poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সময় মুছিয়া ফেলে সব এসে,
সময়ের হাত
সৌন্দর্যেরে করে না আঘাত
মানুষের মনে
যে সৌন্দর্য জন্ম লয়- শুকনো পাতার শুকনো পাতার মতো ঝরে নাকো বনে
ঝরে নাকো বনে।
নক্ষত্রও মুছে যায়- মুছে যায়- পৃথিবীর পুরাতন পথ
শেষ হয়-কমলা ফুল, বন বনের পর্বত;
মানুষের মনে
যে সৌন্দর্য জন্ম লয়- শুকনো পাতার মতো ঝরে নাকো বনে,
ঝরে নাকো বনে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সূর্যের আকাশের মত মানুষেরা অনুভাবনায় স্থির
এক আশ্বাস রয়ে গেছে পৃথিবীতে,
রয়ে গেছে আমাদের হৃদয়ে যে এই
ইতিহাস পৃথিবীর রক্তাক্ত নদীর কেবলি আয়ত
উৎসারণ অন্ধকারে নিজেরে প্রচুর ক’রে তবু
স্তিমিত হয়ে পড়ে;
মতুন নির্মল জলকণিকারা আসে
নক্ষত্রের সূর্যের নীলিমার মানব হৃদয়ের
আশ্চর্য রেবার হিল্লীলের মত।
সময় যা আচ্ছন্ন করেছিল তাকে সময় সংক্রান্তির পারে
মৃত্যু বা নিশ্চিহ্ন করেছিল তাকে উজ্জ্বল বস্তুপুঞ্জে
জাগিয়ে তুল্বার জন্যে দেখ
সচেতন হয়ে জেগে উঠে মানবঃ
চারিদিকে উন্মুক্ত সূর্যের
অন্তরালে সূর্যের
আলোর নক্ষত্রেরা রাত্রির নগরীর জ্ঞানের
অন্তহীন পরিচ্ছন্ন পবিত্রের ভিতর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে
তোমাকে দিলো রূপ-
কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিলো তারা;
তোমার সংস্পর্শের মানুষদের রক্তে দিলো মাছির মতো কামনা৷আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
আমাকে দিলো লিপি রচনা করবার আবেগঃ
যেন আমিও আগুন বাতাস জল
যেন তোমাকেও সৃষ্টি করছি।তোমার মুখের রূপ যেন রক্ত নয়, মাংস নয়, কামনা নয়,
নিশীথ-দেবদারু-দ্বীপ;
কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপস্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে তবু
তুমি মাটির পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছো;
আমি হারিয়ে যাচ্ছি সুদূর দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়ার ভিতর।আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
রূপের বীজ ছড়িয়ে চলে পৃথিবীতে
ছড়িয়ে চলে স্বপ্নের বীজ।
অবাক হয়ে ভাবি
আজ রাতে কোথায় তুমি?
রূপ কেন নির্জন দেবদারু-দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না-
পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে- ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –হয়ে
ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –
আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা হো_ হো ক’রে হেসে উঠলোঃ
‘ব্যবহৃত – ব্যবহৃত হ’য়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়?’হো হো করে হেসে উঠলাম আমি!-
চারিদিককার অট্টহাসির ভিতর একটা বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে
অন্ধকার সমুদ্র স্ফীত হ’য়ে উঠলো যেন;
পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতহেদের দূর্গন্ধের মতো,
যেখানেই যাই আমি সেই সব সমুদ্রের উল্কায় – উল্কায়
কেমন স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমার এ-জীবনের ভোরবেলা থেকে-
সে-সব ভূখণ্ড ছিলো চিরদিন কন্ঠস্থ আমার;
একদিন অবশেষে টের পাওয়া গেল
আমাদের স’জনার মতো দাঁড়াবার
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই,- -আমি বলিনাতো।
কারো লাভ আছে;– সকলেরই;– হয়তো বা ঢের।
ভাদ্রের জ্বলন্ত রৌদ্রে তবু আমি দূরতর সমুদ্রের জলে
পেয়েছি ধবল শব্দ– বাতাসতাড়িত পাখিদের।মোমের প্রদীপ বড়ো ধীরে জ্ব’লে– ধীরে জ্বলে আমার টেবিলে;
মনীষার বইগুলো আরো স্থির,– শান্ত,– আরাধনাশীল;
তবু তুমি রাস্তার বার হ’লে,- ঘরেরও কিনারে ব’সে টের পাবে নাকি
দিকে-দিকে নাচিতেছে কী ভীষণ উন্মত্ত সলিল।তারি পাশে তোমারে রুধির কোনো বই- কোনো প্রদীপের মতো আর নয়,
হয়তো শঙ্খের মতো সমুদ্রের পিতা হ’য়ে সৈকতের পরে
সেও সুর আপনার প্রতিভায়- নিসর্গের মতোঃ
রূপ–প্রিয়– প্রিয়তম চেতনার মতো তারপরে
তাই আমি ভীষণ ভিড়ের ক্ষোভে বিস্তীর্ণ হাওয়ার স্বাদ পাই;
না হলে মনের বনে হরিণীকে জড়ায় ময়ালঃ
দণ্ডী সত্যাগ্রহে আমি সে-রকম জীবনের করুণ আভাস
অনুভব করি; কোনো গ্লাসিয়ার- হিম স্তব্ধ কর্মোরেন্ট পাল–
বুঝিবে আমার কথা; জীবনের বিদ্যুৎ-কম্পাস অবসানে
তুষার-ধূসর ঘুম খাবে তারা মেরুসমুদ্রের মতো অনন্ত ব্যাদানে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে গেলে দিন
আলোকিত হয়ে ওঠে—রাত্রি অন্ধকার
হয়ে আসে; সর্বদাই, পৃথিবীর আহ্নিক গতির
একান্ত নিয়ম, এই সব;
কোথাও লঙ্ঘন নেই তিলের মতন আজো;
অথবা তা হতে হলে আমাদের জ্ঞাতকুলশীল
মানবীয় সময়কে রূপান্তরিত হয়ে যেতে হয় কোনো
দ্বিতীয় সময়ে; সে-সময় আমাদের জন্যে নয় আজ।
রাতের পর দিন—দিনের পরের রাত নিয়ে সুশৃঙ্খল
পৃথিবীকে বলয়িত মরুভূমি ব’লে
মনে হতে পারে তবু; শহরে নদীতে মেঘে মানুষের মনে
মানবের ইতিহাসে সে অনেক সে অনেক কাল
শেষ ক’রে অনুভব করা যেতে পারে কোনো কাল
শেষ হয় নি কো তবু;—শিশুরা অনপনেয় ভাবে
কেবলি যুবক হলো,—যুবকেরা স্থবির হয়েছে,
সকলেরি মৃত্যু হবে,—মরণ হতেছে।অগণন অংকে মানুষের নাম ভোরের বাতাসে
উচ্চারিত হয়েছিল শুনে নিয়ে সন্ধ্যার নদীর
জলের মুহূর্তে সেই সকল মানুষ লুপ্ত হয়ে গেছে জেনে
নিতে হয়; কলের নিয়মে কাজ সাঙ্গ হয়ে যায়;
কঠিন নিয়মে নিরঙ্কুশভাবে ভিড়ে মানবের কাজ
অসমাপ্ত হয়ে থাকে—কোথাও হৃদয় নেই তবু।
কোথাও হৃদয় নেই মনে হয়, হৃদয়যন্ত্রের
ভয়াবহভাবে সুস্থ সুন্দরের চেয়ে এক তিল
অবান্তর আনন্দের অশোভনতায়।
ইতিহাসে মাঝে-মাঝে এ-রকম শীত অসারতা
নেমে আসে;—চারিদিকে জীবনের শুভ্র অর্থ র’য়ে গেছে তবু,
রৌদ্রের ফলনে সোনা নারী শস্য মানুষের হৃদয়ের কাছে,
বন্ধ্যা ব’লে প্রমাণিত হয়ে তার লোকোত্তর মাথার নিকটে
স্বর্গের সিঁড়ির মতো;—হুন্ডি হাতে অগ্রসর হয়ে যেতে হয়।
আমাদের এ-শতাব্দী আজ পৃথিবীর সাথে
নক্ষত্রলোকের এই অবিরল সিঁড়ির পসরা
খুলে আত্মক্রীড় হলো;—মাঘসংক্রান্তির রাত্রি আজ
এমন নিষ্প্রভ হয়ে সময়ের বুনোনিতে অন্ধকার কাঁটার মতন
কাকে বোনে? কেন বোনে? কোন হিকে কোথায় চলেছে?
এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে,—ঝাউ শিশু জারুলে হাওয়ার শব্দ থেমে
আরো থেমে-থেমে গেলে—আমাদের পৃথিবীর আহ্নিক গতির
অন্ধ কন্ঠ শোনা যায়;—শোনো, এক নারীর মতন,
জীবন ঘুমায় গেছে; তবু তার আঁকাবাকা অস্পষ্ট শরীর
নিশির ডাকের শব্দ শুনে বেবিলনে পথে নেমে
উজ্জয়িনী গ্রীসে রেনেসাঁসে রুশে আধো জেগে, তবু,
হৃদয়ে বিকিয়ে গিয়ে ঘুমায়েছে আর একবার
নির্জন হ্রদের পারে জেনিভার পপলারের ভিড়ে
অন্ধ সুবাতাস পেয়ে;—গভীর গভীরতর রাত্রির বাতাসে
লোকার্নো হ্বের্সাই মিউনিখ অতলন্তের চার্টারে
ইউ-এন-ওয়ের ভিড়ে আশা দীপ্তি ক্লান্তি বাধা ব্যাসকূট বিষ-
আরো ঘুম—র’য়ে গেছে হৃদয়ের—জীবনের;—নারী,
শরীরের জন্যে আরো আশ্চর্য বেদনা
বিমূঢ়তা লাঞ্ছনার অবতার র’য়ে গেছে; রাত
এখনো রাতের স্রোতে মিশে থেকে সময়ের হাতে দীর্ঘতম
রাত্রির মতন কেঁপে মাঝে-মাঝে বুদ্ধ সোক্রাতেস্
কনফুচ লেনিন গ্যেটে হ্যোল্ডেরলিন রবীন্দ্রের রোলে
আলোকিত হতে চায়;—বেলজেনের সব-চেয়ে বেশি অন্ধকার
নিচে আরো নিচে টেনে নিয়ে যেতে চায় তাকে;
পৃথিবীর সমুদ্রের নীলিমায় দীপ্ত হয়ে ওঠে
তবু ফেনের ঝর্ণা,—রৌদ্রে প্রদীপ্ত হয়,—মানুষের মন
সহসা আকাশে বনহংসী-পাখি বর্ণালি
কি রকম সাহসিকয়া চেয়ে দেখে,-সূর্যের কিরণে
নিমেষেই বিকীরিত হয়ে ওঠে;—অমর ব্যথায়
অসীম নিরুৎসাহে অন্তহীন অবক্ষয়ে সংগ্রামে আশায় মানবের
ইতিহাস-পটভূমি অনিকেত না কি? তবু, অগণন অর্ধসত্যের
উপরে সত্যের মতো প্রতিভাব হয়ে নব নবীন ব্যাপ্তির
সর্গে সঞ্চারিত হয়ে মানুষ সবার জন্যে শুভ্রতার দিকে
অগ্রসর হয়ে চায়—অগ্রসর হয়ে যেতে পারে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
সে কত পুরনো কথা-যেন এই জীবনের ঢের আগে আরেক জীবন
তোমারে সিঁড়ির পথে তুলে দিয়ে অন্ধকারে যখন গেলাম চুপে
তুমিও ফের নি পিছে-তুমিও ডাকনি আর; আমারও নিবিড় হলো মন
যেন এক দেশলাই জ্বলে গেছে-জ্বলিবেই-হালভাঙ্গা জাহাজের স্তুপে
আমার এ জীবনের বন্দরে;তারপর শান্তি শুধু বেগুনি সাগর-
মেঘের সোনালি চুল- আকাশ উঠেছে ভরে হেলিওট্রোপের মতো রুপেআমার জীবন এই; তোমারও জীবন তাই;এইখানে পৃথিবীর ‘পর
এই শান্তি মানুষের;এই শান্তি,যতদিন ভালোবেসে গিয়েছি তোমারে
কেন যেন লেগুনের মতো আমি অন্ধকারে কোন্ দূর সমুদ্রের ঘরচেয়েছি-চেয়েছি, আহা.. ভালোবেসে না-কেঁদে কে পারে।
তবুও সিঁড়ির পথে তুলে দিয়ে অন্ধকারে যখন গেলাম চলে চুপে
তুমিও দেখনি ফিরে-তুমিও ডাকনি আর-আমিও খুঁজি নি অন্ধকারে
যেন এক দেশলাই জ্বলে গেছে-জ্বলিবেই-হালভাঙ্গা জাহাজের স্তুপে
তোমারে সিঁড়ির পথে তুলে দিয়ে অন্ধকারে যখন গেলাম চলে চুপে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’—
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে;
আমি ঝ’রে যাবো–তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে,
—আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।রয়েছি সবুজ মাঠে—ঘাসে—
আকাশ ছডায়ে অাছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে;
জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে’;—সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল;
রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরেনক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।একবার কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা
বোবা হয়ে পড়ে থাকে—ভুলে যায় কথা;
যে-আগুন উঠেছিলো তাদের চোখের তলে জ্ব'লে
নিভে যায়—ডুবে যায়—তারা যায় স্খ’লে।
নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে—চ’লে আসে নতুন সময়—
পুরানো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয়
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে;
আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে
কোনো এক মানুষীর তরে
যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে।
আমি সেই পুরোহিত—সেই পুরোহিত।
যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত
লাগিতেছে আমার শরীরে—
যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে
তুমি আছো জেগে—
যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে
জেগে আছো;
জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়।
হ’য়ে যায় আকাশের তলে কতো আলো—কতো আগুনের ক্ষয়;
কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত—
তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত
যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার।
যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার।
জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে
পারো তুমি;
তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হ’য়ে আছো—তবু—
বাহিরের আকাশের শীতেনক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝ’রে—
ক্লান্ত হ’য়ে—শিশিরের মতো শব্দ ক’রে।
জানোনাকো তুমি তার স্বাদ—
তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,
জীবন অগাধ।হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার।
তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে।
আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে;
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায়
উড়ে যায়- মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে;
পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বার-বার চায় সে জড়াতে
করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়;
এক-একটি ইট ধ্বসে-ডুবজলে ডুব দিয়ে কোথায় হারায়
ভাঙা ঘাটলায় এই-আজ আর কেউ এসে চাল-ধোয়া হাতে
বিনুনি খসায় নাকো-শুকনো পাতা সারা দিন থাকে যে গড়াতে;
কড়ি খেলিবার ঘর মজে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারায়;ডাইনীর মতো হাত তুলে-তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন
বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো, -বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে
পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নই আমি, হায়, এমন বিজন
শাদা পথ-সোঁদা পথ-বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাঁদে
চলে গেছে শ্মশানের পারে বুঝি;-সন্ধ্যা সহসা কখন;
সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম নিম কার্তিকের চাঁদে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সান্টাক্রুজ থেকে নেমে অপরাহ্নে জহুর সমুদ্রপারে গিয়ে
কিছুটা স্তব্ধতা ভিক্ষা করেছিলো সূর্যের নিকটে থেমে সোমেন পালিত;
বাংলার থেকে এত দূরে এসে- সমাজ, দর্শন, তত্ত্ব, বিজ্ঞান হারিয়ে,
প্রেমকেও যৌবনের কামাখ্যার দিকে ফেলে পশ্চিমের সমুদ্রের তীরে
ভেবেছিলো বালির উপর দিয়ে সাগরের লঘুচোখ কাঁকড়ার মতন শরীরে
ধবল বাতাস খাবে সারাদিন; যেইখানে দিন গিয়ে বৎসরে গড়ায়-
বছর আয়ুর দিকে- নিকেল-ঘড়ির থেকে সূর্যের ঘড়ির কিনারায়
মিশে যায়- সেখানে শরীর তার নকটার্ন-রক্তিম রৌদ্রের আড়ালে
অরেঞ্জস্কোয়াস খাবে হয়তো বা, বোম্বায়ের ‘টাইমস্’টাকে
বাতাসের বেলুনে উড়িয়ে,
বর্তুল মাথায় সূর্য বালি ফেনা অবসর অরুণিমা ঢেলে,
হাতির হাওয়ায় লুপ্ত কুয়েতের মতো দেবে নিমেষে ফুরিয়ে
চিন্তার বুদ্বুদদের। পিঠের ওপার থেকে তবু এক আশ্চর্য সংগত
দেখা দিলো; ঢেউ নয়, বালি নয়, ঊনপঞ্চাশ নায়ু, সূর্য নয় কিছু-
সেই রলরোলে তিন চার ধনু দূরে-দূরে এয়ারোড্রামের কলরব
লক্ষ্য পেলো অচিরেই- কৌতুহলে হৃষ্ট সব সুর
দাঁড়ালো তাহাকে ঘিরে বৃষ মেষ বৃশ্চিকের মতন প্রচুর;
সকলেরই ঝিঁক চোখে- কাঁধের উপরে মাথা-পিছু
কোথাও দ্বিরুক্তি নেই মাথাত ব্যথার কথা ভেবে।
নিজের মনের ভুলে কখন সে কলমকে খড়গের চেয়ে
ব্যাপ্ত মনে ক’রে নিয়ে লিখেছে ভূমিকা, বই সকলকে সম্বোধন ক’রে!
কখন সে বাজেট-মিটিং, নারী, পার্টি- পলিটিক্স, মাংস, মার্মালেড ছেড়ে
অবতার বরাহকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিলো;
টোমাটোর মতো লাল গাল নিয়ে শিশুদের ভিড়
কুকুরের উৎসাহ, ঘোড়ার সওয়ার, পার্শী, মেম, খোজা, বেদুইন সমুদ্রের তীর,
জুহু, সূর্য, ফেনা, বালি- সান্টাক্রুজে সবচেয়ে পররতিময় আত্মক্রীড়া
সে ছাড়া তবে কে আর? যেন তার দুই গালে নিরুপম দাড়ির ভিতরে
দু’টো বৈবাহিক পেঁচা ত্রিভুবন আবিষ্কার ক’রে তুব ঘরে
ব’সে আছে; মুন্সী, সাভাকর, নরীম্যান তিন দৃষ্টিকোণ থেকে নেমে এসে
দেখে গেল, মহিলারা মর্মরের মতো স্বচ্ছ কৌতুহলভরে,
অব্যয় শিল্পীরা সবঃ মেঘ না চাইতে এই জল ভালোবাসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
অপরাজিতার মতো নীল হয়ে-আরো নীল-আরো নীল হয়ে
আমি যে দেখিতে চাই;- সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে লয়ে
কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে,
আমি যে দেখিতে চাই;- আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে,
পৃথিবীর পথ ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে
ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব বয়ে,
যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি পরে কোনো এক সুন্দরীর শব
চন্দন চিতায় চড়ে-আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;
যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ-সবচেয়ে ঘাঢ় বিষন্নতা;
যেখানে শুকায় পদ্মা-বহুদিন বিশালক্ষ্মী যেখানে নীরব;
যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিকমালার
কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী
মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে
উঠে এসে এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার
বছরে বয়সী আমি;
বুদ্ধকে স্বচক্ষে মহানির্বাণের আশ্চর্য শান্তিতে
চ’লে যেতে দেখে— তবু—অবিরল অশান্তির দীপ্তি ভিক্ষা ক’রে
এখানে তোমার কাছে দাঁড়ায়ে রয়েছি;
আজ ভোরে বাংলার তেরোশো চুয়ান্ন সাল এই
কোথাও নদীর জলে নিজেকে গণনা ক’রে নিতে ভুলে গিয়ে
আগামী লোকের দিকে অগ্রসর হ’য়ে যায়; আমি
তবুও নিজেকে রোধ ক’রে আজ থেমে যেতে চাই
তোমার জ্যোতির কাছে; আড়াই হাজার
বছর তা হ’লে আজ এইখানে শেষ হ’য়ে গেছে।নদীর জলের পথে মাছরাঙা ডান বাড়াতেই
আলো ঠিকরায়ে গেছে— যারা পথে চ’লে যায় তাদের হৃদয়ে;
সৃষ্টির প্রথম আলোর কাছে; আহা,
অন্তিম আভার কাছে; জীবনের যতিহীন প্রগতিশীলতা
নিখিলের স্মরণীয় সত্য ব’লে প্রমাণিত হ’য়ে গেছে; দ্যাখো
পাখি চলে, তারা চলে, সূর্য মেঘে জ্ব’লে যায়, আমি
তবুও মধ্যম পথে দাঁড়ায়ে রয়েছি— তুমি দাঁড়াতে বলোনি।
আমাকে দ্যাখোনি তুমি; দেখাবার মতো
অপব্যয়ী কল্পনার ইন্দ্রত্বের আসনে আমাকে
বসালে চকিত হ’য়ে দেখে যেতে যদি— তবু, সে-আসনে আমি
যুগে-যুগে সাময়িক শত্রুদের বসিয়েছি, নারি,
ভালোবেসে ধ্বংস হ’য়ে গেছে তা’রা সব।
এ-রকম অন্তহীন পটভূমিকায়— প্রেমে—
নতুন ঈশ্বরদের বার-বার লুপ্ত হ’তে দেখে
আমারো হৃদয় থেকে তরুণতা হারায়ে গিয়েছে;
অথচ নবীন তুমি।নারি, তুমি সকালের জল উজ্জ্বলতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো নদীকেই
বিকেলে অপর ঢেউয়ে খরশান হ’তে
দিতে ভুলে গিয়েছিলে; রাতের প্রখর জলে নিয়তির দিকে
ব’হে যেতে দিতে মনে ছিলো কি তোমার?
এখনও কি মনে নেই?আজ এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস
কেবলি শিথিল হ’য়ে যায়; তবু তুমি
সেই শিথিলতা নও, জানি, তবু ইতিহাসরীতিপ্রতিভার
মুখোমুখি আবছায়া দেয়ালের মতো নীল আকাশের দিকে
ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চেয়ে তুমি
আমাদের দেশে কোনো বিশ্বাসের দীর্ঘ তরু নও।তবু
কী যে উদয়ের সাগরের প্রতিবিম্ব জ্ব’লে ওঠে রোদে!
উদয় সমাপ্ত হ’য়ে গেছে নাকি সে অনেক আগে?
কোথাও বাতাস নেই, তবু
মৰ্মরিত হ’য়ে ওঠে উদয়ের সমুদ্রের পারে।
কোনো পাখি
কালের ফোকরে আজ নেই, তবু, নব সৃষ্টিমরালের মতো কলস্বরে
কেন কথা বলি; কোনো নারী
নেই, তবু আকাশহংসীর কণ্ঠে ভোরের সাগর উতরোল। (সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থ)
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ভোরের বেলার মাঠ প্রান্তর নীলকন্ঠ পাখি
দুপুরবেলার আকাশে নীল পাহাড় নীলিমা,
সারাটি দিন মীনরৌদ্রমুখর জলের স্বর,-
অনবসিত বাহির-ঘরের ঘরণীর এই সীমা।
তবুও রৌদ্র সাগরে নিভে গেল;
ব’লে গেলঃ ‘অনেক মানুষ ম’রে গেছে’; ‘অনেক নারীরা কি
তাদের সাথে হারিয়ে গেছে?’-বলতে গেলাম আমি;
উঁচু গাছের ধূসর হাড়ে চাঁদ না কি সে পাখি
বাতাস আকাশ নক্ষত্র নীড় খুঁজে
ব’সে আছে এই প্রকৃতির পলকে নিবিড় হ’য়ে;
পুরুষনারী হারিয়ে গেছে শস্প নদীর অমনোনিবেশে,
অমেয় সুসময়ের মতো রয়েছে হৃদয়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
আমরা যাইনি মরে আজও - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন - এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে।আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা ক'টা বেড়ালছানার মতো - ঘুমে-ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলেহিম হয়ে নড়ে গেল ও - পাশের পাইস্-রেস্তরাঁতে,
প্যারাফিন-লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে।
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব নিওলিথ - স্তব্ধ তার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আকাশ ভ'রে যেন নিখিল বৃক্ষ ছেয়ে তারা
জেগে আছে কূলের থেকে কূলে;
মানব্জাতির দু-মুহূর্তের সময়-পরিসর
অধীর অবুঝ শিশুর শব্দ তুলে
চেয়ে দেখে পারাপারের ব্যাপ্ত নক্ষত্রেরা
আগুন নিয়ে বিষম, তবু অক্ষত স্থির জীবনে আলোকিত।
ওদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন হ'য়ে তবু
মানুষ যেদিন প্রথম এই পৃথিবী পেয়েছিল
সেই সকালের সাগর সূর্য অনমনীয়তা
আমাদের আজ এনেছে যেই বিষম ইতিহাসে-
যেখানে গ্লানি হিংসা উত্তরাধিকারের ব্যথা
মানুষ ও তার পটভূমির হিসেবে গরমিল
রয়েছে ব'লে কখনো পরিবর্তনীয় নয়?
মানুষ তবু সময় চায় সিদ্ধকাম হ'তেঃ
অনেক দীর্ঘ অসময়- অনেক দুঃসময়।
চারিদিকে সৈন্য বণিক কর্মী সুধী নটীর মিছিল ঘোরে
মুখ ফেরাবার আগে-
তাদের সবের সহগামীর মতো
ইতিহাসের প্রথম উৎস থেকে
দেখেছি মানুষ কেবলি ব্যাহত
হয়েও তবু ভবিষ্যতের চক্রবালের দিকে
কোথাও সত্য আছে ভেবে চলেছে আপ্রাণঃ
পটভূমির থেকে নদীর রক্ত মুছে মুছে
বিলীন হয় যেমন সেসব পটভূমির স্থান।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
গানের সুরের মতো বিকেলের দিকের বাতাসে
পৃথিবীর পথ ছেড়ে – সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে
হৃদয় ভাসিয়া যায়,- সেখানে সে কারে ভালোবাসে !-
পাখির মতন কেঁপে – ডানা মেলে- হিম- চোখ বুজে
অধীর পাতার মতো পৃথিবীর মাঠের সবুজে
উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে,-
নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে
ঘুমাতে চেয়েছে,- তবু- ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসে,-
তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!
আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর
ক’মে যায়; -তাই নীল আকাশের স্বাদ- স্বচ্ছলতা-
পূর্ণ ক’রে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুদির গহ্বর;
মানুষের অন্তরের অবসাদ – মৃত্যুর জড়তা
সমুদ্র ভাঙিয়া যায়; - নক্ষত্রের সাথে কয় কথা
যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে-
তখন হৃদয়ে জাগে নতুন যে এক অধীরতা ,
তাই ল’য়ে সেই উষ্ণ –আকাশের চাই যে জড়াতে
গোধূলির মেঘে মেঘ, নক্ষত্রের মতো র’বো নক্ষত্রের সাথে!
আমারে দিয়েছ তুমি হৃদয়ের যে এক ক্ষমতা
ওগো শক্তি ,- তার বেগে পৃথিবীর পিপাসার ভার
বাধা পায়, জেনে লয় নক্ষত্রের মতো স্বচ্ছতা!
আমারে করেছ তুমি অসহিস্নু- ব্যর্থ-চমৎকার !
জীবনের পারে থেকে যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার,
কবর খুলেছে মুখ বার-বার যার ইশারায়,
বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষার তার
তাহার আঘাত পেয়ে কেঁপে কেঁপে ছিঁড়ে শুধু যায়!
একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে- বৈকালের আলোয় – সন্ধ্যায় !
সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাধে নাই নীড়, -
তাহার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর – অস্থিরতা !
অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির অধীর !
তাহারি হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মতো ব্যথা!
একবার তাই নীল আকাশের আলোর গাড়তা
তাহারে করেছে মুগ্ধ, - অন্ধকার নক্ষত্র আবার
তাহারে নিয়েছে ডেকে ,- জেনেছে সে এই চঞ্চলতা
জীবনের;- উড়ে উড়ে দেখেছে সে মরণের পার
এই উদ্বেলতা ল’য়ে নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার!
গোধূলির আলো ল’ য়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা,
স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা একা রেখেছে সে ঢাকি ;
আকাশে আঁধার কেটে গিয়েছে যখন ভোরবেলা
সবাই এসেছে পথে,- আসে নাই তবু সেই পাখি!-
নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,
ছায়ার উপরে তার নিজের পাখার ছায়া ফেলে
সাজায়েছে স্বপনের’ পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি !
সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে
সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তারে ফেলেছে সে মুছে অবহেলা !
কেউ তারে দেখে নাই ;- মানুষের পথ ছেড়ে দূরে
হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা ল’য়ে
যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে
কথা কয়,- আকাঙ্ক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে
হেমন্তের নদী,- ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে
হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস,-
তাহাদের মতো হয়ে তাহাদের সাথে গেছি রয়ে :
দূরে পড়ে পৃথিবীর ধূলা – মাটি – নদী- মাঠ – ঘাস,-
পৃথিবীর সিন্ধু দূরে ,- আরো দূরে পৃথিবীর মেঘের আকাশ !
এখানে দেখেছি আমি জাগিয়াছ হে তুমি ক্ষমতা,
সুন্দর মুখের চেয়ে তুমি আরো ভীষণ –সুন্দর !
ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি – আরো ভীষণতা
আমারে দিয়েছে ভয়! এইখানে পাহাড়ের’ পর
তুমি এসে বসিয়াছ,- এইখানে অশান্ত সাগর
তোমারে এনেছে ডেকে ;- হে ক্ষমতা , তোমার বেদনা
পাহাড়ের বনে বনে তুলিতেছে উত্তরের ঝড়
আকাশের চোখে- মুখে তুলিতেছে বিদ্যুতের ফণা
তোমার স্ফুলিঙ্গ আমি, ওগো শক্তি,- উল্লাসের মতন যন্ত্রণা !
আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন
প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে উঠে
তোমারে প্রাণের কাছে একদিন পেয়েছে কখন !
সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুকে ফুটে,
আঁধার রাতের মতো তারার আলোর দিকে ছুটে ,
সিন্ধুর ঢেউ এর মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে
সব আকাঙ্ক্ষার বাঁধ একবার গেছে তার টুটে !
বিদ্যুতের পিছে পিছে ছুটে গেছি বিদ্যুতের বেগে !
নক্ষত্রের মতো আমি আকাশের নক্ষত্রের বুকে গেছি লেগে !
যেই মুহূর্ত চ’লে গেছে ,- জীবনের যেই দিন গুলি
ফুরায়ে গিয়েছে সব,- একবার আসে তারা ফিরে;
তোমার পায়ের চাপে তাদের করেছো তুমি ধূলি !
তোমার আঘাত দিয়ে তাদের গিয়েছ তুমি ছিঁড়ে !
হে ক্ষমতা ,- মনের ব্যথার মতো তাদের শরীরে
নিমেষে নিমেষে তুমি কতবার উঠেছিলে জেগে !
তারা সব চ’লে গেছে;- ভূতুড়ে পাতার মতো ভিড়ে
উত্তর হাওয়ার মতো তুমি আজো রহিয়াছ লেগে!
যে সময় চ’লে গেছে তা- ও কাঁপে ক্ষমতার বিস্ময়ে – আবেগে !
তুমি কাজ ক’রে যাও, ওগো শক্তি , তোমার মতন !
আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে ;
বেদনা- উল্লাসে তাই সমুদ্রের মতো ভরে মন !-
তাই কৌতূহল – তাই ক্ষুধা এসে হৃদয়েরে ঘেরে ,-
জোনাকির পথ ধ’রে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে
দেখিতে চেয়েছি আমি, - নিরাশার কোলে ব’সে একা
চেয়েছি আশারে আমি,- বাঁধনের হাতে হেরে, হেরে
চাহিয়াছি আকাশের মতো এক অগাধের দেখা ! –
ভোরের মেঘের ঢেউয়ে মুছে দিয়ে রাতের মেঘের কালো রেখা!
আমি প্রণয়িনী ,- তুম হে অধীর , আমার প্রণয়ী !
আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে !-
প্রতিধ্বনির মতো হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি
কেঁপে উঠে – হৃদয়ের সে যে কত আবেগে আবেশে!
সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে
তোমার ছায়ার মতো ফিরিয়াছি তোমার পিছনে !
তবু ও হারায়ে গেছ ,- হঠাৎ কখন কাছে এসে
প্রেমিকের মতো তুমি মিশেছ আমার মনে মনে
বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ,-আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে !
কেন তুমি আস যাও ? – হে অস্থির , হবে নাকি ধীর !
কোনোদিন !- রৌদ্রের মতন তুমি সাগরের’ পরে
একবার-দুইবার জ্বলে উঠে হতেছ অস্থির ! –
তারপর, চ’লে যাও কোন দূরে পশ্চিমে- উত্তরে,-
সেখানে মেঘের মুখে চুমু খাও ঘুমের ভুতরে,
ইন্দ্রধনুকের মতো তুমি সেইখানে উঠিতেছ জ্ব’লে,
চাঁদের আলোর মতো একবার রাত্রির সাগরে
খেলা করো ;- জ্যোৎস্না চ’লে যায়,- তবু তুমি যাও চ’লে
তার আগে; - যা বলেছ একবার, যাবে নাকি আবার তা ব’লে !
যা পেয়েছি একবার পাব নাকি আবার তা খুঁজে !
যেই রাত্রি যেই দিন একবার কয়ে গেল কথা
আমি চোখ বুজিবার আগে তারা গেল চোখ বুজে,
ক্ষীণ হয়ে নিভে গেল সলিতার আলোর স্পষ্টতা !
ব্যথার বুকের ‘পরে আর এক ব্যথা বিহ্বলতা
নেমে এলো ;- উল্লাস ফুরায়ে গেল নতুন উৎসবে ;
আলো অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছি শুধু এই ব্যথা, -
দুলিতেছি এই ব্যথা – উল্লাসের সিন্ধুর বিপ্লবে !
সব শেষ হবে , - তবু আলোড়ন ,- তা কি শেষ হবে !
সকল যেতেছে চ’লে ,- সব যায় নিভে – মুছে- ভেসে-
যে সুর থেমেছে তার স্মৃতি তবু বুকে জেগে রয় !
যে নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে –রাতে – নিরুদ্দেশে,
তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয় !
যে মুখ মিলায়ে যায় আবার ফিরিতে তারে হয়
গোপনে চোখের’পরে,- ব্যথিতের স্বপ্ন্বের মতন !
ঘুমন্তের এই অশ্রু –কোন পীড়া –সে কোন বিস্ময়
জানায়ে দিতেছে এসে !- রাত্রি-দিন আমাদের মন
বর্তমান অতীতের গুহা ধ’রে একা একা ফিরিছে এমন !
আমরা মেঘের মতো হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে
অনেক গভীর রাতে- একবার পৃথিবীর পানে
চেয়ে দেখি, আবার মেঘের মতো চুপে চুপে ভেসে
চ’লে যাই এক ক্ষীণ বাতাসের দুর্বল আহ্বানে
কোন দিকে পথ বেয়ে! – আমাদের কেউ কি তা জানে ।
ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে
চ’লে যাই;- কোন এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে ?
পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে
আরো আকাশের দিকে,- অন্ধকারে,- অন্য কারো আকাশের থেকে !
একদিন বুজিবে কি চারিদিকে রাত্রির গহবর !-
নিবন্ত বাতির বুকে চুপে চুপে যেমন আঁধার
চ’লে আসে ,- ভালোবেসে – নুয়ে তার চোখের উপর
চুমু খায়,- তারপর তারে কোলে টেনে লয় তার;-
মাথার সকল স্বপ্ন – হৃদয়ের সকল সঞ্চার
একদিন সেই শূন্য সেই শীত নদীর উপরে
ফুরাবে কি? – দুলে দুলে অন্ধকারে তবুও আবার
আমার রক্তের ক্ষুধা নদীর ঢেউয়ের মতো স্বরে
গান গাবে,- আকাশ উঠিবে কেঁপে আবার সে সঙ্গীতের ঝড়ে !
পৃথিবীর – আকাশের পুরানো কে আত্মার মতন
জেগে আছি; - বাতাসের সাথে সাথে আমি চলি ভেসে,
পাহাড়ে হাওয়ার মতো ফিরিতেছে একা একা মন,
সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো দুপুরের সমুদ্রের শেষে
চলিতেছে ; - কোন এক দূর দেশে – কোন নিরুদ্দেশে
জন্ম তার হয়েছিল ,- সেইখানে উঠেছে সে বেড়ে;
দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে
কোন স্বপ্ন !- এ আকাশ ছেড়ে দিয়ে কোন আকাশেরে
খুঁজে ফিরি !- গুহার হাওয়ার মতো বন্দী হয়ে মন তব ফেরে !
গাছের শাখার জালে এলোমেলো আঁধারের মতো
হৃদয় খুঁজিছে পথ, ভেসে ভেসে ,- সে যে কারে চায় ।
হিমের হওয়ার হাত তার হাড় করিছে আহত,-
সে- ও কি শাখার মতো – পাতার মতন ঝ’রে যায় !
বনের বুকের গান তার মতো শব্দ ক’রে গায় !
হৃদয়ের সুর তার সে যে কবে ফেলেছে হারায়ে !
অন্তরের আকাঙ্ক্ষারে – স্বপনেরে বিদায় জানায়
জীবন মৃত্যুর মাঝে চোখ বুজে একাকী দাঁড়ায়ে ;
ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে মিশিবে কি সে – ঢেউয়ের গায়ে !
হয়তো সে মিশে গেছে- তারে খুঁজে পাবে নাকো কেউ!
কেন যে সে এসেছিল পৃথিবীর কেহ কি তা জানে !
শীতের নদীর বুকে অস্থির হয়েছে যেই ঢেউ
শুনেছে সে উষ্ণ গান সমুদ্রের জলের আহ্বানে !
বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু তবু ছিল তার প্রাণে ,
যে ঝড় ফুরায়ে যায় তাহার মতন বেগ লয়ে
যে প্রেম হয়েছে ক্ষুব্ধ সেই ব্যর্থ প্রেমিকের গানে
মিলায়েছে গান তার ,- তারপরে চ’লে গেছে বয়ে।
সন্ধ্যার মেঘের রঙ কখন গিয়েছে তার অন্ধকার হয়ে !
তবুও নক্ষত্র এক জেগে আছে,- সে যে তারে ডাকে!
পৃথিবী চায় নি যারে,- মানুষ করেছে যারে ভয়
অনেক গভীর রাতে তারায় তারায় মুখ ঢাকে
তবুও সে ! – কোন এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ চোখে ছবি দেখে একা জেগে রয় !
মানুষীর মতো ? কিংবা আকাশের তারাটির মতো ,-
সেই দূর- প্রণয়িনী আমাদের পৃথিবীর নয় !
তার দৃষ্টি তাড়নায় করেছে যে আমারে ব্যাহত ,-
ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম সে ক্ষত !
আলো আর অন্ধকারে তার ব্যথা- বিহবলতা লেগে,
তাহার রক্তে পৃথিবী হতেছে শুধু লাল !-
মেঘের চিলের মতো – দুরন্ত চিতার মতো বেগে
ছুটে যাই ;- পিছে ছুটে আসিতেছে বৈকাল-সকাল
পৃথিবীর ;- যেন কোন মায়াবীর নষ্ট ইন্দ্রজাল
কাঁদিতেছে ছিঁড়ে গিয়ে ! কেঁপে কেঁপে পড়িতেছে ঝ’রে!
আরো কাছে আসিয়াছি তবু আজ, - আরো কাছে কাল
আসিব তবুও আমি,- দিন রাত্রি রয় পিছে প’ড়ে ,-
তারপর একদিন কুয়াশার মতো সব বাধা যাবে স’রে !
সিন্ধুর ঢেউয়ের তলে অন্ধকার রাতের মতন
হৃদয় উঠিতে আছে কোলাহলে কেঁপে বার-বার!
কোথায় রয়েছে আলো জেনেছে তা – বুঝেছে তা মন
চারিদিকে ঘিরে তারে রহিয়াছে যদিও আঁধার !
একদিন এই গুহা ব্যথা পেয়ে আহত হিয়ার
বাঁধন খুলিয়া দেবে ! অধীর ঢেউয়ের মতো ছুটে
সেদিন সে খুঁজে লবে ওই দূর নক্ষত্রের পার !
সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম থেকে উঠে
দেখিবে জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
নিচে হতাহত সৈন্যদের ভিড় পেরিয়ে,
মাথার ওপর অগণন নক্ষত্রের আকাশের দিকে তাকিয়ে,
কোনো দূর সমুদ্রের বাতাসের স্পর্শ মুখে রেখে,
আমার শরীরের ভিতর অনাদি সৃষ্টির রক্তের গুঞ্জরণ শুনে,
কোথায় শিবিরে গিয়ে পৌঁছলাম আমি।
সেখানে মাতাল সেনানায়কেরা
মদকে নারীর মতো ব্যবহার করছে,
নারীকে জলের মতো;
তাদের হৃদয়ের থেকে উত্থিত সৃষ্টিবিসারী গানে
নতুন সমুদ্রের পারে নক্ষত্রের নগ্নলোক সৃষ্টি হচ্ছে যেন;
কোথাও কোনো মানবিক নগর বন্দর মিনার খিলান নেই আর;
এক দিকে বালিপ্রলেপী মরুভূমি হু-হু করছে;
আর এক দিকে ঘাসের প্রান্তর ছড়িয়ে আছে-
আন্তঃনাক্ষত্রিক শূন্যের মতো অপার অন্ধকারে মাইলের পর মাইল।শুধু বাতাস উড়ে আসছেঃ
স্থলিত নিহত মনুষ্যত্বের শেষ সীমানাকে
সময়সেতুগুলোকে বিলীন ক’রে দেবার জন্যে,
উচ্ছ্রিত শববাহকের মূর্তিতে।
শুধু বাতাসের প্রেতচারণ
অমৃতলোকের অপস্রিয়মান নক্ষত্রযান-আলোর সন্ধানে।
পাখি নেই,—সেই পাখির কঙ্কালের গুঞ্জরণ;
কোনো গাছ নেই,—সেই তুঁতের পল্লবের ভিতর থেকে
অন্ধ অন্ধকার তুষারপিচ্ছিল এক শোণ নদীর নির্দেশে।সেখানে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো, নারি,
অবাক হলাম না।
হতবাক হবার কী আছে?
তুমি যে মর্ত্যনারকী ধাতুর সংঘর্ষ থেকে জেগে উঠেছ নীল
স্বর্গীয় শিখার মতো;
সকল সময় স্থান অনুভবলোক অধিকার ক’রে সে তো থাকবে
এইখানেই,
আজ আমাদের এই কঠিন পৃথিবীতে।কোথাও মিনারে তুমি নেই আজ আর
জানালার সোনালি নীল কমলা সবুজ কাচের দিগন্তে;
কোথাও বনচ্ছবির ভিতরে নেই;
শাদা সাধারণ নিঃসঙ্কোচ রৌদ্রের ভিতরে তুমি নেই আজ।
অথবা ঝর্ণার জলে
মিশরী শঙ্খরেখাসর্পিল সাগরীয় সমুৎসুকতায়
তুমি আজ সূর্যজলস্ফুলিঙ্গের আত্মা-মুখরিত নও আর।
তোমাকে আমেরিকার কংগ্রেস-ভবনে দেখতে চেয়েছিলাম,
কিংবা ভারতের;
অথবা ক্রেমলিনে কি বেতসতম্বী সূর্যশিখার কোনো স্থানে আছে
যার মানে পবিত্রতা শান্তি শক্তি শুভ্রতা—সকলের জন্যে!
নিঃসীম শুন্যে শুন্যের সংঘর্ষে স্বতরুৎসারা নীলিমার মতো
কোনো রাষ্ট্র কি নেই আজ আর
কোনো নগরী নেই
সৃষ্টির মরালীকে যা বহন ক’রে চলেছে মধু বাতাসে
নক্ষত্রে—লোক থেকে সূর্যলোকান্তরে!ডানে বাঁয়ে ওপরে নিচে সময়ের
জ্বলন্ত তিমিরের ভিতর তোমাকে পেয়েছি।
শুনেছি বিরাট শ্বেতপক্ষিসূর্যের
ডানার উড্ডীন কলরোল;
আগুনের মহান পরিধি গান ক’রে উঠছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর? কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ আকাশ?
কেন চাঁদ ভেসে ওঠেঃ সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পিছনে?
কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমো খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে
ফুটে ওঠে কাশ?
খঞ্জনারা কেন নাচে? বুলবুলি দুর্গাটুনটুনি কেন ওড়াওড়ি করে
বনে বনে?
আমরা যে কমিশন নিয়ে ব্যস্ত- ঘাটি বাঁধি- ভালিবাসি নগর ও
বন্দরের শ্বাস
ঘাস যে বুতের নীচে ঘাস শুধু- আর কিছু নয় আহা- মোটের যে
সবচেয়ে বড় এই মানব্জীবনে
খঞ্জনারা নাচে কেন তবে আর- ফিঙা বুলবুলি কেন উড়াউড়ি করে
বনে বনে?
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে
সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে
ছুটে যায় দুটি আঁখি!
-কত দূর হায় বাকি!
উধাও অশ্ব বগ্লাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে,
পথে পথে তার বাধা জ’মে যায়,-তবু সে আসে না ফিরে!
দূরে,-দূরে,- আরো দূরে,-আরো দূরে,
অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ- সীমানা জুড়ে
ভাসিয়াছে মরুতৃষা!
-হিয়া হারায়েছে দিশা!
কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে
কোন্ দিগন্তে নির্জন কোন্ মৌন মায়াবী-পুরে!
কোন্-এক সুনীল দরিয়া সেথায় উত্থলিছে অনিবার!
-কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝঙ্কার,
ছোটে অঞ্জলি পেতে,
তৃষার নেশায় মেতে,
উষর ধূসর মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার!
খুলিয়া দিয়াছে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!
কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি!
যত খুন যত খারাবীর ঘোরে পরান আছিল মাতি,
নিমেষে গিয়েছে ভেঙে
স্বপন-আবেশে রেঙে
আঁখি দু’টি তার জৌলস্- রাঙা হ’য়ে গেছে রাতারাতি!
কোন্ যেন এক জিন-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী।
কোন্ যেন পরী চেয়ে আছে দু’টি চঞ্চল চোখ তুলে!
পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে!
গেঁথে গোলাপের মালা
তাকায়ে রয়েছে বালা,
বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস্ কালো পশমিনা চুলে!
বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে।
ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত অশ্ব কশাঘাত- জর্জর,
চারিদিকে তার বালুর পাথার,-মরুর হাওয়ার ঝড়;
নাহি শ্রান্তির লেশ,
সুদুর নিরুদ্দেশ-
অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকের’পর!
পথের তালাসে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!
আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়!
চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়!
ঝড়ের বাতাস মিছে
ছুটছে তাহার পিছে!
মরুভূর প্রেত চকমিয়া তার চক্ষের পানে চায়,-
সুরার তালাসে চুমুক দিল কে গরলের পেয়ালায়!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
স্বাতীতারা, কবে তোমায় দেখেছিলাম কলকাতাতে আমি
দশ-পনেরো বছর আগে; সময় তখন তোমার চুলে কালো
মেঘের মতন লুকিয়ে থেকে বিদ্যুৎ জ্বালাল
তোমার নিশিত নারীমুখের-জানো তো অন্তর্যামী।
তোমার মুখ; চারিদিকে অন্ধকারে জলের কোলাহল।
কোথাও কোনো বেলাভূমির নিয়ন্তা নেই-গভীর বাতাসে
তবুও সব রণক্লান্ত অবসন্ন নাবিক ফিরে আসে।
তারা যুবা, তারা মৃত; মৃত্যু অনেক পরিশ্রমের ফল।
সময় কোথাও নিবারিত হয় না, তবু, তোমার মুখের পথে
আজও তাকে থামিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছ- নারি
হয়তো ভোরে আমরা সবাই মানুষ ছিলাম, তারই
নিদর্শনের সূর্যবলয় আজকের এই অন্ধ জগতে।
চারিদিকে অলীক সাগর জ্যাসন ওডিসিয়ূস ফিনিশিয়
সার্থবাহের অধীর আলো- ধর্মাশোকের নিজের তো নয়, আপতিত কাল
আমরা আজও বহন করে, সকল কঠিন সমুদ্রে প্রবাল
লুটে তোমার চোখের বিষাদ ভৎসর্না…. প্রেম নিভিয়ে দিলাম প্রিয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কখন সোনার রোদ নিভে গেছে — অবিরল শুপুরির সারি
আঁধারে যেতেছে ডুবে — প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস
ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস;
কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে — আসিবে না করে গেছে আড়ি :
ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি
কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ,
কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?এই মাঠে — এই ঘাসে ফল্সা এ-ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে
আজও তার যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক — দুপুরের রোদে
সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি — অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে
তাহার দু-এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে
পৃথিবীর রাঙা রোদে চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে —
জানি সে আমার কাছে আছে আজো — আজো সে আমার কাছে কাছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন সাদা মুখ তার;
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমার মনের ভিতরে ছায়া আলো এসে পড়ে;
যেইসব অনুভূতি ঝরে গেছে তাদের কঙ্কাল
নদীকে দিয়েছি আমি-বিকেলকে-নক্ষত্রের দাহনে বিশাল
আকাশকে; ফিরে আসে নবদিকচিহ্ন নিয়ে মর্মের ভিতরে।সময়ের ঢের উৎস গ্রন্থ ছবি মননের পদ্ধতি সব
নিয়ে যায় হৃদয়কে যেন কোন্ শেষ অনুশীলনের পানে;
অন্তহীন অন্ধকার রয়ে গেছে হয়তো সেখানে:
অসীম আলোর মতো তবুও করেছি অনুভব।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
স্ট্রেচারের পরে শুয়ে কুয়াসা ফিরিছে বুঝি তোমার দুচোখেঃ
ভয় নেই, মৃত্যু নয় কোনো এক অপদার্থ অন্যায় আলোক;
তা’হ্লে কি এত লোক ম’রে যেত মশালের লালসায়- মাছির মতন?
অমৃতের সিড়ি ব’লে মানুষেরা গড়িত কি এত শাদা শ্লোক।
আজ মৃত্যু; এর আগে ম্যাটেডরদের মৃত্যু ছিল স্পেনে?
লড়েছে বীরের মত রাঙা রৌদ্রে আপনারে সব চেয়ে হাম্বড়া জেনে
খেয়েছে আঁধার রাত্রি অকস্মাৎ। তবু এক হরিয়ালঃ বাংলার পাখি
শিকারীর-গুলি-সার-নীলাকাশ ভেবে ময় মরণকে মেনে।
তবু মোরা দিবালোক উত্থাপন করি রোজ শৌণ্ডিকের মত;
গেলাস ভরিয়া দেই;- মনে হয় কম্পাশ, সিন্ধু, রৌদ্র,- জীবন ফলত
ধোমান মৃত্যুর চেয়ে। মরে গেছে ভূস্তরের অন্ধকার চূর্ণ পারা।
কিন্তু আমাদের আয়ু মানস্পট গিলে ফেলে সূর্যের মতন ব্যক্তিগত।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ডুবলো সূর্য; অন্ধকারের অন্তরালে হারিয়ে গেছে দেশ।
এমনতর আঁধার ভালো আজকে কঠিন রুক্ষ শতাব্দীতে।
রক্ত-ব্যথা ধনিকতার উষ্ণতা এই নীরব স্নীগ্ধ অন্ধকারের শীতে
নক্ষত্রদের স্থির সমাসীন পরিষদের থেকে উপদেশ
পায় না নব; তবুও উত্তেজনাও যেন পায় না এখন আর;
চারদিকেতে সার্থবাহের ফ্যাক্টার ব্যঙ্ক মিনার জাহাজ—সব,
ইন্দ্রলোকের অপ্সরীদের ঘাটা,
গ্লাসিয়ারের যুগের মতন আঁধারে নীরব।অন্ধকারের এ-হাত আমি ভালোবাসি; চেনা নারীর মতো
অনেক দিনের অদর্শনার পরে আবার হাতের কাছে এসে
জ্ঞানের আলো দিনকে দিয়ে কি অভিনিবেশে
প্রেমের আলো প্রেমকে দিতে এসেছে সময় মতো;
হাত দু’খানা ক্ষমাসফল; গণনাহীন ব্যক্তিগত গ্লানি
ইতিহাসের গোলকধাঁধায় বন্দী মরুভূমি-
সবের প্রে মৃত্যুতে নয়—নীরবতায় আত্মবিচারের
আঘাত দেবার ছলে কি রাত এমন স্নিগ্ধ তুমি।আজকে এখন আধাঁরে অনেক মৃত ঘুমিয়ে আছে।
অনেক জীবিতেরা কঠিন সাঁকো বেয়ে মৃত্যুনদীর দিকে
জলের ভিতর নামছে—ব্যবহৃত পৃথিবীটিকে
সন্ততিদের চেয়েও বেশি দৈব আধাঁর আকাশবাণীর কাছে
ছেড়ে দিয়ে—স্থির ক’রে যায় ইতিহাসের গতি।
যারা গেছে যাচ্ছে—রাতে যাবো সকলি তবে।
আজকে এ-রাত তোমার থেকে আমায় দূরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে
তবুও তোমার চোখে আত্মা আত্মীয় এক রাত্রি হয়ে রবে।তোমায় ভালোবেসে আমি পৃথিবীতে আজকে প্রেমিক, ভাবি।
তুমি তোমার নিজের জীবন ভালোবাস; কথা
এইখানেতেই ফুরিয়ে গেছে; শুনেছি তোমার আত্মলোলুপতা
প্রেমের চেয়ে প্রাণের বৃহৎ কাহিনীদের কাছে গিয়ে দাবি
জানিয়ে নিদয় খৎ দেখিয়ে আদায় ক’রে নেয়
ব্যাপক জীবন শোষণ ক’রে যে-সব নতুন সচল স্বর্গ মেলে;
যদিও আজ রাষ্ট সমাজ অতীত অনাগতের কাছে তমসুকে বাধাঁ,
প্রাণাকাশে বচনাতীত রাত্রি আসে তবুও তোমার গভীর এরিয়েলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমার জীবনে কোনো ঘুম নাই
মৎস্যনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি
এই নিদ্রা?গায় তার ক্ষান্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ- অবসাদ সুখ
চিন্তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন-বিমুখ
প্রাণ তারএই দিন এই রাত্রি আসে যায়- বুঝিতে দেয় না তারে; কোনো ধ্বনি ঘ্রাণ
কোনো ক্ষুধা- কোনো ইচ্ছা- পরীরো সোনার চুল হয় যাতে ম্লানঃ
আমাদের পৃথিবীর পরীদের;- জানেনা সে; শোনেনা সে
জীবনের লক্ষ্য মৃত নিঃশ্বাসের স্বর;
তাহলে ঘুমাত কবে; সে শুধু সুন্দর,
প্রশ্নহীন অভিজ্ঞতাহীন দূর নক্ষত্রের মতো
সুন্দর অমর শুধু; দেবতারা করেনি বিক্ষত
ইহাদের।এদের অপার রূপ শান্তি সচ্ছলতা
তবুও জানিত যদি আমার এ-জীবনের মুহূর্তের কথা
মানুষের জীবনের মুহূর্তের কথা।দেবতারা করেনি বিক্ষত ইহাদেরঃ
(দেবতারা করেনি বিক্ষত নিজেদের
কোনো অভিজ্ঞতা নাই দেবতার)
ঘুঘুদের শাদা ডানা- নীল রাত্রি- কমলরঙের মেঘ- সমুদ্রের ফেনা রোদ-
হরিণের বুকে বেদনার
নীরব আঘাত;
এরা প্রশ্ন করেনাকোঃ ইহারা সুন্দর শান্ত- জীবনের উদ্যাপনে সন্দেহের হাত
ইহারা তোলে না কেউ আঁধারে আকাশে
ইহাদের দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে।
শুনেছে কে ইহাদের মুখে কোনো অন্ধকার কথা?
সকল সংকল্প চিন্তা রক্ত আনে ব্যথা আনে- মানুষের জীবনের এই বীভৎসা
ইহাদের ছোঁয় নাকো;-
ব্যুবনিক প্লেগের মতন
সকল আচ্ছন্ন শান্ত স্নিগ্ধতারে নষ্ট ক'রে ফেলিতেছে মানুষের মন!গোলাপী ধূসর মেঘে পশ্চিমের বিয়োগ সে দ্যাখে না কি?
প্রজাপতি পাখি-মেয়ে করেনা কি মানুষের জীবনের ব্যথা আহরণ?
তবু এরা ব্যথা নয়ঃ ইহারা আবৃত সব- বিচিত্র- নীরব
অবিরল জাদুঘর এরা এক;- এরা রূপ ঘুম শান্তি স্থির
এই মৃত পাখি কীট- প্রজাপতি রাঙা মেঘ- সাপের আঁধার মুখে
ফরিঙের জোনাকির নীড়
এইসব।
আমি জানি, একদিন আমিও এমন
পতঙ্গের হৃদয়ের ব্যথা হব- সমুদ্রের ফেনা শাদা ফেনায় যেমন
ভেঙে পড়ে- ব্যথা পায়।
মানুষের মন
তবুও রক্তাক্ত হয় কেন এক অন্য বেদনায়
কীট যাহা জানে নাকো- জানে নাকো নদী ফেনা ঘাসরোদ- শিশির কুয়াশা
জ্যোৎস্নাঃ আম্লান হেলিওট্রোপ হায়!
এ-সৃষ্টির জাদুঘরে রূপ তারা- শান্তি- ছবি- তাহারা ঘুমায়
সৃষ্টি তাই চায়।ভুলে যাব যেই সাধ- যে-সাহস এনেছিলো মানুষ কেবল
যাহা শুধু গ্লানি হলো- কৃপা হলো- নক্ষত্রের ঘৃণা হলো-
অন্য কোনো স্থল
পেল নাকো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে বুকে মোর সেই তৃষা!
খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি,
রঙের মাঝারে হেরি রঙডুবি!
পরাগের ঠোঁটে পরিমল-গুঁড়ি,-
হারায়ে ফেলি গো দিশা!
আমি প্রজাপতি-মিঠা মাঠে মাঠে সোঁদালে সর্ষেক্ষেতে;
-রোদের সফরে খুঁজি নাকো ঘর,
বাঁধি নাকো বাসা-কাঁপি থরথর।
অতসী ছুঁড়ির ঠোঁটের উপর
শুঁড়ির গেলাসে মেতে!
আমি দক্ষিণা-দুলালীর বীণা,পউষ-পরশ-হারা!
ফুল-আঙিয়ার আমি ঘুমভাঙা!
পিয়াল চুমিয়া পিলাই গো রাঙা
পিয়ালার মধু,- তুলি রাতজাগা
হোরীর হা রা রা সাড়া!
আমি গো লালিমা,-গোধূলির সীমা,- বাতাসের ‘লাল’ ফুল।
দুই নিমেষের তরে আমি জ্বালি
নীল আকাশের গোলাপী দেয়ালি!
আমি খুশরোজী,-আমি গো খেয়ালি,
চঞ্চল,- চুলবুল।
বুকে জ্বলে মোর বাসর দেউটি,-মধু-পরিণয়-রাতি!
তুলিছে ধরণী বিধবা-নয়ন
-মনের মাঝারে মদনমোহন
মিলননদীর নিধুর কানন
রেখেছে রে মোর পাতি !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;
চালতার পাতা থেকে টুপ — টুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির;
কুয়াশায় সি’র হয়ে ছিল স্নান ধানসিড়ি নদীটির তীরে;
বাদুড় আধাঁর ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা
আকাঙ্খার; নিভু দীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা
সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির…. কিশোরীর ভিড়
আমের বউল দিল শীতরাতে; — আনিল আতার হিম ক্ষীর;
মলিন আলোয় আমি তাহাদের দেখিলাম, — এ কবিতা লেখাতাহাদের ম্লান মনে কবে, তাহাদের কড়ির মতন
ধূসর হাতের রূপ মনে করে; তাহাদের হৃদয়ের তরে।
সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন
তাহাদের হলুদ শাড়ি — ক্ষীর দেহ — তাহাদের অপরূপ মন
চলে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্ত্বনার ঘরে :
আমার বিষন্ন স্বপ্নে থেকে থেকে তাহাদের ঘুম ভেঙে পড়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
চলছি উধাও, বল্গাহারা,- ঝড়ের বেগে ছুটি !
শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে!
কোন্ সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি!
-আঁধার আলোর সাগর-শেষে
প্রেতের মতো আসছে ভেসে!
আমার দেহের ছায়ার মতো, জড়িয়ে আছে মনের সনে,
যেদিন আমি জেগেছিলাম, -সে-ও জেগেছে আমার মনে!
আমার মনের অন্ধকারে
ত্রিশূলমূলে,-দেউলদ্বারে
কাটিয়েছে সে দুরন্ত কাল ব্যর্থ- পূজার পুষ্প ঢেলে!
স্বপন তাহার সফল হবে আমায় পেলে, -আমায় পেলে!
রাত্রি-দিবার জোয়ার স্রোতে
নোঙর-ছেঁড়া হৃদয় হ’তে
জেগেছে সে হালের নাবিক,-
চোখের ধাঁধায়,- ঝড়ের ঝাঁঝে,-
মনের মাঝে,- মানের মাঝে !
আমার চুমোর অন্বেষণে
প্রিয়ার মতো আমার মনে
অঙ্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে,
চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রু-পাথার-কূলে!
ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে
হাতটি রেখে হাতে!
দেখিনি তার মুখখানি তো,-
পাইনি তারে টের,
জানিনি হায় আমার বুকে আশেক,-অসীমের
জেগে আছে জনম-ভোরের সূতিকাগার থেকে!
কত নতুন শরাবশালায় নাবনু একে একে!
সরাইখানার দিলপিয়ালায় মাতি
কাটিয়ে দিলাম কত খুশির রাতি!
জীবন-বীণার তারে তারে আগুন-ছড়ি টানি
গুলজারিয়া এল গেল কত গানের রানি,-
নাশপাতি-গাল গালে রাখি কানে কানে করলে কানাকানি
শরাব-নেশায় রাঙিয়ে দিল আঁখি!
-ফুলের ফাগে বেহুঁশ হলি নাকি!
হঠাৎ কখন স্বপন-ফানুস কোথায় গেল উড়ে!
-জীবন মরু- মরীচিকার পিছে ঘুরে ঘুরে
ঘায়েল হ’য়ে ফিরল আমার বুকের ক্যারাভেন,-
আকাশ-চরা শ্যেন!
মরু-ঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি
প্রাণ যে তাহার রইল তবু জাগি
ইবলিসেরি সঙ্গে তাহার লড়াই হ’ল শুরু!
দরাজ বুকে দিল্ যে উড়ু- উড়ু !
-ধূসর ধূ ধূ দিগন্তরে হারিয়ে- যাওয়া নার্গিসেরি শোভা
থরে থরে উঠল ফুটে রঙিন-মনোলোভা!
অলীক আশার,-দূর-দুরশার দুয়ার ভাঙার তরে
যৌবন মোর উঠল নেচে রক্তমুঠি,-ঝড়ের ঝুঁটির’ পরে!
পিছে ফেলে টিকে থাকার ফাটক- কারাগারে,
ভেঙে শিকল,- ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার
চলল সে যে ছুটে!
শৃঙ্খল কে বাধল তাহার পায়ে,-
চুলের ঝুঁটি ধরল কে তার মুঠে!
বর্শা আমার উঠল ক্ষেপে খুনে,
হুমকি আমার উঠল বুকে রুখে!
দুশমন কে পথের সুমুখে।
-কোথায় কে বা!
এ কোন মায়া!
মোহ এমন কার!
বুকে আমার বাঘের মতো গর্জাল হুঙ্কার!
মনের মাঝের পিছুডাকা উঠল বুঝি হেঁকে,-
সে কোন সুদূর তারার আলোরে থেকে
মাথার পরের খাঁ খাঁ মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে
নেমে এল রাত্রিদিবার যাত্রা-পথে কে রে!
কী তৃষা তার!...
কী নিবেদন!...
মাগছে কিসের ভিখ্!...
উদ্যত পথিক
হঠাৎ কেন যাচ্ছে থেমে,-
আজকে হঠাৎ থামতে কেন হয়!
-এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়!
পথ- আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি
আজকে নিল ডাকি
হালভাঙা এই ভুতের জাহাজটারে!
মড়ার খুলি,-পাহাড়-প্রমাণ হাড়ে
বুকে তাহার জ’মে গেছে কত শ্মশান-বোঝা!
আক্রোশে হা ছুটছিল সে একরোখা,- এক সোজা
চুম্বকেরি ধ্বংসগিরির পানে,
নোঙর-হারা মাস্তুলেরি টানে!
প্রেতের দলে ঘুরেছিল প্রেমের আসন পাতি,-
জানে কি সে বুকের মাঝে আছে তাহার সাথী!
জানে কি সে ভোরের আকাশ,- লক্ষ তারার আলো
তাহার মনের দূয়ার-পথেই নিরিখ হারালো!
জানেনি সে তোহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে
কোন্ দিওয়ানার সারেং কাঁদে
নয়নে নীর ঝরে!
কপোত-ব্যথা ফাটে রে- কার অপার গগন ভেদি!
তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদি
কোন্ সে অসীম আসি!
লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকের পাশাপাশি
প্রেমের খবর পুছে
কবের থেকে কাঁদতে আছে,-
‘পেয়ালা দে রে মুঝে!’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি —
এখনো কি ভালোবাসি?
সেটা অবসরে ভাববার কথা,
অবসর তবু নেই;
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিলো
সব চেয়ে আগে; জানি আমি।
সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই।
তুমি যে এ-পৃথিবীতে র’য়ে গেছো।
আমাকে বলেনি কেউ।
কোথাও জলকে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল
র’য়ে গেছে;-
যে যার নিজের কাজে আছে, এই অনুভবে চ’লে
শিয়রে নিয়ত স্ফীত সুর্যকে চেনে তারা;
আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চিনে উদীচীর
কোনো জল কী ক’রে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?
তবুও জীবন ছুঁ’য়ে গেলে তুমি;-
আমার চোখের থেকে নিমেষ নিহত
সূর্যকে সরায়ে দিয়ে।
স’রে যেতো; তবুও আয়ুর দিন ফুরোবার আগে।
নব-নব সূর্যকে কে নারীর বদলে
ছেড়ে দেয়; কেন দেব? সকল প্রতীতি উৎসবের
চেয়ে তবু বড়ো
স্থিরতর প্রিয় তুমি;- নিঃসূর্য নির্জন
ক’রে দিতে এলে।
মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম
তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো
বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম।
তুমি তা জানো না, তবু, আমি জানি, একবার তোমাকে দেখেছি;-
পিছনের পটভূমিকায় সময়ের
শেষনাগ ছিলো, নেই;- বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা
নিভে যায়;- মানুষ অপ্রিজ্ঞাত সে-আমায়; তবুও তাদের একজন
গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়!
আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু,
অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কে না জেনে কোথায় চলেছি!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
১
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ
বাতাসে ঘুঘুর ডাক—অশত্থে ঘুঘুর ডাক—হৃদয়ে ঘুঘু যে ডাকে—নরম ঘুঘুর ডাক আজ
তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ২
কেউ যে কোথাও নেই—সকলে গিয়েছে মরে—সকলে গিয়েছে চলে—উঠান রয়েছে শুধু একা
শিশুরা কাঁদে না কেউ—রুগিরা হাঁপায় না তো—বুড়োরা কয় না কথা : থুবড়ো ব্যথার কথা যত
এখানে সকাল নাই—এখানে দুপুর নাই—এখানে জনতা নাই—এখানে সমাজ নাই—নাইকো মূর্খ ধাঁধা কিছু
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ৩
আর তো ক্লান্তি নাই—নাইকো চেষতা আজ—নাইকো রক্ত ব্যথা—বিমূঢ় ভিড়ের থেকে নিয়েছি জীবন ভরে ছুটি
হেঁটেছি অনেক পথ—আমার ফুরালো পথ—এখানে সকল পথ তোমার পায়ের পথে গিয়েছে নীলাভ ঘাসে মুছে
তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় — চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,
আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান
রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি… খোসার মতন নষ্ট ম্লান
একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে, — যখন সবুজ অন্ধকার,
নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ কোন এক নবীনাগতার
মুখখানা নিয়ে আসে — মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান
এমন গভীর করে পেয়েছি কি? প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান,
প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যায় –চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে,
প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, — আর তুমি স্বাতীর মতন
রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে, — তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে
মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে সে গভীর শিহরণ,
তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে — অনিবার অরুণের ম্লানে
জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমি কবি-সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক'রে!
জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা-
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ'রে!ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,-
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
প'ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়-
মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়!
ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে-
সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের লোভে
বনের চাতক-মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে!
কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে!
বাদল-বৌয়ের চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে
বনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে,
ঘাটের ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!ওরে চাতক, বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে
নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে,
'দে জল!' ব'লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল
খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে ছল্ছল্ !
মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!
মনের চাতক, হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি
কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি ছাড়ি?
ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে,
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে!
আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, আয় রে তাড়াতাড়ি।বনের চাতক, মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
সে কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
তোমারে ঘেরিয়া জাগে কত স্বপ্ন–স্মৃতির শ্মশান,
ভুলুণ্ঠিত লুব্ধ অভিযান;
সাম্রাজ্যের অশ্রু, রক্ত, সমাধি, পতন
হে হীরক, একে একে করেছ চুম্বন!
স্পর্শে তব অনাদি অতীত যেন নিরন্তর মর্মে ওঠে ধ্বনি!
মাধবের বক্ষে তুমি ছিলে কি গো স্যমন্তক মণি!
শ্ৰীহরির বনমালা চুমি
দিব্য গন্ধে অকলঙ্ক অঙ্ক তব ভরেছিলে তুমি
ওগো কোহিনূর।
হৃদে তব আজও বুঝি গাঁথা আছে গোপনীয় বাঁশরির সুর,
যুগান্তের গাঢ় নীল পুলিনের ভাষা,
বাসনা পিপাসা!
অরুণ ময়ুখ স্পর্শে নিশান্তের স্বপ্ন যাও ভুলি!
নব নবীনের লাগি যুগে যুগে উঠিছ মুকুলি
অভিনব রূপে!
নির্মম কালের অগ্নি-অঙ্গারের স্তুপে
দেহ তব যায় না দহিয়া
হে অটুট বজ্ৰমণি, কোটি কোটি প্রেমিকের বরণীয়া প্রিয়া।
গিয়েছিলে কবে তুমি পাঠানের অন্তঃপুরে পশি
সুলতান-প্ৰেয়সী!
হারেমের অন্ধকারে লক্ষ বাদী বেগমের মাঝে
স্থিরপ্ৰভা দামিনীর সাজে!
মৌন শিখা স্পর্শে তব করেছিলে ইন্দুনিভা কত শত রূপসীর বদন পাণ্ডুর
ওগো কোহিনূর।
ম্লান করি দিলে কত আননের সুশ্ৰী শশীলেখা,
বিচ্ছুরিলে জ্যোতিঃপাত মদগৰ্ব মোগলের প্রমোদসভাতে;
বিভ্রমের লীলাকক্ষে–বিলাসের খুশরোজ রাতে
শাহী বেগমের আঁখি হয়েছিল অশ্রু ছলছল
তোমার সম্পদস্বপ্নে—অলখিতে ছায়াচ্ছন্ন হয়েছিল
উল্লাসের সে মোতিমহল।
নিশীথলাঞ্ছন বিভা জ্বলিয়া উঠিল কবে কাম্য মণি-ময়ূরের চোখে—
কত দীর্ঘ শতাব্দীর অশ্রু দৈন্য শোকে
করে গেল জয়শ্ৰীসম্পাত
উদয়-অরুণসম, তারপর কবে অকস্মাৎ
অস্তগত সাম্রাজ্যের কবর ভাঙিয়া
অভিসারে চলে গেল, প্ৰিয়া-উদাসিয়া
দূর সিন্ধুপারে
ঐশ্বৰ্য-তোরণ-তটে তুঙ্গ সিংহদ্বারে!
নব অভিনন্দনের উন্মেষের দেশে,
আমাদের সৌভাগ্যের শোক রক্ত স্তব্ধ বেলাশেষে!বাসে না সে অশ্রুহিম কুহেলিরে ভালো
মৃত্যুর পিঙ্গল ছায়া প্রেতপুর কালো
আলেয়ার আলো
করে নাকো বিমুগ্ধ তাহারে!
পিরামিডসম সুপ্ত সমাধির দ্বারে
দাঁড়ায় না নিস্পলক প্রহরীর বেশে!
–চেয়ে থাকে,
কবে কোন প্ৰেমাস্পদ এসে
অঙ্কে তার এঁকে দেয় যৌবনের অরুণ-চুম্বন
নিমেষের আঁখিপাতে কেড়ে লয় মন।(অগ্রন্থিত কবিতা)
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
মালয় সমুদ্র পারে সে এক বন্দর আছে শ্বেতাঙ্গিনীদের।
যদিও সমুদ্র আমি পৃথিবীতে দেখে গেছি ঢেরঃ
নীলাভ জলের রোদে কুয়ালালুম্পুর, জাভা, সুমাত্রা ও ইন্দোচীন, বালি
অনেক ঘুরেছি আমি- তারপর এখানে বাদামী মলয়ালী
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন।শাদা-শাদা ছোটো ঘর নারকেল ক্ষেতের ভিতরে
দিনের বেলায় আরো গাঢ় শাদা জোনাকির মতো ঝরঝরে।
শ্বেতাঙ্গদম্পতি সব সেইখানে সামুদ্রিক কাঁকড়ার মতো
সময় পোহায়ে যায়, মলয়ালী ভয় পায় ভ্রান্তিবশত,
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন।বাণিজ্যবায়ুর গল্পে একদিন শতাব্দীর শেষে
অভ্যুত্থান শুরু হ'লো এইখানে নীলসমুদ্রের কটিদেশে;
বাণিজ্যবায়ুর হর্ষে কোনো একদিন,
চারিদিকে পামগাছ- খোলা মদ- বেশ্যালয়- সেঁকো- কেরোসিন
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন।সারাদিন দূর থেকে ধপঁইয়া রৌদ্রে রিরাংসায় সে ঊনপঞ্চাশ
বাতাস তবুও বয়- উদীচির বিকীর্ণ বাতাস;
নারকেল কুঞ্জবনে শাদা-শাদা ঘরগুলী ঠাণ্ডা ক'রে রাখে;
লাল কাঁকরের পথ- রক্তিম গির্জার মুণ্ড দেখা যায় সবুজের ফাঁকেঃ
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুরবাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো---
তবে আমি হেঁটে চ ’লে যাবো মানে মানে ।
---ব’ লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত ।আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত;
তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত ।একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে,
একটি পয়সা পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো---
তাহ ’লে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা ।
ব ’লে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ ।
ভিড়ের ভিতরে তবু--- হ্যারিসন রোডে আরো গভীর অসুখ,
এক পৃথিবীর ভুল;ভিখিরীর ভুলে : এক পৃথিবীর ভুলচুক ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চলে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে,
আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, – কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান
একদিন; – হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে –
হ্নদয়ে ক্ষদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্খার তবু ও তো চোখের উপরে
নীল, মৃত্যু উজাগর – বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ -কখন মরণ আসে কে বা জানে – কালীদহে কখন যে ঝড়
কমলের নাম ভাঙে – ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিকের প্রাণ
জানি নাকো;- তবু যেন মরি আমি এই মাঠ – ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনায় নয় – যেন এই গাঙুড়ের ডেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে – রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
বাতাসের শব্দ এসে কিছুক্ষণ হরিতকী গাছের শাখায়
মিথিরিত হয়ে থেমে যায়, তার মৃত্যু হলো বলে।
এক পা দুই পা করে দুই-চার মাইল
প্রান্তরের সাথে আরো পরিচিত হলে
এমনি প্রান্তর থাকে রৌদ্রময়, শব্দবিহীন,
যতক্ষণ অপরাহ্ন বুকের উপরে পড়ে থাকে
তার; শালিখ পাখিকে আমি নাম ধরে ডাকি;
ছায়া বা অনলোজ্জ্বল পাখিনীকে ডাকে
তবুও সে; মানুষের অন্তঃসার অবহেলা করে
বিহঙ্গের নিয়মে নির্জন।
উনিশশো বেয়াল্লিশ খৃষ্টাব্দের অপরাহ্নে নেই।
উনিশশো অনন্তের ভূখণ্ডে, আকাশ
মাঝে মাঝে অনুভব করে নিতে চাই;
শান্তি নেই; নীললোহিতের প্রতি শেষ অবিশ্বাস
আছে কি না আছে ভেবে চেয়ে দেখি: পাখি,রৌদ্র, ঘাস।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
অনেক বছর হ’ল সে কোথায় পৃথিবীর মনে মিশে আছে।
জেগে থেকে কথা ব’লে অন্য নারীমুখ দেখে কেউ কোনোমতে
কেবলি কঠিন ঋণ দীর্ঘকাল আপামর পৃথিবীর কাছে
চেয়ে নিয়ে তার পর পাশ কেটে, মেয়েটির ঘুমের জগতে
দেনা শোধ ক’রে দিতে ভালোভাসে, আহা।
আকাশে রৌদ্রের রোল, নদী, মাঠ, পথে বাতাস
সেই স্বার্থ বুকে নিয়ে নিরুপম উজ্জ্বলতা হ’ল;
শূন্যের সংঘর্ষ থেকে অনুপম হ’ল নীলাকাশ;
তবু স্বাতির আলো- শিশিরের মত তার অপরীপ চোখ
নিজের শরীর মন প্রাণশিল্পী আর
না জাগায়ে প্রেমিকের ঋতু পরিবর্তনের মত;
নারী আজ সময়ের নিজের আধার।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
তবু তাহা ভুল জানি — রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা:
তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ় —
আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার, আরো ঢের জল, জল আরো;
তোমারো পৃথিবী পথ; নক্ষত্রের সাথে তুমি খেলিতেছ পাশা:
শঙ্খমালা নয় শুধু: অনুরাধা রোহিনীর ও চাও ভালোবাসা,
না জানি সে কতো আশা — কতো ভালোবাসা তুমি বাসিতে যে পার!
এখানে নদীর ধারে বাসমতী ধানগুলো ঝরিছে আবারো;
প্রান্তরের কুয়াশায় এখানে বাদুড়ের যাওয়া আর আসা —এসেছে সন্ধ্যার কাক ঘরে ফিরে, — দাঁড়ায়ে রয়েছে জীর্ণ মঠ,
মাঠের আঁধার পথে শিশু কাঁদে — লালপেড়ে পুরানো শাড়ির
ছবিটি মুছিয়া যায় ধীরে ধীরে — কে এসেছে আমার নিকট?
কার শিশু? বলো তুমি: শুধালাম, উত্তর দিলো না কিছু বটে;
কেউ নাই কোনোদিকে — মাঠে পথে কুয়াশার ভিড়;
তোমারে শুধাই কবি: তুমিও কি জানো কিছু এই শিশুটির।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
হে হৃদয়
নিস্তব্ধতা?
চারিদিকে মৃত সব অরণ্যেরা বুঝি?
মাথার ওপরে চাঁদ
চলছে কেবলি মেঘ কেটে পথ খুঁজে-পেঁচার পাখায়
জোনাকির গায়ে
ঘাসের ওপরে কী যে শিশিরের মতো ধূসরতা
দীপ্ত হয় না কিছু?
ধ্বনিও হয় না আর?হলুদ দু’-ঠ্যাং তুলে নেচে রোগা শালিখের মতো যেন কথা
ব’লে চলে তবুও জীবনঃ
বয়স তোমার কত? চল্লিশ বছর হল?
প্রণয়ের পালা ঢের এল গেল-
হল না মিলন?পর্বতের পথে-পথে রৌদ্রে রক্তে অক্লান্ত শফরে
খচ্চরে পিঠে কারা চড়ে?
পতঞ্জলি এসে ব’লে দেবে
প্রভেদ কী যারা শুধু ব’সে থেকে ব্যথা পায় মৃত্যর গহ্বরে
মুখে রক্ত তুলে যারা খচ্চরের পিঠ থেকে পড়ে যায়?মৃত সব অরণ্যেরা;
আমার এ-জীবনের মৃত অরণ্যেরা বুঝি বলেঃ
কেন যাও পৃথিবীর রৌদ্র কোলাহলে
নিখিল বিষের ভোক্তা নীলকন্ঠ আকাশের নীচে
কেন চ’লে যেতে চাও মিছে;
কোথাও পাবে না কিছু;
মৃত্যুই অনন্ত শান্তি হয়ে
অন্তহীন অন্ধকারে আছে
লীন সব অরণ্যের কাছে।
আমি তবু বলিঃ
এখনও যে-ক’টা দিন বেঁচে আছি সূর্যে-সূর্যে চলি,
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর
নিষ্পেষিত মনুষ্যতার
আঁধারের থেকে আনে কী ক’রে যে মহা-নীলাকাশ,
ভাবা যাক—ভাবা যাক-
ইতিহাস খুঁড়লাই রাশি-রাশি দুঃখের খনি
ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত-শত
শত জলঝর্ণার ধ্বনি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
তবুও যখন মৃত্যু হবে উপস্থিত
আর-একটি প্রভাতের হয়তো বা অন্যতর বিস্তীর্ণতায়,-
মনে হবে
অনেক প্রতীক্ষা মোরা ক'রে গেছি পৃথিবীতে
চোয়ালের মাংস ক্রমে ক্ষীণ ক'রে
কোনো এক বিশীর্ণ কাকের অক্ষি-গোলকের সাথে
আঁখি-তারকার সব সমাহার এক দেখে;
তবু লঘু হাস্যে- সন্তানের জন্ম দিয়ে-
তারা আমাদের মতো হবে- সেই কথা জেনে- ভুলে গিয়ে-
লোল হাস্যে জলের তরঙ্গ মোরা শুনে গেছি আমাদের প্রাণের ভিতর,
নব শিকড়ের স্বাদ অনুভব ক'রে গেছি- ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে।
অনেক গন্ধর্ব, নাগ, কুকুর, কিন্নর, পঙ্গপাল
বহুবিধ জন্তুর কপাল।
উন্মোচিত হ'য়ে বিরুদ্ধে দাঁড়ায়ে থাকে পথ- পথান্তরে,
তবু ওই নীলিমাকে প্রিয় অভিভাবিকার মতো মনে হয়,
হাতে তার তুলাদণ্ড;
শান্ত- স্থির;
মুখের প্রতিজ্ঞাপাশে নির্জন, নীলাভ বৃত্তি ছাড়া কিছু নেই।
যেন তার কাছে জীবনের অভ্যুদয়
মধ্য সমুদ্রের 'পরে অনুকূল বাতাসের প্ররোচনাময়
কোনো এক ক্রীড়া- ক্রীড়া;-
বেরিলমণির মতো তরঙ্গের উজ্জ্বল আঘাতে মৃত্যু।
স্থির- শুভ্র- নৈসর্গিক কথা বলিবার অবসর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস- তেমনি সুঘ্রাণ –
হরিনেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে !
আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে ঘসি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুস্বাদু অন্ধকার থেকে নেমে ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
হে নদী আকাশ মেঘ পাহাড় বনানী,
সৃজনের অন্ধকার অনির্দেশ উৎসের মতন
আজ এই পৃথিবীতে মানুষের মন
মনে হয়; অধঃপতিত এক প্রাণী।
প্রেম তার সব চেয়ে ছায়া, নিরাধার
নিঃস্বতায়- অকৃত্রিম আগুনের মত
নিজেকে না চিনে আজ রক্তে পরিণত
হে আগুন, কবে পাব জ্যোতিঃদীপাধার।
মানুষের জ্ঞানালোক সীমাহীন শক্তি পরিধির
ভিতরে নিঃসীম;
ক্ষমতার লালসায় অহেতুক বস্তুপুঞ্জে হুম;
সূর্য নয়- তারা নয়- ধোঁইয়ার শরীর।এ অঙ্গার অগ্নি হোক, এই অগ্নি ধ্যানালোক হোক;
জ্ঞান হোক প্রেম,- প্রেম শোকাবহ জ্ঞান
হৃদয়ে ধারণ ক’রে সমাজের প্রাণ
অধিক উজ্জ্বল অর্থে করে নিক অশোক আলোক।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
-বেলা বয়ে যায় !
গোধূলির মেঘ- সীমানায়
ধূম্র মৌন সাঁঝে
নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা বাজে !
শতাব্দীর শব্দেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে!
পান্থ ম্লান চিতার কবলে
একে একে ডুবে যায় দেশ , জাতি,- সংসার, সমাজ ,
কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা বসে আছ আজ
কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন !
অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
চকিতে মিলায়ে গেছে- পাও নাই টের !
কোন দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
দেউটি নিভায়ে গেছে ,- চলে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
চলে গেছে প্রিয়তম,- চলে গেছে প্রিয়া !
যুগান্তের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী ,
কবে কোন বেলাশেষে হায়
দূর অস্তশেখরের গায় !
তোমারে যায়নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমরপিয়া ;
সাঁঝের নীহারনীল সমুদ্র মথিয়া
মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী !
তোরণে আসেনি তব লক্ষ লক্ষ মরণ- সন্ধানী
অশ্রু-ছলছল চোখে,-পাণ্ডুর বদনে !
-কৃষ্ণ যবনিকা কবে ফেলে তারা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
জানো নাই তুমি !
জানো না তো মিশরের মূক মরুভূমি
তাদের সন্ধান !
হে নির্বাক পিরামিড ,- অতীতের স্তব্ধ প্রেত-প্রাণ
অবিচল স্মৃতির মন্দির !
আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি বসে আছো স্থির !
নিস্পলক যুগ্মভুরু তুলে
চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে
মেঘ- রক্ত ময়ূখের পানে !
জ্বলিয়া যেতেছে নিত্য নিশি-অবসানে
নূতন ভাস্কর !
বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
নবোদিত অরুণের সনে
কোন আশা- দুরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে !
-পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু’দণ্ডের
রুধির- ফোয়ারা
কি এক প্রগলভ উষ্ণ উল্লাসের সাড়া !
থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন !
শতাব্দীর বিরহীর মন
নিটল নিথর
সন্তরি ফিরিয়া মরে গগনের রক্ত-পীত সাগরের’পর!
বালুকার স্ফীত পারাবারে
লোল মৃগতৃষ্ণিকার দ্বারে
মিশরের অপহৃত অন্তরের লাগি
মৌন ভিক্ষা মাগি
-খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার !
মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
ধ্বনিত হইবে কবে কলহীন নীলার বেলায় !
-বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই বসে আছে
পিরামিড হায় !
-কত আগুন্তুক- কাল,- অতিথি – সভ্যতা
তোমার দুয়ারে এসে কয়ে যায় অসম্ব্রিত অন্তরের কথা!
তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল !
-তুমি রহ নিরুত্তর,- নির্বেদী ,- নিশ্চল !
মৌন , অন্যমনা !
-প্রিয়ার বক্ষের’পরে বসি একা নীরবে করিছ তুমি
শবের সাধনা
হে প্রেমিক-স্বতন্ত্র স্বরাট !
-কবে সুপ্ত উৎসবের স্তব্ধ ভাঙা হাট
উঠিবে জাগিয়া !
সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া
আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদ- কৃষ্ণ , পাণ্ডু , চূর্ণ ,
ব্যথিত কপোলে !
মিশর- অলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্বলে !
বসে আছো অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই!
-ওলটিপালটি যুগ-যুগান্তের শ্মশানের ছাই
জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি ,- প্রেমের প্রহরা!
-মোদের জীবনে যবে জাগে পাতা -ঝরা
হেমন্তের বিদায় – কুহেলি ,
অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি
গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
দুদিনের তরে শুধু,- নবোৎফুল্লা মাধবীর গান
মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
নিমেষে চকিতে !
-অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
হাড়ের মালা গলায় গেঁথে – অট্টহাসি হেসে
উল্লাসেতে টলছে তারা,- জ্বলছে তারা খালি !
ঘুরছে তারা লাল মশানে কপাল- কবর ঘেঁসে ,
বুকের বোমাবারুদ দিয়ে আকাশটারে জ্বালি
পাঁয়জোরে কাল মহাকালের পাঁজর ফেড়ে ফেড়ে
মড়ার বুকে চাবুক মেরে ফিরছে মরুর বালি !
সর্বনাশের সঙ্গে তোরা দম্ভে খেলিস পাশা
হেথায় কোন এক সৃষ্টিপাতের সূত্রপাতের ভূমি ,
-শিশু মানব গড়েছিল ঐ সাহারায় বাসা ;
- সে সব গেছে কবে ঘুমের চুমার ধোঁয়ায় ধূমি !
অটল আকাশ যাচ্ছে জরির ফিতার মতো ফেড়ে ,
জবান তোদের জ্বলছে যমের চিতার গেলাস চুমি !
তোদের সনে ‘ডাইনোসুরে’র লড়াই হলো কত,-
আলুথালু লুটিয়ে বালুর ডাইনী ছায়ার তলে
আজকে তারা ঘুমিয়া আছে ,- চুল্লি শত শত
উঠলো জ্বলে তাদের হাড়ে ,- তাদের নাড়ের বলে ;
কাঁদছে খাঁ খাঁ কাফন-ঢাকা বালুর চাকার নিচে ,
মুণ্ড তাদের ,- মড়ার কপাল ভৈরবেরি গলে!
তোদের বুকে জাগছে মৃগতৃষ্ণা ,- জাগে ঝর!
নিস উড়িয়ে শিকার- সোয়ার ধোঁয়ার পিছে পিছে ,-
মেঘে মেঘে চড়াও ,- বাজের বুক চিরে চক্কর !
নাচতে আছিস আকাশখানার গোখরাফণার নিচে,
আরব মিশর চীন ভারতের হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে !
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হাপর খিঁচে খিঁচে !
তোদের ভাষা আস্ফালিছে শেখ সেনানীর বুকে!
-লাল সাহারার শেরের সোয়ার ,- বালুর ঘায়ে ঘেয়ো ,
ধমক মেরে আঁধির বুকে ছুটছে রুখে রুখে!
-তোদের মতো নেইকো তাদের সোদর- সাথী কেহ ,
নেইকো তাদের মোদের মতন পিছুডাকের মায়া,
নেইকো তাদের মোদের মতন আর্ত মোহ-স্নেহ !
দানোয়-পাওয়া আগুনদানা ,- দারুণ পথের মুখে !
ঘায়েল করি মেঘের বুরুজ বল্লমেরি ঘর,
উড়িয়া হাজার ‘ক্যারাভেন’ ও তাম্বুশিবির বুকে ,
উজিয়ে মরীচিকার শিখা – কালফণা জর্জর ,
-টলতে আছিস ,- দলতে আছিস ,- জ্বলতে আছিস ধূ ধূ !
সঙ্গে স্যাঙাত-মসুদ ডাকাত ,- তাতার যাযাবর !
গাড়তে যাবো যারা তোদের বুকের মাঝে বাসা
হাড্ডি তাদের ফোফরা হ’য়ে ঝুরবে বালুর মাঝে ,
এইখানেতে নেইকো দরদ,-নেইকো ভালোবাসা ,
বর্শা লাফায় ,- উটের গলায় ঘণ্টি শুধু বাজে !
ফুরিয়ে গেছে আশা যাদের,- জুড়িয়ে গেছে জ্বালা ,
আয় রে বালুর ‘কারবালা’তে, অন্ধকারের ঝাঁঝে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
এখন সে কতো রাত;
এখন অনেক লোক দেশ-মহাদেশের সব নগরীর গুঞ্জরণ হ'তে
ঘুমের ভিতরে গিয়ে ছুটি চায়।
পরস্পরের পাশে নগরীর ঘ্রাণের মতন
নগরী ছড়ায়ে আছে।
কোনো ঘুম নিঃসাড় মৃত্যুর নামান্তর।
অনেকেরই ঘুম
জেগে থাকা।
নগরীর রাত্রি কোনো হৃদয়ের প্রেয়সীর মতো হ'তে গিয়ে
নটীরও মতন তবু নয়;-
প্রেম নেই- প্রেমব্যসনেরও দিন শেষ হ'য়ে গেছে;
একটি অমেয় সিঁড়ি মাটির উপর থেকে নক্ষত্রের
আকাশে উঠেছে;
উঠে ভেঙে গেছে।
কোথাও মহান কিছু নেই আর তারপর।
ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রাণের প্রয়াস র'য়ে গেছে;
তুচ্ছ নদী-সমুদ্রের চোরাগলি ঘিরে
র'য়ে গেছে মাইন, ম্যাগ্নেটিক মাইন, অনন্ত কনভয়,-
মানবিকদের ক্লান্ত সাঁকো
এর চেয়ে মহীয়ান আজ কিছু নেই জেনে নিয়ে
আমাদের প্রাণের উত্তরণ আসেনাকো।
সূর্য অনেক দিন জ্বলে গেছে মিশরের মতো নীলিমায়।
নক্ষত্র অনেক দিন জেগে আছে চীন, কুরুবর্ষের আকাশে।
তারপর ঢের যুগ কেটে গেলে পর
পরস্পরের কাছে মানুষ সফল হ'তে গিয়ে এক অস্পষ্ট রাত্রির
অন্তর্যামী যাত্রীদের মতো
জীবনের মানে বা'র ক'রে তবু জীবনের নিকট ব্যাহত
হ'য়ে আরো চেতনার ব্যথায় চলেছে।
মাঝে-মাঝে থেমে চেয়ে দেখে
মাটির উপর থেকে মানুষের আকাশে প্রয়াণ
হ'লো তাই মানুষের ইতিহাসবিবর্ণ হৃদয়
নগরে-নগরে গ্রামে নিষ্প্রদীপ হয়।
হেমন্তের রাতের আকাশে আজ কোনো তারা নেই।
নগরীর- পৃথিবীর মানুষের চোখ থেকে ঘুম
তবুও কেবলি ভেঙে যায়
স্প্লিন্টারের অনন্ত নক্ষত্রে।
পশ্চিমে প্রেতের মতন ইউরোপ;
পূব দিকে প্রেতায়িত এশিয়ার মাথা;
আফ্রিকার দেবতাত্মা জন্তুর মতন ঘনঘটাচ্ছন্নতা;
ইয়াঙ্কির লেন-দেন ডলারে প্রত্যয়;-
এই সব মৃত হাত তবে
নব-নব ইতিহার- উন্মেষের না কি?-
ভেবে কারু রক্তে স্থির প্রীতি নেই- নেই;-
অগণন তাপী সাধারণ প্রাচী অবাচীর উদীচীর মতন একাকী
আজ নেই- কোথাও দিৎসা নেই- জেনে
তবু রাত্রিকরোজ্জ্বল সমুদ্রের পাখি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে!
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের-আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাঁকে
কোথায় লুকায় আপনাকে!
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল-শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
নয়টি হাঁসকে রোজ চোখ মেলে ভোরে
দেখা যায় জলপাই পল্লবের মতো স্নিগ্ধ জলে;
তিনবার তিনগুনে নয় হয় পৃথিবীর পথে;
এরা তবু নয়জন মায়াবীর মতো জাদুবলে!সে-নদীর জল খুব গভীর-গভীর;
সেইখানে শাদা মেঘ- লঘু মেঘ এসে
দিনমানে কারো নীচে ডুবে গিয়ে তবু
যেতে পারেনাকো কোনো সময়ের শেষে।চারিদিকে উঁচু-উঁচু উলুবন, ঘাসের বিছানা;
অনেক সময় ধ'রে চুপ থেকে হেমন্তের জল
প্রতিপন্ন হ'য়ে গেছে যে-সময়ে নীলাকাশ ব'লে
সুদূরে নারীর কোলে তখন হাঁসের দলবলমিশে গেছে অপরাহ্নে রোদের ঝিলিকে;
অথবা ঝাঁপির থেকে অমেয় খইয়ের রঙ ঝরে;
সহসা নদীর মতো প্রতিভাত হয়ে যায় সব;
নয়টি অমল হাঁস নদীতে রয়েছে মনে পড়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, – সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্ণীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর –
শঙ্খমালা নাম তার : এ- বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
মাথার উপর দিয়ে কার্তিকের মেঘ ভেসে যায়;
দুই পা স্নিগ্ধ করে প্রান্তরের ঘাস;
উঁচু-উঁচু গাছের অস্পষ্ট কথা কী যেন অন্তিম সূত্র নিয়ে,
বাকিটুকু অবিরল গাছের বাতাস।
চিলের ডানার থেকে ঠিকরিয়ে রোদ
চুমোর মতন চুপে মানুষের চোখে এসে পড়ে;
শত টুকরোর মতো ভেঙে সূর্য ক্রমে আরও স্থির-
স্থিরতর হতে চায় নদীর ভিতরে।
লাল নীল হলদে শাদা কমলা পালকের
মাছরাঙা চিহ্ন হয়ে চুপে উড়ে এসে
দুই অন্ধ সমুদ্রের মাঝখানে কতটুকু রৌদ্রবিন্দু আছে
দেখাতে চেয়েছে ভালোবেসে।
সমস্ত সন্দেহ থেকে হৃদয়কে সরিয়ে এবার
শান্ত স্থির পরিষ্কার করে
চেয়ে দেখি মাছরাঙা সূর্য নিভে গেছে;
অন্য প্রেমিককে পাবে অন্য এক ভোরে।
দেশ, ৯ পৌষ ১৩৬১
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে
দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে
প্রভাত রবি উঠলো জেগে
দিব্য পরশ পেয়ে,
নাই গগণে মেঘের ছায়া
যেন স্বচ্ছ স্বর্গকায়া
ভুবন ভরা মুক্ত মায়া
মুগ্ধ-হৃদয় চেয়ে।অতীত নিশি গেছে চ'লে
চিরবিদায় বার্তা ব'লে
কোন আঁধারের গভীর তলে
রেখে স্মৃতিলেখা,
এসো-এসো ওগো নবীন
চ'লে গেছে জীর্ণ মলিন-
আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন
মুক্ত সীমারেখা।#অগ্রন্থিত কবিতা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ঘুমায়ে রয়েছ তুমি ক্লান্ত হ'য়ে, তাই
আজ এই জ্যোৎস্নায় কাহারে জানাই
আমার এ-বিস্ময়- বিস্ময়ের ঠাঁই,
নক্ষত্রের থেকে এলো;- তুমি জেগে নাই,আমার বুকের 'পরে এই এক পাখি;
পাখি? না ফড়িং কীট? পাখি না জোনাকি?
বাদামি সোনালী নীল রোম তার রোমে-রোমে রেখেছে সে ঢাকি,
এমন শীতের রাতে এসেছে একাকীনিস্তব্ধ ঘাসের থেকে কোন্
ধানের ছড়ার থেকে কোথায় কখন,
রেশমের ডিম থেকে এই শিহরণ!
পেয়েছে সে এই শিহরণ!জ্যোৎস্নায়- শীতে
কাহারে সে চাহিয়াছে? কতোদূরে চেয়েছে উড়িতে?
মাঠের নির্জন খড় তারে ব্যথা দিতে
এসেছিলো? কোথায় বেদনা নাই এই পৃথিবীতে।না- না- তার মুখে স্বপ্ন সাহসের ভর
ব্যথা সে তো জানে নাই- বিচিত্র এ-জীবনের 'পর
করেছে নির্ভর;
রোম- ঠোঁট- পালকের এই মুগ্ধ আড়ম্বর।জ্যোৎস্নায়- শীতে
আমার কঠিন হাতে তবু তারে হলো যে আসিতে,
যেই মৃত্যু দিকে-দিকে অবিরল- তোমারে তা দিতে
কেন দ্বিধা? অদৃশ্য কঠিন হাতে আমিও বসেছি পাখি,
আমারেও মুষড়ে ফেলিতে
দ্বিধা কেহ করিবে না; জানি আমি, ভুল ক'রে দেবে নাকো ছেড়েঃ
তবু আহা, তারের শিশিরে ভেজা এ রঙিন তূলোর বলেরে
কোমল আঙুল দিয়ে দেখি আমি চুপে নেড়ে-চেড়ে,
সোনালি উজ্জ্বল চোখে কোন্ এক ভয় যেন ঘেরেতবু তার; এই পাখি- এতটুকু- তবু সব শিখেছে সে- এ এক বিস্ময়
সৃষ্টির কীটেরও বুকে এই ব্যথা ভয়;
আশা নয়- সাধ নয়- প্রেম স্বপ্ন নয়
চারিদিকে বিচ্ছেদের ঘ্রাণ লেগে রয়পৃথিবীতে; এই ক্লেশ ইহাদেরো বুকের ভিতর;
ইহাদেরো; অজস্র গভীর রঙ পালকের 'পর
তবে কেন? কেন এ সোনালি চোখ খুঁজেছিলো জ্যোৎস্নার সাগর?
আবার খুঁজিতে গেল কেন দূর সৃষ্টি চরাচর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে;- জানি না সে এইখানে
শুয়ে আছে কিনা।
অনেক হয়েছে শোয়া;- তারপর একদিন চ’লে গেছে
কোন দূর মেঘে।
অন্ধকার শেষ হ’লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগেঃ
সরোজিনী চ’লে গেল অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া- পাখিদের
মতো পাখা বিনা?
হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির
ভূত বলেঃ আমি তো জানি না।
জাফরান- আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগেঃ
লুপ্ত বেড়ালের মতো; শূন্য চাতুরির মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সকাল-সন্ধ্যাবেলা আমি সেই নারীকে দেখেছি
জেনেছি অনেক দিন- তারপর তবুও ভেবেছি।
তারপর ঢের দিন পৃথিবীর সেই শাদা সাধারণ কথা
ছোট বড় জিনিসের বিস্মরণে ক্রমে ভুলে গেছি।
আকাশ আমাকে বলেঃ 'সে না তুমি আত্মসমাহিতি?'
পৃথিবী আমাকে দেখে ভেবে যায়ঃ 'এর প্রাণে, আহা,
লাখেরাজ হয়ে প'ড়ে র'য়েছে সততা;
যে নারীকে নদীর কিনারে জলে ভালোবেসেছিল
সময়ের সুবাতাস মুখ ছঁইয়ে চ'লে গেলে যদি তার কথা
ভুরু কোঁচকায়ে ভেবে নিতে হয়, মানবহৃদয় তবে সে কোন রকম।'
হেমন্তের কুয়াসায় বেড়াতে কারু দাবী
অমল ঋণের মত গ্রহণ ক'রেছি আমি নিতে ভুলে গিয়ে;
তার ভালোবাসা পেয়ে ভয়াবহভাবে সৎ হয়ে আছি- ভাবি।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি
তবুও ভালোবাসা,
দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের শিশির
নেমে আসা,
ভোরের দিকে হৃদয় ফেরাই
যাই চলে যাই-
নীল সকালে যাই চলে যাই-
একটি নদী একটি অরূণ
শিউলি শিশির পাখি-
'আমরা মায়ার মনের জিনিস
মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি'
বলছে সে কোন্ ত্রিকোণ থেকে
ছায়ার পরিভাষা।
কাউকে ভালোবেসেছিলাম, জানি,
তবুও ভালোবাসা।
সে কোন্ সুদূর মরুর মনে চলে গেছ
হায়, যাযাবর তুমি,
সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!হায় বলিভূক, কখন ভেবেছিলে
মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে
ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে
মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
এখন অনেক রাতে বিছানা পেয়েছ।
নরম আঁধার ঘর
শান্তি নিস্তব্ধতা;
এখন ভেবো না কোনো কথা
এখন শোনো না কোনো স্বর
রক্তাক্ত হৃদয় মুছে
ঘুমের ভিতর
রজনীগন্ধার মতো মুদে থাকো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি—
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনও দেখিবে স্বপ্ন–
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
আমি চলে যাব ব’লে
চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে?
লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! চারিদিকে শান্ত বাতি-ভিজে গন্ধ-মৃদু কলরব;
খেয়া নৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;
এশিরিয়া ধুলো আজ-বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
প্রথম ফসল গেছে ঘরে,-
হেমন্তের মাঠে – মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশ – পাতা – মরা ঘাস- আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা !
ধানক্ষেতে – মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা ;
ঝিমায়াছে এ- পৃথিবী ,-
তবু পাই টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে
শিশিরের পালক ঘ’ষে - ঘ’ষে ,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে ,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
সেই পাখি;-
আজ মনে পড়ে
সেদিনো এমনি গেছে ঘরে
প্রথম ফসল;-
মাঠে- মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর,-
কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!-
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে
শিশিরের পালক ঘ’ষে ঘ’ষে ,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে ,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে,
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
এই পাখি!
নদীটির শ্বাসে
সে-রাতেও হিম হয়ে আসে
বাঁশ – পাতা – মরা ঘাস- আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা !
ধানক্ষেতে – মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা ;
ঝিমায়াছে এ- পৃথিবী ,-
তবু আমি পেয়েছি যে টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কবে তব হৃদয়ের নদী
বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি!
সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে
দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে
বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন!
-পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন!
কারাগার-মর্মরের তলে
নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে
ভ’রে যায় বসুধার আহত আকাশ!
অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!
-সহস্রের অঙ্গুলিতর্জন
নিত্য সহিতেছি মোরা,-বারিধির বিপ্লব-গর্জন
বরিয়া লয়েছ তুমি,- তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;
তোমার পঞ্জরতলে টগ্বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!-
তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার,
অবগুণ্ঠিতার
হিমকৃষ্ণ অঙ্গুলির কঙ্কাল-পরশ
পরিহরি গেলে তুমি,-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস
তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা
চকিতে চূর্ণিয়া গেলে,-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা
বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,
তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট
তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!
নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!
প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!
ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,-
অগাধের সাধ
তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ!
মণিময় তোরণের তীরে
মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে
নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে
হে দুরন্ত দুর্নিবার,-প্রাণ তব কাঁদে!
ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন,
সমুদ্রের যৌবন-গর্জন
তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর- শের!
টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের
হে জলধি পাখি!
পক্ষে তব নাচিতেছে লক্ষ্যহারা দামিনী-বৈশাখী!
ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রত্নচূড় ময়ূখের টিপ,
কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ
করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে!
বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে
সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে!
কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে,-
স্তম্ভিত নয়নে
নীল বাতায়নে
তাকায়েছ তুমি!
অতিদূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের
আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি
সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী!
সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি
আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া
হে জল-বেদিয়া!
অলক্ষ্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন
সিন্ধু- বেদুঈন!
নাহি গৃহ- নাহি পান্থশালা-
লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা
তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্য-পাতালে-
বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে!
প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!
সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছু-ডাকা স্বর,
ভুলেছ নোঙর!
কোন্ দূর কুহকের কূল
লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল
কে বা তাহা জানে!
অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়-সে তো আর ফিরে নাহি আসে:
কাঞ্চনমালা যে কবে ঝরে গেছে;-বনে আজো কলমীর ফুল
ফুটে যায়-সে তবু ফেরে না, হায়;-বিশালাক্ষ্মী: সেও তো রাতুল
চরণ মুছিয়া নিয়া চলে গেছে;-মাঝপথে জলের উচ্ছ্বাসে
বাধা পেয়ে নদীরা মজিয়া গেছে দিকে দিকে-শ্মশানের পাশে
আর তারা আসে নাকো; সুন্দরীর বনে বাঘ ভিজে জুল-জুল
চোখ তুলে চেয়ে থাকে-কতো পাটরানীদের গাঢ় এলোচুল
এই গৌড় বাংলায়-পড়ে আছে তাহার পায়ের তলে ঘাসেজানে সে কি! দেখে নাকি তারাবনে পড়ে আছে বিচূর্ণ দেউল,
বিশুষ্ক পদ্মের দীঘি-ফোঁপড়া মহলা ঘাট, হাজার মহাল
মৃত সব রূপসীরা; বুকে আজ ভেরেন্ডার ফুলে ভীমরুল
গান গায়-পাশ দিয়ে খল্ খল্ খল্ খল্ বয়ে যায় খাল,
তবু ঘুম ভাঙে নাকো-একবার ঘুমালে কে উঠে আসে আর
যদিও ডুকারি যায় শঙ্খচিল-মর্মরিয়া মরে গো মাদার।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
বসে থাকি; কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান- অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;
আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো দেখি নাই অত
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসেপৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান,
কিশোরের পায়ে- দলা মুথাঘাস,-লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান- নীরবতা-এরি মাঝে বাংলার প্রাণ;
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
প্রান্তরের পারে তব তিমিরের খেয়া
নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া!
-হেথা, গৃহ-বাতায়নে নিভে গেছে প্রদীপের শিখা,
ঘোমটায় আঁখি ঘেরি রাত্রি-কুমারিকা
চুপে চুপে চলিতেছে বনপথ ধরি!
আকাশের বুকে বুকে কাহাদের মেঘের গাগরী
ডুবে যায় ধীরে ধীরে আঁধার- সাগরে!
ঢুলু-ঢুলু তারকার নয়নের’ পরে
নিশি নেমে আসে গাঢ়,-স্বপন-সঙ্কুল!
শেহালায় ঢাকা শ্যাম বালুকার কূল
বনমরালীর সাথে ঘুমায়েছে কবে!
বেণুবনশাখে কোন্ পেঁচকের রবে
চমকিছে নিরালা যামিনী!
পাতাল-নিলয় ছাড়ি কে নাগ-কামিনী
আঁকাবাঁকা গিরিপথে চলিয়াছে চিত্রা অভিসারিকার প্রায়!
শ্মশান-শয্যায়
নেভ-নেভ কোন্ চিতা-স্ফুলিঙ্গেরে ঘিরে
ক্ষুধিত আঁধার আসি জমিতেছে ধীরে!
নিদ্রার দেউলমূলে চোখ দুটি মুদে
স্বপ্নের বুদ্বুদে
বিলসিছে যবে ক্লান্ত ঘুমন্তের দল-
হে অনল,-উন্মুখ, চঞ্চল
উন্নমিত আঁখিদুটি মেলি
সন্তরি চলিছ তুমি রাত্রির কুহেলি
কোন্ দূর কামনার পানে!
ঝলমল দিবা অবসান
বধির আঁধারে
কান্তারের দ্বারে
এ কি তব মৌন নিবেদন!
-দিকভ্রান্ত,-দরদী,-উন্মন!
পল্লীপসারিণী যবে পণ্যরত্ন হেঁকে গেছে চ’লে
তোমার পিঙ্গল আঁখি ওঠে নি তো জ্ব’লে
আকাঙ্কার উলঙ্গ উল্লাসে!
-জনতায়,-নগরীর তোরণের পাশে,
অন্তঃপুরিকার বুকে,- মণিসৌধ-সোপানের তীরে,
মরকত-ইন্দ্রনীল-অয়স্কান্ত- খনির তিমিরে
যাও নি তো কভু তুমি পাথেয়- সন্ধানে!
ভাঙা হাটে,-ভিজা মাঠে,-মরণের পানে শীত প্রেতপুরে
একা একা মরিতেছ ঘুরে!
না জানি কি পিপাসার ক্ষোভে!
আমাদের ব্যর্থতায়,- আমাদের সকাতর কামনায় লোভে
মাগিতে আসনি তুমি নিমেষের ঠাঁই!
-অন্ধকার জলাভূমি,- কঙ্কালের ছাই,
পল্লীকান্তারের ছায়া,-তেপান্তর পথের বিস্ময়
নিশীথের দীর্ঘশ্বাসময়
করিয়াছে বিমনা তোমারে!
রাত্রি-পারাবারে
ফিরিতেছ বারম্বার একাকী বিচরি!
হেমন্তের হিম পথ ধরি,
পউষ আকাশতলে দহি দহি দহি
- ছুটিতেছে বিহ্বল বিরহী
কত শত যুগজন্ম বহি!
কারে কবে বেসেছিলে ভালো
হে ফকির,- আলেয়ার আলো!
কোন্ দূরে অস্তমিত যৌবনের স্মৃতি বিমথিয়া
চিত্তে তব জাগিতেছে কবেকার প্রিয়া!
সে কোন্ রাত্রির হিমে হ’য়ে গেছে হারা!
নিয়েছে ভুলায়ে তারে মায়াবী ও নিশিমরু,-
আঁধার- সাহারা!
আজো তব লোহিত- কপোলে
চুম্বন-শোণিমা তার উঠিতেছে জ্ব’লে
অনল-ব্যথায়!
-চ’লে যায়,-মিলনের লগ্ন চ’লে যায়!
দিকে দিকে ধূমাবাহু যায় তব ছুটি
অন্ধকারে লুটি লুটি লুটি!
ছলাময় আকাশের নিচে
লক্ষ প্রেতবধূদের পিছে
ছুটিয়া চলিছে তব প্রেম-পিপাসার
অগ্নি অভিসার!
বহ্নি-ফেনা নিঙাড়িয়া পাত্র ভরি ভরি,
অনন্ত অঙ্গার দিয়া হৃদয়ের পান্ডুলিপি গড়ি,
উষার বাতাস ভুলি,- পলাতকা রাত্রির পিছনে
যুগ যুগ ছুটিতেছ কার অন্বেষণে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
পাড়াগাঁর দু’পহর ভালোবাসি — রৌদ্র যেন গন্ধ লেগে আছে
স্বপনের; — কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন যে বাঁধিয়াছে ঘর
আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো — কেবল প্রান্তর
জানে তাহা, আর ওই প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে
যেন এ-জনমে নয় — যেন ঢের যুগ ধরে কথা শিখিয়াছে
এ — হৃদয় — স্বপ্নে যে বেদনা আছে : শুষ্ক পাতা — শালিখের স্বর,
ভাঙা মঠ — নক্শাপেড়ে শাড়িখানা মেযেটির রৌদ্রের ভিতর
হলুদ পাতার মতো স’রে যায়, জলসিড়িটির পাশে ঘাসে
শাখাগুলো নুয়ে আছে বহু দিন ছন্দহীন বুনো চালতার:
জলে তার মুখখানা দেখা যায় — ডিঙিও ভাসিছে কার জলে,
মালিক কোথাও নাই, কোনোদিন এই দিকে আসিবেনা আর,
ঝাঁঝরা ফোঁপরা, আহা ডিঙিটিরে বেঁধে রেখে গিয়েছে হিজলে;
পাড়াগাঁর দু — পহর ভালোবাসি — রৌদ্রে যেন ভিজে বেদনার
গন্ধ লেগে আছে, আহা, কেঁদে কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
এ অন্ধকার জলের মতো; এই পৃথিবীর সকল কিণার ঘিরে
নরক নগর তাপী পাপীর শান্ত শুশ্রুষায়
কোথার থেকে এসে কোথায় লক্ষ্যে চ'লে যায়;
সকল উত্তেজনায় আসে স্নিগ্ধ শরীরেকে ব্যাহত পাখির মতো প্রাণাকাশে ওড়ার পথে সময়শায়কে
কারা কোথায় আলোককণার মতন, সূর্য হতে
জন্ম পেয়েই হারিয়ে গেছে অন্ধ রক্ত স্রোতে;
বু্দ্ধিজীবী নষ্ট হলো কোথায় মনের গোলকধাঁধার ছকে-সবের কাছে নিরাভিমান রাত্রি এসে নমিত হ'লে বলে;
কথা ভাবায়; কথা ভাবার সর্বনাশে শান্তি কোথায় আছে?
তবুও এসে অনেক কাজের পরে অন্তরাশ্রয়িতার কাছে;
মৃত্যু ঘুমের অতীত ব্যথা ক্ষয় পাবে কি সহজ সরলে?এখানে কোনো আকাশসারী ইন্দ্রজাল নেই;
এখানে কালের সিঁড়ির পরে মধ্যপথে অগম সিঁড়ির দিকে
তাকিয়ে বিষয় ভেবে নিতে হয়েছে নতুন যানের প্রতীকে;
মৃত্যু নেই, মায়া নেই, ইতিহাস অমোঘ তবু ঠিক এ-কারণেইক্লান্তি নেই; মনেনদীর দু-পার ঘিরে ছাউনি পড়েছে
এপারে এরা জীবনপ্রেমিক: ঘোষণা ক'রে বলে;
ওপারে এরা এই পৃথিবীর নিষ্পেষিত নরনারীর দলে,
সিদ্ধি চায়: গণনাহীন মৃত্যুসেনা হাজির করেছেঅনেক বিনাশ সাঙ্গ হ'লে অন্ধকারের নতুন জাতক, ঢল
তবুও অনেক প্রাণের প্রয়াস ঝরনা প্রেম সহিষ্ণুতা আলো
দেখেছে আবার নবনবীন নৈরাশ্যে হারালো:
নাবিক ক্লান্ত : নদী কি নিষ্ফল?অন্ধকারের হৃদয় এখন নিজের কাছে থেমে
আশা আলো হারিয়ে যতোই শ্লেষ পরিহাস শক্তিতে কঠিন
হ'য়ে সন্ততিদের কাছে পিতৃলোকের ঋণ
আঁধার জলাঞ্জলি ভাবে- ততোই জনমানব প্রেমেনিহিত হ'য়ে নতুন জলকণিকারাশি বানিয়ে নিতে চায়।
আবার কি তা রক্তকণা হ'য়ে গেলো? স্ফালন ক'রে অন্ধকারে জ্ঞানী
হ'য়ে সে দেখছে ইতিহাসের বিরাট হয়রানি
নবীন বীজের মতন আজো মানবতার বিবর্ণ আত্মায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো-
তোমরা কোথায় যেতে চাও?
এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:
ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;
এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের
তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!
বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;
আবার কোথায় যেতে চাও?
‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন
তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়
-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-
এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে
এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে
জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাক্সক্ষার বেদনার শুধেছিল ঋণ;
দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন!
‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?
সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?
আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাক্সক্ষার ঘর!..
যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাক্সক্ষার ঘর!’
-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সন্ধ্যা হয় — চারিদিকে মৃদু নীরবতা
কুটা মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে;
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ বেড়ে ধীরে ধীরে;
আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে;পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু;জনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
প্রিয়ার গালেতে চুমো খেয়ে যায় চকিতে পিয়াল রেণু!-
এল দক্ষিণা,-কাননের বীণা,- বনানীপথের বেণু!
তাই মৃগী আজ মৃগের চোখেতে বুলায়ে নিতেছে আখিঁ,
বনের কিনারে কপোত আজিকে নেয় কপোতীরে ডাকি!
ঘুঘুর পাখায় ঘুঙুর বাজায় আজিকে আকাশখানা,-
আজ দখিনার ফর্দা হাওয়ায় পর্দা মানে না মানা!
শিশিরশীর্ণা বালার কপোলে কুহেলির কালো জাল
উষ্ণ চুমোর আঘাতে হয়েছে ডালিমের মতো লাল!
দাড়িমের বীজ ফাটিয়া পড়িছে অধরের চারিপাশে
আজ মাধবীর প্রথম উষার,- দখিনা হাওয়ার শ্বাসে!
মদের পেয়ালা শুকায়ে গেছিল,- উড়ে গিয়েছিল মাছি,
দখিনাপরশে ভরা পেয়ালায় বুদবুদ্ ওঠে নাচি!
বেয়ালার সুরে বাজিয়া উঠিছে শিরা-উপশিরাগুলি!
শ্মাশানের পথে করোটি হাসিছে,-হেসে খুন হ’ল খুলি!
এস্রাজ বাজে আজ মলয়ের,- চিতার রৌদ্রাতপ
সুরের সুঠামে নিভে যায় যেন,- হেসে ওঠে যেন শব!
নিভে যায় রাঙা অঙ্কারমালা,- বৈতরনীর জলে,
সুর-জাহ্নবী ফুটে ওঠে আজ মলয়ের কোলাহলে!
আকাশ- শিথানে মধু- পরিণয়,-মিলন- বাসর পাতি
হিমানীশীর্ণ বিধবা তারারা জ্বলে ওঠে রাতারাতি!
ফাগুয়ার রাগে চাঁদের কপোল চকিতে হয়েছে রাঙা!
-হিমের ঘোমটা চিরে দেয় কে গো মরমস্নায়ুতে দাঙা!
লালসে কাহার আজ নীলিমার আনন রুধির- লাল,-
নিখিলের গালে গাল পাতে কার কুঙ্কুম- ভাঙা গাল!
নারাঙ্গি- ফাটা অধর কাহার আকাশ বাতাসে ঝরে!
কাহার বাঁশিটি খুন উথলায়,- পরান উদাস করে!
কাহার পানেতে ছুটিছে উধাও শিশুপিয়ালের শাখা!
ঠোঁটে ঠোঁট ডলে- পরাগ চোঁয়ায় অশোকফুলের ঝাঁকা!
কাহার পরশে পলাশ-বধূর আঁখির কেশরগুলি
মুদে মুদে আসে,-আর বার করে কুঁদে কুঁদে কোলাকুলি!
পাতার বাজারে বাজে হুল্লোড়,-পায়েলার রুণ রুণ,
কিশলয়দের ডাঁশা পেষে কে গো-চোখ করে ঘুম-ঘুম!
এসেছে দখিনা-ক্ষীরের মাঝারে লুকায়ে কোন্ এক হীরের ছুরি!-
তার লাগি তবু ক্ষ্যপা শাল নিম, তমাল- বকুলে হুড়াহুড়ি!
আমের কুঁড়িতে বাউল বোলতা খুনসুড়ি দিয়ে খসে যায়,
অঘ্রাণে যার ঘ্রাণ পেয়েছিল,- পেয়েছিল যারে ‘পোষলা’য়,
সাতাশে মাঘের বাতাসে তাহার দর বেড়ে গেছে দশগুণ,-
নিছক হাওয়ায় ঝরিয়া পড়িছে আজ মউলের কষ গুণ!
ঠেলে ফেলে দিয়ে নীলমাছি আর প্রজাপতিদের ভিড়
দখিনার মুখে রসের বাগান বিকায়ে দিতেছে ক্ষীর!
এসেছে নাগর,- যামিনীর আজ জাগর রঙিন আঁখি,-
কুয়াশার দিনে কাঁচুলি বাঁধিয়া কুচ রেখেছিল ঢাকি,-
আজিকে কাঞ্চী যেতেছে খুলিয়া,- মদঘূর্ণনে হায়!
নিশীথের স্বেদ-সীধুধারা আজ ক্ষরিছে দক্ষিণায়!
রূপসী ধরনী বাসকসজ্জা,- রূপালি চাঁদের তলে
বালুর ফরাশে রাঙা উল্লাসে ঢেউয়ের আগুন জ্বলে!
রোল উতরোল শোণিতে শিরায়,- হোরীর হা রা রা চিৎকার,-
মুখে মুখে মধু,- সুধাসীধু শুধু,- তিত্ কোথা আজ- তিত্ কার!
শীতের বাস্তুভিত ভেঙে আজ এল দক্ষিণা,- মিষ্টি- মধু,
মদনের হুলে ঢুলে ঢুলে ঢুলে হুশ-হারা হ’ল সৃষ্টি- বধূ!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ।
সবুজ পাতার পরে যখন নেমেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ
নদীতে স্মরণ করে একবার পৃথিবীর সকাল বেলাকে।
আবার বিকেল হলে অতিকায় হরিণের মতো শান্ত থাকে।
এই সব গাছুগুলো; -যেন কোন দূর থেকে অস্পষ্ট বাতাস
বাঘের ঘ্রাণের মতো হৃদয়ে জাগায়ে যায় ত্রাস;
চেয়ে দেখ ইহাদের পরস্পর নীলিম বিন্যাস
নড়ে উঠে ত্রস্ততায়;- আধো নীল আকাশের বুকে
হরিণের মতো দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে
অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে তারা বটে ;
একজোটে কাজ করে মানুষেরা যে রকম ভোটের ব্যালটে;
তবুও বাঘিনী হয়ে বাতাসকে আলিঙ্গন করে–
সাগরের বালি আর রাত্রির নক্ষত্রের তরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
আজ রাতে মনে হয়
সব কর্মক্লান্তি অবশেষে কোনো এক অর্থ শুষে গেছে।
আমাদের সব পাপ- যদি জীব কোনো পাপ ক’রে থাকে পরস্পর
কিংবা দূর নক্ষত্র গুল্ম, গ্যাস, জীবানুর কাছে-
হিয়েছে ক্ষয়িত হয়ে।
বৃত্ত যেন শুদ্ধতায় নিরুত্তর কেন্দ্রে ফিরে এল
এই শান্ত অঘ্রাণের রাতে।
যতদূর চোখ যায় বিকোশিত প্রান্তরের কুয়াশায় ব্যাস
শাদা চাদরের মত কুয়াশার নিচে শুয়ে!
হরিতকী অরণ্যের থেকে চুপে সঞ্চারিত হয়ে
নিশীথের ছায়া যেন মেধাবী প্রশান্তি এক রেখে গেছে
প্রতিধ্বনিহীন, হিম পৃথিবীর পিঠে।
সুষুপ্ত হরিব- লোষ্ট্র; মৃত্যু আজ; ব্যাঘ্র মৃত; মৃত্যুর ভিতরে অমায়িক।
জলের উপর দিয়ে চ’লে যায় তারা; তবু জল
স্পর্শ করে নাক’ সিংহদুয়ারের মত জেগে ওঠে ইন্দ্রধনু
তাহাদের যেতে দেয়; অদ্ভুত বধির চোখে তবু তারা
অভ্যর্থনা করে নাক’ আজ আর আলোর বর্বর জননীকে।বাংলার শস্যহীন ক্ষেতের শিয়রে
মৃত্যু, বড়, গোল চাঁদ;
গভীর অঘ্রাণ এসে দাঁড়ায়েছে।
অনন্য যোদ্ধার মত এসেছে সে কতবার
দিনের ওপারে সন্ধ্যা- ঋতুর ভিতরে প্লাবী হেমন্তকে
দৃষ্ট প্রত্যঙ্গের মত এই স্ফীত পৃথিবীতে
ছুরির ফলার মত টেনে নিয়ে।
বেবিলন থেকে বিলম্বিত এসপ্লানেডে
বিদীর্ণ চীনের থেকে এই শীর্ণ এককড়িপুরে
মানুষের অরুন্তুদ চেষ্টার ভিতরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কবের সে বেবিলন থেকে আজ শতান্দীর পরমায়ু শেষ
কি এক নিমেষ শুধু মানুষের অন্তহীন সহিষ্ণুতায়?-
নক্ষত্রের এক রাত্রি- একটি ধানের গুচ্ছ- এক বেলা সূর্যের মত?
কেবলি মুষলপর্ব শেষ ক'রে নব শান্তিবাচনের পথে
মানবের অভিজ্ঞতা বেড়ে মানুষেরি দোষে হতাহতকলঙ্কিনী সংখ্যা গড়ে। অতীতের স্মরণীয় ইতিহাস থেকে
যা কিছু জানার আছে না জানার আছে যতো শ্লোক
সবাইকে দেখতে গিয়ে বার বার অন্ধকার বেশি ক'রে দেখে।
তবু এই স্বভাবের প্রতিশোধে আগামীর সমাজ অশোক
হয়তো বা হতে পারে। হে তুমি গভীর ইতিহাস,
আমরা মধ্যম পথে; তোমাকে সফল ক'রে দিতে
ব্যক্তি বিসর্জন দিয়ে মানবের প্রাণনের সাগরে চলেছি;-
মহানির্বাণের দিকে কিশাগোতমীর অজানিতে
আমরা চলেছি নাকি? তা' নয়তো। আজকের চেয়ে বেশি ভালো
প্রাণসূর্য উদয় হয়েছে কবে? এ রকম অশোক গভীর
শিশিরে উজ্জ্বল দেখে ভুল ব'লে প্রকৃতিকে আজো মনে হ'লে
মনের বিজ্ঞানে তবে শুভ্র হোক মানবীয় নিখিল ও নীড়। কাব্যগ্রন্থ - আলোপৃথিবী
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমার নিকট থেকে
যত দূর দেশে
আমি চলে যাই
তত ভালো।
সময় কেবলই নিজ নিয়মের মতো- তবু কেউ
সময়স্রোতের ‘পরে সাঁকো
বেঁধে দিতে চায়;
ভেঙ্গে যায়;
যত ভাঙ্গে তত ভালো।
যত স্রোত বয়ে যায়
সময়ের
সময়ের মতন নদীর
জলসিঁড়ি, নীপার, ওডার, রাইন, রেবা, কাবেরীর
তুমি তত বহে যাও,
আমি তত বহে চলি,
তবুও কেহই কারু নয়।
আমরা জীবন তবু।
তোমার জীবন নিয়ে তুমি
সূর্যের রশ্মির মতো অগণন চলে
রৌদ্রের বেলার মতো শরীরের রঙ্গে
খরতর নদী হয়ে গেলে
হয়ে যেতে।
তবু মানুষী হয়ে
পুরুষের সন্ধান পেয়েছ;
পুরুষের চেয়ে বড় জীবনের হয়তো বা।আমিও জীবন তবু-
ক্বচিৎ তোমার কথা ভেবে
তোমার সে শরীরের থেকে ঢের দূরে চলে গিয়ে
কোথাও বিকেলবেলা নগরীর উৎসারণে উচল সিঁড়ির
উপরে রৌদ্রের রঙ জ্বলে ওঠে- দেখে
বুদ্ধের চেয়েও আরো দীন সুষমার সুজাতার
মৃত বৎসরে বাঁচায়েছে
কেউ যেন;
মনে হয়,
দেখা যায়।কেউ নেই-স্তব্ধতায়; তবুও হৃদয়ে দীপ্তি আছেদিন শেষ হয় নি এখনও।
জীবনের দিন- কাজ
শেষ হতে আজও ঢের দেরি।
অন্ন নেই। হ্রৃদয়বিহীনভাবে আজ
মৈত্রেয়ী ভূমার চেয়ে অন্নলোভাতুর।
রক্তের সমুদ্র চারি দিকে;
কলকাতা থেকে দূর
গ্রিসের অলিভ বন
অন্ধকার।
অগণন লোক মরে যায়;
এম্পিডোক্লেসের মৃত্যু নয়-
সেই মৃত্যু ব্যসনের মতো মনে হয়।
এ ছাড়া কোথাও কোনো পাখি
বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই
তবু এক দীপ্তি রয়ে গেছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
দেখা হল অনেক রক্ত রৌদ্র কোলাহল;
চারিদিকে অধোমুখে মানুষেরা শব বহন করে;
আজকে শতাব্দীতে মৃত্যু প্রথম কথা। তবু
এ সব মৃত অবশেষে ঘুমের ভিতরে
জুড়োয় গিয়ে দূর পৃথিবীর ঘাস পৃথিবী জলে
এরা নদী সূর্য প্রেমের দিন ফুরিয়ে ফেলে
মাটি, তোমার নিজের মনের কথা হয়ে ধীরে
তোমার কাছে ঘুরছে কেমন অজ্ঞান শরীরেএখন খড়ে ভরে আছে দু-চার মাইল কামিনী ধানের ক্ষেত
ঘুঘুর ডাকে আদিম শান্তি আরো অনেকক্ষণ
মিছরিগুড়ির মতন বৃষ্টি রোদ্দুরে উজ্জ্বল
আকাছে চাতক; ওর একরাশি আত্মীয়জন
এ সব সাড়া ঐ মৃতদের ফুরিয়ে গেছে সবই
সময়ের এই কার্যকলাপ গভীর মনে হয়
জীবন ভালবেসে হৃদয় বুঝেছে অনুপম
মূল্য দিয়ে আসছে চুপে মৃত্যুর সময়
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
‘বরং নিজেই তুমি লিখোনাকো একটি কবিতা-‘
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয়- সে যে আরূঢ় ভণিতা
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের পর
ব’সে আছে সিংহাসনে-কবি নয়- অজর অক্ষর
অধ্যাপক, দাঁত নেই- চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে- আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি
যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো-হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ওরে কিশোর, বেঘোর ঘুমের বেহুঁশ হাওয়া ঠেলে
পাতলা পাখা দিলি রে তোর দূর-দুরাশায় মেলে!
ফেনার বৌয়ের নোন্তা মৌয়ের- মদের গেলাস লুটে,
ভোর-সাগরের শরাবখানায়–মুসল্লাতে জুটে
হিমের ঘুণে বেড়াস খুনের আগুনদানা জ্বেলে!
ওরে কিশোর, অস্তরাগের মেঘের চুমায় রেঙে
নীল নহরের স্বপন দেখে চৈতি চাঁদে জেগে
ছুটছ তুমি চ্ছলচ্ছল জলের কোলাহলের সাথে কই!
উছলে ওঠে বুকে তোমার আল্তো ফেনা-সই!
ঢেউয়ের ছিটায় মিঠা আঙুল যাচ্ছে ঠোঁটে লেগে!
রে মুসাফের,- পাতাল-প্রেতপুরের মরীচিকা
সাগর-জলের তলে বুঝি জ্বালিয়ে দেছে শিখা!
তাই কি গেলে ভেঙে হেথায় বালিয়াড়ির বাড়ি!
দিচ্ছ যাযাবরের মতো সাগর-মরু-পাড়ি,-
ডাইনে তোমার ডাইনীমায়া- পিছের আকাশ ফিকা!
বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে!
ফুটছে ভাষা কেউটে- ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে!
প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে
বরুণ-রানি ফিরছে যেথা,-মুক্তা-প্রদীপ জ্বলে!
যেথায় মৌন মীনকুমারীর শঙ্খ ওঠে ফুঁকে।
যেই খানে মূক মায়াবিনীর কাঁকন শুধু বাজে
সাঁজ সকালে,- ঢেউয়ের তালে, মাঝসাগরের মাঝে!
যায় না জাহাজ যেথায়,- নাবিক, পায় না নাগাল যার,
লুঘ উদাস পাখায় ভেসে আঁখির তলে তার
ঘুরছে অবুঝ সে কোন সবুজ স্বপন-খোঁজার কাজে!
ওরে কিশোর, -দূর-সোহাগী ঘর- বিরাগী সুখ!
-টুকটুকে কোন্ মেঘের পারে ফুটফুটে কার মুখ
ডাকছে তোদের ডাগর কাঁচা চোখের কাছে তার!
-শাদা শকুন-পাখায় যে তাই তুলছে হাহাকার
ফাঁপা ঢেউয়ের চাপা কাঁদন,-ফাঁপর- ফাটা বুক!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তুমি তো জানো না কিছু – না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে –
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমি হাত প্রসারিত ক'রে দেই বায়ুর ভিতরে,
অনেক জীবাণূ এসে রোমকূপে জমে-
এই এক আলোড়ন রয়ে গেছে পৃথিবীতে।
মানুষের অন্তরেও এ- রকম;
কোনো এক রমনীকে দেখে প্রীতি,
কোনো জননায়কের অবয়ব দেখে বিস্ময়,
কোনো বিষয়ীর জানুর উপরে হাত রেখে দিয়ে আশা।এইসব অনুভব তবু আজ কীলক লিপির পরে ভোরের আলোয়
অতীত রাত্রির পরিভাষা।
কেন না মানুষ- বায়ু, রোমকূপ, জীবাণুর মতো নয়!
ইহাদের সরলতা শিশুর মতন
মানুষ অনেকদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকে
ক্রমশই হ'য়ে যায় বিশদ অতল;এইসব ইতিহাস পরম্পরা বুঝে
আমার হৃদয় থেকে বিচুর্ণ কাচের খণ্ড খুঁজে
বুঝে গেঝি মরণ কি। অথবা জীবন কেন অধিক বিশদ নিয়ন্ত্রণ।সকল রঙের শিখা একসাথে মিলে গিয়ে হ'য়ে যায় শাদা।
একটি জমাট ঢিলে বহুতর বিরোধের বাধা
অনেক আবহ তার বুকের ভিতরে ধ'রে রেখে
মানুষ ও বহ্মাণ্ডের পরমায়ু নিম্রীল বাতাসে
লাঙ্গুল ঘুরায়ে অগ্নির অক্ষরে ফেলে এঁকে।#অগ্রন্থিত কাব্যসমগ্র
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কোথাও বাইরে গিয়ে চেয়ে দেখি দু'চারটে পাখি।
ঘাসের উপরে রোদে শিশিরে শুকায়
নিজেদের ক্ষেতে ধান- চার পাঁচজন লোক
মানবের মতন একাকী।
মাটিরও তরঙ্গ স্বর্গীয় জ্যামিতির প্রত্যাশায়
মিশে গেছে অতীত ও আজকের সমস্ত আকাশে।দিগন্তে কি ধর্মঘট?- চিম্নি... পাখির মতন অনায়াসে
নীলিমায় ছড়ায়েছে। এখানে নদীর স্থির কাকচক্ষু জলে
ঘুরুনো সিঁড়ির মত আকাশ পর্যন্ত মেঘ সব
উঠে গেছে।- অনুভব করে প্রকৃতির সাথে মিলিত হতেই,
অমিলনের সূর্যরোল জ্যোতির্ময় এলুমিনিয়ম অনুভব
ক'রে আমি দুই তিন চার পাঁচ ছয়টি এরোপ্লেন গুনে
নীলিমা দেখার ছিলে শতাব্দীর প্রেতাত্মাকে দেখছি অরুণে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
আমাদের রূঢ় কথা শুনে তুমি সরে যাও আরো দূরে বুঝি নীলাকাশ;
তোমার অনন্ত নীল সোনালি ভোমরা নিয়ে কোনো দূর শান্তির ভিতরে
ডুবে যাবে? কত কাল কেটে গেল, তবু তার কুয়াশার পর্দা না সরে
পিরামিড্ বেবিলন শেষ হল — ঝরে গেল কতবার প্রান্তরের ঘাস;
তবুও লুকায়ে আছে যেই রূপ নক্ষত্রে তা কোনোদিন হল না প্রকাশ:
যেই স্বপ্ন যেই সত্য নিয়ে আজ আমরা চলিয়া যাই ঘরে,
কোনো এক অন্ধকারে হয়তো তা আকাশের যাযাবর মরালের স্বরে
নতুন স্পন্দন পায় নতুন আগ্রহে গন্ধে ভরে ওঠে পৃথিবীর শ্বাস;তখন আমরা ওই নক্ষত্রের দিকে চাই — মনে হয় সব অস্পষ্টতা
ধীরে ধীরে ঝরিতেছে, — যেই রূপ কোনোদিন দেখি নাই পৃথিবীর পথে,
যেই শানি — মৃত জননীর মতো চেয়ে থাকে — কয় নাকো কথা,
যেই স্বপ্ন বার বার নষ্ট হয় আমাদের এই সত্য রক্তের জগতে,
আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ — অন্ধ মৃত হিম,
একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে রবে গোলাপের মতন রক্তিম।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
যাহাদের পায়ে পায়ে চলে চলে জাগিয়াছে আঁকাবাঁকা চেনা পথগুলি
দিকে দিকে পড়ে আছে যাহাদের দেহমাটি—করোটির ধূলি,
যাহারা ভেনেছে ধান গান গেয়ে—খুঁটেছে পাখির মতো মিঠে খুদকুঁড়া,
যাহাদের কামনায় ইশারায় মাটি হল পানপাত্র, শষ্প হল সুরা!
ছুঁয়ে ছেনে বারবার এ ভাঁড়ার করে গেছে স্যাঁতসেঁতে ম্লান,
আনাচে-কানাচে আজও দুলিতেছে যাহাদের উড়ানি-পিরান,
যাদের দেহের ছায়া পাঁচিলের গায় গায় মেখে গেছে মায়া,
দেয়ালের শেওলায় নীল হয়ে জেগে আছে যাহাদের কায়া,
যারা গেছে বীজ বুনে মাঠে মাঠে,—চষে গেছে মাটি,
কেটেছে ফসল, শালি বেঁধে-বেঁধে নেছে আঁটি আঁটি,
তুলিয়াছে গোলাবাড়ি—যত তিষি, ধান খড় ভরা,
পেঁচা-ইঁদুরের সনে আন্মনে জাগিয়াছে যাদের প্রহরা,
পনির ননীর গন্ধে ভরিয়াছে যাহাদের তুষ্ট গৃহস্থালি,
ধুনুচিতে ধূপ ঢেলে—উঠানে প্ৰদীপ জ্বালি জ্বালি
চরকায় সুতো কেটে তুলিয়াছে তন্ময় গুঞ্জন,
কহিয়াছে আধো আধো কত কথা—নিভায়েছে–জুলায়েছে আলো,
দেয়ালে তাদের ছায়া জাগিয়াছে এলোমেলো—কালো—
না জানি কোথায় তারা, কত দূরে—জানি না তো কিছু!
রাতভোর ঘোর ঘোর চোখ মোর, ঘাড়খানা নিচু
তাদের সন্ধানে যেন–যাহাদের রেণুঝরা হিম মরা প্রজাপতি ডানা
দিকে দিকে পড়ে আছে—মনে হয়। কত চেনা–কত তারা জানা!
তাহাদেরই পরীপাখা ওড়ে যেন পাউষের নদীটির বুকে!
শিশিরনিবিড় মাঠ-পাথরের মুখে
তারা যেন কথা কয়!—শাঁইঝাড়ে—শালুকের দলে
জোনাকির পাখনার তলে যেন তাঁহাদের দীপ আজও জ্বলে!
সঙ্গোপনে বনে বনে ফেরে তারা—জ্যোৎস্নারাতে পিয়ালের মৌ
আজও তারা পান করে, আজও তারা গান করে—বাসরের বর আর বউ!
শিশিরের জলে জলে স্নান করে–ভিজে ভিজে বালুচর দিয়া
বুনো হাঁস-হাঁসীদের সনে ফেরে পরবাসী প্রিয় আর প্রিয়া!
কোরা-ডাহুকের বুকে কান পেতে শুনে যায় গান—
তাদের আঙুল ছুঁয়ে চুলবুল করে ওঠে হেমন্তের মাঠভরা ধান!
তাদের দেখেছি আমি গেঁয়ো পথে–দেখেছে রে ধাঙড়ের বধূ,
মৌচুষ্কির সনে তারা বনে লুটে খায় কমলার মধু!
নোনার পাতায় তারা মাথা পেতে খায় তাতা ক্ষীর!
নোনার পাতায় তারা মাথা পেতে খায় তাতা ক্ষীর!
বেদের মতন তারা আসে যায়–অবেলায় ভেঙে ফেলে ভিড়!
তাদের দেখেছি আমি শাদা ভোরে—ঘুঘু ডাকা উদাস দুপুরে!
—সাঁঝের নদীর বাটে—ভাঙা হাট–ভিজা মোঠ জুড়ে;
পাড়াগাঁর পথে পথে নিঝ্ঝুম চাঁদিনীর রাতে
ফিরেছে রে, ভিড়েছে রে কত বার তারা মোর সাথে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র’য়ে গেছে – তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ’লে – অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন সিন্ধুর সুর:
মরণের – জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে -
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক’রে জেগে ওঠে?
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোন দিকে সমুদ্রের সুর -
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে?সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল
ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ – তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ – নিত্য দিকদর্শিন;
যা জেনেছে – যা শেখেনি -
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব’লে
জাগে না কি হে জীবন – হে সাগর -
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
সে এক দেশ অনেক আগের শিশুলোকের থেকে
সাগরগামী নদীর মত স্বরে
আমার মনের ঘুঘুমরালহংসী ঝাউয়ের বনে
আধো আলোছায়াচ্ছন্ন ভাবে মনে পড়ে
টিউটনের গল্পে ছড়ায় সাগরে সূর্যালোকে
গ্রিমের থেকে...... শিলাত সানুজ দানবীয়
গ্যেটের সে দেশ সূর্য অনিকেত?
মাঝে মাঝে আমার দেশের শিপ্রা, পদ্মা, রেবা, ঝিলম, জলশ্রীকে আমি
সর্পীযোনের মতন কোথাও পাহাড় অবধি
অথবা নীল ভূকল্লোলে সাগর সুভাষিতকরতে গিয়ে শুনেছিলাম রাইনের মত নদী
কি এক গভীর হ্বাইমারী মেঘ সূর্য বাতাস নিয়ে
নর-নারী নগর গ্রামীণতায় ব্যস্ত রীতি
লক্ষ্য ক'রেই সবিতাসাধ জানিয়েছিল;- তিন দশকের পর
এ-সব স্বপ্নমিশেল কি এক শূন্য অনুমিতি।যদিও আমি আজো বেশি সূর্য ভালোবাসি
তবুও যারা মনের নীহারিকার পথে ঠাণ্ডা অমল দিন
জাগিয়ে সূর্যপ্রতিম আকাশ সমাজ নিয়ে যাত্রা ক'রেছিল
সে সব হৃদয়গ্রাহী টেলর রিলকে হ্যোল্ডার্লিন্
সবংশে কি হারিয়ে গেছে রাইখ্শরিরের থেকে?-
ব্যক্তি স্বাধীনতায় ঘুরে অনাথ মানবতার লেন্দেন
শুধতে ভুলে গিয়ে কি ভয় রক্ত গ্লানি রিরাংসা ফুঁপিয়ে
রেখে গেছে অমোঘ বর্বরতার বেল্জেন্?
বর্বরতা কোথায় তবুও নেই?- তবু এই প্রশ্ন-আতুর মনে
গভীরতার হৃদয়ব্যাধির ঈষৎ সমাধান
আজকে ভীষণ নিরুদ্দেশের অন্ধকারে রয়েছে টিউটন?
রোন্কে চিনি,- ইউরোপের হৃদয়ে রাইন্যান্
সহোদরার মতন রৌদ্র আকশ মাটি যব গোধূমের পাশে
যুগে যুগে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রবেশ ক'রে
এনেছিল কান্ট কাথিড্রাল দেবতাদের
ঊষাপ্রদোষ অখল ভাগনেরের
অভিনিবেশ-বলয়িত গ্যেটের সূর্যকরে।যদিও তা ব্যক্তিকতার মায়ার মৃগতৃষ্ণাতীত,-তবু
চমৎকৃত হয়েছিল ইউরোপের ভাবনাধূসর মন;
সৌরকরভ্রমে ঊনবিংশ শতকীরা
হয়তো তাকে ঘরের বহিরাশ্রয়িত দিব্য বাতায়ন-
বাতায়নের বাইরে মেঘের সূর্য ভেবেছিল;
আমরা আজো অনেক জেনে এর বেশি কি ভাবি?
ইতিহাসের ভূমায় সীমাস্বল্পতাকে যাচাই করার রীতি
গ্যেটের ছিল;- তবুও সীমার কী ভয়ঙ্কর বৈনাশিকী দাবি!
সেই তো পায়ের নিচে রাখে পরমপ্রসাদগভীর তনিমাকে
সময়পুরুষ বলেঃ 'তুমি নিজের কালের ভার
ব'য়েছিলে লীলায়িত সৌরতেজে;- এ যুগ তবু অন্য সকলের;
আরেক রকম ব্যতিক্রমের,- হে কবি, হ্বাইমার।'
সময় এখন জ্যোতির্ময়ী অমেয়তার প্রবাস থেকে ফিরে
নিরিখ পেয়ে গেছে নিজের নিঃশ্রেয়সের পথে;
সেইখানে কাল লোকাতিত হতে গিয়ে
কোথাও থেমে গিয়ে-
ক্রান্তি-আলোর বয়স বেড়ে গেলে কঠিন রীতির জগতে
নবজাতক অর্থনীতি সমাজনীতি কলের
কণ্ঠে কি প্রাণকাকলী?
এই পৃথিবীর আদিগন্ত ব্যক্তিশবের শেষে
দেখা দেবে হয়তো নতুন সুপরিসর, নাগর সভ্যতায়
মানবতার নামে নবীন ব্যক্তিহীনতাকে ভালোবেসে;
হয়তো নগর রাষ্ট্র সফল হয়ে গেলে নাগরিকের মন
হৃদয়প্রেমিক হয়ে যাবে সবার তরে- উচিত অনুপাতে,
জড়-রীতির- অর্থনীতির সনির্বচন
মেশিন ভেনে এসব যদি হয়
তা হ'লে তা অমিয় হোক্ আন্তরিকতাতে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে
ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো;
এইখানে এসে প’ড়ে- থেমে গেলে- একটি নারীকে
কোথাও দেখেছি ব’লে স্বভববশত
মনে হয়;- কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু
প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে;
এইখানে সে-দিন সে হেঁটেছিলো,- আজো ঘুরে যায়;
এর চেয়ে বেশি ব্যাখ্যা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিতে পারে,
অনিত্য নারীর রূপ বর্ণনায় যদিও সে কুটিল কলম
নিয়োজিত হয় নাই কোনোদিন- তবুও মহিলা
মা ম’রে অমর যারা তাহাদের স্বর্গীয় কাপড়
কোচকায়ে পৃথিবীর মসৃণ গিলা
অন্তরঙ্গ ক’রে নিয়ে বানায়েছে নিজের শরীর।
চুলের ভিতরে উঁচু পাহাড়ের কুসুম বাতাস।
দিনগত পাপক্ষয় ভুলে গিয়ে হৃদয়ের দিন
ধারণ করেছে তার শরীরের ফাঁস।
চিতাবাঘ জন্মাবার আগে এই পাহাড়ে সে ছিলো;
অজগর সাপিনীর মরণের পরে।
সহসা পাহাড় ব’লে মেঘ-খন্ডকে
শূন্যের ভিতরে
ভুল হলে- প্রকৃতিস্থ হয়ে যেতে হয়;
(চোখ চেয়ে ভালো ক’রে তাকালেই হতো;)
কেননা কেবলি যুক্তি ভালোবেসে আমি
প্রমাণের অভাববশত
তাহাকে দেখিনি তবু আজো;
এক আচ্ছান্নতা খুলে শতাব্দী নিজের মুখের নিস্ফলতা
দেখাবার আগে নেমে ডুবে যায় দ্বিতীয় ব্যথায়;
আদার ব্যাপারী হ’য়ে এই সব জাহাজের কথা
না ভেবে মানুষ কাজ ক’রে যায় শুধু
ভয়াবহভাবে অনায়াসে।
কখনো সম্রাট শনি শেয়াল অ ভাঁড়
সে-নারীর রাং দেখে হো হো ক’রে হাসে।
দুইমহিলা তবুও নেমে আসে মনে হয়ঃ
(বমারের কাজ সাঙ্গ হ’লে
নিজের এয়োরোড্রোমে-প্রশান্তির মতো?)
আছেও জেনেও জনতার কোলাহলেতাহার মনের ভাব ঠিক কী রকম-
আপনারা স্থির ক’রে নিন;
মনে পড়ে, সেন রায় নওয়াজ কাপূর
আয়াঙ্গার আপ্তে পেরিন-এমনই পদবী ছিলো মেয়েটির কোনো একদিন;
আজ তবু উশিন তো বিয়াল্লিশ সাল;
সম্বর মৃগের বেড় জড়ায়েছে যখন পাহাড়ে
কখনও বিকেলবেলা বিরাট ময়াল,অথবা যখন চিল শরতের ভোরে
নীলিমার আধপথে তুলে নিয়ে গেছে
রসুঁয়েকে ঠোনা দিয়ে অপরূপ চিতলের পেটি,-
সহসা তাকায়ে তারা ইউৎসারিত নারীকে দেখেছে;এক পৃথিবীর মৃত্যু প্রায় হ’য়ে গেলে
অন্য-এক পৃথিবীর নাম
অনুভব ক’রে নিতে গিয়ে মহিলার
ক্রমেই জাগছে মনস্কাম;ধূমাবতী মাতঙ্গী কমলা দশ-মহাবিদ্যা নিজেদের মুখ
দেখায়ে সমাপ্ত হ’লে সে তার নিজের ক্লান্ত পায়ের সঙ্কেতে
পৃথিবীকে জীবনের মতো পরিসর দিতে গিয়ে
যাদের প্রেমের তরে ছিলো আড়ি পেতেতাহারা বিশেষ কেউ কিছু নয়;-
এখনও প্রাণের হিতাহিত
না জেনে এগিয়ে যেতে তবু পিছু হটে গিয়ে
হেসে ওঠে গৌড়জনোচিতগরম জলের কাপে ভবেনের চায়ের দোকানে;
উত্তেজিত হ’য়ে মনে করেছিলো (কবিদের হাড়
যতদূর উদ্বোধিত হ’য়ে যেতে পারে-
যদিও অনেক কবি প্রেমিকের হাতে স্ফীত হ’য়ে গেছে রাঁঢ়):‘উনিশশো বেয়াল্লিশ সালে এসে উনিশশো পঁচিশের জীব-
সেই নারী আপনার হংসীশ্বেত রিরিংসার মতন কঠিন;
সে না হলে মহাকাল আমাদের রক্ত ছেঁকে নিয়ে
বা’র ক’রে নিতো না কি জনসাধারণ ভাবে স্যাকারিন।আমাদের প্রাণে যেই অসন্তোষ জেগে ওঠে সেই স্থির ক’রে;
পুনরায় বেদনার আমাদের সব মুখ স্থুল হয়ে গেলে
গাধার সুদীর্ঘ কান সন্দেহের চোখে দেখে তবু
শকুনের শেয়ালের চেকনাই কান কেটে ফেলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
প্রথম মানুষ কবে
এসেছিল এই সবুজ মাঠের ফসলের উৎসবে!
দেহ তাহাদের এই শস্যের মতো উঠেছিল। ফলে,
এই পৃথিবীর ক্ষেতের কিনারে, সবজির কোলে কোলে
এসেছিল তারা ভোরের বেলায় রৌদ্র পোহাবে ব’লে—
এসেছিল তারা পথ ধরে এই জলের গানের রবে!
এই পৃথিবীর ভাষা
ভালোবেসেছিল, ভালো লেগেছিল এ মাটির ভালোবাসা!
ভালো লেগেছিল এ বুকের ক্ষুধা, শস্যের মতো সাধ!
এই আলো আর ধুলোর পিপাসা, এই শিশিরের স্বাদ
ভালো লেগেছিল—বুকে তাহাদের জেগেছিল আহ্লাদ!
প্রথম মানুষ—চোখে তাহাদের প্রথম ভোরের আশা!
এসেছিল সন্তান—
দেহে তাঁহাদের নীল সাগরের ঢেউয়ের ফেনার ঘ্রাণ!
শঙ্খের মতো কানে তাহাদের সিন্ধু উঠিত গেয়ে।
শস্যের মতো তারা ওই নীল আকাশের পানে চেয়ে
গেয়ে গেছে গান! ধানের গন্ধে পৃথিবীর ক্ষেত ছেয়ে
আলোয় ছায়ায় ফসলের মতো করিয়া গিয়াছে স্নান!
সে কোন প্রথম ভোরে
প্রথম মানুষ আসিল প্রথম মানুষীর হাত ধরে!
ভালো লেগেছিল এ দেহের ক্ষুধা, শস্যের মতো সাধ!
এই আলো আর ধুলোর পিপাসা, এই শিশিরের স্বাদ
ভালো লেগেছিল–বুকে তাহাদের জেগেছিল আহ্লাদ!
নীল আকাশের প্রথম রৌদ্র ক্ষেতে পড়েছিল ঝরে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;- বারবার রোদ তার সুচিক্বণ চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়ে;- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল
বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন,
ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ;
মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধূল,কবেকার কোকিলের জানো কি তা? যখন মুকুন্দরাম, হায়,
লিখিতেছিলেন ব’সে দু’পহরে সাধের সে চন্ডিকামঙ্গল,
কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়- থেমে থেমে যায়;-
অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল
সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধানক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায়
কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
এই পথ দিয়ে কেউ চ'লে যেতো জানি
এই ঘাস
নীলাকাশ_
এ সব শালিখ সোনালি ধান নরনারীদের
ছায়া-কাটাকুটি কালো রোদে
সে তার নিজের ছায়া ফেলে উবে যেতো;
আসন্ন রাত্রির দিকে সহসা দিনের আলো নষ্ট হ'য়ে গেলে
কোথাও নতুন ভোর র'য়ে গেছে জেনে
সে তার নিজের সাধ রৌদ্র স্বর্ণ সৃষ্টি করেছিলো।তবু্ও রাত্রির দিকে চোখ তার পড়েছিলো ব'লে
হে আকাশ, হে সময়, তোমার আলোকবর্ষব্যাপ্তি শেষ হ'লে
যখন আমার মৃত্যু হবে
সময়ের বঞ্চনায় বিরচিত সে -এক নারীর
অবলা নারীর মতো চোখ মনে রবে।#জীবনান্দদাশের অগ্রন্থিত কবিতা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
জীবনে অনেক দূর সময় কাটিয়ে দিয়ে- তারপর তবু
চলার কিছুটা আরো পথ আছে টের পাই;-
সুমুখে বিস্ময়;-
দেখেছি সূর্যের আলো মাঝে মাঝে জলের কম্পন;
আশ্বিনের ঘন নীল আশ্চর্য আকাশে
দেখেছি আরোহী হাঁস বাষ্পের ভিতর থেকে আসে
হংসীর অনিমেষ দেহ লক্ষ্য ক’রে,
মিশে যায় খুব স্বচ্ছ আলোর ভিতরে।
কোথায় ফুরিয়ে যায় তারা সব- থেকে সফল।
অগ্নির উৎসের মতো সৃষ্টি নির্ঝর থেকে জেগে
আমারও শরীর মন মিশে যেতে চেয়েছে আবেগে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
সমুদ্রের জলে আমি দেহ ধুয়ে, চেয়ে থাকি নক্ষত্রের আকাশের পানে
চারিদিকে অন্ধকার: নারীর মতন হাত, কালো চোখ, ম্লান চুল ঝরে
যতদূর চোখ যায় নীলজল হৃষ্ট মরালের মতো কলরব করে
রাত্রিরে ডাকিতে চায় বুকে তার, প্রেম-মূঢ় পুরুষের মতন আহ্বানে
পৃথিবীর কত প্রেম শেষ হ’লো – তবু এই সমুদ্রের আকাঙ্খার গানে
বাধা নাই, ভয় নাই, ক্লান্তি নাই, অশ্রু নাই – মালাবার ঢেউয়ের ভিতরে
চারিদিকে নীল নারিকেল বন সোনালি ফুলের গন্ধে, বিস্ময়ের ভরে
জানে তাহা – কত দিন থেকে ওই মলয়ালী আর তা’র শিশু তাহা জানেজানি না মাদ্রাজ নাকি এই দেশ? জানি না মালয় নাকি? কিংবা মালাবার ?
জানি না এ পৃথিবীর কোন্ পথ – কোন্ ভাষা কোন্ মুখে এখানে বাতাসে
জানি না যৌবন কবে শেষ হয়ে গেছে কোন্ পৃথিবীর ধুলোতে আমার
তবুও আমার প্রাণ তামিলের কিশোরের মতো ওই কিশোরীর পাশে
আবার নতুন জন্ম পায় আজ; কেউ নাই অন্ধকারে কবেকার ঘাসে
কত যে মৌরী খই ঝ’রে গেছে – চারিদিকে ফুটে সব উঠিছে আবার।।কাব্যগ্রন্থ - রুপসী বাংলা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কোনো দিন নগরীর শীতের প্রথম কুয়াশায়
কোনো দিন হেমন্তের শালিখের রঙে ম্লান মাঠের বিকেলে
হয়তো বা চৈত্রের বাতাসে
চিন্তার সংবেগ এসে মানুষের প্রাণে হাত রাখে;
তাহাকে থামায়ে রাখে।
সে চিন্তার প্রাণ
সাম্রাজ্যের উত্থানের পতনের বিবর্ণ সন্তান
হ'য়েও যা কিছু শুভ্র র'য়ে গেছে আজ,
সেই সোম-সুপর্ণের থেকে এই সূর্যের আকাশে-
সে-রকম জীবনের উত্তরাধিকার নিয়ে আসে।
কোথাও রৌদ্রের নাম-
অন্নের নারীর নাম ভালো ক'রে বুঝে নিতে গেলে
নিয়মের নিগড়ের হাত এসে ফেঁদে
মানুষকে যে আবেগে যতোদিন বেঁধে
রেখে দেয়,
যতোদিন আকাশকে জীবনের নীল মরুভূমি মনে হয়
যতোদিন শূন্যতার ষোলকলা পূর্ণ হ'য়ে- তবে
বন্দরে সৌধের উর্দ্ধে চাঁদের পরিধি মনে হবে;-
ততোদিন পৃথিবীর কবি আমি- অকবির অবলেশ আমি
ভয় পেয়ে দেখি- সূর্য উঠে;
ভয় পেয়ে দেখি- অস্তগামী।
যে-সমাজ নেই তবু র'য়ে গেছে, সেখানে কায়েমী
মরুকে নদীর মতো মনে ভেবে অনুপম সাঁকো
আজীবন গ'ড়ে তবু আমাদের প্রাণে
প্রীতি নেই- প্রেম আসে নাকো।
কোথাও নিয়তিহীন নিত্য নরনারীদের খুঁজে
ইতিহাস হয়তো ক্রান্তির শব্দ শোনে, পিছে টানে
অনন্ত গণনাকাল সৃষ্টি ক'রে চলে;
কেবলি ব্যক্তির মৃত্যু-গণনাবিহীন হ'য়ে প'ড়ে থাকে জেনে নিয়ে -তবে
তাহাদের দলে ভিড়ে কিছু নেই- তবু
সেই মহাবাহিনির মতো হ'তে হবে?সংকল্পের সকল সময়
শূন্য মনে হয়।
তবুও তো ভোর আসে- হঠাৎ উৎসের মতো; আন্তরিকভাবে;
জীবনধারণ ছেপে নয়- তবু
জীবনের মতন প্রভাবে;
মরুর বালির চেয়ে মিল মনে হয়
বালিছুট সূর্যের বিস্ময়।
মহিয়ান কিছু এই শতাব্দীতে আছে, -আরো এসে যেতে পারে;
মহান সাগর গ্রাম নগর নিরুপম নদী-
যদিও কাহারো প্রাণে আজ রাত স্বাভাবিক মানুষের মতো ঘুম নেই,
তবু এই দ্বীপ, দেশ, ভয়, অভিসন্ধানের অন্ধকারে ঘুরে
সসাগরা পৃথিবীর আজ এই মরণের কালিমাকে ক্ষমা করা যাবে;
অনুভব করা যাবে স্মরণের পথ ধ'রে চলে;
কাজ ক'রে ভুল হ'লে, রক্ত হ'লে মানুষের অপরাধ ম্যামথের নয়
কতো শত রূপান্তর ভেঙে জয়জয়ন্তীর সূর্য পেতে হলে।
----------------------------------------------------
গ্রন্থ: বেলা অবেলা কালবেলা
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
ভেবে ভেবে ব্যথা পাব: মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে
দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো করে দেখি নাই আমি –
এমনি লাজুক পাখি, — ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে;
যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে অন্ধকারে গাবের নিবিড় বুকে আসে সে কি নামি?শিউলির বাবলার আঁধার গলির ফাঁকে জোনাকির কুহকের আলো
করে না কি? ঝিঁঝিঁর সবুজ মাংসে ছোটো — ছোঁটো ছেলেমেয়ে বউদের প্রাণ
ভুলে যায়; অন্ধকার খুঁজে তারে আকন্দবনের ভিড়ে কোথায় হারালো
মাকাল লতার তলে শিশিরের নীল জলে কেউ তার জানে না সন্ধ্যান।আর সেই সোনালি চিলের ডানা — ডানা তার আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে; — সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজও চ’লে যায় সন্ধ্যা
সোনার মত হলে?
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
আশ্চর্য বিষ্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধাকার বিছানার কোলে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কোথাও চলিয়া যাব একদিন;-তারপর রাত্রির আকাশ
অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি;
জানিব না কতকাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী
পাতাগুলো-মাদারের ডুমুরের-সোঁদা গন্ধ-বাংলার শ্বাস
বুকে নিয়ে তাহাদের;-জানিব না পরথুপী মধুকূপী ঘাস
কত কাল প্রান-রে ছড়ায়ে রবে- কাঁঠাল শাখার থেকে নামি
পাখনা ডলিবে পেচাঁ এই ঘাসে-বাংলার সবুজ বালামী
ধানী শাল পশমিনা বুকে তার -শরতের রোদের বিলাস
কতো কাল নিঙড়াবে;-আচলে নাটোর কথা ভুলে গিয়ে বুঝি
কিশোরের মুখে চেয়ে কিশোরী করিবে তার মৃদু মাথা নিচু;
আসন্ন সন্ধ্যার কাক-করুণ কাকের দল খোড়া নীড় খুঁজি
উড়ে যাবে;-দুপুরে ঘাসের বুকে সিদুরের মতো রাঙা লিচু
মুখে গুজে পড়ে রবে-আমিও ঘাসের বুকে রবো মুখ গুজি;
মৃদু কাঁকনের শব্দ-গোরোচনা জিনি রং চিনিব না কিছু-
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে:
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনাদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।
মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধুসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।
ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনা এক নগরী ছিল একদিন,
কোন এক প্রাসাদ ছিল;
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ;
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্খা,
আর তুমি নারী-
এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,
মেহগনির ছায়াঘর পল্লব ছিল অনেক;
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল;
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলানও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপারিত গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধুসর পান্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ুরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস-
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমর নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।
আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রের ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরো প্রাণ
মূক করে রাখে; তবু চারিদকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–
প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়–
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ফিরে এসো সমুদ্রের ধারে
ফিরে এসো প্রান্তরের পথে;
যেইখানে ট্রেন এসে থামে
আম নিম ঝাউয়ের জগতে
ফিরে এসো; একদিন নীল ডিম করেছ বুনন
আজও তারা শিশিরে নীরব;
পাখির ঝর্ণা হয়ে কবে
আমারে করিবে অনুভব!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
ভক্তিমূলক
|
অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে কোন এক বলয়িত পথে
মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন এক বিভা
দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে থেকে আপনার প্রাণের প্রতিভা
বিচ্ছুরিত ক'রে দেয় সঙ্গীতের মত কণ্ঠস্বরে!
হৃদয়ে নিমীল হয়ে অনুধ্যান করে
ময়দানবের দ্বীপ ভেঙে ফেলে স্বভাবসূর্যের গরিমাকে।
চিন্তার তরঙ্গ তুলে যখন তাহাকে
ডেকে যায় আমাদের রাত্রির উপরে-
পঙ্কিল ইঙ্গিত এক ভেসে ওঠে নেপথ্যের অন্ধকারেঃ আরো ভূত
আধেক মানব
আধেক শরীর- তবু অধিক গভীরতর ভাবে এক শব।নিজের কেন্দ্রিক গুণে সঞ্চারিত হয়ে ওঠে আপনার নিরালোকে ঘোরে
আচ্ছন্ন কুহক, ছায়া কুবাতাস;- আধো চিনে আপনার যাদু চিনে নিতে
ফুরাতেছে- দাঁড়াতেছে- তুমি তাকে স্থির প্রেমিকের মত অবয়ব দিতে
সেই ক্লীববিভূতিকে ডেকে গেলে নিরাময় অদিতির ক্রোড়ে।
অনন্ত আকাশবোধে ভরে গেলে কালের দু'ফুট মরুভূমি।
অবহিত আগুনের থেকে উঠে যখন দেখেছ সিংহ, মেষ, কন্যা, মীন
ববিনে জড়ানো মমি- মমি দিয়ে জড়ানো ববিন,-
প্রকৃতির পরিবেদনার চেয়ে বেশি প্রামাণিক তুমি
সামান্য পাখি ও পাতা ফুল
মর্মরিত ক'রে তোলে ভয়াবহভাবে সৎ অর্থসঙ্কুল।
যে সব বিস্রস্ত অগ্নি লেলিহান হয়ে ওঠে উনুনের অতলের থেকে
নরকের আগুনের দেয়ালকে গড়ে,
তারাও মহৎ হয়ে অবশেষে শতাব্দীর মনে ভেতরে
দেয়ালে অঙ্গার, রক্ত, এক্যুয়ামেরিন আলো এঁকে
নিজেদের সংগঠিত প্রাচীরকে ধূলিসাৎ ক'রে
আধেক শবের মত স্থির;
তবুও শবের মত বিশেষ অধীরঃ
প্রসারিত হতে চায় ব্রহ্মান্ডের ভোরে;
সেইসব মোটা আশা, ফিকে রং, ইতর মানুষ,
ক্লীবকৈবল্যের দিকে যুগে যুগে যাদের পাঠাল দরায়ুস।সে সবের বুক থেকে নিরুত্তেজ শব্দ নেমে গিয়ে
প্রশ্ন করে যেতেছিল সে সময়ে নাবিকের কাছেঃ
সিন্ধু ভেঙে কত দূর নরকের সিঁড়ি নেমে আছে?-
ততদূর সোপানের মত তুমি পাতালের প্রতিভা সেঁধিয়ে
অবারিতভাবে সাদা পাখির মতন সেই ঘুরুনো আধারে
নিজে প্রমাণিত হয়ে অনুভব করেছিলে শোচনার সীমা
মানুষের আমিষের ভীষণ ম্লানিমা,
বৃহস্পতি ব্যাসে শুক্র হোমরের হায়রাণ হাড়ে
বিমুক্ত হয় না তবু- কি ক'রে বিমুক্ত তবু হয়ঃ
ভেবে তারা শুক্ল অস্থি হ'ল অফুরন্ত সূর্যময়।অতএব আমি আর হৃদয়ের জনপরিজন সবে মিলে
শোকাবহ জাহাজের কানকাটা টিকিটের প্রেমে
রক্তাভ সমুদ্র পারি দিয়ে এই অভিজ্ঞের দেশে
প্রবেশ ক'রেছি তার ভূখণ্ডের তিসি ধানে তিলে।
এখানে উজ্জ্বল মাছে ভ'রে আছে নদী ও সাগরঃ
নীরক্ত মানুষের উদ্বোধিত করে সব অপরূপ পাখি;
কেউ কাকে দূরে ফেলে রয় না একাকী।
যে সব কৌটিল্য, কুট, নাগার্জুন কোথাও পায়নি সদুত্তর-
এইখানে সেই সব কৃতদার, ম্লান দার্শনিক
ব্রহ্মাণ্ডের গোল কারুকার্য আজ রূপালি, সোনালি মোজায়িক।
একবার মানুষের শরীরের ফাঁস থেকে বা'র হয়ে তুমিঃ
(যে শরীর ঈশ্বরের চেয়ে কিছু কম গরীয়ান)
যে কোনো বস্তুর থেকে পেতেছে সস্মিত সম্মান;
যে কোনো সোনার বর্ণ সিংহদম্পতির মরুভূমি,
অথবা ভারতী শিল্পী একদিন যেই নিরাময়
গরুড় পাখির মূর্তি গড়েছিল হাতীর ধূসরতর দাঁতে,
অথবা যে মহীয়সী মহিলারা তাকাতে তাকাতে
নীলিমার গরিমার থেকে এক গুরুতর ভয়
ভেঙে ফেলে দীর্ঘছন্দে ছায়া ফেলে পৃথিবীর পরে,-
কবিতার গাঢ় এনামেল আজ সেই সব জ্যোতির ভিতরে।।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো;
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে জ্যোৎস্না — দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: দ্বারকার; — দাঁড়ায়ে রয়েছে নত, ম্লান।
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের ঘুচে — গেছে জীবনের সব লেনদেন;
‘মনে আছে?’ শুধালো সে — শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন?’
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কোনো এক অন্ধকারে আমি
যখন যাইব চ’লে – বারবার আসিব কি নামি
অনেক পিপাসা লয়ে এ মাটির তীরে
তোমাদের ভিড়ে !
কে আমারে ব্যথা দেছে ,- কে বা ভালোবাসে ,-
সব ভুলে ,- শুধু মোর দেহের তালাশে
শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে
এ মাটির’পরে
আসিব কি নেমে !
পথে পথে,- থেমে- থেমে- থেমে
খুঁজিব কি তারে ,-
এখানের আলোয় -আঁধারে
যেইজন বেঁধেছিল বাসা !-
মাটির শরীরে তার ছিল যে পিপাসা ,
আর যেই ব্যথা ছিল,- যেই ঠোঁট , চুল,
যেই চোখ ,- যেই হাত,- আর যে আঙুল
রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা ,-
যেই দেহ একদিন পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা
পেয়েছিল ,- আর তার ধানীসুরা করেছিল পান,
একদিন শুনেছে যে জল আর ফসলের গান,
দেখেছে যে ঐ নীল আকাশের ছবি
মানুষ – নারীর মুখ ,- পুরুষ – স্ত্রীর দেহ সবি
যার হাত ছুঁয়ে আজো উষ্ণ হয়ে আছে ,-
ফিরিয়া আসিবে সে কি তাহাদের কাছে !
প্রণয়ীর মতো ভালোবেসে
খুঁজিবে কি এসে
একখানা দেহ শুধু !-
হারায়ে গিয়েছে কবে কঙ্কালে কাঁকরে
এ মাটির’পরে !
অন্ধকারে সাগরের জল
ছেনেছে আমার দেহ ,- হয়েছে শীতল
চোখ – ঠোঁট- নাসিকা- আঙ্গুল
তাহার ছয়াছে;- ভিজে গেছে চুল
শাদাশাদা ফেনাফুলে ;
কতবার দূর উপকূলে
তারাভরা আকাশের তলে
বালকের মতো এক – সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
জেনেছি দেহের স্বাদ ;- গেছে বুক-মুখ পরশিয়া
রাঙা রোদ ,- নারীর মতন
এ দেহ পেয়েছে যেন তাহার চুম্বন
ফসলের ক্ষেতে !
প্রথম প্রণয়ী সে যে , কারতিকের ভোরবেলা দূরে যেতেযেতে
থেমে গেছে সে আমার তরে !
চোখ দুটো ফের ঘুমে ভরে
যেন তার চুমো খেয়ে !
এদেহ,- অলস মেয়ে
পুরুষের সোহাগে অবশ !-
চুমে লয় রৌদ্রের রস
হেমন্ত বৈকালে
উড় পাখপাখালীর পালে
উঠানের ;- পেতে থাকে কান,-
শোনে ঝরা শিশিরের গান
অঘ্রাণের মাঝরাতে ;
হিম হাওয়া যেন শাদা কঙ্কালের হাতে
এ দেহেরে এসে ধরে ,-
ব্যথা দেয় ! নারীর অধরে
চুলে- চোখে – জুয়ের নিশ্বাসে
ঝুমকো- লতার মতো তার দেহ- ফাঁসে
ভরা ফসলের মতো পড়ে ছিঁড়ে
এই দেহ ,- ব্যথা পায় ফিরে!...
তবু এই শস্যক্ষেতে পিপাসার ভাষা
ফুরাবে না;- কে বা সেই চাষা,-
কাস্তে হাতে ,- কঠিন –কামুক,-
আমাদের সবটুকু ব্যথাভরা সুখ
উচ্ছেদ করিবে এসে একা ! –
কে বা সেই !- জানি না তো ,- হয় নাই দেখা
আজো তার সনে;
আজ শুধু দেহ- আর দেহের পীড়নে
সাধ মোর ;- চোখে ঠোঁটে চুলে
শুধু পীড়া ,-শুধু পীড়া !- মুকুলে মুকুলে
শুধু কীট ,- আঘাত,-দংশন ,-
চায় আজ মন !
নক্ষত্রের পানে যেতেযেতে
পথ ভুলে বারবার পৃথিবীর ক্ষেতে
জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল !-
অন্ধকারে শিশিরের জল
কানে কানে গাহিয়াছে গান,-
ঢালিয়াছে শীতল আঘ্রাণ ;
মোর দেহ ছেনে গেছে অলস-আঢুল
কুমারী আঙুল
কুয়াশার ; ঘ্রাণ আর পরশের সাধ
জাগায়েছে ;- কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
ঢালিয়াছে আলো ,-
প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো
চুম্বনের মতো !
রেখে গেছে ক্ষত
সবজীর সবুজ রুধিরে!
শস্যের মতো মোর এ শরীর ছিঁড়ে
বারবার হয়েছে আহত
আগুনের মতো
দুপুরের রাঙা রোদ !
আমি তবু ব্যথা দেই,-
ব্যথা পাই ফিরে!-
তবু চাই সবুজ শরীরে
এ ব্যথার সুখ !
লাল আলো ,- রৌদ্রের চুমুক,
অন্ধকার ,- কুয়াশার ছুরি
মোরে যেন কেটে লয়,- যেন গুঁড়ি গুঁড়ি
ধুলো মোরে ধীরে লয় শুষে !-
মাঠ- মাঠে – আড়ষ্ট পউষে
ফসলের গন্ধ বুকে ক’রে
বারবার পড়ি যেন ঝ’রে!
আবার পাব কি আমি ফিরে
এই দেহ !- এ মাটির নিঃসাড় শিশিরে
রক্তের তাপ ঢেলে আমি
আসিব কি নামি !
হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক ক্ষেত ছাড়ি
অন্য ক্ষেতে চলিব কি ভেসে
এ সবুজ দেশে
আর একবার! শুনিব কি গান
ঢেউদের !- জলের আঘ্রাণ
লব বুকে তুলে
আমি পথ ভুলে
আসিব কি এ পথে আবার !
ধুলো-বিছানার
কীটেদের মতো
হব কি আহত
ঘাসের আঘাতে!
বেদনার সাথে
সুখ পাব !
লতার মতন মোর চুল,
আমার আঙুল
পাপড়ির মতো ,-
হবে কি বিক্ষত
তোমার আঙুলে – চুলে !
লাগিবে কি ফুলে
ফুলের আঘাত! বারবার
আমার এ পিপাসার ধার
তোমাদের জাগাবে পিপাসা !
ক্ষুধিতের ভাষা
বুকে ক’রে ক’রে
ফলিব কি !- পড়িব কি ঝ’রে
পৃথিবীর শস্যের ক্ষেতে
আর একবার আমি-
নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
মালঞ্চে পুষ্পিত লতা অবনতমুখী,-
নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন- তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে
বনচ্ছায়া- অন্তরালে তরল তিমিরে!
-আকাশে মন্থর মেঘ, নিরালা দুপুর!
-নিস্তব্ধ পল্লীর পথে কুহকের সুর
বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণে!
সে কোন পিপাসা কোন ব্যথা তার মনে!
হারায়েছে প্রিয়ারে কি?- অসীম আকাশে
ঘুরেছে অনন্ত কাল মরীচিকা-আশে?
বাঞ্ছিত দেয়নি দেখা নিমেষের তরে!-
কবে কোন রুক্ষ কাল- বৈশাখীর ঝড়ে
ভেঙে গেছে নীড়, গেছে নিরুদ্দেশে ভাসি!
-নিঝুম বনের তটে বিমনা উদাসী
গেয়ে যায়; সুপ্ত পল্লী-তটিনীর তীরে
ডাহুকীর প্রতিধ্বনি-ব্যথা যায় ফিরে!
-পল্লবে নিস্তব্ধ পিক,- নীরব পাপিয়া,
গাহে একা নিদ্রাহারা বিরহিণী হিয়া!
আকাশে গোধূলি এল,-দিক্ হ’ল ম্লান,
ফুরায় না তবু হায় হুতাশীর গান!
-স্তিমিত পল্লীর তটে কাঁদে বারবার,
কোন্ যেন সুনিভৃত রহস্যের দ্বার
উন্মূক্ত হল না আর কোন্ সে গোপান
নিল না হৃদয়ে তুলি তার নিবেদন!
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.