poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
পৃথিবীর বাধা- এই দেহের ব্যাঘাতে
হৃদয়ে বেদনা জমে;- স্বপনের হাতে
আমি তাই
আমারে তুলিয়া দিতে চাই !
যেইসব ছায়া এসে পড়ে
দিনের – রাতের ঢেউয়ে ,- তাহাদের তরে
জেগে আছে আমার জীবন ;
সব ছেড়ে আমাদের মন
ধরা দিত যদি এই স্বপনের হাতে !
পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
বেদনা পেত না তবে কেউ আর ,-
থাকিত না হৃদয়ের জরা ,-
সবাই স্বপ্নের হাতে দিত যদি ধরা !...
আকাশ ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে
সারা দিন- সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে ,
পৃথিবীর যত ব্যথা,- বিরোধ ,- বাস্তব
হৃদয় ভুলিয়া যায় সব !
চাহিয়াছে অন্তর যে- ভাষা ,
যেই ইচ্ছা,- যেই ভালোবাসা
খুঁজিয়াছে পৃথিবীর পারে পারে গিয়া ,-
স্বপ্নে তাহা সত্য হয়ে উঠেছে ফলিয়া !
মরমের যত তৃষ্ণা আছে ,-
তারি খোঁজে ছায়া আর স্বপ্নের কাছে
তোমরা চলিয়া আস ,-
তোমরা চলিয়া আস সব ! –
ভুলে যাও পৃথিবীর ঐ ব্যথা – ব্যাঘাত – বাস্তব!...
সকল সময়
স্বপ্ন – শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
যাদের অন্তরে ,-
পরস্পরে যারা হাত ধরে
নিরালা ঢেউয়ের পাশে পাশে ,-
গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে
যাহাদের আকাঙ্ক্ষার জন্ম- মৃত্যু ,- সব,-
পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব
শোনে না তাহারা !
সন্ধ্যার নদীর জল,- পাথরে জলের ধারা
আয়নার মতো
জাগিয়া উঠিছে ইতস্তত
তাহাদের তরে ।
তাদের অন্তরে
স্বপ্ন,- শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
সকল সময় !...
পৃথিবীর দেয়ালের’পরে
আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে
একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা,-
সে সব ব্যর্থতা
আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া !
দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে
ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া
হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী
ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায়- ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি ,-
তবে ওই পৃথিবীর দেয়ালের’পরে
লিখিতে যেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে
অন্তরের কথা !
আলো আর অন্ধকারে মুছে যায় সে সব ব্যর্থতা ! ...
পৃথিবীর ওই অধীরতা
থেমে যায় ,- আমাদের হৃদয়ের ব্যথা
দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে
স্বপ্নেরে – ধ্যানেরে
কাছে ডেকে লয় !-
উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায় ,
মানুষেরো আয়ু শেষ হয় !
পৃথিবীর পুরানো সে- পথ
মুছে ফেলে রেখা তার ,-
কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
চিরদিন রয় !
সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব ,-
নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয় !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে
অনেক কবিতা লিখে চলে গেলো যুবকের দল;
পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে
শুনিল আধেক কথা – এই সব বধির নিশ্চল
সোনার পিত্তল মূর্তি: তবু, আহা, ইহাদেরি কানে
অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দল:
একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
বিকেলবেলার আলো ক্রমে নিভেছে আকাশ থেকে।
মেঘের শরীর বিভেদ ক’রে বর্শাফলার মতো
সূর্যকিরণ উঠে গেছে নেমে গেছে দিকে-দিগন্তরে;
সকলি ছুপ কী এক নিবিদ প্রণয়বশত।
কমলা হলুদ রঙের আলো- আকাশ নদী নগরী পৃথিবীকে
সূর্য থেকে লুপ্ত হয়ে অন্ধকারে ডুবে যাবার আগে
ধীরে-ধীরে ডুবিয়ে দেয়;- মানবহৃদয়,দিন কি শুধু গেল?
শতাব্ধী কি চ’লে গেল!- হেমন্তের এই আঁধারের হিম লাগে;
চেনা জানা প্রেম প্রতীতি প্রতিভা সাধ নৈরাজ্য ভয় ভুল
সব-কিছুকেই ঢেকে ফেলে অধিকতর প্রয়োজনের দেশে
মানবকে সে নিয়ে গিয়ে শান্ত-আরো শান্ত হতে যদি
অনুজ্ঞা দেয় জনমানবসভ্যতার এই ভীষণ নিরুদ্দেশে,-
আজকে যখন সান্ত্বনা কম, নিরাশা ঢের, চেতনা কালজয়ী
হতে গিয়ে প্রতি পলেই আঘাত পেয়ে অমেয় কথা ভাবে,-
আজকে যদি দীন প্রকৃতি দাঁড়ায় যতি যবনিকার মতো
শান্তি দিতে মৃত্যু দিতে;-জানি তবু মানবতা নিজের স্বভাবে
কালকে ভোরের রক্ত প্রয়াস সূর্যসমাজ রাষ্ট্রে উঠে গেছে;
ইতিহাসের ব্যাপক অবসাদের সময় এখন, তবু, নর-নারীর ভিড়
নব নবীন প্রাক্সাধনার;-নিজের মনের সচল পৃথিবীকে
ক্রেম্লিনে লন্ডনে দেখে তবুও তারা আরো নতুন অমল পৃথিবীর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে-
বলিলামঃ ‘ একদিন এমন সময়
আবার আসিও তুমি- আসিবার ইচ্ছা যদি হয়;
পঁচিশ বছর পরে ।‘
এই ব’লে ফিরে আমি আসিলাম ঘরে;
তারপর, কতবার চাঁদ আর তারা,
মাঠে- মাঠে মরে গেল, ইঁদুর – পেঁচারা
জ্যোৎস্নায় ধানক্ষেত খুঁজে
এল-গেল ! – চোখ বুজে
কতবার ডানে আর বাঁয়ে
পড়িল ঘুমায়ে
কত- কেউ !- রহিলাম জেগে
আমি একা- নক্ষত্র যে বেগে
ছুটিছে আকাশ,
তার চেয়ে আগে চ’লে আসে
যদিও সময়,-
পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয় !-তারপর- একদিন
আবার হলদে তৃণ
ভ’রে আছে মাঠে –
পাতায় , শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে- দিকে, – চড়ুয়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে, – পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা , ঠাণ্ডা – কড়কড় !
শসাফুল , – দু-একটা নষ্ট শাদা শসা,-
মাকড়ের ছেঁড়া জাল, – শুকনো মাকড়সা
লতায়- পাতায়;-
ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায়,- ইঁদুর – পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে – মাঠে , ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজো মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আজকে রাতে তোমায় কাছে আমার কাছে পেলে কথা
বলা যেত; চারিদিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর।
কিন্তু যেই নীট নিয়মে ভাবনা আবেগ ভাব
বিশুদ্ধ হয় বিষয় ও তার যুক্তির ভিতর;
আমিও সেই ফলাফলের ভিতরে থেকে গিয়ে
দেখেছি ভারত লন্ডন রোম নিউইয়র্ক চীন
আজকে রাতের ইতিহাস ও মৃত ম্যামথ সব
নিবিড় নিয়মাধীন।
কোথায় তুমি রয়েছ কোন পাশার দান হাতে;
কী কাজ খুঁজে; সকল অনুশীলন ভালো নয়;
গভীরভাবে জেনেছি যে-সব সকাল বিকাল নদী নক্ষত্রকে
তারই ভিতর প্রবীণ গল্প নিহিত হয়ে রয়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
হৃদয়, অনেক বড়ো-বড়ো শহর দেখেছো তুমি;
সেই সব শহরের ইটপাথর,
কথা, কাজ, আশা, নিরাশার ভয়াবহ হৃত চক্ষু
আমার মনের বিস্বাদের ভিতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
কিন্তু তবুও শহরের বিপুল মেঘের কিনারে সূর্য উঠতে দেখেছি;
বন্দরের ওপারে সূর্যকে দেখেছি
মেঘের কমলারঙের ক্ষেতের ভিতর প্রণয়ী চাষার মতো বোঝা রয়েছে তার;
শহরের গ্যাসের আলো ও উঁচু-উঁচু মিনারের ওপরেও দেখেছি- নক্ষত্রেরা-
অজস্র বুনো হাঁসের মতো কোন দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমরা ঘুমায়ে থাকি পৃথিবীর গহ্বরের মতো ,-
পাহাড় নদীর পারে অন্ধকারে হয়েছে আহত
একা- হরিণীর মতো আমাদের হৃদয় যখন !
জীবনের রোমাঞ্চের শেষ হলে ক্লান্তির মতন
পাণ্ডুর পাতার মতো শিশিরে শিশিরে ইতস্তত
আমরা ঘুমায়ে থাকি !- ছুটি লয়ে চ’লে যায় মন !-
পায়ের পথের মতো ঘুমন্তেরা প’ড়ে আছে কত,-
তাদের চোখের ঘুম ভেঙ্গে যাবে আবার কখন !-
জীবনের জ্বর ছেড়ে শান্ত হয়ে রয়েছে হৃদয় ,-
অনেক জাগার পর এইমতো ঘুমাইতে হয় ।
অনেক জেনেছে ব’লে আর কিছু হয় না জানিতে ;
অনেক মেনেছে ব’লে আর কিছু হয় না মানিতে;
দিন- রাত্রি- গ্রহ- তারা- পৃথিবী- আকাশ ধ’রে-ধ’রে
অনেকে উড়েছে যারা অধীর পাখির মতো ক’রে,-
পৃথিবীর বুক থেকে তাহাদের ডাকিয়া আনিতে
পুরুষ পাখির মতো ,- প্রবল হাওয়ার মতো জোরে
মৃত্যুও উড়িয়া যায় !- অসাড় হতেছে পাতা শীতে,
হৃদয়ে কুয়াশা আসে,- জীবন যেতেছে তাই ঝ’রে
পাখির মতন উড়ে পায়নি যা পৃথিবীর কোলে –
মৃত্যুর চোখের’পরে চুমো দেয় তাই পাবে ব’লে !
কারন, সাম্রাজ্য – রাজ্য- সিংহাসন – জয়-
মৃত্যুর মতন নয় ,- মৃত্যুর শান্তির মতো নয় !
কারন , অনেক অশ্রু – রক্তের মতন অশ্রু ঢেলে
আমরা রাখিতে আছি জীবনের এই আলো জ্বেলে !
তবুও নক্ষত্র নিজে নক্ষত্রের মতো জেগে রয় !-
তাহার মতন আলো হৃদয়ের অন্ধকারে পেলে
মানুষের মতো নয়,- নক্ষত্রের মতো হতে হয় !
মানুষের মতো হয়ে মানুষের মতো চোখ মেলে
মানুষের মতো পায়ে চলিতেছে যত দিন ,-তাই ,-
ক্লান্তির পরে ঘুম,- মৃত্যুর মতন শান্তি চাই ১
কারণ , যোদ্ধার মতো – আর সেনাপতির মতন
জীবন যদিও চলে ,- কোলাহল ক’রে চলে মন
যদিও সিন্ধুর মতো দল বেঁধে জীবনের সাথে ,
সবুজ বনের মতো উত্তরের বাতাসের হাতে
যদিও বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন
একবার-দুইবার- জীবনের অধীর আঘাতে ,-
তবু- প্রেম- তবু তারে ছিঁড়ফেড়ে গিয়েছে কখন !
তেমন ছিঁড়িতে পারে প্রেম শুধু !- অঘ্রাণের রাতে
হাওয়া এসে যেমন পাতার বুক চ’লে গেছে ছিঁড়ে !
পাতার মতন ক’রে ছিঁড়ে গেছে যেমন পাখিরে !
তবু পাতা – তবুও পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে,
বনের শাখার মতো – শাখার পাখির মতো হয়ে
হিমের হাওয়ার হাতে আকাশের নক্ষত্রের তলে
বিদীর্ণ শাখার শব্দে – অসুস্থ ডানার কোলাহলে ,
ঝড়ের হাওয়ার শেষে ক্ষীণ বাতাসের মতো বয়ে,
আগুন জ্বলিয়া গেলে অঙ্গারের মতো তবু জ্বলে
আমাদের এ জীবন ! – জীবনের বিহ্বলতা সয়ে
আমাদের দিন চলে,- আমদের রাত্রি তবু চলে;
তার ছিঁড়ে গেছে ,- তবু তাহারে বীণার মতো ক’রে
বাজাই ,- যে প্রেম চলিয়া গেছে তারি হাত ধ’রে !
কারণ , সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে
প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি;- তাই রাখিয়াছে ঢেকে
পাখির মায়ের মতো প্রেম এসে আমাদের বুকে !
সুস্থ ক’রে দিয়ে গেছে আমাদের রক্তের অসুখ !-
পাখির শিশুর মতো যখন প্রেমেরে ডেকে ডেকে
রাতের গুহার বুকে ভালোবেসে লুকায়েছি মুখ,-
ভোরের আলোর মতো চোখের তারায় তারে দেখে !-
প্রেম কি আসেনি তবু ? –তবে তার ইশারা আসুক!
প্রেম কি চলিয়া যায় প্রানেরে জলের ঢেউয়ে ছিঁড়ে !
ঢেউয়ের মতন তবু তার খোঁজে প্রাণ আসে ফিরে !
যত দিন বেঁচে আছি আলেয়ার মতো আলো নিয়ে ,-
তুমি চ’লে আস প্রেম, - তুমি চ’লে আস কাছে প্রিয়ে !
নক্ষত্রের বেশি তুমি, - নক্ষত্রের আকাশের মতো !
আমরা ফুরায়ে যাই ,- প্রেম তুমি হও না আহত !
বিদ্যুতের মতো মোরা মেঘের গুহার পথ দিয়ে
চ’লে আসি ,- চ’লে যাই ,- আকাশের পারে ইতস্তত !-
ভেঙে যাই ,- নিভে যাই ,- আমরা চলিতে গিয়ে গিয়ে !
আকাশের মতো তুমি ,- আকাশে নক্ষত্র আছে যত ,-
তাদের সকল আলো একদিন নিভে গেলে পরে,-
তুমিও কি ডুবে যাবে, ওগো প্রেম, পশ্চিম সাগরে !
জীবনের মুখে চেয়ে সেইদিনো রবে জেগে ,- জানি
জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি ,-
ঘুমন্ত ফুলের মনো নিবন্ত বাতির মতো ঢেলে
মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায় ,- তুমি তারে জ্বেলে
চোখের তারার’পরে তুলে লবে সেই আলোখানি !
সময় ভাসিয়া যাবে ,- দেবতা মরিবে অবহেলে ,-
তবুও দিনের মেঘ আঁধার রাত্রির মেঘ ছানি
চুমো খাবে !- মানুষের সব ক্ষুধা আর শক্তি লয়ে
পূর্বের সমুদ্র ওই পশ্চিম সাগরে যাবে বয়ে !
সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন !
সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি ,- তোমার আসন
সকল স্থলের’পরে,-সকল জলের’পরে আছে !
যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে
হে প্রেম তোমার ! – যেইখানে শব্দ নাই তুমি আলোড়ন
তুলিয়াছ !- অঙ্কুরের মতো তুমি,- যাহা ঝরিয়াছে
আবার ফুটাও তারে !- তুমি ঢেউ ,- হাওয়ার মতন !
আগুনের মতো তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে !
আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ চুমি
আমার বুকের’পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি !
জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন
তুমি আছ ব’লে প্রেম,- গানের ছন্দের মতো মন
আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ ব’লে!
হৃদয় গন্ধের মতো –হৃদয় ধূপের মতো জ্ব’লে
ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন !
ওগো প্রেম ,-বাতাসের মতো যেই দিকে যাও চ’লে
আমারে উড়ায়ে লও আগুনের মতন তখন !
আমি শেষ হব শুধু , ওগো প্রেম , তুমি শেষ হলে !
তুমি যদি বেঁচে থাকো ,- জেগে রবো আমি এই পৃথিবীর’পর,-
যদিও বুকের’পরে রবে মৃত্যু ,- মৃত্যুর কবর !
তবুও ,- সিন্ধুর জল-সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো বয়ে
তুমি চ’লে যাও প্রেম ;- একবার বর্তমান হয়ে ,-
তারপর , আমাদের ফেলে যাও পিছনে –অতীতে,-
স্মৃতির হাড়ের মাঠে ,- কার্তিকের শীতে !
অগ্রসর হয়ে তুমি চলিতেছ ভবিষ্যৎ লয়ে –
আজো যারে দেখ নাই তাহারে তোমার চুমো দিতে
চ’লে যাও !- দেহের ছায়ার মতো তুমি যাও রয়ে ,-
আমরা ধরেছি ছায়া ,-প্রেমেরে তো পারিনি ধরিতে !
ধ্বনি চ’লে গেছে দূরে ,- প্রতিধ্বনি পিছে প’ড়ে আছে ;-
আমরা এসেছি সব ,- আমরা এসেছি তার কাছে !
একদিন-একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা !
একরাত- একদিন করেছি মৃত্যুর অবহেলা ।
একদিন-একরাত ;- তারপর প্রেম গেছে চ’লে ,-
সবাই চলিয়া যায় ,- সকলের যেতে হয় ব’লে
তাহারো ফুরাল রাত !- তাড়াতাড়ি প’ড়ে গেল বেলা
প্রেমেরও যে !- একরাত আর একদিন সাঙ্গ হলে
পশ্চিমের মেঘে আলো একদিন হয়েছে সোনেলা !
আকাশে পুবের মেঘে রামধনু গিয়েছিল জ্ব’লে
একদিন ;- রয় না কিছুতে তবু ,- সব শেষ হয় ,-
সময়ের আগে তাই কেটে গেল প্রেমের সময় !
একদিন- একরাত প্রেমেরে পেয়েছি তবু কাছে !-
আকাশ চলেছে ,- তার আগে আগে প্রেম চলিয়াছে !
সকলের ঘুম আছে- ঘুমের মতন মৃত্যু বুকে
সকলের ;- নক্ষত্রও ঝ’রে যায় মনের অসুখে ;-
প্রেমের পায়ের শব্দ তবুও আকাশে বেঁচে আছে !
সকল ভুলের মাঝে যায় নাই কেউ ভুলে-চুকে
হে প্রেম তোমারে !-মৃতেরা আবার জাগিয়াছে !-
যে ব্যথা মুছিতে এসে পৃথিবীর মানুষের মুখে
আরো ব্যথা-বিহ্বলতা তুমি এসে দিয়ে গেলে তারে ,-
ওগো প্রেম ,- সেই সব ভুলে গিয়ে কে ভুলিতে পারে !
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
মনে হয় সমাবৃত হয়ে আছি কোন্ এক অন্ধকার ঘরে–
দেয়ালের কর্নিশে মক্ষিকারা স্থিরভাবে জানে :
এইসব মানুষেরা নিশ্চয়তা হারায়েছে নক্ষত্রের দোষে;
পাঁচফুট জমিনের শিষ্টতায় মাথা পেতে রেখেছে আপোষে।হয়তো চেঙ্গিস আজও বাহিরে ঘুরিতে আছে করুণ রক্তের অভিযানে।
বহু উপদেশ দিয়ে চলে গেলে কনফুশিয়াস–
লবেজান হাওয়া এসে গাঁথুনির ইঁট সব ক’রে ফেলে ফাঁস।বাতাসে ধর্মের কল ন’ড়ে ওঠে–ন’ড়ে চলে ধীরে।
সূর্যসাগরতীরে মানুষের তীক্ষ্ন ইতিহাসে
কত কৃষ্ণ জননীর মৃত্যু হ’ল রক্তে–উপেক্ষায়;
বুকের সন্তান তবু নবীন সংকল্পে আজো আসে।
সূর্যের সোনালি রশ্মি, বোলতার স্ফটিক পাখনা,
মরুভূর দেশে যেই তৃণগুচ্ছ বালির ভিতরে
আমাদের তামাশার প্রগল্ভতা হেঁট শিরে মেনে নিয়ে চুপে
তবু দুই দন্ড এই মৃত্তিকার আড়ম্বর অনুভব করে,
যে সারস-দম্পতির চোখে তীক্ষ্ন ইস্পাতের মতো নদী এসে
ক্ষণস্থায়ী প্রতিবিম্বে–হয়তো বা
ফেলেছিলো সৃষ্টির আগাগোড়া শপথ হারিয়ে,
যে বাতাস সারাদিন খেলা করে অরণ্যের রঙে,
যে বনানী সুর পায়–আর যারা মানবিক ভিত্তি–গ’ড়ে–ভেঙ্গে গেলো বারবার–
হয়তো বা প্রতিভার প্রকম্পনে–ভুল ক’রে–বধ ক’রে–প্রেমে–
সূর্যের স্ফটিক আলো স্তিমিত হ’বার আগে সৃষ্টির পারে
সেইসব বীজ আলো জন্ম পায় মৃত্তিকা অঙ্গারে।
পৃথিবীকে ধাত্রীবিদ্যা শিখায়েছে যারা বহুদিন
সেই সব আদি অ্যামিবারা আজ পরিহাসে হয়েছে বিলীন।
সূর্যসাগরতীরে তবুও জননী ব’লে সন্ততিরা চিনে নেবে কারে।।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
গোধূলির রঙ লেগে অশ্বত্থ বটের পাতা হতেছে নরম;
খয়েরী শালিখগুলো খেলছে বাতাবীগাছে—তাদের পেটের শাদা রোম
সবুজ পাতার নীচে ঢাকা প’ড়ে একবার পলকেই বার হয়ে আসে,
হলুদ পাতার কোলে কেঁপে-কেঁপে মুছে যায় সন্ধ্যার বাতাসে।
ও কার গোরুড় গাড়ি র’য়ে গেছে ঘাসে ঐ পাখা মেলে ফরিঙের মতো।হরিণী রয়েছে ব’সে নিজের শিশুর পাশে বড়ো চোখ মেলে;
আঁকা-বাঁকা শিং তাদের মেরুর গোধূলির
মেঘগুলো লেগে আছে; সবুজ ঘাসের ’পরে ছবির মতন যেন স্থির;
দিঘির জলের মতো ঠান্ডা কালো নিশ্চিত চোখ;
সৃষ্টির বঞ্চনা ক্ষমা করবার মতন অশোক
অনুভূতি জেগে ওঠে মনে।…
আঁধার নেপথ্যে সব চারিদিকে—কূল থেকে অকূলের দিকে নিরুপণে
শক্তি নেই আজ আর পৃথিবীর—তবু এই স্নিগ্ধ রাত্রি নক্ষত্রে ঘাসে;
কোথাও প্রান্তরে ঘরে অথবা বন্দরে নীলাকাশে;
মানুষ যা চেয়েছিল সেই মহাজিজ্ঞাসার শান্তি দিতে আসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর –
সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে — তাই নীলাকাশ
মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়; — পথে পথে তাই এই ঘাস
জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়, — কউমাছিদের যেন নীড়
এই ঘাস; — যত দূর যাই আমি আরো যত দূর পৃথিবীর
নরম পায়ের তলে যেন কত কুমারীর বুকের নিঃশ্বাস
কথা কয় — তাহাদের শান — হাত খেলা করে — তাদের খোঁপায় এলো ফাঁস
খুলে যায় — ধূসর শাড়ির গন্ধে আসে তারা — অনেক নিবিড়পুরোনো প্রাণের কথা কয়ে যায় — হৃদয়ের বেদনার কথা –
সান্ত্বনার নিভৃত নরম কথা — মাঠের চাঁদের গল্প করে –
আকাশের নক্ষত্রের কথা কয়; — শিশিরের শীত সরলতা
তাহাদের ভালো লাগে, — কুয়াশারে ভালো লাগে চোখের উপরে;
গরম বৃষ্টির ফোঁটা ভালো লাগে; শীত রাতে — পেঁচার নম্রতা;
ভালো লাগে এই যে অশ্বথ পাতা আমপাতা সারারাত ঝরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
ভোর হয়,
কি যেন আমাকে দিতে চায় শেষরাত—
কোন আভা, পূর্বাভাস?
হয়তোবা শেষরাত আমাকে দিতে চায় তার ভোর হয়ে ওঠা।
নিদ্রা থেকে জেগে ওঠা পাখি,
দু’ একবার ডাক দিয়ে, চুপ ক’রে থেকে
নিজ অনুক্রমিক ডাকের মধ্যকার
নীরবতা মন দিয়ে শোনে;
তারপর পুনরায় ডাকে।
তুমি দেখো শব্দ অনুক্রমিক, অস্থায়ী, কিন্তু
দু’টি শব্দের মধ্যকার নীরবতা স্থায়ী, স্থায়ী।
শেষরাতে কোনো ধ্বনি একটানা নয়
সব ধ্বনি প্রতিধ্বনিহীন— থেমে-থেমে ডাকে
ডাকের মাঝখানের কসমিক স্থির নীরবতা
সব ধ্বনি থেমে-থেমে, কান পেতে, শোনে।
গাছে গাছে পল্লবের মধ্যখানে শূন্য...শূন্যস্থান,
রাত্রিভর জেগে থাকা মানুষের চোখ ভেদ ক’রে,
গভীর আত্মার মধ্যে, বেদনার মধ্যে, ঢুকে যায়।
কোনও বাস্তবতা থেকে ছিটকে এসে জল
স্বপ্ন-মধ্যে ঢোকে শেষরাতে।
সকাল নদীতে আগে হয়।
গড়িয়ে গড়িয়ে নদী থেকে উঠে আসা কুয়াশার
ভেপু— দশদিকে শোনা গেলে,
মাটিতে, ভূমিতে, ভোর হয়...
এ শহর কসমিক শেষরাত পার হয়ে
কসমপলিটন হয়ে ওঠে।
তখন তোমাকে ভোর,
অন্ধকার কেটে যাওয়া গভীর সুস্থতা,
মানুষের জ্ঞানের চেয়ে ভিন্ন জ্ঞান, আলো,
অন্য এক সুস্থিরতা, পরম আনন্দ দিতে চায়।
তোমার ভিতরে শূন্যস্থান—
আরো বহু ভিতরের শূন্যস্থান থেকে এসে
শেষরাতে— ভোরবেলা, যেন, পূর্ণ হয়…
যেন, সত্যি পূর্ণ হয়।— (অগ্রন্থিত কবিতা)
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সময়ের উপকণ্ঠে রাত্রি প্রায় হয়ে এল আজ
সূর্যকে পশ্চিমে দেখি সারা শতাব্দীর
অক্লান্ত রক্তের বোঝা গুছায়ে একাকী
তবুও আশার মত মেঘে মেঘে বলয়িত হয়ে
শেষ আলো ঢেলে যায়;- জ্যোতিঃপ্রাণধর্মী সূর্য অই;
একদিন অ্যামিবার উৎসরণ এনেছিল;
জীবনের ফেনশীর্ষ সিন্ধুর কল্লোল এক দিন
মানুষকে পেয়ে;- না-মর্মী মানুষ সেই দিন
ভয় পেত, গুহায় লুকাত,- তবু সূর্যকরোজ্জ্বল
সোনালী মানবী তাকে 'হাঁ' বলাল;- নীল
আকাশ নগরীরেখা দেখা দিল;- শঙ্খ আমলকী
সাগর অলিভবন চেনা গেল রোদ্রের ভিতরে;
শ্বেতাশ্বতর-প্লেটো-আলোকিত পৃথিবীর রূপ
অনাদির দায়ভাগে উৎসারিত রক্তের নদীর
শিয়রে আশার মত জেগে উৎসাহিত সূর্যকরে
সহসা নতুন হিংসা রক্ত গ্লানিমার কাছে প্রতিহত হয়ে
ধীরে ধীরে নিঃশেষে ফুরায়ে গেল তবু।ভাই-বোন-স্মৃতি-শান্তি হননের ঘোরে উদ্বেলিত
বহতা নদীর মত আজো এই পৃথিবী চলেছে।
তবুও তো সেই উদ্ঘাতিনী
নদীরমণীর শব্দ কানে নিয়ে,- প্রাণে
আকাশে জ্যোতিষ্ক জ্বলে হস্তা অভিজিৎ,
অনুরাধা শতভিষা লুব্ধক স্বাতী;
পৃথিবীতে- হৃদয়েরো গতিপথে বর্ণালির আভা
সম্পূর্ণ দীপ্তির মত আলোকিত- ক্রমে আলোকিত হতে চায়।লণ্ডন রুশিয়া গ্রীস দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা চীন
অগণন কন্ফারেন্সে বিকীর্ণ য়ুরোপা,
আমেরিকা,- যেন বীতবর্ষণের কৃষ্ণমেঘ নক্ষত্রের পথে;
ক্ষণিক উজ্জ্বল হয়ে ক্লান্তি ক্লেদ ভয় অন্ধকার হতে চায়
এখুনি আবার তবু। প্রকৃতিতে সূর্য আসে, অস্তের আকাশে
চ'লে যায়;- অস্তগতিহীন শুভ্র জনহৃদয়ের
সূর্যনগরীর দিকে যেতে হবে চেতনায় মানুষের সময় চলেছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন — গিয়েছে যে শান — হিম ঘরে,
অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল — পৃথিবীর এই মাঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে
আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে,
আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না কি জামের নিবিড় ঘন ডালে,
মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে –
কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে
মধুর চাকের নিচে — মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে –
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।
নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।
তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।
জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
প্রথম ফসল গেছে ঘরে,
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশাপাতা– মরা ঘাস — আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
ধানক্ষেতে– মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমায়েছে এ পৃথিবী –
তবু টের পাই
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!
হলুদ পাতার ভীড়ে ব’সে,
শিশিরের পালক ঘ’ষে ঘ’ষে,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
সেই পাখি–
আজ মনে পড়ে
সেদিনও এমনি গেছে ঘরে
প্রথম ফসল;
মাঠে মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর–
কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!–
হলুদ পাতার ভীড়ে ব’সে,
শিশিরের পালক ঘ’ষে ঘ’ষে,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
এই পাখি!
নদীটির শ্বাসে
সে রাতেও হিম হয়ে আসে
বাঁশাপাতা– মরা ঘাস — আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
ধানক্ষেতে– মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমায়েছে এ পৃথিবী –
তবু আমি পেয়েছি যে টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
মানবতাবাদী
|
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি।
সেই সব একদিন হয়তো বা কোনো এক সমুদ্রের পারে
আজকের পরিচিত কোনো নীল আভার পাহাড়ে
অন্ধকারে হাড়কঙ্করের মতো শুয়ে
নিজের আয়ুর দিন তবুও গণনা ক'রে যায় চিরদিন;
নীলিমার কাছ থেকে ঢের দূরে স'রে গিয়ে,
সূর্যের আলোর থেকে অন্তর্হিত হ'য়েঃ
পেপিরাসে- সেদিন প্রিন্টিং প্রেসে কিছু নেই আর;
প্রাচীন চীনের শেষে নবতম শতাব্দীর চীন
সেদিন হারিয়ে গেছে।আজকে মানুষ আমি তবুও তো- সৃষ্টির হৃদয়ে
হৈমন্তিক স্পন্দনের পথে ফসল;
আর এই মানবের আগামী কঙ্কাল;
আর নব-
নব-নব মানবের তরে
কেবলি অপেক্ষাতুর হ'য়ে পথ চিনে নেওয়া-
চিনে নিতে চাওয়া;
আর সে-চলার পথে বাধা দিয়ে অন্নের সমাপ্তিহীন ক্ষুধা;
(কেন এই ক্ষুধা-
কেনই বা সমাপ্তিহীন!)
যারা সব পেয়ে গেছে তাদের উচ্ছিষ্ট,
যারা কিছু পায় নাই তাদের জঞ্জাল;
আমি এই সব।
সময়ের সমুদ্রের পারে
কালকের ভোরে আর আজকের অন্ধকারে
সাগরের বড়ো শাদা পাখির মতন
দুইটি ছড়ানো ডানা বুকে নিয়ে কেউ
কোথাও উচ্ছল প্রাণশিখা
জ্বালায়ে সাহস সাধ স্বপ আছে- ভাবে।
ভেবে নিক- যৌবনের জোবন্ত প্রতীকঃ তার জয়!
প্রৌঢ়তার দিকে তবু পৃথিবীর জ্ঞানের বয়স
অগ্রসর হ'য়ে কোন্ আলোকের পাখিকে দেখেছে?
জয়, তার জয়, যুগে-যুগে তার জয়!
ডোডো পাখি নয়;মানুষেরা বার-বার পৃথিবীর আয়ুতে জন্মেছে;
নব নব ইতিহাস-সৈকতে ভিড়েছে;
তবুও কোথাও সেই অনির্বচনীয়
স্বপনের সফলতা- নবীনতা- শুভ্র মানবিকতার ভোর?
নচিকেতা জরাথ্রুস্ট্র লাওৎ-সে এঞ্জেলো রুশো লেনিনের মনের পৃথিবী
হানা দিয়ে আমাদের স্মরণীয় শতক এনেছে?
অন্ধকারে ইতিহাসপুরুষের সপ্রতিভ আঘাতের মতো মনে হয়
যতই শান্তিতে স্থির হ'য়ে যেতে চাই;
কোথাও আঘাত ছাড়া- তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই।
হে কালপুরুষ তারা, অনন্ত দ্বন্দের কোলে উঠে যেতে হবে
কেবলি গতির গুণগান গেয়ে- সৈকত ছেড়েছি এই স্বচ্ছন্দ উৎসবে;
নতুন তরঙ্গে রৌদ্রে বিপ্লবে মিলনসূর্যে মানবিক রণ
ক্রমেই নিস্তেজ হয় ক্রমেই গভীর হয় মানবিক জাতীয় মিলন?
নব-নব মৃত্যুশব্দ রক্তশব্দ ভীতিশব্দ জয় ক'রে মানুষের চেতনার দিন
অমেয় চিন্তায় খ্যাত হ'য়ে তবু ইতিহাসভুবনে নবীন
হবে না কি মানবকে চিনে- তবু প্রতিটি ব্যক্তির ষাট বসন্তের তরে!
সেই সুনিবিড় উদ্বোধনে- 'আছে আছে আছে, এই বোধির ভিতরে
চলেছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের বিষয় হৃদয়;
জয় অস্তসূর্য, জয়, অলখ অরুণোদয়, জয়।'
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছ অমৃতসূর্য আছে।
সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো;
তবুও সময় স্থির নয়,
আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে
দেখেছে সে তোমার বলয়।
এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন
তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;
সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে
সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল-অসংখ্য নক্ষত্রের রাত ;
সারা রাত বির্স্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;
মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো,
কখনো বিছানা ছিঁড়ে
নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে,
এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার-আধো ঘুমের ভিতর হয়তো-
মাথার উপরে মশারি নেই আমার
স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো
উড়ছে সে!
কাল এমন চমৎকার রাত ছিল।
সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল-আকাশে একতিন ফাঁক ছিল না;
পৃথিবীর সমস্ত ধূরস প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের
ভিতর দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের
মতো ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা;
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ!
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।
যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে;
যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ার, মিশরে বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদূরে আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে
করে কাতারে কাতের দাঁড়িয়ে গেছে যেন-
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?
আড়ষ্ট-অভিভূত হয়ে গেছি আমি,
কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন;
আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর
পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল!
আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে
আমার জানালার ভিতর দিয়ে, শাঁই শাঁই করে,
সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো!
হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে,
দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে
মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব
রোমশ উচ্ছ্বাসে,
জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়!
আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল,
নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে,
একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে নিয়ে চলল
একটা দুরন্ত শকুনের মতো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তোমায় আমি দেখেছিলাম ঢের
শাদা কালো রঙ্গের সাগরের
কিনারে এক দেশে
রাতের শেষে–দিনের বেলার শেষে।এখন তোমায় দেখি না তবু আর
সাতটি সাগর তেরো নদীর পার
যেখানে আছে পাঁচটি মরুভূমি
তার ওপারে গেছ কি চ’লে তুমি
ঘাসের শান্তি শিশির ভালোবেসে!বটের পাতায় সে কার নাম লিখে
(গভীরভাবে) ভালোবেসেছিল সে নামটিকে
হরির নাম নয় সে আমি জানি,
জল ভাসে আর সময় ভাসে–বটের পাতাখানি
আর সে নারী কোথায় গেছে ভেসে
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
নিখিল আমার ভই,
-কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে আমি সে বেদনা পাই;
যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি,
কোন্ ফণী যেন আকাশে বাতাসে তোলে বিষ- গরজনি!
কী যেন যাতনা মাটির বুকেতে আনিবার ওঠে রণি,
আমার শস্য-স্বর্ণসরা নিমেষে হয় যে ছাই!
-সবার বুকের বেদনা আমার, নিখিল আমার ভাই।
আকাশ হতেছে কালো,
কাহাদের যেন ছায়াপাতে হায়, নিভে যায় রাঙা আলো!
বাতায়নে মোর ভেসে আসে যেন কাদের তপ্ত শ্বাস,
অন্তরে মোর জড়ায়ে কাদের বেদনার নাগপাশ,
বক্ষে আমার জাগিছে কাদের নিরাশা, গ্লানিমা, ত্রাস,
-মনে মনে আমি কাহাদের হায় বেসেছিনু এত ভালো!
তাদের ব্যথার কুহেলি- পাথারে আকাশ হতেছে কালো।
লভিয়াছে বুঝি ঠাঁই
আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে নিখিলের বোন-ভাই!
আমার গানেতে জাগিছে তাদের বেদনা-পীড়ার দান,
আমার প্রাণেতে জাগিছে তাদের নিপীড়িত ভগবান,
আমার হৃদয়-যূপেতে তাহারা করিছে রক্তস্নান,
আমার মনের চিতানলে জ্ব’লে লুটায়ে যেতেছে ছাই!
আমার চোখের অশ্রুপুঞ্জে লভিয়াছে তারা ঠাঁই।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
স্বপ্নের ভিতরে বুঝি–ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে।
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে
হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;
বাতাস ঝরিছে ডানা — মুক্তা ঝ’রে যায়
পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে-বনে বনে-হরিণের চোখে;
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।
হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে
হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে,–
বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,
ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।
বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে–
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
সেদিন এ ধরণীর
সবুজ দ্বীপের ছায়া-উতরোল তরঙ্গের ভিড়
মোর চোখে জেগে জেগে ধীরে ধীরে হোল অপহত,-
কুয়াশায় ঝ’রে- পড়া আতসের মতো!
দিকে দিকে ডুবে গেল কোলাহল,-
সহসা উজানজলে ভাঁটা গেল ভাসি!
অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি
বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার
সেই দিন মোর অভিসার
মৃত্তিকার শূন্য- পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
ভেসেছিল আতুর,- উদাসী!
বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
কাঁদে কার বারোঁয়ার বাঁশি
সেদিন শুনিনি তাহা,-
ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
অতিদূর তারকার কামনায় তরী মোর দিয়েছিনু খুলে!
আমার এ শিরা-উপশিরা
চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন,-
শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন,
মোর তরে পিছুডাক মাটি-মা,- তোমার!
ডেকেছিল ভিজে ঘাস,-হেমন্তের হিম মাস, জোনাকির ঝাড়!
আমারে ডাকিয়াছিল আলেয়ার লাল মাঠ-শ্মশানের খেয়াঘাট আসি!
কঙ্কালের রাশি,
দাউদাউ চিতা,-
কত পূর্বজাতকের পিতামহ-পিতা,
সর্বনাশ ব্যসন-বাসনা,
কত মৃত গোক্ষুরার ফণা,
কত তিথি,- কত যে অতিথি,
কত শত যোনিচক্রস্মৃতি
করেছিল উতলা আমারে!
আধো আলো-আধেক আঁধারে
মোর সাথে মোর পিছে এল তারা ছুটে!
মাটির বাঁটের চুমা শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে,-রোমপুটে!
ধূ ধূ মাঠ,-ধানক্ষেত,-কাশফুল,-বুনোহাঁস,-বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া!
-মাঝপথে থেমে গেল তারা সব,
শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
দূরে,- দূরে,- আরো দূরে,-আরো দূরে চলিলাম উড়ে,
নিঃসহায় মানুষের শিশু একা,- অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
অসীমের আঁচলের তলে!
স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে,
দূর ছায়াপথে!
পৃথিবীর প্রেত চোখ বুঝি
সহসা উঠিল ভাসি তারকা-দর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি!
ভ্রূণ-ভ্রষ্ট সন্তানের তরে
মাটি-মা ছুটিয়া এল বুকফাটা মিনতির ভরে,-
সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু-বৃদ্ধ মৃত পিতা
সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা।
মোর পাশে দাঁড়াল সে গর্ভিণীর ক্ষোভে,
মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন,- জননীর প্রাণ।
জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত- বাঞ্ছিত সন্তান
তার তরে কালে কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা,- শালতমালের ছায়া।
এনেছে সে নব নব ঋতুরাগ,-পউষনিশির মেঘে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া!
তার তারে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার বারবার ভিজা রসে
উঠিয়াছে ভরি।
উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী!
মশলা-দরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে,-
কেন তবে দুদণ্ডের অশ্রু-অমানিশা
দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
নয়ন মুদিনু ধীরে,- শেষ আলো নিভে গেল পলাতকা নীলিমার পারে,
সদ্য প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
বঁইচির ঝোপ শুধু — শাঁইবাবলার ঝাড়–আর জাম হিজলের বন–
কোথাও অর্জুন গাছ–তাহার সমস্ত ছায়া এদের নিকটে টেনে নিয়ে
কোন কথা সারাদিন কহিতেছে অই নদী?–এ নদী কে?–ইহার জীবনহৃদয়ে চমক আনে;যেখানে মানুষ নাই–নদী শুধু–সেইখানে গিয়ে
শব্দ শুনি তাই আমি– আমি শুনি– দুপুরের জলপিপি শুনেছে এমন
এই শব্দ কতদিন;আমিও শুনেছি ঢের বটের পাতার পথ দিয়েহেঁটে যেতে–ব্যাথা পেয়ে;দুপুরে জলের গন্ধে একবার স্তব্ধ হয় মন;
মনে হয় কোন শিশু মরে গেছে, আমার হৃদয় যেন ছিল শিশু সেই;
আলো আর আকাশের থেকে নদী যতখানি আশা করে–আমিও তেমনএকদিন করি নি কি? শুধু একদিন তবু? কারা এসে বলে গেল, ‘ নেই–
গাছ নেই– রোদ নেই,মেঘ নেই– তারা নেই–আকাশ তোমার তরে নয়! ‘–
হাজার বছর ধরে নদী তবু পায় কেন এই সব? শিশুর প্রাণেই
নদী কেন বেঁচে থাকে?–একদিন এই নদী শব্দ ক’রে হদয়ে বিস্ময়
আনিতে পারে না আর; মানুষের মন থে নদী হারায়– শেষ হয় ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কোথাও দেখি নি, আহা, এমন বিজন ঘাস — প্রান্তরের পারে
নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে– নীল বুকে আছে তাহাদের
গঙ্গাফরিঙের নীড়,কাঁচপোকা, প্রজাপতি শ্যামাপোকা ঢের,
হিজলের ক্লান্ত পাতা– বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে
তাহাদের শ্যাম বুকে–পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে
বেতের নরম ফল, নাটা ফক খেতে আসে,ধুন্দুল বীজের
খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে– বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের
শালিখ, খন্জনা তাহা– লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু-ধারেনরম কান্তারে এই পাড়াগাঁর বুকে শুয়ে সে কোন দিনের
কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শুকায় নি, মজে নি আকাশ,
বল্লাল সেনের ঘোড়া– ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের
শব্দ হত এই পথে–আরো আগে রাজপুত্র কত দিন রাশ
টেনে টেনে এই পথে– কি যেন খুঁজেছে আহা, হয়েছে উদাস;
আজ আর খোঁজাখুজি নাই কিছু–নাটা ফলে মিটিতেছে আশ-
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
মনে পড়ে সেই কলকাতা–সেই তেরোশো তিরিশ–
বস্তির মতো ঘর,
বৌবাজারের মোড়ে দিনমান
ট্রাম করে ঘরঘর।
আমাদের কিছু ছিল না তখন
ছিল শুধু যৌবন,
সাগরের মতো বেগুনি আকাশে
সোনালি চিলের মন।ছেঁড়া শাড়ি পরে কাটাইতে দিন
বাঁটনা হলুদ মাখা
বিভারানী বোস, তোমার দু হাতে
ছিল দুটো শাদা শাঁখা,
শাদা শাঁখা শুধু তোমার দু হাতে
জুটিত না তেল চুলে,
তবুও আমরা দিতাম আকাশে
বকের পাখনা তুলে।জুটিত না কালি কলমে আমার
কাগজে পড়িত টান,
তোমার বইয়ের মার্জিনে, বিভা,
লিখিতাম আমি গান।
পাশের বাড়ির পোড়া কাঠ এনে
দেয়ালে আঁকিতে ছবি।
আমি বলিতাম–’অবন্তী-বিভা’,
তুমি শুধাইতে ‘ঈগল কবি’চক্ষে তোমার মিঙ্ যুগ ভাসে
কাঙড়ার ছবি ঐ নীল চোখে
আমার হৃদয়ে অনুরাধাপুর
পুরানো ফরাসি গানের বোকে
সেদিন আমার পথে পথে হাঁটা
সেও তম্বুরা মান্ডলিন
তোমার সেদিন ঘর সিঁড়ি ভাঙা
বাংলার পট, পুরোনো চীন।পৃথিবীর মুখে তুড়ি দিয়ে দিয়ে
দুইটি হৃদয় সেই
ডাল তেল নুন জোটে না যাদের
জামা-শাড়ি কিছু নেই,
তবুও আকাশ জয়ের বাসনা
দু:খের গুলি সে যেন ঢিল,
আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল—শরীরের ক্ষুধা মাটির মতন
স্বপ্ন তখন সোনার সিঁড়ি,
মানুষ থাকুক সংসারে পড়ে
আমরা উড়িব পৃথিবী ছিঁড়ি।সকাল হয়েছে: চাল নাই ঘরে,
সন্ধা হয়েছে: প্রদীপ নাই,
আমার কবিতা কেউ কেনে নাকো?
তোমার ছবিও ঘুঁটের ছাই?ছ মাসের ভাড়া পড়ে আছে না কি?
ঘরে নাই তবু চাল কড়ি নুন?
আকাশের নীল পথে পথে তবু
আমার হৃদয় আত্তিলা হূণ
আকাশের নীল পথ থেকে পথে
জানালার পর জানালা খুলে
ভোরের মুনিয়াপাখির মতন
কোথায় যে দিতে পাখনা তুলে।সংসার আজ শিকার করেছে
সোনালি চিলেরা হল শিকার,
আজ আমি আর কবিতা লিখি না
তুমিও তো ছবি আঁকো না আর।
তবুও শীতের শেষে ফাল্গুনে
মাতাল যখন সোনালি বন
তেরোশো তিরিশ—দারিদ্র্য সেই
ফিরে চাই আজ সে যৌবন।ফিরে চাই আমি তোমারে আবার
আমার কবিতা, তোমার ছবি—
শুধাতাম আমি ‘অনুরাধাপুর’—
শুধাইতে তুমি ‘শকুন কবি’।
সেই-যে আকাশ খোঁজার স্বপ্ন
দুখের ছররা—সে যেন ঢিল,
আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
সোনার খাঁচার বুকে রহিব না আমি আর শুকের মতন;
কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে — কোন্ কোন্ গান, বলো,
তাহলে এ — দেউলের খিলানের গল্প ছেড়ে চলো, উড়ে চলো, —
যেখানে গভীর ভোরে নোনাফল পাকিয়াছে, — আছে আতাবন,
পউষের ভিজে ভোরে, আজ হায় মন যেন করিছে কেমন; —
চন্দ্রমালা, রাজকন্যা, মুখ তুলে চেয়ে দেখ — শুধাই , শুন লো,
কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে, — কোন্ গান বলো,
আমার সোনার খাঁচা খুলে দাও, আমি যে বনের হীরামন;রাজকন্যা শোনে নাকো — আজ ভোরে আরসীতে দেখে নাকো মুখ,
কোথায় পাহাড় দূরে শাদা হয়ে আছে যেন কড়ির মতন, —
সেই দিকে চেয়ে — চেয়ে দিনভোর ফেটে যায় রূপসীর বুক,
তবুও সে বোঝে না কি আমারো যে সাধ আছে — আছে আনমন
আমারো যে — চন্দ্রমালা, রাজকন্যা, শোনো — শোনো তোলো তো চিবুক।
হাড়পাহাড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে হিম গেছে তার স্নান।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
পৃথিবী এখন এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম।
সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে;
যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে;
যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় ক্ষেতের গোধূম
চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুমগাঢ় করে দিয়ে যায়।-এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের।
সমূদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ
নদীর তরঙ্গে – ক্রমে তুষারের স্তুপে তার ঢেউ
একবার টের পাবে, দ্বিতীয়বারের
সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে ঢের।এইখানে সময়কে যতদুর দেখা যায় চোখে
নির্জন ক্ষেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভুত চাষা;
এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা
সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে;
অঘ্রানের বিকেলের কমলা আলোকে
নিড়োনো ক্ষেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে;
একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে।
পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে
নষ্ট হয়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে;
সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে।ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হয়ে আসে।
মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হল মানুষের বৃত্তি আদায়।
যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে
তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায়
আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন।
অভিভূত হয়ে আছে — চেয়ে দ্যাখো — বেদনার নিজের নিয়ম।
নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়;
জলপাই অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা;
ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়;
প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে
আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে।সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ
অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে
এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়।
পৃথিবীর রাজপথে-রক্তপথে-অন্ধকার অববাহিকায়
এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়।
তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মুক অপেক্ষায়;
তাহার মাথার ‘পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়;
এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হয়ে থেকে ক্রমে একদিন
কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ?চেয়েছে মাটির দিকে — ভুগর্ভে তেলের দিকে
সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা,
মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার;
দুরবীণে কিমাকার সিংহের সাড়া
পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে।
বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তারা।
যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে,
মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা
দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে;
চিরদিন এইসব হ্নদয় ও রুধিরের ধারা।
মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে
নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে;
অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া।মোমের আলোয় আজ গ্রস্থের কাছে ব’সে – অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে
আমরা যতটা দূর চ’লে যাই -চেয়ে দেখি আরো কিছু আছে তারপরে।
অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে
ছায়া ফ্যালে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে,
কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে,
অথবা যে সব থাম সমীচীন মিস্তিরির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে,
তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ।
হয়তো অনেক এগিয়ে তারা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ
জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোলতার নেই অবলেশ।তাই তারা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরও জীবনের লিপ্ত অভিধানে
বর্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে।
সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয় — এই জ্ঞানে
লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে
নিজের বীজের তরে জোর করে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে।
অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে।একটি আলোক নিয়ে বসে থাকা চিরদিন;
নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে;
সে সবের দিন শেষ হয়ে গেছে
এখন সৃষ্টির মনে — অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে।
সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে।
একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে — বালুচরে,
সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে।
আমরা জটিল ঢের হয়ে গেছি — বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে।
যদি কেউ বলে এসে : ‘এই সেই নারী,
একে তুমি চেয়েছিলে এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ–
তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কব্ে ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ?আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর,
যদিও অনেক মৃত্যুপরস্পরা ছিলো ইতিহাসে;
বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অবলঙ ছবি;
নানারুপ ক্ষতি ক্ষয় নানা দিকে মরে গেছি — মনে পড়ে বটে
এইসব ছবি দেখি; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে
নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থাণু।
এক দরজায় ঢুকে বহিস্কৃত হয়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে
অমেয় আলোয় হেঁটে তারা সব।
(আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্ বাতাসের শব্দ শুনেছিল;
তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?)
আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
কাচের গেলাসে জলে উজ্জুল শফরী;
সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো;
তারপর অন্য গ্রহ-নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে
যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে।
সৃষ্টির নাড়ীর ‘পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায়
অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ;
তবু তারা করে নাকো পরস্পরের ঋণশোধ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দুজনে;
আকাশ প্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস
সাজায়েছে, — মাঠ থেকে গাজন গানের স্নান ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস
ভেসে আসে; ডানা তুলে সাপমাসী উড়ে যায় আপনার মনে
আকন্দ বনের দিকে; একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে
নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ
দু’মুহূর্ত ভরে রাখে — তারপর মৌরির গন্ধমাখা ঘাস
পড়ে থাক: লক্ষ্মীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু উড়ে চলে বনেআধো ফোটা জ্যোৎস্নায়; তখন ঘাসের পাশে কতদিন তুমি
হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখনার মতো
বসেছ আমার কাছে এইখানে — আসিয়াছে শটিবন চুমি
গভীর আঁধার আরো — দেখিয়াছি বাদুড়ের মৃদু অবিরত
আসা — যাওয়া আমরা দুজনে বসে বলিয়াছি ছেঁড়াফাঁড়া কত
মাঠ ও চাঁদের কথা: ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছ তো।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
মানুষের জীবনের ঢের গল্প শেষ
হ’য়ে গেলে র’য়ে যায় চারি দিক ঘিরে এই দেশ;
নদী মাঠ পাখিদের ওড়াওড়ি গাছের শিয়রে
কমলা রঙের ঢেউয়ে এসে কিছুক্ষণ খেলা করে।
মনে হয় কোথাও চিহ্নিত এই রৌদ্র ছিল কবে;
মানুষ সার্থক ময়- তবু সার্থকতর হবে;
মনে হত কাজ ক’রে কথা ব’লে গ্রন্থ মিলিয়ে,
মননের তীর থেকে আরো দূরে তীরতটে গিয়ে।
সময় নিজেই তবু সব চেয়ে গভীর বিপ্লবী;
ফুরিয়ে ফেলেছে সেই দিন রাত্রি সেরা সত্য-উদ্ঘাটন সবি;
সেদিনের হৃদয়ের উষ্ণ উত্তেজিত স্থির
ক’রে ফেলে অন্য নব কলেবরে গড়েছে শরীর।
বাহিরে ভিতরে লীন হয়ে থাকে মন,
শান্ত- আরো শান্ত হয় অন্তঃকরণ;
পুরোনো দিনের স্তম্ভ দু-চারটে পশ্চিমের আঁধারের কাছে;
নব সূর্যে সম্মেলনে- যাত্রা যাত্রা যাত্রা যাত্রা আছে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
এইখানে মাইল-মাইল ঘাস ও শালিখ রৌদ্র ছাড়া কিছু নেই।
সূর্যালোকিত হ'য়ে শরীর ফসল ভালোবাসি
আমারি ফসল সব- মীনকন্যা এসে ফলালেই
বৃশ্চিক কর্কট তুলা মেষ সিংহ রাশি
বলয়িত হ'য়ে উঠে আমাকে সূর্যের মতো ঘিরে
নিরবধি কাল নীলাকাশ হ'য়ে মিশে গেছে আমার শরীরে।
এই নদী নীড় নারী কেউ নয়; -মানুষের প্রাণের ভিতরে
এ-পৃথিবী তবুও তো সব
অধিক গভীরভাবে মানবজীবন ভালো হ'লে
অধিক নিবিড়তরভাবে প্রকৃতিকে অনুভব
করা যায়। কিছু নয়- অন্তহীন ময়দান অন্ধকার রাত্রি নক্ষত্র-
তারপর কেউ তাকে না চাইতে নবীন করুণ রৌদ্রে ভোর;-
অভাবে সমাজ নষ্ট না-হ'লে মানুষ এইসবে
হ'য়ে যেতো এক তিল অধিক বিভোর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
স্বদেশমূলক
|
কোথাও পাবে না শান্তি—যাবে তুমি এক দেশ থেকে দূরদেশে?
এ-মাঠ পুরানো লাগে—দেয়ালে নোনার গন্ধ—পায়রা শালিখ সব চেনা?
এক ছাঁদ ছেড়ে দিয়ে অন্য সূর্যে যায় তারা-লক্ষ্যের উদ্দেশে
তবুও অশোকস্তম্ভ কোনো দিকে সান্তনা দেবে না।কেন লোভে উদ্যাপনা? মুখ ম্লান—চোখে তবু উত্তেজনা সাধ?
জীবনের ধার্য বেদনার থেকে এ-নিয়মে নির্মুক্তি কোথায়।
ফড়িং অনেক দূরে উড়ে যায় রোদে ঘাসে—তবু তার কামনা অবাধ
অসীম ফড়িংটিকে খুঁজে পাবে প্রকৃতির গোলকধাঁধাঁয়ছেলেটির হাতে বন্দী প্রজাপতি শিশুসূর্যের মতো হাসে;
তবু তার দিন শেষ হয়ে গেল; একদিন হতই-তো, যেন এই সব
বিদ্যুতের মতো মৃদুক্ষুদ্র প্রাণ জানে তার; যতো বার হৃদয়ের গভীর প্রয়াসে
বাঁধা ছিঁড়ে যেতে চায়—পরিচিত নিরাশায় তত বার হয় সে নীরব।অলঙ্ঘ্য অন্তঃশীল অন্ধকার ঘিরে আছে সব;
জানে তাহা কীটেরাও পতঙ্গেরা শান্ত শিব পাখির ছানাও।
বনহংসীশিশু শূন্যে চোখ মেলে দিয়ে অবাস্তব
স্বস্তি চায়;—হে সৃষ্টির বনহংসী, কী অমৃত চাও?
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড়
কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে
জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলারঙের আলোয়
জ্ব’লে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে।
যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে,-
মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে
কোথায় আছে জানি না তো;
কোথায় সমাজ, অর্থনীতি? স্বর্গগামী সিঁড়ি
ভেঙে গিয়ে পায়ের নিচে রক্তনদীর মতো-
মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী
হয়ে কি আজ চারিদিকে গণনাহীন ধূসর দেয়াল
ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল ক’রে!
পুরাণপুরুষ, গণমানুষ, নারীপুরুষ, মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব
অর্থবিহীন হয়ে গেলে,-তবু আরেক নবীনতর ভোরে
সার্থকতা পাওয়া যাবে ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হ’য়ে
পথে-পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে
তবুও কেবল দ্বীপ বানালো যে যার নিজের অবক্ষয়ের জলে।
প্রাচীন কথা নতুন ক’রে এই পৃথিবীর অনন্ত বোনভায়ে
ভাবছে একা-একা ব’সে
যুদ্ধ রক্ত রিরংসা ভয় কলরোলের ফাঁকেঃ
আমাদের এই আকাশ সাগর আঁধার আলোয় আজ
যে-দোর কঠিন; নেই মনে হয়; সে-দ্বার খুলে দিয়ে
যেতে হবে আবার আলোয় অসার আলোর ব্যাসন ছাড়িয়ে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
সন্ধ্যা হয়ে আসে- সন্ধ্যা হয়ে আসে
একা একা মাঠের বাতাসে
ঘুরি আমি- বসি আমি ঘাসেওই দূরে দেখা যায় কার লাল পাড়
প্রসাদের বউ বুঝি-পাশে বুঝি তার
প্রসাদ রয়েছে বসে-বাড়িতেছে সন্ধ্যার আঁধারবছর আরেক হ’ল হয়েছিলো দু’জনের বিয়ে
মনে পড়ে; তারপর কুড়িয়ে-বাড়িয়ে
আজো তারা যায় নি হারিয়েরোজই তারা সন্ধ্যা হলে আসে
এই মাঠে-বসে থাকে ঘাসে
লক্ষ লক্ষ তারার আকাশে
বসে থাকে-মনে হয়
মাঠের চাঁদের কথা কয়
দুজনার প্রাণে ঢের শান্তি ও বিস্ময়আছে আমি জানি
এরা দুটি পৃথিবীর আঁচলের প্রাণী
মনে কোনো প্রশ্ন নাই-দ্বিধা নাই জানিপ্রাণের আশ্চর্য টান আছে
চিরদিন থাকে কাছে কাছে
বিচ্ছেদে বিনষ্ট হয় পাছেজীবনের শান্ত গল্প- প্রসাদ কখনো তাই
বড় বেশি তীর্থে যায় নাই
যদি তারে এ কথা শুধাইমৃত্যুরেও দেবে নাকি ফাঁকি?
কিন্তু থাক চেয়ে দেখ যেন দুটি পাখি
বসে আছে-পাখনায় শান্ত পাখা ঢাকিনক্ষত্রও চেয়ে দেখে সব
এমন নিবিড় স্নিগ্ধ-এমন নীরব
ভালোবাসাঃ মাটিতেও নয় অসম্ভব?এই তারা বলে
নীল লাল আলো নিয়ে জ্বলে
চেয়ে দেখে আকাশের তলেরক্তে রক্তে ভ’রে আছে মানুষের মন
রোম নষ্ট হয়ে গেছে…গেছে বেবিলন
পৃথিবীর সব গল্প কীটের মতনএকদিন ভেঙে যাবে: হয়ে যাবে ধুলো আর ছাই
রোম নাই আজ আর- বেবিলন নাই
আজো তবু হৃদয়ের হৃদয়কে চাই।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে —
বসন্তের রাতে
বিছানায় শুয়ে আছি;
— এখন সে কত রাত!অই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,
স্কাইলাইট মাথার উপর
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর
তারপর চলে যায় কোথায় আকাশে?
তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে।শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে,
চোখ আর চায় না ঘুমাতে;
জানালার থেকে অই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে,
সাগরের জলের বাতাসে
আমার হৃদয় সুস্থ হয়;
সবাই ঘুমায়ে আছে সব দিকে —
সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময়?
সাগরের অই পারে — আরো দূর পারে
কোনো এক মেরুর পাহাড়ে
এই সব পাখি ছিল;
ব্লিজার্ডের তাড়া খেয়ে দলে দলে সমুদ্রের পর
নেমেছিল তারা তারপর —
মানুষ যেমন তার মৃত্যুর অজ্ঞানে নেমে পড়ে!বাদামি — সোনালি — শাদা — ফুটফুটে ডানার ভিতরে
রবারের বলের মতন ছোট বুকে
তাদের জীবন ছিল —
যেমন রয়েছে মৃত্যু লক্ষ লক্ষ মাইল ধরে সমুদ্রের মুখে
তেমন অতল সত্য হয়ে!কোথাও জীবন আছে — জীবনের স্বাদ রহিয়াছে,
কোথাও নদীর জল রয়ে গেছে — সাগরের তিতা ফেনা নয়,
খেলার বলের মতো তাদের হৃদয়
এই জানিয়াছে —
কোথাও রয়েছে পড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে
তারা আসিয়াছে।তারপর চলে যায় কোন্ এক ক্ষেতে
তাহার প্রিয়ের সাথে আকাশের পথে যেতে যেতে
সে কি কথা কয়?
তাদের প্রথম ডিম জন্মিবার এসেছে সময়!
অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ মাটির ঘ্রাণ,
ভালোবাসা আর ভালোবাসা সন্তান,
আর সেই নীড়,
এই স্বাদ — গভীর — গভীর।আজ এই বসন্তের রাতে
ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে;
অই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর
স্কাইলাইট মাথার উপর,
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
শীতের রাতের এই সীমাহীন নিষ্পন্দন গহ্বরে
জীবন কি বেঁচে আছে তবে?
ডানা-ভাঙ্গা নক্ষত্রের মতন উৎসবে
আঁধারের ভিতরে কি করেকেবলি স্ফুলিঙ্গ অন্ধ সংক্রান্তির মতো?
বহুদিন ক্ষমাহীন সময়ের ভিতরে সে অনেক জ্বলেছে
আছে, তবু তুমি নেই, তাই তো দাহন ভেঙ্গে গেছে
মৃত নক্ষত্রের গন্ধ ক্রমেই হতেছে পরিণতঅন্ধকার সনাতনে_ সৃষ্টির প্রথম উৎসারিত পটভূমি
তারি অন্তিমের কথা? অন্তহীন মোজেইকে আলোকের গোলকধাঁধায়
কেউ প্রিয়া_ কেউ তার অনিবার্ণ হতে চায়;
ঝ'রে যায়_ দূর মৃগতৃষ্ণিকার মতো দীপ্ত তুমি।এখন ভোরের বেলা মনে হয় তুমি শাদা যূথিকার মতো
তেমনি পবিত্র স্বাদ তোমার শরীর শিখা ঘিরে
কোথাও বিষয় খুঁজে তোমাকে দেখেছি রৌদ্রে লুকানো শিশিরে
সৃষ্টির প্রথম ভোর থেকে অবশেষে আজ এই পরিণতশেষ ভোর, শোষ রোদ, শেষ ফুল, অন্তিম শিশির
মীনকেতনের দিন জন্মান্তরে কেটে গেছে, -আজ প্রতিসারী
আরেক প্রয়াণে উৎস; -একটি মেঘের মতো চ'লে এসে ভারি
নীলিমায় ভেসে যেতে-যেতে_ থেমে_ শুনেছি, বলেছো তুমি, স্থিরমেঘশান্তি প্রকৃতির- মানুষ তা হারিয়ে ফেলেছে
চারিদিকে সময়ের সকল বিশাল মরুভূমি
বলয়িত নগরীর সমাজের সভ্যতার কলঙ্কসুন্দর
মৃগতৃষ্ণায় লয় পেয়ে গেলে স্থির তুমি_ স্থিরতর তুমি#জীবনান্দদাশের অগ্রন্থিত কবিতাসমগ্র
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
কোথাও মঠের কাছে — যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে
শ্যাওলায় — অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর,
পাশে দীঘি মজে আছে — রূপালী মাছের কন্ঠে কামনার স্বর
যেইখানে পটরানী আর তার রূপসী সখীরা শুনিয়াছে
বহু বহু দিন আগে — যেইখানে শঙ্খমালা কাঁথা বুনিয়াছে
সে কত শতাব্দী আগে মাছরাঙা — ঝিলমিল — কড়ি খেলা ঘর;
কোন্ যেন কুহকীর ঝাঁড়ফুঁকে ডুবে গেছে সব তারপর
একদিন আমি যাব দু-প্রহরে সেই দূর প্রান্তরের কাছে,সেখানে মানুষ কেউ যায় নাকে — দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা
বেতের বনের ফাঁকে — জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায়
রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়, — শাদা ভাঁট পুষ্পের তোড়া
আলোকতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণফু বাসকের গায়;
তবুও সেখানে আমি নিয়ে যাবো একদিন পাটকিলে ঘোড়া
যার রূপ জন্মে — জন্মে কাঁদায়েছে আমি তারে খুঁজিব সেথায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হ’লে,
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য ক’রে চলে;
সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে
মানুষের শরীরের স্থিরতর মর্যাদার মতো
তার সেই মূর্তি এসে পড়ে।
সূর্যের সম্পূর্ণ বড় বিভোর পরিধি
যেন তার নিজের জিনিস।
এতদিন পরে সেইসব ফিরে পেতে
সময়ের কাছে যদি করি সুপারিশ
তা’হলে সে স্মৃতি দেবে সহিষ্ণু আলোয়
দু-একটি হেমন্তের রাত্রির প্রথম প্রহরে;
যদিও লক্ষ লোক পৃথিবীতে আজ
আচ্ছন্ন মাছির মত মরে -
তবুও একটি নারী ‘ভোরের নদীর
জলের ভিতরে জল চিরদিন সূর্যের আলোয় গড়াবে’
এ রকম দু-চারটে ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা
ভেবে শেষ হ’য়ে গেছে একদিন সাধারণভাবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
প্রকৃতি থেকে ফসল নীলকন্ঠ এলো;
সময়পাপচক্র থেকে বাহির হলো ব্যথিত নিঃসহায়।
সবের পথে শতাব্দীর এই রাত্রি ব্যাপকতা
প্রশান্তি নয়- ক্রমেই বেশি স্পষ্টতা জাগায়।সময় এখন চারদিকেতে ঘনান্ধকার দেখে
বলছে: নগর নরক ব্যধি সন্ধি ফলাফল
জীবনের এই ত্যক্ত সন্ততিদের প্রলাপ আলাপে পরিণত
হ'লো কি প্রায়? -নক্ষত্র নির্মল?হয়তো হলো:- অন্তত আজ রাত্রি একা অল্প সময়ের
ভিতরে শুভ অনুধ্যায়ী সময়দেীর মতো
প্রাণের প্রয়াস দ্যাখাতে গিয়ে চলতে ছেদে ব্যর্থতার
হয়নি নিহত?নদী পাখি প্রহরী জ্ঞান-বিজ্ঞানীরা সব
প্রেমিক? তবু সারাটা রাত অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি
শব কুড়িয়ে ফিরছে অন্ধকারে,
চন্দ্রে সূর্যে রক্ত তরবারী?মানব কেমন স্বভাবত
এই কথা কি ঠিক
দেশ সময়ের মানুষমনের সহজ প্রকাশে
করুণা স্বাভাবিক?আমার চোখে ভেসে ওঠে করুণা এক নারী:
হাত দুটো তার ঠান্ডা শাদা-তবুও উষ্ণতা
প্রিয়ের মতন, কাম তবু আজ প্রিয়তর নিরিখ পৃথিবীর:
স্থুল প্রগলভ বিষয় ব্যবহার ও কথাসবের চেয়ে সুখের বিষয় ভেবে
রন্ধ্রে ঋণে উন্মাদনায় পুরুষার্থ লভি;
জীবনে আরেক গভীরতরভাবে
ঢুকেও তো আজ তা অ-প্রেমই স্বভাব।পিরামিড ও অ্যাটম আগুন অধির প্রাণনার
উৎসারিত রাষ্ট্র সমাজ শক্তি রচনায়
প্ল্যান কমিশন কনফারেন্সের বৃহৎ প্রাসাদে
হঠাৎ মহাসরীসৃপকে দ্যাখা যায়।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তুমি আমার মনে এলে।
বালুঘড়ি বিকল রাতের বেলা।
থেকে থেকে পড়ছে মনে
সে কোন ধূসর বেবিলনে
কবের গ্রীসের অলিভবনে
তোমার সাথে সূর্যতীরে
হয়েছিলো খেলা।জানি সবই ফুরিয়ে গেলে অতল সনাতনে
থেকে থেকে তাঁবা নদীর অতল উৎসারণে
জলদেবীর মতন জেগে জানিয়ে গেছ তুমি
চম্পা কনকবতী এখন সুধার মরুভূমি
মরুভূমি-মরীচিকা-মায়ামৃগের খেলা।তবুও আবার সূর্য নিয়ে এলো রজনী
আমার-তোমার-আধুনিকের
শতঘ্নী আঘাত
জননটের মতন নেচে-কবে
কী হারাল-সে কার মনে রবে
তোমার-আমার-
সে কার অবহেলা।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
সনেট
|
চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে — জামরুল হিজলের বনে;
তলতা বাঁশের ছিপ হাতে রবে — মাছ আমি ধরিব না কিছু; —
দীঘির জলের গন্ধে রূপালি চিতল আর রূপসীর পিছু
জামের গভীর পাতা — মাখা শান — নীল জলে খেলিছে গোপনে;
আনারস ঝোপে ওই মাছরাঙা তার মাছরাঙাটির মনে
অস্পষ্ট আলোয় যেন মুছে যায় — সিঁদুরের মতো রাঙা লিচু
ঝড়ে পড়ে পাতা ঘাসে, — চেয়ে দেখি কিশোরী করেছে মাথা নিচু —
এসেছে সে দুপুরের অবসরে জামরুল লিচু আহরণে —চলে যায়; নীলাম্বরী সরে যায় কোকিলের পাখনার মতো
ক্ষীরুয়ের শাখা ছুঁয়ে চালতার ডাল ছেড়ে বাঁশের পিছনে
কোনো দূর আকাঙ্খার ক্ষেতে মাঠে চলে যায় যেন অব্যহত,
যদি তার পিছে যাও দেখিবে সে আকন্দের করবীর বনে
ভোমরার ভয়ে ভীরু — বহু ক্ষণ পায়চারি করে আনমনে
তারপর চলে গেল : উড়ে গেল যেন নীল ভোমরার সনে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
একজন সামান্য মানুষকে দেখা যেতো রোজ
ছিপ হাতে চেয়ে আছে; ভোরের পুকুরে
চাপেলী পায়রাচাঁদা মৌরলা আছে;
উজ্জ্বল মাছের চেয়ে খানিকটা দূরেআমার হৃদয় থেকে সেই মানুষের ব্যবধান;
মনে হয়েছিলো এক হেমন্তের সকালবেলায়;
এমন হেমন্তের ঢের আমাদের গোল পৃথিবীতে
কেটে গেছে; তবুও আবার কেটে যায়।আমার বয়স আজ চল্লিশ বছর;
সে আজ নেই এ-পৃথিবীতে;
অথবা কুয়াশা ফেঁসে-ওপারে তাকালে
এ-রকম অঘ্রাণের শীতেসে-সব রূপোলি মাছ জ্ব’লে ওঠে রোদে,
ঘাসের ঘ্রাণের মতো স্নিগ্ধ সব জল;
অনেক বছর ধ’রে মাছের ভিতরে হেসে খেলে
তবু সে তাদের চেয়ে এক তিল অধিক সরল;এক বীট অধিক প্রবীণ ছিল আমাদের থেকে;
ওইখানে পায়চারি করে তার ভূত-
নদীর ভিতরে জলে তলতা বাশেঁর
প্রতিবিম্বের মতন নিখুঁতপ্রতিটি মাছের হাওয়া ফাল্গুনের আগে এসে দোলায় সে-সব।
আমাদের পাওয়ার ও পার্টি-পোলিটিক্স
জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরেক রকম শ্রীছাঁদ।
কমিটি মিটিং ভেঙে আকাশে তাকালে মনে পড়ে–
সে আর সপ্তমী তিথি চাঁদ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
রূপক
|
সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে।
একসাথে বিড়াল ও বিড়ালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে
এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার।
ইঁদুরকে খেতে-খেতে শাদা বিড়ালের ব্যবহার,
অথবা টুকরো হ’তে-হ’তে সেই ভারিক্কে ইঁদুর,
বৈকুন্ঠ ও নরকের থেকে তা’রা দুই জনে কতোখানি দূর
ভুলে গিয়ে আধো আলো অন্ধকারে হেঁচকা মাটির পৃথিবীতে
আরো কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে
কিছুটা সুবিধা ক’রে দিতে যেতো – মাটির দরের মতো রেটে;
তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেতো ব’লে বিড়ালের পেটে
ইঁদুর ‘হুর্রে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে-কেটে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
আজ রাতে শেষ হ'য়ে গেল শীত- তারপর কে যে এলো মাঠে-মাঠে খড়ে
হাঁস গাভী শাদা-প্লেট আকাশের নীল পথে যেন মৃদু মেঘের মতন,
ধানের সোনার ছড়া নাই মাঠে- ইঁদুর তবুও আর যাবে নাকো ঘরেতাহার রূপালি রোম একবার জ্যোৎস্নায় সচকিত ক'রে যায় মন,
হৃদয়ে আস্বাদ এলো ফড়িঙের- কীটেরও যে- ঘাস থেকে ঘাসে-ঘাসে তাই
নির্জন ব্যাঙের মুখে মাকড়ের জালে তারা বরং এ অধীর জীবনছেড়ে দেবে- তবু আজ জ্যোৎস্নায় সুখ ছাড়া সাধ ছাড়া আর কিছু নাই;
আছে নাকি আর কিছু? পাতা খড়কুটো দিয়ে যে-আগুন জ্বেলেছে হৃদয়
গভীর শীতের রাতে- ব্যথা কম পাবে ব'লে- সেই সমারোহ আর চাই?জীবন একাকী আজো- ব্যথা আজো- এখন করি না তবু বিয়োগের ভয়
এখন এসেছে প্রেম;- কার সাথে? কোন্ খানে? জানি নাকো;- তবু সে আমারে
মাঠে-মাঠে নিয়ে যায়- তারপর পৃথিবীর ঘাস পাতা ডিম নীড়ঃ সে এক বিস্ময়এ-শরীর রোগ নখ মুখ চুল- এ-জীবন ইহা যাহা ইহা যাহা নয়;
রঙিন কীটের মতো নিজের প্রাণের সাধে একরাত মাঠে জেগে রয়
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
রেনকোট কাঁধে রেখে শহরের রাস্তায় কত বার নেমেছি যে রাতে
কত যে গভীর রাত হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে
কেবল গিয়েছি চলে পিছল পথের থেকে আরো দূর অন্ধকার পথে
গলির ঘুঁজির ফাঁকে- ডাস্টবিন ইঁদুরের বিড়ালের আড়ষ্ট জগতে
কত যে গভীর রাতে রাতে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু গ্যাসপোস্টদের সাথে-হাইড্রেন্ট খুলে গিয়ে কুষ্ঠরোগী ধুয়েছে নীরবে ক্লেদ শরীরে তাহার
গ্যাসের আলোর দিকে চেয়ে আছে ঘোলা চোখ হিম কাঠ মৃতবৎসার
নেড়িকুকুরের ক্ষুধা পথ থেকে পথে মিটে যায় ট্যাক্সির নিচে
চেয়ে দেখি চূর্ণ তার দাঁত মুখ নিঃসহায় নক্ষত্রের দিকে আছে খিঁচে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-অবসন্ন ট্রাম বাস্ কলের পৃথিবী সব তখন গিয়েছে চলে ঘরে
তবুও মানুষ- সে যে কল নয়- পথ থেকে আরো দূর পথের ভিতরে
একা একা চলে যায়- যতদূর স্তব্ধ এই শহরের গ্যাসপোস্ট জ্বলে
কী যেন কিসের তরে হাঁটিয়াছি- হেঁটে হেঁটে একদিন ক্লান্ত হবো বলে
কত যে গভীর রাতে রাতে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-তবুও কোনো ক্লান্তি নাই- কী যে চাই গাঢরাতে মিনোটায় মিনারের পাশে
একেলা দাঁড়াই গিয়ে- নক্ষত্রেরা মুখোমুখি দাঁড়ায়েছে কঠিন আকাশে
বাতাসে ভাসিয়া আসে ধুলো খড় হিম হাওয়া একফোঁটা – আধফোঁটা জল
আমারে কে ডাকে যেন- কেউ নাই; হাওয়া শুধু কথা কয় কেমন বিহবল-
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-চুরুট জ্বালাই চুপে; এখন কত যে রাত- আকাশ ভরেছে ছেঁড়া মেঘে
সারা রাত জলে জলে ভিজে ফিরি…… প্রণয়িনী ডাহুকীর মতন আবেগে
কার সাথে প্রেম তবু? কে বা সেই? কারে আমি ভালোবাসি নক্ষত্রের তলে!
বেবিলনে তারে আমি দেখিয়াছি- আজো আর লাগি আমি ভিজি জলে জলে-
কত যে গভীর রাতে রাতে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
বহুদিন আমার এ-হৃদয়কে অবরোধ ক’রে র’য়ে গেছে;
হেমন্তের স্তব্ধতায় পুনরায় ক’রে অধিকার।
কোথায় বিদেশে যেন
এক তিল অধিক প্রবীণ এক নীলিমায় পারে
তাহাকে দেখিনি আমি ভালো ক’রে,- তবু মহিলার
মনন-নিবিড় প্রাণ কখন আমার চোখঠারে
চোখ রেখে ব’লে গিয়েছিলোঃ
‘সময়ের গ্রন্থি সনাতন, তবু সময়ও তা বে’ধে দিতে পারে?’
বিবর্ণ জড়িত এক ঘর;
কি ক’রে প্রাসাদ তাকে বলি আমি?
অনেক ফাটল নোনা আরসোলা কৃকলাস দেয়ালের ‘পর
ফ্রেমের ভিতরে ছবি খেয়ে ফেলে অনুরাধাপুর- ইলোরার;
মাতিসের- সেজানের- পিকাসোর,
অথবা কিসের ছবি? কিসের ছবির হাড়গোড়?
কেবল আধেক ছায়া-
ছায়ায় আশ্চর্য সব বৃত্তের পরিধির র’য়ে গেছে।
কেউ দেখে- কেউ তাহা দেখে নাকো- আমি দেখি নাই।
তবু তার অবলঙ কালো টেবিলের পাশে আধাআধি চাঁদনীর রাতে
মনে পড়ে আমিও বসেছি একদিন।
কোথাকার মহিলা সে? কবেকার?- ভারতী নর্ডিক গ্রীক মুশ্লিন মার্কিন?
অথবা সময় তাকে সনাক্ত করে না আর;
সর্বদাই তাকে ঘিরে আধো অন্ধকার;
চেয়ে থাকি,- তবুও সে পৃথিবীর ভাষা ছেড়ে পরিভাষাহীন।
মনে পড়ে সেখানে উঠোনে এক দেবদারু গাছ ছিলো।
তারপর সূর্যালোকে ফিরে এসে মনে হয় এইসব দেবদারু নয়।
সেইখানে তম্বুরার শব্দ ছিলো।
পৃথিবীতে দুন্দুভি বেজে ওঠে- বেজে ওঠে; সুর তান লয়
গান আছে পৃথিবীতে জানি, তবু গানের হৃদয় নেই।
একদিন রাত্রি এসে সকলের ঘুমের ভিতরে
আমাকে একাকী জেনে ডেকে নিলো- অন্য-এক ব্যবহারে
মাইলটাক দূরে পুরোপুরি।
সবই আছে- খুব কাছে; গোলকধাঁধার পথে ঘুরি
তবুও অনন্ত মাইল তারপর- কোথাও কিছুই নেই ব’লে।
অনেক আগের কথা এই সব- এই
সময় বৃত্তের মতো গোল ভেবে চুরুটের আস্ফোট জানুহীন, মলিন সমাজ
সেই দিকে অগ্রসর হয় রোজ- একদিন সেই দেশ পাবে।
সেই নারী নেই আর ভুলে তারা শতাব্দীর অন্ধকার ব্যসনে ফুরাবে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:
সারারাত গ্যাস লাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে।
কেউ ভুল করে নাকো-ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।
একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত-তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে;-মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
আর কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা?
চোখ নিচে নেমে যায়-চুরুট নীরবে জ্বলে-বাতাসে অনেক ধুলো খড়;
চোখ বুজে একপাশে সরে যাই-গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
মাঠ থেকে মাঠেমাঠে – সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশেআকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি,- নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে
আরেক আকাশ যেন,- সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর
কঠিন মেঘের থেকে ;- যেন দূর আলো ছেড়ে ধূম্র ক্লান্ত দিকহস্তিগণ
প’ড়ে গেছে;- প’ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের’পর
এইসব ত্যক্ত পাখি কয়েক মুহূর্ত শুধু;- আবার করিছে আরোহণ
আঁধার বিশাল ডানা পাম গাছে,- পাহাড়ের শিঙে শিঙে সমুদ্রের পারে ;
একবার পৃথিবীর শোভা দেখে,- বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন
বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দেখে তাই;- একবার স্নিগ্ধ মালাবারে
উড়ে যায়;- কোন এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন
পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চ’লে যায় যেন কোন মৃত্যুর ওপারে ;
যেন কোন বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ণ লেগুন
কেঁদে ওঠে ... চেয়ে দেখে কখন গভীর নীলে মিশে সেইসব হূন ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে,-মিশর-‘অসুর’ কুয়াশাকালো;
চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক,- মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
সে যে জানে কত পাথারের কথা,- কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জ্যোৎস্না, শুক্লাতিথি!
হয়তো সেদিনো আমাদেরি মতো পিলুবারোয়াঁর বাঁশিটি নিয়া
ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া!
হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে
চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে,- সবুজ চরায়,- সবজি ক্ষেতে!
হয়তো তাহার দুপুর- যামিনী বালুর জাজিমে সাগরতীরে
চাঁদের আলোয় দিগদিগন্তে চকোরের মতো চরিত ফিরে !
হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে
এম্নি কোন এক চাঁদের আলোয়,-মরু- ‘ওয়েসিসে’ তরুর মূলে!
বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহুদিনব্যাপী রণের শেষে
এম্নি কোন এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে!
কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া
হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া!
তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়- খড় পাতা উঠিত বাজি,
তাদের শিয়রে দুলিত জ্যোৎস্না- চাঁচর চিকন পত্ররাজি!
দখিনা উঠিত মর্মরি মধুবনানীর লতা-পল্লব ঘিরে,
চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া,-‘এল বল্লভ,-এল রে ফিরে!’
-তুমি ঢুলে যেতে, দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি,
নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি,-চাঁদিনী-শরাব,- সুরার শিশি!
সেদিনো এম্নি মেঘের আসরে জ্বলছে পরীর বাসরবাতি,
হয়তো সেদিনো ফুটেছে মোতিয়া,-ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাঁতি!
হয়তো সেদিনো নেশাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আঙুরবনে,
হয়তো সেদিনো আপেলের ফুল কেপেঁছে আঢুল হাওয়ার সনে!
হয়তো সেদিনো এলাচির বন আতরের শিশি দিয়েছে ঢেলে,
হয়তো আলেয়া গেছে ভিজা মাঠে এমনি ভূতুরে প্রদীপ জ্বেলে !
হয়তো সেদিনো ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া ‘সরো’র শাখে,
হয়তো সেদিনো পাড়ার নাগরী ফিরেছে এমনি গাগরি কাঁখে!
হয়তো সেদিনো পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাকাঁ ঢেউটি বেয়ে,
হয়তো সেদিনো মেঘের শকুনডানায় গেছিল আকাশ ছেয়ে!
হয়তো সেদিনো মানিকজোড়ের মরা পাখাটির ঠিকানা মেগে
অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্ফট্ দুটি পাখার বেগে!
হয়তো সেদিনো খুর খুর ক’রে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে
ঘন-মেহগিনি- টার্পিন- তলে- বালির জর্দা বিছানা ফুঁড়ে!
হয়তো সেদিনো জানালার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি
মনের হরিনী হেরেছে তোমারে-বনের পারের ডাগর শশী!
শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহরমের তোরণে গিয়া
পারাবত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়ো!
অলিভকুঞ্জে হা হা ক’রে হাওয়া কেঁদেছে কাতর যামিনী ভরি!
ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে ‘মার্টিল’ পাতা প’ড়েছে ঝরি!
‘উইলো’র বন উঠেছে ফুঁপায়ে,-‘ইউ’ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,
তরুনীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!
কোন্ গ্রীস,- কোন্ কার্থেজ, রোম, ‘ত্রুবেদু’র- যুগ কোন,-
চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর- সফরে বেড়ায় মন!
জানি না তো কিছু,-মনে হয় শুধু এম্নি তুহিন চাঁদের নিচে
কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হ’য়ে গেছে কত কী যে!
কত যে শ্মশান,-মশান কত যে,-কত যে কামনা- পিপাস-আশা
অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
আমরণ কেবলই বিপন্ন হয়ে চলে
তারপর যে বিপদ আসে
জানি
হৃদয়ঙ্গম করার জিনিস;
এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বালুচরে নদীটির জল ঝরে,
খেলে যায় সূর্যের ঝিলিক,
মাছরাঙা ঝিকমিক্ করে উড়ে যায়,
মৃত্যু আর করুণার দুটো তরোয়াল আড়াআড়ি
গ’ড়ে ভেঙে নিতে চায় এই সব সাঁকো ঘর বাড়ি;
নিজেদের নিশিত আকাশ ঘিরে থাকে।এ রকম হয়েছে অনেক দিন–রৌদ্রে বাতাসে;
যারা সব দেখেছিল–
যারা ভালোবেসেছিল এই সব–তারা
সময়ের সুবিধায় নিলেমে বিকিয়ে গেছে আজ।
তারা নেই।
এসো আমরা যে যার কাছে–যে যার যুগের কাছে সব
সত্য হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠি।
নব পৃথিবীকে পেতে সময় চলেছে?
হে আবাচী, হে উদীচী, কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোথাও সূর্যের ভোর রয়ে গেছে বলে মনে হয়!
মরণকে নয় শুধু–
মরণসিন্ধুর দিকে অগ্রসর হয়ে
যা-কিছু দেখার আছে
আমরাও দেখে গেছি;
ভুলে গেছ্ স্মরণে রেখেছি।
পৃথিবীর বালি রক্ত কালিমার কাছে তারপর
আমরা খারিজ হয়ে দোটানার
অন্ধকারে তবুও তো
চক্ষুস্থির রেখে
গণিকাকে দেখায়েছি ফাঁদ;
প্রেমিককে শেখায়েছি ফাঁকির কৌশল।
শেখাই নি?শতাব্দী আবেশে অস্তে চলে যায়;
বিপ্লবী কি স্বর্ণ জমায়।
আকন্ঠ মরণে ডুবে চিরদিন
প্রেমিক কি উপভোগ করে যায়
স্নিগ্ধ সার্থবাহদের ঋণ।
তবে এই অলক্ষিতে কোন্খানে জীবনের আশ্বাস রয়েছে।
আমরা অপেক্ষাতুর;
চাঁদের উঠার আগে কালো সাগরের
মাইলের পরে আরো অন্ধকার ডাইনি মাইলের
পড়ি দেওয়া পাখিদের মতো
নক্ষত্রের জোছনায় যোগান দিয়ে ভেসে
এ অনন্ত প্রতিপদে তবু
চাঁদ ভুলে উড়ে যাওয়া চাই
উড়ে যেতে চাই।পিছনের ঢেউগুলো প্রতারণা করে ভেসে গেছে;
সামনের অভিভূত অন্তহীন সমুদ্রের মতন এসেছে
লবণাক্ত পালকের ডানায় কাতর
জাপটার মতো ভেঙে বিশ্বাসহন্তার তো কেউ
সমুদ্রের অন্ধকার পথে পড়ে আছে
মৃত্যু আজীবন অগণন হল, তবু
এ রকমই হবে।‘কেবলই ব্যক্তির–ব্যক্তির মৃত্যু শেষ করে দিয়ে আজ
আমরাও মরে গেছি সব–‘
দলিলে না ম’রে তব এ রকম মৃত্যু অনুভব
ক’রে তারা হৃদয়বিহীন ভাবে ব্যাপ্ত ইতিহাস
সাঙ্গ করে দিতে চেয়ে যতদূর মানুষের প্রাণ
অতীতে ম্লানায়মান হয়ে গেছে সেই সীমা ঘিরে
জেগে ওঠে উনিশশো তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ, অনন্তের
অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রকৃতিমূলক
|
কত দিন ঘাসে আর মাঠে
আমার উৎসাহে প্রাণ কাটে
খড় খুঁটি—অশ্বথ্থের শুকনো পাতা চুপে উল্টাই
দু’একটা পোকা যদি পাই
আমারে চেনো না নাকি: আমি যে চড়াই।
কতদিন তোমাদের ভোরের উঠানে
দু’-একটা খই আর মুড়কির ঘ্রাণে
উড়ে আসি চুপে
দেখি কোনো রূপে
চাল ডাল ছোলা ক্ষুদ খুঁজে পাই কিনা
ঝুরঝুর ক’রে ফুল ফুরায় সজিনা
থুপ্ থুপ্ থুপ্ থুপ্—একাকী লাফাই
ঘুম নাই—চোখে ক্লান্তি নাই -
থুপ্ থুপ্ থুপীর মতন
দেখিনি কি করি আহরণ
চিনি মিঠাইয়ের গুঁড়ি—মিশ্রির কণা
ছাতু আটা…কলসীর পাশে বুঝি নাচিছে খঞ্জনা!
আকাশে কতটা রোদ
তোমাদের এত কি আমোদ।
ছোট ছোট ছেলে আর মেয়েদের দল
উঠানে কিসের এত ভিড়
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে—তোমাদের নরম শরীর
হাতে তবু পাটকেল—ঢিল ?
আমারে তাড়াও কেন? আমি বুঝি দাঁড়কাক চিল!
চীনেবাদামের খোসা শূন্য ঠোঙা এই শুধু চাই
আমি যে চড়াই।
যাই উড়ে যাই
জানালার পাশে
বোলতার চাক খুব বড়ো হয়ে আসে
হলদে বোলতা পাখি, ভাই
এসেছি চড়াই
এনেছি একটা কুটো আর এক খড়
এই নিয়ে ঘরের ভিতর
আমিও বানাবো এক ঘর
কি বলো তোমরা
ভাটের বনের থেকে এলে কি ভোমরা
মধু পেলে খুঁজে
সারাদিন একটুও ঘুমাইনি,—চোখ আসে বুজে
মাকড়শা, অন্ধকারে আছো তুমি মিশে
এখানে কার্ণিশে
আমারে ঘুমাতে দেবে ভাই
আমি যে চড়াই—
থাক ঘুম—যাই উড়ে যাই
আমি যে চড়াই।
ঘুম নাই—চোখে ক্লান্তি নাই
কাঠমল্লিকায়
কাঁঠালী শাখায়
করবীর বনে
হিজলের সনে
বেগুনের ভিড়ে
ঘাসের শরীরে
যাই—যাই—যাই
চাই—চাই—চাই
গাই—গাই—গাই
ঘুম নাই—নাই
আমি যে চড়াই।
তবু একদিন
যখন হলুদ তৃণ
ভ’রে আছে মাঠে
পাতায় শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দেখিলাম খানিকটা রোম
মাঠের কিনারে ঘাসে—নির্জন নরম
শিশিরে রয়েছে ডুবে—চোখ বুজে আছে
কেমন সহিষ্ণু ছায়া মুখের উপরে পড়িয়াছে
বহুক্ষণ আমারে থাকিতে বলে এইখানে
এই স্থির নীরবতা, এই করুণতা
মৃত্যুরে নিঃশেষ ক’রে দেয় নাকি: নক্ষত্রের সাথে কয় নাকি কথা ?
এর চেয়ে বেশি রূপ, বেশি রেখা, বেশি করুণতা
আর কে দেখাতে পারে
আকাশের নীল বুকে—অথবা এ ধুলোর আঁধারে।।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
বাতাবীলেবুর পাতা উড়ে যায় হাওয়ায়- প্রান্তরে,-
সার্সিতে ধীরে-ধীরে জলতরঙ্গের শব্দ বাজে;
একমুঠো উড়ন্ত ধূলোয় আজ সময়ের আস্ফোট রয়েছে;
না হ'লে কিছুই নেই লবেজান লড়ায়ে জাহাজে।
বাইরে রৌদ্রের ঋতু বছরের মতো আজ ফুরায়ে গিয়েছে;
হোক-না তা; প্রকৃতি নিজের মনোভাব নিয়ে অতীব প্রবীণ;
হিসেব বিষণ্ণ সত্য র'য়ে গেছে তার;
এবং নির্মল ভিটামিন।
সময় উচ্ছিন্ন হ'য়ে কেটে গেলে আমাদের পুরোনো প্রহের
জীবনস্পন্দন তার রূপ নিতে দেরি ক'রে ফেলে,-
জেনে নিয়ে যে যাহার স্বজনের কাজ করে না কি-
পরার্থের কথা ভেবে ভালো লেগে গেলে।
মানুষেরি ভয়াবহ স্বাভাবিকতার সুর পৃথিবী ঘুরায়;
মাটির তরঙ্গ তার দু-পায়ের নিচে
আধোমুখে ধ্বসে যায়;- চারিদিকে কামাতুর ব্যাক্তিরা বলেঃ
এ-রকম রিপু চরিতার্থ ক'রে বেঁচে থাকা মিছে।
কোথাও নবীন আশা র'য়ে গেছে ভেবে
নীলিমার অনুকল্পে আজ যারা সয়েছে বিমান,-
কোনো এক তনুবাত শিখরের প্রশান্তির পথে
মানুষের ভবিষ্যৎ নেই- এই জ্ঞান
পেয়ে গেছে; চারিদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন নেশন প'ড়ে আছে;
সময় কাটায়ে গেছে মোহ ঘোচাবার
আশা নিয়ে মঞ্জুভাষা, দোরিয়ান গ্রীস,
চীনের দেয়াল, পীঠ, পেপিরাস, কারারা-পেপার।
তাহারা মরেনি তবু;- ফেনশীর্ষ সাগরের ডুবুরির মতো
চোখ বুজে অন্ধকার থেকে কথা-কাহিনীর দেশে উঠে আসে;
যত যুগ কেটে যায় চেয়ে দেখে সাগরের নীল মুরুভূমি
মিশে আছে নীলিমার সীমাহীন ভ্রান্তিবিলাসে।
ক্ষতবিক্ষত জীব মর্মস্পর্শে এলে গেলে- তবুও হেঁয়ালি;
অবশেষে মানবের স্বাভাবিক সূর্যালোকে গিয়ে
উত্তীর্ণ হয়েছে ভেবে- ঊনিশশো বিয়াল্লিশ সাল।
'তেতাল্লিশ' পঞ্চাশের দিগন্তরে পড়েছে বিছিয়ে।
মাটির নিঃশেষ সত্য দিয়ে গড়া হয়েছিলো মানুষের শরীরের ধুলোঃ
তবুও হৃদয় তার অধিক গভীরভাবে হ'তে চায় সৎ;
ভাষা তার জ্ঞান চায়, জ্ঞান তার প্রেম,- ঢের সমুদ্রের বালি
পাতালের কালি ঝেড়ে হ'য়ে পড়ে বিষণ্ণ, মহৎ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি!
পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনিবে ডাকি?
উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে,
গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে;
নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী,
ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহপ্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি!
কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে,
ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণচিহ্ন বিনে!
যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে,
কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে
তারই প্রতীক্ষা মেগে ব'সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু!
দিকে দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরিচূড়া-তরু
ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে
কালো মৃত্তিকা ঝরা কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে
ছড়ায়ে পড়িছে দিগ্দিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি!
বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি
লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস!
ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস
নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে
বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে!
তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে,
তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দরমূলে।
ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল'য়ে কলরব ক'রে ছুটে
নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে।
তারই লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা,
তাহারই লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা!
চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে
ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে!
যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,
চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল,
-তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সীঁথি,
তার চেয়ে ভালো আলো-ঝল্মল্ শীতল শিশিরবীথি,
তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,
তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!
কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে!
মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে
আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে,
মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
তুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে-অতীত আর
যেই শীত ক্লান্তিহীন কাটায়েছিলাম;
তাই শুধু কাটায়েছি।
কাটায়ে জানেছি এই-ই শূন্যে, তবু হৃদয়ের কাছে ছিল অন্য-কোন নাম।
অন্তহীন অপেক্ষার চেয়ে তবে ভালো
দ্বীপাতীত লক্ষ্যে অবিরাম চ’লে যাওয়া
শোককে স্বীকার ক’রে অবশেষে তবে
নিমেষের শরীরের উজ্জলতায়-অনন্তের জ্ঞানপাপ মুছে দিতে হবে।
আজ এই ধ্বংসমত্ত অন্ধকার ভেদ ক’রে বিদ্যুতের মতো
তুমি যে শরীর নিয়ে র’য়ে গেছো, সেই কথা সময়ের মনে
জানাবার আশার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে
একটি পলক শুধু- হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে?
অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষ মানুষ?-
ভাবি আমি;- জানি আমি,তবু
সে-কথা আমাকে জানাবার
হৃদয় আমার নেই;-
যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার
দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে
একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিষ্ক জগতে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন
আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপন!
নিরালায় সুর সাধি,- বাঁধি মোর মানসীর বেণী,
মানুষ দেখেনি মোরে কোনোদিন,- আমারে চেনেনি!
কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায়নি মোর চারিপাশে,-
শুধায়নি কেহ কভু-‘আসে কি রে,- সে কি আসে-আসে!’
আসেনি সে ভরাহাটে-খয়াঘাটে-পৃথিবীর পসরায় মাঝে,
পাটনী দেখেনি তারে কোনোদিন,মাঝি তারে ডাকেনিকো সাঁঝে!
পারাপার করেনি সে মণিরত্ন-বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,-
চেনা চেনা মুখ সবি,-সে যে সুদূর-অজানা!
করবীকুঁড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে,
রূপ-সাগরের মাঝে কোন্ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে!
সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিলমিল শিশিরের জলে;
খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে,
বাবলার ফুলে ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতি-পাখা,
ননীর আঙুলে তার কেঁপে ওঠে কচি নোনাশাখা!
হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে
বকবধূটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!
হয়তো শুনেছ তারে,-তার সুর,- দুপুর- আকাশে
ঝরাপাতা-ভরা মরা দরিয়ার পাশে
বেজেছে ঘুঘুর মুখে,- জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়
হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পূবালি হাওয়ায়!
হয়তো দেখেছ তারে ভুতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের’পরে
নিভে- যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সুর যেন ঝরে!
শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় যেই জ্যোৎস্না ভাসে
তারি বুকে চুপে চুপে কবি আসে,- সুর তার আসে।
উস্খুস্ এলোচুলে ভ’রে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,-
তারি পাশে সুর ভাসে,- অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি!
বালুঘড়িটির বুকে ঝিরিঝিরি ঝিরিঝিরি গান যবে বাজে
রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে,- অকাজে!
ঘুম-কুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ
যখন ঘুমায়ে থাকে টুনটুনি,- মধুমাছি,-ঘাস,
হাওয়ার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকী ঝাড়ে,
বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মেঘের আঁধারে,
তেঁতুলের শাখে-শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে,
মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে!
জোনাকির মতো সে যে দূরে দূরে যায় উড়ে উড়ে-
আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে !
জ্ব’লে ওঠে আলোয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি।
আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন্ পাষাণী!
জানে না তো কী যে চায়,- কবে হায় কী গেছে হারায়ে।
চোখ বুজে খোঁজে একা,-হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে
কারে আহা।-কাঁদে হা হা পুরের বাতাস,
শ্মশানশবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস!
তারি লাগি মুখ তোলে কোন মৃতা,-হিম চিতা জ্বেলে দেয় শিখা,
তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়া-পুত্তলিকা!
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
সমুদ্রচিলের সাথে আজ এই রৌদ্রের প্রভাতে
কথা ব’লে দেখিয়াছি আমি;
একবার পাহাড়ের কাছে আসে,
চকিতে সিন্ধুর দিকে যেতেছে সে নামি;
হামাগুড়ি দিয়ে ভাসে ফেনার উপরে,
মুছে যায় তরঙ্গের ঝড়ে।
দাঁড়ায়েছি শতাব্দীর ধুলো কাঁচ হাতে।।তরঙ্গের তারা খেয়ে চ'লে যায় আরো দূর তরঙ্গের পানে-
ফেনার কান্তারে
বৃষ্টির প্রথম রোদ যেইখানে
তাহার সোনালি ডানা ঝাড়ে;
যেখানে আকাশ নীল কোলাহলময়,
সমুদ্রের করিছে দূর সমুদ্র সঞ্চয়,
দিগন্ত হারায়ে যায় দিগন্তের প্রাণে।।চঞ্চল ধবল বুকে নাচিতেছে ফেনার আঙুল;
ধানের শিষের মত দু'পায়ের শিরা
নাচিছে স্পানিশ টাঙ্গো নীল ঢেউয়ে;
হৃদয় করিছে পাম মালাবার হাওয়ার মদিরা;
ট্রম্ ট্রম্- ট্রাম্ ট্রাম্- ড্রামের মতন
শৈলে শৈলে সমুদ্রের রুক্ষ আন্দোলন;
রৌদ্রে রৌদ্রে ঝলসায় ঝিনুকের ফুল।।বিজ্ঞান কি মস্তিষ্কের বাক্সের মতন একাকী?
তোমার শরীরে জল- দ্রাক্ষার আঘ্রাণ;
তোমার হৃদয়ে পেকে ঝরিতেছে রৌদ্রের ক্ষেত
জাগিতেছে নব নব শস্যের সন্তান;
আমরা বন্দরে ফিরি- জনতায়- ঘূর্ণিস্রোতে কুকুরের মুণ্ডে
লোল আঁখি
পাবে নাকি লেজ তার? হো-হো- পাবে নাকি!
পাবে নাকি লেজ খুঁজে কুকুরের মত লোল আঁখি।। ছেড়ে দিয়ে উত্তরের বাতাসের প্রাণে
জন্মেছে তোমার্ডানা- জেগেছে হৃদয়;
সহস্র শতাব্দী গিঁট কাটায়েছি পথ আর ঘরের আঘ্রাণে-
আনন্দের পাইনিক' তবু পরিচয়;
জন্মেনি ধবল ডানা বিজ্ঞানের অগ্রসর চিরি
ভেঙ্গে গেছে আকাশের- নক্ষত্রের সিঁড়ি,
উৎসব খুঁজেছি রাতবিরেতের গানে।। পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়ায়েছি মনোবীজ, আহা,
আকাঙ্ক্ষার নিঃসঙ্গ সন্তান;
আথবা ঘাসের দেহে শুয়ে শুয়ে কুয়াশায়
শুনেছি ঝরিতে আছে ধান;
অথবা সন্ধ্যার নীল জনালায়
অদৃশ্য কোকিল এসে গায়
এইসব বেদনার কর্কশ-রেডিয়ামে সারেনাক' তাহা।।মাঝে মাঝে একবার ধরা দেই নক্ষত্রের হাতে
চ'লে আসি সমুদ্রের পাশে;
যে ক্ষেত ফুরাতে আছে- ফুরাইয়ে গেছে
তার তৃষ্ণা মিটিছে আকাশে;
চেয়ে দেখি সেই নীল আকাশের ছবি;
সমুদ্রের অজান্তব জানালার গল্পের সুরভি;
রৌদ্রের ডানার ভেসে সেইখানে পৃথিবী হারাতে
চাই আমি; সমুদ্রচিলের খেলা তুলে নিয়ে হাতে।। ।।২।।
রঙিন বিস্তৃত রৌদ্রে প্রাণ তার করিছে বিলাস;
কোনদিন ধানক্ষেতে পৃথিবীর কৃষকের প্রাণ
এই রৌদ্র পায় নাই,- জলপাই পল্লবের ফল,
জ্যৈষ্ঠের দুপুরে মাছি যে উল্লাসে গেয়ে গেছে গান,
কুমারী কোমল ঘাড় নুয়ে চুপে যেই পক্ক রৌদ্রে বেণী করিছে বিন্যাস,
নীল হয়ে বিছায়েছে পৃথিবীর মধুকূপী ঘাস,
তরমুজ ক্ষেতে শুয়ে স্বপন দেখেছে চৈত্রমাস,
তার চেয়ে আরো দামী গাঢ় মদে প্রাণ তার করিছে বিলাস।। পৃথিবীতে যেই রূপ কোনদিন দেখে নাই কেউঃ
সিংহলের হীরা রত্ন নারী লুটে নাবিকের দল
ভারত সমুদ্রে নেমে নক্ষত্রের রজনীতে
তারপর ভোরবেলা দেখেছিল স্ফটিকের মত যেই জল;
তরঙ্গের পর ঘন তরঙ্গের মধু আর দুধ,
মেঘের গোলাপী মুখ- রৌদ্রের বুদ্বুদ;
তবু তারা দেখে নাই পুরুভুজ-বিছানায় নূপুর বাজায়ে নীচে ঢেউ
বারুণির জানালায়ঃ সিন্ধুচিল- মক্ষিকারা ছাড়া তাহা কেউ জানে নাক কেউ।। ধ্বনিত ঢেউয়ের অগ্নি বয়ঃসন্ধি-দিবসের স্তন হয়ে রক্তে নেমে আসে!
তরঙ্গের উষ্ণ নীল তরমুজ ক্ষেতে
আমারে খুঁজিয়া পায় মৃত্যু যেনঃ
বিস্তৃতির পথে যেতে-যেতে
সমস্ত পৃথিবী যেন মিশে যায় রৌদ্রের সাগরে;
সিন্ধুচিল আর তার বনিতা যেখানে খেলা করেঃ
মরণ আমারে যেন পায় সেই দারুচিনি হাওয়ার আশ্বাসে।।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অনেক পুরোনো দিন থেকে উঠে নতুন শহরে
আমি আজ দাঁড়ালাম এসে।
চোখের পলকে তবউ বোঝা গেল জনতাগভীর তিথি আজ;
কোনো ব্যতিক্রম নেই মানুষবিশেষে।
এখানে রয়েছে ভোর,- নদীর সমস্ত প্রীত জল;-
কবের মনের ব্যবহারে তবু হাত বাড়াতেই
দেখা গেল স্বাভাবিক ধারণার মতন সকাল-
অথবা তোমার মতন নারী আর নেই।
তবুও রয়েছে সব নিজেদের আবিস্ট নিয়মে
সময়ের কাছে সত্য হ’য়ে,
কেউ যেন নিকটেই র’য়ে গেছে ব’লে;-
এই বোধ ভোর থেকে জেগেছে হৃদয়ে।
আগাগোড়া নগরীর দিকে চেয়ে থাকি;
অতীব জটিল ব’লে মনে হ’লো প্রথম আঘাতে;
সে-রীতির মতো এই স্থান যেন নয়ঃ
সেই দেশ বহুদিন সয়েছিলো ধাতে
জ্ঞান মানমন্দিরের পথে ঘুরে বই হাতে নিয়ে;
তারপর আজকের লোক সাধারণ রাতদিন চর্চা ক’রে,
মনে হয় নগরীর শিয়রের অনিরুদ্ধ ঊষা সূর্য চাঁদ
কালের চাকায় সব আর্ষপ্রায়োগের মতো ঘোরে।
কেমন উচ্চিন্ন শব্দ বেজে ওঠে আকাশের থেকে;
মনে বুঝে নিতে গিয়ে তবুও ব্যাহত হয় মন;
একদিন হবে তবু এরোপ্লেনের-
আমাদেরো শ্রুতিবিশোধন।
দূর থেকে প্রপেলার সময়ের দৈনিক স্পন্দনে
নিজের গুরুত্ব বুঝে হ’তে চায় আরো সাময়িক;
রৌদ্রের ভিতরে ওই বিচ্ছুরিত এলুমিনিয়ম
আকাশ মাটির মধ্যবর্তিনীর মতো যেন ঠিক।
ক্রমে শীত, স্বাভাবিক ধারণার মতো এই নিচের নগরী
আরো কাছে প্রতিভাত হয়ে আসে চোখে;
সকল দুরুহ বস্তু সময়ের অধীনতা মেনে
মানুষ ও মানুষের মৃত্যু হয়ে সহজ আলোকে
দেখা দেয় ;- সর্বদাই মরণের অতীব প্রসার,-
জেনে কেউ অভ্যাসবশত তবু দু’চারটে জীবনের কথা
ব্যবহার ক’রে নিতে গিয়ে দেখে অলক্লিয়ারেরও চেয়ে বেশি
প্রত্যাশায় ব্যপ্তকাল ভোলেনি প্রাণের একাগ্রতা।
আশা-নিরাশার থেকে মানুষের সংগ্রামের জন্মজন্মান্তর-
প্রিয়দের প্রাণে তবু অবিনাশ, তমোনাশ আভা নিয়ে এসে
স্বাভাবিক মনে হয়ঃ উর ময় লন্ডনের আলো ক্রেমলিনে
না থেমে অভিজ্ঞভাবে চ’লে যায় প্রিয়তর দেশে।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
কেউ যাহা জানে নাই – কোনো এক বাণী –
আমি বহে আনি ;
একদিন শুনেছ যে- সুর-
ফুরায়েছে,- পুরানো তা – কোনো এক নতুন-কিছুর
আছে প্রয়োজন ,
তাই আমি আসিয়াছি,- আমার মতন
আর নাই কেউ !
সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ
আজিকার ;- শেষ মুহূর্তের
আমি এক;- সকলের পায়ের শব্দের
সুর গেছে অন্ধকারে থেমে;
তারপর আসিয়াছি নেমে
আমি;
আমার পায়ের শব্দ শোনো ,-
নতুন এ – আর সব হারানো- পুরানো ।
উৎসবের কথা আমি কহি নাকো ,
পড়ি নাকো দুর্দশার গান,
যে কবির প্রাণ
উৎসাহে উঠেছে শুধু ভরে ,-
সেই কবি- সে –ও যাবে স’রে;
যে কবি পেয়েছে শুধু যন্ত্রণার বিষ
শুধু জেনেছে বিষাদ ,
মাটি আর রক্তের কর্কশ স্বাদ ,
যে বুঝেছে ,- প্রলাপের ঘোরে
যে বকেছে,- সে- ও যাবে স’রে ;
একে- একে সবি
ডুবে যাবে; - উৎসবের কবি,
তবু বলিতে কি পারো
যাতনা পাবে না কেউ আরো ?
যেই দিন তুমি যাবে চ’লে
পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে ?
কিংবা যদি গায় ,- পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে
একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার ?
আনন্দের আবর্তনে আজিকে আবার
সেদিনের পুরানো আঘাত
ভুলিবে সে? ব্যথা যারা স’য়ে গেছে রাত্রি – দিন
তাহাদের আর্ত ডান হাত
ঘুম ভেঙে জানবে নিষেধ ;
সব ক্লেশ আনন্দের ভেদ
ভুল মনে হবে;
সৃষ্টির বুকের’পরে ব্যথা লেগে রবে,
শয়তানের সুন্দর কপালে
পাপের ছাপের মত সেই দিনও !-
মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে,
রোগা পায়ে করে পায়চারি,
দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি
সৃষ্টির দেয়ালে ,-
আহ্লাদ কি পায় নাই তারা কোনোকালে ?
যেই উড়ো উৎসাহের উৎসবের রব
ভেসে আসে – তাই শুনে জাগেনি উতসব ?
তবে কেন বিহ্বলের গান
গায় তারা!- বলে কেন, আমাদের প্রাণ
পথের আহত
মাছিদের মতো !
উৎসবের কথা আমি কহি নাকো ,
পড়ি নাকো ব্যর্থতার গান;
শুনি শুধু সৃষ্টির আহ্বান ,-
তাই আসি,
নানা কাজ তার
আমরা মিটায়ে যাই ,-
জাগিবার কাল আছে- দরকার আছে ঘুমাবার ;-
এই সচ্ছলতা
আমাদের ;- আকাশ কহিছে কোন কথা
নক্ষত্রের কান্র?-
আনন্দের? দুর্দশার ? – পড়ি নাকো । সৃষ্টির আহ্বানে আসিয়াছি ।
সময় সিন্ধুর মতো :
তুমিও আমার মতো সমুদ্রের পানে , জানি, রয়েছ তাকায়ে ,
ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে ,-
ঘুম ভেঙে যায় বার-বার
তোমার – আমার !
জানি না তো কোন কথা কও তুমি ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে ,
ওপারের থেকে ;
সমুদ্রের কানে
কোন কথা কই আমি এই পারে – সে কি কিছু জানে?
আমিও তোমার মতো রাতের সিন্ধুর দিকে রয়েছি তাকায়ে ,
ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে ,-
ঘুম ভেঙে যায় বার-বার
তোমার আমার ।
কোথাও রয়েছ , জানি,- তোমারে তবুও আমি ফেলেছি হারায়ে;
পথ চলি- ঢেউ ভেজে পায়ে ;
রাতের বাতাস ভেসে আসে ,
নক্ষত্রের’পরে
এই হাওয়া যেন হা-হা করে !
হু-হু ক’রে ওঠে অন্ধকার !
কন রাত্রি – আঁধারের পার
আজ সে খুঁজিছে !
কত রাত ঝ’রে গেছে,- নিচে-তারো নিচে
কোন রাত – কোন অন্ধকার
একবার এসেছিল ,- আসিবে না আর ।
তুমি এই রাতের বাতাস,
বাতাসের সিন্ধু- ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর !
অন্ধকার- নিঃসাড়তার
মাঝখানে
তুমি আনো প্রাণে
সমুদ্রের ভাষা ,
রুধিরে পিপাসা
যেতেছ জাগায়ে ,
ছেঁড়া দেহে – ব্যথিত মনের ঘায়ে
ঝরিতেছ জলের মতন ,-
রাতের বাতাসে তুমি ,- বাতাসের সিন্ধু- ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর ।
গান গায় যেখানে সাগর তার জলের উল্লাসে ,
সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে
যেখানে সমস্ত রাত ভ’রে ,
নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে
যেইখানে ,
পৃথিবীর কানে
শস্য গায় গান ,
সোনার মতন ধান
ফ’লে ওঠে যেইখানে ,-
একদিন- হয়তো – কে জানে
তুমি আর আমি
ঠাণ্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে থামি
সেইখানে রবো প’ড়ে !-
যেখানে সমস্ত রাত্রি নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে
সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে ,
গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে ।
ঘুমাতে চাও কি তুমি ?
অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই ?-
ঢেউয়ের গানের শব্দ
সেখানে ফেনার গন্ধ নাই ?
কেহ নাই ,- আঙুলের হাতের পরশ
সেইখানে নাই আর ,-
রূপ যেই স্বপ্ন আনে ,- স্বপ্ন বুকে জাগায় যে- রস
সেইখানে নাই তাহা কিছু ;
ঢেউয়ের গানের শব্দ
যেখানে ফেনার গন্ধ নাই –
ঘুমাতে চাও কি তুমি ?
সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই !
তোমারে পাব কি আমি কোনোদিন ? – নক্ষত্রের তলে
অনেক চলার পথ, - সমুদ্রের জলে
গানের অনেক সুর – গানের অনেক সুর বাজে ,-
ফুরাবে এ- সব তবু আমি যেই কাজে
ব্যস্ত আজ – ফুরাবে না , জানি ;
একদিন তবু তুমি আমার আঁচলখানি
টেনে লবে ; যেটুকু করার ছিল সেই দিন হয়ে গেছে শেষ ,
আমার এ সমুদ্রের দেশ
হয়তো হয়েছে স্তব্ধ সেই দিন , - আমার এ নক্ষত্রের রাত
হয়তো সরিয়া গেছে – তবু তুমি আসিবে হঠাৎ ;
গানের অনেক সুর – গানের অনেক সুর সমুদ্রের জলে ,
অনেক চলার পথে নক্ষত্রের তলে !
আমার নিকট থেকে ,
তোমারে নিয়েছে কেটে কখন সময় !
চাঁদ জেগে রয়
তারা-ভরা আকাশের তলে ,
জীবন সবুজ হয়ে ফলে ,
শিশিরের শব্দে গান গায়
অন্ধকার,- আবেগ জানায়
রাতের বাতাস !
মাটি ধুলো কাজ করে ,- মাঠে –মাঠে ঘাস
নিবিড় – গভীর হয়ে ফলে !
তারা-ভরা আকাশের তলে
চাঁদ তার আকাঙ্ক্ষার স্থল খুঁজে লয় ,-
আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে যদিও সময় ।
একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা ,
ভুলে গেছ আজ তার ভাষা !
জানি আমি ,- তাই
আমিও ভুলিয়া যেতে চাই
একদিন পেয়েছি যে ভালোবাসা
তার স্মৃতি – আর তার ভাষা ;
পৃথিবীতে যত ক্লান্তি আছে ,
একবার কাছে এসে আসিতে চায় না আর কাছে
যে- মুহূর্ত ;-
একবার হয়ে গেছে , তাই যাহা গিয়েছে ফুরায়ে
একবার হেঁটেছে যে ,- তাই যার পায়ে
চলিবার শক্তি আর নাই ;
সবচেয়ে শীত ,- তৃপ্ত তাই ।
কেন আমি গান গাই ?
কেন এই ভাষা
বলি আমি ! – এমন পিপাসা
বার-বার কেন জাগে !
প’ড়ে আছে যতটা সময়
এমনি তো হয় ।
|
জীবনানন্দ দাশ
|
চিন্তামূলক
|
অনেক সংকল্প আশা নিভে মুছে গেল;
হয়তো এমনই শুরু হবে।
আজকের অবস্থান ফুরিয়ে যাবে কি
নতুন ব্যাপ্তির অনুভবে।
মানুষ এ পৃথিবীতে ঢের দিন আছে;
সময়ের পথে ছায়া লীন
হয়নি এখনও তার, তবুও সে মরুর ভিতরে
একটি বৃক্ষের মত যেন যুক্তিহীন;
সফলতা অন্বেষণ ক’রে
হারিয়ে ফেলেছে প্রাণ, নিকেতন, জল;
প্রেম নেই, শূন্যলোকে সত্য-লাভ তার
অর্ধসত্য অসত্যের মতন নিস্ফল।
ভুলের ভিতর থেকে ভুলে
গ্লানির ভিতর থেকে গ্লানির ভিতরে
মানুষ যে গ্রহণের সূর্যে চলেছে
তা; তবে শাশ্বত গ্রহণ সৃষ্টি করে!কাব্যগ্রন্থ - আলোপৃথিবী
|
জীবনানন্দ দাশ
|
প্রেমমূলক
|
বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়,-
মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়!
ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে,-
সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের লোভে
বনের চাতক-মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!
পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে!
কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে!
বাদল-বৌয়ের চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে
বনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে,
ঘাটের ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!
ওরে চাতক,-বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে
নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে,
‘দে জল!’ ব’লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল
খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে ছল্ছল্ !
মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!
বনের চাতক,- হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি
কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি ছাড়ি?
ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে,
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে!
আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, আয় রে তাড়াতাড়ি।
বনের চাতক,,-মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
সে-কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
চিন্তামূলক
|
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা —
স্তব্ ধ শুধু চলায় কথা বলা —
আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভ’রে রাখুক,
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক ||
ভয় করে তাই আজ সরিয়ে দিতে
কাউকে, ওকে চাইনে দুঃখ দিতে |
কে জানে প্রাণ আনলো কেন ওর পরিচয় কিছু,
গাছের তলায় হাওয়ার ভোরে কোথায় চলে নিচু —
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে সেই অতলে ডাকুক |
মাটির বুকে যারাই আছি এই দুদিনের ঘরে
তার স্মরণে সবাইকে আজ ঘিরেছে আদরে ||
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
চিন্তামূলক
|
তার বদলে পেলে—
সমস্ত ঐ স্তব্ ধ পুকুর
নীল-বাঁধানো স্বচ্ছ মুকুর
আলোয় ভরা জল—
ফুলে নোয়ানো ছায়া-ডালটা
বেগনি মেঘের ওড়া পালটা
ভরলো হৃদয়তল—
একলা বুকে সবই মেলে ||তার বদলে পেলে—
শাদা ভাবনা কিছুই-না-এর
খোলা রাস্তা ধুলো-পায়ের
কান্না-হারা হাওয়া—
চেনা কণ্ঠে ডাকলো দূরে
সব-হারানো এই দুপুরে
ফিরে কেউ-না-চাওয়া |
এও কি রেখে গেলে ||
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
রূপক
|
অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাত্ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না,
দেখি তুমি নেই ||
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
চিন্তামূলক
|
তালিকা প্রস্তুত
কী কী কেড়ে নিতে পারবে না-
হই না নির্বাসিত-কেরানি।
বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।
যার এক খন্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।
যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,
হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।
কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি
গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।
আপন জনকে ভালোবাসা,
বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।
তাড়াও সংসার, রাখলাম,
বুকে ঢাকলাম
জন্মজন্মান্তরের তৃপ্তি যার যোগ প্রাচীন গাছের ছায়ায়
তুলসী-মন্ডপে, নদীর পোড়ো দেউলে, আপন ভাষার কন্ঠের মায়ায়।
থার্ডক্লাসের ট্রেনে যেতে জানলায় চাওয়া,
ধানের মাড়াই, কলা গাছ, কুকুর, খিড়কি-পথ ঘাসে ছাওয়া।
মেঘ করেছে, দু-পাশে ডোবা, সবুজ পানার ডোবা,
সুন্দরফুল কচুরিপানার শঙ্কিত শোভা,
গঙ্গার ভরা জল; ছোটো নদী; গাঁয়ের নিমছায়াতীর-
হায়, এও তো ফেরা-ট্রেনের কথা।
শত শতাব্দীর
তরু বনশ্রী
নির্জন মনশ্রী :
তোমায় শোনাই, উপস্থিত ফর্দে আরো আছে-
দূর-সংসারে এলো কাছে
বাঁচবার সার্থকতা।।
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
রূপক
|
সাক্ষাত্ সন্ধান পেয়েছ কি ৩-টে ২৫-শে?
বিকেলের উইলো বনে রেড্ এরো ট্রেনের হুইসিল
শব্ দ শেষ ছুঁয়ে গাঁথে দূর শূণ্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল ;
মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেলো মিশে ||
অবসান গেল মিশে ||
মাথা নাড়ে ‘জানি’ ‘জানি’ ক্যাথলিক গির্জাচুড়া স্থির,
পুরোনো রোদ্দুরে ওড়া কাকের কাকলি পাখা ভিড় ;
অন্যমনস্ক মস্ত শহরে হঠাত্ কুয়াশায়
ইস্পাতি রেলের ধারে হুহু শীত-হাওয়া ট’লে যায়||
শীত হাওয়া ট’লে যায় ||
হৃত্পিণ্ডে রক্তের ধ্বনিযেখানে মনের শিরা ছিঁড়ে
যাত্রী চ’লে গেল পথে কোটি ওক্লাহোমা পারে লীন,
রক্ত ক্রুশে বিদ্ধ ক্ষণে গির্জে জ্বলে রাঙা সে-তিমিরে—
বিচ্ছেদের কল্পান্তরে প্রশ্ন ফিরে আসে চিরদিন ||
ফিরে আসে চির দিন ||
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
চিন্তামূলক
|
গেলো
গুরুচরণ কামার, দোকানটা তার মামার,
হাতুড়ি আর হাপর ধারের ( জানা ছিল আমার )
দেহটা নিজস্ব |
রাম নাম সত্ হ্যায়
গৌর বসাকের প’ড়ে রইল ভরন্ত খেত খামার|
রাম নাম সত্ হ্যায় ||
দু-চার পিপে জমিয়ে নস্য হঠাত্ ভোরে হ’লো অদৃশ্য—
ধরনটা তার খ্যাপারই—
হরেকৃষ্ণ ব্যাপারি |
রাম নাম সত্ হ্যায়
ছাই মেখে চোখ শূণ্যে থুয়ে, পেরেকের খাট তাতে শুয়ে
পলাতক সেই বিধুর স্বামী
আরো অপার্থিবের গামী
রাম নাম সত্ হ্যায়
রান্না রেঁধেকান্না কেঁদে, সকলেরপ্রাণে প্রাণে বেঁধে
দিদি ঠাকরুন গেলেন চ’লে—
খিড়কি দুয়োর শূণ্যে খোলে!
রাম নাম সত্ হ্যায়
আমরা কাজে রই নিযুক্ত, কেউ কেরানি কেউ অভুক্ত,
লাঙল চালাই কলম ঠেলি, যখন তখন শুনে ফেলি
রাম নাম সত্ হ্যায়
শুনবো না আর যখন কানে বাজবে তবু এই এখানে
রাম নাম সত্ হ্যায় ||
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
মানবতাবাদী
|
হাত থেকে তার পড়ে যায় খসে
অবশ্য আধলা ধুলোয়।
চোখ ঠেলে খোলা অসাড় শূন্যে।
প্রাণ, তুমি আজো আছ ঐ দেহে,
আছ মুমূর্ষু দেশে।
কঙ্কাল গাছ ভাদ্রশেষের ভিখারী ডালটা নাড়ে,
কড়া রোদ্দুর প্রখর দুপুরে ফাটে।
হাতের আঙুলে স্নেহ দিয়েছিলে
চোখে চেনা জাদু আপন ঘরের বুকে –
বাঙলার মেয়ে, এসে ছিল তার জীবনের দাবি নিয়ে,
দুদিনের দাবি ফলন্ত মাঠে, চলন্ত সংসারে;
কতটুকু ঘেরে কত দান ফিরে দিতে।
সামান্য কাজে আশ্চর্য খুশি ভরা।
আজ শহরের পথপাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েকোথা
সভ্যতা ছোটে তেরোশো পঞ্চাশিকে।।
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
শোকমূলক
|
কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।
ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।
শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।
লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;
আকাশে বিদ্যুৎজ্বলা বর্শা হানে
ইন্দ্রমেঘ;
কালো দিন গলির রাস্তায়।
কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে।
নিবিষ্ট ক্রান্তির স্বর ঝরঝর বুকে
অবারিত।
চকিত গলির প্রান্তে লাল আভা দুরন্ত সিঁদুরে
পরায় মূহুর্ত টিপ,
নিভে যায় চোখে
কম্পিত নগরশীর্ষে বাড়ির জটিল বোবা রেখা।
বিরাম স্তম্ভিত লগ্ন ভেঙে
আবার ঘনায় জল।
বলে নাম, বলে নাম, অবিশ্রাম ঘুরে-ঘুরে হাওয়া
খুঁজেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
আদিম বর্ষণ জল, হাওয়া, পৃথিবীর।
মত্ত দিন, মুগ্ধ ক্ষণ, প্রথম ঝঙ্কার
অবিরহ,
সেই সৃষ্টিক্ষণ
স্রোত:স্বনা
মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা
প্রশস্ত প্রচীর নামে নিবিড় সন্ধ্যায়,
এক আর্দ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে।
ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক।
কী বিহ্বল মাটি গাছ, দাঁড়ানো মানুষ দরজায়
গুহার আঁধারে চিত্র , ঝড়ে উতরোল
বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া, হারানো নিরন্ত ফিরে-ফিরে-
ঘনমেঘলীন
কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
|
অমিয় চক্রবর্তী
|
চিন্তামূলক
|
তোমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।
সমস্ত সংসার
হাওয়া
উঠছে নীল ধূলোয় সবুজ অদ্ভূত;
দিনের অগ্নিদূত
আবার কালো চক্ষে বর্ষার নামে ধার।
কৈলাস মানস সরোবর
অচেনা কলকাতা শহর—
হাঁটি ধারে ধারে
ফিরি মাটিতে মিলিয়ে
গাছ বীজ হাড় স্বপ্ন আশ্চর্য জানা
এবং তোমার আঙ্কিক অমোঘ অবেদন
আবর্তন
নিয়ে
কোথায় চলছে পৃথিবী।
আমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।।
|
আবুল হাসান
|
চিন্তামূলক
|
আহত শাবক শেষে আউড়ে নিল রক্তের ক্লিষ্ট ধ্রুপদী
নিহত রক্তের স্রোতে শেষবার দেখে নিল পৃথিবীর মুখ
উত্তপ্ত দেহের গায়ে এঁকে নিয়ে স্থিতির সুখ
প্রার্থনায় আওড়ালে, ওহে প্রভু আর একটু বেচে থাকি যদি…আর বানরের শেষ দৃশ্যে বনমোরগের দুটো পাখা
উড়ন্ত বিলাসে তার নায়কের কথা তুলে নিয়ে
প্রত্যুত্তরে জানালো সে প্রতিবাদে, কেঁপে গেল জারুলের শাখা
(কী হবে স্বর্গে গিয়ে এইসব নৃত্য ছেড়ে দিয়ে?)
শাবক শেষের গানে পিতৃত্বের দামেই বরং
ডেকে গেল প্রভুকেই ভেবে নিয়ে শিকারির উল্লসিত লোভের মাতলামি
মুখ দিয়ে ঘসে নিল ঘাসের সবুজ সেই রঙ
নিহত রক্তের স্রোতে থেকে গেল তার সেই সন্ধ্যা প্রণামী।
কাছে কিছু পিঁপড়ের মুখ দিয়ে শেষ সূর্যের মতো
বের হল সমবেদনার এক সততার কথা
মানুষ বর্বরই শেষে ভোল সে পরুক না যত
অণুর নৃত্যে তার পশুত্বের হেঁয়ালি বারতা।
|
আবুল হাসান
|
চিন্তামূলক
|
একসময় ইচ্ছে জাগে, মেষপালকের বেশে ঘুরিফিরি;
অরণ্যের অন্ধকার আদিম সর্দার সেজে মহুয়ার মাটির বোতল
ভেঙ্গে উপজাতি রমণীর বল্কল বসন খুলে জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসি-আর তারস্বরে বলে উঠি নারী, আমি মহুয়া বনের এই
সুন্দর সন্ধ্যায় পাপী, তোমার নিকটে নত, আজ কোথাও লুকানো কোনো
কোমলতা নেই, তাই তোমার চোখের নীচে তোমার ভ্রুর নীচে তোমার তৃষ্ণার নীচেএই ভাবে লুকিয়েছি পিপাসায় আকণ্ঠ উন্মাদ আমি
ক্ষোভে ও ঈর্ষায় সেই নগরীর গুপ্তঘাতক আজ পলাতক, খুনী
আমি প্রেমিককে পরাজিত করে হীন দস্যুর মতোন
খুনীকে খুনীর পাশে রেখে এখানে এসেছি, তুমি
আমাকে বলো না আর ফিরে যেতে, যেখানে কেবলি পাপ, পরাজয়
পণ্যের চাহিদা, লোভ, তিরীক্ষু-মানুষ- যারা কোজাগরী ছুরি
বৃষ্টির হল্লায় ধুয়ে প্রতি শনিবারে যায় মদ্যশালায়, যারা
তমসায় একফোঁটা আলোও এখন আর উত্তোলন করতে জানে না।
আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে কেবলি যাদের রক্ত, রাত্রিবেলা আমি আজ
তোমার তৃষ্ণার নীচে নিভৃতের জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসেছি আদিম আজ
এখন আমার কোন পাপ নেই, পরাজয় নেই।
একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে যদি দিন যেতো।
|
আবুল হাসান
|
প্রেমমূলক
|
গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান
ছিলাম ।
জোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ারা চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও
প্রেমিক হৃদয় !
আমিও আমার প্রেমহীনতায় গণিকার কাছে ক্লান্তি
সঁপেছি
বাঘিনীর মুখে চুমু খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও !
সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু
হে কবি কিশোর
আমারও অনেক স্বপ্ন শহীদ হয়েছে জীবনে কাঁটার আঘাত সয়েছি
আমিও ।
হৃদয়ে লুকানো লোহার আয়না ঘুরিয়ে সেখানে নিজেকে দেখেছি
পান্ডুর খুবই নিঃস্ব একাকী !
আমার পয়ের সমান পৃথিবী কোথাও পাইনি অভিমানে আমি
অভিমানে তাই
চক্ষু উপড়ে চড়ুইয়ের মতো মানুষের পাশে ঝরিয়েছি শাদা শুভ্র পালক !
হে কবি কিশোর নিহত ভাবুক, তেমার দুঃখ আমি কি বুঝি না ?
আমি কি জানি না ফুটপাতে কারা করুণ শহর কাঁধে তুলে নেয় ?
তোমার তৃষ্ণা তামার পাত্রে কোন কবিতার ঝিলকি রটায় আমি কি
জানি না
তোমার গলায় কোন গান আজ প্রিয় আরাধ্য কোন করতলও হাতে লুকায়
আমি কি জানি না মাঝরাতে কারা মৃতের শহর কাঁধে তুলে নেয় ?
আমারও ভ্রমণ পিপাসা আমাকে নারীর নাভিতে ঘুরিয়ে মেরেছে
আমিও প্রেমিক ক্রবাদুর গান স্মৃতি সমুদ্রে একা শাম্পান হয়েছি
আবার
সুন্দর জেনে সহোদরকেও সঘন চুমোয় আলুথালু করে খুঁজেছি
শিল্প ।
আমি তবু এর কিছুই তোমাকে দেবো না ভাবুক তুমি সেরে ওঠো
তুমি সেরে ওঠো তোমার পথেই আমাদের পথে কখনও এসো না,
আমাদের পথ
ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ
|
আবুল হাসান
|
প্রেমমূলক
|
তুমি পর্বতের পাশের ব’সে আছোঃ
তোমাকে পর্বত থেকে আরো যেনো উঁচু মনে হয়,
তুমি মেঘে উড়ে যাও, তোমাকে উড়িয়ে
দ্রুত বাতাস বইতে থাকে লোকালয়ে,
তুমি স্তনের কাছে কোমল হরিণ পোষো,
সে-হরিণ একটি হৃদয়।
|
আবুল হাসান
|
প্রেমমূলক
|
কনক তুমি শীতে এবার কার্ডিগানটা পরো কেমন?আমাকে তুমি শিখিয়ে দিও লালঝুটো সেই পাখির নামটি?
কনক আমরা এবার শীতে নদীর তীরে হো হো হাসবো
সন্ধেবেলা তোমার চুলে শিশির ভরে রাখবো লক্ষ্মী
তোমার অনামিকায় কামড় দিয়ে আমি হঠাৎ আবার
‘যাহ-কী-দুষ্ট’ ওষ্ঠে তোমার ওষ্ঠ ছোঁবো সকাল বেলায়
সূর্যোদয়ের কাছে কেবল শান্তি চাইবো, বুঝলে কনকতোমার মাথাধরাও আমি এক চুমোতে সারিয়ে দেবো!
|
আবুল হাসান
|
চিন্তামূলক
|
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!
|
আবুল হাসান
|
প্রেমমূলক
|
আমার এখন নিজের কাছে নিজের ছায়া খারাপ লাগে
…রাত্রিবেলা ট্রেনের বাঁশি শুনতে আমার খারাপ লাগে
জামার বোতাম আটকাতে কি লাগে, কষ্ট লাগে
তুমি আমার জামার বোতাম অমন কেনো যত্ন করে
লাগিয়ে দিতে?
অমন কেন শরীর থেকে অস্তে আমার
ক্লান্তিগুলি উঠিয়ে নিতে?
তোমার বুকের নিশীথ কুসুম আমার মুখে ছড়িয়ে দিতে?
জুতোর ফিতে প্রজাপতির মতোন তুমি উড়িয়ে দিতে?
বেলজিয়ামের আয়নাখানি কেন তুমি ঘরে না রেখে
অমন কারুকাজের সাথে তোমার দুটি চোখের মধ্যে
রেখে দিতে?
আমার এখন চাঁদ দেখলে খারাপ লাগে
পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে
কথাবর্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ
খারাপ লাগে,
এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা. . .
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
মোটের উপর, আমি অনেক কষ্টে আছি.. কষ্টে আছি বুজলে যুথী
আমার দাঁতে, আমার নাকে, আমার চোখে কষ্ট ভীসন
চতুর দিকে দাবি আদায় করার মত মিছিল তাদের কষ্ট ভীষণ বুজলে যুথী
হাসি খুসি উড়নচন্ডি মানুষ এখন তাইতো এখন খারাপ লাগে, খারাপ লাগে
আরে তাছাড়া, আমি কি আরে যিশু নাকি- হাবিজাবী ওদের মতন সবসহিষ্ণু
আমি অনেক কষ্টে আছি
কষ্টে আছি, কষ্টে আছি
আমি অনেক কষ্টে আছি
কষ্টে আছি, কষ্টে আছি |
|
আবুল হাসান
|
চিন্তামূলক
|
তবুও নারীর মুখ আমাদের রক্তে মিশে আছে
মিশে আছে জানকীর অঙ্গধর্মী বিশ্লেষণী রূপ
উপমারা ফুল হয়ে আমাদের মনের অঙ্গনে
নৃত্য করে অন্য ধাচে, অন্য এক কামনা কেলিতে।রাত্রির ঠোঁট ছুঁয়ে বিবিক্ত সে দেহের অঙ্গারে
আমরাও টের পাই শারীরিক স্রোতের উষ্ণতা
ঘ্রাণ পাই কোকিলের, বসন্তে যার আকুলতা
দূরের সাগর তীরে, ঢেউ কাঁদে বালির বিবরে।সেগুলো দূরেই রেখে মাংসে তবু আসর জমাই
অসংখ্য লোভের পাতা নেড়ে নেড়ে দেখি আর দেখি
নির্জন অনুষ্টুপ, নানা স্রোতে সবকিছু মেকী
তাইতো চারণক্ষেত্রে নিয়তির গান গেয়ে যাই।পাড়াগাঁর ধানক্ষেত, নদী খাল সাঁকোর কল্পনা
এসে এসে ফিরে যায়, কেননা সে রিপুর মশাল
আমাকে দেখায়ে দেয় দেখে নেয় সিফনের ভীড়
অথবা দরের কোন লোভনীয় সঞ্চয়ের তীর!!
|
আবুল হাসান
|
রূপক
|
একটি আলোর বৃত্তে মুখ দেখে চেতনাসন্ধানী
ভাবে, এই বুঝি সৌন্দর্যের সপ্রতিভ আশ্বাসের নিয়ামক
সংগ্রহের সাহচার্য, সম্ভাবনা, অক্লান্ত সুহৃদ
চিরচেনা বিগ্রহের সংবিধানম অসংযত হৃদয়ের ভীত!
পরিচ্ছন্ন অধ্যায়ের ঘন্টা যদি বেজে যায়
একান্ত আশ্বাসে- বিবেকী মানস, বেহালায়
সুর তোলে যদি, সেই তো আলোর বৃত্তে
ছন্দপ্রকরণ-সবুজ সাক্ষর!
ঝর্ণার জলচ্ছটা, পাথর নুড়ির গায়ে
মিশে থাকা উৎক্ষেপ-গাছ ফুল পাখির বন্দরে
কোন এক নাবিকের অভিযান অনুভবে সৌন্দর্যের
আশ্বাস পাব বলে, খুঁজে পাবে নিটোল শরীর।
নিটোল শরীর এক-সান্তনার কোমল গান্ধারে
পৌষের ফালি রোদে এক চিলতে হলুদ সকাল,
নাবিক সে খুঁজে ফেরে আলোর বাহক
বৃত্ত, ছন্দ, মাত্রার সুর।
|
আবুল হাসান
|
চিন্তামূলক
|
সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি ? এটা তাই ?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী ? উপগ্রহ ? কোনো রাজা ?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা ? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর ?আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,
যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়
সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী
তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে-
এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর,
একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,
তুই যার অনিচ্ছুক দাস !হয়তো যুদ্ধের নাম, জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,
নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের !
সত্যিই কি মানুষের ?তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন
ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল ?
ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল ?
|
আবুল হাসান
|
প্রেমমূলক
|
‘তোমাকে ভালোবাসি তাই ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।
আমার ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো কবিতা সফল হয়নি,
আমার এক ফোঁটা হাহাকার থেকে এক লক্ষ কোটি
ভালোবাসার কবিতার জন্ম হয়েছে।আমার একাকীত্বের এক শতাংশ হাতে নিয়ে
তুমি আমার ভালোবাসার মুকুট পরেছো মাথায়!
আমাকে শোষণের নামে তৈরি করেছো আত্মরক্ষার মৃন্ময়ী যৌবন।
বলো বলো হে ম্লান মেয়ে,এতো স্পর্ধা কেন তোমার?ভালোবাসার ঔরসে আমার জন্ম! অহংকার আমার জননী!
তুমি আমার কাছে নতজানু হও,তুমি ছাড়া আমি
আর কোনো ভূগোল জানি না,
আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি!আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!
হে মেয়ে ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!আমার অপার করুণার মধ্যে তোমারও বিস্তৃতি!
তুমি কোন্ দুঃসাহসে তবে
আমার স্বীকৃতি চাও,হে ম্লান মেয়ে আমার স্বীকৃতি চাও কেন?
তোমার মূর্খতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে,পৃথিবীটা পুড়ে যাবে
হেলেনের গ্রীস হবে পুনর্বার আমার কবিতা!
এই ভয়ে প্রতিশোধস্পৃহায়
আজো আমি ভালোবাসার কবিতা লিখিনি
কোনোদিন ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।হে মেয়ে হে ম্লান মেয়ে তোমাকে ভালোবাসি তাই
ভালোবাসার কবিতা আমি কোনোদিন কখনো লিখবো না!’
|
মঞ্জুষ দাশগুপ্ত
|
প্রেমমূলক
|
হাত পেতে আছি দাও
চোখ পেতে আছি দাও
বুক পেতে আছি দাও
অবহেলা দাও অপেক্ষা দাও
বিশবাঁও জলে
আমাকে ডোবাও
তুলে এনে ফের
আমাকে ঘোরাও
যাক ঘুরে যাক
নাগর দোলাও
দাও তুমি দাও অপমান দাও
চাও বা না চাও নাও
পুড়ে খাঁটি সোনা নাও
আঁচলে বেঁধো না তাও
এতো তুচ্ছতা প্রাপ্য আমার?
সিঁড়ি খুঁজে চলি নরকে নামার।
অন্ধ ভ্রমর গেঁথেছে অমর
শব্দপুঞ্জ ডানায় তোমার
কী অর্থ তার বুঝবে কী আর!
সিঁড়ি খুঁজে চলি নরকে নামার।
শুধু ধ্রুবপদ তোমাকে দিলাম
ভালোবাসা নাও ভালোবাসা নাও
তোমার জন্য জীবন নিলাম
করেছি বলেই
শুধু শূন্যতা বিনিময়ে দাও…
হাত পেতে আছি দাও
চোখ পেতে আছি দাও
বুক পেতে আছি তাও…
|
মাহবুবুল আলম চৌধুরী
|
স্বদেশমূলক
|
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।আমরা জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো
যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে
পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেই সব মৃতদের নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসি দাবি করছি
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি তাদের বিচার দেখতে চাই।
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।পাকিস্তানের প্রথম শহীদ
এই চল্লিশটি রত্ন,
দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা, বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে
এই পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার গড়ে তোলা যাদের
স্বপ্ন ছিল
যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কী ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
তার সাধনা করার,যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।যদিও অগণন অস্পষ্ট স্বর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ
ঘোষণা করবে।
যদিও ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাতে—বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবু তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই মুছে যাবে না।খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনো দিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।চট্টগ্রাম, ১৯৫২
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
ছড়া
|
পাল্কী চলে!
পাল্কী চলে!
গগন-তলে
আগুন জ্বলে!স্তব্ধ গাঁয়ে
আদুল গায়ে
যাচ্ছে কারা
রৌদ্রে সারাময়রামুদি
চক্ষু মুদি’
পাটায় ব’সে
ঢুলছে ক’ষে।দুধের চাঁছি
শুষছে মাছি,
উড়ছে কতক
ভনভনিয়ে।
আসছে কা’রা
হন্ হনিয়ে?
হাটের শেষে
রুক্ষ বেশে
ঠিক দু’পুরে
ধায় হাটুরে!কুকুর গুলো
শুঁকছে ধূলো,
ধুঁকছে কেহ
ক্লান্ত দেহ।গঙ্গা ফড়িং
লাফিয়ে চলে;
বাঁধের দিকে
সূর্য্য ঢলে।পাল্কী চলে রে,
অঙ্গ টলেরে!
আর দেরি কত?
আর কত দূর?
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
প্রকৃতিমূলক
|
ছিপখান তিন-দাঁড় -
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল-জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল |
কঞ্চির তীর-ঘর
ঐ-চর জাগছে,
বন-হাঁস ডিম তার
শ্যাওলায় ঢাকছে|
চুপ চুপ - ওই ডুব
দ্যায় পান্ কৌটি
দ্যায় ডুব টুপ টুপ
ঘোমটার বৌটি!
ঝকঝক কলসীর
বক্ বক্ শোন্ গো
ঘোমটার ফাঁক বয়
মন উন্মন গো|
তিন-দাঁড় ছিপখান
মন্থর যাচ্ছে,
তিনজন মাল্লায়
কোন গান গাচ্ছে?
রূপশালি ধান বুঝি
এইদেশে সৃষ্টি,
ধুপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি|
মুখখানি মিষ্টিরে
চোখদুটি ভোমরা
ভাব-কদমের - ভরা
রূপ দেখ তোমরা !
ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হোলো গোখরী!
ডাক পাখী ওর লাগি'
ডাক ডেকে হদ্দ,
ওর তরে সোঁত-জলে
ফুল ফোটে পদ্ম|
ওর তরে মন্থরে
নদ হেথা চলছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোলছে|
দুইতীরে গ্রামগুলি
ওর জয়ই গাইছে,
গঞ্জে যে নৌকা সে
ওর মুখই চাইছে|
আটকেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পর্শ,
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ|
পান বিনে ঠোঁট রাঙা
চোখ কালো ভোমরা,
রূপশালী-ধান-ভানা
রূপ দেখ তোমরা* * * *
পান সুপারি! পান সুপারি!
এইখানেতে শঙ্কা ভারি,
পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে
চলরে টেনে বৈঠা হেনে;
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে
বুক দে টানো, বইটা হানো -
সাত সতেরো কোপ কোপানো|
হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনী যেন ঝামর-চুলো
নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে
লোক দেখে কি থমকে গেল|
জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে
রাত্রি এল রাত্রি এল|
ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে
ফিরছে কারা মাছের পাছে,
পীর বদরের কুদরতিতে
নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে|* * * *
আর জোর দেড় ক্রোশ -
জোর দের ঘন্টা,
টান ভাই টান সব -
নেই উত্কণ্ঠা|
চাপ চাপ শ্যাওলার
দ্বীপ সব সার সার,
বৈঠৈর ঘায়ে সেই
দ্বীপ সব নড়ছে,
ভিল্ ভিলে হাঁস তায়
জল-গায় চড়ছে|
ওই মেঘ জমছে,
চল্ ভাই সমঝে,
গান গাও দাও শিশ,
বকশিশ! বকশিশ!
খুব জোর ডুব-জল
বয় স্রোত ঝিরঝির,
নেই ঢেউ কল্লোল,
নয় দুর নয় তীর|
নেই নেই শঙ্কা,
চল্ সব ফুর্তি,
বকশিশ টঙ্কা,
বকশিশ ফুর্তি|
ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,
ঝাউ-গাছ দুলছে,
ঢোল-কলমীর ফুল
তন্দ্রায় ঢুলছে|
লকলক শর-বন
বক তায় মগ্ন,
চুপচাপ চারদিক -
সন্ধ্যার লগ্ন|
চারদিক নিঃসাড়,
ঘোর-ঘোর রাত্রি,
ছিপ-খান তিন-দাঁড়,
চারজন যাত্রি|* * * *
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে
ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে -
স্বপন পানে পরাণ টানে|
তারায় ভরা আকাশ ওকি
ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে
লুটিয়ে পল আচম্বিতে
কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে!
* * * *
কেবল তারা! কেবল তারা!
শেষের শিরে মানিক পারা,
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি
কেবল তারা যেথায় চাহি|
কোথায় এল নৌকাখানা
তারার ঝড়ে হই রে কাণা,
পথ ভুলে কি এই তিমিরে
নৌকা চলে আকাশ চিরে!
জ্বলছে তারা! নিভছে তারা!
মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়,
যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায়
জোনাক যেন পন্থা-হারা|
তারায় আজি ঝামর হাওয়া-
ঝামর আজি আঁধার রাতি,
অগুনতি অফুরান তারা
জ্বালায় যেন জোনাক-বাতি|
কালো নদীর দুই কিনারে
কল্পতরু কুঞ্জ কি রে?
ফুল ফুটেছে ভারে ভারে -
ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে|
বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়ে
পাপড়ি মেলে মাণিক-মালা;
বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছে
ফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা|
চোখে কেমন লগছে ধাঁধা -
লাগছে যেন কেমন পারা,
তারাগুলোই জোনাক হল
কিম্বা জোনাক হল তারা|
নিথর জলে নিজের ছায়া
দেখছে আকাশ ভরা তারায়,
ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে
জলে জোনাক দিশে হারায়|
দিশে হারায় যায় ভেসে যায়
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে?
মরা গাঙ আর সুর-সরিত্
এক হয়ে যেথায় মেশে রে!
কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর
জোনাক কোথা হয় সুরু যে
নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা
চোখ যে আলা রতন উঁছে|
আলেয়াগুলো দপদপিয়ে
জ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে',
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে
চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে!
আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা
আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা
একলা ছোটে বন বাদাড়ে
ল্যাম্পো-হাতে লকড়ি ঘাড়ে;
সাপ মানে না, ভাঘ জানে না,
ভূতগুলো তার সবাই চেনা,
ছুটছে চিঠি পত্র নিয়ে
রণরণিয়ে হনহনিয়ে|
বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,
কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,
জাগছে হাওয়া জলের ধারে,
চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে!
শুকতারাটি আজ নিশীথে
দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে,
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে
ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে|
ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,
মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;
রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে
ধরছে কারা মাছগুলোকে!
চলছে তরী চলছে তরী -
আর কত পথ? আর ক'ঘড়ি?
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী,
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি -
ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্
দেখছ আলো? ঐতো কুঠি
ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই
রাতের মতন আজকে ছুটি|
ঝপ ঝপ তিনখান
দাঁড় জোর চলছে,
তিনজন মাল্লার
হাত সব জ্বলছে;
গুরগুর মেঘ সব
গায় মেঘ মল্লার,
দূর-পাল্লার শেষ
হাল্লাক্ মাল্লার!
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
প্রকৃতিমূলক
|
ভোর হল রে, ফর্সা হ’ল, দুল্ ল ঊষার ফুল-দোলা !
আন্ কো আলোয় যায় দেখা ওই পদ্মকলির হাই-তোলা !
জাগলো সাড়া নিদ্ মহলে, অ-থই নিথর পাথার-জলে–
আলপনা দ্যায় আল্ তো বাতাস,ভোরাই সুরে মন ভোলা !
ধানের ক্ষেতের সব্ জে কে আজ সোহাগ দিয়ে ছুপিয়েছে !
সেই সোহাগের একটু পরাগ টোপর-পানায় টুপিয়েছে !
আলোর মাঠের কোল ভরেছে, অপরাজিতার রং ধরেছে–
নীল-কাজলের কাজল-লতা আস্ মানে চোখ ডুবিয়ে যে |
কল্পনা আজ চলছে উড়ে হাল্ কা হাওয়ায় খেল্ খেলে !
পাপ্ ড়ি-ওজন পান্ সি কাদের সেই হাওয়াতেই পালপেলে !
মোতিয়া মেঘের চামর পিঁজে পায়রা ফেরে আলোয় ভিজে
পদ্মফুলের অঞ্জলি যে আকাশ-গাঙে যায় ঢেলে !
পূব্ গগনে থির নীলিমা ভুলিয়েছে মন ভুলিয়েছে !
পশ্চিমে মেঘ মেলছে জটা–সিংহ কেশর ফুলিয়েছে !
হাঁস চলেছে আকাশ-পথে, হাস্ ছে কারা পুষ্প-রথে,–
রামধনু-রং আঁচলা তাদের আলো-পাথার দুলিয়েছে !
শিশির-কণায় মানিক ঘনায়, দূর্বাদলে দীপ জ্বলে !
শীতল শিথিল শিউলী-বোটায় সুপ্ত শিশুর ঘুম টলে |
আলোর জোয়ার উঠছে বেড়ে গন্ধ-ফুলের স্বপন কেড়ে,
বন্ধ চোখের আগল ঠেলে রঙের ঝিলিক্ ঝল্ মলে !
নীলের বিথার নীলার পাথার দরাজ এ যে দিল্ খোলা !
আজ কি উচিত ডঙ্কা দিয়ে ঝাণ্ডা নিয়ে ঝড় তোলা ?
ফির্ ছে ফিঙে দুলিয়ে ফিতে; বোল ধরেছে বুল্ বুলিতে !
গুঞ্জনে আর কূজন-গীতে হর্ষে ভূবন হর্ বোলা !
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
গীতিগাথা
|
দেখা হলো ঘুম নগরীর রাজকুমারীর সংগে
সন্ধ্যা বেলায় ঝাপসা ঝোপের ধারে
পরনে তার হাওয়ার কাপড় ওড়না ওড়ে অঙ্গে
দেখলে সে রূপ ভুলতে কি কেউ পারে?চোখ দুটো তার ঢুলু ঢুলু মুখখানি তার পিঠে
আফিম ফুলের রক্তিম হার চুলে
নিশ্বাসে তার হাসনু হেনা হাস্যে মধুর ছিটে
আলগোছে সে আলগা পায়েই বুল।এক যে আছে কুঞ্ঝটিকার দেয়াল ঘেরা কেল্লা
মৌনমুখী সেথায় নাকি থাকে
মন্ত্র পড়ে বাড়ায় কমায় জোনাক পোকার জেল্লা
মন্ত্র পড়ে চাঁদকে সে রোজ ডাকে।তোঁত পোকাতে তাঁত বোনে তার জানলাতে দেয় পর্দা
হুতোম প্যাঁচা প্রহন হাঁকে দ্বারে
ঝর্ণাগুলি পূর্ণ চাঁদের আলোয় হয়ে জর্দা
জলতরঙ্গ বাজনা শোনায় তারে।কালো কাঁচের আর্শিতে সে মুখ দেখে সুস্পষ্ট
আলো দেখে কালো নদীর জলে
রাজ্যেতে তার নেইকো মোটেই স্থায়ী রকম কষ্ট
স্বপন সেথায় বাড়ায় দলে দলে।সন্ধ্যা বেলা অন্ধকারে হঠাৎ হলো দেখা
ঘুম নগরীর রাজকুমারীর সনে
মধুর হেসে সুন্দরী সে বেড়ায় একা একা
মুর্ছা হেনে বেড়ায় গো নির্জনে।
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
নীতিমূলক
|
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা,
হৃদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল
দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা!
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
স্তোত্রমূলক
|
হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
হে প্রগলভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
তুমি শুধু, নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে
একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুবিনীতে!দিগন্ত বিস্তৃত তোমার হাস্যের কল্লোল তারি মত
চলিয়াছে তরঙ্গিয়া, - চির দৃপ্ত, চির অব্যাহত|
দুর্নমিত, অসংযত, গূঢ়চারী, গহন গম্ভীর;
সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর |রুদ্র সমুদ্রের মত, সমুদ্রেরি মত সমুদার
তোমার বদরহস্ত বিতরিছে ঐশ্বর্যসম্ভার|
উর্বর করিছ মহি, বহিতেছ বাণিজ্যের তরী
গ্রাসিয়া নগর গ্রাম হাসিতেছ দশদিক ভরি|অন্তহীন মূর্ছনায় আন্দোলিত আকাশ সংগীতে, -
ঝঙ্কারিয়া রুদ্রবীণা, মিলাইছ ভৈরবে ললিতে
প্রসন্ন কখনো তুমি, কভু তুমি একান্ত নিষ্ঠুর;
দুর্বোধ, দুর্গম হায়, চিরদিন দুর্জ্ঞেয় সুদূর!শিশুকাল হতে তুমি উচ্ছৃঙ্খল, দুরন্ত দুর্বার;
সগর রাজার ভস্ম করিয়ে স্পর্শ একবার!
স্বর্গ হতে অবতরি ধেয়ে চলে এলে এলোকেশে,
কিরাত-পুলিন্দ-পুণ্ড্র অনাচারী অন্ত্যজের দেশে!বিস্ময়ে বিহ্বল-চিত্ত ভগীরথ ভগ্ন মনোরথ
বৃথা বাজাইল শঙ্খ, নিলে বেছে তুমি নিজ পথ;
আর্যের নৈবেদ্য, বলি, তুচ্ছ করি হে বিদ্রোহী নদী!
অনাহুত-অনার্যের ঘরে গিয়ে আছ সে অবধি|সেই হকে আছ তুমি সমস্যার মত লোক-মাঝে,
ব্যাপৃত সহস্র ভুজ বিপর্যয় প্রলয়ের কাজে!
দম্ভ যবে মূর্তি ধরি স্তম্ভ ও গম্ বুজে দিনরাত
অভ্রভেদী হয়ে ওঠে, তুমি না দেখাও পক্ষপাত|তার প্রতি কোনদিন, সিন্ধুসঙ্গী, হে সাম্যবাদিনী!
মূর্খে বলে কীতিনাশা, হে কোপনা কল্লোলনাদিনী!
ধনী দীনে একাসনে বসায়ে রেখেছ তব তীরে,
সতত সতর্ক তারা অনিশ্চিত পাতার কুটিরে;না জানে সুপ্তির স্বাদ, জড়তার বারতা না জানে,
ভাঙ্গনের মুখে বসি গাহে গান প্লাবনের তানে,
নাহিক বস্তুর মায়া, মরিতে প্রস্তুত চির দিনই!
অয়ি স্বাতন্ত্রের ধারা! অয়ি পদ্মা! অয়ি বিপ্লাবনী!
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
প্রকৃতিমূলক
|
ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!
অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে,
তনু ভরি' যৌবন, তাপসী অপর্ণা!
ঝর্ণা!
পাষাণের স্নেহধারা! তুষারের বিন্দু!
ডাকে তোরে চিত-লোল উতরোল সিন্ধু|
মেঘ হানে জুঁইফুলী বৃষ্টি ও-অঙ্গে,
চুমা-চুমকীর হারে চাঁদ ঘেরে রঙ্গে,
ধূলা-ভরা দ্যায় ধরা তোর লাগি ধর্ণা!
ঝর্ণা!
এস তৃষার দেশে এস কলহাস্যে -
গিরি-দরী-বিহীরিনী হরিনীর লাস্যে,
ধূসরের ঊষরের কর তুমি অন্ত,
শ্যামলিয়া ও পরশে কর গো শ্রীমন্ত;
ভরা ঘট এস নিয়ে ভরসায় ভর্ণা;
ঝর্ণা!
শৈলের পৈঠৈয় এস তনুগত্রী!
পাহাড়ে বুক-চেরা এস প্রেমদাত্রী!
পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে আয় গো,
হরিচরণ-চ্যুতা গঙ্গার প্রায় গো,
স্বর্গের সুধা আনো মর্ত্যে সুপর্ণা!
ঝর্ণা!
মঞ্জুল ও-হাসির বেলোয়ারি আওয়াজে
ওলো চঞ্চলা ! তোর পথ হল ছাওয়া যে!
মোতিয়া মোতির কুঁড়ি মূরছে ও-অলকে;
মেখলায়, মরি মরি, রামধনু ঝলকে
তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুত্পর্ণা
ঝর্ণা!
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
প্রকৃতিমূলক
|
দূর হতে আমি গোলাপেরি মত ঠিক
তবু আমোদিত করিতে পারিনা দিক।।গোলাপেরি মত অতুলন মম হাসি
তুব হায় অলি ফিরে যায় কাছে আসি।।পথের প্রান্তে ফুটে আছি অহরহ
গোলাপের মত রচিতে পারি নে মোহ।।ভালোবাসা মোর রাখি নি কাটায় ঘিরে
সুলভ প্রেমের দুর্দশা তাই কিরে।।গোলাপের মত কন্টকী নই শুধু
তাই কি এ বুকে জমে না গোলাপী মধু।।
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
ছড়া
|
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম|
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম|
কেয়াফুলে ঘুণ লেগেছে,
পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে,
মেঘের সীমায় রোদ হেসেছে
আলতা-পাটি শিম্|
ইলশে গুঁড়ি হিমের কুঁড়ি,
রোদ্দুরে রিম্ ঝিম্|
হালকা হাওয়ায় মেঘের ছাওয়ায়
ইলশে গুঁড়ির নাচ, -
ইলশে গুঁড়ির নাচন্ দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ|
কেউ বা নাচে জলের তলায়
ল্যাজ তুলে কেউ ডিগবাজি খায়,
নদীতে ভাই জাল নিয়ে আয়,
পুকুরে ছিপ গাছ|
উলসে ওঠে মনটা, দেখে
ইলশে গুঁড়ির নাচ| ইলশে গুঁড়ি পরীর ঘুড়ি
কোথায় চলেছে,
ঝমরো চুলে ইলশে গুঁড়ি
মুক্তো ফলেছে!
ধানেক বনে চিংড়িগুলো
লাফিয়ে ওঠে বাড়িয়ে নুলো;
ব্যাঙ ডাকে ওই গলা ফুলো,
আকাশ গলেছে,
বাঁশের পাতায় ঝিমোয় ঝিঁঝিঁ,
বাদল চলেছে| মেঘায় মেঘায় সূর্য্যি ডোবে
জড়িয়ে মেঘের জাল,
ঢাকলো মেঘের খুঞ্চে-পোষে
তাল-পাটালীর থাল|
লিখছে যারা তালপাতাতে
খাগের কলম বাগিয়ে হাতে
তাল বড়া দাও তাদের পাতে
টাটকা ভাজা চাল;
পাতার বাঁশী তৈরী করে'
দিও তাদের কাল| খেজু পাতায় সবুজ টিয়ে
গড়তে পারে কে?
তালের পাতার কানাই ভেঁপু
না হয় তাদের দে|
ইলশে গুঁড়ি - জলের ফাঁকি
ঝরছে কত বলব তা কী?
ভিজতে এল বাবুই পাখী
বাইরে ঘর থেকে; -
পড়তে পাখায় লুকালো জল
ভিজলো নাকো সে| ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
পরীর কানের দুল,
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
ঝরো কদম ফুল|
ইলশে গুঁড়ির খুনসুড়িতে
ঝাড়ছে পাখা - টুনটুনিতে
নেবুফুলের কুঞ্জটিতে
দুলছে দোদুল দুল্;
ইলশে গুঁড়ি মেঘের খেয়াল
ঘুম-বাগানের ফুল|
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
স্বদেশমূলক
|
মধুর চেয়ে আছে মধুর
সে এই আমার দেশের মাটি
আমার দেশের পথের ধূলা
খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।চন্দনেরি গন্ধভরা,
শীতল করা, ক্লান্তি-হরা
যেখানে তার অঙ্গ রাখি
সেখানটিতেই শীতল পাটি।শিয়রে তার সূর্য এসে
সোনার কাঠি ছোঁয়ায় হেসে,
নিদ-মহলে জ্যোৎস্না নিতি
বুলায় পায়ে রূপার কাঠি।নাগের বাঘের পাহারাতে
হচ্ছে বদল দিনে রাতে,
পাহাড় তারে আড়াল করে
সাগর সে তার ধোয়ায় পা'টি।নারিকেলের গোপন কোষে
অন্ন-পানী’ যোগায় গো সে,
কোল ভরা তার কনক ধানে
আটটি শীষে বাঁধা আঁটি।মধুর চেয়ে আছে মধুর
সে এই আমার দেশের মাটি।
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
ছড়া
|
বয়েস- আড়াই কি দুই
মনটি নির্মল জুই,
হালকা যেন হাওয়া
মেয়ে সে মুখ-চাওয়া
মায়ের কাছে কাছে
ছায়ার মত আছে
জানে না মা বিনা কিছুই৷
আর সে দিদি চেনে তার
দিদি সে সাথী খেলিবার,
দুটিতে পিঠোপিঠি
তবুও খিটিমিটি
হয় না বেশী বেশী
নাইক রেষারেষি
কলহ নাইক নিতুই৷
জগৎ মানে যেন,−তার−
মা, দিদি আপনি সে আর,
এ ছাড়া কিছুই নেই
চেনেনা কারুকেই,
অকথা কুকথার
ধারে না কোনো ধার
শেখেনি আজও ‘তুই’ ‘মুই’৷
একদা হ’ল দুটি বোনে
পুতুল নিয়ে কি কারণে
ঝগড়া কাড়াকাড়ি,
তখন দিয়ে আড়ি
হারিয়া কাদোঁ-কাদোঁ
হ’য়ে সে আধো আধো
কহিল ‘ডিডি!টুমি-টুই!’
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমারে ফুটিতে হ’লো বসন্তের অন্তিম নিশ্বাসে,
বিষণ্ণ যখন বিশ্ব নির্মম গ্রীষ্মের পদানত;
রুদ্র তপস্যার বনে আধ ত্রাসে আধেক উল্লাসে,
একাকী আসিতে হ’লো — সাহসিকা অপ্সরার মতো।
বনানী শোষণ-ক্লিষ্ট মর্মরি’ উঠিল এক বার,
বারেক বিমর্ষ কুঞ্জে শোনা গেল ক্লান্ত কুহু স্বর;
জন্ম-যবনিকা-প্রান্তে মেলি’ নব নেত্র সুকুমার
দেখিলাম জলস্থল, — শুন্য, শুষ্ক, বিহ্বল, জর্জর।তবু এনু বাহিরিয়া, — বিশ্বাসের বৃন্তে বেপমান, –
চম্পা আমি, — খর তাপে আমি কভু ঝরিবো না মরি,
উগ্র মদ্য-সম রৌদ্র — যার তেজে বিশ্ব মুহ্যমান, –
বিধাতার আশির্বাদে আমি তা সহজে পান করি।ধীরে এনু বাহিরিয়া, ঊষার আতপ্ত কর ধরি';
মূর্ছে দেহ, মোহে মন, — মুহুর্মুহু করি অনুভব!
সূর্যের বিভূতি তবু লাবণ্যে দিতেছ তনু ভরি';
দিনদেবে নমস্কার! আমি চম্পা! সূর্যের সৌরভ।
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
নীতিমূলক
|
মূলঃ শেখ সাদী
কুকুর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তাই।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে র্ভৎসনা ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে
তোমার কি নাই দাতঁ?
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
“তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়ে
দংশি কেমন করে?”
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়?
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
মানবতাবাদী
|
প্রেমের ধর্ম করছ প্রচার কে গো তুমি সবুট লাথি নিয়ে,
ডায়ার-মার্কা শিষ্টাচারের লাল-পেয়ালার শেষ তলানি পিয়ে!
কুষলে তো চলছে তোমার অর্ধঘন্টা ধর্মোপদেশ দেওয়া,
টিফিন এবং টি-এর ফাঁকে? জমছে ভাল ঋষ্ট কথার খেয়া?
মুখোস খোলা, মুখস্থ বোল বোলো না আর টিয়াপাখির মত,
মোটা মাসহারার মোহে,- দোরেখা ঢং চালাবে আর কত?
বয়স গত, ক্ষ্যাপার মত কামড় দিতে এলে নকল দাঁতে?
বাঁধানো দাঁত উল্টে গিয়ে, আহা, শেষে লাগবে যে টাক রাতে!
নিরীহ যে সত্যাগ্রহী -কি লাভ হল তারে লাথি মেরে?
সে করেছে তোমায় ক্ষমা, তার চোখে আজ নাও দেখে খৃষ্টেরে। অক্রোধে ক্রোধ জিনতে হবে, -সে শিক্ষা কি রইল শিকেয় তোলা,
ডিগ্রি নিয়ে ফুরিয়ে গেছে ডাগর-বুলির যা কিছু বোলাবোলা?
উদর তন্ত্র উদরতা? ধর্ম কেবল কথারই কাপ্তেনী?
ডঙ্কা-নাদের পিছন পিছন সত্য নিয়ে খেলছ ছেনিমেনি?
চেয়ে দেখ ক্রুসের পরে ক্ষুদ্ধ কে ওই তোমার ব্যবহারে।
জীবন্তবৎ পাষাণ-মুরৎ! -হেঁটমাথা তার লজ্জাতে ধিক্কারে।
কুড়ি শ বতসরের ক্ষত লাল হয়ে তাঁর উঠছত্র নতুন করে।
দেখছে জগৎ -পাথর ফেটে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে শোণিত ঝরে।
দাও ক্ষমা দাও, চোখ মেলে চাও,--
কি কান্ড হায় করছ গজাল ঠুকে?
নিরীহদের নির্যাতনের সব ব্যথা কার বাজছে দ্যাখো বুকে!
কিম্বা দ্যাখার নাই প্রয়োজন, তোমরা এখন সবাই বিজিগীষু,
জিঙ্গো আসল ইষ্ট সবার, তার আবরণ-দেবতা মাত্র যীশু!
ডায়ার-ডৌল জবরদস্তি, -তাতেই দেখি আজ তোমাদের রুচি।
গোবর-দস্ত আইন গড়ে নিষ্ঠুরতায় নিচ্ছ করে শুচি। বীরত্বেরই বিজয়-মালা বর্বরতার দিচ্ছ গলায় তুলে।
অমানুষের করছ পূজা, সেরা-মানুষ কৃষ্টদেবে ভুল।
মরদ-মেয়ে ভুগছ সমান হূণ-বিজয়ের বড়াই-লালচ-রোগে,
মানুষকে আর মানুষ বলেই চিনতে যেন চাইছ না, হায়, চোখে।
ঢাকের পিছে ট্যামট্যামি-প্রায় টমির ধাঁচায় ট্যাঁশটোশও আজ ঘোরে।
শয়তানই যে হাওয়ায় হাঁটায় শূন্যে ওঠায় সে হুঁশ গেছে সরে।
নেইক খেয়াল, আত্মা বেচে জগত-জোড়া কিনছে জমিদারী।
কে জানে ক'দিনের ঠিকা, ঠিকাদারের ঠ্যাকার কিন্তু ভারি!
ধিঙ্গি চলে জঙ্গী চালে, কুচ, করে লাল কাগজ-ওলা চলে,
নাক তুলে যায় দালাল-ফোড়ে, আজ দেখি হায় পাদরীও সেই দলে! যাও দলে যাও, ডঙ্কা বাজাও, অহঙ্কারের ছায়া ক্ষণস্থায়ী।
মিছাই ব্রতের বিঘ্ন ঘটাও অহঙ্কারের হুমকি-ব্যবসায়ী!
আমরা তোমার চাই না শিক্ষা, চাই না বিদ্যা, হে বিদ্যা-বিক্রয়ী!
ধর্ম-কথাও পণ্য যাদের তাদের পণ্য কিনতে ব্যাগ্র নাহি।
মানুষ খুঁজে ফিরছি মোরা, -মানুষ হবার রাস্তা যে বাতলাবে,
তিক্ত হয়ে গেছে জীবন ঘরের পরের অমানুষের তাঁবে।
ফলিয়ে দেবে মর্ত্যে যে জন বুদ্ধ-যীশুর স্বর্গ-সূচন বাণী,
শহীদ-কুলের হৃদ্য-শৌর্য হৃদয়ে যার পেতেছে রাজধানী, জাতিভেদের টিটকারী যে পরকে শুধুই দেয় না নানান ছলে,
জমিয়ে বুকে জিঙ্গোয়ানীর জবর জাতিভেদের হলাহলে,
ষোল-আনা মানুষ হবার নিমন্ত্রণ দেবে যে সব জনে,
সেই মানুষে খুঁজছি মোরা, অহনিশি খুঁজছি ব্যাকুল মনে,
নিক্তি ধরে করলে তৌল ওহন সে যার ভজবে পুরাপুরি,
লোভের মোহের মন্ত্রণাতে ভাবের ঘরে করবে না যে চুরি,
পথ চেয়ে তার সই অনাচার দুঃখ অপার অন্তত লাঞ্চনা,
বেশ জানি, আজ সয় যারা ক্লেশ তাদের তরেই স্বর্গীয় সান্তনা,
নিরীহ যেই ধন্য যে সেই ধৃত-ব্রত দৈব-মাশাল-ধারী,
নিঃস্ব যারা তারাই হবে বিপুল ভবে রাজ্যে-অধিকারী।
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
নীতিমূলক
|
কালোর বিভায় পূর্ণ ভুবন, কালোরে কি করিস ঘৃণা?
আকাশ-ভরা আলো বিফল কালো আঁখির আলো বিনা।
কালো ফণীর মাথায় মণি,
সোনার আধার আঁধার খনি,
বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তে যে বাজায় বীণা,
কালোর গানে পুলক আনে, অসাড় বনে বয় দখিনা! কালো মেঘের বৃষ্টিধারা তৃপ্তি সে দেয় তৃষ্ণা হরে,
কোমল হীরার কমল ফোটে কালো নিশির শ্যমসায়রে!
কালো অলির পরশ পেলে
তবে মুকুল পাপড়ি মেলে,
তবে সে ফুল হয় গো সফল রোমাঞ্চিত বৃন্ত পরে!
কালো মেঘের বাহুর তটে ইন্দ্রধনু বিরাজ করে। সন্ন্যাসী শিব শ্মশানবাসী,--সংসারী সে কালোর প্রেমে,
কালো মেঘের কটাক্ষেরি ভয়ে অসুর আছে থেমে।
দৃপ্ত বলীর শীর্ষ পরে
কালোর চরণ বিরাজ করে,
পূণ্য-ধারা গঙ্গা হল- সেও তো কালো চরণ ঘেমে,
দুর্বাদলশ্যামের রূপে-- রূপের বাজার গেছে নেমে। প্রেমের মধুর ঢেউ উঠেছে কালিন্দীরি কালো জলে,
মোহন বাঁশীর মালিক যে জন তারেও লোকে কালোই বলে,
বৃন্দাবনের সেই যে কালো--
রূপে তাহার ভুবন আলো,
রাসের মধুর রসের লীলা, -তাও সে কালো তমাল তলে,
নিবিড় কালো কালাপানির কালো জলেই মুক্তা ফলে। কালো ব্যাসের কৃপায় আজো বেঁচে আছে বেদের বাণী,
দ্বৈপায়ন - সেই কৃষ্ণ কবি- শ্রেষ্ঠ কবি তাঁরেই মানি,
কালো বামুন চাণক্যেরে
আঁটবে কে কূট-নীতির ফেরে?
কালো অশোক জগৎ-প্রিয়, রাজার সেরা তাঁরে জানি,
হাবসী কালো লোকমানের মানে আরব আর ইরাণী। কালো জামের মতন মিঠে- কালোর দেশ এই জম্বুদ্বীপে-
কালোর আলো জ্বলছে আজো, আজো প্রদীপ যায় নি নিবে,
কালো চোখের গভীর দৃষ্টি
কল্যানেরি করছে সৃষ্টি,
বিশ্ব-ললাট দীপ-- কালো রিষ্টিনাশা হোমের টিপে,
রক্ত চোখের ঠান্ডা কাজল-- তৈরী সে এই ম্লান প্রদীপে! কালোর আলোর নেই তুলনা- কালোরে কী করিস ঘৃণা!
গগন-ভরা তারার মীনা বিফল- চোখের তারা বীনা,
কালো মেঘে জাগায় কেকা,
চাঁদের বুকেও কৃষন-লেখা,
বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তের যে বাজায় বীণা,
কালোর গানে জীবন আনে নিথর বনে বয় দখিনা!
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
শোকমূলক
|
সবচেয়ে যে ছোটো পিঁড়িখানি
সেইখানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোট থালায় হয় নাকো ভাত বাড়া,
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে;
বাড়ির মধ্যে সব-চেয়ে যে ছোটো
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে,
সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব-আগে ।সব-চেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি
খুশি ছিল ঘেঁষাঘেঁষির ঘরে,
সেই গেছে, হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে, জায়গা খালি করে ।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি;
ভয়-তরাসে ছিল যে সব-চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি ।...চ'লে গেছে একলা চুপে চুপে--
দিনের আলো গেছে আঁধার ক'রে;
যাবার বেলা টের পেলো না কেহ,
পারলে না কেউ রাখতে তারে ধ'রে।
চলে গেলো, --পড়তে চোখের পাতা,--
বিসর্জনের বাজনা শুনে বুঝি !
হারিয়ে গেলো--অজানাদের ভিড়ে,
হারিয়ে গেলো-পেলাম না আর খুঁজি।হারিয়ে গেছে--হারিয়ে গেছে, ওরে !
হারিয়ে গেছে বোল-বলা সেই বাঁশি
হারিয়ে গেছে কচি সে মুখখানি,
দুধে-ধোওয়া কচি দাঁতের হাসি।
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলি ফুলের রাশি ,
ঢুকেছে হায় শশ্মানঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে তাই হৃদয় শশ্মান-বাসী ।সবচেয়ে যে ছোটো কাপড়গুলি
সেগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোটো
আজকে সেটি শূন্যে পড়ে কাঁদে,
সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিলো
সে গিয়েছে সবার আগে সরে
ছোট্ট যে জন ছিল রে সব চেয়ে
সে দিয়েছে সকল শূন্য করে ।
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
মানবতাবাদী
|
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙ্গা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ
ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র
কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে।…বংশে বংশে নাহিক তফাত
বনেদি কে আর গর্-বনেদি,
দুনিয়ার সাথে গাঁথা বুনিয়াদ্
দুনিয়া সবারি জনম-বেদী।
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
স্বদেশমূলক
|
ভোমরায় গান গায় চরকায়, শোন ভাই!
খেই নাও, পাঁজা দাও, আমরাও গান গাই।
ঘর-বার করবার দরকার নেই আর,
মন দাও চরকায় আপনার আপনার!
চরকার ঘর্ঘর পড়শীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর ক্ষীর-সর, -আপনায় নির্ভর!
পড়শীর কন্ঠে জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া। ঝর কায় ঝুর ঝুর ফুর ফুর বইছে!
চরকার বুলবুল কোন বোল কইছে?
কোন ধন দরকার চরকার আজ গো?
ঝিউড়ির খেই আর বউড়ির পাঁজ গো!
চরকার ঘর্ঘর পল্লীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর ঘির দীপ, -আপনায় নির্ভর!
পল্লীর উল্লাস জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! আর নয় আইটাই ঢিস-ঢিস দিন-ভর,
শোন বিশকর্মার বিস্ময়-মন্তর!
চরকার চর্যায় সন্তোষ মনটায়,
রোজগার রোজদিন ঘন্টায় ঘন্টায়!
চরকার ঘর্ঘর বস্তির ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর মঙ্গল, -আপনায় নির্ভর!
বন্দর-পত্তন হঞ্জে সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! চরকায় সম্পদ, চরকায় অন্ন,
বাংলার চরকায় ঝলকায় স্বর্ণ!
বাংলার মসলিন বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন-তৌলেই কিনতেন একদিন।
চরকার ঘর্ঘর শ্রেষ্ঠীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর সম্পদ, -আপনায় নির্ভর!
সুপ্তের রাজ্যে দৈবের সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! চরকাই লজ্জার সজ্জার বস্ত্র।
চরকাই দৈনের সংসার-অস্ত্র।
চরকাই সন্তান চরকাই সম্মান।
চরকায় দুঃখীর দুঃখের শেষ ত্রাণ।
চরকার ঘর্ঘর বঙ্গের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর সমভ্রম, -আপনায় নির্ভর!
প্রত্যাশ ছাড়বার জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! ফুরসুৎ সার্থক করবার ভেলকি!
উসখুস হাত! বিশকর্মার খেল কি!
তন্দ্রার হুদ্দোয় একলার দোকলা!
চরকাই একজাই পায়সার টোকলা।
চরকার ঘর্ঘর হিন্দের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর হিকমৎ, -আপনায় নির্ভর!
লাখ লাখ চিত্তে জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! নিঃস্বের মূলধন রিক্তের সঞ্চয়,
বঙ্গের স্বস্তিক চরকার গাও জয়!
চরকায় দৌলত! চরকায় ইজ্জৎ!
চরকায় উজ্জ্বল লক্ষীর ইজ্জৎ!
চরকার ঘর্ঘর গৌড়ের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর গৌরব, -আপনায় নির্ভর!
গঙ্গায় মেঘনায় তিস্তায় সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া! চন্দ্রের চরকায় জ্যোৎস্নার সৃষ্টি!
সূর্যের কাটনায় কাঞ্চন বৃষ্টি!
ইন্দ্রের চরকায় মেঘ জল থান থান।
হিন্দের চরকায় ইজ্জৎ সম্মান!
চরকার দৌলত! ইজ্জৎ ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর হিম্মৎ, -আপনায় নির্ভর!
গুজরাট-পাঞ্জাব-বাংলায় সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.