poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
এই কবিতার খাতা ছাড়া আর কার কাছে এমন অঝোরে
অশ্রুপাত করা যায়
কার কাছে প্রাণখুলে লেখা যায় চিঠি,
বলা যায় সব দুঃখ, পাপ, অধঃপতনের কথা
আর কার বুকে আঁকা যায় রবীন্দ্রনাথের মতো
অসংলগ্ন, বিপর্যস্ত ছবি!
একমাত্র কবিতার খাতা ছাড়া কোথায় লুকানো যায় মুখ
আর কোন নীলিমায় এমন স্বচ্ছন্দ ওড়া যায়
কোন স্বচ্ছতোয়া নদীজলে ধোয়া যায় সমস্ত কালিমা
বুক ভরে আর কোন উদার প্রান্তরে নেয়া যায় বিশুদ্ধ বাতাস!
শুধু এই কবিতার কাতা বিরহী যক্ষের মতো সযত্নে
আগলে রাখে স্মৃতি
বহু নিদ্রাহীন রাত্রির দুঃস্বপ্ন, অনন্ত দুঃখের দাহ
আর কতো নীরব নিবিড় অশ্রু বর্ষার মেঘের মতো অবিরাম ঝরে
একমাত্র এই কবিতার খাতা আপাদমস্তক ব্যর্থ মানুষের
চাষযোগ্য একখণ্ড জমি।
এ তার সবচে’ বিশ্বস্ত গৃহ, অন্তরঙ্গ নারী
এই কবিতার খাতা তার একমাত্র নিজস্ব আকাশ,
কেবল নিজের নদী, কেবল নিজের নারী, নিজের সংসার
এই কবিতার খাতা রক্তমাংস স্বপ্নময় শুদ্ধ ভালোবাসা।
এখানেই শুধু অশ্রু সোনালি ডানার চিল হয়ে যায়
দুঃখ হয়ে যায় মেঘ, স্বপ্ন হয়ে যায় শেশবের ঘুড়ি,
নিঃসঙ্গতা হয়ে ওঠে মনোরম হার্দ্য বেলাভূমি
উপেক্ষার ধূলি হয়ে ওঠে মুহূর্তে রঙিন স্নিগ্ধ ফুল।
এই কবিতার খাতা শুধু সহ্য করে অবৈধ মৈথুন
সহ্য করে ব্রভিচার, পরকীয়া প্রেমের সান্নিধ্য,
এই কবিতার খাতা নিমজ্জমানের একমাত্র ভেলা
শুধু তার কাছে ফেলা যায় দুচোখের জল, বলা যায় হৃদয়ের কথা।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
আমি ছিন্নভিন্ন-বিগত বছরের এটাই সর্বাপেক্ষা
প্রধান সংবাদ
বিশ্বের সমস্ত প্রচার মাধ্যম থেকে একযোগে প্রচারযোগ্য
এই একটাই বিশ্বসংবাদ, আমি ছিন্নভিন্ন
যদিও একান্ত ব্যক্তিগত এই শোকবার্তা কারো মনে
জাগাবে না সামান্য করুণা
তবু মনে হয় এই শতাব্দীর এটাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ
একটি সংবাদ-শিরোনাম : আমি ছিন্নভিন্ন ;
এই কবিতার মদ্যে আমি এই একান্ত জরুরী খবরটাই শুধু
উদ্ধৃত করেছি
শিম্ভের সমস্ত সংবাদ উৎস হতে এই একটাই বার্তা শুধু
প্রচারিত হচ্ছে একটি শতাব্দী ধরে-
মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখো, তার বুকের কাছে মুখ নিয়ে
জিজ্ঞেস করো সে বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
গোলাপের দিকে তাকাও সে বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
বন কিংবা উদ্ভিদের কছে যাও সেও এই একই কথাই বলবে,
অনন্ত নীলিমার দিক চোখ ফেরাও তার কন্ঠে শুনতে পাবে
এই একই ভয়াবহ বার্তা ; আমি ছিনইভন্ন
পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে ফিরে তাকাও
সেও ক্রমাগত আর্তনাদ করে উঠবে, আমি ছিন্নভিন্ন
সৌন্দর্যকে জিজ্ঞেস করো সেও এই একই উত্তর দেবে,
মানুষের শুদ্ধতাকে প্রশ্ন করো সেও নিঃসঙ্কোচে
বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
প্রকৃতি ও শস্যক্ষেত্রের কাছে যাও অন্য কিচুই শুনতে পাবে না,
এমন যে শান্ত জলধারা তার কাছেও যাও
আহত কন্ঠে বলবে সেও দলিত-মথিত, ছিন্নভিন্ন
গোলাপের কৌমার্য, ফুলের শুদ্ধতা আর হৃদয়ের বিশুদ্ধ আবেগ
তারাও এই একই কথা বলবে ;
দেশ ছিন্নভিন্ন, মানুষ ছিন্নভিন্ন,মানুষের সত্তা ছিন্নভিন্ন
যতোই লুকোতে চাই তবুও প্রকৃত সত্য হচ্ছে
আমি ছিন্নভিন্ন,কাঁটায় কাঁটায় বিদ্ধ ও বিক্ষত
ট্রাজিডির করুণ নয়ক যেন চোখের সম্মুখে দেখে
একে একে নিভিছে দেউটি, অগ্নিদগ্ধ স্বর্ণলঙ্কাপুরী
মুহূর্তে বিরান এই সমগ্র জীবন,
হয়তো সম্মুখ যুদ্ধে হইনি আক্রান্ক
ভূমিকম্প কিংবা ঘূর্ণিঝড় তছনছ করেনি উদ্যান,
তবুও তাকিয়ে দেখি আমি যেন ধ্বংসস্তপ
এর ব্যক্তিগত শোকবর্তা যদিও কারোই মনে
বিশেষ চাঞ্চল্য কিছু জাগাবে না ঠিক
তবুও যেমন একটি গোলাপ বলে, একটি উদ্ভিদ বলে,
এই দেশ বলে, মানুষের সত্তার শুদ্ধতা বলে
আমিও তেমনি বলি সব চেয়ে সত্য আর মর্মান্তিক একটি সংবাদ ;
আমি ছিন্নভিন্ন-
আমার সমস্ত সত্তা ছিন্নভিন্ন, ছিন্নভিন্ন আমার শরীর
ছিন্নভিন্ন, তবুও দাঁড়িয়ে আছি।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
এতো ধ্বনিময় কণ্ঠ আমি কখনো শুনিনি কোনো
পাখিদের কাছে
কোনো নদী এমন মধুর কলগীতি
শোনায়নি আর কোনোদিন
যা এই শুনেছি আমি চিরদিন মানুষের মুখে
এতো প্রিয় সম্বোধন, এমন হৃদয়বোধ্য ভাষা
কেবল মানুষ ছাড়া কারো কাছে পাইনি কখনো!
এই যে নীলিমা সেও মানুষের মতো এতো স্নেহ
কভু ঝরাবে না
এই যে প্রকৃতি সেও কারো দুঃখে হবে না তো এমন কাতর,
বুক পেতে এমন আঘাত নেবে, হাত পেতে বিষ
কেবল মানুষ ছাড়া আর কোনো
প্রাণী কি উদ্ভিদ কেউ নেই!
কোনো গোলাপের বুকে এতো কোমলতা আমি
কখনো দেখিনি
যা এই দেখেছি আমি চিরদিন মানুষের বুকে!
মানুষের হৃদয়ের মতো এমন সবুজ তৃন
তৃণক্ষেত্র ফোটেনি কখনো
চোখের জলের
মতো এতো আর্দ্র
কোনো শিশির দেখিনি ঝরে রাতে,
এতো হৃদয়সম্পন্ন কোনো নিবিড় বকুল
আমি পাইনি কোথাও
এমন বেদনা শুধু দেখেছি তো মানুষেরই বুকে
দুঃখে সুখে তাই বারবার ফিরে যাই মানুষের কাছে!
এতো অনুভূতিময় চোখ কোনো ভাস্কর্যেরও চোখে আমি
কখনো দেখিনি
কোনো কুসুমের দিকে চেয়ে দেখিনি তো এমন বিষাদ
যা এই দেখেছি আমি চিরদিন মানুষের চোখে
শিল্পের অধিক কিছু দুঃখের অনল!
|
মহাদেব সাহা
|
স্বদেশমূলক
|
আমি যে দেশকে দেখি সে কি এই স্বপ্নভূমি থেকে জেগে ওঠা
বহুদূরব্যাপী কল্লোলিত, সে কি রূপসনাতন
সে কি আমার সোনার বাংলা, কোনো রূপকথা নয়!
তার চক্ষুদ্বয় তবে এমন কোটরাগত কেন, মুখ জুড়ে সূর্যাস্তের
কালোছায়া,
কেন তার সবুজ গাছের দিকে সহসা তাকালে দেখি
ধূসর পিঙ্গল বর্ণ, নেমেছে তুষার আর মাছে সারি সারি
কুয়াশার তাঁবু
লোকশ্রুত এই কি সোনার বাংলা শোনা যায় শুধু শোকগাথা!
কেউ কেউ দেশের বদলে তাই মানচিত্র দেখায় কেবল
বলে, এখানে গোলাপ চাষ হয়, এখানে অধিক খাদ্য ফলে
গান শোনে টেপরেকর্ডার বাংলার চিরন্তন মুগ্ধ ভাটিয়ালি
আর বারোমাস পাখির কূজন
তারও কিছু সামান্য নমুনা এই পেটে
যেন মেপে মেপে দেশের মডেল একখানি
অপরূপ কাসকেটে তুলে রাখা আছে!
মৃদু টেপে এখানে পাখিরও গান শোনা যায়, ম্যাপের রেখায় মূত্য
স্নিগ্ধ নদী, শেস্যক্ষেত, সবুজলালিত ঘন পার্ক
সুচারু ফোয়ারা থেকে ঝরে জল পান করে পাথরের
পীতাভ হরিণ
চেয়ে আছে স্বপ্নময় বাংলাদেশ ট্যুরিস্টের মনোরম ম্যাপের পাতায়।
আমি যে দেশকে দেখি সে যে এই স্বপ্নভূমি থেকে উঠে আসা
আপাদমস্তক ভিন্নভিন্ন
সে যে আজো জয়নুলের দূর্ভিক্ষের ছিন্নভিন্ন
সে যে আজো জয়নুলের দুর্ভিক্ষের কাক
আজো বায়ান্নর বিক্ষুব্ধ মিছিল
আজো আলুথালু, আজো দুঃখী,
আজো ক্ষুন্ন পদাবলী!
তার কনকচাঁপার সব ঝাড় কেটে আজ সেখানেই বারুদ
শুকানো হয় রোদে
আর চন্দ্রমল্লিকার বনে আততায়ীদের কী জমাট আড্ডা বসে গেছে,
নিষ্পত্র নিথর লেকালয় দুঃখ-অধ্যুষিত
সেই পিকাসোর বেয়াড়া ষাঁড়টি যেন তছনছ করে এই নিকানো
উঠোন ঘরবাড়ি
লোকশ্রুত এই কি সোনার বাংলা, এই কি সোনার বাংলা!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
অষ্টপ্রহর নদীর ধারা গভীর বহনীয়
বুকের মধ্যে সামান্য জল সহজ স্মরণীয়;
সাগর জোড়া নোনা জলের গহীন গহনতা
বুকের ভিতর শান্ত জলে অশান্ত তীব্রতা।
চোখের ধারা বুকের ধারা উষ্ণ অধীর জল
তাহার চেয়ে সাগর নদী সরল সমতল;
নদীর ধারা নদীর বুকে সহজ বহে যায়
বুকের গোপন জলের ধারা কোথায় রাখি হায়!
সাগর ভরা জলের চেয়েও আমার বুকে জল
তোমার গভীর সংবেদনায় নিবিড় টলমল।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
আমাকে এখন শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়
শহরের বখাটে মাস্তান,
আধুনিকতার পাঠ নিতে হয় প্রস্তরযুগের
সব মানুষের কাছে;
মাতালের কাছে প্রত্যহ শুনতে হয় সংযমের কথা
বধ্যভূমির জল্লাদেরা মানবিক মূল্যবোধ সতত শেখায়,
জলদস্যুদের কাছে আমাকে শুনতে হয়
সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-
মানবপ্রেমের শিক্ষা নিতে হয় শিশুহত্যাকারীদের কাছে।
কিন্তু আমার শেখার কথা নদী ও বৃক্ষের কাছে
ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতা,
বিবেক, বিনয়, বিদ্যা আমাকে শেখাবে এই উদার আকাশ
জুঁই আর গোলাপের কাছ থেকে সৌহার্দের মানবিক রীতি,
অথচ এখন প্রতিদিন ঘাতকের কাছে
আমাকে শুনতে হয় মহত্ত্বের কথা;
মূর্খ ইতরের কাছে নিতে হয় বিনয়ের পাঠ
দেশপ্রেম শিক্ষা দেয় বিশ্বাসঘাতক বর্বরেরা,
ক্ষমা আর উদারতা শিক্ষা দেয় হিংস্র
নখদাঁতবিশিষ্ট প্রাণীরা
স্নেহ ও প্রীতির সুমধুর গান গায় সব ধূর্ত কাক।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
সঙ্গমে সৎকারে নেমে মানুষের দূরে আরো এক অতিদূরে
চলে যেতে হয়
আরো এক বিশুদ্ধ জল তুলে নিয়ে আপাদমস্তক সিক্ত
করে নিতে হয়। অতৃপ্ত তৃষ্ণা ক্লান্ত, সুখী, শোকমগ্ন
কিংবা শিহরনস্নাত মুখ শিশুদের মতন নিরীহ
তোমরা মানুষ, এই মায়া তোমাকে সম্ভব। এই প্রেমে, এই তৃষ্ণা, এই
সফলতা, এইভাবে একে একে সংজ্ঞাহীন অবগাহনে গমন।
কোনো একদিন এই মায়াময় পথের সীমায় হবে দুজনের মুখোমুখি দেখা
কেউ কাকে শুধাবে না, তবু সেখানে জন্মাবে আবার এই আত্মঘাতী
মানুষের মেধা, মনুষ্যতা
না হলে তোমরা নারী শুধু ঊরুসর্বস্ব অশ্লীল মেয়ে, শুধু স্থূল
সঙ্গমের স্পৃহা
জন্মহনি জন্ম দিয়ে যাবে। মনে হয় তোমাদের একদিন ক্রমান্বয়ে
নেমে যেতে হবে
দূরে, আরো অব্দি দূরে যেতে যেতে সঙ্গমে সৎকারে নেমে
আরো এক বিশুদ্ধ মাটির মর্ম জেনে নিতে হবে। কী সে প্রতিমা
কী সে প্রতীক, তোমরা তাহারও বেশি উদ্দামতা পাবে।
না হলে এ নারী হবে ঊরুর অশ্লীল, কোনো মর্মগ্রাহী নয়
মাত্র গ্রীসের গণিকা, মেয়ে অধর্ম অশ্লীল!
কোনো একদিন, একদিন সঙ্গমে সৎকারে নেমে মানুষের আরো
দূরে, আরো অতি দূরে চলে যেতে হয়।
আরো এক শস্যের সম্মুখে এসে ক্লান্ত করতল মেলে ধরো
আরো এক শস্যের সম্মুখে এসে নতজানু হও আরো এক শস্যের
সম্মুখে এসে
নগ্ন হও তোমরা এখন
তোমরা প্রার্থনা করো হে মানুষ, নগ্ন নতজানু সঙ্গমের সহিষ্ণু মানুষ
সৎকারের সন্তপ্ত মানুষ, তোমরা প্রার্থনা করো
আসন্ন মানুষ যারা তোমাদের সঙ্গমে সৎকারে জন্ম নেবে
তারা যেন জয়ী হয়, তারা যেন না হয় এমন আর বারবার
তোমাদের মতো ব্যর্থ পরাজিত, ব্যর্থ পরাজয়ে নত।
যতোদূর যেতে পারে
নেমে যাও সঙ্গমে সৎকারে প্রেমে সহিষ্ণু মানুষ
সেই এক জলোদ্ভব হোক, শুদ্ধ সনাতন মাটি সেই
মহিমামন্ডিত মর্তোদ্ধার। ক্ষেতময় অপেক্ষায় আছে
তোমাদের শুষ্ক পক্ব পরিণত ধান
নেমে যাও সঙ্গমে-সৎকারে-প্রেমে সহিষ্ণু মানুষ
দূরে, আরো এক অতিদূরে, কাছে ।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
স্বপ্নের ভেতর, স্মৃতির ভেতর, এই
একার ভেতর আমি
অনন্তকাল ডুবে আছি;
বার্চবন, স্নেজগাড়ি, দূরের ঘন্টাধ্বনি
আমার স্মৃতির মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে
সুদূর বাতাস, ধূ-ধূ ঝাউবীথি-
দেখি সূর্যাস্তের ছায়ার ভেতর আরো অশরীরী
নগ্ন নর্তকীরা সব
আরো স্বপ্নের ভেতর
আরো স্মৃতির ভেতর
আরো ছায়ার ভেতর ক্রমাগত ডুব-সাঁতার
দিতে দিতে, ডুব-সাঁতার
দিতে দিতে
এই অপরাহ্নে খুব ক্লান্ত একা একটু বসতি চাই
স্থিতি চাই আমি;
আমি চাই আমার ভেতরে অপরূপ ম্লান কুয়াশায়
যেন ফুটে উঠি।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমি তার শুশ্রূষা হারাবো?
এই ভোরের শিশির, উদাসীন মেঘ,
স্নিগ্ধ বনভূমি
আমি তার সান্নিধ্য পাবো না?
আমাকে কি ফেলে যেতে হবে এই নদীর কল্লোল
ভাটিয়ালি গান, কাশফুল, চেনা ঝাউবন
এই দিঘি, জলাশয়, প্রিয় সন্ধ্যাতারা-
ফেলে যেতে হবে এই স্মৃতির উঠোন
প্রেমিকার মুগ্ধ চোখ, মায়াময় দিব্য হাতছানি?
ফেলে যেতে হবে শৈশবের স্মৃতিময় দিব্য হাতছানি?
ফেলে যেতে হবে শৈশবের স্মৃতিময় মাঠ,
হাটখোলা
বৃক্সের পবিত্র ছায়া, তৃণক্ষেত্র, গ্রামের অথই বিল
শহরের এই ফুটপাত, উত্তাল রেস্তরাঁ।
এই নদ কি আমার নয়, বৃক্ষ কি আমার নয়,
এই নদী কি আমার নয়, বৃক্ষ কি আমার নয়,
ভাঁটফুল, বর্ষার কদম,
নতুন ধানের গন্দ, বৈশাখের মেলা,
রুপালি ইলিশ? ফেলে যেতে হবে মায়ের মধুর স্মৃতি
পিতার অন্তিম শয্যা,
বোনের আদর, ভাইফোঁটা, তুলসীমঞ্চ
সন্ধ্যাপ্রদীপ-
বাউলের গান, সুফী দরবেশের ধ্যানী দৃষ্টি
শরতের শুভ্র সকাল, বৃষ্টিভেজা দোয়েল-শালিক?
আমাকে কি অবশেষে ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তর মতো
ফেলে যেতে হবে এই বাস্তভিটা, ভদ্রাসন,
রাইসরিসার ক্ষেত,
ফেলে যেতে হবে পান্ডুলিপি, কবিতার খাতা!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমার কোনোদিন সমুদ্রদর্শন হয়নি, পাহাড় দেখাও না
কেন যে সমুদ্র বা পাহাড় আমাকে এমন বিমুখ করেছে
সমুদ্র আমাকে দর্শন দেননি কখনো
পাহাড় আমাকে সান্নিধ্য,
বাল্টিকের তীরে দাঁড়িয়ে আমি যেমন ধু-ধু জলরাশি ছাড়া
কোনো সমুদ্রই দেখতে পাইনি আর
তেমনি ময়নামতির পাহাড়েও প্রস্তরীভুত নিস্তব্ধতা,
এই আমার পাহাড় কিংবা সমুদ্রদর্শন!
হয়তো সমুদ্র দেখতে গিয়েই আমার তখনই
মনে পড়ে যায় একটি নিঃসঙ্গ চড়ুই কিংবা কাকের করুণ মৃত্যু
কিংবা মাতিসের কোনো নীল চোখের দিকে তাকিয়েই মনে হয়
সমুদ্র
কখনো কপালকুণ্ডলার আখ্যান জুড়েই উচ্ছল হয়ে ওঠে
নীলফেনিল তরঙ্গমালা!
কিন্তু আমি তো সমুদ্রই দেখতে চেয়েছিলাম তবুও সমুদ্রের কাছে গিয়ে
আমার কখনো সমুদ্র দেখা হয়নি
যেমন পাহাড়ের কাছে গিয়ে দেখা হয়নি কোনো নিবিড় পাহাড়কে,
আমি সেখানে উচ্চতা ছাড়া পাহাড় বলতে কিছুই দেখিনি!
এই সমুদ্র আমাকে চিরদিন বিমুখ করেছে
সমুদ্রের গায়ে হাত রেখে তাই তাকে
কেমন আছে বলে কুশল প্রশ্ন করতে পারিনি কখনো,
যতোবারই তাকিয়েছি ততোবারই মনে হয়েছে ব্যর্থতা
এক অর্থে এই ব্যর্থতার নামই সমুদ্র কিংবা পাহাড়;
পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যে ঈশ্বর জানেন কোথায় যেন কি
মিল আছে
হযতো তাই পাহাড়কে কখনো আমার মনে হয়েছে তরঙ্গময়
সমুদ্রকে শিলাশোভিত;
আমি হয়তো সমুদ্রের মধ্যে আরো কোনো পৃথক সমুদ্র সন্ধান
করেছিলাম কি না কে জানে
পাহাড় কিংবা আকাশের দিকে তাকিয়েও ঠিক তেমনি
অন্য কোনো স্বপ্ন-কোনো আভাস
তাই এখন কেবল মনে পড়ছে বাল্টিক কিংবা আরব সাগরের কূলে
আমি একটিও ঝিনুক কিংবা শঙ্খ কুড়াইনি কখনো
ক্যামেরায় সমুদ্রের ছবি তোলার দুঃসাহস করবো কীভাবে
সমুদ্রের কাছ থেকে আমি উপহার পেয়েছিলাম সামান্য যা টাকাকড়ি
তার নাম ব্যর্থতা;
চিরকাল পাহাড় ও সমুদ্রদর্শন করতে গিয়ে
আমার লাভের মধ্যে এই কিছু পবিত্র বিষাদ অর্জন!
তাই সমুদ্র দেখতে গিয়ে আমার সমুদ্রদর্শন হয়নি
পাহাড় দেখতে গিয়ে পাহাড় দেখা,
না দেখেছি পাহাড় না দেখেছি সমুদ্র
অথচ কী যে দেখতে দেখতে কী যে দেখতে দেখতে
আমার কতোবার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে
হয়তো আমি কিছুই দেখিনি সেই না-দেখাটাই ছিলো আমার
সমুদ্রদর্শন, আমার পাহাড়-প্রবেশ।
সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে তাকিয়ে কখন মনে পড়েছে
আমার মায়ের অশ্রুভেজা দুটি চোখ
সমুদ্রকে তার সেই সিক্ত ও সজল চোখের চেয়ে বিস্তৃত মনে
হয়নি আমার,
যে চোখ এতো অশ্রু ও মমতা ধারণ করে আছে তার দিকে তাকিয়েই
আমি বলেছি এই তো সমুদ্র!
হতে পারে সমুদ্রকে এভাবেই আমি ভিন্ন ও পৃথক রূপে দেখে
ভীত ও শিহরিত হয়েছিলাম।
আবার আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতেই আমার কখন যে
বাংলাদেশের একজন ক্ষুধার্ত কিশোরীর মলিন ছেঁড়া শাড়ির কথা
মনে পড়ে যায়, বলতে পারবো না
আকাশের চেয়ে তার দারিদ্র্যকেই বেশি বড়ো মনে হয় আমার
আমি কি করবো, সমুদ্র দর্শনের ঠিক একাগ্রতাই হয়তো আমার নেই
কিংবা আকাশ কি পাহাড় দেখার সঠিক মনোযোগ,
তাই সমুদ্র দেখতে দেখতে আমার মধ্যে জেগে ওঠে সামান্য একটি
চড়ুইয়ের মৃত্যুদৃশ্য
আকাশ দেখতে দেখতে আমার মনে হয় আমি বুঝি
সারা বাংলাদেশ জুড়ে কেবল বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ি টানানো দেখছি,
পাহাড় দেখতে গিয়ে কতোবার যে আমি এমনি আহত হয়ে
ফিরে এসেছি
সকলে সুদৃশ্য পাহাড় দেখলেও আমি সেসবের কিছুই দেখিনি।
তাই এসব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে বললে
তখনই কেবল চোখের সামনে পাহাড় ও অকূল সমুদ্র
ভেসে ওঠে
চোখের জলই আমার মনে হয় সমুদ্র
অটল মৌনতাই আমার কাছে পাহাড়;
কিন্তু সমুদ্রের সেই পৃথক সুন্দর রূপ আমি স্পষ্ট দেখতে পারিনি কখনো
তাই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বারবার আমি দেখেছি জলের দম্ভ
অনেকটা মরুভূমির মতোই শূন্য ও ধূসর সে, এখানেই তো
বালিরও উদ্ভব
পরক্ষনেই সমুদ্রে জাহাজগুলোকে ভাসতে দেখে
আমার মনে হয়েছে অনন্তের মধ্যে সাঁতার কাটছে তোমার রাজহাঁস,
মাছগুলো এই সমুদ্রের রহস্যের মতোই লাল ও উদাসীন
সূর্যাস্ত আর গোধূলিও যেন এই সুমদ্রের মধ্যেই শুয়ে আছে!
কখনো এই সমুদ্রের মধ্যেই আমি দেখেছি জ্বলজ্বল করছে
অসংখ্য তারা, চাঁদ ভাসছে সমুদ্রে
হঠাৎ সমুদ্রের মধ্যে এই নীলাকাশ দেখে
আমি কেমন বিহ্বল ও অনুতপ্ত হয়ে পড়ি;
আর আমার সমুদ্র দেখা হয় না, সমুদ্রের কলতান
আমার কাছে মনে হতে থাকে তোমার ব্যাকুল আহ্বান যেন,
তাই কেউ যখন পাহাড়ের উচ্চতা মাপতে যায়
আমি তখন মৌনতা বিষয়ে ভাবতে থাকি।
আমি হয়তো সমুদ্রে ঠিক সমুদ্র দেখতে পাই না
পাহাড়ে ঠিক পাহাড়,
হয়তো সমুদ্রের চেয়েও কিছু বেশি পাহাড়ের চেয়েও কিছু অধিক
আমি সেই সমুদ্র ও পাহাড়কেই হয়তো নাম দিতে চাই কবির তন্ময়তা।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো খুঁটে খুঁটে দেখি যদি হয়,
যদি কিছু হয়
যদি একটি পাখিরও মৃদু ঠোঁট হয়ে ওঠে নিরুপায় শিথিল
অক্ষরে
চোখের অধীর অশ্রু যদি কাঁপে এ-কারের ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে
আমি তা জানি না; আমি শুধু অবিচল মুদ্রাকরের মতন
কালিঝুলি-মাখা এই কেসের ভিতরে সারাক্ষণ চালাই
আঙুল।
এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো জড়ো করি
আর ভেঙে ফেলি
কখনো ঘনায় মেঘ কখনোবা রঙিন সূর্যাস্ত নেমে আসে
টাইপের এই জীর্ণ কেসের গহ্বরে
কখনো একটি ভাঙা আ-কার খুঁজতে গিয়ে দেঝি তার গায়ে কতো রহস্যের
রাঙা স্পর্শ লেগে আছে, এ-কার কখনো দেখি তন্ময়ের
তীরে একা-একা,
আমি তবু ভাঙি আর জড়ো করি এই ব্যর্থ বর্ণের ব্যঞ্জনা।
মাঝে মাঝে আমিও কখনো হয়ে উঠি রোমাঞ্চিত যদি দেখি
একটিও সফল আ-কার কোনোখানে বসিয়েছি ঠিক,
আর তাই তো কখনো আমি পড়তে দিইনি ধুলো এই কালো
এ-কারে আ-কারে
তারা যেন ক্ষেতের সোনালি পাকা ধান, থোকা থোকা
পড়ে থাকা জুঁই!
আমি এই অসহায় চিহ্নগুলোকে নিয়েই হয়তো বানাতে
চাই ব্যাকুল বাগান
হয়তো ফোটাতে চাই তারই ডালে প্রত্যাশার গাঢ় স্বর্ণচাঁপা
এমনও হয়তো আমি তারই মাঝে ফুটিয়ে তুলতে চাই
জ্যোৎস্নার নিবিড় জড়োয়া!
এই তো আমার তুচ্ছ কাজ আ-কার এ-কারগুলো তুলি আর
তুলি ভেঙে ফেলি
দেখি যদি হয়, যদি কিছু হয়
কোনো মুখ, কোনো নাম, কোনো প্রিয় স্মৃতির রুমাল
যদি হয়, যদি কিছু হয় একটি আ-কার জুড়ে দিলে
সেই বিস্ফারিত চোখ, জলাশয়, চিত্রিত হরিণ
কিংবা পর্যটনের পাখিটি;
তাই তো এমন মনোযোগে
এতো রাশি রাশি অক্ষরের ফাঁকে বসিয়েছি এই ভালোবাসার
এ-কার
আ-কার তখনো বাকি আমি ভাবি বুঝি আ-কার এ-কার
জুড়ে দিলে
অনায়াসে হয়ে যাবে তোমার প্রকৃতি
তাই তো মেখেছি এতো কালিঝুলি এই হাতে, এই দুটি
হাতে!
যদি হয় এই ব্যর্থ আ-কার এ-কারগুলো তুলে কোনো মগ্ন
মাটির বারান্দা
পাতার ছাউনি আর গ্রিলের লতানো নিশ্চয়তা যদি হয়
একখানি ঘরোয়া ইমেজ;
সেই ভেবে রেফ আর অনুস্বরগুলো প্রায় ছুঁইনি আঙুলে
কেবল পরেছি এই আহত কপালে আমি অকারণ বিস্ময়ের ফোঁটা
আর মাঝে মাঝে প্রশ্নের দরোজাখানি খুলে ডেকেছি তোমাকে
যদি হয়, যদি কিছু হয় এই আ-কার এ-কারগুলো থেকে
রঞ্জিত বা গূঢ় উচ্চারিত!
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
যতোই চাও না কেন আমার কন্ঠ তুমি থামাতে পারবে না,
যতোই করবে রুদ্ধ ততোই দেখবে আমি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়।
আমার কন্ঠকে কেউ কোনোদিন থামাতে পারেনি যেমন পারেনি
কেউ কোনো কালে ঠেকাতে অরুনোদয়,
চাও বা না চাও নৈঃশব্দ্যেও যদি কান পাতো
শুনবে আমারই কণ্ঠস্বর।
কীভাবে আমার কণ্ঠ সম্পূর্ণ রাখবে রুদ্ধ করে
আমি তো পাখির কলস্বরে হই উচ্চারিত,
কখনো নদীর শব্দে কখনোবা শস্যক্ষেতে বাতাসের ছন্দে
বেজে উঠি
আমার নিষিদ্ধ কণ্ঠ দেখবে তুমুল ওঠে বেজে,
আমার কণ্ঠকে কেউ থামাতে পারেনি, পারবে না।
আমাকে নিষিদ্ধ করে লাব নেই, আমি নিষেধ মানি না
সমস্ত নিষিদ্ধ পোস্টার আমি লাগিয়েছি বুকে, কেউ
সরাতে পারেনি
আমার কণ্ঠেই তবু অবিরাম স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা;
তোমাদের সাধ্য নেই আমার কণ্ঠকে কেউ রুদ্ধ করে রাখো।
তোমাদের কোনো অস্ত্রে আমার কণ্ঠকে তুমি থামাতে পারবে না
যতোই আমাকে তুমি পরাবে মিকল, যতোই করবে রুদ্ধ
এই কণ্ঠস্বর,
দেখবে ততোই আমি শব্দহীন নীলিমার মতো ধ্বনি-
প্রতিধ্বনিময়, বিচ্ছুরিত
আমার কণ্ঠকে তাই ঠেকাতে পারবে না, কখনো পারবে না।
|
মহাদেব সাহা
|
স্বদেশমূলক
|
আমাকে দেখাও তুমি দূরের আকাশ, ওই
দূরের পৃথিবী
আমি তো দেখতে চাই কাছের জীবন;
তুমি আমাকে দেখাতে চাও দূর নীহারিকা
সমুদ্র-সৈকত
বিস্তৃত দিগন্তরেখা, দূরের পাহাড়
তুমি চাও আরো দূরে, দূর দেশে
আমাকে দেখাতে কোনো রম্য দ্বীপ, স্নিগ্ধ
জলাশয়
আমি চাই কেবল দেখতে এই চেনা সরোবর,
কাছের নদীটি।
আমাকে দেখাতে চাও বিশাল জগৎ, নিয়ে যেতে
চাও অনন্তের কাছে
আমার দৃষ্টি খুবই সীমাবদ্ধ-
অতো দূরে যায় না আমার চোখ;
কেবল দেখতে চাই জীবনের কাছাকাছি
যেসব অঞ্চল-
দূরের নক্ষত্র থাক তুমি এই নিকটের মানচিত্র
আমাকে দেখাও;
দেখাও নদীর কুল, চালের কুমড়োলতা,
বাড়ির উঠোন
দূরের রহস্য নয়, কেবল বুঝতে চাই
তোমার হৃদয়।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
বৃষ্টির কথা থাক, বিরহের কথা বলি।
শুনাই দুজনে বিদ্যাপতির বিষণ্ন পদাবলী,
বর্ষার কথা থাক, বকুলের কথা বলি।
ঝরা বকুলেই ভরে রাখি এই প্রশস্ত অঞ্জলি।
আকাশের কথা থাক, হৃদয়ের কথা শুনি।
যদিও বিরহ তবু মিলনের স্বপ্নজালই বুনি,
অশ্রুর কথা থাক, আবেগের কথা শুনি-
সহস্র রাত কেটে যাক
দূর আকাশের তারা গুনিব।
গরিমার কথা থাক, বিনয়ের পাঠ ধরি।
কলহের কোনো কাজ নেই, কিছু করুণার গান করি।
বিদ্যার কথা থাক, প্রেমের কবিতা পড়ি।
চারদিকে এই জলধারা তবু সৃষ্টির দ্বীপ গড়ি।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
সীতা, তুমি এখন কলকাতায় বসে বসে
আমাদের বন্যার খবর পড়ছো
প্রতিদিন খবরের কগজের পাতায় দেখছো সেইসব
প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায় দেখছো সেইসব
বন্যাদুর্গত মানুষের দুঃস্থ ফটোগ্রাফ
বন্যায় যাদের ঘরদোর ভেসে যাচ্ছে
প্রকৃতি যাদের সাথে করছে ভীষণ শত্রুতা
জলদস্যুদের মতো বন্যা এসে যাদের ঘরে অকস্মাৎ হানা দিচ্ছে
লুটে নিচ্ছে ঘরের আসবাব, ভাঙা বেঞ্চ, পৈতৃক পিঁড়ি,
পুরনো আমলের খাতাপত্র,
বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বড়ো বড়ো কাঠের গুঁড়ি,
চালাঘর, ভেড়ে পড়ছে ভীষণ জলের তোড়ে কড়িবর্গা,
ভেসে যাচ্ছে শিশুর খেলনা হাতি, বুড়োদের সারাদিন
বসে থাকার হাতলভাঙা মলিন চেয়ার।
বন্যায় ধসে পড়ছে গ্রামের পোস্টাপিস, স্কুলঘর,
মানুষের সাজানো সংসার
এই ভয়ঙ্কর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বাংলার ভবিষ্যৎ
নিঃস্ব বাংলা আজ কোথায় দাঁড়াবে তার কিছুই জানে না,
এমন সময় হয়তো একদল সমাজকর্মী এসে
তাদের লাল সালুতে লেখা কোনো এক ত্রাণশিবিরে নিয়ে যাবে
দুর্গত বাংলা আজ আশ্রয়শিবিরে করবে
সারারাত অজ্ঞাতবাস;
গতকাল আমরা যখন পল্টন থেকে ফিরছিলাম
কয়েকজন তরুণ আমাদের দিকে এগেয়ে এসে
তাদের চাঁদা তোলার কাপড়খানা মেলে ধরেছিলো
আমার সঙ্গী ওদের হতে দিয়েছিলো একটি আধুলি
আমার পকেটে কোনো পয়সা ছিলো না
আমি তইি ওদের দলে মিশে গিয়েছিলাম।
সীতা, সেবার তুমি ছিলে পূর্ববাংলার এক মফস্বল শহরে
সে-বছর ভীষণ বন্যার খবর দিয়ে তার পাঠিয়েছিলো ইদ্রিস
বন্যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে অসংখ্য পরিবার
তোমার বোধহয় মনে আছে সীতা,
দুর্গাদা তখণ সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছে
আমরা শহরে কতো বড়ো ভিক্ষা মিছিল বের করেছিলাম
তোমার হতে ছিলো সেই লাল ব্যানারেরা একটা অংশ
সে-মিছিল ছিলো
এই বন্যার বিসতৃতির চেয়ে অনেক বড়ো
বন্যা সেদিন আমাদের সীমানা বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
সীতা, আজো তো তোমাদের বিহারে বন্যা
তুমি কি সেদিনের মতোই আজো মিছিলে নেমেছো
কলকাতার রাস্তায়
তাই ঢাকাতেও বেরিয়েছে এতো বড়ো মিছিল;
সীতা, এই ভয়ঙ্কর বন্যায় আমাদের সব
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে,
উল্টে গেরেছ টেলিগ্রাফের তারসুদ্ধ খুঁটি
রেললাইন, মালভর্তি ওয়াগন পড়ে আছে স্টেশনে
তবু আমার মনে হয় এই বন্যা বড়িয়ে দিয়েছে
আমাদের সীমানা
স্তলভাগের চেয়ে জলের দূরত্ব বোধ হয় অনেক কম
জলের ওপর দিয়ে মানুষের কন্ঠ অনেক দূর যায়
কিংবা দুর্যোগে দুর্বিপাকে মানুষে মানুষে কোনো ব্যবধান
থাকে না
খুলে পড়ে টুকরো টুকরো মানুষের অন্তর্গত
অসংখ্য লেবাস
তাই আমি যখন ঢাকার রাজপথে
বন্যাত্রাণ মিছিলের পাশাপাশি
তুমি তখন কলকাতার রাস্তায়।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
সবাই কলহে পটু, মানুষ বড়ো পছন্দ করে না
তবু দেখো মা তোমার উদ্দেশ্যে নীরবে এই
কবিতার দীঘৃ অশ্রুপাত
কেউ সে-কথা জানে না, শুধু আমি জানি এই কবিতা
তোমারই জন্য কতো ভাসিয়েছে বুক।
যাদের ব্যথিত ভেবে এতোদিন প্রকৃতিকে উপেক্ষা করেছি
ভেবেছি যাদের চোখ শ্রাবণের জলভরা নদী,
আজ দেখি তাদের চোখে একবিন্দু শিশিরও জমেনি
অনুভূতিহীন সেইসব চোখে শুধু ধু-ধু মরুভূমি;
তাই সবাই যখন দেখি অশ্রুর চেয়েও এই তীরকেই বেশি
ভালোবাসে
তখন নিজেই মুখ ঢেকে তোমার উদ্দেশে শুধু ফেলি অশ্রুজল।
তোমার সন্তান আমি তীর ছোঁড়া কখনো শিখিনি
শৈশবেও তীরন্দাজ হওয়ার ইচ্ছা কোনোদিন হয়নি আমার,
তাই তোমর উদ্দেশে এই অশ্রুপাত ছাড়া আর কোনো
যোগ্য ভাষা নেই
সবই যখন আজ বড়ো বেশি ব্যস্ত শুধু যার যার প্রাপ্য
বুঝে নিতে
যে যেমন পারে আজ টেক্কা দিয়ে চলে যেতে চায়,
তখন মা একান্ত বৈভবহীন আমি তোমার উদ্দেশে উৎসর্গ করেছি
আমার এই অশ্রুভেজা দীন পঙ্ক্তিমালা;
তাদের কারো মতো আমার তো মূল্যবান মণিমুক্তো নেই
এই ব্যর্থতার অশ্রুবিন্দু দিয়ে তাই তো তোমার জন্য বসে
মালা গাঁথি
তাই রাত জেগে জেগে আমি লিখে রাখি এই দীর্ঘশ্বাস।
রাত্রির আকাশ জানে তোমার উদ্দেশে কতো করি অশ্রুপাত,
মানুষ জানে জানে, ক্রন্দন জানে না।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
আমরা কেউ সঙ্ঘসেবকের দলে নেই, আমরা চিরদহনদাহনপ্রিয়
মানুষের জন্ম সহোদর
আমরা কবি ও কামুক আমরা পূণ্যাত্মা সন্ন্যাসী
আমরা সামাজিক স্বাস্থ্যসুখবঞ্চিত স্বাধীন
আমাদের হাতে শুদ্ধ-সংরক্ত গোলাপ তবু কাঁটার আঘাতে
ক্ষত আহত অস্থির
এই শোকে সুখে বড়ো ভালো আছি, বড়ো ভালো আছি যেন
এই ছায়াতে মায়াতে।
মধ্যরাতে আমাদের দাম্পত্যবিবাহ, সবুজ শরীর সেই
মেয়েদের সঙ্গে সমারোহ
কিন্তু পুনর্জন্ম নাই; একবার জন্মাই মরে যাই।
গোলাপ ও কবির মধ্যে এটুকু সৌহার্দ, এইটুকু মিল
এইভাবে হাওয়ায় হারাবে।
এই ভাঙা ইট, পাথরের ধুলো, পরিপার্শ্ব এই মলিন মধুর
তারা কতো অদম্য উড্ডীন, কতো পূর্ণতার দিকে যাত্রা
কতো সিংহবাহী
সেসবে চাঞ্চল্যহীন আরো সহজ ও গভীর উদাসীন
আমরা চিরগহনগাহনপ্রিয় তোমাদেরই জন্ম সহোদর!
আমরা বন্দী কোথাও নিশ্চিত বন্দী তবু ঠিক কারো কাছে নয়
ফেরার সময় কিছু জন্মমৃত্যু খেলা, কিছু প্রাকৃত তন্ময়
পথের উপরে সেই লাটবন্দী দাম্পত্যবিবাহ
সেইখানে পাথর কুপিয়ে কিছু নদী খাল বন্দর বানানো,
তা ছাড়া তেমন কোনো স্পষ্ট বাসা নেই, যা আছে তা
উশকো খুশকো গলির ভিতর
তেমন গরিব নই ভাঙা বাসা রেখেছি অম্লান
আমাদের অসীম অনন্ত অপচয় মধ্যরাতে দাম্পত্য বিবাহ
আর প্রাকৃত তন্ময়
জমিসুদ্ধ কেঁপে ওঠে কোনো কোনো রাতে এই বিবাহবাসর
কিন্তু কোনো প্রাপ্তির অধিক কাম্য গচ্ছিত রাখিনি
বিদায়ে কাঁদাবে!
শুধু ফেরার সময় মায়া মানুষের মতো, যেন সুখস্পর্শ
যেন অন্ধকারে সম্ভাব্য আলোর এক অদৃশ্য আগ্রহ
যেন সবুজ শিকারী
আমাদের এই বুকে এতোটুকু মায়া শুধু স্পর্শ করে আছে
এতোটুকু ভালোবাসায় খেয়েছে
হয়তো এইখানে কোনো এক ছায়াতে মায়াতে
আমরা বন্দী হয়ে আছি!
তা ছাড়া অন্য কোনোখানে স্বচ্ছ চিহ্ন রাখি নাই
আমাদের পা বড়ো মায়াবী হেঁটে যায় চিহ্নও রাখে না।
দেয়ালে যেটুকু পড়ে মুখ থেকে মধ্যবর্তী দুপুরের ছায়া
সে-ছায়াও অপরাহ্নে মেলাবে,
আমরা জন্মাই মরে যাই আত্মায় আত্মজ কিছু নাই
গোলাপের বংশে জন্ম আমাদের, আমরা কবি, আমরা
সকাম সন্ন্যাসী, আমরা অসংলগ্ন গৃহস্ত মানুষ
কোনো কোনো রাতে কেঁপে ওঠে আমাদের অনন্ত বাসর
আমরা কবি আমর চিরদহনদাহনপ্রিয় তোমাদেরই জন্ম সহোদর!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
এবার বর্ষার জলে ধুয়ে নেবো মলিন জীবন
ধুয়ে নেবো আপাদমস্তক এই ভিতর-বাহির,
নতুন বর্ষার জলে পুনরায় হবো সঞ্জীবিত;
আমি চাই কেবল জীবন জুড়ে অঝোর বর্ষণ
দিনরাত বৃষ্টিজল, দুইকুল ভরা স্নিগ্ধ নদী,
বর্ষার শ্যামল ছায়া, পরিশুদ্ধ বৃষ্টিধারা নব-
এবার বর্ষার জলে ধুয়ে নেবো আমার জীবন !
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
কবির কী চাওয়ার আছে এই রুক্ষ
মরুর নিকট
কী আছে চাওয়ার তার অস্ত্র আর বারুদের কাছে।
নেকড়ের চোখের মতো হিংসা ও লোভের
কাছে কী তার চাওয়ার থাকতে পারে,
বলো, নিষ্পত্র বৃক্ষের কাছে কী তার চাওয়ার আছে
কী আছে চাওয়ার তার অনুভুতিহীন এইসব
হৃদয়ের কাছে;
তেজস্ক্রিয়তার মেঘে ঢাকা এই আকাশের কাছে
কী সে প্রত্যাশা করে বলো।
কী সে চাইবে এই দুষিত নদীর কাছে,
নোনা জল, শূন্য মৌচাকের কাছে-
কী তার চাওয়ার আছে লোহার খাঁচার কাছে,
গরাদের কাছে?
কবির কী চাওয়ার আছে এই রক্তাক্ত হাতের কাছে
তীর, তরবারি আর জল্লাদের কাছে,
এই নখদন্তের নিকট কবির কী চাওয়ার
থাকতে পারে আর।
এই বিষাক্ত নিঃশ্বাসের কাছে কবি কী
চাইতে পারে-
কী তার চাওয়ার আছে বলো, এই সূর্যাস্তের কাছে,
আঁধারের কাছে!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
শেষ বয়সে বিশ্ববাউল
ভিতর-বাহির আউল-ঝাউল,
বেঁধেছি ঘর
পথের ওপর;
সেই পথও কি মিথ্যা বা ভুল!
কোথায় দুরে নীল সরোবর
পদ্ম ফোটে অষ্টপ্রহর;
পাখিরা গায়
ফুল ঝরে যায়,
মন্দাকিনী মগ্ন নিথর।
নিজের ঘরে নিজেই বাউল
এই বয়সে আউল-ঝাউল,
যা ছিলো তা
ছিন্ন কাঁথা,
সব হারিয়ে নিঃস্ব বাউল।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো
বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই
দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি,
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাইএভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ
জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না।
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে
যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই
তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের
সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই
বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার
ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো
বেশি ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে
আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ
থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে
প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার
মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও
জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো
ভালোবেসেছি তোমাকে।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমার সাথে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি
মুহুর্তেই উৎসব-
তুমি যখন চলে যাও সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর
সব আলো নিবে যায়,
বইমেলা জনশূন্য হয়ে পড়ে,
কবিতা লেখা ভুলে যাই।
তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো
মনোরম
একেটি তুচ্ছ বাক্যালাপ অন্তহীন নদীর কল্লোল,
তোমার একটুখানি হাসি অর্থ এককোটি বছর
জ্যোৎস্নারাত
তুমি যখন চলে যাও পৃথিবীতে আবার হিমযুগ
নেমে আসে;
তোমার সাথে প্রতিটি কতাই কবিতা, প্রতিটি গোপন কটাক্ষই
অনিঃশেষ বসন্তকাল
তোমার প্রতিটি সম্বোধন ঝর্নার একেকটি কলধ্বনি,
তোমার প্রতিটি আহ্বান একেকটি
অনন্ত ভোরবেলা।
তাই তুমি যখন চলে যাও মুহূর্তে সব নদীপথ
বন্ধ হয়ে যায়
পদ্মার রুপালি ইলিশ তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে,
পুষ্পোদ্যান খাঁখাঁ মরুভূমি হয়ে ওঠে;
যতোক্ষণ তুমি থাকো আমার নিকটে থাকে
সপ্তর্ষিমণ্ডল
মাথার ওপরে থাকে তারাভরা রাতের আকাশ,
তুমি যতোক্ষণ থাকো আমার এই হাতে
দেখি ইন্দ্রজাল
আঙুলে বেড়ায় নেচে চঞ্চল হরিণ;
তুমি এলে খুব কাছে আসে সুদূর নীলিমা
তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত সঙ্গীতের
অপূর্ব মূর্ছনা
যেন কারো অবিরল গাঢ় অশ্রুপাত;
তোমার সাথে প্রতিটি বাক্য একেকটি কবিতা
প্রতিটি শব্দ শুভ্র শিশির।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
এই দুঃখীর জীবনে তুমি ফোটাও
সামান্য দুটি ফুল,
না হোক গোলাপ-চাঁপা নিরিবিলি
দুইটি বকুল;
আমার তাতেই হবে চাইবো না
অনন্ত আকাশ,
কেবল শিশির দিলে একফোঁটা
ভূলি দীর্ঘশ্বাস।
এই দুঃখীর জীবনে তুমি দিও
এতোটুকু ছায়া,
জলভরা মেঘ যদি নাই পাও
কিছু স্নেহমায়া;
এই দুঃখীর জীবনে তুমি জ্বেলে
দাও সন্ধ্যার আলো-
তাতেই উঠবো হয়ে আলোকিত,
হয়ে যাবো ভালো।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
মা আমাকে বলেছিলো- যেখানেই থাকিস তুই
বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। পয়লা বোশেখ বড়ো ভালো দিন
এ দিন ঘরের ছেলে বাইরে থাকতে নেই কভু, বছরের এই একটি দিনে
আমি সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে দিই
ফুলজল, কে বলবে কী করে কার বছর কাটবে,
বন্যা, ঝড় কিংবা অগ্নিকান্ড কতো কি ঘটতে পারে, তোর তো কথাই নেই
মাসে মাসে সর্দিজ্বর, বুকব্যাথা লেগেই আছে, বত্রিশ বছর বয়েস
নাগাদ এইসব চলবে তোর, জানিস খোকা, রাশিচক্র তোর ভীষণ খারপ,
যেখানেই থাকিস তুই বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। সেদিন সকালে
উঠবি ঘুম থেকে, সময়মতো খাবি দাবি, ভালোয় ভালোয় কাটাবি দিনটা
যেন এমনি মঙ্গলমতো সারাটা বছর কাটে, তোকে না ছোঁয় কোনো
ঝড়ি-ঝাপটা, বিপদ-আপদ
আমি নিজ হাতে একশো-একটি বাতি জ্বলিয়ে পোড়াবো তোর
সমস্ত বালাই ।
মা তোমার এসব কথাই মনে আছে, এমনকি মনে আছে
বছরের শেষে ছুটিছাটায় বাড়ি গেলে পয়লা বোশেখ না কাটিয়ে তুমি
কিছুতেই আসতে দিতে না, বাড়ি থেকে বেরুবার সময়
আমার বুকের মধ্যে পুরে দিতে ভালো থাক তুই শুধু এইটুকু
বিশেষ সংবাদ, আমার
গন্তব্যে তুমি ছড়িয়ে দিতে দুর্ঘটনা, রোগ, শত্রুর উৎপাত থেকে
নিরাপত্তা, হায় এই
সংসার যদি মায়ের বুকের মতো স্বাস্ত্যবান হতো,
তখন আমার বৈশাখগুলি
প্রাকৃতিক দুর্যেগে কাটতো না এমন বিষণ্ন ;
এখন আমার বৈশাখ কাটে ধূলিঝড়ে জানালা দরোজা সব
বন্ধ ঘরে অন্ধকার শবাধারে শুয়ে, মাথার সমস্ত চু্ল
কেটে নেয় ভয়ের বিশাল কাঁচি, সকালে খুলিতে বুলায় হাত মেসের
গাড়ল বাবুর্চি এসে
দেয়ালে তাকিয়ে দেখি এমনি করে বছর বছর ক্যালেন্ডরে পাল্টে যায়
আমার বয়স, গোঁফদাড়ি পুষ্ট হয়, কিছু কিছু পরিচয় ঘটে
তথ্যকেন্দ্রে বসে জেনে নিই দুচারটে নতুন খবর, আবার ঘসে মেজে
উজ্জ্বল করি আমার নেমপ্লেট;
শোনো মা, তোমার সমস্ত কথা মনে আছে, বৈশাখে দোকানে হালখাতা
মহরৎ হতো, বাড়ির উঠোন ভরে খেতে দিতে কলাপাতায় ঘরের
মিষ্টান্ন, আমার জন্যে বানিয়ে রাখতে স্বসি-ক, মা তোমার হাতের দেয়া
স্বসি-ক আমি এমন লোভী দেখো নিঃশেষে খেয়ে বসে আছি, আমার মনের
সসি- আমি আজ খেয়ে বসে আছি;
এখন আমার বছর কাটে বিদেশ বিভুঁয়ে
নানাস্থানে, বেশির ভাগ হোটেলের ভাড়াটে কামরায়, স্টেশনের
ওয়েটিং রুমে, বছরে দুএকবার হাসপাতালে, কখনো কখনো পুলিশ-
ফাঁড়িতেও যাই
ইতস্ত ভবঘুরের মতো ঘুরি, ইদানীং সংবাদ সংগ্রহে
বড়ো বেশি ব্যস্ত থাকি, কেবল আমার সংবাদ আজ আমার
কাছে নিতান্ত অজ্ঞাত;
আমার বছর কাটে ধার-ঋণে, প্রত্যহ কিনি একেকটি দেশলাইর বাক্স
আমিই বুঝি না কেন আজকাল এতা বেশি দেশলাই কিনি আমি
হামেশাই বৈদ্যুতিক গোলযোগে জ্বালাতে হয় নিজের বারুদ
আমার এখন বুঝি ভালো লাগে প্রতিদিন নিজের করতলের গাঢ় অন্ধকারে
জ্বালাতে আগুন, কেননা এখন আমাকে বড়ো বেশি কষ্ট দেয় আমার
নিজের আঙুলগুলি, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ভীষণ আঁধার;
এখন প্রায়শই মতবিরোধ, ঝগড়াঝাঁটি
করে কাটে আমার সময়, কোনো কিচুতেই দুঃখও পাইনে বড়ো, বুকের
ব্যথাটাও বোধ হয় না আজকাল আর, আমার বুকের ওপর দিয়ে প্রমাগত
তুষারঝড় হয়ে গেছে, বুঝি ভূমিকম্পে মরে গেছে
বুকের সমস্ত শহরতলী;
মা তুমি বলেছিলে পয়লা বোশেখে
বাড়ি আসবি তুই, আমার মনে আছে- আমারও
ইচ্ছে করে পয়লা বোশেখ কাটাই বাড়িতে প্রতি বছর মনে
করে রাখি সমনের বছর পয়লা বোশেখটা বাড়িতেই কাটিয়ে
আসবো, খুব সকলে উঠে দেখবো পয়লা বোশেখের সূর্যোদয়
দেখতে কেমন, কিন্তু মা সারাটা বছর কাটে, ক্যালেন্ডার পাল্টে যায়, আমার
জীবনে আর আসে না যে পয়লা বোশেখ।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
শান্ত নদী, একাকী নির্জন,
আকাশ বলে মেঘের উপাখ্যান
দুচোখ বুজে দেখার নামই ধ্যান;
আমি বৃথাই জলের দিকে চাই
হৃদয়ে চড়া, সোঁতাও কাছে নাই-
দেখি কেবল দগ্ধ পোড়া বালি
ছয়ারা দেয় শূন্যে হাততালি,
জীবন জুড়ে দুঃখ লেখে নাম
শূন্যতাই কি সবার পরিণাম?
ভালোবেসে যেদিকে হাত বাড়াই
ধরার মতো কোথাও কিছু নাই,
দেখি শুধু পাহাড় ভেঙে পড়ে
কেন নবীন পাতারাও যে ঝরে!
দুপুর যেন মর্মাহত বন
আকাশ কাঁদে, নদীটি নির্জন।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমার জন্য জয় করেছি একটি যুদ্ধ
একটি দেশের স্বাধীনতা,
তোমার হাসি, তোমার মুখের শব্দগুলি
সেই নিরালা দূর বিদেশে আমার ছিলো
সঙ্গী এমন,
অস্ত্র কিংবা যুদ্ধজাহাজ ছিলো না তো সেসব কিছুই
ছিলো তোমার ভালোবাসার রাঙা গোলাপ
আমার হাতে
ছিলো তোমার খোঁপা থেকে মধ্যরাতে খুলে নেয়া
ভালোবাসার সবুজ গ্রেনেড, গুপ্ত মাইন
স্বর্ণচাপা কিংবা ছিলো বক্ষ থেকে তুলে নেয়া
তোমার ভালোবাসার দেশে আমি স্বাধীন
পরাক্রান্ত।
আমার কাছে ছিলো তোমার ভালোবাসার নীল অবরোধ
তোমার জন্য জয় করেছি একটি যুদ্ধ
একটি দেশের স্বাধীনতা!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
এই একরত্তি জীবনে বলো না কীভাবে সম্ভব ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো দীর্ঘ অনন্ত জীবন,
ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব, অতিশয় ছোটো এ জীবন
একবার প্রিয় সম্বোধন করার আগেই
শেষ হয় এই স্বল্প আয়ু-
হয়তো একটি পরিপূর্ণ চুম্বনেরও সময় মেলে না
করস্পর্শ করার আগেই নামে বিচ্ছেদের কালো যবনিকা;
এতো ছোটো সামান্য জীবনের কীভাবে হবেই ভালোবাসা
ভালোবাসি কথাটি বলতেই হয়তোবা কেটে যাবে সমস্ত জীবন,
হয়তোবা তেমার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই
লেগে যাবে অনেক বছর
হয়তো তোমার কাছে একটি প্রেমের চিঠি লিখতেই
শেষহয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ নিদ্রাহীন রাত;
তোমার সম্মুখে বসে প্রথম একটি শব্দ উচ্চারণ করতেই
শেষ হয়ে যাবে কতো কৈশোর-যৌবন,
ঘনাবে বার্ধক্য, কেশরাজি উড়াবে মাথায়
সেই ধূসর পতাকা;
এইটুকু ছোট্ট জীবন, এখানে সম্ভব নয় ভালোবাসা
তার জন্য চাই আরো অনেক জীবন, অনন্ত সময়
তোমাকে ভালোবাসার জন্য জানি তাও খুবই স্বল্প ও সংক্ষিপ্ত মনে হবে।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
মানুষের যা হবার তাই হয়, মানুষ হয় না
কোনো উদ্ভিন্ন মানুষ-
সম্পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত, অন্তরে বাইরে দ্যুতিময়।
সবুজ বৃক্ষের মতো যথার্থ হৃদয়বান হয় না মানুষ
হয় না সে উন্মুক্ত উদার;
মানুষের যা হবার তাই হয় তার বেশি হয় না সে
আলোকিত প্রবুদ্ধ মানুষ,
হয় না আয়ত্ত তার সব বিদ্যা, সামান্যই হয় শেখা
মানবপ্রেমের পাঠ-
বরং হিংসা আর সহিংসতা চর্চায়ই যায় তার অর্ধেক জীবন
আরো বিশ কিছুকাল যায় ধনুর্বিদ্যা শিখে;
এরপর যেটুকু সময় বাকি থাকে কাটে
অনুশোচনায়, মনস্তাপে
মানুসের যা হবার তাই হয় তার বেশি হয় না যে
পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ মানুষ।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
পরিপূর্ণ পাল্টে দাও আমার জীবন, আমি ফের
বর্ণমালা থেকে শুরু করি-
আবার মুখস্ত করি ডাক-নামতা, আবার সাঁতার শিখি
একহাঁটু জলে;
তুমি এই অপগণ্ড বয়স্ক শিশুকে মেরেপিটে
কিছুটা মানুষ করো,
কেতে দাও আলুসিদ্ধ দুটি ফেনা ভাত।
আবার সবুজ মাঠে একা ছেড়ে দাও তাকে,
একটু করিয়ে দাও পরিচয় আকাশের সাথে
খুব যত্ন করে সব বৃক্ষ ও ফুলের নাম শিখি।
আমূল বদলে দাও পুরনো জীবন, ভালোবেসে
আবার নদীর তীরে নরম মাটিতে শুরু করি চলা
বানাই একটি ছোটো বাংলো খড়ের কুঁড়েঘর;
পুরোপুরি পাল্টে দাও আমার জীবন, আমি ফের
গোড়া থেকে শুরু করি-
একেবারে পরিশুদ্ধ মানুষের মতো করি
আরম্ভ জীবন;
এভাবে কখনো আর করবো না ভুলভ্রান্তি- কিছু
এবার নদীর জলে ধুয়ে নেই এই পরাজিত মুখ,
ধুয়ে নেই সকলের অপমান্তউপেক্ষার কালি।
একবার ভালোবেসে, মাতৃস্নেহে
আমূল বদলে দাও আমার জীবন
দেখো কীভাবে শুধরে নেই জীবনের ভুলচুকগুলি।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
মানুষ মানে জন্মতারিখ, কোষ্ঠীখাতা
বাসস্থান ও বধ্যভূমি
কাগজপত্র, ঘরগেরস্ত, পিতামাতা, নামঠিকানা
অন্যবিধ জাতিগোষ্ঠী আত্মীয়তা
স্ত্রী-পরিবার, নুনমরিচ ও খাদ্যদ্রব্য
মানুষ মানেই জীবনযাপন
এই একাকী বন্দীদশা!
মানুষ মানে হাতের পিঠে ওলটপালট
হিজিবিজি, লিখন
এসব ভাগ্যলেখা,
নদীর জোয়ার, চাঁদের ভাঙন,
চিরকালীন এ সমস্ত শীতসন্ত
ভুলভ্রান্তি
কান্নাকাটি, দুঃখসুখের দালানকোঠা
কৃষিকার্য, জমিজমা, শীতলশাদা বৃষ্টিধারা
হলুদ মাটি, সবুজ তৃণ,
এই বাড়িঘর, এই মনিষ্যি
বিদ্রোহ কি রণসজ্জা
মানুষ মানুষ ভুলভ্রান্তি!
মানুষ মানে আমরা তোমরা
মাথার চুল কি হাতের এ নখ
এই সর্বাঙ্গ চোখকান না জন্মকালীন
নগ্ন শরীর
মানুষ মানে মুখের আদল, এই
আমাকে দেখতে যেমন
আহার-নিদ্রা ঘোরাফেরা রাত্রিকালে
নীরব মৃত্যু!
মানুষ মানে আর কিছু নয়
হস্তাক্ষর ও নীল ফটোগ্রাফ!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
কতেদিন হয়নি যাওয়া আমার সবুজ গ্রামে
সোনাবিল, পদ্মাদিঘি, উত্তরকঙ্গের
সেই ধুলোওড়া পথ, বিষণ্ন পাথার,
আখ মাড়াইয়ের দৃশ্য, ক্লান্ত মহিস
কতেদিন হয়নি দেখা; কতেদিন হয়নি
শোনা দুপুরে ঘুঘুর ডাক, হুতোম পেঁচার
শব্দ ঃ হয়তো এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে
প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গ্রামের নদীটি, কখনো
শহরে সবুজের সমারোহ দেখে এই প্রিয় গ্রামটিকে
মনে পড়ে যায় ঃ কোনো পুরনো দিনের
গান শুনে, দোয়েল-শালিক দেখে
আমি খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি;
ফিরে যাই আমার সবুজ গ্রামে, হাটখোলাটিতে
এখনো টিনের চালে কখনো
বৃষ্টির শব্দ শুনে উত্তরবঙ্গের
সেই দুঃখিনী গ্রামটি মনে পড়ে।
এমন কী আছে তার মনে রাখবার মতো
তবু এই উলুঝুলু বন, বিষণ্ন পাথর
নেহাৎ খালের মতো শুকনো নদীটি, এখনো
আমার কাছে রুপকথার চেয়েও বেশি রুপকথা।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
এই সারাদিন আমি গাছের মধ্যে ডুবে ছিলাম, সারাদিন
আমি নারীর মধ্যে ডুবেছিলাম, তোমার মধ্যে
এই সারাদিন আমার শরীর ফেটে বেরিয়েছে ঘ্রাণ,
ঘাসের মতোই গভীর ও কোমল ভালোবাসা
আমার সারা শরীর ছেয়ে গেছে ঘ্রাণে ঘাসপাতার ঘ্রাণে
এই সারাদিন আমি গাছের মধ্যে ডুবেছিলাম, সারাদিন
সারাদিন আমি নারীর মধ্যে ডুবেছিলাম, তোমার মধ্যে
এই সূর্যাস্ত, এই পৃথিবী, দুয়ার খোলা ঘর
একজন দরবেশ এসে আমাদের অধঃপতনের কথা বলে ফিরে
গেলো
একজন আগন্তুক, একজন প্রেমিক, একজন বাউল
গেলো পথ বেয়ে,
এই সারাদিন আমি গাছের মধ্যে ডুবেছিলাম
সারাদিন আমি নারীর মধ্যে ডুবেছিলাম, তোমার মধ্যে।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
কী অর্থ ধারণ করো তুমি
কোন অর্থবহ,
আমি তো বুঝেছি মাত্র তুমি অর্থ
অনন্ত বিরহ!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
হঠাৎ সেদিন হাতে পেয়ে চিরকুট
নিমিষে সময় হয়ে গেলো যেন লুট;
পার হয়ে বহু বছরের ব্যবধান
কানে ভেসে এলো হারানো দিনের গান।
মনে পড়ে গেলো তোমার প্রতম খাম
আদ্যক্ষরে লেখা ছিলো শুধু নাম,
একটি গোলাপ আঁকা ছিলো এককোণে
র-ফলাবিহীন প্রিয় লেখা পড়ে মনে;
খুব সাধারণ খাতার কাগজে লেখা
লুকিয়ে পড়েছি, হয়নি সেভাবে দেখা
তবু মনে আছে কোথায় কী ছিলো তাতে,
এতোদিন পর চিরকুট পেয়ে হাতে
আবার হঠাৎ কেঁপে ওঠে যেন বুক
নিজেই তখন লুকাই নিজের মুখ;
এই বয়সেও একখানি চিরকুট
তোলে শিহরন, কম্পিত করপুট।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
থাকে না এই জলের রেখা
এই জীবনে সবাই একা।
একলা ঘর, শূন্য ফাঁকা
সুখের কোছও বিষাদমাখা,
উদাস বাউল ঘুরছে পথ
ব্যর্থ-বিফল মনোরথ।
দুর আকাশে আলোর রেখা
আর দুজনের হয় না দেখা।
হাওয়ায় ওড়ে বাদামী চুল
স্বপ্ন যেন আকাশী ফুল;
এই জীবনে হয় না দেখা
সুবর্ণ সেই আলোর রেখা।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
কী এমন হয়, কোথায় কী এমন ওলটপালট হয়ে যায়
একবার আমাকে বললে-
ভালোবাসি;
কেবল একটিবার সমস্ত জড়তা, লজ্জা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে
দুকূল ছাপানো বর্ষার নদীর মতো
উচ্ছল ঝর্নার মতো
সব সঙ্কোচ ও নিষেধের প্রাচীর ডিঙিয়ে
আমার কানের কামে মুখ এনে প্রাচীন মন্ত্রের মতো যদি বলো
শুধু চার অক্ষরের একটি অব্যর্থ শব্দ
চারটি শরের এই মৃত্যুবরণ
চারটি ফলার একটি ব্রহ্মাস্ত্র
চারটি পাপড়ির একটি কুসুম
ভালোবাসা;
যদি একবার এই জড় তোলো,এই
ভূমিকম্প আনো
আমার জীবন ছাড়া তাতে আর বলো কোথায়
কী হয়,
কী এমন হয় একবার এইটুকু উন্মোচিত
হলে
মুমূর্ষের কানে একবার এই
সঞ্জীবনী মন্ত্র শোনালে-
ভালোবাসি;
যা কিছুই হোক, ওলটপালট হয়ে
যাক সবকিছু,
তছনছ হয়ে যাক নাহয় জীবন
সমুদ্রে উঠুক ঝড়, মাটিতে কম্পন
যা কিছুই হোক, তবু একবার
তোমার মুখটি থেকে এই চার অক্ষরের সেই দৈববাণী
হোক।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
কাছে আসো, সম্মুখে দাঁড়াও
খুব কাছে, যতোখানি কাছে আসা যায়,
আমি আপাদমস্তক দেখি তোমার শরীর
যেখাবে মানুষ দেখে, প্রথম মানুষ।
দেখি এই কাণ্ড আর ডালপালাখানি, ভিতর-বাহির
কতোটা পেয়েছে মাটি, কতোটা বা এই জলবায়ু
পায়নি শিকড়খানি, পেয়েছে কি তোমার প্রকৃতি?
কাছে আসো আরো কাছে, সহজেই যেন চোখে পড়ে
তোমার সূক্ষ্ম তিল, আঙুলের সামান্য শিশির
যেন দেখি তোমার সজল চোখ, তোমার মদির সলজ্জতা
দূরদৃষ্টি নেই মোটে, কেবল কেবল সন্নিকটে।
তুমি খুব কাছে আসো, খুব কাছে, ঠিকই খুব কাছে
যতোখানি কাছে এলে আর কোনো আড়াল থাকে না;
সকলেই দূরে আজ, তুমি খুব কাছে চলে আসো
দূর থেকে দেখে আমি কিছুই বুঝি না, বুঝি না।
এবার দেখতে চাই কাছে থেকে খুব কাছে থেকে
যেন ডালপালা, কাণ্ড, ফুল কিচুই না ফেলি,
দেখি সব আলো, সব অন্ধকার, সব,
কিন্তু যতোই নিকটে আসো অন্ধের কী আসে যায়।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
আফ্রিকার বুকের ভেতর আমি শুনতে পাই এই
বাংলাদেশের হাহাকার
বাংলাদেশের বুকের ভেতর আফ্রিকার কান্না;
এশিয়া-আফ্রিকা দুইবোন, দুই গরিব ঘরের মেয়ে!
আফ্রিকার কালো মানচিত্র
যেন বাংলাদেশেরই দারিদ্রপীড়িত গ্রাম,
আফ্রিকার দিকে তাকালে তাই আমার
এই নিপীড়িত বাংলার কথাই মনে পড়ে
হয়তো আফ্রিকার কোনো কবিও বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে
তার আর্ত স্বদেশের কথাই ভাবে,
ঔপনিবেশিক সভ্যতা যাকে নাম দিয়েছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ;
কিন্তু আফ্রিকার মানুষের বুকে আজ আলোর মশাল,
আফ্রিকার চোখে স্বপ্ন!
আমি দেখতে পাই এঙ্গোলার কৃষকের মতোই
বাংলাদেশের ভূমিহীন চাষীও
মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলেছে আকাশে
সে-হাত শোষণের বিরুদ্ধে দুর্জয় হাতিয়ার;
আজ এশিয়া তাকিয়ে আছে আফ্রিকার দিকে
এশিয়ার দিকে আফ্রিকা,
এই কালো মানুষের ধারা এসে মিশেছে এশিয়া-আফ্রিকার গ্রামে;
জানি দারিদ্র্য আমাদের উভয়ের সাধারণ পোশাক
বহু যুগের বিদেশী শাসনের ক্ষতচিহ্ন আমাদের উভয়ের কপালে
তাই আফ্যিকার বুকে যখন রক্ত ঝরে
তখন এই বাংলাদেশের মাটিতেও শিশির-ভেজা ঘাস
মনে হয় রক্তমাখা,
ইথিওপিয়া কিংবা নামিবিয়ার পল্লীতে যখন জেগে ওঠে
সাহসী মানুষ
তখন এই বাংলায়ও প্রাণের জোয়ার জাগে পদ্মা-মেঘনায়;
আফ্রিকা, তোমার দুঃখ বুঝি
আমি জানি বর্ণবাদি শাসনের হাত
একদিন ভেঙে দেবে এই মানুষেরই মহৎ সংগ্রাম
আমি জানি এশিয়া ও আফ্রিকার ঘরে ঘরে একদিন উড়বেই
বিপ্লবের লাল পতাকা,
বাংলার স্বপ্নভ্রষ্ট ফুল তাই তো তাকিয়ে আছে
আফ্রিকার অরণ্যের দিকে-
সেদিন একটি পাখির মতো উড়ে যাবো মেঘমুক্ত আফ্রিকার
সুনীল আকাশে
পদ্মার পাড় থেকে আফ্রিকার স্বচ্ছতোয়া নদীটির পাশে
দেখবো মাথার উপরে দ্বিতীয় আকাশ নেই , আছে শুধু
এশিয়া ও আফ্রিকার অভিন্ন আকাশ!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
মানব তোমার কাছে গড় হয়ে করেছি প্রণাম
ওই ধুলোঘ্রাণ নিয়ে, ওই ধুলোভারসুদ্ধ বুকে নিয়ে
আমি একবার তোমাদের আরো কাছে যেতে চাই
একবার ছুঁতে চাই সর্বমধ্যসীমা।
এ বুকে জমেছে বহু গ্রীষ্ম, বহু শ্যন্য গোলাকার একাকীত্ব
এতো একা ভালো নয়, এমন একাকী ভালো নয়
জনশ্যন্য ভ্রমণের নেশা ছেড়ে
আমি তাই মানবী সংসার তোকে করেছি প্রণাম
ওই সবুজ আহ্বান,নীল আমন্ত্রন,
টুলে বসে কোল জুড়ে উদোম শিশুর হিসি করা
বাদামের খোসা খুলে খুনসুটি, ছেলেখেলা
কাঁটায় পশমবোনা, এইগুলি,
তোমাদের মানবী স্বভাব
পাহাড়ে টিলায় একা নির্জন ভ্রমণ ভুলে
এইবার তার কাছে আত্মসমর্পণ
এই ধুলোঘ্রাণ নিয়ে ধুলোভারসুদ্ধ বুকে নিয়ে
আমি একবার তোমাদের কাছে যেতে চাই
মানব তোমার অতি কাছে যেতে চাই।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
ঝর্নাকে আমি কখনো থামতে দেখি না
নদীকে দেখি না,
বৃক্ষকে কখনো আমি নিঃশেষিত হতে
মোটেও দেখি না;
আকাশকে কখনো দেখি না আমি শেষ হয়ে যেতে
সমুদ্রকে ফুরিয়ে যেতে কখনো দেখি না,
আমি এই চিরপ্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখাকে বলি
কবিত্ব, কবিত্ব;
অনিঃশেষ এই অগ্নি বুকে নিয়ে জেগে থাকে কবি।
এই অফুরন্ত শোকের উৎসব, এই অবিরাম
আনন্দের অনন্ত মূর্ছনা
এই রাত্রিদিন বেয়ে চলা নদীর অন্তর সত্তাকে বলি
কেবল উৎসকে
কেবল কবিত্ব বলি আমি।
এই অনিঃশেষ অগ্নিশিখা, এই অনন্ত অশেষ
জলপ্রপাত
এই চিরপ্রস্ফুটিত আলোকিত ফুল
এই অনন্ত বিদ্যুৎদুতি,
আমি একেই কবিত্ব বলি,
বলি মানুষের সৃষ্টিপ্রতিভা।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
সব ছিন্ন হয়ে যাক, এই মিথ্যা মুখ,
এই মুখের মুখোশ
সম্পূর্ণ পড়ুক খুলে;
এই মিথ্যা মানুষের নকল সম্পর্ক, এই
ভোজভাজি
যা যাওয়ার তার সবই খসে যাক,
ঝরে পড়ে যাক,
ছিন্ন হয়ে যাক এই কৃত্রিম ভূগোল,
এই মিথ্যা জলবায়ু;
স্পষ্ট হোক, প্রকাশিত হোক তার নিজস্ব প্রকৃতি
ছিন্ন হোক এই কৃত্রিম বন্ধন,
অদৃশ্য অলীক রজ্জু
থাক শুধু যা কিছু মৌলিক
পদার্থের যা কিছু প্রধন সত্তা;
সব ছিন্ন হয়ে যাক, খসে যাক,
ঝরে পড়ে যাক
থাক শুধু মৌলিক সত্তা, যা কিছু মৌলিক
আমি আর কোথাও কোনো মুখোশ
রাখবো না,
মুখোশ রাখবো না,
মুখোশের সাথে মিথ্যা সম্পর্কের
এই কঠিন কপট রজ্জু
আজ খুলে ফেলে ছিন্ন করে দেবো;
আমি কোনো মুখোশ রাখবো না,
মুখের বদলে কোনো মুখাকৃতি
মোটেও রাখবো না,
সব ছিন্ন হয়ে যাক, চুকে বুকে যাক
শেষ হয়ে যাক
এই মিথ্যা মুখোশ আমি
মোটেও রাখবো না।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
আমি যেন কী রকম সব কিছুতেই কী রকম
একটা ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব
একটা দুঃখিত দুঃখিত ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব,
বুকের ভিতর আমি ধরে রাখি দুঃখের শিশির
পিতৃপুরুষের সেই বাক্যহীন অন্ধকার,
সেই ডুবুন্ত নৌকার দৃশ্য
আমার এ-বুক যেন ভুবন মাঝির সেই শ্যাওলা-পরা ঘাট
আমি প্রতি রাতে শেষ তারা ডুবে যাওয়া লক্ষ্য করে কাঁদি
তবু প্রকাশ্যে এমন আমি এ-রকম
এই ছেলে মানুষি মানুষি ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব!
আমি দুঃখিত হলেও লোকে ভাবে ও কিচ্ছু না শুধু
দুঃখ দুঃখ ভাব
আমি কাঁদলেও কান্না কান্না ভাব বলে ভাবে,
ভালোবাসলেও আমি ধরে নেয় মাত্র ছেলেখেলা
আমি কেন এ-রকম
এই ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব
আমি কেন অহঙ্কারে হাঁটতে পারি না
দশ হাত ফুলিয়ে বুকের ছাতি,
আমার দুঃখের কথা, লালসার কথা, এই নারীলিপ্সার কথা
কেন সিঃসঙ্কোচে বলতে পারি না,
কেন অবিশ্বাসী হাসি হেসে বলতে পারি না
পাপ বলে কিছু নাই,
আমি ক্ষতিগ্রস্থ হলে, অপমান হলে
জল ছুঁয়ে, ভূমি স্পর্শ করে, নারীর অঙ্গ ছুঁয়ে
কেন আমি কাউকে পারি না দিতে ভয়ঙ্কর ক্রূর অভিশাপ!
আমি কেন এ-রকম সব কিছুতেই
এই ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব, লাজুক লাজুক ভাব।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
এই কবিতার জন্যে কতোবার বদ্ধ উন্মাদের মতো ঘুরলাম
রাস্তায় রাস্তায়
কতোবার আগুনে দিলাম হাত, প্রবল তুষারপাত নিলাম মাথায়;
এই কবিতার জন্যে পঞ্চপাণ্ডবের মতো আবদ্ধ হলাম জতুগৃহে
শুধু এই কবিতাকে ভালোবেসে কতোবার দাঁড়ালাম
পরমানু বোমার বিরুদ্ধে
কতোবার একা বুক পেতে দাঁড়ালাম আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সম্মুখে,
কবিতাকে ভালোবেসে এই পৃথিবীকে কতোবার বাঁচালাম
যুদ্ধ ও ধ্বংসের হাত থেকে।
কবিতার প্রতি এই তীব্র ভালোবাসা ছাড়া
এমন বিরূপ আবহাওয়া ও জলবায়ুতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
কখনো সম্ভব নয় বাঁচা;
এই কবিতার জন্রে কতোবার দাঁড়ালাম বিপদের মুখোমুখি
ট্রাফিক সঙ্কেত ভুলে পথের ওপরে,
কতোবার প্রমত্ত ঝঞ্ঝার মুখে, স্রোতের আবর্তে
এই কবিতার জন্যে খোয়ালাম পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি
যা কিচু সম্বল কানাকড়ি।
এই কবিতার জন্রে আমিও রিলকের মতো গোলাপের দংশনেই
হলাম আহত
আমও বুদ্ধের মতো জরামৃত্যুব্যাধি দেখে হলাম ব্যাকুল;
কতোবার এই কবিতার জন্যে সেই কৈশোর থেকেই
তছনছ করেছি জীবন
এই কবিতার জন্যে আমি আপাদমস্তক ছিন্নভিন্ন এমন ফতুর
ভাঙা শিরদাঁড়া, পোড়-খাওয়া একটি মানুষ
এই কবিতার জন্যে যীশুর মতোই আমি ক্রুশবিদ্ধ।
এই কবিতার জন্যেখনো শিশুর মতো কাঁদি, দুঃখ পাই
এখনো আগের মতোই ঠিক কবিতার জন্যে হই
গভীর ব্যথিত, মণঃক্ষুণ্ন কিংবা উত্তেজিত;
এই কবিতার জন্যে এখনো দাঁড়াই এসে অনায়াসে
সকল ঝুঁকির মুখে আমি
এই কবিতার জন্যে জীবনকে এখনো আমি
এতো ভালোবাসি, এতো ঘৃণা করি।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমার অসুখ নেই আর ; কাল সারারাত
থোকা থোকা মৃত্যু পান করে আমি সুস্থ হয়ে গেছি
আর কোনো অসুস্থতা নেই আজ,
আজ ভালো আছি!
এই হাসপাতালও ভালো আছে বেশ
দিব্যি সেজেগুজে পরেছে গাউন, আর গুনগুন সারাক্ষণ লেগে
আছে ঠোঁটে
আভা আলমের সব গান কেউ কি ক্যাসেট ভরে
রেখেছে এখানে
মৃত্যুর মৃন্ময় মুখ থেকে ঝরে সেই ব্যথিত বিহ্বল
প্রিয়হীন কান্না শুনে মনে হয় গান বাজে, পরিচিত গান
আত্মা সে অসুখ থেকে উঠে এসে অনন্তের পাত্র ভরে
মৃত্যু করে পান।
এতো অসুস্থতা এইখানে ভালোবেসে বাসা বেঁধে আছে,
এই আরোগ্য আবাসে
কতোবার মৃত্যুর মর্মর ধ্বনি শুনি
দেখি পায়ে তার পরেছে নূপুর, করিডোরে
ব্যালে কি মধুর
আর তারই ফাঁকে কখন যে কার ঘরে
লাস্যময়ী মৃদু নক করে!
এই হাসপাতালবাড়ির অলিন্দে উঠোনে টবে
এতো ফুলের সুভাসের শোভা
এতো স্বাস্থ্যকর ফল, এতো ডেটলের বিশুদ্ধ সৌরভ, এতো
সঞ্জীবনী ওষুধের ঋতু
আর আমি অসুস্থ থাকবো না। আমি সেরে উঠি
আমি অসুস্থ থাকবো না।
অসুস্থতা সেরে ওঠো। শীতের শুশ্রুষা পেয়ে
ভালো হয়ে ওঠো
হাসপাতলনিবাস হলো বেশ দীর্ঘ মনোরম, চলো যাই,
চলো ফিরে যাই
কাষ্ঠ আহরণে সেই এসেছি কখন,
কতো বেলা হলো
অবসাদবোধ আর মোহমূর্ছা ছিলো কিছু আগে
এখন শরীরে আর ব্যাধির স্পর্শ নাই, ভালো হয়ে গেছি।
শীতের সেবায় তবে সেরে উঠি, ভালো হই,
সুস্থ, প্রবাহিত হই!
|
মহাদেব সাহা
|
স্বদেশমূলক
|
আজ যেখানেই কান পাতি শুনি সজকলে চাপা কণ্ঠস্বর,
খুব ধীরে কানের নিকটে মুখ এনে
কী যেন বলতে চায় এই ফাল্গুনের বিষণ্ন গোলাপ,
বসন্তের প্রথম কোকিল
মনে হয় কী যেন বলতে চায় প্রতিটি নিঃশব্দ মুখ;
কী যেন বলতে চায় মেঘমুক্ত ভোরের আকাশ গতরাতের কাহিনী
লাইটপোস্ট, আইল্যাণ্ডের নীরব দোয়েল আর
রমনার সবুজ চত্বর আমাকে দেখেই যেন ঠোঁট নাড়ে,
আমাকে দেখেই যেন জ্বলে ওঠে রাতজাগা ইউক্যালিপ্টাসের সারি
সামান্য দূরেই আরো একগুচ্ছ ম্লান স্বর্ণচাঁপা;
তাদের যে-কারো দিকে তাকালেই মনে হয়
কী যেন বলতে চায় তারা।
মানুষের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়
ভীষণ জরুরী কোনো কথা যেন তাদের বলার আছে,
তাই কারো চোখের দিকে চোখ পড়তেই সভয়ে সরিয়ে নিই চোখ
কারো মুখের দিকে ভালো করে তাকানোর সাহস পাইনে-
যদি রমনার সবুজ মাঠ, স্বচ্ছ লেক আর এই নিঃসঙ্গ ফুটপাত
আমাকে বলতে থাকে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
তারা যা দেখেছে চোখ মেলে, প্রত্যহ অভিজ্ঞতা
তারা যা দেখেছে চোখ মেলে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
তারা যা দেখেছে চোখ মেলে, প্রত্যহ যেসব ঘটনার সাক্ষী তারা-
কোথায় রাখবো এতো চাপা উত্তপ্ত নিঃশ্বাস!
তাই তো এমন মাথা হেট করে চলে যাই লজ্জার মুখোশ পরে
কোনোদিকে তাকাইনে বড়ো;
আমি তো শুনিনি তাই কী যেন বলতে চায় ক্ষুধার্ত যুবতী
তার অনাহারী কোলের শিশুটি, রুগ্ন বৃদ্ধা, শোকার্ত তরুণ!
গতরাতে বীভৎস রক্তপাত দেখে আহত গোলাপ
নিজের দেহের রঙ নিয়ে যেন নিজেই লজ্জিত,
সেদিন দুপুরবেলা নিষ্ঠুরতা দেখে একদল গ্রামের শালিক
হয়ে আছে সেই থেকে মর্মাহত, গভীর হতাশ।
সবাই আমার কাছে কী যেন বলতে চায় এই গোলাপ, শালিক
আর ব্যথিত মানুষ,
কী যেন বলতে চায় ঝরাপাতা, মায়ের করুণ অশ্রু, বন্দী স্বদেশ!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
কোনো কোনো মুহূর্তে এই মৃত্যুও হয়ে ওঠে জীবনের গূঢ় অভিষেক
আরো গভীর বাঙ্ময়। সে-মৃত্যু প্রার্থনা করি, সে-মৃত্যু প্রণাম করে যায়
একদিকে তুমি, একদিকে মৃত্যুর মৌনতা যেন বৃক্ষের ছায়ায় আরো
শুদ্ধ পুণ্যশীল
আলোর উপরে আরো কোনো অপার্থিব রোদ এসে
করে যায় সবুজ মার্জনা;
দুধারে পথের পাশে নাম লিখে যাওয়া তো মূর্খতা
মানুষে পথিকে তবু জেনেশুনে রেখে যায় নিজস্ব নিশানা! তারা
নিলামে ওঠেনি!
মৃত্যুর পরেও কিছু সুখ, কিছু প্রাপ্য, কিছু নিশ্চিত ভোগের
আমি হাসিমুখে রেখে যেতে পারি
তাহলে কি নিয়ে যাবো মৃত্যুই মৃত্যুতে? আমি মূর্খদৃঢ় শারীরিক
যদি মরি পৃথিবীরই সুখে মরে যাবো।
একদল কেশরফোলানো সিংহ, মহিষের ক্রূর কালো খাঁক
কিংবা কোনো তারও চেয়ে অজ্ঞাত অনাম্নী অতিশয়
সূর্যের ভিতরে আরো এক লক্ষ বাদামী অশ্বের ছুটোছুটি, ধুলো
অন্ধকার
এভাবে মৃত্যু কি যেতে হবে কতো দূরে, কতো কাছে, কতোটা সংজ্ঞায়!
আমি জানি সে-দূরত্ব শুধু এ স্মৃতির অতীত আরো অশেষ অগাধ,
কখনো কখনো তাই বাস্তবিক ভয় পাই ঘর ছেড়ে তাঁবুতে লুকাই
বলি মৃত্যুতে যাবো না তার চেয়ে এসো খেলা করি
এসো মধ্যরাতে অজ্ঞাত রাস্তায়
নেমে কোলাকুলি করি, সে-সময় মাথার উপরে আরো বৃষ্টি হবে
গাঢ় মমতায়
এইভাবে স্নান করে এইভাবে ঋণী হয়ে জন্মের দূরত্বে চলো যাবো।
এইখানে ধুলোস্পর্শী পৃথিবীর মায়া এসে পড়ে
অনন্ত সূর্যাস্ত দেখি কী প্রাচীন কী গভীর কমলালেবুর
মতো মধুর মায়াবী
এভাবে মৃত্যুকে দেখি তার সঙ্গে এভাবেই জানা এভাবেই মৃত্যু
আত্মীয়
আমাদের জানালার ধারে এসে কথা বলে যায়,
করে পরম আদর, অন্য কেউ ভাবে নিতান্ত অস্পৃশ্য
তাকে মৃত্যু শিশুর মতোই গালে-মুখে চুমু খায়, ডাকে।
সে-এক মুহূর্ত আসে সে-এক তন্ময়
মধ্যরাতে ফুটপাতের অজ্ঞাত কংক্রিট তারও চোখে ঝরে জল
ধীরে ধীরে কাছে আসে মৃত্যু কোনো প্রিয় কি পথিক!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
আমিও তো অটোগ্রাফ চাই, আমিও তো লিখতে চাই
তোমাদেরই নাম হৃদয়ের গভীর খাতায়
তোমাদের একেকটি স্বাক্ষর আমিও খোদাই করতে চাই
স্মৃতিতে, সত্তায়।
শুধু এই মানুষের অনবদ্য নাম জুঁই, চাঁপা, শিউলির মতো
আমিও তো চাই মর্মে ফোটাতে আমার;
ভালেবেসে কেউ যদি লেখে নাম, কেউ যদি
একটিও অটোগ্রাফ এঁকে দেয় এই মলিন কাগজে
তাকে আমি করে তুলি অনন্ত নক্ষত্রময় রাত্রির আকাশ;
আমার তেমন নেই অটোগ্রাফ সংগ্রহের মনোরম খাতা
নীল প্যাড, সুদৃশ্য মলাট
কিন্তু আমি দিতে পারি নীলিমার চেয়েও বিসতৃত
সমুদ্রের চেয়েও গভীর
যে-কোনো সবুজ বনভূমি থেকে অধিক সবুজ
এই আমার হৃদয়-
এর চেয়ে অধিক লেখার যোগ্য আর কোনো পত্র বা
প্রস্তরখণ্ড নেই;
তবু আমিই লিখেছি নাম কাগজে, শিলায়, পত্রে
কখনোবা পাহাড়ের গায়ে
দয়ার্দ্র অনেক প্যডে, সুদৃশ্য খাতায়
কিন্তু আজ মনে হয় ঝরা বকুলেল মতো
আমার নশ্বর নাম করে গেছে তৎক্ষণাৎই সামান্য হাওয়ায়
আর যেটুকুও বাকি ছিলো মুছে গেছে শিশিরে বৃষ্টিতে।
অনেক লিখেছি তবু নাম, তবুও এঁকেছি এই বারবার
ব্যর্থ আমার স্বাক্ষর
আজ বুঝ কোথাও পায়নি সে এতোটুকু শ্যামল অঞ্চল
এতোটুকু স্নিগ্ধ ছায়া, এতোটুকু নিবিড় শুশ্রূষা
আজ তার দিকে সবাই তাকিয়ে দেখ
অজ্ঞাত ও নাম;
কোন প্রাগৈতিহাসিক কালের যেন ভাষা
আমার এ ব্যর্থ হস্তাক্ষর আজ প্রাচীন কালের দুর্বোধ্য শিলালিপির
মতোই ধূসর
মনে হয় কেউ তার চেনে না কোনোই বর্ণমালা।
কিন্তু আমার হৃদয় আজো ধারণ করতে পারে মানুষের
গুচ্ছ গুচ্ছ নাম
সেখানে সবুজ অঞ্চলের কোনোই অভাব নেই
তাই তাতে এখনো সে খোদাই করতে পারে মানুষের প্রিয়
নামগুলি।
প্রকৃতই মানুষের নাম ছাড়া আমি আজো
ফুল, পাখি কিংবা বৃক্ষ এসবের পৃথক পৃথক কোনো নাম
তেমন জানি না,
কিন্তু এখনো সমান আমি রাত জেগে মানুষের নামের বানান
মুখস্ত করতে ভালোবাসি
তাই অটোগ্রাফ আমারই নেয়ার কথা, আমিও তো
অটোগ্রাফ চাই।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
তোমার কালো চোখের মতো
পাল্টে গেছে বসতবাড়ি
উদোম চড়া, গাছগাছালি বট-বিরিক্ষ
ওলটপালট সারা বাড়ি একলা এখন,
বাড়ির মধ্যে কালো গাড়ি, এলোমেলো
ভাঙা চাঁদ ও শূলন্য তাঁবু,
শূনো বাড়ির চিহ্ন, চিহ্ন।
তোমার কালো চোখের মতো পাল্টে গেছে শহরতলী
শহরবাড়ি চেনা যায় না, চেনা যায় না
দেয়ালগুলি বদলে গেছে মাটির নিচে
লাল কবরে
শহরতলীর মধ্যে মিশাল এবড়োখেবড়ো
কালো গাড়ি, লাশভরা ট্রাক,
চেনা যায় না বসতবাড়ি, শহরতলী
চেনা যায় না।
তোমার কালো চোখের মতোই
চেনা যায় না, চেনা যায় না।
সারা বাড়ি, সারা শহর
মধ্যে মিশাল এবড়োখেবড়ো
বসতবাড়ি, সারা শহর
নাকাল বাতাস একা একা কেমন ভারী
চেনা যায় না বদলবাড়ি
ভরদুপুরে কোন উড়ো কাক।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
কতো নতজানু হবো, কতো দাঁতে ছোঁবো মাটি
এই শিরদাঁড়া হাঁটু ভেঙে
কতোবার হবো ন্যুব্জ আধোমুখ?
আজীবন সেজদার ভঙ্গিতে কতো আর নোয়াবো শরীর?
এক রকম স্পষ্ট দাঁড়ানো দৃঢ়ভাব
কারো কারো সহজাত থাকে,
মানুষের মধ্যে থেকে তাহাদের পাঁচফুট নয় ইঞ্চি মাথা
মানুষের চে’ও কিছু উঁচু
আমি কতো আর নতজানু হবো
দাঁতে ছোঁবো মাটি?
আমার জনক সে কি জন্ম থেকে নিয়েছেন এই ভিক্ষা,
এই শিশুপালনের ব্রত
ওরে তুই জন্ম নতজাঁনু হয়ে বেড়ে ওঠ
সবাই যখন পায়ের পাতায় ভর করে
পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি মাথা আরো উচ্চে তুলে দম্ভে দাঁড়াবে
আমার বালক তুই তখনো লুকাবি মুখ
নিজেরই পায়ের তলদেশে;
আমি তাই জন্ম নতজানু, নতমুখ
মাথা তুলে বুক খাড়া করে কোনোদিন দাঁড়ানো হলো না
বুকভাঙা বাঁকানো কোমর আমি নতজানু লোক
কতো আর নতজানু হবো কতো দাঁতে ছোঁবো মাটি!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাইভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও …
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ….
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! …করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখোকরুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে দেখার পর থেকে কীরকম গণ্ডগোল
হয়ে গেলো সমস্ত জীবন,
ওলটপালট হয়ে গেলো সবকিছু-
সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম বুঝ খেই, চিন্তাসূত্র হয়ে গেলো
বিশৃঙ্খল, এলোমেলো;
কেবল তোমারই মুখ দেখি বৃক্ষপত্রে, জ্যোতিস্কমণ্ডলে
উচ্ছল ঝর্নার জলে, বুকশেলফে, পড়ার টেবিলে,
টেলিভিশনের উজ্জ্বল পর্দায়-
এমনকি ডিশ অ্যান্টেনাও ঢেকে দিতে পারেনি তোমার মুখ
রেডিও বা ক্যাসেট খুলেই শুনি তোমার নিবিড় কণ্ঠস্বর।
তোমাকে দেখার পর থেকে কীরকম পাল্টে গেলো
আমার আকাশ
সেখানে এখন শুধু চাঁদের বদলে তুমি ওঠো,
আর একটাই ওঠে সন্ধ্যাতারা, সেও তুমি।
বইগুলো খুলে দেখি সব গ্রন’ জুড়ে শুধু
এই একটাই শব্দ তাতে লেখা-
তোমাকে দেখার পর থেকে অসম্ভব বদলে গেছে
আমার ভূবন
বদলে গেছে জলবায়ু, দিনরাত্রি, ঋতু।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
যদি এক পঙ্ক্তি কবিতা না লিখি আমি আজ
তাহলে হয়তো কাল অমন সুন্দর রাঙা ভোর এসে
দাঁড়াবে না তোমাদের ঘরে
ফুটবে না অভিমানে কোনো জুঁই, শিউলি, বকুল!
হয়তো আকাশ কালো কুয়াশায় রাখবে নিজের মুখ ঢেকে
দেখা যাবে হাঁটুর ভিতরে তারা মাথা গুঁজে মনঃক্ষুন্ন বসে
আছে গাছ,
সারারাত একফোঁটা ঝরেনি শিশির
ভীষণ তৃষিত তৃণ, লতাগুল্ম বিষণ্ন সবাই
কারো মুখে কথা নাই, মেঘেদের রঙ বড়ো ফিকে!
পাখিরা ভুলেছে তার গান, নদী কলতানহীন
এমনিক শিশুরা তাদের সব মনোরম প্রাতঃরাশ পরিহার করে
আর মর্নিং ইস্কুল রম্য খেলাধুলা ছেড়ে চলে যায়,
কবিতা না লিখি যদি আজ তবে
হয়তোবা বিজ্ঞানসম্মত এই বিমানও উড়বে না কাল ভোরে,
ওষুধ হারাবে তার ক্রিয়া, গোলাপও গোলাপ
থাকবে না!
এই যে পরস্ত্রী এতো প্রিয় সেও আকর্ষণ হয়তো হারাবে
চাঁদ হবে রুগ্ন ও পীড়িত
ফুল রুক্ষ টিলা!
আমার কবিতা ছাড়া একটি শ্রমিকও তার কাজে যাবে না যে!
কবিতা না লিখি যদি তবে
সংসারের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হবে!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
হয়তো এই পাহাড় সমান উঁচু হতে চায় কেউ
আমি মাটিতে মেশা ঘাস হতে ভালোবাসি,
যার মাড়িয়ে যাওয়ার সে মাড়িয়ে যাক ঘাস
তবু ঘাসের বুকেই জমে শিশিরবিন্দু ;হয়তো কেউ পার হতে চায় দীর্ঘ দূরের পথ
আমি বাড়ির উঠোনে লুটিয়ে থাকি,
উঠানের কোণে হয়ে থাকি চারাগাছ
সেইখানে ঐ দূর আকাশকে ডাকি ;হয়তো কেউ পাখিদের মতো চায় দুইখানি ডানা
আমি ভালোবাসি শিশুদের টলমলে হাঁটা, উড়তে চাইনা,
চাই এইখানে নিরিবিলি শুয়ে থাকি
যার হওয়ার সে হোক জোয়ার,
আমি হতে চাই ভাটা ;হয়তো কেউ হতে চায় ঐ পাহাড়ের মতো
আমি হাত-পা গুটিয়ে মাটিতেই শুয়ে থাকি,
লেগে থাক এই শরীরে শুধুও কাদামাটির ঘ্রাণ
যে কাছে আছে তাকেই আমি আরো কাছাকাছি ডাকি
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকেই আজো মনে মনে করি উপাসনা ভাবি স্মরণযোগ্য
বহু বেদনায় বহু ব্যবধানে তোমাকেই আজো অসময়ে খুঁজি,
তুমি ছাড়া কোনো স্মরণযোগ্য নারী নেই আর নাম নেই আর
তোমার প্রতিভা এই শতাব্দী তারও বেশিকাল পাবে প্রাধান্য
আমাদের ঢের বয়সের বেশি তবু আমাদের বয়সের চেয়ে তারুণ্যময়
তোমারই রূপের দুরন্ত খ্যাতি এ শহরে আজো প্রবাদতুল্য!
আমাদের যুগে তুমিই মাত্র স্মরণযোগ্য রমনীর নাম তুমিই মাত্র গূঢ় স্মরণীয়
তুমিই মাত্র বান্ধবী নারী অসামান্য আর সকলেই বধূ বা কন্যা এভাবে ধন্য
তোমাকেই আজো মনে মনে করি উপাসনা ভাবি স্মরণযোগ্য
এই শহরের বিরুদ্ধ পথ একাকী যখন পাড়ি দিই বড়ো প্রবাসীর মতো
অতি সাবধান হাত রাখি কোনো গোলাপের গায়ে গাঢ় প্রেরণায়
তোমাকেই করি উপাসনা করি বহু প্রশস্তি আপনার প্রিয় প্রাচীন ভাষায়,
ফুল তুলি আর ফসলের কোনো ঋতুতে যখন আমি উৎসাহী
স্বপ্ন জাগাই, সেই উৎসবে মনে মনে ভাবি তোমাকেই শুধু স্মরণযোগ্য
বহু বেদনার বিস্তৃত পথ পাড়ি দিই একা বিক্ষত পায়ে, কখনো একাকী
এইখানে এই সামান্য ছায়া তার নিচে বসে দীর্ঘজীবন দৃঢ় অবসান
তবু তোমাকেই মনে মনে করি স্তুতি-বন্দনা তোমাকেই ভাবি স্মরণযোগ্য
আমাদের যুগে তুমিই মাত্র স্মরণীয় নারী স্মরণীয় নাম
তোমারই রূপের খ্যাতি ও প্রতিভা এ শহরে আজো প্রবাদতুল্য!
আমার মাথায় জলভরা একটি আকাশ
তার নাম তুমি,
খর গ্রীষ্মে আমার উঠোনে অঝোর বর্ষণ
তুমি তার নাম;
ভীষণ তৃষ্ণার্ত এই পথিকের ক্লান্ত চোখে সুশীতল মেঘ
একমাত্র তুমি-
দুপুরের খরতাপ শেষে আমার জীবনে এই শান্ত সন্ধ্যা
তুমি, তুমি, তুমি;
মরুময় এই ভূপ্রকৃতি জুড়ে ঘন প্রেইরীর সবুজ উদ্যান
তুমি তার নাম,
আমার ধূসর দুই চোখে চিরসবুজের গাঢ় হাতছানি
তার নাম তুমি;
আমার স্মৃতির অববাহিকায় একটি স্বপ্নের প্রিয় নদী
তুমি নিরবধি।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় এখানে বাঁচাতে পারি মাথা
লজ্জা ভয়ে এখানে লুকাতে পারি মুখ,
এই নিবিড় আশ্রয় আর কোনখানে পাবো।
সবখানে যকন আমার নামে রটে কুৎসার কালি
সবাই নিন্দায় ওঠে মেতে, ছিছি করে, টিটকারি দেয়
যখন আমাকে এই অশ্লীল বিদ্রূপ আর শীতল উপেক্ষা
করে মর্মাহত, তখনো দাঁড়াই এসে এই আঁচলের
স্নিগ্ধ ছায়ায়।
যখন দেখতে পাই কোথাও যাবার মতো কোনো স্থান নেই
কেউ ফিরে তাকায় না আর, খোলে না দরোজা
যখন দুচোখে কেবল আমি অন্ধকার দেখি
তখনো কেবল তোমারই আঁচলখানি হয়ে ওঠে দয়ার্দ্র, কোমল।
তোমারই আঁচলখানি তখন মুছিয়ে দেয় মুখ
সকলের উপেক্ষার ধুলোবালি খুব যত্নে ঝেড়ে মুখে দেয়,
আমার রক্তাক্ত বুকে বেঁধে দেয় নরম ব্যাণ্ডেজ
তোমার আঁচলখানি সেই গ্রীষ্মে হয়ে ওঠে ছাতা।
যখন দেখেছি আমি সবখানে ভয়ানক কাঁটা, কারো কাছে
মেলে নাই ঠাঁই,
কারো চোখে দেখি নাই সামান্যও করুণার ধারা
একবারো কেউ বাড়ায়নি স্নেহমাখা একখানি হাত,
তখন আবার আমি রোদে পুড়ে ফিরে আসি তোমারই ছায়ায়।
তোমারই আঁচলখানি মুছে দেয় সেই ব্যর্থতায় গ্লানি
আর ক্লান্তির ঘাম,
হয়ে ওঠে এই রুক্ষ মরুভূমি ঢেকে এক রম্য তৃণাঞ্চল।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তুমি বড়ো জীবনকে ভালোবাসতে, জ্যাকুলিন
সুখ কোথায় থাকে, ভালোবাসা কোথায় তার
ক্যাম্পখাট বিছিয়ে ঘুমায়
তোমার চেখের নিচে ভালোবাসার সবুজ ঠিকানা
তোমার গুপ্ত বুকে দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত সোনার খনি
ঐশ্বর্যে তোমার বড়ো সাধ
তুমি চাও জুয়েলারী, টয়লেট,
ছিমছাম সোনালি মোজেক ;
দুঃখকে তোমার বড়ো ভয় জ্যাকুলিন,
দুঃখকে তোমার বড়ো ভয়
দুঃখ কি দেখেছো খুলে তার কালো বাক্স থেকে দেখতে কেমন
তার সারা মুখে ব্রণের দাগ, নিগ্রোদের মতো ভাঙা গলার স্বর
দুঃখ বড়ো ভয়ঙ্কর, দুঃখকে পাশে নিয়ে তুমি কিছুতেই ঘুমোতে
পারবে না
বড়ো শকাত দুঃখের সাথে রাত জাগা
বিশেষত তোমার অভ্যাস নেই,
জ্যাকুলিন, তোমার চাই ভালোবাসার বাসস্থান,
সম্পদ, দম্পতির সুখভোগ
তোমার চোখের নীল সমুদ্রে চাই ওনাসীদের সমসন্ত জাহাজের মালিকানা
জাঁকজমক, যা কিছু ইচ্ছে খরচবরাদ্দ,
তোমার যৌবনে চাই ভুলচুক, প্রকৃতির রক্তমাংস
সন্মৃতির ঝাপসা আংনায় তুমি কারো ফ্যাকাসে মুখ দেখে
এক থাকতে পারো না,
কেনেডীর মৃত্যু যতো করুণই হোক, জ্যাকি, তুমি এক
থাকতে পারো না।
জ্যাকুলিন, তুমি দেখবে সমুদ্র ভ্রমণে গিয়ে
ব্যালকনি দেখে কেমন বাঁচতে আচ্ছে করে
যেঘ দেখতে দেখতে হায় যায় লতাপাতার মতো কাছাকাছি
তুমি কখনো পিকনিকে গেলে দেখবে নারীপুরুষের
পাশাপাশি সুখ ও ভালোবাসার অবস্থান
টকিহল, মন্ত্রীদের বসভবন কিংবা হোয়াইট হাউসের
পাশ দিয়ে যেতে যেতে
তুমি এসব দেখে অযথা দুঃখ পাবে
তোমার অনেক কিছু আচ্ছে করবে জ্যাকুলিন,
ভালোবাসা, সুখ, চুম্বন এরকম আরো কতো কি
ও তুমি সইতে পারবে না ;
তোমার চোখের নিচে ভালোবাসার ধারালো রেজার
তোমার বুকের মধ্যে সুখী দম্পতির সবুজ ভূস্বর্গ
তোমার কোনো দোষ নেই জ্যাকুলিন, তোমার কোনো দোষ নেই
তুমি তো নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে
পারো না।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
হে মানুষ, তোমাদের ঘৃণার বদলে আমি
ভালোবাসার গোলাপ ছড়াবো,
তোমাদের উপেক্ষার মাটি ভেদ করে তুলবো সবুজ চারাগাছ
তোমাদের আলপিন-আঁটা বুটের তুলায় এই নগ্ন বুক পেতে দেবো
হে মানুষ, তোমাদের ঘৃণায় ফিরিয়ে-নেয়া কঠিন মুখের দিকে চেয়ে
আমি একাকী উড়াবো এই স্মৃতির রুমাল;
হায়রে মানুষ, তোমাদের ঘৃণার বল্লম আর হিংসার কুঠারে
ভীষণ রক্তাক্ত এই বুক,
তবু এই হিংসার বদলে চাই কেবল বিছিয়ে দিতে
হৃদয়ের গভীর আবেগ
তোমাদের বিদ্রূপের ঝাঁঝালো হাসির মুখে
এখনো ছড়াতে চাই প্রীতির কুসুম,
হে মানুষ, দাম্ভিক মানুষ তোমাদের তাচ্ছিল্য দেখেও আমি
এখনো আগের মতো বন্ধত্বের উষ্ণ হাত
তেমনি বাড়িয়ে দিতে চাই,
তেমনি ছড়িয়ে দিতে চাই তোমাদের পথে পথে জুঁই, চাঁপা,
শিউলি বকুল
তোমাদের নির্দয় কটাক্ষ ভুলে আমি দিতে চাই গাড় আলিঙ্গন;
হে মানুষ, তোমাদের কপটতা দেখে যদিও বা মর্মে মরে গেছি
তবু তোমাদের কুটিলতা ভুলে আমি সারল্যের সুকুমার পাপড়ি
ছড়াবো।
তোমরা ঘৃণায় যারা নিয়েছো ফিরিয়ে আজ মুক
সম্পূর্ণ করেছো প্রত্যাখ্যান,
আমার নামের ঠিক উপরে দিয়েছো ঢেলে কালিভরা একটি দোয়াত
তোমরা হিংসায় যারা বিছিয়েছো আমার পথের মাঝে
তীক্ষ্ণ তারকাঁটা,
যারা চাও আমাদের মাঝখানে বয়ে যাক শুধু হিমঝড়-
তোমাদের সকলের ঘৃণার বদলে আর উপেক্ষার বিনিময়ে আমি
হে মানুষ, ব্যথিত-ব্যাকুল এই ভালোবাসা আর দুই চোখভরা
এই আলুথালু অশ্রুজল ছাড়া কিছুই আনিনি;
হে মানুষ, দুর্পিত মানুষ, তোমাদের কুৎসা আর ঘৃণার বদলে
আমি সহিষ্ণু বৃক্ষের মতো দেখো বুক চিরে এখনো ফোটাই ফুল,
আজো আরক্তিম ভালোবাসা তোমাদেরই সমর্পণ করি
তোমাদের ঘৃণার উত্তরে বলি প্রিয়, হাত জোড় করে চাই ক্ষমা।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
দূতাবাসে উড়ছে পতাকা
অর্থাৎ স্বাধীন আমরা এ-কথা মানতেই
হয়, রাষ্ট্রীয় সনদ আছে দেশে
দেশে আমরা স্বাধীন;
তবু মনে হয় এ যুগে কোথাও কোনো স্বাধীনতা
নেই, বরং এ যুগে মানুষ যেন
পোষমানা দুর্বল মহিষ, নিজের যৌবন
আজ তার কাছে সবচেয়ে বড়ো অপরাধ, নিজের
বিরেক আজ তার সবচেয়ে
বিদগ্ধ কসাই;
যেখানেই বলো না কেন আমাদের
আজ কোনো স্বাধীনতা নেই,
না কথা বলার, না হাসার, কাঁদার
সবখানে সব দেশে মানুষ আজ স্বাধীনতাহীন
ভীষণ নির্জীব, বিষণ্ন বস্তিতে কিংবা বুর্জোয়া বিলেতে
এখনো প্রত্যহ দেখি গ্রেফতারী
পরোয়ানা হাতে ফেরে নগরপুলিশ;
মানুষ কি পারে তার যৌবনকে ভালোবেসে
বাগানে বেড়াতে
মানুষ কি পারে তার নিজের মনের
শব্দ টেলিগ্রামে ভরে ভরে দূরত্বে পাঠাতে?
মানুষ কি পারে তার নিজের আকৃতি
খুলে স্বচক্ষে দেখতে কখনো?
মানুষ কি আঁকতে পারে নিজের আদলে কোনো
জ্যান্ত বাঘের মুখ? এ যুগে
মানুষ বুঝি বড়ো বেশি কিছুই পারে না
কেবল আইনের হাত ধরে কিছুটা রাস্তা হাঁটা ছাড়া
এ যুগে মানুষ বুঝি
কিছুই পারে না;
অথচ এখথন কোনো রাজা নেই, রাজ্য নেই
কেবল আছে রাজ্যশাসন
আমরা এখন কারো প্রজা নই
প্রজাস্বত্ব সর্বত্র প্রবল
তাই কি আমরা এই প্রজাতন্ত্রে এমন বন্দী স্বাধীন?
তাহলে কি আমরা সবাই আজ বাস
করি পাথরের ঘরে
মানুষ কি কোনোদিনই পারবে না
জন্ম দিতে নিজের যৌবন?
নিজের বুকের মধ্যে পারবে না পুষতে
সে বিশ্বাসের বিশুদ্ধ মৌচাক?
তার চেয়ে আমাদের ফিরে দাও রাজবংশ, রাজকীয়
অলীক বিশ্বাস
রাজকুমার তোমার রক্তে জন্ম নিক
জান্তব যৌবন, যুদ্ধ করে মরি।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
এর আগে আর কোনোদিন আমি
হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন তোমার চোখে প্রথম দেখেছি আমি জল,
অকস্মাৎ মনে হলো নিভে গেলো সব পৃথিবীর আলো
গোলাপবাগান সব হয়ে গেলো রুক্ষ কাঁটাবন।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি
মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম পথে দেখলাম অনাথ কিশোর এক
ক্ষুধায় কাতর কেঁদে মরে,
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীতে কোথাও
তেমন আর সুখ কিছু নেই
ফুলের দোকানগুলি হয়ে গেছে অস্ত্রের গুদাম।
আমি আর কোনোদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম দেখি
ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় রক্ত লেগে আছে,
যেদিন প্রথম সবুজ বৃক্ষের দিকে চেয়ে দেখলাম
সেখানে লুকিয়ে আছে বিষধর সাপ, নদীর গভীরে
চোখ ফেলে দেখি এই জলে দূষণের বিষ, হাঙর-কুমির
তখনই দুহাতে ঢেকে মুখ বুঝলাম কতোখানি দুঃখী
এই কাছের পৃথিবী।
যেদিন প্রথম আমি আকাশেল দিকে চেয়ে দেখলাম
মেঘে বজ্র, ক্রূর ঘূর্ণিঝড়
অরণ্যে ভীষণ সব পশু, লোকালয়ে খুনী আততায়ী
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীর আলো অস্তমিত।
এর আগে আমি আর কোেেনাদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম শুনি প্রেমিক অক্লেশে বসিয়েছে ছুরি প্রেমিকার বুকে
তখন বুঝেছি পৃথিবীতে দুঃখ ছাড়া চাষবাস হবে না কিছুই।
এর আগে কোনোদিন এমন হইনি মর্মাহত
যেদিন বৃক্ষের কাছে গিয়ে দেখলাম রক্ত ঝরে বৃক্ষের শরীরে
নদীর নিকটে গিয়ে দেখি নেই তার বুকে এতোটুকু তৃষ্ণারও জল
তখনই বুঝেছি কতোটা নির্দয় হতে পারে এই ভালোবাসার পৃথিবী।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন দেখেও তুমি চোখ তুলে ফিরে তাকালে না।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
শীত খুব তোমার পছন্দ, কিন্তু আমি
শীত-গ্রীষ্ম-বসন্তের চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালোবাসি;
যে-কোনো ঋতু ও মাস, বৃষ্টি কিংবা বরফের চেয়ে
মনোরম তোমার সান্নিধ্য, আমি তাই
কার্ডিগান নয় বুকের উষ্ণতা দিয়ে ঢেকে দেই
তোমার শরীর-
আমি হই তোমার শীতের যোগ্য গরম পোশাক;
কোল্ড ক্রিম আর এই তুচ্ছ প্রসাধনী রেকে
আমি তোমাকে করতে চাই আরো হই শীত, হই শীতের উদ্ভিদ;
আমি হই সবচেয়ে বেশি তোমার শীতের উষ্ণ কাঁথা,
হই সকালের উপাদেয রোদ, সারো শুভ্র সানবাথ।
আমিজানি নগ্নতাই শীতের স্বভাব, আমি তাই
তোমার নগ্ন গায়ে দিব্য শতিের কামিজ;
তুমি অবহেলা ভরে যাও আমি
শীরেত শিশির হই ঘাসে-
দুপায়ে মাড়িয়ে যাও, তবু তোমার পায়ের রাঙা আলতা
হই আমি
এই শীতে তোমার নিবিড় উষ্ণতা ছাড়া নিউ ইয়ার্স গিফট
কী আর চাওয়ার বলো আছে!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
আমি তো পাখিরও বশ, ভ্রমরের বশ
কেন আমাকে ছাড়িয়া যাও সুস্মিত গোলাপ
বিষণ্ন বাবুই, হে পাখি, হে উদাসীন সরুযুর কাক
তোমরা ছাড়িয়া যাও!
আমাকে ছাড়িয়া যাও সন্ধ্যার শায়িত মাঠ
আজানের হে সুবে সাদেক, আমি তো তোমারই বশ,
তোমাদের সকলেই বশ
তোমরা দুজন বড়ো অভিমানী নারী
আমি তো তোমারই বশ
কালিন্দীর কোন কূলে ভরেছো কলস, কোন তমালের মূলে
ছয়টি কালিমা খুলে করেছো ভূষণ!
সাক্ষী থাকো তুমি হে তৃষ্ণার নদী, হে রাখাল, অশত্থু বাউল
আমি তো তোমারই বশ ওই যে সাতটি হরিৎ তৃণ, সোমত্ত সাতটি তারা
কামিনীর সাতগুচ্ছ চুল, আমি তোমাদেই বশ
টিলায় দাঁড়ানো চাঁদ, যুবক পাহাড়, কালো ধেনু, হে কালো তমসা
আমি তো তোমারি বশ হে শয্যা, হে কালো নয়ন
তবু কেন আমাকে ছাড়িয়া যাও ও দুজন সবুজ রমনী
ও কালো মাঠের গাঁও, ধানের উচ্ছব
কেন তোমারা ছাড়িয়া যাও হে ভিক্ষু, হে আশ্রমের শুভ্র বালিকা
কেন তোমরা ছাড়িয়া যাও হে ভিক্ষু, হে আশ্রমের শুভ্র বালিকা
আমি তো তোমারই বশ,
হে নারী, হে তৃণ, হে পরমা প্রকৃতি!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমাকে ডাকার মাগো বড়ো ইচ্ছা করে
বড়ো সাধ জাগে আজ মা তোমাকে একবার ডেকে কথা বলি
কিন্তু কেন উত্তর মেলে না, নৈঃশব্দ্য আমাকে বিদ্ধ করে?
আমি তো করিনি কোনো দোষ, না বলে যাইনি কোনোখানে
তোমার অবাধ্য হয়ে একাকী নদীতে নেমে কাটিনি সাঁতার,
তবু কেন অযথা এমন ক্ষমাহীন ক্রোধে তুমি ফিরিয়েছো মুখ?
এমন তো হয়নি কখনো ঘরে ফিরে
তোমাকে ডেকেও আমি পাই নাই সাড়া,
বাড়ির উঠোনে আমি পা দিয়েই যতোবার তোমাকে ডেকেছি
যেখানেই থাকো তুমি আমার একটি ডাকে
ঝরেছে তোমার কন্ঠে অপার করুণাধারা যেন
সেই তুমি আজ কেন পাষাণের স্তব্ধতা এমন?
মন চায় আজ শুধু তোমাকেই প্রাণ ভরে ডাকি
কিন্তু দেখো মানুষের এতোই সময় কম, মাকেও ডাকার তার
সময় মেলে না
তোমাকে ডাকার পালা শে হয়ে গেলো,
আর আজো আমি ভালো করে কথাই শিখিনি।
তুমি কি ভেবেছো আমি বড়োসড় হয়ে গেছি খুবই,
তোমাকে এখন আর ব্যাকুল শিশুর মতো ডাকবো না আমি?
কিন্তু মা এখনো আমি তোমার কোলের সেই শিশু রয়ে গেছি।
আজো তো তেমনি মাগো বয় পায়, ক্ষুধা তৃষ্ণা পায়
কেউ একবিন্দু জলও দেয় না;
তুমি তো জানোই মাগো একলা আঁধার ঘরে
কী ভীষণ ভয়ে জড়সড় তোমারই বুকে লুকাতাম মুখ
আজ আঁধারের চেয়েও আঁধার চারদিকে
সামান্য মেঘের ডাকে যার ঘুম ভেঙে যেতো
আজ তরই মাথায় মাগো ভেঙে পড়ে বাজ,
তবু কারো এতোটুকু সরে না আঙুল;
ইঁদুরের শব্দে পাশে ভয় পাই তাই ঘুম পাড়িয়েছো তোমার কোলেই
আজ শ্বাপদসঙ্কুল এই অরন্যে বাস করি;
মাগো, তুমি নেই, তাই কেউ নেই
ভয়ার্ত শিশুর মতো আজো আমি সবটুকু শক্তি দিয়ে
যতোই তোমাকে শুধু ডাকি,
দেখি এই শব্দময় পৃথিবীতে বিশাল মৌনতা এসে গ্রাস করে
কেবল আমাকে।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
একদিন ভোরবেলা যদি সন্ধ্যা হয়
কিংবা মধ্যরাতে ওঠে হঠাৎ ভোরের সূর্য
এই পুরনো মলিন চাঁদ তরল সোনার মতো
গলে গলে পড়ে,
জলাশয়ে পাখিরা সাঁতার কাটে
জলের রুপালি মাছ সহসা হাঁটতে থাকে
এই ফুটপাতে,
তাহলে কি এই দৃশ্যগুলো খুবই উদ্ভট বেখাপ্পা
মনে হবে?
একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হবে এই ভোর
হঠাৎ এমন সন্ধ্যা হয়ে গেলে-
মধ্যরাত হয়ে গেলে রৌদ্রতপ্ত দিন,
জলাশয়ে পাখিরা সাঁতার কেটে স্বচ্ছন্দে বেড়ালে
কিংবা মাছগুলি ফুটপাতে যদি হেঁটে যায়!
অথবা হঠাৎ কেউ ঘুম থেকে উঠে যদি দেখে
তার গায়ে পশুর মতন লোম, বাঘের মতন থাবা
মুখে সিংহের ধারালো দাঁত
কিংবা এই উচ্ছ্বসিত নৃত্যের আসর যদি হয়ে যায়
দুগৃম প্রাচীন দুর্গ,
পৌরাণিক অভিশাপ যদি হঠাৎ আবার
সত্য হতে থাকে।
কেউ হয় নিশ্চল পাষাণ,
কেউ দৈত্য, কেউ বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট,
তাহলে কি খুবই বিস্ময় ঘনাবে দুই চোখে,
মনে পড়ে যাবে কাফফার বিমর্ষ পৃথিবীর কথা?
কিন্তু এই মনোরম পৃথিবীতে কোথাও কি ঘটছে না
এইসব কিছু, কারো হাত, কারো মুখ,
কারো কারো চোখ
সিংহ ও ব্যাঘ্রের নখদন্তের চেয়েও কি ভয়ঙ্কর নয়?
পৃথিবীতে কাফফার অনুরূপ এই পৃথিবী দেকেও তবু কেন
লাগে না মোটেও ধাঁধা আমাদের চোখে!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
জাহাজ যেমন ডাকে সেইভাবে ডাক দিও তুমি
তোমার ছাড়ার আগে একবার হর্নখানি দিও
সকল বন্ধন ছিঁড়ে তোমার বন্ধন তুলে নেবো,
একটি সামান্য ব্যাগ কিংবা তাও ফেলে দিতে পারি।
তুমি তো জাহাজ নও জলের টিকিট কেন নেবে
অধিক ইলিশপ্রিয় ছিলে যদি জলে বাসই ভালো
তবুও পারো না তুমি, দূরের জাহাজখানি পারে।
আমার জন্মের আগে জল ছিলো জাহাজও কি ছিলো?
হয়তো এমনি ছিলো সমুদ্রের স্বাভাবিক সাঁকো
হয়তো এমনি ছিলো সমুদ্রের স্বাভাবিক সাঁকো
মানুষের কিছু নেই ঘরবাড়ি জলেরই তো পাড়ে,
তুমি যদি ডাক দাও জাহাজের ডেক খুব প্রিয়।
ডেকে তো উদ্ভিদ নেই জলের উদ্বেগ কিছু আছে
তবু তো উদ্বেগ আছে দূরের জাহাজখানি জানে
তুমি তো ডাকোনি কাছে, ভালোবেসে জাহাজই ডেকেছে!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
স্মৃতি ছাড়া কোনো নোটবুক নাই
টুকে রাখি কোথা ইট বা খোয়াই
ভাঙা বাড়িটার ধূলি-জঞ্জাল
বুক ভরে যারা ছিলো এতোকাল;
কোথা লিখে রাখি এতো প্রিয় নাম
যার পাশাপাশি একদা ছিলা!
কিছু ভালোবাসা কিছু অবহেলা
কোনটা প্রকৃত কোনটা বা খেলা
বুনো ঝাউবীথি উদাসীন শাল
চিরচেনা নদী মায়াবী রাখাল
কাকে বলি তুমি কাকে নামে ডাকি
অনেক ঠিকানা কাকে মনে রাখি।
এতা পশুপাখি লোক লোকালয়
পরিচিত ঘরে এতো পরিচয়
তুচ্ছ তাকেও কতো দামে জানি
ছেঁড়া কাগজেরও অভিমানখানি
কতোদিন কতো ফুল আর মেঘ
তারও পথ চেয়ে কী যে উদ্বেগ
এই ধূলি কাঠ পাথরের ঘ্রাণ
চিরদিন এই মানুষের গান
লিখে রাখি কোথা এতো প্রিয়নাম
যার পাশে আমি একদা ছিলাম!
স্মৃতি ছাড়া আর নোটবুক নাই
কিছু মনে পড়ে, কিছু ভুলে যাই!
সে আসে আমার কাছে ঘুরে ঘুরে যেন এক
স্রোতস্বিনী নদীর সুবাস, ভালোবাসা সে যেন হৃদয়ে শুধু
ঘুরে ঘুরে কথা কয়, চোখের ভিতর হতে সুগভীর চোখের
ভিতরে, সে আসে প্রতিদিন জানালায় ভোরের রোদের মতো
বাহুলগ্ন আমার প্রেমিকা;
সে আসে প্রত্যহ এই আলোকিত উজ্জ্বল শহরে, ইতিহাস
আরো সব কিংবদন্তী কথা কয় আমার স্মৃতিতে, সে আসে
দূর থেকে মনে হয় শ্যামল ছায়ায় ভরা যেন এক
হরিণীর চোখ, অথবা রোদের সুরভিমাখা হেমন্তের শিশির সকাল
সে আসে আমার কাছে নুয়ে পড়ে আমলকী বন;
সে আসে আমার কাছে ভরে ওঠে বছরের শূন্য খামার
নদীতে সহসা ওড়ে মাছরঙ নায়ের বাদাম
ক্ষেতের দরাজ দেহ সিক্ত করে মেঘের মৈথুন,
সে আসে আমার কাছে
ফুটে ওঠে নিসর্গের নিবিড় কদম
সে আসে আমার কাছে ঘুরে ঘুরে নদীর স্রোতের মতো
জলে-ভাসা ভেলা।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
সর্বক্ষণ উদ্যত পুরুষ
হাতে যার যুদ্ধজয়ী পিতার কৃপাণ
হুলস্তুল মধ্যরাতে
যখন পাল্টে যায় সবুজ দেয়াল
ছত্রখান হয়ে ভেঙে পড়ে অট্টালিকা, চাঁদ
কে পারে বদলে দিতে সে রাত্রিকে ফের
দিনের সমান
সে তোমার গোপন প্রেমিক;
তুমি তাকে চেনো না তেমন ভালোভাবে
তাকে তুমি দেখো নাই ক্রোধে কম্পমান
দীর্ঘতর হতে,
যে পারে আমূল এনে তোমাকে বসাতে
মধ্যস্তলে, জ্বেলে দিয়ে হাজার প্রদীপ
সে তোমার গোপন প্রেমিক;
তাকে তুমি দেখো নাই জ্যোৎ্লাহীন
খোলা মাঠে,
অন্ধকারে দুরন্ত গেরিলা
দেখো নাই তাকে তুমি সুতীক্ষ্ণ ব্যারেল খুলে
লক্ষ্যভেদী অব্যর্থ অর্জুন
সে তোমার ভীষণ প্রেমিক;
কে পারে রক্তাক্ত করোটি থেকে
পুনরায় জন্ম দিতে সভ্যতার মাটি
ইতিহাস সম্ভাবনাময় পথে
নেমে আসে কার ডাকে খোলে স্তব্ধ
শতাব্দীর নিরেট কপাট
আর কেউ নয়
সে তোমার জেদী উদ্ধত প্রেমিক;
সে জানে আদিম সত্য
ভালোবেসে পরাজয় নেই,
চষা ক্ষেতে উলঙ্গ কৃষাণ যেন কৃষাণীকে
করে তোলে শস্যময় অগাধ সবুজ
সে তোমার অবাধ্য প্রেমিক;
তাকে তুমি চোখ তুলে দেখো
সে এসেছে যদ্ধজয়ী যুবরাজ
আর কেউ নয়, এই আমি
সে তোমার গোপন প্রেমিক।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমার চোখে যে এতো জল
আর এতো ব্যাকুলতা-
সব বুঝি তবু বুঝি নাই
এই সামান্য কথা!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
কিনেছি অনেক দামী উপহার
বহু মনোহর কাগজের ফুল;
ভালোবাসা দিয়ে হয় নাই কেনা
একখানি মেঘ একটি বকুল!
জমাজমি আর গৃহ আসবাব
অধিক মূল্যে করে রাখি ক্রয়,
শুধু কিনি নাই কানা কড়ি দিয়ে
একজোড়া চোখ একটি হৃদয়!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
ইচ্ছা করে, কেন ইচ্ছা করে, একদিন উড়ে যাবো
ফিরেও আসবো না
শুধু পড়ে রবে খাঁচা, খাঁচাতেই সম্ভব করেছি বাঁচা
এই উড়ে যাওয়া, আর ফিরেও আসবো না।
তবু ইচ্ছা করে, কেন ইচ্ছে করে, একদিন
উড়ো যাবো, ফিরেও আসবো না,
পাবে না জলের তৃষ্ণা প্রত্যক্ষ রোগের গ্লানি-, গাঢ় নিদ্রা
উড়ে যেতে যেতে এই পাখিত্বেই মেলাবো অধিক, হবে প্রেম গভীর প্রণয়
আমি আর কতোটুকু এই নামমাত্র ছায়া, কায়াটা তো মেকি
একদিন যেতে হবে ঠিকই অতি এক ক্ষুদ্র পাখি হয়ে
তাকে চোখেও দেখিনি
তবু স্বভাবে বুঝেছি পাখি উড়ে যাওয়াটাই তার ধ্যেয়,
সহজ বৃষ্টির মধ্যে অধিকন্তু যায় তারা মেঘের প্রতীক
উড়ে যায়, কিন্তু কেন উড়েও যায় না, একদিন
উড়েও যায় না
তাদের আকাশ ছোট্ট খাঁচা তাও পড়ে থাকে, আর
উড়েও যায় না,
কিন্তু আমি উড়ে যাবো কিংবা উড়ে উড়ে ফিরেও
আসবো না
ইচ্ছে করে, শুধু ইচ্ছে করে আমি উড়ে যাই তবু তুচ্ছ এই
খাঁচাখানা থাক।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
যতোই ব্যথিত হও মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ো না
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে,
যতোই আঘাত পাও মানুষকে কিছুতে ছেড়ো না
যখন কিচুই নেই মনে রেখো,
তখনো সর্বশেষ আশা এই মানুষ;
সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তোমার পাশে এসে মানুষই
দাঁড়াবে
ফুল যখন ফুটবে না, পাখি যখন গাইবে না
কেবল আকাশ-বাতাস মথিত করে আসবে ধ্বংস,
আসবে মৃত্যু
তখনো মানুষই তোমার একমাত্র সঙ্গী;
মানুষেল সব নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার পরও
মানুষই মানুষের বন্ধু।
অরণ্য নয়, পাহাড় নয়, সমুদ্র বা তৃণভূমি নয়
মানুষের হৃদয়ই তোমার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়
আর কোথাও নয় কেবল মানুষের হৃদয়েই মানুষ অমর।
মানুষকে এড়িয়ে কোনো সার্থকতা নেই
যতোই আঘাত পাও, যতোই ব্যথিত হও
মানুষের সঙ্গ ছেড়ো না,
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে
কেবল মানুষই এই মানুষের চিরদিন বাঁচার সাহস।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
আমি চাই একটি ছোটো নদী,
তুমি দাও অসীম সমুদ্দুর-
আমার চাওয়া শ্যামল মাটির ঘর,
তুমি দেখাও রাজার অন্তঃপুর।
আমি চাই একটুখানি ছায়া,
তুমি দাও স্নিগ্ধ নীলাকাশ-
আমার চাই একটু সবুজ জমি,
তুমি করো অনন্তে চাষবাস।
আমি চাই কোনো সজল মেঘ,
তুমি বলো অনন্ত অম্বর-
আমি চাই একটি স্নেহের হাত,
তুমি দেখাও বিশ্বচরাচর।
|
মহাদেব সাহা
|
ভক্তিমূলক
|
মানুষের ভিড়ে মানুষ লুকিয়ে থাকে
গাছের আড়ালে গাছ,
আকাশ লুকায় ছোট্ট নদীর বাঁকে
জলের গভীরে মাছ;
পাতার আড়ালে লুকায় বনের ফুল
ফুলের আড়ালে কাঁটা,
মেঘের আড়ালে চাঁদের হুলস্তুল
সাগরে জোয়ার ভাটা।
চোখের আড়ালে স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে
তোমার আড়ালে আমি,
দিনের বক্ষে রাত্রিকে ধরে রাখে
এভাবে দিবসযামী।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
আমি নিরিবিলি একলা বকুল
তাতে কার ক্ষতি সামান্য ফুল
যদি ঝরে যাই!
ভালোবেসে তবু এই উপহার
ঝরা বকুলের ঝরা সংসার
যেন রেখে যাই!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
আজীবন শুধু হাঁটছি আমি
নারী, তার দেয়া সংসারের
ব্যস্ততা নিয়ে দ্রত দৌড়চ্ছি কেবল
সে আমার ইন্দ্রিয়ে জন্ম দিয়ে গেছে কাজ
ভালোবাসা, প্রলোভন মানবিক ব্যবহার
নারী তার দিয়ে গেছে দুচোখের গুপ্ত ঠিকানা
তার সঙসারের সন্তানের অভিলাষ নিয়ে
তার সে চোখের ইমেজ হাতে
আমি দৌড়চ্ছি কেবল ;
স্টপেজে স্টপেজে যাই হাত তুলি,
ডেকে বলি, শুনুন আমাকে পৌঁছতে হবে, বড়ো তাড়া
দেরি হলে বন্ধ হয়ে যাবে তার নিয়মিত গেট,
বাসভর্তি লোক হাত নাড়ে, রুক্ষ ড্রাইভার
তার করতলে নিষেধের ঝুলানো সাইনবোর্ড
আমাকে নেয় না বাস আবার দৌড়ই
সামনে স্টপেজ ডবল ডেকার থাকে
লোকজন ওঠানামা করে, ছেড়ে যায় বাস
নারী তার গুপ্ত ঠিকানা বুঝি
আমার নাগাল থেকে দূরে ;
শহরে এখন এতো বাস, ছোটো বড়ো গাড়ি
যানবাহনের ভিড়ে চলা দায়
তবু নেই জায়গা কোথাও, সব বাস ভর্তি লোক
স্টপেজ এলেই ড্রাইভার হাত নাড়ে
যেন তার হাত সিনেমা হলের
সামনে হাউসফুল টাঙানো পোস্টার,
যতোই বলি না কেন আমাকে যেতেই হবে
তোমার দূরত্বে যেতে আর কোনো বাস খোলা নেই ;
আমাকে পৌঁছতে হবে নারী আর সংসারের কাছে
আমাকে রেখেই তবু যায় লোকভর্তি বারোটার শেষ বাস,
তোমার দূরত্বে যাবো
কোনো বাস নেয় না আমাকে।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
কেবল স্বপ্নের মধ্যে যাতে পারি আমি
তোমার নিকটে-
তা ছাড়া তোমার কাছে পৌঁছবার আর কোনো পথ খোলা নেই;
সম্ভাব্য সকল রাস্তা অবরুদ্ধ, নৌ বা
বিমানপথে
সতত প্রহরা
স্থলপথ জুড়ে অনেক আগেই ঘন
কাঁটাতার,
এখন দেখছি আমাদের দুজনের মাঝে লক্ষ কোটি মাইল দূরত্ব
তোমার নিকটে যাওয়ার পথ এতো দীর্ঘ
এমনি অচেনা
তার চেয়ে বরং কলম্বাস কিংবা ভাস্কো ডা গামার
সমুদ্রযাত্রাও
ছিলো অনেক সহজ;
এই দক্ষিণ মেরুর পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর
মেরুতে
যেতে কোটি কোটি সৌরবর্ষ
হেঁটে যেতে হবে,
নৌপথে সেখানে যেতে
পৃথিবীর সবক’টি মহাসাগর পাড়ি দিতে হবে কয়েক লক্ষ বর
দ্রুততম মহাশূন্য যানেও এই দূরত্ব পেরুতে গেলে
লেগে যাবে আরো অনেক জীবন;
কেবল ঘুমের মধ্যে তোমার দুচোখে স্বপ্ন হয়ে
যেতে পারি আমি
সোনার কাঁকই দিয়ে খুব যত্নে বেঁধে দিতে পারি
ঘন চুল,
সহজে দেখতে পারি তোমার কোমল পায়ে কোথায়
ফুটেছে ঠিক কাঁটা,
ছড়ে গেছে কয়টি আঙুল, দুই ওষ্ঠে শুষে নিতে
পারি সব
রক্ত, পূঁজ, বিষ;
কেবল সেখানে হাত ধরে পাশাপাশি বসতে পারি পার্কের ছায়ায়
কিংবা নির্জন লেকের ধারে,
কোনো মৌন রেস্তরাঁয়
এ ছাড়া তোমার নিবিড় সান্নিধ্য লাভ
কখনো সম্ভব নয়
তোমার আমার নিভৃতে বসার মতো
এতোটুকু নির্জনতা নেই এ শহরে-
একটিও সবুজ উদ্যান নেই, তিতির-শালিক নেই,
যার পাশে নিরিবিলি একটু বসতে পারি,
মৃদু স্বরে একটু করতে পারি বাক্যালাপ
এমনটি পরস্পর সামান্য কুশল বিনিময়।
এই সমস্ত দূরত্ব আর বাধার প্রাচীর ভেদ করে
কেবল স্বপ্নের মধ্যে অনায়অসে
যেতে পারি আমি তোমার নিকটে।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
আর কোনো চাঁদ নেই,
আমার আকাশ জুড়ে তুমি,
আলোকিত হয় তাকে এই সত্তা,
এই পটভূমি!
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষদ্রুত পায়ে
হেঁটে যায়,
কোনোদিন দেখি তাকে ব্যতিব্যস্ত সাইকেল-আরোহী
ঘরে ঘরে বিলি করে আরক্তিম চিঠি
তাতে খুব বড়ো করে লেখা দুটি শব্দ-স্বাধীনতা এবং বিপ্লব।
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষআছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে,
আবর কখনো দেখি একাকী লিখছে বসে বিশাল পোস্টার
কখনো আঁকছে তাতে উত্তেজিত মানুষের মুখ
কখনোবা আঁকছে সে মানুষের পাশে দাঁড় করিয়ে মানুষ
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দীর্ঘতম সেতু;
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষহেঁটে যায় ছায়াছন্ন পথে
কোনাদিন দেখি তাকে রৌদ্রদগ্ধ পথের ওপর,
তাকে মনে হয় ভীষণ সাহসী যেন
স্পার্টাকাসের মতো ছিঁড়ে ফেলে সমস্ত শৃঙ্খল।
কোনোদিন দেখি তাকে আশাহত বসে আছে
একটি আঁধার ঘরে একা
চারপাশে পড়ে আছে অসংখ্য ধূসর পান্ডুলিপি
আর ছবির মলিন অ্যালবাম;
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষকোনোদিন দেখি তাকে
ক্ষুব্ধ হাতে ভাঙছে সকল কারপ্রাচীরের লোহার দরোজা।
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষছন্নছাড়া কেমন উদাস
কখনো বিষণ্ন চোখে কেবল তাকিয়ে আছে
আকাশের দিকে-
কোনোদিক দেখি মায়াকোভস্কির সেই অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে
লিখছে সে মানুষের দুঃখের কবিতা,
কোনোদিন দেখি তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে আঁকছে সে
বেগবান বিদ্রোহের পাশে দীপ্তিময় লেনিনের মুখ।
|
মহাদেব সাহা
|
স্বদেশমূলক
|
এই গ্রাম প্রতিরাতে হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমাকে
উৎকন্ঠিতা প্রেমিকার মতো
কানে কানে শোনাতো কাহিনী,
যুদ্ধক্ষেত্রে মধ্যরাতে কখনো হঠাৎ
স্বদেশ-স্বজনহারা কান্নায় ভরে যেতো বুক
আমার দুঃখিনী গ্রাম কিছুতেই তোমাকে পারিনি ভুলে যেতে;
এই গ্রাম, লতাগুল্ম-আচ্ছাদিত শৈশবের স্মৃতি
অকস্মাৎ মধ্যরাতে ডাকতো আমাকে মৌনস্বরে,
হয়তো তখন আমি শত্রুর সতর্ক গতিবিধি লক্ষ্য করে
ছুঁড়ছি গ্রেনেড, পাতছি মাইন ব্রিজে, কালভার্ট করছি বিলোপ,
কিংবা রয়েছি লুকিয়ে আমি পার্শ্ববর্তী ঝোপে
ওদিকে দাগছে কামান শত্রুসেনা
ক্রলিংরত আমরা তখন তবু ভাবছি তোমারই কথা-
মাথার ওপর শত্রুর বিমান ক্রমাগত দিচ্ছে চকাকর
সেই মধ্যরাতে, এই গ্রাম ডাকতো আমাকে ফিরে যেতে,
রাত্রির নির্জন চাঁদ ভেঙে যেতো জঙ্গীবিমানের শব্দে
সেই অন্ধকারে বসে শুনতাম গ্রামের লিরিক
যেন ভাসতাম স্নেহময়ী জননীর কোলে,
মৃত দিদিমার সান্ধ্য গল্পের আসরে।
কোথায় সে গ্রাম, সবুজচিত্রিত গাছপালা
মাটির নির্মিত বাড়ি, কাঁসার বাসন,
চাল-ডাল-নুন-মরিচের হাটখোলা?
এই কি আমার গ্রাম, মধ্যরাতে যে আমাকে
করতো উন্মন, গাঢ়স্বরে ডাকতো আমার নাম ধরে?
এই কি আমার গ্রাম নরকঙ্কালের অস্থিমালা পরিহিত মাটি,
আমার গ্রাম কি এই ধ্বংসের স্বাক্ষর
বয়ে খাঁটি বধ্যভূমি?
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, আঘাত দেওয়ার
কথা ছিলো না, কথা ছিলো না, কথা ছিলো না,
তোমাকে আমার আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, গোলাপ তোমার
খুনখারাবি, হত্যাকাণ্ড এসব আমার একটু সয় না
গোলাপ তোমায় আঘাত দেওয়ার নিষ্ঠুরতা ঠিকই আমি করতে
চাইনি
আমি বড়ো কোমল ছিলাম, গোলাপ তোমার মতোই
আমি কোমল ছিলাম
আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, আমি কবি, আমি
কোনো নিষ্ঠুরতা দেখতে চাইনি, করতে চাইনি
নারী তুমি কাঁদবে আমার সহ্য হয় না, গোলাপ তুমি কাঁদবে আমার
সহ্য হয় না, মানুষ তুমি দুঃখ পাবে সহ্য হয় না
আমি কবি বলে আমি যীশুর মতোই কোমল ছিলাম, শুদ্ধ ছিলাম
আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, মানুষ তোমাদের
আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না
গোলাপ তোমায় ভ্রষ্ট করার, নারী তোমায় নির্যাতনের
মানুষ তোমায় দুঃখ দেওয়ার আমার মোটেই কথা ছিলো না
তবুও তোমরা আমার হাতে, নারী তুমি আমার হাতে
গোলাপ তুমি আমার হাতে
সবচেয়ে কঠিন আঘাত পাচ্ছো, দুঃখ পাচ্ছো।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
কবির কি আছে আর
ভালোবাসা ছাড়া,
সমস্ত উজাড় করে
হাতে একতারা।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
ভালোবাসা যদি এ-রকমই হয় রক্তমাংস, কাম
লালনেও মিছে লজ্জা পাবো কি, সঙ্কোচে লিখি নাম?
মানুষ লিখেই কতোবার কাটি, মানুষের বেশি নই
কামে-প্রেমে তাই এতো ভার বহি, এমন যাতনা সই!
মানুষে যদি বা মাহাত্ম্য নেই পাষাণেই দেখা হবে
তোমাতে আমাতে আজকাল বাদে এটুকু তো সম্ভবে।
প্রেমের মূল্যে আমাকে ছেড়েছো ঘৃণার মূল্যে দিও
তুমিও জানো না আমিও জানি না কোনখানে স্মরণীয়
প্রিয়ায় আসেনি হিয়ায় এসেছো, কন্যায় কামনায়
চাইনা বলেও যতোবার ভাবি না চাওয়াও কিছু চায়।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
হয়তো আজই ঠিক পেয়ে যাবো একটা লুফে নেয়ার মতো
সুসংবাদ
একটা কিছু অনবদ্য নীল খামে;
অনেকদিন পর আজ হয়তো ঠিকই পেয়ে যাবো সেই চিঠিখানি
সেই পাখির শিস, ফুলের হৃদ্যতা, সেই আঙুলের ছাপ
আজ ঠিকইপেয়ে যাবো একটা কিছু চমৎকার প্রাঞ্জল সংবাদ!
কতোকাল কোথাও পাইনে কোনো সুখবর,
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নব্ ইথারের রাজ্যে শুধু শুনি দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ
মহামারী-
পোর্ট স্ট্যানলীতে যুদ্ধ থামতে না থামতেই দেখি
আক্রান্ত বৈরুত ;
দেখি মারণাস্ত্র, নিউট্রন বোমার হুঙ্কার
আজ তাই মআমাকে পেতেই হবে একটা কোনো রম্য সুসংবাদ।
কারো কাছ থেকে পাইনে একটাও কোনো আনন্দ-সংবাদ,
একটিও হার্দ্য টেলিফোন, রোমাঞ্চকর বার্তা কোনো
এমন সংবাদ আর পাইনে কখনো যা কিনা মুহূর্তে ঠিক
করে তোলে আরক্তিম গাঢ় উচ্ছসিত ;
পৃথিবীর সবকিছু পাওয়াও যার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।
কতোকাল কোথঅও আমার জন্য একটিও সুসংবাদ নেই
খাম খুলে দেখি কালো বিষণ্ন অক্ষরগুলো
একটা না একটা কিছু দুঃসংবাদ নিয়ে বসে আছে
ঘরে এসে দুঃসংবাদ ছাড়া আর কিছুই মুনি না
এমনকি রেডিওর উত্তেজিত নবে আঙুল রাখতেই শুনি
বেজে ওঠে খাঁখাঁ দুঃসংবাদ,
আবার কলিংবেল বাজিয়েও দুঃসংবাদ ঢুকে পড়ে ঘরে
আজ তাই যেভাবেই হোক একটা কোনো সুসংবাদ চাই,
তুমুল, গভীর একটা কোনো উষ্ণ সুসংবাদ।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
শব্দ আমার ভালোবাসার পাত্র
মাত্র তাকে দিয়েছি এই শান্তি কোমল শান্তি
আরো অনেক দিনের দাহ, রাতের মেহকানি-
তবেই হবে শব্দ আমার গভীর প্রিয় পাত্রী!
শব্দ আমার ভালোবাসার বাগানবাড়ির বৃক্ষ
একখানি ডাল আকাশমুখী, একখানি তার পরম দুঃখী
আর একখানি ছুঁয়েছে কোনো গোপন দুর্নিরীক্ষ্য!
এতোদিন তো শব্দ কেবল শব্দ কেবল শব্দ
বুকের গভীর জলের ধারা তবেই তো সে স্বচ্ছ,
শব্দ তখন অধিক প্রিয় শস্য শালীন স্মরনীয়
শব্দ তোমায় শান্তি শান্তি! শব্দ তোমায় হৈমকানি-!
শব্দ তখন ভালোবাসার চিরকালীন পাত্রী!
এই শব্দে করেছি তোমায় শিল্প আমি শুদ্ধ
শব্দ তোমায় শান্তি শান্তি! শব্দ তোমায় হৈমকান্তি!
শব্দ তোমায় শব্দ!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রকৃতিমূলক
|
হয়তো পেরুনো যাবে
এই সাতটি সমুদ্র আর সাত শত নদী,
কিছু কীভাবে পেরুবো
এই দূর্বাঘাসে ভোরের শিশির
কীভাবে পেরুবো এই নিকোনো উঠোন,
লাউ-কুমড়োর মাচা !
হাজার হাজার মাইল সুদীর্ঘ পথ সহজেই
পার হওয়া যাবে,
কিন্তু তার আগে কীভাবে পার হবো এই
সবুজ ক্ষেতের আল --
ছোট্র বাঁশের সাকো, পার হবো
ঝরে পড়া শিউলি-বকুল !
পাহাড়-পর্বত, বন পার হওয়া হয়তো
তেমন দুঃসাধ্য নয়
কিন্তু কীভাবে পার হবো এই বৃষ্টির ফোঁটা,
একটি শাপলা ফুল,
কীভাবে সত্যই আমি পার হবো এইটুকু
সরু গলিপথ,
কীভাবে পার হবো বহুদিন দেখা এই খেয়াঘাট ।
হয়তো পেরুনো যেতো অসংখ্যা পথের বাধা
মরুভুমি সমুদ্র পর্বত,
আমি পেরুতে পারবো না শিশির-ভেজা
তোমার উঠোন ;
তাই কোথাও যাইনি আমি, এখানেই রয়ে গেছি
তোমাকে জড়িয়ে ।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
এবারও তেমনি শেষ চৈত্রের খর নিঃশ্বাসে
নতুন বছর আসবে হয়তো; কিন্তু তুমি কি জানো
এদেশে কখন আসবে নতুন দিন? কখন উদ্দীপনা
অবসাদ আর ব্যর্থতাকেই দেবে নিদারুণ হানা।
ছড়াবে হৃদয়ে আগামীর গাঢ় রঙে, ভাসাবে
মেঘের দূর নীলিমায় স্বপ্নের সাম্পান?
বলো না কখন এই ক্ষীণ হাতে ঘুরবে যুগের চাকা
কখন সত্যি নতুন বছরে আসবে নতুন দিন,
তুলবে তাদের গর্বিত মাথা আজ যারা নতজানু
এই প্রাসাদে ও অট্টালিকায় উড়বে তাদেরই নাম?
বলো না কখন ফুটবে গোলাপ গোলাপের চেয়ে বড়ো
কখন মানুষ পাবে এই দেশে শস্যের অধিকার
নতুন বছরে সেই অনাগত নতুনের প্রত্যাশা
বন্ধু, তোমাকে নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ!
|
মহাদেব সাহা
|
রূপক
|
এই শতকের শেষে নামে শৈত্য, হিমপ্রবাহ এখানে
এশিয়া ও ইওরোপ কাঁপে শীতে, বৃক্ষপত্র ঝরে যায়
ইতিহাস থেকে টুপটাপ খরেস পড়ে পাতা;
এই ভয়ানক দুঃসময়ে কার দিকে বাড়াই বা হাত
বন্ধুরাই শত্রু এখন, হৃদয়েও জমেছে বরফ।
পরফে পড়েছে ঢাকা বার্চবন, তৃনভূমি, বার্লিনের ব্যতিত আকাশ,
মানুষের কীর্তিস্তম্ভ, মানবিক প্রীতি-ভালোবাসা-
অনেক আগেই ঢাকা পড়ে গেছে মূল্যবোধ নামক অধ্যায়,
অবশেষে বিম্বাস ও সাহসের জাহাজটি বরফে আটকে গেছে দূরে।
তাহলে কি পৃথিবীর মানচিত্রই ক্রমশ ঢেকে যাবে উত্তাল বরফে,
ঢেকে যাবে পৃথিবীর চোখ, মুখ, মাথা?
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষণ্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি
অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল
আর কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর ও তুষারাবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে
কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষণ্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস
চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;
মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস
আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মানি-ক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুস তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,
হায়, কেউ জানে না!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
এক কোটি বছর হয় তোকাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার হবো ভরা দামোদর
কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
ভালোবাসার একটিও উদ্ধৃতি যদি দিতে চাই,
মনে হয় বড়োই অযোগ্য সব কিছু।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
তোমাদের পক্ষে সম্ভব তোমরা এক ধমকে চলন্ত ট্রেন
থামিয়ে দিতে পারো
বেয়াড়া বাসটি তোমাদের গলার শব্দেই কেঁপে ওঠে,
তোমরা চুলের ঝুঁটি ধরে শাসন করতে পারো এই শহরকে
গ্রামের তো কথাই নেই হাঁক না দিতেই তটস্ত;
তোমাদের সবাই সমীহ করে, উঠতে বসতে তোমাদের নিয়ে
সবাই ব্যস্ত
তোমরা চোখ তুলে তোকাতেই লাইটপোস্টগুলোও কেমন বিব্রত
হয়ে যায়
তোমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব, সবই সম্ভব;
আমার কথা ছাড়ো আমি সারাদিন গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েও
একটি শিশুর কান্না থামাতে পারিনে
বাইরের কথঅ থাক নিজের ভিতরই আমার কেমন ভাঙচুর
আমার কথা ঠিক কেউ বোঝে না
ফুলের জন্য আমাকে তাই ফুলদানিই কতোবার ভাঙতে হয়েছে
গানের বদলে গিটার থেকে ঝরেছে কেবল চিৎকার
এই রুক্ষ সংসারে এতোটুকু প্রাঞ্জলতা আনতে পারিনি আমি,
মাটিতে হাত দিয়েছি মাটিই হয়ে গেছে পাথর-
কেউ কেউ পারে না, ঠিক এমনি পারে না;
তাই তোমাদের পক্ষে যা সম্ভব দোস্ত তা হয়তো আমার জন্য নয়
তোমরা যে-কারো মতোই এমনকি গাছপালারও কলার চেপে ধরে
বলতে পারো, চুপ করো,
আমার হয়তো সামান্যও ক্ষমতা নেই
যেমন এক ধরনের লোক থাকে যারা চোখ রাঙাতে গেলে
ক্রোধের বদলে সেখান থেকে অশ্রুই ঝরে পড়ে
ধমকের বদলে গলা থেকে বেরিয়ে আসে অসহায় কান্না
তাই আমি ঠিক অনেক কিছুই পারিনে, তাই এমন লুকোতে হয়,
দৌড়ঝাঁপ করতে হয়, কাদামাটি মাখতে হয়;
আমার জন্য এই শহরে কোনো টেলিফোন-সেট নেই
এমনকি কয়েন বক্সে একটার পর একটা বাঘমার্কা সিকি ফেলে
দেখেছি সেখানে শীতল নীরবতা
কতোদিন মাত্র পাঁচ টাকার একটি নোট হাতে কাউন্টার থেকে
কাউন্টারে ঘুরেছি খুচরো টাকার জন্য
অথচ কতোদিন তোমাদের ওস্তাদের মতো যেখানে সেখানে
নোট বাড়িয়ে দিয়েই ভাড়িয়ে নিতে দেখেছি,
যে-কোনো জায়গায় টেলিফোন মরালের মতো গলা বাড়িয়ে
দিয়েছে তোমাদের জন্য
কতোদিন যে কতোজনের বন্ধ দরোজা দেখে দেখে ফিরে এসেছি
আর কড়া নাড়ারই সাহস হয়নি,
অথচ নিজের চোখেই দেখেছি তোমাদের যাওয়ার শব্দেই
কলরোল করে খুলে গেছে বন্ধ দরোজা
ভিতর থেকে বেজে উঠেছে উষ্ণ আপ্যায়ন;
তোমরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই সেখানে ঝরে পড়ে ফুলের
পাপড়ি
হাত তুলে অভিবাদনের পর অভিবাদন স্বাগত জানায় তোমাদের,
আমার সারা পথে কন্টকশয্যা
একটি পরিচিত মুখেরও দেখা মেলে না কখনো;
তোমাদের সুখদুঃখ-হাসিকান্না নিয়ে রচিত হয় ডকুমেন্টারি
তোমাদের কথাই আলাদা-
তোমরা যেখানেই হাত দিয়েছো সেখানেই ম্যাজিক,
আমার কথা ছাড়ো, আমি অনেক কিছুই পারিনে।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
আমার জীবন আমি ছড়াতে ছড়াতে
এসেছি এখানে,
আমি কিছুই রাখিনি-
কুড়াইনি তার একটিও ছেঁড়া পাতা,
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি শিমুল তুলোর মতো
সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্মৃতি,
আমি এই হারানো জীবন আর খুজি নাই
সেই ফেলে আসা পথে;
ছেঁড়া কাগজের মতো ছড়াতে ছড়াতে এসেছি আমাকে।
পথে পড়ে থাকা ছিন্ন পাপড়ির মতো
হয়তো এখানো পড়ে আছে
আমার হাসি ও অশ্রু,
পড়ে আছে খেয়ালি রুমাল, পড়ে আছে
দুই এক ফোঁটা শীতের শিশির;
এখনো হয়তো শুকায়নি কোনো কোনো অশ্রুবিন্দুকণা,
বৃষ্টির ফোঁটা
চঞ্চল করুণ দৃষ্টি, পিছু ডাক,
হয়তো এখনো আছে সকালের মেঘভাঙা রোদে,
গাছের ছায়ায়
পদ্মাপকুরের স্থির কালো জলে,
হয়তো এখনো আছে হাঁসের নরম পায়ে
গচ্ছিত আমার সেই হারানো জীবন
সেই সুখ-দুঃখ
গোপন চোখের জল।
এখনো হয়তো পাওয়া যাবে মাটিতে
পায়ের চিহ্ন
সেসব কিছুই রাখিনি আমি
ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে এখানে এসেছি;
আমি এই জীবনকে ফ্রেমে বেঁধে রাখিনি কখনো
নিখুঁত ছবির মতো তাকে আগলে রাখা হয়নি আমার,
আমার জীবন আমি এভাবে ছড়াতে ছড়াতে এসেছি।
আমার সঞ্চয় আজ কেবল কুয়াশা, কেবল ধূসর মেঘ কেবল শূন্যতা
আমি এই আমাকে ফ্রেমে বেঁধে সাজিয়ে রাখিনি,
ফুটতে ফুটতে ঝরতে ঝরতে আমি এই এখানে
এসেছি;
আমি তাই অম্লান অক্ষুণ্ন নেই, আমি ভাঙাচোরা
আমি ঝরা-পড়া, ঝরতে ঝরতে
পড়তে পড়তে
এতোটা দীর্ঘ পথ এভাবে এসেছি
আমি কিছুই রাখিনি ধরে কোনো মালা, কোনো ফুল,
কোনো অমলিন স্মৃতিচিহ্ন
কতো প্রিয় ফুল, কতো প্রিয় সঙ্গ, কতো উদাসীন
উদ্দাম দিন ও রাত্রি
সব মিলে হয়ে গেছে একটিই ভালোবাসার
মুখ,
অজস্র স্মৃতির ফুল হয়ে গেছে একটিই স্মৃতির গোলাপ
সব সাম মিলে হয়ে গেছে একটিই প্রিয়তম নাম;
আমার জীবন আমি ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে
এখানে এসেছি।
|
মহাদেব সাহা
|
স্বদেশমূলক
|
এই বাড়িটি একলা বাড়ি কাঁপছে এখন চোখের জলে
ভালোবাসার এই বাড়িতে তুমিও নেই, তারাও নেই!
এই বাড়িটি সন্ধ্যা-সকাল তাকিয়ে আছে নগ্ন দুচোখ
একলা বাড়ি ধূসর বাড়ি তোমার স্মৃতি জড়িয়ে বুকে
অনাগত ভবিষ্যতের দিকেই কেবল তাকিয়ে থাকে,
কেউ জানে না এই বাড়িটি ঘুমায় কখন, কখন জাগে
স্তব্ধ লেকের কান্নাভেজা এই বাড়িটি রক্তমাখা!
এই বাড়িতে সময় এসে হঠাৎ কেমন থমকে আছে
এই বাড়িটি বাংলাদেশের প্রাণের ভিতর মর্মরিত,
এই বাড়িতে শহীদমিনার, এই বাড়িতে ফেব্রুয়ারি
এই বাড়িটি স্বাধীনতা, এই বাড়িটি বাংলাদেশ
এই বাড়িটি ধলেশ্বরী, এই বাড়িটি পদ্মাতীর
এই বাড়িটি শেখ মুজিবের, এই বাড়িটি বাঙালীর!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু, আমি যেন
উড়ো পাতা,
ঝাউবনের কান্না শুনি বুকের মধ্যে
সারা দুপুর-
উড়তে উড়তে কোথায় যাবো, ঠিকানা ঠিক
কোথায় পাবো
নাকি শেষে হারিয়ে যাবো,
এই আমি এই উড়ো পাতা, উড়ো পাতা!
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু টেবিলে বই, লেখার
কাগজ
ঝড় বয়ে যায় মনের ভেতর; সব
উড়ে যায়
আমিও যাই
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু শালবনে
কার ছায়া দেখি-
লোকাল ট্রেনে যাচ্ছি কোথায়!
আমার এখন মনে পড়ে তোমার চোখে
বৃষ্টি নামা,
তবু উড়ু উড়ু এই দুপুরে মধুপুরে হয় না নামা।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
কেমন উদ্ভট উল্টোপাল্টা হাওয়া,
যেন ঝরে যায় সব মানবিক মূল্যবোধ, ইতিহাসের
স্বর্ণাক্ষরে লেখা একেকটি পাতা।
এ কী দৈত্যপুরী থেকে যুদ্ধ জয় করে ফিরে-আসা
লালকমল ও নীলকমলের মুখ
অকষ্মাৎ ভীষণ পান্ডুর বর্ণ হয়ে ওঠে
হঠাৎ গোলাপচারাগুলো এ কী ঢলে পড়ে,
জুই আর চন্দ্রমল্লিকার বন
এ কেমন ছেয়ে যায় ফণিমনসার ঝাড়ে;
কবিতার প্রিয় পান্ডুলিপি জুড়ে
হঠাৎ কেমন ধূসর কুয়াশা নেমে আসে,
প্রেমিকার উষ্ণ হাত মনে হয় যেন নিরুত্তাপ, অনুভূতিহীন
এ কী শীমপ্রাসাদে আবার জমে বরফের স্তুপ;
আর তাতে ঢাকা পড়ে যায় মানুষের
আশা ও স্বপ্নের মুখ, ধসে পড়ে
তার সব মহিমা ও কীর্তির মিনার।
বিশ শতকের এই গোধূলিবেলায় এ কেমন এলোমেলো ধূলিঝড়
এ কেমন সমস্ত আকাশ ছেয়ে কালো মেঘের আঁধার
কিছুই পড়ে না চোখে, কোনো আলো,
কোনে উজ্জ্বলতা-
মনে হয় বুখি এই গোধূলিতে অস্তমিত কালের গৌরব।
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তোমার কাছে আমি যে কবিতা শুনেছি
এখন পর্যন্ত তা-ই আমার কাছে কবিতার সার্থক আবৃত্তি;
যদিও তুমি কোনো ভালো আবৃত্তিকার নও, মঞ্চেও
তোমাকে কেউ কখনো দেখেনি,
তোমার কণ্ঠস্বরও এমন কিছু অসাধারণ নয়
বরং তুমি অনেক সাধারণ শব্দই হয়তো এখনো ভুল উচ্চারণ করো
যেমন …… না থাক, সেসব তালিকা এখানে নিষপ্রয়োজন,
অনেক কথাতেই আঞ্চলিকতার টান থাকাও অস্বাভাবিক নয়
কিন্তু তাকে কিছু এসে যায় না,
তোমার এসব ত্রুটি সত্ত্বেও তোমার কাছেই আমি
কবিতার উৎকৃষ্ট আবৃত্তি শুনেছি।
এমনকি ভুল উচ্চারণ ও আঞ্চলিক টানেও কবিতা যে কখনো
এমন অনবদ্য ও হৃদয়গ্রাহী হতে পারে
তা আমি এই প্রথম তোমার কাছে কবিতা শুনেই বুঝলাম।
কবিতা যে কতোটা আবৃত্তিযোগ্য শিল্প
আর কতোখানি মন্তআকুল-করা ভাষা
তাও আমি এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম
যেদিন তুমি আমার কানের কাছে মুখ এনে একটি কবিতা শোনালে।
সেদিন থেকেই বুঝলাম
কবিতার সার্থক আবৃত্তি আসলে বুকের ভিতর
কেবল তুমিই সেই আবৃত্তি করতে পারো।
কোনো কবিতার এর চেয়ে ভালো আবৃত্তি আর কিছুই হতে পারে না
যদি সেই কবিতা তোমার মতো কোনো সহৃদয় পাঠিকা আবৃত্তি করে
কবির কানে কানে
তখন একসঙ্গে দশ লক্ষ মৌমাছি বুকের মাঝে ওঠে গুঞ্জন করে
এক লক্ষ প্রজাপতি এসে ঋড়ে বসে কঁঅধে আর বাহুতে
আরো এক লক্ষ পাখি একসাথে ওঠে গান গেয়ে,
এর চেয়ে ভালো আবৃত্তি আমি আর কোথাও শুনিনি
যদিও তুমি কোনো ভালো আবৃত্তিকার নও
সেদিন খুব ভয়ে ভয়ে আর সঙ্কোচ
ধীরে ধীরে আবৃত্তি করেছিলে আমার একটি ছোট্ট কবিতা
তার সবটিুকু শেষ করেছিলে কি না তাও আজ আর ঠিক মনে নেই,
কিন্তু এটুকু মনে আছে
এর চেয়ে ভালো আবৃত্তি আর কিচু হতে পারে না
তোমার সেই সলজ্জ গোপন আবৃত্তির মধ্যেই
সম্পূর্ণ ও সফল হয়েছিলো কবিতাটি;
কবিতা বাঁচে ভালোবাসায়, কেবল ভালোবাসায়।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প, আমি তাকে
দুঃখভরা নকশীকাঁথার মতো আমার শরীরে
করেছি সেলাই,
বড়োই যাতনাময় তবু তার নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে আমি
বুঝেছি কেমন এই প্রবাহিত তোমাদের অটুট জীবন
চারধারে, কেমন সুস্থতা
তার মাঝে ক্রমাগত অন্তঃসারশূন্যতার কী গভীর ধস ও ফাটল!
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প তার কাছে থেকেই তো আমি
প্রথম শিখেছি তোমার মুখের সাথে গোলাপের কোথায় অমিল
কিংবা এই চলচ্ছক্তিহীনতার মধ্যে কী প্রখর অন্তহীন ধাবমান আমি
আর সিরিঞ্জের রক্তিম ওষুধই কখনো কখনো
কীভাবে তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতি হয়;
অসুস্থতা আমাকে দিয়েছো গাঢ় অবিমিশ্র এ কোন চেতনা
যতোই তাকাই চোখ মেলে মনে হয়
ওষুধের একেকটি মৃদু ফোঁটা স্মৃতির ভিতরে রাত্রিদিন
ঝরে কোন বিরল শিশির
শুভ্র নার্স যাকে আমি চিরকাল ভেবেছি শুশ্রূষা
মানুষের ক্ষত ও আহত দেহময় উদ্বেলিত কোমল বর্ষণ
বলে চিনি,
অসুস্থতা তাই তারও কণ্ঠে আমি শুনেছি কোরাস
আমার সকল ঘরময় কখনো দেখেছি তাকে অপেরার মতন
উদ্দাম
এলায়িত ভঙ্গি আর নৃত্যপরায়ণ-
না হলে তাকেই বুকে নিয়ে
কীভাবে এমন আছি দীর্ঘ রাত্রি মগ্ন ও মোহিত
কখনো কখনো এই অসুস্থতাকে মনে হয় প্রিয়তমা প্রেমিকার
চেয়ে আরো বেশি
মনে হয় অনুরক্ত বুঝি কোনো লাজুক তরুণী সে যে
খুব সন্তর্পণে শান্তধীর কিংবা দ্বিধায় আমার শরীরে
তার অলৌকিক স্পর্শ রেখে যায়
এই অসুস্থতা আমাকে দিয়েছে তার নগ্নদেহ, নগ্ন শিহরন
আর তার ব্যাকুলতাময় ঊরু, জঙ্ঘা, স্তন ও শোণিত।
তার দিকে চেয়ে দেখি আমার সম্মুখে
বয়ে যায় কল্লোলিত জীবনদেবতা
আমার সামান্য এই ছিটেফোটা পরমায়ুটুকু কেবল তারই তো দেখি
করুণাধারায় সিক্ত
আমি এই অসুস্থতা তোমাকে পেয়েই কতো যে না-পাওয়াগুলি সহজে ভুলেছি!
তোমার ট্রান্সপেরেন্ট উদার চক্ষুদ্বয়ে দেখা যায়
প্রজ্জ্বলিত ঐশ্বরিক মেধা
তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমি তাই মনে মনে ভাবি
তুমি কি মৃত্যুর কাছ থেকে এই সূর্যাস্তের ছায়া, মুগ্ধ টিপ
আর এই সূক্ষ্ম শিল্পের কাজ-করা বিদায়খচিত সুবর্ণপদক
এনেছো আমার জন্য?
যার একদিকে উদাত্ত আহ্বান আর
অন্যদিকে গাঢ় বিস্মরণ!
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প আমি জানি
তোমার একটি তুচ্ছ ব্রণের দাগও এতো বেশি চেনা
আমার আত্মাকে যতো শুদ্ধ হতে বলি, বলি বীজন জড়তামুক্ত হও
তার মুখ ততো নৈঃশব্দ্যের দিকে ঘুরে যায়
আর সেই অস্পষ্ট বিলীয়মান কন্ঠস্বরে যেন মনে হয় শুনি
আমার এ রুগ্নতার ভিতর দিয়েই সভ্যতা ও ইতিহাসই
চায় আজ মৌলিক শুশ্রূষা!
|
মহাদেব সাহা
|
প্রেমমূলক
|
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন গাছের কাছে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ বোধ হতো
লতাপাতার উৎসাহ দেখে আমি সারাদিন তার কাছে ঘুরে বেড়াতাম
কোনো কোনো দেন পাখিদের
বাষভূমিতে আমার অনেক উপাখ্যান শোনা হতো
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন প্রত্যহ সূর্যোদয় দেখতে যেতাম তোমাদের বাড়ির পুরনো ছাদে
তোমার সেই যে দজ্জাল ভাই সারারাত তাস খেলে এসে
পড়ে পড়ে তখনো ঘুমাতো,
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন আমার রোজ ভোরবেলা ঘুম ভাঙতো, যেতাম
প্রকৃতির কাছে মানবিক অনুভূতি নিয়ে
মানুষের দুঃখ দেখে আমার তখন ভীষণ কান্না পেতো
এখন আমার আর সেই অনুভব ক্ষমতা নেই
মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাপ দেখেও আমি দিব্যি চায়ের দোকানে
বসে হাসতে হাসতে চা খাই
সেলূনে চুল কাটার সময় পাশেই অবৈধ কতো কী ঘটে যায়
তুমি কাছে না থাকলে আমি দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠি
আশেপাশে সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি
মানুষ ও প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমার হিংসা বোধ হয়
তুমি না থাকলে মেয়েদের রূপ কিংবা ফাহমিদা খাতুনের
রবীন্দ্রসঙ্গীত কিছুই আমাকে আকর্ষণ করে না
শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ জাগে না আমার
একে একে সকাল দুপুর সারাদিন নষ্ট হয়
কোনোকিছুই করতে পারিনে আমি
তুমি না থাকলে বড়ো দুঃসময় যায়, সর্বত্র বন্ধুবিহীনভাবে
বাস করি
এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়
কাউকি ডাকলে সাড়া দেয় না, সবাই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে
তুমি না থাকলে এই বাড়িঘর শহরের লোকজন
সম্পূর্ণ আমার অপরিচিত মনে হয়
নিজেকেই নিজের অচেনা লাগে
মনে হয় দীর্ঘ দিন থেকে আমি যেন কোনো অজ্ঞাত অসুখে ভুগছি
তুমি না থাকলে বাস্তবিক আমি বড়ো কষ্টে পড়ি
বড়োই কষ্ট হয়।
|
মহাদেব সাহা
|
মানবতাবাদী
|
আমার বাবার এখন দ্রুত পাল্টাচ্ছে চোখ তাকে ততো ব্যথিত লাগে না
তিনি অনায়াসে ঘাসের ভিতর আরো পতঙ্গের উৎসাহ দেখেন,
মানুষের নব জাগরণ,
অতিশয় ব্যগ্র তিনি পৃথিবীর ভালো দেখতে চান,
তাকে আর ব্যথিত লাগে না।
সহজে এখন তিনি পাপীকেও তীর্থধূলির মতো বুকে তুলে নেন।
একদিন যেমন তিনি শস্যের সম্ভাব্য ক্ষতি নিশ্চিত জেনেও তবু বলেছেন,
বর্ষণ থামার বেশি বাকি নাই, এবারের শস্য রক্ষা হবে
উথালপাতাল সেই ভাঙনের স্রোতে আমাদের দক্ষিণের দুটি ঘর
ভাসমান দেখে
তবু তিনি কীভাবে যে বলেছেন আমাদের বাড়ি আর বিশেষ ভাঙবে না,
ভাঙনপবণ এই নদীকেও কোনোদিন এতোটা বিশ্বাস কেউ করে
যেন তিনি এইভাবে বিশ্বাসের বলে ঠেকাবেন যতো সর্বনাশ। এখনো
তেমনি তার অথই বিশ্বাস
সুখী হবে দুর্গত-দুঃখিত এই দেশ, দুর্দিনের দাহ লেশ মুছেযাবে
এই অনশন, অন্নাভাব, অগ্নিমূল্যে বেঁচে থেকে তিনি
অকাতরে এখনো বলেন, আর চাল দুর্মূল্য হবে না, দেখো এইবার
ঠিকই পাওয়া যাবে অপর্যাপ্ত শিশুখাদ্য দেশে
লোকে তার কথা শুনে হাসে। আমি ভাবি স্বপ্ন আর কোথাও নেই
শুধু তার এই দুটি চোখে
না হলে সবুজ তণ্ডুলে এতো কাঁকরের বিষ কেন তার চোখেই পড়ে না!
বাবার চোখের দিকে আমি ভয়ে তাকাতে পারি না। কী করে যে
তার প্রায় অবলুপ্ত এই দুটি চোখে এতো ভরসা রাখেন
এখন তো তার এই চোখ দ্রুত পাল্টাচ্ছে প্রত্যহ এখন হয়তো সবুজকে
তিনি আর তেমন সবুজ দেখেন না
চশমার পয়েন্ট তার দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে তা হলে কী হবে
আমি জানি তবু এই গভীর কুয়াশাচ্ছন্ন চোখে তিনি
আমাদের ভবিষ্যৎ বড়ো বেশি উজ্জ্বল দেখেন। আমার বাবার মতো
বিশ্বাসী লোক আমি কখনো দেখিনি
তার এখন বয়স বেড়েছে বেশ বোঝা যায় আর ততো তাকে মনে হচ্ছে
তিনি এই পৃথিবীর প্রকৃত প্রেমিক শুধু ভালো দেখতে চান
জেনে যেতে চান বুঝি ব্যথিত বৃক্ষের অব্যাহতি মানুষের কুশলকল্লোল
না হলে কী নিয়ে যাবেন তিনি অতো দূরে নিতান্ত একাকী শেষবেলা,
তাও বুঝি!
আমি জানি আজীবন আমার বাবার এই সামান্য বিশ্বাস ছাড়া তেমন
আর কিছুই ছিলো না
শুধু এইটুকু নিয়ে তিনি দুঃসময়ে আমাদের আদিগন্ত দিয়েছেন দোলা
নিজে তিনি পুড়েছেন ব্যর্থতার রোদে বিপর্যয়ে এই একাকী মানুষ,
তবু চিরদিন তিনি বড়ো স্বপ্নচারী লোক
সেই স্বপ্ন আজো তার চোখে, তাকে ততো ব্যথিত লাগে না।
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
কী করে বলি এই মেঘ দেখর দুঃখ, এই গোলাপ দেখার
ব্যাকুলতা-
কিন্তু আমিও যখন মেঘের দিকে তাকাই দেখি কালিদাসই
দেখছেন বিরহী যক্ষকে,
হঠাৎ মন ভরে যায় বহু যুগের ওপার থেকে আসা বর্ষণে:
এই গোলাপ দেখর কথা আমার হয়তো বলাই হবে না
কিন্তু যখান গোলাপের দিকে তাকাই দেখি ব্রেক
তাকিয়ে আছেন গেলোপের রুগ্নতার দিকে,
কিংবা রিলকে আয়ত্ত করে চলেছেন একটি শ্বেতগোলাপ,
কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
মেঘ দেখতে দেখতে আমি যে কখন মেঘদূতের ভেতর ডুবে যাই,
বিরহকাতর যক্ষের জন্য ভারী হয়ে ওঠে এই বুক
কিংবা গোলাপের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসৈ ওঠে
রিলকের মুখটি,
এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
কাউকে বলাই হবে না ;
আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ
দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী
সেই ব্যকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায় -
এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা।
যখন মানুষের সুদ্ধতার কথা ভাবি দেখি দাঁড়িয়ে আছেন
ব্যথিত বোদলেয়ার
শহরের রাত্রির দিকে তাকালে মনে হয় জীবনানন্দ দাশ দেখছেন
লিবিয়ার জঙ্গল,
যখন একজন বিপ্লবীর দিকে তাকাই দেখি দুচোখে
মায়াকোভস্কির স্বপ্ন
আর্ত স্বদেশের দিকে তাকিয়ে আমিও নেরুদার কথাই ভাবি,
কেউ জানে না একটি ফুলের মৃত্যু দেখে, একটি পাখির ক্রন্দন দেখে
আমারও হৃদয় পৃথিবীর আহত কবিদের মতোই হাহাকার
করে ওঠে।
একটি ফুল দেখে আমিও একজন প্রেমিকের মতোই পরাজিত
হতে ভালোবাসি
একটি ঝরাফুলের দুঃখ বুকে নিয়ে যে-কোনো ব্যথিত কবির
মতোই সারাদনি ঘুরে বেড়াই,
আসলে সে-কথাগুলোই বলা হয়নি, বলা হয়নি;
মানুষের সমাজে এই বৈষম্য দেখে আমিও একজন
বিপ্লবীর মতোই শ্রেনীসংগ্রামের জন্য তৈরি হই,
এই জরা বার্ধক্য দেখে কতোবার বুদ্ধের মতোই
ব্যথিত হয়ে উঠি;
কিন্তু কী করে বলবো এইসব মেঘ দেখার দুঃখ, এইসব
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
|
মহাদেব সাহা
|
চিন্তামূলক
|
উহারও ভিতরে আছে প্রাণ, আহা ও কালো কুঠার,
ঘাতকের বিষমাখা ফলা, আহা এ বড়ো নিঠুর, উহাদের
করো না আঘাত
উহারও ভিতরে আছে প্রাণ
জলেরও ভিতরে আছে, মাটিতেও আছে, জড়ত্বেও আছে
এ প্রাণের বীজ
অগ্নিমন্ত্র, এই গুচ্ছ গুচ্ছ প্রাণ, মধ্যমার সনাতন সখা
বৃক্ষেও আছেন প্রাণ, শিলায়ও আছেন
সমুদ্র তাহারও কন্ঠের কাছে ধিকি ধিকি জ্বলে যে আগুন
সেই শিখাটিই প্রাণ
পাথরের মধ্যে যা স্ফটিক ধ-ধু অশ্রুজল
সাত তাল জলের নিম্নে খুঁজে তাকে ও কালো কুঠার
ঘাতকের বিষমাখা ফলা, ও রক্তমাখা হাত
ছেঁড়ো খেঁড়ো যা কিছুই করো
একটি ভ্রমর তার সাতটি পরান!
নির্বপিত কুসুমেরও মধ্যে ফোটে ঘ্রাণ, খোলে মায়া
ওই শুয়ে আছে শিশুর চেখের থির হ্রদে
সকল বস্তুতে আছে বস্তুরঅধিক সেই প্রাণ,
মৃত্যুর পরেও তাই যায় একটি ভ্রমর
আহা ও কালো কুঠার, ঘাতকের বিষমাখা ফলা
উহাদের দিও না ছোবল, ওরা প্রাণ, ওরা প্রাণ!
ওই শিশুর ভিতরে প্রাণ, প্রাণীর ভিতরে, ওই শিলায় অগ্নিতে জলে
একটি ভ্রমর ওরা উহাদের সাতটি পরান।
|
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.