !
কাঁদছে পাখি পউষনিশির
তেপান্তরের বক্ষে!
ওর বিধবা বুকের মাঝে
যেন গো কার কাঁদন বাজে!
ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে,
নিদ্ নাহি মোর চক্ষে!
তেপান্তরের বক্ষে!
এল আমার ছায়া-প্রিয়া,
কিশোরবেলার সই গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে;
মনের মধু-মনোরমা,-
কই গো সে মোর- কই গো!
কিশোরবেলার সই গো!
ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে!
গান কে গাহে, গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
বনের ছায়ায়,-মাঠের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে,-গান না!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
স্বদেশমূলক
|
ছেলে: আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
ব’সে থাকি; বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;
আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোনো পথে এ কন্যারে দেখিনিকো-দেখি নাই অত
অজস্রচুলের চুমা হিজলে, কাঁঠালে , জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে।
মেয়ে: পৃথিবীর কোনো পথে: নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
কিশোরের পায়ের- দলা মুথাঘাস, – লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা- এরই মাঝে বাংলার প্রাণ ।
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।
ছেলে: আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি, /সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।
মেয়ে: ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দুর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস-
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত ।
ছেলে: রাতের বাতাস আসে
আকাশের নক্ষত্রগুলো জ্বলন্ত হয়ে ওঠে
যেন কারে ভালোবেসেছিলাম-
সমস্ত শরীর আকাশ রাত্রি নক্ষত্র-উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাই
আমি টের পাই সেই নগ্ন হাতের গন্ধের
সেই মহানুভব অনিঃশেষ আগুনের
রাতের বাতাসে শিখানীলাভ এই মানবহৃদয়ের
সেই অপর মানবীকে।
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল:
মেয়ে: তোমারে চাই :
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে- খুঁজেছি তোমারে সেইখানে-
ছেলে: নতুন সৌন্দর্য এক দেখিয়াছি- সকল অতীত
ঝেড়ে ফেলে- নতুন বসন্ত এক এসেছে জীবনে ;
শালিখেরা কাঁপিতেছে মাঠে মাঠে- সেইখানে শীত
শীত শুধু- তবুও আমার বুকে হৃদয়ের বনে
কখন অঘ্রান রাত শেষ হ’ল- পৌষ গেল চ’লে
যাহারে পাইনি রোমে বেবিলনে, সে এসেছে ব’লে।
মেয়ে: তুমি এই রাতের বাতাস ,বাতাসের সিন্ধু-ঢেউ
তোমার মতন কেউ নাই আর।
অন্ধকার নিঃসাড়তার মাঝখানে
তুমি আনো প্রাণে .সমুদ্রের ভাষা,
ব্যথিত জলের মতন,
রাতের বাতাস তুমি,- বাতাসের সিন্ধু- ঢেউ,
তোমার মতন কেউ নাই আর।
ছেলে: তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব-
শ্যামলী, করেছি অনুভব।
তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।
ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো
আমাদের নিয়ে যায় ডেকে
তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।
মেয়ে: আমরা কিছু চেয়েছিলাম প্রিয়;
নক্ষত্র মেঘ আশা আলোর ঘরে
ঐ পৃথিবীর সূর্যসাগরে, ভেবেছিলাম,
পেয়ে যাবে প্রেমের স্পষ্ট গতি
সত্য সূর্যালোকের মতন;-
ছেলে: সবার ওপর তোমার আকাশপ্রতিম মুখে রয়েছে
সফল সকালের রৌদ্র।
সৃষ্টি ও সমাজের বিকেলের অন্ধকারের ভিতর
সকালবেলার প্রথম সূর্য-শিশিরের মতো সেই মুখ ;
জানে না কোথায় ছায়া পড়েছে আমার জীবনে,
সমস্ত অমৃতযোগের অন্তরীক্ষে।
আমাদের ভালোবাসা পথ কেটে নেবে এই পৃথিবীতে ;-
আমরা দুজনে এই বসে আছি আজ-ইচ্ছাহীন ;-
শালিক পায়রা মেঘ পড়ন্ত বেলার এই দিন
চারিদিকে ;-
এখানে গাছের পাতা যেতেছে হলুদ হ’য়ে- নিঃশব্দে উল্কার মতো ঝ’রে
একদিন তুমি এসে তবু এই হলুদ আঁচল রেখে ঘাসের ভিতরে শান্তি পাবে ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
রাতের কিনারে বসে নয়
বিকেলের আলোয় স্বপ্ন দেখলামঃ
কোন্ এক সুদূর মরুভূমিতে চলে গেছি
সেখানে গভীর জোছনারাতে
বালির গায়ে বালুকণার শব্দ
(পৃথিবীর পাতা ঝরার মতো)
স্ফটিকের নির্জন আলোর মতো বাতাস
কুমারীর নির্মল মসৃণ দেহের মতো।
কয়েকটি প্রেত উড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে
মানুষের শব্দে চমকে হাওয়ার ভিতর হারিয়ে গিয়ে।
মরণের কতশত শতাব্দীর পর
সেই ধূসর পরিধি খুঁজে পাব আমিঃ
তার সেই হাত আমার জিভকে আচ্ছন্ন করবে
স্ফটিক আলোর মতো বাতাসের অনন্ত নিস্তব্ধতার ভিতর?
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ঐখানে সারা দিন উঁচু ঝাউবন খেলা করে
হলদে সবুজ নীল রঙ্গ তার বুকে;
পাখি মেঘ রৌদ্রের;
তবু আজও হদয়ের গভীর অসুখে
মানবেরা পড়ে আছে কেন।আজ অন্ধ শতাব্দীর শতচ্ছিদ্রতার
ভিতর আলোর খোঁজে যদি চলে যায়
তবুও শাশ্বত হয়ে থাকে অন্ধকার।নতুন যুগের জন্য তবুও প্রয়ান করা ভালো।
চিতল হরিণ ঐ শিঙ তুলে ফিকে জোছনায়
হরিণী কে খোঁজে তবু পাবে না কখনও;
ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে – দূর কুয়াশায়
চ’লে যাবো, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে;- সেদিন দু’দও এই বাংলার তীর —
এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;-
সেদিন র’বে না কোনো ক্ষোভ মনে –এই সোঁদা ঘাসের ধুলায়
জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায় – চারিদিকে বাঙালীর ভিড়
বহুদিন কীর্তন ভাসান গান রুপকথা যাত্রা পাঁচালীর
নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজো শ্রাবণের জীবণের জীবন গোঙায়,আমারে দিয়াছে তৃপ্তি; কোনো দিন রুপহীন প্রবাসের পথে
বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শুকের মতন
কাটাইনি দিন মাস,বেহুলার লহনার মধুর জগতে
তাদের পায়ের ধুলো – মাখা পথে বিকায়ে দিয়েছি আমি মন
বাঙালি নারীর কাছে – চাল- ধোয়া স্নিগ্ধ হাত, ধান – মাখা চুল,
হাতে তার শাড়িটির কস্তা পাড়; – ডাঁশা আম কামরাঙা কুল।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙ্গে
গ্রাম পতনের শব্দ হয়;
মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে,
দেয়ালে তাদের ছায়া তবু
ক্ষতি,মৃত্যু,ভয়
বিহবলতা ব’লে মনে হয়।এসব শূণ্যতা ছাড়া কোনোদিকে আজ
কিছু নেই সময়ের তীরে।
তবু ব্যর্থ মানুষের গ্লানি ভুল চিন্তা সংকল্পের
অবিরল মরুভূমি ঘিরে
বিচিত্র বৃক্ষের শব্দে স্নিগ্ধ এক দেশ
এ পৃথিবী, এই প্রেম, জ্ঞান আর হৃদয়ের এই নির্দেশ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।
দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল-মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে।
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে নড়ে- চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল;
যেখানে আকাশে খুব নীরবতা,শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।
নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বলো; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’
এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর।
হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়
চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–
প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে
যেখানে রবো না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে — বাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
যদিও দিন কেবলি নতুন গল্পবিশ্রুতির
তারপরে রাত অন্ধকারে থেমে থাকাঃ—লুপ্তপ্রায় নীড়
সঠিক ক’রে নেয়ার মতো শান্ত কথা ভাবা;
যদিও গভীর রাতের তারা (মনে হয়) ঐশী শক্তির;তবুও কোথাও এখন আর প্রতিভা আভা নেই;
অন্ধকারে কেবলি সময় হৃদয় দেশ ক্ষ’য়ে
যেতেছে দেখে নীলিমাকে অসীম ক’রে তুমি
বলতে যদি মেঘনা নদীর মতন অকূল হয়ে;‘আমি তোমার মনের নারী শরীরিণী—জানি;
কেন তুমি স্তব্ধ হয়ে থাকো।
তুমি আছ ব’লে আমি কেবলই দূরে চলতে ভালোবাসি,
চিনি না কোনো সাঁকো।যতটা দূর যেতেছি আমি সূর্যকরোজ্জ্বলতাময় প্রাণে
ততই তোমার সত্ত্বাধিকার ক্ষয়
পাচ্ছে ব’লে মনে কর? তুমি আমার প্রাণের মাঝে দ্বীপ,
কিন্তু সে-দ্বীপ মেঘনা নদী নয়।’-এ-কথা যদি জলের মতো উৎসারণে তুমি
আমাকে—তাকে—যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে
ব’লে যেতে;—শুনে নিতাম, মহাপ্রাণের বৃক্ষ থেকে পাখি
শোনে যেমন আকাশ বাতাস রাতের তারকাকে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
মাঠের ভিড়ে গাছের ফাঁকে দিনের রৌদ্রে অই;
কুলবধুর বহিরাশ্রয়িতার মতন অনেক উড়ে
হিজল গাছে জামের বনে হলুদপাখির মতো
রূপসাগরের পার থেকে কি পাখনা বাড়িয়ে
বাস্তবিকই রৌদ্র এখন? সত্যিকারের পাখি?
কে যে কোথায় কার হৃদয়ে কখন আঘাত ক’রে।
রৌদ্রবরণ দেখেছিলাম কঠিন সময়-পরিক্রমার পথে-
নারীর,-তবু ভেবেছিলাম বহিঃপ্রকৃতির।
আজকে সে-সব মীনকেতনের সাড়ার মতো, তবু
অন্ধকারের মহাসনাতনের থেকে চেয়ে
আশ্বিনের এই শীত স্বাভাবিক ভোরের বেলা হ’লে
বলেঃ ‘আমি রোদ কি ধূলো পাখি না সেই নারী?’
পাতা পাথর মৃত্যু কাজের ভূকন্দরের থেকে আমি শুনি;
নদী শিশির পাখি বাতাস কথা ব;লে ফুরিয়ে গেলে পরে
শান্ত পরিচ্ছন্নতা এক এই পৃথিবীর প্রাণে
সফল হ’তে গিয়েও তবু বিষণ্নতার মতো।
যদিও পথ আছে-তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে
নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে;
প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো-
কী বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে।
তবুও তোমায় জেনেছি, নারী, ইতিহাসের শেষে এসেঃ মানবপ্রতিভার
রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে।
মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে
বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কোনো এক বিপদের গভীর বিস্ময়
আমাদের ডাকে।
পিছে-পিছে ঢের লোক আসে।
আমরা সবের সাথে ভিড়ে চাপা প’ড়ে- তবু-
বেঁচে নিতে গিয়ে
জেনে বা না-জেনে ঢের জনতাকে পিষে- ভিড় ক’রে,
করুণার ছোট বড় উপকন্ঠে- সাহসিক নগরে বন্দরে
সর্বদাই কোনো এক সমুদ্রের দিকে
সাগরের প্রয়াণে চলেছি।
সে-সমুদ্র-
জীবন বা মরণের;
হয়তো না আশার দহনে উদ্বেল।
যারা বড়ো, মহীয়ান- কোনো এক উৎকন্ঠার পথে
তবু স্থির হ’য়ে চ’লে গেছে;
একদিন নচিকেতা ব’লে মনে হ’তো তাহাদের;
একদিন আত্তিলার মতো তবু;
আজ তারা জনতার মতো।
জীবনের অবিরাম বিশৃঙ্খলা স্থির ক’রে দিতে গিয়ে তবু
সময়ের অনিবার উদ্ভাবনা এসে
যে-সব শিশুকে যুবা- প্রবীণ করেছে তারপর
তাদের চোখের আলো
অনাদির উত্তরাধিকার থেকে, নিরবচ্ছিন্ন কাজ ক’রে
তাদের প্রায়ান্ধ চোখে আজ রাত লেন্স,
চেয়ে দেখে চারিদিকে অগণন মৃতদের চোক্ষের ফস্ফোরেসেন্স্।
তাদের সম্মুখে আলো
দীনাত্মা তারার
জ্যোৎস্নার মতন।
জীবনের শুভ অর্থ ভালো ক'রে জীবনধারণ
অনুভব ক'রে তবু তাহাদের কেউ-কেউ আজ রাতে যদি
অই জীবনের সব নিঃশেষ সীমা
সমুজ্জ্বল, স্বাভাবিক হ'য়ে যাবে মনে ভেবে-
স্মরণীয় অঙ্কে কথা বলে,
তাহ'লে সে কবিতা কালিমা
মনে হবে আজ?
আজকে সমাজ
সকলের কাছ থেকে চেয়েছে কি নিরন্তর
তিমিরবিদারী অনুসূর্যের কাজ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
-নব নবীনের লাগি
প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমার রয়েছি জাগি!
ব্যর্থ পঙ্গু খর্ব প্রাণের বিকল শাসন ভেঙে,
নব আকাঙক্ষা আশার স্বপনে হৃদয় মোদের রেঙে,
দেবতার দ্বারে নবীন বিধান-নতুন ভিক্ষা মেগে
দাঁড়ায়েছি মোরা তরুণ প্রাণের অরুণের অনুরাগী!
ঝড়ের বাতাস চাই।
-চারিদিক ঘিরে শীতের কুহেলি, -শ্মশানপথের ছাই,
ছড়ায়ে রয়েছে পাহাড় প্রমাণ মৃতের অস্থি খুলি,
কে সাজাবে ঘর দেউলের’পর কঙ্কাল তুলি তুলি?
সূর্য চন্দ্র নিভায়ে কে নেবে জরার চোখের ঠুলি!
-মরার ধরায় জ্যান্ত কখনও মাগিতে যাবে কি ঠাঁই!
ঘুমায়ে কে আছে ঘরে!
মৃতুশিশু-বুকে কল্যাণী পুরকামিনী কি আজ মরে!
কে আছে বসিয়া হতাশ উদাস অলস অন্যমনা?
দোদুল আকাশে দুলিয়া উঠিছে রাঙা অশনির ফণা,
বাজে বাদলের রঙ্গমল্লী. ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝনা!
ফিরিছে বালক-ঘর পলাতক ঝরা পালকের ঝড়ে!
আমরা অশ্বরোহী!-
যাযাবর যুবা, বন্দিনীদের ব্যথা মোরা বুকে বহি,
মানবের মাঝে যে দেবতা আছে আমরা তাহারে বরি ,
মোদের প্রাণের পূজার দেউলে তাহার প্রতিমা গড়ি,
চুয়া-চন্দন-গন্ধ বিলায়ে আমরা ঝরিয়া পড়ি,
সুবাস ছড়াই উশীরের মতো, ধূপের মতন দহি!
গাহি মানবের জয়!
-কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়!
সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে-কোটি কোটি শিখা জাগে,
প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে,
আমরা তাদের শস্ত্র, শাসন, আসন করিব ক্ষয়!
-জয় মানবের জয়!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে।
বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে:
ছড়ায়ে রয়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রানে;-
তাদের উপেক্ষা ক’রে কে যাবে বিদেশে বলো- আমি কোনো-মতে
বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে- উটির পর্বতে
যাব নাকো, দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে
কোন দেশে,- কোথায় এলাচিফুল দারুচিনি বারুণীর প্রাণে
বিনুনী খসায়ে ব’সে থাকিবার স্বপ্ন আনে;- পৃথিবীর পথেযাব নাকো : অশ্বত্থের ঝরাপাতা স্লান শাদা ধুলোর ভিতর,
যখন এ- দু’-পহরে কেউ নাই কোনো দিকে- পাখিটিও নাই,
অবিরল ঘাস শুধু ছড়ায়ে র’য়েছে মাটি কাঁকরের ’পর,
খড়কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছে দু’একটা বিষণ্ণ চড়াই,
অশ্বত্থের পাতাগুলো প’ড়ে আছে স্লান শাদা ধুলোর ভিতর;
এই পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
চারিদিকে নীল সাগর ডাকে অন্ধকারে, শুনি;
ঐখানেতে আলোকস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে ঢের
একটি-দুটি তারার সাথে;- তারপরেতে অনেকগুলো তারা;
অন্নে ক্ষুধা মিটে গেলেও মনের ভিতরের
ব্যথার কোনো মীমাংসা নেই জানিয়ে দিয়ে আকাশ ভ’রে জ্বলে;
হেমন্ত রাত ক্রমেই আরো অবোধ ক্লান্ত অধোগামী হ’য়ে
চলবে কি-না ভাবতে আছে;- ঋতুর কামচক্রে সে তো চলে;
কিন্তু আরো আশা আলো চলার আকাশ রয়েছে কি মানব হৃদয়ে।
অথবা এ মানব প্রাণের অনুতর্ক; হেমন্ত খুব স্থির
সপ্রতিভ ব্যাপ্ত হিরণ গভীর সময় ব’লে
ইতিহাসের করুণ কঠিন ছায়াপাতের দিনে
উন্নতি প্রেম কাম্য মনে হলে
হৃদয়কে ঠিক শীত সাহসিক হেমন্তলোক ভাবি;
চারিদিকে রক্তে রৌদ্রে অনেক বিনিময়ে ব্যবহারে
কিছুই তবু ফল হলো নাঃ এসো মানুষ আবার দেখা যাক
সময় দেশ ও সন্ততিদের কী লাভ হ’তে পারে।
ইতিহাসের সমস্ত রাত মিশে গিয়ে একটি রাত্রি আজ পৃথিবীর তীরে;
কথা ভাবায়, ভ্রান্তি ভাঙে, ক্রমেই বীতশোক
ক’রে দিতে পারে বুঝি মানবভাবনাকে;
অন্ধ অভিভূতের মতো যদিও আজ লোক
চলছে, তবু মানুষকে সে চিনে নিতে বলেঃ
কোথায় মধু-কোথায় কালের মক্ষিকারা-কোথায় আহ্বান
নীড় গঠনের সমবায়ের শান্তি-সহিষ্ণুতার;-
মানুষও জ্ঞানী; তবুও ধন্য মক্ষিকাদের জ্ঞান।
কাছে-দূরে এই শতাব্দীর প্রাণ নদীরা রোল
স্তব্ধ ক’রে রাখে গিয়ে যে-ভূগোলের অসারতার পরে
সেখানে নীলকন্ঠ পাখি ফসল সূর্য নেই,
ধুসর আকাশ,- একটি শুধু মেরুন রঙের গাছের মর্মরে
আজ পৃথিবীর শূন্যপথ ও জীবনবেদের নিরাশা তাপ ভয়
জেগে ওঠে;- এ-সুর ক্রমে নরম- ক্রমে হয়তো আরো কঠিন হ’তে পারে?
সোফোক্লেস ও মহাভারত মানব জাতির এ ব্যর্থতা জেনেছিলো; জানি;
আজকে আলো গভীরতর হবে কি অন্ধকারে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলো: ‘এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।’
‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?’
মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।
সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক – তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
চোখ দুটো ঘুমে ভরে
ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!
ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,- স্বপন ক’দিন রয়!
এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,-এ তবু গোধূলি নয়!
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়,
আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’পরে!
কেটেছে যে নিশি ঢের,-
এতদিন তবু অন্ধকারের পাইনি তো কোনো টের!
দিনের বেলায় যাদের দেখিনি-এসেছে তাহারা সাঁঝে;
যাদের পাইনি পথের ধূলায়-ধোঁয়ায়-ভিড়ের মাঝে,-
শুনেছি স্বপনে তাদের কলসী ছলকে,- কাঁকন বাজে!
আকাশের নীচে- তারার আলোয় পেয়েছি যে তাহাদের!
চোখ দুটো ছিল জেগে
কত দিন যেন সন্ধ্যা-ভোরের নট্কান -রাঙা মেঘে!
কত দিন আমি ফিরেছি একেলা মেঘলা গাঁয়ের ক্ষেতে!
ছায়াধূপে চুপে ফিরিয়াছি প্রজাপতিটির মতো মেতে
কত দিন হায়!- কবে অবেলায় এলোমেলো পথে যেতে
ঘোর ভেঙে গেল,- খেয়ালের খেলাঘরটি গেল যে ভেঙে।
দুটো চোখ ঘুম ভরে
ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!
ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,-স্বপন কদিন রয়!
এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,-এ তবু গোধুলি নয়!
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়,-
আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’ পরে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সর্বদাই অন্ধকারে মৃত্যু এক চিন্তার মতন;
আমাদের এই শতাব্দীর সাধ, স্বপ্ন, কাজ, প্রাণ
আচ্ছাদন ক'রে দিতে আসে।
ভোরের নিশ্চিন্ত মন কেমন সাহসে অনায়াসে
আলো হয়- সূর্য হয়- দেখ;
নদী- মেঘ- দিগন্তের পাহাড়ের নীল
বিচ্ছুরিত হয়ে ওঠে কেমন নিঃশব্দ অনাবিল।
আমরা প্রেমের কথা- জ্ঞান মুক্তি প্রগতির দিন
ঢের আগে শুরু ক'রে এখনো ব্রহ্মাণ্ড-অন্তর্লীন
সুরের ভিতরে সুর-অগ্নি হতে গিয়ে
বার বার অঙ্গারের অন্ধকারে সমাজ নিভিয়ে
মানুষের ইতিহাস-ঊর্ণা হয়ে আছি।হে আকাশ, হে প্রতিভা, হে বিচিত্র উচ্ছ্রিত সূর্যের উজ্জ্বলন,
আমাদের রোগ, পাপ, বয়সের রূঢ় মরুভূমি
শেষ ক'রে মৃজনের অনাদির দীপ্তিকে আদিম
চুম্বনে বিজ্ঞান, প্রেম, প্রেমাগ্নি উড্ডীন কর তুমি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
সমস্ত দিন
সমস্ত পৃথিবীই যেন আকাশ।
চারদিকে রৌদ্রের ভিতর রয়ে গেছে নির্মল জলের অনুভূতি;
জল আকাশ ও আগুনের থেকে এই সব রাত্রির জন্ম হয়;
অন্তহীন শুভ্রবিবেকী নক্ষত্রের;
এই সব স্থায়ী জিনিস চল-বিশ্বলোকের;
মানব্জীবনের; এদের অনবচ্ছিন্ন উজ্জ্বল প্রবাহে ধৌত হয়ে
সমস্ত গৃহযুদ্ধের গৃহবলিভুকদের রক্তের
শেষ বিন্দুও খুঁজে পাবে না কোথাও।
কোথাও থাকবে না আন্তর্জাতিক অন্যায়ের ছায়া আর। দেখা যাবে দিন সূর্যশরীরীঃ
যাযাবর হাঁসকে নিয়ে চলেছে মেঘের
ফেনাওড়ানো দূরতর নীলিমায়;
জেগে উঠবে বিকেলের শিয়রে
সাগরের বাতাস যেন- দূর ময়দানের;
অন্তহীন নক্ষত্রের চলা ফেরার দেশে পাওয়া যায় তাকে;
ঐ ঝাউ গাছের আঁধারের ভিতরেও;
বন্ধরে নগরে
মানুষের হিংস্র বেড়ালের গর্জনকে বিনমিত ক'রে
করুণার রাত্রিঋতুর মত
পাওয়া যায় তাকে- পাওয়া যায় তাকে।আজকের মলিনতা রক্ত কোথায় লীন হয়ে যাচ্ছে
সময়ের মনে- নিরবচ্ছিন্ন বিস্মরণে-
দিন ও রাত্রির অন্তহীন
জলঝর্ণার শুশ্রুষার শব্দের ভিতর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সোনালি অগ্নির মতো আকাশ জ্বলছে স্থির নীল পিলসুজে;
পৃথিবীর শেষ রৌদ্র খুঁজে
কেউ কি পেয়েছে কিছু কোনো দিকে? পায় নি তো কেউ।
তারপর বাদুড়ের কালো কালো ঢেউ
উড়ায়ে শঙ্খচিল কোথায় ডুবল চোখ বুজে।
অনেক রক্তাক্ত সোনা লুফে নিয়ে চ’লে গেছে নগরীর পানে
মানুষেরা রক্তের সন্ধানে।
বাদুড়েরা তারপর ছক কেটে আঁধার আকাশে
জীবনের অন্য-এক মানে ভালবাসেঃ
হয় তো-বা সূর্যের ও-পিঠের মানে।
চিন্তার-ইচ্ছার শান্তি চারদিকে নামছে নীরবেঃ
যত কাল লাল সূর্য পিছু ফিরে রবে।
বাদূড় যেখানে দূর- আরো দূর আকাস কালোয় গিয়ে মেশে
সে-গাহনে একদিন মানুষও নিঃশেষে
নিভে গেলে বুঝি তার শেষ হিরোশিমা শান্ত হবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আমার এ ছোটো মেয়ে — সব শেষ মেয়ে এই
শুয়ে আছে বিছানার পাশে –
শুয়ে থাকে —উঠে বসে —পাখির মতন কথা কয়
হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে
মাঠে মাঠে আকাশে আকাশেভুলে যাই ওর কথা — আমার প্রথম মেয়ে সেই
মেঘ দিয়ে ভেসে আসে যেন
বলে এসে: ‘বাবা, তুমি ভালো আছ? ভালো আছ? — ভালোবাসো?
হাতখানা ধরি তার:ধোঁয়া শুধু কাপড়ের মতো শাদা মুখখানা কেন!‘ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি — আজও মনে কর?’
দুই হাত চুপে চুপে নাড়ে তাই
আমার চোখের ’পরে, আমার মুখের ’পরে মৃত মেয়ে;
আমিও তাহার মুখে দু’হাত বুলাই;
তবু তার মুখ নাই — চোখ চুল নাই।তবু তারে চাই আমি — তারে শুধু — পৃথিবীতে আর কিছু নয়
রক্ত মাংস চোখ চুল — আমার সে মেয়ে
আমার প্রথম মেয়ে — সেই পাখি — শাদা পাখি — তারে আমি চাই;
সে যেন বুঝিল সব — নতুন জীবন তাই পেয়ে
হঠাৎ দাঁড়াল কাছে সেই মৃত মেয়ে।বলিল সে: ‘আমারে চেয়েছ, তাই ছোটো বোনটিরে –
তোমার সে ছোটো-ছোটো মেয়েটিরে এসেছি ঘাসের নিচে রেখে
সেখানে ছিলাম আমি অন্ধকারে এত দিন
ঘুমাতেছিলাম আমি’ — ভয় পেয়ে থেমে গেল মেয়ে,
বলিলাম: ‘আবার ঘুমাও গিয়ে —
ছোটো বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।’ব্যথা পেল সেই প্রাণ — খানিক দাঁড়াল চুপে — তারপর ধোঁয়া
সব তার ধোঁয়া হয়ে খসে গেল ধীরে ধীরে তাই,
শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়ায় সে একবার
কখন উঠেছে ডেকে দাঁড়কাক —
চেয়ে দেখি ছোটো মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে — আর কেউ নাই।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে,- কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে,-কেয়াফুল,- শেফালীর দলে!
-যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরোঝরো
কামিনীর ব্যথার শিয়রে
যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়,-
আজ মনে হয়
পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা!
-শুধু শেষ-নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা,
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা
দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ,
গাগরীর কোলে তার উথলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকাপথের চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি,- আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে- কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো- আধো কথা!
-আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!
পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর,- ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ,- শুধু অবসাদ!
মহুয়ার,- ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায় না তৃষা মোর,- জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ,-আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,-
পথে পথে কালো যবণিকা!
কাতর ক্রন্দন,-
কামনার কবর-বন্ধন!
কাফনের অভিযান,-অঙ্গার- সমাধি!
মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!
মর্মর্ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতা-ভরা ভোররাতের পবন,-
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!-
কোন্ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো মোর
কেঁদে মরে মন!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
চারিদিকে প্রকৃতির ক্ষমতা নিজের মতো ছড়ায়ে রয়েছে।
সূর্য আর সূর্যের বনিতা তপতী
মনে হয় ইহাদের প্রেম
মনে ক’রে নিতে গেলে, চুপে
তিমিরবিদারী রীতি হয়ে এরা আসে
আজ নয়,- কোনো এক আগামী আকাশে।
অন্নের ঋণ,বিমলিন স্মৃতি সব
বন্দ্র বস্তির পথে কোনো এক দিন
নিমেষের রহস্যের মতো ভুলে গিয়ে
নদীর নারীর কথা-আরো প্রদীপ্তির কথা সব
সহসা চকিত হয়ে ভেবে নিতে গেলে বুঝি কেউ
হৃদয়কে ঘিরে রাখে দিতে চায় একা আকাশের
আশেপাশে অহেতুক ভাঙা শাদা মেঘের মতন।
তবুও নারীর নাম ঢের দূরে আজ,
ঢের দূরে মেঘ;
সারাদিন নিলেমেয় কালিমার খারিজের কাজে মিশে থেকে
ছুটি নিতে ভালোবেসে ফেলে যদি মন
ছুটি দিতে চায় না বিবেক।
মাঝে-মাঝে বাহিরের অন্তহীন প্রসারের থেকে
মানুষের চোখে-পড়া-না-পড়া সে কোন স্বভাবের
সুর এসে মানবের প্রাণে
কোন এক মানে পেতে চায়ঃ
যে-পৃথিবী শুভ হতে গিয়ে হেরে গেছে সেই ব্যর্থতার মানে।
চারিদিকে কলকাতা টোকিও দিল্লী মস্কো আতলান্তিকের কলরব,
সরবরাহের ভোর,
অনুপম ভোরাইয়ের গান;
অগণন মানুষের সময় ও রক্তের জোগান
ভাঙে গড়ে ঘর বাড়ি মরুভূমি চাঁদ
রক্ত হাড় বসার বন্দর জেটি ডক;
প্রীতি নেই, পেতে গেলে হৃদয়ের শান্তি স্বর্গের
প্রথম দুয়ারে এসে মুখরিত ক’রে তোলে মোহিনী নরক।
আমাদের এ-পৃথিবীর যতদুর উন্নত হয়েছে
ততদূর মানুষের বিবেক সফল।
সে-চেতনা পিরামিডে পেপিরাসে প্রিন্টিং-প্রেসে ব্যাপ্ত হয়ে
তবুও অধিক আধুনিকতর চরিত্রের বল।
শাদাশাদে মনে হয় সে-সব ফসলঃ
পায়ের চলার পথে দিন আর রাত্রির মতন;-
তবুও এদের গতি স্নিগ্ধ নিয়ন্ত্রিত ক’রে বার বার উত্তর সমাজ
ঈষৎ অনন্যসাধারণ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোন্খানে সফলতা শক্তির ভিতর,
কোন্খানে আকাশের গায়ে রূঢ় মনুমেন্ট উঠিতেছে জেগে,
কোথায় মাস’ল তুলে জাহাজের ভিড় সব লেগে আছে মেঘে,
জানি নাকো, আমি এই বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাধিঁয়াছি ঘর:
সন্ধ্যায় যে দাঁড়কাক উড়ে যায় তালবনে- মুখে দুটো খড়
নিয়ে যায়-সকালে যে নিমপাখি উড়ে আসে কাতর আবেগে
নীল তেঁতুলের বনে- তেমনি করুণা এক বুকে আছে লেগে;
বইচির মনে আমি জোনাকির রূপ দেখে হয়েছি কাতর;কদমের ডালে আমি শুনেছি যে লক্ষ্মীপেঁচা গেয়ে গেছে গান
নিশুতি জ্যোৎস্না রাতে, -টুপ টুপ টুপ টুপ্ সারারাত ঝরে
শুনেছি শিশিরগুলো –ম্লান মুখে গড় এসে করেছে আহ্বান
ভাঙা সোঁদা ইটগুলো,– তারি বুকে নদী এসে কি কথা মর্মরে;
কেউ নাই কোনোদিকে- তবু যদি জ্যোৎস্নায় পেতে থাক কান
শুনিবে বাতাসে শব্দ : ‘ঘোড়া চড়ে কই যাও হে রায়রায়ন –’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
দাও-দাও সূর্যকে জাগিয়ে দাও
হে দিন, জ্বালাও তুমি আলো।
যখন নির্বাণ ছিলো- কোনো দিকে জ্যোতিষ্ক ছিলো না,
যখন শূন্যের সাথে শূন্যের চুম্বনে গাঢ় নীল
নীহারিকা শিখা, সাধ জেগে উঠেছিলো
যখন উদ্দেশ্যহীন আর্ত অন্ধ রোদসীকে চোখে রেখে তবু
অগ্নির বর্ণের মতো আমাদের এই পৃথিবীর জন্ম হলো,-
সে আবেগ সেইদিন সে - আলোকে জেগে
কি যেন অনবতুল আভা চেয়েছিলো,
বহে চলা- সূর্যে কন্ঠে কথা বলা- প্রাণ
জন্ম দেয়া
চেয়েছিলোআজ এক কোটি শতাব্দীর পরে অনন্তের কারুকার্যে লীন
মানুষের সংকল্পের সংঘর্ষে সুন্দর
রাত্রি হ'য়ে যাক সূর্য, মৈত্রী হোক সফল নির্মল
নক্ষত্র মৃত্তিকা হোক; প্রেমের প্রতিভা হোক উজ্জ্বল বিনত-
বহ্মাণ্ড রচনা হ'লে তার ঘাসে এক ফোঁটা শিশিরের মতো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
হঠাৎ তোমার সাথে কলকাতাতে সে এক সন্ধ্যায়
উনিশশো চুয়াল্লিশে দেখা হ’ল- কত লোক যায়
তড়াম বাস ট্যাক্সি মোটর জিপ হেঁকে
যাদের হৃদয়ে বেশি কথা হাতে কাজ কম-
তাদের অনেকে পায়ে হেঁটে চলে যায়।কেবলি ক্লান্তিতে ধুঁকে আমাদের মুখে ঠোঁটে তবু যেই হাসি
ফুটে উঠে স্বপ্নকে খণ্ডন ক’রে বিষয়প্রত্যাশী
অমূল্য সংসারী সে-ই-বাজারে বন্দরে ঘোরে, মাপজোক করে
হিসেবের খতিয়ানে লাভ হলে রক্তের ভিতরে
তৃপ্তি পায়-লোকসান হয়ে গেলে অন্ধকারে নিগৃহীত মনে
অনুভব করে কোনো মনিবের সংকীর্ণ বেতনে
ভৃত্যের শরীর তার- ভৃত্যের শরীরে তার মন
নারী আর নক্ষত্রের তবু মহাজন?তুমি এলে সময়ের ঢের আয়ূ শেষ ক’রে তবে
এখনো প্রদীপ জ্বলে এরকম স্থির অনুভবে
তোমার শরীর আজো সুশ্রী নম্র-তবুও হ্রদয়
সেই স্নিগ্ধ শরীরের সতীনের মতো কাঁটা নয়?
দুরু দুরু হৃদয়ের বিস্ময়ে ব্যথায় একথা যদি ভাবি
তবু সে ব্যথার চেয়ে আরেক শক্তির বেশি দাবি
সেই স্বাদ তুমি- আমাদের চোখে এসেছিলে ব’লে
পৃথিবীকে ভালো ক’রে পাই আমি-এ পৃথিবী অন্তর্হিত হ’লে।সত্যই সূর্যের আলো- তবুও সূর্যের চেয়ে সুখী
তোমার গভীরভাবে ভালো শরীরের মুখোমুখি
আমার শরীর-মন- ঈশ্বরেরা অনুরোধে কখনো সময়
গতি কি থামায় তার-লীন হলে অনুসৃত হয়?
তুমি তাকে থামায়েছ-সৃষ্টির অন্তিম হিতাহিত
ভুলে আজ কলকাতার শীতরাতে কবের অতীত
বহমান সময়কে অন্ধকার চোখঠার দিয়ে
নারীর শরীর নিয়ে রয়েছ দাঁড়িয়ে।
তোমার উরুর চাপে সময় পায়ের নিচে প’ড়ে
থেমে আছে ব’লে মৃত তারিখকে আবিষ্কার করে
ভালোবাসা বেঁচে উঠে, আহা, এক মুহুর্তের শেষে
তবুও কি ম’রে যাবে পুনরায় সময়ের গতি ভালোবেসে?
অতীত তো সুজাতার শিশু; নারি, মনীষীহৃদয়
সে শিশুকে বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত নয়।হে সময় একদিন তোমার গহীন ব্যবহারে
যা হয়েছে মুছে গেছে, পুনরায় তাকে
ফিরিয়ে দেবার কোনো দাবি নিয়ে যদি
নারীর পায়ের চিহ্নে চ’লে গিয়ে তোমার সে অন্তিম অবধি
তোমাকে বিরক্ত করে কেউ
সব মৃত ক্লান্ত ব্যস্ত নক্ষত্রের চেয়েও অধিক
অধীরতা ক্ষমতায় ব্রক্ষ্মাণ্ড শিল্পের শেষ দিক
এই মহিলার মত নারীচোখে যদি কেউ খুঁজে ফেরে-তবে
সেই অর্থ আমাদের এই মুহুর্তের মতো হবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে ;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার ,- চোখণ ,- তার শিশিরের ঘ্রাণ ,
তাদের আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান ,
দেহের স্বাদের কথা কয় ;-
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময় !
চারিদিকে এখন সকাল,-
রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল !
মাঠের ঘাসের’পরে শৈশবের ঘ্রাণ ,-
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান !
চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল !
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে !
শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে
যেঁই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে
আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর,
চারিদিকে ছায়া – রোদ – ক্ষুদ – কুঁড়া – কার্তিকের ভিড় ;
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালী – ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ !
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি নাই ,- রূপ ঝ’রে পড়ে তার,-
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে৪ !
আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স ,
মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ ,- ভাঁড়ারের রস !
মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়
সকালবেলার রৌদ্রে : কুঁড়েমির আজিকে সময় ।
গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া !
তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া ;
ভুলে গিয়ে রাজ্য – জয়- সাম্রজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেঁই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা ,
ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব;-
মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে ,-
শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব ।
হাতে হাত ধ’রে ধ’রে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে ;
ফলন্ত ধানের গন্ধে- রঙে তার- স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের
সকলের দেহ ;
রাগ কেহ করিবে না – আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ ।
আমাদের অবসর বেশি নয়, - ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
আমাদের সকলের আগে শেষ হয়
দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ – অবসাদ-
আমাদের ডেকে লয়,- তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা – অবসন্ন হাত ।
তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে – রোদ গেছে প’ড়ে,
এসেছে বিকেলবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধ’রে;
তখন গিয়েছে থেমে ওই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড় ;
হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির বিছানার’পর;
মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর !
তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল ,
চ’লে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড় মেয়েদের দল !
২
পুরানো পেঁচারা সব কোটরের থেকে
এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে
মাঠের মুখের’পরে ;
সবুজ ধানের নিচে – মাটির ভিতরে
ইঁদুরেরা চ’লে গেছে – আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা ;
শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা !
ফলন্ত মাঠের’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান ,
প্রেম আর পিপাসার গান
আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন !
ফসল- ধানের ফলে যাহাদের মন
ভ’রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে , অবহেলা ক’রে গেছে
পৃথিবীর সব সিংহাসন –
আমাদের পাড়াগাঁর সেইসব ভাঁড় –
যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়
মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নিচে পৃথিবীর তলে !
কোটালের মতো তারা নিঃশ্বাসের জলে
ফুরায়নি তাদের সময় ;
পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয় !
প্রণয়ীর মতো তারা ছেঁড়েনি হৃদয়
ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে !-
চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে
কাটায়নি – কাটায়নি কাল !
অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল
কোনো এক সম্রাটের সাথে
মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে !
যোদ্ধা – জয়ী – বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে- পাশাপাশি –
জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি !
অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে ,- তাদের দিনের
আলো হয়েছে আঁধার ,
সেসব গেঁয়ো কবি- পাড়াগাঁর ভাঁড় ,-
আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর ?
তাদের ফলন্ত দেহ শুষে লয়ে জন্মিয়াছে আজ এই ক্ষেতের ফসল ;
অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইঁদুরেরা জানে তাহা ,- জানে তাহা
নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল !
সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে
তাহাদের নাম ধ’রে যায় ডেকে ডেকে ।
মাটির নিচের থেকে তারা
মৃতের মাটির স্বপ্নে ন’ড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভুত ইশারা !
আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে ,-
আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে ।
সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে
শহর- বন্দর-বস্তি- কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে
আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে ;
শরীরের অবসাদ – হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে ।
শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধ’রে
আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে
দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন ;
অগাধ ধানের রসে আমাদের মন
আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি- পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন !
-জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা
নতুন লাঙল তার প’ড়ে আছে- পুরানো পিপাসা
জেগে আছে মাঠের উপরে :
সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা ওই আমাদের তরে !
হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে ,-
দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে ।
আকাশের মেঠোপথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ ;
অবসর আছে তার,- অবোধের মতন আহ্লাদ
আমাদের শেষ হবে যখন সে চ’লে যাবে পশ্চিমের পানে ,-
এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে !
৩
পুরানো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার ;
পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই ,- কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই দূরে
মাঠে গিয়ে আর !
রোধ – অবরোধ – ক্লেশ – কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়,-
জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোনখানে ,-
কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয় !
আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের রং
দামামা থামায়ে ফেল,- পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য
আর সাম্রাজ্যের সং !
এখানে নাহিকো কাজ ,- উৎসাহের ব্যথা নাই , উদ্যমের নাহিকো ভাবনা ;
এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা ।
অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয় !
সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে ,
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন –
জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে ।
এখানে চকিত হ’তে হবে নাকো ,- ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময় ;
উদ্যমের ব্যথা নাই ,- এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয় !
এইখানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে ,
মাথায় চিন্তার ব্যথা হয়না জমাতে !
এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর ,-
রাখিবে না চোখ আর নয়নের’পর ;
ভালোবাসা আসিবে না ,-
জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর !
অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময় ,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয় ;
সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে,
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে ,
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার
সাধ ভালোবেসে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি ;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিনীর ডাক শুনি , -
কাহারে সে ডাকে !
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার ;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে ,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন ,
এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ঘুম আর আসে নাকো
বসন্তের রাতে ।
চারিপাশে বনের বিস্ময় ,
চৈত্রের বাতাস ,
জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন !
ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে ;
কোথাও অনেক বনে – যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই
পুরুষ- হরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার ;
তাহারা পেতেছে টের ,
আসিতেছে তার দিকে !
আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে ;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায় ,-
পিপাসার সান্ত্বনায় – অঘ্রানে- আস্বাদে !
কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন !
মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই ,
সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু ;
কেবল পিপাসা আছে,
রোমহর্ষ আছে ।
মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতার বুকেও জেগেছে বিস্ময় !
লালসা – আকাঙ্ক্ষা –সাধ – প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে
আজ এই বসন্তের রাতে ;
এইখানে আমার নকটার্ন –।
একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে ,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের – নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে ওই
সুন্দরী গাছের নিচে- জ্যোৎস্নায় !-
মানুষ যেমন ক’রে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে
হরিণেরা আসিতেছে ।
-তাদের পেতেছি আমি টের
অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায় ,
ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায় ।
ঘুমাতে পারি না আর ;
শুয়ে শুয়ে থেকে
বন্দুকের শব্দ শুনি ।
চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণী আবার ডাকে ;
এইখানে প’ড়ে থেকে একা একা
আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে
বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে
হরিণীর ডাক শুনে শুনে ।
কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া ;
সকালে – আলোয় তারে দেখা যাবে –
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা প’ড়ে আছে ।
মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এইসব ।
আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব ,
...মাংস – খাওয়া হল তবু শেষ ?
...কেন শেষ হবে ?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি ?
কোনো এক বসন্তের রাতে
জীবনে কোনো এক বিস্ময়ের রাতে
আমারেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায় – দখিনা বাতাসে
ওই ঘাইহরিণীর মতো ?
আমার হৃদয় – এক পুরুষহরিণ –
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয় – চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে ?
আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে
এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি
জীবনের বিস্ময়ের রাতে
কোনো এক বসন্তের রাতে ?
তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে !
মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমরাও প’ড়ে থাকি ;
বিয়োগের – বিয়োগের – মরণের মুখে এসে পড়ে সব
ঐ মৃত মৃগদের মতো –।
প্রেমের সাহস-সাধ-স্বপ্ন লয়ে বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা –মৃত্যু পাই ;
পাই না কি ?
দোনলার শব্দ শুনি ।
ঘাইমৃগী ডেকে যায় ,
আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো
একা একা শুয়ে থেকে ;
বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয় ।
ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে ;
যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়
হরিনের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে
তাহারাও তোমার মতন ;-
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়
কথা ভেবে – কথা ভেবে – ভেবে ।
এই ব্যথা ,- এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে ,-
কোথাও ফড়িঙে-কীটে ,- মানুষের বুকের ভিতরে ,
আমাদের সবের জীবনে ।
বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
হে হৃদয়, একদিন ছিলে তুমি নদী
পারাপারহীন এক মোহনায় তরণীর ভিজে কাঠ
খুঁজিতেছে অন্ধকার স্তব্ধ মহোদধি।
তোমার নির্জন পাল থেকে যদি মরণের জন্ম হয়,
হে তরণী,
কোনো দূর পীত পৃথিবীর বুকে ফাল্গুনিক তবে
ঝরনার জল আজো ঢালুক নীরবে;
বিশীর্ণেরা আঁজলায় ভরে নিক সলিলের মুক্তা আর মণি
অন্ধকার সাগরের মরণকে নিষ্ঠা দিয়ে_ ঊষালোকে মাইক্রোফোনের মতো রবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
সোনালী খড়ের ভারে অলস গোরুর গাড়ি—বিকেলের রোদ প’ড়ে আসে
কালো নীল হলদে পাখিরা ডানা ঝাপটায় ক্ষেতের ভাঁড়ারে,
শাদা পথ ধুলো মাছি—ঘুম হয়ে মিশিছে আকাশে,
অস্ত-সূর্য গা এলিয়ে অড়র ক্ষেতের পারে-পারেশুয়ে থাকে; রক্তে তার এসেছে ঘুমের স্বাদ এখন নির্জনে;
আসন্ন এ-ক্ষেতটিকে ভালো লাগে—চোখে অগ্নি তার
নিভে-নিভে জেগে ওঠে;—স্নিগ্ধ কালো অঙ্গারের গন্ধ এসে মনে
একদিন আগুনকে দেবে নিস্তার।কোথায় চার্টার প্যাক্ট কমিশন প্ল্যান ক্ষয় হয়;
কেন হিংসা ঈর্ষা গ্লানি ক্লান্তি ভয় রক্ত কলরবঃ
বুদ্ধের মৃত্যুর পরে যেই তন্বী ভিক্ষুণীকে এই প্রশ্ন আমার হৃদয়
ক’রে চুপ হয়েছিল—আজও সময়ের কাছে তেমনই নীরব।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আমি যদি হতাম বনহংস,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;
তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দঃ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!
হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায় — সন্ধ্যায় ঘুমায় নীরবে
মাটির ভিটের ‘পরে — লেগে থাকে অন্ধকারে ধুলোর আঘ্রাণ
তাহাদের চোখে — মুখে; — কদমের ডালে পেঁচা কথা কবে —
কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহ্বান
সাপমাসী পোকাটিরে… সেই দিন আঁধারে উঠিবে নড়ে ধান
ইঁদুরের ঠোঁটে — চোখে; বাদুড়ের কালো ডানা করমচা পল্লবেকুয়াশারে নিঙড়ায়ে উড়ে যাবে আরো দূর নীল কুয়াশায়,
কেউ তাহা দেখিবে না; — সেদিন এ পাড়াগাঁর পথের বিষ্ময়
দেখিতে পাবো না আর — ঘুমায়ে রহিবে সব; যেমন ঘুমায়
আজ রাতে মৃত যারা; যেমন হতেছে ঘুমে ক্ষয়
অশ্বত্থ ঝাউয়ের পাতা চুপে — চুপে আজ রাতে, হায়;
যেমন ঘুমায় মৃতা, — তাহার বুকের শাড়ি যেমন ঘুমায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
গভীর শীতের রাত এই সব,- তবু
চারিদিকে যুবাদের হৃদয়ের জীবনের কথা
মৃত্যুর উপর দিয়ে সাঁকোর মতন
চেয়ে দেখে মরণের অপ্রমেয়তা
সেতুর ছবির মত মিলে গিয়ে জলের ভিতরে
জীবনের জয়-
আর মরণের স্তব্ধতাকে অনুভব করে।
অনুভব করে এই জীবনই মহৎ,
মরণের চেয়ে বড় জীবনের সুর;
যদিও অন্ন আজ ভূমি নয়- তবুও মৈত্রেয়ী
অন্নলোভাতুর;
হৃদয়বিহীনভাবে- দশ বিশ শত কোটি টন
চলে আজ পঙ্গপাল,- নিজেকে উজাড় করে;- জেনে
জীবন হতাশ নয় ব’লেই জীবন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর ,-
নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান !
ফসল উঠিছে ফ’লে ,- রসে রসে ভরিছে শিকড় ;
লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ !
সে কোন প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান
অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে !
আমার দেহের গন্ধে পাই তার শরীরের ঘ্রাণ ,-
সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে !
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে ,- তার সাথে সে-ও আছে জেগে !
২
নক্ষত্রের আলো জ্বেলে পরিষ্কার আকাশের’পর
কখন এসেছে রাত্রি !- পশ্চিমের সাগরের জলে
তার শব্দ ;- উত্তর সমুদ্র তার, - দক্ষিণ সাগর
তাহার পায়ের শব্দে- তাহার পায়ের কোলাহলে
ভ’রে ওঠে ;- এসেছে সে আকাশের নক্ষত্রের তলে
প্রথম যে এসেছিল , তারি মতো ;- তাহার মতন
চোখ তার ,- তাহার মতন চুল,- বুকের আঁচলে
প্রথম মেয়ের মতো ;- পৃথিবীর নদী মাঠ বন
আবার পেয়েছি তারে,- সমুদ্রের পারে রাত্রি এসেছে কখন !
৩
সে এসেছে,- আকাশের শেষ আলো পশ্চিমের মেঘে
সন্ধ্যার গহ্বর খুঁজে পালায়েছে !- রক্তে রক্তে লাল
হয়ে গেছে বুক তার ,- আহত চিতার মতো বেগে
পালায়ে গিয়েছে রোদ ,- স’রে গেছে আলোর বৈকাল !
চ’লে গেছে জীবনের ‘আজ’ এক, - আর এক ‘কাল’
আসিত না যদি আর আলো লয়ে – রৌদ্র সঙ্গে লয়ে ! –
এই রাত্রি – নক্ষত্র সমুদ্র লয়ে এমন বিশাল
আকাশের বুক থেকে পড়িত না যদি আর ক্ষয়ে !-
রয়ে যেত, - যে গান শুনিনি আর তাহার স্মৃতির মতো হয়ে !
৪
যে পাতা সবুজ ছিল – তবুও হলুদ হতে হয় ,-
শীতের হাড়ের হাত আজো তারে যায় নাই ছুঁয়ে ;-
যে মুখ যুবার ছিল ,- তবু যার হয়ে যায় ক্ষয় ,
হেমন্তের রাতের আগে ঝ’রে যায় ,- প’ড়ে যায় নুয়ে ;-
পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে
পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে ,- জলে জলে , পশ্চিম সাগরে
তোমার বিনুনি খুলে ,- হেঁট হয়ে ,- পা তোমার থুয়ে ,-
তোমার নক্ষত্র জ্বেলে ,- তোমার জলের স্বরে স্বরে
রয়ে যেতে যদি তুমি আকাশের নিচে ,- নীল পৃথিবীর’পড়ে !
৫
ভোরের সূর্যের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন
মেঘের মতন চুল – অন্ধকার চোখের আস্বাদ
একবার পেতে চায় ;- যে –জন রয় না-যেই জন
চলে যায় , তারে পেতে আমাদের বুকে যেই সাধ ;-
যে ভালোবেসেছে শুধু , হয়ে গেছে হৃদয় অবাধ
বাতাসের মতো যার ,- তাহার বুকের গান শুনে
মনে যেই ইচ্ছা জাগে ;- কোনোদিন দেখে নাই চাঁদ
যেই রাত্রি ,- নেমে আসে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রেরে গুনে
যেই রাত্রি , আমি তার চোখে চোখ , চুলে তার চুল নেব বুনে !
৬
তুমি রয়ে যাবে,- তবু,-অপেক্ষায় রয় না সময়
কোনোদিন;- কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে !
সকলেই পথ চলে ,- সকলেই ক্লান্ত তবু হয় ;-
তবুও দু’জন কই ব’সে থাকে হাতে হাত ধ’রে !
তবুও দু’জন কই কে কাহারে রাখে কোলে ক’রে !
মুখে রক্ত ওঠে – তবু কমে কই বুকের সাহস !
যেতে হবে ,- কে এসে চুলের ঝুঁটি টেনে লয় জোরে !
শরীরের আগে কবে ঝ’রে যায় হৃদয়ের রস !-
তবু,- চলে ,- মৃত্যুর ঠোঁটের মতো দেহ যার হয়নি অবশ !
৭
হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াউড়ি !-
কবরের থেকে শুধু আকাঙ্ক্ষার ভূত লয়ে খেলা !-
আমরাও ছায়া হয়ে ,- ভূত হয়ে করি ঘোরাঘুরি !-
মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা
সন্ধ্যার অনেক আগে ! – দুপুরেই হয়েছি একেলা !
আমরাও চরি-ফিরি কবরের ভূতের মতন !
বিকেলবেলার আগে ভেঙে গেছে বিকালের মেলা ,-
শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন !
হেমন্ত আসেনি মাঠে ,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন !
৮
শীত – রাত ঢের দূরে ,- অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে !
শাদা হাত দুটো শাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর
একবার মনে আনে,- চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে
পারি এই দিনগুলো ! – আমাদের রক্তের ভিতর
বরফের মতো শীত ,- আগুনের মতো তবু জ্বর !
যেই গতি ,- সেই শক্তি পৃথিবীর অন্তরে পঞ্জরে ;-
সবুজ ফলায়ে যায় পৃথিবীর বুকের উপর ,-
তেমনি স্ফুলিঙ্গ এক আমাদের বুকে কাজ করে !
শস্যের কীটের আগে আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে !
৯
যতদিন রয়ে যাই এই শক্তি রয়ে যায় সাথে ,-
বিকালের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতন !
যে-ফসল নষ্ট হবে তারি ক্ষেত উড়াতে ফুরাতে
আমাদের বুকে এসে এই শক্তি করে আয়োজন !
নতুন বীজের গন্ধে ভ’রে দেয় আমাদের মন
এই শক্তি ,- একদিন হয়তো বা ফলিবে ফসল !-
এরি জোরে একদিন হয়তো বা হৃদয়ের বন
আহ্লাদে ফেলিবে ভ’রে অলক্ষিত আকাশের তল !
দুরন্ত চিন্তার মতো গতি তার ,- বিদ্যুতের মত সে চঞ্চল !
১০
অঙ্গারের মতো তেজ কাজ করে অন্তরের তলে,-
যখন আকাঙ্ক্ষা এক বাতাসের মতো বয়ে আসে,
এই শক্তি আগুনের মতো তার জিভ তুলে জ্বলে !
ভস্মের মতন তাই হয়ে যায় হৃদয় ফ্যাকাশে !
জীবন ধোঁয়ার মতো ,- জীবন ছায়ার মতো ভাসে ;
যে অঙ্গার জ্ব’লে জ্ব’লে নিভে যাবে ,- হয়ে যাবে ছাই,-
সাপের মতন বিষ লয়ে সেই আগুনের ফাঁসে
জীবন পুড়িয়া যায় ;- আমরাও ঝ’রে পুড়ে যাই !
আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি –তবু শক্তি চাই !
১১
জান তুমি ?- শিখেছ কি আমাদের ব্যর্থতার কথা ?-
হে ক্ষমতা , বুকে তুমি কাজ করো তোমার মতন !-
তুমি আছ,- রবে তুমি,- এর বেশি কোনো নিশ্চয়তা
তুমি এসে দিয়েছ কি ? – ওগো মন, মানুষের মন,-
হে ক্ষমতা ,- বিদ্যুতের মতো তুমি সুন্দর- ভীষণ !
মেঘের ঘোড়ার’পড়ে আকাশের শিকারীর মতো ;-
সিন্ধুর সাপের মতো লক্ষ ঢেউয়ে তোলো আলোড়ন !
চমৎকৃত করো,- শরীরেরে তুমি করেছ আহত !
যতই জেগেছ,- দেহ আমাদের ছিঁড়ে যেতে চেয়েছে যে তত !
১২
তবু তুমি শীত- রাতে আড়ষ্ট সাপের মতো শুয়ে
হৃদয়ের অন্ধকারে প’ড়ে থাকো ,- কুণ্ডলী পাকায়ে !-
অপেক্ষায় ব’সে থাকি,- স্ফুলিঙ্গের মতো যাবে ছুঁয়ে
কে তোমারে !- ব্যাধের পায়ের পাড়া দিয়ে যাবে গায়ে
কে তোমারে !- কোন অশ্রু , কোন পীড়া হতাশার ঘায়ে
কখন জাগিয়া ওঠো ;- স্থির হয়ে ব’সে আছি তাই ।
শীত- রাত বাড়ে আরো ,- নক্ষত্রেরা যেতেছে হারায়ে ,-
ছাইয়ে যে-আগুন ছিল সেই সবও হয়ে যায় ছাই !
তবুও আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই !
১৩
অশান্ত হাওয়ার বুকে তবু আমি বনের মতন
জীবনেরে ছেড়ে দিছি !- পাতা আর পল্লবের মতো
জীবন উঠেছে বেজে শব্দে – স্বরে;- যতবার মন
ছিঁড়ে গেছে ,- হয়েছে দেহের মতো হৃদয় আহত
যতবার ;- উড়ে গেছে শাখা , পাতা পড়ে গেছে যত ;-
পৃথিবীর বন হয়ে- ঝড়ের গতির মতো হয়ে ,
বিদ্যুতের মতো হয়ে আকাশের মেঘে ইতস্তত ;-
একবার মৃত্যু লয়ে – একবার জীবনেরে লয়ে
ঘূর্ণির মতন বয়ে যে বাতাস ছেঁড়ে ,- তার মতো গেছি বয়ে !
১৪
কোথায় রয়েছে আলো- আঁধারের বীণার আস্বাদ !
ছিন্ন রুগ্ন ঘুমন্তের চোখে এক সুস্থ স্বপ্ন হয়ে
জীবন দিয়েছে দেখা ;- আকাশের মতন অবাধ
পরিচ্ছন্ন পৃথিবীতে , সিন্ধুর হাওয়ার মতো বয়ে
জীবন দিয়েছে দেখা ;- জেগে উঠে সেই ইচ্ছা লয়ে
আড়ষ্ট তারার মতো চমকায়ে গেছি শীতে- মেঘে !
ঘুমায়ে যা দেখি নাই , জেগে উঠে তার ব্যথা স’য়ে
নির্জন হতেছে ঢেউ হৃদয়ের রক্তের আবেগে !
-যে আলো নিভিয়া গেছে তাহার ধোঁয়ার মতো প্রাণ আছে জেগে !
১৫
নক্ষত্র জেনেছে কবে ওই অর্থ শৃঙ্খলার ভাষা !
বীণার তারের মতো উঠিতেছে বাজিয়া আকাশে
তাদের গতির ছন্দ,- অবিরত শক্তির পিপাসা
তাহাদের,- তবু সব তৃপ্ত হয়ে পূর্ণ হয়ে আসে !
আমাদের কাজ চলে ইশারায় ,- আভাসে- আভাসে !
আরম্ভ হয় না কিছু,- সমস্তের তবু শেষ হয় ,-
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে
তারো বড়ো ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয় !
যা হয়েছে শেষ ,- শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয় !-
১৬
সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস
দোলা দিয়ে গেল কবে ! –বাসি পাতা ভূতের মতন
উড়ে আসে ! – কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস ,-
যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন !-
জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ !
মরণ ,- সে ভালো এই অন্ধকার সমুদ্রের পাশে !
বাঁচিয়া থাকিতে যারা হিঁচড়ায় – করে প্রাণপণ ,-
এই নক্ষত্রের তলে একবার তারা যদি আসে ,-
রাত্রিরে দেখিয়া যায় একবার সমুদ্রের পারের আকাশে !-
১৭
মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো !
সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা !
সকল মাটির গন্ধ আর সব নক্ষত্রের আলো
যে পেয়েছে ,- সকল মানুষ আর দেবতার কথা
যে জেনেছে,- আর এক ক্ষুধা তবু- এক বিহ্বলতা
তাহারো জানিতে হয় ! এইমতো অন্ধকারে এসে !-
জেগে জেগে যা জেনেছ ,- জেনেছ তা- জেগে জেনেছ তা ,-
নতুন জানিবে কিছু হয়তো বা ঘুমের চোখে সে !
সব ভালোবাসা যার বোঝা হল ,- দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে !
১৮
কিংবা এই জীবনেরে একবার ভালোবেসে দেখি !
পৃথিবীর পথে নয় ,- এইখানে- এইখানে ব’সে ;-
মানুষ চেয়েছে কিবা ? পেয়েছে কি ?- কিছু পেয়েছে কি !-
হয়তো পায়নি কিছু – যা পেয়েছে , তা-ও গেছে খ’সে
অবহেলা ক’রে ক’রে , কিংবা তার নক্ষত্রের দোষে ;-
ধ্যানের সময় আসে তারপর,- স্বপ্নের সময় !-
শরীর ছিঁড়িয়া গেছে ,- হৃদয় পড়িয়া গেছে ধ্বসে !-
অন্ধকার কথা কয় ,- আকাশের তারা কথা কয়
তারপর,- সব গতি থেমে যায়,- মুছে যায় শক্তির বিস্ময় !
১৯
কেউ আর ডাকিবে না ,- এইখানে এই নিশ্চয়তা !-
তোমার দু’চোখ কেউ দেখে থাকে যদি পৃথিবীতে ,
কেউ যদি শুনে থাকে কবে তুমি কি কয়েছ কথা ,
তোমার সহিত কেউ থেকে থাকে যদি সেই শীতে ,-
সেই পৃথিবীর শীতে ,- আসিবে কি তোমারে চিনিতে
এইখানে সে আবার !- উঠানে পাতার ভিড়ে ব’সে ,
কিংবা ঘরে – হয়তো দেয়ালে আলো জ্বেলে দিতে দিতে ,-
যখন হঠাৎ নিভে যাবে তার হাতের আলো সে ,-
অসুস্থ পাতার মতো দুলে তার মন থেকে প’ড়ে যাবে খ’সে !
২০
কিংবা কেউ কোনোদিন দেখে নাই ,- চেনেনি আমারে !
সকালবেলার আলো ছিল যার সন্ধ্যার মতন ,-
চকিত ভূতের মতো নদী আর পাহাড়ের ধারে
ইশারায় ভূত ডেকে জীবনের সব আয়োজন
আরম্ভ সে করেছিল ! –কোনোদিন কোনো লোকজন
তার কাছে আসে নাই ;- আকাঙ্ক্ষার কবরের’পরে
পুবের হাওয়ার মতো এসেছে সে হঠাৎ কখন !-
বীজ বুনে গেছে চাষা ,- সে বাতাস বীজ নষ্ট করে !
ঘুমের চোখের’পরে নেমে আসে অশ্রু আর অনিদ্রার স্বরে !
২১
যেমন বৃষ্টির পরে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ এসে
আবার আকাশ ঢাকে ,- মাঠে মাঠে অধীর বাতাস
ফোঁপায় শিশুর মতো,- একবার চাঁদ ওঠে ভেসে ,-
দূরে- কাছে দেখা যায় পৃথিবীর ধান ক্ষেত ঘাস ,
আবার সন্ধ্যার রঙে ভ’রে ওঠে সকল আকাশ ,-
মড়ার চোখের রঙে সকল পৃথিবী থাকে ভ’রে !-
যে মরে যেতেছে তার হৃদয়ের সব শেষ শ্বাস
সকল আকাশ আর পৃথিবী থেকে পড়ে ঝ’রে ।
জীবনে চলেছি আমি সে পৃথিবীর আকাশের পথ ধরে ধরে !
২২
রাত্রির ফুলের মতো – ঘুমন্তের হৃদয়ের মতো
অন্তর ঘুমায়ে গেছে ,- ঘুমায়েছে মৃত্যুর মতন !-
সারাদিন বুকে ক্ষুধা লয়ে চিতা হয়েছে আহত ,-
তারপর,- অন্ধকার গুহাএই- ছায়াভরা বন
পেয়েছে সে ! – অশান্ত হাওয়ার মতো মানুষের মন
বুজে গেছে- রাত্রি আর নক্ষত্রের মাঝখানে এসে !-
মৃত্যুর শান্তির স্বাদ এইখানে দিতেছে জীবন ,-
জীবনের এইখানে একবার দেখি ভালোবেসে !
শুনে দেখি,- কোন কথা কয় রাত্রি, কোন কথা নক্ষত্র বলে সে !
২৩
পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভ’রে-
শস্য ফ’লে গেছে মাঠে ,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা ;
নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ ক’রে
নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা ,-
মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা ,-
আবার জানায়ে যায় !- কবরের ভূতের মতন
পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা হতাশা ,-
বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন !-
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন !
২৪
হলুদ পাতার মতো ,- আলেয়ার বাষ্পের মতন ,
ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া-মেঘ আকাশের ধারে ,
আলোর মাছির মতো- রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন
একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে ,-
ঢেউ ভেঙে ঝ’রে যায় ,- ম’রে যায় ,- কে ফেরাতে পারে !
তবুও ইশারা করে ফাল্গুন- রাতের গন্ধে বয়ে
মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে
জীবন ডাকিতে আসে ;- হয় নাই – গিয়েছে যা হয়ে ,
মৃত্যুরেও ডাকো তুমি সেই ব্যথা আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা লয়ে !
২৫
মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো ,- প্রিয়ার মতন !-
চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ ;
রোগীর জ্বরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন ;
অসুস্থ চোখের’পরে অনিদ্রার মতন অসুখ ;
তাই আমি প্রিয়তম ;- প্রিয়া ব’লে জড়ায়েছি বুক ,-
ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া !-
যে ধূপ নিভিয়া যায় তার ধোঁয়া আঁধারে মিশুক ,-
যে ধোঁয়া মিলায়ে যায় তারে তুমি বুকে তুলে নিয়া
ঘুমোনো গন্ধের মতো স্বপ্ন হয়ে তার ঠোঁটে চুমো দিও , প্রিয়া !
২৬
মৃত্যুরে ডেকেছি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধ’রে ।
যে বালক কোনোদিন জানে নাই গহ্বরের ভয় ,
পুবের হাওয়ার মতো ভূত হয়ে মন তার ঘোরে !-
নদীর ধারে সে ভূত একদিন দেখেছে নিশ্চয় !
পায়ের তলের পাতা – পাপড়ির মতো মনে হয়
জীবনেরে ,- খ’সে ক্ষয়ে গিয়েছে যে, তাহার মতন
জীবন পড়িয়া থাকে ,- তার বিছানায় খেদ ,- ক্ষয় –
পাহাড় নদীর পারে হাওয়া হয়ে ভূত হয়ে মন
চকিত পাতার শব্দে বাতাসের বুকে তারে করে অন্বেষণ !
২৭
জীবন ,- আমার চোখে মুখ তুমি দেখেছ তোমার ,-
একটি পাতার মতো অন্ধকারে পাতা- ঝরা গাছে ;-
একটি বোঁটার মতো যে-ফুল ঝরিয়া গেছে তার;
একাকী তারার মতো , সব তারা আকাশের কাছে
যখন মুছিয়া গেছে ,- পৃথিবীতে আলো আসিয়াছে ;-
যে ভালোবেসেছে , তার হৃদয়ের ব্যথার মতন ;-
কাল যাহা থাকিবে না,- আজই যাহা স্মৃতি হয়ে আছে ;-
দিন-রাত্রি – আমাদের পৃথিবীর জিইবন তেমন !
সন্ধ্যার মেঘের মতো মুহূর্তের রং লয়ে মুহূর্তে নূতন !
২৮
আশঙ্কা ইচ্ছার পিছে বিদ্যুতের মতো কেঁপে ওঠে !
বীণার তারের মতো কেঁপে কেঁপে ছিঁড়ে যায় প্রাণ !
অসংখ্য পাতার মতো লুটে তারা পথে পথে ছোটে ,-
যখন ঝড়ের মতো জীবনের এসেছে আহ্বান !
অধীর ঢেউয়ের মতো – অশান্ত হাওয়ার মতো গান
কোন দিকে ভেসে যায় !- উড়ে যায়,- কয় কোন কথা !-
ভোরের আলোয় আজ শিশিরের বুকে যেই ঘ্রাণ ,
রহিবে না কাল তার কোনো স্বাদ ,- কোনো নিশ্চয়তা !
পাণ্ডুর পাতার রং গালে,- তবু রক্তে তার রবে অসুস্থতা !
২৯
যেখানে আসেনি চাষা কোনোদিন কাস্তে হাতে লয়ে,
জীবনের বীজ কেউ বোনে নাই যেইখানে এসে ,
নিরাশার মতো ফেঁপে চোখ বুজে পলাতক হয়ে
প্রেমের মৃত্যুর চোখে সেইখানে দেখিয়াছি শেষ !
তোমার চোখের’পরে তাহার মুখেরে ভালোবেসে
এখানে এসেছি আমি ,- আর একবার কেঁপে উঠে
অনেক ইচ্ছার বেগে ,- শান্তির মতন অবশেষে
সব ঢেউ ভেঙে নিয়ে ফেনার ফুলের মতো ফুটে ,
ঘুমাব বালির’পরে ;- জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে !
৩০
নির্জন রাত্রির মতো শিশিরের গুহার ভিতরে ,-
পৃথিবীর ভিতরের গহ্বরের মতন নিঃসাড়
রবো আমি ;- অনেক গতির পর- আকাঙ্ক্ষার পরে
যেমন থামিতে হয় – বুজে যেতে হয় একবার :-
পৃথিবীর পারে থেকে কবরের মৃত্যুর ওপার
যেমন নিস্তব্ধ শান্ত নিমীলিত শূন্য মনে হয় ;-
তেমন আস্বাদ এক কিংবা সেই স্বাদহীনতার
সাথে একবার হবে মুখোমুখি সব পরিচয় !
শীতের নদীর বুকে মৃত জোনাকির মুখ তবু সব নয় !
৩১
আবার পিপাসা সব ভূত হয়ে পৃথিবীর মাঠে ,-
অথবা গৃহের’পরে –ছায়া হয়ে , ভূত হয়ে ভাসে !-
যেমন শীতের রাতে দেখা যায় জ্যোৎস্না ধোঁয়াটে ,
ফ্যাকাশে পাতার’পরে দাঁড়ায়েছে উঠানের ঘাসে ;-
যেমন হঠাৎ দুটো কালো পাখা চাঁদের আকাশে
অনেক গভীর রাতে চমকের মতো মনে হয় ;
কার পাখা?- কোন পাখি ? পাখি সে কি ! অথচ সে আসে !-
তখন অনেক রাতে কবরের মুখ কথা খয় !-
ঘুমন্ত তখন ঘুমে, জাগিতে হতেছে যার , সে জাগিয়া রয় !
৩২
বনের পাতার মতো কুয়াশার হলুদ না হতে ,
হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে প’ড়ে গেছি ঝ’রে !-
তোমার বুকের’পরে মুখ আমি চেয়েছি লুকোতে ;
তোমার দুইটি চোখ প্রিয়ার মতো ক’রে
দেখিতে চেয়েছি , মৃত্যু – পথ থেকে ঢের দূরে স’রে
প্রেমের মতন হয়ে !- তুমি হবে শান্তির মতন!-
তারপর স’রে যাব,- তারপর তুমি যাবে মরে,-
অধীর বাতাস লয়ে কাঁপুক না পৃথিবীর বন !-
মৃত্যুর মতন তবু বুজে যাক,- ঘুমাক মৃত্যুর মতো মন !
৩৩
নির্জন পাতার মতো ,- আলেয়ার বাষ্পের মতন ,
ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া-মেঘ আকাশের ধারে ,
আলোর মাছির মতো- রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন
একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে ,-
ঢেউ ভেঙে ঝ’রে যায় ,- ম’রে যায় ,- কে ফেরাতে পারে !
তবুও ইশারা করে ফাল্গুন- রাতের গন্ধে বয়ে
মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে
জীবন ডাকিতে আসে ;- হয় নাই – গিয়েছে যা হয়ে ,
মৃত্যুরেও ডাকো তুমি সেই স্মৃতি আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা লয়ে !
৩৪
পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভ’রে-
শস্য ফ’লে গেছে মাঠে ,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা ;
নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ ক’রে
নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা ,-
মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা ,-
আবার জানায়ে যায় !- কবরের ভূতের মতন
পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা হতাশা ,-
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
যতদিন পৃথিবীতে জীবন রয়েছে
দুই চোখ মেলে রেখে স্থির
মৃত্যু আর বঞ্চনার কুয়াশার পারে
সত্য সেবা শান্তি যুক্তির
নির্দেশের পথ ধ’রে চ’লে
হয়তো-বা ক্রমে আরো আলো
পাওয়া যাবে বাহিরে—হৃদয়ে;
মানব ক্ষয়িত হয় না জাতির ব্যক্তির ক্ষয়ে।ইতিহাস ঢের দিন প্রমাণ করেছে
মানুষের নিরন্তর প্রয়াণের মানে
হয়তো-বা অন্ধকার সময়ের থেকে
বিশৃঙ্খল সমাজের পানে
চ’লে যাওয়া;—গোলকধাঁধাঁর
ভুলের ভিতর থেকে আরো বেশি ভুলে;
জীবনের কালোরঙা মানে কি ফুরুবে।
শুধু এই সময়ের সাগর ফুরুলে।জেগে ওঠে তবু মানুষ রাত্রিদিনের উদয়ে;
চারিদিকে কলরোল করে পরিভাষা
দেশের জাতির ব্যর্থ পৃথিবীর তীরে;
ফেনিল অস্ত্র পাবে আশা?
যেতেছে নিঃশেষ হয়ে সব?
কী তবে থাকবে?
আঁধার ও মননের আজকের এ নিষ্ফল রীতি
মুছে ফেলে আবার সচেষ্ট হয়ে উঠবে প্রকৃতি?ব্যর্থ উওরাধিকারে মাঝে-মাঝে তবু
কোথাকার স্পষ্ট সুর্য-বিন্দু এসে পড়ে;
কিছু নেই উত্তেজিত হলে;
কিছু নেই স্বার্থের ভিতরে;
ধনের অদেয় কিছু নেই, সেই সবই
জানে এ খন্ডিত রক্ত বণিক পৃথিবী;
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালোঃ
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
(এই সব ভালো লাগে) : জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে
আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,—আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল –
এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,
পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে
ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টসটসে ভিজে জামরুল,
নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; –
পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসেকবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর;
তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে
মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়;
তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়;
পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা — একা সারারাত জাগে;
কি বা হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।
নিমপেঁচা তবু হাঁকে : ‘পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো
কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন আর।’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
তোমার সৌন্দর্য নারী, অতীতের দানের মতন।
মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে
ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো
আমাদের নিয়ে যায় ডেকে
শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে;
তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।
অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে
দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি
সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু
দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি:
যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে
তার স্নিগ্ধ মালতী-সৌরভে।
মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড়ো বড়ো নগরীর বুকভরা ব্যথা;
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প স্বপ্নের
উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।
তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো :
এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
শীতের ঘুমের থেকে এখন বিদায় নিয়ে বাহিরের অন্ধকার রাতে
হেমন্তলক্ষ্মীর সব শেষ অনিকেত অবছায়া তারাদের
সমাবেশ থেকে চোখ নামায়ে একটি পাখির ঘুম কাছে
পাখিনীর বুকে ডুবে আছে,–
চেয়ে দেখি;– তাদের উপরে এই অবিরল কালো পৃথিবীর
আলো আর ছায়া খেলে–মৃত্যু আর প্রেম আর নীড়।
এ ছাড়া অধিক কোনো নিশ্চয়তা নির্জন্তা জীবনের পথে
আমাদের মানবীয় ইতিহাস চেতনায়ও নেই;– (তবু আছে।)
এমনই অঘ্রাণ রাতে মনে পড়ে–কত সব ধূসর বাড়ির
আমলকীপল্লবের ফাঁক দিয়ে নক্ষত্রের ভিড়
পৃথিবীর তীরে–তীরে ধূসরিম মহিলার নিকটে সন্নত
দাঁড়ায়ে রয়েছে কত মানবের বাষ্পাকুল প্রতীকের মতো–
দেখা যেত; এক আধ মহূর্ত শুধু;– সে অভিনিবেশ ভেঙ্গে ফেলে
সময়ের সমুদ্রের রক্ত ঘ্রাণ পাওয়া গেল;– ভীতিশব্দ রীতিশব্দ মুক্তিশব্দ এসে
আরো ঢের পটভূমিকার দিকে দিগন্তের ক্রমে
মানবকে ডেকে নিয়ে চ’লে গেল প্রেমিকের মতো সসম্ভ্রমে;
তবুও সে প্রেম নয়, সুধা নয়,– মানুষের ক্লান্ত অন্তহীন
ইতিহাস–আকুতির প্রবীণতা ক্রমায়াত ক’রে সে বিলীন?আজ এই শতাব্দীতে সকলেরি জীবনের হৈমন্ত সৈকতে
বালির উপরে ভেসে আমাদের চিন্তা কাজ সংকল্পের তরঙ্গকঙ্কাল
দ্বীপসমুদ্রের মতো অস্পষ্ট বিলাপ ক’রে তোমাকে আমাকে
অন্তহীন দ্বীপহীনতার দিকে অন্ধকারে ডাকে।
কেবলি কল্লোল আলো–জ্ঞান প্রম পূর্ণত্র মানবহৃদয়
সনাতন মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে– তবু– ঊনিশ শো অনন্তের জয়হয় যেতে পারে, নারি, আমাদের শতাব্দীর দীর্ঘতর চেতনার কাছে
আমরা সজ্ঞান হয়ে বেঁচে থেকে বড়ো সময়ের
সাগরের কূলে ফিরে আমাদের পৃথিবীকে যদি
প্রিয়তর মনে করি প্রিয়তম মৃত্যু অবধি;–
সকল আলোর কাজ বিষণ্ন জেনেও তবু কাজ ক’রে– গানে
গেয়ে লোকসাধারণ ক’রে দিতে পারি যদি আলোকের মানে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
চারিদিকে সৃজনের অন্ধকার র’য়ে গেছে, নারী,
অবতীর্ণ শরীরের অনুভূতি ছাড়া আরো ভালো
কোথাও দ্বিতীয় সূর্য নেই, যা জ্বালালে
তোমার শরীর সব অলোকিত ক’রে দিয়ে স্পষ্ট ক’রে দেবে কোনো কালে
শরীর যা র’য়ে গেছে।
এই সব ঐশী কাল ভেঙে ফেলে দিয়ে
নতুন সময় গ’ড়ে নিজেকে না গ’ড়ে তবু তুমি
ব্রহ্মান্ডের অন্ধকারে একবার জন্মাবার হেতু
অনুভব করেছিলে;-
জন্ম-জন্মান্তের মৃত স্মরণের সাঁকো
তোমার হৃদয় স্পর্শ করে ব’লে আজ
আমাকে ইশারাপাত ক’রে গেলে তারি;-
অপার কালের স্রোত না পেলে কী ক’রে তবু, নারী
তুচ্ছ, খন্ড, অল্প সময়ের স্বত্ব কাটায়ে অঋণী তোমাকে কাছে পাবে-
তোমার নিবিড় নিজ চোখ এসে নিজের বিষয় নিয়ে যাবে?
সময়ের কক্ষ থেকে দূর কক্ষে চাবি
খুলে ফেলে তুমি অন্য সব মেয়েদের
আত্ম অন্তরঙ্গতার দান
দেখায়ে অনন্তকাল ভেঙ্গে গেলে পরে,
যে-দেশে নক্ষত্র নেই- কোথাও সময় নেই আর-
আমারো হৃদয়ে নেই বিভা-
দেখাবো নিজের হাতে- অবশেষে কী মকরকেতনে প্রতিভা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
আকাশের থেকে আলো নিভে যায় ব’লে মনে হয়।
আবার একটি দিন আমাদের মৃগতৃষ্ণার মতো পৃথিবীতে
শেষ হয়ে গেল তবে;— শহরের ট্রাম
উত্তেজিত হয়ে উঠে সহজেই ভবিতব্যতার
যাত্রীদের বুকে নিয়ে কোন্ এক নিরুদ্দেশ কুড়োতে চলেছে।
এই দিকে পায়দলদের ভিড়—অই দিকে টর্চের মশালে বার—বার
যে যার নিজের নামে সকলের চেরে আগে নিজের নিকটে
পরিচিত;— ব্যক্তির মতন নিঃসহায়;
জনতাকে অবিকল অমঙ্গল সমুদ্রের মতো মনে ক’রে
যে যার নিজের কাছে নিবারিত দ্বীপের মতন
হয়ে পড়ে অভিমানে—ক্ষমাহীন কঠিন আবেগে।সে মুহূর্ত কেটে যায়; ভালোবাসা চায় না কি মানুষ নিজের
পৃথিবীর মানুষের? শহরে রাত্রির পথে হেঁটে যেতে যেতে
কোথাও ট্রাফিক থেকে উৎসারিত অবিরল ফাঁস
নাগপাশ খুলে ফেলে কিছুক্ষণ থেমে থেমে এ রকম কথা
মনে হয় অনেকেরই;—
আত্মসমাহিতিকূট ঘুমায়ে গিয়েছে হৃদয়ের!
তবু কোনো পথ নেই এখনো অনেক দিন, নেই।
একটি বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে নিভে গেছে প্রায়।
আমাদের আধো-চেনা কোনো-এক পুরোনো পৃথিবী
নেই আর। আমাদের মনে চোখে প্রচারিত নতুন পৃথিবী
আসে নি তো।
এই দুই দিগন্তের থেকে সময়ের
তাড়া খেয়ে পলাতক অনেক পুরুষ—নারী পথে
ফুটপাতে মাঠে জীপে ব্যারাকে হোটেলে অলিগলির উত্তেজে
কমিটি-মিটিঙে ক্লাবে অন্ধকারে অনর্গল ইচ্ছার ঔরসে
সঞ্চারিত উৎসবের খোঁজে আজো সূর্যের বদলে
দ্বিতীয় সূর্যকে বুঝি শুধু অন্ন, শক্তি, অর্থ, শুধু মানবীর
মাংসের নিকটে এসে ভিক্ষা করে। সারাদিন— অনেক গভীর
রাতের নক্ষত্র ক্লান্ত হয়ে থাকে তাদের বিলোল কাকলীতে।
সকল নেশন আজ এই এক বিলোড়িত মহা-নেশনের
কুয়াশায় মুখ ঢেকে যে যার দ্বীপের কাছে তবু
সত্য থেকে— শতাব্দীর রাক্ষসী বেলায়
দ্বৈপ-আত্মা-অন্ধকার এক-একটি বিমুখ নেশন।শীত আর বীতশোক পৃথিবীর মাঝখানে আজ
দাঁড়ায়ে এ জীবনের কতগুলো পরিচিত সত্ত্বশূন্য কথা—
যেমন নারীর প্রেম, নদীর জলের বীথি, সারসের আশ্চর্য ক্রেঙ্কার
নীলিমায়, দীনতায় যেই জ্ঞান, জ্ঞানের ভিতর থেকে যেই
ভালোবাসা; মানুষের কাছে মানুষের স্বাভাবিক
দাবীর আশ্চর্য বিশুদ্ধতা; যুগের নিকটে ঋণ, মনবিনিময়,
এবং নতুন জননীতিকের কথা— আরো স্মরণীয় কাজ
সকলের সুস্থতার— হৃদয়ের কিরিণের দাবী করে; আর অদূরের
বিজ্ঞানের আলাদা সজীব গভীরতা;
তেমন বিজ্ঞান যাহা নিজের প্রতিভা দিয়ে জেনে সেবকের
হাত দিব্য আলোকিত ক’রে দেয়— সকল সাধের
কারণ-কর্দম-ফেণা প্রিয়তর অভিষেকে স্নিগ্ধ ক’রে দিতে;—
এই সব অনুভব ক’রে নিয়ে সপ্রতিভ হতে হবে না কি।
রাত্রির চলার পথে এক তিল অধিক নবীন
সম্মুখীন— অবহিত আলোকবর্ষের নক্ষত্রেরা
জেগে আছে। কথা ভেবে আমাদের বহিরাশ্রয়িতা
মানবস্বভাবস্পর্শে আরো ঋত— অন্তর্দীপ্ত হয়।কাব্যগ্রন্থ - বেলা অবেলা কালবেলা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
মাঝে মাঝে অন্য সব সত্য থেকে ছুটি
নিয়ে সব জল হয়ে মিশে যেতে চায়;
পৃথিবীর চলমান স্পন্দনের বিহবলতায়
রণ আছে, রক্ত আছে, রুজি আর রুটি
আছে-খাঁটি ভালোবাসা দিতে গিয়ে ত্রুটি
হয়ে যায়;অন্ধকারে হৃদয়ের দায়
বিমুক্ত করার মতো কাকে আর পায়
জল ছাড়া? চারি দিকে কেবলই ভ্রুকুটিছড়িয়ে এ পৃথিবীতে রক্তছাইরেখা
এঁকে মুছে ফেলে দিতে গিয়ে ইতিহাস
নদীর নিবিড় জলে কেবল জলের শব্দ খোঁজে;
যেন কাছে- কোথাও গভীরভাবে রয়েছে সহজে
পৃথিবীর স্নিগ্ধ অন্ধকার জল একাঃ
কবের বিলীন হংসী আর তার হাঁস।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
শতাব্দীর এই ধূসর পথে এরা ওরা যে যার প্রতিহারী।
আলো অন্ধকারের ক্ষণে যে যার মনে সময়সাগরের
ক্লান্তিবিহীন শব্দ শোনে;
অথবা তা নাড়ীর রক্তস্রোতের মতন ধ্বনি
না শুনে শোনা যায়।সময় গতির শব্দময়তাকে তবু ধীরে ধীরে যথাস্থানে রেখে
ট্রামের রোলে আরেক ভোরের সাড়া পেয়ে কেউ বা এখন শিশু,
কেউ বা যুবা, নটী, নাগর, দক্ষ-কন্যা, অজের মুণ্ড, অখল
পোলিটিশ্যান্
এদের হাতেই দিনের আলো নিজের সার্থকতা
খুঁজে বেড়ায়।চারিদিকেতে শিশুরা সব অন্ধ এঁদো গলির অপার পরলোকে আজ
জগৎ-শিশুর প্রাণের আকাশ ভেবে
জানে না কবে নীলিমাকে হারিয়ে ফেলেছে।
শিশু-অমঙ্গলের সকল জনিতারা এই পৃথিবীর সকল নগরীর
আবছায়াতে ক্লান্ত-কলকাকলীর প্রেতের পরিভাষা
ছড়িয়ে কবে ফুরিয়ে আবার সহজ মানব-কণ্ঠে কথা ক'বে?
আকাশমর্ত্যে মহাজাতক সূর্য-গ্রহণ ছাড়া
কোথাও কোনো তিলেক বেশি আলো
রয়েছে জানে না কি?
তবুও সবাই তারা
অন্ধকারের ভিতর থেকে ক্রমে ক্রমে যার হয়ে কি আসছে আরো
বিশাল আলোতে?কোথায় ট্রাম উধাও হয়ে চ'লেছে আলোকে।
কয়লা গ্যাসের নিরেস ঘ্রাণ ছড়িয়ে আলোকে
কোথায় এত বিমূঢ় প্রাণজন্তু নিয়ে অনন্ত বাস্, কার্,
এমন দ্রুত আবেগে চলেছে!
কোথাও দূরে দেবাত্মা পাহাড় রয়েছে কি?
ইতিহাসের ধারণাতীত সাগর নীলিমা?
চেনা জানা নকল আলোর আকাশ ছেড়ে সহজ সূর্য আছে।
নব নবীন নগর মেশিন প্রাণের বন্দর-
জলের বীথি আকাশী নীল রৌদ্রকণ্ঠী পাখি?
সেখানে প্রেমের বিচারসহ চোখের আলোয় গোলকধাঁধার থেকে
মুখ মানুষ নতুন সূর্য তারার পথের জ্যোতিধূর্লি-ধূসর হাসি দেখে
কি দীন, সহৃদয়?
জ্ঞান সেখানে অফুরন্ত প্যারাগ্রাফে ক্লান্তিহীন শব্দ যোজনায়
কিছুই নেই প্রমাণ করে শূন্যতাকে কুড়ায় নাক' তবে?পরস্পরের দাবির কাছে
অন্তরঙ্গ আত্মনিবেদনে
নবীন 'রে পরিচিত হওয়ার পরে নতুন পৃথিবী
রয়েছে জেনে আজকে ওরা চলার পথে ইতিহাসের চরম চেতনা;-
মানব নামের কঠিন হিসাব হয়তো মেলাতেছে
কী এক নতুন জ্যোতির্দেশী সমাজ সময় শান্তি গড়ার নীল সাগরের তীরে।চোখে যাদের চলতে দেখি তারা অনেক দেরী করে অনাথ মরু সাগর ঘুরে চলে;
মনের প্রয়াণ মোড় ঘুরে কি দেখেছে সরণি-
সাহস আলো প্রাণ যেখানে সবার তরে শুভ-
এই পৃথিবী ঘরণী।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
জামিরের ঘন বন অইখানে রচেছিলো কারা?
এইখানে লাগে নাই মানুষের হাত।
দিনের বেলায় যেই সমারূঢ় চিন্তার আঘাত
ইস্পাতের আশা গড়ে- সেই সব সমুজ্জ্বল বিবরণ ছাড়াযেন আর নেই কিছু পৃথিবীতেঃ এই কথা ভেবে
যাহারা রয়েছে ঘুমে তুলীর বালিশে মাথা গুঁজে;
তাহারা মৃত্যুর পর জামিরের বনে জ্যোৎস্না পাবে নাকো খুঁজে;
বধির-ইস্পাত খড়্গ তাহাদের কোলে তুলে নেবে।
সেই মুখ এখনও দিনের আলো কোলে নিয়ে করিতেছে খেলাঃ
যেন কোনো অসংগতি নেই- সব হালভাঙা জাহাজের মতো সমন্বয়
সাগরে অনেক রৌদ্র আছে ব’লে;- পরিব্যস্ত বন্দরের মতো মনে হয়
যেন এই পৃথিবীকে;- যেখানে অঙ্কুশ নেই তাকে অবহেলা
করিবে সে আজো জানি;- দিনশেষে বাদুড়ের-মতন-সঞ্চারে
তারে আমি পাবো নাকো;- এই রাতে পেয়ারার ছায়ার ভিতরে
তারে নয়- স্নিগ্ধ সব ধানগন্ধী প্যাঁচাদের প্রেম মনে পড়ে।
মৃত্যু এক শান্ত ক্ষেত- সেইখানে পাবো নাকো তারে।পৃথিবীর অলিগলি বেয়ে আমি কত দিন চলিলাম।
ঘুমালাম অন্ধকারে যখন বালিশেঃ
নোনা ধরে নাকো সেই দেওয়ালের
ধূসর পালিশে
চন্দ্রমল্লিকার বন দেখিলাম
রহিয়াছে জ্যোৎস্নায় মিশে।
যেই সব বালিহাঁস ম’রে গেছে পৃথিবীতে
শিকারির গুলির আঘাতেঃ
বিবর্ণ গম্বুজে এসে জড়ো হয়
আকাশের চেয়ে বড়ো রাতে;
প্রেমের খাবার নিয়ে ডাকিলাম তারে আমি
তবুও সে নামিল না হাতে।পৃথিবীর বেদনার মতো ম্লান দাঁড়ালামঃ
হাতে মৃত সূর্যের শিখা;
প্রেমের খাবার হাতে ডাকিলাম;
অঘ্রাণের মাঠের মৃত্তিকা
হ’য়ে গেলো;
নাই জ্যোৎস্না- নাই কো মল্লিকা।সেই সব পাখি আর ফুলঃ
পৃথিবীর সেই সব মধ্যস্থতা
আমার ও সৌন্দর্যের শরীরের সাথে
ম্যমির মতনও আজ কোনোদিকে নেই আর;
সেই সব শীর্ণ দীর্ঘ মোমবাতি ফুরায়েছে
আছে শুধু চিন্তার আভার ব্যবহার।
সন্ধ্যা না-আসিতে তাই
হৃদয় প্রবেশ করে প্যাগোডার ছায়ার ভিতরে
অনেক ধূসর বই নিয়ে।চেয়ে দেখি কোনো-এক আননের গভীর উদয়ঃ
সে-আনন পৃথিবীর নয়।
দু-চোখ নিমীল তার কিসের সন্ধানে?
‘সোনা- নারী- তিশি- আর ধানে’-
বলিল সেঃ ‘কেবল মাটির জন্ম হয়।’
বলিলামঃ ‘তুমিও তো পৃথিবীর নারী,
কেমন কুৎসিত যেন,- প্যাগোডার অন্ধকার ছাড়ি
শাদা মেঘ-খরশান বাহিরে নদীর পারে দাঁড়াবে কি?’‘শানিত নির্জন নদী’- বলিল সে- ‘তোমারি হৃদয়,
যদিও তা পৃথিবীর নাদী- ন্দী নয়ঃ
তোমারি চোখের স্বাদে ফুল আর পাতা
জাগে না কি? তোমারি পায়ের নিচে মাথা
রাখে না কি? বিশুস্ক- ধূসর-
ক্রমে-ক্রমে মৃত্তিকার কৃমিদের স্তর
যেন তারা; -অপ্সরা –উর্বশী
তোমার উৎকৃষ্ট মেঘে ছিলো না কি বসি?
ডাইনির মাংসের মতন
আজ তার জঙ্ঘা আর স্তন;
বাদুড়ের খাদ্যের মতন
একদিন হ’য়ে যাবে;
যে-সব মাছিরা কালো মাংস খায়- তারে ছিঁড়ে খাবে।’
কান্তারের পথে যেন সৌন্দর্যের ভূতের মতন
তাহারে চকিত আমি করিলাম;- রোমাঞ্চিত হ’য়ে তার মন
ব’লে গেলোঃ ‘তক্ষিত সৌন্দর্য সব পৃথিবীর
উপনীত জাহাজের মাস্তুলের সুদীর্ঘ শরীর
নিয়ে আসে একদিন, হে হৃদয়,- একদিন
দার্শনিকও হিম হয়- প্রণয়ের সম্রাজ্ঞীরা হবে না মলিন?’
কল্পনার অবিনাশ মহনীয় উদ্গিরণ থেকে
আসিল সে হৃদয়ের। হাতে হাত রেখে
বলিল সে। মনে হ’লো পাণ্ডুলিপি মোমের পিছনে
রয়েছে সে। একদিন সমুদ্রের কালো আলোড়নে
উপনিষদের শাদা পাতাগুলো ক্রমে ডুবে যাবে;
ল্যাম্পের আলো হাতে সেদিন দাঁড়াবে
অনেক মেধাবী মুখ স্বপ্নের বন্দরের তীরে,
যদিও পৃথিবী আজ সৌন্দর্যেরে ফেলিতেছে ছিঁড়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ — বহুকাল গেয়ে গেছ গান
সোনালি চিলের মতো উড়ে উড়ে আকাশের রৌদ্র আর মেঘে, —
লক্ষ্মীর বাহন যেই স্নিগ্ধ পাখি আশ্বিনের জ্যোৎস্নার আবেগে
গান গায় — গুনিয়াছি রাখিপূর্ণিমার রাতে তোমার আহ্বান
তার মতো; আম চাঁপা কদমের গাছ থেকে গাহে অফুরান
যেন স্নিগ্ধ ধান ঝরে.. অনন — সবুজ শালি আছে যেন লেগে
বুকে তব; বল্লালের বাংলায় কবে যে উঠলে তুমি জেগে;
পদ্মা, মেঘনা, ইছামতী নয় শুধু — তুমি কবি করিয়াছ স্নানসাত সমুদ্রের জলে, — ঘোড়া নিয়ে গেছ তুমি ধূম নারীবেশে
অর্জুনের মতো, আহা, — আরো দূর স্মান নীল রূপের কুয়াশা
ফুঁড়েছ সুপর্ন তুমি — দূর রং আরো দূর রেখা ভালোবেসে;
আমাদের কালীদাহ — গাঙুড় — গাঙের চিল তবু ভালোবাসা
চায় যে তোমার কাছে — চায়, তুমি ঢেলে দাও নিজেরে নিঃশেষে
এই দহে — এই চুর্ণ মঠে — মঠে — এই জীর্ণ বটে বাঁধো বাসা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
চিরদিন শহরেই থাকি
পড়ে থাকি পাটের আড়তে
করি কেরানির কাজ—শুভে-লাভে যদি কোনোমতে
দিন যায় চ’লে
আকাশের তলে
নক্ষত্রেরা কয় কোন্ কথা
জোৎস্নায় প্রাণের জড়তা
ব্যথা কেন পায়
সে সব খবর নিয়ে কাজ কিবা হায়বিয়ে হয়েছিল কবে—মরে গেছে বউ
যদিও মহুয়া গাছে ফুটে ওঠে মৌ
একবার ঝরে গেলে তবু তারপর
মহুয়া মহুয়া তবু : কেরানির ঘর
কেরানির ঘর শুধু হায়
জীবনের গল্প শুধু একবার আসে—শুধু একবার নীল কুয়াশায়
নিঃশেষে ফুরায়।দেবতা ভজি না আমি
তীর্থ করি নাকো
তোমরা ঠাকুর নিয়ে থাকো।
তবু আমি একবার ছুটি পেয়ে বেড়াবার তরে
গেলাম খানিকটা দূর—তারকেশ্বরে
গভীর অসাধ নিয়ে—গাঢ় অনিচ্ছায়
ট্রেনে আমি চড়িলাম হায়
কলরবে ধোঁয়ার ধূলায়
সাধ ক’রে কে বা মিছে যায়জানি না ঈশ্বর কে বা—জানি শুধু ভুখা ভগবান
দিনগত পাপক্ষয় ক’রে পাব ত্রাণ
তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে
কিংবা কাশি মিত্রের তল্লাটে
পড়ে রব
তবুও যখন আমি ঢের রাতে ফিরিলাম ঘর
বুকে জাগে সেই দেশ : তারকেশ্বর
দেবতারে কে খুঁজেছে—সারাদিন ঘুরিয়াছি পথে
অবসন্ন ধুলোর জগতে
অসংখ্য ভিড়ের মাঝে আমি
একখানা মুখ দেখে গিয়েছি যে থামি
সিংহের মূর্তির কাছে তাহারে ফেলেছি দেখে
দেখিয়াছি কবে যেন দেবতার পায়ে তা’রে
এশিরিয়া ব্যাবিলনে আমি
দেখেছি মিশরে
ঈসিসের ঘরে
সারাদিন—দিনমান আজ এই তারকেশ্বরে
আবার তাহার মুখ দেখিলাম, (আহা,)
ধানসিড়ি নদীটির বিকেল বেলার মৌন জলে
বেতের ফলের মতো যেই চোখ, যেই রূপ
ধরা দেয় পৃথিবীর নীরব আঁচলে
দেখিলাম তাহা
আবার তাহার মুখ দেখিলাম, আহা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে
তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে।
অমাময়ী নিশি যদি সুজনের শেষ কথা হয়,
আর তার প্রতিবিম্ব হয় যদি মানব-হৃদয়,
তবুও আমার জ্যোতি সৃষ্টির নিবিড় মনোবলে
জ্ব’লে ওঠে সময়ের আকাশের পৃথিবীর মনে;
বুঝিছি ভোরের বেলা রোদে নীলিমায়,
আঁধার অরব রাতে অগণন জ্যোতিষ্ক শিখায়;
মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হ’য়ে গেলে,
মুখে যা বলোনি, নারি, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি
লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো
দেহ হবে মন হবে-তুমি হবে সে-সবের জ্যোতি!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির
ঢালোনি অধরে তব, ধরা-মোহিনীর
উর্ধ্বফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী
আসে নি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি,
চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু
বিষবহ্নি ঢালেনিকো বাসনার বধূ
অন্তরের পানপাত্রে তব;
অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উৎসব,
অশ্রুহীন হাসি,
কামনার পিছে ঘুরে সাজোনি উদাসী।
ধবল কাশের দলে, আশ্বিনের গগনের তলে
তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ণা কভু নাহি জ্বলে!
নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরুদ্যান।
অপরূপ রূপ-পরীস্থান
দিগন্তের আগে
তোমার নির্মেঘ-চক্ষে কভু নাহি জাগে!
আকাশকুসুবীথি দিয়া
মাল্য তুমি আনো না রচিয়া,
উধাও হও না তুমি আলেয়ার পিছে
ছলাময় গগনের নিচে!
-রূপ-পিপাসায় জ্বলি মৃত্যুর পাথারে
স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে
করোনিকো করাঘাত তুমি
সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি
সাজোনিকো নীলকন্ঠ ব্যাকুল বাউল!
অধরে নাহিকো তৃষ্ণা, চক্ষে নাহি ভুল,
রক্তে তব অলক্ত যে পরে নাই আজও রানী,
রুধির নিঙাড়ি তব আজও দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন।
কারাগার নাহি তব, নাহিকো বন্ধন;
দীঘল পতাকা, বর্শা তন্দ্রাহারা প্রহরীর লও নি তুলিয়া,
-সুকুমার কিশোরের হিয়া!
-জীবনসৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী,
বক্ষে তব নাচে নিকো যৌবনের দুরন্ত জলধি;
শূল-তোলা শম্ভূর মতন
আস্ফালিয়া উঠে নাই মন
মিথ্যা বাধা-বিধানের ধ্বংসের উল্লাসে!
তোমার আকাশে
দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠেনিকো জ্বলি
কক্ষচ্যুত উল্কাসম পড়েনিকো স্খলি,
কুজ্ঝটিকা-আবর্তের মাঝে
অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে!
সব বিঘ্ন সকল আগল
ভাঙিয়া জাগোনি তুমি স্পন্দন-পাগল
অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে
দুরন্ত দুরাশা তুমি জাগাও নি প্রাণে।
নিঃস্ব দুটি অঞ্জলির আকিঞ্চন মাগি
সাজোনিকো দিকভোলা দিওয়ানা বৈরাগী!
পথে পথে ভিক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু
বাজাওনি শ্মশান-ডমরু!
জ্যোৎস্নাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর
চক্ষে তব জাগেনি কিশোর!
আঁধারের নির্বিকল্প রূপ,
স্পন্দহীন বেদনার কূপ
রুদ্ধ তব বুকে;
তোমার সম্মুখে
ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল-সুন্দরীর বেশে,
নিত্য বেলাশেষে
যেই পুষ্প ঝরে,
যে বিরহ জাগে চরাচরে,
গোধূলির অবসানে শ্লোকম্লান সাঁঝে,
তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে,
আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া জ্বালো নাই চিতা,
ব্যথার সংহিতা
গাহ নাই তুমি!
দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব-মরুভূমি
জ্বলন্ত নিষ্ঠুর!
নগরীর ক্ষুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃত্যুপ্রেতপুর,
ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি
ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি!
সভ্যতার বীভৎস ভৈরবী
মলিন করে নি তব মানসের ছবি,
ফেনিল করেনি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো,
এ উদভ্রান্ত যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজ ঢালো, বন্ধু, ঢালো!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে-অতীত আর
যেই শীত ক্লান্তিহীন কাটায়েছিলাম;
তাই শুধু কাটায়েছি।
কাটায়ে জানেছি এই-ই শূন্যে, তবু হৃদয়ের কাছে ছিল অন্য-কোন নাম।
অন্তহীন অপেক্ষার চেয়ে তবে ভালো
দ্বীপাতীত লক্ষ্যে অবিরাম চ’লে যাওয়া
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলায়
জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিলো দেহ একদিন;
বাংলার পথে পথে হেঁটেছিলো গাঙচিল শালিখের মতন স্বাধীন;
বাংলার জল দিয়ে ধূয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার;
একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চলে আসে অন্ধকার
বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে —নীল ধোঁয়া নরম মলিন
বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ;
ফেনসা ভাতের গন্ধে আম —মুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার —বার;এই সব দেখেছিল রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে যেই রক্তাক্ততা আছে,
শিখেছিল, সেই সব একদিন বাংলার চন্দ্রমালা রূপসীর কাছে;
তারপর বেত বনে,জোনাকি ঝিঝির পথে হিজল আমের অন্ধকারে
ঘুরেছে সে সৌন্দর্যের নীল স্বপ্ন বুকে করে,রূঢ় কোলাহলে গিয়ে তারে –
ঘুমন্ত — কন্যারে সেই —জাগাতে যায়নি আর — হয়তো সে কন্যার হৃদয়
শঙ্খের মতন রুক্ষ, অথবা পদ্মের মতো — ঘুম তবু ভাঙিবার নয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অনেক রাত্রিদিন ক্ষয় ক'রে ফেলে
এখন এসেছি এক উৎসের ভিতরে;
মাঠের উপরে ক্রমে ছায়া নেমে আসে,
দু-চারটে উঁচু গাছ রোদে খেলা করে।
পৃথিবী রক্তপাত অশান্তি এখন;
অর্থময়তা তবু পেতে পারে মন।কেউ নেই - শুধু এই মননের সহায়তা আছে;
যা-কিছু বুঝেছি অনেক দিন সে-সবের নীতি
দু-চারটে বই ঠাণ্ডা সলতের আলো
নক্ষত্র ও সূর্যে আধো উজ্জ্বল প্রকৃতি
আছে তবে, পৃথিবীতে হৃদয় যা চেয়েছিলো তার
শূন্যতাকে স্নিগ্ধ ক'রে রয়েছে যুক্তির অন্তঃসার।শরীর নির্বল হ'য়ে যেতেছে কেবলি;
ক্রমে আরো ক্ষমাহীন কঠিন সময়
মনকে নিস্তার দিলে দিতে পেরে তবু
শরীরকে ক'রে যাবে ক্ষয়;
ক্ষয়িত এ-শরীরের সঙ্গে মিলন
ভুলে মন হতে চায় সনাতন মন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
অনেক মুহূর্ত আমি করেছি ক্ষয়
করে ফেলে বুঝছি সময়
যদিও অনন্ত, তবু প্রেম যেন অনন্ত নিয়ে নয়।তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
এখন দিনের শেষে তিনজন আধো আইবুড়ো ভিখিরীর
অত্যন্ত প্রশান্ত হ'লো মন;
ধূসর বাতাস খেয়ে এক গাল- রাস্তার পাশে
ধূসর বাতাস দিয়ে ক'রে নিলো মুখ আচমন।
কেননা এখন তারা যেই দেশে যাবে তাকে রাঙা নদী বলে;
সেইখানে ধোপা আর গাধা এসে জলে
মুখ দেখে পরস্পরের পিঠে চড়ে যাদুবলে।তবুও যাবার আগে তিনটি ভিখিরী মিলে গিয়ে
গোল হ'য়ে বসে গেল তিন মগ চায়ে;
একটি উওজির, রাজা, বাকিটা কোটাল,
পরস্পরকে তারা নিলো বাৎলায়ে।
তবুও এক ভিখিরিনী তিনজন খোঁড়া, খুড়ো, বেয়াইয়ের টানে-
অথবা চায়ের মগে কুটুম হয়েছে এই জ্ঞানে
মিলে-মিশে গেল রাতা চার জোড়া কানে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে;
এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে;
জামের আড়ালে সেই বউকথাকওটিরে যদি ফেল দেখে
একবার — একবার দু’পহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে
ধরা দাও — তাহলে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে;
মৌরির গন্ধমাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে
আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা পোকাদের কাছে ডেকে
রব আমি চকোরীর সাথে যেন চকোরের মতন মিলনে;উঠানে কে রূপবতী খেলা করে — ছাড়ায়ে দিতেছে বুঝি ধান
শালিখের; ঘাস থেকে ঘাসে ঘাসে খুঁটে খুঁটে খেতেছে সে তাই;
হলুদ নরম পায়ে খয়েরি শালিখগুলো ডরিছে উঠান;
চেয়ে দ্যাখো সুন্দরীরে : গোরোচনা রূপ নিয়ে এসেছে কি রাই!
নীলনদে — গাঢ় রৌদ্রে — কবে আমি দেখিয়াছি — করেছিল স্নান
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
একটা মোটরকার
খটকা নিয়ে আসে।মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিস,
যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে
রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর
আলোর সন্তানদের মধ্যে
তার নাম সবচেয়ে প্রথম।একটা অন্ধকার জিনিস :
পরিষ্কার ভোরের বেলা
দেশের মটরশুঁটি-কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে-মাঠে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি
লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে
হিজলগাছ দুটোর নিচে দিয়ে
উনিশশো চৌত্রিশের মডেল একটা মোটরকার
ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটেছে;
পথ ঘাট ক্ষেত শিশির সরে যেতে থাকে,
ভোরের আলো প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে কোণের বধূর মতো
সহসা অগোচর
মাঠ নদী যেন নিশ্চেষ্ট,
সহসা যেন প্রতীজ্ঞা হারিয়ে ফেলে,
এই মোটর অগ্রদূত,
সে ছুটে চলেছে
যেই পথে সকলের যাওয়া উচিত;
একটা মোটরকারের পথ
সব সময়েই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।
স্ট্যান্ডে
শহরের বিরাট ময়দানের পুবে পশ্চিমে-ফুটপাথের পাশে
মোটারকার;
নিঃশব্দ।
মাথায় হুড
ভিতরের বুরুশ-করা গভীর গদিগুলো
পালিশ স্টিয়ারিং-হুইল হেডলাইট;
কী নিয়ে স্থির?
কলকাতার ময়দানের একটা গাছ অন্য কিছু নিয়ে স্থির,
আমি অন্যকিছু নিয়ে স্থির;
মোটরের স্থিরতা একটা অন্ধকার জিনিসএকটা অন্ধকার জিনিস :
রাতের অন্ধকারে হাজার-হাজার কার হু-হু করে ছুটছে
প্যারিসে-নিউইয়র্কে-লন্ডনে-বার্লিনে-ভিয়েনায়-কলকাতায়
সমুদ্রের এপার ওপার ছুঁয়ে
অসংখ্য তারের মতো,
রাতের উল্কার মতো,
মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো
তারাও চলেছে;
কোথায় চলেছে, তা আমি জানি না।একটা মোটরকারের পথ- মোটরকার
সবসময়ই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি —
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে
এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।
পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:
সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,
বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;
ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;
নাড়বো না আমি
নেড়ে কার কি লাভ;
মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে
মানে এই — অমিতা বলছি যাকে —
কিন্তু কথাটা থাক;
কিন্তু তবুও —
আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,
নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে
এখন কি করে মন কারভান হবে।
প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৎ সিমুমে
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি,
হৃদয়, হৃদয় তুমি!
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে
সেখানে বালির সব নিরবতা ধূ ধূ
প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।
অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?
অমিতা নিজে কি তাকে?
অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,
ঢের অবসর চাই;
দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই
এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু,
ফিরে এসে রাতে ক্লাবে;
কখন সময় হবে।
হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে —
হৃদয় কেন যে কাঁপে,
‘ভালোবাসতাম’ — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে
তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান।
সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?
আজো ভালোবাসে নাকি?
ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে;
কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে
এর উত্তর হবে?
সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;
অমিতা কি মিহিজামে?
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন-রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার:
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, —
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক
তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস,
সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত
সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ
সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
বুকে তব সুর-পরী বিরহ-বিধুর
গেয়ে যায়, হে জলধি, মায়ার মুকুর!
কোন্ দূর আকাশের ময়ুর-নীলিমা
তোমারে উতলা করে! বালুচর সীমা
উলঙ্ঘি তুলিছ তাই শিরোপা তোমার,-
উচ্ছৃঙ্খল অট্টহাসি,-তরঙ্গের বাঁকা তলোয়ার!
গলে মৃগতৃষ্ণাবিষ, মারীর আগল
তোমার সুরার স্পর্শে আশেক-পাগল!
উদ্যত উর্মির বুকে অরূপের ছবি
নিত্যকাল বহিছ হে মরমিয়া কবি
হে দুন্দুভি দুর্জয়ের, দুরন্ত, আগধ।
পেয়েছি শক্তির তৃপ্তি, বিজয়ের স্বাদ
তোমার উলঙ্গনীল তরঙ্গের গানে!
কালে কালে দেশে দেশে মানুষ-সন্তানে
তুমি শিখায়েছ বন্দু দুর্মদ-দুরাশা!
আমাদের বুকে তুমি জাগালে পিপাসা
দুশ্চর তটের লাগি-সুদূরের তরে।
রহস্যের মায়াসৌধ বক্ষের উপরে
ধরেছ দুস্তর কাল;- তুচ্ছ অভিলাষ,
দুদিনের আশা, শানি, আকাঙক্ষা, উল্লাস,
পলকের দৈন্য-জ্বালা-জয়-পরাজয়,
ত্রাস- ব্যথা হাসি-অশ্রু-তপস্যা সঞ্চয়,-
পিনাকশিখায় তব হ’ল ছারখার।
ইচ্ছার বাড়বকুন্ডে, উগ্র পিপাসার
ধূ ধূ ধূ ধূ বেদীতটে আপনারে দিতেছ আহুতি।
মোর ক্ষুধা-দেবতারে তুমি কর স্তুতি!
নিত্য নব বাসনার হলাহলে রাঙি
‘পারীয়া’র প্রাণ লয়ে আছি মোরা জাগি
বসুধার বাঞ্ছাকূপে, উঞ্ছের অঙ্গনে!
নিমেষের খেদ-হর্ষ-বিষাদের সনে
বীভৎস খঞ্জের মতো করি মাতামাতি!
চুরমার হয়ে যায় বেলোয়ারি বাতি!
ক্ষুরধার আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া চিতা
গড়ি তবু বারবার-বারবার ধুতুরার তিতা
নিঃস্ব নীল ওষ্ঠ তুলি নিতেছি চুমিয়া!
মোর বক্ষকপোতের কপোতিনী প্রিয়া
কোথা কবে উড়ে গেছে,-পড়ে আছে আহা
নষ্ট নীড়,- ঝরা পাতা,- পূবালির হাহা!
কাঁদে বুকে মরা নদী,- শীতের কুয়াশা!
ওহে সিন্ধু, আসিয়াছি আমি সর্বনাশা
ভুখারি ভিখারি একা, আসন্ন-বিকাশ!
-চাহি না পলার মালা, শুক্তির কলস,
মুক্তাতোরণের তট মীনকুমারীর,
চাহি না নিতল নীড় বারুণীরাণীর।
মোর ক্ষুধা উগ্র আরো, অলঙ্ঘ্য অপার!
একদিন কুকুরের মতো হাহাকার
তুলেছিনু ফোঁটা ফোঁটা রুধিরের লাগি!
একদিন মুখখানা উঠেছিল রাঙি
ক্লেদবসাপিন্ড চুমি রিক্ত বাসনার!
মোরে ঘিরে কেঁদেছিল কুহেলি আঁধার,-
শ্মশানফেরুর পাল,- শিশিরের নিশা,
আলেয়ার ভিজা মাঠে ভুলেছিনু দিশা।
আমার হৃদয়পীঠে মোর ভগবান
বেদনার পিরামিড পাহাড়প্রমাণ
গেঁথে গেছে গরলের পাত্র চুমুকিয়া;
রুদ্র তরবার তব উঠুক নাচিয়া
উচ্ছিষ্টের কলেজায়, অশিব-স্বপনে,
হে জলধি, শব্দভেদী উগ্র আস্ফালনে!
-পূজাথালা হাতে ল’য়ে আসিয়াছে কত পান্থ, কত পথবালা
সহর্ষে সমুদ্রতীরে; বুকে যার বিষ-মাখা শায়কের জ্বালা
সে শুধু এসেছে বন্ধু চুপে চুপে একা
অন্ধকারে একবার দুজনার দেখা!
বৈশাখের বেলাতটে সমুদ্রের স্বর,-
অনন্ত, অভঙ্গ, উষ্ণ, আনন্দসুন্দর!
তারপর, দূরপথে অভিযান বাহি
চলে যাব জীবনের জয়গান গাহি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে
জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স’ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
চারিদিকে শান্ত বাতি — ভিজে গন্ধ — মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;-
এশিরিয়া ধুলো আজ — বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
অনন্ত জীবন যদি পাই আমি তাহ’লে অনন্তকাল একা
পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিবো সবুজ ঘাস ফুটে উঠে
দেখিবো হলুদ ঘাস ঝরে যায় দেখিবো আকাশ শাদা হয়ে উঠে ভোরে-
ছেঁড়া মুনিয়ার মত রাঙা রক্ত—রেখা লেগে থাকে বুকে
তার সন্ধ্যায়—বারবার নক্ষত্রের দেখা পাবো আমি;
দেখিবো অচেনা নারী আলগা খোঁপার ফাঁস খুলে ফেলে চলে যায়
মুখে তার নাই আহা গোধূলির নরম আভাস।অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অসীমকাল একা
পৃথিবীর পথে যদি ফিরি আমি—ট্রাম বাস ধুলো দেখিবো অনেক আমি—
দেখিবো অনেকগুলো বস্তি, হাট—এঁদো গলি, ভাঙ্গা কলকী হাড়ী
মারামারি, গালাগালি, ট্যারা চোখ, পচা চিংড়ি—কত কি দেখিব নাহি লেখা
তবুও তোমার সাথে অনন্তকালেও আর হবে নাকো’ দেখা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায়;হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা বায়; - রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে -
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো — অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে
কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে –
দিনমানে কোনো মুখ হয়তো সে শ্মশানের কাছে নাহি আসে –
তবুও কাঁঠাল জাম বাংলার- তাহাদের ছায়া যে পড়িছে
আমার বুকের পরে — আমার মুখের পরে নীরবে ঝরিছে
খয়েরী অশথপাতাত — বইচি, শেয়ালকাঁটা আমার এ দেহ ভালোবাসে,
নিবিড় হয়েছে তাই আমার চিতার ছাইয়ে — বাংলার ঘাসে
গভীর ঘাসের গুচ্ছে রয়েছি ঘুমায়ে আমি, — নক্ষত্র নড়িছেআকাশের থেকে দূর-আরো দূর-আরো দূর-নির্জন আকাশে
বাংলার-তারপর অকারণ ঘুমে আমি পড়ে যাই ঢুলে।
আবার যখন জাগি, আমা শ্মশানচিতা বাংলার ঘাসে
ভরে আছে, চেয়ে দেখি,-বাসকের গন্ধ পাই-আনারস ফুলে
ভোমরা উড়িছে,শুনি-গুবরে পোকার ক্ষীণ গুমরানি ভাসিছে বাতাসে
রোদের দুপুর ভরে-শুনি আমি; ইহারা আমার ভালোবাসে-
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমরা যদি রাতের কপাট খুলে ফেলে এই পৃথিবীর নীল সাগরের বারে
প্রেমের শরীর চিনে নিতাম চারিদিকের রোদের হাহাকারে,–
হাওয়ায় তুমি ভেসে যেতে দখিণ দিকে– যেই খানেতে যমের দুয়ার আছে;
অভিচারী বাতাসে বুক লবণ– বিলুন্ঠিত হলে আবার মার কাছে
উৎরে এসে জানিয়ে দিতে পাখিদেরও স্খলন আছে।
আমরা যদি রাতের কপাট খুলে দিতাম নীল সাগরের দিকে,
বিষণ্নতার মুখর কারুকার্যে বেলা হারিয়ে যেত জ্যোতির মোজেয়িকে।দিনের উজান রোদের ঢলে যতটা দূরে আকাশ দেখা যায়
তোমার পালক শাদা হয়ে অমেয় নীলিমায়
ঐ পৃথিবীর সাটিনপরা দীর্ঘ গড়ন নারীর মতো– তবুও তো এক পাখি;
সকল অলাত এইতিহাসের হৃদয় ভেঙ্গে বৃহৎ সবিতা কি!
যা হয়েছে যা হতাছে সকল পরখ এইবারেতে নীল সাগরের নীড়ে
গুঁড়িয়ে সূর্যনারী হলো, অকূল পাথার পাখির শরীরে।
গভীর রৌদ্রে সীমান্তের এই ঢেউ– অতিবেল সাগর, নারি, শাদা
হতে–হতে নীলাভ হয়;– প্রেমের বিসার, মহিয়সী, ঠিক এ–রকম আধা
নীলের মতো, জ্যোতির মতো। মানব ইতিহাসের আধেক নিয়ন্ত্রিত পথে
আমরা বিজোড়; তাই তো দুধের–বরণ–শাদা পাখির জগতে
অন্ধকারের কপাট খুলে শুকতারাকে চোখে দেখার চেয়ে
উড়ে গেছি সৌরকরের সিঁড়ির বহিরাশ্রয়িতা পেয়ে।অনেক নিমেষ অই পৃথিবীর কাঁটা গোলাপ শিশিরকণা মৃতের কথা ভেবে
তবু আরো অনন্তকাল ব’সে থাকা যেত; তবু সময় কি তা দেবে।
সময় শুধু বালির ঘড়ি সচল ক’রে বেবিলনের দুপুরবেলার পরে
হৃদয় নিয়ে শিপ্রা নদীর বিকেলবেলা হিরণ সূর্যকরে
খেলা ক’রে না ফুরোতেই কলকাতা রোম বৃহৎ নতুন নামের বিনিপাতে
উড়ে যেতে বলে আমার তোমার প্রাণের নীল সাগরের সাথে।না হলে এই পৃথিবীতে আলোর মুখে অপেক্ষাতুর ব’সে থাকা যেত
পাতা ঝরার দিকে চেয়ে অগণ্য দিন,–কীটে মৃণালকাঁটায় অনিকেত
শাদা রঙের সরোজিনীর মুখের দিকে চেয়ে,
কী এক গভির ব’সে থাকায় বিষণ্ণতার কিরণে ক্ষয় পেয়ে,
নারি, তোমার ভাবা যেত।– বেবিলনে নিভে নতুন কলকাতাতে কবে
ক্রান্তি, সাগর, সূর্য জ্বলে অনাথ ইতিহাসের কলরবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারি দিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে — গঙ্গাফড়িং সেও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।‘মাটির অনেক নীচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে
তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছ আধারে?
ওই যে ওকানে পায়রা একা ডাকে জমিরের বনে;
মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি-তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনেআমার এমন কাছে — আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে
আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে –’
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে — প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সময়ের সুতো নিয়ে কেটে গেছে ঢের দিন
এক আধবার শুধু নিশিত ক্ষমতা
এনেছিল,- তারপরে নিভে- মিশে গেছে;
হৃদয় কাটাল কান।
বালুঘড়ি ব'লে গেলঃ সময় রয়েছে ঢের
সেই সুর দূর এক আশ্চর্য কক্ষের
চোখের ভিতরে গিয়ে স্বর্ণ দীনারের
অমোঘ বৃত্তের মত রূপ নিয়ে নড়ে।
বালুঘড়ি ব'লে গেলঃ সময় রয়েছে ঢের
সময় রয়েছে ঢের ইহাদের- উহাদের;
সমুদ্রের বালি আর আকাশের তারার ভিতরে
চ'লেছে গাধার পিঠ- সিংহ, মেষ, বিদূষ্ক,
মূর্খ আর রূপসীর বিবাহ ঘটক,
ক্রীতদাস কাফরী তেল ব'য়ে আনে।
সময় রয়েছে ঢের- সময় রয়েছে ঢের
সরবপ্রাহের সব অগণন গণিকারা জানে।চারিদিকে মৃগয়ার কলরব- সময়ের বীজ।
অনেক শিকারী আজ নেমেছে আলোকে।
আমিও সূর্যের তেজ দেখে গেছি বহুক্ষণ
ভারুই পাখির মত চোখে;
ঘুরুনো আলোয় ঘুরে সংস্করে;- উড়িবার হেতু
যদিও নেইক' কিছু ক্ষিতিজ রেখার পথে আর।
বহু আগে রণ ক'রে গিয়েছিল বুদ্ধ আর মার;
অগ্নির অক্ষরে তবু গঠিত হয়েছে আজো সেতু।
ব্রহ্মার ডিমের সাথে একসাথে জন্মেছিল যারা ভালোবেসে
সেই স্বর্গ নরককে আবার ক্ষালন ক'রে- প্রমাণিত দেশে
তারাই তো রেখে দেবে,- মাঝখানে যদিও র'য়েছে আজ রক্তিম সাগর,
বিশ্বাসীরা চোখ বুজে ব'য়ে নেয় মুণ্ড আর কংকালের কেতু।
সম্রাটের সৈনিকেরা পথে পথে চ'রে
খুঁজে ফেরে কোন এক শুভলাঞ্ছন; সফেন কাজের ঢেউয়ে মৃত্যু আছে- জানে;
তার আগে র'য়ে গেছে জীবন-মৃত্যুর অমিলন;
যেনো কোনো নরকের কর্নিশের থেকে ধীরে উঠে
কোনো এক নিম্নতর আঁধারের বিজৃম্ভিম কাক
আবার সাজাতে পারে দু'মুহূর্ত ময়ূরের মতন পোষাক,
সৈকতে বালির কণা নক্ষত্রের রোলে যদি এক সাথে জুটে
আবছায়া, অগ্নিভয়, অন্ধকার- সময়ের হাত ঠেলে ফেলে
অনাবিল অন্ত"সার নিতে দেয় খুঁটে।সৈনিকের সম্রাটেরা স্থিরতর- তবু;
চারিদিকে মাতালের সাবলীল কাজ শেষ হ'লে
প্রতিধ্বনিত আর থাকে নাক' যখন আকাশে
জলের উপরে হেঁটে মায়বীর মত যায় চ'লে।
(গভীর সৌকর্য দেখে মানবীয় আত্মা জাগে জন্তুদের ভিড়ে;)
অবিস্মরণীয় সব ইতিহাস পর্যায়ের দিকে
চেয়ে দেখে সর্বদাই পৃথিবীর প্রবীণ জ্ঞানীকে
ডেকে আনে তারা নিত্য নতুন তিমিরে;
নিপুণ ছেলের হাতে লাটিমের মত ঘোরে' দ্বৈপায়ন বলে
ঘুরায়ে নিবিড় সেই প্যারাডিমটিরে।'যখন চিনির দাম বেড়ে গেছে ভয়ঙ্কর
রাতা খায় সেচ্ছায় নুনের পরিজ।
সমস্ত ভণ্ডুল হয়ে গেল পৃথিবীর,
মসৃন টেবিলে ব'সে খেলে যায় ব্রিজ।
জীবঙ্কে স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের মত মেনে নিয়ে
মঞ্চে বক্তৃতা দেয় কর গুণে- কুকুর ক্ষেপিরে'।
ব'লে গেল অত্যন্ত অদ্ভুত এক টুপিব্যবসায়ী নেমে এসে;
যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মত হেসে।'সমস্ত সভার মাঝে তারপর
দম আর থাকে নাক' কোনো কুকুরের;
একটি মাছিও আর বসে নাক' বক্তার নাকে
একটি মশাও তাকে পায় নাক' টের;
এবং পায়ের নিচে পৃথিবীরো মাটি আর নেই
তবু সবি পাওয়া যাবে চালানির মাল ছাড়ালেই।'
ব'লে গেল অত্যন্ত অদ্ভুত এক টুপিব্যবসায়ী নেমে এসে;
যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মত হেসে।'আমরা সকলে জানি বানরাজা নক্ষত্রের থেকে
সে জাহাজ এসে গেছে মুগশিরা তারকার দিকে;
হয়তো শরমা তাকে তুলে ধ'রে সারমেয়দের
নিকটে পাঠায়ে দেবে নির্জন তারিখে।
সম্প্রতি রুটিন তবে শেষ ক'রে- ঘুমাবার পরে
আবার সে দেখা দেবে আমাদের স্বাভাবিক সুবিধার তরে।'
ব'লে গেল অত্যন্ত অদ্ভুত এক টুপিব্যবসায়ী নেমে এসে;
যেখানে সম্ভ্রম করা সমুচিত সেখানে ভাঁড়ের মত হেসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস -
আকাশের ওপারে আকাশ।
কবিতা আশ্বিন ১৩৪৪
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
এই কি সিন্ধুর হাওয়া? রোদ আলো বনানীর বুকের বাতাস
কোথায় গভীর থেকে আসে!
অগণন পাখী উড়ে চ'লে গেলে তবু নীলাকাশ
কথা বলে নিজের বাতাসে।রাঙা মেঘ- আদি সূর্য- স্বাভাবিক সামাজিক ব্যবহার সব
ফুরিয়ে গিয়েছে কত দূরে।
সে অনেক মানবীয় কাল ভেঙে এখন বিপ্লব
নতুন মানব-উৎস কোথাও রয়েছে এই সুরে।যাযাবর ইতিহাসসহ পথ চিনে নিতে চায়।
অনেক ফ্যাক্টরি ফোর্ট ব্যাঙ্কারেরো আত্নস্থ মনের
অমার ভিতরে অমা রজনীর ভূকম্পনে কথা বলে যায়ঃ
আলো নেই, তবু তার অভিগমনের।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা–
অথবা দুপুরবেলা — বিকেলের আসন্ন আলোয়–
চেয়ে আছে — চলে যায় — জলের প্রতিভা।মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে।
আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল
কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে — নীচে
তোমার মুখের মতন অবিকল।নির্জন জলের রঙ তাকায়ে রয়েছে;
স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে
নিজের মুখের ঠান্ডা জলরেখা নিয়ে
পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে
এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় বলে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়;
অপরাহ্ণে আকাশের রং ফিকে হলে।তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;
তোমার বুকের ‘পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস;
তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন বাস করে হৃদয়ের নরম কাতর
অনেক নিভৃত কথা জানিয়াছি; পৃথিবীতে আমি বহুদিন
কাটায়েছি; বনে বনে ডালপালা উড়িতেছে — যেন পরী জিন্
কথা কয়; ধূসর সন্ধ্যায় আমি ইহাদের শরীরের পর
খইয়ের ধানের মতো দেখিয়াছি ঝরে ঝর্ ঝর
দু-ফোটা মেঘের বৃষ্টি, — শাদা ধুলো জলে ভিজে হয়েছে মলিন,
ম্লান গন্ধ মাঠে ক্ষেতে… গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ
অস্ফুট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভিতর:এই সব দেখিয়াছি; — দেখিয়াছি নদীটিরে — মজিতেছে ঢালু অন্ধকারে;
সাপমাসী উড়ে যায়; দাঁড়কাক অম্বনে’র নীড়ের ভিতর
পাখনার শব্দ করে অবিরাম; কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে
কে যেন দাঁড়ায়ে আছে: আরো দূরে দু একটা স — ব্দ খোড়ো ঘর
পড়ে আছে; — খাগড়ার বনে ব্যাং ডাকে কেন — থামিতে কি পারে;
‘তুমি কেন এইখানে’, ‘তুমি কেন এইখানে’ — শরের বনের থেকে দেয় সে উত্তর।
(আবার পাখনা নাড়ে — কাকের তরুন ডিম পিছলায়ে পড়ে যায় শ্যাওয়ার ঝাড়ে)
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিলো
সব চেয়ে আগে; জানি আমি।
সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই।
তুমি যে এ-পৃথিবীতে র’য়ে গেছো।
আমাকে বলেনি কেউ।
কোথাও জল্কে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল
র’য়ে গেছে;–
যে যার নিজের কাজে আছে, এই অনুভবে চ’লে
শিয়রে নিয়ত স্ফীত সুর্যকে চেনে তারা;
আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চিনে উদীচীর
কোনো জল কী ক’রে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?
তবুও জীবন ছুঁ’য়ে গেলে তুমি;-
আমার চোখের থেকে নিমেষ নিহত
সূর্যকে সরায়ে দিয়ে।স’রে যেতো; তবুও আয়ুর দিন ফুরোবার আগে।
নব-নব সূর্যকে কে নারীর বদলে
ছেড়ে দেয়; কেন দেব? সকল প্রতীতি উৎসবের
চেয়ে তবু বড়ো
স্থিরতর প্রিয় তুমি;- নিঃসূর্য নির্জন
ক’রে দিতে এলে।
মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম
তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো
বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম।
তুমি তা জানো না, তবু, আমি জানি, একবার তোমাকে দেখেছি;-
পিছনের পটভূমিকায় সময়ের
শেষনাগ ছিলো, নেই;- বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা
নিভে যায়;- মানুষ অপ্রিজ্ঞাত সে-আমায়; তবুও তাদের একজন
গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়!
আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু,
অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কে না জেনে কোথায় চলেছি!দুইচারিদিকে সৃজনের অন্ধকার র’য়ে গেছে, নারী,
অবতীর্ণ শরীরের অনুভূতি ছাড়া আরো ভালো
কোথাও দ্বিতীয় সূর্য নেই, যা জ্বালালে
তোমার শরীর সব অলোকিত ক’রে দিয়ে স্পষ্ট ক’রে দেবে কোনো কালে
শরীর যা র’য়ে গেছে।
এই সব ঐশী কাল ভেঙে ফেলে দিয়ে
নতুন সময় গ’ড়ে নিজেকে না গ’ড়ে তবু তুমি
ব্রহ্মান্ডের অন্ধকারে একবার জন্মাবার হেতু
অনুভব করেছিলে;-
জন্ম-জন্মান্তের মৃত স্মরণের সাঁকো
তোমার হৃদয় স্পর্শ করে ব’লে আজ
আমাকে ইসারাপাত ক’রে গেলে তারি;-
অপার কালের স্রোত না পেলে কী ক’রে তবু, নারী
তুচ্ছ, খন্ড, অল্প সময়ের স্বত্ব কাটায়ে অঋণী তোমাকে কাছে পাবে-
তোমার নিবিড় নিজ চোখ এসে নিজের বিষয় নিয়ে যাবে?
সময়ের কক্ষ থেকে দূর কক্ষে চাবি
খুলে ফেলে তুমি অন্য সব মেয়েদের
আত্ম অন্তরঙ্গতার দান
দেখায়ে অনন্তকাল ভেঙ্গে গেলে পরে,
যে-দেশে নক্ষত্র নেই- কোথাও সময় নেই আর-
আমারো হৃদয়ে নেই বিভা-
দেখাবো নিজের হাতে- অবশেষে কী মকরকেতনে প্রতিভা।তিনতুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে-অতীত আর
যেই শীত ক্লান্তিহীন কাটায়েছিলাম;
তাই শুধু কাটায়েছি।
কাটায়ে জানেছি এই-ই শূন্যে, তবু হৃদয়ের কাছে ছিল অন্য-কোন নাম।
অন্তহীন অপেক্ষার চেয়ে তবে ভালো
দ্বীপাতীত লক্ষ্যে অবিরাম চ’লে যাওয়া
শোককে স্বীকার ক’রে অবশেষে তবে
নিমেষের শরীরের উজ্জলতায়-অনন্তের জ্ঞানপাপ মুছে দিতে হবে।
আজ এই ধ্বংসমত্ত অন্ধকার ভেদ ক’রে বিদ্যুতের মতো
তুমি যে শরীর নিয়ে র’য়ে গেছো, সেই কথা সময়ের মনে
জানাবার আশার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে
একটি পলক শুধু- হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে?
অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষ মানুষ?-
ভাবি আমি;- জানি আমি,তবু
সে-কথা আমাকে জানাবার
হৃদয় আমার নেই;–
যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার
দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে
একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিষ্ক জগতে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে
বিশীর্ন বটের নীচে শুয়ে রব- পশমের মত লাল ফল
ঝরিবে বিজন ঘাসে-বাঁকা চাঁদ জেগে রবে- নদীটির জল
বাঙ্গালি মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে-তারপর যেই ভাঙ্গা ঘাটে
রূপসীরা আজ আর আসে নাকো,পাট শুধু পচে অবিরল,
সেইখানে কলমির দামে বেধে প্রেতনীর মত কেবল
কাঁদিবে সে সারা রাত-দেখিব কখন কারা এসে আমকাঠেসাজায়ে রেখেছে চিতাঃ বাংলার শ্রাবনের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে; ভিজে পেচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে
শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প-ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;
চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি-শাদা শাখা-বাংলার ঘাস
আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে
ভাঙ্গিতেছে ধীরে ধীরে-চারিদিকে জীবনের এই সব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস-
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে,
জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,
সন্ধ্যা-উষার বেদবাণী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,-মিশে গেছে হেথা মসজিদ , মন্দির!
কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি?
-মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী;
আরব মিশর তাতার তুর্কী ইরানের চেয়ে মোরা
ওগো ভারতের মোসলেমদল,- তোমাদের বুক-জোড়া!
ইন্দ্রপ্রস্থ ভেঙেছি আমরা,- আর্যাবর্ত ভাঙি
গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!
-নবীন প্রাণের সাড়া
আকাশে তুলিয়া ছুটিছে মুক্ত যুক্তবেণীর ধারা!
রুমের চেয়েও ভারত তোমার আপন,- তোমার প্রাণ!
-হেথায় তোমার ধর্ম অর্থ,- হেথায় তোমার ত্রাণ;
হেথায় তোমার আসান ভাই গো, হেথায় তোমার আশা;
যুগ যুগ ধরি এই ধূলিতলে বাঁধিয়াছ তুমি বাসা,
গড়িয়াছ ভাষা কল্পে কল্পে দরিয়ার তীরে বসি,
চক্ষে তোমার ভারতের আলো,-ভারতের রবি, শশী,
হে ভাই মুসলমান,
তোমাদের তরে কোল পেতে আছে ভারতের ভগবান!
এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহকো আমার একা,
হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,- মুসলমানের রেখা;
-হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,
ইন্দ্রদ্যুম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!
পাটলিপুত্র শ্রাবস্তী কাশী কোশল তক্ষশীলা।
অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!
-ভারতী কমলাসীনা
কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা!
এই ভারতের তখতে চড়িয়া শাহানশাহার দল
স্বপ্নের মণি-প্রদীপে গিয়েছে উজলি আকাশতল!
-গিয়েছে তাহার কল্পলোকের মুক্তার মালা গাঁথি,
পরশে তাদের জেগেছে আরব- উপন্যাসের রাতি!
জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লি,-লাহোর,-ফতেহপুর,
যমুনাজলের পুরানো বাঁশিতে বেজেছে নবীন সুর!
নতুন প্রেমের রাগে
তাজমহলের তরুণিমা আজো ঊষার আরুণে জাগে!
জেগেছে হেথায় আকবরী আইন,-কালের নিকষ কোলে
বারবার যার উজল সোনার পরশ উঠিল জ্বলে!
সেলিম,-শাজাহাঁ,- চোখের জলেতে এক্শা করিয়া তারা
গড়েছে মীনার মহলা স্তম্ভ কবর ও শাহদারা!
-ছড়ায়ে রয়েছে মোঘল ভারত,- কোটি সমাধির স্তূপ
তাকায়ে রয়েছে তন্দ্রাবিহীন,-অপলক অপরূপ!
-যেন মায়াবীর তুড়ি
স্বপনের ঘোরে ত্বব্ধ করিয়া রেখেছে কনকপুরী!
মোতিমহলের অযুত রাত্রি,- লক্ষ দীপের ভাতি
আজিও বুকের মেহেরাবে যেন জ্বালায়ে যেতেছে বাতি!
-আজিও অযুত বেগম-বাঁদীর শষ্পশয্যা ঘিরে
অতীত রাতের চঞ্চল চোখ চকিতে যেতেছে ফিরে!
দিকে দিকে আজো বেজে ওঠে কোন্ গজল-ইলাহী গান!
পথ-হারা কোন্ ফকিরের তানে কেঁদে ওঠে সারা প্রাণ!
-নিখিল ভারতময়
মুসলমানের স্বপন-প্রেমের গরিমা জাগিয়া রয়!
এসেছিল যারা ঊষর ধুসর মরুগিরিপথ বেয়ে,
একদা যাদের শিবিরে- সৈন্যে ভারত গেছিল ছেয়ে,
আজিকে তাহারা পড়শি মোদের,- মোদের বহিন-ভাই;
-আমাদের বুকে বক্ষে তাদের,-আমাদের কোলে ঠাঁই
‘কাফের’ ‘যবন’ টুটিয়া গিয়াছে,- ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা,
মোস্লেম্ বিনা ভারত বিফল,- বিফল হিন্দু বিনা;
-মহামৈত্রীর গান
বাজিছে আকাশে নব ভারতের গরিমায় গরীয়ান!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
চারিদিকে ভাঙনের বড় শব্দ,
পৃথিবী ভাঙার কোলাহল;
তবুও তাকালে সূর্য পশ্চিমের দিকে
অস্ত গেলে,... চাঁদের ফসল
পূবের আকাশে
হৃদয় বিহীনভাবে আন্তরিকতা ভালবাসে। তেরোশো পঞ্চাশ সালে কার্ত্তিকের ভোর;
সূর্যালোকিত সব স্থান
যদিও লঙ্গরখানা,
যদিও শ্মশান,
তবুও কল্কির ঘোড়া সরায়ে মেয়েটি তার যুবকের কাছে
সূর্যালোকিত হয়ে আছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্ কাহিনীর দেশে –
‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কল্মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে –
নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে
চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে
হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কত ভোরে- দু’-পহরে – সন্ধ্যায় দেখি নীল শুপুরির বন
বাতাসে কাঁপিছে ধীরে;- খাঁচার শুকের মতো গাহিতেছে গান
কোন এক রাজকন্যা- পরনে ঘাসের শাড়ি- কালো চুলে ধান
বাংলার শালিধান- আঙিনায় ইহাদের করেছে বরণ,
হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার- ঘুম নাই, নাইকো মরণ
তার আর কোনোদিন- পালঙ্কে সে শোয় নাকো, হয় নাকো স্লান,
লক্ষ্ণীপেঁচা শ্যামা আর শালিখের গানে তার জাগিতেছে প্রাণ-
সারাদিন- সারারাত বুকে ক’রে আছে তারে শুপুরির বন;সকালে কাকের ডাকে আলো আসে, চেয়ে দেখি কালো দাঁড়কাক
সবুজ জঙ্গল ছেয়ে শুপুরির- শ্রীমন্তও দেখেছে এমন :
যখন ময়ূরপঙ্খী ভোরের সিন্ধুর মেঘে হয়েছে অবাক,
সুদূর প্রবাস থেকে ফিরে এসে বাংলার শুপুরির বন
দেখিয়াছে- অকস্মাৎ গাঢ় নীল : করুণ কাকের ক্লান্ত ডাক
শুনিয়াছে- সে কত শতাব্দী আগে ডেকেছিল তাহারা যখন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কোথাও নদীর পারে সময়ের বুকে-
দাঁড়ায়ে রয়েছে আজো সাবেককালের এক স্তিমিত প্রাসাদ;
দেয়ালে একটি ছবিঃ বিচারসাপেক্ষ ভাবে নৃসিংহ উঠেছে;
কোথাও মঙ্গল সংঘটন হ’য়ে যাবে অচিরাৎ।নিবিড় রমণী তার জ্ঞানময় প্রেমিকের খোঁজে
অনেক মলিন যুগ- অনেক রক্তাক্ত যুগ সমুত্তীর্ণ ক’রে
আজ এই সময়ের পারে এসে পুনরায় দেখে
আবহ্মানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চ’ড়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ঢের দিন বেঁচে থেকে দেখেছি পৃথিবীভরা আলো
তবুও গভীর গ্লানি ছিল কুরুবর্ষে রোমে ট্রয়ে;
উত্তরাধিকার ইতিহাসের হৃদয়ে
বেশি পাপ ক্রমেই ঘনালো।সে গরল মানুষ ও মনীষীরা এসে
হয়তো বা একদিন ক’রে দেবে ক্ষয়;
আজ তবু কন্ঠে বিষ রেখে মানবতার হৃদয়
স্পষ্ট হতে পারে পরস্পরকে ভালবেসে।কোথাও রয়েছে যেন অবিনশ্বর আলোড়নঃ
কোনো এক অন্য পথে- কোন্ পথে নেই পরিচয়;
এ মাটির কোলে ছাড়া অন্য স্থানে নয়;
সেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ।আমাদের পৃথিবীর বনঝিরি জলঝিরি নদী
হিজল বাতাবী নিম বাবলার সেখানেও খেলা
করেছে সমস্ত দিন; হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা
ফেনিল বুদ্ধির দৌড়;- আজকের মানবের নিঃসঙ্গতা যদিসেসব শ্যামল নীল বিস্তারিত পথে
হ’তে চায় অন্য কোনো আলো কোনো মর্মের সন্ধানী,
মানুষের মন থেকে কাটবে না তা হ’লে যদিও সব গ্লানি
তবু আলো ঝল্কাবে অন্য এক সূর্যের শপথে।আমাদের পৃথিবীর পাখালী ও নীলডানা নদী
আমলকী জামরুল বাঁশ ঝাউয়ে সেখানেও খেলা
করেছে সমস্ত দিন;- হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা
বুদ্ধির বিচ্ছিন্ন শক্তি;- শতকের ম্লান চিহ্ন ছেড়ে দিয়ে যদিনরনারী নেমে পড়ে প্রকৃত ও হৃদয়ের মর্মরিত হরিতের পথে-
অশ্রু রক্ত নিস্ফলতা মরণের খণ্ড খণ্ড গ্লানি
তাহ’লে রবে;- তবু আদি ব্যথা হবে কল্যাণী
জীবনের নব নব জলধারা- উজ্জ্বল জগতে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
শোকমূলক
|
এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে।
যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে
সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা
এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা
হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তুপ দেখে মনে হয়
যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফ্রয়েড নিজ নিজ চিন্তার বিষয়
পরিশেষ করে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে
এখন ঘুমায়ে আছে—তাহাদের ঘুম ভেঙে দিতে
নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে—ওই পারে মৃত্যুর তালা
ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিস্টিক ইহুদী কাবালা
ঈশার শবোত্থান—বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু ক’রে
হেগেল ও মার্কস : তার ডান আর বাম কান ধ’রে
দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিল; এমন সময়
দু পকেটে হাত রেখে ভ্রুকুটির চোখে নিরাময়
জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম;
প্রেমের চেয়েও ভালো মনে হল একটি টোটেম :
উটের ছবির মতো—একজন নারীর হৃদয়ে;
মুখে-চোখে আকুতিতে মরীচিকা জয়ে
চলেছে সে; জড়ায়েছে ঘিয়ের রঙের মতো শাড়ি;
ভালো ক’রে দেখে নিলে মনে হয় অতীব চতুর দক্ষিণরাঢ়ী
দিব্য মহিলা এক; কোথায় সে আঁচলের খুঁট;
কেবলই উত্তরপাড়া ব্যাণ্ডেল কাশীপুর বেহালা খুরুট
ঘুরে যায় স্টালিন, নেহেরু, ব্লক, অথবা রায়ের বোঝা ব’য়ে,
ত্রিপাদ ভূমির পরে আরো ভূমি আছে এই বলির হৃদয়ে?
তা হলে তা প্রেম নয়; ভেবে গেল ত্রিবেদীর হৃদয়ের জ্ঞান।
জড় ও অজড় ডায়ালেক্টিক্ মিলে আমাদের দু দিকের কান
টানে ব’লে বেঁচে থাকি—ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিল টান। (মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ)
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমাদের পরিজন নিজেদের চিনেছিলো না কি?
এই সব সংকল্পের পিছে ফিরে হেমন্তের বেলাবেলি দিন
নির্দোষ আমোদ সাঙ্গ ক'রে ফেলে চায়ের ভিতরে;
চায়ের অসংখ্য ক্যান্টিন।
আমাদের উত্তমর্ণদের কাছে প্রতিজ্ঞার শর্ত চেয়ে তবু
তাহাদের খুঁজে পাই ছিমছাম,- কনুয়ের ভরে
ব'সে আছে প্রদেশের দূর বিসারিত সব ক্ষমতার লোভে।
কোথায় প্রেমিক তুমি; দীপ্তির ভিতরে!
কোথাও সময় নেই আমাদের ঘড়ির আঁধারে।
আমাদের স্পর্শাতুর কন্যাদের মন
বিশৃঙ্খল শতাব্দীর সর্বনাশ হ'য়ে গেছে জেনে
সপ্রতিভ রূপসীর মতো বিচক্ষণ,
যে-কোনো রাজার কাজে উৎসাহিত নাগরের তরে;
যে-কোনো ত্বরান্বিত উৎসাহের তরে;
পৃথিবীর বারগৃহ ধ'রে তারা উঠে যেতে চায়।
নীরবতা আমাদের ঘরে।
আমাদের ক্ষেতে-ভূঁয়ে অবিরাম হতমান সোনা
ফ'লে আছে ব'লে মনে হয়;
আমাদের হৃদয়ের সাথে
সে-সব ধানের আন্তরিক পরিচয়
নেই; তবু এই সব ফসলের দেশে
সূর্য নিরন্তর হিরণ্ময়;
আমাদের শস্য তবু অবিকল পরের জিনিস
মিড্ল্ম্যানদের কাছে পর নয়।
তাহারা চেনায়ে দেয় আমাদের ঘিঞ্জি ভাঁড়ার,
আমাদের জরাজীর্ণ ডাক্তারের মুখ,
আমাদের উকিলের অনুপ্রাণনাকে,
আমাদের পড়পরতার সব পড়তি কৌতুক
তাহারা বেহাত ক'রে ফেলে সব।
রাজপথে থেকে-থেকে মূঢ় নিঃশব্দতা
বেড়ে ওঠে; অকারণে এর-ওর মৃত্যু হ'য়ে গেলে-
অনুভব ক'রে তবু বলবার মতো কোনো কথা
নেই। বিকেলে গা ঘেঁষে সব নিরুত্তেজ সরজমিনে ব'সে
বেহেড আত্মার মতো সূর্যাস্তের পানে
চেয়ে থেকে নিভে যায় এক পৃথিবীর
প্রক্ষিপ্ত রাত্রির লোকসানে।
তবুও ভোরের বেলা বার-বার ইতিহাসে সঞ্চারিত হ'য়ে
দেখেছে সময়, মৃত্যু, নরকের থেকে পাপীতাপীদের গালাগালি
সরায়ে মহান সিংহ আসে যায় অনুভাবনায় স্নিগ্ধ হ'য়ে,-
যদি না সূর্যাস্তের ফের হয়ে যায় সোনালি হেঁয়ালি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
পরের ক্ষেতের ধানে মই দিয়ে উঁচু করে নক্ষত্রে লাগানো
সুকঠিন নয় আজ;
যে-কোনো পথের বাঁকে ভাঙনের নদীওর শিয়রে
তাদের সমাজ।
তবুও তাদের ধারা- ধর্ম অর্থ কাম কলরব কুশীলব-
কিংবা এ-সব থেকে আসন্ন বিপ্লব
ঘনারে- ফসল ফলায়ে- তবু যুগে-যুগে উড়ায়ে গিয়েছে পঙ্গপাল।
কাল তবু- হয়তো আগামী কাল।
তবুও নক্ষত্র নদী সূর্য নারী সোনার ফসল মিথ্যা নয়।
মানুষের কাছ থেকে মানবের হৃদয়ের বিবর্ণতা ভয়
শেষ হবে; চতুর্থ- আরো সব
আন্তর্জাতিক গ'ড়ে ভেঙে গ'ড়ে দীপ্তিমান কৃষিজাত জাতক মানব।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
ঘরের ভিতরে দীপ জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায়—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
ভিজে চালে ডুমুরের পাতা ঝরে—শালিখ বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময়
জানালার কাছে এসে, ভিজে জানালার কাছে
মৌমাছি বহুক্ষণ মৃদু গুমরায়
এইসব ভালো লাগে : এইসব ম্লান গন্ধ মৃদু স্বাদ চায়
পৃথিবীর পথে ঘুরে আমার হৃদয়
ডুমুরের পাতা ঝরে ভিজে চালে—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায়।এইসব ভালোবাসি—জীবনের পথে ঘুরে
এইসব ভালোবাসে আমার হৃদয়
ঘরে আলো, বৃষ্টি ক্ষান্ত হ’ল সন্ধ্যায়
ঘরের দীপ জ্বলে ওঠে, ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
ভিজে চালে কদমের পাতা ঝরে—শালিক বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময়
মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায়
মৃদু আরো মৃদু হয়ে অবিরল বাতাসে হারায়।।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছ;
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছ;
গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন
শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীরর গায়ে
কী চেয়েছে? কী পেয়েছে ?— গিয়েছে হারায়ে।
বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের,
ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;
তবুও সমুদ্র নীল: ঝিনুকের গায়ে আলপনা;
একটি পাখির গান কী রকম ভালো।
মানুষ কাউকে চায় — তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোন সাধনার ফল।
মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে
ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে
উতরোল বড়ো সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে
তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে
সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,
আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।
যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা।
মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে
ভূমধ্যসারলীন দূর এক সভ্যতার থেকে
আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে;–
তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
মনে প’ড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার ,
কহিলাম,- শোনো তবে ,-
শুনিতে লাগিল সবে,
শুনিল কুমার ;
কহিলাম ,- দেখেছি সে চোখ বুজে আছে,
ঘুমানো সে এক মেয়ে – নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে ;
সেইখানে আর নাই কেহ ,-
এক ঘরে পালঙ্কের’পরে শুধু এক খানা দেহ
প’ড়ে আছে ;- পৃথিবীর পথে- পথে রূপ খুঁজে খুঁজে
তারপর,- তারে আমি দেখেছি গো ,- সেও চোখ বুজে
প’ড়েছিল;- মসৃণ হাতের মতো শাদা হাত দুটি
বুকের উপরে তার রয়েছিল উঠি !
আসিবে না গতি যেন কোনদিন তাহার দু’পায়ে
পাথরের মতো শাদা গায়ে
এর যেন কোনোদিন ছিল না হৃদয় ,-
কিংবা ছিল – আমার জন্য তা নয় !
আমি গিয়ে তাই তারে পারিনি জাগাতে ,
পাষাণের মতো হাত পাষাণের হাতে
রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে লেগে ;
তবুও,- হয়তো তবু উঠিবে সে জেগে
তুমি যদি হাত দুটি ধরো গিয়ে তার !-
ফুরালাম রূপকথা , শুনিল কুমার ।
তারপর, কহিল কুমার,
আমিও দেখেছি তারে,- বসন্তসেনার !
মতো সেইজন নয় ,- কিংবা হবে তাই ,-
ঘুমন্ত দেশের সে-ও বসন্তসেনাই !
মনে পড়ে ,- শোনো ,- মনে পড়ে
নবমী ঝরিয়া গেছে নদীর শিয়রে ,-
( পদ্মা – ভাগীরথী – মেঘ্না – কোন নদী যে সে –
সে সব জানি কি আমি !- হয়তো বা তোমাদের দেশে
সেই নদী আজ আর নাই ,-
আমি তবু তার পাড়ে আজো তো দাঁড়াই ! )
সেদিন তারার আলো – আর নিবু নিবু জ্যোৎস্নায়
পথ দেখে , যেইখানে নদী ভেসে যায়
কান দিয়ে তার শব্দ শুনে ,
দাঁড়ায়েছিলাম গিয়ে মাঘরাতে ,- কিংবা ফালগুনে ।
দেশ ছেড়ে শীত যায় চ’লে
সে সময় – প্রথম দখিনে এসে পড়িতেছে ব’লে
রাতারাতি ঘুম ফেঁসে যায়,
আমারো চোখের ঘুম খসেছিল হায়,-
বসন্তের দেশে
জীবনের – যৌবনের ;- আমি জেগে,- ঘুমন্ত শুয়ে সে !
জমানো ফেনার মতো দেখা গেল তারে
নদীর কিনারে !
হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন
শুয়ে আছে ,- শুয়ে আছে শাদা হাতে ধবধবে স্তন
রেখেছে সে ঢেকে !
বাকিটুকু ,-থাক – আহা , একজনের দেখে শুধু – দেখে না অনেকে
এই ছবি !
দিনের আলোয় তার মুছে যায় সবি ! –
আজো তবু খুঁজি
কোথায় ঘুমন্ত তুমি চোখ আছো বুজি !
কুমারের শেষ হলে পরে ,-
আর এক দেশের এক রূপকথা বলিল আর একজন ,
কহিল সে ,- উত্তর সাগরে
আর নাই কেউ !-
জ্যোৎস্না আর সাগরের ঢেউ
উঁচুনিচু পাথরের’পরে
হাতে হাত ধ’রে
সেইখানে ; কখন জেগেছে তারা – তারপর ঘুমাল কখন !
ফেনার মতন তারা ঠাণ্ডা – শাদা,-
আর তারা ঢেউয়ের মতন
জড়ায়ে জড়ায়ে যায় সাগরের জলে !
ঢেউয়ের মতন তারা ঢলে !
সেই জল মেয়েদের স্তন
ঠাণ্ডা, – শাদা, - বরফের কুঁচির মতন !
তাহাদের মুখ চোখ ভিজে ,-
ফেনার শেমিজে
তাহাদের শরীর পিছল !
কাচের গুঁড়ির মতো শিশিরের জল
চাঁদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে !
পায়ে- চলা পথ ছেড়ে ভাসে তারা সাগরের গায়ে ,-
কাঁকরের রক্ত কই তাহাদের পায়ে !
রূপার মতন চুল তাহাদের ঝিকমিক করে
উত্তর সাগরে !
বরফের কুঁচির মতন
সেই জল- মেয়েদের স্তন !
মুখ বুক ভিজে,
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল !
কাচের গুঁড়ির মতো শিশিরের জল
চাঁদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে !
উত্তর সাগরে !
সবাই থামিলে পরে মনে হল – একদিন আমি যাবো চ’লে
কল্পনার গল্প সব ব’লে
তারপর ,- শীত-হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন
আবার তো এসে যাবে ;
এক কবি ,- তন্ময় , শৌখিন ,-
আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে !
আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা ,- পরীর মতন এক ঘুমোনো মেয়ে সে
হীরের ছুরির মতো গায়ে
আরো ধার লবে সে শানায়ে !
সেই দিনও তার কাছে হয়তো রবে না আর কেউ ,-
মেঘের মতন চুল ; তার সে চুলের ঢেউ
এমনি পড়িয়া রবে পালঙ্কের’পর ,-
ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা সেই পুরীর ভিতর !
চারপাশে তার
রাজ – যুবরাজ – জেতা – যোদ্ধাদের হাড়
গড়েছে পাহাড় !
এ রূপকথার এই রূপসীর ছবি
তুমিও দেখিবে এসে ,-
তুমিও দেখিবে এসে কবি !
পাথরের হাতে তার রাখিবে তো হাত ,-
শরীরে ননীর ছিরি ,- ছুঁয়ে দেখো – চোখা ছুরি ,- ধারালো হাতির দাঁত !
হাড়েরই কাঠামো শুধু ,- তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা
ছিল কই ! – তবু , সে কি জেগে যাবে ? কবে সে কি কথা
তোমার রক্তের তাপ পেয়ে ?-
আমার কথার এই মেয়ে ,-এই মেয়ে !
কে যেন উঠিল ব’লে,- তোমরা তো বলো রূপকথা,-
তেপান্তরের গল্প সব ,- ওর কিছু আছে নিশ্চয়তা !
হয়তো অমনি হবে,- দেখিনিকো তাহা ;
কিন্তু , শোনো –স্বপ্ন নয় , আমাদেরি দেশে কবে আহা !-
যেখানে মায়াবী নাই ,- জাদু নাই কোনো ,-
এ দেশের- গাল নয়, গল্প নয় , দু’একটা শাদা কথা শোনো !
সে-ও এক রোদে লাল দিন ,
রোদে লাল -, সবজীর গানে গানে সবুজ স্বাধীন
একদিন,- সেই একদিন !
ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল চোখে ,
ছেঁড়া করবীর মত মেঘের আলোকে
চেয়ে দেখি রূপসী কে প’ড়ে আছে খাটের উপরে !
মায়াবীর ঘরে
ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি , দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর ,- মানুষের দেশের মতন;
রূপ ঝ’রে যায় ,- তবু করে যারা সৌন্দর্যের মিছা আয়োজন ,-
যে যৌবন ছিঁড়েফেরে যায়,
যারা ভয় পায়
আয়নায় তার ছবি দেখে !-
শরীরের ঘুণ রাখে ঢেকে ,
ব্যর্থতা লুকায়ে রাখে বুকে,
দিন যাহাদের অসাধে ,- অসুখে !-
দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ ,
চোখে ঠোঁটে অসুবিধা ,- ভিতরে অসুখ !
কে যেন নিতেছে তারে খেয়ে !-
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর ,- ফোঁপরার মতো ক’রে এরে লয় শুষে
দেবতা গন্ধর্ব নাগ পশু ও মানুষে !...
সবাই উঠিল ব’লে ,- ঠিক –ঠিক –ঠিক !
আবার বলিল সেই সৌন্দর্য- তান্ত্রিক,-
আমায় বলেছে সে কি শোনো ,-
আর এক জন এই ,-
পরী নয় ,- মানুষ ও সে হয়নি এখনো ,-
বলেছে সে – কাল সাঁঝরাতে
আবার তোমার সাথে
দেখা হবে ? – আসিবে তো ?- তুমি আসিবে তো !
দেখা যদি পেত !
নিকটে বসায়ে
কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে ,-
কি কথা বলিতে গিয়ে থেমে যেত শেষে
ফিক ক’রে হেসে !
তবু , আরো কথা
বলিতে আসিত ,- তবু, সব প্রগলভতা
থেমে যেত !
খোঁপা বেঁধে ,- ফের খোঁপা ফেলিত খসায়ে,-
স’রে যেত , দেয়ালের গায়ে
রহিত দাঁড়ায়ে !
রাত ঢের , - বাড়িবে আরো কি
এই রাত!- বেড়ে যায় , তবু চোখাচোখি
হয় নাই দেখা
আমাদের দুজনার !- দুইজন ,- একা !-
বার-বার চোখ তবু কেন ওর ভ’রে আসে জলে !
কেন বা এমন ক’রে বলে,
কাল সাঁঝরাতে
আবার তোমার সাথে
দেখা হবে !- আসিবে তো?- তুমি আসিবে তো !-
আমি না কাঁদিতে কাঁদে , দেখা যদি পেত !...
দেখা দিয়ে বলিলাম , ‘ কে গো তুমি ?’- বলিল সে , ‘ তোমার বকুল ,
মনে আছে ?’- ‘ এগুলি কি , বাসি চাঁপাফুল ?
হ্যাঁ , হ্যাঁ , মনে আছে ;’ – ‘ভালোবাসো ?’ –হাসি পেল, - হাসি !
‘ ফুলগুলো বাসি নয় ,- আমি শুধু বাসি !’
আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ফেলে
নিবানো মাটির বাতি জ্বেলে
চ’লে এল কাছে ,-
জটার মতন খোঁপা অন্ধকারে খসিয়া গিয়াছে –
আজো এত চুল !
চেয়ে দেখি ,- দুটো হাত, ক’খানা আঙুল
একবার চুপে তুলে ধরি ;
চোখ দুটো চুন-চুন ,- মুখ খড়ি-খড়ি!
থুতনিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি ,-
সব বাসি ,সব বাসি , একেবারে মেকি !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ঢের সম্রাটের রাজ্যে বাস ক'রে জীব
অবশেষে একদিন দেখেছে দু-তিন ধনু দূরে
কোথাও সম্রাট নেই, তবুও বিপ্লবী নেই, চাষা
বলদের নিঃশব্দতা ক্ষেতের দুপুরে।
বাংলার প্রান্তরের অপরাহ্ন এসে
নদীর খাড়িতে মিশে ধীরে
বেবিলন লণ্ডনের জন্ম, মৃত্যু হ'লে-
তবুও রয়েছে পিছু ফিরে।
বিকেল এমন ব'লে একটি কামিন এইখানে
দেখা দিতে এলো তার কামিনীর কাছে;
মানবের মরণের পরে তার মমির গহ্বর
এক মাইল রৌদ্রে প'ড়ে আছে।২
আবার বিকেলবেলা নিভে যায় নদীর খাড়িতে;
একটি কৃষক শুধু ক্ষেতের ভিতরে
তার বলদের সাথে সারাদিন কাজ ক'রে গেছে;
শতাব্দী তীক্ষ্ম হ'য়ে পড়ে।
সমস্ত গাছের দীর্ঘ ছায়া
বাংলার প্রান্তরে পড়েছে;
এ-দিকের দিনমান- এ যুগের মতো শেষ হ'য়ে গেছে,
না জেনে কৃষক চোত-বোশেখের সন্ধ্যার বিলম্বনে প'ড়ে
চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল;
ঊনিশশো বেয়াল্লিশ ব'লে মনে হয়
তবুও কি ঊনিশশো বিয়াল্লিশ সাল।৩
কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই
একদিন মৃত্যু হবে, জন্ম হয়েছে;
সূর্য উদয়ের সাথে এসেছিলো ক্ষেতে;
সূর্যাস্তের সাথে চ'লে গেছে।
সূর্য উঠবে জেনে স্থির হ'য়ে ঘুমায়ে রয়েছে।
আজ রাতে শিশিরের জল
প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতি নিয়ে খেলা করে;
কৃষাণের বিবর্ণ লাঙ্গল,
ফালে ওপড়ানো সব অন্ধকার ঢিবি,
পোয়াটাক মাইলের মতন জগৎ
সারাদিন অন্তহীন কাজ ক'রে নিরুৎকীর্ণ মাঠে
প'ড়ে আছে সৎ কি অসৎ।৪
অনেক রক্তের ধ্বকে অন্ধ হ'য়ে তারপর জীব
এইখানে তবুও পায়নি কোনো ত্রাণ;
বৈশাখের মাঠের ফাটলে
এখানে পৃথিবী অসমান।
আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
কেবল খড়ের স্তুপ প'ড়ে আছে দুই- তিন মাইল,
তবু তা সোনার মতো নয়,
কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে
করুণ নিরীহ, নিরাশ্রয়।
আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
জলপিপি চ'লে গেলে বিকেলের নদী কান পেতে
নিজের জলের সুর শোনে;
জীবাণুর থেকে আজ কৃষক, মানুষ
জেগেছে কি হেতুহীন সম্প্রসারণে-
ভ্রান্তিবিলাসে নীল আচ্ছন্ন সাগরে?
চৈত্য, ক্রুশ, নাইন্টিথ্রি ও সোবিয়েট শ্রুতি প্রতিশ্রুতি
যুগান্তের ইতিহাস অর্থ দিয়ে কূলহীন সেই মহাসাগরে প্রাণ
চিনে-চিনে হয়তো বা নচিকেতা প্রচেতার চেয়ে অনিমেষে
প্রথম ও অন্তিম মানুষের প্রিয় প্রতিমান
হ'য়ে যায় স্বাভাবিক জনমানবের সূর্যালোকে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
এখন কিছুই নেই—এখনে কিছুই নেই আর,
অমল ভোরের বেলা র’ইয়ে গেছে শুধু;
আশ্বিনের নীলাকাশ স্পষ্ট ক’রে দিয়ে সূর্য আসে;
অনেক আবছা জল জেগে উঠে নিজ প্রয়োজনে
নদী হয়ে সমস্ত রৌদ্রের কাছে জানাতেছে দাবি;নক্ষত্রেরা মানুষের আগে এসে কথা কয় ভাবি;
পল অনুপল দিয়ে অন্তহীন নিপলের চকমকি ঠুকে
ঐ সব তারার পরিভাষার উজ্জ্বলতা;
আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের সাধারণ হৃদয়ের কথা
সহজ সঙ্গের মতো জেগে নক্ষত্রকে
কী ক’’রে মানুষও মানুষীর মতো ক’’রে রাখে।তবু তার উপচার নিয়ে সেই নারী
কোথায় গিয়েছে আজ চ’লে;
এই তো এখানে ছিল সে অনেক দিন;
আকাশের সব নক্ষত্রের মৃত্যু হলে
তারপর একটি নারীর মৃত্যু হয়ঃ
অনুভব ক’’রে আমি অনুভব করেছি সময়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
অশ্বত্থ বটের পথে অনেক হয়েছি আমি তোমাদের সাথী;
ছড়ায়েছি খই ধান বহুদিন উঠানের শালিখের তরে;
সন্ধ্যায় পুকুর থেকে হাঁসটিরে নিয়ে আমি তোমাদের ঘরে
গিয়েছি অনেক দিন দেখিয়াছি ধূপ জ্বালো, ধরো সন্ধ্যাবাতি
থোড়ের মতন শাদা ভিজে হাতে,- এখুনি আসিবে কিনা রাতি
বিনুনি বেঁধেছ তাই-কাঁচাপোকাটিপ তুমি কপালের 'পরে
পড়িয়াছ-তারপর ঘুমায়েছঃ কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে
পানের বাটার 'পরে; নোনার মতো নম্র শরীরটি পাতিনির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ,- বউকথাকওটির ছানা
নীল জামরুল নীড়ে- জ্যোৎস্নায়- ঘুমায়ে রয়েছে যেন, হায়,
আর রাত্রি মাতা-পাখাটির মতো ছড়ায়ে রয়েছে তার ডানা।
আজ আমি ক্লান্ত চোখে ব্যবহৃত জীবনের ধূলোয় কাঁটায়
চ'লে গেছি বহুদূরে;-দ্যাখোনিকো, বোঝোনিকো করনিকো মানা;
রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন- পানের বাটায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অনেক নদীর জল উবে গেছে —
ঘরবাড়ি সাকো ভেঙে গেল;
সে সব সময় ভেদ করে ফেলে আজ
কারা তবু কাছে চলে এল
যে সুর্য অয়নে নেই কোনো দিন,
— মনে তাকে দেকা যেত যদি —
যে নারী দেখে নি কেউ — ছ-সাতটি তারার তিমিরে
হৃদয়ে এসেছে সেই নদী।
তুমি কথা বল — আমি জীবন-মৃত্যুর শব্দ শুনি:
সকালে শিশির কণা যে-রকম ঘাসে
অচিরে মরণশীল হয়ে তবু সূর্যে আবার
মৃত্যু মুখে নিয়ে পরদিন ফিরে আসে।
জন্মতারকার ডাকে বার বার পৃথিবীতে ফিরে এসে আমি
দেখেছি তোমার চোখে একই ছায়া পড়ে:
সে কি প্রেম? অন্ধকার? — ঘাস ঘুম মৃত্যু প্রকৃতির
অন্ধ চলাচলের ভিতরে।
স্থির হয়ে আছে মন; মনে হয় তবু
সে ধ্রুব গতির বেগে চলে,
মহা-মহা রজনীর ব্রহ্মান্ডকে ধরে;
সৃষ্টির গভীর গভীর হংসী প্রেম
নেমেছে — এসেছে আজ রক্তের ভিতরে।‘এখানে পৃথিবী আর নেই–‘
ব’লে তারা পৃথিবরি জনকল্যাণেই
বিদায় নিয়েছে হিংসা ক্লান্তির পানে;
কল্যাণ, কল্যাণ; এই রাত্রির গবীরতর মানে।
শান্তি এই আজ;
এইখানে স্মৃতি;
এখানে বিস্মৃতি তবু; প্রেম
ক্রমায়াত আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কুহেলির হিমশয্যা অপসারি ধীরে
রূপময়ী তন্বী মাধবীরে
ধরণী বরিয়া লয় বারে-বারে-বারে!
-আমাদের অশ্রুর পাথারে
ফুটে ওঠে সচকিতে উৎসবের হাসি,-
অপরূপ বিলাসের বাঁশি!
ভগ্ন প্রতিমারে মোরা জীবনের বেদীতটে আরবার গড়ি,
ফেনাময় সুরাপাত্র ধরি
ভুলে যাই বিষের অস্বাদ!
মোহময় যৌবনের সাধ
আতপ্ত করিয়া তোলে স্থবিরের তুহিন অধর!
চিরমৃত্যুচর
হে মৌন শ্মশান
ধূম-অবগুন্ঠনের অন্ধকারে আবরি বয়ান
হেরিতেছ কিসের স্বপন!
ক্ষণে ক্ষণে রক্তবহ্নি করি নির্বাপন
স্তব্ধ করি রাখিতেছ বিরহীর ক্রন্দনের ধ্বনি!
তবু মুখপানে চেয়ে কবে বৈতরণী
হ’য়ে গেছে কলহীন!
বক্ষে তব হিম হ’য়ে আছ কত উগ্রশিখা চিতা
হে অনাদি পিতা!
ভস্মগর্ভে, মরণের অকূল শিয়রে
জন্মযুগ দিতেছ প্রহরা-
কবে বসুন্ধরা
মৃত্যুগাঢ় মদিবার শেষ পাত্রখানি
তুলে দেবে হসে- তব, কবে লবে টানি
কাঙ্কাল আঙুলি তুলি শ্যামা ধরণীরে
শ্মশান-তিমিরে,
লোলুপ নয়ন মেলি হেরিবে তাহার
বিবসনা শোভা
দিব্য মনোলোভা!
কোটি কোটি চিতা-ফণা দিয়া
রূপসীর অঙ্গ-আলিঙ্গিয়া
শুষে নেবে সৌন্দর্যের তামরস-মধু!
এ বসুধা-বধূ
আপনারে ডারি দেবে উরসে তোমার!
ধ্বক্-ধ্বক্-দারুণ তৃষ্ণার
রসনা মেলিয়া
অপেক্ষায় জেগে আছে শ্মশানের হিয়া!
আলোকে আঁধারে
অগণন চিতার দুয়ারে
যেতেছে সে ছুটে,
তৃপ্তিহীন তিক্ত বক্ষপুটে
আনিতেছে নব মৃত্যু পথিকের ডাকি,
তুলিতেছে রক্ত-ধুম্র আঁখি!
-নিরাশার দীর্ঘশ্বাস শুধু
বৈতরণীমরু ঘেরি জ্বলে যায় ধু ধু
আসে না প্রেয়সী!
নিদ্রাহীন শশী,
আকাশের অনাদি তারকা
রহিয়াছে জেগে তার সনে;
শ্মশানের হিম বাতায়নে
শত শত প্রেতবধূ দিয়া যায় দেখা,-
তবু সে যে প’ড়ে আছে একা,
বিমনা-বিরহী!
বক্ষে তার কত লক্ষ সভ্যতার স্মৃতি গেছে দহি,
কত শৌর্য-সাম্রাজ্যের সীমা
প্রেম-পুণ্য-পূজার গরিমা
অকলঙ্ক সৌন্দর্যের বিভা
গৌরবের দিবা!
তবু তার মেটে নাই তৃষা;
বিচ্ছেদের নিশা
আজও তার হয় নাই শেষ!
আশ্রান্ত অঙুলি সে যে করিছে নির্দেশ
অবনীর পক্কবিম্ব অধরের পর!
পাতাঝরা হেমন্তের স্বর,
ক’রে দেয় সচকিত তারে,
হিমানী-পাথারে
কুয়াশাপুরীর মৌন জানায়ন তুলে
চেয়ে থাকে আঁধারে অকূলে
সুদূরের পানে!
বৈতরণীখেয়াঘাটে মরণ-সন্ধানে
এল কি রে জাহ্নবীর শেষ উর্মিধারা!
অপার শ্মশান জুড়ি জ্বলে লক্ষ চিতাবহ্নি-কামনা-সাহারা!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সূর্যের আলো মেটায় খোরাক কার;
সেই কথা বুঝা ভার
অনাদি যুগের অ্যামিবার থেকে আজিকে ওদের প্রাণ
গড়িয়া উঠিল কাফ্রির মতো সূর্যসাগরতীরে
কালো চামড়ার রহস্যময় ঠাস বুনোনিটি ঘিরে।চারিদিকে স্থির-ধুম্র নিবিড় পিড়ামিড যদি থাকে-
অনাদি যুগের অ্যামিবার থেকে আজিকে মানবপ্রাণ
সূর্যতাড়সে ভ্রুণকে যদিও করে ঢের ফলবান-
তবুও আমরা জননী বলিবো কাকে?
গড়িয়া উঠিলো মানবের দল সূর্যসাগরতীরে
কালো আত্মার রহস্যময় ভুলের বুনুনি ঘিরে।গ্রন্থ: মহাপৃথিবী
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
অইখানে কিছু আগে- বিরাট প্রাসাদে- এক কোণে
জ্ব'লে যেতেছিল ধীরে এক্সটেন্শন্ লেকচারের আলো।
এখন দেয়ালে রাত- তেমন ততটা কিছু নয়;
পথে পথে গ্যাসলাইট র'য়েছে ঝাঁঝালো
এখনো সূর্যের তেজ উপসংহারের মত জেগে।
এখনো টঙ্গে চ'ড়ে উপরের শেলফের থেকে
বই কি বিবর্ণ কীট- ধুলো- মাকড়সা বার হবে
দোকানের সেলস্ম্যান চুপে ভেবে দেখে।
এখনো নামেনি সেই নির্জন রিকশগুলো- নিয়ন্তার মত,
সমূহ ভীড়ের চাপে র'য়েছে হারায়ে।
অজস্র গলির পথে একটি মানুষ
যুগপৎ র'য়েছে দাঁড়ায়ে;
পৃথিবীর সকলের হৃদয়ের প্রতীকের মত;
এই রাত থেকে আরো অধিক গভীরতর রাতে
কলুটোলা- পাথুরিয়াঘাটা- মির্জাপুরে
এসপ্লানেডের ফুটপাতে
মালাঙ্গা লেনের পথে- ক্রিক রো'তে
ককবার্ন লেনের ভিতরে
এক জোড়া শিঙ যদি দেখা দেয় লোকটার টাকে-
পরচুলা চুরি ক'রে নিয়ে গেছে তবে যাদুকর।
এখানে রাত্রির পারে তোমার নিকট থেকে আমি
চ'লে গেলে
চ'লে যাব;-
পৃথিবীর কাছ থেকে নয়;
রাত্রি এই সারারাত জীবনের সকল বিষয়
হয়ে আছে।
তিত্তিরাজ গাছ থেকে শিশির নীরবে
ঝরে যায়;
ডানার আঘাতে যায় কাকদম্পতীর;
হলুদ খড়ের পরে ঝ'রে পড়ে আবার শিশির
হাওয়ার গুঁড়ির মত।
কোথায় হারায়ে তুমি গিয়েছ কখন।
মাথার উপরে সব নক্ষত্রেরা ছুরির মত বিচক্ষণ
সময়ের সূতো কেটে- অবিরাম সময়ের সূতো কেটে ফেলে
আমার চোখের পরে রাত্রির প্রাঞ্জলতা ঢেলে;
কোথাও বাতাবী উষ্ণ হয়ে ওঠে- ঘুরে যায় মাকরসাপোকার লাটিম,
ভাঁড় হাসে,- সম্রাজ্ঞীর অবয়ব হয়ে থাকে হিম;
নদীরা শিশুর মত- শিশুরা নদীর মত দূর;
স্বর্গের কিনারে গিয়ে ভিড় আর ভিখিরির নীল আলো করে টিমটিম।
শিশুর কপাল থেকে বেজে ওঠে নরকের বিচিত্র ডিন্ডিম।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ — বুলায়ে দিয়েছে চুল — চোখের উপরে
তার শান — স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, — আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমা দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;
এই জল ভালো লাগে; — নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে
ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে — বনের ভিতর
বার বার উড়ে যায়, — তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে
আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশেঝরে পড়ে; — যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ,
যখন জামের ডালে পেঁচার নরম হিম গান শোনা যায়,
বনের কিনা েঝরে যেই ধান বুকে করে শান — শালিখুদ,
তেমনি ঝরিছে জল আমার ঠোঁটের পরে চোখের পাতায় –
আমার চুলের পরে, — অপরাহ্নে রাঙা রোদে সবুজ আতায়
রেখেছে নরম হাত যেন তার — ঢালিছে বুকের থেকে দুধ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
থমথমে রাত,- আমার পাশে বসল অতিথি,-
বললে,- আমি অতীত ক্ষুধা,-তোমার অতীত স্মৃতি!
-যে দিনগুলো সাঙ্গ হ’ল ঝড়বাদলের জলে,
শুষে গেল মেরুর হিমে,- মরুর অনলে,
ছায়ার মতো মিশেছিলাম আমি তাদের সনে;
তারা কোথায়?-বন্দি স্মৃতিই কাঁদছে তোমার মনে!
কাঁদছে তোমার মনের খাকে,- চাপা ছাইয়ের তলে,
কাঁদছে তোমার স্যাঁতস্যাঁতে শ্বাস-ভিজা চোখের জলে,
কাঁদছে তোমার মূক মমতার রিক্ত পাথার ব্যেপে,
তোমার বুকের খাড়ার কোপে,- খুনের বিষে ক্ষেপে!
আজকে রাতে কোন্ সে সুদূর ডাক দিয়েছে তারে,-
থাকবে না সে ত্রিশূলমূলে, শিবের দেউলদ্বারে!
মুক্তি আমি দিলেম তারে,-উল্লাসেতে দুলে
স্মৃতি আমার পালিয়ে গেল বুকের কপাট খুলে
নবালোকে,-নবীন উষার নহবতের মাঝে।
ঘুমিয়েছিলাম,- দোরে আমার কার করাঘাত বাজে!
-আবার আমায় ডাকলে কেন স্বপনঘোরের থেকে!
ওই লোকালোক-শৈলচূড়ায় চরণখানা রেখে
রয়েছিলাম মেঘের রাঙা মুখের পানে চেয়ে,
কোথার থেকে এলে তুমি হিমসরণি বেয়ে!
ঝিম্ঝিমে চোখ,- জটা তোমার ভাসছে হাওয়ার ঝড়ে,
শ্মশানশিঙা বাজল তোমার প্রেতের গলার স্বরে!
আমার চোখের তারার সনে- তোমার আঁখির তারা
মিলে গেল,-তোমার মাঝে আবার হলেম হারা!
-হারিয়ে গেলাম ত্রিশূলমূলে,- শিবের দেউলদ্বারে;
কাঁদছে স্মৃতি-কে দেবে গো-মুক্তি দেবে তারে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সূর্য, মাছরাঙা, আমি
উত্তীর্ণ হয়েছে পাখী মদী সূর্যের অন্ধ আবেগের
দু’মুহূর্তে আনন্দের পরীক্ষার বুঝি।
নিভে গেছে;- আমি কেন তবু সূর্য খুঁজি।
তুমি
জানি না কোথায় তুমি- সূর্য নিভে গেছে;
তোমার মননে আজ স্থির
সন্ধ্যার কুমোর পোকা- বাঁশের ছ্যাঁদায় ঘূণ-
শাদা বেতফলের শিশির।
আছে
‘নেই- নেই-’ মনে হয়েছিল কবে- চারিদিকে উঁচু- উঁচু গাছে,
বাতাস? না সময় বলছে; ‘আছে, আছে।’
অনেক অনেক দিনের পর আজ
অঘ্রাণ রাত
অন্ধকারে সময়পরিক্রমা
করতে গিয়ে আবছা স্মৃতির বইয়ের
পাতার থেকে জমা-
খরচ সবি মুছে ফেলে দিয়ে
দানের আয়োজনে নেমে এল,
চেয়ে দেখি নারী কেমন নিখুঁতভাবে কৃতী;
ডানা নড়ে শিশির শব্দ করে
বাহিরে ঐ অঘ্রাণ রাত থেকে;
এসব ঋতু আমার হৃদয়ে
কি এক নিমেষনিহত সমাহিতি
নিয়ে আসে; ভিতরে আরো প্রবেশ ক’রে প্রাণ
একটি বৃক্ষে সময় মরুভূমি
লীন দেখেছে, গভীর পাখি বৃক্ষ তুমি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
মনে হয় একদিন আকাশে শুকতারা দেখিব না আর ;
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে একঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায় – দেখিব না আর আমি এই পরিচিত বাঁশবন ,
শুঁকনো বাঁশের পাতা -ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার
আমার চোখের কাছে – লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জোছনায় – হিজলের বাকা ডাল করে গুঞ্জরন ;
সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে – হাতের কাঁকন
বেজে ওঠে : বুঝিব না – গঙ্গাজল ,নারকোলনাড়ুগুলো তারজানি না সে কারে দেবে – জানি না সে চিনি আর সাদা তালশাঁস
হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাড়ায়ে রবে কি না …
আবার কাহার সাথে ভালবাসা হবে তার – আমি তা জানি না;
মৃত্যুরে কে মনে রাখে ?… কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস
নতুন ডাঙার দিকে – পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায় – শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ ??
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
জয়,- তরুণের জয়!
জয় পুরোহিত আহিতাগ্নিক,- জয়,- জয় চিন্ময়!
স্পর্শে তোমার নিশা টুটেছিল,-উষা উঠেছিল জেগে
পূর্ব তোরণে, বাংলা-আকাশে ,-অরুণ-রঙিন মেঘে;
আলোকে তোমার ভারত,এশিয়া-জগৎ গেছিল রেঙে।
হে যুবক মুসাফের,
স্থবিরের বুকে ধ্বনিলে শ্ঙ্খ জাগরণপর্বের!
জিঞ্জির-বাঁধা ভীত চকিতেরে অভয় দানিলে আসি,
সুপ্তের বুকে বাজালে তোমার বিষাণ হে সন্ন্যাসী,
রুক্ষের বুকে বাজালে তোমার কালীয়-দমন বাঁশি!
আসিলে সব্যসাচী,
কোদন্ডে তব নব উল্লাসে নাচিয়া উঠিল প্রাচী!
টঙ্কারে তব দিকে দিকে শুধু রণিয়া উঠিল জয়,
ডঙ্কা তোমার উঠিল বাজিয়া মাভৈঃ মন্ত্রময়;
শঙ্কাহরণ ওহে সৈনিক,- নাহিকো তোমার ক্ষয়!
তৃতীয় নয়ন তব
ম্লান বাসনার মনসিজ নাশি জ্বালাইত উৎসব!
কলুষ-পাতকে, ধূর্জটি, তব পিনাক উঠিত রুখে,
হানিতে আঘাত দিবানিশি তুমি ক্লেদ-কামনার বুকে,
অসুর-আলয়ে শিব-সন্ন্যাসী বেড়াতে শঙ্খ ফুঁকে!
কৃষ্ণচক্র সম
ক্লৈব্যের হৃদে এসেছিলে তুমি ওগো পুরুষোত্তম,
এসেছিলে তুমি ভিখারীর দেশে ভিখারীর ধন মাগি
নেমেছিলে তুমি বাউলের দলে,- হে তরুণ বৈরাগী!
মর্মে তোমার বাজিত বেদনা আর্ত জীবের লাগি।
হে প্রেমিক মহাজন,
তোমার পানেতে তাকাইল কোটি দরিদ্র-নারায়ণ;
অনাথের বেশে ভগবান এসে তোমার তোরণতলে
বারবার যবে কেঁদে কেঁদে গেল কাতর আঁখির জলে,
অর্পিলে তব প্রীতি-উপায়ন প্রাণের কুসুমদলে।
কোথা পাপী? তাপী কোথা?
-ওগো ধ্যানী, তুমি পতিত-পাবন যজ্ঞে সাজিলে হোতা!
শিব-সুন্দর-সত্যের লাগি শুরু করে দিলে হোম,
কোটি পঞ্চমা আতুরের তরে কাঁপায়ে তুলিলে ব্যোম,
মন্ত্রে তোমার বাজিল বিপুল শানি স্বস্তি ওঁ!
সোনার মুকুট ভেঙে
ললাট তোমার কাঁটার মুকুটে রাখিলে সাধক রেঙে!
স্বার্থ লালসা পাসরি ধরিলে আত্মাহুতির ডালি,
যঞ্জের যূপে বুকের রুধির অনিবার দিলে ঢালি,
বিভাতি তোমার তাই তো অটুট রহিল অংশুমালী!
দরিয়ার দেশে নদী!
-বোধিসত্ত্বের আলয়ে তুমি গো নবীন শ্যামল বোধি!
হিংসার রণে আসিলে পথিক প্রেম-খঞ্জর হাতে,
আসিলে করুণা-প্রদীপ হস্তে হিংসার অমারাতে,
ব্যাধি মন্বন্তরে এলে তুমি সুধা-জলধরি সংঘাতে!
মহামারী ক্রন্দন
ঘুটাইলে তুমি শীতল পরশে, ওগো সুকোমল চন্দন!
বজ্র-কঠোর, কুসুম-মৃদুল,- আসিলে লোকোত্তর;
হানিলে কুলিশ কখনো,- ঢালিলে নির্মল নির্ঝর,
নাশিলে পাতক,-পাতকীরে তুমি অর্পিলে নির্ভর।
চক্র গদার সাথে
এনেছিলে তুমি শঙ্খ পদ্ম,- হে ঋষি, তোমার হাতে;
এনেছিলে তুমি ঝড় বিদ্যুৎ- পেয়েছিলে তুমি সাম,
এনেছিলে তুমি রণ-বিপ্লব,-শানি- কুসুম-দাম;
মাভৈঃ শঙ্খে জাগিছে তোমার নর-নারায়ণ-নাম!
জয়,- তরুণের জয়!
আত্মহুতির রক্ত কখনো আঁধারে হয় না লয়!
তাপসের হাড় বজ্রের মতো বেজে উঠে বারবার!
নাহি রে মরণে বিনাশ, -শ্মশানে নাহি তার সংহার,
দেশে দেশে তার বীণা বাজে-বাজে কালে কালে ঝঙ্কার!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে বুকে মোর সেই তৃষা!
খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি,
রঙের মাঝারে হেরি রঙডুবি!
পরাগের ঠোঁটে পরিমলগুঁড়ি-
হারায়ে ফেলি গো দিশা!
আমি প্রজাপতি-মিঠা মাঠে মাঠে সোঁদালে সর্ষেক্ষেতে;
বোদের সফরে খুঁজি নাকো ঘর,
বাঁধি নাকো বাসা-কাঁপি থরথর
অতসী ছুঁড়ির ঠোটের উপর
শুঁড়ির গেলাসে মেতে!
আমি দক্ষিণা-দুলালীর বীণা,পউষপরশহারা!
ফুল-আঙিয়ার আমি ঘুমভাঙা
পিয়াল চুমিয়া পিলাই গো রাঙা
পিয়ালার মধু তুলি রাতজাগা
হোরীর হারারা সাড়া!
আমি গো লালিমা-গোধূলির সীমা, বাতাসের লাল, ফুল।
দুই নিমেষের তরে আমি জ্বালি
নীল আকাশের গোলাপী দেয়ালী!
আমি খুশরোজী, আমি গো খেয়ালী,
চঞ্চল, চুলবুল।
বুকে জ্বলে মোর বাসর দেউটি-মধুপরিণয়রাতি!
তুলিছে ধরণী বিধবা-নয়ন
মনের মাঝারে মদনমোহন
মিলননদীর নিধুর কানন
রেখেছে রে মোর পাতি! (ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থ)
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.